জীবনের রংধনু – স্বামী স্ত্রীর সংসারের গল্প

শুক্রবার। দুপুরে খেয়ে দেয়ে টিভি দেখছিলাম৷ মিরা ডায়নিং রুম থেকে এঁটো হাতে ছুটে এসে বলল,

  • সবজিতে লবণ কম হয়েছে বললেনা কেন?
  • (মুচকি হেসে) তোমার যা রান্নার হাত, খেতে বসলে হুশ থাকে না। মনে হয় অমৃত খাচ্ছি। তোমার হাতে জাদু আছে বুঝলে।
  • আর কতবার বলবো এসব ন্যাকামো করবে না, যত্তসব৷
    বলেই হনহন করে চলে যায় মিরা।

মিরা আমার স্ত্রী। বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। প্রচন্ড চটপটে আর ঝগড়ুটে। তার ঝগড়া শুধু আমার সাথে। এটাকে ঝগড়া না বলে ভালবাসার ঝগড়া বলাই ভালো। মিরার সাথে পারতপক্ষে আমি লাগি না। কিছু হলে একগাদা কথা শুনিয়ে দেয়। তাই চুপচাপ থাকি। যা দেয় তাই খেয়ে নি। সেও ইচ্ছে করে ভুল করে, যাতে আমি কিছু বলি। কিন্তু আমি কিছু বলি না কেন এটাও দোষ। এটা নিয়েও কথা শুনাবে।

আসলে মিরা এমনই। কিন্তু আগে মিরা এমন ছিল না। গত পরশু বলেছিলাম; মাংসে ঝালটা একটু বেশি হয়ে গেল না। সে ভ্রু কুচকে পাঁচ মিনিট তাকিয়ে থেকে বলল; নিজেতো এক কাপ চা বানাতে গেলেই তালগোল পাকিয়ে চা’এর বদলে শরবত বানিয়ে ফেলো৷ তাতে কিছু হয় না? আসছে আমার ভুল ধরতে।

আমি আরেক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে হেসে বললাম; ঝাল আমার ভালোই লাগে৷ শুধু পেট খারাপ না হলেই হয়।
যেদিন বিকেলে বাসায় থাকি, সেদিন তাকে বলি; শাড়ি পরোতো, বেগুনি রঙেরটা। ঘুরতে যাবো৷
সে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে?

আমি হাত, মুখের চামড়া টেনে বলি; কই চামড়া তো কুচকায় নি, চুলও সাদা হয় নি।
সে প্রচুর বিরক্ত হয়ে বলে; আমার ইচ্ছে নেই সেটা বুঝো না তুমি?
পূর্ণিমার রাতে বেলকনিতে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে৷ আমার ঘুম ধরে না৷ মিরা ওপাশ ফিরে ঘুমোয়৷ আমি ডাকবো না ডাকবো না করেও ডেকে ফেলি৷ সে দাঁত কিড়মিড় করে বলে; তোমার তো কাজ নেই। দশটায় উঠলেও চলবে৷ আমার অনেক কাজ৷ ছয়টা থেকে খাটা লাগে৷ নয়তো গিলতে পারবেনা৷

সকালে ঘুম ভাঙতেই রান্নাঘরে পা বাড়ায় আমি৷ মিরা রান্নায় ব্যস্ত৷ ফর্সা গালে ঘাম চিকচিক করছে৷ আমি মুছে দিয়ে বলি; এত চিল্লাচিল্লি করো কেন? ভেজা চুলের পানি চিটিয়ে ঘুম ভাঙাতে পারো না! ভাবসাব দেখে মনে হয় না সে কথা কানে নিয়েছে। আজকাল মেয়েটা কিছুই কানে নেয়না৷ আমিও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এসবে। আগের মিরা আর এখনের মিরার মধ্যে অনেক তফাৎ।

এইতো ক’দিন আগেও তরকারির ঝাল বা লবণ কম হলেও আমি চুপচাপ খেতাম৷ কিন্তু সে যখন মুখে দিত ব্যাপারটা তখন বুঝতো৷ আর সারাটা দিন এটা নিয়ে কেঁদে ভাসাতো৷ আমার সাথে অভিমান দেখাতো, কেন বলিনি। তাকে ইগনোর করছি আর কতশত কি। টিভি দেখতে বসলে টিভি বন্ধ করে বলতো; তুমি শুধু আমাকে দেখবা, আমার খবর শুনবা৷ টিভির খবর শুনে তোমার কাজ নেই৷

ছুটির দিনে বিকেল হলে বেগুনি রঙা শাড়ি পরে বলতো; চলো আজ দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে শহরটা ঘুরি। আমি যদি না করতাম তখন বলতো; তুমি একটুও রোমান্টিক না৷ এতো ক্ষ্যাত ক্যান তুমি? আচ্চা থাক, রোমান্টিক হওয়ার দরকার নেই। এরকম ক্ষ্যাতই থাকবা বুঝলে৷ আবার না জানি স্মার্ট হলে কোন গোয়ালে ঢুকে পড়।
আব্বা-আম্মার সাথে যেবার মিরাকে প্রথম দেখতে যায়, তখনই তার মোলায়েম চেহারা দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল। সবাই আমাদের আলাদা করে কথা বলতে ছাদে পাঠালো। ছাদে দাঁড়িয়ে দুজন, মিরা মুখ গোমড়া করে আছে। তাই তাকে বলি; হাসলে আপনাকে ভালো দেখাবে।

আমার কথা শুনে মিরা হেসেছিল একটু৷ তার হাসি দেখে আমি আবারও বলি; দেখেছেন সত্যিই ভালো দেখাচ্ছে আপনাকে। এই সুন্দর মুহূর্তের ছবি তোলা যাক৷ মিরা বাঁধা দেয়৷ আমি জোর করি না৷ আমি প্রশ্ন করি,

  • আচ্ছা আপনার কোনো প্রিয় দিন আছে?
  • আমার সবদিনই প্রিয়৷
  • আমি সেটা বলিনি। থাকে না মানুষের বিশেষ প্রিয় কিছু দিন বা সময়৷ কিংবা অপ্রিয় থাকলেও বলতে পারেন।
  • আমার কাছে প্রতিটা মূহূর্তই প্রিয়৷ আমার প্রিয় প্রত্যেকটা শ্বাস প্রশ্বাস৷
    মিরার কথা শুনে মুগ্ধ হই আমি৷ নীরবতা ভর করে৷ একটু চুপচাপ থেকে মিরা বলে উঠল; দেখেছেন গালের এপাশটা? যেটা আমি চুল দিয়ে আড়াল করে রাখি সবসময়।
    গালের বামপাশটা চুলে ডেকে রেখেছিল সে৷ যেটা আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি। গালে কালসিটে দাগ পড়েছে৷ দেখে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে৷ এই কেঁপে উঠার উৎপত্তি কেন হয়েছিল আমার জানা নেই৷ আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম৷

মিরা মুচকি হেসে ছাদের রেলিংয়ে হাত ভর দিয়ে দূরের আকাশটায় তাকায়৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে; ❝জানেন দু’চারটা চড় আমার প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে থাকে৷ আমার প্রতিবাদ করা হয়ে উঠে না৷ কারণ জানি যে দোষ থাকুক আর না থাকুক, চড় খেতেই হবে৷ গালের এপাশটা আমি চুল দিয়ে আড়াল করে রাখি সবসময়। আমি জীবনের প্রতিটা মূহূর্ত জোর করে ভালো থাকি৷ আমি অতীত মনে রাখি না৷ আজকের সকালটাও না। এমনকি সকালবেলা হজম করা চড়টাও না৷

অতীত বলতে শুধু আমার মায়ের মুখটা মনে রেখেছি। মা আমাকে বলেছিল; “আমি এতোদিন ভাবতাম, মরে গেলে ফুরিয়ে যাবো৷ দুনিয়ার রং আমার বিষাদ লাগতে শুরু করেছে৷ অর্থহীন মনে হতো নিজেকে৷ কিন্তু যেদিন ডাক্তার বলল, আপনি আরও ক’টা দিন বাঁচবেন৷। তারপর থেকে কি যেন হলো৷ আমার দুনিয়ার সবকিছু রঙিন মনে হচ্ছে মা৷ ইচ্ছে করছে, যুগ যুগান্তর বেঁচে থাকি৷ আমি প্রতি রাতে মনে মনে বলি, আল্লাহ আরও ক’টা দিন বেশি বাঁচতে দাও৷”

আমার চারপাশটা যখন বিষাদে ভরে যায়, আমি তখন মায়ের সেই গলা ধরে আসা কথাগুলো অনুভব করি। দুঃখগুলো আমার আর দুঃখ মনে হয় না❞।
একটানা কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরা। আমি এতক্ষণ তন্ময় হয়ে তার কথা শুনছিলাম। ক্ষনিক চুপ থেকে আমি বললাম;

  • জানেন মিরা, আমাদের জীবনটা রংধনুর মতো৷ রংধনুর যেমন ভিন্ন কয়েকটা রঙ থাকে, আমাদের জীবনেরও তেমন রং আছে৷ একেক সময় একেক রং ভর করে আমাদের মনে৷ সেই রং নিয়ে বেঁচে থাকা৷
  • আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো৷ ভালো থাকবেন৷ আমি জানি, আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে না৷ (মলিন হেসে)
  • কেন?
  • ক’বছর ধরে এমনই চলছে৷ পাত্র পক্ষ আসে, যায়৷ আমাকে পছন্দ হলেও তাদের দাবী মিটে না৷ এতিম আমি, খালা-খালুর কাছে মানুষ। এতিম মেয়েকে কি কেউ এমনি এমনি বিয়ে করবে? খালু তো সোজা সাপ্টা বলে দিলেন, দেনা-পাওনা দিয়ে বিয়ে দিবে না৷ ওনার এত ঠ্যেকা পড়ে নি। দরকারে চিরকুমারী রাখবে৷ এখন বলুন, আপনাদের দাবীটা?
  • আমি অতো বেহায়া না মিরা৷ দাবীর কথা আপনার চোখে চোখ রেখে বলবো৷ চলুন নিচে যাওয়া যাক৷

মিরা খালু যখন বলল, দাবী দাওয়া কিছু আছে? আমার আব্বা বললেন; আমার তো মেয়ে নেই, শুধু মেয়েটায় আমাদের দাবী৷
আমি পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো মিরাকে দেখি৷ মুখের বিষন্নতার ছাপটা গায়েব হয়েছে৷ ভর করেছে লজ্জা৷ হয়তো সে বিশ্বাস করতে পারছে না তার সঙ্গে এমন কিছু হবে।
আমাদের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। বাচ্চা হয়নি এখনো৷ পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন সবাই হতাশ৷ বাইরে বাচ্চা দেখলেই আমি মিরার দিকে তাকায়। তার চোখে মুখে মা-ডাক শোনার কি আকুলতা৷ অথচ এই মেয়েটা কোনোদিন মা হতে পারবে না, এটা সে জানত না। ক’দিন হলো জেনেছে৷

ইদানীং মিরার পাল্টে যাওয়ার কারণ আমি খুব বুঝি৷ সে চায় আমি বিরক্ত হই৷ কিন্তু আমার বিরক্তি আসে না। আরও বেশি জড়িয়ে যায়। তার প্রতি জন্মানো অনুভূতিগুলো দিনের পর দিন ঘনীভূত হচ্ছে আরো৷
মোবাইলের রিংটোনে ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে। অফিস কলিগ রাকিব কল দিয়েছে। ছেলেটা ভীষণ অসুস্থ। অল্প বয়সে শরীরে মরনঘাতী রোগ বাসা বেধেছে। বছর দেড়েকের একটা বাচ্চা মেয়ে আছে তার৷ আমি বেশ কয়েকবার বলেছি ডাক্তার দেখাতে, ভালো ট্রিটমেন্ট করতে। কিন্তু শুনে না। সবকিছুতেই অবহেলা, নিজের প্রতি বড্ড উদাসীন সে।

আমি যখন অফিসে দুপুরের খেতে বসি, ছেলেটা তখন সিগারেট পোড়ায়৷ আমি রাগ দেখায়৷ সে হেসে বলে;
আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না ভাই৷ কার জন্য বাঁচবো বলুনতো?

আমি তার ছোট্ট মেয়েটার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷ রাকিব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে; মেয়েটার দিকে আমি তাকাতে পারিনা ভাই৷ মিতুর কথা মনে পড়ে। মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন হয় বলুন তো?
আমি রাকিবের কথার উত্তর দেয় না৷ আমি ভাবি, মিতুর কথা, মিরার কথা৷ মিতুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রাকিব৷ বিয়ের দেড় বছরের মাথায় মা’ও হলো৷ ভালোবাসার মানুষ কিংবা বাচ্চা মেয়েটার আদর ভরা চেহারা, কিছুই পরোয়া না করেই মিতু মেয়েটা অন্য পুরুষের হাত ধরে পালালো! নারীরা আসলে কিসে আটকায় বুঝতে পারি না। অথচ মিরার মতো কত মেয়ে একটাবার মা ডাক শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। কত প্রচেষ্টা, কত চিকিৎসা। আমি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলি এসব ভেবে।
রাকিবকে বলি; আমাকে একটা দে, টানি৷

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রাকিব৷ কাছে যেতেই বুঝলাম, চোখের কোণে জল জমেছে৷ পাশে বসতেই হাতটা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিল সে৷ এর আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি আমি৷ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল; ভাই আমি আর বেশি দিন নেই৷ সময় ফুরিয়ে এসেছে।
আমি কাঁধ চাপড়ে বলি, তোমার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে তাহলে৷

রকিব ডুকরে কেঁদে উঠে বলে; ভাই জানেন, এই কথাটা শোনার পর থেকেই আমার মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে৷ ইচ্ছে করছে, লেপ্টে রাখি বুকের মধ্যে।
আমি কিছু বলি না৷ চুপচাপ চোখের জল লুকায়৷ মিছে মিছে শান্তনা দিতে পারি না আমি।
রাকিব আবার বলে; ভাই আজ থেকে আমার মেয়েকে তোমায় দিয়ে দিলাম। তোমরা দুজন ওর মা-বাবা। আমার মেয়েকে কখনো জানতে দিও না, ওর আসল মা-বাবা কে। নিজের মেয়ের মতো করে রেখো ভাই আমার মেয়েটাকে।

খুব সাবধানে কলিংবেল বাজালাম৷ কোলে রাখা মেয়েটা একটু কেঁপে উঠলো৷ আমি পরম মমতায় হাত বুলাই। দরজা খুলে অবাক হয় মিরা৷ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে৷ আমি মেয়েটাকে মিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম; তোমার মা ডাক শোনার ব্যাকুলতা, আর ওর মা-ডাকার আকুলতা৷
বছর পাঁচেক পর৷

  • শুনো, খাবারে ঝাল কম হয়েছে৷
  • কমই খাও৷ বেশি হলে আমার মেয়ের সমস্যা৷
  • লবণ কম হয়েছে৷
  • কমই খাও, আমার মেয়ের সমস্যা৷ আর শুনো, বেগুনী রঙা শাড়িটা পুরনো হয়েছে৷ আসার সময় দু’টো নিয়ে এসো৷
  • দু’টো?”
  • একটা বড় আরেকটা ছোট৷ আমার মেয়ে শাড়ি পড়বে৷
    এখন সকালের ঘুমটা চুলের পানির ছিটায় ভাঙে৷ মিরা আমার ঘুম ভাঙাতে ভাঙাতে ক্লান্ত৷ এখন মেয়ের চুল বড় করে তাকেও সাথে নিয়েছে৷ মা সরে যেতেই মেয়ে আমার কপালে চুমু দিয়ে কানে কানে বলে; বেশি ঘুমালে শরীর নষ্ট হবে বাপী।
    আমি মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে লেপ্টে রাখি৷ চোখ বন্ধ করে ভালবাসা অনুভব করি৷ মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই আমার পরম শান্তি লাগে৷
    রাকিব ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞতা পুষি মনে মনে। আমি অনুভব করি, জীবনটা আসলে একটা রংধনু৷ যার অনেকগুলো রং রয়েছে৷।।

সমাপ্ত ~

জীবনের রংধনু
লেখনিতে: তানভীর আহমেদ

আরো পড়ুন –

Husband Wife Romantic Love Story

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *