রঙে রঙিন – Family Love Story

পনের বছর পর, ঠিক পনের বছর পরে সেই পাত্রের সাথেই আমার বিয়ে হলো, অলি আফসার। এটা এক আশ্চর্য বিষয় সবার কাছে তো বটেই, আমার কাছে আরো বেশি আশ্চর্যের! বসে বসে ভাবছি বিয়েটা করা কি আসলেই ঠিক হলো? কত জনের কটুক্তি, বক্র চাহনি উপেক্ষা করে আমি কি পারবো সংসার করতে?

আমার চুলে পাক ধরেছে, আগের মতো চঞ্চলা হরিণীর মতো ছুটে বেড়াতে পারি না, শরীর জানান দেয়, ‘তুমি পঁয়তাল্লিশের মধ্য বয়ষ্কা’ কিন্তু এত কিছুর পরেও আমার মনটা যে সেই তরুণীর মতোই আছে! আসলে আমাদের মনের বয়স বাড়ে না বরং আমরাই শরীরের সাথে সাথে বৃদ্ধ করে ফেলি মনটাকে। একটা বয়সের পরে ভালোবাসতে, ভালো লাগাতে দেই না, মনের দুয়ারকে বন্ধ করে রাখি।

এই বয়সে নতুন বৌয়ের সাজে বসে থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন এক সদ্য তরুণী নববধূ। আমার মুখটা কি লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে? অলি আফসার এসে আমার ঘোমটা তুলবে এই আশায় বসে থাকা কি আমাকে মানায়? আচ্ছা তাঁকে আমি কি নামে ডাকবো এখন, অলি নাকি আফসার, নাকি ওগো, হ্যাগো এই বলে? ওগো, হ্যাগো কি হাস্যকর , এইভাবে তাঁকে ডাকছি, ভাবতেই আমার হাসি পেলো।
অলির বয়স বায়ান্ন। বয়সের তুলনায় তাঁকে তরুণ দেখায় আর চুল পেকেছেও কম। আচ্ছা তাঁর পাশে আমাকে মানাবে তো?
অলি রুমে ঢুকলে আমি সত্যিই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম, হার্টবিট মিস হলো।

আমার হাতটা নিয়ে তার হাতের মুঠোয় ভরে, আমার কাছ থেকে কথা নিলো, আমৃত্যু দুজন একসাথে থাকবো।
মাস তিনেক আগে অলির সাথে আমার আবার দেখা, পনের বছর পরে। স্কুলের অনুষ্ঠানে আমরা সব টিচার একই কালারের শাড়ি পরবো, বেগুনী কালারের কিন্তু মনের মতো একটা শাড়িও পাচ্ছিলাম না। খুব বিরক্ত লাগছিলো। মার্কেটের প্রায় সব শাড়ির দোকান দেখা শেষ। হঠাৎ পাশ থেকে একজন বলে উঠলো,
–আরে তুমি ঝিরিন না?
আমি তাকালাম কিন্তু চিনতে পারলাম না।

আমার তাকানো দেখেই বুঝতে পারলো, চিনতে পারিনি।
সে নিজে থেকেই বললো-
–আমি অলি আফসার। চিনতে পেরেছ?
নামটা আমাকে যেন একটা ঝাটকা দিলো। হঠাৎ কারেন্টে শক লাগার মতো। অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে তাঁর, কিভাবে চিনবো? পনের বছর তো আর কম সময় নয়?সে যে আমার মনে আছে পনের বছর আগের মতোই।
–চিনতে পেরেছি।

আমার ফিনফিনে কণ্ঠ শুনে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি শাড়ির কথা ভুলে গেলাম। তার দিকে চেয়ে সেই লুকানো অভিমান যেন মাথা বের করে উঁকি দিতে চাইলো। তাঁর প্রতি এই অভিমান আমাকে কাঁটার মতো খুব খোঁচা দিতো প্রথম প্রথম খুব বেশি, এর পরে সময়ের সাথে সাথে কমে এলেও একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি।
সে বললো-
–শাড়ি কিনতে এসেছ?
–হুম।
আমার হঠাৎ মনে হলো সে হয়তো তাঁর বৌয়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছে। মুহূর্তেই আমার পৃথিবী যেন মেঘে ঢেকে গেলো। কষ্ট, কষ্ট আর কষ্টে। আমার কেন কষ্ট হচ্ছে, আমার কি কষ্ট পাওয়া উচিত?
–অনেক্ষণ ধরে তোমাকে দেখছিলাম।এখানে তো তোমার পছন্দের শাড়ি পেলে না, অন্য কোথাও দেখবে? চল তাহলে?
আশ্চর্য,এত স্বাভাবিক ভাবে সে কথা বলছে, মনে হয় দুইদিন আগেও দেখা হয়েছে!

আমার যেন স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আমি যন্ত্রচালিতের মতো তার পাশে চলতে থাকলাম। সে হঠাৎ থেমে বললো-
–তোমার একটু সময় হবে?
–কেন?
–একটু বসে কথা বলতাম, তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে।
মনে মনে না না করলেও ‘ হু’ উচ্চারণ করলাম।আসলে আমি জানতে চাইছিলাম তাঁর বৌ, বাচ্চা সব কিছুর সম্পর্কে। নিজেই অবাক হলাম তার সাথে কফি শপে বসে পড়েছি! আসলে আমার অবচেতন মন কেন জানি সরতে চাইছে না।
সে বললো –

–একা একাই শপিং করা হয়?
–বেশির ভাগ সময় একাই আসি।
–হ্যাসবেন্ড কি করে, অনেক ব্যস্ত বুঝি, সাথে আসতে পারে না?
আমি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালাম তাঁর দিকে?
সে থতমত খেয়ে বলল-
–কেন অন্যায় কিছু বললাম?
–আমি বিয়ে করিনি, হ্যাসবেন্ড আসবে কোত্থেকে?
সে অবাক চোখে তাকালো। সে বললো-
–কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে তখন নতুন ভাড়াটে ছিলো, ওরাই বলেছিলো এখানে যে থাকতো , কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে তাই অন্য কোথাও চলে গেছে। আমি ভেবেছি তোমারই বিয়ে হয়েছে।
–আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়েছিলো তখন।

সে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে রইলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম-
–আপনি একা এলেন যে? বৌয়ের জন্য বুঝি সারপ্রাইজ গিফট কিনতে এসেছেন?
সে তার স্বভাবসুলভ ভুবন ভোলানো হাসি দিলো।
যা মুহূর্তেই কাউকে শান্ত করে দিতে পারে। যেমন জ্বলন্ত কাঠে পানি ফেলে দেয়া।
–আমিও বিয়ে করিনি। আসলে আর হয়ে উঠেনি।
আপত্তি না থাকলে মোবাইল নাম্বারটা দেয়া যাবে তোমার?

–আপত্তি আছে। আমাদের যোগাযোগ হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
সে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেটা মুহূর্তের জন্য। আবার হেসে বললো-
–আমার প্রতি তোমার রাগ, তোমার অভিমান দেখে খুব ভালো লাগছে ঝিরিন। কাছে না থাকলেও অধিকারটা ঠিকই আছে।
আমি উঠতে চাইলে বললো-
–তোমার শাড়ি কিন্তু কেনা হলো না। চল আরেকটু খুঁজি। আমার বোনের মেয়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছি। ভাগ্নির শ্বশুর বাড়িতে যাবো। ভাবলাম ওর জন্য একটা শাড়ি কিনি কিন্তু কেমন শাড়ি কিনবো বুঝতে পারছি না , তুমি একটু হেল্প করবে?
আমি উঠে পড়লাম।
সে আমার পথ আগলে দাঁড়ালো।

–ঝিরিন প্লিজ ক্ষমা করো, সেই দিন মায়ের মুখের উপর কিছুই বলতে পারিনি।
পনের বছর আগে, ঘটকের মাধ্যমে পারিবারিক ভাবেই আমাদের বিয়ে ঠিক হয়।এর পরে ওর সাথে রোজ ফোনে কথা হতো,কত স্বপ্নের কথা, আগামীর কথা, কত শত কথা! আসলে আমি ওর কলের অপেক্ষায় থাকতাম, গোপনেই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো।

বিয়ের ছয়দিন আগে হঠাৎ অলির আম্মা বেঁকে বসেন, ওনার ভাষ্যমতে, মেয়ের বয়সটা একটু বেশি হয়ে যায়। ত্রিশের পরে বাচ্চা কাচ্চা নিলেও তো অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তাঁর ছেলের বয়স সম্পর্কে বলেছিলো, ছেলেদের বয়স কোন ব্যাপার না কিন্তু মেয়েদের বয়স অনেক বড় বিষয়।

আমি দেখতে ভালোই, শিক্ষিত, পারিবারিক অবস্থাও ভালোই তবুও বিয়ে হচ্ছিলো না, আসলে সব দিক মিলিয়ে , মিলছিলো না। অলি আমাকে আর আমি তাকে পছন্দ করায় বিয়েটা ফাইনাল হয়েছিলো।
অবশেষে এতদূর এগিয়েও আমাদের বিয়ে ভেঙে যায় অলির মায়ের জন্য।
এর পরে অবশ্য আমার বিয়ের অনেক চেষ্টা চলেছে। বিয়ের কথা বললেই অসম্ভব রাগ উঠে যেতো। এক সময় সবাই হাল ছেড়ে দিলো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাকি জীবন একাই কাটাবো। আমার স্কুলের চাকরি নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাতে লাগলাম।

অলি আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করেনি, আমিও না। আমার আত্মসম্মানে খুব লেগেছিলো। ওর মায়ের প্রতি একটা ক্ষোভ কাজ করতো। একটা মানুষের সংসারের সূচনা লগ্নেই ধ্বংস করে দিয়েছিলো আর আমার কষ্টকর একা থাকার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভেসে বেড়াতো। যদিও আমি ভাবতাম সব কিছুই আল্লাহ তাআলার হাতে, নিজের ছেলের ভালোর চিন্তা করেই তিনি এমনটা করেছেন কিন্তু মাঝে মাঝে মন খুব অস্থির হয়ে যেতো কোন যুক্তি তখন আর কিছুতেই খাটতো না।

অলি আবার বললো-
–ঝিরিন এত বছর পর যখন তোমার দেখা পেয়েছি তখন আমার কথাগুলো তোমাকে শুনতে হবে। আমার মনে যে বোঝা এতদিন থেকে চেপে আছে সেটা নামাতে চাই প্লিজ।
এর পরে বসলাম।
–ঝিরিন তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাই তো অনেক মেয়ে দেখানোর পরেও ইচ্ছে হয়নি বিয়ে করতে। তোমাকেই খুঁজতাম। আম্মা যখন এই সত্য অনুধাবন করলেন, আমাকে পাঠালেন তোমার খোঁজে।
এর পরে তো ভুল সংবাদ শুনে, এখন পর্যন্ত এই আমাকে যেমন দেখছ তেমন আছি।

আম্মা যত দিন বেঁচে ছিলেন নিজেকে খুব অপরাধী ভাবতেন আমার ছন্নছাড়া জীবনের জন্য। আসলে সব কিছুই আমাদের নিয়তি।
আমি ভেবেছি বিয়ে করে স্বামী সন্তানদের নিয়ে সুখে আছ তুমি।

আমার আর কিছু বলার ছিলো না। শুধু চেয়েছিলাম দুচোখ মেলে, কখন যেন ঝাপসা হয়ে উঠেলো তা।
আমাদের আবার কথা শুরু হলো, দেখা শুরু হলো। দুজনেই কিশোর কিশোরীদের মতো পরিচিত জনদের এড়িয়ে দেখা করি, স্ক্রিনে তার নাম ভেসে উঠলে সবার সামনে লজ্জায় পড়ে যাই, আড়াল করতে চেষ্টা করি। চিন্তা চেতনায় সব কিছুতেই যেন সে বসে গেল আসন পেতে।
সে যখন বিয়ের কথা বললো।

আমি বললাম –
–আমাদের এই বয়সে এসে বিয়ে করাটা ছেলেমানুসি হয়ে যাবে, মানুষ কি ভাববে?
সে হো হো করে হেসে উঠেছিলো। বলেছিলো-
–”হোক না ছেলেমানুসি, হোক না যা ইচ্ছে তাই,
বন্ধ হবে না আর কিছুতেই হৃদয়ের এই দুয়ার।”
তাঁর এই প্রাণ খোলা হাসিটাই আমার হৃদয়ে ঝড় তুলে সব সময়।

আমার ধারণাই ঠিক হলো। অনেকে অনেক কথা বলতে লাগলো। এমন কি ওর বোন আমার ভাই বললো, ‘এই বয়সে বিয়ে করে কি হবে?’
তারা কি কখনো আমাদের একাকিত্ব বুঝতে পেরেছে?
যখন কাজে থাকি, সবার সাথে থাকি সময় কেটে যেতো। সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত, সংসার নিয়ে ভাই বোনেরা ব্যস্ত, কলিগ, বন্ধু সবাই ব্যস্ত। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার জন্য কারো কাছে একটুকু সময় নেই, একটা মনের কথা শেয়ার করার মতো একান্ত কেউ নেই।
এখন আমার অলি হলো। আমি তাঁর হলাম।

আমরা বাইরে বের হলে একই কালারের পোশাক পড়তে চেষ্টা করি, আইসক্রিম খাই, হাওয়াই মিঠাই খাই, এক গ্লাসে দুই স্ট্র দিয়ে কোল্ড কফি খাই, আনন্দে নেচে উঠি অনেকে টিটকারী দেয় , ‘দেখ বুড়ো বয়সে ভীমরতি।’
নিকটবর্তী অনেকে, দূরের বেশিরভাগ, অপরিচিত সবাই বলে- কি ঢং, ‘এই বয়সে এমন কেউ করে?’
আমরা গায়ে মাখি না, দেখেও দেখি না। যে সময় চলে গেছে যাক না, যা এখন আছে যে টুকু সামনে আছে তাকেই সব রঙে রাঙিয়ে তুলবো না কেন?

(সমাপ্ত)
(একটা সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে লেখা গল্প)

রঙে রঙিন
-ফাহমিদা লাইজু

Read more: স্ত্রীর বাইক – Shami Strir Valobasha

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *