পর্ব ১: শিশিরের প্রচুর ঘুম পাচ্ছে,,কিন্তু এই মুহুর্তে কোনোমতেই ঘুমানো যাবে না,,,আর মিনিট দশেক পরেই একটা ফোন আসবে,,,ফোনটা রিসিভ করে কিছু কথা বলা দরকার,,,কথাগুলো জেগে থাকা অবস্থায় বলা প্রয়োজন,,,ঘুমের তালে কথাগুলো বলা যাবে না,,,,গতকাল রাত দশটায় কারেন্ট গেছে আর এসেছে আজ সকাল ৫টায়,,, সারারাত শিশির ঘুমায় নি,,,,গরমে ওর ঘুম হয় না,,,,সারারাত ও জেগে থেকে কিছুক্ষণ সারা ঘরে হাটাহাটি করেছে, কিছুক্ষণ কানে হেডফোন গুযে গান শুনেছে আর কিছুক্ষণ বসে বসে মশার কামড় খেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ভোর হওয়া দেখেছে,,,,কারেন্ট এলে রুমে এসে শোয়ার পরও ঘুম আসছিলো না,,,কিছুক্ষণ হলো ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিলো ঠিক তখনই ফোনের আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলো ও,,,ফোনের স্ক্রিনে নাম দেখা যাচ্ছে শুভ্র।
- “হ্যালো”
-“হ্যাপি বার্থডে শিশির সোনা” - “হুম”
- ঘুম ভাঙ্গলো নাকি ভাঙ্গিয়ে দিলাম? “
- “ভাঙ্গিয়ে দিয়েছো,”
-“তাই নাকি,,আচ্ছা বেশ হয়েছে,, এখন আর ঘুমিয়ো না,,,চট করে উঠে পরো,,,জলদি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও,,,কেমন?”
- “হুম”
-“কি পড়বে মনে আছে তো?”
-“হুম”
-“গুড। আর শোনো ব্রেকফাস্ট করার দরকার নেই, আমরা বাহিরে একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো কেমন?”
-“হুম”
-“রাখি তাহলে,”
-“শুভ্র”
-“হ্যা বলো”
-(নিশ্চুপ)
-“কি কিছু বলছো না যে,,,? আচ্ছা থাক এখন বলতে হবে না,, দেখা হলে বলো,,,নাহয় দেরি হবে,,কেমন? আমি ঠিক ৯টায় তোমাকে পিক করতে আসবো,,ওকে,,,,বাই।”
-“হুম। “
নাহ,, কথাগুলো আর বলা হলো না। ও জানতো কথাগুলো ও বলতে পারবে না,,কেন? শুভ্র মন খারাপ হবে তাই,,,!!! নাহ,, কারন এটা না,,কারন ও শুভ্রকে ভয় পায়,,,এই মুহুর্তে যদি ও শুভ্রকে বলে ও আজ যেতে চাইছে না তাহলে শুভ্র যে কি করবে ও নিজেও জানে না,,,শুভ্রর কথামত আজ শাড়ি পরতে হবে,,,লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও গেলো ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে ৭.৩০ টা বাজে,,, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হওয়া শুরু করলো,,নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেডি হচ্ছে,,,হ্যা,, ও বের হবে,,কিন্তু শরীর খারাপের অজুহাতে দুপুরের আগে ফিরে আসবে,,,এর মধ্যে দরজা ঠেলে শিশিরের মা রাহেলা বেগম ভিতরে ডুকলেন,,
-“ভালো টাইমে এসেছো মা,,,শাড়িটা পরিয়ে দাও তো। “
-“তুই বের হবি? তোর মামাতো বোনগুলো কত শখ করে এসেছে এতো দিন পর, আজ একটু তোর সাথে হৈচৈ করবে বলে,”
-“দুপুরের আগে চলে আসবো মা। না গেলে ওরা অনেক মাইন্ড করবে।”
- “তো তোর ফ্রেন্ডদের বল বাসায় চলে আসতে, সবাই একসাথে আনন্দ করলি।”
-“কোনো প্রয়োজন নেই, বল্লামই তো দুপুরের আগে চলে আসবো।”
শাড়ি পড়ানো শেষ হলে রাহেলা বেগম কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন,,তারপর খুব শান্ত স্বরে বললেন নাস্তা দিচ্ছি খেতে আয়
-“খাবো না মা, ওদের সাথে বাহিরে নাস্তা করবো।”
-এটা কেমন কথা, না খেয়ে যাবি কেনো?
-“উফ!!! মা জোর করো নাতো, দুপুরে বাসায় খাবো। সকালে ও যদি ওদের সাথে না খাই কেমন দেখা যায় তুমিই বলো!!”
- “তাই বলে,,,!!!আচ্ছা অল্প একটু ক্ষীর খেয়ে যা,, তোর জন্যই সকালে রান্না করলাম।”
-“উফ!! একেতো এতো সকালে কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না,,তারউপর তুমি মিষ্টি খেতে বলছো,,,তুমি যাও তো এখন,,ক্ষীর ফ্রিযে রেখে দাও,,এসে ঠান্ডাটা খাবো,,,এখন যাও।”
এমনেই শিশিরের ভালো লাগছে না তারউপর মার জোরাজুরি।
৯টা বাজতে ১৫ মিনিট আগে শুভ্র ফোন দিলো,
-“কি রেডি?”
-“হুম,”
-“তাহলে নিচে নেমে দাড়াও, আমি আসছি।”
-“ওকে।”
নিচে নামার পর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে শিশির ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে ঝাড়তে লাগলো। ওর চুলগুলো মোটামুটি লম্বা আর ঘন তাই শুকাতে বেশ দেড়ি হয়। চুল শুকাতে ব্যস্ত শিশির খেয়ালই করলো না ওর একটু দূরে দাড়িয়ে কেউ একজন মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছ।
শুভ্র একমনে দাঁড়িয়ে দেখেছে,,, শিশির হাত দিয়ে ভেজা চুল নাড়ছে, সকালের হালকা মিষ্টি রোদ ওর মুখে এসে পড়েছে, দেখার মতো কিছু না, কিন্তু এই অতি সাধারণ দৃশ্যে কেনো শুভ্রর চোখ আটকে আছে!! কেনো?
আচ্ছা, মেয়টা কি দিন দিন আরো বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে নাকি!! নাহলে কেনো শুভ্রর ওকে এতো দেখতে ইচ্ছা করে!! ওকে একদিন না দেখলে কেনো এতো হাসফাস করে!! আবার ওকে দেখার পর চোখ আটকে যায়,,, চোখ সরানো দায় হয়ে যায়। কেনো!!
শিশির হঠাৎ সামনে তাকাতেই দেখল শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে, ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। শিশির কাছে যেয়ে বল্লো “দাড়িয়ে আছো কেনো ডাক দিবে না!! ” শুভ্র খুব সুন্দর করে হেসে বল্লো “দেখছিলাম “। শিশির প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিগ্যেস করলো,
-“তোমার বাইক কোথায়?”
- “আনি নি।”
-“তাহলে কিভাবে এলে? গাড়ি এনেছো? “
শুভ্র চোখের ইশারায় কিছুদূর একটা রিকশা দেখিয়ে বল্লো
-“ঐটা দেখো না?”
শিশির খুব বেশি অবাক হয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বল্লো
-“তুমি রিকশায় এসেছো!! কেনো?”
ওর প্রশ্ন করার ধরন দেখে শুভ্র হেসে ফেললো, হাসতে হাসতেই বল্লো
-“আগে রিকশায় উঠো পরে বলছি।”
রিকশা শিশিরদের গলি থেকে বের হতেই শুভ্র বললো,
-“বাইক অর কার আনিনি কারন আজ আমি শুধু তোমাকে দেখবো, বাইক অর কার আনলে তোমাকে দেখতে পারি না শুধু ড্রাইভ করতে হয় তাই রিকশা আনলাম। দুজন পাশাপাশি বসবো,,আর আমি তোমাকে দেখবো।”
শিশির শুভ্রর দিকে তাকালো,,ও একটা ডার্ক ভায়োলেট কালার শার্ট পরেছে,,চুলগুলো অন্যদিন জেল দিয়ে সেট করা থাকলেও আজ ওর মাথা ভর্তি ঘন চুলগুলো ঝরঝর করছে,,বাতাসে কপালে চোখে আছরে পড়ছে,,শুভ্র খুব মনযোগ দিয়ে চুলগুলো বাগে আনার চেস্টা করছে কিন্তু চুলগুলো যেন আজ বেপরোয়া। শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে তাকালো শিশিরের দিকে। তাকিয়ে খুব সুন্দর একটা হাসি দিলো। এতো সুন্দর হাসি কেনো ছেলেটার!! এই হাসি দেখে কে বলবে এই ছেলেটা কতোটা ভয়ানক।
পর্ব ২
রিকশা দোয়েলচত্তর ছাড়িয়ে সামনে এগুচ্ছে।শুভ্র শিশিরের হাতের আঙ্গুলগুলোর ফাকে নিজের আঙ্গুলগুলো গুজে মুঠ করে ধরে রেখেছে,,,এবং শিশিরের দিকে তাকিয়ে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। শিশিরের সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।ও শুভ্রর কোনো কথাই ঠিকমতো শুনছে নাহ। আজকে একটা বিশেষ দিন। ওর জন্য নাহ শুভ্রর জন্য। আজকে শিশিরের জন্মদিন। জন্মদিন নিয়ে শিশিরের তেমন মাথা ব্যথা নেই,,,কিন্তু শুভ্র এই দিনটি নিয়ে খুব উত্তেজনায় থাকে,,,প্রচুর প্লান প্রোগামিং করে। গতবছরও করেছিল। ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনেই করে যেনো শিশিরের ফ্রেন্ডরাও জয়েন করতে পারে।
শুভ্র আর শিশিরের ফ্রেন্ডরা ছাড়াও আরো অনেকে ছিলো। ওদের ফ্রেন্ডরা ছাড়া কেওই সেলিব্রেট করতে আসে নি,,এসেছিলো তামাশা দেখতে। হ্যাঁ,,, তামাশা। ক্যাম্পাসের সব মেয়ের কাছে এখন শিশির একটা তামাশাই তো। ক্যাম্পাসের হ্যান্ডসাম হাংক শুভ্র,,,মেয়েদের ক্রাশ,,,,সেই ছেলে কিনা শিশিরের মতো এই সাধারন মেয়ের সাথে ঘুরে। শিশির যে শুভ্রর যোগ্য না তা সেই মেয়েগুলো ওকে বুঝাতে একটুও কার্পণ্য করে না।রুপ, রং,সৌন্দর্য নিয়ে শিশিরের কোনোকালেই মাথাব্যথা ছিল না,,,কিন্তু এখন নিজেকে আসলেই তুচ্ছ মনে হয়। বিশেষ করে শুভ্রর পাশে দাড়ালে।
শিশিরের ধ্যান ভাঙলো শুভ্রর ডাকে।
- এই শিশির শুনছ!!
- হুম।
- আজকে আমরা সারাদিন এই রিকশায় ঘুরবো।
- হুম। বলেছ একবার।
- তোমার ভালো লাগছে না?
- আমার ভালো লাগা না লাগা দিয়ে কি আসে যায়!!
- কেন যাবে আসবে না। আজ আমি তাই করবো যা তুমি করতে চাও।
শিশিরের এবার খুব রাগ লাগতে লাগলো,,,সাথে হাসিও পেলো।শিশির তাচ্ছিল্যের স্বরে বল্লো, - আজ!!! শুধু একটা দিন আমর ইচ্ছা অনিচ্ছার এতো দাম দেখানোর কি প্রয়োজন!!!!
-শিশির আমি সবসময়ই তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম দেওয়ার চেস্টা করি। (গম্ভীর স্বরে) - ভুল বললে,,শুধুমাত্র সেইগুলোর দাম দাও যা তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলোর সাথে মিলে যায়।
শুভ্র এবার খুব তিক্ষ্ণ চোখে শিশিরের দিকে তাকালো। শিশির তখনো সামনে তাকিয়ে।কিন্তু ও ঠায় বুঝতে পারছে শুভ্র ওর দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে। ভয়ে শিশিরের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। রাগের মাথায় এসব বলেতো দিয়েছে কিন্তু এখন কি করবে।শুভ্র কি রাস্তার সবার সামনে এখন ওকে অপমান করবে!!
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুভ্র খুব শান্ত স্বরে জিগ্যেস করল
- শিশির তুমি কি নিজে কোনো কারনে রেগে আছো নাকি আমাকে রাগাতে চাইছো?
- (নিশ্চুপ)
- আমাকে রাগানোটা যে ঠিক হবে না তাকি বুঝতে পারছো?
-(নিশ্চুপ)
এবার শুভ্র নাক মুখ কুচকে চোখ বন্ধ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বল্লো
-শিশির আমি কিন্তু প্রচুর বিরক্ত হচ্ছি। কথার জবাব দাও।
শুভ্রর রাগের মাত্রা বাড়ছে। রাগে ওর মাথা দপদপ করছে। ওর ইচ্ছা করছে শিশিরকে এই মুহূর্তে রিকশা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে।নাক মুখ কুচকানো অবস্থাই শুভ্র চেচিয়ে উঠল
-এই মামা,,রিকশা ঘুরাও
এতো জোরেই ও চিতকার করল যে ভয়ে শিশিরের আত্মা খাচা ছাড়া হবার উপক্রম। রিকশাওয়ালাও হকচকিয়ে গেল,,কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থেকে রিকশা ঘুরালো।
রিকশা শিশিরদের বাড়ির গলির সামনে আসার আগ পর্যন্ত শুভ্র ওর হাত ঠিক আগের মতই ধরে রেখেছিল। গলির সামনে আসার পর নিজেই হাত ছেড়ে দিল কিন্তু নেমে যাওয়ার কথা বল্লো না।মনে মনে খুব করে চাইছিল শিশির যেন নেমে না যায়। একটা ক্ষীণ আশা ছিল হয়ত শিশির বলবে “আমি বাসায় যাবো না। চল ঘুরব।” কিন্তু নাহ,,,, কিছুক্ষণ বসে থেকে শিশির ঠিকই নেমে গেল।
ও নেমে যাওয়ার সাথে সাথে শুভ্র রিকশা নিয়ে সামনে চলে গেল।
রাত ৯.৩০টা বাজে। শিশির মাত্র রুমে ডুকল। সকালে বাসায় ফেরার পর ওর কাজিনদের খুশি দেখে কে,,!! তারপর শুরু হল ওদের হৈচৈ,আড্ডা। কেক কাটা, খাওয়া দাওয়া,নাচানাচি পর্ব শেষ করে শিশির এখন খুব ক্লান্ত। পড়ার জন্য একটা বই হাতে নিয়েছে অমনি ফোন এল শুভ্রর। বাসায় ফেরার পর শুভ্র আর ফোন দেয় নি তাই শিশিরও দেয় নি। এখন ফোন ধরে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাও রিসিভ করল,,
- হ্যালো,
- কি করছ?
- তেমন কিছু না।
- ডিনার করেছ?
- হুম।
- তাহলে আর রাত করো না ঘুমিয়ে পড়। সকালে ক্লাস তোমার ৮টায় না?
- হুম।
- আমি সময়মত চলে আসব।
- আচ্ছা।
- রাখি, শিশির।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই রেখে দিল শুভ্র। কেটে যাওয়ার পর শিশিরের মনে হল শুভ্র সকালে একসাথে ব্রেকফাস্ট করবে বলেছিল কিন্তু করা হয় নি। ওর যা স্বভাব এখনো কিছু খেয়েছে কি!! জিগ্যেস করা কি উচিত ছিল!! সকালের ঘটনার জন্য সরি বলতে পারত,,কিন্তু বলে নি শিশির। কারন এসব অনুতপ্ত, যত্ন করার অনুভূতিগুলো মন থেকে আসা প্রয়োজন। এই জোর করে বেধে রাখা সর্ম্পকে শুভ্র জন্য শিশিরের মন থেকে কোনো অনুভূতিই আসে না। হ্যাঁ,,,, জোর করে বেধে রাখাই তো,,,,,।
শুভ্রকে শিশির প্রথম দেখে ভার্সিটিতে ওদের নবীন বরণের দিন।
নতুন ভার্সিটি, নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু,,,, শিশির আনন্দে কুটুম কুটুম করতে করতে সেদিন ভার্সিটি যায়। খুব সাধারনভাবেই সেজেছে ও। হালকা বেগুনি কালার একটা জর্জেট শাড়ি পড়েছে, লম্বা চুলগুলো একটা এলো খোপা করেছে। মুখে হালকা পাওডার, চোখে আইলাইনার,আর লিপস্টিক,,,ব্যাস!! কিন্তু ক্যাম্পাসের হলরুমে ঢোকার পর ওর মনে হচ্ছে ও বিশাল ভুল করে ফেলেছে৷ আর একটু সাজা দরকার ছিল। বাকি মেয়েগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা সব বিয়ে খেতে এসেছে।এক একজনের সাজ দেখে ওর মাথা ঘুরে যাচ্ছে। এর মধ্যে এক মেয়েতো রীতিমত বউয়ের সাজে এসেছে।
নিজেকে ওদের মাঝে খুব বেক্ষাপ্পা লাগছে শিশিরের। ও চুপচাপ এক যায়গায় দাঁড়িয়ে দেখছিল ঠিক তখনি ওর সামনে দিয়ে একটা ছেলে গেল। শিশির আশ্চর্য হয়ে গেল,,এতো ছেলে না যেন দেবদূত। শিশির হা করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলেটার মাথাভর্তি ঘন চুল এলোমেলো হয়ে আছে,চোখ, নাক, ঠোঁট এতটাই নিখুঁত,,, দেখলে মনে হয় কোন চিত্রকারের পেন্সিলে আকা।সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটার খাড়া কন্ঠক। এই খাড়া কন্ঠকটাই যেনো ছেলেটাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে।আচ্ছা,,,এতো সুন্দরও কি ছেলে হয়!!!! শিশিরের পেছন থেকে কেউ একজন জিগ্যেস করল,
- কি সুন্দর না ছেলেটা?
শিশির পিছনে না ফিরেই জবাব দিল, - হুম,,, সুন্দর তো বটে।
- এই সৌন্দর্য্য শুধু দেখেই যেতে পারবে। ছুয়ে দেখার সাধ্য হবে না।
এবার শিশিরের একটু লাগলো। ও পিছনে ফিরে দেখে সেই বউ সাজে মেয়েটা।শিশিরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি বললো
- দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর ছেলে। একমাত্র ছেলে। শুভ্র আহমেদ। ওনার সৌন্দর্যে ক্যাম্পাসের সব মেয়েরা পাগল।
- তুমি জানো কিভাবে?
- আরে আমি যেখানে যাই, সেখানকার সব খবরাখবর নিয়েই যাই। ক্যাম্পাসের ৮০% মেয়েদের সাথে অলরেডি তার রিলেশন হয়ে গেছে।
- ৮০%!!
- হুমমম,,,,তাও আবার সব হাই ক্লাস মেয়ে। মিডেল ক্লাস মেয়েদের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই।
শিশির বুঝতে পারছে মেয়েটা খুব সূক্ষ্ণ ভাবে ওকে শুভ্রর থেকে দূরে থাকতে বলছে। যদিও ওর নিজেরও আগ্রহ নেই এই শুভ্রর ব্যাপারে। তাই ও আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “ও”।
-বাই দা ওয়ে,,তোমার নাম কি? - আফরিন শিশির।
- ফার্স্ট ইয়ার? কোন ডির্পাটমেন্ট?
- একাউন্টিং।
- ও,,,আমিও ফার্স্ট ইয়ার,,কিন্তু ম্যানেজমেন্ট।
এর মধ্যেই একটি ছেলে ” এই মিলি” বলে ডাক দিল। মেয়েটিও “আসছি ভাইয়া” বলে গদগদ করতে করতে চলে গেলো।
আচ্ছা,,, মেয়েটার নাম তাহলে মিলি। শিশির আবারো মানুষ দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেল। হঠাৎ একটা ছেলে সামনে এসে বলল,
- হাই আমি ফারাবি।
- শিশির ( হালকা হেসে)
- ফার্স্ট ইয়ার?
- হুম।
- আমিও। অনেকক্ষন যাবত দেখছিলাম তুমি একা দাঁড়িয়ে, তাই একটু কথা বলতে এলাম।
- আসলে নতুন মানুষদের সাথে কথা বলতে আমার একটু আনইজি লাগে। তাই আর কি!!!
- আরে এটা কোনো ব্যপার হল। চল, ওইদিকে যাই। ওইদিকে আরো কয়েকজন নিউ ফ্রেন্ড আছে।
সেদিনের পর শুভ্রর সাথে শিশিরের আরো দুই তিনবার দেখা হল, কথাও হল। এই দুই তিনবার দেখা হওয়ার পরেই শুভ্র ওকে প্রোপজ করে বসল। প্রোপজাল পাওয়ার পর শিশির যত না খুশি হয়েছিল তারচেয়ে বেশি হয়েছিল অবাক।এই গ্রিক দেবতা শিশিরের মত একটা সাধারণ মেয়েকে পছন্দ করে!!!!! প্রচুর অবাক হয় শিশির।
পর্ব ৩
শুভ্র এখন বসে আছে হাতিরঝিল। সকালে শিশিরকে নামিয়ে দিয়ে সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরেছে। রিকশাওয়ালাও তেমন কিছু বলেনি,,,,একেতো শুভ্র ভাড়াটা অনেক দিবে, দ্বিতীয়ত বেচারার আজকে গার্লফ্রেন্ড্রে সাথে লেগে গেছে,,!!তাই রিকশাওয়ালাও সারাদিন ঘুরেছে,,,, সারাদিন ঘুরে কিছুক্ষণ আগে রিকশা ছেড়েছে। যা ভাড়া দিয়েছে তাতে রিকশাওয়ালা ডাবল খুশি। এখানে এসে বসেই শিশিরকে ফোন দিয়েছে। শিশিরের সাথে কথা বলে ও একটা সিগারেট ধরালো। ওর সিগারেটের নেশা নেই কিন্তু কোনো ব্যাপার নিয়ে খুব টেনশন করলে প্রচুর সিগারেট টানে। এখন ওর টেনশনের কারন মূলত শিশির।
আচ্ছা,,,, এভাবে জোর করে সম্পর্ক চালানোটা কি আসলেই ঠিক হচ্ছে!!!! নাহ,,,ঠিক হচ্ছে না,,,কিন্তু ও যে নিরূপায়। আচ্ছা শিশিরকে কি মুক্তি দিয়ে দিবে!! শেষ করে দিবে এই সম্পর্কটা!!! এর আগেও ও একবার ভেবেছিল এই ব্যাপারে,, যখন সম্পর্কের আট মাসের মাথায় শিশির ওকে বলেছিল” এভাবে জোর করে কতদিন!! জোর করে ভালোবাসা আদায় করবে কিভাবে??” সেদিন শুভ্র রেগে বাসায় চলে আসে,,কি ভাবে শিশির নিজেকে!!! শুভ্রতো ওকে ভালোবাসে নাকি,,,ওর ভালোবাসাটা কি মেয়েটা বুঝে না,,,!! যাবে না ফিরে আর ঐরকম মেয়ের কাছে,,,ওরকম একটা গেলে আরো দশটা আসবে তাও ওর চেয়ে সুন্দর।
এরপর শুভ্র দুইদিন বাসায় ছিলো,,ভার্সিটি যায়নি,,যায়নি বন্ধুদের আড্ডায়। এই দুইদিনে ওর খাওয়া নাওয়া বলতে গেলে লাটে উঠেছিল। এই দুইদিনে দুটো কাজ ও খুব মনযোগ দিয়ে করেছে তা হল একের পর এক সিগারেট টানা আর কিছুক্ষণ পর পর মোবাইল চেক করা ভেবে এই বুঝি শিশির মেসেজ দিল অথবা ফোন দিল। যদিও শিশির কোনো মেসেজ অর ফোন দেয় নি কিন্তু তিনদিনের দিন ভোর হতে না হতে শুভ্র ছুটে গিয়েছিল শিশিরদের বাড়ি। বাড়ির সামনে দাড়িয়ে শিশিরকে বেশ কয়বার ফোন দেওয়ার পর ও রিসিভ করতেই শুভ্র বললো,
-একটু বারান্দায় আসবে??
-এখন!! মানে কি!! তুমি কোথায়?
-জাস্ট ৫মিনিটের জন্য। আসবে প্লিজ। কথা দিচ্ছি বেশিক্ষণ নিবো না।
কথা না বাড়িয়ে শিশির বারান্দায় এসে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। একি অবস্থা শুভ্রর!!! চোখের নিচে কালি, উসকখুসক চুল, সিগারেট টেনে টেনে জ্বলিয়ে ফেলা ঠোঁট। শিশির অবাক হয়ে জিগ্যেস করল
-এমন অবস্থা কেনো চেহারার?? কোথায় ছিলে এতদিন??
-(নিশ্চুপ)
-শুভ্র তুমি বোধহয় এই কয়দিন ভালোভাবে ঘুমাও নি,,,এত সকালে কেন এলে এখানে?একটু পরেই তো দেখা হত।
-(নিশ্চুপ)
শিশির বুঝল ওকে প্রশ্ন করে আর লাভ নেই ও জবাব দিবে না তাই নিজেও চুপ করে গেল। বেশ কিছুক্ষন কেটে যাওয়ার পরও শুভ্র কিছুই বলছে না,,পলকহীন তাকিয়ে আছে শিশিরের দিকে,,,এবার শিশিরের খুব অস্বস্থি লাগতে লাগল। আরো কিছুক্ষণ কেটে গেলে শিশির এবার ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল ওর ঠোঁট হালকা নড়ছে। ও কি কিছু বলছে,,ফোনটা ভালোভাবে কানে লাগিয়ে শুনতে পেলো শুভ্র কাউন্টিং করছে,
- ১০, ৯, ৮, ৭……২,১, ০.. হয়েছে। এখন তুমি ভিতরে চলে যাও। তোমার আজকে ক্লাসতো ১০টায় তাই না,,আমি ঠিক ৯টায় পিক করতে চলে আসবো।
হুট করে এসেছিল আবার হুট করেই চলে গেল শুভ্র। শিশির হতভম্ব হয়ে শুধু ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। এমন কেনো মানুষটা!!
আজ ঠিক এক বছর দুইমাস পর আবার শুভ্রর মনে হচ্ছে শিশিরকে মুক্ত করে দিবে কি!!! কি হবে এভাবে বেধে রেখে। মেয়েটা যে এখনো ওর ভালোবাসাটাই বুঝল না।আচ্ছা সেদিন যদি ও না যেত নবীন বরণে,,,যদি না দেখত সেদিন শুভ্র ওকে তাহলে কি খুব ক্ষতি হত। আর যাই হোক এভাবে কষ্ট পেতে হত না কারোই। চোখ বন্ধ করে শুভ্র ফিরে গেল সেইদিনটায় যেদিন শিশিরকে দেখেছিল প্রথমবার।
বন্ধুদের পেরাপেরিতে সেদিন প্রথম বর্ষের সুডেন্টদের নবীন বরনে যাওয়ার জন্য রাজি হয় শুভ্র। কারন অনুষ্ঠানের দ্বায়িত্ব নিয়েছিল ওর ফ্রেন্ডরা। সেদিন যখন বাসা থেকে বাইক নিয়ে বের দিন তখনো দিন বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল। একটা রেস্টুরেন্টে ডুকে মাত্র ব্রেকফাস্ট করা শুরু করে অমনি নামে বৃষ্টি। কোনোরকম খেয়ে না খেয়েই বের হয়ে পরে,,, বৃষ্টি বেরে গেলে যাওয়া বড় কষ্ট হয়ে যাবে,,,কিন্তু একি!!! মাঝরাস্তায় বাইক যায় বন্ধ হয়ে। শুভ্রর মেজাজ যায় গরম হয়ে। সবচেয়ে বেশি রাগ হয় সাজেদের উপর,,,শালা আইসা নেই ক্যাম্পাসে তোরেই আগে ফাটামু,,,রাগের মাথায় এসব বিড়বিড় করতে করতে শুভ্র হেটেই যাওয়া শুরু করে। ক্যাম্পাসের হলরুমে যখন ও ডুকে তখন ও অর্ধেক ভিজে আছে। সাজেদকে দেখেই সেদিকে গিয়ে দেয় সাজেদকে একটা বড়সড় ঘুষি,,।
-দেখ শালা,,তোদের জ্বালায় এই ভিজতে ভিজতে আসতে হইসে কি এক ছাইপাঁশ নবীন বরনে।
- না আইসা কি তুমি পারতা নাকি চাচ্চু,,, না আসলে তোমার বাসায় হামলা দিতাম না আমরা।(সাজেদ)
-তা মাম্মা আজকে কি মনে কইরা এত প্রকৃতি প্রেমিক হইলা যে এমন ভিজতে ভিজতে আইলা।(অনিক) - তুই এমন দাত কেলাইতাসত কেন!! মাইয়্যা পাইয়া গেসস নাকি!!(শুভ্র)
-আরে মাম্মা কইস না,,,মাইয়্যা না এক একটা চাঁদের টুকরা।(অনিক)
-তা এই পর্যন্ত কয়টা চাঁদ খাচায় আটকাইলি?(শুভ্র)
-একটাও না,,,মাইয়্যা দেখলেই অয় যেমনে খাবুত খাবুত করে!! আটকাইব আর কি!! (সাজেদ)
এসব বলাবলি করেই হাসছিল ওরা। অনুষ্ঠানের দ্বায়িত্ব ওর বন্ধুদের উপর থাকায় ওরা কিছুক্ষণ পর পর ব্যাস্ত হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এদিকে শুভ্রও শান্তিমত বসে থাকতে পারছে না,,,ও এসেছে ১৫মিনিটও হয় নি এর মধ্যেই কিছুক্ষণ পর পর মেয়েরা আসছে কথা বলতে। শুভ্র কোন পাত্তা না দিলেও মেয়েগুলোর উৎসাহ কমছে না,,ওরা এসেই নিজেদের মত ভাব জমাতে চাচ্ছে। কি আশ্চর্য্য!!! মেয়েগুলোর কি আত্নসম্মানবোধ নেই নাকি…!! আর কিছুক্ষণ বসার ইচ্ছা থাকলেও মেয়েগুলোর জ্বালায় আর বসা গেলো না। ও উঠে সোজা এগিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে,,,হঠাৎ করেই কারো হাসির আওয়াযে দাড়িয়ে গেল শুভ্র।
হাসির আওয়াজটা একটু অন্যরকম,,,ঝুনঝনির ঝুনঝুন শব্দের মত। অন্যসব কোলাহল ছাপিয়ে আওয়াজটা শুভ্রর কানে বাজচ্ছে। ফিরবে কি ফিরবে না,,,ভাবতে ভাবতেই ফিরে তাকালো পিছনে,,,এদিক সেদিক চোখ ঘুরাতেই পেয়ে গেল হাসির উৎস। কিন্তু….!!! শুভ্রর চোখ যেন আটকে গেল মেয়েটাকে দেখে,,,মেয়েটা হাসছে,,হাসলে মেয়েটার গালে একটা টোল পড়ে। খুব সাধারণ একটা শাড়ি, খুব সাধারন তার সাজ, চুলগুলো খোপা করা কিন্তু ছোট ছোট চুলগুলো কানের পিছন থেকে গলা বেয়ে লতাপাতার মত নেমে এসেছে। খুব সাধারণ একটা মেয়ে কিন্তু শুভ্রর মনে হচ্ছে ও অনিন্দ্য কিছু দেখছে। শুভ্রর চোখ সড়ানো দায় হয়ে যাচ্ছে। ওর হৃদপিণ্ডটা খুব জোড়ে জোরে লাফাচ্ছে এই বুঝি বের হয়ে গেল খাচা থেকে। ও কোনোরকমে কাপা কাপা হাতে ফোন বের করে সাজেদকে ফোন দিয়ে বলল,
-আমি গেটের কাছে দাড়ানো, জলদি আয়।
বলেই ফোন কেটে দিল। সাজেদ আসতেই শুভ্র ইশারায় জিগ্যেস করল,
-মেয়েটার নাম জানিস?
-আরে,, ওইটা তো আমাদের এলাকার মেয়ে।
-তোর এলাকার!!(ভ্রু কুচকে)
-হুম,,,কি যেন নাম,,কি যেন নাম,,,!!! হুম মনে পড়েছে শিশির।
-তোর এলাকার আগেতো বলস নাই,,
-আগে কেনো বলব,,এটা কি বলার মত কোনো কথা!!( অবাক হয়ে)
-যাই হোক,, আমি আর ৫মিনিটের মত আছি। মেয়েটার নিজেরসহ ওর চোদ্দগুষ্টির বায়োডাটা আমাকে এনে দিবি,,, যা দ্রুত।
- ৫মিনিট কেন ৫০ মিনিট সময় দিলেও আমি তোর কাজ করতে পারমু না। বেশি শখ লাগলে নিজে যাইয়া খোঁজ নেন। (শয়তানি হাসি দিয়ে)
শুভ্র কটমট করে তাকালো সাজেদের দিকে, কিন্তু সাজেদ সেই চাহনি সম্পুর্ন উপেক্ষা করে দাঁত বের ভেটকাতে ভেটকাতে চলে গেল। সাজেদ যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরেই শুভ্রর ফোনে মেসেজ এলো ” সন্ধ্যার পর সব ইনফো পেয়ে যাবি। এখন জ্বালাইস না।” মেসেজটা পেয়েই শুভ্রর মুখে বিশালাকার একটা হাসি ফুটে উঠল।
পর্ব ৪
পরেরদিন শুভ্র খুব সকালে বের হয়ে গেল ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। কাল সন্ধ্যায় সাজেদ ওকে শিশির সম্পর্কে সম্পুর্ন বায়োডাটা দিয়েছে। শিশিরের বাবা আফজাল কবির একজন খুব সাধারন ব্যবসায়ী। মা শিরিন সুলতানা গৃহিণী। তিন ভাই বোন ওরা। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজো ভাই দুইবার ইন্টার ফেল হয়ে এখন বাবার সাথে ব্যবসায় বসে। বছর তিনেক হল ওরা সাজেদদের এলাকায় উঠেছে। এক ফুফু থাকে কানাডায়। মাঝে সাঝে আসে বাংলাদেশে।মেয়ে হিসেবে শিশির একদম ক্লিন অর্থাৎ এখন পর্যন্ত এলাকার কোনো ছেলের সাথে ওকে কথাও বলতে দেখা যায়নি। শিশির সম্পর্কে এতো ইনফো পাওয়ার পরও শুভ্রর মনটা খচখচ করছিল। গতকাল ও যে ধাক্কাটা খেল তাকি খানিকের মোহ ছিল নাকি অন্যকিছু। এই ব্যাপারটাই ক্লিয়ার করতে আজ এতো সকালে ক্যাম্পাস আসা উদ্দেশ্য শিশির।
সাজেদের ইনফো অনুযায়ী ও গেল একাউন্টং ডিপার্টমেন্টে। ভিতরে একটু উঁকিঝুঁকি দিল কিন্তু শিশিরকে দেখা গেল না। তাহলে কি এখনো আসে নি। শুভ্র ফিরে গেল।
ভেবেছিল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে আবার যেয়ে একবার খোঁজ নিবে, কিন্তু তা আর করা হল না,,হারামিগুলো নিজেরা গুনে গুনে পুরো তিনটা ক্লাস করল ওকেও ধরে বেধে ক্লাস করালো। ক্লাস শেষে শুভ্র এক দৌড়ে শিশিরের ক্লাসের সামনে চলে এল কিন্তু হায়!! ক্লাস পুরা ফাঁকা,,মানে কি ওদের ক্লাস কি শেষ!!! আজ তাহলে আর দেখা হবে না!! শুভ্র মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। রাগে গজগজ করতে করতে আর মনে মনে বন্ধু নামে মিরজাফরগুলোর পিন্ডি চটকাতে চটকাতে শুভ্র হেটে চলল ক্যাম্পাসের পিছনে পুকুরটার দিকে। পুকুরের কাছাকাছি আসতেই ওর হাটার গতি কমে গেলো।
পুকুরের পাড় গেসে দাড়িয়ে থাকা বিশাল বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে এক এলোকেশী। হাত ভর্তি কৃষ্ণচূড়া ফুল। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া ছুয়ে গেল এলোকেশীকে,,সেই হাওয়ায় তরতর করে লাফিয়ে উঠল মেয়েটির এলোমেলো চুল। সেইসাথে মেয়েটির মুখে ফুটে উঠল এক স্নিগ্ধ হাসি আর গালে পড়ল টোল। শুভ্রর সময় যেন থমকে গেল সেই দৃশ্যে।
আবার!! আবার সেই অনুভুতি,,, শুভ্রর ভিতরটা ধরফর করতে শুরু করল,,এই বুঝি তড়াক করে ব্যাঙের মত একটা লাফ দিবে। ও কোনোরকমে ওর বুকের বা পাশটা চেপে ধরে পিছনে ঘুরে গেল। খুব হাপাচ্ছে শুভ্র,,,নিজেকে শান্ত করা দরকার। মূহুর্ত কয়েকপর শুভ্র ঘুরে তাকাল কিন্তু মেয়েটি নাই, চলে গেল!!! ধুর ছাই!! দিনটাই বাজে আজকে।
পরেরদিন শুভ্র শিশিরের দেখা পেল ক্যান্টিনে। শুভ্র কিছু চিন্তাভাবনা না করেই ধপাস করে বসে পড়ল ওর সামনে। শিশির তখন কেবলমাত্র চায়ের কাপটা নিয়েছে চুমুক দেওয়ার জন্য,, কিন্তু এভাবে একজনকে বসতে দেখে ও ভয় পেয়ে গেল। চায়ের কাপ থেকে অল্পএকটু চা ছলকে টেবিলে পড়ে গেল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভয় পেল সামনে বসে থাকা মানুষটিকে দেখে,, এযে ভার্সিটির মেয়েদের জাতীয় ক্রাস, শুভ্র। উনি এখানে কেন,,!! শুভ্রই প্রথমে জিগ্যেস করল,
-এখানে বসে চা খাচ্ছো যে, ক্লাস নেই?
- জ্বী, মানে,, আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। (ভয়ে ভয়ে)
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। ক্লাসের কি খবর?
-জ্বী মানে,,,আসলে লেট হয়ে গিয়েছিলতো তাই,,,
-এভাবেতো ক্লাসে লেট করা ঠিক না। একদমই ঠিক না। প্রথমদিকের ক্লাসগুলো খুব ভালোভাবে করা উচিত।
-জ্বী ভাইয়া মানে পরেরটা এটেন্ড করবো।,,,,,,,,মানে ভাইয়া আমি এখন উঠি। পরের ক্লাসতো শুরু হয়ে যাবে তাই,,,
-তাই নাকি। আচ্ছা যাও আবার দেখা হবে।
এতটুকু শুনেই শিশির ভো দৌড়ে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে গেল। শুভ্র সেদিক তাকিয়ে হাসছে,,মেয়েটা কি ভয় পেয়ে গেল নাকি!! কিউট তো,,!!
পরেরদিন শিশির আর সায়রা(ফ্রেন্ড) ক্লাসরুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ঠিক তখনই গতকালকের মত শুভ্রর আগমন। হুট করে উপস্থিত হওয়ায় দুই ফ্রেন্ডই বেশ চমকে যায়। শুভ্র হাসি হাসি মুখ করে জিগ্যেস করে
-কেমন আছো শিশির?
-জ্বী এইতো ভালো।
-আমাকে জিগ্যেস করলে না!!
-জ্বী,,মানে,,,কেমন আছেন ভাইয়া?
-ভালো। আরে শিশির গতকালতো তোমার ফোন নাম্বারটা নিতেই ভুলে গেছি।
-আমার নাম্বার??
-হুম,,কেনো তুমি ফোন ইউস করো না!!
-না,,মানে,,জ্বী করিতো,
-তাহলে দাও দাও নাম্বারটা দাও।
নাম্বারটা পেয়ে যেন শুভ্র চাঁদ হাতে পেয়ে গেল। খুশিতে হেলতেদুলতে চলে গেল।পিছনে দুই ফ্রেন্ড হতভম্ব হয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। সেদিন এক ক্লাসের পর শিশির আর ওর ফ্রেন্ডরা মাঠে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল হঠাৎ ফারাবি বলে উঠল, “শিশির শুভ্র ভাই কি তোর দিকে চেয়ে আছে? দেখ তো।” শিশির ঘুরে তাকাল। তাকিয়েই ও জমে গেল। শুভ্র তিক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ঠিক শিশিরের দিকে। এই চাহনির মানে কি,,!! শিশির কি কিছু ভুল করল,, শিশিরের ঘাম ছুটে গেল।
সেদিন রাতে অবশ্য শুভ্র কোনো ফোন দেয়নি। কিন্তু পরদিন ক্লাসে যাওয়ার আগেই শিশিরের ডাক পরল শুভ্রর কাছে। শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে। শিশির হেটে গিয়ে দাড়াল শুভ্রর সামনে। শুভ্র খুব শান্ত চোখে তাকাল শিশিরের দিকে। একমূহুর্ত চেয়ে চোখ নামিয়ে নিল শিশির,,,আশ্চর্য্য এত ভয় লাগে কেন মানুষটাকে!!
শুভ্র কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে খুব শান্তভাবে বলল
-তোমাকে ভালোবাসি শিশির।
শিশিরের কান তব্দা মেরে গেল। কি বলল!! ভালোবাসে!! তাও আমাকে!! ও কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই শুভ্র বলল
- যেদিন নবীন বরণে প্রথম দেখলাম সেদিন থেকেই ভালোবাসি।
-এতো সহজে কি ভালোবাসা যায়!!
-কঠিনে কিভাবে ভালোবাসে তাইতো জানি না। জানলে নাহয় বলতে পারতাম আমার ভালোবাসাটা কি সহজে হল নাকি কঠিনে,,
-আপনিতো আমাকে ভালোভাবে চিনেনও না,,
-কাউকে ভালোবাসতে হলে তাকে চিনতে হয় এই থিউরি তোমার মাথায় কে ঢুকালো!!
-কিন্তু আমিতো……….
-সময় প্রয়োজন?
…..হুম
-নাও সময়। কোনো ব্যাপার নাহ।
শিশির চলে গেল,,, দাড়িয়ে রইল শুভ্র কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে।এইকয়দিনে শুভ্র এতটুকু বুঝে গেছে যে শিশিরের জন্য ওর অনুভূতিগুলো কোনো মোহ বা প্রেম না,,,তা এগুলোর অনেক অনেক উর্ধ্বে।
এরপর শুভ্র যতবার শিশিরকে উত্তরের জন্য জিগ্যেস করে ও আমতা আমতা করতে থাকে। শেষমেশ শুভ্র বলল” তোমাকে আমি আরএকটা অফার দেই শিশির,,,তুমি চাইলে আমরা ১মাস ডেট করতে পারি। তোমার জন্য ভালোবাসতে হলে যেহেতু একজন আরএকজনকে চেনাটা অনেজ জরুরি তাহলে ১মাস কিন্তু যথেষ্ট সময় হবে আমাকে চেনার জন্য। ১মাস পর যদি সব ঠিক থাকে তাহলে কন্টিনিউ করব আর যদি একজন আরেএকজনকে ভালো না লাগে তাহলে ব্রেকআপ করে ফেলব,,,কি বল,,, রাজি?”
পর্ব ৫+৬
সকল সুন্দর জিনিসের প্রতিই মানুষের লোভ থাকে। আর যদি সেই সুন্দর এবং মুল্যবান জিনিস নিজে এসে হাতে ধরা দেয় তাহলে যে লোভ সামলানো দায়। শিশিরও লোভে পড়ে গেল। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটাকে নিজের করার লোভ। আর তাছাড়া ১মাসই তো। ১মাস পড় ভালো না লাগলে ব্রেক আপতো করাই যাবে। এই ভেবেই ও হ্যাঁ বলে দিল। কিন্তু ১মাসেই ও বুঝে গেল এই সম্পর্কের কোন ভবিষ্যত নেই।
শুভ্রর সাথে ওর আকাশ পাতাল তফাৎ। রুচিবোধ, চলাফেরা, সামাজিক অবস্থা, সৌন্দর্য সবদিক দিয়েই দুজন বেক্ষাপ্পা। তারউপর ক্যাম্পাসের মেয়েগুলো,,,, ও একমুহূর্তের জন্য কোথাও একা বসতে পারতো না,,মেয়েগুলো যেখানে সেখানে ওকে যা ইচ্ছা শুনিয়ে যেত। যেন ও কোন মহাপাপ করে ফেলেছে। শুভ্রকে ও কিছুই বলতে পারত না কারন মেয়েগুলো বরাবরই ওর রং রুপ, সামাজিক স্ট্যাটাস নিয়ে কথা শুনাত। শিশির যখন ওর সহ্যসীমার চরমে পৌছালো তখন সিদ্ধান্ত নিল এই সম্পর্ক আর এগুবে না।
শুভ্রকে যেদিন বলল ও ব্রেক আপ করতে চায় সেদিন শুভ্রর চোখে ও রাগের বদলে দেখেছিল বিস্ময়। আসলেই শুভ্র অনেক বেশি বিস্মিত হয়েছিল। ও ভেবেই নিয়েছিল শিশির ওকে ভালোবাসবে। ও ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করল,
-কারন?
-আমাদের যাচ্ছে না শুভ্র। মিলছে না আমাদের মাঝে।
শুভ্র খুব শান্তভাবে বলল”ও” তারপর নিজের কফিতে মনযোগ দিল। বেশকিছুক্ষণ পরও শুভ্রর কোনো সাড়া না পেয়ে শিশির উঠতে যাচ্ছিল,,শুভ্র বলল” কোথায় যাও,,আমিতো এখনও কথা বলাই শুরু করিনি। বসো, বসো।” শিশির জানত ওর কিছু কথা শুনতে হবে সেই প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল,তাই চুপ করে বসে পড়ল,
-তা কি বলছিলে,,আমাদের মিলছে না,,সম্পর্ক ভাঙতে চাও,,বেশ ভালো। কিন্তু আমি যে ভাঙবো না।
-কেনো? তুমি নিজে দেখতে পাচ্ছো আমরা কত আলাদা।
-তো,,!!সেটাই কি স্বাভাবিক না,,দুজন মানুষতো আলাদা হতেই পারে,,
-শুভ্র শোনো,,,,
-তুমি শোনো,,,দুদিন পরপর এসব থিউরি কই পাও শুনি,,ভালোবাসতে হলে চিনতে হবে, একরকম হতে হবে,,,!!! আমিতো এসব ভেবে ভালোবাসিনি,,সুতরাং আমি সম্পর্ক ভাংবো না।
-আমরা কিন্তু শুরুতেই ঠিক করেছিলাম একে অপরকে ভালো না লাগলে আলাদা হয়ে যাবো।
-হুম,, একে অপরকে অর্থাৎ যদি দুজনেরই সমস্যা হয় তো। কিন্তু এখানে তোমার সমস্যা হচ্ছে আমারতো না,,সুতরাং আমি সম্পর্ক ভাংবো না।
“এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লামরে বাবা,,সাইকো কেস নাকি”,,মনে মনে এটা ভাবলেও মুখে শিশির বলল,
-এভাবে হয় না শুভ্র। আমি পারবো না।
-পারবে শিশির,,তুমি অবশ্যই পারবে।
বলেই শুভ্র হাসলো। ওর হাসি দেখে শিশিরের শিড়দারা দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এরকম হাসি শুভ্রর মুখে আগে দেখে নি ও। হাসিটার জন্য ওর পুরা চেহারাই বদলে গেছে।
-মানে কি,,কি বলতে চাইছো তুমি!!
-শিশির তোমার বাবা যেনো কি করেন,,
-তা জেনে তুমি কি করবে,
-ওহ মনে পড়েছে,,ছোটখাটো ব্যবসা,,কি যেন,, হ্যাঁ ফার্নিচারের দোকান। কাল যদি তোমার বাবার ব্যবসাটা বন্ধ হয়ে যায়,,!!
বিস্ফরিত চোখ চেয়ে আছে শিশির। কোনোরকম মুখ খুলে বলল
-তুমি কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছো?
- আরে নাহ,,কি যে বলো,,আমিতো খুব সুন্দর ভাবে বোঝাতে চাইছি এই সম্পর্কটা ভেঙে তুমি কত বড় ভুল করতে পারো,,,
-কেনো করছ এরকম!! - Everything is fair in love and war…
১মাস আগে সম্পর্ক শুরু হলেও সেদিন এক নতুন একতরফা সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে,,যেখানে শিশির হয়ে যায় শুভ্রর কাছে বন্ধি।ভালোবাসা না থাকলেও শুভ্রর জন্য যে ভালো লাগাটা ছিল তাও সেদিন শিশিরের মন থেকে উঠে গেল।
ফোনের আওয়াযে বাস্তবে এলো শুভ্র।
-হ্যালো
-কিরে ব্যাটা কোন গঙ্গায় যাইয়া ডুব মারসোত,,,সারাদিনেও খোজ নাই,,(সাজেদ)
-এইতো ছিলাম আশেপাশেই (হালকা হেসে)
-আশেপাশে থাক আর চিপায়চাপায় থাক,,এইমুহূর্তে আড্ডায় আয় ব্যাটা,, কথা আছে।(সাজেদ)
-কি কথা!
-তোর বিয়ার কথা। অই শালা তুই কি আবি!!
-ফায়ার হইস না,,আসতাসি।
হাসি হাসি মুখে শুভ্র ফোন রাখল। এই বন্ধুগুলো আছে বিধায়ই শুভ্র হয়ত এখনো হাসে। এই বিশৃঙ্খল জীবনের শৃঙ্খলাই তো এই বন্ধুগুলো আর শিশিরের প্রতি ওর ভালোবাসা। নাহ,,,পারবে না এই সম্পর্ক ভাঙতে। হবে না ওর দ্বারা।নিজের ভালোবাসার মানুষটা ওর সামনে অন্য একজনের সাথে ঘুরে বেড়াবে, হাতে হাত ধরে হাটবে,, আর শুভ্র তা হতে দিবে!! এতোটা মহান শুভ্র কখনোই ছিল না।
(চলবে)
পর্ব ৬
সকাল ৭.৩০ টা বাজে। শিশিরের ফোনটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখে কোনোরকমে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বলল “হ্যালো,,” সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। ভালোমত চোখ খুলে দেখল,,ওহ আচ্ছা এর্লাম বাজচ্ছিল। এর্লাম বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে নেমে গেল। ১০টায় ক্লাস এখনই উঠে না পড়লে পরে লেট হয়ে যাবে।
গলির মুখে শুভ্র দাড়িয়ে আছে বাইক নিয়ে। শিশির যেয়ে চুপচাপ ওর পিছনে বসে পড়ল। সেই জন্মদিনের ঘটনার পর আজকে তিনদিন হতে চলল। শুভ্র এখনও খুব স্বাভাবিক আছে তাই শিশিরও আর কিছুই বলে নি। ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিয়ে শুভ্র জিগ্যেস করল,
-ক্লাস দুইটা না আজকে?
-হুম
-ক্লাস শেষে আমি ক্যান্টিন থাকবো।
-আচ্ছা।
-তারপরও আমি একবার ফোন দিবো কেমন!!
-হুম
বলেই শিশিড় আর দাড়ালো না। সোজা ক্লাসে চলে এলো। ক্লাসে সায়রার পাশে বসার পর সায়রা জিগ্যেস করল,
-কিরে কি অবস্থা?
-বন্দি অবস্থা
-মানে!!
-কিছু না।
ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শিশির।
-শুভ্র ভাইয়া কিছু বলেছে?
-ওর কিছু বলা না বলায়ই বা কি আসে যায়।
-শিশিড় আমি বলি কি,,এভাবে কতদিন চলবি। একটু যদি চেষ্টা……………
-কিসের চেষ্টা!! যেখানে কোনো ভালোবাসাই নেই সেখানে চেষ্টা কেন করবো আমি!!
-কিন্তু চুপচাপ বসে থেকেও তো কোন লাভ হচ্ছে না।আচ্ছা সমস্যাটা কোথায়?
-সবই সমস্যা..।
শিশিরের চোখ দিয়ে ইতিমধ্যে পানি পড়ছে। ও আবার বলতে শুরু করল,
-জোড় করে আটকে রেখেছে আমাকে। এভাবে কি হয়!!! আর তুই ক্যাম্পাসের মেয়েগুলোকে দেখিস না,,যা ইচ্ছা তাই বলে খোচা দেয়,,। আমি জানি আমার ওর সাথে যায় না,,, আমি সুন্দর না, স্টাইলিশ না,,কিন্তু….
শিশিড় অনবরত কেদেই যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না,,,তাও ও আবার বলতে লাগল,
-এখন এই মানুষগুলো এভাবে বলে,কি নিশ্চয়তা নেই যে কেউ ভবিষ্যতে এভাবে বলবে না। এসব কথাগুলোকে আমার ভয় হয়। আমার খুব খুব বেশি ভয় হয়,, যদি কখনো ও একবারের জন্যও ভাবে আমাকে ভালোবেসে ঠকে গেছে!! কখনো যদি একবারও বলে আমার চেয়ে বেটার কাউকে ও লাইফে ডিসার্ভ করত,,তখন আমি কি করব!! আমি কি………..
সায়রা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না,,স্বান্তনা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। পরিস্থিতি এখন স্বান্তনায় নরমাল হবে না। শিশিরের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে সায়রা বলল,
-শিশির আমার মনে হয় তোর এই ভয়টাই তোকে আটকে রেখেছে। একবার মাথা থেকে এইসব চিন্তাভাবনাগুলো একপাশ করে দেখ,, দেখবি তখন আর এতো খারাপ লাগবে না এই সম্পর্কটা। আর তাছাড়া উনি তো বললই তোকে ভালোবাসে।
-আরে এটা ওর একটা জিদ। ক্যাম্পাসের অর্ধেকের বেশি মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। সবমেয়েরা ওর জন্য পাগল। কিন্তু আমি এমন না,,তাই এভাবে জোড় করে আটকে রেখেছে।
-আমার কিন্তু তা মনে হয় না………..
ক্লাসে স্যার চলে আসলে ওদের আর কথা বলা হয় না।
একটা ক্লাস শেষ হতে না হতেই শিশিড়ের ফোনটা বেজে উঠল। ফোন বের করে দেখে শুভ্র ফোন দিয়েছে। রিসিভ করবে না ভেবে রেখে দিল। কিন্তু ফোনটা অনবরত বেজেই চলছে। শেষ পর্যন্ত রিসিভ করতেই হল,
-হ্যালো
-একটু বাহিরে আসো তো,,,তোমার ডিপার্টমেন্টের নিচে দাঁড়ানো আমি।
-আর একটা ক্লাস বাকি শুভ্র। এখনো শেষ হয়নি।
-আমি জানি,,অন্য কাজে ডাকছি। তাড়াতাড়ি আসো নয়তো পরের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
শিশিড় নিচে নেমে দেখে শুভ্র চিন্তিত ভঙ্গিতে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। ওকে দেখেই ফোনটা নামিয়ে রেখে বলল,
-শিশিড় একটু ঝামেলা হয়ে গেছে,,,আজকে যে তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসতে পারবো না,,!
শিশিড় অবাক হয়ে গেল। এই দুইবছরে যত যাই হোক শুভ্র ওর এই নিয়ে আসা দিয়ে আসার রুটিন থেকে একচুল নড়ে নি। তাহলে আজ এমন কি হল!! ওকে কিছু বলতে না দেখে শুভ্রই জিগ্যেস করল,
-শিশিড় একা একা যেতে পারবে না?
-হুম পারবো।
-নাকি আমি সাজেদকে বলবো তোমায় নামিয়ে দিয়ে আসতে!!
-না না,,আমি একাই পারবো।
-তুমি কি রাগ করেছ?
-নাহতো কেনো রাগ করব!!
-আচ্ছা তাহলে যাও ক্লাসে যাও কেমন!! বাসায় যেয়ে আমাকে ফোন করে জানাবে।
শুভ্র খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছিলো কি মনে করে আবার ফিরে এলো,,এসেই শিশিড়ের গাল আলতো করে ছুয়ে বলল
-আসলে মাহিদ আর ওর গার্লফ্রেন্ড এক্সিডেন্ট করেছে। ক্রিটিকাল অবস্থা,,আমাদের অনেক বেশি প্রয়োজন সেখানে তাই,,,,,,
এতক্ষণে বুঝল শিশিড়। শুভ্রর দূর্বলতা হল ওর ফ্রেন্ডগুলো। সুতরাং এই মুহূর্তে হসপিটাল যাওয়াটাই স্বাভাবিক। শিশির বলল
-আমি বুঝতে পারছি,,, তুমি আমার চিন্তা করো না,,,আমি একা যেতে পারবো।
-তারপরও তোমার ক্লাস শেষ হলে আমি চেষ্টা করব আসার।
-আশ্চর্য কেন এতো জোর করছ,,, বললামতো আমি পারবো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুভ্র বলল”আচ্ছা,,তাহলে আমি যাই”
শিশিড় ক্লাসে চলে এল। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। হঠাৎ করে ফোনে টুং করে শব্দ হতেই ফোন বের করে দেখে শুভ্রর মেসেজ “দিনের অবস্থা বেশি ভালো না, আজ বেশিক্ষণ আড্ডা দেয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার ঠান্ডার ধাত আছে, বৃষ্টির একফোঁটাও সহ্য হয় না।সুতরাং তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যেও। আর অবশ্যই বাসায় যেয়ে আমাকে মনে করে ফোন দিয়ে জানাবে।”
পর্ব ৭
ক্লাস থেকে বের হয়ে সব ফ্রেন্ডরা গেল মাঠে। অনেকদিন পর মনমত আড্ডা দেয়া যাবে, ভাবতেই শিশির আনন্দে বাক বাকুম করে উঠল।
সবগুলো মিলে একসাথে হৈ হুল্লোর করছিল তখন শান্ত(ফ্রেন্ড) এসে বসল। শান্ত বসতেই সায়রা জিগ্যেস করল
-কিরে কথা বলসিস ??
-হুম,,,আজকে একদম দিসি,,মনমত। বেহায়া না হইলে ঠিক হইয়া যাইবো।
-কিরে কার কথা বলতেসিস? (শিশির)
- আর কইস না ওই এন্টিনারে আজকে ঝাইড়াও দিয়া আইসি একদম…..(শান্ত)
-মানে কার কথা বলতেসিস??(শিশির)
-আরে ও কি সেদিন ছিল নাকি,,,,ওরে ক্লিয়ার কর,,,(সায়রা)
-আরে ওইযে আছে না একটা ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মিলি না চিলি কি যেন,,,ওইটার জ্বালায় ক্যাম্পাসের পোলারা আর টিকতে পারলাম না। এফবিতে রিকো দিসিল,,কথাবার্তা কইলাম কয়দিন। আঁতকা একদিন দেখি লুতুপুতু টাইপ কথা শুরু করসে,,আমিও আস্তে আস্তে ইগনোর শুরু করলাম। কিন্তু ওই মাইয়া সবার কাছে ছড়াইসে আমি নাকি অর প্রেমে দিওয়ান পাগল,,, অইদিন ম্যানেজমেন্ট ডিপোর এক ফ্রেন্ড এই ব্যাপারে জিগাইতেই আমিতো আকাশতে পড়লাম। গেলাম আজকে কথা ক্লিয়ার করতে। যাইয়া দেখি অর ডিপোতে আমার অবস্থা পুরাই “হিরো আলম”,, সব খালি আমারে দেখে আর ভেটকায়। এমন রাগ চড়ল দিলামও ঝাড়ি। এক্স জিএফগো রাগও ওর উপর ঝাইড়া আইলাম।
শান্তর কথাবার্তা শুনে সব হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসি যেন থামতেই চায় না। কোনরকমে শিশির জিগ্যেস করল…
-বাই দা ওয়ে এই এন্টিনা ব্যাপারটা কিরে,,,ক্লিয়ার করে বলত!!(শিশির)
ফারাবি গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল
-এই ব্যাপারটা আমি ক্লিয়ার করছি বন্ধু,,, শোন সব জায়গাতেই দেখবি এমন একটা দুইটা মানুষ থাকে যাদের মাথায় এক বিশাল বড় অদৃশ্য এন্টিনা থাকে। এদের এন্টিনার নেটওয়ার্ক বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে,,এবং সব গাজাখুরি খবর দেখবি ওদের নেটওয়ার্ক থেকেই ছড়ায়। আর আমাদের ক্যাম্পাসের সেই এন্টিনা হচ্ছে আমাদের চিলি আপা। ওনার এন্টিনা ইতুই লম্পা ইতুই লম্পা যে বুলে বুজাইতাম পারতাম না।
ফারাবির এরকম কথাবার্তায় আরেকদফা হাসির রোল পড়ে গেল আড্ডায়। সত্যিই এই বন্ধুগুলো থাকলে দুনিয়ার কোনো টেনশনই কাউকে স্পর্শ করতে পারে না।
-বাই দা ওয়ে শিশির আপা,,আপনার 1mb কই?(শান্ত)
- 1mb!!(শিশির)
- one man army…
একেতো আগের হাসিই থামছিল না। আবার শান্তর কথা শুনে শিশির হাসতে হাসতে হেলে পড়ে গেল,,,কোনরকমে বলল ” ডিউটিতে”। আর কেউ কিছু জিগ্যেস করল না। কিন্তু অনেক আড্ডা দিল। শিশিরও ইচ্ছামত হাসাহাসি করল।
আড্ডাবাজি শেষ হল, যখন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল,, দিন কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল।
-চল উঠি দোস্ত,,,বৃষ্টি শুরু হইলে আবার আটকা পড়তে হইব। (শান্ত)
-হুম ঠিক বলসত। চল,,,কিন্তু শিশির তুই যাবি কেমনে,,,চল তোরে ড্রপ কইরা দিয়া আসি (ফারাবি)
-আরে না না,,,কোনো দরকার নাই। একাই যাইতে পারবো। (শিশির)
-সিওর?? কারন দিন অনেক অন্ধকার করসে। ঝড়ও হইতে পারে। রাস্তায় আটকায় গেলে!!! এরচেয়ে ভালো আমি ড্রপ করে দিয়ে আসি,,
-কোনো প্রয়োজন নাই বললামতো। উল্টা পইরা যাইবো তোর জন্য। আমি একাই যেতে পারব।
শিশিরের জোরের কাছে আর কারো জোরই টিকলো না। শেষপর্যন্ত ওকে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে যে যার মত চলে গেল। রিকশা কিছুদূর যেতেই ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামলো। শিশির রিকশার হুড ফেলে দিল। অনেকদিন পর বৃষ্টিতে ভিজতে মন চাইছে। এই বছরের প্রথম বৃষ্টি।
রিকশা যখন বাসার সামনে থামলো তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। পুরো রাস্তা ভিজেই এসেছে শিশির। এখন ওর প্রচুর শীত করতে লাগল। ভাড়াটা মিটিয়ে,,বাসায় ঢুকে কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে টলতে টলতে গিয়ে বিছানায় পড়ল শিশির।
সকালে গভীর ঘুমের মধ্যেও শিশির টের পাচ্ছে,,ভূমিকম্প হচ্ছে। বিছানা দুলছে,,,শিশিরের মাথাও দুলছে। ও কোনোরকমে চোখ খুলল,,চোখ অসম্ভব জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আগুন বের হবে। শিশির চোখ খুলে কিছুক্ষণ বুঝার চেষ্টা করল এবং দ্রুতই আবিষ্কার করল ভূমিকম্প না ওর ফোন ভাইব্রেট করছে। ফোনের স্ক্রিনে নাম ফারাবি দেখা যাচ্ছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চিৎকার করে উঠল
-শিশির তুই কি পাগল!!! আজকে ইকোনোমিক্স পরীক্ষা ভুলে গেসিস নাকি!!
-না…….না….ভুলি নাই। (হালকা কেশে) মনে আছে।
-তাহলে কই তুই!! কয়টা বাজে জানস!!
-কয়টা?
- পৌনে দশটা। অলরেডি একটা ক্লাস শেষ।
টাইমের কথা শুনে শিশির লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। হঠাৎ এভাবে উঠে বসায় মাথাটা ঘুরে উঠল। বাম হাতে মাথাটা ঠেকিয়ে প্রশ্ন করল,
-পরীক্ষা কয়টায়? - তৃতীয় ক্লাসে। তোর হাতে ১ ঘন্টার মত সময় আছে।
- আমি আসছি।
বলেই ফোনটা রাখতে গেলে দেখল ৮৬ টা মিসডকল। এর মধ্যে ৭৯টা শুভ্রর। ৮.৩০ থেকে ১০.০১ পর্যন্ত একাধারে ফোন দিয়ে গেছে। কিন্তু ও রিসিভ করতে পারেনি। শুভ্রর চেহারাটা ভাবতেই শিশিরের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আচ্ছা,,, ও কি এখনো নিচে দাড়ানো!!
পর্ব ৮
শিশির বারান্দার পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিলো,,,নাহ শুভ্র নেই। শিশির দেরি না করে দৌড়ে গেল ফ্রেশ হতে। প্রচুর শীত করছে। মাথা ভার হয়ে আছে। কিন্তু আজ যেতেই হবে। পরীক্ষাটা না দিলে ইনকোর্সে আটকে দিবে।ফ্রেশ হয়ে এসে শিশির মাথা ঝারতে কেবল চিরুনীটা হাতে নিয়েছে তখন শিশিরের মা রুমে ঢুকেই আতকে উঠলেন,
-সেকি!!! এই জ্বর নিয়ে কই যাস!!
-এতক্ষণে আসার কি দরকার ছিল!! সময়মত এসে ডাক দিতে পারলে না!!
-ডাক দেই নি কে বলল!! সকাল থেকেই ডেকে যাচ্ছিলাম,,পরে তোর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমে এসে দেখি তোর শরীর কাপিয়ে জ্বর এসেছে। নিজের শরীরের অবস্থা নিজে বুঝিস না!! ভিজতে গেলি কেন বৃষ্টিতে!! এইযে এখন ঠান্ডা আর জ্বর বাধিয়ে বসে আছিস!! আবার এই অবস্থাতেই বের হচ্ছিস,,!!
- আচ্ছা আচ্ছা হইসে,,,এক কাজ করো তো মা,, ঘরে একটা নাপা এক্সট্রা থাকলে এনে দাও আমাকে।
- নাস্তা করে নে,,,তারপর ঔষধ খেয়ে নিস।
-নাস্তা ক্যাম্পাসে করব,,ঔষধটাও তখন খেয়ে নিবো। - নাস্তা না করে বাসা থেকে বের হবি!! তাও এই ঠান্ডা জ্বর নিয়ে,,, অসম্ভব!!
-উফফফ মা থামোতো,,তোমার সাথে তর্ক করার মত সময় আমার এখন নেই। প্লিজ ঔষধটা থাকলে নিয়া আসো।
শিরিন বেগম আর কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন,,,ঠিক তখনোই কি মনে করে আবার ফিরে তাকিয়ে বললেন
-তোর এক ফ্রেন্ড ফোন করেছিল সকালে। তোকে ফোন দিয়েছিল তুই নাকি রিসিভ করিস নি,, তাই বাসায় ফোন দিল।
-ফ্রেন্ড!! আমিতো কাওকে বাসার নাম্বার দেইনি। নাম কি বলল?
-কিযেন বলল নামটা,,,,আরে হ্যা শুভ্র।
মার কথা শুনতে শুনতে ফোনটা হাতে নিয়েছে ব্যাগে ঢুকাবে বলে,,কিন্তু নাম শুনে ওর হাত কেপে উঠল সাথে সাথে হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পরে গেল। শুভ্র ফোন দিয়েছিল!! ও নাম্বার পেল কোথায়!!
- কিরে বেশি খারাপ লাগছে নাকি,,,আজ নাহয় না যা ভার্সিটি।
- হুম,,না মানে,,,না….না মা,,, বেশি খারাপ না। তুমি বল কি…কি জিগ্যেস করল শুভ্র!!
- জিগ্যেস করল ভার্সিটি যাবি না নাকি,,,ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তুই ফোন রিসিভ করছিস না,,,
-তো তুমি কি বললে!! - কি বলব!! বৃষ্টিতে ভিজে শরীর খারাপ করেছিস,,,তাই বললাম।
শিশির দিশেহারাভাবে মার দিকে তাকাল,,,!! এতক্ষণ যেই আশংকা মনে ছিল,,,তা মা সত্যি করে দিল,,,। শুভ্রকে জানিয়ে দিল ও কাল বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে। শুভ্র মানা করে দেওয়ার পরও ভিজেছে!! এমনকি এতবার বলে দেওয়ার পরও রাতে ফোন দেয়নি। ওই যে পড়েছে,,,এক ঘুমে সকাল। অবশ্য এতে মারও দোষ নেই,,,মাতো আর জানতো না,,,। কিন্তু এখন……….
শিশির ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। মা রুম থেকে বের হয়ে গেছেন এতক্ষণে। শিশির নিজেই নিজের কপালে হাত রেখে বলল,,ওহ!! আমার জ্বরটা বোধহয় বেড়েই গেছে,,,কত হবে ১০৩ নাহ ১০৪ বোধহয়!!!
শিশির যতো ডিপার্টমেন্টের দিকে এগুচ্ছে,,, ওর কলিজা ততো বেশি ধুকপুক ধুকপুক করছে,,,ডিপার্টমেন্টের সামনে যেতেই ওর কলিজা জমে বরফ হয়ে গেল। শুভ্র দাড়িয়ে আছে। শিশিরকে দেখে এগিয়ে আসছে ওর দিকেই। শিশিরের ইচ্ছা করছে এক দৌড় দিয়ে বাসায় চলে যেতে। শুভ্র এসে দাড়ালো ঠিক শিশিরের সামনে,
-কালকে বাসায় গিয়েছো কখন?
-(নিশ্চুপ)
-শুনতে পাও না,,, কি জিগ্যেস করলাম!
-বি..বিকালে৷
-ক্লাস শেষ হয়েছে দুপুরে,,বিকাল কেনো হল?
-(নিশ্চুপ)
-জবাব দাও না কেন??
শুভ্র এতো জোরে চিৎকার করে উঠল যে আশেপাশের মানুষ পর্যন্ত দাড়িয়ে গেল। উৎসুক জনতা এখন জানতে আগ্রহী ঘটনা কি,,,তাই তারা সব এদিকেই চেয়ে আছে। শিশির ভয়ে আর লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।
-এতো পাখা গজায় কেন তোমার?
-(নিশ্চুপ)
-আমার প্রতিটা কথা কেন সবসময় অমান্য করতেই হবে তোমাকে??
-(নিশ্চুপ)
-বৃষ্টিতে ভিজবে,,,বৃষ্টি!!!! এতো ভিজতে মন চায়,,,আমি তোমাকে ভিজাচ্ছি,,
বলেই শুভ্র নিজের হাতের পানির বোতলের পানি ছুড়ে মারলো শিশিরের মুখে। শিশিরের নাকে মুখে পানি উঠে গেল,, ও কাশতে শুরু করল। শুভ্র বোতলটাও একদিকে ছুড়ে মেরে হনহন করে চলে গেল। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে শিশিরের দিকেই। শিশিরের চোখ ভিজে উঠল। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখের সামনে ধরেই হেটে চলল ক্লাসের দিকে।
ক্লাস শেষে শিশির গেল ক্যান্টিনে। আশপাশে থেকে কানাঘুষার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।ও উঠে চলে গেল পুকুরপাড়। কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসল,,কড়া রোদ উঠেছে কিন্তু শিশিরের শীত করছে। মাথা ব্যাথা করছে। তাড়াহুড়ায় ঔষধও আনতে ভুলে গেছে।শিশিড় কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইল,,যখন চোখ খুলল তখন শুভ্র ওর সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে কিছু প্যাকেট।পাশে বসে শুভ্র শিশিরের কপালে হাত দিয়ে দেখল,,সাথে সাথে শুভ্রর কপালে ভাজ পড়ল। প্যাকেট থেকে দুইপাতা ট্যাবলেট বের করে সেখান থেকে দুইটা ট্যাবলেট আর পানির বোতল এগিয়ে দিল শিশিরকে। হালকা কিছু মুখে দিয়েছিল শিশির তাই চুপচাপ ঔষধ খেয়ে নিল। আরেক প্যাকেট থেকে একটা মাস্ক বের করে শিশিরকে পড়িয়ে দিতে দিতে শুভ্র বলল,
- ধুলাবালিতে তোমার ঠান্ডায় আরো বেশি সমস্যা হয়। আর আজকে সকালের জন্য আমি সরি বলব না,,দোষটা তোমার ছিল।
পর্ব ৯
এভাবেই কাটছিলো দিনকাল। সম্পর্কটাও চলছিল এভাবেই।শুভ্র যত জোর করত শিশির ততোই হাসফাস করত। শুভ্র একপা এগুয়তো শিশির তিন পা পিছায়। এভাবে কি হয়!! একসময় যে তাহলে সম্পর্কের সূতোটাই ছিড়ে যাবে।
শুভ্ররও এখন ভয় হয়,,,এভাবে যদি ও নিজেও একসময় হাপিয়ে উঠে!!! শিশির যদি হারিয়ে যায় কখনো!! কি করবে শুভ্র তখন!! ওর সমস্তটা ঘিরেই যে শিশির। কিন্তু এভাবেই কাটছিল ওদের দিন।
শিশিরের মেজাজ এই মুহুর্তে প্রচুর খারাপ হচ্ছে। ওর সামনে মিলি বসে আছে এবং সে বিনা বিরতিতে বকর বকর করেই যাচ্ছে। আজকে শিশিরদের মিডটার্ম শেষ হয়েছে। ওর সব ফ্রেন্ডরা একসাথে ঘুরতে গেছে ।কিন্তু ও যেতে পারেনি। শুভ্রর অপেক্ষায় বসেছিল ক্যান্টিনে। তার কিছুক্ষণ পরেই মিলির আগমন আর এখনো চলছে নন স্টপ। শুভ্র ঢুকল ক্যান্টিনে,
-অনেকক্ষণ বসে ছিলে?
-আরে শুভ্র ভাইয়া যে কেমন আছেন?(মিলি)
শুভ্র একবার তাকিয়েই চোখ ঘুরিয়ে ফেলল
-আরে ভাইয়া আমাকে চিনেন নি,,,আমি মিলি,,
-………
-আরে ওইতো ম্যানে…..…….
- শিশির চলো ওইদিকটায় বসি,,,এদিকে অনেক হাউকাউ হচ্ছে।
বলেই শিশিরকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আর পিছনে ফেলে গেল রাগে ফুসতে থাকা মিলিকে।
অন্য একটা টেবিলে বসে শুভ্র ধপ করে মাথাটা টেবিলে ফেলে দিলো,
-শিশির মাথাটা খুব ধরেছে,,একটু হাত বুলিয়ে দিবে!!
শিশির ইতস্তত করতে লাগল, আগে কখনো শুভ্র এরকম কিছু বলেনি। হঠাৎ বলায়,,শিশিরের একটু আনইজি লাগল,,কোনো সাড়া না পেয়ে শুভ্র হালকা মাথাটা উঠিয়ে শিশিরের চেহারা দেখে হেসে ফেলল,
- আরে বোকা!! আমিতো এমনি বললাম।
হালকা কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে শুভ্র বলল
-সাজেদরা বান্দরবান যাওয়ার জন্য ছোটখাটো একটা ট্যুরের প্লান করছে।
-হুম।
-তোমার ফ্রেন্ডরাও নাকি যাবে। তুমিও তো যাচ্ছো নাকি?
-নাহ,,,,বাসায় রাজি হবে না।
-আমি কথা বলি বাসায় সমস্যা কি,,?
-দরকার নেই। আর তাছাড়া আমার কাছে একমুহূর্তে টাকাও নেই।
-ও…ওহ…আচ্ছা, তো কি হইসে!! আমি টাকাটা…….
-শুভ্র টাকার জন্যও না। বললামতো বাসায় রাজি হবে না।
- আমি ফোন দিয়ে বলি,,,
- তুমি কি ঝামেলা বাড়াতে চাইছো!
-না,,
-তাহলে আর এ বিষয়ে কথা বলো না,,প্লিজ।
-হুম - তুমি তো যাচ্ছো,,,কয়দিনের ট্যুর এটা?
-৮দিনের। আর আমি যাচ্ছি না।
শিশির অবাক হয়ে তাকাল শুভ্রর দিকে। শুভ্রর বন্ধু, আড্ডা, ট্যুর এগুলো বরাবরই পছন্দ। আর এখানে ওর সব ফ্রেন্ডরা যাচ্ছে,,কিন্তু ও যাবে না!!
-কেনো!!
-না,,,মানে,,,,তোমার সব ফ্রেন্ডরা যাবে। তুমি একা রয়ে যাবে,,,তখন তোমার যদি একা খারাপ লাগে,,,আমি নাহয় থাকি তোমার সাথে।
-আমার কেনো খারাপ লাগবে!! - একা একা ক্যাম্পাসে,,,!! সমস্যা নেইতো আমি,, আর তাছাড়া তোমাকে ছাড়া আমারো ভালো লাগবে না।
শিশির তাকিয়ে আছে সামনের মানুষটার দিকে। যে মানুষটা খুব সুন্দরভাবে নিজের পছন্দগুলো একপাশ করে ফেলছে,,,,শিশিরের জন্য !! এখন, এইমুহুর্তে এই মানুষটাকে দেখলে কে বলবে,,,,এই মানুষটাই ওকে যখন যেভাবে ইচ্ছা অপমান করে। যখন মন চায় ভালোবাসে,,,যখন মন চায় কষ্ট দেয়। কিন্তু শিশিরতো এরকম ভালোবাসা চায় নি। শিশিরকি কখনো পারবে এভাবে ভালোবাসতে!!! কিন্তু সবাই যে বলে ভালোবাসার মানুষকে কখনো কষ্ট দেয়া যায় না,,তাহলে এ কেমন ভালোবাসা…!
শিশিরকে বাসায় দিয়ে শুভ্র গেল আড্ডায়। সাজেদ, রবিন, অনিক বসা,,, শুভ্র যেতেই অনিক চেচিয়ে উঠল,
-দোস্ত এবারের ট্যুর……………….
-আমি যাচ্ছি না ট্যুরে।
একথায় যেন আড্ডায় বাজ পড়ল। সব চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে শুভ্রর দিকে,
-তু…তুই যাবি না ট্যুরে!!! তুই..!! যে কিনা পারলে প্রতি মাসে মাসে যায়…… (রবিন)
- এই চুপ করতো,,,কানের কাছে ক্যাচ ক্যাচ করবি না। (শুভ্র)
- না…. মানে… বন্ধু তুমি কি মাথায় কোনো আঘাত পাইসো,,,দেখিতো এদিকে আসোতো,,(অনিক)
- ধুর শালা,,,,দূর হো এখান থেইকা।(শুভ্র)
- কিন্তু তুই যাবি না কেন?(সাজেদ)
-শিশির যাবে না তাই। ওর ফ্যামিলি রাজি হবে না। আর ওকে একা রেখে যেতে মন চাইছে না।(শুভ্র)
- আহারে,,,!!! লায়লীর প্রেমে আমাদের বন্ধুটা পুরাই দেবদাস হইয়া গেলরে!!(অনিক)
অনিকের এই কথায় সব একসাথে হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামলে সাজেদ বলল,
-তুই যে শিশিরের ব্যাপারে এতো সিরিয়াস,,তা আংকেল আন্টির সাথে ওর ব্যাপারে কথা বলসত তো?
-ওনাদের সাথে কি বলব!!
-কি বলবি মানে!!! শুভ্র তুই তোর বাবা মাকে খুব ভালো করে চিনস!! তারা কি শিশিরের ব্যাপারে……
-শোন যাদের কাছে নিজের ছেলের চেয়েও বেশি টাকা আর তাদের বিজনেস প্রিয়,,,আর যাই হোক তাদের কাছে আমার লাইফের কোনো ডিসিশন শেয়ার করতে চাই না।
-কিন্তু দোস্ত পরে কোনো ঝামেলা না হয়!!
-হইব না,,আর হইলেও আমি দেখবো। আর তাছাড়া আগে শিশিরকে তো রাজি করাই,,,পরে আমার বাপ মার কথা চিন্তা করা যাইবো।
-দেখ যা ভালো বুঝস।
পর্ব- ১০
আজকে চারদিন শিশির আর শুভ্রর ফ্রেন্ডরা বান্দরবান ট্যুরে গিয়েছে। শিশির ভেবেছিল হয়তো ওর খারাপ লাগবে না,,,,কিন্তু অবাক করার বিষয় ওর খারাপ লাগছে,,,এবং প্রচুর খারাপ লাগছে। ফ্রেন্ড নাই,, আড্ডা নাই,,ওদের ছাড়া ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ খালি খালি লাগছে। অনেক চেষ্টা করেও নিজের মন খারাপ ভাবটা ভিতরে লুকিয়ে রাখতে পারে নি, চেহারায় ফুটে উঠেছে। তাই দেখে শুভ্র অনেক জোরাজুরি করে আজকে ক্লাসের পর ঘুরতে যাওয়ার জন্য রাজি করিয়েছে। সেই অপেক্ষায় শিশির এখন ক্যান্টিনে বসা। ওর ক্লাস শেষ,,শুভ্রর আর কিছুক্ষন পর শেষ হবে। ঠিক তখনই ক্যান্টিনের দরজা দিয়ে মিলিকে ঢুকতে দেখে শিশির দ্রুত হাত দিয়ে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করল,,,কিন্তু বেশ কিছু সুবিধা করতে পারলো না,,মিলি ওকে দেখেই ফেলল,,এবং টিটিং টিটিং করতে করতে ওর সামনে এসে বসল,
-কিরে শিশির কেমন আছিস?
-হুম এইতো,,
- হুমমম,,,তোর মনের অবস্থা আমি বুঝিরে,,,
-মানে!
-না,,মানে,,,তোর অনেক ধৈর্যরে,,,,এরকম একটা ছেলের সাথে এখনো সম্পর্ক রাখছিস,,!
চুপ করে রইল শিশির। শুভ্র আর শিশিরের ব্যাপারটা বেশি কেউ জানে না,,,কিন্তু এই মেয়ে কিভাবে জানল!! আর জানলেও পুরো ক্যাম্পাসে না ছড়িয়ে,,এভাবে শিশিরের সাথে কথা বলছে,,!!
-কিভাবে পারিস বলতো!! এমন একটা ছেলের সাথে থাকতে,,,যার কিনা ক্যাম্পাসের এতো মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল,,,
-হুমম,,
-তাও যেনো তেনো সম্পর্ক না,,,ফিজিক্যালি ইনভলভ পর্যন্ত ছিল!!
হতবাক হয়ে চেয়ে রইল শিশির….
কি,,!! কি বলল!! মেয়েটা!! শারিরীক সম্পর্ক!!! মানে,,,!!
-না,,মানে শিশির বলছিলাম কি,,,তোদের তো অনেকদিনের সম্পর্ক,, কত হবে,,দেড় দুই বছরতো হবেই তাই না!! মানে,,, ইয়ে,,,তোরাও কি ফিজিক্যা………
-আমি এখন উঠবো।
বলেই বের হয়ে গেল শিশির। ওর মাথা ভোভো করছে। কানে বাজচ্ছে মিলির কথাগুলো। ক্যাম্পাসের বেশ কিছু মেয়েদের সাথে শুভ্রর সম্পর্ক ছিল। সেটা শুভ্রই নিজে বলেছে,,,এও বলেছে সম্পর্কগুলো টিকতো ২-৩ মাস, এর বেশি না। কিন্তু শারিরীক সম্পর্ক পর্যন্ত!! নাহ আর ভাবতে পারছে না শিশির।
হঠাৎ পিছন থেকে হাতে হেচকা টান লাগায় ঘুরে তাকাল শিশির। শুভ্র!!!
-কি ব্যাপার শিশির কানে তালা মেরে কোনদিকে হেটে যাচ্ছো,,,!! কয়বার ডাকলাম।
কি নিষ্পাপ একটা চেহারা!! কি সুন্দর হাসি,,!!এই হাসি দেখে কে বুঝবে এই ছেলে কতটা জঘন্য!
-মনে আছেতো,,, আজকে কিন্তু ঘুরবো প্লান করেছিলাম।(শুভ্র)
-(নিশ্চুপ)
-গাড়ি এনেছি। একটু দূরেতো। কিন্তু জায়গাটা খুব সুন্দর। চলো,,,
গাড়িতে নিয়ে বসালো শিশিরকে। শুভ্রকে অনেক হাসি খুশি লাগছে। কিন্তু শিশির ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না,,কি করবে এখন! নেমে যাবে গাড়ি থেকে! যদি হিতে বিপরীত হয়!! ভাবতে ভাবতেই গাড়ি চলতে শুরু করল।
গাড়ি থেকে নেমে শিশির দেখল বেশ খোলামেলা একটা জায়গা । সামনে একটা নদী। জায়গাটা শিশির চিনতে পারছে না। আসলে ওর মাথায় এখনো মিলির কথাগুলোই ঘুরছে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হেটে এসে ওরা বসল।
-জায়গাটা সুন্দর….. না শিশির!!
-(নিশ্চুপ)
-আমার খুবই প্রিয় একটা জায়গা। তাই আজ তোমাকেও নিয়ে এলাম। ভালো লাগছে তোমার?
-(নিশ্চুপ)
-কি ব্যাপার, কিছু বলছ না যে!
-ক্যাম্পাসের কয়টা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল তোমার?
হঠাৎ এমন একটা প্রশ্নে শুভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কয়েকমুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-হঠাৎ এই প্রশ্ন!
-জানতে চাচ্ছি,,কেনো বলতে চাচ্ছো না?
-আশ্চর্য…!! বলতে চাইবো না কেনো!! আর তাছাড়া এই ব্যাপারে আমাদের আগেও কথা হয়েছে। আগেই বলেছিলাম যে আমার বেশ কয়েকজন মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল।
-কয়জন?
-জানি না। অত গুনে গুনে রাখিনি শিশির।
-হুম,,তার মানে অগুনিত। বেশ ভালো,,!! আর শারিরীক সম্পর্ক ছিল কয়জনের সাথে?
প্রশ্নটা শিশির করল সোজা শুভ্রর দিকে তাকিয়ে। থ মেরে গেল শুভ্র। কি বলল মেয়েটা!! কানে কি ভুল শুনলাম!! শারিরীক সম্পর্ক মানে!!
-কি বললে তুমি!!
-কয়টা মেয়ের সাথে শারিরীক সম্পর্ক ছিল তাই জিগ্যেস করলাম,,
-শিশির কি বলছো এগুলা। এইসব আবল তাবল কথা কার থেকে শুনো!!
-কেন নাটক করছ!! আমার সামনে এতো ভালো সাজার অভিনয় করে কি লাভ!!
-চুপ করো শিশির,,,অনেক বলে ফেলেছো। অনেক বেশিই বলে ফেলেছো। আর এক মুহুর্ত এখানে বসে তোমার ফালতু কথা শোনার ইচ্ছা আমার নেই। চলো,,,
বলেই শুভ্র হেটে চলে যাচ্ছিল,,পিছন থেকে শিশির চেচিয়ে উঠল,
-হ্যা,,কেনো বসবে এখন। সত্যি কথাটা জেনে গেছি এখনতো পালাবেই। কিন্তু তুমিও জেনে রাখো আমি এখন চুপ থাকবো না,,,কি ভেবেছো আমি বুঝবো না কিছু,,,,এজন্যই নাহ,,,,এজন্যই দুইটা বছর আমার পিছনে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে লেগেছো। ক্যাম্পাসের মেয়েরা পাগল তোমার জন্য,,,তাদেরকে নিজের ইচ্ছামত নাচিয়েছো,,ব্যবহার করেছো। আমার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না,,,তাই ভালোবাসার নাম করে এভাবে আটকে রেখেছ…………………
চিৎকার করেই যাচ্ছে শিশির। শুভ্র খুব শান্তভাবে এগিয়ে এলো শিশির কাছে এবং সশব্দে শিশিরের গালে একট চড় বসিয়ে দিল।
-চুপচাপ এখন আমার সাথে চল। অনেক মুখ চালিয়েছো,,,আর না। আর একটা কথা মুখ দিয়ে বেরুলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
শিশিরের হাত ধরে টান দিলে,,,শিশির এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে নিল,চেচিয়ে বলল,
-যাবো না তোমারা সাথে আমি। কোত্থাও যাবো না।কি পেয়েছো তুমি। কিসের এত কর্তৃত্ব ফোলাও তুমি। ভালোবাসি বলে কি কিনে নিয়েছো আমায়। তোমারটা খাই না পড়ি,,,কোন অধি…………………
শেষ করার আগেই শুভ্র সশব্দে আর একটা চড় বসিয়ে দিল। তব্দা মেরে গেল শিশির। প্রথম চড়টা দেওয়ার পর ভেবেছিল হয়ত রাগের মাথায় ভুলে দিয়েছে শুভ্র। রাগের মাথায় ওর হুশ থাকে না অনেক কিছুই করে বসে। কিন্তু দ্বিতীয় চড়টার পর বুঝল রাগ উঠলেও শুভ্র হুশ হারায় নি। বুঝে শুনেই দিয়েছে।নিজের ইচ্ছায়।
রাগে দু ঃখে শিশির ঘুরে অন্যদিকে হাটা শুরু করল। শুভ্র গিয়ে হাত ধরলে দাপাদাপি শুরু করে দেয়। শেষপর্যন্ত শুভ্র ওকে কাধে তুলে নেয়।
গাড়িতে পিনপতন নিরবতা। নি ঃশব্দে কান্না করছে শিশির। একটা ফার্মেসির সামনে গাড়ি থামিয়ে শুভ্র ভিতরে গেল। ফিরে এসে যখন বসল ওর হাতে তখন একটা মলম।চড় দুইটা খুব জোরেই দিয়ে দিয়েছিল শুভ্র, শিশিরের ঠোঁটের দিকে হালকা কেটে গেছে। শিশিরের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে মলম লাগাতে লাগাতে শুভ্র বলল,
-কখনো ভালোবেসেছো শিশির!!,,,, আমি বেসেছি। ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দিলে কেমন লাগে আমি জানি। ভালোবাসার মানুষটাকে জোর করে বেধে রাখলে কেমন লাগে আমি জানি। ভালোবাসার মানুষটা হারিয়ে যাওয়ার ভয় কেমন তাও আমি জানি। কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার প্রেমিকা না শিশির, তুমি আমার ভালোবাসা। খানিকের প্রেম বা মোহও না। তোমাকে দেখলে আমার কখনো লোভ হয় না শিশির, তোমাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন সাজাতে ভালো লাগে,,সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন। কারন ভালোবাসা তো এমনই হয়,,,তাই না!!….. আমি তোমাকে কখনো মিথ্যা বলি নি শিশির। আমিতো সবই স্বীকার করেছিলাম আগের সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে। যদি মিথ্যাই বলতাম তাহলে ওগুলোও স্বীকার করার কোনো কারন ছিল না। শিশির আমাকে যদি তোমার বিশ্বাস করতে হয় তাহলে পুরোপুরি বিশ্বাস করো,,যেন কেউ কখনো তোমার কান ভরতে না পারে৷ আর যদি বিশ্বাস না করার হয়,, তাহলে একদমই করো না। আমাকে সবসময় খারাপই ভেবে যাও। আমার কোনো আপত্তি নেই।
পর্ব ১১
দুপুরের খাবারের পর বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল শিশির ঠিক তখনই ওর ফুফুর আগমন ঘটল ওর রুমে। আজ দুই সপ্তাহ হবে তিনি কানাডা থেকে এসেছেন সাথে তার একমাত্র ছেলে আরিফকে নিয়ে।
শিশিরের রুমে ঢুকেই তিনি বললেন,
-কিরে এভাবে শুয়ে আছিস কেন?
-কি করব ফুফু!! আজ শুক্রবার কোনো ক্লাস নেই তাই ইচ্ছামত ঘুমাবো।
-এতো ঘুমানো লাগবে না,,এক কাজ কর আমার ছেলেটাকে নিয়ে একটু ঘুরে আয়। এখানে এসেছে পর থেকে ঘরে বন্দি। কোনো জায়গা চিনেও না,,, যে নিজে নিজে বের হবে। শফিককে বললাম ওর তো সময়ই হয় না। তুই যেহেতু আজ ফ্রি,,যা না ওকে নিয়ে একটু।
-আমি একা কই নিয়ে যাবো!! এর চেয়ে ভালো আপা দুলাভাই একদিন আসুক,,,সবাই একসাথে যাবো।
-কবে তোর আপা দুলাভাই আসবে আর কবে যাবি!!! আজ যেহেতু খালি বসেই আছিস যা না একটু মা,,,
-আচ্ছা, আচ্ছা,,,যাচ্ছি। আরিফকে বলো রেডি হতে।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে শিশির চুল বাধচ্ছিল তখন ওর নজর গেল ঠোঁটের কাটার দিকে। শুকিয়ে গেছে অনেকটুক। সেদিন বাসায় ফেরার পর ওর বাবা মা তো হুমরি খেয়ে পড়ল ওর উপর। নজর এড়াতে তারাতারি রুমে ঢুকে যায় শিশির। মাকে কোনোরকম ভুঝুংভাঝুং দিয়ে বুঝালেও, বাবাকে বুঝাতে বেশ বেগ পেতে হলো। বাবা ওদের দুই বোনকে অনেক বেশিই ভালোবাসে। উনি নিজে কখনো ওদের দুই বোনের গায়ে তুলেন নি। তাই খুব ভালো করেই ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে হয়েছে ওকে। বাবা যদি ঘটনা জানতে পারে তাহলে ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার হয়ে যাবে।
শুভ্রর বলা কথাগুলো নিয়ে খুব ভালোভাবে ভেবেছে শিশির। ওই মিলির কথায় আসলেই বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। এতো বাজেভাবে রাগারাগি করাও ঠিক হয়নি। শুভ্র ভুল তো কিছু বলে নি। এই দুইবছরে ও চাইলেই অনেক কিছু করতে
পারতো কিন্তু ও কখনো শিশিরকে বাজেভাবে স্পর্শও করে নি। শিশির আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে নি শুভ্রর সাথে,কারন দোষটা আসলেই ওর ছিল। কিন্তু শিশির ভাবছে শুভ্রকে একটা সুযোগ দেয়া উচিত। হুমম,,অবশ্যই উচিত। দেখাই যাক না কি হয়!!
রেডি হয়ে বের হওয়ার আগে একবার ভাবলো শুভ্রকে জানিয়ে দেই আরিফের সাথে বের হওয়ার কথা,পরে আবার ভাবলো… কি দরকার!! শুভ্র আবার হাজারটা প্রশ্ন করবে,,,শুধু শুধু ঝামেলা হবে। এর চেয়ে ভালো চুপচাপ ঘুরে চলে আসা।
শিশির আর আরিফ সারা দুপুর আর বিকাল এদিক সেদিক ঘুরে সন্ধ্যায় গিয়ে বসল একটা রেস্টুরেন্টে। বসে দুজনই খোশগল্পে মেতে উঠল।
শুভ্র, সাজেদ,আর অনিক ধানমন্ডির ব্লক বি’তে এসেছিল কাজে। কাজ শেষ করে অনিকের জোরাজুরিতে এক শপিং মলে ঢুকল,অনিক ওর গার্লফ্রেন্ডের জন্য গিফট কিনবে। শপিং মল থেকে বের বাইকে উঠার আগে শুভ্র চোখ গেল সামনের রেস্টুরেন্টে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সাজেদ আর অনিকও তাকালো সেদিকে। রেস্টুরেন্টের কাচের দেয়ালের সাথের টেবিলটায় বসে আছে শিশির, সামনে এক ছেলে। সাজেদ আর অনিক তৎক্ষনাৎ তাকালো শুভ্রর দিকে। শুভ্র বেশকিছুক্ষণ দেখল,,শিশির আর ছেলেটা কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে। ব্যাস,,!!শুভ্রর মাথায় চট করে রাগ উঠে গেল।
শিশির আর আরিফ কথা বলছিল,,হঠাৎ আরিফের কলার ধরে কেউ পিছন দিকে হেচকা টান দিয়ে দাড় করালো এবং সাথে সাথে নাক বরাবর একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো। কয়েকমুহুর্ত লাগল শিশিরের ঘটনা কি ঘটছে তা বুঝতে। কিন্তু ও বুঝে উঠার আগেই ঘটনা আরো গুরুতর হয়ে গেল। শুভ্র একের পর এক ঘুষি মেরেই যাচ্ছে আরিফের নাকে মুখে, ইতিমধ্যে রক্তও বের হয়ে গেছে। এদিকে শিশিরের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,,ও মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে,,! কিভাবে থামাবে,,! কার কাছে সাহায্য চাইবে,,!
সাজেদ আর অনিকও হতভম্ব হয়ে গেছে। শুভ্রর অবস্থা এতোটাই হিংস্র হয়ে আছে যে,,ওদেরও সাহস হচ্ছে না শুভ্রকে থামানোর।
কারো ডাকে পাশে ফিরতেই সাজেদ দেখে শিশির দাঁড়ানো,,ভয়ে ও থরথর করে কাপছে। কাপা কাপা গলায় শিশির বলল,”সাজেদ ভাই ওকে থামান। ছেলেটা আমার ফুপাতো ভাই। ও আমার ভাইকে মেরে ফেলবে। ওকে থামান প্লিজ।”
সাজেদ দৌড়ে গেল শুভ্রকে থামাতে। কিন্তু শুভ্র যেনো আর নিজের মধ্যে নেই। সাজেদকে এমন ধাক্কা দিলো সাজেদ ছিটকে গিয়ে পড়ল একটা চেয়ার নিয়ে।
অবস্থা খুব খারাপ মোড় নিচ্ছে বুঝতে পেরে শিশির কোনোরকমে গিয়ে দাড়ালো শুভ্রর সামনে,, কাপা কাপা গলায় বলল, “শুভ্র একটু আমার কথাটা শোনো,,ওকে ছাড়ো………….”
শিশিরকে সামনে দেখে শুভ্রর রাগ যেনো চারগুন বেশি বেরে গেল,,আরিফকে আহত অবস্থায় রেখে ও গিয়ে শিশিরের গলা চেপে ধরল,
- এতো হাসি কই থেকে আসে তোর। দুনিয়ার সব ছেলের সাথে তোর খাতির আর আমি চোখের বিষ,,,,আমার চরিত্র খারাপ,,আমি খারাপ মানুষ,,, তাহলে তুই এই ছেলের সাথে কি করস এখানে,,তোর পাখা আজকে আমি কাটবো,,,অনেক উরতে শুরু করসত তুই……”
অনিক দৌড়ে গেল শুভ্রকে থামাতে। শুভ্রর হাত ধরে টানাটানি করার পরও ছাড়াতে পারছে না শিশিরকে,,
-শুভ্র তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি,,,,মেয়েটাকে মাইরা ফেলবি তুই,,,, ছাড় ওরে। আগে পুরা ঘটনা শোন দোস্ত,,,শান্ত হো,,,ছাড় শুভ্র,,,,,(অনিক)
অনেকক্ষণ জোরাজুরির পর শিশিরকে ছাড়ালো অনিক। আরএকটু দেড়ি হলে শিশির মরেই যেত। শিশির জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল আর কাশতে লাগল।
একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল রেস্টুরেন্টের সামনে। কেউ হয়ত পুলিশকে ফোন করেছিল।আরিফকে আর শিশিরকে পাঠানো হল হাসপাতালে,,,, আর শুভ্রকে নেয়া হল পুলিশ কাস্টাডিতে।
পর্ব ১২
টানা ৫দিন কেস চলল। শিশিরের ফুফু কাকলী খায়ের তার একমাত্র ছেলের এই বেহাল দশা করার জন্য শুভ্রকে কঠিন শাস্তি দিতে চাইছিলেন। তিনি পুলিশের পিছনে টাকার পর টাকা ঢাললেন,,কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। ছেলের এই অবস্থায় শুভ্রর বাবাও দেশে আসলেন। এবং তিনি কেস সম্পুর্ণ নিজের পক্ষে করে ফেললেন। কাকলী খায়ের শুধু টাকার পর টাকাই ঢাললেন,,কিন্তু কোন কৌশলে কার কাছে গেলে সাহায্য পাওয়া যাবে তিনি কিছুই জানেন না। অপর দিকে শুভ্রর বাবা দেশের বড়মানের ব্যাবসায়ী,, তিনি উপরের মহলের সাথে কথা বলে খুব সহজেই ছেলেকে ছাড়িয়ে নিলেন। তিনি চাইছিলেন উল্টো কেস করে কাকলী খায়ের আর আরিফকে ফাসিয়ে দিবেন,,কিন্তু শুভ্র মানা করল।কিন্তু তিনি ছেলের পিছনে লোক লাগিয়ে দিলেন, কার জন্য তার ছেলে এভাবে মারামারি করে বেড়াচ্ছে,, এই খোজ খবর না জানলেই নয়।
সাজেদ শুভ্রকে সম্পুর্ণ ঘটনা খুলে বলেছে সেদিন কি হয়েছিল। শুভ্রর মাথায় হাত পড়ল, কিভাবে এখন ও কি করবে,,,!! সব যেন ওর হাত থেকে ফোসকে যাচ্ছে।
আরিফের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ওকে হাসপাতালেই রেখেছেন কাকলী খায়ের। শিশিরও খুব অসুস্থ ছিল কয়দিন, গলা ব্যাথায় ওর খাওয়া দাওয়া বন্ধ প্রায়। নরম খাবার দিলেও ও খেতে পারতো না। গলায় আংগুলের দাগ বসে গেছে। বাসার সবাই হাজার হাজার প্রশ্ন করলেও শিশির ছিল নির্বাক। কি বলবে ও!! একটা সাইকো ছেলে ভালোবাসার নামে ওকে আর ওর ভাইকে এভাবে মেরেছে!! কিভাবে বলবে এই ছেলের সাথে ও সম্পর্কে জড়িত!! ১সপ্তাহ যাবৎ শিশির বাসায় নিজের রুমে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে। শিশিরের ফুফু ভাইয়ের ছেলেমেয়েগুলোকে অনেক ভালোবাসেন। প্রতিবছর দেশে চলে আসেন ওদের জন্যই। তাই ছেলের এতো বড় দুর্ঘটনার পরও শিশিরকে কোনো প্রকার জেরা করেননি। বরং ভাইকে বলে দিয়েছেন মেয়ের সাথে ধীরেসুস্থে কথা বলতে।
আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে,এই বুঝি ঝুম করে নামবে। শিশির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে,ঠিক সেই সময় ওর ফোন বেজে উঠল,
-কেমন আছো?
-কেনো ফোন করেছো?
-………….ক্যাম্পাসে কেনো আসো না?
-আমার ইচ্ছা,কেনো ফোন করেছো বলো!
-………………..শিশির একটু দেখা করতে চাই। কথা বলতে চাই তোমার সাথে, সামনা সামনি।
-……………হুম,,কথা আমারো আছে। দেখা আমিও করতে চাই।
-তাহলে আজকে দেখা করবে? আমি তোমাকে পিক করতে আসি?
-কোনো প্রয়োজন নেই,আমি একা আসতে পারবো। ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়ে দেখা হবে। ১ঘন্টার মধ্যে আসছি।
শুভ্রর জবাবের অপেক্ষা না করেই ফোন রেখে দিলো শিশির। হুম,,,যেতে হবে। কথাতো অবশ্যই বলতে হবে! আজ এর একটা দফারফা করতেই হবে।হয়তো এসপার নয়তো ওসপার!!!
শিশির রুম থেকে বের হয়ে দেখে মা আর ফুফু সোফায় বসে কথা বলছে। ও বের হওয়ার সময় মা এগিয়ে এসে বললেন, “কই যাস?”,,,”আজকে তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে” এতোটুকু বলেই শিশির বের হয়ে গেল।
সামনা সামনি দাড়িয়ে আছে শিশির আর শুভ্র। শুভ্রর নজর শিশিরের গলায়। দাগ এখনো স্পষ্ট। শুভ্রর ইচ্ছা করছে নিজের হাত কামড়ে ধরতে,,কিভাবে পারলো ও!!! শুভ্র হাত বাড়িয়ে শিশিরের গলায় স্পর্শ করতে যাবে, তখনই শিশির
ঝারা মেরে ওর হাত সড়িয়ে দিলো,
-খবরদাড় আমায় হাত লাগাবে না,,,,
-শিশির আমার কথাটা একটু শোনো…..
-হুম, বলো,,, তোমার কথা শোনার জন্যই তো আজ দেখা করলাম।বলো,,বলো,,,
-শিশির আমার মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি জানি না হঠাৎ কেনো……কিন্তু তোমার সাথে অন্য এক ছেলেকে দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম শিশির,,তোমাকে হারানোর ভয়!!
-(নিশ্চুপ)
-আমি মনে হচ্ছিল আমি………………..তুমি যদি আমাকে ছেড়ে দাও!
-এজন্য তুমি এভাবে মারধোর করেছো!!
-শিশির আমি……
-মেরেই চুপ থাকো নি,,,অপরাধী হওয়ার পরেও বিনা শাস্তিতে ঘুরে ফিরছো!!!
-(নিশ্চুপ)
-তোমার মধ্যে কি অনুতপ্ত বোধ নেই!!!
-(নিশ্চুপ)
-তোমার মত একটা একগুয়ে, রগচটা,বেপরোয়া মানুষ আমি দেখি নি। তুমি বলো,,, তুমি আমাকে ভালোবাসো!!!! আসলে তুমি নিজেকে ভালোবাসো,,তাই তুমি নিজের অপমান সইতে পারো না,,,,তোমাকে ফেলে অন্য ছেলের হাত ধরবো এর চেয়ে বড় অপমান আর কি আছে বলো,,, তাই তুমি এই কাজগুলা করো।
শুভ্রর মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে। শিশির বরাবরই ওর অনুভূতিগুলোকে অদেখা করে আসছে,,,কিন্তু এখন ও চরম পর্যায়ের অবহেলা ও অপমান করছে।
-শুরু থেকেই এটা তোমার গায়ে লেগেছিল একটা মেয়ে তোমাকে রিজেক্ট করেছে। এটাই ছিল তোমার জিদ। আর জিদটাকেই তুমি টেনে এতোদূর এনেছো,,,,
-শিশির তুমি উল্টা পাল্টা বুজচ্ছো,, এমন কখনোই ছিল না,,,একটা ব্যাপারকে এতোটাও তিল থেকে তাল করা উচিত না,,,,,
-তোমার এটাকে তিল মনে হচ্ছে!!! যখন যেভাবে মন চায় অপমান করো,,,গায়ে হাত তুলো,, এত কিসের অধিকার তোমার,,,
-দেখো শিশির……………..
-থামো,,,,অনেক বলেছো আর অনেক শুনেছি। আজ আমি বলছি,,,তোমার সাথে আর একমুহুর্ত না। আর সম্ভব না,,,আমাকে তোমার ভালোবাসার এই জঞ্জাল থেকে মুক্তি দিয়ে উদ্ধার করো,,
ভালোবাসার জঞ্জাল!!! জঞ্জাল,,,,!!! মুহূর্তেই ক্ষেপে গেল শুভ্র,,তুই হাতে শিশিরের দুই কাধ চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-এই জঞ্জালেই তোকে আজীবন থাকতে হবে। এতো সহজে ছাড়ছি না,,,মাথায় ঢুকিয়ে রাখ এই আমার সাথেই তোর ভাগ্য লেখা,,,বিয়েতো আমাকেই করতে হবে।
-তুমি যা করেছো,,,তারপরও কিভাবে ভাবছো,,,আমার বাবা মা তোমার সাথে আমার বিয়ে দিবেন!!!
-সেইটা নিয়ে আমি টেনশনও করি না। আমি চাইলে এখন এই মুহুর্তে তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে পারি,,,কারো কিচ্ছু করার ক্ষমতা থাকবে না,,,,,কিন্তু করবো না,,,কেনো জানো,,,,,কারন আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না,,,এবং সারাজীবন তোমাকে বন্দি করে রাখতে পারবো না……………..
-এবং আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসবো না,,,,এখনতো আরো না,,,,
বলেই শিশির দ্রুত হেটে চলে যেতে লাগলো। শুভ্র তাকিয়ে রইল শিশিরের গমনপথে,,,আচ্ছা শিশির,,,,!!আমার অনুভুতিগুলো কি কখনোই তোমার পর্যন্ত পৌছাবে না!!
বাসায় ঢুকে শিশির দেখে বাবা,মা,ফুফু, বসে আছে ড্রইংরুমে,,,, কাউকে কিছু জিগ্যেস করতে হল না,,,শিশির নিজে থেকেই সব খুলে বলল। সব শোনার পর শিশিরের বাবা মারাত্মকভাবে ক্ষেপে গেলেন। প্রচুর রাগারাগি করলেন শিশির আর ওর মার সাথে। মেয়ে কার সাথে কই যায়,,কি করে খোজ রাখো না,,!! গুন্ডাফুন্ডা ছেলেদের সাথে মেয়ে ঘুরে ফিরে বেড়ায়,,, খেয়াল রাখোনা,,, তুমি সারাদিন ঘরে বসে কি কর!!! এসব নানান কথা বলে রাগে ফুসে উঠলেন কবির সাহেব। শিশিরকেও অনেক বকাঝকা করলেন। এবং এও সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে আর পড়াবেন না,,, ছেলে দেখে বিয়ে দিবেন,, এই মেয়ে বখে গেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত বোনের কথায় থামলেন। শিশিরের ফুফু বললেন, ” তোর মেয়েতো ভুল বুঝতে পেরেছে,,,এবং এও বলেছে ওই ছেলের সাথে আর জড়াবে না,,,তাহলে একটু শান্ত হো। বয়সটাই এরকম ভুলত্রুটি হয়। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে এইতো চাই আমরা।” অনেক বুঝানোর পর কবির সাহেব মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। মেয়েদেরকে তিনি অনেক ভালোবাসেন কথা ঠিক কিন্তু বোনকেও তিনি অনেক সমীহ করেন। সেই বোনের ছেলের আজ এই অবস্থা মেয়ের ভুলের জন্য। এই কথা ভেবেই তিনি বেশি রেগে গেলেন। মেয়েটাকে এখন থেকে চাপের উপর রাখতে হবে।
রুমে ঢুকেই শিশির বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাবা অনেক বিশ্বাস করতেন,,,কিন্তু আজ ও বাবার চোখে কতটা নিচু হয়ে গেল। শিরিন বেগম মেয়ের রুমে ঢুকলেন, কিছু বলার আগেই শিশির বলল,
-মা পরিস্থিতি যতো যেমনই হোক ওই ছেলেকে তোমরা কখনই মাফ করবে না।
পর্ব ১৩
বারান্দায় বসে শুভ্র সিগারেট টানছে,,পাশে দাঁড়িয়ে সাদেক,,
-কি কথা হলো শিশিরের সাথে?
-তেমন কিছুই না।
-মাফ চাইসোস ওর কাছে?
-মাফ চাইবো কেনো!!
-মাফ চাইবি কেনো মানে!!! তুই ভুল করসোস মাফ চাইবি না!! আশ্চর্য্য কথা বার্তা বলস তুই!!
-ভুলটা আমার ছিল,,,তেমনি ওরো ছিল। ও আমাকে আগে জানাইলে কি আমি এই ভুলটা করতাম!!.
-এজন্য তুই তোর ভুলের জন্য মাফ চাইবি না!!
-চুপ করতো,,,জ্ঞান দিতে আসবি না
-এভাবে কিন্তু সমাধান হইবো না মনে রাখিস,,,,ভুল করার পরও গেট ধইরা বইসা থাকলে কোনো সমাধানই হইবো না।
-হইবো,,,,,শিশির আমাকে বুঝলেই সব সমাধান হইবো। ভালোবাসার টান বড় কঠিন,, বুঝলা বন্ধু,,,,এবং সেই টানেই ওরে আসতে হবে আমার কাছে,,ফিরতে হবে,,,
-ও যদি ফিরাও আসে, তোর কাছে কি মনে হয় তোর বাপ মা ওরে মাইনা নিবো,,,আর যেই কেলেংকারী করসোস,, এরপর ওর ফ্যামিলি!!
-এসবের ধার আমি ধারি না,,,এসব টাকা, ব্যাবসা আমার দরকার নাই,,,সব ছাইড়া ওরে নিয়া চলে যাবো। আমি যথেষ্ট শিক্ষিত,,,ওরে নিয়া খাওয়ানোর মত যোগ্যতা আমার আছে!!
-কিন্তু তাই বইলা!! আর ওর………..
-অই থামতো,,,তরে আমি ডাকসি এইসব প্যারা থেইকা আমার mind divert করতে,,, আর তুই আমারে ওই একটা বিষয়েই ফোকাস করায়া বসায়া রাখসোত,,,অন্য কথা কো ব্যাটা,,
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সাজেদ একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,,
-আচ্ছা অন্য কথা কই!! বন্ধু শাকিব খানের নতুন মুভির ট্রেইলার দেখসো?
শুভ্র কটমট করে তাকালো সাজেদের দিকে। আর সাজেদ হো হো করে হাসা শুরু করলো।
ইফতেখার আহমেদ নিজের রুমে বসে বসে ইনফরমেশন ঘাটছিলেন। ছেলের পিছনে লাগানো লোক আজ বিকালে বেশ কিছু ইনফো দিয়ে গেছে। ইনফো ঘাটাঘাটি করে উনি জানতে পারলেন শুভ্র আর ওই মেয়ে সম্পর্কে জড়িত। শিশির সম্পর্কে তিনি মোটামুটি অনেক ইনফো পেলেন। ওর ফ্যামিলি কেমন, কোথায় থাকে, কিসে পড়ে সবই জানলেন। ইনফো যত ঘাটচ্ছেন ওনার মেজাজ ততো খারাপ হচ্ছে। উনি যেখানে ছেলের জন্য রাত দিন খেটে যাচ্ছেন সেখানে উনার ছেলে এক চিপা গলির একজন চিপ ব্যাবসায়ীর মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে!! ওদের কোনো সামাজিক মর্যাদা বলতে নেই!! এই ছেলেকে অনেক স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে,,,তাই এমন লাটে উঠেছে!!
কাগজপত্র ঘাটছিলেন তখন তার স্ত্রী জাফরিন আহমেদ ঢুকলেন রুমে। ঢুকেই উনি ফোস ফোস করে উঠলেন
-তুমি কি জানো তোমার ছেলে কি প্লানিং করছে,,
-(নিশ্চুপ)
-কোন না কোন মেয়ে ওকে ফাসিয়েছে আর তোমার সুপুত্র এখন সেই মেয়ের হাত ধরে পালানোর প্লান করছে!! ওনার নাকি এসব টাকা পয়সা ব্যাবসা কিছুই লাগবে না।
জাফরিন আহমেদ গিয়েছিলেন শুভ্রর রুমে ওর সাথে কথা বলতে,, তখন শুভ্র আর সাজেদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছেন। স্ত্রীর এসব কথা শুনে ইফতেখার আহমেদ কিছুক্ষণ ঠান্ডা চোখে চেয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে, তারপর আবার নিজের কাজ করতে লাগলেন।
- তুমি কি শুনছো কিছু!! ভাবতে পারো এই ছেলের জন্য আমি নিজেও তোমার সাথে ব্যাবসায় নেমে গিয়েছি। একমাত্র ওর ভবিষ্যত যেন সিকিউর থাকে,,,আর আজকে ওর কাছে আমাদের চেয়ে কোন না কোন মেয়ে বেশি বড় হয়ে গেল!!
-চিন্তা করো না কালকে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-কালকে ঠিক হয়ে যাবে মানে!!! কালকের মধ্যে তুমি কি করবে!! আর তাছাড়া কালকে আমাদের সিডনির ফ্লাইট আছে।
-ভ্যাজোর ভ্যাজোর কম করো জাফরিন,,, বললামতো কালকে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন মেইডকে বলো আমার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আনতে।
সকাল থেকে শিশির রুমে বসে আছে। নাস্তার জন্য ডাকা হলেও ওর বের হতে ইচ্ছা করেনি। এই মুহুর্তে ওর বাবার সামনে যাওয়ার কোনো মুখ নেই। তাই যতোটা সম্ভব লুকিয়ে থাকা যায়! ওর বাবা আর ভাই দোকানে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল, আর ওর ফুফু হাসপাতাল যাওয়ার জন্য। আজকে আরিফকে বাসায় নিয়ে আসবে। এমন সময় ওদের বাড়ির সামনে একটা কালো গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক বের হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে সোজা দোতলায় গিয়ে সিড়ির সাথের ফ্ল্যাটে বেল বাজালো। শিশিরের ভাই দরজা খুললে ভদ্রলোক জিগ্যেস করল,
-এটা কি আফজাল কবিরের বাসা?
-জ্বী।
সাজেদ বাসার নিচে বাইকটা পানি দিয়ে পরিষ্কার করছিলো। তখনই দেখল তিন বাড়ি সামনে একটা কালো গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক বের হয়ে উপরে গেলেন আবার কিছুক্ষন পর নিচে নেমে এসে কি যেন বললেন,,এরপর আরো দুইজন মানুষ গাড়ি থেকে বের হলেন। ওনাদের দেখার সাথে সাথে সাজেদের হিচকি উঠে গেল,,,তাও একটু সিউর হওয়ার জন্য পিছন পিছন গিয়ে দেখল ওনারা আসলেই শিশিরদের বাসায় ঢুকছে,,,ও দ্রুত শুভ্রকে ফোন দিল। তিনবার ফোন দেওয়ার হওয়ার পর শুভ্র ফোন রিসিভ করল,
-সকাল সকাল মোরগের মত ডাকা শুরু করসোস কেন?
-বাহ ভালো ঘোড়া গরু বেইচ্চা ঘুমাইতেসত বেশ ভালো,,ঘুমা,,,,কিন্তু তোর বাপ মা কই খবর আছে!!
-তাদেরও বেইচ্চা দিসি,,
-তাই নাকি!! তাহলে তারা শিশিরদের বাসায় কি করে!!
ধরফর করে উঠে বসল শুভ্র,,,
-মানে!!
-এই মাত্র ঢুকল শিশিরদের বাসায়,,,কি বোম জানি ফাটায় দোস্ত!! তারাতারি আয়,,, নাহয় আজকে আমগো এলাকায় আগুন লাইগা যাইবো,,
ফোনটা কেটেই শুভ্র ছুটলো,,বাসার স্লিপার পরেই শুভ্র বাইক স্টার্ট দিলো।
শিশিরদের বসার ঘরে সব জোড়ো হয়েছে। শিশিরের ফুফু আর বাবা খুব ভালো করে সামনে বসা মানুষ দুজনকে চিনতে পারলেও বাকিরা চিনতে পারছে না।সবাই মৌন হয়ে বসে আছে। নিরবতা ভেঙে শিশিরের বাবা’ই জিগ্যেস করলেন,,
-আমাদের বাসায় আসার কোনো বিশেষ কারন!!
-কারনতো আছেই,,,মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছেন আমাদের ছেলের পিছনে জবাবদিহিতা করতে হবে না আপনাদের!! (জাফরিন আহ.)
এরকম এক কথায় সবাই যেনো হতবাক হয়ে গেলো,,,
-এই মেয়ে তুমিই শিশির?? দেখতে শুনতেও তো থার্ডক্লাস!! শুভ্রর সাথে তোমার আদৌ কি যায় নাকি,,!! কি দেখিয়ে আমাদের ছেলেকে বন্দি করে রেখেছো!!( জাফরিন আহ.)
এতক্ষণে বুঝলো শিশির,,,, তারপরও বিস্ফরিত চোখে চেয়ে রইল সামনে। লজ্জায় ঘৃণায় ওর মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
কবির সাহেব চেচিয়ে উঠলেন,
-আমার মেয়ে সম্পর্কে এরকম আজেবাজে কথা বলার কি অধিকার আছে আপনার!!
-অন্যের মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা আমাদেরও নেই। কিন্তু আপনার মেয়ের কারনে আমাদের ছেলে বখাটে হয়ে যাচ্ছে। মারধোরে পর্যন্ত নেমে গেছে। এখনতো কিছু না বললেই নয় মি. আফজাল। (ইফতেখার আহ.)
-আপনার ছেলেতো ছোট কোনো বাচ্চা না যে,,,আমার মেয়ে যা বলবে তাই করতে হবে!! এরকম শিক্ষা কেনো দিয়েছেন ছেলেকে!!
-শিক্ষার কথা আমাদের শুনাতে আসবেন না,,,, আমার ছেলে যেখান থেকে পড়াশোনা করে এসেছে সেখানে পা রাখার ক্ষমতাও আপনাদের মেয়ের নেই। এরকম একটা প্রেস্টিজিয়াস ইন্সটিটিউশনে আপনার মেয়ে ঢুকতে পেরেছে বলে নিজেদের এতো উচু মনে করবেন না।
এইসময় শিশিরের ফুফু চেচিয়ে উঠল,
-আমাদের উচু নিচু বুঝানোর আপনি কে!! ছেলে একটা বানিয়েছে বখাটে গুন্ডা। নিজের ছেলেকে সামলে রাখতে পারেনা যারা তারা আমার মেয়ে নিয়ে কথা বলে কোন মুখে!!
-আমার ছেলেতো শখে মারধোর করেনি,,এই মেয়েই ওকে উসকিয়ে দিয়েছে। এই মেয়ে বলছো না কেনো শুভ্রকে তুমি ফাসিয়েছো,,তোমার কথায় ও আমাদের ছেড়ে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পর্যন্ত রাজি হয়ে গেছে,, বলছো না কেনো কথা!!
ঘরে একটা নিরব বাজ পড়ে গেলো…. এই কথা বুঝি ওর কানের পাশ দিয়ে ফোস করে চলে গেলো,,কানে কিছুই ঢুকলো না। কি বলে এই মহিলা!!
পর্ব ১৪
শিশির চেয়ে আছে সামনের মহিলার দিকে আর ঘরের সবাই চেয়ে আছে শিশিরের দিকে। এতোসব মিথ্যা অপবাদ কি আসোলেই নেওয়া যায়!! আর আমি!! আমি শুভ্রকে বন্দি করে রেখেছি!! ভাবতেই শিশিরের চোখ থেকে পানি পরতে লাগল। জাফরিন আহমেদ যেন সুযোগ পেয়ে গেলেন
-এই দেখুন এখনো আপনার মেয়ে মুখে কিছু বলছে না। এর মানে কি এই না যে আপনার মেয়েই আমার ছেলেকে আটকে রেখেছে। আর আমার ছেলেকে দিয়ে এসব করাচ্ছে!!
কবির সাহেব নিজেও এবার কিছু বলতে পারলেন না!! মেয়ের উপর থেকে উনার বিশ্বাস উঠেই গেছে,,তারউপর পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে শোনার পর উনি নির্বাক হয়ে গেলেন। কিন্তু শিশিরের ফুফু চেচিয়ে উঠলেন,
-আমার মেয়েকে সামনে বসিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছেন!! আপনার ছেলেকে কেনো আচলের নিচে লুকিয়ে রেখেছেন। তাকে ডাকুন,, সামনা সামনি কথা হয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই হোক।
-এমন নোংরা মানুষের মাঝে আমার ছেলেকে কখনোই আনবো না। আর এই মেয়ের সামনেতো আরো না। কি না কি বলে আবার ফাসাবে ছেলেকে। এর মতো মেয়েরা বড়লোক ছেলেদের বন্দি করে শুধু টাকা নিয়ে উড়াতে জানে।
-থামুন
খুব শান্তগলায় কিন্তু খুব কঠিন ও স্পষ্টভাবে কথাটা বললো শিশির। এমনকিছু ছিল ওর কথায় যে জাফরিন আহমেদ আসলেই চুপ করে গেলেন।
-কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে!! এসব দোষ আপনি আমার উপর চাপাচ্ছেন কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে!!!
-এই মেয়ে তু……………
-আপনার ছেলে আপনাকে বলেছে!! আমি ওকে পালিয়ে যেতে বলেছি!!! আপনার ছেলেকে আমি বন্দি করে রেখেছি!!!!
-তোমার কি মনে হয় আমি…………..
-বাহ!!!! এতো দেখছি চোরের মায়ের বড় গলা!!! আমাকে এসব বলার আগে,,,,আপনার ছেলেকে আগে জিগ্যেস করুন ও কি করেছে
চেচিয়ে উঠল শিশির। রাগে ওর হাত পা কাপছে।
-আপনার ছেলেকে বন্দি করার মত ক্ষমতা আমার নেই,,,কিন্তু আপনার ছেলে ওর ক্ষমতার বলে আমাকে ঠিকই আটকে রেখেছে। দুইবছর ওর টর্চার সহ্য করে এসেছি। কি ভাবেন আপনারা নিজেদের!!! আপনার ছেলে কুকর্ম করে বেড়াবে আর তার অপবাদ আমাকে দিবেন!!! কোন অধিকারে!!!! অন্যের উপর জোর করে অধিকার খাটানোর শিক্ষাটা আপনার ছেলে বেশ ভালো করেই রপ্ত করেছে……..
-কি বলতে চাইছো তুমি?( ইফতেখার আহ.)
-হাহ!!! সেটা নাহয় আপনার ছেলেকেই জিগ্যেস করবেন!! আপনার ছেলেকেই জিগ্যেস করবেন কেনো ও আমার মত মেয়ের পিছনে ঘুরে!!!কেনো আমার মত মেয়ের সাথে পালিয়ে যেতে চায়!!! যেভাবে আমাকে জবাবদিহি করতে এসেছেন,,,ঠিক সেইভাবেই আপনার ছেলেকে জবাবদিহি করবেন,,, আগে আপনার ছেলেকে জিগ্যেস করে অন্যের ঘরে ঢুকবেন কথা বলতে।
-(নিশ্চুপ)
-আপনার ছেলের সাথে ঘুরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। কোনোকালেই ছিল না।ওর মত মানুষের চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছা করে না। অত হাইক্লাস স্মার্ট ছেলের যোগ্য আমি নই সেটা আমিও জানি। সুতরাং আমাকে কিছু বলার আগে আমি আপনাদের কিছু কথা বলি তা আপনারা আপনার ছেলেকে যেয়ে বলবেন,,,,,
ও যেন আর কক্ষনো আমার আশেপাশে না আসে। ওকে দেখলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যেতে ইচ্ছা করে,,,বলবেন আপনার ছেলেকে,,,ওর সাথে থাকলে আমার দম ফেলতে কষ্ট হয়,,,,আপনার ছেলে আমার জীবনে এসেছে
একটা অভিশাপের মত,,এই অভিশাপ আর নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। দয়া করে,,,,দয়া করে আপনার ছেলেকে বলবেন ওর যোগ্য কাওকে খুজে নিতে। আপনার ছেলের সাথে আর একমুহূর্ত থাকলে আমি মারা যাবো,,,,প্লিজ প্লিজ আপনার ছেলেকে বলবেন আমার থেকে দূরে থেকে আমাকে উদ্ধার করতে। কি বলতে পারবেনতো আপনার ছেলেকে এগুলো!!! যেই মুখে আমাকে কথা শুনাতে এসেছিলেন ঠিক সেই মুখেই বলবেন আপনার ছেলেকে এগুলো।
-দেখো মেয়ে……………..
-আমার মনে আপনারা যথেষ্ট বলেছেন,,,,এখন আপনারা আসতে পারেন,,,
বলেই শিশির দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা অনেকটাই ভিড়ানো ছিল। শিশির দরজা খুলতেই ওর পা কেপে উঠল। শুভ্র দাঁড়ানো গেটের বাইরে। তাকিয়ে আছে সোজা শিশিরের দিকে। কি কঠিন সেই চাহনি,,, চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। শিশির ভয়ে পেয়ে গেলেও পরমুহূর্তে সামলে নিয়ে বলল
-বাহ!!! আপনাদের আর কষ্ট করতে হলো না,,,দেখুন আপনার ছেলে নিজ কানে সব শুনেছে!! বাচিয়ে দিলো আপনাদের নিজের ছেলের কাছে ছোট হওয়া থেকে,,,,,,
আর কিছু বলার আগেই শুভ্র সিড়ি ভেঙে নিচে চলে গেলো। ইফতেখার আহমেদ ও জাফরিন আহমেদও চলে গেলেন।
ঘরময় সবার দৃষ্টি শিশিরের দিকে,,,সবার চোখে বিস্ময় আর প্রশ্ন,,,,সবার সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করেই শিশির নিজের রুমে চলে গেলো। এই মুহুর্তে কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় ও নেই। রুমে ঢুকে শিশির ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। শেষপর্যন্ত ও পারলো!!! ও বলতে পারলো!!! কিন্তু শুভ্র!! ওকি আবার কোনো কাহিনী করবে!! নাহ!!! এবার হয়তো সব শেষ হয়ে গেলো তবে!! হুমমমম, শেষ!
সন্ধ্যার দিকে শুভ্র বাসায় ফিরলো। ভিতরে ঢুকেই দেখে ইফতেখার আহমেদ আর জাফরিন আহমেদ সোফায় বসা। সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে ও উপরে চলে যাচ্ছিল তখন ইফতেখার আহমেদ ডেকে উঠলেন,,
-দাড়াও কথা আছে তোমার সাথে
-এইমুহুর্তে আমি কোনো কথা বলতে ইচ্ছুক না।
-অনেক বেশি বেড়েছো তুমি না!!! বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলা উচিত তা কি ভুলে গেছো!!!
-অন্যের লাইফে যে জোর করে ইন্টারফেয়ার করা উচিত না এটা বোধহয় তোমরা ভুলে গেছো!!
-শুভ্র!!
-চেচাবে না প্লিজ!!! তোমাদের সাথে চেচামেচি করতে আমার একদম মুড নেই।
-কোন বুদ্ধিতে তুমি অমন একটা থার্ডক্লাস মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ালে!!!
-আমার পারসোনাল লাইফ নিয়ে তোমাদের না ভাবলেও চলবে।
-এসব কোনধরনের কথাবার্তা শুভ্র!! তোমার বাবা তোমার ভালোর জন্যই কথাগুলো বলছে,,,
-ওহহহ,,প্লিজ আমাকে নিয়ে তোমাদের এমন চিন্তার নাটক করতে হবে না। তোমাদের এমন হঠাৎ চিন্তা দেখে আমার নিজের চিন্তা লাগছে!!
-শুভ্র আমাদের কথাটা শুন বাবা,,,
-আপনারা শুনুন,,, আজ পর্যন্ত আপনাদের আমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা হয়নি সুতরাং এখন আমার সামনে এসব চিন্তা করার ঢং করবেন না। আপনাদের জন্য এখন পর্যন্ত মুল টেনশন ছিল ব্যাবসা, টাকা, সুতরাং এগুলো নিয়েই আপনারা টেনশন করুন।
আর একটা কথা ক্লিয়ার করে দেই,,,, আমি কার সাথে সম্পর্ক করবো কাকে বিয়ে করবো এসব সম্পুর্ণ আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আপনারা নাক না গলালেই খুশি হব।
বলেই হনহন করে চলে গেল।
রুমে গিয়ে শুভ্র বারান্দায় চলে গেল।
অনেক ক্লান্তিকর একটা দিন ছিল। অনেক কিছু ঘটে গেলো আজকে। শুভ্রর এখন প্রচুর ক্লান্ত লাগছে। মানুষের সহ্য করার একটা লিমিট থাকে।আসলেই ও শিশিরের সাথে অনেক বেশিই অতিরিক্ত করে ফেলেছে। তাই আজ……!!!!
আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করল না শুভ্রর। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে আবার প্রচন্ড ঘুমও পাচ্ছে। শুভ্র ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
আজকে দুইসপ্তাহ হয়ে গেল সেই ঘটনার পর। এর মধ্যে শুভ্র শিশিরকে একবারের জন্যও ফোন দেয়নি। শিশিরের খানিকটা অস্বস্তিই লাগছিল, ভয় ভয়ও লাগছিল। কিন্তু যখন দেখল শুভ্র এতোদিনেও ফোন দেয় নি তখন ওর ভয়টা কমে গেল। বাসায় প্রথম প্রথম খুব ঝামেলা হলেও পরে সব শান্ত হয়ে গেল। ওর ফুফুও চলে গেছেন আজ বেশ কয়দিন। শিশির ইচ্ছা করেই এইকয়দিন ক্যাম্পাসে যায় নি।শুভ্রর রিএকশন দেখার জন্য। শুভ্র যেহেতু যোগাযোগের চেষ্টা করেনি তারমানে এবার সব একেবারের জন্যই শেষ!!!
আজকে এতোদিন পর একা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার পর শিশিরের প্রচুর অস্বস্তি লাগছে। আচ্ছা!!! সবাই কি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে!! কেনো তাকিয়ে আছে!! কেউ কিছু জেনে যায়নি তো। যেনে গেলেও সমস্যা নেই। কিন্তু এভাবে সবার তাকানোটা ওর বাজে লাগছে। গেট থেকে কিছুদূর ভিতরে এগোতেই শিশির দেখল,,,, শুভ্র!!! দাড়িয়ে গেল সাথে সাথে,,,শুভ্র এদিকেই আসছে। ঠিক ওর দিকে। দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে শিশির মনে মনে বলল “আল্লাহ আজকে আমাকে বাচাও”
পর্ব ১৫
শিশির মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।ওর আর শুভ্রর মাঝে ধীরে ধীরে দূরত্ব কমে আসছে। শুভ্র অনিকের সাথে কথা বলতে বলতে আর হাতে ফোন টিপতে টিপতে এগিয়ে আসছিল,,,,এবং নিঃশব্দে শিশিরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
শিশির থম মেরে দাড়িয়ে রইল। কি হইল এটা!!
ও কি আমাকে দেখে নাই!!! শিশির ধুম করে পিছনে ঘুরে তাকালো। শুভ্র চলে যাচ্ছে,,,শিশির কতক্ষণ হা করে দাড়িয়ে থেকে হেটে চলল নিজের ডিপো’র উদ্দেশ্যে। এতটুক শিশির নিজেও বুঝে গেছে,,,শুভ্রর থেকে ও এখন পুরোপুরি ছাড়া পেয়ে গেছে। শুভ্র আর এখন ওর কেউ না।
ক্লাসে ঢুকতেই সায়রা চেপে ধরল শিশিরকে। ঘটনা ক্যাম্পাসে মোটামুটি ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে!!! ওতো কাউকে কিছু বলেনি!!! আর শুভ্রও এসব গেয়ে বেড়ানোর মত ছেলে না!!! আশ্চর্য্য ব্যাপার!!!
শিশির সায়রাকে সব খুলে বলল, সায়রা খুব খুশি হলেও শিশিরকে জিগ্যেস করল “তুই বুঝে শুনে ডিসিশন নিয়েছিসতো!!! পরে যদি খারাপ লাগে!!”
-“খারাপ লাগবে কেনো আশ্চর্য্য!!! আমি এই জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হাপিয়ে উঠেছিলাম তুই জানিস সেটা। আর কিছুদিন গেলে হয়ত আমি পাগল হয়ে যেতাম নয়ত মারা যেতাম।”
বলেই শিশির ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
-হুম, বুঝলাম। কিন্তু দুইটা বছর শিশির। দুই বছরের সব অভ্যাস পারবি এত সহজে ঝেড়ে ফেলে দিতে!!
-পারতে হবে যে!!!! অবশ্যই পারতে হবে,,,,
সায়রা আর কিছু বলল না। যেহেতু শিশির এতোটা নিশ্চিত সুতরাং ওকে আর এসব বলার কি দরকার। ও খুশি থাকলেই হয়।
শিশির এখন ইচ্ছামত আড্ডা দেয়। এখানে সেখানে ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে যায়। কেউ কিচ্ছু বলার নেই। কারো কোন বাধা নেই। ও এমনভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে,,যে মনে হয় ওর লাইফ সবসময় এরকমই ছিল। শুভ্র নামের কেউ কখনো ওর লাইফে ছিলই না।শুভ্র নামের কাউকে ও কখনো চিনতোই না।
কিন্তু আসলেতো এমনটা না। শুভ্র নামে কেউ ছিল এবং এখনো আছে। প্রায়ই ক্যাম্পাসে শুভ্রর সামনাসামনি হয়ে যায় শিশির। তখন ওর বুকের ভিতর ড্রাম বাজতে শুরু করে,,, ডিপডিপ করতে থাকে। কিন্তু শুভ্র প্রতিবার ওকে খুব সুন্দরভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যায়,,,,যেনো এই মেয়েটিকে ও কখনো দেখেই নি। প্রথম প্রথম শিশিরের খুব ভয় আর অস্বস্তি লাগলেও ধীরে ধীরে তা ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু শুভ্রকে দেখলে কেনো যেনো মনের অজান্তেই দাঁড়িয়ে যায় শিশির। মাঝে মাঝে ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেও দেখে,, তখনো দাঁড়িয়ে থাকে।কেনো!!!! মেজাজ খারাপ হয়ে যায় শিশিরের নিজের উপর!!!
ক্যাম্পাসে রীতিমত সবাই জানে ও আর শুভ্র এখন একসাথে নেই। প্রায়ই বিভিন্ন মেয়ের সাথে শুভ্রকে কথা বলতে দেখা যায়। মেয়েগুলো যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সবসময় শুভ্রর আশেপাশে কোন না কোন মেয়েকে দেখা যাবেই।
হাসি পায় শিশিরের,,,,,মেয়েগুলো এতোটা এমন কেনো!!!!
এভাবেই চলছিল। দুজন এখন দুজনকে খুব ভালোভাবেই এড়িয়ে চলে। সম্পর্কে ফিরে যাবার যেনো কারো কোনো আগ্রহই নেই।
এভাবেই হঠাৎ একদিন শুভ্রর সাথে এক মেয়েকে দেখা যায়। মেয়েটা সুন্দর,,,, বেশ ভালো সুন্দর। শুভ্রর সাথে মানিয়েছেও ভালো। পুরো ক্যাম্পাসে আবার ফুসুর ফাসুর শুরু হয়ে যায়। শিশির এসব কথায় কান দিতে চায় না। কিন্তু হায়!! উরো কথা যেন জোর করে কানে ঢুকে যায়, এবং শিশির জানতে পারে মেয়েটা শুভ্রর নতুন গার্লফ্রেন্ড। কেউ কেউ আবার বলে শুভ্রর সাথে এই মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলে অলরেডি এনগেজমেন্টও হয়ে গেছে। অবশ্য এসব কথা বলার পিছনে কারনও আছে। শিশির দেখেছে মেয়েটাকে। বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে শুভ্রর সাথে সবসময়। যেখানেই দেখা যাক,, হয় শুভ্রর হাত জড়িয়ে ধরে হাটছে নয় শুভ্রর সাথে ঘেষে বসে আছে। এভাবে দুজনকে একসাথে দেখলে যেকেউ বলবে ওদের সম্পর্কটা অফিশিয়ালি ঠিক হয়ে আছে। এমনকি শুভ্রর ফ্রেন্ডদেরও মেয়েটার সাথে খুব হাসাহাসি করতে দেখা যায়।
এসব দেখে শিশির মুখ দিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি বের হয়। খুবতো ভালোবাসি ভালোবাসি করে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে দুইবছর যাবৎ জোর করে সম্পর্ক করল। এখন যখন সুন্দর কোনো মেয়ে পেলো,,, ব্যাস!! অমনি ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালালো। এসব ছেলেদের নামে খুব শুনেছে শিশির। এখন যদি নিজের চোখে না দেখত তাহলেতো শুভ্রকে ভালোই ভেবে ফেলেছিল। আল্লাহর কাছে অসংখ্য ধন্যবাদ,,,যে ওদের সম্পর্কটা বেশিদূর আগায় নি। আর শুভ্রর আসল চেহারা সামনে চলে এসেছে। হাহ!!!
শিশিরও এখন সামনে এগোতে চায়। সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ নিতে চায়। কারো হাতে হাত রেখে হাটতে চায়। পুরোপুরি ভুলে যেতে চায় অতীতকে।
কিন্তু বিষয়টা এতোটাও সহজ হবে না, ও এখন বুঝতে পারছে। শিশির এখন বসে আছে লাইব্রেরিতে। সামনে পরীক্ষা, অনেক কিছু নোট করা বাকি। ও ঠিক বসেছে একটা জানালার সাথে। সেই জানালা দিয়ে ক্যাম্পাসের ডানদিকের মাঠটা দেখা যায়। ওর দৃষ্টি যেয়ে থেমেছে মাঠের উপর বসে আড্ডা দেওয়া শুভ্রদের দলটার উপর। শুভ্র আর ওর বন্ধুরা ছাড়াও অই মেয়েটি আছে। মেয়েটির নাম শিশির শুনেছে, তানহা। কানাডা থেকে এসেছে, তাই ড্রেসাপে এতোটা মর্ডান। কিন্তু একমুহূর্তের মেয়েটির কান্ডে শিশির রীতিমত অবাক। মেয়েটি শুভ্রর সাথে এতোটা সেটে আছে যে ওদের মধ্যে দিয়ে বাতাস চলাচলের রাস্তাটুকু নেই। কোনো একটা ব্যাপারে খুব হাসাহাসি চলছে সেখানে, এবং মেয়েটি হাসতে হাসতে শুভ্রর উপর ঢলে পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা যতবার এই কাজটা করছে শিশির ভ্রু ঠিক ততোবার কুচকে যাচ্ছে। ওদের দুইবছরের সম্পর্কে শিশির কখনো শুভ্রর সাথে এতোটা ঘনিষ্ট হয়নি। আর এই মেয়ে কয়দিনের সম্পর্কে এতোটা কিভাবে পারে!! আশ্চর্য্য!!!
শিশিরের বাহিরের দৃশ্যে এতোটাই মগ্ন ছিল যে সামনে হঠাৎ ধুপ ধাপ করে শব্দ হতেই ও ভয়ে লাফিয়ে উঠে। মনে হয় যেন কেউ বোম ফাটিয়েছে, ওর বুক ধড়ফড় করতে থাকে। খেয়াল করে দেখে টেবিলে ওর বই ছাড়াও আরো বেশ কিছু বই পড়ে আছে। কিন্তু বইয়ের মালিক কই!! শিশির সামান্য সামনের দিকে ঝুকে দেখার চেষ্টা করতেই নিচ থেকে একটা ছেলে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। শিশির সাথে সাথে পিছিয়ে যায়।
ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলে,
-ভাগ্যিস বইগুলা ঠিক আছে,,নয়তো আজতো আমি গিয়েছিলাম পুরাই।
বলেই হাত দিয়ে গলায় পোস দেওয়ার মত একটা ভঙ্গি করে।
শিশির নিজের কাজে মন দেয়। ছেলেটা বইগুলো গুছিয়ে নিয়ে বসতে বসতে বলে,
-বসে পড়লাম কেমন!! আসলে লাইব্রেরিতে বেশ থমথমে পরিবেশ,,,,আমার প্রচুর গরম লাগছিল তাই ভাবলাম এই টেবিলটায় বসি জানালা দিয়ে হালকা পাতলা বাতাস যদি আসে।
-…………
-সবার বোধহয় পরীক্ষা তাই না!!! তাই সবাই এতো সিরিয়াস হয়ে আছে,,,,,এতোটা সিরিয়াস হয়ে আছে যে আশেপাশের আবহাওয়া ও সিরিয়াস করে ফেলেছে,,৷ তাই আমি এদিকে আসলাম,,,,
শিশির বিরক্ত হয়ে বলল,
-আপনার কি আমাকে লাইব্রেরিয়ান মনে হচ্ছে!!
-না,,,না,,,তা মনে হবে কেনো!!
-তাহলে এতো কৈফিয়ত দিচ্ছেন কেনো,,,যেখানে ইচ্ছা হয় বসুন।
বলেই শিশির নিজেই অবাক হয়ে গেল। আগেতো কখনো কারো সাথে এভাবে কথা বলি নি!! আজ কি হল!!! ধ্যাত!!! শিশিরের সামনে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা এখনো ওর দিকে তাকানো
-সরি আসলে আমি এভাবে বলতে চাই নি। সামনে পরীক্ষাতো,,,, আসলে অই টেনশনেই আর কি একটু বেশি বলে ফেলেছি,,,,
-হুম বুঝতে পেরেছি। আসলে আমিও তোমাকে অত কিছু বলতাম না। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপার স্যাপার আমি একটু ভয় পাই আরকি!!! মেয়েরা এমন,,, তাকিয়ে থাকলে বলবে,, “অসভ্য তাকিয়ে আছে কেনো” আর না তাকালে বলবে
“বলদটা তাকায় না কেনো”…… তাই তোমাকে আগেই বসার কারনটা বলছিলাম আরকি।
এমন জবাব শুনে শিশিরের হাসি চলে এলো। ওকে হাসতে দেখে ছেলেটা একটু ধাতস্থ হয়ে বলল,
-বাই দা ওয়ে আমি আবির।
পর্ব ১৬
শিশির মুখে হাসি লাগিয়ে রেখেই বলল
-আমি শিশির
-বিন্দু?
-জ্বী!!
-না,,,মানে শিশিরবিন্দু একসাথে খুব মানায়,,,,তাই মুখ দিয়ে টুপ করে বের হয়ে গেল।
-ওহহ!! আচ্ছা আচ্ছা,,,কিন্তু আমি শুধু শিশির।
-শুধু শিশিরও সুন্দর।
তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা। আবির বেশ কিছু বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। এতো এতো বই কিভাবে শেষ করবে!!!! আবির মাথা নিচু না করলেও চোখ নিচু করে বই ঘেটেই যাচ্ছে। শিশির নোট করার ফাকেই একবার দেখল, তারপর আবার নিজের কাজে মন দিল।
বাতাস চলছে খুব জোরে। জানালা দিয়ে বাতাস ঝাপাঝাপি করছে। শিশিরের সামনের ছোট ছোট চুলগুলোও দাপড়াদাপড়ি শুরু করে দিল। চুলগুলোকে বাগে আনতে শিশিরের বেশ পরিশ্রম করতে হচ্ছে। একহাতে চুল ধরে রেখে এক হাতে লেখালেখি করতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। কি করা যায়!!! কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই সামনে বসে থাকা আবির হাতের বইটা ধপাস করে টেবিলে ফেলে,,বলে উঠল
-ধুররর,,,,এত্তো বাতাস!!! আমার চুলগুলোতো খুব ডিসটার্ব করছে দেখি!!
বলেই নিজের দুইটা কলমের ক্যাপ নিয়ে ক্লিপের মত চুলে আটকে রাখল। শিশির কতক্ষণ ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থেকে হাহা করে হেসে দিল।
-আরে আপনি হাসছেন কেনো!!! চুলগুলো সত্যিই ডিসটার্ব করছিল।
-জ্বী জ্বী বুঝতে পেরেছি!!!
পরে শিশির নিজেও একইভাবে চুলগুলো আটকে নিল। এরপর আর কোন কথা না হলেও টুকটাক ইনফো নিল একে অপরের। এই যেমন কোন ইয়ার, কোন ডিপো, কোন সাব. তারপর যে যার মত চলে গেল। শিশিরের পরদিন পরীক্ষা ছিল তাই আর দেড়ি করল না।
পরদিন শিশির ক্যান্টিনে বসে আছে। পরিসংখ্যান পরীক্ষা ছিল। বরাবরই এই সাব্জেক্টটা ওর তিতা লাগে। প্রশ্ন সামনে নিয়ে বারবার চোখ বুলাচ্ছে। যেন বারবার দেখলেই না পারা প্রশ্নগুলো সহজ হয়ে যাবে।এর মধ্যে হঠাৎ আবির এসে সামনের চেয়ার টেনে বসে পড়ল,,
-কি ব্যাপার শিশিরবিন্দু মুখটা এমন কদুর মত করে রেখেছ কেন!!!
-…………..
-না, মানে এখনতো আমরা একে অন্যকে চিনি তাই এভাবে বসে পড়লাম।
-………………….
-তাহলে কি উঠে যাবো?
-এক কাপ রঙ চা দিতে বলেনতো।
আবির চিৎকার করে বলল, “অই মামা, দুই কাপ চা দিয়ো। একটা সাদা, একটা কালা”
-সাদা, কালা!!!
-ওইটা উনারা বুঝবো। তুমি তোমার কদু মুখের কারন বল,,,,
-পরীক্ষা ভালো হয় নাই।
-হুমমম,,, পরিসংখ্যান পরীক্ষা ছিল তাই না??
-হুম!! এতো তিতা একটা বিষয় কিভাবে আপনার সাবজেক্ট হিসেবে নিলেন!!! অসহ্যকর!!!
-কি জানি বলতেতো পারবো না,,,তোমার মত কখনো খেয়ে দেখি নাই।
- ধুররর,,,ভুয়া একটা সাবজেক্ট।
-হুম,,তা বলতে পারো। পরিসংখ্যান সাবজেক্টটা আসলেই ভুয়া। একটা ভুল। এর কোন নিশ্চয়তা নেই শুধুই সম্ভাবনা। কিন্তু তারপরও তোমাদের একাউন্টিং থেকে ভালো। তোমাদের জীবনেরতো পারমানেন্ট পার্টনার হল ক্যালকুলেটর আর স্কেল।
এটা শুনে শিশির ফিক করে হেসে দিল। ততক্ষণে ওদের চা খাওয়া শেষ। এক কাপ চা শেষ করেই আবির আরেক কাপ চা অর্ডার দিলো।
-মাত্রইতো এককাপ শেষ করলেন!!!
-হুম আসলে যখন ছোট ছিলাম তখন একদিন মনে প্রশ্ন জাগলো একটা চা সাদা তাহলে আরেকটা চা কালো কেন!!! পরে নিজেই ভেবে আবিষ্কার করলাম হয়ত কালো চা খেলে মানুষ কালো হয়ে যায় আর সাদা চা খেলে মানুষ সাদা হয়ে যায়। তাই বেশি বেশি দুধ চা খেতে শুরু করলাম। এখনতো আমি এক বসায় ৩/৪কাপ দুধ চা খেয়ে ফেলতে পারবো।
-আপনি মানুষটা বড় অদ্ভুত!!!
-তাই নাকি!!! থ্যাংকস,, I’ll take that as a compliment….
তারপর খুব সুন্দর করে হাসল আবির।
ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে ওরা হাটতে লাগল গেটের দিকে। গেটের কাছাকাছি যেতেই শিশির দাড়িয়ে গেল। গেটের কাছে বেশ কিছু বাইক পার্ক করানো। সেই বাইকগুলোর উপর গোল হয়ে বসে আছে শুভ্র আর ওর ফ্রেন্ডরা। শুভ্র যেই বাইকটায় বসা অইটতেই তানহা বসে আছে। এবং ঠিক আগেরমতোই সেটে আছে। দেখেই শিশির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।শিশির গটগট করে হেটে চলে এল। বাহিরে এসে রিকশা খুজতে লাগল।
প্রচুর রোদ উঠেছে। রোদে পুরো শহরটা ঝাঝা করছে। শিশির মাথায় উড়না টেনে নিল। ছাতা নিয়ে আসলে ভালো হত। হাত দিয়ে কপালের উপর ছায়ার মত ধরেছে। কিন্তু কি যন্ত্রণা!!! হাতও দেখি পুরে যাচ্ছে।হঠাৎ………… আবির এসে সামনে দাড়ালো। পিছন ফিরে পিঠ দিয়ে দাড়ালো। শিশির কিছুটা অবাক হলেও,,, আবির বলল, “আমার পিছনেই থাকো শিশির রোদ কিছুটা কম লাগবে”
শিশিরের খুব ভালো লাগল ব্যাপারটা।
এভাবেই চলতে শুরু করল আবির আর শিশিরের দিনকাল। শিশিরের আবির ডাকা এখন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমিতে’ নেমে এসেছে। আবিরই ওকে বারবার রিকোয়েস্ট করে ‘তুমিতে’ নিয়ে এসেছে। আবিরের মতে ওরা আগে ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ডদের মধ্যে আবার আপনি আপনি কি!!! আবিরতো ‘তুই’ করে বলার জন্য চাচ্ছিল। কিন্তু শিশির সাফ মানা করে দিয়েছে, “তুমি চাইলে আমাকে তুই করে বলতে পারো। কিন্তু আমি পারবো না। বড়দের আমি কখনো তুমি করেই বলি না,,,তাও তোমার পেরাপেরি বলতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু তুই!!! সেটাতো অসম্ভব!!!”,,,,,,,, তাই আবির আর জোরাজুরি করে নি।
এইকয়দিনে আবির যেমন শিশির সম্পর্কে জেনেছে। শিশিরও আবির সম্পর্কে বেশ কিছু জেনেছে। আবির মা বাবার একমাত্র ছেলে। কিন্তু ওর বাবা মারা গেছেন ওর যখন মাত্র ১১ বছর। তারপর থেকে মা’ই ওর সব। ছোটকাল থেকে বড়কালের বন্ধু। ওর মা বাবার মূলত প্রেমের বিয়ে ছিল। যার জন্য দাদা বাড়ি অথবা নানা বাড়ি ওর কখনো যাওয়া হয়নি। কারন মা’র এবং বাবা’র পরিবার কখনোই ওদের তিনজনকে মেনে নেয় নি। এমনকি ওর বাবা মারা যাবার পরও না,,, যখন ওর মা বাবা’র রেখে যাওয়া ব্যবসা নিয়ে অথৈ সাগরে ভাসছিল তখনও কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে নি। ওর মা একা এই পর্যন্ত ব্যবসাটা একা টেনে এনেছেন। আবির মাস্টার্স শেষ করেই ব্যবসায় বসে যাবে। আর মা’কে পাঠাবে দুনিয়া ভ্রমণে।ওর মা’র নাকি খুব শখ দেশে বিদেশের সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরার।
আবিরের সাথে ঘুরতে শিশিরের ভালোই লাগে। আবিরের কথায় ওর হাসতেও ভালো লাগে। নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার কথাগুলোও আবিরের সাথে শেয়ার করতে ভালো লাগে। এবং আবির শুধু শুনেই চুপ থাকে না,,, ওকে সবসময় ভালো মন্দ বুঝিয়ে সাপোর্ট ও করে। এমন একজনকেই তো চেয়েছিল শিশির। যে ওকে বুঝবে, ওর মুল্য বুঝবে। ওর ইচ্ছা অনিচ্ছার কদর করে ওকে সাপোর্ট করবে।কিন্তু!!!……..
তারপরেও শিশিরের মনে একটা কিন্তু উকি দেয়!!! যেই কিন্তুর পর আর কোনো কিছু নেই!!!!
পর্ব ১৭
শিশিরের মনে আবির জায়গা করে নিচ্ছে ঠিকই,,,কিন্তু তাও কেনো খালি খালি লাগে ভিতরটা!!! তাও কেনো সবসময় কিছু নাই কিছু নাই মনে হয়। আবির ওকে এর মধ্যে অনেক বার বলেছে, “শিশির তোমাকে আমার ভালো লাগে, শুধুমাত্র ভালো বন্ধু হিসেবে না,,,এর চেয়েও বেশি কিছু হিসেবে ভালো লাগে!!” শিশিরের এর বিপরীতে কি বলা উচিত ও ভেবে পায় না।
আবির এর মধ্যে ওর বাবার ব্যবসায় বসে গছে। “এত তাড়াতাড়ি করার কি ছিল!! ৬মাস পরেই তো মাস্টার্স শেষ হয়ে যেত,,,, তখন নাহয় বসা যেত। স্টাডির সাথে সাথে ব্যবসা সামলানোটা একটু বেশিই ধকল হয়ে যাবে না!!!!” এই কথা বলাতে আবির হেসে হেসে বলল, “আরে!! প্রতিষ্ঠিত না হলে কোন বাপ মেয়ে দিবে নাকি!!”
এই কথার সাথে ওর কথার কি মিল!!! শিশির খুজে পায় না।
আবির শিশিরদের বাসায়ও গিয়েছে। শিশিরের বাবারতো আবিরকে খুবই পছন্দ হল। উনার নিজের ছেলে হল একটা গবেট, উল্লুক কিন্তু আবিরের মত এত ভদ্র, তুখোড় আর ব্রিলিয়েন্ট ছেলে দেখে কবির সাহেবের মন ভরে গেল।
কিন্তু শিশির!!! দিন দিন ওর অস্থিরতা যেনো বেড়েই যাচ্ছে। ও সবসময় ক্যাম্পাসে ইচ্ছে করে আবিরের সাথে ঘুরে আর ওর চোখ ঘুরে এদিক ওদিক। কাকে খুজে ও!!! কেনো খুজে!!! ও তো নিজ থেকেই মানুষটাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। তাহলে কেনো এখন এত খারাপ লাগে। শুভ্রকে দেখা যায় ক্যম্পাসে,,,, শিশির এখনো ওকে দেখলে দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু শুভ্র ও যেন ঘুরেও তাকায় না। আশ্চর্য্য!!! এতোটা পরিবর্তন!!! শুভ্রকে দেখলে শিশিরের ভিতরটা এখন ডিপডিপ করে না,,,কিন্তু কেমন যেন চিনচিন করে ব্যাথা করে!!! এর কারন কি!!! এ আবার কোন নতুন রোগ বাধালো!!!
সেদিন শুভ্রর সাথে তানহাকে দেখে শিশিরের চোখে পানিই চলে এলো। আবির ওর সাথেই ছিল। ছিঃ!!! আবির যদি দেখে ফেলতো তাহলে কি লজ্জাজনক ব্যাপার হত!!!
নিজের উপর খুব রাগ হয় শিশিরের!!! আবিরের মত ছেলে ওর পাশে থাকতে ও কিনা একটা গুন্ডা ছেলের জন্য এমন করছে। কিভাবে ভুলে যাচ্ছে ও,,,, যে এই গুন্ডা ছেলের জন্যই ওর ফুপাতো ভাই হাসপাতালে এডমিট ছিল,,,,বাবা ওকে কত কি বলল,,,,এমন কি শুভ্রর বাবা মা ও কত কথা শুনিয়ে গিয়েছিল। সেদিনের কথা মনে পড়তেই শিশিরের চোখের সামনে শুভ্রর মুখটা ভেসে উঠল,,,,,সেদিন শুভ্রর চোখগুলো অসম্ভব রকমের লাল ছিল। কিন্তু কেনো!!!
আচ্ছা!!! সেদিন কি শিশির খুব বেশিই বলে ফেলেছিল!! শুভ্র কি ওর বলা সব কথা শুনে ফেলেছিল!! উফফফফ,,,,,!!! নিজের চুল এখন নিজের ছিড়তে মন চায় শিশিরের।
শিশিরের মন ছোটাছুটি শুরু করলেও,,,আবিরের মন ছিল স্থির। শিশিরের সাথে ওর পরিচয়ের এখন ৫ মাস চলছে। ৫ মাস ধরে আবিরের মনে শিশির একটু একটু করে জায়গা করে নিয়েছে। আর এখন,,, আবিরের পুরো মন জুরেই শিশির। কিন্তু শিশিরকে ও এখনই কিছু বলে নি। মাস্টার্স শেষ করে পাকাপোক্ত ভাবে ব্যবসায় বসেই বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠাবে শিশিরদের বাসায়। শিশিরকে দেখে আবির বুঝে নিয়েছে শিশিরের ওকে পছন্দ। হোক না, তা বন্ধু হিসেবেই। একজন লাইফ পার্টনার খুজে নিতে হলে বন্ধুর চেয়ে আর পারফেক্ট কে হতে পারে। আবির মা’কেও এখনো কিছু বলে নি কিন্তু আজ জানাবে ঠিক করল।
অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখে আইরিন বেগম সোফায় বসে টিভি দেখছেন। ছেলেকে দেখে হেসে কাছে ডাকলেন। আবির মায়ের কাছ ঘেষে বসে,,
-অনেক পরিশ্রম যাচ্ছে নারে,,,বাপ!
-আরেহ মা,,, কি যে বল,,,তুমি কি ভুলে গেছো,,,তোমার ছেলে অলরাউন্ডার,,,
-নাহরে,, বাপ ভুলি নাই,,,তুইতো আমার পুচকা হিরো,,,,
-মা,,, একটা কথা বলি!?
-জিগ্যেস করছিস কেনো! কোনো আকাম কুকাম ঘটিয়েছিস নাকি!!
-মা,,,,!!! প্লিজ বি সিরিয়াস,,,, সিরিয়াস একটা কথা,,।
-ওহহ,,,তাই নাকি,,আচ্ছা,,, ওকে,,, ওকে,,,,সিরিয়াস। হুম বল,,
-মা,,,আমি তোমার ছেলের বউ পছন্দ করে এসেছি।
- আলহামদুল্লিলাহ,,,,,, তা আমার ছেলে কি বউ পছন্দ করেই এসেছে,,,নাকি আবার বউ বিয়ে করে রেখে এসেছে,,,
-আরে,,না নাহ,,,আপাতত শুধু তোমার জন্য একটা নরম সরম বউই পছন্দ করে এসেছি। অতদূরে আর যায় নি,,,পরে যদি ঠ্যাং ভেঙ্গে দাও!!!
-তা কেমন নরম সরম বউ আমার!
-উমমম,,,একদম অরেঞ্জ জেলির মত নরম।
-বলেই নজর লাগাবি নাকি ছবি টবি দেখিয়েও মন ভরাবি মায়ের!
আবির ওর ফোনে তোলা শিশিরের কিছু ছবি দেখালো। শিশিরকে দেখে আইরিন বেগমের খুব পছন্দ হল। তিনি ছেলের পিছনে উঠে পড়ে লাগলেন বিয়ে কবে করবে!! আবির অনেক বুঝালো মাস্টার্স শেষ হোক পরে শিশিরদের ফ্যামিলির সাথে কথা বলবে।আর তাছাড়া শিশিরের পড়ালেখা,,,সামনে ওর থার্ড ইয়ার ফাইনাল। কিন্তু আইরিন বেগম অত দেড়ি করতে নারাজ। তিনি আবিরকে বুঝালেন আগে এনগেজমেন্টটা করে রাখি,,,বিয়ে নাহয় পরে ধুমধাম করে দিবো। আবির অনেক চেষ্টা করেও ওর মা’কে বুঝাতে পারলো না৷ এখন মনে হচ্ছে আজকে বলাটাই ঠিক হয় নি। একদম পরেই বলা উচিত ছিল। শেষমেশ ও মা’কে বুঝালো আগে শিশিরের সাথে কথা বলে নেই। এতে আইরিন বেগম একটু থামলেন। কিন্তু ছেলেকে ওয়ার্নিং দিয়ে রাখলে ৩/৪ দিনের মধ্যেই যেন তিনি উত্তর পেয়ে যান।
সাদেক হন্তদন্ত হয়ে হেটে আসলো “আহমেদ এন্ড কাজী” টাওয়ারের সামনে। শুভ্র বসে আছে সেখানে বাইকের উপর। বসে বসে ফোন গুতাচ্ছে। সাদেক এসে দাড়াতেই শুভ্র চোখ উঠিয়ে জিগ্যেস করল,
-ছেলেটা কে?
-আবির রহমান। আমাদের ইয়ার মেট। পরিসংখ্যানের ছাত্র। আমাদের সাথে একই কলেজে পড়েছে। এখন পড়াশোনার পাশাপাশি বাবা’র ব্যবসায় আছে। যদিও বাবা বেচে নেই। ফ্যামিলি বলতে ও আর ওর মা।
-হুম বুঝলাম। কিন্তু শিশিরের সাথে ওই ছেলের এত কি!!
-শিশিরের সাথে আজকে ৪/৫মাস যাবৎ পরিচয়। মানে তোদের আলাদা হওয়ার সপ্তাহ খানিক পরেই ওদের পরিচয়। ভালো ঘনিষ্ঠতা আছে। শিশিরদের বাসায় যেতেও দেখেছি কয়েকবার। শিশিরের পক্ষ থেকে কিছু না বুঝা গেলেও,,,ছেলেটার পক্ষ থেকে ইংগিত স্পষ্ট বুঝা যায়,,,হয়ত পছন্দ… টছন্দ……….
অন্যদিকে ফিরে অনমনস্ক হয়ে কথাগুলো বলছিল সাদেক। হঠাৎ শুভ্রর দিকে তাকাতেই ওর কথা বন্ধ হয়ে গেল। পা কেপে উঠল। শুভ্রর চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে। মাথার দুইপাশের রগ দাঁড়িয়ে গেছে। চোয়াল কঠিন হয়ে গেছে। ভয়ংকর লাগছে শুভ্রকে। শুভ্র কিছু না বলেই ঘুরে বসে বাইক স্টার্ট দিলো,,,সাদেক দ্রুত যেয়ে বাইকের সামনে দাড়ালো,
-কই যাস!?
-অনেক বেড়ে গেছে তাই না!!! শিশিরকে এবার একটু টাইট দেয়া প্রয়োজন কি বলিস!
-ভাই শোন,,তুই আগে ঠান্ডা মাথায় আমার কথা একটু শোন,,,,
-আরে রাখ ব্যাটা তোর কথা। আমি কয়দিন ছাড় কি দিলাম,,ওর পাখনা গজায় গেসে। অনেক উড়তে শুরু করসে। কিন্তু মাটিতে আসার টাইম হইয়া গেসে,,,এইটা আমি আজকে ওরে হারে হারে বুঝাবো।
-তুই পাগল হইস না শুভ্র। এতে অবস্থা আরো বিগড়ায় যাইবো। ওর ফ্যামিলি এমনেও তোর উপর ক্ষেপা ভুইলা গেসস!?
-জাহান্নামে যাক সব,,,ওরে…….আজ আমি উচিত শিক্ষা দিবো,,,,
-শুভ্র!!!! জোর করার পরিনাম একবার দেখসত,,,,!! দেখস নাই!? তারপরও এমন শুরু করলি। আজকে তুই একটু উনিশ বিশ করলে পরিস্থিতি খুব খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে,, একটু বুঝার ট্রাই কর। আজকে জোর করবি কালকে আবার হাত ফোসকায় বের হইয়া যাইবো।
শুভ্র বাইক থেকে নেমে গেল। রাগে ওর মাথা দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। সাদেকের কথা একদম ফেলতে পারছে না,,,আবার ওই কথাগুলোও ভুলতে পারছে না। শুভ্র কষে একটা লাথি মারলো বাইকের চাকায়।
পর্ব ১৮
শিশির ক্যাম্পাসে এসেছে ঠিক,,,কিন্তু হঠাৎ করেই ক্লাস করতে ইচ্ছা করছে না। শিশির হাটতে হাটতে এগুলো, কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে,,,কাছাকাছি গিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। শুভ্র বসে আছে সাথে তানহা। উফফ!!! কি উটকো একটা মেয়েরে বাবা!!! সবসময় এভাবে চিপকে থাকে কেনো!! আচ্ছা,,শিশির কি যাবে একবার ওদের সামনে,,,! যাওয়াটা কি ঠিক হবে,,,!
শুভ্র খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনে গেম খেলে যাচ্ছে। আশেপাশের কারো সাথে এইমুহুর্ত ওর কোনো যোগাযোগ নেই,,,,তানহা পাশে বসে অনরগল বকবক করেই যাচ্ছে,,শুভ্রর কানে কিছুই যাচ্ছে না। কথা বলতে বলতেই তাহনা শুভ্রর গালে একটা চুমো খেলো,,,
থেমে গেল শিশির। এবং সাথে সাথে ঘুরে হাটা শুরু করল।
হঠাৎ এমন একটা কান্ডে খুব রেগে গেল শুভ্র। সটান করে উঠে দাড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
-হোয়াট দ্যা………. কি করলে তুমি এটা তানহা?
-কিস করলাম,,,তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে না,,,,কি বলবো
-জাস্ট সাট আপ,,,এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি হ্যা,,,,,কি চাও কি তুমি। একেতো সারাটাদিন এভাবে পিছন পিছন ঘুরো। কতবার…….কতবার তোমাকে আমি বলসি এভাবে আমার সাথে লেগে লেগে থাকবা না,,, কান নাই তোমার,,,, মাথায় ঢুকে না আমার কথা!! কি মনে করে তুমি আজকে এই কাজটা করলে,,,আমাকে ছোয়ার অধিকার কি আমি তোমাকে দিয়েছি!!! কোন সাহসে এই কাজটা করলে!!
-এভাবে বলছো কেন শুভ্র!!
-চুপ,,,,,আর খবরদার আমার আশেপাশে যেনো তোমাকে না দেখি আমি।
তানহার দিকে একটা কড়া দৃষ্টি দিয়ে চলে গেল শুভ্র।
শিশিরের কেনো যেন হঠাৎ মাথা ঘুরাচ্ছে,,,প্রচুর। ও কোনরকমে এসে একটা জায়গায় বসল। ফোনটা বেজে যাচ্ছে অনবরত। ধরতে ইচ্ছা করছে না। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল তার হিসাব নেই। হুশ ফিরলো আবিরের ডাকে।
-এই মেয়ে ফোন যদি রিসিভ করতেই না হয় তাহলে ব্যবহার করো কেনো,,,,কতবার ফোন দিলাম,,,, হুমমম।
-হুম? ওহ,,,খেয়াল করি নি বোধহয়!!
-এখানে বসে কেনো!! ক্লাস?
-যেতে ইচ্ছা করছে না,,বাসায় চলে যাবো।
-এতো তাড়াতাড়ি!! তুমি কি অসুস্থ শিশির,,? তোমাকে প্রচুর ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
-হুম,,,অনেক ক্লান্ত আমি আবির। আমি বাসায় চলে যাবো,,,,প্লিজ।
-আচ্ছা আচ্ছা,,,ঠিক আছে চলো। রিকশায় উঠিয়ে দেই।
শিশির রিকশায় চড়ে বসল। আবির পাশেই দাড়িয়ে। শিশিরের উরনার এক মাথা চাকার সাথে ঝুলছে,,,সেদিকে শিশিরের কোন খবর নেই। আবির নিজেই উরনার মাথাটা গুছিয়ে নিয়ে শিশিরের হাত দিয়ে হাত ধরে বলল,
-শিশির আমি বুঝতে পারছি না এখন এইমুহূর্তে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা!! আর তুমিও কিভাবে নিবে,,,কিন্তু তাও আমি বলতে চাই।
আমি তোমাকে ভালোবাসি শিশির।
২মাস পর………..
সকাল সকাল শিশির মোড়ের দোকানটায় ঢুকল। চা পাতা নেই,,চা পাতা নিয়ে পিছনে ফিরতেই দেখে সাদেক দাড়িয়ে। উসকো খুসকো চুল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে দোকানে ঢুকছিল। শিশিরকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো। অপ্রস্তুত ভাবে হেসে জিগ্যেস করল,
-কেমন আছো শিশির?
-জ্বী ভালো।
-তোমাদের ইয়ার ফাইনালতো শেষ তাই না!
-জ্বী,,,
কিছুটা ইতস্তত করে শিশির জিগ্যেস করল,
-আপনারা সবাই ভালো,,
-হুম! হ্যা,,হ্যা ভালো। সবাই ভালোই আছে।
-আসি তাহলে।
দুইকদম এগিয়ে শিশির পিছন ফিরে ডাকল,
-সাদেক ভাই,,
-কিছু বলবে?
-জ্বী,,,এই শুক্রবার,,আমার এনগেজমেন্ট।
হালকা একটা সৌজন্যতার হাসি দিয়ে চলে গেল শিশির। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সাদেক।
বাসায় ফিরে শিশির চা পাতা ওর মা’র হাতে দিয়ে বলল,”এক কাপ গরম গরম চা করে দাওতো মা,,,প্রচুর মাথা ধরেছে।” আজকাল এই মাথা ধরাটা যেনো বেড়েই চলছে। কোন কিছু নিয়ে টেনশন শুরু হলেই মাথা ধরাটা শুরু হয়ে যায়।
শিশির ফোন নিয়ে বারান্দায় বসল। আবিরকে একবার ফোন দেওয়া দরকার। কিছু ব্যাপার আগে থেকে ক্লিয়ার করে রাখা ভালো। কিন্তু আবিরই তখন ফোন দিয়ে বসল,
-হ্যালো শিশির,,,,কি করছো?
-তেমন কিছু না,,,এইতো,,,আবির আমি……..
-আচ্ছা শিশির,,,আজকে কি তোমার হাতে সময় আছে? না মানে পরীক্ষাতো শেষ ভার্সিটি আপাতত বন্ধ,,,,তো আজ একটু সময় দিতে পারবে,,,?
-কেনো,,? কোনো জরুরি কিছু…………..
-আচ্ছা এক মিনিট এক মিনিট একটু হোল্ড করোতো,,,,,, মা যেন কি বলছে,,,
তারপর কিছুক্ষণ ফোনের অইপাশে দুই মা ছেলের মধ্যে ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ির আওয়াজ।অবশেষে মা ফোন নিয়ে নিলেন,
-হ্যালো শিশির,,,, কেমন আছো?
- আসসালামু আলাইকুম আন্টি,,,এইতো ভালো। আপনি ভালো?
-ওয়ালাইকুম আসসালাম,,,,এন্ড গুড মর্নিং। আর হ্যা আমি ভালো। শোন শিশির তোমার কি রঙ পছন্দ? গোলাপি নাকি ক্রিম কালার?
-একটা হলেই হয়,,,আন্টি
-কিসের একটা হলেই হয়!!! আমার ছেলের বউয়ের পছন্দ অপছন্দ আছে না!! এই শিশির এক কাজ কর,,,আজ আমার সাথে তুমি যাবে শপিংয়ে। তারপর নিজের পছন্দমত শাড়ি কিনবে।
-না,,,,নাহ আন্টি তার কোন প্রয়োজন নেই,,,,আপনি একটা পছন্দ করলেই……….
-একদম কথা না,,,আজকে আমরা যাচ্ছি শপিংয়ে। শপিং শেষে বউ শাশুড়ি মিলে ফুসকা খাবো। দারুন মজা হবে,,,,,,
আইরিন বেগমের উচ্ছ্বাস দেখে শিশির আর মানা করতে পারলো না। অতঃপর বিকেলে ওরা শপিং এর জন্য বের হবে বলে ঠিক হল।
ফোন রাখতেই শিরিন বেগম ঢুকলেন চায়ের কাপ হাতে।
-বাবা কখন ফিরবে মা?
-ঠিক নেই,, বলল তোর মেজো মামা’র বাসায় যাবে তোর এনগেজমেনন্টের ব্যাপারে কথা বলতে।
-এতো ঝুট ঝামেলা কেনো করছো? বুঝলাম না!!
-তোর বুঝতেও হবে না। এমনতো না যে বিয়ে এর পর আরো ৩/৪টা করবি!!! তাই প্রথমটায় আয়োজন না করলেও চলবে,,,,,
-আমিতো তা বলিনি,,,,কিন্তু শুধু মাত্র এনগেজমেন্টের জন্য এতকিছু কেনো!! ফুফুও কি না কি পাঠাচ্ছে কানাডা থেকে!!! আজব,,,,মা
-ওমা,,,পাঠাবে না,,,উনি জামাইকে কিছু একটা দিতে চাইবেন না,,,,!!!
-জামাই জামাই করবে নাতো মা,,,,অসহ্য।
বিকেল দিকে শিশির আর আবিররা গেলো শপিং-এ। শিশির ঠিক করেই রেখেছে আজ আবিরকে শুভ্রর ব্যাপারে সব জানাবে। সুযোগ পেলো গাড়ি করে বাসায় ফিরার সময়। আবির ওকে বাসায় নামিয়ে দিতে চাইল, শিশিরও না করে নি। গাড়িতে বসেই শিশির বলল,
-আবির তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
-হুম,,,! তাই,,,! বলো তাহলে,,, আমি শুনছি।
-আবির,,,আসলে,,,আমি,,,আসলে,,হয়েছি কি,,,,
আমি,,,মানে,,,
-তুমি যদি অনেক বেশি আনইজি ফিল কর তাহলে নাহয় পরেই বলো,,,
শিশির অল্পকিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,,
-আবির,,,আমার এর আগেও একটা সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কটা ছিল শুভ্রর সাথে।
-হুম, আমি জানি এটা।
-কিভাবে!
-তোমাকে দেখেছিলাম আমি শুভ্রর সাথে ১/২ বার। আর তাছাড়া শুভ্রকে দেখলে তোমার চেহারার মানচিত্র যেভাবে পাল্টে যায়,, তা দেখেও হালকা পাতলা বুঝেছিলাম।
-আমাকেতো আগে বলোনি তুমি এসব জানতে।
-যে ব্যাপারটা নিয়ে তুমি নিজে থেকে কোন কথা বলতে না,,,তা নিয়ে আমি কি বলতাম। তুমি যদি বিরক্ত হতে!!
-হুম।
-শিশির তোমাকে আমি সবসময় বলি,,,সবকিছুর আগে আমরা দুজন বন্ধু। বন্ধুত্ত্বের উপরে কোন সম্পর্ক না। তুমি বিনা সংকোচে আমার সাথে তোমার যেকোন কথা শেয়ার করতে পারো,,,। প্লিজ,,, শিশির আমাদের বন্ধুত্ত্বটা অনেক মুল্যবান আমার কাছে, তুমিও প্লিজ আগে আমাদের বন্ধুত্ত্বের সম্পর্কটাকে মুল্য দিবে,,এবং সবসময় ইজি থাকবে। ওকে,,,,???
-হুম,,
-কি বললে,,,শুনতে পেলাম নাতো!!
-ওকে ওকে।
সাদেক খুব টেনশন নিয়ে ঘুরছে আজকাল। শিশিরের এনগেজমেন্ট!! এটা ও শুভ্র কে কিভাবে বলবে!! শুভ্র শুনার পর কি রিএক্ট দিবে!!! আল্লাহ রক্ষা করো,,,,
সাদেক প্রতিদিন সাহস জুগিয়ে বের হয় আজ বলবেই বলবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর বলতে পারে না। সেদিন শুধু আবিরের নাম শুনে যা করল,, যদি শুনে ওই আবিরের সাথেই এনগেজমেন্ট,,,,!
সাদেক বসে থাকলেও,,,সময় বসে থাকে না। অবশেষে শুক্রবারটাও এসে পড়ল।
সাদেকের ফোন পেয়েই শুভ্র বেরুলো,,,আজকে যদিও ওর বের হওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না। কিন্তু সাদেক আর্জেন্ট বলে বের করল। শুভ্র বেশ কিছুক্ষন যাবৎ বাইকে বসে আছে আড়ং-এর সামনে, সাদেকও আছে। ও এই কথা সেই কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু কোনো কাজের কথা বলছে না। শুভ্রর মেজাজ খারাপ লাগছে।
-কিরে তুই আমাকে এসব আউল ঝাউল শুনাতে ডাকসস!?
-হ্যা!! না মানে,,,,হ্যা আছে কথা আছে।
-তো বল কি বলবি!!
-আসলে তুই কিভাবে কি রিএক্ট করবি,,,হয়েছি কি আসলে…….
হঠাৎ করে শুভ্রর ফোন এলো। অনিক ফোন দিয়েছে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অনিক চিৎকার করে উঠল,
-দোস্ত তুই কি করস!
-কি করি মানে!!
-তুই কি শিশিরদের বাসায় যাইতেসত,,,,?
-ওদের বাসায় কেনো যাবো!!
-আরে আজব তুই জানস না!!! আমি মাত্র শুনলাম শিশিরের এক ফ্রেন্ড আছে না ফারাবি ওর থেকে,,,শিশিরের নাকি আজকে এনগেজমেন্ট। কোন আবির না কি যেনোর সাথে।
পর্ব ১৯
শিশির হাটছে বেশ কিছুক্ষণ যাবত,,কিন্তু রাস্তার কোন কূল কিনারা খুজে পাচ্ছে না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাড়িয়ে আছে, শুভ্র। শিশির গুটিগুটি পা করে সামনে এগুলো। শুভ্র একটা সাদা কালার শার্ট পড়ে আছে। শিশিরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে ওর দিকে ঘুরে তাকালো। ওর মুখে সেই হৃদয়কাপানো হাসি। কিন্তু চোখে কেমন বিষন্নতা। শিশিরের ছলছল চোখে জিগ্যেস করল,
-তুমি এখানে কি করো,,,! কেনো আসছো আমার সামনে?
-আর কই যাবো বলো, তুমি ছাড়া আর কার কাছে যাবো!!
-আমি ছাড়া তোমার আরো অনেকে আছে যাবার জন্য।
-না শিশির,,,, আমি ছাড়া তোমার আশেপাশে অনেক মানুষ আছে তাই তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারো। কিন্তু আমারতো আসলেই তুমি ছাড়া কেউ নাই। আমি কই যাবো বলো,,,
-যেখানে ইচ্ছা যাও,,,,কিন্তু আমার সামনে থেকে চলে যাও,,,,
-চলে যাবো?
-হ্যা,,হ্যা,,হ্যা,,,চলে যাবে এক্ষুনি,,,, আর কক্ষনো আসবা না আমার সামনে।
-তাহলে তাই হোক চলে যাই আমি,,,,একদম তোমার জীবন থেকে।
বলেই শুভ্র পিছাতে শুরু করল। পিছাতে পিছাতে পুকুরের কাছাকাছি চলে গেছে। শিশির আশংকা আর ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। পিছনে কেনো যাচ্ছে ও!!! শিশির কিছু বলার আগেই পা ফোসকে শুভ্র পড়ে গেলো পুকুরে। শিশিরের বুকটা ধ্বক করে উঠল। “শুভ্র…………” অস্ফুট স্বরে একবার শুধু মুখ দিয়ে নামটা উচ্চারণ করল শিশির। পুকুরে শুভ্রর কোন চিহ্ন নেই কিন্তু রক্ত ভেসে উঠছে। রক্ত!!! রক্ত কেনো!!! শুভ্র কি পড়ে গিয়ে কিছুতে ব্যাথা পেলো!!! পুকুরে রক্তের পরিধি বাড়ছে। শিশিরের মাথা ঘুরাচ্ছে,,,সব ঘুরছে,, হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে,সাথে মুখও। শিশির চিৎকার করতে চাইছে,,একটা শব্দ বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। কারো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে,,কেউ ডাকছে।
শিশিরের ঘুম ভাঙলো শ্রেয়ার ডাকে। শিশিরের ধাতস্থ হতে কিছু সময় লাগল। পরে যখন বুঝতে পারলো ও স্বপ্ন দেখছিলো,,হালকা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।কিন্তু ওর শরীর ঘেমে গেছে পুরো, আর হাত পা অবশ হয়ে আছে এখনো। শ্রেয়া শিশিরকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,
-কিরে,, সেই কখন থেকে কি জিগ্যেস করছি!! জবাব দেস না কেনো?
-হুম,,,
-কি হুম!!! আমি জিগ্যেস করলাম আবিরের সাথে তোর কথা হয়েছে কি না!!
-হুম,,,? হুম,,,,, না।
-তুই উঠে পড় তারপরও। সেই যে গোসল করে এক ঘুম দিলি,,,কতবার ডাকলাম!! এভাবে কেউ মরার মত ঘুমায়!! বিকেলতো হয়েই এলো। উঠ,,,,,,উঠে রেডি হতে শুরু কর।
-হুম
-হুম না,,,,তাড়াতাড়ি উঠ। আমি দেখি বাবাকে গিয়ে বলি আবিরদের ফোন দিয়ে জানতে,,ওরা কতক্ষণে পৌছুবে।
শ্রেয়া চলে গেল। শিশির বিছানা থেকে নামতে গিয়ে টের পেলো,, ওর হাত পা এখনো অবশ হয়ে আছে,,, এখন তার সাথে যোগ হয়েছে অস্থিরতা। প্রচুর অস্থির লাগছে ওর। মনের ভিতর কেমন খচখচ করছে।
শুভ্র ফোন রাখার পরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সাদেক তাকিয়ে রইল। একটা হালকা ধাক্কা দিলো শুভ্রকে।
-কিরে কই হারায়া গেলি!! কি বলল অনিক?
শুভ্র সাদেকের কলার ধরে, চিবিয়ে চিবিয়ে জিগ্যেস করল,
-তুই জানতি? তুই জানতি না!? ইচ্ছা করে লুকাইসত? শালা হারামি,,,লজ্জা করে না নিজেরে বন্ধু বইলা দাবি করতে!!
সাদেক বলদের মত চেয়ে রইল শুভ্রর দিকে। ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। শুভ্র কি বলছে,,,
-কথা কস না কেন,,,,ওই আবির শালায় তোরে টাকা দিয়া কিনসে? আজকে শিশিরের এনগেজমেন্ট ওর কু** বাচ্চার লগে জানার পরও তুই আমারে কস নাই,,,,,** র বন্ধুগিরি দেখাও!!
-শুভ্র শোন একবার………
-ওই শালার ** চুপ থাক,,,,তোর মত টাকায় বেচা মানুষের আর কি কওয়ার আছে!! বেঈমান বাচ্চা বেঈমান।
সাদেককে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল শুভ্র। তারপর বাইক নিয়ে ছুটল। শিশিরকে কখনোই অন্যকারো হতে দিবে না । শিশিরের এই কান্ডে শুভ্রর মেজাজ প্রচুর খারাপ হচ্ছে। আর সাদেকের বেঈমানিতে ওর মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। সবাই এমন কেনো!! কেনো সবাই ওকে ছেড়ে চলে যেতে চায়!! কেনো!!! সাদেকও এভাবে ঠকালো ওকে!! আর শিশির!!! শুভ্রর চোখ জ্বলছে,,,বুকের ভিতর চিনচিন করছে। অনেক দ্রুত বাইক চালাচ্ছে ও। পৌছুতে হবে তাড়াতাড়ি। রাস্তা ক্রস করতে গিয়ে ডানপাশ থেকে একটা বাস আসছিলো সেটা খেয়াল করলো না শুভ্র,,,দ্রুত সেটাকে পাশ কাটিয়ে এগুতেই সামনে থেকে আসা একটা গাড়ির মুখোমুখি,,,,,,,,,
ছিটকে পড়ল শুভ্র,,,,লোকজন জড় হতে শুরু করেছে। কেউ গাড়ির ড্রাইভারকে ধরছে তো কেউ শুভ্রকে তোলার চেষ্টা করছে,,আবার অনেকেই মানা করছে। পুলিশের ঝামেলা আগে পুলিশ আসুক। রাস্তায় রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে শুভ্র……….।
শিশির রেডি হয়ে বসে আছে বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু হঠাৎ করেই…….. একদমই হঠাৎ করে সব খালি খালি লাগছে। চারপাশে সব শুন্য শুন্য লাগছে। বুকের ভিতরটা খালি খালি লাগছে। স্বপ্নের ঘোরটা ওর এখনো কাটেনি। আচ্ছা একবার কি শুভ্রকে ফোন দিবে,,,,,ও কি জানতে পেরেছে শিশিরের এনগেজমেন্টর ব্যাপারে। সাদেক কি ওকে জানিয়েছে!!
বেল বেজে উঠল। আবিররা এসে গেছে বোধহয়।শিশির ফোন রেখে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।
আবির, ওর মা আর ওদের অফিসের দুইজন ক্লোজ কলিগ এসেছে মাত্র। বেশি কেউ ছিলোও না বলার মত। আবিরের ঘনিষ্ট কোনো বন্ধু নেই। ও সবার সাথে একইভাবে মিশে,,,তাই ক্লাসের সবাই ওর বন্ধু। কাকে রেখে কাকে দাওয়াত দিবে ও!! তাই কাউকেই বলে নি। আজ আবিরের অনেক বেশি ভালো লাগছে,,,অনেক অনেক বেশি।
সাদেক, অনিক, মাহিদ, রবিন ওরা সব বসে আছে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ভিতরে শুভ্র। এভাবে কি হওয়ার কথা ছিল!! নাহ তো!! ওরা সবাই স্তব্দ। অনিকের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। বাকিরা দেখলেও কেউ কিছু বলার মত অবস্থায় নেই। সবার অবস্থাই এক। সান্ত্বনা দেয়ার মত কারোই অবস্থা নেই। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে এলেন।
-আপনারা প্লিজ রোগীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করুন। উনি খুব মেজরলি ইনজুরড। মাথার ক্ষতটা সব থেকে বেশি মেজর। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। আপনারা ব্লাডের ব্যাবস্থা রাখেন আর যতদ্রুত সম্ভব উনার ফ্যামিলিকে খবর দিন।
ডাক্তার আবার থিয়েটারের ভিতরে চলে গেলেন। কিন্তু ওরা কেউ জায়গা থেকে নড়তে পারলো না। অনিক হাউমাউ করে কেদে উঠল। মাহিদ নিজেকে হালকা ধাতস্থ করে দ্রুত ব্লাডের ব্যাবস্থা করতে লাগল। সাদেক ভাঙা ভাঙা গলায় রবিনকে বলল,
-তুই একটু আংকেল, আন্টির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা কর,
-তুই কই যাস?
-কেউ একজনকে এই খবরটা জানিয়ে আসি।
শিশিরের ফোনটা বাজচ্ছে। আননোন নাম্বার ,,তাও সাথে সাথেই রিসিভ করল শিশির,
-আমি সাদেক শিশির, কেমন আছো?
-জ্বী ভালো,,,
-হ্যা ভালো,,,,,,তোমার অবশ্য ভালো থাকারই কথা,,,তোমার খুশি থাকারই কথা,,,,,,,
-…… ভাইয়া শু…………..
-তোমার জীবনের সব ঝামেলা শেষ। একেবারে নিজের থেকেই শেষ। তোমাকে আর কষ্ট দেওয়ার মত কেউ নেই,,,,,পাগলাটা নিজ থেকেই সড়ে গেলো,,,,
-মানে!
সাদেকের গলা ধরে আসে,,,,
-আমার ভাইটা কি শিশির এতোই নিকৃষ্ট ছিল বলতো,,,,আমার ভাইটা বোধহয় আর বাচবো না শিশির……………. শিশির শুভ্র………… শুভ্র,,,,,,,
শিশির বুক ধ্বকধ্বক করছে,,,, হাত পা কাপছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না,,,,পা অবশ হয়ে আসছে,,,,
-ক….কি হইসে ভাইয়া!?
সাদেক হাউমাউ করে কাদতে থাকে,
-তোমার কা….. কাছেই আসছিল শিশির,,,,,রাস্তার মাঝখানে,,,,,,,আমার,,,,,,আমার ভাইটা অনেক ভালোবাসতো তোমাকে শিশির………..আমার…..
আর কথা বলতে পারে না সাদেক। ফোন রেখে দেয়।
আবির একটু চিন্তায় পড়ে গেছে। ওরা এসেছে সেই কথা ২০মিনিট আগেই শিশিরকে মেসেজ দিয়ে বলে দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিশিরের খবর নেই তারউপর একটা পিচ্চি মেয়ে হয়ত শিশিরের কাজিন টাজিন হবে কিছুক্ষণ আগে শিশিরের রুমে গেল এবং একটু পরেই দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর ওই মেয়েটা আর শিশিরের বড় বোন চিন্তিত ভাবে শিশিরের রুমে গেল,,,একটু পর ওই পিচ্চি মেয়েটা বের হয়ে গিয়ে শিশিরের মা’কে ডেকে নিয়ে গেল। কি হচ্ছে ওই রুমে!!!!! সব এমন চিন্তিত ভাবে যাওয়া আসা করছে কেনো!!! শিশির ঠিক আছেতো!!!
আরো ২৫মিনিট পার হয়ে গেল। আবিরের চিন্তা এখন বাড়ছে। আবির কি একবার যাবে শিশিরের রুমে!! যাওয়াটা কি ভালো দেখাবে!! শিশিরের বাবা, মামা’রা বসে আছে সামনে। ওনারা আবিরের মা’র সাথে ফ্যামিলির ব্যাপারে কথা বলছে।আবির,দেখল শিশিরের বোন শ্রেয়া বের হয়ে ওদের সামনে আসছে,
-আসলে এভাবে আপনাদের বসিয়ে রাখার জন্য খুব দুঃখিত। আসলে শিশিরের শরীরটা একটু খারাপ। হঠাৎ করেই ওর জ্বর আসলো,,,
-কি বলিস!!! কিছুক্ষণ আগেইতো ঠিক ছিল (বাবা)
-হ্যা,,,মানে বাবা,,,তুমি একটু ভিতরে আসোতো।
-শরীর কি খুব বেশি খারাপ রে!?
-একটু ভিতরে এসে দেখে যাও
-আপু, আমি একটু শিশিরের সাথে দেখা করতে চাই।
-আরে না,,, নাহ,,,আবির তুমি বসো। বাবা যাচ্ছে তো,,,,ঠিক হয়ে যাবে,,,এই কিছুক্ষণের মধ্যে নিয়ে আসছি শিশিরকে।
-আপু,,,প্লিজ,,,,আমি জানি না কি সমস্যা হয়েছে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি সমস্যা কিছু একটা হয়েছে। প্লিজ একবার আমাকে শিশিরের সাথে দেখা করতে দিন,,,প্লিজ আপু,,,
শ্রেয়া বাবার দিকে তাকালো,,,কবির সাহেব বললেন
-চলো আমার সাথে।
শিশিরের রুমে ঢুকে দেখে সবাই চিন্তিত মুখে শিশিরের পাশে বসে আছে। আর শিশির হাটু ভাজ করে তারউপর মাথা উপুর করে বসে আছে। কেপে কেপে উঠছে ও। কান্না করছে!!! কিন্তু কেনো!!! আবিরের চিন্তা বেড়ে গেল। সাথে সাথে বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল। কবির সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন,
-কিরে মা,,,,কি হয়েছে,,,,,
-………………
-বাবাকে বল,,,,,কি হয়েছে রে মা,,,,,,
-…………………………..
আবির গিয়ে বসল পাশে,
-শিশির তুমি কি এনগেজমেন্টটা করতে চাইছো না!
-…………………….
-শিশির তুমি আমাকে নির্দিধায় বলতে পারো,,,কি হয়েছে বল শিশির,,,,,,,
-……………
সাদেকের ধাতস্থ হতে বেশ সময় লাগল। শিশিরকে ফোন দেয়াটা ঠিক হয়নি। সাদেকের নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। ও যদি আগেই শুভ্রকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিত, তাহলে আজকে এই এক্সিডেন্টটা হত না। ভাগ্যিস ক্যাম্পাসের এক ছোটভাই তখন দেখেছিল শুভ্রকে। ও যদি ধরাধরি করে শুভ্রকে হাসপাতাল না আনতো,,,,সাদেককে ফোন করে না জানাতো,,,তখন ওরা কি আদৌ এই এক্সিডেন্টের ব্যাপারে জানত!! ভাবতেই সাদেকের বুকটা কেপে উঠল। নাহ,,,,!!!! শিশিরকে ফোন দিয়ে সরি বলে দেওয়া উচিত। সাদেক চোখ মুছে ফোন দিল শিশিরকে।
শিশিরের ফোনটা বেজে উঠতেই শিশির মাথা তুলে তাকালো। আশেপাশে কারো দিকে ওর খেয়াল নেই। কাপা কাপা হাতে ফোন হাতে নিল,,,সাদেকের নাম্বার,,,,শিশিরের চোখ উপচে পানি পড়ছে,,,,,কি বলবে ও!!!
আবির বুঝতে পারলো সমস্যার কারন এই ফোনকল। শিশিরের হাত থেকে ফোনটা নিয়েই আবির বারান্দায় চলে গেল।
-হ্যালো শিশির,,,সরি,,,তোমাকে আসলে ওভাবে ফোন করে বলা ঠিক হয়নি। শুভ্রর এক্সিডেন্টের পিছনে তোমারতো কোন দোষ নেই। এটা ওর ভাগ্যে ছিল,,,,,,ওকে নিয়ে তুমি টেনশন করো না। ওকে আমরা সামলে নিবো। শুধু তুমি ওর উপর কোন রাগ রেখো না,,,,ও যা করতো তোমাকে ভালোবাসে বলেই করতো। এতটুক প্লিজ বিশ্বাস করো। পারলে ওকে মাফ করে দিও শিশির।
-কোন হাসপাতালে এডমিটেড শুভ্র?
-কে? আবির!
-হাসপাতালের এড্রেসটা দাও।
হাসপাতালের এড্রেস নিয়ে ফোন রেখে দিলো আবির। কি করবে এখন। ও চাইলেই এখন এইমুহূর্তে যা কথা হলো সব ভুলে গিয়ে শিশিরকে নিজের করে নিতে পারে। অথবা শিশিরকে নিয়ে এখনই শুভ্রর কাছে দিয়ে আসতে পারে।
“ভালোবাসা” বেছে নিবে!! নাকি “বন্ধুত্ত্ব”
কিন্তু শুভ্রর চেয়ে আবিরই শিশিরকে বেশি খুশি রাখতে পারবে এটা আবির জানে। হয়ত আজকে কষ্ট পাবে কিন্ত আজীবন তো সুখে থাকবে।
পর্ব ২০
আবির রুমের ভিতরে এলো। আবিরের মা’ও ইতিমধ্যে রুমে এসে পড়েছেন। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সকলের চোখে প্রশ্ন। আবির তাকালো শিশিরের চোখে, মেয়েটার চেহারা ভয়ে এতটুকু হয়ে আছে। চোখে প্রশ্ন সেইসাথে ভয়। আবির চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
-চল শিশির,,,
শিশির ঠিক বুঝল না,,,,কই যাবার কথা বলল আবির!
কবির সাহেব প্রশ্ন করলেন,
-কই যাবে! আর কে ফোন করল, বাবা?
-শিশিরের এক ফ্রেন্ড
-কেনো কি হয়েছে? আর শিশিরই বা এভাবে কাদছে কেনো!?
-আংকেল আসলে হয়েছে কি,,,,শিশিরের খুব ক্লোজ এক ফ্রেন্ড আছে,,ওর এক্সিডেন্ট হয়েছে।
-ইয়া আল্লাহ,,,,কি অবস্থা এখন ওর?
-খুবই ক্রিটিকাল কন্ডিশনে আছে আংকেল।
কবির সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন,
-এভাবে কেউ কাদে বোকা মেয়ে,,,যার ভাগ্যে যা আছে তাইতো হবে। তুই আর কান্নাকাটি করিস না মা,,
শিশির এখনো আবিরের কথা বার্তা ধরতে পারছে না। হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কবির সাহেব আবার বললেন,
-যা মা হাত মুখ ধুয়ে আয়। অনুষ্ঠানটা শেষ করি। এরপর আমরা যাবো তোর ফ্রেন্ডকে দেখতে।
-মানে আংকেল আমি শিশিরকে নিয়ে এখনই যেতে যাইছি।
এবার শিশিরের সাথে সাথে, ঘরের বাকিরাও অবাক হয়ে গেল।
-এখন যেতে চাইছো? এনগেজমেন্টটা আগে শেষ করে যাও
-না,,,,মানে আংকেল ফ্রেন্ডের অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তার ওর ফ্যামিলিকে ইনফরম করতে বলেছেন,,,যেকোনো সময় ভালো মন্দ কিছু ঘটে যেতে পারে। তাই আমি দেড়ি করতে চাইছি না,,
-বুঝলাম নাহয়। কিন্তু আংটি পড়াতে আর কতক্ষণ লাগে। এখানে বসেই নাহয় আংটি পড়ে যাও।
-আংকেল শিশিরের অবস্থা এখন আংটি পড়ানোর মত না। ও খুব বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। তাই আমি চাইছি না,,,,এখন এমন কিছু করতে।
সবাই শিশিরের দিকে তাকালো। মেয়েটার অবস্থা আসলেই খারাপ।চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খুলে পড়ে আছে। চোখের পানির সাথে আইলাইনার মাসকারা সব ধুয়ে গেছে। মুখটা চুপসে এতখানি হয়ে আছে। কবির সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকালেন,,,মতামতের আশায়। শিরিন বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা একটু সম্মতি দিলেন।অর্থাৎ আমি বলি যেতে দাও,,,কিন্তু বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত। কবির সাহেব কিছু বলার আগেই,,আবির বলে উঠল
-যাও শিশির হাত মুখটা ধুয়ে আসো। আমরা এখনই বের হবো।
শিশির বাবার দিকে তাকালে উনি ইশারায় সম্মতি দিলেন। শিশির দৌড়ে ওয়াশরুমে গেল। মুখে চোখে কোনরকম পানি দিয়ে ধুয়ে বের হল। মাথায় একটা হাত খোপা করেই আবিরের সাথে বের হয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে আবির শুধু মলিন একটা হাসি দিয়ে ওর মা’কে বলল
-বাসায় চলে যাও মা। এখানে থেকে আর লাভ নেই। আমি বাসায় যেয়ে তোমার সাথে কথা বলব।
আইরিন বেগম ছেলের কথায় বুঝলেন সমস্যা গুরুতর। তাই উনিও বাসায় চলে গেলেন।
হাসপাতাল যাওয়ার পুরোটা রাস্তা শিশির অঝোরে কেদে গেছে। আবিরও কিছু বলে নি। কি বলবে ও!! ওকি আদৌ কিছু বলার মত অবস্থায় আছে!!
শুভ্রকে আইসিউ’তে শিফট করা হয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। কোনোরকম ব্লাড লসিংটা আটকাতে চাচ্ছেন। তাও ব্লিডিং চলছে। এভাবে ব্লাড লস হয়ে গেলে পেশেন্টর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে। মাহিদ ব্লাডের ব্যাবস্থা করেই চলছে। শুভ্রর ব্লাড গ্রুপ O- …… হাসপাতাল থেকেও চেষ্টা করছে। বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে,, বলল। সাদেক কিছুক্ষণ পরপর শুভ্রর বাবা মা’কে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু আনরিচেবল। সাদেকের মাথায় ঢুকছে না ওনাদের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবে। অফিসের নাম্বার সাদেক ওদের কারো কাছে নেই। বাসায় ফোন দিয়ে সাদেক জানিয়েছে যদি আংকেল আন্টি হঠাৎ বাসায় আসে অথবা ফোন করে,,,, ওনাদের যেনো হাসপাতালের এড্রেস দিয়ে দেওয়া হয় আর সাদেকের নাম্বারে যেনো ফোন দিয়ে জানানো হয়।
আইসিউ’র সামনে পায়চারি করছে শুভ্রর বন্ধুরা।
এর মধ্যে কাউকে দৌড়ে ওদের দিকে আসতে দেখে সবাই দাড়িয়ে গেল।
শিশির এসেই সাদেকের হাত চেপে ধরল। শিশিরের চোখ বেয়ে দুই ফোটা পানি সাদেকের হাতে পড়ল। সাদেক ইশারায় আইসিউ রুম
দেখালে, শিশির দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো।
আইসিউ’র দরজায় গোল কাচের জানালা দিয়ে শিশির দেখল,শুভ্রকে। একটা অক্সিজেন মাস্ক মুখে লাগানো। খুব ধীরে ধীরে বুক উঠানামা করছে। যেন নিঃশ্বাস নিতে ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাম হাতের কুনইয়ের পর থেকে কব্জির আগ পর্যন্ত একটা বড়সড় ব্যন্ডেজ,,,তাতে ছোপ ছোপ রক্ত। হাতের দুই আঙুল ও দেখি ব্যন্ডেজ করা। ডান পা’টা প্লাস্টার করা ভেঙেছে বোধহয়। সবচেয়ে ভয়ানক মাথার ব্যন্ডেজটা। মাথার ব্যন্ডেজটা রক্তে ভিজে উঠছে। সাদা ব্যন্ডেজে রক্তের পরিধি বাড়ছে।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না শিশির। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। আবির যেয়ে ওকে ধরল। উঠিয়ে কোনরকমে একটা চেয়ারে বসালো। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কাদছে শিশির।
সাদেক এসে বসল পাশে,,,
-শুধু শুধু এলে শিশির,,,,,
কিন্তু মনে মনে বলল,,এলেতো এলে শেষ সময়ে।
আবির মাহিদ আর রবিনের সাথে কথা বলল,,,শুভ্রর মা বাবার ব্যাপারে জিগ্যেস করল। ডাক্তার কি বলল তাও জিগ্যেস করল। সব জানার পর আবিরের টেনশন বেড়ে গেছে। যদি আজ রাতে ভয়ানক কোন ঘটনা ঘটে তাহলে কি নিতে পারবে শিশির।
আবির পাশে যেয়ে বসল,কিছু বলার আগেই দুইজন ডাক্তার ঢুকল আইসিউ’তে। শুভ্রকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বের হলেন চিন্তিত মুখে।
- পেশেন্টের ব্লিডিং এতক্ষণে কমে যাওয়ার কথা,, কিন্তু তার কোন উন্নতিই হচ্ছে না। ওনার হেড ইনজুরি থেকে এখনো ব্লাড লস হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্রেন ফাংশন কাজ করা বন্ধ করে দিবে।
শিশির এতক্ষণ কান্নাকাটি করলেও এখন হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেছে। আবির বেশ কয়বার ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু শিশির কোন জবাব দেয় নি। আবিরের বাসা থেকে বার বার ফোন আসছে। এইমাত্রও এলো,,,, আবির ফোনটা কেটে শিশিরের দিকে ঘুরলে,
-আবির তুমি বাসায় চলে যাও।
-আর তুমি!?
-আমি থাকবো এখানে।
-তাহলে আমিও আছি।
-আবির প্লিজ, আন্টি বাসায় একা। বারবার ফোন করছেন,,উনি খুব টেনশনে আছেন,,৷ তুমি বাসায় চলে যাও।
-তুমিও তো একা। আর মা তোমার খবর জানতেই বারবার ফোন করে যাচ্ছেন। সুতরাং আমি কোথাও যাচ্ছি না।
সাদেক এসে বলল,
-শিশির তুমি থেকে কি করবে? তুমিও চলে যাও।তোমার বাসার সবাই………….
শিশির গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-আমি কোত্থাও যাবো না। শুভ্রর সাথে বোঝাপড়া এখনো বাকিতো আমার।
ওর কথার মানে কেউ না বুঝলেও ওকে আর যাওয়ার জন্য জোর করল না।
ব্লাডের ব্যাবস্থা মাহিদ করল। বেশ কয়জনের ব্লাড টেষ্ট করার পর আপাতত মাত্র একজনের ব্লাড গ্রহণযোগ্য হল । কিন্তু বিপত্তি বাধলো ব্লাড দিবার সময়।
শুভ্রর ইন্টারনাল ব্লাড স্টোরেজ খুবই কম,, বডি ব্লাড একসেপ্ট করছে না। ব্লাড দিতেই আরো না ধরনের সমস্যা শুরু হয়ে গেল। শুভ্রর জ্বরের মাত্রাও বাড়ছে। মেডিসিন দিয়েও জ্বর নামানো যাচ্ছে না। তারউপর খিচুনি শুরু হয়ে গেল হঠাৎ করেই। শুভ্রর হুশ আছে আবার নেই। বডি আউট অফ কনট্রোল,,,ঘুমের ইনজেকশনও কাজ করছে না।
শুভ্রর ফ্রেন্ডরা দিশেহারা ভাবে এরদিক ওরদিক তাকাচ্ছে। শুভ্রর বাবা মা’র ফোন এখনো আনরিচেবল। কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না সাদেক। মাথার চুল টেনে ধরল নিজের।
ডাক্তার আইসিউ থেকে বের হয়ে বললেন,
-পেশেন্টের রিলায়েবল গার্ডিয়ান প্রয়োজন। আমাদের কিছু ফর্মালিটিস আছে, বুঝতেই পারছেন।
অবস্থা যে হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে তা সবাই বুঝতে পারলো। আবির সবার সাথে কথা বলে ওর মা’কে গার্ডিয়ান হিসেবে আসতে বলল।
আবিরের মা এলেন। ফর্মালিটিস পুরোন করলেন। ছেলের উপর তার অগাদ বিশ্বাস ছেলে কখনো ভুল কিছু করবে না। যাবার সময় শিশিরকে দেখে গেলেন। এনগেজমেন্টর জন্য কেনা লাল খয়েরী কালার শাড়িটা পড়া। কিন্তু চোখে মুখে কি বিষন্নতা। উনি গিয়ে শিশিরের মাথায় হাত রাখলেন। শিশির মলিনভাবে তাকাল। যেন চিনতেই পারলো না কাউকে।
আবির মা’কে এগিয়ে দেওয়ার সময় আবার বলল
-আমি বাসায় যেয়ে তোমাকে সব খুলে বলব মা। কিন্তু এই ব্যাপারে শিশিরের বাবা মা’র সাথে কোন কথা বলো না।
-আমি জানি রে বাপ। তুই মেয়েটার খেয়াল রাখিস। কিছু খেয়েছে কি ও!?
মায়ের কথায় মনে হল আসলেই তো শিশিরের এখনো কিছু খাওয়া হয়নি। রাত ১.৩০ টা বাজে।
আবির হাসপাতালের ভিতর ফিরে গিয়ে দেখল শিশির নেই। সাদেককে জিগ্যেস করতে বলল ওয়াশরুমে গেছে।
শিশির চোখে মুখে একনাগারে কতগুলো পানির ঝাপটা দিলো। চোখ আর মাথা খুব ব্যাথা করছে। বাসায় একবার ফোন দেওয়া উচিত। খোজ নেওয়া উচিত।সবাই টেনশন করছে হয়ত।
হঠাৎ কেমন যেন একটা বাজে অনুভূতি হলো শিশিরের। ও ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দৌড়ে চলল আইসিউ রুমের দিকে। শুভ্র ঠিক আছে তো!!
পর্ব ২১
আইসিউ রুমের কাছাকাছি গিয়ে শিশির দেখল,ওরা সবাই দাড়িয়ে ডাক্তারের সাথে কোন একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। শিশির এগিয়ে গেল। ভয়ে ওর ভিতরটা ধুকপুক করছে সমানে।ওকে দেখে আবির চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বলল “ইমপ্রুভ করছে বডি। ব্লাড একসেপ্ট করছে। ব্লাড দেওয়া হচ্ছে ওকে শিশির” শিশিরের ভিতরে চেপে রাখা টান টান ভয়টা যেনো এক নিমিষেই উড়ে গেলো। শিশিরের চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। সাদেক ওদের সবার মুখে হালকা হাসি দেখা যাচ্ছে।
শিশির আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না,,,তাল সামলাতে না পেরে ঢলে পড়ে যেতে নিলে আবির ধরে ফেলল
-খুব খারাপ লাগছে শিশির!?…… তুমি কিছু খাও নি…… তুমি বসো আমি কিছু নিয়ে আসি খাবার জন্য।
শিশির ইশারায় আবিরকে মানা করল। কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না। এতক্ষণের ভয়টা হঠাৎ করেই চলে যাওয়ার জন্য শরীর যেন ছেড়ে দিয়েছে। তারপরও আবির জোর করে বলল
-মানা করছো কেনো? তুমি ক্লান্ত শিশির,,,,এভাবে না খেয়ে কতক্ষণ বসে থাকবে। প্লিজ শিশির…..
হুট করে শিশিরের মনে পড়ল বাসায় ফোন করা দরকার।
-আবির আমার বাসায় ফোন করতে হবে। সবাই হয়ত চিন্তা করছে। তুমি বসো আমি কথা বলে আসি।
আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মেয়েটাকে দেখলে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে এতোটা জেদি হতে পারে!! ওকে এখন হাজার জোর করলেও কিছু খাবে না বুঝে… আবির বলল,
-আচ্ছা যাও,আমি আছি এখানেই।
শিশির হেটে একটা বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। বাসায় মা’র কাছে ফোন দিলো। ফোন দিয়ে সত্য মিথ্যা মিলিয়েই মা’কে বুঝ দিলো। আর বলল বাবা’কেও বুঝিয়ে বলতে। কথা বলা শেষ করে পিছনে ঘুরতেই দেখে সাদেক দাঁড়িয়ে
-শিশির….. শুভ্রর কন্ডিশন এখন অনেকটাই ভালোর দিকে যাচ্ছে।তুমি আর আবির বরং এখন বাসায় চলে যাও। রাত অনেক হয়েছে।
-আমি যাবো না ভাইয়া। শুভ্রর সাথে আমার কথা আছে।
-তুমি বুঝতে পারছো না শিশির…… শুভ্র এই অবস্থায় তোমায় দেখলে অনেক বেশি রিএক্ট করে ফেলতে পারে। শুভ্র জন্য এই কন্ডিশনে রাগারাগি চেচামেচি করাটা কি ঠিক হবে!?…..
-..………..
-আর তাছাড়া আবিরও সেই কখন থেকে বসে আছে। শিশির আমি কি বলি শোনো,,,শুভ্রকে নিয়ে তুমি আর মাথা ঘামিয়ো না…..তুমি আর আবির একটা নতুন জীবন শুরু করেছো। তোমরা যেন…………….
-আবির আর আমার এনগেজমেন্টটা হয়নি ভাইয়া।
-হুম…… কি…..কি বললে? হয়নি!!! মানে?
শিশির তার জবাব না দিয়ে বলল “তাই আমি শুভ্রর সাথে কথা বলতে চাই”
নিজের অজান্তেই সাদেকের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
সারারাত বসে পার করার জন্য আবিরের পুরো শরীর, ঘাড় ব্যাথা করতে লাগল। এর মধ্যে ডাক্তার দুইবার এসে শুভ্রকে চেক করে গেলেন। প্রথমবার চেক করার পর তেমন কিছু না বললেও দ্বিতীয়বার চেক করার পর বললেন “আপনারা এখন একটু টেনশনমুক্ত থাকতে পারেন। হি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার নাও। তারপরও আমারা অভজারবেশনে রাখবো”
এটা শোনার পর সবারই যেন বুকের উপর থেকে ভারি একটা পাথর নেমে গেলো। শিশিরকে শুধু দেখা গেলো চোখ মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেদে উঠতে। সবাই বুঝল এই কান্নার মানে।
আবিরের বুক চিড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো!!! শিশিরের গায়ে আবিরের দেওয়া শাড়িটাই জড়ানো,,,,আবিরই অনেক পছন্দ করে কিনেছিল শাড়িটা!! কিন্তু এখন!!!
এসব ভাবতে ভাবতেই আবিরের হালকা তন্দ্রা মতন চলে এলো। শিশিরের ডাকে লাফিয়ে উঠল ও,,
-আবির,,,,তুমি এখন বাসায় যাও প্লিজ।
-নাতো। তোমাকে ছাড়া আমি এক পা’ও নড়ছি না।
-তুমি শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছো। প্লিজ আবির তুমি অনেক কষ্ট করেছো। তাছাড়া আন্টি বাসায় একা,,টেনশন করছেন হয়ত। প্লিজ আবির,,,আমি হাত জোর করে বলছি এখন বাসায় যাও।
-আশ্চর্য্য শিশির এভাবে বলছো কেনো!?….
-………..
-শিশির,, তুমি নিজেও অনেকটা ক্লান্ত। বাসায় যাবে না তুমি?
-আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো। প্লিজ আবির……
শিশিরের চোখে মিনতি,,
-………………আমি যাবো এক শর্তে,,,তুমি এখনই আমার সাথে যাবে এবং হালকা কিছু মুখে দিবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো। পরে তোমাকে বাসায় পৌছে দেব।
শিশির মাথা কাত করে সম্মতি জানালো।
ভোর ৪.১৫ বাজে। হালকা করে চোখ খুলল শুভ্র। একবার চোখ খুলেই সাথে সাথে বন্ধ করে ফেলল। প্রচুর আলো লাগল চোখে। মাথাটা ভার ভার লাগছে। চিনচিনে একটা ব্যাথাও আছে। শুভ্র ঠিক বুঝল না ও কোথায় আছে।যখন বুঝল এটা একটা হাসপাতালের রুম তখন ও আরো বেশি অবাক হয়ে গেল। হাসপাতাল!!!! ও হাসপাতালে কেনো!! কি হয়েছিলো!!! শুভ্র বা দিকে তাকানোর চেষ্টা করতেই মুখের মাস্কে টান পড়ল। হঠাৎ করে ওর খুব পিপাসা পেয়ে বসল। একটু পানি খাওয়া দরকার। তখনই দরজা ঠেলে একজন ডাক্তার ঢুকল রুমে। শুভ্রকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে,,উনি হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
-গুড মর্নিং ইয়াং ম্যান,,,,,ইউ নেয়ারলি গেব আস আ হার্ট এট্যাক। বাট ইটস রিয়েলি গুড টু সি ইউ গেটিং রিকোভার্ড।
শুভ্র মাস্কের ভিতর দিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করল। উনি এগিয়ে এসে শুভ্রকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। যাওয়ার সময় হাসি হাসি মুখ করেই বললেন “গেট ওয়েল সুন ইয়াং ম্যান। ইউর ফ্রেন্ডস আর ওয়েটিং ফর ইউ”
উনি বাহিরে এসে সবাইকে জানালেন শুভ্রর জ্ঞান ফিরার কথা। তখনই সবাই ভিতরে একবার শুভ্রকে দেখতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। প্রথমে ডাক্তার মানা করলেও পরে কিছুসময়ের জন্য ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। কিন্তু সবাই যেতে পারবে না,,তাও বলে দিলেন।
সাদেক ওরা ঠিক করল শিশিরকে ভিতরে যেতে দিবে। মেয়েটা কাল থেকে বসে আছে। ওরই আগে যাওয়া উচিত। শিশির খুব খুশি হলেও ভয়ও করতে লাগল। ওকে দেখে কিভাবে রিএক্ট করবে শুভ্র!! আর ও-ই বা কি বলবে!!
তারপরও দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। কারো ভিতরে আসার আভাস পেয়ে শুভ্রও দরজার দিকে তাকালো। শিশির!!!
শুভ্রর মনে পড়ল,,, শিশিরের এনগেজমেন্ট ছিল….!!! হয়ে গেছে কি এনগেজমেন্ট!! তাহলে শিশির এখানে কি করে!!
কিন্তু শিশিরকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। পরনের কাপড়টা এলোমেলো, চুলগুলো উসকোখুসকো, চোখ মুখ ফুলে আছে। এই অবস্থা কেনো মেয়েটার!!!! ওর তো এখন আবিরের সাথে খুশি থাকার কথা।
শুভ্রর চোখ বুঝে আসছে ধীরে ধীরে। আবার ঘুমে তলিয়ে গেলো ও।
শুভ্রর যখন ঘুম ভাঙলো তখন ওকে কেবিনে শিফট করা হয়ে গেছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক নেই। ডান দিকে তাকাতেই শুভ্র দেখল ওর বিছানার পাশে একটা স্টুলে বসে শিশির বিছানায় উপুর হয়ে ঘুমাচ্ছে। শুভ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে
শিশিরের মাথায় হাত রাখল। মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে তড়াক করে উঠে বসল শিশির। শুভ্রকে দেখে আরো বেশ সোজা হয়ে গেল,,কাছে ঝুকে এসে বলল,
-কিছু লাগবে তোমার! দাড়াও আমি সাদেক ভাইকে ডেকে নিয়ে আসি।
বলেই দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো এবং এক প্রকার টানতে টানতেই সাদেককে নিয়ে কেবিনে ফিরে এলো।
-শিশির তুমি একটু ঠান্ডা হয়ে বসো। অনিক গেছে ডাক্তারকে ডাকতে। তুমি ভয় পেয়ো না,৷ বসো তুমি,,,,বসো।
বলেই সাদেক শুভ্রর দিকে এগুলো,
-কিরে এখন কেমন লাগছে!! মাথাটা কি ব্যাথা করছে? তুই ঠিক হয়ে যাবি ভাই,,,একদম ঠিক হয়ে যাবি,,,আগের মত একদম,,,,
শুভ্র হালকা ঠোঁট নাড়লো, হয়ত কিছু বলল। কিছু শুনতে না পেয়ে শিশির সাদেক দুইজনই একটু এগিয়ে এলো। শুভ্র এবার একটু হালকা জোড়েই বলল,
-ও এখানে কেনো?
পর্ব ২২
শুভ্র একটা বালিশ পিছনে দিয়ে হালকা আধোশোয়া অবস্থায় বসে আছে। মাথাটা ভার ভার লাগছে। কিন্তু শুয়ে থাকলে আরো বেশি খারাপ লাগে, শিরদাঁড়া পর্যন্ত ব্যাথা করা শুরু করেছে। ডাক্তার কিছুক্ষণ আগে চেকাপ করে গেছেন। জ্বর এখন অনেকটা কম। ডাক্তার পানীয় জাতীয় খাবার খেতে বলেছেন। খাবারের পর মেডিসিন।
সাদেক আর অনিক গেছে খাবার আনতে, মাহিদ আর রবিন গেছে শুভ্রর বাসায় ওর কাপড় আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে আসতে।
শিশির বসে আছে শুভ্রর সামনে একটা স্টুলে। শুভ্র ওর দিকেই তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে। শিশির একবার চোখ তুলে তাকালো শুভ্রর দিকে। শুভ্রর ডানচোখটা লাল হয়ে আছে, চোখের নিচে ছিলে গিয়ে কালছে হয়ে আছে। চোখ নামিয়ে নিলো শিশির। রুমের ভিতর পিনপতন নিরবতা। অনেক কিছু বলার জন্য উসখুস করলেও শিশিরের মুখ যেনো এখন বন্ধ হয়ে আছে। এদিকে শুভ্রও চুপ করে আছে। নিরবতা ভেঙে শিশিরই আগে কথা বলল,
-তুমি যে একটা অমানুষ তা কি তুমি জানো?
-……………………………
-তোমাকে আমার অনেক বেশি ঘৃণা করা উচিত, তা কি জানো?
শুভ্র তাকিয়েই আছে শিশিরের দিকে। মাথার ব্যাথাটা বাড়ছে,,,তার সাথে বাড়ছে রাগ। ও কি এগুলো বলতে এসেছে!!! এই কথাগুলো বলতে এভাবে ঘটা করে এসেছে!! হাহ!!
-তুমি আমার সাথে যেসব করেছো,,,,তারপর তোমার মুখ আমি আর জীবনেও দেখতে চাইতাম না।
-…………………………
-কিন্তু তোমাকে এভাবে দেখে এখন আমার এমন লাগছে কেনো!!
শিশির মাথা নিচু করেই কথাগুলো বলেছে যার কারনে ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। শিশিরের হাত দুটো একসাথে কোলের উপর রাখা।সেই হাতে টপ টপ করে পানি পরছে।
-ভি….ভিতরটা এমন ভার ভার লা….লাগছে কেনো বলতে পারো!
-…………………….
-ভালো……..ভালোবাসি শুভ্র। সত্যি…..ভালোবাসি……..
শুভ্র চোখ বড় বড় কতে তাকিয়ে আছে। হুট করেই যেনো ওর মাথা ব্যাথাটা গায়েব হয়ে গেলো।
শিশির কেদেই যাচ্ছে। শুভ্র কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আচ্ছা….. শুভ্র যখন কনফেস করেছিলো তখন শিশিরও এমন থতমত খেয়ে গিয়েছিলো!!!
শিশির উঠে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে আগাতেই,, শুভ্র এবার ডেকে উঠল,
-কই যাও!
-আসছি….
-আসছি মানে!? যাচ্ছো কই?
-নাক মুছে আসি….
শিশির বেরিয়ে গেলে শুভ্র হা করে চেয়ে রইল। নিজের অজান্তেই ওর মুখে হাসি ফুটতে শুরু করেছে।
অনিক খাবার দাবার নিয়ে রুমে ঢুকল।
-গরম গরম স্যুপ এনেছি। অল্প একটু দিচ্ছি,,, খেয়ে নে।
অনিক ঘন ঘন শার্টের হাতায় চোখ মুচছে।শুভ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আশেপাশে কি হচ্ছে এগুলা!!! যেই অনিককে ও আজ পর্যন্ত কখনো কাদতে দেখে নি, ও আজ অনবরত কেদেই যাচ্ছে। শিশিরের ধাক্কাটাই সামলাতে পারছে না…..অনিকের কান্না দেখে শুভ্র থ মেরে বোকার মত জিগ্যেস করল,
-তুই কানতেসত কেন?
ঝারি মেরে উঠল অনিক,
-চুপ থাকা শালা অমানুষ। মরতে এত মন চায় আগে কইলি না কেন!!! আমার গাড়ির নিচে ফালায়া তোরে মারতাম।কিন্ত এ….. এভাবে!!
হাউমাউ করে কেদে উঠল অনিক,,শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-আল্লাহ’র দোয়াই লাগে দোস্ত,,,, আর জীবনে এমন কিসু করিস না,,,,দোস্ত দোয়াই লাগে। তোর যারে লাগবো,,, যেই মাইয়া লাগবো আমি নিজে তোর সামনে দাড় করামু তাও দোস্ত………….
-আরেহ,,,বোকা নাকি রে!!! বাচ্ছার মত এমনে হাউমাউ করে কানলে তোর গিএফ’রা তো সব পালায় যাইবো।
-চুপ থাক,,,শালা রাসকেল…….
মাহিদ আর রবিন রুমে ঢুকল। শুভ্র আর অনিককে এভাবে দেখে মাহিদ বলে উঠল,
-এতো কিসুর পরও তুই ওরে জড়ায় ধরে বসে আসোত কেন অনিক? ওর সাথে এখন আমাদের এত খাতিরের কোন সম্পর্ক নাই।
-তাই!! তাহলে এত কিসুর পরও আমার জন্য তোরা এত কষ্ট কেনো করতেসত?
-বিকজ উই সি ইউ এজ আওয়ার ফ্যামিলি! কিন্তু তোর মনে আমাদের জন্য নুন্যতম ভালোবাসা নাই। থাকলে এমন বেপোয়ারা একটা কাজ করতে পারতি না। (রবিন)
-আরে,,, আমি কি আর ইচ্ছা কইরা করসি বল,,,,আমার এমন চাঁদের মত হ্যান্ডসাম ফেসটায় কোন দাগ পড়ুক তাকি আমি চামু,,৷ তোরাই বল,,,,(শুভ্র)
-শালার ভাই ডায়লগ মারার আর জায়গা পাও না….একবার খালি ঠিক হও তারপর এই হাসপাতালে তোমার পার্মানেন্টলি ব্যবস্তা কইরা দিমু। এমন রাম ধোলাই খাবি!!!
-এখনই দিয়া দে……তুই তো জানস বার বার একজায়গায় যাইতে আমার ভালো লাগে না।
মাহিদ ঘুষি বাগিয়ে গেলো শুভ্রর কাছে এবং কাছে গিয়েই ওকে জড়িয়ে ধরল।
-আল্লাহ’র কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করি দোস্ত।
রবিন আর বাদ যাবে কেনো ও গিয়েও জড়িয়ে ধরল।
-আবার এমন কিছু করার চিন্তাভাবনাও করলে তোরে আমি নিজ হাতে খুন করমু দেখিস।
শুভ্র মুখ চওড়া করে একটা হাসি দিলো। হাসিটা আবার মিলিয়ে গেলো সাথে সাথেই,
-সাদেক কই?
শুভ্রর এই প্রশ্নে সকলের হুশ হলো,,,আসোলেই তো সাদেক কই?…….অনিক বলল
-আমার হাতে খাবারের প্যকেট দিয়ে বলল “তুই যা, আমি আসছি।” কই ওর দেখি আর কোন খোজ নাই।
মাহিদ বলল,
-দাড়া আমি বাহিরে গিয়ে দেখে আসি……
সাদেককে নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই শুভ্র তাকালো ওইদিকে……সাদেক মাথা নিচু করে আছে। সাদেকের সাথে ও অনেক বাজে ব্যবহার করেছে!!!কি কিই না বলেছে সাদেককে!!! এত বাজে ব্যবহার ও কখনোই ওর বন্ধুদের সাথে করে নি। আর সাদেক!!! সাদেককে ও নিজের থেকেও বেশি মানে,,,,তাহলে কিভাবে বললো ওই কথাগুলো!!!
শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল..
-সাদেক আমি ঠিক হয়ে গেলে চান মিয়ার চা খাইতে যাবো একসাথে,,,কেমন?
সাদেক সাথে সাথে পিছন ঘুরে গেল। শুভ্রকে ওর চোখের পানি দেখানো যাবে না। সাদেক জানে শুভ্র এখন কতটা অনুতপ্ত বোধ করছে,,,ওর চোখে পানি দেখলে আরো খারাপ লাগবে শুভ্রর।
কিন্তু বাকিরা হৈ হৈ করে উঠল। অনিক বলল
-আরে আমদের শুভ্র ভাইয়ের আনঅফিশিয়াল বউ কি কান্না করে নাকি!!!!
অনিকের এই কথা শুনে সব হো হো করে এসে উঠল।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব দেখে শিশির একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। প্রাণ খুলে হাসছে শুভ্র। এমন প্রাণ খুলে কখনো ওকে হাসতে দেখে নি শিশির। কিভাবে দেখবে!!! শিশির কি আদৌ শুভ্রর সাথে কখনো প্রাণ খুলে কথাও বলেছে!! কি এমন হত একবার…… শুধু একবার সুন্দর করে সম্পর্কটা চালিয়ে নিলে………
এতক্ষণ সাদেক শিশিরকে শুভ্রর ফ্যামিলির কথা বলেছে। একদম আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত। শুভ্রর এমন বেপরোয়া জীবনের জন্যতো শুভ্র দায়ী না। কিন্তু এখন এসব বুঝেও বা কি লাভ!!! শুভ্রর জীবনে কি এখন আর ওর কোন জায়গা আছে!!!…
হঠাৎ দরজা খুলে রবিন বাহিরে এলো,,,কিছু না বলেই শিশিরের হাত ধরে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে গেলো।শিশিরকে বসালো বেডের পাশে একটা স্টুলের উপর।
-কাল থেকে কিছু মুখে দাও নি শিশির……নাও একটু স্যুপ খাও।
শিশিরের হাতে একটা স্যুপের বাটি দিয়ে সব বের হয়ে গেল। রুমে আবারো পিনপতন নিরবতা। শুভ্র একমনে স্যুপ খেয়ে যাচ্ছে।
-আমি…………… তোমাকে কোনপ্রকার ডিস্টার্ব করবো না…..… আমি শুধু তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাইছিলাম….ব্যস!!
-…………..একজনের সাথে এনগেজমেন্ট করে এভাবে আমার সামনে বসে আছো!!! তোমার ফিয়ান্সে কিছু বলবে না!
-……………………
-আমি কিভাবে আছি আর থাকবো তা নিয়ে আদৌ কি তোমার কি এখন কিছু যাওয়া আসার কথা!!! তুমি তো এখন তোমার……………………
-হয় নি….
-মানে!?……
-এনগেজমেন্ট হয় নি……………কিন্তু তুমি ভেবো না……. আমি তোমার আর তানহার মাঝে
আসবো না।
শুভ্র কিছু বলার আগেই দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে ঢুকলো একটা মেয়ে। পিছন পিছন হুরমুড় করে ঢুকল শুভ্রর বন্ধুরা। মেয়েটাকে দেখেই শুভ্র মেজাজ খারাপ করে তাকালো বন্ধুদের উপর। সবগুলা ওকে ইশারায় “সরি” বলতে লাগলো।
তানহা একদম শুভ্রর পাশে যেয়ে বসল।
-একি হাল করেছো নিজের!? এতোটা কেয়ারলেস কেনো তুমি!!……. কাল সারারাত তোমাকে ফোন করেছি জানো!!!……ইভেন বাসার কেউ আমাকে এব্যাপারে কিচ্ছু বলে নি। মাহিদ আর রবিনও না……। তারপর শেষপর্যন্ত ওদের ফলো করে এসে যখন জানলাম তুমি এডমিটেড আর এক্সিডেন্ট করেছো……জানো আমি পরিমান ভয় পেয়েছিলাম………
-তো তুমি এখানে কেনো এসেছো!
-তো…….তুমি হসপিটালে….আর আমি চুপচাপ বাসায় বসে থাকবো!!!!
শুভ্র তাকালো শিশিরের দিকে….. মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে আছে!!! শুভ্র ওর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে….শিশির হালকা একটু মাথা উঠালো,
-তুমি এখন একটু বাহিরে যাও…
শিশিরের চোখে প্রায় পানি চলে এলো। ঠিকই তো আছে….ওদের মাঝে শিশির এখন একটা থার্ডপারসন,,ওকে তো চলে যেতেই বলবে শুভ্র।
শিশির কথা না বলে উঠে চলেই যাচ্ছিলো,,,শুভ্র পিছন থেকে চেচিয়ে উঠল,
-তুমি কই যাও!! আশ্চর্য্য….. বার বার কথার মাঝখানে উঠে দৌড় দাও কেনো!!!!
তারপর তানহার দিকে তাকিয়ে বলল,
-কি ব্যাপার তানহা,,,,বাহিরে যেতে বললাম তোমায়,,,
-আ…আমি যাবো?? বাহিরে!?
-নাহ…..এক কাজ করো তুমি বাসায় চলে যাও। এখানে থেকে তুমি কি করবে!
-শুভ্র!! আমি…..
-প্লিজ তানহা কথা বাড়িয়ো না!! এই মুহুর্তে কারো সাথে চেচামেচি করতে আমার ইচ্ছা করছে না। এমনেই মাথায় ব্যাথা তুমি আর তা বাড়িয়ে দিও না,,,,প্লিজ যাস্ট গো….
-এভাবে বলছো কেনো শুভ্র!!! আই এম রিয়েলি ওয়ারিড এবাউট ইউ,,,
-হু টোল্ড ইউ টু বি!!!
-এই মেয়ের জন্য তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করছো!!!
চোখ মুখ শক্ত করে শুভ্র বলল,
-নাহ…… এই মেয়ের জন্য না….. আমার যাস্ট তোমাকে সহ্য হচ্ছে না,,,,সো গেট………….আউট।
তানহার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। চোখের পানি মুছার বৃথা চেষ্টা না করে তানহা রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
-এই মেয়ে তুমি এখনো ওদিকে দাঁড়িয়ে আছো কেনো!!! এদিকে এসে কথা শেষ করো,,,,
শুভ্রর ডাকে ধীরে ধীরে শিশির গিয়ে স্টুলে বসতে নিলে,,,শুভ্র টান দিয়ে ওকে বিছানায় নিজের পাশে বসালো…
-ভালোবাসি বলেছিলে…..তাহলে এভাবে অন্য মেয়ের সাথে নিজের ভালোবাসাকে ছেড়েই চলে যাচ্ছিলে….
-আমি ভাবলাম!
-কি ভাবলে!!! শোনো শুধু ভালোবাসলেই হবে না…ভালোবাসা আদায় করাও শিখতে হবে।
বলেই শুভ্র জড়িয়ে ধরলো শিশিরকে। কাঠের মত সোজা হয়ে গেলো শিশির। ওর হৃদপিণ্ডটা এতো জোরে লাফাচ্ছে কেনো….ঠিক পিংপং এর মত করে……ওকে এভাবে নার্ভাস হতে দেখে শুভ্র আরো গভীরভাবে চেপে ধরল ওকে। শিশিরের ঘাড়ে মুখ গুজে বলল,
-আর যদি কখনো কোনো আবির ফাবিরের সাথে দেখেছি….. তো টেংড়ি ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবো বলে দিলাম।
পর্ব ২৩
শিশির বাসায় ঢুকল ১১টার দিকে। বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছে সাদেক। যদিও আবিরের আসার কথা ছিল, কিন্তু ও আসে নি। শিশিরও আর ফোন দেয়নি। যথেষ্ট কস্ট দিয়ে ফেলেছে আবিরকে। আর ওর মুখোমুখি হওয়ার মত সাহস শিশিরের নেই।
শিশিরের মা দরজা খুললেন। শিশির বাসায় ঢুকে একবার চারদিকে চোখ বুলালো,
-নেই তোর বাবা বাসায়।
-হ্যা,,,,না…..মানে…ও আচ্ছা।
-আবির কোথায়?
-বাসায় চলে গেছে মা।
শিরিন বেগম মেয়েকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন। শিশিরের চোখ মুখ ফুলে আছে, খুব কেদেছে বোঝাই যাচ্ছে। ফ্রেন্ডের জন্য কাদাটা স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু তাও কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে লাগছে।
শিশির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, মেঝেতে বাম পায়ের পাতা ডানে বায়ে ঘষছে। এতক্ষণ কথা বলার সময় একবারও মা’র দিকে তাকায় নি। কিছু লুকাচ্ছে কি!!!
শিরিন বেগম সোজা সাপটা প্রশ্ন করলেন,
-তুই কি কিছু লুকাচ্ছিস আমার কাছে!?…..
শিশির একমুহূর্ত ভাবলো, কি করবে…..! মা’কে যদি এখন সব বলে দেয় তাহলে কি ভালো হবে না খারাপ!! কিছুমুহুর্ত ভাবনা চিন্তা করে সব বলে দেয়াটাই শ্রেয় মনে করল।
-আসলে মা হয়েছে কি…… আমি আসলে….. কালকে আসলে……
-এভাবে আমতা আমতা কেনো করছিস!!!
-মা আসলে কাল আমার কোন ফ্রেন্ডের এক্সিডেন্ট হয় নি……
-তাহলে!! কই গিয়েছিলি কাল?
-না মানে!! হাসপাতালেই গিয়েছিলাম। কিন্তু ফ্রেন্ডকে দেখতে না………
-তোর কথার কিছুই মাথায় ঢুকছে না…..
-মা কাল শুভ্রর এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।
নামটা শুনে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। এই ছেলেটার জন্য কিছুদিন আগে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে সবাইকে। এই ছেলে আবার কেনো!!
-আমি ওকেই দেখতে গিয়েছিলাম।
-মানে!! তুই কেনো ওই ছেলেকে দেখতে যাবি। তোর সম্পর্ক ঠিক হয়ে আছে আবিরের সাথে…….
-মা এনগেজমেন্টটা আর হচ্ছে না।
-কেনো হবে না!?…… এটা কোন ধরনের কথাবার্তা…..
-আমি…. আসোলে….. মা….আমি শুভ্রকে পছন্দ করি….
-শিশির!!! তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে!! এসব কি বলিস তুই!!!
-মা আমি আসলে আগে বুঝতে পারি নি…..
শিরিন বেগম মেয়ের কাছে গিয়ে দাড়িয়ে বললেন
-মা তুই আমাকে সত্যি করে বলতো, ওই শুভ্র ছেলেটা তোকে আবার কিছু বলেছে!!
-ও কি বলবে আমাকে!! ওতো এক্সিডেন্টই করে বসে আছে…
-ছেলেটা কি তোকে আবার হামকি ধামকি দিয়েছে…. তুই ভয় পাস না মা…. তুই আমাকে সব খুলে বল…আমি তোর বাবার সাথে কথা বলবো… তাকে সব বুঝিয়ে বলবো….
শিশির আতংকিত চোখে মা’র দিকে তাকালো….
-মা তুমি একটু এদিকটায় বসোতো, বসো। তুমি আগে আমার কথা শোনো……মা শুভ্র আমাকে কিছুই বলে নি বিশ্বাস করো….. মা আমি ওকে সত্যি পছন্দ করি……
-পছন্দ করিস মানে!!! তোর আর আবিরের সম্পর্ক ঠিকে আছে…. ভুলে গেছিস তা তুই!?..
-মা আসলে….আবির জানে সব….কালকে তো ওই আমাকে শুভ্রর কাছে নিয়ে গেলো….
শিরিন বেগম বিস্ফোরিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি সুন্দর করে তার মেয়ে এসব উলটা পালটা কথা বলে যাচ্ছে!!! ওকি একটুই বুঝতে পারছে… এসব কথা যদি ঘুনাক্ষরও ওর বাপের কানে যায় তাহলে ঘরে আগুন লেগে যাবে…
-শিশির এসব আজে বাজে কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। এসব কিছুই হচ্ছে না। আবিরের সাথে তোর সম্পর্ক ঠিক হয়ে আছে। তোর বাবা আবার ওদের সাথে কথা বলবে…এবার হয়ত একদম আকদ করানো ঠিক করবে। সুতরাং এসব অসংলগ্ন কথা যেনো তোর মুখে আমি আর না শুনি।
বলেই শিরিন বেগম উঠে সামনে এগুলেন। শিশিরও দাড়িয়ে গেলো,
-হবে না মা…আমি পারবো না…. আমি শুভ্রকে…..
কথা শেষ করার আগেই শিরিন বেগম ওর গালে সশব্দে এক চড় বসিয়ে দিলেন।
-অনেক বেড়ে গেছোস তাই না। ছাড়া পেয়ে যা ইচ্ছা তাই করবি… আর আমরা তোর কথামত নাচবো…. এই মন চাইল বিয়ে করবি…. এই মন চাইলো বিয়ে করবি না…. খেলা পেয়েছিস তুই!!!
চিৎকার করে উঠলেন শিরিন বেগম। গালে হাত দিয়ে তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে আছে শিশির।
-এই ছেলের জন্য কয়দিন আগে ঘরে কি অশান্তি হয়ে গেল। বাহিরের মানুষজন এসে যা না তা বলে গেলো তোর বাপকে!! তোর বাপের উপর দিয়ে কি গেছে বিন্দুমাত্র আন্দাজ আছে তোর!!! মানুষটা নিজের বোনের কাছে পর্যন্ত ছোট হয়ে গেছে। যেই ফুপুর টাকায় এত নামি দামি ভার্সিটিতে পড়িস সেই ফুপুর দিকটা তো খেয়াল রাখবি। কোন মুখে বললি তুই এই কথা যে তুই ছেলেকে পছন্দ করিস!!! নিজে একসময় ওই ছেলের নামে কি বলেছিলি তাও ভুলে গেছিস………
রাগে ফোসছেন শিরিন বেগম। ঘরে আর কোন অশান্তি চান না তিনি।
-চুপচাপ নিজের রুমে যা। আর যেন এসব আলতু ফালতু কথা না শুনি। মানুষটা দুপুরে বাসায় আসবেন বুঝে শুনে কথা বলবি। আর হ্যা….. বিয়েটা হবে….. আবিরের সাথেই হবে।
বলেই শিরিন বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন। শিশির যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসলো। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা, বলে একটা কথা আছে, যার অর্থ এখন শিশির হারে হারে বুঝতে পারছে। শুভ্রকে নিজের ফ্যামিলির কাছে ভিলেন বানিয়েছে শিশির নিজে। তাও যেমন তেমন ভিলেন না….. মারাত্নক পর্যায়ের খারাপ ভিলেন। এখন ওকে হিরো বানানোটা যে কতটা কঠিন হবে তা ভাবতেই শিশির নিজের মাথা চেপে ধরল। হায় আল্লাহ….. এ কোন মুসিবতে পড়লাম।
ভবিষ্যতে বহুত ঝড় ঝাপটা সামলাতে হবে,,, মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে….. ঠান্ডা করা উচিত….।
রাত ৯.৩০ বাজে। শুভ্রর ঘুম ভাঙলো। সেই যে দুপুরে ঘুমিয়েছে আর এই এখন উঠল। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরই ওর হাত পা কাপতে শুরু করছে। বুক ধরফর করছে। সাইট টেবিলেই রাখা ওর নতুন ফোন। ফোনটা হাতে নিয়েই একটা নাম্বার ডায়াল করল।
শিশির আননোন নাম্বার দেখে ফোনটা রেখে দিলো। কিন্তু ফোনটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে।বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল শিশির,
-হ্যালো… কে বলছেন?
-শিশির তোমার কি এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে?
-কে!! শুভ্র?
-হুম…. হয়ে গেছে এনগেজমেন্ট!?
-আশ্চর্য্য!!!! আজকে সকালে মাত্র বাসায় এলাম!!!! এর মধ্যে এনগেজমেন্ট কিভাবে হবে!!!! আর আমিতো বললাম এনগেজমেন্ট আর হবে না…..
-না মানে…. আমি দেখলাম কি!! আচ্ছা তুমি আজ ছিলেতো আমার সাথে তাই না!?…..
-কি হয়েছে শুভ্র!!! এমনসব কথা বলছো কেনো!?……..
-শিশির তুমি কি এখন আমাকে একবার দেখতে আসবে!
-শুভ্র তোমার জ্বরটা বোধহয় বেড়েছে……মেডিসিন নিয়েছো!
শুভ্রর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলেও এখন শিশিরকে আসলেই দেখতে মন চাইছে…মন খারাপ ভাব নিয়েই বলল,
-না নেই নি…
-নাও নি মানে!! কয়টা বাজে এখন!! রাতের খাবার খেয়েছো!?
-না খাই নি…
-কি সমস্যা শুভ্র!! এতটা বেপরোয়া কেনো তুমি!! তুমি তো কোন ছোট বাচ্ছা না যে,,,তোমাকে সব মুখের কাছে তুলে দিতে হবে….
শিশিরকে আগে কখনো এভাবে চেচাতে শুনে নি শুভ্র। তাই একটু থতমত খেয়ে গেলো,,,
-তুমি কি আমার উপর চেচাচ্ছো?
-হ্যা চেচাচ্ছি,, তো!!
এরকম সোজা সাপটা জবাবে আরো থতমত খেয়ে গেল শুভ্র,,
-না… মানে… চে…চেচাচ্ছো কেনো! মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। তাই খাওয়া হয় নি।
-ঘুমিয়েছিলে?
-হুম..
-গুড… রিকোভারির জন্য ঘুমটা প্রয়োজন। ঠিকাছে….. এখন খাওয়া শেষ করো আগে… আমি কিছুক্ষণ পরে ফোন দিবো।
-আর একটু কথা বলি….
-না… একদম না। আগে খাবে… যাও।
-তুমি এখন আবার আমাকে অর্ডার দিচ্ছো?
-তো……. সমস্যা কোথায়। কথা না শুনলে বকাও দিবো। রেগে গেলে কিন্তু আমি তোমাকেও হার মানিয়ে দেই বুঝলে। সো,,,চুপচাপ খাওয়া শেষ করো গিয়ে।
-বাপরে তাই নাকি,,,,,,,হুমমম খাবো এক শর্তে…. কাল সকালে আমি ঘুম থেকে উঠার আগে তোমাকে আমার সামনে হাজির থাকতে হবে।
-তুমি কখন উঠবে আমি কিভাবে জানবো…
-আহা… আহা…. নো এক্সকিউজেস….
-আরে এক্সকি…………..
-তুমি কি চাও আমি না খেয়ে থাকি!?…….
-আচ্ছা ঠিকাছে… বুঝলাম।আমি আসবো…. এখন খাওয়া শেষ করো।…… আমি রাখি।
-হুম… মনে থাকে যেনো…. আমি ঘুম থেকে উঠার আগে….
-আচ্ছা….. আচ্ছা….।
ফোন রেখেই শিশির হাসলো। আগে কখনো ওরা দুজন এভাবে কথা বলেছে কি!!! কক্ষনো না….
শুভ্রর সাথে এভাবে চেচামেচি করা, অর্ডার দেওয়া,,,,আগে ও কখনো পারতো না। বরাবরই ভয় পেত। কিন্তু এখন!!! এখন হঠাৎ করেই এগুলো ওর অধিকার মনে হচ্ছে।
সকাল ৮.৪৫ বাজে। শুভ্র উঠেছে বেশ কিছুক্ষণ। শিশিরের সাথে ওর শর্ত ছিলো… শুভ্র ঘুম থেকে উঠার আগেই চলে আসতে হবে। কিন্তু এখনো শিশিরের কোন খোজ খবর নেই। সময় যাচ্ছে আর তার সাথে বাড়ছে শুভ্রর ভয়। শুভ্রর কেনো জানি এখনো সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। স্বপ্ন ভাবতেই শুভ্র আরো অস্থির হয়ে গেলো। দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে শিশিরকে ফোন দিলো, কিন্তু রিসিভ হলো না। ৩বার ফোন দিলো একবারও ফোন রিসিভ করলো না শিশির। শুভ্রর ভয় বাড়ছে।
অনিক সামনের একটা সোফায় বসে আছে,,, শুভ্রর এমন অস্থিরতা দেখছিলো বসে বসে। শেষমেশ নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে গান ধরলো,
“মন ভাসায়া প্রেমের সামপানে….. এহে..
আছো লুকায়া তুমি কোনখানে… এহে এহে…..”
শুভ্র কটমট করে ওর দিকে তাকালো,,, তাতে অনিকের গান বন্ধ হয়ে হাসি শুরু হয়ে গেল।
শিশির এলো ঠিক ১০টায়। ওকে দেখে শুভ্রর এতক্ষণের রাগ, ভয় সব যেন টিং করে ভ্যানিস হয়ে গেল। কিন্তু!!! শিশিরের পিছন পিছন আবিরকে দেখে শুভ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো,, কপালের রগ দাঁড়িয়ে গেলো। মুহুর্তেই মাথায় আগুন ধরে গেলো ওর।
পর্ব ২৪
শিশির ঘুম থেকে উঠল ৬.৩০-এ। শুভ্রর সাথে কাল কথা বলার পর পরই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। শুভ্রকে যেহেতু কথা দিয়েছে,সুতরাং ওর ঘুম থেকে উঠার আগেই শিশিরকে উপস্থিত থাকতে হবে। নয়ত আবার কি কেলেংকারি করে কে জানে!!!
শিশির ওর বাবার থেকে একটু লুকিয়ে লুকিয়েই থাকছে। ওর বাবা আবিরকে ফোন দিয়ে কথা বলেছে। কি বলেছে তা এখনো যদিও শিশির জানে না। সকাল সকাল ঘর থেকে বের হতে পারলেই ভালো। কারো প্রশ্নের খপ্পরে পড়বে না। চুপ করে বের হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হলো না। গেট দিয়ে বের হওয়ার সময়ই শিরিন বেগম মেয়েকে আটকালেন।
-কই যাস?
-কই যাবো আবার ক্যাম্পাসে…..
-কিছুদিন আগেই না বললি পরীক্ষা শেষ হলো, তাহলে এতো তাড়াতাড়ি ক্লাস শুরু হয় কিভাবে?
-ক্লাস করতে যাচ্ছি না। ভর্তির ইনফো নিতে যাচ্ছি।
-একা যেতে হবে না। তোর ভাই উঠুক ঘুম থেকে ওর সাথে যাবি।
-আজবতো মা…. কি শুরু করলে সকাল সকাল। যাবো আর আসবো,,,এতো ক্যাচাল লাগাচ্ছো কেনো?
-ভুজুং ভাজুং আর আমাকে বুঝাতে আসবি না। যা বলছি তাই কর চুপচাপ।
আজকে সহজে ছাড়া পাবে না তা বেশ বুঝতে পারছে শিশির। কিন্তু ওর যাওয়াটা তো প্রয়োজন। নিজের মনটাও যাওয়ার জন্য টানছে, আবার শুভ্রকেও কথা দিয়েছে। কি করবে বুঝতে পারছে না শিশির। কি করবে, কি করবে,,,ভাবতে ভাবতেই শিশির ফোট করে বলে দিলো
-আমি আবিরের সাথে যাচ্ছি মা,
শিরিন বেগম ভ্রু কুচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
-কোথায় ও?
-আসবে, নিচেই থাকবে বলল।
-ফোন দিয়ে উপরে আসতে বল।
-উফফ মা,,,কি জেরা করা শুরু করলে সকাল সকাল বলোতো!!
-যেটা করতে বলেছি সেটা কর। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঘরে বন্দি করে রাখব….. এক পা ঘর থেকে বের করতে পারবি না।
শিশির এর আগে কখনো মায়ের এমন ভয়ানক রুপ দেখে নি। হঠাৎ ওর মায়ের পরিবর্তনে খুব বড়সড় একটা শক খেলো। ওর মা’কে ও সবসময় খুব চুপচাপ এবং নরম সরম রুপে দেখে এসেছে। শিশির ফোনটা হাতে নিলো….. শিরিন বেগম সামনে দাঁড়ানো। আবিরের নাম্বার ডায়াল করার সময় মনে প্রাণে দোয়া করছে যেনো আবির ফোনটা রিসিভ না করে, কিন্তু ফোন রিসিভ না করলে মা যেতে দিবে না। হায় আল্লাহ…. আমি এখন তোমার কাছে কি দোয়া চাইবো!!! শুধু আমাকে এইমুহুর্তে রক্ষা করো আল্লাহ…..
চার বার রিং হওয়ার পর আবির ফোন রিসিভ করল।
-শিশির আমি ড্রাইভ করছি। তোমাকে কিছুক্ষন পর ফোন দেই….
-ওহ তাই না… তাই… আচ্ছা কতক্ষণ লাগবে তোমার আসতে?
-শিশির আমি অফিসে যাচ্ছি।
এই পর্যায়ে শিরিন বেগম ফোন নিয়ে নিলেন মেয়ের হাত থেকে….
-আবির আমি শিশিরের মা বলছিলাম…. তা বাবা তুমি এখন কোথায়?
এভাবে হঠাৎ ফোনের হাত বদল হওয়ায় আবির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।
-আসসালামু আলাইকুম আন্টি…. জ্বী মানে আন্টি আমি এখন রাস্তায়….
-কতক্ষণ লাগবে বাবা,,,তোমার আসতে?
-জ্বী মানে আন্টি..আমি ঠিক…….
মা, মেয়ে কি জিগ্যেস করছে তার বিন্দুমাত্র আবিরের মাথায় ঢুকছে না…… বারবার প্রশ্ন করা হচ্ছে কখন আসছো!!!! কিন্তু আবিরের তো আজকে ওদের বাসায় যাওয়ার কথা না। ওর যাওয়ার কথা সামনের শুক্রবার……. এমনটাই আংকেলের সাথে কথা হয়েছিলো। কিন্তু এখন হঠাৎ………
ভাবনায় ছেদ পড়লো,,,শিরিন বেগমের ডাকে
-আবির…. তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
-জ্বী মানে….. জ্বী জ্বী আন্টি শুনছি….
-কতক্ষণ লাগবে তোমার?
ঝামেলা হয়ত একটা হয়েছে বুঝতে পেরে…. আবির আর কিছু না বলে,,সোজা জবাব দিলো
-এইত আন্টি দশ মিনিটেই পৌছে যাবো।
-আচ্ছা,,,,আচ্ছা বাবা…. রাখি তাহলে।
-আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
শিশিরের এদিকে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। মা যেই বাঘিনীর রুপ নিয়েছে,,,হালকা কিছু উনিশ বিশ টের পেলে আজ আর ওর রক্ষা নেই। কোন কুক্ষনে যে মা’কে সব বলতে গিয়েছিলো!!!! ফোন কাটার পরও মায়ের কোন নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া না দেখে ছোটখাটো একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো শিশির।
আবির এলো ঠিক ৮.১০-এ। ততক্ষণে কবির সাহেবও ঘুম থেকে উঠে গেছেন। আবির আসবে জানতে পেরে তিনি বললেন “ভালোই হল আজ দেখা হবে। ফোনেতো আর সব কথা ক্লিয়ারলি বলা যায় না”
দরজা খুলে দিলো শিশির। শিশিরের করুন চেহারা দেখেই আবির বুঝে গেলো ঝামেলা খুব ভালোই লেগেছে। কতটুক গড়িয়েছে কে জানে!!!
আবির আর শিশির পাশাপাশিই বসে আছে। শিশির যতটুকু নার্ভাস ঠিক ততটুকু আবিরও নার্ভাস হয়ে আছে।
কবির সাহেব আর শিরিন বেগম সামনে বসা।
গলা খাকারি দিয়ে কবির সাহেব শুরু করলেন,
-আবির তা বলছিলাম কি…. এনগেজমেন্টের ব্যাপার নিয়ে তোমার মা’র সাথে কথা বলতে চাইছিলাম….. কিন্তু তার আগে তোমার সাথে আলাপ করাটা শ্রেয় মন হল।
-জ্বী আংকেল……
-তা বাবা…. আমরা আগামী সপ্তাহে একটা ডেট ফেলতে চাইছি। কিন্তু এবার চাইছিলাম ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করে আকদ করিয়ে ফেলবো….
এই কথা শুনে আবির বোকার মত চেয়ে রইল শিশিরের দিকে……. শিশির নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কলিজার পানি শুকিয়ে আত্মা যাই যাই করছে।
-আসলে আংকেল হয়েছে কি……. একটু সমস্যা হয়ে গেছে আসলে…..
-কি সমস্যা হয়েছে…….
-না…. মানে আংকেল কিছু মনে না করলে…..
-কোন কিছুই মনে করবো না…. তোমার সব সমস্যার কথা বল নিশ্চিন্তে ….তুমিতো আমাদের ঘরের ছেলে।
-আসলে আংকেল বিজনেসটা নিয়ে একটু সমস্যা হয়ে গেছে। আমাদের সাথে আজ পর্যন্ত দাদাবাড়ির কারো সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না….
-হুম…..
-আমাদের ব্যবসাটা বাবা নিজে দাড় করিয়েছিলেন। বাবা মারা যাবার পর মা সামলিয়েছে। আর এখন আমি….
-হুম…এখন….
-কিন্তু এখন আংকেল আমার চাচারা এই ব্যবসায় নিজেদের অধিকার দাবী করছেন। তো এটা নিয়ে প্রচুর ঝামেলা শুরু হয়ে গেছ…..
-ওহো….. তোমার মা একা কিভাবে সব হ্যান্ডেল করবেন?
-আমি নিজেও আছি মা’র সাথে আংকেল। তাই আংকেল এখন এসব অনুষ্ঠান করাটা……. মা’র উপর বেশিই প্রেশার পড়ে যাবে…. তাই এখন………
-তুমি কি এখন এই ব্যাপারটা আরো কিছুদিনের জন্য পিছাতে চাইছো?
-জ্বী আংকেল।
কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলেন কবির সাহেব। তারপর বললেন,
-ঠিক আছে,,,তোমাদের সমস্যা আমরা না বুঝলে আর কে বুঝবে!!!! তোমাদের কোন প্রকার সাহায্য লাগলে বলবে।
-জ্বী আংকেল….. অবশ্যই…… ধন্যবাদ আংকেল।
-আরে ধন্যবাদের কি হলো বোকা ছেলে….. তুমিতো আমাদেরই ছেলে।
আবিরের খুবই খারাপ লাগছে এভাবে মিথ্যা বলতে…. কিন্ত কিছু করার নেই।
শিশিরকে নিয়ে নিচে নামতেই আবির বলল,
-গাড়িতে বসো….. আমি নামিয়ে দিচ্ছি
-তুমি শুধু শুধু কেনো কষ্ট করবে!!!! আমি চলে যেতে পারবো…..
-প্লিজ শিশির….. আমদের মাঝে এরকম ফরমালিটি কি আদৌ মানায়!!!!! বসো গাড়িতে।
গাড়িতে বসে শিশির উসখুস করছিলো,কিছুক্ষণ পর জিগ্যেস করেই ফেলল,
-বাসায় যা বললে……..
-মিথ্যা ছিলো……
-তাহলে আন্টি……….
-মা’কে আমি যা বলার বলেছি…… মা’কে নিয়ে তুমি টেনশন করো না।
-হুম……….
-শিশির বাসায় কি কোনো ঝামেলা হয়েছে!?
-না…. না…. তেমন কিছু না……
-বলতে চাইছো না!?……..
-আবির তোমাকে আমি…অলরেডি আমার ঝামেলায় অনেকবার জড়িয়ে ফেলেছি…..আর তোমাকে আমার ঝামেলায় জড়াতে চাইছি না……
-বাহ!!!! আর এদিকে আমি ভাবলাম আমার তোমাকে দূরে সড়িয়ে দেওয়া উচিত….
-বুঝলাম না!!!!
-শিশির আমি সোজা সাপটা কথা বলতে পছন্দ করি…..এই যে এত কিছু হয়ে গেল!! এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি। সেইক্ষেত্রে আমার তোমার সাথে রাগ দেখানোর কথা ছিল,,,,,,,আমার তোমাকে দূরে সড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল…….. কিন্তু এখন ঘটছে উল্টা।……. তুমি আমাকে দূরে সড়িয়ে হাত ঝেড়ে ফেলছো,,,,,, ঠিক যেইমুহুর্তে আমার একজন ভালো ফ্রেন্ডের প্রয়োজন তখন…… বেশ ভালো তো……… ভালো না!?……..
-আসলে আবির….. আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইছিলাম না…….
-শিশির আমি অলওয়েজ তোমাকে বলি…… সব কিছুর আগে আমাদের বন্ধুত্ব……. একজন বন্ধু আর একজন বন্ধুর খুশির জন্য কতকিছুই করতে পারে……. তাই না!…..আমি শুধু আমার বন্ধুর খুশির জন্যই কয়টা কাজ করেছি……
শিশিরের প্রচুর কান্না পাচ্ছে…… এত ভালো বন্ধু আর বন্ধুত্বের জন্য কি আসলেই ও যোগ্য!!!!
শিশির আর আবির যখন কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল,,,,তা দেখে শুভ্র চরম ক্ষেপে গেলো। আবার এই আবির!!!!
-কেমন আছো শুভ্র? ইউ আর রিকোভারিং ফাস্ট…. দেটস গুড…..
-হুম…… তোমার আমাকে নিয়ে এত নাচানাচি করতে হবে না…… মাইন্ড ইউর অওন বিজনেস….
হালকা হেসে আবির আবার জিগ্যেস করল,
-মেডিসিন নিচ্ছোতো ঠিক মত!!…… পায়ের অবস্থা কি!?….. রেগুলার থেরাপি নিলে আমার মনে হয় না…. বেশিদিন লাগবে তোমার ঠিক হতে….
আবিরের এমন সাবলীল ব্যবহারে শুভ্র আরো ক্ষেপে গেলো,,,,, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-ডিড আই আস্ক ফোর ইউর সাজেশন?
-না…. না…. তা চাও নি…. আমি যাস্ট বললাম আমার কথাটা……বাই দা ওয়ে বাকিরা কই!?….. সাদেক মাহিদ কই ওরা…..
-ওই তোর কাছে কি মনে হয়….. তোর সাথে আমি পিতরা আলাপ করার জন্য বসে আছি!!
-শুভ্র…. রিলেক্স…. এতোটা চিৎকার চেচামেচি করো না…. তোমার জন্য এখন চিৎকার চেচামেচি করা ঠিক হবে না। আমি যাস্ট শিশিরকে এগিয়ে দিতে আসছিলাম। তাই ভাবলাম তোমাকে দেখে যাই একবার….
-হইসে দেখা….. এখন যা…… যাস্ট গেট আউট….
-ঠিকাছে আমি যাচ্ছি….. তুমি প্লিজ শান্ত হও…. এতোটা উত্তেজিত হওয়ার মত কিছু ঘটে নি….
-শাট আপ….. তোর বলতে হইবো না ঘটনা কি ঘটছে কি ঘটে নাই…. তুই এইমুহুর্তে এই রুম থেকে বের হো…..
আবির আর কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে চলে গেল। বের হওয়ার আগে ছোট করে শুধু শিশিরকে বলল, “আসি শিশির।”
শিশির এতক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে হতভম্বের মত শুভ্রর কান্ড দেখছিল। শুভ্র এতোটা খেপে যাবে ও ভাবে নি। আবির বেরিয়ে যেতেই শিশিরের হুশ হল,,,আর সাথে সাথে ও রাগে ফেটে পড়ল,
-কি সমস্যা কি তোমার? এসব কথাবার্তার কি মানে!?
-তার আগে বলো তুমি অই পোলার সাথে কেনো? মানা করছিলাম আমি…… করি নাই মানা….!?
-তাই বলে এভাবে চারালের মত বিহেভ করবা তুমি!!!! যারে তুমি এত কিছু বললা তার সাহায্যের জন্যই আজকে আমি তোমার সামনে দাড়ানো…. নাহয় এই জীবনে আর আমার মুখ দেখা লাগতো না….
শুভ্র রাগে সাইড টেবিলের উপর রাখা কাচের গ্লাসটা নিয়ে শিশিরের সামনেই একটা আছার মারলো। শিশির ঠায় তাকিয়ে রইল শুভ্রর দিকে…. পলকও ফেলল না…. শুভ্রর এসব কাজ কর্মের সাথে ও পরিচিত…
-আমি আবিরকে ফোন দিয়ে আসতে বলছি… তুমি এক্ষন আমার সামনে ওর কাছে মাফ চাইবে।
-আর তুমি কে আমাকে এসব কথা বলার….
-আমি যেই হই তুমি মাফ চাইবে কি না বল!?….
-এই মেয়ে কি মনে কর নিজেকে!!! আমি কি তোমার গোলাম নাকি,,,,, যে তোমার কথায় উঠবো আর বসবো….
-তুমি ভুল করেছো……. আবিরের কাছে মাফ না চাইলে আমিও আর আসছি না তোমাকে দেখতে,,,,,
-আসতে হবে না তোমার…… তোমার ঢং-এর আসা আসির কোন দরকার নেই। গেট লস্ট।
শিশির চুপচাপ বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। শিশির বের হয়ে শিড়ির কাছে যেতে না যেতেই ফোন এলো, শুভ্রর ফোন,
-তুমি যে একটা জঘন্য খারাপ মেয়ে তা কি তুমি জানো!!!………… নিয়ে আসো……. তোমার আবির না ফাবির কে।
পর্ব ২৫
সাদেক, মাহিদ, রবিন ওদের বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌচেছে। অনিক নিজেও ঘোরের মধ্যে রয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগের সব ঘটনা ওর সামনেই ঘটে গেল। শুভ্রর চেচামেচি, রাগারাগি এবং শেষ পর্যন্ত আবিরের কাছে ক্ষমা চাওয়া।
সাদেক আবার জিগ্যেস করল,
-কি….. কি…. করেছে শুভ্র?
-মাফ চাইসে…..
-ধুর ব্যাটা তুই ভুলভাল দেখসত!!!!
-কসম দোস্ত আমার সামনে….. একদম আমার চোক্ষের সামনে ঘটসে ঘটনা…….
-তুই সিউর তুই ঘুমের মধ্যে কোন স্বপ্ন দেখোস নাই!?….( মাহিদ)
-হুররররর…… বিশ্বাস না হইলে শুভ্ররেই জিগা……
ওরা তাকাল শুভ্রর দিকে। শুভ্র আর শিশির পাশাপাশি বসে আছে। দুজনে মিলে গুটুর গুটুর করে কথা বলছে…… আবার একটু পর পর মুচকি মুচকি হাসছে।
ওদের চোখ যেন ধাদিয়ে গেলো এই দৃশ্য দেখে। অনিক বলল,
-দোস্ত আমার বুঝি আর হায়াত নাই রে…. আমার জীবনের অষ্টম আশ্চর্য্য তো আমি দেইখালাইসি।
আজ ২৫দিন হতে চলল…. শুভ্রর এক্সিডেন্টের। যদিও শুভ্র এখন বাসায় চলে এসেছে। হাসপাতাল ওর কোন কালেই পছন্দ ছিল না। তাই গত সপ্তাহেই জোরজবস্তি করে বাসায় চলে এসেছে। ডাক্তারাও মানা করছিল,,,সাথে শিশির,,,, আর শুভ্রর বন্ধুরাও মানা করছিল,,,,,,, কিন্তু ও কিছুতেই আর থাকবে না হাসপাতালে। তাই বাধ্য হয়েই ওকে রিলিজ দিয়েছে ডাক্তার।
কিন্তু এইমুহুর্তে শুভ্রর মনে হচ্ছে… হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেওয়ার ডিসিশনটা ওর বিরাট বড় ভুল ছিল। আজকে ৬দিন ৯ঘন্টা ১৩ মিনিট ও শিশিরের মুখ দেখে নাই। শিশির ওদের বাসায় আসবে না….. ভিডিও কলে ফোন দিয়ে কথা বলা যাবে না…… শিশিরের মা’র কড়া নজরদাড়ি মেয়ের উপর। তাই ফোনেও ঠিকমত কথা বলা যায় না। শুভ্র বলতে গেলে একরকম ঘরের মধ্যে বন্দি। ওর বন্ধুদের পাহাড়ায় আটকে আছে।
তানহা ঘুম থেকে উঠল একটা মন খারাপ ভাব নিয়ে। শুভ্র সেদিন ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তারপর ও আর রাগ করে শুভ্রকে দেখতে যায় নি এমনকি ফোনও দেয়নি। শুভ্র ওর কাজকর্মের জন্য কক্ষনো সরি বলবে না তা তানহা জানে, কিন্তু শুভ্রর কাছ থেকে একটা ফোন কল ও আশা করেছিল। আর যাই হোক ওরা ছোটবেলা থেকেই একে অপরকে চিনে। শুভ্রর বাবা আর ওর বাবা যেহেতু বিজনেস পার্টনার, সেহেতু ওদের পরিচয়টা অনেক আগের। তানহা নিজের ক্যারিয়ারের জন্য বাহিরে চলে যায় ওর বাবার সাথে এবং পরে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যাওয়ার জন্য শুভ্রর সাথে আর যোগাযোগ হয় নি। কিন্তু এত বছর পর দেশে ফিরে শুভ্রকে দেখে তানহার মন সাথে সাথেই বলে উঠল, “ইয়েস ইউ….. অনলি ইউ আর দ্যা ওয়ান ফর মি”
ধীরে ধীরে শুভ্রর সাথে মিশে তানহা যেনো আরো বেশি দুর্বল হয়ে গেলো……. শুভ্রকেই ওর চাই…..কিন্তু শুভ্রর অবহেলা যেনো এখন বেড়েই চলছে। প্রথম প্রথম শুভ্রর অল্প আধটু অবহেলাগুলো তানহার খারাপ লাগত না…..কিন্তু ইদানিং অবহেলার সাথে সাথে চলছে ওর খারাপ ব্যবহার। আজ পর্যন্ত তানহার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহারতো দূরে থাক কেউ ওকে একটা কড়া কথা পর্যন্ত শোনায় নি। আর অবহেলা…… তানহাকে অবহেলা করার সাধ্য কারো নেই। সেই জায়গায় তানহা চুপচাপ এসব সহ্য করে যাচ্ছে……. কারন ও শুভ্রকে ভালোবাসে…..
কিন্তু আর সম্ভব না….. আজ ও শুভ্রর সাথে কথা বলবেই বলবে…. এবং বুঝিয়ে বলবে যে “দে আর মেড ফর ইচ আদার……..”
শুভ্র অনেক কষ্টে মাহিদকে রাজি করালো ক্যাম্পাসে যেতে দেওয়ার জন্য। দুইদিন আগে ওর পায়ের প্লাস্টার খোলা হয়েছে। কিন্তু তারপরও ওকে কমপ্লিট বেড রেস্ট সাজেস্ট করা হয়েছে……সবার সামনে হু হা করে রাজি হয়ে গেলেও…… মনে মনে ঠিক করে ফেলল….. বেড রেস্ট না…. বেডকে একদমের জন্য রেস্ট দিয়ে দিবো… একবার এই প্লাস্টার খুলুক আমাকে আর পায় কে!!!
শিশিরের ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে…. পুরাদমে ক্লাস চলছে। ক্যাম্পাসে এলেই ওর শুভ্রর কথা মনে পড়ে। ক্যাম্পাসে না এলেও হয় না…. ক্লাস মিস করা যাবে না…. কিন্তু এর মধ্যেও মায়ের স্পাইগিরি। কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিবে…. চেক করতে শিশিরের ফোন বিজি কিনা….. মায়ের এই পরিবর্তনে শিশির মনে হচ্ছে… এই মা’টা মনে হয় আমার না…. ভুল করে বোধহয় ওর মায়ের মত কেউ ওদের সংসারে ঢুকে পড়েছে….এত ঝামেলা কেনো জীবনটা…….হুহহহহ!!! করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শিশির…..
শুভ্র ক্যাম্পাসে এসে সোজা চলে গেল ক্যান্টিনে… ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে চা খাওয়া শিশিরের পুরানো অভ্যাস….. শিশির আজ ভালো সারপ্রাইজ হবে ভাবতেই শুভ্র খুশিতে কুতুর কুতুর করে উঠল। সময় পার করার জন্য ফোন বের করে গুতাতে লাগল ও…. এমন সময় সামনের চেয়ারে কেউ একজন বসল….. শুভ্র তাকিয়ে দেখল…. কিন্তু চিনল না মেয়েটাকে….. মুখের অতিরিক্ত মেকাপ রোদে গলে গিয়ে মেয়েটার চেহারার মানচিত্রই বদলে গেছে…. এক সেকেন্ড তাকিয়েই আবার নিজের কাজে মন দিল….
-কেমন আছেন ভাইয়া?
-…………………
-আমাকে চিনতে পেরেছেন ভাইয়া!?…… আমি মিলি..……
-…………………..
-আমি কিন্তু আপনাকে খুব ভালো করেই চিনি…….. বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল আপনার আমার সাথে……..
-……………………
-ইশশশশ…. ভাইয়া আপনার কি কোন এক্সিডেন্ট হয়েছিল নাকি!!!….. কিভাবে হলো!!! উফফফ খুব গুরুতর ছিলো!!!!
কানের কাছে মেয়েটার বকর বকরে শুভ্রর কান ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে……. চাইলেই মেয়েটাকে ধামকি দিয়ে ভাগিয়ে দিতে পারে…. কিন্তু তাতে নিজের মুড খারাপ হয়ে যাবে…… এতদিন পর শিশিরকে দেখবে… মুড খারাপ করতে চাচ্ছে না তাই…… শুভ্র ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে চারপাশে এক নজর তাকালে…. আশ্চর্য্য!!!! আশেপাশে মেয়েগুলো সব ওর দিক তাকিয়ে ফুসুর ফাসুর করছে….. ওর মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে,,,,,
-বাই দা ওয়ে ভাইয়া আপনি কিন্তু ভালো কাজ করেছেন……
-……………..
-শিশিরের সাথে সম্পর্কটা এমনেও কিন্তু টিকত না ভাইয়া…….
এইবার শুভ্র একটু ভালো করে সরু চোখে তাকালো মেয়েটার দিকে……. মেয়েটা শিশিরকেও চিনে…….
-আপনি তো জানেন না ভাইয়া….. শিশির কিন্তু আপনাকে ছাড়াও অন্য ছেলেদের সাথে যোগাযোগ করত…….
ব্যস…..!!!! শুভ্রর মেজাজ গেলো আউট অফ কনট্রোল হয়ে…… সামনের দিকে তাকাতেই ওর চোখ মেয়েটাকে ছাড়িয়ে গেল গেটের দিকে…… শিশির অবাক চোখে তাকিয়ে আছে….. বেশ অবাক হয়ে গেছে মেয়েটা বোঝাই যাচ্ছে…. শিশিরকে দেখে শুভ্র চারপাশের সব ভুলে গেল….মুখে বিশাল বড় এক হাসি ফুটে উঠল ওর…… শিশির মুচকি মুচকি হেসে এগিয়ে আসছিল। কাছে আসতেই মিলিকে দেখল…. শুভ্রর সামনে বসে অনবরত বকবক করছে……. উফফফফ!!!! এই মেয়েটা পারেও বটে!!!
মিলি তখনো বলেই যাচ্ছে….
-আরে ভাইয়া আমার এক চাচাতো ভাই আছে জানেন…. ওর সাথেও কিন্তু শিশির কয়দিন ঘুরেছে…. ছেলেটাকে ভেজে খেয়েছে একদম….আরে হ্যা ভাইয়া….. আপনার সাথে ব্রেকাপ হওয়ার কয়দিনের মাথায় আরেক ছেলের সাথে ঘুরতে লাগল….. আপনেই দেখেন…..
শিশির পিছনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনলো….
-তাই না…… তা তোমার চাচাতো ভাইয়ের সাথে তুমি নিজে লাইন না মেরে আমাকে লাইন মারতে দিলা….!!!! বাহ এতোটা উদার তুমি……!?……
-আরে…. শি…..শিশির….. কখন এলি তুই!?…. কেমন আছিস দোস্ত?……..
-তুমি আমার এত সুন্দর সুনাম করছো ভালো না থেকে কি পারি!!!!!…….
-না মানে…. আমিতো এমনেই শুভ্র ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম।…..
বলেই মিলি উঠে যাচ্ছিল…. শিশির হেচকা টান দিয়ে ওকে আবার চেয়ারে বসালো……
-আরে যাও কই…. শেষ করো…… শেষ করো…. কি কথা যেনো বলছিলে শেষ করো…..
-কিছুই বলছিলাম নারে….. বি…. বিশ্বাস কর,,,,
-তোর চাচাতো ভাইকে ভেজে খেয়েছি… দেখি দেখি কোন চাচাতো ভাই তোর….পিক দেখা দেখি একবার……তোর তো আবার ভাইয়েদের অভাব নেই কিনা…..মামাতো ভাই, খালাতো ভাই, চাচাতো ভাই, পাড়াতো ভাই,,,,,,কত কত ভাই তোর…….
-শিশির আমিতো এমনেই বললাম আরকি….. ওইতো একটু ফাজলামি কর…………….
-চুপ… একদম চুপ…. ফাজলামি!!!!! আমার সাথেও এমন অনেক ফাজলামি করেছো তুমি…..শুভ্র হেন…. শুভ্র তেন….. আর আমিও তখন খুব সুন্দর করে তোমার ফাজলামি শুনে শুনে নেচেছি…….এত ফাজলামি কেনো তোমার পেটে পেটে……এখন আর না…. এইবার তোমার ফাজলামি আমি ছুটাবো….
-…..শিশির……..আমি…..
-আর যদি কক্ষনো শুভ্রর আশেপাশে তোকে অথবা তোর কোনো চেলি পেলি দেখেছি তো….ফাজলামি করার জন্য এই মুখ আর থাকবে না….. এমনভাবে ভাঙবো যে আর জোরাও লাগাতে পারবি না……খবরদার বলে দিলাম…..
শিশির এতো জোরেই জোরেই হামকি ধামকি করছিলো যে আশেপাশের সব…. হা করে তাকিয়ে রইল। আর শুভ্র!!!!! ওর তো মনের ঘন্টা বেজে গেলো……শিশিরের এই রুপ প্রথম দেখল…..শিশির কি সুন্দর করে ওর জন্য ঝগড়া করছে…….!!!!
পর্ব ২৬
(পাঠকের সুবিধার্থে প্রথম থেকে এইপর্যন্ত সব পর্ব পোস্ট করেছি…. নতুন পর্বও পোস্ট করে দিবো)
শিশিরের এমন বড়সড় হুমকি শুনে মিলি একদম মিয়িয়ে গেলো….. চুপ করে উঠে চলে যাচ্ছিল…. শিশির আবার চিৎকার করে ডেকে উঠল,
-এই… কই যাস কই এখন,….. কি ফাজলামি করা শেষ!!!!,……. কি ব্যাপার চলে যাচ্ছিস যে…….
মিলির পিছন পিছন শিশির এক পা এগুতেই শুভ্র ওকে পিছন থেকে টেনে ধরল…..
-কি ব্যাপার তুমি আমাকে আটকালে কেনো!?….
-না…মানে….. ছাড়ো না শিশির….. কি দর…………..
-কি….. কি বললা তুমি!!!!ছাড়বো!!!! অই তুমি ওই মেয়ের সাপোর্ট করছো কেনো!!!
-হ্যা!!!! মানে কি!!! কখন করলাম!!!
-ওহহহ… করবেইতো সাপোর্ট…. ওরা আবার তোমার ফ্যান, ফলোয়ার না…… ওদের সাপোর্ট না করলে তো তোমার ফ্যান আর ফলোয়ার কমে যাবে তাই না………
-আল্লাহ….!!! শিশির… কি ব……
-চুপ….আর একটা কথা বলবা না…. আর তুমি আমাকে এভাবে ঝাপটায় ধইরা রাখসো কেনো!!….
-ভালো লাগে তাই……😀
-ছাড়ো আমাকে…..
-না… ছাড়বো না….. ছাড়লে যদি আবার ওই মেয়ের পিছনে দৌড় দাও…..
শিশির শুভ্রর দিকে কটমট করে তাকালো….. শুভ্র ৩২ দাত বের করে একটা হাসি দিলো…..
শিশির নিজের রাগ কোনমতে কন্ট্রোল করে বলল,
-দিবো না দৌড়….. ছাড়ো এখন….
-সিউরতো….
-উফফফ… হ্যা সিউর ছাড়ো…..
শুভ্র ছাড়লতো না-ই……. বরং পট করেই শিশিরকে পাজঁাকোলা করে কোলে তুলে নিলো…..ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে শিশির থ মেরে গেল…. শুভ্র ওকে কোলে নিয়ে দিব্বি ক্যান্টিনের ভিতরে সবার সামনে থেকে হেটে বাহিরে চলে এলো…. বাহিরে বের হতেই শিশির লজ্জায় দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল…… এতে শুভ্রর মুখে হাসি আরো বিস্তৃত হলো…… ক্যান্টিন থেকে বের হতেই ক্যান্টিনের উপরের বারান্দা থেকে শুভ্রর সব বন্ধুরা হৈহৈ করে উঠল……
-আরেএএএএ…. মাম্মা চোখ জুরায় গেলো এই দৃশ্য দেইখা….(অনিক)
সবগুলো একসাথে তালি বাজাতে লাগলো….কোনটায় যেনো আবার শিশও বাজালো……… শুভ্র ঘুরে তাকিয়ে মুখে হাসি রেখেই একটা চোখ মেরে আবার হেটে চলল…… আর সবার চোখের আড়ালে সাদেক এই সুন্দর মুহুর্তটাকে নিজের ফোনের ক্যামেরায় বন্দি করে নিলো…………
শুভ্রর বন্ধুগুলোর প্রত্যেকের চোখে মুখে একটা তৃপ্তির হাসি……
শুভ্র হেটে এসে থামল কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে…..গাছটা খুব সুন্দর করে বাধানো…. শুভ্র শিশিরকে সেখানেই বসালো…. শিশির তখনো মুখ লুকিয়ে রেখেছে….. শুভ্র মুখ টিপে সে কি হাসি…. শুভ্র সম্পুর্ণ বাকা হয়ে এসে শিশিরের কাধে একটা আলতো করে ধাক্কা দিলো……শিশিরের কোন নড়াচড়া নেই….. মেয়েটা খুব বেশিই লজ্জা পেয়ে গেছে…..শুভ্র এবার শিশিরের গা ঘেষে….. শিশিরের মাথায় আলতো করে নিজের মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল……..
-তুমি কেনো এই কাজটা করলে……!?……
-তুমিও তো ক্যান্টিনে চিৎকার করে সবার সামনে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করলে…….. তাই আমিও করলাম….
-তাই বলে এভাবে!!! সবাই কি ভাববে?!!!
-সবাই ভাববে “ওয়াও রাবনে বানা দি জড়ি”……
-ফাজলামি করবে না……!!!! ক্যাম্পাসের মেয়েগুলোর জন্য আমি কলিজা হাতে নিয়ে হাটি জানো…..যেভাবে তাকায়….বাপরে বাপ…..!!!
এইপর্যায়ে শিশির মুখ থেকে হাত নামালো…. শুভ্র দেখলো….শিশিরের নাকের ডগা লাল হয়ে আছে…. গালদুটোও অনেকটা লাল…..লজ্জা পেলে কি মেয়েদের আসোলেও এত সুন্দর লাগে!!! নাকি শুধু শিশিরকেই সুন্দর লাগে…..শুভ্রর হাত নিশিপিশি করতে লাগল শিশিরকে একটু ছুয়ে দিতে…… কিন্তু ইচ্ছাটা চেপে গেলো….. যদি শিশির রেগে যায়….
-এই মেয়ে খবরদার…. কারো সামনে কখনো লজ্জা পেতে পারবে না বলে দিলাম….কারো সামনে কখনো এই লজ্জামাখা মুখ দেখিয়েছো তো তোমার একদিন আর আমার আজীবন……. মনে থাকে যেনো……
-আহারেএএ…. আসছে!!! আর শুনো তুমি ছাড়া আমাকে লজ্জা দেওয়ার মত এমন কাজ কেউ কখনো করবেও না বুঝলা…….
-হুম…. তা অবশ্য ঠিক…. এসব কাজ করার অধিকারতো আর কারো নাই….
-কিন্তু তুমি কেনো ওই কাজটা করলা….. এমনেই ক্যাম্পাসে সবাই কেমন করে তাকায়…. এখনতো আমি ওদের কাছে পুরাই ফোকাস!!!!
-কি করবো….. তুমি তো কখনো নিজ থেকে কাছেই ঘেষতে দাও না…..ভালো ও বাসতে দাও না…. তাই আমি নিজ থেকেই তোমাকে একটু ভালোবাসলাম…….
শুভ্রর কথা আসলেই ঠিক….সম্পর্ক তিন বছরের কাছাকাছি ছিলো ওদের…….. কিন্তু এই সময়টায় শিশির কখনো শুভ্রকে কাছে ঘেষতে দেয় নি….. শুধুমাত্র ওই হাত ধরা পর্যন্তই….. এর বেশি শুভ্রও কখনো কিছু করে নি…… যেখানে অন্য সম্পর্কগুলোতে মাস দুয়েক গেলেই কত কি না জানি হয়ে যায়……..শুভ্রর দিকে তাকিয়েই এসব ভাবছিলো শিশির…… ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ্র একটু আমতা আমতা করতে লাগল……
-না… মানে আমি নালিশ করছি না শিশির…. এমনেই বললাম আর কি……
ঝট করে উঠে দাড়ালো শিশির…… ওকে দাড়াতে দেখে শুভ্রও দাঁড়িয়ে গেলো….. শিশির আশেপাশে তাকাচ্ছে…….
-শিশির…. তুমি কি রাগ করলে…. আমি সত্যি এমনেই বললাম….আমিতো……..
থেমে গেলো শুভ্র…….
শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে শিশির….. করবে না করবে না করেও চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরেই ফেলল…. দেখুক যার ইচ্ছা দেখুক…. আর কিছু আসে যায় না এখন…..শুভ্রকে জড়িয়ে ধরার আগে যতটা আনইজি লাগছিল… ওকে জড়িয়ে ধরার পর যেনো সব চুপ হয়ে গেলো…. মনের ভিতর একটা শান্তি শান্তি ভাব লাগতে লাগলো…… শিশির আরো গভীর ভাবে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরল…….
সেদিন যখন হাসপাতালে শিশিরকে জড়িয়ে ধরেছিলো… সেটা নিতান্তই ঘোরের বসে ধরেছিলো শুভ্র….. তখন অতসত অনুভূতি কাজ করে নি……. আর ওদের মধ্যেও তখন কিছুটা দুরত্ব ছিলো……. কিন্তু আজ বাতাস চলাচলের জায়গাটা পর্যন্ত নেই…..এতটুকুতে থেমে গেলেও শুভ্র বেচে যেত… এরপর শিশির যা করল………শুভ্রর যেন দম বন্ধ হবার জোগাড়
………!!!!
শিশির দুইপায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হালকা একটু উচু হয়ে শুভ্রর গলার কাছাকাছি গেলো….. এবং শুভ্রর খাড়া কন্ঠকটায় একটা আলতো করে চুমু খেয়েই সড়ে গেলো…… তিন কদম পিছিয়ে গিয়ে দাড়ালো শিশির…..”নাও দিলাম ভালোবেসে”
বুকের বা পাশের যন্ত্রটা যেনো উৎপাত শুরু করে করে দিয়েছে…..
আচ্ছা ভিতরের যন্ত্রটা বুঝি এবার বার্স্টই হয়ে গেলো….!!! শুভ্রর হাত পা অবশ হয়ে আসছে…..দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না বোধহয় আর…….. শিশিরের দিকে তাকালো…….
শিশির দুইহাত একসাথে মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে…..ওরনার এক পাশ গড়িয়ে পড়ে গেছে…..সামনের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে…. গভীর অনুভূতিতে শিশিরের নিচের ঠোঁট কাপছে…. থুতনি আর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম…… আচ্ছা….মেয়েটা বুঝি পুরোদমে পাগল করেই ছাড়বে আমায়!!!!………….
তানহা এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল…. পুকুরটা থেকে হালকা একটু দূরে….. কখন যে গাল বেয়ে পানি পড়তে শুরু করল নিজেই টের পেলো না…..
শুভ্রর সাথেই কথা বলতে সকালে ওর বাসায় গিয়েছিলো….. সেখানে যেয়ে শুনতে পেলো….শুভ্র বের হয়ে গেছে কতক্ষণ আগে….. তাই ক্যাম্পাসে এলো….. ও জানত শুভ্রকে এখন ক্যাম্পাসেই পাওয়া যাবে……. কিন্তু এখন মনে হচ্ছে…. না এলেই হত…… এতটা মরে যাওয়া পর্যায়ের কষ্ট পেতে হত না…….. তানহা উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটতে লাগলো…..জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো বোধহয় দেশে ফিরে আসাটা…..….বেশতো ছিলাম নিজের মত……!!!! কিন্তু এখনতো চাইলেও নিজের মত থাকা যাবে না…..!!!! সেই উপায় নেই…..
হঠাৎ করে কেউ একজন সামনে এসে দাড়ালো…. তানহা চোখ উঠিয়ে মহাবিরক্তি নিয়ে তাকালো মানুষটার দিকে….. ছেলেটা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে, বলল….
-ইয়ে মানে…. আপনার চোখের কাজল বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে………
তানহা ব্যাগের ভিতর থেকে একটা পকেট মিরর বের করে সামনে ধরতেই রীতিমত আতকে উঠল…. ও কাজল লাগায় নি….. কিন্তু লোয়ার লেসেস -এর মাসকারা চোখের পানিতে পুরো গালে লেপ্টে আছে…. ও তাড়াতাড়ি মুখ নিচু করে ব্যাগের ভিতর টিসু খুজতে লাগল…..কিন্তু ওইযে কথায় আছে না….তাড়াহুড়োর সময় প্রয়োজনের জিনিসটা বোধহয় ফুরুৎ করেই গায়েব হয়ে যায়…..
ছেলেটা তখন সামনে নিজের রুমালটা তুলে ধরল…..
-থ্যাংকস….. বাট নো থ্যাংকস….
-চিন্তা করবেন না…. আমি মেয়েধরা না… আপাতত রুমালটা নিয়ে নিন…. টিসু পেলে তখন রুমাল ফেলে দিয়েন…..
-……………
-আর তাছাড়া আমার মনে হয়…… টিসুর চেয়ে রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছাটা ইজি হবে…..
তানহার হাতে রুমালটা গুজে দিয়ে চলে গেলো ছেলেটা…… তানহার মনে হল ও ছেলেটাকে আগে কোথাও দেখেছে….. যখন ও প্রথম প্রথম শুভ্রর সাথে ক্যাম্পাসে এসেছিলো….তখন অনেক ছেলেই নিজ থেকে এসে পরিচিত হতে চাইতো…… কিন্তু তানহা কখনোই কাউকে পাত্তা দেয় নি….. আচ্ছা এই ছেলেটাও কি ওদের মধ্যে একজন…….
নাহ….!!!! মনে পড়েছে…. ছেলেটাকে শিশির নামের মেয়েটার সাথে দেখেছিলো তানহা….. কি যেন নাম….. হ্যা….!!! আবির…. আবিরই তো তাই না……!
পর্ব ২৭
-তুমি কি সত্যিই যেতে চাইছো….!?….
-হুম…. তোমার সাথে আজ পর্যন্ত কোথাও ভালোমত ঘুরতে যাই নি..….. আর আজ সুযোগও আছে….
-তাহলে কোথাও দূরে যাই চলো….. কক্সবাজার তো বাড়ির কাছে……
-ওরে বাপরে তাই নাকি!!!
-আরে সিরিয়াস!!! চলো সিলেট যাই…. হ্যা…. শিশির…… মজা হবে…..
-অসম্ভব….!!!! আমার হাতে সময় কম…. এই কম সময়ে তোমার সাথে দূরে কোথাও যাওয়ার সাহস আমার নেই….!!!
-আমাকে অবিশ্বাস করছো!?…..
-না….. আমি বাবা মা’র কথা বলছি…. তারা তিনদিনের জন্য গ্রামে গেলেও…. সময়ের আগে চলে আসতে পারেন…… তাই দূরে যাওয়াটা রিস্ক হয়ে যাবে….
-ওহ….. আচ্ছা…. তাহলে চলো যাওয়া যাই কক্সবাজারেই….আর কি করব!
-হুম কাল সকালে রওনা দিবো…..
-কাল সকালে কেনো!!! আজ এক্ষন এইমুহুর্তে যাবো আমরা…..
-এখন যাবে মানে!!! কোন প্রিপারেশন ছাড়া এভাবে হুট করে কি বললেই হলো নাকি!!!
-হুট করে ঘুরারই তো মজা বেশি…… আর প্রিপারেশন কি আবার!!!
-আজব আমি কাপড় চোপড় কিছু নেই নি…. একরাত থাকলেও তো কাপড় প্রয়োজন…..
-আরে ওটার টেনশন তুমি করো না…..আমিতো আছি…… তোমার হিরো…….
১০টার দিকে ক্যাম্পাসের জন্য বের হয়েছিল শিশির….. সেখান থেকেই কক্সবাজার ঘুরার প্লান করে ফেলল……. এবং যাওয়ার জন্য রওনাও দিয়ে দিলো……শুভ্রও যেনো কি মনে করে আজ গাড়ি এনেছে..…… আর শুভ্রর গাড়ি দেখেই মূলত শিশিরের দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা হল…..
পথের মাঝখানে শিশির এক লম্বা ঘুম দিলো…. কোন একটা ব্যাপার নিয়েই কথা বলছিলো ওরা…. কথার মাঝেই শিশির ঘুমিয়ে পানি…… যখন ঘুম ভাংলো তখন প্রায় বিকাল হয়ে এসেছে….. ও আড়মোড়া ভাঙতেই শুভ্র বলে উঠল,
-যেই ঘুম দিয়েছো….আজ রাতে তো না ঘুমালেও চলবে…..
-রাতের ঘুম রাতে আর দিনের ঘুম দিনে…. কোন সেক্রিফাইস নেই….
-তাই বলে এরকম হাতি ঘোড়া বেচে কেউ ঘুমায়!!!! একটা মানুষ যে এখানে একা একা শুধু ড্রাইভই করে গেলো…..
এবার শিশিরের একটু খারাপ লাগল….. আসোলেই তো এভাবে তেনা তেনা হয়ে কি ঘুম দিলো ও!!!! একটু মন খারাপ করে বলল,
-সরি আসলে কাল রাতে… মা বাবা’র সাথে সব গুছিয়ে দিতে গিয়ে ঘুমাতে পারি নি…..
-আরে আরে…. কেদে দিচ্ছো নাকি…. আমি তো মজা করলাম…..!!!
-আজকাল মনে হচ্ছে অনেক মজে আছো!!! কথায় কথায় খালি মজা করো…..
-হুম…. তুমি চলে এসেছো না…..
ওরা হোটেলে চেক ইন করে নিজেদের রুমে চলে গেলো,…… দুইটা রুম নিয়েছে শুভ্র…… এক রুম নিলে শিশিরের চেয়ে বেশি বোধহয় ও আনকমফোর্টেবল ফিল করত……
শিশির রুমে ঢুকার মিনিট ২/১ পরেই কেউ একজন দরজায় নক করল…..
-কি ব্যাপার…. তুমি!!! কিছু লাগবে!!
-না মানে শিশির….. এটা তোমার জন্য…
-কি এটা!!!
-খুলেই দেখো…. আর এটা পরেই বের হয়ো….
বলেই শুভ্র চলে গেল….. শিশির বোকার মত শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল…..ব্যাগ খুলতেই বের হয়ে এলো একটা শাড়ি…… এটা কখন নিলো!!! ঢাকা থেকে নেয় নি বুঝা যাচ্ছে…… ব্যাগের উপর শপিং মলের নামটাও অপরিচিত….. তাহলে কি এখানে আসার পথে নিলো……!!!!
শিশির শাড়িটা খুলে দেখলো…. হালকা অরেঞ্জ আর ধূসর কালালের শেডে জরজেট শাড়ি….. শাড়িটাতে হালকা কাজ…… শিশিরের খুব পছন্দ হলো…..
শুভ্র ১০মিনিট যাবৎ হোটেলের লবিতে বসে আছে……. চাইলেই ও শিশিরকে রুম থেকে নিয়ে আসতে পারতো….. কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শিশিরের রুমের সামনে গেলেই ওর খুব নার্ভাস লাগা শুরু হয়ে যায়,,,, মেয়েদের ক্ষেত্রে শুভ্র সবসময়ই সাবলীল…. এত মেয়েদের ক্রাশ ও…. চলতে ফিরতে এত মেয়ের সাথে কথা হয়…… কখনো কোন মেয়ের সামনে এতটা ভেবে চিন্তে কিছু বলে নি……. কিন্তু শিশিরের সামনে গেলেই ওর খুব নার্ভাস লাগে….. হাত পা কাপতে শুরু করে……
অবশেষে শিশির এলো….. শাড়িটা দারুন মানিয়েছে ওকে….. শুভ্রর চোখ যেন আটকে আছে…… শিশির কাছে এসে দাড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিগ্যেস করল,
-কি মিষ্টার কেমন লাগছে!!!
-মেজাজ খারাপ হচ্ছে শিশির..…. সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে আছে……মন চাইছে ওদের চোখগুলো গেলে দেই……!!!!
শিশির সমুদ্র কখনো কাছ থেকে দেখে নেই….পরিবারের সাথে কখনো এতটা দূর ঘুরতে আসা হয়নি….. ছোটবেলা থেকেই ওদের ঘুরার দন্ডি ছিল মামা বাসা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ……. স্কুলজীবনেও কখনো কোনপ্রকার ট্যুরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না…… সেই হিসেবে এত কাছ থেকে সমুদ্র দেখে শিশির দিশেহারা হয়ে গেল…. এদিক ওদিক ছুটতে লাগল……
ওকে সামলাতে শুভ্র হিমশিম খেয়ে গেল….. হাত ধরেও বেধে রাখা যাচ্ছে না…..উরাধুরা দৌড় শুরু করে দেয়…….
না পেরে শুভ্র শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলো…….ঘুরুক মেয়েটা নিজের মত….. শিশিরকে দেখেই বোঝ যাচ্ছে ও কতটা আনন্দিত হয়েছে……. শুভ্ররও খুব আনন্দ আনন্দ লাগছে…… ভালোবাসার মানুষটাকে খুশি দিতে পারলে আসলেই বুঝি এতটা রিলিফ ফিল হয় ভিতর থেকে……!!!
বেশকিছুক্ষণ ঝাপটা ঝাপটি করে উঠে এলো শিশির….. ভিজে শাড়ি লেপ্টে আছে শরীরের সাথে…..সন্ধ্যার কাছাকাছি হলেও…… মানুষজন ভালোই আছে বিচে….. এবং কিছু জোড়া চোখতো ঘুরে ঘুরেও তাকাচ্ছে…..
-শিশির চলো এখন যাই….
-এত তাড়াতাড়ি!!! মাত্রই তো এলাম….
-আবার পরে আসবো….. তোমার কাপড় ভিজে গেছে…. এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে..….
-আর কিছুক্ষণ থাকি….. প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ……. আরতো সহজে আসতে পারবো না…… কি সুন্দর লাগছে এইসময়টা। আর কিছুক্ষণ প্লিজ……
এত করুন চেহারা করেছে শিশির যে শুভ্র আর মানা করতে পারলো না……. কিন্তু এই সময় থাকাটা কি ঠিক হবে!!!!
পর্ব ২৮
শুভ্র আর শিশির বেশ কিছুক্ষণ ভেজা বালিতে হাটাহাটি করল…… শিশির এতক্ষণ অনেক দৌড় ঝাপ করলেও…. এখন হঠাৎ করেই চুপ করে গেছে……. নিজের ডানহাত দিয়ে শুভ্রর বা হাত জড়িয়ে ধরে মাথাটা শুভ্রর হাতে এলিয়ে দিয়ে হাটছে শিশির……
-কি ব্যাপার!!!!! ……. ফড়িং -এর মত এতক্ষণ ফুরুৎ ফুরুৎ করে হঠাৎ এরকম চুপ হয়ে গেলে যে…….!!!!
-না কিছু না… এমনেই
-আসলেই কি!!!
-………….শুভ্র একটা কথা জিগ্যেস করি!?…….
-কেনো করবে না….. হাজারবার করো….. কিন্তু উলটা পালটা কিছু জিগ্যেস করবে না….. যাতে আমার মুড নষ্ট হয়ে যায়……
-তুমি আমাকে কেনো ভালোবাসো!?……
-ভালোবাসা বাসির জন্য আবার কারনও লাগে নাকি!?…….
-না… মানে স্পেসিফিক কি ভালো লাগে আমার……
-তোমাকে পুরোটাই আমার ভালো লাগে…..
-মানে কি দেখে ভালোবেসেছিলে……!?
-তোমাকে দেখে…….
-উফফফ কেনো হেয়ালি করছো!!! ঠিকভাবে জবাব দেওয়া যায় না!!!! যত্তসব ঢং!!
বলেই শিশির এক ঝাড়া মেরে শুভ্রর হাত ছাড়িয়ে সামনে হেটে চলল….
-আরে শিশির!!! চলে যাচ্ছো…. শুনবে না…. কেনো তোমায় ভালোবাসি…..
-…………………
-আরে শিশির….…. শুনোতো……
শুভ্রর এই ডাকে শিশির কোন পাত্তাই দিলো না….. শুভ্র শিশিরের পিছনে হেটে যেতে যেতে গান ধরল,
“চুমকি চলেছে একা পথে….
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে….
হার মেনেছে……………..
……………………”
শুভ্র দৌড়ে গিয়ে শিশিরের হাত টেনে ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরালো……
-উফফফ….. কি সমস্যা…. এখন কেনো জ্বালাচ্ছো!?….
-কি করবো তুমি যে পালাচ্ছো!!!
-বাহ বাবা!!! তাহসানের ডায়ালগও এখন মারা হচ্ছে!!!
-হুমমমম….. একটু আকটু প্রেম শিখার ট্রাই করছি আর কি!!!!
-হুহহহহহহ!!!! আসছে প্রেমওয়ালা!!!
-শিশির পায়ে পায়ে হেটেছো কখনো!!!
-পায়ে পায়ে!!! হুম কতওওওওওও…. ছোট থাকতে বাবার পায়ে পায়ে হেটেই তো হাটা শিখেছি….
-এখন আমার পায়ে পায়ে হাটবে!!! পারবে না!!
-তোমার পায়ে পায়ে!!! মাথা খারাপ!!! তুমি আমাকে নিতে পারবে নাকি!!!
-তুমি আগে পায়ে উঠো…. পরে দেখো আমি পারি কি না!!!
-ধুররর!! ছাড়ো তো আমি এখন বড় হয়েছি না…..তুমি আমার ভার নিতে পারবে না……..
-ইসসসস….. পাতলা একটা কাঠি আর আমাকে বলে কিনা ভার নিতে পারবো না…..এই মেয়ে তুমি উঠোতো…… উঠো….
-পরে কিন্তু আমাকে দোষতে পারবা না…. বলে দিলাম………
শিশির শুভ্রর পায়ের পাতায় উঠে দাড়ালো…. শক্ত করে শুভ্রর শার্ট চেপে ধরল…..শুভ্র শিশিরকে জড়িয়ে ধরল… যেনো পড়ে না যায়….তারপর ওকে নিয়েই হেটে যেতে লাগল…..
-মনে আছে শিশির, আমি বলেছিলাম তোমাকে…….নবীনবরণে প্রথম দেখেই তোমাকে আমি ভালোবেসেছি….. তুমি জিগ্যেস করলে এত সহজে ভালোবাসা হয় কি না!!!…… হয় শিশির….. তোমাকে যখন আমি প্রথম দেখলাম…. আমার সময় যেনো তখন থমকে গেলো!!! ওইমুহুর্তটা আমার কাছে জীবনের পাওয়া সবচেয়ে মুল্যবান মুহুর্ত ছিল…..সেদিন রাতে যখন বাসায় গেলাম…. আমার দম বন্ধ হবার জোগাড়….. হাসফাস লাগতে লাগল…. নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হল…. শেষপর্যন্ত জ্বর এসে গেলো…..তোমাকে একমুহুর্ত দেখতে না পেলে…. পাগলের মত কাজ কারবার শুরু করতাম….. অসুস্থ হয়ে যেতাম..…..
কিছুক্ষণ থামল শুভ্র…….
-……… জানো কি শিশির….… আমার মনে হয় কাউকে ভালোবাসতে হলে বছরের পর বছরের প্রয়োজন নেই…. একটা মুহুর্তই যথেষ্ট……
-তাহলে আমি কেনো তোমায় একমুহুর্ত দেখেই ভালোবাসলাম না…..!!! কেনো!!!!
-সবার কাছেতো ভালোবাসার সংজ্ঞা এক না শিশির…. বলতে পারো….তোমার জন্য আমার ভালোবাসাটা বিশৃঙ্খলা টাইপের….. লাইক উথাল পাতাল….. কিন্তু আমার জন্য তোমার ভালোবাসাটা একদম গুছানো….. তুমি প্রায়ই আমাকে বলো…. আমাকে দেখলে তোমার মনে খুব শান্তি শান্তি লাগে….. যেখানে তোমাকে দেখলে আমার ভিতরে ড্রাম পিটানো শুরু হয়ে যায়….. সেখানে তোমার আমাকে দেখলে মন শান্তিময় হয়ে যায়……তাই তো আমাদের ভালোবাসার ধরনটাও ভিন্ন…..কিন্তু দিনশেষে কিন্তু সব একজায়গায়তেই থামে……..আমাদের ভালোবাসায়……
-শুভ্র…..
-হুম….
-সেদিন….. সেদিন যখন তোমার বাবা মা’র সামনে আমি এতো কিছু বলেছিলাম…… তুমি সব শুনেছিলে তাই না!!???…….
-হুম…..
-খুব রেগেছিলে তাই না!!????……
-না…. রেগে ছিলাম না…….
-রেগে ছিলে না!!!! তাহলে যে ব্রেকাপ করে ফেললে!?…..
-আমি কিন্তু কখনো বলি নি ব্রেকাপ…..!!
-তাহলে…….
-সময় দিয়েছিলাম তোমায়……..
সেদিন তুমি যখন বললে……. আমার সাথে থাকতে তোমার খুব কষ্ট হয়…. দম বন্ধ হয়ে মরে যেতে মন চায়…. নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়!!!!……… ওই কথাগুলো শোনার পর আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম…..কারন ঠিক ওই অনুভূতিগুলো আমিও ফিল করতাম….. কিন্তু তফাৎ…….. আমি তোমায় দেখতে না পেলে ওরকম ফিল করতাম…… আর তুমি আমার সাথে থাকলে…….ওই অনুভূতিগুলোর সাথে আমি খুব ভালোভাবে পরিচিত…..তাই ভাবলাম তোমায় সময় দেই….. সামলে নেবার জন্য….
-আমি খুব খারাপ একটা মানুষ তাই না শুভ্র!!!! তোমাকে অনেক বেশি ভুগিয়েছি…..!!
-হুম….. খারাপতো বটে…… তুমি একটা আস্ত বদ মেয়ে…….
………….. শিশিরের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে…… এই মেয়েটাই যে কখনো শুভ্রর জন্য কাদবে…….. শুভ্র সেটা কখনো স্বপ্নেও চিন্তা করেনি…….!!! একেই বুঝি বলে “সবুরে মেওয়া ফলে”
হেসে ফেলল শুভ্র….
-আরে আরে….. করছো কি শিশির….. নাকের পানি দিয়ে শার্টের তো একদম বেড়াছেড়া অবস্থা করে ফেলছো……!!!!
-………..……..
পা থেকে নেমে গেলো শিশির….. ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে….ভীষণ…… নিজেকে অমানুষ মনে হচ্ছে এখন…. সেদিন কি করে ও এত অনায়াসে ওই কঠিন কথাগুলো বলেছিল….!!!
শুভ্র দুইহাতে শিশিরের দুইগাল ধরে নিচু করে রাখা মুখটা উপরে উঠালো……
-ইসসসসস!!! নাক দিয়ে দেখি তোমার পদ্মা মেঘনা বইতে শুরু করেছে শিশির!!!!
-ছাড়োতো….. ফাজলামি করবে না……
কান্নার বেগ বেড়ে গেলো শিশিরের….. শুভ্র মুচকি হেসে শিশিরের নাকের ডগায় একটা চুমু খেলো….
-নাক বুচি আমার…..
তারপর শিশিরের কপালে খেলো আর একটা চুমু….. গভীর আবেগ আর ভালোবাসার এক চুমু….. জড়িয়ে ধরল শিশিরকে……. শিশির নাকের পানি চোখের পানি নিয়ে একাকার অবস্থায় মুখ গুজল শুভ্রর বুকে……
শুভ্র নিজের থুতনি শিশিরের মাথার তালুতে ঠেকালো,,,”এই আধ পাগলী…. … চড়ুই পাখির ছাও….. আমি জানতাম যত যেখানেই যাও….. আবার আমার কাছেই ফিরে আসবে…..ভালোবাসি যে তোমায়…. অনেক বেশি…..”
কক্সবাজার থেকে ফিরে শুভ্রর মন অনেকটা ফুড়ফুড়ে হয়ে গেলো…… শিশিরের সাথে একান্তে এতটা সময় আগে কাটায় নি……. শিশিরকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে…… শুভ্র সোজা বাসায় চলে এলো….. বাসায় ঢুকতেই দেখল…. তানহা বসা ড্রইংরুমে…… শুভ্রর মেজাজা খারাপ হয়ে গেল সাথে সাথে….. তানহা শুভ্রকে দেখে সুন্দর করে একটু হাসল…..
-কোথায় গিয়েছিলে শুভ্র!?…. জানো আমি সেই সকাল থেকে এখানে বসা……
-কেনো এসছো!?……
-শুভ্র তুমি জানোতো……. জানো না….. আমি যে তোমাকে চাই….. ভালোবাসি যে…..
-তানহা আমি এইব্যাপারে তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাইছি না……
-শুভ্র শোন না….. প্লিজ…. এভাবে ফিরিয়ে দিও আমায় প্লিজ…..
শুভ্রর হাত চেপে ধরল তানহা…… শুভ্র একটান মেরে নিজের ছাড়িয়ে নিলো….তানহার এরকম জোরাজুরিতে ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে প্রচুর…
-কি সমস্যা কি তানহা….!!!! তুমি জানো শুরু থেকেই আমি তোমাকে যাস্ট এজ এ ফ্রেন্ড হিসেবেই ট্রিট করেছি….. তাহলে এখন এমন জোর জবস্তি করার কি মানে!!!
-তুমিও তো জোর করেই শিশিরের সাথে সম্পর্ক করেছো….. তাহলে আমিতো কোন দোষ করছি না……..
এখন চুপ করে গেলো শুভ্র…..
পর্ব ২৯
শুভ্রকে চুপ থাকতে দেখে… তানহা বলেই চলল…
-তুমি কেনো বুঝতে চাইছো না আমাকে…..নিজের ভালোবাসার জন্য তুমি সব করতে পারো…. আমি কি করতে পারি না….!?….
-……………………..
-তোমার আর আমার ভালোবাসার মধ্যে এত তফাৎ কিভাবে হয় বলো!!?…
-………
-আমি তোমাকে চাই শুভ্র…… তোমাকে ভালোবাসি বলেই চাই।
শুভ্র খুব শান্ত ভাবেই তানহার প্রতিটা কথা শুনলো…. এবং খুব শান্ত স্বরেই জবাব দিলো…
-তানহা…. আমি কাকে কিভাবে ভালোবাসবো… সেটা নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে….
-আমিও তো ঘামাতে চাইছি না….. আমি যাস্ট এতটুকু বলতে চাইছি…. প্লিজ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না……
-আমি তোমাকে ইনসাল্ট করতে চাইছি না.. তানহা….. খুব ভালোভাবে বলছি…. তুমি এখন যাও…. তোমার সাথে আর একটা কথা বলার ইচ্ছাও আমার নেই।
-কেনো!! কেনো যাবো আমি….. ফর গড সেক শুভ্র কি আছে ওই মেয়ের মধ্যে!!!! যার জন্য তুমি আমার সাথে….. ইভেন তোমার প্যারেন্টস এর সাথে রুড বিহেভ করো….
শুভ্র ভ্রু কুচকে তাকায়….. তানহা আবার বলতে শুরু করে,
-হ্যা আমি জানি…. আংকেলের সাথে আমার কথা হয়েছে শুভ্র…… তুমি ওই মেয়ের জন্য কি কি করেছো…. সব কিছুর খবর এখন আমার আছে,…..
-তো….. আমি কি করতে পারি!!!!??? আমাকে কি তুমি ভয় দেখানোর চেষ্টা করছো নাকি!!! হাহ!! হাসালে… তানহা…
-আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চাইছি…. মেয়েটা তোমার যোগ্য না শুভ্র… সি ইজ নট ওরর্থি…. নাথিং বাট এ প্যাকেট অফ প্রবলেম…..
-থামো তানহা…. বেশি বলে ফেলেছো… খুব বেশিই বলে ফেলেছো…..ইউ সুড মাইন্ড ইউর অওন বিজনেস…..
-তাই তো করতে চাইছি….. এই শুভ্র শোন না…. তুমি প্লিজ আমার দিকে একটু তাকাও…. তুমি কি একটুও আমাকে ফিল করছো না…..
-এভাবে হয় না তানহা….. তুমি যাও এখান থেকে…
-প্লিজ প্লিজ প্লিজ শুভ ফিরিয়ে দিও না আমায়!!
তানহা শুভ্রর হাত চেপে ধরল….শুভ্র এবার খুব আস্তে করেই হাতটা সড়িয়ে নিলো….
-যাও তানহা….. আমি আর এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নই….
শুভ্র সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিল… পিছন থেকে তানহা বলে উঠল,
-আজ রাতে আমার ফ্লাইট শুভ্র…. আমি চলে যাচ্ছি আজ….কিন্তু খুব দ্রুতই আবার তোমার সাথে দেখা হবে…….
শুভ্র রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে দিলো…. তানহার জন্য ওর এখন একটু খারাপ লাগছে…. কারন শুভ্র জানে… জোর করে ভালোবাসা আদায় করাটা কতটা কষ্ট দেয়….. একটা মানুষ কতটা নিরুপায় আর অসহায় না হলে একজনকে জোর করে নিজের করতে চায়……. আর যেই মানুষটার সাথে জোর করছে ওই মানুষটাও কি আদোতে ভালো থাকে…… আজ তানহা ক্ষনিকের জন্য শুভ্রর সাথে এরকম ব্যবহার করেছে তাতেই শুভ্রর অসহ্য লাগছিল….. আর শুভ্রতো টানা দুই বছর….. না…. তার চেয়েও বেশি সময় যাবত এভাবে জোর করে বন্দি করে রেখেছে শিশিরকে…. শিশির তখন কতটা তিক্ত হয়ে গিয়েছিল!!!!
বেশ লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুভ্র বিছানায় বসা অবস্থা থাকতেই শুয়ে পড়ল…. এক হাত ভাজ করে দুই চোখের উপর রাখল…….. বিড়বিড় করে বলল “সরি শিশির”
শিশির বাসায় আসতেই মা ফোন করে জানালেন কাল সকালেই ওনারা ঢাকা চলে আসবেন…… শিশির আর ঘরের খোঁজ খবর নিলেন….শিশির বাসায় এসে এতোটাই ক্লান্ত ছিল যে সাথে সাথে বিছানায় যেয়ে উপুর হয়ে পড়ল……
শুভ্র বেশকিছুক্ষণ যাবৎ শিশিরকে ফোন দিয়েই যাচ্ছে…. কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না….শুভ্র বার বার ঘড়ি দেখছে… এখন বাজে সাতটা….. ৯টায় তানহার ফ্লাইট….. শুভ্র কি একবার যাবে….. আর যাইহোক মেয়েটার কোন দোষ ছিল না….
“লাভ ইস ব্লাইন্ড” যারা এই লাভের পাল্লায় পড়ে তারাতো সব অন্ধই হয়ে যায়!!! সঠিক বেঠিক কি তখন মাথায় থাকে!!! সাত পাচ ভাবতে ভাবতেই শুভ্র বাসা থেকে বের হলো..….।
শিশিরের ঘুম ভাঙলো ৭.২৮- এ…… উঠে সাথে সাথে ও গোসল করতে চলে গেলো…. গোসল থেকে এসে দেখে ফোনটা অনবরত বাজছে….
-কি করো শিশির!?….
-এইতো… ফ্রেশ হলাম… মাত্র… ঘুমিয়ে ছিলাম এতক্ষন তাই…..
-ওহহহ! একটা কাজ করো…চট করে তোমাদের বাসার ছাদে চলে যাও…..
-ছাদে যাবো কেনো!!! তুমি কি বাসার সামনে এসেছো!?…..
-আগে যাওতো রে বাবা…. তারপর কিচিরমিচির করো….
-তুমি কি সত্যি বাসার সামনে!?….. প্লিজ শুভ্র এখন তুমি যাও….. আমি কোথাও যেতে টেতে পারবো না…..
-আমি কিন্ত দাড়িয়ে থাকবো….
-থাকো দাড়িয়ে……
ফোন রেখে দিলো শিশির….. এই ছেলেটা এমন কেনো!!! যখন যা মন চায় তখন তা করলে কি চলে!! আজই মাত্র এলো ঘুরে টুরে!!! আজই আবার বাসার সামনে!!!…… যাবে না শিশির…. কিছুতেই না….. বাসার কেউ যদি দেখে ফেলে….. বাবা’র কানে এইখবর যদি যায় তাহলে আগুন লেগে যাবে……..
কিন্তু শুভ্রকে শিশির চিনে…. যতক্ষন না শিশির ছাদে যাবে…. ততক্ষণ শুভ্র নিচেই দাঁড়িয়ে থাকবে…. শিশির বসার রুমের জানালার ফাঁকে দিয়ে একটু নিচে উকি দিলো…. শুভ্রকে দেখা যাচ্ছে না…. কিন্তু ও জানে শুভ্র আশেপাশেই আছে……থাকুক…!!! তাতে শিশিরের কি!! শিশির যাবেই না……
উফফফ!! ধ্যাত কিসব যন্ত্রণা….. বলতেই বলতেই শিশির জুতা পড়ে ছাদের জন্য ঘর থেকে বের হল।
গেট ঠেলে ছাদে ঢুকতেই শিশির হাত পা জমে বরফ হয়ে গেলো….. পাশের সাততলা বিল্ডিং-এর পাঁচতলার ফ্ল্যাটের থেকে আলো এসে পড়ছে শিশিরদের ছাদে। সেই আলোয় শিশিড় স্পষ্ট দেখল… লম্বা একটা অবয়ব…. কালো কালার শার্ট পড়া,,,মাথায় কালো একটা ক্যাপ। ক্যাপটা এমন ভাবে পড়া যে মুখের অর্ধেক ঢেকে আছে…… ছাদে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অবয়বটা পিছন ফিরে একটা হাসি দিয়ে বলল,
-এতক্ষন লাগলো তোমার আসতে শিশির!!! ৩৭টা মশার কামড় খেয়েছি দাড়িয়ে থাকতে থাকতে!!
তানহার ফ্লাইট আর মিনিট খানিকের মধ্যেই টেক অফ করবে। তানহার উইন্ডো সিট…… জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে….. অনবরত চোখের পানি পড়ায় চোখ ব্যাথা করছে……
“শেষসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম শুভ্র…. তাও তুমি এলে নাতো!!! বেশ…..এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা…. আমিও চুপ থাকবো না” -বিড়বিড় করে এতটুক বলেই চোখ মুছল তানহা।
পর্ব ৩০
শিশির ক্যাম্পাসের স্ট্যাটিস্টিক্স ডিপো. এর সামনে ঘুরঘুর করছে। আজ ক্যাম্পাসে ঢুকার সময় আবিরকেও ক্যাম্পাসে আসতে দেখেছে ও…. আবিরের সাথে কথা বলা উচিত। আবির নাহয় ব্যস্ততার জন্য ওকে ফোন দিতে পারে না…. কিন্তু শিশিরেরতো উচিত ছিল মাঝেমাঝে একবার ফোন দিয়ে খোজ খবর নেওয়া। এতোটা স্বার্থবাদী কিভাবে হয়ে গেল ও….আবির ওর এতবড় একটা উপকার করল….দিন দিন নিজেকে এত অসহ্য লাগছে শিশিরের!!! হঠাৎ নিজের কাধে পিছন থেকে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে সাথে সাথে ঘুরে তাকালো শিশির……
-কি ব্যাপার!!! আজ কি ম্যডাম ভুল করে এই পথ ধরলেন নাকি!?………….
-নাহতো….. পুরোনো এক বন্ধুকে এই রাস্তায় হারিয়ে ফেলেছিলাম…..তারই খোজ নিতে এলাম….
-তা পেলেন নাকি বন্ধুকে?……
-হুম….. পেলামতো,,,,, কিন্তু শুধু পেলেই কি চলবে….. এক কাপ চা যদি খেতে পারতাম বন্ধুটার সাথে……!!!
শিশিরের এরকম করুন ভংগিতে আবদার করা দেখে আবির হেসে ফেলল,,,,,
-তাতো খাওয়াতেই পারি…..
আবির ডানহাতটা একটু সামনের দিকে বারিয়ে বলল”আফটার ইউ…”
শুভ্রর সারাদিন ঘরে বসে কাটাতে ভালো লাগে না…. মাস্টার্সের ফাইনাল শেষ… রেজাল্টের অপেক্ষা…..কিন্তু রেজাল্ট পেলেও কি…. ওর বাবার ব্যবসা দেখার কোন ইচ্ছাই ওর নেই…. চাকরি করাও ওর পছন্দ না…..কিন্তু এখন……. কিছু একটা করা উচিত…….. বন্ধুগুলাও সব শেষ ছুটি কাটিয়ে নিচ্ছে বলল…. মানে ওরাও যার যার ব্যবসার হাল ধরবে…… সকালে শিশিরকে ক্যম্পাসে দিয়েই বাসায় ফিরে এসেছিলো শুভ্র। ঘড়ির দিকে তাকালো….. ১.৩০ টা বাজতে চলল….. শুভ্র বাইকের চাবি নিয়েই বের হয়ে গেলো….
শিশির আর আবির সামনাসামনি বসে আছে…… শিশির চায়ের জন্য বলেতো ছিল…. কিন্তু এখন চরম পর্যায়ের অসস্তি হচ্ছে….. এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিন্তু আবিরের দিকে তাকাতে পারছে না……
-আমি বোধহয় আর আগের মত হ্যান্ডসাম নেই…. তাই না শিশির!?…..
-হুম!!… নাহ… নাতো…. কই… আছোতো হ্যান্ডসাম….আছো… এখনো…
-তাহলে তুমি এই ক্যান্টিনের চেয়ার টেবিল… দেয়াল… ইভেন চা দিয়ে যায় ওই লোকটাকেও ঘুরে ঘুরে দেখছো….অথচ আমার দিকে একবারও তাকাচ্ছো না…….!!!!
-না….মানে… এমনেই আরকি!
-আমি মনেহয় তোমার ফ্রেন্ড হওয়ারও যোগ্য না…. তাই না শিশির!?……
-……………….
-আমার কিন্তু তোমার উপর রাগ করার কথা….. খুব বেশি রাগ করার কথা……
-……………….. আমি অনেক স্বার্থপর হয়ে গেছি তাই না!!!
-হুম….. হয়েছো তো বটেই….
-সরি আবির!!!! আমি আসলে খুব বেশি গিল্টি ফিল করছিলাম… তোমার সাথে কথা বলতে!!
-…………….
-কিন্তু যতযাই হোক আমার এট লিস্ট তোমার সাথে যোগাযোগ রাখা উচিত ছিল…. নিজের মধ্যে এতোটা ব্যস্ত না হলেও পারতাম……. যখন প্রয়োজন হয় তখনই তোমাকে শুধু ফোন করি এটাকি ঠিক!?……
-উহু…. একদমই ঠিক না…..
-আওওফফফ…. আমি একটা আস্ত বদ মেয়ে…..
-হুম…. একদম ঠিক…..
-তুমি হাসছো কেনো!?……
আবির জোর করে নিজের হাসি চেপে রেখে বলল….
-কই নাহ তো!!!
-তুমি কি মজা নিচ্ছো!!?… আমি কিন্তু সিরিয়াস….
-আমিও সিরিয়াস….
বলেই আবির জোরে জোরে হাসতে লাগল….” শিশির মাঝে মাঝে চেহারা এমন করো না…. যে হাসি চলে আসে….”….. বেশকিছুক্ষন পর হাসি থামিয়ে আবির বলল
-আচ্ছা শিশির এসব কথা ছাড়ো….. তোমাদের ব্যাপারটা কি করবে!?…..
-কোন ব্যাপার!!
-তোমার আর শুভ্রর….. তোমার ফাইনাল হয়ে গেলেই কিন্তু আংকেল বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগবে….
-হুম….
-তার আগেই তোমার শুভ্রকে উনাদের সামনে হাজির করা উচিত…. আর আমাদেরতো মাস্টার্স শেষ হয়ে গেলো…. শুভ্র কি করবে!?…. ওর বাবার ব্যবসায় বসবে!?…..
-কিছু বলেনি তো এই ব্যাপারে!! বাসায় তোমার ব্যাপারটা কিভাবে সামলাবো তাই তো বুঝতে পারছি না……
-ওটার চিন্তা করো না…. ওটা আমি ক্লিয়ার করে রেখেছি……
-কিভাবে!! বাবা’র সাথে কথা হয়েছে তোমার!?…..
-হুম….. আংকেলের সাথে বলতে গেলে প্রতিদিনই কথা হয়…. কখনো আংকেল ফোন দেয়! কখনো আমি দেই…..!!
-কিহ!!
-হুম….. আংকেলের সাথে আমি অনেক আগেই সব কথা ক্লিয়ার করে রেখেছি……ভেবেছিলাম উনি হয়তো প্রচুর রাগ করবেন…. কিন্তু উনি তারপরও আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন….. তোমার বাবা’টা খুব ভালো…. বুঝলে শিশির……. এভাবে যে কাউকে সবাই ভালোবাসতে পারে না…. কিন্তু উনি তারপরও আমাকে ভালোবাসেন…..
শিশিরের এখন আরো বেশি খারাপ লাগছে…. আবির ওর ফ্যামিলির সাথে ঠিকই যোগাযোগ রেখে সবকিছু সামলে রেখেছে…. যেনো শিশিরের কম ঝামেলা পোহাতে হয়…. আর শিশির কিনা!!! এতোটা ভুলে যাওয়া একটা মানুষকে!!! কিভাবে পারলো ও!!!!
শুভ্র ক্যান্টিনে ঢুকে সোজা গিয়ে দাড়ালো শিশিরদের টেবিলের সামনে….
-তোমার ফোন কথায়!?…..
শুভ্রকে এভাবে হঠাৎ দেখে শিশির ভীষণ রকম ভয় পেয়ে গেলো…. সামনে আবির…. শুভ্র যদি এখন ক্ষেপে গিয়ে কোন কেলেংকারি করে বসে!!!
-আছে…ব্যাগে….
-যদি ফোন রিসিভই না করতে হয়…. তাহলে ফোন ব্যবহার করো কেনো!!! কবুতর ব্যবহার করলেই পারো!!
এই রে!!! ক্ষেপেছে,,, ভালো রকম ক্ষেপেছে!!! এখন উপায়!! হে আল্লাহ…. সহায় হও….
ভাবতে ভাবতেই শিশির একটা শুকনো ঢোক গিলল…….
-কেমন আছো শুভ্র!?……
-ভালো………
-বসো…. শুভ্র…. তোমাদের ব্যাপারেই কথা বলছিলাম…..
শুভ্র ঘুরে গিয়ে শিশিরের সাথের চেয়ারটায় বসলো….
-তা কি চিন্তা ভাবনা করলে!!! মাস্টার্স তো শেষ…. ক্যারিয়ারের কি প্লান…..
-আমাকে নিয়ে তোমার টেনশন করতে হবে না….
-অবশ্যই করতে হবে…. কারন এখন তোমার সাথে শিশির জড়িত…..
-তো!!!
-এত কাঠখড় পুড়িয়ে শিশিরকে তোমায় দিলাম….. হেলা ফেলা করার জন্যতো না…..শিশিরের জন্যই তোমাকে শিশির যোগ্য হতে হবে….. বুঝো তো নাকি!!!
-দিন দিন শিশিরের দায়িত্ব কি তুমি নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিচ্ছো নাকি!!
-বলতে পারো….. কাউ না কাউকে তো নিতেই হবে…..! কি বলো!?….
-ডোন্ট ট্রাই টু প্লে স্মার্ট…….
-ভালো করে বুঝে শুনে কাজ করো শুভ্র…… সুযোগ একবার পেয়েছো বলে যে বার বার সুযোগ পেয়ে যাবে!!! তা কিন্তু হবে না…..!!
-আর এসব কথা তোর বলতে হবে না…. নিজেরটা দেখ….. নিজের যোগ্যতা নিয়া ভাব….. আমি কিভাবে শিশিরকে খুশী রাখবো তা আমি জানি……. আমার জিনিসের দেখভাল আমি পারি….. তোর নজর দিতে হবে না……..
এবার আবির চোখমুখ শক্ত করে বলল
-শুভ্র…. যেটা সত্যিকার অর্থে তোমার…. সেটা তোমারই থাকবে…. কেউ নজর দিলো না দিলো…..তাতে কিছু যায় আসে না….. এতোটা ইনসিকিউর কেনো ফিল করো!!!!
-তু………
“থামো……….. দুইজনই এখন একটু থামো” বলেই দুজনের দিকে কড়া নজরে তাকালো শিশির…… “দেখা হলেই ঝগড়া করতে হবে নাকি!!! আশ্চর্য্য!!…. ”
” চলি শিশির… পরে একসময় কথা হবে” বলেই আবির চলে গেলো……
শিশির রেগেমেগে তাকালো শুভ্রর দিকে…
-ওকে দেখলেই তুমি সবসময় এমন চাড়ালের মত করো কেনো!!
-ও সবসময় তোমার পিছন পিছন ঘুরে কেনো!!
-প্লিজ শুভ্র সস্তা এক্সকিউজ ঝাড়বা না…… আবির আমাদের ভালোর জন্যই কথা বলছিল…. এতোটা রুড বিহেভ না করলেই পারতা…..তোমার ওকে যেয়ে সরি বলা উচিত….
-আমি অবাক হয়ে যাই শিশির….. সবসময় ওর আর আমার মাঝে তুমি আবিরকে সাপোর্ট করো!!! কেনো….!!!! এতোই যখন ওরে ভালো লাগে…. তাহলে আমি কেনো আছি!!! আমি না থাকলেই পারি!……
শিশির খুব শান্তভাবে শুভ্রর হাত ধরল…..
-শুভ্র ভুল করলে সরি বলাটা তো ভুলের কিছু না….. সরি বললে তুমি ছোট হয়ে যাচ্ছো নাতো….
পর্ব ৩১
শিশিরদের বাসার গলির সামনে এসে শুভ্রর বাইকটা থামলো….. হেলমেট খুলতে খুলতে শুভ্র বলল,
-আর কতবার!?…. একজেক্টলি….আর কতবার আমাকে আবিরের কাছে সরি বলতে হবে বলতো…..
শিশিরের হেলমেটে পেচিয়ে যাওয়া নিজের চুল ছাড়াতে ব্যস্ত অবস্থায়ই জবাব দিলো….
-ঠিক যতবার তুমি ভুল করবে…..
শুভ্র এই জবাবে ভ্রু কুচকে তাকালো শিশিরের দিকে…. তারপর হাত দিয়ে শিশিরের পেচিয়ে যাওয়া চুল খুলে দিলো……শিশির হুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-শুভ্র ভুল করাটা খুব অন্যায়…. কিন্তু তুমি যদি তোমার ভুল বুঝতে পারো…. সরি বলো…. তাহলে অন্যায় সরিতে কাটাকাটি হয়ে যায় ব্যস…..!!!… তাহলে সরি বলতে কেনো এত বাজে তোমার…..!?
-না…… মানে আসোলে এমনেই…… আচ্ছা যাও…. তুমি বাসায় যাও…..
শিশিরকে দিয়ে শুভ্র সোজা নিজের বাসায় চলে এলো…..ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো…. ঠান্ডা মাথায় কিছু প্লানিং করা প্রয়োজন….. শুভ্র চোখ বন্ধ করে দাড়ালো…. আবিরের বলা কথাগুলো তিতা লাগলেও সত্য…. ওকে অবশ্যই যোগ্য হতে হবে…… আর তাছাড়াও…… ও অনেক বেশি ঝামেলা ছড়িয়ে ফেলেছে…… শিশিরের ফ্যামিলির সাথে ওর অলরেডি একটা নেগেটিভ সম্পর্ক তৈরি হয়ে আছে….. আগে সেটাকে ঠিক করা প্রয়োজন….. হুম… অবশ্যই প্রয়োজন…. শিশিরকে নিজের করে নিতে হলে ওর আশেপাশের সবকিছুকেই নিজের করে নিতে হবে….. শুভ্র আরো কিছুক্ষণ এভাবে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থেকে… ভিতরে চলে গেলো….
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করল শিশির…. এরপর শুভ্রকে ফোন দিলো….
-কি খাওয়া দাওয়া হলো?…
-হুম… মাত্রই শেষ করে ফোন দিলাম তোমাকে……..তুমি খেয়েছো?…
-হুম!!! এইতো খাবো…. তোমার সাথে কথা বলা শেষ করেই যাবো…….
-তোমার এই বদঅভ্যাসটা ছাড়োতো….. এত লেট করে কেউ ডিনার করে নাকি!…….
-হ্যা করেতো…এই যে আমি…..
-ধুর….. ঢং একটা……
-আর তুমি একটা ঢংগী….. আমাদের ঢং ঢংগীর ভালোবাসা…..
-যাও তো খেতে যাও…..
-হুম যাবোতো রে বাপ….. একটু কথা বলি…. পরে তো আর কথাই বলবা না….. খালি ভোসভোস করে ঘুমাবা…
-এই আমার ঘুমের ব্যাপারে কিছু বলে একদম ঘাড় মটকে দিবো বললাম….. তুমি নকটার্নাল প্রানী…. আমি না হলেও চলবে…..
-হাহাহা…. আচ্ছা মানলাম…. তোমার সাথে কথাই বলা যায় না…. সবসময় তর্ক….. আমি যে তোমার বড় তা কি মনে আছে…. বেয়াদপ মেয়ে…..
-ওরেরেরে আসছে…. এত যখন বড় তাহলে আমার মত ছোট মেয়ের সাথে প্রেম করলা কেন….
-এইযে আবার আবার আবার…. তর্ক…. উফফফ….
-আচ্ছা সরি,,,,, আর করবো না….
-হুম গুড গার্ল…… আচ্ছা শিশির…. আমি…. আসলে আমি একদিন তোমার বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম….
-এই না না….. তুমি ভুলে গেসো বাবা আর ফুপু তোমার উপর কি ক্ষেপা….
-হ্যা… মানে ওইজন্যই আর কি…. আমি ওনাদের সাথে কথা বলতে চাই…..
-কি!??…. কি বললা…. তুমি কি আসলেই কথা বলতে চাইছো!…
-আমি ভুল তো করেছিলাম….. সেজন্য তো অবশ্যই কথা বলা প্রয়োজন তাই না…..
-রিয়েলি!!???….. আল্লাহ…. সত্যি!!! থ্যাংক ইউ… থ্যাংক ইউ সো মাচ শুভ্র….. তুমি জানো আমি খুব টেনশনে ছিলাম,,,, কিভাবে তোমাকে বাবার সামনে হাজির করবো….. বাট এখন…. তুমি আমাকে পুরাই টেনশন মুক্ত করে দিলা…..
-আমিও এখন সব ঠিকাঠাক করতে চাই………. তো আমি কালকে আসি!?….
-না না কালকে না….. দুইমাস পর ফুপু আসবে আবার….. তুমি একবারে তখনই আইসো…. কেমন!?….
-হুম…. ওকে……
কথাবার্তা শেষ করে ফোন রাখার পর শিশিরের মনে হল ওর বুকের উপর থেকে একটা ভারি পাথর নেমে গেছে….. বাবা আর ফুপু শক্তের শক্ত হলেও আবার খুবই নরম….. শুভ্র যদি একবার এসে সিনসিয়ারলি মাফ চায় তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে….. আহ!!! এবার বুঝি সব আসোলেই ঠিক হয়ে গেলো……
দুই সপ্তাহ পর……
শিশির তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠল…. আজ কোনভাবেই ক্যম্পাসে লেট করে যাওয়া যাবে না… শিশির আগে ভাগেই শুভ্রকে বলে দিয়েছে…আজ যেনো ওকে পিক করতে না আসে…. তাহলে যে সারপ্রাইজটা আর হবে না….. শিশির খুবই উত্তেজিত ফিল করছে…. আজ শুভ্রর জন্মদিন…. শিশির এই প্রথম শুভ্রর জন্মদিন নিয়ে এতোটা প্লান প্রোগ্রাম করল…. ভালোয় ভালোয় সারপ্রাইজটা দিতে পারলেই হয়….শিশির খুব হালকা কিন্তু সুন্দর করে সাজলো…. গুছিয়ে শাড়ি পরলো নিজে নিজে……… সময়মত বাসা থেকে বের হয়ে গেলো…. বের হওয়ার সময় মা একটু আড় চোখে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না…..
শিশির ক্যাম্পাসে যেয়ে শুভ্রকে ফোন দিলো…..বলল কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে থাকতে…… শিশির পৌছানোর আগেই শুভ্র পৌছে গেলো…..
শিশির শুভ্রর পিছন থেকে গিয়ে “ভাউ” করে উঠল….. শুভ্র পিছনে ফিরে হালকা হাসি দিলো….. চোখে মুগ্ধতার ছাপ স্পষ্ট……
শুভ্রকে নিয়ে শিশির একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল…..রেস্টুরেন্টে শুভ্রর বন্ধুরা আগে থেকে উপস্থিত….. ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট কিন্তু খুব ওয়ার্ম ডেকোরেশান….. খুব হৈ হৈ করে শুভ্রর জন্মদিন পালন করা হল….শিশির বেশকয়েকবার শুভ্রর দিকে আড়চোখে তাকালো…. শুভ্র হাসছে, আড্ডা দিচ্ছে…. বেশ স্বাভাবিক…. কিন্তু তাও কিছু একটা বাজলো শিশিরের চোখে…..
ক্লান্ত দুপুরের দিক…..….
শুভ্র আর শিশির হাতে হাত ধরে ফুটপাত ধরে হাটছে….. গন্তব্যহীন হাটা……
-শিশির…..
-হুম……
-কিছু বলার ছিলো…..
-আমি জানি……. তুমি কিছু বলতে চাইছো…… কিন্তু এতক্ষণ পর……!!
-আসোলে….. শিশির….. কাল রাতে সিডনি থেকে ফোন এসেছিলো….
-সিডনি!?….
-হুম….. বাবা আর মা আছে সেখানে….. কি একটা নিউ বিজনেসের জন্য বেশ কয়েকমাস যাবৎ…….
-ওহ….. পরে কি বলল…..
-জানালো….. ব্যবসা নিয়ে কি ঝামেলা হচ্ছে….. বাবা’র শরীরটাও ভালো না…… হসপিটালাইজড….
-আল্লাহ…. তাহলে এখন!?….
-আমি সিডনি যাচ্ছি………… শিশির…..
শিশির পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইল শুভ্রর দিকে…….. তারপর মুখটা নিচু করে বলল
-আগে বলো নি কেনো!?……
-আগে বললে যে তোমার এই কষ্ট মাখা চেহারাটা বেশিক্ষণ দেখতে হত……
-কবে যাচ্ছো?….
-আজ রাতে ফ্লাইট….
শিশির ঝট করে উপরে তাকালো….. চোখ দুটো ছলছল করছে….
-এই বদ মেয়ে…. খবরদার কাদবে না….. কাদলে কিন্তু এক চড় লাগিয়ে দিবো……
শিশিরের গাল বেয়ে ততক্ষণে পানি পড়তে শুরু করেছে……
-শিশির….. প্লিজ…..
শুভ্রর নিজের ভিতরটাও যেনো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে…… যেখানে শিশিরকে ছাড়া একদিনও চলে না….. সেখানে এতদিন…….
-কয়দিনের জন্য যাবে!?…..
-বেশিদিন না শিশির সত্যি….. একদম সত্যি…… ঝামেলা মিটিয়েই চলে আসবো…….
শিশির চোখের পানি যেনো থামতেই চাইছে না…..
শুভ্র জড়িয়ে ধরল শিশিরকে…… দুপুরদিকে এমনেই রাস্তায় মানুষজন কম থাকে… আর ওরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে সেখানে মানুষই নেই…… শুভ্র বেশকিছুক্ষন শিশিরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল…….।
বাসায় গিয়েই শিশির নিজের রুমের দরজায় খিল দিল…….শুভ্রকে বলেতো এসেছে ও থাকতে পারবে!! কিন্ত আদৌ কি পারবে!!!…. হাউমাউ করে কাদতে মন চাইছে….. কিন্তু তা সম্ভব না….. বাহিরে আওয়াজ গেলেই সমস্যা……. বিকাল পর্যন্ত টানা চোখের পানি ফেলার জন্য চোখ ব্যাথা করতে লাগল….. শিশির কোনরকমে উঠে ফ্রেশ হয়ে চোখেমুখে পানি দিয়েই বিছানায় পড়ল….. মা বেশকয়েকবার ডাকাডাকি করলেও শিশির দরজা খুলল না,……..পাছে সবাই টেনশন না করে তাই হালকা করে বলে দিলো “শরীর ভালো না”
ফোন বাজছে….. শুভ্র ফোন করেছে…. নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে…. শিশিরের কান্নার দমক বেড়ে গেলো….ফোন রিসিভ করল না…..শুভ্র ছোট করে একটা মেসেজ দিলো “আমি যাবো না শিশিড়……. তুমি প্লিজ এভাবে কেদো না”
শিশির কাপা কাপা হাতে ফোন নিয়ে রিপ্লাই দিলো…..”আমি এখন কথা বলতে পারবো না শুভ্র….. প্লিজ জোর করো না…… আর আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি প্লিজ যাও….. তুমি না গেলে আমি জীবনেও তোমার সামনে আসবো না….”
মেসেজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শুভ্র….. মেয়েটা না জানি কি পরিমান কাদছে….. শুভ্রর ইচ্ছা করছে এক দৌড় দিয়ে এক্ষুণি শিশিরের কাছে চলে যাক…. কিন্তু পারবে না…. সিডনি থেকে জরুরি তলব এসেছে… ওকে নাকি যেতেই হবে….. এয়ারপোর্টের ভিতরে পা বাড়াতেই শুভ্রর ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগল…. শুভ্র আরেকবার শিশিরের নাম্বার ডায়াল করল… রিসিভ হলো না…….
দীর্ঘ তেরো ঘন্টার ফ্লাইট শেষ করে শুভ্র যখন সিডনির কিংসফোর্ড স্মিথ এয়ারপোর্টে পা রাখল….. তখনও ওরা দুজনের কেউই জানতো ভবিষ্যত আসোলেই কতটা ভভয়াবহ হতে পারে!!!
পর্ব ৩২
শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে শিশির…. কিন্তু কোনমতেই চোখে ঘুম আনতে পারছে না ….শিশির মনে মনে গান আওড়াতে লাগল “ঘুম পাড়ানি মাসী পিসি মোদের বাড়ি এসো……………………………………………………”
শিশিরের চোখ জ্বালা করতে শুরু করছে…. মাথাও টনটন করছে… মুখ তিতা হয়ে আসছে…. জ্বরটা আবার আসতে শুরু করেছে….. গত ৫দিন ধরে শিশির জ্বরে নেতিয়ে আছে…. গতকাল থেকে আবার নতুন নিয়মে জ্বর আসতে শুরু করেছে…. সারাদিন ভালো থাকে,,, রাত হলেই জ্বর শুরু হয়ে যায়….. তাও যেমন তেমন না আকাশ পাতাল জ্বর…
শিশির জ্বলন্ত চোখই বন্ধ করল…. গড়গড় করে চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো….. শুভ্রর কথা মনে পড়ছে….. আজ ২ মাস ২১ দিন হচ্ছে… শুভ্র যাওয়ার….. যাওয়ার পর প্রথম ১৩ দিন শুভ্রর সাথে প্রতিদিন কথা হত…. বলতে গেলে ঘন্টায় ঘন্টায় ওর ফোন আসতো…. কিন্তু এরপর হঠাৎই একদিন চুপ…….. চুপ মানে পুরাই চুপ….. একদিন,,,দুইদিন,,,তিনদিন,,,,,এবং দিনের পর দিন…. শুভ্রর কোন ফোন, মেসেজ কিছুই নেই!!! শিশিরের মনে ঝেকে বসে একরাশ ভয় আর বিস্ময়!!!! এমনতো হওয়ার কথা না…. কোন বিপদ হলো কিনা……!!! শিশির শুভ্রর প্রত্যেক বন্ধুর কাছে খোজ করল….. তারাও কোনভাবে শুভ্রর সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না……শিশির নিজেও বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো….. অনেক অনেক গুতাগুতি করেও শুভ্রর ছায়াও কেউ খুজে বের করতে পারলো না…….
ব্যস!!!! সেই থেকে এই পর্যন্ত শুভ্রহীনা শিশির…..!!!
ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে শিশিরের বুক ভারি হয়ে উঠল…. বালিশের ভিতর মুখ গুজে শিশির ফুপিয়ে উঠল….. গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আটকে আছে…. যেনো কাদতেও কষ্ট……….!!!!
সারারাতের জ্বরে সারাটা দিন শিশির মরার মত পড়ে থাকে….. সারারাতের জ্বর যেনো ওর শরীরের সব শক্তি নিয়ে যায়…!! খাওয়ার রুচিও নেই….. সকাল দিকে মা এসে বেশ কিছুক্ষণ খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করল….. অল্প একটু মুখে দিয়েই শিশির ঘর ভাসিয়ে বমি করে দিলো….. গলা দিয়ে কিছু নামার আগেই বমি হয়ে যায়…..!!!! কি যন্ত্রণা!!!
দুপুর দিকে শিশিরের ফুপু এলো ওর রুমে….
-কিরে মা…. এখন কেমন লাগছে তোর!?…..
-চোখ জ্বলে খালি…. ফুপু….
কাকলি বেগম একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে শিশির চোখ আর কপালের উপর রাখলেন…..
-কিছু খাবি..?….. অপ্ল কয়েটা ভাত আনি!!…
-রুচি করে না,,,,ফুপু…..
-একটু ঝাল ঝাল করে আনি!!???….ভালো লাগবে…..
-না…. এনো না প্লিজ…বমি করতে করতে গলা ব্যাথা হয়ে গেছে……
কাকলি বেগম বেশকিছুক্ষণ ভাইঝির মাথার কাছে বসে রইলেন….. মেয়েটার এই অবস্থা দেখে উনার নিজের কষ্ট লাগছে….. উনি ভেবে রেখেছিলেন এবার দেশে এসেই শিশিরের বিয়েটা দিয়ে যাবেন……. ভাইয়ের পছন্দ করা ছেলেটার সাথেই উনি শিশিরের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন……..হঠাৎ বিয়ে থেকে বেকে বসায় প্রথম প্রথম উনি ছেলেটার উপর খুব চটে ছিলেন……কিন্তু শিশির অসুস্থ হওয়ার পর ছেলেটা বেশকয়েকবার বাসায় এসেছে…….তখনই তিনি ছেলেটার সাথে কথা বলে পুরোপুরি মত বদলে ফেললেন……. এরমত আর ছেলেই হয় না…… যেমন সুন্দর তেমনই নম্র ভদ্র!!…….কিন্তু মেয়ের অবস্থা দেখে উনি বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে কি করবেন!!! ডাক্তার বলেছেন সিজন চেঞ্জের জন্য এমন জ্বর হয়েছে….. কিন্তু তাই বলে এতোটা….. মেয়েটা শুকিয়ে বিছানার সাথে লেগে আছে একদম….!!!
শিশির গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছে….. মানে ঘুমিয়ে গেছে বুঝে কাকলী বেগম উঠে গেলেন রুম থেকে…..
বিকাল দিকে সায়রা আর শান্ত এলো…. ক্লাসের নোটস নিয়ে…..বাকিরাও আসতো…. কিন্তু হুট করেই সবার একসাথে আসাটা কি ঠিক হবে কি না ভেবেই বাকিরা বলল “আজ তোরা যা,,,,আমরা নাহয় আরেক দিন যাবো”
ওদের দেখে শিশির খুব খুশি হলো….. কথা বার্তা বলল…. এমনকি ওদের সাথে কিছু হালকা খাবারও মুখে দিলো….. যাবার সময় শান্ত বলে গেলো….
-দ্রুত খেয়ে দেয়ে আবার পোক্তা হয়ে উঠ….. ক্লাসগুলো মিস গেলে পরীক্ষায় খুব প্যারায় পড়বি…… আর তাছাড়াও….. তোরে খুব মিস করছিরে বন্ধু…. সো দ্রুত দ্রুত যেনো তোকে ক্যাম্পাসে দেখি……
কথাটা শুনে আসোলেও শিশিরের মনে হল…. এখন জোর করে হলেও ঠিক হতে হবে…. যেকোন সময় মিডটার্মের ডেট দিয়ে দিবে…. ক্লাস না করলে পরীক্ষায় পাস করা তখন মুসকিল হয়ে যাবে……………..
এরপর শিশির অনেকটা জোর করেই খাওয়া দাওয়ায় মনোযোগ দিলো….. এভাবে আর কতদিন!!!!! আবিরের সাথেও শিশিরের প্রতিনিয়ত কথা হয়…. আবিরের মা’ও শিশিরের খোজ খবর নেন প্রায়ই….. উনাদেরও একই কথা জোর করে হলেও খাওয়া উচিত… অন্তত শরীরে কিছুটা বল পাবে…..চলাফেরা করার মত……সাজেদ, মাহিদ, রবিন, অনিক ওরাতো কতক্ষণ পর পর ফোন দিয়ে খোজ নেয়…..সবাই আছে আশেপাশে…. সবাই…… কিন্তু শুভ্র নেই!!!! আচ্ছা….. শিশিরকে এখন এত অসুস্থ দেখে শুভ্র নিশ্চয়ই চিন্তায় পাগল পাগল হয়ে যেত….. সম্পর্কের প্রথম প্রথম যখন শিশিরের হালকা ঠান্ডাও লাগতো তখন শুভ্র সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ওর সেবায় লাগত….. যতক্ষণ একসাথে থাকতো ঠিক ততক্ষণ শুভ্র পাগল করে ফেলতো…. তখন শুভ্রর ওই কান্ডগুলো ওর কাছে মহাবিরক্তিকর যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই মনে হত না….
আর এখন…….!!!!!
শিশির পণ করে নিজেকে ঠিক করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো……এবং আজ ৬দিন হতে চলল….. শিশির এখন অনেকটা সুস্থ থাকলেও জার্নি করতে পারে না…. তাই ক্যাম্পাসে যায় না কিন্তু ওর ফ্রেন্ডরাই এসে নোটস আর পড়া দেখিয়ে দিয়ে যায়……..সেখান থেকেই কিছু নোটস নিয়ে বসেছিলো শিশির…… মাথায় একটা ভোতা যন্ত্রণা থাকলেও শিশির জোর করেই পড়তে চেষ্টা করছে….. তখনই ফোনটা বেজে উঠল……নাম্বারটা দেখে শিশিরের ভ্রু কুচকে গেলো….. কাল রাত থেকে এই নাম্বারটা ডিস্টার্ব করে যাচ্ছে…. বাহিরের নাম্বার হলেও বুঝত হয়ত শুভ্র ফোন করেছে…. কিন্তু নাম্বারটা বাংলাদেশের। শিশির চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ নিয়ে ফোন রিসিভ করল…..
-এই কে আপনি!?…. সমস্যা কি আপনার!!??….. কথা না বললে ফোন করে কেনো জ্বালাচ্ছেন!!!???……. এতো টাকা পয়সা বাড়লে ছাদে যেয়ে উড়ান…… মানুষকে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করেন কেনো!?…..
-………….
-ধুর….আস্ত ফাজিল……
শিশির ফোন রাখতে যাবে তখনই ওপর পাশ থেকে কারো আওয়াজ পেলো……
-শিশির…….
শিশিরের শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা যেনো কেপে উঠল মানুষটার কন্ঠ শুনে…….
-শিশির…………….. আমি………..
-শুভ্র!!!
-হুম…..
শিশিরের ভিতরের পুষে রাখা এতোদিনের ভয়টা রাগে পরিণত হয়ে গেলো…… এতোদিন!!! এতোদিন পর মনে পড়ল শিশিরের কথা……!!!!
-ওহ…. বেচে আছো…. তাহলে!!
-………..,,,,,,,,,………………
-কেনো ফোন করেছো!?…….
-খুব রেগে আছো তাই না!!??…..
-নাহতো!!!! আমি কেনো রেগে থাকবো…. তাও তোমার উপর!!!! সেই অধিকারতো আমার নেই…..
-শিশির…. প্লিজ…..
-কেনো ফোন করেছো সেটা বলো……
-দেখা করতে চাই শিশির……
-কেনো!!! আমার সাথে কেনো দেখা করতে চাইছো!!??…..
-একবার শিশির!!! শুধুমাত্র একবারের জন্য দেখা করো…..
এবার শিশির মনে মনে হেসে ফেলল..রাগ ভাঙ্গানোর পায়তারা…. তাই না বাচ্চু…. লাভ নেই… এই রাগ এতো সহজে ভাঙবে না…. গলা গম্ভীর রেখেই শিশির আবার বলল,
-আমার সময় নেই…..
-ক্যাম্পাসেই দেখা করবো শিশির….. তোমাকে বাহিরে কোথাও আসতে হবে না…..
-আচ্ছা দেখি…..
-কাল?…. কাল দেখা করি শিশির?
-কয়টায়?
-১০টার দিকে….
-আচ্ছা দেখি…. ক্যাম্পাসে গিয়ে জানাবো….
-রাখি তাহলে শিশির……
কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলো শিশির…. মুখে যাই বলুক মনে মনে এতদিন পর শুভ্রকে দেখার খুশি যেনো ধরে রাখতে পারছে না…… এই খুশিতেই যেনো শিশির পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলো…..।
পরদিন খুব সকাল সকাল শিশির ঘুম থেকে উঠল….. আজ খুব ঝড়ঝড়ে লাগছে নিজেকে… শিশির তাড়াতাড়ি রেডি হতে শুরু করল…..আশ্চর্য্য!!! সময় যেনো চলছেই না…..রেডি হয়ে বেশকিছুক্ষণ বসে থেকে শিশির ধীরেসুস্থে নাস্তা করল…. তারপর ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হল…. মা আর ফুপু যদিও খুবই গাইগুই করছিল…. কিন্তু শিশির তো আজ যাবেই যাবে ক্যাম্পাসে!!! বাসা থেকে নিচে নামতেই দেখল কুয়াশা কাটেনি এখনো….. উরনা দিয়ে খুব ভালোভাবে মাথাটা পেচিয়ে শিশির রওনা দিলো….. আজ কেনো যেনো ওর খুব খুশি খুশি লাগছে…..!!!
পর্ব ৩৩
শিশির দ্রুত পা চালাচ্ছে…. ক্যাম্পাসে পৌছাতে পৌছাতে ১০.১৩ বেজে গেছে….. শিশির হাত ঘড়ির দিকে তাকালো…. আরো দ্রুত হাটতে লাগলো…….. কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছাকাছি আসতেই শিশিরের হাত পা কাপা শুরু করলো…..সেই পুরানো অনুভূতি!!!! শুভ্র দাড়িয়ে আছে গাছটার নিচে…….
দূর থেকে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল শিশির….. যত সামনের দিকে এগুচ্ছে…. তত বেশি অবাক হচ্ছে….. এই অবস্থা কেনো মানুষটার!!!!
শুভ্রর উসকো খুসকো চুল…. চেহারা ভেঙে গেছে…. আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে….গালে মুখে খোচা খোচা দাড়ি…!!!!
শিশির পাশে গিয়ে শুভ্রর কাধে হাত রাখল…. শুভ্র ওর দিকে তাকিয়েই একটা হাসি দিলো….সেই হাসিতে খুশির চেয়ে বেশি অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট!!! শিশির পলকহীন ভাবে দেখছে,,,,,,তার অতি আপন ভালোবাসার মানুষটার এই বেহাল দশা………. শুভ্রকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কি পরিমান ঝড় ঝাপটার মধ্য দিয়ে ও গেছে….. মুহূর্তেই শিশিরের রাগ অভিমান সব হাওয়ায় ভেনিস হয়ে গেলো……দিনশেষে মানুষটা যে ওর কাছে ফিরে এসেছে এইতো বেশি!!!!
ওরা বসল গাছটার বাধানো জায়গাটায়……
ওদের দৃষ্টি স্থির একে অপরের উপর…….
শিশিরের চোখ ছলছল করছে….অনেক চেষ্টা করছে কান্না না করতে…. কিন্তু তাতে যেনো কান্নাটা আরো উপচে বের হয়ে আসছে…….
শুভ্রর বুকের ভিতরে সেই ড্রাম বেজেই চলছে…. এতোদিন পর আবার এই অনূভূতিতে শুভ্রর মনে হলো “আহ!!! এবার বুঝি আমি বাচতে পারবো….. এই মুখটাই যে আমার বেচে থাকার উপায়…..”
শিশির এক হাতে শুভ্রর গালে স্পর্শ করে বলল
-একি হাল করেছো নিজের!?……
-…………………
-বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছো….. তোমার তো আরো সুন্দর হয়ে যাওয়ার কথা……
-……………………..
-নিজের হ্যান্ডসাম চেহারার এতো অবহেলা!!?……
-……………………
-শুকিয়েও গেছো অনেক!! কেনো!?…….
-…………………………..
-কথা বলছো না কেনো!
-আগে….. তোমাকে মন ভরে কতক্ষণ দেখতে দাও……..নাহলে যে নিঃশ্বাস নিতে পারবো না!!!
-ফালতু কথা বলবা নাহ….. ৩মাস তো আমায় না দেখে না শুনে দিব্যি কাটিয়ে দিলে……
জবাবে শুভ্র কিছু না বললেও,,,,,, মনে মনে বলল”যদি তুমি জানতে কিভাবে ছিলাম আমি!!”
-কি হলো আবার চুপ হয়ে গেলে যে!!….
-এমনেই…… কতদিন তোমায় শুনি না….. আজ তুমি বলবে আমি শুনবো…….
-কবে এসেছো দেশে….
-গতকালের আগের দিন…..
-ওখানে সব ঠিকঠাক?
শুভ্র মাথাটা সামনে ঘুরিয়ে নিলো…. সাথে দৃষ্টিও….. কোনদিক চেয়ে আছে বুঝা যাচ্ছে না…. শুন্য দৃষ্টি…..
-প্রশ্ন কেনো করছো শিশির…… তুমি শুধু কথা বলো…….আমি চুপচাপ শুনি….
-কি কথা বলবো!!!! আমি কি তোতাপাখি যে পটর পটর করেই যাবো!!!
ম্লান হাসলো শুভ্র…… সেটা আবার পরোক্ষণেই মিলিয়ে গেলো……
-…………….. শিশির!……
-হুম বলো……..
-আমার কিছু বলার ছিলো……!!
-হুম আমি শুনছি…….
-………………. শিশির…… আমি…..
-কি হয়েছে!?…..
-আমি….. আমি কিছুই ঠিক করতে পারিনি শিশির!!?….
-মানে!?…. কি হয়েছে শুভ্র!?….
-………..
-তুমি খুলে বলো আমাকে…. বিশাল কোনো ঝামেলা!!! আংকেল!! আংকেল কি বলেছেন!?….
-শিশির…… আমি ব্যার্থ!!
-এভাবে কেনো বলছো….
শিশির শুভ্রর গালে হাত রাখলো আবার…..
পাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ বলে উঠল……
-আমি জানতাম তুমি এখানেই থাকবে…. সকাল সকাল এভাবে আমাকে না বলে কেনো বের হয়ে গেলে!!!
শিশির শুভ্র দুইজনই ঘুরে তাকালো….. শিশির প্রচুর অবাক হলো…… তানহা কেনো এখানে!!! আবার কেনো!!! কিন্তু শুভ্র….. ভাবলেশহীন!!!
শুভ্রর প্রতিক্রিয়ায় শিশিরের বুকে এক অজানা আশংকা আর ভয় কামড় দিয়ে উঠল…..
-তুমি এখানে কেনো তানহা!?…..
-প্রশ্নটা তো আমার তোমাকে করা উচিত….
-মানে!?…. আমাকে কেনো তুমি এই প্রশ্ন করবে!?…. আমি আমার ক্যাম্পাসে….. আমার মানুষের সাথে বসে আছি!!!
-হুম… কিন্তু মানুষটা যে এখন আর তোমার নেই!!…..
-উলটা পালটা কথা বন্ধ করো…. এবং আমাদের একা ছাড়ো….. অনেক ঘুরেছো পিছন পিছন… নাও যাস্ট লিভ আস এলোন…..
-তোমার হাভ ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে শুভ্র তোমাকে কিছু বলে নি!!! কি ব্যাপার শুভ্র…. এখনো কিসের অপেক্ষা করছো তুমি!?….
-কি বলবে শুভ্র আমাকে…..
-…….. এই বলবে যে…. যে মানুষটার হাতে হাত জড়িয়ে তুমি এখন বসে আছো….. সেই মানুষটার উপর তোমার আর কোনো অধিকার নেই…..
বলেই এগিয়ে এলো তানহা….. এবং খুব আস্তে করে শুভ্রর হাত শিশিরের হাত থেকে ছাড়িয়ে দিলো…….
-তোমার পাগলামি শোনার বা দেখার ইচ্ছা আমাদের নেই…..শুভ্র চলো এখান থেকে
বলেই উঠে দাড়ালো শিশির……
-এই মেয়ে… তুমি কি কানে শোনো না…. নাকি চোখেও দেখো না…. এতক্ষন যাবৎ বলছি…. কি কিছু ঢুকে না মাথায়!?…..
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় শিশির…..
-আমি শুভ্রর বাগদত্তা…..
তানহা নিজের বাম হাতটা উচিয়ে দেখালো…. অনামিকায় একটা সুন্দর ডায়মন্ড রিং চকচক করছে…. শিশির ঝট করে শুভ্রর হাতের দিকে তাকালো….. এবং আশ্চর্য্য!!!! শুভ্রর অনামিকায়ও একটা রিং দেখা যাচ্ছে…..
শিশিরের মাথা ঘুরে উঠল….. কি থেকে কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না….. ভোনভোন করছে কান…. কি শুনলো ও!!!! এনগেজড!!! শুভ্র আর তানহা!!! কিভাবে! কেনো!
শিশির গিয়ে শুভ্রর হাত খামছে ধরল…. কোনমতে ডাকল”শুভ্র”…….
শুভ্র শুন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে…. গলা কাপছে ওর…..
তানহা এক ঝটকায় শিশিরের হাত ছাড়িয়ে নিলো শুভ্রর হাত থেকে…..
-আর কিছু মেয় বি বলতে হবে না….. এখন আর শুভ্র শুভ্র করবে না…. অনেকতো পিছন পিছন ঘুরে রং তামাশা করলে….. এখন আমাদের পিছু ছাড়ো…… খবরদার যেনো তোমাকে আমাদের আশেপাশেও না দেখি….
তানহা শুভ্রর হাত ধরে টান দিলো….. তারপর শিশিরের চোখের সামনে দিয়েই হাতে হাত জড়িয়ে হেটে চলে যেতে লাগল…..আর শুভ্র একটা বাধ্য রোবটের মতই হাটতে লাগল!!
শিশির দেখলো…. শুভ্র একটু একটু করে ওর থেকে কত দূরে চলে যাচ্ছে….. যেখান থেকে হাত বাড়ালেও শুভ্রকে আর খুজে পাওয়া যাবে না….শুভ্র কি হারিয়েই গেলো শিশিরের জীবন থেকে!!!
দুপুরে শিশির বাসায় ফিরলো আকাশ পাতাল জ্বর নিয়ে…. দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই হাটু গেড়ে বসে পড়ল ও…… হাউমাউ করে কেদে উঠল….. শিরিন বেগম দৌড়ে এসে মেয়েকে ধরলেন…. এবং রীতিমত আতকে উঠলেন….. মেয়ের যে পুরে যাচ্ছে একদম……এভাবে তো মেয়েটা মারাই যাবে!!!….. মাকে জড়িয়ে ধরে শিশির হাউমাউ করে কাদতে লাগল….
-মা……মাগো…. আমি আর পারি না মা…. অনেক কষ্ট হচ্ছে…… মাগো আমি বুঝি মরে গেলামগো মা…… মা আম…..আমার…..
সেখানেই জ্ঞান হারালো শিশির,,,,,
শিশিরকে হসপিটালাইজড করা হলো….. ডাক্তার প্রথমে জ্বরটা সিজন চেঞ্জের জন্য ভাবলেও… জ্বরের মাত্রা দেখে নিজেই ভ্রু কুচকে অবাক হয়ে গেলেন…..দ্রুত জ্বর নামানো প্রয়োজন…. জ্বরটা মাথায় উঠে গেলেই সমস্যা গুরুতর হয়ে যাবে….
পর্ব ৩৪
শুভ্রকে ফোন করে জানানো হয়েছিলো…. সিডনিতে ওর বাবা’র অবস্থা খুব ক্রিটিকাল….. নতুন এক বিজনেসের জন্য ওর বাবা মা’কে সিডনি যেতে হয়েছিলো….. যেহেতু বাবা’র ব্যবসায় শুভ্র কোনভাবেই ইন্টারেস্টেড ছিলো না…. তাই কি ব্যবাসার জন্য সিডনি যাওয়া হয়েছিলো…. আর ব্যবসায় কি সমস্যা হয়েছে তার আগা মাথা সম্পর্কে কিছুই ধারনা ছিলো না শুভ্রর……
ও ভেবে রেখেছিলো সিডনি যেয়েই ওর বাবা মা’কে সাফ জানিয়ে দিবে…. যেনো নিজেদের ব্যবসায়ের জন্য ওকে কখনো না যন্ত্রণা করে না….. যখন ও অফিসে পৌছোলো…… সেখানাকার অবস্থা দেখে শুভ্র স্তব্দ হয়ে গেলো…….
যেই নতুন বিজনেসটা শুভ্রর বাবা মা শুরু করতে যাচ্ছিলো…. সেটার জন্য প্রচুর মুলধনের প্রয়োজন ছিলো….. সেজন্য নিজেদের ফান্ড ছাড়াও ওনারা বেশ বড়সড় একটা লোন নেন ব্যাংক থেকে……এবং বিজনেস পার্টনার ছিলো নতুন…… ওনারা ধরেই নিয়েছিলেন বিজনেসটা খুব ভালোভাবেই দাঁড়াবে……..কিন্তু নতুন পার্টনার আর নিজেদের বিশ্বস্ত এক লোকের কারসাজিতে ওনারা বিজনেসটায় পুরোদমে লস করেন…… এবং চোখের পলকে তা ধ্বসে পড়তে দেখেন….. এত বড় একটা লস খাবেন তা কেউই আশা করেন নি ওনারা…… শুভ্রর বাবা এই ঘটনার পরপরই মাইন্ড স্ট্রোকে মারা যান……
এই সংবাদ শুভ্রকে আগেই জানানো হয়নি……ও জানতে পারে ২সপ্তাহ পর…….. শুভ্র যখন জানতে পারলো…. তখন যেনো হাজার ভোল্টের শক খেলো……… জাফরিন বেগমও হসপিটালাইজড……. হঠাৎ করে যেনো শুভ্র মাঝ সমুদ্রে এসে পড়ল……
বিভিন্ন পেপারে ওর থেকে সাইন নেওয়া হল…… ওর অনুমতি নিয়েই ইফতেখার সাহেবকে সিডনিতেই মাটি দেওয়া হল……. শুভ্র মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল……… কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে…….!!!! শুভ্র কিছু থিত করার আগেই….. সব হারিয়ে ফেলল….. নিলামে উঠল ওদের বিজনেস, সম্পদ, এবং বাড়িটাও…… শুভ্রর কিছুই করার ছিলো না….শুধু দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া…….
শুভ্র এই প্রথমবার লক্ষ্য করল….. ও খুব জোরালো ভাবে ওর বাবা’কে মিস করতে শুরু করেছে……
হসপিটালে যখন মা’কে দেখতে গেলো…. শুভ্রর তখন নিজেকে প্রচুর অসহায় লাগতে লাগলো….
ওর বাবা মা যেসবের জন্য এতো কিছু করল…… শুভ্র সেসব কিছুই রক্ষা করতে পারলো না। আচ্ছা!! বাবাও কি এতোটা অসহায় বোধ করেছিলেন!!! বাবা যদি একটু অপেক্ষা করত ওর জন্য…..!!! বাবা কি শেষ সময় পর্যন্ত ওর অপেক্ষায় ছিলো!!!!
হসপিটাল বেডে শয্যাশয়ী নিজের মায়ের করুন মুখটা দেখে শুভ্র নিজেকে ধিক্কার জানাতে লাগলো!!!!! আদৌ কি ও সন্তান হওয়ার যোগ্য!!!
মায়ের পাশে বসল শুভ্র…… ছোটবেলা ও খুবই মা পাগলা ছেলে ছিলো….. মায়ের কোল ঘেষে বসে থাকা…. মায়ের পিছন পিছন সারাবাড়ি ঘুর ঘুর করা…. ঘুম থেকে উঠেই মায়ের গলা ধরে ঝুলে পড়া…… এগুলো যেনো ওর নিত্যদিনের রুটিন ছিলো…… প্রথম প্রথম মায়ের দূরে যাওয়াটা ওর খুব বেশি খারাপ লাগতো….. কেনো মা একা একা ঘুরতে যায়!!! শুভ্রকে কেনো সাথে নেয় না!!! এসব ভেবে ভেবে কান্নাকাটিও খুব করত….. কিন্তু ধীরে ধীরে যেনো সব মেনে নিলো….. যখন বুঝতে শিখলো…. ওর চেয়েও ওর বাবা মা’র ব্যবসাটা বেশি প্রিয়….. তখন থেকেই এসব সবকিছুর উপর ওর ক্ষোভ জন্মে গেলো…. কিছুই চাই না ওর…. ব্যবসা, টাকাপয়সা, বাবা মা…… কিছুই না……!!!!!!
কিন্তু আজ এভাবে মা’কে দেখে শুভ্রর মনে হল….. বাবাকে যদি এতো অবহেলা না করতাম তাহলে বাবা এভাবে হারিয়ে যেত না…… এখন যদি মা’ও হারিয়ে যায়!!!!
শুভ্র ওর মায়ের হাত হালকা করে স্পর্শ করল….. অল্প চোখ মেলে তাকালেন জাফরিন বেগম…… চোখের সামনে ছেলেকে দেখে হুহু করে কেদে উঠলেন জাফরিন বেগম…… মায়ের এভাবে কান্না যেনো শুভ্র বুকে যেয়ে বিধলো……!!! দ্রুত কেবিন ছেড়ে বের হয়ে গেলো ও…..
করিডোরে দাড়াতেই দেখা হল তানহার সাথে….. ওকে এখানে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে জানতে পারলো……তানহা আর ওর বাবা বিজনেস সংক্রান্ত ঘটনার ব্যাপার জানতে পেরেই এখানে চলে এসেছে…… এবং তখনই শুভ্র জানতে পারে ওদের নিলামে বিক্রি হওয়া ব্যবসাটা তানহার বাবা কি নিয়েছেন…….. শুভ্র ভাবলেশহীন ভাবে সব শুনলো…… এসব শুনে আর কি করবে ও!!!! ওর তো নেই সেসব!!!
তানহা পরোক্ষনেই একটা ডিল রাখলো শুভ্রর সামনে……. শুভ্রর যা ছিলো তা আবার শুভ্রই ফিরে পাবে কিন্তু কন্ডিশন ওদের এনগেজমেন্ট
…!!!!!
শুভ্র কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,
-অসম্ভব….. আমার কিছুর প্রয়োজন নেই….. আমারটা আমি নিজে গড়ে নিতে পারবো….
-বেশ ভালো!!! কিন্তু তোমার মা!!!! ওনার চিকিৎসা করানোর মতও কি কিছু তোমার আছে!?……..
-………………………
-নিজের মা’কে নিয়ে ফিরে যাবার মতও কি কিছু তোমার আছে শুভ্র!?…….
-…………
-নিজের বাবা’কে তো অনেক অবহেলা করলে…… শেষ সময়ে ওনার সাথে থাকতে পারলে না!!!! মায়ের ক্ষেত্রেও কি একই কাজ করবে!!!!
বাকশুন্য হয়ে গেলো শুভ্র!!!! আসলেই তো…..!!! মা’কে তো ও ফেলে দিতে পারবে না!!! কিন্তু শিশির!!! ও যে অপেক্ষা করে আছে!!!
-ভেবে দেখো শুভ্র!!! তুমি কাকে বেছে নিবে!?….. নিজের মা’কে নাকিইইইইই…….!!!
এবার খুব শান্ত চোখে তাকালো শুভ্র
-কেনো করছো এসব!?….
- well,,, everything is fair in love and war….
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো শুভ্র…… না,,,, তানহার উপর নাহ,,,,,নিজের উপর,,,,,,, ঠিক এই কথাটাই ও একদিন শিশিরকে বলেছিলো!!
পর্ব ৩৫
শিশিরের হসপিটাল বেডের কাছে শিশিরের মা শিরিন বেগম বসা….. কাকলি বেগম বসা একটু দূরে….. শিশিরের জ্বর এখনো কমে নি…. মেয়েটার শরীরের সাথে কত কত নল পেচানো…..ভরা গোলাট মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে…..এক দীর্ঘ হতাশা, চিন্তা আর ভয়ের নিঃশ্বাস ছাড়লেন শিরিন বেগম।
শিশির একটু নড়ে উঠল…..ওর ঠোঁট কেপে কেপে উঠছে…… কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে….. শিরিন বেগম মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন……খুবই নিচু স্বরে জিজ্ঞাস করলেন…
-কিরে মা…. খুব খারাপ লাগছে….
শিশিরকে কি যেনো বিড়বিড় করতে শোনা গেলো…..মেয়েটা সারাক্ষণ জ্বরের ঘোরে বেহুশ থাকে…. আর মাঝে মাঝে এরকম বিড়বিড় করে কি যেনো বলে…. শিরিন বেগম আবার বললেন
-কিরে মা……. শিশির…… মা আমার…….. অনেক খারাপ লাগছে!!!
শিশির হালকা একটু চোখ মেলল…… তারপর আগের মতই বিড়বিড় করে বলল,,,,,” ও বুঝি চলে গেছে মা…..আমি ভুল করেছি মা,,,, জানো!!! মা আমি ওকে অনেক কষ্ট দিয়েছি….. তাই চলে গেলো ও……. ও চলে গেলো মা…..আমার ভিতরটা কেমন যেনো পুড়ছে মা….. আমহ,,,, আমারহ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,……..!!!!
বলতে বলতে ডুকরে কেদে উঠল শিশির…….. মেয়ের মুখের কথা শুনে শিরিন বেগমের নিজের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো……. মেয়েটা কি কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কে জানে!!!!! কি নিয়ে এত কষ্ট মেয়েটার!!!!
শিশির আবার চুপ করে গেলো….. চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল….. কিন্তু চোখের পানি!!! সেতো অবাধ্য……..
হসপিটালে এডমিটেড থাকার তিনদিনের মাথায় শিশিরের জ্বর কমতে শুরু করল….. কিন্তু বডিতে প্রচুর উইকনেস থাকায় পুরোপুরি জ্বর নামছিলো না…….
আবির মাথা নিচু করে শিশিরের বেডের কাছে বসা…… দুইহাত দিয়ে শিশিরের বাম হাত ধরে রেখেছে…… এইমুহূর্তে আবির টের পাচ্ছে…… সেদিন এনগেজমেন্টটা না করে ও জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলো….. আর এটা ভাবলেই ওর রক্ত গরম হয়ে যায়….. নিজের ভুলের জন্য নিজেকে মেরে ফেলতে মন চায়….. কিন্তু এইবার না….. এইবার সব ঠিকঠাক করে দিবে….. আবির খালি হাতে আসেনি….. ও সম্পুর্ণ ইনফো নিয়েই এসেছে……..
শিশির চোখ মেলার পর সাথে সাথে আবিরকে দেখে খুব খুশি হলো…… একমাত্র আবিরই আছে যার সাথে এইমুহূর্তে ও সবকিছু শেয়ার করতে পারবে….. যেইকথাগুলো এই পর্যন্ত চেপে রাখতে হয়েছে… শিশির হালকা নড়ে চড়ে উঠলে…আবির মাথা তুলে তাকাল….. আবিরের চোখ লাল হয়ে আছে….. একটু ভিজাও,,,,,আবির কি কান্না করছিলো!!!!! কিন্ত কেনো!!!!
আবির একনজর দেখে সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল…. ও অবশ্যই ধরা পড়ার ভয়ে লুকাতে চাইছিলো…..!!!! কিন্তু বেশ একটা সুবিধা করতে পারে নি….
শিশির আধশোয়া অবস্থায় বসল…..
-তোমার চোখ লাল হয়ে আছে কেনো!!!
-ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো না কেনো!?….
-প্রশ্নতো আমি আগে করেছিলাম!!
-উত্তরটা নাহয় তুমি আগে দাও!……
হালকা হাসলো শিশির!!! হুম আবির ডেফেনটলি লুকিয়ে যেতে চাইছে…..
-এত টেনশন কেনো কর!!!! ঠিক হয়ে যাবো আমি…..
-হুম,,,,,, তা আমি দেখতেই পাচ্ছি…..
-বাদ দাও…. তোমার খবর বলো….
-আর তোমার মনে হয় সেটা এইমুহুর্তে জরুরি একটা বিষয়!!!
-তাহলে জরুরী বিষয়টা কি!!! শুনি!?….
শিশির একটু দুষ্টামির ছলে বলল….
-শুভ্রকে ভুলে যাও শিশির…..
শিশির মুখের রঙ বদলে পাংশুটে হয়ে গেলো….
-আমি খবর নিয়েছি… খুব ভালো করেই খবর নিয়েছি…..শুভ্র আর তানহার এনগেজমেন্টটা কোন নাটক না….. ইভেন নেক্সট মান্থ বিয়ের ডেটও ফাইনাল করা আছে…….
শিশির হাত পা কাপতে লাগল…… গাল বেয়ে নোনা পানির ধারা গড়িয়ে পড়তে শুরু করল…..
-আবির!!!
-আমি জানি শিশির খুব কষ্ট হবে……. কিন্তু আজ যদি এই কষ্টটা ইনডিউর করতে পারো তাহলে আজীবন সুখে থাকবে তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি শিশির…
-আমি পারবো না…………. অসম্ভব!!!! আমি ভালোবাসি ওকে!!!
রেগে উঠে দাড়ালো আবির…… বসে থাকার স্টুলটায় এক লাথি মারলো…..
-বাচ্চামি বন্ধ করো শিশির….. তুমি কোন বাচ্চা না…ভালো মন্দ বুঝতো নাকি!!!! এসব নাটক বন্ধ করো প্লিজ,!!!
-আবির আমি যাস্ট একবার…… যাস্ট একবার শুভ্রর সাথে দেখা করতে চাই……
রাগান্বিত চোখে তাকালো আবির শিশিরের দিকে,,,
-তুমি গত তিনদিন যাবৎ এডমিটেড….. এই খবরটা শুভ্রর কানে পৌছেছে….. কিন্তু ও একবারের জন্যও আসার প্রয়োজন মনে করেনি….. ইভেন ফোন পর্যন্ত করে নি……
শিশিরের ফুপিয়ে কান্না অনবরত চলছে…. আবির আরো কিছু কঠিন কথা বলত…… কিন্তু শিশিরকে এভাবে কাদতে দেখে আর কিছু বলতে পারলো না…….
সেইমুহুর্তে শিশিরের বাবা, মা আর ফুপু ডুকলেন কেবিনে…. কবির সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আবির বলে উঠল
-আংকেল আমি শিশিরকে বিয়ে করতে চাই…… এবং সেটে এই মাসের মধ্যেই……
পর্ব ৩৬
শুভ্র চোখ মেলে তাকালো…..বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করতেই টের পেলো… কিছু একটা ওকে আটকে রেখেছে….. পাশে তাকালে বুঝল সেই কিছু একটা তানহা….. শুভ্র ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো….নাহ!!! শুভ্রর এখন আর অবাক লাগে না…. রাগও লাগে না….. শুভ্রর রুমে তানহার অবাধ যাতায়াত…… শুভ্র কিছু বলতে পারবে না…. কারন….. তানহার এখন ওর উপর অনেক অধিকার…….!!!! শুভ্র তানহার হাতটা ওর শরীরের উপর থেকে সড়িয়ে আস্তে করে বিছানা ছেড়ে নামলো…..
বিকাল দিকে শুভ্র অফিস থেকে বাসায় ফিরেই সোজা নিজের রুমে চলে এসেছিলো….. এতোটাই ক্লান্ত ছিলো… কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেছে টেরই পায় নি….. আর সেই ঘুমের মধ্যেই তানহা ওর রুমে এসে বিছানার পাশের জায়গা দখল করেছে……
বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো শুভ্র…. চোখ বন্ধ করল…. মাথাটা দপদপ করছে হঠাৎ….. চোখ জ্বালা করছে…… অফিসের কাজ গুছিয়ে উঠতে ওর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে….. ব্যবসা তানহার বাবা কিনে নিলেও ব্যবসায়ের সম্পুর্ণ দায়ভার শুভ্রর কাধেই দেওয়া হয়েছে….. তানহার বাবা স্পষ্ট করেই বলেছেন “যা তোমার ছিলো…. তা তোমারই থাকবে….. এতে আমি কখনো হস্তক্ষেপ করবো না” কিন্তু শুভ্রর এসবের কিছুই চাওয়া ছিলো না……. কখনোই না…… একমাত্র নিজের মায়ের জন্য ও এতোটা সহ্য করে আছে……. সব ছেড়ে চুপ করে আছে…… মা’কে এভাবে তো ফেলে রেখে চলে যেতে পারবে না…… পারলে তো সেদিনই যেতে যেদিন শিশিরের বিয়ের খবর সম্পর্কে ওকে অবগত করেছে সাজেদ….. শুভ্র শুধু শুনেছে…… এছাড়া আর কিছু করার নেই…….নিজেকে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করছে….. শিশিরকে একমাত্র আবিরই সুখে রাখতে পারবে……. এমনকি শান্তিতেও রাখতে পারবে…… যেটা শুভ্রর সাথে থাকলে শিশির কখনোই পেত না……. শান্তি এখন আর শুভ্রর জীবনে নেই..……!!!!! কিন্তু আর কতটা সহ্য করা যায়!!!!
শুভ্র নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল…… চোখের জ্বালাটা বাড়ছে….. শুভ্র জানে না ওর সহ্যের সীমা আর কতদিন এভাবে ধরে রাখতে পারবে!!! কিন্তু ওর কাছে এখন মরে যাওয়াটা খুব সোজা মনে হয়…… যদি না…. ওর কোন দায়িত্ব থাকত….তাহলে হয়ত এতোদিনে শুভ্র এসব উগ্র ব্যাথাগুলো থেকে চিরতরেই মুক্তি নিয়ে নিত……..
শিশির বসে বসে নখ খুটছে আর নিজের বা হাতের আংটিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে….আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ওর কাবিন…… আবিরের সাথে…. কিন্তু এ নিয়ে শিশিরের কোন মাথা ব্যাথা নেই…… সব ছেড়ে দিয়েছে ভাগ্যের উপর….. যদি এই থাকে ভাগ্যে তাহলে সারাজীবন এভাবে অনুভূতিহীন হয়েই থাকবে……
শিশির বারান্দায় বসে রয়েছে….. ওর কেনো যেনো মনে মাঝে মাঝে শুভ্র আসে ওদের বাড়ির সামনে…… ওর বারান্দার দিকে উকি ঝুকি মারে…….. এই আশায় ও নিজেও বলতে গেলে সারাদিম বারান্দায় বসে থাকে…… একবার শুধু একবার যদি শুভ্রকে দেখতে পারতো….
শিশিরের ফুপু আর মা এলেন সেই মুহুর্তে রুমে,,,,
-কিরে দুপুরে লাঞ্চ করিস নাই…… ডিনারটা তো করবি নাকি!!
-রুচি করছে না মা,,,,,যখন খিদে পাবে তখন খেয়ে নিবো…….
-এভাবে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কি আবার বিছানায় পড়তে চাস নাকি!?……
-মা প্লিজ,,,,,চিৎকার করো না…. আমার এমনে তেই মাথা ধরেছে……
-এতো কেনো টেনশন দিস আমাদের!?….. তোর বাপের দিকটা একটু চিন্তা কর!!!!
-তো কি চাইছো কি তোমরা!!! কি করবো আমি!!! মরে যাই!? মরে গেলেই তো সবাই শান্তি তাই না!!!!
কান্নায় ভেঙে পড়ল শিশির!!!
-কি করবো আমি বলো!! আর কি করতে বলো তোমরা আমাকে!!!! তোমাদের কথামত বিয়েতে পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম!!! এর চেয়ে বেশি আর কি চাও তোমরা!!
-এটাই তোর জন্য ভালোরে মা!!!
-নাহ!! এটা আমার জন্য ভালো না,,,মা!!! তুমি জানো এটা আমার জন্য ভালো না!!!!
-আমি জানি না কিছু!!!! তুই যদি কিছু করতে পারিস,,,, কর…. আমি তোকে বাধা দিবো না…. কিন্তু আমার থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করিস না……
বলেই শিরিন বেগম রুম থেকে চলে গেলেন…..
শিশিরের ফুপু এসে বসলেন শিশিরের পাশে…. শিশিরের কান্নার বেগ ততক্ষণে কিছুটা কমে এসেছে…..
-আমরা বিয়ের জন্য মানা করে দিবো….. বিয়েটা দেওয়া তোর সুখের জন্য….. কিন্তু তোরই যদি মত না থাকে, তাহলে………
-বাবা রাজি হবে না……ফুপু…
- ওমা!!! কেনো!!!!
-তুমি নিজেও রাজি হবে না!!
-কেনো ছেলেটা কি ভালো না!?
-ভালো ফুপু…. খুব ভালো….
-তাহলে…..!?…..
-ও একটা ভুল করেছিলো!!! হুম,,,,বড়সড় একটা ভুল….. যার জন্য….
-তুই কি শুভ্র ছেলেটার কথা বলছিস!?….
শিশির একটু অবাক হলো…. ফুপুর এখনো শুভ্রর নাম মনে আছে!!! তাহলে ঘটে যাওয়া ঘটনাও স্পষ্ট মনে থাকার কথা!! ফুপু তাহলে এখন একদমই এই বিয়ে ভাঙার জন্য রাজি হবে না!!
-ফুপু….. আমার সাথেই কেনো এমন হচ্ছে!?…..
-ছেলেটাকে তুই ভালোবাসিস!?….
শিশির ফুপিয়ে কেদে উঠল…..
-শুভ্র…. শুভ্র… তোমাদের কাছে মাফ চাইবে বলেছিলো…. কিন্তু তখন তুমি বাংলাদেশে ছিলে না….. তাই আমি তোমার আসার অপেক্ষা করছিলাম….. কিন্তু তার আগেই!!!!
-কি হয়েছে রে মা!???
শিশিরের কান্নার বেগ বেড়ে গেলো……
-ফুপু………. শুভ্র সত্যিই খুব অনুতপ্ত ওর ভুলের জন্য…. বিশ্বাস করো…..
-তুই ছেলেটাকে বাসায় নিয়ে আসিস…. আমি কথা বলবো…..
-এখন আর সম্ভব না,,,, ফুপু….
-মানে!!!
শিশির ওর ফুপুর বুকে মুখ গুজলো….. মনে মনে বলল,,,, ও যে আর আমার ভাগ্যে নেই!!!
পর্ব ৩৭
শিশির বেশকিছুক্ষন যাবৎ ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে….. মন স্থির করতে পারছে না…. ভয় লাগছে প্রচুর…… অনেক চিন্তাভাবনার পর কাপা কাপা আঙুলে নাম্বার ডায়াল করল…… রিং হচ্ছে….হচ্ছে……এবং হয়েই যাচ্ছে….. ঠিক যেই মুহুর্তে শিশির ফোনটা কেটে দিবে ভাবছিলো….. সেই মুহুর্তে ফোন রিসিভ হলো….. কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই…. না ফোনের এপাশে…. না ওপাশে……
নিরবতা ভেঙে শিশিরই প্রথম প্রশ্ন করল,
-কেমন আছো?
-……….…………….
অনেক কষ্টে শিশির নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে শক্ত থাকার….. ও দুর্বল হয়ে পড়তে চায় না……জোরে একটা নিঃশ্বাস ভিতরে টেনে নিলো শিশির….. বুকের ভিতরের ধুকপুকানি ও স্পষ্ট টের পাচ্ছে….. কোনমতে টেনেটুনে বলল,
-শুভ্র………..
-…………………..
শিশির নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল,,,,কান্নাটা উগ্রে বেড়িয়ে আসতে চাইছে….. শিশির নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না….ফুপিয়ে উঠল ও…..
-একটু কথা বলবা প্লিজ…..!!!! কতদিন শুনি না তোমায়!!!!……
-………………….
-নিজের খেয়াল রাখোতো!?……
-………………..
এতোক্ষনেও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে শিশির একটু ভয় পেয়ে গেলেও…. পরক্ষণেই ওপাশে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো ও……. এবং ততক্ষনাৎ বুঝে গেলো…. ফোনের ওপাশে সঠিক মানুষটাই আছে…… এই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দের সাথে যে ও গভীরভাবে পরিচিত….. তা আদৌ কি ভুলা সম্ভব!!!!!!
-একবার কি আসবে আমায় দেখতে…… আমি বারান্দায় তোমার অপেক্ষা করবো!!!!…..
-…………………..
-কাল…….কাল…. আমার বিয়ে শুভ্র!!! আমি চলে যাচ্ছি!!!!
-………………..
-এরকমতো হওয়ার কথা ছিলো না!!!…….. শুভ্র!!!
-………………………
মুখ চেপে কান্নাটা আটকে ধরল শিশির……
-আচ্ছা,,,,,,,ঠিক আছে…… আমি রাখছি কেমন!!!! ভালো থেকো……… ঠিক……. ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো……. নি…. নিজের খেয়াল রেখো প্লিজ………
রাখি বললেও রাখলো না শিশির…… ফোন কানে চেপে বসে রইল!!! ফোনের এপাশে চাপা কান্নার আওয়াজ আর ওপাশে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ গভীর থেকে গভীর হতে লাগল।……….
প্রায় দশমিনিট এভাবে থাকার পর ফোন রেখে দিলো শিশির!!! ফোনটা কেটে যাওয়ার পরও শুভ্র ফোনটা কানে চেপে ধরে রাখলো…যেনো ওপাশে এখনো শিশিরকে অনুভব করতে পারছে ও……. একসময় এভাবেই ফোন কানে চেপে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলত ওরা দুজন…… কত খুনসুঁটি,, কত স্বপ্ন,,, কত ভালোবাসার কথাই না বলত!!!! আর আজ কথা যেনো ফুড়িয়ে গেছে…… শিশিরের কান্নার আওয়াজ যেনো শিলের মত বিধছিলো শুভ্রর বুকে….. বুক ভার হয়ে আসছিলো….. গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে আটকে ছিলো…. যেনো কেউ গলা চেপে ধরেছে!!!
শুভ্র প্রচুর ইচ্ছা করছে শিশিরকে একবার দেখার,,,,একবার স্পর্শ করার,,,,সিডনি থেকে ফিরে শুধু ওই একবারই শুভ্র দেখেছিলো শিশিরকে….. এরপর আর সুযোগ পায় নি….. তানহা ওকে বলতে গেলে প্রায় মুঠো বন্দি করে রেখেছে,,,, কঠিন অভজারবেশনে রেখেছে শুভ্রকে…… শুভ্রর প্রতিটা মুভমেন্ট সম্পর্কে তানহার অবগত হয় …… তাই শুভ্র এখন চাইলেও কিছুতেই কিছু করতে পারবে না!!!!
শুভ্র নিজের ডেস্ক ছেড়ে উঠে গিয়ে দাড়ালো জানালার সামনে…… এখান থেকে ওদের বাড়ির ছোট গার্ডেনটা দেখা যায়…… নিজের বাড়িতেই ওর একটা অফিস রুম আছে……. বাসায় থাকলে বেশির ভাগ সময়ই ও নিজের এই অফিসে থাকে…।
শুভ্র টের পেলো হঠাৎ করে পিছন থেকে ওকে কেউ জড়িয়ে ধরেছে…..
-সারাটা দিন এই রুমে পড়ে থাকো……!!! আমার সাথে একটু আধটু কথাতো বলতে পারো নাকি!?…..
-মা কেমন আছে!?…..
-ভালো….. আমি কাল গিয়েছিলাম দেখতে….. আজ আবার যাবো। তুমিও চলো আমার সাথে……!!!
-দেখি!!!
-দেখি ফেকি না….. তুমি একটু সময় দাও না আমায়,,,,এমনকি তোমার মা’কেও না….. আই এম মিসিং ইউ সো ব্যাডলি,,,,নাও!!!
-তানহা,,,,, আমাদের,,,,,…… আমদের বিয়ের ডেট কি ফিক্স হয়ে গেছে!!!
-না…. তুমি তো বাবার সাথে কথাই বলছো না…..বাবা কতবার আমাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে জানো!!!
-হুম!!!!… আমি ভাবছিলাম এই মানথেই একটা ডেট ফিক্স করবো,,,,
তানহা শুভ্রর পিছন থেকে সড়ে এসে সামনে এসে দাড়ালো…… দুই হাতে শুভ্রর দুইগাল চেপে ধরে বলল,
-সত্যি!?……
ম্লান হাসলো শুভ্র….. যেই হাসিতে কোনো প্রাণ নেই…..
-এটাই যে আমার ভাগ্য তানহা!!! তাহলে শুধু শুধু কেনো আর লড়াই করবো!!!
-মানে!?…. বুঝলাম না!!!
-কিছু না….. আমি কথা বলবো আংকেলের সাথে….. এই ব্যাপার নিয়ে…..
-ও…. ওয়াও শুভ্র!!!!! আই এম সো হ্যাপি রাইট নাও…….. সো সো সো মাচ হ্যাপি!!!!
-তানহা…..
ধরা গলায় ডেকে উঠল শুভ্র……
-তানহা,,,,আমি,,,,, আমার সম্পুর্ণ চেষ্টা করবো..
শুভ্রর গলা যেনো আরো বেশি ধরে এলো…..
-তোমাকে সবসময় হ্যাপি রাখার,,,,,, এভাবে খুশী রাখার..….. কিন্তু…..
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুভ্র আবার শুরু করল,,,,
-কাল শিশিরের বিয়ে তানহা,,,,,, কাল,,,, আমি একবার যাস্ট একবারের জন্য ওকে দেখতে যেতে চাই…… যাস্ট একবার…. এরপর আর কক্ষনো ওর সামনে যাবো না…… শুধু কালকে..
তানহার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো… তীক্ষ্ম গলায় জবাব দিলো….
-না…. যাবে না তুমি!!!! কোত্থাও যাবে না…. আমি জানি একবার গেলে,,,, তুমি আর ফিরে আসবে না…. একদম যাবে না তুমি বলে দিলাম,,,,
শুভ্র মুখটা ঘুরিয়ে ফেলল….. কোনমতে বলল “হুম”,,, এরপর রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো….।
পর্ব ৩৮
সারাটা দিন তানহার কাটল চিন্তায় চিন্তায়,,,,,, চিন্তা ছাড়াও প্রচুর তিক্ততা বিরাজ করছে ওর মনে…… ও ভেবেই নিয়েছিলো,,,,শুভ্রর মন ফিরে গেছে,,,, কিন্তু এতো সহজে মেয়েটাকে বের করতে পারবে বলে মনে হয় না……. বিকালের দিকে ছাদে বসে বসে এসবই ভাবছিলো,,,, হাতে ধুমায়িত কফির মগ,,,,,, কিন্তু কফির মগে ওর মনোযোগ নেই…… মগের মাথায় শুধু আঙুল বুলিয়ে যাচ্ছে ও….…
এরমধ্যে একজন মেইড এসে জানালো,,,নিচে ভিসিটর এসেছে,,,, তানহার বিরক্ততা বেড়ে গেলো,,,,
-স্যারকে ইনফরম করো,,,,,আমাকে কেনো বলছো!?….
-স্যার বাসায় নেই ম্যাম!!!
-তাহলে ভিসিটরকে অফিসে যেতে বলো,,,,
-কিন্তু ম্যাম উনিতো আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।
তানহার ভ্রু কুচকে গেলো,,,,,ওর সাথে দেখা করতে কে আসতে পারে!!!!
তানহা ধীরে সুস্থে উঠে নিচে নেমে গেলো,,,৷ ড্রইংরুমে বসা ছেলেটাকে চিনতে ওর মিলিসেকেন্ড সময়ও লাগলো না,,,, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ছেলে এখানে কেনো!!!!
-কেমন আছো!?….
-চিনতে পেরেছো আমায়!?…
-অবশ্যই,,,, তুমি আবির……এন্ড কংগ্রেস ইন এডভান্স,,, বিয়ের জন্য…….
-হুম……
-তা,,,,হঠাৎ আমার সাথে দেখা করতে চাইছো!?…. এনি প্রবেলম,,,আই ক্যান হেল্প উইথ!!
-হুম…. প্রবেলম আছে…. এবং একটু বেশিই বড় প্রবলেম,,,,,,এবং একমাত্র তুমিই হেল্প করতে পারো আমাকে,,,,,
-আ…..চ্ছা!!! তা কি প্রবলেম…..
-আমি শিশিরকে বিয়ে করতে পারবো না তানহা!!
তানহা একটু সতর্ক হয়ে উঠল,,,,নড়েচড়ে বসল,,,,
-এটাতে আমি তোমাকে কি হেল্প করতে পারি….. সমস্যাটা একান্তই তোমার ব্যাক্তিগত……
-নাহ…. সমস্যাটা শুধুই আমার ব্যাক্তিগত না….. এতে তুমিও জড়িত!!
-মানে!?….
-মানে,,,,, আমি শিশিরকে বিয়ে করতে পারবো না,,,,কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি,,৷!!!
তানহার মনে হল,,,,, কেউ বুঝি বরফ ঠান্ডা পানি ওর মুখে ছুড়ে মেরেছে!!!
-আর ইউ ইনসেন!!! তুমি শিশিরকে বিয়ে করছো কারন তুমি ওকে ভালোবাসো!!! আর এখানে এসে এসব আবোল তাবোল কি বলছো!!!
-আমার মনে হত,,,আমি শিশিরকে ভালোবাসি!!! কিন্তু ওর প্রতি আমি যাস্ট একটু উইক ছিলাম,,,,যেটা আমি তোমাকে দেখার পর বুঝলাম,,,,
-তোমার সাথে আমার দেখাই বা কয়বার হয়েছে!!!!
-কাউকে ভালোবাসতে হলেতো তাকে বারবার দেখার প্রয়োজন পড়ে না…… একবারই যথেষ্ট,,,৷
-হুহ!!! দেখো আবির…. তুমি যদি এসব উটকো কথা বলতে এখানে এসে থাকো,,, দেন আই মাস্ট টেল ইউ,,,,আই এম নট ইন্টারেস্টেড,,,,,
-কিন্তু কেনো!!! আমি বলছি আমি তোমাকে ভালোবাসি,,,,,তাহলে কেনো তুমি একে উটকো কথা বলছো,,,,
-কারন “এটা” উটকো কথা!!!! তুমি জানো আমি শুভ্রকে ভালোবাসি,,,,এবং শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হবে,,,,,এবং আগামীকাল তোমার বিয়ে,,,,সো এখানে বসে টাইম ওয়েস্ট না করে,,,,তোমার যাওয়া উচিত,,,,
তানহা উঠে দাড়ালো,,,,সাথে সাথে আবিরও…..তানহা সিড়ির দিকে এক পা বাড়াতেই আবির পিছন থেকে চেচিয়ে উঠল,,,
-কেনো তুমি আমাকে ইগনোর করছো!!! কেনো!!!
-যাস্ট লিভ আবির…. প্লিজ সিন ক্রিয়েট করো না….
আবির দ্রুত হেটে একদম তানহার কাছে এসে দাড়ালো…. তানহা পিছিয়ে যাওয়ার আগেই,,,শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে,,,,
-কেনো বুঝতে পারছো না,,,আমি ভালোবাসি তোমাকে,,,,,অনেক অনেক বেশি,,,,,একমাত্র আমার সাথেই তুমি সুখে থাকবে,,,,
তানহা দুই হাত দিয়ে আবিরকে পিছন দিকে ধাক্কা দিতে লাগলো,,,,কিন্তু আবির একচুলও নড়লো না,,,,বরং আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে,,,,
-কি সমস্যা কি তোমার,,,,ছাড়ো আমাকে,,,,
চিৎকার করে উঠল তানহা,,,
-না,,,একদমই ছাড়বো না,,,,যতক্ষন পর্যন্ত না,,,,তুমি আমাকে একসেপ্ট করবে,,আমি ছাড়ছি না,,,আমি শুভ্রর চেয়ে বেশি সুখে রাখবো তোমাকে,,,,,শুভ্রতো তোমাকে ভালোবাসে না,,,,কিন্তু আমিতো বাসি,,,,তাহলে প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না,,,,
-ছাড়ো আবির,,,,আমায় ছাড়ো তুমি,,,, আমাকে এভাবে জোড় করতে পারো না তুমি,,,
-জোড় করে হলেও আমার তোমাকে চাই,,,,
-আশ্চর্য্য!!!! জোড় করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না আবির,,,,, এভাবে জোড় করে কাউকে ভালোবাসতে ও বলা যায় না,,,,,
সাথে সাথে ছেড়ে দিলো আবির তানহাকে,,,,, চার কদম পিছিয়ে গিয়ে দাড়ালো,,,,একটু আগে চেহারার এগ্রেসিভ লুক মুছে গিয়ে খুব শান্ত একটা লুক চলে এলো,,,, শান্ত গলায় আবির বলল,
-একজেক্টলি,,,,,,,জোড় করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না!!! তাহলে তুমি কেনো জোড় করছো!!!
স্তব্দ হয়ে গেলো তানহা,,,
-তোমার ভালোবাসায় জোড় চললে,,,,আমার বেলায় কেনো চলবে না!!!
এবারও জবাব এলো না কোনো তানহার কাছ থেকে,,,,,ওর সব শব্দ যেনো হারিয়ে গেছে,,,,,
-তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে তানহা,,,,,ভুল কাজ করে নিজের কপালে “বোকা” ট্যাগ লাগিয়ে নিও না,,,…
তানহা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে,,, খুব চেষ্টা করছে,,,চোখের পানি আটকে রাখার,,,
-ভালোবাসা খুব বিচিত্র একটা অনুভূতি তানহা,,,,প্রয়োজন না,,,,আমরা যাদের ভালোবাসি,,,তারাও আমাদের ফিরতি ভালোবাসবে,,,,প্রয়োজন এটা,,,আমাদের ভালোবাসার মানুষটা যেনো,,,সুখে থাকে,,,হাসি খুশি থাকে,,,,ভালো থাকে,,,……………………..
আমি আমার যথা সম্ভব চেষ্টা করছি,,,যেনো শিশির হাসি খুশি থাকে,,,ভালো থাকে,,, আমি চাইবো তুমিও তোমার যথেষ্ট চেষ্টা করো,,,যেনো শুভ্র খুশি থাকে,,,,,,
তানহা মুখ ঘুরিয়ে তাকালো জানালার দিকে,,, বাহিরে গার্ডেনে ও গতকালই একটা দোলনা বসিয়েছে,,,,ওর খুব ইচ্ছা,,,ঝুম বৃষ্টিতে এই দোলনায় বসে শুভ্রর সাথে ভিজবে,,,,আর হাতে থাকবে গরম ধুমায়িত কফির মগ,,,,,,
-আমি কাল সন্ধ্যায় ঠিক ৬টা বাজে বরযাত্রী নিয়ে বের হবো,,,,এবং ঠিক ৮টার মধ্যেই বিয়ের কার্যক্রম শেষ করবো,,,, আমি আশা করবো এই ৮টার মধ্যেই তুমি তোমার সঠিক সিদ্ধান্ত নিবে,,, কারন এই ৮টার পর,,,আমার হাতেও কিছু করার থাকবে না,,,,,,।
কথাটা শেষ করেই আবির বেড়িয়ে গেলো,,,,,,,, ওর মনে হচ্ছে,,,,বিশাল বড় একটা পাথর সড়ে গেলো ওর বুকের উপর থেকে।
সারারাত তানহার ঘুম হলো না,,,, এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দিলো ও…. ভোরের দিকে উঠে,,,,তানহা দৃঢ় পায়ে শুভ্রর রুমের সামনে গিয়ে দাড়ালো,,,, রুমের দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো,,,,,বিছানায় শুভ্র উপুর হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে…. বাহিরের কাপড় পর্যন্ত চেঞ্জ করে নি….
তানহা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে…. শুভ্রর ডান হাতে ওর ফোন ধরে রাখা হালকা করে…. ঘুমোনোর আগে হয়ত ফোনে কোনো কাজ করছিলো… হাতে ফোন নিয়েই ঘুমিয়ে গেছে…
তানহা আস্তে করে ফোনটা ওর হাতে নিলো…. ফোনের সাইডে অন বাটনে প্রেস করতে ফোনে লাইট জ্বলে উঠল,,,, স্ক্রিনে শুভ্র আর শিশিরের একটা হাসিখুশি ছবি…. শুধু হাসিখুশি…. খুবই প্রাণখোলা হাসি…. ছবিটাতে শিশির হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসছে,,,,আর শুভ্র ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে…. বা হাতে শিশিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে রেখেছে…….
ফোনটা জায়গামত রেখে তানহা শুভ্রর মাথার পাশে,,,বিছানার ডিভানে বসল,,,,, ওর সিদ্ধান্ত থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ওকে নড়াতে পারে নি….
পর্ব ২৯
শুভ্রকে চুপ থাকতে দেখে… তানহা বলেই চলল…
-তুমি কেনো বুঝতে চাইছো না আমাকে…..নিজের ভালোবাসার জন্য তুমি সব করতে পারো…. আমি কি করতে পারি না….!?….
-……………………..
-তোমার আর আমার ভালোবাসার মধ্যে এত তফাৎ কিভাবে হয় বলো!!?…
-…………………………
-আমি তোমাকে চাই শুভ্র…… তোমাকে ভালোবাসি বলেই চাই।
শুভ্র খুব শান্ত ভাবেই তানহার প্রতিটা কথা শুনলো…. এবং খুব শান্ত স্বরেই জবাব দিলো
-তানহা…. আমি কাকে কিভাবে ভালোবাসবো… সেটা নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে….
-আমিও তো ঘামাতে চাইছি না….. আমি যাস্ট এতটুকু বলতে চাইছি…. প্লিজ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না……
-আমি তোমাকে ইনসাল্ট করতে চাইছি না.. তানহা….. খুব ভালোভাবে বলছি…. তুমি এখন যাও…. তোমার সাথে আর একটা কথা বলার ইচ্ছাও আমার নেই।
-কেনো!! কেনো যাবো আমি….. ফর গড সেক শুভ্র কি আছে ওই মেয়ের মধ্যে!!!! যার জন্য তুমি আমার সাথে….. ইভেন তোমার প্যারেন্টস এর সাথে রুড বিহেভ করো….
শুভ্র ভ্রু কুচকে তাকায়….. তানহা আবার বলতে শুরু করে,
-হ্যা আমি জানি…. আংকেলের সাথে আমার কথা হয়েছে শুভ্র…… তুমি ওই মেয়ের জন্য কি কি করেছো…. সব কিছুর খবর এখন আমার আছে,…..
-তো….. আমি কি করতে পারি!!!!??? আমাকে কি তুমি ভয় দেখানোর চেষ্টা করছো নাকি!!! হাহ!! হাসালে… তানহা…
-আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চাইছি…. মেয়েটা তোমার যোগ্য না শুভ্র… সি ইজ নট ওরর্থি…. নাথিং বাট এ প্যাকেট অফ প্রবলেম…..
-থামো তানহা…. বেশি বলে ফেলেছো… খুব বেশিই বলে ফেলেছো…..ইউ সুড মাইন্ড ইউর অওন বিজনেস…..
-তাই তো করতে চাইছি….. এই শুভ্র শোন না…. তুমি প্লিজ আমার দিকে একটু তাকাও…. তুমি কি একটুও আমাকে ফিল করছো না…..
-এভাবে হয় না তানহা….. তুমি যাও এখান থেকে…
-প্লিজ প্লিজ প্লিজ শুভ ফিরিয়ে দিও না আমায়!!
তানহা শুভ্রর হাত চেপে ধরল….শুভ্র এবার খুব আস্তে করেই হাতটা সড়িয়ে নিলো….
-যাও তানহা….. আমি আর এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নই….
শুভ্র সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিল… পিছন থেকে তানহা বলে উঠল,
-আজ রাতে আমার ফ্লাইট শুভ্র…. আমি চলে যাচ্ছি আজ….কিন্তু খুব দ্রুতই আবার তোমার সাথে দেখা হবে…….
শুভ্র রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে দিলো…. তানহার জন্য ওর এখন একটু খারাপ লাগছে…. কারন শুভ্র জানে… জোর করে ভালোবাসা আদায় করাটা কতটা কষ্ট দেয়….. একটা মানুষ কতটা নিরুপায় আর অসহায় না হলে একজনকে জোর করে নিজের করতে চায়……. আর যেই মানুষটার সাথে জোর করছে ওই মানুষটাও কি আদোতে ভালো থাকে…… আজ তানহা ক্ষনিকের জন্য শুভ্রর সাথে এরকম ব্যবহার করেছে তাতেই শুভ্রর অসহ্য লাগছিল….. আর শুভ্রতো টানা দুই বছর….. না…. তার চেয়েও বেশি সময় যাবত এভাবে জোর করে বন্দি করে রেখেছে শিশিরকে…. শিশির তখন কতটা তিক্ত হয়ে গিয়েছিল!!!!
বেশ লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুভ্র বিছানায় বসা অবস্থা থাকতেই শুয়ে পড়ল…. এক হাত ভাজ করে দুই চোখের উপর রাখল…….. বিড়বিড় করে বলল “সরি শিশির”
শিশির বাসায় আসতেই মা ফোন করে জানালেন কাল সকালেই ওনারা ঢাকা চলে আসবেন…… শিশির আর ঘরের খোঁজ খবর নিলেন….শিশির বাসায় এসে এতোটাই ক্লান্ত ছিল যে সাথে সাথে বিছানায় যেয়ে উপুর হয়ে পড়ল……
শুভ্র বেশকিছুক্ষণ যাবৎ শিশিরকে ফোন দিয়েই যাচ্ছে…. কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না….শুভ্র বার বার ঘড়ি দেখছে… এখন বাজে সাতটা….. ৯টায় তানহার ফ্লাইট….. শুভ্র কি একবার যাবে….. আর যাইহোক মেয়েটার কোন দোষ ছিল না….
“লাভ ইস ব্লাইন্ড” যারা এই লাভের পাল্লায় পড়ে তারাতো সব অন্ধই হয়ে যায়!!! সঠিক বেঠিক কি তখন মাথায় থাকে!!! সাত পাচ ভাবতে ভাবতেই শুভ্র বাসা থেকে বের হলো..….।
শিশিরের ঘুম ভাঙলো ৭.২৮- এ…… উঠে সাথে সাথে ও গোসল করতে চলে গেলো…. গোসল থেকে এসে দেখে ফোনটা অনবরত বাজছে….
-কি করো শিশির!?….
-এইতো… ফ্রেশ হলাম… মাত্র… ঘুমিয়ে ছিলাম এতক্ষন তাই…..
-ওহহহ! একটা কাজ করো…চট করে তোমাদের বাসার ছাদে চলে যাও…..
-ছাদে যাবো কেনো!!! তুমি কি বাসার সামনে এসেছো!?…..
-আগে যাওতো রে বাবা…. তারপর কিচিরমিচির করো….
-তুমি কি সত্যি বাসার সামনে!?….. প্লিজ শুভ্র এখন তুমি যাও….. আমি কোথাও যেতে টেতে পারবো না…..
-আমি কিন্ত দাড়িয়ে থাকবো….
-থাকো দাড়িয়ে……
ফোন রেখে দিলো শিশির….. এই ছেলেটা এমন কেনো!!! যখন যা মন চায় তখন তা করলে কি চলে!! আজই মাত্র এলো ঘুরে টুরে!!! আজই আবার বাসার সামনে!!!…… যাবে না শিশির…. কিছুতেই না….. বাসার কেউ যদি দেখে ফেলে….. বাবা’র কানে এইখবর যদি যায় তাহলে আগুন লেগে যাবে……..
কিন্তু শুভ্রকে শিশির চিনে…. যতক্ষন না শিশির ছাদে যাবে…. ততক্ষণ শুভ্র নিচেই দাঁড়িয়ে থাকবে…. শিশির বসার রুমের জানালার ফাঁকে দিয়ে একটু নিচে উকি দিলো…. শুভ্রকে দেখা যাচ্ছে না…. কিন্তু ও জানে শুভ্র আশেপাশেই আছে……থাকুক…!!! তাতে শিশিরের কি!! শিশির যাবেই না……
উফফফ!! ধ্যাত কিসব যন্ত্রণা….. বলতেই বলতেই শিশির জুতা পড়ে ছাদের জন্য ঘর থেকে বের হল।
গেট ঠেলে ছাদে ঢুকতেই শিশির হাত পা জমে বরফ হয়ে গেলো….. পাশের সাততলা বিল্ডিং-এর পাঁচতলার ফ্ল্যাটের থেকে আলো এসে পড়ছে শিশিরদের ছাদে। সেই আলোয় শিশিড় স্পষ্ট দেখল… লম্বা একটা অবয়ব…. কালো কালার শার্ট পড়া,,,মাথায় কালো একটা ক্যাপ। ক্যাপটা এমন ভাবে পড়া যে মুখের অর্ধেক ঢেকে আছে…… ছাদে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অবয়বটা পিছন ফিরে একটা হাসি দিয়ে বলল,
-এতক্ষন লাগলো তোমার আসতে শিশির!!! ৩৭টা মশার কামড় খেয়েছি দাড়িয়ে থাকতে থাকতে!!
তানহার ফ্লাইট আর মিনিট খানিকের মধ্যেই টেক অফ করবে। তানহার উইন্ডো সিট…… জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে….. অনবরত চোখের পানি পড়ায় চোখ ব্যাথা করছে……
“শেষসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম শুভ্র…. তাও তুমি এলে নাতো!!! বেশ…..এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা…. আমিও চুপ থাকবো না” -বিড়বিড় করে এতটুক বলেই চোখ মুছল তানহা।
পর্ব ৩০
শিশির ক্যাম্পাসের স্ট্যাটিস্টিক্স ডিপো. এর সামনে ঘুরঘুর করছে। আজ ক্যাম্পাসে ঢুকার সময় আবিরকেও ক্যাম্পাসে আসতে দেখেছে ও…. আবিরের সাথে কথা বলা উচিত। আবির নাহয় ব্যস্ততার জন্য ওকে ফোন দিতে পারে না…. কিন্তু শিশিরেরতো উচিত ছিল মাঝেমাঝে একবার ফোন দিয়ে খোজ খবর নেওয়া। এতোটা স্বার্থবাদী কিভাবে হয়ে গেল ও….আবির ওর এতবড় একটা উপকার করল….দিন দিন নিজেকে এত অসহ্য লাগছে শিশিরের!!! হঠাৎ নিজের কাধে পিছন থেকে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে সাথে সাথে ঘুরে তাকালো শিশির……
-কি ব্যাপার!!! আজ কি ম্যডাম ভুল করে এই পথ ধরলেন নাকি!?………….
-নাহতো….. পুরোনো এক বন্ধুকে এই রাস্তায় হারিয়ে ফেলেছিলাম…..তারই খোজ নিতে এলাম….
-তা পেলেন নাকি বন্ধুকে?……
-হুম….. পেলামতো,,,,, কিন্তু শুধু পেলেই কি চলবে….. এক কাপ চা যদি খেতে পারতাম বন্ধুটার সাথে……!!!
শিশিরের এরকম করুন ভংগিতে আবদার করা দেখে আবির হেসে ফেলল,,,,,
-তাতো খাওয়াতেই পারি…..
আবির ডানহাতটা একটু সামনের দিকে বারিয়ে বলল”আফটার ইউ…”
শুভ্রর সারাদিন ঘরে বসে কাটাতে ভালো লাগে না…. মাস্টার্সের ফাইনাল শেষ… রেজাল্টের অপেক্ষা…..কিন্তু রেজাল্ট পেলেও কি…. ওর বাবার ব্যবসা দেখার কোন ইচ্ছাই ওর নেই…. চাকরি করাও ওর পছন্দ না…..কিন্তু এখন……. কিছু একটা করা উচিত…….. বন্ধুগুলাও সব শেষ ছুটি কাটিয়ে নিচ্ছে বলল…. মানে ওরাও যার যার ব্যবসার হাল ধরবে…… সকালে শিশিরকে ক্যম্পাসে দিয়েই বাসায় ফিরে এসেছিলো শুভ্র। ঘড়ির দিকে তাকালো….. ১.৩০ টা বাজতে চলল….. শুভ্র বাইকের চাবি নিয়েই বের হয়ে গেলো….
শিশির আর আবির সামনাসামনি বসে আছে…… শিশির চায়ের জন্য বলেতো ছিল…. কিন্তু এখন চরম পর্যায়ের অসস্তি হচ্ছে….. এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিন্তু আবিরের দিকে তাকাতে পারছে না……
-আমি বোধহয় আর আগের মত হ্যান্ডসাম নেই…. তাই না শিশির!?…..
-হুম!!… নাহ… নাতো…. কই… আছোতো হ্যান্ডসাম….আছো… এখনো…
-তাহলে তুমি এই ক্যান্টিনের চেয়ার টেবিল… দেয়াল… ইভেন চা দিয়ে যায় ওই লোকটাকেও ঘুরে ঘুরে দেখছো….অথচ আমার দিকে একবারও তাকাচ্ছো না…….!!!!
-না….মানে… এমনেই আরকি!
-আমি মনেহয় তোমার ফ্রেন্ড হওয়ারও যোগ্য না…. তাই না শিশির!?……
-……………….
-আমার কিন্তু তোমার উপর রাগ করার কথা….. খুব বেশি রাগ করার কথা……
-……………….. আমি অনেক স্বার্থপর হয়ে গেছি তাই না!!!
-হুম….. হয়েছো তো বটেই….
-সরি আবির!!!! আমি আসলে খুব বেশি গিল্টি ফিল করছিলাম… তোমার সাথে কথা বলতে!!
-…………….
-কিন্তু যতযাই হোক আমার এট লিস্ট তোমার সাথে যোগাযোগ রাখা উচিত ছিল…. নিজের মধ্যে এতোটা ব্যস্ত না হলেও পারতাম……. যখন প্রয়োজন হয় তখনই তোমাকে শুধু ফোন করি এটাকি ঠিক!?……
-উহু…. একদমই ঠিক না…..
-আওওফফফ…. আমি একটা আস্ত বদ মেয়ে…..
-হুম…. একদম ঠিক…..
-তুমি হাসছো কেনো!?……
আবির জোর করে নিজের হাসি চেপে রেখে বলল….
-কই নাহ তো!!!
-তুমি কি মজা নিচ্ছো!!?… আমি কিন্তু সিরিয়াস….
-আমিও সিরিয়াস….
বলেই আবির জোরে জোরে হাসতে লাগল….” শিশির মাঝে মাঝে চেহারা এমন করো না…. যে হাসি চলে আসে….”….. বেশকিছুক্ষন পর হাসি থামিয়ে আবির বলল
-আচ্ছা শিশির এসব কথা ছাড়ো….. তোমাদের ব্যাপারটা কি করবে!?…..
-কোন ব্যাপার!!
-তোমার আর শুভ্রর….. তোমার ফাইনাল হয়ে গেলেই কিন্তু আংকেল বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগবে….
-হুম….
-তার আগেই তোমার শুভ্রকে উনাদের সামনে হাজির করা উচিত…. আর আমাদেরতো মাস্টার্স শেষ হয়ে গেলো…. শুভ্র কি করবে!?…. ওর বাবার ব্যবসায় বসবে!?…..
-কিছু বলেনি তো এই ব্যাপারে!! বাসায় তোমার ব্যাপারটা কিভাবে সামলাবো তাই তো বুঝতে পারছি না……
-ওটার চিন্তা করো না…. ওটা আমি ক্লিয়ার করে রেখেছি……
-কিভাবে!! বাবা’র সাথে কথা হয়েছে তোমার!?…..
-হুম….. আংকেলের সাথে বলতে গেলে প্রতিদিনই কথা হয়…. কখনো আংকেল ফোন দেয়! কখনো আমি দেই…..!!
-কিহ!!
-হুম….. আংকেলের সাথে আমি অনেক আগেই সব কথা ক্লিয়ার করে রেখেছি……ভেবেছিলাম উনি হয়তো প্রচুর রাগ করবেন…. কিন্তু উনি তারপরও আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছেন….. তোমার বাবা’টা খুব ভালো…. বুঝলে শিশির……. এভাবে যে কাউকে সবাই ভালোবাসতে পারে না…. কিন্তু উনি তারপরও আমাকে ভালোবাসেন…..
শিশিরের এখন আরো বেশি খারাপ লাগছে…. আবির ওর ফ্যামিলির সাথে ঠিকই যোগাযোগ রেখে সবকিছু সামলে রেখেছে…. যেনো শিশিরের কম ঝামেলা পোহাতে হয়…. আর শিশির কিনা!!! এতোটা ভুলে যাওয়া একটা মানুষকে!!! কিভাবে পারলো ও!!!!
শুভ্র ক্যান্টিনে ঢুকে সোজা গিয়ে দাড়ালো শিশিরদের টেবিলের সামনে….
-তোমার ফোন কথায়!?…..
শুভ্রকে এভাবে হঠাৎ দেখে শিশির ভীষণ রকম ভয় পেয়ে গেলো…. সামনে আবির…. শুভ্র যদি এখন ক্ষেপে গিয়ে কোন কেলেংকারি করে বসে!!!
-আছে…ব্যাগে….
-যদি ফোন রিসিভই না করতে হয়…. তাহলে ফোন ব্যবহার করো কেনো!!! কবুতর ব্যবহার করলেই পারো!!
এই রে!!! ক্ষেপেছে,,, ভালো রকম ক্ষেপেছে!!! এখন উপায়!! হে আল্লাহ…. সহায় হও….
ভাবতে ভাবতেই শিশির একটা শুকনো ঢোক গিলল…….
-কেমন আছো শুভ্র!?……
-ভালো………
-বসো…. শুভ্র…. তোমাদের ব্যাপারেই কথা বলছিলাম…..
শুভ্র ঘুরে গিয়ে শিশিরের সাথের চেয়ারটায় বসলো….
-তা কি চিন্তা ভাবনা করলে!!! মাস্টার্স তো শেষ…. ক্যারিয়ারের কি প্লান…..
-আমাকে নিয়ে তোমার টেনশন করতে হবে না….
-অবশ্যই করতে হবে…. কারন এখন তোমার সাথে শিশির জড়িত…..
-তো!!!
-এত কাঠখড় পুড়িয়ে শিশিরকে তোমায় দিলাম….. হেলা ফেলা করার জন্যতো না…..শিশিরের জন্যই তোমাকে শিশির যোগ্য হতে হবে….. বুঝো তো নাকি!!!
-দিন দিন শিশিরের দায়িত্ব কি তুমি নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিচ্ছো নাকি!!
-বলতে পারো….. কাউ না কাউকে তো নিতেই হবে…..! কি বলো!?….
-ডোন্ট ট্রাই টু প্লে স্মার্ট…….
-ভালো করে বুঝে শুনে কাজ করো শুভ্র…… সুযোগ একবার পেয়েছো বলে যে বার বার সুযোগ পেয়ে যাবে!!! তা কিন্তু হবে না…..!!
-আর এসব কথা তোর বলতে হবে না…. নিজেরটা দেখ….. নিজের যোগ্যতা নিয়া ভাব….. আমি কিভাবে শিশিরকে খুশী রাখবো তা আমি জানি……. আমার জিনিসের দেখভাল আমি পারি….. তোর নজর দিতে হবে না……..
এবার আবির চোখমুখ শক্ত করে বলল
-শুভ্র…. যেটা সত্যিকার অর্থে তোমার…. সেটা তোমারই থাকবে…. কেউ নজর দিলো না দিলো…..তাতে কিছু যায় আসে না….. এতোটা ইনসিকিউর কেনো ফিল করো!!!!
-তু………
“থামো……….. দুইজনই এখন একটু থামো” বলেই দুজনের দিকে কড়া নজরে তাকালো শিশির…… “দেখা হলেই ঝগড়া করতে হবে নাকি!!! আশ্চর্য্য!!…. ”
” চলি শিশির… পরে একসময় কথা হবে” বলেই আবির চলে গেলো……
শিশির রেগেমেগে তাকালো শুভ্রর দিকে…
-ওকে দেখলেই তুমি সবসময় এমন চাড়ালের মত করো কেনো!!
-ও সবসময় তোমার পিছন পিছন ঘুরে কেনো!!
-প্লিজ শুভ্র সস্তা এক্সকিউজ ঝাড়বা না…… আবির আমাদের ভালোর জন্যই কথা বলছিল…. এতোটা রুড বিহেভ না করলেই পারতা…..তোমার ওকে যেয়ে সরি বলা উচিত….
-আমি অবাক হয়ে যাই শিশির….. সবসময় ওর আর আমার মাঝে তুমি আবিরকে সাপোর্ট করো!!! কেনো….!!!! এতোই যখন ওরে ভালো লাগে…. তাহলে আমি কেনো আছি!!! আমি না থাকলেই পারি!……
শিশির খুব শান্তভাবে শুভ্রর হাত ধরল…..
-শুভ্র ভুল করলে সরি বলাটা তো ভুলের কিছু না….. সরি বললে তুমি ছোট হয়ে যাচ্ছো নাতো….
পর্ব ৩১
শিশিরদের বাসার গলির সামনে এসে শুভ্রর বাইকটা থামলো….. হেলমেট খুলতে খুলতে শুভ্র বলল,
-আর কতবার!?…. একজেক্টলি….আর কতবার আমাকে আবিরের কাছে সরি বলতে হবে বলতো…..
শিশিরের হেলমেটে পেচিয়ে যাওয়া নিজের চুল ছাড়াতে ব্যস্ত অবস্থায়ই জবাব দিলো….
-ঠিক যতবার তুমি ভুল করবে…..
শুভ্র এই জবাবে ভ্রু কুচকে তাকালো শিশিরের দিকে…. তারপর হাত দিয়ে শিশিরের পেচিয়ে যাওয়া চুল খুলে দিলো……শিশির হুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-শুভ্র ভুল করাটা খুব অন্যায়…. কিন্তু তুমি যদি তোমার ভুল বুঝতে পারো…. সরি বলো…. তাহলে অন্যায় সরিতে কাটাকাটি হয়ে যায় ব্যস…..!!!… তাহলে সরি বলতে কেনো এত বাজে তোমার…..!?
-না…… মানে আসোলে এমনেই…… আচ্ছা যাও…. তুমি বাসায় যাও…..
শিশিরকে দিয়ে শুভ্র সোজা নিজের বাসায় চলে এলো…..ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো…. ঠান্ডা মাথায় কিছু প্লানিং করা প্রয়োজন….. শুভ্র চোখ বন্ধ করে দাড়ালো…. আবিরের বলা কথাগুলো তিতা লাগলেও সত্য…. ওকে অবশ্যই যোগ্য হতে হবে…… আর তাছাড়াও…… ও অনেক বেশি ঝামেলা ছড়িয়ে ফেলেছে…… শিশিরের ফ্যামিলির সাথে ওর অলরেডি একটা নেগেটিভ সম্পর্ক তৈরি হয়ে আছে….. আগে সেটাকে ঠিক করা প্রয়োজন….. হুম… অবশ্যই প্রয়োজন…. শিশিরকে নিজের করে নিতে হলে ওর আশেপাশের সবকিছুকেই নিজের করে নিতে হবে….. শুভ্র আরো কিছুক্ষণ এভাবে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থেকে… ভিতরে চলে গেলো….
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করল শিশির…. এরপর শুভ্রকে ফোন দিলো….
-কি খাওয়া দাওয়া হলো?…
-হুম… মাত্রই শেষ করে ফোন দিলাম তোমাকে……..তুমি খেয়েছো?…
-হুম!!! এইতো খাবো…. তোমার সাথে কথা বলা শেষ করেই যাবো…….
-তোমার এই বদঅভ্যাসটা ছাড়োতো….. এত লেট করে কেউ ডিনার করে নাকি!…….
-হ্যা করেতো…এই যে আমি…..
-ধুর….. ঢং একটা……
-আর তুমি একটা ঢংগী….. আমাদের ঢং ঢংগীর ভালোবাসা…..
-যাও তো খেতে যাও…..
-হুম যাবোতো রে বাপ….. একটু কথা বলি…. পরে তো আর কথাই বলবা না….. খালি ভোসভোস করে ঘুমাবা…
-এই আমার ঘুমের ব্যাপারে কিছু বলে একদম ঘাড় মটকে দিবো বললাম….. তুমি নকটার্নাল প্রানী…. আমি না হলেও চলবে…..
-হাহাহা…. আচ্ছা মানলাম…. তোমার সাথে কথাই বলা যায় না…. সবসময় তর্ক….. আমি যে তোমার বড় তা কি মনে আছে…. বেয়াদপ মেয়ে…..
-ওরেরেরে আসছে…. এত যখন বড় তাহলে আমার মত ছোট মেয়ের সাথে প্রেম করলা কেন….
-এইযে আবার আবার আবার…. তর্ক…. উফফফ….
-আচ্ছা সরি,,,,, আর করবো না….
-হুম গুড গার্ল…… আচ্ছা শিশির…. আমি…. আসলে আমি একদিন তোমার বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম….
-এই না না….. তুমি ভুলে গেসো বাবা আর ফুপু তোমার উপর কি ক্ষেপা….
-হ্যা… মানে ওইজন্যই আর কি…. আমি ওনাদের সাথে কথা বলতে চাই…..
-কি!??…. কি বললা…. তুমি কি আসলেই কথা বলতে চাইছো!…
-আমি ভুল তো করেছিলাম….. সেজন্য তো অবশ্যই কথা বলা প্রয়োজন তাই না…..
-রিয়েলি!!???….. আল্লাহ…. সত্যি!!! থ্যাংক ইউ… থ্যাংক ইউ সো মাচ শুভ্র….. তুমি জানো আমি খুব টেনশনে ছিলাম,,,, কিভাবে তোমাকে বাবার সামনে হাজির করবো….. বাট এখন…. তুমি আমাকে পুরাই টেনশন মুক্ত করে দিলা…..
-আমিও এখন সব ঠিকাঠাক করতে চাই………. তো আমি কালকে আসি!?….
-না না কালকে না….. দুইমাস পর ফুপু আসবে আবার….. তুমি একবারে তখনই আইসো…. কেমন!?….
-হুম…. ওকে……
কথাবার্তা শেষ করে ফোন রাখার পর শিশিরের মনে হল ওর বুকের উপর থেকে একটা ভারি পাথর নেমে গেছে….. বাবা আর ফুপু শক্তের শক্ত হলেও আবার খুবই নরম….. শুভ্র যদি একবার এসে সিনসিয়ারলি মাফ চায় তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে….. আহ!!! এবার বুঝি সব আসোলেই ঠিক হয়ে গেলো……
দুই সপ্তাহ পর……
শিশির তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠল…. আজ কোনভাবেই ক্যম্পাসে লেট করে যাওয়া যাবে না… শিশির আগে ভাগেই শুভ্রকে বলে দিয়েছে…আজ যেনো ওকে পিক করতে না আসে…. তাহলে যে সারপ্রাইজটা আর হবে না….. শিশির খুবই উত্তেজিত ফিল করছে…. আজ শুভ্রর জন্মদিন…. শিশির এই প্রথম শুভ্রর জন্মদিন নিয়ে এতোটা প্লান প্রোগ্রাম করল…. ভালোয় ভালোয় সারপ্রাইজটা দিতে পারলেই হয়….শিশির খুব হালকা কিন্তু সুন্দর করে সাজলো…. গুছিয়ে শাড়ি পরলো নিজে নিজে……… সময়মত বাসা থেকে বের হয়ে গেলো…. বের হওয়ার সময় মা একটু আড় চোখে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না…..
শিশির ক্যাম্পাসে যেয়ে শুভ্রকে ফোন দিলো…..বলল কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে থাকতে…… শিশির পৌছানোর আগেই শুভ্র পৌছে গেলো…..
শিশির শুভ্রর পিছন থেকে গিয়ে “ভাউ” করে উঠল….. শুভ্র পিছনে ফিরে হালকা হাসি দিলো….. চোখে মুগ্ধতার ছাপ স্পষ্ট……
শুভ্রকে নিয়ে শিশির একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল…..রেস্টুরেন্টে শুভ্রর বন্ধুরা আগে থেকে উপস্থিত….. ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট কিন্তু খুব ওয়ার্ম ডেকোরেশান….. খুব হৈ হৈ করে শুভ্রর জন্মদিন পালন করা হল….শিশির বেশকয়েকবার শুভ্রর দিকে আড়চোখে তাকালো…. শুভ্র হাসছে, আড্ডা দিচ্ছে…. বেশ স্বাভাবিক…. কিন্তু তাও কিছু একটা বাজলো শিশিরের চোখে…..
ক্লান্ত দুপুরের দিক…..….
শুভ্র আর শিশির হাতে হাত ধরে ফুটপাত ধরে হাটছে….. গন্তব্যহীন হাটা……
-শিশির…..
-হুম……
-কিছু বলার ছিলো…..
-আমি জানি……. তুমি কিছু বলতে চাইছো…… কিন্তু এতক্ষণ পর……!!
-আসোলে….. শিশির….. কাল রাতে সিডনি থেকে ফোন এসেছিলো….
-সিডনি!?….
-হুম….. বাবা আর মা আছে সেখানে….. কি একটা নিউ বিজনেসের জন্য বেশ কয়েকমাস যাবৎ…….
-ওহ….. পরে কি বলল…..
-জানালো….. ব্যবসা নিয়ে কি ঝামেলা হচ্ছে….. বাবা’র শরীরটাও ভালো না…… হসপিটালাইজড….
-আল্লাহ…. তাহলে এখন!?….
-আমি সিডনি যাচ্ছি………… শিশির…..
শিশির পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইল শুভ্রর দিকে…….. তারপর মুখটা নিচু করে বলল
-আগে বলো নি কেনো!?……
-আগে বললে যে তোমার এই কষ্ট মাখা চেহারাটা বেশিক্ষণ দেখতে হত……
-কবে যাচ্ছো?….
-আজ রাতে ফ্লাইট….
শিশির ঝট করে উপরে তাকালো….. চোখ দুটো ছলছল করছে….
-এই বদ মেয়ে…. খবরদার কাদবে না….. কাদলে কিন্তু এক চড় লাগিয়ে দিবো……
শিশিরের গাল বেয়ে ততক্ষণে পানি পড়তে শুরু করেছে……
-শিশির….. প্লিজ…..
শুভ্রর নিজের ভিতরটাও যেনো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে…… যেখানে শিশিরকে ছাড়া একদিনও চলে না….. সেখানে এতদিন…….
-কয়দিনের জন্য যাবে!?…..
-বেশিদিন না শিশির সত্যি….. একদম সত্যি…… ঝামেলা মিটিয়েই চলে আসবো…….
শিশির চোখের পানি যেনো থামতেই চাইছে না…..
শুভ্র জড়িয়ে ধরল শিশিরকে…… দুপুরদিকে এমনেই রাস্তায় মানুষজন কম থাকে… আর ওরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে সেখানে মানুষই নেই…… শুভ্র বেশকিছুক্ষন শিশিরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল…….।
বাসায় গিয়েই শিশির নিজের রুমের দরজায় খিল দিল…….শুভ্রকে বলেতো এসেছে ও থাকতে পারবে!! কিন্ত আদৌ কি পারবে!!!…. হাউমাউ করে কাদতে মন চাইছে….. কিন্তু তা সম্ভব না….. বাহিরে আওয়াজ গেলেই সমস্যা……. বিকাল পর্যন্ত টানা চোখের পানি ফেলার জন্য চোখ ব্যাথা করতে লাগল….. শিশির কোনরকমে উঠে ফ্রেশ হয়ে চোখেমুখে পানি দিয়েই বিছানায় পড়ল….. মা বেশকয়েকবার ডাকাডাকি করলেও শিশির দরজা খুলল না,……..পাছে সবাই টেনশন না করে তাই হালকা করে বলে দিলো “শরীর ভালো না”
ফোন বাজছে….. শুভ্র ফোন করেছে…. নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে…. শিশিরের কান্নার দমক বেড়ে গেলো….ফোন রিসিভ করল না…..শুভ্র ছোট করে একটা মেসেজ দিলো “আমি যাবো না শিশিড়……. তুমি প্লিজ এভাবে কেদো না”
শিশির কাপা কাপা হাতে ফোন নিয়ে রিপ্লাই দিলো…..”আমি এখন কথা বলতে পারবো না শুভ্র….. প্লিজ জোর করো না…… আর আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি প্লিজ যাও….. তুমি না গেলে আমি জীবনেও তোমার সামনে আসবো না….”
মেসেজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শুভ্র….. মেয়েটা না জানি কি পরিমান কাদছে….. শুভ্রর ইচ্ছা করছে এক দৌড় দিয়ে এক্ষুণি শিশিরের কাছে চলে যাক…. কিন্তু পারবে না…. সিডনি থেকে জরুরি তলব এসেছে… ওকে নাকি যেতেই হবে….. এয়ারপোর্টের ভিতরে পা বাড়াতেই শুভ্রর ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগল…. শুভ্র আরেকবার শিশিরের নাম্বার ডায়াল করল… রিসিভ হলো না…….
দীর্ঘ তেরো ঘন্টার ফ্লাইট শেষ করে শুভ্র যখন সিডনির কিংসফোর্ড স্মিথ এয়ারপোর্টে পা রাখল….. তখনও ওরা দুজনের কেউই জানতো ভবিষ্যত আসোলেই কতটা ভভয়াবহ হতে পারে!!!
পর্ব ৩২
শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে শিশির…. কিন্তু কোনমতেই চোখে ঘুম আনতে পারছে না ….শিশির মনে মনে গান আওড়াতে লাগল “ঘুম পাড়ানি মাসী পিসি মোদের বাড়ি এসো……………………………………………………”
শিশিরের চোখ জ্বালা করতে শুরু করছে…. মাথাও টনটন করছে… মুখ তিতা হয়ে আসছে…. জ্বরটা আবার আসতে শুরু করেছে….. গত ৫দিন ধরে শিশির জ্বরে নেতিয়ে আছে…. গতকাল থেকে আবার নতুন নিয়মে জ্বর আসতে শুরু করেছে…. সারাদিন ভালো থাকে,,, রাত হলেই জ্বর শুরু হয়ে যায়….. তাও যেমন তেমন না আকাশ পাতাল জ্বর…
শিশির জ্বলন্ত চোখই বন্ধ করল…. গড়গড় করে চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো….. শুভ্রর কথা মনে পড়ছে….. আজ ২ মাস ২১ দিন হচ্ছে… শুভ্র যাওয়ার….. যাওয়ার পর প্রথম ১৩ দিন শুভ্রর সাথে প্রতিদিন কথা হত…. বলতে গেলে ঘন্টায় ঘন্টায় ওর ফোন আসতো…. কিন্তু এরপর হঠাৎই একদিন চুপ…….. চুপ মানে পুরাই চুপ….. একদিন,,,দুইদিন,,,তিনদিন,,,,,এবং দিনের পর দিন…. শুভ্রর কোন ফোন, মেসেজ কিছুই নেই!!! শিশিরের মনে ঝেকে বসে একরাশ ভয় আর বিস্ময়!!!! এমনতো হওয়ার কথা না…. কোন বিপদ হলো কিনা……!!! শিশির শুভ্রর প্রত্যেক বন্ধুর কাছে খোজ করল….. তারাও কোনভাবে শুভ্রর সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না……শিশির নিজেও বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো….. অনেক অনেক গুতাগুতি করেও শুভ্রর ছায়াও কেউ খুজে বের করতে পারলো না…….
ব্যস!!!! সেই থেকে এই পর্যন্ত শুভ্রহীনা শিশির…..!!!
ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে শিশিরের বুক ভারি হয়ে উঠল…. বালিশের ভিতর মুখ গুজে শিশির ফুপিয়ে উঠল….. গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আটকে আছে…. যেনো কাদতেও কষ্ট……….!!!!
সারারাতের জ্বরে সারাটা দিন শিশির মরার মত পড়ে থাকে….. সারারাতের জ্বর যেনো ওর শরীরের সব শক্তি নিয়ে যায়…!! খাওয়ার রুচিও নেই….. সকাল দিকে মা এসে বেশ কিছুক্ষণ খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করল….. অল্প একটু মুখে দিয়েই শিশির ঘর ভাসিয়ে বমি করে দিলো….. গলা দিয়ে কিছু নামার আগেই বমি হয়ে যায়…..!!!! কি যন্ত্রণা!!!
দুপুর দিকে শিশিরের ফুপু এলো ওর রুমে….
-কিরে মা…. এখন কেমন লাগছে তোর!?…..
-চোখ জ্বলে খালি…. ফুপু….
কাকলি বেগম একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে শিশির চোখ আর কপালের উপর রাখলেন…..
-কিছু খাবি..?….. অপ্ল কয়েটা ভাত আনি!!…
-রুচি করে না,,,,ফুপু…..
-একটু ঝাল ঝাল করে আনি!!???….ভালো লাগবে…..
-না…. এনো না প্লিজ…বমি করতে করতে গলা ব্যাথা হয়ে গেছে……
কাকলি বেগম বেশকিছুক্ষণ ভাইঝির মাথার কাছে বসে রইলেন….. মেয়েটার এই অবস্থা দেখে উনার নিজের কষ্ট লাগছে….. উনি ভেবে রেখেছিলেন এবার দেশে এসেই শিশিরের বিয়েটা দিয়ে যাবেন……. ভাইয়ের পছন্দ করা ছেলেটার সাথেই উনি শিশিরের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন……..হঠাৎ বিয়ে থেকে বেকে বসায় প্রথম প্রথম উনি ছেলেটার উপর খুব চটে ছিলেন……কিন্তু শিশির অসুস্থ হওয়ার পর ছেলেটা বেশকয়েকবার বাসায় এসেছে…….তখনই তিনি ছেলেটার সাথে কথা বলে পুরোপুরি মত বদলে ফেললেন……. এরমত আর ছেলেই হয় না…… যেমন সুন্দর তেমনই নম্র ভদ্র!!…….কিন্তু মেয়ের অবস্থা দেখে উনি বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে কি করবেন!!! ডাক্তার বলেছেন সিজন চেঞ্জের জন্য এমন জ্বর হয়েছে….. কিন্তু তাই বলে এতোটা….. মেয়েটা শুকিয়ে বিছানার সাথে লেগে আছে একদম….!!!
শিশির গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছে….. মানে ঘুমিয়ে গেছে বুঝে কাকলী বেগম উঠে গেলেন রুম থেকে…..
বিকাল দিকে সায়রা আর শান্ত এলো…. ক্লাসের নোটস নিয়ে…..বাকিরাও আসতো…. কিন্তু হুট করেই সবার একসাথে আসাটা কি ঠিক হবে কি না ভেবেই বাকিরা বলল “আজ তোরা যা,,,,আমরা নাহয় আরেক দিন যাবো”
ওদের দেখে শিশির খুব খুশি হলো….. কথা বার্তা বলল…. এমনকি ওদের সাথে কিছু হালকা খাবারও মুখে দিলো….. যাবার সময় শান্ত বলে গেলো….
-দ্রুত খেয়ে দেয়ে আবার পোক্তা হয়ে উঠ….. ক্লাসগুলো মিস গেলে পরীক্ষায় খুব প্যারায় পড়বি…… আর তাছাড়াও….. তোরে খুব মিস করছিরে বন্ধু…. সো দ্রুত দ্রুত যেনো তোকে ক্যাম্পাসে দেখি……
কথাটা শুনে আসোলেও শিশিরের মনে হল…. এখন জোর করে হলেও ঠিক হতে হবে…. যেকোন সময় মিডটার্মের ডেট দিয়ে দিবে…. ক্লাস না করলে পরীক্ষায় পাস করা তখন মুসকিল হয়ে যাবে……………..
এরপর শিশির অনেকটা জোর করেই খাওয়া দাওয়ায় মনোযোগ দিলো….. এভাবে আর কতদিন!!!!! আবিরের সাথেও শিশিরের প্রতিনিয়ত কথা হয়…. আবিরের মা’ও শিশিরের খোজ খবর নেন প্রায়ই….. উনাদেরও একই কথা জোর করে হলেও খাওয়া উচিত… অন্তত শরীরে কিছুটা বল পাবে…..চলাফেরা করার মত……সাজেদ, মাহিদ, রবিন, অনিক ওরাতো কতক্ষণ পর পর ফোন দিয়ে খোজ নেয়…..সবাই আছে আশেপাশে…. সবাই…… কিন্তু শুভ্র নেই!!!! আচ্ছা….. শিশিরকে এখন এত অসুস্থ দেখে শুভ্র নিশ্চয়ই চিন্তায় পাগল পাগল হয়ে যেত….. সম্পর্কের প্রথম প্রথম যখন শিশিরের হালকা ঠান্ডাও লাগতো তখন শুভ্র সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ওর সেবায় লাগত….. যতক্ষণ একসাথে থাকতো ঠিক ততক্ষণ শুভ্র পাগল করে ফেলতো…. তখন শুভ্রর ওই কান্ডগুলো ওর কাছে মহাবিরক্তিকর যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই মনে হত না….
আর এখন…….!!!!!
শিশির পণ করে নিজেকে ঠিক করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো……এবং আজ ৬দিন হতে চলল….. শিশির এখন অনেকটা সুস্থ থাকলেও জার্নি করতে পারে না…. তাই ক্যাম্পাসে যায় না কিন্তু ওর ফ্রেন্ডরাই এসে নোটস আর পড়া দেখিয়ে দিয়ে যায়……..সেখান থেকেই কিছু নোটস নিয়ে বসেছিলো শিশির…… মাথায় একটা ভোতা যন্ত্রণা থাকলেও শিশির জোর করেই পড়তে চেষ্টা করছে….. তখনই ফোনটা বেজে উঠল……নাম্বারটা দেখে শিশিরের ভ্রু কুচকে গেলো….. কাল রাত থেকে এই নাম্বারটা ডিস্টার্ব করে যাচ্ছে…. বাহিরের নাম্বার হলেও বুঝত হয়ত শুভ্র ফোন করেছে…. কিন্তু নাম্বারটা বাংলাদেশের। শিশির চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ নিয়ে ফোন রিসিভ করল…..
-এই কে আপনি!?…. সমস্যা কি আপনার!!??….. কথা না বললে ফোন করে কেনো জ্বালাচ্ছেন!!!???……. এতো টাকা পয়সা বাড়লে ছাদে যেয়ে উড়ান…… মানুষকে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করেন কেনো!?…..
-………………………..
-ধুর….আস্ত ফাজিল……
শিশির ফোন রাখতে যাবে তখনই ওপর পাশ থেকে কারো আওয়াজ পেলো……
-শিশির…….
শিশিরের শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা যেনো কেপে উঠল মানুষটার কন্ঠ শুনে…….
-শিশির…………….. আমি………..
-শুভ্র!!!
-হুম…..
শিশিরের ভিতরের পুষে রাখা এতোদিনের ভয়টা রাগে পরিণত হয়ে গেলো…… এতোদিন!!! এতোদিন পর মনে পড়ল শিশিরের কথা……!!!!
-ওহ…. বেচে আছো…. তাহলে!!
-………..,,,,,,,,,………………
-কেনো ফোন করেছো!?…….
-খুব রেগে আছো তাই না!!??…..
-নাহতো!!!! আমি কেনো রেগে থাকবো…. তাও তোমার উপর!!!! সেই অধিকারতো আমার নেই…..
-শিশির…. প্লিজ…..
-কেনো ফোন করেছো সেটা বলো……
-দেখা করতে চাই শিশির……
-কেনো!!! আমার সাথে কেনো দেখা করতে চাইছো!!??…..
-একবার শিশির!!! শুধুমাত্র একবারের জন্য দেখা করো…..
এবার শিশির মনে মনে হেসে ফেলল..রাগ ভাঙ্গানোর পায়তারা…. তাই না বাচ্চু…. লাভ নেই… এই রাগ এতো সহজে ভাঙবে না…. গলা গম্ভীর রেখেই শিশির আবার বলল,
-আমার সময় নেই…..
-ক্যাম্পাসেই দেখা করবো শিশির….. তোমাকে বাহিরে কোথাও আসতে হবে না…..
-আচ্ছা দেখি…..
-কাল?…. কাল দেখা করি শিশির?
-কয়টায়?
-১০টার দিকে….
-আচ্ছা দেখি…. ক্যাম্পাসে গিয়ে জানাবো….
-রাখি তাহলে শিশির……
কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলো শিশির…. মুখে যাই বলুক মনে মনে এতদিন পর শুভ্রকে দেখার খুশি যেনো ধরে রাখতে পারছে না…… এই খুশিতেই যেনো শিশির পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলো…..।
পরদিন খুব সকাল সকাল শিশির ঘুম থেকে উঠল….. আজ খুব ঝড়ঝড়ে লাগছে নিজেকে… শিশির তাড়াতাড়ি রেডি হতে শুরু করল…..আশ্চর্য্য!!! সময় যেনো চলছেই না…..রেডি হয়ে বেশকিছুক্ষণ বসে থেকে শিশির ধীরেসুস্থে নাস্তা করল…. তারপর ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হল…. মা আর ফুপু যদিও খুবই গাইগুই করছিল…. কিন্তু শিশির তো আজ যাবেই যাবে ক্যাম্পাসে!!! বাসা থেকে নিচে নামতেই দেখল কুয়াশা কাটেনি এখনো….. উরনা দিয়ে খুব ভালোভাবে মাথাটা পেচিয়ে শিশির রওনা দিলো….. আজ কেনো যেনো ওর খুব খুশি খুশি লাগছে…..!!!
পর্ব ৩৩
শিশির দ্রুত পা চালাচ্ছে…. ক্যাম্পাসে পৌছাতে পৌছাতে ১০.১৩ বেজে গেছে….. শিশির হাত ঘড়ির দিকে তাকালো…. আরো দ্রুত হাটতে লাগলো…….. কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছাকাছি আসতেই শিশিরের হাত পা কাপা শুরু করলো…..সেই পুরানো অনুভূতি!!!! শুভ্র দাড়িয়ে আছে গাছটার নিচে…….
দূর থেকে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল শিশির….. যত সামনের দিকে এগুচ্ছে…. তত বেশি অবাক হচ্ছে….. এই অবস্থা কেনো মানুষটার!!!!
শুভ্রর উসকো খুসকো চুল…. চেহারা ভেঙে গেছে…. আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে….গালে মুখে খোচা খোচা দাড়ি…!!!!
শিশির পাশে গিয়ে শুভ্রর কাধে হাত রাখল…. শুভ্র ওর দিকে তাকিয়েই একটা হাসি দিলো….সেই হাসিতে খুশির চেয়ে বেশি অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট!!! শিশির পলকহীন ভাবে দেখছে,,,,,,তার অতি আপন ভালোবাসার মানুষটার এই বেহাল দশা………. শুভ্রকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কি পরিমান ঝড় ঝাপটার মধ্য দিয়ে ও গেছে….. মুহূর্তেই শিশিরের রাগ অভিমান সব হাওয়ায় ভেনিস হয়ে গেলো……দিনশেষে মানুষটা যে ওর কাছে ফিরে এসেছে এইতো বেশি!!!!
ওরা বসল গাছটার বাধানো জায়গাটায়……
ওদের দৃষ্টি স্থির একে অপরের উপর…….
শিশিরের চোখ ছলছল করছে….অনেক চেষ্টা করছে কান্না না করতে…. কিন্তু তাতে যেনো কান্নাটা আরো উপচে বের হয়ে আসছে…….
শুভ্রর বুকের ভিতরে সেই ড্রাম বেজেই চলছে…. এতোদিন পর আবার এই অনূভূতিতে শুভ্রর মনে হলো “আহ!!! এবার বুঝি আমি বাচতে পারবো….. এই মুখটাই যে আমার বেচে থাকার উপায়…..”
শিশির এক হাতে শুভ্রর গালে স্পর্শ করে বলল
-একি হাল করেছো নিজের!?……
-…………………
-বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছো….. তোমার তো আরো সুন্দর হয়ে যাওয়ার কথা……
-……………………..
-নিজের হ্যান্ডসাম চেহারার এতো অবহেলা!!?……
-……………………
-শুকিয়েও গেছো অনেক!! কেনো!?…….
-…………………………..
-কথা বলছো না কেনো!
-আগে….. তোমাকে মন ভরে কতক্ষণ দেখতে দাও……..নাহলে যে নিঃশ্বাস নিতে পারবো না!!!
-ফালতু কথা বলবা নাহ….. ৩মাস তো আমায় না দেখে না শুনে দিব্যি কাটিয়ে দিলে……
জবাবে শুভ্র কিছু না বললেও,,,,,, মনে মনে বলল”যদি তুমি জানতে কিভাবে ছিলাম আমি!!”
-কি হলো আবার চুপ হয়ে গেলে যে!!….
-এমনেই…… কতদিন তোমায় শুনি না….. আজ তুমি বলবে আমি শুনবো…….
-কবে এসেছো দেশে….
-গতকালের আগের দিন…..
-ওখানে সব ঠিকঠাক?
শুভ্র মাথাটা সামনে ঘুরিয়ে নিলো…. সাথে দৃষ্টিও….. কোনদিক চেয়ে আছে বুঝা যাচ্ছে না…. শুন্য দৃষ্টি…..
-প্রশ্ন কেনো করছো শিশির…… তুমি শুধু কথা বলো…….আমি চুপচাপ শুনি….
-কি কথা বলবো!!!! আমি কি তোতাপাখি যে পটর পটর করেই যাবো!!!
ম্লান হাসলো শুভ্র…… সেটা আবার পরোক্ষণেই মিলিয়ে গেলো……
-…………….. শিশির!……
-হুম বলো……..
-আমার কিছু বলার ছিলো……!!
-হুম আমি শুনছি…….
-………………. শিশির…… আমি…..
-কি হয়েছে!?…..
-আমি….. আমি কিছুই ঠিক করতে পারিনি শিশির!!?….
-মানে!?…. কি হয়েছে শুভ্র!?….
-………..
-তুমি খুলে বলো আমাকে…. বিশাল কোনো ঝামেলা!!! আংকেল!! আংকেল কি বলেছেন!?….
-শিশির…… আমি ব্যার্থ!!
-এভাবে কেনো বলছো….
শিশির শুভ্রর গালে হাত রাখলো আবার…..
পাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ বলে উঠল……
-আমি জানতাম তুমি এখানেই থাকবে…. সকাল সকাল এভাবে আমাকে না বলে কেনো বের হয়ে গেলে!!!
শিশির শুভ্র দুইজনই ঘুরে তাকালো….. শিশির প্রচুর অবাক হলো…… তানহা কেনো এখানে!!! আবার কেনো!!! কিন্তু শুভ্র….. ভাবলেশহীন!!!
শুভ্রর প্রতিক্রিয়ায় শিশিরের বুকে এক অজানা আশংকা আর ভয় কামড় দিয়ে উঠল…..
-তুমি এখানে কেনো তানহা!?…..
-প্রশ্নটা তো আমার তোমাকে করা উচিত….
-মানে!?…. আমাকে কেনো তুমি এই প্রশ্ন করবে!?…. আমি আমার ক্যাম্পাসে….. আমার মানুষের সাথে বসে আছি!!!
-হুম… কিন্তু মানুষটা যে এখন আর তোমার নেই!!…..
-উলটা পালটা কথা বন্ধ করো…. এবং আমাদের একা ছাড়ো….. অনেক ঘুরেছো পিছন পিছন… নাও যাস্ট লিভ আস এলোন…..
-তোমার হাভ ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে শুভ্র তোমাকে কিছু বলে নি!!! কি ব্যাপার শুভ্র…. এখনো কিসের অপেক্ষা করছো তুমি!?….
-কি বলবে শুভ্র আমাকে…..
-…….. এই বলবে যে…. যে মানুষটার হাতে হাত জড়িয়ে তুমি এখন বসে আছো….. সেই মানুষটার উপর তোমার আর কোনো অধিকার নেই…..
বলেই এগিয়ে এলো তানহা….. এবং খুব আস্তে করে শুভ্রর হাত শিশিরের হাত থেকে ছাড়িয়ে দিলো…….
-তোমার পাগলামি শোনার বা দেখার ইচ্ছা আমাদের নেই…..শুভ্র চলো এখান থেকে
বলেই উঠে দাড়ালো শিশির……
-এই মেয়ে… তুমি কি কানে শোনো না…. নাকি চোখেও দেখো না…. এতক্ষন যাবৎ বলছি…. কি কিছু ঢুকে না মাথায়!?…..
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় শিশির…..
-আমি শুভ্রর বাগদত্তা…..
তানহা নিজের বাম হাতটা উচিয়ে দেখালো…. অনামিকায় একটা সুন্দর ডায়মন্ড রিং চকচক করছে…. শিশির ঝট করে শুভ্রর হাতের দিকে তাকালো….. এবং আশ্চর্য্য!!!! শুভ্রর অনামিকায়ও একটা রিং দেখা যাচ্ছে…..
শিশিরের মাথা ঘুরে উঠল….. কি থেকে কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না….. ভোনভোন করছে কান…. কি শুনলো ও!!!! এনগেজড!!! শুভ্র আর তানহা!!! কিভাবে! কেনো!
শিশির গিয়ে শুভ্রর হাত খামছে ধরল…. কোনমতে ডাকল”শুভ্র”…….
শুভ্র শুন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে…. গলা কাপছে ওর…..
তানহা এক ঝটকায় শিশিরের হাত ছাড়িয়ে নিলো শুভ্রর হাত থেকে…..
-আর কিছু মেয় বি বলতে হবে না….. এখন আর শুভ্র শুভ্র করবে না…. অনেকতো পিছন পিছন ঘুরে রং তামাশা করলে….. এখন আমাদের পিছু ছাড়ো…… খবরদার যেনো তোমাকে আমাদের আশেপাশেও না দেখি….
তানহা শুভ্রর হাত ধরে টান দিলো….. তারপর শিশিরের চোখের সামনে দিয়েই হাতে হাত জড়িয়ে হেটে চলে যেতে লাগল…..আর শুভ্র একটা বাধ্য রোবটের মতই হাটতে লাগল!!
শিশির দেখলো…. শুভ্র একটু একটু করে ওর থেকে কত দূরে চলে যাচ্ছে….. যেখান থেকে হাত বাড়ালেও শুভ্রকে আর খুজে পাওয়া যাবে না….শুভ্র কি হারিয়েই গেলো শিশিরের জীবন থেকে!!!
দুপুরে শিশির বাসায় ফিরলো আকাশ পাতাল জ্বর নিয়ে…. দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই হাটু গেড়ে বসে পড়ল ও…… হাউমাউ করে কেদে উঠল….. শিরিন বেগম দৌড়ে এসে মেয়েকে ধরলেন…. এবং রীতিমত আতকে উঠলেন….. মেয়ের যে পুরে যাচ্ছে একদম……এভাবে তো মেয়েটা মারাই যাবে!!!….. মাকে জড়িয়ে ধরে শিশির হাউমাউ করে কাদতে লাগল….
-মা……মাগো…. আমি আর পারি না মা…. অনেক কষ্ট হচ্ছে…… মাগো আমি বুঝি মরে গেলামগো মা…… মা আম…..আমার…..
সেখানেই জ্ঞান হারালো শিশির,,,,,
শিশিরকে হসপিটালাইজড করা হলো….. ডাক্তার প্রথমে জ্বরটা সিজন চেঞ্জের জন্য ভাবলেও… জ্বরের মাত্রা দেখে নিজেই ভ্রু কুচকে অবাক হয়ে গেলেন…..দ্রুত জ্বর নামানো প্রয়োজন…. জ্বরটা মাথায় উঠে গেলেই সমস্যা গুরুতর হয়ে যাবে….
পর্ব ৩৪
শুভ্রকে ফোন করে জানানো হয়েছিলো…. সিডনিতে ওর বাবা’র অবস্থা খুব ক্রিটিকাল….. নতুন এক বিজনেসের জন্য ওর বাবা মা’কে সিডনি যেতে হয়েছিলো….. যেহেতু বাবা’র ব্যবসায় শুভ্র কোনভাবেই ইন্টারেস্টেড ছিলো না…. তাই কি ব্যবাসার জন্য সিডনি যাওয়া হয়েছিলো…. আর ব্যবসায় কি সমস্যা হয়েছে তার আগা মাথা সম্পর্কে কিছুই ধারনা ছিলো না শুভ্রর……
ও ভেবে রেখেছিলো সিডনি যেয়েই ওর বাবা মা’কে সাফ জানিয়ে দিবে…. যেনো নিজেদের ব্যবসায়ের জন্য ওকে কখনো না যন্ত্রণা করে না….. যখন ও অফিসে পৌছোলো…… সেখানাকার অবস্থা দেখে শুভ্র স্তব্দ হয়ে গেলো…….
যেই নতুন বিজনেসটা শুভ্রর বাবা মা শুরু করতে যাচ্ছিলো…. সেটার জন্য প্রচুর মুলধনের প্রয়োজন ছিলো….. সেজন্য নিজেদের ফান্ড ছাড়াও ওনারা বেশ বড়সড় একটা লোন নেন ব্যাংক থেকে……এবং বিজনেস পার্টনার ছিলো নতুন…… ওনারা ধরেই নিয়েছিলেন বিজনেসটা খুব ভালোভাবেই দাঁড়াবে……..কিন্তু নতুন পার্টনার আর নিজেদের বিশ্বস্ত এক লোকের কারসাজিতে ওনারা বিজনেসটায় পুরোদমে লস করেন…… এবং চোখের পলকে তা ধ্বসে পড়তে দেখেন….. এত বড় একটা লস খাবেন তা কেউই আশা করেন নি ওনারা…… শুভ্রর বাবা এই ঘটনার পরপরই মাইন্ড স্ট্রোকে মারা যান……
এই সংবাদ শুভ্রকে আগেই জানানো হয়নি……ও জানতে পারে ২সপ্তাহ পর…….. শুভ্র যখন জানতে পারলো…. তখন যেনো হাজার ভোল্টের শক খেলো……… জাফরিন বেগমও হসপিটালাইজড……. হঠাৎ করে যেনো শুভ্র মাঝ সমুদ্রে এসে পড়ল……
বিভিন্ন পেপারে ওর থেকে সাইন নেওয়া হল…… ওর অনুমতি নিয়েই ইফতেখার সাহেবকে সিডনিতেই মাটি দেওয়া হল……. শুভ্র মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল……… কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে…….!!!! শুভ্র কিছু থিত করার আগেই….. সব হারিয়ে ফেলল….. নিলামে উঠল ওদের বিজনেস, সম্পদ, এবং বাড়িটাও…… শুভ্রর কিছুই করার ছিলো না….শুধু দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া…….
শুভ্র এই প্রথমবার লক্ষ্য করল….. ও খুব জোরালো ভাবে ওর বাবা’কে মিস করতে শুরু করেছে……
হসপিটালে যখন মা’কে দেখতে গেলো…. শুভ্রর তখন নিজেকে প্রচুর অসহায় লাগতে লাগলো….
ওর বাবা মা যেসবের জন্য এতো কিছু করল…… শুভ্র সেসব কিছুই রক্ষা করতে পারলো না। আচ্ছা!! বাবাও কি এতোটা অসহায় বোধ করেছিলেন!!! বাবা যদি একটু অপেক্ষা করত ওর জন্য…..!!! বাবা কি শেষ সময় পর্যন্ত ওর অপেক্ষায় ছিলো!!!!
হসপিটাল বেডে শয্যাশয়ী নিজের মায়ের করুন মুখটা দেখে শুভ্র নিজেকে ধিক্কার জানাতে লাগলো!!!!! আদৌ কি ও সন্তান হওয়ার যোগ্য!!!
মায়ের পাশে বসল শুভ্র…… ছোটবেলা ও খুবই মা পাগলা ছেলে ছিলো….. মায়ের কোল ঘেষে বসে থাকা…. মায়ের পিছন পিছন সারাবাড়ি ঘুর ঘুর করা…. ঘুম থেকে উঠেই মায়ের গলা ধরে ঝুলে পড়া…… এগুলো যেনো ওর নিত্যদিনের রুটিন ছিলো…… প্রথম প্রথম মায়ের দূরে যাওয়াটা ওর খুব বেশি খারাপ লাগতো….. কেনো মা একা একা ঘুরতে যায়!!! শুভ্রকে কেনো সাথে নেয় না!!! এসব ভেবে ভেবে কান্নাকাটিও খুব করত….. কিন্তু ধীরে ধীরে যেনো সব মেনে নিলো….. যখন বুঝতে শিখলো…. ওর চেয়েও ওর বাবা মা’র ব্যবসাটা বেশি প্রিয়….. তখন থেকেই এসব সবকিছুর উপর ওর ক্ষোভ জন্মে গেলো…. কিছুই চাই না ওর…. ব্যবসা, টাকাপয়সা, বাবা মা…… কিছুই না……!!!!!!
কিন্তু আজ এভাবে মা’কে দেখে শুভ্রর মনে হল….. বাবাকে যদি এতো অবহেলা না করতাম তাহলে বাবা এভাবে হারিয়ে যেত না…… এখন যদি মা’ও হারিয়ে যায়!!!!
শুভ্র ওর মায়ের হাত হালকা করে স্পর্শ করল….. অল্প চোখ মেলে তাকালেন জাফরিন বেগম…… চোখের সামনে ছেলেকে দেখে হুহু করে কেদে উঠলেন জাফরিন বেগম…… মায়ের এভাবে কান্না যেনো শুভ্র বুকে যেয়ে বিধলো……!!! দ্রুত কেবিন ছেড়ে বের হয়ে গেলো ও…..
করিডোরে দাড়াতেই দেখা হল তানহার সাথে….. ওকে এখানে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে জানতে পারলো……তানহা আর ওর বাবা বিজনেস সংক্রান্ত ঘটনার ব্যাপার জানতে পেরেই এখানে চলে এসেছে…… এবং তখনই শুভ্র জানতে পারে ওদের নিলামে বিক্রি হওয়া ব্যবসাটা তানহার বাবা কি নিয়েছেন…….. শুভ্র ভাবলেশহীন ভাবে সব শুনলো…… এসব শুনে আর কি করবে ও!!!! ওর তো নেই সেসব!!!
তানহা পরোক্ষনেই একটা ডিল রাখলো শুভ্রর সামনে……. শুভ্রর যা ছিলো তা আবার শুভ্রই ফিরে পাবে কিন্তু কন্ডিশন ওদের এনগেজমেন্ট
…!!!!!
শুভ্র কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,
-অসম্ভব….. আমার কিছুর প্রয়োজন নেই….. আমারটা আমি নিজে গড়ে নিতে পারবো….
-বেশ ভালো!!! কিন্তু তোমার মা!!!! ওনার চিকিৎসা করানোর মতও কি কিছু তোমার আছে!?……..
-………………………
-নিজের মা’কে নিয়ে ফিরে যাবার মতও কি কিছু তোমার আছে শুভ্র!?…….
-…………
-নিজের বাবা’কে তো অনেক অবহেলা করলে…… শেষ সময়ে ওনার সাথে থাকতে পারলে না!!!! মায়ের ক্ষেত্রেও কি একই কাজ করবে!!!!
বাকশুন্য হয়ে গেলো শুভ্র!!!! আসলেই তো…..!!! মা’কে তো ও ফেলে দিতে পারবে না!!! কিন্তু শিশির!!! ও যে অপেক্ষা করে আছে!!!
-ভেবে দেখো শুভ্র!!! তুমি কাকে বেছে নিবে!?….. নিজের মা’কে নাকিইইইইই…….!!!
এবার খুব শান্ত চোখে তাকালো শুভ্র
-কেনো করছো এসব!?….
- well,,, everything is fair in love and war….
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো শুভ্র…… না,,,, তানহার উপর নাহ,,,,,নিজের উপর,,,,,,, ঠিক এই কথাটাই ও একদিন শিশিরকে বলেছিলো!!
পর্ব ৩৫
শিশিরের হসপিটাল বেডের কাছে শিশিরের মা শিরিন বেগম বসা….. কাকলি বেগম বসা একটু দূরে….. শিশিরের জ্বর এখনো কমে নি…. মেয়েটার শরীরের সাথে কত কত নল পেচানো…..ভরা গোলাট মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে…..এক দীর্ঘ হতাশা, চিন্তা আর ভয়ের নিঃশ্বাস ছাড়লেন শিরিন বেগম।
শিশির একটু নড়ে উঠল…..ওর ঠোঁট কেপে কেপে উঠছে…… কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে….. শিরিন বেগম মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন……খুবই নিচু স্বরে জিজ্ঞাস করলেন…
-কিরে মা…. খুব খারাপ লাগছে….
শিশিরকে কি যেনো বিড়বিড় করতে শোনা গেলো…..মেয়েটা সারাক্ষণ জ্বরের ঘোরে বেহুশ থাকে…. আর মাঝে মাঝে এরকম বিড়বিড় করে কি যেনো বলে…. শিরিন বেগম আবার বললেন
-কিরে মা……. শিশির…… মা আমার…….. অনেক খারাপ লাগছে!!!
শিশির হালকা একটু চোখ মেলল…… তারপর আগের মতই বিড়বিড় করে বলল,,,,,” ও বুঝি চলে গেছে মা…..আমি ভুল করেছি মা,,,, জানো!!! মা আমি ওকে অনেক কষ্ট দিয়েছি….. তাই চলে গেলো ও……. ও চলে গেলো মা…..আমার ভিতরটা কেমন যেনো পুড়ছে মা….. আমহ,,,, আমারহ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,……..!!!!
বলতে বলতে ডুকরে কেদে উঠল শিশির…….. মেয়ের মুখের কথা শুনে শিরিন বেগমের নিজের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো……. মেয়েটা কি কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কে জানে!!!!! কি নিয়ে এত কষ্ট মেয়েটার!!!!
শিশির আবার চুপ করে গেলো….. চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল….. কিন্তু চোখের পানি!!! সেতো অবাধ্য……..
হসপিটালে এডমিটেড থাকার তিনদিনের মাথায় শিশিরের জ্বর কমতে শুরু করল….. কিন্তু বডিতে প্রচুর উইকনেস থাকায় পুরোপুরি জ্বর নামছিলো না…….
আবির মাথা নিচু করে শিশিরের বেডের কাছে বসা…… দুইহাত দিয়ে শিশিরের বাম হাত ধরে রেখেছে…… এইমুহূর্তে আবির টের পাচ্ছে…… সেদিন এনগেজমেন্টটা না করে ও জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলো….. আর এটা ভাবলেই ওর রক্ত গরম হয়ে যায়….. নিজের ভুলের জন্য নিজেকে মেরে ফেলতে মন চায়….. কিন্তু এইবার না….. এইবার সব ঠিকঠাক করে দিবে….. আবির খালি হাতে আসেনি….. ও সম্পুর্ণ ইনফো নিয়েই এসেছে……..
শিশির চোখ মেলার পর সাথে সাথে আবিরকে দেখে খুব খুশি হলো…… একমাত্র আবিরই আছে যার সাথে এইমুহূর্তে ও সবকিছু শেয়ার করতে পারবে….. যেইকথাগুলো এই পর্যন্ত চেপে রাখতে হয়েছে… শিশির হালকা নড়ে চড়ে উঠলে…আবির মাথা তুলে তাকাল….. আবিরের চোখ লাল হয়ে আছে….. একটু ভিজাও,,,,,আবির কি কান্না করছিলো!!!!! কিন্ত কেনো!!!!
আবির একনজর দেখে সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল…. ও অবশ্যই ধরা পড়ার ভয়ে লুকাতে চাইছিলো…..!!!! কিন্তু বেশ একটা সুবিধা করতে পারে নি….
শিশির আধশোয়া অবস্থায় বসল…..
-তোমার চোখ লাল হয়ে আছে কেনো!!!
-ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো না কেনো!?….
-প্রশ্নতো আমি আগে করেছিলাম!!
-উত্তরটা নাহয় তুমি আগে দাও!……
হালকা হাসলো শিশির!!! হুম আবির ডেফেনটলি লুকিয়ে যেতে চাইছে…..
-এত টেনশন কেনো কর!!!! ঠিক হয়ে যাবো আমি…..
-হুম,,,,,, তা আমি দেখতেই পাচ্ছি…..
-বাদ দাও…. তোমার খবর বলো….
-আর তোমার মনে হয় সেটা এইমুহুর্তে জরুরি একটা বিষয়!!!
-তাহলে জরুরী বিষয়টা কি!!! শুনি!?….
শিশির একটু দুষ্টামির ছলে বলল….
-শুভ্রকে ভুলে যাও শিশির…..
শিশির মুখের রঙ বদলে পাংশুটে হয়ে গেলো….
-আমি খবর নিয়েছি… খুব ভালো করেই খবর নিয়েছি…..শুভ্র আর তানহার এনগেজমেন্টটা কোন নাটক না….. ইভেন নেক্সট মান্থ বিয়ের ডেটও ফাইনাল করা আছে…….
শিশির হাত পা কাপতে লাগল…… গাল বেয়ে নোনা পানির ধারা গড়িয়ে পড়তে শুরু করল…..
-আবির!!!
-আমি জানি শিশির খুব কষ্ট হবে……. কিন্তু আজ যদি এই কষ্টটা ইনডিউর করতে পারো তাহলে আজীবন সুখে থাকবে তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি শিশির…
-আমি পারবো না…………. অসম্ভব!!!! আমি ভালোবাসি ওকে!!!
রেগে উঠে দাড়ালো আবির…… বসে থাকার স্টুলটায় এক লাথি মারলো…..
-বাচ্চামি বন্ধ করো শিশির….. তুমি কোন বাচ্চা না…ভালো মন্দ বুঝতো নাকি!!!! এসব নাটক বন্ধ করো প্লিজ,!!!
-আবির আমি যাস্ট একবার…… যাস্ট একবার শুভ্রর সাথে দেখা করতে চাই……
রাগান্বিত চোখে তাকালো আবির শিশিরের দিকে,,,
-তুমি গত তিনদিন যাবৎ এডমিটেড….. এই খবরটা শুভ্রর কানে পৌছেছে….. কিন্তু ও একবারের জন্যও আসার প্রয়োজন মনে করেনি….. ইভেন ফোন পর্যন্ত করে নি……
শিশিরের ফুপিয়ে কান্না অনবরত চলছে…. আবির আরো কিছু কঠিন কথা বলত…… কিন্তু শিশিরকে এভাবে কাদতে দেখে আর কিছু বলতে পারলো না…….
সেইমুহুর্তে শিশিরের বাবা, মা আর ফুপু ডুকলেন কেবিনে…. কবির সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আবির বলে উঠল
-আংকেল আমি শিশিরকে বিয়ে করতে চাই…… এবং সেটে এই মাসের মধ্যেই……
পর্ব ৩৬
শুভ্র চোখ মেলে তাকালো…..বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করতেই টের পেলো… কিছু একটা ওকে আটকে রেখেছে….. পাশে তাকালে বুঝল সেই কিছু একটা তানহা….. শুভ্র ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো….নাহ!!! শুভ্রর এখন আর অবাক লাগে না…. রাগও লাগে না….. শুভ্রর রুমে তানহার অবাধ যাতায়াত…… শুভ্র কিছু বলতে পারবে না…. কারন….. তানহার এখন ওর উপর অনেক অধিকার…….!!!! শুভ্র তানহার হাতটা ওর শরীরের উপর থেকে সড়িয়ে আস্তে করে বিছানা ছেড়ে নামলো…..
বিকাল দিকে শুভ্র অফিস থেকে বাসায় ফিরেই সোজা নিজের রুমে চলে এসেছিলো….. এতোটাই ক্লান্ত ছিলো… কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেছে টেরই পায় নি….. আর সেই ঘুমের মধ্যেই তানহা ওর রুমে এসে বিছানার পাশের জায়গা দখল করেছে……
বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো শুভ্র…. চোখ বন্ধ করল…. মাথাটা দপদপ করছে হঠাৎ….. চোখ জ্বালা করছে…… অফিসের কাজ গুছিয়ে উঠতে ওর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে….. ব্যবসা তানহার বাবা কিনে নিলেও ব্যবসায়ের সম্পুর্ণ দায়ভার শুভ্রর কাধেই দেওয়া হয়েছে….. তানহার বাবা স্পষ্ট করেই বলেছেন “যা তোমার ছিলো…. তা তোমারই থাকবে….. এতে আমি কখনো হস্তক্ষেপ করবো না” কিন্তু শুভ্রর এসবের কিছুই চাওয়া ছিলো না……. কখনোই না…… একমাত্র নিজের মায়ের জন্য ও এতোটা সহ্য করে আছে……. সব ছেড়ে চুপ করে আছে…… মা’কে এভাবে তো ফেলে রেখে চলে যেতে পারবে না…… পারলে তো সেদিনই যেতে যেদিন শিশিরের বিয়ের খবর সম্পর্কে ওকে অবগত করেছে সাজেদ….. শুভ্র শুধু শুনেছে…… এছাড়া আর কিছু করার নেই…….নিজেকে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করছে….. শিশিরকে একমাত্র আবিরই সুখে রাখতে পারবে……. এমনকি শান্তিতেও রাখতে পারবে…… যেটা শুভ্রর সাথে থাকলে শিশির কখনোই পেত না……. শান্তি এখন আর শুভ্রর জীবনে নেই..……!!!!! কিন্তু আর কতটা সহ্য করা যায়!!!!
শুভ্র নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল…… চোখের জ্বালাটা বাড়ছে….. শুভ্র জানে না ওর সহ্যের সীমা আর কতদিন এভাবে ধরে রাখতে পারবে!!! কিন্তু ওর কাছে এখন মরে যাওয়াটা খুব সোজা মনে হয়…… যদি না…. ওর কোন দায়িত্ব থাকত….তাহলে হয়ত এতোদিনে শুভ্র এসব উগ্র ব্যাথাগুলো থেকে চিরতরেই মুক্তি নিয়ে নিত……..
শিশির বসে বসে নখ খুটছে আর নিজের বা হাতের আংটিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে….আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ওর কাবিন…… আবিরের সাথে…. কিন্তু এ নিয়ে শিশিরের কোন মাথা ব্যাথা নেই…… সব ছেড়ে দিয়েছে ভাগ্যের উপর….. যদি এই থাকে ভাগ্যে তাহলে সারাজীবন এভাবে অনুভূতিহীন হয়েই থাকবে……
শিশির বারান্দায় বসে রয়েছে….. ওর কেনো যেনো মনে মাঝে মাঝে শুভ্র আসে ওদের বাড়ির সামনে…… ওর বারান্দার দিকে উকি ঝুকি মারে…….. এই আশায় ও নিজেও বলতে গেলে সারাদিম বারান্দায় বসে থাকে…… একবার শুধু একবার যদি শুভ্রকে দেখতে পারতো….
শিশিরের ফুপু আর মা এলেন সেই মুহুর্তে রুমে,,,,
-কিরে দুপুরে লাঞ্চ করিস নাই…… ডিনারটা তো করবি নাকি!!
-রুচি করছে না মা,,,,,যখন খিদে পাবে তখন খেয়ে নিবো…….
-এভাবে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কি আবার বিছানায় পড়তে চাস নাকি!?……
-মা প্লিজ,,,,,চিৎকার করো না…. আমার এমনে তেই মাথা ধরেছে……
-এতো কেনো টেনশন দিস আমাদের!?….. তোর বাপের দিকটা একটু চিন্তা কর!!!!
-তো কি চাইছো কি তোমরা!!! কি করবো আমি!!! মরে যাই!? মরে গেলেই তো সবাই শান্তি তাই না!!!!
কান্নায় ভেঙে পড়ল শিশির!!!
-কি করবো আমি বলো!! আর কি করতে বলো তোমরা আমাকে!!!! তোমাদের কথামত বিয়েতে পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম!!! এর চেয়ে বেশি আর কি চাও তোমরা!!
-এটাই তোর জন্য ভালোরে মা!!!
-নাহ!! এটা আমার জন্য ভালো না,,,মা!!! তুমি জানো এটা আমার জন্য ভালো না!!!!
-আমি জানি না কিছু!!!! তুই যদি কিছু করতে পারিস,,,, কর…. আমি তোকে বাধা দিবো না…. কিন্তু আমার থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করিস না……
বলেই শিরিন বেগম রুম থেকে চলে গেলেন…..
শিশিরের ফুপু এসে বসলেন শিশিরের পাশে…. শিশিরের কান্নার বেগ ততক্ষণে কিছুটা কমে এসেছে…..
-আমরা বিয়ের জন্য মানা করে দিবো….. বিয়েটা দেওয়া তোর সুখের জন্য….. কিন্তু তোরই যদি মত না থাকে, তাহলে………
-বাবা রাজি হবে না……ফুপু…
- ওমা!!! কেনো!!!!
-তুমি নিজেও রাজি হবে না!!
-কেনো ছেলেটা কি ভালো না!?
-ভালো ফুপু…. খুব ভালো….
-তাহলে…..!?…..
-ও একটা ভুল করেছিলো!!! হুম,,,,বড়সড় একটা ভুল….. যার জন্য….
-তুই কি শুভ্র ছেলেটার কথা বলছিস!?….
শিশির একটু অবাক হলো…. ফুপুর এখনো শুভ্রর নাম মনে আছে!!! তাহলে ঘটে যাওয়া ঘটনাও স্পষ্ট মনে থাকার কথা!! ফুপু তাহলে এখন একদমই এই বিয়ে ভাঙার জন্য রাজি হবে না!!
-ফুপু….. আমার সাথেই কেনো এমন হচ্ছে!?…..
-ছেলেটাকে তুই ভালোবাসিস!?….
শিশির ফুপিয়ে কেদে উঠল…..
-শুভ্র…. শুভ্র… তোমাদের কাছে মাফ চাইবে বলেছিলো…. কিন্তু তখন তুমি বাংলাদেশে ছিলে না….. তাই আমি তোমার আসার অপেক্ষা করছিলাম….. কিন্তু তার আগেই!!!!
-কি হয়েছে রে মা!???
শিশিরের কান্নার বেগ বেড়ে গেলো……
-ফুপু………. শুভ্র সত্যিই খুব অনুতপ্ত ওর ভুলের জন্য…. বিশ্বাস করো…..
-তুই ছেলেটাকে বাসায় নিয়ে আসিস…. আমি কথা বলবো…..
-এখন আর সম্ভব না,,,, ফুপু….
-মানে!!!
শিশির ওর ফুপুর বুকে মুখ গুজলো….. মনে মনে বলল,,,, ও যে আর আমার ভাগ্যে নেই!!!
পর্ব ৩৭
শিশির বেশকিছুক্ষন যাবৎ ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে….. মন স্থির করতে পারছে না…. ভয় লাগছে প্রচুর…… অনেক চিন্তাভাবনার পর কাপা কাপা আঙুলে নাম্বার ডায়াল করল…… রিং হচ্ছে….হচ্ছে……এবং হয়েই যাচ্ছে….. ঠিক যেই মুহুর্তে শিশির ফোনটা কেটে দিবে ভাবছিলো….. সেই মুহুর্তে ফোন রিসিভ হলো….. কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই…. না ফোনের এপাশে…. না ওপাশে……
নিরবতা ভেঙে শিশিরই প্রথম প্রশ্ন করল,
-কেমন আছো?
-……….…………….
অনেক কষ্টে শিশির নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে শক্ত থাকার….. ও দুর্বল হয়ে পড়তে চায় না……জোরে একটা নিঃশ্বাস ভিতরে টেনে নিলো শিশির….. বুকের ভিতরের ধুকপুকানি ও স্পষ্ট টের পাচ্ছে….. কোনমতে টেনেটুনে বলল,
-শুভ্র………..
-…………………..
শিশির নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল,,,,কান্নাটা উগ্রে বেড়িয়ে আসতে চাইছে….. শিশির নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না….ফুপিয়ে উঠল ও…..
-একটু কথা বলবা প্লিজ…..!!!! কতদিন শুনি না তোমায়!!!!……
-………………….
-নিজের খেয়াল রাখোতো!?……
-………………..
এতোক্ষনেও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে শিশির একটু ভয় পেয়ে গেলেও…. পরক্ষণেই ওপাশে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো ও……. এবং ততক্ষনাৎ বুঝে গেলো…. ফোনের ওপাশে সঠিক মানুষটাই আছে…… এই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দের সাথে যে ও গভীরভাবে পরিচিত….. তা আদৌ কি ভুলা সম্ভব!!!!!!
-একবার কি আসবে আমায় দেখতে…… আমি বারান্দায় তোমার অপেক্ষা করবো!!!!…..
-…………………..
-কাল…….কাল…. আমার বিয়ে শুভ্র!!! আমি চলে যাচ্ছি!!!!
-………………..
-এরকমতো হওয়ার কথা ছিলো না!!!…….. শুভ্র!!!
-………………………
মুখ চেপে কান্নাটা আটকে ধরল শিশির……
-আচ্ছা,,,,,,,ঠিক আছে…… আমি রাখছি কেমন!!!! ভালো থেকো……… ঠিক……. ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো……. নি…. নিজের খেয়াল রেখো প্লিজ………
রাখি বললেও রাখলো না শিশির…… ফোন কানে চেপে বসে রইল!!! ফোনের এপাশে চাপা কান্নার আওয়াজ আর ওপাশে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ গভীর থেকে গভীর হতে লাগল।……….
প্রায় দশমিনিট এভাবে থাকার পর ফোন রেখে দিলো শিশির!!! ফোনটা কেটে যাওয়ার পরও শুভ্র ফোনটা কানে চেপে ধরে রাখলো…যেনো ওপাশে এখনো শিশিরকে অনুভব করতে পারছে ও……. একসময় এভাবেই ফোন কানে চেপে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলত ওরা দুজন…… কত খুনসুঁটি,, কত স্বপ্ন,,, কত ভালোবাসার কথাই না বলত!!!! আর আজ কথা যেনো ফুড়িয়ে গেছে…… শিশিরের কান্নার আওয়াজ যেনো শিলের মত বিধছিলো শুভ্রর বুকে….. বুক ভার হয়ে আসছিলো….. গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে আটকে ছিলো…. যেনো কেউ গলা চেপে ধরেছে!!!
শুভ্র প্রচুর ইচ্ছা করছে শিশিরকে একবার দেখার,,,,একবার স্পর্শ করার,,,,সিডনি থেকে ফিরে শুধু ওই একবারই শুভ্র দেখেছিলো শিশিরকে….. এরপর আর সুযোগ পায় নি….. তানহা ওকে বলতে গেলে প্রায় মুঠো বন্দি করে রেখেছে,,,, কঠিন অভজারবেশনে রেখেছে শুভ্রকে…… শুভ্রর প্রতিটা মুভমেন্ট সম্পর্কে তানহার অবগত হয় …… তাই শুভ্র এখন চাইলেও কিছুতেই কিছু করতে পারবে না!!!!
শুভ্র নিজের ডেস্ক ছেড়ে উঠে গিয়ে দাড়ালো জানালার সামনে…… এখান থেকে ওদের বাড়ির ছোট গার্ডেনটা দেখা যায়…… নিজের বাড়িতেই ওর একটা অফিস রুম আছে……. বাসায় থাকলে বেশির ভাগ সময়ই ও নিজের এই অফিসে থাকে…।
শুভ্র টের পেলো হঠাৎ করে পিছন থেকে ওকে কেউ জড়িয়ে ধরেছে…..
-সারাটা দিন এই রুমে পড়ে থাকো……!!! আমার সাথে একটু আধটু কথাতো বলতে পারো নাকি!?…..
-মা কেমন আছে!?…..
-ভালো….. আমি কাল গিয়েছিলাম দেখতে….. আজ আবার যাবো। তুমিও চলো আমার সাথে……!!!
-দেখি!!!
-দেখি ফেকি না….. তুমি একটু সময় দাও না আমায়,,,,এমনকি তোমার মা’কেও না….. আই এম মিসিং ইউ সো ব্যাডলি,,,,নাও!!!
-তানহা,,,,, আমাদের,,,,,…… আমদের বিয়ের ডেট কি ফিক্স হয়ে গেছে!!!
-না…. তুমি তো বাবার সাথে কথাই বলছো না…..বাবা কতবার আমাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে জানো!!!
-হুম!!!!… আমি ভাবছিলাম এই মানথেই একটা ডেট ফিক্স করবো,,,,
তানহা শুভ্রর পিছন থেকে সড়ে এসে সামনে এসে দাড়ালো…… দুই হাতে শুভ্রর দুইগাল চেপে ধরে বলল,
-সত্যি!?……
ম্লান হাসলো শুভ্র….. যেই হাসিতে কোনো প্রাণ নেই…..
-এটাই যে আমার ভাগ্য তানহা!!! তাহলে শুধু শুধু কেনো আর লড়াই করবো!!!
-মানে!?…. বুঝলাম না!!!
-কিছু না….. আমি কথা বলবো আংকেলের সাথে….. এই ব্যাপার নিয়ে…..
-ও…. ওয়াও শুভ্র!!!!! আই এম সো হ্যাপি রাইট নাও…….. সো সো সো মাচ হ্যাপি!!!!
-তানহা…..
ধরা গলায় ডেকে উঠল শুভ্র……
-তানহা,,,,আমি,,,,, আমার সম্পুর্ণ চেষ্টা করবো..
শুভ্রর গলা যেনো আরো বেশি ধরে এলো…..
-তোমাকে সবসময় হ্যাপি রাখার,,,,,, এভাবে খুশী রাখার..….. কিন্তু…..
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুভ্র আবার শুরু করল,,,,
-কাল শিশিরের বিয়ে তানহা,,,,,, কাল,,,, আমি একবার যাস্ট একবারের জন্য ওকে দেখতে যেতে চাই…… যাস্ট একবার…. এরপর আর কক্ষনো ওর সামনে যাবো না…… শুধু কালকে..
তানহার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো… তীক্ষ্ম গলায় জবাব দিলো….
-না…. যাবে না তুমি!!!! কোত্থাও যাবে না…. আমি জানি একবার গেলে,,,, তুমি আর ফিরে আসবে না…. একদম যাবে না তুমি বলে দিলাম,,,,
শুভ্র মুখটা ঘুরিয়ে ফেলল….. কোনমতে বলল “হুম”,,, এরপর রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো….।
পর্ব ৩৮
সারাটা দিন তানহার কাটল চিন্তায় চিন্তায়,,,,,, চিন্তা ছাড়াও প্রচুর তিক্ততা বিরাজ করছে ওর মনে…… ও ভেবেই নিয়েছিলো,,,,শুভ্রর মন ফিরে গেছে,,,, কিন্তু এতো সহজে মেয়েটাকে বের করতে পারবে বলে মনে হয় না……. বিকালের দিকে ছাদে বসে বসে এসবই ভাবছিলো,,,, হাতে ধুমায়িত কফির মগ,,,,,, কিন্তু কফির মগে ওর মনোযোগ নেই…… মগের মাথায় শুধু আঙুল বুলিয়ে যাচ্ছে ও….…
এরমধ্যে একজন মেইড এসে জানালো,,,নিচে ভিসিটর এসেছে,,,, তানহার বিরক্ততা বেড়ে গেলো,,,,
-স্যারকে ইনফরম করো,,,,,আমাকে কেনো বলছো!?….
-স্যার বাসায় নেই ম্যাম!!!
-তাহলে ভিসিটরকে অফিসে যেতে বলো,,,,
-কিন্তু ম্যাম উনিতো আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।
তানহার ভ্রু কুচকে গেলো,,,,,ওর সাথে দেখা করতে কে আসতে পারে!!!!
তানহা ধীরে সুস্থে উঠে নিচে নেমে গেলো,,,৷ ড্রইংরুমে বসা ছেলেটাকে চিনতে ওর মিলিসেকেন্ড সময়ও লাগলো না,,,, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ছেলে এখানে কেনো!!!!
-কেমন আছো!?….
-চিনতে পেরেছো আমায়!?…
-অবশ্যই,,,, তুমি আবির……এন্ড কংগ্রেস ইন এডভান্স,,, বিয়ের জন্য…….
-হুম……
-তা,,,,হঠাৎ আমার সাথে দেখা করতে চাইছো!?…. এনি প্রবেলম,,,আই ক্যান হেল্প উইথ!!
-হুম…. প্রবেলম আছে…. এবং একটু বেশিই বড় প্রবলেম,,,,,,এবং একমাত্র তুমিই হেল্প করতে পারো আমাকে,,,,,
-আ…..চ্ছা!!! তা কি প্রবলেম…..
-আমি শিশিরকে বিয়ে করতে পারবো না তানহা!!
তানহা একটু সতর্ক হয়ে উঠল,,,,নড়েচড়ে বসল,,,,
-এটাতে আমি তোমাকে কি হেল্প করতে পারি….. সমস্যাটা একান্তই তোমার ব্যাক্তিগত……
-নাহ…. সমস্যাটা শুধুই আমার ব্যাক্তিগত না….. এতে তুমিও জড়িত!!
-মানে!?….
-মানে,,,,, আমি শিশিরকে বিয়ে করতে পারবো না,,,,কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি,,৷!!!
তানহার মনে হল,,,,, কেউ বুঝি বরফ ঠান্ডা পানি ওর মুখে ছুড়ে মেরেছে!!!
-আর ইউ ইনসেন!!! তুমি শিশিরকে বিয়ে করছো কারন তুমি ওকে ভালোবাসো!!! আর এখানে এসে এসব আবোল তাবোল কি বলছো!!!
-আমার মনে হত,,,আমি শিশিরকে ভালোবাসি!!! কিন্তু ওর প্রতি আমি যাস্ট একটু উইক ছিলাম,,,,যেটা আমি তোমাকে দেখার পর বুঝলাম,,,,
-তোমার সাথে আমার দেখাই বা কয়বার হয়েছে!!!!
-কাউকে ভালোবাসতে হলেতো তাকে বারবার দেখার প্রয়োজন পড়ে না…… একবারই যথেষ্ট,,,৷
-হুহ!!! দেখো আবির…. তুমি যদি এসব উটকো কথা বলতে এখানে এসে থাকো,,, দেন আই মাস্ট টেল ইউ,,,,আই এম নট ইন্টারেস্টেড,,,,,
-কিন্তু কেনো!!! আমি বলছি আমি তোমাকে ভালোবাসি,,,,,তাহলে কেনো তুমি একে উটকো কথা বলছো,,,,
-কারন “এটা” উটকো কথা!!!! তুমি জানো আমি শুভ্রকে ভালোবাসি,,,,এবং শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হবে,,,,,এবং আগামীকাল তোমার বিয়ে,,,,সো এখানে বসে টাইম ওয়েস্ট না করে,,,,তোমার যাওয়া উচিত,,,,
তানহা উঠে দাড়ালো,,,,সাথে সাথে আবিরও…..তানহা সিড়ির দিকে এক পা বাড়াতেই আবির পিছন থেকে চেচিয়ে উঠল,,,
-কেনো তুমি আমাকে ইগনোর করছো!!! কেনো!!!
-যাস্ট লিভ আবির…. প্লিজ সিন ক্রিয়েট করো না….
আবির দ্রুত হেটে একদম তানহার কাছে এসে দাড়ালো…. তানহা পিছিয়ে যাওয়ার আগেই,,,শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে,,,,
-কেনো বুঝতে পারছো না,,,আমি ভালোবাসি তোমাকে,,,,,অনেক অনেক বেশি,,,,,একমাত্র আমার সাথেই তুমি সুখে থাকবে,,,,
তানহা দুই হাত দিয়ে আবিরকে পিছন দিকে ধাক্কা দিতে লাগলো,,,,কিন্তু আবির একচুলও নড়লো না,,,,বরং আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে,,,,
-কি সমস্যা কি তোমার,,,,ছাড়ো আমাকে,,,,
চিৎকার করে উঠল তানহা,,,
-না,,,একদমই ছাড়বো না,,,,যতক্ষন পর্যন্ত না,,,,তুমি আমাকে একসেপ্ট করবে,,আমি ছাড়ছি না,,,আমি শুভ্রর চেয়ে বেশি সুখে রাখবো তোমাকে,,,,,শুভ্রতো তোমাকে ভালোবাসে না,,,,কিন্তু আমিতো বাসি,,,,তাহলে প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না,,,,
-ছাড়ো আবির,,,,আমায় ছাড়ো তুমি,,,, আমাকে এভাবে জোড় করতে পারো না তুমি,,,
-জোড় করে হলেও আমার তোমাকে চাই,,,,
-আশ্চর্য্য!!!! জোড় করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না আবির,,,,, এভাবে জোড় করে কাউকে ভালোবাসতে ও বলা যায় না,,,,,
সাথে সাথে ছেড়ে দিলো আবির তানহাকে,,,,, চার কদম পিছিয়ে গিয়ে দাড়ালো,,,,একটু আগে চেহারার এগ্রেসিভ লুক মুছে গিয়ে খুব শান্ত একটা লুক চলে এলো,,,, শান্ত গলায় আবির বলল,
-একজেক্টলি,,,,,,,জোড় করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না!!! তাহলে তুমি কেনো জোড় করছো!!!
স্তব্দ হয়ে গেলো তানহা,,,
-তোমার ভালোবাসায় জোড় চললে,,,,আমার বেলায় কেনো চলবে না!!!
এবারও জবাব এলো না কোনো তানহার কাছ থেকে,,,,,ওর সব শব্দ যেনো হারিয়ে গেছে,,,,,
-তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে তানহা,,,,,ভুল কাজ করে নিজের কপালে “বোকা” ট্যাগ লাগিয়ে নিও না,,,…
তানহা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে,,, খুব চেষ্টা করছে,,,চোখের পানি আটকে রাখার,,,
-ভালোবাসা খুব বিচিত্র একটা অনুভূতি তানহা,,,,প্রয়োজন না,,,,আমরা যাদের ভালোবাসি,,,তারাও আমাদের ফিরতি ভালোবাসবে,,,,প্রয়োজন এটা,,,আমাদের ভালোবাসার মানুষটা যেনো,,,সুখে থাকে,,,হাসি খুশি থাকে,,,,ভালো থাকে,,,……………………..
আমি আমার যথা সম্ভব চেষ্টা করছি,,,যেনো শিশির হাসি খুশি থাকে,,,ভালো থাকে,,, আমি চাইবো তুমিও তোমার যথেষ্ট চেষ্টা করো,,,যেনো শুভ্র খুশি থাকে,,,,,,
তানহা মুখ ঘুরিয়ে তাকালো জানালার দিকে,,, বাহিরে গার্ডেনে ও গতকালই একটা দোলনা বসিয়েছে,,,,ওর খুব ইচ্ছা,,,ঝুম বৃষ্টিতে এই দোলনায় বসে শুভ্রর সাথে ভিজবে,,,,আর হাতে থাকবে গরম ধুমায়িত কফির মগ,,,,,,
-আমি কাল সন্ধ্যায় ঠিক ৬টা বাজে বরযাত্রী নিয়ে বের হবো,,,,এবং ঠিক ৮টার মধ্যেই বিয়ের কার্যক্রম শেষ করবো,,,, আমি আশা করবো এই ৮টার মধ্যেই তুমি তোমার সঠিক সিদ্ধান্ত নিবে,,, কারন এই ৮টার পর,,,আমার হাতেও কিছু করার থাকবে না,,,,,,।
কথাটা শেষ করেই আবির বেড়িয়ে গেলো,,,,,,,, ওর মনে হচ্ছে,,,,বিশাল বড় একটা পাথর সড়ে গেলো ওর বুকের উপর থেকে।
সারারাত তানহার ঘুম হলো না,,,, এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দিলো ও…. ভোরের দিকে উঠে,,,,তানহা দৃঢ় পায়ে শুভ্রর রুমের সামনে গিয়ে দাড়ালো,,,, রুমের দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো,,,,,বিছানায় শুভ্র উপুর হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে…. বাহিরের কাপড় পর্যন্ত চেঞ্জ করে নি….
তানহা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে…. শুভ্রর ডান হাতে ওর ফোন ধরে রাখা হালকা করে…. ঘুমোনোর আগে হয়ত ফোনে কোনো কাজ করছিলো… হাতে ফোন নিয়েই ঘুমিয়ে গেছে…
তানহা আস্তে করে ফোনটা ওর হাতে নিলো…. ফোনের সাইডে অন বাটনে প্রেস করতে ফোনে লাইট জ্বলে উঠল,,,, স্ক্রিনে শুভ্র আর শিশিরের একটা হাসিখুশি ছবি…. শুধু হাসিখুশি…. খুবই প্রাণখোলা হাসি…. ছবিটাতে শিশির হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসছে,,,,আর শুভ্র ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে…. বা হাতে শিশিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে রেখেছে…….
ফোনটা জায়গামত রেখে তানহা শুভ্রর মাথার পাশে,,,বিছানার ডিভানে বসল,,,,, ওর সিদ্ধান্ত থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ওকে নড়াতে পারে নি….
পর্ব ৩৯
শিশিরের চোখ প্রচুর ব্যাথা করছে,,,, চোখ ফুলে আছে খুব ভালোভাবেই। কাল সারারাত কিভাবে পাড় করেছে একমাত্র ওই জানে,,,, একমুহুর্তের জন্যতো সুইসাইড করার চিন্তাও মাথায় এসেছিলো…. কিন্তু পরোক্ষনেও বাবা’র মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে,,,,,বাবা’কে এভাবে কস্ট দিতে পারবে না,,,,,,অসম্ভব,,, ওর জন্য।
বেশকয়েক বার শুভ্রকে ফোন করার চিন্তাও করেছে,,,,,কিন্তু পরমুহূর্তেই আটকে ফেলেছে নিজেকে,,,,,কিন্তু এখন ওর কাছে সব অনুভূতিহীন মনে হচ্ছে,,,,,মাথাটা শুন্য হয়ে আছে….. চিন্তা চেতনা যেনো সব গায়েব হয়ে গেছে….. আর মাত্র কয়েক ঘন্টা,,,,,এরপর…….!!!!
বিয়েটা নিন্তাতই ঘরোয়া ভাবে সম্পন্ন হবে,,,,,যার জন্য কাছের কিছু মানুষ ছাড়া বেশি গেস্ট ইনভাইট করা হয়নি…. আবিরের ফ্যামিলিতে তেমন কেউ নেইও ইনভাইট করার মত….. চাচা’দের সাথে মাঝখানে একটু যোগাযোগ হলেও,,,, এখন তা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে….. আর শিশিরের ফ্যামিলিতেও খুবই কাছের মানুষজনকে জানানো হয়েছে।
শিশিরের ফুপু সকাল থেকে,,,,ভাইয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে…… কিন্তু সময় সুযোগ পাচ্ছেন না….. আজ সকালে তিনি শিশিরকে দেখে রীতিমতো আতকে উঠেছেন। মেয়েটা সম্ভবত পুরো রাত কেদেই গেছে….. চোখ মুখ ফুলে আছে….. এভাবে যদি বিয়েটা হয়,,, মেয়েটা তো মরেই যাবে….. এর চেয়ে একবার ভাইয়ের সাথে কথা বলা উচিত……
বিকালের দিকে তিনি সুযোগ পেয়েও গেলেন…. ভাইকে আর ভাইয়ের বউকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন….. এরপর বেশকিছুক্ষনের জন্য রুমের দরজা বন্ধ করে তিনজন আলাপ করলেন। কিন্তু কি নিয়ে আলাপ করলেন তা বাহিরের কেউ জানলো না…. এমনকি কবির সাহেবের ছেলেমেয়েরাও না…….
শিশির আয়নার সামনে বসে আছে…… শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে….. ওকে ঘরেই সাজানো হয়েছে….. খুবই সিম্পল সাজ,,,, গলা আর হাত ভর্তি ছোট বড় গয়নায়,,,,লেহেঙ্গার উড়নাটা মাথায় ঘোমটার মত দেয়া…. হাতে ফোনটা চেপে ধরে রেখেছে…… প্রতিমুহূর্ত আল্লাহ’র কাছে দোয়া করছে…. যেনো একবার শুভ্র ফোন করে,,,,একবার!!!! অনেকক্ষণ বসে থেকে শেষপর্যন্ত নিজেই নাম্বার ডায়াল করল,,,,রিং হতে শুরু করেছে…. ক্ষীন আশা হচ্ছে আজ শুভ্রর সাথে কথা হবে!!!! কিন্তু রিং বেজেই গেলো কেউ ফোন রিসিভ করল না….. ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রেখে,,,,আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। নিচের ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরে রেখেছে…. কিন্তু এতে কোন লাভ হলো না,,,, চোখের পানি গাল বেয়ে পড়তে লাগল…. দুই হাতে মুখ চেপে ধরল শিশির…… মনে মনে শুধু এতটুকুই বলল,,, হে আল্লাহ আমি যদি এখন মরে যাই,,,তাহলে খুব বড় গুনাহগার হয়ে যাবো!!!……
এদিকে শুভ্র সেই সকালে বের হয়েছে,,,এখন পর্যন্ত ওর কোনো খবর নেই,,,,,তানহা বেশকয়েকবার ফোন করেছে ওকে কিন্তু শুভ্র রিসিভ করেনি….. পরে জানা গেলো শুভ্র নিজের ফোন বাসায় ফেলে রেখে গেছে…. তানহা জানে শুভ্র কাজটা ইচ্ছা করেই করেছে….. তানহা অফিসেও ফোন করেছে, শুভর ফ্রেন্ডদের কাছে ফোন করেছে কিন্তু কেউই ওর কোন খবর জানে না….. এবার তানহার খুব টেনশন হতে লাগল। খারাপ খারাপ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। গতবারের মত যদি কিছু হয়ে থাকে,,,,কোন এক্সিডেন্ট!!!! তানহা যত চেষ্টা করছে পজিটিভলি চিন্তা করতে,,, নেগেটিভ ভাইব যেনো ততোই মাথায় ঘিরে ধরছে….!!!!
কিছু একটা শীঘ্রই করা দরকার,,,,কিন্তু কি!….
তানহা ঘরের ভিতর বিরামহীন পায়চারী করে যাচ্ছে। টেনশনে ওর মাথা খারাপের মত অবস্থা। দিনের অবস্থা বেশি সুবিধার না। থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছে। শুভ্রর এখন পর্যন্ত কোনো খোজ পাওয়া যায় নি। ওর বন্ধুরাও খোজা খুজি করছে। কিন্তু এখনো ওকে ট্রেস করতে পারেনি। হঠাৎ নিচে কলিংবেল বেজে উঠল। দৌড়ে তানহা নিচে ড্রইংরুমে গেলো।
দরজা দিয়ে শুভ্রকে ভিতরে ঢুকতে দেখা গেলো। তানহা যেয়ে শুভ্রর সামনে দাড়ালো। শুভ্র কোনরকমে চোখ তুলে উপরে তাকালো। চোখে স্পষ্ট বিরক্তি ছাপ।কিন্তু এই বিরক্তি তানহাকে অতোটা ভাবালো না।
-কোথায় ছিলে!?… সেই কখোন থেকে অপেক্ষা করছি জানো!?….
-……………………
-ফোনটাতো অন্তত নিজের সাথে নিয়ে যাবে!!!
-……………………
-…….. শুভ্র…… আমার সাথে এক জায়গায় যাবে!?……
শুভ্র ভাবলেশহীন তাকিয়ে রইল। তানহা শুভ্রর হাত ধরে টেনে বাহিরে এনে গাড়িতে বসালো। নিজে বসল ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি কতক্ষন চলল,,,,কোন রাস্তায় গেলো,,,সেদিকে শুভ্রর কোনো হুশই ছিলো না,,,,সেই আগের মতই ভাবলেশহীন বসে রইল গাড়িতে। বাস্তবে এলো তানহার ডাকে….. শুভ্র চোখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো,,,,সাথে সাথে আবার তানহার দিকে তাকালো। চোখে স্পষ্ট অবাক আর অবিশ্বাস্যের ছাপ। তানহা হালকা হেসে বলল,
-তোমার একটা গুরুতর ইচ্ছা পূরন করে দিলাম আমি………
শুভ্র তখনো ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে তানহার দিকে। কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। শিশিরদের বাড়ির সামনে ওদের গাড়ি এসে থেমেছে। কিন্তু তানহা ওকে এখানে কেনো নিয়ে এলো..….. শেষএকবারের জন্য শিশিরকে দেখতে চেয়েছিলো শুভ্র….. তানহা কি তাহলে রাজি হয়ে গেছে!!!! তানহা আবার বলতে শুরু করল,
-তোমার ইচ্ছা পূরন করে তোমাকে আমার কাছে আজীবনের জন্য ঋণী করে নিলাম। আমার দাশ বানিয়ে ফেললাম আজীবনের জন্য…….
বলেই তানহা ফিক করে হেসে ফেলল……ওর কথার একটা শব্দও শুভ্রর মাথায় ঢুকে নি। ও শুধু তাকিয়েই আছে,,,,
-কি হলো যাবে না….. তাহলে কি গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলবে….
দুষ্টমির ছলে জিজ্ঞাস করল তানহা। শুভ্র ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। আর একবার তানহার দিকে তাকালো,,,, আস্তে আস্তে গাড়ির দরজা খুলে বের হল। শুভ্র বেড়িয়ে দু’কদম এগিয়ে যেতেই তানহা গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে মাথা ফেলে দিলো। হুহু করে কেদে উঠল,,,,,এতক্ষনের কষ্ট করে চেপে রাখা পানিগুলো এখন যেনো অবাধ রাস্তা খুজে নিয়েছে, “যাও,,,,,,মুক্ত করে দিলাম তোমায়”
শুভ্র যতই সামনের দিকে এগুচ্ছে ওর কলিজার পানি ততই শুকিয়ে যাচ্ছে,,,,,,, চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল,,,দুই হাত দিয়ে চোখ কচলে নিলো শুভ্র….. আশ্চর্য্য!!!! সব এমন গোলা হয়ে যাচ্ছে কেনো,,,,!!! আবার ঝাপসা হয়ে উঠল শুভ্রর চোখের সামনের দৃশ্যগুলো। হাত পা কাপছে ওর। আচ্ছা বিয়েটা কি হয়ে এতক্ষনে হয়ে গেছে !!! যদি হয়ে যায়,,,শুভ্র কি পারবে এত সহজে মেনে নিতে!!!! ভিতরের চিনচিনে ব্যাথাটা যেনো শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে গেছে। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে,,,,,,পা ফেলে ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরেতো উঠেছে,,,, কিন্তু দরজা ঠেলে আর ভিতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না শুভ্রর। দরজা হালকা চাপিয়ে রাখা হয়েছে। ভিতর থেকে মানুষজনের হাউকাউয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বেশকিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে শুভ্র আস্তে করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। ভিতরে যেয়ে একবার চোখ বুলাতেই পরিচিত মুখটা খুজে পেয়ে গেলো শুভ্র…….. আবারও চোখ কচলে চোখের সামনের ঝাপসা দৃশ্য স্পষ্ট করে নিলো ও।
পর্ব ৪০
ড্রইংরুমে বড় করে ফ্লোরিং বিছানা করা হয়েছে। সেখানেই শিশিরকে বসানো হয়েছে…… বরযাত্রী উপরে ছাদে বসানো হয়েছে…. মাথা নিচু করে বসে ছিলো শিশির……. হঠাৎ ওর মামাতো বোন এসে হালকা একটু ধাক্কা দিতেই ওর দিকে তাকালো শিশির। মামাতো বোন ডালিয়া সামনের দিকে তাকিয়ে আছে,,,,ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই শিশিরের বুক কেপে উঠল। এতো!!! এতো দিন পর!!! তাও এলে কিনা আজ!!! শিশির অবিশ্বাস্য চোখ নিয়ে উঠে দাড়ালো,,,,আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো শুভ্রর দিকে!!!……. মানুষটা কি আসলেও দাঁড়িয়ে আছে সামনে!!! শিশির একদম শুভ্রর সামনে গিয়ে দাড়ালো,,,, ডান হাত রাখলো শুভ্রর গালে!!! আশেপাশের কোলাহল থেমে গেলো হঠাৎ করেই,,,,
-তুমি!!! তুমি,,,, সত্যিই এসেছো!?….
শুভ্র তাকিয়ে আছে শিশিরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে,,,,, কি সুন্দর লাগছে শিশিরকে!!!!
-এই হাল কেনো করেছো নিজের!!! এই!! এই অবস্থা কেউ করে!!! নিজের দিকে একটু তাকাবেতো নাকি!!!
শিশিরের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে…..
-তোমাকে,,,,,,,……..অনেক সুন্দর লাগছে শিশির,,,,,,ঠিক যেমটা আমার স্বপ্নে দেখতাম তেমন!!!!!!
-………………..
-শিশির,,,,আমি,,,,আমি সরি শিশির,,,,আমি যা করেছি শুরু থেকে এই পর্যন্ত সবকিছুর জন্য সরি,,,,
মাথা নিচু করে কেদে যাচ্ছে শিশির….. প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করতে শুভ্রর গলা কেপে কেপে উঠছে,,,,,ভিতরের রুম থেকে শিশিরের ফুপু আর বাবা বেড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে দাড়িয়েছেন।,,,,,,শুভ্র টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে,,,যেনো নিঃশ্বাস নিতে ওর প্রচুর কষ্ট হচ্ছে,,,,কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করল ও,,,,,
-তুমি…. আমার থেকে অনেক ভালো কাউকে ডিসার্ভ করো শিশির,,,, আমি,,,,,আমি তোমার যোগ্য না,,,,,,
শিশির জানে,,,এবং খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে,,,এই কথাগুলো বলতে শুভ্রর কতটা কষ্ট হচ্ছে,,,,,তারপরও শুভ্র বলেই যাচ্ছে,,,,
-আমি একটা কাউয়ার্ড শিশির,,,,,, আমি তোমার জন্য লড়তে পারি নি,,,,,আমার জন্য আজ আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলছি শিশির,,আমি!!! আমি নিজেই দোষী,,,,,,
-………..……………
-তুমি,,,,, তুমি,,, আবিরের সাথে আমার চেয়ে বেশি ভালো থাকবে শিশির,,,,আমি শুধু তোমাকে কষ্টই দিয়ে গেছি,,,,,,তুমি আমার না,,,,,,শিশির……!!!!!
শেষের কথাটা বলার সময় শুভ্রর মনে হল কেউ বুঝি একটা ধারালো ছুড়ি দিয়ে ওর বুকটা ফালি ফালি করে দিচ্ছে,,,,,বলেই সাথে সাথে মুখটা ঘুরিয়ে ফেলল,,,,দুই আঙ্গুল দিয়ে চোখ চেপে ধরল। নিচের ঠোট কামড়ে ধরল।
আস্তে করে শিশিরের হাতটা ধরল শুভ্র,,, হাত ধরে শিশিরকে ওর আগের জায়গায় নিয়ে গেলো যেখানে ও বসেছিলো…. শুভ্র নিজেই বসালো শিশিরকে,,,,,, নিজের দুই হাত দিয়ে শিশিরের দুইহাত চেপে ধরল,,,এক নজর তাকালো হাতের দিকে,,,,,এটাই কি তাহলে শেষ!!! আর এভাবে হাত ধরা হবে না,,,,, পাশাপাশি হাটা হবে না,,,,,,,জড়িয়ে ধরা হবে না!!!!
শুভ্র শিশির দুইজনই নিচের দিকে তাকিয়ে আছে,,,,, হাতের দিকে তাকানো অবস্থায়ই শুভ্র বলল,,,,,
-আমাকে একটা কথা দিবে শিশির………… সবসময় ভালো থাকবে,,,,সবসময়,,,,,,,,আমার মত একটা মানুষের জন্য কখনো আর কাদবে না,,,,,ভেবে নিবে আমি কখনো ছিলামই না…..তোমার জীবনে আমি একটা ভুল…….
একাধারে কান্না করে যাওয়ার ফলে,,শিশিরের মাথার রগ যেনো টনটন করতে শুরু করল। ডালিয়া একগ্লাস পানি নিয়ে এলো শিশিরের জন্য,,কিন্তু শিশির তা ঠেলে দূরে সড়িয়ে দিলো…… বাসার পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে…. একটু আগের আনন্দ ফুর্তি,,,কোলাহল থেমে গিয়ে এখন গুজুর গুজুর ফুসুর ফাসুরে পরিণত হয়েছে…… শিশিরকে ভিতরের ঘরে বসানো হয়েছে,,,,,বাহিরে আবহাওয়া প্রচুর খারাপ হচ্ছে বিধায় বরযাত্রী ড্রইংরুমে বসানো হয়েছে…..
কবির সাহেব স্তব্দ হয়ে ডাইনিং-এর একটা চেয়ারে বসে আছেন…… ঘটনা কয়েক সেকেন্ড আগেই ঘটল। ছেলেটা এইমাত্র বেড়িয়ে গেলো…. যাওয়ার আগে ওনার আর বোনের কাছে হাত জোড় করে মাফ চেয়ে গেলো…….নিজের ভুলের জন্য ছেলেটা আসলেও খুব অনুতপ্ত,,,,,,,,, ছেলেটার সম্পর্কে বোনও আজ বিকালে বেশকিছু কথা বললেন। ভিতরের রুমে মেয়েটা অনবরত কেদেই যাচ্ছে…… কবির সাহেব পড়েছেন মহামুসকিলে। বরযাত্রী বসে আছে সামনে……. বিয়ের কার্যক্রম কি শুরু করতে বলবেন…….!!!!!
শুভ্র সিড়ি দিয়ে নেমে এসে নিচে দাঁড়িয়ে আছে…..এখান থেকে শিশিরের রুমের বারান্দা দেখা যায়!!! দিনের পর দিন এই যায়গায় দাড়িয়েই শিশিরের অপেক্ষা করত একসাথে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য…… প্রতিরাতে বাসায় ফিরার আগে বাইক নিয়ে একবার ডু মেরে যেত,,,এই আশায় যদি শিশিরকে দেখা যায়,,,কখনো দেখা যেত,,,কখনো যেত না….. কিন্তু শুভ্র কখনো থেমে যায়নি…… প্রতিমুহূর্তে শিশিরের সামনে নিজের ভালোবাসা জাহির করে গেছে….. কিন্তু আজ!!!! যেখানে ওর থাকার কথা ছিল,,,,,সেইজায়গাটা এখন অন্যকারো!!!! শিশিরদের বাড়ির উজ্জ্বল লাইটিং গুলো শুভ্রর চোখে ঝাপসা হয়ে আসছে…… এবার আর শুভ্র তা মুছার বৃথা চেষ্টা করল না…… গাল বেয়ে পড়তে লাগল……!!!!
শিশিরকে বসার রুমে নিয়ে আসা হয়েছে,,,,, আবির আর ওকে পাশাপাশিই বসানো হয়েছে….শিশিরের অনবরত কান্নাতেও আবির নির্বাক বসে আছে…… কারন পদক্ষেপ এখন শিশিরকে নিতে হবে………!!!! রেজিস্টার খাতা নিয়ে কাজী সামনে এসে বসল,,,, শিশিরের হাত পা কাপতে শুরু করল,,,, সবকিছু,,,এইসবকিছু এখন একটা বাজে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে,,,, মনে হচ্ছে এই বুঝি সকালের ঘুমটা ভাংবে শুভ্রর ফোন কলের আওয়াজে,,,,!!!
-বিয়েটা এখনো করবে শিশির!!!
চকিত হয়ে সামনে তাকালো শিশির,,,, তানহা দাঁড়িয়ে,,,,,
-আমি ভুল ছিলাম শিশির……. অন্যের সম্পদকে নিজের ভেবে আগলে রাখতে চেয়েছিলাম….. কিন্তু শেষপর্যন্ত বুঝলাম,,,, সম্পদটা যার তারই প্রাপ্য হওয়া উচিত…………………. তাইতো মুক্ত করে দিলাম তোমার শুভ্রকে…… সকল প্রকার দায়ভার ও ঋণ সম্পর্ক থেকে মুক্ত…. বিকজ হি ডিসার্ভস টু বি হ্যাপি…… আর শুভ্র একমাত্র তোমার সাথেই হ্যাপি থাকবে…..প্লিজ শিশির বিয়েটা করো না…… হি নিডস ইউ……
শিশিরের সম্পুর্ণ কথা বুঝতে একটু সময় লাগল…. যখন বুঝতে পারলো,,,শুভ্র আর তানহার মাঝে এখন আর কোন সম্পর্ক নেই….. শিশির ততক্ষনাৎ উন্মুখ হয়ে বাবাকে খুজতে লাগল…… বাবাকে খুজে পেয়েই শিশির উঠে গিয়ে দাড়ালো বাবার সামনে…….
-বাবা…… বাবা তুমি বিশ্বাস করো,,,শুভ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে….. ও আসলেই অনুতপ্ত বাবা…… বাবা একবারের মত কি ওকে মাফ করে দেওয়া যায় না,,,বলো!!!! বাবা আমি সত্যিই পারবো না,,,,এভাবে বিয়ে করতে,,,,, আমি,,, বাবা………….
শিশির বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল……
-বাবা প্লিজ মাফ করে দাও,,,,প্লিজ প্লিজ প্লিজ,,,,,৷ বাবা প্লিজ…….
মেয়েরা কাকুতি মিনতি কবির সাহেবের নিজেরও ভিতরটা হুহু করে উঠল,,,,,তিনি মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন,,,
-এই শেষ আবদারটাই পুরন করছি….. এরপর আমার কাছে আর কখনো আবদার করতে পারবি না,,,,, বলে দিলাম,,,,।
শিশির বাবা’র দিকে তাকালো,,,
-বাবা তুমি কি,,,,,……….
-মানুষ ভুল করে,,,,কিন্তু সবাইতো নিজের ভুলটা বুঝতে পারে না…..!!!! ছেলেটা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে……… আমিও তাই ভাবছি……………
শিশির অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে বাবা’র দিকে…….. বাবা কি তাহলে মেনে নিলো,,,!!!
-কি জানি নাম বললি!?….. হ্যা,,,শুভ্র!!!! তোর ফুপু থাকতে থাকতেই নিয়ে আসিস,,,,কথা বার্তা বলতে…..
বাবা’র গলা জড়িয়ে শিশির হাউমাউ করে কেদে উঠল,,,,
-বাবা থ্যাংক ইউ বাবা,,,,,অনেক অনেক থ্যাংক ইউ….. তুমি অনেক ভালো বাবা,,,,,সত্যি বাবা তুমি আমার অনেক ভালো বাবা……
শিশির বাবা’কে ছেড়ে ঘুরে দাড়াতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো আবিরের সাথে,,৷এতোটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো যে আশেপাশের সবকিছু ভুলে গিয়েছিলো শিশির……. আবিরের দিকে একপা এগুতেই,,,, আবির নিজের সবচেয়ে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে,,,,,, চোখের ইশারা করে আস্তে আস্তে বলল “যাস্ট গো আফটার হিম”
শুভ্র এলোমেলো পা ফেলে হেটে চলছে রাস্তায়…. দিনের অবস্থা খুবই খারাপ করছে…… আকাশ ডাকছে…. ঝড়ের বেগে বাতাস বইছে,, যেনো সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে…. রাস্তার মানুষজন তারাহুরা করে বাড়ি ফিরতে ব্যাস্ত…… দোকানপার্ট বন্ধ করে দিচ্ছে দোকানিরা….. রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেটে চলছে শুভ্র….. মাঝে মাঝে সব ঘোলা হয়ে যায় ওর চোখের সামনে….. পরমুহূর্তে গাল বেয়ে পানি পড়তে থাকে…… শুভ্র শার্টের হাতায় চোখ মুছছে বারবার…… কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না……
হঠাৎ করেই মাথার পিছনে কিছু একটা আঘাত পেয়ে ঘুরে তাকালো……. ঝাপসা চোখে দেখল কেউ একজন দৌড়ে এসে সামনে দাড়িয়েছে…. দ্রুত শার্টের হাতায় চোখ মুছল,,,চোখ মুছে ভুত দেখার মত চমকে উঠল….. এতটুক পথ দৌড়ে এসে শিশির খুব হাপাচ্ছে…. শুভ্র মাটির দিকে তাকালো,,,,,শিশিরের পায়ের জুতার এক পাটি পড়ে আছে….. তার মানে জুতাটাই ছুড়ে মেরেছিলো শুভ্রর দিকে…… শুভ্র আবার তাকালো শিশিরের দিকে…….শিশির বড় করে একটা দম নিলো,,,,
-এই তুমি কি বয়ড়া,,,,!!! কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি শুনো না!!! আর এভাবে মাতালের মত কেনো হাটছিলে রাস্তায়!!!!
দুই আংগুলে শুভ্রর গাল চেপে ধরল,,,
-এমন দাড়ি মোছ কেনো গজিয়েছো!!! কালকের মধ্যেই এই জংগল সাফ করবা…..
-তুমি,,,,,, তুমি এখানে কি করো!?….
-তো তুমি কাকে চাচ্ছো!!! তোমার তানহাকে!!!! উহু!! সেটাতো হতে দিবো না…… আমি থাকতে অন্য মেয়ের দিকে তাকাবা…… একদম চোখ গেলে দিবো…….
শিশিরের বলার ধরন দেখে হেসে দিলো শুভ্র…..
-তাহলে তোমায় দেখবো কিভাবে!!!!
-দেখতে হবে না আমায়…… একদম দেখতে হবে না………
কেদে ফেলল শিশির….
-শিশির….. কান্না থামাও…. তোমার নাকের পানি বেয়ে বেয়ে পড়ছে…..
-বেশি কথা বলবা না….. এক ঘুষি মেরে তোমার নাক বোচা করে দিবো…..
-ভালো হবে,,,, তুমি নাক বুচি আমি নাক বোচা,,,, বোচা-বুচির সংসার…….
দুইহাতে জড়িয়ে ধরল শুভ্র শিশিরকে…… নাক বরাবর একটা চুমু খেলো….. শিশির নাক টানতে টানতে বলল,,,,”একটা কিছু দাও নাক মুছবো”
হো হো করে হেসে উঠল শুভ্র…..
রাস্তার উৎসুক জনগন এখন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে…. এক জোড়া যুবক যুবতী,,, কেদে কেদে হাসছে,,,,,আবার হেসে হেসে কাদছে,,,,কি সুন্দর সেই হাসি….. যেনো বিশ্ব জয় করার হাসি….. নিজেদের ভালোবাসা জয় করার হাসি………
(সমাপ্ত)
লেখাঃ মৃন্ময়ী (তাসনিম)
Read More: দ্বিতীয় বসন্ত – New Real Life Story