মুগ্ধ দৃষ্টি – অসমাপ্ত প্রেমের গল্প

আজকাল নিশি প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে সে নিজেকে বিশাল এক ট্রেনে একা বসে থাকতে দেখে। সাথে কেউ নেই-কিছু নেই। না কোন মোহ-মায়া, না কোন পিছুটান। একান্ত একা এক যাত্রী।
ট্রেনটা ঝড়ের বেগে ছুটে চলে। কোন স্টেশনে থামে না। নিশি জানালার একপাশে আনমনে বসে অপেক্ষা করে। চলতে চলতে যখন দিনের আলো কমে আসে তখন একটা স্টেশনে এসে ট্রেনটা থেমে যায়। স্টেশনে নেমে নিশি দেখে কোথাও কেউ নেই। অনেকটা দূরে শুধু একটা আলো দেখা যায়। নিশি আস্তে আস্তে সেই আলোর দিকে এগোতে থাকে….

ভাদ্র মাসের শেষের দিক। এই সময় আবহাওয়ায় ভ্যাপসা একটা গরমভাব থাকে। বেশ কিছুদিন অসহ্য গরম থাকার পর আজ ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতে ভাদ্রের তপ্ত আবহাওয়া কিছুটা কমে এসেছে।

নিশি উদাস হয়ে বেলকনিতে বসে আছে। জানালা দিয়ে একবার বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখলো। বিরক্ত লাগলো বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা। বাসার নিচে রাস্তার পাশের এক টংয়ের দোকানে চোখ পড়তেই দেখলো উঠতি বয়সী দুই তরুণ-তরুণী এই বৃষ্টিতে একসাথে বসে চা খাচ্ছে। দুজনের কানে দুটো ইয়ার বাডস। হয়তো পছন্দের কোন গান শুনছে। দৃশ্যটা ভালো লাগলো নিশির। আচ্ছা, কি গান শুনছে ওরা?

এক সময় চা খুব পছন্দ করতো নিশি। এখন মুখেও নেয় না। বিষাক্ত লাগে। আগে বাড়িতে থাকতে প্রতিদিন ১০/১৫ কাপ চা না খেলে ওর দিন কাটতো না। ওর মা চা বানাতে বানাতেই বিরক্ত হতো। বৃষ্টির দিন হলে তো কোনো কথাই নেই। বৃষ্টি হলেই ফ্লাক্সে চা নিয়ে বেলকনিতে বসে যেতো। গুণ গুণ করে রবীন্দ্রনাথের ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’ গানটা গাইতো। ওটা নিশির প্রিয় গান ছিল। এখন আর গানও শোনা হয় না।
আচ্ছা টংয়ের দোকানের ছেলে-মেয়ে দুজনও কি রবীন্দ্রনাথের ওই গানটাই শুনছে?! জীবনের সবচেয়ে মধুর সময়গুলোতে কি মানুষ রবীন্দ্রনাথ শোনে?

চা শেষ করে মেয়েটা বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় নেমে গেল। দু হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে চেয়ে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন অনুভব করছে। ছেলেটা মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছে। কিছুক্ষণ পর ছেলেটাও রাস্তায় নামল, গিয়ে মেয়েটার হাত ধরলো। দু’জন দু’জনার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।

এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তার ওপাশ থেকে অনাবিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। দু’জন হাসছে।
নিশিও এক সময় এরকম প্রাণ খুলে হাসতো। এখনো হাসতে হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু চোখে সেই হাসির ঝলক আর দেখা যায় না। মানুষ যখন খুশি হয়ে হাসে, তখন তার আত্মাও হাসে। সেই হাসির প্রতিফলন চোখে স্পষ্ট দেখা যায়।

টংয়ের দোকানে বসে চা খাওয়া মেয়েটার পড়নে ছিল নীল রংয়ের শাড়ি। নীল রং আবিরের খুব প্রিয় ছিল। নিশি যখন ওর সাথে দেখা করতে যেত, তখন চোখে হালকা কাজল দিয়ে, নীল শাড়ি পড়ে যেত। ছেলেটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকতো। একবার নিশি জিজ্ঞেস করেছিল “এভাবে তাকিয়ে থাকো কেন? কি দেখো?”
আবির মুচকি হেসে বলেছিল ‘তোমাকে দেখি। কেন! দেখতে নিষেধ করছো?
“আমি কি একবারও নিষেধ করছি!? গাঁধা”

আবির কোন কথা না বলে মুগ্ধ হয়ে শুধু চেয়ে থাকতো।
নিশির সাথে আবিরের পরিচয় হয়েছিল এক প্রাইভেট সেন্টারে। দুজন একই প্রাইভেটে পড়তো। টুকটাক কথা হতে হতে একজন আরেকজনের প্রতি এডিক্ট হয়ে যায়। তবে ওদের সম্পর্কের কোন নাম ছিল না।
আবির-নিশির আদৌও কি সম্পর্ক ছিল সেটা আজও রহস্য। ছেলেটাকে নিশির ভালো লাগতো। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলা হয়নি কোনদিন। আবিরও ওকে পছন্দ করতো কিন্তু কোনদিন বলতে পারেনি। অথচ দুজন দুজনার জন্য কত কিছুই না করেছে। আজও তাই দু’জনের শুধু ’ভালোবাসি বলাটা বাকি’ রয়ে গেছে।

নিশি তার স্বামীর সাথে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছে। তার স্বামী তানভীর সাহেব এবার বিভাগীয় পর্যায়ে ‘সেরা উদ্যোক্তা’ নির্বাচিত হয়েছেন। এখানে আসার কোন ইচ্ছে ছিল না নিশির। কিন্তু এখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক কাজই করতে হয় ওকে।

নিশির খুব ইচ্ছে ছিল আইনজীবী হবে। ন্যাশনাল ‘ল’ কলেজে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ আর কমপ্লিট করা হয়নি। এর মধ্যে ওর মায়ের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে টিউমার দেখা দেয়। চিকিৎসকরা রোগের নাম বলেছিলেন নিউরোফাইব্রোমেটোসিস। এ রোগে আক্রান্ত রোগীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট গুটি আকারে টিউমার দেখা দিতে শুরু করে।
মায়ের অপারেশন করানো হয়। অপারেশনের পর ৬ মাস বেডরেস্ট করতে বলে ডাক্তার। যার ফলে নিশি ওর মায়ের দেখাশোনা করতে ’ল’ কলেজ ছেড়ে আসে।

অপারেশনর জন্য বড় বোনের কাছে অনেক টাকা ধার করেছিল নিশির বাবা। তারপর থেকে ওদের পরিবারে কর্তৃত্ব খাটাতে শুরু করে ওর ফুফু। পরিবারের বড় বড় সব সিদ্ধান্ত ওর ফুফুই নিতো। যেমন নিশির বিয়ের ব্যাপারটা। তানভীর নিশির ফুফাতো ভাই। ওর ফুফু যখন ওর বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে তখন কেউ কিছু বলতে পারেনি। নিশিও কিছু বলেনি। প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও পরে ভেবেছিল জীবনে চলার পথে ধন-সম্পদ ই বেশি ম্যাটার করে। মায়ের অপারেশনের সময় বিষটা বুঝতে পেরেছে সে।

আবিরের কথা ভেবে তখন একটু মন খারাপ হয়েছিল, পরে ভেবেছিল যে সম্পর্কের কোন নামই নেই সেটা নিয়ে মন খারাপ করে কি লাভ। দুজন নিজেদের লাইফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে, আস্তে আস্তে সবকিছু ভূলে যাবে।
কিন্তু স্মৃতি অনেকটা জন্ম দাগের মতো, কোনদিন মুছে যায় না।

একবার নিশির জন্মদিনে আবির ওকে একটা চিঠি দিয়েছিল। চিঠিতে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের একটা লাইন লেখা ছিল, “আলোটুকু তোমায় দিলাম। ছায়া থাক আমার কাছে।”

নিশির এখন মনে হয় লেখাটা বিপরীতে লিখছে ছেলেটা। তার লাইফের আলোকিত সময়টা সে ওর কাছেই ফেলে এসেছে। এখন শুধু ছায়া নিয়ে বেঁচে আছে। তার নামটাও এখন নিজের নেই। তানভীর সাহেবের স্ত্রী পরিচয় নিয়ে এখন বেঁচে আছে সে। নিজের যে স্বপ্নগুলো ছিল সেগুলোকে কবেই মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে। গানের শখ ছিল একসময়, এখন ভূলেও গান গায় না। নাচের একাডেমি খোলার ইচ্ছে ছিল, এখন নিজেই ভূলে গেছে। উকিল হওয়ার স্বপ্ন ছিল, এখন কোন বিষয়ে তর্ক করে না। তবে অভিনয় করার স্বপ্নটা পূরণ হইছে। স্বামীর স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী কি করতে হবে, কখন করতে হবে, কিভাবে করতে হবে সবকিছু করে।
আসলে কিছু সম্পর্কের কোন নাম লাগে না, সেখানে ভালোবাসি বলতে হয় না, ফিল করতে হয়। সম্পদের চেয়ে জীবনে ভালোবাসাটা বেশি জরুরি।

নিশির এখন সবকিছু আছে। টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, অর্থ-সম্পদ সব… শুধু কেয়ার করার একজন মানুষ নেই। এমন কেউ নেই যার সাথে বৃষ্টির দিনে হাঁটা যায়, যার সাথে রাস্তার পাশে দোকানে বসে চা খাওয়া যায়, যার সাথে পছন্দের গানগুলো শোনা যায়, যার সাথে বসে রাতের তারা ভরা আকাশ দেখা যায়, যার সাথে মন খুলে হাসা যায়। ওর জীবনে এমন কেউ নেই যার জন্য অপেক্ষা করা যায়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষা নামের ব্যাপারটি খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক। (হুমায়ুন আহমেদ)।

নিশির মনে হয় সবকিছু ছেড়ে যদি কোথাও যাওয়া যেত! যেখানে কোন বাধা নেই, মানা নেই, কোন দূঃখ নেই, কষ্ট নেই। আজকাল নিশি প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে সে নিজেকে বিশাল এক ট্রেনে একা বসে থাকতে দেখে। সাথে কেউ নেই-কিছু নেই। না কোন মোহ-মায়া, না কোন পিছুটান। একান্ত একা এক যাত্রী।

ট্রেনটা ঝড়ের বেগে ছুটে চলে। কোন স্টেশনে থামে না। নিশি জানালার একপাশে আনমনে বসে অপেক্ষা করে। চলতে চলতে যখন দিনের আলো কমে আসে তখন একটা স্টেশনে এসে ট্রেনটা থেমে যায়। স্টেশনে নেমে নিশি দেখে কোথাও কেউ নেই। অনেকটা দূরে শুধু একটা আলো দেখা যায়। নিশি আস্তে আস্তে সেই আলোর দিকে এগোতে থাকে। কিছুটা এগোতেই দেখে আবির বসে আছে, দুই কাপ চা নিয়ে।
নিশির মনে পড়ে আবিরকে সে একবার চা’য়ের জন্য ডেকেছিল। কোন কারণে তাদের একসাথে চা খাওয়াটা হয়নি। চায়ের ডেট’টা বাঁকিই ছিল।

নিশি গিয়ে আবিরের পাশে বসে। আবির ওকে দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। নিশি জিজ্ঞেস করে, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কি দেখো?”
উত্তরে আবির বলে ‘তোমাকে দেখি। কেন! দেখতে নিষেধ করছো?

আবিরের কথা শুনে নিশি হেসে ওঠে। সেই হাসির প্রতিফলন ওর চোখে ভেসে ওঠে। আবির আগের মতোই মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই হাসি দেখতে থাকে।

  • মুগ্ধ দৃষ্টি
    লেখা- ইমরান

More: ত্রিভুজ প্রেমের গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *