জলপদ্ম – Bonyo premer golpo full: পরাগ সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখ চেপে ধরেছিল। আর কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, ছিঃ! এমন কথা কেউ বলে? মৃত্যুর কথা আর কখনো বলবে না।
১ম পর্ব
বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার ডিভোর্স হয়েছে। ডিভোর্সের একমাত্র কারণ আমি কোনদিন সন্তানের মা হতে পারবো না। ডাক্তার বলেছে। আর এই কথা শুনে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়েই আমার স্বামী নিতুল বললো, নিতু, তোমাকে একটা ভয়ংকর কথা বলবো এখন। তুমি প্লিজ প্রস্তুত হয়ে নাও কথাটা শোনার জন্যে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ভণিতা করছো কেন? সহজ করে বলে ফেলো তো কী বলতে চাও।
নিতুল কঠিন মুখ করে বলে ফেললো, আমি তোমাকে নিয়ে আসলে সংসার করতে পারবো না। তাছাড়া আমার মাও যখন শুনবেন যে তুমি কখনো কনসিভ করতে পারবা না তখন মাও সেইম কথাটাই বলবেন। বলবেন তোমায় ডিভোর্স দিয়ে দিতে!
আমি নিতুলের দিকে অসহায় এবং অবাক হওয়ার চোখে তাকিয়ে রইলাম। নিতুল মুখ শক্ত করে রেখেই বললো, নিতু আমি অপারগ। সন্তান দিতে পারবে না, বন্ধ্যা এমন মেয়ে নিয়ে গল্প উপন্যাসের নায়কেরাই শুধু সংসার করতে পারে। বাস্তবে এমন হয় না। নিতু আমি তোমাকে সত্যি সত্যিই ডিভোর্স দিবো।
নিতুলের সাথে সাথে তবুও তার বাসা পর্যন্ত গেলাম।
ভাবলাম আমায় এভাবে বেহায়ার মতো ওর পেছন পেছন যেতে দেখে আমার প্রতি ওর মায়া জন্মাবে। তখন আর আমায় ডিভোর্স দিতে পারবে না ও। কিন্তু অদ্ভুত রকম কান্ড হলো বাড়িতে যাওয়ার পর সবকিছু শুনে ওর মা বললেন, নিতুল, শত হোক নিতুর সাথে তুই তিন বছর সংসার করেছিস। ওর প্রতি তো আমাদের একটা দায়িত্ব কর্তব্য তো আছে। ওকে ডিভোর্স দিতে হলে দিবি। দু তিন মাস যাক। ততদিনে তোর জন্য আমরা নতুন বউ দেখি। নিতুও আমাদের সাথে বউ দেখবে।
আমি তখন ভীষণ রকম চমকে উঠলাম। পৃথিবীতে একজন নারী অন্য একজন নারীর প্রতি এতো নিষ্ঠুর হতে পারে তা ভাবতেও পারছি না আমি। এই বাড়িতে থাকার আর কোন ইচ্ছে হচ্ছে না আমার। আমি সঙ্গে সঙ্গে কান্নামাখা গলায় বললাম, নিতুল আর কোন মায়া দেখাতে হবে না আমার প্রতি। যথেষ্ট মায়া দেখিয়েছো। আমি এক্ষুনি চলে যাবো বাসায়। মার কাছে চলে যাবো।
নিতুলের মা বললেন, তাহলে নিতুল গিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসুক?
আমি বললাম, না আমাকে কারোর দিয়ে আসতে হবে না।
নিতুলের মা এবার নিতুলকে বললেন, নিতুল, তুই তবে ওকে তিন তালাক বলে দে। মামলা ডিসমিশ হয়ে যাক।
নিতুল সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলো-
এক তালাক
দুই তালাক
তিন তালাক
রাত করে বাড়িতে ফেরার মা ভীষণ রকম অবাক হয়ে গেলেন। অবাক হলেন ভাইয়াও। মা ভয় কাঁপা গলায় বললেন, কী হয়েছে নিতু? অত রাতে যে একা একা চলে এলি?
আমি সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠে বললাম, মা মাগো আমি একেবারে চিরতরে চলে এসেছি।
ভাইয়া অবাক হওয়া গলায় বললেন, মানে?
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, আমায় নিতুল ডিভোর্স দিয়েছে।
মা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কী বলছিস? হঠাৎ করে এমন করলো কেন ও?
আমার সন্তান হবে না এই জন্য। ডাক্তার বলেছে আমি কোনদিন মা হতে পারবো না।
ভাইয়া একেবারে চুপ হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। মা কাঁদতে শুরু করলেন আমায় জড়িয়ে ধরে। আর আমি ভাবতে লাগলাম, আমার কী উপায় হবে এখন? আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল এভাবে!
সকাল বেলা পরাগ এলো আমাদের বাসায়। পরাগ আমার ভাইয়ের বন্ধু এবং আমার প্রাক্তন। তার চাকরি ছিল না বলে তখন তার সাথে আমার বিয়েটা হয়নি। তার মা এসে ছিলেন আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে। কিন্তু
মা তার মাকে এক রকম অপমান করেই সেদিন বলেছিলেন, আপনার বেকার ছেলের কাছে আমার মেয়েকে তুলে দিয়ে নিজের পায়ে আমি কুড়াল বসাতে চাই না!
সেই পরাগ এসে মাকে বললো, আন্টি, কী শুনেছি এটা নিতুর বিষয়ে?
মা কেঁদে উঠলেন হাউমাউ করে। বললেন, সত্যি শুনেছো বাবা। আমার নিতুর সব শেষ হয়ে গেল।
মেয়েটার কী যে হবে এখন!
পরাগ সঙ্গে সঙ্গে বললো, আন্টি আপনি কিছু না মনে করলে আমি একটা আবদার করতে চাই!
কী আবদার করতে চাও বাবা?
নিতুর দায়িত্ব নিতে চাই আমি। নিতুকে বিয়ে করতে চাই আমি!
মা সঙ্গে সঙ্গে—–
২য় পর্ব
মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পরাগ এই যে চেয়ারটায় একটু বস তো বাবা। এক কাপ চা খাও। তারপর তোমার বন্ধু পল্লবের সাথে গল্প গুজব করে বাড়ি ফিরে যাও। শুনো বাবা, আবেগে পড়ে মানুষ অনেক কিছু বলে ফেলে। করেও ফেলে অনেক কিছু। কিন্তু পরে পস্তাতে হয়। আমি চাই না তুমি আবেগ গ্রস্ত হয়ে এমন কিছু করো!
পল্লব বললো, না আন্টি আমি আবেগী হয়ে কিছুই বলছি না। তাছাড়া আমি মেরিডও না। আপনি জানেন কি না জানি না। কিন্তু পল্লব জানে, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে কখনও বিয়েই করবো না। একচ্যুয়েলি লজ্জা রেখে তো আর লাভ নেই। আমি মাকে বলে দিয়েছিলাম নিতুকে ছাড়া আর কারোর সঙ্গে আমার সংসার করা ইম্পসিবল। কারণ আমি একেক দিন একেক জনকে ভালো বাসতে পারবো না!
মা খানিক সময় চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আজ তুমি উঠো। আমি এই বিষয়ে নিতুর সঙ্গে কথা বলবো। ওর রাজি না রাজির একটা ব্যপার আছে। আর তোমাকেও তিনদিন সময় দেয়া হলো। এই তিনদিন তুমি খুব করে ভাবো। ভেবে দেখো এই রিস্ক তুমি নিতে পারবে কি না! এটা কিন্তু ছেলে খেলা নয়। যার সাথে তুমি সংসার করবে তার কোন সন্তান সন্তুতী হবে না। এখন হয়তো আবেগের বশে নিতুকে বিয়ে করলে।
তিন বছর পর দেখা গেল নিতুলের মতো তুমিও বললে, তোমাকে দিয়ে আর চলবে না আমার নিতু। আমার সন্তান চাই। সন্তান ছাড়া আমার কোন ভবিষ্যৎ নাই। তোমাকে আমি তালাক দিচ্ছি-
এক তালাক।
দুই তালাক।
তিন তালাক।
পরাগ চমকে উঠা গলায় বললো, আন্টি এই রিস্ক তো আমি আরো আগেই নিয়েছি। আমি এমনও যদি জানতাম যে নিতু আর মাত্র তিন বছর বাঁচবে তবুও তাকে আমি বিয়ে করতাম।
মা বললেন, আচ্ছা যায়হোক তোমার হাতে সময় আছে পর্যাপ্ত। মেয়ের তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। তার বিয়ে হবার সম্ভাবনা জিরো। তুমি অনেক সময় নিয়ে ভাবতে পারো। তারপর দেখো কী করতে পারো!
পরাগ বললো, আচ্ছা। আমি কী নিতুর সাথে একটু কথা বলতে পারি আন্টি?
মা বললেন, না। ওর সাথে এখন কোন কথা বলা যাবে না।
পরাগ বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। আজ তবে আসছি।
মা বললেন, আচ্ছা যাও।
পরাগ চলে যাওয়ার পর মা এলেন আমার কাছে। এসে বললেন, সব তো শুনেছিস? ছোকড়াটা এসেছে দরদ দেখাতে। আরে তোদের সাথে আমাদের না মিলে বংশ গৌরব না মিলে অর্থ সম্পত্তি। যায়হোক এখন এটা বিষয় না। তোর হাতে ভালো সরকারি চাকরি আছে। কিন্তু এই চাকরির লোভে তোর হাতে মেয়ে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। তোদের মতো ছেলেদের আমি চিনি। এটা ভালোবাসার কোন বিয়ে হবে না। এটা হবে প্রতিশোধ নেয়ার আনুষ্ঠানিক আয়োজন। এটা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। কিছুতেই না।
আমি মার দিকে তাকিয়ে রইলাম। পরাগকে আমি এক সময় পাগলের মতো ভালো বাসতাম। পরাগও আমায় ভালো বাসতো। পরাগ আর আমি একবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম। ওর মাথা ছুঁয়ে আমি বলেছিলাম, পরাগ, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি মেনে নিতে পারবো না। মা যদি জোর করে অন্য কোন ছেলের সাথে আমায় বিয়ে দিয়ে দিতে চায় তবে আমি বিষ খেয়ে মরে যাবো!
পরাগ সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখ চেপে ধরেছিল। আর কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, ছিঃ! এমন কথা কেউ বলে? মৃত্যুর কথা আর কখনো বলবে না।
তারপর পরাগ আমার মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলো। সে বললো, নিতু, আমি মৃত্যুর মতো কঠিন বিষয়কে ভয় পাই তাই মরে যাওয়ার মতো কঠিন প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পারবো না। তবে যা পারবো তা হলো আমার জীবনে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন নারীকে আসতে দিবো না। তোমায় যদি না পাই তবে অন্য কোন মেয়েকে আমি বিয়ে করবো না। আল্লার কসম। (কসম কাটা ভালো নয়)
পরাগ তার কথা রেখেছিল। আমি বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে সব ভুলে গিয়েছিলাম। প্রতিজ্ঞা রাখা হয়নি। মা বলেছিল, নিতুলকে বিয়ে না করলে মা সোইসাইড করবে। আমি তখন ভয় পেয়েছিলাম। বাধ্য হয়েছিলাম সেদিন বিয়ে করতে।
বিয়ের পর যে পরাগকে ভুলে গিয়েছিলাম একেবারে বিষয়টা এমন না। বারবার মনে পড়তো ওর কথা। আমি শুধু ভুলে থাকার অভিনয় করতাম। আমার মনে হয় পৃথিবীর সব মানুষই এমন। সত্যিকারে কেউ কাউকে ভুলে থাকতে পারে না। শুধু চেষ্টা করে ভুলে যাওয়ার। আর অভিনয় করে যে আমি ভুলে গেছি। সম্পূর্ণ রকম ভুলে গেছি।
ঠিক তিনদিন পর পরাগ আবার এলো আমাদের বাড়িতে। এসে মাকে বললো, আমি প্রস্তুত আন্টি।
মা খেয়ালি সুরে বললেন, কিসের জন্য প্রস্তুত তুমি?
পরাগ সহজ গলায় বললো, নিতুকে বিয়ে করার জন্য। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে নিতুর আমার জীবনে ফিরে আসাটা হবে আমার জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ! ওকে পাওয়া হবে আমার পরম সৌভাগ্য!
মা কঠিন গলায় বললেন, শুধু তুমি এসে এসব বললে তো হবে না। মুরুব্বি লাগবে। তোমার মুরুব্বি তো তোমার মা। তোমার মাকে পাঠাও আমাদের বাড়িতে। উনি এসে বলুক। তারপর ডিসিশনে যাবো আমরা।
পরাগ বললো, আন্টি, মা এখানে আসবেন না।
কেন আসবে না? আজ আমার মেয়ে ডিভোর্সি বলে ভাব দেখাচ্ছে?
না আন্টি বিষয়টা তেমন না। মা আগে একবার এসে লজ্জিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি এখানে আসতে লজ্জা পাচ্ছেন। তবে তাকে আমি রাজি করিয়েছি। তিনি আমায় সম্পূর্ণ অনুমতি দিয়েছেন।
মা হেসে উঠলেন। হেসে বললেন, পরাগ এটা ছেলে খেলা নয় বাবা। তোমার মতো একটা বাচ্চা ছেলের কথায় তোমার হাতে আমার মেয়েকে আমি তুলে দিতে পারি না। এখন যাও। মাকে নিয়ে আসো।
পরাগ বললো, আন্টি, নিতুর সাথে আজ একটু কথা বলা যাবে?
মা বললেন, না। সে কথা বলতে পারবে না।
পরাগ কী করবে আর! বোকার মতো মার সামনে থেকে উঠে বাসার দিকে পা ফেললো।
৩য় পর্ব
অত জেদ ভালো নয়। মার জেদ শেষে মাটি হলো। অহংকার মিশে গেল মাটির সাথে। সেদিন আমাদের বাড়ি থেকে পরাগ অপমানিত হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমি কাঁদতে শুরু করলাম। মা বললেন, কাঁদছিস কেন তুই? কী হয়েছে রে নিতু?
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, তোমার এই জেদটার কারণেই আমি একবার আমার সুখ হারিয়েছিলাম। পরাগকে কঠিন কষ্ট দিয়েছিলাম। এর ফল কী ভালো হয়েছে? ভালো হয়নি। এবারের জেদটার ফল কী হবে? আমায় কী এবার তুমি মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিতে চাও মা?
মা আমার কথার জবাব দিতে পারলেন না। রাতে ভাইয়া বাসায় ফিরলে মা সবকিছু ভাইয়ার কাছে বললেন। ভাইয়া শুনে বললো, মা তুমি মূর্খের চেয়ে অধম। পরাগ আর কখনো বোধহয় আমাদের বাড়িতে ফিরবে না। কোনদিন না!
মা বললেন, আমি ওকে ফেরাবো। আমি ভুল করেছি এর মাশুল তো আমাকেই দিতে হবে!
সে রাতেই মা একা একা চলে গেলেন পরাগদের বাড়ি। তারপর পরাগের মার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। তারপর বিয়ের ব্যাপারে কথা বললেন। পরাগের মা বললেন, এতে আমার কোন অমত নাই। আমার সন্তানের মঙ্গলের জন্য আমি সব করতে পারি।
মা হাসি মুখে পরাগদের বাড়ি থেকে ফিরলেন। এর ঠিক পনেরো দিন পর আমার আর পরাগের বিয়ে হয়ে গেল। বাসর রাতে পরাগ আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বললো, নিতু আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমার চেয়ে কোন সুখী মানুষ এই পৃথিবীতে নাই।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ এটা কে বললো?
আমি বলেছি। তোমাকে পাওয়ার পর মনে হয়েছে আমার আর কোন দুঃখ নাই।
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর বললাম, আমার সম্পর্কে সবকিছু জানার পরও তুমি কেন আমায় বিয়ে করতে রাজি হলেন?
পরাগ মৃদু হেসে বললো, ভালোবাসি বলে। তাছাড়া তোমার সন্তান হবে না এটা কী করে ডাক্তার জানে? সন্তান দানের মালিক কী ডাক্তার? আমার তো মনে হয় তুমি সন্তানের মা হবে শীঘ্রই!
আমি ওর কথা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। আর ভাবলাম, কত সহজ মনের একটা মানুষ এই পরাগ। কত সুন্দর করে ভাবতে পারে সে। এমন করে তো নিতুলও ভাবতে পারতো। একদিন ঠিক আমাদের কোল আলো করে সন্তান আসবে এমন একটা আশায় সাড়াটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো না সে?
পরাগের সাথে আমার দিনগুলো ভালোই কাটছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর মা কেমন খাপছাড়া আচরণ করতে লাগলেন আমার সাথে। বাড়ির সব ফুট ফরমাশ করাতে লাগলেন আমায় দিয়ে। সেদিন সকাল বেলা হঠাৎ করে বললেন, নিতু, আমারে এক কাপ চা দেও তো।
আমি এক কাপ চা করে নিয়ে গেলাম শাশুড়ি মার কাছে। সেই চা মুখে দিয়ে মুখ কুঁচকে চায়ের কাপটা ফেলে দিলেন মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে ঝনাৎ করে ভেঙে খান খান হয়ে গেল কাপ। তারপর মা বললেন, এইটা চা করছো না শরবত করছো?
আমি চুপ করে নিচ দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মা বললেন, এমন বেকুবের মতন দাঁড়াইয়া রইছো কেন? এমন আকাইম্যা একটা মাইয়া নিয়া তো তোমার মা বিরাট ভাব দেখাইছিলো!
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, মা আমি আরেক কাপ চা করে আনি?
শাশুড়ি মা আমায় ধমক দিয়ে বললেন, একটা কাপের দাম আশি টাকা। আশি টাকা নষ্ট হইলো তোমার এই গু মার্কা চা বানানির লাইগা। আমি এই সকাল বেলা আরেকটা কাপ ভাইঙ্গা আমার পয়সা নষ্ট করতে চাইনা। এখন সামনে থাইকা তুমি বিদায় হয়। এমনিতেও তুমি অপয়া। বন্ধ্যা। গুণীজন কয়, সকাল বেলা এইসব মানুষের মুখ দেখলে সারা দিনটাই মাটি! তুমি আর কোনদিন ভোর সকালে আমার চোখের সামনে পড়বা না। এখন এইভাবে খাম্বার মতন দাঁড়াইয়া না থাইকা সড়ো। যাও!
মার সামনে থেকে কাঁদতে কাঁদতে এলাম আমি রান্না ঘরে। ইচ্ছে করলেও এখন আমি বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে যেতে পারবো না। ভাত শালুন রাঁধতে হবে আমার। পরাগ বাজার করতে গেছে। ওখান থেকে এসে সে গোসল করে সকালের খাবার খাবে।
তারপর অফিসে যাবে। দেরি করা যাবে না। অবশ্য পরাগের সামনেও কান্না কান্না ভাব করে থাকা যাবে না। ওর সামনে থাকতে হবে হাসিখুশি। পরাগ তার মাকে খুব ভালোবাসে। আমি চাই না তাদের মা ছেলের সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে কোন ফাটল ধরুক। তারচেয়ে আমি একটু কষ্ট করি। হতে পারে এই কষ্টের শেষে আমার জন্য অপেক্ষা করছে পরম সুখ।
৪র্থ পর্ব (অন্তিম)
কিছু কিছু মানুষ অত্যাচার করতে গিয়েও করতে পারে না। আমার শাশুড়ি মা এদের দলের। দু চার দিন তিনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেন। একদিন তো তিনি আমায় এমন ধমকা ধমকি শুরু করলেন যে একটু পরই তার শরীর খারাপ করে ফেললো। তার আবার হাঁপানির টান আছে। সেই টান উঠে গেল। দমের পর দম ফেলছেন তিনি। আমি দৌড়ে গেলাম তার কাছে।
তার প্রতি জন্ম নেয়া সব রাগ অভিমান মুহূর্তে ভুলে গিয়ে তার শিয়রে বসলাম। তার হাতে পায়ে গলার কাছে তেল রসুন গরম করে ঘষে ঘষে লাগিয়ে দিলাম। ওষুধ এনে খাইয়ে দিলাম। এর খানিক পরই তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তারপর আমায় ডেকে বললেন, নিতু, আমি যে তোমারে অনেক পছন্দ করি এটা তুমি জানো?
আমি মার এই কথার কোন উত্তর দিলাম না। চুপ করে রইলাম। আমার চোখ কেমন ছলছল করছে।
মা বললেন, তোমার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করছি এই কদিন এটা তোমার মার উপর রাগ থেকে। তোমার মায়ের অহংকারের জন্য আমার ছেলের কী যে কষ্টের দিন গিয়েছে গো মা! কতদিন আমার ছেলে ঠিকমতো খায়নি, গোসল করেনি, চুল ঠিক করেনি। তার জীবনটা হয়ে গিয়েছিল একেবারেই এলোমেলো। গরীব বলে তোমার মা আমার ছেলেকে অপমান করেছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কী মা, আমার ছেলের ভালোবাসা ছিল সত্য। গুণীজন বলে, সত্য ভালোবাসার জয় একদিন না একদিন ঠিকই হয়।
এই যে সেদিন তোমারে বন্ধ্যা বললাম এইটা আমি এমনিই বলছি। ভাবছি এই কথা তুমি তোমার মার কাছে বলবা। এতে তোমার মা রাগবে। কষ্ট পাবে। তোমার মার কষ্ট দেখতে চাইছিলাম আমি। কিন্তু মা তুমি হইলা জ্ঞানী মাইয়া।
তোমার কষ্টের কথা তুমি কারোর কাছে বলো নাই। এই যুগে বউদের একমাত্র প্রধান কাজ হলো শাশুড়ি আর ননদদের নামে সত্য মিথ্যা বানিয়ে কথা লাগানো। কিন্তু তুমি এই কাজেও নাই। তোমার কাছে আমি ক্ষমার দরখাস্ত করি মা। আমার খারাপ ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। তুমি আমারে নিজের মা ভেবে মাফ করে দাও এবারের মতো!
মার কথাগুলো শুনে এবার আমার চোখ থেকে টপটপ করে কয়েক ফোটা জল গড়িয়েই পড়ে গেল। আমি বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে সেই জল মুছে নিয়ে বললাম, মা আমি কিছু মনে রাখিনি।
মা এবার আমার হাতটা টেনে ধরলেন। তারপর বললেন, বাচ্চা কাচ্চার জন্য মন খারাপ করবা না। কোন দেশের কোন ডাক্তারের বাচ্চা বলছে যে তোমার কোনদিন সন্তান সন্ততি হবে না এটা হলো চরম ভুয়া কথা। হারামজাদা হইলো একটা খবিশ। সন্তান দানের মালিক সে না। সন্তান দানের মালিক আল্লাহ। তোমারে একটা ঘটনা বলি শুনো বউ মা। আমার ছোট বোনের নাম সাজু।
এই সাজুর বিয়ের আট বছরেও সন্তান নাই। চেষ্টার কম করে নাই। টাকা পয়সা আছে। তার স্বামী তারে নিয়া বিলেত আমেরিকাও গেছে। সব ডাক্তারই ব্যার্থ। সন্তান হবে না। তার স্বামী কিন্তু তারে তালাক দেয় নাই। সে বললো, সন্তান দানের মালিক আল্লাহ। না দানের মালিকও আল্লাহ। সন্তান হবে না এটা আমাদের ভাগ্য। এই ভাগ্যের পরিহাস আমাদের মেনে নেয়া লাগবে। এই জন্য তো আট বছরের সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়া যাবে না।
সাজুর স্বামী ধৈর্য্য ধরছিলো। ধৈর্যের ফল পাওয়া গেলো তাদের বিয়ের এক যুগ পর। কথা নাই বার্তা নাই হুট করে সংবাদ পাইলাম সাজু গর্ভবতী। এখন তো তার তিন ছেলে চার মেয়ে। এখন বুঝছো আসল কাহিনী। ডাক্তাররে আল্লাহ চিকিৎসা করার ক্ষমতা দিলেও সন্তান তৈরির ক্ষমতা দেন নাই। তুমি ধৈর্য্য ধরো। ধৈর্যের ফল হয় সুফল।
মার কথাগুলো শুনে আমি কী যে তৃপ্তি পেলাম! পরাগও তো এমন সুন্দর করেই আমাকে বোঝায়। সান্তনা দেয়। আসলে পৃথিবীতে এখনও অনেক ভালো মানুষ আছে। ভালো মানুষ না থাকলে পৃথিবী টিকে থাকতো কীভাবে?
আরো দু বছর পরের ঘটনা-
আমার শাশুড়ির শরীরটা আরো খারাপ হয়েছে। তিনি এখন বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। হাঁপানি তাকে একেবারে কাহিল করে ফেলেছে।
এই সময় একদিন আমি টের পেলাম অস্বাভাবিক কিছু। কিন্তু বিষয়টা আমি গোপন রাখলাম। এর আরো তিন মাস পর মা আমায় ডেকে কাছে নিলেন। তারপর বললেন, নিতু, তুমি তো ভীষণ ভেতর বজ্জাত মানুষ গো মা!
আমি অবাক হয়ে বললাম, মা হঠাৎ এমন কথা বলছেন কেন আপনি?
মা বললেন, কারণ তুমি আমার চোখ ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছো। কিছু একটা লুকাচ্ছো।
আমি বললাম, কী লুকোবো মা আপনার কাছে?
তোমার সন্তান হবে এই কথা।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এই কথা তো আমি ছাড়া আর কেউ জানে না মা। তবে আপনি জানলেন কী করে?
মা বললেন, মায়েরা অনেক কিছু জানে। তারা সন্তানের গায়ের রং দেখেই বলতে পারে সন্তানের ভেতর কোন অসুখ আর কোন সুখ চলছে এখন!
আমি সঙ্গে সঙ্গে জড়জড় করে কেঁদে উঠলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, মা আমি বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা আমার দেখা কোন স্বপ্ন। একটু পর দেখবো স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। এই জন্য ভয়ে ভয়ে বলছিলাম না কারোর কাছে।
মা সেদিন অদ্ভুত এক কান্ড করলেন। এমনিতে তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারেন না একা একা। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যা বেলা তিনি ছোট্ট মেয়েদের মতো লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেলেন। তারপর গেলেন আলমাড়ির কাছে। আলমাড়ি থেকে একটা সোনার চেইন নামিয়ে এনে আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার পক্ষ থেকে এই উপহার। পরাগদের বংশের নিয়ম এটা। বউ প্রথম গর্ভবতী হলে তার শাশুড়ির চেইন বউয়ের গলায় পরিয়ে দেয়। তুমিও একদিন তোমার সন্তানের বউয়ের গলায় পরিয়ে দিবা এই চেইন।
সেদিন সন্ধ্যা বেলায় মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম আমি। আর মনে মনে ভাবলাম পৃথিবীর সবগুলো মানুষ কেন এমন না? এমন হলে কী সত্যি সত্যি পৃথিবীটা ভীষণ সুন্দর হয়ে যেতো না!
রাতে পরাগ ফিরে যখন শুনলো সে আমার সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছে তখন সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো। সে সঙ্গে সঙ্গে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো, নিতু, তুমি জানো না একজন বাবা প্রথম সন্তানের বাবা হবে এমন সংবাদের চেয়ে খুশির সংবাদ আর কোন কিছু নাই এই পৃথিবীতে!
আমি পরাগের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর চোখে চকচক করছে জল। আমি আঙুলের ডগায় সেই জলের কণা তুলে নিয়ে বললাম, পরাগ, আজ তোমার চোখে যে জল?
পরাগ বললো, এটা আনন্দের। মানুষ শুধু দুঃখেই কাঁদে না খুশিতেও কাঁদে। আমিও খুশিতে কাঁদছি। আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম যে আল্লাহ ঠিক আমাদের সন্তান দিবেন। এবার আমার মনের আশা পূরণ হলো!
আমি পরাগকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আর চুপিচুপি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, পরাগ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক অনেক ভালোবাসি।
পরাগ আমার পিঠে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, আমিও। আমিও তোমাকে ভালোবাসি। অনেক অনেক ভালোবাসি।
আরেকটি খবর দেয়া খুব প্রয়োজন-
ওই যে নিতুল আমায় ডিভোর্স দিয়েছিল আমার সন্তান হবে না এই খবর শুনে। সে কিন্তু আমায় ডিভোর্স দিয়ে আরেকটি বিয়ে করেছিল। ডাক্তার এবারও নাকি বলেছে তাদের কোন সন্তান সন্ততি হবে না। কী অদ্ভুত ব্যাপার! আসলে অবিশ্বাসীরা কোনদিন জিততে পারে না।
লেখা – অনন্য শফিক
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “জলপদ্ম – Bonyo premer golpo full” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – পাপমোচন – A Bangla love story