প্রথম পর্ব : “রিমঝিম, নুহাশে যাবা? নীল ফিনিক ফোঁটা শাড়ি,নীল চুড়ি আর কাঠগোলাপ, বৃষ্টিবিলাস, দিঘী লীলাবতী আর তুমি তুমি আর তুমি। কেমন হয় বলোতো?”
ত্রয়ী রীতিমত চমকালো এমন এসএমএস দেখে! অচেনা নাম্বার থেকে নিঃসঙ্কোচ লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু সে যে ত্রয়ীকে বলেনি সেটা একদম ক্লিয়ার। রিমঝিমকে বলেছে,আর ওর নাম তো রিমঝিম নয়। এরপর থেকে ত্রয়ীর কেবলই কষ্ট হতে লাগলো আর মনেমনে বললো,” কেন আমার নাম রিমঝিম হলোনা! কেন আমায় কেউ এভাবে বলেনা? হয় এ কপালে প্রেম নাই,নয়ত জগতেই প্রেম বলে কিছু নাই।”
সকাল সকাল এমন মেসেজ দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ওকে কেন কেউ এভাবে বলেনা! একা একা গালি কপচাতে কপচাতে চা বানাল ত্রয়ী। মুখে দিয়ে দেখলো,চা তো নয় যেন গরম পানি। গরম পানিতে আদা নুন দিলে যেমন হয়,ঠিক তেমনি হইছে। মনেমনে বললো, “সামান্য চা ই বানাতে পারিনা, এজন্যই আমার প্রেম হয়না।”
মুখ বিকৃত করে গরম পানি খেয়ে নিলো। আবারো মেসেজ টোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে মেসেজ অন করলো,
“আচ্ছা তুমি কি ঘুমাচ্ছো এখনো? বেলা কত বাজে দেখেছো? এতবেলা অব্দি কেউ ঘুমায় বুঝি?”
ত্রয়ীর রাগটা চড়ে উঠলো। এমন কেয়ারনেস ময় এসএমএস দেখলে নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যাবো। নাম্বারে কল দিয়েই ফেললো “হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।”
সালামের জবাব দিয়ে, “কেমন আছো রিমঝিম?”
- “সেটা আমি কিভাবে বলবো?”
- “তুমি কেমন আছো সেটা তুমি জানোনা?”
- “আমি ভালো আছি।”
- “বেশ। কি বললাম বলোতো? নুহাশে যাবা?”
- “হ্যা যাবো। আমার পছন্দের একটা জায়গা। না যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। কবে যাবেন?”
- “আজই,তুমি কি সবকিছু ভূলে যাও? আজ হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। ভূলে গিয়েছো?”
- “ওহ আচ্ছা। হুমায়ূন আহমেদ যেন কে?”
- “রিমঝিম, সকাল সকাল জোক করছো? হুমায়ূন আহমেদ তোমার আমার সবার প্রিয় একজন মানুষ।”
- “এজন্যই নামটা চেনা চেনা লাগে। ভূলেই গিয়েছিলাম। আমার নাম যে রিমঝিম সেটাও বোধহয় ভূলে গেছি। কেন যেন মনেহচ্ছে আমার নাম রিমঝিম নয়।”
লোকটা শব্দ করে হাসলো। ত্রয়ীও হাসলো। সে ত্রয়ীকে রিমঝিম ভেবেছে ঠিকই,কিন্তু ত্রয়ী তো সে মেয়ে নয়। ভাবলো, এ ভূল ভাঙাবো? নাকি এভাবেই চলে যাবো তার সাথে? সে হয়ত শ্রবণাকে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে ভূলেই আমাকে পাঠিয়েছে। গেলে মন্দ হয়না।
এটা ভেবে ত্রয়ী বলল, “আমি রেডি হচ্ছি। আপনি থাকবেন কোথায়?” - “তুমি দ্রুত রেডি হয়ে শাহবাগ মোড়ে চলে আসো।”
- “দ্রুত রেডি হতে পারবো না,আমি ধীরেধীরে রেডি হবো।”
- “আচ্ছা হও,তবুও আসো।”
কল কেটে দিয়ে নাচতে নাচতে রেডি হতে চলে গেলো ত্রয়ী। বেশ ভালোই হয়েছে। এবার একটা মজা হবে। সে যখন ত্রয়ীকে দেখে বিস্ময়ে কথা বলতেই ভূলে যাবে তখন ত্রয়ী বলবে, আমাকে ভূলে গেলেন কিভাবে? আপনি কি সবকিছু ভূলে যান? রিমঝিম যে কে, আজকে একটা হাস্যকর ব্যাপার ঘটবে।
ত্রয়ী দ্রুত রেডি হয়ে চলে গেলো শাহবাগ মোড়ে। মনটা দারুণ উৎফুল্ল। শাহবাগ মোড়ে সে আসুক, দেখা হলেই দারুণ মজা হয়। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। নীল ফিনিক ফোঁটা শাড়ি ওর নেই,এমনকি কোনো শাড়িই নেই। একটা নীল জামা পড়ে এসেছে ও।
স্নিগ্ধ শাহবাগ মোড়ে এসে কল দিলো রিমঝিমের নাম্বারে। রিমঝিমের সাথে ওর ফেসবুকে পরিচয়। এরপর টুকটাক কথা,একটু বন্ধুত্ব। রিমঝিমের ফোন নাম্বার চাওয়ার পর সে এই নাম্বারটা দিয়েছে। কিন্তু নাম্বারটা ভূল দিয়েছিলো ইচ্ছে করেই। স্নিগ্ধ কল দিলে ত্রয়ীর ফোন বেজে উঠলো।
ত্রয়ীকে দেখতে পেয়ে চোখ কপালে তুলে তাকালো স্নিগ্ধ। ছবিতে তো এমন দেখেনি,তাহলে কি অন্যকারো ছবি দেখেছিলো? অবশ্য ছবিতে স্পষ্ট করে দেখতেই পায়নি রিমঝিমের মুখটা। এ কারণেই বোধহয় চিনতে পারছে না। ছবিতে কেবলমাত্র সাইড প্রোফাইল দেখেছে। সে যাই হোক, রিমঝিম মেয়েটা সত্যিই অনেক সুন্দর দেখতে। মাঝেমাঝে নক করলেই স্নিগ্ধ ছবি চাইতো,কিন্তু ত্রয়ী কোনো ছবি দিতো না। ফোন নাম্বারটাও দিয়েছে অনেক বার রিকুয়েস্ট করার পর। তারপর ও যে সত্যি সত্যি আসবে সেটা ভেবেই অবাক লাগছে স্নিগ্ধ’র। এদিকে এটা যে রিমঝিম নয় সেটা স্নিগ্ধ’র মাথাতেই এলোনা।
ত্রয়ী ফোনে কথা বলে এগিয়ে এলো স্নিগ্ধ’র কাছে। স্নিগ্ধ হেসে বললো, “তুমি এসেছ রিমঝিম? আমি বিশ্বাস ই করতে পারছি না।”
-বিশ্বাস না করলে আমি আবার ফিরে যাই।
- এই না না। এত সাধনা করে আজকে তোমাকে দেখতে পেয়েছি আর বলছো কিনা চলে যাবে? তুমি যে কি?
- আমি আবার কি?
- তুমি ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু একটু ত্যাড়া।
- যেমন?
স্নিগ্ধ বললো,এইযে সবসময় কেমন কেমন করো। তোমার কাছে ছবি চাইলে কখনোই দিতেনা। অথচ আজকে বলামাত্র আসলে আমি তাতেই অবাক হয়েছি খুব। ভেবেছিলাম আসবে না। যাইহোক,নুহাশে যাবা শুনে যেতে ইচ্ছে করলো তাইনা? - হ্যা।
ত্রয়ী আর কোনো কথা বললো না। ওর অবাক লাগছিলো এটা ভেবে যে, ছেলেটা কেন ওকে চিনতে পারলো না? এবার নিশ্চিত হয়ে গেলো। তারমানে ছেলেটা আগে রিমঝিমের ছবি দেখেনি তাই ওকে চিনতে পারলো না। যাক,এবার আরো মজা হবে তাহলে।
দুজনে এসে গাজীপুরের বাসে উঠে পড়লো। পাশাপাশি সিটে বসে একবার একে অপরের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধ ছেলেটার চেহারায় বেশ মাধুর্য আছে। লম্বা, ফর্সা, আর চেহারায় একটা অন্যরকম শুভ্রতা ছড়িয়ে আছে। ত্রয়ী মনেমনে ভাবলো, ফাজলামি করে কথাবার্তা বললাম আর সে নাহয় ভূল করেছে তাই বলে এভাবে বোকা বানিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
কিছু একটা বলতে যাবে তখনই ছেলেটা বললো, আচ্ছা রিমঝিম তোমার বাসায় যেন কি প্রব্লেম হয়েছে বললে?
থতমত খেয়ে গেলো ত্রয়ী। এবার কি জবাব দেবে? ও তো রিমঝিম নয়। ও ত্রয়ী, আর সেটা কিভাবেই বা বলবে? যদি বকাঝকা দেয়? দেখলেই মনেহয় ছেলেটা খুব রাগী।
ত্রয়ী বলল, বাস ছাড়বে কখন?
স্নিগ্ধ জবাব দিলো, জ্যামে আটকে গেছে। কতক্ষণ যে লাগে জ্যাম ছেড়ে দিতে।কেন?
- না মানে একটা চিপস আনতে পারবেন? মিস্টার টুইস্ট।
স্নিগ্ধ বাসের জানালা দিয়েই একবার দোকান দেখার চেষ্টা করলো। তারপর বললো, আচ্ছা আনছি। তুমি বসো। বাস ছেড়ে দেয় কিনা ভাবছি।
কথাটা বলেই স্নিগ্ধ বাস থেকে নেমে গেলো চিপস আনার জন্য। ত্রয়ী গালে হাত দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলো কি বলা যায়? কিভাবে বললে আর কেমন করে বললে সে রাগ করবে না? ছেলেটার রাগী রাগী চেহারার কথা ভাবলেই ওর ভয় লাগছে। রাগী ছেলেদের মনটা নাকি অনেক ভালো হয়!ত্রয়ী ভাবলো, যা হবার হবে। আগে নুহাশ পল্লী থেকে ফিরে আসি। তারপর দেখা যাবে। কেমন হয়, যদি ফিরে এসে বাসায় যাওয়ার সময় বলা হয়, “আমি রিমঝিম নই,আমি ত্রয়ী” তখন কেমন মজা হবে? ছেলেটা তো রেগেমেগে আগুন হয়ে যাবে একেবারে।
ত্রয়ীর হাসি পেয়ে গেলো এটা ভেবে। গালে হাত দিয়ে বসে রইলো চুপচাপ। স্নিগ্ধ দুইটা চিপস আর একগাদা চকোলেট নিয়ে এসে ত্রয়ীর হাতে দিলো। চিপস নিয়ে ত্রয়ী মিষ্টি করে হেসে বললো, থ্যাংকস মশাই।
স্নিগ্ধ সিটে বসে বলল,হ্যা। এবার বলোতো বাসায় কি প্রব্লেম হয়েছে?
- কিসের প্রব্লেম?
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। নিজেই বলেছিলো ওর সমস্যা চলছে বাসায়। এখন আবার নিজেই বলছে কিসের প্রব্লেম! আজব একটা মেয়ে মাইরি।
ত্রয়ী বলল,আরেকবার বলুন তো কিসের প্রব্লেম? আমার কিছু মনে নেই তো। - মনে নেই? তুমি এমন কেন বলোতো? তোমার কি কিছুই মনে থাকেনা?
- অনেক কিছুই থাকে। আবার অনেক কিছুই থাকেনা। যেমন, আপনার নামটা এই মুহুর্তে ভূলে গেছি। আপনার নাম যেন কি?
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে বলল,রিমঝিম তুমি আমার নামটাও ভূলে গেছো! ওহ গড! এই মেয়েটা এমন পাগলী কেন?
ত্রয়ী মুখ টিপে হাসলো। সে তো রিমঝিম নয়,রিমঝিম হলে তবে তো মনে থাকবে এসব। হাসতে হাসতে চিপস খুলে খেতে শুরু করলো। স্নিগ্ধ’র দিকে তাকিয়ে দেখলো ও হা করে চেয়ে আছে ওর দিকে। আর মুগ্ধ হয়ে কি যেন ভাবছে। ত্রয়ী একটা চিপস ঢুকিয়ে দিলো স্নিগ্ধ’র মুখের ভিতর। তারপর স্নিগ্ধ’র মুখটা আরো ভ্যাবাচেকা টাইপের হয়ে গেলো। সেই কাছুমাছু হওয়া মুখটা দেখে দারুণ মজা লাগছে ত্রয়ীর। ছেলেটা ইন্টারেস্টিং অনেক, আর দেখতেও মাশাল্লা। বেশ মজা হবে মনেহচ্ছে।
২য় পর্ব
নুহাশ পল্লীতে যাওয়ার জন্য হোতাপাড়ায় নেমে রিক্সায় উঠে পড়লো ওরা দুজনে। ত্রয়ীর একদম গা ঘেষে বসেছে স্নিগ্ধ। ত্রয়ী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। এদিকে কখনো আসেনি ও। গাজীপুর থেকে এদিকে আসার সময় অনেক শালবন চোখে পড়েছিলো। সেসব দেখতে দেখতে ত্রয়ীর আনন্দ যেন আর ধরেই না।
স্নিগ্ধ বলল,তুমি কি কখনো পাহাড়ে গিয়েছিলে?
- না যাইনি। আপনি গিয়েছিলেন?
- হুম গিয়েছিলাম। একবার পাহাড়ে গেলে দেখবে আর ফিরতেই ইচ্ছে করবে না। চারিদিকে কত সুন্দর সবুজ! জানো পাহাড়ের এক ধরণের গন্ধ আছে?
ত্রয়ী মুগ্ধ হয়ে গেলো স্নিগ্ধ’র কথায়। বলল,তাই? কেমন গন্ধ? - একটা অন্যরকম গন্ধ। এই গন্ধের জন্যই পাহাড় আমাকে টানে। এত সুন্দর পাহাড় যে একবার গেলে আবারো যেতে চাইবে।
- সত্যি! আমার না এক্ষুণি যেতে করছে। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যাই।
- সত্যি? যাবা কখনো?
- ইচ্ছে তো করে যেতে। কিন্তু কে নিয়ে যাবে আমায়? আমার বাবাকে বললে তার সময়ই হয়না। আর আমার ভাইয়া এসব পছন্দই করেনা। মেয়েদের ঘুরাঘুরি তার সহ্য হয়না। এখন একমাত্র ভরসা আমার স্বামী।
বিয়ে হলে আশাকরি ঘুরতে যেতে পারবো।
স্নিগ্ধ হো হো করে হেসে বলল,বিয়ে করলে কে ঘুরতে নিয়ে যাবে তোমায়? তোমার বর? - হুম। আমার বরের সাথে সব জায়গাতেই ঘুরতে যাবো।
- তবেই হয়েছে তোমার ঘোরাঘুরি। বিয়ে হলে একেবারে সংসারের আয় উন্নতি করার জন্য উঠেপড়ে লাগবা। তখন আর কোথাও যেতেই মন চাইবে না।
- চাইবে চাইবে। আর আমি যাবো ও।
- মন চাইবে ঠিকই কিন্তু যাবা না। এই আমি বলে দিলাম তুমি মিলিয়ে নিও।তুমি হবা কিপটা আর তোমার বর হবে বোরিং। কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবেনা।
ত্রয়ী রেগে বলল, আপনি লোকটা অনেক খারাপ। আমি বারবার বলছি কখনো আমিও ওরকম কিপ্টে হবোনা,আর আমার বরও ওরকম বোরিং হবেনা। আমরা ঠিকই যাবো আর অনেক এনজয় করবো দেখে নিবেন।
ত্রয়ীর ছেলেমানুষি রাগ দেখে হেসে ফেললো স্নিগ্ধ। মেয়েটা দারুণ বাচ্চা স্বভাবের। দেখতেও যেমন, মেয়েটার কথাবার্তাও সেরকম ছেলেমানুষি।
এভাবে কথা বলতে বলতে ওরা নুহাশ পল্লীতে পৌছে গেলো। ভেতরে ঢোকার পর এক ছুটে গিয়ে মাঠের মাঝখানে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো ত্রয়ী। ঘাসের উপর হাত বুলাতে বুলাতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আবার কখনো লাফ দিয়ে উঠে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। একটু পরেই আবার দাঁড়িয়ে নাচানাচি আরম্ভ করে দেয়। এরকম বাচ্চামি স্বভাবের মেয়ে কক্ষনো দেখেনি স্নিগ্ধ। ও হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে আবার কখনো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকছে ত্রয়ীর দিকে। মেয়েটা মেসেজে সেরকম কথাই বলেনা,অথচ এখানে কত সহজ সাবলীল ভাবে মিশে যাচ্ছে ওর সাথে!
স্নিগ্ধ নিজেও গিয়ে ত্রয়ীর পাশে বসে পড়লো। ত্রয়ীর মাথার চুলগুলো দুহাতে নেড়েচেড়ে দিয়ে বললো পাগলী একটা মেয়ে। এত পাগলী কেন তুমি?
- এত সুন্দর কেন জায়গাটা? জানেন আমি কখনো নিজের বাসা থেকেই বের হতে পারিনা। এত চাপে থাকতে হয়। বিশেষ করে আমার ভাইয়ার জন্য। ভাইয়া একদম ই বাইরে যাওয়াটা পছন্দ করেনা।
- তাহলে আজকে আসলে কিভাবে?
- আজকে আসলাম আপনি বললেন বলে। আমাকে তো কেউ কখনো কোথাও ঘুরতি নিয়ে যায়না। বাবা, ভাইয়া কেউনা। প্রথম কেউ যখন বলল তখন মানা করি কি করে?
স্নিগ্ধ হেসে বলল,বাসায় জবাব দেবে কি? - কি আবার? বলবো এক জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিলাম।
- তাই নাকি?
- হুম,আসুন না ওই বৃক্ষঘরে উঠবো।
ত্রয়ী রীতিমত হাত ধরে টানতে টানতে স্নিগ্ধ কে নিয়ে বৃক্ষঘরের দিকে এগোলো। মেয়েটা দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে আর হাত ধরে টানছে স্নিগ্ধ’র। স্নিগ্ধ ওর সাথে দৌড়াতেই পারছে না। মেয়েটা সত্যিই একটা পাগলী!
ত্রয়ী দ্রুত গিয়ে গাছের নিচে দাঁড়ালো। স্নিগ্ধ গাছের নিচে পৌছানো মাত্রই ওর সাথে জেদ ধরে বসলো গাছের উপরের ওই ঘরটায় ওঠার জন্য। হুমায়ূন আহমেদ ওর প্রিয়া লেখক। হুমায়ূন স্যারের এই নুহাশ পল্লীও এত সুন্দর হবে সেটা ও কল্পনাও করেনি। ক্রমশই উৎফুল্ল হয়ে উঠছে ত্রয়ী। বৃক্ষের উপরের ছোট্ট ঘরটায় ওঠার জন্য নাচানাচি শুরু করে দিলো।
স্নিগ্ধ হাত ধরে ধরে গাছের উপরে উঠতে সাহায্য করলো ত্রয়ীকে। ত্রয়ী গাছের উপরের ঘরটায় ওঠার পর বসে বসলো ধপ করে। ছোট্ট একটা ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না, বসে থাকতে হয়। স্নিগ্ধ ওঠার পর বসতে গিয়ে ঠুক করে মাথার সাথে মাথায় ধাক্কা খেলো ত্রয়ীর সাথে।
ত্রয়ী একটু এগিয়ে এসে বসতেই অনেক কাছ থেকে চোখাচোখি হয়ে গেলো স্নিগ্ধ’র সাথে। স্নিগ্ধ’র ভয়ংকর সুন্দর দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে পাগল হয়ে যেত ইচ্ছে করলো ওর। ছেলেদের চোখ ও এত সুন্দর হয়!
স্নিগ্ধ বলল,কি দেখছো রিমঝিম?
- এ চোখে হারিয়ে যাওয়া যায়।
- তাই নাকি? কি আছে এই চোখে?
- সমুদ্র।
স্নিগ্ধ একটু এগিয়ে এসে ত্রয়ীর মুখের একদম কাছে চলে এলো। এত কাছাকাছি থেকে এর আগে কোনো পুরুষ কে দেখেনি ত্রয়ী। বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। ধুকপুকুনি টা হুট করেই বেড়ে গেলো। স্নিগ্ধ’র শরীর থেকে একটা সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। ছেলেদের শরীরে একটা অন্যরকম গন্ধ আছে সেটা বিশ্বাস করতেই হলো আজকে। দারুণ মিষ্টি একটা সুবাস!স্নিগ্ধ গভীর ভাবে তাকালো ত্রয়ীর চোখের দিকে। ত্রয়ী বলল,কি দেখছেন এভাবে? - তোমার চোখ দুটোও কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর! মায়াবী, কাজল কালো দুটো ভয়ংকর সুন্দর চোখ।
- হয়েছে। এভাবে বলতে হবেনা।
- বারে,তুমি বলতে পারো আর আমি বলতে পারিনা?
- নাহ, পারেন না। মেয়েরা সব বলতে পারে কিন্তু ছেলেদের সবকিছু বলতে হয়না।
স্নিগ্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ত্রয়ী এই ঘরটা থেকে বের হয়ে গাছের উপরের ডালগুলোর দিকে যেতে চেষ্টা করলো। স্নিগ্ধ বের হয়ে ওর হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গাছে উঠতে সাহায্য করলো ওকে।
তারপর জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে আমি নীল ফিনিক ফোটা শাড়ি পড়ে আসতে বলেছিলাম না?
- আমার ওরকম শাড়ি নাই। ইন ফ্যাক্ট আমার কোনো শাড়িই নাই।
- সত্যি নেই?
- মিথ্যে বলে লাভটা কি আমার শুনি? আমার সত্যিই শাড়ি নেই কোনো।
- আহারে! মন খারাপ করোনা। তোমাকে শাড়ি কিনে দেবো একটা।
ত্রয়ী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,সত্যি! আমাকে শাড়ি কিনে দেবেন? শুধু শাড়ি? - না,শাড়ি পড়তে যা যা লাগে সবই কিনে দেবো।
ত্রয়ী একটু কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, শাড়ি পড়তে কি কি লাগে মশাই?
স্নিগ্ধ হেসে বলল,ব্লাউজ পেডিকোট আর..
ত্রয়ী আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল,আর?
- আরো অনেক কিছুই। থাক ওসব বলতে হয়না।
লজ্জা পেয়ে মিষ্টি করে হাসলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধকে ওর খুবই ভালো লাগছে। কেন যেন স্নিগ্ধ’র প্রতি অন্যরকম একটা মায়া জন্মে যাচ্ছে ওর। একদিনেই মাত্র কয়েক মুহুর্তের পরিচয়ে কতটা আপন মনেহচ্ছে ছেলেটাকে। মজা করতে এসে ছেলেটাকে যদি মনে ধরে যায় কেমন হবে? ভালোই হবে কিন্তু টেনশনের ব্যাপার হচ্ছে স্নিগ্ধ কে যদি সত্যিটা বলা হয় যে,ত্রয়ী রিমঝিম নয়। তখন কেমন রিয়েকশন হবে স্নিগ্ধ’র? রেগে এক্ট। থাপ্পড় বসিয়ে দেবে না তো?
আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ’র গলা শুনে চমকে উঠলো। স্নিগ্ধ ওকে হাত ধরে ধরে নামালো বৃক্ষঘর থেকে।এরপর বৃষ্টিবিলাস, ভূতবিলাস, দিঘি লীলাবতী সব ঘুরে ঘুরে দেখালো ওকে। দিঘী লীলাবতীর ঘাটে বসে অনেক্ষণ চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো স্নিগ্ধ। আর ওর স্নিগ্ধ মুখ ও মুগ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ধুকপুকানি টা বেড়ে গেলো ত্রয়ীর। ছেলেটা কত সুন্দর! মনটাও অনেক নির্মল ওর। কত সাবলীল ভাবে মিশে গেলো ওর সাথে।
বিকেল গড়িয়ে এলে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে এলো ওরা। নুহাশ পল্লী থেকে ফেরার পথে পুরোটা রাস্তা বকবক করে স্নিগ্ধ’র মাথা খারাপ করে দিলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ’র বুকের ভেতরটাও তোলপাড় হতে শুরু করেছে।
বাসার পথে এসে ত্রয়ী বলল,আমি এটুকু পথ একাই যাই। আপনাকে আর যেতে হবেনা।
স্নিগ্ধ বলল,আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি সাবধানে যেও। আর নিজের দিকে খেয়াল রেখো কেমন?
- অবশ্যই। আর আপনি ও রাখবেন।
স্নিগ্ধ মাথা দুলালো। ত্রয়ী এক পা এগিয়ে পিছন ফিরে আবারো স্নিগ্ধ’র মুখের সামনে এলো। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল, একটা কথা বলবো মিস্টার স্নিগ্ধ?
স্নিগ্ধ মাথা নেড়ে বলল,হ্যা বলো।
ত্রয়ী বলল,আমি আপনার রিমঝিম নই,আমি ত্রয়ী। আপনি আসলে রং নাম্বারে ডায়াল করে ফেলেছেন। খুব সম্ভবত রিমঝিম আপনাকে ভূলভাল নাম্বার দিয়েছিলো। আমি সত্যিই রিমঝিম নই।
স্নিগ্ধ একদম হা করে চেয়ে রইলো। কি বলছে এসব কিছুই বুঝতে পারছে না। রিমঝিম নয়, ত্রয়ী! রীতিমত মাথা ঘুরতে শুরু করেছে ওর।
পর্ব ৩
ত্রয়ী নাচতে নাচতে বাসার পথের দিকে চলে গেলো। কিন্তু স্নিগ্ধ চিন্তিত মুখে চেয়ে আছে। এসবের মানে কি কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সে রিমঝিম নয়,ত্রয়ী। তাহলে সারাদিন এভাবে নুহাশে ঘুরাঘুরি করে, একসাথে জার্নি করে ওর মাথাটা খারাপ করে দেয়ার কোনো মানে হয়? অদ্ভুত একটা মেয়ে।
ভেবে ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ত্রয়ীকে খুব ভালো লেগেছে ওর। কিন্তু ত্রয়ীর আগে রিমঝিম কে ভালো লেগেছিলো। তাহলে রিমঝিম ভেবেই ত্রয়ীকে আপন করে নিয়েছিলো ও। এখন ব্যাপার টা কেমন যেন হয়ে গেলো না? ত্রয়ীর প্রতি এক ধরণের রাগ জন্মাচ্ছে, ভালোলাগাও জন্মাচ্ছে। আবার রিমঝিমের প্রতিও এক ধরণের রাগ জন্মাচ্ছে। ভূলভাল নাম্বার দেয়ার কি দরকার ছিলো ওর?
রাগে ফুঁসতে ফুসতে ফেসবুকে লগ ইন করলো স্নিগ্ধ। ইচ্ছেমত বকা দিতে হবে রিমঝিমকে। কিন্তু ফেসবুকে ঢুকে দেখলো রিমঝিম রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিয়েছে। এটা দেখে আরো রাগ উঠে গেলো ওর। কিছুতেই রাগ সামলাতে পারলো না। এরকম করার কোনো মানে হয়? নিজে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিয়ে আমাকে ভূলভাল নাম্বার দেয়া হচ্ছে? কিন্তু কিছু বলতেও পারলো না। বলে তো কোনোই লাভ নেই। সরাসরি রিমঝিম কে ব্লক দিয়ে রেখে দিলো। রাগ কিছুতেই কমছে না।
অনেক্ষণ ধরে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ মাইন্ডে এসে রুমে বসলো। এখন একটু ভালো লাগছে কিন্তু মেজাজ এখনো গরম হয়ে আছে। মেয়েরা এত স্বার্থপর আর অদ্ভুত চরিত্রের কেন হয় সেটার উত্তর খুঁজছে ও। একটা মানুষ কে রং নাম্বার দিয়ে একজন বোকা বানালো, আরেকজন রং নাম্বারে কথা বলেও অচেনা একজনের সাথে ঘোরার জন্য রেডি হয়ে চলে এলো। মেয়েদের সাথে কখনোই পারা গেলো না। এরা আজীবন অদ্ভুত ই থেকে গেলো!
শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছে আর রাগটা কমানোর চেষ্টা করছে। ফোনে টুং করে একটা এসএমএস এলো। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো ত্রয়ীর নাম্বার থেকে মেসেজ। সেটা অন করে দেখলো লেখা, “sorry”
রাগ করা উচিৎ নাকি হাসা উচিত বুঝতে পারছে না স্নিগ্ধ। রাগ ঝারার জন্য হলেও একবার ফোন দেয়া দরকার ত্রয়ীকে। আকাশ সমান রাগ নিয়ে ঝারি দেয়ার জন্য কল দিলো ত্রয়ীকে। কিন্তু রিসিভ করেই ত্রয়ী গান গাইতে আরম্ভ করলো,
“তুমি আর তো কারো নও শুধু আমার..
যত দূরে সরে যাও রবে আমার..
স্তব্ধ সময় টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার।
তবে আজ এত একা কেন? আলো হয়ে দূরে তুমি..
আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না..
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবেনা…”
গান থামালো ত্রয়ী। কিন্তু গান শুনে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে স্নিগ্ধ। এত সুন্দর করে গান গাইতে পারে মেয়েটা। গান শুনেই সমস্ত রাগ নিমেষেই উধাও হয়ে গেছে। মুগ্ধ হয়ে বললো, বাহ! এত সুন্দর করে গাইতে পারো তুমি!
ত্রয়ী বললো, তাই নাকি? গান ভালো লেগেছে?
- হুম খুব। আরেকটা শোনাবা?
- আচ্ছা।
ত্রয়ী আবারো গান ধরলো। গানটা শেষ করে জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগলো?
- আমি ইমপ্রেসড। তুমি গান প্রাক্টিস করোনা কেন?
- নাহ। অন্য কাউকে গান শোনাবো না তো। আমি তো গান শোনাবো শুধুমাত্র আমার স্পেশাল মানুষ টাকেই।
- হা হা। তাই নাকি? আমি বুঝি তোমার স্পেশাল মানুষ?
- অবশ্যই। আমায় দিঘী লীলাবতীর জল ছুঁইয়ে আনলেন। অবশ্যই আপনি আমার স্পেশাল মানুষ। তাইনা?
স্নিগ্ধ বলল,হুম। এবার বলোতো কেন মিথ্যে মিথ্যে আমার সাথে নুহাশে গেলা?
- আজব তো। আমি কখন মিথ্যে মিথ্যে গেলাম? আমি কি সত্য সত্য যাইনি আপনার সাথে?
- তা গিয়েছো। কিন্তু এভাবে বোকা বানানোর কোনো দরকার ছিলো?
- আমি কি আপনাকে একবার ও বলেছি আমি রিমঝিম? ভাবুন তো। মনে করে দেখুন কখনো কি বলেছিলাম আমি রিমঝিম?
স্নিগ্ধ একটু থ মেরে গেলো। বলল,না তো। সেটা তো বলোনি। কিন্তু তুমি যখন রিমঝিম নও তাহলে যাওয়ার কি দরকার ছিলো?
- বারে, আপনি ফোন করে আমায় ডাকলেন বলেই আমি গেলাম। আমিতো আর ভূল করিনি।
- তাও ঠিক। আমিই ফোন করে বলেছিলাম। সে যাই হোক,কাজটা কিন্তু ঠিক হয়নি।
- আচ্ছা, তাহলে ফোন রাখুন।
স্নিগ্ধ থতমত খেয়ে বলল,ফোন কেন রাখবো? একটু কথা বলি?
- নাহ। যেহেতু কাজটা ঠিক করিনি। কাজেই আপনার এখন ফোন রেখে দেয়া উচিৎ।আমি আর কক্ষনো আপনাকে ফোন দিবো না। ভালো থাকবেন আর আমাকে মাফ করে দিবেন।
কথাটা বলে কল কেটে দিলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে রইলো। এটা আবার কেমন মেয়েরে বাবাহ! সে নিজে দোষ করে আবার নিজেই রাগ দেখিয়ে রেখে দিলো। কিন্তু ওর কথা শুনতে ই অনেক বেশি ভালো লাগছিলো স্নিগ্ধ’র। যদিও মেয়েটার প্রতি রাগ হচ্ছিল,কিন্তু রাগ করে বেশিক্ষণ থাকাও যাচ্ছিলো না।
পুনরায় কল দিলো স্নিগ্ধ। দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো ত্রয়ী। রিসিভ করে বলল,কেন ফোন করেছেন? - তোমার রাগ দেখার জন্য।
- আমি কাউকে ফ্রিতে রাগ দেখাই না।
- হা হা হা। তাহলে বিনিময়ে কি করতে হবে?
- বেশি কিছুনা। আপাতত একটা নীল ফিনিক ফোঁটা শাড়ি গিফট চাই আমার। আমার শাড়ি পড়তে খুব ইচ্ছে করছে।
- আমার রাগ ভাঙানোর ভালোই উপায় জানা আছে তোমার দেখছি।
ত্রয়ী বলল,বারে। জানতে হবেনা? হাজার হলেও আমি আপনার স্পেশাল মানুষ। হা হা হা।
স্নিগ্ধ ও হেসে ফেললো ওর কথায়। তারপর বলল, কি করছিলে?
- ঘাস কাটছিলাম। আপনি?
- ঘাস কাটছিলে মানে?
- আরে বুদ্ধু,ঘাস কাটা মানে কি সেটাও জানেন না? অকাজ কে বলে ঘাস কাটা। আমার কোনো কাজ নেই এখন।
- তাই নাকি? আমার জানা ছিলোনা।
- আপনার আরো অনেক কিছুই জানা নেই। আপনি একটা রামগরুড় ছানা।
- কিহ! দেখো আমার আব্বাকে রামগরু বলবা না।
- একশবার বলবো, হাজারবার বলবো। আপনার শুনতে খারাপ লাগলে ফোন রাখুন। বাই।
স্নিগ্ধ মুচকি হাসলো কথাটা শুনে। যদিও অন্যকেউ বললে প্রচণ্ড রাগ হতো। কিন্তু ত্রয়ীর মুখে শুনে একটুও রাগ হচ্ছেনা ওর। বরং ভালো লাগছে শুনতে। মেয়েটা অনেক সুন্দর করে কথা বলে। কথা বলার সময় হাত নেড়ে নেড়ে চোখ পিটপিট করে। দারুণ ভালো লাগে ওর।স্নিগ্ধ বললো, আচ্ছা কাল দেখা করো আমার সাথে। শাড়ি কিনে দিবো।
ত্রয়ী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,সত্যি!
- হ্যা সত্যি। নীল ফিনিক ফোটা শাড়ি, নীল চুড়ি, আর যা যা চাও সবই কিনে দিবো।
- আচ্ছা ঠিকাছে। দারুণ মজা হবে তাহলে। আমি শাড়ি পরেছ ঘুরতে যাবো। কোথায় নিয়ে যাবেন আমায়?
ত্রয়ীর আনন্দ দেখে হাসি পেয়ে গেলো স্নিগ্ধ’র। হাসতে হাসতে বলল,তুমি এখনো বাচ্চাদের মত করো। যেন একেবারে ছোট বাচ্চাটি আছো। - হ্যা আছিতো। আমার কোনোকিছুর সাইজ কি বড়দের মত?
- হা হা হা। আমি কিভাবে বলবো? আমি কি কিছু দেখেছি নাকি?
- কিহ! ছি কি বাজে লোক আপনি।
স্নিগ্ধ হো হো করে হাসি শুরু করে দিলো। লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে ত্রয়ী। কথা বলতেও লজ্জা লাগছে ওর। এদিকে স্নিগ্ধ’ও হাসি থামাচ্ছে না। হো হো করে হেসেই চলেছে সমানে। ত্রয়ী বলল,থামুন তো। আপনি লোকটা খারাপ আছেন।
- তাই! হ্যা আমিতো খারাপ ই। বহুত খারাপ। জানোনা?
- জানি। খারাপ লোকটার হাসির শব্দ কিন্তু দারুণ।
স্নিগ্ধ আবারো হা হা করে হাসতে লাগলো। ত্রয়ী মুখ বেঁকিয়ে বলল,ধেৎ খালি হাসে। আমি রাখলাম ফোন।
কথা বলে এক সেকেন্ড ও দেরি করলো না। টুক করে কল কেটে দিলো। স্নিগ্ধ ফোন রেখে দিয়ে হাসতে শুরু করলো। মেসেজ করে পাঠিয়ে দিলো আগামীকাল কোথায় দেখা করতে হবে। আরো ভালো করে বলা উচিৎ ছিলো, কিন্তু স্নিগ্ধ জানে তবুও ত্রয়ী আসবে। ঠিকই আসবে। মেয়েটা একটু আলাদা,উচ্ছল কিশোরী বলা যায়। একটু আগেই কতটা রাগ নিয়ে ওকে কল দিলো স্নিগ্ধ, অথচ এখন সমস্ত রাগ ভ্যানিশ করে দিয়েছে একেবারে। পাগলী একটা!
পর্ব ৪
অনেক্ষণ ধরে ত্রয়ীর অপেক্ষায় আছে স্নিগ্ধ। সারাটা রাত কেটেছে ব্যকুলতা আর অস্থিরতায়। ত্রয়ীর উচ্ছলতা, মায়াবী মুখ সবকিছু কেই প্রচন্ড মিস করেছে ও। মেয়েটা কখন যে আসবে? তারই প্রতীক্ষায় পথচেয়ে আছে স্নিগ্ধ।
হঠাৎ পেছন থেকে ঘেউ করে উঠলো। লাফিয়ে উঠে পিছন দিকে তাকানো মাত্র ত্রয়ী হো হো করে হেসে উঠলো। স্নিগ্ধ ও ত্রয়ীর পাগলামি দেখে না হেসে পারলো না।
ত্রয়ী একটা সাদা রঙের জামা পড়ে এসেছে। আজ ওকে নীল ফিনিক ফোঁটা শাড়ি কিনে দেয়ার কথা। ব্যস্ত হয়ে স্নিগ্ধ বললো, ‘আচ্ছা চলো তাহলে। শাড়ি দেখবে না?’
ত্রয়ী এক পলক স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে থাকার পর মুচকি হেসে বলল, আপনি একটা কিউট মাইরি।
আবারও হেসে ফেলল স্নিগ্ধ। রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো দুজনে।
একসাথে মার্কেটে ঘুরেঘুরে শাড়ি কেনা, চুড়ি ও টিপ কেনা হয়ে গেলে টুকটাক গল্প করতে করতে যে যার মত ফিরে যায় বাসায়। ত্রয়ীকে বিদায় দেয়ার পর থেকেই স্নিগ্ধর মনে হতে লাগলো আজকে একসাথে খাওয়াদাওয়া করা হয়নি। এতটা সময় একসাথে কাটিয়ে নিশ্চয় মেয়েটার খুব খিদে পেয়েছিল কিন্তু ওকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা মোটেও মনে ছিলোনা। এটা কোনো কথা হলো? একটা ছেলে হয়ে এটা কিভাবে ভূলে যায় ও? দ্রুত আবার দেখা করতে হবে আর এবার অবশ্যই রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে হবে ওকে।
বাসায় ঢুকলো ত্রয়ী।
বাসায় ঢোকামাত্র মামীর চেচামেচি কানে আসলো। ত্রয়ীর হাতে শপিং ব্যাগ দেখে উনি দৌড়ে এসে বললেন, এইগুলা কি আবার? কার জন্য কি কিনলি? টাকা পাইলি কই?
ত্রয়ীর মুখটা শুকিয়ে গেলো। এই ভরদুপুরে মামীর বাসায় থাকার কথা না। মামী বাসায় আছে জানলে অবশ্যই ব্যাগটা লুকিয়ে বাসায় আসত। আসলে ত্রয়ীর মামা মামীর কাছেই মানুষ। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। সৎ মায়ের হাতে পড়ার ভয়ে নানা নানী ওকে নিজেদের কাছে এনে রাখেন। কিন্তু সেই নানা নানীও যখন ওপারে চলে গেলেন তখন ত্রয়ীর দায়ভার এসে পড়লো বড়মামার উপর। বড়মামা ভালো মানুষ হলেও মামী অনেক কঠিন। হিংসুটে আর খুবই কৃপণ। উনি ত্রয়ীর সাথে বেশিরভাগ সময় ভালো আচরণ করলেও মাঝেমধ্যে খুব কঠোর হয়ে ওঠেন। হিংসায় ফেটে পড়েন কখনো। কখনো আবার বিরক্ত হয়ে ওঠেন ত্রয়ীর উপর। আজকেও কৌতুহলী চোখে তাকাচ্ছেন ত্রয়ীর দিকে।
ত্রয়ী দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বললো, মামী এইগুলা একটু…
আর কিছু বলতে পারলো না। মামী এসে ব্যাগটা নিয়ে বললেন, দেখি কি কিনছিস…
ত্রয়ীর বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ শুরু করে দিলো। এমনিতেই মাঝেমাঝে মামি খুব হিংসে মনোভাবি হয়ে যায়। আজকে যদি আবার রেগে যায় তাহলে কপালে খারাপ আছে।
মামি ব্যাগ খুলে শাড়ি বের করলেন। শাড়িটা দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো ওনার। এত সুন্দর আর দামী শাড়ি! এরকম সুন্দর শাড়ি অনেকদিন দেখেননি উনি। মুগ্ধ হয়ে বললেন, এটা কিনলি কিভাবে? এত সুন্দর শাড়ি! তোর পছন্দ আছে। দারুণ জিনিস কিনছিস তো।
ত্রয়ী হাসার চেষ্টা করল। মামি খুশি হয়েছেন এটাই অনেক। কিন্তু এরপর মামি বললেন, এত টাকা পাইলি কই? কই পাইলি এত টাকা? বলতো?
ত্রয়ী আমতা আমতা করতে লাগল। মামি আবার জিজ্ঞেস করলেন, বল? এমনিতে সংসারে যত খরচ একাই সামলাতে হয়। একটু তো মাঝেমধ্যে বাজার টাজার করতেও পারিস। তা বাদ দিয়ে এসব কিনিস? এত দামী শাড়ি?
ত্রয়ী এবার আর চুপ থাকতে পারল না। বলল,মামি এটা আমাকে একজন গিফট দিয়েছে।
মামি চোখ কপালে তুলে বললেন, গিফট? তোকে আবার কে গিফট দিলো? সে কি ছেলে নাকি মেয়ে?
ত্রয়ী নিশ্চুপ। এখন যদি ছেলের নাম বলা হয় তাহলে মামি আবার ঝামেলা করবেন। ও বলল, মামি আমার বান্ধবী দিয়েছে।
- বান্ধবী? বড়লোক বান্ধবী?
- হ্যা মামি। বড়লোক আর ওর জন্মদিনে অনেক শাড়ি পেয়েছে। আমাকে ভালোবাসে খুব তাই একটা দিয়েছে আমাকে।
- ও আচ্ছা। ভালই করেছে। সবসময় এরকম মেয়ের সাথেই মেশা দরকার বুঝলি? তা গিফটের শাড়ি যখন ভালোই তো। ধর, নিয়ে যা।
ত্রয়ীর মনে যেন লাড্ডু ফুটে উঠল। শাড়ি নিয়ে সোজা রুমে চলে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিজেকে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর মনেমনে হাসলো। স্নিগ্ধ ছেলেটা সত্যিই বেশ অদ্ভুত। কেমন হুট করে শাড়ি কিনে দিলো! গোসল করে এসে একবার পড়ে দেখতে হবে কেমন মানিয়েছে।
ত্রয়ী শাড়ি বিছানার উপর রেখে গোসল করতে গেলো। বাথরুম থেকে বের হওয়া মাত্র দেখলো মামি ওর রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি পড়ছেন। অবাক হয়ে ত্রয়ী বলল, মামি!
মামি বললেন, শাড়িটা ভালো লাগছে। পড়লাম। শোন না, একটু বেড়াতে যাচ্ছি তোর আন্টির বাসায়। শাড়িটা পড়ে যাই? কি বলিস?
- আচ্ছা মামি যাও।
- তোর মামা আসলে খাবার খেতে দিস কেমন? পিকলুকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
- আচ্ছা।
মামি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। একটা জোরে নিশ্বাস ফেললো ত্রয়ী। কিছু করার নেই। পড়েছে যখন পড়ুক। কিন্তু এই শাড়িটা আর ফেরত পাওয়া যাবে কিনা সেটাই ভাববার বিষয়। আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস!
মামি এসে বলে গেলেন আজকে রাতে উনি নাও ফিরতে পারেন।রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনে কথা বলছিলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ শব্দ করে হাসছে ওর দুষ্টুমি ভরা কথা শুনে। হাসতে হাসতে ফেটে পড়ছে যেন। ত্রয়ী কথায় কথায় বলে ফেললো, আজকে মামি বাসায় নেই। মামাও এখনও ফেরেন নি। মামা মাঝেমাঝে রাত দুইটা তিনটাতেও ফেরে। কখনো ফেরেনা। আজকে একেবারে একা বাসায়।
স্নিগ্ধ বললো, কি বলো? আমি আসি তাহলে?
ত্রয়ী একটু নিচের ঠোঁটটা টিপে বললো, আপনি কিভাবে আসবেন? অনেক রাত হয়েছে তো।
- তো? তুমি একা একা আছো। আমি এসে তোমাকে সংগ দিই।
- আপনি এসে যদি কোনো সুযোগ নেন?
- কিসের সুযোগ?
- উলটা পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করলে?
- আজব তো। কি উলটা পালটা করবো?
- বুঝেন না? একটা ছেলে একটা মেয়েকে কি উলটা পালটা করে?
- হা হা হা। আমি ওসব করবো কেন?
- আপনি কি ছেলে নন?
- ওহ রিমঝিম। আমি ওরকম ছেলে নই।
- আমি রিমঝিম নই। আর সব ছেলেই ছেলে। রিমঝিমকে একা পেলে তারা পুরুষত্ব ফলাবেই।
- আমি যদি না ফলাই?
- তাহলেই বুঝবো আপনি সত্যিকার মানুষ। আর যদি উল্টা পালটা কিছু করে চলেই যান, তখন আমার কিছু করার থাকবে?
স্নিগ্ধ একটু ভেবে বলল, আচ্ছা যাও। যাবো না। - ঠিকাছে। আসা লাগবে না।
এরপর অন্য প্রসংগে চলে গেলো। এরপর স্নিগ্ধ হঠাৎ বলল, আচ্ছা আমি যদি আবার ছোটবোনকে সাথে নিয়ে আসি? তাহলে তো সমস্যা হবেনা আশাকরি?
ত্রয়ী অনেকটা অবাক হয়ে বলল, সত্যি! কত বড় সে?
- তোমার বয়সী। নিয়ে আসি? ও রাতে ঘুরতে খুব ভালোবাসে। অনেক ফ্রি আমার সাথে। বললেই যাবে সাথে।
ত্রয়ী একটু চুপ থেকে বলল,একটু দাড়ান। মামাকে ফোন দিয়ে দেখি।
ত্রয়ী মামাকে ফোন করার পর মামা জানালো সে আজকে রাতে ফিরবে না। ত্রয়ী স্নিগ্ধকে ফোন দিয়ে বলল, তাহলে চলে আসুন। আপনারা আজকে রাতটা থেকে সকালে যেতে পারবেন। সারা রাত জমিয়ে আড্ডা দিতে পারবো।
স্নিগ্ধ একলাফে উঠে পড়লো। জোরে ডাক ছাড়লো ছোটবোন স্নিগ্ধার নামে।
পর্ব ৫
স্নিগ্ধকে দেখে কিছুক্ষণ থ মেরে গেলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধা কথা বলার পর চমকে উঠল। স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে বলল,হাই আপু।
ত্রয়ী মাথা ঝাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। স্নিগ্ধা মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ত্রয়ী বলল, কেমন আছেন আপনারা?
স্নিগ্ধ বলল,বাইরে দাঁড়িয়ে রেখে কথা বলবে নাকি?
ত্রয়ী লজ্জা পেয়ে বলল, সরি আসুন।
- ভয় পাচ্ছো এখনও?
- না না ভয় পাবো কেন?
- ভয় পেলে পাও অসুবিধা নেই। কিন্তু ভয় পাওয়ার একটা যুক্তি দেখাতে পারবা? আমাকে কি কোনো এংগেল থেকে তোমার বখাটে মনেহয়? আমি একটা নিষ্পাপ বাচ্চা।
স্নিগ্ধা স্নিগ্ধ’র দিকে ফিরে বলল,ভাইয়া তুই বাচ্চা? তুই বাচ্চা?
স্নিগ্ধ বোনের মাথায় একটা টোকা মেরে বলল, হ্যা বাচ্চাই তো। - তাহলে আমি কি?
- তুই তো বুড়ি।
শুরু হয়ে গেল দুই ভাই বোনের মধ্যে খুনসুটি। ত্রয়ী দেখছে আর হাসছে। এরকম খুনসুটি যদি এ বাড়িতে প্রতিদিন হতো, কতই না ভালো হতো। কত সুন্দর দুষ্টুমি করছে দু ভাইবোন মিলে! ওর তো কেউ নেই দুষ্টুমি করার মত, কেউ নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ত্রয়ী। ওর বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছো?
- কিছুনা। আপনারা বসুন আমি নাস্তা নিয়ে আসি?
- এই সময় কেউ নাস্তা খায়?
- তাহলে কি খায়?
স্নিগ্ধ শয়তানি হাসি হেসে বলল, সেটা তো বলা যাবেনা।
দুই ভাইবোন হেসে উঠলো শব্দ করে। ত্রয়ীও হাসলো। এরপর ওদেরকে বসিয়ে রেখে তিনকাপ কফি নিয়ে আসলো। কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্নিগ্ধ বলল, কি নিয়ে এত মন খারাপ তোমার?
ত্রয়ী মাথা ঝাকিয়ে বলল,আরে না না। মন খারাপ কেন হবে? আমার মন খারাপ না। আসলে ভাবছিলাম আমার যদি এরকম একটা ভাই থাকতো যার সাথে অনায়াসে এভাবে দুষ্টুমি করতে পারতাম।
স্নিগ্ধ বলল, ও আচ্ছা। আমাকে ভাই বানিয়ে ফেলো। প্রতিদিন এসে দুষ্টুমি করে যাবো। হা হা হা।
- এ বাড়িতে ওরকম সুযোগ নেই।
- তাহলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই তোমাকে? কি বলিস স্নিগ্ধা?
স্নিগ্ধা বলল, হ্যা ভাইয়া। একেবারে পারমানেন্ট করে নিয়ে যাবো।
বলে দুই ভাই বোন আবারও হাসি শুরু করলো। ত্রয়ী মুখ বেকিয়ে বলল, হাসছেন কেন এভাবে? - সে তুমি বুঝবে না। আচ্ছা ওসব ছাড়ো, এখন তুমি আমার জন্য একটা কাজ করতে পারবা কষ্ট করে?
- বলুন? কষ্ট হলেও পারবো।
- তুমি শাড়িটা পড়ে আসো তো কষ্ট করে।
কথাটা শুনতে খুব ভালো লাগলেও মুহুর্তেই মন খারাপ হয়ে গেল ত্রয়ী’র। শাড়ি তো মামি পড়ে গেছেন। তাহলে এখন কি বলবে ওকে? কি লজ্জাজনক একটা পরিস্থিতি!
ত্রয়ী বলল, সরি। আজকে না পড়লে হয়না? আমি না একদম ই শাড়ি পড়তে পারিনা।
- তো? পড়তে না পারলে আমরা পড়িয়ে দিবো। অসুবিধা কি?
- সেটা কিভাবে হয়? থাক না আজকে। আমারও পড়তে ইচ্ছে করছে না।
- আমার জন্য কষ্ট করে পড়তে পারবা না?
লজ্জায় মরে যাওয়ার মত অবস্থা ত্রয়ীর। শাড়ি পরার জন্য ছেলেটা এত করে অনুরোধ করছে। কিন্তু কিছুই যে করার নেই। কথাটা বলতেও লজ্জা লাগছে। আবার অন্যকিছু বলে আরো বেশি লজ্জা পাচ্ছে। কিভাবে কথাটা এরিয়ে যায় বুঝতে পারছে না। স্নিগ্ধ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছো? পরবে না? তোমাকে শাড়িতে দেখার জন্যই এত রাতে কষ্ট করে এলাম।
ত্রয়ী কি করবে বুঝতে পারছে না। লজ্জাজনক একটা ব্যাপার। অনেক ভেবে একটা উপায় বের করলো। এখন শাড়ি পরতেই হবে। মামির একটা শাড়ি ওর রুমে আছে, সেটা পরে আসলেই পারে।
বুদ্ধি করে বলল, আচ্ছা ঠিকাছে। তাহলে আমি শাড়ি পরে আসি। কিন্তু আমি শাড়ি পড়তে পারিনা যে।
- সিরিয়াসলি পারোনা?
- না।
- স্নিগ্ধা পরিয়ে দিবে। নিয়ে যাও ওকে।
স্নিগ্ধা আৎকে উঠে বলল, এ বাবা আমি? আমি পারবো না। আমি কি ওসব পারি নাকি? আমাকে দিয়ে হবেনা।
ত্রয়ী সাথে সাথে উত্তর দিলো, তাহলে থাক আজকে পরতে হবেনা।
স্নিগ্ধর মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলো না ত্রয়ী। ও মন খারাপ করবে ভেবে বলল, আচ্ছা তাহলে শাড়ি পরেই আসি।
কথাটা বলে আর দেরি করলো না। দ্রুত রুমে চলে এলো। দরজা লাগিয়ে অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করল শাড়ি পরার। প্রায় মিনিট চল্লিশেক হয়ে গেল তাও ভালো মত পারল না। একবার কুচি গুলো উচু হয়ে যায় তো আরেকবার পাড়্গুলো উচু নিচু হয়। এরকম অবস্থা দেখে ত্রয়ী হাল ছেড়ে দিলো। শাড়িতে সুন্দর না দেখালে তো হবেনা।
ও স্নিগ্ধর নাম্বারে কল দিয়ে বলল, সরি আমি পারছি না। সবসময় আমাকে মামিই শাড়ি পরিয়ে দেয়। আজকে মামি নেই। আমি পারতেছি না তো।
স্নিগ্ধ একটু ভেবে বলল, আমি আসবো?
লজ্জায় লাল হয়ে ত্রয়ী বলল, আপনি পারেন শাড়ি পড়াতে?
- না পারলেও এখন পারতেই হবে। আমি এসে শাড়ি পরিয়ে দিই? আমি এটা জানি কিভাবে পরতে হয়।
- আপনি কিভাবে জানেন? আপনি কি শাড়ি পরেন?
হো হো করে হেসে উঠলো স্নিগ্ধ। হাসি থামিয়ে বলল, সেই বুদ্ধি আমার আছে। ওয়েইট করো। আসবো? - আচ্ছা আসুন।
শাড়িটা এলোমেলো ভাবে পরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ত্রয়ী। স্নিগ্ধ এসে দরজায় নক করা মাত্র খুলে দিলো। শাড়িতে বেশ অপূর্ব লাগছে দেখে ভালো লাগলো স্নিগ্ধর। এলোমেলো হলেও দারুণ লাগছে। স্নিগ্ধ ইউটিউবে শাড়ি পরার ভিডিও চালু করে দিয়ে বলল দাড়াও দিচ্ছি।
ত্রয়ী হাসলো ওর বুদ্ধি দেখে। স্নিগ্ধ কাছে এগিয়ে এসে শাড়িতে হাত লাগানো মাত্র চোখ বন্ধ করে ফেললো ত্রয়ী। প্রচন্ড লজ্জা পাচ্ছে। স্নিগ্ধ শাড়িটা ধরে আস্তে করে টান দিতেই ত্রয়ী জোরে ধরে রইলো। শাড়ি ছাড়তে চাইছিলো না। স্নিগ্ধ বলল, ছাড়ো নয়ত পড়াবো কিভাবে?
ত্রয়ী বুকের উপর আচলটা শক্ত করে চেপে ধরে কোমর থেকে শাড়ির কুচিগুলো ছেড়ে দিলো। ছেড়ে দেয়া মাত্রই ত্রয়ীর নগ্ন নাভীর দিকে চোখ যেতেই চমকে গেলো স্নিগ্ধ। এত সুন্দর নাভী কোনো মেয়ের হয়! ফর্সা কোমল পেটের মাঝখানে কি সুন্দর নাভীকোমল ফুটে আছে! উফফ ঘোর লেগে যাচ্ছে তো।
স্নিগ্ধ ওখানে ওভাবে তাকিয়ে আছে খেয়ালই করেনি ত্রয়ী। ত্রয়ী এখন চোখ বন্ধ করে আছে। পুরো শাড়িটা খুলে নতুন করে কুচি দিতে আরম্ভ করেছে স্নিগ্ধ। আর ত্রয়ী চোখ বন্ধ করে বুকের উপর শাড়ি চেপে ধরে রেখেছে। স্নিগ্ধ পেট আর কোমরের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে শাড়ি কুচি করছে। ঘোর ঘোর লেগে যাচ্ছে ওর। এত কাছাকাছি অবস্থান করে ত্রয়ীর কেমন যেন লাগছে। স্নিগ্ধ সবগুলো কুচি গুছিয়ে ত্রয়ীর কোমরে গুজে দেয়ার জন্য হাত বাড়ালো। হাত কাপছিলো স্নিগ্ধর। কখনো কোনো মেয়ের কোমরে হাত দেয়নি সে। আলতো করে ত্রয়ীর পেডিকোটে শাড়ি গুজেদেয়ার জন্য হাত ঢুকাতেই উষ্ণ স্পর্শে শিউরে উঠলো ত্রয়ী।
আর তলপেটের কোমল স্পর্শে পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে গেল স্নিগ্ধর। শাড়িটা গুজে দিয়ে হাত বের করতে ভূলেই গেল। ও তাকিয়ে আছে ত্রয়ীর দিকে। ত্রয়ীর লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা ক্রমশঃ আরো লাল হয়ে উঠছে। স্নিগ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই আর পারলো না তাকাতে। হাতটা বের করে নিলো। আবেশে স্নিগ্ধর বাহু জড়িয়ে ধরলো ত্রয়ী। ত্রয়ীর হাতটা জাপটে ধরতেই স্নিগ্ধও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ত্রয়ীকে বুকে জাপটে ধরে ধরলো শক্ত করে। স্নিগ্ধর বুকে মাথাটা ঠেকিয়ে গায়ের সমস্ত ভর স্নিগ্ধর উপর দিয়ে দিলো ত্রয়ী। এই প্রথম কাউকে জড়িয়ে ধরেছে ও। অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। জড়িয়ে ধরে পরম আবেশে চোখ বুজে রইলো দুজনে।
পর্ব ৬
একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ কেটে গেছে কেউই বলতে পারেনা। দরজা খোলাই ছিলো। স্নিগ্ধা হা করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। ভাইয়া আর ত্রয়ীর ভালোবাসাবাসি দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর দুজনের হুশ হলো হয়তো। ত্রয়ী একটু নড়েচড়ে উঠলে স্নিগ্ধ ছেড়ে দিল ওকে। ত্রয়ীর মুখটা লাল বর্ণের হয়ে উঠেছে। স্নিগ্ধ কয়েক পলক চেয়ে রইলো। ত্রয়ী দরজায় তাকিয়ে স্নিগ্ধাকে দেখে চোখ বড়বড় করে ফেললো। এত লজ্জা এর আগে কখনো পায়নি ও..
স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো, কিরে তুই এখানে?
স্নিগ্ধা সাথে সাথেই বলল, হু এখানে। আমাকে তো কেউ আসতে বারণ করেনি।
ত্রয়ী লজ্জায় মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। স্নিগ্ধ ত্রয়ীর দিকে একবার তাকিয়েই স্নিগ্ধাকে বলল, বড়দের মাঝখানে ছোটদের আসতে হয়না। দেখছিস আমরা কথা বলছি তাও কেন এলি?
- এইগুলাকে বুঝি কথা বলা বলে? তাহলে আমিও কারো সাথে কথা বলতে চাই এভাবে।
বলেই মুখ টিপে হাসলো স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধ ক্ষেপে বলল, পাজি মেয়ে রে। ধরে একটা মাইর লাগাবো।
মাইর খাওয়ার ভয়ে ছুটে পালিয়ে গেলো স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধ ত্রয়ীর দিকে ফিরে বলল, কি ভাবছো? লজ্জা পাচ্ছো?
ত্রয়ী কথা বলল না। স্নিগ্ধ আবারও জিজ্ঞেস করল, তুমি কি রাগ করেছো?
- না। তবে আপনি ই আমার লাইফে প্রথম পুরুষ…
প্রথম পুরুষ কথাটা শুনতে ভালো লাগলো স্নিগ্ধ’র। হেসে বলল, প্রথম পুরুষ হওয়া মানে আমার ভাগ্যটা ভালো। তবে আমি প্রথম নয়, শেষ পুরুষ হতে চাই। যার পরে তোমার লাইফে আর কেউ আসবে না।
চমকে উঠে খানিক্ষন চুপ করে থাকলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ বলল, কি হলো আবার?
- আপনি এতকিছু ভেবে ফেলেছেন? আপনি কি সিরিয়াস? আমি তো রিমঝিম নই।
- তো? আমিতো রিমঝিমকে দেখি ই নি। আমি তোমাকে দেখেছি, তোমার সাথে হেটেছি। তোমার চোখ আমাকে মুগ্ধ করেছে। রিমঝিম আসছে কোথ থেকে?
- আপনি তো রিমঝিম ভেবেই আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন তাইনা? রিমঝিম ভেবেই মুগ্ধ হয়েছেন।
- হ্যা। কিন্তু তোমাকে দেখার পর যতটা মুগ্ধ হয়েছি, এরপর রিমঝিমকে দেখলে হয়ত আর এতটা হতাম না। মানুষের চেহারাই সবসময় মুগ্ধ করেনা রে পাগলী। চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুই করে।
ত্রয়ী জানালার পাশে গিয়ে দাড়াল। জানালা এখনো খোলা। বাইরে থেকে মৃদু হাওয়া আসছিলো। ত্রয়ী বাইরে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এত দ্রুত কারো প্রেমে পড়া যায়?
- এটাকে দ্রুত বলছো কোন এংগেল থেকে? মাত্র এক পলকের দেখায় ভালো লাগলে একটা ছেলে ছুটতে ছুটতে সেই মেয়ের বাসায় চলে যায়।
- ওহ আচ্ছা। তাহলে কেবল একটা মেয়েই অনেক সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে কাউকে ভালোবাসে। তাই তো?
- এগজ্যাক্টলী। তুমিও তাই করছো এবং করবেও। আমার ক্ষেত্রে যা হয়ে গেছে সেটাই খুশিমনে মেনে নিয়ে তোমাকেই চাইছি। কিন্তু তুমি ভালো লাগা সত্বেও অনেক সময় নেবে, আমাকে ঘোরাবে পিছুপিছু, অযথা
অবহেলা করবে, ঝুলিয়ে রাখবে, আমাকে কষ্ট দিয়ে মজা পাবে আর তারপর রাজি হবে।
বলেই হেসে উঠলো স্নিগ্ধ। ত্রয়ী মুখ বাকা করে বলল, কি যে বলেন। ভারি দুষ্টু তো আপনি। - ছেলেরা একটু দুষ্টু না হলে প্রেমিক হতে পারে বলো?
- বাবারে বিশ্বপ্রেমিক দেখছি আপনি! তা এ যাবত কতগুলা প্রেম করেছেন?
স্নিগ্ধ একটু ভেবে বলল, করেছি কয়েকটা। আজকালের প্রেমকে প্রেম বলা যায় নাকি? সবাই তো জাস্ট ফ্রেন্ড। হা হা হা..
ত্রয়ী হেসে বলল, স্নিগ্ধা ওয়েট করছে। চলেন ওই রুমে যাই।
আমার যে কেবল তোমার সাথে একান্ত একা সময় কাটাতে ভালো লাগছে।
- ও অন্যকিছু ভাব্বে আবার। চলুন যাই বরং।
স্নিগ্ধ বাধ্য হয়ে ত্রয়ীর সাথে বসার ঘরে চলে এলো। ত্রয়ীকে শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে। এতক্ষণ ওর শাড়ি পড়ার দিকে খেয়ালই করেনি স্নিগ্ধ। এবার শাড়ি সজ্জায় দেখতে লাগলো ত্রয়ীকে। ত্রয়ী গুটি গুটি পায়ে নাস্তা এনে রাখলো সামনে। স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
- তোমার এই বাসায় কে কে থাকে?
- মামা মামি আর ভাই বোন।
- মামা মামি কেন? তুমি নিজের বাসায় থাকো না? এটা জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারিনি।
ত্রয়ী মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বাবা মা নেই।
কথাটা শুনে প্রচন্ড খারাপ লাগলো স্নিগ্ধর। যে কারো জন্য বাবা মা না থাকাটা অনেক বেশি কষ্টের। সেখানে ত্রয়ীর মত একটা মেয়ের…. কত লক্ষী একটা মেয়ে। অথচ কত একা! মামা মামীর কাছে মেয়েরা কেমন আদরে থাকে সেটা জানা আছে স্নিগ্ধর। ত্রয়ীর জন্য খারাপ লাগায় ছেয়ে গেল ভেতরটা। বাবা নেই শুনে দায়িত্ববোধের কথা মাথায় আসছে। আর মা নেই শুনে অন্যরকম মায়া কাজ করছে ত্রয়ীর প্রতি।
বলল, সরি ত্রয়ী। আমি আসলে ভাবিওনি এমন হতে পারে। ভেবেছিলাম হয়ত মামা মামীর বাসায় বেড়াতে এসেছো। কখনো বাসার কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি তাই। প্লিজ কষ্ট পেওনা।
ত্রয়ী হাসার চেষ্টা করে বলল, আরে ধুর। আমি এখন আর কষ্ট পাইনা। বাদ দিন তো। আপনি চা নিন।
- তুমি খুব সুন্দর চা বানাও ত্রয়ী। আচ্ছা এখানে তোমার প্রবলেম হয় কোনো?
- কিরকম প্রবলেম?
- অনেকেই আছেনা যারা অন্যের কাছে মানুষ হলে নানান প্রবলেম ফেস করে?
- না। আমার সেরকম কোনো সমস্যা নেই। আছি বেশ ভালই। তবে একজন বাবাকে বড্ড মিস করি। আর একজন মাকেও। মা থাকলে কত্ত আদর করতো তাইনা?
ত্রয়ী কথাটা এমনভাবে বলল যে আরো কষ্ট হলো স্নিগ্ধর। মা থাকলে কত্ত আদর করতো। সত্যিই তাই। যার মা আছে সে তো বুঝবে না যে মা না থাকার কি কষ্ট। কাউকে মা বলে ডাকার অধিকার যে ওদের নেই। এর মত কষ্ট আর কি আছে?
মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো স্নিগ্ধর। আর ভালো লাগছে না। এই দুষ্টু মিষ্টি মেয়েটার এত কষ্ট থাকতে পারে সেটা ভেবেও দেখেনি স্নিগ্ধ কিংবা স্নিগ্ধা কেউই।
স্নিগ্ধ কাছে এসে ত্রয়ীর হাতের উপর হাত রেখে বলল, কষ্ট পেওনা ত্রয়ী। মন খারাপ কোরোনা। এই দেখো আমি আছি। সব কষ্ট ভূলিয়ে দিবো তোমার। বাবা মায়ের মতই আগলে রাখবো তোমাকে। দেবে কি সে সুযোগ?
ত্রয়ী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে। এই প্রথম কেউ এভাবে বললো ওকে। এতটা ভালোবাসা আর মমতা নিয়ে কেউ কখনো কথা বলেনি ওর সাথে। কেউ কখনো ওর কষ্টটা বোঝারও চেষ্টা করেনি। আজকে প্রথম এই অনুভূতিটা হয়ে দারুণ ভালো লাগা কাজ করলো ত্রয়ীর। কত দরদ নিয়ে বললো স্নিগ্ধ!
ত্রয়ীকে চুপ থাকতে দেখে স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
- ভাইয়ের বয়স কেমন?
- ছোট।
- তুমি এখানেই মানুষ?
- হ্যা। নানা নানীর কাছে ছিলাম। ওরা চলে যাওয়ার পর এদের কাছে।বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ ত্রয়ীর কষ্টটা নিজের মাঝে অনুভব করলো। ত্রয়ীর পাশে সবসময় থাকার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
স্নিগ্ধ বলল, ত্রয়ী আমার দিকে তাকাও তো।
ত্রয়ী স্নিগ্ধ’র চোখের দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাতে পারলো না। মন কেমন করছে খুব। আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকালো স্নিগ্ধর চোখের দিকে। স্নিগ্ধ চোখের ভাষা পড়ে নিলো। ত্রয়ীর চোখে অসম্ভব মায়া দেখতে পারছে ও। এই মায়াকে অনুভব করেই তো যেকোনো দুঃসাধ্য কাজও সম্ভব করা যায়।
ত্রয়ী ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল, আপনার বাসায় কে কে আছে?
স্নিগ্ধ উত্তর দিলো, বাবা মা আর আমরা দুই ভাই বোন।
- ওহ আচ্ছা। মায়ের সাথে আপনার নিশ্চয়ই অনেক ভাব?
- হুম। সেটা অনেক। মায়ের সাথে সবসময় ছেলেদের ই ভাব থাকে। আর এইযে স্নিগ্ধাকে দেখছো না? মা ওর চেয়ে আমাকেই বেশি ভালোবাসে।
স্নিগ্ধা চেতে উঠে বলল, একদম ই না। মা আমাকে বেশি ভালোবাসে।
- কচু বুঝিস ভালোবাসার? মা আমাকে বেশি ভালোবাসে।
- মা আমার।
- আমারও মা। মা আমাকেই বেশি আদর করে আমি জানি।
দুই ভাই বোনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেলো। খুনসুটিময় ঝগড়া চলতেই লাগলো। ত্রয়ী দেখছে আর হাসছে। আর মনেমনে ভাবছে, আজকে যদি আমার একটা আপন ভাই থাকো, আমাকেও এইভাবে সবসময় জ্বালাতো! সবার জীবনটা একরকম হয়না। এই সুখ আমার কপালে ছিলো না…
পর্ব ৭
ত্রয়ীকে আনমনা দেখে স্নিগ্ধ ভ্রু দুটো নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি হলো তোমার আবার?
ত্রয়ী বলল, আমি একটা ভাইকে খুব মিস করি।
স্নিগ্ধা সাথে সাথেই বলল, তোমাকে আমরা আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো দ্রুত। তাহলে খুব ভালোই হবে কি বলো আপু?
ত্রয়ী কিছু বলল না। এমন সময় স্নিগ্ধার ফোন বেজে উঠলো। তার প্রেমিক কল দিয়েছে। স্নিগ্ধা কথা বলার জন্য উঠে পাশের রুমে চলে গেলো। স্নিগ্ধ একেবারে ত্রয়ীর কাছাকাছি এসে বলল, কোনোকিছু নিয়ে মন খারাপ? নাকি আমার কথায় মন খারাপ হয়ে গেছে ত্রয়ী?
ত্রয়ী মাথাটা দুদিকে নাড়িয়ে বলল, নাথিং।
এরপর চোখ ঘুরিয়ে স্নিগ্ধ’র চোখের দিকে তাকানো মাত্রই চোখাচোখি হয়ে গেল। স্নিগ্ধর দৃষ্টি গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে। সেই চোখের দিকে তাকানো যায়না এতটাই ভয়ংকর চোখ! ত্রয়ীর বুকটা কেপে উঠলো হঠাৎ করে। কেপে উঠলো ত্রয়ী নিজেও। এত সাংঘাতিক চাহনি কারো হয়?
স্নিগ্ধ আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে ত্রয়ীর হাত ধরে ফেলল। ত্রয়ী একটু নড়েচড়ে বসলো তখন। চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিল। তাকিয়ে থাকতে পারছিল না। স্নিগ্ধ মুখটা আরো কাছে এগিয়ে এনে বলল, কি?
ত্রয়ী দুদিকে মাথা নাড়াল। দুজনের নিশ্বাস ঘন হচ্ছে। এমন সময় বেজে উঠলো দরজার কলিং বেল। চমকে উঠলো দুজনেই। কলিংবেল বাজছে! এবার কি হবে? নিশ্চয় মামা এসেছে। কিন্তু মামা তো বলেছিল আজকে আসবে না। তবুও..
ভয়ে দুরুদুরু করে বুকটা কাপতে শুরু করেছে ত্রয়ীর। স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমার রুমে যান। মামা কখনো আমার রুমে যায়না। আপনি গিয়ে লুকান।
স্নিগ্ধ আর এক মুহুর্ত দেরি না করে দ্রুত ত্রয়ীর রুমে চলে গেলো। এদিকে স্নিগ্ধা কথা বলতে বলতে পাশের রুমের বেলকুনিতে চলে গেছে। ও বুঝতে পারেনি বাসায় কেউ এসেছে। ত্রয়ী এসে রুমে ওকে খুঁজে না পেয়ে ভাবল, অসুবিধা নেই। স্নিগ্ধাকে ওর বান্ধবী বলে পরিচয় করালেই হবে। এরপর এসে দরজা খুলে দিলো।
মামা ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, ঘুমাই গেছিলি নাকি?
- হ্যা মামা। আপনি এত রাতে?
বলেই চোখ কচলে ঘুমানোর ভান করলো ত্রয়ী। মামা বললেন, কালকে আমার একটা কাজ পড়ে গেছে। সেজন্য তারাহুরো করে চলে আসতে হল। তোর মামি থেকে গেছে। তুই যা, গিয়ে ঘুমা।
স্নিগ্ধা যে রুমে ঢুকেছে তার পাশের রুমে গিয়ে মামা ঢুকলেন। মামা দরজা লাগিয়ে দিলেন খট করে। ত্রয়ী দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে বিছানার উপর বসতে বসতে বলল, বাড়িটা তিনটা মাত্র রুম। এটা আমার, একটা মামা মামির আর আরেকটা আমার মামাতো বোনের। মামা নিজের রুমে ঘুমাইছে গিয়ে। - আর স্নিগ্ধা কোন রুমে?
- স্নিগ্ধা অন্য একটা রুমে। ওকে ডাকবো?
- আপাতত ডাকতে হবেনা। ওই দরজা বন্ধ পেলে নিজেই এই রুমে এসে পড়বে।
- যদি ভাইয়া বলে ডাকা আরম্ভ করে?
- আমি ওকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি, নো টেনশন।
স্নিগ্ধ তৎক্ষণাৎ স্নিগ্ধাকে কল দিয়ে দেখলো ফোন ওয়েটিং। স্নিগ্ধা কল রিসিভ করলে বললো, যেখানে আছিস সেখানেই কথা বলতে থাক। বের হোস না, মামা এসেছে। আমি আর ত্রয়ী ত্রয়ীর রুমে।
- তোরা এক রুমে?
- চুপ, কথা বলতে বলতে ঘুমা। ত্রয়ী সময়মত তোকে জাগিয়ে দিবে।
ফোন রেখে ত্রয়ীর দিকে তাকানো মাত্রই ত্রয়ী অবাক হয়ে চেয়ে রইল। স্নিগ্ধ চোখ বড়বড় করে বলল, কি দেখছ এভাবে?
- আপনি এখানেই থাকবেন?
- হ্যা। তো?
- আপনি ওই রুমে যান। আমি আর স্নিগ্ধা এখানে ঘুমাবো।
- আরে তোমাকে রেখে একা গিয়ে ঘুমাবো?
- স্নিগ্ধা কি ভাব্বে আমাদেরকে এক রুমের কথা শুনলে?
- আরে বাদ দাও তো৷ ও কিছুই ভাব্বে না।
- তবুও.. ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না?
- ব্যাপারটা স্বাভাবিক ম্যাম। এবার এদিকে আসেন।
ত্রয়ী কাপা কাপা গলায় বলল, এদিকে আসবো মানে? - আহা আসো তো।
ত্রয়ী কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। স্নিগ্ধ ওকে কাছে টেনে নিয়ে সামনে দাড় করিয়ে দিয়ে হা হয়ে মুখের দিকে চেয়ে রইলো অপলক ভাবে। ত্রয়ীর খুব আনইজি লাগছে। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিল না ও। একটু পরে শুধু চোখ তুলে মুখটা তাকায় আর তারপর আবার অন্যদিকে তাকায়।
স্নিগ্ধ আলতো করে ত্রয়ীর মুখটা ধরলো দুহাতে। ত্রয়ী কোনো শব্দ করলো না। শুধু বারংবার কেঁপে উঠতে লাগলো। ত্রয়ী স্নিগ্ধকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেও পারলো না। অনেক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর স্নিগ্ধ ত্রয়ীর মাথাটা টেনে এনে কপালে চুমু একে দিলো। ত্রয়ীর নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। কিন্তু এরকম অনুভূতি প্রথমবার হওয়ায় অনেক টা পাগল পাগল আর নেশার ঘোরে চলে যাচ্ছিলো স্নিগ্ধ ত্রয়ীর চোখে চোখ রাখা মাত্রই ত্রয়ী আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।
স্নিগ্ধর বুকে ঝাপিয়ে পড়লো হঠাৎ করে। স্নিগ্ধর মনে হল হঠাৎ বুকের উপর গুলি এসে বিধলো। আচমকা এরকম বুলেটাঘাতে নিস্তব্ধ হয়ে ত্রয়ীকে জাপটে ধরলো বুকের সাথে। প্রেম দিয়ে শুরু না হলেও ধীরেধীরে একজন আরেকজনের প্রেমে ভালো মতই পড়ছে সেটা টের পেয়ে গেলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধকে কিছুতেই আর নিজের মন থেকে আলাদা করা সম্ভব হবেনা। ভালোলাগা থেকে সবসময় ভালোবাসা হয়েছে আর আজকে ভালোবাসা থেকে ভালোলাগা হয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধতা কতটুকু ছিলো কেউই জানেনা। এখন শুধুই অনুভূতি!
ত্রয়ী বলল, আপনার শরীরে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ আছে।
মুচকি হেসে মুখ তুললো স্নিগ্ধ। ত্রয়ী ওর মুখের দিকে তাকাতেই পারছিলো না। স্নিগ্ধ ওর কোমরে হাত দিয়ে কাঁছে টেনে নিয়ে বলল, রাগ কোরোনা। আর কিচ্ছু করবো না। তুমি আমার লক্ষিটি না? তোমার ভরসা ভাংবো না কখনও।
ত্রয়ী কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। তারপর আর কোনো শব্দ করলো না। নিশব্দে স্নিগ্ধর বাহু চেপে ধরে রইলো।
পর্ব ৮
ত্রয়ী মনেমনে ভাবছে, স্নিগ্ধর কপালটা এত প্রশস্ত আর সুন্দর কেন? কপালের উপরে সিল্কি চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। দেখলেই মনচায় হাত দিয়ে সরিয়ে দিই। চওড়া কপালের নিচে দুটো অপূর্ব সুন্দর চোখ। ছেলেদের চোখও বুঝি কখনো এত সুন্দর হতে হয়? এরকম অনেক প্রশ্ন নিয়ে মুগ্ধ নয়নে স্নিগ্ধর স্নিগ্ধ চোখের দিকে চেয়ে আছে ত্রয়ী।
স্নিগ্ধ বলল এই মেয়ে কি দেখছো?
ত্রয়ীর হুশ নেই। সে দেখেই যাচ্ছে, দেখেই যাচ্ছে। স্নিগ্ধ আবারও বলল, কি হলো ম্যাম? কি দেখেন এভাবে?
ত্রয়ী লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল – আপনি এইযে আমার এত কাছে। আমার ভয় করছে না কেন?
স্নিগ্ধ হেসে উত্তরে বলল, ভয় করার মত কিছু করবো না বলে ভয় করছে না।
- যদি কিছু করেন?
- বারে, কি আবার করবো?
- ফুলকে এত কাছে পেয়েও ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছে হয়না?
- ফুলটা যদি আমার না হয়, ঘ্রাণ নেয়ার অধিকার আমার নেই। ফুলের মালী তো ফুলটাকে আমার হাতে তুলে দেয়নি। তাই..
ত্রয়ী আবারও লাজুক সুরে হাসল। হাসার পর বলল- ফুলের মালী যদি ফুল দিতে আগ্রহী হয়ে থাকে?
- তাহলে সে আমার গলায় মালা পড়াবে। আর আমি ফুলের ঘ্রাণ নেবো।
- সত্যি!
ত্রয়ীর লাজরাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল স্নিগ্ধ নিজেও। ত্রয়ী আচমকা উঠে কাছে এসে স্নিগ্ধর গলায় দুহাতে মালা পড়িয়ে গলা চেপে ধরলো। তারপর বলল,
- এইযে মালা পরালাম।
- তাহলে এবার ফুলের মালিকানা আমার?
- মালীর দায়িত্ব মালি করেছে। এবার ফুল যার, বাকিটা সে বুঝে নিবে।
স্নিগ্ধ দুষ্টমি হাসি দিলো। এরপর ত্রয়ীর মুখটা দুইহাতে কাছে টেনে চেপে ধরল মাথাটা। মাথার উপর মুখ ডুবিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিতে আরম্ভ করল মন ভরে। ত্রয়ী চোখ বন্ধ করে ফিল নিচ্ছে। স্নিগ্ধ যতবার ঘ্রাণ নিচ্ছে ততবারই ভালো লাগায় ভরে যাচ্ছে ওর ভেতরটা। মেয়েদের চুলে একটা মাদকতাময় গন্ধ থাকে। মাতাল হয়ে যাচ্ছে স্নিগ্ধ।
ত্রয়ী নিশ্চুপ। স্নিগ্ধ বলল- এই চুলের গন্ধ প্রাণ ভরে একবার নিলেই তো বাকি জীবন পার করে দেয়া যাবে।
ত্রয়ীর এতটা ভালো লাগছে যে আরামে চোখ বুজে আছে। দারুণ ফিল করছে ও।
বলল- পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহুর্ত কোনটা জানেন?
- না তো। কোনটা?
- প্রেমে পড়ার মুহুর্তটা।
- বাহ। ভালো বলেছো তো।
- মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন সবকিছুই রঙিন আর সুন্দর লাগতে শুরু করে। ধীরে ধীরে জীবনটা রঙে রাঙা হয়ে যায়। চারদিকে যা দেখে তাই ভালো লাগে। সুখ আর সুখ। ইচ্ছে হয় হাজার বছর বাচি। এজন্যই
বলা হয় পৃথিবীর সবচে সুন্দর মুহুর্ত হচ্ছে প্রেমে পড়ার মুহুর্তটা।
স্নিগ্ধ মুগ্ধ হয়ে বলল- তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারো।
ত্রয়ী মুচকি হাসল। স্নিগ্ধ ত্রয়ীর কোমরে হাত রেখে সুন্দর করে আগলে ধরে রইল ওকে। স্নিগ্ধ বিছানায় বসে আছে। ত্রয়ী বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর স্নিগ্ধর গলা ধরে আছে।
স্নিগ্ধ বলল- আচ্ছা ত্রয়ী একটা কথা বলবা? - হুম বলুন।
- ধরো হঠাৎ করে তোমাকে আর আমাকে পুরো পৃথিবী থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়া হল। আমরা দুজন ভিন গ্রহের মানুষ হয়ে গেলাম। সেখানে শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ নেই। তখন কি তুমি আমাকে নিয়েই সুখী হবে? নাকি ফিরে আসতে চাইবে এখানে? সবার কাছে।
ত্রয়ী এক মুহুর্ত থমকে থেকে বলল- এই পৃথিবীতে আমার আপন বলতে কেউ নেই যার কাছে ছুটে আসবো। আমি তো অনেক একা। আপনজনের টানে আসার মত আপনজন নেই আমার। আপনার সাথে ভিন
গ্রহে বাস করাই যায়। কিন্তু আপনি কি আমার আপনজন?
প্রশ্নটা বুকে বিধল স্নিগ্ধর। এই মেয়েটা অনেক একা সত্যিই। কেউ নেই ওর। এত একা আর দুঃখী একটা মেয়ে। কত কষ্ট করে বেচে আছে। বাবা মা ভাই বোন যার কেউ নেই, তার জীবন তো মরুভূমির মত। মেয়েটা বেচে আছে কিভাবে?
ত্রয়ী জিজ্ঞেস করলো- দুনিয়াটা কত স্বার্থপর জানেন? সবাই শুধু স্বার্থের জন্য কাছে আসে। এইযে আজকে আপনি এখানে এসেছেন এর পেছনেও আপনার স্বার্থ আছে। সেটা হচ্ছি আমি। স্বার্থ ছাড়া কেউ কখনো কোনো কিছু করেনা। - তুমি যদি আমার স্বার্থ হয়ে থাকো সেটা আমার সৌভাগ্য হয়ে থাক ত্রয়ী। তোমার জন্য যেন সবকিছু করার তীব্র বাসনা আমার মধ্যে থাকে। তাহলেই হবে। এরকম স্বার্থ থাকলে ক্ষতি কি বলো?
- স্বার্থ ফুরোলেই আপনি আর আমাকে চিনবেন না।
- আমাকে এরকম মনে হচ্ছে?
- না হওয়ার কারণ নেই। এই জগতের নিয়মই এমন। আপনাকে মাত্র দুটো দিনে কি এমন চিনেছি বলেন?
- সেটা ঠিক বলেছো। কিন্তু সবাই একরকম হয়না।
- সবাই আলাদাও হয়না। স্বার্থ জিনিসটা সবার মাঝেই থাকে। সবার মাঝেই।
- আমি যদি নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে চাই?
- পারবেন না। কেউ পারবে না।
- আমাকে সুযোগ দেয়া যায়?
- দেখিয়ে দিতে পারেন। তারপর বিশ্বাস করবো।
- শুধু বিশ্বাস করলেই হবে? বিনিময়ে আমি কি পাবো?
ত্রয়ী অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল- হাসালেন আমায়। এইযে এক রুমে দুজনে আছি। আপনাকে বিশ্বাস করে রুমে এনেছি। আপনার গলা জড়িয়ে ধরেছি। তারপরও বলছেন আপনার বিনিময় কি? আপনি নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসলে আমি কি ছেড়ে দিবো? আমিও বেসে পুষিয়ে দিবো আপনার কষ্ট।
স্নিগ্ধ সন্তুষ্ট হয়ে বলল- ওকে ডান। আমার মিশন শুরু হোক তাহলে?
- ওকে ডান।
- মিশনের নাম নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে প্রমাণ করে দিতে হবে যে পৃথিবীতে এখনো নি’স্বার্থ ভালোবাসা আছে। তাইতো?
ত্রয়ী হেসে বলল- ঠিক তাই। আমার বিশ্বাস আপনি ফেইল করবেন। এরকম ভালোবাসা নেই কোথাও।
স্নিগ্ধ সাথে সাথেই ত্রয়ীর গলা ছেড়ে দিয়ে বলল- এখন থেকেই শুরু হোক।ত্রয়ী উঠে এসে সামনে বসলো। স্নিগ্ধ আর ত্রয়ী মুখোমুখি। ত্রয়ীর চোখে হাসির ঝিলিক। স্নিগ্ধ বলল- কি ভাবছ?
- আসুন আমরা শুয়ে পড়ি। একটা কাজ করে দেখাতে পারবেন?
- কি কাজ?
- দুজনে পাশাপাশি শুয়ে গল্প করবো। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবো কিন্তু কেউ কাউকে ছোবো না। পারবেন?
স্নিগ্ধ হেসে বলল- না পারার কিছু নেই। তোমাকে ছুয়ে দেখলেই যে আমার শান্তি এটা কি করে ভাবলে? তোমার আনন্দ দেখলেই আমার খুশি। তোমাকে ছুয়ে দেখাতে নয়। মনে রেখো কথাটা।
- ওকে ফাইন।
ত্রয়ী বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। স্নিগ্ধ পাশের বালিশে শুয়েছে। দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। মাঝখানে এক হাতের দূরত্ব।
ত্রয়ী স্নিগ্ধর ঠোঁট, মুখ, নাক, চুল সবকিছু খেয়াল করছে। আর স্নিগ্ধ খেয়াল করছে ত্রয়ীর চোখ। মায়াভরা দুটো চোখ। দেখলে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। পাগল করার জন্য যথেষ্ট ওর চোখ দুটো।
ত্রয়ী বলল- আপনার পড়াশোনা কিংবা জব? কিসে আছেন এখন?
- গ্রাজুয়েশন শেষ করে এখন জবের চেষ্টা করছি।
- বাহ বেশ। ভালো। মাকে খুব ভালোবাসেন তাইনা?
- হ্যা। মাকে সব কথা না বললে ভাত হজম হয়না আমার।
- আমার তো মা ই নেই।
কথাটা ত্রয়ী এমনভাবে বলল যে ভেতরটা ছ্যাত করে গেলো স্নিগ্ধর। শুনতে খুবই খারাপ লাগল। ত্রয়ীর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল- আমি আছি তো। পাগলী। এভাবে বলেনা। আমি সব পুষিয়ে দিবো।
তারপরই খেয়াল হল আজকে তো ছোয়া যাবেনা। হাত সরিয়ে নিয়ে স্নিগ্ধ বলল- সরি সরি। ভুল হয়ে গেছে।
ত্রয়ী বলল- ভূল না। আমার ভালো লাগছে। আমার মাথায় কেউ কখনো হাত বুলিয়ে দেয়নি। একটু ঘুম পারিয়ে দিন না। খুব আরাম লাগছে।
স্নিগ্ধ পরম যত্নে ত্রয়ীর চুলে হাত বুলাতে লাগলো। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ল ত্রয়ী।
পর্ব ৯
ত্রয়ী গাঢ় ঘুমে তলিয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধ ভাবছে কিভাবে ওকে প্রমাণ করে দেয়া যায় পৃথিবীতে এখনো স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে। এটা প্রমাণ করাটা সত্যিই অনেক কঠিন। আদৌ কি কেউ কাউকে স্বার্থহীন ভাবে ভালোবাসে? হয়তো বাসতো, কিন্তু এখন আর সেই ভালোবাসা টা নেই। তাহলে কিভাবে বুঝাবে ওকে?
ত্রয়ীর মুখের পানে তাকিয়ে এসবই আনমনে ভাবছে স্নিগ্ধ। আর আরাম করে হাত বুলাচ্ছে চুলে যাতে মেয়েটা সুন্দর ভাবে ঘুমাতে পারে।
ত্রয়ীর বয়স খুব বেশি হবেনা। চঞ্চলতায় ভরপুর একটা মেয়ে। কিন্তু ওর জীবনের সাথে কিছু অদ্ভুত কষ্ট মিশে আছে। এই কষ্টগুলোকে এড়ানো যায়না কোনোভাবেই। বাবা মা ছাড়া একটা মেয়ে কতটা কষ্ট নিয়ে বাঁচে সেটা শুধুমাত্র তারাই বুঝবে যাদের বাবা মা নেই।
স্নিগ্ধ ভাবতে ভাবতে অনেক রাত করে ফেললো। কিন্তু ঘুম আসছে না কিছুতেই। ত্রয়ীকে ভেবে ভেবে রাতটা কাটিয়ে দিতে হবে। মেয়েটা কি জানবে এই ছেলেটা সারারাত ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছে? হয়তো কখনোই জানবে না। ছেলেটা নিজেও অবাক হয়ে যাচ্ছে, কখনো কোনো মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ভেবে সারারাত কাটাবে এটা সে নিজেও ভাবেনি কখনো।
দেখতে দেখতে রাত ভোর হতে চললো। তবুও স্নিগ্ধর চোখে ঘুম এলোনা। ত্রয়ী হঠাৎ পাশ ফিরে অন্য পাশ হয়ে শুয়ে পড়ল। স্নিগ্ধ একটা হাত জাপটে ধরে গালের নিচে দিয়ে ঘুমালো। স্নিগ্ধ শিউরে উঠলো ত্রয়ীর নরম গালের স্পর্শ পেয়ে। কেমন কেমন যেন লাগছে। কিন্তু ত্রয়ী বলেছিলো সারারাত পাশাপাশি শুয়ে থাকতে হবে কিন্তু ছোয়া যাবে না। কথাটা ভেবে তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো স্নিগ্ধ। কিন্তু এতে ফল হলো আরো উল্টো। ত্রয়ী স্নিগ্ধর হাতটা টেনে ধরে নিজের বুকের উপর টেনে নিলো স্নিগ্ধকে। এই-বার তো আরো বিপদ। দুহাতে স্নিগ্ধর গলা ধরে স্নিগ্ধর বুকের ভেতর এসে ঢুকতে চাইছে। স্নিগ্ধ প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর। এমনভাবে হাতটা সারিয়ে নিচ্ছে যাতে ত্রয়ীর ঘুম না ভাঙে। আবার যদি ঘুম ভেংগে যায় তাহলে ভাব্বে স্নিগ্ধ সুযোগ নিচ্ছে। কি এক বিপদে পড়া গেলো…
স্নিগ্ধ ত্রয়ীর হাত ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এলো হাতের বাধন থেকে। ত্রয়ী সরতে সরতে স্নিগ্ধর অনেক কাছে চলে এসেছে। স্নিগ্ধ আরো সরে আসতে লাগলো বিছানার কোনায়। ত্রয়ী আরো সরে আসলো। স্নিগ্ধও সরতে লাগলো। এভাবে সরতে সরতে একেবারে বিছানার কোনায় পৌছে গেল স্নিগ্ধ। আরেকটু হলে বিছানা থেকে পড়েই যাবে একেবারে। নিজেকে সামলে নিলো স্নিগ্ধ। ত্রয়ীকে সরিয়ে দিলে যদি সে জেগে যায়? মেয়েটা ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। জাগানো যাবেনা। অন্যদিকে জাগিয়ে দিলে আবার অন্য কিছু ভাবতে পারে। বাধ্য হয়েই স্নিগ্ধ বিছানা থেকে নেমে এলো। বিছানার পাশে চেয়ারে বসে তাকিয়ে রইলো ত্রয়ীর দিকে।
মেয়েটা এখন ঘুমাচ্ছে আরাম করে। তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধ। কিছুক্ষণ তাকানোর পর নিজেরও ঘুম এসে গেলো। ঘুমে ঢলতে ঢলতে দেয়ালে হেলান দিয়ে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়লো স্নিগ্ধ।
ভোরবেলা ঘুম ভাংলো ত্রয়ীর। ঘুম ভাঙার পর সর্বপ্রথম চোখ মেলে তাকালো সামনে। একি! স্নিগ্ধ চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে কেন?
ত্রয়ী কয়েক মুহুর্ত চোখের পলক ফেলতে পারলো না। তারপর আস্তে করে উঠে এলো বিছানা ছেড়ে। ভোর হওয়ার আগ মুহুর্ত, বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া।
ত্রয়ী স্নিগ্ধর হাতের উপর হাত রাখতেই চমকে উঠলো স্নিগ্ধ। ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ মেলে তাকালো ও। অবাক হয়ে চোখ কচলে বলল, ত্রয়ী! তুমি!
ত্রয়ী বলল, আপনি এখানে ঘুমাচ্ছেন কেন? বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছেন যে?
স্নিগ্ধ বললো, আসলে তোমাকে ডাকলে যদি ঘুম ভেংগে যায়? সেজন্য ডাকিনি। তুমি আমার অনেক কাছে সরে এসেছিলে। সেজন্য উঠে এসে এখানে শুয়েছি।
মুগ্ধ হয়ে কথা বলতে ভূলে গেছে ত্রয়ী। কাছে সরে আসার কারণে উঠে এসে চেয়ারে শুয়েছে! কি অদ্ভুত একটা মানুষ। বিস্ময়ের জন্য কথা বেরোচ্ছে না ত্রয়ীর মুখ থেকে৷ ত্রয়ী অবাক হয়ে বলল, আপনি সত্যিই অন্যরকম একটা মানুষ!
স্নিগ্ধ বলল, ঘুম ভাংলে আমাকে তোমার কাছে দেখলে আবার আমাকে ভূল ভাবতে। তাই..
চোখে পানি এসে গেলো ত্রয়ীর। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, এত ভালো কেন আপনি? আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালেও রাগ করতাম না।
- কিন্তু তুমি ই তো বলেছিলে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমাবো কিন্তু কেউ কাউকে টাচ করা যাবেনা।
ত্রয়ী অবাক হল। বেশ অবাক হলো। বলল- আচ্ছা উঠুন তো। এখন বিছানায় গিয়ে শোবেন।
- ত্রয়ী বোধহয় ভোর হয়ে গেছে। আমি বরং চলে যাই?
- কোথায় চলে যাবেন?
- বাসায়।
- আরে সমস্যা নেই। মামা আমার রুমে আসেনা কখনও। মামা সকালে নাস্তা করে চলে যাবে, তখন আপনি চলে যেতে পারবেন, অসুবিধা নাই।
স্নিগ্ধ তবুও বসে থাকলো চেয়ারে। ত্রয়ী জোর করে হাত ধরে টেনে তুললো স্নিগ্ধকে। তারপর হাত ধরেই বিছানায় টেনে এনে বসালো। বিছানায় শুইয়ে দিলো স্নিগ্ধকে।
নিজেও শুয়ে পড়লো স্নিগ্ধর পাশে। তারপর স্নিগ্ধ কিছু বুঝে ওঠার আগেই জড়িয়ে ধরলো স্নিগ্ধকে। অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরায় অবাক স্নিগ্ধ! কিন্তু কিছু বললো না। চুপচাপ শুয়ে রইলো। ত্রয়ী নিজেই একটা হাত দিয়ে স্নিগ্ধকে শক্ত করে শরে শুয়ে রইলো।স্নিগ্ধ চুপচাপ। ত্রয়ী স্নিগ্ধর শরীরের গন্ধটাকে উপভোগ করছে। চোখ ভিজে আসছে বারবার। স্নিগ্ধটা আসলেই একটা পাগল। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রমাণ দেয়া শুরু করেছে নাকি?
ত্রয়ীর আর ঘুম এলো না। স্নিগ্ধর ও এলোনা ঘুম। কোনো মেয়ে এভাবে বুকের উপর পড়ে শুয়ে থাকলে কি আর ঘুম আসে? তাও সে মেয়েকে স্নিগ্ধ নিজে অনেক ভালোবাসে। স্নিগ্ধ বলল- ত্রয়ী, আমরা কোনদিকে আগাচ্ছি?
- কোনদিকে মানে?
- ভালোবাসার দিকে। আমি তো তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। তুমিও এখন আমাকে ভালোবাসো কিন্তু এটা ক্ষণিকের হতে পারে। কয়দিন গেলে আমাকে তোমার অসহ্য লাগবে না তো?
ত্রয়ী অবাক হয়ে বলল- কি যে ব’লেন? অসহ্য লাগবে কেন? আর আপনাকে অসহ্য লাগার কোনো কারণ নেই। এইযে আপনার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছি, একটুও অবাক লাগছে না? আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না?
স্নিগ্ধ কিছু বলল না। ত্রয়ী আবারও জিজ্ঞেস করলো, আমাকে বিশ্বাস হয়না? একটা অচেনা মানুষকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছি তবুও….?
স্নিগ্ধ নিচু হয়ে ত্রয়ীর কপালে চুমু দিলো। সাথে সাথেই স্নিগ্ধকে আরো শক্ত করে ধরলো ত্রয়ী। চোখটা আবারও ভিজে উঠতে শুরু করেছে।
পর্ব ১০
জড়িয়ে রেখে স্নিগ্ধ নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ত্রয়ী আর নড়াচড়া করল না। ছেলেটা ঘুমায়নি সারারাত।
ত্রয়ী বেশ কিছুক্ষণ স্নিগ্ধর নিশ্বাসের শব্দ উপভোগ করলো। তারপর হাতটা ছাড়িয়ে আস্তে করে উঠে এলো বিছানা ছেড়ে। স্নিগ্ধ খুব আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ত্রয়ী বিছানা থেকে নেমে সোজা রান্নাঘরে চলে এলো। চা বসিয়ে দিয়ে রুমে এলো। শাড়িটা বদলানোর সময় বারবার মনেহচ্ছিলো গতরাতের কথা। স্নিগ্ধ কত ভালোবেসে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছিল সেটা ভাবতে লাগলো। ভাবলেই শরীর শিউড়ে ওঠে।
নাস্তা বানানো শেষ করে স্নিগ্ধাকে ডেকে তুললো ঘুম থেকে। রাতের ব্যাপারটার জন্য সরি বললো। স্নিগ্ধা হেসে বলল- আরে আমি কিছু মনে করিনি।
- তুমি নিশ্চয় ভাবছো আমাদের মধ্যে অনেক কিছু হয়ে গেছে? সেরকম কিছু হয়নি।
স্নিগ্ধ বলল- আমি কিছু ভাবিনি। সেরকম কিছু মনেও করিনি। আমি জানি আমার ভাইটা কেমন। ছোটবেলা থেকে দেখছি তো।
ত্রয়ী মিষ্টি হেসে বলল- তোমার ভাইটা সত্যি অন্যরকম একটা মানুষ। নাস্তা হয়ে গেছে, খাবে চলো।
স্নিগ্ধা ও ত্রয়ী একসাথে বসে নাস্তা করলো। মামা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে চলে গেলেন কাজে। ত্রয়ী রুমে এসে দেখলো স্নিগ্ধ এখনো ঘুমে। ছেলেটা এত সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে যে মোটেও ডাকতে ইচ্ছে করলো না ত্রয়ীর। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে স্নিগ্ধকে ঘুমাতে দেখলো। তারপর এসে পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। ত্রয়ীর হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকালো স্নিগ্ধ। ওর মনে হচ্ছিলো ত্রয়ী ওর বিয়ে করা বউ। কি যে ভালো লাগছিলো। মনে মনে ভেবে ফেললো মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেললে মন্দ হবেনা।
ত্রয়ী জিজ্ঞেস করল- কি ভাবছেন এভাবে?
- তেমন কিছু না। মামা চলে গেছেন?
- হ্যা। অনেক বেলা অব্দি ঘুমিয়েছেন। যেকোনো মুহুর্তে মামী চলে আসতে পারে। এখন নাস্তা করে বাসার উদ্দেশ্যে বের হোন মশাই।
- আমার তো যেতে ইচ্ছে করছে না।
- ছাড়তে তো আমারও ইচ্ছে করছে না।
- তুমি বুঝি আমাকে ধরে আছো যে ছাড়তে ইচ্ছে করবে না?
হেসে ফেললো ত্রয়ী। বলল- আপনি উঠুন এখন। মামী আসলে সমস্যা হবে।
বাধ্য ছেলের মত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল স্নিগ্ধ। উঠতে উঠতে বলল- এত আরাম করে বহুদিন ঘুমাইনি। - বুকের উপর কেউ ছিলো বলে…
স্নিগ্ধ ত্রয়ীর দিকে তাকানো মাত্র লজ্জায় চোখ ঘুরিয়ে নিলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ বলল- ভাবছি এটাকে পার্মানেন্ট করা যায় কিনা?
লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটা। স্নিগ্ধ বলল- আর লজ্জা পেতে হবেনা। স্নিগ্ধাকে ডাকুন, বের হবো। - এখনই? নাস্তা করবেন না?
- না। আরেকদিন এসে করবো।
- সেকি! আমি এত কষ্ট করে বানালাম।
- তাহলে তো খেতেই হয়। একটা শর্ত আছে,তুলে খাওয়ালে খাবো।
- তুলে খাওয়াতে হবে? আমি কক্ষনও কাউকে তুলে খাওয়াই নি।
- আমাকে খাওয়াতে হবে। নয়তো খাবো না।
বাধ্য হয়ে ত্রয়ী বলল- আচ্ছা। আমি নিয়ে আসছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।
স্নিগ্ধ ফ্রেশ হয়ে আসলো। খাবার তুলে খাওয়ানোর সময় স্নিগ্ধা দেখে হাসছিলো। ভাইয়ার সাথে মানিয়েছে বেশ। বিয়ে করলে মন্দ হবেনা। মনেমনে প্রার্থনাও করলো যেন এই মেয়েটাকেই ভাবি হিসেবে পায়।
নাস্তা শেষ করে স্নিগ্ধরা বেড়িয়ে পড়লো বাসার উদ্দেশ্যে।
প্রেমটা ধীরেধীরে শুরু হলো এখানেই। এভাবেই চলছিলো দিনগুলো। টুকটাক দেখা করা, কফি খেতে খেতে দুটো কথা বলা, একটু হাত ধরে হাঁটা, অনেক রাত অব্দি ফোনে কথা বলা। ত্রয়ীর কাছে দিনগুলো স্বপ্নের মত লাগছিলো। সারাজীবন একা চলাফেরা করে আসা মেয়েটা আজকে কারো সাথে চলতে পারছে। কেউ একজন খেয়াল রাখছে, বারবার জিজ্ঞেস করছে খেয়েছে কিনা। যখন বাইরে যাওয়ার সময় স্নিগ্ধ একবার ফোন করে ফোনে, সাবধানে যেও। ত্রয়ীর সুখে কান্না পায়। কেউ কখনো এভাবে একটু যত্ন করেনি ওর। স্নিগ্ধকে পেয়ে জীবনটা অন্যরকম লাগতে শুরু করেছে। ইস! এত সুখ কি কপালে সইবে?
রাত্রিবেলা প্রতিদনকার মতই ত্রয়ী বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনে কথা বলছে। স্নিগ্ধ হঠাৎ বলল- কালকে তোমার ক্লাস আছে?
- না নেই।
- বাসা থেকে বের হবা?
- হতে পারি। যদি তুমি বলো।
- কালকে দেখা করো। প্রতিদিন তোমাকে না দেখলে ভালো লাগেনা। আর অনেক দিন তোমাকে অন্য রূপে দেখিনা।
ত্রয়ী কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল- অন্যরুপে বলতে? - শাড়িতে। শাড়ি পড়লে তোমাকে কি যে অপূর্ব লাগে। আমি যে শাড়িটা কিনে দিয়েছিলাম সেটায় তোমাকে দেখিনি কখনো। ওটা পড়ে আসবা।
- আহারে! ছেলেটার শখ হয়েছে বউকে দেখার। তাইনা?
- হুম। শাড়িতে তোমাকে সিরিয়াসলি বউ বউ লাগে। তুমি কালকে শাড়ি পড়ে আসবা। আর চুলগুলো শ্যাম্পু করেছিলে কবে?
- দুদিন আগে।
- সকালে শ্যাম্পু কোরো। তোমার চুলের গন্ধ আমার প্রিয় জিনিস। খুব ভালোলাগে।
- ইস রে। পাগল একটা।
সবকিছু সুন্দর ভাবেই চলছে। প্রতিদিনের মত আজকেও খুব সুন্দর করে কথা বলে দুজনে ঘুমিয়ে পড়ল। বিপত্তি হলো পরেরদিন।
মামীর কাছে আলমারির চাবি চাইতে গেলে মামি জানতে চাইলো, কি করবি?
- মামী শাড়িটা নিবো।
- শাড়ি কি করবি?
ত্রয়ী মিথ্যে বলতে পারেনা। তবুও আমতা আমতা করে বলল- মামি একটা বন্ধুর বার্থডে আছে। সবাই শাড়ি পড়ে আসবে।
- বন্ধু না বান্ধবী?
- বান্ধবী।
- নাম কি?
ত্রয়ী একটু না ভেবেই চট করে বলল- সামিয়া। - আচ্ছা। কখন ফিরবি?
- মামী সন্ধ্যার আগেই ফিরবো।
- ঠিকাছে যা। বার্থডে তে কি উপহার দিবি? টাকা পাইলি কই?
ত্রয়ী আটকে গেল। আবারও আমতা আমতা করে বলল- আমার কাছে টাকা নাই। তিন বান্ধবী মিলে একটা গিফট দিবো। ওরা আমার টাকাটাও দিয়েছে। - অ, ঠিক আছে যা। সন্ধ্যার আগেই ফিরবি।
মামী চাবিটা ত্রয়ীর হাতে দিলো। ত্রয়ী খুশিমনে আলমারি খুলে শাড়ি বের করল। মনে অনেক আনন্দ। স্নিগ্ধর গিফট দেয়া শাড়ি পরে আজ তার সাথে দেখা করতে যাবে। উফফ কি যে এক্সাইটেড লাগছে!
কিন্তু শাড়িটা খুলেই বুকটা ফেটে যেতে চাইলো কষ্টে। মাঝখানে একটু জায়গা ছিড়ে গেছে। এত সুন্দর শাড়িটা মামী ছিড়ে ফেলেছে! একদিনও ত্রয়ী পরতে পারলো না, তার আগেই ছিড়ে ফেলেছে! খুব কান্না আসতে চাইছিলো ওর।
অনেক কষ্টে কান্না দমিয়ে মামীকে গিয়ে বলল- মামী আমার শাড়িটা আপনি ছিড়ে এনেছেন কেন?
মামী চোখ রাঙালো। বলল- ওটা এক জায়গায় লেগে ছিড়ে গেছে।
- আমাকে তো বলেন নাই মামী। ছিড়ে গেছে শাড়িটা।
- তাতে কি হইছে? যদি তোর কাছে ছিড়তো?
- মামী আমি অনেক সাবধানে চলাফেরা করি। ছিড়বে না আমার কাছে।- কি বললি? আবার মুখে মুখে তর্ক করছিস?
- তর্ক না মামী। নিজের জিনিসের প্রতি মায়া থাকে সবারই। আপনার শাড়ি তো অনেক যত্নে রাখেন। আমার টাই ছিড়লেন।
কান্না আটকাতে পারলো না ত্রয়ী। মামী রেগে বললো, ন্যাকা কান্না কানবি না। আহামরি কিছু ছিড়ি নাই। একটা শাড়ি ই তো। আর এত বেশি দামেরও না। - যত দামের ই হোক, প্রিয় মানুষের দেয়া জিনিস মামী। আপনি বুঝবেন না।
- আমাদের বান্ধবী ও মেলা জিনিস দিতো। সব কি এখনো আছে নাকি? এটাই নিয়ম। কান্দাকাটি থামা। আমার শাড়ি পরে যা।
ত্রয়ীর আরো কান্না পেলো। সেদিনও স্নিগ্ধ চেয়েছিলো এই শাড়িতে দেখবে ওকে। পারেনি ও। আজকেও এরকম হলো। কপাল টাই এমন। ছেলেটার ইচ্ছে কখনো পূরণ করতে পারেনা ও।
মামী ত্রয়ীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো, দাড়াই আছিস কেন? আমার শাড়ি পরে যা। না হলে তোরটা সেলাই কর সুতা দিয়ে। - মামী ওটা এমন জায়গায় ছিড়ছে যে সেলাই করলে বাজে দেখাবে।
- তাহলে ওটার আশা বাদ দে। তুই আমার শাড়ি পড়ে যা।
- মামী!
ত্রয়ী আর কথা বলতে পারলো না। রুমে এসে কান্নায় ভেংগে পড়লো। নিজেকে সামলে নিতে অনেক সময় লাগলো ওর। ছোটবেলা থেকেই মামী এরকম করে। ত্রয়ীর পছন্দের জিনিস গুলো নিয়ে রেখে দেয়। কান্না থামাতে অনেক সময় লাগলো। স্নিগ্ধ কল দিয়ে জিজ্ঞেস করল- কতক্ষণ লাগবে?
ত্রয়ী ধরা গলায় বলল- সরি স্নিগ্ধ। আজকে আর দেখা করতে পারবো না।
- সেকি! কেন পারবা না?
- বাসায় সমস্যা হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিও তুমি প্লিজ।
- মাফ করার প্রশ্ন আসছে কেন?
- স্নিগ্ধ, আমাকে তুমি ভুলে যাও।
হঠাৎ ত্রয়ীর এমন কথায় ভয় পেয়ে গেল স্নিগ্ধ। বলল- এসব কি বলছো! কি হয়েছে তোমার? মামী কি বুঝে গেছে আমাদের রিলেশনের ব্যাপারে কিছু?
ত্রয়ী ভেজা ভেজা গলায় বলল- না। কিন্তু আমি পারবো না আর। আমাকে ভুলে যাও। আমার জীবনটা অনেক জালে পরিপূর্ণ। এই এলোমেলো জীবনে আমি কাউকে জড়াতে চাইনা।
- ত্রয়ী। তোমার জীবনটা এলোমেলো নয়। আমি জানি তোমার জীবন কেমন। কি হয়েছে আমাকে বলো। প্লিজ?
ত্রয়ী বলল- পারবো না স্নিগ্ধ। ফোন রাখি। আমাকে ভুলে যাও তুমি।
ফোন রেখে দিলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ত্রয়ীর এরকম বদলে যাওয়া? কি এমন হলো যে ভূলে যেতে হবে ওকে?
ফোন দিয়ে দেখলো ত্রয়ীএ নাম্বার বন্ধ। বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করেছে স্নিগ্ধর। ত্রয়ীকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতে পারবে না ও। ত্রয়ী ঠিক আছে তো?
পর্ব ১১
অনেকবার ফোন দিয়েও ত্রয়ীর নাম্বার বন্ধ পেলো স্নিগ্ধ। টেনশন বাড়ছে হু হু করে। কথাবার্তা ছাড়া হঠাৎ করে ভূলে যেতে বলা আর তারপর পরই ফোন বন্ধ। বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। কোন অশনি সংকেত আসছে সামনে?
স্নিগ্ধ কিছু না বুঝে সমানে পায়চারি করতে লাগলো। চিন্তার কূল কিনারা খুজে পাচ্ছে না। ত্রয়ীর বাসায় চলে যাওয়ার ও উপায় নাই কোনো। মনেমনে ভেবে রাখলো, যদি ত্রয়ী কিছুক্ষণের মধ্যে ফোন না দেয় তাহলে বিকেলে স্নিগ্ধাকে ওর বাসায় পাঠাবে।
অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরপর ই ত্রয়ীর নাম্বার থেকে কল আসলো। হন্তদন্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো স্নিগ্ধ। কাপা কাপা গলায় জানতে চাইলো, কি হয়েছে তোমার?
ত্রয়ীর একটা ছোট্ট নিশ্বাস শোনা গেলো। বলল- আমার কপাল ই খারাপ স্নিগ্ধ। বাদ দাও।
- আমাকে বলবা না কি হইছে?
- শুনে কি করবা তুমি?
- চেপে রেখে কি করবা তুমি? কথাবার্তা ছাড়া হঠাৎ কল রেখে দিয়েছো। বলে দিয়েছো যেন ভূলে যাই তোমাকে। তোমার কি জানা নাই আমি তোমাকে ভূলে যেতে পারবো না? যেটা অসম্ভব সেটা হুট করে কেন বলো তুমি?
ত্রয়ী বলল- স্নিগ্ধ। এত সিরিয়াস হচ্ছো কেন? আমি বলেছি বলেই কি সত্যি সত্যি আমায় ভূলে যাবা? - তুমি হঠাৎ কেন এভাবে বলবা? আর তারপর থেকেই ফোন বন্ধ। আমার টেনশন হয়না?
- আচ্ছা স্নিগ্ধ সরি। কিন্তু সত্যি বলতে কি জানো? আমি নিজেই তোমাকে ভূলে যেতে পারবো না। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতেও পারবো না রে।
স্নিগ্ধ বললো- হুম। এখন বলো তো ঘটনা কি? হঠাৎ কি হলো?
ত্রয়ী বলল- আজকে কি দেখা করবা না? দেখা হলে বলতাম সবকিছু।
- হুম কখন আসবো বলো?
- এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ো। কিন্তু স্নিগ্ধ…
কিন্তু বলে আমতা আমতা করতে লাগলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে?
ত্রয়ী বলল- কিন্তু আমি শাড়ি পড়ে আসতে পারবো না।
- ওহ হো ত্রয়ী, তুমি কি পড়ে আসবা সেটা ব্যাপার নয়। তুমি যে আসছো এটাই আমার কাছে সবকিছু।
- আচ্ছা আমি দ্রুত আসছি। তুমিও বেড়িয়ে পড়।
দ্রুত চলে আসলো দুজনেই। জায়গা পূর্ব নির্ধারিত ছিলো। ত্রয়ীর মলিন মুখ দেখে মনটা কেমন করে উঠলো স্নিগ্ধর। আর ত্রয়ীও স্নিগ্ধকে দেখে বুঝে গেলো কতটা টেনশন করেছে সে।
দেখা হওয়ার পর স্নিগ্ধ ছুটে এসে ত্রয়ীর সামনে দাড়ালো। চোখেমুখে চিন্তার রেখা দেখে ভালো লাগল ত্রয়ীর। স্নিগ্ধ বলল- এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়?
ত্রয়ী বললো- তোমাকে আমার চেয়ে বেশি করুণ দেখাচ্ছে স্নিগ্ধ। এতটা ভালোবাসো আমায়?
কিছু বুঝে ওঠার সময় দিলোনা স্নিগ্ধ। আচমকা জাপটে ধরলো ত্রয়ীকে। আশেপাশে কি আছে একবারের জন্যও মনে পড়লো না। হুশ হীন হয়ে গেছে যেন। এক মুহুর্ত পড়েই আবার ছেড়ে দিয়ে বলল- সরি ত্রয়ী। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।
- স্নিগ্ধ আমিও সরি তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য। তখন আমার এত কষ্ট হচ্ছিলো যে আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
- কি হয়েছে বলবা তো?
- মামী আমার শাড়িটা নিয়েছে আর দেয়নি স্নিগ্ধ। যেদিন শাড়িটা কিনে নিয়ে গেছিলাম সেদিনই নিয়েছিলো। আর ফেরত পাইনি। আজকে শাড়ি খুলে দেখি ছিড়ে ফেলেছে।
মুখটা ভার করে নিচু হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ হাসার চেষ্টা করে বলল- পাগলী। কাদছ কেন এভাবে? শাড়ি একটা নিয়েছে তাতে কি? আবার একটা কিনে দিবো। এর জন্য মন খারাপ করে বসে থাকতে হবে? সামান্য একটা কারণে ভূলে যেতে বলবা আমাকে?
ত্রয়ী বলল- কি করবো বলো? আমার জীবন টা যে কষ্টে পরিপূর্ণ। এ জীবনে তোমাকে জড়িয়ে কি দিতে পেরেছি? কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি।
- ধুর বোকা মেয়ে। এভাবে বলছো কেন? তুমিও না। এভাবে বলতে হয়না। তোমার চেয়ে বড় কিছু আছে নাকি আমার কাছে? তুমি ই তো আমার সব, সব সব। আমার আর কিচ্ছু চাইনা পাগলী মেয়েটা।
ত্রয়ী চোখ মুছে বলল- সরি স্নিগ্ধ। আমি বারবার তোমাকে শুধু কষ্ট ই দেই। আমাকে মাফ করে দিও তুমি। - আবার? ভূলে যাও ওই ব্যাপারটা। আমি তোমাকে আবার একইরকম একটা শাড়ি কিনে দিবো। আজকেই দিতে হবে কিনা বলো?
ত্রয়ী মাথা ঝাকিয়ে বলল- উহু লাগবে না। তুমি বলেছো না? এতেই হবে। কিন্তু আমার আর এ জীবন ভালো লাগেনা স্নিগ্ধ। যেখানে কোনো মায়া নেই, ভালোবাসা নেই।
স্নিগ্ধ এক মুহুর্ত ভেবে বললো- তাহলে যে জীবনে মায়া আছে, ভালোবাসা আছে সে জীবন চাও?
ত্রয়ী স্নিগ্ধর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। সেরকম একটা জীবন কে না চায়? স্নিগ্ধও চায় ত্রয়ীকে নিজের কাছে এনে রাখতে। কিন্তু ওর যে এখন কোনো চাকরি নেই। চাকরি বাকরি ছাড়া বিয়ের কথা বাসাতেও বলা যাবেনা আর ত্রয়ীর বাসাতেও প্রস্তাব পাঠানো যাবেনা।
ত্রয়ী বলল- সবার ভাগ্যে কি আর সবকিছু থাকে?
স্নিগ্ধ ওকে বাধা দিয়ে বলল- এভাবে বলোনা মেয়ে। আমি আছি না? সবই হবে শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা।
ত্রয়ী আর কিছু বললো না। স্নিগ্ধ যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলো ত্রয়ীর মনটা ভালো করে দেয়ার জন্য।
সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে এলো ত্রয়ী। কিন্তু বাসায় ঢুকেই মামীর এমন অগ্নিমুর্তি দেখবে সেটা কল্পনাও করেনি। মামী রাগী রাগী চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ত্রয়ীকে দেখেই বলল- কই গিয়েছিলি তুই?
ত্রয়ী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মামীর দিকে। মামীকে এত ভয়ংকর দেখাচ্ছে কেন? মামী কি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে?
মামী বলল- সত্যি করে বল কোথায় গিয়েছিলি?
চুপ করে রইলো ত্রয়ী। অনেক্ষণ কথা বলতে পারলো না। মামীর ভয়ংকর গলা শুনে কেপে উঠলো এবার – সামিয়ার বাড়ির নাম করে কোন জায়গায় গিয়েছিলি তুই?
সত্যি সত্যি ভয় হতে লাগলো ত্রয়ীর। এবার কি জবাব দেবে? মামী সত্যিটা জেনে গেছেন কিভাবে যেন…
ত্রয়ী বলল- মামী…
আমতা আমতা করতে দেখে আরো রেগে গেলেন মামী। বললো- কার সাথে গিয়ে ইটিশ পিটশ করতেছিলি বল?
- মামী এসব কেন বলছেন?
- তাছাড়া কি বলবো? সামিয়ার বাড়িতে না গিয়ে অন্য কোথাও গেলে কিছু বলতাম না। কিন্তু মিথ্যে বলছিস। সামিয়ার জন্মদিন এখন না, অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। আমি খোজ নিয়েছিলাম।
ভয়ে শুকিয়ে গেলো ত্রয়ী। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওর। কে জানতো মামী খোজ নেবে সামিয়ার ব্যাপারে। আর তখন হুট করে সামিয়ার নামটাই মাথায় চলে এসেছিল। এবার কি যে হবে…
ভয়ে কাপতে লাগল ত্রয়ী। আর মিথ্যে বলতে পারবে না ও। চুপ করে রইলো। কিছু বলছে না দেখে মামী আবারও হুংকার দিলো। ত্রয়ী তবুও চুপ।মামী জিজ্ঞেস করলো – এভাবে আরো কতদিন মিথ্যে বলে গিয়েছিলি বল আমাকে।
ত্রয়ী বলল- আর কখনো যাইনি মামী। বিশ্বাস করেন।
ঠাস করে ত্রয়ীর গালে একটা থাপ্পড় বসালো মামী। সাথে সাথে বলল- তুই সারারাত ফোনে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করিস আমি জানিনা নাকি? তোর মামা আমাকে বলে মেয়েটা খারাপ হয়ে গেছে।
চোখে পানি এসে গেল ত্রয়ীর৷ সে নাহয় একটু কথাই বলেছে ফোনে। খারাপ হয়ে যাওয়ার প্রশ্ন কেন আসছে? এত বড় মেয়ের গায়েও কেউ হাত তোলে? আর কান্না সামলাতে পারল না। চলে যেতেও পারলো না। পায়ের নিচে শিকড় গজানোর মত অবস্থা হলো ওর।
মামী যখন বলল- যা আমার মুখের সামনে থেকে। তোর ব্যবস্থা আমি নিচ্ছি।
ত্রয়ী ছুটে নিজের রুমে এসে কান্নায় ভেংগে পড়ল৷ নিজেকে সামলে রাখার সাধ্য ওর নেই আর। এত বড় হওয়ার পর মামীর হাতে মার খাবে এটা ভাবতেও পারেনি ও। এজন্যই স্নিগ্ধকে বলেছিলো ভূলে যেতে ওকে। স্নিগ্ধর জন্য আরো অনেকবার মিথ্যে বলতে হবে, মার খেতে হবে।
কিন্তু সেই সুযোগ আর ত্রয়ী পাবেনা। কারণ রাতেই মামা মামী বুদ্ধি করলেন ত্রয়ীকে এবার বিয়ে দিয়ে আপদ মুক্ত হবেন। তার উপর মেয়ে যদি এখন পালিয়ে যায় তাহলে মান সম্মান সব যাবে। আগে ভাগেই বিয়ে দিয়ে দিলে ভয়ও থাকবে না আর আপদ ও থাকবে না।
দুজনে বুদ্ধি করে দ্রুত কাজেও নেমে পড়লো। পরেরদিন ই পাত্রপক্ষ দেখতে এলো ত্রয়ীকে। ত্রয়ী যা কল্পনাও করতে পারেনি।
পর্ব ১২
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ত্রয়ী দেখল বাড়ির সবাই অনেক ব্যস্ত। মামী রান্নাবান্না আর রসুন পেয়াজ বাঁটছে। মামা বাজার করে এনেছে অনেক গুলো। মুরগি, মাছ, ফলমূল সহ অনেক কিছু। মিষ্টিও এনেছে। হঠাৎ এত আয়োজন কেন বুঝতে পারছে না ত্রয়ী। কোনো মেহমান আসলে তো ত্রয়ী জানতো। ত্রয়ীকে কিছুই জানানো হয়নি, আবার এখনো কেউ ওর সাথে কথা বলার সময় পাচ্ছেনা ঘটনাটা কি?
এমনিতে সবসময় ত্রয়ীকে রান্নাবান্না সহ সব কাজ করতে হয়। আজকে ত্রয়ীকে কেউ কাজের কথাও বলছে না। মানে!
ত্রয়ী কৌতুহলী চোখে রান্নাঘরে এসে বসলো। মামী কাজে প্রচুর ব্যস্ত। ত্রয়ী জিজ্ঞেস করলো, এত আয়োজন কেন মামী? কেউ কি আসবে?
- হ্যা আসবে। তোকে এখানে বসতে হবেনা, যা যা ঘরে যা।
ত্রয়ী বেশ চমকালো। যে মামী প্রতিদিন সব কাজের দায়িত্ব ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, সে মামী আজ এভাবে বলছে ব্যাপার কি? অনেকটা ভড়কে গিয়ে ত্রয়ী জিজ্ঞেস করলো, মামী আমাকে বলেন না কে আসবে? - আরে মেহমান আসবে। আসলেই দেখতে পারবি।
- কোন মেহমান?
- তোর মামার বন্ধুবান্ধব আর তার পরিবার।
ত্রয়ী আরো বেশি চমকালো। মামী এমনিতেই অনেক কিপটা। আজকে মামার বন্ধুবান্ধব আসবে বলে এত আয়োজন? কোনো রহস্য নিশ্চয় ই আছে। হয়ত মামার ব্যবসায়ীক কোনো কথাবার্তা আছে সেজন্য। ব্যবসায় লাভ হলে মামা মামী দুজনেই খুশি হবে সেজন্য হয়ত এত আয়োজন। কিন্তু মামী তো বললো পরিবার নিয়ে আসবে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না ত্রয়ীর। চুপচাপ বসে চিন্তা করতে লাগলো ও।
মামী ওকে তাড়া দিয়ে বললো, তুই ঘরে যা তো। আমাকে একা একা রান্না করতে দে।
- কেন মামি? আমি একটু সাহায্য করি?
- আহা লাগবে না। তুই আজকে শুয়ে থাক গিয়ে। তোকে কোনো কাজ করা লাগবে না।
- কিন্তু কেন? তুমি কি আমার উপর রেগে আছো মামি?
মামী মাথা নেড়ে বললো, না। রাগবো কেন? রাগ করিনি। তুই রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর। এখানে থাকলে কালো হয়ে..
কথাটা বলতে বলতে থেমে গেলো মামী। ত্রয়ীকে কথাটা বলা যাবেনা। যেহেতু মেয়েটা প্রেম করছে। যদি জানে পাত্রপক্ষ আসবে তাহলে প্রেমিকের সাথে পালিয়েও যেতে পারে। পালিয়ে গেলে মানসম্মান কিছুই থাকবে না। কাজেই ওকে বলা যাবেনা কিছু।
ত্রয়ীকে একরকম ঠেলেঠুলে মামী রুমে পাঠিয়ে দিলো। এক রাশ চিন্তা নিয়ে রুমে আসলো ত্রয়ী। মনেমনে নানান প্রশ্ন জাগছে। কিন্তু মামা মামী ওর বিয়ের চিন্তা করতে পারে এটা ওর মাথাতেই এলোনা কিছুতেই। রুমে এসে ফোন দিলো স্নিগ্ধর নাম্বারে।
মামা মামী ভাবছেন অন্য কথা। পাত্রর বাবা আগেই ত্রয়ীকে দেখে পছন্দ করেছেন। আজকে পাত্র নিজে দেখবে। দেখে পছন্দ হলে আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দেবেন ওনারা। বিয়ে পড়িয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ। কোনো আয়োজন করতে হবেনা, পয়সাও খরচ করতে হবেনা। ঝামেলা ছাড়াই আরামে বিয়েটা শেষ করা যাবে। মেয়েটার বোঝা নেমে যাবে কাঁধ থেকে। এমনিতেই মামী কয়েক বছর থেকে এই বোঝা সামলাচ্ছেন। যার কেউ নেই, অন্য মানুষের কাছে সে বোঝার সমতুল্য ই। তার উপর সে যদি একটা মেয়ে হয়।
ত্রয়ী স্নিগ্ধকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, উঠেছো কখন?
- একটু আগে। আমার আজকে একটু দূরে যেতে হবে। আব্বু হঠাৎ একটা কাজে পাঠাচ্ছে আমাকে।
- কিসের কাজ?
- একটু ব্যবসার কাজ। দিনের বেলা তোমাকে ফোন দিতে না পারলে টেনশন কোরো না। আমি সময় পেলেই তোমাকে কল করবো। আচ্ছা জানপাখি?
ত্রয়ী আস্তে করে বলল- আচ্ছা। তুমি সারাদিন সাবধানে থেকো কেমন?
স্নিগ্ধ আচ্ছা বলে দু একটা কথা শেষ করে ফোন রেখে দিলো। ত্রয়ী রুমে পায়চারি করতে করতে চিন্তা করছিল বাসায় কারা আসবে?
মামী এমন সময় রুমে এসে ওকে বললো, তুই মুখে কিছু লাগা।
ত্রয়ী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি লাগাবো?
- ওইযে মাঝেমাঝে কিসব লাগাস।
ত্রয়ী কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। মুখে ফেসপ্যাক লাগানো টা স্বাভাবিক কিন্তু আজকে কেন লাগাতে হবে? মামী কি বোঝাতে চাইছে?
মামীও ব্যাপার টা বুঝতে পেরে বললো, ওইগুলা মুখে লাগানোর পর তোকে অনেক উজ্জ্বল দেখায়। আজকেও দে। মেহমান রা আসবে, তারা দেখবে না? - মেহমান আমাকে সুন্দর দেখলে আমার লাভ কি?
- আরে বুঝিস না? বড় হইছিস। যদি তোকে দেখে তাদের ভালো লাগে এরপর ভালো ভালো সম্বন্ধ নিয়ে আসবে। এইজন্যই বললাম।
ত্রয়ী ভ্রু কুচকে বললো- ওহ আচ্ছা। আমাকে সুন্দর দেখানোর দরকার নাই মামী। আমার বিয়া হওয়ারও দরকার নাই। তোমার যদি বিয়া করার ইচ্ছা থাকে তাহলে তুমি নিজেই এইগুলা মাখো বসে।
মামীও সাথে সাথে রেগে জবাব দিলো, তাহলে মাঝেমাঝে মাখিস কি জন্য? ও বুচ্ছি। কতগুলা ছেলের সাথে পিরিতি আছে না? রাত জেগে তাদের সাথে কিগো টাইপের কথাবার্তা কও। আমরা কি জানিনা নাকি?
ত্রয়ী রেগে গেলো হঠাৎ। এরকম অপবাদ ওর একেবারেই অসহ্য লাগে। কিন্তু মামা মামী একবার যখন জানতে পেরেছেন ওর সম্পর্কের কথা, তারমানে এখন থেকে স্নিগ্ধর জন্য অনেক কথাই শুনতে হবে ওকে। মাইর ও খেতে হবে আরো অনেক বার। তাই চুপ করে রইলো ত্রয়ী।
মামী রাগ দেখাতে দেখাতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
ত্রয়ীর মনটা খারাপ হয়ে গেল আবারও। এভাবে কি থাকা যায়? সম্পর্কের ব্যাপারটা জানার পর থেকে মামীর আচরণ আরো বেশি খারাপ হয়ে গেছে। জীবনটা এরকম ই। সুখের মুহুর্ত গুলোর চেয়ে দুঃখের মুহুর্ত ই এখানে বেশি। তবুও মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় একটু সুখের ছোয়া পেতে। স্নিগ্ধ যদি সেই সুখের সন্ধান দিতো! একমাত্র স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে থেকেই বাকি জীবনটা পার করে দিতে চায় ও।ধীরেধীরে দুপুর পেরিয়ে গেলো। ত্রয়ী গোসল করে মাত্র বেড়িয়েছে এমন সময় মামী এসে বলে গেলো সাজগোজ করে বসে থাকার জন্য। সাজগোজ করা নিয়েও মামীর এত আগ্রহ কেন আজ? ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না ত্রয়ী। বিতৃঞ্চা নিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।
কিছুক্ষণ পর মামী আবারও আসলো রুমে। এবার এসে সরাসরি বললো, শোন ত্রয়ী। শাড়ি পড়ে সাজগোজ করে বসে থাক। আজকে যারা আসবে,তারা তোকে দেখতে ই আসবে।
এতক্ষণে সত্যি কথা বেড়িয়ে এসেছে। কিন্তু কথাটা শুনে বুকে হাতুরি পিটতে আরম্ভ করলো ত্রয়ীর। দেখতে আসবে মানে! মামা মামী ওকে না জানিয়েই পাত্রপক্ষের সাথে কথা বলে ফেলেছে। এখন কি হবে? যদি তাদের পছন্দ হয়ে যায়?
মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা ওর। মামী কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে বেড়িয়ে গেছে রুম থেকে। ত্রয়ী চুপচাপ বসে আছে। জীবনটা শেষ হয়ে যাবে এবার। যদি তারা পছন্দ করে তাহলে তো মামা মামী ওর সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা করবে। স্নিগ্ধকে আজই জানাতে হবে কথাটা।
ত্রয়ী পুরো ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো। মামী এসে বলে গেলো দ্রুত রেডি হতে, তারা নাকি এসে গেছেন। অনেক টেনশন নিয়ে শাড়ি পড়ে হালকা সাজগোজ করলো ত্রয়ী৷ টেনশন বাড়ছে হু হু করে। স্নিগ্ধকে কল দিয়েছিলো কয়েকবার কিন্তু সেও কল রিসিভ করছে না। জানেনা এরপর কি হবে।
ত্রয়ী মনমরা হয়ে বসে আছে রুমে। পাত্রপক্ষ এসে গেছে। ওদের সামনে চা নাস্তা নিয়ে দিয়ে আসতে হলো। পাত্রকে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য ত্রয়ীর রুমে পাঠানো হলো। ত্রয়ী কিছু বলতে পারলো না। শুধু চুপচাপ পাত্রের করে যাওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে গেলো। ত্রয়ী অপছন্দ হওয়ার মত মেয়ে নয়। পাত্রের অনেক পছন্দ হয়েছে ওকে। বিয়েটা আজকে পড়িয়ে দিলে সবেথেকে পাত্র নিজে বেশি খুশি হবে।
ত্রয়ী যখন নিজের রুমে বসে টেনশনে মরে যাচ্ছিলো, মামী তখন এসে ওকে বলে গেলো পাত্রপক্ষ ওকে পছন্দ করেছে। ওরা আজকেই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবে। বিয়ের শাড়ি কিনতে গেছে ওরা।
এবার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলো ত্রয়ী। সবকিছু এত দ্রুত শেষ হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি ও। স্নিগ্ধকে অনেকবার কল দিলো কিন্তু রিসিভ হলোনা। মেসেজও পাঠালো অনেকগুলা। কিন্তু কোনোই উত্তর নেই। বাড়িতে সবাই হাসাহাসি আর আনন্দ উল্লাস করছে। ত্রয়ীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে যেন। জীবনটা তো শেষ হয়েই গেলো। সত্যি সত্যি শেষ হয়ে গেলো। স্নিগ্ধও এই মুহুর্তে পাশে নেই। বাড়ি থেকে বের হওয়ারও কোনো উপায় নেই। ত্রয়ীর মরে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। ও জানে সুইসাইড কোনো ভালো সমাধান না। কিন্তু জীবনে কখনও সুখ পায়নি যে মেয়ে, সে একজনকে ভালোবেসেও সুখ পাবেনা? এত কষ্ট নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?
পর্ব ১৩
সুইসাইড করার পথ টাকেই বেছে নিলো ত্রয়ী। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পড়তে হবে। মরণেই সবচেয়ে সহজ সমাধান হবে এটার। যে জীবনে এত বাধা পেরিয়েও কখনো সুখের দেখা মিললো না, সে জীবন রেখেই বা কি লাভ?
ফ্যানের সাথে ওড়না পেচাতে যাচ্ছিলো এমন সময় দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। ত্রয়ী চমকে দরজার দিকে তাকালো। কেউ দরজায় নক করছে। ওর গলা শুকিয়ে কাঠ। দরজায় জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে। ত্রয়ী তারাহুরো করে ফ্যানে পেচানো ওড়নাটা খুলে ফেলল। তারপর দরজা খুলতে গেলো। এদিকে পা কাপছে দুরুদুরু করে।
ত্রয়ী নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে এসে দরজা খুললো। দুজন মহিলা আর একটা মেয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, তোমাকে সাজাই দেই।
বিতৃঞ্চায় চোখ বন্ধ করে ফেলল ত্রয়ী। মরার রাস্তাটাও বন্ধ হয়ে গেল। এখন সাজগোজ করতে করতেই বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হবে। আর কিচ্ছু হবেনা জীবনে। সবকিছু শেষ হয়ে গেল!
চোখে পানি এলেও সামলে নিলো ও। মহিলারা ঘরে ঢুকে ওকে সাজানোর জন্য জোর দিতে লাগলো৷ ত্রয়ী বাথরুমে গেলো হাতমুখ ধুয়ে আসার জন্য। কিন্তু হাতমুখ ধুতে গিয়ে অনেক্ষণ বাথরুমের দেয়ালে ঠেস দিয়ে কান্না করে চললো। স্নিগ্ধ জানতেও পারবে না ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই কষ্ট করতে করতে শেষ হয়ে যাবে মেয়েটা। তবে যদি সত্যিই বিয়েটা হয়ে যায়, তাহলে ওই বাড়িতে গিয়েই বর ঘরে ঢোকার আগে কাজ সেরে ফেলবে ও। চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে। এত কষ্ট আর ভালো লাগছে না ওর। বাকি জীবনটা তুষের অনলে পোড়ার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো।
ত্রয়ীর গাল বেয়ে পানি পড়ছে ঝরঝর করে। মুখে পানির ছিটা দিয়ে রুমে আসলো। মলিন মুখে বসলো মেহমান দের সামনে। তারা শাড়ি পড়িয়ে, গয়নাগাটি দিয়ে সাজাতে আরম্ভ করল ওকে।
গায়ে একটা করে গয়না পড়ানো মাত্রই বুকটা ফেটে কান্না আসতে চায় ত্রয়ীর। কিন্তু চাইলেও কাঁদতে পারেনা। বিয়ের বেনারসি পড়ানোর সময়ও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিলো। নিজেও সহ্য করা যায়না, কাউকে বোঝানো ও যায়না।
ত্রয়ী চুপচাপ মূর্তির মতো বসে আছে। বিয়েটা কি ফাইনালি হয়েই যাবে? এদের সামনে স্নিগ্ধকে কল দেয়ারও সুযোগ নেই।
চিন্তিত মুখে ফোনের দিকে তাকালো ত্রয়ী। ইচ্ছে করছে আরেকবার স্নিগ্ধকে কল দেই কিন্তু পারছে না। ওরা কি ভাব্বে আর ওদের সামনে কথাও বলা যাবেনা। বারান্দায় গিয়ে কথা বললে মামী দেখে ফেলবে।
সাজগোজ সব শেষ হলে ত্রয়ীকে নিয়ে আসা হলো ড্রয়িং রুমে। এখন বিয়ে পড়ানো হবে। পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছে ত্রয়ী। দেখে মনেহয় মরে গেছে। নিশ্বাস টাও পড়ছে কিনা সন্দেহ। নিষ্পলক ভাবে চেয়ে আছে মেঝের দিকে।
পাত্র ও পাত্রীকে একসাথে বসানো হলো। পাত্রের মুখে সে কি হাসি! ত্রয়ীর চোখের পাতাও নড়ছে না। কিছু চিন্তাও করতে পারছে না ও। একেবারে স্থবির হয়ে গেছে। মোবাইলটা পাশের রুমে ভাইব্রেট করে রাখা। এই অবস্থায় স্নিগ্ধ কল দিলেও বোঝা যাবেনা। বিয়েটা হয়েই যাবে এবার! নিজেকে শেষ করে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে ত্রয়ী।
পাত্রের মুখ হাসিহাসি। সুন্দরী বউ পাচ্ছে সে তো খুশি হবেই। দেখতে এসে বিয়ে করে নিয়ে যাওয়ার আনন্দটা ভরিয়ে দিচ্ছে ওকে। ত্রয়ীর দিকে আড়চোখে তাকাতে লাগলো বারবার। সবাই অপেক্ষা করছে কাজী আসার জন্য।
এমন সময় হঠাৎ রুমে স্নিগ্ধা প্রবেশ করলো। রুমে ঢুকে ত্রয়ীকে বউ সাজানো অবস্থায় দেখেই আৎকে উঠলো ও। সবাই তাকালো স্নিগ্ধার দিকে।
স্নিগ্ধা কাজ শেষ করে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলো। হঠাৎ মনে হলো একবার আপুর সাথে দেখা করে যাই। কিন্তু বাসায় ঢুকেই এরকম কিছু দেখবে সেটা কল্পনাও করেনি। ত্রয়ী ছলছল চোখে তাকালো স্নিগ্ধার দিকে। হঠাৎ স্নিগ্ধাকে দেখে বুকে একটু আশার আলো জেগে উঠেছে ত্রয়ীর। ও হঠাৎ বলল, স্নিগ্ধা..
তারপর হুট করে উঠে এলো স্নিগ্ধার কাছে। হাত ধরে বলল, তোমার সাথে কথা আছে।
সবাই থ হয়ে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাশের রুমে গিয়ে ঢুকলো ত্রয়ী। নিজের অজান্তেই দরজাও লাগিয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধাকে দেখে ওর মনে একটু আশা সঞ্চার হয়েছে বলে অজান্তেই করে ফেলছে কাজগুলো।
এদিকে পাত্রপক্ষ হা করে একজন আরেকজনকে দেখছে। কারো মুখে কথা আসছে না। সবাই কৌতুহল নিয়ে দেখছে আরেকজনের দিকে। পাত্র নিজেও স্তব্ধ।
ত্রয়ী স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমি বিয়ে করতে চাইনি। সবকিছু এমন ভাবে ঘটে গেছে যে আমাকে বাধ্য হতে হয়েছে। আমি মামা মামীকে না ও বলতে পারিনি। বললেই আমাকে মারধোর করতো। ওরা আমাকে বোঝা মনে করে। তাড়িয়ে দিতে চায়। আমি এখন কি করবো বলো? এই বিয়ে আমি করতে পারবো না। বিয়েটা হলে ও বাড়িতে গিয়েই আমি সুইসাইড করবো।’
স্নিগ্ধা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, এসব বলতে হয়না আপু। তুমি একদম ই টেনশন কোরোনা। আমি বিয়েটা ভাংছি।
- স্নিগ্ধা। বিয়ে ভাংগার পর প্রলয় হয়ে যাবে।
- হোক। সেটার জন্য তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
- স্নিগ্ধ ও ফোন ধরছে না। আর বিয়ে ভাংগার পর আমি কই যাবো? আমার তো যাওয়ার ও জায়গা নাই৷
- আগে বিয়েটা ভেংগে দেই। তারপর কি হয় দেখা যাবে।
- পরিনতি না ভেবে কাজ কোরোনা প্লিজ।
- তাহলে কি বিয়ে করে নেবে?
থমকে গেলো ত্রয়ী। বিয়েটা ও কিছুতেই করতে পারবে না। এদিকে স্নিগ্ধও ফোন ধরছে না। কি যে করবে ও।
স্নিগ্ধা বলল, আমি তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো।
- কিন্তু স্নিগ্ধ তো এই মুহুর্তে বিয়ে করার জন্য রেডি না। ও পারবে না আমাকে বিয়ে করতে।
- সেটা আমি বুঝবো। তুমি চুপ থাকো।
আশার আলো দেখতে পেয়ে শান্ত হলো ত্রয়ী৷ কিন্তু টেনশন বাড়ছে হু হু করে। নিজেকে সামলে নিতেই পারছে না। স্নিগ্ধ ও কল ধরছে না।
স্নিগ্ধা সবার আগে পাত্রপক্ষের রুমে এসে ঢুকলো৷ সোজাসাপটা বললো, ত্রয়ী আমার ভাবি। আমার ভাইয়ের সাথে অনেক আগেই ওর মনেমনে বিয়ে হয়ে গেছে। ওকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে দুদিন পর আবার পালিয়ে আমার ভাইয়ের কাছে চলে আসবে। সেটা কি মানতে পারবেন আপনারা? পারলে এই বিয়ে করুন নয়তো কি করবেন আপনারাই ভাবুন।
সবাই চেচামেচি শুরু করে দিলো। মামা মামীর মান সম্মান ধূলায় মিশে যাওয়ার উপক্রম। ওরা এটা সেটা বলাবলি করতে লাগলো। এদিকে মামা মামী চিল্লাচিল্লি আরম্ভ করেছে। স্নিগ্ধা কে, কোথ থেকে এসে এসব শুরু করেছে এ ধরণের নানান কথা। স্নিগ্ধা কারো কথার তোয়াক্কা করলো না। কড়া কড়া কথা শুনিয়ে বিদায় করেদিলো পাত্রপক্ষ কে।
ত্রয়ীর মামা মামি যাচ্ছেতাই বলে গালি দিচ্ছে ত্রয়ীকে। স্নিগ্ধা বললো, আমি আমার ভাবিকে আমার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। আপনাদেরকে আর ওর বোঝা বইতে হবেনা।
মামী জোরে জোরে গালি দিচ্ছিলো ত্রয়ীকে- শয়তান মেয়ে তোকে এত কষ্ট করে মানুষ করলাম পড়াশোনা করালাম তার এই প্রতিদান দিলি।
ত্রয়ীর ও কষ্ট হচ্ছিলো মামা মামীর জন্য। কিন্তু এই ছেলেকে বিয়ে করলে সে নিজেই মেনে নিতে পারতো না। চলে যেতো পরপারে। তারচেয়ে স্নিগ্ধ’র বুকে থাকতে পারলে আজীবন নিশ্চিত সুখে থাকবে ও।
স্নিগ্ধা ত্রয়ীর হাত ধরে বেড়িয়ে এলো বাড়ি থেকে। রিক্সায় উঠে সোজা চলে এলো নিজের বাসায়। কিন্তু এখানে এসে আরেক বিপত্তি বাধবে সেটা কেউ আগে ভাবেনি। যদিও ত্রয়ী মনেমনে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলো।
বাসায় এসে বেল বাজাতেই মা এসে দরজা খুলে দিলেন। ত্রয়ীকে বউয়ের সাজে দেখে উনি রীতিমতো অবাক! স্নিগ্ধা বললো,
- মা, ও হচ্ছে ভাইয়ার বউ।
বড় ধরণের ধাক্কা খেয়ে গেলেন মা। অবাক হয়ে বললেন, মানে! - মানে ও স্নিগ্ধ ভাইয়ার বউ। বাসায় তোলো।
- স্নিগ্ধ কোথায়? আর কি বলিস এসব?
স্নিগ্ধা অনেক বুদ্ধিমতী। ও জানে মাকে যদি বলা হয় ত্রয়ী স্নিগ্ধর প্রেমিকা, তাহলে মা ওদেরকে মেনে নেয়ার সুযোগ কম থাকবে। আগে বাসায় তোলা যাক, তারপর ধীরেসুস্থে সত্যিটা বলা যাবে।
বললো,
- মা, ওরা আগেই বিয়ে করে ফেলেছে। আজকে আপুকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিচ্ছিলো তাই নিয়ে এলাম।
মা একেবারে স্তব্ধ। এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না উনি। দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। স্নিগ্ধা ত্রয়ীকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। মায়ের বুকটা ফেটে যাচ্ছে ছেলের একা একা বিয়ের কথা শুনে। এদিকে ছেলে কিছুই জানেনা এসবের। কেউ জানেনা এরপর কি হবে…
পর্ব ১৪
দম বন্ধ হয়ে আসছে মায়ের। স্নিগ্ধ কত ভালো আর লক্ষী একটা ছেলে। সে এরকম না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললো এটা মেনে নেয়াই যায়না। অবিশ্বাস্য লাগছে পুরোপুরি। মেয়েটা দেখতে ভালোই, কিন্তু বিয়ে….
মা গালে হাত দিয়ে সোফার উপর বসে চিন্তা করছেন। স্নিগ্ধা ত্রয়ীকে নিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে বললো। ত্রয়ী বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নিলো অনেক্ষণ ধরে। স্নিগ্ধা মায়ের কাছে এসেছে মাকে সামলানোর জন্য।
মা বললেন, আমার ছেলেকে আমি ভালোমতো চিনি রে মা। ও যে এরকম একটা কাজ করবে আমি কল্পনাও করি নি।
- মা, আপু অনেক ভালো একটা মেয়ে। ওরা খুব সুখী হবে তুমি দেখো। আর আমরাও আশাকরি সবাই মিলে অনেক হ্যাপি থাকতে পারবো।
- তুই আগে থেকে জানতিস সব?
- হুম।
- হায়রে। আমার মেয়েও আমাকে কিছু বলেনাই। আমার কপাল সবই।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো স্নিগ্ধার। ইচ্ছে করলো সত্যিটা বলে দেই। মাকে খুব ভালোবাসে ও। আর প্রতিটা মা ই সন্তানকে অনেক স্নেহ যত্নে বড় করে তোলে। কাজেই মায়ের কষ্টটা স্বাভাবিক। কি যে করবে এখন। ভাইয়াকে একটাবার ফোন দেয়া দরকার।
স্নিগ্ধা রুমে এসে ভাইয়ার নাম্বারে কল দিলো। এখনো ব্যস্ত সে। ফোন রিসিভ করছে না। এদিকে মায়ের দিকে তাকিয়ে মনেহচ্ছে যেকোনো মুহুর্তে হার্ট এটাক করে ফেলবে। সত্যিটা বলার জন্য মায়ের পাশে এসে বসলো স্নিগ্ধা। কিন্তু তার আগেই মা বাবাকে কল দিয়ে স্নিগ্ধর বিয়ের কথা জানিয়ে দিয়েছে। বাবাও দ্রুত চলে আসলেন বাসায়। স্নিগ্ধা একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার মায়ের দিকে। কি যে করবে বুঝে আসছে না ওর।
বাবা রেগেমেগে আগুন হয়ে বললেন, কোথায় সেই মেয়ে দেখি? আসতে বলো ওকে।
স্নিগ্ধা বাবাকে অনেক ভয় পায়। এখন রাগত চেহারা দেখে আরো ভয় লাগছে। কথা বলার সাহস পাচ্ছে না ও। গুটি গুটি পায়ে রুমে এসে ত্রয়ীকে ডেকে নিয়ে গেলো ড্রয়িংরুমে।
ত্রয়ীর মুখটা দেখে বাবা ভ্রু কুঁচকালেন। মেয়েটা বেশ সুন্দর। স্নিগ্ধর পছন্দ আছে বলতে হবে। মেয়েকে পছন্দ হয়েছে বলে বাবা আর রাগ দেখালেন না। কিন্তু এভাবে একা একা বিয়ে করাটাকে উনি প্রাধান্য দিবেন না কখনো। উনি সরাসরি স্নিগ্ধ যেখানে কাজে গেছে সেখানকার একজনকে ফোন দিয়ে বললেন, দ্রুত বাসায় চলে আসতে। স্নিগ্ধ জানালো খুব দ্রুত বাসায় আসবে সে।
স্নিগ্ধ বাসায় এসে বাবা মায়ের সাথে ত্রয়ীকে দেখে ভড়কে গেল৷ সাথে সাথেই মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ওর মুখে৷ ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে বললো- বাসায় চলে এসেছো? চিনলে কিভাবে বাসা?
বাবা রেগে গেলেন ছেলের আচরণ দেখে৷ বাবা মাকে না বলেই বিয়ে করেছে আবার বাবার সামনেই স্ত্রীকে বলছে বাসা চিনলে কিভাবে? উনি রেগে আগুন হয়ে স্নিগ্ধকে বললেন, শ্বশুরবাড়ি সব মেয়েই চেনে।
বাবার মুখে কথাটা শুনে শব্দ করে হাসলো স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধা ইশারায় ওকে হাসতে বারণ করছিলো কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। বাবা বললেন, এত বেয়াদব কবে হয়েছিস তুই?
স্নিগ্ধ এবার সিরিয়াস হলো। মাথা সোজা করে বললো, বাবা..
- মেয়ে পছন্দ হয়েছে আমাদেরকে বললে সমস্যা কোথায় ছিলো? অনেকবার বলেছি কখনো একা একা বিয়ে করবি না।
স্নিগ্ধ ভ্রু কুচকালো। একা একা বিয়ে মানে! সে কবে বিয়ে করেছে আবার। এ চোখ বড়বড় করে একবার ত্রয়ীর দিকে তো আরেকবার স্নিগ্ধার দিকে তাকাতে লাগলো৷ ত্রয়ী মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে। স্নিগ্ধা ইশারায় বুঝাতে চাইলো, আমি বলেছি।
স্নিগ্ধ বাবার পাশে বসে বললো, আব্বু স্নিগ্ধা ফাজলামো করেছে তাইনা? ধুর তুমিও না।
- ইয়ার্কি রাখ। আমি জানতে চাচ্ছি বিয়ে কেন করেছিস আমাদেরকে না জানিয়ে?
স্নিগ্ধ মাথাটা ঝাকুনি দিয়ে বলল- আমি বিয়ে করবো কোন দুঃখে? আমি তো জানি তোমাদেরকে বললেই তোমরা বিয়ের ব্যবস্থা করবে। - এই মেয়ে কে তাহলে?
- আব্বু সি ইজ মাই গার্ল ফ্রেন্ড। আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক।
বাবা মা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তারপর বাবা বললেন, ফাজলামো করার জায়গা পাওনা? বিয়ে করা বউ এখন গার্ল ফ্রেন্ড হয়ে গেল?
- আব্বু তোমরা আমাকে বিশ্বাস করোনা?
স্নিগ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে বললো- আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলছি। প্লিজ আগেই রেগে যেওনা তোমরা। আসলে ত্রয়ী আপু ভাইয়ার প্রেমিকা, বউ নয়৷ ওদের বিয়ে হয়নি।
বাবা মা একসাথে চেচিয়ে উঠে তাকালেন স্নিগ্ধার দিকে। হঠাৎ এরকম মিথ্যে বলার মানে কি তাহলে?
স্নিগ্ধা বললো- আজকে ত্রয়ী আপুকে দেখতে এসেছিলো। ও সারাদিন ভাইয়ার নাম্বারে কল দিয়েছে কিন্তু ভাইয়া রিসিভ করেনি। মেয়েটা সুইসাইড করতে যাচ্ছিলো। তখনই পাত্রপক্ষ বিয়ের সাজগোজ নিয়ে হাজির। ওরা আজকেই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবে। বিয়ে হয়েই যাচ্ছিলো প্রায়। সেই মুহুর্তে আমি গিয়ে হাজির। আমি ওই রাস্তা দিয়েই আসছিলাম, ভাবলাম একবার আপুর সাথে দেখা করে যাই। ভাবিওনি এরকম দেখতে পাবো। আমি ই আপুর বিয়ে ভেংগে দিয়ে ওকে নিয়ে এসেছি।
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে তাকালো ত্রয়ীর দিকে। ওর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছিলো। আজকেই হারিয়ে ফেলত ওর ভালোবাসাকে। ভাগ্যিস সময়মত স্নিগ্ধা গিয়ে হাজির হয়েছিলো।
স্নিগ্ধা বললো- বাসায় এসে যদি বলতাম ও আমার বান্ধবী তাহলে আম্মু বলত বিয়ের কনেকে বাসায় পাঠিয়ে দে। কারণ কোনো বাবা মা ই চায়না কারো মেয়ে পালিয়ে আসুক। ত্রয়ী আপুর পড়ণে বিয়ের শাড়ি ছিলো। তাই বাধ্য হয়েই আমি বলেছিলাম এটা ভাইয়ার বউ। বান্ধবী বললে আম্মু উঠতে দিতো না। আর ভাইয়ার গার্ল ফ্রেন্ড বললে জিজ্ঞেস করত বিয়ের শাড়ি কেন? তাই বলেছি ভাইয়ার স্ত্রী। যাতে ওকে বাসায় তোলা যায়। আমি আপুকে অনেক পছন্দ করি আম্মু, আর ভাইয়াও খুব ভালোবাসে। আমরা আর ওকে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে দিবো না।
বাবা মা দুজনে দুজনের দিকে তাকালেন। তারপর হাফ ছেড়ে বাচার মত মা বললেন – জানতাম একটা ব্যাপার আছে। আমার ছেলে একা একা বিয়ে করতেই পারেনা। ঠিকাছে আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করবো, তোমরা কোনো টেনশন কোরোনা।
ত্রয়ী চমকে উঠলো এবারে। সত্যিই কি তাহলে এই বাড়িটা আজ থেকে ওর বাড়ি হবে? বাবা মা এত সহজেই মেনে নেবেন!
মা মেনে নিয়েছেন ঠিকই কিন্তু বাবার ব্যাপারে বাঁধলো বিপত্তি। বাবা বললেন, ঠিকাছে তোমাকে আমার ও পছন্দ হয়েছে। তোমার বাবা মাকে আমাদের বাসায় আসতে বলো, আমরা কথা বলবো। নয়তো ঠিকানা দাও আমরাই যাই।
ত্রয়ী তাকালো স্নিগ্ধর দিকে। স্নিগ্ধ বললো- আব্বু ওর কেউ নেই জগতে। ও মামা মামীর কাছে থাকতো।এবারেই যত বিপত্তি বাবার। যার বাবা মা নেই, বাড়িঘর নেই, মামা মামীর কাছে মানুষ সেরকম একটা চালচুলোহীন মেয়েকে কিছুতেই উনি বাড়ির বউ হিসেবে গ্রহণ করবেন না। এটা অসম্ভব।
বললেন – এটা তাহলে কিছুতেই মানতে পারিনা আমি। বাবা মা নেই এরকম একটা মেয়ে…
ত্রয়ীর বুকে একটা ধাক্কা এসে লাগলো। স্নিগ্ধা তাকালো বাবার দিকে। স্নিগ্ধ বললো- আব্বু ও একটা মেয়ে। এখন যদি ও আমার স্ত্রী হয় তাহলে এই বাড়িটাই ওর বাড়ি হবে। তখন ওর একমাত্র পরিচয় হবো আমরা।
- তাই বলে বাবা মা ছাড়া কাউকে…
স্নিগ্ধ থমকে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। ত্রয়ী উঠে রুমের দিকে দৌড়ে চলে গেল। কষ্ট হতে লাগলো স্নিগ্ধর। ও জানে ত্রয়ী এখন কাঁদছে। স্নিগ্ধ বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। বললো- মেয়েটা অনেক ভালো।
- ভালো অনেক মেয়েই থাকে। আমরাও তোমাকে ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দেবো।
- আব্বু আমরা তো ওর ঘরে গিয়ে পড়ে থাকবো না। ওর বাড়িঘর আছে কিনা সেটা দিয়ে আমাদের কি তাইনা? ও আমার স্ত্রী হবে এটাই সবচেয়ে বড় কথা।
- নিজের স্ত্রীকে তাহলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখো। এটা আমার বাড়ি, আমার বাড়িতে কেন? তুমি কোনো চাকরি ও করোনা। বউকে খাওয়াবে কি?
স্নিগ্ধ মাথা নিচু করে ফেললো। বললো- তাই বলে তুমি এখন ওকে তাড়িয়ে দিতে পারোনা। ও কোথায় যাবে? - যেখানে খুশি যাক। ও কোথায় থাকবে সেই চিন্তা আমার না। আমি ওর সাথে তোমার বিয়ে দিচ্ছিনা এটাই আসল কথা। তুমি পারলে ওর থাকার জায়গা করে দাও। কিন্তু এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলো ওকে
- তুমি আমাদের ভালোবাসা মেনে নেবে না?
- না।
- আব্বু আমিও তাহলে চলে যাবো ওর সাথে।
বাবা রেগে বললেন, – যাও। যেতেই তো বললাম। তুমি এখনো বেকার, কি খাওয়াবে বউকে তাই দেখবো। - আব্বু আমি বেকার বলেই তোমাকে অনুরোধ করছি মেয়েটাকে এই বাড়িতে থাকতে দাও।
- থাকতে দিলে তো হবেনা। আমাদের সামনে তোমরা প্রেম করবে তা তো হবেনা। হয় ওকে ত্যাগ করো নয়ত আমাদেরকে ত্যাগ করো।
বুকের উপর পাথর এসে পড়লো স্নিগ্ধর। বাবা একটু বাড়াবাড়ি করছেন এবার। ত্রয়ী নিশ্চয় রুমে গিয়ে কান্নায় ভেংগে পড়েছে। ওর কান্না আর কষ্ট সহ্য করতে পারেনা স্নিগ্ধ। বুকটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। এখন কি করবে ও?
পর্ব ১৫
বাবা না থাকলে কি সেই মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেয়া যাবেনা? একজন শ্বশুর কি বাবা হতে পারেন না? এ কেমন নিয়ম আমাদের সমাজের? রাস্তায় বড় হওয়া একটা মেয়ে কখনো কি কাউকে ভালোবাসতে পারবে না? পিতৃ পরিচয়হীন মেয়ের চেয়ে ত্রয়ী অনেক ভালো অবস্থানে আছে, তবুও কি এটা মেনে নেয়া যায়না? বাবার অন্যায় সিদ্ধান্তের সমর্থন করতে পারবে না স্নিগ্ধ। ভালোবাসাকে মেনে না নেয়ার অন্য অজুহাত দেখালেও মানা যেতো। মেয়েকে অসুন্দর বললেও সহ্য করতো স্নিগ্ধ। কিন্তু এত ভাল আর লক্ষী একটা মেয়েকে এভাবে অপমান করতে পারেন না বাবা।
স্নিগ্ধ বাবার সাথে কথা না বাড়িয়ে আগে ত্রয়ীর কাছে এলো। রুমের দরজা আটকিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে ত্রয়ী। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু আত্মা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। এই ধ্বসের কোনো শব্দ নেই, এই কান্নার ও কোনো শব্দ নেই। কেউ জানেনা মেয়েটার ভেতরে কি বয়ে যাচ্ছে।
স্নিগ্ধ কয়েকবার দরজায় শব্দ করার পরও দরজা খুললো না ত্রয়ী। যদি আবার সুইসাইড করার চেষ্টা করে? সেই চিন্তাটা ক্রমশ ভাবিয়ে তুললো স্নিগ্ধ কে। স্নিগ্ধ জোরে জোরে ডাকতে ডাকতে দরজা ধাক্কাচ্ছিলো সমানে। তবুও ত্রয়ীর কোনো সাড়া শব্দ নেই। বুকটা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে স্নিগ্ধর। ত্রয়ী যেন ভূলভাল কিছু করে না বসে। যতই ভাবছে ততই দুশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে স্নিগ্ধ’র। এবার টেনশনের চাপে এত জোরে ডাকলো যে দরজা খুলতে বাধ্য হলো ত্রয়ী।
দরজা খুলে স্নিগ্ধর সাথে চোখাচোখি হওয়ামাত্র ত্রয়ীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে স্নিগ্ধ। এতক্ষণ যে ভয়টা ভেতরে চেপে বসেছিলো সে ভয়টা মিথ্যে হওয়ায় খুব আনন্দ হলো। ত্রয়ীকে জাপটে ধরে পিছনে একহাতে দরজা আটকিয়ে দিলো। ত্রয়ীও স্নিগ্ধর বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। স্নিগ্ধ ওর মুখটা তুলে দুহাতে চেপে ধরল। তারপর চোখের নিচে চুমু দিয়ে আবারো জাপটে ধরলো। ত্রয়ীর কান্না থেমে গেছে এখন। ও বললো, আমার ভাগ্যটা এমন কেন স্নিগ্ধ?
স্নিগ্ধ বলল- চিন্তা কোরোনা। আমি আছি তোমার পাশে।
ত্রয়ী দুহাতে আকড়ে ধরে সর্বোচ্চ ভরসাটুকু পেতে চাইলো। স্নিগ্ধ ওকে চেপে ধরে মুখটা আবারো ধরলো। এরপর মুখটা যতটা সম্ভব কাছে এগিয়ে আনতে লাগলো। ত্রয়ী চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।স্নিগ্ধ ত্রয়ীর গালে লেগে থাকা সমস্ত জল দুই ঠোঁট দিয়ে চুষে নিলো। শিউরে উঠলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধকে বুকে চেপে ধরে পিছনে হাত দিয়ে স্নিগ্ধর পিঠের উপরে শার্ট খামচে ধরলো। নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে চাইলো স্নিগ্ধর কাছে। স্নিগ্ধ ত্রয়ীকে নিয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। ত্রয়ীর কপালে, গলায়, গালে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। এত কষ্ট আর ধাক্কার পর স্নিগ্ধরর আদর পেয়ে বারবার শিহরিত হচ্ছিলো ত্রয়ী। স্নিগ্ধকে জাপটে ধরে মিশে যেতে চাইলো ওর মাঝে।
এরপর স্নিগ্ধ বললো- এখন না। আমি তোমাকে বিয়ে করবো ত্রয়ী।
- বিয়ে! আমি কি আদৌ তোমাকে পাবো স্নিগ্ধ?
- পাওয়ার জন্যেই ভালোবেসেছি। না পেলে জীবন দিয়ে দিবো।
- জীবন দিতে পারবে না। আপাতত বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। আমি চাইনা আমার জন্য তুমি সেটা করো।
- তাহলে কি করবো বলো? বাবার অন্যায় কথা আমি মানতে পারবো না।
ত্রয়ী বললো- অন্যায় নয়। ওটাই সত্য স্নিগ্ধ। আমাদের উচিৎ বাবার কথা শোনা। - উচিৎ? আর তুমি? যে বাড়ি ছেড়ে তুমি চলে এসেছো সেই বাড়িতে আবার তোমাকে পাঠাতে পারবো? ওই বাড়িতে গেলে তোমাকে খুন করে ফেলবে। আর তোমাকে একা ছেড়ে দিলে কোথায় যাবে বলো?
- আমার জন্য ভেবোনা। মরেই নাহয় যাবো।
ত্রয়ীর ঠোঁট কামড়ে ধরে স্নিগ্ধ চুলগুলোও চেপে ধরলো ওর। ত্রয়ী উত্তেজনায় ছটফটানি শুরু করে দিলো। এবার ছেড়ে দিয়ে স্নিগ্ধ বললো- আবার বলবা আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা?
ত্রয়ী লজ্জায় লাল হয়ে কথা বলতে ভূলে গেছে। স্নিগ্ধ চোখ পাকিয়ে বলল- আমি যাচ্ছি বাবার সাথে শেষ বোঝাপড়া করার জন্য। তুমিও চলো।
ভয়ে শুকিয়ে ত্রয়ী বলল- বাবা যদি বলেন আমার হাত ধরে বেড়িয়ে যেতে?
- যাবো। তবুও এভাবে একা তোমাকে ছেড়ে দিতে পারবো না। যদি তোমার বাবা মা থাকতো তাহলে নাহয় বাবার সুখের জন্য ছাড়তে পারতাম। কিন্তু তোমার কেউ নেই, তোমাকে আমি ফেলে গেলে কার কাছে যাবে তুমি?
আবারো কান্না পেলো ত্রয়ীর। তবে এবার কষ্টে কান্না পায়নি, এবার কান্না পাচ্ছে সুখে। এভাবে কোনো ছেলে ওকে ভালোবাসতে পারে সেটা ও কল্পনাও করেনি। স্নিগ্ধর ভালোবাসার স্পর্শে এত শান্তি পাচ্ছে যার কোনো তুলনা হয়না। স্নিগ্ধ অনেক ভালো একটা মানুষ সত্যিই।
স্নিগ্ধ উঠে দাড়াল। ত্রয়ীর হাত ধরে ওকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। বাবা মায়ের সামনে এসে বলল- আব্বু তোমার সাথে ফাইনাল কথা বলতে এসেছি।
বাবা অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। মা দ্রুত এসে স্নিগ্ধর বাবাকে বললেন, ওগো তুমি এমন কোরোনা প্লিজ। মেয়েটা অনেক লক্ষী, তুমি দেখে বুঝতে পারছো না?
বাবা রেগে বললেন, আমার কথার উপরে কথা বলতে আসবা না তুমি। আমি একবার যা বলেছি তাই।
স্নিগ্ধ সাথে সাথেই বলল- ওকে। তাহলে তুমি আমাকে বের করে দিচ্ছো বাড়ি থেকে?
- আমি মোটেও বের করে দিচ্ছিনা, তুমি নিজ ইচ্ছায় বের হয়ে যাচ্ছো।
- হ্যা যাচ্ছি। তুমি তোমার অহংকার আর আধিপত্য নিয়েই থাকো। আমি চলে যাচ্ছি।
মা পাগলের মত এগিয়ে এসে স্নিগ্ধকে ধরে বললেন – বাবা এমন করিস না। আমার একমাস ছেলে তুই। আমার কোল শূন্য করে কোথায় যাবি বাবা? - আমি কোল শূন্য করতে চাইনি মা। বরং তোমার আরেকটা মেয়ে এনে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা…
স্নিগ্ধর মা আবার ছুটে গেলেন স্বামীর কাছে। স্বামীর হাত ধরে বললেন – তুমি বোঝার চেষ্টা করোনা একটু? - সামনে থেকে চলে যাও তুমি। যেই ছেলেকে নিজের সবটুকু দিয়ে বড় করে তুললাম আজ সে বড় হয়ে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য এই বাবাকে ছেড়ে যাবে সে। এই বাবা না থাকলে সে পৃথিবীতেই আসতো না, এই বাবা না থাকলে সে বড় হতেই পারতো না।
ত্রয়ী এবার আর সহ্য করতে পারলো না। তার জন্য একটা বাবাকে কষ্ট পেতে দেবেনা সে। ওর কেউ নেই, কেউ না ই থাকুক। কিন্তু বাবাকে কষ্ট দিয়ে মোটেও সুখী হতে পারবে না ও। বাবা যদি বুঝতে না পারেন, সেটা তার ব্যর্থতা।
ত্রয়ী স্নিগ্ধর হাত ছেড়ে দিয়ে বললো- আমি চলে যাচ্ছি স্নিগ্ধ। আমার আগে ভাবা উচিৎ ছিলো আমার বাবা মা নেই। একটা এতিম বাচ্চার জন্য সবার দয়া হবে কিন্তু ভালোবাসাটা সবাই দিতে পারবে না। তুমি ভালো থেকো আমাকে ছারাই। আর আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব টা আর তোমার নিতে হবেনা স্নিগ্ধ। তুমি তোমার বাবা মাকে ভালো রাখো।
কথাটা বলেই আর এক মুহুর্ত দাড়াল না ত্রয়ী। দ্রুত বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে।সোজা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। স্নিগ্ধ ও ছুটে বেড়িয়ে এলো বাড়ি থেকে। কিন্তু বাইরে এসে ত্রয়ীকে আর পেলোনা। মুহুর্তের মধ্যেই মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো স্নিগ্ধ। ত্রয়ী কোথায় চলে গেলো? মেয়েটা যদি আত্মহত্যা করে বসে? আত্মহত্যা না করলেও মেয়েটা যাবে কোথায়? এই
দেশে কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। এখন বিপদ ঘটতেও দেরি হবেনা। নানান টেনশন মাথায় এসে ভির চাপালো স্নিগ্ধর। ভেতর থেকে ঠেলে কান্না আসতে চাইলো।
বাবা মায়ের জন্য এভাবেই প্রতিনিয়ত এলোমেলো হয়ে যায় কত ছেলে মেয়ের জীবন! যে সন্তানের জন্য এতটা করেছেন তারা, সেই সন্তানের সুখের কথা একবার ও কেন ভাবেন না? আলাদা করে দেয়াতেই কি সমস্ত সুখ? ত্রয়ী এখন কোথায় যাবে মানবতার খাতিরে সেটাও ভেবে দেখা উচিৎ ছিলো।
পর্ব ১৬
সমস্ত ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেছে স্নিগ্ধর। ত্রয়ী কোথায় চলে গেছে জানেনা ও। ফোনটাও বন্ধ। সারাজীবনের মত হারিয়ে গেল মেয়েটা। স্নিগ্ধ রুমে এসে চিন্তিত মুখে বসে রইলো।
রাত বাড়লো ধীরেধীরে। ত্রয়ী কোথায় উঠবে সেই চিন্তায় এখনো বিভোর হয়ে ওকে খুজে বেড়াচ্ছে স্নিগ্ধ। বাসায় খোজ নিয়ে দেখলো সেখানেও যায়নি। রাস্তার মাঝখানে বসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো স্নিগ্ধ।
স্নিগ্ধ’র বাবা বাইরে থেকে ফিরছিলেন তখন। ছেলেকে এভাবে রাস্তায় বসে কাদতে দেখে ভ্রু কুচকালেন। তার এত বড় ছেলেটা এভাবে চিৎকার করে কাঁদছে? তাও একটা মেয়ের জন্য?
বুকটা চিনচিন করে উঠলো ওনার। রাস্তায় উনি কিছু বললেন না। মন খারাপ করে বাসায় এসে চিন্তায় বুদ হয়ে রইলেন। কি জানি কোনো অন্যায় করে ফেলেছেন কিনা। নয়তো ছেলেটা এভাবে কাদবে কেন? নিজের আভিজাত্যের জন্য ছেলের সুখ যেন নষ্ট না হয়ে যায়। বাবা বসে বসে এসবই ভাবছিলেন। পরবর্তীতে নিজেই নিজেকে বোঝালেন এটা বলে যে, প্রথম অবস্থায় মেয়েটাকে ভূলে যেতে একটু কষ্ট পাবে এটাই স্বাভাবিক। ধীরেধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তবুও মেয়েটাকে মেনে নেয়ার চিন্তা একবারও করলেন না।
অনেক রাতে বাসায় ফিরলো স্নিগ্ধ। বাসায় ঢুকে না খেয়েই রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বাবা মা লক্ষ্য করলেন সবকিছু। ছেলেটা কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে। একদিনেই কি হাল হয়েছে চেহারার।
মা স্নিগ্ধর বাবাকে বললেন – একবার কি ভেবে দেখা যায়না? ছেলেটার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে তো। তখন বুঝবা কত বড় ভূল হয়ে গেছে। কিন্তু সুধরানোর সুযোগ থাকবে না।
বাবা রেগে বললেন, একটা মেয়ের জন্য জীবন নষ্ট কেন হবে? জীবন কি এতই সস্তা?
- একটা মেয়েকে এত সস্তা ভাবছো কি করে? একটা সন্তানের জন্য বাবা মা কি কম প্রার্থনা করে? যদি এত সস্তাই হতো তাহলে কারো শূন্য কোল থাকতো না। সে তোমার সন্তান বলেই এত ভাবছো। আর অন্য কারো মেয়ে বলে ভাবতে পারোনা?
- না পারিনা। আমার ছেলে মানে আমার ছেলে। সে তো রাস্তার ছেলে নয়।
- ত্রয়ীকে রাস্তার মেয়ে কেন বলছো? আজকে যদি জন্মের পরপরই তুমি মারা যেতে তাহলে স্নিগ্ধকে আমাকেই মানুষ করতে হতো। ওর কি বিয়ে হতোনা?
- হতো। কিন্তু সব পরিবারে হতো না।
- বাহ! কি ভাবছো নিজেকে?
- আমাদের বংশ পরিচয় আছে। আমাদের একটা সম্মান আছে সমাজে।
- সেটা নিয়েই থাকো। ছেলেই যদি মরে যায় তখন বংশ কই যাবে আমিও দেখবো
বাবা এবার রেগে বললেন, তোমার ছেলের জন্য এত দরদ থাকলে তুমিও বেরিয়ে যাও। ছেলেকে নিয়ে যেখানে খুশি গিয়ে থাকো। ছেলে রোজগার করে তোমাকে আর তোমার ছেলের বউকে খাওয়াবে।
- আজকে ছেলেটা যদি নিজের পায়ে দাড়াতো, তাহলে এই কথাটা বলতে না জানি। সে এখনো বেকার বলেই বিয়ে দিতে এত বাধছে? এত বছর ছেলেকে মানুষ করতে পারলাম আর ক’টাদিন একটা মেয়েকে খাওয়াতে পারবো না?
- চুপ করো। এত রাতে চেচিয়ে পাড়ার লোক জড়ো করার মানে হয়না।
- তুমি তো সেটাই চাচ্ছো।
বাবা মায়ের রাগারাগি ক্রমেই বাড়তে লাগলো। স্নিগ্ধ পাশের রুমে বসে শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে উঠছে। এমনিতেই মনে অশান্তি চলছে। আবার বাড়িতেও অশান্তি। সহ্য করতে না পেরে বাবা মায়ের রুমের সামনে এসে বললো,
- তোমাদের সমস্যা কি? আমি কি কোনো দয়া চেয়েছি তোমাদের কাছে? ত্রয়ী তো সমাধান করে দিয়ে চলেই গেছে। আবার তাকে নিয়ে আলোচনা কেন এ বাড়িতে? তোমাদের তো খুশি হওয়ার কথা।
বাবা মা চুপ করে গেলেন। স্নিগ্ধ আবারও বললো- আমি কষ্ট পাচ্ছি ত্রয়ীকে হারানোর জন্য নয়। আমি কষ্ট পাচ্ছি মেয়েটা এখন কোথায় যাবে সেটা ভেবে। এই শহরে আর কেউ নেই ওর। স্নিগ্ধা ওকে আমার ভরসায় নিয়ে এসেছে। সেই আমিই তাড়িয়ে দিলাম বাড়ি থেকে। এই দেশের অবস্থা কেমন জানোই আশাকরি। একটা মেয়ে একা একা কোথায় যাবে, কি বিপদে পড়বে সেটা নিয়ে ভাবছি আমি। আমি বিয়ের কথা ভাবছি না। তোমাদের মত আমার ভাবনা এত নিচু নয়।
কথাটা বলেই আবারও বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো স্নিগ্ধ। রাগের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। অসহ্য দহন বুকের ভেতরে। এত যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে যায়। ত্রয়ী যে কিভাবে বেচে আছে?
বাবা রাগের চোটে টেবিলে জোরে একটা ঘুষি বসালেন। মা বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে। এদিকে স্নিগ্ধাও অশান্তিতে ভুগছে। একটা ব্যাপার সবার মাঝে অস্বস্তি এনে দিয়েছে।
স্নিগ্ধ বাইরে বের হয়ে রাস্তা ধরে হাটতে লাগলো। একদিন ত্রয়ীকে জিজ্ঞেস করেছিলো, তোমার যদি কখনো মন খারাপ হয় তাহলে তুমি কি করো?
ত্রয়ী বলেছিলো, চুপচাপ বসে থাকি।
- কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে তোমার?
- হ্যা করে। খুব কষ্ট পেলে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে।
- ধরো কখনো তোমার রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করলে তুমি কোথায় যাবা?
এই প্রশ্নের উত্তরে ত্রয়ী ওর একটা ফুপির কথা বলেছিলো। বাবার বাড়ির কারো সাথে ওর তেমন ভালো সম্পর্ক নেই। কিন্তু শুধুমাত্র এই ফুপিটা ওকে নিজের মেয়ের মত আদর করেন। মাঝেমধ্যে সেখানে চলে যেতে ইচ্ছে করে ওর। কিন্তু ঠিকানাটা ওর কিছুতেই মনে পড়ছে না।
মাথা চুলকাচ্ছে স্নিগ্ধ। এটা একটা ভালো কথা মনে পড়েছে। ত্রয়ী কোথাও গিয়ে থাকলে সেখানেই যাবে। কিন্তু কিভাবে এড্রেস জোগাড় করবে ও?
মাথা চুলকাতে চুলকাতে ত্রয়ীর এক বান্ধবীর নাম্বারে কল দিলো স্নিগ্ধ। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতেই বাসার ঠিকানা পাওয়া গেলো। ওই মেয়ে সহ একদিন সেই ফুপির বাসায় গিয়েছিলো। অনেকটা আশার আলো দেখতে পেয়েছে স্নিগ্ধ। দ্রুত সিএনজি নিলো সেখানে যাওয়ার জন্য।
রাত তখন প্রায় ভোরের দিকে। এত রাতে কোথাও যাওয়াটাও রিস্কি। তবুও হাল ছাড়েনি স্নিগ্ধ। ত্রয়ীর জন্য দুশ্চিন্তা কমাতে যেতেই হবে ওকে।
স্নিগ্ধ দ্রুত চলে এলো সেই বাড়ির সামনে। কিন্তু বাড়ির গেট লাগানো। এত রাতে কোনো বাড়ির গেট খোলা থাকার কথা নয়। কি করবে বুঝতে না পেরে ঠায় বসে রইলো গেটের সামনে।
.
ধীরেধীরে ভোরের আলো ফুটলো। গেট খুলে দেয়া হলো বাড়ির। অন্ধকার কেটে ফর্সা হচ্ছে মাত্র। রাস্তাতেই বসে আছে স্নিগ্ধ। গেট খোলার পর কয়েকবার তাকালো বাড়ির দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন বয়স্ক লোক নামাজের জন্য বাইরে বের হলেন। লোকটি স্নিগ্ধকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন এখানে কি করছে?
স্নিগ্ধ পাগলের মত করতে করতে বললো, এই বাড়িটা কি আপনার? আমি এখানে দোতলার বাসায় এসেছি।
- দোতলার বাসা আমারই। কি চাই?
- আপনি কি ত্রয়ীর কেউ হোন?ভ্রু কুঁচকালেন লোকটি। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সেই ছেলেটা? যার বাপ মা তাড়িয়ে দিয়েছে ওকে?
কথাগা বুকে এসে বিধলো স্নিগ্ধর। সহ্য করতে পারলো না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো- সরি আংকেল। ত্রয়ীর সাথে দেখা করা দরকার আমার। - বাসায় যাও। দোতলায় বেল বাজালেই দরজা খুলে দেবে।
স্নিগ্ধ ছুটে বাসায় ঢোকার চেষ্টা করছিলো। আংকেল পিছন থেকে বললেন – তোমার বাবার আচরণ অনুযায়ী আমারও উচিত ছিলো তোমাকে তাড়িয়ে দেয়া। আমি এতটা নিষ্ঠুর নই।
ত্রয়ী ছুটে এসে ওনার পা ছুয়ে সালাম করলো। ছেলেটার বিনয়ে মনেমনে খুশি হলেন বৃদ্ধ। বললেন ঠিক আছে বাসায় যাও। আমি নামাজ পড়ে আসি।
লোকটি চলে যাওয়ার পর স্নিগ্ধ দ্রুত হন্তদন্ত হয়ে বাসায় এসে বেল বাজালো। এখনো বাড়ির আর কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। দরজা খুলে দিলো ত্রয়ী নিজেই।
দরজা খুলেই আচমকা স্নিগ্ধকে দেখতে পাবে সেটা ভাবতেও পারেনি ত্রয়ী। স্নিগ্ধকে দেখার পর নিজেকে সামলাতে পারলো না। ঝাপিয়ে পড়লো ওর বুকে। স্নিগ্ধও ওকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেললো। ত্রয়ী বললো- একি উসকোখুসকো অবস্থা তোমার?
স্নিগ্ধ বলল- ত্রয়ী আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
- আর ছাড়বো না স্নিগ্ধ।
ত্রয়ী স্নিগ্ধর হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের চোখ মুছলো। স্নিগ্ধ ত্রয়ীর মুখটা ধরে চোখের উপর চুমু একে দিলো।
পর্ব ১৭
কান্নার বাঁধ ভেঙেছে আজ। স্নিগ্ধ ত্রয়ীকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে চাইছে। ত্রয়ী দুহাতে জাপটে ধরেছে প্রিয় মানুষটাকে। কি যে অসহ্য কষ্ট গেছে সারাটা দিন আর রাত।
ত্রয়ী ছেড়ে দেয়ার পর বললো- তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে? আর বাসার এড্রেস পেলে কিভাবে?
- সারাটাদিন পাগলের মত খুজেছি ত্রয়ী।
- তুমি কখন এসেছো?
- রাতে। সারারাত রাস্তায় বসে। এই বাড়ির গেটের সামনে।
আরেকবার স্নিগ্ধকে জাপটে ধরলো ত্রয়ী। এতটা কষ্ট করেছে মানুষটা। সারারাত এভাবে রাস্তায়! নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আর কোনো প্রমাণ চায়না ত্রয়ী। এখনো ভালোবাসা আছে সেটা বুঝে গেছে ও।
ত্রয়ীর চোখ মুছে দিয়ে স্নিগ্ধ বললো, আর কেদোনা। তোমার আংকেল বাসায় বসতে বলেছে।
- আসো ভিতরে আসো।
ত্রয়ী স্নিগ্ধকে হাত ধরে বাসার ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালো। ছেলেটার চেহারার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। দেখলেই মায়া লাগছে। কি পরিমাণ কষ্ট পেয়েছে তার ছাপ চেহারায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরেও শান্তি পাচ্ছেনা ত্রয়ী। বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে চাইছে।
স্নিগ্ধ বললো- আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
- তুমি একেবারে গোসল সেরে নাও স্নিগ্ধ। বাসায় শুধু ফুপি আছে। ফুপি ঘুম থেকে উঠলেও সমস্যা হবেনা। আমি সব বলেছি তোমার ব্যাপারে।
স্নিগ্ধকে বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে রুমে চলে গেল ত্রয়ী। ফিরে এলো একটা তোয়ালে হাতে। বাথরুমের দরজায় শব্দ করামাত্র খুলে দিলো স্নিগ্ধ। দরজা খুলে স্নিগ্ধ বললো, আমার মাথাটা শ্যাম্পু করে দিবে ত্রয়ী?
ত্রয়ী হাসার চেষ্টা করে বললো, দাড়াও গা ধুয়ে দিচ্ছি। কি হাল করেছো চেহারার। আমি ঘষে ঘষে ধুয়ে দিচ্ছি।
ত্রয়ী বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর সাবান হাতে নিয়ে স্নিগ্ধর গায়ে লাগাতে শুরু করলো। স্নিগ্ধ বললো- তুমিও বাথরুমের ভেতরে। ফুপি বুঝতে পেলে কি ভাব্বে?
- ফুপি ঘুম থেকে উঠবে আরো দেরিতে। তাছাড়া আমি দরজা লক করে এসেছি। রুমে না ঢুকতে পারলে বাথরুমে আছি এটাও জানবে না।
- ত্রয়ী।
- হুম বলো।
- আর আমাকে ছেড়ে যাবা না তো?
স্নিগ্ধর মুখের দিকে তাকালো ত্রয়ী। মুখটা দেখে খুব মায়া লাগছে। শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে ছেলেটার মুখ। মায়ার টানে চোখে পানি এসে গেল ত্রয়ীর। গা ডলে দিতে দিতে বললো- তুমি এতটা পাগল কেন স্নিগ্ধ?
স্নিগ্ধ অকপটে বললো- পাগল হওয়ার মত ভালোবাসি যে তাই।
- এতটা ভালোবাসার দরকার ছিলো?
- হ্যা ছিলো। ভালোবাসলে বাসার মত বাসবো।
- আহারে! পাগল একটা।
স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে ত্রয়ীর হাতটা ধরে কাছে টেনে নিলো। বুকের উপর টেনে নিতে নিতে বললো- এত মায়া কেন রে তোর মাঝে? পুরো দুনিয়া ছাড়তে মন চায় শুধু তুই পাশে থাকিস।
- যাও। এভাবে বলতে হবেনা। আমি জানি, বুঝি।
স্নিগ্ধ ত্রয়ীর মুখটা দুহাতে ধরে বললো, এত যত্ন করে গোসল করিয়ে দিচ্ছো, গায়ের ময়লা ডলে দিচ্ছো। আর কোন মেয়েটা আমাকে এভাবে আদর করবে বলোতো? - আদর তো করি ই নি এখনো।
স্নিগ্ধ হেসে বলল- তাই! আদর আবার কিভাবে করতে হয়?
ত্রয়ী স্নিগ্ধ’র নাক টেনে ধরে বললো, জানোনা বুঝি?
স্নিগ্ধ ত্রয়ীর কোমর চেপে ধরে বললো,
- উহুম জানিনা তো।
ত্রয়ী মুচকি হাসলো। একহাতে স্নিগ্ধর চুলের পিছনে চেপে ধরে, আরেকহাতে ওকে কাছে টানতে লাগলো। পা দুটো স্নিগ্ধর পায়ের উপর তুলে দিয়ে উচু হয়ে এলো অনেকটা। স্নিগ্ধও ত্রয়ীর কোমর চেপে ধরে রেখেছে। ত্রয়ী স্নিগ্ধর চুল টেনে ধরে ওর ঠোঁটের ভেতরে নিজের ঠোঁট দুটো পুরে দেয়ার চেষ্টা করল। স্নিগ্ধও এত কষ্টের পর ত্রয়ীকে কাছে পেয়ে গভীর আবেশে চুম্বন করতে লাগলো। দুজনে মিশে যেতে লাগলো সুখের অন্য এক রাজ্যে। ত্রয়ী আস্তে আস্তে ঠোঁট নাড়াচ্ছে, স্নিগ্ধও সমানভাবে সাড়া দিচ্ছে। এত মধুর চুম্বন বোধহয় আর হয়না। দুজন দুজনকে গভীরভাবে আকড়ে ধরে রইলো।
শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ত্রয়ীও মিশে গেলো স্নিগ্ধর মাঝে। স্নিগ্ধ ত্রয়ীর গালে, ঠোঁটে, মুখে সবখানে লেগে থাকা জল ঠোঁট দিয়ে মুখের ভেতর নিতে লাগলো। একজন আরেকজনের খুব বেশি আপন হয়ে গেল অল্প সময়ের মধ্যেই।
ত্রয়ী স্নিগ্ধর গালে, থুতনিতে, কপালে সবখানে অসংখ্য চুমু একে দিলো। তারপর ছেড়ে দিয়ে বললো- আর না। আজ থাক।
স্নিগ্ধ আর জোর করলো না। ত্রয়ীকে ছেড়ে দিয়ে বললো- আচ্ছা। তুমি তো ভিজে গেছো।
- উহুম। প্রেমের বৃষ্টিতে তুমি ভিজিয়েছো আমাকে।
ত্রয়ী বের হলো বাথরুম থেকে। ভেজা কাপড় বদলে জামা পড়ে নিলো। স্নিগ্ধও বাথরুমে পোশাক বদলে টাওয়েল পড়ে বাইরে এলো। ত্রয়ী ওর আংকেলের লুংগী এনে দিলো স্নিগ্ধকে। লুংগী পড়া অবস্থায় স্নিগ্ধকে দেখে হাসি আর থামতেই চাইছিলো না ওর।ত্রয়ী নাস্তা রেডি করে স্নিগ্ধকে এনে দিলো। এরমধ্যেই আংকেল চলে এসেছেন। লুংগী পড়া অবস্থায় স্নিগ্ধ, আর ত্রয়ী ছুটাছুটি করে নাস্তা খাবার দিচ্ছে দেখে ওনার মনে হলো নতুন বিয়ে হয়েছে। মেয়ে জামাই এসেছে বেড়াতে। দুটোকে মানিয়েছে বেশ, চোখ জুড়িয়ে যায় দেখলে।
আংকেল স্নিগ্ধকে নানান প্রশ্ন করতে লাগলেন। বিয়ে নিয়ে কোনো কথা হলোনা। সারাদিন সেখানে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলো স্নিগ্ধ। ত্রয়ীর ফুপিরও স্নিগ্ধকে অনেক পছন্দ হয়েছে। জামাই হিসেবে একেবারে পারফেক্ট। এখন শুধু বিয়েটা হলেই হয়। সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করার পর স্নিগ্ধ এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, বাসায় গিয়ে খুব মনমরা হয়ে থাকবে। সবসময় এমন ভান করে থাকবে যেন ত্রয়ীকে ছাড়া থাকতেই পারবে না সে। এভাবেই বাবাকে রাজী করানো সম্ভব।
বাসায় ফিরে সেটাই করলো স্নিগ্ধ। রুমে ঢুকে মনমরা হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। বাবা যখন খেতে ডাকলেন তখন খাবার টেবিলে গিয়ে চুপচাপ খেয়ে নিলো।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ছিলে সারাদিন?
- বাইরে।
- ফোন বন্ধ ছিলো কেন?
- ফোন রেখে কি করবো? বন্ধ ছিলো নাকি খোলা ছিলো খেয়াল করিনি।
আর কোনো কথা না বলে সামান্য একটু ভাত মুখে দিয়ে উঠে এলো স্নিগ্ধ। এখন আর খাওয়ার রুচি নেই এমন ভাব। কিন্তু ঠিকই ত্রয়ীর সাথে বসে খেয়ে এসেছে।
বাবা মা দেখলেন ছেলে অনেক মনমরা। রাতে খাবার খেলোনা ঠিকমতো। পরেরদিনও সকালে নাস্তা না করেই বেড়িয়ে গেল। দুপুরে বাসায় ফিরে গোসল করে রুমে শুয়ে আছে।
মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটা কোথায় আছে জানিস কিছু?
- শুনেছি ওর ফুপির বাসায়। আর তো কেউ নেই।
- কথা হয়?
- মেয়েটা অনেক আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মেয়ে মা। ও কথা বলতে চায়না।
এটা মিথ্যে হলেও বলতে হলো। মাকে বললে অনেক কাজে আসবে। মা অবাক হয়ে বললেন, মেয়ে আর কথা বলতে চায়না? - ও খুব কষ্ট পেয়েছে মা। আমি ফোন দিয়েছিলাম। সরাসরি বলেছে যদি তোমরা রাজী হও তবেই কথা বলবে নয়তো ভূলে যাও আমাকে।
মা অবাক হয়ে বললেন, বেশ তেজী মেয়ে তো। - হ্যা মা। অনেক তেজী।
মা কিছুক্ষণ ছেলের পাশে বসে রইলেন। স্নিগ্ধ যথাসাধ্য চেষ্টা করলো আনমনা হয়ে থাকার। মা হতাশ হয়ে চলে গেলেন। ছেলের কষ্ট দেখে ওনারও কষ্ট হচ্ছে।
স্নিগ্ধর বাবাকে উনি আবার বললেন, একবার ভেবে দেখা যায়না? কিন্তু বাবা চোখ পাকিয়ে তাকানোর পর উনি আর কথা বাড়ান নি।
দুটো দিন এভাবেই কাটলো। স্নিগ্ধ একেবারেই খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিলো। সারাদিন উসকোখুসকো হয়ে ঘুরে বেড়ায়, মন খারাপ করে থাকে। দেখে বাবার মনটাও আর মানছে না। একমাত্র ছেলেটা এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে উনি মানতে পারছেন না। অবশেষে নিজেই স্নিগ্ধকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়েটার কি খবর বাবা?’
চমকে উঠলো স্নিগ্ধ। মনে সুখের জোয়ার এসে ধাক্কা দিলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে।
বাবা বললেন, মনেহয় একটা ভূল করে ফেলেছি। তুই ওকে এতটা ভালোবাসিস, বুঝিনি।
আর কিছু বলতে হলোনা। স্নিগ্ধ বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, খুব ভালোবাসি আব্বু। আমি ওকে ছাড়া ভালো নেই, ভালো থাকবো না।
বাবা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, মেয়েটা আছে কোথায়? আমি কথা বলবো।
পর্ব ১৮
ত্রয়ী দরজা খুলে শ্বশুরমশাইকে দেখে পুরোপুরি থ! মাথায় বাজ পড়ার মত ভয় পেয়ে গেলো। উনি এই বাসার ঠিকানা কিভাবে পেলেন? আর কেনই বা এসেছেন? স্নিগ্ধ এখানে এসেছিলো সেটা নিশ্চয়ই কোনোভাবে জানতে পেরেছেন আর সেটার জন্য আজকে আবার কথা শুনতে হবে। ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল ত্রয়ী। মাথা নিচু করেই সালাম করলো ওনাকে।
উনি কঠিন স্বরে বললেন- ভেতরে ঢুকতে দাও।
ত্রয়ীর আরো ভয় বেড়ে গেল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ঢোক গিলে বললো, আসুন।
উনি ভেতরে ঢোকার পর দরজা লাগাতে যাওয়ামাত্রই দরজায় স্নিগ্ধর মুখ দেখা গেলো। কিন্তু স্নিগ্ধর মুখটা হাসি হাসি ত্রয়ী অবাক হয়ে বললো, তুমিও!
স্নিগ্ধ ত্রয়ীর কোমরে হাত রেখে বুকে টেনে নিয়ে বললো- আমার পাগলীটা।
ত্রয়ী চোখ বড়বড় করে বললো- ব্যাপার কি?
স্নিগ্ধ ভ্রু নাঁচালো। ত্রয়ীর বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললো- ভয় পেয়েছো খুব?
- হুম খুব। উনি হঠাৎ? তাও আবার তুমিও সাথে। বুঝতে পারছিনা কিছু।
স্নিগ্ধ বললো- বাবা তোমাকে রিং পড়াতে এসেছেন।
চমকে উঠে স্নিগ্ধর দিকে তাকালো ত্রয়ী। মুখে কোনো কথা আসছে না। রিং পড়াতে এসেছেন মানে! অনেক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না ত্রয়ী। নিজের কানকেই বিশ্বাস হতে চাইলো না। কোনোমতে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে।
স্নিগ্ধ বললো, হা হয়ে আছো কেন? মুখের ভেতর জিভ ঢুকিয়ে দিবো?
লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে ফেললো ত্রয়ী। স্নিগ্ধ ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো, চলো।
ত্রয়ীর মেঝেতে পা ফেলার মত শক্তিটাও বোধহয় নেই। স্বপ্নের রাজ্যে প্রবেশ করার মত অন্য এক জগতে হারিয়ে গেছে ও। বাস্তবে ফিরে আসার সাধ্য নেই। কিন্তু বাস্তেবই যে উনি এসেছেন সেটা অবিশ্বাস্য লাগতে
শুরু করলো। স্নিগ্ধ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ত্রয়ীর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো।
ত্রয়ীর ফুফু স্নিগ্ধর বাবার পরিচয় পেয়ে ওনাকে বসতে বলে নাস্তা বানাতে গেছেন। ত্রয়ীর রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা বানাতে সাহায্য করলো। এরপর নাস্তা নিয়ে বসার ঘরে আসার পর স্নিগ্ধর বাবা ডেকে নিয়ে ওকে পাশে বসালেন।
তারপর বললেন, কেমন আছো মা?
ত্রয়ী চোখ বড়বড় করে তাকালো। উনি এভাবে সম্বোধন করছেন সেটা একদমই বিশ্বাস হতে চাইছে না। চোখের পলক ফেলে অবাক হয়েই চেয়ে রইলো ও।
উনি নাস্তা খেতে খেতে ত্রয়ীর ফুফু আর ফুফার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলেন। তারপর ত্রয়ীকে বললেন, আমার ছেলেটার দায়িত্ব নিতে পারবি তো?
ত্রয়ী মাথা নিচু করে একহাতে চোখ মুছলো। সেদিনই ওনারা অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আজকে আবার নিজের মেয়ের মত করে….
বাবা ওর হাতটা নিয়ে হাতে আংটি পড়িয়ে দিয়ে বললেন, আজ থেকে আমার পাগল ছেলেটার দায়িত্ব তোমার।
ত্রয়ী কান্না চেপে রাখতে পারছে না। বাবা ব্যাপারটা দেখে মনেমনে খুশি হলেন। এদিকে ত্রয়ীর কাছে এখনো সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগতে আরম্ভ করেছে। স্নিগ্ধ একা একা কিভাবে এতকিছুর ম্যানেজ করে ফেলেছে সেটা সেই ভালো জানে। খুব লজ্জা করছে তো।
ত্রয়ী উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। বাবা ফুফু ও ফুফার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বললেন। খুব দ্রুত বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবেন ওনারা। এ বাড়িতেই বিয়ে পড়ানো হবে। আয়োজন বলতে স্নিগ্ধর বাবা মা বোন ও দু একজন কাছের লোক আসবেন শুধু। ত্রয়ীর তো কেউই নেই। তাই ছোট্ট আয়োজনে শুধু বিয়েটা পড়িয়ে নেয়া হবে। স্নিগ্ধ বাবাকে বলে ত্রয়ীর সাথে একবার কথা বলার জন্য ওর রুমে এলো। ত্রয়ী এখনো কাঁদছে। স্নিগ্ধ এগিয়ে এসে বললো, কাঁদছো কেন পাগলী?
ত্রয়ী জড়িয়ে ধরলো স্নিগ্ধকে। স্নিগ্ধ সবকিছু ম্যাজিকের মত করে ফেলেছে দেখে অবাক লাগছে ওর।
ত্রয়ী বললো, কিভাবে পারলে তুমি!
- তোমার জন্য সব পারবো রে পাগলী।
- অদ্ভুত লাগছে স্নিগ্ধ। এত ভালোবাসো কেন আমাকে?
- একটু চালাকি করেছি এই আরকি।
স্নিগ্ধ নিচু হয়ে ত্রয়ীর কপালে ছোট্ট একটা চুমু একে দিলো। ত্রয়ী শক্ত করে ধরে রইলো ওকে। দুজনের মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেছে। আর কেউ আলাদা করতে পারবে না। আর কোনো হারানোর ভয় নেই, কোনো একা থাকার যন্ত্রণা নেই, কোনো কষ্ট নেই। আজ থেকে দুজনের দায়িত্ব শুধু দুজনের। একজন আরেকজনকে খুব আগলে রাখবে।পরেরদিন স্নিগ্ধ ত্রয়ী ও স্নিগ্ধ তিনজনে মিলে একসাথে বিয়ের শপিংয়ে এলো। ত্রয়ী লজ্জায় কোনোকিছু কেনাকাটা করতেই চাইছিলো না। স্নিগ্ধ আর স্নিগ্ধ ওকে ঝাড়ি দিয়ে দিয়ে সবকিছু কেনাকাটা করে দিচ্ছিলো। লাল টুকটুকে বেনারশী শাড়ি, গয়না সবকিছু কেনার সময় ত্রয়ী লজ্জায় কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলো। স্নিগ্ধ যখন লাল ঘোমটাটা ত্রয়ীর মাথায় টেনে দিচ্ছিলো, ত্রয়ী মুখটা নিচু করে থুতনির সাথে লাগিয়ে ফেলেছিলো প্রায়। লাজে রাঙা মুখটা দেখে ভেতরটা অন্যরকম ভালোলাগায় ছেয়ে গিয়েছিলো স্নিগ্ধর।
ত্রয়ী নিজে পছন্দ করে কিছুই কেনেনি। সবকিছু স্নিগ্ধ পছন্দ করে দিচ্ছিলো। স্নিগ্ধর সমস্ত কেনাকাটা ত্রয়ী নিজের পছন্দে করে দিলো। দুজনে হাত ধরে বিয়ের কেনাকাটা করার মাঝে কি যে আনন্দ! ত্রয়ী আগে জানতো না এটা। জীবনটা মাঝেমাঝে এত সুন্দর হয়ে ওঠে! আহা!
শেষ পর্ব
গায়ে হলুদের মঞ্চ দেখে অবাক হয়ে গেলো ত্রয়ী। ওকে না জানিয়েই বাড়ির বাইরে গায়ে হলুদের মঞ্চ সাজানো হয়েছে। যদিও লোকজন নেই, তবুও বিয়ের কোনো আয়োজন বাকি রাখেনি। ত্রয়ীর মুগ্ধ চেহারাটা উপভোগ করছেন ফুফু ফুফা।
বিয়ের দিন সকাল থেকেই রান্নাবান্নায় ব্যস্ত ফুফু। ত্রয়ীকে উনি কোনো কাজেই হাত লাগাতে দিচ্ছেন না। ত্রয়ী শুধু বিছানার উপর বসে স্নিগ্ধর সাথে ফোনালাপ করছে। বিয়ে হওয়াতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধ’র আনন্দের সবথেকে বড় কারণ ত্রয়ীর নিরাপত্তা। আজ থেকে মেয়েটার সমস্ত দায়িত্ব সে নিতে পারবে সেই আনন্দেই মুখর হয়ে রইলো ও।
যথাসময়ে পাত্রপক্ষ চলে এলো। পাত্রপক্ষ বলতে বর, বাবা, মা বোন ও কাছের তিন চারজন আত্মীয় স্বজন। ত্রয়ী নিজের রুমে বিছানায় বসে আছে চুপচাপ।
স্নিগ্ধা নিজের হাতে মনের মত করে কনের সাজে সাজালো ভাবীকে। বউয়ের সাজে ত্রয়ীকে এত সুন্দর লাগবে সেটা যেন কল্পনাতীত ছিলো। সত্যিই মেয়েটা অপূর্ব বটে!
ত্রয়ী আয়নায় তাকিয়ে লাজুক ভংগিতে হাসলো। বউ সেজে নিজের কাছেই নিজেকে অচেনা লাগছে। লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে ওর।
সাজগোজ শেষ হলে ত্রয়ীকে নিয়ে আসা হলো বসার ঘরে৷ এখানে সবাই অপেক্ষা করছিলো ওর জন্য। ত্রয়ীকে বউয়ের সাজে দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার মত অবস্থা হলো স্নিগ্ধর৷ নিজের বউ ভাবতেও সুখ লাগছে আজ। বারবার আড়চোখে তাকাতে লাগলো ত্রয়ীর দিকে। ঠোঁটে রাঙা লিপস্টিক, লাল বেনারসি, লাল ঘোমটা মাথায় অপ্সরীর মত লাগছে মেয়েটাকে। কাজী সাহেব এসে বিয়ে পড়ানোর কার্যক্রম শুরু করলেন। বিয়েটা হয়েই গেলো অতঃপর।
বিয়ের পর খাওয়াদাওয়া ও বিদায়ের পর্ব শেষ করে ত্রয়ীকে নিয়ে বরপক্ষ রওনা দিলো বাসার উদ্দ্যেশ্যে। গাড়িতে ত্রয়ী স্নিগ্ধ’র পাশে বসে ওর হাত ধরে রইলো শক্ত করে৷
বাসর ঘরে ঢুকে স্নিগ্ধ যখন ধীরপায়ে বিছানার দিকে এগোচ্ছিলো, ত্রয়ী হঠাৎ চেঁচিয়ে বললো, ‘এই আসবা না, আসবা না।’
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে বললো, কেন?
ত্রয়ী বিছানা থেকে নেমে শাড়িটা দুহাতে তুলে ধীরেধীরে এগিয়ে এলো স্নিগ্ধর কাছে। তারপর বললো, আমি চেয়েছিলাম আমার বরটা আমাকে কোলে নিয়ে বিছানায় যাক।
কথাটা বলা শেষ না হতেই ত্রয়ীকে আচমকা কোলে তুলে নিলো স্নিগ্ধ। ত্রয়ী বললো, আরে আরে এখনই কেন নিলে? তোমাকে সালাম করতে হবে তো।
- আরে লাগবে না। তুমি আজীবন আমার কোলেই থাকবে।
- যাও আমার কিন্তু লজ্জা করছে।
- বাব্বাহ! এত লজ্জা কেন হুম?
- লজ্জা ভাঙিয়ে দিয়েছো কখনও?
স্নিগ্ধ চোখ বড়বড় করে বললো, কি বললা? এক্ষুণি লজ্জা ভাংতেছি দাড়াও।
ত্রয়ী লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে বললো, তুমি এমন কেন? আমার লজ্জা করেনা এভাবে বললে?
স্নিগ্ধ ত্রয়ীকে কোলে নিয়ে বিছানার উপর এসে বসলো। ত্রয়ী স্নিগ্ধর গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে নানান কথা বলতে লাগলো৷ নিজের কষ্টভরা জীবনের নানান ঘটনা বলে যেতে লাগল।
স্নিগ্ধ বাঁধা দিলোনা। কিন্তু ত্রয়ীর ছলছল চোখ দেখে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, মেয়েটা কাঁদছো কেন? আজকেই লাস্ট কিন্তু। আজকের পর থেকে আর কক্ষনো তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেবোনা। আজকেই তোমার সমস্ত কান্নারা বিদায় নেবে।
- সত্যিই স্নিগ্ধ। তোমাকে পেয়ে আমার নিজেকে পরিপূর্ণ মনেহচ্ছে।
- আমারও। আমিও তোমাকে ছাড়া অপূর্ণ ত্রয়ী।
- আচ্ছা স্নিগ্ধ, যদি আমি তোমাকে না পেতাম তাহলে বাকি জীবনটাও আমার এত যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই কাটত তাইনা?
- আমি তোমাকে হারাতে দিতাম না ত্রয়ী। তুমি শুধু আমার এটা ভূলে যেওনা। আর তোমাকে একা ছেড়েও দিতাম না কখনও।
ত্রয়ী কিছু বললো না। অপলকভাবে তাকিয়েই রইলো স্নিগ্ধর দিকে। ছেলেটার চোখে মায়া আছে। অনেক বেশি মায়া। মায়াবী চোখের ছেলে খুব কম হয়, তার মধ্যে স্নিগ্ধ একজন। সত্যিই খুব ভাগ্যবতী মনেহচ্ছে নিজেকে।
স্নিগ্ধ বললো, আচ্ছা ত্রয়ী একটা কথা বলবা?
- হুম বলো।
- প্রথমদিন তুমি জানা নেই শোনা নেই, ওভাবে আমার সাথে গেলে কেন? আর কেনই বা রিমঝিম সাজলে আমার কাছে?
- আমি রিমঝিম সাজিনি মোটেও। আপনি ই আমাকে দেখে চিনতে পারেননি জনাব।
- না চেনাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার তো বলা দরকার ছিলো তাইনা?
-না বলে ভালই করেছি। বললে তো আর প্রেমটা হতোনা, আর বিয়ে তো দূরের কথা।
হাসলো স্নিগ্ধ। ত্রয়ীও শব্দ করে হাসলো। কি ভূলের মধ্য দিয়েই না দুজনের পরিচয়টা হয়েছিলো!বাসর রাতের মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। এইযে দুজন মানুষ সবসময় এত কাছাকাছি থেকেছে তবুও আজ রাতে একজনের আরেকজনকে বড্ড অচেনা মনেহচ্ছে। ঠিক একইভাবে খুব আপনও মনেহচ্ছে। একইসাথে দু ধরণের অনুভূতি কাজ করছে। একজন আরেকজনকে দেখে বারবার মুগ্ধ হচ্ছে। চোখ, ঠোঁট, দৃষ্টি, সবকিছুর মধ্যেই খুজে পাচ্ছে ভালোলাগা। ব্যাপার এমন যে, যত দেখি, দেখার সাধ কখনো মিটবে না। আজীবন দেখতেই ইচ্ছে করছে। এ ভালোবাসায় মিশে আছে কত অনাবিল সুখ, সমৃদ্ধি, আশা, স্বপ্ন আরো কত কি…
ত্রয়ী বললো, আমি ভাবতেও পারিনি বাবা নিজে গিয়ে আমাকে ছেলের বউ করে আনবেন। সত্যিই তুমি অসাধ্য সাধন করে ফেলেছো একেবারে।
- হুম এখন তোমার কাজ হবে মা বাবার কাছে তাদের আরেকটা মেয়ে হয়ে ওঠা। আমি আশাকরি তুমি সেটা পারবে।
স্নিগ্ধ’র বাহু শক্ত করে চেপে ধরে ত্রয়ী ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইলো।
ভালোবাসার যে এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সেটা সত্যি প্রমাণ করে দিলো ত্রয়ী। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বাবা মায়ের চোখের মণি হয়ে উঠলো। প্রত্যেকটা কাজে তাদেরকে সহায়তা করা, রান্নার কাজে সাহায্য করা, বাবার কাজ কর্মে একটু আধটু হিসেব নিকেশ করা, স্নিগ্ধ ও স্নিগ্ধার ঠিকমতো খেয়াল রাখা সবকিছুই করলো নিজের সমস্ত সত্তা দিয়ে। বাবা মাকে আপন করে নেয়ার কারণে তারাও আর আপন না হয়ে কোথায় যায়? এমন একটা মেয়েকে ভূল বোঝার জন্য বাবা নিজেই নিজেকে রাগ দেখান মাঝেমাঝে। মেয়েটার প্রতি ভালোবাসাটা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে আর এক স্বর্গীয় সুখের বন্ধনে বেঁধে ফেলছে সবাইকে।
- নীলাভ্র নেহাল