মনোপ্যাথি (শেষ খণ্ড) – মেয়েদের মনের গোপন কথা

মনোপ্যাথি (শেষ খণ্ড) – মেয়েদের মনের গোপন কথা: ইনায়াজ ভাই জোর করে আমাকে টেনে দাড়ঁ করালেন। আমি উনার পাশ থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলাম। উনি আটকে দিয়ে আমার ডান হাতের ওপর উনার ডান হাত রেখে আমার হাতটা পেটে নিয়ে গেলেন।


পর্ব ৭

একটুপর মা আর আপু ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নাফিস ভাইয়েরা আসার সময় হয়ে এসেছে। আমি চুপচাপ বিছানার ওপর বসে আছি। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়েছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। যাইহোক মনে ভরসা রাখলাম এই ভেবে যে দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।

ভাগ্যের করুণ পরিহাস দেখে আপন মনেই হাসছি। যাকে আমার ধ্যান জ্ঞান সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালোবেসেছি সে কি না আমার জন্য পাত্র দেখতে এসেছে? এরকম পরিস্থিতিতে কারো মাথা ঠিক থাকতে পারে কি না আমি জানি না। তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম স্বাভাবিক থাকার। তারপরও মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে।

সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার দিকে নাফিস ভাইয়ারা এসে ভেতরে ঢুকলো। আমি ভেতরের রুমে বসে আছি। আপু এসে আমাকে খবর দিলো যে ওরা এসে পড়েছে। একটুপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ওদের সামনে।
ভেবেছিলাম পাত্রপক্ষের সামনে যাবো না। কিন্তু না গেলে বাবার অসম্মান হবে। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হলো।
ওখানে গিয়ে দেখলাম ইনায়াজ ভাই বাবার পাশে সোফাতে বসে আছে। পরনে কালো একটা টি- শার্ট আর সাদা ট্রাউজার। হাতে বরাবরের মত ঘড়ি! ড্যাশিং লাগছে! দুপুরের পর আর উনাকে দেখি নি। অবশ্য আমিই বের হই নি ঘর থেকে। ইমতিয়াজ ভাইয়া আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

নাফিস ভাইয়ের মা আমাকে ডেকে উনার পাশে বসালেন। আমি যেদিকটাতে বসেছি ইনায়াজ ভাই আমার ঠিক মুখোমুখি। আমার দিকে একপলক তাকালেন। তারপর ফোন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।
নাফিস ভাইয়ের মা আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করে আমাকে আর নাফিস ভাইকে আলাদা করে কথা বলার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। আপু আমাকে আর নাফিস ভাইয়াকে আমার ঘরে নিয়ে এসে বাইরে থেকে দরজা হালকা ভেজিয়ে দিলো।
দুজনেই নিশ্চুপ। কেউ কোন কথা বলছি না। আমি একমনে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছি। নিরবতা ভেঙ্গে নাফিস ভাই আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো?

  • ভালো।
    উনি আরো অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করলেন উনার সব কথারই সংক্ষেপে জবাব দিলাম।
    হঠাৎ উনি অসহায় কন্ঠে আমার নাম ধরে ডাক দিলেন। আমি জবাব দিলাম না। বললেন, তুমি জানো আজকে কয়মাস আমি ঠিকমত ঘুমোতে পারি না? চোখবন্ধ করলেই তোমার মুখটা ভেসে ওঠে!
    আমি উনার দিকে তাকালাম। নাফিস ভাই বাস্তবিকই বেশ শুকিয়ে গেছে। আগের মত ফিট বডি নেই। রোগারোগা চেহারা। চোখ বসে গেছে। চোখের নিচে অনিদ্রার ছাপ!

উনি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, আর হ্যাঁ সেদিনের জন্য আমি ভীষণ অনুতপ্ত তনু! মন থেকে ক্ষমা চাইছি। তুমি চাইলে আমাকে যেকোন শাস্তি দিতে পারো, আমি সব মাথা পেতে নিবো। চাইলে ইমতিয়াজ কিংবা ভাবী সবাইকে জানাতে পারো তাদের যে কোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজী আছি। কিন্তু একটাই অনুরোধ, সেদিনের অপরাধে আমাকে ফিরিয়ে দিও না প্লিজ। আমি সহ্য করতে পারবো না। উনার চোখভর্তি পানি টলমল করছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। ভালোবাসার যন্ত্রনা আমি বুঝি। নাফিস ভাইতো উনার মনের কথাগুলো আমাকে বলে দিলেন কিন্তু আমি কাকে বলবো?

উনি কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, আমি কি তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি?
আমি উনার এমন প্রশ্ন শুনে রীতিমত চমকে উঠলাম।
আমার রিয়েকশন দেখে উনি লজ্জা এবং অনুশোচনা মিশ্রিত কন্ঠে বললেন, ভয় পাচ্ছো কেন? আমি অতটাও খারাপ নই। তোমার পারমিশন ছাড়া তোমাকে টাচ করবো। আসলে তোমার হাত ধরতে খুব ইচ্ছে করছিলো। সরি! আমার এভাবে তোমার হাত ধরতে চাওয়াটা ঠিক হয় নি।

আপু এসে বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলো
আমাদের শেষ হলো কি না?
নাফিস ভাই আর কথা বাড়ালেন না শুধু বললেন, তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো। তারপর মলিন একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

আমি বোকার মত ওখানেই দাঁড়িয়ে আছি। উনার ওপর রাগ করে থাকতে পারলাম না। একটা জিনিস আমি জানি, .. অনুশোচনা সবচেয়ে বড় শাস্তি এবং উনি সেটা পাচ্ছেন।
কিন্তু আমার পক্ষে উনাকে বিয়ে করাটাও অসম্ভব! কথাটা উনাকে বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। আমি এমনই ছোটবেলা থেকেই কারোর মুখের ওপর না বলতে পারি নি, নিজের প্রিয় জিনিসটা কারো কাছে চেয়ে নিতে পারি নি। ইগোতে লাগে! সবকিছু নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে থাকি।

তবে একটা ব্যাপারে আমি কখনো দ্বিধাহীনতায় ভুগি নি। সেটা হচ্ছে ইনায়াজ ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা।
উনারা চলে যাওয়ার একটু পর ইমুও চলে গেলো। বাবার টেলিফোন পেয়ে সে পরীক্ষা ফেলে চলে এসেছে। কালকে পরীক্ষা দিয়ে হয়ত আবার আসবে বললো।

রাতের বেলা সবাই মিলে আবার মিটিংয়ে বসলো। আমি চুপচাপ আমার রুমে বসে আছি। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। কপালের রগগুলো ছিঁড়ে যাবে মনে হচ্ছে। নিশ্বাসেও সমস্যা মনে হচ্ছে। কাউকে কিছু জানালাম না।
আপু এসে জানালো নাফিস ভাইয়ের মা ফোন জানিয়ে উনাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। ভীষণ খুশি লাগছে ওকে। আমার বুকের ভেতটায় ছ্যাৎ করে উঠলো। অস্বাভাবিক মাত্রায় ধুকপুক ধুকপুক করা শুরু করে দিলো। হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আপুকে বলতে চাইছি যে আমার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না।

আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আপু আমাকে জিজ্ঞেস করছে, এই তনু? তোর কি খারাপ লাগছে নাকি? তনু? ..তনু? ..মা! ..ইমতিয়াজ ..বাবা?
আপু কথা আমার কানে আসছে কিন্তু আমি কোন উত্তর করতে পারলাম না তার আগেই জ্ঞান হারালাম। আপুর চিৎকার শুনেই পাশের ঘর থেকে সবাই দৌড়ে আসলো।

জ্ঞান ফিরলে দেখলাম ইনায়াজ ভাই আমার পালস চেক করছেন। উনাকে এতটা কাছ থেকে আগে কখনো দেখিনি। আজকেই প্রথম এত কাছ থেকে দেখলাম। কি সুন্দর শান্ত, স্নিগ্ধ মুখ!
আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম। এবার আর লজ্জায় নয়, অভিমানে।

যদিও আমি জানি উনি এসবের কিছুই জানেন না তবুও অনেক অভিমান হলো উনার ওপর।
বিছানার একপাশে বাবা অন্য পাশে আপু বসে আছে। ইমতিয়াজ ভাইয়া একটা চেয়ারের ওপর বসে আছে।

আমার জ্ঞান ফিরুলে বাবা গিয়ে মাকে গিয়ে খবর দিলেন। একটুপর মাও এসে আমার পাশে বসলো। মায়ের চোখমুখ ফুলে আছে। আমি জানি, মা এতক্ষণ পাশের ঘরে নামাজ পড়ছিলো। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমরা ভাইবোনরা কেউ অসুস্থ হলে মা নফল নামাজ পড়তো, এখনো তাই করেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কেমন লাগছে মা?
আমি কিছু বলার আগেই ইনায়াজ ভাই বললো, আন্টি ওকে আগে কিছু খাইয়ে দিন। শরীর ভীষণ দুর্বল। উইকনেস থেকে এমন হচ্ছে!

উনার কথা শুনেই মা আপুকে সঙ্গে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলেন।
এদিকে কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলো লজ্জা, ভয়, অভিমান সব দূরে ঠেলে দিয়ে বলি, মিথ্যে কথা! ওসব উইকনেস টুইকনেস কিচ্ছু না আপনার জন্য আমার এই অবস্থা। আপনি আমার সর্বনাশ করছেন। কিন্তু পারলাম না।
রুদ্র গোস্বামী একটা কথা মনে পড়ে গেলো, একতরফা ভালোবাসা গুলোর এই এক অদ্ভুত নিয়ম, একদিন সে একটা লাট খাওয়া হাওয়ার মত এসে ছোঁ করে ছুঁয়ে যাবে, আর যাকে ছোঁবে তাকে এমন ভিকিরি করে দিয়ে যাবে একজন্মে কেন সাত জন্মেও তার সেই অভাব ঘুচবে না।

নিজেকে ভিকিরির চাইতেও নিঃস্ব মনে হচ্ছে। নাফিস ভাই কে না করবো কীভাবে? উনি তো আশা করে বসে আছেন।
কিন্তু আমার যে উনাকে দেওয়ার মত কিছুই নেই। থাকবেই বা কি করে বুঝজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তো আমার যত হাসি, কান্না, মায়া, মমতা, মান অভিমান সব ইনায়াজ ভাইকে ভালোবাসতেই ব্যয় করে ফেলেছি।
আমার বলতে তো আর কিছুই নেই।

আমি কান্না চেপে রাখতে পারছি না। বুকফেটে কান্না আসছে।
হঠাৎ ইনায়াজ ভাইয়ের ফোনে দেখলাম কল আসলো। উনি উঠে বারান্দায় চলে গেলেন। আমি উনার দিকে চেয়ে আছি। এই মানুষটা কি কোনদিন আমার ভালোবাসাটা বুঝবে না?

ঘড়িতে রাত দুটো বাজে। ইমতিয়াজ ভাইয়ার চোখদুটো লাল হয়ে আছে। তাও আমার পাশে বসে আছে। চোখভর্তি দুশ্চিন্তা!
আমি বাবাকে চুপিচুপি ডেকে বললাম, ইমতিয়াজ ভাইয়াকে শুতে পাঠাও নি কেন? এতজন আমার পাশে বসে থাকা লাগবে না।

বাবা এতক্ষন হুঁশে ছিলো না আমি জানি। আমার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে ইমতিয়াজ ভাইয়াকে শুতে যেতে বললেন।
ইমতিয়াজ ভাইয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে আশ্বস্ত করলাম, আমি এখন ঠিক আছি ভাইয়া, আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। এতজন আমার পাশে বসে থাকলে সবাই অসুস্থ হয়ে যাবেন।
আমার আর বাবার জোরাজুরিতে ইমতিয়াজ ভাইয়া উঠে যেতে বাধ্য হলেন।

ইমতিয়াজ ভাইয়া চলে যাওয়ার একটু পরই ইনায়াজ ভাই ভেতরে আসলেন। বাবাকে জানালেন ভাইয়া আসছে। নাইটকোচে উঠেছে। কাছাকাছিই চলে এসেছে আর বোধহয় ঘন্টা দুয়েক লাগতে পারে। ইনায়াজ ভাই ইমতিয়াজ ভাইয়া যেই চেয়ারটায় বসে ছিলো সেটাতে বসলেন। আমি ভালো করে ইনায়াজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনার মুখটা বেশ শুকনো লাগছে। আমার জন্য উনাকে আর কষ্ট দিতে চাইলাম না।

বাবাকে বললাম, আমি ঘুমাবো! তোমরাও শুতে যাও।
আমার কথা না শেষ হতেই মা আপুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। হাতে স্যুপ, আমার কথা শুনেই আপু বললো, আগে একটুখানি খেয়ে নে। তারপর শুবি। আমি না করে দিলাম কিন্তু ওরা শুনলো না।
ইনায়াজ ভাই এখনো চেয়ারে বসে আছেন। ডাক্তার মানুষ রোগী ঠিক আছে কি না নিশ্চিত না হয়ে হয়ত যেতে পারছেন না। আপু আমাকে জোর করে প্রায় অনেকখানি স্যুপই খাইয়ে দিলো।

খাওয়া শেষ হতেই ইনায়াজ ভাই উঠে এসে আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কি না চেক করলেন। আমার খালি বারবার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। যেই মানুষটাকে নিয়ে এত আকাঙ্ক্ষা এত অনুভূতি সেই মানুষটা আজকে আমার এত কাছে ভাবতেই না চাইতেও মন ভালো হয়ে গেলো। বুকের ধুকপুকানি আবার বেড়ে গেলো।
আমি জানি এগুলো হয়ত ডাক্তারি এথিকস এর মধ্যে পড়ে তবুও মন বারবার অন্যকিছু প্রমাণ করতে চায়।
জ্বর আপাতত নেই। ইনায়াজ ভাই আপুকে বললেন, আর কোন ভয় নেই। ভালোমত ঘুম দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি কিচ্ছু ঠিক হবে না।

ইনায়াজ ভাই বেরিয়ে গেলে আপু বললো, তুই তো আমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। ভাগ্যিস ইনায়াজ ভাই ছিলো। তা না হলে কি অবস্থা হতো আল্লাহ জানে। একশো চার ডিগ্রি জ্বর ছিলো তোর। সেই সন্ধ্যা থেকে বেহুঁশ ছিলি। উনি একটা সেকেন্ডের জন্যেও তোর পাশ থেকে নড়ে নি।

আমি আপুর কথার কোন প্রতিউত্তর করলাম না। কারন আমি জানি উনি যা করেছেন আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও তাই করতেন। উনার কোন শত্রুর বেলাতেও উনি ঠিক একই কাজই করতেন। মানুষটা কি ধাতুকে গড়া আল্লাহই জানেন! আমার জীবনে আমি যেই কয়জন ভদ্রলোক দেখেছি তারমধ্যে ইনায়াজ ভাই একজন। আপাদমস্তক ভদ্রলোক উনি! খুবই ঠান্ডা স্বভাবের। তবুও কোথায় যেন একটা দৃঢ়তা আছে। স্পষ্ট ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে উনার চেহারায়। তাকালে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় যেন দেখেই যাই!

