সূচনা পর্ব: রাস্তায় রক্তাক্ত শরীরে পড়ে আছে নেহার অর্ধমৃত দেহ। সারা শরীরে ধর্ষণের হিংস্র চিহ্ন৷ এই ভোরবেলা এখনো রাস্তায় মানুষ হাঁটতে বের হয়নি। দু একটা গাড়ি হুশ করে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। নেহার পাশে গাড়ি স্লো করে চোখ বড়বড় করে অনেকে তাকায়৷ কেউবা ফোনে ছবি তুলে নেয়। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার সাহস কেউই পাচ্ছে না। এটা বাংলাদেশ, এখানে ঘটনার থেকে গুজবের ছড়াছড়ি বেশি। তেমনি শাস্তির চেয়ে কটুক্তির সংখ্যাও বেশি৷ কৌতুহল পরিণত হয় কৌতুকে৷ যার পরিবার একটা মেয়েকে হারালো, কেবল সেই শোক লালন করে বেঁচে থাকে। মাঝে মাঝে মেয়ের কথা ভেবে চোখের জল ফেলেন মা। আর বাকিরা হয়তো দু চারটা ছবি তুলে নিয়ে যাবে, তারপর সেটা ফেসবুকে ভাইরাল করে দিয়ে লিখবে, ‘ধর্ষকের শাস্তি চাই’। আবার দুদিন পর সেটাও ভুলে যাবে সবাই।
হঠাৎ লাশের পাশে একটা মেয়েকে দাঁড়াতে দেখা গেলো। ধীরপায়ে হেঁটে এসে নেহার দিকে থমকে তাকালো মেয়েটা। অনেক্ষণ তাকিয়েই রইলো৷ ওর চোখের পলকও পড়ছিলো না। লাশ দেখে শকুন যেভাবে তাকায়, ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা। এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে গোশত খাওয়া শুরু করবে। রাস্তার পাশে চলতে থাকা গাড়ির লোকজনের কৌতুহল এখন আরো বেড়ে গেছে। সবাই এখন নেহার পাশাপাশি মেয়েটারও ছবি তুলে নিচ্ছে।
চোখ তুলে সামনের দিকে তাকালো মেয়েটা। দেখলো গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসা লোকটা ছবি তুলছে আর তার পাশে বসা লাল লিপস্টিক মাখা মেয়েটা লোকটার হাত খামচি দিয়ে ধরে আছে। ধর্ষিতা মেয়েটা এখও জীবিত আছে কিনা সেটা দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে কারো নেই? বরং ছবি তোলাতেই এত আনন্দ? ছিহ মানবতা।
মেয়েটা পাশে তাকিয়ে একটা ইটের টুকরো দেখতে পেয়ে হাতে তুলে নিয়ে সোজা গাড়িটার লাইট বরাবর ছুড়ে মারলো৷ সাথে সাথে ভয় পেয়ে গাড়ি জোরে টান দিলো লোকটা। এরপর আর কোনো গাড়ি পাশে দাড়াচ্ছিলো ও না। দূরে চলে যাওয়ার পর মাথা বের করে দেখতে লাগলো। সবকিছুকে হাস্যকর মনে হচ্ছিলো মেয়েটার। এদেরকে বলা যায়, কুকুর। কোথাও গরু জবাই করতে দেখলে দেখতে আসা কুকুর। এদেরকে দিয়ে হবেনা কিচ্ছু, সমাজের কোনো উপকার না।
মেয়েটা কাছে গিয়ে নেহার হাত তুলে পরীক্ষা করার চেষ্টা করলো। এমন সময় আবার একটা গাড়ি এসে সামনে দাড়ালো। এবার ওর এত রাগ হলো যে ইচ্ছে করলো ড্রাইভারের মাথায় ইট ছুড়ে মারে। কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে নেহার দিকে মনোযোগ দিলো। এখনও বেঁচে আছে। যদিও অবস্থা অনেক ভয়াবহ, তবুও যদি বাঁচানো যায়! একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক।
কিন্তু কোন গাড়িতে করে ওকে হাসপাতালে নেবে ও? যে গাড়িগুলো এতক্ষণ মানবতার খাতিরে একবার দাঁড়াচ্ছিলো ও না, সেসব গাড়িতে উঠলে মেয়েটা নিজেও যে ধর্ষিতা হবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? আজব দেশ আমাদের।
মেয়েটা কিছুক্ষণ নেহার পাশে বসে থাকার পর একটা হেডলাইটের হলুদ আলো চোখে লাগলো এসে৷ ও চোখে হাত দিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো।
গাড়ির দরজা খুলে দুজন লোক বেরিয়ে আসলো। একজনের বয়স বড়জোর ছাব্বিশ সাতাশ হবে, আরেকজন মধ্যবয়সী। মেয়েটার শরীর শিরশির করে উঠলো৷ কিন্তু লোক দুজনকে দেখে যথেষ্ট ভালো মানুষ মনে হচ্ছে।
ওনারা কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ও মাই গড! ওনার এই অবস্থা হলো কি করে?
মেয়েটা তেজের সাথে বললো- দেখে বুঝতে পারছেন না?
তরুণ ছেলেটি বললো, বাবার হয়ে আমি সরি। ওনার কি শ্বাস প্রশ্বাস চলছে?
মেয়েটি মাথা ঝাকিয়ে বললো, হ্যা। হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু অবস্থা দেখে খুব ভয় লাগছে।
- তাহলে আর কথা বাড়াতে চাচ্ছি না। ওনাকে গাড়িতে তুলতে হবে।
যুবক এগিয়ে এসে নেহাকে তোলার চেষ্টা করলো। তিনজনে মিলে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে দিলো।
মেয়েটি বলল, কোন হসপিটালে নিয়ে যাবেন বলে যান।
যুবক বললো, আপনি হসপিটালে যাবেন না? - না।
- সেকি! কেন?
মেয়েটি রেগে বললো, আপনার গাড়িতে উঠে আমি যে ধর্ষিতা হবো না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
বয়স্ক লোকটি বললেন, একজন বাবার বয়সী লোককে দেখেও এই কথা বলছো মা?
মেয়েটা বললো, বাবার বয়সী কিন্তু বাবা তো আর নন। এই ছোট্ট মেয়েটাকে হয়তো কোনো বাবার বয়সী লোকও ধর্ষণ করতে পারে৷ আমাদের দেশে নিজের জন্মদাতা বাপ ছাড়া আর কেউই বাবা হতে পারে না।
বয়স্ক লোকটি লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলেন। যুবক ছেলেটি বললো, কিন্তু এই রাস্তায় দাড়িয়ে থাকলে আপনার ক্ষতি হবে না সেটাই বা ভাবলেন কি করে?
মেয়েটা গাড়িতে উঠে বসলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো, একটা মেয়ে তাহলে কোথায় নিরাপদ আপনি বলুন? আমার চাচা মারা গেছেন। তাকে দেখার জন্য গ্রামের বাড়ি যাবো৷ এখন গাড়িতে উঠতে না পারলে সময়মত পৌঁছাতে পারবো না। শেষদেখা টাও দেখা হবে না। এজন্যই এই ভোররাতেই বের হতে হলো। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে দেখি এই মেয়েটা এভাবে পড়ে আছে। কত গাড়ি যাচ্ছে অথচ কেউই…
বলতে বলতে কেঁদে ফেললো মেয়েটা। তারপর বললো, আজ যদি আমি ধর্ষিতা হতাম, আমাকেও লোকে বলত কেন ভোররাতে বের হয়েছি? আমি তো এখানে পড়াশোনা করি। আমার গ্রামের বাসায় পৌছাতে ৮ ঘন্টার বেশি সময় লেগে যায়। জ্যাম থাকলে তো কথাই নেই। আমি কি আমার চাচাকে শেষ দেখাটাও দেখবো না?
বলতে বলতে জোরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। ওড়নায় মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো। বয়স্ক লোকটি ও যুবক ছেলেটা দুজনেই বাকরুদ্ধ। কিছুই বলার নেই। আর বলার মত কিছু খুজে ও পাচ্ছে না। সাথে একজন ধর্ষিতা অর্ধমৃত মেয়েকে নিয়ে কোনো মেয়েকে স্বান্তনাও দেয়ার ভাষা থাকার কথা নয়। বরং কষ্ট হচ্ছে ভীষণ।মেয়েটা কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে সামলে নিলো। গাড়ি এসে থামলো হাসপাতালের সামনে। দ্রুত নেহাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হাসপাতালের ভেতরে নেয়া হলো। যে দু একজন লোক বাইরে আছেন সবাই অবাক হয়ে তাকাচ্ছিলেন নেহার রক্তাক্ত বিশ্রী শরীরটার দিকে। দেখলেই ডুকরে কান্না আসে। ডাক্তাররা প্রথমে যে যার মত ব্যস্ত হতে চাইলেন। এই রোগীর কাছে কেউ যেতেও চান না।
নেহাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর বয়স্ক লোকটি এসে মেয়েটাকে বললেন, মা তুমি গ্রামে যাবে না? তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে আসবো?
মেয়েটা মাথা নেড়ে বললো, কষ্ট করতে হবে না চাচা। আমি একাই চলে যেতে পারবো।
যুবক ছেলেটি বললো, আমি আপনাকে বাস কাউন্টারে রেখে আসি?
মেয়েটি ইতস্তত করে বলল, থাক না।
- মানবতার খাতিরে এইটুকু উপকার করতেই তো পারি।
- আমার চাচা মারা না গেলে আমি এই অবস্থায় মেয়েটাকে ফেলে যেতাম না। যদিও আপনারা এখনই হয়তো চলে যাবেন, তবুও অনেক ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য। আর একটা রিকুয়েষ্ট, এটা নিয়ে ফেসবুকে আজেবাজে টাইপের পোস্ট দিয়েন না।
ছেলেটা ভ্রু কুচকে বললো, আজেবাজে পোস্ট দিবো মনেহচ্ছে? ভয় পাবেন না। আমরা মানুষ হিসেবে খারাপ না।
- সেটা বুঝতে পেরেছি। নয়তো আপনারাও পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন।
- তাহলে তারাতাড়ি আসুন আপনাকে কাউন্টারে রেখে আসি। সকাল হয়েই গেলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে আপনার।
মেয়েটা এবার বলল, আচ্ছা চলুন তাহলে।
বয়স্ক লোকটি বললেন, তুমি টেনশন কোরো না মা। আমি যতটুকু পারি এই অসহায় মেয়েটির পাশে আছি। আল্লাহ ভরসা। - আসি চাচা, আসসালামু আলাইকুম।
গাড়িতে এসে উঠলো মেয়েটি। ছেলেটি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো, একজন পুরুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগছে আমার।
মেয়েটি নিশ্চুপ থেকে বলল, আমাদের সমাজে পুরুষ বলে আদৌ কিছু আছে? সব তো মুখোশধারী শয়তান।
- দেখুন ভালো মানুষ এখনো সমাজে আছে।
- আর সমাজ!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মেয়েটা।
বাস কাউন্টারে নেমে বাসের টিকেট কেটে বাসে উঠে পড়লো। বাস ছাড়ার বিশ মিনিট বাকি। ছেলেটা কিছুক্ষণ বসে থেকে বললো, আপনি সাবধানে যাবেন।
- এ দেশে সাবধানে থেকেও লাভ নেই
- একেবারে আশা হারাবেন না প্লিজ। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
- আপনি ও প্লিজ মেয়েটাকে একটু দেখবেন। আমি পরশু এসে হাসপাতালে যাবো৷ আর আপনার নাম্বারটা দিন আমি ফোন দিয়ে যেন ওর ব্যাপারে খোঁজ নিতে পারি। জানিনা কোন মায়ের বুক খালি হতে চলেছে। কোন বাবার সম্মান নিয়ে লোকজন এখন ভাইরাল করার খেলায় নামবে!
আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। ফোন নাম্বার নেয়ার পর সেভ করে গিয়ে মেয়েটি জানতে চাইলো, আপনার নামটা কি ভাই?
- অয়ন আহমেদ। আর আপনি?
- রূপন্তী সরকার। আপনি তাহলে এখন হাসপাতালে যান৷ আর অবস্থা কি হয় আমাকে প্লিজ ফোনে জানাবেন। মানুষ মানুষের জন্য।
- ভরসা রাখুন। সাবধানে যাবেন।
অয়ন নেমে গেলো বাস থেকে। বাস ছাড়লে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো রূপন্তী। চাচার কথা খুব মনে পড়ছে। কান্না আসছে ভীষণ!
২য় পর্ব
নেহা ধর্ষণের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো ইন্টারনেটে৷ সবার টাইমলাইনে শেয়ার হলো ঠিকই কিন্তু কমেন্টে নেহাকে উপহাস করেই অনেকে মন্তব্য করলো। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে নেহার বাবা মা নিজের মেয়ের ধর্ষণের খবরটা সর্বপ্রথম অনলাইনে দেখেই জানতে পারলেন। পরে খোঁজ পেয়ে ছুটে এলেন হাসপাতালে৷ অয়ন আহমেদ ও তার বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন ওনারা৷ কিন্তু নেহার অবস্থা আশংকাজনক। ডাক্তাররা কোনো ভরসা দিতে পারছেন না। সবই আল্লাহর হাতে।
নেহার শরীরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়ে আছে। দেখলেই কষ্টে বুক ফেটে যেতে যায়। বেশ কয়েক জায়গায় ব্যান্ডেজ বেধে দিয়েছে ডাক্তার। মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক। কোনোমত নিশ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা চাইলেই কেবল প্রাণ ফিরে পাবে সে। কিন্তু এই বাঁচার আদৌ কি কোনো অর্থ আছে? সব’চে বড় মৃত্যুটা তো হয়েই গেছে। তবুও বাবা মা চাইছেন মেয়েটা বাঁচুক, মেয়েটা সুস্থ হয়ে উঠুক। পাগল হলেও বাবা মায়ের কাছে সন্তান আদরের, ভালোবাসার। নেহার অবস্থা দেখে ওর বাবা মায়েরই পাগল প্রায় অবস্থা।
রাত্রিবেলা অয়ন বাসায় ফিরে ফোন দিলো রূপন্তীকে৷ দুবার ই রিং হয়ে কেটে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারাদিনের ঘটনাটা নিয়ে ভাবছিলো অয়ন। একটা মেয়েকে এতটাই অসহায় করে পাঠানো হয়েছে যে, পুরুষ জাতি একা পেলে তাকে হিংস্র কুকুরের মত ছিড়ে ছিড়ে খাবে। এসব পুরুষের তুলনায় মেয়েরা আজকাল কুকুরকেও বিশ্বাস করে৷ কুকুর দেখলে তবুও সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। ভয়টা আর লাগে না। কিন্তু লালসায় ভেজা কোনো লোকের চাহনি দেখলেই আর সামনে আগানোর ইচ্ছে জাগে না। ধিক্কার জানাই সেসব লোকের প্রতি।
শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিলো অয়ন। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো৷ রূপন্তী ফোন করেছে। অয়ন রিসিভ করে বললো, হ্যালো..
- আমি রূপন্তী বলছি।
- চিনতে পেরেছি। কেমন আছেন?
- মরা বাড়িতে কেমন থাকা যায় বলুন? সন্ধ্যায় পৌঁছেছি। এসে দেখি চাচাকে জানাজায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবার কান্নাভেজা মুখ দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার।
অয়ন স্বান্তনা দিয়ে বললো- দেখুন আমাদের সবাইকেই একদিন মরতে হবে। একবার ভাবুন তো আজকের সেই মেয়েটির কথা? যার সম্ভ্রম নষ্ট করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়েছে? কোনোমত নিশ্বাস টিকে আছে ওর। রাস্তাতেই জমে মরে যেতে পারতো মেয়েটা। কিন্তু আপনার চাচার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। প্লিজ নিজেকে শক্ত করুন।
- আমি অনেক স্ট্রং।
- সেটা আপনাকে দেখে বুঝতে পেরেছি। ভেংগে পড়বেন না প্লিজ। নিজের ব্যাপারে একটু যত্নবান হবেন। এই সময়টাতে শরীর খারাপ হয়ে অসুস্থ হতে পারেন।
- কিছু হবেনা। মেয়েটা কেমন আছে?
- আগের মতই৷ কোনোমত শ্বাস প্রশ্বাস চলছে। ডাক্তার রা কিছু বলতে পারছে না। খুব নির্মম ভাবে তান্ডবলীলা চালানো হয়েছে। মেয়েটার…
কথাটা বলে থেমে গেলো অয়ন। রূপন্তী জিজ্ঞেস করলো, মেয়েটার কি?
অয়ন বললো, মেয়েটার যৌনাঙ্গ স্বাভাবিক নেই৷ জড়ায়ু ফেটে অবস্থা ভয়ানক খারাপ হয়ে গেছে।
ভয়ে শিউরে উঠলো রূপন্তী। অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ও। অয়নের ও বুকটা চৌচির হতে শুরু করেছে রূপন্তীর কান্নার শব্দ শুনে। ও রূপন্তীকে বললো, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
রূপন্তী বললো, মেয়েটার বাবা মা এসেছে?
- হ্যা। কিন্তু আমি কোনো পোস্ট না করলেও লোকজন ঠিকই ভাইরাল করে দিয়েছে।
- লোকজন ভাইরাল করবেই৷ কিন্তু এর কোনো শাস্তি আদৌ হবে না।
- হুম।
রূপন্তী বললো, আচ্ছা যারা ওকে ধর্ষণ করেছে তারা কি নিউজটা দেখে হাসাহাসি করে?
কথার কোনো জবাব খুঁজে পেলো না অয়ন। কি বলা উচিত সেটাও জানেনা।
রূপন্তী বললো, প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। আমি ফোনটা রাখি। পারলে কালকে একবার গিয়ে দেখে আসবেন। আর আমাকে একবার ফোনে জানিয়ে দিয়েন মেয়েটার কি অবস্থা।
- আচ্ছা। আপনি রেস্ট করুন। বাড়ির লোকজনকে স্বান্তনা দিন। জীবনটা এরকম ই তো তাই না?
রূপন্তী উত্তর না দিয়ে ‘রাখি’ বলে ফোন কেটে দিলো। অয়ন কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এলো না। একটা অজানা যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভিতর।
একদিন পরে শহরে চলে এলো রূপন্তী। এসেই হাসপাতালে এলো নেহাকে দেখতে। নেহার অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ভয়াবহ মৃত্যুঝুঁকি থেকে ফিরলেও এখনো আশংকাজনক অবস্থায় আছে। অনেক্ষণ নেহার পাশে বসে রইলো রূপন্তী৷ রূপন্তীর চোখ দুটো যেন পাথর হয়ে গেছে। চোখের পাতা থমকে গেছে। নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে নেহার দিকে। নেহার শ্বাস চলছে কোনোমত৷ এখনো চোখ মেলেনি মেয়েটা।
নেহার মাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিলো রূপন্তী। যদিও এই অবস্থায় স্বান্তনা দেয়ার মত ভাষাও থাকে না। তবুও বৃথা চেষ্টা।
হাসপাতালে থেকে বাসায় ফেরার পর অয়নের নাম্বার থেকে কল এলো। রিসিভ করামাত্র অয়ন বললো, আপনি হসপিটালে এসেছিলেন?
- হ্যা
- আমাকে জানালেন ও না। দেখা হয়ে যেতো।
- আপনাকে জানানোর কি আছে এতে?
অয়ন চুপ করে গেলো। ও ভালোভাবে বুঝতে পারল যে ও রূপন্তীকে নিয়ে ভেবে মন খারাপ করলেও রূপন্তীর এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি ওর কথা। তাছাড়া এরকম পরিবেশে মনে থাকার কথাও না। নিজেকে শক্ত করে নিলো অয়ন। ওকে বলে ফোন কেটে দিলো।
পরপর কেটে গেলো দুটো দিন।
নেহার অবস্থা আগের চেয়ে একটু ভালো। রূপন্তী দেখতে এসেছে ওকে। মেয়েটা এখন চোখ মেলে সবার দিকে তাকায়৷ চাইলে কথাও বলতে পারে কিন্তু ওর মুখ দিয়ে শব্দ বের হতেও চাইছে না। কেমন যেন স্থবির হয়ে গেছে। নেহার দিকে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে রূপন্তী।
অয়ন কেবিনে ঢুকতেই নেহার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। কিন্তু নিজে থেকে কোনো কথা বললো না। বরং নেহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললো, কেমন আছে আমার বোনটা?নেহার কোনো ভাবান্তর নেই। এই দুদিনে এই ছেলেটা বারবার এসেছে। অনেক্ষণ সময় পাশে বসে কাটিয়েছে। নেহার বাবা মাকে শক্ত হতে বলেছে, নেহার জন্য মেডিসিন, ডাক্তারের সাথে কথা বলা, ওষুধ খাওয়ানো সবকিছুতে সাহায্য করেছে। নেহার বাবা একবার কাঁদতে কাঁদতে বলেই ফেললেন, ‘তুমি আমার মেয়েকে নিজের বোন ভেবে এতকিছু করছো। জগতের বাকিরা কেন একটা মেয়েকে নিজের বোন ভাবতে পারে না?’
বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। অয়ন ওনাদেরকে স্বান্তনা দেয়। বুকে জড়িয়ে বাবার মত আগলে রাখে। এ কারণে অয়নের সাথে ওনাদের একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। যে সম্পর্ক বিশ্বাসের, সহানুভূতির।
রূপন্তী নেহার মাথায় হাত রেখে চোখে চোখ রেখে বললো, কেমন আছো আপু?
নেহার চোখ স্থির হয়ে আছে। কোনো ভাবান্তর নেই৷ অয়ন গিয়ে নেহার পাশে দাড়িয়ে বললো, বোন। ভয় পাচ্ছিস এখনো? এই যে তোর ভাই আছে তোর পাশে। কথা বল৷ ভাই আর বাবা তোকে আগলে রাখবে। তোর অপমানের বিচার হবে বোন।
নেহার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। অয়ন হাত দিয়ে মুছে দিলো সে জল।
নেহা উঠে বসতে চাইলে ওকে ধরে বসিয়ে দেয়া হলো। রূপন্তী নিজের গায়ে নেহার ভর নিয়ে নেহাকে ধরে রইলো। নেহা আস্তে আস্তে বললো, আমাকে যারা মেরে ফেলেছে তাদের বিচার হবে সত্যি?
রূপন্তী তৎক্ষনাৎ বললো, এদেশে কোনোকিছুর বিচার হয় না বোন। বিচারের আশা বাদ দাও। নিজেকে শক্ত করো।
অয়ন রূপন্তীকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বললো, এভাবে কেন বলছেন? বিচার হবে।
- কে করবে বিচার? আপনি না আমি? আমরা চাইলেই কি দা দিয়ে এক কোপে ওই জানোয়ারদের মাথা আলাদা করতে পারবো? পরে লোকজন আমাদেরকেই বলবে, সরকার বিচার করলো না আর আপনারা কি ফালাইতে আসছেন?
অয়ন উঠে এসে নেহাকে বললো, বোন তুই ভেংগে পড়িস না। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। বিচার হবেই রে বোন।
তারপর কিছুক্ষণ নেহাকে বুঝিয়ে রূপন্তীকে বাইরে আসতে বললো অয়ন। রূপন্তী বারান্দায় এলে অয়ন বললো, কি দরকার ছিলো মেয়েটাকে ওভারে বলার? এমনিতেই মানসিক ভাবে খারাপ অবস্থায় আছে।
- সেজন্য মিথ্যা স্বান্তনা দেবেন? কার বিচার কে করবে? বিচার হবেনা জেনেও তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেয়াটা তো আরেক প্রকার ধর্ষণ তাই না?
অয়ন রীতিমতো রেগে গেলো রূপন্তীর উপর। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, এরকম ধারণা কেন আপনার? - কারণ এরকম হ্যারাসমেন্টের শিকার প্রতিনিয়ত আমি হই। কত জায়গায় বিচার দিয়েছি, কোন লাভটা হয়েছে? কে করেছে বিচার? পুরো পুরুষ জাতির প্রতি ঘৃণা জন্মে গেছে।
অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, রূপন্তী। আপনি মাথা ঠান্ডা করুন। বিচারের জন্য আমাদেরকে আন্দোলন করতে হবে। কোনো মানুষ এর বিচার করতে পারবে না। সরকারি ভাবে কঠিন শাস্তি জারি করতে হবে। এজন্য আমাদেরকে আন্দোলন করতে হবে রূপন্তী। সবাই একজোট হয়ে জোরালো আন্দোলনে নামতে হবে।
রূপন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শক্ত করে বললো, জানিনা কত টুকু ফলপ্রসূ হবে। কিন্তু আমাদেরকে আন্দোলনে নামতেই হবে৷ শেষ চেষ্টাটুকু করে দেখা যাক। কিন্তু ধর্ষকের সাজা বড়জোর ক’বছর জেল। জেল থেকে বেরিয়ে সে আরো শত মেয়েকে রেপ করবে। একাত্তরে যারা আমাদেরকে এটাক করেছিলো, তাদের বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধ করা হয়ে থাকে। তাহলে এখন কেন শুধু জেল জরিমানা? এখন ফাঁসির দাবি জানানো উচিত।
অয়ন মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ঠিক বলেছেন। তার আগে নেহার কাছে বিস্তারিত শুনতে হবে আমাদের। কারা এসব করেছে সেটা যদি ও বলতে পারে৷
রূপন্তী তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হায়রে জীবন!
পর্ব ৩
অয়ন ও রূপন্তী অনেক চেষ্টা করে নেহার মুখ থেকে ঘটনাটা বের করে আনলো। নেহা সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরছিলো। ফাঁকা রাস্তা থেকে ওকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধর্ষণকারী আর কেউ নয়, পাশের বাড়ির সুমন ও তার বন্ধুরা। কথাগুলো বলতে বলতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো নেহার। রূপন্তী ওকে জাপটে ধরে ভরসা দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলো।
এবার আন্দোলনে নামতে হবে। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করে কি আদৌ কোনো ফল হবে? চেষ্টা করার জন্যও অন্তত কতগুলো মানুষ দরকার৷ রাস্তায় নামার জন্য এখন মানুষজন কোথায় পাবে ওরা? রূপন্তী অয়নকে বললো ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে আন্দোলনের জন্য মানুষকে ডাক দেয়া যেতে পারে। পোস্টটা সবাইকে শেয়ার করতে বলতে হবে। তাহলে আশা করা যায় অনলাইনে একটা আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে আর অফলাইনেও অনেকে সাড়া দেবে৷
আইডিয়াটা পছন্দ হলো অয়নের। তৎক্ষনাৎ সমস্ত ঘটনার রোমহষর্ক বর্ণনা দিয়ে পোস্ট করে দিলো ফেসবুকে। দ্রুত সাড়া পড়তে লাগলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনেক গুলো শেয়ারে সবার টাইমলাইনে চলে গেলো পোস্টটা৷ একটা মেয়ে নিজের এলাকাতেও নিরাপদ নয়? আগের দিনে কলেরা মহামারী আকার ধারণ করতো। মাঝেমাঝে কিছু আতংক তৈরি হতো মানুষের মাঝে। এখন সেই আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ধর্ষণ। কোনো মেয়েই আর ভয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস করবে না। একটা মেয়েকে কি তাহলে সারাদিন ঘরে বন্দি থেকেই মরতে হবে? – এরকম শত শত কমেন্টে ভরে গেলো অয়নের পোস্ট।
অয়ন পোস্ট দিয়ে সবাইকে আহবান করলো পরেরদিন একত্র হওয়ার জন্য। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, যে কয়জন ছেলেমেয়ে এসেছে তাদের অধিকাংশ ই মেয়ে। ছেলেদের বিবেক কি তাহলে লোপ পেয়েছে? যেখানে একাত্তরে যুদ্ধ করে তারা মা বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করেছে। আজ একটা ধর্ষণের আন্দোলনে মাত্র হাতে গোণা কয়েকটা পুরুষ এসেছে। অথচ দলে দলে স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা এসেছে। তাদের মুখ রক্তবর্ণ। এর একটা বিচার চাই ই। কথায় বলে, যার মাথা তারই ব্যথা। মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য মেয়েদেরকেই লড়তে হবে।
হাতে পোস্টার নিয়ে রাস্তায় সাড়িবেঁধে দাঁড়িয়ে গেলো সবাই। সবার মুখে স্লোগান, ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি হোক। জনসমুক্ষে ফাঁসি দেয়া হোক। এটা দেখে লোকজন ভয়েই আর ধর্ষণ করার সাহস পাবে না। এই শাস্তি কার্যকর না হলে ধর্ষণ থামবে না।
রূপন্তী নেহার স্কুলে গিয়ে ছেলে মেয়েদেরকে একজোট করলো। নেহা সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ওর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আন্দোলনের তীব্র সাহস দেখা গেলো। প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের যেন এতে কোনো মাথা ব্যথা ই নেই। বরং স্কুলের সব ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে পোস্টার হাতে চিৎকার করতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, ‘ধর্ষণের সাজা ফাঁসি কার্যকর করা হোক’।
সারাদিন রোদে দাড়িয়ে আন্দোলন করে গেলো ছেলেমেয়েরা। দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে যে যার মত ফিরে গেলো। পরের দিন আবারও রাস্তায় নামা হবে। এবার রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে সাময়িক আন্দোলন করতে হবে। যাতে করে সবার একটু হলেও হুশ হয় যে আন্দোলন কেন হচ্ছে?
বাসায় গিয়ে অনেক্ষণ শাওয়ারের নিচে বসে রইলো রূপন্তী। মনের উপর দিয়ে প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই ও ছেলেদেরকে সহ্য করতে পারে না। কতবার যে কতরকম হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সে কারণে ছেলেদের প্রতি প্রবল ঘৃণা কাজ করে ওর।
গোসল শেষ করে এসে ফেসবুকে ঢুকলো। অয়নের পোস্ট এতবেশি শেয়ার হয়েছে যা অকল্পনীয়! প্রথমে অবাক হলেও পরে হাসি পেলো। কারণ #রূপন্তী ভালো করেই জানে এই পোস্ট এই কয়েকটা শেয়ার পর্যন্ত ই সীমাবদ্ধ। মাত্র তিন থেকে চারদিন, তারপর সবাই ভুলে যাবে সবকিছু। সোশ্যাল মিডিয়া একেই বলে। সবকিছুকে জোয়ারের মত ফুলিয়ে তোলে ঠিকই আবার মুহুর্তেই ভাটা পড়ে যায়।
অয়নের নাম্বার থেকে কল এলো এমন সময়। রিসিভ করতেই অয়ন বললো, হ্যালো।
- হুম বলুন।
- একটা ভালো খবর আছে। সুমন আর ওর একটা বন্ধু ধরা পড়েছে।
- স্বাভাবিক। অপরাধ যখন করেছে, ধরা তো পড়বেই।
- স্বাভাবিক?
- হ্যা। এটাও স্বাভাবিক যে চারদিনের মধ্যে আন্দোলন থেমে যাবে। সবাই ভুলেই যাবে নেহা ধর্ষণের কথা৷ আর অপরাধীর সাজা? সেটা তো কয়মাসের জেল। ব্যস, কাহিনি শেষ।
অয়ন নিস্তব্ধ হয়ে গেল রূপন্তীর কথা শুনে। তারপর বললো- আচ্ছা রূপন্তী। পুরুষদেরকে নিয়ে তোমার এত ক্ষোভ কেন?
- ক্ষোভ এই সমাজের প্রতি। সমাজের নিয়ম কানুনের প্রতি।
- কিন্তু এত ক্ষোভ থেকে লাভ কি হবে বলো?
- লাভ একটাই। আমি যন্ত্রণা নিয়েও টিকে আছি। ক্ষোভ না থাকলে আমাকে কতবার ইউজ করে মানুষ ফেলে দিতো রাস্তায়।
- রূপন্তী…
স্তব্ধ হয়ে গেলো অয়ন। মেয়েটা সত্যিই খুব ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। থাকার কারণটাও হয়তো স্বাভাবিক। কিছুই বলার নেই আর। কিইবা বলার থাকতে পারে। তারচেয়ে বরং অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
অয়ন বললো- কিছু খেয়েছিলে?
- না। এক ঘন্টা ধরে ভিজলাম।
- বৃষ্টিতে?
- ধুর। বৃষ্টি কখন হলো যে ভিজবো? গোসল করলাম। এখন অনেক ফ্রেশ লাগছে।
- ভালো করেছো। এখন কিছু খেয়ে নাও।
- খেতে ইচ্ছে করছে না। চাচাতো ভাইবোন দের জন্য মন খারাপ লাগছে।
- জানি মন খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। তবুও রিকুয়েষ্ট করবো, প্লিজ ভেংগে পড়িও না।
- হুম। আমি ঘুমাবো একটু। গত কয়েকদিন যাবত ঘুম হচ্ছে না একটুও।
- কিছু খেয়ে তারপর ঘুমাও।
- দেখুন, দরদ দেখাবেন না। এই একটা জিনিস আমি প্রচন্ড রকম অপছন্দ করি। সেটা হচ্ছে বিনা কারণে দরদ দেখানো। আমি আপনার কেউ না, আমি অসহায় ও না। দরদ টা আমাকে না দেখিয়ে তাদের জন্য রাখুন। রাখছি।
ফোন কেটে দিলো রূপন্তী। থমকে গেলো অয়ন। এ কেমন মেয়ে! রীতিমতো অপমান ধরণের কথা। সে যাই হোক, এসব ভেবে লাভ নেই। মেয়েটা রগচটা স্বভাবের, সে থাকুক তার রাগ নিয়ে।পরের দিন সকালে উঠে অয়ন পত্রিকা নিয়ে দেখলো পত্রিকাতেও নেহা ধর্ষণের ব্যাপারটা উঠে এসেছে। অপরাধী রাও ধরা পড়েছে। কিন্তু আন্দোলন টা হচ্ছে মূলত ধর্ষণের সাজা ফাঁসির জন্য। সেটা এখনও উঠে আসে নি। আর আসলেও কতটা ফলপ্রসূ হবে জানা নেই। তবুও আজ এমন আন্দোলন করতে হবে যাতে মিডিয়ার নজরে আসে।
সকাল সকাল গোসল সেরে নির্ধারিত স্থানে চলে এলো অয়ন। এসে দেখলো রূপন্তী কয়েকটা ছেলেমেয়েকে নিয়ে ইতিমধ্যে রাস্তায় দাড়িয়ে গেছে। বাচ্চারা চেঁচিয়ে বলছে, ‘ধর্ষণের সাজা ফাঁসি চাই।’
অয়ন কয়েকটা ছবি তুলে ও ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করে দিলো। লোকজন বাড়লে তাদের সবাইকে রাস্তার মাঝখানে দাড় করিয়ে গাড়ি অবরোধ করা হলো। #রূপন্তী অয়ন কে বললো, এভাবে হবে না। আমাদেরকে লোকজনের মাঝে একটা উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিতে হবে। সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমরা যেভাবে এই শাস্তি চাইছি, এটা সবাইকেই চাইতে হবে। তবেই সম্ভব।
অয়ন মাথা দুলিয়ে বললো, ঠিক আছে। কিন্তু কিভাবে?
রূপন্তী বললো, নেহাকে রাজি করাতে হবে। ও ভিডিওতে বলবে কি নির্মম ভাবে ওকে রেপ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে ওর জবানবন্দি থাকবে, ওর কষ্টের কথা সবার সাথে শেয়ার করবে। এমন ভাবে বলবে যাতে লোকের চোখে পানি চলে আসে। তারপর ও সবাইকে অনুরোধ করে বলবে ধর্ষণের শাস্তি ফাসি না হলে আপনারা ধর্ষকদেরকে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে মারুন। তাহলে সরকারের টনক নড়বে৷ নয়তো ধর্ষণের শাস্তি হবে না, আর এভাবে আরো শত শত মেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে। নেহা যদি করতে পারে তাহলে অনেকটা ফলপ্রসূ হবে, ভাবতে পারছেন?
অয়ন বললো, হুম।
- নেহাকে সবাই চেনে ধর্ষিতা হিসেবে। মানসম্মান যা যাওয়ার তা তো গেছে। এখন ওকে একটা ভিডিও করতেই হবে। লোকজনকে জানাতে হবে, সচেতন করতে হবে।
- ঠিক। আমরা তাহলে নেহার সাথে কথা বলে দেখি? মেয়েটা মানসিক ভাবে ডিপ্রেসড, রাজি হবে কিনা জানিনা।
- আপনি বুঝিয়ে বলবেন। এতে করে আরো হাজারো বোন বেঁচে যাবে। নেহার মাথায় এটা কাজ করলেই হবে।
- তাহলে চলো। এদিকে আন্দোলন চলুক।
অয়ন আন্দোলনে কয়েকজনে দায়িত্ব দিয়ে রূপন্তীকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এলো। নেহাকে বলামাত্র ও রাজি হয়ে গেল। খুশি হয়ে বললো, বোন দের জন্য এদেশের ছেলেরা হয়তো ভাবে না। একজন ধর্ষিতা এই কষ্টটা বুঝে। আমি আমার বোনদের জন্য এটা করবো।
রূপন্তী ও অয়নের শিখিয়ে দেয়া কথার সাথে নিজের এই কষ্টকর অভিজ্ঞতা শেয়ার করে ভিডিও করলো নেহা। ওর কথা শুনে রূপন্তী ও অয়ন দুজনেই কাঁদতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত এসে আর কথাই বলতে পারছিলো না মেয়েটা। কোনোমত শেষ করে দিয়ে বন্ধ করে দিলো। রূপন্তী নেহাকে জাপটে ধরে স্বান্তনা দিলো। পরম আদরে কপালে চুমো দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিলো।
অয়ন ভিডিওটা ভাইরাল করার জন্য কয়েকটা বিখ্যাত পেজে ছড়িয়ে দিলো। পাশাপাশি নিজের টাইমলাইনেও দিয়ে দিলো। যতজন লোক দেখবে, একজন ধর্ষিতার স্বীকারোক্তি। ততজনের চোখে জল আসতে বাধ্য। সবাই জানুক, একজন ধর্ষিতা মেয়ে কিভাবে অপরাধীর শাস্তি প্রার্থনা করে।
নেহার শরীর আবার খারাপ করতে শুরু করেছে। অয়ন ও রূপন্তীকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। মেয়েটা সুস্থ হতে গিয়েও আবার ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে না তো? হাসপাতালে রূপন্তীকে রেখে আন্দোলনের স্থানে চলে এলো অয়ন। এসে দেখলো আরো জোরালো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। লোকজনের সংখ্যা বেড়েছে, সবার চেহারা রক্তবর্ণ। সবার একটাই দাবি, বোনদের নিরাপত্তা। দেখেই বুক ভরে গেলো অয়নের। এভাবে চলতে থাকলে একটা ভালো ফলাফল হবেই ইনশাআল্লাহ।
মিডিয়া এসে গেছে। কয়েকজন সাংবাদিক ছবি ও ভিডিও তুলে নিলেন। কেউ আবার লাইভে এসে সংবাদে দেখিয়েও দিলেন। থামা যাবে না, চালিয়ে যেতে হবে। ধর্ষণের শাস্তি ফাসি কার্যকর না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলছে, চলবেই।
পর্ব ৪
আন্দোলন জোরালো ভাবে চললো সারাদিন জুরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে গেলো সবাই। রূপন্তীর শরীর খুব খারাপ লাগছে। যেকোনো মুহুর্তে জ্বর চলে আসবে মনে হচ্ছে।
বাসায় ফিরে গোসল সেরে শুয়ে পড়লো রূপন্তী। রুমমেট এসে জিজ্ঞেস করলো কিছু খেয়েছে কিনা?
রূপন্তী বললো, খাবো না রে৷ ভালো লাগছে না।
রাত নামার সাথে সাথে রূপন্তীর জ্বর ও বেড়ে গেলো। না খেয়েই শুয়ে রইলো বিছানায়। হঠাৎ জ্বর আসার কারণ বুঝতে পারছে না ও। সারাদিন রোদে দাড়িয়ে থাকার দরুন হতে পারে। দুটো দিন ধরে সারাদিন কাঠফাটা রোদে দাড়িয়ে থাকা৷ তার উপর মানসিক চাপে শরীরের অবস্থা খারাপ।
রুমমেট রা সবাই যে যার মত ব্যস্ত। রূপন্তীর শরীর খারাপ করেছে সেদিকে কেউ খেয়ালও করলো না। যখন জ্বরের মাত্রা বেড়ে গেছে, এমন সময় অয়নের নাম্বার থেকে কল। ছেলেটা ফোন দিতে না চাইলেও দিয়ে ফেলে।
রূপন্তী রিসিভ করে বললো, বলুন।
- কি করছেন?
- আমি কি করছি সেটা জানার জন্য ফোন করেছেন?
- না মানে হ্যা।
- একটা মেয়ে কি করছে সেটা জেনে আপনার কি কাজ? এ জন্য এত রাতে ফোন দিতে হবে?
- এত রাত হলো কোথায়? ভাবলাম কেমন আছেন সেটা জিজ্ঞেস করি। একটু খোঁজ খবর নেই।
- বিকেলেই চলে আসলাম আপনার সামনে থেকে। এই মুহুর্তে আপনার মনে হচ্ছে খোঁজ খবর নিতে হবে?
অয়ন ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, এত রগচটা কেন আপনি?
- আপনাদের মত পুরুষদের প্রতি আমার ভিষণ ক্ষোভ। আমি সহ্য করতে পারিনা এদেরকে।
- আমার মত পুরুষ বলতে?
- এই যে যারা বিনা কারণে মেয়েদেরকে ফোন করে।
- কি আজব! আমরা তো পরিচিত। একটু কথা বলার জন্য ফোন দিতেই পারি তাই না?
- বাহ। আমি আপনার পরিচিত মাত্র দুদিনের। আর আমাদের নিশ্চয় এমন সম্পর্ক নয় যে ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে হবে।
- রূপন্তী! আপনি একটু বেশিই রগচটা কিন্তু। অযথা রেগে যাচ্ছেন।
- দেখুন আপনি ফোন না কাটলে আরো রেগে যেতে বাধ্য হব। এমনিতেই শরীর খারাপ লাগছে।
- শরীর খারাপ লাগছে মানে?
- মানে কিছু না। আপনার জানার কোনো প্রয়োজন নেই। ফোন রেখে আমাকে উদ্ধার করুন প্লিজ।
- রূপন্তী, আপনাকে দেখলে যতটা শান্ত আর ভদ্র মনেহয় আপনি মোটেও সেরকম নন। আপনার আচরণ রুড।
রূপন্তী আরো রেগে বললো, আপনাদের সাথে রুডলি কথা বলাটাই শ্রেয়। ভালো করে কথা বললে ফোন কাটবেন ই না। উল্টো প্রতিদিন ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে চাইবেন। আপনাকে দেখেও যতটা ভদ্র মনেহয় আপনি সেরকম নন। - আমি ভদ্র নই? আমি আবার কি অভদ্রতা করলাম?
- আমি বিরক্ত হচ্ছি জেনেও ফোন করা আর ফোন করে ফোন না কাটা টা হচ্ছে অভদ্রতা।
- বিরক্ত হলে ফোন রিসিভ করলেন কেন?
- আজব! ফোন বাজলে রিসিভ করবো না? রিসিভ করে ভালোয় ভালোয় বললাম ফোন কেটে দিন। দিলেন না। জোর করে কথা বলতে চাইলেন। এটাও একটা অভদ্রতা নয়?
রাগ হচ্ছে অয়নের। প্রচন্ড মাত্রায় রাগ হচ্ছে। কিন্তু কারো সাথে রেগে কথা বলতে পারেনা ও। আর একটা মেয়ের সাথে তো নয় ই। ও বললো, ঠিক আছে বোন। আমার পাপ হয়েছে ফোন দেয়াটা। আর ভুলেও কখনো ফোন দেবো না। রাখছি।
কথাটা বলে কল কেটে দিয়ে ফোন রাখলো অয়ন। মনেমনে নিজের উপর রেগে গেলো। এরকম কখনো হয়না ওর। কেন যে রূপন্তীত সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো নিজেও জানেনা। আর কল দিয়েই এরকম ঝাড়ি খেতে হবে তাও ভাবেনি। প্রথমবারের মত কোনো মেয়ের রুড আচরণ সহ্য করতে হলো। যাক, আর কখনো ফোন দেয়ার ইচ্ছেও করবে না ও। কিন্তু রূপন্তীর কি এতটা রেগে যাওয়া যৌক্তিক হয়েছে?
তবে অয়নের মনে একটা প্রশ্ন জাগছে, #রূপন্তী কি সবার সাথেই এরকম আচরণ করে? নাকি শুধু অয়নের সাথেই করছে? সে যাই হোক, আপাতত চুপচাপ শুয়ে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। একটা মেয়ের ঝাড়ি খাওয়ার মত কাজ আর কখনোই করবে না অয়ন।
পরের দিন সময়মত হাসপাতালে চলে এলো অয়ন। নেহার শরীরের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অয়নকে দেখে খুশি হলো ও। অয়ন ওর পাশে বসে মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো বোন আমার?
- ভালো। আপু আসেনি?
অয়ন চুপ করে গেলো। আপু রাত্রিবেলা যেভাবে ঝাড়ি দিয়েছে তাতে ওর কথা মনে করতেও কষ্ট হচ্ছে অয়নের। হাসিমুখে অয়ন বললো, না রে। আপু আসে নি। - কেন আসেনি?
- জানিনা। চলে আসবে হয়তো। আপুর সাথে আমার যোগাযোগ নেই।
- সেকি? তোমরা না একসাথে আসো?
- সে তো রাস্তা থেকে একসাথে আসি।
- রাস্তা? আমার জন্য তোমরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছো তাই না? আমার ভাগ্যটা এমন কেন হলো? আমার কি অপরাধ ছিলো ভাইয়া? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। আমি তো কখনো কারো ক্ষতি করিনি। আমি সবসময় শালীন পোশাক পড়ি। তাহলে আমার অপরাধ কি ভাইয়া?
অয়ন বলল, তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছো এটাই তোমার সবচেয়ে বড় অপরাধ। - আমি কি নিজের ইচ্ছায় জন্মেছি? আমাকে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন। আমাকে বাবা মা জন্ম দিয়েছেন। আমার তো এতে কোনো হাত নেই।
- কষ্ট পেও না বোন। যা হবার তা হয়ে গেছে। নিজেকে শক্ত কর বোন, শক্ত কর।
- যা হবার তা হয়ে গেছে মানে? একটা মেয়ের জন্ম হয়েছে ধর্ষিতা হবার জন্য?
- জানিনা। কিন্তু পুরুষ রা এখনো মেয়েদেরকে সম্মানের চোখে দেখে না। আগে মেয়েদেরকে বিয়ে করতো ভোগ করার জন্য আর সন্তান জন্ম দেবে সেজন্য। এখনো পুরুষের চোখে নারীরা নেহাত ভোগের বস্তু ছাড়া কিছুই না। এ কারণেই তারা ধর্ষণ করে।নেহা মুখ বিকৃত করে অন্যদিকে তাকালো। এই পুরুষ সমাজের প্রতি ধিক্কার৷ তারা মেয়েদের যথাযথ সম্মান দিতে শিখলো না আজও।
অয়ন বললো, এইসব খারাপ লোকের মাঝে যে দু একজন ভালো মানুষ আছে, তাদের জন্য এখনও মানুষ টিকে আছে। নয়তো কবেই সব শেষ হয়ে যেতো।
- ভাইয়া, এভাবে ধর্ষিতা হয়ে মরে যাওয়াকে তুমি টিকে থাকা বলো?
অয়ন কোনো জবাব দিতে পারলো না।
নেহা বললো, যদি তোমরা আমাকে হাসপাতালে না এনে সবার মত ফেলে চলে যেতে তাহলে হয়তো আমাকেও এই কষ্ট নিয়েই মরে যেতে হতো। কিন্তু মরলেই ভালো ছিলো ভাইয়া। এই যে ধর্ষকের সাজা হচ্ছে না, ওরা হেসেখেলে দিন পার করছে। আমাকে নিয়ে লোকজন হাসাহাসি করছে। এসব দেখার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো ছিলো তাই না বলো?
অয়ন নেহার হাত ধরে বলল, ভাবিস না বোন। সব ঠিক হয়ে যাবে। জানি এই ক্ষতি অপূরনীয়। কিন্তু তোর নিজেকে শক্ত করা দরকার। তোর থেমে গেলে চলবে না। বরং ভালো কিছু করে ওদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে তুই পারিস। তোকে ওরা দমাতে পারেনি। বুঝেছিস?
নেহা অয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি যে আর উঠে দাড়াতে পারছি না। আমি সুস্থ হবো?
- অবশ্যই সুস্থ হবি। আত্মবিশ্বাস রাখ। সুস্থ হয়ে ওদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ফাসির জন্য আন্দোলন করতে আমরা লড়ে যাবো। আর তুই নিজেকে গড়ে তুলবি৷ তুই ভালো কিছু করে ওদেরকে দেখিয়ে দিবি। বুঝলি বোন?
নেহা মাথা নিচু করে ফেললো। কিছুই করার সাহস নেই ওর। নিজেকে নোংরা নর্দমার মত লাগছে।
কথাটা শুনে অয়ন বললো, নিজেকে নর্দমার মত ভাবিস না। তোর শক্তি আছে, কিছু শয়তান রূপী মানুষ এটাকে দমানোর জন্য চেষ্টা করবে। তোকে সেসব ভাবলে চলবে না। উঠে দাড়াতে হবে, লড়তে হবে।
- আমার জড়ায়ুর অবস্থা ভালো না। ডাক্তার নাকি বলেছে আমার বড় কোনো অসুখ হতে পারে। এই বেচে থাকার কি দরকার ছিলো?
বলতে বলতে কান্নায় ভেংগে পড়লো। অয়ন তবুও ওকে সাপোর্ট দিয়ে বললো, কাদিস না বোন। কিচ্ছু হবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। - ভাইয়া, আমি হয়তো আর কখনো মা হতে পারবো না। তারচেয়েও বড় কথা, আমাকে কেউ বিয়েই করবে না। একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলাটাও ভালো। এভাবে বাঁচার কোনো অর্থ নেই ভাইয়া। আমার নারীত্বের কোনো অহংকার নেই। বেঁচে থেকে আর কি করবো?
অয়ন জানে স্বান্তনার কোনো ভাষা হয়না। তবুও নেহার হাত চেপে ধরে বললো, ভাবিস না বোন। তোকে সংগ্রামী হতে হবে। এমন জায়গায় নিজেকে দাড় করাবি যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ তোকে চিনবে। তোকে ফলো করবে, তোর মত হতে চাইবে। সেদিন জনসম্মুখে বলবি তোর কষ্টের কথা। তোকে কেউ থামাতে পারেনি। মোটিভেশান দিবি। সেদিন তোকে বিয়ে করার জন্য অনেক পুরুষ ই নিজে থেকে এগিয়ে আসবে। ধর্ষণের জন্য তুই দায়ী না। তোকে মেরে ফেলার একটা অপপ্রয়াস এটা। কিন্তু বেচে গেছিস এটা তোর সৌভাগ্য। আর ধর্ষকের সাজার জন্য যা যা করতে হয় সেসব আমরা দেখবো।
অয়নের কথা শুনে ভরসা পেলো নেহা। একটা অসহায় মেয়েকেও কেউ এভাবে অনুপ্রেরণা দিতে পারে? সত্যিই খুব ভালো একটা মানুষ অয়ন ভাই। নেহার এখন বাঁচার ইচ্ছে জাগছে।
নেহা বললো, অয়ন ভাই। আমি সুস্থ হবো তো? আমি মরে যাবো না তো ভাইয়া?
- না রে। সুস্থ হয়ে যাবি তুই।
- ভাইয়া আমার ভয় করছে। আমি বাঁচতে চাই।
- তোর কিচ্ছু হবে না বোন। সুস্থ হয়ে যাবি তুই। আত্মবিশ্বাস রাখ।
- হ্যা, আমাকে সুস্থ হতে হবে। আমাকে লড়াই করতে হবে।
- ধর্ষকের শাস্তির জন্য আরো প্রতিবাদ করতে হবে বোন।
নেহা বললো, ভাইয়া। আমি যে ভিডিও করেছি এটা ভাইরাল হলে সবাই আমাকে চিনবে৷ আমাকে রাস্তাঘাটে দেখলে হাসাহাসি করবে ভাইয়া। আমাকে উপহাস করবে। কেউই আমাকে বাঁচতে দিবে না। - আসলে আমরা এমন এক দেশে জন্মেছি যেখানে মানুষ খুব কম। বেশিরভাগেরই বিবেক পশুর ন্যায়। যে মেয়েটা মরতে মরতে বেঁচে গেছে, তাকে অসম্মান করতে করতে মেরে ফেলাতে এরা ওস্তাদ। সমাজের এসব মানুষ ধর্ষকের চেয়েও খারাপ।
নেহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই সমাজ কখনও বদলাবে না। সারাজীবন এই কষ্টটা বয়ে বেড়াতে হবে ওকে। অয়ন ভাই ঠিকই বলেছেন। এ সমাজে থেকে কিছুই হবে না। বরং সবকিছুর মাঝেও নিজেকে গড়ে একটা যোগ্য জবাব দিতে হবে। নয়তো এ সমাজের চোখে অপমানিত হতে হতে জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। এতকিছুর পরও নিজেকে নিয়ে লড়াই করে যাওয়াটা যে অনেক কষ্টের। তবুও একটাবার চেষ্টা করা যায়..
নেহা বলল, আপু আজকে আসবে না?
অয়ন চমকে উঠে বলল, জানিনা রে। আজকে রাস্তায় মিছিল হবে। আমি মিছিলে যাই। #রূপন্তী ও সেখানে থাকতে পারে।
অয়ন উঠে দাড়ালে নেহা ডাকলো, ভাইয়া..
পিছন ফিরে তাকালো অয়ন।
নেহা বলল, তুমি অনেক ভালো মানুষ ভাইয়া। সব ছেলেরা যদি তোমার মত হতো।
অয়ন এগিয়ে এসে নেহার মাথায় হাত রাখলো। অয়নের হাত চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো নেহা।