মনোপ্যাথি (১ম খণ্ড) – মেয়েদের মনের গোপন কথা

মনোপ্যাথি (১ম খণ্ড) – মেয়েদের মনের গোপন কথা: আপুকে লাগানোর সময় আমার গালেও একটু হলুদ লাগিয়ে দিলো। আমি উনার দিকে তাকিয়ে নাকমুখ কুঁচকে ফেললাম, তার ফলস্বরূপ উনি আমার নাকেও একটু হলুদ লাগিয়ে দিলেন।


পর্ব ১

সবাই রেডি হচ্ছে। আমি চুপচাপ বসে সবার সাজগোজ দেখছি।

এমন সময় ভাইয়া এসে তড়িঘড়ি করে বললো এই তনু, তাড়াতাড়ি আমার রুমে কাউকে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দে তো। মেজাজটা পুরো খারাপ হয়ে গেলো। ভাইয়ার এই এক অভ্যেস সময় অসময়ে মেহমান নিয়ে বাসায় হাজির হবে। ঘরভর্তি এত মানুষজন সবার ফরমাশ খাটতে খাটতে আমার হাতে পায়ের জয়েন্টগুলো সব ঢিলে হয়ে গিয়েছে তারমধ্যে আবার কোন ঝামেলা এনে হাজির করেছে কে জানে? শান্তিমত যে একটু সাজগোজ করবো সেই উপায়টুকুও নেই।

আমি বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম ভেতরে ঢুকবার জো নেই। চাচীরা সব রান্নাঘরের দরজায় বসেই গল্প জুড়িয়ে দিয়েছে।
আমাকে দেখেই মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি রে তুই এখনো রেডি হোস নি?
আমি বিরক্ত মুখে না বললাম, তোমার ছেলে আবার কাকে নিয়ে হাজির হয়েছে কে জানে? আমাকে বললো ওর ঘরে নাস্তা
পাঠিয়ে দিতে।
মা আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না শুধু বললেন, ফ্রিজে মিষ্টি রাখা আছে, বের করে নে।
আমি মায়ের কথামত মিষ্টি বের করে পাঁচ ছয়টার মত মিষ্টি পিরিচে নিলাম। কে জানে কয়জন এসেছে? ভাইয়ার আক্কেল দেখলে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। বলা নেই কওয়া নেই দুপুরবেলা লোকজন নিয়ে এসে বলবে, মা আমার ঘরে ভাত পাঠিয়ে দাও তো। এমন অনেক দিন গিয়েছে মাকে আবার নতুন করে ভাত রান্না করা লেগেছে কিংবা তরকারি।

আমি মিষ্টির প্লেট একটা ছোট্ট ট্রে তে নিয়ে তাতে একগ্লাস পানি ঢেলে আমাদের কাজের মেয়ে রুনুকে দিয়ে ভাইয়ার ঘরে পাঠাতে নিলে মা বাধা দিল, শুধু মিষ্টি দিচ্ছিস কেন? একটু ফল কেটে দে? আমি অনিচ্ছা সত্বেও ফ্রিজ থেকে দুটো আপেল আর কমলা বের করে নিলাম। ফল কাটা শেষ হতেই আমি রুনুকে নিয়ে ভাইয়ার ঘরে পাঠিয়ে দিলাম।
আপুর রুমে এসে দেখলাম সবার মোটামুটি সাজগোজ শেষ। আমিই বাকি আছে। মনে মনে খুশিই হলাম। যাক! এবার নিশ্চিন্ত মনে সাজগোজ করা যাবে। গিজগিজ পরিবেশ আমার একদম পছন্দ না।

আধঘণ্টার মধ্যেই আমার সাজগোজ প্রায় শেষ। এবার শাড়ি পরার পালা। এদিকে আপুকে নিয়ে বোধহয় সবাই ছাদে উঠে গেছে। আমি আমার আলমারি থেকে কলাপাতা রংয়ের শাড়িটা বের করে নিলাম। হলুদের পরবো বলে কিনেছি। শাড়িটা তসর সিল্ক। গাঢ় সবুজ পাড় সাথে হলুদ স্ক্রিনপ্রিন্ট। মা অবশ্য বেশ আপত্তি করেছিলো। যেহেতু হলুদের প্রোগ্রাম তাই মা চেয়েছিল আমি হলুদ জামদানী কিংবা কাতানের মধ্যে কোন শাড়ি নেই। কিন্তু শেষমেশ আমার জোরাজুরিতে বাধ্য হলো কিনে দিতে।

শাড়ি পরা শেষ কপালে একটা গাঢ় সবুজ টিপ পরে নিলাম। নিজেকে আয়নায় দেখে কিছুক্ষণ আপনমনে হাসলাম। আমাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে আমি হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সেজেছি। মা নিশ্চই দেখলেই মেজাজ খারাপ করে ফেলবেন। যদিও আমাকে দেখতে ততটা খারাপ লাগছে না তবুও হলুদের প্রোগ্রামে এমন সাজ সত্যিই বেমানান হবে কি না কে জানে?

বাইরে কোন শোরগোল শোনা যাচ্ছে না। তারমানে সবাই ছাদে চলে গিয়েছে। বিয়েবাড়িতে আসা মেহমানরা অনেকেই আমার এমন আচরণের অসন্তুষ্ট। কনের ছোটবোন হিসেবে সবার আগে আমারই এইসব নিয়ে হৈচৈ করার কথা আর আমি এখনো রেডিই হতে পারি নি। আপুর এংগেইজম্যান্ট এর দিন তো ইমতিয়াজ ভাইয়া মানে আমার দুলাভাই এর এক খালা বাবার মুখের ওপর বলেই ফেললেন, মেয়েমানুষের এমন খামখেয়ালি স্বভাব ভালো কথা নয়। মেয়েকে না শোধরালে কপালে দুঃখ আছে। তার এমন বলার কারন হচ্ছে, সবাই যখন এংগেইজম্যান্ট নিয়ে ব্যস্ত আর আমি তখন আমাদের একেবারে কোনার রুমটায় দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোতে চলে গেলাম। তবে আমি অবশ্য লোকের কথায় তেমন কান দেই না।

আমার মা বলেন, আমরা চারভাইবোন চারটি ভিন্ন প্রজাতির প্রানী। সবার আগে আমার আপুর কথা বলি। চারভাইবোনের মধ্যে ও দ্বিতীয়। বাস্তববাদী, অসম্ভব সুন্দরী এবং ভীষণ মিশুক প্রকৃতির। মানে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মত মেয়ে। তবে শুধু রূপে নয় পড়াশোনায়ও বেশ ভালো। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ। শুনেছি বিয়েরপর ও আর ইমতিয়াজ ভাইয়া মিলে পিএইচডি করতে যাবে। একসাথে মধুচন্দ্রিমাও হয়ে যাবে।

ইমতিয়াজ ভাইয়া, আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ যার কথা না বললেই নয় দারুণ হাসিখুশি একজন মানুষ। ভীষণ হ্যান্ডসাম, ফর্সা গায়ের রঙ, সাথে ঘন কাল চুল। লম্বায় প্রায় ছ’ফিট। সোজা বাংলায় যাকে বলে একেবারে সুপুরুষ। তবে উনাকে দেখলে বোঝাই যায় না উনি পড়াশোনায়ও ততটা ভালো যতটা দেখতে ভালো। কোথায় যেন পড়েছিলাম সুন্দর ছেলেরা জীবনে সফল হয় না। এই কথাটা ইমতিয়াজ ভাইয়ার বেলায় ডাহা ফেল!

ইমতিয়াজ ভাইয়া আর আপুর কিন্তু প্রেমের বিয়ে নয়। ইমতিয়াজ ভাইয়া অবশ্য প্রথমে আপুকে প্রপোজ করেছিলো। কিন্তু আপু রাজী হয় নি। আর ভাইয়া তার জায়গাতেই অনড় ছিলো, বিয়ে করলে আপুকেই করবে। শেষমেশ বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো। বাবা মাও উনার মত সুপাত্র হাতছাড়া করতে চাইলেন না।

এবার আমার ভাইয়ার কথায় আসি। আপুর তিনবছেরর বড়। খুবই ইমোশনাল, পেশায় ডাক্তার, এমবিবিএস শেষ করে এখন সার্জারি ওপর এফসিপিএস করছে। ভাইয়া হয়েছে একেবারে বাবার মত, সবার খেয়াল রাখবে। আপনজন ছআড়া বাইরের লোকেদের কাছে ভাইয়া কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট। ভাইয়ার বিয়ের জন্যেও বাবা মা পাত্রী খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ভাইয়ার এক কথা এফসিপিএস শেষ করে তারপর বিয়ে। তবুও বাবা মা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদি রাজী করানো যায়।
আমাদের সবার ছোট ইমু। সিলেট মেডিকেল কলেজে পড়ছে। দুটা প্রফ শেষ। বাকি দুটো দিলেই তারপর ইন্টার্ন ডক্টর। ওর ধ্যানজ্ঞান সব হচ্ছে পড়াশোনা।

আমি অবশ্য ওদের সবার মত মেধাবী না। এভারেজ টাইপ স্টুডেন্ট। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে চেষ্টার জোরে পাবলিকে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। তবে মা একটু দুঃখ পেলেও বাবা কিন্তু কোনদিন আমাকে সেটা বুঝতে দেন নি। বাবার কথা হাতের পাঁচটা আঙুল তো আর সমান হয় না। আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। আমি সবসময়ই একটু শান্ত প্রকৃতির। নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করি।

ওদিকে নিশ্চই আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। ছাদে উঠতেই দেখলাম পুরো ছাদটা আলোতে ঝলমল করছে। স্টেজ সাজানো হয়েছে ছাদের দক্ষিণ পাশটায়। স্টেজের ওপর আপু হাসিমুখে বসে আছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। চারদিকে লাইটিং, সাজসজ্জা এত কিছুর মধ্যেও আপুর হাসিমাখা মুখটাই যেন সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে।
আমি স্টেজের দিকে এগোতেই ইমু এসে বললো, এতক্ষণ লাগে আসতে? কতক্ষন থেকে তোমার জন্য সবাই ওয়েট করছে?

  • ভাইয়া মেহমান নিয়ে এসেছে তাই একটু দেরী হয়ে গেলো।

আমার কথা শুনে ইমু ভ্রু কুঁচকে ফেললো। তারপর একটু বিরক্তি নিয়ে বললো, এইসময় আবার কাকে নিয়ে এসেছে ভাইয়া?

  • জানি না।
    ও আর কিছু বলার আগেই আমার ফোন বেজে উঠলো। ইমতিয়াজ ভাইয়া ভিডিও কল দিয়েছে। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে ছাদের একেবারে শেষ মাথায় চলে গেলাম। এপার্টমেন্ট হওয়ায় আমাদের ছাদটা মোটামুটি বেশ বড়।
    ফোনটা রিসিভ করতেই ইমতিয়াজ ভাইয়া হাসিমুখ বললেন, তোমার আপু কোথায়?
  • স্টেজে। ইমতিয়াজ ভাইয়া খানিকটা লাজুক গলায় বললো আমি কতবার ফোন দিলাম ধরছে না। তুমি ওর কয়েকটা ছবি পাঠাতে পারবে আমাকে?
    আমি না করলাম না। বেচারা আশা করে বলেছে। বললাম, ঠিক আছে, আমি ছবি তুলে তারপর আপনাকে পাঠাচ্ছি।
    তারপর আমি ফোনটা কেটে দিতে নিলেই ইমতিয়াজ ভাইয়া তড়িঘড়ি করে বললেন, এই তনু শোনো!
  • আবার কি? ইমতিয়াজ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, তোমাকে কিন্তু ভীষণ সুন্দর লাগছে। উনার কথার জবাবে আমি মুচকি হাসি দিলাম। উনিও উনার সেই ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে বললেন, রাখছি।
    ফোন রেখে যখন স্টেজের দিকে যাবো, এমন সময় ছাদের দরজায় চোখ পড়তেই দেখলাম ভাইয়া হাসিমুখে ঢুকছে। নিশ্চই সাথে মেহমানও আছে। আমি ওর সাথে কে আছে সেটা দেখার জন্য একনজরে সেদিকে দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছাদের দরজা দিকে তাকিয়ে থাকার সময় আমি কয়েকসেকেন্ডের জন্য পজড হয়ে গেলাম। আমার হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠলো, বুকের ভেতর তীব্র ভূমিকম্প শুরু হলো যার মাত্রা পৃথিবীর যে কোন রিখটার স্কেলে ক্যাপচার করা অসম্ভব!

কাকে দেখছি আমি? ভাইয়ার সাথে ইনায়াজ ভাই! উনার তো আসার কথা ছিলো না? তবে কি ছুটি পেয়েছেন? নিশ্চই পেয়েছেন, ছুটি না পেলে তো আসতে পারতেন না।
কি সুন্দর লাগছে উনাকে! কালো পাঞ্জাবী সাথে সাদা চুড়িদার। হাসিমুখে ভেতরে ঢুকছেন। গলায় ক্যামেরা ঝোলানো। আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
ইনায়াজ ভাই, ভাইয়ার সেই ছোটবেলার বন্ধু। দুজনে একই সাথে স্কুল, কলেজ পার করে শেষে একই মেডিকেল পড়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাসার সবার সাথেই উনার খুব ভালো সম্পর্ক। এমনকি উনার বাবা মাও প্রায়ই আমাদের বাসায় আসেন।

তবে আমার সাথে উনার সম্পর্কটা ঠিক বাকি সবার মত না। ছোটোবেলা থেকেই আমি উনাকে দেখলেই এড়িয়ে যেতাম। লজ্জায় কখনো উনার সাথে কথা বলতে পারি নি। উনিও হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন আমি উনার সাথে কথা বলতে সংকোচ বোধ করি তাই বাসার সবার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকলেও আমার সাথে কখনো অতোটা ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করেন নি।
আমি এতক্ষনে বুঝতে পারলাম ভাইয়া তাহলে উনার জন্যই নাশতা পাঠাতে বলেছিলো। ইশশস! এখন আফসোস হচ্ছে। ফ্রিজে পিঠা রাখা ছিলো। উনি পিঠা খেতে খুব পছন্দ করেন। ভাইয়ার ওপর জেদ করে কেন যে দিলাম না! রাগ লাগছে নিজের ওপর।


পর্ব ২

ভাইয়ার সাথে আরো কয়েকজন বন্ধু বান্ধব এসেছে। ওরা সবাই স্টেজের দিকে গেলো। ইনায়াজ ভাইকে কে দেখলাম ক্যামেরা নিয়ে আপুর ছবি তোলা শুরু করে দিয়েছে। আমি আর স্টেজের দিকে গেলাম না।
দূরে দাঁড়িয়ে উনার ছবি তোলা দেখছিলাম, হঠাৎ করে আমার মামাত বোন রুহি এসে বললো, আপু তুমি এখানে কি করছো? এসো আমাদের সাথে ছবি তুলবে। তাসফি আপু তোমাকে ডাকছে।

আমি ওকে বললাম, তোরা ছবি তোল, আপু একটু পরেই আসছি।
কিন্তু রুহি কিছুতেই শুনলো না। এই মেয়ে হয়েছে একেবারে একরোখা টাইপ। যা বলেছে সেটাই করতে হবে, তা না হলে চিৎকার চেঁচামেচি করে হুলস্থুল কান্ড বাধিয়ে দেবে। ও আমার হাত ধরে স্টেজের দিকে টেনে নিয়ে গেলো।
আমাকে দেখেই আপু ধমক দিয়ে বললো, এতক্ষণ লাগে রেডি হতে? সেই কখন থেকে তোর জন্য বসে আছি।

ইনায়াজ ভাই ক্যামেরা হাতে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি লজ্জায় উনার সামনে আর কিছু বলতে পারলাম না। আপু উনাকে ডাক দিয়ে বললো, আমার আর তনুর সুন্দর দেখে কয়েকটা ছবি তুলে দাও তো ইনায়াজ ভাই। আপুর কথা শুনে উনি এগিয়ে এলেন, ক্যামেরাতে ক্লিক করতেই আমি আপুকে বললাম, তুমি তোলো, ইমতিয়াজ ভাইয়া তোমার সলো পিক পাঠাতে বলেছেন।

আপু আমাকে ধমক দিয়ে বললো, আমার সলো পিক অনেক তোলা হয়েছে, সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। তুই আয় বোস, আমার পাশে।
ইনায়াজ ভাই একের পর ছবি তুলে যাচ্ছেন আমি লজ্জায় ক্যামেরার দিকে তাকাতে পারছি না। সবগুলো ছবিতে মাথা নিচু করে আছি। শেষে আপু বিরক্ত হয়ে বললো, কনে তুই না আমি? তুই এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন?
আপুর কথা শুনে ইনায়াজ ভাই বোধহয় একটু হাসলেন। আমি আর বসে থাকতে পারলাম আপুর হাজার বারণ সত্বেও স্টেজ থেকে নেমে চলে এলাম।

একটু পরই হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেলো। একে একে সবাই হলুদ লাগাচ্ছে। আমি শুধু সবার অলক্ষে ইনায়াজ ভাইকে দেখছি। উনি একপাশের চেয়ারে বসে ফোনে কি যেন দেখছিলেন।
হঠাৎ রুহি সহ আমার আরো দুতিনটে কাজিন এসে উনার গালে হলুদ লাগিয়ে দিলো। কিন্তু সর্বনাশ হলো ওরা হলুদ লাগাতে গিয়ে উনার পাঞ্জাবিতে হলুদ ফেলে দিয়েছে। উনার পাঞ্জাবিতে হলুদ লাগায় ওরা সবাই ভয়ে দূরে সরে গেলো। উনি প্রথমে ব্যাপারটা বুঝলেন না। শেষে রুহিকে ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকাতে দেখে চট করে রুহিকে কোলে তুলে নিয়ে নিলেন।

বললেন, রুহি দেখছি বেশ দুষ্টু! আমার পাঞ্জাবিতে হলুদ মাখিয়ে দিলো। এবার কি শাস্তি দেওয়া যায় রুহিকে?
রুহি সেই আগের মত চোখ বড়বড় উনার দিকে চেয়ে আছে। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে উনি হেসে ফেললেন। তারপর রুহির নাকটা একটু টিপে দিয়ে ওর গালে একটা চুমু দিলেন। রুহির ভয় কিছুটা কমেছে। উনি পকেট থেকে চকলেট বের করে সবার হাতে হাতে একটা একটা করে চকলেট ধরিয়ে দিলেন। চকলেট পেয়ে রুহি কোল থেকে নেমে এক দৌঁড় দিলো স্টেজের দিকে। ওর দেখাদেখি বাকিরাও একই কাজ করলো।

উনি পাশে থাকা টিস্যুবক্স নিয়ে পাঞ্জাবীর হলুদগুলো ঘষে তোলার চেষ্টা করছে। কালো পাঞ্জাবিতে দাগ বোঝা যাওয়ার কথা না। তবুও উনাকে দেখলাম বেশ ঘষাঘষি করছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উনার কান্ড দেখছিলাম এমন সময় ইমু এসে আবার আমার হাত ধরে স্টেজের দিকে নিয়ে গেলো আপুকে হলুদ লাগানোর জন্য। আমাকে দেখে আপু বেশ বিরক্ত হয়ে বললো, হলুদ লাগানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুই আমার পাশ থেকে উঠবি না। একটু পরপর কোথায় হারিয়ে যাস?

  • ছাদেই ছিলাম। এদিকে শোরগোল দেখে দূরে দাঁড়িয়েছিলাম।

আমি বাধ্য মেয়ের মত আপুর পাশে বসে রইলাম। এরপর একএক করে ভাইয়া, ইমু, ওর বন্ধুরা সবাই আপুকে হলুদ লাগিয়ে দিলো, নাহিদ ভাইয়া(উনার কথা পরে বলছি) আপুকে হলুদ লাগানোর সময় উনার স্বরচিত কবিতার আবৃতি করলেন,
হে, প্রিয়তমা অপরূপা, অনন্যা
পূর্ণিমারচাঁদ বুঝি ধরনীতে আসিয়াছে নামি?

ওহে প্রিয়া,
মোর সকলই যে তুমি করিয়া নিলে চুরি
আহা! কি রূপ! মরি, মরি!
উনার কবিতা শুনেই সবাই হেসে ফেললো।

আপুকে লাগানোর সময় আমার গালেও একটু হলুদ লাগিয়ে দিলো। আমি উনার দিকে তাকিয়ে নাকমুখ কুঁচকে ফেললাম, তার ফলস্বরূপ উনি আমার নাকেও একটু হলুদ লাগিয়ে দিলেন। আমি সামনে থাকা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার গালে লাগানো হলুদ মুছে টিস্যুটা উনার দিকে ছুঁড়ে মারলাম। উনি টিস্যুটা ক্যাচ ধরে ঠিক আমার কপাল বরাবর সই করলেন। আমি আবার উনাকে সই করে মারলাম। ইনায়াজ ভাই যে এদিকে আসছিলো আমি সেটা খেয়াল করিনি। টিস্যুটা গিয়ে পড়লো উনার বুক বরাবর। উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি লজ্জায় যেন দেখতেই পাই নি এমন ভান করে বসে রইলাম।

এরমধ্যেই ইমতিয়াজ ভাইয়ার ভিডিও কল আমাকে অস্বস্তি থেকে বাঁচিয়ে দিলো। ইনায়াজ ভাই আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। আমি ফোনটা আপুকে ধরিয়ে দিলাম। আপু বেশিক্ষণ কথা বলল না। ইমতিয়াজ ভাইয়াকে ধমক দিয়ে ফোন রেখে দিলো। আমার ভালোই লাগছে ইমতিয়াজ ভাইয়া আর আপুর দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটি দেখতে। আমি ফিসফিস করে আপুকে বললাম, ইমতিয়াজ ভাইয়ার যা অবস্থা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে বিয়ের পর তোমাকে একদিনের জন্যেও কোথায় যেতে দিবে না। আপু আমার কথা শুনে একটু মুচকি হাসলো।

সবার হলুদ লাগানো শেষ হতেই ইনায়াজ ভাই এলো আপুকে হলুদ লাগাতে। হলুদ লাগানোর সময় আড়চোখে কয়েকবার আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমার তখন লজ্জায় মরে যাই! মরে যাই অবস্থা।

হলুদপর্ব মোটামুটি শেষ। এবার নাচগানের পালা। শুরু হলো আসল হৈচৈ। সাউন্ড বক্সের বিকট আওয়াজে মনে হচ্ছে যেন পুরো বিল্ডিংটাই কাঁপছে। আমি ইমুকে ইশারা দিয়ে ভলিউমটা একটু কমিয়ে দিতে বললাম। ইমু ভলিউমটা একটু কমাতে নিলেই কাজিনরা সবাই বাধা দিলো। সবার এক কথা, বিয়ে বাড়িতে হৈচৈ না থাকলে মজা আছে নাকি?

প্রথমেই ছোটদের নাচগান। বেশি রাত হলে ওরা হয়ত ঘুমিয়ে পড়তে পারে তাই। রুহি আর (পিয়ু) ছোটমামার মেয়ে ওরা দুজন স্টেজে উঠতেই সবাই জোরে জোরে চিৎকার শুরু করে দিলো। রুহি ইনায়াজ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি ওদের দিকে তাকিয়ে একটা ফ্লাইং কিস দিলেন। রুহির সাথে উনার অনেক আগে থেকেই বেশ ভাব। রুহি আমাদের বাসায় এলে প্রায়ই ভাইয়াকে দিয়ে উনাকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন। ব্যস্ততার কারনে উনি
সবসময় আসতে না পারলেও প্রায়ই আসতেন।

ওদের নাচ শেষ হতেই এবার আরো কয়েকটা পিচ্চিকে স্টেজে উঠানো হলো। ভালোই লাগছে ওদের নাচ দেখতে।
ছোটদের নাচ শেষ, এবার বড়দের পালা। ইমুর বন্ধুরা কয়েকজন উঠলো। ইমু স্টেজে উঠে ভাইয়া আর ইনায়াজ ভাই দুজনকে টেনে নিয়ে গেলো। নাহিদ ভাইয়া নিজে থেকেই স্টেজে উঠে গেলো। আমি বসে বসে ওদের কান্ড দেখছি। ওরা স্টেজে উঠে এলোপাথাড়ি লাফাচ্ছে। বাকিরা ওদের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অনেক্ষন পর শেষে ক্লান্ত হয়ে স্টেজ থেকে নামলো।

ওরা নামতেই অয়ন(বড়ফুপির ছেলে) সবাইকে বললো এবার, তনু আপুর পালা।
যদিও আমি নাচ তুলে রেখেছিলাম, ইনায়াজ ভাইয়ার সামনে নাচবো কি করে সেই লজ্জাতেই না করে দিলাম। কিন্তু ওরা ছাড়লো না। সবাই মিলে জোর করে আমাকে স্টেজে তুলে দিয়ে মিউজিক প্লে করে দিলো।
শেষমেশ বাধ্য হয়ে নাচ শুরু করলাম। ভয়ে আমার বুক কাপঁছে। নাচ ভুলে যাবো কি না সেই ভয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম ইনায়াজ ভাই ফোনে কথা বলতে বলতে ছাদের অন্যপাশে সরে গেলো।

আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। নাচ শেষ হতেই ইমু আরেকটা গান প্লে করে দিলো। ওকে গতকাল বলে রেখেছিলাম আমি স্টেজে উঠলে এই গানগুলো প্লে করার জন্য। কিন্তু এখন যে ওকে বারণ করবো সেই সুযোগও নেই। একটুপর ইনায়াজ ভাই আবার এসে বসলেন। উনার হাতে ক্যামেরা। আমি মনে মনে দোয়া করছি কখন গান শেষ হবে আর কখন রেহাই পাবো এই যন্ত্রনা থেকে। নাচের সময় একবারও উনার দিকে তাকালাম না লজ্জায়। তবে না তাকালেও উনি যে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি, তাতে করে আরো বেশি লজ্জা লাগছে।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, মানে গান শেষ হলো। সবাই হাততালি দিয়ে বলছে আরেকটু নাচার জন্য। কিন্তু আমি না করে দিলাম। এমনিতেই বেশ হাঁপিয়ে গেছি।
আমি স্টেজ থেকে নামতেই ইমু এসে আমার হাতে পানির বতল ধরিয়ে দিয়ে বললো, সাথে সাথে খাবি না আপু। আগে একটু রেস্ট নিয়ে তারপর খাবি।

ডাক্তার মানুষ! সবকিছুতে ডাক্তারি বিদ্যা না কপচালে এদের পেটের ভাত হজম হয় না। আচ্ছা ইনায়াজ কি এমন? কি জানি?
যাইহোক, আমি ইমুর কথা মত চেয়ারে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলাম। তারপর একটু রেস্ট নিয়ে ঢকঢক করে পুরো বোতল পানিই শেষ করে ফেললাম। ঘামে ভিজে এক অবস্থা হয়ে গেছে। মেকাপ উঠে গেছে কি না কে জানে?
আমি অবশ্য বেশি মেকাপ করি নি। তবুও যেগুলো দিয়েছি সেগুলোও বোধহয় উঠে গেছে।

আমার ফুপাতো বোন অনু আপু আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উনাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম আমার মেকাপ ঠিক আছে কি না। ব্যস্ততার কারণে উনি আমাকে ঠিকমত দেখলেনই না। শুধু বললেন, ঘেমে তো একেবারে চুবচুবে হয়ে গেছি। তবে খারাপ লাগছে না। বউ বউ লাগছে!

  • চুল ঠিক আছে?

উনি ভেংচি কেটে বললেন,

  • পাখির বাসা একেবারে।
    আপুর কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সাধ করে খোঁপা করেছি। নিশ্চই চুলগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি চুপিচুপি সবাইকে ফাঁকি দিয়ে নিচে নেমে গেলাম। আমার রুমের ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে প্রথমে নিজেকে কতক্ষন দেখলাম। আসলেই চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি খোঁপাটা খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। খুলতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। বিশেষ করে ক্লিপ গুলো খুলতে খুলতেই অনেকটা সময় লেগে গেছে। খোঁপা খুলে উঁচু করে চুলগুলো জুঁটি বেধে নিলাম। তারপর পরনের শাড়িটা চেইঞ্জ করে আলমারি থেকে কাঁচা হলুদ রংয়ের একটা থ্রি পিস বের করে পরে নিলাম।

ছাদে আবার যাবো কি না ভাবছি। দরজার কাছে আসতেই ইনায়াজ ভাইকে দেখলাম টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ডাইনিং টেবিলের সামনে এলো। উনাকে দেখেই আমি সরে গেলাম। উনি আমাকে খেয়াল করেন নি। উনার পরনে নীল একটা গেঞ্জি আর ট্রাওজার, পায়ে স্যান্ডেল। চুলগুলো ভেজা নিশ্চই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে।

কিন্তু আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না উনি নিচে এলেন কখন? আর দরজা খোলার সময় আমিই বা টের পেলাম না কেন? তারপর মনে পড়লো তাড়াহুড়োতে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। নিজের এমন বোকামিতে নিজেই কিছুটা বিরক্ত হলাম। পুরো বাসায় কেউ নেই, অথচ আমি দরজা খোলা রেখে ভেতরে ঢুকে পড়লাম! গাধা না হলে কেউ এমন কাজ করতে পারে না!
আমি উকিঁ মেরে দেখার চেষ্টা করলাম ইনায়াজ ভাই কি করছে?

উনি টেবিলের ওপর থাকা পানির জগ থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেলেন। পানি খাওয়ার সময় উনার এডাম’স এপল টা উঠানামা করছিলো সাথে আমার হৃদপিন্ডটাও! প্যালপিটিশন শুরু হয়ে গেলো! পেটের ভেতর কেমন জানি করছে! উনার এই এডামস এপলটা আমাকে নেশার মত টানে! মারাত্মক সুন্দর একটা জিনিস!
তারপর টেবিলের ওপর থেকে ফোন নিয়ে বাসার স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই বেরিয়ে গেলেন। উনি বেরিয়ে গেলে আমিও আবার ছাদের দিকে গেলাম।

সিঁড়ির কাছে আসতেই আমাকে আবার থেমে যেতে হলো। ইনায়াজ ভাই ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। পায়ের আওয়াজ পেয়ে পেছনে ঘুরতেই আমাকে দেখতে পেলেন।
উনি হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বোধহয় ভাবছনে আমি নিচে কখন গেলাম?

আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। না পারছি উঠতে না পারছি নেমে যেতে। ওড়নার কোনা চেপে ধরে আঙুলের সাথে মোচড়াচ্ছি। উনি বুঝতে পেরে দরজার পাশে থেকে সরে আমাকে ভেতরে ঢুকার জায়গা করে দিলেন। আমি উনার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটা একটা সিঁড়ি পার করছি আর আমার হৃদস্পন্দন একহাজার গিগাহার্জ করে বাড়ছে। ছাদ থেকে গানের বিকট আওয়াজ আসার পরেও আমার মনে হচ্ছিলো আমার হৃদস্পন্দন তার চেয়ে বেশি ভয়ংকর আওয়াজ করছে।
অবশেষে বাংলাদেশ মায়ানমারের বর্ডার পার করলাম আমি! মানে সিঁড়িঘর পেরিয়ে আমি ছাদে প্রবেশ করেছি। উনিও আমার পেছন পেছন ঢুকলেন।

রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। সবাই এখনো চিৎকার চেঁচামেচিতে ব্যস্ত। বাবা তাড়া দিলেন তাড়াতাড়ি প্রোগ্রাম শেষ করার জন্য। পরদিন বিয়ে আজকে আপুকে এতরাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখা ঠিক হবে না। তবুও প্রোগ্রাম শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে তিনটা বেজে গেলো।

সবার ঘুমানোর ব্যবস্থা প্রায় আগেই করা হয়ে ছিলো। কিন্তু সমস্যা হলো ইনায়াজ ভাইয়েরা ঘুমাবে কোথায়? যেহেতু উনারা পরে এসেছেন তাই উনাদের ঘুমানোর জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা করা হয় নি। উনি অবশ্য বারবার করে বাবাকে নিষেধ করছিলেন ব্যস্ত না হতে। বিয়েবাড়িতে রাত জেগে থাকা যায়। বাবা শুনলেন না। ইমুর ঘরে উনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। ভাইয়ার ঘরে মা আগেই চাচুদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।

মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো আপুর ঘরে। আপুকে মা মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন। কারন এখানকার চেঁচামেচিতে আপু কিছুতেই ঘুমাতে পারবে না।
ফ্রেশ হয়ে এসে আমি অনু আপুর পাশে শুয়ে পড়লাম। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছি ইনায়াজ ভাই কি কালকেই চলে যাবে? নাকি আরো কিছুদিন থাকবে। ইমুর ঘর থেকে হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওরা সবাই নিশ্চই হাসাহাসি করছে। আমি চুপিচুপি উঠে গিয়ে ইমুর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম উনারা কি নিয়ে হাসাহাসি করছে?

ইনায়াজ ভাই খুব ঠান্ডা গলায় মেপে মেপে কথা বলেন। উনার কথা বলার ধরনটাও অনেক বেশ আকর্ষণীয়, উনি কথা বলার সময় মিটমিট করে হাসেন!
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি না। কিন্তু উনি কিছু একটা বলার পরেই সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সেটা বুঝতে পারলাম। উনার গলা শুনেই আমার বুকটা দুরুদুরু করা শুরু করে দিলো। হার্টবিট বেড়ে গেলো। আমি দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে আটকে রাখা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিলাম। আর তখনই পৃথিবীর সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটা আমার সাথে ঘটলো। ইনায়াজ ভাই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন! আমাকে দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। আমি তখন বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিৎ! দশ সেকেন্ডের মত হ্যাং মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

  • কিছু বলবে তনু?
    আমি উনার কথার জবাব দিতে পারলাম না। একদৌঁড়ে আপুর রুমে চলে এলাম, লজ্জায় পুরো শরীর শিরশির করছে। কি করলাম আমি?
    মুক্তিবেগ অর্জন করতে পারলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর বাইরে চলে যেতাম! …কি লজ্জা! কি লজ্জা!

পর্ব ৩

আমি নিঃশব্দে অনু আপুর পাশে শুয়ে পড়লাম। সারারাত লজ্জায় ছটফট করে শেষরাতের দিকে সামান্য একটু ঘুম হলো।
সকালবেলা ঘুম ভাঙলো সবার চেঁচামেচিতে। মা এসে আমাকে তাড়া দিলো আপুকে পার্লারে নিতে হবে। আমি উঠে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিলাম।

ডাইনিং যেতেই দেখলাম ভাইয়া, ইনায়াজ ভাই, অনু আপু ওরা সবাই নাশতা করছে। মা এসে আমাকে বললো ওদের সাথে বসে যেতে। আমি লজ্জায় বসতে পারছি না। ইনায়াজ ভাইয়া আশেপাশে থাকলেই আমাকে লজ্জারোগ ধরে বসে।

ভাইয়া ডাক দিয়ে বললো, এই তনু, কি হলো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় নাশতা করবি।
আমি আড়চোখে একবার ইনায়াজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি নাশতা খেতে খেতে রুহির সাথে দুষ্টুমি করছে।
আমি গিয়ে ভাইয়ার পাশের চেয়ারে বসলাম। নাহিদ ভাইয়া এসে আমার পাশে বসলো। খেতে খেতে বললো, তনু এখন কোন ইয়ারে আছিস?

নাহিদ ভাইয়াকে আমার বেশ ভালো লাগে, কেমন যেন আপন আপন মনে হয়। উনিও ভাইয়ার অনেক পুরোনো বন্ধু। হুট করেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে। ভাইয়ার কাছে শুনেছি ওদের সার্কেল নাকি নাহিদ ভাইকে ছাড়া অনেকটা চিনি ছাড়া চায়ের মত। বেশির ফ্রেন্ড সার্কেলে নাহিদ ভাইয়ের মত একজন থাকা বোধহয় ইউনিভার্সাল ফ্রেন্ডর ‘ল’ হয়ে গেছে।
আমি নাহিদ ভাইয়ার কথার জবাবে শুধু বললাম, ফাইনাল ইয়ার।

  • এসেছি থেকেই দেখছি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস, কি হয়েছে বলতো?
    নাহিদ ভাইয়ার কথা শুনে আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কি বলবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনু আপু একটা মিষ্টিকে চামচ দিয়ে টুকরা করে নিলেন। তারপর একটা টুকরো নাফিসার(উনার মেয়ে) মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, তাসফির পর তো ওর সিরিয়াল তাই লজ্জা পাচ্ছে হয়তো।

উনার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। অন্য সময় হলে আমি হয়ত প্রতিউত্তর করতাম কিন্তু আজকে লজ্জায় কিছু বলতে পারলাম না।

নাস্তা শেষে আমি সবে টেবিল ছেড়ে উঠতে যাবো টেবিলের কোনার সাথে পা বেধে হোঁচট খেলাম, আর আমার হাতে থাকা পানির গ্লাস পানি সহ একেবারে ইনায়াজ ভাইয়ার মাথায়! চোখের একটু উপরে কপালে লেগেছে বাড়ি। রুহি ছিলো উনার কোলে, ওর মাথাও পড়তো যদি না উনি ধরে একহাত দিয়ে কাঁচেরগ্লাসটা ফেলতেন। গ্লাস রেখে সাথে সাথে কপালে হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি উনি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ‘থ’!

অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই কপাল ফুলে আলু। ফোলা জায়গাটা লাল হয়ে গেলো।
রুহি দৌঁড়ে গিয়ে টাওয়েল এনে দিলো। উনি রুহির হাত থেকে টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছলেন। অনু আপু উনার কপালে বরফ চেপে ধরলেন! আমি তার পাশে হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অনু আপু আফসোস করে বললেন,

  • কি যে করিস তনু? ..সাবধানে চলবি না? ..বেচারার কপাল ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।
    নাহিদ ভাইয়া হেসে উঠে বললেন, এত লোক থাকতে শেষে কি না ইনায়াজ এর মাথায় ঢাললি? ..ওর তো এমনিতেই সুপার কুল!

নিজেকে মনে মনে যত কুৎসিত রকমের গালি আছে সব দিলাম। আসলেই তো এত জনের মাথা থাকতে ইনায়াজ ভাইয়ের মাথাতেই আমার পানি ফেলতে হলো? একটু পর অনু আপু আমার হাতে বরফ ধরিয়ে দিয়ে বলল, নে ধর! .আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, নাফিসাকে খাওয়ানো হয় নি! তুই ধর!
আমি বরফের বাটি হাতে নিয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। ইনায়াজ ভাইয়া আমার হাত দিয়ে বাটি নিয়ে নিজেই কপালে লাগানো শুরু করলেন। আমি তখনো চুপ!

উনি বললেন, আমি লাগিয়ে নিচ্ছি! তুমি যাও রেডি হয়ে নাও। পার্লারে যাবে না?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। রুহি এসে হঠাৎ দুম করে আমার পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। রাগে ওর চোখমুখ লাল হয়ে আছে।

ওর এমন কান্ডে আমি, ইনায়াজ ভাই দুজনেই হতবাক! বাকিরা হাসছে। ভদ্রতা রক্ষার জন্য আমিও হাসলাম। কিন্তু পিঠের ব্যথায় সেটা ঠোঁটের কোনা পর্যন্তই থেকে গেলো, সবার মত অট্টহাসি বেরোলো না। বদ মেয়েটা আমার মেরুদণ্ড বোধহয় ভেঙেই দিয়েছে। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আরো মারবে, ভয়ে আমার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো, মুখ বোকা হাসি। ভাগ্য ভালো যে, ইনায়াজ ভাই ওকে টেনে কোলে তুলে নিলেন।

  • ছি ছি! রুহি! বড়দের গায়ে কেউ হাত তুলে? আল্লাহ গুনাহ দেবে তো।
  • ও তোমার মাথায় বাড়ি মারলো কেন?
    রুহির কথা শুনে আমি অপ্রতিভ হয়ে গেলাম। রুহি ভেবেছে আমি ইচ্ছে করে উনাকে বাড়ি মেরেছি।
    নাহিদ ভাইয়া হেসে উঠলেন বললেন, শেষ পর্যন্ত একটা বাচ্চাকেও তুই হাত করলি? ..আমাদের ওপর এত জুলুম কেন ভাই? দয়া করে তাড়াতাড়ি বিয়েটা কর! নাহলে যে হারে মেয়েরা তোর জন্য ক্রাশ কাচ্ছে শেষে আমাদেরকে মেয়ে খুঁজতে চাঁদে যেতে হবে।

ইনায়াজ ভাই মুখটিপে হাসলেন। রুহিকে বললেন, ও তো ইচ্ছে করে মারে নি। হাত থেকে পড়ে গেছে। যাও আপুকে সরি বলো?
রুহির আমাকে সরি বললো ঠিকই কিন্তু ওকে দেখে মনে হলো না সে কোনরকম অনুতপ্ত বোধ করছে আমার মারার জন্য। বরং ইনায়াজ ভাই যদি আমার পিঠে আরো দুএকটা কিল বসিয়ে দেওয়ার কথা বলতো তাহলে বোধহয় ও আরো বেশি খুশি হত। এইপ্রথম রুহিকে আমার হিংসে হচ্ছে। কি কারণে হচ্ছে? কেন হচ্ছে? আমি জানি না। কিন্তু হচ্ছে!
ইনায়াজ ভাইয়ের একটা কল আসলে উনি উঠে চলে গেলেন। ফিরে এলো মুখটা কালো করে। উনার মুখ কালো দেখেই ভাইয়া উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে?

উনি উনার স্বভাবসুলভ ঠান্ডা কিন্তু গম্ভীর গলায় বললেন উনাকে আজকেই নাকি চট্টগ্রাম যেতে হবে। ওখান থেকে ফোন এসেছে, ভেরি আর্জেন্ট!
মুহূর্তেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
ভাইয়া অনুরোধ করে বললো, এখন না গেলে হয় না? রাতের দিকে না হয় আমি আর নাহিদ তোকে বাসে তুলে দিয়ে আসবো।!
উনি ভাইয়াকে কি জানি দেখলাম বোঝালো, এরপর ভাইয়া আর অমত করলো না।

নাহিদ ভাইয়া উনার দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার সুরেই বললেন, ডাক্তারদের লাইফে এই এক জ্বালা। সময় অসময় নেই কাজ পড়ে যায়। দেখিস, বাসর রাতে বউকে ছেড়ে রোগীদের নিয়ে না আবার বাসর করা লাগে।
ইনায়াজ ভাইয়া চট করে আমার দিকে তাকালেন। আমি সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললাম। উনি নাহিদ ভাইয়ের মাথায় টোকা মেরে ব্যাগ গোছাতে চলে গেলেন।

আমি বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। সবার অলক্ষে কোনরকমে কান্না চেপে রেখে উঠে এলাম। উনার চলে যাবার কথা শুনে নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছি না। উনাকে চোখের দেখাটাই ছিলো আমার একমাত্র আনন্দ, এখন তো সেই উপায়ও বন্ধ। এর আগে উনি যতবারই আমাদের বাসায় এসেছেন চলে যাওয়ার পর কিছুদিন আমি কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারতাম না। রাতে চোখ বন্ধ করলেই উনার চেহারা ভেসে ওঠতো। উনার সেই সরল শান্ত মুখটার কথা ভেবে যে কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি তার হিসেব নেই।

ওয়াশরুমে ঢুকে অনেক্ষন কাঁদলাম। মা এসে ওয়াশরুমের দরজার সামনে আমার নাম ধরে ডাকছে বারবার, শেষে বিরক্ত হয়ে ধাক্কানো শুরু করলো।
আমি চোখমুছে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই মা জিজ্ঞেস করলো, কি রে তোর চোখমুখের এই অবস্থা কেন? শরীর খারাপ নাকি?

আমি মায়ের কথার জবাবে শুধু বললাম, কিছু না।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। আপুকে নিয়ে পার্লারে যেতে হবে। রেডি হয়ে বেরোতেই দেখলাম ভাইয়া আর ইনায়াজ ভাইক বেরোচ্ছে।
ভাইয়া বললো, চল তোদেরকে নামিয়ে দিয়ে তারপর ইনায়াজকে ছাড়তে যাবো।

ইনায়াজ ভাইকে দেখলাম ব্যাগ কাধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভীষন কষ্ট লাগছে আমার! ইচ্ছে করছে উনার হাত চেপে ধরে বলি, আপনি যাবেন না প্লিজ। আপনি গেলে আমার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু পারলাম না। মনের কথা মনেই রয়ে গেলো।
আপুকে রাগ দেখিয়ে বললো, আমার বিয়ে আর তুমি চলে যাচ্ছো? আমার মনমত ছবি তুলে দেবে কে? মনে থাকবে সব। আর যদি তোমার সাথে কখনো কথা বলেছি দেখো।
আপুর কথা শুনে উনি হেসে ফেললেন। আপুর গাল টেনে দিয়ে বললেন, কি করবো বলো বসের ফোন! উনার আন্ডারেই তো ট্রেনিং করছি। উনার কথা ফেলবো কি করে?

আপু ক্ষেপে গিয়ে বললো, তোমার ঐ বসকে ফোন দাও দেখি আমি কথা বলবো। উনি কি বিয়েশাদী করেন নি নাকি?
আপুর কথা শুনে ইনায়াজ ভাই আবারও হেসে ফেললেন। আমি শুধু উনার দিকে চেয়ে আছি উনি অবশ্য সেটা খেয়াল করেন নি। উনার হাসিটা মারাত্মক সুন্দর! আলাদা একটা জাদু আছে। যে কোন মেয়েই উনার এই একহাসিতেই ঘায়েল হয়ে যাবে।
ভাইয়ার কাছে শুনেছি ওদের কলেজের সব সুন্দরী মেয়েরা নাকি ইনায়াজ ভাইয়ের জন্য পাগল ছিলো, ইনফেক্ট এখনো পাগল। উনি নাকি পাত্তা দেন না। শুনে আমি মনে মনে শান্তি পাই, সে সাথে ভরসা!

ভাইয়া তার প্রায় সব বন্ধুদের গল্পই আমাদের সাথে শেয়ার করেছে। ভাইয়া যখন ইনায়াজ ভাইয়ের গল্প বলে তখন আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকি। মনে হয় যেন শুনেই যাই, শুনেই যাই। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে।
গাড়িতে আমি, ইমু আর আপু বসলাম পেছনের সিটে। উনি সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে রুহিকে কোলে নিয়ে বসেছেন। আরেকটা গাড়িতে ভাইয়া সব কাজিনদের নিয়ে আসছে নিয়ে আসছে।
আমি ফোনে নিউজফিড স্ক্রল করছিলাম। ইমু হঠাৎ বলল, এই আপু তুমি নাকি গ্লাস দিয়ে বাড়ি ইনায়াজ ভাইয়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে? .আমি কিন্তু বিশ্বাস করি নি।
আপু বলল, কে বলেছে তোকে?

ইনায়াজ ভাই রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। আমি লজ্জা অস্বস্তিতে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম।
ইমু যখন বলল কথাটা ওকে ইনায়াজ ভাই বলেছে আমি চমকে উঠে উনার দিকে তাকালাম। উনি বাইরের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। আশ্চর্য উনি কি সত্যিই ধরে নিয়েছেন আমি ইচ্ছে করে উনাকে বাড়ি মেরেছি? ..ওহ নো!
আপু, ইমু দুজনেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এখানে এত হাসির কি হলো আমি বুঝতে পারছি না। এরা সবাই মিলে কি আমাকে কনফিউজড করে চাইছে? হচ্ছে টা কি?

পার্লারে পৌঁছে ভাইয়া বললো, আমি ইনায়াজকে বাসে তুলে দিয়ে আসি। তোদের হলেই আমাকে ফোন দিবি। খবরদার একা একা বেরোবি না। আমি নিতে আসবো।
ইনায়াজ ভাইয়া রুহির গালে কয়েকটা চুমু দিয়ে ওকে ইমুর কোলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রুহি কিছুতেই আসতে চাইছে না। উনি গাড়ি থেকে নেমে রুহিকে পুরো একবক্স চকলেট কিনে দিয়েছিলো। রুহি রাগে সেগুলোও ফেলে দিলো।

ইমু অনেক কষ্টে ওকে উনার কোল থেকে ছাড়িয়ে শেষে আমার কোলে এনে দিয়ে দিলো। ইমুকে খামছি, দিয়ে কামড় দিয়ে একস্থা করে দিয়েছে। আমি অনেক আদর যত্ন করে রুহিকে কিছুটা শান্ত করলাম।
ইনায়াজ ভাই আপুকে উইশ করে চলে গেলেন। আমি কিছুতেই চোখের পানি চেপে রাখতে পারছিলাম না। কেউ দেখে ফেলবে সেই ভয়ে রুহিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি পার্লারে ঢুকে পড়লাম।

আপুর সাজ শেষ হতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল। এর মাঝখানে ইমতিয়াজ ভাইয়া ফোন দিয়েছে প্রায় দশ বারো বারের মত। ইমু ফোন দিয়েছে তিনবার। আমি বিরক্ত হয়ে শেষে ফোন সাইলেন্ট করে রাখলাম। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে। অসহ্য লাগছে সবকিছু!

কাজিনরা সবাই বেশ সাজগোজ করেছে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমি চুপচাপ বসে আছি। শেষে আপু ধমক দিয়ে বলল, তোর বোনের বিয়ে আর তুই এভাবে চুপচাপ বসে আছিস? কি হয়েছে তোর?
আমি আপুর কথার জবাব দিলাম না। আমার যে কেমন লাগছে তা শুধু আমিই জানি।
শেষমেশ আপুর নির্দেশে আমাকেও সাজানো হলো। সাজগোজ শেষে ভাইয়াকে ফোন দিলাম আসার জন্য। প্রায় দশমিনিটের মধ্যেই ভাইয়া এসে আমাকে ফোন দিলো আপুকে নিয়ে নিচে নামার জন্য।

আমি আপুকে নিয়ে নিচে নামতেই চারশ চল্লিশ ভোল্টের বড়সড় একটা শক খেলাম। ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম দুজনে। ভাইয়ার সাথে ইনায়াজ ভাই দাঁড়িয়ে! এতখুশি বোধহয় আমি জীবনেও হই নি, ইনায়াজ ভাইকে দেখে যতটা খুশি হলাম।
আমাদেরকে দেখে ভাইয়া হাসিমুখে এগিয়ে এলো।
আপু খুশিতে চিৎকার দিয়ে বললো, ইনায়াজ ভাই তুমি যাও নি?

রুহি দৌঁড়ে গিয়ে উনার কোলে উঠে পড়লো। উনি রুহিকে কোলে নিয়ে আপুর কথার জবাবে মুচকি হেসে বললেন, শেষ মুহুর্তে ক্যান্সেল হয়ে গেছে।
আপু উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো, আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না ইনায়াজ ভাই তোমাকে দেখে কতটা খুশি হয়েছি।
উনি আবারও উনার সেই ঘায়েল করা হাসিটা দিয়ে বললো, আমিও তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না বিয়ের সাজে তোমাকে কত সুন্দর লাগছে। উনার কথা শুনে আপু লজ্জা পেয়ে গেলো।

ভাইয়া ইনায়াজ ভাইকে সমর্থন করে বললো, সত্যি তাসফি, তোকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ভাইয়ার কথা শুনে আপু দুষ্টুমির স্বরে বললো, তোমার ওপর আমার বিশ্বাস নেই। তবে ইনায়াজ ভাই যেহেতু বলেছে তাই বিশ্বাস করলাম।
আপু হুট করে আমাকে ইনায়াজ ভাইয়ার দিকে ঘুরিয়ে বললো, তনুকে কেমন লাগছে ইনায়াজ ভাই? সুন্দর লাগছে না?
আপুর এমন কান্ডে আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ও এমন কিছু করবে আমি ভাবতেও পারি ন। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। আপুর কথা শুনে ইনায়াজ ভাই ঠোঁট কামড়ালেন, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
তারপর স্বাভাবিক ভাবে বললো, সুন্দরীর বোন তো সুন্দরী হবে তাই না?

আপু উনার কথায় পালটা জবাব দিয়ে বললো, সাজ কেমন হয়েছে ইনায়াজ ভাই আমি সেটাই জিজ্ঞেস করছি। ও তো সাজতেই চাইছিলো না। সুন্দর হয়েছে না সাজটা?
আমি আপুকে ফিসফিসিয়ে বললাম, আপু তুমি বিয়ের কনে, এত কথা বলছো কেন?
আপু আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো, তো কি করবো? তোর মত চুপচাপ বসে থাকবো নাকি? তোকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা আমার না তোর হচ্ছে।

আমি আপুর কথার কোন উত্তর দিলাম না। ভাইয়া তাড়া দিয়ে বললো, হয়েছে এবার থাম তোরা। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেন সময় নষ্ট করছিস? বাবা অনেকবার ফোন দিয়েছে, তোদের হলো কি না জিজ্ঞেস করছিলো, আর দেরী করিস না এবার চল।

পর্ব ৪

সেন্টারে পৌঁছালাম আধঘন্টা পর। বর এসে গেছে। ইমতিয়াজ ভাইয়াকে আপুর পাশে বসানো হলো। বাবা এসে আমাকে, ভাইয়াকে আর ইমুকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেলেন। বাবার চোখমুখ কেমন যেন শুকনো লাগছে।
ভাইয়া বাবাকে বললো, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে নাকি বাবা? চোখমুখ এমন শুকনো লাগছে কেন?

বাবা কিছু বললেন না। ইমু আর ভাইয়া মিলে বাবাকে প্রায় জোর করে একপাশে নিয়ে গিয়ে প্রেসার চেক করলো। ভাইয়া তাড়াতাড়ি বাবাকে প্রেসারের ওষুধ দিয়ে আমাকে বললো, বাবাকে শোয়াতে হবে। বিপি মারাত্মক হাই!
আমাদেরকে এদিকে ব্যস্ত দেখে ইনায়াজ ভাই এগিয়ে এসে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো, কি হলো আঙ্কেলের শরীর খারাপ নাকি? ইমু উনাকে জানালো যে বাবার প্রেসার বেড়ে গিয়েছে।

আমাদের কথা বলার মাঝখানেই বাবা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বাবাকে আর কখনো এমন অসহায় লাগে নি। তারপর চট করে আবার চোখের পানি মুছে বললেন, তাফসিটা চলে গেলে পুরো ঘর ঠান্ডা হয়ে যাবে, আমার মেয়ে একা একা সব সামলাবে কি করে?

এতক্ষনে বুঝতে পারলাম বাবার মুখটা এত মলিন দেখাচ্ছিলো কেন? ইনায়াজ ভাই বাবার পাশে বসলেন। বাবার হাত চেপে ধরে সান্ত্বনার সুরে বললো, তাসফি খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে। আপনি শুধুশুধু ওকে নিয়ে টেনশন করছেন আঙ্কেল।
বাবা উনার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। উনি বাবার দিকে তাকিয়ে মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে বললেন, আমি জানি তাসফিকে নিয়ে আপনার টেনশন হচ্ছে। নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ খাপ খাওয়াতে পারবে কি না। আসলে মেয়েরা হচ্ছে বাবার প্রিন্সেস। ছোটবেলা থেকে সংসার জীবনের আগ পর্যন্ত একটা মেয়ে তার সকল লড়াই বাবার হাত ধরেই পার করে। তারপর যখন
একটা নির্দিষ্ট বয়স হয় এতবছরের চেনা জগৎ ছেড়ে একটা মেয়েকে সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশের সাথে নিজেক মানিয়ে নিতে হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু এই সময় প্রতিটা মেয়েই মনে মনে এমন একজন মানুষকে চায় যে তার বাবার মত, তার বড় ভাইয়ের মত তাকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখবে। আর সেই মানুষটাকে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে তার পরিবারের লোকজনকে। একবার ইমতিয়াজ কে দেখুন তো? আপনার কি মনে হয় ইমতিয়াজ তাসফির জন্য সেই মানুষ, যার মাঝে আপনি আপনার ছায়া দেখতে পান?

বাবা ইমতিয়াজ ভাইর দিকে একনজর তাকিয়ে বললো, ইমতিয়াজের ওপর আমার সেই ভরসা আছে।
ইনায়াজ ভাই এবার হেসে উঠে বললেন, তাহলে শুধু শুধু টেনশন করছেন কেন? আপনি যদি এমনভাবে ভেঙ্গে পড়েন তাসফি ভরসা পাবে কার কাছ থেকে? এখন তো আপনাদের সবার দায়িত্ব ওকে ভরসা দেওয়া যে এতদিন ধরে ও যাদের ওপর ভরসা করে এসেছে এখন থেকে ইমতিয়াজই ওর জন্য সেই ভরসার জায়গা।

বাবা নরম গলায় বললেন, আসলে মেয়ের বাবা তো তাই না চাইতেও অনেক চিন্তা মাথায় চলে আসে।
বাবা কিছুটা শান্ত হতেই আমার মনটাও বেশ হালকা হয়ে গেলো। ছোটবেলা থেকেই বাবা মা দুজনই আমাদের ব্যাপারে বেশ সেন্সিটিভ। তবে বাবা একটু বেশি, এত বড় হয়েছি তবুও সেই ছোট্টটির মত এখনো আগলে রাখার চেষ্টা করে।
ঠিক আড়াইটায় বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো। এরপর শুরু হলো খাওয়া দাওয়ার পর্ব। ভাইয়া, ইমু, ইনায়াজ ভাই, বাবা, চাচুরা সবাই ব্যস্ত। আমি আপুর পাশে বসে আছি। ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধুরা আপুকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।

আমি আপুকে ফিসফিস করে বললাম, আপু তোমার কি ক্ষিদে পেয়েছে?

  • উহু!
    ইমতিয়াজ ভাইয়া সবার অলক্ষে ফিসফিস করে বললো, না খেলে তো দুর্বল হয়ে পড়বে, সারারাত জাগবে কি করে?
    আমি না শোনার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি ইমতিয়াজ ভাইয়া পারেও বটে, লাজলজ্জা কিচ্ছু নেই। আশেপাশে কত লোকজন তবুও নির্লজ্জের মত আপুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। আপু চোখ গরম করে উনার দিকে তাকাতেই উনি আবারও উনার সেই মিষ্টি হাসিটা দিলেন।

আমি খেয়াল করে দেখলাম ইমতিয়াজ ভাইয়ার হাসিটা অনেকটা ইনায়াজ ভাইয়ের হাসির মত, বেশ পবিত্র। একেবারে নিখাদ হাসি! বাবার কাছে শুনেছি যাদের হাসি সুন্দর তাদের মন নাকি ভীষন ভালো হয়।
একটুপর ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধুরা আমাকে নিয়েও হাসাহাসি শুরু করে দিলো। আমি মাঝেমাঝে দুএকটার জবাব দিলাম।
খাওয়াদাওয়া শেষে কথা উঠলো আপুর সাথে যাবে কে কে?

আমি বললাম আমি যাবো। রুহিও আমার সাথে যাবে বায়না ধরেছে, কিন্তু মামি ছাড়তে নারাজ। ও এমনিতেই ভীষণ দুষ্টু। মামি বললো আমরা সামলাতে পারবো না। অবশেষে ইনায়াজ ভাই বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে শান্ত করলো।
শেষমেশ ঠিক হলো আপুর সাথে, আমি, তিথী(বড়ফুফুর মেয়ে) আর তিশা(আমার খালাত বোন)যাবো।

গাড়িতে আমি আপুর পাশে বসে আছি। অন্যপাশে ইমতিয়াজ ভাইয়া। ইমতিয়াজ ভাইয়া আপুর হাতদুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে। আপু একটু পর পরই ডুঁকরে কেঁদে উঠছে। আমি নিজেও কান্না চেপে রাখতে পারছি না। গাড়িতে উঠার সময় বাবা, মা, ভাইয়া, ইমু সবার কান্নাভেজা মুখগুলো বারবার ভেসে উঠছে। ইমতিয়াজ ভাইয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করছে আপুকে ভুলিয়ে রাখার জন্য।

ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় রাত হয়ে এলো। বেশ ক্লান্ত লাগছে। আপুকে ইমতিয়াজ ভাইয়ার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।
আমি ফ্রেশ হয়ে আপুর কাছে যেতেই দেখলাম ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধুরা আপুর সাথে দুষ্টুমি করছে। তারওপর বাসাভর্তি মেহমান সব বউ দেখতে এসেছে। আমি ভালো করে আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ওর খারাপ লাগছে কি না। আপুকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখে স্বস্তি পেলাম। একটু পর মুক্তা আপু এসে সবাইকে আপুর রুম থেকে বের করে দিলেন। মনে মনে খুশিই হলাম। আপু কিছুটা রিলেক্স হতে পারবে।

এমনিতেই সারাদিন অনেক ধকল গেছে। একটু পরেই বাবা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো আপু কি করছে, এখন আর কান্নাকাটি করছে কি না। আমি বাবাকে আশ্বস্ত করে বললাম আপু এখন কিছুটা শান্ত আছে।
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে আমাদের তিনজনের জন্য আলাদা একটা রুম ছেড়ে দেওয়া হলো। আপুর শ্বাশুড়ি, মুক্তা আপু এসে বারবার বলে গেলো কোন সমস্যা হলে উনারদেরকে জানানোর জন্য। আমি মনে মনে বেশ স্বস্তি পেলাম যাক আপুর কোন অযত্ন হবে না ইমতিয়াজ ভাইয়ার ফ্যামিলিতে। আপুর শ্বাশুড়ি, মুক্তা আপু এনারা অসম্ভব ভালো মানুষ।

আমি শুয়ে সবে চোখ বন্ধ করেছি এমন সময় তিশা আমাকে বললো, এই তনু! একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস?
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। ও দুষ্টুভাবে হাসতে হাসতে বললো, ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধু নাফিস ভাই তোর দিকে তাকিয়ে কেমন মিটমিট করে হাসে? মনে হয় তোকে মনে ধরেছে।
তিশার কথা শুনে আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। কই আমি তো একবারও খেয়াল করি নি!
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিথীও তিশার সাথে সুর মিলিয়ে বললো, আমিও খেয়াল করেছি। খেতে বসেও উনি আড়চোখে বারবার তনুর দিকে তাকাচ্ছিলো।

আমি ওদের কথায় পাত্তা না দেওয়ার ভান করে বললাম, সকালে আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। তাড়াতাড়ি ঘুমা এখন।
তিথী আমার কথায় গা না করে বললো, যাই বলিস দেখতে কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম! আমি তো ক্রাশড! গায়ের রংটা একটু চাপা আর কি। অবশ্য ছেলেরা একটু শ্যামলা হলেই দেখতে ভালো লাগে।
তিশা বলল, তারওপর শুনেছি মেরিন অফিসার, তোর সাথে বেশ মানাবে। তাসফির আপুর বান্ধবীরা উনাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো। অনেকেই নাকি ক্রাশ খেয়েছে!

আমি ওদেরকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু মাথা থেকে ব্যাপারটা সরাতে পারলাম না। তবে একটা কথা ওরা সত্যি বলেছে নাফিস ভাই ইজ কোয়াইট আ হ্যান্ডসাম গাই। ইমতিয়াজ ভাইয়া, ইনায়াজ ভাই এদের থেকে কোন অংশে কম যায় না। চেহারা মায়াময় কাঠিন্যভাব আছে। চোখেমুখে বুদ্ধিমত্তা আর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ছাপ। কিন্তু উনি আমাকে? ..নাহ্! আর কিচ্ছু ভাবলাম না। চোখ বন্ধ করে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।

পর্ব ৫

পরেরদিন সকালবেলা মুক্তা আপু এসে আমাদের ডেকে তুলে দিলেন। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসতেই দেখলাম ভাইয়া, ইনায়াজ ভাই, ইমতিয়াজ ভাইয়াসহ ওনার বন্ধুরা সবাই ডাইনিং এ বসে গল্প করছে।

আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ইনায়াজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনার পরনে ছাই কালারের একটা পাঞ্জাবি তারওপর কালো কোটি সেই সাথে ব্ল্যাক জিন্স। পাঞ্জাবীর হাতা গোটানো। হাতে ব্র‍্যান্ডেড ঘড়ি। ভাইয়ার কাছ থেকেই জেনেছি উনি বরাবরই ঘড়ির ব্যাপারে সৌখিন। আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, গতকালের চাইতে আজকে দাড়ি হালকা ছাটানো তবে ক্লিন সেইভ না। উনাকে অবশ্য কখনই ক্লিন সেইভ হতে দেখি নি। খোঁচা খোঁচা দাড়িতেই উনাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। সকাল সকাল উনার মুখটা দেখেই মনটা ভরে গেলো। আমি পাশে তাকাতেই দেখলাম তিথী হাঁ করে উনার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে ভীষন রাগ হলো। ওকে কিছু বলতে যাবো তখন দেখলাম তিশারও একই অবস্থা। মানে কি? সবার কেন উনাকেই দেখতে হবে?

রাগে আমি ভাইয়াকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে কেন? তোমাদের তো আরো দেরীতে আসার কথা ছিলো।

ভাইয়া জানালো ইমতিয়াজ ভাইয়াই নাকি ফোন করে ওদেরকে আসতে বলেছে। আপু নাকি সারারাত কান্নাকাটি করেছে।
আপুকে দেখলাম হালকা গোলাপি রংয়ের একটা শাড়ি পরে হয়ে নাশতার টেবিলে এসেছে। গোলাপি শাড়িতে ওকে বেশ মিষ্টি লাগছে। বিয়ের পর নাকি মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায় আপুকে দেখে বুঝতে পারলাম কথাটা আসলে মিথ্যে নয়। আপুকে দেখেই ইনায়াজ ভাই সহ ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধুরা সবাই ঠাট্টা মশকরা শুরু করে দিলো।

আমি তিথী আর তিশাকে নিয়ে নাশতা করতে বসে গেলাম। নাশতার টেবিলে নাফিস ভাই এসে আমার পাশে বসলো। মিষ্টি একটা গ্রাণ নাকে আসছে। সম্ভবত শাওয়ার নিয়ে এসেছেন উনি। চুল ঝরঝরে! টি- শার্টের বোতামগুলো খোলা। লোমশ বুকের খানিকা দেখা যাচ্ছে। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। তিথী আর তিশা শুধু আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছিলো।
নাফিস ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলেন। প্রতিউত্তরে আমিও হাসলাম।

  • এখনো নাশতা করা হয় নি?
  • না। মাত্র এলাম। আপনার এত দেরী যে?
    উনি রুটি আর মাংস চিবোতে চিবোতে বললেন, রাতে ভালো ঘুম হয় নি।
    তিথী ফট করে বলে বসলো, কেন ঘুম হয় নি কেন ভাইয়া? ..কাউকে স্বপ্নে দেখেছিলেন?
    নাফিস ভাই প্রতিউত্তরে হাসলেন। আমি খেয়াল করলাম তিথীর কথা শুনে আমার গালদুটো অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে গেছে। কেন হচ্ছে? .লজ্জায়? উহু অস্বস্তিতে! আমি মাথা নিচু করে খাওয়া শুরু করলাম। নাফিস ভাই আবার ডাক দিলেন।
  • তনু?
  • জ্বী?
  • কিসে পড়ো তুমি?
  • অনার্স ফাইনাল ইয়ার।
  • ওহ! সাবজেক্ট কি?
  • সয়েল সাইন্স!
  • ভালো। তো ফিউচার প্ল্যান কি? .চাকুরীবাকরি কিছু করবে না বিয়ে?
    আমি কি উত্তর দিবো ভেবে পেলাম না। আসলেই আমার ফিউচার কি? ..আই ডোন্ট নো!
    আমি বললাম, আপাতত বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। পরীক্ষা টা শেষ করি তারপর ডিসিশন নেওয়া যাবে।
    উনি কোন রিয়েকশন দিলেন না। শুধু বললেন, পানির জগটা দাও।

তিথী তিশা দুজনে এখনো হাসছে। মাঝে মাঝে আমাকে ইশারা দিচ্ছে। শেষে ধরা খেয়ে ফেলো নাফিস ভাইয়ের কাছে। উনি অনুযোগ করে বললেন, তোমার দুজন জ্বালাচ্ছো কেন বেচারীকে? ..বেচারী এমনিতেই লজ্জায় খেতে পারছে না।
দুপুরের দিকে মেহমানরা সবাই আসতে শুরু করে দিয়েছে। আপুকে পার্লারে থেকে সাজিয়ে আনা হলো।

আজকে আমিও অনেক সেজেছি। বিয়েতে মিষ্টি কালারের একটা লেহেঙ্গার সাথে ভারী মেকাপ, ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক, গলা খালি রেখে কানে লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচ করে বেশ বড় এয়ারিংস পড়লাম। সবটা নিজে নিজেই সেজেছি। সাজ শেষ হতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অনেক্ষন দেখলাম।
আমাকে দেখে তিথী আর তিশা ঠাট্টা করে বললো, এত সেজেছিস কার জন্য? নাফিস ভাইয়া তো মনে হচ্ছে আজকে আর চোখ সরাতেই পারবে না।

মেজাজটা পুরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছু বললাম না। রুম থেকে বেরোতে যাবো এমন সময় দেখলাম ইনায়াজ ভাই একহাতে ফোন অন্যহাতে রুহিকে নিয়ে নিচে নামছে। উনার পারফিউমের মিষ্টি গন্ধে পুরো জায়গাটা সুরভিত হয়ে গেছে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, উনি আমার ঠিক একহাত দূরে ছিলো, ফোনের দিকে চোখ থাকায় আমাকে দেখতে পান নি।
উনার উপস্থিতিতেই আমার বুকটা ধুকপুক ধুকপুক শুরু করে দিলো। আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি কথা বলতে বলতে নিচে নেমে গেলেন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ ভাইয়া বললেন, কি হলো তনু? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো নিচে চলো।

নিচে গিয়ে দেখলাম রুহি ইনায়াজ ভাইয়ের কোলের ওপর বসে আছে। এই মেয়ে সারাক্ষণ উনার সাথে লেগে থাকে! ..কেন? দুজনে মিলে ফোনে গেইম খেলছে। ইনায়াজ ভাইয়ার কপালের ওপর এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে আছে। উফফফ! কি অসহ্য এক দৃশ্য। ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে উনার ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কপালের ওপর থেকেই সরিয়ে দেই।

উনি কি ভেবে সামনে তাকালো। চোখেচোখ পড়ার আগে আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম। রুহিকে দেখলাম উনার কানে কানে কিসব বললো। তারপর দুহাতে উনার গাল চেপে ধরে চুমু খেলো। নাহ! আমি দেখতে পাচ্ছি না। সহ্য হচ্ছে না!
হঠাৎ কোথা থেকে নাফিস ভাইয়া এসে পেছন থেকে ডাক দিতেই আমি বেশ চমকে উঠলাম। উনি আমার দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে।

উনার পরনে জাম কালারের একটা পাঞ্জাবি সাথে সাদা চুড়িদার। শুনেছি যাদের গায়ের রঙ শ্যামলা তাদেরকে নাকি লাইট কালারটা স্যুট করে না। কিন্তু উনাকে বেশ মানিয়েছে। উনি আমাকে দেখে চোখ বড়বড় করে বললেন, আই এম ডান! ওহ মাই গড! আই এম ডান!
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। বোকার মত কিছুক্ষন উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, রিয়েলি ইউ আর লুকিং সো গর্জিয়াস!

প্রথমে বিরক্ত হলেও উনার রিয়েকশন দেখে আমি হেসে ফেললাম। মুখে থ্যাংক ইউ বলার প্রয়োজন পড়লো না। আমি মুখের হাসিটাই অনেক কিছু জানান দিয়ে দিলো। প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে?
উনি আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে বললেন, চলো ওদিকে ফটোসেশন চলছে, সবাই তোমার খোঁজ করছে।

আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এরপর উনি ইনায়াজ ভাইয়াকেও জোর করলেন আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য, উনার কথার মাঝখানে ইমু, ভাইয়ার বন্ধুরা সবাই এসে ইনায়াজ ভাইকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিলো। ইনায়াজ ভাই স্বাভাবিক ভাবেই রুহিকে কোলে নিয়ে ওদের সাথে ছবি তুলতে চলে গেলেন। উনি কি আদৌ স্বাভাবিক ছিলো? ছিলো হয়ত।
আমি যাবো কি যাবো না ভাবছি। ইনায়াজ ভাইয়া না থাকলে হয়ত এতটা সংকোচ হতো না। জানি না কেন উনি সামনে থাকলেই আমার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ মুক্তা আপু এসে আমার হাত ধরেই টেনে নিয়ে গেলেন।
ওখানে গিয়ে দেখলাম নাহিদ ভাইয়া, অনু আপু ওরা সবাই এসে গেছে। আপুকে স্টেজে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফটোগ্রাফার ইমু। ইনায়াজ ভাই এর ক্যামেরাটা ওর হাতে। ইনায়াজ ভাই রুহিকে কোলে নিয়ে সবার মাঝখানে দাড়িয়েছেন। আপুর ঠিক পেছনে। মুক্তা আপু আমাকে তার পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমাকে দেখেই আপু ধমক দিয়ে বললো, সব জায়গায় তোকে ডেকে ডেকে আনা লাগে কেন? কোথায় হারিয়ে যাস একটু পরপর?

আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে একটু হাসলাম। ইমু বললো, এই আপু তুমি বাদ পড়ছো তো? মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াও।
আমি বললাম, তুই আগে ওদের সবার ছবি তুলে নে, আমি বরং বেরিয়ে যাই। সবার তোলার শেষ হলে আমি আলাদা করে আপুর সাথে তুলবো।

কিন্তু আপু রাজী হলো না। ধমক দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললো, তুই আমার পেছনে দাঁড়া। আপুর কথা শুনে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। আপুর পেছনে মানে তো ইনায়াজ ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমি লজ্জায় মরে যাবো উনার পাশে দাঁড়াতে গেলে। উনার অবশ্য কোন রিয়েকশন নেই, নির্বিকার ভাবে সবার সাথে হাসাহাসি করছে। বোধহয় আপুর কথা শুনতে পেয়েছে তাই একপাশে সরে আমাকে জায়গা করে দিলো।

আমার চোখ লেগে আছে তার সুন্দর মুখটার দিকে। আজকে তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই আন্তরিক হাসি দিলেন। বরাবরের মত এবারও আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মানুষটাকে আল্লাহ একসাথে কতগুলো গুন দিয়েছেন। কি সুন্দর সবার সাথে মিশে যান। দেখতে সুন্দর, পড়াশোনায় ভালো, ভাইয়া বলে ওদের মেডিকেল এর নাকি সবচেয়ে জিনিয়াস স্টুডেন্ট ইনায়াজ ভাই, অথচ কি নিরহংকার একজন মানুষ। সৃষ্টিকর্তা যে কত মায়া দিয়ে যে উনাকে তৈরি করেছেন সেটা শুধুই উনিই জানেন।

আমি উনাকে নিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত, এমন সময় নাফিস ভাইয়া হুট করে বলে উঠলো, আমার পাশে এসে দাঁড়াও তনু! এদিকে স্পেস আছে।
উনার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে আপুর দিকে তাকালাম। আপু আমাকে ইশারায় বোঝালো উনার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে, কোন সমস্যা নেই। আমি কিছুটা বাধ্য হয়েই উনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ভীষণ বিরক্ত লাগছে উনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। রাগ হচ্ছে! একমুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো উনি ইচ্ছে করে আমাকে ইনায়াজ ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে দেন নি। তিথী আর তিশাকে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। ছবি তোলার এক পর্যায়ে ইনায়াজ ভাই রুহিকে আপুর কোলে দিয়ে ইমুকে বললো, এবার তুমি গিয়ে দাঁড়াও। আমি তুলছি। এবার আমি আরো অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এখন তো আর ক্যামেরার দিকেই তাকাতে পারবো না লজ্জায়। আমি তড়িঘড়ি করে আপুর কানে ফিসফিসিয়ে বললাম, আপু আমি ওয়াশরুমে যাবো।

আপু বিরক্ত হয়ে বললো, যা!
আমি চলে আসার সময় নাহিদ ভাইয়া, নাফিস ভাইয়া মুক্তা আপু সবাই জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে?
আমি কিছু বলার আগেই আপু বললো, ওর একটু কাজ আছে। আমি পাঠাচ্ছি। আমি মনে মনে আপুকে ধন্যবাদ দিয়ে সোজা ওপরে চলে এলাম।

এরপর আর নিচে যাই নি। মুক্তা আপুর রুমে এসে ঘুম দিলাম।
ঘুম ভাংতেই দেখলাম, আমার পাশে নাফিস ভাই লম্বা হয়ে ঘুমাচ্ছে। পুরো ঘর আবছা আলো আবছা অন্ধকার! দরজাটা হালকা ভেজানো। এইমুহূর্তে অন্য কোন মেয়ে হলে হয়ত নাফিস ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখটা দেখে মনে মনে শিহরিত হতো কিন্তু আমি হলাম না!

উনাকে দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো আমার হৃদপিন্ড! মেজাজ প্রচন্ড রকমের খারাপ হয়ে গেলো!
উনার কাছে গিয়ে তিক্ত গলায় ডাক দিলাম, নাফিস ভাই?
সাড়া নেই। আমার মেজাজ তখন একেবারে সপ্তম আসমানে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। এইবার কাজ হলো। উনি ঘুমঘুম চোখে আমার দিকে তাকালেন।

  • তুমি?
    আমার চোখে তখন আগুন ঝরছে। উনার চোখদুটো লাল হয়ে আছে। সম্ভবত কাঁচা ঘুম নষ্ট করে দিয়েছি।
    ক্ষিপ্ত গলায় বললাম, আপনার কোন আক্কেল আন্দাজ নেই?
    উনি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত বুঝতে পারেন নি আমি কি মিন করতে চাইছি।
  • বাড়ি ভর্তি মানুষজন আপনি আর আমি একরুমে! আপনি এইরুমে কেন এসেছেন? আমাকে দেখতে পান নি?

এবার বোধহয় বুঝলেন। শান্ত গলায় বললেন, কালরাতে ভালো ঘুম হয় নি। আমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। বাকিরুমগুলোতে মানুষজন ভর্তি! সরি তনু আমার খেয়াল করা উচিৎ ছিলো।

  • আমাকে সজাগ করে দিলেন না কেন?
  • কাথামুড়ি দিয়ে ছিলে তো তাই দেখি নি। ভেবেছিলাম আধাঘণ্টার মধ্যেই উঠে যাবো।

মেজাজ বিগড়ে গেলো! বাহ! কি সুন্দর কথা?
রাগে চিৎকার দিয়ে বললাম, আপনার উদ্দেশ্য আমি ভালো করেই বুঝে গেছি। একা একটা মেয়েকে ঘুমাতে দেখে আপনার মাইগ্রেনের সমস্যা উঠে গেলো? ..আপনি যে এতবড় ইতর আমার জানা ছিলো না।
আমি এমনিতে খুব শান্ত স্বভাবের। কিন্তু আজকে কেন এত মেজাজ খারাপ হলো আমি জানি না। আমার কথা শুনে নাফিস ভাই উঠে বসলেন।

চোয়াল শক্ত করে বললেন, আমার উদ্দেশ্য মানে? ..তোমার আমাকে কি মনে হয়? আমি চরিত্রহীন? ..বদমাশ লম্পট? ..তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে আমি ঘুমাতে নয় তোমাকে রেইপ করার জন্য ঢুকেছি।
আমি দ্বিগুন জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম। হুট করে কেন এত রাগ হচ্ছে আমি নিজেও জানি না। ঠাস করে উনার গালে চড় বসিয়ে
দিলাম। আমি নিজেই হতবম্ভ! .মুহূর্তেই নাফিস ভাইয়ের চেহারা অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে। হ্যাঁচকা টানে আমাকে উনার কাছে নিয়ে গেলে। তারপর ঠেলতে ঠেলতে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলেন। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। বাহুতে সজোরে চাপ দিয়ে বললেন, ভদ্রভাবে বললে গায়ে লাগে না..না? তোমার এতবড় সাহস কি করে হয় আমার গায়ে হাত দেওয়ার? ..হু দ্যা হেল আর ইউ? ..আমি ইতর না? ইতর কাকে বলে জানো? ..আজকে দেখাবো ইতরামি কি জিনিস!

উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আতংকে উত্তেজনায় আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। প্রান পণ চেষ্টা করলাম মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করার। কেবল ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ হচ্ছে।

নাফিস ভাই আমার হাত দুটো উনার একহাতের মুঠোয় নিয়ে উঁচু করে ধরলেন। অন্যহাত দিয়ে ঝুঁটিকরা চুলগুলো একটানে খুলে ফেললেন। আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। আঙুল দিয়ে আমার ঠোঁটের লিপস্টিক লেপ্টে দিলেন, কাজল এবড়োখেবড়ো করে দিলেন। গায়ের ওড়নাটা টান দিয়ে খুলে ফেললেন। চিৎকার করতে যাবো তার আগেই হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন। আমি কখনো ভাবতেই পারি নি নাফিস ভাই এমন একটা কান্ড ঘটাবেন। ভয়ে সারা শরীর কাঁপছে।

উনি রাগে আমার ঘাড়ে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলেন। চিৎকারে দিতে পারছি না মুখ বন্ধ! দম বন্ধ হয়ে মরে যাবার মত অবস্থা।
তারপর রাক্ষসটা ধাক্কা মেরে আমাকে বের করে দিলো। বের করে দেওয়ার আগে বলল, অসভ্যের মত ছেলেদের রুমে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়বে আবার বড়বড় লেকচার দিবে? .. খাট থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দিলে উচিৎ শিক্ষা হতো। ..এবারে মত ছেড়ে দিয়েছি আর কখনো যদি লাগামছাড়া কথাবার্তা বলেছো তখন দেখবে কি হাল করি। আমি যতটা ভালো তার চেয়ে বেশি খারাপ হতে পারি। ..মাইন্ড ইট!

তারপর আমার মুখের ওপর ওড়না ছুড়ে দিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। জীবনে এই প্রথম কারো কাছ থেকে এত অপমানিত হয়েছি আমি। বুক ফেটে কান্না আসছে। পা দুটো টলছে। ঘাড়ের ব্যথায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। দরজার কাছেই ঘুরে পড়ে যেতে নিলাম। কিন্তু কেউ একজন ধরে ফেললো। হাঁটু আর ঘাড়ে হাত রেখে শূন্যে তুলে নিলো আমাকে। আমি তার বুকের ওপর গিয়ে পড়লাম। পরিচিত একটা গ্রাণ আসছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হারালাম।

পর্ব ৬

মুক্তা আপুর কাছ থেকে যখন শুনলাম উনার ঘরটা গতকাল নাফিস ভাই, উনার বর, উনার দেবর সহ ইমতিয়াজ ভাইয়ার আরো কয়েকজন বন্ধুদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তখন আমার মাথায় বাজ পড়লো।
নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হলো। মুক্তা আপুকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিৎ ছিলো।
কিন্তু নাফিস ভাইয়ের তখনকার বিহেভিয়ারে কথা মনে পড়তে ঘৃনায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
এভাবে কেউ একটা মেয়ের সাথে বিহেভ করে?

কাউকে বাইরে থেকে দেখলে আসলে বোঝা যায় না তার ভেতরটা কতটা জঘন্য!
নাফিস ভাই আমাকে একটা জঘন্যভাবে অপমান করবে আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। উনার ব্যাবহারের কথা মনে পড়লেই অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করে! কিভাবে পারলো উনি? আমি তাকে কোনদিন ক্ষমা করবো না!

হ্যাঁ আমি কাউকে জানাই নি ঠিকই কিন্তু তারমানে এই নয় যে আমি উনাকে মাফ করে দিয়েছি। আমি শুধু চাই নি আপুর বিয়েতে কোনরকম ঝামেলা হোক। তাছাড়া ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধু উনি। ব্যাপারটা জানাজানি হলে একটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে তাই। তা না হলে তাকে আমি..? তবে শুধু একজন জানতে পেরে গেছে। তিনি হলেন মুক্তা আপু।

আমার জ্ঞান ফিরার পর আমি নিজেকে মুক্তা আপুর রুমে আবিষ্কার করলাম। আমার পাশে নাফিস ভাই বসে ছিলেন। উদ্ভ্রান্ত চেহারা নিয়ে। চেহারা অনুশোচনায় ভরপুর। আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, এখন কেমন আছো?
আমি জবাব দিলাম না।

তিনি নরম গলায় বললেন, রাগ উঠলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। তোমার তখন ওভাবে বলা ঠিক হয় নি।
রাগে আমার সমস্ত শরীর কিড়মিড় করে উঠলো। কতবড় অভদ্র ইতর হলে এভাবে কথা বলতে পারে? ..আমার দোষ? আমি কি জানতাম মুক্তা তার রুমটা উনাদের ছেড়ে দিয়েছে? রাগের মাথায় নাহয় একটা থাপ্পড় দিয়েছি, তাও জীবনে এই প্রথম কারো সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করেছি। তাই বলে এভাবে আমাকে..? দুঃখে কষ্টে, আমার চোখে পানি চলে এলো।

আমি কিচ্ছু বললাম না। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি আমার দিকে একপলক তাকালেন। আমার চোখেমুখে ঘৃনা। কিছু বললেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। তখনই মুক্তা আপু হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢূকলেন। আমার মাথার কাছে এসে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কি করেছে ও তোকে?

আমি কষ্ট চেপে রাখতে পারলাম না। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। মুক্তা আপু আমার ঘাড়ের কাছে কামড়ের দাগটা দেখে আঁতকে উঠলেন। উনার বুঝতে বাকি রইলো না কি ঘটেছে! নাফিস ভাইয়ের গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন। নাফিস ভাই মাথা নিচু করে বসে রইলো।
রাগিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন মুক্তা আপু,

  • এভাবে জানোয়ারের মত কেউ কামড়ায়? ..এই তুই কি রাক্ষস নাকি? ..আমার দিকে তাকা? ..তাকা বলছি। কেন করেছিস এমন?

নাফিস ভাই মুখ তুললেন। উনার চোখের পানি টলমল করছে।
মুক্তা আপু বললেন, ওর বাপ ভাই শুনলে কি হবে বুঝতে পারছিস? ..ওরা তোকে আস্ত রাখবে? ..ইমতিয়াজের কাছে মুখ দেখাতে পারবি?

নাফিস ভাই তখনও নিশ্চুপ। আমি মুক্তা আপুকে বললাম আমাকে আপুর রুমে নিয়ে যেতে। আপু আসছি বলে বেরিয়ে গেলেন। আমি উনাকে নিষেধ করে দিয়ে বললাম, আপনি প্লিজ কাউকে কিচ্ছু বলবেন না। আমি চাইনা আপুর আনন্দের মুহূর্তটা আমার জন্য নষ্ট হোক।

মুক্তা আপু বেরিয়ে গেলেন। তবে মনে হচ্ছে উনি আপাতত কাউকে কিচ্ছু বলবেন না।
আপুরা সম্ভবত নিচে এখনো সবার সাথে গল্প করছে। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম আমার ঘাড়ে ব্যথাটা আর নেই। আশ্চর্য হলাম। একটু আগে ব্যথার কারনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। ঠিক তখনই নাফিস ভাই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। একঝটকায় আমাকে কোলে তুলে নিলেন। ইচ্ছা থাকলেও বাধা দেওয়ার শক্তি তখন ছিলো না। তারপর আর মনে নেই! সেই ব্যথা হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলো কি করে?

নাফিস ভাই আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, ব্যথানাশক স্প্রে করে দিয়েছি।
আমি এবারও জবাব দিলাম না। মুক্তা আপু বরফ নিয়ে এসেছে। নাফিস ভাই ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন যাওয়ার সময় শুধু বললেন, মাইগ্রেনের ব্যথা উঠলে আমার হুঁশ থাকে না। অসহ্য লাগে সবকিছু! ..এনিওয়ে সরি ফর এভ্রিথিং!
কথাটা বলার সময় নাফিস ভাইয়ের গলা ধরে আসছিলো। আমি মুক্তা আপু দুজনেই খেয়াল করলাম।
নাফিস ভাই বেরিয়ে গেলে মুক্তা আপু আমার ঘাড়ে বরফ লাগিয়ে দিলেন।

আমি বললাম, ব্যথা করে গেছে আপু। বরফ লাগবে না।

  • ব্যথা নেই জানি। নাফিস বলার পর আমিই তো ব্যথানাশক দিয়ে গেলাম। কিন্তু ফুলে আছে যে।
  • আস্তে আস্তে কমে যাবে। তবে ব্যথা তো বড় কথা নয় আপু অপমানটাই আসল।
    মুক্তা গভীরভাবে আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, কি হয়েছে আমাকে খুলে বলতো? ..নাফিস তো এমন করার ছেলে না? আমি তো ওকে চিনতেই পারছি না। এমন জঘন্য কাজ ও করলো কি করে?
  • উনি আপনাকে বলে নি?
  • না। তোকে রুমে নিয়ে ঢোকার সময়ই আমি দেখে বুঝে গেছি যে কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম বারবার কিন্তু কিচ্ছু বললো না। থম মেরে বসে রইলো।
    আমি আপুকে পুরো কাহিনী খুলে বললাম। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছি।
    মুক্তা আপু কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন।

আমি আহত স্বরে বললাম, আমি রাগের মাথায় উনাকে থাপ্পড় দিয়ে ফেলেছি আপু। আমি নিজেও বুঝতে পারি নি এমনটা হবে। বিশ্বাস করুন আমি কারো সাথে কোনদিন এত খারাপ ব্যবহার করি নি, গায়ে হাত তোলা তো অনেক বড় ব্যপার। কিন্তু তখন নিজেকে সামলাতে পারি নি। আমি নিজেও ভীষণ ভাবে অনুতপ্ত আপু। নাফিস ভাই আমার বয়সে বড় উনার গায়ে হাত তোলা আমার একদমই উচিৎ হয় নি!

  • একটা কথা বলি তনু?

আমি মাথানাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালাম। মুক্তা আপু বললেন, তুই নাফিসের সাথে যেমন বিহেভ করেছিস তুই কি আসলে তেমন? ..না! তুই মোটেও তেমন না। হঠাৎ করে এমন করে ফেলেছিস! কিংবা রাগের মাথায় যেমনই হোক। আসল কথা হচ্ছে তুই এমন না। আমরা সবাই জানি।

আমি আপুর কথার মানে বুঝতে পারলাম না। মুক্তা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, নাফিসের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যপার। তুই ওকে যেমন ভাবছিস ও আসলে তেমন না। পুরোপুরি আলাদা। আমি কি করে বুঝতে পেরেছি জানিস? কারণ ওকে আমি সেই ছোটবেলা থেকে চিনি। কোন মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করার মত ছেলে ও না। আসলে এমন অনেক সময় হয় যেটা আমরা
নিজেরাও কল্পনা করতে পারি না এমন কিছু হয়ে যাবে। কিন্তু হয়ে যায়। যাই হোক! ভুল তোদের দুজনেরই ছিলো। আমি জানি তুই নাফিসকে অনেক খারাপ ভাবছিস, ভাবারই কথা তবে ও কিন্তু খারাপ মানুষ না। প্রথমে আমার অনেক রাগ হয়েছিলো, এখনও হচ্ছে! সামনে থাকলে আরো কয়েকটা দিতাম গালে। তবে হ্যাঁ! আমি কিন্তু একটাও মিথ্যে কথা বলি নি।
মুক্তা আপুর কথাগুলোয় যুক্তি ছিলো কিন্তু তবুও সেদিনের পর থেকে আমি নাফিস ভাইকে
পুরোপুরি ইগ্নোর করা শুরু করে দিলাম। পুরোপুরি মানে পুরোপুরি।

যদিও তার সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক সেই পর্যায়ে নয় তবুও তাকে দেখলে অপমানের কথা মনে পড়ে যেত।
কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে একেবারে নিষ্ঠার সাথে ইগ্নোর করলাম। সেদিন রাতের বেলা খেতে বসে নাফিস ভাই খাবারে পানি ঢেলে উঠে গেলেন। সবাই বসে আড্ডা দেওয়ার সময় আমি গিয়ে বসতেই উনি উঠে গেলেন। আমি পাত্তা দিলাম না। তারপর আর উনার সাথে আমার দেখা হয় নি।

আপু, ইমতিয়াজ ভাই দুজনে নিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম আমরা। আগের দিন আসার কথা থাকলেও মুক্তা আপু আর ইমতিয়াজ ভাইয়ার মা আসতে দিলেন মা। ইনায়াজ ভাই খাওয়াদাওয়ার পরই গতকালই চিটাগাং চলে গেছেন।
দেখতে দেখতে আপুর বিয়ের ছয়দিন হয়ে গেলো। মেহমানরা সবাই চলে গিয়েছে। ভাইয়াও চলে গিয়েছে। ভাইয়া আগেই বলেছিলো মাত্র চারদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলো ওরা। বাসায় শুধু আমি, ইমু আর বাবা, মা আর রুনু মানে আমাদের কাজের মেয়ে। বাবারও অফিস খোলা হয়ে গিয়েছে। ইমু কালকে চলে যাবে বলছে। সামনে ওর টার্ম ফাইনাল আছে।

আমি আমার ঘরে চুপচাপ বসে আছি। আপু চলে যাওয়াতে বাড়িটা বেশ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। রুনু এসে আমার ঘরে চা দিয়ে গেলো। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ইমু কি করছে।
রুনু বললো, ছোটমামা কম্পুটারে কি জানি করে! আমি ধমক দিয়ে বললাম, তোকে কতবার বলেছি কম্পুটার বলবি না? ওটা কম্পিউটার! মনে থাকবে?

রুনু আমার কথা শুনে শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। আমি জানি সে আবার একই ভুল করবে। ও বেরিয়ে গেলে আমি চা শেষ করে ইমুর সাথে গল্প করার জন্য ওর ঘরের দিকে গেলাম। ইমু পড়ার টেবিলের চেয়ারের ওপর পা তুলে বসে ল্যাপটপে আপুর বিয়ের ছবি দেখছে।

আমাকে দেখে হাসিমুখে বললো, আপু? এসো ভেতরে এসো। আমি ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর বসলাম।
ইমু একটা একটা করে আমাকে ছবিগুলো দেখাচ্ছে। ইনায়াজ ভাইয়ের অনেক গুলো ছবি আছে। নাফিস ভাইয়েরও আছে। ইমুকে বললাম, তুই যাওয়ার আগে আপুর বিয়ের ছবিগুলো আমাকে দিয়ে যাস।

ইমু বললো, এখানে তো বাইরের অনেকের ছবি আছে আমি সেগুলো আলাদা করে তারপর তোমাকে দেবো, ঠিক আছে?
আমি কিছু বললাম না। কিন্তু মনে মনে ভয় হচ্ছে ও যদি আমাকে ইনায়াজ ভাইয়ের ছবিগুলো না দেয়? মনটা ভার হয়ে গেলো। কিন্তু ইমুকে বুঝতে দিলাম না। হঠাৎ ইমু চেঁচিয়ে বললো, আপু দেখো, তোমার ছবিটা ভীষণ সুন্দর হয়েছে। একদম বউ বউ লাগছে তোমাকে।

ইমুর কথা শুনে আমি ছবির দিকে তাকালাম। ছবিটা দেখেই আমার চোখ আটকে গেলো। হলুদের দিন তোলা ছবি। ছবিটাতে আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছি। যতদূর মনে পড়ে তাতে মনে হয় নাচ শেষ করে স্টেজ থেকে নামার পর ছবিটা তোলা হয়েছে। আসলেই অনেক ভালো হয়েছে ছবিটা। সমস্যা শুধু একটা যে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে আমার পেটের একাংশ দেখা যাচ্ছে। আমি ভালো করে পিনআপ করেই পড়েছিলাম। নাচতে গিয়ে বোধহয় খুলে গেছে।
কিন্তু আমার মাথায় আসছে না ছবিটা তুললো কে?

যেই ফটোগ্রাফারকে নিয়ে আসা হয়েছে উনি তুলেছে? আমি দ্বিধা সংকোচ রেখে শেষমেশ ইমুকে বললাম, ছবিগুলো আসলেই অনেক ভালো হয়েছে। কে তুলেছে? আমার কথা শুনে ইমু বেশ উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো, এগুলো ইনায়াজ ভাই তুলেছে। উনি ছবি তুলবে আর ভালো হবে না সেটা তো অসম্ভব ব্যাপার তাই না।

ওর কথা শুনে আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অজানা উত্তেজনায় বুকের ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। কেন এই উত্তেজনা কাজ করছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। কিন্তু আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিতেই তাকাতেই আমার মুখটা কালো হয়ে গেলো। তিথীর একটা সলো পিক। তারপর দেখলাম, তিশা, রুহি সবারই মোটামুটি সলো পিক তোলা হয়েছে। এমনকি ছেলেদেরও। সবগুলো ছবিই বেশ ভালো হয়েছে।

কিন্তু কেন জানিনা মনটা খারাপ হয়ে গেলো। একটু আগের উত্তেজনা নিমিষেই কষ্টে রূপান্তরিত হলো। তারমানে উনি সবারই আলাদা ছবি তুলেছেন? আমার প্রতি উনার কোন ফিলিংসই নেই সেটা আমি জানি, কোনদিনই ছিলো বলেও আমার মনে হয় না। তবুও একটু আগে ছবিটা দেখে যেই ক্ষীণ আশা জন্মেছিল একনিমিষেই সব উধাও হয়ে গেলো।
হঠাৎ করেই যেন নিজেকে বড় ছোট মনে হচ্ছে। একটা প্রশ্নই বারবার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। আমি কিসের জোরে উনাকে পাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছি?

উনার যেই পরিমান যোগ্যতা তাতে উনি চাইলেই যে কোন মেয়েকে উনার জীবনসঙ্গী করতে পারেন। সেখানে আমি নিতান্তই তুচ্ছ, আহামরি সুন্দরী নই, তারওপর আমার একাডেমিক ক্যারিয়ারও মোটামুটি টাইপ। পশগার্ল টাইপও নই, তবে?
উনাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার সাজে না! কিন্তু মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারলাম না। ইমু একের পর এক ছবি দেখাচ্ছে আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমার মনে যেই ঝড় উঠেছে সেই ঝড় আমার দেহ, মন সমস্ত সত্তাকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে।

আমি ওর ঘর থেকে উঠে চলে এলাম।
পরদিন ইমু যাওয়ার আগে বললো, সরি আপু, আসলে ছবিগুলো সিলেক্ট করার কথা মনেই ছিলো না। তুমি দেখে বাড়তি ছবিগুলো বাদ দিয়ে দিও।

কেন জানিনা সেদিন ইমু যাওয়ার সময় ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষন কাঁদলাম। ইমু হয়ত ভাবছে আপু নেই একলা বাসায় থাকবো তাই কষ্ট হচ্ছে। ও যতক্ষণ না আমার কান্না থামছিলো আমার কাছেই বসে ছিলো আর বারবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। ইচ্ছেমত কাঁদলাম সেদিন। এই কান্নাটা আমার ভীষন জরুরি ছিলো।

এরপর দেখতে দেখতে ছয়মাস কেটে গেলো। ঘর প্রায় বলতে গেলেই ফাঁকা। রুনুকেও ওর বাবা এসে নিয়ে গেছে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষে বিসিএস ও দিলাম। এবার বেশ জোর দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষাও ভালোই হয়েছে। তবে রেজাল্ট এখনো বেরোয় নি।

বাসায় বসে অবসর সময় কাটে। প্রায় প্রতিদিনই ইনায়াজ ভাইয়ের ছবিগুলো একবার করে দেখি। উনার হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখলেই মনটা ভরে যায়। মাঝে মাঝে উনার ছবির দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগে। মনে হয় যেন উনি আমার দিকে চেয়ে আছে।
এর মাঝখানে হঠাৎ একদিন আপু ইমতিয়াজ ভাইয়াকে নিয়ে বাসায় হাজির হলো। আমাকে দেখেই আপু শাসন করে বললো, কি রে খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম করছিস নাকি? এত রোগা হয়ে গেছিস কেন?

মা অনেক কষ্টে আপুকে বোঝাতে সক্ষম হলো যে পরীক্ষা চাপে আমার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে, অন্য কিছু না।
আপু শান্ত হলে আমি ওকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোন খবর না দিয়ে হুট করে এলে যে? কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?

আপু মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, কোন সমস্যা নেই তবে তোর জন্য একটা সুখবর আছে। এখন না পরে বলবো।
রাতে বাবা ফিরলে আপু ইমতিয়াজ ভাইয়া, মা সবাই কি যেন আলাপ করছে আমাকে দেখে চুপ হয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম না ওরা কি নিয়ে আলোচনা করছে, আমাকে দেখেই বা চুপ হয়ে গেলো কেন?

যাইহোক ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামালাম না। পরেরদিন দুপুরবেলা দেখলাম ইনায়াজ ভাই, ইমু ওরাও বাসায় এলো। আমি বুঝতে পারছি না এসব কি হচ্ছে? আপুকে জিজ্ঞেস করলে বলে আস্তে আস্তে সব জানতে পারবি।
সন্ধ্যের দিকে জানতে পারলাম আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। কথাটা শুনেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! এতকিছুও হয়ে গেলো অথচ আপু একবারও আমাকে জানালো না?

সেইজন্যেই বাবা ইমতিয়াজ ভাইয়া আপু, ইনায়াজ ভাই, ইমু সবাইকে খবর দিয়ে এনেছে।
ইমতিয়াজ ভাইয়া যখন উনার ফ্যামিলি নিয়ে আপুকে দেখতে এসেছিলো তখনও বাবা সবাইকে খবর দিয়েছিলো। বাবা সবসময়ই যেকোন বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবাইকে খবর দেন, ইনায়াজ ভাইকেও। উনাকে বাবা ভাইয়ার মতই ভরসা করেন। ভাইয়ার ট্রেনিং থাকার কারনে ও আসতে পারে নি। বাবাকে দেখলাম ইনায়াজ ভাই আর ইমুকে ডেকে গভীরভাবে আলোচনা করছে। ইমতিয়াজ ভাইয়াও সাথে আছে।

সন্ধ্যের দিকে আপু আমাকে সাজাচ্ছে। আমি ড্রেসিংটেবিলের আয়নার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আপুকে করলাম, পাত্র কে আপু? আপু আমার কথার জবাবে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো, তুই চিনবি!
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে এবার সরাসরি আপুর দিকে তাকালাম। আপু মিটমিট করে হেসে বললো, নাফিস। ইমতিয়াজ এর বন্ধু। বিয়েতেই তোকে দেখে ওর পছন্দ হয়েছে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।

আপুর কথা শুনে আমি রিতিমত বেশ বড়সড় একটা শক খেলাম। ঘটনাটা এতদূর গড়াবে আমি ভাবতেই পারি নি। বিয়ের পর এতগুলো দিন গেলো অথচ উনার কথা একবারও মাথায় আসে নি। আমার চেহারায় কালো মেঘ জমতে শুরু করলো। মুখ থমথমে। আপু জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? আমি জবাব দিলাম না।

লেখা – অরিত্রিকা আহানা

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালো লাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “মনোপ্যাথি (১ম খণ্ড) – মেয়েদের মনের গোপন কথা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – মনোপ্যাথি (শেষ খণ্ড) – মেয়েদের মনের গোপন কথা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *