পর্ব- ১: রাশেদাবানুর বাড়িতে আজ ভীষণ আনন্দের দিন। তার একমাত্র মেয়ে ঝিলমিলকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। পুরো বাড়িতে সাজসাজ রব, ঘরের প্রতিটা কোণা যেন ঝলমল করছে। রাশেদাবানুর তত্ত্বাবধানে বাড়ির সকলে ফুলবাবু সেজে ঘোরাঘুরি করছে। বাড়ি গমগম করছে আত্নীয় স্বজনে। ঘরের ই লোকজন সকলে- প্রতিবেশী কয়েকজন, রাশেদাবানুর স্বামী আনোয়ার মিয়া, ঝিলমিলের বড় ভাই-ভাবী, তাদের তিন বছরের ছোট্ট ছেলে ফাগুন আর আনোয়ার মিয়ার বোনঝি মোহনা।
তের বছর বয়সে গাড়ি এক্সিডেন্টে মা-বাবাকে হারায় মোহনা, সেই থেকে এ বাড়িতে মামা মামীর কাছেই আশ্রিতা। মাথায় তুলে ভাগ্নিকে নিজের কাছে নিয়ে এলেও, আদর করে রাখতে পারেননি আনোয়ার মিয়া। মধ্যবিত্ত পরিবারে বাড়তি একটি মুখের যোগানে রাশেদাবানু মোটেও সুখী হননি। সমাজের ভয়ে আর মোহনার আগ্রহে বাড়ির পাশের সরকারি স্কুলে মোহনাকে ভর্তি করে দিলেও, পরদিন ই ঘরের কাজের লোকটিকে ছাড়িয়ে দেন রাশেদাবানু। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির সব কাজের দায়িত্ব এসে পরে মোহনার ঘাড়ে। ঝিলমিলের নিত্য নতুন খাবারের আবদার, তমালের অফিসের টিফিন, ছোট্ট ফাগুনের দেখাশোনা, বাড়িঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া- এইরকম হাজার কাজের মাঝখানে পরে প্রথম প্রথম খুব অসহায় লাগত মোহনার। মা বাবার আদরের মেয়েটা কোনোদিন কি ভেবেছিল একদিনের ব্যবধানে একবাড়ি লোকের দায়িত্ব এসে জুটবে ওর ঘাড়ে?
প্রায় প্রতিদিনই গভীর রাতে ঘুম ভেঙে কাদতো মোহনা, একেক সময় মনে হতো সব ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে সময় ওর পাশে বন্ধুর মত হাত বাড়িয়েছিল ঝিলমিল। মায়ের মতিগতি বেশ বুঝে গিয়েছিল ঝিলমিল। মোহনার মা বাবা বেচে থাকতে প্রায় ই ওদের বাসায় বেড়াতে যেতো ঝিলমিল। একদম নিজের বোনের মত সম্পর্ক ছিল দুটিতে। আজ মোহনার এই চরম দুর্দিনে সেসব কি ভুলে যাওয়া যায়? চুপিচুপি নিজের খাবারের অংশ রেখে দিতো সে মোহনার জন্য। মোহনার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে ছিল ঝিলমিল, তাই নিজের বইগুলো সব খুব যত্ন করে ব্যবহার করতো ও, যেন পরের বছর মোহনার কাজে লাগে!
বিকেলে মা ঘুমিয়ে গেলে বারান্দায় বসে মোহনার পড়াগুলো বুঝিয়ে দিত, তারপর ছাদে যেয়ে ঘন্টাখানেক আড্ডা দিত দু’জনে। এভাবেই গড়িয়ে গেছে কয়েকটি বছর, আজ সেই ঝিলমিলের বিয়ের কথাই পাকাপাকি হবার দিন!
সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ততায় সারাদিন কেটেছে মোহনার। এই কয়েক বছরে বেশ রান্নার সুনাম হয়েছে তার। তাই এই বিশাল আয়োজনের প্রায় পুরোটার দায়িত্বই আজ মোহনার ওপর। রান্নাবান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছে,এমন সময় মোহনাকে পেছন থেকে আস্তে গুঁতো দেয় ঝিলমিল, ফিসফিসিয়ে বলে-‘আমার ঘরে একবার আসবি? খুউব দরকারি কথা আছে!’
-‘তুমি যাও, আমি রান্নাটা একদম শেষ করেই আসছি।’
-‘আচ্ছা! আসবি কিন্তু!’ – বলে নিজের ঘরে চলে যায় ঝিলমিল। রান্নাটা গুছিয়ে নিয়েই ঝিলমিলের কাছে যায় মোহনা।
-‘দরজাটা বন্ধ করে এখানে এসে বোস, কথা আছে!’ চটপট বলে ঝিলমিল। তারপর মোহনাকে নিজের পাশে বসিয়ে ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে-
‘ আমার একটা কাজ করে দিবি?’
মোহনা বেশ অবাক হয়। ঝিলমিলকে নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসে সে! ভাল ছাত্রী হিসেবে কলেজে বেশ সুনাম রয়েছে মোহনার। সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে সে এ বছর, ঝিলমিলের সাহায্য না পেলে এতদূর কখনই আসতে পারতো না ও!
-‘বলোনা কী করতে হবে? সব পারব!’ ঘাড় হেলিয়ে বলে মোহনা।
-‘এই বিয়েটা ভেঙে দিবি! কীভাবে, কখন এসবের কিচ্ছু আমি জানিনা, হাজার ভেবেও পাইনি- তাই তোকেই বললাম!’
মোহনা আকাশ থেকে পড়ে, বলছে কী ঝিলমিল! মামার অফিসের মালিকের ছেলের বাড়ি থেকে এ বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলের মা নাকি কবে ঝিলমিলকে অফিসে দেখেছিলেন, সেই থেকেই এই প্রস্তাবের সূচনা। যদিও ছেলের বয়স একটু বেশি, কিন্তু এত বড় বাড়ির প্রস্তাব রাশেদাবানু কি ফেলবেন?
ঝিলমিলকে না জানিয়েই কথা একপ্রকার পাকা করে ফেলেছেন তিনি। শুধু প্রথা রক্ষার্থেই আজকে ছেলের বাড়ি থেকে এ বাড়িতে আসা! আর তাছাড়া, এতদূর আগানোর পর এখন ঝিলমিল যদি সব ভেস্তে দিতে চায়, তবে মামা-ই বা অফিসে মুখ দেখাবেন কি করে! মাথায় যেন বাজ পরে মোহনার। ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করে-
‘কেনো আপু? এই বিয়েতে তোমার মত নেই?’
-‘ তোকে বলিনি মোহনা, আমি একজনকে পছন্দ করি! ছেলেটা খুব ভাল রে, কিন্তু এখনো ছাত্র! আমাদের সাথেই পড়ে। এই বিয়েটা আমি কিছুতেই করতে পারবনা। মা’কে বলেছিলাম কিন্তু মা গলা চেপে ধরে আমাকে বারণ করেছে আর কাউকে একথা বলতে! মা’কে ত তুই চিনিস বোন! এখন তুই আমার শেষ ভরসা!’
মোহনা হাজার ভেবেও কূল কিনারা পায়না কীভাবে কি করবে সে! অনেকক্ষণ ভাবাভাবির পর হালকা হেসে বলে-‘ ঝিলিপু, তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। আজকেই এই বিয়ে ভেঙে দিবো, চিন্তা করোনা! তোমার লাল জামদানি শাড়িটা আমায় দেবে আজকের জন্য?’
ঝিলমিল অবাক হয়, কিন্তু মোহনার বুদ্ধির কথা বেশ ভালমতই জানে ও। এর আগেও প্রচুর ঝামেলার হাত থেকে বেঁচেছে মোহনার বুদ্ধিতে। তাই আর প্রশ্ন না করে আলমারি থেকে লাল শাড়িটা বের করে বাড়িয়ে দেয় মোহনার দিকে। শাড়িটা হাতে নিয়ে মোহনা বলে-‘ আর মামী যদি আমার খোঁজ করে, তো দরজা খুলোনা। চেঁচিয়ে বলে দিও এ ঘরে আমাকে দরকার তোমার, শুধু শুধু যাতে আর না ডাকে। একেবারে তোমার সাথেই বেরোবো এখান থেকে আমি!’
দুপুর গড়াতে না গড়াতেই ধবধবে সাদা দুটি গাড়ি এসে থামে ঝিলমিলদের বাড়ির দরজায়। ছেলেরা এসে গেছে! ব্যস্তসমস্ত হয়ে দরজার দিকে দৌড় দেন আনোয়ার মিয়া, শরবত-মিষ্টির আয়োজনে যান রাশেদাবানু। হালকা আলাপচারিতার পর মেয়েকে নিয়ে আসতে বলেন ছেলের মা। তমালের বউকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ঝিলমিলকে নিয়ে আসতে বলেন রাশেদাবানু, হাতে আলতো চাপ দিয়ে কানে কানে বলে দেন-‘মোহনাকে বারণ করবে এদিকে আসতে! ও মেয়ের যা রুপের ধক, বলা তো যায়না কখন ঝিলুকে বাদ দিয়ে ওই আবাগীর বেটিকেই মনে ধরে যায় ছেলের!’
তমালের বউ তনিমা বেশ জানে শ্বাশুড়ির মতিগতি। কিছুক্ষণ আগেই ঝিলমিলের ঘরে ডেকে নিয়ে সব খুলে বলেছে মোহনা ওকে। ননদ হলেও ঝিলমিল-মোহনার সাথে নিজের বোনের মতই সম্পর্ক তনিমার। তাই খুশিমনেই ওদের পরিকল্পনার ভাগীদার হয়েছে সে।
মিনিটখানিক পরেই আপাদমস্তক লাল শাড়িতে মোড়া ঝিলমিলকে নিয়ে আসে তনিমা। আধহাত ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢাকা ঝিলমিলের, মাথা নিচু করে চেহারার বাকিটুকুও আড়াল করে রেখেছে। ছেলের মা নিজের পাশে নিয়ে বসান ওকে, তারপর ঘোমটা খুলে চিবুকটা উঁচু করে তুলে ধরে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখেন তার হবু পুত্রবধূকে। তনিমা বাদে ঘরের বাকি সকলের ততক্ষণে চক্ষু চড়কগাছ! এ কী? কনের সাজে এ তো মোহনা বসে আছে, ঝিলমিল কই?
রাশেদাবানুর হতভম্ব মুখে কথা ফোটার আগে ছেলের মা খুশিখুশি গলায় বলে ওঠেন-‘ এই তো সে মেয়ে! তোমার সাথেই তো সেদিন অফিসে দেখা হয়েছিলো আমার! এক দেখাতেই ভাল লেগেছিল, আজকে তো তোমায় আরো অনেক সুন্দর লাগছে!’
এবার অবাক হবার পালা ঝিলমিল-মোহনা বাহিনীর! তনিমা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রয়েছে, মোহনা এতক্ষণ প্রচন্ড ভয়ে কাঁপছিলো। এ কথা শোনার পর কেমন অনুভূতিহীন লাগছে ওর। পাশের ঘর থেকে আড়িপেতে সব শুনছিল ঝিলমিল, প্রচন্ড খুশি আর বিস্ময় তাকে একেবারে হতবাক করে দিয়েছে যেন!
এ যেন বজ্রপাতের প্রথম আঘাত কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় আঘাত! এসব কী আবোলতাবোল বলে যাচ্ছেন এই মহিলা! রাশেদাবানু প্রমাদ গোনেন। টুকটাক কাজে কিংবা আনোয়ার মিয়ার টিফিন দিতে প্রায় ই মোহনাকে অফিসে পাঠাতেন তিনি। শেষমেশ ওকেই কীনা তাদের মেয়ে বলে ভুল করলেন অফিসের মালিকের স্ত্রী! এত্ত বড় ঘরে সম্বন্ধ- এ তো শাপে বর হলো মোহনার! এদিকে ‘বিয়ে দেবোনা’ বলে ছেলে পক্ষকে চটানোও যায়না, হাজার হোক অফিসের বড়কর্তা! ওদিকে বিনে পয়সার এমন বিশ্বস্ত ঝি’কে ছাড়তে হবে- রাশেদাবানুর মাথায় রীতিমতো বাজ পরলো যেন!
আনোয়ার মিয়া ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। খানিক ভাবতেই বুঝে গেছেন গলদটা কোথায়। মালিকের স্ত্রী যেদিন এসে বলেছিলেন -‘ আপনার মেয়েটাকে বেশ মনে ধরেছে আমার। আমার একটি মাত্র ছেলের জন্য ওকে দেবেন আনোয়ার সাহেব?’ সেদিন আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করেননি তিনি! আকাশের চাঁদ হাতে পেলে কেই বা প্রশ্ন করতে যায় নির্বোধের মত? মোহনা একদম তার মায়ের মত সুন্দর হয়েছে, অনেকেই আনোয়ার মিয়ার মেয়ে মনে করে ওকে। ইনিও সেই ভুল ই করেছেন। ‘যাক তবু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল! অভাগীর কপালে এবার যদি একটু সুখ মেলে!’ আনোয়ার মিয়া মনে মনে ভাবেন।
-‘তাহলে কথা পাকাপাকি করে ফেলি? কী বলেন?’ আনোয়ার মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন ছেলের মা হোসনে আরা।
আনোয়ার মিয়া কিছু বলার আগেই রাশেদাবানু যেন ফুঁসে ওঠেন-‘ও তো আমাদের মেয়ে ই নয়! কথা পাকার আগে সব ত জানুন! ও এতিম, আমাদের এখানেই থাকে। কাজ-টাজ করে! ঝিলুর বদলে দিব্যি সেজেগুজে এসে বসে আছিস যে মুহি?’
মোহনার চেখে জল চলে আসে বাইরের লোকেদের সামনে মামীর এমন ব্যবহারে। হোসনে আরা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই আনোয়ার মিয়া সব খোলাসা করেন-‘ আসলে রাশেদার সব কথা ঠিক নয়। মুহি মানে মোহনা- আমার আপন বোনের ই মেয়ে। ওর যখন তের বছর বয়েস তখন গাড়ি এক্সিডেন্টে ওর মা বাবা দু’জনেই মারা যায়। মোহনা কিন্তু বড় ঘরের মেয়ে, ওর মা বাবা দু’জনেই ডাক্তার ছিলেন! মোহনার ইচ্ছে সেও ডাক্তার হবে। ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ওকে নিজের কাছে এনেছিলাম আমি,কিন্তু বেচারির কপালে সুখ নেই! দিনরাত কেবল খেটেই চলেছে মামা-মামীর ঘরে। অথচ এর মাঝেই মা আমার সরকারি বৃত্তি পেয়েছে দু’বার! লেখাপড়ায় ভীষণ আগ্রহ ওর, যদি নিজের মেয়ে মনে করে ওকে নিয়ে যেতে চান তো আমি এবার নিশ্চিন্তি হই!’
হাসি ফুটে হোসনে আরার মুখে। স্বামীর মৃত্যুর পর একা হাতে ব্যবসা আর সংসার চালিয়েছেন তিনি। জহুরির চোখ জহর চেনে, তিনিও ঠিক চিনেছেন মোহনাকে। চলন-বলন দিব্যি বলে দেয় ও ভাল ঘরের ই মেয়ে। ভাগ্যের দোষে এতদিন পঙ্কে ডুবে থাকলেও, এই পদ্মকে আজ ই তিনি নিজের ঘরে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করেন।
‘আচ্ছা! তবে ত ভালই হলো। আমাদের ও এই বিয়ের ব্যাপারে একটু তাড়াহুড়ো আছে কীনা, তাহলে আজকেই কাজী ডেকে বিয়েটা পড়ানো হোক। আজই আমি বউকে নিয়ে যাই।’ – হোসনে আরা অভয় দেন আনোয়ার মিয়াকে। রাগে গজগজ করতে করতে জ্বলন্ত লাভার মত ঘর ছাড়েন রাশেদাবানু।
সকলের সম্মতিতে সেদিন বিকেলেই বিয়ে হয়ে যায় মোহনা আর নীলের। নীল- হোসনে আরার একমাত্র ছেলে, যার বিয়েকে ঘিরেই এতকিছু। অথচ, একটিবারের জন্যও মোহনার দিকে মুখ তুলে চায়নি আজ সারাদিন। ঘোমটার ফাঁকে বেশ কয়েকবার মোহনা দেখে নিয়েছে নীলকে, কিন্তু ভারী চশমায় ঢাকা নীলের দুর্বোধ্য চোখজোড়া একবারও মোহনার চোখে ধরা দেয়নি! কে জানে, নীল ও কি ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই বিয়ে করছে তাহলে? এত তাড়াহুড়োই বা কীসের? -মোহনা শঙ্কিত হয় হোসনে আরার তীব্র উচ্ছ্বাসের বিপরীতে নীলের এমন বরফ শীতল আচরণে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। মোহনা তো সেই কবেই কপালপোড়া, এত সুখের আড়ালে কোনো গভীর দুঃখ ঘাপটি মেরে রয়নি তো আবার মোহনার জন্য?
-‘দেখো, তোমাকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না। আর শুধু তোমাকেই বলছি কেনো, বৃষ্টি ছাড়া অন্য কাউকেই বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা আমার কোনোদিন ছিলনা, হবেও না! গত তিন বছর ধরে চেষ্টা করেও মা আমাকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারেননি। কিন্তু দু’ মাস আগে মায়ের গলার টিউমারটা ধরা পরার পর আমি দুর্বল হয়ে যাই। মায়ের শর্ত ছিল আমি বিয়ে করলে তবেই তিনি অপারেশন করাবেন, তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই বিয়েটা করেছি।
পর্ব- ২
আমি এখনো তোমার মুখটাই ভালমত দেখিনি- আশা করি বুঝে গেছো কীরকম অনীহা সত্ত্বেও এই বিয়ে করেছি? তোমাকে সরি বলে অযথা বিড়ম্বনায় ফেলব না, যতদূর জানি মামা-মামীর কাছে খুব আদরে বড় হওনি তুমি। ওখানের চেয়ে এই বাড়িতে বেশ ভালই থাকবে কথা দিচ্ছি। বিনিময়ে যতদিন মা আছেন, শুধু তার সামনে সামান্য অভিনয় করে যেতে হবে তোমাকে। তোমার পড়ালেখার সব দায়িত্ব আমি নিয়েছি, তোমার মামা বারবার বলেছিলেন তোমার নাকি ডাক্তার হবার ইচ্ছে- তার চেষ্টাও আমি করব। তোমার ভবিষ্যতের সবটুকু আমি গড়ে দেবো, সে সামর্থ্য আমার আছে তুমি জানো। শুধু আমার কাছে স্ত্রীর অধিকার চাইতে এসো না!’- এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামে নীল।
মোহনা বুদ্ধিমতী, সারাদিন নীলের নিষ্ক্রিয় ভাব দেখে সে আগেই আঁচ করতে পেরেছিলো কোথাও কিছু একটা ঝামেলা আছে। নীলের কথাগুলো শুনেই যা বোঝার বুঝে গেল সে। কে এই বৃষ্টি, কতদিন ধরে নীলের সাথে তার পরিচয়, কেনই বা ওদের বিয়ে হলোনা-এইসব প্রশ্ন মোহনার মনে ঘুরপাক খেলেও এগুলো জিজ্ঞেস করে অযথা নীলকে বিব্রত করার কোনো ইচ্ছে নেই ওর। সত্যিই তো, মামা-মামীর বাড়ির চেয়ে এখানে অনেক ভালো থাকবে মোহনা। স্বপ্নের রাজকুমার পঙ্খীরাজে চেপে উড়ে এসে পাতালপুরীর রাজকন্যাকে উদ্ধার করেছে- এইতো অনেক!
নতুন দাবী নিয়ে মোহনাও নাহয় যাবেনা নীলের কাছে, যেকটা দিন বাকি আছে হোসনে আরার জীবনে ততদিন একটু অভিনয় করতে সমস্যা নেই মোহনার। এই বাড়ির নিচের তলার লাইব্রেরি ঘরটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওর, কত্ত নতুন নতুন সব বই! দিব্যি ওগুলোতে ডুবে থেকে দিনগুলো কেটে যাবে ওর। জীবনে একজন কাউকে একদম নিজের করে পাবার ইচ্ছে মোহনার ও ছিল, কিন্তু এই ক’বছরে সে জেনে গেছে সবার সব ইচ্ছে পূরণ হয়না! নীলের কথাগুলো তাই ওর মনের কঠিন দেয়ালে আঘাত করে ফেরত যায়, সে দেয়াল ভেঙে ভেতরের নরম হৃদয়টাকে চুরমার করতে পারেনা।
-‘আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরতে পারেন। আমি নিচে শুচ্ছি!’- এতগুলো কথার পর মোহনার কাছ থেকে অন্তত একটা কিছু জবাব পাবার অপেক্ষায় ছিল নীল। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরেও মোহনার কোনো নড়চড় না দেখে হালকা ঝাঁঝালো গলায় বলে সে।
-‘আপনার বাড়িতে আপনি নিচে শোবেন এটা হয়না। আর তাছাড়া, আমার নিচে ঘুমিয়েই অভ্যাস! আপনি বরং খাটেই ঘুমান, আমিই নেমে যাচ্ছি।‘- বিয়ের রাতে স্বামীর প্রতি এই-ই প্রথম কথা মোহনার!
-‘আমার কথাগুলো শুনে যতটা খারাপ কিংবা কাপুরুষ আপনি আমাকে ভেবেছেন, তার প্রেক্ষিতে এটা ভাবতেই পারেন একজন মেয়েকে নিচে ঘুমুতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে খাটে ঘুমাতে পারব। কিন্তু, এতটাও বিবেকহীন আমি নই, মেয়েদের সম্মান আমি দিতে জানি। নিতান্তই যদি জোর করেন, তো আমাদের দু’জনকেই শেষমেশ নিচে শুতে হবে! আর তা যদি না চান তো ভদ্র মেয়ের মত ঘুমিয়ে যান।‘- নীলের সোজাসাপটা উত্তর শুনে এবার প্রথমবারের মত কিছুটা ঘাবড়ে যায় মোহনা।
-‘’বাব্বাহ! এ ছেলে তো মস্ত ঘোড়েল! দিব্যি বউ মানিনা, বিয়ে মানিনা বলছে আবার একত্রে ঘুমানোর ভয় ও দেখাচ্ছে!’- মনেমনে ভাবে মোহনা। তারপর নির্বিবাদে খাটের এক কোণায় ঘুমিয়ে পরে।
বেশ ভোরে ঘুম ভাঙার অভ্যেস মোহনার। পরদিন সকালে সবার আগে উঠে বাড়ির রাঁধুনির থেকে সকালের নাস্তার আয়োজনটা বুঝে নিয়েই নিজেই রান্নায় লেগে পরে। নাস্তাপর্ব শেষ হলে হোসনে আরাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চলে যায় নীল। বিশাল বাড়ির আনাচে কানাচে পরিষ্কারের কাজে লেগে পরেছে কয়েকজন লোক, অনেকদিন পর মোহনা অবসর পেয়েছে! ঝাড়া হাত পা, ঠিক যেন অনেক বছর আগে মা-বাপির কাছে থাকার মত- মোহনা মনে মনে ভাবে। তারপর গুটিগুটি পায়ে নিচের লাইব্রেরি ঘরের ভেতর চলে যায়। প্রায় পুরোটা সকাল বেলা গল্পের বইতে ডুবে ছিলো মোহনা।
ছোটগল্পের একটা আস্ত বই শেষ করে নতুন বই খোঁজা শুরু করবে কিনা ভাবছে আর এলোমেলো হাতে বইগুলো ছুঁয়ে দেখছে। হঠাৎ করেই ওর চোখে পরে এক কোণায় ছোট একটা তালাবিহীন কাঠের বাক্স। কৌতূহল দমন করতে না পেরে বাক্সটা খুলে দেখতে পায় সারিসারি বই রাখা ওটাতে। কয়েকশ বইয়ের ভেতর এগুলো এমন আলাদা করে রাখা কেন- ভাবতে ভাবতে আলগোছে একটা বই হাতে তুলে নেয় ও। জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’। বইটা খুলতেই বহুদিনের পুরানো গন্ধ ওর নাকে ঝাপটা দেয়, পাতা উল্টাতেই চোখে পরে নীল শাড়ি পরা হাস্যোজ্বল একটি মেয়ের ছবি বইটির ভেতর রাখা। ঝুরঝুর করে ঝরে পরে কতগুলো শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাতা, বইটির কোনো এক কোণায় লুকানো ছিল বোধহয়! ছবির পেছনে গোটাগোটা হাতে লিখা- ‘আরেক ফাল্গুনের বৃষ্টি, তোমাকে দিলাম!’ মোহনা বুঝতে পারে, এই মেয়েটিই সেই বৃষ্টি, যার কথা গতকাল নীল বলেছিল। বাকি বইগুলোতেও একই ভাবে এই মেয়েটির অনেকগুলো ছবি খুঁজে পায় মোহনা। শ্যামলা, মিষ্টি দেখতে মেয়েটি, কেমন স্নিগ্ধ চেহারা- দেখলেই বড় মায়া হয়। মোহনার কৌতূহল বেড়ে যায়, এত মিষ্টি মেয়েটিকে কেন বিয়ে করতে পারেনি নীল?
বাড়ির সামনে গাড়ি থামার আওয়াজ পেয়ে দ্রুতহাতে বইগুলো বাক্সবন্দি করে জায়গামতো রেখে দেয় মোহনা। মাকে নিয়ে ফিরে এসেছে নীল। আগামী পরশু হোসনে আরার অপারেশনের তারিখ ঠিক করে এসেছে। একদিনের ভেতর সব গোছগাছ করে নিতে হবে জানতেই দ্রুত কাজে লেগে পরে মোহনা। শ্বাশুড়ির হাতে হাতে সব কাজ এগিয়ে দেয়। রাতে খাবারের পর মোহনাকে নিজের ঘরে ডেকে নেন হোসনে আরা। এ বাড়িতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কীনা, নীল কোনোকিছু বলেছে কীনা- এসব প্রশ্নের পর হঠাৎই বলে বসেন-
‘বৃষ্টির কথা বলেছে কিছু নীল?’
মোহনা চমকে ওঠে। একদম জায়গামতো টান দিলেন যে উনি, এখন? নীল তো বলেছে মা’র সামনে অভিনয় করতে, কিন্তু উনিই যদি সব জানেন তাহলে….
মোহনার চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা দেখে হোসনে আরা অনুমান করে নেন কী বলেছে নীল। নিতান্তই দায়ে পরে ছেলে এ বিয়ে করেছে, তাই এত সহজে মোহনাকে যে নীল মেনে নিতে পারবেনা তা তিনি আগেই আন্দাজ করেছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি, তারপর মৃদু গলায় বলেন-
‘মেয়েটার সাথে প্রায় চার বছরের সম্পর্ক ছিল নীলের। আমাদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল যেয়েই পরিচয় হয় ওদের। আমি প্রথমদিকে জানতাম না, পরে নীল আমাকে সব জানায়। সব শুনে আমি ওকে বলি বৃষ্টিকে আমাদের ঢাকার বাসায় এনে আমার সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে, আমার পছন্দ হলে নীলের বউ করে নেব কথাও দিই। নীলের কথায় মেয়েটি বরিশাল থেকে আসেও আমাদের এই বাসায়, কিন্তু ঘরে ঢোকার পর ওর হাবভাব ভালো লাগেনি আমার। একান্তে কথা বলার ছুতোয় আমার ঘরে নিয়ে আসি ওকে। আমাদের সম্পর্কে কিছু জানতে চায় কীনা জিজ্ঞেস করি।
বারবার আমাদের ব্যবসা, টাকা, সম্পত্তি- এসবের কথাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে বৃষ্টি! ওকে পরীক্ষা করতেই আমি কতগুলো বানোয়াট কথা বলি! বলি যে নীল আমার নিজের সন্তান নয়, এতিমখানা থেকে আমার স্বামী ওকে দত্তক নিয়েছিলেন আমার অমতেই। যেহেতু এখন আমার স্বামী আর বেঁচে নেই, তাই আমার মৃত্যুর পর এই সবকিছু আমি আমার বোনের ছেলেদের দিয়ে যাব। সামান্য একটা অংশ হয়ত নীলের হবে- এই সব কিছু জেনেও কি বৃষ্টি নীলকে বিয়ে করতে রাজি কীনা জিজ্ঞেস করি ওকে। আমার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে বৃষ্টি ঝাঁঝের সাথে বলে -‘তাহলে এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না! আমি এক্ষুণি নীলকে সব জানিয়ে চলে যাচ্ছি।’ – মোহনা স্তব্ধের মত শুনে যাচ্ছে।
একটু বিরতি নেন হোসনে আরা। তারপর আবার বলতে শুরু করেন-
‘আমি ওকে থামাই, বলি নীলকে এখনই কিছু না জানাতে, দু’দিন বাদে আমিই জানাব সব। আমার ছেলেটা খুব সরল, হয়ত এসব বিশ্বাস ই করে বসতো! মেয়েটা প্রচন্ড লোভী, জানো! দাঁত বের করে আমাকে বলে দু’দিনের জন্য কথাগুলো চেপে রাখতে নাকি দশলাখ টাকা লাগবে ওর! ছেলেকে হারানোর ভয়ে আমি রাজি হই। টাকাগুলো নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যায় বৃষ্টি! নীলকে আমি অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আগেই। অফিস থেকে ফিরে আমার কাছে এগুলো শুনে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনি নীল! দু’দিন বাদে নিজে যেয়ে দেখা করে ঐ মেয়ের সাথে। যাচ্ছেতাইরকম অপমান করে নীলকে ফিরিয়ে দেয় ও!
সেই থেকে নীল প্রচন্ড অবিশ্বাস করে মেয়েদের। করবে নাই বা কেন? ওরকম মিষ্টি,নিষ্পাপ চেহারার মেয়েই যদি এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তাহলে আর কাকেই বা বিশ্বাস করবে আমার নীল? চার বছরের চেনাজানা ছিলো ওদের, খুব আঘাত পেয়েছে ছেলেটা আমার! অপারেশনের পর আর ফিরব কিনা জানিনা, তাই তোমাকে সব বলে হালকা হলাম। ও ভাল কথা, টাকা নেয়ার সময় স্ট্যাম্প পেপারে ঐ মেয়ের স্বাক্ষর রেখেছিলাম আমি! যে লোভী মেয়ে, বলা তো যায়না কখন কী করে বসে! লাইব্রেরি ঘরের দেরাজে সব ডকুমেন্ট রাখা আছে- চাবি আমার ড্রয়ারে থাকে। যদি কোনোদিন লাগে, আমার ছেলেটাকে ঐ ডাইনির হাত থেকে বাঁচাবে তো মা?’ -শেষের দিকে গলা ধরে আসে হোসনে আরার। মোহনার চোখ ও ছলছল করছে। গতকাল নীলকে কি খারাপটাই না ভেবেছে সে! অথচ বুকের ভেতর এতবড় দুঃখের সমুদ্র পুষে রেখেছে ছেলেটা! আহারে, আহারে!
-‘বাঁচাব মা! যদি কোনোদিন সেই দিন আসে, অবশ্যই বাঁচাব আপনার ছেলেকে’- হোসনে আরাকে আশ্বস্ত করে মোহনা।
-‘যাক! এবার ডাক্তারের ছুরির নিচে যেতেও আর ভয় নেই’- খুশি ঝরে পরে হোসনে আরার গলায়। ‘আমার ছেলেটাকে ভুল বোঝোনা মা। ও ভীষণ সরল। একটু সময় দিও, ঠিক তোমাকে কাছে টেনে নেবে!’
‘বয়েই গেছে ওরকম ছুঁচোমুখোর কাছে যাওয়ার আমার!’ মনে মনে মুখ ভেংচায় মোহনা। মুখে শুধু হালকা একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে হোসনে আরার জন্যে।
মোহনার বিয়ের সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেছে, এখনো নীলের সাথে তেমন করে কথাই হয়নি! হবেই বা কী করে? হোসনে আরার অপারেশন নিয়েই তো এই ক’দিন ব্যস্ততা গেল ওদের। এখনো হসপিটালেই ভর্তি আছেন তিনি। অপারেশনের আগে থেকেই সারাদিন সারারাত তার কেবিনে পরে আছে মোহনা।
অনেকদিন পর নিজের মায়ের মত স্নেহ পেয়েছে সে, শ্বাশুড়িকে ফেলে বাড়িতে যেতে একদমই মন চাচ্ছেনা। পাঁচদিনে নাওয়া খাওয়া একরকম হয়নি বললেই চলে, মোহনার চোখমুখ একদম বসে গেছে। গতকাল হোসনে আরার সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এলে ছেলেবউয়ের এমন বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে ধমকে ধামকে বাড়ি যেতে বলে মোহনাকে। হোসনে আরার জন্য দুজন নার্স আর একজন আয়া ঠিক করে রেখে তবেই বাড়ি যেতে রাজি হয়েছে মোহনা। আর শর্ত দিয়েছে- যেকোনো ইমার্জেন্সিতে যেন তাকে অবশ্যই জানানো হয়!
মোহনা সব গোছগাছ করতে না করতেই নীল চলে আসে হসপিটালে। অফিস থেকে সোজা মায়ের কাছে চলে এসেছে ও। ঘন্টাখানেক বাদে মায়ের কথামতো মোহনাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় নীল।
পর্ব- ৩
-‘আপনার তো খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। বাড়িতে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন নাকি পথে কিনে নেব কিছু?’ – মোহনাকে প্রশ্ন করে নীল। প্রায় পাঁচ মিনিট যাবত সিগন্যালে বসে আছে ওরা, সামনে বিশাল যানজট।
-‘না, একেবারে ফ্রেশ হয়েই খাবো’ -মোহনা উত্তর করে।
-‘চাইলে নেমেও কিনে আনতে পারি। মায়ের এই অবস্থা, এখন তুমিও অসুস্থ হয়ে পড়লে…’
নীলের কথা শেষ হবার আগেই সশব্দে হেসে ফেলে মোহনা।
-‘গত কয়েকদিন ধরেই আমাকে একবার আপনি একবার তুমি করে বলছেন! সম্পর্কের খাতিরে না হলেও বয়সের খাতিরে আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন, সমস্যা নেই!’
নীল নিজেও এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ বিব্রত ছিল এ’কয়দিন। মোহনার দিকে হালকা একটা হাসি ছুঁড়ে দেয় সে। রাস্তায় প্রচন্ড যানজট, বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় দ্বিগুণ সময় লাগবে। যতই না না করুক, মোহনার জন্য হালকা নাস্তা আর পানির ব্যবস্থা করবে ঠিক করে নেয় নীল।
-‘আপনি বসুন, আমি আসছি….’ -মোহনার দিকে ফিরে এ কথা বলতে না বলতেই লক্ষ্য করে মোহনা কেমন নির্জীবের মত ঘাড় হেলিয়ে রয়েছে। হয়ত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেছে- মনেমনে ভাবে নীল। যানজট কমতেই গাড়ি ছুটায় সে।
-‘এসে গেছি, উঠুন এবার!’ -ঘন্টাখানেকের ভেতর বাড়ি পৌছে ঘুমন্ত মোহনাকে বলে নীল। বারকয়েক ডাকার পরেও সাড়াশব্দ না মিললে খানিকটা ভড়কে গিয়েই আলতো করে মোহনাকে স্পর্শ করে সে। গায়ে হাত দিতেই টের পায় প্রচন্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার! জ্বরের ঘোরে হয়ত বেহুঁশ হয়ে গেছে-ভাবে নীল। তারপর গাড়ির দরজা খুলে পাঁজাকোলে করে মোহনাকে ভিতরে নিয়ে যায়। খাটের একপাশে শুইয়ে দেয় ওকে, তারপর মুখের ওপর ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলোকে সরিয়ে দেয়। এই প্রথম কাছ থেকে ভালোমত মোহনাকে দেখছে নীল।
লালচে ফর্সা চেহারা, পানপাতার মত মুখের আদল, মাথাভর্তি একগোছা চুল, ঘনপল্লবের মত চোখের পাপড়ি- নীলের বড় মায়া হয় মেয়েটির জন্য! এতটুকু বয়সে কী না সহ্য করতে হয়েছে ওকে! নীল চলে যেতে নিতেই আধো জাগরণ আধো ঘুমের ঘোরে নিজের ডান হাতটা দিয়ে নীলের বাম হাত চেপে ধরে মোহনা। বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে-‘মা! আমাকে নিয়ে যাও,মা!’ সবিস্ময়ে নীল লক্ষ্য করে মোহনার ডান হাতে গাড় নীল বেল্টের ঘড়ি, ঠিক যেমনটা বৃষ্টি পরতো! ডান হাতে ঘড়ি পরা নিয়ে কত তর্ক করতো নীল বৃষ্টির সাথে, নীলের ধারণা ছিল ঘড়ি বাম হাতে পরার নিয়ম। আর বৃষ্টি পরতো ডান হাতে। এক ঝটকায় অনেক পুরানো স্মৃতি ভিড় করে নীলের মনে।
সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এলে মোহনা দেখে ওর মাথার কাছে নীল ঘুমিয়ে আছে। নিজের পরনের জামার বদলে হালকা একটা ঢিলে পোশাকের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করে ও। পাশের টেবিলে পানিতে ভেজানো তোয়ালে, গায়ে ভীষণ ব্যাথা। মোহনার নাড়াচাড়াতে নীলের ঘুম ভেঙে যায়।
-‘কিছু লাগবে?’ প্রশ্ন করে নীল।
-‘নাহ! আপনি এখানে ছিলেন সারারাত? আর এইটা কার জামা আমার গায়ে?’ মোহনা ঝাঁঝের সাথে প্রশ্ন করে।
-‘বাব্বাহ! সারারাত হুঁশ নেই মেয়ের, আমি তো চলেই যেতে চেয়েছিলাম। নিজেই ত ধরে রাখলে! রাত জেগে সেবা করে এখন ঝাড়ি খাব! ‘ নীলের চোখে কৌতুক।
মোহনা বিব্রতবোধ করে। রাতের কথা আবছাভাবে মনে আছে তার। মা’কে স্বপ্নে দেখেছিলো ও। মায়ের সাথে চলে যেতে চাইলে মা নেননি, বরং মোহনাকে বলেন সামনে নীলের খুব বিপদ, তখন নাকি নীলের খুব দরকার মোহনাকে! এই সাতসকালে সে কথা মনে পরতেই হাসি পায় মোহনার। এত টাকা আর প্রাচুর্যে ভরা নীলের নাকি মোহনাকে দরকার! সেই সিংহ-ইঁদুরের গল্পের কথা মনে পরে যায় মোহনার।
-‘নাস্তা আনতে বলি?’ -নীলের প্রশ্নে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে মোহনার।
-‘না, আমি নিচে নেমেই খাচ্ছি’।
নাস্তাপর্ব শেষে মোহনার দিকে দুই পাতা ঔষধ বাড়িয়ে দেয় নীল। গতকাল রাতেই ডাক্তার এনেছিল বাড়িতে। ‘শরীর খারাপ লাগলে জানাবেন।আর টেনশন করার দরকার নেই- রাতে আপনাকে মদিনা খালাই চেঞ্জ করে দিয়েছিলো, আমি শুধু ভোররাতে উঠে জলপট্টি দিয়েছি।’- বলে মোহনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে রওনা দেয় সে।
বেলা গড়ালে হোসনে আরাকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছিল মোহনা। কাল-পরশু রিলিজ পাবেন সম্ভবত। বাড়ি ফিরে মদিনা খালাকে হোসনে আরার ঘর ভালমত পরিষ্কার করে রাখতে বলে মোহনা। তারপর লাইব্রেরিতে যায় নতুন বইয়ের খোঁজে।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে মোহনাকে লাইব্রেরিতে আবিষ্কার করে নীল। কোলের উপর বই ফেলে দিব্যি গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে গেছে। গত সপ্তাহটা প্রচন্ড ধকল গেছে মেয়েটার- মনেমনে ভাবে নীল। আবার জ্বর এসেছে কিনা দেখার জন্য কপালে হাত ছোঁয়াতেই চোখ মেলে মোহনা। রক্তজবার মত লাল টকটক করছে চোখজোড়া, নীল কাছে এগোতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে মোহনা।
-‘কী হলো? কোনো অসুবিধা? কাঁদছেন কেন?’ নীল সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে।
প্রচন্ড দুঃস্বপ্ন দেখেছে মোহনা। ঝুম বৃষ্টিতে নীল আর মোহনা ভিজছিল দু’জনে মিলে, হঠাৎ করে কোত্থেকে শ্যামলা গড়নের এক মেয়ে এসে নীলকে হ্যাঁচকা টানে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ‘মা!মা!’ বলে তীব্র চিৎকারে হোসনে আরাকে ডাকছিলো তখন মোহনা, আর মেয়েটি হাসতে হাসতে বলছিল -‘ কেউ নেই! মরে গেছে সবাই,সবাই মরে গেছে! ‘ হঠাৎ করে মেয়েটির জায়গায় মোহনার মামী রাশেদাবানু চলে এলেন। সাপের মত ফুঁসতে ফুঁসতে বলছিলেন- ‘সুখ পাবিনা মুহি! একদম সুখ হবেনা তোর! আমার মেয়েকে ঠকালি হা হা হা….’
ঠিক তখনই নীলের স্পর্শে ঘুম ভাঙে মোহনার। ভয়ানক দুঃস্বপ্নের পর এক ঝলক ঠান্ডা বাতাসের মত স্পর্শ, মোহনা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা। নীলকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বলে- ‘ যাবেন না প্লিজ! আমার আর কেউ নেই! মা’কেও যেতে দিবেন না প্লিজ!’
নীল বুঝতে পারে জ্বরের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখছিলো বোধহয় মেয়েটা। আলতো করে মোহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে।
হসপিটাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন হোসনে আরা। মদিনাকে সাথে নিয়ে তার ঘরের আনাচে কানাচে ঝকঝকে করে রেখেছে মোহনা। নিজের হাতে শ্বাশুড়ির প্রিয় সেমাই রান্না করেছে তারপর কলেজে গেছে। আজকে তার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। কলেজে রওনা দেবার আগ মুহুর্তেই নীলের ফোন পায় মোহনা।
-‘কংগ্র্যাটস! তুমি জিপিএ ফাইভ ই পেয়েছ। এবার শুধু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাটা বাকি ডাক্তার হবার জন্য!’
-‘আপনি কীভাবে জানলেন!’ মোহনা অবাক হয়।
-‘জানতে হয় এসব! তোমার ড্রয়ার এ রাখা এডমিট কার্ড থেকে রোল নাম্বারটা জেনে নিয়েছিলাম আরকি!’ সহাস্যে বলে নীল। মায়ের অসুস্থতার সময় বাড়িতে নীল-মোহনা দু’জনেই ছিল দু’জনের ভরসা। সহজ স্বাভাবিক একটা বন্ধুত্ব তাই গড়ে উঠেছে ওদের মধ্যে।
কলেজে যাবার পরিকল্পনা বাদ দেয় মোহনা। মা-বাপি থাকলে খুব মজা হতো আজকে! মনেমনে ভাবে ও। আজকে মোহনার জন্মদিন, আর তার সাথে এতবড় সুখবর! এক হিসেবে এখনোও অন্যের বাড়ির আশ্রিতাই সে, তাই জন্মদিন পালনের আশা আর করেনা এখন।
মোহনাকে চূড়ান্ত অবাক করে দিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় তার মামা মামী সহ ঐ বাড়ির সবাই এবাড়িতে এসে হাজির হয়। লাইব্রেরিতে ছিল ও, মানুষজনের কোলাহল শুনে বেরোতেই দেখে হুলুস্থুল কান্ড একেবারে! কেক,বেলুন,ফেস্টুন, অসংখ্য ব্যাগপত্র সাথে একবাড়ি লোক! কোনোরকমে ঝিলমিলকে খুঁজে বের করে মোহনা। ওর থেকে জানতে পারে নীল ই নাকি ফোনে মোহনার জন্মদিনের দাওয়াত দিয়েছে সকলকে! মোহনা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। নীলের ত জানার ই কথা না আজ যে ওর জন্মদিন, আর সে কিনা এতসব করে ফেলেছে! বহুবছর পর মোহনার জন্মদিন পালন করা হয় ধুমধাম করে, ঠিক ওর মা-বাবা যেভাবে করতেন। ঝিলমিলের সাথে ওর হবু বর সেই ছেলেটিও এসেছে, নাম অর্ক। ওকালতি পড়ছে, বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে- সব দিক দেখে রাশেদাবানু ওকে মেনেই নিয়েছেন অবশেষে। পড়ালেখার পর্ব চুকলেই ওদের বিয়ে ঠিকঠাক করা হয়ে আছে।
জন্মদিনের উৎসবের পর্ব মিটলে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেছে। নিজের ঘরে বসে একে একে উপহারগুলো খুলে দেখছিল মোহনা। মনে মনে নীলের দেয়া উপহারটাই খুঁজছিলো আসলে! সবগুলো প্যাকেট খোলার পরেও কাঙ্ক্ষিত উপহারটা না পেয়ে ভারী অভিমান হয়েছিল ওর। গাল ফুলিয়ে নিচে লাইব্রেরির দিকে সবে ছুট লাগিয়েছে মোহনা, ঠিক তখনি সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল নীল। হুমড়ি খেয়ে নীলের নাক বরাবর উল্কার মত আছড়ে পড়ে মোহনা। নিজে গড়িয়ে পড়ে যেতে নিলেও মোহনাকে শক্ত করে ধরে রাখে নীল। ফলাফল যা হবার তাই হয়, গড়িয়ে পড়ে যায় দু’জনে মিলে! কোনোরকমে রেলিং ধরে গড়ানো থামালেও ঠকাস করে মাথায় মাথায় বাড়ি লাগে দু’জনের।
-‘আজব লোক তো আপনি! আমাকে ছাড়লে ত আমি পরতাম না। ধরে রেখেছিলেন কেন?’- কপাল ঘষতে ঘষতে বলে মোহনা।
-‘ছাড়লে তো গড়িয়ে একদম নিচে পরে যেতে, তাই তো ছাড়িনি!’ নীল উত্তর দেয়।
-‘বেশ করেছেন! উদ্ধার করে দিয়েছেন।’ মোহনা ভেংচায়। উপহার না পেয়ে আগেই নীলের ওপর চটেছিল সে, সুযোগমত পেয়ে ঝাল মেটাচ্ছে।
-‘আরেকটা গুঁতা দেন তো মাথায়, শিং হবে নইলে!’ নীল বলে।
-‘শখ তো কম না!’ মোহনা ভেংচি কেটে লাইব্রেরির দিকে চলে যায়। মেয়েটা হঠাৎ রেগে গেল কেন!- মাথা চুলকায় নীল।
রাতে ঘুমাতে যাবার সময় মোহনার কাছে যায় নীল। তারপর বলে- ‘আপনার জন্মদিনের উপহারটা দেইনি ইচ্ছে করেই। নিজের পছন্দমতো কিছু আনলে আপনার হয়ত ভাললাগবে না তাই… আপনার কোনো পছন্দের কিছু আছে? বলে দিলে কালকে নিয়ে আসব।’
মোহনা নীলের চোখের দিকে তাকায়, তারপর দেশলাই কাঠির মত ফস করে বলে ফেলে-‘ যা চাই কিংবা যাকে চাই তা তো দিতে পারবেন না, অযথা জিজ্ঞেস করলেন যে বড়!’
পর্ব- ৪
মুখ ফসকে কথাগুলো বলে দিলেও, পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় মোহনা। হালকা হেসে বলে- ‘এতিম মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন, পড়ালেখার সুযোগ দিয়েছেন এইই অনেক। আর উপহার-টুপহার দিয়ে আমার ঋণের বোঝা বাড়াতে চাইছেন কেন?’
নীল বুঝতে পারে না চাইতেও ওর সাথে জড়িয়ে গেছে মোহনা। সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্বের দাবিগুলোও তাই জটিল হচ্ছে ক্রমেই। নীল নিজেও তো দূরে দূরে থাকতে চেয়েছিল মোহনার থেকে, কিন্তু পারল কই? মায়ের অসুস্থতা ওকে ভেতরে ভেতরে কাবু করে দিয়েছিল। হাতের কাছে সম্বল করে পেয়েছিল এক মোহনাকেই- তাই নিজের অজান্তে তো সেও মোহনাকেই আঁকড়ে ধরেছিল! শুধু মোহনাই বা কেন, নীল নিজেও কি বন্ধুত্বের বাইরে দু’পা এগিয়ে যায়নি?
নিজেকে প্রশ্ন করে নীল, উত্তরটাও দ্রুতই মিলে যায়। এগিয়েছে! অবশ্যই এগিয়েছে! মোহনা যতদিন মায়ের সাথে হসপিটালে ছিল, বড় খালি খালি লাগত বাড়িটা নীলের কাছে। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল হয়ত মা নেই বলে এমন মনে হচ্ছে। কিন্তু, মোহনা চলে আসতেই বাড়িটা আর একলা গিলে খেত না নীলকে। মোহনার জ্বরের সময় রাত জেগে থাকা, মোহনার ড্রয়ার থেকে ওর এইচএসসির রোল নাম্বার খুঁজে নেয়া, ওর মামার কাছ থেকে ওর জন্মদিনের তারিখ আর প্রিয় খাবারের লিস্ট জেনে নেয়া- এগুলো কেন করেছে নীল? মেয়েটা প্রচন্ড সরল, ওকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। তবে কি আবার নতুন করে বসন্ত আসতে চলেছে নীলের জীবনে? নীল ভাবে, কোনো কূলকিনারা পায়না। এর মধ্যে কখন ওকে একলা ঘরে ফেলে রেখে মোহনা চলে গেছে তার প্রিয় লাইব্রেরির কোণায়, নীল টের ও পায়না।
দিন কেটে যায় এভাবে সেভাবে। সেদিনের পর থেকে মোহনা আপ্রাণ চেষ্টা করে নীলের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে। নীল সেই চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়েছে। অনেক ভাবাভাবির পর ঠিক করেছে যা হবার তাই হতে দিবে। বৃষ্টির অপরাধের শাস্তি তো মোহনাকে দেয়া যায়না! এই ক’মাসে নীল বিশ্বাস করে ফেলেছে মোহনার ওপর, আস্তে আস্তে যদি সেই বিশ্বাসের সিঁড়ি ধরে ভালবাসার জন্ম হয়- তাতে আর বাঁধা দিতে চায়না নীল। যদি সে টের পায় মোহনা দূরে সরে যেতে চাচ্ছে ওর থেকে। কিন্তু যে দূরত্বের বীজ নীলের নিজের হাতেই বোনা, মোহনা যদি তাতে সার-পানি দিয়ে মহীরুহ বানাতে চায়- নীল তাতে আপত্তি করবেই বা কোন মুখে? নীল তাই একনদী অভিমান বুকে পুষে রাখে, কাউকে জানতে দেয়না।
সেদিন সকালে হোসনে আরার ঘরেই ছিল মোহনা। দিনের অর্ধেক সময় এখানেই থাকে ও। দুপুরের খাবার খাওয়ার পরপরেই প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট ওঠে হোসনে আরার। দ্রুত এম্বুলেন্স আর নীলকে ফোন করে মোহনা। মুহুর্তের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সব গোছগাছ করে হোসনে আরাকে নিয়ে এম্বুলেন্সে ওঠে মোহনা, অফিস থেকেই নীল রওনা করে হসপিটালের দিকে। ক্রিটিকাল অবস্থায় আইসিইউ তে ভর্তি করা হয় হোসনে আরাকে। রাতের দিকে তার জ্ঞান ফিরে এলে মোহনাকে নিজের কাছে ডেকে নেন তিনি। ওর দু’হাত চেপে বলেন- ‘আমি যদি চলে যাই, নীলকে দেখবি মা! তোর ওপর খুব অভিমান হয়েছে ওর, আমি টের পাই। এতবড় ছেলের আমার, মনটা একদম বাচ্চাদের মত। ভেতরে ভেতরে চাপা কষ্টে মরে যাবে, তবু মুখ ফুটবে না। মান-অভিমান আর বাড়াস না, এবার মিল করে নিস!’ ঘন্টাদুয়েক বাদে নীলের হাতে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি।
নীলের থেকে দূরে যাবার পর এ বাড়িতে মোহনার একমাত্র আশ্রয় ছিলেন হোসনে আরা। তার প্রস্থানের পর এতবড় পৃথিবীতে তাই নিজেকে বড় একা লাগে মোহনার। প্রচন্ড অস্থিরতা আর বিব্রতকর পরিবেশে কেটে যায় সপ্তাহখানেক। নিজেকে একদম এক কোণে গুটিয়ে নিয়েছে মোহনা, শুধু দু’বেলা খেতে বসে দেখা হয় নীলের সাথে। ভারী চশমার আড়ালে নীলের চোখজোড়া প্রিয় মানুষের একটু কথা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে, কিন্তু মোহনা সে চোখের সাথে চোখ মেলায় না। নীল বড় শান্ত-সুবোধ, সেও কখনো অধিকারের দাবি নিয়ে আসেনা। বোকা নীল অপেক্ষা করে মোহনার জন্য, আর নিজেকে ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভেবে আস্তে আস্তে দূরে সরে যায় মোহনা!
দু’দিন বাদে অফিসফেরত নীল আসে ছোট্ট একটা কেক হাতে। রাতে খেতে বসে মোহনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে- ‘আজকে আমার জন্মদিন। মা থাকতে কখনই এ দিনটা এত বিচ্ছিরি কাটেনি আমার। মা থাকলে যা যা করতেন, তার অন্তত একশোভাগের এক ভাগ করব ভেবেই কেকটা এনেছিলাম। যদি কিছুক্ষণ সময় দিতেন তো….’
নীলের কথা শেষ না হতেই বাদলধারার মত জল নামে মোহনার চোখ বেয়ে। হোসনে আরার মৃত্যুর পর শুধু নিজেকে নিয়েই ভেবেছে সে, অথচ নিজের মা’কে হারিয়ে নীলের ভেতর কিরকম ভাঙচুর চলছে-একবারও সে কথা ওর মাথায় ই আসেনি! মা তো বলেই দিয়েছিলেন ভেতরে ভেতরে কষ্টে ভেঙে গেলেও নীল জানাবে না। মা’কে সে কথাও দিয়েছিল নীলকে দেখে রাখার, অথচ স্বার্থপরের মত কেবল নিজেকে নিয়েই ভেবে যাচ্ছে ও! ‘প্লিজ মাফ করে দিন! আমি বুঝিনি, আমি বুঝতে পারিনি ভেতরে ভেতরে একা হয়ে গেছেন আপনি! আর হবেনা এমন, আর হবেনা….’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পরে মোহনা। অভিমানের বরফ ভাঙতে দেখে বড্ড স্বস্তি পায় নীল। সমস্ত জড়তা আর দ্বিধা কাটিয়ে মোহনার হাতটা নিজের হাতের ভেতর পুরে নেয়। কী বলে কিংবা কীভাবে এই শ্রাবণ ধারার মত কান্না থামাবে নীল জানেনা। মোহনার হাতটা নিজের হাতে পুরে নিয়ে শুধু বসে থাকে অচল মূর্তির মত।
মিনিটখানেক বাদে বাড়ির দরজায় টোকা দেয় কেউ। চোখ মুছে দরজার দিকে এগোয় মোহনা। দরজা খুলতেই প্রচন্ড পরিচিত একটা মুখ দেখতে পায়।
-‘নীল আছে? আমি বৃষ্টি, নীলকে নাম বললেই চিনবে!’ – দীর্ঘাঙ্গী মিষ্টি মেয়েটি বলে।
নীলের সেই বহুদিন আগে হারিয়ে ফেলা প্রেম আজ ওর মুখোমুখি দাঁড়ানো। সেই খোলা চুল, সেই চিবুকের লাল তিল, সেই হাসি, সেই কণ্ঠ- সেই বৃষ্টি!
-‘তুমি এখানে কেনো এসেছ? ‘ ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন করে নীল।
-‘নীল,আমি আর পারিনি তোমাকে ছেড়ে থাকতে। অনেক সহ্য করেছি আর না! আমি সব বলব, স-ব! শুধু একটু সময় দাও!’ বৃষ্টির গলায় মিনতি ঝরে পরে।
-‘সেদিন তো বলেছিলে আমার মত কুড়িয়ে পাওয়া, রাস্তার ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাও না, আজকে বলছো আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা- অদ্ভুত!’
মোহনার বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি। লাইব্রেরিতে রাখা ছবিগুলো এই মেয়েটির ই। তারমানে প্রায় চার বছর আগে চলে যাওয়া সেই বৃষ্টি আজকেই ফিরে এসেছে! মোহনার কপালে কি পুরো একটা দিনের জন্যও সুখ লেখা নেই?
-‘সেদিন যা বলেছিলাম সব মিথ্যে ছিল নীল! যেদিন এ বাড়িতে এসেছিলাম, তোমার মা আমাকে একদম ই পছন্দ করেননি। বলেছিলেন তোমাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিতে। আরো বলেছিলেন- আমাদের বিয়ে হলে উনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। সেই ভয়েই আমি অতগুলো বানানো মিথ্যা কথা বলে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম! গতকাল গ্রামের বাড়িতেই জানতে পারি তোমার মা মারা গেছেন কিছুদিন আগে, আর তখনি আম সিদ্ধান্ত নিই তোমার কাছে ফিরে আসার।’
বৃষ্টির কথাগুলো যেন আগুনের মত এসে লাগে মোহনার গায়ে। নিজের মায়ের মত ভালবেসেছে সে হোসনে আরাকে, আর এই মেয়ে তার নামেই একের পর এক মিথ্যা বলে যাচ্ছে!
-‘কিন্তু আপনি ত দশ লাখ টাকা নিয়েছিলেন মায়ের থেকে, সে প্রমাণ ও আছে!’
মোহনার কথায় ভ্রু কুঁচকায় বৃষ্টি। ‘এই হতচ্ছাড়িটা আবার কে’- মনেমনে ভাবে। মুখে বলে-
‘নিতে বাধ্য হয়েছিলাম! আমার হাতে জোর করে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে কাগজে স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ঐ ব্যাগে কী ছিলো আমি জানিনা, ওটা আমি তোমাদের বাড়ির দরজাতেই ফেলে রেখে গেছিলাম!’ – কাঁদো কাঁদো গলায় বৃষ্টি বলে।
অর্থাৎ যে প্রমাণের কথা মা বলে গেছেন, সেটাও আর কাজ করবে না- মনে মনে ভাবে মোহনা। এর মাঝেই নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। নীলের যে বিপদের কথা বারবার স্বপ্নে দেখেছে সে, সম্ভবত এটাই সেটা! মোহনাকেই যা করার করতে হবে। বৃষ্টির মায়াকান্নায় নীল যদি গলেও যায় তবে যাক, এর শেষ আমিই দেখে ছাড়ব- মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে মোহনা।
৫+৬ (শেষ পর্ব)
বৃষ্টির যন্ত্রণায় মোটামোটি অতিষ্ঠ হয়ে গেছে বাড়ির সকলে। হোসনে আরার ঘরটা ফাঁকা পেয়ে তাতেই ব্যাগপত্র সমেত উঠে পরেছে ও। মোহনা বারবার ওকে নিচের গেস্টরুমে থাকতে বললেও তাতে রাজি হয়নি বৃষ্টি। নীল বারবার অনুরোধ করে বলেছিল- ‘যা হবার হয়ে গেছে, জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নাও বৃষ্টি!’ কিন্তু বৃষ্টি অনড়! মোহনাকে বিয়ে করতে নীল অনিচ্ছুক ছিল, একথা সবাইই জানে- সেই সুযোগটাই সে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। বারবার নীলকে প্রলোভিত করছে মোহনাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য।
হোসনে আরা বেঁচে থাকলে এই সত্য-মিথ্যার বেড়াজাল কবেই ভেঙে ফেলা যেতো! অথচ এখন না বৃষ্টিকে অবিশ্বাস করা যাচ্ছে না নিজের মাকে! নীলের মানসিক পীড়ন প্রচন্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে মোহনাকেও। একেকবার মনে হচ্ছে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে ওদের নতুনভাবে বাঁচতে দিবে, কিন্তু পরেই মনে পড়ছে হোসনে আরার কাছে করা প্রতিজ্ঞার কথা। তাছাড়া, এই বৃষ্টি নামের মেয়েটাকে খুব একটা সুবিধেরও মনে হচ্ছে না মোহনার কাছে! চাল-চলন, কথা-বার্তায় কেমন অহংকার আর লোভ মেশানো। এইতো আজকে সকালেই চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় মদিনা খালাকে যাচ্ছেতাইরকম ভাবে অপমান করলো বৃষ্টি! প্রায় পনের বছর ধরে এ বাড়িতে আছেন মদিনা খালা, অথচ দিব্যি তাকে নাম ধরে তুইতোকারি করছে অল্পবয়েসী এই মেয়েটা! নীল ও ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল সকালের ঘটনায়। মৃদু গলায় মোহনাকে বলেছিল- ‘বৃষ্টি এরকম ছিলনা তো একদম ই! একটু রোদ-বৃষ্টি হলেই নিজে যেচে দ্বিগুণ রিকশাভাড়া দিতো, রিকশাওয়ালার মাথায় ছাতা ধরে বসে থাকত রিকশায় ওঠার পর যেই মেয়ে- সে এরকম হলো কবে!’
নীলের বিস্ময় নাড়া দেয় মোহনাকেও। এর আগেও দু-চার বার বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টির কথা শুনেছে ও নীলের মুখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তদান কর্মসূচিতে যেয়ে নাকি পরিচয় হয়েছিল ওদের। অথচ, যে বৃষ্টিকে চোখের সামনে দেখছে মোহনা- এ মেয়ে তো রীতিমত রক্তচোষার দলের! মোহনার সাথেও কাজের লোকদের মতই আচরণ করছে বৃষ্টি। একের পর এক ফরমাশ করে চলেছে মোহনাকে। নীরবে সহ্য করলেও ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে মোহনা।
সকালের নাস্তা শেষেই মার্কেটে নিয়ে যাওয়ার বায়না করে নীলের কাছে বৃষ্টি। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে নীল চলে যেতে চাইলে ওকে বাধা দেয় বৃষ্টি। রীতিমত ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যায় ওদের কথোপকথন, কোনোভাবেই নীলকে আজ অফিসে যেতে দেবেনা বৃষ্টি! শেষমেশ বাধ্য হয়ে নীল রাজি হলে পোশাক বদলে তৈরি হয়ে নেয় সে। ওরা বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পরে মোহনার- বৃষ্টি ঘড়ি পরেছে বাম হাতে! অথচ মোহনাকে ডান হাতে ঘড়ি পরতে দেখে একদিন নীল বলেছিল, এটা নাকি বৃষ্টিরও ছোটবেলা থেকে লালিত অভ্যাস! হাজার চেষ্টা করেও নাকি বৃষ্টিকে বাম হাতে ঘড়ি পরাতে রাজি করতে পারেনি নীল!
ওরা দু’জনে বের হতেই দ্রুত লাইব্রেরিতে যায় মোহনা। বৃষ্টির ছবিগুলো আবার বের করে উলটে-পালটে দেখে। প্রত্যেকটাতেই ডান হাতে বেল্টের ঘড়ি বাঁধা! বামে সিঁথি করে খুলে রাখা চুল, কৃত্রিমতাবিহীন জোড়া ভ্রু, চিবুকের লাল তিল, কানের লতি, হাত, কব্জি, পায়ের পাতা- খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খেয়াল করে মোহনা। তারপর দৌড়ে যায় বৃষ্টির ঘরে। ওর ব্যাগপত্র সব খুটিয়ে খুঁটিয়ে খোঁজে। খানিক বাদে বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায় মোহনাকে। প্রায় দু’ঘন্টা পর আবার ফিরে আসে মোহনা, খানিক্ষণ খুটখাট টুকটাক করে, এঘর-ওঘর করে নীলের বিছানার উপর একটা ছোট্ট চিরকুট ফেলে রেখে আবার বেরোয় বাড়ি থেকে।
বাড়ি ফিরে নীল আবিষ্কার করে মোহনা বাড়িতে নেই! মদিনা খালাকে জিজ্ঞেস করেও কোথায় গেছে জানতে না পেরে বেশ দুশ্চিন্তা শুরু হয় নীলের। বৃষ্টি অবশ্য মহাখুশি, আপদ বিদায় হয়েছে! খোঁজখবর লাগানোর আগে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় নীল। নিজের ঘরে যেতেই দেখতে পায় খাটের ওপর ছোট্ট চিরকুট রাখা একটা। খুলতেই চোখে পরে মোহনার হাতে লিখা কয়েকটি লাইন- ‘দু-তিনদিনের জন্য কাজে যাচ্ছি। বাড়িতে কাউকে জানানোর দরকার নেই, খোঁজ করেও লাভ হবেনা। সাবধানে থাকবেন, সত্য-মিথ্যার খেলা শেষ করে ফিরব।’
বৃষ্টি চলে আসার আগেই চিরকুটটা লুকিয়ে ফেলে নীল। মেয়েটা এরকম অদ্ভুতভাবে কই চলে গেল ভাবতে ভাবতে নিচে নামে। এঘর ওঘর ঘুরেও মোহনার নিরুদ্দেশ হবার কোনো কারণ বা সূত্র খুজে পায়না। হঠাৎ করেই নিজেকে খুব একা লাগতে আরম্ভ করে নীলের। মা নেই, কাছের মানুষ বলতে ছিল মোহনা-সেও কই গেলো কে জানে। বাকি পরে আছে বৃষ্টি নামের অনেক চেনা অথচ প্রচন্ডরকম অপরিচিত এই মেয়েটি! যে বৃষ্টিকে নীল ভালবেসেছিল, এই বৃষ্টির সাথে তার দিন আর রাতের মত ফারাক! মাত্র চার বছরে কি কেউ এত বদলে যায়?
এদিকে মোহনা নিরুদ্দেশ হওয়ায় বৃষ্টি পূর্ণ উদ্যমে ঝাপিয়ে পরেছে নীল আর তার বিয়ের আয়োজনে। নীল এসবের কিছুই জানেনা, নিজের মত করে মোহনার খোঁজ নিয়ে চলেছে সে। মোহনা চলে যাবার দু’দিন পরেই অফিসফেরত নীল দেখতে পায় দু’জন লোক নিয়ে বৃষ্টি বসে আছে বাড়ির নিচতলার বসার ঘরে। নীল প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায় বৃষ্টি। বলে-
‘উনি আজমল খান, ডিভোর্স ল’ইয়ার! তোমাদের মানে মোহনার আর তোমার ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলার জন্যই উনাকে ডেকেছি। আমরা সবকিছু গুছিয়ে ফেলি, মোহনা যদি কোনোদিন ফিরে আসে তখন ওর স্বাক্ষর আর বাদবাকি কাজ….’
নীলের আগুন চোখের দিকে চোখ পড়তেই কথা থেমে যায় বৃষ্টির। রীতিমত জ্বলন্ত চুল্লির মত রক্তচোখে ওর দিকে দেখছে নীল। কোনো উত্তর না করেই সোজা নিজের ঘরে চলে যায় নীল, খানিক বাদে বৃষ্টিও ওর পিছু নেয়।
-‘এভাবে চলে এলে যে! ডিভোর্স টা না হলে তো আমাদের বিয়েও হবেনা!’ -বৃষ্টি ঝাঁঝ মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করে।
-‘দেখো বৃষ্টি, এখন এতদিন পর এসবের কোনো মানে হয়না। মোহনা আমার বিয়ে করা স্ত্রী, ওকে এভাবে জলে ভাসিয়ে দিতে আমি পারিনা!’
-‘মানে! তোমার জন্য আমি এতবছর জলে ভেসে রইলাম, বাবা-মা সবাইকে ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম আর তুমি কোথাকার কোন রাস্তার মেয়েকে ছাড়তে…’
বৃষ্টির কথা শেষ না হতেই চিৎকার করে ওঠে নীল-
‘enough বৃষ্টি! মোহনাকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবে না!
-‘একশোবার বলব নীল! কোথাকার কে, এতিম- নিঃস্ব! এটা তো গরিবখানা নয় যে রাস্তা থেকে ধরে ধরে এদের তুলে নিয়ে আসবে। এখন আমি এসেছি, ও আর কেন থাকবে?’ বৃষ্টি রীতিমত চেঁচায়।
বৃষ্টির দুই গালে চড় মারার প্রচন্ড ইচ্ছেকে অবদমিত করে নীল বলে- ‘ এবাড়িতে কারো থাকতে হলে মোহনাই থাকবে, তুমি নও!’ তারপর দ্রুতপায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
‘হতচ্ছাড়ি যেয়েও শান্তি দেবেনা! আমিও ওর ভূত একেবারে তাড়িয়ে তবে ছাড়ব’- নিজের মনে গজগজ করতে থাকে বৃষ্টি।
আরো দু’দিন বাদেও মোহনার কোনো খবর না পেয়ে রীতিমত চিন্তায় পরেছে নীল। মামার বাড়িতেও যায়নি সে, খোঁজ নিয়ে জেনেছে। এদিকে নীলকে কোনোমতেই ডিভোর্সের জন্য রাজি করাতে না পেরে নতুন ফন্দি এটেছে বৃষ্টি। কবে কোনদিক দিয়ে হতভাগী মোহনা আবার এসে ঘাড়ে চেপে বসে, তাই আর দেরি করতে রাজি নয় ও। সবে চারদিন ধরে নিরুদ্দেশ হয়েছে, বৃষ্টির ভয় এখনো কাটেনি। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে নীলের মন জয় করার সময়টুকুও আর নষ্ট করতে চাচ্ছেনা বৃষ্টি। এর ফলাফলেই অফিসফেরত নীল হতবাক হয়ে দেখে রীতিমত বিয়ের কনের সাজে বসে আছে বৃষ্টি! নীল বাড়িতে ঢুকতেই দ্রুত হাত ধরে ওকে এনে নিজের পাশে বসিয়ে দেয়।
-‘আজকেই বিয়ে করব আমরা! – হাসিমুখে বলে বৃষ্টি।
-‘লিগ্যালি মোহনা এখনো আমার স্ত্রী বৃষ্টি! আমার পক্ষে…’
নীলকে থামিয়ে দিয়ে বৃষ্টি বলে-
‘সে কই নিরুদ্দেশ হয়েছে কে জানে! দেখ গিয়ে আবার কোন বড়লোকের ছেলের ঘাড়ে ঝুলেছে, এ বাড়িতে জায়গা হবেনা বুঝে গেছে… ‘
-‘তোমাকে আগেও বলেছি মোহনাকে নিয়ে একটা বাজে শব্দও বলবেনা তুমি!’ ধৈর্যের বাধ ভেঙে চেঁচিয়ে ওঠে নীল।
-‘যা সত্যি তাইই বলছি! আমি কাজীকে ডেকেছি, আজ আমাদের বিয়ে না হলে এখানেই আত্নহত্যা করব আমি। সমস্ত দায় তোমার আর তোমার ঐ মোহনার ওপর দিয়ে আমি চলে যাব। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে
মরে যাওয়া ভাল নীল!’ কান্নার অভিনয় করে বৃষ্টি। নীল সহজে এ বিয়েতে রাজি হবেনা জেনে, সমস্তটা আগে থেকেই ঠিকঠাক করে রেখেছিল ও।
এবারে ভড়কে যায় নীল। এই বৃষ্টিকে ও চেনেনা! প্রেমের দিনগুলোতে বহুবার ওকে বলেছিল বৃষ্টি- যদি কখনো, কোনো কারণে কিংবা পরিস্থিতির চাপে নীল মুক্তি চায় তবে হাসিমুখে চলে যাবে সে! অথচ আজকের এই বৃষ্টি কী বলছে এসব!
-‘সেদিনের চূড়ান্ত অপমানের পরেও তোমাকে আমি ভুলতে পারিনি বৃষ্টি! ভালবাসার নদীকে পায়ে ঠেলে দিয়ে যে উত্তপ্ত মরুভূমির ভেতর আমায় ফেলে দিয়েছিলে তুমি, বহুদিন আমি সেখানে হাহাকার করে মরেছি! মোহনা সেখানে ঝর্ণার মত এসেছিলো, এখন আমি আর সেইসব দিনে ফিরে যেতে চাইনা। ভেবে নাওনা আমি আজও রাস্তার ছেলে, এ বাড়ির পালিত ছেলে- প্লিজ! আমাকে একটু শান্তি দাও এবার!’
-‘কী বলছো এসব! সেদিন আমি বাধ্য হয়ে তোমার মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্যই তো এসব মিথ্যে নাটক করেছিলাম! আর আজকে আমাকেই শাস্তি পেতে হবে? আর সত্যি তো এটাই যে তুমি আজো আমাকেই ভালবাসো! কেবল দায়িত্বের কারণে ঐ মেয়েটাকে ছাড়তে পারছনা। বেশ তো, ওকে কিছু টাকা আর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও নাহয়! শান্তি চাও? এরপরেই তো সব শান্তি! আমি আর তুমি আবার আগের দিনগুলোর মত…’
-‘কিচ্ছু ঠিক নেই কিচ্ছুনা! কোনোকিছুই আর আগের মত নেই! তুমি আগের মত নেই বৃষ্টি! তুমি আমার সেই বৃষ্টি হতে পারোনা! কখনোই না! ‘- নীলের আর্তচিৎকার ধ্বনিত হয়।
নীলের কথা শুনে ধক করে যেন জ্বলে ওঠে বৃষ্টির চোখজোড়া।
-‘আমিই বৃষ্টি। আমি! বৃষ্টি নামের কেউ যদি তোমার জীবনে এসে থাকে তাহলে আমিই সে- এটা তোমাকে মানতে হবে নীল। শুধু তোমাকে না, সবাইকে এটা মানতে হবে। মানতেই হবে…’
-‘আমি মানিনা! আমি জানি তুমি বৃষ্টি নও!’- মোহনার আত্নবিশ্বাসী কণ্ঠ যেন চাবুকের মত আছড়ে পরে বৃষ্টির ওপর। মোহনা কখন ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, কেউ দেখেনি।
রীতিমত ঝড়ের বেগে উঠে মোহনার দিকে এগিয়ে এলো বৃষ্টি।
‘বেহায়া মেয়ে, আবার এসেছো! কোন চুলায় গিয়েছিলে যাওনা, আমাদের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছ কেন অযথা?’ চিৎকার করে বলে।
-‘ চিৎকার করে লাভ নেই রোদেলা! সমস্ত প্রমাণ হাতে নিয়েই কথা বলছি আমি।’- শান্ত গলায় বলে মোহনা।
বৃষ্টি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মোহনার দিকে। চূড়ান্ত বিস্মিত নীল প্রশ্ন করে- ‘রোদেলা? এই নাম তুমি কীভাবে জানলে মোহনা? এটাতো বৃষ্টির বোনের নাম!’
-‘আর এই মেয়েই সেই রোদেলা! বৃষ্টি সেজে এতদিন অভিনয় করে গেছে।’- বৃষ্টির দিকে আঙুল তুলে বলে মোহনা।
-‘রোদেলা চার বছর আগেই মারা গেছে। আমিই বৃষ্টি, নতুন করে নাটক করবেনা। তোমার সম্পত্তি আর চাকচিক্যময় জীবনের লোভে যা-তা নাটক বানিয়ে যাচ্ছে এই মেয়ে, নীল! বের করে দাও ওকে এক্ষুণি!..’
বৃষ্টির চিৎকার শেষ হবার আগেই একজন প্রৌঢ়া মহিলা এসে দাঁড়ান ঘরের ভেতর। তাকে দেখে চমকে যায় বৃষ্টি, যেন ছোটখাটো বজ্রপাত হয়েছে- এমনভাবে ছিটকে সরে যায়।
-‘আন্টি, আপনি এখানে?’ মহিলাটিকে দেখে নীলও অবাক হয়েছে। বৃষ্টির মা এখানে কী করে এলো!
নীলকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করেন তিনি-
-‘মোহনা যা বলছে সব ই সত্যি! রোদেলা আর বৃষ্টি আমার ই দুই মেয়ে,জমজ বোন ওরা! একদম একই রকম দেখতে ছিল ওরা দু’জনে, কেউই আলাদা করতে পারতোনা শুধু আমি আর ওদের বাবা ছাড়া। ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টি খুব নরম মনের আর সোজা-সরল মেয়ে ছিল। আর রোদেলা ছিল একদম উলটো! ওদের বাবা মারা যাবার পর খুব কষ্টে দু’বোনকে বড় করি আমি। হাসিমুখে সব অভাব আর দারিদ্র মেনে নিয়েছিল বৃষ্টি, কিন্তু রোদেলা একদম ই মানতে পারেনি এসব। কলেজে থাকতেই এলাকার বড়লোকের ছেলেদের সাথে মিশতো, নিত্য নতুন জামাকাপড় আর কসমেটিকস না হলে চলতো না ওর।
অনেক বলেও ওকে বোঝাতে পারিনি আমরা। এরইমধ্যে এক ঈদের ছুটিতে তোমরা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলে, তখনই তোমার আর বৃষ্টির সম্পর্কটা গড়ে ওঠে। সব স্বাভাবিক ই চলছিল, আমাকেও জানিয়েছিল সব বৃষ্টি। এর মধ্যে একদিন তুমি বৃষ্টিকে তোমাদের ঢাকার বাসায় আসতে বলো। রোদেলাও আবদার করে বৃষ্টির সাথে ঢাকায় আসার। দু’বোনকে একত্রে লঞ্চে তুলে দিই আমি। ওরা ঢাকায় পৌঁছলে তুমি লঞ্চঘাটে এসে ওদের রিসিভ করবে-এমনটাই বলেছিল ওরা। এরপর কী হয়েছিল আমি এখনো জানিনা, কিন্তু আমি আমার এক মেয়েকে হারিয়ে ফেললাম সেদিনই!
সেই যে দু’জনকে বিদায় দিয়েছিলাম, ফিরে এলো একজন! ঢাকা থেকে পরদিন কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলো আমার এক মেয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো রাতের বেলা লঞ্চ থেকে পা পিছলে নদীতে পরে ডুবে গেছে রোদেলা, অনেক খুঁজেও ওর সন্ধান না পেয়ে বৃষ্টি ফিরে এসেছে একা! দু’দিন বাদে আমার এক মেয়ের লাশ ভেসে ওঠে নদীতে, তখনো আমি জানতাম সেটা রোদেলার ই লাশ। আসলে মেয়েকে হারানোর দুঃখে বাস্তব বুদ্ধিও হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন। কিন্তু কিছুদিন যেতেই আমি বুঝতে পারি আসলে রোদেলা নয় আমার বৃষ্টি মারা গেছে।
আর বৃষ্টির পরিচয়ে যে ফিরে এসেছে সে আসলে রোদেলা! দেখতে একরকম হলেও ওদের চলাফেরা, আচার আচরণে অনেক তফাত ছিল। আমি তো মা, আমি টের পেতাম সব। কিন্তু নিজের পরিচয় লুকিয়ে রোদেলার কী লাভ হবে- এটা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। একদিন আর থাকতে না পেরে চেপে ধরি রোদেলাকে, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয় আমার! পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ, পাগল প্রমাণ করে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দেয় এই মেয়ে! আমার নিজের মেয়ে- রোদেলা! গত চারটা বছর ধরে আমাকে এভাবে সবার কাছে পাগল সাজিয়ে রেখেছে ও! দিন-রাত ভেবেছি কেনো এসব করছে, কিন্তু উত্তর পাইনি। শেষে গতকাল এই মোহনা মেয়েটি আমার খোঁজে যায়, ওর কাছ থেকে সব শুনেই বুঝতে পারি রোদেলা একটু একটু করে কী ভয়ঙ্কর জাল পেতেছে! তাই আজকে ওর সাথে এখানে এসেছি আমি।’
একনাগাড়ে কথাগুলো বললেও মাঝে মাঝেই কান্নায় গলা ধরে আসছিলো বৃষ্টির মায়ের। নিঃশ্বাস বন্ধ করে এই ভয়ঙ্কর কাহিনী শুনছিলো নীল। মোহনা এর মধ্যেই সব জেনে গেছে, এমনকি ঘটনার আরো গোড়ার রহস্যও সে জানে! উনি থামতেই নীলের দিকে তাকিয়ে মোহনা বলতে শুরু করে-
‘রোদেলাকে বাম হাতে ঘড়ি পরতে দেখে আমার প্রথম সন্দেহ হয়। কারণ আপনি আগেই আমাকে বলেছিলেন বৃষ্টিও আমার মত ডান হাতে ঘড়ি পরতো। তারপর বৃষ্টির ছবিগুলো দেখতেই আরো কয়েকটি অসামঞ্জস্য চোখে পরে আমার। যেমন বৃষ্টির ছিল ঝাঁকড়া চুল, সব ছবিতেই খোলা চুল ছিল। কিন্তু এই মেয়ে, যে কীনা বৃষ্টি সেজে রয়েছে তার চুল একদম সোজা। বোঝাই যায় পার্লারে রিবন্ডিং করানো! তাছাড়া বৃষ্টি ডানে সিঁথি কাটত, আর এই মেয়ে করে বামে। তারওপর রোদেলার উগ্র আচরণেও সন্দেহ জাগে আমার। তাই সুযোগ বুঝে একদিন ওর ঘরে যাই আমি, ওর ব্যাগপত্র খুঁজতেই একটা ছোট্ট ফোন পেয়ে যাই। দ্রুত ওটার সিম আমার ফোনে নিয়ে নাম্বারটা কপি করে নিই।
তারপর চলে যাই ঝিলমিল আপুর হবু স্বামী অর্ক ভাইয়ার কাছে। অর্ক ভাইয়া ওকালতি পড়ছেন, সব শুনে তিনিই আমাকে বুদ্ধি দেন একটা টেপ রেকর্ডার এই বৃষ্টির মানে আসলে রোদেলার ঘরে রেখে দিতে। তখনি দোকানে যেয়ে রেকর্ডার কিনে ঐ ঘরে রাখি আমি আর বেরিয়ে যাই বৃষ্টিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আপনার অফিস থেকেই আপনাদের গ্রামের ঠিকানা নিয়ে সেখানে যাই, লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বৃষ্টিদের বাড়ি পৌঁছে দেখি তালা ঝুলছে। প্রতিবেশীদের কাছেই জানতে পারি বৃষ্টির জমজ বোন রোদেলার মৃত্যুর খবর আর ওদের মায়ের মানসিক অসুস্থতার কথা। দ্রুত সেই হাসপাতালে যেয়ে আন্টির সাথে কথা বলতেই সব রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে। আপনার মায়ের কাছ থেকে সেদিন রোদেলাই দশ লাখ টাকা নিয়েছিল বৃষ্টি সেজে, তারপর সে-ই আপনাকে বৃষ্টি সেজে বাড়ি থেকে দূরে আপনার সাথে দেখা করে এবং আপনাকে অপমান করে ফিরিয়ে দেয়। আপনিও বোকার মত ফিরে আসেন, একবার ওদের বাড়ি পর্যন্ত যেয়ে দেখলেও হয়ত টের পেতেন সবকিছু। দশলাখ টাকার বিনিময়ে এসব করেছিল রোদেলা কারণ ও ভেবেছিলো আপনি এ বাড়ির পালিত সন্তান, সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন না। চারবছর পর মায়ের মৃত্যুর খবর আর আপনার হাতে চলে আসা সম্পত্তির খবর শুনে আবার ফিরে আসে এখানে নতুন নাটক সাজাতে।’
-‘কিন্তু, তাহলে বৃষ্টি কোথায়? এতগুলো দিন কেন আমার সামনে আসেনি ও?’ -হতভম্বের মত প্রশ্ন করে নীল।
-‘এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর রোদেলা ছাড়া আর কেউ আমরা জানিনা। আমি কিছুটা ধারণা করলেও, তা বলতে চাচ্ছিনা। রোদেলাই বলুক।’-মোহনা উত্তর করে।
-‘সব বানোয়াট! সব মিথ্যে! মায়ের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে এই মেয়ে নাটক লিখে এনেছে! রোদেলাকে হারিয়ে মা পাগল হয়ে গেছে, আর এই মেয়ে তার সুযোগ নিচ্ছে…’ খেপা বাঘের মত হুংকার দেয় বৃষ্টি।
মোহনা ততক্ষণে দৌড়ে চলে গেছে বৃষ্টির ঘরে। লুকানো টেপ রেকর্ডার টা এনে চালিয়ে দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে রোদেলার গলা বেজে ওঠে, কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল ও।
-‘আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো সজীব! নীলের সম্পত্তি পাওয়ার জন্য কি না করেছি আমি! এবার নাহয় ওকে কিছুদিনের জন্য বিয়ে করতে হবে। ঢাকায় যাবার পথে নিজের বোনকে নদীতে ফেলে দিতেও হাত কাঁপেনি আমার, আর এই নীলকে ডিভোর্স দিতে পারবনা এটা ভাবছ কিভাবে! সবকিছু আমার নামে লিখে নিয়ে ওকে ছেড়ে দিয়ে তোমার সাথেই নতুন জীবন শুরু হবে আমার…’
রেকর্ডার বেজে চলেছে, হঠাৎ ই দৌড়ে পালাতে যায় রোদেলা। মদিনা খালা খপ করে ধরে ফেলে ওকে- ‘অনেক জ্বালাইছস ছেমড়ি! আমার লগে তুইতুকারি! এইবার জ্যালের ভাত খাবি।’
নীলের কাছে যেয়ে আলতো করে ওর মাথায় নিজের মাথা ঠেকায় মোহনা। ছোট্ট গুঁতো দিয়ে হেসে বলে- ‘পাওনা গুঁতো মিটিয়ে দিলাম, এবার আর শিং হবেনা আপনার!’ রোদেলা তখনো রাগে ফুঁসছে, মদিনা খালা দুহাতে জাপটে ধরে রেখেছে ওকে।
পাঁচ বছর পরঃ
সাড়ে তিন বছরের এক মিষ্টি মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছে তার বাবা-মা আর দিদুন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তার গাল চেপে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘নাম কী মা তোমার?’
-‘বতন্ত বিস্টি চৌধুলি!’ – আধো আধো গলায় মেয়েটি উত্তর দেয়।
হেসে ফেলে সকলে। ‘বসন্ত বৃষ্টি চৌধুরী ‘- পরিষ্কার করে আবার নামটা বলে দেয় মেয়েটির বাবা নীল চৌধুরী। বৃষ্টিহারা নীলের জীবনে দ্বিতীয়বার বসন্ত এনেছিলো মোহনা, তাই তাদের মেয়ের এই নাম রেখেছে সে। সবার হাসির ভেতরেও আঁচলের কোণা দিয়ে চোখের জল মুছতে দেখা যায় ‘বসন্ত বৃষ্টি চৌধুরী’র দিদুনকে। বৃষ্টি নামটা শুনলেই যে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার কথা বড় মনে পরে!
Read More: