এলিয়েন রহস্য পর্ব ৩

এলিয়েন রহস্য পর্ব ৩ – এলিয়েন মানবের গল্প | Alien Story

এলিয়েন রহস্য পর্ব ৩ – এলিয়েন মানবের গল্প: গত পর্বে আমরা শ্রাবণের কিছুটা পরিচয় পেয়েছি। শ্রাবণ কি সাধারণ মানুষ নাকি ঐ আশ্চর্য মেয়েটির ছেলে? আর এই অপরিচিতা কে যে শ্রাবণের জীবনে এসেছে? বিষাদময় শ্রাবণের জীবনে কি ঘটতে চলেছে তা দেখার পালা এখন। চলুন রহস্য জানার চেষ্টা করি।

অপরিচিতার জীবনের গল্প

নিজের আপন ভাই যখন তার রক্তের ছোট বোনকে বেশ্যা বলে সম্বোধন করে, তখন ঐ বোনটার কাছে পৃথিবীটা কত অদ্ভুত লাগে বলতে পার শ্রাবণ? ছোটো বেলা থেকে যে ভাইয়ের সাথে টিভিতে কার্টুন দেখার জন্য রিমোট নিয়ে মারামারি করতাম, স্কুলের টিফিনটা পর্যন্ত ব্যাগে করে নিয়ে এসে ভাইদের সাথে ভাগ করে খেতাম, ওদের অনুপস্থিতিতে অগোছালো জামাকাপড়গুলো পরম মমতায় গুছিয়ে রাখতাম, সেই ভাইগুলো আমার এমন হয়ে যাবে ভাবিনি।

আসলে কি জানো? টাকা মানুষের মধ্য থেকে মনুষত্ব কেড়ে নেয়। বড়লোকরা কেন বড়লোক? কারণ তারা একটা টাকারও অনেক মূল্য দেয়। তাদের কাছে টাকার মূল্য পৃথিবীর অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে বেশি বলেই টাকাও তাদের আপন করে নেয়। উদার মনের মানুষরা কখনো বড়লোক হতে পারেনা। কারণ তারা খুব সামান্য কারণেও টাকা উড়ায়।

কাউকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়াটা আমার অপরাধ না। অপরাধ তার, যে ঠকিয়েছে।

দু’বছর আগে আমার এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়। বেশ স্মার্ট, সুদর্শন।

একটা সময় আমাদের পরিচয়টা আরো গভীর হয়। আমরা ভালোবাসায় জড়িয়ে পরি। ওর মেন্টালিটি ছিল অনেকটা খোলামেলা টাইপের। একজন মানুষ কারো সাথে মিশলে তার মেন্টালিটি যেরকম, অন্যজনও সেরকম হতে বাধ্য। আমিও ওর মত করে আস্তে আস্তে ভাবতে শুরু করি সব। কিন্তু শেষের গল্পটা খুব জঘন্য।

ওর লুকিয়ে করা খারাপ কাজগুলো আমার সামনে আসতে থাকে। মাদকাসক্ততা, মেয়ে নিয়ে রাত বিরাতে হোটেলে পরে থাকা, জুয়া খেলা এগুলো সব কিছু আমার দৃষ্টিগোচর হতে থাকে।

আমি অন্য মেয়েদের মত চুপ করে থাকিনি। প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। আমাদের মাঝে প্রতি মাসেই কয়েকবার করে ফিজিকাল রিলেশন হত।

ও ভেবেছিল এজন্য আমি হয়ত ওর কাছে আটকে আছি। ও যা বলবে সব মেনে নিতে হবে আমার। কারণ ও তো আমাকে পেয়েই গিয়েছে। কিন্তু আমি তেমনটা ভাবতাম না। মন ও শরীরের কাছে আমার মনটা কেই সবচেয়ে দামি মনে হত। ফিজিকাল রিলেশন হয়ে গেছে বলে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছি, এমন কিছু আমার ভাবতেও ইচ্ছে করত না। আমি ওর সাথে থেকে আমার মন কে বুঝ দিতে পারছিলাম না। অসহ্য লাগত, অশান্তি লাগত, তাই এক পর্যায়ে ওকে ডাম্প করি। নিজের মত জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে থাকি। মনে যে কষ্ট ছিল না আমার তা বলব না। তবে সামলে নিয়েছিলাম।

অপরিচিতার আকুতি

বাবা অনেকটা বৃদ্ধ। মারা যাওয়ার আগে আমাকে বিয়ে দিয়ে যাওয়ার শখ খুব তার। এজন্য ছেলে ঠিক করলেন। বিয়ের সব কিছু ঠিক ঠাক। এর কয়েকদিন আগেই বের হলো আমার আর আমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের ফিজিকাল রিলেশনের ভিডিও ক্লিপ।

আমি একটুও বিব্রত হইনি। যা করেছি সেটা আমার ভুল ছিল। এ সমাজ শুধু ভুলকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রণা দিতে পারে। তাছাড়াও মুখোশের আড়ালে ভাল মানুষটি হয়ে থাকার ইচ্ছে আমার ছিল না। বিয়ের পরেও তো মানুষের ডিভোর্স হয় শুধু হাজবেন্ড এর সাথে মনের মিল না থাকার কারণে। সমাজ কিন্তু সেটাকে তখন ঠিকই এপ্রিশিয়েট করে। এই অসুস্থ সমাজকে নিয়ে চিন্তা করে কষ্ট পাওয়ার মত মন আমার নেই। কিন্তু নিজেকে যখন নিজের পরিবারের লোকের কাছে একটা পণ্য বলে মনে হয়, দাম কষাকষির দ্রব্য বলে মনে হয়, ভাই যখন বোনকে বলে বেশ্যাগিরি করে মানুষ টাকা আনে আর আমাদের উলটো দিতে হবে কেন?

তখন সে পরিবারের মুখের উপর থাপ্পড় মেরে চলে আসা উচিৎ। আমি সেটাই করেছি। এই পৃথিবীটা বড্ড অসুস্থ। তাই চেয়েছিলাম এখানে বেঁচে থেকেও থেকে লাভ নেই। কিন্তু আবার ভাবলাম এ দুনিয়ায় তো একবারই আসার সুযোগ হয়েছে। একবার চলে গেলে আর ফিরে আসার কোন চান্স পাব না। তাই কিছুদিন ঘুরে ফিরে দুনিয়ার ভাল জিনিসগুলোকে উপভোগ করে তারপর যাই। কি ভাগ্য দেখো,কাকতালীয়ভাবেই তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া।

শ্রাবণঃ বুঝলাম। কিন্তু আমার চেয়ে তোমার কষ্ট বেশি নয়। তোমার বাবা মায়ের পরিচয় আছে, যেটা আমার নেই। আমার মাকে ধর্ষিত অবস্থায় রাস্তায় পাওয়া গিয়েছিল নাকি।

অপরিচিতাঃ এ কথাগুলো যে সত্য তার কোন প্রমাণ আছে?

শ্রাবণঃ রহিম আলী আমার মাকে খুঁজে পেয়েছিল। তারা বেঁচে নেই। তাদের ছেলেরা আমাকে এ কথা জানিয়েছে।

অপরিচিতাঃ জমিজমার ভাগ দিতে চায়না সেজন্যও তো হতে পারে এমনটা বলেছে।

শ্রাবণঃ আমি জানিনা। আমার মানুষের সাথে কথা বলতে ভাল লাগে না। কারণ আমি ‘কে?’ আমি অন্য সবার মত না এ জিনিসটা আমার প্রতিক্ষণ মনে হতে থাকে।

অপরিচিতাঃ এক কাজ করা যায়। চলো তোমার সেই মফস্বলে যাই। আমি ঢাকার বাইরে কখনো যাইনি। সত্যিটা সব সময় সুন্দর। তোমার প্রকৃত ব্যাপারটা ও উদঘাটন করা যাবে। আমার ঘোরাঘুরিও করা হবে।

শ্রাবণঃ তা যাওয়া যায়।

অপরিচিতাঃ তবে এখন না। কিছুদিন পরে। আমার সাথে কাল একটু বের হবে। জামাকাপড় সহ অনেক কিছু কেনাকাটা করতে হবে।

শ্রাবণঃ বেশ। বের হওয়া যাবে। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাই।

অপরিচিতাঃ হুম।

স্বপ্নের কালো ঘোড়া

শ্রাবণ রুমের লাইট অফ না করেই একটা বালিশ নিয়ে ঘুমিয়ে পরে। কোন প্রকার ফর্মালিটি বা সৌজন্যবোধ না দেখানোর কারণে স্নেহা একটু হলেও বিরক্ত হয় শ্রাবণের প্রতি। আবার অন্য রকম একটা রহস্যও কাজ করে। স্নেহা চোখের সামনেই যেন একটা জীবন্ত লাশ দেখতে পাচ্ছে। যার ভেতরে কোন ফিলিংস নেই। রোবট মানুষের মত অনেকটা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রাবণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। অপরিচিতারও ঘুম পাচ্ছে খুব। বিকেল থেকে একটু পানিও খায় নি। খাওয়ার ইচ্ছে নেই, কিন্তু ক্ষুধা তো আর অভিমান বুঝে না। লাইট অফ করে দেয় স্নেহা। ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দেয় শ্রাবণের বিছানায়। দু তিনটা বালিশ নিয়ে ঘুমানো মেয়েটার মাথার নিচে আজ একটা ও বালিশ নেই। তা নিয়ে আফসোস নেই তার। সুইসাইড করলে হয়ত দেহটা এতক্ষনে আরো খারাপ অবস্থায় থাকতো। তখন নরম তোষকটুকু ও পাওয়া যেত না। ঠিক তখন ই অপরিচিতার উপলব্ধি হয়, বেঁচে থাকাটার মূল্য সত্যিই অনেক। একা একা কবরে নিশ্চুপভাবে শুয়ে থাকতে তার এখন মোটেই ভাল লাগত না। আর ধর্মের বিধানে শাস্তি তো আছেই। অপরিচিতা ক্লান্ত দেহে ঘুম এসে পরে খুব তাড়াতাড়ি।

ঘুমের ঘোরে অপরিচিতা স্বপ্নে দেখে একটা বেশ বড় কালো ঘোড়া স্নেহাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ঘোড়াটা আসলে কালো ধোঁয়ার তৈরি এবং যে রাস্তায়ই পা ফেলছে সে রাস্তায় থাকা ঘাস, লতা পাতা এবং গাছগুলো সব নিস্তেজ হয়ে নেতিয়ে পরছে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে নিচে পরে যায় সে। ঘোড়াটা ততক্ষণে তার কাছে এসে গেছে। নিষ্ঠুর চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর লম্বাটে মুখটা নামিয়ে আনে অপরিচিতার মুখের কাছে। প্রচন্ড জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিল স্নেহা। সেই নিশ্বাসের সাথেই কালো ঘোড়াটি আস্তে আস্তে ধোঁয়ায় পরিণত হয়ে অপরিচিতার শরীরের ভেতরে ঢুকে যায়।

সাথে সাথে অপরিচিতার মনে হতে থাকে কেউ যেন তার গায়ে এসিড ঢেলে দিল। ডান হাত থেকে মাংস খুলে পরে গিয়ে ইতিমধ্যেই হাড়গোড় বেরিয়ে গিয়েছে অপরিচিতার। ঠিক এমন সময়েই তার ঘুমটা ভেংগে যায়, বুকের ভিতরে কেমন ধুকপুক ধুকপুক করতে শুরু করে। তখন ই দেখতে পায় শ্রাবণের পিঠের নিচে তার ডান হাতটি চাপা পরে আছে। আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে নেয় অপরিচিতা। এত ভয়ানক দু:স্বপ্ন আগে কখনোই দেখা হয় নি তার।

ডান হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে কেমন ঝিঝি করা শুরু হয়েছে, সাথে অসহ্য যন্ত্রণা। বাকি রাতটা না ঘুমিয়েই পার করে দেয় সে।

শ্রাবণের ঘুম ভাঙ্গে ৭ টার দিকে। কম্পিউটার টেবিলের সামনে রাখা টেবিলটায় বসে বসে তখন চা খাচ্ছিল অপরিচিতা।

শ্রাবণ বুঝতে পারে অপরিচিতা অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে সব কিছু খুঁজে খুঁজে চা বানিয়েছে।

দুজনের নামহীন সম্পর্কের সংসার সাজানো

শ্রাবণের ঘুম ভাংতে দেখে অপরিচিতা তাড়া দেয়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিতে, অনেক কিছু কেনাকাটা করতে হবে তার। শ্রাবণের হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দেয় স্নেহা। টুথব্রাশ, জামাকাপড় থেকে থেকে শুরু করে টিভি ফ্রিজ সোফা সব কিছুই আছে লিস্ট এ, শ্রাবণের জন্য ও সেখানে বাজেটের কমতি ছিল না। জামা জুতা থেকে শুরু করে যা যা লাগে সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিল। শ্রাবণের মনে কেমন খটকা লাগে। এই মেয়ে কি সারাজীবনই এখানে থাকার প্লান করেছে কিনা কে যানে! টাকার গরম দেখাচ্ছে ভেবে একটু বিরক্তও লাগে তার। কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করে না শ্রাবণ।

সকাল সকাল বের হয়ে পরে তারা দুজনে। কালো একটা বোরকার সাথে নিকাব বেঁধে সাথেই আছে অপরিচিতা। ধীরে ধীরে গুছিয়ে সব কিছু কেনাকাটা করতে থাকে তারা। দুপুরের খাওয়াটাও হয় বাইরেই।

শপিং শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়। অপরিচিতা অনলাইন থেকে একজন ডেকারেশনের লোক এনে বাসাটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলে।

লাল নীল লাইটের আলোতে সুসজ্জিত হয়ে উঠে বাসাটি। সব ঝামেলা শেষে বাইরে থেকে কিনে আনা খাবার খায় দুজনে একসাথে। অপরিচিতার মেজাজ ততক্ষণে বেশ ফুরফুরে। শপিং করলে তার মন এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। অপরিচিতা এখন নিজে স্বাধীন, এটা ভেবেই সবথেকে বেশি আনন্দ পাচ্ছে সে।

তবে শ্রাবণের ভিতর কোন ধরণের আনন্দের লেশমাত্রও খুঁজে পায়না অপরিচিতা। অপরিচিতার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট হবে শ্রাবণ, তবুও অপরিচিতার কাছে শ্রাবণকে অনেক পরিপক্ব ও গম্ভীর মনে হতে থাকে।

নিজের রুম থাকলেও অপরিচিতা শ্রাবণের রুমে এসে বেশি সময় কাটায়। এভাবেই কেটে যায় দু তিন দিন।

এরপর অপরিচিতা নিজ থেকেই বলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রেডি হতে।

শ্রাবণের জন্মের ব্যাপারে সকল রহস্য সমাধানের জন্য একটা ভালো এডভেঞ্চার হয়ে যাক।

শ্রাবণ ও দ্বিমত করে না। ব্যাগ প্যাক করে পরদিন সকালেই বেরিয়ে পরার জন্য রাজি হয়ে যায়।

টিকেট কেটে বাসে উঠতে উঠতে সকাল ১০ টা বেজে যায়।

বাসে আর অপরিচিতা তার বোরকা পড়ার প্রয়োজনবোধ করে না। কিন্তু ওর ওয়েস্টার্ন পোশাক দেখে অনেকেই আড় চোখে তাকায়।

এতে অপরিচিতা একটু অস্বস্তিকর অবস্থায় পরলেও শ্রাবণ জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার এইসব দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

স্নেহা (অপরিচিতা) ও শ্রাবণের ভ্রমণ

১৮ ঘন্টার একটা লম্বা জার্ণি। স্নেহা (অপরিচিতার আসল নাম) এত বড় জার্ণিতে অভ্যস্ত নয়। তার ছটফটানি বাসের সকল যাত্রীর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেশ কয়েকঘন্টা পর বাস এসে পৌঁছায় পদ্মার পাড়ে। এখানে ফেরীর জন্য অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। সে সুযোগে শ্রাবণকে নিয়ে বাস থেকে কিছু সময়ের জন্য বাইরে নামে স্নেহা। শহরের বাইরে এসে যেন একটা ছোট্ট মেয়ে হয়ে গিয়েছে সে। অযথাই মনের ভিতরে একটা ভয় কাজ করে তার। শ্রাবণের অনুমতি না নিয়েও হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করাতে শ্রাবণ অনেকটাই বিব্রতবোধ করে।

অন্য মানুষদের দেখাদেখি তারা দুজনেও একটা হোটেলে গিয়ে তাজা ইলিশ আর চিংড়ি ভাজি দিয়ে বেশ মজা করে দুপুরের খাওয়াটা শেষ করে। খাওয়া শেষে স্নেহা প্রচন্ড ঝালে ছটফট করে কাতরাতে থাকলে সে দৃশ্য দেখে শ্রাবণের প্রথবারের মত একটু পৈচাশিক হাসি পায়। কিন্তু মুহুর্তেই আবার সেই হাসিটা ফিকে হয়ে আসে। কোন একটা অতীতের স্মৃতি তাকে হাসতে দেয় না। হয়ত আর কখনো দিবেও না। স্নেহার ঝালের সাথে যুদ্ধ করা শেষ হতে না হতেই বাস ফেরিতে উঠে পরে। ওপার পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় ২.৫ ঘন্টা লাগে।

পদ্মার মাঝের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে করতে সময়টা কেটে যায়। ফেরি পার হওয়ার পরে বাসের শুধুই ছুটে চলা। আর কোন থামাথামি নেই। এভাবে ছুটতে ছুটতে রাত নামে একটা স্টেশনে বাস থামে। রাতের খাবার সারার পরে আবারো নিরবিচ্ছিন্নভাবে ছুটে চলবে বাস। সকাল ৬ টায় তারা নামে একটা জেলা শহরে। এখান থেকে যেতে হবে একদম এই জেলার শেষ প্রান্তের উপজেলায়। সেখান থেকে আরো উঁচুনিচু পথ পাড়ি দিয়ে তবেই কাংখিত জায়গা।

রাস্তাঘাট দুর্গম হওয়ায় উন্নয়নের ছোয়া সেখানে লাগে নি এখনো।

জেলা শহর থেকে উপজেলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যায়। স্নেহা ততক্ষণে একদম নেতিয়ে পড়েছে। তবে শ্রাবণের কোন ক্লান্তি আসে নি এখনো। উপজেলায় পৌঁছানোর পরে ভ্যান গাড়িতে মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে কাঙ্ক্ষিত মফস্বলে।
মফস্বল টার একটা নাম ছিল; “হেমন্তপুর”।

বিকেলের আলোতে হেমন্তপুরকে রূপকথার গ্রামের মত লাগছিল। চারদিকে সুসজ্জিত গাছ পালা। মাইলের পর মাইল খোলা, ধানী জমি। পাখ পাখালির মুগ্ধ করা গান,পুকুরে সবুজাভ পানি আর টিনের ঘর, সব মিলিয়ে হাতে আঁকা কোন ছবি যেন।

হঠাৎ একটা ট্রলি গাড়ির আওয়াজে স্নেহার ঘোর কাটল। না একটা না। কয়েকটা ট্রলি গাড়ি। ইট বালু সিমেন্ট বহন করে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও যেন।

বেশ অবাক হয় স্নেহা। এদিকেও তবে দালান কোঠা উঠছে।

তাইসন রাজার রাজপ্রাসাদ

সন্ধ্যের আগে আগে হেমন্তপুরের রহিম আলীর বাড়ির সামনে এসে থামে শ্রাবণ দের ভ্যান। তিনতলার একটা দালান বাড়ি। এ গ্রামের মাঝে এমন বাড়ি আর আশেপাশে চোখে পড়ে না। শ্রাবণ ও স্নেহার আশেপাশে বেশ কিছু ছোট ছোট বাচ্চারা ভীড় জমিয়েছে। তাদের চোখে কৌতুহল। ভ্যান গাড়িটা শ্রাবণদের নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। বাচ্চাগুলো কানে কানে ফিস ফিস করে কি যেন কথা বলতে থাকে নিজেদের মধ্যে।

সেগুলো ইগনোর করে শ্রাবণ ও স্নেহা তিনতলা বাসাটার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

সাথে সাথে ছোট বাচ্চারা চিৎকার দিয়ে বলে উঠে, ঐ বাসায় কেউ এখন থাকে না। ওখানে যাচ্ছেন কেন?

স্নেহা ও শ্রাবণ দুজনেই ঘুরে বাচ্চাদের দিকে তাকায়।

শ্রাবণ প্রশ্ন করে,

এখানে যারা থাকত তারা কোথায় থাকে?

কেউ কোন উত্তর না দিয়ে নিজেদের ভিতর ফিসফিসিয়ে কথা বলতে থাকে।

হঠাৎ একজন বলে উঠে, ঐ দিকে আরোওওও দূরে, একটা রাজপ্রাসাদ আছে। সেখানে।

স্নেহা বিষ্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করে!

রাজপ্রাসাদ?

শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে এদিকে তো কোন রাজ প্রাসাদের কথা শুনিনি আগে।

আরেকজন ছোট বাচ্চা উত্তর দেয়,
তাইসন রাজার রাজপ্রাসাদ। অনেক বড় রাজপ্রাসাদ।

নামটা চিনতে পারে শ্রাবণ।
তাইসন হলো রহিম আলীর ছোট ছেলের নাম।

বড় ছেলের নাম তাহির।

শ্রাবণ আবার জিজ্ঞেস করে, তাদের বাসার রাস্তাটা কোন দিকে? দেখিয়ে দিবে?

কথাটা বলা মাত্রই বাচ্চাগুলো হঠাৎ এক দৌড়ে চলে যায় কোথাও।

ডার্ক হর্সের প্রাসাদ

এদিকে আঁধার নেমে এসেছে প্রায়। স্নেহা আর কোন মতেই হাঁটতে পারছে না।

শ্রাবণ এবার স্নেহার হাত ধরে টেনে নিয়ে এগিয়ে চলছে। রাস্তাঘাটে দু একজন মানুষের সাথে দেখা হলে তাদের কাছে শ্রাবণ তাইসনের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু তাদের প্রায় সবাইই উত্তর না দিয়ে খুব তাড়াহুড়া করে কেটে পরে শ্রাবণদের সামনে থেকে।

ব্যাপারটা মাথায় ঢোকেনা শ্রাবণের।

অবশেষে এক বৃদ্ধর সাথে দেখা হয় তাদের। খুব অনুরোধ করে বলার পরে বৃদ্ধ মুখ খুলে। শুধু এটুকুই বলে, এখান থেকে ট্রলি গাড়ির চাকার ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে যাও।

ক্লু পাওয়া গিয়েছে। শ্রাবণ বুঝতে পেরেছে এই ট্রলি গাড়িগুলো হয়ত তাইসনের তাহির এর বাসা বানানোর জন্য ইট বালু বহন করে। তারা লাইট জ্বালিয়ে সে চাকার ছাপ অনুসরণ করে আস্তে আস্তে এগুতে থাকে সামনের দিকে। কিছুদুর যাওয়ার পরই বেশ অবাক হয় স্নেহা। একদম নিট এন্ড ক্লিন পাকা রাস্তার শুরু হয়েছে এখানটা থেকে। সামনে আর কোন মেঠো পথ নেই।

যাক তাও ভালো। বাটার বানে কামড় দিতে দিতে মিনিট পাঁচেকের মত হেঁটে সামনে আগায় তারা দুজনে। অন্ধকার রাতে লাইট মেরে রাস্তা দেখে এগুতে হচ্ছে। হঠাৎ লাইটের আলো গিয়ে পরে একজন লোকের গায়ের উপরে। বেশ কয়েকফুট দূরে একটা চাঁদর গায়ে দিয়ে রাস্তার মাঝ বরাবর বসে আছে লোকটি। শ্রাবণদের দেখেই হঠাৎ এক লাফে উঠে দাঁড়ায়। দু হাত দুপাশে উঁচু করে ধরে এক দৌড়ে শ্রাবণদের খুব কাছে এসে পরে। দেখে মনে হয় লোকটি পাগল। ছেড়া জামা জুতো জট পাকানো লম্বা চুল। নোংরা মুখমণ্ডল, আর লাল টুকটুকে দুটি চোখ। এসে শ্রাবণ দের চারপাশে ঘুরে খতিয়ে খতিয়ে দেখতে থাকে ভাল করে।

তারপর স্নেহার সামনে এসে দাঁড়ায়।

স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে আধো হিন্দি আধো বাংলায় বলে..

ইয়ে লাড়কি, ইয়ে রাস্তা পার মাত যা, ইহা এক কালে ঘোড়া হ্যায়… জিন্দা নেহি ছোড়েগি, ভাগ – ভাগ হিয়াসে…বলতে বলতে শ্রাবণরা যে দিক থেকে এসেছিল সে পথে দৌড় দিয়ে চলে যেতে থাকে আর বলতে থাকে কালো ঘোড়া হ্যায় কালো ঘোড়া হ্যায়।

স্নেহা শ্রাবণকে আরো শক্ত করে ধরে বলে, শ্রাবণ আমার আর এখানে ভাল লাগছে না চল, আমরা ফিরে যাই। শ্রাবণের মুখে তখন বাঁকা হাসি। মনে মনে সে ভাবে এত দূর এসে সব প্লান ভেস্তে দেই কিভাবে স্নেহা!

স্নেহাকে আশ্বস্ত করে শ্রাবণ, এ লোকটা যা বলছে সব কি আপনি বিশ্বাস করেছেন? কালো ঘোড়া কোথা থেকে আসবে? চলুন সামনে এগুনো যাক। শ্রাবণের গলার স্বর আর কথা বলার ভংগিমায় আশ্চর্য পরিবর্তন। এই মুহূর্তে স্নেহা যেন শ্রাবণকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। ( চলবে)

পরের পর্ব- এলিয়েন রহস্য পর্ব ৪ – এলিয়েন মানবের গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *