পর্ব ৬
রাহার কথামতো ওকে আমার রুমে নিয়ে এলাম। রুমে এসে রাহা বিছানার উপর বসে পড়লো৷ দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এসেছি। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছি দূরত্ব বজায় রেখে বসার জন্য। রাহা যেন আমাকে ভূল না বোঝে। রাশার স্পর্শে আমার মনে যে শয়তান উকি দিচ্ছিল এবার যেন তা হয়।
রাহা বলল, আপনিও বসুন না। কোনো সমস্যা নেই।
- ইটস ওকে। আমার বসতে হবেনা।
- বসলেও আমি কিছু মনে করবো না। প্লিজ বসুন।
আমি রাহার পাশে বসে জড়োসড়ো হয়ে রইলাম। কিভাবে কথা বলবো সেটাই বুঝতে পারছি না। নরমালি আমি অনেক বকবক করলেও এইমুহুর্তে এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়ার পর মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে।
রাহা নিজেই আগে কথা শুরু করলো, একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বললো- বোনটা আর মানুষ হলোনা!
আমি চুপ করে আছি৷ এরকম কথায় কিছু বলার থাকেও না। যেহেতু ঘটনাটার সাক্ষী রাহা নিজে। ভাগ্যিস রাহা সব শুনে ফেলেছে৷ অন্যথায় আমাকে খারাপ ভেবে বসে থাকতো।
রাহা বললো- আপনাকে অসম্মানিত হতে হলো আমাদের বাসায় এসে। প্লিজ এসব কথা কারো সাথে শেয়ার করবেন না। আমার বোনের লজ্জা কম থাকলেও আমার বাবা মায়ের একটা সম্মান আছে। প্লিজ!
আমি বললাম, ওকে কিছু মনে করবো না। ইটস ওকে।
- ইটস ওকে?
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, কি আর বলব। রাশা আমাকে পছন্দ করে তাই হয়তো নিজেকে সামলাতে পারেনি। - তাই বলে এভাবে? পছন্দ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাশা যা করেছে সেটা অস্বাভাবিক। আমি ওকে ক্ষমা করতে পারছি না।
- প্লিজ রাহা, ব্যাপারটা ভুলে যান।
- ভুলে যাবো? আমার বোন সেটা ভাবতেই আমার লজ্জা হচ্ছে জানেন?
- বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা মনে করে অযথা কষ্ট পেওনা প্লিজ৷ সরি, তুমি বলে ফেলেছি।
- ইটস ওকে। আপনি বাবাকে কিছু বলবেন না। আর আমি রাশাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিবো। অন্যকেউ হলে ঠিকই এই সুযোগ কাজে লাগাত। আপনি ভালো ছেলে বলে…
আমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত বোধ করলাম। সেইসাথে নিজের পছন্দের মানুষের মুখে এরকম কথা শুনে ভালো লাগলো।
রাহা বলল- আমি ওর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনি ঘুমান এখন। জানি ঘুম আসবে না। তারপরও চেষ্টা করুন। এসব ভেবে নিজে কষ্ট পাবেন না প্লিজ।
আমি রাহাকে স্বান্তনা দিয়ে বললাম, আমি কষ্ট পাবো না। আপনি নিজের রুমে চলে যান।
রাহা বিছানা ছেড়ে উঠলো। দরজার কাছাকাছি এসে থমকে দাড়াল। আমি হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। রাহা পিছন ফিরে বলল- আপনার অনেস্টি আমাকে মুগ্ধ করেছে। এরকম ছেলেও আজকাল আছে! রাশা তো কম সুন্দরী নয়। তবুও আপনি ওকে ইগনোর করলেন! এরকম একটা সুযোগ ছেড়ে দিলেন। মহান আপনি!
আমি মনেমনে দারুণ খুশি। খুশিতে মনটা আগডুম বাগডুম করছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, রাহা। আমি একজন মানুষ বলে নিজেকে দাবী করি৷ এরকম কিছু করলে আমি আর মানুষ থাকলাম কই বলেন?
রাহা কিছু বললো না। নিঃশব্দে চলে গেল আমার ঘর থেকে। আমি থ মেরে বিছানায় বসে পড়লাম। আমার প্রিয়জনের রেখে যাওয়া সুবাস আমাকে মুখরিত করে ফেললো৷ রাহাকে ইমপ্রেসড করতে পেরে আনন্দিত আমি। নিজেকে নিয়ে নিজেরই আনন্দ হচ্ছে। রাহা যদি আমার প্রেমে পড়ে যেতো, কতই না ভালো হতো!
আমি অনেক রাত অব্দি বিছানায় গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। ঘুমাতেই পারলাম না। ভোররাতে ঠান্ডা আবহাওয়ায় চোখে ঘুম নেমে এলো।
বেঘোরে ঘুমালাম সকাল দশটা পর্যন্ত। নাস্তার সময় হলে রাহা এসে ডেকে তুললো৷ চোখ মেলে ওকে দেখতে পেয়ে আমার আনন্দ যেন আর ধরেই না। কিন্তু বাইরে খুশি প্রকাশ করলাম না। রাহা আমাকে ডাকতে ডাকতে বলল, উঠুন। আর কত ঘুমাবেন? আব্বু আম্মু নাস্তার টেবিলে ওয়েট করছে।
আমি মুগ্ধ হলাম ওর আচরণে। এমনভাবে কথা বলছে যেন গতরাতে কিছুই হয়নি। রাহার এই গুনটা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাড়া করলো আমাকে। মেয়েটা সত্যিই অভাবনীয় সুন্দর!
রাহা হাসিহাসি মুখে বললো- উঠুন তো। দশটা বাজে।
আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, দশটা বাজে! ও মাই গড।
আমি না ওঠা পর্যন্ত রাহা দাড়িয়ে রইলো। আমি ওঠার পর ওয়াশরুমে গেলাম। বেরিয়ে এসে দেখলাম রাহা বিছানা গোছাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে৷ হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে কিছু বললো না। আমার বউ হলে এভাবেই প্রতিদিন বিছানা গোছাবে ও। আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখবো শুধু!
রাহা বলল- চুলটা ঠিক করে খেতে আসুন।
আমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে রইলাম থ হয়ে। চুল আবার কিভাবে ঠিক করবো৷ আয়নায় নিজেকে দেখা বাদ দিয়ে রাহাকেই দেখছিলাম। রাহা এসে বলল, কি হলো? চুল আচড়াতে বললাম।
আমার মনেহচ্ছিল রাহা আমার ঘরের বউ৷ হাসি পাচ্ছিল আবার ভাল লাগছিল। রাহা ব্যস্ত হয়ে বলল- কথাই শোনেনা লোকটা। চুল আচড়ান মশাই।
আমি হুশ ফিরে পেয়ে বললাম, চিড়ুনি কই?
- ওহ হো৷ চিরুনি তো আমার রুমে। দাড়ান নিয়ে আসছি।
- আরে আরে লাগবে না। থাক কষ্ট করতে হবে না।
- কে বলেছে হবেনা? চুল ঠিক না করে সবার সামনে যাবেন? তা হয়না।
- সেজন্য তো আপনাকে কষ্ট দিতে পারিনা।
- ঠিকাছে, কষ্ট দিতে না চাইলে আমিও কষ্ট করবো না৷ কিন্তু চুলটা তো ঠিক করতেই হবে। তাহলে উপায় কি?
রাহা আমাকে অবাক করে আমার কাছে এসে নিজের হাতে আমার চুল ঠিক করে গুছিয়ে দিলো। আমি তো পুরোপুরি হতবাক! রাহা এটা করছে বিশ্বাস ই হচ্ছিলো না। রাহা চুল ঠিক করতে করতে মুচকি মুচকি হাসছিল৷ সত্যিই এখন ওকে আমার বউ মনেহচ্ছে। আমিও মুচকি হাসছিলাম।
রাহা চুল ঠিক করে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল। আমি ওর পিছুপিছু নাস্তার টেবিলে এলাম।
নাস্তার টেবিলে এসে দেখি রাশা বাদে সবাই আছে৷ মুজতবা আলম সাহেব আমাকে দেখে শুভ সকাল জানালেন আমিও হেসে জানালাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, শরীর মন সব ভালো তো?
- জ্বি ভালো। আপনার?
- আমারও ভালো।
ওনাকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। সেটা দেখে আমার বেশ ভালো লাগলো৷ আমি রাহার দিকে তাকালাম। রাহা ইশারায় আমাকে ধন্যবাদ জানালো। আমি বেশ বুঝলাম কেন ধন্যবাদ দিলো। কারণ গতরাতে ওর বাবাকে ব্যাপারটা জানালে হয়তো উনি এখন হাসপাতালে থাকতেন৷ এই হাসিমুখটা আর দেখা হতো না।
রাহা আমার দিকে নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিলো৷ আমি প্লেট নিয়ে খাওয়া আরম্ভ করলাম। মুজতবা আংকেল বললেন, রাশা এলোনা খেতে?
রাহা বললো, বাবা ওর শরীর খারাপ তাই শুয়ে আছে।
- সেকি! কি হইছে?
- আরে তেমন কিছুনা৷ সারারাত জেগে ছিল তাই এখন মাথা ব্যথা। ঘুমাচ্ছে। তুমি টেনশন কোরো না তো।
আংকেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলে নীলাভ?আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।
আংকেল বললেন, এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারিনা। আমার একটা কথাও ও শুনবে না। খুব অনিয়ম করে চলবে। মেয়েটাকে নিয়ে আমি কি যে করবো…
আমি কিছু বললাম না। আন্টি বললেন, কিছুই করতে হবেনা। দেখতে দেখতে মেয়ে বড় হয়ে গেলো। এখন বিয়ে দিয়ে দাও দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
আংকেল সম্মতি দিয়ে বললেন, তা ঠিক বলেছো। বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। হা হা হা..
আন্টি বললেন, আগে রাহার বিয়েটা দিতে হবে। ওর বিয়েটা হয়ে গেলে তারপর রাশা৷
আমি আড়চোখে রাহার দিকে তাকালাম। দেখি লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। বিয়ের কথা শুনলে বোধহয় মেয়েরা এভাবেই লাল হয়ে যায়!
আংকেল বললেন, হ্যা হ্যা ঠিক বলেছো৷ কিন্তু ভয় পাই জানো? মেয়ে দুটো স্বামীর ঘরে চলে গেলে বড্ড একলা হয়ে যাবো আমরা। তাইনা?
রাহা বলল- বাবা তুমি থামো তো। এখন আমি কোথাও যাচ্ছিনা তোমাদেরকে ছেড়ে। বিয়ের সময় অনেক পড়ে আছে। আমাকে বিদায় করার কথা ভাবলে কিন্তু রাগ করবো।
আংকেল আন্টি হাসলেন। আমিও হাসলাম ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু মনেমনে বলছিলাম রাহাকে যেন আমিই পাই। মেয়েটা যে আমার বুকের ভিতর খনন করে ফেলেছে৷ তাকে তো আমার চাই ই। বাঁচবো কি করে ওকে ছাড়া?
খাওয়াদাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বসে আড্ডা দিলাম। আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে। আমাকে এবার চলে যেতে হবে। সকাল থেকে খুব ভালো সময় কাটিয়েছি৷ রাহার গুণে গতরাতের বাজে ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি আংকেল আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে বের হবার পর রাহা দৌড়ে বাইরে এলো৷ রাস্তায় দাড়িয়ে আমাকে বলল, শুনুন।
- হুম।
- চলেই যাচ্ছেন?
- হ্যাঁ যাচ্ছি তো।
রাহা কি যেন বলতে চাচ্ছে। আমতা আমতা করছে শুধু৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনো সমস্যা? - আপনি আর আসবেন না? অবশ্য এরকম বিশ্রী ঘটনার পর আমাদের বাড়িতে আর না আসাটাই স্বাভাবিক।
- আসবো।
- আমি জানি আপনি আসবেন না৷ জানি, ভালো করে জানি।
- আসবো বললাম তো। আপনার জন্য আসবো।
রাহা আমার চোখের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই আবার চোখ নামিয়ে নিলো। বলল- আপনার ফোনটা দেখি?
আমি ফোন বের করে এগিয়ে দিলাম। রাহা কি যেন করল। তারপর আমার ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো- আমার নাম্বার সেভ করে দিলাম। বাসায় পৌঁছে আমাকে একটা ফোন দেবেন। একটা কথা বলতাম কিন্তু এখন বলতে পারছি না৷ আসি..
রাহা দৌড়ে বাসার ভেতরে চলে গেলো। আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। তারপর চলে এলাম নানুবাড়িতে। মনে খুশির জোয়ার বইছে। এ আনন্দ কোথায় রাখি?নানুবাড়ির সবাই আমার লাফালাফি দেখে কারণ জানতে চাচ্ছিলো। খুশির ঠেলায় কথাই বলতে পারছিলাম না। ছাদে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে রাহাকে ফোন দিলাম।
রাহার মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। অনেক আশা ও উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি কথা যেন বলবেন বলেছিলেন?
রাহা বললো- তেমন কিছু না। রাশার কাজটার জন্য সরি বলতে চেয়েছিলাম। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি। প্লিজ এটা মনে রাখবেন না।
আমি হতাশ হয়ে বললাম, জাস্ট এটাই?
- হ্যাঁ এটাই। আর কিছু বলার নেই।
- ওহ আচ্ছা৷ আমি আরো ভাবলাম…
- কি ভাবলেন?
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। রাহা জিজ্ঞেস করলো, কি করছেন? - এইতো ছাদে পায়চারি করছি। তুমি?
এভাবে কথা বাড়তেই লাগলো। অনেক্ষণ কথা বলার পর একজন আরেকজনের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিলাম। কথা বলে বিকেল হয়ে এলে ফোন রেখে নিচে নেমে এলাম। রাহাকে দ্রুত আমার করে নিতে পারবো মনেহচ্ছে। কি আনন্দ!
পরেরদিন
রাতেও অনেকরাত পর্যন্ত রাহার সাথে কথা হলো৷ মনেহচ্ছে এই একটা ঘটনার পরেই রাহা আমার প্রতি দূর্বল হয়ে গেছে। যাইহোক, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে৷
কিন্তু রাতে খাবার টেবিলে মামা যা বললেন সেটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বড় মামা হঠাৎ করেই তার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিলেন। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়লো। মা বাবা দুজনই মামাকে অনেক ভালোবাসে। যদি তারা বিয়ের ব্যাপারে জোর করে তাহলে কি হবে!
পর্ব ৭
মামাতো বোন রাইসাও আমাদের সাথে খাচ্ছিলো। বিয়ের প্রস্তাব দেয়াতে উঠে চলে গেলো। ওর চোখমুখ দেখে আমি নিশ্চিত ও বিয়েতে রাজি৷ আমি নিরুপায় হয়ে মামার দিকে তাকালাম।
মামা বললেন, রাইসা তোকে অনেক পছন্দ করে। আমরাও সবাই করি। যদিও বোনের ঘরে আত্মীয়তা করতে চাইছিলাম না। কিন্তু রাইসা ওর বোনদের সবাইকে বলেছে বিয়ে করলে তোকেই করবে। ওর পছন্দ তো ফেলতে পারিনা বাবা।
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। রাইসা তো নিজের কথা বলে রেহাই পেয়েছে। আমি এবার কিভাবে থামাবো সবকিছু? আমার পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে বাবা মা সেটা ভেবেও দেখবেন না৷ তার কাছে বড়ভাই ভাবীর ইচ্ছেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কি যে করি!
আমি আর খেতে পারলাম না। তারাহুরো করে খাবার শেষ করে বললাম, মামা আমার মাথা ধরেছে আমি রুমে যাই একটু। এ ব্যাপার নিয়ে আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলে নিবেন।
কথাটা বলে আর দাড়ালাম না৷ সবাই হতভম্বের মত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ আমি জানি এটা অভদ্রতা হয়ে গেছে। কিন্তু এটার মাধ্যমে হলেও অন্তত বুঝতে পারুক আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। যার প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই তাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে কল দিলাম রাহাকে। মনের যন্ত্রণা মেটানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করলাম। ভার্সিটি লাইফ, বন্ধুবান্ধব, প্রেম এসব নিয়ে কথা হতে লাগলো। কথা বলতে বলতে রাহাকে অনেক আপন মনে হচ্ছিলো আমার।
নানুবাড়ির কারো সাথেই আমার আর তেমন কথা হলোনা। মামা অফিসে গেলে আমি মামীদের থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এলাম। বড় মামী অবাক হয়ে বারবার বলছিলেন কেন চলে যাচ্ছি এভাবে?
তবে আশাকরি সবাই এটুকু বুঝতে পেরেছে যে আমি রাইসাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিনা বলেই চলে যাচ্ছি। এবার এসে লাভ ক্ষতি দুটোই একসাথে হতে চলেছে আমার।
আমি সবার কথা অমান্য করেই রীতিমতো জোরপূর্বক বাসায় চলে এলাম। আম্মু আমাকে দেখে পুরোপুরি অবাক। কোনো ফোন না দিয়ে বাসায় চলে এসেছি তার উপর হঠাৎ করে। মা অবাক হলেও আমার মুড দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না।
আমি বাসায় পৌঁছে গোসল সেরে একটা ফ্রেশ ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে ওঠার পরপরই মা চা নিয়ে এসে আমার পাশে বসলো। কৌতুহলী চোখে জিজ্ঞেস করলো, কি হইছে বাবা? তুই কি কোনো সমস্যায় আছিস?
- আম্মু আমি একজনকে ভালোবাসি৷
মা খানিকটা হকচকিয়ে গেলো ঠিকই তারপরও স্বাভাবিক গলায় বলল- ও সে তো ভালো কথা। মেয়েটার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে? - না মা এখনো তাকে জানাতেই পারিনি।
মা হেসে বললো- তাহলে আর দেরি কেন বাবা? দ্রুত জানিয়ে দে। আর আমারও তো একটা লাল টুকটুকে বউ খুব দরকার।
আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে বললাম, মা আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।
- তোকে পারতে কে বলেছে? আমরা কি তোকে অন্য কোথাও বিয়ে দিচ্ছি নাকি?
- না মা তবুও বলে রাখলাম। আমি ওকে ভালোবাসি মানে ওকেই আমার চাই। আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে গ্রহণ করতে পারবো না ব্যস।
মাকে কথাটা বলে আমি চায়ে চুমুক দিলাম। মা হাসতে হাসতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমি আবেগের সুরে বললাম, আম্মু রাহা অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। ওকে তোমার খুব পছন্দ হবে দেখো।
- ওর নাম বুঝি রাহা?
- হ্যাঁ আম্মু। নামের মতই মিষ্টি। কি যে কিউট তুমি ভাবতেও পারবা না। যতটা না মিষ্টি দেখতে, তারেচেয়েও বেশি সুন্দর ওর পারসোনালিটি। আম্মু তারাতাড়ি আমি ওকে নিয়ে আসতে চাই। আমার ঘরে হেঁটে হেঁটে বেড়াবে দেখতে খুব ভালো লাগবে না বলো?
মা আমার কথা শুনে হেসেই খুন হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। আমার কথায় মায়ের আগ্রহ খানিক বেড়ে গেছে বুঝতে পারলাম।
আমি আরো বেশি বেশি রাহাকে নিয়ে সুনাম গাইতে চেষ্টা করলাম যাতে ওর প্রতি মায়ের একটা আলাদা ফিলিংস জন্মে। শেষে ক্লান্ত হয়ে মাকে রুম থেকে বিদায় দিলাম। মনটা এখন অনেক ফুরফুরে। রাহাকে কিভাবে ইমপ্রেসড করা যায় মনেমনে সেই ফন্দি আটছি।
সারাদিন রাহার সাথে ফোনে মেসেজিং চালিয়ে গেলাম। রাত্রিবেলা খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে এসে মাত্র শুয়েছি। এমন সময় বাবা মায়ের রুম থেকে আমার ডাক পড়লো। ফোন টিপতে টিপতে ওদের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। বাবার মুখ অনেক গম্ভীর। কাহিনি কি বুঝতে পারলাম না আমি৷ কৌতুহলী চোখে গিয়ে পাশে দাড়ালাম।
আব্বু বললো, বসো।
- কি হয়েছে আব্বু? এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? এনি প্রবলেম?
মা বললো, তুই তোর নানুবাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছিস?
আমি চুপ থেকে বললাম, মেজো মামীকে বলে এসেছি। - এনাফ? মেজো মামীকে বলে চলে আসলেই হবে? আগে থেকে কাউকেই কিছু না জানিয়ে হুট করে চলে আসাটা কোন ধরণের বেয়াদবি?
- মা, আমার মনের উপর প্রেশার পড়ছিলো। আমি নিতে পারছিলাম না।
- কিসের প্রেশার?
- মামা কিছু জানায়নি তোমাকে?
মা বললো, না। শুধু তোর নানা ফোন দিয়ে বললো ছেলে মানুষ করতে পারোনি। বেয়াদব হয়েছে একটা৷ গতকাল রাতে বাসার বাইরে ছিল আর আজকে কাউকে কিছু না বলেই চলে গেছে। আমাদের মান সম্মান রাখলি না কিছু৷ সবাই তোকে কত ভালো জানতো অথচ এটা কি করে এলি?
আমি নিশ্চুপ। আমি নিজেও জানি এটা উচিত হয়নি। কিন্তু সেখানে থাকলে আবার বিয়ের কথা বলতো। তাছাড়া রাইসা যেহেতু আমাকে পছন্দ করে, সেখানে থাকা ন্যায়সংগত মনে হয়নি আমার। তাই চলে এসেছি। কিন্তু বাবা মাকে কিভাবে বোঝাই?
আব্বু রেগে বললেন, এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে? ঘুরতে গিয়ে এভাবে আমাকে ছোট করলে। তোমার নানা আমাকে এসব কি বললো আজকে? এত বছরের সংসারে কখনো কেউ কিছু বলতে পারেনি আমাকে।
আমি মাথা নিচু করে রইলাম।
আব্বু আবার বললো- তোমার তো এরকম বাজে স্বভাব ছিলোনা। এসব আসলো কোথ থেকে? কার সাথে মিশে এরকম হয়ে গেলে?
- আব্বু বড় মামা..
- চুপ থাকো। একটা কথাও বলবে না তুমি।
- আমার কথাটা শোনো। তাহলে বুঝবে কেন চলে এসেছি।
বাবা মা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। আমি বললাম, আগে শোনো তারপর বলিও আমার কাজটা আদৌ খারাপ হয়েছে কিনা?
আব্বু আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, তার আগে বলো তোমরা কি আসলেই কিছু জানোনা? - না। কি জানার কথা বলছিস?
- বড় মামা রাইসাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
আব্বু আম্মু দুজনেই চমকে উঠলো। বাবা অবাক হয়ে বললো, হোয়াট! কি বলো তুমি?আমি বললাম, হ্যাঁ আব্বু। বড় মামা চান আমি রাইসাকে বিয়ে করি। আর রাইসা নিজেও আমাকে পছন্দ করে। আমি যাওয়ার পর থেকে সারাক্ষণ আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আমার আনইজি লাগছিলো। আমি রাইসাকে কোনোভাবেই বিয়ে করতে পারবো না। কারণ আমি একজনকে ভালোবাসি। আর সেজন্যই আমি চলে আসতে বাধ্য হয়েছি৷
বাবা মা কোনো কথা বললেন না৷ মা কেমন হতভম্ব হয়ে গেছে। অনেক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মা বললো, তুই রাইসাকে পছন্দ করিস না?
আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। এখন আবার মা’র মন ঘুরে যাবে না তো? রাইসা মায়ের নিজের ভাতিজি আর নিজের ভাই যদি বিয়ে দিতে চায় মা না করতে পারবে না।
মা বললো, রাইসাকে ভালো লাগেনা তোর?
- রাইসাকে ভালো লাগা খারাপ লাগার বিষয় নয়৷ আমার পছন্দের একজন আছে৷ আমি তাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না৷ বাকিটা তোমরা ম্যানেজ করে নিও। মামার সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে তোমরা বলবে৷
আব্বু আম্মু দুজনেই গম্ভীর। আমি উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললাম, আমি এখন রুমে যাবো? - যাও।
আমি সোজা নিজের রুমে চলে এলাম। আব্বু আম্মুর উপর ছেড়ে দিয়েছি ব্যাপারটা। এখন সবকিছু ওনারা ম্যানেজ করে নেবেন। আমার আর ঝামেলা রইলো না।
মনের সুখে রাহার সাথে চ্যাটিং করতে লাগলাম।
রাহা বলল, কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে খুব।
- চলো যাই। আমার ভাইকে যাবা?
রাহা রিপ্লাই দিলো, কিভাবে সম্ভব! - আমি আসবো বাইক নিয়ে
- এতদূর থেকে বাইক নিয়ে!
- হ্যাঁ। তুমি যেতে বললে অবশ্যই আসবো৷
- আপনার কষ্ট হবে থাক।
- কষ্ট একটু নাহয় হবে৷ আমি আসবো?
- আপনি আসতে চাইলে ট্রেনে আসুন। এসে দেখা করেই চলে যাবেন।
- ওকে ম্যাম, যথা আজ্ঞা।
রাহার সাথে পরেরদিন দেখা করতে যাবো এরকমই পরিকল্পনা করে রাখলাম। অথচ সকাল বেলা রেডি হয়ে বের হওয়ার সময় দেখি মুজতবা আংকেল আমাদের বাসার সামনে৷ আমি তো অবাক! আংকেল এখানে!
উনি আমাকে দেখে হাসলেন। আমি ছুটে গিয়ে শুভেচ্ছা জানালাম। আংকেল বললেন, তোমার টানে না এসে পারলাম না।
- সত্যি!
আমি আংকেলের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। ঘোরের মধ্যে আছি বোধহয়।
আংকেল বললেন, রাহার জন্য পাত্র দেখতে এসেছিলাম। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই৷ আমার ট্রেন আর দুই ঘন্টা পরে।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমি যে ট্রেনে যাওয়ার জন্য বের হয়েছি আংকেল সেই ট্রেনেই বাড়ি ফিরবেন। আমার তাহলে কোনোভাবেই রাহার সাথে দেখা হবেনা৷ কিন্তু তারচেয়েও করুণ কথা যেটা সেটা হচ্ছে রাহার জন্য পাত্র!
আমি কৌতুহলের ভান করে বললাম, আংকেল পাত্র দেখতে এসেছিলেন?
- হ্যাঁ। পাত্র ইঞ্জিনিয়ার। ছেলে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
আমার বুকের ভেতর দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো৷ আংকেলকে নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলাম। আজ আমার কোনোভাবেই আর যাওয়া হবেনা। কিন্তু রাহার বিয়ে কিভাবে আটকাবো আমি! একইসাথে দুজনের বিয়ের কথা উঠেছে। কি অদ্ভুত নিয়ম!
মুজতবা আংকেল নাস্তা করে বাবা মায়ের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেই চলে যাওয়ার জন্য বের হলেন৷ আমি আজ আর যাবোনা৷ আগামীকাল গিয়ে রাহাকে প্রপোজ করে দিবো সরাসরি।
রাহাকে ফোনে বিয়ের কথাটা বলতেই ও কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেল৷ অনেক্ষণ থ মেরে চুপ রইল। আমি হ্যালো হ্যালো বললাম কিছুক্ষণ কিন্তু কোনো রিপ্লাই পেলাম না৷ শেষে বাধ্য হয়ে ফোন কেটে দিলাম।
পরেরদিন গিয়ে সরাসরি ওকে প্রপোজ করবো এরকমই চিন্তা ভাবনা আমার। কিন্তু এরমধ্যে বাঁধলো আরেক বিপত্তি৷ রাত্রিবেলা আব্বু আম্মু আমাকে ডেকে বললেন,
- তোমার নানুবাড়ির সবাই চায় তুমি রাইসাকে বিয়ে করো।
- সবাই চাইলে কি হবে? আমি তো চাইনা।
- তোমাকেও চাইতে হবে। আমাদেরও রাইসাকে অনেক পছন্দ।
- কিন্তু আব্বু আমি একজনকে পছন্দ করি…
আব্বু বললো, তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসো। আমরা দেখে যদি পছন্দ হয় তাহলে তাকেই বিয়ে করিও। আর যদি মনেহয় সে আমাদের বাড়ির বউ হওয়ার অযোগ্য, তাহলে রাইসাকেই বিয়ে করতে হবে তোমার।
আমার বুকের ভেতর দহন শুরু হয়ে গেল৷ রাহা নিজেও জানেনা আমি ওকে পছন্দ করি। রাহাকে বাসায় আনলে আব্বু আম্মুর পছন্দ হবে শিওর। কিন্তু রাহা তো জানেনা আমি ওকে ভালোবাসি। ও তো কোনোভাবেই আমাদের বাসায় আসবে না। তাছাড়া এতদূর পথ পারি দিয়ে এখানে এসে দেখা করাটা ওর জন্য অনেক টাফ। ওদিকে মুজতবা আংকেল ওর জন্য ছেলেও ঠিক করে ফেলেছেন। কোনোভাবেই মেয়েকে কোথাও যেতেও দিবেন না৷ আমি যেন মহাসমুদ্রে পড়ে গেলাম। জানিনা এরপর কি হবে…
পর্বঃ ৮ এবং শেষ
রাহাকে হারানোর চিন্তাটা আমার ভেতর একেবারে জেকে বসেছে। শান্তিমত চলাফেরাও করতে পারছি না। কিভাবে সবকিছু সমাধা করা যায় সেই চিন্তা আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে৷
রাহাকে মেসেজ দিয়ে কোনো উত্তর পেলাম না। ফোন দিলেও কয়েকবার রিং হলো কিন্তু রাহা রিসিভ করলো না। আমি আজকে দেখা করতে যাবো বলেছিলাম, ও নিশ্চয় অপেক্ষা করে বসেছিলো৷ আমি যাইনি বলে নির্ঘাত ভয়ানক রেগে আছে৷ কিন্তু ফোন না ধরলে তো রাগও ভাঙাতে পারবো না।
মেসেজ দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেক্ষণ পর রাহার নাম্বার থেকে কল আসলো৷ রিসিভ করার পর ও ভেজা ভেজা কণ্ঠে বললো- আমার তো মরণ দশা হয়ে গেছে।
- কেন?
- আমার বিয়ে পাকা করে ফেলেছে বাবা।
- একেবারে পাকা করে ফেলেছে! কি বলো এসব?
- হ্যাঁ। বাবা এই ছেলের সাথেই আমার বিয়ে দিবে৷ কিন্তু আমি কোনোভাবেই ওকে বিয়ে করতে পারবো না।
আমি কৌতুহল বশত জানতে চাইলাম, কেন পারবে না? - কারণ ওই ছেলেটার সাথে আমার একসময় রিলেশন ছিল। ব্রেকাপ হয়ে গেছে। ছেলে আমাকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছিল। যে আমাকে অপমান করেছে তার সাথে থাকা আমার পক্ষে পসিবল না।
আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি।
রাহা বললো- ছেলেটা আমার পিছু ছাড়েনি৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ফিলিংস নেই৷ আমি ওকে বিয়ে করলে সুখী হতে পারবো না৷ অপমানগুলো আজীবন আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। ওকে ভালোবাসতেও পারবো না।
- কিন্তু বাবা তো পাকা কথা দিয়ে ফেলেছে বললে?
- এখন যেভাবেই হোক বিয়েটা আটকাতে হবে।
- রাহা, একটা কথা বলবো?
- হ্যাঁ বলুন।
- আমারও সেইম প্রবলেম। বাসা থেকে বিয়ের জন্য মেয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আমার মামাতো বোনের সাথে। কিন্তু আমি তো তোমাকে…
- আমাকে কি?
- রাহা আমি তোমাকে পছন্দ করি। শুধু পছন্দ না, আমি তোমাকে নিয়ে আজীবন থাকার স্বপ্ন দেখি৷ বিশ্বাস করো প্রথম দিন তোমাকে দেখেই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।
রাহা নিশ্চুপ।
আমি বললাম – আমাকে বিলিভ করো রাহা। আমি একটুও মিথ্যে বলছি না। আমি সেই প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়েছি। লাভ ইন ফার্স্ট সাইট। প্লিজ রাহা আমাকে ভুল বুঝো না। আমি সারাজীবনের জন্য শুধুমাত্র তোমাকেই পেতে চাই।
হুট করে কলটা কেটে গেলো। ধক করে উঠলো আমার বুক। আবার ডায়াল করলাম কিন্তু রাহা রিসিভ করলো না। এদিকে আমার টেনশন হু হু করে বাড়ছে। একদিকে বিয়ের টেনশন, একদিকে রাইসা, একদিকে ভালোবাসা হারানো৷ সবমিলিয়ে কঠিন প্যারায় পড়েছি আমি।
রাহাকে আর ফোন দেয়ার সাহস পাইনি। ক্ষমা চেয়ে এসএমএস পাঠালাম ওর নাম্বারে। জানিনা এতে কতটুকু লাভ হবে কিন্তু রাহা যেন আমাকে ভুল না বোঝে।
পরেরদিন থেকে দেখি রাহার নাম্বার বন্ধ। আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করার জন্যই ফোন অফ রেখেছে নাকি আবার বিয়ের ব্যবস্থা করছে সেটা ভেবে চিন্তায় ভেংগে পড়লাম আমি। সারাদিন ফোন দিয়ে বন্ধই পেলাম।
এভাবে দুটো দিন পার হয়ে গেলো। আব্বু আম্মু আমাকে বারবার প্রেশার দিচ্ছে হয় রাহাকে নিয়ে এসে তাদের সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার জন্য আর নয়তো রাইসাকে বিয়ে করার জন্য।
আমি অনেক চেষ্টা করেও মায়ের ডিসিশন বদলাতে পারলাম না। বারবার শুধু মনেহচ্ছে মা তো একজন মেয়ে৷ একজন মেয়ে কেন বুঝতে পারছে না তার ছেলের ভেতরে কি বয়ে যাচ্ছে।ছেলেরা নাকি কখনো কাঁদেনা৷ অথচ আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। এ কেমন পরিস্থিতিতে পড়লাম আমি! যে আমি সারাজীবন হেসে খেলে পার করেছি সেই আমাকেই এভাবে চাপে ফেলে দেয়া হলো। কার জীবনে কখন কি আসে কেউ বলতে পারেনা।
আজ আর থাকতে পারলাম না। রাহার ফোন তো বন্ধ৷ কিন্তু আমি একবার ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। আমি সরাসরি যাবো ওর বাসায়। ওকে ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করবো আমাকে ভালোবাসতে পারবে কিনা? আর যদি ও আমার থেকে হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে কি করবো নিজেও জানিনা।
আশা হারালাম না। কিন্তু দুশ্চিন্তায় মরমর অবস্থা আমার। মনে হাজারো প্রশ্ন আর দগ্ধ হৃদয় নিয়ে রাহাদের বাসায় চলে এলাম। রাহার মা আমাকে দেখে অবাক! খুশি হয়ে বললেন, বাবা তুমি!
আমি বললাম, আন্টি আংকেল কোথায়?
- উনি তো বাসায় নেই বাবা। কাজে গেছেন। বিকেলের আগে ফিরবেন না মনেহয়।
- আমি তাহলে একটু বসি।
- হ্যাঁ বাবা বসো। আমি শরবত এনে দিচ্ছি।
- আন্টি লাগবে না, আমি রাহার সাথে একটা জরুরি কথা বলতে চাই। ও কি বাসায় আছে?
আন্টি অবাক হলেও লুকিয়ে গিয়ে বললেন, রাহা রুমেই আছে। কি বিষয়ে কথা বাবা? - আন্টি একটা পারসোনাল কথা৷ আগে আমি ওর সাথে কথা বলবো তারপর আপনি ওর কাছ থেকে জেনে নিয়েন।
আন্টি ভ্রু কুঁচকালেন। ভাবটা এমন যে রাহার সাথে আমার কি পারসোনাল কথা থাকতে পারে? আন্টি রাহার নাম ধরে ডাকলে আমি বললাম আমি নিজে গিয়ে কথা বলছি।
রাহার রুমের দরজায় এসে দেখি ও শুয়ে বই পড়ছে। কিন্তু মুখটা অনেক মলিন। বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মনোযোগ অন্যদিকে। আমি দরজায় দাড়িয়ে বললাম, বইয়ে মুখ ডুবিয়ে অন্যমনস্ক কেন?
রাহা চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। আমি বললাম, হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। অপরপাশের মানুষটার কথা একবার অন্তত ভাবা উচিত ছিলো।
রাহা কোনো জবাব দিলোনা৷ বসা থেকে উঠে দাড়ালো। আমি বললাম, জাস্ট একটা কথা বলতে এসেছি আর একটা কথা শুনতে এসেছি।
- কি কথা?
আমি কাছে এগিয়ে এসে বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি৷ এর উত্তর শুনতে চাই। হ্যাঁ নাকি না? যদি হ্যাঁ হয় তাহলে তোমাকে আমার বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে হবে।
রাহা থ হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল- কি বলছেন এসব? - আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই৷ তুমি চাইলে দুজনের বিয়েটাই বন্ধ করে আমরা নতুন লাইফ শুরু করতে পারি রাহা?
রাহা নিস্তব্ধ থেকে বলল- বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। - কিন্তু তুমি তো সেই ছেলেকে চাওনা। আমি তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। তুমি শুধু হ্যাঁ বলো?
- না। আমি আপনাকে ভালোবাসি না৷
- আমার সমস্যাটা কোথায়?
- কোনো সমস্যা নেই। আমি পারবো না। চলে যান প্লিজ।
রাহা আমাকে রুমে রেখেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। আমি ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। আন্টি এসে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে?
আমি বললাম, আন্টি আমার বিয়ে। কিন্তু আমি রাহাকে ভালোবাসি। আর বিশ্বাস রাহাও আমাকে পছন্দ করে। ও কি করতে চায় সেটা শুনতেই এসেছিলাম।
আন্টি অবাক হয়ে তাকালেন। আমি বেরিয়ে এসে চলে এলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।
আরো একটা দিন কঠিনভাবে কাটলো। ওদিকে রাইসা খুব কান্নাকাটি করার কারণে বড়মামা আরো বেশি চাপ দিতে লাগলেন। সব চাপ এসে পড়লো আমার কাঁধে। আমি উদাস ভাবে বসে আছি। এমন সময় শুনতে পেলাম রাহার গলা। আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি এক ছুটে বসার ঘরে চলে এলাম।
রাহা বলল- আমি এসেছি নীলাভ। আমাকে কি করতে হবে?
আমি মুচকি হাসলাম। এরমধ্যে আব্বু আম্মুও ঘরে প্রবেশ করেছেন। রাহাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করার পর বাবার মুখ দেখে মনেহচ্ছিল উনি রাহাকে পছন্দ করেছেন। কিন্তু মায়ের মুখ এখনো মলিন। বাবা একটা কিছু বললেই হয়।
রাহা আমার দিকে তাকিয়ে বাবাকে বলল- আমিও ওনাকে পছন্দ করি। এখন আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন কি করবেন?
বাবা সময় চেয়ে রাহাকে রেস্ট নিতে বললো। রাহা ফ্রেশ হয়ে আমাদের সাথেই খাবার খেলো৷ ওর আদব কায়দা দেখে বাবার মন গলেছে আশাকরি।
বিকেলেই রাহার বাবা মুজতবা আংকেল এসে হাজির৷ আন্টি নিশ্চয় ওনাকে সব বলে দিয়েছেন। আমি দুশ্চিন্তা করছিলাম ফাইনালি কি ঘটে সেটার জন্য। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মুজতবা আংকেল বললেন, নীলাভ কে প্রথম দেখেই আমার পছন্দ হয়েছে। খুব খাটি ছেলে। আমার মেয়ে যদি ওকে পছন্দ করে থাকে তাহলে আর আপত্তি করবো কেন?অবশেষে রাহার সাথেই আমার বিয়েটা হলো। অনেক মানসিক চাপ সহ্য করে ফাইনালি রাহাকে পাচ্ছি। কি যে অন্যরকম এক আনন্দ হচ্ছে!
বাসর ঘরে ঢুকে দেখি রাহার পড়নে নীল শাড়ি। নীল টিপ আর হাতে নীল চুড়ি। পাক্কা নীলপরি নীলাঞ্জনা। আমার সেই প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। এ যেন আমার স্বপ্নের রাজ্যের নীল পদ্মাবতী।
আমি অপলক রাহাকে দেখছি আর মনে মনে বলছি..
তুমি পদ্ম আমি নীলাভ।
না তুমি নীলপদ্ম নীলান্তি।
না না তুমি আমার নীল পদ্মাবতী।
জানো পদ্ম ফুলের কোন আকর্ষণীয় ঘ্রাণ নেই!
তবু আমি তোমাতে স্নিগ্ধ কোমল ঘ্রাণ খুঁজে পাই।
হ্যাঁ পদ্মের ও ঘ্রাণ আছে
যে ঘ্রাণ শুধু তোমাতেই সাজে।
জানো তোমাকে আজ ঠিক পদ্মফুল এর মতো লাগছে।
তবুও আমার ইচ্ছে হচ্ছে এক গুচ্ছ পদ্ম ওর হাতে তুলে দেই। আপাতত পদ্ম তো নেই, ভালোবাসার হাতটাকেই নাহয় পদ্মা ভেবে গ্রহণ করুক।
আমি রাহার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। রাহা হেসে সাদরে গ্রহণ করলো সেই ভালোবাসার স্পর্শ।
- নীলাভ্র নেহাল
এবং রূপন্তী (১৮ পর্ব) – Sad Valobasar Golpo
একটুখানি প্রেম (সব পর্ব) – Romantic Valobasar Golpo