সতীনকাঁটা – দুই সতীনের লড়াই

সতীনকাঁটা – দুই সতীনের লড়াই: নতুন বৌ যে আর কেউ না তারই ছোট বোনের একমাত্র মেয়ে রাফিয়া। নিজের ভাগ্নীকে কি করে কষ্ট দিবেন তিনি। এরপর…..


পর্ব – ১

  • তোর কপাল পুড়ছেরে তানজিনা আফা। তোর জামাই নতুন বউ লইয়া আইছে দুয়ার খুইল্যা বাইরে আইয়্যা দেখ। খুবতো তহন ভাইগ্যা বিয়া বইছিলি। এহনতো জামাই হত্তীন লইয়া আইছে।

এমন না আমি দেখেনি ঘটনাটা। সবকিছু দেখেই ঘরে খিল এঁটেছি। তবুও আমাকে বার বার ডেকে কথাগুলো বলে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে বড়জা সানজিদা।

সম্পর্কে আপন চাচাতো বোন আমরা। বয়সেও আমিই সানজিদার চেয়ে চার বছরের বড়। কিন্তু ছোট থেকেই সানজিদা আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না।

সানজিদা কখনো চায় নি আমি খান বাড়ির ছোট বউ হয়ে আসি। এমনকি আমার আর আজুয়াদের রিয়েতে দুই বাড়ির কেউ রাজি ছিলো না।

আমার শ্বশুর- শ্বাশুড়ি তো একদমই না। কারণ প্রথমত তারা এখনি তাদের ছোট ছেলেকে বিয়ে করাতে চায় নি৷ দ্বিতীয়ত তারা চেয়েছিলো বড় ছেলের বউয়ের মতো স্বল্প শিক্ষিত আর কম বয়সী মেয়ের সাথে ছোটো ছেলের বিয়ে দিতে।


সেদিকে থেকে আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি। আবার বয়সেও আজুয়াদের থেকে মাত্র দু’বছর ছোট। আবার গায়ের রঙটাও হালকা চাপা।

দুই বাড়ির কাউকে আমাদের রাজি করাতে পারছিলাম না। এদিকে আমার মা- বাবা আজুয়াদের সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেন। শত চেষ্টা করে যখন আমার বিয়েটা ভাঙছিল না তখন একরকম নিরুপায় হয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি আমি আর আজুয়াদ।
বাড়ির মানসম্মান রক্ষা করতে সবাই বাধ্য হয়ে আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলো।

শ্বশুর বাড়ি। বাপের বাড়ি কিংবা সমাজের মানুষের দেওয়া অপমান- লাঞ্ছনা সব তখনি তুচ্ছ হয়ে গেছে যখন আজ নিজের স্বামী আজুয়াদকে বরের বেশে নতুন বউয়ের সাথে বাড়ির দরজায় দেখলাম।
বদ্ধ ঘরে বসে এসব কথাই ভাবছে তানজিনা।
এদিকে আমজাদ খান তার স্ত্রী রেহেনা খাতুনকে জোরে হাঁক দিয়ে বলে।

  • আবরারের মা। এত দূর থিকা আইসা আর কতক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকমু? নতুন বৌ ঘরে তুলো।
    পান চিবোতে চিবোতে রেহানা খাতুন বলে।
  • বউ ঘরে কেমনে তুলুম? আজুয়াদের বউয়ের লাইগ্যা বানানি সব গয়না তো দিয়া দিছি। আর তোমাগো উচ্চ শিক্ষিত বউ তো ঘরে খিল দিছে।
    আমজাদ খান বলে।
  • আল্লা দিলে তোমারে তো কম গয়না দেই নাই। ঐখান থেকে একটা দিয়া নাহয়..
  • তুমি চুপ থাকো শুভ অশুভের একটা ব্যাপার আছে। ঐ খানদানি গয়নাগুলা আজুয়াদের বউয়ের লাইগ্যা। হেইগুলাতে নতুন বৌয়ের হক আছে। ঐ গয়না ছাড়া আমি নতুন বৌ ঘরে তুলুম না।

আমজাদ খান বিরক্ত হয়ে তানজিনার ঘরের দিকে গেলেন।
অনেকবার ডাকার পর কোন সাড়া না পেয়ে। একসময় রেগে গিয়ে বলে।

  • এবার যদি বাইর হইয়া না আসো তবে দরজাটা ভাইঙ্গা ফালামু ছোট বউমা।
    তানজিনা ভেতরে থেকে শ্বশুরের গলা শুনতে পায়।

তানজিনা ধীর পায়ে খিল খুলে দেয়।

  • ছোট বউমা ভালা কইরা হুনো(শুনো)। পুরুষ মাইনসের চাইরডা বিয়া জায়েজ। এহন বিয়া হইয়া গেছে নতুন বউয়ের সাথে বইনের মতো থাকবা। যাও দেহি অহন তোমার শ্বাশুড়ির দেওয়া খানদানি বালাজোড়া লইয়া নতুন বউরে বরণ করতে আসো।
    চোখে পানি চলে আসে তানজিনার। অস্ফুটস্বরে শ্বশুরকে বলে।
  • বাবা। আমি বরণ করবো!
  • তুমি নাইলে আর কে করবো? এ বাড়ির বউ হিসাবে তোমার একটা দায়িত্ব আছে না? যাও অহন জলদি করো। আর কথা বাড়াইয়ো না। নতুন বৌ সারাদিন বাইরে দাড়াইয়্যা থাকবো নি?
    তানজিনা চুপচাপ আলমারি থেকে গয়নার বাক্সটা বের করে। বালাজোড়া দেখে তার অতীত মনে পড়ে।
    যেদিন তানজিনাকে তার শ্বাশুড়ি বালা পরাচ্ছিলো পাড়া- প্রতিবেশী সবাই ছিলো।
    একসময় পাশের বাড়ির সালেহা বলে উঠে।
  • কিছু মনে কইরো না আবরারের মা তোমার ছোট বউয়ের রঙটা একটু ময়লা। ধলা অইলে বালা জোড়া হাতে ফুইট্টা থাকতো।
  • কপাল সবই কপাল গো আফা। নাইলে পোলা এমুন কাম করে? শত্তুর পেটে ধরছি।
  • হুনছি তোমার ছোট বৌ আর আবরারের বউয়ের বইন লাগে?
  • ঠিকই হুনছো। হেরা হুদ্দোর(আপন) চাচাতো বইন।
  • তয় এগো রঙে এত ফারাক কেন?
    এই কথা শুনে পাশ থেকে সানজিদা বলে উঠে।
  • চাচী আমাগো পুরা বংশে সবাই ধলা। খালি জেঠী মানে তানজিনা আফার মায় কাইল্যা। আফা হের মা’র মতো হইছে।
  • অ্যঁ। বলে মুখ বাঁকায় সালেহা বেগম।
  • আর দুইন্যার বেবাক মাইয়া থুইয়্যা আমার পোলার ওরেই বিয়া করা লাগলো। না আছে রূপ। না আছে বয়সে তালগোল। এই মাইয়্যা লইয়া আমার আজু যে কেমনে ভাত খাইবো কে জানে?
  • ছোট বউমা হলো তোমার।
    আমজাদ খানের ডাকে বর্তমানে ফিরে আসে তানজিনা।
  • আসছি বাবা। বলে গয়নার বাক্সটা আলমারিতে রেখে বালা জোড়া নিয়ে বের হয়।
    তারপর মাথানিচু করে সেটা শ্বাশুড়ির হাতে দেয়।
    রেহানা খাতুন নতুন বৌকে বালা জোড়া পরিয়ে বরণ করে।
  • দেখছো নি আম্মা নতুন ভাবীর হাতে বালা জোড়া কি সুন্দর ফুটছে। কথাটা বলে আজুয়াদের ছোট বোন আফিয়া।
  • ফুটবো না? হাজারে এক নতুন বৌমা। গায়ের রং তো না যেনো কাঁচা অলদি (হলুদ)।
    আজুয়াদ এসব আর নিতে পারছিলো না তাই গটগট করে ভেতরে চলে গেল।
    বাকিরা নতুন বৌকে ঘরে নিয়ে যাবে সেই সময় সানজিদা ফোঁড়ন কাটে।
  • নতুন বউরে কোন ঘরে নিমু আম্মা?
  • এ আবার কেমুন কথা বড়বৌমা? নতুন বৌ তার সোয়ামীর ঘরে যাইবো।
    সানজিদা তানজিনাকে শুনানোর জন্য জোরেই বলে।
  • তাইলে তানজিনা আফা কই থাকবো?
    রেহানা খাতুনও উঁচু গলায় বলে।
  • হেয় দরকার হইলে আইজ আফিয়ার ঘরে থাকবো। নিজের সোয়ামীরে আঁচলের বাইন্ধা রাখুনের লাইগ্যা রূপও লাগে হেইডা হের অহন বুঝোন লাগবো।
    আফিয়া তানজিনাকে খুব একটা পছন্দ করে না। তাই মুখ বাঁকিয়ে বলে।
  • আমি কারো লগে এক ঘরে থাকবার পারুম না। তাছাড়া ছোট ভাবীরও তো একটা আলগা ঘর লাগবো নাকি?
    আমজাদ খান ধমকের সুরে বলে।
  • এই বাড়িত কি ঘর কম নাকি? দরকার হইলে ছোটবউ এহন থিইকা দক্ষিণের ঘরে থাকবো। যাও তোমারা। এই নিয়া আর কোন কতা না। নতুন বৌ লইয়া ঘরে যাও সে অনেকক্ষণ দাড়াইয়া আছে। হের কষ্ট হইতাছে।

শ্বশুরের এমন কথা দুঃখের মধ্যেও হাসি পেলো তানজিনার।
যেদিন বিয়ে করে এসেছিল টানা আট ঘন্টা খান বাড়ির প্রধান ফটকে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে।
যখন তার বাবা আর ছোট চাচা এসে মাফ চেয়েছিলো তখন তাকে ঘরে তোলা হয়েছিল।
কিন্তু আজ সেই আমজাদ খান নতুন বউয়ের কষ্ট খুব সহজেই বুঝতে পারছে।
বুঝবে নাই- বা কেন?

নতুন বৌ যে আর কেউ না তারই ছোট বোনের একমাত্র মেয়ে রাফিয়া। নিজের ভাগ্নীকে কি করে কষ্ট দিবেন তিনি।

গতকাল হঠাৎ আজুয়াদকে নিয়ে তার বাবা আমজাদ খান তার ফুপুর বাড়ি গিয়েছিল। যাবার সময় বলেছিলো। আম- কাঁঠালের দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে আজ ফিরলো। সাথে রাফিয়াকে নিয়ে এলো খান বাড়ির বউ বানিয়ে।

  • পাত্তরের মত খারাইয়্যা না থাইক্যা ঘরেত্তে জিনিস- পত্তর নিয়া আসেন।

আফিয়ার কথায় সম্বিত ফিরে পায় তানজিনা।
অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

  • আমাকে কিছু বলেছো আফিয়া?
  • আপনেরে কমু না তয় কারে কমু? মা’য় কইছে আপনার জিনিসপাতি নিয়া দক্ষিণের ঘরে যাইতে। দেরী কইরেন না নতুন ভাবী জিনিস গুছাইয়া গোসল করবো। বৈকালে পাড়া- প্রতিবেশী আইবো বউ দেখতে। জলদি করেন।
    আফিয়ার এমন ব্যবহারে তানজিনা মোটেও আবাক হয় নি। কারণ এবাড়িতে আসার পর কেউ তার সাথে ভাল ব্যবহার করে নি।
    যার কাছ থেকে তানজিনা ভালবাসা আর সম্মান পেয়েছিলো সে ছিল তার স্বামী আজুয়াদ। কিন্তু আজ সেই স্বামীই তাকে জীবনের চরম আঘাত দিলো।
    দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে জিনিসপত্র গুছাতে চলে গেলো। ঘরে গিয়ে দেখে তার শ্বশুর আর আজুয়াদ ছাড়া সবাই আছে। সবার মধ্যমনি হয়ে খাটের উপর বসে আছে রাফিয়া।
    তানজিনার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকের ভিতরে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। কষ্টে দু’ফোটা পানি বের হয়ে এলো। কারও নজরে আসার আগেই সেই পানি মুছে ফেলে সে।
    তানজিনা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছানো শুরু করে দিলো। সে তার কাপড়- চোপড় ব্যাগে ভরছিলো আর ফাঁকে ফাঁকে আঁড়চোখে নিজের ঘরটা দেখছিলো।

ঘরের প্রায় সব জিনিসই তানজিনার বাবার দেওয়া। গয়না থেকে শুরু করে সংসার সাজানোর সব জিনিসই দিয়েছিলো তানজিনার বাবা তারেক ভুঁইয়া। তিনি ভেবেছিলো এসব জিনিস দিয়ে মেয়ের অপরাধ ঢেকে দিবেন।

কিন্ত একবারও এটা ভাবেন নি যে ছেলেটা তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিলো সেও সমান অপরাধী। না এটা সমাজের কেউ ভোবতেই পারে না। কারণ এসব ক্ষেত্রে ছেলেকে কখনোই অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় না।

জিনিস গোছানোর সময় সবার কিছু ভাসা ভাসা টিপ্পনী তানজিনার কানে আসছিলো।

  • রূপ না থাকলে খালি মিষ্টি কতায় কিছু হয় না।
  • কই তানজিনা কই আমাগো রাফিয়া। মাশাল্লাহ দেখতে একদম আসমানের পরী। রঙটাও পাইছে অক্করে নানির লাহান।
    চোখের পানি আটকানোর অনেক চেষ্টা করছিলো তানজিনা। কিন্তু তানজিনার মনে হলো আজ নিজের চোখের পানিও তার শত্রু হয়ে গেছে। যতই বাধা দিচ্ছে আবার দ্বিগুন গতিতে দু’গাল দিয়ে বেয়ে পড়ছে।

রেহানা খাতুন তানজিনাকে তাড়া দিয়ে বলে।

  • বলছি এখন যা লাগে খালি সেগুলান নিয়া ঘরটা খালি করো। বাকি জিনিস পরে নিও। এতো ভারী শাড়ী গয়না পইরা রাফিয়া আর কতক্ষণ থাকবো?
    সানজিদা আগুনে ঘি ঢেলে বলে।
  • ব্যাগ গুছাইতে এতো সময় লাগে না আম্মা। তানজিনা আফা এড্ডু বেশিই কানতাছে তাই সময় লাগতাছে।
    হুংকার দিয়ে ওঠে রেহানা খাতুন।
  • তোমার চক্ষের পানির কারণে যদি আমার আজু আর রাফিয়া সংসারে কোন অশান্তি হয় তোমার খবর আছে। আরে কেমুন ইস্ত্রিরী তুমি সোয়ামির ভালা বুঝো না।
    তানজিনা কোনরকমে কিছু কাপড়- চোপড় গুছিয়ে ঘর হতে বের হয়ে যাচ্ছিলো। তখনই আজুয়াদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
  • তুমি কোথায় যাচ্ছো। তানু?
    তানজিনা এই ঘটনার পর আজুয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। আর তার ইচ্ছেও করছেনা তাকাতে তাই মাথা নিচু করে রইলো।
    রেহানা খাতুন খাটে বসেই জবাব দিলো।
  • রাফিয়া নতুন বৌ। তাই তোর আব্বা আর আমি ঠিক করছি ছোটবৌমা কয়েকদিনের জন্য দক্ষিণের ঘরে থাকবো।
    এই কথা শুনে ক্ষোভে ফেটে পরলো আজুয়াদ। চিৎকার করে রাফিয়ার দিকে আঙুল তুলে বলে।
  • আমার ঘরে থেকে কেউ বের হলে এই মেয়ে বের হবে তানু না।
    কথাটা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল আর রাফিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো।

পর্ব- ২

  • একদম ঢং করবি না আমার সামনে। আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করার সময় মনে ছিলো না? তোরে তো আমার খুন করতে ইচ্ছে করতেছে।
    আজুয়াদ এতটা চেঁচিয়ে কথাগুলো বলছিলো যে পাশের ঘর থেকে আমজাদ খান চলে এলো।
  • হইতাছেটা কি এহানে? আজু। নতুন বউয়ের উপর কেউ এমনে চিল্লায়?
    ধমকের সুরে কথাটা বলে আমজাদ খান।
  • আমি তো কাল থেকে চুপই ছিলাম। আব্বা। এই কালনাগিনীর সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিলেেন। তাও চুপ ছিলাম। কিন্তু সে এই ঘরে থাকবে না বলে দিলাম।
  • এগুলাইন কি কতা? মুহে মধু নাই? আর ভুইল্যা যাইস না যা হইছে এতে তোরও বরাবর দোষ আছিলো। তোর পছন না হইলে রাফিয়া এই ঘরে থাকবো না। কিন্তু হেইডা অইবো ফিরউল্ডার পর।
    একথা শুনে তেলে- বেগুনে জ্বলে উঠে আজুয়াদ।
  • কিসের ফিরউল্ডা আব্বা? বিয়েটাই যখন আমি মানি না।
    দাঁত কিটিমিটি করে চিৎকার করে আমজাদ খান বলে।
  • এহন না মানলে কি অইবো? ঘরে বউ রাইখ্যা পিরীত করবার সময় মনে আছিলো না? তিনদিন বাদে শুক্কুরবার তোগো বৌভাতের অনুষ্ঠান। তোর লাইগ্যা বইনের কাছে হের হউর(শ্বশুর) বাড়ির মাইনসের কাছে আমারে অনেক ছোড হউন লাগছো। এহন চুপচাপ এই অনুষ্ঠানগুলা কইরা আমারে উদ্ধার কর।

একটু নরম হয়ে আজুয়াদ বলে।

  • আব্বা আমি কালও বলেছি। আজকেও বলতেছি রাফিয়া যা বলেছে তার অর্ধেকই মিথ্যা কথা।
  • বাকি আধা তো হাছা এইডাই অনেক।

“ঘরে বউ রাইখ্যা পিরীত করার সময় মনে আছিল না?শ্বশুরের এই কথাটা তানজিনার কানে বিষের মত বাজতে ছিলো। আর কোন কথা তার কানে পৌঁছাতেই পারলো না। সে বুঝতে পারলো আজুয়াদের সম্মতিতেই এ বিয়েটা হয়েছে।

নিজেকে সর্বশক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে একটু জোরে কঠিন গলায় বলে।

  • বাবা। এত ঝামেলা কেন হচ্ছে তাইতো বুঝতে পারছি না। শুধু শুধু একটা ঘর আগলে থেকে আমি কি করবো? যেখানে মানুষটাকেই আগলে রাখতে পারলাম না। আমি ঐ ঘরে চলে যাচ্ছি।
    তানজিনা বের হয়ে গেলো।

আজুয়াদ এবার আর তাকে আটকাতে চেষ্টা করলো না। কারণ তানজিনা যেভাবে আর যে কথা বলেছে তাতে আজুয়াদের সাহস হলো না তাকে আটকানোর।

  • দেখছো নি তেজ কমে না। মাইয়্যার। কতা- বারতার লাগাম নাই। বেত্তমিজ কোনহানকার।
    রেহানা বেগম এত চেঁচিয়ে কথাগুলো বলেছে যে ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে গিয়েও সব শুনতে পাচ্ছে তানজিনা।
  • মা তানুরে কিছু কইলে বাড়িতে কিন্তু আগুন লাগাইয়া দিমু।

গলার স্বর উঁচুিয়ে আমজাদ খান বলে।

  • আরে আবার কি অইলো? আর আবরারের মা তুমি এত কতা কিয়ের লাইগ্যা কইতাছো? বুইড়া বয়সে কেচা(মাইর)খাইবার মন চাইছে নি?
    আমজাদ খানের কথায় রেহানা খাতুনের মুখটা চুন হয়ে গেল।
  • আজু। তুই খারাইয়্যা আছোছ কেন? জলদি যা গতর ধুইয়্যা ল বাজারো যাওন লাগবো। আবরাররে ফোন করছি হের আইতে আইতে বুইধবারে অইবো। তাই আমার লগে সব বাজার- আট তোরই করন লাগবো।
    আজুয়াদ পুকুরে ডুব দিতে চলে গেল। আর আমজাদ খান নিজের ঘর।

ইচ্ছেমত তানজিনাকে কথা শুনাতে না পারায় গা জ্বলতে ছিলো রেহানা খাতুনের।

  • শত্তুরের ঘরে তো শত্তুরইতো জন্ম নিবো। যেমুন বাপ তেমুন পোলা। আমার লগে হেরা ভালা ব্যবহার করতেই পারে না।
    নাকি কান্না কেঁদে কথাগুলো বলছিলো তিনি।
    তখন আফিয়া বলে।
  • আম্মা ছোট ভায়ের আর আব্বার কি দোষ? সব তো হইছে ভাবীর লাইগ্যা।
    মুখ বাঁকিয়ে রেহানা খাতুন বলে।
  • হের কতা আর কি কমু? যবেত্তোন (যেদিন থেকে)এ বাইত আইছে আমার হাড্ডী- গোশত জ্বালাইয়্যা খাইতাছে।
    এতক্ষণ রাফিয়া চোখের পানি ফেলছিলো।
  • থাহুক না মাইমা(মামীমা)। তানজিনা ভাবীরে আর বইক্যেন না। দোষতো আমার আমিই তো হের সংসার ভাঙবার আইছি।
    বলে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল।
    সানজিদা মুখ বাঁকিয়ে বলে।
  • অ্যাঁ..তুমি কান্দ কিয়ের লাইগ্যা? তানজিনা আফারে আমি ছোডোত্তে চিনি। হের পেডে পেডে যে কত্ত বড় শয়তান লুকাইয়্যা আছে হেইডা আমি জানি। হের আর হের মা’র কামই অইলো ছলাকলা কইরা বাড়ির পুরুষ মাইনসেরে বশ করা।
    রেহানা খাতুন সানজিদার কথায় তাল মিলায়।
  • বড় বৌমা উচিত কতা কইছে। তুই কানবি না। নিজের সোয়ামীর মন জয় কর। কিরে পারবি না।
  • আফনেরও যেমুন কতা আম্মা কেন পারবো না? আমাগো রাফিয়ার যে রূপ! হেই রূপ দেইখাইতো আজুয়াদ ভাই সব ভুইল্যা যাইবো।
    বলে রাফিয়ার গায়ের সাথে নিজের গা দিয়ে একটা ধাক্কা দিলো সানজিদা।

সানজিদার এমন টিটকারির বিপরীতে রাফিয়া কিছু বলতে পারলো না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

  • অক্করে হাছা কতা কইছেন বড় ভাবী কই ছোড ভাবী আর কই আমাগো রাফিয়া। কথাটা আছিয়া বলে। তার রাজপুত্রের মতো ভাইয়ের বৌ তানজিনার মত বয়সী কালো মেয়ে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি।
    ভারাক্রান্ত গলায় রাফিয়া বলে।
  • না। গো আফিয়া আফা। তানজিনা ভাবী অনেক গুণবতী। হেইলার তুলুনায় আমি কিচ্ছু না।
    মুখ বাঁকায় সানজিদা।
  • ভাবী কি গো রাফিয়া আফা ডাহো। হেয় অহন তোমার হত্তীন। আর তুমি অতো নরম অইয়ো না। হেরে অহনো তুমি চিনো নাই। ছুডুবেলাত্তন আমারে জ্বালাইছে। হেয় নাহি ফাশ কইরা জজ- বেরিস্টার অইবো। আমি পড়া- লেহায় এড্ডু খারাপ আছিলাম তাই কত কতা হুনতে অইছে। আমার আব্বাতো আমার চাইতে তানজিনা আফারে আদর করে। কিয়ের লাইগ্যা না হেয় গুনবতী। ভাইগ্যা বিয়া বওনের সময় কই আছিলো গুণ? পুরা বংশের মুহে চুনকালি মাহাইছিলো। এরপরেও আমার বাপে তানজিনা তানজিনা করে। পুরুষ মাইনসেরে হেরা মা- বেডী খুব বাইন্দা রাখবার পারে। সময় থাকতে নিজের সোয়ামীরে সামলাও গো রাফিয়া। নাইলে তোমার হত্তীন তোমারে এই বাড়ির বাত(ভাত) খাইবার দিবো না।
  • বড় বৌ ঠিকই কইছে তোর মন পরিষ্কার তাই ঐ মাইয়্যার ছলা- কলা তুই বুঝবি না। নিজের সোয়ামীরে আঁচলের সাথে বাইন্ধা রাখবি বুঝবার পারছস নি?
    এভাবেই তিনজন মিলে রাফিয়ার কানে বিষ ঢালতে থাকে তানজিনার বিরুদ্ধে।
  • কি- রে আজু হুনলাম তুই নাহি আবার বিয়া করছোস?
    শান বঁধানো পুকুর ঘাটে বসে দাঁতে খিলাল করতে করতে প্রশ্নটা করেছে আজুয়াদের পাশের বাড়ির মুরব্বি করিম মুন্সি। সাধারণত ই সময় খান বাড়ির পুকুরে তিনি ছাড়া আর কেউ আসে না।

আজুয়াদ কিছু বলতে পারলো না। শুধু মাথা নিচু করে সায় দিলো।

  • তগো এহনকার পোলাপাইনের মতিগতি বুঝা মুশকিল। অত কিছু কইরা তো পাশের গেরামের ভুঁইয়াগো মাইয়াডারে বিয়া করছোস। অহন বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার নয়া বউ ঘরে তুলছোস? তয় কি সবাই রূপের পুজারি। একখান কতা কই। আগের বউডারে অনাদর করিস না। তরে ভরসা কইরা ঘর- দোর ছাড়ছিলো অহন হত্তীনের বাত খাওন লাগবে। ডর লাগতাছে। মাইয়াডা না আবার তগো বাড়ির মাইনসের অত্যাচার আর তর অনাদরে হারায়িয়্যা যায়।
    ওজু করে করিম মুন্সি চলে গেলো। তিনি এখন খান বাড়ির মসজিদে বসে কুরআন তিলাওয়াত করবেন। তারপর একবারে জোহরের নামায পড়ে বাড়ি যাবেন। এটাই তার রোজকার নিয়ম।

পুকুরে ডুব দিতে দিতে আজুয়াদ মনে মনে ভাবতে লাগলো।

  • রূপে আমি ভুলে যাবো? আমি অনাদর করবো তাও তানুকে? কখনোই না। সারাজীবন ওকে আগলে রাখবো আমি। একটা ছোট ভুলের জন্য আমি তানুকে হারাতে পারবে না। দরকার হলে রাফিয়াকে তালাক দিবো। আব্বার সাথে আজই কথা বলবো।
    আজুয়াদ উঠানে পা রাখতেই আমজাদ খান বলে।
  • আজু। তুই তৈয়ার হইয়া ল। হাটে যামু। বাবুর্চি ঠিক করুন লাগবো৷ কিছু সদাইও করুন লাগবো।
  • আচ্ছা।

বলে আজুয়াদ ঘরে গেলো।
আজুয়াদ আলমারি খুলে দেখে তানজিনার কাপড়ের জায়গায় রাফিয়ার কাপড়। এটা দেখে তার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেলো।
এমন সময় রাফিয়া গোসল করে ঘরে এলো।
রাফিয়াকে দেখে নিজের রাগ ঝাড়তে আজুয়াদ রাফিয়ার গালে স্ব জোরে চড় দিলো। রাফিয়া মেঝেতে পড়ে গেল।

  • ও মাগো। বলে রাফিয়া চিৎকার করে উঠে।
  • আমার লগে ন্যাকামি করবি না তোর জিনিস যাতে আমার আলমারিতে না থাকে।
    বলে রাফিয়ার সব কাপড় ছুঁড়ে তার মুখের উপর ফেলতে লাগলো।
    রাফিয়ার চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে আজুয়াদের ঘরে এলো৷
    ঘরের এলোমেলো অবস্থা আর রাফিয়ার ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ দেখে সবাই বুঝতে পারলো কি ঘটেছে।
    আমজাদ খান হুংকার দিয়ে ওঠে।
  • আমার মা’য়ের গায়ে হাত তোলার তোর সাহস কেমনে হয়?
    আজুয়াদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কারণ যাই হোক সে একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলে অন্যায় করেছে।
    অবশ্য এই অন্যায়টা এর আগেও সে একদিন করেছিলো তানজিনার সাথে। আর এই মানুষগুলোই তার কাজের জন্য সেদিন তাকে বাহবা দিয়েছিলো।
    কিন্তু আজ রাফিয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বদলে যায়।

আজুয়াদের চোখের সামনে সেই দিনটা ভেসে উঠে।

  • আজুরে। কই গেলি রে? দেইখা যা তোর বউ কি করছে। আমার কি সব্বনাশ অইলো গো।
  • কি হয়েছে আম্মা চিল্লাচ্ছো কেনো?
  • হ আমি তো খালি চিল্লাই আর তোর বউ আমার লগে কাইজ্জা করে তার বেলা?
    তানজিনার বিয়ের তখন তিনমাসও হয় নি। শ্বশুড় বাড়ির সবাই তার সব কাজে ভুল ধরতো। বিশেষ করে তার শ্বাশুড়ি।
    তানজিনা সহ্য করতো। কিন্তু আজ এত সামান্য একটা ব্যাপারে তিনি এত হুলস্থুল বাঁধিয়েছে যে
    তানজিনা জবাব দিয়ে ফেলে।
  • মা আপনি শুধু শুধু ব্যাপারটা নিয়ে ঝামেলা করতেছেন। আমি হাতের কাজটা করেই আসছিলাম।
    মুখ বাঁকিয়ে রেহানা খাতুন বলে।
  • তোমার কাম মানে তো সারা দিন তো কিতাবের মাইধ্যে থাহা। সংসারের কামে মন নাই কিছু না।
    আজুয়াদ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
  • হইছেটা কি বলবা তো?
  • কি আর অইবো? তোর আব্বায় এতগুলান বাজার আনছে। তোর বউরে কছিলাম গুছাইয়া রাখতে হেয় কইলো হাতের কাম সাইরা পরে আইবো। একঘন্টা হইয়া গেলো হেয় কিচ্ছু করে নাই। যাইয়া দেহি নবাবের ছেড়ি টেবিলে বইয়্যা পড়ে। মাছগুলাইন পঁইচা গেলো। এতক্ষণ কেরে আইলো না জিগাইতেই কয় এতো জরুরি হইলে আফিয়ারে কেন ডাকলাম না।
    প্রতিবাদ করে তানজিনা বলে।
  • মা আপনি কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলছেন। আপনি আমাকে ডেকেছেন দশ মিনিটও হয় নাই তার মধ্যেই আমি চলে আসছি। আর আফিয়ার কথাতো আমি এমনি….
    কথাটা শেষ করার আগেই আজুয়াদ তানজিনার দুই গালে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে বসে।
    তারপর প্রবল আক্রোশে বলে।
  • হারামজাদি আমার আম্মারে মিথ্যাবাদী বলিস? আমার মা- বোন তোরে কাজ করে খাওয়াবে? আর তুই নবাবের বেটী পায়ের উপর পা তুলে বসে খাবি? আজকে থেকে তোর পড়ালেখা বন্ধ। আবার যদি তোরে বইয়ের সামনে বসতে দেখি তবে আমি তোর বই খাতা আগুন দিয়া পুড়িয়ে ফেলবো।
    এরপরে গটগট করে বের হয়ে গিয়েছিল।

ঘটনার আকষ্মিকতায় তানজিনা বুঝতে পারছিল না। কি হচ্ছে তার সাথে। এই কি সেই আজুয়াদ য়ার হাত ধরে সব সম্পর্ক ভুলে সে ঘর ছেড়ে এসেছিলো।
এতসবের পরেও ছেলের শাসনে খুশি হতে পারে নি রেহানা খাতুন। তাই আমজাদ খান বাড়ি এলে বিচার দেন।
আমজাদ খানও জরুরি তলব পাঠায় ছেলে আর ছেলের বউকে।

  • তেমার মায়ের কাছ থেইক্কা সব হুনলাম। বউয়ের হইয়া তোমার কিছু বলার আছে আজু?
  • আব্বা। তানু একটা ভুল করে ফেলেছে।
    ধমক দিয়ে আমজাদ খান বলে।
  • কিয়ের ভুল। নিজের হউরির(শ্বাশুড়ির) লগে তক্ক করে। হেরে মিথ্যাবাদী কয়। এইডা কোন ভুল? না। এইডা গুনা। তাই তুই যা শাস্তি ঠিক করছোস তাই অইব। আইজকার পর ছোট বউমা লেহাপড়া করবো না।
  • কিন্তু বাবা আমি তো এমনি রাগের মাথায় কথাটা বলেছিলাম।
  • হেইডা আমি বুইঝাই তোগোরে ডাকছি। এই বাড়ির বাত খাওনের হইলে তোর বউয়ের পড়া ছাড়ুন লাগবো।
    তানজিনা শ্বশুরের পায়ে ধরে বসে কান্না করে দেয়।
  • বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমারে আর একটা সুযোগ দেন। আমার পড়া বন্ধ করবেন না। একটু দয়া করেন।

আমজাদ খান তার সিদ্ধান্তে অনঢ় হয়ে বল।

  • অহন সুযোগ দিলে তুমি আবার একই অন্যায় করবা। হেইডা আমি অইতে দিমু না। তাই কোন সুযোগ দেওন যাইবো না।
    সেদিন তানজিনার পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শ্বশুর- শ্বাশুড়ির পায়ে ধরেও লাভ হয় নি।
    সেদিন বাড়ির সবার কাছে অনেক প্রশংসা পেয়েছিল আজুয়াদ।

আজও একই কাজ করেছে শুধু মানুষটা বদলে যাওয়ার কারণে তিরস্কার পাচ্ছে!
আমজাদ খানের চিৎকারে হুঁশে আসে আজুয়াদ।

  • কিরে কতা কছ না কেরে? এই শিক্ষা দিছি? ফুলের মতো মাইয়ার গায়ে হাত দেছ।
  • ভুল হইছে আব্বা।
    বলে বের হতে নিলে তাজিনার মুখোমুখি হয় আজুয়াদ।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সেও এসেছে। সব দেখে পুরোনো কথাগুলো মনে করছে। মাথা নিচু করে সরে গিয়ে আজুয়াদকে জায়গা দিলো।
আজুয়াদ দিকে তাকিয়ে দেখে এই কয়েক ঘন্টায় যেন ঝরে যাওয়া শুকনো ফুলের মত শুকিয়ে গেছে তানজিনা।
তানজিনার এ চেহারা সহ্য করতে পারছে না আজুয়াদের নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে তার। চোখ নামিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

  • পোলার উপর চিল্লাও কেন? নষ্টের গেড়া তো অইলো তোমার ছোড বউমা। হেয়ই আড়ালে আজুর কান ভারী করছে। নাইলে এমুন পরীর লাহান বউরে আমার পোলায় মারে? রেহানা বেগম নিজের স্বামীকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে।

আমজাদ খান তানজিনার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে।

  • তোমার জইন্য যুদি আমাট ভাগ্নীর কোন অসুবিদা অয় তাইলে কিন্তু তোমারে আমি ছাইড়া দিমু না।
    আমজাদ খান রেগে বের হয়ে যায়।
    রেহানা বেগম চেঁচিয়ে বলতে থাকে।
  • সংয়ের মত খারাইয়া আছো কেন? যাও ভালা কিছু নাস্তা বানাও। দুফুরের পরেই নতুন বৌ দেখতে সবাই আইতে শুরু করবো। তাগো সামনে তো কিছু দেওন লাগবো। আফিয়া। যাতো দৌড়াইয়া ফিরিজত্তে বরফ লইয়া আয়। আহারে গালঢা লাল হইয়া রইছে। না জানি কত জ্বলতাছে।
    তানজিনা এই আদিখ্যেতাগুলো আর নিতে পারছিলো না। তাই বের হয়ে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছে।
    আর মনে মনে ভাবছে।
  • কি কপাল আমার স্বামী সতীন নিয়ে এলো। মন খুলে একটু কাঁদতেও পারলাম না। পাড়ার লোক সতীনকে দেখতে আসবে তাদের আপ্যায়নের জন্য রান্নাও আমাকেই করতে হবে। আজ আমি এতটাই অসহায় আর নিরুপায় যে বাপের বাড়িও যেতে পারছি না। কপালে সতীনকাঁটা ফুটে সব তছনছ হয়ে গেছে।
    একটা করুণ দীর্ঘঃশ্বাস্ বের হয়ে এলো তানজিনার মুখ থেকে।

পর্ব- ৩

  • ফহিন্নির মত কাফর(কাপড়) পিইন্দা আছো যে ছোড বউমা। এক্ষণ পাড়াত্তে বেবাকতে(সবাই) আইয়া পড়বো। হেরা তুমারে এমুন কাফরে দেকলে বাড়ির মান- ইজ্জত থাকবো? ।
    এসব বলে তানজিনাকে ঝাড়ছিল রেহেনা খাতুন।
    তানজিনার অপরাধ সে রান্না- বান্না শেষ করে এখনো ভালো কাপড় পরে তৈরি হতে পারে নি।
  • পাড়ার মানুষ তো আর আমাকে দেখতে আসবে না। আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি ঘর থেকে বের হবো না।
  • তুমি চাইতাছোডা কি হাছা কইরা কও দেহি। বেবাকতের সামনে খান বাড়ির ইজ্জত ডুবাইতে? নাইলে ঘররেত্তন বাইর অইবা না কেরে?
  • এখানে ইজ্জত ডুবানোর কথা কেন আসছে মা? পাড়ার মানুষ নতুন বৌ দেখতে আসবে। আমি ঘরের ভিতরে থাকলাম না বাইরে থাকলাম তাতে কি যায় আসে?
  • শিক্ষিত অইয়্যা মুরুখ্যের লাহান কতা কইয়ো না।

তুমি ঘরে খিলি দিয়া বইয়্যা থাকলে বেবাকতে কইবো আগের বউরে বেজার(অখুশি) কইরা খান বাড়ির পোলায় নতুন বউ আনছে।

  • এটাই তো সত্যি মা। আমি তো আপনার ছেলের এই বিয়েতে খুশি নই।
  • তুমার খুশি- বেজারে আমার কিছু আইয়্যে যায় না। তয় পাড়ার লোহের(মানুষের) কতায় বহুত কিছু আইয়্যে যায়। গেরামে আমরা(আমাদের) বাড়ির একটা ইজ্জত আছে। তুমি ঘরে বইয়্যা থাকলে মাইনসে কইবো খান বাড়ির মানু(মানুষ) বালা না। বউরে দুক(দুঃখ) দেয়।
    নতুন বৌকে সাজিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিলো সানজিদা। তখনই তার চোখ শ্বাশুড়ি- বউয়ের তর্ক চোখে পড়ে।
    তাই সানজিদা সেখানে গিয়ে ফোঁড়ন কাটে।
  • কারে কি বুজাঈন আম্মা। তানজিনা আফা যুদি বাড়ির মান- ইজ্জতের কতা চিন্তা করতো তয় কি ভাইগ্যা বিয়া বইত? আগে বাফের(বাবার) বাড়ির ইজ্জত ডুবাইছে অহন হঊর বাড়িরটা ডুবানের লাইগ্যা চেস্টা- চরিত্তি করতাছে।
  • তা যা কইছো বড় বউমা। তয় তুমিও কান খুইল্যা হুন ছোড বউমা এইডা তুমার বাফের বাড়ি না হঊর বাড়ি। হেই বাইত যা করছো তা এই বাইত করন যাইবো না। অহন যাও তুমার মামা হঊরে যেই লাল শাড়ি কাফরডা দিছিন হেইডা পিইন্দা আহ। লগে এড্ডু সন্নও(স্বর্ণ) পিইন্দ। এমুন বিধবার লাহান আইয়ো না।

তানজিনা আর সেখানে দাঁড়ালো না কারণ এ বাড়িতে যখনই সানজিদা আর রেহানা খাতুন একসাথে হয়েছে তাকে অপমান করেছে। কখনো পড়াশোনা। কখনো তার ঘরের কাজ না পারা নিয়ে। কখনোবা তার শ্যামলা রঙ নিয়ে।
এমন না তানজিনা প্রতিবাদ করে নি।
কিন্তু সব প্রতিবাদের মন্তব্য এসে দাঁড়াতো।
যে মেয়ে নিজের মা- বাবাকে আঘাত দিয়ে দুই দিনের পরিচয়ে। একটা ছেলের সাথে পালাতে পারে। সে কিছুতেই ভালো হতে পারে না।
তানজিনা ঘরে এসে শাড়ি বদলাচ্ছে। আর ভাবছে।

আমার কি দোষ? এই পালিয়ে বিয়ে করেছি।
এই একটা ভুলের জন্য সবসময় সবাই কথা শুনায়। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মা- বাবা তোলে গালি- গালাজ করে।
প্রতিবাদ করে কি পেয়েছি মাঝপথে পড়াশোনা থামিয়ে দিয়েছে তারা।
অথচ এই আজুয়াদের বাবাই আমার আব্বুর হাতে ধরে ওয়াদা করেছিল আমি যতদিন পড়তে চাই তারা পড়াবে।

আমার পড়া বন্ধ করে দেওয়ার পর যখন বাবা আর চাচা এসেছিল আমার শ্বশুরকে বোঝাতে তখন উনি বলেছিল।
বেয়াই বউ মানু ঢেঙ ঢেঙ কইরা রাস্তা দিয়া কলেজ যাইবো বালা দেহায় না। আর আমনের(আপনার) মাইয়্যারে তো কোনো কিছুর অবাবঅ(আভাবে) দেই না। অত পইরা কি অইব। এছাড়া হের মন তো ঘরের কামে কম কিতাবো বেশি থাহে।

আমার বাড়ির বউ ঘরে থাকবো কাম করবো। খাইবো। আইবোদ(বাচ্চা) পালবো। হেয় আর কলেজ যাইবো না। এইডা শেষ কতা।
না সেদিন আমার বাবা- চাচা প্রতিবাদ করতে পারে নি। মাথা নিচু করে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো।

একবারও বলে নি চল তানজিনা। শুধু রান্না করা আর বাচ্চা মানুষ করার জন্য এ বাড়িতে তোর থাকতে হবে না।
তুই আমাদের বাড়ির মেয়ে কোন কাজের লোক বা বাচ্চা জন্ম দিয়ে লালন- পালনের যন্ত্র না।
আচ্ছা আমি যদি পালিয়ে বিয়ে না করতাম। যদি বাবার পছন্দে বিয়ে করতাম তাহলেও কি তারা আমাকে না নিয়ে এভাবে চলে যেতে পারতো?
এসব ভাবতে ভাবতে গয়না পড়তে লাগলো তানজিনা।

যখন হাতে চুড়ি পরবে তখন সেদিনের কথা মনে পড়লো যেদিন শ্বাশুড়ি এই চুড়ি নিয়েও তাকে কথা শুনিয়েছিলো।

একটু দেরি করে ঘুম ভাঙায় চুড়ি আর গলার চেইন না পরেই কাজ করছিল তানজিনা।
হঠাৎ আজুয়াদ এসে পানি খেতে চায়। সে স্বর্ণ পরে ঘুমাতে পারে না অস্বস্তি হয়।
তানজিনা পানি এগিয়ে দিলে তার শ্বাশুড়ি হাত থেকে গ্লাস ফেলে দেয়।

  • বলি আমার পোলাডারে অসুকে(রোগে) ভুগাইতে চাও?
  • মা আমি এমন কেন চাইবো? আর আপনি গ্লাসটা কেন ফেলে দিলেন?
  • অ তুমি বুজ নাই ফিডার খাও। তোমার মায় কি শিহাইয়্যা (শিখিয়ে) হঊর বাইত পাডাইছে? এহেনিও(এতটুকু) জানো না খাইল্যা আত আর খাইল্যা গলায় সোয়ামীরে দানা- পানি দিতে নাই। হের অসুক অয়।
    সামান্য একটা কারণে মা তুলে কথা তানজিনার ভাল লাগে নি।
    তাই সে জবাব দেয়।
  • মা এগুলো কুসংস্কার। কোন হাদিসে কিন্তু এসব লেখা নেই।
  • অ- মায়া- মায়া- গো (বিশেষ বিলাপ) দুই দিনের মাইয়্যা আমারে কুরান- আদিস শিহায়। ও আজুরে। তুই কইত্তে আনছোস এইডারে?
    সেদিন আজুয়াদ কিছু বলেনি তার মা’কে।
    রাতে যখন তানজিনা তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিল ;তখন আজুয়াদ জবাবে বলেছিলো।
  • তুমি এসব ছোট- খাটো বিষয় নিয়ে ঝামেলা না করলেই পারো। মা’তো অনেক বড়ো কিছু করতে বলে নি। শুধু গহনা পরে থাকতে বলেছে। তাছাড়া গহনাতে তোমাকে বেশ সুন্দর লাগে।
    অসাবধানতা বশত একটা কাঁচের চুড়ি ভেঙে তানজিনার হাত কেটে যায়। আর সে বর্তমানে ফিরে আসে।
    তারপর রক্তটা মুছে একবার আয়নার দিকে তাকায়। তানজিনার মনে হয় নিজের প্রতিচ্ছবিটাও আজ তাকে দেখে হাসছে৷

বাজারে বাবুর্চি ঠিক করে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরছে আমজাদ খান আর আজুয়াদ।
অনেকক্ষণ যাবত সাহস সঞ্চার করে আজুয়াদ কথাটা বলেই ফেলে।

  • আব্বা আমি রাফিয়াকে তালাক দিবো৷

আমজাদ খান খুব বিজ্ঞ লোক। ছেলের মনোভাবটা সহজেই ধরে ফেললেন। তাই মাথা খাটিয়ে বলেন।

  • তর বউ তুই তালাক দিবার পারস। তয় তালাক দিলে দুনো বউরে দেওন লাগবো।
  • আব্বা এ কেমন কথা। তানজিনার কি দোষ? সে কেন সতীনের সংসার করবে?
  • দুশ তো রাফিয়ারও নাই। যা দুশ সব তর। বউয়ের লাইগ্যা এত পীরিত আগে কই আছিন?
    আজুয়াদ কোন জবাব দিতে পারলো না।
    আমজাদ খান আবার বলে।
  • খান বাড়ির পুরুষ মাইনসে দরহার অইলে চাইড্যা(চারটা) বিয়া করে। কিন্তুক তালাক দেয় না। আর তুই বউ খেদাবি (তাড়াবি) আমি বাইচ্যা থাকতে হেইডা অইবো না। দুই বউয়ের লগে বালা ব্যবার(ব্যবহার) কর দেকবি সব ঠিক অইব। সবতে(সবাই) সব মাইন্যা নিবো।
    আজুয়াদ কোন কথা বলতে পারলো না। কোনদিনই পারেনি।

তাছাড়া বাবার সামনে কথা বলতে পারলে আজ তার অবস্থা এত করুণ হতো না।

এদিকে খান বাড়ির বসার ঘরে পাড়ার সব মহিলারা ভিড় জমিয়েছে।
নতুন বউ তার উপর ছেলের আগে একটা বউ আছে তাই ভিড়টা একটু বেশিই। সবাই আসলে নতুন বৌ দেখতে না পুরাতন বউয়ের কষ্ট দেখে মজা নিতে এসেছে।

  • কিগো আবরারের মা আগের বউ পছন অয় নাই দেইখ্যা পোলারে আবার বিয়া করাইয়্যা দিলা?
  • কি যে কন সালেহা ভাবী আমার পোলারে তো চিনেন। হেয় হের মজ্জি(মর্জি)মত বিয়া করছে। আগেরডাও অহেনরডাও।
  • তা তুমার ছোডু বউ রাজি আছিন নি সোয়ামীর বিয়াত।

রেহানা খাতুন জানতো এই প্রশ্নটা উঠবে তাই তিনি এর উত্তর আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন।

  • সোয়ামীর খুশিতেই ইস্তিরীর খুশি। আমার ছোড বউমা উচ্চ শিক্ষিত এইসব ভালা জানে বুজে। দেহেন না নতুন বউয়ের লগে কি সৌন্দর বইনের লাহান বইয়্যা রইছে। আইজকার বেবাক রান্নাও হেয়ই করছে।
    সালেহা মুখ পানসে করে বলে।
  • বালা অইলেই বালা।
    এতক্ষণে রেহানা খাতুনের চাল বুঝতে পারলো তানজিনা। তাকে দিয়ে রান্না করানো। সাজিয়ে নতুন বউয়ের সাথে বসানো এসব করেছে তার শ্বাশুড়ি শুধু সবাইকে এটা বুঝাতে যে আজুয়াদ প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেছে।
    তানজিনার ইচ্ছে করছিল চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে আমি এ বিয়ে মানি না। কিন্তু বলে কি হবে কয়েকজন মজা পাবে। কয়েকজন দুঃখ প্রকাশ করবে। একসময় সবাই এক হয়ে তাকে নিয়ে গল্প করবে।
    সবশেষে প্রমাণ হবে। নিশ্চয়ই তানজিনার মধ্যে তার স্বামী খারাপ কিছু পেয়েছে তা না হলে তার স্বামী কেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে। এটাই সমাজের বাস্তব চিত্র।
    একসময় সবাই চলে গেলো।

তানজিনা ঘরে চলে গেলো।
সন্ধ্যার পর আফিয়া এসে বলে তাকে রেহানা খাতুন ডাকছে।
ঘরে যেতেই তার শ্বাশুড়ি বলে।

  • আইছো। এদিকে আহো। আমার কাছে বহো।
    শ্বাশুড়ির এমন ভাল ব্যবহারের কোন কারণ খুঁজে পেল না তানজিনা। তাও গিয়ে পাশে বসলো।
    তানজিনার শ্বাশুড়ি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে।
  • মায়াআ(মা) আমি বুজি তর খারাফ লাগতাছে। কি করবি ক। যা অওনের তা তো অইয়্যাই গেছে।
    এড্ডু মানাইয়া ল। তোরে একখান কতা কই হুনবি?

মাথা নেড়ে সায় দেয় তানজিনা। বিয়ের পর আজ প্রথম তার শ্বাশুড়ি তার সাথে ভাল ব্যবহার করছে। স্নেহ করছে। কিছু সময়ের জন্য তো সে সব দুঃখই ভুলে গেলো।

  • তুই আজুরে এড্ডু বুজা। ছোট্টু মাইয়্যাডারে ঘরেত্তন বাইর কইরা দিছে৷ নতুন বউয়ের লগে কেউ এমুন করে? তুই ওর ঘরে যা গিয়া কবি তোর এই বিয়ায় কুনো আপত্তি নাই।
    আবার ধোঁকা পেল তানজিনা। বুঝলো এ স্নেহ তার জন্য না রাফিয়ার জন্য।
    কিছু না বলে চোখের পানি নিয়ে শ্বাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

তানজিনা দেখতে পেলো রাফিয়া সেজেগুজে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পানিতে তার কাজল মুছে যাচ্ছে।
তানজিনা যেন নিজেকেই অন্যরূপে দেখতে পেলো। কারণ একইভাবে একদিন সেও দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। এ বাড়ির কেউ তাকে মেনে নিতে পারে নি বলে।
আজ রাফিয়ার সাথে বাড়ির সবাই তাও সে ঘরে যেতে পারছে না কিন্তু কেন? তাকে যদি এমন কষ্টই দিবে তাহলে বিয়ে কেন করেছে আজুয়াদ?
শ্বাশুড়ির কথায় গলে গিয়ে নয় এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আজুয়াদের দরজার কড়া নাড়লো তানজিনা।
ভেতর থেকে আজুয়াদের চিৎকার করা গলা শুনা গেলো।

  • আবার যদি কেউ আমাকে ডাকে তাহলে আমি গলায়দড়ি দিবো।
    তানজিনা একটু জোরেই বলে।
  • আমি তানজিনা।
    একটু পর খট করে আওয়াজ হলো এবং দরজা খুলে গেলো।

পর্ব- ৪

হেঁচকা টানে তানজিনাকে নিজের দিকে টেনে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় আজুয়াদ।
দরজা খোলা থাকায় পুরো দৃশ্যটা দেখতে পায় রাফিয়া।
রাফিয়ার মনে হচ্ছিল কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে তার কলিজাটা কুচি কুচি করে কাটছে।
রাফিয়া মনে মনে বলে।

  • খোদা। বেবাকতা (সব) জাইন্ন্যা- হুইন্ন্যা (জেনে- শুনে) ইত্তো হত্তীনের ঘর করবার আইছি তয় পরাণডা অত পুরাইতাছে কিয়ের লাইগ্যা?
    আজুয়াদ একবার বাইরে দরজার তাকিয়ে দেখতে পেল রাফিয়া কাঁদছে। দৃশ্যটা দেখে তার গা জ্বলে ওঠে। তাই সে দেরী না করে তানজিনাকে ছাড়িয়ে রাফিয়ার মুখের উপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল।

রেহানা বেগম স্বামীকে পান সাজিয়ে দিচ্ছিলো।

  • কামডা কি ঠিক অইলো। আবরারের মা?
  • কুন কাম?
  • ছোড বউমারে কুনদিন মন থেইক্যা আমরা কেউ মাইন্যা নিবার পারি নাই। আইজ নাটক কইরা কাম আদাই করতাছি। নাহ আমার পরানে মানতাছে না।
  • আবাইত্তার(ফালতুর) মতো কতা কইয়ো না। ছোড বউয়ের কতা থুইয়্যা নিজের বইনজির (ভাগ্নী) কতা বাবো(ভাবো)। ছুডো মাইয়া এই বয়সে হত্তীনের ঘর কেমনে করবো।
    দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজম খান বলে।
  • কতা হাছা কইছো। কি পোড়া কপাল লইয়্যা জন্মাইলো। বাপ মরা মাইয়্যাডার জীবনডা তোমার পোলার লাইগ্যা নষ্ট হইয়্যা গেলো।
    মুখে আরো একটা পান গুঁজে দিয়ে। একটু রেগে রেহানা বেগম বলে।
  • হুদাই(শুধু) হুদাই আমার আজুরে দোষ দিয়ো না। বেডা(পুরুষ) মাইনসের এড্ডু আড্ডু ছুকছুক স্বভাব থাহেই। ঘরের বউ বালা না হেয় তো অইলে বাইরে মুক দিবঐ। আর তোমার বইনজি পানিত পইরা যায় নাই। আমার আজুর খালি আগের একখান বউ আছে এইডা ছাড়া আর কুনো সমিস্যা নাই। হুন বেডা মানু অইলো সন্নের আংটি। ব্যাঁহ্যা (বাঁকা) অইলেও দর কমে না।

আমজাদ খান তার স্ত্রীর যুক্তি শুনে চুপ হয়ে যায়। কারণ তিনিও মনে- প্রাণে বিশ্বাস করে পুরুষ মানুষ স্বর্ণের আংটি।

এদিকে দরজা বন্ধ করে আবার তানজিনাকে কাছে টেনে নেয় আজুয়াদ।
তানজিনা এবার চুপচাপ না থেকে নিজেকে আজুয়াদের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে।

  • দাঁড়াও আজুয়াদ। আগে বোঝাপড়াটা শেষ হোক। এসবের জন্য সারারাত পড়ে আছে।
  • তানু। কি বলছো তুমি কিসের বোঝাপড়া?
  • তুমি খুব ভাল করেই জানো আমি কিসের বোঝাপড়ার কথা বলছি। এখন বলো।
  • তানু। আজকে না। আমার এই অনুরোধটা রাখো।
  • ঠিক আছে আমি জোর করবো না। কিন্তু সবকিছু না জেনে তোমার কাছাকাছি গেলে আমার নিজের উপর ঘৃণা চলে আসবে। তাই এখন চলে যাচ্ছি।
  • না আমি তোমাকে যেতে দেব না।
    ভ্রূ কুঁচকে তানজিনা বলে।
  • জোর করবে?
  • যদি বলি তাই।
    তানজিনা গলাস্বর ভারী করে বলে।
  • হ্যাঁ। সেটা তুমি করতেই পারো। সারাদিন পেছনে পড়ে থেকে প্রেম করতে পারো। আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য করতে পারো। যখন ইচ্ছা গায়ে হাত তুলতে পারো আবার নতুন করে বিয়েও করতে পারো। এসব যদি তুমি করতে পারো তবে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার সাথে জোরও খাটাতে পারবে।
    আজুয়াদের জানা ছিল না তানজিনা তার মনে এত অভিমান লুকিয়ে রখেছে। অবাক হয়ে আজুয়াদ বলে।
  • তানু!
  • অবাক হওয়ার কি আছে। আমি কি মিথ্যে বলেছি।
  • না তানু। তুমি সত্যিটা বলেছো। আমি তোমাকে সম্মান দিতে পারি নি।
  • তাহলে কি আমি চলে যাবো?
    আজুয়াদ তানজিনার মনোভাব বুঝতে পারলো। তানজিনা সত্যিটা না জেনে আর কোনমতেই তাকে মানতে পারবে না।
    তাই মনে মনে ভাবলো।
    যে সত্যিটা এক না এক দিন তানজিনা জানতে পারবে তা আজকে বললে ক্ষতি কি? বরং অন্য কারো মুখে শোনার চেয়ে আমার মুখে শোনা ভালো।
    আজুয়াদ বলে।
  • না। আমি এখনই সব বলবো। তুমি থাকো কিন্তু কথা দিতে হবে তুমি সবটা শুনবে।
  • আচ্ছা শুনবো। তবে আমারও একটা কথা আছে। তোমাকে আল্লাহর কসম দিলাম একটা শব্দ মিথ্যা বলবে না আর লুকাবে না।
    আজুয়াদের শেষ আশার আলোটা নিভে গেল সে ভেবেছিলো। কিছু সত্য কিছু মিথ্যা আর কিছু কথা গোপন করে তানজিনাকে বুঝিয়ে নিবে। কিন্তুু কসমের কারণে আর সেই উপায় রইলো না।
    অবশেষে আজুয়াদ আর তানজিনা মুখোমুখি বসে। আজুয়াদ বলা শুরু করলো।
  • তানু তুমি তো জানো। চাকরি হওয়ার পর আমি ঢাকায় গেলাম। ঢাকা আমার কাছে নতুন ছিলো না। আমার কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় সব ঢাকাতেই ছিল।
    তবু বিয়ের পর তোমার সঙ্গ ছাড়া থাকতে গিয়ে বুঝতে পারলাম। চিরচেনা ঢাকা শহরে আমি অনেক একা।
    এর মাঝে একদিন ফুফুর ফোন আসে।
  • আসসালামু আলাইকুম ফুআম্মা(ফুফুআম্মা)
  • ওয়ালাইকুম আসসালাম। আজু বালা আছোছ নি।
  • জ্বি। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা?
  • আমরাও বালা। তয় একখান মুশকিলো পইরা ফোন দিছি৷
  • কি বিপদ?
  • তর বইনে হের ফুআম্মার লগে ঢাহা গেছিন। অহন তো এলহা(একা) এলহা আইবার পারে না। তুই যুদি হেরে এড্ডু দিয়া যাইতি।
  • আমার তো অফিস আছে।
  • তর না শুক্কুর শনি বদ্দ।
  • জ্বি। আচ্ছা আমি শুক্রবার রাফিয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিবো।
  • না শুক্কুরবার না। মাইয়াডা খুব আউস(আশা) কইরা গেছিল। ঢাহা গুরবো। তুই এক কাম করিস শুক্কুরবারে হেরে এড্ডু গুরাইয়া শনিবার লইয়া আসিস। পরে তুই রোরবারে যাইছগা।
  • আচ্ছা তাহলে রাফিয়ারে বলবেন শুক্রবার বিকেলে তৈরি হয়ে থাকতে।
  • বিহালে কেন সহালে বাইর অইলে তো বেশি গুরন যাইবো।
  • ফুআম্মা ঢাকায় কেউ সকালে ঘুরে না সবাই বিকেলেই ঘুরে।
  • অ..

এরপর দিন চলে যায়। শুক্রবার বিকেল চলে আসে।
আমি রাফিয়ার ফুপুর বাড়ির বসার ঘরে তার ফুপুর সাথে গল্প করছিলাম আর তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
তখন রাফিয়া আসে। আমি রাফিয়াকে প্রথম এত খেয়াল করে দেখলাম। কেননা এর আগে আমি তাকে বাচ্চা ভাবতাম।
সেদিন রাফিয়াকে লাল থ্রি- পিসে অন্যরকম লাগছিলো। খেয়াল করলাম চোখে গাঢ় কাজল আর লিপস্টিক ছাড়া গোলাপি ঠোঁটে তার চেহারায় অদ্ভুত আভা ফুটে উঠেছে। বুঝতে পারলাম কৈশোর শেষে নব্য যৌবনে পা রাখার সৌন্দর্য এটা।

রাফিয়াকে নিয়ে বের হলাম। অনেক ঘুরলাম। রাতে বাইরে খেলাম তুমি তো এগুলো সবই জানো।
সন্ধ্যার পর তাকে নিয়ে তার ফুপুর বাড়ি দিয়ে আসলাম।
পরদিন সকালে ঢাকা থেকে রাফিয়াকে নিয়ে ফুপুর বাড়ি গেলাম।
তুমিতো জানো ফুপুর বাড়িতে এখনো বিদ্যুৎ যায় নি। তাই খুব গরম লাগছিলো। তার উপর রাতে হারিকেনের উত্তাপ গরমটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
ঘুম আসছিলো না। তাই আমি দরজাটা খোলা রেখেই শুয়েছিলাম।

মাঝরাতে বুঝতে পরলাম কেউ ধীর পায়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে।
দেখি রাফিয়া একটা নীল রঙের পাতলা জর্জেট শাড়ি পরে আমার বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে রাফিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

  • কিরে এত রাতে তুই এই ঘরে কি করিস। কেউ দেখলে ঝামেলা হবে যা।
  • কেউ তো এইডা দেহে না আমি আপনেরে কত ভালাবাসি। তয় এইডা কেমনে দেকবো আমি এইহানে আইছি।
  • কি বললি তুই? তোর মাথা ঠিক আছে তো?
  • না। আমার মাতা ঠিক নাই। আমি পাগল অইয়্যা গেছি। যহনেত্তে ভালবাসা কি বুজজি। আপনেরে ভালবাসছি। আর আপনে তানজিনা ভাবীর লগে ভাগাইয়্যা বিয়া কইরালাছেন। আমার কতা ইট্টু(একটু) চিন্তা করলেন না।
    বলে রাফিয়া কাঁদতে লাগলো।
    কথাটা বলে আজুয়াদ থামলো হয়তো ভেবেছিলো তানজিনা কিছু বলবে কিন্তু তাজিনার পাথরের মতো স্থির দৃষ্টি নিয়ে বসেছিল।
    তাই সে আবার বলতে লাগলো।
    আমার কি হয়েছিলো জানি না।
    কিন্তু এক সাড়ে সতেরো বছর বয়সী নব্য যুবতীর পাতলা শাড়ির আড়ালে থাকা যৌবন এক মুহূর্তের জন্য আমাকে বাধ্য করলো তোমার কথা ভুলে যেতে।
    রাফিয়ার চোখের পানিতে সেইরাতে আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস ধুয়ে গেলো৷
    আমি দুহাতে রাফিয়ার ধবধবে ফর্সা কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে নিলাম।
    তারপর ওর ওষ্ঠদ্বয়কে গভীর চুম্বনে বার বার সিক্ত করে দিচ্ছিলাম।

তখনই রাফিয়ার দাদী চলে আসে।
উনি পানি খাওয়ার জন্য উঠেছিলো। আমাকে আর রাফিয়াকে ঐ অবস্থায় দেখে চিৎকার করে উঠে।
বাড়ির সবাই চলে আসে। আমার ঘোর কাটলে। নিজের ভুল বুঝতে পারি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সবাই নানান কথা বললো। রাফিয়াকে মারধর করলো।
পরদিন ভোরে আমি পালিয়ে বাঁচলাম।

ঘটনার অনেক দিন কেটে গেলো। মা- বাবা বা অন্যকেউ আমাকে কিছু না বলায় আমি সবটা ভুলে গিয়েছিলাম।
তারপর বাবা গতকাল হঠাৎ ফুপু বাড়ি দাওয়াত নিয়ে উনার সাথে যেতে বলে।
আমি ভাবলাম সবার কাছ থেকে মাফ চাওয়ার এর চাইতে ভাল সুযোগ আর পাবো না তাই সাথে গেলাম।
ঐ বাড়ি গিয়ে দেখি রাফিয়ার হলুদ। খুব খুশি হলাম এই ভেবে রাফিয়ার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু আজ সকালে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো। যখন বাবা বললেন রাফিয়ার বিয়ে আমার সাথে হচ্ছে।

  • বাবা এসব কি বলছেন। আমি রাফিয়াকে বিয়ে কেন করবো আমি বিবাহিত।
  • হেই জওয়াবডা(জবাবটা) আমি দেই আজু।
  • ফুআম্মা। আপনি!
  • হেইদিন রাইতে তর ঐ কান্ডের পর আমি মাইয়্যার বিয়া ঠিক করছিলাম। কিন্তু মাইয়্যা বিষ খাইলো।
  • কি। বিষ! কিন্তু কেন?
    মুখ বিকৃত করে তিনি বললেন।
  • বেবাকতা জাইনা ঢঙ করিস না আজু। রাফিয়া আমারে সব কইছে। তুই হের লগে দিনের পর দিন পেরেম করছোস। ঢাকা নিয়া হের লগে ছি! ছি! ছি!
  • ঢাকাতে আমি ওর সাথে কি করবো। আপনিইতো বলেছিলেন রাফিয়াকে নিয়ে ঘুরতে যেতে।
  • আমি বাইরে গুবার কতা কইছিলাম আমার মাইয়্যারে লইয়া তর বাসাত গিয়া লীলা খেলা করনের লাইগ্যা কই নাই।
  • ছি ফুআম্মা কি বলছেন এসব। আমি রাফিয়াকে নিয়ে আামার বাসায় কেন যাবো।
    বাবা বললো।
  • আমারে যহন বইনে কইল তর লাইগ্যা রাফিয়া বিয়া ভাইঙ্গা বিষ খাইছে। আমি এই বাইত আইলাম। ইতা(এসব) কতা মানতে আমি রাজি আছলাম না। কিন্তুক যহন মাঐমা(বোন/ভাইয়ের শ্বাশুড়ি) কইলো হেইলা কি দেখছে। শরমে আমার মাতা কাঠা গেল।
    আমি কতা দিলাম কলঙ্ক যহন তুই দিছোছ তুইঐ ঘুচাবি। রাফিয়ারে তুই বিয়া করবি৷
    আমি মাথা নিচু করে রইলাম।

ফুপু কেঁদে বলেছিল।

  • দেখ আজু। তোরে জোর করমু না। তয় একখান কতা মনে রাহিস এই বিয়া না অইলে আমি আর আমার মাইয়্যা গলায় কলসি বাইন্দা ডুইব্যা মরুম।
  • না বইনে(বোন) এই বিয়া অইবো। না অইলে খান বাড়িত আইজ আমজাদ খানের লাশ যাইবো। আজু ফয়সালা অহন তর বিয়া করবি কিনা।
    এসব বলা শেষে আজুয়াদ থেমে তানজিনার হাত ধরে বলে।
  • আমি কাউকে বুঝাতে পারলাম না যে রাফিয়ার সাথে আমার কিছু হয় নি। সে মিথ্যা বলেছে। তাই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হলো। বিশ্বাস করো তানু আমি শুধু তোমাকে ভালবাসি।
    তানজিনা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।
    তারপর কিটমিট করে বলে।
  • আমার এই মুহূর্তে কি ইচ্ছে করছে জানো। আজুয়াদ? বাইরে থেকে জুতা এনে ঠাস ঠাস করে তোমার দুই গালে মারতে। একজন তার মাথায় হাত দিয়ে কসম কাটিয়েছিল যে। শ্বশুর বাড়িতে যাই হোক আমি যেন বাবার বাড়ি ফিরে না যাই। তাই এখনো আছি। তা- না হলে অনেক আগেই তোমার সংসারের কপালে লাত্থি মেরে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম।
    অস্ফুটস্বরে আজুয়াদ বলে।
  • তানু! !
  • কি তানু? কিসের তানু? আমি ভাবছিলাম বাবা জোর করে তোমাকে বিয়ে করিয়েছে। আমি তো রাফিয়াকে আমার শত্রু ভাবছিলাম কিন্তু আমার প্রধান শত্রু তো তুমি। এখন ভালবাসার কথা বলছো। যখন সতের বছরের এক মেয়ের যৌবন দেখে সব ভুলে গিয়েছিলে। তখন কোথায় ছিলো এই ভালবাসা।
    অনুরোধ করে আজুয়াদ।
  • তানু। আমাকে মাফ করে দাও। ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে আমাকে অপমান করো না।
    চেঁচিয়ে তানজিনা বলে।
  • অপমান! মান- আপমান বোধ থাকলে রাফিয়ার সাথে এমন করতে? মেয়েটার এখানে কোন দোষ নেই। সে যাকে ভালবেসেছে তাকে সব উজাড় করে দিতে চেয়েছে। সেদিন ওর দাদী ঐ ঘটনা না দেখলে তুমি মেয়টার সাথে ছি! কি ভেবে এমন করেছিলে গাছের খাবে আবার তলারও কুড়াবে এমন কিছু?
    আচ্ছা একটা কথা বলো। একই ভুল আমি করলে মাফ করতে তুমি। যাকগে তোমার সাথে কথা বলতে আমার গা ঘিনঘিন করছে।

আজুয়াদ রেগে গেল। এবার গলারস্বর উঁচু করে বলে।

  • অনেক হয়েছে তানু। কখন থেকে মাফ চাইছি। বলছি ভুল হয়ে গেছে। তাছাড়া তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি রাফিয়ার কাছে যাই নি। সে নিজেকে সঁপে দিতে আমার কাছে এসেছিল। তাই দোষটা কিন্তু তার। আমার ভুল এটুকুই যে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি। একটু পিছলে গিয়েছিলাম। আর তুমি এই ছোট একটা ভুলের জন্য যা মুখে আসছে তা বলে অপমান করছো। ভুলে যেও না আমি তোমার স্বামী। আমাকে সম্মান করতে শেখো।
  • এই হল তোমার আসল চেহারা। আসলে তুমি আমাকে ভাল- টাল কিচ্ছু বাস না যদি বাসতে তাহলে এটাকে ছোট ভুল মনে হতো না। তোমার মতো চরিত্রহীন কাপুরুষকে স্বামী বলতে আমার আত্মসম্মানে লাগে।
    আজুয়াদ রাগ দেখিয়ে বলে।
  • তানু আমার ধৈর্য্যের একটা সীমা আছে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছ; যেন আমি চুরি। ডাকাতি বা খুনের মত জঘন্য কোন অপরাধ করেছি। আমি কালেমা পড়ে বিয়ে করেছি। তাছাড়া অনেকেই দুই বিয়ে করে। আর আমাকে তো বাধ্য করা হয়েছে বিয়েটা করতে।

এই যে। আমার ভালবাসা নিয়ে তুমি প্রশ্ন করছো। এখন আমি যদি প্রশ্ন করি তুমি আমাকে কেমন ভালবাস? যে সামান্য একটা ভুল মাফ করে রাফিয়াকে মেনে নিতে পারছো না।
তাচ্ছিল্য করে হাসলো তানজিনা।

  • এতক্ষণে তোমার মনের কথা বুঝতে পারলাম। তোমার রাফিয়াকে বিয়ে করার জন্য কোন আফসোস হচ্ছে না। এত নাটক শুধু আমি যাতে রাফিয়াকে মেনে নিই তাই।
    কথাগুলো বলে আজুয়াদ বুঝতে পারলো এইগুলো বলা তার উচিত হয় নি।
  • তানু। তুমি আবার আমাকে ভুল বুঝছো।
  • আমার যা বুঝার আমি বুঝে গেছি।
    এই কথা বলে তানজিনা দরজা খুলে দেখলো রাফিয়া কান্নাভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছে।
    তানজিনা রাফিয়ার দিকে এগিয়ে রাগী গলায় বলে বলে।
  • এই লোকটা আমার কেউ হয় না। তুমি ভেতরে যাও। আমার ভালবাসাতো সেদিনই মরে গেছে যেদিন বিবাহিত হয়েও সে তোমাকে ছুঁয়েছিলো।
    তাজিনা আর দাঁড়ায় না। দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দেয়।
    আজুয়াদ রাফিয়াকে বাহিরে রেখেই দরজা বন্ধ করে।

বাইরে রাফিয়া দরজা ধরে বসে পড়ে।
আর কাঁদতে কাঁদতে বলে।

  • আমি আপনেগো মইদ্দ্যে কুনদিন আইমু না। আমারে খালি হেই(সেই) রাইতের(রাতের) লাহান(মতো) এড্ডু কাছে টাইন্যা লইন।
    আজুয়াদ কথাটা শুনতে পেলো। ওর বুকের ভিতরটা একটু মোচড় দিয়ে উঠলো। সে বুঝতে পারলো না তার রাফিয়ার জন্য খারাপ লাগলো কি- না।

মধ্যে রাত। কাল বৈশাখী ঝড় উঠেছে।
রাফিয়া দরজা ধরে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে গেছে।
কিন্তু তানজিনার চোখে ঘুম নেই। বাতাসে জানালা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে সেজন্য জোরে জোর আওয়াজ হচ্ছে।
তানজিনা মনে মনে ভাবছে।

  • বাহিরের ঝড়তো থেমে যাবে কিন্তু যে ঝড় আমার জীবনে উঠেছে সেটা থামবে কিভাবে। কি করে মুক্তি পাবো এমন একটা বিয়ে থেকে যেখানে সতীনকাঁটা ফুটে আছে।
    বাইরে প্রচন্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোর ঝলকানিতে মাথার উপর স্থির ঝুলানো বৈদ্যুতিক পাখাটার উপর তানজিনার নজর পড়ে।
    ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল। ফজরের পর আকাশটা বেশ পরিষ্কার দেখা গেলো। ভোরের আলো কেবল ফুটছে।

এমন সময় সানজিদার চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে গেলো।

  • ও মা গো! কি সব্বনাশ অইলো গো।

পর্ব- ৫

  • ও মা গো! কি সব্বনাশ অইলো গো।
    সানজিদার চিৎকার শুনে সবাই বের হয়ে দেখে।
    ঝড়ে উঠানের বড় জলপাই গাছটা উপড়ে গিয়ে গোয়াল ঘরের উপর পড়েছে। এতে সাত মাসের গর্ভবতী লাল গাভীটা জিহ্বা বের করে মরে পড়ে আছে।
    সবার সাথে তানজিনা। রাফিয়া আর আজুয়াদও এলো।

সবার কষ্ট হচ্ছে। নিরীহ মৃত গরুর খোলা চোখ। পাষাণের চোখেও পানি এনে দিবে।

  • এইগুলান হইতাছে তুমার লাইগ্যা ছোড বউমা।
    তানজিনা অবাক হয়ে যায় শ্বাশুড়ির কথায়।
    তানজিনার হয়ে জবাবটা আজুয়াদ দেয়।
  • মা ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে তানু এলো কিভাবে?
  • নতুন বৌ হের লাইগ্যা কেওয়ার(দরজা) দইরা(ধরে) ঘুমাইলো। বাইত বালা কিছু অইবো কেমনে। অালিক্কী(অলক্ষী) একটা।
  • আম্মা বন্ধ করো। আমি নতুন বৌকে বাইরে রাখছি এতে তানুর। কি দোষ?
    আফিয়া বলে।
  • আপনের কানে এইসব মন্তর(মন্ত্র) তো ছোটভাবীই দিছে ছোড ভাই।
  • তা যা কইছো আফিয়া। বলি তানজিনা আফা অত বড় সব্বনাশটা না করলে তুমার শান্তি লাগতাছিন না। তাই- না?
    আজুয়াদ অনেক রেগে যায়।
  • আফিয়া আর একটা কথা বললে তোর হাড়- গোড় সব ভেঙে দিবো আমি। এই যে ভাবি আপনারে সাবধান করতেছি। তানুর সাথে এমন করে যদি আর কোনদিন কথা বলেন আমি আপনাকে দেখে নিবো। আমি এতদিন অনেক সহ্য করেছি আর না।
    অন্য সময় হলে তানজিনা খুশিতে গদগদ হয়ে যেত। কারণ আজুয়াদ তার পক্ষ নিয়ে বাড়ির সবার সাথে ঝগড়া করছে। কিন্তু আজকে আজুয়াদের এই আদিখ্যেতা দেখে তার মেজাজ খারাপ হলো।

তাছাড়া এই গাভীর নির্মম মৃত্যুটা সে মেনে নিতে পারছে না। এই বাড়িতে ঐ জীবটাইতো ছিলো যে নিরবে তার সব দুঃখের কথা শুনতো। তানজিনা গরুটার একটা নামও দিয়েছিলো সুখী। এটা নিয়ে এবাড়ির সবাই কত ঠাট্টা করেছে।
তানজিনার সবসময়ই মনে হতো খান বাড়ির মানুষগুলোর চেয়ে এখানকার হাঁস- মুরগি আর সুখী তাকে বেশি ভালবাসে। তাই এদের নিয়ে তানজিনার খান বাড়িতে একটা আলাদা সংসার তৈরি হয়েছিল। সেই সংসারের একজন আজ তাকে ছেড়ে চলে গেছে।

তানজিনার চোখ ভরে কান্না আসছে। কিন্তু এদের সামনে কাঁদলে এরা মজা পাবে। তাই ঘরে চলে গেল।
ঘরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাবতে লাগলো।

  • আমি যাকেই ভালবাসি সেই কেন আামাকে ছেড়ে দূরে চলে যায়? গতকাল সকালেও তো সব ঠিক ছিলো। আমার জীবনটা সুন্দর সাজানো ছিল। এই ঝড়ে কেন সুখী মারা গেলো? গাছটা আমার উপর কেন পড়লো না? একবার তো ভেবেছিলাম মরে যাবো কিন্তু আমি এত ভীতু যে মরার জন্য যেটুকু সাহস লাগে তাও আমার নেই।
    তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বলে।
  • আল্লাহ আমার জীবনটা কেন এমন হলো? তুমি আর কত কষ্ট দিবে আমায়?
  • না বেয়াইসাব এইডা অয়না। আমরা বাড়ির মাইয়্যা হত্তীনের ঘর করব না। আফনে জামাইয়ের নতুন বউ ছাড়ানির(তালাক) বাউ (ব্যবস্থা) করুইন।
    কথাটা বলছে তানজিনার বাবা।
    কাল রাতে সানজিদার কাছ থেকে সব শুনে আজ সকালেই তানজিনার বাপের বাড়ির লোকেরা খান বাড়িতে হাজির হয়েছে।
    তানজিনার বাবা জমির ভুঁইয়া আর চাচা কবির ভুঁইয়া আমজাদ খানের সাথে এসব নিয়েই তর্ক- বিতর্ক করছে।
    আর এদিকে তানজিনার মা সাবিহা বেগম তানজিনার ঘরে একান্তে বসে মেয়ের সাথে কথা বলছে।
    তিনি মেয়ের উপর ভীষণ রেগে আছেন।
  • কবে তুমি এত বড় হয়ে গেলে তানু যে। এত বড়ো একটা ঘটনা নিজের মাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করনি।
    তানজিনা একটু গম্ভীর আর ভারাক্রান্ত স্বরে বল।
  • সেইদিন আম্মু যেদিন তুমি আমাকে পর করে দিয়েছিলে। কসম দিয়েছিলে এ বাড়িতে যাই হোক না কেন। ঐ বাড়ি যেন ফিরে না যাই।
  • পিটিয়ে তোমার পিঠের চামড়া তুলে নেবো আমি। এমনিতে তো মায়ের কোন কথা শুন না সেদিন রাগের মাথায় একটা কথা বলেছি আর সেটা ধরে বসে আছো তুমি? কবে বুঝবে। তোমার চেয়ে দামী আমার কাছে এই দুনিয়ায় আর কিছু নেই।

তানজিনা মায়ের এই কথা শুনে আনন্দে কেঁদে দিলো।

  • আম্মু!
    সাবিহা বেগম মেয়েকে টেনে বুকে নিলেন।
    একটু ধীর গলায় বলতে লাগলেন।
  • যখন তুমি জন্মালে তখনই ঠিক করেছিলাম তোমার জীবনটা আমার মত হবে না। তুমি পড়বে। বড় চাকরি করবে। নিজের পায়ে দাঁড়বে। আর তুমি আজুয়াদের সাথে প্রেম করে সব নষ্ট করে দিলে। তোমার বাবা যখন তোমার বিয়ে ঠিক করে সেই বিয়ে ভাঙার জন্য আমি কি- না করেছি।
    মায়ের এই কথা শুনে অবাক হলো তানজিনা।
    মায়ের বুকে থেকে মুখ উঠিয়ে প্রশ্ন করে।
  • আম্মু এইসব কথা তো তুমি আগে কখনো বলো নি।
    সাবিহা বেগম একটু হাসলো।
  • তুমি কখনো জানতে চেয়েছো? দোষ তোমার না। আসলে যে নারীর স্বামী তাকে সম্মান করে না সেই মেয়ে শ্বশুর বাড়ির মানুষ কিংবা তার সন্তানদের কাছ থেকে সম্মান পায় না।
    তানজিনা অস্ফুটস্বরে বলে।
  • আম্মু!
  • কি হলো এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। তানু এমন না যে তোমার বাবা। আমি কালো বলে আমায় ভালবাসে না। তিনি আমাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু ভালবাসা আর সম্মান এক নয়। আর সেই জন্যই হয়তো তুমি কিংবা তোমার ভাই কেউই কোনদিন আমাকে সেই সম্মানটা দিতে পারনি যেটা পাওয়ার যোগ্য আমি।
    মুখভার করে তানজিনা বলে।
  • আম্মু। আমাকে কি মাফ করা যায় না?
  • পাগল মেয়ে এখানে মাফ চাওয়ার প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে? তোমরা দুইজন ছোটবেলা থেকে যা দেখেছো তাই শিখেছ। তোমার বাবা যদি আমাকে সম্মান দিতো তবে কখনো কারও সাহস হতো না আমাকে অপমান আর অসম্মান করার। কিন্তু তানু এখন এই বয়সে এসে বুঝতে পেরেছি যে ভুলটা আমার ছিলো।
    ততক্ষণ সংসারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো যতক্ষণ সেখানে তোমার সম্মান বজায় থাকে। যদি নিজের সম্মান নষ্ট করে কিছু মেনে নিতে হয় তবে থেমে যাও। কারণ সম্মান এমন একটা জিনিস যে। কেউ তোমাকে যেচে দিবে না তোমার আাদায় করে নিতে হবে। আমার ভুলটা কোথায় ছিলো জানো?
    আগ্রহ ভরে বাচ্চাদের মতো প্রশ্নটা করে।
  • কোথায় আম্মু?
  • তোমার নানার বাড়ির লোকের বরাবরই আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা ছিলো। কালো মেয়ের বিয়ে হবে কি করে? আমি ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছিলাম তখন তোমার দাদা আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ার কাছ থেকে আমার বাবার বাড়ির টাকা- পয়সার কথা শুনে আমাকে ঢাকায় দেখতে যায়। মোটা যৌতুকোর লোভে তোমার দাদা বিয়ে করাতে রাজি হয়ে যায়। আমার ডাক্তারি পড়া মাঝপথে থামিয়ে অজপাড়াগাঁয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হয়েছিল তোমার নানা। বাবার মুখে কন্যা বিদায়ের আনন্দ দেখে আমি নিজের স্বপ্নকে মেরে ফেলি। আর তোমার দাদার বাড়িতে প্রতি পদে পদে মানিয়ে নিতে নিতে একসময় নিজের আত্মসম্মানটা ভুলে যাই৷

কিন্তু তুমি জন্মানোর পর সেই স্বপ্নটা আবার দেখতে শুরু করি। তুমি পড়াশোনায় ভালো তাই আমার স্বপ্নটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে একটা ভাল জীবন দিতে। সেজন্য বাড়ির সবার বিরুদ্ধে লড়াই করে তোমাকে কলেজে পড়িয়েছি। কিন্তু আমার সব স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় যখন তুমি আজুয়াদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরো।
তারপর তাকে আবার বিয়েও করলে। তানু তুমি এমন একটা মানুষকে বিয়ে করেছো যে তোমার ভালবাসা আর ত্যাগের কোন মূল্যই দিতে জানে না।
অনেকক্ষণ মা- মেয়ে কোন কথা বলে নি। তারপর সাবিহা বেগম নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে।

  • তুমি কি এখনো এই নরকে থাকবে?
  • মা আমি। বলে তানজিনা হঠাৎ জ্ঞান হারায়।
    এঘটনা আগেও কয়েক বার ঘটেছে এ নিয়ে সাবিহা বেগম তানজিনাকে ডাক্তারও দেখিয়েছিলো। তাই তিনি বুঝলেন মেয়ে হয়তো কাল থেকে কিছু খায় নি। তাই শরীরে গ্লুকোজ কমে জ্ঞান হারিয়েছে।

উনি জগ থেকে একটু পানি নিয়ে তানজিনার মুখে দিলেন। তানজিনার জ্ঞান ফিরলো।
তারপর একটু পানি খাইয়ে দিয়ে বলেন।

  • কিছু না খেলে তো এমনই হবে। যে মানুষটা তোমাকে ঠকালো তার জন্য নিজেকে কেন শাস্তি দিচ্ছো তানু?
    দুর্বল গলায় তানজিনা বলে।
  • না। আম্মু খাবারের জন্য না। কিছুদিন হলো শরীরটা খুব দুর্বল আর খাবারগুলো গন্ধ লাগে। মাছ মাংস দেখলেই গা গোলায়।
    একথা শুনে সাবিহা বেগম মেয়েকে আরও কিছু প্রশ্ন করলো। যেগুলোর জবাব দিতে তানজিনা সংকোচবোধ করছিলো।
    তারপর বললো।
  • চলো
  • কোথায় আম্মু।
  • তুমি প্রশ্ন শুধু আমাকেই করতে জানো। বাকি সবার বেলায় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকো।
    তানজিনা আর কিছু বললো না চুপচাপ মায়ের সাথে গেলো।
    অন্যদিকে বসার ঘরে তুলকালাম চলছে। রেহানা খাতুন লম্বা ঘোমটার আড়ালে পায়ে- পা দিয়ে ঝগড়া করছে।
  • সোয়ামীরে বাইন্দা রাখবার না পারলে আমরা কিতা করুম? আপনেগো মাইয়্যারে বিয়া কইরা আমার আজুর জেবনডা (জীবন) শেষ অইয়্যা গেছে।
  • খোদারে এড্ডু ডরাইন বিয়াইন। আমার ভাইজির নামে অত বদনাম কইরেন না। আমনের (আপনার) ঘরেও একখান মাইয়্যা আছে।
  • আমার মাইয়্যার লগে আপনেগো ভাইগ্যা বিয়া করা মাইয়্যার তুলনা দিবাইন না।
  • আমার ভাইজিরে তো আপনের বাড়ির পোলায়ই ভাগাইছিলো।
    জমির ভুঁইয়া ছোট ভাইকে থামিয়ে বলে।
  • আহা! কবির থাম এলা। মাইয়্যা মাইনসের লগে তক্ক করস কিয়ের লাইগ্যা?
    আমজাদ খানও রেহানা বেগমকে চোখ রাঙিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।
  • আমার মাইয়্যা হত্তীনের ঘর করবো না বেয়াইসাব এইডা পথমেত্তে(প্রথম থেকে) আমি কইতাছি অহন আবার কইলাম।
    রেহানা বেগম স্বামীর চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে বলে উঠে।
  • তয় নিজেগো মাইয়্যারে লইয়্যা যান গা।

তখনই সাবিহা বেগম দরজা দিয়ে তানজিনাকে নিয়ে ভেতরে আসতে আসতে বলে।

  • নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো। এই নরকে তো আর নিজের মেয়েকে রেখে যাবো না আমি।
    এবার আমজাদ খান ক্ষেপে যায়। এতক্ষণ নিজের স্ত্রীর উপরতো রাগ হচ্ছিলোই তার উপর সাবিহা বেগমের কথা বলায় রাগ তার চরমে পৌঁছে গেল।
    পুরুষ মানুষের মধ্যে মেয়েদের কথা বলা আমজাদ খানের একদম পছন্দ না।
    মেয়েরা থাকবে ঘরের ভিতরে।
  • তাই নাহি আমরা বাড়ি নরহক। যান তাঅইলে অক্ষণ নিজের মাইয়্যা লইয়া বাইরোয়্যা যাইন।
    বলে গর্জে উঠে আমজাদ খান।
  • হ্যাঁ। নিয়ে যাচ্ছি।

বলে সাবিহা বেগম আজুয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়য়।

  • তুমি তালাকের কাগজ পেয়ে যাবে কিন্তু বাচ্চাটা হওয়ার পর। কারণ গর্ভাবস্থায় তালাক হয় না।
    এক মুহূর্তে পুরো ঘরে নিরবতা ছেয়ে যায়।
    আজুয়াদ নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে।
  • বাচ্চা মানে?
  • তানজিনা সন্তান সম্ভাবা।
    তানজিনা নিজের মায়ের মুখ হতে এই কথা শুনে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়। সে এখন ঐ প্রশ্নগুলোর মানে খুঁজে পায়।
  • এইডা কি হাছানি আবরারের মা?
    রাগী গলায় স্ত্রীকে ধমকে উঠে আমজাদ খান।
  • আমি কেমনে কমু? তয় কয়দিন দইরা দেকতাছি ছোড বউমার পোয়াতি অওয়ার লক্কন।
    আমজাদ খানসহ সবাই বুঝতে পারে তানজিনা মা হতে চলছে।
  • তাঅইলে অহন ছোড বউমার আর কুনোহানে যাওন অইবো না।
  • তাহলে বেয়াই সাহেব। আপনি আপনার ছেলে আর নতুন বউয়ের তালাকের ব্যবস্থা করুন।
    সাবিহা বেগমের কথায় জমির আর কবির ভুঁইয়া সায় দেয়।
    কোন মতেই তাদের মানাতে না পেরে নিরুপায় হয়ে আমজাদ খান বলে।
  • ঠিক আছে। আজু রাফিয়ারে তালাক দিবো। তয় আমার একখান শত্ত আছে?
  • কি শর্ত
  • আপনের মাইয়্যার পোলা পয়দা করুন লাগবো।
    একটু অবাক হয়ে সাবিহা বেগম প্রশ্ন করে।
  • আর যদি মেয়ে হয়।
  • তয় হের যা খুশি করবো। তয় আজু আর রাফিয়ার তালাক অইবো না। যদদিন ছোড বউমার আইবোদ(বাচ্চা) না অইব তদদিন রাফিয়া এ বাইত থাকবো। হের পর পোলা না মাইয়্যা হেইডা দেইক্যা তালাক অইবো।
    ভুঁইয়া বাড়ির সবাই ভাবছে কি করবে।
    তখনই তানজিনা বলে।
  • আম্মু এই সিদ্ধান্তটা আমি নেই?

পর্ব – ৬

  • আম্মু এই সিদ্ধান্তটা আমি নেই?
    মেয়ের কথায় সাবিহা বেগম একটুও অবাক হয় না।
  • জীবনটা তোমার তানু। তাই তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তবে এইবার আর ভুল করো না।
    তানজিনা মুচকি হেসে বলে।
  • সেটা তো সময় বলে দিবে আম্মু। এইতো পাঁচ মিনিট আগেও আমি তোমার কথামত নতুন একটা জীবনের স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু নিয়তি আবার তার খেলা দেখালো। যখন আমি একা ছিলাম আমার সিদ্ধান্ত একরকম ছিল। কিন্তু এখন আমার সাথে আরেকটা জীবন জড়িয়ে আছে। তাই তাড়াহুড়ো করে আমি কিছু করতে চাই না।
  • কি করতে চাও তুমি?
  • বলছি তার আগে আমি আব্বুর সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আম্মু তুমি খুব খেয়াল করে শুনবে কথাগুলো।
    তারপর তানজিনা নিজের বাবাকে বলে।
  • আব্বু আজুয়াদ আমাকে তালাক দিলে তুমি কি সারাজীবন আমাকে আর আমার বাচ্চাকে তোমার বাড়িতে থাকতে দিবে। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা না হয় আমি নিজেই করে নিবো।

তানজিনা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তাকে থামিয়ে পাশ থেকে আজুয়াদ বলে উঠে।

  • আমার দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ তোমাকে আমি তালাক দিবো না।
  • আমি আমার বাবার সাথে কথা বলছি। তুমি একটু চুপ থাকো না হয় বাইরে চলে যাও৷
    বলে আজুয়াদকে ধমক দেয়। তানজিনার ধমক শুনে আজুয়াদ চুপ হয়ে যায়।
  • যা বলছিলাম আব্বু তুমি বলো। তুমি কি আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে। আমাকে কেউ কোন দিন বাপের বাড়ি থাকার জন্য খোটা দিবে না বা সেখানে কখনো আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে বাধ্য করা হবে না। বাবা আবেগী হয়ে আমি আবার ভুল করতে চাই না। তাই তুমিও সত্যটা বলো কোন লুকোচুরি না।
    জমির ভুঁইয়া নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো। তার সেই ছোট্ট অবুঝ কল্পনা বিলাসী মেয়েটা আজ কত বাস্তববাদী হয়ে গেছে।
  • তুই সারা জেবন এলহা থাকতে চাছ? এমনে কি জেবন চলে?
  • আব্বু কথা ঘুরিয়ো না। সরাসরি উত্তর দাও।
  • না এইডা ত অয় না। এক বস্সর। দুই বস্সর না অয় মাইনা নিলাম। বাদে? বাদে কি অইব? মাইনসে কি কইবো?
  • আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি।
    বলে সে তার মায়ের কাছে যায়।
  • আম্মু। তোমার মেয়েকে নিয়ে তুমি যতই স্বপ্ন দেখো না কেন আমাদের এই সমাজটা এখনো একটা মেয়েকে স্বপ্নপূরণের পুরোপুরি অধিকার দেয় নি।
    আম্মু আমরা মেয়েরা যতই শিক্ষিত আর প্রতিষ্ঠিত হই না কেন আমাদের পাশে স্বামী নামক একটা সাইনবোর্ড লাগে। নাহলে এই সমাজ আমাদের একঘরে করে দেয়। এখন তোমার সাথে গেলে তাই হবে যা বাবা বললো। প্রথম প্রথম মানুষ সহানুভূতি দেখাবে পরে আবার তারাই আমার নামে কুৎসা রটনা করবে। আমার সন্তানকে বলবে তোর মা কলঙ্কিনী তাই স্বামীর ঘর করতে পারে নি।

আর আবার বিয়ে করলেই যে সেই বাড়িতে সম্মান পাবো তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? তারা যদি আমার সন্তানকে মেনে না নেয় তখন। মা আমি বলছি না সবাই খারাপ। কিন্তু আম্মু আমি ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘেও ভয় পাই। তাই আবার বিয়ে করে নতুন কাউকে নিয়ে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সাবিহা বেগম বলে।

  • বুঝতে পারলাম তোমার কথা কিন্তু তুমি কি করতে চাও একটু খুলে বলো।
  • মা আমি আজুয়াদকে ক্ষমা করবো কি- না সেটা আমার বাচ্চা জন্মের পর ঠিক করবো। আমিও দেখি ছেলে না মেয়ে? আল্লাহ কি চায়? আমি আজুয়াদের সাথে থাকি। না ওর থেকে আলাদা হই। তাছাড়া তুমিই তো বললে গর্ভে সন্তান থাকলে তালাক হয় না। তবে আম্মু একটা কথা মনে রেখো। সতীনের সাথে এক সংসারে তোমার মেয়ে থাকবে না। কিন্তু আজুয়াদের সাথে আমি থাকবো কি- না সেটা আল্লাহর হাতে।

সাবিহা বেগম কিছু বলবেন তার আগেই তানজিনা আবার বলে।

  • আম্মু আর একটু বাকি আছে। বাবা আপনার সাথে কিছু কথা আছে।
    আমজাদ খান একটু নড়েচড়ে বসে বলে।
  • কি কইবা কও।
  • বাবা রাফিয়ার সাথে আমি এক বাড়িতে থাকবো না। কিন্তু আপনি তো বলে দিলেন যে। রাফিয়া এই বাড়িতেই থাকবে।
  • তয় তুমি কি কয়ডা মাসের লাইগ্যা বাপের বাইত যাইবার চাও।
  • না বাবা। সেখানে যাওয়ার হলে আব্বুকে বলতাম। আপনাকে না।
  • তয় কই যাইবার চাও?
  • আব্বা আমি এই কয় মাসের জন্য পুরাতন বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাই আপনি ব্যবস্থা করুন।
    আমজাদ খান চমকে গেল। কারণ কোন মেয়ে যে পাকা দালানের ঘর ছেড়ে জীর্ণ- শীর্ণ ভাঙা টিনের বাড়িতে থাকার কথা ভাবতে পারে সেটা তার জানা ছিলো না।
    রেহানা খাতুন এ কথা শুনে গরম তেলে দেওয়া কই মাছের মতো টগবগ করে ফুটে উঠে।
  • বলি আক্কেল জ্ঞিয়ান কিচ্ছু আছে নি তোমার। পেট লইয়া পুরান বিডাত(ভিট) যাইবার কিতা কও। মাইনসের লগে মুক দেহাইতে পারুম?
  • মা আমি কথাটা বাবাকে বলেছি। আর মুখ না দেখাতে না পারার কি আছে? আপনার ছেলের বউ চলে যাচ্ছে না শুধু অন্য বাড়ি থাকছে তাও আবার আপনাদেরই৷কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন দুই সতীনের ঝগড়া হবে তাই আপনারাই পাঠিয়ে দিয়েছেন। মিটে গেলো।
    আমজাদ খান স্ত্রীকে চোখ রাঙিয়ে বলে।
  • হারামজাদি। বেত্তমিজ মাইয়্যা মানু কুমবালাত্তে (অনেকক্ষণ) কইতাছি চুপ কর। হুনে নি আমার কতা। এইবার মুক খুললে তরে পোলার হউর বাড়ির মাইনসের সামনে ছেঁছুম(মার দিবো)।
    এবার রেহানা খাতুন ভয় পেয়ে চুপসে গেল ।
  • ছোড বউমা তুমি কও। হেইহানে তুমারে দকবো কেডা?
  • বাবা আজকে এক মুহূর্তের জন্য আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে বলুন এই বাড়িতে আমাকে দেখার মত কে আছে? এত অন্যায় অবিচারের মধ্যে কি আমি ভালভাবে বাচ্চার জন্ম দিতে পারবো? আপনি বলুন আপনারা কখনো কি আমার সাথে দুটো ভালো কথা বলেছেন? সেখানে গেলে অন্তত এইসব মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো৷
    আমজাদ খানের জীবনে প্রথমবার তানজিনার জন্য খারাপ লাগলো। সত্যিতো মেয়েটা এ বাড়িতে শুধু অত্যাচার সহ্য করে গেছে। সবার সব কাজ করেছে।
  • ঠিক আছে। তয় এলহা এলহা পুরান বিডাত তুমারে দেই কেমনে কও দেহি?
    আজুয়াদ বলে।
  • আব্বা আমি সাথে যাবো।
  • তুই কেমনে যাবি? পরের সাপ্তা থেইক্যা তোর অপিস যাওন লাগবো। তাই আমি কই কি ছোড বউমা তুমি বাপের বাড়িতে যুদি যাইতে চাও যাইতে পারো।
  • না বাবা। আমি পুরানো বাড়িতেই যেতে চাই। আমি জামালের মা’কে বলবো আমার সাথে থাকতে। সে এমনিতেও দুধের ছেলেটাকে নিয়ে খাবারের কষ্ট করে। জামালের বাবা মারা যাওয়ার পর দু’বেলা খাবারের আশায় দেবর – ভাসুরের সংসারে চাকরানীর মতো খাটে। আমার সাথে থাকলে তো সেটা করতে হবে না।
    আমজাদ খান দেখলেন এটা সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি এতে মানসম্মান আর নিজের ভাগ্নীর সংসার দুটোই বেঁচে যায়।
  • আইচ্চা তয় আমি বেবাক বাউ করি।
  • বাবা। আরেকটা আবদার। আমার ঐ বাড়িতে সময় কাটবে না তাই যদি কিছু বই নিয়ে যেতে দিতেন।
  • হ নিবা। পোয়াতি থাইক্যা বই পললে আমার নাতি বিদ্যা লইয়া জম্ম নিবো। তয় আমার রাইত লইয়া ডর। ভাঙ্গা টিনের ছাড়ফা (বেড়া)।
  • বাবা আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। জামালের মা থাকবে তো। আর আপনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবার ঘুরে আসবেন।
    আর আপনি কি এত ভাবছেন বলুন তো। খান বাড়ির বউয়ের দিকে কে নজর দিবে? এমন সাহস কারও আছে।
  • এইডা অক্করে খাঁডি কতা কইছো তুমি।

আবারো মা- মেয়ে একান্তে।
তানজিনা মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে।

  • আমার উপর আবার তোমার অনেক রাগ হচ্ছে তাই না আম্মু?
    মেয়েকে ছাড়িয়ে সাবিহা বেগম বলে।
  • সত্যি বলতে। তোমার উপর একটু আগে অনেক রাগ হয়েছিলো। কিন্তু এখন ভেবে দেখছি তুমি ঠিক বলেছো।
    তানু। তুমি তখন অনেক ছোট। তোমার বাবা আর আমার মধ্যে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আমাকে খুব মেরেছিলেন। আমার অনেক রাগ হয়েছিলো। আমি তোমাকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। প্রথম দুই তিন দিন সব ঠিক ছিলো।
    এরপর থেকে শুরু হলো সবার কথা। তোর স্বামী কোথায়? কবে আসবে?
    একদিন তোমার নানা ডেকে বলে।

তিনি তোমার বাবাকে খবর পাঠিয়েছে আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি যেন তার সাথে ফিরে যাই। যদি তা- না করি তাহলে যেন আমি তোমার বাবাকে তালাক দিয়ে দেই৷ আর তোমাকে তোমার বাবার সাথে পাঠিয়ে দেই। কারণ তার কথা ছিলো তালাক প্রাপ্ত কালো মেয়েকে কেউ হয়তো বিয়ে করবে। কিন্তু বাচ্চা থাকলে তা প্রায় অসম্ভব ।

  • এরপর?
  • আমার পক্ষে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারা সম্ভব ছিলো না বলে তোমার বাবার সাথে ফেরত চলে এলাম। তিনি সবার সামনে কথা দিয়েছিলেন আর কখনো আমার গায়ে হাত তুলবেন না। কিন্তু কি বলোতো। কিছু পুরুষ মানুষ হয় কুকুরের লেজের মতো কখনো সোজা হয় না। তিনি আবার একই কাজ করেছিলেন। তবুও আমি বাবার বাড়ি যাই নি। কারণ বাবার বাড়ি গেলে আবার সেই এক ঘটনা ঘটতো।
    তাই মার খেয়েও সংসার করে যাচ্ছি। তোমার বাবা আমাকে খুব বেশি মারতেন না কিন্তু একটা দুটো থাপ্পড়ই যথেষ্ট ছিলো আমার ভেতরটা ভেঙে দেওয়ার জন্য। এমনকি তোমাদের সামনেও কত মার খেয়েছি। সেই জন্য হয়তো তোমারও আমাকে কখনো সেভাবে মূল্য দাও নি।
  • আম্মু
  • জানোতো তোমার নানাকে প্রশ্ন করেছিলাম।
    আমি তার মেয়ে আমার কি কোন হক নেই? কেন ঐ বাড়িতে আমি সারাজীবন থাকতে পারি না। তিনি জবাব দিয়েছিলো। হক ততক্ষণ পাবো যতক্ষণ সাথে স্বামী নিয়ে যাবো। অথবা সব অতীত মুছে দিয়ে ফেরত যাবো।

আমি বুঝতে পারছি। যে কথা আমি বাবার বাড়িতে দু’দিন থেকে বুঝেছিলাম সেটা তুমি এখন বুঝে গেছো।

তবে তোমাকে একটা কথা বলি। যা- ই হোক আমাকে লুকিয়ে যেও না। আমি হয়তো তোমাকে ঐ বাড়িতে সবসময়ের জন্য রাখতে পারবো না কিন্তু তোমার লড়াইয়ের সাথী হতে পারবো। নিজেকে কোনদিন একা মনে করবে না। মনে রাখবে তোমার মা তোমার মা তোমার সাথে সবসময় আছে।
ভুঁইয়া বাড়ির লোকজন চলে গেলো।

কিছুদিন পর রাফিয়া আর আজুয়াদের বৌভাত হয়।
এরপরই তানজিনা খানদের পুরানো বাড়িতে উঠে যায়।
আজুয়াদ ঢাকা চলে যায়।
একমাস পর পর শুক্রবারে আজুয়াদ আসে তানজিনার কাছে। তানজিনার সাথে তার শুধু কুশলাদি বিনিময় হয়।

তখন তানজিনার সাতমাস চলে। তার নানা কিছু খেতে মন চায়।
তানজিনার শ্বশুর প্রতিদিন একবার এসে খোঁজ নিয়ে পরদিন বাজার পাঠিয়ে দেয়। ইদানিং তিনি তানজিনাকে খুব সমীহ করে।
বাইরে চুলায় গরুর মাংস রান্না করছে জামালের মা। জামাল উঠানে আতাগাছটির নিচে মাটি নিয়ে খেলছে।
তানজিনার খুব মিষ্টি কুমড়া দিয়ে গরুর মাংস খেতে মন চাইছিলো। তাই এ রান্না।

মাংসের গন্ধ নাকে পৌঁছাতেই ঘর থেকে একটা বই নিয়ে এসে উঠানে বসে তানজিনা।
সে কপালকুণ্ডলা পড়ছিলো।
হঠাৎ আজুয়াদ এসে দাঁড়ায়।
তানজিনা কেবল বইয়ের এই লাইনটা পড়েছে।
যেখানে কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে বলছে।

  • পথিক। তুমি পথ হারাইয়াছ?

আজুয়াদকে দেখে তানজিনার তাই মনে হলো সে পথ হারিয়েছ৷
জামালের মা ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷

  • বাইজান আমনে বিতরে গিয়া বহেন। আমি শরবত কইরা আনি৷
    তানজিনা ধীরে ধীরে উঠে ঘরে চলে যায়। আজুয়াদও যায়।
  • তানু তুমি ভালো আছো?
  • তোমার বাড়ি থেকে অনেক বেশি। তা হঠাৎ কি মনে করে?
  • কেন আমিতো এখানে আসি।
  • সেটা মাসের প্রথম শুক্রবারে আজ তো মঙ্গলবার আবার মাসের শুরুও নয়।
  • জমির একটা মামলা ছিলো। তার হাজিরা দিতে এসেছি ভাবলাম তোমাকে দেখে যাই।
  • ভালো করেছো। খেয়ে যেও। কিন্তু তুমি তো মিষ্টি কুমড়া খাও না। আমি জামালের মাকে বলে আসি একটু তরকারি আলাদা করে রাখতে।
  • থাক না। একদিন খেলে কিছু হবে না। তুমি বসো।
  • যা অপছন্দ তার জন্য জীবনের একমুহূর্তও ব্যয় করা উচিত না। তাতে বিরক্তি বাড়ে।
    বলে তানজিনা চলে যায়।
    এই কয় মাস আজুয়াদ তানজিনাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছে। যদি মেয়ে হয় তবে সে কি করবে? কিন্তু আজকেও জিজ্ঞেস করতে পারে নি।
    এভাবে আরও দুই মাস কেটে যায়।

একদিন ফজরের সময় জামালের মায়ের চিৎকার শুনা যায়।

  • ওরে কেউ আছুননি? ছুড়াইয়া(জলদি) বাইর অইন নাইলে সব্বনাশ অইয়া যাইবো।
    চিৎকার শুনে খান বাড়ির সবাই বের হয়ে উঠানে আসে।
    রেহানা খাতুন বিরক্ত হয়ে বলে।
  • কি লা? এমনে চিল্লাছ কেন জামাইল্যার মা? কেউ মরছে নি।
    বিলাপ করে জামালের মা বলে।
  • আল্লা বিবিসাব ইতা কিতা কইন? ভাবীর বেদনা উঠছে। ছুড়াইয়া কিছু করুইন।
    রেহানা খাতুন মুখ বিকৃত করে।
  • উঁহ! খুব এলহা থাহুনের সক উতলাইয়া উঠছিন অহন।
    আমজাদ খান স্ত্রীকে উদ্দশ্য করে বলে।
  • হারামজাদি তরে মনডায় চাইতাছে কিযে করাবার লাইগ্যা। কিন্তুক অহন সময় নাই৷ জামাইল্যার মা তুই যা দৌড়াইয়্যা গিয়া দাই আর ঐ বাড়ির করিম মুন্সির বউরে ডাইক্যা লইয়া আয়। আর তোমরা হগ্গলতে লও পুরান বাইত যাওন লাগবো।
    জামালের মা চলে যায় দাই ডাকতে।
    রেহানা খাতুন মুখ বাঁকিয়ে বলে।
  • হেন কি মেমানি নাহি? যে হগ্গলতের যাওন লাগবো। লও তুমার লগে আমি যাই আর হেরা বাইত থাহুক। আফিয়া তুই বেইল(দিন) উঠলে মুরগীডি ছাইড়া খাওন দেইছ।
    সানজিদা বলে।
  • কইছিলাম কি আম্মা এমুন সময় আমি না থাকলে মাইনসে নিন্দা করবো। লাক কতার এক কতা। হেয় তো আমার বইন।
  • অঁহ! আইছে বইন। এই সাতমাসে একবার বইনের মুকও দেহ নাই। অহন ঢং কইরো না।
    আমজাদ খান খেঁকিয়ে উঠে।
  • তুমরা কি এহানে খারাইয়্যা তামশাই করবা নাকি। যাইবাও।
  • আরে তুমার ছোড বউমা মইরা যাইতো না। আইবোদ আমারও অইছে লও যাই।
    তারা তিনজন যাচ্ছিলো তখন রাফিয়া এসে বলে।
  • আব্বা আমিও লগে যামু। দেহি আমার কপালো কি লেহা আছে।

কেউ কিছু বলতে পারলো না। কারণ আজ সত্যি সবাই দেখতে চায় ওদের কপালে কি লেখা আছে।
চারজন মিলে পুরনো বাড়ি গেলো।
আমজাদ খান বাইরে অস্থির পায়চারি করতে লাগলো।

ভেতর থেকে রেহনা খাতুন আর দাই বের হয়ে এলো।
একরাশ আশঙ্কা নিয়ে রেহানা খাতুন বলে।

  • আবরারের আব্বা হুনেন। ছোড বউয়ের অবিস্তা তো বেশি বালা না।
    আমজাদ খান তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে।
  • কি কও এইগুলান তুমি।
    দাই একটু বিলাপের সুরে বলে।
  • হরে আমজাত। আইজ চল্লিশ বস্সর আমি দাইয়ের কাম করি এমুন দেহি নাই। যা খুশি অইবার পারে৷ তুই হেরে এড্ডা ডাক্তরের বারাত লইয়া যা।
    আমজাদ খান কথাটা শুনে দমে যায়। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলে।
  • আপনের আতে গেরামের বেবাকতের আইবোদ অইছে আজুর বউয়েরটাও অইবো।
    এই গেরামে বেবাক ডাক্তর বেডা। খান বাড়ির বউরে বেগানা(পর) পুরুষ মাইনসে আত লাগাইবো আমি আমজাদ খান বাঁইচ্যা থাকতে হেইডা অইবো না।
    দাই যেন একটু রেগে যায়।
  • তয় কেউ মরলে আমারে দুশ দিছ না। মাও মরতারে। বাইচ্চাও।
    বলে দাই ভিতরে গেলো। পিছন পিছন রেহানা খাতুন।
    রাফিয়া উঠানে আতাফল গাছটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে।
    আর সানজিদা ভেতরে তানজিনার পাশে বসে মনে মনে দোয়া করছে যেন মেয়ে হয়। না হলে যেন বাচ্চাটা মারা হয়। কারণ খান বাড়ির প্রথম ছেলের জন্ম সে দিতে চায়।
    পূর্বাকাশে নতুন সূর্য রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে।

তখন আমজাদ খান ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। কিন্তু আওয়াজটা একবারই হয় তারপর থেমে যায়।
রাফিয়ার বুকের ভিতরটা ধুকপুক শুরু করে।
আমজাদ খান দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসে না।
আমজাদ খানের মনে ভয় ঢুকে যায়।
তিনি মনে মনে বলে।

  • তয় কি কুনো বদ (খারাপ) খব্ব র(খবর)?

পর্ব ৭ (অন্তিম)

সদ্য জন্মানো একটা শিশু মারা গেলো।

আমজাদ খান বাকরূদ্ধ। নিজেকে বার বার সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছে। তবুও তার মনের এক কোণে একটা খটকা লাগছে তখন যদি দাইয়ের কথা শুনে তানজিনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতো তবে কি বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতো।
ভেতর থেকে বিলাপের স্বর ভেসে আসছে।

তানজিনা ঠুকরে ঠুকরে নিজের বাচ্চার লাশ ধরে কাঁদছে।
এত যন্ত্রণার পর জন্ম দেওয়া সন্তান। যখন আধ ঘন্টার মধ্যেই মারা যায় তখন একজন মায়ের কান্না ছাড়া আর কি- ই- বা করার থাকতে পারে?
আমজাদ খান নিজের মায়ের কবরের কাছে চলে গেলেন।

বড় কাঁঠাল গাছের নিচে বাঁধানো উঁচু কবরটা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সবার চোখে পড়ে। জীবনে যেকোন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমজাদ খান একান্তে মায়ের কবরের পাশে কিছু সময় কাটান।
আজকেও সেজন্যই এসেছেন।
কিছুক্ষণ পর

আমজাদ খান ফিরে যায়।

পুরোনো খান বাড়ি।

আঁতুড় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমজাদ খান গলা ঝাড়া দেয়।

  • আমি এড্ডু বিতরে আইতাম। বউমার গতরের(শরীরের) কাপড় ঠিক করো।
    রেহানা বেগম। রাফিয়া। সানজিদা সবাই সেখানেই ছিলো। তারা বুঝলো আমজাদ খান বাচ্চার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়ে তানজিনাকে তাড়ানোর জন্য আসছে।
    তাই সব ঠিকঠাক করে আমজদ খানকে ভেতরে ডাকলো রেহানা বেগম।

ভেতরে গিয়ে তিনি দেখলেন তানজিনা মরা বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে আছে।

  • বাইচ্চাডারে কব্বর দেওন লাগবো। সব কাম শেষে ছোড বউমা লও(চলো) বাইত যাওন লাগবো। বাড়িডা তুমারে ছাড়া খাঁ খাঁ করতাছে।
    পাশ থেকে খেঁকিয়ে উঠে রেহানা খাতুন।
  • তুমার মাতা ঠিক আছে নি? এই আলীক্কীরে(অলক্ষী) আবার ঘরে নিবা। আরে তুমার নাতি মইরা গেছে।
    বংশের পত্থম বাত্তি নিইব্বা(নিভে) গেছে এইডার লাইগ্যা।
  • কতা কম কও আবরারের মা। আমি যা কইছি তাই অইবো। আজু আইলে রাফিয়ার লগে হের তালাকের কামডা সাইরা ফালামু।
    তানজিনা এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পায়। সে আমজাদ খানের কথা শুনে চমকে উঠে।
    ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
  • বাবা আমি তো আপনাকে নাতি দিতে পারি নি। সে তো জন্মের পরই চলে গেলো তাহলে?
    শক্ত হয়ে আজম খান বলে।
  • বৌমা আমারে তুমি নাতি দিতে পার নাই ঠিকঐ। তয় আমি যে অত দিন বাদে আমার মায়ের দেহা পাইছি।
  • বাবা!
  • বৌমা আমার মায় যহন মরে আমি খুব ছোড। বইনে অইতে গিয়া মায় মইরা গেল। মায়ের মুকখান ছাড়া অহন আর কিছু তেমুন দিশ(মনে) করবার পারি না।
    তহন অত ডাক্তর বদ্যি আছিল না তাই আমার মায় বাঁচে নাই৷ আইজ সব থাইক্যাও আমার নাতি বাঁচে নাই। হের কারণ আমার জিদ। আমি পাপী তাই পাশ্চিতির করুম। হের আগে তুমি মাফ করো আমারে।
  • বাবা এরকম বলে আমাকে আর কষ্ট দিবেন না।
  • তয় আমার মায়রে লইয়া বাইত চলো যাই।
    বলে তানজিনার পাশে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয় আমজাদ খান।
    হ্যাঁ তানজিনার জমজ বাচ্চা হয়। ছেলেটি আঁতুড়েই মারা গেছে।

সবাই অবাক হয়। একটা মেয়েকে আমজাদ খান এভাবে আদর করে মেনে নিবে তা সবার কল্পনাতীত ছিলো।

  • জানো ছোড বউমা। দাই যহন হেরে দেহাইতে আমার বারাত(কাছে) নিল আমি মনে মনে কইতাছিলাম মাইয়্যার মুক দেইকা কি করুম বংশের বাত্তিঐ যহন নিইব্বা গেলো।
    কিন্তুক দাইয়ে কতায় একবার চাইয়া দেহি এইডা অক্করে তুমার মাইয়্যার মুক অক্করে আমার মায়ের মুহের(চেহারা) লাহান। তুমি আমার মায়েরে ফিরত দিছ। তুমি যা চাইবা তাই অইবো। চলো।

আমজাদ খানের মুখের উপর কথা বলার সাহস কারও নেই। তাই বাচ্চার দাফনের পর অগত্যা সবাই তানজিনাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো৷

দুদিন পর আজুয়াদ ফিরে এলো। সে মেয়েকে দেখে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেল। আবার ছেলের জন্য দুঃখও পেলো।
আজুয়াদ যখন বাবার সিদ্ধান্ত জানলো খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো।

আজ আমজাদ খান তার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো যে কালকেই রাফিয়াকে তিনি বাপের বাড়ি রেখে আসবেন।
রাতে তানজিনা মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলো। হঠাৎ মেয়ে জেগে ওঠলে তারও ঘুম ভেঙে যায়৷ মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে খেয়াল করে আজুয়াদ ঘরে নেই।
শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও আজুয়াদকে খুজতে বের হয়। সব কয়টা ঘরে খুঁজে। একবার নিজের মনের সন্দেহ দূর করার জন্য রাফিয়ার ঘরেও দেখে। কিন্তু পায় না। রাফিয়ার ঘর দেখে মনে হলো রাফিয়া কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে।

পরক্ষণেই মনে হলো। হয়তো সিগারেট পান করতে বাড়ির পেছনে গেছে। তানজিনা মনে মনে খুশি হলো যে আজুয়াদ তার কথা শুনে এখনও ঘরে সিগারট খায় না আজুয়াদকে তার কিছু বলার ছিলো। তাই মেয়েকে খাইয়ে চারপাশে বালিশ দিয়ে দরজা লাগিয়ে বাড়ির পেছন দিকে যায়৷

খান বাড়ির পিছনদিকটা হাসনাহেনা ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়ে আছে।
তানজিনা গিয়ে দেখে রাফিয়া আজুয়াদের পায়ে ধরে কান্না করছে। তানজিনা বুঝতে পারে মেয়েটা আবার একটা তালগোল পাকাবে। তাই একটু জোরে হেঁটে কাছে যায়।

  • সারা জেবন আপনেগো দুইজনের বান্দি গিরি খাটুম। তাও আমারে খেদাইবেন না।

তানজিনার খুব মেজাজ খারাপ হলো। সিদ্ধান্ত নিল এবার এই মেয়েকে উচিৎ শিক্ষা দিবে। চুলের মুঠি ধরে এ বাড়ি থেকে বের করবে। কিন্তু কিছু একটা শুনে থেমে যায়।

  • আপনে যুদি অহন আমারে ছাইড়া দেন আমার পেডের বাইচ্চার কি অইবো।
    তানজিনার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।
    না আর কোন ভনিতা নয়।
    সে সোজাসুজি গিয়ে আজুয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে।
  • এই মেয়েটার পেটে তোমার বাচ্চা? সত্যি কথা বলো।

আজুয়াদ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে বলে।

  • হ্যাঁ।
  • কেন করলে এটা। তুমি মিথ্যে বলছো না তো? তুমি তো এই মেয়েটাকে কখনো মেনে নিতে পারো নি।
  • তানু এতে তোমারও দোষ আছে। এই কয়মাস আমাকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দাও নি। তোমার কাছে গেলে দূর দূর করেছো। আমি ঢাকা থেকে এসে কতবার তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম প্রতিবার তুমি আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলে। তুমি কেন বুঝ না। আমারও তো একটা চাহিদা আছে। তুমি চিন্তা করো না আমি রাফিয়াকে…
    না আর কোন কথা শুনলো না তানজিনা। ধীর পায়ে সেখান থেকে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছে আর শরৎ বাবুর বলা দুটো লাইন ভাবছে।
  • যাহার ভালবাসা পাইয়াছি বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছি। সেইখানে ভুল ভাঙিয়া যাওয়াটাই নিদারুণ।
    আজ তানজিনার ভুল ভেঙেছে।

আমজাদ খানের দরজায় তানজিনা জোরে জোরে কড়া নেড়ে ডাকছে।
মাঝরাতে তানজিনার গলা শুনে আমজাদ খান ভয় পেয়ে যায়। মনের মধ্যে কুডাকে। একবার মনে হয় মেয়েটার আবার কিছু হলো না তো।
তারপর দরজা খুলতেই তানজিনা কাঁদতে কাঁদতে দরজা ধরে নিচে বসে পড়ে।

২৭ বছর পর….

সময়ের স্রোতে আমজাদ খান। তানজিনার মা। বাবা। চাচা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও বাকি সবাই রয়ে যায়।

খান বাড়ি।
খান বাড়ির এখন আর আগের মতো সমৃদ্ধশালী নেই।
হাসনাহেনা গাছটা মরে গেছে।

বাড়ির দালানগুলোতে শেওলা জমেছে। ছাউনির টিনগুলোতে জং পড়েছে। কাঠের দরজা- জানালাগুলোতে ঘুন ধরেছে।
খান বাড়ির উঠোন।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া রেহানা খাতুন ময়ালা আধা সেলাই করা একটা কাপড় পড়ে। ময়লা ফেটে যাওয়া একটা বাসন নিয়ে রান্না ঘরের সামনে বসে আছে। সে এখন লাঠি ভর দিয়ে হাঁটে।

রেহানা খাতুনের আগের তেজ এখন নেই। এখন তাকে দেখলে যে কারও অন্তর কেঁপে উঠবে।
একটা মলিন হাসি দিয়ে করুন সুরে আবদার করে।

  • আমারে দুইলা(অল্প) বাত(ভাত) দিবা? সহালেত্তে(সকাল) কিচ্ছু খাইতে দেও নাই অহন বিহাল(বিকেল) অইয়্যা গেছে। পেডর(পেটে) ভুক(খুদা) লাগজে।
    সামনে থাকা মহিলাটি দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দেয়।
  • বুড়ি খালি বাত কেরে? আমারেও খা। তর জামাই জমিদারি থুইয়্যা গেছে। এড্ডু পরে পরে খালি কয় পেডর ভুক লাগজে। অত খাছ যায় কই? কামের বেলা তো খুইজ্যা পাই না।
  • রাফিয়া আম্মারে এমনে কইয়্যো না।
    গরুকে খড় দিতে দিতে সানজিদা কথাটা বলে।
  • এহ আইছে আরেক আলীক্কী(অলক্ষী)। বান্জা(বাঁজা) মাইয়া মানু। তর খাওনঢা তুই বুড়িরে দিলেই পারস। নিজের সোয়ামীরে খাইয়্যাঅতো পরান জুরায় নাই। অহনতো আমার সংসারে বইয়্যা বইয়্যা খাস।

ভেতর থেকে আজুয়াদদের গলা শুনা যায়।

  • রাফিয়া মুখ বন্ধ করো। ওদের ওরকম করে বলো না। টাকাতো আমার খেতের ধান থেকেই আসে।
  • ওরে গোলামের- গরের- গোলাম(গালি বিশেষ)। আমারে টেহার খুঁডা দেছ তুই। খেতে কাম করে কেডা? আমার পোলায়। ক্ষেমতা নাই উট্টা বইবার তক্ক করে। তর কপালো উঁস্টা মারি।

আর কতদূর (কতটুকু) খেত আছে তর? তর বাপে তো বেবাকতা তর বড় বউরে দিয়া গেছে। বাহি(বাকি) যদ্দূর(যতটুকু) আছিন তর বইনের বিয়ার সম বেইচ্যা হেরে দিছে। তাও যুদি তর বইনে বালামত ঘর সংসার করবার পারত। দুইদিন বাদে বাদে জামাইয়ের কেচ্যা(মাইর)খাইয়্যা আমার বাইত আইয়্যা উঢে। আমার মুক খুলাইবি না।
আর আমার লগে বাড়াবাড়ি করলে আইজ তর
গু- মুত সাফ করতাম না। এমনেঐ পইরা থাকবি।

আজুয়াদ চুপ হয়ে যায়। কারণ আজ সে এমন অবস্থানে পড়ে আছে যেখানে থেকে রাফিয়াকে কিছু বলা তার পক্ষে অসম্ভব। সে এটাও জানে রাফিয়া মিথ্যা বলছে কারণ আমজাদ খান তানজিনাকে পুরাতন ভিট আর ভিটের সামনের এক বিঘা জমি ছাড়া কিছুই লিখে দেয় নি।

দশ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আবরার মারা যায় আর আজুয়াদের কোমড় ভেঙে যায়। তখনই আজুয়াদের চাকরিটা চলে যায়। চার বছর আগে আমজাদ খান মারা যায়। তখন থেকেই পুুরো পরিবারের কর্তী হয় রাফিয়া।

সানজিদা তার বাবার বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সেখানে কেউ তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ দেখায় নি। তাই বাধ্য হয়ে এখন খান বাড়িতে রাফিয়ার কাজের লোকের মতো থাকে।

  • আম্মা।
    বলে ডাক দেয় রাফিয়ার একমাত্র ছেলে রফিক।
  • আব্বা আইছো? দেহো তুমার লাইগ্যা মুরোগ রাইন্দা কহনেত্তে বইয়্যা আছি। যাপ মুক- আত দুইয়্যা আইয়্যো।
    হাত মুখ ধুয়ে রফিক খেতে বসে। সে মুরগীর রানের টুকরো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে আর বাইরে থেকে রেহানা খাতুন আর সানজিদা খালি পেটে অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে।
    এতে তাদের দুজনের লজ্জা বা রাগ কিছুই হচ্ছে না।

দৃশ্যটা ঘরে শুয়ে থেকে দেখছে আজুয়াদ। আর নিরবে চোখের পানি ফেলছে।
এটা এ বাড়ির নিত্য ঘটনা। রাফিয়া নিজের খেয়াল খুশিমতো এদের দুজনকে খাবার দেয়।

খান বাড়ির পুরোনো ভিটায় এখন একটা পাকা দালান উঠছে।
সেই বাড়ি বাইরে বড় একটা মুরগির খামার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খামারে পাশের পুকুরের কিছু মাছ লাফাচ্ছে।
এসব কিছুর মালকিনই তানজিনা। সেদিন রাতে আজুয়াদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সে চিরদিনের মতো ঐ বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসে ওঠে। আমজাদ খান সব জানতে পেরে দুইটি জায়গা তানজিনাকে লিখে দেয়।

সাবিহা বেগমের গয়না বিক্রির টাকা দিয়ে জামালের মাকে সাথে নিয়ে একটা ছোট মুরগির খামার শুরু করেছিলো। সেখান থেকে লাভের টাকা জমিয়ে এই ভিটায় পাকা দালান তুলেছে। খামারটা বড় করেছে। আবার এখন একটা পুকুরও কেটেছে।

সন্ধ্যার পর….

বাড়ির প্রধান ফটক ধরে এক যুবক বাজার হাতে ভেতরে যাচ্ছে।
উঠানে লেবু গাছটায় নতুন ফুল ফুটেছে।

সেখানে দাঁড়িয়েই সে আওয়াজ দেয়।

  • খালাম্মা ও খালাম্মা। খাদিজা।
    তানজিনা বের হয়ে দেখে যুবকটি ব্যাগ ভর্তি বাজার আর চার- পাঁচ কেজি ওজনের একটা রুইমাছ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
  • আরে জামাল কি হইছে? এতো বাজার দিয়ে কি হবে? তোর মাথা ঠিক আছে।
  • হ আমার মাতা ঠিক আছে। এই যে আইজকার আন্ডা(ডিম) বেচার টেহা। আরে এই খাদিজা কই গেলা তুমি? বাইরে আহ।
    বলে অনেকগুলো টাকা তানজিনার হাতে দেয়।

ভেতর থেকে ছয়- সাত মাসের গর্ভবতী এক মহিলা বের হয়ে বলে।

  • আমি এহানেই। কও কি কইবা।
  • এই বাজারগুলান ঘরে নেও। এই মাছডা কাইট্টা আগে ফিরিজ রাহো। বড় একটা দেশি মুরগও আছে। কাইল পোলাও। গোশত আর মাছর মাতা দিয়া মুরিঘন্ড রানবা। আর মাছের পেডিঢি কড়া কইরা ভাজবা।
  • পুস্কুনিত অতো মাছ থাকতে বাজারত্তন মাছ কেরে আনলা যে।
  • পুস্কুনির মাছ ছুডু। বইনের জন্মদিবসো ছুডো মাছ কেমনে খাওয়াই? এর লাইগ্যা মুন্সি বাড়ির পুস্কুনীত্তে জালোরে(জেলে) দিয়া বড় মাছ ধরাইয়্যা আনলাম। কাইল সহাল সহাল রাইন্দো।

খাদিজা হলো জামালের স্ত্রী। জামালের মা কখনোই তানজিনাকে ছেড়ে যায় নি। সেই সুবাদে মায়ের মৃত্যুর পরও জামাল তানজিনার কাছে থেকে যায়। খাদিজাকে তানজিনাই পছন্দ করে বিয়ে করায়৷

  • যাক এ বাড়িতে কারও অন্তত মনে আছে কাল আমার জন্মদিন। নাহলে মানুষ (তানজিনাকে উদ্দেশ্য করে) জানতো আমার বিয়ে ভেঙে গেছে সেই নিয়ে চিন্তা করছে আর মরাকান্না কাঁদছে।

ভেতর থেকে বের হতে হতে কথাগুলো বললো তানজিনার মেয়ে তারিন।

  • বইন এইড্ডা তুমি কি কতা কইলা? তুমার জম্মদিবস আমি ভুইল্যা যামু এইডা অয়।
    তানজিনা একটু রেগে বলে।
  • তাই বলে এতো বাজার। আর তুই ভুলে যাস কেন খাদিজা গর্ভবতী এত কাজ করা তার পক্ষে কষ্টের।
    জামাল কিছু বলার আগেই খাদিজা বলে।
  • খালাম্মা। আপনে এত চিন্তা করুইন না। আমিতো খালি রানদি। আর বেবাক ভারি কাম তো আপনে আর আপনের পোলায়ই করেন। ডাক্তরেও কইছে এড্ডু গতর খাঢাইতে এইডা পেডের বাইচ্চার লাইগ্যা বালা। আপনেরা তো কুনো কামঐ করবার দেন না।
  • কিন্তু তোরা যার জন্য এত কাজ করবি। সে দেখ কেমন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বলি সে আমাদের কোন কাজে কোনদিন সাহায্য করেছে?
    জামাল একটু রেগে গিয়ে বলে।
  • খালাম্মা এইতা কি কতা কইন। আমার বইনে অইল রাইজকইন্যা। খাদিজা কাম না করবার পারলে। বেবাক কাম আমি করুম। তাও আমার বইনেরে কুনো কাম করবার দিমু না।
  • তুমি থামোতো। খালাম্মা। আমার লাহান এতিম এই বাইত আইয়া মা পাইছি। বইন পাইছি। বড় বইন বাইচ্যা থাকতে ছোড বইন কাম করবো এইডা অয়?
  • তোরা দুইজন লাই দিয়েই তারিনকে মাথায় তুলেছিস। নাহলে পাত্র পক্ষের সামনে এভাবে কথা বলে।
  • এনার সাথে কথা বলে লাভ নেই সারাদিন মাথায় বিয়ে ঘুরে। চলো ভাবী বাজারগুলো আমাকে দাও নিয়ে যাই। দুজনে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিই। আজকে আমি আমার ভাতিজিকে শেক্সপিয়ার পড়ে শুনাবো।

তারিন ভেতরে যাচ্ছিলো তখন তানজিনা বলে।

  • জন্মদিনে একবার বাবার সাথে দেখা করবে না?
    এবার তারিন ক্ষেপে যায়।
  • দাদা যেদিন মারা গেছে সেইদিন ঐ বাড়ির সাথে আমার সব সম্পর্ক মুছে গেছে। ঐ বাড়ির লোকের প্রতি তোমার দয়া থাকলেও আমার নেই। আমি তো এটাই বুঝতে পারি না এত বছরেও তুমি ঐ লোকটার কাছ থেকে তালাক কেন নাও নি।
    তারিন খাদিজাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো।

তানজিনা মেয়েকে কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু মনে মনে বললো।

  • তুই বুঝবি নারে মা। কারণ তোকে আমি আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে আলাদা করে গড়ে তুলেছি। তোর বাবাকে তালাক দেওয়া মাত্রই আমার গায়ে তালাকপ্রাপ্ত মহিলা হওয়ার পোস্টার লেগে যেতো। তখন চারপাশ থেকে কিছু পুরুষ শকুনের মতো আমার উপর নজর দিতে। কিছু মহিলা আমার নামে কুৎসা রটনায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো। তখন সমাজ আমাকে একঘরে করে দিতো। আর তোকে নিয়ে আমি এই সমাজে বাঁচতে পারতাম না। তারচেয়ে একজনের নাম সাথে জড়িয়ে যদি একটু ভালভাবে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারি তাহলে ক্ষতি কি।
  • খালাম্মা।

জামালের ডাকে ধ্যান ভাঙে তানজিনার।

  • হ্যাঁ। বল।
    একটু অভিযোগের স্বরে জামাল বলে।
  • খালাম্মা আপনে বইনের উপরে রাগ করেন কেন? বইনে কত বড় চারহি করে। আমাগো গেরামে কলেজো ইংরাজি পড়ায়। যহন ডাক্তরে কইলো আমার মাইয়্যা অইবে তহন ঐ ঠিক করছি আমার মাতায় কুনোদিন লেহা- পড়া ঢুহে নাই তয় কি অইছে? আমার মাইয়্যারে বইনের মতো শিক্ষিত বানামু।
  • তোরা বুঝতে পারবি না জামাল আমার কষ্টটা কোথায়৷ মেয়েতো আমার হীরের টুকরো কিন্তু জহুরি যে পাই না। এতো বয়স হয়ে গেছে এখনো বিয়ে হয় নি। নানান লোকে নানান কথা বলে। মরার আগে মেয়ের স্বামী – সংসার দেখে যেতে পারবো কি- না কে জানে।
  • খালাম্মা আল্লায় যেদিন চাইবো হেইদিন সব অইবো।
  • আর কবে? কতগুলো বিয়ে তো সব ঠিকঠাক হওয়ার পর ভেঙে গেলো।
  • খালাম্মা হেইডাতো রফিক্যা করছে। হেই বাড়ির হেরা জ্বলে। আমনের বালা চায় না। এর লাইগ্যা ঐত্তো যত্তবার বইনের বিয়ার পাক্কা কতা অইছে রফিক্যা পোলার বাইত গিয়া উল্ডা- পাল্ডা কতা কইয়া বিয়া বাঙানি(ভেঙে) দিছে। আর বাকিগুলান তো বইনেই বাঙছে কারণ পোলারা টেহা(টাকা) চাইছে।
    জামাল চলে গেলো।

রাফিয়ার কারণে আজও তানজিনার জীবনের সুখ বিঘ্নিত। নিজের ছেলেকে দিয়ে বার বার রাফিয়া তানজিনার ক্ষতি করেছে৷
কখনো পুকুরে বিষ দিয়েছে। কখনো ফসলের ক্ষেত আগুন লাগিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে বার বার তারিনের বিয়ে ভেঙে দিয়ে।
সতীনকাঁটা এখনো তানজিনার জীবনে ফুটে আছে।

তানজিনা একটু বির বির করে বলে।

  • মা তুমি বেঁচে থাকলে দেখতে এই সমাজটা আজও বদলায় নি। মেয়েরা যতই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক না কেন। তাদের পাশে স্বামী নামের একটা সাইনবোর্ডের প্রয়োজন হয়।
    রাতে তারিনের আওয়াজ শুনা যায়।
    তানজিনা উঁকি দিয়ে দেখে। তারিন খাদিজাকে পড়ে শুনাচ্ছে।
    Blow। blow the winter wind
    Thou(you) are not so unkind

As man’s ingratitude
তানজিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে যায়।
সে ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে।
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত।

তানজিনা খেয়াল করে। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলোর আওয়াজ অন্ধকারটা ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর করে তুলছে।

লেখিকা – নুশরাত মনিষা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “সতীনকাঁটা – দুই সতীনের লড়াই” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – নীল ডাইরিতে – ব্রেকআপের পর কিছু কথা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *