একজন সৎ পুলিশ অফিসার – দেশের জন্য ভালোবাসা

একজন সৎ পুলিশ অফিসার – দেশের জন্য ভালোবাসা: এতো ভালোবাসতেন পরিবারকে যা বুকে লালন করেছেন সারা জীবন। আর নিজের শ্রম বিলীয়ে দিয়েছেন দেশের জন্য।


মূলগল্প

সেদিন রাতে তারাতারি আমাদের পড়া শেষ করতে বলতেন আম্মু।
পড়া শেষ করে খেয়ে ঘুমিয়ে পরো তোমরা। আমাদের ড্রইং করার রং, সিগনেচার প্যান সব চেয়ে রেখে দিতেন আম্মু।
আমি বুজতাম আম্মু আজ আব্বুকে চিঠি লিখবেন।
চমৎকার আর্ট করতেন আম্মু।

চিঠি লিখার আগে চমৎকার ফুল এঁকে রঙ করে আমাকে দেখাতেন।
আমার পড়ার টেবিলে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় চিঠি লিখতেন।
আমি আম্মুর কান্নার ফিস ফিস শব্দে ঘুমানোর চেষ্টা করেও পারতাম না।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতাম ঘুমের ভান ধরে।

ল্যাম্পের আলোয় আম্মুর চোখের পানি চিকচিক করতো।
চোখ মুছতেন আর চিঠি লিখতেন তিন চার পৃষ্ঠা।
কষ্টে আমার বুক ভেঙে যেতো।
আব্বুর উপর ভিশন রাগ হতো আমার।

মা এর চোখের পানি কোন সন্তান সহ্য করতে পারে? এক চিঠি লিখতেই ভোর হতো আম্মুর।
কান্নায় ভেসে যাওয়া চিঠি লিখায় না জানি আম্মুর কত ভালোবাসা, মিস করা, অনুভুতি আবেগ, কষ্টের কথা লিখতেন।
পরের দিন আমরা ভাই বোন চিঠি লিখতাম।

যে লিখা শিখেনি সে একটা পৃষ্ঠায় কলমের আঁকি ঝাঁকি করিয়ে দিতেন তার হাত ধরে নিচে আম্মু লিখে দিতেন এই চিঠি অমুক লিখেছে।
আব্বুর কাছে চিঠি চলে যেতো যে পুলিশ আংকেলের হাতে আব্বু মাসের খরচ দিয়ে পাঠাতেন সেই আংকেলের মাধ্যমে। আর সবার জন্য একটা করে চিঠি।
আব্বুর কাছে লিখা চিঠি গুলো আমারো দুই তিন পৃষ্ঠা হতো।

আব্বুর চিঠি পড়তে গিয়ে মন খারাপ হতো খুব মাত্র এক পৃষ্ঠা থাকতো তাই।
চিঠির শেষে লিখতেন আব্বু আমাকে ক্ষমা করে দিও।

ছুটিতে যখন বাসায় আসতেন তখন আমাদের ঈদ মনে হতো।
আব্বু নতুন ড্রেস সবার জন্য আনতেন।

আম্মুর জন্য শাড়ী, থ্রীপিস কত কি, আমরা ভাই বোন কেউ স্কুলে যেতামনা নতুন ড্রেস পরে আব্বুর কাছে সারাক্ষণ থাকতাম।
এমন মনে হতো আব্বুকে সোনার খাচায় বন্দি করে রাখতে পারতাম যদি।
আব্বুর মুখ ছুঁয়ে দেখতাম।

পা গুলো, হাত গুলো ধরে নক গুলো পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখতাম, চিরুনি দিয়ে চুলগুলো পর্যন্ত আঁচরিয়ে দিতাম।
আব্বুর গায়ের গন্ধটা এতো অসাধারন লাগতো।

উনার সার্ট নাকের কাছে নিয়ে শুকতাম।
আব্বুকে জাপটে ধরে রাখতাম বুকের সাথে। পছন্দের খাবার, খেলনা সব জানতো আব্বু।
অবাক হতাম উনি কিভাবে বুঝেন আমি এগুলো পছন্দ করি?

আব্বু তাজা ফুল আনতেন সবসময়, আম্মুর খোঁপায় গুজে দিতেন।
কি যে সুন্দর লাগতো আম্মুকে!

আব্বু ছুটিতে যেদিন আসতেন সেদিন আমি বুজতে পারতাম কত দিনের ছুটিতে এসেছেন।
আব্বুর আড়ালে উনার কাপড়ের ব্যাগ চেক করতাম।

ব্যাগে দুইটা লুংগি আর দুই সেট কাপড়, জানতে চাইলে কখনো বলতেননা কত দিনের ছুটিতে এসেছেন।
খুব মন খারাপ হতো তাই আমার।
যেদিন চলে যাবেন ঠিক বুজতাম মন খারাপ থাকতো উনার।

এটা করবানা ওটা করবানা, এভাবে চলবা তোমাদের আম্মুকে দেখে রাখবা বুজতাম আব্বু আজ চলে যাবেন।
সবাই ঘুমিয়ে পরলেও চোখ বন্ধ করে পরে থাকতাম ঘুমের ভান ধরে আমি।

আম্মুর ফিস ফিস কান্নার শব্দ, শব্দ হীন কাঁদতেন অথচ কান্নার শব্দ আমার কানে বিস্ফোরিত হতো বোমার মতো।

চোখ ভিজে যেতো আমার।

দরজা খোলার শব্দ আব্বু আমার রুমে দাড়িয়ে এক ঝলক দেখে নিলো ঘুমের ভান ধরে পরে থাকা মেয়েটিকে।
চলে গেলেন দরজা খুলে আম্মু দরজার সামনে দাড়িয়ে কাঁদছেন।

আমি বিছানায় উল্টো ঘুড়ে বালিশে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছি।
এ এক অসহ্য যন্ত্রণার কান্না, শব্দহীন কান্না।

আব্বু কেনো যে এতো ছোট একটা কাপড়ের ব্যাগ আনে বুঝিনা। একটু বড় ব্যাগ হলে তো আরো কিছু কাপড় আটাতে পারতেন।
থাকতেন আমাদের কাছে আরো কয়েকদিন।

কবে যে অনেক বড় হবো একটা চাকরী করব সবার আগে আব্বুকে একটা বড় ব্যাগ কিনে দিবো।
আব্বু চাকরীর খাতিরে হঠাৎ বদলি হতেন তখন ৪/৫ মাস পর ছুটিতে আমাদের কাছে আসতেন।
৪/৫ মাসের অপূর্ণতা উনি ৩/৪ দিনের ছুটিতে এসে অলৌকিক ক্ষমতায় পরিপূর্ণ করে দিতেন।

মুহূর্তে মুহূর্তে মিস করা আব্বুর উপর মাঝে মাঝে ভিশন রাগ হতাম। মনে করতাম আব্বুকে মনে হয় আমরাই অনেক ভালোবাসি উনি আমাদের এতো বেশি ভালোবাসেননা।

সবসময় একই কথা আব্বুর ক্ষমা করে দিও।
আমার অনেক দায়িত্ব, অনেক ব্যস্ততা, অনেক কাজ।

নেত্রকোনা আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে ১৫ টাকা রিক্সা ভাড়া নেয় পুলিশ লাইন।
আব্বু ফোন দিয়ে বললেন আমাকে, জামাইকে নিয়ে চলে আসো। আজকে সারারাত আড্ডা দিব আমরা সবাই একসাথে।

আব্বুর চাকরি অবসর নিয়েছেন যেদিন সারাজীবনের জন্য।
আব্বুর মুখে ভাংগা হাসি ছিলো চাপা কষ্ট তবুও হাসছিলেন।

আমরা সারা রাত সেরাতে আড্ডা দিয়েছি।
আব্বু একটা বাক্স খুলতে বললেন, বাক্স খুলেছি।
বাক্স ভর্তি চিঠি সেই কত পুরানো।
এতো চিঠি বাক্স ভরে গেছে চিঠিতে।

আব্বু একটা চিঠিও ফেলেননি আমাদের।
আম্মুর লিখা চিঠি, আমাদের লিখা চিঠি কত আগের চিঠি কত যত্নে রেখেছেন।
এই রহস্যময়ী বাক্সে কি আছে সব সময় তালা থাকতো।
আজ সে বাক্স উন্মোচন শুধু ভালবাসা ছাড়া আর কিছুইনা।

এক বুক অনুভুতি মিস করেছেন আব্বু প্রতিটা মুহূর্তে।
পরিবারকে বুকে আগলে রেখে দেশকে নিজের একান্ত সময় বিলিয়ে দিয়েছেন চাকুরী জীবনে।

এতো ভালোবাসতেন পরিবারকে যা বুকে লালন করেছেন সারা জীবন।
আর নিজের শ্রম বিলীয়ে দিয়েছেন দেশের জন্য।
একজন সৎ পুলিশ অফিসার হয়ে।

লিখা – সৈয়দা কেয়া

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “একজন সৎ পুলিশ অফিসার – দেশের জন্য ভালোবাসা”গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ। )

আরো পড়ূন – কালো মেয়ে – সত্যিকারের ভালোবাসার গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *