আজ সকালে পত্রিকার সাথে একটা চিঠি এসেছে। অবাক করা ব্যাপার চিঠির প্রাপকের জায়গায় আমার নাম-ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর। ডাকপিয়ন মাধ্যমে চিঠিটা আসার কথা অথচ পত্রিকাওয়ালা দিলো কিভাবে? কিছু বলেও গেলো না। যাকগে, যেভাবেই আসুক! আমার চিঠি আমার কাছে এসেছে, ঠিক আছে। আমি আগ্রহভরে চিঠিখানা খুললাম, তাতে লেখা,
“আকাশ সাহেব! আগামীকাল সকালে আমি আসছি। অনুগ্রহপূর্বক নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন না কিংবা কোথাও যাবেন না। আপনার সাথে দেখা করাটা জরুরী আমার।”
প্রেরকের কোনো নাম ঠিকানা নেই। একজন অপরিচিত মানুষ দেখা করতে চান। কারণটা যেমন আমার অজানা তেমনি তিনি ছেলে না মেয়ে সেটাও অজানা।
পরেরদিন বেলা তখন ১০ টা সম্ভবত…কিছুক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠেছি। বিছানার চাদর ঠিক করছি। আমার জানামতে আমি ভালভাবেই ঘুমায়। কিন্তু প্রতিদিন দেখি বিছানার চাদর মেঝে পযর্ন্ত চলে যায়। মাঝেমাঝে বালিশও পড়ে যায়। কখনো ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বালিশ সহকারে মেঝেতে ও আবিষ্কার করি। ওয়াশরুমে যাবো, তখনি দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনতে পেলাম। আশিক’কে বললাম, দেখতো কে…
আশিক দরজা থেকে ঘুরে এসে বললো, কেউ নেই।
আমি আবার শব্দ শুনতে পেলাম। ও’কে বললাম, ঐ যে! আবার ধাক্কা দিচ্ছে। ছোটবাচ্চা মনে হয়, দেখ।
আশিক আমাকে ঝাঁড়ি মেরে বললো, পাগল হলি নাকি? কই? কোনো শব্দ তো শুনতে পাচ্ছি না।
-তোর কানে সমস্যা। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
-তো তুই গিয়ে দেখ, কে?
বলেই আশিক রুমে গেলো। ব্রাশ করতে করতে গিয়ে গেট খুলে দিলাম। দরজা খুলে একটু বেশিই অবাক হতে হল। অপরূপ এক সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, আকাশ সাহেব?
-জ্বি, কিন্তু আপনি?
-আমি মেঘলা আফরিন। গতকাল চিঠি পাঠিয়েছিলাম। পড়েছেন, নিশ্চয়। আজকে দেখা করতে চেয়েছিলাম।
-ওহ আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। ভিতরে আসুন।
-ধন্যবাদ। ভিতরে যেতে চাচ্ছি না। কাইন্ডলি বাহিরে বের হবেন? হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি?
-জ্বি, আপনি জাস্ট পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।
-ঠিক আছে।
খুব দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
-সরি, একটু মনে হয় বেশিই দেরি হয়ে গেল।
-ইট’স ওকে। চলুন যাওয়া যাক।
-জ্বি। কিন্তু কোথায়?
-সরি, আমি এ’শহরের তেমন কিছু চিনি না। আপনি এমন একটা জায়গায় নিয়ে চলুন, যেখানে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়া যাবে। প্রকৃতিকে অনেক কাছে থেকে দেখা যাবে।
-এমন জায়গা আছে, তবে এখন বেলা ১১টা। তাই আপনি যেমনটা চাইছেন তেমনটা সম্ভব না।
-সম্ভব হত। কিন্তু আপনার ঘুম ভাঙতেই দেরি হয়ে গেলো।
-তাই…?যাইহোক চলুন, যাওয়া যাক।
-জ্বি। হেঁটে হেঁটেই যাব? রিকশা নেয়…?
-ওহ সরি। আমার খেয়াল ছিল না।
আমরা একটা রিকশা নিলাম। মেয়েটা অনেক চঞ্চলা এবং স্পষ্টভাষী। খুব সুন্দর করে কথা বলে। প্রায় পনের মিনিটের মধ্যেই আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেলাম।
জায়গাটা একদম শহরের বিপরীত। বিভিন্ন ধরনের গাছপালার সমারোহে ছোট্ট একটি বন বলা যায়। যার মধ্যখানে ছোট্ট একটি পুকুর। প্রকৃতিকে কাছে থেকে দেখার জন্য প্রায় যথেষ্ট। জায়গাটা মেয়েটার বেশ পছন্দ হয়েছে তা তার চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।
মেয়েটা আমার সাথে কেন দেখা করতে এসেছে তা আমার এখনো অজানা । জিজ্ঞেস করবো কিনা ভেবে পাচ্ছি না। নিজে থেকে কিছু বলছেও না। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর মুচকি হাসছে।
আমি মনোযোগ আকর্ষণ করলাম, এই যে!
-নাম ধরেই ডাকতে পারেন, সমস্যা নাই।
-ওকে। মেঘলা যেটা বলছিলাম সেটা হচ্ছে, আমার সাথে দেখা করার কারণটা আমি জানি না।
-কোন কারণ নেই। এমনি দেখা করতে এসেছি। কেন, কারণ ছাড়া কি আপনার সাথে দেখা করা যায় না?
-যায়। কিন্তু আপনি তো আমার পরিচিত নন।
-আমিও আপনাকে সেভাবে চিনিনা। তবু মনের অজানা একটা ইচ্ছে, দেখা করবার। কিন্তু আমি যশোরে থাকি। তাই সম্ভব হয়ে উঠছিলো না।
-আপনি কি যশোর থেকে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন?
-আমি আসলে গাজীপুরে আসছি গত সপ্তাহে আমার এক আত্মীয়ের বাসায়। পরে যখন জানলাম আপনি ঢাকায় থাকেন। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, খুব তো দূরে নয়, দেখা করেই যাই।
-ওহ আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। আপনার স্থায়ী বাসা কি যশোরেই?
-আমার কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই।
-আপনি অনেক রসিক মানুষ।
-আমি মোটেও মজা করছি না, আকাশ সাহেব। আমার সত্যিই কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই।
-বেশ! যশোরে, কই থাকেন? কি করেন? আপনার বাবা-মা কি করেন?
-থাকি আমি যশোর বেনাপোলে। আমার ছোট্ট একটা ভাই আছে এবার ক্লাস এইটে।
-আর বাবা-মা কই থাকে?
-নেই।
-নেই মানে? উনারা কি?
-না না মারা যায় নি। দিব্যি পৃথীবীর আলো বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে আমাদের দুই ভাই-বোনের মন থেকে অনেক আগেই মরে গেছে।
-বেশ মর্মান্তিক ঘটনা মনে হচ্ছে। বিস্তারিত বলা যাবে কি?
-হুম যাবে। আপনার শোনার ধৈর্য্য থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই।
-কারো কথা শোনার ধৈর্য্য আমার বেশ অনেকটাই আছে। আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।
-বেশ! আমার গ্রামের বাড়ি ছিল খুলনায়। আমার বাবা এলাকার মধ্যে নামকরা একজন ব্যবসায়ী। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আর আমার ভাই রাফি, সে অনেক ছোট। ছোট হওয়ার কারণে আব্বু-আম্মুদের সাথেই ঘুমাতো। রাফি আমাকে প্রায় প্রায় বলতো, আব্বু-আম্মু কোন একটা কারণ নিয়ে প্রায় প্রায় ঝগড়া করে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না। আমি আকার-ইঙ্গিত দিয়ে আম্মুকে জিজ্ঞাসা করতাম কিন্তু আম্মু কিছু বলতেন না।
ছোটখাট নানান বিষয় নিয়ে সংসার ঝগড়া হয়-ই। তাই আমি এ-ব্যাপারে আম্মুকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনাই। তবে ঝগড়ার কারণটা আমি জানতে পারলাম সে-বছরি ঈদুল ফিতরের ঈদের দিন। আব্বু সেদিন সকাল থেকেই বাসায় ছিল না। অনেক রাতে বাসায় ফিরেন সেদিন। আর ফিরার সাথে সাথেই আম্মু নানান প্রশ্ন শুরু করে। কিন্তু আব্বু তাঁর প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না। তবে কথা হতে হতে ভয়াবহ রূপ নেয়। আব্বু-আম্মু দুজনেই চিৎকার করে কথা বলতে লাগলেন। এক পর্যায়ে আব্বু, আম্মুর গায়ে হাতও তুললেন।
আর তখনই জানতে পারলাম মূল কাহিনি কি! আব্বু জোরে জোরে আম্মুকে বলছিল, “বিয়ে করছি ভালো করেছি রে মা **। কালকেই তারে বাড়িতে নিয়ে আসবো। আর সকালের পরে তর মুখ যেন না দেখি। বাড়ি থেকে চলে যাবি।”
আম্মু শুধু কাঁদছিল সেদিন। আমার বলার মত কিছুই ছিল না। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আমিও শুধু কেঁদেছিলাম।
পরেরদিন সকাল দশটার দিকেই আব্বু নতুন বউ নিয়ে বাসায় আসল। এলাকার মানুষজন বাড়িতে ভিড় করতে শুরু করল। একেকজনের একেক কথা। অতঃপর একদিন রাতে আম্মু আমাদের দুজনকে নিয়ে যশোরে চলে আসলেন। আপনি শুনছেন তো…?
-হ্যাঁ, শুনছি। তবে একটা কথা, আপনি বললেন, আপনার মা ও আপনাদের জীবন থেকে মরে গেছেন। এরকমটা কিভাবে হয়েছিল?
-সেই দিকেই এগোচ্ছি।
-ঠিক আছে, আপনি বলতে থাকুন।
-যশোরে এসে, আম্মু বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ শুরু করেন। নতুন জীবন বেশ ভালই কাটতে শুরু করে। এ ভাবেই কেটে যায় প্রায় তিনটি বছর। আমি ভাল ফলাফল নিয়ে এসএসসি পাশ করি। রাফি তখন ক্লাস ফোরে। হঠাৎ করেই একদিন শুনি, আম্মু একজন বিপত্নীক বাড়িওয়ালাকে বিয়ে করেছেন।
অাম্মু বিষয়টা কখনোই আমাদের সাথে শেয়ার করেন নাই। আম্মু প্রায় প্রায় উনার বাসায় যায়। ধীরে ধীরে বিষয়টা আমার কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠল। কেননা তখন যথেষ্ট বুঝতে শিখেছিলাম। দুইটা পরিবার সামলানো আম্মুর জন্য হিমশিম হচ্ছিল। সেটা ভেবে আম্মুকে মুক্তি দিতে একদিন বাসা ছাড়লাম দুই ভাইবোন। কোথায় যাব? কি করবো? কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। আমার এক বান্ধবীর বাসায় কয়েকদিনের জন্য উঠলাম।
বান্ধবীর বাবা আমাদের কথা শুনে অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং উনি আমাদের দায়িত্ব নিতে চাইলেন কিন্তু কারো করুণার পাত্রী হয়ে বাঁচার কোন ইচ্ছে ছিল না। তাই টিউশনি খুঁজতে শুরু করলাম। সবেমাত্র মাধ্যমিক মেষ করেছি তাই টিউশনি পাচ্ছিলাম না। প্রায় ১ মাস পরে টিউশনি পেলাম। তাও আবার একটা না, দুইটা পাইলাম। ধীরে ধীরে টিউশনির সংখ্যা বাড়তে থাকল। আলাদা বাসা ভাড়া নিলাম । জীবন নতুন রং খুজে পেল। বর্তমানে আমি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর সেদিনের পর থেকে এখনো টিউশনি করছি।
-বেশ সংগ্রামী জীবন আপনার। উনাদের খোঁজ-খবর কি নেন?
-উনাদের বলতে কাদের?
-আপনার বাবা-মার…
-না। তবে রাস্তায় আম্মুর সাথে একদিন দেখা হয়েছিল। কিন্তু আমি কথা বলিনাই।
-একটা কথা বলি…
-জ্বি, বলেন।
-আমার মনে হয়, উনাদের সাথে আপনার কথা বলা উচিত।
-একদমই না।
-কিন্তু আপনি তো তাঁদের মিস করেন…
-কে বলেছে? আমি তাঁদের মিস করি? একদমই মিস করিনা।
-আপনার চোখের কোণে জমা হওয়া জলের ফোঁটায় বলে দিচ্ছে, আপনি তাঁদের মিস করেন।
মেঘলা চোখের জল মুছে আমাকে বলল, বাদ দিন ঐসব। চলুন যাওয়া যাক, অনেক বেলা হয়ে গেছে।
রিকশায় উঠে, সে রিকশাওয়ালাকে বাসট্যান্ডে যেতে বলল। এখনই যশোরের উদ্দেশ্য রওনা দিবে।
আমি মেঘলাকে বিকেল পযর্ন্ত থাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু সে থাকতে রাজি নয়।
অতঃপর আমাকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠল সে। জানালার ফাঁক দিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি নজর সরিয়ে নিলাম। কেন জানিনা খুব কষ্ট হচ্ছিল, তাকে বিদায় জানাতে।
অনেকের জীবনেই এইরকম পরিস্তিতি আসে। তবে কেউ সেই পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে পারে, আবার কেউ পারে না। যে পারে, সেই সফল। সেই আত্মবিশ্বাসী মানুষ।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা মোড়ের টং দোকানে বসলাম চা-বিস্কুট খেতে। দোকানি মামা পেপারে মুড়ে একটা বিস্কুট দিলেন। বিস্কুট হাত নিয়েই কাগজটা ফেলে দিবো তখনই একটা লেখা দেখে বেশ অবাক হলাম।
“ছ’তলা ভবনের বারান্দা থেকে পড়ে যবিপ্রবি ছাত্রী মেঘলার(২১) মৃত্যু।”
বিস্তারিত পৃষ্ঠা ৬, কলাম ৮।
পত্রিকাটা দৈনিক ডাকঘরের ১৫ মার্চের। আজ ২৮ মার্চ, অর্থাৎ ১৪ দিন আগের। আমাদের বাসায় খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে। আমি দ্রুত বাসায় ফিরে পত্রিকা ঘাটাঘাটি করে বের করলাম।
“ক্লাস শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলো মেঘলা। সে গ্রিলে হেলান দিয়ে ছিলো। হঠাৎ গ্রিল ভেঙ্গে সে নিচে পড়ে যায়। জরুরী ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে, দায়িত্বরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।
চাক্ষুষ সাক্ষ্যমতে এটাকে সাধারণ দূর্ঘটনা হিসেবে মনে করা হলেও বিস্তারিত জানা যাবে ময়নাতদন্তের পরে যে আসলেই দূর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত মার্ডার।
পুলিশ ছ’তলা ভবনের গ্রিল গুলো খুঁতিয়ে দেখেছেন। সেগুলোর অবস্থা যথেষ্ট ভালো না। এরপরেও সেসব মেরামতের কোনো কাজ করা হয়নি কিংবা শিক্ষার্থীদের সচেতনও করা হয়নি। এটা রসায়ন বিভাগের নিরাপত্তা কমিটির গাফিলতিও বলা চলে।”
একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি সংযুক্ত করা আছে খবরের পাশে। বেশ পরিচিত মুখ। যার সঙ্গে সকালবেলা দেখা হয়েছে আমার। অথচ সে আজ পৃথিবীতেই নেই। জীবনযুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে তাকে। তার অব্যক্ত কথা গুলো সবাইকে জানানোর জন্যই বুঝি এসেছিলো সে আজ। জীবনের রূপ কত’টা বিচিত্র। কত বিচিত্রময় মানুষের জীবন।
গল্পঃ শেষদেখা
লেখকঃ রাজু আহাম্মেদ
(১ম প্রকাশ ১১ জুন, ২০১৮)
(সংশোধিত ও পরিমার্জিত প্রকাশ ২৪ জুন, ২০২৩)
Read more: মা – একটি দারুণ শিক্ষণীয় গল্প