ভোররাতের দিকেই টের পেলাম কেউ একজন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম আপু কিন্তু চোখ খুলে দেখলাম ভাইয়া আমার মাথার পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। স্মিত হেসে বললো, কি হয়েছে তোর? হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে গেলি কেন? ইনায়াজ এর কাছে শুনলাম প্রচন্ড জ্বরও নাকি ছিলো?
ভাইয়ার পাশে ইনায়াজ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। তারমানে উনি এতক্ষন পর্যন্ত জেগে ছিলেন? উনাকে দেখে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আমি ভাইয়ার কথার জবাবে একটু হাসার চেষ্টা করলাম।

ভাইয়া উদ্বিগ্ন গলায় বললো, এখন কেমন লাগছে? আমি ওকে আশ্বস্ত করা জন্য জোর গলায় বললাম, ভালো। এত টেনশন করার মত কিছু হয় নি। সামান্য জ্বরেই তোমরা তুলকালাম বাধিয়ে দাও!

  • তোর যা শরীর তুলকালাম না বাধিয়ে উপায় আছে? দিনদিন শুঁটকির মত হয়ে যাচ্ছিস! ..কত করে বলি নিয়ম করে খাওয়া দাওয়া করবি তুই শুনিস?
  • আচ্ছা শুনবো। এখন তুমি বলতো? তুমি এসেই আমার পাশে বসে গেছো কেন? যাও চেইঞ্জ করো আগে। তারপর হালকা কিছু খেয়ে একটা ঘুম দাও। আমাকে নিয়ে এত চিন্তার কিছু নেই আমি একদম ঠিক আছি।
    ভাইয়া বললো, ঠিক আছে তুই ঘুমা। কোন সমস্যা হলে ভাইয়াকে ডাক দিবি। ভাইয়ার মনে হয় এখন আর, ঘুম হবে।

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালাম। ভাইয়া ইনায়াজ ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ইনায়াজ ভাই বেরিয়ে যাওয়ার সময় দ্বিতীয়বার আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কি না চেক করলেন। আমার সমস্ত শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো। উনি স্বাভাবিক ভাবেই বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু আমি স্বাভাবিক থাকতে পারলাম না। উনার স্পর্শ সারারাত আমাকে ছুঁয়ে বেড়ালো।


পর্ব ৮

সকালবেলা বেশ দেরীতে ঘুম ভাংলো আমার। ঘুম হওয়াতে ফ্রেশ লাগছে। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ গেলাম। সবাই বসে নাশতা করছে। রুহিকে মামা এনে দিয়ে গেছে। ইনায়াজ ভাই এসেছে শুনে আমাদের বাসায় আসার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলো। মামা অফিসে যাওয়ার সময় দিয়ে গেছে।

আমাকে দেখেই আপু বললো, উঠে গেছিস? আমি কয়েকবার ডাকতে গিয়েছিলাম ভাইয়া বারণ করলো তাই আর ঘুম ভাঙাই নি। আমি আপুর কথার জবাবে কিছু বললাম না। নাশতা করতে বসে গেলাম।
মা এসে জিজ্ঞেস করল কি খাবো। টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আজকে অনেক আইটেম করা হয়েছে। আমি বললাম, তোমার যা ইচ্ছে দাও। তবে বেশি দিও না।
আমার কথা মা আমাকে দুটো শুকনো রুটি আর ভূনা মাংস দিয়ে গেলো সাথে একগ্লাস দুধ। কোন রকমে গিলে রুমে চলে এলাম।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম চুলগুলো সব আউলাঝাওলা হয়ে আছে। পরনে ফতুয়াটাও কুঁচকে আছে। নিশ্চই কালরাতে আপু বদলে দিয়েছে। আমার ঠিক মনে আছে আমি যখন বেহুঁশ হয়েছিলাম তখন আমার পরনে লাল রংয়ের একটা শাড়ি ছিলো।
আমি আলমারি থেকে কালো রংয়ের একটা থ্রিপিস বের করে নিলাম। ইনায়াজ ভাই বাসায় থাকলে আমি কখনোই ফতুয়া, স্কার্ট, গেঞ্জি এসব পরি না। ভীষণ অকওয়ার্ড লাগে।

আমি ওয়াশরুমে ঢুকে মাথাটা হালকা করে একটু ধুয়ে নিলাম। বেশি ভেজালাম না আপু দেখলে রাগারাগি করতে পারে। চেইঞ্জ করে জামাকাপড় গুলো ঝুড়িতে রেখে বেরিয়ে এলাম।
আমি চিরুনি দিয়ে চুলের জট খোলার চেষ্টা করছি এমন সময় মা এসে আমার কানে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো, ইমু, তোর সাথে কথা বলবে। আমি হ্যালো বলতেই ইমু উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনতে পেলাম।

  • হ্যাঁ আপু এখন কেমন আছো?
  • আমি ঠিক আছি। তোর পরীক্ষা শেষ?
  • হুম। হল থেকে বেরিয়েই তো ফোন করলাম।
  • কেমন হয়েছে?

ইমু হেসে উঠে বললো, হয়েছে মোটামুটি! পাশ করবো মনে হচ্ছে।
আমি জানি ইমুর পরীক্ষা ভালো হয়েছে, ও বরাবরই প্লেস করা স্টুডেন্ট। তবে ওর কাছে পরীক্ষা ভালো হওয়া মানে একশোতে একশো। ছোটবেলার অভ্যেস এতবড় হলো এখনো বদলাতে পারে নি। ফার্স্ট প্রফ যেবার দিলো, সেবার পরীক্ষা শেষে পনেরো ঘর থেকে বের হয় নি। ভাইবা বোর্ডে এক্সটারনাল নাকি ওর কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো। বাচ্চাদের মত মন খারাপ করে বসে থাকতো। কত বোঝালাম ভাইবা বোর্ডে এসব কমন ব্যাপার কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেষে ইনায়াজ ভাই আর ভাইয়া দুজনে প্ল্যান করে ট্যুরে নিয়ে গেলো।

ইমু বলল, নেক্সট এক্সামের আগে পাঁচদিন বন্ধ আছে। ভাবছি একবার আসবো। আমি অবশ্য ওকে বারন করে দিয়েছি। বারবার করে বলেছি এখন আসার দরকার নেই। কিন্তু আমি জানি শুনবে না। ঠিক আসবে। তবে সবে ঠিকই কিন্তু বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকবে।

  • ইমু?
  • হুম?
  • তোর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কি? ..বই?
    ইমুর হাসির আওয়াজ পাচ্ছি ওপাশ থেকে। হাসি থামিয়ে বলল, আমার লাইফের সবচেয়ে জিনিস বই কি না জানি না তবে সবচেয়ে পছন্দের মানুষ হচ্ছে আপু। লাইফে এত জলি পার্সন আমি খুব কম দেখেছি। লাইফ নিয়ে ওর পজিটিভ ভিউ গুলো আমাকে দারূণভাবে মোটিভেট করে। যেটা আমাদের কারো মধ্যেই নেই। তোমার তো না- ই! শী ইজ রিয়েলি আ ব্লেসিং ফর মি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তোমাকে। আপুর সবকিছু আমার ভালো লাগে বাট ভালোবাসি তোমাকে বেশি। তাই তোমার অনেক কিছু তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারি। আরো একজন কে ভালোবাসি আমি।

হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটে। আমি জানি ইমু মিথ্যে বলছে না। একবর্ণও না। হি লাভস মি মোর দ্যান এনিথিং। প্রেম ভালোবাসার ধার ও ধারে না। তবে একটা ব্যাপার আজকে বুঝতে পারলাম, ইমু অনেক ম্যাচিউর হয়ে গেছে।

  • সেই আরো এক জনটা কে বলা যাবে?
  • যাবে।
  • কে শুনি।
  • ইনায়াজ ভাই।
  • উনাকে কেন?
  • কারণ তুমি!
  • আমি?
  • হ্যাঁ! তুমি উনাকে ভালোবাসো তাই!

ইমুর কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। ইমু..!

  • হ্যালো আপু?
    আমার জবাব নেই।
  • আমি কিন্তু আজকে আসছি। হোস্টেলে গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে রওনা দিবো।
  • আজকেই?
  • হুম।
    আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। ইমু ফোন রেখে দিলো। কেটে দেওয়ার আগে শুধু বলল, ভয় নেই। আমি এমন কিছু করবো না যাতে তোমার আত্মসম্মান নষ্ট হয়। বাট আই থিংক হি লাভস ইউ।
    ফোন রেখে আমি কিছুক্ষন থম মেরে বসে রইলাম। ইমুর কথাগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথাটা ভার লাগছে। কানের কাছে ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে।

আমি চুলগুলো জুঁটি বেধে নিলাম। আপুকে বললাম আমি একটু ছাদে যাবো। এখন প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে। অন্য সময় হলে আপু হয়ত বলতো বিকেলে যেতে কিন্তু শরীর খারাপ দেখে আজকে আর না করলো না।
আমি সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে উঠে গেলাম। ছাদে রোদ নেই। কেমন যেন একটু শীত শীত করছে। শীতকাল বোধহয় চলে এসেছে। আমি গুটিগুটি পায়ে গিয়ে ছাদের দক্ষিন পাশের কার্নিশের ওপর বসলাম। আমাদের ছাদের কার্নিশগুলো বেশ চওড়া। তাই মাঝে মধ্যে উঠে বসা যায়।

কার্নিশের ওপর বসে বসে গতকাল রাতের কথা ভাবছি। ইমুর বলা কথাগুলোও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ইমু কি করে বুঝলো?
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক থেকে। কি থেকে কি হয়ে গেলো? আমি জানি আজকে আবার আমার বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করা হবে। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে নাফিস ভাইকে ওদের ভালোই পছন্দ হয়েছে। এদিকে বিয়েটা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আটকাবো কি করে? আর যাই হোক আমি কখনো ইনায়াজ ভাইকে বলতে পারবো না আমি উনাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা তো আজকালকার নয়। সেই ছোটবেলা থেকেই উনাকে ভালোবেসে এসেছি।

আচ্ছা, উনি যদি কোনভাবে জানতে পারেন আমি উনাকে ভালোবাসি তাহলে কি উনি হেসে উড়িয়ে দেবেন নাকি গোলগাল চোখে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন? উনার রিয়েকশন কি হতে পারে ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমি বসে বসে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ দেখলাম ইনায়াজ ভাই ফোন কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে। উনাকে দেখেই আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম। উনি আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন!

উনি যে ছাদে আছেন সেটা আমি জানতাম না। এইজন্যই নাশতার টেবিলে উনাকে দেখি নি। আমি মনে মনে দোয়া করছি উনি যাতে ছাদ থেকে নেমে যায় অথবা আবার ওই পাশে চলে যায় তাহলে আমি এক দৌড়ে নিচে নেমে যেতে পারবো।
আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি দুটোর একটাও করলেন না। উনার দিকে না তাকালেও উনি যে সোজা আমার দিকে আসছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে উত্তেজনায়! উনি এদিকে আসছেন কেন আমার মাথায় আসছে না।
উনি আমার কাছ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ের মধুর গলায় বললেন, কাল রাতেই তো মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলে। এই শরীর নিয়ে কার্নিশের ওপর বসেছো যদি বিপদ আপদ কিছু ঘটে যায়?

আমি চট করে কার্নিশের ওপর থেমে নেমে গেলাম তবে ছাদে আর দাঁড়ালাম না। সোজা নিচে চলে এলাম। আমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বড়বড় দম নিলাম। উত্তেজনায় নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। বুকের ভেতর ঢোল পেটাচ্ছে! আমাকে এভাবে দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে মা আর আপু বাইরে থেকে দরজা ধাক্কানো শুরু করে দিলো। আমি কোন জবাব দিলাম না। চুপ করে বসে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। বাইরে দরজা ধাক্কানোর পরিমান ক্রমশ বাড়ছে। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই মা আর আপু হুড়মুড়িয়ে ভেতর ঢুকে পড়লো। মা আমার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললো, কিরে আবার শরীর খারাপ করছে নাকি? এভাবে দৌঁড়ে নেমে গেলি যে? কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কি না দেখলো। মায়ের কথার জবাবে আমি কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না। বললাম,

  • আমার মাথা ব্যথা করছে।

ওদেরকে একরকম জোর করে বাইরে বের করে দিলাম। বারান্দায় বসে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছি। ইনায়াজ ভাই আমার সাথে কথা বলেছে ভাবতেই মনে হচ্ছে আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। ভাগ্যিস উনি আমার সামনে এসে দাঁড়ান নি তা না হলে আমি হয়ত লজ্জায় মরেই যেতাম।
দুপুরের দিকে আমি চুপিচুপি ভাইয়ার রুমের উঁকি দিলাম। ভাইয়া বাসায় নেই। ভেতরে ইনায়াজ ভাই ঘুমাচ্ছে। দুইহাত ভাঁজ করে তারওপর মাথা দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন উনি। উনার পিঠের ওপর উপুড় হয়ে রুহি ঘুমাচ্ছে। কি সুন্দর দৃশ্য! যেন পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসাগুলোর একটি!

আমি আবার চুপিচুপি সরে এলাম। রুমে এসে ইমুর বলা কথাগুলো ভাবছি। ছাদের ঘটনাটা ভাবতেই অকারণে লাল হয়ে যাচ্ছি।
এসব ভাবতে ভাবতে যে কখন বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই বলতে পারবো না। ঘুম ভাঙ্গলো আসরের আজান শুনে। আমি তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে উঠে ভেতরে চলে এলাম। ভেতরে এসে ভাবছি এত বেলা পর্যন্ত ঘুমালাম অথচ কেউ আমাকে ডাকলো না?

আমি দরজা খুলে বেরিয়ে দেখলাম ড্রয়িংরুম থেকে হাসাহাসির আওয়াজ পেলাম। ড্রয়িংরুম এ উঁকি দিয়ে দেখলাম ভাইয়া, নাফিস ভাই, ইনায়াজ ভাই, ইমতিয়াজ ভাইয়া সবাই সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি সেদিক থেকে সরে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। আপু আর মা দুজনে মিলে নাশতা বানাচ্ছে।
আমাকে দেখে আপু বললো, এতবেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমালে চলবে? খাওয়াদাওয়া কিছু লাগবে না?

আমি আপুর কথা জবাব না দিয়ে বললাম, ড্রয়িংরুমে মেহমান দেখলাম মনে হচ্ছে?
আপু মুচকি হেসে বললো, নাফিস এসেছে তোকে দেখতে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে দেখতে? ..?

আপু আমার কথা বুঝতে পেরে বললো, হ্যাঁ! ইমতিয়াজের কাছে তোর অসুস্থতার কথা শুনেই তোকে দেখতে চলে এলো। যা দেখা করে আয়!
আপুর কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম যে নাফিস ভাইকে বাসার সবার পছন্দ হয়েছে। আমি আর কোন কথা না বলে সোজা আমার ঘরে চলে এলাম।


পর্ব ৯

একটুপরই আপু ইমতিয়াজ ভাইয়া আর নাফিস ভাইয়াকে নিয়ে আমার ঘরে ঢুকলো। আমাকে দেখেই নাফিস ভাইয়া মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো, এখন কেমন আছো?

আমি শুধু বললাম, ভালো।
উনি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ভাবীর কাছে শুনলাম তুমি নাকি নিজের শরীরের প্রতি একটুও যত্ন নাওনা? ..হুটহাট ঘুরে পড়ে যাওয়া তো ভালো লক্ষন নয়? ..নিজের শরীরের প্রতি এমন অযত্ন করলে চলবে হুম?

নাফিস ভাইয়ের কথা শুনে আপু নালিশের সুরে বললো, কাকে কি বলছো তুমি? ওর নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়ার সময় আছে নাকি? সারাক্ষণই চিন্তাবিদদের মত কি জানে ভাবে আল্লাহই জানে। এই তো আজকে দুপুরেও না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।
নাফিস ভাইয়া আপুর কথা শুনে আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। অস্বস্তি লাগছে।

  • এখন থেকে সবসময় শরীরের যত্ন নেবে ঠিক আছে? ..আমি কিন্তু অনিয়ম একদম পছন্দ করি না। শরীর ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে। খাওয়াদাওয়ার কোন অনিয়ম করবে না। এই বয়সে প্রতিটা মেয়েরই উচিৎ হেলথ এন্ড হাইজিন মেইনটেইন করে চলা। তা না হলে তাদের গাফিলতির জন্য নেক্সট জেনারেশন সাফার করবে।

তারপর আবার নিজে থেকেই হেসে উঠে বললেন, স’রি! লেকচার দিয়ে ফেললাম না? বোঝোই তো মেরিনের মানুষ। ডিসিপ্লিন মেনে চলতে সবাইকে সেই উপদেশ দেওয়াটা অভ্যেসে পরিনত হয়ে গেছে। তুমি কিছু মনে করো না। তোমার বেলায় নাহয় একটু আধটু ছাড় দিলাম। কি বলো?

আমি কিছু বললাম না।
উনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন, সরি। অনেক বেশি সরি! আমি বোকার মত উনার দিকে চেয়ে আছে। উনি কি ধরে নিয়েছেন আমি বিয়েতে রাজী? ইচ্ছে করলো উনাকে কিছু কথা শুনিয়ে দেই কিন্তু উনার মুখের ওপর কিছু বলতে পারলাম না।

সন্ধ্যেবেলায় উনি চলে যাওয়ার পর আমি রুমে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম এমন সময় আপু এসে আমার হাতে একটা বক্স ধরিয়ে দিল।
জিজ্ঞেস করলাম, কি এটা?

আপু বললো, দেখতে পাচ্ছিস না গিফট বক্স, তোর জন্য। নাফিস যাওয়ার আগে আমার কাছে দিয়ে গেছে। খোল তো দেখি!
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপুর জোরাজুরিতে গিফট বক্সটা খুললাম। অনেকগুলো চকলেট বক্স আর র‍্যাপিং করা একটা প্যাকেট। প্যাকেটটা খুলতেই দেখলাম কালো আর খয়েরী রংয়ের এক জোড়া জামদানী, সাথে একটা চিরকুট। শাড়িগুলো দেখে আপু বললো, নাফিসের তো দারুণ পছন্দ। শাড়িগুলো ভীষণ সুন্দর।

আমি কোনরকম উচ্ছ্বাস বোধ না করে বললাম, তুমি নিয়ে নাও। আমার তো তেমন শাড়ি পরা হয় না।
আপু নাকমুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললো, তুই এমন কেন বলতো? বেচারা শখ করে তোর জন্য শাড়ি দিয়ে গেছে ওর তুই আমাকে নিয়ে যেতে বলছিস? ভদ্রতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে?
মনে মনে ভাবলাম, ভদ্রতা? ..এই ভদ্রতা নামক জিনিসটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যাই হোক! আপুকে আর বেশি চটালাম না। ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, তোমার পছন্দ হয়েছে তাই ভাবলাম তুমি নিলে তো পরতে পারবে আমার তো খুব বেশি শাড়ি পরা হয় না। আচ্ছা সরি!
আপু শান্ত হলো। বললো, চিরকুটে কি লিখেছে?
আমি চিঠিটা খুললাম। গোটগোট হাতে লিখা, ফর ইউ, স্পেশালি! নিচে দিকে ছোট্ট করে সরি লিখা। আমি চিঠিটা ভাঁজ করে তোশকের নিচে রেখে দিলাম।

আপু এবার সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকালো। সন্দিগ্ধ গলায় বললো, তোর কি হয়েছে বলতো? তুই কি আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস?
আমার মা বাবা ভাইবোনেরা আমাকে বুঝে। তাই সর্বক্ষণ আমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকে। হয়ত অন্যান্য ভাইবোনদের তুলনায় পিছিয়ে থাকায় তারা একটু বেশিই কেয়ার করে। তবে ওদের এই ভালোবাসার মাঝে কোন কৃত্রিমতা নেই।
,
আমি বললাম, তোমার সবাই আমাকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবো। আমার আবার কি হবে। সবে মাত্র পরীক্ষা গেলো রেজাল্ট নিয়ে একটু টেনশনে আছি এই আর কি।
আপু আর কিছু বললো না। চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। ভাবছি কোন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাকে? একদিকে যাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে এসেছি, সেই মানুষটা আরেকদিকে পরিবার! আর নাফিস ভাই? উনাকে ফিরিয়ে দেবো কি করে? কিচ্ছু মাথায় আসছে না! সব অসহ্য লাগছে!

সেদিন রাত্রিবেলা আমাকে বাবার ঘরে ডাকা হলো। ভেতরে সবাই গোল করে বসে আছে।
বাবা ইনায়াজ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সবাই তো সবার মতামত দিলো, তুমি কি বলো?

ইনায়াজ ভাই আমার দিকে তাকালো। আমি উনার দিকে চেয়ে আছি। এই প্রথম উনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে মনে খোদাকে বলছি খোদা! ইনায়াজ ভাই যেন বাবাকে বারণ করে দেয়। উনি যেন আমার চোখের ভাষা একটু হলেও বুঝেন! আল্লাহ! আমার প্রতি একটু সদয় হও। এই মানুষটা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারে! অলৌকিক কিছু ঘটার অপেক্ষায় ছিলাম।

ইনায়াজ ভাই আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঠান্ডা গলায় বাবাকে বললো, সবার আগে তনুর মতামতটা জানা প্রয়োজন। আপনি আগে ওকে জিজ্ঞাসা করুন, ওর কোন আপত্তি আছে কি না? ওর যদি কোন আপত্তি না থাকে আপনি এগোতে পারেন, ছেলে হিসেবে নাফিসকে আমার ভালোই লেগেছে।
উনার কথা শুনে আমার কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠলো। হৃদপিন্ডে কেউ ছুরি চালিয়ে দিলো মনে হচ্ছে। আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। এমন কেন এই মানুষটা? আচমকা জেদ চেপে গেলো।

আমি চোখমুখ শক্ত করে কঠিন গলায় বললাম, আমার কোন আপত্তি নেই বাবা। তুমি ওদেরকে হ্যাঁ বলে দাও।
আমার এমন গলা শুনে সবাই একটু চমকে উঠলো। ইনায়াজ ভাই স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।

সোজা আমার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। চোখের পানি আজকে আর বাধ মানছে না। অনবরত ঝরেই চলেছে। আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে ইনায়াজ ভাইয়ের নির্লিপ্ত জবাব। বারবার মনে হচ্ছে একতরফা ভাবে কেন উনাকে ভালোবাসতে গেলাম! আমি হলফ করে বলতে পারি উনার জীবনে যত মহীয়সী নারীই আসুক না কেন আমার চেয়ে বেশি ভালো উনাকে কেউ বাসতে পারবে না। কেউ না! আমি আমার সমস্তটা দিয়ে ইনায়াজ ভাইকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি!

কাঁদতে কাঁদতে কখন বেহুঁশ হয়ে গেছি বলতে পারবো না। জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম হস্পিটালের বেডে শুয়ে আছি। কতগুলো মুখ উৎকন্ঠা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখেই সবাই চিন্তামুক্ত হলো। কিন্তু আমি কোন কথা বলতে পারছি না। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মাস্কটা খুলতে নিলেই ভাইয়া বাধা দিয়ে বললো, আজকে তিনদিন পর তোর জ্ঞান ফিরেছে। তুই এখনো পুরোপুরি সুস্থ না। এখন কথাবলার দরকার নেই।

ভাইয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। তিনদিন যাবত আমি বেহুঁশ ছিলাম?
একটু পরেই নার্স এসে সবাইকে বের করে দিলো। যাওয়ার আগে আপু আমাকে বললো, আজকে তিনদিন ধরে নাফিসও আমাদের সবার সাথে হস্পিটালে। বেচারা লজ্জায় সামনে আসছে না।

আমি কিছু বললাম। শুধু ভাবছি সবাই আমাকে দেখতে এলো অথচ ইনায়াজ ভাইকে একবারও দেখলাম না? আজ তিনদিন যাবত আমি বেহুঁশ ছিলাম জেনেও উনি আমাকে একটাবার দেখতে এলো না? আমার এই অবস্থা জেনেও উনি কি চিটাগাং চলে গেছেন? নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না। উনার ওপর ভীষন রাগ হচ্ছে। উনি আসলে একটা নিষ্ঠুর, উনার মন বলতে কিচ্ছু নেই, উনার মত একটা মানুষকে ভালোবাসা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

জ্ঞান ফিরার পর আরো চারদিন আমাকে হস্পিটালে রাখা হলো। আগামীকাল আমাকে রিলিজ দেওয়া হবে। আমি চুপচাপ কেবিনে শুয়ে আছি। রাতে হস্পিটালে কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না। দিনে এসে সবাই দেখা করে যায়। প্রতিদিনই নাফিস ভাই আসার সময় এটা ওটা নিয়ে আসে। বিরক্ত লাগে কিন্তু কিছু বলি না। বেচারা আশা করে নিয়ে আসে। আপু জানতে পারলে কষ্ট পাবে তাই চুপ করে থাকি। সাথে সেই ভদ্রতা সূচক হাসি তো আছেই। আজকে
ইদানীং কিছুতেই শান্তি পাই না। অস্থির অস্থির লাগে। আজকে বিকেলে সবাই এসে দেখা করে গেছে।

এখন ঘড়িতে রাত বারোটা একটুপর নার্স এসে দেখে যাবে ঘুমিয়ে পড়েছি কি না। প্রতিদিনই এসে দেখে আমি জেগে আছি। কোন কোন দিন আমাকে ঘুমানোর জন্যে বলে যায় অথবা কোন দিন মাইল্ড সিডেটিভ দিয়ে যায়।
আমি নার্স আসার অপেক্ষায় ছিলাম। এমন সময় পায়ের আওয়াজ পেয়ে ভাবলাম নার্স বোধহয় এসে গেছে। কিন্তু আবছা আলোতে স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার সামনে এগিয়ে আসছে একটা পুরুষ মানুষের ছায়া। আরেকটু কাছে আসতেই চেহারাটা স্পষ্ট হলো! সেই শান্ত স্নিগ্ধ পৌষরদীপ্ত চেহারা!

পরনে কালো শার্ট, কালো জিন্স। গায়ে সাদা এ্যাপ্রন! গলায় স্টেথো ঝোলানো। হাতে বরাবরের মত ঘড়ি! আমার হার্টবিট মিস হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমার হৃদয় টা হাহাকার করে উঠলো! ইয়া আল্লাহ! আমি জীবনে আর কিচ্ছু চাইবো না। শুধু এই মানুষটাকে আমার চাই! মানুষটাকে আমার করে দাও খোদা!
আমি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে উচ্চারণ করলাম, ইনায়াজ ভাই!

ইনায়াজ ভাই আমার কথার জবাব না দিয়ে আমার পাশে চেয়ারটেনে বসলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললেন, অনেকদিন থেকে তোমাকে জিজ্ঞেস করবো করবো ভাবছি কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠে নি! তোমার নাফিসকে বিয়ে করতে সত্যিই কোন আপত্তি নেই তো? বিয়ের ব্যাপারে কথা উঠলেই দেখছি তুমি হুটহাট জ্ঞান হারিয়ে ফেলো। এনিথিং রং?

আমি উনার কথার জবাবে কিছু বলতে পারলাম না। স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। অতিরিক্ত উত্তেজনায়, মুহূর্তেই আবার জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম ইনায়াজ ভাই একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছাপ। আমার দিকে একটু ঝুঁকে মৃদুস্বরে ডাক দিলেন, তুমি ঠিক আছো? …তনু?

উনার সেই ডাক আমার হৃদয় পর্যন্ত পৌছে গেলো। আমি ছলছল চোখে উনার দিকে তাকালাম! আমার কি হলো জানি না শোয়া থেকে উঠে উনাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্বাস চেপে রেখেই বলে ফেললাম, আমি আপনাকে ভালোবাসি ইনায়াজ ভাই! আপনি কেন বোঝেন না?

ইনায়াজ ভাই কোন উত্তর করলেন না, শুধু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি বুঝতে পেরেছি! তুমি শান্ত হও! এই মুহূর্তে উত্তেজনা তোমার শরীরের জন্য ঠিক নয়।

উনি আমার শুইয়ে দিলেন। আমার প্রেশার চেক করলেন। আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে! বারবার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি! বরফের মত জমে যাচ্ছে আমার পুরো শরীর! ইনায়াজ ভাই আমার হাতে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিলেন। আমি অপলক ভাবে উনাকে দেখছি! উনি আন্তরিকভাবে হেসে বললেন, চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো, কেমন? আমি বন্ধ করলাম না। চোখ বন্ধ করলেই যদি উনি চলে যায়?

উনি বললেন, ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি! এবার ঘুম আসবে। তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো! আমি আছি!

পর্ব ১০

আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু ঘুম কি আসে? পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলাম ইনায়াজ ভাই বেডের পাশে চেয়ারে বসে নিউজফিড স্ক্রল করছে। আমি চোখ খুলতেই ধরা খেয়ে গেলাম,
ইনায়াজ ভাই ফোন থেকে চোখ না তুলেই বলল, হুউ! ..ঘুমাও!
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

উনি ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই আমি খপ উনার হাত চেপে ধরলাম।

  • কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
  • যাচ্ছি না তো। পানি খাবো।

আমি উনার হাত ছেড়ে দিলাম। উনি পানির গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেলেন। আমার হৃদপিন্ডে তখন ভূমিকম্প। উনার এডামস এপলটা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। সহ্য হলো না। অধৈর্য গলায় বললাম, পানি খাবো।
ইনায়াজ ভাই পানির গ্লাস এনে আমার হাতে দিলেন। কিন্তু আমার হাতদুটো অনবরত ভাবে কাঁপছে। তারচেয়ে বেশি কাঁপছে আমার শরীর! রীতিমত ঝাঁকুনি দিচ্ছে!

ইনায়াজ ভাই আমার হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে নিজেই আমার মুখের সামনে ধরে ইশারা করলেন খাওয়ার জন্য। আমি বোকার মত উনার দিকে চেয়ে আছি। আজকে কি হচ্ছে আমার সাথে? আমি কি সত্যি সত্যি বেঁচে আছি? না মরে গেছি? নাকি পুরোটাই আমার ভ্রম।
ধ্যান ভাঙলো ইনায়াজ ভাইয়ের ডাকে।

  • পানি খাবে না?
    আমি মাথা দুলিয়ে না বোঝালাম। ভেবেছিলাম উনি বিরক্ত হবেন। কিন্তু উনি স্বাভাবিকভাবেই পানির গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। তারপর আবার চেয়ারে বসে বললেন, এবার ঘুমাও।
    আমি আবারও বোকার মত উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবে?
    আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম।
  • তাহলে ঘুমাচ্ছো না কেন?
  • ঘুম আসছে না।
  • আসবে। তুমি চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো। দেখবে ঠিক ঘুম চলে আসবে!
    উনি এত সুন্দর করে কথাটা বললেন যে আমার চোখদুটো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেলো। আমি ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
    সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো নার্সের ডাকে। বাসা থেকে বাবা, আপু, আর ইমু এসেছে, বারোটার দিকে আমাকে রিলিজ দেওয়া হবে। এখন বাজে সাড়ে আটটা।

আপু ভেতরে ঢুকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, ঘুম কেমন হয়েছে?
আমি হাসলাম। গত কয়েকমাসে এত ভালো ঘুম হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। একেএকে সবাই ভেতরে ঢুকলো। নাফিস ভাইও এসেছে। হাসিহাসি মুখ! চোখদুটো খুশিতে ঝলমল করছে।

সবার কথা বলা শেষে আপু বললো, নাফিস কিছুক্ষন থাকুক তনুর পাশে। আমরা বাকি ফর্মালিটিজ গুলো সেরে নেই।
ওরা বেরিয়ে গেলে নাফিস ভাই আমার পাশে বসলেন। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো এখন?

  • ভালো।
  • এই কয়েকদিন অনেক টেনশনে ছিলাম!
    আমি ভদ্রতাসূচক হাসি দিলাম। নাফিস ভাই বোধহয় মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। পরোক্ষনেই আবার খুশি খুশি গলায় বললেন, একটা গুড নিউজ আছে।
  • কী?
  • নাহ! বাসায় গেলে বলবো।
  • আচ্ছা!
  • থাক এখনই বলি?
    উনার অবস্থা দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম, বলুন!
  • আমার প্রমোশন হয়েছে।
  • বাহ!
    নাফিস ভাই বোধহয় এবারও হতাশ হলেন। আমার কাছ থেকে যেই পরিমান উচ্ছ্বাস আশা করেছিলেন তা আমি প্রকাশ করতে পারি নি। আমি উনার প্রমোশনের খবর শুনে খুশি হয়েছে। কিন্তু উনি যেই অর্থে খুশি বোঝাতে চাইছেন তা আমি হতে পারলাম না।
    উনি মনে মনে হতাশ হলেও আমাকে বুঝতে দিতে চাইলেন না। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বললেন, থ্যাংকস!
  • কেন?

নাফিস ভাই কৃতজ্ঞতাসূচক হাসি হেসে বললেন, বিয়েতে রাজী হওয়ার জন্য। আমি অনেক টেনশনে ছিলাম, ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় সত্যি সত্যি আমাকে ফিরিয়ে দেবে। তারপর ভাবী যখন বলল তোমার বিয়েতে কোন আপত্তি নেই আমি বিশ্বাসই করতে পারতে পারছিলাম না। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। এরপর আংকেল নিজে ফোন করে বাবাকে পাকা কথা দিলেন। থ্যাংকস তনু আমাকে ক্ষমা করার জন্য।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি তো ভুলেই গেছিলাম সেদিন রাতের কথা! ..বাবা কি সত্যি সত্যি পাকা কথা দিয়ে ফেলেছেন?
নাফিস ভাই উদ্বেগ নিয়ে বললেন, তুমি খুশি হও নি তনু?

  • আমি একটু রেস্ট নিবো নাফিস ভাই। হঠাৎ করে মাথা ব্যথা করছেন।

নাফিস ভাই চূড়ান্ত রকমের হতাশা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। শুধু বললেন, আসি!
নাফিস ভাই যাওয়ার কিছুক্ষন পর ইনায়াজ ভাই এসে ঢুকলেন।
হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, সব ঠিকঠাক? .ঘুম হয়েছে ভালোমত?

আমি কিছুক্ষন ইনায়াজ ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে কঠিন গলায় বললাম, আপনি এখান থেকে চলে যান ইনায়াজ ভাই!
ইনায়াজ ভাই বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু আমি চোখেমুখে সেই একই দৃঢ়তা নিয়ে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

উনি কি বুঝলেন কে জানে। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে সরে গেলেন। উনি চলে যেতেই আমি বালিশ আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমি কি করবো? যেই মানুষ মুখ ফুটে বলার পরও আমার আকুলতা বোঝে নি তাকে আর বুঝতে দিতে চাইলাম না।

আমার সমস্ত মন প্রান জুড়ে এক বিষাদের ছায়া নামলো। যার ঘোর অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। উপুড় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছি খবর নেই।
ঘুম ভাঙ্গলো নার্সের ডাকে। একটু পরই আমাকে রিলিজ করা হবে।

বাসায় এসে ভাবছি হস্পিটাল থেকে চলে আসার আগে একবারও ইনায়াজ ভাইকে দেখলাম না। নিশ্চই চলে গেছে। ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় মরে যাচ্ছি আমি। কেন কালরাতে আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না। কি করলাম আমি? কেন উনাকে জানাতে গেলাম। যতই এসব ভাবছি ততই ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরে যাচ্ছি। কেন জানি না মনে হচ্ছে এটাই উনার সাথে আমার শেষ দেখা। আর কোনদিন হয়ত উনাকে দেখতে পাবো না।

দুপুরে গোসলের পর খাটের ওপর বসে চুল শুকাচ্ছিলাম। আমার চোখ গেলো টেবিলের ওপর পড়ে থাকা আমার রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনের দিকে।
আমি কি মনে করে সেগুলো খুললাম আমার রিপোর্টে কি এসেছে দেখার জন্য। কিন্তু ফাইলটা খুলতেই প্রেসক্রিপশন এর ওপর লিখাটার দিকে আমার চোখ আটকে গেলো।

আমি হাত দিয়ে একবার লেখাটা ছুঁয়ে দেখলাম। লিখাটা ছুঁতেই আমার হৃদপিন্ডের ধুকপুক ধুকপুক বেড়ে গেলো। শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। অদ্ভুত এক উত্তেজনা অনুভব করছি। সেটা দুঃখের না সুখের আমি জানি না। আবারও হাত দিয়ে লিখাটা স্পর্শ করলাম। চোখ বন্ধ করে চুমু খেলাম তাতে। প্রেসক্রিপশন এর ওপর সেই মানুষটার নাম লিখা যে নিজেই আমার রোগের কারন।

ডাঃ ইনায়াজ আহমেদ, এমবিবিএস,
বিসিএস (স্বাস্থ্য), এফসিপিএস পার্ট- ২(মেডিসিন).
আমার ভেতরটা হঠাৎ ডুঁকরে কেঁদে উঠলো উনি কি আমার ওপর অভিমান করে চলে গেছে? একবার আমার কষ্টটা বুঝলো না?
আপু দুপুরবেলা ভাত নিয়ে এলো আমাকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য। আমি খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার ট্রিটমেন্ট কে করেছে আপু?

কেন জিজ্ঞেস করলাম জানি না। হয়ত উত্তরটা বারবার শুনতে চাই বলে।
আমার কথা শুনে আপু অবাক হয়ে বললো, কেন তুই জানিস না?
আমি বললাম, না!

  • ইনায়াজ ভাই। উনি তো হস্পটালেই ছিলো তুই দেখিস নি?

আমি শুধু বললাম, ঘোরের ভেতর ছিলাম তাই মনে নেই হয়তো!
আমি ভেবেছিলাম ইনায়াজ ভাই আমাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু আমার ট্রিটমেন্ট যে উনি করেছে সেটা আমি জানতাম না। অথচ হস্পিটাল থেকে চলে আসার সময় একবার সামনে পর্যন্ত এলেন না।
আপু মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করতে পারে নি। আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।

পরেরদিন সকালবেলা নিজের ঘরে শুয়ে আছি। এমন সময় আপু বলল, নাফিস এসেছে তোর সাথে দেখা করার জন্য!
আমি কিছু বললাম না। আপু নাফিস ভাইয়াকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলো। নাফিস ভাই আমার পাশে বসলেন। আমি খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। উনি আমাকে ভালো করে একবার দেখে নিয়ে বললেন, ভালো আছো?

  • হুম!
  • একটা কথা বলতে চাই।
  • বলুন।
  • না মানে এইমুহূর্তে বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। তুমি সবে হস্পিটাল থেকে ফিরলে!
  • আপনার ইচ্ছে।
  • আংকেল বলছিলেন আমি আগামীবার ফিরে এলে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করবে। আমার ছুটি আর মাসখানেকের মত আছে। তাই চাইছিলাম ছুটি শেষ হওয়ার আগেই বিয়েটা সেরে ফেলতে অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে।
    উনার কথা শুনে আমি অসহায় চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে কৈফিয়ত দেওয়ার মত করেই বললেন, তুমি না চাইলে আমি অপেক্ষা করতে পারবো। আমার কোন অসুবিধে হবে না।

আমি উনার কথার কোন প্রতিউত্তর করলাম না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। নিজেকে এতটা অসহায় কোনদিন লাগে নি। ইনায়াজ ভাই কি সত্যিই আমাকে একটুও ভালোবাসে না। আমার এত আকুলতা দেখেও উনি এভাবে চলে গেলেন? আমার ভালোবাসা, অভিমান কি উনি একটুও বুঝে নি? কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

আমার আকস্মিক কান্নাতে নাফিস ভাই ভয় পেয়ে গেলেন। উনার ডান হাতটা আমার মাথার ওপরে রাখতে গিয়ে আবার সংকোচে সরিয়ে নিলেন। নরম গলায় বললেন, কেঁদো না প্লিজ।
আমি চোখ মুছে ইনায়াজ ভাইয়ের ওপর অভিমান করে বলে ফেললাম, আপনি বাবার সাথে কথা বলুন। আমার কোন আপত্তি নেই।

আমার উত্তর শুনে নাফিস ভাই অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখেমুখে কৌতূহল।
আমি উনার মনের কথা বুঝতে পারলাম, কিন্তু তার উত্তর যে আমি চাইলেও দিতে পারি না।
আমি শুধু বললাম, আমি রাজি।

উনার চোখজোড়া খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। মুখে তৃপ্তির হাসি। আমি আবারও ঠোঁট চেপে কান্না আটকালাম।
উনি মুখে কোন কথা বললেন না কিন্তু আমি উনার চোখে অপরিসীম আনন্দ দেখতে পাচ্ছি। সেই সাথে আমার জন্য একরাশ ভালোবাসা।

পর্ব ১১

সাতদিনের মধ্যেই আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। বাবা, ইমতিয়াজ ভাইয়া, ভাইয়া, ইমু সবাই ভীষণ ব্যস্ত। শুধু নেই ইনায়াজ ভাই। ভাইয়ার কাছে শুনেছি উনি নাকি ছুটি পান নি। আমি মনে মনে সবই বুঝলাম, কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না।

নাফিস ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চোখেমুখে কি দারুণ প্রশান্তির ছাপ। খুশিতে চেহারাটা চকচক করছে।
এতকিছুর মাঝেও আমার মনের মধ্যে কি চলছে তা কাউকে বুঝতে দিলাম না। একমুহূর্তের জন্যেও ভাবতে পারি না আমি অন্য কারো হতে যাচ্ছি। আমার সমস্ত সত্তা শুধু একজনকেই মনে মনে চায়।
আর পারলাম না! বারবার শুধু মনে হচ্ছে আমি নাফিস ভাইকে ঠকাচ্ছি। তাকে সবকিছু জানানো উচিৎ! এংগেইজম্যান্ট এর দিন রাতে আমি চুপিচুপি নাফিস ভাইকে ডেকে পাঠালাম।

নাফিস ভাই বেশ খুশিখুশি চেহারা নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এলেন। প্রায় দশমিনিট যাবত প্রস্তুতি নিয়ে শেষমেশ নিজেকে শক্ত করে বলেই ফেললাম, আমি একজনকে ভালোবাসি নাফিস ভাই।

মুহূর্তেই উনার মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো। যেন ঘোর অন্ধকার নেমেছে। যে ছাত্র গোল্ডেন প্রত্যাশা করে সে হঠাৎ ফেল করেছে শুনলে মুখটা যেমন হয় উনার মুখটাও ঠিক তেমন হয়ে গেলো।
উনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, কে সে?

আমি বললাম, বলা যাবে না।
উনি একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, আমার কাছে তোমার ভয় নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি তনু!

  • ইনায়াজ ভাই!
    উনি একটু অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তারপর চোখেমুখে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ডাক্তার সাহেব সেটা জানেন?

আমি শুধু বললাম, না।
উনি এবার একটু বেশিই আশ্চর্য হলেন। তারপর মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন, আমি তাকে জানাবো?
আমি আবারও বললাম, না।
উনি আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

আমি শুধু বললাম, আমি তার যোগ্য নই। আমি শুধু আপনাকে জানিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। আমার সমস্তটা শুধু তাকে ঘিরে। সেখানে আপনার কোন স্থান নেই। শুধু আপনি কেন তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষের কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। এরপরেও যদি আপনার মনে হয় আপনি আমাকে বিয়ে করবেন তবে করতে পারেন। তবে সেটা হবে শুধু আমার পরিবারের কথা ভেবে, আমার ইচ্ছেতে নয়। এবার বলুন আপনার কি সিদ্ধান্ত? ..নিশ্চই না?
আমাকে অবাক করে দিয়ে নাফিস ভাই বললেন, বেশ! আমি বরং একবার চেষ্টা করেই দেখি আমার জন্য কোন জায়গা করতে পারি কি না।

আমি বললাম, যদি ব্যর্থ হন?
উনি একটুখানি হেসে বললেন, ভয় নেই ব্যর্থ হলে শূনতাকে প্রাপ্তি বলে মেনে নেবো। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। তোমার অনুমতি ছাড়া আমি কখনো তোমার কাছে স্বামীর অধিরকার দাবী করবো না।

এরমাঝে একদিন ভাইয়া এসে জানালো ইনায়াজ ভাইয়ের এফসিপিএস হয়ে গেছে। বেস্ট ডক্টর এওয়ার্ড পাচ্ছেন উনি। টিভিতে উনার সাক্ষাতকার নেওয়া হবে। পত্রিকায় উনার ছবি ছাপা হয়েছে!
সেদিন রাতে টিভিতে উনাকে দেখে সারারাত শুধু চোখের পানি ফেলছিলাম। দুর্দান্ত সাক্ষাতকার দিয়েছেন।

বাবা, ভাইয়া আপু সবাই মুগ্ধ হয়ে উনার তারিফ করছিলো। আমি উঠে চলে এলাম। মনকে বোঝালাম, ইনায়াজ ভাই বহু দূরের মানুষ! তাকে ছোঁয়া আমার সাধ্যের মধ্যে নেই। মরীচিকা পেছনে দৌঁড়েছি এতদিন। কিন্তু বেহায়া মন সব যুক্তি মানতে নারাজ। কিছুতেই তার দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারলাম না। হাজারবার নিজেকে নিজে বুঝাতে চাইলাম তিনি অহংকারী, নিষ্ঠুর! ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না, তাকে ভুলে গেলেই মঙ্গল! কিন্তু এতকিছুর পরেও তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাড়লো বৈকি কমলো না। ভালোবাসা আর যাই হোক যুক্তি মানতে নারাজ।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। ইনায়াজ ভাই বিয়েতে এলেন না। আমাকে বিয়ের আসরে নিয়ে আসতেই চারদিকে খুশির রোল, আর আমার বুকের ভেতর শুধু তীব্র যন্ত্রনা। মনে হচ্ছে হৃদপিন্ডটা যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। মাথার উত্তজনা ক্রমশ বাড়ছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।

অবশেষে ধুমধাম করে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো। আমার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে আমি ইনায়াজ ভাইকে পেলাম না। সে আমাকে তার প্রনয়ের আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দিয়ে গেলো।
গাড়িতে উঠার সময় আমি আবার জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম নাফিস ভাই মানে যাকে আমি একটু আগে আমার স্বামী হিসেবে গ্রহন করেছি, যাকে আমার জীবন যৌবন, ভালোবাসা সবকিছুর অধিকার দেবো বলে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি সেই মানুষটা আমার হাত শক্ত করে তার হাতের মুঠোয় চেপে ধরে গভীর স্নেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।

আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই তার সেই সুন্দর মুখটা আবার হাস্যজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না, চোখ সরিয়ে নিলাম। বারবার মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। আমি তো মনে প্রানে আমি শুধু একজনকেই চেয়েছি, অথচ এই মানুষটা কত আশা নিয়ে আছে আমার কাছে। তাকে দেওয়ার মত যে আমার কিছু নেই। আমি তো আগেই সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে ভিখিরি হয়ে গেছি।

আমার চোখের পানি টুপটুপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। আমার স্বামী সেটা যত্ন করে তার ডান হাত দিয়ে মুছে দিলেন।
নাফিসের ছুটি আর বেশিদিন নেই। সপ্তাহ খানেকের মত আছে। এই উপলক্ষে একটা পার্টির আয়োজন করলো সে।
এতদিনেও আমার আর নাফিসের মাঝে স্বামী স্ত্রীর কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। নাফিসও জোর করে নি। আমি আমার মত থাকি। নাফিস তার মত। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভাংলে দেখি সে সিগারেট ফুঁকছে। একদিন বারণ করলাম।

  • ইচ্ছে হলে আমাকে শাস্তি দাও। নিজেকে শেষ করে দিচ্ছো কেন? ..সিগারেট ফেলে দাও। এত সিগারেট খেলে মরে যাবে।
    সে হেসে বলল, সিগারেট না খেলে কি তোমার ঠোঁটে চুমু খেতে দিবে?
    তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আমি চুপচাপ বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষন কাঁদলাম। নাফিসের সাথে অন্যায় করছি। তার প্রস্তাবে রাজী হওয়া ছিলো আমার লাইফের সবচেয়ে বড় ভুল। তার জন্য কষ্ট হয়! কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে কি করে কাছে টেনে নেই?

আমি নাফিসের দেওয়া শাড়ি পরে রেডি হয়ে নিলাম। মেহমানরা সবাই আসতে শুরু করেছে। নাফিস রিসিপশনে গেস্টদের রিসিভ করছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ গেস্টদের মাঝে একজনকে ঢুকতে দেখে হার্টবিট আটকে গেলো। ইনায়াজ ভাই হাসিমুখে ভেতরে ঢুকছেন, সাথে একটা মেয়ে! ভাইয়া ইমু ওরাও আছে। ইনায়াজ ভাই আমাকে দেখে থমকে গেলেন, এবং
বরাবরের মতই নিজেকে সামলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। আবার সেই আগের রোগ!
ইনায়াজ ভাই, ভাইয়া, নাফিস ইমতিয়াজ ভাই সবাই আড্ডা দিচ্ছে। সাথে মেয়েটাও আছে। সেই লেভেলের সুন্দরী! দুধে আলতা গায়ের রঙ! নায়িকাদের মত স্লিম ফিগার! আর সুন্দর মুখশ্রী! আমি ধৈর্য রাখতে পারলাম না। ইমুকে ডেকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটা কে রে ইমু?

ইমু আগে থেকেই সব জানতো।
মলিন কন্ঠে বলল, ইনায়াজ ভাইয়ের ফিয়ন্সে!

  • ওহ!
  • মন খারাপ করো না আপু। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।
  • ঠিক আছে তুই যা।

পার্টির এক ফাঁকে দেখলাম ইনায়াজ ভাই উপরে যাচ্ছেন। আমি সবার অলক্ষে পা টিপেটিপে উনার পিছু নিলাম, সেই সাথে সর্বানাশের! উনি ওয়াশরুমে ঢুকলেন। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই আমি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবাই নিচে, আমরা দুজন ছাড়া ওপরে কেউ নেই।
ইনায়াজ ভাই আমাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। পরোক্ষনেই মুখে হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো?

  • কেন করলেন আমার সাথে এমন?
  • এদিকে কেউ নেই। চলো নিচে চলো।
  • কেন আপনার ফিয়ন্সে দেখে ফেলবে সেই জন্য?
    ইনায়াজ ভাই এবারও নিশ্চুপ। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, আপনি অহংকারী, আপনার মন বলতে কিচ্ছু নেই। আমি আপনাকে ঘৃনা করি। আই জাস্ট হেইট ইউ মি.ইনায়াজ আহমেদ।
    ইনায়াজ আগের মত দাঁড়িয়ে আছেন। রাগের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলাম। সর্বনাশের তোয়াক্কা করলাম না। নিজেও মরবো এনাকেও মেরে যাবো।

হ্যাঁ! রাগ, অভিমান জেদের বশে দ্বিতীয় ভুলটা করতে বসেছিলাম আমি। ইনায়াজ ভাইকে আঁকড়ে ধরে পাগলের মত উনার ঠোঁট খুঁজছিলাম। কিন্তু ইনায়াজ ভাই আটকে দিলেন। আমি তখন উন্মাদ হয়ে গেছি। আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে লাগলাম।
ইনায়াজ ভাই অনেক কষ্টে আমাকে সরিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন, পাগলামি করো না তনু। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

এই প্রথম উনার চোখে আমি আমার জন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি, নাহ! রাগ নয়!
তারপর ইনায়াজ ভাই আমাকে রেখে ধীরে পায়ে নিচে নেমে গেলেন। আমি সেখানে বসেই হাঁটুতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম।
আমার মাথায় কারো হাত কোমল স্পর্শ পেতেই মুখ তুলে তাকালাম।

নাফিস হাটুমুড়ে আমার পাশে বসে আছে। দৃষ্টি ছলছল! নাফিসকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম।
নাফিস আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলো না! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আর তাকে কষ্ট দেবো না। নতুন করে নাফিসের সাথে শুরু করবো। যেভাবেই হোক আমাকে এই মেন্টাল ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যার কাছে আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই তাকে ভেবে আর সময় নষ্ট করবো না। হয়ত অনেক দেরী হয়ে গেছে, তবুও আমাকে নতুন করে শুরু করতে হবে।

আমি ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
পার্টি থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ির কাছে গেলাম। ড্রাইভিং সীটে নাফিস বসে আছে। তার চোখদুটো অসম্ভব লাল। ভয় পেয়ে গেলাম। নাফিস কি ড্রিংক করেছে? .নাফিস আমাকে ইশারায় বসতে বললো। ভয়ে ভয়ে গাড়িতে বসলাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল নাফিস গাড়ি নয়, রকেট চালাচ্ছিলো।

বাসায় এসেছি ঘন্টাদুয়েক হয়েছে। সবাই এখনো পার্টিতে পুরো বাসা ফাঁকা। আমি ফ্লোরে বসে কাঁদছি। নাফিস আমার ব্যাগ গোচাচ্ছে। তার যা করার সে করে ফেলেছে। আমার কোন কথাই শুনে নি। পাগলের মত আর্তনাদ করলাম কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অটল। ব্যাগ গোছানো শেষে আমার হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে চললো। আমি বুঝতে পারছিলাম সে নেশাগ্রস্ত তবুও বারবার মিনতি করলাম। কিন্তু সে শুনলো না। গাড়িতে বসিয়ে আবারও সেই রকেটের গতিতে গাড়ি ছোটালো!

পর্ব ১২

বুঝতে পারলাম একূল ওকূল দুইকূলই গেছে আমার। নাফিস হয়ত আমাকে রাখবে না। কিন্তু চারদিন পর যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন আমি চোখ খুলেই আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, নাফিস কোথায়?
আপু আমার কথার জবাবে শুধু বললো, ও ভালো আছে।
আমি পুরো রুমটা চোখ বুলিয়ে দেখলাম সবাই আছে শুধু নাফিস ছাড়া। রুমের দরজায় হেলান দিয়ে ইনায়াজ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।

একি অবস্থা হয়েছে উনার? চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। চুল উসকোখুসকো, খোঁচাখোঁচা দাড়িগুলোও বেশ বড় হয়ে গেছে। ভীষণ ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত লাগছে মনে হচ্ছে যেন অনেকদিনের অনিদ্রায়, অনাহারে ভূক্ত একজন মানুষ।
আমি তাড়াতাড়ি উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে, বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো।
আমি উঠে বসার চেষ্টা করে আপুকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম নাফিস কোথায়?

আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আপু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছে। সবার চোখেমুখে কেমন যেনো একটা আতঙ্কের ছাপ। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। নাফিসের কিছু হয় নি তো?

সেদিন রাতে পার্টি থেকে নাফিস আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। তারপর সেখান থেকে প্রচন্ড রাগে আমাকে আমাদের বাসায় দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার শত আকুতি ওর কানে পৌঁছায় নি। পৌঁছাবে কি করে? সম্পূর্ণ মাতাল ছিলো সে। মাতাল অবস্থায় ড্রাইভ করায় আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করলো। বারবার তাকে বলেছিলাম এই অবস্থায় গাড়ি না চালাতে কিন্তু আমার একটা কথাও সে শোনে নি। এক্সিডেন্টের চারদিন পর আজকে আমার জ্ঞান ফিরেছে।

অজানা আশংকায় আমার বুক কেঁপে উঠলো। সৃষ্টিকর্তা কি আমাকে ভুল গুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগও দেবেন না? আমি তো নাফিসের সাথে আবার নতুন করে শুরু করতে চাই। আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বারবার চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম নাফিসের কি হয়েছে?
কিন্তু কেউ আমাকে কোন জবাব দিচ্ছে না।

আমার চিৎকার চেঁচামেচি আরো বেড়ে গেলো।
আমাকে উত্তেজিত হতে দেখে ইনায়াজ ভাই দৌঁড়ে এগিয়ে এসে চোখেমুখে উৎকন্ঠা নিয়ে বললেন, নাফিস ঠিক আছে। তুমি প্লিজ শান্ত হও। এমন করলে তোমার জন্যই রিস্ক হয়ে যাবে।
উনি আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করতেই আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, আপনি সরে যান আমার কাছ থেকে। সরে যান! সরে যান বলছি!

আমার এমন ব্যবহারে উনি অবাক হলেন না। আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আমার মাথায় কিচ্ছু কাজ করছিলো না। আমি ক্রমাগত চিৎকার করে উনাকে বেরিয়ে যেতে বলছি।
উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখলেন তারপর আর একসেকেন্ডও দেরী করলেন না। বেরিয়ে গেলেন।
উনি বেরিয়ে গেলে আমি ইমতিয়াজ ভাইয়ার হাত চেপে ধরে বললাম, প্লিজ আমাকে বলুন ভাইয়া, নাফিসের কি হয়েছে? প্লিজ! আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

ইমতিয়াজ ভাইয়া শুধু বললেন, ওকে আইসিউতে রাখা হয়েছে। তুমি প্লিজ শান্ত হও। তুমি এখনো সুস্থ নও।
উনার কথা শুনে আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। আমি হঠাৎ ঝরেপড়া পাতার মত নিজেকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, সব আমার জন্য হয়েছে ইমতিয়াজ ভাই। সব আমার জন্য।
আমার চিৎকার চেঁচামেঁচি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলো। আমার ক্রমাগত চিৎকারে ভাইয়া আমাকে সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।

তিনদিন বাদে যখন আমি কিছুটা সুস্থ হলাম তখন আমি নাফিসকে দেখতে চাইলাম। সবাই আমাকে জানালো যে ও সুস্থ আছে। কিন্তু আমি নিজেকে শান্ত রাখতে পারলাম না।
নার্সকে চুপিচুপি ডেকে বললাম আমার একটা খবর জোগাড় করে দিতে। অনেক অনুনয় বিনয় এর পর নার্স রাজি হলো। অবশেষে নার্স এসে যখন জানালো হস্পিটালে নাফিস ফারহান নামের কোন পেশেন্ট আইসিউতে নেই তখন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

তারমানে সবাই মিলে আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে! এবার আর কিছুতেই আমাকে শান্ত করতে পারলো না। পুরো হস্পিটাল জুড়ে শুধু আমার চিৎকার চেঁচামেচি। আমাকে কিছুতেই শান্ত করতে না পেরে শেষে মা চাপাকান্নার স্বরে বললেন, নাফিস আর নেই তনু!

মুহূর্তেই আমার পুরো পৃথিবীটা যেন থমকে গেলো। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। আমার সমস্ত শরীর যেনো অসাড় হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যাচ্ছে। আমি আবার জ্ঞান হারালাম।
হস্পিটাল থেকে আমাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। বাবা, ইমু, ভাইয়া, ইমতিয়াজ ভাইয়া সবাই কাজকর্ম ফেলে রেখে আমার সাথে পড়ে আছে। ইনায়াজ ভাই আমার জ্ঞান ফেরার দিনই বিদেশে চলে গেছে। উনার নাকি কি ট্রেনিং আছে। সবার একটাই চেষ্টা আমাকে স্বাভাবিক করতে হবে।

হ্যাঁ ওদের চেষ্টায় আমি অনেকটা স্বাভাবিক হতে পেরেছি। তখনও আমার পৃথিবীটা স্নেহ মায়া মমতা দিয়ে জড়ানো ছিলো। বাস্তবতার কিছুই দেখি নি।
আমি গলা থেকে নাফিসের দেওয়া চেইন, নাকের নাকফুল কানের দুল সব খুলে ফেলে একটা সাদা শাড়ি পরে নিলাম। আমার মাইন্ড রিফ্রেশের জন্য সবাই মিলে ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করলো। বাবা ড্রয়িংরুমে বসে গলা ছেড়ে আমাকে ডাক দিলেন।
আমি যখন বেরোলাম আপু দৌঁড়ে এসে বললো, পাগল হয়ে গেছিস নাকি?

আমি ওর কথার জবাবে শুধু বললাম, নাফিস মারা গেছে আপু!

  • কতটুকু বয়স তোর? এইবয়সে এসব পাগলামি কেন করছিস?
    আমি আপুর কথা শুনে ডুঁকরে কেঁদে উঠে বললাম, সব আমার জন্য হয়েছে আপু। আমি উনাকে চাই নি বলেই উনি অভিমানে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। আমি উনার সাথে ছলনা করেছি।

আপু আমাকে ধমক দিয়ে বললো, তুই না এইযুগের মেয়ে? এসব কথা তোর মুখে মানায় না। দুর্ঘটনা যে কারো জীবনেই ঘটতে পারে, তাই বলে মানুষের জীবন কখনো থেমে থাকে না। আয় আমার সাথে এক্ষুনি শাড়িটা বদলাবি।
আমি অনড়! আপু চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে অনুরোধের সুরে আমাকে বললো, দোহাই তোর, আয় আমার সাথে।

আমি দৃঢ়কন্ঠে বললাম, না!
এবার বাবা নিজে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কান্নাভেজা গলায় বললেন, মা আমার। বাবার কথা শুনবি না তুই? যা আপুর সাথে যা! শাড়িটা বদলে আয় বাবা!
কিন্তু আমি নড়লাম না। বাবা আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ডুঁকেরে কেঁদে উঠলেন। তারপর কাদঁতেই বললেন, তোর চোখের পানি দেখার আগে কেন খোদা আমাকে তুলেন নিলেন না। চোখের সামনে আমার ছোট্ট আদরের মেয়ের এমন বেশ আমি দেখবো কি করে? বাবার কথা শোন মা শাড়িটা বদলে আয়।

আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললাম, বেশভূষা দিয়ে কি হবে বাবা! আমার জীবনটাই তো পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে।
বাবা আমাকে শক্ত করে তার বুকের ভেতর এমন ভাবে চেপে ধরলেন যেন সমস্ত কিছু থেকে আমাকে আড়াল করার এক অপরিসীম চেষ্টা করছেন। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদেই চলেছি।
তবে এখানেই শেষ নয়। জীবনের আসল রূপ শুরু হলো নাফিসের মৃত্যুর পরে। যেই নির্মম অধ্যায়ের কথা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবি নি।

নাফিসের বাসায় আমার ঠাঁই হলো না। নিজের বাসায় আমি এখন চূড়ান্ত অবহেলিত। এইবার সবকূলই হারালাম আমি।
নাফিসের ডাইরীতে সবঘটনা লিখে গেছে নাফিস। সেখানে আমি একজনকে ভালোবাসতাম, বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছি এবং আমার ও নাফিসের মাঝে কোন শারীরিক সম্পর্ক তৈরী হয় নি এসবের উল্লেখ ছিলো। তাই আমার গর্ভের সন্তান অবৈধ বলে প্রমাণিত হলো।

পরিবারের সবাই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সত্যিটা বলে দিলাম। বারবার করে বললাম, এক্সিডেন্টের দিন রাতে নাফিস আমার সাথে জোরপূর্বক মিলিত হয়েছিলো। আমি সেদিন ওকে আটকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। কারণ ও মাতাল ছিলো। আমি চেয়েছিলাম একসাথে দুজনে নতুন করে শুরু করবো। কিন্তু তাকে আটকাতে পারি নি। মাতাল অবস্থায় সে স্বামী অধিকার প্রয়োগ করেছিলো। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে করে নি। মৃত নাফিসের ডাইরীই সবার কাছে সত্যি প্রমাণিত হলো। আমার শ্বাশুড়ি ননদ আত্মীয় স্বজন সবার কাছে ছড়ালো আমার গর্ভে অবৈধ সন্তান।

এই সন্তান নাফিসের নয়!
তারপর শুরু হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়! বাস্তবতার আসল রূপ দেখলাম এতদিনে। হয়ত নাফিসের সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি দিচ্ছেন খোদা আমাকে। আমার চরিত্রে সবাই মিলে ইচ্ছেমত কালিমা লেপন করলো। লজ্জা সইতে না পেরে বাবা হার্ট এটাক করলেন। হুইচেয়ারে চলাফেরা করেন। মায়ের চোখের বিষ হয়ে গেলাম। আপু ভাইয়া কেউ ঠিকমত কথা বলে না আমার সাথে। শুধুমাত্র ইমু ছাড়া! ও বারবার করে বলল ইনায়াজ ভাইয়ের কথা বাসার সবাইকে জানিয়ে দিতে, কিন্তু আমি না করলাম।

কার সাথে আমার সম্পর্ক সেটা জানার জন্য মা, আপু প্রথম প্রথম নরমে গরমে জোর চেষ্টা চালালেন। কিন্তু আমি কি বলবো? আদৌ কি কোন সম্পর্ক ছিলো? আমার নিরুত্তর মনোভাব দেখে তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিলেন আমার সন্তান অবৈধ! আমার গলা ফাটানো চিৎকার, বারবার করে বলা ‘এই সন্তানের বাবা’ নাফিস তাদের কানে গেলো না।

রাতে খেতে বসে অসহায়ভাবে সবার দিকে তাকালাম। সবাই নিজের মত খাচ্ছে। কেউ আমাকে খেতে ডাকে নি। নিজেই এসেছি। কিন্তু টেবিলে কুমড়ো ভাজি, পটল আর করলাভাজি দেখে মায়ের দিকে তাকালাম। তিনটেই আমার সবচেয়ে অপছন্দের! যেদিন এসবের কোনটা রান্না করা হয় সেদিন মা আমার জন্য আলাদা করে কিছু না কিছু রান্না করতেন। কিন্তু আজকে কিছুই নেই। আমি চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ ফিরেও তাকালো না। অবশেষে নিজেই বসে গেলাম। কিন্তু খাবার গলা নিয়ে নামছে না। প্রেগন্যান্সির কারনে এমনতেই খাবারে রুচি নেই তারওপর এসব!
ইমু খাবার টেবিলে বসে আমার দিকে তাকালো। তারপর মাকে বলল, ছোট আপুর জন্য কিছু রান্না করো নি?

মায়ের কাঁটাকাঁটা জবাব, না।
ইমু রাগে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো। ওঠার সময় চেয়ারে সজোরে লাথি মেরে গেলো। কিন্তু আমি উঠলাম না। বেহায়ার মত বসে বসে করলাভাজি দিয়ে ভাত খেলাম। ভাতের সাথে চোখের পানিও গিলে গেলাম!
খাবার শেষে, নিজের ঘরে শুয়ে আছি। ইমু এসে পাশে বসে বলল, আমি শুধু পাশ করে নেই আপু। তোমাকে আমি এখান থেকে নিয়ে যাবো।

ইমুর চোখের পানি টুপটুপ করে আমার কপালে গড়িয়ে পড়লো। ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলাম। এত অবহেলা সহ্য করার চেয়ে সেদিন নাফিসের জায়গায় আমি মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো! আমার এই ভাইটা না থাকলে বোধহয় মরে যেতাম আমি।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ইমু বলল,

  • বাবা তোমাকে ডাকছে আপু। যেতে পারবে?

আমার শরীরে শক্তি নেই। তবুও এতদিন পর বাবা ডাকছে শুনে নিজেকে জোরপূর্বক টেনে তুললাম। ইমুও আমাকে ধরে ধরে বাবার ঘরে নিয়ে গেলো। বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন। মা তার পাশে শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে উঠে বসলেন। আমি বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু আগের মত ‘আয় কাছে আয়’ বলে বাবা ডাকলো না। বাবার নিজেই অচল আমাকে কি দেখবে? শুধু জিজ্ঞেস করলেন, খেয়েছিস?

খাওয়ার কথা শুনে বুক চেপে কান্না এলো। যেই আমি ঠিকমত খেতাম না বলে সবার অভিযোগ ছিলো, মা আপু খাবার নিয়ে পেছন পেছন ছুটতো সেই আমি দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলেও কেউ খোঁজ করে না। খাবারের জন্য অস্থির লাগে, অথচ কেউ এখন খাবার সাধে না। কুকুর বেড়ালের মত খেতে বসি। চোখের পানি আটকে ঢোক গিলে বললাম, হুম!

  • শরীর ঠিক আছে?
  • আছে।
    মা তিরিক্ষি মেজাজে বললেন, তোমার এসব নাটক রাখো! আমি কথা বলবো ওর সাথে। বাবা চুপ করে গেলেন। আসামীর পক্ষে কথা বলার জন্য জোরালো কোন যুক্তি নেই উনার কাছে। ইমু রাগে ফেটে যাচ্ছে। মায়ের এমন নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য হচ্ছে না ওর। এই শরীর নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছি।

মা গম্ভীর গলায় সেই একই প্রশ্ন করলেন,

  • সত্যি করে বল বাচ্চাটা কার?
  • নাফিসের।
  • তাহলে তোর সাথে কার সম্পর্কে ছিলো?
  • কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো না। আমি একজনকে ভালোবাসতাম।
  • সে বাসতো না?
    আমি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালাম।
  • না বাসলে এই কুকীর্তি ঘটালি কি করে?

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা। মা ধমক দিয়ে বললেন,

  • কে সে?

আমি চুপ করে রইলাম। ইমু জবাব দিতে চাইলো কিন্তু আমি হাত চেপে আটকালাম। কি হবে বলে? শুধু শুধু ঝামেলা বাড়বে। মায়ের চেহারা ইতিমধ্যে কালো হয়ে গেছে।
আরো কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু কিছুতেই আমার মুখ দিয়ে তার নাম বের করতে পারলেন না। রাগে ঠাস করে আমার গালে কয়েক চড় বসিয়ে দিলেন। থামলো না! মায়ের অনবরত থাপ্পড়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ইমু আমাকে টেনে বের করে নিয়ে গেলো। বাবার চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ডুঁকরে উঠে বললেন, এভাবে তিল তিল করে না মেরে একবারে মেরে ফেলো! মরে যাক! সবার শান্তি হোক!

থাপ্পড় খেয়ে যতটা না কষ্ট হয়েছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে শুধু এই ভেবে যে আমার সেই মমতাময়ী মা আর নেই! প্রায় ধাক্কা মেরে আমাকে বের করে দিলেন। ইমুর চেহারা আমার চেয়েও বেশি অসহায়! না পারছে সইতে না পারছে কিছু করতে।
বিসিএস এর রেজাল্ট বেরোলো, আমার হয় নি। প্রতিদিন চাকরীর খোঁজে বের হই। কিন্তু প্রতিবারই ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসে হতাশ হই। আজকের বাজারে চাকরী পাওয়াটা তো মায়ের হাতের মোয়া না, যে চাইলেই পেয়ে যাবো। অবশ্য আমার জন্য মায়ের হাতের মোয়াও এখন দুর্লভ বস্তু!

যেখানে ব্রিলিয়ান্ট ব্রিলিয়ান্ট ছাত্ররা সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে চাকরী জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে সেখানে আমার মত একজন এভারেজ টাইপ স্টুডেন্ট এর কাছে চাকরী আর সোনার হরিণ দুটোই একই। মামা চাচার জোরও নেই। থাকলেও এইমুহূর্তে কেউ আমার পরিচয় দেবে না। পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন সবার কাছে পরিত্যক্তা আমি।
রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম নাফিস থাকলে বোধহয় এমনটা হতো না। তার ঔরষজাত সন্তানকে নিশ্চই সে ফেলে দিতো না। আমাকে তো সে ভালোবাসতো। আমার এত কষ্ট নিশ্চই ওর সহ্য হতো না?

সে আমাকে কি শাস্তি দিয়ে গেলো? জোর করে আমার ওপর অধিকার খাটালো। আমি যখন সবটা মেনে নিয়ে নতুন করে শুরু করতে চাইলাম তখন সে আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। একবারও ভাবলো না আমার কি হবে? যাবেই যখন কেন আমাকে এই ছোট্টপ্রানটার সাথে বেধে দিয়ে গেলো। সে তো আমাকে ওয়াদা করেছিলো আমার অনুমতি ছাড়া আমার কাছে স্বামীর অধিকার দাবী করবে না? তবে কেন এমনটা হলো? এই ছোটপ্রানটা না থাকলে আরো আগেই সবাইকে মুক্ত করে দিতাম। আমার অন্যায়ের শাস্তি এই নির্দোষ প্রানটা কেন পাচ্ছে?

এসব ভাবছি আর হাঁটছি। আমার চোখের পানি টুপটুপ করে পড়ছে। প্রচন্ড রোদে মাথা ঝিমঝিম করছে। রিক্সাভাড়ার টাকা পর্যন্ত নেই। একটা চাকরী হলে নিজের আর সন্তানের জন্য একটা ভরসা হতো। কিন্তু সেই আশাও দিনদিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

অন্তিম পর্ব

ক্লান্ত হয়ে যখন বাসায় ঢুকলাম। ইনায়াজ ভাই তখন ফোনে কথা বলছিলেন। উনি যে বাসায় এসেছেন আমি তা জানতাম না!
আমার পরনে সাদা সুতির শাড়ি! গায়ে সাদা শাল জড়ানো। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরার ফলে আমার স্বাস্থ্য বেশ ভেঙ্গে গেছে। এখন তো কেউ যত্ন করার মতও নেই। ইনায়াজ ভাই বজ্রপাতে চমকে যাওয়ার মত শক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। ধাক্কা সামলাতে পাশে চেয়ারের হাতল চেপে ধরলেন।

আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। ধীরপায়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলাম। ইনায়াজ ভাই ধপ করে সোফায় বসে পড়েছেন। তার অসহায় মুখ আমারও সহ্য হলো না। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি আর আগের তনু নই! সেদিন নাফিসের সাথে সাথে তনুও মরে গেছে। এই তনু আগের মত চুপিচুপি ইনায়াজ ভাইয়ের কথা ভেবে হাসে না, কারো কথা শুনে মন খারাপ করে না, খাওয়া নিজে ঝামেলা করে না। এই তনু মরার মত বেঁচে আছে।

একটুপর বুঝতে পারলাম ইনায়াজ ভাই কেন এসেছেন? .ভাইয়ার আকদ!
প্রবল ধাক্কা খেলাম! কেউ আমাকে কিচ্ছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না? এত অবহেলা সহ্য করতে পারছি না। আমার পেটে এই ছোট্ট প্রাণটা না থাকলে আরো আগে সুইসাইড করতাম আমি। কিন্তু নিজেকে সামলেও নিলাম। এখন আর এসব নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। তবুও বেহায়া তনুর বেহায়া অশ্রু বাধা মানলো না। অনবরত ঝরলো!
আকদের দিন সেন্টার থেকে ফিরে রাত্রে সবাই মিটিংয়ে বসলোভাইয়ার অনুষ্ঠানে আমাকে নেওয়া হয় নি। এদিকে আমাকে একা বাসায় রেখে ইমু কিছুতেই যেতে রাজী হলো না। বাবা অবশ্য বাসায় ছিলেন।

আজকে আবার সেই আগের মত মিটিং বসেছে। বাবা সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসেছেন। আমি পানি খেতে এসে আড়াল থেকে দেখলাম ভেতরে সবাই বসে নাশতা করছে, অথচ আমাকে একটাবার কেউ ডাকলো না। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে ঘনঘন খেতে মন চায়! কিন্তু..থাক!
কোনায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। কুকুর বিড়ালের সাথেও বোধহয় এমন আচরণ কেউ করে না। আমি তো একটা মানুষ!

হঠাৎ ইনায়াজ ভাই উঠে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে সবার মাঝখানে নিয়ে দাঁড় করালেন। তারপর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আংকেল আপনার অনুমতি থাকলে আমি আজই তনুকে বিয়ে করতে চাই।
ইনায়াজ ভাইয়ার কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো।

আচমকা এমন প্রস্তাব শুনে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। আমি শুধু শুন্য দৃষ্টিতে ইনায়াজ ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম। কি হচ্ছে আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না!
উনি চোখেমুখে সেই দৃঢ়তা নিয়ে বাবাকে বললেন, আপনি চাইলে আমি যে কোন শর্তে রাজী আছি। আমার শুধু তনুকে চাই।
বাবা উনার কথা শুনে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। নিজের মেয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত সুখের কথা ভেবে ছোটবাচ্চাদের মত ইনায়াজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ডুঁকরে কেঁদে উঠলেন। শেষে অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে বললেন, আমার কোন আপত্তি নেই বাবা! তুমি আমার মেয়েটাকে বাঁচাও!

কিন্তু আমি বাধা দিলাম। দৃঢ় গলায় বললাম আমার আপত্তি আছে। আমি এই বিয়েতে কিছুতেই রাজি না।
ইনায়াজ ভাই আমার কথা না শোনার ভান করে বাবাকে বললো, আপনি কাজি ডেকে বিয়ের ব্যবস্থা করুন, আমি আজই ওকে বিয়ে করবো।
আমি আবারও চোখমুখ শক্ত করে বললাম, আমি কিছুতেই এই বিয়ে করবো না।

আমি আর দাঁড়ালাম না সোজা নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মাথাটা ঘুরছে, সাথে একটা অসহ্য যন্ত্রনাও হচ্ছে। ইনায়াজ ভাই অনবরত দরজা ধাক্কাচ্ছে। বারবার অনুরোধ করছে উনার কথা শোনার জন্য। কিন্তু আমি দরজা খুললাম না। কারো দয়া আমার চাই না। আমার মত একটা মেয়েকে উনি হঠাৎ কেন বিয়ে করতে চাইবেন? আমাকে দয়া করছে উনি! নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। এতগুলো দিন যাকে মন প্রান দিয়ে চেয়েছি সে আজ আমার এমন পরিস্থিতিতে আমাকে দয়া করতে চাইছে। এতদিনও উনি বুঝতে পারলো না আমার ভালোবাসায় কখনোই দয়ার কোন স্থান নেই।
যে গেছে সে আর কখনো ফিরে আসবে না। সে আমাকে তার ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমার দোষে আমি তাকে হারিয়েছি। আমি কারো দয়া পাবারও যোগ্য নই।

ইনায়াজ ভাই বারবার অনুনয় করছে দরজাটা খুলে দেওয়ার জন্য। আমি ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে উনাকে বললাম, আপনি চলে যান ইনায়াজ ভাই। প্লিজ আপনি চলে যান।
উনি দৃঢ় গলায় বললেন, তুমি দরজা না খুললে আমি এখান থেকে এক পাও নড়বো না।
আমি হতাশ হয়ে দরজা খুলে দিলাম। চোখের পানি কিছুতেই আটকে রাখতে পারছি না। ইনায়াজ ভাইয়া ভেতর এসে দাঁড়ালেন।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, কেন এসেছেন ইনায়াজ ভাই?

ইনায়াজ ভাইয়া আমার কথা শুনে নরম গলায় বললেন, আমারই তো আসার কথা ছিলো।
আমি শুন্য দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, বিশ্বাস করো তনু আমি নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না। আমি তোমাকে এত ভালোবেসেছিলাম বলেই বোধহয় নাফিসের….আমার ভালোবাসার কি সত্যিই এত জোর?

আমি উনার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম, ইনায়াজ ভাই!
উনি আবারও অপরাধির মত করে বললো, হ্যাঁ তনু। আমি তোমাকে ভালোবাসি। কখনো বলা হয় নি। তুমি আমার চোখের দিকে তাকাতে পারো না লজ্জায় তাই আমি কখনো তোমার চোখে চোখ রাখি নি, কেন জানো? কারন আমি চেয়েছিলাম তুমি যেন নিঃসংকোচে আমাকে তোমার হরিনীর মত চোখদুটো দিয়ে আমাকে ভালোবেসে যেতে পারো! তুমি জানো কতবার তোমার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু তোমাকেই দেখেছি! মনে মনে কত সহস্রবার আউড়েছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি তনু! কিন্তু বলা হয়ে ওঠে নি, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল। লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসা উপভোগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হস্পিটালে যেদিন তোমার মুখ থেকে শুনলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো বিশ্বাস করো আমার সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হয়ে গেছিলো।

আমি সেদিনই আংকেলের কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু তখন জানতে পারি আংকেল ওদেরকে কথা দিয়ে ফেলেছে। যেই মানুষটা আমাকে নিজের ছেলের মত বিশ্বাস করে তার মুখটা আমি কি করে ছোট হতে দিতাম বলো? তাই তোমার বিয়ের খবর শুনেই মিথ্যে কাজের অজুহাত দেখাতে শুরু করলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার দোষেই তোমাকে এতটা সাজা ভোগ করতে হয়েছে। কেন আংকেল কে সেদিন আমার ভালোবাসার কথা বললাম না তাহলে হয়তো এমন কিছুই ঘটতো না। বিশ্বাস করো, তোমাকে হারানোর যন্ত্রনা আমাকে ঠিকমত ঘুমাতে দেয় নি, খেতে দেয় নি। আমি কাজে মন বসাতে পারতাম না।

মনে হচ্ছিলো মৃত্যুও বুঝি এর চাইতে ভালো। তোমাকে দেখার জন্য ছটফট করতাম তবুও নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি চেয়েছি তুমি সুখি হও। আমাকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করো। তাই নিজেকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি পারি নি। যতবারই তোমাকে দূরে সরাতে চেয়েছি তুমি এমনভাবে আমার মনের মধ্যে জেঁকে বসেছিলে যে আমি মনে প্রানে তোমাকেই চাইতে শুরু করলাম।

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। ইমু এসে ভেতরে ঢুকল। রাগী গলায় বললো ইনায়াজ ভাই তোমাকে পুরো সত্যি বলে নি আপু।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কি ইমু কি বলতে চাইছে?

ইমু বলল, নাফিস ভাই কিন্তু পুরোটাই জানতো। তুমি ইনায়াজ ভাইকে ভালোবাসো একথা যেমন জানতো ইনায়াজ ভাইও যে তোমাকে ভালোবাসে সেটাও জানতো, কিন্তু উনি বলেন নি। সেদিন হস্পিটাল থেকে ইনায়াজ ভাই শুধু আংকেলের কাছে নয়, নাফিস ভাইয়ের কাছেও গিয়েছিলো। তোমার সাথে যখন নাফিস ভাইয়ের বিয়ের কথা চলছিলো তখন ইনায়াজ ভাইয়ের মাথায় ছোট্ট একটা টিওমার ধরা পড়ে। ইনায়াজ ভাই ভয়ে তোমাকে জানাতে পারে নি। কিন্তু নাফিস ভাইকে অনুরোধ করেছিলো উনি যাতে বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়। অন্তত ইনায়াজ ভাইয়ের অপারেশন পর্যন্ত ওয়েট করে! কিন্তু উনি কি করলেন? ইচ্ছে করে বিয়েটা এগিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হলো কি? তোমার মন ঠিকই ইনায়াজ ভাইয়ের কাছে পড়ে ছিলো। নাফিস ভাই ইনায়াজ ভাইকে ডেকে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলো। এবং তোমার আর নাফিস ভাইয়ের সম্পর্কের জটিলতা গুলো খুলে বলল। তুমি যাতে নাফিস ভাইকে নিয়ে সুখি হতে পারো সেই জন্য সেদিন পার্টিতে ইনায়াজ ভাই আমাকে মিথ্যে বলতে বাধ্য করেছিলো। সেদিন ইনায়াজ ভাইয়ের সাথে যাকে দেখেছিলে সে ভাইয়ার হবু বউ। মানে আমাদের উডবি ভাবী। আর ওদের ক্লাসমেট!

ইনায়াজ ভাইয়ের ব্রেনে টিউমারের কথা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। আমি আবারো পাগলের মত কান্না শুরু করে দিলাম। ইনায়াজ ভাই প্রথমে অপরাধির মত চুপ করে থাকলেও আমার কান্না দেখে মিটমিট করে হাসছিলেন।

ইমু হেসে বলল, কেঁদো না আপু। তুমি জানো আপু শুধুমাত্র তোমাকে ফিরে পাবে বলে ইনায়াজ ভাই এতদিন পর বিদেশ গিয়ে অপারেশন করিয়ে এসেছে? অথচ তোমার বিয়ের পর থেকে এতগুলো দিন এইরোগ বয়ে বেড়াচ্ছিলো। সবাইকে মিথ্যে বলেছিলো, আমরা সবাই জানতাম উনি ট্রেনিংএ ছিলেন। ভয়ের কিছু নেই অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।
অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে শুনে আমার কান্না বেগ কমলো। সেই সাথে এতদিনের অপরাধবোধ! নাফিস এমন কিছু করবে সত্যি ভাবতেই পারি নি।

ইমু বলল, তুমি কোন অন্যায় করো নি আপু। নাফিস ভাই তার কৃতকর্মের সাজা পেয়েছেন। নাফিসের ভাইয়ের চিঠিতে উনি উনার অপরাধ স্বীকার করে গেছেন। নাফিস ভাইয়ের বোন সম্পত্তির লোভে বাচ্চাটাকে নাফিস ভাইয়ের না বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিলো। উনার মা প্রথমে সব জানতেনা। নাফিস ভাইয়ের পুরো ডাইরী আর চিঠি পড়ে সব বুঝতে পেরেছে। ভদ্রমহিলা নিজের
মেয়ের কৃতকর্মের জন্য বাবার কাছে ফোন করে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি ভাবছি বাবা আর ভাইয়াকে বলে উনার বোনের নামে মানহানির মামলা করবো। নাফিস ভাই তোমাকে ভালোবাসতো ঠিকই কিন্তু উনি স্বার্থপরের মত আচরণ করেছে। যাই হোক মৃত মানুষের দোষগুণ মনে রাখতে নেই। সেই জন্যই ইনায়াজ ভাই উনার কথা তোমাকে কিছু বলে নি। আমার মনে হয়েছে তোমার জানা দরকার তাই আমি তোমাকে কথাগুলো বলে দিয়েছি। আমি শুধু এইটুকু বুঝি ভালোবাসতে হলে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে হবে।

ইমু বেরিয়ে গেলে ইনায়াজ ভাই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।

  • আমি স্বপ্নেও ভাবি নাফিস মারা যাওয়ার পর তোমার সাথে এমন কিছু হবে। ভেবেছিলাম সবাই তোমাকে আগলে রাখবে। তাই নিশ্চিন্ত মনে অপারেশন করাতে গেছিলাম। কিন্তু এসে এমন কিছু দেখবো সত্যিই ভাবি নি।
  • আমি নিজেই তো ভাবি নি সবাই আমাকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেবে আপনি কি করে ভাববেন?

ইচ্ছে করছিলো এইমুহূর্তে ইনায়াজ ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদি। কিন্তু নিজেকে আবারও সংযত করে ফেললাম। আমি ইনায়াজ ভাইয়ের কাছে ডাকে সাড়া দিলে আমার চরিত্রের কালিমা যে ইনায়াজ ভাইয়ের গায়েও পড়বে! আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না।

আমার অনাগত সন্তানের কথা মনে পড়লো। হতে পারে নাফিস অন্যায় করেছে! কিন্তু এ তো আমার গর্ভের সন্তান। আমি তো এখন মা!
ইনায়াজ ভাইকে ফিরিয়ে দেওয়ার আর কোন উপায় খুঁজে পেলাম না, কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লাম। ইনায়াজ ভাই আমাকে তুলে দাঁড় করাতে চাইলেন। আমি ইনায়াজ ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে বললাম, সব শেষ হয়ে গেছে ইনায়াজ ভাই, সব শেষ হয়ে গেছে! আপনি প্লিজ চলে যান।

আমি উনার পা চেপে ধরতেই উনি ছিঁটকে দূরে সরে গিয়ে বললেন, কিন্তু আমার যে তোমাকেই চাই! একবার হারিয়েছি এবার হারালে মরে যাবো।

আমি আবারও কান্না ভেজা গলায় বললাম, পাগলামি করবেন না ইনায়াজ ভাই! তনু আপনার পাশে বড্ড বেমানান!
ইনায়াজ ভাই জোর করে আমাকে টেনে দাড়ঁ করালেন। আমি উনার পাশ থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলাম। উনি আটকে দিয়ে আমার ডান হাতের ওপর উনার ডান হাত রেখে আমার হাতটা পেটে নিয়ে গেলেন। দ্বিধা সংকোচ হীন ভাবে বললেন, যে তোমার অংশ সে আমারও অংশ! এত অপমান অবহেলা সহ্য করার পরেও আমার তনু যাকে যাকে আগলে রেখেছে, তিলতিল করে বড় করছে তাকে আমি দূরে ঠেলে দেই কি করে?

তারপর আমার আমার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, আমি তোমাকে চাই তনু! আমার সমস্তটা দিয়ে চাই। আমার মতন করে ভালোবাসতে চাই, যেখানে থাকবে না কোন সংশয়, কোনকিছু হারানোর ভয়।
সৃষ্টিকর্তা আমার সব কেড়ে নিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি নিষ্ঠুর নন। হারানো সব আবার ফিরিয়ে দিলেন।

আমার চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসলেন ইনায়াজ ভাই। উনার সেই দৃষ্টি আমি উপেক্ষা করতে পারলাম না। তাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা যে সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেন নি। আমি নাক টেনে টেনে কাঁদছি। আগের মত সেই অনুভূতি হচ্ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, উনার উপস্থিতি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। লজ্জায় মুখ তুলতে পারছি না। ইনায়াজ ভাই দুষ্টু হাসি দিলেন। তারপর সযত্নে চোখের আমার পানি মুছে দিয়ে আমার হাতটা ধরলেন, বেশ শক্ত করে ধরলেন, আবেগ জড়িত মধুর গলায় বললেন, তুমি জানো তনু? তোমাকে যখন দেখি, তারচেয়েও বেশি দেখি যখন দেখি না।

উনার দৃষ্টি ছলছল। এই প্রথম তাকে কাঁদতে দেখছি। আমার মনে হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নয় ইনায়াজ ভাইয়ের কাছেই প্রথম শুনছি! এই অল্পকিছু শব্দমালায় তার সমস্ত হৃদয়ের আবেগ যেন উপচে পড়েছে! অবশেষে তার মনোপ্যাথি আমি বুঝতে পারলাম। এতদিনে জানতে পারলাম সে আমাকে ভালোবাসে! আমি শুধু বললাম, ঠকেছেন আপনি ইনায়াজ ভাই!

লেখা – অরিত্রিকা আহানা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “মনোপ্যাথি (শেষ খণ্ড) – মেয়েদের মনের গোপন কথা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – মনোপ্যাথি (১ম খণ্ড) – মেয়েদের মনের গোপন কথা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *