পর্ব ২১
ফিয়োনাকে ছেড়ে যাওয়ার কারণটা বলতে শুরু করলো ফাহমি, “সেদিন তোমার আব্বু আমাকে যা যা বলেছিলো, তারপরও সম্পর্ক টা গোপনে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু রাতে যা ঘটেছে তারপর আর ধরে রাখতে পারিনি ফিয়োনা। আমি জানি তুমি আমাকে অপরাধী ভাবছো কিন্তু আমার জায়গায় থাকলে কিন্তু তুমিও সেটাই করতে”।
ফিয়োনা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো, কি করতাম? কি ঘটেছিল রাতে?
ফাহমি বলল, রাত্রিবেলা তোমার আম্মু আমার রুমে এসেছিলো। আমাকে রিকুয়েষ্ট করে বলেছিল যেন তোমার লাইফ থেকে সরে যাই। নয়তো ব্যাপারটা আমার ফ্যামিলিকে জানাতে বাধ্য হবে। তুমি একবার ভেবে দেখো আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করা একটা ছেলে। আমি একটা কোচিং সেন্টারে পড়াই। বাবা মায়ের চোখের মধ্যমণি। সারাজীবনে আমি এমন কিছু করিনি যাতে আমার বাবা মায়ের মান সম্মান নষ্ট হয়। আজ যদি আমি এমন কিছু করি তাও একটা ছোট্ট মেয়ের সাথে, আমার বাবা মায়ের কাছে আমি জবাব দিতাম? আমার মান সম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো বলতে পারো?
ফিয়োনা কিছু বলল না। ফাহমি আবারও বলল- প্লিজ একবার বোঝার চেষ্টা করো। তোমার আম্মু বলেছিলেন যদি তোমার রেজাল্ট খারাপ হয়, যদি তোমার বাবা আবারও জানতে পারেন তুমি আমার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো তাহলে তোমার মাকে উনি ছেড়ে দেবেন। এটা শোনার পর কিভাবে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ রাখি বলো?
- ছেড়ে দেবেন মানে?
- মানে তোমার আমার সম্পর্কের কথা আবারও ওনার কানে পৌঁছালে উনি তোমার মাকে ডিভোর্স দেবেন বলেছিলেন।
- কিহ! বাবা এ কথা বলেছিল মাকে?
- হ্যাঁ। আন্টি আমাকে তাই বলেছিলেন।
- আমার বিশ্বাস হয় না।
- এর সত্যতা আমি জানিনা। আমাকে যা বলা হয়েছে তাই বললাম। আমি চাইনি আমার জন্য একজন মায়ের সংসার ভাঙুক। আমি চাইনি আমার কারণে আমার বাবা মা কেলেংকারীর শিকার হোক। আমি চাইনি আমার জন্য
সমস্ত টিচার জাতির অপমান হোক। এটা কি আমার অন্যায় হয়েছে তুমি বলো?
ফিয়োনা অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। সত্যিই ফাহমির কথায় কড়া যুক্তি আছে। কিন্তু ফিয়োনার যে অনেক চাপা অভিমান জমে আছে ভেতরে।
ফাহমি বললো- দেখো আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। তাই কখনো তোমাকে ভুলতে পারিনি। ভালো জব পাওয়ার পর বাবা মা আমার বিয়ের জন্য অনেক জোর দিচ্ছিলো। তবুও আমি বিয়েতে রাজি হইনি। কারণ তোমাকে ভুলতে পারবো না বলে। আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি ফিয়োনা। আর ভালোবাসি বলেই এখনও তোমার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছি। ভালোবাসি বলেই অন্য কারো সাথে তোমাকে মেনে নিতে পারি না।
ফিয়োনা চুপচাপ শুনে গেলো। ওর চোখ জলে টলমল করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আজ।
ফাহমি বলল- আমি যদি এসব শোনার পরও তোমার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যেতাম, আমার সাথে আর একটা ইন্টার পড়ুয়া বাচ্চা ছেলের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকতো না। আমি যথেষ্ট ম্যাচিউরড একটা মানুষ। আবেগের বশবর্তী হয়ে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ানো টা আমার শোভা পায় না। তুমি বড় হয়েছো, আশাকরি বুঝবে আমার ব্যাপারটা। তাছাড়া আমি ছিলাম একজন শিক্ষক, শিক্ষকের একটা সম্মানের জায়গা আছে। সব জেনেও কি তুমি চুপ করে থাকবে? সবটা শুনেও কি আমাকে অপরাধী ভাব্বে?
ফিয়োনা কাঁদতে কাঁদতে বলল- একটাবার আমাকে জানাতে পারতে। আমাকে অপেক্ষা করতে বলতে পারতে। আমি অপেক্ষা করতাম..
- সেই মুহুর্তে তোমার বাবা মায়ের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়টাই আমাকে পেয়ে বসেছিলো বেশি। এখন আর সে ভয় নেই। এখন আমি স্বাবলম্বী। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসে দেবো।
ফিয়োনা কাঁদতেই লাগলো অনবরত। কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো ওর। কান্না থামতেই চাইছিল না। ফাহমি ফিয়োনার মুখটা ধরে গালে জিভ লাগিয়ে সমস্ত জল চুষে নিয়ে বলল, তুমি আমার ফিয়োনা। তুমি কি সত্যি সত্যি নীলাভকে ভালোবাসো? - না। নীলাভ আমার বন্ধু।
- আমাকে ভালোবাসতে তোমার কষ্ট হবে?
ফিয়োনা ড্যাবড্যাব করে ফাহমির দিকে তাকিয়ে রইলো। এতগুলো সময় পেরিয়ে গেছে, দীর্ঘদিন দূর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কেটেছে। এতদিন পর এসে এই আবদার করছে ফাহমি!
ফিয়োনার হাত পা কাঁপতে লাগলো। নিজেকে মনে হতে লাগলো স্বপ্ন। যেন যা কিছু ঘটে চলেছে সবটা স্বপ্নে। ফাহমি নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। আচমকা বুকে টেনে নিলো ফিয়োনাকে। ফাহমির প্রতি হয়তো ভালোবাসাটা এখনো রয়েই গেছে। রাগ, অভিমান সবই জড়ো হলো ভালোবাসায় এসে। সবটা পরিণত হলো প্রেমে। ফিয়োনা ফাহমির বুকে মাথা রেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ফাহমির বাহু বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করে অন্যরকম সুখের খোঁজ করছিলো।
ফাহমিও দুহাতে পরম আবেশে জাপটে ধরে রইলো ফিয়োনাকে। এ সুখের যেন কোনো শেষ নেই। এতদিন পর ফাহমির মনে হচ্ছে নিজের একটা ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে ও। বুকে একটা শান্তি শান্তি ভাব।
ফিয়োনা অনেক্ষণ যাবত নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও পারলো না। ফাহমি ফিয়োনার মুখটা ধরে উপরে তুললো। তারপর গভীর আবেশে চুম্বন করলো ফিয়োনার ঠোঁটে। এই প্রথম কারো ঠোঁট ফিয়োনার ঠোঁট ছুঁয়েছে। কাঁপতে লাগলো ফিয়োনা। ফাহমি দুহাতে মুখটা ধরে আলতো করে চুম্বন করেই যাচ্ছে। চুম্বনের মহাসুখে মেতে উঠেছে দুটি প্রাণ।
দীর্ঘ চুম্বনের পর ফাহমি ফিয়োনার মুখ ছেড়ে দিয়ে দেখলো জলে গাল ভিজে গেছে। কাঁদছে ফিয়োনা। ফিয়োনার কান্না দেখে ফাহমি চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, কেঁদো না লক্ষিটি। তোমাকে আমার করে নিলাম।
ফিয়োনা সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনার আগাগোড়া কিছুই খুঁজে পেলো না। হঠাৎ ফাহমির উদ্ভব আর তারপর এসব ঘটে যাওয়া এখনো নিছক স্বপ্নের মত লাগছে। ফিয়োনা বুঝতেই পারছে না কি করবে। ও দুহাতে আকড়ে ধরলো ফাহমি কে।
ফাহমি ফিয়োনাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে চাইলো। ফিয়োনা হাত পা ক্রমাগত কাঁপছে। ফাহমি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, পাগলী আমার। আজ থেকে তুমি শুধুই আমার বুঝেছো?
- কিন্তু..
- কোনো কিন্তু নয়। আমাকে তোমার সবকিছু ভেবে মেনে নাও। আজ থেকে তোমার সবটা জুরে আমি বিরাজ করবো আর আমার তুমি।
- এটা কিভাবে হবে ফাহমি? বিয়ে পর্যন্ত এগোবে কি করে?
- দেখো আমি এখন ভালো চাকরি করি। আর আমার মা আর খালা আমার সম্পর্কে তোমার মাকে একটা ভালো রিকমেন্ডেশন দিয়েছেন। তোমার মা জামাই হিসেবে আমাকে চায় আমি এটা বিশ্বাস করি। খুব দ্রুত আমার মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো তোমাদের বাসায়। তারপর দেখা যাক কি হয়..
- বাবা যদি রাজি না হয়?
- হবে। রাজি না হলে তুমি বুঝিয়ে বলবে। আমি ভালো সরকারি জব করি। আর আমার ব্যাকগ্রাউন্ড, ফ্যামিলি সবই ভালো। বিয়েতে আপত্তি করার কারণ দেখছি না। আগে আপত্তি করেছিল কারণ তোমার বয়স কম ছিল আর সামনে পরীক্ষা ছিল। কয়েকদিন পর তুমি সেকেন্ড ইয়ারে উঠবে। এই বয়সে একটা মেয়ের বিয়ে হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রয়োজনে আংটি পড়িয়ে রাখবো।
ফিয়োনার চোখ আনন্দে ছলছল করে উঠলো। এটা কিসের আনন্দ বুঝতে পারলো না ও। ফাহমিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার অনেক কষ্ট হয়েছ ফাহমি। তোমাকে ভুলতে আমার অন্যরকম কষ্ট হয়েছিলো। যা কখনো এক্সপ্লেইন করতে পারবো না। - তুমি ভেবো না। সব কষ্ট আমার ভালোবাসার আদর দিয়ে দূর করে দেবো।
- ফাহমি..
- কি?
- এত গুলো দিন আমি কোনো ছেলের সাথে কথা বলিনি। কারো সাথে মিশিনি। কারো সাথে অপ্রয়োজনে কথাও বলিনি। এমনকি ফেসবুকে কারো রিকুয়েষ্ট পর্যন্ত একসেপ্ট করিনি।
ফাহমি মুচকি হেসে বলল, তুমি যে আমাকে ভালোবাসো। তাই.. - ফাহমি।
- হ্যা বলো।
- আমি তোমাকে পাবো তো?
- বিশ্বাস রাখো লক্ষিটি। আর নিজের প্রতি যত্নশীল হও।
ফিয়োনাকে বুক থেকে তুলে ফাহমি বলল, এখন আমায় চলে যেতে হবে। ফোন দেবো বাসায় গিয়ে।
ফিয়োনা আরেকবার জাপটে ধরলো ফাহমিকে। এতদিনের জমে থাকা সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, অভিমান সবই জলে মিশে গেলো যেন।
ফাহমি বাসায় ফিরেই কল দিলো ফিয়োনাকে। ফিয়োনা এখনও স্বপ্নের ঘোরে আছে। স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে সবকিছু। ফোন রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, হ্যালো..
- তোমাকে রেখে আসতেই ইচ্ছে করছিলো না।
- আমারও। সবচেয়ে অবাক হচ্ছি এটা দেখে যে, এতদিন আমাদের যোগাযোগ ছিলো না অথচ মনে হচ্ছে আমরা সবসময় একসাথেই ছিলাম।
- এটাই তো ভালোবাসা রে পাগলী। মন খারাপ করো না। খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
- সত্যি! আমার না সুখে কান্না আসছে।
- কাঁদো। আমি তোমার কান্নার শব্দ শুনে প্রাণটা জুরাই।
- কান্নার শব্দ শুনলে প্রাণ জুড়াবে? খুব আনন্দ হবে আমি কাঁদলে তাই না? আমি তো জানি তুমি আমাকে কষ্ট দিতেই বেশি ভালোবাসো।
ফাহমি হাসতে শুরু করলো। অনেক্ষণ ধরে হাসার পর বললো, পাগলী রে। আমি কি টের পাইনি তুমি আমাকে কতটা মিস করছিলে? তুমি যতবার আমাকে স্মরণ করে কাঁদতে, ততবার আমারও তোমাকে মনে পড়তো।
- তাই!
- হ্যাঁ। তোমাকে ভেবে ভেবে আমারও কি কম কষ্ট হয়েছে? পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভেবে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। অনেকবার চেয়েছিলাম যোগাযোগ করতে কিন্তু হাজারো কথা ভাবতাম। আমার কারণে দুটো ফ্যামিলি কষ্ট পাক সেটা চাইনি। আমি অপেক্ষায় ছিলাম আজকের দিনটির জন্য।
ফিয়োনার আবারও চোখে জল আসছে। ও চোখ মুছে বলল, এই কান্নাই যেন আমার শেষ কান্না হয়।
- তাই হবে লক্ষিটি। তাই হবে।
ফিয়োনা দেখলো ফোনে কল আসছে বারবার। এদিকে নীলাভ অনেক্ষণ ধরেই ফিয়োনাকে কল করে চলেছে। কল দিতে দিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ফোন ওয়েটিং দেখে টেনশন হতে লাগলো ওর। ফিয়োনা কার সাথে বলছে এত কথা?
দীর্ঘদিন পর ফাহমির সাথে কথা। তাই ঘন্টা খানেক কথা বলার আগে কথা শেষ হতেই চাইলো না।
ফিয়োনা কথা শেষ করে বলল- নীল।
- এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলে তুমি? আমাকে ওয়েটিংয়ে রেখেছো।
- তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। কাল দেখা করো, সব বলবো তোমাকে।
- কি ব্যাপারে কথা?
- দেখা হলেই সব বলবো। এখন রাখি?
- মানে! এতক্ষণ ওয়েটিংয়ে রাখার পর আবার রাখতে চাইছো?
- হ্যাঁ। আমার কিছু করার নেই। রাখতেই হবে যে। কাল দেখা হোক, সবকিছু খুলে বলবো তোমাকে।
ফিয়োনা ফোন কেটে দিলো। এখন নীলাভের সাথে কথা বললে ফাহমি কষ্ট পাবে। দেখা হলে নীলাভকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হবে।
পরদিন
ফিয়োনার সাথে দেখা করার জন্য পাগলের মত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নীলাভ। তিনদিন ধরে ফিয়োনাকে অন্যরকম লাগছে। কি হয়েছে ওর কে জানে। কিন্তু যাই হোক তা যেন ভালোর জন্য নয়।
ফিয়োনাকে আসতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো নীলাভ। ফিয়োনা দ্রুত এগিয়ে আসছে নীলাভের দিকে। নীলাভকে সবকিছু বুঝিয়ে বললে ও যেন বোঝে।
২২ এবং শেষ পর্ব
ফিয়োনা যতই এগিয়ে আসছে, ততই হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে নীলাভের। কেন এমন হচ্ছে কে জানে। কোনো এক অজানা কারণে হারানোর ভয় কাজ করছে ভেতরে। তবুও অপেক্ষা করছে নিলাভ। ফিয়োনা আসছে, কথা হবে, এটাই বা কম কিসে! গত তিনদিন যাবত ও তো কথাই বলেনি।
ফিয়োনা কাছে এগিয়ে আসছে আর ওর মুখটা কঠিন হয়ে ধরা দিচ্ছে নিলাভের কাছে। ফিয়োনা এসে নিলাভের পাশে বেঞ্চে বসলো। নিলাভকেও বসতে বললো।
ফিয়োনাকে দেখে বসতে ভুলে গেছে নিলাভ। ও বলল, কেমন আছো তুমি?
- আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
- যেমন রেখেছো।
- আমি রেখেছি?
- হ্যাঁ। তুমি যেমন রাখো আমি তো তেমনই থাকি।
নীলাভের কণ্ঠ মলিন শোনালো। কিভাবে কথাটা শুরু করবে বুঝতেই পারছে না ফিয়োনা। অনেক্ষণ কথা বলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। তবুও সমস্যা একটা আছে সেটা ধরে ফেললো নীলাভ।
বলল- তুমি কি কোনো সমস্যায় আছো?
ফিয়োনা হাসার চেষ্টা করলো- না না। ঠিক সমস্যা না। কিন্তু..
- কিন্তু কি ফিয়োনা?
- আজ আমি তোমার কাছে দুটো অনুরোধ নিয়ে এসেছি নীল। আমার অনুরোধ দুটো রাখবে না?
- রাখার মত হলে অবশ্যই রাখবো।
- যদি রাখার মত না হয়?
- আই থিংক তুমি এমন অনুরোধ করবে না। রাখার মত হবে না কেন?
ফিয়োনার বুক কাঁপছে। ফিয়োনা বেশ ভালো করেই জানে নীলাভ ওকে কতটা ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার মানুষ টাকে কঠিন কোনো কথা বলার আগে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক।
ফিয়োনা বললো, নীল। তুমি বিষয়টাকে সহজভাবে নেবে কথা দাও। মাথা গরম করবে না।
- আচ্ছা কথা দিলাম। তুমি যত কঠিন কথাই বলবে, শোনার জন্য আমি প্রস্তুত।
কথাটা বলার সময় নীলাভের গলা কাঁপছিলো। ফিয়োনা নীলাভের চোখে চোখ রেখে বললো, আমরা কি সারাজীবন বন্ধু হয়ে থাকতে পারি না?
নীলাভ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। মনে মনে এই ভয়টাই পেয়েছিল ও। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, হুম। তারপর?
- প্লিজ নীল। তুমি বন্ধু হিসেবে অনেক ভালো একজন মানুষ। প্লিজ কোনো ছেলেমানুষী কোরো না। আমি তোমার মত বন্ধুকে হারাতেও চাই না, তোমাকে কষ্ট দিতেও চাই না। কথা দাও সারাজীবন আমার বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে?
নীলাভ ফিয়োনাকে ভালোবেসে ফেলেছে। শুধু বন্ধু হয়ে থাকার বিষয়টা ওর ভালো লাগছে না। কষ্ট কষ্ট রকমের একটা ফিলিংস হচ্ছে। তবুও ফিয়োনাকে হারাতে চায় না ও। তাই বলল, বেশ। তুমি যা চাইবে তাই হবে। এটা তোমার অনুরোধ? - হ্যাঁ নীল। প্লিজ আমার কথাটা রাখো।
- বেশ রাখলাম। এবার তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ বলো।
- আমি একজনকে ভালোবাসি।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত চমকে উঠলো নীলাভ। ফিয়োনা একজনকে ভালোবাসে! ফিয়োনা! ফিয়োনা তো ছেলেদেরকে সহ্যই করতে পারে না। ছেলেদের সাথে কথা বলে না, কারো সাথে বন্ধুত্ব করে না। সেই মেয়েটা কাউকে ভালোবাসে এটা কেমন যেন শোনালো। নীলাভ কি বলবে বুঝতে পারলো না।
ফিয়োনা বললো- আমি একজনকে প্রচন্ড ভালোবাসি। মাঝখানে আমাদের মধ্যে একটা ঝামেলা হয়েছিলো তাই আমি ওর কথা তোমাকে বলিনি। আবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। তুমি প্লিজ কষ্ট পেও না। আমি তোমাকে একজন ভালো বন্ধু ভাবি। আমি জানি তুমিও তাই ভাবো।
নীলাভ কিছু বললো না। বুকের ভেতর কেমন যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কোথাও ভাঙন হওয়ার শব্দ হচ্ছে। নীলাভের কিছুই বলার নেই।
ফিয়োনা বললো- তুমি কষ্ট পেও না প্লিজ।
- কষ্ট পাওয়ার কি আছে? কেন কষ্ট পাবো বলো?
- শোনো না ফাহমি, আমাকে ভুল বুঝো না।
- ফাহমি!
ইস রে! একটা ভুল হয়ে গেছে। নীলাভকে ফাহমি বলে ডেকে ফেলেছে ফিয়োনা। এবার কি ভাব্বে নীলাভ!
নীলাভ বললো, ফাহমি!
ফিয়োনা বললো, তুমি কষ্ট পাবে তাই বলতে পারিনি এতদিন। আমি তোমার ভাইয়া ফাহমিকে ভালোবাসি।
স্থবির হয়ে গেলো নীলাভ। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইলো। নিজের কানকেও অবিশ্বাস্য লাগছিলো ওর। ফাহমি ভাইয়া আর ফিয়োনা! ব্যাপারটা যেন আকাশ কুসুম কল্পনার মতোই। কিভাবে কি সম্ভব হলো কিছুই মাথায় আসছে না।
ফিয়োনা বললো, ফাহমি আমাদের চিলেকোঠার অতিথি হয়ে এসেছিল। ভাড়া ছিলো আমাদের চিলেকোঠার ঘরে। প্রেমটা তখন থেকেই আমাদের। মাঝখানে ভুল বুঝাবুঝির কারণে যোগাযোগ বন্ধ ছিলো। কিন্তু আমি এখনো ওকে ভালোবাসি আর ফাহমিও। তোমার জন্মদিনে বেড়াতে গিয়ে ফাহমির সাথে দেখা হওয়ার পর আমি বুঝতে পারি যে আমি সত্যিই ফাহমিকে ভালোবাসি। আর ফাহমিও। তাই আমরা আবার সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়েছি। বিশ্বাস করো, আমরা কিছুতেই দুজন দুজনকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।
ফিয়োনার কথা শুনে কি আর বলবে নীলাভ। অনেক্ষণ স্থবির হয়ে চুপচাপ বসে রইলো। তারপর হাসার চেষ্টা করে বললো, বেশ তো। তোমার সেকেন্ড অনুরোধ টা তাহলে কি?
- তুমি আমার আর ফাহমির বিয়েটা হতে হেল্প করো প্লিজ?
- বেশ। করবো। এতদিনের বন্ধুত্ব আমাদের। বন্ধুর জন্য এটুকু করবো না?
- নীলাভ..
নীলাভের হাত চেপে ধরলো ফিয়োনা। নীলাভ ফিয়োনার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ভরসা রেখো। কোনোদিনো তোমার বিশ্বাস ভাংবো না আমি। আজীবন ভালো বন্ধু হয়ে পাশে থাকবো। আর তোমাদের বিয়েটা করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব টাও আমি নিলাম। খুশি?
ফিয়োনার চোখে পানি চলে এলো। নীলাভ বলল, উহু একদম কাঁদবে না। এখন থেকে তোমার শুধু আনন্দের দিন। হ্যাপি, বি হ্যাপি ফিয়োনা।
নীলাভ হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বিদায় নিলো ফিয়োনার কাছে থেকে। চলে যেতে যেতে দুচোখ ভিজে জল আসছিলো। বুক ফেটে যেতে চাইছিলো তবুও নিজেকে সংযত করে নিলো নীলাভ। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। ফিয়োনা সুখী থাকলেই হলো। একজন বন্ধুর জন্য এতটুকু করাই যায়। বন্ধুত্বের মর্যাদা থাকুক তবু আজীবন।
ফিয়োনা ফাহমিকে কল দিয়ে দেখা করতে বললো। ফিয়োনার ডাকে ছুটে চলে এলো ফাহমি। ফিয়োনার হাতে একটা লাল টকটকে গোলাপ তুলে দিয়ে বলল, দিস ইজ ফর ইউ মাই সুইট ডার্লিং।
- ওরে আমার কিউট রে। এত সুন্দর ফুল এনেছো!
- হুম ডার্লিং। হঠাৎ জরুরি তলব?
- আমার তোমাকে হারানোর ভয় হয় ফাহমি। তুমি একটা কাজ করো। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও। কারণ আবার যদি বাবা মা আমাদেরকে আলাদা করাএ চেষ্টা করেন?
- আলাদা করার চেষ্টা করলে তুমি সবকিছু ছেড়ে আমার কাছে চলে আসবে। পারবে না?
- তোমার জন্য তো সবই করতে পারবো। কিন্তু এটা আমি করবো না। আব্বু আম্মু অনেক কষ্টে আমাকে মানুষ করেছেন। তাদের সম্মান রাখাটা আমার দায়িত্ব ফাহমি।
ফিয়োনার উত্তরে সন্তুষ্ট হলো ফাহমি। ফিয়োনা আরো বলল, একদিন বাবা মায়ের সম্মানের জন্য তুমি আমাদের সম্পর্ক টাকে নষ্ট করেছিলে। আজ আমার বাবা মায়ের জন্য যদি আবার তোমাকে ছাড়তে হয়, আমাকেও এটুকু করতে দিও। - খুব সুন্দর বলেছো আমার পাগলীটা। কিন্তু এই দিন আশাকরি তোমাকে দেখতে হবে না। সব ব্যবস্থা আমি করছি। তুমি শুধু দেখো।
নীলাভ মাকে খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বললো ফিয়োনাকে বাড়ির বউ করে আনার জন্য। মা খুব অবাক হলেন যখন নীলাভ নিজের কথা না বলে বড় ভাইয়ের বিয়ের কথা বললো। এও শুনে অবাক হলেন যে ফাহমির আর ফিয়োনার সম্পর্ক ছিলো এটা কেউই জানতো না।
মা নীলাভের কথা রাখলেন। রাতে ফাহমির বাবা বাসায় ফেরামাত্রই তিনি ছেলের পছন্দের কথা জানালেন। ফাহমি নিজে প্রতিষ্ঠিত ছেলে। বাবা ছেলের পছন্দকে অমত করলেন না।
পরেরদিন ই ফাহমির বাবা ফিয়োনাদের বাসায় গেলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যা ফাহমি ও ফিয়োনা কেউই জানতো না। এদিকে ফিয়োনার বাবা ফাহমি ভালো গর্ভনমেন্ট জব করে শুনে মহাখুশি হয়ে বিয়েতে রাজি হলেন। তাছাড়া ছেলে হিসেবে ফাহমি একেবারে ই খারাপ না। বিষয়টা দাঁড়ালো ফিয়োনার বাবা মেয়েকে ফাহমির কাছে দিচ্ছেন না, দিচ্ছেন সরকারি চাকুরিজীবি জামাইয়ের কাছে। আজকাল বিষয়টা অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলে সরকারি চাকুরি করলেই হলো। কারোই বিয়েতে আর কোনো আপত্তি থাকে না। ফিয়োনার বাবা তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলেন। ফাহমির যদিও এই বিষয়টা একেবারেই ভালো লাগে না। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, ফিয়োনাকে পেলেই হলো।
পরেরদিন যখন বাবা ফাহমিকে বললেন, চলো তোমার জন্য মেয়ে দেখতে যাবো, ফাহমি অবাক হয়ে বললো, বাবা আমি একজনকে ভালোবাসি।
- আগে তো বলোনি কাউকে ভালোবাসো। বয়স হয়েছে, বিয়ে তো করতেই হবে।
- না বাবা। এটা কিছুতেই হতে পারে না।
বাবা রেগে বললেন, কোনো কথা শুনবো না। আমার বন্ধুকে কথা যখন দিয়েছি, সে কথা আমি রাখবো ই। মেয়ে দেখতে যাওয়ার সাথে আমার সম্মান জড়িয়ে আছে।
তবুও আপত্তি জানালো ফাহমি। ফাহমির মা এসে বললেন, বাবা আপত্তি করিস না। পাত্রী দেখে এসে বলবি পাত্রী তোর পছন্দ হয়নি। ব্যস।
অবশেষে পাত্রী দেখতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো ফাহমি। ফিয়োনাকে জানালো না বিষয়টা। এদিকে ফিয়োনাকেও দেখতে আসবে শুনে মুখ গোমরা করে বসে রইলো ও। কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, এই বুঝি ফাহমিকে হারিয়ে ফেলতে হয়।
সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে যখন পাত্র পাত্রী একে অপরের সামনা সামনি হলো, আকাশ থেকে পড়লো দুজনেই। খুশির জোয়ার বয়ে গেলো দুজনের মনে। ফাহমির বাবা ফাহমিকে বললেন, কেমন দিলাম?
ছেলে খুশিতেই জাপটে ধরলো বাবাকে। নীলাভ পাত্রী দেখতে আসেনি। কথাবার্তা বলা ও বিয়ের দিন তারিখ পাকা করার সময় পাত্র পাত্রীকে ভেতরে পাঠানো হলো আলাদা করে কথা বলার জন্য।
ভেতরে ঢুকেই ফাহমি হাত টেনে ধরে ফিয়োনাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, কি মজাটাই না হলো তাইনা?
- উহুম এখন কিছু নয়। যা হবে সব বিয়ের পর।
- ধৈর্য ধরার সক্ষমতা আমার আছে টুকটুকি। কিন্তু তোমাকে পাওয়ার সুখে না হার্ট এটাক করি সেটাই ভাবছি।
- আমিও তো সুখে মরে যাবো।
- না না মোরো না, মরলে আমি কাকে বিয়ে করবো?
হাসতে হাসতে ফাহমির বুকে লুটিয়ে পড়লো ফিয়োনা। বহু যন্ত্রণা, হাসি, কান্নার পর অবশেষে দুটি হৃদয়ের বন্ধন হতে চললো।
সমাপ্ত