মিলেমিশে থাকা – পারিবারিক ভালবাসার গল্প: আগে কখনোই সোহানাকে এতো যত্ন করে মায়ের চুল আঁচড়ে দিতে দেখিনি। আজকে দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ফয়সাল আমার হাতটি টেনে বললো…….
মূলগল্প
মায়ের নামে অভিযোগ শুনে তাড়াতাড়ি করে বাড়িতে আসলাম। ঘরে ঢুকতেই আমার স্ত্রী সোহানা কঠিন গলায় বললো,
- ভাগ্যিস টের পেয়েছিলাম, নয়তো তোমার মায়ের কারণে আজকেই সবাইকে মরতে হতো।
সোহানাকে শান্ত করার জন্য কোমল গলায় বললাম, - হঠাৎ করে মা কি করেছে?
সোহানা কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনি পাশের রুম থেকে মা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বললো,
- গোসল করার জন্য গ্যাসের চুলায় পানি বসিয়েছিলাম। গরম হতে দেরি হবে বলে রুমে ঢুকে বিছানায় একটু পিঠ লাগিয়েছি, সাথে সাথেই চোখে ঘুম চলে আসবে বুঝিনি।
মায়ের কথা শেষ হতেই সোহানা সাথে সাথে বললো,
- তোমার মা বুঝবে কি করে? গ্যাসের আগুন লেগে এখন যদি সবাই মারা যেতো তাহলেই বুঝতে পারতো। একটা মানুষের জ্ঞান এতো কম হয় কিভাবে? সঠিক জ্ঞান থাকলে চুলা লাগিয়ে কেউ বিছানায় যেতো না।
আমি সহজ গলায় বললাম, - যা হওয়ার হয়েছে, এবার থামো তো।
সোহানা কথা থামালো না। একটার পর একটা বলেই যাচ্ছে। মা নিজে ও প্রতিটা কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছে।
দু’জনের চেঁচামেচি শুনে ফয়সাল টিভির রুম থেকে দৌড়ে আসলো। ছেলেটা এবার দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠেছে। আজ শুক্রবার, স্কুল বন্ধ, তাই স্কুলে যায় নি। ফয়সাল একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে কি কথা বলছে বুঝার চেষ্টা করছে। দু’জনের এই ঝগড়া কখন শেষ হবে কারোই জানা নেই। আমি ফয়সালকে নিয়ে ছাঁদে চলে আসলাম।
ঘুম থেকে উঠে অফিসের যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করে ব্রাশ করলাম। মুখ ধুয়ে খাইতে বসবো ঠিক তখনি মা তরকারির বাটিতে পুরো এক জগ পানি ঢেলে দিলো। পানি ঢেলেই আমার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত গলায় বললো,
- তোর বৌ আজকে যে তরকারি রান্না করেছে, আজকে আর ভাত খেতে হবে না! তরকারিতে যে পারিমানে লবণ দিছে মুখে দিতেই মনে হয়েছে সাগরের লবণাক্ত পানি মুখে দিলাম। ঠিকভাবে একটু তরকারি ও রান্না করতে পারে না, মন থাকে কই?
সোহানা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচু গলায় বললো,
- প্রতিদিন তো এমনটা হয় না। আজকে ভুলে হয়তো এক বারের জায়গায় দুই বার লবণ দিয়ে ফেলেছি।
মা বললো, - দুই বার তো দিবেই, রান্না করার সময় মন থাকে অন্য জায়গায়। এখন তো লবণ দুই বার দেওয়া হয়েছে, কয়েক দিন পর চারবার দিলে ও মনে থাকবে না।
এবার সোহানা রেগে গেলো। রাগী গলায় বললো,
- তাই বলে আপনি তরকারির বাটিতে পানি ঢেলে দিবেন?
আমি ভাত না খেয়েই শার্ট গায়ে দিলাম। অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে, আজকে আর ভাত খেয়ে বের হওয়া যাবে না। সোহানা যখন রেগে যায় তখন ঝগড়া দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে।
অফিসে যাওয়ার আগে ফয়সালকে সাথে নিয়ে বের হতে হয়। যাওয়ার সময় ছেলেটাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাই। আজকে ছেলেটাকে সোহানা এখনো খাইয়ে দেয় নি। তাকিয়ে দেখি ফয়সাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া দেখছে। তাকে এখনি স্কুলে যেতে হবে, মনে হচ্ছে ছেলেটা এটা ভুলেই গেছে।
অফিস শেষ করে বাসায় ফিরলাম খুব রাত করে। রাত করে বাড়িতে ফিরে দেখি মা এবং সোহানা দু’জনেই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সোহানা বললো,
- আজকে এমনিতেই কিছুই খেয়ে যাও নি! তবু ও এতো দেরি করেছ কেন?
আমি শীতল গলায় বললাম,
- একটা নতুন বাসা ঠিক করে এসেছি, তাই দেরি হয়েছে। এক রুমের বাসা, এক রুমের নতুন বাসায় ফয়সালকে নিয়ে গতকালই উঠে যাবো। মা এবং তুমি এই দু’জনের কেউ সাথে যেতে হবে না। শুধু ছেলেটাকে সাথে নিয়ে যাবো, কারণ- ছেলেটাকে সঠিক শিক্ষা দেওয়াটা খুবই জরুরি।
সোহানা বিস্মিত গলায় বললো,
- এতো নামি দামী স্কুলে পড়াচ্ছি, এতো টাকা খরচ করছি। তবু ও সঠিক শিক্ষা নেওয়া হচ্ছে না?
আমি আত্মবিশ্বাসী গলায় বললাম,
- একটা ছেলে সঠিক শিক্ষা অর্জন করতে পারে তার পরিবার থেকে। পারিবার থেকে যে শিক্ষা অর্জন করতে পারে তা পৃথিবীর কোন স্কুল থেকেই অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের ছেলে ফয়সাল পরিবার থেকে কি শিখছে? ঝগড়া ছাড়া তো কিছুই শিখছে না। যে ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই ঝগড়া দেখে বড় হচ্ছে সেই ছেলেকে যতো নামি দামী স্কুলেই পড়াই না কেন, কোন কাজে আসবে না।
মা আমার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় বললো,
- আমাদের ছেড়ে ফয়সালকে নিয়ে দূরে চলে যাবি?
- মা তুমিই বলো, কেন যাবো না? সোহানাকে পুত্র বধূ নয় নিজের মেয়ে ভাবতে পারবে? যতোদিন ভাবতে না পারবে সামান্য ভুল হলে ও ভুলটা চুপ থেকে মানতে পারবে না। সোহানা তুমি ও শুনো, মাকে যতোদিন নিজের মা মনে করবে পারবে না, ঝামেলাটা ততোদিন চলতেই থাকবে। যদি নিজের মা ভাবতে না পারো তাহলে সামান্য ভুল হলে ও ছাড় দিয়ে কথা বলাটা শিখতে পারবে না।
মা সোহানার দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকালো। সোহানা দাঁড়িয়ে না থেকে মাথা নিচু করে রুমে চলে গেলো।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসলাম। এসে দেখি ছেলেটা পড়তে বসেছে। ঘরটি কেমন যেন নিস্তব্ধ, ঘরে কাউকে না দেখে ফয়সালকে সাথে নিয়ে ছাঁদে আসলাম। ছাঁদে আসতেই বিস্মিত হয়ে গেলাম। সকালের রোদের আলোয় সোহানা খুব যত্ন করে মায়ের চুল ঠিক করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে চুল থেকে উকুন বের করে মায়ের হাতে দিচ্ছে। মা অতি ব্যস্ততায় উকুন মারছে।
আগে কখনোই সোহানাকে এতো যত্ন করে মায়ের চুল আঁচড়ে দিতে দেখিনি। আজকে দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ফয়সাল আমার হাতটি টেনে বললো,
- বাবা শুনেছি আপনি আমাকে নিয়ে আজকে নতুন বাসায় উঠবেন?
আমি কোমল গলায় বললাম,
- না খোকা, এই বাসা ছেড়ে কোথা ও যাবো না। এই যে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে, আন্তরিকতার এমন সুন্দর দৃশ্য বারবার দেখার জন্যই পরিবারের সবাই একসাথে থাকতে চাই।
ফয়সাল চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
- বাবা আপনি কঠিন ভাষায় কি যে সব বলেন। মাঝে মাঝে কিছুই বুঝি না।
- বুঝতে হলে তোমাকে অনেক বড় হতে হবে।
ছেলেটা বুক উঁচু করে আত্মবিশ্বাসী গলায় বললো, - বাবা আমি বড় হতে চাই, খুব বড়।
ছেলেটার কথা শুনে হৃদয়টা আনন্দে ভরে গেলো। ছেলেদের এমন আত্মবিশ্বাস দেখলে পৃথিবীর সকল বাবার হৃদয়ে হয়তো ঠিক এরকমভাবে আনন্দময় অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হয়।
লেখক- মতিউর মিয়াজী
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “মিলেমিশে থাকা – পারিবারিক ভালবাসার গল্প”গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – মিথ্যা অপবাদ – Sad love story bangla