এক আকাশ আলো – A Beautiful Change

আমরা দুই ভাই। আমি ভার্সিটিতে পড়ছি। আর বড়ো ভাই ব্যাংকে চাকরি করেন। কিছুদিন হলো বিয়ে করেছেন।
আমরা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। বাবা ছোটো খাটো একটা চাকরি করতেন। মা ছিলেন গৃহিণী। ঘরের সব কাজ তিনি একা করতেন। এখনো করেন। আমাদের বাসায় কখনো বুয়া রাখা হয় নি।
বাবা মা’র জীবন যাপন ছিলো সাধারণ। এই সাধারণ বাবা মা’র ঘরে বড়ো ভাই হয়ে উঠলেন চরম আধুনিক, এবং নাক উঁচু স্বভাবের। হাল ফ্যাশনের জিনিসপত্র ছাড়া তিনি ব্যবহার করতেন না। বাবা মা’র জীবন যাপন তিনি পছন্দ করতেন না। বিশেষ করে মায়ের।

বড়ো ভাই মাকে প্রায় বলতেন,”আপনার চালচলন সেকেলে ধরনের। খুবই বাজে।”
হাল ফ্যাশনের বড়ো ভাই বিয়ে করলেন তার মতো আরেক হাল ফ্যাশনের মেয়েকে। তাদের ছিলো প্রেমের বিয়ে। বাবা মা অমত করেন নি।
ভাবীকে যেদিন ঘরে তুলে আনলেন সেদিন বড়ো ভাই কাটা কাটা উচ্চারণে মাকে বললেন,”আমার স্ত্রী আপনার মতো অল্প শিক্ষিত সেকেলে চিন্তা ভাবনা করা মেয়ে নয়। ও মাস্টার্স পাশ করা মেয়ে। আধুনিক মননশীল পরিবারের মেয়ে সে। তার সাথে হিসেব করে কথা বলবেন। আপনার কোনো আচরণে যদি সে আঘাত পায়, তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। কথাটা মনে রাখবেন।”
মা সরল মানুষ। এই সরলতার সুযোগ নিয়ে আমরা সবাই যা ইচ্ছে মাকে বলতাম। উঁচু গলায় তার সাথে কথা বলতাম। মা কষ্ট পেতেন। কিন্তু কিছু বলতেন না।
বড়ো ভাইয়ের কথাতে মা তাই সেদিনও কিছু বললেন নি।

কিছুদিন যাওয়ার পর বড়ো ভাই সবাইকে শুনিয়ে বলতে লাগলেন, এই বাড়িতে থাকার পরিবেশ নেই। তিনি আলাদা হয়ে যাবেন। তার মতে, তার স্ত্রীর সাথে যেভাবে আচরণ করা উচিত মা সেভাবে করতে পারছেন না।
ভাবী চাকরি করেন। বাসার কাজও করেন। এতে বড়ো ভাইয়ের ধারণা হয়েছে মা তার স্ত্রীকে বেশি খাটাচ্ছেন।
ভাইয়া একদিন রাগের সঙ্গে মাকে বললেন,”ও সারাদিন পরিশ্রম করে বাসায় আসে। ওকে দিয়ে আপনার এতো কাজ না করালে কি চলে না?”
মা শান্ত গলায় বললেন,”আমি তোর বউকে কিছু করতে বলি নি। সে নিজ থেকে করে।”

“নিজ থেকে করে, নাকি করান সব জানি। এই বাড়িতে আর থাকবো না। যেখানে আমার স্ত্রীর সম্মান নেই, সেখানে থাকার মানে হয় না।”
ভাবী যখন ঘরের কাজ করতেন, ভাইয়া তখন শকুনের মতো মাকে পর্যবেক্ষণ করতেন। মাকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করার কারণ ছিলো। শুরুতেই বলেছি, মা ঘরের সব কাজ করেন। এমনকি ভেজা ত্যানা দিয়ে ঘর মোছা পর্যন্ত। বড়ো ভাই মাকে এজন্যই পর্যবেক্ষণ করতেন যে, তার মনে হয়েছিলো, মা যে কোনো সময় তার আধুনিক, শিক্ষিত, চাকরি করা বউকে বলবেন, ভেজা ত্যানা দিয়ে ঘর মোছার জন্য।

ভাইয়ার এই মনোভাব বুঝতে পেরেছিলাম এ কারণে যে, মা যখন ঘর মুছতেন, ভাইয়া তখন আশেপাশে ঘুরঘুর করতেন। মাকে চোখে চোখে রাখতেন। যেনো মা তার স্ত্রীকে ঘর মোছার কথা বলতে না পারেন। ভাইয়া এটা করতেন বন্ধের দিনগুলোতে। কারণ অন্য দিনগুলোতে ভাইয়া ভাবী অফিসে থাকতেন।
তারপর একদিন ঘটনা ঘটে গেলো। এক শুক্রবার ঘর মোছার সময় মা হঠাৎ মোছা বন্ধ করে ক্লান্ত গলায় বললেন,”আজ শরীরটা ভালো লাগছে না।”
ভাবী তখন রান্নাঘরে ছিলেন। সেখান থেকে এসে মাকে বললেন,”আপনি রুমে গিয়ে শুয়ে থাকুন।”

ভাইয়া তো যথারীতি আশেপাশেই ছিলেন। তিনি তখন তেড়ে এসে মাকে বললেন,”আমি জানতাম, আপনি একদিন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন, যাতে আমার স্ত্রী ঘর মোছে। এটাই তো আপনার ইচ্ছে ছিলো, তাই না? আর কতো অসম্মান করবেন আমার স্ত্রীকে? আর সহ্য করবো না। আজই আলাদা হয়ে যাবো।”

এই সময় একটা দুর্দান্ত ব্যাপার হলো। ভাইয়া যে গতিতে মায়ের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন, বাবা তার চেয়ে বেশি গতিতে ভাইয়ার দিকে তেড়ে গেলেন।
এরপর ধমকে ভাইয়াকে বললেন,”তোর স্ত্রীকে বিন্দুমাত্র অসম্মান না করার পরও তুই দিনের পর দিন আমার স্ত্রীকে অসম্মান করে যাচ্ছিস। তোর স্ত্রীকে কেউ কিছু বললে তোর কষ্ট লাগে, আর আমার স্ত্রীকে আমার সামনে কেউ কিছু বললে আমার কষ্ট লাগে না? আমার দু:খ যে, তোর মতো কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছি। তুই যদি এখন তোর মায়ের পা ধরে ক্ষমা না চাস, তাহলে তোর ঘর থেকে বেরুনোর আগে, আমি তোকে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেবো।”

ভাইয়া তখন তেজ দেখিয়ে ভাবীকে বললেন,”দেখেছো এদের ব্যবহার! এই নোংরা পরিবেশে তোমাকে আর এক মুহূর্তও রাখবো না। এখনই আমরা চলে যাবো।”
এই বলে ভাইয়া ভাবীর হাত ধরে রুমে নিয়ে যেতে চাইলে ভাবী টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলেন। এতে ভাইয়া অবাক হয়ে গেলেন।
তারপর ভাইয়াকে আরো অবাক করে দিয়ে ভাবী বললেন,”এতোদিন তোমার পাগলামির কারণে আমি এই ঘরের মেয়ে হয়ে উঠতে পারি নি। সব সময় নিজেকে দূরের মনে হয়েছে। কিন্তু আজ এই ঘরের মেয়ে হয়ে উঠবো।”
এরপর আমাদের সবার চোখের সামনে ভাবী মায়ের হাত থেকে ভেজা ত্যানাটা নিয়ে ঘর মুছতে শুরু করলেন।
মা ভাবীকে থামাতে গেলে ভাবী বললেন,”যে কাজ মা করতে পারেন, সে কাজ মেয়ে কেনো করতে পারবে না?আমার আরো আগে এসব বলা উচিত ছিলো। কিন্তু আমার স্বামীর হম্বিতম্বির কারণে সাহস করে কিছু বলতে পারি নি। এজন্য আমাকে মাফ করবেন।”

অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় ভাইয়া স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
বাবা তখন ভাইয়াকে বললেন,”তুই বেরিয়ে যেতে চাইলে বেরিয়ে যা। বউমা থাকবে আমাদের সাথে।”
ভাইয়ার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছিলো না।
মা তখন পুনরায় ভাবীকে থামিয়ে নিজে ঘর মুছতে গেলে, ভাইয়া তখন আমাকে ধমকে বললেন,”দাঁড়িয়ে কী দেখছিস! আয় মাকে আর তোর ভাবীকে থামাই।”
তারপর বললেন,”আজ থেকে বাড়ির মহিলারা কেউ ঘর মুছবে না। ঘর মুছবো আমরা দুই ভাই।”

আমি আঁতকে উঠলাম ভাইয়ার কথা শুনে। ঘটনা যে এদিকে বাঁক নেবে চিন্তা করি নি।
অত:পর ভেজা ত্যানা দিয়ে আমি আর বড়ো ভাই ঘর মুছতে লাগলাম।
ঘামে সিক্ত কর্মরত আমাদের দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বাবা তখন ভাবীকে বললেন,”মাগো, আমি আর আমার স্ত্রী এদের জন্ম দিয়েছি, কিন্তু মানুষ করতে পারি নি। কিন্তু তুমি এদের মানুষ করে দিলে।”
এই হলো গল্প। আপনারা পড়তে থাকুন। আর আমি ঘরের বাকি অংশটুকু মুছে ফেলি।

“এক আকাশ আলো”
-রুদ্র আজাদ


Read More:

নিস্বার্থ ভালোবাসা

আমি এবং আমরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *