Sad Valobasar Golpo

এবং রূপন্তী (১৮ পর্ব) – Sad Valobasar Golpo

পর্ব ৯

বিকেলবেলা নির্দিষ্ট জায়গায় চলে এলো রূপন্তী। অয়ন এখনো আসেনি। আর কিইবা আসবে। সকাল থেকে উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে অয়নের। একবার বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, একবার উঠে লাফালাফি করছে, একবার ছাদে যাচ্ছে, একবার মেঝেতে বসে আনমনে ভাবছে৷ ওর মনের অবস্থা এখন ভয়ানক। ভাগ্যিস মন দেখা যায় না। নয়তো যেকেউ দেখলে ভয়ে আৎকে উঠতো।
রূপন্তীর মত একটা রাগী মেয়েকে রাজি করানোটা অয়নের কাছে খুব কঠিন একটা বিষয়। তার উপর মেয়েটার কিছু বাস্তবিক বাজে অভিজ্ঞতা আছে। ওর সামনে দাড়িয়ে বিয়ের কথাটা বলার সাহসও অয়নের হবেনা বোধহয়। নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে করতেই বিকেল গড়িয়ে এসেছে।

কিন্তু মানসিক প্রস্তুতি নিতে গিয়ে শারীরিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা হয়নি। বের হওয়ার আগে আগে আবারো এলোমেলো হয়ে গেল অয়ন। শার্ট খুলে আবার অন্য একটা শার্ট গায়ে দিলো। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভুতের মত আবিষ্কার করলো। সবকিছু চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুয়ে এসে একটা সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পড়লো। তারপর নিজেকে দেখে স্কুল ড্রেস মনে হচ্ছিলো। যেন স্কুলে ক্লাস করতে যাচ্ছে। রাগে গজরাতে গজরাতে আবার সেগুলো খুলে একটা সবুজ পাঞ্জাবি ও জিন্স পড়লো। তারপর চুল আচড়ে এবার মনটা কিছুটা শান্ত হলো অয়নের।

গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে সোজা চলে এলো ফুলের দোকানে। একটা গোলাপ নিয়ে কিছুক্ষণ হা করে দেখলো। এরপর মনে হলো এই গোলাপটা কেমন সিংগেল সিংগেল ভাব। সিংগেল দিয়ে প্রপোজ করে মেয়ের মাথায় সিংগেল ই ঘুরবে। তারচেয়ে বরং দুইটা গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করবে।

ধেৎ, দুইটা গোলাপে আরো অদ্ভুত দেখায়। একসাথে অনেকগুলো গোলাপ নিলেই সব’চে ভালো হয়।
ভাবামাত্র কয়েকটা গোলাপ নিয়ে তোড়া বানিয়ে সিটে রেখে দিলো। টেনশনে রীতিমতো ঘামছে অয়ন। নিজেকে সামলে নিতে সময় পাচ্ছে না। গাড়ি ঠিকভাবে চালাতেও পারছে না বেচারা।
কোনোমতে ধীরেধীরে গাড়ি চালিয়ে রূপন্তীর কাছে পৌঁছে টের পেলো এক ঘন্টা লেট করে এসেছে।
রূপন্তী বললো- কি ব্যাপার মশাই? এত উত্তেজিত কেন?

  • সরি রূপন্তী। খুব দেরি হয়ে গেলো।
  • উত্তেজনায় ঘামছেন। ব্যাপার কি আজকে আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে?
    অয়ন হাসলো৷ তারপর মনে হলো গাড়িতে গোলাপ রেখে এসেছে। আবার একটা দৌড় দিয়ে গাড়ি থেকে গোলাপ নিয়ে এসে রূপন্তীর সামনে দাঁড়ালো৷ রূপন্তী ফিক করে হাসলেও পরবর্তীতে অবাক হয়ে তাকালো৷ গোলাপ দিয়ে কি হবে? কোনো লক্ষণ নেই তো?

অয়ন গোলাপগুলো রূপন্তীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল এগুলো রাখো৷ তারপর বলি।
রূপন্তী গোলাপ হাতে নিয়ে এদিক সেদিক তাকালো। নির্দ্বিধায় বলল- আপনার সাজ আজকে চেইঞ্জ হয়ে গেছে৷ আবার গোলাপ ও। বিশেষ ভাবে দেখা করতে বললেন। কোনো প্রস্তাব দিবেন?
অয়নের বুকটা ধড়াক করে উঠলো৷ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল- না না তেমন কিছু না। প্রস্তাব রাখলে তুমি কি রেগে যাবে?

  • রাগার মত প্রস্তাব দিলে অবশ্যই রেগে যাবো।
  • প্লিজ রূপন্তী, শান্ত হও। রেগে গেলে কিছুই হবে না। আমি কোনো আজেবাজে প্রস্তাব দিবো না। আমি তোমার কষ্টের ভাগ নিতে চাই রূপন্তী।
  • ও আচ্ছা। তো বলুন শুনি কি উপায়ে আপনি আমার কষ্টের ভাগ নেবেন?
    অয়ন হাঁটুগেরে বসে হাফাতে হাফাতে বললো- রূপন্তী। আমি কখনো ভাবিনি এরকম পরিস্থিতিতে পড়বো। আমার ভেতরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। এত কথা না বাড়িয়ে আমি বরং বলেই ফেলি। I love you রূপন্তী, Will you marry me?
    থমকে গেলো রূপন্তী। বিয়ের প্রস্তাব!

অয়ন বলল- হ্যা। আমি জানি প্রেমের প্রস্তাব দিলে তুমি না করে দিবে। উলটো রেগেও যাবে। কারণ তোমার বিশ্বাসে প্রেমের কোনো জায়গা নেই। সেজন্য বিয়ের প্রস্তাব। রূপন্তী আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি বললে এক্ষুনি, তুমি চাইলে কয়েক বছর পরে। কিন্তু আমার তোমাকেই চাই। ইন ফ্যাক্ট আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। প্লিজ রূপন্তী, একবার আমাকে নিয়ে ভেবে দেখো।
কথাগুলো বলতে বলতে হাফিয়ে গেলো অয়ন। রূপন্তীর পায়ের কাছে হাটুগেরে বসে পড়লো। রূপন্তী থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাসের উপর বসে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।
রূপন্তীও ধুপ করে অয়নের পাশে বসে পড়লো।

অয়ন মাথা নিচু করে ভাবছে। রূপন্তীর মুখে কোনো কথা নেই। বাধ্য হয়ে অয়নই আগে মুখ খুললো- সরি রূপন্তী। যদি রাগিয়ে দিয়ে থাকি, রিয়েলি ভেরি সরি। দেখো, একজন মানুষ তার মনের কথা জানিয়েছে। প্লিজ সিনক্রিয়েট কোরো না। তোমার ইচ্ছে হলে যা খুশি হলো। তবুও ওভার রিয়েক্ট করবে না প্লিজ রূপন্তী।
রূপন্তী বলল- হুম। আমি রেগে যাই নি।

  • রূপন্তী…
  • হুম।
  • আমি জানি তোমার মনে অনেক কষ্ট। তুমি যাতে আমাকে বিশ্বাস করতে পারো সেজন্যই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই৷ আমি বাবাকে তোমার ব্যাপারে বলেছি, বাবা অনেক খুশি হয়েছেন।
  • হুম।
  • বাবা বলেছেন তোমার মত মেয়ে আজকাল পাওয়া যাবে না। তুমি নাকি যেমন কঠিন ঠিক তেমনি ভালো।
  • উনি একদিন দেখেই সেটা বুঝে গেছেন?
  • হ্যা। কারণ তুমি অনেক স্পষ্টবাদী।
  • বুঝলাম।

অয়ন রূপন্তীর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালো। দেখলো রূপন্তীর মুখ শক্ত হয়ে গেছে। ভয়টা আরো বেড়ে গেল ওর। নিজেকে শক্ত করে অয়ন বলল- রূপন্তী। কি ভাবছো?
রূপন্তী বলল- আমি কিছু ভাবছি না। আর কিছু ভাবতেও চাইনা। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই। কখনো প্রস্তুত হতেও পারবো না। কারণ আমার বিয়ে করার মন মানসিকতা নেই। আমি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি কখনো বিয়ে করবো না। আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আর বিয়ের ব্যাপারে ফোর্স ও করবেন না। প্লিজ।

কথাটা বলেই উঠে দাড়ালো রূপন্তী। অয়নকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হেঁটে চলে গেল। নির্মল চোখে তাকিয়ে রইল অয়ন। এভাবে একটা শক্ত কথা বলে দিয়েই চলে গেলো রূপন্তী? এখন ওকে ফোন দিলেও বিরক্ত হবে। সবকিছু এত সহজে নষ্ট করে দেয়া যায় সেটা জানা ছিলোনা অয়নের।

মনটা কেমন ভেংগে চূড়ে গেলো।রূপন্তী বাসায় ফিরে কঠিন মুখ করে বসে আছে। আজকে দুটো বছর ধরে কোনো ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি রূপন্তী। ছেলেদেরকে ও কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। কিভাবে যে এই অয়নের সাথে পরিচয় হয়ে গেলো। মানুষের সাথে কখন পরিচয় হয়ে যায় বলা মুশকিল। আর পরিচয়ের চেয়েও বড় কথা, মানুষটা মনের ভিতর দাগ কেটে বসেছে। হুট করে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ায় কষ্ট হচ্ছে রূপন্তীর।
অয়নকে রূপন্তীর সহ্য হয়না।

আবার ভালোও লাগে। একটা বাজে বিরক্তিকর অবস্থায় পড়েছে ও। অয়নের কথাবার্তা, মানসিকতা সবই সুন্দর। যে কারো ভালো লাগবে ওকে। আর অয়নের মনটাও স্বচ্ছ। অভ্যাসবশত অয়নকে সহ্য করতে ইচ্ছে করছে না। সবমিলিয়ে খুবই খারাপ লাগছে। না পারছে ওকে নিয়ে ভাবতে আর না পারছে ঝেড়ে ফেলে দিতে। একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে রূপন্তীর।

বিছানায় শুয়ে বালিশ জড়িয়ে ধরলো রূপন্তী। কখনো বালিশ জড়িয়ে ধরেনা ও। আজকে জড়িয়ে ধরার পর একটা অন্যরকম শান্তি লাগছে। সেইসাথে কান্নাও পেল। মনে হচ্ছে জীবনটা এতটাও খারাপ না, বরং নিজের অভিজ্ঞতার কারণে জীবনকে তিক্ত করে রেখেছে রূপন্তী।
কত কি ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেংগে পড়লো ও। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

রূপন্তীর ঘুম ভাংলো তিন ঘন্টা পর। এখন শরীর ও মন দুটোই বেশ ভালো লাগছে। ফোন হাতে নিলো ও। অবচেতন মনে চেয়েছিলো অয়ন হয়তো ফোন দেবে৷ কিংবা একটা হলেও এসএমএস পাঠাবে। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে দেখলো একটা এসএমএস ও নেই, কল তো দূরের কথা।

মুহুর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। অয়নকে ও চায় ই না কিন্তু অবচেতন মনটা চেয়েছিলো অয়ন ফোন করুক। কেন যে এমন হয়! আজব মন।
রূপন্তী হাত মুখ ধুয়ে বেলকুনিতে এসে দাড়ালো। সামনে চোখ যেতেই দেখল অয়ন! প্রথমে ভাবলো ভুল দেখছে। পরক্ষণে চোখ কচলে আবার দেখলো। বুকটা ধক করে উঠলো ওর। অয়ন বাসার সামনে!
হার্টবিট বাড়তেই লাগল। রূপন্তী ভেতরে যাবে ভাবছে। কিন্তু যেতেও পারছে না। এমন সময় অয়নের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।

চোখে চোখ পড়তেই অয়ন এমনভাবে তাকালো যে বুকের ধুকপুকানিটা আরো বেড়ে গেলো। অয়ন রূপন্তীকে বিরক্ত করতে চায় না। সেজন্য ওকে আর ফোন করবে না। কিন্তু মনের অজান্তেই এখানে এসে দাড়িয়ে আছে।
রূপন্তী বাসার ভেতরে চলে গেল৷ অয়ন আজকের মত চলে গেলো সেখান থেকে। কিন্তু রূপন্তী কিছুক্ষণ পর আবার এসে দেখার চেষ্টা করল অয়ন এখনো আছে কিনা। এবার ওকে দেখতে না পেয়ে চোখ দুটো ওকে আবারো খুঁজছিলো। এর কারণ জানেনা রূপন্তী। বাসাএ ভিতরে ঢুকে গেলো ও।

সারারাত বিছানায় শুয়ে চুপ করে রইলো অয়ন। একবারের জন্যও ফোন হাতে নিলো না। রূপন্তীকে ফোন করল না, কারো সাথে কোনো কথা বলল না।
রূপন্তী একবারও অয়নের কথা ভাবলো না। কিন্তু ঠিকই মনে মনে চাইছিল অয়ন একবার ফোন করুক। ফোন দিলে রিসিভ করবে না রূপন্তী। অয়ন আবার ফোন করবে, ফোন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাবে। তাও রিসিভ করবে না রূপন্তী। শেষে রিসিভ করে বলবে, আর বিরক্ত করবেন না তো। কিন্তু এসবের কিছুই হচ্ছে না। অয়ন একটাবারও কল দিলো না। ইভেন একটা এসএমএস ও না।

পরদিন সকালে ক্লাসে গেলো রূপন্তী। ক্লাস থেকে ফেরার সময় বাসার কাছাকাছি এসে অয়নের সাথে মুখোমুখি দেখা। অয়ন দেখা হওয়ামাত্র চোখ ফিরিয়ে নিলো। রূপন্তীও আর তাকালো না। মাথা নিচু করে বাসায় চলে এলো।
বিকেলবেলা রূপন্তী বেলকুনিতে দাড়িয়ে চা খাচ্ছিল, এমন সময় দেখলো অয়ন বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রূপন্তী রুমের ভেতর চলে এলো।

এভাবেই চলতে লাগলো দিন। প্রতি দিন দুই থেকে তিনবার দুজনের দেখা হয়ে যায়। কিন্তু কেউ কথা বলে না। নেহাকে দেখার জন্য অয়ন হাসপাতালে আসে সকালে, রূপন্তীর তখন ক্লাস থাকে।
এদিকে রূপন্তী যখন নেহাকে দেখতে আসে, অয়ন তখন বাসায় থাকে।
আজকে হঠাৎ দুজনেই একই সময়ে হাসপাতালে এলো। অয়ন নেহার কেবিনে ঢুকে পাশে বসে যখনই কথা বলতে যাবে, এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো রূপন্তী।
দুজনের চোখাচোখি হতেই দুজনে খেই হারিয়ে ফেললো। আজকেও কি কথা হবেনা ওদের?

পর্ব ১০

রূপন্তী এসে নেহার পাশে বসলো। নেহার একপাশে অয়ন, অন্য পাশে রূপন্তী। দুজনে মুখ তুললেই দুজনকে দেখতে পারছে। একে অপরের সাথে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। তবে অয়নের দিক থেকে অয়ন পুরোপুরি স্বস্তিতে আছে। ওর বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে আজকের ব্যাপারটা।
রূপন্তী নেহার জন্য নিয়ে আসা ফলগুলো বের করে নেহাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলো, হসপিটাল থেকে রিলিজ নিচ্ছো কবে?

  • আজকেই।
  • আজি?
  • হ্যা। শরীর পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু সমাজে বের হলেই লোকজন তাকিয়ে থাকবে সেই ভয়ে ঘরকুনো হয়ে থাকতে হবে।
  • ধুর পাগলী। ঘরকুনো হয়ে থাকবি কেন? বাইরে বের হবি। কে কি বললো সেটা মাথায় নিবি না বুঝলি?
  • এভাবে কতদিন চলবে আপু?
  • চিন্তা করিস না। নিজের জায়গা তৈরি কর। নিজের উপর ভরসা রাখ মেয়ে।
  • পারছি না যে।
    অয়ন এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। রূপন্তীর কথা শুনছে মাথা নিচু করে।
    রূপন্তী বললো- তুই বড্ড টেনশন করছিস। এত দুশ্চিন্তা করিস না। যা হবার হয়ে গেছে, এখন নতুন করে উঠে দাড়াতে পারলেই ভাব্বি তুই জিতে গেছিস। জগতের নিয়মটাই এমন, জয় পরাজয়ের খেলা। ওদের কথায় ভয় পেয়ে যদি ঘরে বসে থাকিস, তাহলে তো তুই হেরে গেলি।

নেহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রূপন্তী ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো- একদম মন খারাপ করবি না ওকে? যেকোনো দরকারে আমাকে স্মরণ করবি। এই বোন সবসময় পাশে আছে তোর।

  • আচ্ছা আপু। আজকে চলে যাবো, তুমি ফোন দিয়ে আমার খোঁজ নিও।
  • অবশ্যই নিবো। তুই আমার লক্ষী বোন না? আজকে তাহলে আসি?
  • আরেকটু থেকে যাও না। তুমি আর অয়ন ভাইয়া একসাথে যেও।

রূপন্তী তাকালো অয়নের দিকে। দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। অয়নের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না #রূপন্তী। ভয় ভয় লাগে!
অয়ন বললো- আপুকে যেতে দাও নেহা। তোমার আপু ছেলেদের সাথে মেশে না।
নেহা বললো- ছেলে আর তুমি বুঝি এক হলে? তুমি আমার অয়ন ভাইয়া। সবার থেকে আলাদা।
রূপন্তী কথা না বাড়িয়ে উঠে দাড়ালো। তারপর নেহাকে বললো- আজকে আসি। নিজের যত্ন নিবি নেহা।
এক মুহুর্ত না দাড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো রূপন্তী। অয়ন একটা নিশ্বাস ফেলে নেহার সাথে গল্পে মেতে উঠলো। নেহাকে বুঝাতে লাগলো এরপর ও কি কি কাজ করবে। হাসি আড্ডায় মেতে উঠলো দু ভাইবোন মিলে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা রূপন্তীর বাসার সামনে চলে এলো অয়ন। রূপন্তী বাইরে থেকে এসে গোসল সেরে জামাকাপড় শুকাতে দেয়ার জন্য বেলকুনিতে এলো। আসামাত্রই দেখলো বাসার ঠিক সোজাসুজি দাঁড়িয়ে অয়ন গাড়ির উপর বসে চা খাচ্ছে আর বাঁকা চোখে বেলকুনির দিকে তাকাচ্ছে। পাছে চোখাচোখি হয়ে যায় সেজন্য আর তাকালো না রূপন্তী। তারাতাড়ি কাপড় শুকাতে দিয়ে রুমের ভিতরে চলে এলো।

কিছুক্ষণ রুমে বসে থাকার পরও রূপন্তীর মন টিকছিলো না। ইচ্ছে করছিলো আরেকবার গিয়ে অয়নকে দেখে আসতে। কিন্তু বেলকুনিতে এসে দেখলো অয়নকে দেখা যাচ্ছে না। গাড়িটাও নেই। মুহুর্তে ছটফট লাগতে আরম্ভ করলো। আর একটু সময় থাকলে কি এমন হতো? পরক্ষণেই আবার নিজের মাথা থেকে অয়নের ভুত ঝরে ফেলে দিলো রূপন্তী।

বিকেলে শপিংমলে যাওয়ার জন্য বের হলো রূপন্তী ও ওর বান্ধবী মিথিলা। কেনাকাটা করার সময় এক দোকান থেকে আরেক দোকানে যাওয়ার সময় হঠাৎ অয়নের সাথে দেখা। দুজনেই একেবারে থ! হোয়াট এ কোইন্সিডেন্ট!
অয়ন মনেমনে ভাবলো, রূপন্তী এখানে আসবে সেটা আমি কল্পনাই করিনি। অবশ্য মনেমনে চাচ্ছিলাম একবার দেখা হয়ে যাক। অবশেষে!

রূপন্তীর হার্টবিট হঠাৎ করেই বেড়ে গেল। চমকে উঠে পিছন দিক দিয়ে হাঁটা শুরু করলো রূপন্তী।অয়ন মুচকি হেসে রূপন্তীকে ফলো করা শুরু করলো। পিছুপিছু হেঁটে এসে রূপন্তীর কেনাকাটা দেখছিলো। কত্তদিন দুজনের মাঝে কথা হয় না। রাগ দেখানোর ছলেও যদি একবার কথা হতো সেটাই চাচ্ছিলো অয়ন।

এমন সময় অয়নের ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে সত্যি সত্যিই রূপন্তী এসে সামনে দাড়ালো। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। অয়ন মনেমনে হাসলো আর বলল, দাড়াও। এরপর আরো বেশি বেশি ফলো করবো। কথা তোমাকে বলতেই হবে মিস।
অয়ন রূপন্তীকে ফলো করে ওর বাসা পর্যন্ত এলো। রূপন্তীর রাগী চেহারাটা শেষ একবার দেখেই আবার চলে গেল নিজের পথে।

পরদিন …
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। এমন দিনে ঘরে শুয়ে থাকা গরম গরম খিচুড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা। কিন্তু দূর্ভাগ্য যে খিচুড়ি রান্না করার মত মানুষটা নেই।
অয়নের ইচ্ছে করছে রূপন্তীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে। এই ঝুম বৃষ্টিতে ইচ্ছে হলে একবার হাত ধরে ভিজতে। রূপন্তী পানির ঝাপটা নিয়ে অয়নের গায়ে ছিটিয়ে দেবে। কত সুন্দর ই না হতো!

ভাবতে ভাবতে কোন কল্পনার রাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছিল অয়ন। রূপন্তীকে নিয়ে ভাবতে খুব সুখ সুখ অনুভূত হয় ওর। মনকে সামলাতে না পেরে একটা এসএমএস দিয়েই ফেললো-
‘janina rag krbe kina. Kintu ei borshay monta tomake khub kache pete chaiche. Eksathe shuye bristir shobdo suntam kingba tumi kotha bolte ar ami suntam. Khub sundor hoto na? Eto rag niye thakle kivabe hobe bolo? Amra chaile e jibon k sundor kore rangate pari. Cholo bristite viji..’
এসএমএস টা দিতে গিয়ে বুকটা কাঁপছিলো অয়নের। সেন্ট হওয়ার পর রীতিমতো হাফাচ্ছিলো ও।
টুং করে রিপ্লাই এলো এসএমএস এর। এত দ্রুত রিপ্লাই পাবে ভাবেনি ও। যাই লিখুক, রিপ্লাই দিয়েছে এটাই অনেক।

রূপন্তী লিখেছে,
‘এত প্রেম আসে কোথ থেকে? নাটক বন্ধ করুন।’
হাসলো অয়ন। তারপর লিখলো,
‘sob prem natok hoyna re pagli. Kichu prem sotti e pagoler moto hoy.’

রূপন্তী লিখল- পাগলের মত প্রেম দিয়া আমি কি করবো? আমার পাগল ছাগল পোষার শখ নাই। মানুষ দরকার, মানুষ।
অয়ন হেসে উঠলো মেসেজ দেখে। এরকম রোমান্টিক এসএমএস এর উত্তরেও যে এত কটকটি মার্কা রিপ্লাই দেয়া যায় সেটা অজানা ছিলো ওর।
অয়ন দ্রুত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে রূপন্তীর বাসার সামনে চলে এলো। এসেই একটা এসএমএস দিয়ে রূপন্তীকে বেলকুনিতে আসতে বললো।

রূপন্তী বেলকুনিতে এসে দেখলো অয়ন বৃষ্টিতে ভিজছে। রূপন্তীর ও ইচ্ছে করলো ভিজতে। কিন্তু এভাবে বেরিয়ে গিয়ে ভেজা তাও আবার অয়নের সাথে! সেটা কক্ষনো সম্ভব না। তবুও মনটাকে আটকে রাখা যাচ্ছে না।

কি করবে রূপন্তী? নিজের নিয়মের বাইরে গিয়ে কি অয়নের সাথে ভিজবে? নাকি কঠিন মুখ করে বসে থাকবে?

পর্ব ১১

অয়নের বৃষ্টিতে ভেজার একটা আলাদা আর্ট আছে। ভিজছে আর গান গাইছে রীতিমতো। সিনেম্যাটিক স্টাইলে সিনেমার নায়কের মত। নায়িকার প্রতীক্ষায় ভিজছে আর খুব আপনমনে নায়িকাকে কাছে চাইছে।
রূপন্তী বেলকুনিতে দাড়িয়ে দেখতে দেখতে বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছিলো। বাধ্য হয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে হলো ওকে।

ঘরে ঢুকেও মনে শান্তি পাচ্ছে না রূপন্তী। অয়ন কিভাবে ভিজছে, ভিজতে ভিজতে চুলে হাত বুলিয়ে ফ্যাশন করছে সেসব দেখতে ইচ্ছে করছে অয়নের। কিন্তু কিভাবে দেখবে? রুমের জানালা যেদিকে, সেদিকে তো অয়ন নেই। অয়ন ঠিক তার উলটো দিকে। এদিক থেকে দেখতে চাইলে বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আর বেলকুনিতে দাঁড়ানো মানে ভিজে যাওয়া।
রূপন্তী নিজেও জানেনা কেন অয়নকে এত দেখতে ইচ্ছে করছে ওর? সেই প্রশ্নের উত্তর নাহয় অজানাই থাক। বিছানায় শুয়ে অয়নকে এসএমএস দিলো রূপন্তী,
‘এভাবে ভিজছেন কেন? তাও আবার আমার বাসার সামনে?’

অনেক্ষণ কোনো রিপ্লাই এলো না। নিশ্চয়ই অয়ন ফোনটা গাড়িতে রেখে এসেছে। ছেলেটা পারেও বটে।
বৃষ্টির তোড় আরো বেড়ে গেলো। এখন মনটা উড়ুউড়ু করছে রূপন্তীর। নিজেরও ভিজতে ইচ্ছে করছে খুব। ইচ্ছেটাকে উড়িয়ে দিতে পারলো না ও। ছুটে বাসার ছাদে এলো। ছাদ থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো অয়ন ভিজছে। অয়নের দেখাদেখি রূপন্তীও ঘুরে ঘুরে ভিজতে লাগলো। একটু পরপর তাকাচ্ছিলো অয়নের দিকে। তাকানো মাত্রই বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে আরম্ভ করে রূপন্তীর। অনেক্ষণ ভেজার পর তাকিয়ে দেখলো নিচে অয়ন নেই আর গাড়িটাও নেই। মনটা কেমন করে উঠলো রূপন্তীর৷ ভেজা শরীরেই দৌড়ে সিড়ি দিয়ে নেমে এলো রাস্তায়।

রাস্তায় এসে সামনে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো অয়নকে। কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না কোথাও। কৌতুহলী চোখে ডানদিকে তাকানো মাত্রই অয়নের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। অয়ন কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি রূপন্তী। এদিকে রূপন্তীকে দেখে অয়ন এটুকু নিশ্চিত হলো যে রূপন্তীও ওর প্রেমে পড়েছে। নয়তো নিচে নেমে এলো কেন? মুচকি হেসে কাছে এগিয়ে এলো অয়ন।
রূপন্তীর হৃদস্পন্দন আরো বেড়ে গেছে। ও জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে কাঁপছিলো রীতিমতো। অয়ন আরো কাছে এগিয়ে এসে রূপন্তীর চোখে চোখ রাখলো।

ভয়ে পিছিয়ে গেলো রূপন্তী। অয়ন বললো, ভিজবে না নাকি? তাহলে নেমে এলে কেন? সখি কি জানে না তার অবচেতন মনে ভালোবাসার রং লেগেছে?
অয়নের চোখের দিকে মাত্র একবার তাকিয়েই একটা ভো দৌড় দিলো #রূপন্তী। দৌড়ে সোজা বাসার ভিতরে চলে এলো। কিছুক্ষণ ওর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো অয়ন।

রাত্রিবেলা
রূপন্তী বিছানায় শুয়ে ভাবছে দিনে এসব কি ঘটে গেলো! শেষ পর্যন্ত নিচে চলে গেলো ও? এটা কিসের কারণে? অয়নের মন কি তবে প্রবল আকর্ষণে টেনে নিয়ে গেছে ওকে? ভাবতে ভাবতে নানান আঁকিবুঁকি করছিলো।
এমন সময় অয়নের এসএমএস-
Tomake bristite khub mayabi lagchilo. Ecche korchilo…
রূপন্তী রিপ্লাই দিলো- কি?

  • kichu na. Tomar sorir thik ache? Abar jor aseni to?রূপন্তী মনেমনে হাসলেও রিপ্লাইতে লিখলো- আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। বাই..
    আর মেসেজ দিলো না অয়ন। এতটুকু এগিয়েছে এটাই বা কম কিসে? খারাপ না, দিন তো ভালোই যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখার প্রত্যাশায় বিভিন্ন কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো অয়ন।

পরদিন
সকাল সকাল রূপন্তীর ফোন দেখে অবাক হয়ে গেল অয়ন। রিসিভ করতেই রূপন্তী বলল- আপনি তারাতাড়ি আমার সাথে দেখা করুন।

  • সেকি? কেন?
  • দেখা হলেই বলবো। এক্ষুনি দেখা করুন, আর কোথায় আসবেন আমি এসএমএস করে দিচ্ছি।
    অয়ন থ মেরে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ করে সুন্দরীর কি এমন দরকার পড়লো যে ফোন দিয়ে ডাকছে। তাও আবার সকালবেলা ঘুম না ভাংতেই। একগাদা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে দেখা করতে চলে এলো অয়ন।
    রূপন্তীর চেহারা দেখে বুঝতে পারলো মেয়েটার চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ছে। নির্ঘাত কোনো কারণে রেগে আছে। নিজের দোষ খুঁজছে অয়ন।

রূপন্তী রাগী রাগী গলায় বললো- আপনি পেয়েছেন টা কি বলুন তো? এভাবে আমার পিছনে লেগেছেন কেন? বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই আপনার?

  • আমি আবার কি করলাম?
  • কি করেননি সেটা বলুন তো?
  • না মানে নতুন করে কিছু করেছি?
  • চুপ করুন। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। আপনাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি..
    অয়ন অবাক হয়ে বললো- সমস্যাটা কি সেটা বলবা প্লিজ?
  • সমস্যা আপনি নিজেই। আপনি যা করছেন সেটা ঠিক করছেন না। দয়া করে আমার রাস্তা থেকে সরে দাড়ান। কারো প্রতি আমার ফিলিংস নিয়ে আসা কক্ষনও সম্ভব না। আমি ছেলেদেরকে সহ্য করতে পারিনা। দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করে ঠকতেও চাইনা।
    অয়ন বললো- আমি তো তোমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলছি না। আমি সরাসরি বিয়ে করতে বলেছি।

রূপন্তী রেগে বললো- রাখুন আপনার বিয়ে। আমি বিয়ে করবো না কখনো। আমার বাবা পঁচিশ বছর সংসার করে আবার বিয়ে করেছে। আমি আবার বাপকেও ঘৃণা করি। বিয়ে করে আমাদেরকে দেখলেও নাহয় একটা কথা ছিলো। সে আমাদেরকে একেবারে ত্যায্য করার মত ভুলেই গেছে। আর আমার বয়স্ক মাকে কে দেখবে সেটা একবার ভেবেও দেখলো না। পুরুষ নামে কলংক।
অয়ন বললো, প্লিজ রূপন্তী রাগ কোরো না। আমাকে এতদিনে একটুও কি চেনো কি?

  • আপনি জানেন আপনার জন্য আমার কত বড় সমস্যা হয়ে গেছে?
  • মানে?

আৎকে উঠলো অয়ন ন। #রূপন্তী বললো- আমি যেখানে থাকি সেটা ভাড়া বাসা৷ আমার নিজের বাসা নয়। প্রত্যেকদিন কয়েকবার করে আপনাকে বাসার নিচে ঘুরঘুর করতে দেখে বাড়িওয়ালা আংকেল ভয়াবহ রেগে আছেন। উনি ভেবেছিলেন আমি আপনাকে পছন্দ করিনা তাই আমাকে জানান নি। আপনাকে সময় মত রাগ দেখাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু গতকাল আমাকে আপনার সাথে বৃষ্টিতে দেখে যা ভাবার ভেবে নিয়েছেন। আমাকে পাঁচ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছেন। এখন মাসের অর্ধেক। এই সময়ে আমি বাড়ি কোথায় পাবো? উনি বললেন, এসব ফষ্টিনষ্টি আমার বাসায় হবে না। কোথায় থাকবে সেটা তোমার ব্যাপার।
অয়ন পুরোপুরি থ হয়ে গেল। রূপন্তী বললো- এখন বলুন আমি কি করতে পারি? সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই উনি এসে এসব বলে গেলেন। এখন আপনাকে বলি, প্লিজ আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আমার সামনে আর কক্ষনো এসে দাঁড়াবেন না প্লিজ। আমি আপনার মুখ আর দেখতে চাইনা।

  • কিন্তু তুমি থাকবে কোথায়?
  • সেটা আমাকেই বুঝতে দিন। আমার পথ আমিই দেখবো।
    কথাটা বলে এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না #রূপন্তী। সোজা হেঁটে চলে গেলো। থ হয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লো অয়ন। কত আশা নিয়ে এসেছিলো ও। ভেবেছিলো যেহেতু রূপন্তী ওর সাথে দেখা করতে নিচে নেমে এসেছে তারমানে ওর মনেও প্রেম জেগেছে। সেই প্রেমের ছোট্ট চারাটা নিমেষেই নষ্ট হয়ে গেলো! আর কি কখনো দেখা হবে না রূপন্তী?

পর্ব ১২

দুদিন পর
ছাদে শুকনো মুখে বসে আছে অয়ন। মনটা তেমন ভালো নেই। দুটো দিন একদম ই বাসা থেকে বের হয়নি ও। রূপন্তীকে একবারের জন্যও ফোন দেয়নি৷ কিন্তু ওর কথা ভেবেই দুশ্চিন্তায় ডুবে আছে।
রূপন্তীকে বাড়িওয়ালা বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছে। মেয়েটা এখন কোথায় যাবে সেটা ভেবেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কল দেয়ার সাহস পায়নি অয়ন। কিন্তু বাবাকে পাঠিয়েছিলো রূপন্তীর সাথে কথা বলার জন্য। তবুও কাজ হয়নি কোনো। এমনকি একটা বান্ধবীকেও পাঠিয়েছিলো রূপন্তীর বাসা ম্যানেজ করে দেয়ার জন্য। রূপন্তী সেই মেয়েটাকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। আর অয়নকে এসএমএস দিয়ে বলেছে ভুল করেও যেন কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে। তাই আর ফোন দেয়নি অয়ন। একটা এসএমএস দিয়েছিল, তবুও লাভ হয়নি।

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অয়ন একা৷ এই বয়সে বন্ধু বান্ধব রা প্রেম বিয়ে করে করে সবকিছু মাতিয়ে রাখে। অথচ অয়ন সমস্ত ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছে একমাত্র প্রেয়সীর জন্য। রূপন্তীকে দেখার পর মনে হয়েছিলো এই সেই প্রেয়সী। কিন্তু না, ভাগ্যে রূপন্তীও নেই। অয়ন জানেনা এভাবে মন থেকে কাউকে চাওয়ার পরেও কেন সে দূরে চলে যায়?

আনমনে ভাবছিল অয়ন। এমন সময়ে নেহার নাম্বার থেকে কল। ফোন রিসিভ করে অয়ন স্বাভাবিক গলায় বললো, নেহা। কেমন আছো?
নেহা বলল- ভালো না গো ভাইয়া। আমার খুব আপসেট লাগছে। আজকে উঠোনে বসেছিলাম। কয়েকটা মহিলা আমাকে দেখে কিসব আজেবাজে কথা বলছিল। আমার নাকি বিন্দুমাত্র লজ্জা নাই, ভয় নাই। রেপ হওয়ার পরও বাইরে বসে আছে। ভাইয়া তুমিই বলো, রেপ হয়েছি বলে আমি কি আর কখনো বাইরে যেতে পারবো না?

  • অবশ্যই পারবি রে পাগলী। তুই মন খারাপ করিস না। ভাইয়া আছি তো। আমি তোদের বাসায় আসলে কি সমস্যা হবে? তোর সাথে গল্প করলে আস্তে আস্তে তোর কষ্টটা কমে যাবে।
  • লোকজন যদি কিছু বলে?
  • লোকজনের কথার ধার ধারিনা আমি। পাছে লোকে কথা বলবেই।
  • এর বাইরে আর কোনো সমস্যা নেই ভাইয়া।
  • ওকে। তাহলে আমি আসতেছি।

ফোন কেটে দিয়ে দ্রুত রেডি হয়ে নেহাদের বাসায় চলে এলো অয়ন। এই নেহার মারফতেই রূপন্তীর সাথে দেখা। কিংবা রূপন্তীকে দেখেছে বলেই নেহার সাথে দেখা। দুজনকে একইসাথে রাস্তায় পেয়েছিলো অয়ন। অথচ আজ নেহা সুস্থ হয়ে গেল, মাঝখানে কতগুলো দিন- কতগুলো অধ্যায় পার হয়ে গেলো। সহজে ভোলা যায়না সবকিছু। স্মৃতিতে গভীর ছিদ্র করে কিছু জিনিস সবসময় আটকে থাকতে চায়। রূপন্তীর স্মৃতি গুলোও সেরকম।
সেদিনের সেই সন্ধ্যায় গোধূলির রং গায়ে মাখা, এলোমেলো বাতাসে রূপন্তীর চুলের ডানা ঝাপটানো, মাঝেমাঝে মুচকি হাসা – সবই আজকে মরিচিকা। এতটুকু প্রাপ্তি হয়েছিল, সেটাও আজকে সৌভাগ্যক্রমে মনেহচ্ছে। ঠিক স্বপ্নের মতই।

অয়নকে অন্যমনস্ক দেখে নেহা বলল- কি হয়েছে ভাইয়া তোমার?
অয়ন চমকে উঠে বললো- কই কিছু না তো।

  • কিছু একটা তো হয়েছেই। বাসায় কোনো সমস্যা?
  • না রে।
  • তাহলে কেউ কিছু বলেছে?
  • কেউ কিছু বললে আমার মন খারাপ হয় না রে। আমি অতটা দূর্বল নই।
  • তাহলে আপসেট কেন বলবা তো? ব্রেকাপ হয়েছে?
    চমকে উঠলো অয়ন। ব্রেকাপ! শুরুই হয়নি, শেষ হবে কোথ থেকে। তবে যা শেষ হয়েছে তা আর কক্ষনো শুরু হবার নয়।
    নেহা বলল- বলো না ভাইয়া।
  • শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেছে রে। যা শুরু হয়, তার শেষ হতে পারে। যা শুরুই হয়নি, তা শেষ হয়ে গেলে আত কোনোদিনো শুরু হবে না।
  • কি যে বলো। তোমার কথার আগাগোড়া কিচ্ছু বুঝিনা আমি।
  • থাক বাদ দে। খেয়েছিস?
  • না। মা রুই মাছ রেধেছে। তুমি আসলে একসাথে খাবো সেজন্য।
    অয়ন নেহাকে নিয়ে খাবার টেবিলে চলে আসলো। নেহার আব্বা আম্মা অয়ন কে অনেক স্নেহ করেন। খাবার টেবিলে বসে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করছিলেন। আংকেল বললেন, এই এলাকায় আর থাকবো না। ভালো লাগছে না মানুষ জনের ইশারা। লোকজন এতটা নিচে নামতে পারে আমার জানা ছিল না।
  • এলাকা ছেড়ে ভয়ে পালাবেন?
  • ভয়ে না, আত্মরক্ষার জন্য। বেচে থাকার জন্য ভালো পরিবেশে যাবো।
  • সেখানে কয়েকদিন পরে লোকজন খারাপ কথা বলবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? আপনারা এখানেই থাকবেন। আর নেহা নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেখিয়ে দেবে।
    নেহা বলল- যে এলাকায় রাস্তা থেকে মেয়েকে তুলে নিয়ে গেলে কেউ ফিরে তাকায় না। হেল্প করা তো দূরের কথা। সে এলাকায় থেকে কি হবে ভাইয়া?
    অয়ন নেহাকে বিশ্বস্ত করে বললো- তুই শক্ত হ। এত তারাতাড়ি হাল ছেড়ে দিবি না।
  • আমার যে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে ভাইয়া।
  • সবকিছু শেষ থেকেও শুরু করা যায়। তুইও শেষ থেকে শুরু করবি। আমি আছি সবসময়। তোকে সাপোর্ট দেয়া, পথ দেখানোর জন্য।
    অয়নের চেহারার দিকে তাকিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো নেহা। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো- আমি পারবো ভাইয়া। আমি হেরে যাবো না। আমাকে পারতেই হবে।
    অয়ন প্রসন্ন হাসি দিলো।
    নেহাকে মোটিফ করতে গিয়ে মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছিলো অয়নের। আস্তে আস্তে নিজেকে আগের স্বাভাবিক রূপে ফিরে পাচ্ছে যেন। মনের উপর যে বেদনার আস্তরণ পড়েছিলো তা যেন ক্রমশ দূর হয়ে যাচ্ছে।নেহা অয়নের কথার মাধ্যমে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে শুরু করেছে। কষ্টগুলো দূর হয়ে যাচ্ছে ওর। আর মনে মনে প্রার্থনা করছে জগতের সব ছেলে যেন অয়নের মত হয়ে যায়।

বেশ কিছুদিন কেটে গেলো মাঝখানে। অয়ন এখন আর রূপন্তীকে ভেবে কষ্ট পায় না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে দিনকাল বেশ ভালো কাটছে ওর। সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছে। সারাদিন অফিস করতে হয়। এত ব্যস্ততার মাঝে কাউকে মনে করার সময়ই পায় না।
অফিস শেষে বাড়ি ফিরছিলো অয়ন। পথে গাড়ি থামিয়ে চা খেতে বসেছে এক দোকানে। এমন সময় একটা মেয়েলি চিৎকার ভেসে আসলো। চিৎকারটা শুধু একবার ই শুনতে পেল অয়ন। চায়ে চুমু দেয়া বাদ দিয়ে চমকে উটজে চারিদিকে তাকাতে লাগলো ও।

কিন্তু এখন আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ কোথ থেকে এমন ভয়ংকর আওয়াজ এলো!
দোকানদার কে জিজ্ঞেস করলে দেখলো উনিও ভয় পেয়ে আতংকে হলুদ হয়ে গেছে। অয়ন আর চা খেতে পারছে না। কোনো অশনি সংকেত মনেহচ্ছে।
মেয়েটার চিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। এখন মনেহচ্ছে কারো মুখ চেপে ধরে থাকার শব্দ। মুখ চেপে ধরে রাখলে গলা দিয়ে এরকম আওয়াজ বের হয়। কেউ খুব করে চিৎকার করতে চাচ্ছে কিন্তু মুখ চেপে ধরে থাকার কারণে শব্দ বের হচ্ছে না।

আতংক এসে ভর করলো মনে। কাছেই কোথাও এরকম শব্দ হচ্ছে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো অয়ন। দোকানের পাশে একটা বিশাল গুদাম। কেন যেন মনেহচ্ছে এই গুদামের ভেতর থেকেই এরকম আওয়াজ আসছে। উঠে দাড়ালো অয়ন। দোকান ও গুদামের চারপাশে ভালো করে পরখ করলো। এখন আর সেই শব্দটুকুও নেই। মনের ভেতর অজানা একটা ভয় এসে ভর করলো।
গুদামের চতুর্দিকে ঘুরতে লাগলো অয়ন। শব্দটা এখন বাম দিক থেকে সরে অন্য কোথাও গেছে মনেহচঘে। আইডিয়া অনুযায়ী দেয়ালে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো অয়ন। কিন্তু যা শুনলো তাতে ওর শরীরে রক্ত ছলকে উঠলো। দু থেকে তিনটা ছেলের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে ওদের মুখের বিশ্রী ভাষা। ভাষা শুনেই বোঝা যাচ্ছে ওরা একটা মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করছে। নিশ্চিত মেয়েটার মুখ বেধে ফেলেছে। শরীর কাটা দিয়ে উঠলো অয়নের।

অয়ন ছুটে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে গুদামে প্রবেশের চেষ্টা চালালো। কিন্তু গুদামের বিশাল দরজা ভেতর থেকে আটকানো। এই দরজা ভাংগা সম্ভব না। এখন কি করবে অয়ন? হাতে বেশি সময়ও নেই।
দোকানে এসে দোকানদারকে বলল এক্ষুনি আমার সাথে আসেন। রাস্তায় কয়েকটা গাড়ি দাড় করিয়ে গাড়ির ড্রাইভার ও ভেতরে থাকা লোকজনকে নিয়ে দ্রুত গুদামের দরজায় চলে এলো সবাই মিলে। আট দশজন লোক মিলে গুদামের দরজায় সমান তালে লাথি দিতে লাগলো আর বলতে লাগলো ভেতরে কে?

সেই সাথে কারো কয়েকজনের দৌড়ে পালানোর শব্দ শোনা গেলো। মেয়েটাকেও যদি নিয়ে যায় তাহলে সমস্যা। অয়ন গুদামের চারিদিকে দৌড়াতে লাগলো। নিশ্চিত কোথাও আরেকটা দরজা আছে।
কিন্তু অনেক্ষণ ঘুরেও কোনো দরজা খুজে পেলো না। মেইন দরজায় এসে দেখলো লোকজন খুব জোরে লাথি দিচ্ছে দরজায়।

প্রায় মিনিট বিশেক লাগলো বিশাল গেট টা ভেংগে ভেতরে ঢুকতে। ভিতরে ঢুকে দেখলো গুদামের এক কোণায় একটা মেয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। সবাইকে থামতে বলে আগে ছুটে গেলো অয়ন। গিয়ে নিজের গা থেকে কোট খুলে মেয়েটার গায়ে দিয়ে দিলো। দেখে মনেহচ্ছে কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু মেয়েটার চোখের কোণায় রক্ত গড়াচ্ছে।
অয়ন এসে মেয়েটার হাতের বাঁধন খুলে দিলো। এখনো অজ্ঞান না হলেও হুশ নেই মেয়েটার। আলতো করে মেয়েটার মুখের বাঁধন খুলে দিতেই বুকের ভেতর বিশাল পাথর আছড়ে পড়লো। #রূপন্তী! রূপন্তীকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অয়ন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *