পর্বঃ ৯
ফিয়োনাকে দেখতে আসবে ব্যাপার টা এখনো সহজভাবে নিতে পারছে না ফাহমি। মেয়েটাকে বাচ্চা বাচ্চা লাগত, বাচ্চাদের মত দেখতে ও। কিন্তু আজ শাড়ি পড়াতে বয়স টাও যেন লাফ দিয়ে বেড়ে গেছে, আর চেহারার মাধুর্যতাও টুপ করেই তরুণী রূপ ধারণ করেছে। সে যাই হোক, ফিয়োনার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এটা নিয়ে ফাহমির এত মাথাব্যথা হচ্ছে কেন কে জানে। নিজেই খুঁজে পাচ্ছে না এর উত্তর। এ জন্যই বোধহয় বলে, পুরুষ মানুষ বড় হয়েও বড় হতে পারে না। এদের কিছু জিনিস বোঝার ক্ষমতাটা নাবালক ই থেকে যায়।
ফাহমি ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করে চিরকুট খুঁজতে লাগল। কোনো উত্তর এসেছে কিনা সেটা দেখার জন্য। কিন্তু হতাশ হলো। চিঠির কোনো উত্তর আসে নি। ফাহমি ভেবেছিল এটা ফিয়োনার হাতের লেখা হবে। সেটা আজকে প্রমাণ করে দেখতেও চেয়েছিল। কিন্তু পাত্রপক্ষ এসেই সব গুবলেট করে দিলো। মেয়েটা যদি ফাহমিকে ভালোই বাসতো তাহলে পাত্রপক্ষ কে দেখে এত খুশি হওয়ার কোনো কারণই ছিলো না। এই ভেবে ফাহমি নিশ্চিত হলো যে এই চিরকুট ফিয়োনার নয়। হয়তো আশেপাশের ছাদ থেকে কেউ লক্ষ করে কিংবা ফিয়োনার কাজিন…
এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগছে না ফাহমির। ও রুমে এসে একটা বই নিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চোখে ঘুম লেগে এসেছিল এমন সময় কারো ধাক্কায় ঘুম ভেংগে গেলো। চোখ মেলে দেখলো মুখের উপর উপুড় হয়ে আছে ফিয়োনা। ফিয়োনা খিলখিল করে হাসছে। সেই হাসির শব্দ ঝংকার করছে ফাহমির কানে। ফাহমি চোখ বড়বড় করে বললো, কি? তুমি এখানে?
- মিষ্টি এনেছি। আপনার জন্য।
বলেই দাঁত বের করে হাসলো ফিয়োনা। ফিয়োনার হাসির কারণ বুঝতে পারছে না ফাহমি। অবাক হয়ে জানতে চাইল, হাসছো কেন? কিসের মিষ্টি? - আমার বিয়ের।
- মানে!
এক লাফে বিছানার উপর উঠে বসল ফাহমি। চোখেমুখে উৎকন্ঠা নিয়ে বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মত উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে বলল, তোমার কি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
- এখনো শিওর নই, তবে মেয়বি হয়ে যাবে।
- মেয়বি?
- হুম। কারণ আমি অপছন্দ হওয়ার মত মেয়েই নই। আই থিংক পাত্রপক্ষ আমাকে ভীষণ পছন্দ করেছে।
- নিজের উপর এত ওভার কনফিডেন্স কেন আপনার বলুন তো? কারণটা কি?
ফিয়োনা হাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতেই প্যাকেট থেকে মিষ্টি বের করে ফাহমির মুখের সামনেই নিজের মুখে পুরে দিলো। মিষ্টি খেতে খেতে বলল, ইয়াম্মি। আর যাই হোক পাত্রপক্ষ রুচিশীল আছে। ভালো মিষ্টি এনেছে। নরমালি পাত্রীর বাসায় কেউ ভালো মিষ্টি আনে না। হা হা হা।
ফিয়োনার আনন্দ দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে ফাহমি। চোখেমুখে হাজারো প্রশ্ন। কৌতুহলী মনে ঘুরপাক খাচ্ছে নানান রংয়ের প্রশ্ন। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস কুলোচ্ছে না। নাই বা জানা হলো কিছু। যদি বিয়ে করে মেয়েটা সুখীই হয়, হোক না। কিছু কিছু ঘটনায় না চাইলেও খুশি হতে হয়। যেমন বিয়ের সংবাদে। ফাহমি খুশি হওয়ার ভান করে বলল, দোয়া করি বিয়েটা হয়ে যাক।
- অবশ্যই। নিন মিষ্টি খান।
- ওরা কি চলে গেছে?
- তাছাড়া? আপনার কি মনেহয় পাত্রপক্ষ কে ঘরে বসিয়ে রেখে আপনার সাথে দেখা করতে আসবো? আপনি কি আমার হয় ফ্রেন্ড নাকি? হা হা হা।
আবারো হাসি ফিয়োনার। ফাহমি আজকে বিভ্রান্ত হচ্ছে বারবার।
ফিয়োনা বলল, মিষ্টি ভালো লাগছে না?
- হ্যাঁ ভালো।
ফাহমি মিষ্টি খাচ্ছে। ফিয়োনা বিছানায় বসে পা ঝুলিয়ে মিষ্টি খাচ্ছে আর পা নাচাচ্ছে। ফাহমি কথা বলছে না, চুপচাপ। বিয়ের ব্যাপারে কোনো মেয়ের উত্তেজনা দেখার সুযোগ কখনো হয়নি ওর। এই প্রথম বার দেখছে বলে বেশ উত্তেজিত বোধ করছে। সেইসাথে অবাকও হচ্ছে বেশ।
ফিয়োনা বললো, জানেন আমার না বরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। অনেক রকমের ইচ্ছা। এই ধরুন প্রতিদিন রাতে দুজনে মিলে অনেক্ষণ গল্প করবো। সে যত টেনশনেই থাকুক, রাতে গল্প করতেই হবে। প্রয়োজনে তার সমস্ত টেনশন আমার সাথে শেয়ার করবে। আমি আমার স্বপ্নের কথা বলবো।
- তাই? আর কি কি ইচ্ছা আছে শুনি?
- আমার ইচ্ছা করে বরকে নিয়ে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে। কেমন হবে বলুন তো?
- হুম। খুব সুন্দর হবে।
- একবার ভাবুন। দুজন মানুষ, সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছি। শিরশিরে হাওয়ায় আমার চুল উড়ছে। হাত ধরাধরি করে হাঁটছি দুজনে।
ফাহমি কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেলো। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে ফিয়োনা একটা আসমানী রংয়ের শাড়ি পড়েছে। লম্বা আঁচল উড়িয়ে হেঁটে চলেছে সমুদ্র ধরে। ফাহমি দৌড়ে এসে ফিয়োনার হাত ধরে ফেললো। তারপর দুজনে হাঁটতে লাগলো একসাথে। ফাহমির কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়ালো ফিয়োনা। দুজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের দিকে।
ফিয়োনা একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, কি ভাবছেন?
চমকে উঠলো ফাহমি। ফিয়োনার কথা শুনে ফিয়োনাকে নিয়েই স্বপ্নের রাজ্যে ঢুকে গিয়েছিলো। মাথা ঝাড়া দিয়ে ফাহমি বলল, ভাবছি আমিও আমার বউকে নিয়ে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটবো।
কথাটা বলার পরপর ই কেমন অন্যরকম একটা ফিলিংস এসে ভর করল ফাহমির মনে। যা আগে কখনো হয়নি। বউ আর কল্পনার ফিয়োনা, দুটো মিলে একজন হয়ে গেছে। ফিয়োনাকে দেখেছে কল্পনায়, আর বলে ফেলেছে বউ। তারমানে কি মনটা ফিয়োনাকেই ভাবতে শুরু করেছে? আপনমনেই নিজেকে প্রশ্ন করলো ফাহমি। উত্তর খুঁজে পেলো না।
ফিয়োনা হাসিমুখে বলল, কবে যে বিয়ে হবে!
- তোমার বিয়ে করার অনেক শখ তাই না?
- বারে শখ থাকবে না? বিয়ে হবে ভেবে কত মেয়ে কত কিছু ভেবে ভেবে ঘুমাতে যায়।
- তুমিও যাও?
- হ্যাঁ। আমিও প্রতিদিন রাতে কতকিছু ভাবি। রাতে সেসব স্বপ্নেও দেখি। কত রোমাঞ্চকর কিছু মুহুর্ত, অন্যরকম ফিলিংস।
- তুমি রোমাঞ্চ নিয়েও ভাবো?
শব্দ করে হেসে উঠলো ফিয়োনা। আর হা করে তাকিয়ে আছে ফাহমি।
ফিয়োনা উত্তর দিলো, যেটা অনিবার্য সেটা নিয়ে ভাবতে দোষ কোথায়? সবই ভাবি। আলাদা করে রোমাঞ্চ বললেন কেন?
- না। আমি কখনো ভাবতে পারি না তো তাই।
- আপনিও ভাব্বেন। দেখবেন শান্তি শান্তি লাগছে।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ। ইচ্ছে করবে কাউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে। কানের কাছে ফিসফিস করে গল্প করতে।
- ইচ্ছে করলে কি করবো তখন?
- বিয়ে করে ফেলবেন। হা হা হা…
আবারো হেসে উঠলো ফিয়োনা। হাসতেই লাগলো, হাসতেই লাগলো। ফাহমি হতবাক। কি বলে এই ছোট্ট মেয়েটা? অবশ্য এখন ওকে একটুও ছোট মেয়ের মত লাগছে না। ফিয়োনা এখনো শাড়ি পড়ে আছে সেটা খেয়াল করেনি ফাহমি। এবার খেয়াল করে বলল, শাড়িতে তোমাকে সুন্দর লাগছে ফিয়োনা।
- থ্যাংকস। শাড়িতে সব মেয়েকেই সুন্দর লাগে। একটা ছন্দ বলবো?
- হ্যাঁ বলো।
- মেয়েদের প্রিয় শাড়ি আর ছেলেদের প্রিয় শাড়ি পড়া নারী। হা হা হা..
আবারো হাসি ফিয়োনা। অবাক হয়ে যাচ্ছে ফাহমি। এই মেয়ে এত হাসছে কেন? বিয়ে হবে বলে আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। কি অদ্ভুত!
ফিয়োনা আরো একটা মিষ্টি খেয়ে মিষ্টির প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে বলল, খাবেন তো? নাকি আমি নিয়ে যাবো?
- নিয়ে যাও।
- কেন? আমার বিয়ের মিষ্টি খেতে কষ্ট হবে নাকি?
- কষ্ট হবে কেন?
- হা হা, মজা করলাম। মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হবে এই ভয়ে যদি কষ্ট হয়? হা হা হা।
ফিয়োনা হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালো। মিষ্টির প্যাকেট সাথে নিয়ে গেল। দরজার কাছে গিয়ে বলল, আসি তাহলে। শুভ রাত্রি।
চলে গেল ফিয়োনা। রেখে গেল এক রাশ হাসির ঝংকার। হাসির শব্দ ধ্বনিত হতে লাগলো দেয়ালে দেয়ালে। মুখরিত হয়ে বাজতে লাগল ফাহমির কানে।
ফাহমি বাইরে গিয়ে হোটেলে খাবার খেয়ে ফিরে এলো। বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুম আসছিল না। ঘুম না এলে ফিয়োনার দেয়া বুদ্ধিটা খাটানো যায়। ফাহমি ভাবতে লাগল কারো হাত ধরে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটার সেই মুহুর্ত। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ,কল্পনায় কোনো অবাস্তব মেয়েকে নিয়ে ভাবতেই পারছে না সে। ভাবনাতে শুধু ফিয়োনাই ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন? যতবার ভাবছে ততবার ই শুধু ফিয়োনা আসছে। চোখ বন্ধ করলে ফিয়োনার ছবি চোখে ভাসে। বিছানার পাশ ফিরলে ফিয়োনার চেহারা ভেসে ওঠে। ইচ্ছে করে কাউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে। কিন্তু অন্য কারো ছবি মোটেও ভেসে ওঠে না, ফিয়োনা ছাড়া। অবাক হলেও ভাবনা এড়াতে পারলো না ফাহমি।
পরদিন
সারাদিনের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরলো ফাহমি। সিঁড়িতে দেখা হলো ফিয়োনার সাথে। ফিয়োনা বলল, আজকে আর পড়াতে আসতে হবে না। বাসায় থাকবো না আমি। এক জায়গায় যাবো।
- কোথায়?
- এক বান্ধবীর জন্মদিন কাল। রাতে ওর বাসায় থাকবো, পার্টি হবে। খুব মজা হবে।
- হুম। ঠিক আছে।
- ওকে কি বই উপহার দিলে ভালো হবে বলুন তো?
- সাতকাহন।
- ওকে থ্যাংক ইউ। রাতে ঘুমাতে পেরেছিলেন তো?
- মানে?
ফাহমি ফিয়োনার চোখের দিকে তাকালো। তাকিয়ে খেই হারালো। মেয়েটার চোখ ভয়ংকর। তাকিয়ে থাকা যায় না। আজকে আরো ভয়ংকর লাগছে। ফাহমির বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ করতে আরম্ভ করেছে। ফিয়োনা হা হা করে হাসতে হাসতে নেমে গেলো। উপরে উঠে এলো ফাহমি। সারাদিন কাজের চাপে থেকে এসব মাথায় আসেনি। এখন ফিয়োনার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার কেমন যেন লাগছে। অস্থির অস্থির লাগতে শুরু করেছে। একটা অন্যরকম অস্থিরতা।
ফাহমি আবারও বাইরে বেরিয়ে গেলো। ভালোই বুঝতে পারলো আজও রাতে ঘুম হবে না। তাই আজকের রাতটা বন্ধুর বাসায় কাটাতে চলে গেলো। বন্ধুর রুমে বসে আড্ডা দেয়ার সময় পাশের রুম থেকে হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছিলো। ফাহমি জানতে চাইল কিসের শব্দ এত?
ওর বন্ধু তোফায়েল বলল, তোরসার কিছু বান্ধবী এসেছে। ওরা সবাই হাসাহাসি করছে।
তোরসা তোফায়েলের বোনের নাম। ফাহমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ও আচ্ছা।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ পাশের রুম থেকে ভেসে আসা একটা কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয়ে গেলো ফাহমি। বুকের ভেতর ঢং করে উঠলো। সেই হাসির ঝংকার। তারমানে ফিয়োনা এই বাড়িতেই এসেছে!
ফাহমি তোফায়েলকে বলল, তোর বোনের কি কাল জন্মদিন?
- হ্যাঁ। তাই ওরা বান্ধবীরা মিলে সেলিব্রেট করছে। তুই কিভাবে জানলি?
ফাহমি উত্তর দিলো না। ওর অস্থির লাগছে, ভীষণ রকম অস্থিরতা।
পর্ব ১০
ফাহমি অস্থিরতা কাটানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলে বেরিয়ে আসার সময় তোফায়েল জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছিস?
- আয় তো একটু। তোরসার রুমে যাবো।
তোফায়েল অবাক হয়ে গেছে। তবুও বন্ধুর সাথে তব্দা খেয়ে হাঁটতে লাগলো। ফাহমি পাশের রুমের দরজায় ধাক্কা দিলো। দরজা খুলে দিলো তোরসা। ফাহমিকে দেখে অবাক হয়ে বলল, আরে ভাইয়া তুমি! হোয়াট এ প্লেসেন্ট সারপ্রাইজ! কেমন আছো ভাইয়া? - ভালো। তুমি?
তোরসার সাথে কথা বললেও ফাহমির চোখ ফিয়োনাকে খুঁজছে। এক পলক দেখে অস্থির মনটাকে শান্ত করতে চায় ফাহমি। ফিয়োনা তো ফাহমিকে দেখেই অবাক। তোরসার সাথে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কে রে তোরসা? - আমার ভাইয়ার বন্ধু। ফাহমি ভাইয়া, ভাইয়া ভেতরে আসুন না।
ফাহমি ভেতরে প্রবেশ করলো। ফিয়োনা কিছু বললো না। ফাহমি কিছু বলে কিনা সেটার অপেক্ষা করতে লাগলো। ফাহমিও নিজে থেকে কিছু বলল না। ফিয়োনার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে তোফায়েলকে নিয়ে ওর রুমে চলে আসলো। আসার সময় তোরসা বলে দিলো, ভাইয়া আমরা বারোটার পরপরই কেক কাটবো। তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে।
ফাহমি কোনো উত্তর দেয় নি। মনটা কিছুটা শান্ত হয়েছে। কিন্তু বন্ধু তোফায়েল ভ্যাবাগঙ্গারামের মত তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে ওই রুমে আবার চলে আসার কারণ বুঝতে পারলো না ও। তাই কৌতুহল দমাতে না পেরে বলেই বসলো, ওই রুমে কেন গেছিলি রে?
- ওই মেয়েটাকে আমি পড়াই।
- কাকে?
- ফিয়োনা। আমাদের বাড়িওয়ালার মেয়ে।
- সিরিয়াসলি? শুধু পড়াস নাকি অন্যকিছু? বাড়িওয়ালার মেয়ে বলে কথা।
- না অন্যকিছু নয়। শুধু পড়াই।
- ওহ। অন্যকিছু যদি নাই হবে, এভাবে হঠাৎ ছুটে গেলি কেন? নিশ্চয় ভয়েস শুনে গিয়েছিলি? নাকি আগে থেকেই জানতিস ও আমাদের বাসায় আসবে?
- না রে জানতাম না। এটা জাস্ট একটা কোইন্সিডেন্ট। হঠাৎ ফিয়োনার গলা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কনফিউজড হয়ে গেছিলাম। তাই দেখে শিওর হলাম ওটা ফিয়োনা।
- তাহলে মেয়েটার সাথে কথা বললি না কেন?
- ওর বান্ধবী রা আবার নানান প্রশ্ন করবে ওকে। তাই আর কথা বাড়াই নি।
তোফায়েল আর কিছু জানতে চাইলো না। কৌতুহলী হয়ে ফাহমির দিকে চেয়ে রইল ও। মুখে যাই হলুক, ফাহমির চোখ তো বলছে অন্য কথা। ফিয়োনার কথা বলতে বলতে চোখ মুখ সমস্তটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল! কে জানে ভেতরে ভেতরে কিছু চলছে কিনা। তবে বন্ধু যেটুকু বলেছে সেটুকু জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইলো তোফায়েল। নিজে থেকে আর কোনো প্রশ্ন করলো না।
ফাহমি আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে। ভাবনা এড়িয়ে বন্ধুর সাথে গল্পে মেতে উঠলো।
এদিকে ফিয়োনা ওর বান্ধবীদেরকে বলল, এই শোন না, এটা সেই ছেলেটা।
সবাই অবাক হয়ে বললো, তোর ফাহমি? স্টিল হ্যান্ডসাম ইয়ার।
বান্ধবীরা মশকরা শুরু করে দিলো। আজকেই কলেজে সবাইকে ফাহমির কথা বলেছে ফিয়োনা। ফাহমি ওকে পড়ায়, ছেলেটা অনেক ভালো, বেশ ভালো লাগে ওকে ইত্যাদি। বান্ধবী রা শুনেই তো ওর বাসায় গিয়ে ফাহমিকে দেখার বায়না ধরেছিল। ফিয়োনা বলেছিল দুদিন পর নিয়ে যাবে। আজকেই সেই যুবকের দর্শন পেয়ে সবাই মহা খুশি। মোটকথা, বান্ধবীর ভালো লাগার ছেলেকে দেখতে পাওয়াটা বিশাল আনন্দের। অনেক কৌতুহল থাকে এ ব্যাপারে। ফিয়োনাকে ঘিরে ধরে সবাই ফাহমির ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন করতে লাগলো।
তোফায়েল তোরসাকে ডেকে বলল ওদের দুই বন্ধুর জন্য রুমে ডিনার পাঠিয়ে দিতে। তোরসা আচ্ছা বলে চলে গেলো। রুমে গিয়ে বান্ধবী দের জিজ্ঞেস করলো ,আচ্ছা ফাহমি ভাইয়ার সাথে এক টেবিলে বসে খেতে তোদের আপত্তি নেই তো?
বান্ধবীরা ভাবলো এতে ফিয়োনারই ভালো হবে। আর বান্ধবীকে হেল্প করার জন্য এইটুকু তো ওরা করতেই পারে। সবাই এক যোগে বলল, কোনো আপত্তি নেই।
তোরসা ভাইয়ার রুমে এসে বলল, সবাই একসাথে বসে খেতে কি সমস্যা হবে ভাইয়া? রুমে একা একা খাবি কেন তোরা? আমার বান্ধবীরা সহ আম্মু মিলে সবাই একসাথে খাই?
তোফায়েল কিছু বলার আগেই ফাহমি বলল, আমার কোনো সমস্যা নেই।
ফাহমির দিকে তাকিয়ে হেসে তোফায়েল বলল, আচ্ছা টেবিলে ই দে।
টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। তোরসার বান্ধবীরা সবাই খেতে বসে গেছে। খাবারে হাত দিয়ে সবাই অপেক্ষা করছিল ফাহমির জন্য। ফাহমি ও তোফায়েল ফোন টিপতে টিপতে খাবার টেবিলে আসলো। ফিয়োনা ফাহমিকে ফোন টিপতে দেখে মনে মনে বিরক্ত হলো। ফোনে কার সাথে চ্যাটিং করছে সেটা ভাবতে লাগলো ও।
ফাহমির জন্য ফিয়োনার সামনের চেয়ারটা ফাঁকা রেখেছে ওরা। ফাহমি চেয়ারে বসে গেলো। খাবার খেতে শুরু করে চুপচাপ খাচ্ছিল দুই বন্ধু। ফিয়োনার একটা বান্ধবী ফিয়োনাকে ইশারা করে হেসে উঠলো। বাকিরাও হেসে উঠলো একসাথে । ফাহমি হাসির কারণ বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।
একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা ফাহমি ভাইয়া আপনি নাকি সুন্দর গান জানেন?
ফাহমি ফিয়োনার দিকে তাকালো। ফিয়োনা তাহলে বলে দিয়েছে সব?
ফাহমি বলল, হুম একটু আধটু জানি।
- একটু আধটু না ভাইয়া। আপনি অনেক সুন্দর গাইতে পারে। তোফায়েল ভাইয়ার তো গিটার আছে। কেক কাটার পর গান শোনাবেন তো?
ফিয়োনা বাদে সব মেয়ে একসাথে বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ শোনাতে হবে অবশ্যই শোনাতে হবে।
ফাহমি ফিয়োনার দিকে তাকালো। ফিয়োনা ইশারায় বুঝাতে চাইলো, শুনাবেন?
ফাহমি হেসে বললো, আচ্ছা ঠিকাছে শোনাবো।
সবাই হৈ চৈ করে উঠলো। আন্টি বললেন, ফাহমি এখন কোথায় থাকো?
ফাহমি বাসার ঠিকানা না বলে হুট করে বলে ফেললো, ফিয়োনাদের বাসায় আন্টি।
সবাই খাওয়া বন্ধ করে তাকালো। ফাহমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, না মানে ফিয়োনাদের বাসায় ভাড়া থাকি। আমি জানতাম না ফিয়োনা তোরসার বন্ধু। আজকে এখানে এসে হঠাৎ ওকে দেখে অবাক হয়ে গেছি আরকি।
আন্টি মাথা ঝাঁকালেন। বান্ধবীদের দল মুচকি মুচকি হাসছে। যেন কত মজার কথা বলে ফেলেছে ফাহমি। এভাবে হাসি আনন্দে খাওয়া দাওয়া শেষ করলো ওরা। খাবার খাওয়ার পর ফাহমিরা নিজেদের রুমে চলে এলো। ফিয়োনার সাথে কয়েকবার চোখাচোখি হওয়ার বাইরে আর কোনো কথা হয়নি।
তোফায়েলের সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ জোরে চিৎকার শোনা গেলো, হ্যাপি বার্থডে তোরসা…
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বারোটা এক বাজে। তোফায়েল বলল, আমি ওকে উইশ করে আসি দোস্ত। তুইও চল।
ফাহমি ইতস্তত করে উঠে দাঁড়ালো।
দরজা খোলাই ছিলো। তোরসা ভাইয়ার উইশ পেয়ে খুশিতে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলো। ফাহমি ফিয়োনার দিকে তাকানো মাত্রই চমকালো। এর মধ্যেই ফিয়োনার গেট আপ চেঞ্জ! জামাকাপড় বদলে একটা গাউন পড়েছে। মেকাপ দিয়ে সুন্দর করে সেজেছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বারবি ডল। ফাহমি অনেক্ষণ চোখ সরাতে পারলো না।
তোরসা ফাহমিকে বলল, ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন?
- হ্যাপি বার্থডে তোরসা।
- থ্যাংক ইউ ভাইয়া। প্লিজ এখানে এসে দাঁড়ান। সবাই মিলে একটা ছবি তোলা হবে তারপর কেক কাটবো।
ফাহমির পাশে ওরা ফিয়োনাকে দাড় করিয়ে দিলো। তোরসার মা এসে দাঁড়ালেন তোরসা পাশে। তোরসার বাবা নেই। ভাই তোফায়েলকে আরেক পাশে নিয়ে কেক কাটলো তোরসা। সবার মুখে আনন্দ হাসি। তোরসা একে একে সবাইকে কেক খাইয়ে দিলো। ফাহমিকেও খাইয়ে দিলো। ফিয়োনা তোরসাকে কেক খাইয়ে দেয়ার পর ফাহমির দিকে তাকালো। ফাহমি চোখ সরিয়ে নিলো পলকেই।
কেক কাটার পর আন্টি নিজের রুমে চলে গেলেন। বান্ধবীরা মিলে মেতে উঠেছে সেলফির তালে। ফাহমি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দোস্ত আমরা চলে যাই।
ওর তড়িঘড়ি করে মোবাইল লুকিয়ে রেখে বলল, না না হবে না। গান শোনাতে হবে।
তোরসা দৌড়ে গিয়ে গিটার এনে দিলো। অগত্যা ফাহমিকে গান ধরতেই হলো।
ফাহমি গান গেয়ে উঠলো,
যখন নিঝুম রাতে..
সবকিছু চুপ..
নিষ্প্রাণ নগরীতে ঝিঁঝিঁরাও ঘুমমম..
আমি চাঁদের আলো হয়ে, তোমার কালো ঘরে,
জেগে রই সারা নিশি..
এতটা ভালোবাসি…
এতটা ভালোবাসি…
সবাই মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে ফাহমির। ফিয়োনা তো হা করে তাকিয়ে আছে। গানের সুরে হারিয়ে গিয়েছে সবাই। ফাহমি মন খুলে গাইছে। গান শেষ করার পর সবাই আরো গান শোনানোর রিকুয়েষ্ট করলো। ফাহমি বাধ্য হয়ে আবার গান ধরলো।
গান চলল রাত একটা পর্যন্ত। ফিয়োনার বান্ধবী রাও গান শোনালো আজকে। ফিয়োনা নিজেও একটা গান শুনিয়েছে। এরপর ফাহমি ও তোফায়েল নিজের রুমে চলে এলো। অনেক মজা হয়েছে সে কথা বলতে লাগলো দুজন মিলে। ফাহমির কাছে তো এটা রীতিমতো সারপ্রাইজ ছিলো। ও তো আশাই করেনি এখানে ফিয়োনাকে দেখতে পাবে। সেখানে ফিয়োনার গানও শোনা হলো।
তোফায়েল হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, বন্ধু তুই কি মেয়েটাকে পছন্দ করিস?
- তেমন কিছু না রে।
- তাহলে? তোর চোখ মুখ তো অন্য কথা বলে দোস্ত।
- জানিস আমার ওর সাথে সবসময় থাকতে ইচ্ছে করছে। এই যে ওকে রেখে এখানে চলে আসলাম, আমার ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে ওর সাথেই বসে আড্ডা দেই।
- এটাই তো প্রেম দোস্ত।
- না। প্রেম না। আমি প্রেমে পড়ি নি।
- তাহলে প্রেম তোর উপরে পড়েছে।
- কি যে বলিস।
- দাড়া, তোর সাথে মেয়েটার কথা বলার ব্যবস্থা করি। দ্যাখ তো কেমন ফিল হয়।
- থাক না। অযথা ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার?
- ঝামেলা নয় ইয়ার, আই থিংক তোদের মাঝে কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু ছোটবোনের বান্ধবী। ওখানে যাওয়াটাও ঠিক দেখায় না।
ফাহমি কিংবা তোফায়েল কাউকেই যেতে হলো না। একেই বলে সোনায় সোহাগা। তোরসা এসে বলল, ফাহমি ভাইয়া ফিয়োনা ডাকছে।
ফিয়োনার কথা শুনলে তোফায়েল কিছু বলবে না এটা ভেবেই তোরসা এ কথা বলেছে। এদিকে ফিয়োনা ভুল করেও ফাহমিকে ডাকে নি। তোরসা ফাহমিকে বেলকুনিতে দাঁড়াতে বলে রুমে চলে গেলো। ফিয়োনাকে নিয়ে এসে বেলকুনিতে রেখে বলল, দাড়া আমি আসছি।
ফিয়োনা তো অবাক। সামনে তাকিয়ে দেখে আবছা অন্ধকারে ফাহমি দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করে উঠলো ফিয়োনার। বলল, আপনি এখানে!
- তুমি নাকি আমাকে ডেকেছো?
- আমি! আমি কখন ডাকলাম?
- এখন। তোরসা তো তাই বলে আমাকে নিয়ে আসলো।
ফিয়োনা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, সে কি। আমি তো আপনাকে ডাকিনি। বিশ্বাস করুন? প্লিজ মাইন্ড করবেন না। আমি আপনাকে আসতে বলিনি।
- মাইন্ড করিনি। ওরা হয়তো ফাজলামো করছে। আমাদেরকে নিয়ে উল্টা পাল্টা ভাবছে না তো?
- সেটা তো আমি জানিনা। বাড়িওয়ালার মেয়ে হলে এটাই একটা প্রবলেম। বান্ধবী রা যদি শুনেছে ভাড়াটে একটা ছেলে, তাহলেই হয়েছে।
- তারমানে এর আগেও কোনো ছেলের সাথে…
- ছি ছি এরকম ভাব্বেন না প্লিজ। আমি মোটেও এরকম ভেবে বলিনি। আসলে এটা তো কমন তাই…
- বুঝেছি বুঝেছি।
- ভুল বুঝেছেন। আমি তাহলে যাই।
ফিয়োনা অভিমান করে চলে যাচ্ছিল। ফাহমি আচমকা হাত টেনে ধরলো।
পর্ব ১১
ফাহমি আচমকা ফিয়োনার হাত টেনে ধরলো। চকিতে ফিরে তাকালো ফিয়োনা। ও দারুণভাবে চমকেছে। অবাক হয়ে ফাহমির চোখের দিকে তাকাল। দূর থেকে আলো এসে পড়েছে ফিয়োনার মুখে। সেই আলোয় ফাহমি দেখলো ফিয়োনার কৌতুহলী ও ভয়ার্ত দুটো চোখ। চোখে কত তৃষ্ণা, প্রতীক্ষা আর প্রশ্ন। ফাহমির চোখের দিকে তাকিয়ে ফিয়োনাও খেই হারালো। এ চোখের দিকে চেয়ে একটা জীবন পার করে দেয়া যাবে। চোখ তো নয়, যেন অগ্নি। বুকের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। দুজনই একই রকম ভাবে দুজনের চোখের কথা ভাবছে। ফাহমি নির্দ্বিধায় হাত চেপে ধরে আছে আর ফিয়োনা ফাহমির কাজে অবাক হয়ে থরথর করে কাঁপছে।
ফাহমি বলল- কোথায় যাচ্ছো?
- চলে যাচ্ছি।
- এত অভিমান?
- স্বাভাবিক নয় কি?
- হাত ধরে কি অপরাধ করেছি?
- যদি বলি করেছেন?
- তাহলে হাত ছেড়ে দেবো।
- আর যদি বলি অপরাধ হয়নি?
- তাহলে আরো কিছুক্ষণ ধরে রাখতে চাইবো।
ফিয়োনা কেঁপে উঠলো। ফাহমি কি বলছে এসব! ওর কথাগুলো তো শরীরে শিহরণ তুলে দিচ্ছে। এ কেমন অনুভূতি হচ্ছে বুঝতে পারছে না ফিয়োনা। পা কাঁপছে তো কাঁপছেই।
ফাহমি বলল- এভাবে কাঁপছো কেন?
- সেটা নিজেকে প্রশ্ন করুন।
- নিজেকে প্রশ্ন করলে কি উত্তর পাবো?
- আমাকে করলে অন্তত উত্তর পাবেন না। আমি এর উত্তর দিতে পারবো না।
- কেন পারবে না? কাঁপছো কেন সে তো কেবল তুমি ই বলতে পারবে।
- আপনার হয়ত পা কাঁপছে না কিন্তু বুকের ভেতর টা কি কাঁপছে না?
- সেটা তো অনেক আগ থেকেই কাঁপন ধরে গেছে।
- তাহলে কেন প্রশ্ন করছেন?
- কাঁপুনি থামাবো কিভাবে?
- যেভাবে থামতে চায়।
ফাহমি আচমকা আরো কাছে টেনে নিলো ফিয়োনাকে। একেবারে বুকের কাছাকাছি। ফিয়োনার শ্বাস বেড়ে গেলো। পা আরো জোরে কাঁপছে। বুকের ভেতর শুধু ধুকপুক ধুকপুক করছে।
কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। দুজনেই স্তব্ধ। শুধু ফিয়নার শরীরটা কাঁপছে।
ফিয়োনা কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু গলা দিয়ে কথা বের হলো না। ফাহমি বলল, তুমি বড় হয়ে গেলে খুব দ্রুত।
- আমি বড়ই ছিলাম। আপনি আমাকে ছোট ভাবতেন।
- হয়তো বা।
- এখনো কি ভাবছেন?
- তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে ফিয়োনা।
- আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি।
- এখন কি ভাবছি জানো না?
- না তো।
ফাহমি ফিয়োনার চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বলল- ভাবছি তুমি পূর্ণযৌবনা তরুণী।
লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো ফিয়োনা। এরচেয়ে লজ্জাকর আবার মধুর বাক্য বোধ হয় কখনো শোনেনি ও। ওর বুকের ভেতর ধুকপুকুনিটা ক্রমশও বেড়েই চলেছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না। ফাহমিও নিজেকে সামলাতে পারছে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে সম্বিৎ ফিরে পেলো ফিয়োনার কথায়। ফিয়োনা বলল- হাতটা আস্তে ধরুন, আমার লাগছে।
ফাহমি ফিয়োনার হাত ছেড়ে দিলো। ফিয়োনা বলল- ছেড়ে দিতে বলেছিলাম?
- না। ধরতেও তো বলোনি।
- বলতে হবে?
- না বললে ধরবো কিভাবে হুম?
- ছি, আপনি লোকটা ফাজিল।
- অন্যকিছু তো ধরতে চাইনি। ফাজিল কেন বললা?
- যাহ দুষ্টু লোক। আমি গেলাম।
ফিয়োনার লজ্জায় লাল হতে হতে ছুটে চলে গেলো। ফাহমি বেলকুনিতেই বসে পড়লো চুপ হয়ে। ইস কেমন যেন লাগছে। এই অনুভূতির কোনো নাম হয় না।
ফিয়োনা ছুটে এসে বাথরুমে ঢুকলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে অনেক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো। রাতটা ওর কাছে স্বপ্নের মত লাগছে। এটা স্বপ্ন ছিলো না তো? কি জানি স্বপ্ন হলে হবে। কিন্তু এই ভালোলাগার রেশ যেন থেকেই যায়। উফফ কি যে ভালো লাগছে। মনে সুখের দোলা লাগতে শুরু করেছে।
কিছুক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে ফিয়োনা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। এরপর মুখ ধুয়ে রুমে চলে গেলো। ওর বান্ধবী রা ছুটে এসে ঘিরে ধরলো ওকে। কি কি হলো সেটা শোনার আগ্রহ সবার চোখেমুখে। ফিয়োনা হাসতে হাসতে বলল- দাড়া একটু সময় দে। তারপর বলছি।
সারা রাত বান্ধবী রা মিলে গল্প করেই কাটালো। এদিকে ফাহমি বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছে। ঘুমাতে পারছে না। ওর বন্ধু বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। প্রসঙ্গ বদলে দুই বন্ধু মিলে গল্প করতে লাগলো। এভাবে ভোর হয়ে গেলো। ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়লো দুই বন্ধু।
ফিয়োনা আর ওর বান্ধবী রা সকালের নাস্তা সেরে কলেজে চলে গেলো। সকালে ফাহমির সাথে দেখা হলে কিভাবে কথা বলবে কিংবা দাড়িয়ে থাকতেই লজ্জা পাবে সেসব ভাবছিল ফিয়োনা। তোরসা জানালো ভাইয়া এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি, দরজা লাগানো।
হাফ ছেড়ে বাঁচলো ফিয়োনা। তবুও নাস্তার টেবিলে বসে বুক ধুকধুক করছিল আবার কখন ফাহমি চলে আসবে এই ভেবে। ফিয়োনার অস্থিরতা শুধু বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু আজ আর ফাহমির সাথে দেখা হলো না।
ওরা কলেজে চলে গেলে ঘুম ভাংল ফাহমির। রাতের কথা ভেবে কেমন রোমান্টিক ফিল হচ্ছিল। ফিয়োনার সাথে দেখা হবে এই ভেবে বাইরের বেসিনে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসলো ফাহমি। কিন্তু ফিয়োনার সাথে দেখা হলো না। রুম ফাঁকা দেখে বুঝতে পারলো ওরা চলে গেছে।
বন্ধুর সাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফাহমিও নিজের কাজে চলে গেলো।
ফাহমি আজ বাসায় ফিরলো তারাতাড়ি। সন্ধ্যার পরপরই পড়াতে গেলো ফিয়োনাকে। ফিয়োনা রুমে শুয়ে ছিলো। যখন মা ডেকে বলল, ফিয়ো ফাহমি পড়াতে এসেছে।
ফিয়োনার হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠলো। তারাতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে এসে একটা সুন্দর স্যালোয়ার কামিজ পড়লো। হালকা করে সাজগোছ ও করলো। তারপর দরজা খুলে দিয়ে ফাহমিকে আসতে বললো।
ফাহমি রুমে ঢুকে চেয়ারে গিয়ে বসলো। ফিয়োনা মাথা নিচু করে রেখেছে। আজকে ফাহমির চোখের দিকে তো দূরের কথা, মাথা তুলে তাকানোর সাহস ই নেই ওর। পড়ার টেবিলে বসে চুপ করে রইলো।
ফাহমি একটা বই নিয়ে জিজ্ঞেস করলো- কোন অধ্যায় পড়বে আজ?
- চতুর্থ।
- আচ্ছা বের করো।
ফিয়োনা নিঃশব্দে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। আন্টি এসে নাস্তা দিয়ে গেলেন। ফাহমি একটা বিস্কুট নিয়ে কামড় দিয়ে বলল- তোমার হাতের চা খাবো। এক কাপ চা করে আনতে বললে কি আন্টি রাগ করবে? - এটা আমার হাতের চা। আমিই বানিয়েছিলাম আপনার জন্য।
ফাহমি মুচকি হাসলো। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল- ভালো হয়েছে তো। ইদানীং ভালো চা বানাও তুমি। - থ্যাংকস।
- তুমি চা খেয়েছো?
- না।
- সেকি? নাও এখান থেকে খাও।
ফাহমি নিজের খাওয়া চায়ের কাপটাই এগিয়ে দিলো ফিয়োনার দিকে। ফিয়োনা অবাক হতে কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা নিলো। খুব সতর্ক ছিলো আবার যেন চায়ের কাপ পড়ে না যায়। ফাহমির খাওয়া চা খাচ্ছে এটা ভেবে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলো ফিয়োনা।
ফাহমি জিজ্ঞেস করলো- পাত্রপক্ষ কি জানিয়েছে?
- সেটার ব্যাপারে এত আগ্রহ কেন?
- আগ্রহ নয়, এমনি জানতে চাইলাম।
- বিয়ে ফাইনাল হয়েছে শুনলে বোধহয় খুশি হবেন?
- না।
- তাহলে খুশি হোন। আমি মাকে বলেছি পাত্রকে আমার পছন্দ হয়নি।
- মা বলেনি যে ছেলেদের আবার পছন্দ অপছন্দের কি আছে?
- না। আমার মা এরকম নয় যে এটা বলবে। তাছাড়া বিয়ের এখনো অনেক সময় আছে। এত তারাতাড়ি বিয়ে করার তো কোনো দরকার নেই।
- তুমি কিন্তু কাল বলেছিলে পাত্রপক্ষ কে হাতছাড়া করতে চাও না। ভালো পাত্র বলে কথা।
- এরচেয়ে ভালো পাত্র থাকতে…
ফাহমি ভ্রু কুঁচকে ফিয়োনার দিকে তাকালো। ফিয়োনা এক পলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। কিন্তু সেই এক পলকের মাঝে যেন কত কি লুকিয়ে আছে। ফাহমির ভালো লাগছে, আনন্দ হচ্ছে, সুখ হচ্ছে। আর ফিয়োনার যন্ত্রণা হচ্ছে, ভালোলাগার যন্ত্রণা।
পড়া শেষ করে ফাহমি বলল- আজ অনেক্ষণ পড়ালাম। এখন উঠি..
- বসুন না কিছুক্ষণ গল্প করি।
- রাতে ছাদে আসবে?
- যেতে পারি যদি কেউ অনুনয় করে।
- অনুনয় করতে পারবো না। কারো ইচ্ছা করলে আসুক, ইচ্ছা না করলে না আসুক।
ফিয়োনা চুপ রইলো। ফাহমি উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। দরজার কাছে গিয়ে আরেকবার তাকালো ফিয়োনার দিকে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই লুকিয়ে ছিলো শত ভালোলাগার অনুভূতি।
রাত ক্রমশ বাড়তে লাগলো। ফিয়োনা ছাদে এলো না। ফাহমি অনেক্ষণ পায়চারি করতে করতে ফিয়োনার জন্য অপেক্ষা করলো। দরজা খোলাই রাখলো যাতে ফিয়োনা আসলে বুঝতে পারে। কিন্তু ফিয়োনার দেখা মিললো না আজকে। কি আর করার। রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে অনেক রাতে ঘুমিয়ে পড়লো ফাহমি।
ঘুম ভেংগে গেলো দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে। ফাহমি হন্তদন্ত হয়ে এসে দরজা খুললো। ফিয়োনা দাঁড়িয়ে আছে। ও বলল- গুড মর্নিং।
- এত সকালে উঠেছো যে?
- ভোরেই ঘুম ভেংগে গেছে। আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না।
- আহারে। রাতে ঘুম ভালো হয়েছিলো?
- সেটা কি আপনার জানা নেই?
- হুম।
ফিয়োনা বলল- আসলে আমি যখন আসার জন্য বের হবো তখনই মা এসে বলল কই যাচ্ছিস? ছাদে যাওয়ার কথা শুনে রেগে বলল, এখন আর আগের মত নেই। ছাদে একটা ছেলে ভাড়া থাকে। তোর জন্য ছেলেটা কি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতেও পারবে না নাকি?
- আমি কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যে ই আছি।
- মায়ের বকা দেয়াটা তো স্বাভাবিক। তাই আর আসার নাম করিনি। যাইহোক, ঘুম হয়নি?
- সেটা তো তোমার ভালো জানার কথা।
- হুমমম। আজকে কোথাও যাবেন?
- কোচিংয়ে ক্লাস আছে বিকেলে। সকালে কোনো কাজ নেই।
- চলুন না আজকে বাইরে একসাথে লাঞ্চ করি।
- শিওর?
- শিওর না হয়ে বলি?
ফাহমি একটু ভেবে বললো- ওকে। ফোনে জানিয়ে দিও কোথায় থাকতে হবে।
ফাহমি ওর ফোনটা এগিয়ে দিলো ফিয়োনার দিকে। ফিয়োনা ফাহমির ফোনে নিজের ফোন নাম্বার তুলে কল দিলো নিজের নাম্বারে। ফোন নাম্বার টা নেয়া হলো এই আনন্দে ওর লাফাতে ইচ্ছে করছিলো। হাসি দিয়ে নিচে নেমে এলো ফিয়োনা। বেশিক্ষণ থাকলে আবার মা সন্দেহ করবে। দুপুরে তো দেখা হবেই। চলে যাওয়ার সময় একবার পিছন ফিরে তাকালো ফিয়োনা। সেই চাহনিতে ফাহমি এক অন্যরকম মায়া খুঁজে পেলো। প্রশান্তিতে ভরে গেলো বুকটা।
পর্ব ১২
দুপুরে খুব তারাতাড়ি রেস্টুরেন্টে এসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ফিয়োনা। খুব সিম্পল সাজে এসেছে ও। মাঝে মাঝে সাধারণ সাজের ও প্রয়োজন আছে। নয়তো প্রিয়জনরা বুঝবে কি করে অপর মানুষ টা সত্যিই সুন্দর?
ফিয়োনা বসে বসে কি যেন ভাবছিলো। এমন সময় ফাহমি চলে আসলো। ফিয়োনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো ফাহমি। ফিয়োনা ফাহমিকে বসতে বললো।
ফাহমি ফিয়োনার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, কখন এসেছো?
- কিছুক্ষণ আগে।
- বসে বসে কি ভাবছিলে?
- এই যে আমাদের পরিচয়টা কত অদ্ভুত ভাবে হয়েছিলো সেটা। আমি তো আপনাকে সহ্যই করতে পারতাম না। দেখলেই রাগে গা জ্বলে যেতো।
- হা হা হা। এখন জ্বলে না?
- এখনও জ্বলে। আগে জ্বলত আর ভাবতাম লোকটা চলে যায় না কেন? আর এখন জ্বললে ভাবি…
- কি ভাবো?
- না কিছু না।
লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো ফিয়োনা। ফাহমি কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, এখন ভাবো মানুষ টা কাছে আসে না কেন?
ফিয়োনা ফাহমির চোখের দিকে তাকালো। লজ্জায় মরে যাওয়ার মত অবস্থা। মুখ তুলে তাকিয়ে থাকার মত অবস্থায় নেই। ও দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। ছেলেটা দুষ্টু আছে। অবশ্য ছেলেরা দুষ্টু না হলে ভালো লাগে না। তাই বলে এভাবে মুখের উপর বলে দিলে তো লজ্জার আর কিছু বাকি থাকবে না।
ফাহমি বলল- এত লাজ কেন কন্যা?
- এভাবে কেউ বলে?
- আমি বলি।
- মানে কি? আরো কতজনকে এভাবে বলেছেন আপনি?
- আমার সুন্দরী স্টুডেন্টস দেরকে তো এভাবেই পটাই।
মুহুর্তেই ফিয়োনার চোখে সমুদ্রের জলের মত ঢেউ চলে এলো। দ্রুত মুখে নেমে এলো অন্ধকার। যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। ফাহমি তারাতাড়ি হাতদুটো ফিয়োনার থুতনির নিচে ধরলো। ফিয়োনা বলল, কি?
- চোখের জল পড়লে আবার গা ভিজে যাবে। তাই হাত দিয়ে রাখি যাতে জল পড়ে জামা না ভিজে। পড়লে আমার হাতেই পড়ুক।
ফিয়োনা ফাহমির হাত খামচে ধরে বলল- কি ফাজিল আপনি। এত দুষ্টু কেন শুনি? - তুমি কি বিশ্বাস করেছিলে কথাটা?
- আমি আপনার সব কথাই বিশ্বাস করি।
- উহুম। সব কথা অন্ধের মত বিশ্বাস করা ঠিক না। ফাজলামো আর সত্যতার মাঝে পার্থক্য তো বুঝতে হবে তাই না?
ফিয়োনা চুপ করে রইলো। ফাহমি খাবারের মেনু দেখতে দেখতে জানতে চাইলো, কি অর্ডার করবো?
- আপনার পছন্দমতো করুন।
- নাহ, তুমি করো।
- আমি আরেকদিন করবো।
- আমি পছন্দ করলে কি আমাকেই বিল দিতে হবে? হা হা হা।
- ফাজিল। ঠিকাছে বিল আমি দিবো আপনি খান।
- বাহ, এরকম মেয়ে প্রতিটা ঘরে ঘরে হওয়া দরকার।
- যে জামাকাপড়ে বিলাই চিমটি লাগিয়ে দিবে তাই না?
- হা হা হা। ও হো হো হো।
ফাহমি শব্দ করে হাসতেই লাগলো। ফিয়োনা মুগ্ধ হয়ে ওর হাসির দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ফাহমির হাসির শব্দ শুনে রেস্টুরেন্টের বাকি লোকজন ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। পাবলিক প্লেসে এভাবে লোকজন কাউকে হাসতে দেখে না। ফিয়োনা বলল, আপনাকে হাসলে তো সুন্দর লাগে।
- আমাকে সবসময় ই সুন্দর লাগে মিস।
- হুম সেটা ঠিক। ছাত্রীরা প্রেমে পড়ে না?
- পড়ে তো। মোক্ষম উদাহরণ হচ্ছেন আপনি।
কথাটা বলে আবারও সহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠলো ফাহমি। লোকজন আবারও তাকাচ্ছে। মানুষ এমনই একটা জীব যারা অন্যের হাসি দেখলে নিজেরা না হেসে থাকতে পারে না। লোকজনও অনেকে হেসে উঠলো।
ফিয়োনা বলল- এত ফাজিল লোককে নিয়ে কোন মেয়ে সংসার করবে কিভাবে করবে তাই ভাবছি।
- নিজে বোধহয় ফাজিলটাকে হাতছাড়া করে অন্য কারো হাতে পাঠাবে?
ফিয়োনা কি বলবে বুঝতে পারলো না। লজ্জা, ভালোলাগা সবকিছু ঘিরে ধরলো ওকে। ও বলল- আপনি লোকটা মহা বদমাশ।
- ছি এমন কথা বলে না। কেউ শুনে ফেললে পুলিশ ডাকবে। হা হা হা।
- হয়েছে এবার খাবার অর্ডার করি?
ফাহমি খাবার অর্ডার করলো। খাবার চলে আসা পর্যন্ত দুজনে হাসি তামাশায় ব্যস্ত রইলো। ওয়েটার খাবার দিতে এসে বলল, স্যার আপনারা বোধহয় এই শহরের সবচেয়ে হ্যাপি কাপল।
ফিয়োনা লাজুক মুখে ফাহমির দিকে তাকালো। ফাহমির চোখের মায়ায় ডুবে গেল মুহুর্তেই। ফাহমি এমনভাবে তাকালো যে ওদের এভাবে তাকাতে দেখে ওয়েটার প্রর্যন্ত লজ্জা পেয়ে চলে গেলো।
ফাহমি মুচকি হেসে খাবার মুখে দিলো। ফিয়োনা খাবার তুলে দিলো ফাহমির মুখে। দুজনেই একটা জিনিস ফিল করছে, গভীরভাবে ফিল করছে। সেটা হচ্ছে- ভালোলাগা। অন্যরকম একটা ভালোলাগার অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে দুজনের ভেতরটা। আনন্দ, ভালোলাগা, তৃপ্তি, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু ঘিরে রইলো ওদের দুজনকে। একইসাথে দুজনেই একই জিনিস ফিল করছে। ফিয়োনা ভাবছে, এই মানুষ টাকে সবসময় পাশে চাই ই চাই। মানুষ টাকে ছাড়া যেন একটা দিনও চলবে না। একটা মুহুর্ত ও তাকে ছাড়া ভাবা যায় না।
ফাহমি বলল- কি ভাবছো?
- কিছু না।
- মিথ্যে বললে কেন? কিছু একটা তো ভাবছিলে শিওর।
- তেমন কিছু না।
- তেমন কিছু না টাই শুনবো। বলো তো।
- ভাবছি আপনাকে ছাড়া একটা দিনও আমি কাটাবো কি করে?
ফিয়োনার কণ্ঠের আবেগমাখা কথায় ডুবে গেলো ফাহমি। কথাটা শোনার পর নিজেও ইমোশনাল হয়ে পড়লো। ভাবতে লাগলো সত্যিই মেয়েটা তাহলে ওকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। আসলে কিভাবে এত দ্রুত দুজনের মাঝে এমন আত্মার বন্ধন গড়ে উঠলো দুজনের একজনও টের পায়নি। ধীরে ধীরে সম্পর্কটা এগিয়ে যাচ্ছে।
ফিয়োনা বলল- আপনি বাসায় ফেরেন কয়টায়?
- কাজ না থাকলে তারাতাড়ি ফিরি। আমার কোচিংয়ে ক্লাস থাকে বিকেলে। কোনোদিন সন্ধ্যায়। যেদিন বিকেলে থাকে ওইদিন তারাতাড়ি ফিরি।
- চাকরি বাকরি খুঁজছেন?
- খুঁজছি তো অবশ্যই। পড়াশোনা শেষ করে কেউ কি বেকার থাকতে চায়?
- আপনি তো বেকার নন।
- তবুও। এই সামান্য ইনকামে কি আর সংসার চলে?
- সংসার?
- এমনি বললাম আরকি। এখন তো বড় হয়েছি। পরিবারের দায়িত্ব কাধে নিতে হবে। বাবা মা আর কতদিন চালাবে বলো। যদিও টিউশনি থেকে ওদেরকে কিছু টাকা দেই। শপিং করে দেই। তবুও..
- বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছেন না?
- আপাতত ভাবছি না। আগে একটা ভালো চাকরি হোক। ভেবেছিলাম বিয়ের ব্যাপারটা বাবা মায়ের উপর ছেড়ে দিবো।
ফিয়োনার বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠলো। ফাহমির বাবা মায়ের যদি ওকে পছন্দ না হয়? তখন কি হবে? সম্পর্কটাকে ফাহমি আদৌ কি সিরিয়াস ভাবে নেবে? যদি না নেয়, তখন কি হবে?
ফাহমি ফিয়োনার চোখে ভয় দেখতে পেলো। হারানোর ভয় কিংবা অন্যকিছু ।কিন্তু ফাহমির হৃদয়ে এমনভাবে দোলা লাগলো যে নিজেই কোথায় হারিয়ে গেলো। কোনো মেয়ের চোখে নিজের জন্য ভয় দেখতে পাওয়াটা প্রত্যেকটা ছেলের জন্য সৌভাগ্যের। ফাহমিরও এর ব্যতিক্রম হলো না।
ফাহমি বলল- একটা প্রশ্ন করি?
- হ্যাঁ শিওর।
- কখনো কাউকে ভালোবেসেছিলে কিনা জানতে চাইবো না। তবে কেউ কষ্ট দিয়েছিলো?
- হঠাৎ এই প্রশ্ন?
- এমনিই জানতে ইচ্ছে হলো। কারো কাছ থেকে কষ্ট পেয়েছিলে?
ফিয়োনা বলল- হুম। একটা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। অনেক ভালো বন্ধুত্ব ছিলো আমাদের। আমরা সবই শেয়ার করতাম, একজন আরেকজনের অনেক কেয়ার করতাম। হঠাৎ ও একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে আমাকে এভোয়েড করতে শুরু করে। তখন অনেক কেঁদেছিলাম। হোক না ফ্রেন্ড, তবুও আত্মার অংশ হয়ে গিয়েছিলো তো। হারানোর কষ্টটা নিতে পারিনি।
- হুম।
ফিয়োনা বললো- আপনি পেয়েছেন? - কি যে বলো। এতগুলো বছর পার করে এসেছি, কষ্ট পাবো না? একজনকে প্রচন্ড পরিমানে ভালোবাসতাম। কিন্তু বিনিময়ে পেয়েছি লজ্জা আর লজ্জা। যাকে এতটা ভালবেসেছি সে প্রতারণা করেছে প্রত্যেকটা মুহুর্ত। থাক
ওসব কথা। এসব বলে আমাদের সুন্দর সময়টাকে নষ্ট করতে চাই না। - সে কি এখনো আপনার মনে আছে?
- না। এই হেইট হার।
- ভালোবাসার মানুষকে কি ঘৃণা করা যায়?
- ভালোবাসার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কাউকে ভালোবাসলে তাকে ঘৃণা করা যায়। ঘৃণাটা আপনা আপনি চলে আসে। কিংবা ভালোবাসাটাই ঘৃণায় পরিনত হয়ে যায়।
ফিয়োনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ফাহমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বলল- যাক ওসব। খাবার কেমন লাগছে সেটা বলো? টেস্টি না?
- হুম অনেক টেস্টি।
- তাহলে আরেকদিন খাওয়াই যায় কি বলো?
- অবশ্যই।
- আগামী শুক্রবার?
- শুক্রবারে তো বের হওয়াটা ঝামেলার। আম্মুকে কি বলবো?
- তাহলে রবিবার।
- আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কি মাঝে মাঝে ফোন করতে পারি?
- উমমম, পারো।
- মাইন্ড করবেন না। পড়াশোনার ব্যাপারে জানার জন্য আরকি।
- আমাকে শেখাতে এসো না মিস ফিয়োনা।
ফিয়োনা হেসে ফেললো।
খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ালো দুজনে। ফাহমি বিল দিয়ে দিলো। ফিয়োনা দেয়ার জন্য জেদ করছিল কিন্তু ফাহমি শুনলো না। বেরিয়ে এসে দুজনে একসাথে রিক্সায় করে গল্প করতে করতে বাসার দিকে ফিরছিল। ফিয়োনা বলল, জানেন আমার খুব ইচ্ছে ছিলো রিক্সায় কারো সাথে বসে শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখি।
- কারো সাথে?
- হ্যাঁ। অবশ্যই প্রিয় কারো সাথে।
- আমি কি তাদের মধ্যে পড়ি?
- তাদের মানে? আমার গাদা গাদা প্রিয় মানুষ নেই।
- ওকে। আমি প্রিয় হই বা না হই। একটা দিন রিক্সায় করে শহরটা ঘুরতেই পারি।
- শিওর?
- হুম। হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর।
ফিয়োনা খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল- ওকে। তাহলে কবে বলুন তো?
- রবিবারেই হোক না। সারাদিন ঘুরবো ফাকে একবার লাঞ্চ করে নেবো। রবিবার আমার ক্লাস নেই।
- আচ্ছা ঠিকাছে। এ কথাই রইলো।
বাসার সামনে পৌছানোর আগেই ফাহমি রিক্সা থেকে নেমে গেলো। ফিয়োনাকে বলল বাসায় চলে যেতে। ফিয়োনা রিক্সা নিয়ে চলে এলো বাসায়। ফাহমির আগেই নেমে যাওয়ার ব্যাপারটা দারুণ লেগেছে ওর কাছে।
আজ মনটা অনেক ফুরফুরে। ফাহমি পড়াতে এলো সন্ধ্যার পরপরই। ফিয়োনা চা বানিয়ে অপেক্ষা করছিলো কখন ফাহমি আসবে সেই অপেক্ষায়। ফাহমি আসার পর ও চা ও নুডুলস নিয়ে আসলো। নুডুলস দেখিয়ে বলল- আমি রান্না করেছি।
- ওয়াও! দেখতেই ডিলিশাস লাগছে।
- খেয়ে দেখুন না কেমন বানিয়েছি।
- হুম খাচ্ছি। রাখো।
ফাহমি নুডুলস তুলে আগে ফিয়োনাকে খাইয়ে দিলো। তারপর ফিয়োনা ফাহমিকে খাইয়ে দিলো। ফাহমি খাওয়া শেষ করে বলল- পড়ার সময় কোনো দুষ্টুমি নয় ওকে? পরীক্ষা সামনে।
ফিয়োনা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। পড়াশোনার অনেক চাপ এখন। ও বই খুলে পড়তে শুরু করলো। ফাহমি একটা চ্যাপ্টার ভালো করে বুঝিয়ে দিলো ওকে। তারপর বলল কিভাবে ভালো রেজাল্ট করা যাবে। ভালো ভাবে পড়াশোনা করার জন্য মনোযোগী হতে বললো ফিয়োনাকে। ফিয়োনা ফাহমির কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। তারপর মাথা ঝাকিয়ে বলল- আচ্ছা এখন থেকে মন দিয়ে পড়বো।
ফাহমি অন্য একটা বই নিয়ে একটা চ্যাপ্টার বের করলো। সেটা ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়ে কিছু হোম ওয়ার্কস দিলো। অন্য একটা সাবজেক্ট থেকেও অনেকগুলো পড়া কমপ্লিট করতে দিলো। ফিয়োনা বলল- আজ এতগুলো পড়া?
- জ্বি ম্যাম। এখন থেকে এতগুলো করেই পড়তে হবে। সামনে পরীক্ষা এটা যেন মাথায় থাকে।
- আচ্ছা। আপনি আমার দিকে খেয়াল রাখলেই হবে।
- খেয়াল তো রাখতেই চাই। কিন্তু সামনে তো সমস্যা রে পাগলী।
- কি সমস্যা?
ফাহমি চিন্তিত মুখে বলল- আমি একটা বাসা দেখে এডভান্স দিয়ে এসেছিলাম। বলেছিলাম আগামী মাসেই উঠবো। আজকে গিয়ে বললাম এই বাসা ছাড়বো না। আপনার বাসায় উঠতে পারবো না। আমি একমাসের ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। উনি কিছুতেই মানলেন না। বললেন অন্তত তিনমাস থাকতে হবে। চিলেকোঠার একটা রুমের জন্য এরকম আচরণ আমি ঠিক নিতে পারছি না।
ফিয়োনা অবাক হয়ে বলল- আপনি আর আমাদের বাসায় থাকবেন না?
- আমি তোমাকে প্রমিস করেছিলাম আগামী মাসেই চলে যাবো।
- তাই বলে সত্যি চলে যাবেন?
- কথা দিলে কথা রাখতে হবে না?
- কিন্তু.. আপনি থেকে যান না প্লিজ। আপনি চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে।
- ভেবে দেখি কি করা যায়। ওই বাসায় উঠতেই হবে এরকম হলে প্রয়োজনে তিনমাসের ভাড়াই দিয়ে দিবো। তোমাকে ছেড়ে যেতে আমারও তো ইচ্ছে করছে না।
এমন সময় দরজা খুলে রুমে আন্টি প্রবেশ করলেন। ফিয়োনার মুখ শুকিয়ে গেলো ভয়ে। মা আবার শুনে ফেলেনি তো কিছু!