বয়সটা তখন ১৫ ছিল (শেষ খণ্ড) – abegi diner golpo

বয়সটা তখন ১৫ ছিল (শেষ খণ্ড) – abegi diner golpo: ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দরজার দিকে যাব, তখন নজরে পড়ল ম্যাম দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। কারো সাথে কথা বলছেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার দিকে ফিরলেন। তখন দেখলাম দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আরিয়ান কে।


পর্ব ৭

সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। সরি, একটু ভুল বললাম, সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান। আমাদের স্কুল কর্তৃক আয়োজিত। ১৪এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হওয়ায় সেদিন অনুশান হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি ছুটি থাকায় স্কুল গুলোতে সাধারণত এই দিন অনুষ্ঠান রাখা হয় না। বেশিরভাগ স্কুলেই ছুটি থাকে। তার কয়েক দিন পর আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। এই অনুষ্ঠানের সব চেয়ে আনন্দদায়ক অংশ অনুষ্ঠানের আগে হয়ে থাকে। অনুষ্ঠানের আগে র দিন সবাই নিজ নিজ ক্লাস রুম সাজায়। এতে আলাদা আনন্দ লুকিয়ে থাকে।

আমাদের অনুষ্ঠান হয়েছিল তার টিন দিন পর। মানে ১৭ ই এপ্রিল। সেই উপলক্ষ্যে আমরাও সেবার ক্লাস্রুম সাজিয়েছিলাম। প্রথম দিন সবাই মিলে চাদা তুলেছিলাম। আর তার পর ১৬ ই এপ্রিল সবাই মিলে নিজেদের ক্লাস্রুম সাজাই। এতে এক আলাদা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল প্রতিটা ক্লাস্রুমে। সব ছাত্রীরা নিজ নিজ ক্লাস্রুম সাজাচ্ছে। আমরাও সাজিয়েছিলাম। সেদিন ক্লাসে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু ক্লাস করানো হয় নি। প্রথম ক্লাসে রোল কল করে আমাদের ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই ছিল সুযোগ নিজেদের ক্লাস সাজানোর। তবে নতুন বিল্ডিং বলে বেশি কিছু করার অনুমতি দেওয়া হয় নি। ক্লাসরুমের দেওয়াল না ফ্লোর নষ্ট হবে এমন কোন কাজ করা যাবে। সে অনুযায়ী কঠিন ই ছিল ক্লাস্রুম সাজানোর ব্যাপার টা। পরে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিই কিভাবে ক্লাস সাজাব।

সেই জন্য প্রথমে ক্লাস থেকে সব টেবিল বেঞ্চ বের করি, যারা যারা কখনো নিজের রুম ঝাড়ু দেয় নি, তারাও ওই দিন এই মহৎ কাজ করতে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। কে দিবে ঘর ঝাড়ু? খুব সুন্দর একটা প্রশ্ন।

এই প্রশ্নের উত্তর কতকটা এমন ছিল।

সবাই চান্স পাবে তবে যে বেশি ভালো করে দ্রুত জাহ্রু দিতে পারবে সেই এই কাজ করবে। রুম পরিষ্কার করার খেত্ত্রে এই প্রথম ধাপে কম কষ্ট ছিল না। দেখা গিয়েছে যে সবাই তো ঠিক করল ঠিকই, কিন্তু ঝাড়ু খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়েছিল। কারণ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সবাই রুম পরিষ্কার করবে। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছিল ফ্যান পরিষ্কার করার আর ছবি রং করার। আর সেসব শেষ হলে উঁচু কাজ গুলো করার, যেমন উঁচুতে পর্দা টাঙানো, ছবি আর বেলুন টাঙানো। আর বেলুন ফুলানোর কাজ তো প্রতিবারের মতো মোস্ট কমন কাজ আমার।

কাজ করতে করতে ক্লাস টাইম শেষ হয়ে যায় তবুও কাজ শেষ হয় না। তবে ওই দিন যে যতই কাজ করুক না কেন। কারো মুখে ক্লান্তির ছাপ পাওয়া যায় না। মিললেও অনেক কষ্টে। সবাই আনন্দের সাথে কাজ করে।

ক্লাস টাইম শেষ হলেই কোচিং টাইম শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন আমাদের গণিত কোচিং ছিল। আর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস করানোর প্রস্তুতি নিয়েই ম্যাথ স্যার আমদের মাঝে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্লাসে ঢুকে যখন খুব কম সংখ্যক ছাত্রী দেখলেম তখন তাদের দিয়ে অন্যদের ধরে ধরে আনিয়েছিলেন। তবে সবার অনুরোধে বেশি ক্ষণ ক্লাস করাতে পারেন নি। শুধু বোর্ডে একটা সংজ্ঞা লিখেছিলেন। সেটাই সবাইকে মুখস্ত করিয়ে পড়া ধরে ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন। আমরাও ভীষণ খুশি। আবার যে যার রুমে চলে যাই। রং করতে গিয়ে হাতে মুখে লেগেছে, তবে কম। সতর্কতা আরও বাড়ানো উচিত ছিল। তবে হই নি। অনেকেই ততক্ষনে চলে গিয়েছিল।

আমরা কয়েক জন ই ছিলাম। সব ঠিক ঠাক করছিলাম। আজ তার উপর সাধারণত জতক্ষন থাকার কথা তার থেকে ২ ঘণ্টা বারতি সময় চেয়ে নিয়েছিলাম আব্বু র কাছ থেকে। তাও শেষ হয় নি। মোটামুটি শেষ। ছবি আর বেলুন গুলো দড়ি দিয়ে টাঙানো হয়েছে। পর্দার সাথে বাহারি ওড়না। বেশি সাজাই নি। তবে যা সাজিয়েছিলাম, তাতে রুমের কোন সমস্যা হয় নি। শেষে আর দেরি না করে একা একাই নেমে যাই ৫ তলা থেকে। নেমে দেখি যে নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তাতেই উঠে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলি। গন্তব্য বাড়ি। তবে সেদিন যে আরিয়ান আমাকে দেখেছিল সেটা আমার মনে হলেও বেশি ভাবি নি এ নিয়ে। সারাদিনের দৌড় ঝাপের পর ঘুম শ্রেয়।

পরের দিন ঠিক সময়ে এসে যাই স্কুলে। এসে দেখি বেশি মানুষ আসে নি। সবাই বাহারি সাজ এ আছে। কিন্তু নিজেকে দেখে এবার রাগ হল। অন্যরা ভালোই সেজেগুজে এসেছে। কিন্তু আমাকে দেখে আমাদের ক্লাস টিচার ম্যাম বলেছিলেন- ন্যাচারাল বিউটি। যাই হোক সাজগজের ব্যাপারে আমি একদমই কাঁচা। কখনো সাজি নি, আবার সাজার ত্রি করি নি। মাঝে মধ্যে সাজগোজের সরঞ্জামের নাম শুনলে আমার মুখ থেকে একটা লাইন, বড়জোর দ্দুত লাইন ই বের হয়,

এইটা আবার কি? এটা কি খায় না মাথায় দেয়?

অবশ্য এই প্রশ্নে একবার উত্তর মিলে গিয়েছিল। সেই বার কয়েক জন মিলে টিকলি নিয়ে কথা বলছিল। আমার একই প্রশ্ন শুনে বলেছিল,

এইটা মাথায় দেয়।

কিন্তু এছাড়া আর একটাও মিলে নাই। আমি যখন একটা ছোট বাচ্চার সামনে বসে ছিলাম কোন সাজ ছাড়া মেয়েটি আমার কাছে এসে বলে,
~ তুমি সাজ নি কেন আপু?
~ আমি তো পারি না।
~ আপু তুমি কি মানুষ?
এই টুকু বাচ্চা আমি মানুষ কি না সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। সেদিন যে পরিমাণ রাগ হয়েছিল নিজেই মনে মনে বলেছিলাম যে,

নাহ আমি মানুষ না, আমি এলিয়েন, আমি আম, আমি গরু, আমি মানুষ বাদে দুনিয়ার সব কিছু। আরে বইন, আমি হোমো স্যাপিয়েন্স। মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম দিয়ে বলেন আর যাই বলে আমি জলজ্যান্ত মানুষ ই।

কিন্তু বাইরে একটা নকল চওড়া হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছিল মুখে। আজও ভাবলে নিজেই চিন্তায় পড়ি, আমি কি সত্যিই মানুষ?

অনুষ্ঠানে সবাই মিলে ভাগ করে খাবার ঘর থেকেই বানিয়ে এনেছিল। আমিও নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার দায়িত্বে ছিল পায়েস। বাকিরা অন্যসবের আয়োজন করেছিল। আম্মুর পিছনে ২ দিন পড়ে থেকে আম্মুকে রাজি করিয়েছিলাম পায়েস বানানোর জন্য। স্কুল এ গিয়ে সব শেষ বারের মতো দেখে নিই সবাই। তারপর আমাদের রুমে কলেজ সেকশনের সব শিক্ষক শিক্ষিকারা আসেন। সাথে আসেন প্রিন্সিপাল স্যার, ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাম, প্রতিষ্ঠাতা ম্যাম। সবাইকে নিয়ে আমাদের রুমেই ছত খাটো অনুষ্ঠান করা হয়। স্যার ম্যাম দের সামনে নৃত্য প্রদর্শন, গান, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি প্রদর্শন করা হয়। শেষে সবাই চলে যান অন্য রুমে তাদের আয়োজন দেখতে। আর আমরা স্যার ম্যাম দের খাবার আলাদা করে টিচার্স রুমে পাঠিয়ে অন্য সহপাঠীদের খাবারের ব্যাবস্থা করি। তারপর নিজেদের মধ্যে ছোট খাটো আয়োজন করি। কেউ জ্ঞান গায়, তো কেউ আবৃত্তি, কেউ নাচ প্রদর্শন করে সময় কাটাই।

তবে এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ যে বিষয়টা লেগেছে সেটা হল আমাদের বাঙালিদের অনুষ্ঠানে অন্য ক্লাস রুমে হিন্দি বা ইংরেজি গান ছাড়া হয়েছিল।

আর পরের যেটা খারাপ লেগেছিল, এটা একান্তই আমার খারাপ লেগেছিল। আর সেটা হল আমি যেই বাটি তে করে পায়েস এনেছিলাম, সেটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এর জন্য বাড়ি গিয়ে আম্মুর কাছে কম বোকা খেতে হয় নি। রোজ আম্মু একবার করে বলত,
~ তোর আর জীবনে কোন কথা শুনব না, বাটিটা রেখে আসলি কি করে তুই? সামনে বার রান্নার কথা বলতে আসিস।

ওইদিন আরেকটা ঝামেলা হয়েছিল। সেটা হল জীববিজ্ঞান মিস আমাদের ব্যাবহারিক খাতা ফেরত দিয়েছিলেন। একে তো ব্যাগ নিয়ে যায় নি। হাতে একটা ছোট ব্যাগ, তার পাশাপাশি অতো বড় খাতা ধরে রাখা এক বিরক্তিকর মুহূর্ত ছিল। এই নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল অনেকক্ষণ। এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিলাম রাস্তার দিকে কখন আমাকে নিতে গাড়ি আসবে। কখন আমি বাসায় যাব সেই নিয়ে। শাড়ি পরা বা শাড়ি পরে থাকা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হল বৈশাখ মাসের উত্তাপ। রোদ আর তার তাপ মিলে আমাকে অতিষ্ট করে তুলেছিল। তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা। চোখে মুখে এতক্ষণ হাসি থাকলেও এখন বিরক্তি প্রচণ্ড ভাবে জায়গা দখল করে নিয়েছে। মুখের প্রতি কোষে কোষে যেন বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে।

কিন্তু এই সময় যে ছেলেদের টিফিন টাইম সেদিকে আমার খেয়াল নেই। অনেক ছেলেরাই রাস্তার ওপারের বিল্ডিং থেকে নিচে নেমেছে। কিন্তু হু কেয়ারস? সেদিকে পাত্তা দেবে কে? একবার মনে হয়েছিল ছেলেদের ভিড়ে চেনা কাউকে দেখেছিলাম। কিন্তু সেই দিকেও পাত্তা দিই নি। গাড়ি আসতেই তাতে উঠে পড়লাম।

তার ২ দিন পর ছিল ছেলেদের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান। বলা যায় সবগুলো শ্রেণির সব শাখায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে এর প্রসার বেশি বড় হওয়ায় এক দিনে সবার টা দেখা সম্ভব হয় না। তাই অংশে অংশে বিভক্ত করা হয়। ১৫ আর ১৬ তারিখে বাচ্চাদের হয়েছে। ১৭ তারিখে আমাদের হল। ১৮ আর ১৯ তারিখে অন্যদের হবে। এমন করে। ১৯ তারিখে ছিল ওদের অনুষ্ঠান। সব ক্লাস কোচিং শেষ করে আমরা সবাই বাইরে বের হয়েছিলাম আর বিল্ডিং এর নিচে দারিয়েছিলাম। যাদের অভিভাবক এসেছিল তারা বাড়িতে চলে যায় আর আমরা যাদের এখনো আসে নি তারা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল।

বসার জায়গা পুরো ভোরে যাওয়ার দাঁড়ানোর দলে আমিও ছিলাম। শুধু দাঁড়িয়েছিলাম না, কাঁধে আর হাতে ব্যাগ নিয়ে হাতাহাতি করছিলাম। এই দেড় বছরে ভারী ভারী দুটো ব্যাগ বহন করার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সে দিকেও মনোযোগ নেই। সম্পূর্ণ মনোযোগ প্রথমে রাস্তার দিকে ছিল। কখন আমাকে নিতে আসবে।

হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি অনেকগুলো ছেলে পাঞ্জাবী পরে যাচ্ছে। প্রথমে বুঝি নি যে ওরা কারা। কারণ আমি এই স্কুলের মেয়েদেরই চিনি শুধু, ছেলেদের না। পরে অখন ওদের স্কুলের ভিতর ঢুকতে দেখলাম, তখন নিশ্চিত হলাম যে ওরা আমদের স্কুলেরই ছাত্র। আশেপাশে মানুষদের কথা থেকে তাই বুঝতে পারলাম। তবে সবার দিকে নজর পড়ে নি। আমার নজর কেঁড়ে ছিল আরিয়ান। সেও শালা লাল মিশ্রিত একটি পাঞ্জাবী পরে ছিল। চোখে সেই আগের মতো চশমা, জিন্সের প্যান্ট, স্পোর্টস শু, হাতে ঘড়ি। আর কাঁধে ব্যাগ ছিল না তবে। অন্যদের সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। বুঝলাম যে আজ ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলেদের অনুষ্ঠান হবে। তবে আজও সেই একই অনুভূতি হচ্ছিল।

জেলাসি

আরিয়ান কে সবাই দেখছে ঠিক আছে, ভাই এর দৃষ্টিতে দেখো। কিন্তু না, ওদের দেখার ধরন দেখে মনে হচ্ছে গিলছে। ক্লাস নাইন এর মেয়েরা দেখছে, আমার ক্লাসে মেয়েরাও দেখছে। এমন কি বড় আপুরাও দেখছিল। আরে বাবা এদের কি রহিম রুব্বান হওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল? কে জানে!

তার উপর ওদের সেই পর্যায়ের কথা বার্তা। শুনতেই ইচ্ছে করছিল সবার মাথায় একটা করে গাট্টা মারতে। কিন্ত সম্ভব না। ততক্ষনে আমাকে নিতে চলে এসেছিল। আমিও ভদ্র বাচ্চার মতো গাড়িতে ওঠার জন্য হাঁটা ধরলাম। শেষ বারের মতো ওর দিকে তাকাতেই ওর সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল। তারপর আমি চোখ নামিয়ে চলে গেলাম।


পর্ব ৮

এপ্রিলের মাস টা পেরোতে না পেরোতেই যেন পরীক্ষার ঘনঘটা শুরু হয়। যে পরীক্ষা এতদিন মাথার বহু উপর থেকে ভাসছিল, সেটা ধীরে ধীরে নিচে নামতে নামতে মাথায় এসে থেকে আর বিশাল ভাবেই বিদ্যুতের ঝটকা খাওয়ায় আমাদের বিনা পয়সায়। এতো পরীক্ষা হয় নি তেমন না। তবে এতদিন আমরা গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে এসেছি। একের পর এক পরীক্ষার গাড়ি আমাদের উপর দিয়ে বয়ে চলা শুরু করে বছরের মধ্য বর্তী সময় থেকে। তার উপরে কয়েক মাস পর এসএসসি পরীক্ষা। আগে যেমন বলতে পারতাম যে পরীক্ষার এখনো এক বছর বাকি, সে অধিকার টা দিনে দিনে হারিয়ে ফেলতে থাকি আমরা। আর আগের চার মাস পাত্তা না দেওয়ায় সেটা আমাদের উপরই ভারী হয়ে পড়ে।

পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটা কথাই আমাদের মাথায় ঘুরে,
~ আমি হাত দিয়ে যেই প্রশ্ন ছুঁই সেটাই আনকমন হয়ে যায়।
আর আমি হাত দিয়ে মাথা ছুলেই স্মৃতি হারিয়ে ফেলি।
তাই এটাই বলা সমীচীন যে পরীক্ষার চাপে এক পর্যায়ে আমরা সব কিছুই ভুলতে বসি।

আমাদের বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল বছরের প্রথম দিকেই। তবে সেটাও পিছাতে পিছাতে বছরের শেষে দিকে চলে যাচ্ছে যেন। যখনই জিজ্ঞেস করি, উত্তরে বলা হয়,
~ পরের মাসে হতে পারে।
কিন্তু এদিকে ছাত্র ছাত্রীরা যে পুরদমে উঠে পড়ে লেগেছে যে বিজ্ঞান মেলায় কি করবে, সেদিকে কারো খেয়াল আছে কি না কে জানে। আমাদের স্কুলের ক্ষেত্রে আরেকটি বৈশিষ্ট্য আমি বলতে পারি।

কোন স্কুল যখন কোন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আর অন্যান্য স্কুল কে আহ্বান জানায় তাতে অংশ নিতে, সে ক্ষেত্রে আমাদের স্কুলে নোটিশ আসে সব শেষ দিনে। এমন যে আজ জানাল আর কাল প্রতিযোগিতা। এতে শিক্ষার্থীরা রেগে গেলেও তারা এক দিনে কি করে প্রস্তুতি নেয় সেটা জানতে বড় ইচ্ছে করে। কিন্তু কাউকে সাহস করে জিজ্ঞাসা করা হয় নি। কিন্তু এসব ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে আরিয়ান যেন অন্যতম। এসব ক্ষেত্রে আমি নাম দিতাম ঠিকই, তবে আরিয়ান কে দেখার জন্য।

আর আফসোস, আজও আমি আরিয়ানের নাম জানি না, কাউকে জিজ্ঞেস করতেও পারি না, এক প্রকার লজ্জা এসে ভর করে আমাকে। যেমন যদি অনেকদিন কারো সাথে কথা হয় কিন্তু তাও তার নাম জানি না, এমন মানুষকে যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করি যে
~ তোমার নাম কি?

তাহলে তার অনুভূতি কি রকম হতে পারে। এটা ভাবতেই ওর নাম জানার ইচ্ছা মারা যায়।
~ দরকার নেই নাম জানার
এমন মনে হয় শুধু। কিংবা এমন কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করব, ছেলেটার নাম কি? এর প্রতিউত্তরে যেসব প্রশ্ন শুনতে হবে সেগুলো কতকটা এমন,
~ তুমি এতদিন চিন কিন্তু আজও নাম জানো না?
~ কি ব্যাপার? ছেলেদের খবরা শোনা হচ্ছে?
~ তুমি ছেলেদের নাম জানতে চাইছ? সত্যি কথা? এই সুখবর কবে আসলো?
~ ছেলেদের নাম? আমি তো কাউকে চিনিই না।

~ আমি আজই মিসের কাছে জানাব, তুমি কি না ছেলেদের নাম জানতে চাইছ?
~ আঙ্কেলের নাম্বার জানি কি ছিল? ওহ হ্যাঁ মনে পড়ছে। তবে অ্যান্টির নাম্বার টা আমি সিউর। আমি জানাবো না কি তুমি জানাবে?

এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া আরও ভয়ানক। প্রথম প্রশ্ন টা রুপন্তির কাছ থেকেই শুনতে হবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু দোষ টা তো ওরই। সেদিন সারাদিন চলে গেল। কিন্তু নাম বলল না আমাকে। আর শেষ প্রশ্নটা যদি কেউ করে তাহলে সেদিন আর রক্ষে নেই। তবে আরিয়ান কি আমার নাম জানে? অবশ্য জেনেও বা লাভ কি? জানা আর না জানা একই। না আমি ওর জীবনের কোন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।

পরীক্ষার আগে সবসময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আমি যেই বিল্ডিং এ থাকি সেই বিল্ডিং এর নিছ দিয়ে ওর কিছুদিন আগে এক লোক ঝাড়ু বিক্রি করতে আসে। এটা আমি লক্ষ্য করেছি। প্রতি বার পরিক্কার কয়েক দিন আগে থেকেই ওদের আনাগোনা পাওয়া যায়। কে জানে, এর সাথে আমাদের পরীক্ষার কি সম্পর্ক? আচ্ছা ওরা কি বুঝতে পারে যে এইখানে বসবাসরত বাচ্চার পরীক্ষা সন্নিকটে?

জানা নেই। তবে পরীক্ষার চাপে আরিয়ান বাবাজীবন যেন আমাদের এই স্কুল বিল্ডিং ভুলতে চলেছেন। তার দেখা পাওয়াও যেন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আচ্ছা, ভালো লাগার অনুভূতি কি এতো তীব্র হতে পারে যে দেখা না পেলে অতিষ্ট হয়ে উঠতে সময় নেয় না। শুধু ক্রাশ ই তো খেয়েছিলাম ওর উপর। তাই এতো দিন ধরে যে আমার ক্রাশ লিস্টে টিকে আছে সেটা ভাবতেই অবাক হচ্ছি। সাধারণত আমি খুব কম সময়েই একেক জনের উপর ক্রাশ খাই আবার ক্রাশ লিস্ট থেকে বাদ দেই। কিন্তু এই মানুষ কিনা কয়েক মাস ধরে আমার ক্রাশ লিস্টে আছে। ভাবতেই অবাক হই মাঝে মাঝে। তবে ছেলেটা যে কেন এতো পড়ুয়া, ভাবতেই কান্না পায়। কোথায় ও, কোথায় আমি?

তবে ক্রাশ খাওয়াই যায়। এটা জাতীয় খাবার। তবে ছেলেটা কেন বহুদিন যাবত এই স্কুল মুখী হয় নি, ভাবায় আমাকে। কারণ আগে তো তাও হাজিরা দিয়ে যেত, এখন হয়তো নিজেকে সম্পূর্ণ পড়ার মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। পড়ুয়া একটা!

প্রায় তিন কি সাড়ে তিন মাস পর আমাদের দেখা হয়েছিল। এটা অবশ্য আমার ফিজিক্স মিসের সুবাদেই। সোনা যাচ্ছিল যে সেপ্টেম্বর এর দিকেই বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এই নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে আমাদের ক্লাস ও। আর এটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ক্লাস টেনের সবার জন্য। আমিও আছি তবে গ্রুপ প্রজেক্টে। তাই বেশি চাপ নিই নি। হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবেই আছি।

সেদিন ও এসেছিল ফিজিক্স মিসের কাছে। মনে হয় মেলা সম্পর্কে জানতেই। আর নিজে কি করবে সেটা জানাতেও এসেছিল সেদিন। সবার পড়া শেষ বলে সবাই চলে গিয়েছিল তখন। আমিও চলে যেতেই ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম। বই খাতা সব ঠিকঠাক ভাবে নিয়েছি কি না। নাহলে বই হারালে সেটা খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হয়। অনেকে খুঁজেও পায় না। শেষমেশ কার না কার ঝালমুড়ির প্যাকেট হিসেবে পাওয়া যায় সেই খাতার পৃষ্ঠা। তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম ভেবে আগে থেকেই সচেতন থাকার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দরজার দিকে যাব, তখন নজরে পড়ল ম্যাম দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। কারো সাথে কথা বলছেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার দিকে ফিরলেন। তখন দেখলাম দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আরিয়ান কে। বেচারা ৫ তলা উঠতেই বেশ হাঁপিয়ে গিয়েছে। অবশ্য হওয়ারই কথা। এই দালানের সিঁড়িগুলো সাধারণ দালানের থেকে পরিমাণে বেশি। তাই বেশি কষ্ট করতে হয়। আর যদি কেউ একেবারে উঠে পড়ে, কোন থামা থামি ছাড়াই, তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না যেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। কোন মতে রুমে গিয়ে ফ্লরেই বসে পড়ে, না হয় যদি শোয়ার ব্যবস্থা কোন দিন করে তাহলে শুয়েও পড়বে। অবশ্যা শুয়ে পড়তে দেখেছি কয়েকজনকে।

আমার চিন্তা ভাবনার মধ্যে মিস বলে উঠলেন,
~ তুমি একটু ওর কাছ থেকে ফাইল এনে আমার কাছে পৌঁছে দেবে? আসলে ওর কাছে যে ফাইল টা আছে সেটা আমার দেখা লাগবে আর ও তো একটা কারণে এসে দিয়ে যেতে পারবে না তাই।
~ কবে দিতে হবে ম্যাম?
~ পরশু।
~ ওকে পারব।
~ আচ্ছা আরেকটা কাজ করো তাহলে, কাল পারলে ওর সাথে গ্রুপ স্টাডি কর। তোমরাও তো প্রজেক্ট বানাচ্ছ, ও হেল্প করতে পারবে আর ও হেল্প পাবে। তাছাড়া আমারও কিছু প্রশ্ন থাকলে তুমি আমাকে বলে দিতে পারবে ওর প্রজেক্ট সম্পর্কে।
~ ম্যাম বাট আব্বু অনুমতি দিবে না তো।
~ আমি তোমার আব্বুর সাথে কথা বলে নিব।
~ ম্যাম আমি বলে নিব, আনি শুধু অনুমতি দেওয়ার কথা বলেন।
~ ওকে আমাকে ফোন কর।
~ আজ রাতে?
~ ঠিক আছে।
~ থ্যাংকস ম্যাম।
~ ইটস ওকে।
বলে আরিয়ানের সাথে বের হয়ে আসলাম। আর কথা বলতে বলতে নিচে নামলাম। কিভাবে ওর বাসায় যাওয়া হবে, কতক্ষণ লাগবে এসব নিয়ে।

নিচে নেমে ওর থেকে আলাদা হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। বিশেষ করে আমরা পড়া নিয়ে কথা বললেও নানান গুজব ছড়াবে প্রত্যক্ষ দর্শীরা।

গাড়ি আসলে ব্যাগ আগে রেখে নিজে বসে পড়লাম। তারপর নিজের মাথা এলিয়ে দিলাম গাড়ির সিটে। গাড়ি চলা শুরু করলে ভাবতে থাকলাম যে কেন মিসকে সব বলতে মানা করলাম।

আব্বু এমনিই মেয়েদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করার কথা বললেই বলেন যে
~ ওদের বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। তার বদলে তুমি ওদেরকে আমাদের বাসায় ইনভাইট করো।
সেখানে একটা ছেলের বাসায় যাবো? অসম্ভব। কিন্তু মিশে কাজটাও জরুরি। তাই আমি রাজি হলাম। আব্বু কেও এই বলে রাজি করাতে হবে যে গ্রুপ স্তাদির জন্য যাচ্ছি। স্কুলেই থাকব। আবার শেষ হলে স্কুল থেকে চলে আসবো।


পর্ব ৯

সেদিন ছিল শুক্রবার। স্বভাবতই স্কুল বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু মাঝে মধ্যে এই দিনেও কোচিং হয়ে থাকে। এতে ছাত্রছাত্রীদের ও আপত্তি থাকে না। তারাও হয়তো সারা সপ্তাহে কোন না কোন কারণে কোচিং করার সুযোগ পায় না। তারাই শুক্রবার সময়টাকে বেছে নেয়। এই শুক্রবারে কোচিং হওয়ার সুবাদে স্কুল খোলা থাকে। তবে ৫ টা বিল্ডিং ই নয়। শুধু একটা বিল্ডিং এর একটা পুরো ফ্লোর। সেখানেই সময় অনুযায়ী পড়ান শিক্ষক শিক্ষিকারা। তাই আব্বুকে রাজি করাতে বেশি কষ্ট করতে হয় নি। কারণ ক্লাস নাইনে থাকতে আমাকেও ছুটির দিনে বেশ কয়েকবার কোচিং করতে হয়েছিল। তার উপর মিস বলে দিয়েছেন যাওয়ার কথা। তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। আমি স্কুল এ পৌঁছে গাড়ি ছেড়ে দিই যেটা আম্মুর অফিসে গিয়ে থাকবে। আমার স্কুল থেকে আম্মুর অফিস বেশি দূরে, আবার দুরেও নয়। বাসে গেলে বা গাড়িতে গেলে ১০-১৫ মিনিট মতো সময় লাগে। তাই সেখানেই গাড়ি রাখা হয়। স্কুল বিল্ডিং এর নিচেই দাঁড়িয়েছিলাম।

সময়মত আরিয়ান এসে আমাকে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল। আমি ওর পিছনে পিছনে হেঁটে চলেছি। মন টা আমার বেশ গান প্রবণ ছিল। তাই মনে মনে গেয়ে চলেছিলাম,

এই পথ যদি না শেষ হয়।
তবে কেমন হত তুমি বল তো।

বেশি দূরে ছিল না আরিয়ানের বাসা। তাই বেশি সময় লাগলো না ওর বাড়ি পৌঁছাতে। বাড়ি যেতেই অ্যান্টি দরজা খুলে দিল। আমি সালাম দিলে হাসি মুখেই জবাব দিলেন উনি। আরিয়ান কে দেখে মনে হল ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। আর সেভাবেই বেরিয়ে গিয়েছিল আমাকে নিতে। অগোছালো চুল, চশমাটা পরতে ভুলে নি তবে। আমাকে বসতে দিল ওর রুমের এক চেয়ারে। টেবিলের সাথে ছিল চেয়ার টি। আরিয়ান আমাকে বসিয়ে চলে গেল। তাই আমিও কোন কাজ না পেয়ে পুরনো এক অভ্যাস জেগে উঠল।

কারো বাড়ি গেলে আমি দুটো কাজ করি। এক, চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকি, আর নড়ি না, এই বসে থাকার জায়গাটা বিশেষত বারান্দা হয়ে থাকে। আর দুই, সামনে টেবিল বস বুকশেলফ টাইপ কিছু দেখলে সেখানে কোন গল্পের বই আছে কি না খোঁজা। আর পেয়ে গেলে সেটা নিয়ে আবার কোন এক জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে পড়া, আর সেখান থেকে উঠি না। জতক্ষন না কেউ ডাক দেয়।

আরিয়ানের বাড়ি গিয়ে দ্বিতীয় কাজটি করেছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে সামনেই একটি বই পেলাম, হ্যামলেট এর বাংলা অনুবাদ। দেখে খুব পড়তে ইচ্ছে হল। আমার মধ্যে এই ব্যাপারে আমি বেশ অবাক হই। আমি বই পড়ি। তবে এক্ষেত্রে পার্থক্য হল আমি গল্পের বই পড়লে পুরো ৯৯% মনোযোগ তাতে দিতে পারি, তবে পড়ার বই, পাঠ্য বই এর ক্ষেত্রে সেই মনোযোগ আসতে চায় না। কেউ আমাকে গল্পের বই পড়তে দেখে এটাও ভেবেছেন যে,

গল্পের বই যখন এতো মনোযোগ দিয়ে পড়ে, তখন পড়ার বই না জানি কত মনোযোগ দিয়ে পড়ে?

তাদের মন্তব্য – আমি স্কুলের পড়া পড়লে আমার ক্ষেত্রে মনোযোগ ইন্টু হান্ড্রেড হয়ে যায়। কিন্তু আসলে কি হয়, সেটা আমিই জানি।

কিছুক্ষণ পর রুমে আরিয়ান ঢুকল ঠিকই কিন্তু সাথে আরও মানুষ এলো। সবার কাধেই ব্যাগ। মনে হল ওরা আরিয়ানের বন্ধু বান্ধব। এতো মানুষের মধ্যে নিজেকে বড্ড বেখাপ্পা মনে হচ্ছে। আমি তখনও চেয়ারে বসে আছি। কিন্তু তাড়াহুড়োয় হ্যামলেট বইটা রাখা হয় নি। তাই আগের মতই আছি। আরিয়ানের রুম টা বড় হওয়ায় সবাই বেশ ভালভাবেই ধরে গেল। ৭-৮ জন মতো এসেছে। ৫ জন ছেলে আর ৩ জন মেয়ে। ওরাও নিজেদের মতো কথা বলছে।

হয়তো জানে যে আমি প্রজেক্টের কাজের জন্যই এসেছি তাই আমাকে কিছু বলে নি। নিজেদের মাঝে কথা বলে যাচ্ছে। তবে বাংলিশ ভাসা ব্যবহারের কি হল জানি না, বাংলার থেকে ইংরেজিতেই বেশি কথা বলছে। কথা ফাকে ফাকে বাংলা দু একটা হয়তো ভুলে চলে আসছে। এমনটাই মনে হবে। এজন্যই অত্যাধুনিকতা জিনিসটা আমি অপছন্দ করি। বললে পুরো কথাই ইংরেজিতে বলা হোক।

এদের কথা শুনে ভবানীপ্রসাদ মজুমদার এর বাংলাটা ঠিক আসে না – কবিতাটা মনে পড়ে যায় বারবার। যতবার মানুষের কাছে অত্যাধুনিক ভাষা শুনি, ঠিক ততবারই।

ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।
ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে
‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।

হুহ আগে এই কবিতা পড়ে হাসতাম, খুব সুন্দর ভাবে যেমন ছন্দের মিল দিয়েছেন কবি, তেমনি আনন্দে পূর্ণ একটি কবিতা। পরে যখন বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলাম, সত্যি অবাক হয়েছিলাম, সাথে মুখে ফুটেছিল তাচ্ছিল্য ভরা হাসি। কিন্তু এটাই বাস্তবতা।

এখন বলা যেতে পারে, অনেক ইংরেজি শব্দের বাংলা অনুবাদ কঠিন বা সেগুলোর প্রচলন নেই বলে অনেকে জানে না। হ্যাঁ, অবশ্যই কিন্তু তাই বলে যেগুলো জানে সেগুলো ও তো না বলে বলে হারিয়ে ফেলছে মানুষ। এমন করলে কি করে টিকে থাকবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব? টেবিল কে চৌপায়া না বলুন, মানা যায়। কিন্তু যদি এমন একটা লাইন বলা হয় যে- আমি youকে like করি না। এমন লাইন শুনে কি মনে করবেন? আমি তোমাকে পছন্দ করি না? না কি আমি যুক্তরাষ্ট্র (UK= United Kingdom) পছন্দ করি না। বড্ড ভাবায় আমাকে।

আরিয়ান আমাকে সেখানেই বলল বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব কি না? আমি রাজি হয়ে গেলাম। অবশ্য হাতের কাছে তখনও হ্যামলেট বইটা খোলা অবস্থায় ছিল। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
~ আমি তাহলে কি ততক্ষণ এই বইটা পড়ার অনুমতি পেতে পারি?
~ হুম অবশ্যই, আমি দুঃখিত আসলে ওরা হঠাৎ করেই চলে এলো না জানিয়ে। ওদের ফিরিয়ে দিতে পারছি না।
~ চিন্তা করবেন না। আমি কিছু মনে করি নি। আপাতত কোন বই পেলেই হল, সময় কাটানো যাবে। কিন্তু বেশি দেরি করবেন না। আমাকেও বাসায় ফিরতে হবে।
~ আপনি খুব পড়ুয়া।
~ এই না না, একদমই না। এই কথা ভাবার কোন কারণ নেই। আমি আসলে গল্পের বই এর কথা বলছিলাম। তবে বলতে পারেন গল্পের বই পড়ুয়া। এটা ঠিক হবে। বেশি কথা বলে ফেললাম। এবার আপনি যান।
~ ঠিক আছে।
বলেই চলে গেল আরিয়ান ওর বন্ধুদের কাছে। আরিয়ানের রুমের এক কোণে টেবিল আর চেয়ার, আমি সেখানেই ছিলাম। রুমের মাঝে গোল টেবিল তার উচ্চতা কম। মাটিতে সবাই গোল হয়ে বসেছে। আর পড়ালেখা করছে। তখন আমি বইয়ে মগ্ন থাকলেও একটা উক্তি বলতে খুব খুব ইচ্ছা হচ্ছিল,

ইয়ে আরিয়ান কা ঘার হ্যায়
ইয়ে আরিয়ান ওর উসকা দোস্ত হ্যায়
ওর ইয়াহা প্যাড়াই হও রাহি হ্যায়
যাহা মে কুছ নেহি কার রাহা হু।

পড়তে পড়তে ঘণ্টা এক দেড় পার হল, সবাই এখনো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। তবে আমার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। আরিয়ানের মা এসে জুসের গ্লাস দিয়ে গিয়েছেন ঠিকই তবে সেটা ছুয়েও দেখি নি। আজকাল গল্প পড়তে গেলেও ঘুম আসে যদি উত্তেজনা পূর্ণ গল্প না পাই। তার উপর এটা নাটক। আর প্রতিটা সংলাপ পড়তে আমার ঘুম আরও বেড়ে যাচ্ছে। কি করে যে এতক্ষণ চোখ খুলে রেখেছি, সেটা আমি নিজেও জানি না।

হঠাৎ চোখ আরিয়ানের দিকে যেতেই ঘুম সব চলে গেল। নাহ, এবার আরিয়ান কে দেখে মুগ্ধ হয়ে ঘুম কাটে নি। কেটেছে রাগের জন্য। আরিয়ান বসেছে ঠিক আছে। ওর দুই পাশে ২ টা মেয়ে আর বাকি একটা মেয়ে ওর পিছন থেকে উপরে উঠে আসছে যেন। এখন টুপ করে গালে ঠোঁট না ছুঁইয়ে দিলেই হয়। নাহলে আমি ওর চুল ছিঁড়ব। টানটান উত্তেজনা। আমার ঘুম তখনই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তবে অপেক্ষায় আছি, কখন ওর চুল ছিঁড়ব ভেবে। কিন্তু আমার আশায় পানি ঢেলে দিয়ে ও ওখান থেকে উঠে গেল।

হঠাৎ আরিয়ান ওই দুই মেয়ের মাঝ থেকে উঠে আমার দিকে আসলো, এসে টেবিল থেকে বই নিয়ে যেই চলে যেতে নিবে, অসতর্কতায় জুসের গ্লাসটা আমার উপর পড়ে যায়। ভাগ্যিস ওই মেয়েটার উপর রাগ করে জুসের গ্লাসটা বেশ খানিকটা খালি করেছিলাম, নাহলে আজ জুসের গোসল হয়ে যেত। এদিকে আরিয়ান আমাকে সরির পর সরি বলেই যাচ্ছে। আরিয়ানের এমন কথার বেগ শুনতে পেরে বাকিরাও আমাদের দিকে তাকাল। আমি কোনোমতে আরিয়ানকে থামিয়ে সেখান থেকে বাথরুমে চলে গেলাম। কামিজের জুসে ভেজা অংশ টুক পানিতে ভিজিয়ে পরিষ্কার করে নিজের জামা কে ধন্য করেই তারপর বের হলাম।

দেখলাম সবাই একে একে চলে যাচ্ছে, আরিয়ান আমাকে বলল ওই গোল টেবিলটায় বসতে। আমিও মাটিতে বসে পড়লাম। কিন্তু কারো অসাবধানতায় আমাকে আবার ভিজতে হল। জানি না কার। তবে এবার আমাকে একেবারে ভিজে চুপচুপে হতে হয়েছে। পুরো এক বালতি পানি মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে, আর আমি তাতে সাতার কাটছি। মানে পুরো ভিজে গিয়েছি। আরিয়ান এসে এই অবস্থা দেখে ওর মুখটা দেখার মতো ছিল তখন। একেবারে অপরাধী ফেস। দু চোখ দিয়ে যেন হাজ্র বার সরি বলে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে বলার সাহস পাচ্ছে না। তাই আমিই ওকে বললাম,
~ চিন্তা করবেন না, আমি ঠিক আছি। আমাকে শুধু একটু সাহাজ করতে পারবেন?
আরিয়ান অনেক কষ্টে বলে উঠল,
~ কি?
~ আমাকে অ্যান্টির কোন একটা ড্রেস দিতে পারবেন? দরকার পড়লে আপনি অ্যান্টিকে ডাকুন, আমি বলে দিচ্ছি।
~ কিন্তু মা তো এখন বাসায় নেই, বাজারে গিয়েছে।
~ তাহলে আপনি আমাকে একটা ড্রেস বের করে দিন।
~ আমি?
~ হুম আপনি।
~ ওকে। আচ্ছা, আপনি শাড়ি পড়তে পারেন?
~ কেন?
~ আসলে আমার মা বেশিরভাগ সময় শাড়ি পরেন, তাই অন্য ড্রেস খুঁজে পাবো কি না
~ সমস্যা নেই।
বলতেই আরিয়ানের দুই চোখে খুশির ঝলক দেখলাম। কিন্তু কেন?

আরিয়ান কথা থেকে একটা শাড়ি বের করে আনল, সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ আর পেটিকোট। আমি অবাক হয়ে গেলাম। একটা নর্মাল শাড়ি দিলেই তো। এটাও সাধারণ, তবে এটাকে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ বলা যায়। আমি আবার ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আসলাম। আর জামা ধুয়ে বেলকনিতে নেড়ে দিলাম। তারপর গিয়ে দেখি আরিয়ান রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সাথে ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু মনে হল ও আমার পাশাপাশি আসে নি। পরে তাকিয়ে দেখি ও আসেই নি। ওকে আবার ডাকায় কোন এক ভাবনা থেকে বের হয়ে আসলো।

তারপর একসাথে বসলাম দুজন। খুব সুন্দর ভাবে ও আমাকে বুঝিয়ে দিল যে কি প্রজেক্ট। তাছাড়া সব কিছু এতো সুন্দর ভাবে সাজিয়ে লিখেছে যে কারো কিছু ব্যাখ্যা করা লাগবে না। আমি অবাক হয়ে ওর প্রজেক্ট সম্পর্কে জানছিলাম। পর প্রজেক্ট টা পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের। ওরা একটা ড্রোন বানাবে। আর সেটা উড়িয়েও দেখাবে।

ওকে শুভকামনা জানিয়ে আমি নিজের জামা গুলো দেখলাম। সেগুলো তখনও ভেজা। আরিয়ান কে জানাতেই ও সাথে সাথে বলল যে আমি যেন শাড়ি পরেই যাই। আর উপায় না পেয়ে আমি আমার জামাগুল ব্যাগে নিয়ে শাড়ির উপর বোরকা আর হিজাব পরে নিলাম। আরিয়ান আমাকে দেখে অবাক হল। আমি আসলে এগুলো পরেই এসেছিলাম, তবে গরমের পরিমাণ এতই বেশি ছিল যে ওগুলো খুলে বাগে রেখেছিলাম। তারপরই আরিয়ান আমাকে নিতে আসে।

আমি যাওয়ার সময় ও আরিয়ানের ফোন দিয়ে আব্বুকে কল করি যেন গাড়ি স্কুলে পাঠিয়ে দেয় ড্রাইভারকে বলে। আর আরিয়ানের সাথে স্কুল পর্যন্ত গিয়ে সেখানে অপেক্ষা করি। তবে একটা কথা আমার মাথায় তখনও ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি শাড়ি পরতে রাজি হলে আরিয়ান হাত মুঠ করে ইয়েস কেন বলেছিল?


পর্ব ১০ (অন্তিম)

আরিয়ানের বাড়িটা চিনতাম তাই সেদিন গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। শাড়িটা ফেরত দেওয়া হয় নি তখনও। অনেকবার আরিয়ানের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিভাবে দেখা করতাম। আমি জানতাম না ও এই ৫ টা বিল্ডিং এর মধ্যে কোণ বিল্ডিং এর কোণ ক্লাস্রুমে পড়ে। তাই খোঁজার চেষ্টা করি নি। এতে করে নিজের হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ প্রথম তিনটি বিল্ডিং পাশাপাশি হওয়ায় ভেতরে বিভিন্ন তলায় সিঁড়ি রয়েছে যার সাহায্য এ এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং এ যাওয়া যায়। এতে করে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই চেষ্টা করতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছি। বেশ কয়েকবার ফুচকা ঝালমুড়ি কিনতে আগের একই সময়ে নিচে নেমেছি, কিন্তু তাতেও লাভ হয় নি। তাই এক দিন সিদ্ধান্ত নিলাম যে যাই হোক, ওর বাড়ি গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবো। ওখান থেকে তো ও হারিয়ে যেতে পারবে না।

স্কুল ছুটির পর যে ব্রেক টাইম থাকে, সে সময় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে ওর বাড়ি যাই। অ্যান্টি দরজা খুলে দিলে প্রথমে সালাম দিই। উনিও জবাব দেন। তারপর আমি উনার হাতে যে শাড়িটা দিব, খেয়াল হল আমার কাছে ব্যাগ নেই। তাড়াহুড়োয় ব্যাগ আনাই হয় নি। অবশ্য ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু শাড়িটা ও আনা হয় নি। কোনোমতে শুধু অ্যান্টির খোঁজ খবর নিয়ে ফিরে আসলাম। এসে নিজ ক্লাস রুমে ঢুকে দেখি রসায়ন ম্যাম তার পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। তাই আমি বসে পড়ি। ছুটির সময় যে স্কুল থেকে বের হব তার সুযোগ নেই। তাই অগত্যা বাড়ি ফিরতে হয়েছিল সেদিন।

কিন্তু তার বেশ কিছু দিন পর আরিয়ানের সাথে দেখা হয়। একইভাবে। ও সেদিনও পদার্থবিজ্ঞান মিসের সাথে দেখা করতে এসেছিল, আর উনি আমাকে পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ মিস বলে উঠলেন,
~ অদ্রিতা, আরিয়ানকে নিয়ে তোমাদের জীববিজ্ঞান মিসের কাছে যাও। ও মিসকে চিনে না।
এই দিন মিসের উপর আমার এতো ভালোলাগা কাজ করেছিল, যে বলে বোঝানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত এতো মাস পর এসে আমি ও র নাম জানতে পারলাম। হাসিমুখেই মিসের কাছে নিয়ে গিয়ে উনাদের কথা বলিয়ে দিই। ওদের কথা থেকে যা বুঝলাম, আরিয়ান এই বিজ্ঞান মেলায় দুটো প্রজেক্ট পরিদর্শন করবে, তার মধ্যে জীববিজ্ঞান ও রয়েছে। এরপে আমার মনে হল, আরিয়ান যে পড়ুয়া ছেলে, নিশ্চিত ১২ টা বিষয়ের মধ্যে সব গুলোর ই প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। তার মধ্যে আমি শুধু দুটো সম্পর্কে জানি। তাই ওখান থেকে সরে আসলাম। বেশি দেরি করলে মিস বকা দিত। শাড়ির কথা মনে পড়তেই মনে মনে নিজেকে বকলাম কতক্ষণ। এতো দিন এনেছি, আরিয়ান মহাশয়ের খবর নাই, আজ আনি নি, আজ উনি একবারে আমার দুই চোখের সামনে হাজির।

ক্লাসের মাঝে আব্বু কল করল, ড্রাইভার নিতে আসতে পারবে না। তাই আজ আমাকে একাই বাড়ি ফিরতে হবে। ক্লাস শেষে নিচে এসে স্কুল গেট পার করলাম। তারপর রাস্তা পার করতে যাবো, তখন সামনে তাকিয়ে দেখি আরিয়ান ও দাঁড়িয়ে আছে। কারো অপেক্ষায়। ও আমাকে দেখে রাস্তা পার করে আমার কাছে আসলো। ওকে আসতে দেখে ঘাবড়ে যাই।
~ আজ আপনি একাই যাচ্ছেন?
~ হ্যাঁ, আসলে গাড়ি আসে নি, তাই আজ একাই যেতে হবে। আপনি এই সময়ে এখানে?
~ আমাদের আজ বেশি ক্লাস হয় নি। কোন এক কারণে আগেই ছুটি দিয়েছে। তাই বাড়ি ফিরছিলাম। তো আপনি কিভাবে যাবেন?
~ বাসে।
~ হোয়াট? বাসে?
~ হ্যাঁ। কেন? বিশ্বাস হয় না?
~ না মানে, বাসে যাবেন তাও এতো ভারী ব্যাগ নিয়ে।
~ সমস্যা নেই, এই পরিস্থিতিতে বাসেই যেতে হবে।
~ রিক্সায় যাওয়া যায় না?
~ যায়, কিন্তু এখন পাওয়া যাবে না, আর যাদের পাওয়া যাবে তারা বেশি ভাড়া নিবে, যেটা আপাতত নেই আমার কাছে। তো কখনো আমাদের বারিতেও বেড়াতে আসবেন।
~ আমি? চাইলে আজও নিয়ে যেতে পারেন।
~ সত্যি যাবেন? মানে আর ইউ সিউর?
~ হুম।
~ মজা করছেন না তো? আমি কিন্তু সত্যিই নিয়ে যাবো, তাও বাসে।
~ হ্যাঁ, আমি যাবো।

ওর রাজি হওয়াতে দুজন এক সাথে মেইন রোড পার হয়ে ওপারে গেলাম। বাস পেতেই তাতে প্রথমে আরিয়ান কে উঠিয়ে নিজে উঠে পড়লাম। আমার বাড়ির রাস্তা ছিল সোজা রাস্তা, কোন মোড় নেই। তাই চিনতে কারোর ই সমস্যা হয় না। আমি আর আরিয়ান পাশাপাশি বসেছিলাম। তবে ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম না। আড়চোখে দেখছিলাম শুধু। সে হয়ত প্রথমবার বাসে চড়েছে। তাও এতো দ্রুত বাসে উঠতে হয়েছিল। অবাক হয়ে ছিল। বাস থেকে নামতেই আবার রাস্তা পার হয়ে রিক্সায় উঠিয়ে দিলাম ওকে আর নিজের ব্যাগ ওর কাছে দিলাম। একই রিকশায় ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব না।

তার উপর আমাদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য গলির রাস্তার যত প্রশংসা করব, কম পড়বে। ভাঙাচোরা রাস্তা যদি কেউ দেখাতে বলে তাহলে এটাই যে এ্যাওয়ার্ড পাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ব্যাগ দিয়ে হালকা মনে হওয়ায় এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। দেখলাম আরিয়ানের রিকশাও থেমেছে। ভাড়া দিয়ে আরিয়ানের সাথে বিল্ডিং এ উঠতে শুরু করলাম, চার তলায় এসে থেমে ওকে দেখিয়ে বললাম যে কোনটা আমার বাড়ি। বেল বাজাতেই আরিয়ান জোর করল যে ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। আমি ওকে বললাম যেন শাড়ি নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, কিন্তু শাড়ি নিয়ে এসে দেখি আরিয়ান উধাও। বারান্দা দিয়ে দেখলাম একটা রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছে।

একদিন আব্বু বলে উঠল, আমরা বাড়ি পাল্টাব। শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু পরে আব্বু যে ব্যাখ্যা শোনাল, তার সারাংশ এই যে ~ – আব্বু আমাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট বানিয়েছেন, আর আমাকে আবার স্কুল বদলাতে হবে। শুনতেই অবাক হলেও কিছু করার ছিল না। পরের দিন গিয়ে আরিয়ানের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সম্ভব হয় নি। শাড়ি নিয়ে সেদিন আরিয়ানের বাড়ি গিয়ে অ্যান্টির হাতে ধরিয়ে এসেছিলাম ঠিকই, কিন্তু আরিয়ান কে দেখি নি। ছুটির পর স্কুলের খাতা কেনার বাহানায় ৩ নং বিল্ডিং এ গিয়েছিলাম, কিন্তু কোথায় খুঁজব ওকে জানতাম না, তাই ফিরে আসতে হয়েছিল। তবে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। কেন যাওয়ার আগে শেষবারের মতো ওকেই দেখতে চেয়েছিলাম, তখন জানা ছিল না আমার।

সেদিন রাস্তায় কোন এক কারণে অনেক মানুষ মিলে অবরোধ করেছিল। পুরো রাস্তা আটকে রেখেছিল। কিন্তু এর পরের দিন আমার পরীক্ষা ছিল, তাছাড়া আরিয়ানের সাথে দেখ আ হয় নি বলেও মন খারাপ ছিল। তাই মাঝারি ব্যাগ টা বড় ব্যাগে ঢুকিয়ে সেটা কাঁধে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। আব্বুকেও ফোনকরে কোনোমতে বুঝিয়েছিলাম, যে আমি হেঁটে যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতেই বাসায় পৌঁছেছিলাম। সেদিন জানতে পারলাম যে আমার বাড়ি থেকে স্কুল হেঁটে এক ঘণ্টার রাস্তা। মাঝ পথ থেকে বাস নেওয়ার সুবিধা থাকলেও নিই নি। কারণ একে তো ফাঁকা রাস্তা ছিল। যেকোনো কিছু হতে পারতো আমার সাথে। যেখানে ভরা রাস্তায় কারো কিছু হলে একটা মানুষও এগিয়ে আসে না, সেখানে ফাঁকা রাস্তায় কিছু হলে তো কথাই নেই!

সময়টা এসএসসি র আগে যে মডেল টেস্ট হয়, তার আগের সময় ছিল যখন আমরা বাসা, স্কুল বদল করেছিলাম। মডেল টেস্টের আগে হওয়ায় পড়ালেখায় কোন প্রভাব ফেলে নি। আর স্কুল কর্তৃপক্ষ ও কোন আপত্তি করে নি। তারপর আমাদের আর দেখা হয় নি।

~ তারপর কি হল?
~ আর কি হবে? আর আমাদের দেখা হয় নি।
~ ইশ, যদি দেখা হত, তাহলে আরিয়ান আজ আমাদের জিজু হত রে অদ্রি। কিন্তু তুই তো বিয়ে করে ফেললি।

~ সমস্যা নেই যে আছে সে কি কম নাকি রে তিশা?
~ কি করছ তোমরা? অদ্রি নিশ্চয়ই আবার ১৫ বছরের গল্প শোনাচ্ছে তোমাদের?
অদ্রিতা আর তিশা কথা বলছিল। পিছন থেকে চশমা চোখে দিতে দিতে একটি ছেলে এসে কথাটি বলল তখন।
~ সো তিশা, এই হল আমার হাসবেন্ড। আর হাসবেন্ড এই হল আমার ফ্রেন্ড তিশা।
~ হাই জিজু। আসলে আমিই জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে।
~ তাহলে ও নিশ্চয়ই আরিয়ানের কথাও বলেছে।
~ হুম, কিন্তু আপনি আরিয়ানকে চিনেন কি করে?
~ ও তোকে তো আবার ওর নাম বলা হয় নি তিশা। আমি আবার রুপন্তির মতো করব না। সো মিট মাই হাসবেন্ড আরিয়ার চৌধুরী।
~ হোয়াট? জিজুই আরিয়ান? সেই আরিয়ান?
~ হুম।

~ কিন্তু কিভাবে? তুই যে বললি আর তোদের দেখা হয় নি।
~ হুম, আসলে তারপর সত্যিই আমাদের আর দেখা হয় নি। কয়েক বছর আগে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ফার্স্ট দেখা টা হয়েছিল আমার বাসায়। বাবা আমার জন্য ছেলে দেখছিলেন। আর প্রথম যে ছেলেটা দেখতে এসেছিল, সে আরিয়ান ই ছিল। তাই আর কোন ছেলে বা পাত্র দেখা হয় নি। ওর সাথেই বিয়েটা হয়ে যায়। অবশ্য ছোট থাকতে আলাদা হওয়ায় সুবিধাই হয়েছে।
~ কিভাবে?

~ বয়সটা তখন ১৫ ছিল আমার। কি বড়জোর ১৬। কিই বা বুঝতে পারতাম? আবেগের বসে গিয়ে অনেক কিছুই করতে পারতাম। আর সব কাজ যে শতভাগ ঠিক বা ভালো হবে, সেটার কোন নিশ্চয়তা নেই। তার থেকে আলাদা হওয়ার পর আর অন্য কোন ছেলের প্রতি ওই অনুভূতি আসে নি আমার। তখন বুঝতে না পারলেও বড় হওয়ার সাথে সাথেই একটু একটু করে বুঝতে শুরু করি আরিয়ান আমার জীবনে কি ছিল। তবে আব্বু আম্মুর সিদ্ধান্তের উপরে যে

~ আজ আমি তোর আর জিজুর একটা ছবি তুলব আর আমার পরবর্তী গল্পের বইয়ে এটা ই দিব।
~ কিন্তু
~ চিন্তা করিস না, লেখিকার নাম থাকবে না। ছবিটাও বইয়ে দিব না। তবে আমি যেহেতু বই পাবলিশ করি, তাই এটা না দিয়ে থাকতে পারব না। প্লিজ? জিজু?
~ ওকে।
বলেই সম্মতি জানাল আরিয়ান। আর তিশা আমাদের দুজনের ছবি তুলে নিল।

লেখনী – সাদিয়া সৃষ্টি

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “বয়সটা তখন ১৫ ছিল (শেষ খণ্ড) – abegi diner golpo” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – বয়সটা তখন ১৫ ছিল (১ম খণ্ড) – Obuj diner golpo

আপনারা এখন অনেক প্রশ্ন করতে পারেনঃ

১। আপু গল্পটা এরকম কেন হল?

==> আপু গল্পটার নামই ছিল বয়সটা তখন ১৫ ছিল। তাই ১৫ বছর বয়সে একটা মেয়ের প্রথম ভালোলাগার অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি আমি। গল্পের নাম থেকেই হয়তো বুঝতে পারবেন যে কাহিনীতে শুধু ১৫ বছর বয়সের চিত্রই তুলে ধরা হবে। সেই সময়ের একটা মেয়ের অনুভূতি, সেই অনুভূতি থেকে করা প্রতিটি কাজ আমি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। গল্পটা মূলত শহর কেন্দ্রিক। তাই শুরুটা হয়েছে অদ্রিতা নামক একজন শহুরে মেয়েকে নিয়ে। এবং ১৫ বছর শেষ হওয়ার সাথে গল্পটাও শেষ হয়েছে।

২। ইন্ডিং টা এরকম কেন?

==> আমি শুধু ১৫ বছর শেষ হওয়ার সাথে সাথে গল্পটা শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা কেমন জানি লাগছিল, তাই হ্যাপি ইন্ডিং দিয়েছি।

৩। এর মাঝে কি কোন গল্প আছে? বিয়ের আগের ঘটনা?

==> আছে, কিন্তু আমি সেটা সাজাই নি, তাই আপনারা নিজের মতো করে ভেবে নিতে পারেন।

৪। এর কোন সিজন ২ আসবে কি?

==> উত্তরে বলব, তবে এর সিজন ২ নিয়ে আগেও দুরকম ভাবনা ছিল। এক, অন্য একটি থিম নিয়ে আরেকটি গল্প লেখা, যেটাকে ছোট করে উঠতি বয়সের অবাধ্যে অনুভূতি ২ তে লিখে ফেলেছি। আর দুই, বিয়ে কিভাবে হল, সেটা নিয়ে অন্য নামে সিজন ২ লেখার। সময় কিংবা সুযোগ কোনটাই নেই আমার কাছে। তাই সিজন ২ লেখার কথা ভাবছি না। তবে কোনোদিন সুযোগ পেলে, আর আমার মনে থাকলে লেখার চেষ্টা অবশ্যই করব।

৫। গল্পটি পড়ে আমি সময় নষ্ট করলাম?

==> এর উত্তর একটাই, I am Sorry যদি আপনাদের সময় নষ্ট করে থাকি তাহলে আমি সত্যি দুঃখিত। আমি মুলত একটা ১৫ বছর বয়সী শহুরে মেয়ের জীবন ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি, যার মূল অংশে তার অনুভূতি, একটা ছেলের প্রতি ভালোলাগার অনুভুতিই প্রকাশ পেয়েছে। এবং তুলে ধরেছিও। তবে এতে করে যদি আপনাদের সময় নষ্ট করে থাকি তাহলে ক্ষমা করবেন।
এতদিন পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *