আমি এবং আমরা – A Beautiful Relationship

বাবাকে বললাম, “বাবা,বিয়ে দাও”।
বাবা টিভি দেখছিলেন। হাতের ভিতর রিমোট গোজা। চ্যানেল পালটাচ্ছেন অনবরত। সম্ভবত তিনি যা খুজছেন তা পাচ্ছেন না।
বাবা আমার দিকে তাকালেন না। শান্ত স্বরে বললেন,
” বিয়ে করে বউকে খাওয়াবি কি?”

আমি এ প্রশ্নটার জন্য প্রস্তত ছিলাম। আমি বললাম,
“গরু ছাগল বিয়ে করলে খাস খাওয়াতাম। মাঝে মাঝে ডায়েট ফুড হিসেবে ভুসি খাওয়ানো যেতো। যেহেতু একজন মানুষ বিয়ে করছি সেহেতু তাকে ভাত খাওয়ালেই হবে। “
উত্তর শুনে বাবার রেগে যাওয়ার কথা। তিনি রাগলেন না। তাছাড়া বাবা কখনো রাগেন না। তিনি বুদ্ধিমান মানুষ। কথার প্যাচ তিনি বুদ্ধি দিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন। যদিও অনেক ভেবে চিনতে এ উত্তরটা প্রস্তত করেছি। বাবা এর বিপক্ষে কি উত্তর দেন সেটাই দেখার পালা।
বাবা বললেন,

” সব গরু ছাগল তো ঘাস খায় না। তোমার মত কিছু গরু থাকতে পারে যারা ভাত খাওয়ার সাথে সাথে মানুষের মাথাও খায়। একদম জ্বালাবে না বলে দিলাম। আগে কিছু রোজগার করতে শিখো। তোমার বড় ভাইটা হয়েছে একটা অপদার্থ তুমি তার থেকে বড় অপদার্থ। “

আমি এরকম একটা উত্তর আশা করেছিলাম। যত ভালো উত্তরই আমি প্রস্তত করি বাবা তার ঠিক বিপরীত একটি উত্তর ঠিকই প্রস্তত করে ফেলবেন। তাছাড়া বাবা আমার সাথে সাথে বড় ভাইয়াকেও অপদার্থ ভাবছেন জেনে ভালো লাগলো। অবশ্য বড় ভাইয়াকে অপদার্থ ভাবার কারণ আছে। তিনি বিয়ে করেছেন আজ দু বছর হলো। এখনো একটি চাকরি জোগাড় করতে পারেননি। বলতে গেলে সে আর ভাবী বাবার ঘাড়ে চেপে বসে আছেন। ভাইয়া চাকরির চেষ্টা যদিও করছেন। কিন্তু বাবার ধারণা এসব লোক দেখানো চেষ্টা। তার মন ভর্তি শয়তানি। তাই উঠতে বসতে বাবার কথা শুনতে হয় ভাইয়াকেকে। এজন্য ভাইয়া বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকেন না। এমন সময় বাসায় প্রবেশ করেন যখন বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন।

চাকরি পাবার জন্য ব্রেনে কিছু থাকতে হবে। আমার ধারণা ভাইয়া একজন উচু মাত্রার গাধা। তিনি প্রেম করে সব খুইয়েছেন। একসময় তার রেজাল্ট দেখিয়ে আমরা পুরো পরিবার গর্ব করতাম। কিন্তু ভার্সিটিতে উঠে তিনি বদলে গেলেন। চার বছর প্রেম করে বিয়ে করেছেন। বাবাকে জানাননি পর্যন্ত। আর এমন একটি রেজাল্ট করেছেন যে লজ্জায় মাথা কাটা যায় অবস্থা। (আমার কথা শুনে আপনাদের মনে হতে পারে আমি ভাইয়াকে অপছন্দ করি। আসল সত্যিটা হলো আমি ভাইয়াকে খুবই পছন্দ করি কিন্তু বুঝতে দেই না। )

আমার যে বিয়ে হচ্ছেনা আমি মনে করি সেটা ভাইয়ার জন্যই। তিনি অতি জলদি বিয়ে করে একটি বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু চাকরি না পাওয়ায় তার দোষ কাটা দেওয়া যাচ্ছে না। বাবার বদ্ধমূল ধারণা তিরিশের আগে পুরুষ মানুষ বিয়ে করলে তার মাথা বিগড়ে যায়।

আমি যে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছি সেটাও একরকম ভাইয়ার ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দেয়া যায়। তার আর ভাবীর অতিরিক্ত আহ্লাদ তো আছেই সাথে ভাইয়া সুযোগ পেলেই আমাকে খোটা দেয়ার চেষ্টা করেন। আজকে সকালে ভাইয়ার বাইকটা একটু চাইতে গেলাম কিন্তু তিনি বাইকের চাবি কিছুতেই দিবেন না। আমি একপর্যায়ে বললাম,
“বাবার টাকায় কেনা গাড়ি, আমারও অধিকার আছে। তুমি কেন বাইকের চাবি আমাকে দিবে না?”
“বাবার টাকায় কেনা হলেই কি সেটা তোকে দিতে হবে?এটাতো আমাকে বাবা কিনে দিয়েছেন। “

আমি ভালোমত চেয়ে দেখলাম ভাইয়া যে প্যান্টটা পড়ে আছেন ওইটা আমার প্যান্ট। আমি পক্ষাঘাত করার সুযোগ পেয়ে বললাম,
“বাইকের বেলায় শুধু ওইটা তোমার,আর তুমি যে আমার প্যান্ট পড়ে আছো তার কি হবে?এই মূহুর্তে আমার প্যান্ট ফেরত দেও। “
ভাইয়া থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি সেই মূহুর্তে প্যান্ট খুলে আমাকে দিয়ে দিলেন। অবশ্য তার প্যান্টের নিচে আন্ডারওয়্যার থাকায় লজ্জায় পড়তে হয়নি। তবে আমি ভাবিনি প্যান্ট চাওয়ার সাথে সাথেই সে খুলে দিয়ে দিবে। জানলে অবশ্য আমি চাইতাম না।

বাবা ভাইয়াকে হাত খরচের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তাকে কিছু কিনে দেয়ার বদলে ভাবীকে কাপড় চোপড় কিনে দেন। ভাইয়ার অল্প কিছু শার্ট প্যান্ট আছে। আর সেগুলোর অবস্থাও নাজেহাল। ভালো কোথাও সেগুলো পড়ে যাওয়া যাবে না। আগেই বলেছি বাবা বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি এমনভাবে ভাইয়াকে শাস্তি দিচ্ছেন যে গর্দভ ভাইয়ার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়।

ভাইয়া গর্দভ হলেও তার তর্ক করার ক্ষমতা অসাধারণ। তিনি তর্কে যেকোনো মূল্যে জিতবেন। তিনি শেষমেশ এমন একটি কথা বললেন যে লজ্জায় আমার কান গরম হয়ে গেলো। তিনি বললেন,
“বিয়েটাও তো আমি বাবার টাকায় করেছি। তাই বলে কি আমার বউকে তোর সাথে শেয়ার করতে হবে। আমি তোর ভাই বলে সবকিছুর উপর তোর অধিকার নেই। এটা মনে রাখবি। “
আমি কিছু বলতে পারলাম না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম দরজার পাশে ভাবী দাঁড়িয়ে। তিনি এতক্ষণ কথা শুনছিলেন। চোখে চোখ পড়তেই তিনি ভিতরে চলে গেলেন।

আমার মনে হলো ভাইয়ার গর্ব করার মত কিছু না থাকলেও একটি সুন্দরী বউ আছে। তাকে নিয়ে গর্ব করাই যায়। সেই মুহূর্তে আমি ভেবে নিলাম আমাকেও বিয়ে করতে হবে। ভাইয়া আর ভাবী যদি বাবার ঘাড়ে চেপে বসে থাকতে পারেন আমিও আমার বউকে নিয়ে কোনো মতে ঘাড়ের এক কোনে গুটিশুটি মেরে বসে থাকব। পাতলা দেখে একটা মেয়ে বিয়ে করলে জায়গা পাবার সমস্যা হবে না। তাছাড়া শুটকো একটা মেয়ে খাবেও কম। আমার ভাগের খাবার তাকে অর্ধেক দিয়ে খাব।

কিন্তু বাবার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে নিজে রোজগার শুরু করা ছাড়া আমার আর বিয়ে হচ্ছে না।
বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। যা ভেবে এসেছিলাম সব ভুলে গেছি। বাসার নিচ থেকে ভাইয়ার চেচামেচি শুনছি। উপরে আসার সময় বাইকের চাকার পাম ছেড়ে দিয়েছি। এখন থেকে প্রতিদিন সকালে উঠে পাম ছেড়ে দেব। বাইক না দেবার মজা বুঝাব।

এমন সময় ভাবী এলেন চা নিয়ে। বাবার সামনে পেয়ালা রেখে পাশে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাবীর ইতস্তত ভাব দেখে বাবা বুঝতে পারলেন ভাবী কিছু বলতে চান। তিনি মুখে গম্ভীর ভাব বজায় রেখে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত ভাবী কিছু বলার সাহস সঞ্চার করতে পারলেন না। দ্রুত কিন্ত নিঃশব্দে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর হেলতে দুলতে আমিও রান্নাঘরে হাজির হলাম। ভাবখানা এমন যে খাবার খুজতে এসিছি। কিন্তু তলে তলে ভাবীর সাথে খাতির করতে চাইছি। ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানিতে চুমুক দিয়ে রান্না ঘরে উকি দিলাম। কন্ঠ যথাসম্ভব মধুর করে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি রান্না হচ্ছে মা। বিরিয়ানির ঘ্রাণ পাচ্ছি মনে হলো। “
উকি দিতেই ঝাঝালো কন্ঠে মা চেচিয়ে উঠলো।
“একদম মেয়ে মানুষের মত রান্না ঘরে ঘুরঘুর করবি না। “

আমি আম্মার কথা এতটা আমলে নিলাম না। তিনি বাইরেই ঝাঝালো ভাব ধরে রাখেন। কিন্তু খুবই নরম মনের মানুষ। তিনি ভাবীর পক্ষ না নিলে ভাইয়া এ বাড়িতে থাকতে পারতেন না।
আমি কন্ঠস্বর আরও কোমল করার চেষ্টা করে বললাম,
“কি কাটছো ভাবী?ও মুরগী। মুরগীর পা টা আস্তে করে ধরো। ব্যাথা পাবে। “

হালকা রসিকতা করার চেষ্টা। পরিবেশ ঠান্ডা কিনা তাও জেনে নেওয়া আরকি। ভাবীকে অন্য মনস্ক মনে হলো। ওপাশ থেকে মা হেসে উঠলেন। দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলেন যদিও।
এমন সময় একটা অঘটন ঘটল। আচমকা ভাবী হাত কেটে ফেললেন। বৃদ্ধ আংগুলে গভীর ক্ষত হয়ে গেল। মা চেচিয়ে উঠলেন। শাড়ী দিয়ে মা তার আংগুল চেপে ধরলেন। আমি দ্রুত কাপড় জোগার করে হাত বেধে ফেললাম। রক্তপাত বন্ধ হলো না। আমি বললাম,” সেলাই করতে হবে। ফার্মেসী তে চলো!”
ভাবী নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,” কিছু হবেনা। রক্ত পাত থেমে যাবে দেখো। শুধু শুধু বাজে খরচ। “

মা বলল,
“একদম বেশি কথা বলবে না। “
আমাকে ইশারা করে বললেন,
“দ্রুত নিচে নিয়ে যা। যা রক্তপাত হচ্ছে। ভয়ই লাগছে আমার। এসময় রক্তপাত হওয়া ঠিক না। “
ভাবীকে জোড় করে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনলাম। ভাবী আবারও রান্না ঘরে ঢুকলেন। মা কঠিন কন্ঠে বললেন “এ সময় একটু সাবধানে চলার চেষ্টা করবে। তোমার কাজ করতে হবে না। রেস্ট নাও গিয়ে। “
“আপনি একা পারবেন না মা। আমি থাকি একটু। “
মা একরকম জোড় করেই ভাবীকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিল। আমি একটু পরেই ভাবীর রুমে হাজির হলাম,
-” ভাবী আসব?”

ভাবীর পেটের কথা না জানতে পারলে আমার পেটের ভাত হজম হবে না। শেষমেশ অতি জোড় জবরদস্তি করে যা শুনলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গেল।
ভাবী তিনমাসের প্রেগন্যান্ট। মা কেনো বারবার তাকে সাবধানে কাজ করতে বলছেন তা বুঝে আসল। যদিও ভাইয়াকে কথাটি বলার সাহস পাননি। কিভাবে বলবেন তাও বুঝতে পারছেন না। একটি চাকরির চেষ্টায় ভাইয়ার জীবন যায়যায় অবস্থা। আজকে ভাবীর মেডিকেল চেকআপ করতে হবে। এক হাজার টাকা প্রয়োজন।
সবকিছু শুনে আমি বললাম,

“আমি থাকতে আপনার কোনো টেনশন নাই। আমি আপনার ছোটো ভাই। সব টাকা পয়সা আমি জোগাড় করে দেব”
ভাবী আমার আত্মবিশ্বাস দেখে স্মিত হাসল।
“তুমি টাকা পাবে কোথায়?তুমিতো কাজ করো না। “
“সেটা আমার উপর ছেড়ে দেন ভাবী। টাকা আমি জোগাড় করছি। “

আমার পুরাতন টেকনিকটা আবার অবলম্বন করতে হবে। কাজটা করতে হবে খুব সাবধানে। দ্রুত আব্বার রুমে গিয়ে বালিশের নিচ থেকে চাবি বের করলাম। নিঃশ্বব্দে আলমারি খুলে চার হাজার টাকা বের করলাম। চাবি যথাস্থানে রেখে আমি পগারপার। অপদার্থ যখন হয়েছি। কিছু ভালো কাজ করে অপদার্থ হই।
ভাবীর হাতে টাকা দিয়ে আমি দাত কেলিয়ে হাসলাম।
“তোমার আগামী চারবার মেডিকেল চেকআপ এর টাকা। টাকা লাগলে আমার কাছে চাইবে কোনো অসুবিধা নাই। “

ভাবীকে চিন্তিত দেখাল। তিনি বললেন,
“তুমি ঠিক কোনো বিপদে পড়বে দেখো। এত রিস্ক নেওয়া ঠিক হয়নি। বাড়িতে তোমার অবস্থা তোমার ভাইয়ার মতই নাজেহাল। “
আমি হেসে বুঝিয়ে দিলাম আমি এসব গায়ে মাখি না।
গায়ে না মাখলেও মাঝে মাঝে অর্থের চিন্তা আমার মনে অনবরত খচখচ করতে থাকে। বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে আর কতকাল। একজন নতুন মানুষ আসছে দুনিয়াতে। এসেই সে মারাত্মক অর্থকষ্টে পড়বে এটা হতে দেওয়া যায় না। আমার কিছু করতে হবে। ভেবেচিন্তে আরও দুটি টিউশন নিলাম। চারটি টিউশন শেষ করে নিজের পড়াশোনা করতে একটু কষ্ট হতে লাগলো। নিজেকে শান্তনা দিলাম এই ভেবে আর মাত্র কিছুদিন। নতুন মানুষটা যখন আমাকে চাচ্চু বলে ডাকবে আমার সব কষ্ট সেদিন উবে যাবে।

সময় যত যাচ্ছে বাসার সবাই তত চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। বাসার এলোমেলো ভাব দেখেই সবার মনের ভেতর প্রচন্ড টেনশন টের পাওয়া যায়। ভাবী এখনও ভাইয়াকে মুখ ফুটে তার বাচ্চার কথা বলতে পারেনি। তবে এতদিনে ভাইয়ার জেনে যাওয়ার কথা শত হলেও সে তার স্ত্রী। তবে ভাইয়া যা গর্দভ। তার উপর সন্দেহ রয়েই যায়। ভাইয়া যদি নিজে নিজেও ব্যাপারটা আচ করে থাকে সে কোনো রকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে না। সে এখনও অতটা অধিকার অর্জন করতে পারেনি।

একদিন সন্ধ্যার পর চারটি টিউশন পড়ে গেল। রাস্তায় এসে দেখি রাত তখন বারোটা ছুইছুই করছে। বাস পেলাম না। শেষে পাঠাও কল করলাম। পকেট হাতিয়ে দেখলাম রাইডে যাওয়ার পর্যাপ্ত টাকাও নেই। ভাবলাম বাসার সামনে গিয়ে ঘর থেকে আনিয়ে দিব।

বাসার সামনে পৌছে যখনি কথা বলতে যাব তখন পাঠাও ড্রাইভার বলে উঠল,
“এত রাত্রে তুই বাইরে কেন?”
আমি দেখলাম ভাইয়া কথা বলছে। আমি অবাক হলাম। ভাইয়া হেলমেট পড়ে থাকায় তাকে চিনতে পারি নি।
“তুমি রাইড শেয়ার করছো কবে থেকে?”
“যেদিন জানলাম তোর ভাবী প্রেগন্যান্ট। এই সময়ে ঘরে টাকা থাকা প্রয়োজন। কখন কি হয়ে যায় বলাতো যায় না। তুই এখনোও বাইরে কেন?
” টিউশন ছিল। “

আমার বিস্ময় ভরা মুখ দেখে ভাইয়া বলতে লাগল,
“দিনের বেলায় ইন্টারভিউ থাকে। সাধারণত সন্ধ্যার পর রাইড শেয়ার দেই। আজ শুরু করতে দেরী হয়ে গেল। তুই হইলি আজকের আমার প্রথম যাত্রী। আরও দুই একটা ট্রিপ দিয়ে আসি। তুই বাসায় যা। “

ভাইয়া বাইক স্টার্ট করে নিমিষেই বেড়িয়ে গেল। আমি নিঃশব্দে খোলা আকাশের নিচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।
ঈদের ঠিক আগে বোনাস সহ ভালো কিছু টাকা পেলাম। ঠিক বুঝলাম এ টাকা পর্যাপ্ত নয়। টাকা সঞ্চয় করে রাখতে হবে। নিজের জন্য কিছু কিনলাম না। ভাইয়ার জন্য একটা সাদা শার্ট কিনলাম। ভাইয়ার ইন্টারভিউ দেয়ার সাদা শার্টটা কলারের দিক দিয়ে ছিড়ে গেছে। খুব সন্তর্পণে সেলাই করার পরেও সেটা স্পষ্ট বুঝা যায়। ভাইয়াকে সেটা নিয়ে অতটা বিব্রত মনে হয়না। এখন ভাইয়ার চিন্তাভাবনা তার আগত সন্তানকে নিয়েই। আমার সাথে মুখোমুখি হলেই টুকটাক আলাপ করার চেষ্টা করে।

“তোর কি মনে হয় তোর ভাবীর ছেলে হবে না মেয়ে হবে?যদিও আমার মনে হয় তার মেয়ে হবে। কিন্তু মা বলল ছেলে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। দেখেছিস তো তোর ভাবীর নাকমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। এটা ছেলে হওয়ার লক্ষ্মণ। যদিও ছেলে মেয়ে যাই হোক আমি মহা খুশি। তবে একটি মেয়ে হলে বড়ই ভালো লাগত। “
আমি স্মিত হাসি। ভাইয়া উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করে না। ব্যাস্ত ভাবে বেড়িয়ে যায়।
ভাবীর জন্যও কিছু কাপড় কিনলাম। ভাবী তা দেখে মন খারাপের ভংগি করে বলল,
“শুধু শুধু টাকা নষ্ট করলা ভাই। এই পেট নিয়ে ওসব পড়তে পারব?”

মুখে এসব বললেও আমি বুঝলাম ভাবী বেশ খুশি হয়েছেন। উলটে পালটে কাপড়গুলো দেখলেন। কিছুক্ষণ বুকের কাছে ধরে রাখলেন।
ঈদের আগেরদিন সন্ধ্যায় আব্বুর ঘরে ডাক পড়লো। আমি বুঝলাম ওইদিন টাকা চুরির অপরাধে আজ হয়ত কথা শুনাবেন। অবসরপ্রাপ্ত একজনের কাছে চার হাজার টাকা প্রায় অনেক টাকা। কিন্তু রুমে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। বাবা কাছে এসে হাতে একটি লাল পাঞ্জাবি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখতো পছন্দ হয় কিনা?”

আমি পাঞ্জাবি গায়ের সাথে চেপে ধরে সাইজ মিলানোর চেষ্টা করছি। তখন ধরে আসা কন্ঠে বাবা বললেন,
“এবার ঈদে কিছু দিতে পারলাম না। কিছু মনে করিস না বাবা। তোর ভাবীর অপারেশন এর জন্য টাকা জমাচ্ছি। কখন কি হয়ে যায় বলাতো যায় না। “
ঈদের দিন সকালে অনেক দিন পর বাড়িতে একটা খুশির আমেজ তৈরি হলো। ভাইয়াকেও দেখলাম সবার সাথে নাস্তা সারছেন। মজার ব্যাপার হলো আমরা কেউ নিজের জন্য কিছু কিনিনি। তবুও সবাই নতুন কাপড় পড়ে ঘুরাঘুরি করছে। বাবা আর মা কে ভাইয়া পাঞ্জাবি শাড়ি দিয়েছে। পাঞ্জাবি পড়ে বাবা গর্বিত ভংগিতে হাটাহাটি করছেন। ভাবীকে দেখা গেলো পেট ধরে ধরে সবাইকে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন। মা তাকে বসে থাকতে বললেও তিনি কথা গায়ে মাখছেন না।

ঈদের নামাজ পড়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম বাসার পরিস্থিতি বদলে গেছে। ভাবীর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ভাইয়া বাসায় নেই। বাবা গাড়ী জোগাড় করতে নিচে গেছেন। মা চেচাতে চেচাতে বললেন,
“পানি ভেঙেছে। হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নিতে হবে। “

আমি কোলে করে ভাবীকে নিচে নিয়ে গেলাম। ততক্ষণে বাবা এম্বুলেন্স নিয়ে হাজির হলেন। দ্রুত ভাবীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
ভাবীর অবস্থা ভালো না। তিনি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন বাড়ে বাড়ে। অতিরিক্ত ব্লিডিং হচ্ছে। বেবীর মাথা খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেবী উলটা দিকে মুখ করে আটকে আছে।

ডাক্তার এসে বললেন রক্ত লাগবে। প্রচুর রক্ত লাগবে। রোগীকে ইমার্জেন্সি তে নিতে হবে। একটা ভালো এমাউন্টের টাকা লাগতে পারে। টাকা জোগাড়ের ব্যাবস্থা করেন। ডাক্তার প্রায় সাথে সাথে ব্যাস্ত ভংগিতে বেড়িয়ে গেলো।
বাবা বললেন উনি আলমারীতে আলাদা করে পঞ্চাশ হাজার টাকা রেখেছেন সেটা নিয়ে আসতে। আমি আলমারী খুলে দেখলাম সেখানে টাকা রাখা ছেচল্লিশ হাজার। আমার চার হাজার টাকা সরিয়ে নেয়ার পরেও কেন বাবা কিছু জিজ্ঞেস করেননি তা বুঝতে পারলাম। তিনি ভাবীর জন্য অনেক আগেই টাকা আলাদা করে রেখেছিলেন। এবং সেখানে হাত দেননি বলে তিনি ব্যাপারটি জানেন না।

আমি আমার সমস্ত সঞ্চয় গুনে দেখলাম সেখানে তেইশ হাজার তিনশো তেত্রিশ টাকা আছে। সমস্ত টাকা কাউন্টারে জমা করে দিলাম। ভাবীকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো। মা হাসপাতালের বাইরেই মোনাজাত ধরেছেন, কান্নাকাটি করছেন। বাবা ক্ষণে ক্ষণে মাকে ধমকাচ্ছেন। চিন্তুিত মুখে পায়চারি করছেন। ভাইয়া এখনো হাসপাতালে এসে উপস্থিত হননি। তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবীর অবস্থা সিরিয়াস। ডাক্তার নার্সরা হুড়োহুড়ি করছেন।
ঠিক যখন সন্ধ্যার আজান দিল তখন একজন ডাক্তার এসে বললেন “মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চা সুস্থ আছে। মায়ের অবস্থা ক্রিটিকাল। তাকে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে ভর্তি করতে হবে। অনেক ব্লাড লস হয়েছে। ব্লাড দেওয়া হচ্ছে। ২৪ ঘন্টায় জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনা নেই। “

একই সাথে দুটো সংবাদ শুনে আমরা আবেগশূন্য হয়ে গেলাম। হাসব না কাদব বুঝতে পারলাম না। মা ছোটো বেবিকে কোলে নিয়ে কাদছেন। বাবা পাশে দাঁড়িয়ে অতি আগ্রহের সাথে বলছেন,
“আমার কোলে দাও। আমার কোলে দাও। “
আমার চোখে জল চলে এলো।

ভাইয়া রাত দশটার সময় হাজির হলেন। ভাবী তখনও গভীর ঘুমে। আমার দু হাত ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন,”আমার মেয়ে হয়েছে!আমার মেয়ে হয়েছে!”
তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। পরমুহূর্তেই একটু লজ্জা পেয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। প্রায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“টাকা পয়সার কি অবস্থা? “

“অর্ধেক দেওয়া হয়েছে। বাকি অর্ধেক এখনো জোগাড় হয়নি। “
ভাইয়াকে ভাবুক মনে হলো। যেন তিনি দ্রুত কিছু চিন্তা করছেন।
দুদিন পর ভাবীকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। অত্যাধিক দূর্বল শরীর নিয়ে যেন তার কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপরই তিনি মা’র ধমক খাচ্ছেন।
“তুমি নড়বে না। নড়ার প্রয়োজন নাই। কি লাগবে বলো আমি এনে দিচ্ছি। “

ভাইয়া তার অতি পছন্দের বাইকটা বেচে দিয়ে বাকি টাকা জোগাড় করলেন। চোখে চোখ পড়তে বলে উঠেন,
“বেশ কয়েকদিন ধরে বাইকটা ভারী সমস্যা দিচ্ছে। রাতে ভালো বাইক রেখে দিলাম সকালে উঠে দেখি দুটো চাকার একটায়ও হাওয়া নেই। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বেচে দিয়েছি। ভালো করেছি না?”
খুশির আমাজের মধ্যেই আর একটি ব্যাপার ঘটলো। ভাইয়া একটি চাকরি জোগাড় করে ফেললেন। স্টার্টিং স্যালারি পঞ্চাস হাজার টাকা। ভাইয়া গম্ভীর মুখে বললেন,
“বুঝলি!এই চাকরি পাওয়ার পিছনে আমার কোনো ক্রেডিট নাই। সমস্ত ক্রেডিট আমার মেয়ের। প্রথমবার মেয়ে সন্তান হওয়া একটা বরকত। সে তার রিজিক নিজের হাতে নিয়ে হাজির হয়েছে”

পুনশ্চ ১-
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে আমি পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি। একদিন বাসায় ঢুকার সময় দেখলাম নতুন একটা বাইক ফুল দিয়ে সাজানো। চুপিচুপি মার থেকে শিউর হলাম বাইকটি আমার জন্যই কেনা হয়েছে। বাবার কাছে গিয়ে বললাম,
“বাবা ধন্যবাদ। অনেক দিন ধরে মনে মনে চাইছিলাম। “

বাবা এমন একটা ভাব করলেন যেন তিনি কিছু জানেন না। গেলাম ভাইয়ার কাছে,
“ভাইয়া!তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। বাইকটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। “
“পছন্দ হলেও লাভ নাই। বাইকটি আমার জন্য কিনেছি। “
মাঝখান থেকে ভাবী উঠে বলল, “কেন ঠাট্টা করছো। “
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” তোমার বাবা আর ভাই মিলে তোমাকে উপহার দিয়েছেন। তোমাকে চাবি দিব তবে শর্ত হলো একদিন অবশ্যই আমাকে ফুচকা খাইয়ে আনতে হবে”।
ভাবী হেসে ফেললেন। ভাইয়াও হাসতে শুরু করলেন। তার মেয়ে বলে উঠলো,”আমিও ফুচকা খাব”।

পুনশ্চ ২-
প্রতিদিন সকালে কে যেন আমার বাইকের পাম ছেড়ে দেয়। জিজ্ঞেস করলে ভাইয়া এবং তার মেয়ে মিটিমিটি হাসে। আপনারা কি বলতে পারবেন কে এই কাজ করে?

গল্প- আমি এবং আমরা
লেখা – পারভেজ মোশাররফ


Read More: একটি ডায়েরি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *