পর্ব ১৭
অয়নের মায়ের সযত্নে তুলে রাখা কালো রংয়ের লাল পেড়ে একটা শাড়ি পড়লো রূপন্তী। ফর্সা গায়ে কালো রং দারুণ ফুটে উঠেছে। চুড়ির আলনা থেকে ধুলো ঝেড়ে এক গোছা কালো কাঁচের চুড়ি আর দুটো বালা পড়লো। নিজের ব্যাগের এক কোণায় টিপ রাখা আছে। সেখান থেকে টিপ বের করে একটা টিপ পড়লো কপালে। তারপর লম্বা চুল আচড়ে ছেড়ে দিয়ে বাইরে এলো।
অয়ন নিজের ঘরে বসে আছে। রূপন্তীর পায়ের শব্দ শুনে নড়েচড়ে বসলো। শাড়িতে রূপন্তীকে ভালো লাগবে এতটুকু ধারণা করেছিল কিন্তু কতটা ভালো লাগতে পারে অথবা কেমন লাগবে সেটা কল্পনাই করতে পারেনি অয়ন। যখন রূপন্তী দরজায় দাঁড়িয়ে বলল- আসবো?
অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ভেতরে আসো কথাটা বলতেও ভূলে গেলো। হা করে তাকিয়ে রইল রূপন্তীর দিকে। লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছে রূপন্তী।
ভেতরে ঢুকে খাটের পাশে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অয়ন বিছানায় শুয়ে ছিল। ও উঠে বসল আর রূপন্তীকে বলল ওর পাশে বসার জন্য।
রূপন্তী বিছানায় বসে বলল- আপনার বাবা যদি চলে আসেন?
- আসুক। অসুবিধা নেই।
- উনি মাইন্ড করবেন না তো আবার? যদি আবার খারাপ কিছু ভাবেন?
- আমার বাবা খারাপ কিছু ভাববেন না। বরং তুমি শাড়ি পড়ে আমার পাশে বসে আছো দেখলে আরো খুশি হবে। কারণ বাবা তোমাকে পুত্রবধূ হিসেবে চায়।
রূপন্তী আর কথা বাড়াল না। ওর লজ্জার বাইরেও একটা আলাদা ফিল হচ্ছে। মন কেমন উতলা হয়ে আছে। শাড়ি পড়লে স্বভাবতই মেয়েদের অন্যরকম লাগে। এটা অয়নের মায়ের শাড়ি আবার সেটা পড়েই অয়নের সামনে বসে আছে সেটা ভেবে ওর কেমন লাগলো।
অয়ন বললো- তোমাকে আজকে অনেক স্নিগ্ধ লাগছে। অবশ্য স্নিগ্ধর চেয়েও বেশি কিছু। এই সৌন্দর্যকে প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই রূপন্তী।
- কি যে বলেন না। থাক কিছু বলা লাগবে না।
- হাতে মায়ের বালা পড়েছ? তোমার চিকন হাতে বালা দুটো বেশ মানিয়েছে। রূপন্তী, তুমি যদি আমাকে বিয়ে নাও করো তবুও এই বালা দুটো নিয়ে যাও। তোমার হাতে এত সুন্দর মানিয়েছে যে আমার আর খুলে নিতে ইচ্ছে করছে না।
রূপন্তী অবাক হয়ে অয়নের দিকে তাকাল। বিস্ময় বেড়ে গেলো ওর। অয়ন এটা কি বললো!
অয়ন বললো- তুমি খুব লক্ষী একটা মেয়ে। - আমি একদম ই লক্ষী না। আমি অনেক রাগী, বদমেজাজি একটা মেয়ে।
- মোটেও না। আমি তোমাকে ভালোভাবে চিনি। তুমি প্রকৃত অর্থে অনেক লক্ষী মেয়ে।
- হয়েছে। আপনার দেখা হলো? আমি তাহলে রুমে যাই।
- তোমার কি বিরক্ত লাগছে?
- না। কেমন কেমন যেন লাগছে।
- শাড়ি খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে?
- ঠিক তাও না। আমার মনটা অস্থির অস্থির করছে।
- কেন বলোতো?
- জানিনা। সব প্রশ্নের উত্তর হয়না। হলেও সব উত্তরের কারণ হয়না।
ছুটে নিজের ঘরে এলো রূপন্তী। বের হবার সময় অয়নের বাবার সামনে পড়ে গেছিল। ওনার সামনে দাঁড়িয়ে আরো লজ্জা পেয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে এসেছে ও। তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে। একটা সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে, অচেনা মানুষদের সাথে একই ছাদের নিচে ঘুমাচ্ছে ও। বিন্দুমাত্র টেনশন কাজ করছে না বরং নিজেকে আরো নিরাপদ মনে হচ্ছে। তাছাড়া এ বাড়ির মানুষ দুটোকে কখনো অপরিচিত মনে হয়নি। যেন জন্ম জন্মান্তরের চেনা পরিচিত। আপনজনের থেকেও বেশি কিছু। সবাই তো এমন আপন হতে পারে না। মানুষ গুলো কেন হলো?
মনে মনে এসব ভেবে চলেছে রূপন্তী। পুরুষ মানুষদের প্রতি সবসময় অবিশ্বাস, ঘৃণা, বাজে ধারণা ছিলো। ছেলেদেরকে দেখলে মেজাজ গরম হয়ে যেতো ওর। সব পুরুষকেই মনে হত বেঈমান, খারাপ। অথচ এই দুটো দিন থাকার পর এ বাড়ির মানুষ গুলোর ব্যবহার, মন মানসিকতা সবকিছু এত সুন্দর লাগছে যে এতদিনের ধারণা ভেংগে যাচ্ছে ওর। সময় কত অদ্ভুত তাই না? ঠিক সময়মত ঠিক বিশ্বাস জাগিয়ে দেয়।
ঘুমিয়ে পড়লো রূপন্তী। পরেরদিন..
নেহার মামলার কারণে আদালতে এসেছে রূপন্তী, অয়ন ও তার বাবা। তিনজন সাক্ষী ছাড়া আর কোনো সাক্ষী নেই। সবচেয়ে বড় সাক্ষী নেহা নিজেই। ধর্ষিতা নিজ মুখে নৃসংস ধর্ষণের বর্ণনা দেয়ার পরও আর কারো সাক্ষী কিংবা উকিলের দরকার পড়ে না। অথচ এখানে ধর্ষকের পক্ষে একজন আইনজীবী দাঁড়িয়েছেন। সেটা দেখেই অবাক হয়ে গেছে সবাই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সেই আইনজীবী একজন মহিলা!
রূপন্তী পুরোপুরি হা হয়ে গেছে মহিলাকে দেখে। আদালতে কিভাবে সে ধর্ষকের হয়ে জবান দিচ্ছে দেখে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। ধর্ষিতা নিজমুখে বলার পরও সে আসামীকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য লড়ছে। এরচেয়ে অপমানের জাতির জন্য আর কি হতে পারে?
কিন্তু কোনো লাভ হলো না। নেহার জবানীতে পুরো আদালত কক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। রূপন্তী ও অয়ন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর প্রতিদিন যে পরিমাণ সেবা করেছে, সাপোর্ট দিয়েছে কোনোটাই বলতে বাদ দিলো না নেহা। একের পর অনেকগুলো গাড়ি রাস্তায় একটা রক্তাক্ত মেয়েকে পরে থাকতে দেখেও কেউ সাহায্য করেনি। পারলে সবাই ছবি তুলে নিয়ে গেছে। এ সমাজের কাছ থেকে এরচেয়ে আর কি আশা করা যায়? একদল শুধু ধর্ষণ করে যাবে, আরেকদল ধর্ষিতাকে নিয়ে ট্রল করবে, স্ট্যাটাস দেবে। আর যে ধর্ষিতা হলো, তার শেষ পরিণতি হলো মৃত্যু। সৌভাগ্যক্রমে নেহা বেঁচে গেছে। তাই নিজ মুখে সে শাস্তি দাবি করছে।
নেহা কাঁদতে কাঁদতে ধর্ষকের ফাঁসির দাবি জানিয়ে কাঠগড়ায় বসে পড়লো। বাকিটুকু জজ সাহেবের বিবেকের বিবেচনা। কিন্তু জজের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিয়েও লাভ নেই। কারণ এদেশে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। আগে তো সেটা বিধান করতে হবে।
ধর্ষকদেরকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলো। রূপন্তী মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। একটা মেয়ের সম্মান নষ্ট করার শাস্তি এই? ফাঁসি কার্যকর করার জন্য আবার আন্দোলনে নামতে হবে। নয়তো ধর্ষকদেরকে রাস্তাতেই খুন করে ফেলতে হবে। যে দেশে কোনো আইন নেই, সে দেশের থেকে কিছু আশা করা যায় না।
বাড়ি ফেরার আগে অয়ন রূপন্তীকে নিয়ে একজন মহিলা আইনজীবীর কাছে যাবে বলেছিলো। মহিলাকে ও আগে কখনো দেখে নি। বন্ধুর কাছে ঠিকানা নিয়ে ওনার চেম্বারে গেলো দেখা করার জন্য।
চেম্বারে ঢুকে অয়ন ও রূপন্তী দুজনেই স্তব্ধ। কারণ ওরা যে মহিলা আইনজীবীর কাছে এসেছে তিনি আর কেউ নন, নেহার বিপরীতে ধর্ষকের পক্ষে যিনি লড়েছেন সেই মহিলা।
একজন মহিলা হয়ে ধর্ষকের পক্ষে কথা বলা যায় সেটা অজানা ছিলো রূপন্তীর।
চেম্বারে ঢুকেই রাগে ওর মাথা গরম হয়ে গেলো। অয়ন ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলো তার নিজেরও খুব রাগ হচ্ছে। ধর্ষকের পিছনে আইনজীবী তো থাকবেই কারণ ধর্ষকের বাপ উকিলের পিছনে টাকা ভরে দিয়েছে। টাকায় দুনিয়ে চলছে। সেজন্য একজন মহিলা হয়েও আরেকজন মহিলার বিপক্ষে অন্যায়ের পক্ষে কথা বলবে। এ দেশে মেয়েদের বড় শত্রু হচ্ছে মেয়েরা।
রূপন্তীর ইচ্ছে করলো এই মহিলাকে কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু আইনের প্যাঁচে ফেলে আবার রূপন্তীকেই না জেলে ঢুকিয়ে দেয় সেটা ভেবে অয়ন ওকে টেনে বাইরে নিয়ে আসলো। আপাতত রূপন্তীকে কোনো ঝামেলায় জড়াতে দিতে চায় না ও। অয়ন চায় রূপন্তীকে ভালোবেসে নিজের কাছে আগলে রাখতে। কারণ যে সমাজ ভালো হবে না, সে সমাজে রূপন্তীকে টেনে আনার দরকার নেই। রূপন্তী ওর বুকেই শান্তিতে থাকুক।
শেষ পর্ব
রাগে, কষ্টে রূপন্তীর চোখে পানি এসে গেছে। যে সমাজে মেয়েদের পাশে মেয়েরা দাঁড়ায় না, সে সমাজের কাছে কিচ্ছু আশা করা বৃথা। অয়ন ওকে ধরে বাসায় নিয়ে আসলো।
রূপন্তীকে ওর রুমে রেখে বের হওয়ার সময় একবার ওর দিকে তাকাল অয়ন। চেহারায় বেদনা ভর করেছে। এজন্যই বোধহয় বলে, সব’চে সুন্দর নদীর নাম হচ্ছে বেদনা!
রূপন্তীর কোনো ভাবান্তর হলো না।
অয়ন বলল- মন খারাপ কোরো না। ধর্ষকের পক্ষে একজন মহিলাকে দেখে তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো সেটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কি করার আছে বলো? মেয়েরাই আজকাল মেয়েদের ভালো বুঝতে পারে না। মেয়েরা মেয়েদের শত্রু হয়ে গেছে। তবে আমি যেমন বর্ণবাদে বিশ্বাস করিনা, ঠিক তেমনি মেয়েদের জন্য মেয়েকেই লড়তে হবে এটাও বিশ্বাস করিনা। আইনের ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে বিভেদ নেই। সহজভাবে নাও বিষয়টাকে। তাছাড়া নারীদের পাশে শুধু নারী নয়, নারী পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ সর্বোপরি দেশের সবাইকে দাঁড়ানো দরকার।
রূপন্তীর তবুও কোনো ভাবান্তর নেই। নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়েই আছে দেয়ালের দিকে।
অয়ন বললো- তবে এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে এত আন্দোলনের পরেও ধর্ষকের শাস্তি ফাঁসি কার্যকর হলো না। আর কি করবো বলো? আমরা তো আন্দোলন কম করিনি। এখন সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার যেদিন জনসম্মুখে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার হুমকি দিবেন সেদিন থেকেই এটা কার্যকর হবে। বিধানে যদি শাস্তির নিয়ম না থাকে, পাবলিক তো নিজ হাতে খুন করে আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না তাই না? খুনের বিনিময়ে ফাঁসি জিনিসটাই যেখানে কার্যকর হয়না। একটা মেয়েকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার পরও তার আসামীর শাস্তি ফাঁসি হয়েছে? আইন যতক্ষণ কঠিন হবেনা ততক্ষণ আমাদেরকে এই অসহ্য যন্ত্রণা মেনে নিতেই হবে। নয়তো সমগ্র দেশের মানুষকে এক হয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হবে।
রূপন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অয়ন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলো না। মন খারাপ করে নিজের রুমে চলে এলো। রূপন্তীর বিশ্বাস অর্জনের জন্য ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে রেখেছে, সবসময় চেষ্টা করছে যেন ওর বিশ্বাসযোগ্য হওয়া যায়৷ আর কি করতে পারে ওর জন্য? কি করলে সহজভাবে মেয়েটা ওকে গ্রহণ করতে পারবে?
ভাবতে ভাবতে অয়ন গোসল সেরে নিলো। রান্না ঘর থেকে খাবার এনে নিজে টেবিলে সাজালো৷ জগ ভর্তি করে জল এনে রেখে রূপন্তীর রুমের দরজায় এসে বলল- জেগে আছো?
রূপন্তীর গলা শোনা গেলো – হ্যাঁ। ভেতরে আসবেন?
- না। তুমি লাঞ্চ করবে না? খাবার সাজিয়েছি।
- আপনি কেন এসব করতে গেলেন?
- আসো। তোমার কি মাথাব্যথা কিংবা জ্বর?
রূপন্তী বলল, আমার কিছু হয়নি। আমি স্বাভাবিক আছি।
হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে চলে এলো রূপন্তী। অয়ন চেয়ার টেনে বলল- বসো। ফ্যান চালিয়ে দেবো?
- লাগবে না।
- তোমার জ্বর টর আসেনি তো?
- আরে না না। আপনি বসুন তো। আংকেল আজকে আসবেন না খেতে?
- বাবার একটা জরুরি মিটিং আছে তাই আসতে পারবে না।
রূপন্তী খাবার মুখে দিলো। মুখের সামনের কাটা চুল গালের একপাশে এসে দোল খাচ্ছে। ঘুম জড়ানো রূপন্তীর চেহারা দেখতে লাজুক লতার মত লাগছে। অয়ন মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে রূপন্তীর যত্ন আত্মিতে কোনো কমতি না রাখার৷
রূপন্তী খেতে খেতে বললো- আমি বাসায় চলে যাবো৷
অয়ন চমকে উঠে বলল- যেতেই হবে?
রূপন্তী অয়নের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। অয়নের চোখ দেখেই ফিল করা যায় কিছু একটা। অয়ন যে ওকে ছাড়তে চাইছে না সেটা ভালোমতোই টের পাচ্ছে রূপন্তী। মনের উপর একটা প্রেশার অনুভূত হচ্ছে।
চুপচাপ খাবার খাচ্ছে রূপন্তী। অয়ন কথাবার্তা বলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো – তুমি কি কোনো চাকরি করতে চাও? কাজের মাঝে থাকলে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে তোমার কোনো মানসিক চাপ আসবে না।
রূপন্তী বলল- আইডিয়াটা ভালো কিন্তু চাকরি পাওয়াটা তো অনেক টাফ। কে দেবে আমাকে চাকরি?
- সেই চিন্তা কোরো না। আমি দেখি কিছু ম্যানেজ করা যায় কিনা। তুমি আরেকটু ভাত নাও।
অয়নের অতিথি পরায়ণ আচরণ দেখে রূপন্তীর মুগ্ধ হওয়ার পালা! ছেলেরাও এত ভালো হতে পারে সেটা ওর জানা ছিলো না। অয়নের আর ওর বাবার সাথে এই কয়েকটা দিন থাকার পর অনেক ধারণাই বদলে গেছে।খাওয়া শেষ করে রূপন্তী বসেই রইলো। অয়ন থালাবাসন রান্নাঘরে রেখে এসে রূপন্তীর পাশে বসল।
রূপন্তী বলল- দেখুন কোনো চাকরি ম্যানেজ করা যায় কিনা? আমার তাহলে আর শুয়ে বসে কাটাতে হবে না।
- আর পড়াশোনা? সেটাও চালিয়ে যেও।
- সেটা অবশ্যই চলবে।
- কোন বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিলে?
- যেখানে থাকতাম সেখানেই যাবো৷ অন্য কোথাও থাকার কথা আছে নাকি?
রূপন্তীর প্রশ্ন শুনে অয়ন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। নির্দ্বিধায় বললো- এই প্রশ্ন করলে তো থেকে যেতে বলবো। - এটা হয়না। অনেকদিন তো ছিলাম। একজন যুবতী মেয়ে এভাবে অন্যের বাসায় থাকতে পারে না৷ তাছাড়া আপনার ও বিয়ের বয়স হয়েছে। লোকজন নানান কথা বলবে।
অয়ন হেসে বললো- লোকজনের কথার ধার ধারি না আমি। তোমাকে তো প্রস্তাব দেয়াই হয়েছে। এতদিন থাকার পরেও তো এতটুকু আশ্বস্ত হওয়ার কথা। সত্যি করে বলোতো রূপন্তী, এখনো কি পুরুষদেরকে আগের মতই খারাপ মনেহচ্ছে?
রূপন্তী কোনো উত্তর দিলো না৷ অয়ন অন্যদিকে তাকিয়ে বললো- আজকে তো দেখলে। এদেশে মেয়েরাও মেয়েদের শত্রু। কেউ কারো ভালো চায় না। নারী পুরুষ উভয়ের মাঝেই ভালো খারাপ মিশে আছে। সেখানে শুধুমাত্র পুরুষ শ্রেণীকে ঘৃণা করে তুমি সারাজীবন কাটাতে পারো না।
রূপন্তী জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। অয়নের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।
অয়ন বললো- তোমার বাবা তোমার মাকে ঠকিয়ে একটা মেয়ের বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছে। তুমি শুধুমাত্র তোমার বাবাকে ঘৃণা করছো। তোমার বাবা বলে তুমি তাকে অপরাধী ভাবছ। তার কারণে পুরো পুরুষ সমাজকে তোমার প্রতারক মনেহয়? এভাবে পুরুষ বিদ্বেষের কারণ কি বলতে পারো? যে মেয়েটা তোমার বাবাকে বিয়ে করেছে অন্যায় তো তারও৷ সে জেনেশুনে বাবার বয়সী একজনকে বিয়ে করে তার পুরনো সংসার ভেংগে দিয়েছে। সেইসাথে তার ছেলে মেয়ের হক নষ্ট করেছে। তোমার উচিত পুরুষদের সাথে সাথে মেয়েদেরকেও ঘৃণা করা। বাবার সাথে যদি গোটা পুরুষ জাতিকে ঘৃণা করতে পারো তাহলে সেই মেয়ের জন্য পুরো নারী সমাজকে ঘৃণা করা উচিৎ।
রূপন্তী একেবারে নিস্তব্ধ। সত্যিই তো বিষয়টা যৌক্তিক। কিন্তু এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি ও। ও কেবল নিজের বাবাকে বেঈমান ভাবে৷ বাবার কারণে পুরো পুরুষ সমাজকে ওর কাছে খারাপ মনেহয়৷ তাহলে তো বাবা যাকে বিয়ে করেছে সেই মেয়ের কারণে পুরো মহিলা সমাজকেও খারাপ মনে হওয়ার কথা। কিন্তু রূপন্তী ভাবে মাত্র কয়েকটা মেয়ে খারাপ, বাকি সব মেয়ে ভালো। তাহলে পুরুষদের ক্ষেত্রেও এমন হতে পারে। কয়েকজন লোক খারাপ হতে পারে কিন্তু তাই বলে তো সবাই খারাপ হতে পারে না। অয়ন কিংবা তার বাবাকে কখনো খারাপ মনে হয়নি ওর।
মগজে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। রূপন্তী উত্তেজিত হয়ে উঠলো। এতদিনের একটা ধারণা আজকে ভূল প্রমানিত করে দিলো অয়ন। অয়ন অনেক ব্রিলিয়ান্ট সেই সাথে যুক্তিবাদীও। ও অনেক ভালো মনের একটা মানুষ। নিজে ভালো না হলে অন্যকে ভালো করে ভালোটা বোঝানো যায় না৷
রূপন্তী তবুও কোনো উত্তর করলো না। অয়ন বলল- আমাকে তোমার কেমন লাগে #রূপন্তী?
- কখনো ভাবিনি।
- কখনো না ভাবলে একবার মনকে জিজ্ঞেস করো। আমাকে ভালো না লাগলে অন্য কাউকে লাগবে৷ কিন্তু পুরুষদের উপর বিদ্বেষ নিয়ে নিজের লাইফটা শেষ করে দিও না।
- আমি ভালো আছি।
- প্রতিনিয়ত পুড়ে যাচ্ছো আর বলছো ভালো আছো? তোমার বাবা কি করেছে সেটা ভূলে যাও না। নিজের জীবন নতুন ভাবে শুরু করো৷ আগের জীবনে কোনো সুখ পাওনি, এ জীবনে তোমাকে সুখী হতে হবে।
রূপন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো- আর সুখ! আমার লাইফে আসবে না কখনো। - এটা সবাই ভাবে। কিন্তু এ ভাবনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে৷ নিজের প্রচেষ্টায় নিজেকে সুখী হতে হবে রূপন্তী৷ প্লিজ আমার কথাগুলো একবার ভেবে দেখো৷
- ওকে, আমাকে ভাবতে দিন। কিন্তু আমি আজকেই চলে যেতে চাই। আপনার বাবাকে তারাতাড়ি ফিরতে বলবেন। ওনার সাথে দেখা করে বিকেলেই চলে যেতে চাই।
- রূপন্তী…
- বলুন।
- আর জোর করবো না। বাকিটা তোমার ইচ্ছা। আমি আমার মত করে তোমাকে বুঝিয়েছি৷ সঠিক কথাটা জানানোর চেষ্টা করেছি৷ তুমি নিজেও যথেষ্ট বোঝো৷ আশাকরি বুঝতে পারবে।
রূপন্তী কিছু না বলে উঠে দাড়ালো৷ জামা কাপড় গোছানোর কথা বলে রুমে চলে গেলো।
অয়নের বাবাকে ফোন দিলে উনি রূপন্তীকে আজকের দিনটাও থেকে যেতে বললেন। কিন্তু রূপন্তীর মন মানসিকতা এতটাই খারাপ যে ও কিছুতেই থাকতে চাইছে না। বাধ্য হয়ে অয়নের বাবা বলে দিলেন তাহলে চলে যাও। আমি আগামীকাল তোমার সাথে দেখা করে আসবো৷ মাঝেমাঝে আমাদের বাসায় এসো।
রূপন্তী ব্যাগ গুছিয়ে বের হওয়ার জন্য রেডি হলো৷ অয়ন এসে বলল- গাড়ি তো বাবা নিয়ে গেছে। আমাদেরকে সিএনজি নিয়ে যেতে হবে।
- আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি একাই চলে যাবো।
অয়ন আর কথা বাড়াল না। রূপন্তী ব্যাগ হাতে নিয়ে ডাইনিংরুম পর্যন্ত এলো। অয়ন এসেছে দরজা খুলে বিদায় দেয়ার জন্য৷ দরজা খুলেছে এমন সময় #রূপন্তী থপ করে ব্যাগটা ফেলে দিলো৷ অয়ন অবাক হয়ে তাকালো রূপন্তীর দিকে। রূপন্তীর চোখে পানি।
অয়ন বলল- কি হয়েছে তোমার?
রূপন্তী চোখের পানি ফেলে বললো- আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো না৷
অয়নের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠার আগেই #রূপন্তী ঝাপিয়ে পড়লো অয়নের বুকে। ওকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে ফেললো।
রূপন্তীর চুলে হাত বোলাতে বোলাতে অয়ন বলল- যেতে হবেনা। আমরা আজকেই বিয়ে করে ফেলবো।
- আমাকে কখনো কষ্ট দেবেন না তো?
- এতদিন থাকার পর এই বুঝলে?
রূপন্তী অয়নকে আরো শক্ত করে চেপে ধরতে ধরতে বললো- বুঝে গেছি আপনি একাই আমাকে সুখে রাখার জন্য যথেষ্ট।
অয়নও ভালোবেসে বুকে আগলে রইলো রূপন্তীকে।
সমাপ্ত
- নীলাভ্র নেহাল