বীণার চোখ হঠাৎ আটকে যায় রাস্তার পাশের ফুচকার দোকানটাতে। তার প্রাক্তন স্বামী এক মেয়েকে নিয়ে ফুচকা খাচ্ছে। একটি প্লেটে ফুচকা নিয়ে তার স্বামী খুব সযত্নে মেয়েটিকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি কিছু একটা হাত নেড়ে নেড়ে বলছে আর ফারুক অর্থাৎ বীণার প্রাক্তন স্বামী হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। দৃশ্যটা আপাতঃ দৃষ্টিতে খুব রোমান্টিক হলেও, বীণার চোখ নোনা জলে ভিজে উঠতে লাগলো।
বীণা ধানমন্ডির এই ক্যাফেতে প্রায়ই অফিস শেষে এসে এক মগ কফি নিয়ে বসে। নিজের সাথে নিজে কিছুটা সময় কাটায়। মন বেশ হালকা লাগে তখন।কিন্তু আজ মনে বাষ্প জমছে। বীণা মেয়েটিকে ভালভাবে দেখবে বলে চেয়ার বদলালো।
ফারুকের পাশে বসা মেয়েটি ফারুকের বর্তমান স্ত্রী। ফারুকের মা বাবাই ছবি পাঠিয়েছিল বীণাকে।দেখতে বেশ সুশ্রী নয়। তবুও ফারুকতো সুখি বর্তমানকে নিয়েই।
বীণা ছিল ফারুকের থেকে আট বছরের ছোট । ফারুকের পাশে বসা নারী ফারুকের সমবয়সী মনে হচ্ছে। কি মুগ্ধতা নিয়ে দুজন দুজনকে দেখছে। বীণা তার ব্যাগ থেকে ছোট আয়নায় নিজেকে দেখে নিল ।এখনও তার সৌন্দর্য একই আছে। নিজের দিকে তাকিয়ে আবার ফারুকের পাশে বসা মেয়েটিকে দেখতেই কেমন বিষন্ন লাগলো বীণার।
বীণা গোলাপী ফর্সা,ছিপছিপে গড়নের ,মাঝারি উচ্চতার মেয়ে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও স্যারদের হৃদয়ের কম্পন ছিল সে এক সময়। খুব চুপচাপ শান্ত ভদ্র হওয়ায় চোখের ভাষা বুঝলেও কারও মুখে প্রেম নিবেদনের অভিজ্ঞতা নেই বীণার। এছাড়া বীণার বাবা মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোন শিক্ষিত ,ভদ্র স্বচ্ছল ছেলে পেলে বীণার বিয়ে দিয়ে দিবেন। বীণা কখনোই বাবা মায়ের অবাধ্য নয়। তাই অনার্স থার্ড ইয়ারে উঠতেই বীণার বিয়ে হয়ে গেল বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে জব করা ফারুকের সাথে।
ফারুক যখন বীণাকে প্রথম দেখতে এসেছিল সেইদিনই বীণা নিজেকে প্রশ্ন করেছিল ,”আচ্ছা মানুষ কখন প্রেমে পরে?”বীণা ফারুকের প্রেমে পরেছিল তাঁর ভদ্রতা, গম্ভীর কন্ঠস্বর আর সুঠাম শারীরিক গঠন দেখে। মোট কথা ফারুক ছিল স্বাভাবিকভাবেই প্রেমে পরার মতই ছেলে।
বিয়ের পর বীণা আর ফারুককে যেই দেখতো সেই বলতো ঈশ্বর নিজ হাতে দুজনের জোড়া মিলিয়েছেন। ফারুক আর বীণা দুজনই ভদ্র। কখনো কোন বিষয়ে তাদের মতের অমিল হয়না। দুই পক্ষের শ্বশুর শ্বাশুড়িও বন্ধু সুলভ। একবছর স্বপ্নের মত কেটে গেল। একদম সহজ সরল সম্পর্ক ফারুক আর বীণার মাঝে।
কিন্তু দেড় বছর পর ফারুক কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে উঠল। সব সময় কাজে ডুবে থাকতো।অবসর সময় মোবাইল নিয়ে সময় কাটাতো। বীণা আর ফারুক কোন প্রোগ্রামে আত্মীয়দের বাড়ি ছাড়া কোথাও ঘুরতে যেত না। বীণা মন দিয়ে সংসার আর ফারুক কাজ, এভাবেই দিন কাটছিল। দুজনের একান্ত সময় বলতে চার দেয়ালের মাঝে কিছুটা একান্ততা।সেটাও কমে আসতে লাগলো। বীণার কোন কিছুতেই অভিযোগ নেই।আসলে এত ভাল পরিবেশে কারও অভিযোগ থাকেনা।বীণা পড়াশুনা করতে পারছে।সংসারে মা বাবার মত শ্বশুর শ্বাশুড়ি। আর কি লাগে?
দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠান শেষে সবাই বীণা আর ফারুককে সন্তান নেওয়ার প্লান করতে বলল। যখন পুরো পরিবেশ দুষ্টুমীতে ভরে গেল ফারুক সবার মাঝ থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেল। ফারুকের চোখ মুখের ভাষা সবার বোধগম্য হল যে সে খুব বিরক্ত।
বীণা রাতে নিরিবিলি বলল, “তুমি ওভাবে চলে এলে যে। তোমার বেবি পছন্দ নয়? ফারুক কোন কথার উত্তর না দিয়েই শুয়ে পরল।”
পরদিন সকালে খাবার টেবিলে ,বীণার শ্বাশুড়ি বললেন, “বীণার পড়া প্রায় শেষের দিকে,এবারতো নাতী বা নাতনীর মুখ দেখার সুযোগ করে দে বাবা।”
ফারুক কথাটি শোনার পর খাবারের প্লেট ধাক্কা দিয়ে উঠে অফিসে চলে গেল। ফারুকের মা বীণার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে বীণা? তোমরা কি ঝগড়া করেছো?”
বীণা অবাক হয়ে বলল, “মা আমাদের মাঝে তো আজ পর্যন্ত কোন ঝগড়া হয়নি।”
বীণার শ্বশুর নিজের স্ত্রীর তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে বললেন, “তুমিও না।আমাদের বৌমার মত মেয়ে হয়। সে করবে ঝগড়া। মাথা ঠিক আছে তোমার।”
ফারুকের ব্যপারটা কেউ বুঝতে পারল না। সন্ধ্যায় বীণার শ্বশুর শ্বাশুড়ি ফারুকের সাথে বসলেন। ফারুকের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় ফারুক কোন সমস্যা নেই বলে এড়িয়ে গেল।
বীণার বাবা মা ফারুকের বাবা মাকে বুদ্ধি দিলেন ছেলে মেয়েকে ঘুরতে পাঠানোর। বিয়ের পর থেকে বীণা আর ফারুক কোথাও একান্তে ঘুরতে যায় নি। হয়তো এতে ফারুক বীণাকে তার সমস্যা থাকলে বলতে পারে। আর মনটাও ভাল হয়ে যাবে।
বীণাকে নিয়ে ফারুক ঘুরতে রাজি হলো।এক সপ্তাহের ট্যুরে প্রথম কক্সবাজার,এরপর রাঙামাটি ঘুরে সবশেষে গেলো সেন্টমার্টিন। সাগরের তীরে দুজন পাশাপাশি বসে থাকছে ।বীণা পুরো ট্যুরটা খুব এনজয় করলো। প্রিয় মানুষের সাথে ঘুরতে তার স্বর্গের মত লাগছে।কিন্তু পুরোটা সময় ফারুক নির্লিপ্তভাবে আছে। বীণা বুঝতে পারছে না ফারুকের মনে কি চলছে।
সাগরের তীরে বসে বীণা বলল, “শুনছো, কি সুন্দর পরিবেশ তাই না?”
ফারুক মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল,”হুম।”
বীণা বলল,” তোমার কি কোন কারনে মন খারাপ?”
ফারুক বেশ খানিক সময় বীণার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। এরপর সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল ।কোন উত্তর এলো না।
ঢাকায় ফেরার পর আবার দুজনে দুজনের মত। এদিকে বেশ সময় পেরুলো। বীণার মাস্টার্সও শেষ। আবার সেই সন্তানের চাহিদা সবার মুখে মুখে।
বীণারও চাকরি করার ইচ্ছা নেই। সবাই বীণাকে চাপ দিল সন্তানের ব্যপারে ফারুককে বোঝাতে।এক রাতে বীণা ফারুককে বলল,
“শুনছো, আমাদেরতো সন্তান নেবার ব্যাপারে ভাবতে হবে তাই না?”
ফারুক ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল,” বীণা তোমার কি তাই ইচ্ছা?”
বীণা খুশি হয়ে বলল, “সব মেয়েদেরইতো এই স্বপ্ন থাকে তাই না।”
ফারুক বলল, “বীণা চল আমরা আজ সারারাত হেটে বেড়াই।”
বীণা বলল, “বাবা মা কি ভাববেন!”
ফারুক হেসে শুয়ে পরল। কিন্তু ঘুমালো না।অনেকক্ষন এপাশ ওপাশ করে রাত একটায় উঠে বসল। বীণাও ঘুমায়নি। বীণাকে ডাকতেই বীণা উঠে বসল।
ফারুক বীণার হাত দুটো নিজের হাতে রেখে বলল,” বীণা তুমি খুব ভাল মেয়ে। শুধু ভাল নয় অসম্ভব ভাল মেয়ে। কিন্তু আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই। বলতে পারো আমি সব কিছু থেকেই মুক্তি চাই।”
বীণা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে নিজেকে সামলে বলল,
“কি হয়েছে আমায় বল। আমি সব সামলে নেব। কি আবোল তাবোল বলছো?”
ফারুক বলল, “কি সামলে নেবে তুমি? তেমন কিছুই হয়নি। আমি জাস্ট সব কিছু থেকে মুক্তি চাই। সংসার ,পরিবার, চাকরি সব কিছু থেকে। আমি জানি তুমি খুব ভালো। আমায় মুক্তি দিবে।”
বীণা ভাঙা গলায় বলল, “তুমি কি অন্য কাউকে ভালবাসো? “
ফারুক বলল, “আমি ভালবাসতে চাই। কিন্তু কয়েকবছর ধরে মনে হচ্ছে আমি একটা রোবট। আমার একই মাত্রায় জীবন চলাকে আমি নিতে পারছি না। আমি দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছি।বীণা আমার এ জীবন ভাল লাগছে না। প্লিজ বোঝ।”
বীণা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সকালে দেখা যাবে, বলে বীণা ফারুককে ঘুম পারালো। সকালে শ্বশুর শাশুড়িকে ব্যাপারটা জানাতেই হিতে বিপরীত হল। ফারুকের বাবা মা ফারুকের উপরই উল্টো রেগে গেল। ফারুকের সব রাগ গিয়ে পড়ল বীণার উপর। ফারুক বাসায় আসাও প্রায় বন্ধ করে দিল।
দুই পক্ষ ফারুক আর বীণার সম্পর্ক নিয়ে ফারুককে বোঝাল। ফারুক কেবল শুনতো। কোনো প্রতি উত্তর দিত না।বীণাকে এড়িয়ে চলতে থাকায় বড়রা প্রায় জোর করে ফারুক আর বীণাকে বারবার ঘুরতে পাঠাতো। ফারুককে বেশ বিভ্রান্ত লাগতো। শেষে মনোচিকিৎসক, কাউন্সিলর সব কিছুর শরনাপন্ন হয় ফারুকের পরিবার। পরিশেষে, ফারুক চাকরি ছেড়ে দিল। তৃতীয় পক্ষের যেহেতু কোন অস্তিত্ব নেই বীণা বাসা ছেড়ে নিজের বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখল ফারুকের কোন পরিবর্তন আসে কিনা। নাহ ফারুক বেশ অসুস্হ হয়ে পড়তে লাগলো দিন দিন।
শেষমেষ বীণা ফারুককে ডিভোর্স দিয়ে দিল।বীণা বা অন্য কেউ ফারুকের বিষয়টা বুঝলো না। বীণা একটি বছর ঘোরের মাঝে ছিল। এরপর ফারুককে ভুলতে চাকরির চেষ্টা করে একটি ব্যাংকে কর্মরত হয়।
ফারুকও এক বছর পর চট্টগ্রাম চাকরি নিয়ে একা থাকা শুরু করে।
ফারুকের বাবা মা বীণার সাথে সব সময় যোগাযোগ রাখতো। বোঝাতো সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। ফারুক দুই বছর পর তার অফিস কলিগের প্রেমে পড়ল। ও আর আগের ফারুক নেই। খুব হাসি খুশি প্রানোচ্ছ্বল ।অল্প কথায় অট্ট হাসিতে গড়িয়ে পরা, হঠাৎ কোথাও মেয়েটিকে নিয়ে বাইকে লং ড্রাইভে যাওয়া । পার্টি ,কোলাহল প্রিয় এক নতুন মানুষে রূপান্তরিত হল।
ফারুকের বাবা মা যেন নিজের ছেলেকে চিনতেই পারেনা। ঢাকায় এসে ফারুক মা বাবাকে জোর করতে লাগলো মেয়েটির সাথে ফারুকের বিয়ের সম্মতি যেন বাবা মা দেন।
সম্মতি না পেয়ে ফারুক একাই বিয়ে করে নেয় মেয়েটিকে। ঢাকায় আবার ফিরে আসে।আলাদা বাসা নেয়।নতুন সংসার গড়ে।এর মাঝে একটি বারও বীণাকে কল দেয়না ফারুক। বীণা হয়তো নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল কিন্তু ফারুকের অবহেলা আর বিয়ের ফিরে আসা চারটি বছর তাকে কখনো স্বস্হিতে থাকতে দিচ্ছিল না।
ডিভোর্সের তিন বছর পর আজ পুরাতন ঘাঁ যেন আবার নতুন হয়ে গেল।ব্যথাটাও প্রচন্ড অনুভূত হচ্ছে।
বীণা ফারুক আর ওর নতুন স্ত্রীর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। কিছুক্ষন পর বীণা দেখল ফারুক একটি সি.এন.জি তে মেয়েটিকে উঠিয়ে দিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।
বীণা কি করবে বুঝে ওঠার আগেই ফারুক ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে কফি অডার করে বীণার পাশের টেবিলে বসতেই চোখ পরল বীণার দিকে।
বীণা চোখ সরিয়ে রাখলেও ফারুক উঠে বীণার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “বীণা না? কেমন আছো?”
বীণা ভেতরের ঝড়কে সামলে বলল, “বেশ ভাল। তো তোমার খবর কি? “
ফারুক মাথা নিচু করে বলল, “ভাল।”
কিছুক্ষন চুপ থেকে ফারুক বলল, “কিছু অডার করব?”
বীণার হঠাৎ কি মনে হলো বলল, “খাওয়াবে আমায়?”
ফারুক বলল,” অবশ্যই, বল কি খাবে?”
বীণা বলল, ” তাহলে অডার ক্যান্সেল কর। বাইরে চল।”
ফারুক বীণার দিকে স্হির চোখে তাকালো। এরপর বাধ্য ছেলের মত অডার ক্যান্সেল করল।
বীণা বাইরে বের হতেই ফারুক বীণাকে অনুসরন করল।
বীণা বলল,”তুমি বাইক নিয়ে এসেছ না?”
ফারুক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
বীণা বলল, “চল তোমার বাইকে করে রবীন্দ্র সরোবর যাই। ওখানে লুচি আর চিকেন চাপ খাব।আর মাটির হাড়িতে চা খাবো?”
ফারুক আবারো বীণাকে দেখলো। পরে বলল, “চলো।”
বাইকে উঠতেই বীণা ওর চুলগুলো খুলে দিল। সিল্কি লম্বা চুল বাতাসে বারবার ফারুকের শরীরে আছড়ে পরছে। ফারুকের পিঠে জোরে হাতটা চেপে ধরে রাখলো বীণা। ফারুক একবার পেছন ফিরে বাইক চালিয়ে গন্তব্যে ছুটলো।
রবীন্দ্র সরোবরে গিয়ে লুচি আর চাপ খাওয়া হলে মাটির কাপে চা নিয়ে হাঁটতে শুরু করল বীণা। ফারুকও হাটছে। হঠাৎ থেমে বলল,
” এই ফারুক ,গোলাপ গোলাপ। প্লিজ একটা কিনে দাও না।”
ফারুক বিস্ফোরিত চোখে বীণাকে দেখছে। এরপর এক গোঁছা গোলাপ কিনে এনে বীণাকে দিতেই।বীণা একটা গোলাপ ফারুকের হাতে দিয়ে বলল, “কানে গুঁজে দাও তো।”
ফারুক কানে গুঁজে দিল।
বীণা হাঁটছে আর গান গাইছে।হঠাৎ পেছন ফিরে বলল,
“ফারুক তোমার বৌ কি রাগ করবে? তোমার এত সময় নিচ্ছি যে?”
ফারুক বোকার মত মুখ করে বলল, “না না ,ওতো জানবে না। ও আজ চট্টগ্রামে যাচ্ছে বাবার বাড়ি। আমি এমনিতেই ফ্রি।”
বীণা বলল, “তোমার বাবা মা কেমন আছে?”
ফারুক অপরাধীর মত বলল, “জানি না। আসলে ঝুমুর মানে আমার ইয়ে ,ও একদম পছন্দ করে না যে আমি মা বাবার সাথে যোগাযোগ রাখি। “
বীণা জোরে হেসে ফেলল। চুল খোঁপা করে বাঁধার চেষ্টা করতেই,
ফারুক বলল , “খোলা চুলে তোমাকে সুন্দর লাগছে। থাকনা ওভাবে। “
বীণা বলল, “”নৌকায় চড়বো। চলো।”
ফারুক বীণার কথামত নৌকায় বসল। ফারুক বলল, “বীণা তুমি বিয়ে করেছ?”
বীণা বলল,” আমাকে কে বিয়ে করবে?”
ফারুক বলল,”কি বলছ আবোল তাবোল তুমি তো সাক্ষাৎ পরী।তোমায় কে বিয়ে করবে মানে?”
বীণা চোখ কুঁচকে তাকালো ফারুকের দিকে। ফারুক চোখ সরিয়ে নিল।
নৌকা থেকে নামতেই বীণা বলল , “তোমার বৌ তো নেই চল মা বাবাকে দেখে আসি।”
ফারুক শিশুদের মত বলল, “যাবে সত্যি। মা বাবা যে কি খুশি হবে!”
বীণা দেখল মোবাইলে বারবার কল আসছে।কখনো মা কখনো বাবার। মোবাইল সুইচ অফ করে ফারুকের সাথে বাইকে উঠে পূর্বের ঠিকানায় এগিয়ে চলল।
ফারুকের বাসায় পৌঁছে যখন ফারুকের মা দরজা খুললেন তিনি যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। পরক্ষনেই বীণাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। বীণা নিজ হাতে নুডুলস সেমাই রান্না করে দুজনকে খাওয়ালো। বীণার শ্বশুরের স্বাস্হ্য খুব ভেঙে গেছে। ফারুক অসহায়ের মত বসে থাকলো এক কোণায়। ফেরার সময় বীণা প্রমিস করল প্রায়ই দেখতে আসবে উনাদের।
বীণার ফেরার পালা। ফারুক বলল, ঝুমুর না আসা পর্যন্ত সে মা বাবার কাছেই থাকবো।
বীণা আর ফারুক পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটছে। আকাশে অনেক বড় চাঁদ উঠেছে। ফারুক বলল,
“বীণা , তুমি আমায় নাম ধরে ডেকেছিলে ,খুব ভাল লেগেছিল।”
বীণা মৃদু হাঁসলো।
ফারুক হঠাৎ থেমে গেলো।রাস্তার চারপাশে কোন মানুষ নেই।গম্ভীর কন্ঠে বলল ,”বীণা তোমার হাতটি ধরতে পারি। “
বীণা দুটি হাত বাড়িয়ে দিল। ফারুক কাঁপা হাতে বীণার দুটি হাত চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল।
ফারুক ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “আমি প্রেমিকার খোঁজে সংসার স্ত্রী পরিবার সব হারিয়েছি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।”
বীণার দুটি হাত জলে সিক্ত হচ্ছে। বীণা চাঁদের দিক তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষন পর একটি রিক্সা ডেকে বীণা উঠে পড়ল। পেছনে অশ্রুসিক্ত দুটো চোখ বীণাকে দেখছে।
বীণা মোবাইল সুইস অন করতেই শিশিরের কল। শিশিররা বীণাদের পাশের ফ্ল্যাটে উঠেছে দুই বছর হয়। বীণার বাবা মায়ের খুব পছন্দের ছেলে। প্রচন্ড হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। আকারে ইংগিতে বীণাকে অনেকবার বলেছে যে সে বীণাকে পছন্দ করে। কিন্তু বীণা এক মোহের স্রোতে প্রতিনিয়ত ভেসে যেতো বারবার।
আজ তার মুক্তি। সমস্ত কষ্ট, গ্লানি অন্য কাউকে দিয়ে সে আজ নিঃস্ব। পাখির পালকের মত আজ হালকা লাগছে।
শিশিরের কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অধিকার ভরা কন্ঠ বলে উঠল,
“কি ব্যাপার, আন্টি আংকেল কত চিন্তিত।আর আপনি কোথায়?”
বীণা বলল,” তুমিতো আমার থেকে চার বছরের বড়। তুমি আমায় তুমি ডাকতে পারো না?”
ওপাশে কেবল নিঃশ্বাসের শব্দ।
বীণা বলল,” মা বাবাকে বল সারারাত তুমি আর আমি জোৎস্না দেখবো। আমি বাসার নিচে আছি।”
শিশির বলল, “দশ মিনিট সময় হবে। মানে একটু গুছিয়ে…….”
বীণা বলল, “হবে……..”
বীণা আকাশের দিকে তাকায়। জোৎস্না এতসুন্দর হয় ওর আগে জানা ছিল না।
“জোৎস্না কাব্য”
-প্রীতিলতা চক্রবর্তী
Read More: রঙে রঙিন – Family Love Story