পর্ব ১৩
রুপন্তীর প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। চোখ মেলার মত অবস্থায় নেই ও। তবুও বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে। কেউ একজন শক্ত করে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। ওকে ধরে কাঁদার মত কেউ নেই এই শহরে।এই শহরে বললে ভুল হবে, এই জগতেও কেউ নেই ওর।তাহলে কে কাঁদছে এভাবে?
অয়ন রূপন্তীর মুখ ধরে বলল, রূপন্তী। চোখ মেলো, তোমার কিছু হয়নি। তুমি ভালো আছো রূপন্তী..
রূপন্তী হালকাভাবে চোখ মেলে অস্পষ্ট অয়নকে দেখে চমকে উঠলো। শরীরে শক্তি না থাকার পরও অবচেতন মনে অয়নকে জাপটে ধরে বলল, আমাকে ফেলে যাবেন না প্লিজ। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
অয়নের আত্মা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। নিজেকে শক্ত করে রূপন্তীকে কোলে তুলে নিয়ে এসে গাড়িতে তুললো। লোকজনকে বলল, আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। ও আমারই কাছের মানুষ। এটা নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। আপনারা কি একটা উপকার করতে পারবেন?
সবাই কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলেন, কি উপকার?
অয়ন পুলিশকে ফোন দিয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসতে বলল। তারপর দুজনকে গাড়ির পাশে দাড় করিয়ে আরো কয়েকজন লোককে নিয়ে গুদামের ভেতরে গিয়ে ঢুকলো। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে সবাইকে ফিসফিস করে বলল, আমি নিশ্চিত এখানে কোনো লুকানো দরজা আছে। হতে পারে সুড়ঙ্গ কিংবা মাটির নিচে কোনো ঘরও থাকতে পারে। আসুন আমার সাথে। কারো ভয় পেলে চলবে না। যেহেতু এই গুদামে আর কোনো দরজাই নেই, সেহেতু অন্য কোনো পথ নিশ্চয় ই আছে। আমাদেরকে সেইটাই খুঁজে বের করতে হবে।
দ্রুত ছোটাছুটি করে অয়ন সবখানে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোনো গোপন সুড়ঙ্গ পেলো না। গুদামের মাঝখানে কয়েকটা ধানের বস্তা রাখা। এগুলো সরিয়ে নিচে যাওয়ার রাস্তাও থাকতে পারে।
অনেক খোঁজার পর ব্যর্থ হয়ে অয়ন পুরো ব্যাপারটা পুলিশের উপর ছেড়ে দিতে চাইলো। যেহেতু রূপন্তীর কোনো ক্ষতি হয়নি, ওদেরকে ধরার জন্য এত তাড়াহুড়ো না করলেও চলবে। এই মুহুর্তে রূপন্তীর পাশে থাকাটা জরুরি।
অয়ন বাইরে চলে এলো। পুলিশকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বুঝিয়ে বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো ও। পুলিশ গুদামের ভেতরে ও বাইরে সবখানে খুঁজে দেখবে। বাকি দায়িত্ব পুলিশের। এখন রূপন্তীর সেবা করাটা অয়নের প্রধান দায়িত্ব। রূপন্তীর মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলো অয়ন। ওকে দেখে কি যে কষ্ট হচ্ছে কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না। মেয়েটাকে সত্যি অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলো অয়ন। পুরনো দগ্ধ হওয়া জায়গাটা আবার যেন জ্বলে উঠলো। ভালোবাসা কখনো মরেনা, কখনো কমে না। কিছুক্ষণের জন্য হয়তো বুকে লুকিয়ে থাকে। সুযোগ পেলে আবার লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
রূপন্তীকে সোজা বাসায় নিয়ে গেলো অয়ন। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই। তাছাড়া এই মুহুর্তে হাসপাতালে যেতে আরো রাত বেড়ে যাবে। বাসায় ফিরতেই অয়নের বাবা ছুটে আসলেন। মেয়েটার এ অবস্থা দেখে ওনারও বুকটা ধক করে উঠলো।
অয়ন একজন পরিচিত ডাক্তারকে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বললেন। ডাক্তার এসে পৌঁছানোর আগেই গামছা ভিজিয়ে রূপন্তীর গা মুছে দিলো অয়ন। গায়ের উপর একটা চাদর টেনে দিয়ে রূপন্তীর চুলে হাত বুলাতে লাগলো।
ডাক্তার মশাই এসে নাড়ি পরীক্ষা করলেন, প্রেশার পরীক্ষা করে দেখলেন। রূপন্তীকে এখন কিছু খাইয়ে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। অয়ন অনেক চেষ্টা করে সামান্য একটু খাবার খাওয়াতে পারলো। ডাক্তার ওর হাতে একটা স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আর বলে গেলেন কোনোভাবেই যেন মানসিকভাবে প্রেশার দেয়া না হয়।
অয়ন মনেপ্রাণে চেষ্টা করছিলো নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে রূপন্তীর সেবা করার। অয়নের বাবা নিজেও অবাক হয়ে গেলেন রূপন্তীর প্রতি অয়নের ভালোবাসা ও কেয়ারনেস দেখে। অয়ন যে রূপন্তীকে ভালোবাসতো সেটা উনি জানতেন। কিন্তু এতটা ভালোবাসতেন সেটা ওনার অজানা ছিলো। মেয়েটা সুস্থ হলে অয়নকে যেন তুচ্ছ না করে। এই মেয়েকে পেলে অনেক খুশি হবে অয়ন।
সারারাত জেগে #রূপন্তীর পাশে বসে রইল অয়ন। রূপন্তীর জ্বর এসে গেছে। অয়ন পাশে বসে থেকে ওর কপালে জলপটি দিয়ে দিচ্ছিলো। সেবা যত্নের কোনো কমতি রাখলো না। রূপন্তী জ্বরের ঘোরেই টের পাচ্ছিলো অয়ন কিভাবে ওর যত্ন নিচ্ছে। বুকটা ফাটলেও অনুভূতিরা কেমন মরে গেছে যেন।
এমন সময় পুলিশের নাম্বার থেকে ফোন। ওনারা জানালেন অয়নের ধারণাই সত্যি। গুদামের নিচে আরেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড ঘর আছে। সে ঘরেও মালপত্র রাখা হয়। কিন্তু ওটার দরজাটা ঢাকা পড়ে আছে এ জন্য সহজে বোঝা যায়না। পুলিশ তন্নতন্ন করে ঠিকই খুঁজে বের করেছে। এই প্রথম পুলিশের কাজে খুশি হলো অয়ন ওনারা পরেরদিন অয়নকে থানায় গিয়ে জিডি করতে বলে দিলেন।সকালবেলা সূর্যের আলো ফুটে গেলো। তবুও রূপন্তীর ঘুম ভাংছে না। অয়ন ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে মাত্র। সাথে সাথেই ঘুমে চোখ বুজে এলো। খানিক বাদেই আবার হুরমুর করে উঠে পড়লো ঘুম থেকে। রূপন্তীর যদি ঘুম ভেংগে যায়! পাশে কাউকে না পেলে কষ্ট পাবে ও।
ছুটে রুমে চলে এলো অয়ন। রূপন্তী এখনও ঘুমাচ্ছে। স্যালাইন দেয়ার ফলে শরীরটা আশাকরি ভালো হয়ে যাবে।
অয়ন নিজের হাতে হালুয়া বানালো রূপন্তীর জন্য৷ বাবাকে বলল বাজার থেকে ফল কিনে আনতে। তারপর রূপন্তীর বিছানার পাশে চেয়ারে গিয়ে বসলো।
রূপন্তী চোখ মেললো কিছুক্ষণ পরে। রীতিমতো কেঁপে কেঁপে উঠছে ও। অয়ন ভয়ে ভয়ে রূপন্তীকে ধরতে যাওয়া মাত্র রূপন্তী নিজেই অয়নকে জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো৷ তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল- আমাকে ওরা মেরে ফেলতো! মেরে ফেলতো।
অয়ন রূপন্তীকে ধরে বলল- আর ভয় নেই। আমি আছি তো।
‘আমি আছি তো’ কথাটা সবাই বলতে পারে না। সেটা অয়ন বলতে পেরেছে দেখে রূপন্তীর অবাক লাগার কথা। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর সেরকম অনুভূতি নেই। ও বলল, পুরুষ জাতি এত খারাপ কেন?
- পুরো জাতিকে খারাপ বলতে পারো না। নয়তো তোমাকে বাসায় এনে আমি সেবার বদলে ক্ষতি করতে পারতাম।
- মেয়েরা আসলেই অসহায়।
- মেয়েরা অসহায় নয়। প্রিয় মানুষটার সাথে চলাফেরা করলে এত সমস্যায় পড়তে হতো না। আমি আছি সবসময়।
- ঘরে এসে রেপ করে যায় না?
- ঘরে এসে তোমাকে টাচ করার আগে আমাকে খুন করে তারপর এগোতে হবে। আমি তোমার সর্বোচ্চ সিকিউরিটি। সেসব থাক, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও। এখন কেমন লাগছে।
- মনের উপর একটা চাপ অনুভব করছি। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
- একটা জীবনের মূল্য অনেক। রূপন্তী। সুখের মুহুর্তে সেটা অনুভব করবে। আর সেই মুহুর্ত টুকু আমি এনে দিতে চেয়েছিলাম। বাদ দাও, ওঠো ফ্রেশ হয়ে নেবে।
রূপন্তী ওঠার চেষ্টা করলো। অয়ন বেশ বুঝতে পারলো ওর শরীরটা দূর্বল এখনও। অয়ন বলল, আমার হাত ধরবে?
রূপন্তী কিছু বলল না। নেহার অসুস্থতার সময়ে অয়ন কিভাবে ওকে সাপোর্ট দিয়েছে রূপন্তী জানে সবটা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে নেহার অবস্থার মত একই অবস্থায় আজকে রূপন্তী!
রূপন্তীর হাত ধরে ওকে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো অয়ন। ও ফ্রেশ হয়ে বের হওয়ার সময় আবার ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। ফ্রুটস দিয়ে জুস বানিয়ে ওকে খেতে দিলো। হালুয়া দিয়ে নাস্তা করালো। খাওয়া শেষ হলে আবার ওষুধ খেয়ে ওকে রেস্ট নিতে বলল।
পাশের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে অয়ন বলল- এখানে তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কোনো টেনশন কোরো না। যতদিন সুস্থ হওনি, এখানে থাকবে। চাইলে সারাজীবন ও থাকতে পারো। তা এখন তুমি কোথায় আছো?
রূপন্তী কোনো উত্তর না দিয়ে বলল- আপনি কিভাবে টের পেলেন আমি ওই গুদামের ভেতর? নাকি পুরোটাই আপনার সাজানো নাটক ছিলো?
পুরোপুরি হা হয়ে গেলো অয়ন। সারারাত এভাবে পাশে বসে থাকার পর, যার জন্য এত চোখের জল ঝড়লো- সেই বলছে সাজানো নাটক ছিলো কিনা! হায়রে দুনিয়া!
পর্ব ১৪
রূপন্তীর কথা শুনে অয়নের এখন মুখে কথা ফুটছে না। যে মেয়েটার জন্য এতকিছু করলো আজকে দিনশেষে সেই বললো সাজানো নাটক ছিলো কিনা!
অয়ন বাঁকা ঠোঁটে হেসে বললো, কালকে থানায় জিডি করবো। আমার সাথে যেও। আর মামলার চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত দেখো কি হয়। তারপর এই কথা বইলো।
রূপন্তী আর কোনো কথা বলল না। কিংবা বলার মত বাকি কিছুই নেই।
অয়ন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো- আমি পাশের রুমে যাচ্ছি। সারারাত ঘুম হয়নি। তুমি শুয়ে রেস্ট করো।
- সারারাত ঘুমাননি কেন? কে বলেছিল আমার পাশে বসে থাকতে?
- এতটাও মনুষ্যত্বহীন নই আমি।
- বেশ ভালো। আমাকে এখন একা থাকতে দিন।
অয়ন পাশের রুমে চলে এলো। রূপন্তী ভয়াবহ বিপদে পড়ার পরও রাগ,তেজ এখনো আগের মতই আছে। অদ্ভুত মেয়ে বাবাহ!
রূপন্তী একাই বসে রইলো অনেক্ষণ। অয়নের বাবা রুমের দরজায় এসে বললেন – মা ভেতরে আসবো?
রূপন্তী দরজার দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে ওনাকে ভেতরে আসতে বললেন। তিনি ভেতরে এসে বসতে বসতে বললেন – এখন কেমন লাগছে?
- ভালো। আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো আমি।
- থাক না। বাবার কাছে ছেলেমেয়ের কৃতজ্ঞতার কিছু নেই। তবে যা করেছে অয়ন করেছে।
রূপন্তী কোনো কথা বললো না। বাবা আবারো বললেন – অয়ন সারারাত এখানে বসে ছিল। তোমার মাথায় জলপটি দিয়েছে। সারারাত জেগে আল্লাহকে স্মরণ করেছে। স্যালাইন চলছিল কিনা বারবার চেক করেছে। ওকে যদি খারাপ ভেবে থাকো সেই ধারণা ভুল তোমার মা।
রূপন্তী বলল- আরে না না। আমি ওনাকে খারাপ ভাব্বো কেন? উনি অনেক ভালো একজন মানুষ।
- তাহলে তুমি ওকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিলে কেন বলো?
- কষ্ট দিলাম কবে? আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আংকেল।
- এখনো কি পারছো না?
কথার জবাব দিলো না রূপন্তী। বাবা বললেন – দেখো অয়ন কিন্তু তোমার দিকে খারাপ ইংগিতেও কখনো তাকাবে না। ও যথেষ্ট ভালো আর নম্র একটা ছেলে। আমার ছেলেকে আমি চিনি মা। তুমি ওকে কেমন ভাবো জানিনা। কিন্তু ওকে আমি আমার মত করে মানুষ করেছি। অয়নের মা নেই, কিন্তু মায়ের অভাব ওকে বুঝতে দেইনি কখনো।
- আংকেল, আমি ওকে কখনো খারাপ ভাবিনি। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।
- মা রে, অয়ন তোমাকে নিজের হেফাজতে রাখতে চায়। তোমাকে ভালোবেসে নিজেও সুখী হতে চায়। এর বেশি ওর আর কিছু চাওয়ার নেই রে মা।
রূপন্তী কিছু বললো না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। অয়ন সত্যিই মানুষ হিসেবে অনেক ভালো সেটা #রূপন্তী নিজেও জানে। কিন্তু ভালোবাসাটা ওর ঠিক আসে না। সেটা কারো জন্যই আসেনা। কেন যেন পুরুষ মানুষদেরকে ওর ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে। অয়ন হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে নাস্তা করতে এলো। রূপন্তীকে এখন অনেকটা ফুরফুরে দেখাচ্ছে। টেবিলে বসে খাবার রেডি করছিলো ও। দেখে মনেহচ্ছে অয়নের বিয়ে করা স্ত্রী। নিজের বাড়ির মত আপনমনে সমস্ত কাজ করে যাচ্ছে।
অয়ন খুশি হয়ে বললো- ধন্যবাদ মহারানী। শরীর ভালো লাগছে? - হ্যা লাগছে।
- খেয়েদেয়ে ওষুধ খাবেন। বুঝেছেন?
- হ্যাঁ। আমাকে বাসায় যেতে হবে।
- কিসের বাসা? এখানে থাকতে বলেছি না? বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। আগে সুস্থ হও
- আমার এখন অনেক ভালো লাগছে।
- না, এত বড় ধকল চলে গেলে। আগে সুস্থ হও তারপর বাসায় যেও। তুমি এখন কোথায় থাকো? বাসা চেঞ্জ করেছো?
- না।
- কেন?
- বাড়িওয়ালাকে বুঝিয়ে বলেছি। উনি থাকার পারমিশন দিয়েছেন। তাছাড়া এই সময়ে অন্যকোথাও বাড়ি পাওয়ার ও কথা না।
- তা ঠিক। ভালো করেছো। খাবার কি বুয়া রান্না করেছে? ওর হাতের রান্না তো এমন না।
রূপন্তী বললো- আজকে বুয়া সবকিছু রেডি করে দিয়েছে আর আমি রেঁধেছি।
অয়ন চোখ বড়বড় করে বললো- সিরিয়াসলি? আমি তোমার হাতের রান্না খাচ্ছি? ও মাই গড!
রূপন্তী হতভম্ব হয়ে জানতে চাইলো- রান্না ভালো হয়নি? - ওহ অসাধারণ রান্না হয়েছে ম্যাম। একবার খেলে জিভে হাজারবছর লেগে থাকবে।
- আমিতো ভেবেছিলাম রান্নার পার্থক্য ধরতেই পারবেন না।
- কি যে বলো। এত সুন্দর রান্না! আর বলে কি না।
খুব আয়েশ করে খাবার খাচ্ছে অয়ন। রূপন্তীর চোখ চলে যাচ্ছে ওর দিকে। দেখতে ভালোই লাগছে। রূপন্তী নিজেও খাবার মুখে দিতে আরম্ভ করলো।
খাওয়া শেষ করে অয়ন বললো- আজকে তো পুরা এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলছি। প্রতিদিন তুমিই রান্না কোরো কেমন? - আমি কেন রান্না করবো? আমি তো চলে যাবো।
অয়ন রূপন্তীর কাছে এসে বলল- আমাদের যোগাযোগ বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। পরিস্থিতি আমাদেরকে কাছে টেনে এনেছে। সময় তোমাকে আমার বাড়িতে এনে হাজির করেছে। এটাকে তুমি অস্বীকার কোরো না। অন্যায় হয়ে যাবে রূপন্তী।
রূপন্তী আর কোনো কথা বলল না। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। অয়ন রুম থেকে বের হয়ে ওর নিজের রুমে গেলো। রূপন্তীকে এখন এই কথাগুলো উপলব্ধি করতে হবে।
বিকেলে রূপন্তীকে নিয়ে থানায় চলে এলো অয়ন। পুরো ঘটনার বিবৃতি দিয়ে জিডি করে ফেলল। রূপন্তী কথাগুলো বলতে বলতে ভয়ে কাঁপছিল। অয়ন হাত ধরে রাখলো ওর।
রূপন্তীকে একটা ছোট বাচ্চা এসে হাত ধরে গলিতে টেনে নিয়ে গেছে। সেখান থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে গুদামের কাছে নিয়ে এসে মুখ চেপে ধরে গুদামে ঢুকিয়েছে ওকে। তখন দুপুরবেলা হওয়ায় দোকানপাট সব বন্ধ ছিল। মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে রাত পর্যন্ত। তারপর রাতে এই আক্রমণ। রূপন্তী কিছুতেই বুঝতে পারেনি কারা এরা? কেন ওকে কিডন্যাপড করে রেপ করার চেষ্টা করেছে?
থানার কাজ তারাতাড়ি শেষ করে রূপন্তীকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বের হল অয়ন। রূপন্তী নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল। অয়ন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়ি কোথাও না থামিয়ে ওকে বাসায় নিয়ে এসেছে।
তারপর গাড়ি থেকে নেমে বলল- বেশি বাড়াবাড়ি করবা না। তোমার এখন সময় খারাপ যাচ্ছে। এই বাড়িতেই থাকবে তুমি। বাকিটা পরে দেখা যাবে।
রূপন্তী অয়নের কথা শুনে কি বলবে বুঝতে পারল না। তবে নির্জন ও শান্ত এই বাড়িটা ওর অনেক ভালো লেগেছে। মোটকথা অয়ন ওর বাবা আর কাজের মেয়েকেও পছন্দ হয়েছে রূপন্তীর। অয়ন নিজের রুমে চলে গেলে ধীরেধীরে গাড়ি থেকে নেমে রুমে এলো রূপন্তী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নানান কথা ভাবতে লাগলো।
পর্ব ১৫
আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চেহারা দেখছিলো রূপন্তী। অয়ন দরজায় এসে দাঁড়ালো। রূপন্তীর চেহারা হাসিমুখ দেখে বিস্মিত হলো ও। মেয়েরা আয়নায় নিজেকে দেখে এতটা খুশি হয় সেটা অয়ন জানত না। রূপন্তীর মাঝে আলাদা একটা বিস্ময় লুকিয়ে থাকে। খুব ভালো লাগে অয়নের।
রূপন্তী কি ভাবছে সেটা জানার জন্য খুব কৌতুহল জাগছে অয়নের মনে। কি ভাবতে পারে সেটা অনুমান করতে করতেই রূপন্তী পিছন ফিরে অয়ন কে দেখে ফেললো। অয়ন বললো, সরি।
- সরি কেন?
- তুমি আবার আমাকে ভুল ভাবো কিনা সেজন্য। আমি একটা কথা বলার জন্য এসেছিলাম। তুমি ব্যস্ত বলে আর বিরক্ত করিনি।
- কি কথা বলুন?
- নেহার সাথে একবার দেখা করতে যেতে হবে। বিস্তারিত কথা বলে কোর্টে সাক্ষী দেয়ার ব্যাপারে আলাপ করতে হবে। আজকে তো আর যাওয়া হবে না। কালকে যাই চলো?
- শিওর। আমি কি সাক্ষী দেবো?
- তোমাকে এতটুকু বলতে হবে যে তুমি ওকে রাস্তায় কি অবস্থায় দেখেছিলে। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, চিকিৎসা, আন্দোলন এ সব।
- ওকে। আসামীরা সবাই কি ধরা পড়েছে?
- হ্যা। পরশু একটা শুনানি আছে। তোমাকে কঠিন হয়ে সাক্ষী দিতে হবে। সেইসাথে বলতে হবে গতকাল তুমি নিজে কোন পরিস্থিতিতে পড়েছিলে। যদি ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি কার্যকর করা হয় তাহলে কেউ আর ধর্ষণের সাহস পাবে না। বুঝেছো?
- হুম ঠিক বলেছেন। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
- রেস্ট নাও। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে নক দিও। আমি আমার রুমে আছি।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অয়ন আবার জিজ্ঞেস করল- একা একা থাকতে তোমার খারাপ লাগবে না? - যদি বলি লাগবে তাহলে কি আপনি পাশে বসে থাকবেন?
- চেষ্টা করতাম খারাপ না লাগানোর।
- ওকে। বলার জন্য থ্যাংকস। আমার একা থাকতেই বেশি ভালো লাগে।
অয়ন কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে এলো। রূপন্তী বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমে ঢলে পড়লো।
রাতে খাওয়াদাওয়া করার পর অয়নের বাবা রূপন্তীর সাথে দু চারটা কথা বলে রুমে চলে গেলে অয়ন চেষ্টা করলো রূপন্তীকে বিনোদন দেয়ার জন্য। ও টিভিতে বিনোদনধর্মী ভিডিও ছেড়ে দিয়ে রূপন্তীকে দেখতে বলল। ফানি ভিডিও গুলো দেখতে দেখতে রূপন্তী হা হা করে হাসছিল। বহুদিন পর মন খুলে হাসছে। হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। অয়ন ওর হাসি দেখে বেজায় খুশি। যাক, অবশেষে হাসাতে তো পেরেছে। এটাই বা কম কিসে?
এক পর্যায়ে রূপন্তী বলল- আমার পেট ব্যথা করছে। আপনি ভিডিও থামান।
অয়ন চিন্তিত মুখে বলল- পেট ব্যথা কেন করছে?
- হাসতে হাসতে।
- ও তাই বলো। আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভিডিও বন্ধ করে দেবো?
- হ্যা দিন। আমরা কথা বলি?
অয়ন ভিডিও বন্ধ করে দিয়ে এসে রূপন্তীর পাশে বসলো। ভার্সিটি লাইফ, বন্ধুবান্ধব এসব নিয়ে আড্ডা দিতে দিতে রাত বেড়ে গেলো। রূপন্তী চোখ কচলে বলল- আমার ঘুম আসছে। - তাহলে রুমে যাও। দরজা আটকিয়ে দিয়ে ঘুমাও।
- ওকে। আপনি ঘুমাবেন কখন?
- একটু পরেই।
রূপন্তী উঠতে গিয়ে পরে যাচ্ছিল। অয়ন হাত ধরে বলল- শরীর কি দূর্বল এখনো?
- না না ঠিক আছি। কোনো সমস্যা নেই।
হাত ধরে রূপন্তীকে রুমে রেখে দরজা আটকে দিতে বলল অয়ন। হাসিমুখে বলল- রাতে ঘুম না এলে আমাকে ডেকো। প্রয়োজনে ফোন দিও। - আমার ঘুম না এলে আপনি কি করবেন?
- কথা বলবো। এখনো কি আমাকে বিশ্বাস হয় না?
- হয়।
- এটুকুই এনাফ। গুড নাইত রেড এঙ্গেল।
রূপন্তী দরজা লাগিয়ে দিলে অয়ন ঘুমাতে গেলো। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকার পরও ঘুম আসতে চাইলো না। বিছানার উপর বসে চিন্তা করল খানিকক্ষণ। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে রূপন্তী আরামে গভীর ঘুমে মগ্ন। এত সুন্দর ঘুম কখনো হয়নি ওর।সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা রেডি করলো রূপন্তী। রুটির সাথে ভাজি ও চা। কমরে ওড়না বেধে কাজের মেয়ের সাথে কথা বলে কাজ করতে করতে ওর নিজেকে এ বাড়ির গিন্নী মনে হচ্ছিলো। সব রেডি করে রেখে অয়নের বাবাকে নাস্তা খেতে ডাকলো। অয়নের রুমে এসে দেখে দরজা খোলা।
ভেতরে ঢুকে বিছানার ধারে এলো রূপন্তী। অয়নের মুখের দিকে তাকানো মাত্র মায়া কাজ করতে আরম্ভ করলো। নিষ্পাপ একটা মুখ! চাপ দাড়ি গুলো বড় হয়ে গেছে। দেখলেই মায়া ভর করে। কথা না বলে চোখ বড়বড় করে অয়নের দিকে তাকিয়ে রইল ও।
বিছানার কাছে এসে ডাকল- এইযে শুনছেন? অয়ন সাহেব।
প্রথম ডাকে অয়নের ঘুম ভাংলো না। দ্বিতীয়বার ডাক শুনে দ্রুত চোখ মেলে অয়ন বললো- বলো।
- নাস্তা রেডি করেছি। খাবেন না?
- তুমি কেন কষ্ট করে নাস্তা বানাতে গেলে?
- আমার ভালো লাগে। তাই। এখন আপনি আসবেন নাকি এক বালতি পানি ঢেলে দেবো বলেন তো?
অয়ন মুচকি হেসে বলল- গায়ে জোর আছে? এক বালতি পানি আনতে পারবা তো? - ফাজলামি করছেন? ওঠেন ওঠেন। বেলা হয়ে গেছে। আমরা আবার নেহাদের বাসায় যাবো।
রূপন্তীর তাড়া দেখে অয়নের মনেহচ্ছে সদ্য বিয়ে করা বউ। কত কাজ করছে। আবার ঘুম ভাঙাতে এসেছে। পাগলী একটা।
নাস্তা খেতে খেতে নেহার বিষয়টি নিয়ে কথা হলো। নাস্তা শেষ করার পর দুজনে নেহাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। পথে যেতে যেতে রূপন্তীকে যতটুকু মোটিভ করা যায় করে গেলো অয়ন। এবার কিছু একটা করতেই হবে। নয়তো আবারও শুরু করতে হবে আন্দোলন।
এতদিন পর রূপন্তীকে দেখে নেহা আনন্দে লাফানো শুরু করল। রূপন্তী ওকে জড়িয়ে ধরে বলল- কেমন আছিস বোন?
- ভালো। তুমি?
রূপন্তী যখন গত পরশু ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার বর্ণনা দিলো তখন ভয়ে শিউরে উঠে ওকে জাপটে ধরে রাখলো নেহা। একই ঘটনা রূপন্তীর সাথেও ঘটতে যাচ্ছিল। এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায়না। প্রয়োজনে রাজপথে নামতে হবে। তবুও একটা ফলাফল এবার চাই ই। আন্দোলন ছাড়া ভাষাও অর্জিত হয়নি, স্বাধীনতাও অর্জিত হয়নি। আন্দোলন ছাড়া এটাও সফল হবে না। ধর্ষকের শাস্তি ফাঁসি কার্যকর করতেই হবে। করতেই হবে।
কঠিন মুখ করে বসে আছে রূপন্তী। মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মানুষ এত খারাপ হয়ে গেলে মেয়েরা বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেবে। যাদের এত চুলকানি তারা বিয়ে করলেই পারে৷ অযথা…
অয়ন বলল- কি ভাবছো রূপন্তী?
- মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আপনাদের এত চুলকানি কেন?
- মানে?
রূপন্তী বলল- মেয়ে দেখলেই আপনাদের মাথা খারাপ হয়ে যায় তাইনা? নিজেদেরকে ঠিক রাখতে পারেন না? তাহলে ঘরে যে মা আছে তাকে দেখলেও তো মাথা খারাপ হওয়ার কথা। নাকি মাকে মেয়ে মনেহয় না? কিজানি বাবা হয়ত ওরা মাকেও ধর্ষণ করতে ছাড়ে না।
অয়ন বলল- এসব আমাকে কেন বলছ? আমার আকার ইংগিত কখনো খারাপ মনে হইছে?
- আমি ওসব জারজদের কথা বলছি। ওরা কি ওদের মাকেও ছাড় দেয় না?
- এই চিন্তাটা ওদের মাথায় থাকলে সমস্ত নারীকেই ওরা সম্মান করতো। ওরা তো পশু। ওদের মাথায় এসব চিন্তা নেই।
- আর খুব বেশিদিন নেই। শীঘ্রই ওদের উপর কঠিন গজব নেমে আসবে। এত অন্যায় আল্লাহ সহ্য করবেন না।
ক্ষোভে, কষ্টে রূপন্তীর চেহারা লাল হয়ে উঠলো। চোখ যেন পাথরের মত।
পর্ব ১৬
রূপন্তীর শক্ত হওয়া চেহারাটা দেখে নেহা ও অয়ন রীতিমতো অবাক। চোখ দিয়ে আগুন ঝরতে চাইছে ওর। অয়ন রূপন্তীকে ধরে বসালো। নেহার মা চা নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন।
অয়ন বললো, আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?
- হ্যা বাবা। তোমরা ভালো আছো?
- জ্বি আন্টি। এসবের কি দরকার ছিলো?
- ধুর। বসো, আজকে পোলাও রান্না করবো। খেয়ে যাইও।
- আন্টির মনটা অনেক ভালো মনেহচ্ছে?
- আমার আর মন। বুড়ো হলে আমাদের মনের হুশ থাকে বাবা?
- সেকি আন্টি। আপনাকে আরো তিনবার বিয়ে দেয়া যাবে। আর আপনি বলছেন বুড়ো? হা হা হা।
নেহা ও রূপন্তীও হেসে উঠল। নেহা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ওর মুখের হাসি দেখে ভালো লাগছে মায়ের। উনি রূপন্তীকে বললেন, তোমার বাসার খবর কি? - ভালো। পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। মেয়েরা এখানে কেবলই সন্তান জন্মদানের বস্তু আর ভোগের বস্তু।
অয়ন অবাক হয়ে রূপন্তীর দিকে তাকালো।
রূপন্তী বলল- মেয়েদেরকে রাস্তাঘাটে ধর্ষণ করা হয়। কারণ পুরুষ দের কাছে এরা ভোগের বস্তু। আর আমার বাবা আমার মাকে কেবল ভোগ করার জন্য আর বাচ্চা দেয়ার জন্য বিয়ে করেছিল। নয়তো শেষ বয়সে এসে আমাদেরকে ফেলে আরেক মেয়ের কাছে যেত না। যে মহিলার কাছে গেছে সে আমার চেয়ে মাত্র চার বছরের বড়।
কেউ কোনো কথা বললো না। রূপন্তীর কষ্টের কারণ আর ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক। প্রতিটা মেয়ে যথাযথ সম্মান আর অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু এই পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ এদেরকে বারবার এভাবে ছোট করে এসেছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, মেয়ে তোর জায়গা পায়ের নিচে। হায়রে পুরুষ! কবে তোরা মানুষ হবি?
রূপন্তীর কথার শেষে দীর্ঘশ্বাস শুনে বুকে লাগল অয়নের। ও চায় রূপন্তীর পাশে থাকতে কিন্তু সেই সুযোগটা পাচ্ছে না। মেয়েটার মন একেবারে পাথরের মত কঠিন। এই দূর্বার পাথর রোধ করা যায়না সহজে। আনমনে ভাবছিল অয়ন। রূপন্তীর কথায় হুশ ফিরে পেলো।
রূপন্তী বলল- আমি উকিলের সাথে কথা বলবো। আমার আসামীরা সবাই ধরা পড়েছে। এখন এদের কঠিন বিচার হওয়া দরকার। ভালো যুক্তি দিয়ে কঠিনভাবে লড়তে পারবে এরকম লইয়ার দরকার। আপনার পরিচিত কেউ আছে?
অয়ন বলল- আমার বাবার পরিচিত একজন আছে। আমার তো উকিল টুকিলের সাথে কখনো দরকার হয়নি। বাবার একজন বন্ধু আছেন। উনি অনেক ভালো যুক্তিবাদী। আর তোমার আসামীদের পক্ষে উকিল থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি। অপরাধ করেছে যখন শাস্তি ওরা পাবেই।
রূপন্তী হেসে বলল, এ পর্যন্ত কত ঘটনাই না ঘটলো। শাস্তি কার হয়েছে বলবে? নুসরাতের ঘটনা মনে নেই? ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমে বলে ধর্ষকের মুক্তি চাই। এ কোন দেশে বাস করছি আমরা। হা হা হা।
রূপন্তীর হাসির শব্দ শুনে তাক লেগে তাকিয়ে আছে রুমের বাকি তিনজন। নেহার মা বললেন, মন খারাপ কোরো না মা। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।
রূপন্তী বলল- মেয়েদের মধ্যে ভালো লইয়ার নেই? মেয়েদের মনের ক্ষত মেয়েরাই ভালো বুঝবে। আমি কোনো মহিলা উকিলের সাথে কথা বলতে চাই।
অয়ন বলল- আমি একজনকে চিনি। সেরকম ভালোভাবে চিনিনা কিন্তু নাম জানি। ওনার চেম্বারে যাবে?
- আগামীকাল নেহার মামলার শুনানি। কোর্টে যাই আগে। ওর কাহিনি দেখি তারপর আমার ব্যাপারটা দেখা যাবে।
অয়ন বলল- ওকে। এখন এসব বাদ দিয়ে চা টা খাও। চা অনেক ভালো হয়েছে। আন্টি আপনি তারাতাড়ি পোলাও চড়িয়ে দিন।
রূপন্তী বলল- মাথা খারাপ? এখন ওসব রান্না করতে হবে না।
- ধুর রাখো তো। অনেকদিন পোলাও খাইনা। আর মায়ের হাতের রান্নার ব্যাপার ই আলাদা। আন্টি আপনি রান্না বসান। পোলাওয়ের সাথে কি থাকবে?
আন্টি হেসে বললেন, বসাচ্ছি। তোমরা কি খেতে চাও? ফ্রিজে মুরগী আছে। রোস্ট করবো? নাকি সরষে ইলিশ করবো?
অয়ন তৃপ্তির সাথে বলল- উফফ আন্টি জিভে জল এসে গেলো। আপনি সরষে ইলিশ করুন। ইলিশ দিয়ে পোলাও। - আচ্ছা। অয়ন আমার সাথে একটু আসো তো।
আন্টি অয়নকে রান্নাঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, নেহার মনের অবস্থা এখনো অনেক খারাপ। ও তোমার কথায় খুব ভরসা পায়। ওকে একটু মোটিভ করো না বাবা।
- চিন্তা করবেন না আন্টি। আমি আছি তো।
- ও যেন সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যায়। পড়াশোনায় যেন মনোযোগী হয়।
- অবশ্যই আন্টি। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো। আপনি ওকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করবেন। ব্যস্ত থাকলে ডিপ্রেশন ভর করার সময় পায় না। রান্না সম্পন্ন হতে হতে অয়ন ভালো করে নেহাকে বুঝিয়ে বলল নিজের একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কি কি করা দরকার। পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে, ক্যারিয়ারের জন্য সময় দিতে হবে তবেই সম্ভব। ঘুরে দাড়াতে পারলে যারা থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল তাদের মোক্ষম জবাব দেয়া হবে। অয়নের কথায় ভরসা পেলো নেহা। রূপন্তীও খুশি হয়েছে ওর কথা শুনে। মনেমনে ভাবছে অয়ন শিক্ষক হলে খুব ভালো হতো।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে অয়ন রূপন্তীকে নিয়ে বাসায় চলে এলো।
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে রূপন্তী।
অয়ন দরজায় এসে নক করলো৷ রুম থেকে জবাব দিল রূপন্তী- কে?
অয়নের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমি। একটা কথা ছিলো।
- কি কথা?
- দরজা না খুললে কিভাবে বলবো?
- ওয়েট আসছি।
রূপন্তী এসে দরজা খুললো। অয়ন হাসিমুখে বলল- মন খারাপ না ভালো? মুড ভালো হলে বলবো।
- মোটামুটি। আজকে মুড খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নাই।
- আমার তো মনেহয় সারাক্ষণ তোমার মুড খারাপ থাকে। কখন যে ভালো থাকে বোঝা যায় না।
- এত পেঁচাবেন না তো। কি বলতে চান বলে ফেলুন।অয়ন বললো, রেগে যাবে না তো?
- রাগার মত হলে অবশ্যই রাগবো। তাছাড়া আমার রাগ একটু বেশিই। যা বলার বলে ফেলুন। না বলতে চাইলে চলে যান।
- বাপরে। আগেই এভাবে ভয় দেখালে কিভাবে বলি? আসো আমার সাথে।
- কোথায়?
- আহা আসোই না। ভয় পেও না।
অয়ন রূপন্তীকে নিয়ে ওর বাবার ঘরে এলো। অয়নের বাবা এখনো বাসায় ফেরেন নি। রূপন্তী ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকালো। এর আগে এই ঘরে ঢোকা হয়নি। সবখানে কিসের যেন স্পর্শ লেগে আছে।
অয়ন আলমারি খুলে বলল, এখানে আসো।
রূপন্তী এগিয়ে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলো আলমারিতে অনেকগুলো শাড়ি। সব শাড়ি ঝলমল করছে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তার উপর মেয়েদের শাড়ির প্রতি আলাদা একটা দূর্বলতা থাকে।
অয়ন বললো- আসো। একবার ছুঁয়ে দেখো
- এগুলো কার শাড়ি?
- আমার মায়ের। মা শাড়ি খুব ভালোবাসতো। অনেক শাড়ি আছে যেগুলোতে মায়ের ভালোবাসা লেগে আছে। গয়নাও আছে অনেক গুলো।
রূপন্তী এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে। মুগ্ধ হয়ে শাড়িগুলোতে চোখ বুলাল। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখলো সবগুলো শাড়ি। অয়ন ওকে বের করতে বলামাত্র রূপন্তী কোনটা রেখে কোনটা বের করবে বুঝতে পারল না। অয়ন একটা একটা করে সব শাড়ি বের করে বিছানার উপর রাখলো। রূপন্তী বিছানায় বসে শাড়িগুলো ধরে ধরে দেখছে। আর অয়ন মুগ্ধ হয়ে দেখছে রূপন্তীকে।
একটা গয়নার বাক্স বের করে দিয়ে অয়ন বলল- এগুলো দেখো।
গয়নাগুলো দেখে মন ভরে গেল রূপন্তীর। ভারি আর খুব আধুনিক ডিজাইনের গয়না। আজকালকার দিনে এরকম গয়না পাওয়াই যায় না। হাতে নিয়ে তুলে দেখতে দেখতে কখন যে গলায় পড়ে, হাতে চুড়ি পড়ে দেখা শুরু করেছে নিজেও বুঝতে পারেনি।
অয়ন বলল, তোমাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে রূপন্তী।
লজ্জা পেয়ে গয়না সরিয়ে রূপন্তী বলল- সরি। গয়না আর শাড়ি দেখলে গায়ে দিয়ে দেখাটা একটা বদভ্যাস।
- যে বদভ্যাসে কারো সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় সে বদভ্যাস ও ভালো।
রূপন্তী সবগুলো রেখে বলল- সত্যিই অনেক সুন্দর। আপনার মা অনেক রুচিশীল ছিলেন। - হ্যা। আভিজাত্য জিনিসটা মায়ের হাড়ে হাড়ে ছিল।
- হা হা। আভিজাত্য থাকা ভালো।
- একটা অনুরোধ রাখবে রূপন্তী?
- বলুন।
- যদি কষ্ট না হয় আর আপত্তি না থাকে।
- বলুন।
কৌতুহলী চোখে অয়নের দিকে তাকালো #রূপন্তী। অয়ন রূপন্তীর চোখে চোখ রেখে বললো- যদি কিছু মনে না করো, মায়ের একটা শাড়ি তুমি পড়বা? আর গয়নাগাটি। আমার খুব ইচ্ছে করছে মায়ের শাড়িতে তোমাকে দেখি। এগুলোতে আমার মায়ের স্পর্শ লেগে আছে। মা চেয়েছিল তার বৌ মা কে শাড়ি গুলো পড়াবেন।
অয়নের কণ্ঠে মায়া খুঁজে পাচ্ছে রূপন্তী। কিছু বলতেও পারছে না, না ও করতে পারছে না।
অয়ন বলল, রূপন্তী রাখবা আমার কথাটা? প্লিজ।
রূপন্তী কথা না বলে উঠে দাড়াল। জানালার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো নিরবে। অয়ন মাথা নিচু করে শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
রূপন্তী বললো, আচ্ছা পড়ছি।
উজ্জ্বল হয়ে উঠলো অয়নের মুখ।