একটি ডায়েরি – না ফেরার দেশে (Emotional Story)

অর্পিতা শুইসাইড করেছে, এ কথাটা অভিক ছাড়া আর কেউ জানেনা। সবাই জানে ঘুমের মাঝেই অর্পিতা মারা গেছে। সাত সকালে পাশে শোয়া অর্পিতার বরফ শীতল গায়ে হাত লাগতেই চমকে উঠেছিল অভিক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে বালিশের ওপর আবিষ্কার করেছিল এক টুকরো কাগজ মানে একটা চিরকুট। তাতে অর্পিতার হাতেই লেখা ছিল তার শুইসাইডর কথা ও কাউকে কিছু জানতে না দেবার অনুরোধ।

কিংকর্তব্য বিমুঢ় অভিক চিরকুটটি তখনই লুকিয়ে রেখেছিল তার স্টিলের আলমারির গোপন ড্রয়ারে। শুইসাইডর কথাটা জানাজানি হলে শুধু কি তার বিপদ, অর্পিতার সম্মানহানির ব্যপারও ঘটতে পারে। নানাকিছু চিন্তা করেই সে কাউকে কিছু বলেনি। কারণ সে ভেবেছিল অর্পিতার মতো ধৈর্য্যশীল, সহনশীল, ইতিবাচক, সদা হাস্যময় একটা শিক্ষিত মেয়ে যে এ রকম আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে, তা সবাইকে তাদের পরিবার ও অর্পিতার ব্যপারে অহেতুক কৌতুহলীই করে তুলতে পারে। সবাই জনতো অর্পিতার হাই ব্লাড প্রেশার ছিলো, তাই তারা ধারণা করেছে হয়ত হার্ট এটাকেই মারা গেছে সে। কিন্তু অভিকের অশান্ত মন কি তাতে শান্ত হয়েছিল? না কি স্ত্রীর অমন তিরোধান রহস্যের কিনারা করবার জন্যে তার মন কেবলই ছটফট করছিল?

অর্পিতার শেষকৃত্য ও শ্রাদ্ধছাড়াও ধর্মীয় ও সামাজিক সব রকম আচার অনুষ্ঠান শেষ হবার পর অভিক মনে মনে এক প্রতিজ্ঞা করে, যে করেই হোক সে খুঁজে বের করবে কি এমন গোপন কষ্ট কিংবা অনুশুচনা অর্পিতাকে ধাবিত করেছিল চিরোতরে হারিয়ে যেতে। অভিক আর অর্পিতার সুদীর্ঘ, প্রায় তিন দশকের সুখী দাম্পত্য জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা সে। স্ত্রী বলতে বন্ধু কিংবা চেনাজানা মানুষের কাছে যে রকম ভয়ঙ্করসব তথ্য পেয়েছিল অর্পিতা ছিলো তার একদম উল্টো। কোন দিন স্বামীর সাথে খামোখা কোন ঝগড়া বাঁধিয়ে তোলেনি

নিজের চাকরী আর সংসারের মাঝে বেশ একটা সমতা রক্ষা করেই চলেছে। অভিকের যৌথ পরিবারের প্রতিও অর্পিতার দায়িত্ববোধেরও কমতি ছিলোনা। এছাড়াও আত্মীয় বন্ধু ও সহকর্মীদের নানা আপদ বিপদে নির্দ্বিধায় এগিয়ে যাওয়াও ছিলো তার স্বভাবের অংশ। এরকম একটা শান্ত সমাহিত পরোপকারি মানুষ যে নিজের জীবনের প্রতি মায়া বা সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে পারে তা কিছুতেই ভাবতে পারেনা অভিক।

মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমেরিকা থেকে আসা বড় মেয়ে কঙ্কনা ফিরে যাবার আগে বাবার কাছে জানতে চায়,
“বাবা, আমরা ভাইবোনরা মার জিনিসপত্র থেকে মার স্মৃতি হিসেবে কিছু নিয়ে যেতে চাই। তোমার অনুমতি ছাড়া তো আমরা কোন কিছুতে হাত দিতে পারিনা।” অভিকের বুকের ভেতরে ধড়াস করে ওঠে, নিজেকে কোন রকমে সামলে নিয়ে বলে,

“আমাকে আর কটা দিন সময় দে, তারপর তোদের যা নেবার নিয়ে যাস।” সেদিন দুপুরের খাবার পর বাড়ির কাজ কর্ম একটু স্তিমিত হয়ে এলে অভিক ওদের স্টিলের আলমারিটা খুলে পরতে পরতে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখা অর্পিতার কাপড়গুলো বের করে খাটের ওপর সাজিয়ে রাখে। আলমারির ড্রয়ার ও তাকের ভেতর আতি পাতি খোঁজে যদি এমন কিছু পাওয়া যায় যা অর্পিতার তিরোধান রহস্য উন্মোচন করে দেবে। কিছুই পায়না, কাপড়গুলো আবার উঠিয়ে রাখে সেখানে। তার গয়নার বাক্স আর দুলের কৌটোটা বের করে দেখে সেখানে সুস্মিতা নিজেই একটা লিস্ট করে রেখে গেছে।

বিয়ের গয়না ও বাকি সব গয়না তিন মেয়ে আর ছেলে বৌয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে গেছে। বাকি গয়নার ব্যপারেও সুস্পস্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছে সে। যেমন কোনটা তার দিদি, ছোট বোন কিংবা বোনঝিদের জন্য তাও লিখে রেখে গেছে। লিস্টের নিচে যে তারিখ লেখা তা দেখে চমকে যায় সে, তা প্রায় তিন বছর আগের একটা তারিখ। রহস্য আরো ঘনিয়ে আসে যেন। অভিক ভাবে তাহলে কি অনেক আগে থেকেই অর্পিতা মৃত্যর কথা ভাবছিল!
পরদিন মেয়েদের কাছে গয়না আর আলমারির ভার দিয়ে বলেছিল,

“তোরা যে ভাবে ভাল বুঝিস সেভাবে এগুলোর ব্যবস্থা করিস। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবার বা জানাবার দরকার নেই।” এর মধ্যে সে চেষ্ট অব ড্রয়ারের ভেতর রাখা অর্পিতার নতুন আর পুরোনো ব্যগগুলোও ঘেঁটে দেখেছে, খাটের নিচে থাকা দুটো টিনের ট্রাঙ্ক খুলেও দেখেছে, কিছুই পায়নি। অর্পিতার পড়ার টেবিল, ড্রয়ার, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার, বিছানার ফোম ও তোষকের নিচে, কত কিছুই যে সে নেড়ে চেড়ে দেখেছে হিসেব নেই। সন্দেহ করার মতো কিংবা কোন ক্লু পাবার সমস্ত আশাই ছেড়ে দিয়েছে সে। ভেতরে ভেতরে অভিক ভেঙ্গে পড়তে থাকে, কিন্তু গোপনীয়তা রক্ষার তাগিদে সে কারোর কাছেই মুখ খুলতে পারেনা।

অবিবাহিত ছোট মেয়েটি ছাড়া অন্য ছেয়েমেয়েরা যার যার যায়গায় ইতিমধ্যে ফিরে গেছে। অর্পিতার মৃত্যুর মাস দুয়েক পর তার সহকর্মী শফিক এক সন্ধ্যায় অভিকের বাড়িতে আসে। অভিক আসন্ন রিটায়ারমেন্টের প্রাপ্য টাকার হিসেব নিয়ে মাত্র বসেছে অমনি মেয়ে সুজাতা এসে বাবাকে ডাক দেয়,

“বাবা, শফিক মামা এসেছেন। তোমার সাথে তার জরুরী দরকার আছে বলেছেন।” টেবিলে রাখা কাগজপত্র থেকে চোখ না সড়িয়েই সে জানতে চায়,
“শফিক মামা? কে সে?” মেয়ে অবাক হয়ে বলে,
“সেকি বাবা, তুমি এরই মধ্যে ভুলে গেলে। মার কলিগ শফিক মামা, উনি তো কতবারই আমাদের বাড়িতে এসেছেন।”
“ও, তাই বল। আসলেই ভুলে গিয়েছিলাম। তোর মাটা এমন করে কিছু জানান না দিয়ে চলে গেল, আমার মাথাটা একদম ঠিক নেই রে। যা ওনাকে গিয়ে বল, আমি আসছি।” অভিকের মনে পড়ে যায়, এই চিরোকুমার শফিককে নিয়ে সে কত রকম ঠাট্টা মস্কারাইনা করেছে অর্পিতার সাথে। আর অর্পিতাও সব সময়ই রেগেমেগে লাল হয়ে যেতো, ওকে আমন করে রাগিয়ে তুলতে বেশ আনন্দও হতো অভিকের।
বসার ঘরে ঢুকে দেখে শফিক চন্দন কাঠের জপমালা দিয়ে রাখা অর্পিতার বাঁধানো বড় ছবিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অভিককে দেখে উঠে দাঁড়ায়,
“আদাব দাদা, কেমন আছেন?”

“কেমন আর থাকা, অর্পিতা এভাবে…” ও কথা শেষ করবার আগেই শফিক বলে,
“আমরাও তাই ভাবি, দাদা। অর্পিদি এভাবে নিরবে চলে গেলেন আমরা ভাবতেই পারিনা। আমাদের অফিসের সবাই ভীষণ মর্মাহত। দিদি সবার কত যে আপন ছিলেন তা এখন আরো বেশী করে বুঝতে পারি আমরা। ছোটবড় এমন কেউ নেই যে দিদির কাছে একটু মায়া বা ভালবাসা পায়নি,” একটু থামে সে। অভিক লক্ষ্য করে শফিকের চোখে দুঃখের ছোঁয়া। শফিক আবার শুরু করে,

“দাদা, যে জন্যে এসেছিলাম। অফিস থেকে দিদির পাওনা টাকার হিসেব করার জন্যে দিদির একটা জিনিস দরকার, সে জন্যই অফিস থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে।”
“কি জিনিস?”

“আমাদের সবার মতো দিদিরও একটা লগ বই ছিলো, যেটায় দিদির সব ট্যুর ও অতিরিক্ত কাজের হিসেব লেখা আছে। অফিসের দু’জন একাউন্ট্যাটের হিসেব মিলে যায়নি, তাই ওটা একটু দরকার।”
“আমি তো কখনো ওর চাকরির ব্যপারে নাগ গলাইনি, কোথায় যে কি রেখে গেছে জানি না। আপনি বসুন, ভেতরে গিযে দেখি কিছু করতে পারি কিনা। ভেতরে ঢুকে সুজাতার ঘরে ঢুকে জানতে চায়,
“সুজাতা, তুই কি বলতে পারবি, তোর মা কোথায় তার অফিসের কাগজপত্র রাখত? শফিক সাহেব এসেছেন একটা কাগজের খোঁজে।”

“কেন বাবা, তুমি জাননা? মা তো বইয়ের আলমারিতে যে ড্রয়ার দুটো আছে তার একটাতে তার অফিসের জিনিসপত্র রাখতো। অন্যটায় আমাদের সবার যত সার্টিফিকেট রাখা।” হ্যাঁ, এবার অভিকের মনে পড়ে এ ক’দিনে একবারও তার বইয়ের আলমারিটার কথা মনে পড়েনি। অর্পিতা আর অভিক কখনোই তাদের সীমা অতিক্রম করেনি, কেউই কখনো কারো ব্যক্তিগত কিংবা চাকরির বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। এমনকি কখনো একজনের চিঠি অন্যজন খুলেও ফেলেনি।

ছেলে বিদেশ চলে যাবার পর ড্রইং রুম থেকে বইয়ের আলমিারিটা এনে সেখানে রেখেছিল। আলমারি খুলে দু’টো ড্রয়ারই একটানে খুলে ফেলে সে। বাঁ পাশেরটিতে তার নিজেরসহ অন্য সবার একগাদা সার্টিফিকেট দেখতে পায়। আর ডান পাশেরটিতে অর্পিতার কাগজপত্র। সবই সুন্দর আর পরিপাটি করে গোছানো। ক্লিয়ার প্লাস্টিকের ব্যাগে এপয়েন্টমেন্ট লেটার থেকে শুরু করে প্রমোশোন, ইক্রিমেন্টের চিঠি, নানা কিছু। সেখানেই আভিক পেয়ে যায় তার লগ বইও। লগ বইটা বের করার পর কাগজগুলো আবার ঠিক করে রাখতে গিয়ে দেখে ড্রয়ারের একদম পিছনে কিছু একটা উঁচু হয়ে রয়েছে।

হাত ঢুকিয়ে সমান করতে গিয়ে সেটা বের করে আনে। একটা মাঝারি আকৃতির ডায়েরি। অভিক ভাবে, অর্পিতা যে ডায়েরি লিখতো তা তো সে জানতো না। তার বুকের ভেতর কাঁপন শুরু হয়ে যায়, অজানা রহস্যের সন্ধান পেতে চলেছে ভেবে শিহরিত বোধ করে । সেটা নিজের ঘরের পড়ার টেবিলের ওপর রেখে ড্রইংরুমে গিয়ে শফিকের কাছে অর্পিতার লগ বইটা দেয়,

“নিন, এটার কথাই বলছিলেন বোধহয়।” শফিক উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে লগ বইটা নিতে নিতে বলে,
“জি দাদা, এটাই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”-

২য় পর্ব

শফিককে বিদেয় করে নিজের ঘরে ফিরে দরজা আটকে ডায়েরিটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে অভিক, উত্তেজনায় তার হাত কাঁপে। মাঝারি আকারের একটা গাঢ়ো নীল রঙের রেকসিনের কাভার ওয়ালা সাদামাটা ডাইরী, অনেকটা জার্নালের মতো। ছোট ছোট অন্তর্ভূক্তি, কখনো দু’লাইন বা আধাপৃষ্ঠা। কখনো তারিখ আছে, কখনো নেই। অভিক হাতে নিয়ে বার কয়েক নাড়াচাড়া করে ডায়েরিটা, পড়তে শুরু করার আগে নানা রকম ভয় আর সংশয় এসে ভর করে তার ওপর। ভাবে না জানি কোন অজানা আর অপরিচিত অর্পিতাকে জানতে চলেছে সে। সুজাতা বাবাকে রাতের খাবারের জন্য ডাকে,
“বাবা, রাত হয়ে গেছে, খাবে এস।” খাবার টেবিলে তাকে অন্যমনস্ক দেখে সুজাতা জানতে চায়,

“বাবা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?” একটু নড়ে চড়ে বসে সে বলে,
“কই না তো।”
“তবে খাচ্ছোনা কেন, বাবা?” আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে আসে সে। ডায়েরিটা নিয়ে বিছানায় বসে বেডসাইড টেবিলে রাখা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নেয়। পড়তে শুরু করে প্রথম পৃষ্ঠা থেকে,

১ ( কোন তারিখ লেখা নেই)
‘সেদিন মা (শাশুড়ি) আর আজ পিসিমা বাবাকে ধোলাই করেছেন আমার সামনে। ওদের চাওয়া মতো পনের সবকিছু দিতে পারেননি বলে যাতা গালাগাল করেছে তাকে। আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন। আমার কিছুই করবার বা বলার ছিল না, কারণ আমার স্কুল মাস্টার বাবা যা দিয়েছেন তাতেই তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এখন আর আমার ভাইদের কাছে যাবারও উপায় নেই, কারণ বাবার ভিটেমাটির অনেকটাই আমার জন্য খরচ হয়ে গেছে। এটাই হয়ত মেয়েদের নিয়তি!’

২ ( তারিখ নেই)
‘আমার সন্তান হবে শুনে মা (শাশুড়ি) মনে হয় খুশি হননি। তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক, আজো বাচ্চা হয়নি। বাড়ির পুরোনো ঝি মলিনাদি একটা কথা বলেছিল সেদিন। কারোর কানকথায় কান দেবনা ভেবে ওসব নিয়ে ভাবনা করিনি। আজ বুঝলাম মলিনাদি মিথ্যে বলেনি। তিনি চাইছিলেন আমার আগে তার মেয়ের কোলে সন্তান আসুক। আমি ভাবছি অভিক কি তার সন্তান নয়! মা হয়ে তিনি কেন নিজের সন্তানদের সাথে পক্ষপাতিত্ব করবেন?’ তারিখ না থাকলেও অভিক বুঝতে পারে এটা পঁচিশ/ছাব্বিশ কিংবা তারো বেশী আগের কথা। আবার পড়তে শুরু করে,

৩ (তারিখ নেই)
‘আজ আমর বড় খুশির দিন। শহরে যে নতুন এনজিওটা অফিস খুলেছে সেখানে চাকরী করবার জন্যে অভিকের মতামত জানতে চেয়েছিলাম। ও রাজি হয়েছে আর বলেছে ওর মাকে ও সামাল দেবে। বড় একটা দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেলাম যেন। এখন মানে মানে চাকরিটা পেলেই বাঁচি। অনেকদিন তো অপেক্ষা করলাম, এখন মেয়েরা মানে কঙ্কনা আর কল্পনা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। এত কষ্ট করে, এত পরিশ্রম করে, বাবার টাকার শ্রাদ্ধ করে ডিগ্রী নিয়ে এভাবে শিক্ষার অবমাননা করার কি কোন মানে আছে? একটু কষ্ট হবে তাহলেও আমি সামলে নিতে পারব।’ অভিক মনে মনে হাসে সেদিনের কথা মনে করে। আসলেই সেদিন অনেক খুশি হয়েছিল অর্পিতা।

৪ (২০/১১/৮০)
‘আজকের তারিখটা লিখে রাখলাম। বিয়ের তারিখের মতো এটাও আমার জীবনের একটা স্মরনীয় দিন। আজ বাড়ির সবার মানে মা, বাবা, বড়দি, দেবর আর অন্যদের আপত্তির মুখেই অভিকের সাহসের জোড়ে চাকরিতে জয়েন করে এসেছি। নিজেকে কেমন যেন স্বাধীন স্বাধীন লাগছিল অফিসে গিয়ে। ওখানে বাড়ির মতো কেউ মা, কেউ বৌদি, কেউ বৌমা কিংবা কেউ অর্পি বলে আমায় ডাকছিলনা। একটু ভয়ভয় লাগছিল, তবে সেটা বাড়ির মতন নয়। বাড়িতে যেমন কারোর মুখে খুশির বদলে দেখি অভিযোগের সুর। ওখানে কাজের চাপ থাকলেও তা নিয়ম মাফিক। সকালবেলা তৈরী হয়ে বাইরে যাবার সময়ই মনটা অন্য রকম লাগছিল, মনে হচ্ছিল আমার বুকটা ফুলে উঠেছিল কয়েক হাত। মেয়েমানুষ পরিচয়ের বাইরেও আমি এখন একজন কর্মজীবী মেয়ে। বিকেলে অবশ্য মা আর মালতিদির কালোমুখ হজম করতে হয়েছে। কঙ্কনা আর কল্পনাকে স্কুল থেকে আনা-নেয়া, বাকী সময়টায় সামলানোর ঝক্কির বেশ বড় এক ফিরিস্ত দিয়েছিলো তারা। আমি চুপ করে ছিলাম, কথা বাড়িয়ে ঝগড়া বাজাতেই আমার যতো ভয়।’

৫ (তারিখ বিহিন)
‘দিনে দিনে চাকরি নয়, সংসারই আমার কাছে কঠিন মনে হচ্ছে। আর দু’দিকের সমতা ঠিক করতে গিয়ে আমি যেন হিমশিম খাচ্ছি। অফিসের কাজে নটা-পাঁচটা থকালেও বাড়িতে কোন টাইম টেবিল নেই। অভিকের ইঞ্জিনিয়ার ছোট ভাই এই শহরের বাইরে পোস্টিং নিয়ে চলে গেছে, তাই বাড়ির সব দায়িত্ব এখন আমাদের। একটু ভুল ত্রুটি হলেই আমার চাকরির খোঁটাটা হজম করতে হয়। কিন্তু যে যাই বলুক, আমি কিন্তু চাকরি থেকে ইস্তফা নেবনা। কারণ ঐ সময়টা শুধুই আমার একার, আমার একান্ত সময়। সেখানে আমি শুধুই অর্পিতা, একটি মানুষ, এটি কর্মী।’ অভিক উপলব্ধি করে সেসব দিনের কথা, সত্যিই প্রচন্ড একটা ধকল গেছে অর্পিতার ওপর দিয়ে। পাতার পর পাতা উল্টে যেতে থাকে অভিক, তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই চোখে পড়েনা, সবই প্রায় আটপৌরে কথা। কোথাও দু’লাইন কিংবা দুটো বাক্যেই শেষ হয়ে গেছে।

৬ (তারিখ বিহিন)
‘মা মানে আমার শাশুড়ি আর অন্যান্যরা মানে তার অন্য ছেলেমেয়েরা ও ভাইবোনেরা আমায় একটা পুত্র সন্তানের জন্যে ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছেন। আমি তো বেশ সুখেই আছি আমার কঙ্কনা আর কল্পনাকে নিয়ে। অভিককে মার কথাটা বলতেই ও মায়ের সুরে সুর মেলালো বলল, “একটা ছেলে হলে কিন্তু মন্দ হতোনা। দেখছ না মেয়েরা কেমন তরতরিয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে, বাড়িতে একটা ছেলে থাকলে বেশ হতো এখন। কিচিরমিচির করে মাতিয়ে রাখত বাড়িটা।” আমি বলেছিলাম, অভিক কি আমায় একটা ছেলে হবার গ্যারন্টি দিতে পারে। ও কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলেছে “চেষ্টা করতে দোষ কি।”

৭ (১১/৮/৮২)
‘গত একটা বছরে আমার ওপর দিয়ে বেশ একটা ধকল গেলেও একটা সুসংবাদ এসেছে আমার জীবনে। হ্যাঁ, আমার একটা ছেলেই হয়েছে। যাক বাবা, বাঁচা গেল। আর একটি মেয়ে হলে আবারও হয়ত কোন চাপে পড়তে হতো, সমাজ তো আর মেয়েদের এত সহজে ছেড়ে দেয়না। সংসার, চাকরী, মেয়েদের স্কুল, লেখাপড়া, vebechil সব মিলে কি যে এক সময় গেছে আমার!’ আবার পাতা উল্টায় অভিক, এক পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা। দু’লাইন পড়তেই হঠাৎ থমকে যায় সে।’

৬ (তারিখ বিহিন)
‘আজ সারাদিন কাজে একটুও মন বসাতে পারিনি। গত ক’বছরে একবারও লিখতে বসিনি, মানে বসার সুযোগ হয়নি। এই ডায়েরি ছাড়া কোথায় আমার মনটা হালকা করব এখন! এত বছর পর অভিক আমায় এমন একটা বিপদে ফেলে দেবে তা ভাবতেও পারিনি। অভিক, আমার ভালবাসা, আমার সম্মান, আমার সিঁথির সিঁদুর, আমার সন্তানদের জনক, …..আমি কিছু ভাবতে পারছিনা।

একটা সম্পর্ক টিকে থাকে বিশ্বাস আর ভালবাসায়, একবার সেখানে চিড় ধরলে তার ভাঙ্গন কি রোখা যায়! যাকে আমি এতকাল শুধু আমার একনিষ্ঠ প্রেমিক বলেই জানতাম, যার চোখে শুধু আমার ছবিই দেখতাম, তার চোখের দৃষ্টিই আজ দুর্বিসহ মনে হচ্ছে আমার। হায় ভগবান, এ কেমন পরীক্ষায় ফেলেছো আমায়! আজ রাতে অভিককে কি বলব আমি, কি বলা উচিত আমার! আমি কি সত্যিই অভিকের ঢাল হয়ে থাকতে পারব সারা জীবন!’

পড়তে পড়তে অভিকের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায়, নিজের বুকের ‘ধড়াস’, ‘ধড়াস’ শব্দগুলো যেন প্রচন্ড শব্দে কান বাজতে থাকে। এতকাল ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা তার জীবনের গোপন অধ্যায়টা মনে পড়ে যায়। অর্পিতার সহযোগিতায় সে নিজেই বলতে গেলে একদম ভুলে গিয়েছিল তার সেই পদস্খলনের ঘটনাটা। তার স্পস্টই মনে পড়ে যায় সেসব দিনের কথা যা অর্পিতার বিশ্বস্ততায় সবার চোখের আড়ালই রয়ে গেছে এতকাল।

সেবার অফিসের একটা প্রজেক্টের কাজে তাকে রাজশাহীতে থাকতে হয়েছিল এক বছরের মতো। ছুটিছাটা আর সপ্তাহশেষে সে বাড়ি ফিরে আসত। সে সময় সেখানে তার সাথে নমিতা মানে সেই অফিসের সহকর্মী সুদীপ্তর বিধবা বোনের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রজেক্টের কাজ শেষে সে যখন শেষবারের মতো ফিরে আসবে, তখন নমিতা জানিয়েছিল সে অন্তঃসত্ত্বা। আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল তার মাথায়। ব্যপারটা জানাজানি হওয়ায় নমিতাও হয়েছিল ঘরছাড়া। তাই অভিক তাকে আলাদা বাসা ভাড়া করে রেখে ফিরে এসেছিল, আর দূর থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল।

অফিসের ট্যুরের কথা বলে সে ছুটে গিয়েছিল সেখানে নির্ধারিত তারিখে, কিন্তু নমিতা একটা কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে লেবার রুমের টেবিলেই মারা গিয়েছিল। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল অভিকের, ছুটে গিয়েছিল নমিতাদের বাড়ি। তারা প্রচন্ড অপমান করেছিল তাকে। এরপর সে এক নার্সের কাছে মেয়েটিকে রেখে ফিরে এসেছিল অর্পিতার কাছে। তার কাছে সব দোষ স্বীকার করে মাফ চেয়েছিল।

আর তার জীবনসঙ্গী হিসেবে তার সব গোপনীয়তা রক্ষার অনুরোধ করেছিল তাকে। তার চেয়েও বড় আব্দার করেছিল স্ত্রীর কাছে, নমিতার মেয়েকে আপন করে নেবার জন্যে। আর সেই ব্যপারটা যে কতটা কষ্ট দিয়েছে অর্পিতাকে তা সে কখনোই প্রকৃত অর্থে উপলব্ধি করেনি। ভেবেছিল একটা ক্ষমা আর অনুসুচনাই যথেষ্ট ছিল। ঐ ব্যপারটা নিয়ে অর্পিতার সাথে কথাও বলেনি তেমন একটা, ভালো করে জানতেও চায়নি স্ত্রীর মনের অবস্থাটা। আবার পাতা উল্টায়।

৩য়: সমাপ্তি পর্ব

(১২/১/৯২)
‘আজ নিজ হাতে যেন বিষপান করেছি। অভিকের গোপন ভালবাসার ফুলকে নিজের কোলে তুলে নিয়েছি। অভিকের কথা মতো সবাইকে বানানো কথা বলেছি। সবাই অবাক হয়েছে তিনটি সন্তান থাকতেও কেন আমি মানে আমরা আরো একটি মেয়ের লালন পালনের ভার নিতে যাচ্ছি। যৌথ পরিবারে থেকে মুখ কালো করে থাকা যায়না, মন খুলে কাঁদা যায়না, স্বামীর সাথে সরবে কিংবা নীরবে ঝগড়াও বাঁধানো যায়না।

তাই অনেক কষ্টে বুকে পাথর চাপা দিয়েই স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করছি। অভিককে একদম স্বার্থপরের মতো হনে হচ্ছে এখন, ভাবখানা এমন যেন এটা আমার জন্য খুবই একটা সাদামাটা ব্যপার। আমার নামের সাথে মিলিয়ে ও নাম রেখেছে মেয়েটির। সুজাতা, এক অবোধ শিশু, কিন্তু আমি যে ওর দিকে চাইতে পারছিনা। এ এমন এক অসহায় অবস্থা কেমন করে কাউকে বোঝাব!

যাকে জীবন মরণের সঙ্গী ভেবেছি এতকাল, সেই তো আমার কষ্টের, দুঃখের কথা একটুও উপলব্ধি করছে বলে বোধ হচ্ছেনা। আমি যখন আমার মনের অবস্থাটা একটু তার কাছে ব্যক্ত করতে চাইছিলাম, ও বলেছিল “সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।” সতিই কি ভাঙ্গা হৃদয় সময়ে জোড়া লেগে যায়!অভিকের কৃতকর্ম ফাঁস করে দিলে ছেলেমেয়ে, আত্মীয় পরিজন, কিংবা সমাজের কাছে আমার কি কোন মুখ থাকবে?

আমাকে অনেককিছুই ভাবতে হচ্ছে, মেয়েদের বিয়ে, ছেলের ভবিষ্যৎ, নিজের মান-সম্মান, সামাজিক মর্যাদা, কোনটিই ক্ষুণ্ণ করে সমাজে বাস করা যায় না। আবার এ এমন কোন সহজ বিষয়ও নয় আমার নিজের জন্যে। কেমন যে এক মানসিক অবস্থার সাথে আমার দিন কাটছে কেউ কি তা বুঝতে পারছে? মনের জগতের এই যুদ্ধ তো ঘরের, বাইরের, কাছের, দূরের কোন মানুষকেই জানানো যায় না। বড় অসহায় বোধ করছি আমি।‘ অর্পিতাকে হারিয়ে এখন অভিক যেন উপলব্ধি করতে পারে সেদিনের অর্পিতার মনের অবস্থা, তার চোখও ঝাঁপসা হয়ে আসে। আবার পাতা উল্টায়।

৮ (৩১/১/০৪)
‘কতদিন পর আজ লিখতে বসেছি, আগের তারিখ থেকে আন্দাজ পেলাম, প্রায় এক যুগ পর। গত মাসে সুজাতার বারো বছর হয়ে গেল। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে করে আমি আজ ক্লান্ত। প্রথম প্রথম সুজাতা যখন আমায় মা বলে ডাকত কেমন জানি লাগত, কিন্তু একটা মানুষ হিসেবে একটা শিশুকে অবহেলাও করতে পারিনি। অভিকের মাঝে কোন রকম দ্বিধা, সঙ্কোচ, কিংবা অপরাধবোধ দেখিনি কখনো এই এতগুলো বছরে। পুরুষ মানুষ কি অমনই স্বার্থপর হয়! ওদের ধারণা তাদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে স্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেই সব চুকেবুকে গেল।

আমি সত্যিই কি অভিককে ক্ষমা করতে পেরেছি! এ ক’বছরে আমি অভিকের চোখের দিকে ভালো করে তাকাইনি, অবিস্বাসী সেই চোখ দু’টোর দিকে। যে চোখে আমি ছাড়া অন্য কারো প্রতিচ্ছবি পড়েছিল এককালে। হোক তা ক্ষণিকের মোহ, তবুও তা পোড়ায় আমায় কেবল।’ অর্পিতার আবেগঘন লেখাগুলো পড়তে পড়তে নিজেকে যেন নতুন করে আবিস্কার করে অভিক, এক ধরণের অপরাধবোধ বাসা বাঁধে তার মনে। এরপর একের পর এক সাদা পাতা উল্টে যেতে থাকে সে, ভাবে বোধয় এটাই শেষ লেখা। শেষের দিকের একটা পাতায় আঁটকে যায় তার চোখ ।

৯ (১২/১৫/২০০৭)
‘আমার বিয়ের তিরিশ বছর হবে আসছে বছর। ছেলে মেয়েরা ঘটা করে পঁচিশ বছরপূর্তি পালন করেছে, আমার কিন্তু একটুও ভালো লাগেনি। কঙ্কনা আর কল্পনার বিয়ে দিয়ে দিয়েছি সুপাত্রে। কঙ্কনা ওর বরের সাথে আমেরিকায় চলে গেছে। আর কল্পনাও ঢাকায় চলে গেল বরের সাথে। আমার ছেলে নিলয়ও এবার বুয়েট থেকে পাশ করে ঢাকায় বড় চাকরি করছে। বাড়িটা যেন হঠাৎ করেই খালি হয়ে গেছে।

মাথার ওপর এখন মুরুব্বিও নেই, মাও গত হয়েছেন সেই কবেই। এখন আমিই এ বাড়ির একচ্ছত্র অধিকর্তা, কিন্তু অভিকের সেই ব্যপারটা থেকে সংসারের জন্যে কোন আকর্ষনই আর বোধ করিনা। এতদিন যা করেছি তা শুধুই ছেলেমেয়েগুলোর মুখ চেয়ে কর্তব্যের খাতিরে। আমার জন্যে ওদের জীবন নষ্ট হবে সেটা চাইনি কখনো। অভিকের জন্যে ভালবাসার যে বান ডেকেছিল বুকে, তা তো কবেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। এতদিন আমি যে অভিনয় করে চলেছি, এখন আর যে তা চালিয়ে নিতে পারছিনা। একটু একটু করে গোছাতে শুরু করেছি, প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ প্রস্তুতি কথাটা পড়ে অবাক হয় অভিক, কই তার নজড়ে তো এমন কিছু ধরা পড়েনি কখনো। ডায়েরির শেষের দিকের পাতাটা উল্টে চোখ রাখে অভিক।

১০ (৮/৫/২০০৮)
‘ছেলেটাও চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে গেল, এখন কাকে নিয়ে থাকব? কাদের জন্যে বাঁচব? সেদিন কথাটা অভিককে বলতেই ও হেসে দিয়ে বলল, সুজাতার কথা। সুজাতা যদি অভিকের সন্তান না হয়ে অনাথ কেউই হতো তো বেঁচে যেতাম আমি। ও যে প্রতিক্ষণই আমায় মনে করিয়ে দেয় অভিকের সেই চোখ যা নমিতার দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিল। আমি তো আমার চোখে বা মনে কখনোই অন্য কাউকেই ঠাঁই দিতে পারিনি!

আমি কি কখনো অভিক ছাড়া আমার আশপাশের মুগ্ধ চোখগুলোর ভাষা বুঝতে পারিনি? না, আমার কাছে ভালবাসা মানে সবটুকু একজনকেই উজাড় করে দেয়া, কোন খাঁদ রাখতে নেই তাতে। কেন যে এত ভালবেসেছিলাম অভিককে আমি! তাই হয়ত এত কষ্ট পাচ্ছি। দিনে দিনে এই বেঁচে থাকাটাই অসহ্য লাগছে আমার কাছে। নিজের সত্যিকার আবেগ লুকিয়ে রাখায় যে কি কষ্ট!

আমার জিনিসপত্র কি করে ভাগ বাটেয়ারা হবে তার একটা লিস্ট করে ফেলেছি। অভিককে কি কিছু বলার আছে আমার? তাই ভাবছি ক’দিন ধরে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাবার পর ওকেই যে এখন আমার একদম সহ্য হচ্ছেনা। আজ পর্যন্ত কারোর কাছেই অভিকের ব্যপারে মুখ খুলিনি, কিন্তু এখন যে এ ভার আর বইতে পারছিনা। মনের রাজ্যের এই তুফান যে আর বাঁধ মানছেনা, জীবনের সবকিছুই অসার মনে হচ্ছে।’ অভিক অস্থির হয়ে ওঠে, কি করে পাশে থেকেও অর্পিতাকে সে বুঝতে পারেনি, একটুও আঁচ করতে পারেনি তার মনের অবস্থা।

সে ভাবে অর্পিতা যদি তার ওপর রাগে ফেটে পড়তো, কিংবা সত্য জানিয়ে সবকিছু তছনছ করে দিতো, তাও হয়ত ভালো ছিলো। সেটায় হয়ত জীবনটা এলোমেলো হয়ে যেত, তবুও তো সুজাতা বেঁচে থাকত। সুজাতাকে আনার দিন থেকে অর্পিতা একদম স্বাভাবিক থেকেছে, তার মনের খবর তো তাকেও জানতে দেয়নি কখনো।

নাকি সে কোনকিছু জানার বা কোনকিছু বোঝার, মানে স্বামী হয়ে স্ত্রীর ভালমন্দ বোঝার জন্য আন্তরিক কোন চেষ্টাই করেনি, নানা কথারা ঘুরপাক খায় অভিকের মনে। তার মনে পড়ে শেষদিনও কত স্বাভাবিক থেকেছে অর্পিতা। তাদের পছন্দের ক রকম পদ যে রান্না করেছিল, একসাথে বসে খাইয়েছিল। একটুও বোঝার উপায় ছিলনা কি ঘটতে যাচ্ছে। পরের পাতা, মানে ডায়েরির শেষ পাতায় চোখ রাখে সে।

১১ (তারিখ বিহীন)
‘শেষ পর্যন্ত সাহসটা সঞ্চয় করে উঠতে পেরেছি। গুণে দেখেছি তিরিশটা ট্যাবলেট, একবারে খেয়ে নিলে আর কাল চোখ মেলে তাকাতে হবেনা। আজ অফিস ছুটি ছিলো, অভিক আর সুজাতার পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি। সন্ধ্যায় সুজাতার চুলে তেল দিয়ে বেনী করে দিয়েছি। অভিকের ধোয়া জামা কাপড় ইস্ত্রি করে আলমারিতে গুছিয়ে রেখেছি। মেয়েদের জন্যে প্রার্থনা করেছি, ওরা যেন শোকটা সামলে নিতে পারে। ছেলেটার বিয়ের জন্যে আমার বিয়ের গয়না আর বৌয়ের জন্যে একটা লাল বেনারসি শাড়ী কিনে রেখে গেলাম, বিয়েটা আর দেখতে পারবনা।

আর পিছু হটতে চাইনা আমি, এখনই অভিকের জন্যে একটা নোট লিখে রাখি।’ অভিকের দু’চোখ জ্বালা করে ওঠে, চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে যায়। সেই চিরকুটটার কথা মনে পড়ে, “জীবনের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি, তোমার দেয়া সেই গুরুভার আর সইতে পারছিনা। তাই নিজের ইচ্ছায় চলে গেলাম। পনের বছর আগে যেমন তোমার গোপনীয়তা রক্ষার ভার নিয়েছিলাম, আর তা আমি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেছি বুকে পাথর চাপা দিয়ে। আজ তোমার কাছে আমার ভার দিয়ে গেলাম, আশা করি বাকী জীবন তুমিও আমার মতই বিশ্বস্ত থাকবে।‘…অর্পি

Author: নীলাভ্র আর নীলাম্বরীর গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *