বিয়াল্লিশ বছর বয়সে রীতিমতো বিব্রত অবস্থায় বসে আছি পাত্রী পক্ষের সামনে। আমার কানের দু’পাশে উঁকি দেয়া কাঁচা পাকা চুলে আজ মা যদিও কলপ লাগিয়ে দিয়েছেন বলে আরও বেশি বিব্রত লাগছে। আমার সামনে তিন জোড়া চোখ উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি যারপরনাই ঘামছি,মাথানিচু করে আছি।
বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে গিয়ে, ছোট ভাই বোনদের মানুষ করতে গিয়ে মেঘে মেঘে যখন বেলা বয়ে যাচ্ছিল, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু স্বার্থপরের মতো নিজের চাহিদার কথা জানান দিতে পারিনি। ছোট বোন তিনটার বিয়ে দিয়ে নিজে সংসার করবো ভেবে রেখেছি কিন্তু মায়ের আবদার ছোট ভাইটার যেন একটা গতি করে দেই। বিয়ে করে ফেললে পরের মেয়ের মন্ত্রণায় পড়ে যাব।
বাবা হারা মায়ের ছোট ছেলেটা জলে ভেসে যাবে। অবশেষে ভাইয়ের চাকরি হতেই শুনলাম সে গোপনে বছর খানেক আগেই বিয়ে করে ফেলেছে। মনে মনে হাসলাম। হায়! কী বিচিত্র পৃথিবী। সবাই নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছে নিজেদের। একমাত্র আমিই অগোছালো রয়ে গেলাম।
ততদিনে আমার চল্লিশ পার হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি মনে মনে, বিয়ে আর করবো না। কিন্তু এখন মা আমার জন্য পাত্রী খুঁজছেন। বহু ভাবে বুঝিয়েছি কিন্তু মা গোঁ ধরে বসে আছেন।
আজকে একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে আমাকে নিয়ে এসেছেন পাত্রীর বাড়ি। পাত্রী তেইশ বছর বয়সী। উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর তার আর পড়াশোনা হয়নি। বাবা কাপড় ব্যবসায়ী। পাত্রীর নাম সানজিদা আক্তার সাজু। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাই মধ্য প্রাচ্যে থাকে। সাজুর মা শয্যাশায়ী বহু বছর ধরে। বড় বোন জামাই সহ ওদের বাড়িতে থাকে। ওর দুলাভাই মসজিদের ইমামতি করেন।
বর্তমানে আমার সামনে বসে আছেন সাজুর বাবা আব্দুস সালাম, সাজু এবং সাজুর বড় বোন নাজু। আমার সাথে আমার মা এবং ঘটক। কনে দেখার এক ফাঁকে আমাদের একান্তে কথা বলার সুযোগ দিতে চাইলেন সাজুর বাবা। আমার মা একটু গাঁইগুঁই করলেও,যুগের চাহিদা হিসেবে মেনে নিলেন। নিজের অর্ধেক বয়সী এই মেয়ের সাথে কি কথা বলবো আমি ভেবে পাচ্ছি না।
সাজুদের বাড়িটা মফস্বলে। সেমিপাকা বাড়ির সামনে এক টুকরো উঠোন। উঠোনের বাম পাশে ছোট একটা বাগান। বাগানের সামনে দুটো চেয়ার পেতে দেয়া হলো।প্রথমে আমিই কথা বললাম।
- আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
- আপনার বয়স শুনেছি পঁয়ত্রিশ, এটা কি সত্যি?
- কে বলেছে? ঘটক??
- হ্যাঁ, তবে আপনার মা ও নাকি বাবাকে বলেছেন আপনার বয়স পঁয়ত্রিশ।
- আপনার কি মনে হয়?
- হবে হয়তো। আমি তো জানি না। আপনাকে দেখে মনে হয় বয়স আরও কম। আচ্ছা, আপনি এতোদিন বিয়ে করেননি কেন? আপনার ছোট ভাইবোনরা তো অনেক আগেই সংসার পেতেছে। নাকি পছন্দের কাউকে পাননি?
- পরিবার সামলাতে সামলাতে কখন এতো বয়স হলো টের পাইনি।
- আপনার পরিবার চেষ্টা করেনি?
আমি মৃদুহেসে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, - আপনার নাম তো সানজিদা?
- আমাকে সবাই সাজু ডাকে।
- সাজু আমি মিথ্যা বলতে পারি না। আমার বয়স বেয়াল্লিশ।
সে কিছুটা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কি বলছেন? - হ্যাঁ। এটা জানার পর আপনার আপত্তি থাকলে বলতে পারবেন।
-এটা পরিবারের বড়রা সিদ্ধান্ত নেবে, আমি আর কি বলব। একটা কথা জিজ্ঞেস করি? - জি,বলুন।
- আপনি ওভাবে ঘামছিলেন কেন? আপনি কি অসুস্থ?
- আসলে আমি একটু বিব্রত বোধ করছি। এর আগে আমি কখনো আনুষ্ঠানিক ভাবে পাত্রী দেখতে যাইনি। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে এবং একটু লজ্জাও। এই বয়সে পাত্রী দেখতে আসা বিব্রতকর।
সে মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। তার হাসিতে শিশুসুলভ সারল্য এখনো আছে। হঠাৎ করে মনে হলো, মেয়েটার সাথে বিয়ে হলে রোজ ভোরবেলা এমন হাসি দেখার সুযোগ হতো। আবার মনে হলো আমাদের মধ্যে বয়সের বিস্তর ব্যবধান। এই ব্যবধান আসলেই কি পেরুনো সম্ভব?
টুকটাক কথার পরে আমরা নেমে গেলাম। নেমে আসতেই মা জিজ্ঞেস করলো, মেয়ে কেমন দেখলাম। আমি বললাম আমার পছন্দ হয়েছে। বিদায় নেয়ার সময় সাজুর বাবা জানালেন তিনি তার ছেলের সাথে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। সাধারণত এসব কথা ছেলে পক্ষ থেকে বলা হয়। এইক্ষেত্রে আমি একটু দূর্বল প্রার্থী না হলে ঘাটতি একটা বয়স। বড় বাজারে আমার মুরগির দোকান আছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনমতে বিএ পাশ কিন্তু বয়স বেশি।
সপ্তাহ খানেক পরে ওরা জবাব দিলো,পাত্রের বয়স বেশি। তাই ওরা রাজি না। আমিও মা’কে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম আমি বিয়ে আর করবো না। এই বয়সে এসে লোকে সংসারে ব্যস্ত থাকে। আর আমি বিয়ের পাত্রী খুঁজছি। মা তারপরও অনেক পাত্রীর ছবি, বায়োডাটা দিল। কিন্তু ইচ্ছে হলো না।
একদিন খবর পেলাম সাজুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে । আমি কেন জানি না মাঝে মাঝে সাজুর খবর রাখতে চাইতাম। আমার জীবন আবার আগের মতোই চলতে লাগলো। কিন্তু মনোজগতে বিশাল একটা পরিবর্তন হলো। সারাদিন আমি কাজের ব্যস্ততায় কাটালেও, রাতে ঘরে ফিরলেই মনেহয় সাজু আমার পাশে আছে। এক কাল্পনিক আবেশে থাকি। এই টুকু সুখ নিয়ে আমি ভালোই আছি। মাঝে মাঝে ভাবি ভালোই হলো। আমার অর্ধেক বয়স পার করে এসে বিয়ে হলে এডজাস্ট করতেও সমস্যা হতো।
পাঁচ বছর পর সাজুর সাথে হঠাৎ দেখ শপিংমলে। আমি জুতা দেখছিলাম রুবাইয়ের জন্য। রুবাই আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে। রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে আমি ওকে আমি কুড়িয়ে পাই। পরে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ওকে দত্তক নিই। যেদিন রুবাইকে আনলাম, মা আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাল। তারপর বলল, আর কত যে পাগলামি করবি বুঝি না। তারপর বেশ কয়েকদিন আমার সাথে ঝগড়া করে ছোট ভাইয়ের সাথে চলে গেল। সেই থেকে মেয়েকে নিয়ে আমি একাই থাকি। মেয়েকে আমি ঘুম পাড়িয়ে রেখে দোকানে যাই,এক ঘন্টা পর পর এসে দেখে যাই। মাঝে মাঝে মাকে গিয়ে দেখে আসি। ভাই বোনেরা কেউ পারতপক্ষে আমার এখানে আসে না।
আমাকে দেখতে পেয়ে সাজু ডাক দিল।
-এই যে শুনছেন?
আমি ঘাড় ফিরিয়ে জবাব দিলাম, হ্যাঁ, শুনছি। বলুন।
- আমায় চিনতে পেরেছেন? আমি সানজিদা।
- জি, চিনতে পেরেছি। কেমন আছেন?
- এইতো বেশ। আপনার কি খবর?
- আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কি এখানেই থাকেন এখন?
- হ্যা্ঁ। আমি তো এখানে গত চার বছর ধরে । ফুফুর বাসায় থাকি। কেনাকাটা করতে এলেন বুঝি? কি কি কিনলেন?
- এইতো অল্প কিছু জিনিস।
- সবতো বাচ্চাদের জিনিস কিনলেন। আপনার কয়টা বাচ্চা?
- একটাই মেয়ে। আপনার হাসব্যান্ড কি করেন? বেবি আছে? কয়টা?
- আমার সন্তান নেই।
- ওহ! আচ্ছা।
- আচ্ছা আজ যাই। দেখা হয়ে ভালো লাগলো।
আমিও মৃদু হেসে চলে এলাম। সাজুকে দেখার পর থেকে বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে সাজুর স্বামীকে, সাজুর সাজানো সংসারকে। অথচ সাজুকে আজকের আগে শুধু একবার মাত্র দেখেছি। আমাদের মধ্যে কোন হৃদয়ঘটিত সম্পর্কও ছিল না। নাকি আমাকে করা রিজেকশন মানতে পারিনি?
আমার মন আমার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। চুপিচুপি সাজুর পিছু নিলাম। ওর ফুফুর বাড়ির ঠিকানা দেখে নিলাম। এরপর থেকে সময় করে প্রতিদিন একচক্কর দিয়ে আসি। নিজের কর্মকান্ডে আমি নিজেই বিরক্ত। টিনএজ ছেলেদের মত আচরণ করছি। অনর্থক সাজুর বাড়ির আশেপাশে ঘুরছি। নিজের এই সাতচল্লিশ বছর বয়সে এই প্রথম কোন কিছুই যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। তবে কি আমি প্রেমে পড়েছি?
একদিন এভাবে ঘুরাফিরার সময় সাজুর সাথে আবার দেখা হল। আমি তাকে দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, আরেহ্, আপনি এখানে? এদিকে বাসা বুঝি?
- শুধু শুধু অবাক হওয়ার ভান করে কি লাভ? আপনি তো প্রতিদিনই আসছেন। সেদিন আমার পিছু নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এসেছেন। ভেবেছি আপনি এদিকে কোথাও কাজে এসেছেন। কেন এমন করছেন?
কথাটা শুনেই আমি অধোবদনে চেয়ে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে বললাম, আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছি। আমার বয়সে এসে মানুষ এমন আচরণ সাধারণত করে না। - কি চান আপনি বলুন তো?
- আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। আগামী শুক্রবার কোথাও দেখা করি। কিন্তু কথা দিতে হবে এরপর আর কখনো এমন উদ্ভট কিছু করবেন না।
- কথা দিচ্ছি।
সেদিন সাজুর কাছে ওর নাম্বার চাইতে লজ্জা করছিল। কিন্তু নিজের নাম্বার ওকে দিয়ে এসেছি। তারপর শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। শুক্রবার সাজুর কল এলো। বিকেলে দেখা করতে বলেছে।
সেদিন সাজু এলো একটা কলা পাতা রঙের শাড়ি পরে। হালকা প্রসাধনে যেন অনন্যা লাগছে। আমি আর সাজু পাশাপাশি হাঁটছিলাম। আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল।\
হঠাৎ সাজু আমার হাতটা ধরতে চাইলো। সাজুর হাত ধরে আমি আরেকটু সাহসী হয়ে বললাম, সাজু, আপনার সাথে আমার বিয়েটা হোক আমি খুব চেয়েছিলাম মনে মনে। আপনাকে দেখার আর কাউকে দেখতে ইচ্ছে করেনি।
সাজু আমার হাত চেপে বসেই রইল।
সেদিনের পর থেকে সাজুর সাথে আমার প্রায় নিয়মিত দেখা হতে লাগলো। ফোনে কথা হতে লাগলো। সাজু তার স্বামীর সাথে সুখী নেই। ওর বাচ্চা হচ্ছে না বলে স্বামী অবহেলা করছে। সে তাই ফুফুর বাসায় চলে এসেছে।
সাজুকে নিয়ে যেখানেই যাই লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ মুখ টিপে হাসেও। তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমার বয়স বেশি বলে হয়তো হাসে।
আট নয় মাস যাওয়ার পর একদিন মাকে বললাম, মা আমি বিয়ে করতে চাই। আমার মেয়েটারও মায়ের দরকার।
মা খুশি হয়ে বলল, ঠিক আছে। তাহলে পাত্রী দেখি?
আমি মোবাইল বের করে মাকে আমার আর সাজুর একসাথে তোলা ছবি বের করে দেখিয়ে বললাম, আমি একে বিয়ে করবো। এর নাম সাজু। ওই যে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম?
মা মোবাইলটা হাতে নিয়ে একবার মোবাইলের দিকে তাকায়, একবার আমার দিকে তাকায়।
মায়ের তাকানো দেখে আমি বললাম, আরও ছবি আছে দেখো।
ছবি গুলো দেখতে দেখতে মায়ের চোখে মুখে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। তারপর হঠাৎ চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি পাড়ার মোড়ে পল্লী ডাক্তারে ডেকে আনলাম। ডাক্তার পরামর্শ দিল তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে ভর্তি করতে। মেয়েটাকে পাশের বাসার এক ভাবীর কাছে রেখে আমি ছুটলাম মাকে নিয়ে।
মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ভাই বোনদের খবর দিলাম। তিন বোনের মধ্যে বড়জন এবং মেঝো জন কিছুক্ষণের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। ওরা বারবার জানতে চাইছে হঠাৎ মায়ের কি হলো। আমি বিস্তারিত বলতেই ওরাও সাজুর ছবি দেখতে চাইল। আমি দেখাতেই মেঝো বোনের গলা ছিরে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো, কই? এখানে তো কোন মেয়ে নেই, তুমি তো একা সব ছবিতে।
একই কথা বড় বোনটিও বলতে লাগলো। অথচ কী অদ্ভুত আমি সাজুকে আমার পাশে দাঁড়ানো দেখতে পাচ্ছি।
আলেয়ার ঘরকন্না
-তাসনূভা ঝিনুক
Read more: মা – একটি দারুণ শিক্ষণীয় গল্প