পাপমোচন – A Bangla love story: কথাটা হজম হয় নি রিফাতের। রিফাত বসা থেকে উঠে গিয়ে খুব জোরেই থাপ্পড় বসিয়ে দেয় রুহির গালে। রুহির মা বাবা মাথা নিচু করে নেন, ওরা কখনো ভাবেন নি রুহি এমন খারাপ কাজ করবে।
পর্ব ১
আমি কখনো বাবা হতে পারবো না। এই কথাটা তুইও জানিস। তবুও কেন বারবার বাড়ি ছাড়ার কারণটা জিজ্ঞেস করছিস? কথাটা খুব রেগেই বললো রিফাত। কথা বলার সময় বারবার স্বর ভেঙে আসছিলো রিফাতের।
কখনো ভাবেনি এমন দিন দেখতে হবে তার। রিফাতের এমন রেগে কথা বলা দেখে নীলিমা ফোন কেটে দেয়৷ একটু পর নাহয় রিফাতের রাগ কমলে ফোন দিবে।
এইদিকে রিফাতের মুখে এমন কথা শুনে বাসের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, বাসের সবাই যেন গোবরে গোলাপ ফুল ফুটেছে এমন কিছু দেখছে। রিফাতের পাশে বসা মেয়েটাও অবাক নয়নে তাকাচ্ছে।
ওরাইবা কী করবে! পাবলিক বাসে এমন কথা শুনলে সবাই এমন অবাক হয়ে তাকাবেই এটাই স্বাভাবিক।
রিফাত ফোনটা নিজের পকেটে রাখে। রিফাত দেখলো, তার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে, কেউ আবার উঁকিঝুঁকি দিয়েও তাকে দেখছে৷ পাশে বসা মেয়েটাও তাকাচ্ছে, চোখে হাজারো প্রশ্নের আভাস।
সবার এমন চাহনি দেখে বুঝতে সমস্যা হয়নি রিফাতের। পাবলিক বাসে নিজের সমস্যার কথা নিজেই বলে ফেলছে। এরাও বাঙালী, “গায়ে ত্যানা পেঁচিয়েও, অন্যের পড়নের মসলিন কাপড় নিয়েও মন্তব্য করতে পিছু হটেনা”
আর রিফাততো নিজের গোপন সমস্যার কথা বলেছে।
রিফাতেরইবা দোষ কী! এর পূর্বে কখনো বাস চড়েনি সে। নিজের গাড়ি দিয়েই চলাফেরা করতো।
জঙ্গলের বাঘ খাঁচায় বন্ধি হলে যেমন অচেনা আচরণ করে। রিফাতেরো আজ একি অবস্থা।
সবার এভাবে তাকানোটা রিফাত সহ্য করতে পারলো না। রিফাত বরাবরই রাগী মস্তিষ্কের মানুষ। এখানেও নিজের রাগটা সামলে রাখতে পারেনি। তাইতো এই অচেনা জায়গায় বাঘের মতো গর্জে উঠলো।
আপনাদের তাকানো দেখে মনে হচ্ছে আমি কোনো এলিয়েন বা জঙ্গলের কোনো প্রাণী?
রিফাতের রেগে বলা কথা গুলো সবাই হজম করে নিলো। সবাই নিজেদের মতো করে বসলো। তারপরেও বাসের লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। রিফাত জানে ওরা তাকে নিয়েই কথা বলবে। রিফাতের পাশের মেয়েটা কেঁপে উঠেছিলো রিফাতের রাগ দেখে। এখনো রিফাতের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।
একটা টগবগে যুবকের মুখে এমন কথা শুনা মানে। “ধনী লোককে পান্তাভাত খাইতে দেখা”
নিজের মধ্যে ইচ্ছে জন্মানো, ধনী লোকটি কেন পান্তাভাত খাচ্ছে। সেই কারণটা জানা।
তেমনি রিফাতের পাশের মেয়েটারো ইচ্ছা হয়েছে রিফাতের সাথে কথা বলার। কিন্তু কীভাবে কথা বলবে?
রিফাত গাড়ির জানালার দিকে নিজের দৃষ্টি রাখলো। গাড়ি গুলো তার আপন গতিতে চলছে, মাঝেমধ্যেই তৃষ্ণা মেটাতে পথচারীদের নিজের চাকায় পৃষ্ঠ করে নেয়।
রিফাতকেও পৃষ্ঠ করে নিয়েছে, তবে কোনো চাকা না! তার নিয়তি।
রিফাত ভেবেছিলো, এখানে হয়তো ভালোভাবে নিজের বাকী জীবনটা কাটাবে।
কিন্তু নিজেই সব প্রকাশ করে দিলো।
মেঘ যেমন উত্তপ্ত সূর্যকে ঢেকে রাখে নিজ শক্তিতে। রিফাতো চেয়েছিলো ঢেকে রাখতে তার কঠিন সমস্যার কথাটা। কিন্তু সে ব্যর্থ।
রিফাত জানে সত্যি একদিন প্রকাশ পাবেই। জানে বললে ভুল হবে, সে এই কথায় বিশ্বাসী। তবে এতো তাড়াতাড়ি প্রকাশ পাবে এটা ভাবেনি। তাও নিজের মুখ থেকেই।
বাসের সবাই হয়তো আমাকে নিয়েই গল্প আলাপে মেতে উঠেছে। যেখানে তারা নিজেদের অন্য গল্পে মগ্ন থাকতো!
সেখানে আজ আমাকে নিয়েই মগ্ন ওরা। পাশে বসা মেয়েটাও না জানি কী ভাবছে আমাকে নিয়ে? তাহলে বাংলাদেশ ছেড়ে লাভ হলো কী?
(রিফাত নিজেকেই নিজে প্রশ্ন গুলো করলো। পারবে কি এই উত্তর গুলো রিফাতের মধ্যে থাকা আত্মাটা দিতে?)
রিফাতের চোখে হালকা পানি এসে রাজত্ব বাঁধলো। সময়ের ব্যবধানে হয়তো সৈন্যদল নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমে যাবে। ভিজিয়ে দিবে গাল দুটো।
বাংলাদেশে থাকা প্রতিটা মানুষের কথা মনে পরছে রিফাতের। চোখে বাসা বাঁধা পানি সৈন্যদল নিয়ে গাল ভিজিয়ে দিলো রিফাতের। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো। মানুষ ভালোবাসে, আবার সেই মানুষগুলোই অপবাদ, অপমান সব করে। মানুষ সব পারে৷ এভারেস্ট জয় থেকে মানুষের মন ভাঙা, সব কাজ খুব নিখুঁত ভাবে মানুষ পারে।
আবারো রিফাতের ফোনটা বেজে উঠে। নীলিমা আবার ফোন দিয়েছে। শত ইচ্ছা করেও রিফাত নীলিমাকে রাগ দেখাতে পারে না। ফোনটা রিসিভ করে রিফাত।
রাগ কমেছে তোর? ফোনের ওপাশে মুচকি হেসে কথাটা বলে নীলিমা।
হ্যাঁ, বল কী বলবি?
ওইসব জানতে চেয়েছিলাম তোর কাছে আমি?
না।
তো আমায় এসব বারবার শোনাচ্ছিলি কেন?
এমনিই।
রিফাত ছোট একটা শব্দ বলে চুপ হয়ে থাকলো। রিফাতের এখনো রাগ কমেনি। কিন্তু নীলিমাকে রাগ দেখাবেনা রিফাত। কারণ রিফাতকে যদি কেউ বিশ্বাস করে। তাহলে প্রথম নামটাই হবে নীলিমা৷ এবং শেষ নামটাও নীলিমা।
এমনি শব্দটা শুনে নীলিমার খুব রাগ হয়।
থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিবো তোর। ওই আজেবাজে কথাগুলো আমার সাথে বকবি না। আমি কখনো এসব জানতে চেয়েছি তোর কাছে?
নীলিমার রাগ দেখে মুচকি হাসে রিফাত।
না।
তো? (না শব্দটা শুনে নীলিমার রাগটা চরম পর্যায়ে উঠে।)
তুই একজন আমার পক্ষে থাকবি কেন? যেখানে নিজের পরিবার, নিজের ভালোবাসা আমায় অপমান করেছে। সেখানে তুই বাকী থাকবি কেন? তাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছি আমি বাবা হতে পারবো না। যেন আমার প্রতি তোরও ঘৃণা জন্মায়। রিফাত খুব শান্ত ভাবে কথা গুলো বললো। এবার আর বাসের কেউ তাকাচ্ছেনা তার দিকে৷
নীলিমার অনেক রাগ হয় রিফাতের কথা শুনে। কিন্তু রাগলে চলবে না তার।
রিফাতকে বুঝাতে হবে সব। নীলিমা বললো।
তোর মা তো তোকে অপমান করেনি? তাহলে পরিবার বলছিস কেন?
নীলিমার প্রশ্ন শুনে চুপ থাকে রিফাত। রিফাত নিজের মায়ের কষ্ট দেখতে পারবে না নিজের চোখে৷ তাইতো দূরে চলে আসলো।
রিফাতের চুপ থাকতে দেখে নীলিমা আবারো প্রশ্ন করলো। এই দুইদিনে একবারো ফোন
অন করস নি কেন?
কথা বলার কেউ নাই, তাই।
কিহ? আমি কে তাহলে? রিফাতের বলা সব কথায় নীলিমার রাগ উঠছে৷ তবুও শান্ত থাকলো।
বোন, আপু, বেষ্ট ফ্রেন্ড এক কথায় তুই সব আমার। রিফাত মুচকি হেসে বললো।
কোথায় আছিস তুই? ফোন তো অফ করেই রাখছিস। বাসায় যাস না, কোথায় আছিস তুই বলতো আমায়? আমি তোর সাথে দেখা করবো।
নীলিমার এতো উত্তেজিত আর এতো প্রশ্ন করা দেখে রিফাতের খুব ভালো লাগছে। রিফাত ছোট্ট একটা শব্দই বললো।
কলকাতায় আছি।
কিহ? রিফাতের কথাটা শুনে নিলীমা খুব অবাক হয়।
ওরা এতো অভিমান জন্মিয়ে দিলো রিফাতের মনে?
পর্ব ২
কলকাতায় আছি শব্দটা শুনে খুব অবাক হয় নীলিমা। কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এতোটা অভিমান জন্মিয়ে দিয়েছে রিফাতের মনে ওরা?
এতো অভিমান কেন? নীলিমা অভিমানী কণ্ঠে কথাটা বলে। নীলিমার অভিমানী কণ্ঠ দেখে অবাক হয়নি রিফাত। রিফাতের কোনো সমস্যা, আর নীলিমাকে না জানিয়ে তা সমাধান করা মানেই নীলিমার মনে অভিমান জন্মানো।
কী করবো বল? যেখানে সবাই আমাকে কথা শুনাচ্ছে। সেখানে কীভাবে থাকবো। নিজের স্ত্রী যখন অপমান করে, তখন কার ভালো লাগে বল? আর আমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেলো। কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় রিফাত, আর তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় নিজের স্ত্রীর কথা মনে করে।
নীলিমা কী বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা। নীলিমার মনে হচ্ছে রিফাতকে এখন সান্তনা দেওয়া মানে, তার কঠিন কষ্ট গুলো মনে করিয়ে দেওয়া। ঠিক যেন, “পাথরে ছিদ্র করে ফুলের ছাড়া রোপণ করে পাথরের ব্যথাটা বাড়িয়ে দাওয়া। কারণ পাথরে কখনো গাছ হয় না।”
নীলিমার কাছেও ঠিক তাই মনে হচ্ছে।
কলকাতায় যাবার আগে আমায় একবারো জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?
জানিয়ে কী করবো? মিথ্যে সান্তনা শোনার জন্য? কলকাতায় কোথায় উঠবি তুই? রিফাতকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করে নীলিমা। একটা মাত্র ছেলে ফ্রেন্ড তার। আর সেই রিফাত আজ এতো কষ্টে।
কোথাও উঠবো জানিনা, ফুটপাত আছে তো, আজকের রাত কাটিয়ে দিতে পারবো।
রিফাতের কথাটা শুনে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে নীলিমার। যেই ছেলে কখনো জুতো ছাড়া মাটিতে পা রাখেনি। সেই ছেলে আজ ফুটপাতে থাকার চিন্তা করছে। নীলিমা নিজের কান্নাকে চাপা দিয়ে রিফাতকে বললো।
আমায় রাগাচ্ছিস কিন্তু?
তোকে রাগতে বললো কে?
ভালোই কথা শিখেছিস? রিফাতের কথায় আজ রাগ হলেও প্রকাশ করছে না নীলিমা। অন্যদিন হলে এসব কথা বললে রিফাতকে কাচা খেয়ে নিতো, কিন্তু আজ যে রিফাত হাজারো দুঃখে দুঃখী।
হুম, আচ্ছা এখন রাখছি। পরে তোর সাথে কথা বলবো। রিফাত কথাটা বলে ফোন কাটতে চাইলেই নীলিমা বলে উঠলো।
এই শুন! শুন!
হুম বল?
তোর নাম্বার দে? তুই অফলাইনে গেলে তোর সাথে কথা বলবো কীভাবে? নীলিমার কথা শুনে রিফাত তার নাম্বার দিলো। এতক্ষণ ওরা মেসেঞ্জারে কথা বলছিলো।
নিজের খেয়াল রাখিস কিন্তু? রিফাতের নাম্বার পেয়ে কথাটা বললো নীলিমা।
হুম, নীলিমাকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দেয় রিফাত।
ফোনটা নিজের পকেটে রাখে।
বারবার রিফাতের চোখে তার মা’য়ের চেহারা বাসছে। আর কবে নিজের মা’কে জড়িয়ে ধরবে রিফাতের তা অজানা। আর নিজের স্ত্রীকে কী কখনো ক্ষমা করবে তাও অজানা রিফাতের।
এইদিকে খুব মনযোগ দিয়ে রিফাতের কথা শুনছিলো পাশের ছিঁটের মেয়েটা। মেয়েটার চোখে বারবার পানি জমেছে। এই বয়সের একটা যুবকের এতো কষ্ট, সত্যিই যে কাউকেই কাঁদাবে। অনেক প্রশ্ন জমেছে মেয়েটার মনে। ইচ্ছাও জেগেছে রিফাতের সাথে কথা বলার। কিন্তু ওর ভয় হচ্ছে, অচেনা ছেলের সাথে কী কথা বলবে৷ যদি বকা দেয়।
রিফাত কোনো ভাবেই নিজের মনকে স্থির রাখতে পারছে না। চোখটাও তার সাথে বেইমানি করতে শুরু করেছে। বারবার সব চেনা প্রিয় মুখগুলো সামনে বাসছে। চোখে রি বা কী দোষ, মন যদি ওদের কথা ভাবে। কাউকে মনে আসলেই তার চেহারাটা চোখের সামনে বাসে। রিফাতের প্রতিটা অঙ্গ তার সাথে বেইমানি করছে।
রিফাত নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে ফোনটা বের করে। গ্যালারিতে ঢুকে। একএক করে নিজের পরিবারের সবার ফটো দেখছে। মা’য়ের মুখে মিষ্টি হাসি, নিজের স্ত্রী সুমার ছবিটা দেখছে খুব মন দিয়ে। অনেক সুন্দর করে জড়িয়ে ধরে ছবি গুলো তুলেছে সুমা। রিফাতকে অনেক ভালোবাসতো সুমা। রিফাত মুচকি হাসলো। আজ সেই সুমা আর তার নাই। ডিভোর্স নামক কঠিন সিদ্ধান্ত হয়েছে তাদের মাঝে।
সুমারই বা দোষ কী, দোষ তো রিফাতের নিজের। সে যে বাবা হতে পারবে না।
অনেক ভালোবাসা ছিলো দুজনের মধ্যে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেলো। দুটি মনের ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটলো ডিভোর্স নামক কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে।
“যেখানে মাটির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ গুলোকে লণ্ডভণ্ড করে দেয় ঝড়তুফান। সেখানে তো সম্পর্ক একটা তুচ্ছ বিষয়।
ভাঙতেও সময় লাগে না, আবার গড়তেও সময় লাগে না।”
এইযে শুনছেন? রিফাত যখন নিজের পরিবারের সবার ফটো দেখছিলো। আর গভীর ভাবনায় মগ্ন ছিলো। তখন তার পাশে থাকা মেয়ে কথাটা বললো। রিফাতের পাশে থাকা মেয়েটা এতক্ষণ ভাবছিলো কথা বলবে কি-না? মেয়েটা নিজের ভয়কে জয় করে রিফাতকে ডাকলো।
মেয়েটার ডাক শুনে রিফাত তাকালো। আর বললো।
হুম বলেন?
কলকাতায় নতুন? মেয়েটি ভেবেছিলো এই অচেনা ছেলে হয়তো তাকে দমক দিবে৷ কিন্তু ছেলেটা তেমন কিছুই করে নি৷ তাই মেয়েটাও কিছুটা সাহস পায়৷ আর প্রশ্নটা করে।
মেয়েটার করা প্রশ্নের উত্তরে রিফাত শুধু হুম শব্দটাই বললো। রিফাতের অসহ্য লাগে মেয়েদের সাথে কথা বলতে৷ রিফাত এটাও ভাবে, সব মেয়েরা তো আর এক না। সুমা আর নীলিমা দু’জন-ই মেয়ে। তবে দু’জনের মধ্যে কোনো ভাবেই একটুও মিল নাই।
মেয়েটা আবারো বললো। আমি রুহি, রুহি ইসলাম। আপনার নামটা জানতে পারি?
হ্যাঁ অবশ্যই! আমি রিফাত। রিফাত নিজের নামটা বলে আবার চুপ হয়ে যায়।
কিন্তু রুহি চুপ থাকবে না৷ রিফাতের সম্পর্কে জানতে আগ্রহ জেগেছে রুহির মনে৷ রুহি সব সময় নিজের আগ্রহকে প্রাধান্য দেয়।
রুহি এই কথায় বিশ্বাসী।
“যতক্ষণ পর্যন্ত একটা কাজের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পারবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত সেই কাজে সফল নামক শব্দটাও খুঁজে পাবে না।”
তাইতো রুহি নিজ থেকেই রিফাতের সাথে কথা বললো। কারণ রিফাতের প্রতি তার আগ্রহ জন্মিয়েছে। তাই রুহি আবারো রিফাতকে প্রশ্ন করলো।
কোথায় থেকে এসেছেন?
বাংলাদেশ থেকে।
ওও, রুহি আর কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। রিফাতের সাথে কথা বলতে কেমন জানি ভয় পাচ্ছে রুহি।
কোথায় উঠবেন? রুহি যদিও একটু আগেও শুনেছে রিফাতের কথাগুলো। রিফাত কোথায় উঠবে সেটা ফোনেই বলেছে৷ তবুও রুহি আবার বললো।
রুহির প্রশ্নটা শুনে রিফাত তাকায় রুহির দিকে৷ রিফাতের তাকানো দেখে রুহি ভয় পেয়ে যায়। নিজের মাথাটা নিচু করে নেয়। এতক্ষণ রিফাতের দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলো। রিফাত সামনের দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলো।
রুহি এই ভেবে ভয় পেয়েছে যে, রিফাত ফোনে কী কী কথা বলেছে৷ সব রুহি শুনেছে, তারপরেও আবার প্রশ্ন করলো৷ এর জন্য যদি রিফাত রাগ করে? রিফাত রুহির দিকে তাকিয়ে, রুহিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। রুহিকে দেখে স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে। রিফাত সেই দিকে আর মন না দিয়ে রুহির করা প্রশ্নের উত্তর দিলো।
জানা নেই, ইন্ডিয়াতে প্রথম এসেছি। রিফাতের কথা শুনে মন খারাপ হয় রুহির। রুহি কোনো কথা বললো না, চুপ থাকলো। রুহির চুপ থাকা দেখে রিফাত বললো। তবে রাত হবার আগেই কোনো হোটেলে উঠবো।
একটা কথা বলবো? রিফাতের কথা বলা দেখে রুহি আবার প্রশ্নটা করলো।
রিফাত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।
আপনিতো ইন্ডিয়াতে নতুন। তাই বলছিলাম,
কথাটা বলে থামে রুহি। তার কথা শুনে রিফাত যদি রাগ করে। এই ভয় পাচ্ছে রুহি।
কী?
রুহির কথার মধ্যে থেমে যাওয়া দেখে প্রশ্নটা করে রিফাত।
আপনি চাইলে আমার সাথে আমার বাসায় যেতে পারেন?
কথাটা বলে রুহি রিফাতের দিকে তাকায়। ভয় হচ্ছে রুহির, বকা দিবে না তো। রুহি বকা সহ্য করতে পারে না। কেঁদে দেয় কেউ বকা দিলে। রিফাত রুহির দিকে তাকায়। রুহিও রিফাতের দিকে তাকায়। রিফাত কী উত্তর দিবে সেই আশায়।
আপনার বাসায় কে কে আছে? রিফাত কিছুক্ষণ ভাবার পর এই কথাটা বলে। রুহি তো না শব্দটাই ধরে নিয়েছিলো।
তখনি বাসেত হেল্পার বলে উঠে। রাজাবাজার
এর কে কে আছেন? তৈরি হয়ে নেন। দুই মিনিট এর মধ্যেই বাস রাজাবাজার ঢুকবে।
রুহি হেল্পার আর রিফাতের প্রশ্নের উত্তর দিলো।
আমার বাসা রাজাবাজার, একটু জোরেই বললো। যাতে কথাটা হেল্পার এর কান পর্যন্ত পৌঁছায়।
আমি, মাবাবা আর আমার ছোট এক ভাই আছে। আর কেউ নাই। যাবেন তো আমার সাথে?
আপনার মা বাবা কী বলবে? এভাবে একটা অপরিচিত ছেলেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া। রিফাতের কথা শুনে রুহি মুচকি হাসে। আর বলে।
সেটা সময় বলে দিবে। তাহলে আপনি আমার সাথে যাচ্ছেন?
হুম।
হুম শব্দটা শুনে রুহি অনেক খুশী হয়। মা বাবাকে বুঝিয়ে নিবে সে।
রাজাবাজার এসে বাস থামে। রুহি আর রিফাত বাস থেকে নামে। রিফাতের কাছে দুটো কাপড়ের ব্যাগ। আর রুহির কাছে একটা কাপড়ের ব্যাগ। রুহির কলেজ কয়েকদিনের বন্ধ। তাই সে বাড়িতে যাচ্ছে। রুহি এটাও ভেবে রাখছে, সে আর পড়বে না।
মধ্যবিত্তদের এতো পড়তে হয় না। আর রুহিও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। রুহির হাতে কাপড়ের ব্যাগ দেখে প্রশ্ন করতে চেয়েছিলো রিফাত। কিন্তু রিফাত এর অভ্যাস কারো পার্সোনাল কিছু জানতে না চাওয়া।
রুহি আর রিফাত একটা টেক্সিতে উঠে। ২৯ মিনিট এর মধ্যেই ওরা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
সুমা বিষন্ন মনে বসে আছে জানালার পাশে। নিজেকে স্বার্থপর ভাবছে৷ রিফাতকে সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।
“আকাশ যেভাবে চাঁদকে ভালোবেসে নিজের বুকে রেখেছে”
তার চেয়ে আরো অনেক বেশি ভালোবাসে রিফাতকে সুমা। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেলো।
রিফাতের যদি দুই হাত দুই পা’ও না থাকতো, তারপরেও রিফাতকে ছাড়তো না। কিন্তু কী হলো।
রিফাত বাবা হতে পারবে না। এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে নিজের ভালোবাসাকে অপমান করলো, ডিভোর্স দিলো।
সুমার চোখ দুটো ভিজে যায়। যাদের জন্য সে রিফাতকে ছেড়েছে, অপমান করেছে। তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবে না। সুমা জানে রিফাত খুব কষ্ট পাচ্ছে। সে নিজেই তার ভালোবাসাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে। ডিভোর্স নামক শব্দটা যাদের ডিকশনারিতে আসে, তাদের কষ্ট অসীম হয়।
কিন্তু সুমা যে পরিস্থিতির শিকার।
সবাইকে কীভাবে বিশ্বাস করাবে। সবাই তো তাকেই বকবে।
সুমার ভিতর ফেটে যাচ্ছে রিফাতকে একটা নজর দেখার জন্য। একটা বার কথা বলার জন্য।
আজ ১১ দিন হলো রিফাত আর সুমার ডিভোর্স হয়েছে।
আমি কী কখনো রিফাতকে সব সত্য কথা বলতে পারবো? না কি মরার আগ পর্যন্ত রিফাতের চোখে ছলনাময়ী হয়েই মরবো?
আমি কী বলতে পারবো না, রিফাত বাবা হতে পারবে না বলে আমি ওরে ডিভোর্স দেই নি। এখনো ভালোবাসি রিফাতকে। আমাকে জোর করা হয়েছে রিফাতকে ছাড়তে।
সুমা চিৎকার করে কথাগুলো বলছে। আর শব্দ করেই কান্না করছে। সুমার কান্না কেউ শুনবে না। যে দুঃখের সময় বুকে আগলে রাখতো, তাকেই যে সুমা অপমান করেছে। এই চার দেয়াল ছাড়া সুমার কান্নার সঙ্গী আর কেউ হবে ন
পর্ব ৩
টেক্সিতে রিফাত আর রুহি পাশাপাশি বসে আছে। রুহি সব সময় চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করে। ছেলেদের সাথে কথা বলতে নিজেকে অপ্রস্তুত মনে করে রুহি।
তাইতো নিজেকে ছেলেদের কাছ থেকে দূরে দূরেই রাখে। কিন্তু রুহি তার বান্ধবীদের কাছে ভিন্ন এক চরিত্র৷ যে রুহি ছেলেদের সামনে কথা বলতে বারবার কথা হারিয়ে ফেলে৷ সেই রুহিই নিজের বান্ধবীদের সামনে কথার বর্ষণ করে। কেউ বলবে না এই রুহি ছেলেদের সামনে নীরবতা শব্দটাকে প্রাধান্য দেয়।
কিন্তু আজ সে এক অচেনা ছেলের সাথে কথা বললো৷ আবার সেই অচেনা ছেলের পাশে বসেও আছে।
রুহি মুচকি হাসে এই ভেবে, নিজেকে পরিবর্তন করতে শিখছে।
রুহি রিফাতের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে, রিফাত চোখ বন্ধ করে বসে আছে। রুহি রিফাতকে একটু গভীর ভাবেই দেখছে, এতোটা গভীর ভাবে সে তার পড়ার বইগুলোও দেখেনা।
রুহি রিফাতকে গভীর ভাবে দেখতে গিয়ে রিফাতের চোখে পানি দেখতে পায়। হয়তো নিজের আপনজনদের কথা ভাবছে৷ সবাইকে ছেড়ে নতুন অচেনা দেশে আসছে, তাই হয়তো চোখের কোণে পানি জমেছে। বা তার কোনো কঠিন অতীত আছে, যা একটু হলেও রুহি শুনেছে, সেইসব ভাবছে হয়তো?
রুহি রিফাতের কঠিন অতীত শব্দটা ভাবতেই মনে পড়ে রিফাতের তখনকার ফোনে কথা বলার দৃশ্য। আবারো রুহি রিফাতের মুখের দিকে গভীর ভাবে তাকায়। রুহি রিফাতের দিকে তাকিয়ে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে, বয়স বেশি হলে ২৭বা২৮ হবে আবার বেশিও হতে পারে।
রিফাতের বয়সের কথা চিন্তা করতেই রুহির ভিতর কেঁদে উঠে। এই অল্প বয়সের একটা ছেলের এতোটাই কষ্ট। এই বয়সেই রিফাত জানতে পেড়েছে সে বাবা হতে পারবে না। এই বাবা হতে পারবে না বলেই নিজের স্ত্রী ডিভোর্স দিয়েছে। এরকম হয়তো আরো হাজারো কষ্ট লুকিয়ে আছে রিফাতের মধ্যে।
একটা লোক তখনি নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে, যখন সে দুঃখী হয়, খাবারের তাগিদে দেশ ত্যাগ করে৷ আবার নিজের জন্মভূমির কারো কাছ থেকে একটু বেশিই কষ্ট পেলে জন্মভূমি ত্যাগ করে।
রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় রিফাতের কষ্টের অধ্যায়ে নিজেকে হারিয়ে।
এসে গেছি মেডাম! রুহি যখন রিফাতকে নিয়ে এসব ভাবনায় মগ্ন তখন টেক্সি ড্রাইভার কথাটা বলে।
ড্রাইভার এর কথা শুনে রিফাত চোখে খুলে ফেলে। রিফাতকে চোখ খুলতে দেখে রুহিও নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
রিফাত আর রুহি গাড়ি থেকে নামে।
রুহি টেক্সির ভাড়া মিটায়, যদিও রিফায় ভাড়া দিতে চেয়েছিলো।
রুহি রিফাতকে ওর পিছন পিছন আসতে বললো। রিফাত কোনো কথা না বলে রুহির পিছন পিছন হাটতে থাকে।
রুহি আর রিফাত বাসার গেইটের ভিতর ঢুকে। রিফাত চারদিকে তাকাচ্ছে। ছোট একটা বাসা। দেখতে খুব সুন্দর। রিফাতের নিজের প্রাসাদ এর চেয়ে এই ছোট্ট বাসা খুব সুন্দর লেগেছে। তাইতো মুগ্ধ হয়ে চারদিক দেখছে।
রিফাত অল্প সময়ের মধ্যেই বাসার চারদিক ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। বাসার চারদিকে এরকম আরো অনেক বাসা দেখতে পায় রিফাত। এর পূর্বে এমন কিছু দেখেনি রিফাত। তাইতো এতোটা মুগ্ধ হয়েছে। আরো মুগ্ধ হয়েছে সব বাসা একতলা আর এক স্টাইলে বানানো দেখে।
রুহি রিফাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো, রিফাত চারদিকে তাকাচ্ছে আর সব দেখছে। রুহি আস্তে করে বললো।
চলেন?
রুহির কণ্ঠ শুনে রিফাত একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো।
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ চলেন।
রিফাতের এভাবে কথা বলা দেখে রুহি মুচকি হাসে।
রুহি বাসার কলিংবেল বাজায়। রুহির পিচ্চি ভাই এসে দরজা খুলে দেয়। রুহির সাথে অচেনা ছেলেকে দেখে সিয়াম চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে।
মা ও মা! বাবা ও বাবা! তোমরা কোথায়। দেখে যাও আপ্পি এসেছে। এভাবে চিৎকার করতে করতে সিয়াম রান্নাঘরে তার মায়ের কাছে যায়।
কিছু মনে করবেন না, আমার ভাইটা এমন-ই। আমি প্রতিবার বাসায় আসলে এভাবেই চিৎকার করে।
রুহি নিজের ভাইয়ে এভাবে চিৎকার করার জন্য লজ্জা পায়, তাই রিফাতকে কথা গুলো বললো।
রিফাত রুহির কথায় শুধু মুচকি হাসলো। রুহির ভাইয়ের এমন কান্ড দেখে রিফাতের মনে কালো মেঘের ছায়া নেমে আসে। মাহিও এভাবেই চিৎকার করতো রিফাত যখন বাসায় আসতো। আর কখনো হয়তো মাহির এমন দৃশ্য দেখা হবে না রিফাতের। মাহি হলো রিফাতের ছোট বোন।
রিফাত এখন আর এসব ভাবতে চায় না। তাই মিথ্যে হাসার চেষ্টা করলো।
সিয়ামের চিৎকার শুনে বাবা মা দু’জনেই আসেন। সিয়াম নিজের মায়ের পিছন পিছন আসে। সিয়াম এবার ক্লাস সিক্সে পড়ে। রুহি নিজের মা-বাবাকে সালাম করে। রিফাতও রুহির মা-বাবাকে সালাম করে। রুহির মা-বাবা রিফাতের সালামের জবাব দিয়ে প্রশ্নবোধক চাহনিতে রিফাতের দিকে তাকান।
রুহি তার মা বাবার এমন তাকানো দেখে একটু ভয় পায়। তাই রুহি বললো।
মা উনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। কলকাতায় নতুন, গাড়িতেই আমার সাথে পরিচয়। এখানের কিছুই ভালোভাবে চিনেন না। তাই আমি ভাবলাম!
কথা গুলো বলে থামে রুহি। ভিতরে ভিতরে ভয় পাচ্ছে খুব। তাই অপরাধীর মতো তাকায় নিজের মা বাবার দিকে। রুহির এমন তাকানো দেখে রুহির বাবা মা হুহু করে হেসে দেন।
রুহি তার বাবামায়ের হাসি দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। রুহি তার বাবা-মা’র হাসির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না।
এই দিকে রিফাতও ওদের হাসি দেখে অবাক হয়।
রুহি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না৷ তাই,
এমন অপরাধীর মতো তাকিয়ে আছিস কেন? মনে হচ্ছে কোনো বড়সড় অপরাধ করে ফেলছিস? রুহি যখন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না, তাই রুহি নিজের মাবাবার হাসির কারণটা জানতে চাইবে৷ তখনি কথা গুলো বলেন রুহির বাবা।
রুহি নিজের বাবার কথা শুনে চিন্তামুক্ত হয়। রুহির বাবা আবার বলেন।
যা ছেলেটাকে পাশের রুমে নিয়ে যা! আর রুমটা গুছিয়ে দে? রেস্ট নে তোরা, পরে কথা হবে৷ সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রুহির বাবা কথাগুলো বলে মুচকি হেসে বেরিয়ে যান।
রুহি মুগ্ধ হয় নিজে বাবার এমন আচরণ দেখে।
রুহির মা আর কিছু বললেন না। রান্না ঘরে চলে যান।
রুহির মা এখন নানান ধরণের খাবার আর নাশতা তৈরি করবেন।
রুহি যে অনেক দিন পর এসেছে। তাইতো রুহির মা আজ খুব খুশী।
রুহি রিফাতকে সাথে করে নিয়ে রুমে যায়। সিয়ামও ওদের পিছনে পিছনে যায়।
রুহি রিফাতকে বসতে বলে আর রুমটা গুছাতে শুরু করে।
রিফাত বিছানায় বসে আর বলে।
আপনার বাবা-মা খুব ভালো। রিফাত কথাটা বলে থামতেই দরজার পাশ থেকে সিয়াম বলে উঠলো।
আমিও আমার বাবা-মা’র মতোই ভালো। সিয়াম কথাটা বলে সামনের দাঁত গুলো বের করে হুহু করে হেসে দেয়। সিয়ামের নিচের দুটো দাঁত নাই, সিয়ামের এমন পাকামি কথা শুনে রিফাত হেসে দেয়।
সিয়াম তোর দাদা খুব ক্লান্ত। একটু পরে কথা বলিস ভাই আমার।
রুহির কথা শুনে সিয়াম হুম বলে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু পিছন ফিরে আবার বললো।
দাদা না আমি উনাকে ভাইয়া ডাকবো। এই বলে দৌড়ে পালায় সিয়াম।
ও এমন’ই, অনেক দুষ্টু। রুহি কথাটা বলে হাসার চেষ্টা করে।
ওয়াশরুমটা? রিফাত হাত মুখ ধুতে যাবে। তাই রুহিকে প্রশ্নটা করে। রিফাতের প্রশ্ন শুনে রুহি হাত দিয়ে ইশারা করে দেখায়।
রিফাত ফ্রেশ হবে বলে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়।
রুহি রুমটা ভালো ভাভে গুছিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
রিফাত ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে।
সে আজ খুব অসহায়। “এতোটা অসহায় যে সে, নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করতে হয়েছে”,
রিফাত নিজের মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে আবারো আয়নার দিকে তাকায়।
এতো কিছুর পর কীভাবে বেঁচে আছি আমি। আল্লাহ আমাকে মৃত্যু দাও। এই ছলনাময়ী পৃথিবীতে আমি বাঁচতে চাইনা।
কথাগুলো বলে রিফাত কান্নায় ভেঙে পড়ে।
রিফাত হাত মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় শুয়।
সাথে সাথেই ঘুম চলে আসে।
‘মানুষ ক্লান্ত থাকলে ঘুম একটু তাড়াতাড়িই আসে’,
” তাইতো গরীব লোকেরা রাতে খুব তাড়াতাড়িই ঘুমায়। গরীব লোকের খুব পরিশ্রমী হয়, আর পরিশ্রমী লোকেরাই খুব ক্লান্ত থাকে”
রুহি গ্লাসে করে শরবত নিয়ে আসে। এসে দেখে রিফাত চোখ বন্ধ করে আছে। রুহি শরবত এর গ্লাস হাতে নিয়ে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। রিফাতকে ডাকার সাহস হয়নি রুহির।
রিফাতকে ঘুমে দেখে রুহি না ডেকেই চলে যায়। শরবত এর গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে যায়।
আম্মু ভাইয়া কোথায়? ভাইয়ার ফোনে কল যাচ্ছে না। বারবার ফোন বন্ধ বলছে। আম্মু ভাইয়া বাসায় আসছে না কেন? ও আম্মু বলো ভাইয়া কোথায়?
কেঁদে কেঁদেই প্রশ্ন গুলো করে মাহি। মাহি হলো রিফাতের ছোট বোন। এইবার ইন্টারে উঠেছে।
মাহির প্রশ্ন শুনে ডুকরে কেঁদে উঠেন নাফিজা। কী বলবেন উনি! উনি নিজেই জানেন না রিফাত কোথায়। রিফাত এতো অভিমান করলো। একটাবার ফোন দেয় নি নাফিজাকে। নাফিজা নিজের মেয়ের সামনে শক্ত থাকতে চান। নাফিজা জানেন মাহির সামনে বেশি কান্না করলে মাহিও কান্না করবে।
তাই মাহিকে কিছু একটা বলে সান্তনা দিতে হবে।
নাফিজা নিজের মেয়ে মাহিকে কিছু বলতে যাবেন। তখনি রিফাতের বাবা আরমান চৌধুরী রুমে ঢুকেন। আর রেগে গর্জে উঠেন।
ওই ছেলেকে নিয়ে এই বাসায় কোনো কথা হবে না। কথাটা মনে রেখো তোমরা? মাহি নিজের বাবার এমন আচরণ দেখে বারবার ঘৃনা জন্মে নিজের বাবার প্রতি। মাহি নিজের বাবার সাথে তর্ক করতে চায় না। তাই নিজের রুমে চলে যায়।
আরমানের চিৎকার শুনে রিফাতের চাচা হুমায়ুন আর রিফাতের ছোট ভাই মিনার আসে। তিনজন মিলে নাফিজাকে অনেক ভাবে অনেক কথা বলে অপমান করে।
নাফিজা নিজের স্বামী আর ছেলের এমন নষ্টামি দেখে নীরবে কান্না করছেন। নাফিজার কান্না দেখে আরো রেগে যান আরমনা চৌধুরী। আবারো নাফিজাকে খারাপ খারাপ কথা বলতে শুরু করেন। নাফিজা এসব আর সহ্য করতে না পেরে। প্রতিবাদ করতে শুরু করেন।
জেনে রেখো তোমরা, রিফাত একদিন সব জানবে। সত্য কখনো চাপা থাকে না। একদিন প্রকাশ পাবেই৷ সেদিন তোমরা সবাই কাঁদবে।
নাফিজা আর কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আরমান থাপ্পড় বসিয়ে দেন নাফিজার গালে।
নাফিজা থাপ্পড় খেয়ে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তিনি কান্না করেন নি। কারণ মাহি এসব দেখলে কষ্ট পাবে। রিফাতের চাচী এসে নাফিজাকে নিয়ে যান।
নাফিজা যাবার আগে শুধু এটাই বললেন।
আল্লাহ সব দেখছেন। আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দিবেন। সেদিন তোমাদের শাস্তি দেখে হাসবো আমি। শান্তি পাবো, একদিন তোমাদের সব নষ্টামি প্রকাশ পাবে।
পর্ব ৪
রাতের খাবার খাওয়ার জন্য বসে আছে সবাই খাবার টেবিলে। রুহি আর রুহির মা দুজন মিলে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন। সন্ধ্যার পরেই রুহির বাবা গরুর মাংস নিয়ে আসেন। বাড়িতে অতিথি আছে যে। রুহির বাবা আবার অতিথিদের খুব ভালোভাবেই সেবাযত্ন করেন।
সন্ধ্যার পর রিফাত ঘুম থেকে উঠে অনেক আড্ডা দেয় রুহির পরিবারের সাথে। রিফাত ভালোই বুঝতে পারে রুহির পরিবার খুব মিশুক।
রিফাত নীরবে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও সে নিজের হাতে রাতের খাবার খেতো না। সুমা নইলে রিফাতের মা খাইয়ে দিতো। তবে বেশিরভাগ সময় সুমা খাইয়ে দিতো রিফাতকে। কিন্তু আজ?
নিজ হাতে খাচ্ছে রিফাত। এসব কথা ভাবতেই রিফাতের চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করছে।
রিফাত এসব না ভেবে নিজের খাবারের প্রতি মন দেয়।
রুহির বাবা টুকটাক কথা বলছেন রিফাতের সাথে। রিফাতও সব কথার উত্তর দিচ্ছে।
রিফাত নিজের বাবার কথা ভাবে, বাবারা নাকি নিজ সন্তানদের খুব ভালোবাসে। তাহলে আমার বাবা? রিফাত নিজেকেই প্রশ্ন করে। রিফাতের হয়তো অজানা, সব বাবারা ভালোবাসে না। কিছু বাবা খুব খারাপ হয়।
“ঠিক পুরুষ বাঘের মতো”
রিফাত একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজের খাবারের প্রতি মন দেয়।
সকালে রুহির ডাকে ঘুম ভাঙে রিফাতের। আজো সুমাকে স্বপ্নে দেখেছে রিফাত। খুব করে বকা দিচ্ছে সুমা, আর রিফাত মুচকি হাসছিলো।
রিফাত স্বপ্নের কথা মনে করে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। ‘যার সাথে সব সম্পর্ক শেষ, সে কিনা আবার স্বপ্নেও আসে’?
রিফাত আবার মুচকি হাসে এই ভেবে।
“সুমাকে তো স্বপ্নে ডিভোর্স দেয় নি সে, তাইতো এখনো স্বপ্নে রাজত্ব করে সুমা”
রিফাত সকালের নাশতা শেষ করে রুহিদের বাগানে গিয়ে বসে।
জায়গাটক খুব নীরব। মাঝেমধ্যে নীল আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে।
সব দিকে শুধু বাসা আর বাসা, চুল পরিমাণ জায়গাও ফাঁকা নেই। তারপরেও জায়গাটা এতো নীরব। শুধু গাড়ির শব্দ শুনা যাচ্ছে। রিফাত অনেক সময় ভাবতো সুমাকে নিয়ে এমন কোথাও যাবে। যেখানে দু’জন মিলে কিছুটা সময় কাটাতে পারবে।
আজ রিফাত এমন জায়গার সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু যাকে নিয়ে এমন জায়গার স্বপ্ন দেখতো। সে আজ নেই।
“সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিছু স্বপন অপূর্ণ থেকে যায়, স্বপ্ন দেখা মানুষটিকে তিলতিল করে শেষ করে দেওয়ার জন্য”,
বসতে পারি?
রিফাত যখন প্রকৃতির মায়ায় নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছিলো, তখন পিছনে এসে রুহি কথাটা বলে।
হুম বসুন। রিফাত পিছন ফিরে রুহিকে দেখে কথাটা বললো।
রিফাতের চেয়ে কিছুটা দূরে বসলো রুহি।
রুহিদের বাসার পাশে আরো যে কয়টা বাসা আছে সব কয়টা বাসায় ছাল বিশিষ্ট। এখানের কোনো বাসা দু’ তলা নয়। তাই তো এক অন্য রকম সৌন্দর্য চোখে ভাসে।
আচ্ছা এখানের সব বাসা একইরকম কেন? সব বাসা একরকম দেখে রিফাতের জানতে ইচ্ছা হয়। তাই রুহিকে প্রশ্নটা করে।
এই বিষয়টা আমিও জানিনা। তবে সব বাসা একইরকম, তাই দেখতেও ভালো লাগে। রিফাতের প্রশ্নে রুহি মুচকি হেসে কথাগুলো বলে।
হুম,
দুজনের মধ্যে গভীর নীরবতা। রুহির মনে অনেক কথা এসে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু রিফাতের কাছে এতো তাড়াতাড়িই সব জানতে চাওয়া বোকামি। তাই রুহি চুপ থাকলো। রিফাত যা প্রশ্ন করে তার উত্তির গুলোই দিচ্ছে রুহি।
সবদিক এতো নীরব কেন? রিফাত নীরবতা ভেঙে কথাটা বলে।
জায়গাটা এমনি। দেখতে যেমন সুন্দর, আর নীরবতা। ঠিক তার চেয়ে বেশি ভয়ংকর এই জায়গা।
রিফাত রুহির কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি। তাই উৎসাহ কণ্ঠে রুহির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল।
মানে?
এইতো, জায়গাটা নীরব বলে এখানে বেশি খারাপ কাজ হয়।
যেমন?
শিশু পাচার, চুরি ডাকাতি, চিন্তাই, ইভটিজিং এর মতো আরো অনেক ভয়ংকর খারাপ খারাপ কাজ হয়। এই নীরবতাকেই লুফে নিয়েছে কিছু খারাপ লোক। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে রুহি।
রুহির সব কথা মন দিয়ে শুনে রিফাত।
রিফাত জায়গাটাকে যতোটা ভালো ভাবছিলো, এখন দেখছে তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর।
রিফাত হয়তো ভুলে গিয়েছে! ‘প্রতিটা সুন্দরের একটা ভয়ংকর রূপ থাকে’,
এখানে কী সবাই মুসলিম? রিফাত আবারো রুহিকে প্রশ্নটা করে।
না, হিন্দুরাও আছে। মুসলিম আর হিন্দুরা মিলেই থাকে এখানে।
ওও, রিফাত আবার কিছু বলতে যাবে। তখন’ই রুহিদের বাসার গেইট দিয়ে একটা মেয়ে ঢুকে।
রুহি মেয়েটিকে দেখার সাথে সাথেই গিয়ে দৌড়ে জড়িয়ে ধরে।
কাকিমা বললো তুই এসেছিস, আমাদের বাসায় এখনো যাসনি কেন? তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতেই আমি চলে আসলাম। (অর্ণি কথাগুলো বলে থামে।)
কাল সন্ধ্যার সময় এসেছি। ভাবছিলাম দুপুরের খাবার খেয়ে যাবো তোদের বাসায়। রুহি অর্ণির কথার উত্তরে কথা গুলো বলে।
অর্ণি রিফাতের দিকে তাকায়, আর বলে।
কে-রে?
ও রিফাত আমার ফ্রেন্ড।
ফ্রেন্ড শব্দটা শুনে অবাক হয় রিফাত। তারপরেও চুপ থাকে। ফ্রেন্ড ছাড়া আর কী-বা বলেই পরিচয় দিবে।
রুহি আবার বললো।
ওর নাম অর্ণি, আমার সেই পিচ্ছি কালের বান্ধবী।
আসসালামু আলাইকুম, রিফাত অর্ণিকে সালাম করে। রিফাতের মুখে সালাম শুনে অর্ণি রুহির দিকে তাকায়। রিফাত কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
ও স্যরি! আমি ভালো ভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি। ওর নাম হচ্ছে অর্ণি রায়। কথাটা বলে জিহ্বায় কামড় দেয় অর্ণি। রুহির এমন অবস্থা দেখে রিফাত আর অর্ণি দু’জনেই হেসে দেয়।
অর্ণির সাথে রিফাত আর রুহি কিছুক্ষণ কথা বলে।
তারপর অর্ণি নিজের বাসায় চলে যায়। রিফাতের ভালো লাগেনি অর্ণির তাকানোটা।
অর্ণির চাহনির মানে বুঝতে পারে রিফাত।
দুপুরের খাবার খেয়ে রিফাত জায়গাটা ঘুরে দেখার জন্য বের হয়েছিলো।
অনেক ঘুরাঘুরির পর বাসায় আসে রিফাত। নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে রিফাতের। রিফাতের ভয় হচ্ছিলো। সে যদি আবার বাসার ঠিকানা হারিয়ে ফেলে। প্রায় কয়েক দিকেই রাস্তা চলে গেছে। তাই রিফাত এতোটা ভয় পাচ্ছিলো।
ঘুরতে যাওয়ার আগেই রিফাতের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সেই বুদ্ধিটাই কাজে লাগায় রিফাত। রুহিদের বাসার দেয়ালের উপর ছোট্ট ইটের টুকরো রেখে গিয়েছিলো। তাই ভালোভাবেই ফিরে এসেছে বাসায়। নইলে কোথায় যে রাস্তা হারিয়ে যেতো রিফাত। রিফাতের কাছে অচেনা জায়গা মানেই, “আমাজন জঙ্গল “
বাসায় এসে হাত মুখ ধুয়ে নেয় রিফাত।
ড্রয়িং রুমে এসে দেখে রিফাত, রুহি সহ তার বাবা মাও বসে আছে।
রিফাত গিয়ে রুহির বাবার পাশে বসে। রিফাত ভাবছে কথাটা বলবে কি-না?
একপর্যায়ে বলেই ফেলে।
আংকেল আমার জন্য কোনো ব্যাচেলর বাসা দেখে দিতে পারবেন?
কথাটা বলে নিচের দিকে তাকায় রিফাত। রিফাতের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে সবাই চমকে যায়। রুহির বাবা বললেন।
এখানে থাকতে কী তোমার অসুবিধা হচ্ছে বাবা? না-কি আমরা গরীব বলে?
না আংকেল? মানে আ,,
আমরা গরীব বলে অন্য বাসায় উঠতে চাচ্ছো। আমাদের বাসার খাবার তোমার ভালো লাগছে না, তাই-না?
রিফাতকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই রুহির বাবা কথাটা বলেন।
রুহির বাবার মুখে এমন কথা শুনে খুব লজ্জা পায় রিফাত।
আসলে এসব কিছুই না আংকেল।
তো?
লোকে কী বলবে?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে রুহির বাবা হেসে দেন।
লোকে কিছু বলবে না বাবা। এখানের সবাই চাকরিজীবী। সবাই নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত। কে কী করছে, এসব দেখার টাইম নাই ওদের।
রুহির বাবার এমন কথা শুনে রিফাতের আর কিছু বলার থাকলো না।
তাই রিফাত চুপ থাকলো।
এইদিকে রিফাতকে চুপ থাকতে দেখে রুহির বাবা প্রশ্ন করলেন।
ইন্ডিয়াতে কী স্থায়ী ভাবেই থাকবে?
হুম, সেটাই চিন্তা ভাবনায় আছে এখন। তাইতো একটা বাসার কথা বলেছিলাম।
কেন? ইন্ডিয়াতে স্থায়ী ভাবে থাকলে, এই বাসাতে থাকা যাবেনা বুঝি? রুহির বাবার এমন প্রশ্নে রিফাত চুপ থাকে।
রিফাতকে কিছু বলতে না দেখে, ওদের আড্ডা দিতে বলে চলে যান রুহির বাবা। রুহির বাবা একজন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
রিফাত তার রুমে আসে। রিফাত কখনো ভাবেনি ইন্ডিয়াতে এসেও এমন একটা ভালো পরিবার পাবে।
রুহির পরিবার বা রুহি এতোই ভালো যে, এখনো রিফাতের বাংলাদেশ ছাড়ার কারণটা জানতে চায়নি। যদিও রুহি গাড়িতে কিছু শুনেছিলো।
রিফাত এসব আর না ভেবে নীলিমাকে ফোন দেয়। নীলিমার সাথে অনেক কথা বলে রিফাত।
রিফাত নীলিমাকে রুহির পরিবারের কথা বলে। নীলিমা মনে মনে খুশি হয়। রিফাত এমন পরিবারের সাথে থাকলে, হয়তো রিফাতের কষ্ট গুলো কিছুটাও কম হবে।
নীলিমাকে রিফাত এটাও বলে। তার সম্পর্কে যদি কেউ কিছু জানতে চায়। নীলিমা যেন কিছুই না বলে। এবংকি তার মা’কেও।
নীলিমা রাজি হচ্ছিলো না। নীলিমা বলছিলো, রিফাতের মাকে সব বলে দেওয়ার কথা, কিন্তু রিফাত এককথায় না শব্দটাই বেছে নেয়। যদি সে জীবিত থাকে তাহলে নিশ্চয় একদিন নিজের মায়ের কাছে যাবে। নীলিমাকে খুব কষ্ট করে রাজি করায়।
কারণ রিফাত চায় নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, সুমা সবার কাছে মৃত হয়ে থাকতে।
সুমা নাফিজার কাছে ফোন দেয়।
সুমার কল দেখে নাফিজা খুব রেগে যান। পরপর তিনবার ফোন কেটে দেন নাফিজা। সুমার প্রতি খুব রাগ জমেছে নাফিজার।
আবার ফোনে রিং হয়। এইবার ফোন ধরেন নাফিজা। সুমাকে নিজের মেয়ে মাহির মতোই ভালোবাসতেন। কিন্তু সুমা রিফাতের সাথে যা করেছে। তা খুব খারাপ। এবং কি নাফিজার কল্পনার বাহিরে।
সুমা ভয়ে ভয়ে নাফিজাকে সালাম করে। নাফিজার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সুমার সালামের উত্তর দেন। সুমা রিফাতের সাথে কেন এমন করেছে এসব যে জানতে হবে নাফিজার!
পর্ব ৫
কেমন আছেন আম্মু? কথাটা বলার সময় খুব ভয় পায় সুমা। সুমা জানে নাফিজা এখন অনেক কথা শোনাবেন। সুমাও প্রস্তুত সব কথা শুনার জন্য।
নাফিজা যদি তাকে মেরেও ফেলেন, তাতেও কোনো দুঃখ নেই সুমার।
কে আম্মু? সুমার মুখে আম্মু ডাক শুনে নাফিজার খুব রাগ হয়। সুমাকে এখন কাছে পেলে কী যে করতেন সেটা নাফিজার অজানা।
সুমা নাফিয়াজার এতো রাগান্বিত কণ্ঠে কথা শুনে খুব ভয় পায়। “আপনি”
কথাটা বলে চোখ বন্ধ করে নেয়।
আপনি শব্দটা শুনে নাফিজা আবারো রেগে যায়। এখন সুমাকে কিছু কথা না শুনালে শান্তি পাবেন না নাফিজা।
“সামনে তেতুল রেখেও মিষ্টি কিছু পান করার ন্যায়”
কিন্তু নাফিজা মিষ্টি কথা বলবেন না। তিনি সুমাকে কিছু কথা শুনিয়েই সান্তনা পাবেন।
কেন ফোন দিয়েছো? এটা দেখার জন্য বেঁচে আছি কি-না মরে গেছি?
নাফিজার মুখে এমন কথা শুনে সুমার চোখে জ্বল চলে আসে। নাফিজা তাকে ঘৃণা করছে। এতোই ঘৃণা করছে যে৷ সুমাকে তুই না বলে তুমি করে বলছে।
এভাবে কথা বলছেন কেন আম্মু?
তো কো ভাবে কথা বলবো তোমার সাথে?
নাফিজার কথা শুনে সুমা কী বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা। তারপরেও সুমা বললো।
‘আম্মু রিফাত কেমন আছে?
আজ কয়টা দিন ধরে রিফাতকে দেখতে পারছেনা সুমা, না পারছে কথা বলতে। এতোটা ভালোবেসেও আজ রিফাতকে ছাড়া কাটাতে হচ্ছে নিজেকে।
সুমা একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়।
এখনো রিফাতকে ছাড়া নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে করে সুমা। কিন্তু কী করবে সে!
রিফাত আর সুমার বিয়ে হয়েছে তিন বছর হয়েছিলো। বিয়ের আগে ৩মাস প্রেম করে ওরা। তারপরেই দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করে। ডিভোর্স এর এক মাস আগেও দু’জনের সম্পর্ক অনেক ভালো ছিলো।
কিন্তু কিছু খারাপ লোকদের জন্য সব শেষ হয়ে গেলো।
‘সম্পর্ক ততোদিন ভাল থাকে, যতদিন ওই সম্পর্কে কোনো ক্ষত স্থান না দেখা যায়। ক্ষত স্থান মানেই খারাপ লোকের হাতে চাঁদ পাওয়ার আনন্দ’,
সুমা এখনো রিফাতকে অনেক ভালোবাসে। তাইতো রিফাত কেমন আছে সেটা জানত্র চাইলো।
সুমা জানে তার প্রতিটা কথার উত্তর অন্য পাশ থেকে খুব তিক্ত ভাবেই আসবে।
তোমার ওই মুখে আমার ছেলের নাম শুনতে চাই না। তোমার জন্য আজ আমার ছেলে আমার কাছে নাই। কথাটা বলেই কান্নায় ভেঙে পরেন নাফিজা।
নাফিজার মুখে এমন কথা শুনে সুমাও কেঁদে দেয়। রিফাত নিজের খারাপ কিছু করে ফেলেনি তো?
সুমার কান্নার শব্দ শুনে নাফিজার গা জ্বলে যাচ্ছে।
-ন্যাকা কান্না করবে না, তোমাকে নিজের মেয়েই ভাবতাম। তুমি না আমার ছেলেকে ভালোবাসতে?
এই ছিলো আমার ছেলের প্রতি তোমার ভালোবাসা? এতোই ভালোবাসা ছিলো যে আমার ছেলের প্রতি, আমার ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে। আমার ছেলেকে অপমান করলে। কেন এমন করলে? এই পৃথিবীতে হাজারো স্বামী-স্ত্রী আছে যাদের সন্তান নেই। তারা কী সংসার করছে না? কই তারা তো কেউ কাউকে ডিভোর্স দেয় নি বা কেউ কাউকে অপমান করে নি?
কথা গুলো এক নিশ্বাসে বলেই কেঁদে দেন নাফিজা। আজ কয়টা দিন ধরে নিজের ছেলেকে দেখছেন না নাফিজা। একটাবারের জন্যেও বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছেন না। কোথায় আছে সেটাও নাফিজার অজানা। নাফিজার কান্নার শব্দ ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে।
নাফিজার কান্নার শব্দ সুমা ছাড়া আর কেউ শুনবে না।
সুমাও কান্না করছে, নাফিজার করা প্রশ্নের উত্তর গুলোও দিতে পারবে না সুমা। আর হয়তো সুমার উত্তর গুলো শুনে নাফিজা আরো বেশি কষ্ট পাবেন। নয়তো-বা নাফিজা বিশ্বাস করবেন না সুমার কথা।
তবুও সুমা বলে।
আম্মু আমার কথা গুলো ঠাণ্ডা মাথায় শুনেন! আমি সব বলবো, কেন এসব করেছি। আমি নিজের ইচ্ছায় কিছুই করিনি।
আ, আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা। আর কখনো আমার কাছে ফোন দিবেনা তুমি।
নাফিজা কথা গুলো বলেই ফোন কেটে দেন সুমাকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়েই।
আর সাথে সাথেই ফোনটা অফ করে রাখেন নাফিজা।
কারণ নাফিজা জানেন সুমা এখন বারবার ফোন দিবে। সুমার কোনো কথাই বিশ্বাস করেন না নাফিজা। নাফিজার কাছে সব কিছুই অভিনয় মনে হচ্ছে। শুধু সুমার জন্যই আজ রিফাতের এতো কষ্ট।
সুমা আরো অনেকবার ফোন দেয়। কিন্তু নাফিজার ফোন বন্ধ। সুমা চিৎকার করে কান্না করছে। নাফিজা একবার তো সব শুনতে পারতেন। নাফিজার ভুল কী ভাঙতে পারবে না সুমা?
সুমা রিফাতের নাম্বারে কল দেয়, কিন্তু রিফাতের ফোন বন্ধ। প্রতিদিন রাত শতশত ফোন দেয়৷ কিন্তু ফল একটাই সেটা ফোন বন্ধ।
আমি কী পারবোনা ওই খারাপ লোকেদের মুখোশ খুলে দিতে? পারবো না কী রিফাতকে সব সত্য কথা বলতে? রিফাতকে কী আর কখনো আপন করে পাবো না? কখনো কী ক্ষমা চাইতে পারবো না রিফাতের কাছে?
সুমা নিজের সাথেই বকবক করছে, আর চোখের পানি ফেলছে।
সুমা কখনো নিজের মা বাবা আর ওই লোকদের ক্ষমা করবে না। ওদের জন্যেই রিফাতকে এতোটা কষ্ট দিলো সুমা।
রিফাত ইন্ডিয়ায় আসছে আজ পাঁচদিন হলো। এই অল্প কয়দিনেই রুহি সহ ওর পরিবারের সবার সাথে ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। রুহির মা বাবা খুব ভালো, রুহির বাবাকে দেখে রিফাত ভাবে।
“পৃথিবীর সব বাবারাই ভালো, শুধু নিজের বাবা ছাড়া”
রুহির সাথে এখন তুমি করেই কথা বলে রিফাত। রুহির সাথে তেমন কথা হয় না রিফাতের। আর হলেও খুব সামান্য। রিফাত সারাক্ষণ রুহির বাবা-মা আর সিয়ামের সাথেই আড্ডা দেয়।
রুহি চায় রিফাত প্রথমে তার বাবা মা’র সাথে ভালো ভাবে মিশুক। তারপর না হয় তার সাথে মিশবে।
রিফাত ইন্ডিয়াতে আসার দুইদিন পরেই নিজের ফেসবুক আইডি নষ্ট করে ফেলে।
বাংলাদেশের কারো সাথেই সম্পর্ক রাখতে চায় না রিফাত, শুধু নীলিমা ছাড়া। নীলিমার কাছ থেকেই নিজের পরিবারের খোঁজ-খবর নিবে।
আম্মু কী আমার জন্য কান্না করেন?
রিফাত ফোনে নিজের মায়ের ছবি দেখে কথাটা ভাবে। রিফাত তার মায়ের সাথে কথা না বললেও, ছবি দেখেই তৃষ্ণা মেটায়।
“ছাতক পাখি যেমন বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা করতে করতে ওই নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের তৃষ্ণা মেটায়”
রিফাতের বিশ্বাস একদিন সে নিজের মায়ের কাছে ফিরে যাবে। নিজের মায়ের বুকে অনেক্ষণ নিজেকে জড়িয়ে রাখবে।
আসবো? রিফাত বিছানা শুয়ে শুয়ে যখন এসব ভাবছিলো তখনি রুহি এসে কথাটা বলে।
হুম আসো।
রুহি এসে বিছানার এক পাশে বসে। রিফাত শুয়া থেকে উঠে বসে।
তুমি কী সব কাজেই প্রথমে পারমিশন নাও? না-কি শুধু আমার কাছ থেকেই? রিফাত মুচকি হেসে প্রশ্ন গুলো করে।
রুহি রিফাতের কথা গুলো বুঝে উঠতে পারেনি।
তাই রিফাতকে উল্টো প্রশ্ন করে রুহি।
মানে?
এই যে আসবো, বসবো, আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কী শুধু আমার কাছ থেকেই পারমিশন নিয়ে করো?
রিফাত কথা গুলো বলে হেসে দেয়।
ওও এইসব। আসলে এর আগে কখনো ভালোভাবে কোনো ছেলের সাথে কথা বলিনি আমি। তুমিই প্রথম, যার সাথে আমি এতো কথা বলতেছি বা বলবো। তাই কেমন জানি আনইজি ফিল করি। তাই তোমাকে সব কিছু প্রথমে জিজ্ঞেস করি।
রুহি কথাগুলো বলে থামে, রুহি কখনো ভাবেনি সেও এভাবে কোনো ছেলের সাথে এতো কথা বলবে। রুহির কথা শুনে হাসছে রিফাত। রুহি সেই হাসি খুব মুগ্ধ হয়ে দেখছে। যেভাবে, “আকাশে থাকা চাঁদকে মানুষ খুব ভালোবেসে মুগ্ধ হয়ে দেখে”
,
আচ্ছা আমরা কী ভালো বন্ধু হতে পারি? রুহি কথাটা বলে রিফাতের দিকে তাকায়। রিফাত কী উত্তর দিবে সেই আশায়।
হ্যাঁ অবশ্যই।
রিফাতের কথা শুনে রুহির মুখে হাসি ফুটে উঠে।
সুমাও এভাবে হাসতো, কিন্তু সুমা আর রুহির মধ্যে কোনো মিল নেই। দু’জনের মধ্যে আকাশ আর মাটি তফাৎ।
সুমা খুব চঞ্চল মেয়ে ছিলো, আর রুহি খুব নীরব প্রকৃতির মেয়ে।
সুমার কথা ভাবতেই রিফাত এর কষ্ট শুরু হয়।
— যেভাবে একটা মা শিশু জন্ম দেওয়ার আগে পাহাড় সমান ব্যথা উপভোগ করে।
রিফাতও সুমার কথা মনে পরলে এমন ব্যথা অনুভব করে, তারপরেই চোখে এসে পানি রাজত্ব করে।
রুহির মিষ্টি হাসির দিকে তাকিয়ে আবারো সুমার কথা ভাবে রিফাত।
সুমাও প্রতিটা কথা বলার পর এভাবে হাসতো।
সুমার সেদিনের আচরণের পর মেয়েদের প্রতি একপ্রকার ঘৃণা জন্মেছিলো। কিন্তু রিফাত সেই ঘৃণাকেই মাটি চাপা দেয় এই ভেবে, তার বোন মেয়ে, তার মা মেয়ে, নীলিমা মেয়ে, ওরা তো খারাপ না।
সুমা নারী তাই বলে যে প্রতিটা নারী খারাপ হবে এমন তো না।
কিছু ভাবছো?
রিফাতকে অনেক্ষণ ধরে দেখছে কোনো কিছু চিন্তা করতে।
তাই প্রশ্নটা করে।
রুহির কণ্ঠ শুনে রিফাত ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। আর বলে ” কিছু না”
এই কথাটা রিফাত আবার বলে।
আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো?
তুমিও এখন কথা বলার জন্য পারমিশন চাচ্ছো? কথাটা বলেই রুহি হেসে দেয়। কারণ একটু আগেই রুহিকে এই কথা বলেছিলো রিফাত।
ইয়ে মানে, রিফাত নিজের মাথায় হাত বোলাচ্ছে৷
কী যেন বলতে চেয়েছিলে? রিফাতের এমন লজ্জা পাওয়া দেখে রুহি আবার প্রশ্নটা করে।
এই দিকে রুহির মা পর্দার আড়াল থেকে ওদের কথা শুনছিলেন।
নিজের মেয়ের পরিবর্তন দেখে অনেকটা খুশি তিনি।
রুহির মা জানেন রুহি ছেলেদের সাথে কথা বলেনা বা বলতে চাইতো না। রুহি নিজের খালা বা ফুফুর ছেলেদের সাথেও কথা বলতে লজ্জা পেতো। এই জন্য রুহিকে অনেক কথা শুনাতেই সবাই।
রুহির মা হাসি মুখে রান্না ঘরে চলে যান।
আজ পাঁচ দিন হলো ইন্ডিয়ায় আসছি। তাই ভাবছি আর বসে থাকবো না, কোনো চাকরি করবো।
রিফাত কখনো কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চায় না। এটা তার অভ্যাস।
তো কী ভাবছো?
ভাবছি কাল থেকে চাকরি খুঁজবো। এমনিতে আগে নিজেদের কোম্পানি নিজেই দেখা শোনা করেছি।
রিফাতের মুখে নিজেদের কোম্পানি শব্দটা শুনে খুব অবাক হয় রুহি। রিফাতকে দেখেই বুঝেছিলো রুহি, রিফাত নিশ্চয় রিফাত কোন ধনী পরিবারের ছেলে। তবে এতোটা ধনী যে রিফাত বুঝতে পারিনি।
রিফাতের প্রতি আরো আগ্রহ জন্মাচ্ছে, রিফাত সম্পর্কে সব কবে জানবে৷
কালকে বাবাকে দিয়ে অর্ণির বাবার সাথে কথা বলতে বলবো নে। রুহি কথাটা বলে।
অর্ণি কে?
ওইযে সেদিন ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম না? রুহি হাসি মুখে কথটা বলে। রুহির কথা শুনে রিফাত হুম বলে।
রিফাত আর রুহি মিলে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। তারপর রুহি তার রুমে চলে যায়। রিফাতও কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করে।
পর্ব ৬
সকালের নাশতা শেষ করে ড্রয়িং রুমে বসে আছে রিফাত। রুহির বাবার জন্য অপেক্ষা করছে, নাশতার টেবিলেই রুহি তার বাবার সাথে রিফাতের চাকরি নিয়ে কথা বলে। রুহির বাবা রিফাতকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিসের চাকরি করবে সে? রিফাত কাল রুহিকে যে কথা গুলো বলেছিলো। এই কথাগুলো রুহির বাবাকেও বলে।
রুহির বাবা রিফাতের মুখে সব শুনে অনেকটাও অবাক হন। রিফাতকে কিছু একটা প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই রুহি অর্ণিদের বাসায় যাওয়ার কথা বলে। তাই আর প্রশ্নটা করা হয়নি রুহির বাবার।
রুহি তার বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলো। রিফাতকে বাংলাদেশের কথাই প্রশ্ন করবেন, এতে রিফাত একটু হলেও কষ্ট পাবে। তাই রুহি একটু তাড়া দিলো।
রুহির বাবা আর রিফাত অর্ণিদের বাসার গেইটে ঢুকেন। রুহির বাবা গিয়ে বাসার কলিংবেল বাজান। কলিংবেল এর শব্দ শুনে অর্ণি এসে দরজা খুলে দেয়। রুহির বাবাকে দেখে ভিতরে আসতে বলে অর্ণি। রিফাতকে এখনো দেখেনি সে। রুহির বাবা ভিতরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকেন নি, কারণ রিফাত এখনো বাগানে দাঁড়িয়ে আছে।
এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে? রিফাতকে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, রিফাতের দিকে একটু এগিয়ে এসে প্রশ্নটা করেন রুহির বাবা। রিফাত প্রশ্নটা শুনে নীরব থাকে।
অর্ণিও রুহির বাবার পিছনে এসে দাঁড়ায়।
রিফাতকে দেখে অর্ণির মুখে হাসি ফুটে উঠে। অর্ণি ভাবছিলো রুহিদের বাসায় যাবে একটু পর। যার জন্য যেতে চেয়েছিলো তাকে তো এখন নিজের বাসায় আবিষ্কার করলো।
সেদিন রিফাতকে দেখার পর থেকেই রিফাতের প্রতি কেমন একটা টান সৃষ্টি হয়েছে অর্ণির। সেই অজানা টান কীসের জন্য? সেটা অর্ণি বুঝে উঠতে পারছে না।
কথা বলছো না যে? রিফাতকে নীরব থাকতে দেখে আবারো প্রশ্নটা করেন রুহির বাবা।
মানে আমাদের বাংলাদেশে! কথাটা বলে থামে রিফাত।
কী তোমাদের বাংলাদেশে?
রিফাতের বলা কথার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না রুহির বাবা। তাই আবার প্রশ্নটা করলেন।
রিফাত একবার অর্ণির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে।
বাংলাদেশে প্রায় অনেক হিন্দুদের ঘরে মুসলিমদের ঢুকতে দেয় না। তাই ভাবছিলাম এখানেও এমন। রিফাত কথাগুলো বলে মাথা নিচু করে নেয়।
রিফাতের কথা শুনে অর্ণি আর রুহির বাবা শব্দ করে হেসে দেন।
আমাদের বাসায় বাসায় মুসলিমরা আসে, খাবার খায়, আড্ডা দেয়, আমরাও মুসলিমদের বাসায় যাই। এমন নিয়মের কথা এই প্রথম শুনলাম।
অর্ণি কথাগুলো বলে আবারো শব্দ করে হেসে দেয়। অর্ণির হাসি দেখে খুব লজ্জা পায় রিফাত। রিফাত নিজেকে বোকা ভাবছে এখন। না জেনে এক জায়গার নিয়ম অন্য জায়গায় বলা, এসব বোকামি ছাড়া কিছুই না।
ভিতরে আসুন?
রিফাত আর কোনো কথা বললো না। রুহির বাবা আর রিফাত ভিতরে ঢুকে গিয়ে সোফায় বসলেন।
রিফাত সোফায় বসে বসে ভাবছে, বাসায় গিয়ে রুহির কাছ থেকে ইন্ডিয়ার সব কিছু সম্পর্কে জেনে নিবে। যাতে এভাবে আর কোথাও লজ্জা না পেতে হয়।
অর্ণি চা নিয়ে আসে ওদের জন্য। অর্ণির মা দাদু আর অর্ণির ভাই পূজা দিতে মন্দিরে গেছেন। একটু সময়ের মধ্যেই এসে যাবেন ওরা। বাসায় শুধু অর্ণি আর ওর বাবা আছেন। উনিও একটু পর অফিসে চলে যাবেন।
রুহির বাবা চা’য়ের কাপ হাতে নিয়ে চা খাচ্ছেন। কিন্তু রিফাত এখনো চা খায় নি। সে সোফায় বসে আছে। এটা দেখে অর্ণি বলে।
আপনাদের দেশে হিন্দুদের ঘরের কিছু খাওয়াও মানা না-কি?
অর্ণির এই প্রশ্নটা রিফাতের ভালো লাগেনি। একটু বেশিই বুঝে ফেলছে এই মেয়ে। রিফাত একটু অসহ্য বোধ করলো।
রিফাত একটু আগেই নাশতা করেছে। তাই এখন আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু অর্ণির প্রশ্ন শুনে ইচ্ছা না থাকা সত্যেও চা’য়ের কাপটা হাতে নেয়। আর চা’য়ে একের পর এক চুমুক দিয়েই যাচ্ছে। রিফাত কথাটা শুনে রাগ করেছে, এই বিষয়টা ভালোই বুঝতে পারে অর্ণি। অর্ণি মুগ্ধ হয়ে রিফাতের রাগী চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে।
তোমার বাবা কোথায়? অর্ণি যখন রিফাতকে দেখতে মগ্ন তখনি প্রশ্নটা করেন রুহির বাবা।
বাবা গোসল করছেন।
ওও,
এইতো বাবা চলে এসেছেন। অর্ণি তার বাবার রুমের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো।
আরে মাজহারুল (রুহির বাবা) ভাই যে, কেমন আছো?
অর্ণির বাবা তাপস রায় নিজের গায়ের পানি টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন।
এইতো আল্লাহ যেমন রাখছে। তোমার খবর কী? দেখাই যায় না তোমায়?
কাজের অনেক চাপ। তাই একটু কম কম দেখো। কাজের চাপ না থাকলে অবশ্যই ভাবির হাতের রান্না খাওয়ার জন্য তোমাদের বাসায় যেতাম। কথাটা বলেই হুহু করে হেসে দেন তাপস রায়।
তা তো বটেই।
ছেলেটা কে?
রিফাতকে দেখে প্রশ্নটা করেন তাপস।
ওর নাম রিফাত। আমার মেয়ের ফ্রেন্ড, বাংলাদের থেকে এসেছে।
ওও! তাপস রায় রিফাতের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে কথাটা বলেন।
কেমন আছেন আংকেল?
ভালো আছি।
মাজহারুল ভাই তা কোনো কাজে আসছো না-কি?
হ্যাঁ একটা কাজেই আসছি।
কী কাজ?
বলছিলাম কী! ওর জব্য একটা চাকরি প্রয়োজন। তাই তোমার অফিসে যদি ওরে?
কতটুকু পর্যন্ত লেখাপড়া করেছো বাবা? রুহির বাবার কথাগুলো শুনে রিফাতকে প্রশ্ন করেন তাপস।
আমি মাস্টার্স পাস করেছি।
বাংলাদেশে কী কখনো কোনো জব করেছো?
হ্যাঁ, আমাদের নিজের কোম্পানি আমি নিজেই দেখাশোনা করতাম।
ওও, তাহলে তো অনেক অভিজ্ঞতা আছে।?
কতটুকু অভিজ্ঞতা আছে জানিনা, তবে নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
রিফাতের কথা শুনে মুচকি হাসেন তাপস, আর বলেন।
আমি তৈরি হয়ে আসি, তোমরা একটু বসো।
এই বলে নিজের রুমে চলে যান। অর্ণিও তার রুমে চলে যায়।
অর্ণির মা, দাদু আর অর্ণির ভাই মন্দির থেকে আসেন।
ওরা বাসায় এসে রুহির বারা আর রিফাতকে দেখে, ওদের সাথে কথা বলেন।
রুহির ভাই একজন পুলিশ অফিসার। ছুটিতে বাড়ি আসছে।
নাম রাহুল রায়।
তাপস তৈরি হয়ে আসেন। আর বলেন,
আজ তোমাকে স্যারের সাথে কথা বলাবো। দেখবো উনি কী বিলেন তোমার সাথে কথা বলে।
রিফাত হুম বলে তাপসের কথার উত্তরে।
তাপস রিফাতকে নিয়ে অফিসে যাবার জন্য রওনা দিতে চাইলে অর্ণি পিছন থেকে ডাক দেয়।
বাবা?
কিছু বলবি?
হ্যাঁ,
বল কী বলবি?
বাবা আমিও তোমাদের সাথে যাবো।
তুই আবার কোথায় যাবি আমাদের সাথে? অর্ণির কথা শুনে খুব অবাক হয়েই বললেন তাপস।
গাড়িতে বলবো৷
অর্ণির কথা শুনে তাপস রায় আর কিছু বলেন নি।
রুহির বাবা অর্ণিদের বাসায় কিছুক্ষুণ গল্প করে চলে যান নিজেদের বাসায়।
ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভ করছে। ড্রাইভার এর পাশে অর্ণির বাবা বসে আছেন।
আর পিছনে রিফাত আর অর্ণি। রুহির এক আলাদা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে রিফাতের পাশে বসে, এভাবে আরো অনেক ছেলের পাশেই অর্ণি বসেছে। কিন্তু এভাবে কোনো ছেলের প্রতি নিজের অনুভূতি কাজ করেনি। অর্ণি কিছুক্ষণ পরপর রিফাতের দিকে তাকাচ্ছে।
এইদিকে রিফাতের কেমন জানি লাগছে অর্ণির তাকানোটা।
অর্ণিকে রিফাতের কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। রিফাত যা ভাবছে, আসলেই কী তা? রিফাত নিজের চোখটা বন্ধ করে নেয়।
অর্ণির ইচ্ছা করছে রিফাতের সাথে কথা বলার। কিন্তু রিফাত যে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্ণি রিফাতের কয়েকটা পিক তুলে নেয়। তাও রিফাতের সাথে সেলফি।
গাড়িটা এসে অফিসের সামনে থামে। ওরা অফিসে ঢুকে।
অর্ণির বাবা এই অফিসের ম্যানেজার। রিফাত আর অর্ণিকে সাথে নিয়ে নিজের অফিস রুমে যান।
আজকে স্যার আসবে কথা ছিলো। মাসে দুই তিনবার আসেন। এখনো আসেন নি।
অর্ণির বাবাই সব সামলান।
এই কোম্পানির মালিকের আরো অনেকটা বিজনেস আছে। তাই এতো সময় পান না আসার।
ওদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আসেন মিনাল চক্রবর্তী (কোম্পানির মালিকের নাম)।
অর্ণির বাবা সব ফাইল সহ সব কিছু উনার সামনে পেশ করেন।
মিনাল চক্রবর্তী সব দেখেন। নির্ভুল ভাবেই সব কাজ করে এখানের সবাই। আর তাপস রায়কে খুব বিশ্বাস করেন মিনাল।
মিনাল চক্রবর্তীর চলে যাবার সময় হলে রিফাতের কথা বলেন তাপস।
তাপসের সাথে অনেক্ষণ কথা বলেন মিনাল চক্রবর্তী।
রিফাত সম্পর্কে সব বলেন তাপস। রিফাত এর নিজের কোম্পানি আছে জেন একটু অবাক হন মিনাল। ইন্ডিয়াতে আসার কারণ জানতে চান মিনাল রিফাতের কাছে। রিফাত অনিচ্ছা জানায় এসব জানাতে। উনিও আর কিছু বলেন নি। আর এমনিতেই মিনাল চক্রবর্তী বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না।
মিনাল চক্রবর্তী তাপস রায়কে বলেন, ওর (রিফাত) সব কাগজ দেখে, ওর যোগ্যতা অনুযায়ী যেই পোস্ট ফাঁকা রয়েছে, সেই পোস্টেই ওরে কাজি দিবা। এই কথা গুলো বলে মিনাল চক্রবর্তী চলে যান।
রিফাতের মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফুটে উঠে। যদিও মনের ভিতরটা চিৎকার করে কাঁদছে তার।
তাপস রায় রিফাতকে বাসায় চলে যেতে বলেন। দুই দিন পর এসে যেন কাজে জয়েন্ট হয়। কী পোস্টে জয়েন্ট করবে রিফাত, সেটা কাজে আসার পরেই বলবেন।
রিফাত হুম বলে চলে আসতে চাইলে অর্ণি বললো।
আমিও যাবো! অর্ণির কথা শুনে তাপস রায় তাকান ওর দিকে। অর্ণি যে তাদের সাথে আছে, সেটা ভুলেই গেছিলেন।
কেন আসলি সেটাই তো বললি না?
অর্ণির কথা শুনে কথাগুলো বললেন তাপস।
আমি কিছু ড্রেস কিনবো। অর্ণি খুব আদুরী গলায় বললো।
সেটা তো রাহুলকেই বলতে পারতি, আমাদের সাথে আসলি কেন? আমার কী সময় আছে?
তাপসের কথা শুনে অর্ণি প্রথমে বিড়বিড়িয়ে কি যেন বললো। তারপর আবার অর্ণি বলে।
দাদাকে বললে ধমক ছাড়া আর কিছুই দিবে না। ন্যাকা কান্না করে কথাটা বলে অর্ণি।
তোকে এখন নিয়ে যাবে কে? একটু চিন্তিত হয়ে বললেন তাপস।
উনাকে সাথে করে নিয়ে যাই? রিফাতের দিকে ইশার করে বলল।
অর্ণির কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় রিফাত। রিফাত অর্ণিকে নিয়ে যা ভেবে আসছিলো, তা এখন আস্তে আস্তে সত্য হচ্ছে।
অর্ণির কথা শুনে রিফাতের দিকে তাকান তাপস।
আর বলেন।
তুমিও তো বাসায় যাবে, এখনো ভালোভাবে রাস্তাঘাট চিনো না। তুমি তাহলে অর্ণির সাথেই যাও।
তাপসের কথায় রিফাত শুধু মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বললো।
অর্ণি মুচকি হাসলো, সে তার কাজে সফল হয়েছে।
অর্ণি আর রিফাত টেক্সিতে বসে আছে।
অর্ণি আর রিফাত একটা শপিংমলে ঢুকে। অর্ণি নিজের জন্য কিছু ড্রেস কিনবে, তাই একের পর এক ড্রেস দেখেই যাচ্ছে। রিফাত পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
এখন সুমার কথা খুব মনে হচ্ছে রিফাতের। এভাবেই সুমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো রিফাত। রিফাতের পছন্দ মতোই ড্রেস কিনতো সুমা। অর্ণির সাথে এসে রিফাতের কষ্টটা একটু বেড়েই গেলো।
কতোই না খুনসুটি করতো সুমার সাথে সে।
সব মনে হচ্ছে, আর কষ্টের মাত্রা বাড়ছে।
অর্ণি রিফাতের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য, নানান বাহানায় অনেক গুলো ড্রেস কিনে।
এই দিকে রিফাতের অসহ্য লাগছে।
রিফাতের ইচ্ছা না থাকা সত্বেও রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় অর্ণি। অর্ণি রিফাতের সাথে অনেক গল্প করে৷ আর দুপুরের খাবারটাও খেয়ে নেয়। রিফাতের বোরিং লাগছিলো অর্ণির সাথে কথা বলতে, তবুও অনেক কথাই বলেছে। আর মনে মনে অনেক বকা দিয়েছে রিফাত অর্ণিকে।
রিফাত বাসায় এসে গোসল করে নেয়। আর একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে।
ঘুমানোর আগে রুহিকে বলেছে রিফাত।
সে দুপুরের খাবার খেয়ে এসেছে অর্ণির সাথে। অর্ণির সাথে কথাটা শুনে রুহির কিছুটা হলেও মন খারাপ হয়েছে।
পর্ব ৭
ভাইয়া রিফাতের তো কোনো খোঁজ-খবর নাই। কোথায় আছে সেটাও আমরা জানি না! একটু চিন্তিত হয়েই কথাগুলো বললেন রিফাতের চাচা হুমায়ুন। হুমায়ুন এর কথা শুনে চিন্তায় পড়েন রিফাতের বাবা আরমান। কিন্তু পরেই আবার অট্টহাসিতে মেতে উঠেন আরমান। আর বলেন।
রিফাতকে আর খুঁজতে হবে না, শুধু টিভির নিউজে চোখ রাখবি! দেখবি রেল লাইনে বা রাস্তায় কোনো অজ্ঞাত যুবকের লাশ খুঁজে পায় কি-না প্রশাসন। তখন বুঝে নিবি এটাই রিফাতের লাশ। কথাটা বলে হুহু করে হেসে দেন আরমান, খুব বিশ্রী ধরণের হাসির শব্দ।
সাথে হুমায়ুনও হাসছে।
আরমান এর এমন নিষ্ঠুর কথা শুনে নাফিজা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি। দৌড়ে গিয়ে আরমানের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেন। আরমানের সাথে রিফাতকে নিয়েই কথা বলতে আসছিলেন নাফিজা। কিন্তু নিজের ছেলেকে নিয়ে এমন কথা শুনে নাফিজা রাগে আগুনে জ্বলে উঠেছিলেন।
নাফিজার হাতে থাপ্পড় খেয়ে উলটো আরো দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আরমান নাফিজার গালে।
তোর সাহস হয় কীভাবে আমার গায়ে হাত তোলার?
কুকুর এর গায়ে হাত তুলতে আবার সাহস এর প্রয়োজন হয় না-কি?
কথাটা বলে আবারো হাত তোলেন আরমানকে মারতে। কিন্তু আরমান নাফিজার হাত ধরে ফেলে।
নাফিজা আবারো চিৎকার করে বলেন।
একজন বাবা হয়ে কীভাবে এসব বলতে পারলে নিজের ছেলেকে নিয়ে? এসব বলার আগে একবারো তোমার অন্তর কেঁপে উঠলো না?
নাফিজা কান্না করছেন।
কারো কাছে দেওয়া কথা তিনি রাখতে পারেন নি। নাফিজার কান্না দেখে আরমনা হেসে বললো।
অন্তর কাঁপবে? তাও ওই ছেলের জন্য, যার কি-না বাবা হওয়ার ক্ষমাত নাই।
আরমান এর কথাটা সহ্য করতে পারলেন না নাফিজা।
ভুলে যেও না সব? আমি মুখ খুললে কিন্তু তোমাদের এই হাসি মুখটা আর দেখা যাবে না।
এর আগেই যদি তোকে এই পৃথিবী থেকেই বিদায় করে দেই? নাফিজার কথার উত্তরে আরমান এই কথাটা বলল।
তুমি সত্যিই অমানুষ হয়ে গেছো! কোনো ভালো মনের মানুষ কখনো এমন খারাপ কথা বলতে পারে না।
নাফিজার কথা শুনে আরমান হুহু করে হেসে দেয়।
এই পৃথিবীতে আর কিছুদিন ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে নিজের মুখটা বন্ধ রাখ। নইলে,,
আরমানকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়েই নাফিজা রুম ত্যাগ করেন।
মন্দ লোকের বিচার আল্লাহ একদিন করবেন।
সব সত্য যেদিন প্রকাশ পাবে। সেদিন অবশ্যই ওরা কাঁদবে ওদের পাপ কাজের জন্য।
দুই বার রিং হয়েই কেটে যায় ফোন। নেটে সমস্যার জন্য এমন হচ্ছে। সুমা আবারো ফোন দেয়। নীলিমা বই পড়ছিলো, ফোনের শব্দ শুনে নীলিমার খুব রাগ হয়। বই পড়ার সময় কোনো ভাবেই কারো ডিস্টার্ব সহ্য করতে পারে না নীলিমা। তাই ফোনের দিকে মন না দিয়ে আবারো বই পড়ার দিকে মন দেয় নীলিমা।
কিন্তু আবারো ফোনে রিং হওয়ায় নীলিমার রাগ হয়। বই পড়া থেকে মনযোগ উঠে যায়। এখন সে হাজারো চেষ্টা করেও বইয়ের দিকে মন দিতে পারবে না। বিছানা থেকে উঠতে উঠতেই আবারো ফোনটা কেটে যায়।
রিফাত তো একবারের বেশি কল দেয় না। তাহলে কে দিলো ফোন?
এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা হাতে নেয় নীলিমা। আবারো ফোনটা বেজে উঠে।
ফোনের স্কিনে সুমা নামটা দেখেই রেগে যায় নীলিমা।
সুমা হলো নীলিমার খালাতো বোন। নীলিমার মাধ্যমেই রিফাত আর সুমার সম্পর্ক হয়েছিলো।
এইবার ফোন কেটে যাওয়ার আগেই নীলিমা ফোনটা তোলে।
কেন ফোন দিয়েছিস?
সুমার জন্যেই আজ রিফাত এতো কষ্টে।
আমি জানি তুইও আমায় কথা শোনাবি! তারপরেও আমার সাথে একটু সময় কথা বল। নীলিমার কথাটা শুনে সুমার মন খারাপ হয়ে যায়। তাই এই কথাটা বলে।
রিফাতকে যেদিন ডিভোর্স দেয় সুমা। সেদিন রাতেও ফোন দিয়ে অনেক বুঝিয়েছিলো নীলিমা। কিন্তু সুমা বুঝে নি। কেন বুঝেনি এসব সুমা নীলিমার কাছ থেকে লুকিয়েছে।
তাই নীলিমার কথা না শুনেই ফোন কেটে দিয়েছিলো।
রিফাতের সাথে কেন এমন করলি তুই? তুই না রিফাতকে খুব ভালোবাসতি। এই ছিলো রিফাতের প্রতি তোর ভালোবাসা।
নীলিমার কথা শুনে সুমা কান্না করে দেয়।
আর বলে।
প্লিজ তুই ফোন কাটবি না, আমার সব কথা শুনবি প্লিজ?
হুম বল,
আমি ইচ্ছা করে রিফাতকে ডিভোর্স দেইনি। আমাকে জোর করা হয়েছে, আমার মাথায় বন্দুক ধরে রাখছিলো রিফাতের বাবা। বল আমি কেন রিফাতকে ডিভোর্স দিবো? আমি যে রিফাতকে খুব ভালোবাসি।
কথা গুলো বলে কান্নার গতি বাড়িয়ে দেয় সুমা।
কান্না না করে সব বল আমায়?
সুমার এভাবে কান্না দেখে নীলিমার সব এয়াগ হাওয়ার সাথে মিশে যায়। নিজের আপন খালাতো বোন। কান্না শুনলে কষ্ট তো হবেই। তাই সুমাকে কান্না করতে মানা করে নীলিমা।
সুমা বলতে শুরু করে।
রিফাতের যদি হাত পা’ও না থাকতো তারপরেও আমি রিফাতকে ছাড়ার কথা ভাবতেই পারতাম না। কিন্তু সেই আমিই রিফাত বাবা হতে পারবে না বলে, এই কারণে রিফাতকে ডিভোর্স দিয়ে দিলাম স্বার্থপর এর মতো।
কথাটা বলে থামে সুমা।
আছিস লাইনে? নীলিমাকে প্রশ্নটা করে সুমা। কারণ নীলিমার কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলো না।
হুম আছি৷ তুই বলতে থাক আমি সব শুনতেছি।
নীলিমার কথা শুনে আবারো সুমা বলতে শুরু করে।
সবাই ভাবছে আমি স্বার্থপর। রিফাত আমায় বাচ্চা দিতে পারবেনা বলে আমি রিফাতকে ডিভোর্স দিয়েছি। কিন্তু রিফাতকে ডিভোর্স দেওয়ার আড়ালে লোকায়তি ঘটনা গুলো কেউ শুনতে চায় নি৷ সবাই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে আমায়।
রিফাতের বাবা চাচা আর রিফাতের ছোট ভাই আমায় জোর করেছে রিফাতকে ডিভোর্স দিতে।
কিহ? সুমার কথা শুনে নীলিমা খুব অবাক হয়।
সুমার কথা শুনে মনে হচ্ছে নীলিমা সূর্য আর চাঁদকে এক সাথে দেখতেছে।
অবাক হচ্ছিস তাই না? সব শুনলে আরো অবাক হবি। নীলার এমন অবাক হওয়া দেখে সুমা কথাটা বলে।
হুম, তারপর বল
আমার মা বাবাও আমায় জোর করেছে রিফাতকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্যে।
কথাটা বলে কেঁদে দেয় সুমা।
যে বাবা মা রিফাতকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতো। সেই তারাই আমায় জোর করেছে রিফাতকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য।
সুমা কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না।
সুমার মুখে এমন কথা শুনে খুব অবাক হয় নীলিমা।
খালা খালু কেন জোর করলো তোকে?
টাকার জন্য। সুমা কথটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়।
মানে?
রিফাতের বাবা না-কি অনেক বড় অংকের টাকা দিয়েছে। সেই টাকার লোভে পরেই আমার মা বাবা আমার জীবনটা শেষ করে দিলো।
সুমার কান্না বেড়েই যাচ্ছে।
খালা খালু টাকার জন্য এসব করলো? আর রিফাতের বাবাই বা কেন এসব করলো? খুব চিন্তিত হতেই বললো নীলিমা।
আল্লাহ জানেন, নিজের ছেলের সাথে কেন এমন খারাপ কাজ করলো। সুমার কথা শুনে নীলিমা চুপ থাকে।
সুমা আবারও বলে।
রিফাত কেমন আছে রে? ওর ফোন বন্ধ। আমি রিফাতকে ছাড়া বাঁচবো না রে।
ডিভোর্স দেওয়ার আগে মনে ছিলো না এসব?
সব শুনেও তুই এসব? নীলিমার প্রশ্নটা শুনে সুমা কান্না করে কথাটা বলে।
ন্যাকা কান্না করবি না। তুই ছাইলে রিফাতকে সব লুকিয়েও বলতে পারতি। তুই রিফাতকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারতি। তুই আমায় কাক দেখিয়ে কোকিলের গল্প শোনাচ্ছিস।
বুঝেছিস তোর এসব কথা আমি বিশ্বাস করবো।
আসলে কী জানিস?
কী?
রিফাত তোকে বাচ্চা দিতে পারবে না। আর তুই মা ডাক শুনতে পারবি না। এই জন্যেই রিফাতকে ডিভোর্স দিয়েছিস। আর আমাকে যা বলছিস, এসব তোর সাজানো গল্প।
কীভাবে বললে তুই বিশ্বাস করবি?
নীলিমার এমন কথা শুনে সুমার কান্না আর কষ্টটা আরো বেশিই বেড়ে যায়। নীলিমাই ছিলো সুমার শেষ ভরসা। কিন্তু নীলিমাও সব অবিশ্বাস করলো।
আমার আর বুঝতে হবে না, রিফাতকে সত্যিই যদি ভালোবাসতি তাহলে কখনো ডিভোর্স দিতি না। রাখছি ফোন, বায়।
কথাটা৷ অলেই ফোন কেটে দেয় নীলিমা।
নীলিমার কাছে সুমার কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিকারের ভালোবাসায় কখনো বিচ্ছেদ শব্দটা থাকে না।
সুমা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে কান্না করছে। কেউ কী তার কথা বিশ্বাস করবে না? সবাই কী তাকে এভাবেই অবিশ্বাস করে যাবে?
রাত ১০টা, মিনার একটি মেয়েকে সাথে নিয়ে হোটেলে রাত্রি কাটাতে যাচ্ছে। মিনারের সাথে থাকা মেয়েটা মিনারের প্রেমিকা না। মেয়েটা টাকার জন্য নিজের দেহ বিক্রি করে।
রিফাতের ৭ বছরের ছোট মিনার। কিন্তু রিফাতের মতো ভালো ছেলে না মিনার। মিনার সারাক্ষণ খারাপ কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে।
মেয়েটাকে নিজের মতো করে ব্যবহার করছে মিনার। এই ২১ বছর বয়সেই এতো খারাপ সে। এই নিয়ে ২৯ নাম্বার মেয়ের সাথে রাত কাটাচ্ছে মিনার। মিনারের এমন খারাপ কাজের কথা ওর পরিবার বা ওর প্রেমিকা অনন্যাও জানে না।
মিনারের ন্যাকা হয়ে সেঁজে থাকা দেখেই প্রেমে পড়েছে অনন্যা।
অনন্যার সামনে মিনার আলিফ এর মতো সোজা হয়ে থাকে।
অনন্যাও খুব বিশ্বাস করে মিনারকে।
মিনার অনন্যার কথাও ভাবে না। ভাবেনা মিনার অনন্যা এসব শুনলে কতোটা কষ্ট পাবে।
মিনার উলঙ্গ অবস্থায় মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরলো।
সকালেই এই পাপী শরীর নিয়ে বাসায় যাবে সে।
বাসায় বলে দিয়েছে, সে তার বন্ধুর বাসায় আছে। ওরাও সেটা বিশ্বাস করে বসে আছেন।
রিফাত আজ দুইমাস ধরে ইন্ডিয়া আছে৷ ভালোই কাটছে তার দিন গুলো। রাতেই শুধু কষ্টটা বেড়ে যায়। চোখে শুধু সুমার চেহারাই ফুটে উঠে।
রিফাত বাবুই পাখির মতো ঘর বাঁধবে। তবে বাবুই পাখি যেভাবে দু’জন মিলে কষ্ট সুখ সব কিছু ভাগাভাগি করে নেয়। রিফাত তেমন কিছুই করবে না। রিফাত ঘর সাজাবে একা। যেখানে শুধু সে থাকবে। সঙ্গী হবে না কেউ। আসলে সে তার অন্ধকার জীবনে কাউকে জড়াতে চায় না।
রিফাত খুব মন দিয়ে নিজের কাজ গুলো করে।
১ম মাসেই অফিসের সবার মন জয় করে নেয়। রিফাত এর পারিশ্রমিক ৪৫হাজার টাকা।
রিফাত তার প্রথম বেতন এনে রুহির মাবাবার কাছে দেয়।
নিজের কাছে এক আনাও রাখেনি।
রুহির মাবাবা রিফাতের এমন কাণ্ড দেখে খুব অবাক হন। ওরা টাকা নিতে চাননি। রিফাত জোর করে সব টাকা ওদের হাতে ধরিয়ে দেয়।এই কাজ দেখে রুহি সহ রুহির মাবাবার খুব ভালো লাগে রিফাতকে।
রুহির বাবা রিফাতকে ১৫হাজার টাকা দিয়ে বলছিলেন।
তুমি আমাদের এভাবে সব টাকা দিয়ো না। নিজের কাছে ১৫হাজার রেখে বাকি গুলো আমাদের দিয়ো। রিফাতও আর কিছু বলেনি।
রিফাত নিজের মা বাবাকে দেখতে অয়ায় রুহির মা বাবার মধ্যে।
রুহি আর রিফাতের একটা ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। তবে নীলিমার মতো না।
অর্ণি মেয়েটাও সারাক্ষণ রিফাতের আশেপাশে থাকে। রিফাত যতোটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখে অর্ণির কাছ থেকে।
আজ রবিবার, রিফাতের অফিস আজ বন্ধ। তাই আজ সে রুহিকে নিয়ে কলকাতা শহর ঘুরে দেখবে। সকাল থেকেই রুহি তৈরি হচ্ছে। রিফাত এখনো ঘুমিয়ে আছে। আর এই দিকে রুহি এখনই তৈরি হতে ব্যস্ত।
রিফাত ঘুম থেকে উঠেই গোসল করে নেয়। সকালের নাশতা করে সেও তৈরি হয়ে নেয়।
রিফাত আর রুহি টেক্সিতে বসে আছে৷ রুহি রিফাতের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে বারবার। রিফাত চোখ দু’টো বন্ধ করে বসে আছে। এই সুযোগে ভালোভাবে রিফাতকে দেখে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে রুহি। রিফাতের চুলগুলো বারবার কপাল পড়ছে। রুহি ইচ্ছা করেই রিফাতের কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।
এই দিকে চোখ বন্ধ করে থাকলেও রিফাত ঘুমায় নি। রিফাত ঠিক বুঝতে পারছে, রুহি তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুহি সুমার চেয়ে দেখতে অনেক সুন্দর। রুহির রূপে রক অন্যরকম মুগ্ধতা আছে। রিফাত রুহির রূপ, কথা বলার ধরণ সব কিছু নিয়েই পিএইচডি করে ফেলছে এই কয়দিনে। কিন্তু এসব রুহির অজানা।
রিফাত আর রুহি দু’জন মিলে অনেক মজা করলো। অনেক জায়গায় ঘুরাঘুরি করলো। নানান ধরণের খাবার খেলো।
দু’জন খুব ক্লান্ত হয়ে বাসায় আসলো।
রুহি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে আছে নিজের রুমে।
রুহি একটা জিনিস ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। সেটা হলো, সে রিফাতকে ভালোবেসে ফেলছে।
কিন্তু রিফাত এর পার্সোনাল জিনিস গুলো সম্পর্কে রুহি এখনো কিছুই জানে না। সেদিন গাড়িতে যা জেনেছিলো, সেটুকুই।
অনেকবার জানতে চেয়েছে। কিন্তু রিফাতকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পায় নি৷
রুহি ভাবছে তার মনের কথা গুলো রিফাতকে বলে দিবে।
কাউকে ভালোবাসলে, ভালোবাসার কথাটা সেই মানুষকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। নইলে নিজের ভালোবাসা হেরে যায়। তুমি যাকে ভালোবাসো, তার মধ্যেও তোমার জন্য অনুভূতি সৃষ্টি করো।
নইলে সেই ভালোবাসা কখনো পূর্ণতা পাবে না।
পর্ব ৮
রিফাত আজ খুব রেগেই অফিস থেকে আসে। প্রতিদিনের ন্যায় আজ সিয়ামের সাথে কথা বা মজা কোনোটাই করেনি রিফাত। এই পাঁচ মাস ধরে প্রতিদিন বাসায় এসে প্রথমে সিয়ামের সাথে কিছুক্ষণ মজা করে নিজের রুমে যেতো রিফাত।
ঠিক এভাবেই অফিস থেকে এসে নিজের বোন মাহির সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিতো রিফাত। তাই অভ্যাস হয়ে গেছিলো। এইজন্যেই সিয়ামের সাথেও সেই অভ্যাসটা স্থায়ী করে রেখেছিলো।
কিন্তু আজ কিছুই করে নি।
এই বিষয়টা রুহি খেয়াল করে।
রুহির বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, আজ রিফাতের কিছু একটা হয়েছে। তাই মন খারাপ হয়তো!
রুহি অনেকবার অনেক ভাবে চেষ্টা করেছে বা বুঝাতে চেয়েছে নিজের মনের কথা গুলো রিফাতকে। কিন্তু রিফাত কিছুই বুঝতেছে না। তাইতো বারবার রিফাতকে ভালোবাসি বলতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে।
রিফাতকে ভালোবেসে রুহি কী কোনো বোকামি করেছে? রিফাতের কথা কারো কাছেই শেয়ার করতে পারছে না। রিফাতের কিছু কিছু অতীত জেনেও তাকে ভালোবাসা, এসব কী বোকামি? এই উত্তর গুলো রুহির অজানা।
রিফাত বিছানায় দু’চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আর আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভাবছে। রিফাতের বারবার রাগ হচ্ছে ওই মেয়ের উপর।
রুহি চা’য়ের কাপ হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে। রিফাতকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে রুহি চলে যেতে নিলে। আবারো পিছন ফিরে তাকায়।
রিফাত শুয়ে থাকলেও নিজের পা দুটি নাড়াচ্ছে। এটা দেখে রুহি বুঝতে পারে রিফাত জেগে আছে।
সে-ই যে এসে রুমে ঢুকলে আর বের হলে না?
রুহির কথায় রিফাত চুপ হয়ে আছে।
কোনো কথা বলছে না। রুহি ভাবলো রিফাত হয়তো সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু রিফাতের পা’য়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো রুহি।
রিফাত এখন আর পা নাড়াচ্ছে না। তার মানে রিফাত জেগে আছে, রুহির কথা শুনে পা নাড়ানো বন্ধ করেছে। রুহি মুচকি হাসে রিফাতের এমন কাণ্ড দেখে। তাই আবার বলল।
মন খারাপ?
রুহির প্রশ্ন শুনে রিফাত আবারো চুপ থাকলো। রিফাতকে চুপ থাকতে দেখে রুহি আবার বললো।
আমি জানি তুমি জেগে আছো। কারণ তুমি আমার কণ্ঠ শুনেই পা নাড়ানো বন্ধ করেছো। তুমি ঘুমিয়ে থাকলে পা স্বাভাবিক ভাবে নাড়িয়েই যেতে।
কথাটা বলে রুহি রিফাতের পাশে বসে।
মন খারাপ হলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো? নিজের মধ্যে চাপা রাখলে একটু বেশিই কষ্ট পাবে।
রুহির কথা শুনে রিফাত এবার চোখ খুলে। রিফাত শুয়া থেকে উঠে বসলো।
কী হয়েছে? আজ এভাবে নীরবতাকে আপন করে রেখেছো কেন?
রিফাতকে উঠে বসতে দেখে আবারো প্রশ্ন করে রুহি।
অফিসের এক মেয়ে না-কি আমায় ভালোবাসে! রিফাত কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়।
রিফাতের মুখে এমন কথা শুনে রুহি নির্বাক হয়ে যায়। সাথে সাথেই রুহির ভিতরটা কেঁদে উঠে। সে কী রিফাতকে হারিয়ে ফেলবে! তার ভালোবাসার কথা কী না বলাই থেকে যাবে।
তবুও রুহি মুখে হাসির রেখা রেখে বললো।
তাই বলে মন খারাপ!
না, মেয়েটা খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলো।
মানে?
মেয়েটা আমায় প্রপোজ করে৷ আমি সরাসরি না করে দেই। তখন মেয়েটা বলে ওর সাথে একান্ত সময় কাটাতে।
রিফাতের কথা শুনে রুহির মন থেকে ভয়টা উড়ে যায়।
থাপ্পড় দিতে পারো নি ওই মেয়েকে?
রুহির কথায় রিফাত রুহির দিকে তাকায়। রিফাতের তাকানো দেখে রুহি মাথা নিচু করে নেয়।
মেয়েদের গায়ে যদি হাত তুলতে পারতাম, তাহলে আজ আমায় ইন্ডিয়াতে আসতে হতো না। করতে হতো না নিজের জন্মভূমি ত্যাগ।
রিফাত কথাটা বলে নিজের চোখে আসা পানি মুছে।
স্যরি! আসলে আমি মজা করছিলাম। রিফাতের চোখে পানি দেখে রুহি কথাটা বলে।
জানো, মানুষের জীবনে কিছুটা মুহূর্ত আছে যা কখনো চাইলেও ভুলে থাকা যায় না। সেই মুহূর্ত গুলোই একটা মানুষকে কাঁদাতে যথেষ্ট।
রুহি বুঝতে পারে রিফাতের খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই কথা ঘোরানোর জন্য বলল।
এই দেখো তোমার জন্য চা নিয়ে আসছিলাম, মনে হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তুমি বসো, আমি আবার চা গরম করে নিয়ে আসি।
কথাটা বলেই রুহি চলে যায়।
রুহির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রিফাত মুচকি হাসলো।
রুহি হাতে করে দুইটি চা’য়ের কাপ নিয়ে আসে৷ আজকেই সুযোগ রিফাতের সব শোনার।
রিফাতের হাতে একটা চা’য়ের কাপ দিলো রুহি।
দু’জনেই নীরবে চা খাচ্ছে।
রিফাত চা’য়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে।
জানো রুহি! কিছু মানুষ ‘শরতের শিশির’ হয়ে আসে জীবনে শুধুই কাঁদানোর জন্য।
রিফাতের কথার অর্থ বুঝতে পারে রুহি। রুহি মনে মনে হাসে, “ময়ূর আজ নিজ থেকেই নাচবে”
রুহি রিফাতের কথায় ‘হুম’ বলে।
রিফাত আবারো বলে, আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি তোমায়?
হুম করো?
যাকে ভালোবাসবে, তাকে কী কখনো ছেড়ে যাবে?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে রুহি মনে মনে বলে, আমি তোমাকেই ভালোবাসি।
রুহিকে চুপ থাকতে দেখে রিফাত আবারো বলে৷
কিছু তো বলো?
আমি যাকে ভালোবাসবো, তাকে কখনো ছেড়ে যাবো না। হাজারো কষ্ট হলেও সেই মানুষটির হাত ধরে রাখবো। নিজের ভালোবাসার পরশে তাকে গেঁথে রাখবো এই মনে।
মুচকি হাসে রুহি কথা গুলো বলে, রুহির কথা শুনে রিফাত কান্না মাখা চেহারায় মুচকি হাসে।
তার কপাল’ই শুধু খারাপ।
প্রতিটা মেয়েই নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন দেখে, আর আমার ভালোবাসার মানুষ আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলো, “ছেড়ে যাওয়ার”
রিফাত কথা গুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস নেয়, রিফাতের প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসেই সুমার প্রতি ঘৃণা জন্মে।
আমি কী তোমার পরিবারের সবার পিক দেখতে পারি?
রুহি কথাটা বলার সময় একটু ভয় পায়।
স্বার্থপর মানুষগুলোর পিক দেখে কী করবে?
রিফাতের প্রশ্নটা শুনে রুহি কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না।
রিফাত রুহির দিকে তাকিয়ে দেখে রুহি মন খারাপ করে আছে। রুহিকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে রিফাত বলে।
আমি তোমায় তিনজন ভালো মানুষের পিক দেখাতে পারি। যারা কখনো স্বার্থপর ছিলো না। আর কখনো স্বার্থপর হবেও না।
ওই তিনজন নীল আকাশের চেয়েও ভালো। নীল আকাশ যেমন ঘনঘন রঙ বদলায়। কখনো মেঘলা আবার কখনো নীল হয়ে মানুষের মনে ভালোলাগা অনুভূতি জন্মায়।
ওরা তিনজন এমন না। ওরা কখনো রঙ বদলায় না। আবার মানুষের মনে নতুন নতুন অনুভূতির সৃষ্টি করে না।
ওদের প্রতি অনুভূতি সাগরের পানির মতোই স্থায়ী হয়ে থাকে।
কথা গুলো বলে থামে রিফাত। কথাগুলো বলার সময় যদিও রিফাতের মুখে হাসির রেখা ছিলো। কিন্তু চোখে ছিলো কষ্টের চাহনি, যে চাহনিতে শুধুই প্রিয়জনদের না দেখার তৃষ্ণা।
হুম দেখি সেই তিনজন মানুষের পিক।
রিফাতের কথা শুনে রুহির অনেক আগ্রহ জন্মে ওই তিনজনকে দেখার।
রিফাত নিজের ফোন বের করে প্রথমে নিজের মা’য়ের ছবি দেখায়।
আর বলে,
পৃথিবীর বুকে থাকা আমার প্রথম ভালোবাসা। এই হলো আমার মা, খুব ভালোবাসি আমার মা’কে। কিন্তু আজ আমি আমার মা’য়ের কাছ থেকে অনেকটা দূরে।
রিফাত নিজের চোখের পানি মুছে, পরের জনকে দেখায়।
সে আর কেউ না, সে হলো নীলিমা।
জানো রুহি! অনেকেই বলে একজন ছেলে একজন মেয়ের ভালো বন্ধু হতে পারে না। কিন্তু নীলিমা মিথ্যে করে দিয়েছে সেসব কথা, প্রমাণ করে দিয়েছে ছেলে মেয়েও ভালো বন্ধু হতে পারে।
তারপর রিফাত নিজের বোন মাহির পিকটা দেখায়।
এই দেখো আমার আরেকটা ভালোবাসা। যদি কখনো বলা হয় আমার দুটো কিডনি লাগবে, দুটো কিডনি না হলে আমি মারা যাবো। তাহলে মাহি তার দুটো কিডনিই দিয়ে দিবে।
খুব ভালোবাসে আমায়।
কথা গুলো বলে রিফাত কান্না করে দেয়। কিছু ব্যথার জন্য আজ সে ওদের চেয়ে অনেক দূরে। চাইলেও নিজের মা’কে মা বলে ডাকতে পারছে না। পারছে না নিজের পিচ্চি বোনটাকে একবার জড়িয়ে ধরতে।
রুহি তিনজনের পিক খুব মন দিয়েই দেখে।
সত্যিই ওদের প্রতি অনুভুতি নতুন ভাবে সৃষ্টি হয় না, মনে হয় অনেক পূর্বেই অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিলো ওদের প্রতি।
রিফাতের কান্না দেখে রুহি রিফাতের হাতে হাত রাখে। রুহির শরীর কেঁপে উঠে। এই প্রথম রুহি কোনো পুরুষের হাতে হাত রাখলো।
রুহির হাতের ছোঁয়া পেয়ে রিফাত একটু অবাক হয় আর রুহির দিকে তাকায়।
রুহি বলে,
কেন এতো কষ্ট পাচ্ছো, যাওনা ফিরে নিজের জন্মভূমিতে। কেন সবার থেকে দূরে এসেছো। আর নিজেকে এতোটা কষ্ট দিচ্ছো?
রুহির প্রশ্ন শুনে রিফাত মুচকি হাসে। আর বলে,
যেখানে সবাই স্বার্থপর সেখানে কীভাবেই যাই বলো?
ওই তিনজনের জন্যেও তো যেতে পারো?
রুহির প্রশ্নে রিফাত কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলে।
আল্লাহ চাইলে অবশ্যই একদিন যাবো। তবে তা একটু দেরীতেই।
রুহি আর কিছু বললো না।
আচ্ছা আমায় আরো একজনের পিক দেখাবে? খুব ইচ্ছা জেগেছে তাকে দেখার। প্লিজ প্লিজ!
রুহির এমন আদুরী গলায় বলা দেখে রিফাত কোনো কথা না বলেই সুমার পিকটা বের করে রুহির সামনে ধরে।
রুহি পিকের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সত্যিই খুব মিষ্টি মেয়ে, রুহি নিজের অজান্তেই মাশা’আল্লাহ বলে ফেলে। রুহির মুখে মাশা’আল্লাহ শুব্দটা শুনে রিফাত মুচকি হাসে, আর ফোনটা নিজের বালিশের পাশে রাখে,
রুহির চোখে সুমার চেহারাটাই বাসছে। সত্যিই একটা ছেলেকে প্রেমে পাগল করার মতো চেহারা।
আর কোনো ইচ্ছা আছে তোমার? থাকলে বলো, আজ সব ইচ্ছা পূরণ করবো।
রুহির দিকে তাকিয়ে বলে রিফাত।
রিফাতের কথা শুনে রুহি খুব খুশী হয়।
না করবে না তো?
বললাম তো, আজ সব ইচ্ছা পূরণ করবো।
রুহি ছোট একটা বাক্য বলে।
“আমি তোমার অতীত শুনবো” আজকের দিনের এটাই আমার চাওয়া।
রুহির কথা শুনে রিফাত অবাক হয়ে যায়। রুহি জানে রিফাত তার অতীত বলতে গেলেই কান্না করবে। তারপরেও কেন রুহি এমন আবদার করলো।
রিফাত তাই একটু বেশিই অবাক হয়েছে।
রিফাত কিছু একটা বলতে গেলেই রুহি বলে।
তুমি কিন্তু বলেছো আমার সব ইচ্ছা পূরণ করবে আজ।
রুহির কথা শুনে রিফাত বলে,
যাও আমার জন্য আরো এক কাপ চা নিয়ে আসো। চা খেয়ে খেয়েই বলি আমার ঘাতক অতীতের কথা।
রুহি রিফাতের কথা শুনে চা তৈরি করার জন্য রান্না ঘরে যায়।
রিফাত আবারো দীর্ঘশ্বাস নেয়, আজ রাতটাই কান্না করে কাটাতে হবে তাকে।
পর্ব ৯
আমার আর সুমার প্রেম এর সম্পর্ক মাত্র ৩ মাসের ছিলো। নীলিমার খালাতো বোন সুমা। সেই সুবাদেই আমার আর সুমার একটা ভালবাসার সম্পর্ক হয়। তারপরেই বিয়ে।
সুমা আমার জীবনে না আসলে বুঝতেই পারতাম না একটা মানুষ অন্য একটা মানুষকে কতোটা ভালোবাসতে পারে।
কথাটা বলে চা’য়ের কাপে চুমুক দেয় রিফাত। এইদিকে রুহির আগ্রহ বেড়েই যাচ্ছে। রিফাতকে খুব আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করে রুহি।
তারপর?
বিয়ের প্রথম রাতেই সুমা আমার কাছে কয়েকটা জিনিস আর কয়েকটা মূহুর্ত চেয়েছিলো। বলেছিলো, এইগুলো পূরণ করতেই হবে।
সুমা যে জিনিস গুলো চেয়েছিলো সেগুলো ছিলো;
কালো দুটো শাড়ি, ‘ওর না-কি স্বপ্ন ছিলো ‘ বাসর রাতে নিজের স্বামীর কাছে কালো শাড়ি চাইবে।
আরো কিছু পছন্দের জিনিস চেয়েছিলো।
আর মূহুর্ত গুলো ছিলো।
ওরে প্রতি রাত স্পর্শ করার আগে, কম পক্ষে ৩০ মিনিট হলেও দুজন গল্প করবো, দিন রাত মিলে কে কী করেছি। মাঝেমধ্যে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া। ওর চাওয়া মূহুর্ত গুলো ছিলো অন্য মেয়েদের দিক দিয়ে আলাদা।
জানো? আমি ওর সব চাওয়াই পূরণ করেছি। শুধু মা ডাক শুনাতে পারিনি।
এই চাওয়াটা ছাড়া সুমার কোনো চাওয়াই অপূর্ণ থাকে নি।
রিফাতের চোখে আসা পানি গুলো গাল বেয়ে পরলো।
রুহির খারাপ লাগছে রিফাতের চোখের পানি। তবুও জিজ্ঞাস করলো রুহি।
তারপর?
সুমা আর আমি দুজন মিলে খুব ভালোই চলছিলো।
আমাদের মধ্যে ঝগড়া কখনো হয়নি।
আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি আমার আর ওর বিয়ের তিন বছর সম্পর্কে ঝগড়া শব্দটা আসতেই পারেনি। কারণ আমার আর ওর সম্পর্কে ঝগড়ার রাস্তা তৈরি হয় নি। আর আমরাও তৈরি করিনি।
খুব সুখেই ছিলাম দু’জন।
কিন্তু,
কিন্তু শব্দটা বলে রিফাত থামে। আবারো নিজের চোখের পানি মুছে।
কিন্তু কী?
আমাদের সুখের সংসারে হঠাৎ করেই কালো মেঘ এসে রাজত্ব বাঁধলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যেন সব হয়ে গেলো।
বিয়ের দুইদিন পরেই আম্মু বলেছিলেন;
রিফাত বাবা বউমা তো এনে দিলাম, এবার একটা ছোট্ট খেলার সাথী এনে দিবি আমায়!
সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।
১বছর গেলো ২বছর গেলো, এবং কি বিয়ে ৩বছর গিয়ে ১ মাস হলো। আমার আর সুমার কোনো বাচ্চা হলো না। আম্মু বলতেন, বাবা মন খারাপ করিস না কিছু কিছু স্বামী-স্ত্রীর একটু দেরীতেই বাচ্চা হয়।
কিন্তু আমার বাবা-চাচা এরা এসব মানতে নারাজ।
আমায় আর সুমাকে ডক্টর এর দেখাতে বলে আমার পরিবার।
বাধ্য হয়েই ডক্টর দেখাতে যাই আমরা।
আমার আর সুমা দুজনেরি পরীক্ষা করে ডক্টর ফাহাদ।
ডক্টর ফাহাদ বাবার বন্ধুর ছেলে। উনি বললেন; কাল সকালে এসে রিপোর্ট নিতে।
কিন্তু কে জানতো কাল সকালটাই আমার জন্য কালসাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
সকালে আমি একাই যাই ডক্টর ফাহাদের কাছে। ডক্টর ফাহাদ রিপোর্ট হাতে দিয়ে বললো;
তোমার স্ত্রীর কোনো সমস্যা নেই। তুমি বাবা হতে পারবে না।
আমি বাবা হতে পারবো না শব্দটা শুনে মাথা ঘেরাচ্ছিল।
সব কিছু কেমন জানি আন্ধার দেখছিলাম। কখনো বাবা ডাক শুনতে পারবো না। আরো অনেক কিছু মাথায় চলছিলো।
গাড়ি ড্রাইভ করার সময়ও মাথায় ফাহাদের বলা কথা গুলো কানে বাসছিল।
রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে ঢুকতেই সবাইকে ড্রয়িং রুমে দেখতে পাই।
বাবা আমার আর সুমার রিপোর্ট দেখে মুচকি হাসলেন। সেই সময় বাবার হাসির কোনো অর্থ খুঁজে পাইনি আমি!
রিফাত কথার মধ্যে থামে, আর বলে।
আমি ওয়াশরুম থেকে আসি।
কথাটা বলেই রিফাত ওয়াশরুমে ঢুকে।
রুহি বুঝতে পারে রিফাত ওয়াশরুমে গিয়ে কান্না করবে,
পাঁচ মিনিট পর রিফাত ওয়াশরুম থেকে বের হয়।
রুহির পাশে এসে বসে।
রুহি বললো;
তারপর?
সেদিন রাতটাও খুব ভালো যায়।
সারারাত সুমা আমার বুকে শুয়ে ছিলো। সুমা বলছিলো,
আমার বাচ্চা লাগবেনা। তুমি থাকলেই হবে।
অনেকেরই তো বাচ্চা নাই, তাই বলে কী এভাবে মন খারাপ করে!
সুমা আমার বুকে শুয়ে শুয়ে এভাবেই বুঝাচ্ছিলো।
আমি মনে মনে আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। সুমাকে আমার জীবন সঙ্গী করার জন্য।
রাতটা ভালো গেলেও দিনটা আমার জন্য একবারেই ভালো ছিলো না।
সকালের নাশতা শেষ করে যখন অফিসে যেতে তৈরি হই। রাস্তায় বের হওয়ার পর কিছু মানুষ বলতে শুরু করে এই দেখো রিফাত যাচ্ছে, যে কিনা কখনো বাবা হতে পারবে না। এরকম নানান ভাবে খারাপ কথা বলতে থাকে লোকে।
আমি খুব অবাক হই। ঘরের খবর মানুষ জানলো কীভাবে। তখন শুধু চোখ থেকে পানি পরছিলো।
অফিস থেকে বাসায় আসার পর দেখি। আম্মুর সাথে বাবা ঝগড়া করছে। আমায় দেখে ওরা নীরব হয়ে যায়।
এভাবে দুইদিন যায়।
তিনদিনের দিন হঠাৎ বাবা ছোট ভাই আর চাচার ব্যবহারে আমি খুব কষ্ট পাই। নাশতা খাইতে গেলেও আমার বাবা হওয়া নিয়ে কথা, হেন তেন হব কিছুতেই বাবা হওয়ার কারণ দেখিয়ে আমায় অপমান করতো ওরা।
বাহিরে লোকেরা আর বাসায় ওরা।
প্রতিটা রাতেই সুমা আমায় বুঝাতো। কিন্তু বুকে আর মাথা রাখতো না। সুমাকেও কেমন জানি অগোছালো মনে হচ্ছিলো আমার প্রতি।
আম্মু আমায় বলতেন, লোকের কথায় যেন কান না দেই, কিন্তু আম্মু আর সুমাকে দেখলে মনে হতো আমার কাছ থেকে কিছু লোকাচ্ছেন।
হঠাৎ অফিসে থাকা অবস্থায় সুমা ফোন দেয়, বলে এক জায়গায় যাবে আনায় নিয়ে। আমি ওর সাথে গিয়ে দেখি উকিলের নিয়ে গেছে আমায়।
বিষয় ছিলো ডিভোর্স।
সত্যি সেই মূহুর্তে আমি এতোটা অবাক হয়েছিলাম যেটা বলার বাহিরে।
সুমা সেই দিন থেকে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। উকিল ৬মাসের টাইম দিলে, সুমা সেটা ১১দিন এর ভিতর করে। ডিভোর্স এর ১১ দিন আগ থেকেই সুমা অন্য রুমে থাকা শুরু করে। আম্মু আর মাহি ছাড়া আমার সাথে কেউ ভালো ব্যবহার করতো না।
সুমা আমায় অনেক ভাবে অপমান করতো। সুমার সাথে কথা বলতে চাইতাম, কিন্তু সুমা আমার সাথে কথা বলতো না।
নীলিমা সুমাকে অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু সুমা বুঝেনি।
যার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নাই, তার সাথে সংসার করে নাকি ওর লাভ নাই।
আমি সুমার এই রূপ দেখে খুব অবাক হতাম। এ কোন সুমা, যাকে আমি চিনতে পারছি না।
সুমার হঠাৎ পালটে যাওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। আম্মু কিছু বলতেন না, শুধু অবাক হয়ে দেখতেন। আম্মুও হয়তো সুমার এমন রূপ আশা করেন নি।
যেদিন আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করি, সেদিন সকালেও আমি সুমার সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সুমার এমন আচরণ আমায় খুব কষ্ট দিতো। ভাবতেই পারিনি সুমা আমার সাথে এসব করবে।
ডিভোর্স এর দিনেই সুমা ওর বাবার বাসায় চলে যায়। তারপর শুরু হয় আবারো আমায় অপমান করা। বাবা হয়ে কীভাবে নিজের সন্তানকে এতো খারাপ কথা এতো অপমান করতে পারে, সেটা আমার বাবাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
d
এসব সহ্য করতে না পেরেই বাধ্য হয়েই দেশ ত্যাগ করি।
জানো বাসা থেকে আসার সময় আম্মু আর মাহি ঘুমিয়ে ছিলো। খুব সকালেই নিজের সব কিছু নিয়ে চলে আসছিলাম।
কথা গুলো বলে থামে রিফাত। রুহি রিফাতের মুখে সব শুনে কবে যে নিজের চোখে পানি আসছে, খেয়াল করেনি রুহি।
রুহি সুমার সম্পর্কে প্রথমে শুনে খুব হিংসে হচ্ছিলো, কেন রিফাতকে এতোটা ভালবাসবে। কিন্তু শেষের সব কথা শুনে খুব রাগ হচ্ছে রুহির। মন চাচ্ছে এখনি সুমাকে মেরে ফেলতে।
রুহি বুঝে উঠতে পারছে না! সুমা কেনই বা হঠাৎ পালটে গেলো। আর রিফাতের বাবা বা ওরাই বা কেন রিফাতের বাবা হতে পারবে না নিয়ে এতো মাথা ব্যথা, আর রিফাতকে কেনোই বা এতো অপমান করলো? আর বাহিরের মানুষ এসব জানলো কীভাবে?
সব প্রশ্ন রুহির মাথায় ঘুরছে, নিশ্চয় এখানে কোনো রহস্য আছে। কিন্তু কী রহস্য?
রুহি এসব না ভেবে আবারো প্রশ্ন করে;
এতো দেশ থাকতে ইন্ডিয়াতে আসার কারণ কী?
রুহির প্রশ্নে রিফাত কান্না মাখা মুখেও হেসে দেয় আর বলে।
সুমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, সুমাকে নিয়ে কাশ্মীর আসার কথা ছিলো। সব সময় ভাবতাম, সুমা যখন শুনবে ওরে নিয়ে আমি কাশ্মীর ঘুরতে যাবো, তখন কতোই না খুশী হবে!
কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল, স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো।
মাথায় কাজ করছিলো না আমার৷ যেহেতু ইন্ডিয়ার ভিসা ছিলো। তাই ইন্ডিয়াতেই চলে আসি। কাশ্মীর না গিয়ে কলকাতায় আসি। কারণ এখানে আমার মতোই সবাই বাঙালি।
রিফাতের মুখে ওর সব অতীত শুনে এখনো রুহি কষ্ট পাচ্ছে।
সত্যিই মানুষের জীবন খুব কষ্টের।
রুহি নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। চোখের সামনে রিফাতের চেহারাই বাসছে।
রিফাত হয়তো নীরবে কান্না করছে।
রুহি কথাটা ভাবতেই শুয়া থেকে উঠে বসে।
রিফাতকে সে আর কান্না করতে দিবে না। সে রিফাতের কষ্টের ভাগ নিবে। রুহি তার মনের কথা রিফাতকে বলে দিবে। বাবা না হতে পারলে নাই।
ভালোবেসে বুকের মধ্যে রাখলেই হবে।
রিফাতের কষ্ট ভুলিয়ে দিবে নিজের ভালোবাসা দিয়ে।
রুহি মুচকি হাসে।
যেভাবেই হোক রিফাতকেও ভালোবাসতে বাধ্য করবে রুহি।
মেয়েয়েরা সব পারে, পারেনা শব্দটা মেয়েদের ডিকশনারীতে খুব কমই থাকে।
পর্ব ১০
ইন্ডিয়াতে বেশ ভালোই দিন কাটছিলো রিফাতের। এই দিকে নীলিমার কাছ থেকে নিজের পরিবারের সব খবরও নিচ্ছিলো। রিফাত নিজেকে সব সময় কাজের মধ্যেই ডুবিয়ে রাখতো। এতে একটু হলেও নিজের অতীতকে ভুলে থাকতে পারে সে।
“আকাশ আছে বলেই তো মেঘ, সূর্য, চাঁদ সব কিছুর অস্তিত্ব আছে”
ঠিক রিফাতেরও আকাশের মতো অবস্থা;
সারাক্ষণ আকাশে মেঘ জমে থাকার মতো অবস্থা তার। তার চাঁদটা তো সেই কবেই ঢেকেছে মেঘ। রাত হলেই রিফাত বৃষ্টি নামায়, যেই বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দেয় মাথার নিচে থাকা বালিশটাকে। প্রতিটা রাতেই রিফাত একটা অংক সমাধান করতে চায়, কিন্তু এখনো পারেনি সমাধান করতে। হয়তো পারবেও না সুমাকে নিয়ে সুমার এমন পালটে যাওয়া অংকের সমাধান করতে।
কোনো ভাবেই সুমাকে ভুলে থাকতে পারছে না রিফাত৷
এটাই কী তাহলে ভালোবাসার সংজ্ঞা;
–সম্পর্কে ভাঙন ধরলে, দু’জন আলাদা হলেও। প্রতিটা মুহূর্তে তাকে ভেবেই সময় কাটিয়ে দেওয়ার নাম-ই ভালোবাসা।
কারো প্রতি না-কি একবার ভালবাসা জন্মালে, ৫০ বছর কাটিয়ে দেওয়া যায় সেই ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়েই। আর বাকি বছর গুলো সেই ভালোবাসার মানুষের অনুপস্থিতিতে তাকেই কল্পনা করে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
সন্ধ্যার আকাশে চাঁদের দু’পাশে হাতে গোনা কয়েকটা তারা চোখে ভাসছে রিফাতের।
বাগানের এক পাশে খুব নীরবে বসে বসে চাঁদটার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে রিফাত। চাঁদটা আজ পরিপূর্ণ, তাইতো চাঁদটাকে আজ এতোটা সুন্দর লাগছে। কতোটা রাত এভাবে সুমাকে পাশে রেখে চাঁদ দেখেছে রিফাত তা খুব সহজেই গণনা করা যাবে। রিফাত মুচকি হেসে নিজের মাথায় নিজেই টোকা দিয়ে বললো। মাত্র কয়েক মিনিটের ভালোবাসায় ১ঘন্টা চাঁদ দেখাটা হয়তো বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। সুমার সাথে তার ভালোবাসার দিন গুলো সে ‘মিনিট’ এর সাথেই তুলনা করলো।
চাঁদের সৌন্দর্যে রিফাতের চোখে পানি এনেছে৷ আজ বলতে ইচ্ছে করছে তার, চাঁদ তুমিই বেশি সুন্দর অনেক বেশি সুন্দর। তোমাকে দেখে কেউ কখনো প্রতারিত হয়নি বা তোমার সৌন্দর্যের প্রেমে পরেও কেউ কষ্ট পায় নি। মানুষের মনে যদিও তুমি মানুষ অপেক্ষা অতি সুন্দর না, কিন্তু তুমি মানুষ অপেক্ষা খুব ভালো।
রিফাতের কাঁধে কেউ হাত রাখে, রিফাত চাঁদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিছনে তাকায়।
রুহি তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। কারণ রুহিকে বলেছে যে, সে আর কান্না করবে না কখনো।
রুহি এসে রিফাতের কাছ থেকে এক ফুট দূরে বসে।
কান্না করছিলে?
রুহির প্রশ্নে রিফাত মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” শব্দটা বললো।
রুহির রাগ হলেও কিছু বললো না। আজ সে রিফাতের উপর রাগ করবে না। কারণ আজ যে সে রিফাতকে নিজের ভালোবাসার কথা বলবে।
রিফাত রুহিকে চুপ থাকতে দেখে আবারো নিজের দৃষ্টিটা চাঁদের দিকে দেয়। একটু আগেও যেই চাঁদটার দু’পাশে মাত্র কয়েকটি তারা ছিলো। কিন্তু এখন গোনা যাবে না চাঁদের চারপাশের তারা গুলো। এতো তাড়াতাড়ি আকাশ ভরে গেলো তারায়।
“আকাশের অসংখ্য তারার মেলায় চাঁদটাকেই রাণী মনে হচ্ছে”
এ যেন আকাশের রাণী। আকাশ আর চাঁদ নামক রাণীর প্রজা গুলো হচ্ছে এই লক্ষকোটি তারা।
আচ্ছা আকাশ আর চাঁদের যদি মন বলে কিছু থাকতো, তাহলে কী চাঁদটা আকাশের সাথেই প্রেম আদান-প্রদান করতো? না-কি মানুষকে নিজের রূপ দেখিয়ে আকৃষ্ট করে প্রতারণা করতো?
হঠাৎ নীরবতার মধ্যে রিফাতের এমন প্রশ্ন শুনে রুহি অনেকটাই চমকে উঠে।
রিফাত প্রশ্নটা করে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে, রুহির উত্তরটা কী হবে সেই আশায়।
এটা কখনো সম্ভব না, আর যদি চাঁদের মন বলে কিছু থাকতো! তাহলে চাঁদের এই রূপটা অনেক আগেই বিলীন হয়ে যেতো।
মানে?
রুহির কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি রিফাত।
মানে টা হলো, চাঁদ নিজের রূপ দেখিয়ে কখনো মানুষকে প্রতারণা করতো না।
চাঁদটাকেই প্রতারণার ফাঁদে ফেলতো মানুষ। আর এভাবেই চাঁদটা প্রতারিত হয়ে হয়ে নিজের রূপটাই হারিয়ে ফেলতো।
কারণ মানুষ অপেক্ষা চাঁদ কখনো বড় প্রতারক হতে পারে না।
রুহির কথাটা শুনে রিফাত মাথা নাড়ালো। সত্যিই মানুষ অপেক্ষা আর কোনো বড় প্রতারক এই পৃথিবীতে নাই।
সেই মানুষটাই সব চেয়ে বড় প্রতারক। যে কাউকে ভালোবেসে আপন করে আবার দূরে সরিয়ে দেয়।
আকাশ আর সূর্য থাকতে চাঁদটা মানুষের সাথেই কেন প্রেম করবে? মানুষের সাথে প্রেম করাটা মানে চাঁদ নিজের রক্তের সাথে বেইমানী করা হয়ে গেলো না?
রিফাতের এমন প্রশ্ন শুনে রুহি মুচকি হেসে বলে;
মানুষ পারে না এমন কোনো কিছুই নাই।
মানুষের মিষ্টি কথার ফাঁদে চাঁদটা বরফের মতো গলে যেতো। আর নিজের রক্তের সাথে বেইমানী করতো। আর তুমি জানোনা চাঁদ অপেক্ষা মানুষ বেশি সুন্দর৷ “আর প্রতিটা বস্তু বা প্রাণী সৌন্দর্যের পূজারী” এতে কোনো সন্দেহ নাই যে চাঁদটা মানুষের প্রেমে পড়বেই।
আর প্রেম আর ভালোবাসা শব্দটা রক্তের সম্পর্ক বুঝে না। তাইতো হিন্দু মুসলিম নারী-পুরুষের মধ্যেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।
রুহির কথা শুনে রিফাত বলে;
বাহ! তুমি দেখি এসব খুব ভালোই জানো?
রিফাতের কথায় মুচকি হাসলো রুহি।
আর বললো;
আমি তোমায় একটা প্রশ্ন করি?
হুম করো,
একটা মুক্ত পাখি যদি অনেক দিন বন্ধ পিঞ্জিরায় থাকে, তারপর হঠাৎ সেই পাখিটি খোলা আকশে উড়াল দেওয়ার সুযোগ পায়। তখন কী পাখিটা খুব খুশী হবে?
রুহি কথাটা বলে রিফাতের দিকে মুচকি হেসে তাকায়।
হ্যাঁ অবশ্যই, সেই পাখিটি খুব ভাগ্যবান, কারণ প্রথমে মুক্ত, পরে বন্ধ পিঞ্জিরায়, তারপর আবার খোলা আকাশ।
রিফাত কথাগুলো বলে থামতেই রুহি বলে উঠে।
তোমার জীবনে যদি আবার প্রেম শব্দটা আসে?
মানে?
রুহির এমন প্রশ্নে রিফাত যেন আকাশ থেকে পরলো। রিফাত এখন উপরের পাখির কথার মানে বুঝতে পারছে।
আই লাভ ইউ রিফাত!
রুহির মুখে এই শব্দটা শুনে বসা থেকে উঠে পরে রিফাত। মূহুর্তেই রিফাতের মুখটা রাগে লাল হয়ে যায়।
হালকা চিৎকার করেই রিফাত বললো;
এসব কী বলছো রুহি?
রিফাতের রেগে যাওয়া দেখে রুহি ভয় পেয়ে যায়, তবুও ভয়ের মধ্যেই বলল রুহি;
আমি তোমার চাঁদ দেখার সঙ্গী হতে চাই রিফাত।
তোমায় ভালোবেসে তোমার বুকে মাথা রেখে নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই রিফাত। এই কয়দিনে খুব ভালোবেসে ফেলছি তোমায়।
রুহির কথা শুনে রিফাতের পা’য়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়।
রিফাত নিজের হাতটা তুলে রুহিকে মারতে। কিন্তু আবারো নিজের হাতটা নামিয়ে নেয়। রুহিকে কোনো কথা না বলেই ঘরের ভিতরে চলে যায় রিফাত।
রুহি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে। রিফাত কী এই কয়দিনে একটুও বুঝতে পারেনি আমার ভালোবাসার কথা?
রুহির কাছে এই প্রশ্নের উত্তর অজানা।
রুহি বাগানে কিছু সময় থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে ঘরের ভিতর যায়। রিফাতের কাছে যেতে চাইলে দেখলো রিফাত ভিতর থেকে দরজা আটকিয়ে রেখেছে।
রুহি রিফাতের দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমে যায়।
রিফাত বিছানার এক পাশে বসে আছে।
রিফাতের চোখ থেকেও ঝর্ণা গতিতে পানি পরছে।
সে আর কোনো ভুল করতে চায় না। আর কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে চায় না রিফাত।
রিফাত কখনো ভাবেনি রুহি তাকে ভালোবাসে। রুহির মুখে ভালোবাসি রিফাত শব্দটা শুনে খুব রেগে গিয়েছিলো রিফাত। মন চাচ্ছিলো তখন-ই রুহির গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিতে রিফাতের। কিন্তু রিফাত যে মেয়েদের শরীরে কখনো হাত তুলে না।
রিফাত একটা ডিসিশন নেয়, সেই ডিসিশন নিজেকে সুখে রাখার ডিসিশন। রিফাত চায় না আর কারো মিথ্যে মায়ায় জড়াতে।
রিফাত রাতের খাবার খায়নি, সেই যে রুমে ঢুকেছিলো আর বের হয়নি।
রুহি সহ ওর মা বাবাও ডেকেছে, কিন্তু রিফাত দরজা খুলে নি আর কথাও বলেনি। রুহির মা বাবা ভালোই বুঝতে পারেন রিফাতের কিছু একটা হয়েছে! রুহিকে জিজ্ঞেস করলে রুহি চুপ থাকে, কিছুই বলেন নিজের মা বাবার প্রশ্নে।
রুহি নিজেকে খুব বকা দিচ্ছে, রিফাতের চোখের ভাষা না বুঝেই পাগলের মতো ভালোবাসি বলেছে তাই।
সকালে রুহি ড্রয়িং রুমে বসে আছে, আকাশ ফেটে মাত্র আলোটা বের হয়েছে। এখনো সবাই ঘুমিয়ে আছে।
রিফাতের রুমের দরজার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো, রুমে এখনো লাইট এর আলো।
তার মানে রিফাত রাতে ঘুমায় নি, হয়তো রুহির কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে রিফাত।
সকাল ৮টা,
রুহি সহ ওর মা বাবা সবাই বসে আছে নাশতার টেবিলে।
রুহি কিছুক্ষণ পর পর রিফাতের রুমের দিকে তাকাচ্ছে।
রিফাত নিজের দরজা খুলে, হাতে তার সব জিনিস পত্র নিয়ে আসে। রিফাতের হাতে এসব দেখে মূহুর্তেই রুহির চোখ ভিজে যায়। রিফাতের হাতে ব্যাগ দেখে রুহির বাবা মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন, এখনই হয়তো রিফাতকে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাবেন রুহির মা বাবা।
পর্ব ১১
রিফাতের হাতে ব্যাগ গুলো দেখে রুহির মা বাবা রিফাতের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন।
এসব কী বাবা? কাল রাতের খাবার খাও নি, আমরা সবাই এতো ডাকলাম, আর এখন আবার হাতে ব্যাগ। কী হয়েছে তোমার?
এভাবে আরো অনেক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন রুহির মা বাবা।
রিফাত হাতে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুপ হয়ে আছে রিফাত, কোনো কথা বলছে না সে। কী বলারই বা আছে তার। রুহি তাকে ভালোবাসে বলে বাসা ছেড়ে যাচ্ছে এসব?
রিফাতকে চুপ থাকতে দেখে আবারো রুহির বাবা বলেন;
রিফাত এভাবে চুপ হয়ে আছো কেন? আমরা তোমায় কিছু প্রশ্ন করছি, সেগুলোর উত্তর দিচ্ছো না কেন?
এবারো রিফাত চুপ থাকলো, সত্যিই রিফাত ভাবতেই পারেনি রুহি তাকে ভালোবাসে, বুঝতে পারলে হয়তো অনেক আগেই বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতো।
রিফাতের চুপ থাকা দেখে রুহির মা বাবার মনে হাজারো প্রশ্ন এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ কোনো কিছু ছাড়াই রিফাত কেন এমন করছে? নাকি ওদের চোখের আড়ালে কিছু হয়েছে রিফাতের সাথে!
রিফাতকে চুপ থাকতে দেখে রুহি এবার মুখ খুললো, আর বললো;
বাবা আমি বলছি কি হয়েছে!
রুহির কথা শুনে রিফাত রুহির দিকে তাকায়। রিফাত ভাবনায় পড়ে যায়, রুহি কী বলবে তার মা বাবাকে?
বলতো মা কী হয়েছে? রিফাতের হঠাৎ এমন আচরণে আমাকে খুব ভাবাচ্ছে!
রুহির কথা শুনে কথাটা বললেন রুহির বাবা।
রুহি রিফাতের দিকে একবার তাকায়৷ রিফাত নীরবে তাকিয়ে আছে রুহির দিকে। হয়তো রুহি কী বলবে তা শুনার জন্য।
রুহি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো;
- আমি রিফাতকে ভালোবাসি বাবা, কাল রাতে রিফাতকে আমার মনের কথা বলেছিলাম, তারপরেই এসব!
রুহির কথা শুনে রুহির মা-বাবা খুব অবাক হয়, এই কি তাদের আগের রুহি? যেই রুহি ছেলেদের সাথে কথা বলতে লজ্জা পেতো।
এই কয় মাসেই মেয়েটা এতো পরিবর্তন হয়ে গেলো।
রুহি নিজের বাবা-মাকে এসব বলছে দেখে রিফাত খুব অবাক হয়।
মেয়েটা পাগল হয়েছে নিশ্চয়।
মাজহারুল নিজের মেয়ের কথায় রাগান্বিত না হয়ে একটু খুশীই হলেন। তবুও একটু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মাজহারুল।
তোর লজ্জা করেনা নিজের বাবা-মার সামনে এসব বলতে?
রুহি মাথা নিচু করে নেয়।
মাজহারুল আবার বলেন;
রিফাত বাবা এই ছোট্ট একটা কারণের জন্য বাসা ছেড়ে চলে যাবে?
রিফাত কিছু বলতে গিয়েও চুপ থাকে, মাজহারুল আবার বলেন।
আজ যদি আমি বলি; আমাদের ইচ্ছা তোমায় আমার মেয়ের জামাই বানাবো, তখনো কী এভাবেই রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে যেতে?
রিফাত খুব অবাক হয় রুহির বাবার মুখে এমন কথা শুনে, রিফাত ভেবেছিলো! রুহিকে হয়তো বকবেন ওর বাবা। কিন্তু তার ভাবনা তার একান্তই রয়ে গেলো।
রুহির মুখে হাসি ফুটে উঠে। তবুও রুহি মন খারাপ করে থাকে।
কিছু তো বলো? এভাবে চুপ করে থেকো না? আমরা তো অনেক্ষণ ধরেই তোমার সাথে কথাই বলে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি তো কিছুই বলছো না!
কী বলবো আমি?
রিফাত আস্তে আস্তেই কথাটা বলে।
রিফাতের কথা শুনে মাজহারুল বলেন।
আমার মেয়ের কথায় বাসা ছাড়তে চাচ্ছো নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
রিফাত শুধু মাথা নাড়িয়ে “না” বললো।
মাজহারুল মুচকি হেসে বললেন।
আমার মেয়েকে কী তোমার পছন্দ হয়নি?
আসলে জানো কী বাবা! এই কয় মাসে আমি আর রুহির মা অনেকবার তোমায় নিয়ে কথা বলেছি। রুহির মা তোমাকেই নাকি রুহির বর বানাবেন৷ ভাবছিলাম একদিন তোমায় বলবো, কিন্তু তার আগেই আমার মেয়েই তোমায় বলে দিয়েছে। রুহির মা ভয় পাচ্ছিলেন, রুহি কী তোমায় পছন্দ করবে? এখন দেখছি রুহি তোমায় পছন্দই না, ভালোবাসে।
মাজহারুল এর কথাগুলো শুনে রিফাত শুধুই অবাক হচ্ছে। এবার তাকে কিছু বলতে হবেই। রুহি পাগলামি করছে। রুহি সব জেনেও কেন এসব করছে রিফাত বুঝতেই পারছে না।
রিফাত এতো না ভেবে বললো;
আমি আমার অন্ধকার জীবনে কাউকে জড়াতে চাই না।
মানে? রুহির বাবা রিফাতের কথাটা বুঝতে পারেন নি, তাই এতো অবাক হয়েই প্রশ্ন করলেন।
আপনাদের আমি কখনো বলিনি কেন বাংলাদেশ ছেড়ে ইন্ডিয়ায় এসেছি। কিন্তু রুহি সব জানে। এখন আপনাদেরকেও জানতে হবে। আর আমি নিশ্চিত, আপনারা সব শুনে কখনো চাইবেন না আমি রুহিকে বিয়ে করি।
মাজহারুল কোনো চিন্তা না করেই বললেন;
কী এমন কারণ আছে যে, আমরা শুনলে তোমার সাথে আমাদের মেয়েকে বিয়ে দিবো না? বলো সব আমাদের৷ আমরা শুনবো;
রিফাত যেই কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনি অর্ণিদের বাসা থেকে চিৎকার শোনা যায়। ‘কান্নার চিৎকার’
চিৎকার শুনে রুহির বাবা একটু তড়িঘড়ি করেই বাসা থেকে বেড়িয়ে জান। পিছন পিছন রুহির মা আর রুহিও যায়।
বাসায় শুধু রিফাত আর সিয়াম আছে।
অর্ণিদের বাসার চিৎকারটা একটু বেশিই শোনা যাচ্ছে। তাই রিফাতেরও ইচ্ছা হয় অর্ণিদের বাসায় যাওয়ার। সবাই এভাবে কান্না করছে কেন, সেটা জানা প্রয়োজন।
রিফাত ও অর্ণিদের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়, পিছন পিছন সিয়ামও বাসার দরজাটা আটকিয়ে যায়।
রিফাত অর্ণিদের বাসায় ঢুকে দেখে রুহি সোফায় বসে কান্না করছে। রুহির পাশেই অর্ণির দাদি বসে কান্না করছেন। রুহির সামনে গিয়ে রিফাত দাঁড়ায়৷ রিফাত কিছু বলার আগেই, রুহি হাত দিয়ে ইশারা করে একটা রুমের দিকে।
যেই রুম থেকে অনেকেরি কান্নার শব্দ আসছিলো।
রিফাত আর কোনো কথা না বলেই সেই রুমের দিকে হাটতে থাকে।
পিছন পিছন রুহিও যায়।
রিফাত রুমের ভিতর ঢুকে অনেক বেশিই অবাক হয়ে যায়।
ফ্যানে অর্ণির দেহ ঝুলে আছে। রিফাত ভাবতেই পারেনি চিৎকার করে কান্নার উৎস অর্ণিকে নিয়েই হবে।
অর্ণির আত্মহত্যা এর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না রিফাত। এমন চাঞ্চল্য মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। কী এমন কষ্ট মেয়েটার মনে, যার জন্য আত্মহত্যা এর মতো পাপ কাজ করলো।
রিফাতের চোখ থেকেও পানি পড়তেছে। রিফাত যদিও অর্ণির সাথে বেশি মিশতো না। কিন্তু এই কয় মাসে অর্ণির চাঞ্চল্য স্বভাব রিফাতের ভালো লাগতো। আর কখনো অর্ণির এমন চাঞ্চল্য দেখবে না রিফাত, দেখবে না অর্ণি আর রুহির আড্ডা।
তাপস রায় আর রাহুল মিলে অর্ণির ঝুলন্ত শরীরটা নামিয়ে বিছানায় রাখে। তাপস আর রাহুলের চোখ থেকে অনবরত পানি পরেই যাচ্ছে। অর্ণির মা চিৎকার করে কান্না করছেন রুহির মা সহ আরো কয়েকজন মহিলা অর্ণির মা’কে সান্তনা দিচ্ছেন।
রিফাত দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ সামনে অর্ণির লাশ আর পাশেই রুহি দাঁড়িয়ে আছে।
অর্ণি হঠাৎ এভাবে এমন পাপ কাজ করলো কেন?
রুহির দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো।
রিফাত কথাটা বলার সময় কণ্ঠস্বর ভেঙে আসছিলো।
রিফাতের প্রশ্ন শুনে রুহি মাথা নাড়িয়ে “না” বললো।
রুহিকে সান্তনা দিতে গিয়েও নিজেকে ফিরিয়ে নেয় রিফাত। একটু কান্না করলে কষ্টটা কম হবে।
তাপসের চোখ রিফাতের দিকে পরতেই দৌড়ে রিফাতকে জাপ্টে ধরেন তাপস। চিৎকার করে কান্না করছেন তাপস। রিফাত তাপসকে সান্তনা দিচ্ছে।
রাহুল হঠাৎ করে এসে রিফাতের শার্টের কলারে ধরে, আর চিৎকার করে বলে।
তোর জন্য আমার বোন আত্মহত্যা করেছে, তোকে আমি খুন করেই ফেলবো।
কথাটা বলেই রিফাতকে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় রাহুল।
হঠাৎ এমন কিছু দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। বেশি অবাক রুহি আর রুহির পরিবার হয়েছে।
রিফাত অবাক হবে কী, সে বুঝতে চাচ্ছে রাহুল কী বলতে চায়!
তাপস রাহুলকে ধরে আটকান।
এর মধ্যেই পুলিশ এসে বাসায় ঢুকে।
রাহুল চিৎকার করে বলছে।
এই ছেলে আমার বোনের খুনি, ওরে নিয়ে জান আমার সামন থেকে।
রাহুল চিৎকার করে বলছে আর কান্না করছে।
রিফাত কিছুই বুঝতেছে না। কী হচ্ছে এসব?
পুলিশ অফিসার রাহুলকে বলেন।
স্যার কী হয়েছে একটু বুঝিয়ে বলেন? (রাহুল একজন পুলিশ অফিসার হওয়ায় অন্য পুলিশ অফিসার স্যার বলেই সম্মোধন করেন)
রাহুল কোনো কথা না বলে একটা কাগজ এগিয়ে দেন পুলিশ অফিসার এর দিকে।
পুলিশ অফিসার কাগজটি পড়েন, কাগজটা পড়ে রাহুলের দিকে তাকান অবাক হয়ে।
রিফাত পুলিশ অফিসারকে বললো;
আমি কী কাগজটা দেখতে পারি?
রিফাতের কথা শুনে কাগজটা এগিয়ে দেন রিফাতের দিকে।
রুহি সহ অন্য সবাই অবাক হয়েই যাচ্ছে। রুহি বুঝতে পারছে না, কী হচ্ছে এসব?
রিফাত কাগজটা নিয়ে পড়তে শুরু করে।
কেন তুমি হিন্দু হলে না রিফাত?
কেন তুমি বাংলাদেশ ছেড়ে এই দেশে আসলে! আর আমার মনে তোমার প্রতি প্রেম জাগিয়ে তুললে। আমি জানি তুমি আমার লেখা কাগজটি পড়বে! কিন্তু তখন আমি হয়তো পৃথিবীতে থাকবো না।
আমার দেখা সব চেয়ে সুদর্শন পুরুষ তুমি।
প্রথম দিন দেখেই আমি প্রেমে পড়েছিলাম।
দেখো আমি আমার ভালোবাসার কথা তোমায় না জানিয়েই এই পৃথিবী ত্যাগ করতে হচ্ছে।
মনে মনে হয়তো আমায় পাগল বলছো।
কী করবো বলো, আমি চেয়েছিলাম ফুলসজ্জার রাতেই তোমায় ভালোবাসি শব্দটা বলবো। কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম তুমি মুসলিম।
তোমার কথা আমি আমার পরিবারকে বলায়, রাহুল দা আমায় খুব মেরেছেন। বাবাও খুব বকেছেন। তোমায় ভালোবেসেছি এটাই আমার ভুল। বুঝতে পারিনি তোমায় ভালোবেসেছি বলে এতো বকা আর মার খেতে হবে আমায়।
তোমাকে ভালোবাসি কথাটাও আমি বলতে পারিনি। খুব ইচ্ছা ছিলো তোমার বুকে মাথা রাখবো।
তোমাকে ভালোবাসি, অথচ তুমি জানোই না। তোমার জন্য আমি সব করতে পারতাম।
তোমার আড়ালে খুব বেশিই ভালোবেসেছি তোমায়। যেখানে তোমায় না জানিয়ে প্রথমে নিজের পরিবারকে জানিয়েছিলাম। ফল হিসাবে চড়থাপ্পড় পেয়েছি।
তাই বাধ্য হয়েই আত্মহত্যা এর পথ বেঁচে নিলাম।
আমি জানি তোমাকেও বললে হয়তো ‘না’ শব্দটাই বলতে, তাইতো রাতে তোমার কাছে দৌড়ে যেতে পারিনি।
এটাই আমার ভাগ্য, মৃত্যুটা এভাবেই ছিলো।
শেষে একটা কথাই লিখবো, আমার লেখা কাগজটা একবার জড়িয়ে রেখো বুকে,
এই কাগজটা রেখো তোমার কাছে, কাগজটা দেখলে যেন একবার হলেও আমার কথা মনে পড়ে।
খুব ভালোবাসি রিফাত।
রিফাত লেখা টুকু পড়ে কাগজটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে। রিফাতের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
চোখ তুলে রাহুলের দিকে তাকায় রিফাত। আর বলে;
এই কাগজে সব সত্য লেখা আছে, খুনি আমি না খুনি আপনি। নিজের বোনকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন। কী করেছিলো অর্ণি।
শুধু আমায় ভালোবাসে এই কথাটা আপনাদের বলেছিলো। তার ফল সে কী পেয়েছে এই কাগজেই লিখে গেছে। আপনারা চাইলে অর্ণিকে ভালভাবে বুঝাতে পারতেন। আমাকেও জানাতে পারতেন। ওকে ভালোবাসতে না পারলেও ভালোভাবে বুঝাতে পারতাম। তাহলে হয়তো আজ এই দিন দেখতে হতো না।
রিফাত চিৎকার করে কথাগুলো বলে থামে। রিফাত কিছুটা বুঝতে পেরেছিলো অর্ণির চোখ কী চায়?
তাইতো অর্ণি থেকে নিজেকে দূরে রাখতো। অর্ণি তো নিজ থেকে বলতে পারতো। ভালোভাবে হয়তো বুঝাতে পারতো। অর্ণি পাগলের মতো কেন এমন করলো। ভালোবাসে কিন্তু ভালোবাসি বলতে পারেনি। একজনকে ভালোবাসলো, কিন্তু তাকে না জানিয়েই খারাপ কিছু করা, এসব সত্যিই পাগলামো।
বিকালে অর্ণিকে মাটি দেওয়া হয়। অর্ণি নাকি ছোট থাকতে থেকেই বলতো, ওরে যেন না জ্বালানো হয়। এসব নাকি খুব ভয় পায়। তাইতো অর্ণির কথা রাখে ওর পরিবার।
রিফাত নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে ভাবছে৷, তার অজান্তেই তার জন্য একটা মেয়ে এতোটাই স্বপ্ন দেখেছিলো।
রুহিও তো অনেক স্বপ্ন দেখতেছে হয়তো। তাহলে রুহিও যদি খারাপ কিছু করে। রুহিকে ভালোভাবে বুঝাতে হবে।
রিফাত কে একবার যদি অর্ণি তার মনের কথা বলতো।
তাহলে হয়তো এমন কিছু হতো না।
অর্ণির লেখা কাগজটি রিফাত নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, প্রতিদিন না হয় একবার হলেও কাগজে হাত দিবে সে।
পর্ব ১২
অর্ণির মৃত্যুর আজ ২০দিন হলো। অর্ণির পরিবার কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছে। রাহুল আর তাপস রায় দু’জনেই নীরবে কাঁদেন। তাদের ভুলেই অর্ণি আত্মহত্যা করেছে। অর্ণির সাথে এমন আচরণ না করলে হয়তো অর্ণি এই খারাপ কাজটা কখনো করতো না। অর্ণি মানুষ ছিলো, কোনো অবুঝ প্রাণী ছিলো না।
তাই হয়তো ভালভাবে বুঝালে অর্ণিও বুঝতে পারতো।
রিফাত খুব স্বাভাবিক ভাবেই অফিসে যায় আসে, অফিসে বা রাস্তায় রিফাতকে দেখলেই তাপস রায় কেমন করে জানি তাকান, এই তাকানোর মানে হয়তো নিজের মেয়েকে দেখতে পান তাপস রিফাতের মাঝে।
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে আছে রিফাত, নেট অন করতেই পরপর কয়েকবার শব্দ করে রিফাতের ফোন।
নীলিমা অনেক গুলো ফোন দিয়েছে।
রিফাত নীলিমার কল দেখে ফোন দেয়।
কেমন আছিস?
নীলিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো।
ভালো, তুই কেমন আছিস?
রিফাত ইন্ডিয়াতে কী করে না করে, সব কিছুই নীলিমাকে বলে। রুহির কথা, অর্ণির মৃত্যুর কথা সব কিছুই নীলিমার অজানা নয়।
আল্লাহ যেমন রেখেছেন। বাসার সবাই কেমন আছেন রে?
সবাই ভালো আছেন, একটা কথা বলবো তোকে?
নীলিমা মন খারাপ করেই কথাটা বলে।
রিফাত হুম বলে৷
নীলিমা জানে রিফাত কথাটা শোনার পর খুব কষ্ট পাবে। তারপরেও রিফাতকে জানানো প্রয়োজন। নীলিমাকে চুপ থাকতে দেখে রিফাত বললো;
কি’রে কিছু বলছিস না যে?
মন খারাপ করবি না তো?
এতো ন্যাকামি না করে বলতো কী হয়েছে?
রিফাতের রেগে যাওয়া দেখে নীলিমা মুচকি হাসলো, নীলিমা বললো;
আগামীকাল সুমার বিয়ে৷ তোকে জানানো প্রয়োজন মনে করলাম আমি।
সুমার বিয়ে শব্দটা শুনে অট্টহাসি দিয়ে উঠে রিফাত, আর বলে;
এই কথা শুনে আমি মন খারাপ করবো, তুই এটা মাথায় আনলি কী ভাবে? সুমা কে ছিলো সেটা আমি ভুলে গেছি। ওর বিয়ে হোক বা মরুক এতে আমার কিছু যায় আসে না। রাখছি ফোন।
নীলিমাকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই রিফাত ফোন কেটে দেয়।
নীলিমা একটা লম্বা শ্বাস নিলো। রিফাত এখন কান্না করবে। যতোই সুমাকে ঘৃণা করুক রিফাত, তবুও সুমাকে ভালবাসে সে, রিফাতের জীবনটাই হয়তো কান্না করে করে কাটাতে হবে!
বউ সেজে বসে আছে সুমা, প্রায় এক মাস ধরে বিয়ের কথা চলছিলো। সুমা কখনো বিয়ে করবে না, কিন্তু মা বাবা জোর করে সব ঠিক করেছে। রাতেই হসপিটাল থেকে আসে সুমা।১৪ দিন হসপিটাল থাকে সুমা।
সুমার মা যখন বলেছিলো কয়েকদিন পর তোর বিয়ে৷ কথাটা শুনেই প্রতিবাদ করেছিলো সুমা। কিন্তু মা বাবার লোভ দেখে সুমা বারবার অবাক হয়। মা বাবার সামনেই ফল কাটার চাকু নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিছিলো।
সুমার ভাগ্যটাই হয়তো এমন। তাইতো এতো কিছুর পরেও সে বেঁচে গেলো।
রাতেই বাসায় আসছে৷ আর সকালেই তাকে বউ সাজানো হয়। নীলিমা বা অন্য কেউ বিয়েতে নাই। শুধু সুমার মা বাবা দু’জন মিলেই বিয়ে দিচ্ছেন। সুমার বিয়ে যার সাথে হচ্ছে সে একজন সরকারী চাকরিজীবী। তাই আর সুমার মা বাবা নিজেদের লোভ আটকিয়ে রাখতে পারেন নি।
সুমার প্রথম বিয়ের কথাও লুকিয়ে রাখা হয় ওদের কাছ থেকে।
সুমার ঘৃণা জন্মেছে নিজের মা বাবার প্রতি।
ওর একটা বাস্তব জ্ঞান হলো। মা বাবা লোভী হলে সন্তানের ভালো খারাপ কিছুই বুঝে না।
ভালোভাবেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।
রিফাতের কাছে এই কয় মাসে কম হলেও কয়েক হাজার কল দিয়েছে, কিন্তু রিফাতের ফোন অফ। রিফাত কোথায় আছে সেটাও অজানা।
রিফাতের মায়ের কাছেও আর ফোন দেওয়ার সাহস হয়নি। নীলিমার সাথে মাঝেমধ্যে কথা হলেও তা শুধুই অপমান, নীলিমা নানান ভাবে সুমাকে অপমান করে।
সুমা আজ একটুও কান্না করেনি। তিন কবুল পড়ার পর থেকেই সুমা নিজেকে মৃত নদীর সাথে মিলিয়ে নিয়েছে। রিফাতকে দেওয়া কোনো কথাই রাখতে পারেনি সে। রিফাতকে ছেড়ে যাবেনা বলা কথাটাই মিথ্যা হলো। আজ সে অচেনা এক পুরুষের স্ত্রী। অন্য পুরুষ আজ রাতে স্পর্শ করবে। অন্য পুরুষ নয়তো সে, সেও তো এখন আমার স্বামী। সুমা মনে মনে হাসলো, সময় খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয়।
রিফাতকে ছাড়া যেখানে অন্য কাউকে কল্পনাই করতে পারতো না। সেখানে আজ অন্য একটা পুরুষের সাথেই তার বিয়ে হলো।
রিফাতকে ডিভোর্স দিয়ে খুব বড়ই পাপ করেছে সে। টিনের ছিদ্র টিন দিয়েই মোচন করতে হয়, কিন্তু রিফাতের সাথে করা পাপ কী দিয়ে মোচন করবে?
মাহিকে প্রথমে থাপ্পড় মারে মিনার। মাহির দোষ রিফাত এর জন্য কান্না করছিলো। মাহির কান্নার শব্দ শুনে নাফিজা দৌড়ে আসেন। মাহি চিৎকার করে বলছে।
তোমার লজ্জা করে না আমার শরীরে হাত তুলতে, আর কীভাবে পারছো ভাইয়ার নামে খারাপ কথা বলতে?
তুই চুপ থাকবি নাকি আবারো থাপ্পড় দিবো?
মাহি কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেনা মিনারের এমন আচরণ। মাহি আড়ালে থাকা খবর গুলো জানলে হয়তো প্রতিবাদ করতো, চুপ হয়ে থাকতো না নিজের মায়ের মতো।
মাহি আবারো বলে;
ভাইয়া তোমার বড়, কীভাবে ভাইয়াকে নিয়ে খারাপ কথা বলতে পারলে তুমি? আর চুপ হবো কেন, নিজের বড় ভাইকে যে সম্মান করতে পারে না, সে কখনো মানুষ হতে পারে না।
তুই থামবি? কথাটা বলেই খুব জোরেই থাপ্পড় দেয় মাহির গালে। নাফিজা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি।
দৌড়ে গিয়ে পর পর দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দেন মিনারের গালে।
মিনার চিৎকার করে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই মুখে আঙুল দিয়ে মিনারের মুখ বন্ধ করে দেন। আর বলেন;
আমার পেটে তোর মতো একটা পশু ধরেছিলাম। যে নিজের ভাইকে ভাই বলে স্বীকার করে না, নিজের ছোট বোনের শরীরেও হাত তুলতে ভয় পায় না।
নাফিজা কথা গুলো বলে কান্না করে দেন।
তোমার ওই ছেলের মতে হওয়ার কথা ছিলো নাকি, যাকে নিজের বউ ছেড়ে গেছে শুধু বাবা হতে পারবে না বলে। কথাটা বলে অট্টহাসি দিয়ে উঠে মিনার।
মিনারএএএ বলে চিৎকার দিয়ে উঠেন নাফিজা।
ভাবতে পারেন নি এই ছেলেটা এমন হবে। মাহি কিছু বলার আগেই নাফিজা বলে উঠলেন।
খুব তাড়াতাড়ি তুই ধ্বংস হবি, শুধু তুই না তোর বাপ চাচা ওরাও ধ্বংস হবে। আল্লাহ সব দেখছেন। নিশ্চয় এসবের বিচার করবেন আল্লাহ।
কথাগুলো বলে কান্না করে চলে জান নিজের রুমে নাফিজা। সাথে মাহিকেও নিয়ে জান। এই পশুর সামনে মাহিকে রাখলে হয়তো মেরেই ফেলবে।
নাফিজা নিজের রুমে এসে বিছানার এক পাশে বসলেন। অঝরে অশ্রু বর্ষণ করছেন নাফিজা। মাহি একটু এগিয়ে এসে নিজের মা’কে জড়িয়ে ধরে।
আম্মু আমি জানিনা ওই মানুষরূপী জানোয়ার গুলো কেন ভাইয়ার সাথে এমন করছে! আর ভাবিই বা কেন এমন পালটে গেলো।
মাহির কথা শুনে নাফিজা মাহির দিকে তাকান। আর নরম কণ্ঠে বললেন।
তোর বাপ ভাই কেন এমন করছে তা আমার অজানা না। কিন্তু সুমা কেন এমন করেছে সেই বিষয়টা বুঝতে পারছি না। সুমার এমন পালটে যাওয়া আমি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
আব্বু আর ভাইয়া কেন এমন করছে?
সুমার প্রশ্ন শুনে নাফিজা নীরব থাকলেন। মাহিকে এসব জানাতে চাননা নাফিজা। মাহি অনেকবার প্রশ্ন করলো। কিন্তু নাফিজা প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন।
রিফাত বাগানে বসে আছে। আকাশে থাকা চাঁদটার দিকে তাকালো।
আজকে সুমা অন্য কারো সাথে এক বিছানায়। রিফাত কথাটা ভাবতেই চোখজোড়া ভিজে যায়।
নীলিমার সাথে আর কথা হয়নি। সেদিন রেগে ফোন রাখারার পর নীলিমা আর ফোন দেয় নি। হয়তো সুমার বিয়ের জন্য ব্যস্ত।
নীলিমাকে যতোই সুমার কথা তিক্ত ভাবে বলে, কিন্তু সুমাকে এখনো ভালোবাসে রিফাত। আগের চেয়ে আরো বেশি ভালোবাসে।
পাপ হবে না তো সুমাকে এখনো ভালোবাসলে? এটা কী মনের পাপ। সুমা যে এখন পরনারী।
রিফাত মুচকি হাসলো। কিছুদিন আগেও যে সুমা ছিলো তার প্রেয়সী, আজ সময়ের ব্যবধানে সেই সুমাই পরনারী এবং অন্যের স্ত্রী।
একটু পরেই হয়তো সুমা খুব ঘনিষ্ঠ হবে নিজের স্বামীর সাথে! আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নেয় রিফাত। ভাগ্য আর বউ কখনো আপন হয় না।
পিছন থেকে রুহি সব দেখছে, রিফাতের মন খারাপ কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। অর্ণিটাও পাগলামি করে চলে গেলো অজানা পথে যেখানে গেলে মানুষ পৃথিবীতে আসার পথ খুঁজে পায় না।
অর্ণির মৃত্যু আর রিফাতের মন খারাপ দুটোই খুব কষ্ট দিচ্ছে রুহিকে।
রুহি রিফাতকে নিয়ে নিজের মা বাবার সাথে আবার কথা বলবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
রিফাত বাগানে বসে আছে, এই সুযোগে রুহি নিজের বাবামায়ের কাছে গেলো রিফাতকে নিয়ে কথা বলতে।
রাত ১১টা, বউ সেজে বসে আছে সুমা। নতুন বর রুমে ঢুকেই ওয়াশরুমের ঢুকে যায়। সুমাই একমাত্র মেয়ে যে কিনা নিজের বরের নাম জানেনা। জানবেই কিভাবে? হসপিটাল থেকে এসেই বিয়ে। মা বাবা এতো নিষ্ঠুর কেন? কেন এভাবে আমাকে এভাবে ধ্বংস করে দিলো।
সুমা একটু নড়েচড়ে বসে।
নতুন বর এসেই সুমার পেটে হাত দিলো।
সুমা কেপে উঠলো। রিফাত তো এমন ছিলো না।
সুমা অনুতপ্ত হলো, অন্য পুরুষের মাঝে রিফাতকে খুঁজতেছে।
সুমা তাড়াতাড়ি করেই উনার হাত সরিয়ে দেয়।
সুমার নতুন বর খুব রেগেই সুমার দিকে তাকায়।
সুমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
সুমা না শব্দটাও বলতে পারবে না।
উনিও তো স্বামী।
সুমার বর শুধু বলল।
তোকে আমি দুই লক্ষ টাকা দিয়ে কিনেছি।
তাই আমি যা বলবো তাই করবি।
সুমা কথাটা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে।
সুমার বর সুমাকে নিজের মতোন করে ইউজ করলো। সুমা নীরবে কান্না ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি।
এটাই হয়তো রিফাতের সাথে পাপ করার ফল।
পর্ব ১৩
সকালে যখন নাশতা শেষে অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলো রিফাত।
তখন রিফাতের রুমে রুহির মা বাবা আসেন।
রিফাত বাবা কোনো ডিসিশন নিয়েছো কী?
বিছানায় বসতে বসতে কথাটা বললেন রুহির বাবা।
রুহির বাবার কথা শুনে চুপ থাকে রিফাত। রিফাত বুঝতে পারছে রুহির বাবা কী বলতে চাচ্ছেন। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়।
রুহির মা বললেন;
বাবা কিছু একটা বলো? আমাদের এভাবে ফিরিয়ে দিয়ো না!
রুহির মা বাবা রিফাতকে এতোটাই পছন্দ হয়েছে যে, তাই কোনো ভাবেই চাননা রিফাতকে হাত ছাড়া করতে। রুহির জন্য পারফেক্ট ছেলেই রিফাত। তাইতো রিফাতের প্রতি এতো টান ওদের।
রুহিও এসে রুহির মা বাবার পাশে বসে।
রিফাত মনে মনে হাসছে এই কথা ভেবে যে! ওর জন্য যতোটা পাগল হয়েছে ওরা, সত্যটা শুনলে হয়তো এর চেয়ে বেশি অবাক হবেন। আর কখনো ভাববেন না নিজের মেয়ের বর বানানোর কথা।
রুহির বাবা মাজহারুল বললেন;
রিফাত এভাবে চুপ থেকো না, কিছু একটা বলো?
আমি চাইনা আমার অন্ধকার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে।
রিফাতের কথার আগামাথা কিছুই বুঝেননি রুহির মা বাবা।
তাই অধীর আগ্রহে বললে।
অন্ধকার জীবন মানে?
ওদের কথায় মুচকি হাসে রিফাত, আর বলে;
বাংলাদেশ থেকে কেন এই দেশে এসেছি সেটা আপনাদের মেয়ে রুহি জানে, তবুও কেন পাগলামি করছে রুহি। সেটা আমার জানা নেই।
বাংলাদেশ থেকে কেন এসেছো?
(রুহির মা প্রশ্নটা করলেন)
রিফাত একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো।
ভেবেছিলাম এসব নিয়ে আর কারো সাথে কখনো কথা বলবো না। কিন্তু পরিস্থিতি বলাতে বাধ্য করছে আবারো।
বাবা তুমি সব সরাসরি বলো তো। এভাবে বলে আমাদের মধ্যে শুধুই আগ্রহ সৃষ্টি করতেছো।
রুহির বাবার কথায় মুচকি হাসে রিফাত।
আর বলে;
“আমি বিবাহিত” কিছুদিন আগেই আমার স্ত্রী আমায় ডিভোর্স দিয়েছে।
কিহহ?
রিফাতের কথা শুনে রুহির মা বাবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
রিফাতকে দেখে ওরা কখনো বুঝতেই পারেন নি রিফাত এর পূর্বেও বিবাহ করেছে।
হুম, আরো অনেক সমস্যার কারণেই আমি ইন্ডিয়াতে এসেছি।
তার মধ্যে সব চেয়ে বড় সমস্যা হলো আমি কখনো বাবা হতে পারবো না। তাই তো আমার স্ত্রী আমায় ডিভোর্স দিয়েছে।
তাই বলছি আমি চাইনা আমি আমার অন্ধকার জীবনের সাথে কাউকে জড়িয়ে তার জীবনটাও নষ্ট করে দিতে।
রিফাত এর প্রতিটা কথা শুনেই অবাক হচ্ছেন রুহির বাবা মা। রিফাত সম্পর্কে এসব কখনো তাদের কল্পনায়ও আসে নি।
রিফাতের মুখে রিফাতের এমন সমস্যার কথা শুনে দু’জনই চুপ হয়ে যান। একটু আগেও যারা কথার বর্ষণ করছিলো। তারা নিমিষেই চুপ হয়ে গেলো।
সবার মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করে।
এবার রিফাত বললো।
দেখেছেন সব শুনে আপনারা কেমন চুপ হয়ে গেছেন! আমি চাইনি আমার এসব আপনাদের জানাতে। কিন্তু আপনারাই বলতে বাধ্য করালেন।
একটু আগেও যখন আপনারা আপনাদের মেয়ের বর হিসেবে আমায় পছন্দ করেছিলেন। এখন হয়তো সব জেনে আপনারা মনে মনে ভাবতেছেন, কী ভুলটাই না করতে গেছিলাম!
রিফাতের এমন কথা শুনে রুহির মা বাবা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
রুহির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করে। তাহলে কী সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পাবে না। একটা ছেলে বাবা হতে পারবে না, এসব জেনেও নিশ্চয় কোনো বাবা মা তাদের মেয়েকে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দিবেন না। তাহলে কী অপূর্ণই থেকে যাবে রুহির ভালোবাসা?
রিফাত রুহির দিকে তাকায়। এই মেয়েটা কেন এমন পাগলামো করলো? সব জেনেও কেন ভালোবাসতে গেলো আমায়? রুহির কান্না মাখা চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এসব ভাবছে।
কিন্তু রিফাত হয়তো ভুলেগেছে! “কারো প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হতে একটা ভালো মন প্রয়োজন”
একটা ভালোমনের মানুষ একটা অন্ধ মানুষকেও ভালোবাসতে পারে।
রুহি নিজের মা বাবার দিকে একটু পর পরেই তাকাচ্ছে। ওরা কী তাহলে?
তুমি বাবা হতে পারবে না, পূর্বেও একটা বউ ছিলো। এসব তোমার অতীত।
“মানুষকে ভালোবাসতে তার অতীত জানতে হয় না” আর আমার মেয়ে তোমার সব কিছু জেনেই তোমায় ভালোবেসেছে। হয়তো এখন যদি আমরা মেয়ের ভালোবাসা অস্বীকার করি, তাহলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। রুহি যদি তোমাকে নিয়ে সুখে থাকতে পারে তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। বিয়ে মানেই যে সন্তান লাভ করা এরকম নিয়ম কোথাও লেখা আছে বলে আমার মনে হয় না?
রুহির বাবা কথা গুলো বলে থামেন।
রুহির বাবা খুব চিন্তা করেই এসব কথা বলেছেন। কারণ রুহি রিফাতের সব কিছু জেনেই ভালোবেসেছে। তাহলে তাদের ‘না’ শব্দটা এখানে বোকামির পরিচয় দিবে।
রুহির মুখে হাসি ফুটে উঠে, মুহূর্তেই রুহির মুখ থেকে কান্না হাওয়া হয়ে যায়।
রিফাত রুহির বাবার কথা গুলো শুনে অবাক হলো না। কারণ উনার কথা গুলো চরম সত্য। তাহলে অবাক হবে কেন?
রুহিও যে কিছুদিন পর পালটে যাবে না এমনও তো কোথাও লিখা নাই। রিফাত এবার দোটানায় পড়ে গেল। কী করবে সে খুঁজে পাচ্ছে না।
রিফাত দেখো আমাদের কারো অমত নাই। তাহলে আর না করো না বাবা? তোমার না শব্দটাই আমাদের কষ্টের কারণ। আর তোমার হ্যাঁ শব্দটা আমাদের মুখের হাসির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সমাজ কী বলবে? যখন বিয়ের অনেক গুলো বছর কেটে যাবে বাচ্চা হবে না। তখন সমাজ আমার আর রুহির দিকেই আঙুল তুলবে।
রিফাতের এমন কথা শুনে রুহির বাবার খুব রাগ হয়। একটু রেগেই বললেন মাজহারুল;
বাবা সমাজ কী বলবে এটা একটা নিয়ম হয়ে গেছে আমাদের সবার নিকট। একটু গভীর ভাবে তাকালে দেখতে পাবে ” ধানের শীষে থাকা এক বিন্দু জমে থাকা কুয়াশাও শুখিয়ে যায়” এর মানে তোমার মধ্যে সমাজের লোকের প্রভাব পড়লেও সেটা মোচন হবে। মনে রেখো আমরাই সমাজ, আর আমরাই সব করি।
একটা পরিবার তাদের জায়গায় অটুট থাকে। তাহলে সমাজ এর খারাপ প্রভাব কখনো সেই পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনা। সমাজ কী বলবে শব্দটা ভুল। বলো একটা পরিবার সমাজকে কী দেখাচ্ছে, সমাজের কেউ কিন্তু ঘরে এসে কিছু বলে না। আমরাই সুযোগ করে দেই ওদের বলতে।
তাই তুমি সমাজের অজুহাত দেখাবেনা আমায়।
রুহির বাবার কথা গুলো শুনে রিফাত ভাবনায় পড়ে যায়। রিফাতের কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে আছে। কী বলবে সে খুঁজে পাচ্ছে না। সুমাকে ছাড়া আর কাউকে কখনো কল্পনাও করতে পারবেনা রিফাত। যাকে একবার ভালোবেসেছিলো তাকে আজ পর্যন্তও ভুলতে পারেনি। এখন আর নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না।
আমাকে আজকের দিনটা ভাবতে দিন! আমি রাতেই জানাচ্ছি সব।
কথাটা বলেই রিফাত বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
রিফাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো রুহি সহ রুহির মা বাবা।
রুহি তুই কিন্তু পরে আমাদের কিছু বলতে পারবি না।
রিফাত বাসা থেকে বের হওয়ার পর রুহির মা কথাটা বললেন।
মানে?
এই যে রিফাত বাবা হতে পারবে না এই বিষয় নিয়ে।
মা তুমি তোমার মেয়েকে এখনো চিনলে না। রিফাত এর মতো মানুষ এর স্ত্রী হওয়া ভাগ্যের বেপার। রিফাতের প্রথম স্ত্রী বুঝেনি রিফাতকে।
রুহির কথা শুনে রুহির মা আর কিছু বললেন ন।
সন্তান যদি নিজের ক্ষতি হবে জেনেও কোনো ডিসিশন নেয় সেখানে বাবা মার কিছুই বলার থাকে না। আর এখানে তো রুহির মা বাবা প্রথম থেকেই রিফাতকে নিজের মেয়ের বর বানাবেন ভেবে আসছিলেন।
রিফাত বাসা থেকে বের হয়ে একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে বসে। আজ আর অফিসে যাবে না। অফিস এর চেয়ে এই বিষয়টা খুব বড় রিফাতের কাছে।
রিফাত এতক্ষণ ধরে ভেবেও কিছু পাচ্ছে না। তাই নীলিমার কাছে ফোন দেয়। নীলিমা ফোন ধরে কিছু বলার আগেই রিফাত বলে উঠে।
বোনের বিয়েতে ব্যস্ত, তাই না? পার্শ দেশে যে একটা ভাই আছে তার কথা ভুলেই গেলি। বাহ!
রিফাত মন খারাপ করেই কথা গুলো বলে।
রিফাতের কথা শুনে নীলিমার রাগটা চরম পর্যায়ে উঠে যায়। তাই নীলিমা খুব রেগেই বলে;
এখন যদি তুই আমার সামনে থাকতিস, তাহলে তোকে মেরে শুটকি বানিয়ে দিতাম ইন্ডিয়ার গন্ডার।
নীলিমার রেগে চিৎকার করে কথা বলা দেখে রিফাত আবারো বলে উঠে।
উচিত কথা বলছি তো তাই রাগ দেখানো হচ্ছে।
শুন রিফাত! আমায় রাগাবি না। যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলবি না।
কি জানি না আমি? রিফাত ভেংচি কেটে বলে।
এই যে আমি ওই মেয়ের বিয়েতে ব্যস্ত। তুই জানিস সুমার বিয়ে শুধু ওর মা বাবা দিয়েছে। সুমাই না-কি বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
নীলিমার মুখে এমন কথা শুনে রিফাতের মন খারাপ হয়ে যায়।
সুমা এতোটা পরিবর্তন হলো।
রিফাত আর এই বিষয়ে আর কোনো কথা না বলে আসল কথায় আসলো।
নীলিমা আমায় একটা চিন্তার সমাধান করে দে?
তোর চিন্তার সমাধান আমি করবো? কীভাবে রে!
মজা করবি না। রিফাত হেসে দেয়। রিফাতের হাসির শব্দ শুনে নীলিমা শান্তিতে নিশ্বাস নিলো।
বল তোর কোন চিন্তার সমাধান করতে হবে?
‘রুহি’
কী রুহি?
রুহি সহ রুহির মা বাবা,, (তারপর আজকের সব কথা নীলিমাকে বললো রিফাত)
নীলিমা সব কথা খুব মন দিয়ে শুনলো।
আর বললো;
রিফাত আমি একটা কথা বলবো রাখবি?
হুম বল,
মানুষের জীবনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তুইও মানুষ, তাই তুইও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিস। তাই বলছি কী?
হুম বল কি বলছিস!
রুহিকে বিয়ে করে নে।
কিহহ! তুই সব জেনেও। কীভাবে বলতে পারলি এই কথা?
রিফাত রাগবি না, আমার কথাটা রাখ। সুমাকে ভুলে যা। আর রুহিকে আপন করে নে।
আমি যে রুহিকে কখনো মা ডাক শুনাতে পারবো না।
রুহি তো সব জেনেই তোকে ভালোবাসছে। তোর রাইট হবে রুহিকে ভালোবাসা।
নীলিমার কথা শুনে রিফাত চুপ থাকে।
তার কী করা উচিত?
রিফাত আম্মু ডাকছেন, পড়ে কথা বলি। আর তুই রুহিকেই বিয়ে করবি এটাই শেষ কথা।
নীলিমা রিফাতকে আর কোনো কথাই বলতে দেয় নি। ফোনটা কেটে দেয়।
সন্ধ্যার পর রিফাত বাসায় যায়। সন্ধ্যার নাশতা করে নাশতার টেবিলেই বসে আছে সবাই।
রিফাতও অনেক ভেবেছে। রুহিকে বিয়ে করবে সে, ভালোবাসতে না পারলেও রুহিকে ভালোবাসতে দিবে সে।
রুহি তুমি আমায় ভালোবাসো। আমার সব জেনে আমায় ভালোবেসেছো। বিশ্বাস আমার খারাপ সময়েও আমায় ভালোবাসবে। অনেক ভেবেছি। তাই ভাবলাম আমি আবারো কোনো নারীকে বিশ্বাস করতে পারি। আর হ্যাঁ মনে রেখো। তুমি কখনো সুমার মতো পরিবর্তন হলে আমি কখনো আর কোনো মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারবো না।
নাশতার টেবিলেই কথা গুলো বললো। রিফাতের কথা শুনে রুহি সহ রুহির মা বাবার মুখে হাসি ফুটে উঠে। ওরা যেন ঈদের চাঁদ দেখার ন্যায় খুশি।
তাহলে বিয়ের তারিখটাই তোমায় বলে দেই।
মানে?
আগামী রবিবার তোমার আর রুহির বিয়ে।
রিফাত অবাক হয়ে বলে।
এতো তাড়াতাড়ি,
আমি চাইনা তোমরা বিয়ের আগে প্রেম করো।
তাই আমরা আগ থেকেই বিয়ের তারিখ ঠিক করে রেখেছি। শুধু তোমার হ্যাঁ বলার অপেক্ষায় ছিলাম।
রিফাত রুহির বাবার কথা শুনে রুহির দিকে তাকায়। রুহি নিচের দিকে তাকিয়ে হাসছে। রিফাত আর কিছু বললো না।
শুধু হুম বলে নিজের রুমে চলে যায়।
আজকে শুক্রবার।
তার মানে মাঝে একদিন আছে।
রিফাত মুচকি হাসলো, সুমারো বিয়ে হলো, এখন তারও বিয়ে। সময় কখনো থমকে থাকে না।
পর্ব ১৪
রিফাত রুমে এসে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে। মানুষ ক্লান্ত হলে বিছানায় গড়াগড়ি খায় কিছুটা হলেও যেন আরাম পায়। আর রিফাত বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে নিজের মনকে সান্তনা দিতে। জেনে শুনেও যে আবার ভুল ডিসিশন নিলো।
কিন্তু গড়াগড়ি করলে কী আর মনকে সান্তনা দেওয়া যায়। বেশি হলে শরীরের ক্লান্তি কাটবে নয়তো ঘুম আসবে, মনকে সান্তনা দেওয়া কখনো সম্ভব না।
রিফাত নিজের মনকে সান্তনা দিতে পারছে না কোনো ভাবেই। বারবার সুমার কথা মনে পরছে রিফাতের। রিফাত এই কথাও ভাবে, সুমাও তো আর তার না, কালকেই কালেমা আর তিন কবুল পড়ে অন্য এক পুরুষের বউ। তাহলে কেন সুমার জন্য এতো কষ্ট।
রিফাত নীলিমার কাছে ফোন দেয়।
দুইবার রিং হয়েই কেটে যায়। হয়তো নীলিমার নেটে সমস্যা। তারপরেও আবার ফোন দেয় রিফাত। এবার আর নেট ভিলেনের মতো মধ্যে বাধা দিচ্ছে না।
নীলিমা ফোন ধরেই বলে;
বল কী খবর তোর?
রবিবারে আমার আর রুহির বিয়ে। কথাটা বলে ছোট একটা শ্বাস নিলো রিফাত। এই ছোট একটা শ্বাসেই অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে।
সত্যি! রিফাতের মুখে বিয়ে শব্দটা শুনে নীলিমা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। তাই চিৎকার করেই কথাটা বললো।
নীলিমার এতো খুশী দেখে রিফাতের কষ্টটা হাওয়া হয়ে যায়।
হুম রে, কখনো ভাবিনী আমার এই অন্ধকার জীবনকেও কেউ ভালোবাসবে। সব কিছু জেনেও নিজেকে জড়াবে আমার সাথে।
রিফাত সত্যিই কখনো ভাবেনি আবারো সে বিয়ে করবে। বা তাকে আবারো কেউ ভালোবাসবে।
রিফাত শুন! নিজের জীবনকে কখনো অন্ধকার বলতে নাই। তুই এখনো পিচ্চি, এই বয়সেই যদি ভেঙে যাস। তাহলে বাকি জীবন কী করবি। আর মনে রাখিস সবার জীবন সুখ-দুঃখ নিয়েই সৃষ্টি। আর আল্লাহ যা করেন সব ভালোর জন্যই করেন। তোরও কোনো ভালোর জন্য এমন হয়েছে। এটাও হতে পারে এই বিষয় গুলো না হলে তোর অনেক কিছুই অজানা রয়ে যেতো।
নীলিমার কথাটা হয়তো রিফাতকে সান্তনা দেওয়ার জন্য। কিন্তু সত্যি যদি কখনো রিফাতের জীবনের সাথে নীলিমার বলা কথা গুলো মিলে যায়।
নিলীমা রিফাতকে চুপ থাকতে দেখে আবারো নীলিমা বললো।
রিফাত মন খারাপ? কখনো মন খারাপ করবি না। অতীত ভুলে যা। আর যে এখন তোকে ভালোবাসে তাকেই ভালোবাস নইলে তোকেই ভালোবাসতে দে তাকে। ভুলে যাস না একতরফা ভালোবাসা কিন্তু খুব শক্ত হয়। কারণ একতরফা ভালোবাসার মানুষটাই তোকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। তাই আবারো নিজের জীবনকে সাজা।
হুম, জানিনা সামনে আমার ভাগ্যে কী আছে। আর এটাও সত্য আমি সুমাকে কখনো ভুলতে পারবো না। আর রুহিকেও ভালোবাসতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।
রিফাতের কথা শুনে নীলিমা কিছু বলতে গিয়েও বলেনি। নীলিমা চুপ থাকে এই কারণে, সুমার কথা বলে রিফাতের আর কষ্ট বাড়াতে চায় না।
সুমা সেদিন নীলিমাকে যে কথা গুলো বলেছিলো, নীলিমা চেয়েছিলো রিফাতকে সেই কথা গুলো বলতে। কিন্তু এসব শুনে হয়তো রিফাতও নীলিমার মতো বিশ্বাস করবে না। তাই আর রিফাতকে এসব শোনায় নি। সুমা রিফাতকে ভালোবাসলে একবার হলেও রিফাতকে সব বলতে পারতো ডিভোর্স এর আগে।
নীলিমাকে চুপ থাকতে দেখে রিফাত বললো;
কীরে কথা বলছিস না যে?
আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাই রে। নীলিমা কথাটা বলেই ফোন রেখে দেয়। রিফাতও আর কিছু বলেনি। রিফাত ভাবে নীলিমার বলা কথা গুলো কি কখনো সত্য হবে? সত্যিই কী ভবিষ্যতে নতুন কিছু জানবে?
রিফাত যখন এসব ভাবনায় মগ্ন তখনই রুহি দুই কাপ চা নিয়ে রুমে ঢুকে।
রুহিকে দেখে রিফাত ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসে। রুহির মুখে আজকে স্পষ্ট ভাবে লজ্জার আভাস দেখতে পারছে রিফাত। এর পূর্বে কখনো রুহির মুখে এমন লজ্জা দেখেনি।
এই নাও চা? চা’য়ের কাপ দুটো নিয়ে বিছানায় বসতে বসতে কথাটা বললো রুহি।
রিফাতও কোনো কথা না বলে চা’য়ের কাপ হাতে নেয়।
আমরা কী তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম?
রিফাত যখন চা’য়ের কাপে চুমুক দিবে। তখনই প্রশ্নটা করে রুহি।
রুহির প্রশ্ন শুনে রুহির দিকে তাকায় রিফাত। চা’য়ের কাপটা বিছানার একপাশে রাখে রিফাত, আর বলে;
উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয়? আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো। তাহলে কী করবে তখন?
রিফাতের কথাটা শুনে রুহি মন খারাপ করে তাকায় রিফাতের দিকে। রুহির কাছে রিফাতের করা প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই। তাই রুহি চুপ থাকে। রুহিকে চুপ থাকতে দেখে রিফাত আবারও বলে;
তবে আমি উপরের কথাটা বলবো না।
রুহির মুখে হাসি ফুটে উঠে রিফাতের কথা শুনে। রিফাত আবারো বলে;
সত্যিই তুমি পাগলামি করেই যাচ্ছো। একবার শান্ত ভাবে ভাবো। তাহলেই বুঝতে পারবে, আমাকে ভালোবাসা এটা তোমার পাগলামি।
আমি অনেক ভেবেছি, কখনো মনে হয়নি আমি তোমাকে ভালোবেসে কখনো পাগলামি করেছি।
রুহির কথায় রিফাতের আর কিছু বলার থাকেনি।
আমি এটাও জানি তুমি আমায় ভালোবাসতে পারবে না। কিন্তু আমি চেষ্টা করবো আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা সৃষ্টি করতে।
রিফাত এবার মুচকি হাসলো।
রিফাতের হাসির মানেটা রুহি বুঝতে পারেনি, আর বুঝতেও চায় না।
রুহি রিফাতের পাশে বেশিক্ষণ না থেকে নিজের রুমে চলে যায়। মাঝে মাত্র একটা দিন-ই। তারপর থেকে রিফাত শুধু তারই।
রিফাত রাতের খাবার খেয়ে নিজের রুমে আসে। আজ আর বাগানে যায় নি। মন ভাল থাকলে হয়তো বাগানেও যাওয়াটা হতো। চাঁদটা হয়তো আজ রিফাতকে খুব মিস করবে। কারণ চাঁদটাকে রিফাতের মতো এতো মন দিয়ে আর কেউ হয়তো দেখে না।
রুহির মা বাবা নিজেদের রুমে বসে বসে পরামর্শ করছেন কী কী করবেন। রুহির মা একপর্যায়ে বলে উঠলেন।
আচ্ছা রুহির বাবা! লোকেরা তো বলবেই রুহি আর রিফাতের মধ্যে হয়তো কিছু ছিলো তাই এতো তাড়াতাড়ি করে আমরা বিয়ে দিচ্ছি?
রুহির মা’র কথা শুনে হাসলেন মাজহারুল। আর বললেন;
লোকে বলার মতো কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না তো আমি। আর আমার ছেলেমেয়ে তো লোককে কিছু বলার সুযোগ কখনো দেয় নি।
মানে?
এই যে বাহিরে অবাধে দু’জনের চলাফেরা, বা এরকম কোনো কিছুই করেনি রিফাত আর রুহি। আর আমার জানামতে রুহি কে সবাই চেনে, আর রিফাতকেও এই কয়দিনে সবাই চিনেছে। মনে হয় না রিফাত আর রুহির বিয়েতে কেউ আঙুল তুলবে।
তাই যেনো হয়। মিথ্যে কিছু হলেও লোকের কথায় খুব কষ্ট হয়।
রুহির মা’র এই কথার উত্তরে মাজহারুলও একমত।
আচ্ছা বিয়েতে কতোজন মানুষের খাবারের আয়োজন করবে?
এই তো আমাদের আশে-পাশের বাসা গুলোতে দাওয়াত দিবো। ছোট করেই সব আয়োজন হবে।
রুহির মা-বাবা নিজেদের মেয়ের বিয়েতে কী কী হবে সব কিছুই আলোচনা করেন।
আর রুহির মা বাবা সব দিক দিয়েই তৈরি হয়ে আছেন, লোকের কথা বলা, বা রিফাত আর রুহিকে নিয়ে সামনে কোনো সমস্যা হলে সব কিছুই ভাবছেন দু’জন।
সকালের নাশতা করেই রিফাতকে নিয়ে জান বিয়ের কাপড় সহ সব কিছু কিনতে। রিফাতের সাথে তাপস রায় আর রুহির বাবা আর তাদের পাশের বাসার আরো এক মুসলিম প্রতিবেশী।
দুপুরের আগেই সব কিছু শেষ করে আসেন ওরা।
এই দিকে রুহির মা সবাইকেই দাওয়াত দিয়েছে। এখন যারা আসবার আসবে, আর যাদের আসার ইচ্ছা নাই তারা আসবে না।
অর্ণির পরিবার প্রথমে খুব অবাক হয়েছিলো। পরে আবার সব বুঝেছে। মধ্যে শুধু নিজের মেয়েকেই হারালো ওরা।
বিকেলের আগেই রুহিদের বাসায় অনেক মেহমান এর উপস্থিত। অর্ণির পরিবারও এসেছে।
সিয়াম খুব খুশী নিজের আপুর বিয়ে বলে কথা। সিয়াম তার বয়সরে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নাচানাচি করতেছে, পিচ্চি সিয়াম এতোটাই খুশী যে তা বলার বাহিরে।
সবার মুখে হাসি থাকলেও রিফাতের মুখে হাসি নাই। হয়তো ভাবেনি কখনো তার জীবনে দ্বিতীয় বিয়ে বলে কোনো শব্দটা থাকবে। রিফাতের বেশি কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে। তার বিয়ে অথচ তার পরিবারের কেউ নাই। সুমার সাথে বিয়েতে রিফাত অনেক মজাই করেছে। রিফাত তখন ভুলে গিয়েছিলো তার নিজের বিয়ে এইটা।
রিফাত দীর্ঘশ্বাস নিলো এই ভেবে! “প্রথম বিয়ের মতো নিজের দ্বিতীয় বিয়ে এতো মজার হয় না” প্রথম বিয়েটা হয় হাজারো অনুভূতির মেলা। প্রথম বিয়ে মানে প্রথম ভালবাসা।
আর দ্বিতীয় বিয়ে মানে হাজার অনুভূতির মৃত্যু। কাউকে মিস করা, দ্বিতীয় স্ত্রীর মধ্যে প্রথম জনের মিল খোঁজা।
সকাল থেকেই রুহিদের বাড়িতে হৈচৈ।
আজ যে তার আর রিফাতের বিয়ে। শনিবারটা খুব তাড়াতাড়িই চলে গেলো।
রুহিকে বউ সাজানো হচ্ছে। রুহির মুখে হাসি থাকলেও, কিছুটা কষ্ট হচ্ছে অর্ণির জন্য। আবার এটাও ভাবে রুহি!
আজ অর্ণি পৃথিবীতে থাকলে হয়তো অর্ণি কান্না করতো নয়তো সে। কারণ দু’জনের স্বপ্নের নায়ক একজনই যে। বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও হয়তো ফাটল ধরতো। আল্লাহ যা করেন সত্যিই ভালোর জন্য করেন।
রুহিকে ফুফু খালার মেয়েরা বউ সাজাচ্ছে, সবাই প্রথমে অবাক হয়েছিলো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হলো কীভাবে।
রুহির মা বাবা সব বলেছেন সবাইকে। রিফাত এর আগেও বিবাহিত ছিলো, এসব বাধে। রুহি বুঝতে পারছে না ওরে বউ সাজানো হচ্ছে নাকি লজ্জা দেওয়ার খেলা চলছে।
রিফাতকে বর সাজানো হয়, রিফাতের কানে অনেকের বলা কথার আওয়াজ আসছে। সবাই রিফাতের গুণগান করছে।
রিফাত মনে মনে হাসছে এই ভেবে যে,
ওই লোক গুলোই যদি রিফাতের সত্য অতীত গুলো জানতে পারতো! তাহলে কখনো তার গুণগান করতো না।
সবাই একে একে এসে রিফাতের সাথে ফটো তুলছে, রিফাতের সাথে নানান ভাবে সবাই মজা করছে।
রিফাত আজ দ্বিতীয় বার বউ সেজেছে, আর রুহি বউ সেজেছে প্রথমবার। রিফাতের এসব ভাবনার সমাপ্তি ঘটে রাহুলের কথায়।
আমার বোনটা পাগলামি করে ভালোই করেছে। যদি আজ সে নিজের চোখে দেখতে পারতো নিজের ভালোবাসার বিয়ে অন্যের সাথে। তাহলে হয়তো আরো বেশি কষ্ট পেতো।
রাহুল কথাটা বলে মুচকি হাসে। রিফাত স্পষ্ট দেখতে পারছে এই মুচকি হাসির আড়ালে থাকা কষ্টের নদীটা।
রিফাত কোনো কথা বললো না, শুধু তাকিয়ে আছে রাহুলের দিকে। রাহুল রিফাতের সাথে কয়েকটা পিক তুলে।
রাহুল কিছুক্ষণ পরপর রিফাতের দিকে তাকায়। হয়তো নিজের বোনকে দেখতে পায় সে রিফাতের মধ্যে।
রুহি বউ সেজে বাসরঘরে বসে আছে। রুহি খুব ক্লান্ত, বিয়েটা ভালো ভাবেই শেষ হয়েছে। রাত ১০টা বেজে ২০ মিনিট। রিফাত হয়তো বাগানে বসে আছে। এই ফাঁকেই রুহি কাপড় চেঞ্জ করে নেয়। রাত ৯টা পর্যন্ত বাসা ভরা মানুষ ছিলো।
তাই আর কাপড় চেঞ্জ করেনি রুহি।
রিফাতকে দেখেই তার আজকের দিনটা শেষ হয়েছে। আজ রিফাতকে এতোটা সুন্দর লেগেছিলো সেটা রুহির কল্পনার বাহিরে।
রুহি একটা পাতলা শাড়ি পড়ে বাগানের দিকে যায়। বাসায় যদিও তেমন মেহমান নেই। আর থাকলেও কী, নিজের বাসা।
রুহি বাগানে গিয়ে রিফাতকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। রুহি মুচকি হাসে, বিয়ের প্রথম রাতটা বরের সাথে কিছুটা সময় হলেও বাগানে কাটাতে পারবে।
পর্ব ১৫
রিফাতকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুহি মুচকি হেসে রিফাতের পাশে বসে।
রিফাত রুহিকে নিজের পাশে দেখে একটু অবাক হয়। অবাক হলেও কোনো কথা বললো না রিফাত।
অবাক হচ্ছো তাই না? নতুন বউ বাসর ঘরে না থেকে বাগানে কী করছে?
রিফাতের এমন তাকানো দেখে রুহি মুচকি হেসে কথাটা বললো।
চাঁদের আলোয় রুহির হাসি মাখা মুখটা খুব সহজেই দেখতে পারছে রিফাত। রুহির হাসিটা আজ রিফাতের কাছে খুব ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে, রিফাত বুঝতে পারছে না!
অবাক হওয়ার কী আছে? নতুন বউ বলে যে বাসরঘরে বসে থাকবে তা তো কোথাও লেখা নাই।
রিফাতের এমন স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে দেখে রুহির কেমন এক অজানা ভালো লাগা কাজ করছে।
আল্লাহ এর কাছে মনে মনে অনেক শুকরিয়া আদায় করে রুহি। সত্যিই ভাবেনি এমন কাউকে পাবে সে?
আর পাবেই না বা কেন? রুহি নিজেকে সব সময় ছেলেদের কাছ থেকে আড়ালে রেখেছে। তাই তো আজ সে দামী কিছু পেয়েছে। রুহির বাবা বলতেন, মা তুই যদি নিজেকে ভালো রাখতে পারিস। আর তোর জীবনটা কোনো খারাপ কাজের দিকে ধাবিত না করিস! তাহলে নিশ্চয় তোর জীবন সঙ্গী খুব ভালো পাবি।
সত্যিই রুহি নিজেকে কখনো কোনো খারাপ কাজের দিকে নেয় নি। তাই তো আজ সে আল্লাহ এর অনেক বড় নেয়ামত পেয়েছে।
দু’জনের মধ্যে গভীর নীরবতা। রিফাত ভেবেছে রুহি হয়তো আবার কথা বলবে, কিন্তু রুহিও চুপসে আছে।
রুহিকে চুপ থাকতে দেখে রিফাত আবারো রাতের কালো আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদটা অর্ধ খণ্ডিত আজ।
চাঁদটাও পূর্ণ হয়, আবার অপূর্ণ হয়, আবার পূর্ণ হয়। এই নির্দিষ্ট কাজে চাঁদ খুব সুখী। নদীর যেমন স্রুত আছে, চাঁদেরও তেমন জন্ম আছে। চাঁদও ছোট থেকে বড় হয় আবার ছোট হয়। তাই চাঁদ তার নির্দিষ্ট গতিতেই সুখী।
রিফাতও একবার পূর্ণ হয়ে আবার অপূর্ণ হলো এখন আবার পূর্ণ হলো। রিফাত নিজেকে চাঁদের সাথে তুলনা করতে পারবেনা কখনো! চাঁদের ভাগ্য নির্দিষ্ট হলেও রিফাতের ভাগ্য তো আর নির্দিষ্ট না। চাঁদের দিকে খুব ভালোবেসে তাকিয়ে আছে রিফাত। চাঁদটা ঠিক আগের মতোই আছে। শুধু রিফাতের সঙ্গীর পরিবর্তন হয়েছে, আগে যাকে পাশে নিয়ে চাঁদ দেখেছে, আজ সে পর খুব অচেনা।
আজ আমি খুব সুখী, নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পেয়েছি। কখনো ভাবিনি যাকে ভালোবাসবো তাকেই আপন করে পাবো। আর এটাও ভাবিনি আমি কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবো!
রিফাতের কাঁধে মাথা রেখে কথাটা বলে রুহি। রুহি প্রথমেই ভেবে রেখেছে রিফাতের সাথে সব কিছু রুহি নিজ থেকেই করবে। কারণ রিফাতের অনুভূতি গুলো যে মৃত।
রুহির কথা গুলো শুনে রিফাত ভীষণ ভাবে আহত।
রিফাতের কাঁধে রুহি নিজের মাথা রেখে রিফাতের কথা বলার অপেক্ষায় আছে।
কিন্তু রিফাত কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না তাই চুপ থাকলো।
রুহি অপেক্ষা করতে থাকে রিফাতের কথা বলার। রিফাতকে কথা বলতে না দেখে রুহি রসিকতা করে বললো।
হায় কপাল! কার প্রেমে পড়েছি আমি, যে কিনা চাঁদের প্রেমে আসক্ত। এখন তো চাঁদের উপর খুব হিংসে হচ্ছে আমার।
রুহি একটু রাগী কণ্ঠে বললো। রাগী কণ্ঠ থাকলেও রুহির মুখে হাসির রেখা ছিলো।
রুহির কথা শুনে রিফাত মুচকি হেসে দেয়। চাঁদের দিক থেকে নিজের দৃষ্টিটা রুহির দিকে নেয় রিফাত। আর বলে;
আমি হয়তো তোমার অনুভূতির যথাযথ সম্মান করতে পারবো না। তবে ইনশাআল্লাহ আমি আর তুমি একটা পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি। চেষ্টা করবো তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করতে। শুধু?
কথাটা বলে থামে রিফাত।
রুহির একটু মন খারাপ হলেও খুব ভালো লাগে রিফাতের কথা শুনে। শুধু শব্দটা শুনে রুহি বুঝতে পারছে রিফাত কী বলতে চাচ্ছে। রুহি কোনো ভাবেই চায়না আজ রিফাতের মন খারাপ হোক। তাই রুহি কথা ঘুরালো।
অনেক তো চাঁদ দেখলাম দু’জন মিলে। রাত মনে হয় ১১টা হয়ে গেছে। চলো রুমে যাই। আজ যে আমাদের বাসর রাত।
রুহি মুচকি হেসে কথাটা বলে রিফাতকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই, হাত ধরে নিজের সাথে করে রুমে নিয়ে যায়।
রিফাত রুমে ঢুকে চিনতে পারছেনা এই রুমটা তার। চিনবেই বা কী করে, নানাধরণের ফুল দিয়ে রুমটা সাজানো। কবে রুমটা এভাবে সাজানো হলো রিফাত খুঁজে পাচ্ছে না। বিকেলেও দেখেছে রুমটা অন্যরকম, তাহলে এখন?
রিফাত ওয়াশরুমে যায়। কিছুক্ষণ ওয়াশরুমের সাথেই না হয় চোখের অশ্রুগল্পআলাপ করবে সে।
রুহি আজকের রাতটা নিয়ে কোনো ভাবনাই ছিলো না। কারণ এসব নিয়ে কখনো ভাবেনি সে। রিফাতকে দেখার পরেও কখনো তার ভাবনায় বাসর রাত নিয়ে কিছু আসে নি। রুহি ভাবতো যাকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করবে, স্বামীর যা স্বপ্ন থাকবে সব স্বপ্ন রুহিরও।
স্বামী যদি বলতো আমি তোমার মতোই স্ত্রী খুঁজেছি এতোদিন। তখন রুহিও বলতো আমিও আপনার মতো স্বামীর অপেক্ষায় ছিলাম। তখন দু’জনেই হেসে দিবে। এসব ভাবনাই ছিলো রুহির মনে। কিন্তু ভাবনার বাহিরে বাস্তবতা কঠিন সত্য।
রিফাত ওয়াশরুমে আছে। এই ফাঁকেই রুহি ভেবে নিলো রিফাত আসলে কী কী করবে।
রুহি মুচকি হাসে, রুহি যা ভাবছে তা করলে রিফাত রুহিকে নিয়ে কী কী ভাববে। রুহি লজ্জাও পেলো কিছুটা।
রিফাত খুব স্বাভাবিক হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়।
রুহি বিছানার ঠিক মাঝখানটাতে বসে আছে। রিফাত এতো কিছু না ভেবে গিয়ে রুহির পাশে বসে। এতো ভেবেও তো কিছু করার নাই। রিফাতকে পাশে বসতে দেখে রুহি বললো;
এতোক্ষণ কী করলে ওয়াশরুমে?
ওয়াশরুমে মানুষ কী করে তুমি জানো না?
রিফাত রুহিকে উল্টো প্রশ্ন করে। রিফাতের প্রশ্ন শুনে রুহি লজ্জা পেয়ে নীরব হয়ে যায়।
রিফাত আবার বললো;
আচ্ছা তুমি কেন আমার জীবনের সাথে নিজের জীবনটা এভাবে জড়ালে?
আজ তোমার এসব প্রশ্ন থাক না, আজ আমাদের বাসর রাত। রিফাতের কথার উত্তরে রুহি কথাটা বললো।কিন্তু রিফাত রুহির এসব কথা না শুনে আবার বললো;
আমার সব জেনেও কেন এমন করলে? বলবে আমায়? রিফাত রুহিকে আজ ছেড়ে দিবেনা সব জেনেই তার শান্তি। রুহি এবার একটু রাগান্বিত হলো।
তোমায় আমার ভালো লেগেছে, আর তুমিই আমার প্রথম দেখা সুদর্শন পুরুষ।
রুহির এসব কথা রিফাতের কাছে পাগলামো মনে হচ্ছে।
আমায় পছন্দ হলো আর এমন পাগলামো করে ফেললে। আমি তো তোমায় আমার সব অতীত বলেছি। তারপরেও তুমি এমন পাগলামো?
একটা কথা বলবো?
রিফাতের কথার মধ্যে থামিয়ে প্রশ্ন করে রুহি।
হুম বলো।
তোমার অতীতের অনেক কিছুই তোমার অজান।
মানে? রুহির কথা শুনে রিফাত একটু অবাক হয়।
মানে টা হলো এই, তোমার অতীত শুনে আমার মনে কেমন জানি কিছুটা রহস্যের মনে হচ্ছে।
কী বলছো এসব? রিফাত কিছুই বুঝতেছে না।
একদিন হয়তো আমার ভাবনাটাই সত্য হবে দেখবে তুমি!
রিফাত এবার কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রুহির দিকে।
আমি তোমায় ধীরে ধীরে ভালোবেসেছি। আর সব ভেবেই ভালোবেসেছি তোমায়। আর আমি এটাও নিশ্চিত আমার ভাবনা সত্য হলে তুমিও খুশী হবে।
রিফাত রুহির কথা গুলো বুঝতে পারছে না, তাই আর এসব কথায় আগ্রহ দেখালো না রিফাত।
রিফাত যেই ঘুমাতে যাবে, ঠিক তখনই রুহি বলে।
এই তুমি ঘুমাচ্ছো কেন?
তো কী করবো?
আজ আমাদের বাসররাত যে, আমার জীবনের প্রথম বাসর রাত। আর তুমি বলছো ঘুমাবে?
রুহি লজ্জা না পেয়েই কথা বলে। রিফাত রুহির এমন কথা শুনে খুব অবাক হয়। রিফাত হয়তো ভাবছে রুহির কী আজকে লজ্জাটাও হাওয়া হলো। রিফাত এর মনও খারাপ হয়। তার যে আজ দ্বিতীয় বাসর।
রুহি আবার বলে;
আমি চাই আজ বাসর রাতেই তুমি আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করবে।
কথাটা বলে রুহি নিচের দিকে তাকায়।
রিফাত হা করে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। রিফাত এতোদিন যে রুহিকে দেখে আসছে, আজ সেই রুহি আর এই রুহির কোনো মিল নেই। যে রুহি আগে লজ্জা পেতো। আজকের রুহি একটুও লজ্জা পাচ্ছেনা।
তুমি সব জেনেও আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাচ্ছো, আচ্ছা সত্যিই কী তুমি পাগল হয়েছো রুহি?
রিফাতের কথায় রুহি মুচকি হাসলো। আর বললো;
সব জানি আমি, আর পাগলামো করছি না আমি। তুমি বাবা হতে পারবে না, এটাই তোমার দুঃখ। কিন্তু আমরা দু’জন দু’জনকে তো উপভোগ করতে পারবো।
রুহি কথাটা বলে রিফাতের বুকে মুখ লোকায়। রিফাত রুহির প্রতিটা কাজেই অবাক হচ্ছে। রুহি এমন হবে বিয়ের পর রিফাত কখনো কল্পনাও করেনি।
রিফাত এর উত্তর এর আশা না করেই রুহি নিজেই সব করতে শুরু করলো। রিফাত আর না করতে পারেনি, সে তো পুরুষ, কোনো নারীর ছোঁয়ায় নিজেকে কতক্ষণ ঠিক রাখবে। আর রুহি তো তার স্ত্রী৷ আর কার জন্য কষ্ট পাবে, যেই মেয়ে আজ অন্যের বউ, যেই মেয়ে তাকে অপমান করেছে, তার জন্য কষ্ট পাবে
কোনো ছলনাময়ী নারীর জন্য সত্যিকারের ভালোবাসাকে সে এড়িয়ে যাবে?
রুহিকেও তো ভালোবেসে দেখা যায়। সুমাকে না হয় নীরবেই কাউকে না জানিয়ে ভালোবাসবে রিফাত।
রুহি আর রিফাত একে ওপরের ভালোবাসায় মিশে গেলো।
খুব ভালোই চলছিলো রিফাত আর রুহির সংসার। রুহির মা বাবাও খুব খুশি ছিলেন। কিন্তু রিফাত আর রুহির বিয়ের ৪মাস পরেই দু’জনের সংসারে কালো মেঘের ছায়া নেমে আসলো।
পর্ব ১৬
রিফাত আর রুহির বিয়ে হয়েছে ৪ মাস হলো, এই ৪ মাসে ওদের মধ্যে কখনো ঝগড়া হয়নি৷ রুহি সারাক্ষণ রিফাতকে মাথায় তুলে তুলে রেখেছে, রিফাত যা বলেছে রুহিও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। তাহলে ঝগড়া হবে কী করে!
একটা পরিবারে তো তখনই ঝগড়া হয়, যখন দুজন দুজনকে বুঝতে পারেনা। দুজনের মধ্যে একজন একটু অন্যরকম হলেই সংসারে ঝগড়া বা অশান্তির দেখা মিলে।
কিন্তু দুজন যদি দুজনকে বুঝতে পারে, দুজন যদি চায় আমরা ঝগড়া করবো না, তাহলে সত্যিই একটা সুখী পরিবার হয়ে গড়ে উঠে তাদের এসব ভাবনার কারণে। সেই সংসারে কখনো অশান্তি সৃষ্টি হয় না। রুহির মা-বাবা খুব খুশী ছিলেন দুজনের এমন সুখী সংসার দেখে।
কিন্তু বিয়ের চার মাস পরেই যে সুখী সংসারটা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবার পথে। সুখ শব্দটা কখনো স্থায়ী হয় না, সুখ-দুঃখ এই দুটো জিনিস মানুষের মধ্যে অস্থায়ী ভাবে বসবাস করে। একটা মানুষ কিছুদিন সুখে থাকে আবার কিছুদিন দুঃখী।
রিফাতও তার ব্যতিক্রম না, তার জীবনে দুঃখটাই মনে হয় একটু বেশিই বসবাস করে। তাইতো আকাশের মতো রঙ বদলায় তার জীবনও। রিফাত খুব ভালোই বুঝতে পারলো আবার। সুমার সাথেও তো খুব সুখেই ছিলো সে।
রুহির সাথে যতোটা সুখে আছে তার চেয়ে আরো বেশি ছিলো সুমার সাথে। কিন্তু খুব অচেনা সুনামি সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিলো৷ এবারও ভিন্ন হয় নি। যখন রিফাত দুঃখকে জয় করে একটু সুখ খুঁজে পেয়েছিলো, ঠিক তখনই অচেনা অন্ধকার এসে সব কেড়ে নিলো।
আজ সকালেই নাশতার সময় হঠাৎ রুহি বমি করতে থাকে অবিরত। রুহি বা ওর মা-বাবা বিষয়টা এতো মাথায় নেন নি। ওরা ভেবেছেন খাবার এর জন্য এমন হচ্ছে, হয়তো রুহির খাবারটা ভালো লাগেনি। কিন্তু রিফাত রুহির প্রতি খুব যত্নবান। তাইতো রুহির বমি দেখে রিফাত পাগল হয়ে যায়।
নাশতা শেষেই কাছের একটা হসপিটালে নিয়ে যায় রুহিকে। কে জানতো? এই অতি যত্নটাই রিফাতকে আবার কষ্ট দিবে?
রুহিকে হসপিটাল নিয়ে যাবার সময় রুহি বলেছিলো; “এই সামন্য বমির জন্য এতো কিছু করতেছো কেন?”
উত্তরে রিফাত বলেছিলো; সামান্য না! স্বামী হিসেবে আমার কর্তব্য তোমার অসুস্থে পাশে থাকা।
কিন্তু রিফাতের এই দায়িত্বের কথা গুলো তখনি হাওয়া হয়, যখন ডক্টর রুহির বমি করার কারণ বলে। একটু আগেও যে রিফাত শুধু রুহির একটু বমি করাতেই পাগল হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু এখন সেই রিফাতই হতবাক হয়ে গেছে রুহির বমির কারণ শুনে।
ডক্টর যখন রুহিকে ভালোভাবে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বললো; রুহি ‘মা’ হতে যাচ্ছে, তখনি এক রাশ কালো মেঘ রিফাতের মনে এসে ঘর বাধে। রিফাত নিজের কানকেই বিশ্বাস করাতে পারছিলো না, কী শুনতেছে সে? রুহি মা হচ্ছে কথাটা শুনে রুহির চোখ দুটো ভিজে যায় খুশিতে। কিন্তু খুশিটা স্থায়ী থাকেনি বেশিক্ষণ। রিফাতের দিকে তাকাতেই রিফাতের মন খারাপ আর চেহারায় কিছুটা হলেও রাগ দেখে রুহির খুশি নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। রুহি বুঝতে পারছে কেন রিফাত এমন করছে।
রিফাতের মন খারাপ দেখে ডক্টর তেমন অবাক হয় নি। ডক্টর বললো; আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে আপনারা নতুন দাম্পত্য জীবন শুরু করেছেন। মন খারাপ করবেন না, প্রথম সন্তান দুনিয়াতে আসতে দেন।
দেখবেন আপনাদের ভালোবাসা আরো বেশি পূর্ণতা পাবে।
ডক্টর হাসি মুখে কথাটা বলেন। রিফাত ডক্টরের সামনে তখন একটু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছিলো। রুহি একটু ভয় পাচ্ছে সামনে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে!
রিফাত আর রুহি টেক্সিতে বসে আছে। একটু আগেও রিফাত রুহিকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছিল, এখন সেই রিফাতই রুহিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রিফাতের ভিতর ফেটে যাচ্ছে কষ্টে৷ আবারো কেউ তাকে ধোকা দিলো। রুহি একটু পর পর রিফাতের দিকে তাকাচ্ছে।
রিফাতের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। রিফাতের চোখে পানি দেখে রুহিরও কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু রিফাত এর চোখের পানি মুছে দেওয়ার মতো সাহস পাচ্ছেনা রুহি। রুহিরও মন খারাপ, সে মা হতে যাচ্ছে, আর রিফাত বাবা৷ খুব খুশি হওয়ার কথা ছিলো দুজনের। কিন্তু মধ্যে যে একটা মর্চে পড়া দেওয়াল গড়ে রাখা হয়েছে মিথ্যে ইট দিয়ে।
রুহি মুচকি হাসলো, কারণ রুহি আর আরো একজনের ভাবনা সত্য হয়েছে। এখন শুধু রিফাতের ভুল ধারণাটা ভাঙতে হবে৷ তবে এখন না, রিফাত একটু স্বাভাবিক হোক তারপর। এখন কথা বলতে গেলেই খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। রুহি এটাও জানে! বাসায় যাওয়ার পর হয়তো খারাপ কিছুই হবে তার সাথে। তবে সে একটুও মন খারাপ করবে না। কারণ সময় এসেছে যে রিফাতের সামনে সত্যটা তুলে ধরার।
রিফাত গাড়ি থেকে নেমেই বাসায় ঢুকে যায়৷ রিফাতের এমন কাণ্ড দেখে রুহি মুচকি হাসলো। কোথায় তাকে যত্ন করে ধরে নিয়ে যাবে বাসার ভিতরে। তা না করে অভিমান করা হচ্ছে।
রুহি টেক্সির ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকে। ঢোকার আগে নিজেকে বুঝালো রুহি, বাসার ভিতরে তার সাথে যা কিছুই হোক না কেন, সে যেন ভেঙে না পরে। ভেঙে পরলে যে সত্যটা অজানা থেকে যাবে সবার।
রুহি বাসায় ঢুকে দেখে রিফাত সোফায় বসে আছে, পাশেই সিয়াম বসা। সিয়াম হয়তো ভাবছিলো তার জন্য খাবার বা কিছু আনবে, কিন্তু রিফাত বা রুহি কেউ কিছুই আনেনি।
রুহি গিয়ে সিয়ামে পাশে বসে, রুহির মা বাবাও আসেন।
রুহির মা যখন জানতে চান রুহির বমি হওয়া সম্পর্কে ডক্টর কী বলেছে? তখন রিফাত আর রুহি দুজনই চুপ থাকে। ওদের চুপ থাকতে দেখে রুহির মা বাবা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন। কিন্তু রুহি বা রিফাত কেউই কথা বলেনি।
ওদের চুপ থাকা দেখে রুহির মা-বাবার ভিতর ভয় ঢুকে যায়। ওরা ভাবেন হয়তো কোনো বড় সমস্যা হয়েছে, তাই দুজনের মন খারাপ আর এভাবে চুপ হয়ে আছে। রুহির মা তো কান্না করে দিবেন এমন অবস্থা।
কী বলেছে ডক্টর সেটা কী তোমরা কেউ বলবে আমাদের? নাকি এভাবেই চুপ থাকবে?
এবার মাজহারুল একটু রেগেই বললেন কথা গুলো।
রুহি তার বাবার রাগ দেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো; “ডক্টর বলেছে আমি মা হতে চলছি”
রুহি হয়তো ভেবেছিলো রুহির মুখে কথাটা শুনে খুব খুশি হবেন ওরা। কিন্তু রুহির মা বাবাও চুপ হয়ে যান রুহির কথা শুনে। এবার রুহির ভিতর ভয় ঢুকলো। তবে ভয়টা অন্য কারণে না, ভয়টা হলো এই তিনজনকে কীভাবে সে বুঝাবে?
রিফাত এবার মুখ খুললো। তবে রিফাতের মুখে ভালো কোনো কথা আসে নি। রিফাতের কণ্ঠে এসেছে রুহির জন্য খুব খারাপ একটা প্রশ্ন। যে প্রশ্নটা কখনো একটা নব মায়ের জন্য ভালো না।
এই বাচ্চাটা কার?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে রুহি অবাক হয়ে তাকায় রিফাতের দিকে। রুহি চুপ থাকেনি, সাথে সাথেই রুহি বলে উঠে।
বাচ্চাটা কার হবে আবার? বাচ্চা তোমার, এই বাচ্চার বাবা তুমি।
কথাটা হজম হয় নি রিফাতের। রিফাত বসা থেকে উঠে গিয়ে খুব জোরেই থাপ্পড় বসিয়ে দেয় রুহির গালে। রুহির মা বাবা মাথা নিচু করে নেন, ওরা কখনো ভাবেন নি রুহি এমন খারাপ কাজ করবে।
রুহি থাপ্পড় খেয়ে মুচকি হেসে বললো।
আমি জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না? আর আমি বিয়ের পূর্বেই এমন দিনের জন্য তৈরি ছিলাম। আ,,
রুহিকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই রিফাত বললো।
মানুষ একবার ধাক্কা খেলে অন্যবার যেন ধাক্কা না খায় সেই পথেই চলে। কিন্তু আমি একবার ধাক্কা খেয়েও আবার সেই একি পথেই চলেছি। ভাবছিলাম হয়তো একটু সুখ পাবো। কিন্তু তুমিও আমায় ধোকা দিলে। আমার সব জেনে আমায় বিয়ে করেছিলে৷ তাহলে কেন বাচ্চা নেওয়ার জন্য অন্য পু,,
রুহি আর রিফাতকে কোনো কথা বলতে দেয় নি। তার আগেই রুহি নিজের হাত দিয়ে রিফাতের মুখ চেপে ধরে। আর বলে; “আমাকে মেরে ফেলো তবুও আমার চরিত্রে আঙুল তুলবে না, আমি সহ্য করতে পারবো না” রুহির কান্না দেখে রিফাত চুপ হয়ে যায়। রুহি আবারো বলে;
তোমরা নীরব হয়ে আমার কথাটা শুনো, তোমাদের ভুল ধারণা ভেঙে দিবো যদি তোমরা কথাটা শুনো?
রুহির কথার উত্তরে রিফায় কিছু বলতে চাইলে মাজহারুল বললেন।
রিফাত বাবা শুনোনা মেয়েটার কথা, যদি আমার মেয়ে দোষী হয়, তাহলে আমি নিজের হাতে বিচার করব।
মাজহারুলের বিশ্বাস নিজের মেয়ে কখনো এমন খারাপ কাজ করবে না। এতো বছর ধরে নিজের মেয়েকে দেখে আসছেন।
রুহি বললো; রিফাত প্লিজ নিজের মনকে স্থির রেখে আমার সাথে এক জায়গায় যাবে?
রিফাত কোনো কথা বললো না, চুপ থাকলো। রুহি আবারো বললো; বাবা বলো না রিফাতকে আমার সাথে আসতে? নইলে সত্যটা যে জানতে পারবে না?
রুহির কথা শুনে রিফাতকে অনেক বুঝিয়েই রুহির সাথে পাঠান মাজহারুল। মাজহারুল বিশ্বাস করেন খারাপ কিছু হবেনা নিশ্চয়।
রিফাত আর রুহি গাড়িতে বসে আছে। রুহি রিফাতকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। সেটা রিফাতের অজানা৷ রিফাত মন খারাপ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি রিফাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো।
সত্যটা জানার পর কিন্তু এই গালে অনেক গুলো চুমু এঁকে দিবে৷ আর বেবি হবার পর বেবির সব কাজ তুমিই করবে এটা তোমার আজকের কাজের শাস্তি।
রুহির কথা শুনে রিফাত রুহির দিকে তাকায়। তারপর আবার বাহিরের দিকে নিজের দৃষ্টি নেয়।
রুহি রিফাতকে চুপ থাকতে দেখে আবারো বলে। মিথ্যে অভিমান ভালো না, সত্যটা জানার পর আমিও অভিমান করবো দেখবা তুমি!
রিফাতের এবারো কোনো পক্রিয়া দেখালো না। রুহি এবার নিজের ফোন বের করে কাউকে কল দিলো।
ওপাশ থেকে ফোনটা ধরতেই রুহি বললো; “ওই শুন! ভালো দেখে অনেক মিষ্টি কিনে এনে তোর কাছে রাখ? আমি আর তোর ভাইয়া আসছি। ভালো মিষ্টি এনে রাখবি কিন্তু?” রুহি কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দেয়। রিফাত এসবের কিছুই বুঝতেছে না। হচ্ছেটা কী? রুহিকে এতো খুশী লাগেছেবা কেন?
রিফাত মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করছে।
রুহি এবার জোর করেই রিফাতে কাঁধে মাথা রাখে। রিফাত কিছু বলতে গিয়েও বললো না।
গাড়িটা একটা হসপিটাল এর সামনে থামে। রিফাতকে নিয়ে হসপিটালের ৪ নাম্বার তলায় যায়। রিফাত হসপিটাল দেখে একটু অবাক হয়। আবার হসপিটাল কেন?
চার তলায় গিয়ে একজন ডক্টরের রুমে ঢুকে রুহি আর রিফাত। রুহিকে দেখে একটা মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। রুহি আর রিফাতকে বসতে বলে। সামনেই ডক্টরের পোষাক পড়া একজন পুরুষ। আর মেয়েটার পড়নে নার্সের ড্রেস।
মেয়েটি বললো;
মিষ্টি এনে রেখেছি, বল কোনো খুশীর খবর নাকি?
হুম রে, সবই তো জানিস তুই আর তোর বর! এবার সব প্রমাণ করে আমার উনার মুখে হাসি ফুটাতে হবে।
রিফাতের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল রুহি। রুহির কথা শুনে ওই মেয়েটি আর মেয়েটির স্বামী হেসে দেয়।
রিফাত বললো;
রুহি আমি কিছুই বুঝতেছিনা, এরাই বা কারা? কিছু বলবে আমায়? নাকি আমি চলে যাবো?
রিফাত একটু রেগেই বললো। রিফাতের কথা শুনে রুহি সহ তিনজনেই হো হো করে হেসে উঠে।
পর্ব ১৭
রুহি এবার হাসি থামিয়ে বললো;
এ হলো সূচী আমার বান্ধবী, আর ইনি হলেন সূচীর বর। আর সূচী এই হলো আমার বর রিফাত।
রিফাত কিছুই বুঝতেছে না। রুহি কী করতে চাচ্ছে এখানে! রিফাত যে রেগে আছে সেটা কী রুহি জানে না। রুহির এসব কার্যকলাপে রিফাতের রাগটা যে আরো দ্বিগুণ করে দিচ্ছে সেটা কী রুহি বুঝতে পারছে না।
আমাকে এখানে নিয়ে আসার মানে কী রুহি? তোমার এসব কার্যকলাপে কিন্তু একটু বেশিই রাগ হচ্ছে আমার?
রিফাত রুহির কানের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তেই কথাটা বললো। রিফাতের কথা শুনে রুহি বললো; “সত্য জানতে হলে একটু ধৈর্য ধরতে হয়, আর আমি ১০০% বিশ্বাস করি সত্যটা জেনে তুমিও খুব খুশি হবে!” রুহি কথাটা বলে সূচীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। রিফাত এখনো রুহির কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না।
কী চলছে রুহির মনে, রিফাত যে রুহির উপর রাগ করে আছে, এর জন্য একটুও মন খারাপ এর চিহ্ন দেখতে পারছেনা রুহির চেহারায় রিফাত। তাহলে কী রিফাত কোনো বড় সত্যের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে?
ভাইয়া আপনি তো সব জানেন! সূচী আর আপনার কারণেই আজ আমি রিফাতকে আপন করে পেয়েছি। আপনারা যদি আমায় সাহস না দিতেন তাহলে হয়তো আমি রিফাতকে আমার ভালোবাসার কথা কখনো বলতে পারতাম না।
আর আমি রিফাতের জীবনে না আসলে হয়তো রিফাত কখনো সত্য কথা জানতে পারতো না, আজ যে সত্য কথা গুলো রিফাত জানবে।
রুহির দু’চোখে পানি এসে জমেছে। রুহির কথায় সূচী আর সূচীর বর মুচকি হাসলো। রিফাত নীরবে সব শুনেই যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে। রিফাতের মাথা ব্যথা শুরু হয়, আর চিন্তা করতে পারছেনা রিফাত।
রিফাত কিছু বলতে গেলে সূচীর বর বললো;
আপনি আমার সাথে আসেন, আজকে সময় এসেছে সত্য কথা জানার!
রিফাত কিছু বলতে গেলে রুহি চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে উনার সাথে যাওয়ার জন্য।
রিফাতও আর কিছু বললো না, সেও দেখতে চায় কী সত্য কথা প্রকাশ পায় আজ। যে সত্য কথা শুনলে খুশী হবে সে।
সূচীর বরের সঙে গেলো রিফাত। সূচীর বর রিফাতকে পরীক্ষা করছেন। এর আগেও বাংলাদেশে এই পরীক্ষা করেছিলো ডক্টর। এই পরীক্ষাই তার জীবনে দুঃখ সৃষ্টির কারণ। এই পরীক্ষা করেই তো রিফাত জানতে পেরেছিলো সে বাবা হতে পারবে না।
এই পরীক্ষার কারণেই সুমা তাকে ছেড়ে গেছে, রিফাত হারিয়েছে নিজের পরিবারকে, নিজের জন্মভূমিকে। মুহূর্তেই চোখ ভিজে যায় রিফাতের। রিফাতের চোখে পানি দেখে সূচীর বর বললো; আরে আপনি কান্না করছেন কেন? আজকে তো আপনার মুখে হাসি ফুটে উঠবে। আপনি সত্যটা জানার পর আপনি এতোটাই খুশি হবেন যে, যতোটা খুশি হলে একটা মানুষ কান্নায় ভেঙে পরে।
সূচীর বরের কথা রিফাত বুঝতে পারেনি। চুপ থাকলো রিফাত। রুহির কথা আর সূচীর বরের কথা খুব ভাবাচ্ছে তাকে, কী এমন সত্য? এই অল্প সময়েই রিফাত হাজারবার ভেবেছে, কী এমন সত্য যা সে আজ জানবে!
৩০ মিনিট পর আবার রুহির কাছে যায় রিফাত। রুহি আর সূচী গল্প করছিলো। রিফাতকে দেখে মুচকি হাসে রুহি।
সূচীর বর বললো; একটু সময় অপেক্ষা করো তোমরা, রিপোর্ট এসে যাবে। হাসি ফুটে উঠবে দুজনের মুখে।
রিফাত এবার বুঝতে পারছে রুহি কেন এখানে নিয়ে এসেছে তাকে। রিফাত তো জানেই তার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নাই। রুহির নিশ্চয় আর কারো সাথে সম্পর্ক আছে। আর বাচ্চাটা তারই, তাহলে রুহি কেন এসব করতেছে?
রুহি কী প্রমাণ করাতে চায় এসব করে? তারপরেও রিফাত চুপ থাকে, রিপোর্ট আসার পরেই রুহির সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটাবে। তাকে যে ঠকায় তার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখার প্রশ্নই আসে না। রুহি আর সূচী গল্প করছে, আর রিফাত এক পাশে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
রুহি কিছুক্ষণ পর পর রিফাতের দিকে তাকাচ্ছে, এই মেঘে ঢাকা আকাশে একটু পরেই সূর্যের দেখা পাবে সে। রিফাতকে যখন হাসতে দেখবে রুহি তখন পৃথিবীর সব সুখ এসে জমা হবে রুহির কাছে।
রুহি সেই সময়টার অপেক্ষায় আছে, কখন রিপোর্ট আসবে, আর কখন রিফাতের মুখে হাসি দেখবে। রিফাত সত্যটা জেনে কী করবে, সেটা ভেবেই রুহির ভিতর খুশিতে আত্মহারা।
রিফাত চোখ বন্ধ করে শুধু ভাবছে৷ আবারো কেউ তাকে ঠকালো।
বেশ কিছুক্ষণ পর সূচীর বর রিপোর্ট হাতে রুমে ঢুকে। রিফাত তখনো চোখ বন্ধ করে ছিলো। সূচীর বরের কণ্ঠ শুনে রিফাত চোখ খুলে। সূচীর বর একটা চেয়ার টেনে রিফাতের সামনে বসে।
রুহি আর সূচীও এসে ওদের কাছে এসে দাঁড়ায়। রুহি তো জানেই রিপোর্ট কী আসবে। কারণ তার পেটে যে রিফাতের ফল রয়েছে। শুধু রিফাতকে প্রমাণ করার সময় এখন।
সূচীর বর রিপোর্টটা রিফাতের হাতে দেয়। রিফাত রিপোর্টটা দেখে শুধু এটাই বলল; “সত্যি”
সূচীর বর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝাল।
রিফাত বসা থেকে উঠেই রুহিকে জড়িয়ে ধরে রুহির কপালে অনেক গুলো চুমু খায়। সূচী আর সূচীর বর এসব দেখে হাসছে। রুহির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, সুখের পানি।
রিফাত রুহিকে ছেড়ে দিয়ে বললো;
সত্যিই কী এই রিপোর্ট সত্যি?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে রুহি বললো; হ্যাঁ! এই রিপোর্ট সত্যি। আমি এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিলাম, তোমায় আমি প্রথম দেখার পর আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলি।
তোমার অতীত শুনে সত্যিই আমার মনে খটকা লেগেছিলো। তাইতো আজ সত্যটা সামনে আসলো, বলছিলাম না আমি! তুমি সব শুনে খুব খুশী হবে।
রুহি খুব হেসে কথাটা বলে।
তাহলে বাংলাদেশে? রিফাত খুব চিন্তিত হয়ে প্রশ্নটা করে।
রিফাতের প্রশ্ন শুনে সূচীর বর বললো;
রুহি যখন সূচীকে সব বলে৷ তখন সূচী আমার সাথে সব শেয়ার করে। যখন সূচী আমায় বললো, আপনার রিপোর্ট একদিন পর আপনার কাছে দেওয়া হয়, তখন আমার মনে সন্দেহ ঢুকে।
তাই সূচীকে বলি, তুমি তোমার বান্ধবীকে বলো সে যাকে ভালোবাসে, তাকেই যেন বিয়ে করে। কারণ তার ভালোবাসার মানুষটির মধ্যে নিশ্চয় কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।
সূচীর বর কথা গুলো বলে থামে। রিফাতের এতোটা খুশী লাগছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। রিফাত এতোটাই খুশী যে তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা আসছেই না।
সূচীর বর আবার বললো;
“আপনার কর্তব্য ছিলো, আবার ভালো ডক্টর দেখানো!” কারণ এইটা আপনার সম্মান আপনার লাইফের এক কথায় আপনার সব কিছু ডিফেন্স করছিলো আপনার ওই রিপোর্টের উপরে। আপনি বোকামি করে প্রথম রিপোর্টকেই সত্য ভাবলেন। নিশ্চয় আপনার এমন কোনো শত্রু আছে, যার ইশারায় এসব হয়েছে।
সূচীর বরের কথা শুনে রিফাত ভাবে, সত্যিই তো তার ভাবনায় কখনো এমন আসেনি। এমন একটা রিপোর্ট সে প্রথমবারই বিশ্বাস করে নিলো। যেই রিপোর্টের সাথে তার জীবনের সব অংশই গেঁথে ছিলো। কতোই না বোকা ছিলো সে।
সত্যিই রুহি তার জীবনে না আসলে এসব সত্য কথা গুলো কখনো জানতো না সে। তার কে এমন শত্রু। কে তার সাথে এমন করতে পারে। তার অজান্তেই কে তার এতো বড় শত্রু? কে এতো বড় খেলা খেললো তার সাথে? কোনো ভাবেই রিফাত খুঁজে পাচ্ছে না কে হতে পারে তার শত্রু?
রিফাত এটাও ভাবে, যখন কোনো মানুষের উপর অপবাদ তোলা হয়, তখন কি আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে। তখন কী মাথায় থাকে এসব, এসব মিথ্যে, আমি সত্যতা প্রমাণ করবো। তখনতো মাথায় শুধু একটা কথাই থাকে।
কীভাবে এই মিথ্যে অপবাদ থেকে বাঁচবে। যার উপর অপবাদ তোলা হয়, সেই মানুষটি বুঝতে পারে। জীবনটা কেমন! রিফাত এসব ভেবে খুব করে নিশ্বাস নিলো। যেই নিশ্বাসে আছে শুধু তার বোকামি আর প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট।
রিফাতের কিছু একটা মনে হতেই বলে উঠলো।
তাহলে আমার আর সুমার বাচ্চা হচ্ছিলো না কেন? তাহলে কী সুমার মা হওয়ার ক্ষমতা নাই?
রিফাতের মুখে সুমার নাম শুনে রুহির একটু মন খারাপ হয়। সূচীর বর বললো; “হতে পারে আপনার প্রথম স্ত্রীর মা হওয়ার ক্ষমতা নাই, আপনার প্রথম স্ত্রী হয়তো এখনো জানেনা সে মা হতে পারবে না নয়তো সেই এসব করেছে যাতে আপনি থাকে ভুলে যেতে পারেন। আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করার ফলে।
সূচীর বরের কথা শুনে রিফাত ভাবে সত্যিই কী তাই? সুমা কী এসব এই জন্যই করেছে, কারণ সুমার এসব মা না হওয়ায় রিফাতের কিছু যায় আসতো না।
সুমাকে ভালোবাসতো, সুমাকে ভালোবেসেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো৷ এটা সুমা জানে, তাই হয়তো?
নাকি অন্য কেউ আছে এর পিছনে? থাকলে কে সেই মানুষ? একটা সত্য যখন জেনেছি তখন সব সত্য আমায় জানতে হবে।
রিফাত এসব ভেবে রুহির দিকে অপরাধীর মতো তাকিয়ে থাকলো। রিফাত রুহির দিকে তাকাতেই রুহি একটা মিষ্টি রিফাতের সামনে ধরে। রিফাতও খেয়ে নেয়।
সূচী আর সূচীর বরের সঙ্গে অনেক্ষণ আড্ডা দেয়। সূচী আর সূচীর বর কিছুটা সময়ের জন্য ছুটি নিয়েছিলো যখন রুহি ফোন দিয়েছিলো তখন।
রিফাতের ভুল ধারণা ভেঙেছে এটাই সব৷
রিফাত আর রুহি বাসায় আসে। রুহি এসেই রুমে চলে যায়। আর রিফাত হাসি মুখেই ড্রয়িং রুমে হাতে অনেক ধরণের মিষ্টি নিয়ে যায়। রিফাতের মুখে হাসি দেখে কিছুটা শান্তি পান রুহির মা বাবা। রিফাত মিষ্টি বের করেই বললো;
আম্মু আব্বু এই নাও মিষ্টি খাও, আমি বাবা হতে যাচ্ছি।
কথাটা শুনে রুহির মা বাবার মুখে হাসি ফুটে উঠে। রুহির মা বাবা আর কিছু জানতে চাননি। নিজের মেয়ের উপর তাদের যে সন্দেহ ছিলো তা দূর হলো। রিফাতকে এতো খুশি এর আগে কখনো দেখেন নি।
রিফাত রুমে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে নেয়। আর রুহিকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করে। রুহি রিফাতকে ছাড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে। রিফাত বুঝতে পারছে রুহি অভিমান করেছে। তাই রিফাতও রুহির অভিমান ভাঙানোর জন্য রুহিকে আবারো জড়িয়ে ধরে। আর আদুরী গলায় বলে ; আচ্ছা তুমিই বলো, আমি কী তোমার উপর খারাপ চিন্তা করে কী কোনো ভুল করেছি? আমার উপর যে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয়েছিলো। তাহলে আমার কী করার ছিলো বলো?
রিফাতের কথা শুনে রুহি বললো; “উম আমি এমন দিনের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম, আমি জানতাম আমার জীবনে এমন দিন আসবে।”
তাহলে এখন অভিমান করছো কেন? রিফাত মন খারাপ করে বললো কথাটা।
বরের কাছ থেকে আদর পাওয়ার জন্য।
কথাটা বলেই রুহি হি হি করে হেসে দেয়। রিফাতও আর কিছু না বলে রুহির কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
রিফাত বাবা হতে চলছে কথাটা শুনে নীলিমা খুব অবাক হয়, আর অনেক খুশী হয়। মনে হচ্ছে রিফাতের চেয়ে নীলিমাই বেশি খুশি হয়েছে। নীলিমা রিফাতকে বলে৷
দেখেছিস রিফাত সত্যের জয় হয়। তোর জীবনের না জানা সত্য গুলো তুই জানবি আস্তে আস্তে।
নীলিমার মন খারাপ হয় সুমার জন্য, নিশ্চয় সুমা মা হতে পারবে না।
তাহলে কী সুমার বলা সেদিনের কথা গুলো সত্যি!
কিন্তু সুমা তো রিফাতকে ভালোবাসতো, তাহলে কেন ডিভোর্স দিবে?
এই একটা কারণেই সুমার উপর নীলিমা রেগে আছে। তাই রিফাতকেও এসব কথা বলতে পারছে না নীলিমা।
রুহির প্রেগন্যান্ট এর আজ ৩ মাস হলো। রিফাত রুহিকে অনেক যত্ন করে। রুহি ইচ্ছা করেই অসুখের অভিনয় করে। এতে রিফাত একটু বেশিই ভালোবাসা দেয়।
রুহি রিফাতের এতো এতো ভালোবাসা পেয়ে আরো বেশিই ভালোবাসার লোভ জেগেছে। তাই প্রতিদিন নানান বাহানায় এটা ওটা চায়৷ রিফাতও সব ইচ্ছা পূরণ করে রুহির।
রিফাত এখনো সুমার কথা ভাবে৷ সুমার প্রতি রিফাতের যে রাগ ছিলো সেটা রুহির প্রেগন্যান্ট এর খবর এর পরেই রাগটা হাওয়া হয়ে গেছে। সুমা এখন কেমন আছে খুব জানতে ইচ্ছে করে রিফাতের। কিন্তু কাউকে যে সে সুমার কথা বলতে পারবে না।
এসব খারাপ কাজের পিছনে কে বা কারা আছে সেটাও খতিয়ে দেখবে রিফাত। এতো কষ্ট পেয়েছে সে, কে দিয়েছে এতো কষ্ট তা তো নিশ্চয় দেখবে রিফাত। সে যতোই আপন হোক কখনো ক্ষমা করবে না। যেই অপবাদ তোলা হয়েছিলো তার উপর, সেই অপবাদের প্রমাণ হিসেবে রিফাত তার সন্তান আর রুহিকে নিয়ে বাংলাদেশে যাবে। সবাইকে প্রমাণ করে দিবে সে, তার বাবা হওয়ার ক্ষমতা আছে। তার উপর মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয়েছিলো।
পর্ব ১৮
রিফাত এখন একটু বেশিই সুমার কথা ভাবে। সত্যটা জানার পর রিফাতের খুব কষ্ট হচ্ছে। সুমা কী সুখে আছে? সুমার তো কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছে।
সুমার বর যদি সুমাকে ভালো না বাসে? রিফাত সত্যটা জানার পর ভুলে গেছে সুমার করা অপমানের কথা। হয়তো সুমা এসব রিফাতকে সুখে রাখার জন্য করেছে? রিফাতের খুব মনে পরছে সুমার কথা। কেমন আছে সুমা? একবারো কী তার কথা মনে পড়ে? যেভাবে এখন সে সুমাকে মন করে কাটাচ্ছে! নাকি নতুন বরের সাথে খুব সুখেই আছে?
রিফাত এসব প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাবে? কাউকে তো জিজ্ঞেসও করতে পারবে না।
রুহিও দেখে রিফাত কেমন জানি মন খারাপ করে থাকে। কিন্তু রিফাতকে প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে না রুহি। রিফাত তো রুহির যত্ন খুব ভালোভাবেই নিচ্ছে, রুহিও তো রিফাতের মন খারাপ হোক এমন কিছু করেনি। তাহলে কেন রিফাতের মন খারাপ? যদি রুহির কোনো কারণে রিফাতের মন খারাপ হতো, তাহলে নিশ্চয় রুহিকে এতো ভালোবেসে যত্ন নিতো না রিফাত।
তাই তো রিফাতের মন খারাপ করার কারণ জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছে রুহি।
রুহি ভাবে আজকে রাতে রিফাতকে জিজ্ঞেস করবে কেন তার মন খারাপ। রিফাত বলতে না চাইলেও, জোর করবে রুহি মন খারাপের কারণটা জানার জন্য।
এই দিকে রুহির ভাই সিয়াম কিছুক্ষণ পর পর রুহিকে জ্বালাচ্ছে। রুহির বেবি আসলে সিয়াম এটা করবে ওটা করবে। রুহিও মজা পায় সিয়ামের কথায়। রুহির মা বাবাও অনেক স্বপ্ন দেখে রাখতেছেন নিজের নাতি বা নাতিন এর জন্য।
রিফাতও কম পাগলামি করে না, বাচ্চা হলে কী কী করবে সব রুহিকে বলে৷ আর রুহি সব শুনে হেসে হেসে গড়াগড়ি খায়। রুহিও ভাবে নিজের বাচ্চার সেবা যত্ন কীভাবে নিবে। মেয়ে হলে তার মতো করে গড়বে। আর ছেলে হলে রিফাতের মতো। এখন শুধু অপেক্ষা, আল্লাহ যা দিবেন তাতেই খুশি থাকবে রুহি।
রুহি মাঝেমধ্যেই একা একা ভাবে। আজ যদি রিফাতের পাশে সে না থাকতো, তাহলে হয়তো রিফাত কখনো এসব জানতোই না। রিফাত সারাজীবন ওই মিথ্যে রিপোর্ট দিয়েই কাটিয়ে দিতো। কখনো হয়তো সত্যটা জানতে কোনো ভাবেই ইচ্ছা প্রকাশ করতো না।
আর কোন কঠিন সত্য রিফাতের জন্য অপেক্ষা করছে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না! রুহি এসব ভাবতেই শরীরটা কেঁপে উঠলো, আল্লাহ্নযেন রিফাতকে ধৈর্য দেন। সব সত্য শুনে যেন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে।
রুহি এটাও জানে রিফাত রুহিকে এখনো সুমার মতো করে ভালোবাসে না। রুহি যতটুকু ভালোবাসা পাচ্ছে এতেই সন্তুষ্ট। রুহিকে রিফাত একটু কম ভালোবাসে বা বেশিই ভালোবাসুক এতে রুহির কোনো সমস্যা হচ্ছে না। রিফাতের যা ভালোবাসা পাচ্ছে তা সত্যিই পৃথিবীর চেয়ে দ্বিগুণ।
এভাবেই ভালোবাসলেই রুহি খুশি। নিজের ভালোবাসাকে আপন করে পেয়েছে এটাই সব চেয়ে বড় সুখ রুহির কাছে।
রাতের খাবার খেয়ে রিফাত প্লেটে ভাত আর তরকারি নিয়ে যায় রুহির জন্য। রিফাতের এমন পাগলামো দেখে রুহির বাবা মা মুচকি হাসেন, রুহিকে কোনো কাজ করতেই দিচ্ছেনা।
রুহি বিছানার উপর বসে আছে। রিফাত খাবার নিয়ে রুহির পাশে বসে। রুহির প্রেগন্যান্ট এর মাত্র ৩মাস হলো, এর মধ্যেই রুহির প্রতি এতো যত্ন রিফাতের।
হা করো? খাবার ভালো ভাবে মাখিয়ে রুহিকে কথাটা বললো রিফাত।
রুহিও হা করে, রিফাত এক লুকমা এক লুকমা করে রুহিকে খাইয়ে দিচ্ছে। রুহি অল্প খেয়েই বললো;
আমার বমি বমি পাচ্ছে, আমি আর খাবো না!
রুহির কথা শুনে রিফাত খুব রেগেই বললো; “মিথ্যা কথা বলবেনা তো, বমি বমি ভাব করছে করছে বলে প্রতিদিন খাবার নষ্ট করো। কিন্তু বমি তো করো না, আজকে সব খাবার শেষ করবে?”
রিফাতের রাগ দেখে রুহি আর খিছু বললো না, চুপচাপ করে খাবার খাচ্ছে৷ সব খাবার শেষ করেছে আজ রুহি। রিফাত মুচকি হেসে রুহির ঠোঁট কাপড় দিয়ে মুছে নিলো। আর প্লেট রেখে আসতে গেলো।
রিফাত সব কাজ শেষ করে রুমে আসলো। দরজা আটকিয়ে রুহিকে ঘুমাতে বললো। কিন্তু রুহি কী আর ঘুমাবে, সে তো আজ রিফাতের মন খারাপের কথা জানবে।
রুহিকে বসে থাকতে দেখে রিফাত বললো; কিছু লাগবে তোমার?
না,
তাহলে ঘুমাচ্ছো না যে? আমি তো লাইট অফ করে দিবো এখন।
একটু সময় গল্প করি না, প্রতিরাতই তো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি।
রুহির কথা শুনে, রিফাত আর লাইট অফ করলো না। বিছানায় বসে তার কোলে মাথা রাখতে বললো রুহিকে। রুহিও রিফাতের কথা মতো কাজ করলো।
রিফাত রুহির মাথায় হাত বোলাচ্ছে। আর রুহি ভাবছে প্রশ্নটা কীভাবে করবে। রুহি একটু সময় চুপ থেকে বললো।
একটা কথা বলি তোমায়?
হুম বলো,
বেশ কিছুদিন ধরেই দেখতে পাচ্ছি তোমার মন খারাপ, কেন মন খারাপ তোমার? আমাকে বলবে প্লিজ? তোমায় মন খারাপ আমার দেখতে ভালো লাগেনা। আমি কী কিছু করেছি, যার জন্য তোমার মন খারাপ?
রুহির কথা শুনে রিফাত একটু ভাবতে লাগলো, রুহিকে কী সত্যটা বলবে, কেন তার মন খারাপ।
রুহি শুনলে তো মন খারাপ করবে।
রিফাতকে নীরব থাকতে দেখে রুহি রিফাতের কোল থেকে নিজের মাথা উঠাতে উঠাতে বললো;
চুপ হয়ে রইলে যে? আমি তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেছি?
রিফাত রুহির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো; সুমার কথা খুব মনে পরছে, তাই একটু মনটা খারাপ। মা আর মাহির কথাও মনে পরছে, সব মিলিয়ে মনটা একটু বেশিই খারাপ।
রুহি শুধু ওওওও বললো। সুমার কথা কেন মনে পরবে রিফাতের, তাই রুহিও একটু মন খারাপ করলো। যতোই হোক সুমা এখন রিফাতের কাছে পরনারী, তাই রুহির মন খারাপ করার কারণটাও ভুল কিছু না।
রুহির হাসি মুখটা মলিন দেখে রিফাত বুঝতে পারে, সুমার কথা শুনেই হয়তো রুহির মন খারাপ। রিফাতই বা কী করবে, সুমাকে তো ভুলেই যাচ্ছিলো। সুমার প্রতি খুব ঘৃণা জন্মেছিলো। কিন্তু সত্যটা জেনে কীভাবে সুমাকে দোষ দিবে রিফাত।
রুহি কিছুক্ষণ রিফাতের দিকে তাকিয়ে বললো;
ঘুমাবে না তুমি?
তুমি না বললে একটু সময় গল্প করবে, তাহলে এখন ঘুমাতে চাচ্ছো যে?
রিফাতের প্রশ্নটা শুনে রুহি খুব মন খারাপ করে বললো।
আমি হয়তো তোমার দ্বিতীয় ভালোবাসা, কিন্তু তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। মেয়েরা নিজের ভালবাসার মানুষের মনে অন্য কোনো মেয়ে থাকুক তা কখনো চায় না রিফাত! বলতে পারো আমি খুব হিংসুটে৷ পৃথিবীর সব নারীই নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে রাখার দিক দিয়ে সব বস্তু ব্যক্তির কাছেই হিংসুটে। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়।
রুহি কথা গুলো বলার সময় কান্না করে দেয়। রুহির চোখে পানি দেখে রিফাতেরও খুব কষ্ট হচ্ছে। রিফাত কিছু বলতে চাইলেই রুহি আবার বলে উঠে।
রিফাত আমায় একটা কথা দাও! আমি বেঁচে থাকতে কোনো পর নারীর জন্য মন খারাপ করে থেকো না? এবং কি তোমার প্রথম স্ত্রীর জন্যেও মন খারাপ করে থাকবে না। কারণ তোমার প্রথম স্ত্রী কিন্তু এখন তোমার কাছে পরনারী।
আমার মৃত্যুর পর না হয় অন্য কোনো নারীর জন্য মন খারাপ করবে?
রুহি কথাটা বলে শব্দ করে কান্না করে দেয়।
রুহির এমন কথা শুনে রিফাত খুব চিৎকার করেই বললো।
রুহিইইই! পাগল হয়ে গেছো? কী বলছো এসব?
রিফাতও কান্না করে দেয়। রুহিকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিফাত৷ আর বলে।
মৃত্যুর কথাটা বলবার আগে একবারো ভাবলে না তোমার সামনে তোমার ভালোবাসার মানুষ বসে আছে?
তুমিও তো পর নারীর কথা মনে করার আগে একবারো ভাবোনি কেউ তোমায় খুব ভালোবাসে?
রুহির কথা শুনে রিফাত নিজেকে খুব তিক্ত মানুষ ভাবলো। এতো ভালো স্ত্রী থাকতেও কেন সে অন্য নারীর কথা ভাবলো।
বলো আর কখনো কোনো পর নারীর কথা ভেবে মন খারাপ করবে না? আমি সহ্য করতে পারবো না।
হুম কথা দিলাম আর কখনো মন খারাপ করবো না, আর তুমি ছাড়া অন্য নারীর কথাও ভাববো না।
কথাটা বলে রিফাত রুহির কপালে একটা চুমু দেয়। রুহি আবারো রিফাতের বুকে মাথা রাখে। রিফাত রুহির মাথায় হাত বোলিয়ে দিচ্ছে। রুহির চোখ থেকে এখনো টপটপ করে পানি পরছে রিফাতের বুকে।
রুহির প্রেগন্যান্ট এর আজ ১০ মাস পূর্ণ হলো। কাল রাতেই রুহিকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ রাতে রুহির অবস্থা একটু বেশিই খারাপ ছিলো। রুহিকে রিফাত খুব কষ্ট করে সামান্য খাবার খাইয়ে ছিলো। রিফাত খাবারটা খাইয়ে রুহির ঠোঁট মুছতে পারেনি তার আগেই রুহি একটা চিৎকার দিয়েই বিছানায় পড়ে যায় আর সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়।
রুহির চিৎকার শুনে রুহির মা বাবা পাগলের মতো ছুটে আসেন। তারপরে রাতেই রুহিকে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়। রাত তিনটার দিকে রুহির জ্ঞান ফিরে। ডক্টর বললো রুহি ব্যথা সহ্য করতে পারেনি তাই সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যায়।
রুহির জ্ঞান ফিরার পর রুহিকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়।
রিফাত একটাবারের জন্যেও রুহির পাশ থেকে অন্য কোথাও যায় নি। রিফাত রুহির এমন অবস্থা দেখে কান্না করে করে চোখ দুটো লাল করে ফেলছে। রুহির মা বাবা রিফাতকে কোনো ভাবেই বুঝাতে পারেন নি বা কান্নাও থামাতে পারেননি।
সকাল ৯টার দিকে রুহির ঘুম ভাঙে। রিফাতকে নিজের পাশে চেয়ারে বসা আবিষ্কার করে রুহি। রিফাত রুহিকে চোখ খুলতে দেখেই ঝাপটে ধরে।
রিফাত ভুলেই গেছিলো রিফাত রুহিকে ধরলে রুহির কষ্ট হবে। রুহি রিফাতের ছোয়াঁ পেয়ে ব্যথা পেলেও চিৎকার করেনি। রিফাতের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝেছে রুহি কান্না করেছে খুব। এখনো কান্না করছে রিফাত৷ রিফাত রুহিকে ছেড়ে রুহির কপালে অনেক গুলো চুমু এঁকে দেয়।
কান্না করেছিলে? রুহির প্রশ্ন শুনে রিফাত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রুহি কথাটা বলে হিহিহি করে হেসে দেয়। রিফাত রুহির হাসির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
রুহির দিকে তাকিয়ে রিফাতের একটা কথা মনে পরে যায়। যেই কথা রিফাতের মা বলেছিলেন।
জানিস রিফাত! তুই যেদিন এই পৃথিবীতে এসেছিলি। তার দুইদিন আগেই তোর আব্বু খুব কেঁদেছিলো। সারাক্ষণ আমার পাশে বসেছিলো। আর বলছিলো; জানো নাফিজা? তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, চুল গুলো এলোমেলো, শরীরটা গোল হয়েছে, এরকম আরো অনেক কথা। তারপর তুই যখন হয়েছিস, তখন নাকি আমায় খুব সুন্দর দেখিয়েছিলো।
তোর বাবা বলছিলো; তার জীবনে সব চেয়ে সুন্দরী রমণী লেগেছিলো আমায়। আমার সৌন্দর্য নাকি তোর জন্মের কিছুক্ষণ পরেই বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো৷ তোর বাবা নাকি আমার চেহারা থেকে তার চোখজোড়া সরাতে পারছিলো না।
কথাটা বলে তখন নাফিজা একটু সময় থামেন আর আবার একটু বেশি করেই হেসে বলেন।
আমি যখন তোকে কোলে নিয়ে বাসায় আসলাম, তখন আমার এক বান্ধবী আসে আমায় দেখতে। তখন বান্ধবীটা হেসে হেসে আমায় বলেছিলো; “নাফিজা তোকে হসপিটালে পেত্নীর মতো লেগেছিলো” কথাটার মানে ছিলো তুই আমার কোলে আসার দুই তিন দিন আগ থেকেই আমার রূপে মর্চা পরে গিয়েছিলো, আর তোর জন্মের পর আমার চেহারা আরো নষ্ট হয়ে গেছিলো।
কিন্তু তোর বাবার বর্ণনায় আমি ছিলাম তখন পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দরী রমণী।
নাফিজা হো হো করে হাসলেন কথা গুলো বলে।
রিফাত তখন কথা গুলো খুব মন দিয়ে শুনেছিলো।
রিফাত কথা গুলো ভাবছে আর রুহির দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে, সত্যিই তার বাবার বলা কথাগুলো ঠিক, রুহিকে আজ সব চেয়ে বেশি সুন্দরী লাগছে। এর আগে কখনো রুহিকে এতো সুন্দর লাগেনি। রিফাতকে এতক্ষণ ধরে নীরব থাকতে দেখে রুহি বললো;
এমন করে কী দেখছো?
তোমাকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। কথাটা বলেই রুহির কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। রিফাত এখন শুধু তার মায়ের বলা শেষের কথাটা দেখতে চায়। সন্তান প্রসবের পর রুহিকে কতটুকু সুন্দরী দেখায়। রুহিকে এখনই যেটুকু সুন্দর দেখাচ্ছে, না জানি তখন কতটুকু সুন্দর দেখাবে৷। নিশ্চয় তখন রিফাত রুহির সেই চেহারার প্রেমে হাজারবার পরবে। মিথ্যে হবে নিজের মায়ের বান্ধবীর বলা কথা গুলো।
রিফাতের এসব ভাবনা ভাঙে রুহির চিৎকারে। রুহির চিৎকার শুনে রিফাত রুহির দিকে তাকিয়ে দেখে রুহি ব্যথায় চিৎকার করছে আর এপাশ ওপাশ করেই যাচ্ছে। রিফাত চিৎকার করে ডক্টর ডক্টর বলে চিল্লাতে থাকে। রুহির মা বাবা আসেন রিফাতের জন্য নাশতা নিয়ে।
রিফাতের চিৎকার শুনে মাজহারুল দৌড়ে যান ডক্টরের কাছে। মাজহারুল ডক্টরকে নিয়ে আসেন। রুহি ব্যথায় চিৎকার করছে, আর সেই চিৎকারে রিফাতের ভিতর ফেটে যাচ্ছে।
ডক্টর এসে রুহিকে দেখে সাথে সাথে অন্য একটা কক্ষে নিয়ে যাবার কথা বলে। রুহিকে কক্ষে ঢোকাবার আগ পর্যন্ত রুহির হাত ধরেছিলো রিফাত। শেষবার রুহির কপালে চুমু দেয় রিফাত। রুহির মা বাবার চোখেও পানি। আল্লাহ আল্লাহ করছেন ওরা, আল্লাহ যেন রুহির হায়াত দেন।
সকাল ১১টার দিকে ডক্টর বের হন রুম থেকে, ৯টার পর রুহিকে রুমে নেওয়া হয়েছিলো। ডক্টর বের হবার আগেই কিছুটা কান্নার আওয়াজ আসছিলো রুম থেকে, কান্নাটা কোনো নব শিশুর ছিলো। ডক্টরকে বের হতে দেখেই রিফাত আর মাজহারুল দৌড়ে যান ডক্টরের কাছে। ওরা কিছু বলবার আগেই ডক্টর বললেন; “আপনার ছেলে সন্তান হয়েছে, মা এবং সন্তান দুজনেই ভালো আছে, আপনারা দেখা করতে পারেন এখন!”
কথাটা বলে ডক্টর চলে যায়। রিফাত আর রুহির মা বাবা তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকেন। সিয়ামকে অর্ণিদের বাসায় রেখে এসেছিলেন তাই সিয়াম এসব এখনো জানেনা।
রিফাত গিয়ে রুহির হাত ধরে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। রুমে ৩জন নার্স সহ রুহির মা বাবাও আছেন। মাজহারুল নিজের নাতিকে কোলে নিয়ে হাসিতে মেতে উঠেন। রিফাত এখনো রুহির হাত নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। রুহি রিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে, রুহির কথা বলার শক্তি নেই এখন।
রুহির মা রিফাতের কোলে তার বাচ্চাটিকে দেন।রিফাত নিজের ভালোবাসাকে কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে, একের পর এক চুমু দিয়েই যাচ্ছে নিজের ছেলেকে রিফাত। রুহি রিফাতের এমন দৃশ্য খুব মুগ্ধ হয়ে দেখছে।
মাজহারুল রুহির মাকে ইশারা করে বাহিরে আসতে বললেন, নার্সরাও চলে যায়।
রিফাত নিজের কলিজার টুকরাকে রুহির পাশে রাখে। আর রুহির এক হাত আবার রিফাত নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আর বলে।
সত্যিই রুহি আজ তোমাকে সব চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। এর পূর্বে কখনো এতো সৌন্দর্য তোমার মধ্যে আমি খুঁজে পাইনি। রিফাত কান্না করেই কথা গুলো বলে। রুহি বললো;
কান্না করছো কেন? দেখো আমি আর আমার ছেলে হাসতেছি।
সত্যিই মা ছেলে দুটোর মুখে হাসি লেগে আছে।
রিফাত হাজার চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছে না। রিফাত রুহির অপরূপ সৌন্দর্য্যের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি বললো;
যখন একটা মেয়েকে সব থেকে খারাপ লাগে দেখতে, তখনই সেই মেয়ের স্বামীর চোখে আল্লাহ এক অন্যরকম সৌন্দর্য এর সৃষ্টি করেন।
রুহি মুচকি হেসে কথাটা বলে নিজের সন্তানের মাথায় চুমু খেলো।
মানে? রিফাত কিছুই বুঝেনি।
মানেটা হলো, তুমি ছাড়া এখন সবার চোখে আমি পেত্নী। কারণ এখন আমার সৌন্দর্য মুছে গেছে। কিন্তু তোমার চোখে আজকে আমি সব চেয়ে বেশি সুন্দরী। কারণ একটু আগেও তোমার মনে ভয় ছিলো আমায় হারানোর। আর যখন আবার আমায় দেখলে তখন তোমার দেহে প্রাণটা ফিরে এসেছে, চোখে হাজার গুণ সুন্দর কিছু দেখার মতো কিছু আল্লাহ তোমায় দান করেছেন।
তাই আমায় তোমার কাছে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে।
রিফাত জানেনা রুহির কথা কী সত্যিই? কিন্তু রিফাতের চোখে সত্যিই রুহিকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। রিফাতের মায়ের কথাই সত্য।
রুহিকে দুইদিন পর বাসায় নিয়ে আসা হয়। অর্ণির বাবা সেদিনই দুপুরে সিয়াম সহ নিজের পরিবারকে নিয়ে জান রুহি আর রুহির সন্তানকে দেখার জন্য।
রিফাত রুহির পাশাপাশি নিজের ছেলেরও খুব যত্ন নিচ্ছে। রিফাত আর রুহি মিলে নিজের ছেলের নাম রাখে আয়ান আহমেদ।
রুহির বাবা মাও তাদের নামেই খুশি। সিয়াম নিজের ভাগ্নের উপর খুব রাগ। এই পর্যন্ত একবার মামা ডাকলো না তাকে। নীলিমার দুই মাস আগেই বিয়ে হয়েছে একজন কলেজের শিক্ষক এর সাথে। নীলিমা সহ নীলিমার বরও খুব খুশি রিফাতের ছেলে হওয়ায়।
রিফাত আয়ানের কথা নিজের পরিবারের কেউ জানেনা তাই একটু মন খারাপ। একদিন তো রুহি আর আয়ানকে নিয়ে বাংলাদেশে যাবেই। তখন না হয় সবাই দেখবে।
আয়ানের বয়স ১ বছর ১মাস হলো। খুব তাড়াতাড়িই আয়ানের এক বছর হয়ে গেলো। রিফাত আর রুহির ভালোবাসা আরো বেশি পূর্ণতা পেয়েছে।
রিফাত আর রুহি বাসে বসে আছে। আয়ানকে মায়ের কাছেই রেখে এসেছে ওরা। গন্তব্য কলকাতা শহরে যাবে। রিফাত যেতে চায়নি, রুহি জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। রুহির ফুফুর মেয়ে মানে রুহির ফুফাতো বোনের বিয়ে আজ। তাই সকালেই রুহি আর রিফাত কলকাতায় যাবার উদ্দেশ্যে বের হয়। রাতেই ফিরতে পারবে। আয়ানও কান্না করবেনা। তাই নিশ্চিত রুহি।
রিফাতের কাঁধে মাথা রেখে গল্প করছে রুহি।
হঠাৎ করে একটা শব্দ হয়। সাথে সাথেই সব অন্ধকার দেখে ওরা।
রিফাত আর রুহি যে বাসে ছিলো সেই বাসকে সামন থেকে অন্য একটা বাস এর ধাক্কা লাগে। আর আগুন ধরে যায় দুটো বাসে।
ফায়ার সার্ভিসের লোক আর স্থানীয় লোকেরা মিলে দুটো বাসের সবাইকে কাছের একটা বড় হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হচ্ছে।
এই হাসপাতালের ডক্টর হলো সূচীর বর আর নার্স সূচী।
কিছুক্ষণ পর পর এম্বুলেন্স এসে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মানুষকে দিয়ে যাচ্ছে।
সূচী সহ হাসপাতালের কর্মরত সবাই এদের সেবা দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সূচী দুজন কে দেখে চিৎকার করে উঠে। যদিও ওদের ভালোভাবে চিনা যাচ্ছেনা তবুও বুঝতে বাকি নেই এই দুটো রক্তাক্ত শরীর নিজে বান্ধবী আর বান্ধবীর বরের। সূচী একটু তাড়াতাড়ি করেই ওদের ইমার্জেন্সি রুমে নেওয়া হয়।
পর্ব ১৯
একটু আগেও একজন অন্যজনের কাঁধে মাথা রেখে নানান গল্পে মেতে উঠেছিলো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে দুজনেই এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
সূচীর হাত পা কাজ করছে না, এতো রক্তাক্ত মানুষ দেখে কারই-বা ভালো লাগবে? এই রক্তাক্তের ভীড়ে যদি আবার নিজের প্রিয় কেউ থাকে, তাহলে তো নিজেকে ঠিক রাখা ভীষণ কষ্টের।
রুহির অবস্থা একটু বেশিই খারাপ, রুহি আর রিফাত দুজনকেই আইসিইউতে ঢুকানো হয়, এই হাসপাতাল থেকে আরো অনেক কে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
এম্বুলেন্স এসে দুটো বাসে থাকা সর্ব শেষ মানুষকে দিয়ে গেলো, এর মধ্যে ৪জন মারা গেছে।
রিফাত আর রুহিকে যে হাসপাতালে রাখা হয়, সেই হাসপাতালের তিনজন মারা গেছে ইতি মধ্যেই, লাশের ছোটখাটো মিছিল এখানে। সূচী নিজেকে একটু সামলিয়ে রুহির বাবার কাছে ফোন দেয়। আর রুহি রিফাতের এক্সিডেন্ট এর কথা বলে। তবে এতো বড় এক্সিডেন্ট, সেটা সূচী বলেনি রুহির বাবাকে।
রুহির বাবা সূচীর মুখে নিজের মেয়ে আর মেয়ের জামাইর এক্সিডেন্ট এর কথা শুনে কিছুটা সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। মাজহারুল এর হাত পা কাঁপছে, কোনো বড় এক্সিডেন্ট না তো?
আয়ানকে কোলে করে নিয়ে আসেন রুহির মা। মাজহারুল কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুহির মা প্রশ্ন করলেন; কী হয়েছে তোমার? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
রুহির মা’য়ের প্রশ্ন শুনে মাজহারুল কোনো কথা বলছেন না। পাথর হয়ে গেছেন মাজহারুল। সূচীর কান্না করে কথা গুলো এখনো মাজহারুলের কানে ভাসছে। মাজহারুল আয়ানের দিকে তাকান। আয়ান এর মুখে হাসি ফুটে আছে, মাজহারুল এর কোলে আসার জন্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আয়ান।
এই দিকে মাজহারুল কোনোভাবেই নিজের চোখকে ঠিক রাখতে পারেন নি।
মাজহারুলের চোখে পানি দেখে রুহির মা এবার একটু রেগেই বললেন; “আমি তোমায় কিছু বলছি?” মাজহারুল কী বলবেন, রুহি এক্সিডেন্ট করেছে এই কথা শুনলে রুহির মা যে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন না। আবার না বলেও উপায় নেই।
‘সূচী ফোন দিয়েছিলো’ বললো রুহি আর রিফাত গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। এখন ওরা হাসপাতালে আছে।
কথাটা বলার সময় মাজহারুল এর কণ্ঠস্বর ভেঙে আসছিলো বারবার। মাজহারুল এর কথা শুনে রুহির মা চিৎকার করে বললেন; কিহ? আমার রুহি কেমন আছে? কীভাবে এক্সিডেন্ট হলো?
সামান্য সময়ের মধ্যেই রুহির মা কান্নায় ভেঙে পরলেন। মাজহারুল এখন নিজেকে ঠিক রাখবেন নাকি নিজের স্ত্রীকে? অনেক কষ্টে নিজেকে সামলান মাজহারুল, নিজের স্ত্রীকে সান্তনা দিচ্ছেন। তবুও রুহির মা কান্না করেই যাচ্ছেন। রুহির মা’য়ের কান্না শুনে অর্ণিদের বাসা থেকে অর্ণির মা ছুটে আসেন। সিয়াম রাস্তায় খেলা করছিলো, নিজের মা’য়ের কান্না শুনে সিয়ামও দৌড়ে আসে। নিজের বোনের এক্সিডেন্ট এর কথা শুনে সেও কান্নায় ভেঙে পরে।
মাজহারুল আর অর্ণির মা খুব কষ্টে সিয়াম আর মাকে কান্না থামাতে সফল হন। মাজহারুল গাড়ি আনেন। অর্ণির মা’ও তাদের সাথে হসপিটালে যাচ্ছে। গাড়িতেও কান্না করছে রুহির মা। নিজের মেয়েকে না দেখা পর্যন্ত স্বাভাবিক হবেন না তিনি।
এই দিকে হাসপাতালে লাশের মিছিল বেড়েই যাচ্ছে, অন্য হাসপাতালেও ইতিমধ্যে ২জন মারা গেছে। এই নিয়ে ১২জনের মৃত্যু হলো।
সূচী আর দুজন ডক্টর রুহির রুমে আছেন। রুহির সেন্স নাই। পা’য়ের দিক থেকে পেট পর্যন্ত রুহির ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, মুখটাতে কোনো ক্ষত না থাকলেও। মাথার পিছনে আঘাত পেয়েছে। ডক্টর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে রিফাতের অবস্থাও খুব ভয়াবহ। রিফাতের বা হাতের দুটি আঙুল কেটে ফেলছে ডক্টর। এতোটাই আঘাত পেয়েছে রিফাত হাতে৷ হাতের দুটো আঙুল ঝুলে ছিলো। বাঁচানো যাবে কিনা সেটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।
হাসপাতাল ভরে গেছে মানুষে। সবার পরিচিত মানুষরাই এসেছে। হাসপাতালের এক পাসে ফ্লোরে ১০জনের লাশ শুয়ে রাখা হয়েছে। মানুষ গুলো নিজেদের আত্মীয়দের খুঁজছে ওই লাশদের ভীড়ে। কেউ নিজের আপনজনদের জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছেন। হাসপাতাল এর ডক্টর থেকে এমন কোনো নার্স বাকি নেই যাদের কাপড়ে লাল রক্তে কাপড় নষ্ট হয়নি!
হাসপাতাল জুড়ে প্রিয় মানুষ হারানোর আর্তনাদ। প্রতিটা ডক্টর নার্স নিজেদের চোখের পানিও আটকে রাখতে পারছেন না। তাদের ভেঙে পরলে চলবে না। এখনো আরো মানুষ বেডে শুয়ে পাঞ্জা লড়ছে মৃত্যুর সাথে।
মাজহারুল নিজের স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই তাদের সামনে করে আরো একটা লাশ এনে রাখা হয় অন্য লাশ গুলোর ভীড়ে। মাজহারুল এমন দৃশ্য দেখে নিজেকে মানাতে পারছেন না। এটা কোনো ছোট এক্সিডেন্ট না। রুহির মায়ের কান্নার গতি আরো বেড়ে যায়। অর্ণির মা নিজের সাথে জড়িয়ে রাখেন রুহির মাকে। মাজহারুল এর মনকে সান্তনা দিতে না পেরে ছুটে যান ফ্লোরে থাকা লাশের ভীড়ে।
এক এক করে ১১টা লাশের মুখের কাপড় শরিয়ে দেখলেন। এর মধ্যে রুহি বা রিফাত নাই। মাজহারুল এর মন থেকে কিছুটা হলেও ভয় দূর হয়। তবে এই ১১টা লাশ দেখে মাজহারুল খুব ভয় পান। ছুটে যান আবার নিজের স্ত্রী সন্তানের কাছে। সান্তনা দিচ্ছেন নিজের স্ত্রী সন্তানকে। অর্ণির মায়ের কোলে আয়ান। এতো মানুষের কান্না দেখে আয়ানও কান্না করছে। মাজহারুল আয়ানকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করেন।
একটু সামনেই সূচীকে দেখে দৌড়ে যান মাজহারুল। সূচীর চোখ লাল হয়ে গেছে, হয়তো কান্না করেছে। মাজহারুল সূচীকে কিছু বলবার আগেই সূচী বললো; আংকেল আল্লাহ এর কাছে দোয়া করেন।
সবাইকে বাঁচানোর মালিক এক মাত্র আল্লাহ। আন্টিকে সামলান আপনি, নিজেকে শক্ত রাখেন।
কথটা বলে আয়ানের কপালে চুমু খায় সূচী। ছেলেটার কপালে আল্লাহ কী লিখে রেখেছেন তিনি নিজেই জানেন।
সূচী কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। মাজহারুল জানতে চান, নিজের মেয়ে আর মেয়ের বর কেমন আছে। দেখা করতে পারবেন কী? সূচী শুধু বলল; যেমন আছে ভালোই আছে। বাকিটা আল্লাহ এর হাতে। সূচীর কথাটার মানে বুঝে মাজহারুল নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর মনে মনে আল্লাহ এর কাছে দোয়া করতে তাকেন, আল্লাহ যেন ভালো কিছুই করেন।
রুহি আর রিফাতকে আলাদা আলাদা কক্ষে রাখা হয়। রিফাত আর রুহির যে দুই কক্ষে আছে সেই দুই কক্ষের দরজা একে ওপরের মুখোমুখি তাকিয়ে আছে। দুই কক্ষের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রুহির পরিবার আর অর্ণির মা বাবা। অর্ণির মা নিজের স্বামীকে ফোন দিয়ে সব বলেন।
তাপস রায় সব শুনে পাগলের মতো ছুটে আসেন হাসপাতালে, নিজের মেয়ের ভালোবাসা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক সেই কামনা করেন উপরওয়ালার কাছে। তাপস মাজহারুলকে বুঝাচ্ছেন। আয়ান কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে অর্ণির মায়ের কোলে। হয়তো আয়ান বুঝতে পারছে তার সাথে কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
বিকেল তিনটার দিকে রুহির কক্ষের দরজা খোলা হয়, সূচী অন্য রোগীদের কক্ষে ছিলো। রুহির কক্ষ থেকে ডক্টরকে বের হতে দেখে মাজহারুল সহ সবাই দৌড়ে যান ডক্টরের কাছে।
আমার মেয়ে কেমন আছে ডক্টর? আমরা কী কথা বলতে পারবো। মাজহারুল কান্না করতে করতে করতে কথাটা বলেন।
মাজহারুল এর কথা শুনে মধ্য বয়সী ডক্টর মহিলা শুধু বললেন।
“আপনার মেয়ে মৃত্যুর মিছিলের সাথে যুগ দিয়েছে, আমরা দুঃখিত!” ডক্টর কথাটি বলে চোখ মুছতে মুছতে চলে যান।
ডক্টর এর কথা শুনে মাজহারুল দৌড়ে নিজের মেয়েকে দেখতে যান। রুহির মা নিজের মেয়ের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে শুধু রুহি বলে একটা চিৎকার দেন।
সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে ঢলে পড়েন। সিয়াম আর মাজহারুল রুহির শরীর জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাটা আর রুহি কখনো শুনবে না। সে যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। মৃত্যুর মিছিলে সেও নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। ভুলে গেছে তার এক বছরের ছেলের কথা, ভুলে গেছে নিজের ভালোবাসার কথা। চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছে।
রুহির মাকে দুজন নার্স মিলে রুহির পাশে একটা বেডে শুয়ায়।
সূচী নিজের বান্ধবীর মৃত্যুর কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পরে। ভুলে গেছে সে একজন নার্স। তাকে কান্না করলে চলবে না। সূচীর বর এসে নিজের সূচীকে সান্তনা দেয়৷ সূচী আয়ানের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো মানুষের কান্না কী আয়ানের ঘুম ভাঙাতে পারছেনা। সূচীর বর এক নজর রুহিকে দেখে আবারো চলে যান রিফাতের কক্ষে। রিফাতও যে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
রিফাতের কক্ষে সূচীর বর সহ আরো দুজন ডক্টর আছেন। সূচীর বর মনে মনে আল্লাহ এর কাছে এই দোয়া করছে; “এই ছোট দুধের বাচ্চার জন্য না হলেও রিফাত মৃত্যুর রাস্তা থেকে ফিরে আসতে পারে, রুহিকে তো আল্লাহ নিয়ে গেলেন।”
রুহির মায়ের জ্ঞান আসেনি এখনো।
মাজহারুল নিজেকে কিভাবে ঠিক রাখবেন। নিজের মেয়ের মৃত্যু, রিফাত বাঁচবে কিনা সেটাও উনার অজানা! নিজের স্ত্রীও চোখ বন্ধ করে বেডে শুয়ে আছে, এই দিকে আয়ান আর সিয়ামের কান্না।
আয়ানের কান্না থামানো গেছে রুহির মৃত শরিরের উপর আয়ানকে রেখে।
মাজহারুল নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। রুহির ফুফুও রুহির এক্সিডেন্ট এর খবর জেনে গেছেন। উনি বিয়ের কাজ শেষ করেই আসবেন। রুহির মৃত্যুর খবর ইচ্ছা করেই জানান নি নিজের বোনকে মাজহারুল।
এইদিকে ডক্টর রুহির মায়ের পরীক্ষা করেও বললো, উনার অবস্থাও খুব খারাপ।
মাজহারুল এতো কিছুর পরেও কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখছেন মাজহারুলের অজানা।
প্রায় অনেক্ষণ পর রুহির মা’য়ের জ্ঞান আসে৷ তবে রুহির মা এর অজ্ঞান হওয়া ভালো কিছু ছিলো না। রুহির মায়ের পা দুটো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলছেন। ছোট খাটো একটা হার্ট অ্যাটাক। রুহির মা’কে হুইলচেয়ারে বসানো হয়।
নিজের স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে মাজহারুল কী করবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। সব দিক থেকেই মাজহারুল এর আকাশে মেঘ জমেছে।
সূচী রুহির রুম থেকে সবাইকে বের করে দেয়। হাসপাতালের রুমে শুধু রুহির লাশ আর সূচী এবং আয়ান আছে।
সূচী শেষবারের মতো আয়ানকে নিজের মা’য়ের দুধ পান করাতে থাকে। রুহির উপরের দিকে তেমন ক্ষত নেই। পেট থেকে পা পর্যন্ত আর মাথার পিছনে ক্ষত জায়গা। হয়তো আল্লাহ চেয়েছেন আয়ান শেষবারের জন্যে হলেও যেন নিজের মায়ের দুধ পান করতে পারে। তাই এমন!
আয়ান রুহির দুধ পান করছে। আয়ানের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে, সূচী এই দৃশ্য দেখে নিজের কান্না আটকিয়ে রাখতে পারেনি। হয়তো পিচ্চি আয়ানও বুঝে গেছে “আর কখনো নিজের মায়ের দুধ পান করতে পারবে না ” তাই হয়তো চোখ থেকে পানি পরছে। আয়ান অনেক্ষণ দুধ পান করে।
আয়ান রুহির বুক থেকে মাথা তুলে রুহির চোখ বন্ধ চেহারার দিকে তাকিয়ে মা মা মা মা ডাকছে, আর গালে ছোট ছোট হাত দিয়ে ধাক্কাচ্ছে। সূচী নিজ মুখ চেপে কান্না করছে এমন দৃশ্য দেখে। আবারো আয়ান দুধ পানে মগ্ন হয়।
সূচী নিজের ফোনটা বের করে কিছু পিক আর আয়ানের এম দৃশ্য গুলো ক্যামেরা বন্দি করে রাখে। আয়ানের মা ডাক শুনে বারবার সূচীর ভিতর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলো। আয়ানকে নিজের কোলে নেয় সূচী। আয়ান নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর ভাবে।
রাত ৬টার সময় রুহির মৃত দেহ বাসায় নিয়ে আসা হয়। রুহির বাসা মানুষে ভরপুর। সবার চোখে পানি, মাজহারুল এর চোখ থেকে আর পানি আসছে না। সব পানি শেষ হয়তো! সিয়াম এর কান্না থামানোর সাহস হয়নি কারো। হাজারো চেষ্টা করেও কেউ কান্না থামাতে পারেন নি সিয়ামের।
রাত ৭টার সময় রুহিকে মাটি দেওয়া হবে। আর মাত্র ৩০ মিনিট আছে। রুহির মা কে রুহির লাশের সামনে আনা হয় হুইলচেয়ারে করে। রুহির মা রুহির লাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, চোখ থেকে বেয়ে বেয়ে শুধু পানিই পরছে। কোনো কথা বলার সাহস নেই।
এই চোখ হয়তো অনেক কিছু বলতে চায়। রুহির মা কে রুমের ভিতর নেওয়া হয়। রুহির মাকে রুমে নেওয়ার আগ পর্যন্তও দু হাত দিয়ে ছড়াছড়ি করেছেন। হয়তো নিজের মেয়েকে আর কখনো দেখতে পাবেন না, সেই আর্তনাদ মুখে করতে পারছেন না বলে হাত দিয়ে করছেন।
আয়ানকে নিজের মায়ের কাছে শেষবারের মতো কিছুক্ষণ দেখায় মাজহারুল। আয়ান কান্না করছিলো। আয়ানের কান্না দেখে উপস্থিত সবাই নিজেদের কান্না আটকে রাখতে পারেন নি। আয়ান হয়তো জানেনা তার মা আর কখনো তাকে আয়ান বলে ডাকবে না।
রুহিকে রাত ৭টার সময় মাটি দেওয়া হয়। সিয়ামকে কেউ সান্তনা দিতে পারছেনা।
রুহিকে মাটি দিয়ে আসেন বাসায়। রুহির বাবা মা কে সান্তনা দিচ্ছেন সবাই। রুহির মায়ের চোখ দিয়ে শুধুই পানি পড়ছে। নিজের মেয়ে এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেন নি তাই আজ এই অবস্থা রুহির মা’য়ের। কাল যে বাসায় হাসিখুশি ছিলো। আজ সেই বাসা নীরব, চোখের পানিতে বাসার ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে বারবার।
দুই বাস মিলে সর্বোচ্চ ২১ জন মারা গেছেন। রুহির পরিবারের মতো কতো পরিবার কান্না করছে আল্লাহ জানেন। কতো হাসিখুশি পরিবার কান্নায় ভিজিয়েছে নিজের চোখ।
রিফাতের এখনো জ্ঞান আসেনি। শেষ বারের মতোও রুহিকে দেখতে পারেনি রিফাত।
মাজহারুল রুহিকে মাটি দিয়ে আয়ানকে রুহির ফুফুর কাছে রেখে পাগলের মতো ছোটে আসেন আবার হাসপাতালে। নিজেদের আরো একটা কলিজা রয়ে গেছে এখনো হাসপাতালে, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মাজহারুল রিফাতের দিকে তাকিয়ে কান্না করছেন। রিফাতও কী এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবে।
রিফাত এর জ্ঞান কী আর কখনো ফিরবে? নাকি রুহির সঙ্গী সেও হবে। আয়ানকে একা করে রিফাতও চলে যাবে? আয়ান কী তার বাবাকেও ঘুমন্ত অবস্থায় দেখবে?
রিফাতের মতো আরো অনেকেই মৃত্যুর রাস্তায় আছে, যাদের বাঁচার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ডক্টর। হয়তো আয়ান বাঁচবে মা বাবা বিহীন এই পৃথিবীতে! বড় হয়ে বলবে আমার বাবা মা আকাশের তারা হয়েছে আমাকে একা করে ছেড়ে এই পৃথিবীতে।
পর্ব ২০
রিফাতের আজ ১১ দিন পর জ্ঞান ফিরলো। এই ১১ দিনে মাত্র চার বার রিফাতের জ্ঞান ফিরেছিলো, কিন্তু স্থায়ী ছিলো না, সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো। কিন্তু আজ আর জ্ঞান হারায় নি। প্রায় ১ ঘন্টা হতে চললো রিফাতের জ্ঞান ফিরেছে। ডক্টররা খুব কষ্ট করেছে এই কয়দিন৷ আল্লাহ এর রহমতে আর কারো মৃত্যু হয়নি। সব ডক্টররাই নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
রিফাতের পাশেই আয়ান বসে আছে। রুহির মৃত্যুর পর থেকেই আয়ান কেমন নীরব হয়ে গেছে। মুখে এখন আর হাসি দেখা যায় না আয়ানের। আগে আয়ানের মধ্যে যে চঞ্চলতা দেখা যেতো, সেই চঞ্চলতাও হারিয়ে গেছে।
হয়তো বুঝতে পারছে তার ভালোবাসা মা নামক শব্দটা পৃথিবীতে নাই, কেউ আর হাজারো নামে ভালোবাসা জড়ানো কণ্ঠে তার নাম ধরে ডাকবে না। তাহলে হাসি আসবে কী করে? রুহির মৃত্যুর পরের দিন সকাল থেকেই আয়ান খুব কান্না করছিলো। মাজহারুল বাধ্য হয়েই আয়ানকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
রিফাতকে দেখে আয়ানের কান্না থেমেছিলো সেদিন। আর কান্না করেনি এই পর্যন্ত। সারাক্ষণ রিফাতের পাশে বসে বা শুয়ে থাকে আয়ান। মাজহারুল বা কোনো ডক্টর আয়ানকে রিফাতের পাশ থেকে সরাতে পারেন নি। আয়ান এই কয়দিন ধরে রিফাতের পাশেই ছিলো। এটাই হয়তো বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা!
সূচী এই কয়দিন ধরে অনেক রাত করে হাসপাতাল থেকে বাসায় যায়। আয়ানকে খাবার খাওয়ানো খুব কষ্টের ছিলো সূচীর জন্য, সূচী খুব কষ্টে আয়ানকে নিয়ম করে প্রতিদিন খাবার খাওয়া থেকে সব কাজ করেছে। মাজহারুল দিনে বাসায় আর রাতে হাসপাতালে কাটিয়েছেন।
বাসায় নিজের স্ত্রী, আর হাসপাতালে রিফাত মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নিচ্ছে। সব দিক দিয়েই মাজহারুল এর অবস্থা নাজেহাল।
সুখে শান্তি পরিবারটা ভেঙে গেছে খুব অচেনা ঝড়ে। মাজহারুল ভেঙে পড়েন নি, ভাগ্যকে বিশ্বাস করে বাস্তবের সাথে লড়ে যাচ্ছেন।
“ভাগ্যে যেটা লিখিত আছে, সেটাই পরবর্তী বাস্তব” তাহলে ভেঙে পরলে কী চলবে তার! তাইতো লড়ে যাচ্ছেন কঠিন বাস্তবের সাথে।
রিফাতের জ্ঞান ফিরেছে এই দৃশ্য দেখে সবাই অনেক খুশি। আয়ান মাজহারুলের কোলে, মাজহারুলের পাশে সূচী আর সূচীর বর সহ আরো দুজন ডক্টর রয়েছেন৷ রিফাত নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। কথা বলার শক্তি নাই রিফাতের।
আয়ান রিফাতের কাছে যাবার জন্য হাত বাড়িয়েছে, মাজহারুল আয়ানকে রিফাতের পাশে রাখেন। আয়ান নিজ হাতের উপর ভর করে বসে রিফাতের মুখে হাত বোলাচ্ছে, আর মা মা বাব বাব করে ডাকছে। এমন দৃশ্য দেখে মাজহারুল নিজের কান্না ধরে রাখতে পারছেন না। বারবার হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতেছেন।
রিফাতের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে, হয়তো আবারো জীবন ফিরে পেয়েছে বলে খুশীতে চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার!
রিফাত চোখ দিয়ে এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে, হয়তো রুহিকে খুঁজছে? রুহিকে পাশে দেখতে না পেয়ে রিফাত অস্থির হয়ে পরে। রিফাতের এমন অবস্থা দেখে সাথে সাথেই ডক্টর ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিফাতের চোখে ঘুম চলে আসে। রিফাতকে চোখ বন্ধ করতে দেখে আয়ান কান্না করে দেয়। বাব বাব বলে ডাকছে আর রিফাতের মুখে ধাক্কাছে আয়ান। মাজহারুল আয়ানকে নিয়ে রুমের বাহিরে যান। কিন্তু আয়ানের কান্না থামছেই না।
সূচীর কাছে আয়ানকে দিয়ে মাজহারুল বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দেন। বাসায়ও তো অন্য একজন অসুস্থ।
রিফাত আজ কথা বলতে পারছে, হালকা হালকা নরম খাবার খেতে পারবে আজ থেকে। রিফাতের বা হাতের দুটো আঙুল প্রথম দিনেই কেটে ফেলছিলো ডক্টর, এক্সিডেন্ট এর ৪দিনের মাথায় বা হাতের আরো একটি আঙুল কাটতে বাধ্য হয় ডক্টর।
রিফাতের পেটের ঠিক বা অংশের মাংস বেশিই ক্ষত ছিলো, ডক্টর এই কারণেই ভেবেছিলো রিফাতকে হয়তো বাঁচানো যাবে না! ক্ষতটা এতোই গভীর ছিলো যে কিডনির পাশ পর্যন্ত গিয়েছিলো। এছাড়া শরীরের আরো বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত আছে। রিফাতের বা হাতের তিনটি আঙুল কাটা হয়েছে, সেটা রিফাত এখনো জানে না।
আয়ান রিফাতের পাশে বসে আছে, মাজহারুল রিফাতকে কিছু ফল খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। পাশেই সূচী দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত কোনো ভাবেই খাবার খাচ্ছে না।
আমার রুহি কোথায়?
খুব কষ্টে রিফাত কথাটা বলে। রিফাতের কথা শুনে মাজহারুল এর ভিতর কেঁদে উঠে, কীভাবে বলবেন? রুহি যে আর এই পৃথিবীতে নাই। মাজহারুল কে চুপ থাকতে দেখে রিফাত আবার বললো; বাবা আমার রুহি কোথায়?
মাজহারুল রিফাতের প্রশ্ন শুনে কিছু বলতে চাইলেই, সূচী বলে উঠলো!
রুহি বাসায় আছে, তুমি সুস্থ হলেই রুহির কাছে যাবে।
কথাটা বলার সময় সূচীর খুব কান্না পাচ্ছিলো। রিফাত যখন জানবে রুহি বেঁচে নেই, তখন তার কী অবস্থা হবে? আর এখনই রুহির মৃত্যুর খবর রিফাতকে বলা যাবে না, এতে রিফাতের খারাপ কিছু হতে পারে।
আমায় দেখতে আসলো না রুহি?
কথাটা বলেই কেঁদে দেয় রিফাত। রিফাতের কান্না দেখে আয়ানও শব্দ করে কেঁদে দেয়। আয়ানের কান্না থামানোর জন্য মাজহারুল রুম থেকে বাহিরে নিয়ে যান আয়ানকে।
সূচী নানান ভাবে নানান ধরণের মিথ্যা কথা বলে রিফাতকে সান্তনা দেয়।
রিফাত একটু ভালো হলে তখন সত্যটা জানলে কোনো সমস্যা হবেনা তার।
১ মাস ৩ দিনে রিফাতকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রিফাত এখনো রুহির মৃত্যুর কথা জানে না, আর নিজের বা হাতের আঙুলের কথাও জানে না। বাসায় যাবার পরেই রিফাতের হাতের ব্যান্ডেজ খোলা হবে।
রিফাতকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। মাজহারুল আর সূচীর বর মিলে রিফাতকে রুমে নেওয়া হয়। সূচীর কোলে আয়ান। সিয়াম এসে রিফাতকে দেখে কান্না করে দেয়। রিফাতকে বিছানায় শুয়ে রাখে ওরা।
আমার রুহি কোথায়? এখনো রুহি আমায় দেখতে আসলো না?
রিফাতের কথায় এবার অভিমানের সুর পেলেন মাজহারুল। কিন্তু কী করবেন? রুহি তো আর কখনো রিফাতের সামনে আসবেনা।
সবাইকে চুপ থাকতে দেখে রিফাত আবারো প্রশ্ন করে রুহির কথা। তখন সূচী আয়ানকে বিছানায় রাখতে রাখতে বললো;
ধৈর্য ধরো, জানতে পারবে রুহির কথা?
রিফাত কী আর ধৈর্য ধরবে! সে যে রুহিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে।
অর্ণির মা হুইলচেয়ার করে নিয়ে আসেন রুহির মা কে। রুহির মা রিফাতকে দেখে শুধুই কান্না করছেন। রুহির মায়ের এমন অবস্থা দেখে রিফাত এবার আরো বেশি অস্থির হয়ে পরে।
মায়ের এমন অবস্থা কীভাবে হলো? কী লোকাচ্ছ তোমরা আমার কাছ থেকে? কেউ কথা বলছো না কেন?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে মাজহারুল ভাবলেন। এখন যদি রুহির কথা না বলেন তাহলে রিফাতকে সামলানো যাবেনা। তাই তিনি বলেই ফেললেন,
বাবা রিফাত! তোমার আর রুহির এক্সিডেন্ট এর দিনেই রুহি মারা যায়, আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। আর তোমার মায়ের এই অবস্থা রুহির মৃত্যুর কারনেই হয়েছে।
মাজহারুল নিজেকে ঠিক রেখেই কথাটা বললেন।
রুহি মারা গেছে কথাটা শুনে রিফাত পাগল হয়ে যায়। অচেনা আচরণ করতে থাকে। চিৎকার করে কান্না করতে থাকে রিফাত।
কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর কথা। রিফাত চিৎকার করে বলতেছে, সে এসব বিশ্বাস করে না। এভাবে আরো অনেক কিছু বলে কান্না করছে রিফাত। রিফাতকে কেউ সান্তনা দিচ্ছেনা। একটু সময় কান্না করলে রিফাতের মন হালকা হবে।
রিফাতকে সান্তনা দিতে চাইলে খারাপ কিছু হতে পারে। রিফাত কান্না করতে করতে নিজ থেকেই নীরব হয়ে যায়, যখন দেখে তার কান্না দেখে আয়ানও কান্না করছে। মাজহারুল হাসলেন মনে মনে, আয়ান এর জন্যই রিফাত নিজেকে শক্ত রাখবে।
মাজহারুল রিফাতের জন্য একটা ফোন আর সিম কিনে আনেন। রিফাতকে বাসায় আনা হয়েছে বেশ কয়েক দিন হলো। রিফাতের ব্যান্ডেজ খোলা হয় যখন তখন রিফাত শুধু নীরবে চোখের পানি ফেলেছে। নিজের শরীর থেকে তিনটা আঙুল বিলীন হয়ে গেলো। কেন এমন হলো তার সাথে? কেন কেড়ে নিলো নিজের ভালোবাসাকে?
সব কিছুই যে রিফাতের ভাগ্যে ছিলো।
অনেকদিনে নীলিমার সাথে কথা বলে রিফাত। নীলিমা পাগল হয়ে গেছিলো এই কয়দিনে। রিফাতের ফোন এতো দিন ধরে অফ, পাগল হওয়ার কথাই তো!
রিফাতের মুখে সব শুনে নীলিমা কান্নায় ভেঙে পরে, রিফাতকে সান্তনা দিবে না নিজের কান্না থামাবে নীলিমা? বুঝতে পারছে না!
এতো কিছুর পরও রিফাত বেঁচে আছে এতেই শুকরিয়া নীলিমা। রুহির মৃত্যুর কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে নীলিমার। রিফাতের সাথেই কেন এসব হয়?
আয়ানের জন্যেও নিজেকে শক্ত রাখতে হবে, রিফাতকে এসব বলেই সান্তনা দেয় নীলিমা।
রুহি মরেছে তিন বছর হলো। আয়ানের বয়স ৪ বছর হয়েছে। রিফাত বাস্তবকে বিশ্বাস করে সময়ের সাথে মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। রিফাত আগের কাজই করছে, রিফাত এখন মাস শেষে ৮০ হাজার টাকা পাচ্ছে।
মাজহারুল বাসার সব কাজ করছেন, রান্না থেকে শুরু করে নিজের স্ত্রী সন্তানেরও যত্ন নিচ্ছেন।
আর আয়ানের যত্নের সবটুকুই মাজহারুল করেন। রিফাত বিকালে অফিস থেকে এসে মাজহারুলে আর কোনো কাজ করতে দেয় না। রাতের রান্নার কাজটা রিফাত নিজেই করে। আয়ানকে সময় দেওয়া, সিয়ামকে হাসিখুশি রাখা, মায়ের যত্ন সব করে রিফাত। রিফাত অফিসে থাকা পর্যন্ত সব কাজ মাজহারুল করেন।
রুহির মা আর কখনো কথা বলতে পারবেন না। তবে উনার হাত দুটু ভালো আছে। রুহির শূন্য জায়গাটা পূর্ণ করার চেষ্টা করছে রিফাত।
আয়ান মাঝেমধ্যেই রুহির জন্য কান্না করে। আয়ান জানতো না তার মা কে? আয়ান কথা বলা শেখার পর থেকেই, রিফাত রুহির ফটো আয়ানকে দেখায়, রিফাত এটাও বলে রুহি এই পৃথিবীতে নাই। আয়ান কেমন বড় মানুষের মতোই নিজের বাবার কথা বুঝে নেয়। হয়তো আল্লাহ আয়ানকে সেই বুঝ দান করেছেন।
তবুও মাঝেমধ্যে কান্না করে আয়ান মায়ের জন্য। তখন রিফাত বা মাজহারুলের খুব কষ্ট হয়।
সিয়াম এখন বড় হয়েছে, ক্লাস নাইনে পড়ে। বাসায় আয়ানের সাথে ভালোই খেলাধুলা করে সিয়াম।
একটা সুখী পরিবার হয়েছে, কিন্তু তবুও কিছুটা শূন্য লাগে রুহির জন্য। রিফাত নীরবে কান্না করে সবার আড়ালে কান্নায় ভেঙে পরে রুহির জন্য। কঠিন বাস্তবের দ্বারা ধর্ষিত রিফাত।
সকালের নাশতা করেছে রিফাত সবাইকে নিয়ে। রুহির মা আয়ানকে খাওয়াচ্ছেন। আয়ানও নীরবে খেয়ে যায়৷
রিফাত অনেক্ষণ ধরে ভাবছে একটা কথা বলবে, কিন্তু কথাটা বলা কী ঠিক হবে?
তবুও রিফাত বলল।
বাবা একটা কথা বলার ছিলো?
হুম বলো,
বাবা আমি আয়ানকে নিয়ে ১মাসের জন্য বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসতে চাই। আমার উপরে দেওয়া অপবাদটা মিথ্যে প্রমাণ করতে চাই। ভাবছিলাম রুহিকে নিয়ে যাবো, কিন্তু তার আগেই তো?
রিফাত কথাগুলো বলে মাথা নিচু করে নেয়।
মাজহারুল এবার নিজের ভিতর রাখা কথাটা বলার সময় পান। তিনিও বললেন;
“আমার একটা কথা রাখবে?”
হুম বলো বাবা।
বাংলাদেশে যাও সমস্যা নাই। তবে আসার সময় আমার জন্য একটা মেয়ে এনো?
রিফাত কথাটার মানে বুঝে খুব অবাক হয়ে তাকায় মাজহারুলের দিকে। মাজহারুল চোখ দিয়ে আবারো কথাটার মানে বুঝালেন। সিয়ামও তার বাবার সাথে কথা মিলাচ্ছে।
রিফাত বললো,
বাবা আমার পক্ষে আর বিয়ে করা সম্ভব না।
রিফাত বাবা তুমি কী চাও না, আয়ান একটা মা খুঁজে পাক।
মাজবারুলের কথা শুনে আয়ানের দিকে তাকায় রিফাত। আয়ান খুব নীরবে খাবার খেয়ে যাচ্ছে।
মাজহারুল এর দিকে মাথা নেড়ে হুম বুঝালো।
রিফাত নিজের নিয়তিকে দোষ দিচ্ছে। কেন এমন হলো। তার পক্ষে আবার বিয়ে করা সম্ভব না। কিন্তু চারটা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে আবার বিয়ে করতে হবে।
কিন্তু রিফাত কী পাবে এই চারটা মানুষের জন্য যোগ্য মানুষ? আর রিফাতকে কে-ই বা বিয়ে করবে? এক হাতের তিনটা আঙুল নাই, আর বয়সও বেড়েছে।
সব ভেবে দীর্ঘশ্বাস নিলো রিফাত।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে, আয়ানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিফাত নিজের চীরচেনা বাসার সামনে। আস্তে আস্তে বাসার দরজার সামনে যায় রিফাত। আয়ানকে কোলে রেখে ডান হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগ রেখে কলিংবেলটা বাজালো রিফাত।
সবাই তাকে দেখে খুব অবাক হবে। একটু বেশি অবাক মা আর মাহি হবে। নীলিমাকেও বলেনি রিফাত সে যে বাংলাদেশে আসবে বা এসেছে। সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে। আর অনেক সত্য কথা জানার আছে যে!
আবারো কলিং বেল চাপলো রিফাত। কে দরজা খোলে সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে সে।
পর্ব ২১
কে দরজা খুলবে? তাকে দেখে দরজার ভিতরে থাকা মানুষটি কী খুব অবাক হবে? নাকি একটুও অবাক হবে না? নাকি তাকে সবাই ভুলে গেছে? অনেক প্রশ্ন এসে রিফাতের মাথায় রাজত্ব বাঁধলো।
রিফাত এসব ভাবতে ভাবেতেই ৩য় বার কলিংবেল চাপতে গেলেই কেউ এসে দরজাটা খুলে দেয়। দরজার ভিতরে থাকা মানুষটি এখনো রিফাতকে দেখেনি।
দেখলে হয়তো রিফাতকে দরজার বাহিরে রেখেই কান্না করা শুরু করে দিতো। রিফাতও দেখেনি কে দরজা খুলে দিয়েছে, রিফাত নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকে। এবার কেউ তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে, আর কান্না করতে থাকে। চিৎকার করে বলতে থাকে, “আম্মু আম্মু দেখে যাও কে এসেছে?”
রিফাতও কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারে এটাই তার পিচ্চি মাহি।
মাহি দরজা খুলে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো, তাই দেখেনি কে ছিলো বাহিরে। কিন্তু রিফাত ভিতরে ঢুকতেই মাহির চোখ ফেটে পানি ঝরতে থাকে। নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে সাথে সাথেই রিফাতকে জড়িয়ে ধরে।
রিফাত মাহিকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আয়ানকে কোল থেকে নামায়।
কিন্তু মাহি আবারো রিফাতকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।
রিফাত আয়ানকে এক হাত দিয়ে ধরে, আর মাহিকে বুকের সাথে জড়িয়েই ড্রয়িং রুমের দিকে আগাতে থাকে। মাহি কান্না করেই যাচ্ছে। কতো বছর পর নিজের ভাইকে দেখতে পারছে মাহি।
প্রিয় একদিন না দেখলেই মনে হয় হাজারো বছর দেখা হয়নি। আর এখানে তো মাহি নিজের ভাইকে কয়েক বছর দেখেনি, শুধু দেখেইনি যে তাও না! কেউ কারো সাথে এই কয় বছরে কথাও বলেনি।মাহি চিৎকার করে কান্না করছে, রিফাতের মুখে বারবার চুমু খাচ্ছে মাহি, আর কান্না করে কথা বলেই যাচ্ছে। এটাই তো ভাইবোনের ভালোবাসা। তাইতো ভাইবোনের ভালোবাসা মধুর চেয়েও মিষ্টি।
মাহির কান্না শুনে ইতিমধ্যেই ড্রয়িংরুমে সবাই উপস্থিত হয়। নাফিজা রিফাতকে দেখে দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে পড়েন রিফাতের বুকে। বুকের দুই পাশে দুজন একদিকে নিজের মা আর অন্যপাশে নিজের বোন। রিফাতও কান্না করছে এতোটা বছর পর নিজের প্রিয় আপনজনকে দেখছে সে৷
রিফাত জানতো তার মা আর মাহি তাকে দেখে খুব খুশি হবেন। একটু আগে যা ভেবেছিলো রিফাত তা কখনো সত্য হওয়ার না। তার বাবা বা অন্যেরা তাকে ভুলতে পারে। কিন্তু মা আর মাহি কখনো তাকে ভুলতে পারেনা।
পারেনা কী? বাস্তবেই তো আজ সব দেখতে পারছে সে।
তাই রিফাত মনে মনে অনেক খুশী, সে যা ভেবেছিলো তা-ই হয়েছে। মা আর মাহি দুজনেই দেখে থাকে পাগল হয়ে গেছেন। রিফাত আল্লাহ এর কাছে অনেক শুকরিয়া আদায় করলো, আবার নিজের পরিবারকে কাছে পাওয়ায়। কিন্তু মধ্যে কেটে গেলো অনেকটা বছর। মিথ্যে অপবাদে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো তাকে নিজের পরিবার থেকে।
রিফাত মাহি আর নিজের মাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সামনে দাঁড় করায়। নাফিজার পা ধরে সালাম করে রিফাত, আর নাফিজার কপালে অনেক গুলো চুমু খায় রিফাত।
নাফিজা কান্না করে করে বললেন,
বাবা কোথায় ছিলি এতোদিন, একবারো কী আমাদের কথা মনে পড়লো না তোর? তোর মনে একবারো কী তোর এই মায়ের কথা আসলো না?
কীভাবে পারলি আমাদের থেকে নিজেকে এতোটা দূরে রাখতে?
নাফিজার চোখের পানি মুছে দিয়ে রিফাত বললো।
আম্মু এই তো এসেছি, তোমাদের ভুললে কী আর কখনো ফিরে আসতাম বলো?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে নাফিজা কিছু বলতে গেলে রিফাত আবারো বললো, “মাহি আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়? খুব পিপাসা পেয়েছে।”
রিফাতের কথা শুনে মাহি দৌড়ে যায় টেবিলের কাছে আর রিফাতের জন্য পানি নিয়ে আসে। রিফাত পানি পান করে মাহির দিকে তাকিয়ে বলল, “খুব বড় হয়ে গেছে আমার মাহি বুড়িটা”
রিফাতের কথায় মাহি আবারো কান্না করে দিলো।
রিফাতের প্রতিটা কথায় এখন মাহির কান্না আসবেই, রিফাত মাহিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় আবার। নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে রিফাত একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়।
চুল গুলো পেকে গেছে, চামরাগুলোও আর আগের মতো টান টান নেই। এই কয় বছরেই মা’য়ের শরীরটা এতোটা পরিবর্তন হলো?
রিফাত এসব ভেবে ভেবেই প্রশ্ন করে নিজের মাকে!
আম্মু তোমার শরীরের এমন অবস্থা কেন? মাহি তুই আম্মুর যত্ন নিচ্ছিস না ভালোভাবে?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে নাফিজা খুব করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন।
আর বললেন, নিজের ছেলের খুঁজ নাই, এতোটা বছর ধরে একটা বার কথাও হলো না। বল কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখি? আর মাহি আমার যত্ন নিবে কী? ওর যত্নই আমায় নিতে হচ্ছে। দেখ তোর জন্য কান্না করতে করতে নিজে কী অবস্থা করেছে মেয়েটা!
নাফিজার কথা শুনে মাহির দিকে তাকায় রিফাত, সত্যিই মাহির আগের সৌন্দর্য নাই। তার প্রতি এতোটাই ভালোবাসা নিজের মা আর বোনের। কিন্তু কিছু কারণে এতোটা বছর দূরে ছিলো এমন ভালবাসা থেকে।
এই দিকে আরমান আর হুমায়ুন দুজনেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রিফাতকে দেখে। কখনো ভাবেন নি রিফাত ফিরে আসবে! আরমান আর হুমায়ন এমন ভাবে রিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হয় ওরা “বনের সিংহকে নিজেদের সামনে দেখছে” আরমান আর হুমায়ন দুই ভাইয়ের ভিতর আবারো ভয় ঢুকে যায়। ওরা তো ভেবেছিলো রিফাত মরে গেছে! কিন্তু ওদের সব চিন্তা বিফলে গেলো। আবার ফিরে এসেছে রিফাত। আবার সাথে করে একটা ছেলে (আয়ান) কে ও নিয়ে এসেছে।
নাফিজার চোখ এবার আয়ানের দিকে পড়লো। আয়ান খুব শান্ত ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, আর সব দেখছে। নাফিজা বা মাহি এতক্ষণ রিফাতকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তাই আয়ানকে চোখে পরেনি। আয়ানকে চোখে পড়তেই নাফিজা প্রশ্ন ছুড়লেন রিফাতের দিকে।
রিফাত এই পিচ্চিটা কে?
রিফাত নিজের মায়ের প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসেই বললো।
আম্মু এ হলো আমার কলিজা আয়ান, তোমার একমাত্র নাতি তোমার বংশের প্রদীপ।
রিফাত কথাটা বলে আয়ানকে কোলে নেয়, আর নিজের মায়ের কাছে দেয়।
নাফিজা আয়ানকে কোলে নিয়ে একের পর এক আদর দিতে তাকেন। ভুলেই গেলেন রিফাতের বাবা হতে পারবেনা এই কথাটা। আয়ানও নাফিজার কোলে চুপটি করে আছে। মাহিও আয়ানকে নিজের কোলে নিয়ে আদর করছে।
রিফাত এবার নিজের বাবা আর চাচার দিকে তাকালো। আর বললো,
আব্বু আমায় দেখে একটাবারো নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলেন না? চাচ্চু তুমিও একটাবারের জন্য আমার কাছে আসলে না?
রিফাত মুচকি হেসেই কথাটা বলে। রিফাতের কথা শুনে আরমান রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে। আবার রিফাতের মুখে আয়ান তার ছেলে কথাটা শুনেও খুব অবাক হয়। তাহলে কী আয়ান বাবা হওয়ার ক্ষমতা জেনে গেছে?
রিফাতের বাবা আর চাচার মুখে ভয়ের রেখা দেখতে পারছে রিফাত। এসব দেখে মুচকি হাসে রিফাত। কারণ তার বাবা হওয়া নিয়ে একটু বেশিই কথা বলছিলেন এই মানুষ গুলো। রিফাত এখনো দুজন মানুষকে দেখতে না পেয়ে নিজের মায়ের কাছে প্রশ্ন করলো।
আম্মু মিনার আর চাচী কোথায়?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে হেসেই বললেন।
বাবারে! বাপ খারাপ হলে সন্তানও খারাপ হয়। জানিস তো কথাটা? মিনারও তেমন। আজ দুই বছর ধরে জেলে আছে মিনার। অনন্যা নামের একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে আছে সে। বাপ যেমন ছেলেও তো তেমন হবে।
আর তোর চাচীকে তোর অমানুষ চাচা ডিভোর্স দিয়েছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলো বলে।
জানিস বাবা মিনারের জন্য একটুও কষ্ট হয় না আমার! কোনো কুকুরদের জন্য কষ্ট হয়না আমার।
নাফিজার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
নাফিজার মুখে এসব কথা শুনে আরমান চিৎকার করে উঠলেন।
নাফিজায়ায়ায়ায়া
নাফিজাও আজ ভয় পাচ্ছেন না। তিনিও চিৎকার করে বললেন।
এইযে চুপ থাক জানুয়ার! আজ তোদের সব মুখোশ খোলার পালা। রিফাতকে যা বলতে পারিনি, আজ সব বলবো।
রিফাত নিজের মাকে সান্তনা দিয়ে বলে, আম্মু আমি সব সত্য জানতেই আসছি। তবে এখনি না। কাল দিনে এসব নিয়ে কথা হবে, এখন আমার আর আমার ছেলের রেস্ট প্রয়োজন।
নাফিজা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেন।
নাফিজার একটা কথা মনে হতেই আবার বললেন,
রিফাত আমার দাদাভাইটা মানে একটু বুঝিয়ে বলবি? আর আমার দাদা ভাইয়ের মা কোথায়?
আয়ানকে চুমু দিয়ে কথাটা বললেন নাফিজা।
নাফিজা কী বুঝাতে চাচ্ছেন রিফাত ভালোই বুঝতে পারছে। তাই রিফাত বললো,
আম্মু আমার উপর মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয়েছিলো।
এই দেখো মিথ্যে অপবাদের সত্য প্রমাণ আমার ছেলে আয়ান। এখন শুধু দেখার পালা কে আমার এতো বড় শত্রু! রিফাত আরমান আর নিজের চাচার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো। আরমান রাগ দেখিয়ে রুমে চলে যান। হুমায়ন এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
রিফাতের মুখে বাবা হওয়ার ক্ষমতা আছে জেনে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাফিজা। একটা মিথ্যে অপবাদের জন্য এতোটা কষ্ট পেলো রিফাত।
এসব মিথ্যে কোথা থেকে কোথাকার ছেলে ধরে নিয়ে নিজের বাবা হওয়ার ক্ষমতা প্রমাণ করা যায় না।
হুমায়ন চিৎকার করেই কথাটা বলে।
রিফাত নিজের চাচার মুখে এমন কথা শুনে বললো,
কালকেই আমি সব সত্য জানবো। আর কে আমার সাথে এমন খেলা খেলেছে তাও জানবো। আর আমার ছেলেকে নিয়ে কেউ কোনো একটা খারাপ কথা বললে, তার অবস্থাও আমি খারাপ করে দিবো।
ছেলের মা কোথায়? এখানে মিথ্যে নাটক সাজালে হবে না। আর আমরা এতোটা অবুঝ না! ডক্টর বলেছে তোর বাবা হওয়ার ক্ষমতা নাই। আর তুই এখন মিথ্যে নাটক সাজাচ্ছিস? তোকে কালকেই আমরা পুলিশে দিবো।
আরমান রুম থেকে এসে আবার কথা গুলো বলেন।
রিফাত বুঝে উঠতে পারছে না। বাবা হয়ে নিজের সন্তানের সাথে কীভাবে এতো খারাপ ব্যবহার করতে পারছে এই মানুষটা?
রিফাত কিছু না বলে ড্রয়িং রুম থেকে আয়ানকে কোলে করে নিয়ে নিজের রুমের দিকে যায়। তার রুম কোনটা তা রিফাতের এখনো মনে আছে।
আরমান আর হুমায়ন রাগে ফুসতে ফুসতে নিজেদের রুমে যান।
রিফাত আয়ানকে বিছানায় রেখে সেও বিছানায় বসে। কতো বছর পর নিজের চিরচেনা রুমে আবারো সে। কতো মধু মাখা স্মৃতি আছে এই রুমে। এসব ভাবতে রিফাতের ভিতর কেঁদে উঠে। আয়ান খুব শান্ত হয়ে বিছানায় বসে আছে। নতুন জায়গা, আর এমনিতেও আয়ান চুপচাপ থাকে সবসময়।
রিফাতের মা এসে রিফাতের পাশে বসেন। মাহি রিফাতের ব্যাগ পাশে রাখতে রাখতে বললো।
ভাইয়া ভাবি কোথায়, এমন মিষ্টি বাবার মা’টাও খুব মিষ্টি হবে দেখতে৷ আয়ানের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে মাহি।
আমার রাজকুমারের মা টা এই পৃথিবীতে নাই রে।
আয়ানকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে কথাটা বলে রিফাত আর কান্না করে দেয়। আয়ান রিফাতের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, “আব্বু কান্না করো না তো, এই দেখো তোমরা এতোক্ষণ ধরে ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে যাচ্ছো, আমি কী কান্না করছি?”
আয়ানের পাকামো কথা দেখে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে নিজের বুকের সাথে রিফাত।
মা নাই শব্দটা শুনে নাফিজা আর মাহি দুজনেই এক সাথে বললেন
মানে?
রিফাত নিজের বা হাতটা দেখিয়ে সব বললো নিজে মা আর বোনকে। কোথায় ছিলো এতো দিন। তার সাথে কী কী হয়েছে সব।
রুহি কীভাবে মরেছে, সেও মৃত্যুর রাস্তা থেকে ফিরেছিলো। অর্ণি মেয়েটার কথাও বলে। ইন্ডিয়া থেকে এক মাসের জন্য এসেছে এসবও বলে রিফাত।
রিফাত প্রায় দুই ঘন্টায় সব কথা বলে শেষ করে নিজের মা আর বোনকে। আয়ান রিফাতের বুকেই ঘুমিয়ে গেছে।
রিফাতের মুখে সব কথা শুনে নাফিজা কান্না করতে করতে বললেন।
সব দোষ আমার, আমি যদি তোকে প্রথম থেকেই সব সত্য কথা বলে দিতাম। তাহলে এসব কিছুই হতো না! তুই থাকতি না আজ এতোটা বছর আমার থেকে দূরে।
রিফাত আয়ানকে বিছানায় শুয়ে রেখে একটা কথাই বললো, “আম্মু সত্য কখনো ঢেকে রাখা যায় না, সত্য প্রকাশ পায় হয়তো একটু দেরীতেই সত্য প্রকাশ পায়!”
রিফাতের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস নেন নাফিজা আর বললেন, “বাবা সত্যটা জানার পর আমায় ভুল বুঝবিনা! আমি আর সইতে পারবো না।”
রিফার তার মায়ের কথা কিছুই বুঝতেছে না। তাই এখন আর বুঝতে চায় না। কাল তো সব সত্য জানবেই। তাই এখন রিফাত চুপ থাকবে।
রাত ১১ টার দিকে রিফাত আর আয়ান মিলে নিজের পরিবারের সাথে খাবার খায়। তবে আরমান আর হুমায়ুন ছাড়া!
রিফাত কিছুক্ষণ মায়ের সাথে গল্প করে নিজের রুমে যায়।
নাফিজা নিজের রুমে গিয়ে দু রাখার নফল নামাজ পড়ে নিলেন নিজের ছেলের ফিরে পাওয়ার আনন্দে।
মাহি তার মায়ের সাথেই ঘুমায়। পড়ালেখা হয়নি মাহির, ইন্টারে উঠার পর নিজেই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে। রিফাতের অবর্তমানে মাহি একটু বেশিই ভেঙে পড়েছিলো। ভাই বোনের ভালোবাসাটা হয়তো এমন-ই!
রিফাত আয়ানকে নিজের বুকের উপর রেখে খেলা করছে, রাতটাও গভীর হয়েছে। সিয়াম আর মাজহারুলের সাথেও অনেক কথা বলে, মায়ের খবরটাও নিয়েছে। মাজহারুল আবারো মনে করিয়ে দেন নিজের বলা কথাটা।
আয়ানের সাথেও অনেক্ষণ মজা করেন মাজহারুল।
রিফাত আয়ানকে বুকের উপর রেখেই নীলিমাকে ফোন দেয়। নীলিমা আয়ানের সেই আগের সিম দেখে খুব অবাক হয়েই ফোনটা ধরে।
রিফাত তুই বাংলাদেশে এসেছিস?
খুব আনন্দের সাথে প্রশ্নটা করে নীলিমা।
হুম রে, কাল আমাদের বাসায় আসিস। আর পারলে সুমা আর সুমার বরকেও বলবি আসতে।
নীলিমা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো।
আসলে রিফাত আমি সুমার কোনো খবর জানিনা।
মানে?
তোর সাথে এসব করার পর মনে হয় দুই তিনদিন কথা হয়েছিলো। আর কখনো হয়নি। মধ্যে কয়েক বছর কেটে যায়।
রিফাত একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় নীলিমার কথা শুনে। নীলিমা আবার বলে, “বাংলাদেশে আসলি আমায় বললিও না একবার?”
সারপ্রাইজ, জানিস আম্মু আর মাহি খুব খুশি হয়েছেন!
তোর বাবা আর চাচা খুশি হন নি? মিনার তো জেলে আছে।
জানিনারে আমার আব্বু আর চাচ্চু কেন এমন? এতো খারাপ কেন ওরা? সন্তানের প্রতি বাবাদের ভালোবাসা থাকে অনেক, কিন্তু আমার বাবা?
কথাটা বলে কেঁদে দেত রিফাত।
ধুর এসব রাখ! আয়ান কী করছে বল?
রিফাত বুঝতে পারলো নীলিমা কথা ঘোরাচ্ছে।
এইতো আমার বুকে বসে খেলা করছে। কাল সকালেই কিন্তু আসবি?
নীলিমা হুম বললো। “সুমার কথা কেন বললি?”
আয়ানকে দেখাবো, আমার উপর দেওয়া অপবাদ মিথ্যে, এটা প্রমাণ করতে হবে তো।
হুম, এখন ঘুমাবো আমি।
নীলিমার কথা শুনে রিফাত আর কিছু বললো না।
রিফাতের সিমে সুমার নাম্বার আছে।
তাই রিফাত ছোট একটা মেসেজ দিলো।
“আমি রিফাত বলছি! কাল সকাল সকাল আপনার বরকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসবেন? নইলে অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে!”
রিফাত মেসেজটা সুমার নাম্বারে পাঠায়, রিফাত জানেনা সুমার এই নাম্বার আছে, নাকি অন্য সিম কিনেছে।
আয়ান রিফাতের বুকের উপর বসে নানান ধরণের কথা বলতেছে। আর রিফাত হুম হ্যাঁ বলছে। আয়ানের মধ্যেই রুহিকে খুঁজে পায় রিফাত। রুহি যেভাবে রিফাতের সামনে কথার ঝুরি নিয়ে বসতো, আর অন্যের সামনে চুপ থাকতো। ঠিক আয়ানও এসব করে। সত্যিই রুহির মতো আয়ান হয়েছে।
রিফাত ভাবলো রুহির জায়গায় আর কাউকে বসাবে না। কিন্তু আয়ান সহ সবাই যে নতুন একটা রুহি চায়? রিফাত এসব ভেবে কোনো সমাধান পাচ্ছেনা। কী করবে সে? রিফাত আর না ভেবে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত নিচ্ছে। আয়ানকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে আর ভাবছে,
সকালে কোন সত্য তার সামনে প্রকাশ পাবে? কে তার সাথে এমন খারাপ কাজ করেছে? সুমা? নাকি অন্য কেউ? কালকেই সব উত্তর পাবে সে।
রিফাতের দু-চোখে রাজ্যের ঘুম এসে বাসা বাঁধল।
সুমা বাসার সব কাজ শেষ করে ঘুমাতে যাবে, তার আগে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। একটা মেসেজ দেখে সুমা ভাবলো সিম কোম্পানি মেসেজ দিয়েছে। তবুও মেসেজটা দেখার ইচ্ছা জাগে সুমার।
মেসেজ ওপেন করতেই rifat pakhi নামটা দেখে খুব অবাক হয় সুমা। কিন্তু মেসেজে বাংলা লেখা থাকায় কী আছে মেসেজে তা দেখতে পেলো না। নকিয়া ফোন সুমার তাই বাংলা সাপোর্ট করেনা।
রিফাতের মেসেজ দেখে পাগল হয়ে যায় সুমা। ফোনটা বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে কিছুক্ষণ। মেসেজে কি লেখা আছে সেটা দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে সুমা।
ফোনটা হাতে নিয়ে দৌড়ে যায় বাসার মালিকের কাছে, যে বাসায় সে কাজের মহিলার কাজ করে।
দরজায় ধাক্কাচ্ছে সুমা। বাসার মালিকের স্ত্রী দরজা খুলে সুমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কিছু প্রয়োজন কিনা?
সুমা বললো, এই মেসেজটা আপনার ফোনে ফরওয়ার্ড করবো। প্লিজ আপনার ফোনটা দিবেন?।
সুমার চোখে জল দেখে বাসার মহিলা বললেন, কান্না করছিস কেন?
সুমা উনার কথার উত্তর না দিয়ে ফোন টা হাতে নেয় আর মেসেজটা ফরওয়ার্ড করে।
মেসেজের লেখাটা দেখে খুব খুশীতেই সামনে থাকা মহিলাকে জড়িয়ে ধরে সুমা। মহিলাটিও সুমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কারণ জানতে চান।
সুমা মেসেজটি দেখিয়ে বলে আমার ভালোবাসা আমায় মেসেজ দিয়েছে। কালকেই বাসায় যেতে বলছে।
সুমার কথা শুনে মহিলাটি হাসি মুখেই বললেন, তাই এতো খুশী?
হুম কতো বছর দেখিনা।
মহিলা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। মহিলা সুমার সব ঘটনা জানেন। প্রতিটা রাত সুমার কান্নার সঙ্গী হন এই মহিলা।
সুমা নিজের রুমে আসে, রিফাতের সাথে পাপ করার সব ফল সে পেয়েছে। সুমা শিক্ষিত হয়েও আজ এই বাসার কাজের মেয়ে হয়ে আছে।
সুমার সব কষ্টের কথা কী রিফাত শুনবে?
কেন এতো বছর পর রিফাত তাকে মেসেজ দিলো? এতোটা বছর কোথায় ছিলো রিফাত?
সব জানবে সুমা, কাল সকালেই যাবে রিফাতের বাসায়। রিফাতের মা তো খুব অপমান করবে তাকে, তবুও সে যাবে। তার ভালোবাসা যে তাকে ডেকেছে। যেতে তো হবেই!
পর্ব ২২
সুমার আজকের সকালটা একবারে অন্যরকম। প্রতিদিনের মতো কান্না করে শুরু হয়নি সুমার সকাল, প্রতিটা রাত রিফাতের জন্য কান্না করে ঘুমায়, ঘুমানোর আগে রিফাতের সাথে করা সব খারাপ মুহূর্তের কথা মনে হয়। আর বালিশ ভিজিয়ে দেয় কান্না করে। সকালে উঠেও কান্না করতো নিজের নিয়তিকে ভেবে। রিফাতের সাথে খারাপ কাজ করার ফল সুমা এই কয় বছরে পেয়েছে।
কিন্তু আজকের সকালটা সুমার কাছে ভিন্ন, সকালে উঠেই নামাজ পড়ে নেয় সুমা। বাসার সব কাজ শেষ করে বাসার বাগানে গিয়ে মুক্ত হাওয়াটা নিজের শরীরে লাগায় সুমা।
সত্যিই সুমা আজ খুব খুশী। শুধু প্রিয় মানুষটির একটা মেসেজ ই সুমার মুখে হাসি ফুটিয়ে দিয়েছে।
সুমা সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হয় রিফাতের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
আজ সে রিফাতকে সব সত্য কথা বলবে৷ রিফাত শুনতে না চাইলেও জোর করে শোনাবে।
তবুও সুমার মনে ভয় কাজ করছে, কেমঅন অজানা ভয়। কোথায় ছিলো এতোটা বছর রিফাত? আর এখনই বা কোথা থেকে আসলো সে?
একটু পরেই সব সত্য জানবে সুমা৷
কিন্তু তার সাথে কী হবে সামনে, এসব সুমার অজানা! রিফাত কী তাকে আগের মতোই ভালোবাসে? রিফাত কী নিজের বাবা হওয়ার ক্ষমতাটা জেনেছে? সব কথা সুমার মনে এসে বাসা বাঁধলো।
একটু পরেই তো সব জানবে সে?
সকালের নাশতা করে বসে আছে রিফাত ড্রয়িং রুমে। নাফিজা বারবার রিফাতের দিকে তাকাচ্ছেন। হয়তো ভয় পাচ্ছেন! রিফাত সব সত্য জানলে কী পাগলামো করবে? ভুল বুঝবে কী তাকে?
কিন্তু সত্য তো একদিন প্রকাশ পাবেই। নাফিজা দীর্ঘশ্বাস নিলেন, নাফিজার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস ভয়ের। রিফাত যদি সব শুনে আবার দূরে সরে যায়?
সবই নিয়তি, নাফিজা কখনো ভাবেন নি তাকে এমন কিছু দেখতে হবে! তবে রিফাতেরও তো সত্যটা জানা উচিত। নাফিজা নিজেকে নিজেই বকা দিচ্ছেন, কেন সব সত্য কথা রিফাতকে ছোট থাকতেই বললেন না! নইলে হয়তো আজ এমন কিছু হতো না?
রিফাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নাফিজা আরো অনেক কিছু ভাবতে শুরু করেন।
মাহি আয়ানকে নিয়ে রিফাতের রুমে খেলা করছে। আরমান আর হুমায়ুন নিজেদের রুমে বসে আছে। হয়তো কোনো শয়তানী বুদ্ধির খেলা খেলছে আবার!
কলিংবেল এর শব্দ শুনে নাফিজা চিন্তা থেকে বের হয়ে আসেন, আর উঠে দাঁড়ান দরজা খুলে দিতে। কে আসতে পারে বাসায়? সেই চিন্তাই এখন নাফিজার মাথায়।
রিফাত হাত দিয়ে ইশারা করলো নিজের মা’কে বসতে। রিফাত উঠে দাঁড়ায় আর দরজা খুলতে যায়। রিফাত বুঝতে পারছে নীলিমাই হবে দরজার ওপর দিকে। সুমা কী আর তার মেসেজ পেয়ে আসবে? সুমা তো পরিবর্তন হয়ে গেছে? হতে পারে সিমটাও আর ইউজ করছে না?
এসব ভেবেই রিফাত দরজা খুলে।
রিফাতের বুকে কেউ ঝাপিয়ে পড়লো। রিফাতের বুঝতে বাকি নেই এটা নীলিমা! নীলিমা কান্না করছে আর বলছে, কতোটা বছর পর তোর সাথে দেখা। কীভাবে পারলি আমাদের থেকে নিজেকে এতোটা দূরে রাখতে?
রিফাত মুচকি হেসে বললো, “এই দেখ! তোর বর রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে, আমাকে ছাড় নয়তো তোর বর রাগে কালো হয়ে যাবে।”
তবুও নীলিমা রিফাতকে জড়িয়ে ধরে আছে। নীলিমার বর এসব দেখে একটুও মন খারাপ করেনি। রিফাত নীলিমার সম্পর্কের সব জানেন উনি।
অনেক কষ্টে নীলিমাকে নিজের কাছ থেকে ছাড়াতে সক্ষম হয় রিফাত।
নীলিমা আর নীলিমার বরকে সাথে করে নিয়ে এসে ড্রয়িং রুমে বসায়।
নাফিজা শুধু সব দেখছেন, নীলিমা মেয়েটা সত্যিই আলাদা। মেয়েটা ভালো তাই বরও ভালো পেয়েছে।
নীলিমা আয়ানের কথা জিজ্ঞেস করলে রিফাত মাহিকে ডেকে বলে আয়ানকে নিয়ে আসতে।
মাহিও আয়ানকে নিয়ে আসে, মাহি নীলিমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে। মাঝেমধ্যেই আসতো নীলিমা বাসায়।
আয়ানকে কোলে নিয়ে নানান কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলিমা।
রিফাত সোফায় বসে নীরবে ভাবছে তার জন্য কী এমন সত্য অপেক্ষা করছে? সত্যটা কী খুব কঠিন হবে! নাকি সাধারণ সত্যগুলোর মতোই হবে? রিফাত আর ধৈর্য ধরতে পারছে না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে রিফাত।
ঘড়ির গতিও থেমে নেই, ঘড়ি নিজের গতি পথ অনুসরণ করে চলছে। আর রিফাতের মনে আগ্রহ জাগছে৷ কী এমন সত্য, কে তার শত্রু? সব আজ জানবে। তবে যেই হোক ক্ষমা করবেনা রিফাত কাউকেই। এতোটা বছর সে কষ্ট পেয়েছে, কোনো দোষ না করেও নিজের মাতৃভূমি ছেড়েছিলো। কীভাবে ক্ষমা করবে শত্রুদের!
রিফাত এখন শুধু নিজের বাবা আর চাচার জন্য অপেক্ষা করছে, ওরা দুজন রুমে দরজা আটকিয়ে এতক্ষণ ধরে কী করছে? রিফাত ভেবে উঠতে পারছে না।
আরমান আর হুমায়ুন খুব শান্ত ভাবেই এসে ড্রয়িং রুমে বসেন। রিফাত একবার নিজের বাবার দিকে তাকালো। রুহির বাবা খুব ভালো, কতো মিশুক। কিন্তু আমার বাবা? রিফাত এসব ভেবে শুধুই কষ্ট পায়।
একটা বারও জড়িয়ে ধরেন নি রিফাতকে আরমান, রিফাত বারবার আরমানের দিকে তাকচ্ছে। তার বাবাই কী সব বাবা থেকে আলাদা?
নাফিজা নিজের স্বামীর দিকে তাকালেন, একটুও ভয় নেই মানুষটির মনে? এতো কিছু করার পরেও কীভাবে বুক ফুলিয়ে বসে আছে লোকটা?
নাফিজা খুব ঘৃণিত চোখে তাকাচ্ছেন নিজের স্বামীর দিকে। নাফিজাও চান খারাপ লোকদের শাস্তি হোক।
বাসার কলিংবেল বেজে উঠে আবারো। মাহি গিয়ে দরজা খুলতেই ৪ থেকে ৫ জন পুলিশ এসে ঘরে ঢুকে। পুলিশ দেখে রিফাত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎ বাসায় পুলিশ কেন? খুঁজে পাচ্ছেনা কোনো কারণ, পুলিশ আসার।
আরমান একটু এগিয়ে গিয়ে পুলিশের সাথে মিশলেন, আর বসতে বললেন ওদের।
রিফাত প্রশ্ন করলো, “আব্বু বাসায় পুলিশ কেন?”
রিফাতের কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন আরমান,
তোকে জেলে পাঠাবো তাই, কোথা থেকে রাস্তার ছেলেকে নিয়ে এসে বলবি এটা আমার ছেলে আর আমরাও মেনে নিবো?
আরমানের কথা শুনে রিফাতের রাগটা চরম পর্যায়ে উঠে যায়। সেদিন চুপ ছিলো বলে অনেক বড় অপবাদ নিজের মাথায় করে নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়েছিলো। কিন্তু আজ আর সে চুপ থাকবে না।
নাফিজা সহ সবাই অবাক হন আরমানের এমন কথা শুনে।
নাফিজা কিছু বলতে গেলেই রিফাত চিৎকার করে বলে উঠলো,
আমার ছেলেকে নিয়ে আর একটা খারাপ কথা বলবে, তাহলে ভুলে যাবো তুমি আমার বাবা হও!
রিফাতের চিৎকার করে কথা বলা দেখে আরমান বললেন, “দেখছেন অফিসার! আপনাদের সামনে আমায় হুমকি দিচ্ছে এই ছেলে?”
আরমানের কথা শুনে পুলিশ অফিসাররা কিছু বলতে গেলেই আবার বাসার কলিংবেল বেজে উঠে।
মাহি গিয়ে আবার দরজা খুলে দেয়।
ঘড়ির কাটায় ১১টা ছুঁই ছুঁই।
মাহি দরজা খুলে যাকে আবিষ্কার করে দরজার বাহিরে তাকে দেখার জন্য হয়তো কখনো প্রস্তুত ছিলোনা মাহি।
মাহি কোনো কথা না বলেই এসে নিজের মায়ের পাশে দাঁড়ায়।
মাহির এমন আচরণে সুমা একটুও মন খারাপ করে নি, কারণ এসব তার পাপ্য।
সুমা এসে সবার সামনে দাঁড়ায়, সুমা একটু অবাক হয় বাসায় পুলিশ দেখে। তাহলে কী বাসায় কিছু হয়েছে?
সুমাকে দেখে নাফিজা নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি, চিৎকার করে বললেন নাফিজা,
তোমাকে এই বাসায় কে আসতে বলেছে?
নাফিজার প্রশ্ন শুনে সুমা মাথা নিচু করে নেয়, এখনো রিফাতকে দেখেনি সুমা।
সুমা যখন নাফিজার কথার উত্তর দিতে যাবে তখন রিফাত বললো,
“আম্মু আমি বলছি আসার কথা, আমার যে সব সত্য জানতে হবে।”
রিফাত কথাটা বলে সুমার পিছনের দিকে তাকিয়ে আছে, কখনো ভাবেনি সুমা আসবে? কারণ সুমার তো অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে। আর রিফাত তো শুধু মেসেজ দিয়েছে, একটা মেসেজ পেয়ে ছুটে আসলো সুমা! রিফাত খুব আশ্চর্য হলো। সুমা সেই পূর্বের সিম ইউজ করছে এখনো।
রিফাতের কণ্ঠ শুনে সুমা পিছনের দিকে তাকায়। রিফাতের সাথে সুমার চোখাচোখি হয়। সুমা দৌড়ে গিয়েও রিফাতের কাছে যেতে পারেনি। পারেনি একবার রিফাতকে জড়িয়ে ধরতে।
রিফাত নিজের দৃষ্টি মাটির দিকে নেয়, কোনো পরিবর্তনশীল মানুষের দিকে তাকাতে চায়-না সে।
কিন্তু সুমা রিফাতের দিকে এখনো তাকিয়ে আছে, আর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে।
সুমা কিছুক্ষণ রিফাতের দিকে তাকিয়ে নিজের দু নয়নের তৃষ্ণা মেটায়। রিফাতকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় সুমা।
সুমাকে দেখে চিনতেই পারছেনা নীলিমা। এই কী সেই সুন্দরী সুমা? যেই সুমার সৌন্দর্যের কাছে চাঁদটাও হেরে যায় বারবার, আজ এই সুমার এই অবস্থা কেন?
কালো বোরখা আর হিজাব পড়ে আছে সুমা, মুখে নেই কোনো মায়া। চোখের নিচে কালো দাগ, এককথায় সুমাকে চিনাই যাচ্ছেনা। নীলিমা সুমাকে দেখেই যাচ্ছে৷ আর সুমা এখনো রিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
আরমান আর হুমায়ুন এর মনে ভয় ঢুকলো, সুমা এখানে কী করছে? এবার আরমান আর হুমায়ুন একটু বেশিই ভয় পাচ্ছে।
অফিসার নিয়ে যান এই ছেলেকে?
আরমানের কথাটা শুনে সুমা বাস্তবে ফিরে।
রিফাত বারবার অবাক হচ্ছে।
পুলিশ অফিসার রিফাতকে কিছু বলতে চাইলে রিফাত নিজেই বললো, “আমার দোষ?”
রিফাতের কথা শুনে আরমান চুপ থাকলেন।
কী দোষ সেটা তো নিজেই জানেন না। তবুও বললেন,
তুই এই ছেলেকে কোথায় থেকে এনেছিস? কোথায় এই ছেলের মা? আর যার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নাই, সে কীভাবে বাচ্চা জন্ম দিবে? তুই নিশ্চয় এই ছেলেকে কোথাও থেকে চুরি করে এনেছিস?
আরমানের কথা শুনে একটু বেশি অবাক হয় সুমা, সুমা এবার রিফাতের পাশের ছোট্ট আয়ানের দিকে তাকায়। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি ছোট ছেলেকে। রিফাতও বিয়ে করেছে? রিফাতেরও বাচ্চা বউ আছে?
সুমার আকাশে মেঘ জমে যায় নিমিষেই।
রিফাত চিৎকার করে বলে,
বলছি না এই ছেলে আমার, আর একবার আমার ছেলেকে নিয়ে খারাপ কথা বলবে তাহলে খারাপ কিছুই হবে।
সুমার মনটা আরো খারাপ হয়, তাহলে কী রিফাত এসব এর জন্যই তাকে এখানে এনেছে?
আরমান এর কথাগুলো শুনে নাফিজা চুপ থাকলেন না আর।
আজ তিনি চুপ থাকলে রিফাতের খুব সমস্যা হবে। তাই নাফিজা বললেন,
খাল কেটে কুমির এনে ভালোই করেছো?
আরমান নাফিজাকে ধমক দেন চুপ থাকার জন্য।
কিন্তু নাফিজা আজ চুপ থাকবেন না।
তাইতো আবারো বললেন,
আজ আমি চুপ থাকবো না। সেদিন চুপ ছিলাম বলে তোমরা রিফাতের সাথে এতোকিছু করা সাহস পেয়েছো। আর আজ কিনা আমার সামনেই আমার ছেলেকে পুলিশে দিবে? বাহ!
এবার অফিসার মুখ খুললেন, আর বললেন,
কে দোষী এখানে বুঝা যাচ্ছে না, আপনি একটু বুঝিয়ে বলবেন আমাদের?
নাফিজার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন অফিসার,
হুম আমি আজ সব বলবো!
হুম বলুন আপনি?
নাফিজা নিজের ছেলের দিকে তাকালেন, রিফাত খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে নিজের মায়ের দিকে। কী এমন সত্য লুকিয়ে আছে?
সুমাও আজ সব বলবে, যা এতোদিন কেউ শুনেনি। আজ সব বলবে, মুখোশ খুলে দিবে খারাপ লোকদের। এখন শুধু সময়ের পালা।
নাফিজা নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন, যে কথা গুলো খুব কঠিন, কাউকে কাঁদাতে বা ভেঙে দিতে যথেষ্ট!
পর্ব ২৩
নাফিজা জানেন না, রিফাত সব শুনে কী পাগলামি করবে? নাকি চুপ হয়ে নিজের ভাগ্য নামক বাস্তবকে মেনে নিবে। রিফাত সব শুনে খুব কষ্ট পাবে জেনেও নাফিজা বলতে শুরু করলেন,
রিফাত বাবা আমি জানি তুই আজ সব শোনার পর হয়তো আমার উপর রাগ, অভিমান এবং কী ঘৃণাও করতে পারিস? কিন্তু কী করবো বল? আল্লাহ যে আমাদের জন্মের পূর্বেই সব ঠিক করে দিয়েছেন। তাই ভাগ্যকে তো আর দোষ দিতে পারিনা! তবুও তোর আমার ভাগ্যটা হয়তো একটু বেশিই কঠিন ছিলো?
শুন তুই যাকে এতোদিন আব্বু ডেকে এসেছিস, যেই জানোয়ারকে নিজের জন্মদাতা ভেবেছিস? আর চুপ করে ছোট থেকেই যেই মানুষটির অত্যাচার সহ্য করে এসেছিস। এই মানুষটা তোর আসল বাবা না! এই মানুষ নামক জানোয়ার কখনো তোর বাবা হওয়ার যোগ্যতাই নাই।
নিজের মায়ের মুখে এমন কঠিন সত্য কথা শুনে রিফাত বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। আর চিৎকার করে বলে,
কিহ?
রিফাতের এতো আশ্চর্য আর চোখে পানি দেখে নাফিজা আবার বলতে শুরু করলেন,
জানি সব শুনে আশ্চর্য হবি? একটু শক্ত কর নিজেকে।
ভুল করেছিলাম আমি, যদি তোর ছোটবেলায় তোকে সব বলে দিতাম। তাহলে আজকে এসব আমায় দেখতে হতোনা হয়তো?
তো,
রিফাত নিজের মাকে কথার মধ্যে থামিয়ে দিয়ে বললো,
আম্মু কথাগুলো অযথা না পেচিয়ে সব আমায় বুঝিয়ে বলো।
রিফাত কথাটা শান্ত ভাবে বললেও কণ্ঠস্বরে ছিলো ভাঙা ভাঙা শব্দের খেলা।
আরমনা নাফিজার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলতে পারছেন না, সামনে পুলিশ থাকায়৷ কেন যে বোকামি করে নিজেই পুলিশ আনতে গেলো?
সবাই অধীর আগ্রহে নাফিজার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, পরের কথা গুলো শোনার জন্য।
নাফিজা শাড়ির আচল দিয়ে নিজের দু চোখের পানি মুছলেন। আর রিফাতের দিকে তাকিয়ে আবারো বলতে শুরু করলেন,
তোর বাবার নাম মোহাম্মদ মানসুর, অবাক হচ্ছিস তাই না?
তোকে ২বছর বয়সের রেখেই তোর বাবা ক্যান্সার রোগে মারা যান, ছেড়ে যান আমাকে আর তোকে। রেখে যান অসহায় করে তোকে। তোর বাবার মৃত্যুর সময় আমি ৭ মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলাম মনে হয়। তোর বাবার মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে খুব ভেঙে পড়েছিলাম, যার ফলে আমার গর্ভে থাকা সন্তানটাও এই পৃথিবীতে আসতে পারেনি।
তোর বাবার মৃত্যুর ১ বছর পরেই তোর দাদা আর তোর নানা-নানি আমাকে জোর করে এই জানোয়ারটার সাথে বিয়ে দেন। আমি ওদেরকেও দোষ দেবো না! কারণ কোনো জানোয়ার যদি বাহিরে ভালো মুখোশ পড়ে থাকে, তাহলে তাকে খারাপ প্রমাণ করা খুব কষ্টের!
বিয়ের রাত থেকেই তোর উপর আর আমার উপর নানান ভাবে অত্যাচার করতে থাকে। সব সহ্য করেছিলাম, শুধু তোর জন্য তোকে যে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে, এটা যে তোর বাবাকে দেওয়া আমার কথা ছিলো। কিন্তু তোকে মানুষ করতে পারলেও পূর্ণ সুখ তোকে এনে দিতে পারিনি।
তুই যখন মাঝেমধ্যেই বলতি আমার বাবা এমন কেন? তখন চুপ থাকতাম। এই চুপ থাকাটাই তোর আমার জীবনের কালসাপ ছিলো। তখন নীরব না থেকে যদি সব সত্য কথা তোকে বলতে পারতাম তাহলে হয়তো এই জানোয়ারটা এতো সাহস পেতো না!
তোর মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে? লোকটা কেন এমন করেছে? আমি তো নিজের আব্বুই জানতাম?
তাহলে আসল কারণ শুন!
সত্য কখনো মাটি চাপা দিয়ে রাখা যায় না। যেখানে ৬০ বছর পূর্বের খুনীও প্রকাশ পায়, সেখানে তো তুই তুচ্ছ(আরমানের দিকে তাকিয়ে বললেন)।
বলছিলাম না রিফাত যেদিন সব সত্য জানবে সেদিন তোরা পস্তাবি? আজকেই সেই সময়।
রিফাত শুনে রাখ! এই বাসা, কোম্পানি সহ যতো টাকা পয়সা সম্পদ আছে, সব তোর বাবার। তোর বাবার অবর্তমানে সব কিছুর মালিক তুই। আর তোর এই অঢেল সম্পত্তির লোভেই এই জানোয়ার আমায় বিয়ে করেছে শুধু তোর নানা নানি আর দাদার মন জয় করে।
তোর এই অঢেল সম্পত্তি পাবার লোভে অনেকবার তোর ক্ষতি করতে চেয়েছে। কিন্তু এই জানোয়ার জানেনি কখনো? আল্লাহ এর ছায়া যার উপর থাকে, তার ক্ষতি কেউ করতে পারে না।
আমি জানি সব শুনে এখন আমার প্রতি তোর ঘৃণা জন্মাবে? সত্যিই রে আমি খুব বড় ভুল করেছি, ক্ষমার অযোগ্য সব। আমি জানি হয়তো তুই এখন আমায় মা বলে ডাকতেও ঘৃণা করছিস?
তবুও আজ আমি খুশী! যেই সত্য এতো বছর বলতে পারিনি, সেই সত্য আজ সবার সামনে বলতে পেরে সত্যিই আমি ভীষণ আনন্দিত।
নাফিজা কান্না করে কথা গুলো বলতে বলতে মাটিতে বসে পড়েন।
নাফিজার কথা শুনে উপস্থিত সবাই খুব অবাক, বেশি অবাক হয়েছে মাহি৷ হয়তো রিফাত তার মায়ের ছেলে, বাবার ছেলে না তাই এতোটা অবাক। মাহি শরীরের উর্ণা মুখে গুজে কান্না করছে, সত্যিই মাহি এসব কিছু কখনো আশা করেনি। মাহি রিফাতের দিকে তাকায়, রিফাতের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
রিফাত কখনো এসব কল্পনায়ও আনেনি। রিফাত নিজের শরীরের শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলছে এখন। রিফাত ভাবতে পারেনি তার জীবনটা অন্য মানুষদের মতো এতোটা সহজ না। তার জীবনে শুধুই নদীর ভাঙন।
কিন্তু নদী তো এক দিকে ভেঙে অন্যদিকে পূর্ণ করে। কিন্তু তার জীবন? শুধু ভাঙা শব্দটাই আছে।
রিফাত ভাবেনি তার জন্য এমন কঠিন কিছু অপেক্ষা করছিলো? তাহলে আজ রুহির বলা কথা গুলোই সত্য হলো, রুহি বলেছিলো, তোমার জীবনের ঘটে যাওয়া অনেক সত্য হয়তো জানতে পারবে। সত্যিই জানতে পারছে আজ সব।
রুহি তার জীবনে আসার কারণেই এসব সত্য জানতে পারছে রিফাত।
রিফাত সোফায় বসে সোফার কবারে শক্ত করে ধরলো। চোখ থেকে ঝর্ণা গতিতে পানি পরছে রিফাতের।
নাফিজার কথা শেষ হবার পর সবাই চুপসে আছেন। উপস্থিত পুলিশ গুলোর চোখেও কিছুটা পানির রেখা দেখা যাচ্ছে, তারাও কঠিন মনের মানুষ হয়ে আজ চোখ ভিজেছে কারো অতীত জেনে!
সবাই রিফাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। রিফাত কী বলবে, রিফাত কী নিজের মাকে ভুল বুঝবে? আরমানকে কী করবে রিফাত? এসব জানার আগ্রহে সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুমা রিফাতের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে, তার বলা সত্য কথা শুনলে রিফাত কী করবে আজ? এমন দিনেই কেন সব সত্য কথা জানতে হবে রিফাতের? সুমা এসব ভেবে শুধুই মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে।
রিফাতের চোখে পানি দেখে আয়ান নীলিমার কোল থেকে নেমে এসে রিফাতের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো।
আব্বু কান্না করছো কেন? আব্বু এই দেখো আমারো কান্না পাচ্ছে তোমার কান্না দেখে। আব্বু এবার আর কান্না করলে কিন্তু আমিও আম্মুর কাছে চলে যাবো, আর আসবো না কখনো।
আয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিফাত, আয়ানের মুখে এমন কথা শুনে আরো বেশি কান্নায় ভেঙে পরে রিফাত। আয়ানের কপালে মুখে একের পর এক চুমু খাচ্ছে রিফাত আর বলতেছে, “এমন বলিস না বাবা, তোর জন্যেই আমি বেঁচে আছি, এমন কথা বলিস না বাবা এমন কথা বলিস না!” আয়ানকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিফাত।
সুমা শুধু অবাক হচ্ছে এসব দেখে, তাহলে কী রিফাতের স্ত্রী এই পৃথিবীতে নাই, নাকি রিফাতকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে?
রিফাতের কথা গুলো শুনে আয়ান রিফাতের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
আব্বু জানো সেদিন সূচী আন্টি আমায় আম্মুকে দেখিয়েছে৷ আমি আম্মুর রক্ত লাগা শরীরে বুকের উপর শুয়ে শুয়ে দুধ খাচ্ছিলাম।
কই তখন তো আমি কান্না করিনি? সূচী আন্টি এটাও বলেছে, তখন নাকি আম্মু আমায় ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে।
আব্বু তুমিও তো আমায় আম্মুর ছবি দেখিয়ে বলো, আম্মু আমাদের ছেড়ে মাটির নিচে একটা দেশে চলে গেছে, তখন দেখেছো আমায় কান্না করতে, তাহলে তুমি কেন কান্না করছো আজ? ও আব্বু এভাবে আর কান্না করো না, আমারো কান্না পাচ্ছে।
আয়ানের কথা শুনে রিফাত নিজের চোখের পানি মুছে নেয় আর বলে।
এই দেখ বাবা আর কান্না করছিনা, আর করবোওনা।
রিফাতের গালে চুমু খায় আয়ান, আর জড়িয়ে ধরে নিজের বাবাকে।
আয়ানের বয়স মাত্র ৪, এই বয়সেই এতো কিছু বুঝে সে!
আয়ানের মুখে এমন কথা শুনে আবারো সবার চোখে পানি এসে যায়।
এই ছোট আয়ান কীভাবে নিজেকে এতো সামলিয়ে রাখছে। নাফিজা নিজের নাতিকে শুধু অবাক হয়েই দেখছেন। এতটুকু পিচ্চিটা অনেক বড় মানুষের মতো করে কথা বলে।
সুমা এবার বুঝতে পারলো, রিফাতের জীবনে যে এসেছিলো, সে আর এই পৃথিবীতে নাই। রেখে গেছে শুধু এমন একটা রাজকুমারকে।
রিফাত আয়ানকে কোলে করে নিয়ে দাঁড়ায়, রিফাত আয়ানকে কোলে নিয়ে নিজের মায়ের দিকে অগ্রসর হয়।
নাফিজা এখনো একভাবেই মাটিতে বসে আছেন। সবাই চুপ হয়ে আছে এখনো।
রিফাত নিজের মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
নিজের মা কে বসা থেকে উঠায়।
আর বলে,
আম্মু আমি যে কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম সেই কথাগুলো আমার ছোট্ট আয়ানকে দেখেই বুঝে গেছো?
তবুও আমি তোমায় বলি।
আমি তোমায় কখনো ঘৃণা করবো না আম্মু, আর রাগও করবোনা। রাগ তো করবো যাকে এতোদিন ধরে বাবা জেনে এসেছি তার উপর।
কিন্তু তোমায় একটা কথা বলি আম্মু।
আমার ছোট বেলার মতো আমার আয়ানের ছোটবেলাটাও।
দেখো আমি ছোট থাকতেই বাবা হারিয়েছিলাম, আর আমার ছেলে হারিয়েছে মা।
কিন্তু আমার মধ্যে আর আমার সন্তান আয়ানের মধ্যে পার্থক্য কী জানো?
রিফাত কথা বলে থামে, রিফাতের কথা শুনে নাফিজা নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। রিফাত আবার বলল,
আমি আমার ছেলেকে ছোট থাকতে থেকেই কঠিন সত্য কথাগুলো বলে আসছি। তাই দেখো আজ আমার ছেলে তার চার বছর বয়সেও খুব সুন্দর করে কথা গুলো বললো, বললো নিজের কষ্টের কথা হাসিমুখে।
এখানেই আম্মু আমার আর আমার ছেলের মধ্যে পার্থক্য।
আমায়ো যদি ছোট বেলায় সব কিছু বলে দিতে তাহলে হয়তো আজ এমন কিছু দেখতে হতো না।
আম্মু আমি তোমার উপর রেগে নেই। আর রাগও করবো না। আম্মু তুমি হয়তো ভেঙে পড়ায় সব জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলে, তাই আমার জীবনটা কঠিন থেকে কঠিন পরীক্ষায় কাটাতে হয়েছে আর হচ্ছেও।
জানো আম্মু! আয়ানের মাও আমায় আয়ানের মতো কান্না করতে মানা করতো, আয়ানের মাও আমায় বলতো। দেখবে তোমার জীবনে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে, যা তোমার অজানা।
সত্যিই আজ ওর কথা সত্য হলো। সে আজ থাকলে খুব খুশি হতো।
কথাগুলো বলে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে রিফাত। নাফিজার ভিতর থেকে ভয়টা কেটে যায়। সত্যিই তিনিই ভুল করেছেন সব রিফাতকে পূর্বেই না জানিয়ে।
রিফাত পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললো,
স্যার! দেখলেন তো? কে অপরাধী, সত্যিই সত্য কখনো গোপন থাকেনা। “চাঁদ বা সূর্যকে কিন্তু মেঘ বেশিক্ষণ ঢেকে রাখতে পারেনা, ঠিক সময়েই কিন্তু মেঘ এর কালো ছায়া জয় করে চাঁদ বা সূর্যটা বের হয়ে আসে।” সত্য শব্দটাও তেমন।
আশাকরি স্যার আপনাদের আর কিছু বুঝাতে হবেনা!
রিফাতের কথা শুনে অফিসার মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালেন।
আরমান আর হুমায়ুন দুই ভাইয়ের মাথায় যে আকাশ ভেঙে পরলো। খাল কেটে কুমির ওরা নিজেই আনলো। সে কুমির মানে পুলিশ এখন নিজেদেরকেই ধরবে।
পুলিশ অফিসার কিছু বলতে গেলে সুমা বলে উঠলো,
তাহলে এই খারাপ মানুষ গুলোর আরো কিছু খারাপ কাজের কথা আজ আপনাদের শুনতে হবে। শুধু এই মানুষ গুলোর জন্য আজ আমি হাজারো কষ্টে কষ্টিত।
আরমান আর হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে বললো সুমা।
নাফিজা জানতে চাইলে সুমা বললো,
সবাই শুধু আমাকেই ভুল বুঝলো, কিন্তু কেউ একবার আমার কথাগুলো শুনেনি। আম্মু (নাফিজা) বা নীলিমা কেউই শুনেনি আমার কথা গুলো সবাই আমায় ভুল বুঝেছে।
সুমার কথা শুনে রিফাত সুমার দিকে তাকায়, এখন তো সুমা বলবে কে রিফাতের উপর এমন মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে। নিশ্চয় এসবের পিছনেও এই জানোয়ার গুলো আছে?
রিফাত সুমার কথায় মন দিলো।
আমি রিফাতকে খুব ভালোবাসি, কখনো আমার কল্পনায়ও আসেনি রিফাতকে ডিভোর্স দেওয়ার ভাবনা। একজনকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসলে কীভাবে ভাববো ডিভোর্স এর কথা।
কিন্তু সেই আমাকে দিয়েই ডিভোর্স দেওয়ালো এই আরমান লোকটা, আমার মাথায় পিস্তল ধরিয়ে ওরা ডিভোর্স দেওয়াতে রাজি করে শুধু তা না, আমি রিফাতকে ডিভোর্স না দিলে ওরা রিফাতকে মেরে ফেলবে আরো হেন তেন বলে।
রিফাতের ভাই মিনার তো আমার শরীরে হাত পর্যন্ত দিয়েছিলো, নিজেকে পবিত্র রাখার জন্য তখন রাজি হয়ে যাই ওদের কথায়।
ভাবি যে রিফাতকে সব বলে দিবো, কিন্তু সেই সময়টুকুও পাইনি, সারাক্ষণ আমায় চোখে চোখে রাখতো ওরা, আমাকে আর রিফাতকে আলাদা আলাদা রুমে রেখে দিলো রিফাতের অজানাতেই।
রিফাত আমায় মনে মনে ঘৃণা করতে শুরু করে।
ওদের জন্য আমার প্রিয় মানুষদের কাছে খারাপ বানালো।
রিফাত ভেবেছে আমি তাকে শুধু তার সমস্যার জন্য ডিভোর্স দিয়েছি।
কিন্তু ডিভোর্সের আড়ালে থাকা কথা গুলো কেউ শুনলো না।
এই খারাপ লোকগুলো আমার জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছে।
শুধু এখানেই থেমে নাই। রিফাতের উপর ওরা মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে। এটা বুঝতে পারি আমি আমার নতুন বিয়ের ১বছর ৬মাস পর, আমার নতুন স্বামী যখন আমার বাচ্চা হচ্ছিলো না বলে নানান ভাবে মারধর করছিলো।
তখন বাধ্য হয়েই ডক্টরের কাছে নিজের পরীক্ষা করাই, তারপর জানতে পারি আমার মা হওয়ার ক্ষমতা নাই। তখন ছুটে যাই আগের ডক্টর ফাহাদের কাছে, তখন ফাহাদ হাসতে হাসতে বলে আরমান এসব করিয়েছে।
এই আরমান নামক খারাপ মানুষ সব করিয়েছে শুধু রিফাতের এই অঢেল সম্পত্তি পাবার আশায়।
সুমা কথা গুলো বলে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে।
সুমার মুখে সব শুনে একটু বেশিই অনুতপ্ত হয় নীলিমা। সেদিন তো সুমা তাকে সব বলেছিলো। কিন্তু নীলিমা বিশ্বাস করেনি তখন।
সুমার কথা শুনে রিফাত বুঝতে পারে তার শত্রু কে, শুধু সম্পত্তির লোভে পরে রিফাতের এতো ক্ষতি করলো।
রিফাত সুমার দিকে তাকায়। সুমা কান্না করেই যাচ্ছে। একটা মিথ্যে অপবাদে কতোটা মানুষকে কাঁদালো এই লোকগুলো।
রিফাত এবার আরমানের দিকে তাকিয়ে বললো,
ঘৃণা হচ্ছে আপনার প্রতি আর আপনার ভাইয়ের প্রতি। হাসি মুখে যদি আমায় বলতে তাহলেই সব দিয়ে দিতাম। এতো কিছু না করলেও হতো!
অফিসার এদের নিয়ে যান? আর কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি কামনা করি এদের!
আরমান আর হুমায়ুন পালানোর কোনো রাস্তা পেলো না। তার আগেই পুলিশ ওদের ধরে ফেলে।
কি করতে এনেছিলো পুলিশ? আর কী হলো!
নিজেরাই নিজেদেরকে ফাঁসিয়ে দিলো।
সত্যের জয় হয়েছে। খারাপ লোকরা আজ শাস্তির দেয়ালে।
অনেক কিছুর মধ্যে আজকের দিনটা কাটে। নীলিমা আর নীলিমার বর চলে যায়, যাবার আগে সুমার হাত ধরে ক্ষমা চায় নীলিমা। এতোদিন ভুল বুঝার জন্য।
সুমা এখনো রিফাতের সাথে একটা কথাও বলতে পারেনি। সুমাকে এড়িয়ে চলছে সারা দিন। আয়ান সবার সাথে মিশে যায় ঠিক সুমার সাথেও মিশেছে।
নাফিজাও সুমার সাথে কথা বললেন, সুমা নাফিজার কাছে ক্ষমা চায় কিন্তু সুমাকে ক্ষমা করেন নি নাফিজা। কারণ যতোই হোক রিফাতকে কষ্ট দিয়েছে সুমা। তাই সুমাকে ক্ষমা করা কাম্য বলে মনে করেননা নাফিজা।
রাত ৯টা রিফাত মাজহারুলের সাথে ফোন দিয়ে আজকের দিনের সব কথা বললো। মাজহারুল সব শুনে খুব অবাক হন। খুশীও হন রিফাত সত্যটা জানতে পেরেছে যে।
রাতের খাবার খেয়ে রিফাত নিজের রুমে শুয়ে আছে, আয়ান হয়তো মাহির কাছে আছে?
রিফাত আজকের সব কথা ভাবছে, সত্যিই রিফাত কখনো এসব কল্পনা করেনি। রিফাত নিজের বাবার ছবি দেখতে চায়। ভাবলো দিনে নিজের মাকে বলবে নিজের জন্মদাতার ফটো দেখার কথা, একটাবার নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরবে।
রিফাতের এসবের ভাবনার মধ্যেই সুমা আয়ানকে কোলে করে নিয়ে রিফাতের রুমে ঢুকে।
খুব কষ্টে নাফিজার কাছে ক্ষমা চায় সুমা। মাহির কাছেও ক্ষমা চায় সুমা। এতক্ষণ তিনজন মিলে আড্ডা দিচ্ছিলো সাথে আয়ানও ছিলো।
রিফাত নিজের রুমে সুমাকে দেখে খুব অবাক হয়, আর রাগ হয় আয়ানকে সুমার কোলে দেখে। তাই একটু রেগেই বললো রিফাত সুমাকে।
পর্ব ২৪
সাহস হয় কী করে আপনার? আমার ছেলেকে স্পর্শ করার?
আয়ানকে সুমার কোলে দেখেই খুব রেগে যায় রিফাত, আর চোখমুখ রেগে লাল করেই কথাটা বলে। রিফাতের কথা শুনে সুমা নির্বাক হয়ে যায়।
রিফাতের মুখে প্রথম এই কথা শোনার ছিলো তার? সুমা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, রিফাতের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা সুমা। এই কী তার সেই রিফাত? যে রিফাতের রাগ শব্দটা ছিলোই না! সেই রিফাত আর আজকের রিফাতের মধ্যে সাদা-কালো তফাত।
আয়ান এখনো সুমার কোলে রয়েছে। আয়ান নিজের বাবার রাগ দেখে সুমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
রিফাত আবারো বলে,
“আয়ান এই মহিলার কোল থেকে নেমে আসো?”
রিফাতের রাগ দেখে চুপসে যায় পিচ্চি আয়ান। সুমার কোল থেকে নেমে আয়ান দৌড়ে চলে যায় রুম থেকে, পিছন থেকে রিফাত ডেকেছে, কিন্তু আয়ান চিৎকার করে “রাগ কমলে আমি আসবো আব্বু” কথাটা বলতে বলতে চলে যায়।
সুমা এখনো সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সুমার চোখ থেকে পানিগুলো ঝর্ণার গতিবেগে পরতে থাকে।
সুমাকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিফাত আবারো রেগে বলে,
আপনার জন্য আজ আমি আমার ছেলের উপর রাগ দেখিয়েছি, আর কখনো যেন আমার ছেলের আশে-পাশে না দেখি আপনাকে? আমি চাইনা কোনো খারাপ মহিলার সাথে আমার ছেলে মিশুক।
রিফাত কথাটা বলে থামতেই সুমা দৌড়ে রিফাতের কাছে যায়, আর রিফাতের পা ধরে বলতে শুরু করে।
সব জেনেও কেন এখন এমন করছো, আমি কী সব ইচ্ছে করে করেছি? সকালেই তো সব বলে দিয়েছি সবার সামনে, হ্যাঁ আমার ভুল ছিলো! সেদিন তোমাকে সব বলতে না পারা। কিন্তু আমি তো নিজ থেকে কিছুই করিনি রিফাত।
আমি তোমায় সত্যিই খুব ভালোবাসি রিফাত! কখনো আমাদের মধ্যে ফাটল ধরুক, এসবের কিছুই আমি কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের সাথে তা-ই হলো, যা কখনো কল্পনা করিনি। রিফাত তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে কী আমি ভালো ছিলাম, প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত কান্না করে কেটেছে আমার।
এই কয়টা বছর পাগলের মতো খুঁজেছি তোমায়। আমার বিয়ের আগে আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার ভাগ্যে যে কষ্ট লেখা ছিলো। তাইতো বাবা-মা ওই পশুর সাথে আমার বিয়ে দেয়, বিয়ের পর থেকে কখনো আমি সুখ পাইনি, আমার শরীর দেখলে হয়তো বুঝতে পারতে আমি এতো বছর কতোটা সুখে ছিলাম?
আমার জীবনের সব অর্জন (সার্টিফিকেট) জ্বালিয়ে দিছিলো ওই কাপুরুষ। যখন মা হবার ক্ষমতা নাই জানতে পারলো আমার, তখন খুব মেরেছেলি আমায়।
ডিভোর্স দিয়ে দেয়, তারপর এই কয়টা বছর ধরে একটি বাসার কাজের মহিলা হয়ে কাটিয়েছি।
সত্যিই রিফাত এসব আমার পাপের ফল! তোমার সাথে করা পাপ কাজের ফল আমি এই কয় বছরে পেয়েই যাচ্ছি। আমায় ক্ষমা করে দাও রিফাত? আ,,
সুমাকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়েই ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সুমার গালে রিফাত।
রিফাতের হাতে থাপ্পড় খেয়ে সুমা খুব অবাক হয়।
সুমা কখনো আশা করেনি এমন কিছুর। সুমা মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়, রিফাতের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে সুমা। রিফাত এতোটা পরিবর্তন হয়ে গেলো, যে রিফাত তিন বছরের বিবাহ জীবনে একদিনো হাত তোলেনি সুমার শরীরে। আজ কিনা?
সুমা রিফাতের দিকে তাকিয়ে কান্নাভরা কণ্ঠে বললো,
রিফাত তুমি আমাকে?,
সুমাকে কিছু বলতে না দিয়ে রিফাত বললো,
ছিঃ আমার ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি! আমি কিনা কোনো ছলনাময়ী মহিলার শরীরে স্পর্শ করলাম? নোংরা করে দিলাম নিজের হাতকে।
কথাটা বলেই রিফাত ওয়াশ রুমের দিকে চলে যায়, আর নিজের হাতটা ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়।
রিফাতের এমন কাণ্ড দেখে সুমা শুধু অবাক হচ্ছে। এখনো রিফাতের রুমে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সুমা।
আর কল্পনা করে যাচ্ছে রিফাত এই মাত্র তার সাথে কী করলো, এসব।
রিফাত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে সুমাকে দাঁড়িয়ে দেখে বললো,
“দরজাটা খোলা আছে, আমার সামন থেকে আপনি দূর হন?”
রিফাতের দিকে সুমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, নিজেকে ভেঙে ফেললে চলবে না। রিফাত যতোই রাগ দেখাক, আমি পিছপা হবো না।
সুমা এসব ভেবে আবারো রিফাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর বলে,
আমি জানি তুমি এখনো আমায় ভালোবাসো, তোমার চোখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি। আর আমি জানি এসব তুমি আমার প্রতি রাগ থেকেই করছো? আমি একটুও কষ্ট পাবো না তোমার আচরণে।
আমি তোমার সাথে যে খারাপ কাজ গুলো করেছি, তা অনেক বড় পাপ। আর এই পাপের জন্য আমি সব শাস্তি মাথা পেতে নিবো। আমি আমার পাপ মোচন করতে চাই রিফাত। প্লিজ আমাকে পাপমোচন এর একটা সুযোগ দাও তুমি?
সুমার কথা গুলো শুনে রিফাত অবাক হয়ে যায়, থাপ্পড় খেয়েও কথা বলে যাচ্ছে! রিফাত এবার আরো বেশিই রেগে বললো,
ছলনাময়ী মেয়ের সাথে কথা বলাও আমার পাপ। আমি চাইনা কোনো ছলনাময়ী আমার সামনে থাকুক, কোনো ছলনাময়ী থেকে দেহ বিক্রি করা মেয়ে গুলোও ভালো। ওরা কখনো ছলনা করে না। দূর হয়ে যান আমার সামনে থেকে, নয়তো খারাপ কিছু করতে বাধ্য হবো।
রিফাতের কথা শুনে সুমা চিৎকার করে বলে,
‘রিফায়ায়াত’
রিফাত শব্দটা বলে সুমা চুপ হয়ে যায়। কীভাবে রিফাত এমন কথা বলতে পারলো। কীভাবে পারলো এসব মহিলাদের সাথে তুলনা করতে?
সুমার চিৎকার শুনে রিফাত বললো,
চিৎকার করে নিজেকে ভালো প্রমাণ করা যায় না! আর আমি খুশি হবো আমার সামন থেকে আপনি চলে গেলে?
সুমা কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়, দৌড়ে রুম ত্যাগ করে সুমা। রিফাত দু ফোটা চোখের পানি ফেললো। এসব তো হওয়ারই ছিলো।
মাহি আয়ানকে দিয়ে যায় রিফাতের কাছে। মাহির সাথে গল্প করতে করতেই আয়ান ঘুমিয়ে পরে। মাহি রিফাতের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে রেগে আছে খুব। তাই আর বেশি কথা বলেনি মাহি।
আয়ানকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আয়ানের ঘুমন্ত শরীরে চুমু খায় রিফাত। আয়ানের প্রতি রাগ দেখানোর জন্য রিফাত মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে খুব। সুমার প্রতি রাগটা আরো গভীর হতে থাকে।
সকাল হয়েছে, সুমার রাত কাটে নির্ঘুমে। সুমার কল্পনায় ছিলোনা কালকের রাতটা। রিফাত এভাবে অপমান করবে? সুমা ভাবতেই পারেনি। কিছু কিছু জিনিস ভাবনার বাহিরেই হয়ে যায়। সুমা পাপের দিক থেকে রিফাতের খুব অপমান সাধারণ তুচ্ছই সুমার কাছে। রিফাত যতোদিন পর্যন্ত ক্ষমা করবেনা ততোদিন সুমাও রিফাতের পিছু ছাড়বে না।
নিজের করা পাপ কাজ নিজেকেই মোচন করতে হবে। পাপমোচন করার পর মরলেও শান্তি পাবে সুমা।
সবাই নাশতার টেবিলে বসে আছে, মাহি আয়ানকে খাইয়ে দিচ্ছে৷
রিফাত যেই নাশতার টেবিলে বসতে যাবে, ঠিক তখনই সুমাকে বসে থাকতে দেখে। তাই রিফাত বললো,
মাহি আমার নাশতা আমার রুমে দিয়ে যাবি? রুমেই খাবো আমি।
সুমা বুঝতে পারে রিফাত কেন এই কথা বলেছে।
সুমার মনটা আবারো খারাপ হয়ে যায়।
রিফাত নিজের রুমে যেতে চাইলেই নাফিজা বলে উঠলেন,
রিফাত আমাদের সাথে বসেই তুই নাশতা করবি, বস বলছি?
রিফাত নিজের মায়ের কথা শুনে বললো,
আম্মু কোনো ছলনাময়ীর সাথে বসে খাবার খেলে, পাপ হবে। পারলে তুমি আর মাহিও আসো আমার সাথে আমার রুমে? একসাথেই খাবো আমরা। তবুও ছলনাময়ী কারো সামনে খাবো না।
রিফাতের কথা গুলো সুমার গায়ে তীরের বেগে লাগলো।
নাফিজা রিফাতের কথা শুনে একটু রেগেই বললেন,
রিফাত বেশি পাগলামো ভালো না, কেউ নিজের ভুল বুঝতে পারলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়াই ভালো মানুষের কাজ।
আম্মু ক্ষমা কাকে করবো? কাজ গুলো ক্ষমার যোগ্য হলে ক্ষমা করা যায়। আর আম্মু প্লিজ এসব নিয়ে কোনো কথা বলবেনা আমার সাথে?
রিফাত ভুলে যাস না আমি তোর মা? তোকে যা বলবো তোকে তাই করতে হবে, আমি তোকে আদেশ করছি সুমাকে ক্ষমা করে দে?
রিফাত নিজের মায়ের কথা শুনে হেসে বললো, “আম্মু এই আদেশে আমি তোমার অবাধ্য সন্তান”
নাফিজা এবার আরো বেশি রেগে যান। আর বলেন,
রিফাত আয়ানের দিকে একটু তাকা? আয়ানেরও একটা মা প্রয়োজন। আয়ানের নানা-নানির জন্যেও তোকে বিয়ে করতে হবে। তাই আমার লক্ষী ছেলে পাগলামো করিস না? মেয়েটা তো নিজ থেকে কিছুই করেনি। ওতো সব খারাপ লোকের চাপে পরে করেছে। সোনা ছেলে আমার পাগলামো করিস না?
রিফাত নিজের মায়ের কথা শুনে সুমার দিকে তাকায়, সুমা নাশতার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে, গাল বেয়ে পানি গুলো নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
রিফাত এসব দেখে, আর নিজের মায়ের কথা শুনে বললো রিফাত।
আম্মু যেই মেয়ের মাথায় বন্দুক ধরে ডিভোর্স পেপারে সাইন করানো যায়।
সেই মেয়ের হয়ে তুমি কথা বলছো? আম্মু যেই মেয়ে একটা ছেলে বাবা হতে পারবেনা জেনে খারাপ ভাবে অপমান করতে পারে, তার হয়ে তুমি কথা বলছো আম্মু! আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আমি, আমি খুশী হবো আম্মু যদি তুমি এসব নিয়ে আর কোনো কথা না বলো।
রিফাত রাগকে প্রাধান্য দিচ্ছিস তুই, রাগ ভালো না রিফাত।
আম্মু তুমি ওর হয়ে কথা বলে কী বোঝাতে চাও?
আমি চাই আয়ানের মা হোক সুমা, দেখ বাবা তোদের ডিভোর্স হয়েছে কিছু খারাপ মানুষের কারণে। এখানে সুমার দোষ নাই, আর তোর আর সুমার বিয়ে এখন ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজ আছে। কারণ সুমার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে, আর সেই স্বামীর সাথে অনেক দিন সংসার করেছে, এখন ওদের ডিভোর্সও হয়েছে। তাই আমি চাই! তুই সুমাকেই বিয়ে কর। বাবা ঠাণ্ডা মাথায় ভাব, তাহলে ভালো কোনো ডিসিশন মাথায় আসবে।
রিফাত এবার বুঝলো এতক্ষণ ধরে কেন নিজের মা এতো কথা বলছেন। রিফাত মুচকি হাসলো, আর বললো,
আম্মু আমি কখনো তোমার এই কথার সাথে একমত হতে পারবো না। আমি এমন মেয়েকে আর কখনো ক্ষমা করবোনা আর তুমি কী থেকে কী বকে যাচ্ছো! আমি রুহিকে ভালোবেসেছি, রুহির ভালোবাসার ফল আয়ানা আছে।
আয়ানকে নিয়েই আমি কাটিয়ে দিতে পারবো জীবনটা।
রিফাত আমার কথা তো শুন।
রিফাত আর দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের রুমে চলে যায়।
মাহি হেসে হেসে বললো, আম্মু ভাইয়া হেব্বি রেগে আছে।
তা তো দেখছিই, ছেলেকে কীভাবে বোঝাই বল!
সুমা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই করা ভুলের জন্য এতো কষ্ট পেতে হবে তাকে।
রিফাত আর আয়ান আর মাত্র ১২ দিন আছে দেশে, খুব তাড়াতাড়িই সময় কেটে যাচ্ছে।
সুমাকে খুব খারাপ ভাবেই রিফাত অপমান করে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়। সুমা যে কয়দিন রিফাতের বাসায় ছিলো সে কয়দিনই নতুন রিফাতকে দেখতে পেয়েছে, এমন কোনোদিন নেই রিফাত তাকে অপমান করেনি।
সুমাও এতোদিন সব সহ্য করে ছিলো নিজের পাপ মোচন করার জন্য, কিন্তু পাপমোচন করা এতো কষ্টের সুমা জানতোই না।
সুমা এখন নীলিমার বাসায় আছে। নীলিমাও এবার সুমার দিকে, কিন্তু রিফাতকে বুঝাতে দিচ্ছেনা। নীলিমাও চায় সুমা আর রিফাতের আবার মিলন হোক।
রিফাত নিজের বাসাটা রেখে বাকি সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছে, প্রায় দুই কোটির বেশি টাকা পেয়েছে।
বাসাটাও বিক্রি করে দিতো, কিন্তু বাংলাদেশে আসলে থাকার জন্য আর বিক্রি করেনি।
যা টাকা পেয়েছে সব বিক্রি করে, ভালোভাবে একটা ব্যবসা শুরু করা যাবে।
রিফাতের মাও খুশী।
রিফাত নিজের মা আর মাহির জন্যেও ইন্ডিয়া যাওয়ার সব কিছু ঠিক করে ফেলে।
রাতটা কাটলেই হলো এখন, তারপর আবার যাবে নিজের ভালবাসার জায়গায়।
সকালেই সব কিছু ঘুছিয়ে নেয় রিফাতের পরিবার। সকাল ১১টার দিকে এয়ারপোর্টে যাবে ওরা, আর দুপুরেই দেশ ত্যাগ করবে। নীলিমার সাথে কথা হয়েছে রিফাতের, কিন্তু দেখা হয়নি।
রিফাত নিজের পরিবারকে নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে।
এয়ারপোর্টে এসে রিফাত নীলিমা আর নীলিমার বরকে দেখে রিফাতের মুখে হাসি ফুটে উঠে।
রিফাত নীলিমার সাথে কথা বলছে, তখন কথা বলার এক পর্যায়ে নীলিমা বললো,
রিফাত রাগ করবিনা একটা কাজ করে ফেলছি তোকে না জানিয়ে।
রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী কাজ?
নীলিমা ভয়ে ভয়ে বললো।
তোদের সাথে সুমাও যাবে।
কিহ?
রাগ করবি না, এসব আন্টি আর মাহি দুজন মিলে করেছেন৷ এই দেখ সুমা বসে আছে?
রিফাতের রাগটা এবার আকাশে উঠে যায়।
নিজের মাকে তো আর রাগ দেখাতে পারবে না, তাই নীলিমাকেই বললো।
তোকে তো আমি!
মাথা ঠাণ্ডা কর রিফাত, মনে রাখিস আয়ানের একটা মা প্রয়োজন। এইতো আন্টি এসেছেন, আর তোদের সময় হয়েগেছে।
রিফাত নিজের রাগকে কন্ট্রোল রাখলো। এখানে রেগে লাভ নাই, ওরা যা ভাবছে তা কখনো হবে না। এটাই এখন রিফাতের চিন্তা ভাবনায় আছে।
রুহির জায়গায় আর কাউকে বসাতে পারবেনা সে।
প্লেনে উঠার পর সুমার দিকে কয়েকবার রাগী চোখে তাকিয়েছে রিফাত।
নাফিজা এবার রিফাতের উপর একটু রাগ দেখিয়েই সব কাজ লুফে নিবেন। রিফাতের সুখের জন্য সুমার আগমন খুব প্রয়োজন।
রিফাত আবার নিজের চিরচেনা জায়গায় ফিরে আসলো। ফিরে আসলো নিজের ভালোবাসার জন্মভূমিতে।
বাগানেই মাজহারুল আর সিয়াম বসে আছে তাদের অপেক্ষায়, রাত হয়েছে, রিফাত গাড়ি থেকে নেমে সবাইকে নিয়ে বাসার ভিতর ঢুকে।
রিফাতকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে সিয়াম। আয়ান নিজের নানার কোলে যায়, অনেকদিন পর আবার নিজের কাছে ফিরে আসলো আয়ান। মাজহারুল রিফাত সহ সবাইকে নিয়ে বাসার ভিতর যান।
রিফাত নিজের মা আর বোনকে পরিচয় করিয়ে দেয় মাজহারুল এর সাথে, কিন্তু সুমার কথা ছাড়া।
নাফিজা আর মাহি মাজহারুল আর রুহির মায়ের সাথে পরিচিত হন। রুহির মাকে দেখে নাফিজার একটু কষ্ট হলো, একটা এক্সিডেন্ট কতো কিছুই না করে দিলো।
মাজহারুল এবার সুমার কথা জানতে চাইলে রিফাত খুব খারাপ ভাবেই সুমার পরিচয় দেয়, যার কারণে সবার সামনেই নাফিজা থাপ্পড় বসিয়ে দেন রিফাতের গালে।
পর্ব ২৫ (অন্তিম)
মাজহারুল সুমার পরিচয় জানতে চাইলে রিফাত খুব খারাপ ভাবেই সুমার পরিচয় দেয়।
বাবা এই মেয়েকে বাসার কাজের জন্য বাংলাদেশ থেকে এনেছি। এর পূর্বেও অন্যবাসার কাজের মহিলা ছিলো।
রিফাত কথাটা বলে সুমার দিকে তাকিয়ে এক অন্যরকম হাসি দেয়। সুমা রিফাতের করা এমন অপমানের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সুমা নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু নিজের চোখে আসা পানি গুলো নিজ হাত দিয়ে মুছলো।
কিন্তু নাফিজা সহ্য করতে পারেন নি, তাই রিফাতের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেন সবার সামনেই। রিফাত গালে হাত দিয়ে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। অনুভব করছে সময়টা, কী হলো এই মাত্র!
রিফাত এখন একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না? আর ভাই সাহেব (মাজহারুল) এই মেয়ে রিফাতের স্ত্রী আর আয়ানের নতুন মা হবে, আর আপনাদের মেয়ে।
মাজহারুল নাফিজার কথা শুনে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠলেন। সুমার দিকে ভালভাবে তাকিয়ে বললেন, “ভারি মিষ্টি তো মেয়েটা!” ঠিক রুহির মতোই। কথাটা বলে মাজহারুল একটু মন খারাপ করলেন।
মাজহারুল এর কথা শুনে রিফাত খুব শান্ত ভাবেই বললো,
বাবা কোনো খারাপ মেয়েকে আমার রুহির সাথে তুলনা করবেন না!
রিফাত কথাটা বলেই নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
রিফাতের কথাগুলোর কোনো অর্থই খুঁজে পাচ্ছেন না মাজহারুল।
সবার সামনে রিফাত সুমাকে এভাবে অপমান করলো, সুমা রিফাতের এমন আচরণ নিতে পারছে না। সুমা নাফিজার দিকে তাকায়, নাফিজা সুমাকে কান্না করতে দেখে চোখ দিয়ে বোঝালেন কান্না না করতে।
রিফাত এর কী মেয়েটাকে পছন্দ না?
মাজহারুল নাফিজার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন,
ভাই সাহেব এই মেয়েই রিফাতের প্রথম স্ত্রী, আর কিছু খারাপ মানুষের জন্য ওদের ডিভোর্স হয়েছিলো। এখানে ওদের দোষ ছিলো না, কিন্তু রিফাত এখন আর সুমাকে ভালোভাবে নিতেই পারে না। সারাক্ষণ কোনো ভাবে না কোনো ভাবে অপমান করে মেয়েটাকে।
রিফাত সব বলেছে আমাদের। তবে রিফাত দেশে যাবার পর যখন সব সত্যকথা জানতে পারে, আর আমাকে ফোন দিয়ে সব বলে, তখনই রিফাতকে বলেছি, সব দোষ ওই মানুষগুলোর, কিন্তু রিফাত বোঝেনি।
মাজহারুল এর কথা শুনে নাফিজা শুধুই মাথা নাড়ালেন।
সবাই আরো কিছুক্ষণ কথা বলে, মাজহারুল ওদেরকে রুম দেখিয়ে দেন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।
মাজহারুল মনে মনে একটু খুশী হলেন, রিফাতের তো কাউকে প্রয়োজন। অভিমান ভাঙলেই ওদের বিয়ে দিবেন। কিন্তু রিফাতের কী অভিমান ভাঙবে? মাজহারুল এসব আর না ভেবে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে রুমের দিকে যান।
রিফাত রুমে এসে চুপটি করে বিছানায় বসে থাকে, আয়ান হয়তো সিয়ামের কাছে আছে!
রিফাত ভেবেই নিয়েছে সুমাকে কখনো ক্ষমা করবে না।
রিফাত নিজের মাকে নিয়ে ভাবছে, সুমার জন্য কেন এতো চাপ দিচ্ছেন তাকে।
রিফাত সুমাকে কখনো চায় না আর, রিফাত এই দিক দিয়ে নিজের মায়ের অবাধ্য সন্তান হয়েই থাকবে। এতে যদি কারো কষ্ট হয় এতেও রিফাতের কোনো আক্ষেপ নাই, সেখানে নিজের মা হলেও।
রিফাত রাত ৯টার দিকে রান্না ঘরে গিয়ে প্লেটে করে ভাত আর তরকারি নিয়ে রুমে আসলো, আয়ানকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে প্লেটে থাকা বাকিটুকু খাবার সেও খেয়ে নিলো।
রিফাত যতোটা সম্ভব এখন থেকেই সুমা থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে।
রিফাত এর এই দৃশ্য গুলো মাজহারুল দেখলেন।
রিফাতের এমন পাগলামো গুলো মাজহারুলকে খুব করে হাসায়।
রিফাতকে ছাড়াই রাতের খাবার খায় সবাই। মাহি যখন রিফাতকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে যায়, তখন মাজহারুল বললেন, রিফাত খেয়ে নিয়েছে একটু আগেই।
মাজহারুল বা সিয়ামের সাথে ভালোই মিশে গেছেন নাফিজা সহ মাহিও। কিন্তু সুমা এখনো কারো সাথে তেমন কথাই বলেনি, তার মনে শুধু রিফাতের পালটে যাওয়াটাই ভাসছে। কিন্তু সুমা এ কথা একবারো ভাবলো না, রিফাত এর পালটে যাওয়ার কারণটা যে নিজেই। সুমা শুধু ভাবছে রিফাত কেন পালটে গেলো, কিন্তু তার জন্যই যে রিফাত নিজেকে বদলে নিয়েছে, এই কথাটা সুমার মস্তিস্কে একবারো আসেনি।
রিফাত নিজের পরিবারকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছে আজ ১ মাস হলো। রিফাত নতুন ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিলো, কিন্তু মাজহারুল অমত করার কারণে রিফাত সেই আগের কাজটাতেই আবার জয়েন্ট হয়েছে। এখানে সে নিজের ইচ্ছা মতো ছুটি নিতে পারে, বলতে গেলে সব দিক দিয়েই ভালো, তাই তো তাপস রায় এখনো কাজ করে যাচ্ছেন।
মাজহারুল রিফাতকে এটাও বললেন, রিফাতের টাকা গুলো যেন আয়ানের ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেয়। এটাই ভালো বলে মনে করেন মাজহারুল। আর রিফাতও মাজহারুল এর কথাটা মেনে নেয়। ইন্ডিয়ার একটা ব্যাংকে নিজের সব টাকা রেখে দেয় রিফাত। রিফাত নিজের জীবনটা না হয় কাজ করে প্রতি মাসের টাকা দিয়েই চালিয়ে নিবে।
আস্তে আস্তে মাসের পর মাস কাটতে থাকে কিন্তু রিফাতকে কোনোভাবেই রাজি করানো যায়নি সুমাকে বিয়ে করার প্রস্তাবে। এই বিষয়টা নিয়ে নাফিজা এবং কী মাজহারুল এর সাথেও কথা কাটাকাটি করেছে রিফাত। রিফাত আর কোনো মেয়েকে নিজের জীবনে চায় না আর সেটা সুমা বা অন্য কেউ হোক।
আজকেও ড্রয়িংরুমে বসেছে সবাই। নানান গল্পে মেতে উঠেছে ড্রয়িং রুমটা।
রিফাতও আছে আজকের আড্ডায়। সুমা রান্নাঘরের দরজা থেকে রিফাতকে দেখছে, খুব ইচ্ছা করছে একটাবার রিফাতের বুকে নিজেকে মিলিয়ে দিতে, কিন্তু রিফাত তো সুমার সাথে কথাই বলে না। আর বললেও শুধুই অপমানজনক কথা। তাহলে রিফাতের বুকে কীভাবেই মাথা রাখবে সে?
মাজহারুল আড্ডার এক পর্যায়ে কোনোভাবে না কোনোভাবে রিফাত আর সুমার কথাটা তুলেই ফেললেন। রিফাত এসব শুনে যেই উঠতে যাবে ঠিক তখনই মাজহারুল রিফাতকে বসতে বললেন।
রিফাত অনেক মাস তো হয়ে গেলো। কী সিদ্ধান্ত নিলে?
বাবা আমি আর বিয়ে করতে চাই না, প্লিজ এই বিষয়ে আর কথা বলবেন না?
রিফাত এতো অভিমান ভাল না বাবা! আমি মা হয়ে তোকে বলছি, সুমাকে নিজের সঙ্গী বানিয়ে নে আবার?
রিফাত নিজের মায়ের কথা শুনে বললো,
আম্মু আজ তোমাকে একটা কথা না বললেই হয় না! আমি তোমার ছেলে তাই বলে ভেবে নিয়ো না যে আমি তোমার মতোই হবো?
আমি আমার ছেলেকে বাবা হয়ে শাসন, স্নেহ, সব করবো, আর মা হয়ে লালনপালনও করবো। আয়ানকে রুহির ভালবাসাটা আমিই দিবো।
তুমি পারোনি হয়তো আমাকে বাবার ভালোবাসা দিতে? তাই তো আমার জন্য নতুন বাবা এনেছিলে। তাই বলে ভেবো না, আমি আমার আয়ানকে মায়ের ভালোবাসা দিতে পারবো না। আমি ঠিক আয়ানকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলব।
রিফাতের কথা গুলো নাফিজার গায়ে তীরের বেগে লাগলো গিয়ে। রিফাত বুঝিয়ে দিলো আজ নাফিজার ভুলটা।
রিফাতের কথা গুলো শুনে নাফিজা আর কোনো কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না।
মাজহারুল বললেন,
রিফাত তুমি আমাদের এতোগুলো মানুষের কথাও রাখবে না?
বাবা রুহিকে আমি মন থেকেই মেনে নিয়েছিলাম, মন থেকেই ভালোবেসেছিলাম। রুহি আমায় তার অল্প সময়ের ভালোবাসা দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসা কী। রুহি আমায় শিখিয়েছে বাস্তবতা কী।
ভেঙে পরলে আবার গড়ে উঠবো কীভাবে, সব রুহি আমায় শিখিয়েছে। রুহির জন্যই আমি আবার নতুন করে হাসতে শিখেছি। এখন বলো বাবা! আমি কীভাবে রুহির অবর্তমানে অন্য কাউকে সঙ্গী করি৷ তাহলে যে আমার পাপ হবে। আমি আয়ানকে নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবো বাবা।
রিফাত কথা গুলো বলে নিজের রুমে চলে যায়।
নাফিজা আর মাজহারুল ব্যর্থ, রিফাতের অভিমানটা খুব বেশিই সুমার উপর।
কারো প্রতি রাগ থাকলে একদিন ভেঙে যায় ঠিকই। কিন্তু কারো প্রতি অভিমানটা যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, তাহলে সেই অভিমান ভাঙেনা কখনো। সুমার প্রতি রিফাতের অভিমানটাও ঠিক তেমন।
সুমা এতক্ষণ কান্না করছিলো, রিফাতের কথাগুলো শুনে রান্না ঘরেই কান্নায় ভেঙে পরে সুমা। মাহি সুমাকে রুমে নিয়ে যায়, এতক্ষণ রুমে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান্না করছিলো সুমা। সুমা শুয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়, রিফাতের সাথে এবার সে নিজেই কথা বলবে। রিফাতকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলবে সে।
নাফিজার মনটাও খারাপ, রিফাত মনে করিয়ে দিলো আজ। রিফাতকে নিজে একা সামলাতে পারবেন না বলেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। রিফাত কীভাবে পারলো এসব বলতে। নাফিজার কষ্টটা আজকে বেশিই হচ্ছে।
সুমা রিফাতের রুমে গিয়ে দেখলো, রিফাত আয়ানকে বুকে নিয়ে খেলা করছে।
সুমা কোনো কিছু না ভেবেই রিফাতের রুমের দরজাটা আটকিয়ে দেয়।
কারো দরজা লাগানোর শব্দয় রিফাত আয়ানকে বুক থেকে সরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। রিফাত সুমাকে দেখে খুব রেগে যায়, আর বলে,
আপনি আমার রুমে কেন? আর দরজাইবা কেন লাগিয়েছো?
রিফাতের রেগে প্রশ্ন শুনে সুমা কোনো কথাই বললো না। বিছানার কাছে এসে আয়ানকে নিজের কোলে নেয় সুমা। রিফাত এবার আরো রেগে যায়, কিছু বলতে চাইলে সুমা রিফাতকে কিছুই বলতে দেয় নি। তার আগেই সুমা বলতে শুরু করে।
আয়ানের দায়িত্ব নিতে চাই আমি।
আমি তোমার বিছানার সঙ্গী হতে চাইনা, শুধু রুমের সঙ্গী বানাবে? ফ্লোরে ঘুমাতে পারবো আমি। তবুও তোমার দেওয়া এই কষ্ট গুলো নিতে পারছিনা আমি। আমি তো তোমার কাছে আমার পাপ কাজের ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছি বারবার। দাওনা একটা সুযোগ আমায় পাপমোচন করার!
সুমা কথাগুলো বলার সময় কণ্ঠ ভেঙে আসছিলো।
সুমার কথা গুলো শুনে রিফাত অট্টহাসি দিয়ে উঠে। আর বলে,
আয়ানের বাবা-মা দুটোই আমি। আর কী বললেন? পাপমোচন করার সুযোগ দিবো? হাহাহা হাসালেন আমায়।
“যেই মেয়ে ডিভোর্স দিতে পারে সেই মেয়ে খুনও করতে পারে”
আপনি আমায় ডিভোর্স দেন নি! আমাকে আপনি জীবিত রেখেই মেরে দিয়েছিলেন। বলুন এখন! আমি কী করবো?
জানেন! “খুনির যদি ফাঁসি হওয়ার আইন থাকে, তাহলে আমি চাই আপনারো কোনো শাস্তি হোক।” আমায় যে কষ্ট দিয়েছেন, সেই কষ্টর দিন গুলো কী পারবেন সুখের দিনে গড়ে দিতে।
আমার প্রতিটা চোখের পানি ফিরিয়ে দিতে পারবেন? জানি পারবেন না! আজ যদি আপনার স্বামী থাকতো, তাহলে আসতেন কী নিজের পাপমোচন করতে?
পারতেন না,
তাহলে থাকুক না কিছু পাপ পাপের জায়গায়। না হোক পাপ গুলো মোচন।
রিফাতের কথাগুলো শুনে সুমা কান্না করে দেয়। রিফাতের দুই পা জড়িয়ে কান্না করতে থাকে৷ কিন্তু রিফাত এর মন একটুও নরম হচ্ছেনা।
রিফাত তুমি তো এমন ছিলে না! তাহলে কেন এমন করছো?
রুহির পূর্বেও অর্ণি নামের এক মেয়ে আমায় ভালোবেসে এই পৃথিবী ছেড়েছে। অর্ণির জন্যেও আমার কষ্ট হয়, কিন্তু আপনার চোখে পানিতে আমি আনন্দই পাচ্ছি।
আর এমন কেন করছি জানেন? আপনার জন্য আমার অনুভূতি গুলোর মৃত্যু হয়েছিলো। সেই মৃত অনুভূতিকে রুহি জাগিয়েছিল, দিয়ে গেছে নিজের ভালোবাসার ফল আয়ানকে।
এখন আপনাকে গ্রহণ করা মানেই রুহিকে অসম্মান করা, রুহির ভালবাসাকে অপমান করা।
প্লিজ আমায় জোর করবেন না? আমি খুব ভালো আছি, আমায় ভালো থাকতে দেন!
সুমা রিফাতের মতো পাথর মনের মানুষকে দেখে বারবার অবাক হচ্ছে। সুমা নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছে। সুমাও তো কম কষ্ট পায়নি। রিফাত কী একটাবারো সুমার কষ্ট গুলো বুঝবে না?
সুমা রিফাতকে কিছু বললো না, আয়ানের দিকে তাকিয়ে কান্না কান্না কণ্ঠেই বললো।
আমার আব্বুটা তুমি কী আমায় তোমার আম্মু বানাবে?
আয়ানের গালে আদর দিয়ে সুমা কথাটা বলে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে।
আয়ানের বয়স প্রায় পাঁচ ছুঁই ছুঁই।
আয়ান খুব সহজেই বলে দিলো।
আমি তোমাকে আম্মু ডাকবো আজ থেকে, তবুও কান্না করবেনা এমন করে।
আয়ানের কথা শুনে সুমা এবার রিফাতের দিকে তাকালো।
আর বললো রিফাত দেখো তোমার ছেলেও বলছে আমায় আম্মু ডাকবে। প্লিজ রিফাত একটা সুযোগ দাও। আমি তোমায় কখনো কষ্ট দিবো না। সবার জীবনেই তো কষ্ট থাকে, আমাদের জীবনেও ছিলো। প্লিজ রিফাত!
রিফাত কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো।
আপনি কী আমার পিছনে এভাবেই লেগে থাকবেন?
সুমা ভেবেছিল রিফাত হয়তো এবার হ্যাঁ বলবে, কিন্তু রিফাত তো সেই আগের গান গেয়ে যাচ্ছে।
রিফাত পিচ্চি আয়ানও বলছে আমায় মা ডাকবে। তাহলে কেন তুমি অভিমান করে আছো এখনো? সুমা আজ রিফাতকে যেভাবেই হোক অভিমান ভাঙাবে, এতে যদি চোখের সব পানি ফেলতে হয় সুমা তাই করবে।
আয়ান এখনো ছোট তাই এই কথা বলছে৷ আমার ছেলে যদি বাস্তবটা নিজের চোখে দেখতো! তাহলে কখনো বলতো না এসব। সুমার কথা শুনে রিফাত কথাগুলো বলে।
রিফাতের প্রতিটা কথা সুমাকে হতাশা করে দিচ্ছে বারবার।
রিফাত আমি আমার পাপ মোচন করতে চাই, তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছি, সেই কষ্টের জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি তোমার কাছে, আমি আবার তোমার জীবনের অংশ হতে চাই!
রিফাতের হাত দুটো সুমা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কথাটা বলে।
রিফাত নিজেত হাত সুমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
আপনাকে আমার জীবনের অংশ কখনো না, আপনি এখন আমাদের একা ছেড়ে দিবেন একটু?
আয়ান সব দেখছে বিছানায় বসে বসে, পিচ্চি আয়ানতো এতো কিছু বুঝে না। তাই সুমার চোখে আসা পানি গুলো মুছ্র দিয়ে বলল, “আম্মু কান্না করো না, এই দেখো আমি তোমায় আম্মু বলে ডাকছি।”
আয়ানের কথা শুনে সুমা আয়ানকে জড়িয়ে ধরে অনেকগুলো চুমু দেয়।
রিফাত কেউ ভুল বুঝলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত! আর আমি তো নিজ থেকে কিছুই করিনি, তবুও তুমি! রিফাত আমি আমার পাপমোচন করতে চাই, আর পারছিনা এই পাপ নিয়ে বাঁচতে।
সুমার কথা শুনে রিফাতের কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
রিফাত সুমার দিকে তাকিয়ে বলল,
পাপমোচন করতে চান?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে এবার সুমা খুব খুশীতেই বললো, ‘হ্যাঁ’
সুমার খুশী দেখে রিফাত মনে মনে হাসলো আর বললো,
আয়ান আপনায় মা ডেকেছে, কিন্তু মা বানাতে বলেনি। তাই আপনি আয়ানের মা ডাক শোনার পারমিশন পাবেন আমার কাছ থেকে, তবে আমার স্ত্রী হওয়ার না। আপনি যেহেতু পাপমোচন করবেন।
তাই এটাই আপনার জন্য বেষ্ট বলে আমি মনে করি।
সুমা রিফাতের কথা গুলো শুনে একটু শান্তি পায়।
সুমা শান্ত হয়ে নিজের চোখের পানি মুছে বললো রিফাতকে।
স্ত্রী বানালে সমস্যা কী আমায়?
আমি আপনাকে পাপমোচন করার সুযোগ দিয়েছি। আর যদি স্ত্রী বানালে সমস্যা কী জানতে চান তাহলে প্রথমেই বলবো আমি।
যার মা হওয়ার ক্ষমতা নাই তাকে কী ভাবে স্ত্রী বানাবো বলেন?
রিফাতের কথার অর্থ ভালোই বুঝেছে সুমা। রিফাত এই কথাগুলো বলে শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছে সুমার করা অপমান গুলোর কথা। সুমা এবার ভালোই বুঝেছে রিফাত তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই এসব করছে।
সুমা সেই দিকে আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
ক্ষমা করেছো তো আমায়?
রিফাত সুমার প্রশ্নে হাসলো, আর বললো,
আপনাকে পাপমোচন করার সুযোগ দিয়েছি, ক্ষমা আমি আপনাকে কখনোই করবো না। এখন আমাকে একটু একা থাকতে দিন!
সুমা আর কিছু বললো না রিফাতের কথা শুনে। সুমা নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে রিফাতের রুম থেকে চলে যায়।
রিফাত আয়ানকে ঘুম পাড়িয়ে, নিজে নিজেই ভাবতে থাকে।
রুহি আমাকে বলেছিলো, আমি যেন তার জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য কোনো মেয়ের কথা ভাবিনা বা ভেবে কষ্ট না পাই। আমিও রুহিকে কথা দিয়েছিলাম।
আজ রুহি নাই এই পৃথিবীতে, কিন্তু রুহির কথা কী শুধু ওর জীবিত থাকা অবস্থায় রাখার কথা ছিলো। হয়তো আমি তখন ওর কথা রেখেছি কর্তব্যের খাতিরে। কিন্তু এখন রুহির কথা রাখবো রুহিকে ভালোবেসে। চাইনা এই মন রুহি ছাড়া আর কারো কথা ভাবুক! এটাই রুহির প্রতি আমার ভালবাসা।
দেখতে দেখতে চারটা বছর কেটে যায়। আয়ানের বয়স এখন ৮বছর। মাহিকেও ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দেয় রিফাত। সিয়াম এখন কলকাতায় শহরে থেকে পড়া লেখা করছে। মাজহারুল ভেঙে পরেছিলেন নিজের স্ত্রীর মৃত্যুতে। রুহির মা মরেছেন আজ দুই বছর হলো। দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছিলো, সুমা খুব যত্ন নিয়েছিলো রুহির মায়ের। কিন্তু এতো কষ্ট সহ্য করতে পারেন নি রুহির মা। দুই পা, মুখের ভাষা, আর নিজের মেয়েকে হারিয়ে এতোদিন বেশ কষ্টেই ছিলেন।
রিফাত নিজের অভিমানকে প্রাধান্য দিয়ে গেলো এই চারটা বছর। নাফিজা বা মাজহারুল কারো কথাই রিফাত শুনেনি। মাহি আর সিয়ামও কম করেনি রিফাত আর সুমাকে এক করতে কিন্তু রিফাতকে মানাতে পারে নি।
রিফাত এর সামনে সুমাকে বাধ্য হয়েই পর্দা করে চলতে হয়। এটা রিফাতের আদেশ, রিফাত চায় না সুমার প্রতি তার অনুভূতি জন্মাক। তাই এতো কিছু করে। সুমাকে এই চার বছরে কম অপমান করেনি। সুমা এখনো বিশ্বাস করে! রিফাত তাকে নিজের জীবন সঙ্গী বানাবে।
সুমা নিজের পাপমোচন খুব ভালোভাবেই করে যাচ্ছে।
রিফাতের মায়ের যত্ন রুহির বাবার যত্ন, আয়ানের যত্ন, রুহির মা জীবিত থাকা অবস্থা উনার যত্নও সুমা নিয়েছে।
আয়ান তো সুমাকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা। সুমা আয়ানকে স্কুলে নিয়ে যায় আসে।
সবাই সুমাকে ভালোবাসলেও রিফাত এখনো ঘৃণা করে।
রিফাতের যত্ন নিতেও কম করেনি সুমা! রিফাতের বা হাতে যখন ইনফেকশন হয় এবং হাতটা কেটে ফেলে তখন সুমা সব যত্ন নিয়েছে। তবুও আজ পর্যন্ত রিফাত সুমাকে একবারো তুমি করে ডাকেনি, এতোটাই ঘৃণা সুমার প্রতি তার।
রিফাতের সাথে করা একটা পাপ এর জন্য এখনো সুমা নিজেকে পাপী ভাবে। কিন্তু রিফাত নিজের কাজে অনুতপ্ত হয়নি, এতোটা বছর ধরে সুমা রিফাতের বুকে ঘুমানোর জন্য অপেক্ষা করে আসছে।
দিন যায় মাস যায় বছরও যায়, রিফাত কবে সুমাকে ক্ষমা করবে সেই অপেক্ষার প্রহর গুনে যাচ্ছে সুমা। কিন্তু রিফাত হয়তো সুমাকে কবেই ক্ষমা করে দিয়েছে, কিন্তু সুমার সামনে প্রকাশ করেনি।
আজ রিফাত প্রকাশ্যেই সুমাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু বড্ড দেরীতে।
রিফাতের বয়স এখন ৪০ পেরিয়েছে, চোখে ঝাপসা দেখে। আয়ানও এখন খুব বড় হয়েছে ক্লাস ফাইভে উঠেছে।
সুমাকে যখন আজ নিজের রুমে ডেকে আনে রিফাত।
কিছু লাগবে তোমার?
না,
তাহলে আজ হঠাৎ নিজ থেকে ডাকলে যে?
আজ আর ক্ষমা চাইবেন না?
রিফাতের প্রশ্ন শুনে সুমা মুচকি হেসে বললো,
হঠাৎ এমন কথা?
আমি যদি আজ আপনাকে ক্ষমা করে দেই?
আমার আর ক্ষমার প্রয়োজন নেই। নিজের করা পাপ মোচন করেই জীবন কাটাতে পারবো।
রিফাত ডান হাত দিয়ে সুমার চোখ মুছে দিয়ে বললো,
আজ আমি ক্ষমা করে দিলাম আপনাকে, আর আপনিও আমায় আজকে ক্ষমা করে দিবেন?
সুমা মুচকি হেসেই বললো, আমি তোমাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি।
সুমা কথাটা বলে যেতে চাইলে রিফাত পিছন থেকে আবার ডাকে।
সুমা!
হুম,
কারো প্রতি একবার অভিমান জন্মিলে, সেই অভিমান কখনো ভাঙেনা। আর রুহিকে আপনার চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিলাম। তাই রুহির জায়গায় আর কাউকে বসানোর সাহস আমার নেই।
আমি নিজ থেকে ভুল না করেও এতো কষ্ট পেয়েছি, জানো রিফাত ভুল কিন্তু আমি করিনি, খারাপ লোকেদের জন্যই আজ আমি এখনো কষ্টে।
সুমা কথাটা বলে দুপুরের রান্না করতে চলে যায়।
রিফাত হাটতে হাটতে রুহির কবরের পাশে যায়, রুহিকে ভালোবেসেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে সে। সুমাকেও কষ্ট দিচ্ছে। সুমা করে যাচ্ছে তার পাপমোচন।
আর রিফাত রুহির স্মৃতি আয়ানকে নিয়ে কাটাবে। রুহির কবরের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারো বাসার উদ্দেশ্যে যায়।
সুমা পাপমোচন করে যাবে আজীবন। সুমা এখন নিজের করা পাপ কাজ মোচন করাতেই ভালোবেসে যাচ্ছে।
রিফাত নিজের কথায় অটল থেকে বুঝিয়ে দিলো নিজের মায়ের ভুলটা। সুমার সাথে বাকিটা জীবন ভালো ব্যবহার করেই কাটাবে। আর কষ্ট দিবেনা সুমাকে।
রিফাত মাঝেমধ্যে সুমার জন্য শাড়ি কিনে আনে, রিফাত বন্ধু হতে চাইলেও সুমা রিফাতকে মনেমনে স্বামী হিসেবেই চায়।
সুমা নিজের মৃত্যুর আগেও হলে রিফাতের স্ত্রী হবে, সেটা না হয় ৮০ বছর বয়সেও।
লেখক – হানিফ আহমেদ
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “পাপমোচন – A Bangla love story” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – ভালোবাসি – পারিবারিক প্রেম কাহিনী