আজ প্রথম দিনের টিউশনি তে এসেছি।
ছাত্রী ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। নিতান্তই বাচ্চামেয়ে, যদিও কলেজে পড়ে। আমি আজ থেকে বছর সাতেক আগে এই লেভেল পার করে এসেছি। কাজেই বাচ্চা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাসায় ঢুকে ড্রয়িংরুমে সোফার উপরে বসে আছি। ছাত্রীর আম্মা আমাকে নাস্তা দিয়ে গেলেন। চায়ের সাথে বিস্কুট ও বাতাসা। আমি দুটো বাতাসা মুখে দিয়ে বিস্কুট হাতে নিলাম। চায়ে চুবিয়ে মাত্র মুখে দিয়েছি সেইমুহুর্তে কেউ একজন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা সালাম দিলো- আসসালামু আলাইকুম স্যার।
সালামের জবাব নিয়ে মুখ তুলে তাকাতেই দেখি একটি হাস্যময়ী সাবালিকা। মুখে মিষ্টি হাসি লেগে আছে। কিন্তু চেহারায় দুষ্টুমির ছাপ প্রবল। এটিই নিশ্চয় ই আমার স্টুডেন্ট!
সে বলল,স্যার ভালো আছেন?
- হ্যা আছি।
- স্যার কি লজ্জা পেয়েছেন?
- কি কারণে লজ্জা পাবো?
- এইযে চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে চুবিয়ে খাচ্ছিলেন। হঠাৎ আমি চলে এসেছি।
- এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই।
কথাটা বলেই আবারো বিস্কুট চায়ে অর্ধেক চুবিয়ে মুখে দিতে যাবো এমন সময় মেয়েটা চেঁচিয়ে বলল,খাবেন না স্যার।
আমি থতমত খেয়ে বললাম, কেন খাবো না? - চুল স্যার,চুল।
- চুল! কই?
মেয়েটি একটু এগিয়ে এসে আমার বিস্কুট থেকে একটা চুল টেনে বের করে বলল,এই যে স্যার।
আমি রীতিমত অবাক! বিস্কুটে চুল কি করে এলো? তাও আবার মেয়ে মানুষের চুল!
মেয়েটি বলল,সরি স্যার। এই চা আর খেতে হবে না। আমি নতুন করে চা এনে দিই?
- আচ্ছা দাও।
মেয়েটি নতুন করে চা বানানোর জন্য উঠে চলে গেলো। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম চায়ে চুল এলো কোথ থেকে? নাকি মেয়েটি ই ইচ্ছে করে চুল দিয়ে দিয়েছিলো? সিনেমায় এরকম হয়।নতুন টিচারকে তাড়ানোর জন্য ছাত্রী ঠিক এরকম বুদ্ধি বের করে। সেরকম কিছু করছে না তো?
ভাবতে ভাবতে আমার ছাত্রী এসে হাজির। হাতে এক কাপ ধোয়া ওঠা চা। আমি সেটা হাতে নিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম।তারপর চায়ে চুমুক দিয়েই চেঁচিয়ে উঠলাম। একগাদা মরিচের গুড়া ঢেলে দিয়েছে চা এ! কি পাজি মেয়েরে বাবাহ!
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠলো।তারপর বলল,স্যার চা খান।
আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, চায়ে মরিচের গুড়া দিয়েছ কেন?
- সেকি স্যার! চায়ে মরিচের গুড়া? এত বড় সাহস কার হলো যে আমার টিচারের চায়ে মরিচের গুড়া দিয়েছে? রিওনের মা,এই রিওনের মা…
ডাকতে ডাকতে ছাত্রী ভিতরের ঘরে চলে গেলো। যদিও ভান করছে সে ধোয়া তুলসি পাতা। কিন্তু আসল ব্যাপার টা আমি বুঝে গেছি।এই মেয়ে দারুণ ফাঁকিবাজ আর পাজিও বটে। একে সামলানো দায় হয়ে যাবে দেখছি!
চা রেখে পড়াতে আসলাম। ছাত্রী আমার সামনে বসে পা দোলাচ্ছে। যদিও পা টেবিলের নিচে কিন্তু আমার বুঝতে অসুবিধা হলোনা। সে পায়ের সাথে সাথে টেবিল টাও নাচাচ্ছে।
আমি বললাম, অংক বের কর।
- স্যার,আমার না অংক একদম ই ভালো লাগেনা। আজ আমরা অংক না করি?
- না করবে কেন? আমি তোমার ফিজিক্স আর ম্যাথের টিচার। অংক তো করতেই হবে।
- স্যার থাক না আজ, আজ তো প্রথম দিন। আজ আমরা পরিচিত হই? গল্প করি?
আমি একটু নাক চুলকে বললাম, ঠিক আছে। নাম কি তোমার? - স্যার আমার নাম বর্ষা। খুব সুইট নাম না?
- হুম সুইট।
- আপনার নাম কি স্যার?
- শ্রাবণ।
বর্ষা অবাক হয়ে বলল,যেই শুনেছেন আমার নাম বর্ষা অমনি আপনার নাম শ্রাবণ হয়ে গেলো?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, রিয়েলি আমার নাম শ্রাবণ। বিশ্বাস হচ্ছেনা?
- উহু,
- স্যার নিশ্চয় ই নাম নিয়ে ফাজলামি করবে না। স্যার রা তোমার মত ফাজিল হয়না।
বর্ষা হেসে বলল,আমি ফাজিল স্যার? - ফাজিলের ডিব্বা। দেখেই বোঝা যায়।
- আপনাকে দেখে কি বোঝা যায় জানেন স্যার?
- কি?
- আপনি না হেভি রোমান্টিক।
ছাত্রীর মুখে প্রথম দিনেই এমন কথা শুনে আমার কাশি উঠে গেলো। অনেক্ষণ ধরে কাশলাম। বর্ষা ছুটে গিয়ে পানি এনে দিলো এক গ্লাস। পানি খেয়ে হাফাতে লাগলাম।
বর্ষা বলল,স্যার এনিথিং রঙ?
- না।
- আপনি কি বিড়ি খান?
আবারো উদ্ভট প্রশ্ন। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, হ্যা তা খাই মাঝেমাঝে। বিড়ি আবার কে না খায়? - আমার ও না স্যার খুব বিড়ি খাইতে মন চায়।
এবারে আমার আরো জোরে কাশি উঠলো। এটা কেমন কথা! বিড়ি খাইতে মন চায়! আল্লাহ এ কেমন ছাত্রীকে পড়াতে আসলাম? আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না কিছুতেই।
বর্ষা বেশ কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করার পর হলল,স্যার কিছু ভাবছেন?
- নাহ,ফিজিক্স বই বের করো।
বর্ষা মুখটা একটু বাঁকা করে বই বের করলো। তারপর আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,স্যার আমার এখানে সমস্যা। এই চ্যাপ্টার টা আগে বুঝাই দেন।
ওর কথামত বিষয়টা ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিলাম।বর্ষা শুধু মাথা ঝাকালো। কিছুক্ষণ বোঝানোর পর জিজ্ঞেস করলাম, মাথায় ঢুকলো? - কি ঢুকবে স্যার?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, পড়া ঢুকেছে? - কোন দিক দিয়ে ঢুকবে স্যার?
এবারে আমার বিস্ময় চরম সীমায় পৌছে গেলো। এরকম বাদর মেয়েকে কিভাবে পড়ানো সম্ভব? তবুও রাগ করলাম না। স্বাভাবিক গলায় বললাম, বেশি পাকনামো করলে চুপচাপ এসে বসে থাকবো। সময় শেষ হলে চলে যাবো। আমার শুধু মাস গেলে বেতন চাই,বেতন পেলেই এনাফ। তুমি বুঝলে কি বুঝলে না, কতদূর এগিয়ে গেলে সেটা তোমার ব্যাপার। তোমার লাইফের দায়ভার শুধু তোমার নিজের।
কথাটা বলার পর বর্ষার চেহারাটা কেমন বদলে গেলো। চোখ টলমল করে উঠলো। মুখটা কালো হয়ে গেলো। ও চুপচাপ বইটা টেনে নিয়ে মাথা নিচু করে পড়তে লাগলো। আমি মনে মনে বেশ খুশি হলাম।
বর্ষা পড়া শেষ করে মাথা না তুলেই বলল,স্যার পড়া হয়েছে।
- ভেরি গুড।পড়া কাল নেবো। এবার গল্প করবো।
বর্ষা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে মাথা নামিয়ে নিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কয় ভাই বোন তোমরা? - এক ভাই এক বোন। আমার ভাইয়া ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
- খুব ভালো। কলেজে বন্ধুবান্ধব কতগুলো তোমার?
বন্ধুবান্ধবের কথা জিজ্ঞেস করায় বর্ষা খুব আনন্দিত হলো। বলল,হ্যা স্যার আমার অনেক ফ্রেন্ডস। ওরা এত্ত ভালো আর ফ্রেন্ডলি কি বলবো! সবাই খুবই মজার।
- তাই নাকি! তাহলে অনেক মজা হয় তাইনা?
- হ্যা স্যার। খুব মজা হয় আমাদের। আমরা তো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাই,সিনেমা দেখতে যাই, বন্ধুর বাসায় যাই আরো কত কি করি।
বর্ষা অনেক খুশি খুশি হয়ে কথাগুলো বলছে। আমার খুবই ভালো লাগছে দেখতে। এরকম খুশি হয়ে কথা বলতে অনেকদিন কাউকে দেখিনা!
আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। বর্ষা বলল,স্যার কি হলো?
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, কিছু না। তোমার প্রিয় সাবজেক্ট কি? - ইংলিশ।
- তাহলে সায়েন্স পড়ছ কেন? ইংলিশ পড়তে।
- ধুর আব্বু আম্মুর এক কথা সায়েন্স পড়তে হবে। আমাদের কি আর নিজের ইচ্ছায় পড়া হয় বলেন?
বর্ষা খুবই আপন মানুষ দের মত করে কথা বলে। কত লক্ষ্মী মেয়ে মনেহচ্ছে।অথচ একটু আগেই আমাকে মরিচের চা খাইয়েছে। ভাবাই যায়না।
আরো অনেক্ষণ গল্প করার পর বর্ষাকে আজকের মত ছুটি দিলাম।আবার কাল আসতে হবে।
পর্ব ২
আজ টিউশনির দ্বিতীয় দিন।
এসেই দেখি আমার ছাত্রী খুব মনোযোগ দিয়ে মোবাইল টেপাটেপি করছে। আমাকে দেখে মোবাইল টা পাশে রেখে তাকালো। তারপর লম্বা করে সালাম দিলো, আসসালামু আলাইকুম স্যার।
আমি সালাম নিয়ে বললাম, কেমন আছো?
- জি স্যার ভালো আছি, আপনি?
- আমিও বেশ ভালো। তোমার মা কোথায়?
- রান্নাঘরে স্যার। আপনি আসুন,
বর্ষা আমাকে নিয়ে ওর রুমে আসলো। তারপর নিজেই শুদ্ধ মেয়েদের মতন বইখাতা নিয়ে টেবিলের বসে গেলো। বাহ! একদিনের একটা ডায়ালগেই মেয়েটার অনেক উন্নতি হয়েছে দেখছি! একদম একা একাই পড়তে বসে গেলো। আর গতকালের চেয়েও বেশ লক্ষ্মী হয়েছে।
বর্ষা আমাকে বসিয়ে রেখে একটু বাইরে চলে গেলো। তারপর ফিরে এলো এক কাপ চা ও এক পিরিচ বিস্কুট নিয়ে। সেগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল, খান স্যার।
- আজ আবার মরিচ মিশিয়ে দাওনি তো?
বর্ষা হেসে বলল,না স্যার। কালকের ব্যাপার টার জন্য আমি সরি। - ইটস ওকে। তুমি বসো।
বর্ষা পড়তে বসে গেলো। আমি একটা বিস্কুট নিয়ে কুট কুট করে কামড়াতে লাগলাম। বর্ষা বলল,স্যার লজ্জা পাবেন না। আপনি চাইলে চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খেতে পারেন।
আমি হেসে চা এ বিস্কুট চুবিয়ে খেলাম। বর্ষা বই বের করে একা একাই পড়তে লাগলো। আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেছি। বেশ হতভম্ব ও! মেয়েটা একদম চেঞ্জ হয়ে গেছে দেখছি!
বর্ষা পড়তে পড়তেই পা নাচাচ্ছে। একসময় বলল,স্যার একটা কথা বলি?
- হ্যা বলো।
- স্যার আপনি কি বিবাহিত?
আমি একটু কেশে বললাম, না। আমাকে দেখে কি বিবাহিত মনেহয়? - না মানে একদম ক্লিন সেভ করে এসেছেন তো তাই আরকি। ব্যাচেলর দের মোটামুটি দাড়ি থাকে।
- তাই নাকি! জানতাম না তো।
বর্ষা হেসে আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলো। আমি হাসিহাসি মুখেই তাকিয়ে থেকে ভাবছি আসলেই তাই নাকি? ব্যাচেলর রা দাড়ি কামানোর পয়সা পায়না বলেই কি দাড়ি রাখে? নাকি শখ করেই রাখে? জানিনা। এবার দাড়ি আর কাটবো না। এরকম ই থাক। কেন যেন বর্ষার কথা শুনে মনেহচ্ছে আমাকে দাড়িতেই ভালো লাগবে।
ও বলল,স্যার আপনার বাসা কোথায়?
- এইতো উত্তরায় আছি।
- গ্রামের বাসা?
- যশোরে।
- ওহ আচ্ছা।
পড়ার ফাঁকেফাঁকে এরকম গল্প করাও যায়? মেয়েটাকে বেশ লক্ষ্মী মনেহচ্ছে। একটু পড়ার পর বলল,স্যার আমি একটু আসছি।
তারপর উঠে গিয়ে একটু পরেই এক বাটি পায়েস নিয়ে এসে বলল,স্যার খেয়ে নিন।আম্মু ভালো পায়েস বানাতে পারে।
আমি পায়েস দেখে বেশ খুশি হলাম।অনেকদিন পায়েস খাইনা। সেই কবে মায়ের হাতে খেয়েছিলাম মনেই পড়েনা। পায়েস মুখে দিয়ে বললাম, দারুণ টেস্ট হয়েছে তো।
- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আমার পড়া নিন।
আমি দুটো অংক দেখিয়ে দিয়ে বললাম, এগুলা করে দাও।
বর্ষা অংক করা শুরু করে দিলো। আমি পায়েস খাচ্ছি। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে একবার পায়েস মুখে দিচ্ছি আরেকবার চা মুখে দিচ্ছি। বর্ষা মুখ টিপে হাসছে আমার কান্ড দেখে।
খাওয়া বন্ধ করে বললাম, হাসছো?
- না স্যার। আমিতো অংক করছি।
- করো।
বর্ষা পা নাচাতে নাচাতে অংক করতে লাগলো। অনেক্ষণ পর অংক করা শেষ করে বলল, স্যার হয়ে গেছে।
আমার খাওয়াও হয়ে গেছে। পানি খেয়ে ওর অংক দেখতে লাগলাম। দুটোই সঠিক হয়েছে। বেশ ব্রিলিয়ান্ট আছে মেয়েটা!
এরপর আরো কিছু পড়া বুঝিয়ে দেয়ার পর বইটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ও খাতায় অংক করতে লাগলো। এমন সময় আমার পেট টা কেমন গুড়গুড় করে উঠলো। একবার টয়লেট যেতে হবে মনেহচ্ছে।
উঠে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ফিরে এলাম দু মিনিট বাদে। বর্ষার অংক করা হয়ে গেছে। অংক টা দেখে আরেকটা বুঝিয়ে দিতে যাব এমন সময় আবারো পেট গুড়গুড় করে উঠলো। আমি আবারো ছুটলাম ওয়াশরুমে।
এভাবে পরপর চারবার গেলাম ওয়াশরুমে। বর্ষার ঠোটের কোণে চাপা হাসি। আমার আর বুঝতে বাকি নেই এই মেয়ের কাজ। ও নিশ্চয় ই পায়েসের সাথে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলো। পেট টা খুব খারাপ করেছে।
কিন্তু ওকে কিছু বললাম না। ছোট মানুষ একটু তো দুষ্টু হবেই। উঠে বললাম, আজ আর পারবো না পড়াতে। আজ আসি।
বর্ষা উঠে দাঁড়াল। আমি বেড়িয়ে আসলাম বাড়ি থেকে। খুবই অস্বস্তি লাগছে।
বাসায় এসেও দুইবার গেলাম। শুধু বাথরুম বেডরুম করছি। এভাবে কতক্ষণ কাটবে কে জানে? এক ডাক্তার বন্ধুকে ফোন দিয়ে ওষুধ কি কি খেতে হবে শুনে নিলাম। তারপর ওষুধ কিনে এনে খেয়ে শুয়ে রইলাম।
অনেক্ষণ পর কিছুটা আরাম লাগছে। উফফ বাবাহ মেয়েটা এত ফাজিল! আজ দেখে এরকম মনেই হয়নি। ওর চালাকি যেন বুঝতে না পারি সেজন্যই এরকম ভদ্র আর লক্ষ্মী হয়ে ছিলো। না জানি আরো কি কি অকাম কুকাম করবে?
শুয়ে শুয়ে ফোন টিপলাম কিছুক্ষণ। ওষুধ খেয়ে অনেকটা ভালো ফিল করছি। কিন্তু শরীর দূর্বল লাগছে খুব। অনেক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লাম আস্তে আস্তে।
পরদিন আবারো এলাম টিউশনি তে।
বর্ষা বরাবরের মতই লম্বা করে সালাম জানালো। আমি আজ হাসলাম না। সালামের জবাব দিয়ে সোজা ওর পড়ার ঘরে এসে চেয়ারে বসলাম। বর্ষা কিছুক্ষণ পরে এক কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বলল,স্যারের কি মন খারাপ?
- না।
- অমন ই দেখাচ্ছে।
- না তো। বসো।
বর্ষা বসতে বসতে বলল,স্যার কি সুস্থ? - হ্যা, মোটামুটি সুস্থ।
- আগে কোনটা পড়াবেন স্যার?
- ফিজিক্স বের করো।
বর্ষা ফিজিক্স বই বের করে পাতা উলটে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এইটা বুঝিনি স্যার। একটু বুঝিয়ে দিন।
আমি বুঝিয়ে দিলাম। বর্ষা বলল,স্যার আজ চা খাচ্ছেন না কেন?
- ওহ,ভুলেই গেছিলাম।
- এখন খান।
- না থাক,ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
বর্ষা কোনো অনুমতি না নিয়েই উঠে গেলো। ফিরে এলো এক কাপ ধোয়া ওঠাত চা নিয়ে।
আমি বললাম,আজ চা খেতে ইচ্ছে করছে না। - তাহলে কি কফি খাবেন স্যার?
- না,
- স্যার,শরবত বানিয়ে দেই?
- কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। থাক।
বর্ষা চোখ উপরে তুলে বলল,স্যার কি রাগ করেছেন? - না তো।
- তাহলে কি সন্দেহ করছেন?
- নাহ।কেন সন্দেহ করব?
- চায়ের সাথে কিছু মিশিয়েছি কিনা।তাই ভাবছেন?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, নাহ।
বর্ষা চায়ের কাপ টা নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,এই যে আমি খেলাম। এবার বিশ্বাস হলো?
আমি হাসলাম।হেসে বললাম, ধুর পাগলী। আজ খেতেই ইচ্ছে করছিলো না।
- আমি জানি আপনি সন্দেহ করছিলেন।
- আরে না, দাও খাচ্ছি।
- আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি আরেক কাপ।
বর্ষা উঠে যাচ্ছিলো। আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, লাগবে না। তুমি বসো। এটাই দাও আমাকে।
বর্ষা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আমি বললাম, দাও…
ও অবাক করা চোখে তাকিয়েই চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। আমি ওকে অবাক করে দিয়েই চায়ে চুমুক দিলাম। বর্ষা অনেক্ষণ বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। আমি পুরো চা টাই খেয়ে ফেললাম।
বর্ষা অবাক হয়ে চেয়ে আছে দেখে বললাম, কারো এঁটো করে খেয়ে রাখা কিছু খেলে কি হয় জানো? মায়া বেড়ে যায়।
বর্ষা মুচকি হাসলো। তারপর পড়ায় মন দিলো। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি।মেয়েটাকে খুব ভদ্র মনেহয়। সে কাল ওরকম একটা কাজ করেছে বিশ্বাস ই হয়না। রাতে আমার যা অবস্থা হয়েছিল! শুধু বাথরুম আর বেডরুম!
বর্ষা পড়া শেষ করে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে বলল,স্যার একটা গল্প শোনান না।
- কিসের গল্প শুনবা?
- যেকোনো গল্প। আমার ম্যাডামের গল্প শুনান।
আমি হেসে বললাম, আমি সিংগেল। কোনো ম্যাডাম নেই। - কেন নেই?
- জানিনা। আমি খুব বেখেয়ালি একজন মানুষ তো। তাই হয়ত।
- আপনাকে তো যে কোনো মেয়ের ই পছন্দ হবে স্যার।
- তাই নাকি?
বর্ষা লজ্জা পেয়ে হাসলো। তারপর খাতার দিকে তাকিয়ে অংক করতে লাগলো। আমি বই নিয়ে ওকে একটা অংক বুঝিয়ে দিলাম।বর্ষা মনোযোগ দিয়ে অংক করলো।
তারপর বলল,সরি স্যার।
- কেন?
- কাল আপনার পায়েসে পেট খারাপের ওষুধ মিশিয়ে দেয়ার জন্য।
আমি হেসে বললাম, কেন দিয়েছিলা? - আপনি বাথরুমে ছুটবেন দেখার জন্য।
বলেই হাসলো। আমি অবাক হয়ে গেলাম।কি পাজি মেয়েরে বাবাহ!
বর্ষা অনেক্ষণ ধরে হাসলো। আমি হা করে চেয়ে রইলাম ওর হাসির দিকে।
পর্ব ৩
বর্ষা হাসি থামিয়ে বলল, স্যার আপনার আর কোনো শার্ট নেই?
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, থাকবে না কেন?
- প্রতিদিন এই একটা শার্ট ই পড়েন আপনি। আর কি শার্ট নেই আপনার? তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আমি লজ্জা পেলাম খুব। লজ্জিত গলায় বললাম, না মানে শার্ট ধুয়ে দিতে হয় এজন্য আরকি। একটাই চার পাঁচদিন পড়ি।
- পারফিউম ইউজ করেন না কেন?
আমি আবারো থতমত খেয়ে গেলাম। এটা আবার কেমন প্রশ্ন!
বর্ষা বলল, একটা শার্ট এক সপ্তাহ পড়লে গন্ধ বের হয়। সেজন্য পারফিউম ইউজ করা উচিৎ।
আমি বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম। আমার গায়ে কি গন্ধ আছে নাকি? কই কখনো তো কেউ সেভাবে বলেনি। সর্বনাশ! যদি আমার গায়ে গন্ধ থাকে তো আমার তো করুণ অবস্থা! এই মুখ কিভাবে দেখাবো! আমার বেশ অপ্রস্তুত লাগছে।
বর্ষা বলল, স্যার কি মন খারাপ করলেন?
- না।
- রাগ করেছেন?
- না।
- তাহলে এমন দেখাচ্ছে কেন আপনাকে? সরি স্যার।
আমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম, আরে না না ঠিকাছে। - স্যার আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আপনাকে স্টাইলিশ হতে বলতো না?
- না।
- কেন বলতো না?
- কারণ আমার গার্ল ফ্রেন্ড ছিলোই না।
- কেন ছিলনা? আপনার কি শারীরিক কোনো সমস্যা আছে স্যার?
সর্বনাশ করেছে রে! এই মেয়ের মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে। এমন কেন মেয়েটা। স্যারকে কেউ এভাবে বলে? কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই নাকি? কিছু বলতেও পারিনা, চুপ করেও থাকতে পারিনা। কঠিন একটা অবস্থা।
বললাম, আমি একদম পারফেক্ট। - তাহলে গার্ল ফ্রেন্ড কেন ছিলোনা?
- আসলে আমার জীবনের লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে হতেই ভার্সিটি লাইফ শেষ হয়ে গেলো, তারপর এভাবে ই চলে আসলো। আর প্রেম করা হয়ে উঠেনি।
- ও আচ্ছা স্যার। প্রেম না করলে জীবন টাই বৃথা। পারলে বিয়ে করার আগেই একবার প্রেম করবেন।
- প্রেম না করলে জীবন বৃথা কেন?
- অবশ্যই বৃথা। প্রেমের মত সুখ কিছুতেই আছে নাকি?
- তাই নাকি! জানতাম না তো। তুমি সেই সুখের স্বাদ পেয়েছো?
- না স্যার পাইনি। কিন্তু আমি জানি। ফিল করতে পারি।
- তুমি পাওনি কেন? অনেক তো বড় হয়েছো।
- আসলে স্যার আমার মনের মত কাউকে পাইনি।
- ওহ আচ্ছা।
- শুনুন আমি আপনাকে স্যার স্যার না ডেকে ভাইয়া ডাকলে আপনার আপত্তি আছে?
- নাহ,আপত্তির কি আছে? তুমি ভাইয়া ডাকলে আমার ও সহজ লাগবে। সহজে কথাবার্তা বলতে পারবো আরকি।
বর্ষা হাসলো। আমি চুপচাপ চেয়ে রইলাম অনেক্ষণ। তারপর ওকে কিছু হোমওয়ার্ক দিয়ে উঠে পড়লাম বেড়িয়ে আসার জন্য।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি, ভাইয়া থেকেই কিন্তু অনেক কিছু হয়ে যায়। সেরকম কিছু হতে পারে নাকি? কিজানি বাবাহ! মেয়েটা খুব রহস্যময়ী!
এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো। একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল। রিসিভ করতেই সালাম দিলো। জবাব দিয়ে বললাম, কে বলছেন?
- ভাইয়া আমি বর্ষা।
আমি চমকে উঠলাম। ওর কথা ভাবতে ভাবতেই ও ফোন দিলো। বললাম, হ্যা বলো।।নাম্বার কোথায় পেলে? - আম্মুর ফোন থেকে নিয়েছি। ভাইয়া একটা প্রব্লেম হয়েছে।
- কি প্রবলেম?
- একটা ছেলে আমাকে খুবই ডিস্টার্ব করছে।
- কিভাবে?
- খুবই ফোন দেয়,মেসেজ দেয়। প্রেম করতে চায় আমার সাথে।
- নাম্বার ব্লাক লিস্টে রেখে দাও।
- স্যার, ও তো আমার ক্লাসমেট। ক্লাসেও জ্বালায় খুব।
- ওহ।
- ওহ কি? এখন কোনো উপায় বলে দিন।কি বলবো ওকে?
- বলো তুমি প্রেম করতে চাও না।
- বলেছি অনেক। কাজ হয়নি। এখন একটা কাজ করা যায়।
- কি?
- ও আমাকে বারবার ফোন দিচ্ছে। আমি এখন অনেক্ষণ আপনার সাথে ফোনে কথা বলি? তাহলে ও কল দিয়ে ওয়েটিং পাবে। এরপর আমি ওকে বলবো, আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।কি বিচ্ছু মেয়েরে বাপ! পাক্কা ধড়িবাজ মেয়ে।
বর্ষা বলল, ভাইয়া বলবেন কিছুক্ষণ কথা? - হ্যা বলো।
- আপনার তো কথা বলার কেউ নেই। কিছুক্ষণ কথা বলাই যায়। তাতে যদি কারো উপকার হয়।
আমি মনে মনে বললাম, কি আমার উপকার রে!
মুখে বললাম, খুব ভালো কথা বলেছো। বলো কি বলবা? - আপনার ভয়েজ টা কিন্তু সুন্দর অনেক।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম।আমার ভয়েস সুন্দর! জীবনে প্রথমবার কেউ বলল এ কথা!
বর্ষা বলল, অনেক রোমান্টিক ভয়েস।
- ভয়েস আবার রোমান্টিক হয়?
- হ্যা হয়।
- ওহ,তোমার ভয়েস টা অনেক মিষ্টি।
- খেতে ইচ্ছে করে তাইনা?
আমি একদম থ! মুখে দেখি কিচ্ছু আটকায় না। বললাম, ভয়েস কিভাবে খাওয়া যায়?
- যায় যায়। মনে মনে খাওয়া যায়।
- খেতে ইচ্ছে করলে কি খাবো?
- হ্যা খেতে পারেন। আপনাকে পারমিশন দিলাম।
- বাব্বাহ! আমি কি স্পেশাল কেউ নাকি?
- অবশ্যই, আমার প্রিয় একজন টিচার।প্রিয় একজন ভাইয়া।
- টিচার বললে নিজেকে মুরুব্বি মনেহয়।
বর্ষা হেসে বলল,এতক্ষণে আপনি লাইনে এসেছেন। - এর আগে কি লাইনচ্যুত ছিলাম?
- না মানে খুবই আনরোমান্টিক কথাবার্তা বলতেন।
- এখন কি রোমান্টিক কথাবার্তা বলছি?
- হুম,রাত যত গভীর হয় কথাও তত রোমান্টিক হয়।
খাইছে রে! এই মেয়ে তো একদম সাংঘাতিক! আমি কি বলবো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছিনা। চুপ করে রইলাম।
বর্ষা বলল, ভাইয়া আমি যদি আপনাকে একটা গিফট দেই আপনি নেবেন? - হ্যা নিবো।
- আচ্ছা তাহলে কাল দিবো।
- ওকে, তোমার সেই বন্ধু আর কল দিচ্ছে না?
- দিচ্ছে তো। দিক গে, আপনি বলুন।
- আমার তো ঘুম পাচ্ছে।
- আমি যদি ঘুমাতে না দেই?
- কিভাবে?
- যদি আপনার বিছানায় চলে আসি?
কথাটা শুনেই আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো। এরকম কথা এ জীবনে কখনো শুনিনি আমি। সে কিভাবে আমার বিছানায় চলে আসবে? মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না। সে বিছানায় এলে কি হবে? আমিতো জীবনেও ঘুমাতে পারবো না।
বর্ষা বলল, হি হি হি। ভয় পেয়েছেন আমিতো মজা করলাম।
- আচ্ছা আচ্ছা। ভয় পাইনি।
- আমি কি সবকিছু শেয়ার করতে পারি আপনার সাথে?
- হ্যা পারো।
- ধুর,এরকম করে বলছেন কেন? একটু রোমান্টিক হয়ে বলুন না,তখনকার মত।
আমি অনেক চেষ্টা করেও রোমান্টিক হয়ে বলতে পারলাম না। বর্ষা একাই বকবক করতে লাগলো।কথা বলতে বলতে একসময় আমাকে বলল,এবার আপনি কিছু বলুন।
আমি দু একটা কথা বলার পর আর ওর কোনো সারাশব্দ পেলাম না। তার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।
আমিও ফোন রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।
চিন্তা করছি,মেয়েটা একটু ইনোসেন্ট স্বভাবের। তবে খুব ভালো মনের। যদিও আমাকে অনেক ধোলাই মোলাই করেছে। কিন্তু তবুও ভালো অনেক। এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।
পর্ব ৪
দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেলো। বর্ষার সাথে সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মত হয়ে গেছে।
সারাদিন নিজের সকল কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়েই কাটালাম।
সন্ধ্যায় পড়াতে আসলাম। বর্ষা আমাকে দেখে মুচকি হাসলো।
আজ আমাকে দেখামাত্রই পড়তে এলো ও। গোলাপি রঙের একটা জামা পড়ে মাথায় ওড়না দিয়েছে। ঠোটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। সবমিলিয়ে ওকে দারুণ লাগছে। চেহারায় একটা গোলাপি আভা চলে এসেছে।
বর্ষার মা আমাকে নাস্তা ও চা দিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন, “মেয়ে পড়াশোনা কেমন করছে?”
আমি জবাব দিলাম, “খুবই ভালো। অনেক তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে ও।”
আন্টি হেসে চলে গেলেন। বর্ষা বই বের করে দিয়ে বলল,” এটা পড়াবেন আজ।”
- “আচ্ছা দাও।”
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওকে পড়া বুঝিয়ে দিলাম। বর্ষা পড়তে পড়তে পা নাচাচ্ছে। টেবিল সুদ্ধ নড়ছে ওর পা নাচানোর শব্দে। আমি চোখ রাঙালাম কিন্তু ও বই থেকে মাথাই তুললো না। জোরে জোরে পড়ছে আর পা নাচাচ্ছে। বারবার চোখ রাঙাচ্ছি কিন্তু খেয়াল ই করছে না। আমি অকস্মাৎ পা দিয়ে ওর পা ছুঁয়ে দিলাম। সাথে সাথেই ওর পায়ের নাচন থেমে গেলো। চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। সেই চোখে একইসাথে দেখতে পেলাম প্রেম ও ভয়। ভয়টা কিসের সেটা বুঝতে পারলাম না।
বর্ষা পা সরিয়ে নিলো। আর নাচাচ্ছে না। আমি বললাম, এখন পড়ো মন দিয়ে।
বর্ষা পড়তে লাগলো। অনেক্ষণ পর মুচকি হাসলো। আমি হাসির কারণ জানতে চাইলাম।
বর্ষা বলল, আমি যদি আবার পা নাচাই আপনি কি আবার পা দিয়ে ছুঁয়ে দিবেন?
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এই সেরেছে রে। এটা কেমন কথা! আমি তো অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ওটা করিনি। অকস্মাৎ হয়ে গেছে। এরপর মাথা নিচু করলাম কিন্তু কিছু বললাম না। বর্ষা আলতো করে আমার পা ছুঁয়ে দিলো। আমি শিহরিত হয়ে উঠলাম। পা সরিয়ে নিলাম কিন্তু ও আবারো পা রাখলো আমার পায়ের উপর। এবার তো আমার ই ভয়ভয় লাগছে। এভাবে পায়ের উপর পা রাখছে কেন!
আবারো পা সরালাম। বর্ষা আবারো পায়ের উপর পা রাখলো। আমি এবার আর সরালাম না। বর্ষা আমার পায়ের উপর পা দিয়েই পড়তে লাগলো। জানিনা ওর মাথায় কিছু ঢুকছে কিনা। আমিতো শিহরিত হচ্ছি বারবার। আমার জীবনে কখনো এভাবে কোনো মেয়ের কাছাকাছি আসিনি। কি রকম ফিল হচ্ছে সেটা আমিই জানি।
মনটা কেমন উড়ুউড়ু করছে। পা সরানোর চেষ্টা করেও পারছি না। বর্ষা মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসছে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো কে জানে! আমি সময়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারছি না।
অনেক্ষণ পর বললাম, “এবার বইটা দাও কিছু অংক দিচ্ছি করে দাও।”
বর্ষা বইটা এগিয়ে দিলো। আমি অংক বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। বর্ষা বলল,আপনি কয়েকটা করতে দিন স্যার। আমি করে দিচ্ছি।”
ওর কথামত কয়েকটা অংক চিহ্নিত করে দিলাম। বর্ষা বই খাতা নিয়ে অংক করতে বসে গেলো। মাথা নিচু করে খুব মনোযোগ দিয়ে অংক করলো। তারপর খাতা এগিয়ে দিলো।
আমি খাতা নিয়ে দেখি এক সাইডে লেখা, আপনার পা দুটো মেয়েদের মত সফট।
লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেলো আমার। এ কেমন কথা ছাত্রীর মুখে! কিন্তু শুনতে বেশ ভালো লাগলো। ইচ্ছে করছে এরকম কথা আরো শুনি। আরো ভালো লাগবে তাহলে। আসলে বোধহয় আমিও আস্তে আস্তে বর্ষার উপর দূর্বল হয়ে যাচ্ছি।
সবগুলো অংক ই সঠিক হয়েছে। সত্যিই মেয়েটা মেধাবী অনেক।.
পড়া শেষ হলে বর্ষা উঠে গিয়ে একটা প্যাকেট হাতে করে নিয়ে এলো। সেটা আমার হাতে দিয়ে বলল,এই নিন আপনার গিফট।
- কিসের গিফট?
- আপনাকে দিবো বলেছিলাম না?
- কি আছে এতে?
- খুলে দেখুন।
বর্ষা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো। আমি প্যাকেট খুলে দেখি একটা শার্ট! অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম শার্টের দিকে। দারুণ ভালো কোয়ালিটির। দামী মনেহচ্ছে অনেক।
শার্ট দেখে বললাম, এটার কি দরকার ছিলো বর্ষা?
বর্ষা এগিয়ে এসে বলল,গায়ে হবে তো?
- হবে মনেহচ্ছে। কিন্তু কেন এটা এনে দিলা?
- এনে দিলাম কই? গিফট দিলাম।
- কিন্তু কেন? গিফটের কি দরকার ছিলো?
- উফফ আপনি না বেশী বুঝেন।
- হ্যা একটু বেশি বুঝি। শার্ট দিয়ে কি হবে?
- শার্ট দিয়ে কি হয়?
- গায়ে দেয়।
- আপনি ও দেবেন।
আমি দাঁত বের করে হাসলাম। বর্ষা ও হাসলো। তারপর শার্ট গুছিয়ে ব্যাগে দিয়ে বলল, নিন এটা।
আমি নিয়ে বললাম, থ্যাংকস। - ওয়েলকাম। বসুন।
- আরো গিফট আছে নাকি?
বর্ষা হেসে বলল, নাহ। বসুন গল্প করি।
আমি বসলাম। বর্ষা হাত দিয়ে আমার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলল, এইবার ঠিক আছে। এত অগোছালো কেন আপনি বলুন তো?
আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম ওর এই আচরণে! কিন্তু কিছু বললাম না। জীবনে প্রথম কোনো মেয়েকে পড়াতে এসে এরকম হচ্ছে আমার সাথে। আমিও বাধা দিতে পারছিনা।কারণ আমার ও ভালো লেগে গেছে বর্ষাকে। আর কি যে ফিল হচ্ছে নিজেই বুঝতে পারছি না।
বর্ষা আমার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিয়ে বলল, এখন দারুণ দেখাচ্ছে। সেভ করেন নি কেন?
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। কি বলবো? ও সেদিন বলেছিল বলেই আমি আর শেভ করিনি। ওর কথা রাখার জন্যই। কিন্তু সেটা বলতে লজ্জা লাগছে।
বর্ষা বলল,এখন আপনাকে ব্যাচেলর দের মত লাগছে। এবার যান।
আমি একবার ওর চোখের দিকে তাকালাম। তাকানো মাত্র কি যেন হয়ে গেলো। বিদ্যুৎ খেলে গেলো আমার শরীরে! আমি উঠে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এলাম। এরকম ফিল হচ্ছে কেন আমার! কেন!
বাসায় ফিরেও নিজের মনটাকে বেধে রাখতে পারছি না। বারবার বর্ষার মুখটা ভেসে উঠছে। কি মায়াবী মুখখানা! আমি কি ওর প্রেমে পড়ে গেছি? জানিনা, কিচ্ছু জানিনা। দুই সপ্তাহ পড়ানোর পরই প্রেমে পরে গেলাম। কিন্তু প্রেমের কথা ওকে বলাও আমার দাড়া সম্ভব না।
রাতে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না। কিসব ভাবতে ভাবতে অনেক রাত হয়ে গেলো।
এমন সময় বর্ষার নাম্বার থেকে কল। রিসিভ করতেই ও বলল, ঘুমাচ্ছিলেন?
- না, ঘুম আসছে না। তুমি এখনো জেগে আছো কেন?
- আমার ও ঘুম আসছিল না। আপনি আমাকে কল দেন না কেন?
- কিজানি, কেন যে দেইনা। কি ভাব্বে তাই দেইনা।
- তাহলে কল রিসিভ করেন কেন? কল রিসিভ করাও যাবেনা তাহলে।
- আচ্ছা আর করবো না।
- ধুর আপনি এরকম কেন? একটু রোমান্টিক হওয়া যায়না? এতদিনেও আপনাকে রোমান্টিসিজম শেখাতে পারলাম না।
আমি চুপ করে রইলাম। রোমান্টিক কিভাবে হতে হয় আমার জানা নেই।
বর্ষা বলল,আবার চুপ? - তাহলে?
- ধুর আপনি ফোন রাখুন তো।
আমি ফোন রেখে দিলাম। যদিও আমার ইচ্ছে করছিল কথা বলতে। কিন্তু আমি এমন ই। আমি কি করবো?
আবারো কল এলো। বর্ষা বলল,আপনি কাটলেন কেন ফোন? এত সাহস কই থেকে আসলো? - তুমিই তো বললা।
- আমি বললেই শুনতে হবে?
- হ্যা হবে।
- আমি যদি বলি আমাকে আদর করুন করবেন?
এ কথা শুনে আমার সমস্ত শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। ভেতরে ভেতরে রোমাঞ্চিত হতে লাগলাম । কিন্তু মুখে বললাম, কিভাবে? - একটু কাছে আসুন।
- এত রাতে?
- হুম। এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ুন।
- কিহ! এত রাতে গিয়ে শুয়ে পড়বো তোমার আম্মু কিছু বলবে না?
- ধুর, এরকম বোকাও কেউ হয়? বুঝেনা কিচ্ছু।
- কি বুঝবো?
- চুপ থাকুন। কাল আপনি দেখা করবেন আমার সাথে।
- কোথায়?
- আমি যেখানে বলবো। আমার দেয়া শার্ট টা পড়ে আসবেন। ঠিকাছে?
- ঠিকাছে।
- আরো কিছু বলুন।
- তুমি খুব ভালো।
বর্ষা রেগে বলল,আপনি একটা গাধা। একটা ভ্যাবাগঙ্গারাম। একটা….
কল কেটে দিলো। আমার বেশ মজা লাগলো ওর সাথে এমন করতে। যাক, মেয়েটা খুবই রেগে গেছে। এখন আর রাগানো যাবেনা। একবার কল ব্যাক করা উচিৎ। কল দিলাম কিন্তু রিসিভ করলো না। আমি ফোন রেখে দিলাম। মিনিট দশেক পর আবার কল এলো। রিসিভ করে বললাম, হ্যালো।
- আপনি আর কল দিলেন না কেন?
- একবার তো দিলাম।
- শুধু একবার? কেউ রাগ করে কল কেটে দিলে কল ব্যাক করা উচিৎ। আর প্রথমবার না ধরলে ভাব্বেন সে রেগে আছে। আবারো দেয়া উচিৎ। আপনি যতবেশি কল দিবেন, সে ততবেশি খুশি হবে। বুঝেছেন?
- হ্যা বুঝেছি। তোমার কাছে প্রাইভেট পড়তে হবে। পড়াবা?
- হ্যা পড়াবো। কাল আসুন আগে। বিকেলে দেখা করবেন তারপর একসাথে আমাদের বাসায় আসবো।
- আচ্ছা।
- এখন তাহলে রাখছি। রাত জাগবেন না,ঘুমান।
- আচ্ছা।
- উফফ বোরিং একটা। অসহ্য…
বর্ষা ফোন রেখে দিলো। আমি হাসলাম। হাসতে হাসতে অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করতে লাগলাম। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম একটা সময়।