পর্ব ৬
নিরা দেখতে যেমন রূপবতী, তেমনি সুন্দর হাসি। সব সুন্দরী মেয়ের হাসি সুন্দর হয়না,কিন্তু নিরার হাসি চমৎকার। এই হাসি দেখেই কত ছেলে ওর প্রেমে পড়ে যায়। রিয়ানও তাদের মধ্যে একজন। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যায় নিরা’র।
এরপর দিনের পর দিন নিরার পিছনে আঠার মত লেগে থাকে ছেলেটা। নিরা অনেকবার বলেছে সে একটা সম্পর্কে আছে, তবুও পিছু ছাড়েনি রিয়ান। প্রতিদিন নিরার অপেক্ষায় বাইক নিয়ে দাড়িয়ে থাকতো। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্যাপারটা স্বাক্ষরকে জানালো নিরা।
স্বাক্ষর প্রচন্ড ভালোবাসে নিরাকে। নিজের প্রেয়সীর ভালো মন্দ দেখাটা ওর দায়িত্ব। পরেরদিন নিরার কলেজে এসে হাজির হয়েছিলো স্বাক্ষর। নিরাকে বাইকে তুলে বাসার সামনে নিয়ে গেছে। এভাবে পরপর কয়েকদিন স্বাক্ষর নিজেই নিরাকে ড্রপ করে দিয়েছে। রিয়ান সহ্য করতে না পেরে একদিন একাকী রাস্তায় হামলা চালায় স্বাক্ষরের উপর।
স্বাক্ষর তখন বাসায় ফিরছিলো। সময়টা ছিলো রাত এগারোটা। রাস্তায় স্বাক্ষরের বাইক আটকে মারার জন্য এগিয়ে আসে রিয়ান৷ দুটো ঘুষিও খেয়েছিলো স্বাক্ষর। এরপর পালটা আক্রমণ করে হঠাৎ একটা ট্রাক চলে আসায় সেদিনের মত সুযোগ পেয়ে সুস্থ শরীরে ফিরতে পেরেছিলো স্বাক্ষর। পরেরদিন সোজা থানায় গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলো রিয়ানের নামে। কয়েকদিন থানায় আটক থাকার পর রিয়ানের বাবা মা ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে ছেলেকে।
রিয়ান ছাড়া পেয়েই নিরার ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। মাঝখানে কয়েকটা দিন তুমুল বিপদের সম্মুখীন হতে হয় নিরাকে৷ রিয়ান নিরাকে বিরক্ত করা ছেড়ে দিলেও ওর চেলারা বারবার আক্রমণ চালাতে থাকে নিরার উপর। পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে নিরা বাসা থেকেও বের হতে পারতো না। একইসাথে স্বাক্ষরের উপর ভীষণ মানসিক চাপ নেমে আসে। নিরার বাবা মা মেয়েকে বাচাতে হঠাৎ করেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু একমাত্র ভালোবাসাকে ছাড়াটা অসম্ভব ছিলো স্বাক্ষরের জন্য৷ তাই বাধ্য হয়েই নিরার বাসায় এসে বিয়ে পড়িয়ে নিরাকে বাসায় নিয়ে যায় স্বাক্ষর।
রিয়ানের কোনো খোজ ছিলো না ঠিকই কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই সে সামান্তাকে ফাঁদে ফেলে চরম সর্বনাশটা করে ফেললো। পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই রাস্তায় ধপ করে বসে পড়লো নিরা।
কোনোকিছু ভাবার অবকাশ পাচ্ছেনা ও। স্বাক্ষরকে কল দিয়ে হাফাতে হাফাতে বললো, আমি উঠতে পারছি না। আমার গায়ে কোনো শক্তি নেই। প্লিজ তুমি এখানে এসে আমাকে নিয়ে যাও।
কথাটা বলতে বলতে কান্নায় ভেংগে পড়লো নিরা। ওর দম আটকে আসছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। না আছে উঠার শক্তি, না চলাফেরার শক্তি। স্বাক্ষর ঠিকানা নিয়ে দ্রুত চলে আসলো নিরার কাছে। তারপর ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলো, এখানে কেন তুমি? কিভাবে এলে? আর এই অবস্থা কেন?
নিরার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রাস্তাতেই স্বাক্ষরকে জাপটে ধরে বললো, আমি মরে যাবো স্বাক্ষর।
- আরে কিছু হবেনা৷ কি হয়েছে বলো তো?
- রিয়ান..
- রিয়ান!
চেচিয়ে উঠলো স্বাক্ষর- রিয়ান কি করেছে আবার? তোমার কোনো ক্ষতি করেনি তো নিরা?
- আমার কোনো ক্ষতি করেনি। কিন্তু…
বলেই হাফাতে লাগলো নিরা। স্বাক্ষরের গলাটা শুকিয়ে গেল ভয়ে। করুণ মুখে জানতে চাইলো, কি হয়েছে নিরা? বলো আমাকে?
নিরা স্বাক্ষরকে আবারও জাপটে ধরলো। তারপর একটা ঢোক গিলে বললো, রিয়ান সামান্তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে সেক্স করে ছেড়ে দিয়েছে।
বজ্রপাতের মত ধাক্কা লাগলো স্বাক্ষরের বুকে। অনেক্ষণ কথা বলতে পারলো না। চোখের পলক এমনকি নিশ্বাসও থেমে গেছে ওর। নিজের বোনকে সন্তানের মত ভালোবাসে স্বাক্ষর। সেই সামান্তাকে…নিরা কাঁদতে কাঁদতে বললো,মাঝখানে অনেকদিন রিয়ানের কোনো খোজ ছিলোনা। জেল থেকে বেরিয়ে ও উধাও হয়ে গেছিলো। ওই সময়েই সামান্তাকে ফাঁদে ফেলেছে। সামান্তার বয়স অল্প, তাছাড়া রিয়ানকে দেখলে মনেই হয়না ছেলেটা শয়তান। ওকে অনেক ভালো বিনয়ী ছেলে মনেহয়। সেই ছেলেটা এভাবে ওকে ব্যবহার করবে ভাবতে পারেনি সামান্তা…
স্বাক্ষরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে। মাটি ফাঁক হয়ে গেলে ভেতরে ঢুকে যেতো ও। জীবনটা এমন করে খেললো ওর সাথে? ও তো কখনো কারো কোনো ক্ষতি করেনি। ওর সাথেই কেন এমন হলো? সব প্রশ্নের হয়তো উত্তর থাকেনা, এর উত্তরও খুজে পেলোনা স্বাক্ষর। নিরা স্বাক্ষরকে শক্ত করে ধরে রইলো। দুজনই অর্ধমৃতের মত বাসায় এসে পৌছালো।
স্বাক্ষরের মা দরজা খুলে দুজনকে দেখে চমকে উঠলেন। একেকজনকে দেখে মনেহচ্ছে যেন কাছের কোনো আত্মীয় মারা গেছে। কি হাল হয়েছে চেহারার। দুজন ঢ্লতে ঢ্লতে বাসায় ঢুকে রুমে গিয়ে বসলো।
মা উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলেন কাহিনিটা কি?
স্বাক্ষর কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর সামান্তার রুমে চলে এলো। সামান্তা বিছানায় মরার মত শুয়ে আছে, উদাসীন চেহারা। স্বাক্ষর কাছাকাছি আসামাত্র ও একবার মুখ তুলে তাকালো। দুই ভাইবোন চোখাচোখি হওয়ামাত্র সামান্তা আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। কান্নায় ভেংগে পড়লো ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে।
কান্নার শব্দ শুনে মা ছুটে এলেন। স্বাক্ষর মাকে বললো, কিছু হয়নি। তুমি যাও এখান থেকে।
মা নাছোরবান্দা। দুই ভাইবোন একসাথে কাদছে, তার উপর নিরাকেও মনমরা দেখাচ্ছে। কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে। কিন্তু কি হলো আবার?
স্বাক্ষর মাকে বললো, আমি সামান্তার সাথে কথা বলতে চাই। আমাদের মাঝে তুমি থেকো না মা, প্লিজ যাও।
- কি হয়েছে বলবি না?
- শুনতে চাও কি হয়েছে?
স্বাক্ষর বললো, তোমার মেয়ে ভূল করেছে একটা। একটা বাজে ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো।
- কি বলিস?
- হ্যা। সেটা জানতে পেরেই কাদছি। এখন তুমি যাও, সামান্তার সাথে আমার কথা আছে।
মা বাধ্য হয়ে বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। কিন্তু পাশের রুমে গিয়ে দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন ওদের মধ্যে কি নিয়ে কথা হচ্ছে।
স্বাক্ষর বোনকে বললো, ছেলেটা অনেক চালাক। তোকে কিভাবে ফাঁদে ফেলেছে বুঝতে পারিস নি। কিন্তু তোর মনে রাখা উচিত ছিলো, একটা মেয়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার সম্ভ্রম। যত ভালোবাসাই থাক, নিজের সম্ভ্রম বিলিয়ে দেয়াটা কি উচিত হয়েছে বল?
সামান্তা কোনো কথা বললো না। স্বাক্ষর আবারও বললো, ছেলেটা যদি খুব ভালো ও হতো তবুও সেক্স করাটা উচিত হতো না। কারণ চাহিদা মিটলে তোকে ছুড়ে ফেলে দেবে। বুঝিস না এসব? ওর নামে ধর্ষণের মামলাও দিতে পারব না কারণ তোর নিজের ইচ্ছায় এটা হয়েছে। তুই না চাইলে এটা কখনোই হতো না।
সামান্তা ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললো, আমি বুঝিনি রে ভাইয়া। আমি সত্যিই অনেক বড় ভূল করে ফেলেছি।
- হ্যা। রিয়ান অন্যায় করেছে আর তুই করেছিস ভূল, এই ভূলের মাশুল সারাজীবন তোকে দিয়েই যেতে হবে। আজীবন নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকবি তুই। আর বিয়ের পর নিজের স্বামীর কাছে ছোট হয়ে থাকবি। কোনো মেয়েরই এটা করা উচিৎ না। বুঝিস না তুই?
সামান্তার কান্নার গতি আরো বেড়ে গেলো। স্বাক্ষর ওকে জাপটে ধরে বলে যেতে লাগলো নিজের পুরনো শত্রুতার কথা। নিরার পিছনে লাগা, স্বাক্ষরকে রাস্তায় মারা, রিয়ানকে পুলিশে দেয়া একের পর এক সব খুলে বললো স্বাক্ষর। তারপর বোঝাতে লাগলো সামান্তাকে অনেক শক্ত হতে হবে।
এদিকে স্বাক্ষরের মা প্রথম কথাগুলো শুনে কেঁদে বুক ভাসালেও পরের কথাগুলো শুনে চিৎকার করে কাদতে কাদতে বললেন, স্বাক্ষর তুই কাকে বিয়ে করে আনলি? তোর বউয়ের জন্য আজ আমার মেয়ের এই দশা।
নিরা একেবারে থ। এটা কি বললেন মা! এখন সমস্ত দোষ নিরার কাধে এসে চাপলো। সামান্তা নিজেও বললো, ভাবির কোনো দোষ নেই। সবটা আমার নিজের ভূলে হয়েছে।
তবুও উনি নিরাকে যাচ্ছেতাই বলে গালি দিতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন নিরার জন্যই এই অবস্থা হয়েছে সামান্তার। স্বাক্ষর পড়ে গেল মহাবিপদে। সবাই কাঁদছে। একদিকে বোন, একদিকে মা অন্যদিকে স্ত্রী। তিনজনকে সামলানোটা একটা যুদ্ধের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পর্ব ০৭
নিরার শ্বাশুড়ি ক্রমাগত কেঁদেই চলেছেন। আর জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলছেন নিজের পুত্রবধূর কথা। ওনার ভাষ্যমতে সমস্ত দোষ এখন নিরার। নিরার জন্য আজ ওনার মেয়ের এই দশা। এদিকে নিরা পারছে না কিছু বলতে, পারছে না সহ্য করতে। শুধু নিরবে চোখের পানি ফেলছে। ওর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। সব’চে বেশি প্রেশার যাচ্ছে স্বাক্ষরের উপর। তিনজনকে নিয়ে পড়েছে কঠিন সমস্যায়।
মাকে বুঝাতে গেলে উনি উলটো গালাগালি শুরু করেন। আর সামান্তা তো অঝোরে কেঁদেই চলেছে। অন্যদিকে নিরার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কালবৈশাখীর মেঘ এসে জড়ো হয়েছে ওর মুখে যেন।
সামান্তা বাধ্য হয়ে মাকে বললো- তোমাকে লাস্ট বারের মত বলছি, চুপ করে যাও। আর একটা কথাও বলবা না ভাবিকে নিয়ে। ভাবির কোনো দোষ নেই, বরং ভূলটা আমারই। পারলে ভাবি আমার উপকার করেছে। তাকে না জানালে রিয়ানের সত্যিকার রূপটা আমার কখনোই জানা হতো না।
সামান্তার কথায় যুক্তি আছে। তবুও মা থামলেন না। বারবার বলেই যেতে লাগলেন নিরার মত একটা মেয়েকে কিভাবে বিয়ে করলি? ঘরে শত্রু নিয়ে আসলি। আমার ভাগ্যে এমনও দিন ছিলো…
শ্বাশুড়ি মা ক্রমাগত বলে যেতে লাগলেন। এমন সময় সামান্তা আর সহ্য করতে না পেরে নিজের রুমে চলে গেল। দরজা লাগিয়ে দিয়ে ওড়না নিয়ে ফ্যানের সাথে পেঁচানো শুরু করলো। মানসিক যন্ত্রণাগুলো কুড়ে কুড়ে মারছে ওকে। সবচেয়ে ভালো হবে যদি পৃথিবী ছেড়েই চলে যাওয়া যায়। বাবা, মা, ভাই সবাই ভালো থাকবে।
কারো বোঝা হয়ে থাকতে হবেনা আর। এসব ভাবতে ভাবতে ওড়নাটা পেঁচিয়ে ফেললো সামান্তা। টুলের উপর ফাঁসের ভেতর গলাটা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো।
এমন সময় স্বাক্ষর হঠাৎ নিরার ঘরেই আসছিলো। দরজা বন্ধ দেখে পাশের রুমের ভেতর দরজা দিয়ে ঢোকার জন্য আসলো। ঘরের ভেতর দরজাটা বন্ধ করতে ভূলে গেছে সামান্তা। চিৎকার দিয়ে উঠলো স্বাক্ষরের। তারপর ছুটে গিয়ে বোনকে আটকালো গলায় ফাঁস দেয়া থেকে। সাথে সাথে একটা কষে থাপ্পড় লাগালো সামান্তার গালে।
সবকিছু থেমে যাওয়ার মত অনেক্ষণ থেমে গেলো দুজনেই। নিরা ও স্বাক্ষরের মা দুজনেই ছুটে রুমে চলে এসেছে। নিরা সামান্তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর মা সামান্তার হাত ধরে আছেন। নিরা নিজের বুকে চেপে ধরেছে সামান্তাকে। এরকম করে কাঁদতে দেখলে সেই মেয়েকে আর কিছুতেই অপরাধী বলা যায় না। খারাপ ভাবনাও আনা যায়না তার বিষয়ে।
মেয়েটা যে অনেক নরম মনের! মুহুর্তের জন্য নিরার ব্যাপারে ভালোবাসা জেগে উঠলো শ্বাশুড়ির মনে। উনি নিজেও সামান্তাকে জাপটে ধরলেন বুকে।
সবাই মিলে কতক্ষণ কাঁদলো কেউই বলতে পারে না। স্বাক্ষর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো সবাইকে। সামান্তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে খুব যত্মে গোসল করিয়ে দিলো নিরা। তারপর খাবার টেবিলে এনে খাবার তুলে খাওয়ালো। সামান্তার মা তখন দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছেন। আজকে সবার মনে বিরহ ভর করেছে। এতটুকুও শান্তি নেই কারো মনে।
খাবার খাওয়ানোর পর সামান্তাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে আদর করে ঘুম পারিয়ে দিলো নিরা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বোঝাতে লাগলো নিজের আত্মসম্মানের কথা। সম্মানের সাথে বেচে থাকাটাই জীবন। যা হয়েছে সেটা ভেবে কষ্ট পেলে জীবনের অর্থটাই হারিয়ে যাবে। ভূল একটা হয়ে গেছে, তাই বলে আরেকটা ভূল করাটা নিতান্তই বোকামি। জীবনটাকে জানার অনেক বাকি। পুরো জীবনটা এখনো পড়ে আছে। সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে হবে। নিজের যোগ্যতায় ভালো কিছু করে দেখাতে হবে যে একটা দূর্ঘটনা জীবনকে থামাতে পারেনি। রিয়ান যেভাবে ওর ক্ষতি করেছে তার যোগ্য জবাব দিতে হবে, প্রতিশোধের জন্যও নিজেকে প্রস্তুত করা দরকার।
সামান্তা বললো, আমি ওকে পুরোপুরি ভূলে যেতে চাই। ওকে মনে রাখলেই আজীবন এই কষ্টটা আমাকে পুড়ে মারবে।
- তাহলে তাই করো। প্রতিশোধের জন্য আমি আছি। আমি রিয়ানের এমন অবস্থা করবো… এতদিন সবকিছু নীরবে সহ্য করে এসেছি। কিন্তু আজকে তোমার অপমান আর সহ্য করবো না আমি।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে এলো নিরা। থালাবাসন মাজতে আরম্ভ করবে এমন সময় শ্বাশুড়ি এসে বললেন, সেকি। তুমি ওগুলো পরিষ্কার করতে লাগলে কেন? এসবের জন্য তো বুয়া আছে।
নিরা মিষ্টি স্বরে বললো, আমার নিজের কাজগুলো নিজেই করতে ভালো লাগে মা। বুয়ার কাজ আমার পছন্দ হয়না। - ঠিক আছে। করছো যখন করো। দেখো আবার পরে যেন বোলোনা কাজ করে করে তোমার হাতের চামড়া উঠে গেছে। নতুন বউ হয়ে এসেছো, এত কাজ না করলেও পারো।
নিরা উত্তরে বললো, মা বউ তো সবসময়ই বউ। নতুন পুরাতনের সাথে কি সম্পর্ক? বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসামাত্রই তো আপনাদেরকে আপন করে নিয়েছি। - প্রথম প্রথম সবাই এরকম বলে। তার উপর আজকাল এমন মেয়ে বিশ্বাস করা শক্ত। দুদিন পরেই আসল রূপ বেড়িয়ে আসবে।
- যদি আসে সেদিন নাহয় আমাকে তাড়িয়ে দিবেন। পারবেন না মা?
মা কোনো কথা বললেন না। মেয়েটার সাথে কথায় পারা যাবেনা। যেমনই কাজের, তেমনই জ্ঞান বুদ্ধিতেও। ঠিকই কথার পটে কথা বলে দেবে। উনি ভ্রু কুচকে বললেন, আচ্ছা করো তাহলে।
মা নিজের রুমে এসে কিছুক্ষণ বসলেন কিন্তু থাকতে পারলেন না। ওনার ইচ্ছে করছে নিরার সাথে রান্নাঘরে কাজ করতে। সাথে আরো ইচ্ছে করছে মেয়েটার সাথে গল্প করতে, ওর ব্যাপারে অনেককিছু জানতে। এদিকে নিরা মনে মনে ভাবছে সামান্তাকে কিভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা যায়।
পর্ব ৮
শ্বাশুড়ি মাকে আবারও রান্নাঘরে আসতে দেখে নিরা জিজ্ঞেস করলো, মা আপনার কিছু লাগবে?
- না। তোমার সাথে গল্প করতে আসলাম।
অবাক হয়ে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো নিরা। শ্বাশুড়ি তো ওকে সহ্য ই করতে পারতো না। সে নিজে থেকে এসেছে গল্প করতে! ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে। ওকে অবাক হয়ে থাকতে দেখে মা বললেন, কি দেখছো এমন হা হয়ে?
নিরা লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। শ্বাশুড়ি মা ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। জানতে চাইল, কি রান্না করছো?
- পরোটা বানাচ্ছি। রুটির সাথে ডিম ভাজি আর সবজি।
মা হেসে বললেন, বাহ। ভালোই তো আইটেম বানাচ্ছো দেখছি। পরোটা বানাতে পারো? - হ্যা পারি। না পারলে কি এখন সাহস করে বানাতে যেতাম?
- তাও ঠিক। আমার সময়ে আমি কিছুই বানাতে পারা তো দূরের কথা, ভাতও রাঁধতে পারতাম না। আমার শ্বাশুড়ির যা কথা শুনেছি…
নিরা হেসে বললো, সেজন্যই আগেভাগে সব কাজ শিখে রেখেছি। যাতে করে আমাকে আমার শ্বাশুড়ির কথা শুনতে না হয়।
লজ্জা পেলেন শ্বাশুড়ি মা। উনি আসলেই মেয়েটাকে অনেক কথা শোনান। উঠতে বসতে গালি দেন, রাগ দেখান। ওর কোনো কাজকেও সহজ ভাবে দেখতে পারতেন না। তাকে উদ্দ্যেশ্য করে কথাটা বলা হলো নাকি?
মাকে আনমনা দেখে নিরা বললো, আপনার জন্য কি তেল ছাড়া পরোটা ভাজবো?
- তেল দিয়েই ভাজো। আচ্ছা তোমরা কয় ভাই বোন?
নিরা চমকে উঠলো। এতক্ষণে বুঝি এটা জানার ইচ্ছা হলো ওনার। হায়রে শ্বাশুড়ি কপাল আমার!
নিরা মুচকি হেসে বললো- আমরা দু বোন। - ভাই নেই?
- না।
- বাবা কি করেন?
নিরা শ্বাশুড়ির মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললো, বাবা স্কুল টিচার।
- ওহ আচ্ছা। ভালো। মা কি করেন?
- মা ও স্কুল টিচার।
- দুজনেই কাজ করেন তাহলে?
- হ্যা। মা পড়াতে ভালোবাসেন, বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।
শ্বাশুড়ি আর কিছু বললেন না। নিরাকে এখন ওনার ভালোই লাগছে। যে মেয়ের বাবা মা দুজনেই মানুষ গড়ার কারিগর, তার উপর মা বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। সেরকম বাবা মায়ের মেয়ে তো লক্ষী। মা গুণেই তো সন্তান। কিন্তু মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি আসার পর থেকে তারা কি একবারও খোজ নেয়নি?
কৌতুহল বশত প্রশ্নটা করেই ফেললেন উনি- আচ্ছা তোমার বাবা মা কি খুশি হয়ে এ বিয়ে দিয়েছেন? তাদের কি মত ছিলো?
- স্বাক্ষর আমাদের বাসায় গিয়ে যখন বললো সে আমাকে ভালোবাসে আর আমার সব দায়িত্ব নিতে চায়, বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমিও ওকে চাই কিনা? আমি তো সোনায় সোহাগা। মা আগে থেকেই স্বাক্ষরের ব্যাপারে জানতো। মায়ের সাপোর্ট পেয়ে বাবা আর কিছু বলেনি।
শ্বাশুড়ি মা বললেন, ওনারা ফোন করেন না? - ফোন তো করেই। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে বলে কি পর হয়ে গেছে নাকি? আজ সকালেও ফোন দিয়েছিলো। কথা হয়। জানতে চায় আমি কেমন আছি?
- তুমি কি বললে?
নিরা একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো- বললাম খুব সুখেই আছি। বাড়ির সবাই আমাকে পেয়ে অনেক সন্তুষ্ট। মা যখন বললো, আমরা কি তোর শ্বশুর বাড়ি যাবো না? তখন ইনিয়ে বিনিয়ে এটা সেটা বলে কাটিয়ে দিয়েছি আর কি..
শ্বাশুড়ি মা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলেন। মেয়েটা আসলেই অনেক লক্ষী। এমন বউ পাওয়া তো কপালের ব্যাপার। যাক, স্বাক্ষর তাহলে ভূল কাউকে বেছে নেয়নি।
উনি লজ্জা কাটিয়ে বললেন – তোমার বাবা মাকে আসতে বোলো। তারা আসুক, আমরাও পরিচিত হই।
নিরা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। চোখে পানি এসে গেলো ওর। মায়ের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই ফেললো। শ্বাশুড়ি বুঝতে পেরে কাছে এসে নিরাকে জাপটে ধরলেন।
কাজ শেষ করে হাত ধুয়ে রুমে এসে স্বাক্ষরের বালিশের পাশে বসলো নিরা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ মেলে তাকালো স্বাক্ষর। নিরার হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে চোখ পিটপিট করে বললো, ব্যাপার কি মহারানী? সাত সকালে এত খুশি যে?
নিরা স্বাক্ষরের কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, খুব সুন্দর আজকের সকালটা।
- হুম। তোমার স্পর্শে আমারও সুন্দর হয়ে গেলো। তা ম্যাম, এত আনন্দের কারণ কি জানতে পারি?
- অবশ্যই পারেন। আগে উঠুন, চা এনেছি চা খেতে খেতে শুনবেন।
স্বাক্ষর নিরাকে বুকের উপর টেনে নিয়ে বললো, উঠবো না। আবার তোমাকে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়বো। - ছি ছি এসব বলেনা। একটা সারপ্রাইজিং কথা আছে।
- তাই নাকি! অবশ্য সেটা তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উঠছি।
স্বাক্ষর উঠে ফ্রেশ হয়ে আসো। নিরা চায়ের কাপে চা ঢেলে দিলো। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো- বাহ অসাধারণ চা বানিয়েছো তো ম্যাম। আজকে এত চমক কেন? - আজকে চমকের মতই একটা ব্যাপার ঘটেছে তাই।
- শুনি এবার?
নিরা আস্তে আস্তে খুলে বললো সকালে মায়ের সাথে ওর কথোপকথন আর জড়িয়ে ধরার ব্যাপারটা। স্বাক্ষর অবাক হয়ে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে নিরার দিকে। বিস্ময়ের সাথেই বললো- তাহলে! কাম তো সেরে ফেলেছো একেবারে। - হা হা। হুম। এখন আব্বু আম্মুকে কল দিয়ে আসতে বলো না প্লিজ। ওদেরকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
- আচ্ছা। এমনিতেও আর দেরি করা যায়না, মা নিজে থেকে আসতে বলেছে যখন।
এমন সময় শ্বাশুড়ি মায়ের ডাক শোনা গেলো, নিরা কই গো? তোমার তরকারি হয়ে গেছে বোধহয়।
স্বাক্ষর হেসে বললো, বাহ মাকে একেবারে বশ করে ফেলেছো দেখছি। বলেছিলাম না শ্বাশুড়িকে বশে আনার টনিক হচ্ছে বেশি বেশি কাজ করতে হবে।
- শুধু কাজ করলেই হয়না বাপু। কাজ তো কাজের মেয়েরাও করে। কিন্তু শ্বাশুড়ির মন জয় করার জন্য পুত্রবধূ হয়ে উঠতে হয়। বউ তো সবাই হয়, সবাই কি আর পুত্রবধূ হতে পারে?
স্বাক্ষর হেসে বললো, তা বলেছো। যাও আরেক কাপ চা এনে দাও। আজকের চায়ে মধু আছে। - যাচ্ছি। তুমি ওঠো, গোসল সেরে আসো। সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করবো।
নিরা এরপর তরকারি শেষ করে সামান্তার রুমে চলে এলো। বিছানায় অগোছালো ভাবে শুয়ে আছে সামান্তা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নিরা কাছে এসে ওর চুলগুলো সরিয়ে বললো, সামান্তা..
গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে সামান্তা। বোধহয় ভোররাতে ঘুমিয়েছে মেয়েটা। খুব মায়া লাগলো সামান্তার জন্য। নিরা আস্তে আস্তে পাশে বসে বললো- সামান্তা উঠবে না?
ডাক শুনে চোখ মেলে তাকালো সামান্তা। চোখ কচলে বললো- আমি উঠবো না এখন।
- নাস্তা করবো ওঠো।
- নাস্তা করবো না এখন।
- একা একা খেতে ভালো লাগবে না। সবাই একসাথে খাবো আসো।
আস্তে আস্তে খুব যত্নে সামান্তাকে বিছানা থেকে তুললো নিরা। নিজে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দিলো। ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে দিলো। সামান্তা মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো।
সামান্তার চোখে মুখে কান্নার রেখা। মেয়েটা নিশ্চয় কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে গেছে। নিরা ওকে সুন্দর করে বোঝানোর চেষ্টা করলো যাতে মন খারাপ করে না থাকে। সামান্তা মাথা ঝাকিয়ে বললো, আচ্ছা। নাস্তা করবো চলো।
নিরার আজ আনন্দের শেষ নেই। সবাই মিলে নাস্তা করার সময় সামান্তা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওর কষ্ট ভূলে গেলো। নাস্তা করতে করতে বাজার করার প্লান করে ফেললো স্বাক্ষর। আজকে প্রথম বারের মত শ্বশুর শ্বাশুড়ি আসবেন। সব কাজের ফাঁকেও নিরা মনেমনে ভাবছিলো রিয়ানকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়? এই অপমানের প্রতিশোধ তো নিতেই হবে।
পর্ব ৯
সামান্তার ফোন বাজছে অনেক্ষণ ধরে৷ ও ফোনটা নিয়ে দেখলো একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল। প্রথমে কলটা কেটে দিলো। এরপর আবারও কল আসলো। এবার রিসিভ করে কানে ধরে রইলো সামান্তা। ওপাশ থেকে একটা স্পষ্ট সুন্দর ছেলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, হ্যালো সামান্তা…
সামান্তা বললো, হ্যা। কে বলছেন?
- আমাকে চিনতে পারছো না?
- না তো, কে?
- আমি তো জীবনানন্দ দাশ। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি…
সামান্তা বিরক্ত হয়ে বললো, ফাজলামো করার জায়গা পান না? শোনেন এসব ফাজলামো অন্য জায়গায় গিয়া করেন। ফোন রাখেন।
রেগে ফোনটা রেখে দিলো সামান্তা। অনেক্ষণ পর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো কলটা এখনো আছে, কাটা হয়নি। ও অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকাল। এখনো কল কাটেনি কেন!
ফোনটা কানে ধরতেই শুনতে পেলো একটা গিটারের শব্দ আর সুমধুর একটা গান-
“তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার…
যত দূরে সরে যাও রবে আমার..”
সামান্তা মুগ্ধ হয়ে গানটা শুনছে। এত সুন্দর কণ্ঠ! আর কি সুন্দর করে গান গাইছে ছেলেটা। গানটা শেষ হতেই সামান্তা বললো, খুব সুন্দর করে গান গাইতে পারেন তো।
- মহারানীর ভালো লেগেছে?
- আচ্ছা আপনি কে বলুন তো?
- বললাম তো আমি জীবনানন্দ দাশ।
- জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখতেন, উনি গান গাইতেন না।
- ওহ সরি। নিজের নামটাও ভূলে গেছি। আমি তো এন্ড্রু কিশোর।
- এন্ড্রু কিশোর এসব গান গাইতেন?
- তাহলে আমি..
সামান্তা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, এখন নিশ্চয়ই বলবেন আমি তাহসান?শুনুন, আমি তাহসানের ফ্যান নই। ওর চেয়ে এন্ড্রু কিশোরই ঠিক আছে।
ওপাশের ছেলেটা শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসির শব্দ শুনেই মন ভালো হয়ে যাবার উপক্রম। সামান্তা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো কে এই ছেলেটা! এভাবে মুগ্ধ করছে কেন!
ওপাশের ছেলেটা বললো- তো ম্যাডামের কি এখনো মন খারাপ?
- আমার মন খারাপ আপনাকে কে বলেছে?
- হুম, আমি তো সুপারম্যান। আমি সব জানি।
- বাহ! এখন আবার এন্ড্রু কিশোর থেকে সুপারম্যান হয়ে গেলেন? তা এরপরে কি হবেন শুনি?
- আপাতত তোমার বন্ধু হবো।
- আমার বন্ধু! কে বলুন তো আপনি? আমার বন্ধু হওয়ার আগ্রহ কেন এত?
- আমার পরিচয় অনেকবার দিয়েছি। আর তোমার মত লক্ষী মেয়ের বন্ধু তো সবাই হতে চাইবে তাইনা?
সামান্তা বললো- ঠিক আছে বুঝেছি। কিন্তু নিজের যে পরিচয়গুলো দিয়েছেন এগুলো তো সব ভুংভাং। - আমি কি একবারও বলেছি এগুলো সত্য? এগুলো তো ভুংভাং ই।
- দেখুন আপনি কিন্তু অনেক ফাজিল।
- ফাজিল মানে তো জ্ঞানী। আমি শুধু ফাজিল না, সাথে নম্র ভদ্রও।
- থাক থাক বাবা। নিজের আর গুনগান গাইতে হবেনা। আমার নাম্বার পেয়েছেন কোথায় সেটা বলুন?
- এটা কি খুব কঠিন কাজ? তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে নিয়েছি।
- মানে! আমার ভাইয়া? আমার ভাইয়া আপনাকে আমার নাম্বার দিয়েছে এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
- হ্যা। আমার মত ভালো ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করতে সব ভাই ই তার বোনের নাম্বার দেবে।
সামান্তা ক্ষেপে বললো- ফাজলামো রাখুন দয়া করে৷ ফোন দেয়ার পর থেকেই ফাজলামো করে যাচ্ছেন। আপনার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করছি না। - না করলে ক্ষতি নেই তো। শুধু বন্ধুত্বের অনুরোধটা গ্রহণ করো।
- আমার নাম্বার কে দিয়েছে বলুন?
ওপাশ থেকে ছেলেটা হাসতে হাসতে বললো- তোমার ভাই দিয়েছে। বিশ্বাস না হলে গিয়ে জিজ্ঞেস করো গে।
- আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করবো? দাড়ান, আপনাকে ভাইয়া এমন গালি দেবে…
- চৌদ্দ গুষ্টির নাম ভূলে যাবো তাই তো? হা হা হা.।
আবারও অট্টহাসি শুরু করেছে ছেলেটা। সামান্তা ক্ষেপে যাচ্ছে ভীষণ।
ছেলেটা বললো- সুন্দরী কমলা, এখন বলো তো আমার বন্ধু হচ্ছো কিনা? আমার তাড়া আছে বাবা। - চিনিনা জানিনা বন্ধু হবো?
- হ্যা। এতগুলো পরিচয় দিলাম, তাছাড়া চেনার জন্যই তো বলছি। জানার জন্যই বন্ধু হবে।
- জানার জন্য এখন আপনার বন্ধু হতে হবে?
- হ্যা হবে।
- নাম্বারটা কে দিয়েছে বলুন?
- তোমার ভাই স্বাক্ষর দিয়েছে। বিশ্বাস করো।
- দাড়ান। আপনাকে শায়েস্তা করতে হবে বুঝেছি। আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে আসি। আজ আপনার কপালে শনি আছে।
ছেলেটা হেসে বললো- আমার কপালে শনি আছে নাকি রবি আছে সেটা একটু পরেই টের পাবা। - মানে!
- মানে আগে ফ্রেন্ডশিপ তো করো। তারপর বুঝাবো।
সামান্তা ক্ষেপে টেপে টুক করে কল কেটে দিলো। তারপর ছুটে এলো পাশের রুমে। দরজায় দাঁড়িয়ে বললো- এই ভাইয়া..
স্বাক্ষর সামান্তার দিকে তাকিয়ে বললো- কি?
সামান্তা কাছে এগিয়ে গিয়ে নাম্বারটা দেখিয়ে বললো- এই নাম্বারটা চিনো?
স্বাক্ষর এক পলক তাকিয়ে থেকেই বললো- এটা তো আয়াশের নাম্বার।সামান্তা ভ্রু কুচকে বললো- আয়াশ কে?
- আমার একটা ফ্রেন্ড। ও গতকাল আমার ফোনটা নিয়ে বললো একটা কাজ আছে। তোকে ফোন দিয়েছে?
- হ্যা। কি দুষ্ট দুষ্টু কথা। আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইছে।
- বলিস কি? আয়াশের মত ছেলে তোর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইছে?
- হ্যা।
- করতে পারিস। আমার সব বন্ধুর মধ্যে অন্যতম ভালো একটা ছেলে। খুব ফানি আর ভালো ও। তোর মন খারাপ থাকতে দেবেনা কখনো। আর আশাকরি ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করলে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাবি। তোর পাশে এখন একজন ভালো বন্ধু দরকার।
- ভাইয়া! তুই বলছিস?
- হ্যা। আমি তো তোকে রিলেশনশিপে যেতে বলিনি। রিলেশনের থেকে হাজারগুণ ভালো সম্পর্ক হচ্ছে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের সম্পর্কে দুষ্টুমি, খুনসুটি, বিশ্বাস, হেল্প সবই থাকে। রিলেশনের ব্রেকাপ হয় কিন্তু বন্ধুত্বের কখনো ব্রেকাপ হয়না।
সামান্তা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাক্ষর বললো- ফ্রেন্ডশিপ কর। তোর একটা ভালো বন্ধু দরকার। - আচ্ছা ঠিক আছে।
সামান্তা হা হয়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। স্বাক্ষর নিরার দিকে তাকিয়ে বললো- নিরা, সামান্তার ভালো হবে তো? - হুম। আয়াশ ওকে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি দিতে পারবে।
স্বাক্ষর মাথা ঝাঁকালো। মূলত আইডিয়াটা নিরার। আয়াশ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো খুব ভালো বোঝে। আর ছেলেটাও অনেক ফানি। নিরার মনেহচ্ছিলো এই মুহুর্তে একজন ভালো বন্ধু সামান্তাকে উঠে দাড়াতে হেল্প করবে। কিন্তু কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করলে ঠিকমতো গুরুত্ব দিতো না। তাই আয়াশের কথাই প্রথমে মাথায় এসেছে। আয়াশ যেমন দুষ্টুমি করতে পারে, তেমনি সামান্তাকে স্বাভাবিক করতেও পারবে। নিরার আইডিয়া মতই স্বাক্ষর ও নিরা আয়াশের সাথে কথা বলেছে। সব শুনে আয়াশ আর না করেনি। একটা বন্ধু হলে তো ভালোই, আর সেইসাথে কারো যদি উপকার হয় তো হোক না।
নিরার বাবা মা প্রথমবারের মত বেয়াইবাড়িতে এসেছেন। ওনাদেরকে অনেক নার্ভাস দেখাচ্ছে। বেয়াই পরিবারের মানুষগুলো কেমন, তাদের মেয়েটা ভালো আছে কিনা, এভাবে বিয়ে পড়িয়ে দেয়ায় ঠিকভাবে নিয়েছে কিনা এরকম নানান প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে তাদের৷ প্রথমবার এসেছে বলেই ওনারা নার্ভাস ফিল করছেন। নিরাও ভয়ে ভয়ে আছে শ্বাশুড়ি মা তাদের সাথে কেমন আচরণ করবে এটা নিয়ে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে উনি নিরার মাকে জাপটে ধরলেন। হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসতে আসতে বললেন, কেমন আছেন? আপনাকে আপা ডাকবো না বেয়াইন ডাকবো?
নিরার মা হেসে বললেন, যেহেতু বেয়াইন হই কাজেই বেয়াইন বলেই ডাকা দরকার তাইনা?
বলে দুজনেই হেসে উঠলেন। নিরাও হাসলো ওদেরকে দেখে। সামান্তা কাছে এসে নিরার বাবা মাকে সালাম জানালো।
নিরা রান্নাবান্না শেষ করে অনেক যত্নে সবাইকে আপ্যায়ন করলো। নিরার মা নিরাকে এভাবে কাজ করতে দেখে অনেক সন্তুষ্ট। মেয়েটা তাহলে দ্রুত শ্বাশুড়ির মন জয় করতে পেরেছে!
এমন সময় ফোন বেজে উঠলো সামান্তার। ও স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আয়াশ ফোন করেছে। ফোন হাতে নিজের রুমে এসে ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে আয়াশ বললো- কি অবস্থা ম্যাম?
- এইতো ভালো। আপনার?
আয়াশ হো হো করে হেসে বললো- আমাকে শায়েস্তা করার বদলে নিজেই শায়েস্তা খান হয়ে গেছো দেখছি। বলেছিলাম না, আমার কপালে শনি নেই, রবি আছে।
সামান্তা হেসে বললো- আপনি এত ফাজিল কেন?
- হ্যা। আমি খুব জ্ঞানী। সুপারম্যান না?
হাসি পেলো সামান্তার। সত্যিই কি দুষ্টু রে বাবাহ!
পর্ব ১০
সামান্তার হাসির শব্দ শুনে আয়াশ খানিকটা সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো, ‘তোমার হাসি ঢেকির মত ঢুকুর ঢুকুর শব্দ করে।’
সামান্তা ক্ষেপে বললো, কি বললেন? আমার হাসি ঢেকির মত?
- হ্যা।
- জানেন সবাই আমার হাসির কত প্রেইজ করে? সবাই বলে আমার হাসি অনেক সুইট।
- সবাই সেম কথা বলে বলেই তো আমি অন্যকিছু বলি। এ জন্যই আমি তোমার বন্ধু।
সামান্তা কিছু বললো না। আয়াশের কণ্ঠটা অনেক সুন্দর। ছেলেটার উচ্চারণ অনেক স্পষ্ট আর খুব মজা করে কথা বলে। ভালোই লাগছে সামান্তার। ও বলল, আচ্ছা আপনি হঠাৎ আমার বন্ধু হওয়ার জন্য লেগেছেন কেন?
- এখনও লাগিনি। মাত্র তো ইচ্ছা প্রকাশ করলাম।
- বেশ দুষ্টুও আছেন।
- সে তো তোমাকে জ্বালাবার ই জন্য।
- আমি কি জ্বালানি?
- আমার জ্বালানি।
সামান্তা বললো, বাপরে। ছেলেমানুষ রাও এত ঝগড়াটে স্বভাবের হয় আমি জানতাম না। - আমি এসে জানাবো বলে এতদিন জানতে না।
- ও আচ্ছা? তাই নাকি? আর কি কি জানাবেন শুনি?
- যা যা জানলে নিজেকে নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে পারবা।
- বাহ! তাহলে এখনই জানানো শুরু করুন।
- তাহলে তো মজা থাকবে না। ধীরেধীরে জানাবো।
- অল্প একটু জানান না..
আয়াশ বললো- তুমি হাসলে তোমার চোখ দুটোও হাসে। খুব সুন্দর লাগে দেখতে।
- সবাই হাসলেই চোখ হাসে।
- উহু না। সবাই হাসলে চোখ হাসে না। তোমার হাসির সাথে সাথে চোখ দুটোও হাসে। মায়াবতীর হাসি।
সামান্তা কিছু বললো না। ছেলেটা কি যে আবোলতাবোল বলছে! তবে কথাগুলো শুনতে মোটেও খারাপ লাগছে না। বরং বেশ মন ভালো করা কথাগুলি। ছেলেমানুষী মিশে আছে কথায়।
সামান্তা যখন নিরব হয়ে এসবই ভাবছিলো, ওদিকে সুন্দর করে বকবকানি চালিয়েই গেলো আয়াশ।স্বাক্ষরের শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে ওর বাবা মায়ের বেশ ভালোই খাতির চলছে। সবাই মিলে দারুণ আড্ডায় মেতে উঠেছে। নিরা ও স্বাক্ষর হাসিমুখে চেয়ে আছে ওনাদের দিকে।
হঠাৎ স্বাক্ষরের মা বললেন, তো বেয়াইন সাহেবা, আমার রুমে আসেন না। আমরা বেয়াইন বেয়াইন একটু গল্প করি।
বেয়াইন সাহেবা হেসে বললেন, চলেন।
বাকিদেরকে বসিয়ে রেখে ওনারা দুজন পাশের রুমে চলে গেলেন। ও রুমে গিয়ে বিছানায় বসে শ্বাশুড়ি মা নিরার মাকে বললেবললেন, আমার ছেলেটাকে কেমন লাগে বেয়াইন?
নিরার মা বললেন, অনেক ভালো একটা ছেলে। নিরাকে তো ভাগ্যবতী বলি এরকম একটা স্বামী পাওয়ার জন্য। তো বেয়াইন, আমার মেয়েটাকে কেমন লাগে?
উনি উত্তরে বললেন, হ্যা ভালোই। কাজ কর্ম বেশ ভালোই করে। তা, মেয়ের ঘর তো দেখলেন। বাড়িটা করতে অনেক টাকা পয়সা খরচ করেছি। স্বাক্ষরের বাবার আর আমার অনেক সাধের বাড়ি। দুটো রুম ই দিয়েছি স্বাক্ষরকে। আর একটা দিয়েছি সামান্তাকে। স্বাক্ষর তো স্টুডেন্ট অবস্থায় বিয়ে করলো, আমরা তো চেয়েছিলাম ও চাকরিতে জয়েন… থাক যা হবেনা সেটা ভেবে আর কি হবে..
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন স্বাক্ষরের মা। নিরার মা কি বলবেন বুঝতে না পেরে বললেন, মন খারাপ করবেন না বেয়াইন। নিশ্চয় এর পিছনে ভালো কিছু আছে। যা কিছু ঘটে, আমাদের ভালোর জন্যই তো ঘটে।
- হ্যা। দেখি কি ভালো হয়। আশা ভরসা সব তো শেষ। আর কি ভালো হয় দেখি..
নিরার মায়ের মনটা কেমন করে উঠলো। একজন মায়ের এরকম আক্ষেপ করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু স্বাক্ষর যা করেছে নিরাকে ভালোবেসেই করেছে। নিরাকে হারালে হয়তো একটা ভালো ক্যারিয়ার হতো, কিন্তু নিরাকে তো আর পেত না। কিছু কিছু মানুষের জীবনে প্রিয় মানুষটার প্রাধান্য অনেক বেশি থাকে, অনেক বেশি।
নিরার শ্বাশুড়ি বললেন, যা হবার হয়েই গেছে। এসব ভেবে আর লাভ নেই। বলছি যে, ছেলেটার পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বাকরি নেয়া, সেটা তো সময় লাগবেই৷ এতদিন ছেলে আর ছেলের বউকে তো আমাদেরকেই দেখাশোনা করতে হবে। ভরণ পোষণ, কাপড় চোপড় যা লাগে। আপনারাও পারলে একটু খেয়াল রাখবেন এদিকে।
নিরার মা চমকে উঠলেন। নিরাকে কি ওনারা নিজের মেয়ে ভাবতে পারছেন না? ওনাদের যদি আরেকটা মেয়ে থাকতো, তার দায়িত্ব কি নিতে হতো না?
প্রশ্নটা মনে রেখে উনি মুখে বললেন, আচ্ছা। আপনি এত দুশ্চিন্তা করবেন না।
- তা না হয় করলাম না। আপনাকেও বলি, মেয়ের ঘরভর্তি জিনিসপত্র থাক আপনি কি সেটা চান না?
- কেন চাইবো না?
- এখন তো ওরা কাজ কর্ম করছে না কিছুই। দুটো ঘর, সাজানোটা আমাদের পক্ষে তো কঠিন ই হয়ে যায়। মেয়ের ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে আপনি যদি কিছু একটা..
অবাক হয়ে চোখ বড়বড় করে ফেললেন স্বাক্ষরের শ্বাশুড়ি মা। ছেলের শ্বশুরবাড়ির কাছে এভাবে কিছু চাওয়ার জন্য উনি তাহলে ডেকেছেন! ওনারা ভেবেছিলেন নিরার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েই আজকে দেখা করতে বলছেন ওনারা। কিন্তু শুধু দেখা না, আত্মাটাও অনেক ছোট দেখছি। রীতিমতো যৌতুক চেয়ে বসলেন।
উনি কিছু না বলে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্বাক্ষরের মা বললেন, ছেলেকে বড় করতে প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করেছি। যখন যা বলেছে, তাই করেছি। ক্যান্ট পাবলিকে রেখে পড়িয়েছি, কোনোকিছুর কমতি রাখিনি। ইচ্ছা ছিলো একটা ভালো জায়গায় যাবে ছেলেটা, কিন্তু তার আগেই বিয়েটা করে সব আশা নষ্ট করে দিলো।
- আশা হারাবেন না। বিয়ে করলেই জীবন যে শেষ হয়, তা কিন্তু না। জীবনটা শুরুও হতে পারে। ওর মেধা আছে, ভালো কিছুই করবে।
স্বাক্ষরের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, হুম। আপনি একটু মেয়ের দিকটা দেখবেন। চাকরি বাকরি করতে বলছি না। আমার বাড়ির বউকে চাকরি করাতে হবেনা, শুধু ঘরের আসবাবপত্র আর যদি মেয়েকে খুশি করতে গয়নাগাটি কিছু দেন। দেখেন আসবাবপত্র আপনার মেয়ের ঘরেই তো থাকবে। আর অর্নামেন্টস ও আপনার মেয়েরই থাকবে।
নিরার মা কিছু বললেন না। যদিও মনেমনে ভীষণ মন খারাপ করলেও মুখে হাসার চেষ্টা করে বললেন, অবশ্যই। স্বাক্ষরকে আমি নিজের ছেলেই মনে করি।
কথাটা বলে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কিভাবে পারেন এই মহিলা! ওনার মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা হয়ে গেলো। নিরা ই বা কিভাবে এত ছোট মন মানসিকতার মহিলাটাকে মেনে নিয়ে এত হাসিখুশি। মেয়েটা কখনও নিজের মন খারাপের কথা কাউকে জানতে দেবে না। অদ্ভুত প্রজাতির একটা মেয়ে।
কোনোমতে কথা শেষ করে বসার ঘরে এলেন ওনারা দুজন। সবার সাথে দু একটা কথা বলে বিদায় নিলেন বেয়াইবাড়ি থেকে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছে নিরা। কিন্তু কি এমন বলতে পারে সেটা ধারণাতেও এলো না। ও হাসিমুখে মাকে বিদায় দিয়ে দিলো।
রুমে এসে নিরা স্বাক্ষরকে বললো- সবকিছু ভালোভাবে হয়ে গেছে তাইনা? আমি তো ভাবতেই পারিনি মা এত তারাতাড়ি আমাকে মেনে নেবেন।
স্বাক্ষর নিরাকে বুকের উপর টেনে নিয়ে বললো- আমার মায়ের উপর আমার এতটুকু ভরসা আছে। আর তোমার উপরেও ভরসা আছে। আমি তো জানি আমার নিরা পাগলীটাকে কেউ ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না।
নিরা হেসে জাপটে ধরলো স্বাক্ষরকে। আজ কষ্টটা খানিকটা কমে এসেছে। কিন্তু দুশ্চিন্তা হচ্ছে সামান্তার জন্য। মেয়েটা ওর ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে পারবে তো?সামান্তার ঘর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। দীর্ঘ সময় পর বোনের হাসির শব্দ শুনতে পেলো স্বাক্ষর। ও অবাক হয়ে নিরার দিকে তাকিয়ে বললো- সামান্তা হাসছে? আমি ভূল শুনছি না তো?
- না গো। সামান্তা খুব সুন্দর করে হাসে তাই না?
- থ্যাংকস নিরা। তোমার আইডিয়াটা কাজে লেগেছে। এবার বলোতো রিয়ানকে কিভাবে সায়েস্তা করা যায়?
- ও যেভাবে সামান্তাকে ফাঁদে ফেলেছে, আমিও ওকে ঠিক সেভাবেই ফাঁদে ফেলতে চাই।
- মানে!
- মানে রিয়ানকে আমি প্রেমের ফাঁদে ফেলতে চাই। এছাড়া আর কোনো উপায় আপাতত মাথায় আসছে না। ওকে এভাবেই উচিত শিক্ষাটা দিতে হবে।
- কিন্তু তোমার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়?
- আমাকে ভাবতে দাও আরো। কিন্তু ওই ছেলেটা তোমার, আমার সামান্তার, আমাদের পুরো ফ্যামিলিটাকে অশান্তিতে ফেলে দিয়েছে। ওকে একটা শিক্ষা তো আমি দেবো ই।
তেজী হয়ে উঠেছে নিরার চেহারা। চোখে যেন আগুন ফুটে উঠেছে। নিরার দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো স্বাক্ষরের।
আগেই বলেছি গল্পটা বর্তমান সমাজের কিছু কিছু পরিবারে নিয়মিত ঘটে চলা ঘটনার কিছু চিত্র।
কিছু কিছু বাবা, মা ছেলে বিয়ে করিয়ে ফার্নিচার, গহনা, ছেলেটাকে একটা লাইন করে দেয়া, বিদেশ পাঠানোর জন্য টাকার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি নামক যৌতুক নিতে উঠে পড়ে লেগে যায়। আর যারা দিতে অপারগ তাদের সংসারে নেমে আসে অশান্তি।
পর্ব ১১
ফেসবুকে ঢুকে রিয়ান দেখলো একটা মেয়ের আইডি থেকে মেসেজ রিকুয়েষ্ট। মেসেজে ক্লিক করে কথাগুলো পড়েই হাসি ফুটে উঠলো রিয়ানের মুখে।
মেয়েটা লিখেছে, ‘আপনার ছবিগুলো অসম্ভব সুন্দর। আপনার প্রত্যেকটা স্ট্যাট্যাস ও অনেক সুন্দর। এতটাই ভালো লাগে দিনে কয়েকবার আপনার প্রোফাইলে ঢু মারি। আপনার সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে রাখলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।’
মেসেজটা পড়ার পর খুশিতে গদগদ হয়ে গেল রিয়ান। এই প্রথম কোনো মেয়ে এভাবে প্রশংসা করেছে ওর। আনন্দে লাফালাফি করতে ইচ্ছে করছে ওর। সাথে সাথেই মেয়েটার মেসেজ রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করে রিপ্লাই দিল, ‘কি যে বলেন আপনি। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! তবে রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করে নিলাম।’
মেয়েটা সাথে সাথে রিপ্লাই দিলো, ‘সত্যি বলছি। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন। আপনি সত্যিই অনেক জিনিয়াস। প্রাউড অব ইউ।’
রিয়ানের খুশি এবার আর দেখে কে! একটা মেয়ে লাইফে ফার্স্ট টাইম এভাবে প্রশংসা করলো। শুনেই তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। তাও আবার মেয়েটার কথা বলার ধরণটাও মনে ধরার মত।
রিয়ান লিখলো, ওকে বিশ্বাস করলাম। কিন্তু আপনি কে?
- আমি রিয়া। আপনার নামের সাথে আমার নামের অদ্ভুত মিল তাইনা?
- হুম অদ্ভুত মিল। কই থাকো?
- এত তারাতাড়ি তুমি বলাতেই ভড়কে গেলাম। তবে আপনার জন্য ঠিক আছে। আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন।
- ওহ শিট। সরি প্রথমবার তুমি বলার জন্য। আমার সাধারণত এমন হয়না, কেন জানি তোমার ক্ষেত্রেই এরকম হলো। প্লিজ মাইন্ড করবেন না।
- রিয়ান আপনি আমাকে তুমি করে বললেই আমি বেশি খুশি হবো।
- ওকে ফাইন। কই থাকো?
- আমি কুমিল্লায় থাকি। আপনি?
- ওহ রিয়েলি? আমিও কুমিল্লায় থাকি।
- জানি।
- কিভাবে জানো?
- এতবার আপনার প্রোফাইলে ঘুরঘুর করি আর এটুকু জানবো না? আমার তো সব মুখস্থ। আপনি কোথায় থাকেন কি করেন সব জানি।
রিয়ান চমকালো। মুগ্ধ হওয়ার মত ব্যাপার তো। কে এই মেয়ে? এত বড় ফ্যান কিভাবে হলো?
মেয়েটা লিখলো – আপনার একটা ছবি দেবেন? - ছবি তো আমার ওয়ালেই আছে অনেক।
- ওগুলো সব আমার ফোনের গ্যালারিতে সেভ করা। নতুন ছবি দিন।
- সেকি আপনার ফোনে আমার ছবি কেন?
- কারণ আমি যে আপনার অনেক বড় ফ্যান। তাই।
এবার ইমপ্রেসড হওয়ার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে রিয়ান। মনটা তিরিং বিরিং করে লাফাচ্ছে। খুশিতে গদগদ হয়ে মেসেজের রিপ্লাই দেয়া শুরু করলো ও।
এদিকে এত দ্রুত রিয়ানকে জালে ফেলতে পেরে নিরার আনন্দ যেন আর ধরেই না। এভাবেই আস্তে আস্তে ফাদে ফেলে অবস্থা খারাপ করতে হবে ওর। তারপর বুঝবে নিরা কি জিনিস? কত ধানে কত চাল এবার টের পাওয়াবো।
নিরা মোবাইলে মেসেজিং করাতে ব্যস্ত। স্বাক্ষর এসে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধের উপর মাথা রেখে বললো- এত কি করা হচ্ছে ফোনে?
- গেম খেলি।
- ওসব খেলা বাদ দাও। এখন আমরা খেলবো আসো।
নিরা মুখ তুলে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে বলল- কি দুষ্টুমি কথাবার্তা এসব? - হুম দুষ্টুমি। আমার বউয়ের সাথে আমি একশো বার দুষ্টুমি করবো। এখন খেলবা কিনা বলো তো?
- কি খেলবো?
- লুডু খেলবো।
নিরা হেসে স্বাক্ষরকে মাইর শুরু করে দিয়ে বললো- ফাজিল একটা। এই না বললা দুষ্টুমি?
- বাব্বাহ! দুষ্টুমির এত ইচ্ছে?
- যাও তো এখন। আমাকে মোবাইলে গেম খেলতে দাও।
- দিবো না। তোমাকে জ্বালানোটা আমার নৈতিক অধিকার।
- ঠিকমতো তো জ্বালাতেও পারো না। খালি চাপা।
স্বাক্ষর চোখ পাকিয়ে বলল- কি বললা? আমি জ্বালাতে পারিনা? - একদম ই না।
- দাড়াও দেখাচ্ছি মজা।
স্বাক্ষর নিরাকে তুলে কোলে নিলো। কোলে করে এনে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে বলল- আমি জ্বালাতে পারি না তাই না?
- মোটেও না।
স্বাক্ষর নিরার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর মুখের উপর উঁচু হয়ে এসে বললো- আমার চোখে কি দেখো? - কিছুই দেখিনা।
- কিছুই দেখো না?
নিরা হাসতে আরম্ভ করে দিলো। স্বাক্ষর নিরার পেটের উপর হাত রেখে হাতটা আস্তে আস্তে উপরে তুলতে লাগলো আর চাপ দিচ্ছিলো আলতো করে। নিরা হাসতে হাসতে বলল- এই কাতুকুতু লাগছে তো।
স্বাক্ষর তবুও থামলো না। নিরা ওর হাতটা সরানোর চেষ্টা করে বলল- বাবু ছাড়ো না। - কেন? আমি নাকি জ্বালাতে পারি না?
- খুব পারো। এখন থামো।
স্বাক্ষর নিচু হয়ে এসে নিরাকেই থামিয়ে দিলো, নিরার ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের মাঝে আবদ্ধ করে ভালোবাসার নতুন বন্ধনে বাঁধলো।
একটা দিন কেটে গেলো মাঝখানে। নিরা রিয়ানের সাথে ফেক আইডি দিয়ে চ্যাটিং চালিয়ে গেল। রিয়ান নিরার ছবি দেখতে চাইলে একটা সুন্দরী মেয়ের ছবি পাঠিয়ে দিলো নিরা। বেশ জমে উঠেছে কথাবার্তা। রিয়ানের কথার ধরণ আর মেসেজের গুরুত্ব দেখেই বোঝা যায় ছেলেটা খুব দ্রুত প্রপোজ করবে ওকে। মজাই লাগছে নিরা’র।
এদিকে নিরার বাবা মা চিন্তায় ডুবে আছেন। মেয়ের বাসায় আসবাবপত্র পাঠাতে হবে। কিন্তু কি পাঠাবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। নিরার সাথে আলোচনা করার জন্য ওনারা ফোন দিলেন মেয়েকে।
নিরার মা জিজ্ঞেস করলেন – তোর কেমন আলমারি পছন্দ রে মা?নিরা অবাক হয়ে বলল- এটা আবার কেমন প্রশ্ন আম্মু? আমার কেমন আলমারি পছন্দ বলতে?
- কেমন চেয়ার পছন্দ? বেতের নাকি আরএফএল?
নিরা এবার বিব্রত হয়ে বলল- এগুলো কেমন প্রশ্ন বলবা? উদ্ভট কথাবার্তা তোমার। কি বলতে চাচ্ছো বলো তো দেখি। - তুই কি কি আসবাবপত্র নিবি সেটা বল?
- মানে কি? আমি কি আসবাবপত্র নেবো? মাত্র সংসার শুরু করলাম। আগে আমার জামাই আয় রোজগার করতে শিখুক তারপর ওসব।
- তোর শ্বাশুড়ি যে বললো..
নিরার দুই ভ্রুয়ের মাঝে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। অবাক হয়ে বলল- মানে? কি বলেছেন উনি?
মা এবার খোলাখুলিভাবে কথাগুলো তুলে ধরলো নিরার সামনে। সব শুনে নিরা যেন আকাশ থেকে পড়লো। শ্বাশুড়ি মা এসব কি বলেছেন! যৌতুক চাইছেন উনি! এত ধনসম্পত্তি থাকার পরও ছেলের শ্বশুর শ্বাশুড়ির কাছ থেকে এসব চাওয়াটা তো ছোট মনের বহিঃপ্রকাশ। কি বলবে বুঝতে না পেরে নিরা বলল- তোমার মাথা থেকে এই চিন্তা ঝেড়ে ফেলো মা। আমি কোনো যৌতুক দেবো না ব্যস। - যৌতুক তো চায় নাই। আসবাবপত্র চেয়েছে।
- এটা কি যৌতুক না? তাদের ছেলেকে বড় করতে তাদের টাকা পয়সা খরচ হয়েছে আর তোমার হয়নি? তোমার মেয়ে কি এমনি এমনি বড় হয়েছে?
মা চুপ করে রইলেন। এগুলো ওনারও মনের কথা কিন্তু সেদিন চুপ থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না।
নিরা বলল- আমি আমার শ্বশুর বাড়িতে কিছুই আনবো না। তুমি ভূলেও আর এই চিন্তা ভাবনা মাথায় এনো না। - দ্যাখ মা, অশান্তি বাড়াস না। ওনারা তোকে মেনে নিয়েছে এটাই শোকরিয়া। যা চেয়েছে, দিতে অসুবিধা তো নেই।
- তুমি চুপ থাকো আম্মু। আমি এদিকটা দেখছি। যৌতুক দেয়া নেয়া কোনোটাই সাপোর্ট করিনা আমি।
- আরেকবার ভেবে দেখলে হয়না? জিনিসগুলো দিলে ওনারা খুশি হবেন তোর উপর।
নিরা রেগে বলল- তারমানে পুত্রবধূর সন্তুষ্টি ওনারা আসবাবপত্র দিয়ে মেটাবেন? এ কেমন নিয়ম!
পর্ব ১২
নিরার ভীষণ পেট ব্যথা করছে। পেট চেপে ধরে শুয়ে আছে ও। মাথায় এলোমেলো ভাবে চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে। শ্বাশুরি মা আসবাবপত্র চেয়েছেন সেটা এখনো মেনে নিতে পারছে না ও।
মেসেঞ্জারে টুংটাং করে মেসেজ আসছে। নিশ্চয় রিয়ান। নিরা ফোনটা নিয়ে দেখলো সত্যিই রিয়ান। ও মেসেজে লিখেছে, কি খবর মিস রিয়া? আজকে কোনো টেক্সট নেই যে?
নিরা লিখলো, পেট ব্যথা করছে।
- অসুস্থ নাকি?
- পেট ব্যথা যদি অসুখ হয় তাহলে অসুস্থ।
মেসেজটা সেন্ড করে দিয়েই অফলাইনে চলে গেলো নিরা। পেট চেপে ধরে শুয়ে রইলো। স্বাক্ষর বাসায় ফিরলো কিছুক্ষণ পরেই নিরাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললো, বাবু কি হয়েছে তোমার?
পেট ব্যথার কথা শুনে চিন্তিত মুখে স্বাক্ষর বললো, মাকে বলেছো?
- না। বলেও বা লাভ কিসে?
- কি বলো এসব? পেট ব্যথা করছে এটা মাকে জানাবা না? এ বাড়িতে মা ছাড়া আপন কে আছে তোমার?
- মা কি আমাকে নিজের মেয়ে মনে করে স্বাক্ষর?
স্বাক্ষর রেগে গেলো। কিন্তু এ অবস্থায় কোনো সিনক্রিয়েট করলো না। নিরার শিয়রে বসে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কিসের ব্যথা মনেহচ্ছে তোমার? গ্যাস্ট্রিক বা অন্যকিছু?
- পেটের ডানদিকে প্রচণ্ড ব্যথা করছে স্বাক্ষর।
- ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো? যাবা?
- আমি এখন যেতে পারবো না।
- তুমি নড়াচড়া কোরো না। আমি ডাক্তার আংকেলকে ফোন দিচ্ছি।
নিরার মাথার কাছে বসে থেকে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো স্বাক্ষর। অসুস্থতার সময়ে স্বামীকে এভাবে পাশে পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। পেটের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। নিরা স্বাক্ষরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে রইলো।
ডাক্তার আংকেল এসে ওষুধ দিয়ে গেলেন। খাবার তুলে খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালো স্বাক্ষর। ওষুধ খাওয়ার পর অনেকটা আরাম বোধ করছে নিরা। স্বাক্ষর তবুও ওর পাশে বসে রইলো। স্ত্রীকে ছেড়ে একটুর জন্যও কোথাও নড়লো না।
নিরার ফোন বেজে উঠলো এমন সময়ে। নিরা ঘুমাচ্ছে বলে ফোনটা রিসিভ করলো স্বাক্ষর। শ্বাশুরি মা ফোন করেছে। স্বাক্ষর রিসিভ করামাত্র ওপাশ থেকে উনি বললেন, মা রে। আসবাবপত্র দিতেই তো হবে, অযথা এত সময় নিচ্ছিস কেন?
স্বাক্ষর কৌতুহলী হয়ে বলল, মা আমি স্বাক্ষর বলছি। আসবাবপত্র বলতে? কাকে দিতে হবে আর কে সময় নিচ্ছে?
শ্বাশুরি মা বললেন, বাবা তোমার মা বলছিলেন কিছু দিতে।
- মানে! কি দিতে বলেছে আমার মা?
- ঘরের আসবাবপত্র কিছু দিলে ওনাদের জন্য ভালো হতো।
মাথায় রক্ত উঠে গেলো স্বাক্ষরের। রাগটা সামলে নিয়ে বলল, কিছু দিতে হবে না। আপনারা এই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমি এদিকটা দেখছি।
ফোন রাখার পর মেজাজ বিগড়ে গেলো স্বাক্ষরের। মা এত নিচে নামলো কবে? এভাবে ছেলের শ্বশুরবাড়ির কাছে কিছু চাওয়া যায় নাকি? অন্য কারো পরিবার চাইলেই স্বাক্ষরের মাথায় রক্ত উঠে যায়। সেখানে নিজের মা এভাবে.. নাহ, এটা মানা যায় না।
স্বাক্ষর নিরার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ও ঘুমাচ্ছে। চোখেমুখে ব্যথার ছাপ। ওকে না ডেকে স্বাক্ষর সোজা মায়ের রুমে চলে এলো।
মা জিজ্ঞেস করলেন, কি রে বাবা? কিছু বলবি?
- হ্যা আম্মু। নিরা যে অসুস্থ এটা তুমি জানতে?
- ডাক্তার আসার পর দেখলাম। আগে তো তোর বউ কিছু বলেনি।
- তুমি তো একটাবার দেখতে যাওনি আমার বউ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। একই বাসায় পাশাপাশি রুমে থেকেও এটা জানোনা। তাহলে আমার ঘর নিয়ে তোমার এত টেনশন কেন? আমার ঘর নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা হওয়ার তো কথা না।
মা অবাক হয়ে বললেন, কি বলছিস বুঝতে পারছি না বাবা। - তুমি নিরার মায়ের কাছে ঘরের ফার্নিচার দাবি করেছো?
মা চুপ করে রইলেন। ছেলের মুখের উপর এর উত্তরে কিইবা বলার থাকে। তবুও আমতা আমতা করে বললেন, ঘরদুটো খালি পড়ে আছে। আসবাবপত্র থাকলে সুন্দর দেখাতো। আর এখন বউ এসেছে, ওর তো লাগবেই এটা সেটা।
স্বাক্ষর বললো, আমার ঘর আলো করে আমার স্ত্রী এসেছে আম্মু। ওর চেয়ে বড় কিছু আমার দরকার নাই। আর আমাদের ঘরে আর কোনো আসবাব ও দরকার নেই। আমি যখন আয় রোজগার করবো, তখন সব হবে।
মা বললেন, তাহলে আয় রোজগার কর না। এখনো রোজগার করার মুরদ নেই, বিয়ে তো করে নিয়ে এসেছো। বাপের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে কেন? যাও, কাজ কর্ম করে রোজগার করো। সংসার খুব কঠিন জিনিস বুঝলি? মুখে বললেই হয়না।
স্বাক্ষর নিজেকে সংযত করে নিয়ে বলল, সংসার আগেও যেমন ছিলো, এখনো তেমনি আছে মা। একটা মেয়ে কি এমন খাবার খায় যে ওকে মানসিক চাপ দেবে?
- তোর বউকে আমি মানসিক চাপ দিচ্ছি?
- মা, আমি চাইনা তোমাকে এগুলো নিয়ে কেউ কিছু ভাবুক। প্লিজ আর কখনো এমন কোরো না। আমার ঘর জুরে আলোকময় হয়ে আমার স্ত্রী ই থাকুক।
- ভালো। আজকে বিয়ে করতে না করতেই মায়ের মুখে মুখে তর্ক করা শিখে গেছিস।
- তর্ক নয় আম্মু। আমার আত্মসম্মানে খুব লেগেছে তাই বলছি। আমি কখনো কি তর্ক করেছি তুমি বলো?
- হইছে হইছে। এখন তো তর্ক ই করছিস। মুখের সামনে থেকে যা তো। বউয়ের সেবা কর গিয়ে। এটা তো জানা কথা, বউ এলে মা পর হয়ে যায়।
স্বাক্ষরের প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গেলো। বললো, এভাবে বলছো কেন আম্মু? তুমি আমার উপর রাগ করছো কেন? একটা ভালো কথা বলতে এসেছিলাম। এজন্য এতকিছু..
মা কিছু বললেন না। স্বাক্ষর নিজের রুমে চলে এলো। মায়ের কথার ধরণ বদলে গেছে। দিনদিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। বিয়েটা করার পর থেকেই মা এরকম আচরণ করছে। নিরার তো দোষ দেয়া যায় না। কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছে না ও। মনেমনে প্রতিজ্ঞা করলো আর কখনোই মাকে কিছু বলতে যাবে না ও। বলতে গেলেই তো মা উলটা পালটা বোঝে। তারচেয়ে নিজেই সহ্য করে নেবে।
নিরা পুরোটা সন্ধ্যা ঘুমিয়ে কাটালো। রাতে রান্না করার সময় শ্বাশুরি মা ভয়াবহ ক্ষেপে গেলেন। মনেমনে বলতে লাগলেন, কাজ করার ভয়ে ওভাবে শুয়ে আছে। এদিকে নিরার শরীর খারাপ সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওনার। বরং বারবার এটাই বলতে লাগলেন যে কাজ করার ভয়ে শুয়ে আছে।
নিরা রাত্রিবেলা উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। স্বাক্ষর ওকে নিয়ে খাবার টেবিলে এসে সামান্তাকে ডাকলো খেতে। সবাই খেতে বসার পর দেখলো মা আসেননি। স্বাক্ষর মাকে ডেকে বললো, কি গো আম্মু তুমি খাবে না? আসো।
মা হঠাৎ খেমটা মেরে বললেন, ওখানে আমার জায়গা হবে? সবাই থ। এটা কেমন কথা? জায়গা হবে এটা কোন ধরণের প্রশ্ন! নিরা মাথা নিচু করে ফেললো। সামান্তা হা করে মায়ের দিকে তাকালো। স্বাক্ষর মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করছে এবার মাকে কি বলা উচিৎ? কিছু বললেই তো মা ভূল বুঝবেন। আর এর উত্তরে কিইবা বলা যায়? বিয়েটা করে কি খুব অন্যায় হয়ে গেছে? বিয়ের পর থেকেই মা বদলে গেছে।
স্বাক্ষরের বাবা বললেন, এটা কেমন কথা তোমার? জায়গা হবে বলতে কি বোঝাতে চাইছো? সবসময় একটা চেয়ার ফাঁকাই ছিলো, এখনো আছে। তুমি এমন চটাং চটাং জবাব দেয়া কবে শিখেছো?
- আমি তো খারাপ, খুব খারাপ মহিলা। খারাপ মানুষরা কি ভালো মানুষদের সাথে বসতে পারে?
স্বাক্ষর মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। মনের শান্তিটাই নষ্ট হয়ে গেলো। মাকে বোঝানোর সাধ্য কারো নেই আর। এদিকে নিরা হা হয়ে বসে আছে। শ্বাশুরি মা আগে থেকেই এমন ছিলেন নাকি ও আসার পর থেকে এমন হয়ে গেছে সেটাই ভাবছে ও।
শ্বশুর মশাই বললেন, এত কাহিনী বাদ দিয়ে এখন এসে আমাদের সাথে খেতে বসো। না আসলে খাবার টেবিল উলটে ফেলে দিবো মনে থাকে যেন।
ওনার জবাব শুনে মনেমনে খুশি হলো নিরা। অন্তত একজন মানুষ যদি ওকে বোঝে তাতেও শান্তি। স্বামীর জবাবে ভয় পেয়ে টেবিলে এসে বসলেন স্বাক্ষরের মা। তবুও ওনার মুখটা ভার। স্বাক্ষর আর কিছু বললো না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে যার যার রুমে চলে গেলো সবাই।
স্বাক্ষরের মা ঘুমাতে এসে স্বামীকে বললেন, কাজের ভয়ে মেয়েটা পেট ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে শুয়ে থাকে।
- কি বলো? প্রথম কদিন তো বেশ ভালো কাজ করতে দেখলাম।
- প্রথম প্রথম সবাই ওরকম কাজ দেখায়। পরে টের পাওয়া যায় আসল চরিত্র। কিছু বলাও যায় না তোমার ছেলের কারণে। মুখে মুখে তর্ক করে।
স্বাক্ষরের বাবাও ভাবলেন সত্যিই হয়ত নিরা এরকম। আর স্বাক্ষরও বিয়ের পরে বদলে গেছে। এসব ভেবে ওনারও মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
এদিকে স্বাক্ষর নিরাকে বুকে চেপে ধরে বললো, এখনো পেট ব্যথা করছে? - না। এখন তেমন নেই।
- মায়ের আচরণে কিছু মনে কোরো না নিরা। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে সব।
- জানি। কিন্তু উনি কি আমি আসাতে এমন রেগে আছেন?
- বোঝোই তো সবকিছু। একা একা বিয়ে করেছি বলেই এত রাগ। এখন তোমার নামে অনেক অভিযোগ আসবে। যদি ওনাদের পছন্দে বিয়ে করতাম তাহলে সেই মেয়ে খুব খারাপ হলেও ওনাদের চোখে ভালো কারণ তারা পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছে। আমার পছন্দ তাই ওনারা নানান অভিযোগ তুলবেন।
- বাদ দাও এসব। আমি কোনো প্রতিবাদ করবো না। আমি জানি একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
- নিরা, তুমি অনেক লক্ষী একটা মেয়ে।
- এটা তোমার বাবা মা বুঝলেই হয় গো। ওনাদের মন জয় করার জন্যই আমার সব প্রচেষ্টা থাকবে।
- আজকে তোমার মায়ের সাথে কথা বলেছি। উনি বললেন আমার আম্মু নাকি আসবাবপত্র চেয়েছে। এটা নিয়ে মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে আমার।
নিরা অবাক হয়ে বললো- কি বলো এসব? আমি ভেবেছিলাম তোমাকে এসব জানাবো না। তুমি কেন মায়ের সাথে তর্ক করতে গেলে? - আমার আত্মসম্মানে লেগেছে নিরা।
- আত্মসম্মানে আমারও লেগেছে। কই আমি তো তোমাকে বলিনি কিছু।
- তুমি যে আমার লক্ষী বউ।
নিরার কপালে আলতো করে চুমু দিলো স্বাক্ষর। স্বাক্ষরকে শক্ত করে জাপটে ধরলো নিরা। এখন এই মানুষটাই ওর সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে ভরসার। পুরো দুনিয়া ভূল বুঝুক, শুধু মানুষটা সবসময় পাশে থাকুক এটাই প্রার্থনা।
পর্ব ১৩
রাত বাড়ছে। একে অপরকে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। স্বাক্ষরের গরম নিশ্বাস পড়ছে নিরার গলায়। নিরা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। স্বাক্ষর ওর গলার কাছের এক গোছা চুল সরিয়ে আলতো করে স্পর্শ করলো। কেঁপে উঠে নিরা স্বাক্ষরকে আরো জোরে জাপটে ধরলো।
স্বাক্ষর বললো- তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি নিরা।
- আর আমি তোমাকে পেয়ে পেয়েছি পূর্ণতা। তুমি ছাড়া আমি অপূর্ণই থেকে যেতাম স্বাক্ষর। আমাকে পূর্ণ করে দিয়েছো তুমি।
- সত্যিই!
- হ্যা গো সত্যিই। তোমাকে ছাড়া এই আমি যে অপূর্ণ।
স্বাক্ষর নিরার শরীরে আলতো করে স্পর্শ করতে লাগলো। প্রতি স্পর্শে সুখ খুঁজে পাচ্ছিলো নিরা। ধীরেধীরে দুটো মানুষ মিশে এক হয়ে যাচ্ছে। দুটো আত্মা মিশে একটা আত্মায় পরিণত হচ্ছে। আর দুটো শরীর মিশে এক হয়ে এক নতুন সুখের রাজ্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই। দুজন যেন এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিরা দেখলো অনেক বেলা হয়ে গেছে। শ্বাশুরি মা নিশ্চয় আজকেও রেগে গেছেন। কি যে করবে! রাতে দেরিতে ঘুমানোর কারণে সকালে ঘুম ভাংতেও দেরি হয়ে গেলো। কিন্তু শ্বাশুরি মায়ের রাগ থেকে তো রেহাই পাওয়াটা দূরূহ।
ঘুম থেকে উঠে আগে গোসল করে এলো নিরা। এসে দেখলো সকাল সারে নয়টা বাজে। আজকে তো মায়ের কথা শুনতেই হবে। ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো শ্বাশুরি মা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন। নিরা জিহ্বায় কামড় দিয়ে আস্তে আস্তে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। বললো- আজকে আমার উঠতে দেরি হয়ে গেলো। কি রাঁধছেন মা?
শ্বাশুরি কোনো কথা বললেন না। নিরা আবারো জিজ্ঞাস করলো, মা কি আমার সাথে রেগে আছেন?
- আমাদের কি আর রাগ করা মানায়? আর রাগ কার সাথে করবো? তুমি উঠলা কেন? যাও শুয়ে থাকো। ঘুমাও গিয়ে।
- ঘুম থেকেই তো উঠলাম।
- ঘুম থেকে উঠতে কে বলছে? তোমার মা মনেহয় বিয়ের পর বেলা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমাতেন। সেই অভ্যাস তুমিও পেয়েছে।
নিমেষেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো নিরার। মাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে সহ্য হয়না ওর। আজ শ্বাশুরি বলে কিছু বলতে পারলো না। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়।
শ্বাশুরি মা রান্নাঘরে যেতে যেতে বললেন, দাঁড়িয়ে থাকতে বলিনি। গিয়ে ঘুমাও যাও।
নিরা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাড়াল। দেরি করে উঠেছে, একটু তো বকা শুনতেই হবে।
শ্বাশুরি মা আর কিছু বললেন না। বরং এড়িয়ে যেতে লাগলো নিরাকে। নিরা উপায় না দেখে সোজা রুমে চলে এলো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে স্বাক্ষর জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে?
- মা রেগে আছেন। আমার বোধহয় বাড়ি থেকে আসবাবপত্র নেয়াটাই ভালো হবে।
- কি বলো এসব? ভূলেও এসব ভেবো না। যা তা কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।
- তাহলে তোমাকে একটা চাকরী খুঁজে নিতে হবে স্বাক্ষর। নয়তো মায়ের এমন আচরণ দিনেদিনে বাড়তেই থাকবে।
- হুম। বিয়ে করলেই মায়েদের আচরণ কেমন যেন হয়ে যায়। আচ্ছা নিরা, আমি কি পর হয়ে গেছি?
নিরা স্বাক্ষরের মুখের দিকে তাকালো। এই মানুষটা আগেও যেমন ছিলো, এখনো তেমনি আছে। তাছাড়া নিরা তো কোনোরকম খারাপ আচরণ করেনি ওর সাথে কিংবা মায়ের সাথে। যাক ওসব, এসব নিয়ে ভাবলে অযথা অশান্তি বাড়বে।
নিরা স্বাক্ষরের কপালে হাত রেখে বলল, এখন ওঠো। ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা করবে। কিন্তু আমি তো মায়ের সামনে যাওয়ারই সাহস পাচ্ছি না। উনি ভয়ংকর রেগে আছেন।
স্বাক্ষর উঠে ফ্রেশ হতে গেলো। বাবা ওদের দুজনকেই নাস্তা খেতে ডাকলেন। খাওয়াদাওয়ার পর বললেন, স্বাক্ষরের সাথে আমার কিছু কথা আছে। খেয়েদেয়ে আমার রুমে আসো, একা আসবে।
নিরা স্বাক্ষরের সাথে চোখাচোখি করলো। দুজনেই অবাক হয়ে ভাবছে বাবা কেন ডাকলেন ওনার ঘরে।
খাওয়াদাওয়ার পরে বাবার রুমে গেলো স্বাক্ষর। বাবা ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, তোমার বউ নাকি কাজের সময় ঘুমায় আর বলে পেট ব্যথা করছে? এসব কি? নতুন বউ যদি এরকম করে তোমার মা তো রাগারাগি করবেই।
স্বাক্ষর অবাক হয়ে বললো, আমার স্ত্রী’র কোনো দোষ নেই বাবা। বরং ও প্রথম থেকেই খুব কাজ করতো। মা তখন থেকেই ওকে সহ্য করতে পারেনা আর এখনো পারবে না।
- সেটা তুমি আর তোমার মা জানো। আমি আর কখনো তোমার মায়ের থেকে এসব শুনতে চাই না। আর একটা কথা, বিয়ে করেছো এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো।
- আচ্ছা বাবা। আমার মনে থাকবে। আমি আজকে থেকেই চাকরি খুঁজবো।
- আর তোমার বউকে বলবে মায়ের কাজে সাহায্য করার জন্য। মহিলাটা একটু রগচটা সেটা তো জানোই।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
- যাও এখন।
রুম থেকে বেরিয়ে এলো স্বাক্ষর। মনেমনে ভাবতে লাগলো, আমার স্ত্রী’র কোনো অপরাধ তো দেখলাম না। তবুও মা এরকম করে। এসব ভেবে ও একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো।
পত্রিকা, বিডি জবস সবখানে চোখ বুলাতে লাগলো স্বাক্ষর। যদি কোনো চাকরির সার্কুলার পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না। হতাশ হয়ে নিরার দিকে তাকালো ও। নিরা বললো, টেনশন কোরো না। কিছু একটা হবে ই দেখো। এতটা দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
স্বাক্ষর নিরার হাত ধরলো শক্ত করে। বিপদে হোক আর সুসময়ে হোক, এখন এই একটা মানুষই সব সময় পাশে থাকবে ওর।
এভাবেই সময়ে যেতে লাগলো। সামান্তা ওর ডিপ্রেশন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। আয়াশ সারাক্ষণ ফোনে কথা বলে মন ভালো রাখার চেষ্টা করে ওর। পাশাপাশি মোটিভেট করে ওকে। এবার তো রীতিমত ঝগড়া শুরু হয়ে গেলো।
আয়াশ বললো- পড়াশোনা করো মনোযোগ দিয়ে। রাত সাড়ে এগারোটায় পড়াশোনা শেষ করে আমাকে কল দেবে। যদি এর আগে পড়া ছেড়ে ওঠো তাহলে কথা বলবো না দুদিন।
সামান্তা ওর চাপে পরে পড়াশোনা করে যেতে লাগলো ঠিকমত। সাড়ে এগারোটায় পড়া শেষ করে আয়াশকে কল দেয় ও। এরপর ঘন্টাখানেক ফোনে কথা বলে ঘুমিয়ে যায় দুজনে। অতীতের ভূলটাকে পিছনে ফেলে গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত রাখা দরকার নিজেকে। এতে করে জীবন ও ভবিষ্যৎ দুটোই ভালো হবে।
এদিকে নিরা এখন ভীষণ সতর্ক। বাসার সব কাজে মাকে সাহায্য করার পাশাপাশি ঘুমের ক্ষেত্রেও ভীষণ সতর্ক হয়ে গেছে। নিজের যত কষ্টই হোক না কেন, মায়ের মন জয় করতেই হবে। এবার কিছু একটা হবেই। আর হাল ছাড়বে না নিরা।
রাত্রিবেলা কাজ শেষ করার পর ঘুমাতে যাচ্ছে নিরা। শ্বাশুরি মাকে দেখে মনে খটকা লাগলো ওর। দেখে মনেহচ্ছে উনি অসুস্থ। কৌতুহলী হয়ে নিরা শ্বাশুরির কাছে এসে বললো, কোনো সমস্যা মা?
উনি প্রথমে না বললেও পরে স্বীকার করলেন যে শরীর ঝিমঝিম করছে আর জ্বর জ্বর বোধ হচ্ছে। নিরা ওনার হাতটা নিয়ে পরীক্ষা করে বললো- আসলেই তো জ্বর এসে গেছে মা। আপনি বিছানায় গিয়ে বিশ্রাম নিন মা।
উনি কিছু বললেন না। সত্যিই শরীরটা খারাপ লাগছে অনেক। নিরার কথামত বিশ্রাম নেয়ার জন্য নিজের রুমে গেলেন।
রাত বাড়ার সাথে সাথে ওনার জ্বরও বেড়ে গেলো। নিরা কয়েকবার এসে দেখে গেলো শাশুরিকে। যখন দেখলো জ্বর অনেক বেড়ে গেছে, তখন বালতিতে পানি ভরে এনে ওনার মাথায় ঢেলে দিলো। এরপর ওষুধ খাইয়ে দিলো। অনেক রাত পর্যন্ত শ্বাশুরির বিছানার কাছে বসে মাথায় জলপটি দিয়ে দিতে লাগলো নিরা।
শ্বাশুরি পুরোপুরি জ্বরের ঘোরে চলে গেছেন। জ্বরে গা কাঁপছে ওনার। কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারছেন যে নিরা শিয়রেই বসে জলপটি দিয়ে দিচ্ছে। মনেমনে নিরার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে উঠলেন। অন্য কোনো মেয়ে হলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। সামান্তা নিজেও তো ঘুমাচ্ছে। সেখানে এভাবে সারারাত বসে আছে মেয়েটা এটা সত্যিই অবাক করার মতই।
নিরার শ্বশুরমশাই বললেন, অনেক রাত হইছে নিরা। এবার ঘুমাতে যাও তুমি।
- মাকে এভাবে ফেলে কি করে যাই?
- যাও, আমি তো আছি পাশে।
নিরা তবুও উঠতে চাইলো না। শ্বশুরের জেদ দেখে উঠতে বাধ্য হলো। নিরা নিজের রুমে চলে গেলে উনি স্ত্রীকে বললেন, সেদিন নিরা হয়ত মিছেমিছি শুয়ে থাকে নি। হয়ত ওর সত্যিই পেট ব্যথা করছিলো। তুমি মিছেমিছি মেয়েটাকে ভূল বুঝেছো।
নিরার শ্বাশুরি মা ও কোনো কথা বললেন না। আজকে আর কিছুই বলার নেই। যখন নিজের মেয়েই কোনো সেবাযত্ন করতে চায় না, তখন পরের মেয়ের এমন মায়ের মত সেবা পেয়ে আর কিইবা বলার থাকে! অদ্ভুত লাগছে।
পর্ব ১৪
আজ খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে এলো নিরা। অনেক যত্নে নাস্তা, রান্নাবান্না ও বাসার কাজগুলো সেরে নিলো। শ্বাশুরি মায়ের রুমের দরজায় এসে ডাকলো, মা আসবো? বাবা কি ভেতরে আছেন?
ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বুঝলো বাবা ভেতরে নেই। ও রুমে ঢুকে দেখলো মায়ের শরীরে এখনো অনেক জ্বর। উনি ঘুমাচ্ছেন বলে আর ডাকার চেষ্টা করলো না। চুপচাপ টেবিলে এসে নাস্তা সাজিয়ে রাখলো।
শাশুড়ি মা ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথমেই নিরাকে ডাকলেন। নিরা ছুটে এলো মায়ের ডাক শুনে। ওনার শরীর কাঁপছে জ্বরে, একা বাথরুমে যেতে পারবেন না। উনি নিরাকে বললেন হাত ধরে বাথরুমে রেখে আসার জন্য।
নিরা কোনো শব্দ করলো না। শাশুড়িকে হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলো। তারপর কমোডে বসিয়ে রেখে বাইরে এসে দাঁড়াল। শাশুড়ির এই কঠিন সময়ে পাশে থাকতে পারছে বলে বড্ড ভালো লাগছে ওর। এরপর ওনার হাত ধরে বাইরে এনে বসালো। পানি দিয়ে মুখ ধুইয়ে দিলো, গামছা ভিজিয়ে গা মুছে দিলো। খাবার এনে বললো, মা আপনাকে তুলে খাওয়াই?
- না রে মা। আমি হাত দিয়ে খেতে পারবো।
- আপনার কষ্ট হবে। আমি তুলে খাওয়াই, আপনি শুধু কষ্ট করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলুন। ডাক্তার বলেছে আপনার ভাইরাস জ্বর হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে মা।
- এত কষ্ট করে সকালে নাস্তা বানিয়ে ফেলেছো?
- রান্নাও করে ফেলেছি। আপনাকে আর টেনশন করতে হবে না। আপনি খেয়ে নিন।
নিরা খাবার এনে শাশুড়ির মুখে তুলে দিলো। এই প্রথম শাশুড়ি মায়ের মন থেকে ভালো লাগা কাজ করলো নিরার প্রতি। অনেক বছর হয়ে গেছে কেউ তুলে খাওয়ায় না। কত বছর আগে মা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। সেই বিয়ের আগে মায়ের হাতে এমন সেবা পেয়েছিলো। এরপর থেকে অসুস্থ হলেও কেউ চোখ তুলে তাকাতো না।
উনি সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, মা নিরা।
- হ্যা মা।
- আজকে আমার মনেহচ্ছে আমার মা আমার সেবা করছে রে। কতগুলো বছর চলে গেছে কারো হাতে এমন পরিচর্যা পাই না। আমাকে নিয়ে ভাবার সময় কারো আছে নাকি বল?
- এইতো আমি এসে গেছি মা। আমিই আপনার মেয়ে আবার আমিই আপনার মা।
- কতজন আর এভাবে সাহস করে বলতে পারবে যে আমি আপনার মেয়ে? এ যুগের মেয়েরা সব তো নিজের স্বার্থ বোঝে। আর শাশুড়িকে ভাবে সতীনের মত।
- আমার যেন কখনো মাথায় আজেবাজে চিন্তা না আসে এই দোয়া করবেন মা। আমি আজীবন আপনার সেবা করেই যেন কাটিয়ে দিতে পারি।
শাশুড়ির কারণেই তো স্বামীকে পেয়েছি। তাহলে মাকে আর শাশুড়িকে আলাদা করে কেন দেখবো বলুন?
শাশুড়ি মা কিছু বললেন না। নিরার প্রতি থাকা সমস্ত রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ সবকিছু হাওয়ায় উরে গেছে। নিরা মেয়েটাকে আসলেই অনেক লক্ষী মনে হচ্ছে। এক রাশ ভালোবাসা মেয়েটার জন্য।
স্বাক্ষর ঘুম থেকে উঠে যখন দেখলো মায়ের সাথে নিরার একেবারে মধুর সম্পর্ক, তখন এতটা ভালো লাগলো যা প্রকাশ করার মত না। নিরাও এবার কোমর বেঁধে লেগেছে শাশুড়ির মন জয় করার জন্য। মেয়েটার গুণ আছে বলতে হবে। সব কাজে যেমন পটু, তেমনি সুন্দর মন মানসিকতা।
এদিকে রিয়ানের সাথে ফোনে চ্যাটিং চালিয়েই গেলো নিরা। ছবি চাইলে নিরা অন্য একজনের ছবি পাঠিয়ে দিতে লাগলো। ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিলো ওদের চ্যাটিংয়ের সুর। এক পর্যায়ে রিয়ান প্রপোজ করেই বসলো নিরাকে-
- রিয়া, একটা কথা বলার ছিলো তোমাকে। তুমি কি মনে করবে সেটা ভেবে বলা হয় না।
- আমি কিছু মনে করবো না। বলে ফেলুন আপনি।
- তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে। আমার মনেহয় আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
অনেক্ষণ সিন করে রিপ্লাই দিল না নিরা। চুপচাপ ফোনটা রেখে দিলো। রিয়ান কিছুক্ষণপর আবারো মেসেজ পাঠালো, রাগ করলে? কথা বলা বন্ধ করলে কেন? তুমি কি আমার উপর রেগে গেছো? প্লিজ রাগ কোরো না।
এই ধরণের মেসেজ করেই যেতে লাগলো রিয়ান। নিরা চুপচাপ হাসছিলো আর মজা নিচ্ছিলো। এইতো রিয়ান ব্যাটা লাইনে এসেছে। এবার ওকে জালে ফেলে ইচ্ছে মত ধোলাই দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সামান্তা ফোনে কথা বলতে বলতে খাবার টেবিলে আসলো। টেবিলে বসেও খাবার ফাঁকে ফাঁকে ফোনে এসএমএস টাইপ করছিলো। নিরা ভয়ানক রেগে বললো- এসব কি সামান্তা? মোবাইল নিয়ে একেবারে ভেংগে ফেলবো।
সামান্তা চমকে উঠে তাকালো ভাবির দিকে। ভয়ে কেঁপে উঠলো ও। স্বাক্ষরও একেবারে হতবাক হয়ে গেছে। নিরা কে কখনোই এতটা রাগী রাগী মুডে দেখা যায় নি। মেয়েটা হঠাৎ এতটা রেগে গেলো কি কারণে? সাধারণত খুব খারাপ সিচুয়েশনেও নিরা এত রাগে না। সামান্তা এখনো থ হয়ে তাকিয়ে আছে নিরার দিকে।
নিরা বললো- খাবার টেবিলে বসে মোবাইল টিপতে কে বলেছে তোমাকে? এই শিক্ষা পেয়েছো কোথায়?
সামান্তা নিশ্চুপ।
নিরা বললো- খাবার খাওয়ার ফজিলত অনেক জানোই বোধহয়। খেতে বসে অন্তত মোবাইল চালানো ঠিক না। আর ফোনে কি পেয়েছো তুমি? দিন রাত সারাক্ষণ ফোন ইউজ করলে তোমার পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাবে।
স্বাক্ষর নিরার দিকে অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে। আয়াশের সাথে কথা বলার জন্য নিরা নিজেই সামান্তার নাম্বারটা আয়াশকে দিয়েছে। আবার নিজেই সামান্তাকে শাসন করছে। অদ্ভুত না?
নিরা বললো- সবকিছুর একটা লিমিট রাখা দরকার। ফোনে কথা বলছো বলো কিন্তু লিমিট বুঝবা না? এত কথাবার্তা বললে লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিটাই তোমার হবে। কারণ ফোনে কথা বলাটা টাইম ওয়াস্ট ছাড়া কিছুই না। তোমার পুরো জীবনটাই পড়ে আছে সামান্তা। রিসেন্টলি যে ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছো সেটা যেন আর কখনো না হয় সেভাবে নিজেকে সেইফ রাখো। আর সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রাখো কোনো কাজে। তোমার সামনে আগানোটা খুব জরুরি। রিয়ানকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে ওর দেয়া আঘাতে তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি বরং লাভ হয়েছে ..
সামান্তা কোনো কথা বললো না। ফোন রেখে চুপচাপ খেয়ে নিলো। খাবার খেয়ে উঠে বললো, সরি ভাবি। তোমার এই কথাগুলো আমার জন্য খুব দরকারি ছিলো। আমার আর কক্ষনো এমন ভূল হবে না। এখন থেকে নিয়মিত পড়াশোনায় মনোযোগী হবো।
নিরা প্রসন্ন হাসি হাসলো। সামান্তা চলে গেলো নিজের ঘরে। এদিকে খাবার খাওয়ার পর স্বাক্ষর নিরাকে রুমে ডেকে নিয়ে জাপটে ধরে বললো, তোমাকে খুব বউ বউ লাগছে আজ।
- এখন ছাড়ো মায়ের সাথে বসে কথা বলি।- আমাকে একটু সময় দাও না বাবু।
- তোমাকে সময় অনেক দিয়েছি, সারাজীবন দেবো ও। কিন্তু মায়ের এই অসুস্থতার সময়ে তার পাশে থাকাটা জরুরী। মায়ের সাথে গল্প করলে ওনারও ভালো লাগবে।
স্বাক্ষর নিরার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল- এই না হলে লক্ষী বউ আমার। একেবারে গল্পের মত একটা বউ।
সারাটা দিন শাশুড়ির সাথে বসে গল্প করে কাটালো নিরা। মনটা ভালো হয়ে গেছে ওর। শাশুড়ি মা ওনার বিয়ের পরের জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন। বিয়ের পর থেকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ওনাকে। ওনার শাশুড়িও ওনাকে মেনে নেননি, অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে এতদূর আসতে হয়েছে। শাশুড়ির অনেক ঝাড়ি খেয়ে খেয়ে এখন ওনারও মন মানসিকতা অনেক খারাপ হয়ে গেছে। এসব কথা শুনে নিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ির দিকে। মাকে যতটা খারাপ মনে হয়েছিলো, উনি মোটেও সেরকম নন। ওনার মনটা অনেক নরম, মানুষ হিসেবে উনিও অনেক ভালো। শাশুড়ির কথা শুনতে শুনতে ভেতরটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে ওনার। সব শুনে নিরার কেমন যেন নিজেকে অপরাধী লাগছিলো। ও অযথাই মাকে ভূল বুঝেছিলো।
বিকেলে মায়ের মাথায় পানি ঢেলে দিয়ে গামছা ভিজিয়ে গা মুছে দিলো নিরা। তারপর ভাত খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো। পুরোটা বিকেল দুই শাশুড়ি পুত্রবধূ গল্পে মেতে রইলো। এখন আর কোনো দূরত্ব আছে বলে মনেহয় না। বরং মনেহচ্ছে শাশুড়ি মা নিরার কাছের বন্ধু। যেন মা ও মেয়ে!
পর্ব ১৫
শাশুড়ি মা সুস্থ হয়ে গেলেন দুদিনের মাথায়। এই দুদিন নিরার পরম সেবা পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছেন তিনি। নিরার ও মনটা অনেক উৎফুল্ল শাশুড়ীর ভালোবাসা পেয়ে। শরীরটা সেরে উঠতেই উনি নিরাকে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমাদের তো হানিমুন হলোনা। তোমরা বরং কোথাও গিয়ে ঘুরে আসো।
অবাক হওয়ার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে নিরা। শাশুড়ী মা নিজে থেকে হানিমুনের কথা বলছেন এটা অবিশ্বাস্য! নিজের কানকেও মাঝেমাঝে অবিশ্বাস্য লাগে সেরকম হলো ব্যাপারটা। নিরা শাশুড়ীর হাত ধরে বললো- মা আমাকে একটা চিমটি কাটুন তো।
শাশুড়ী হেসে বললেন, সত্যিই বলেছি রে মা। যা, ঘুরে আয় তোরা।
- মা, আমাকে তুই করে বলছেন! আপনার এই ভালোবাসা টুকু পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম আমি।
- বুঝি রে। আমি তোকে আরো সহ্য করতে পারতাম না। এজন্য আমার উপর রাগ করিস না কেমন?
- আচ্ছা মা। আমাকে দোয়া করবেন যেন আজীবন আপনার ভালোবাসা ও দোয়া নিয়েই বাঁচতে পারি।
- দোয়া তো সবসময়ই করি। আসলে ছেলেটা হুট করেই বিয়ে করে ফেলেছে বলে একটু কষ্ট পেয়েছি আর কি।
- বিয়েটা বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে মা। নয়তো স্বাক্ষর কোনোদিনো বাসায় না জানিয়ে বিয়ে করত না। বাসায় এই মুহুর্তে জানালে আপনারাও রাজি হতেন না। ওদিকে আমারও বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো। সে কারণেই বাধ্য হয়ে এই কাজটা করতে হয়েছে আমাদেরকে।
নিরা ওর বিয়ের পুরো ব্যাপারটা খুলে বললো শাশুড়ি মাকে। সব শুনে মা অনেক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তাহলে অনেক রিস্ক নিয়ে চলাফেরা করতে হয়েছে তোমাকে।
- শুধু কি আমাকে? স্বাক্ষরকেও সেইম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
- হুম বুঝতে পারছি। স্বাক্ষর হয়তো আমার উপর রেগে আছে।
- না মা। ছেলেরা মায়ের উপর রাগ করে কিনা জানিনা কিন্তু স্বাক্ষর কখনো করবে না।
- আমার ছেলেটা অনেক ভালো রে মা। ওকে আগলে রাখিস।
- আপনার ছেলে আপনার ই থাকবে মামনি। আমি তো ওকে কেড়ে নিচ্ছি না। বরং আমিও এখন আপনার মেয়ে হয়ে গেছি।
নিরা শাশুড়ি মাকে জাপটে ধরলো। উনি নিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
স্বাক্ষর বাসায় ফিরলে নিরা ওকে জানালো হানিমুনের ব্যাপারে। স্বাক্ষরও রীতিমতো অবাক। ও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো- তুমি তো দেখছি অসাধ্য সাধন করে ফেলেছো!
নিরা স্বাক্ষরের কলার টেনে ধরে বললো, চলো না একটা হানিমুন ট্রিপ দিয়ে আসি। ক’দিনের জন্য দুজনে হারিয়ে যাই অন্য কোনো জগতে। শুধু তুমি আর আমি, ভালোবাসার একটা স্বপ্নীল জগতে হারাবো।
স্বাক্ষর নিরাকে কোলে তুলে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো- তোমার জন্য এক পৃথিবী প্রেম তো আমারই আছে। সেই জগতে হারাও।
- উহুম, ঘুরতে যাবোওওও। চলোনা যাই?
- কোথায় যাবা বলো? কক্সবাজার?
- আচ্ছা। কালকেই যাই?
- আগে একটু ভালোবাসতে দাও।
স্বাক্ষর নিরাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর মুখের উপর মুখটা আনতেই নিরা বললো- এই এই থামো। - কি হলো আবার?
- দরজা?
স্বাক্ষর হেসে বললো- যাচ্ছি।
স্বাক্ষর দরজা বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়ানো মাত্রই নিরা বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে একটা দৌড় লাগালো। এরপর দুজন মিলে দৌড়াদৌড়িই চললো অনেক্ষণ ভর। নিরা কিছুতেই ধরা দেবে না, এদিকে স্বাক্ষরও ছাড়বে না। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে খপ করে ধরে ফেললো ওকে। নিরা দুহাতে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। দুজনে ধস্তাধস্তি চললো কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত নিরাকে আত্মসমর্পণ করতেই হলো স্বাক্ষরের কাছে।
রাতেই টিকেট করে আনলো স্বাক্ষর। নিরা অনেক রাত অব্দি লাগেজ গুছিয়ে নিলো। দুজন মিলে প্লান করতে লাগলো হানিমুনের জন্য। নিরার মুখে বিজয়ের উল্লসিত হাসি লেগেই আছে সবসময়। অনেকদিন পর যেন নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে।
রাতটা স্বপ্নের মতই কাটলো দুজনের। পরের দিন সকাল থেকে বাড়ির সমস্ত কাজ গুছিয়ে সেরে ফেলল নিরা। হানিমুনে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে পড়লো।
অতঃপর রাতের বাসে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ওরা। বাসের লাইট নিভিয়ে দেয়ার পর শুরু হলো স্বাক্ষরের দুষ্টুমি। নিরার কাঁধটা নিজের ঘাড়ের উপর নিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো- আচ্ছা নিরা একটা কথা বলি?
- হ্যা বলো।
- প্রথম যখন তোমাকে দেখে লাইন মারতাম তখন তোমার কেমন লাগতো?
- আমারও তোমাকে পছন্দ ছিলো। তুমি আমার পিছে ঘুরঘুর করলে ভালোই লাগতো আমার।
- তোমার চুলের গন্ধটা মারাত্মক গো নিরা। আজীবন যেন এই চুলের গন্ধ এমনই থাকে। সবসময় তোমার চুলে আমাকে বেঁধে রাখো
- চুলে বেধে রাখবো? মাথায় যখন চুল থাকবে না তখন বাধবো কিসে?
- হা হা হা।
নিরাও হেসে উঠলো শব্দ করে৷ নিরার হাসির শব্দ মুগ্ধ হয়ে শুনলো স্বাক্ষর। তারপর নিরার মুখটা চেপে ধরে ঠোঁট এগিয়ে এনে আলতো করে নিরার ঠোঁট স্পর্শ করলো। কেঁপে উঠে স্বাক্ষরের গলা জড়িয়ে ধরলো নিরা। অন্ধকারের মাঝে এক ধরণের ঘোর কাজ করছে। স্বাক্ষর অনেক্ষণ সময় নিয়ে নিরাকে চুম্বনের পর ছেড়ে দিয়ে বললো- অসম্ভব মিষ্টি ছিলো!
নিরা স্বাক্ষরকে মাইর শুরু করে দিলো এবার। স্বাক্ষর নিরাকে বুকে চেপে ধরে চুপ করে রইলো। আর কোনো দুষ্টুমি না করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেই রইলো। জড়িয়ে ধরার মাঝে একটা অন্যরকম শান্তি আছে। অনাবিল প্রশান্তি!
কক্সবাজারে পৌঁছে গেলো সকালবেলাতেই। বাস থেকে নেমে হোটেলে গিয়ে উঠলো। রিসিপশনে নাম বুক করার পর রুম নাম্বার নিয়ে লিফটে এসে ঢুকল। লিফটের দরজা লক হয়ে যেতেই নিরাকে বুকের উপর টেনে নিয়ে আরেকবার চুম্বন করলো স্বাক্ষর। খেই হারিয়ে ফেলেছে নিরা। ছেলেটা যে এত দুষ্টু আর রোমান্টিক! মাঝেমাঝে কথাই বলতে পারে না নিরা।
রুমে ঢোকার পর দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরা’র উপর। ভালোবাসার নতুন রঙে রাঙাতে শুরু করেছে প্রিয়সীকে।
গোসল শেষ করে নাস্তা করেই ঘুম দিলো দুজন মিলে। জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে ঘুম থেকে উঠলো দুপুরবেলা। লাঞ্চ সেরে বিকেলবেলাটা হোটেলে বসেই গল্প করে কাটিয়ে দিলো। বিকেলে বের হলো বিচে যাওয়ার জন্য।
সাগড়পাড়ে এসে নিরার ছুটাছুটি আর দেখে কে? উত্তাল সমুদ্র দেখে একেবারে পাগল হয়ে গেছে। ছুটে গিয়ে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। স্বাক্ষর একটা চাকা নিয়ে নিরাকে নিয়ে ভেসে বেড়াল। এরপর বাইকে করে বালির উপর অনেকদূর ঘুরে এলো। নিরার উচ্ছ্বসিত মুখ দেখে আনন্দ হচ্ছে ওর। পুরোটা বিকেল সমুদ্রে স্নান, ঘুরাঘুরি করে কাটিয়ে দিলো দুজনে। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখে হোটেলে ফিরে এলো।হোটেলে ফিরে গোসল শেষ করে নাস্তা করে নিলো দুজনে। তারপর টিভি দেখতে দেখতে আড্ডায় মেতে উঠলো৷ একে অপরের আঙুলে আঙুল রেখে বিভিন্ন গল্পে মেতে উঠলো। পুরো জগতের জটিলতা ভূলে কেবল দুজন মানুষ দুজনের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে যেন। নিরার চেহারায় একটা পরিবর্তন এসেছে সেটা এখানে এসেই অনুধাবন করলো স্বাক্ষর।
নিরা ওকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো- কি দেখছো এভাবে? যেন আগে কখনো দেখো নি?
- আগের দেখা আর এখনকার দেখা কি এক হলো?
- আলাদা হবে কেন?
- হানিমুনের দেখা সবসময় আলাদাই হয়। হা হা হা।
- তুমি এত দুষ্টু কেন?
- আমি দুষ্টু এটা আগে জানতে না? আজকে নতুন জানলে?
- আগেও জানতাম। জেনেশুনেই ফাজিলটাকে বিয়ে করেছি। কারণ ফাজিলটাকে আমিও যে অনেক ভালোবাসি।
- অনেক?
- অবশ্যই অনেক। প্রচন্ড ভালোবাসি স্বাক্ষর।
নিরা স্বাক্ষরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। স্বাক্ষর ও নিরাকে ভালোবাসার আবেশে বেঁধে ফেললো৷ দুজনের মধ্যে এখন বিন্দুমাত্র দূরত্ব নেই। দুজনে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ এরকম মনে হচ্ছে। নিরার চেহারায় একটা উজ্জ্বলতা এসে ভর করেছে।
রাত্রিবেলা অনেক রাত অব্দি গল্প করে ডিনার করতে বের হলো দুজনে। ডিনারের সময় নিরা দুষ্টুমি করে স্বাক্ষরকে খাইয়ে দেয়ার ছলে ওর নাকে লাগিয়ে দিচ্ছিলো। খাওয়া শেষ করে আবার রুমে চলে এলো ওরা। সারাটা রাত গল্প, দুষ্টুমি আর গান গেয়েই কাটিয়ে দিলো।
পরদিন সকালে উঠে বের হলো সমুদ্রে যাওয়ার জন্য৷ একেবারে ভোরেই উঠে দুজনে সমুদ্রের পাড়ে চলে এলো। সাত সকালে সমুদ্রের খোলা হাওয়ায় শরীরটা শীতল হয়ে যাচ্ছিলো। নিরা খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলো সমুদ্রের দিকে।
স্বাক্ষর ওর পিছুপিছু ছুটে এসে বললো- কি করছো কি?
- আরে এখন তো ঢেউ নেই।
- তবুও সমুদ্রে যেওনা।
- আমার হাত ধরে নিয়ে যাও।
স্বাক্ষর নিরার হাত ধরে ওকে নিয়ে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটছিলো। তখন কেউই জানতো না পরবর্তীতে কি বিপদ অপেক্ষা করছে দুজনের জন্য।
পর্বঃ ১৬
নিরা ও স্বাক্ষর হাত ধরে সমুদ্রের তীর ঘেষে হাঁটছিলো। দুজনের মনটা উৎফুল্ল। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম আবেগ, প্রথম অনুভূতিকেই সারাজীবনের মত করে পাওয়ার আনন্দটা দুজন মিলে উপভোগ করছিলো। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে জীবনের পরম সুখটুকুর স্বাদ নিচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে ঝাউবনের দিকে চলে এলো ওরা। গল্প করছিলো আর হাসছিলো। নিরা তো হেসেই লুটোপুটি। হঠাৎ সামনে তাকানো মাত্র ভয় পেয়ে স্বাক্ষরের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো নিরা। দূরে রিয়ানের মত কাউকে দেখা যাচ্ছে। নিরার চোখ স্পষ্ট দেখতে পায়। ও পুরোপুরি নিশ্চিত ওটা রিয়ান ই। রিয়ান এখানে কিভাবে এলো! তারমানে সে কি জানে আমরা এখানে এসেছি নাকি পুরো ব্যাপারটাই কাকতালীয়?
নিরার মনে নানান প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছিলো। স্বাক্ষর দ্রুত ওকে নিয়ে সরে পড়লো সেখান থেকে। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে এলো ওরা। স্বাক্ষর নিরাকে সাহস জুগিয়ে বললো, ভয় পেওনা নিরা। আমি আছি তো।
নিরা তবুও টেনশন করছে। রিয়ান এখানে কেন এসেছে জানতে হবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়লো রিয়ানের সাথে ফেসবুকে কথা বলা যায়। অবশ্য সে যদি এখন একটিভ থাকে।
নিরা তাড়াতাড়ি ফেসবুকে ঢুকে মেসেজ পাঠালো – Hello Riyan..
অনেক্ষণ সময় পার হয়ে গেলো কিন্তু এসএমএস সিন হলো না। রিয়ান ফেসবুকে আসেনি রাত থেকে। নিরা স্বাক্ষরের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। টেনশন হচ্ছে ওর।
অবশেষে এসএমএস রিপ্লাই এলো, আরে রিয়া যে? তুমি আমাকে এসএমএস পাঠিয়েছো! বাবা সেই যে রাগ করে চলে গেলে। আমি তো বলেছিলাম ফাজলামি করে আই লাভ ইউ বলেছি। তবুও এত রাগ?
নিরা চিন্তা ভাবনা করে লিখলো- না না রাগ না। আমি অসুস্থ ছিলাম। হাসপাতালে ছিলাম এই দুদিন। আমার ফোন কার কাছে ছিল জানিনা।
রিয়ান কান্নার ইমুজি পাঠিয়ে দিয়ে লিখল- কি হয়েছিলো আমার সোনা টার?
সোনা বলাতে রাগ উঠে গেলো নিরার। তবুও ঠাণ্ডা মাথায় লিখল- হঠাৎ করে প্রেশার কমে গেছিল। জ্বর সর্দি তো আছেই।
- এখন কেমন আছো?
- এইতো ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
- আমিও ভালো আছি। রিয়া, তুমি সত্যি সত্যি রেগে নেই তো?
- সত্যিই রেগে নেই। আপনি কোথায় এখন?
- কক্সবাজার।
- ঘুরতে গেছেন?
অনেক্ষণ পর রিপ্লাই আসলো- হ্যা। একটা কাজ আছে অবশ্য।
- কি কাজ?
- ওটা আমার ব্যবসায়ীক হিসেব নিকাশ। তুমি বুঝবা না।
নিরা স্বাক্ষরের দিকে তাকালো। স্বাক্ষর বলল- ব্যবসায়ীক হিসেব নিকাশ বলে কিছু নেই। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। কক্সবাজারে ওর কিসের ব্যবসা?
নিরা মেসেজ পাঠালো- ও আচ্ছা। একা গেছেন? - না গো। আমার বন্ধুরা সাথে আছে।
নিরা হাসলো। ও রিয়ানকে একাই দেখেছে সাগরপাড়ে। ঘাপলা একটা তো আছে ই। ও নিরা ও স্বাক্ষরের ক্ষতি করার জন্য আসেনি তো?
নিরা আবার লিখলো- আচ্ছা কক্সবাজার কবে গেছেন? কোথায় কোথায় ঘুরলেন? আমাকে একটু ছবি পাঠান না দেখি। - দাড়াও দিচ্ছি।
রিয়ান ওর কয়েকটা ছবি তুলে পাঠাল। এরপর লিখলো- মাত্র তুললাম। - কোথায় এখন আপনি?
- আমি হোটেলের দিকে যাচ্ছি।
- কোন হোটেলে উঠেছেন?
- কক্স টুডে তে। তুমি চেনো নাকি?
- একবার ঘুরতে গেছিলাম। অনেকগুলো হোটেল দেখে এসেছি সেজন্যই জিজ্ঞেস করলাম।
- ওহ। তোমাকে নিয়ে আসা ভালো ছিল।
- ইস.. আপনি বললেই বুঝি আমি যেতাম?
- সেটাও বটে। তবে বিয়ের পর আমার সাথে হানিমুনে তো আসতেই হবে তাইনা ম্যাম?
- আপনার সাথে হানিমুনে যাবো কেন? হানিমুনে যাবো আমার বরের সাথে।
- তোমার বরটা আমি ছাড়া আর কে হবে শুনি?
নিরা হো হো করে হেসে উঠলো। স্বাক্ষরও ওর সাথে হাসতে লাগলো। কিন্তু দুজন মিলে ঠিকই বলাবলি করতে লাগলো রিয়ান ওদের পাশের হোটেলেই উঠেছে।
নিরা লিখলো- কি করছেন এখন? - হোটেলের দিকে যাচ্ছি।
- খেয়েছেন?
এরপর অনেক্ষণ মেসেজের রিপ্লাই নাই। নিরা সমানে মেসেজ দিয়েই যেতে লাগলো। অনেক্ষণ পর অনলাইনে এসে রিয়ান লিখলো- সরি ব্যস্ত ছিলাম।
- ইটস ওকে। খেয়েছেন কিনা বললেন না যে?
- খাই নি। মেজাজটা খুব হট হয়ে আছে বুঝলে?
- সেকি? কেন? মেজাজ হট হবার কারণ কি শুনতে পারি?
- তোমাকে বলাই যায়। তুমি তো আমার কাছের মানুষ। কিন্তু তুমি আবার আমাকে খারাপ ভাব্বে না তো?
- খারাপ ভাবার মত কিছু করবেন?
- না মানে তুমি আবার কি ভাবো?
- কিছুই ভাব্বো না। বলুন আপনি।
রিয়ান রিপ্লাই দিল, এখানে এসেছি একটা কাজে। আমার একটা শত্রু আছে সে এখানে এসেছে। ওদের সাথে আমার পুরনো হিসেব নিকাশ বাকি আছে। এখানেই ধরবো ওদের।
নিরা ও স্বাক্ষর দুজনেই অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
নিরা লিখলো- ধরে কি মেরে ফেলবেন?
- না। তবে বড়সড় একটা শিক্ষা দেবো।
- আমার তো ভয় লাগছে। যদি আপনার কিছু হয়ে যায়।
- ভয় পেও না সোনা। আমার কিছুই হবে না। আমার সাথে কেউ পারবে নাকি?
- ওহ। আপনার অনেক ক্ষমতা মনে হচ্ছে।
- তা তো বটেই। আমার পুরো গ্যাং আছে এখানে।
- সেকি। আপনি গুণ্ডা?
- না না। গ্যাং মানে আমার বন্ধুবান্ধব আর কি।
রিয়ান এবার ফোনটা নিয়ে নিজে এসএমএস পাঠালো- আচ্ছা আপনি ওদেরকে ধরবেন কিভাবে? ধরে কি মারধোর করবেন? - আমার বন্ধুরা ওকে সাইজ করবে। কোন হোটেলে উঠেছে সেটা আগে খুঁজে বের করি। তারপর ওদের অবস্থা খারাপ করবো। ওরা যেখানেই যাবে ফলো করে যাবো। তারপর ফুসলিয়ে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবো যেটা কেউ জানতেও পারবে না।- আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে আপনার জন্য।
- ভয় পেও না লক্ষিটি।
- আচ্ছা আম্মু ডাকছে এখন বাই।
ফোন রেখে নিরা তাকালো স্বাক্ষরের দিকে। এবার তাহলে সত্যিকার ঘটনাটা বোঝা গেলো। তখন নিরার চোখে না পড়লে রিয়ানের এই ষড়যন্ত্র কিছুতেই বোঝা যেত না। ভাগ্যিস নিরা ওকে দেখতে পেয়েছিল। এবার ওকে ই বোকা বানিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে। কে কাকে সাইজ করে এবার দেখা যাবে।
স্বাক্ষর দ্রুত পুলিশে ইনফর্ম করে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললো। তারপর সন্ধ্যায় বের হলো সূর্যাস্ত দেখতে। সূর্যাস্ত দেখার পর নিরাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঝাউবনের দিকে গেলো। যেদিকে কেউ নেই। মানুষের আনাগোনা সেখানে কম। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সেদিকে যেতে লাগলো। এদিকে নিরা ফেসবুকে ঢুকে দেখলো রিয়ান একটিভ নেই। তবুও ও এসএমএস দিলো- কি করছেন?
রিয়ান রিপ্লাই দিলো- সোনা আমি ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো।
নিরা পুরোপুরি নিশ্চিত। তারমানে ও ওদেরকেই ফলো করছে। দুজনে আরো আপন মনে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে লাগল। পুলিশ সার্বক্ষণিক নজর রাখছে। তারপরও ভয় হচ্ছে ওদের। সিভিল ড্রেসে পুলিশ ফলো করে যাচ্ছে ওদের কে। নিরা শক্ত করে স্বাক্ষরের হাত ধরে রেখেছে। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশই। এই অপারেশনে সাকসেসফুল হতেই হবে।
অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর একেবারে পয়েন্ট গুলো ছাড়িয়ে চলে গেলো ওরা। দূর পর্যন্ত কোনো পর্যটকের আনাগোনাও নেই। ঝাউবনের ভেতরে ঢুকে গেলো ওরা।
এমন সময় হঠাৎ ঝাউবন থেকে কয়েকটা ছেলে বের হয়ে এসে ঘিরে ধরলো ওদেরকে। দুজন খপ করে স্বাক্ষরকে ধরে নিরাকে টানাটানি করে সরনোর চেষ্টা করলো। এখানে চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। তারপরও নিরার মুখ চেপে ধরে দুইটা ছেলে মিলে ধরে আছে ওদেরকে। স্বাক্ষর হাতাহাতি করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। এমন সময় রিয়ান আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো।
রিয়ানকে দেখে চোখ কপালে উঠে গেলো স্বাক্ষরের। ও চেঁচিয়ে বলল- তুই?
রিয়ান হাসতে হাসতে বলল- আজকে তোর বউয়ের সাথে হানিমুন করবো আমি বুঝলি?
- কুত্তার বাচ্চা, তোর একদিন কি আমার একদিন।
- হা হা হা। আগে পারলে নিজেকে ছাড়াস তারপর তোর বউকে যদি আমার হাত থেকে বাঁচিয়ে আনতে পারিস, তাহলেই বুঝবো তুই বাপের ব্যাটা। তোর বোনকে রেপ কইরা ছাইড়া দিছি। কি করতে পারলি? তোর বউরেও এখন… বেশি বাড়লে এরকমই হয় বুঝছোস?
স্বাক্ষর গর্জন করার চেষ্টা করলো। রিয়ান ওর নাকে একটা ঘুষি মেরে বলল- আস্তে চিল্লা। এখানে চিল্লায়েও লাভ নাই। বউ নিয়া হোটেল রুমে শুইয়া থাকা বাদ দিয়া জংগলে ঘুরতে আসছ? মজা টের পাইছো এখন? অবশ্য তোমার হোটেল রুমে গিয়া তোমার বউরে রেপ করে আসতে পারতাম, তুমি কিছুই করতে পারতা না। বুঝছ?
এমন সময় চারিদিক থেকে পুলিশ এসে ঘিরে ফেললো সবাইকে। রিয়ান পুরোপুরি হতভম্ব। নিরাকে ধরতে যাওয়ার আগেই পুলিশ এসে রিয়ানের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ওর হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলো। বাকি পুলিশরা ধরে ফেললো ওর চ্যালাদের। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোপুরি থ হয়ে গেছে রিয়ান। ও ভাবেও নি এভাবে ওর সাজানো প্লান মাটি হয়ে যাবে।
নিরা হো হো করে হাসতে হাসতে বললো- এবার বাকি ক্ষমতা জেলে গিয়া ফলাইয়ো। তুমি সবার সামনে নিজ মুখে বলছো সামান্তাকে রেপ করেছো। আবার আমাকে বাকি হোটেল রুমে গিয়ে.. ছিহ, কি নোংরা মানুষ তুমি। একসাথে তিনটা অভিযোগে মামলা হবে তোমার নামে। যা পারো, করো গিয়ে।
রিয়ান রাগে গজরাতে লাগলো। নিরা আরেকটু জ্বালানোর জন্য বললো- আর হ্যা, রিয়া সোনা কই তোমার? ওই রিয়া মেয়েটা হচ্ছি আমি। হা হা হা..
রিয়ানের কোনো রিয়েকশন দেখার সময় দিলো না পুলিশ। ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। বাকিদেরকেও টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্বাক্ষর কাছে এসে জাপটে ধরলো নিরাকে। এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো নিরা। ব্যাটাকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছেটার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।
১৭ এবং শেষ পর্ব
দুদিন পর
বাসায় ফিরে এসেছে নিরা ও স্বাক্ষর। টানা ঘুম দেয়ার পরও তাদের হানিমুনের রেশ এখনো কাটেনি। তবে হানিমুনের মুহুর্তটা ছিলো নিরার জীবনের অন্যতম বেস্ট একটা সময়। এই সময়টুকু সে সমস্ত চিন্তার অবসান করে নিশ্চিন্তে স্বামীর সাথে উপভোগ করতে পেরেছে। নিরার চোখেমুখে অন্যরকম সুখের আভা এখনও লেগেই আছে।
ঘুম থেকে উঠে রীতিমতো কাজে লেগে পড়েছে নিরা। শাশুড়ী এসে হেসে হেসে বললেন, কি রে এত সাত সকালেই কামে লেগে পড়লি?
- মা, তোমার কাজে এইটুকু হেল্প না করতে পারলে আমি কি করে নিজেকে তোমার মেয়ে হিসেবে দাবী করি বলো?
শাশুড়ী মা হেসে বললেন – পাগলী টা। তুই সত্যিই অনেক পাগলী রে। আমিতো প্রথম প্রথম ভাবতাম লোক দেখানোর জন্য এসব করিস। - কি যে বলেন মা। লোক দেখানোর জন্য কেন করবো? তাছাড়া কোন লোকটা আছে যাকে দেখাবো বলুন?
- হুম বুঝছি সেটা। তোর শ্বশুর ও আমাকে অনেক বলত মেয়েটা বোধহয় ভালোই আছে। আমি উলটা তাকে ঝাড়ি মেরে থামিয়ে দিতাম। এইগুলা নিয়ে আবার মন খারাপ করিস না যেন।
নিরা হেসে বলল- না মা। আমি মন খারাপ করিনি। যেহেতু একা একা বিয়ে করেছি, এইটুকু সহ্য করতে তো হবে ই। - এইটুকু কই? অনেক কটু কথাই শুনিয়েছিলাম তোকে। তুই বড্ড স্যাকরিফাইস করতে জানিস।
- সংসারের জন্য প্রত্যেকটা মেয়েকেই স্যাকরিফাইস করতে হয়।
- কয়টা মেয়ে করে বলতো? সবাই তো শুধু নিজের স্বার্থের পিছনে ছোটে। শ্বশুর মরলে জমাজমি ভাগাভাগি করার ধান্ধায় থাকে।
- জানি মা। কিন্তু ওসবের ধান্ধা করে আমার লাভ কি? আর আমার যে ওসবের ধান্ধা নেই আশাকরি সেটা জানেন। ভালোবাসা এমনই একটা জিনিস যেটা আপনা আপনি হয়ে যায়৷ ছেলের বাবার কি আছে সেসব তো দেখতে যাইনি।
শাশুড়ী মা হেসে বললেন, এসব নিয়ে মাইন্ড করিস না যেন। - আচ্ছা মা। আপনি আজকে খাওয়ার সময় গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট টা খেতে ভুলবেন না যেন।
- আচ্ছা বাবা। তুই আছিস না মনে করিয়ে দিতে।
শাশুড়ী মা হাসিমুখে রান্না করতে আরম্ভ করলেন। এখন ওনার মনে অনেক প্রশান্তি। যেরকম একটা ছেলের বউ চেয়েছিলেন ঠিক সেরকমই কিংবা তারচেয়েও বেশি কিছু পেয়েছেন। নিরার মাঝে সব রকমের গুণই আছে। সর্বশেষ রিয়ানের উচিত শাস্তিটার জন্য উনি সবসময় নিরার উপর কৃতজ্ঞ থাকবেন। ওই শয়তান ছেলেটা যা করেছে তার ক্ষমা হয়না কখনো। একজন মায়ের অভিশাপ লেগেছে ওর উপর।
কলেজ যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে এলো সামান্তা। সবাই মিলে একসাথে নাস্তা খেতে বসেছে। সামান্তাকে ইউনিফর্মে অনেক কিউট দেখাচ্ছে। মেয়েটার মাঝে স্বাভাবিক উচ্ছলতা ফিরে এসেছে। মনেমনে আয়াশ কে ধন্যবাদ দিলো নিরা৷ এরকম একজন বন্ধু এই মুহুর্তে ওর খুবই দরকার ছিলো। যে বন্ধুটা শুধু হাসাবে না, কান্নার শব্দ শুনেও স্বান্তনার বাণী শোনাবে। অনুপ্রেরণা দেবে, শক্তিশালী হতে শেখাবে। সেরকম ই একজন বন্ধু আয়াশ। ভালো থাকার জন্য এমন একজন বন্ধুই যথেষ্ট। সামান্তা পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী হচ্ছে ধীরেধীরে।
খাওয়া শেষ করতে করতে শাশুড়ী মা নিরার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর পড়াশোনার কি অবস্থা? বন্ধ টন্ধ করে দিলি নাকি?
নিরা এ স্বাক্ষর অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। নিরা বলল, না মা। বন্ধ করিনি। ক্লাস করবো না, শুধু পরীক্ষা দিবো..
- না না তা হবে না। ক্লাসও করবি। এমন না যে বাড়ির সব কাজ তোকে দিয়ে করাবো৷ তুই আমাকে মায়ের মত ভেবেছিস, আমিও তোকে মেয়ের মতই নিয়েছি৷ এক মেয়ে দিব্যি পড়াশোনা করবে আর আরেক মেয়ে খালি ঘর ঝাট দেবে সেটা তো হয় না।নিরা মুচকি হেসে বলল, আমার পড়াশোনার অনেক আগ্রহ মা। আপনার ছেলে জানে আমি পড়তে কত ভালোবাসি।
স্বাক্ষর বলল- হ্যা। অনেক ভালো স্টুডেন্টস ও। আমিও বলতে চেয়েছিলাম ক্লাসে যাওয়ার কথা৷ কিন্তু তোমার রাগ দেখে আর সাহস করিনি।
স্বাক্ষরের বাবা বললেন, তুমি এখন থেকে ক্লাসে যেও। সকাল আর দুপুরের রান্নাটা তোমার শাশুড়ী করবে। আর তুমি রাতের রান্নাটা করতে পারো৷ তোমার মাত্র নতুন বিবাহিত জীবন, এখনই এত চাপ নিতে হবে না। তুমি তোমার মত এনজয় করো৷ তোমার শাশুড়ী তো আর অচল হয়ে যায় নি। তবে মহিলার মাথায় মাঝেমধ্যে পোকা কামড়ায়৷ এটা সহ্য করে নিও।
মা ক্ষেপে গিয়ে তাকালেন বাবার দিকে। সবাই মুচকি মুচকি হাসল ওনাদের কান্ড দেখে।
স্বাক্ষর নিরার দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি হাসলো৷
রাত্রিবেলা
সামান্তা নিরাকে ডাকতে ডাকতে এসে বললো- ভাবি একটু কথা বলতাম।
নিরা সামান্তাকে ভেতরে আসতে বলল। স্বাক্ষর বাসায় নেই এখন। সামান্তা ঘরে এসে নিরার সামনে বসতে বসতে বলল- ভাবি।
- হ্যা বল।
- তোমার কোনো তুলনা হয়না ভাবি। তুমি একদিন ভালো মা হতে পারবা।
- মানে?
- ভালো মা হওয়ার জন্য আগে ভালো মেয়ে হতে হয়। তুমি অনেক ভালো গো ভাবি। আম্মু তো তুমি বলতে পুরাই ফিদা। তোমার জন্য অনেক দোয়া করি গো।
- হঠাৎ এত প্রশংসা ঢালছিস কেন বুড়ি?
- তুমি তো প্রশংসার ই যোগ্য ভাবি।
সামান্তা নিরাকে জড়িয়ে ধরল। বলল- ভাবি গো৷ তোমার কথা ইন্সপায়ার হয়ে আমি এখন পড়াশোনায় মন দিয়েছি৷ মাঝেমাঝে আমাকে একটু শাসন করবা ভাবি। - আচ্ছা। এখন মন ভালো?
- হ্যা। মন অনেক ভালো। ভাবি জানো আমার একজন ভালো বন্ধু হয়েছে? যার সাথে পড়াশোনা থেকে শুরু করে সুখ দুঃখ সবই শেয়ার করতে পারি৷
নিরা হেসে বলল- জানি।
সামান্তা অবাক হয়ে বলল- কিভাবে?
নিরা হেসে বলল- সেটা জানতে হবে না।
সামান্তা নিরাকে জড়িয়ে ধরে বললো- ভাবি তোমাকে অনেক আপন ভেবে ফেলেছি। রিয়ানের এই প্রতারণা আমার জীবনটাকে একেবারে নষ্ট করে দিতো। তুমি আমাকে একটু একটু করে অনুপ্রেরণা না দিলে মরেই যেতাম ভাবি।
সামান্তা কেঁদে ফেলল নিরাকে ধরে। নিরা ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল- কাঁদিস না। এমন ভুল আর করিস না কখনো। নিজেকে গড়ে তোল বোন আমার। রিয়ান তার উচিত শিক্ষা পাবে।
- ভাবি, আমার পাশেই থেকো সবসময়। আমি যেন আমাকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারি৷
সামান্তা আরো কিছুক্ষণ নিরার পাশে বসে থাকার পর নিজের রুমে চলে গেলো। এই মুহুর্তে স্বাক্ষরও বাসায় নেই। নিরা বুদ্ধি করে ওর মাকে কল দিয়ে বলল- আম্মু সবকিছু এখন ঠিকঠাক হয়ে গেছে। তুমি একটা কাজ করবে? আমার শাশুড়ীকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবে তারা কি কি ফার্নিচার চায়। দেখো তো উনি কি বলে? - আচ্ছা ঠিক আছে।
নিরার কথামত ওর শাশুড়ীকে কল দিলেন নিরার মা। ওনার প্রশ্নে লজ্জিত হয়ে বলার মত কিছু খুঁজেই পেলেন না নিরার শাশুড়ী। বলে দিলেন কিছু লাগবে না।
মায়ের মুখে কথাটা শুনে নিরা মনেমনে হাসলো আর ভাবলো, ব্যাপারটা এখানেই চাপা থাকুক। শাশুড়ী মাকে আর কখনোই ফার্নিচারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস না করাই ভালো। উনিও আশাকরি আর কখনও এসব নিয়ে কথা বলবেন না। ওনাকে কিছু বললে বরং লজ্জা পাবেন। উনি হয়তো ভেবেছেন নিরা এসবের ব্যাপারে কিছুই জানেনা। ব্যাপারটা এ পর্যন্তই থাক তবে।
স্বাক্ষর রুমে ঢুকেই নিরাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরাতে লাগলো। ওর হাসিহাসি মুখ দেখে নিরা মুগ্ধ হয়ে বলল- কাহিনি কি বলো তো? এত আনন্দ কেন?
- ওহ হো নিরা, একটা দারুণ সুখবর আছে।
- কি সুখবর? সেটাই তো জানতে চাইছি।
- ম্যাডাম, আজকে চাকরির ব্যাপারে একজনের সাথে কথা বলেছি। আশাকরি এটা হয়ে যাবে। হয়ে গেলেই বাসায় আব্বু আম্মুর কাছে আমাদের মাথাটা উঁচু হবে বুঝেছো পাগলী?
নিরা খুশি হয়ে স্বাক্ষরকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল- আমাদের কষ্টের দিন ফুরিয়েছে স্বাক্ষর।
- তুমি আমার জীবনে আলো নিয়ে এসেছো নিরা।
নিরা কোনো কথাই বলতে পারলো না। লজ্জায় মুখ লুকালো স্বাক্ষরের বুকে।
সমাপ্ত ……।
পরিশেষে কিছু কথা আমাদের সমাজে ছেলের মায়েরা কখনো কখনো ভুলেই যান যে শুধু ছেলে বড় করতে কিংবা মানুষ করতে অর্থ খরচ হয়না মেয়েদের ক্ষেত্রেও সেইম খরচ হয়।
তাহলে কেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ছেলের পরিবারের আনুসাঙ্গিক চাহিদা পুরন করতে হবে পরিবার কে?
আবার কখনো দেখা যায় ছেলে বউয়ের সাথে এতোটাই অমানবিক আচরণ করে যে এটাও ভুলে যায় যে নিজের ঘরেও মেয়ে আছে নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে যদি এমনটাই হয়!
মেয়ের মায়েরা নিজ বান্ধবীদের সাথে খোশ গল্পে এমনটাও উড়ায় যে মেয়ে জামাই আমার একদম মন মতো হয়েছে। মেয়ের জন্য এক পায়ে খাড়া মেয়ের যখন যা চাই এনে হাজির। সবসময়ই বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যায় বাহির থেকে খেয়ে আসে।
আর ছেলেটা আমার হয়েছে বউয়ের গোলাম বউয়ের কথায় উঠে বসে যেন বউ ই সব।
এ হচ্ছে আমাদের মানসিকতা, আমাদের মানসিক পরিবর্তন প্রয়োজন আমরা সমাজের মানসিক রোগীতে পরিনত হয়েছি।
এ কথাগুলো এলোমেলো হওয়ার কারণ হলো ঘটনাগুলি এভাবে এলোমেলো ঘটে থাকে তাই এলোমেলোভাবে বুঝানোর চেষ্টা।
আবার ভালো কিছু নিয়ে আসার আশা রেখে আজ বিদায় নিলাম।।
লেখকঃ নীলাভ্র নেহাল
বেলা শেষে – স্ত্রীর সত্যিকারের ভালোবাসা