কালো অধ্যায় ছিলে তুমি (শেষ খণ্ড) – Bangla golpo love

কালো অধ্যায় ছিলে তুমি – Bangla golpo love: আনিশার পা অটোমেটিক আটকে গেল মুগ্ধের কথা শুনে। আসলেই সে অন্য কাউকে নিয়ে আর ভাবতে পারবে না। ভাবনার জগৎটা যে এই মুগ্ধ নিজের মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। এটা ভেবে আনিশার মুখ পুরো লাল হয়ে গেছে।


পর্ব ৯

অনিক কেঁদে কেঁদে ফোনে কথা বলছে,
~ মা, তুমি কোথায় আছো? কখন আসবে? আশু সকাল থেকে আমার সাথে একটা কথাও বলেনি, মা! আমার অনেক ভয় করছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো গ্রাম থেকে।
~ আরে বাবা, তুই এমন পাগলামি করিস না। আমি তোর বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। আর দশ মিনিটের মতো লাগবে। তুই শান্ত হ। সব ঠিক হয়ে যাবে।

~ মা, আমি,
অনিক কিছু বলতে যাবে তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে। এসময় আবার কে আসবে?
হঠাৎ একজন সার্ভেন্ট এসে বললো,
~ স্যার, একটা মেয়ে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।
~ আমার সাথে?
~ হ্যাঁ।

~ আচ্ছা, তুমি যাও, আমি আসছি।
সার্ভেন্ট চলে গেল। অনিক তার মাকে বললো,
~ মা, কে যেন এসেছে। আমি দেখা করে আসি।
~ হুম যা। আমিও চলে এসেছি তোর বাড়ি।

বলেই ফোন কেটে দিল। অনিক ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো, অনি সোফায় বসে আছে। অনিকে দেখে অনিক অসম্ভব রেগে গেল এবং অনির সামনে গিয়ে দাড়ালো। অনি বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে অনিকের দিকে তাকিয়ে আছে। এই সেই অনিক, যে কিনা খুবই সাধারণ ভাবে একটা বাইক নিয়ে চলাফেরা করতো। যাকে অনি সারাক্ষণ জ্বালাতো। কিন্তু আজ সেই সাধারণ মানুষটার সাথে দেখা করতে এপোয়েন্টমেন্ট লাগে। এখনতো আগে থেকে আরো বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে। দেখতেও একজন বিজনেস টাইকুনের মতো দেখায়।

অনি মনে মনে বলছে,
~ আয়াশের অর্থের মোহে পড়ে তোমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা-মা এর কথা শুনে তোমার সাথে থাকলে আমি সুখী হতাম, অনিক। সাময়িক মোহের কারণে আজ আমার ভাগ্য থেকে সুখ নামক সম্পদটা হারিয়ে গেছে।
অনি অনিকের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে কাঁদছিল, তা খেয়াল করেনি। অনিক উল্টো দিকে ঘুরে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
~ কী হয়েছে, কী চাই এখানে?

অনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
~ অনিক, অনিক, আনিশা,
অনিক তার ডান হাত উঁচিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ স্টপপপ। আপনার ঐ ভ্যালুয়েবল মুখ দিয়ে আমার এন্ড আমার মেয়ের মতো ভ্যালুলেস মানুষের নাম বলবেন না, কাইন্ডলি।

অনি অস্ফুট স্বরে বলে,
~ অনিক!
অনিক অনির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললো,
~ অ্যাগেইন! হোয়াটেভার, আপনি কী ভেবেছেন? আপনার মতো ছলনাময়ীর চোখের ওই ফেইক পানি দেখে আমি সব ভুলে যাবো?
বলেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।

অনি অনিকের কথায় নিজের গালে হাত দিয়ে দেখলো, সে সত্যিই নিজের অজান্তেই কাদছিল। চোখের পানি গুলো মুছে বললো,
~ আনিশা কোথায়? ও কি আর স্কুলে যাবে না?

অনিক ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
~ আমার মেয়ে, আমি কোথায় পাঠাবো, কী করবো; দ্যাট টোটালি ডিপেন্ডস আপঅন মি, নান অফ ইয়র বিজনেস, মিসেস আয়াশ আহনাফ হাসান।
অনিকের কথায় অনি আহত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। নিজেকে শক্ত করে বললো,
~ আনিশা আমার সন্তান, আমি ওর মা।

অনির কথায় অনিক সারা বাড়িময় কাপিয়ে হো হো করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে চোখ লাল লাল করে বললো,
~ মা! ওহ রিয়েলি! আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম হয়তো। কী বলতো, যে মা সন্তান জন্ম দিয়ে তার মুখও দেখেনি; স্বামী, সন্তান, পরিবার সবাইকে ভুলে সব দায়-দায়িত্ব ভুলে সকল বাধা ছিন্ন করে শুধু মাত্র অর্থ-সম্পদ ও সুখের লোভে পড়ে অন্য একজনের হাত ধরে চলে গিয়েছিল, সে আজ হঠাৎ মাতৃত্বের দাবি নিয়ে আসলে তো ভুলে যাওয়ারই কথা। অ্যাম আই রাইট?
অনি মাথা নিচু করে বললো,

~ আমি জানি সবকিছু। কিন্তু আমারও তো কিছু বলার আছে। আমার কথা,
অনিকে কিছু বলতে না দিয়ে অনিক চিৎকার করে বললো,
~ কী বলবে তুমি, হে? কী বলবে? আমি অনেক কষ্টে আছি, আমি অন্যায় করেছি। এগুলোই তো বলবে?
~ অনিক, আমার কথাটা একটু শোনো। দয়া করো আমার প্রতি।
~ ওকে বলো। তবে এটাকে নিজের জন্য কোনো সুযোগ বলে মনে করো না।
অনি নিজের চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বললো,
~ তোমার মনে আছে, আমি তোমায় একদিন বলেছিলাম, আমার তোমার বাবা মা থেকে আলাদা রাখতে। তার কিছু দিন আগে আমার আয়াশের সাথে দেখা হয় ও পরিচয় হয়। ও জানতো না যে আমি বিবাহিত। পরিচয়ের কয়েক দিন পর ও আমায় বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি অনেক অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তবে পরে বুঝেছিলাম যে ও হয়তো জানে না। তাই আমি বলে দেই যে, আমি বিবাহিত।

একথা শোনার পর আয়াশ স্যরি বলে চলে গিয়েছিল। কিন্তু দুদিন পরে আবার আমায় ফোন দেয়। তারপর আমাদের ব্যাপারে যে ও সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছে তা আমায় জানায়। ও আমায় বলেছিল, যদি অনিক তোমায় সুখে রাখতে না পারে তবে আমার কাছে চলে এসো। আমি তোমায় বিয়ে করবো। আমি না করে দিলে ও আমায় বলে, আমি যাতে তোমায় বলি আমায় তোমার বাবা-মা থেকে আলাদা রাখতে আর যদি না রাখে তাহলে বুঝবে যে, তুমি আমায় ভালোবাসো না।

আমার মাথা তখন ভালো করে কাজ করছিল না, তাই আমি তোমায় ওসব বলেছিলাম। কিন্তু তুমি না করে দেওয়ায় আয়াশ আমায় বেশি করে ফোন দিতো আর আমিও ওর কথায় গলে যেতে থাকি। এই পরকীয়া নামক ব্যাধিতে আমি এতোটাই আক্রান্ত হয়ে গেছিলাম যে, নিজের অনাগত সন্তানকেও পরোয়া করিনি। তাই ওর মুখ না দেখেই আমি হসপিটাল থেকে চলে যাই, যদি আনিশাকে দেখার পর আর না যেতে পারি এই ভয়ে। আমি সুখ খোঁজার জন্য গিয়েছিলাম, অনিক।

কিন্তু বুঝতে পারিনি যে, প্রকৃত সুখ অর্থ দ্বারা পাওয়া যায় না। সেটা শুধু নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দ্বারাই পাওয়া যায়, যেটা তুমি আমায় দিয়েছিলে। আয়াশের সাথে বিয়ের পর আমি জানতে পারলাম যে, আমি আর মা হতে পারবো না। একথা শোনার তিনদিন পরে আয়াশ দ্বিতীয় স্ত্রী ঘরে তোলে। এখন আমার জীবনে সব আছে, শুধু ভালোবাসা নেই। আয়াশ আমার সব প্রয়োজন গুলো পুরন করলেও আমায় ভালোবাসে না। আমি সুখে নেই, অনিক। আমি সুখে নেই।

~ তোমার পাপের শাস্তি এসব। কথায় আছে না, পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না।
হঠাৎ কোনো নারীকণ্ঠ শুনে অনিক আর অনি মেইন ডোরের দিকে তাকালো। অনিকের মা অনিকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
~ এতোকিছু ঘটে গেছে তোর জীবনে, আার তুই আমাদের এসবকিছু ঘুনাক্ষরে জানতে দিসনি। তুই বলেছিলি অনিকে পাওয়া যাচ্ছে না আর তুই খোঁজার চেষ্টা করছিস। অথচ এই মেয়ে কি না, ছিঃ।

অনিকের মা অনির কাছে গিয়ে বললো,
~ তুমি কী করে পারলে এতো জঘন্য একটা কাজ করতে? তোমায় তো আমরা কম স্নেহ ভালোবাসা দেইনি। তাও এভাবে কী করে চলে গেলে। নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে ফেলে লোভে পড়ে চলে গেলে। তুমি জানো অনিক কীভাবে আশুকে বড় করেছে? একটা শিশু, যার কিনা সেসময় মাকে দরকার ছিল, সে কতটা অসহায় ছিল তার মাকে ছাড়া ভাবতে পারছো?

অনিক ওর দুই হাত দিয়ে আশুকে বড় করেছে একদম জন্মের পর মুহুর্ত থেকে এখন পর্যন্ত। একটা সদ্যোজাত শিশুকে পালতে গিয়ে তো মায়েরাই হিমশিম খায়। আর সেখানে অনিকের কী কষ্ট করতে হয়েছে ওর নতুন ব্যবসা আর আশুকে একসাথে সামলাতে?
অনিক বলে উঠলো,

~ উফ মা, প্লিজ থামো। ওকে এতো কিছু বলার কী দরকার? আর তুমি, তোমার তো আর কিছু বলার নেই, তাই না? তোমার আশুকে নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। ও একটু অসুস্থ, সুস্থ হলে স্কুলে যাবে। তোমার জন্য তো আর আমি আনিশাকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করবো না।
অনি বললো,
~ আনিশাকে,
অনিক ওকে বলতে না দিয়ে বললো,
~ নো নো, আমি আর কোনো কথা শুনবো না।

বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। আমার আর আশুর জীবনে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই। আই সেইড গেট লসৃট ফ্রম হেয়্যার। গোওওওও।
অনি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে ছুটে চলে গেল। হয়তো এটাই তার পাওনা ছিল। কিন্তু না, অনি এতো সহজে হাল ছাড়বে না। চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
~ সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল কীভাবে বাঁকাতে হয় তা আমার ভালো করে জানা আছে।
বলেই শয়তানি হাসি দিল।


পর্ব ১০

অনি আয়াশকে বলছে,
~ তোমার সানশাইন ম্যানশন নামের বাগান বাড়িটা আমার চাই। ওটা আমার নামে লিখে দিতে হবে।
আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বললো,
~ হঠাৎ সানশাইন ম্যানশন এর দিকে তোমার নজর গেল কেন?
~ কারণ ঐ বাড়িতে আমি থাকবো। এই বাড়িতে থাকতে আমার ভালো লাগে না।

~ এতো বড় বাড়ি রেখে তুমি ঐ বাড়িতে একা কেন থাকবে? সমস্যা কোথায়? এমনি তোমার প্রাক্তন স্বামী অনিক চৌধুরীর জ্বালায় আমার ব্যবসা বারবার ফ্লপ হচ্ছে। অনিক চৌধুরী কিভাবে সব ডিল নিজের হাতে নিয়ে নেয় আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। ওর ব্যবসা দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে আর আমারটা দিন দিন চুপসে যাচ্ছে। তার ওপর তোমার এই রোজকার পাগলামি আমার অসহ্য লাগে।

~ অসহ্য যখন লাগে, তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন?
~ ভুল করেছিলাম। এখন আমি কি খুব সুখে আছি? মোটেই না। আসলে কি বলতো, অনিক অনেক লাকি যে তুমি ওর জীবন থেকে চলে গেছ। তোমার আসল রূপ যে কতটা জঘন্য তা শুধু আমি জানি। আমার লাইফটা হেল হয়ে গেছে তোমায় বিয়ে করে, অনি।

~ এতো কিছু তো আমি জানি না, তুমি আমায় সানশাইন ম্যানশন লিখে দিবে। দ্যাটস ফাইনাল।
আয়াশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
~ কাল তোমার কাছে পেপারস পাঠিয়ে দিব। সানশাইন ম্যানশন কাল থেকে তোমার।
কথাটা শোনার সাথে সাথে অনির মুখে ভিলেনি হাসি ফুটে ওঠে।

সাত দিন পর আজ আনিশা স্কুলে যাচ্ছে। অনিক আনিশার চুল গুলো দুই ঝুটি করে দিতে দিতে বললো,
~ আশু, এতোদিন অসুস্থ ছিলে, শরীরটা এখনো সামান্য উইক। সো, স্কুলে গিয়ে বেশি লাফালাফি করবে না। আর ঐ এ.এস. ম্যামের সাথে বেশি মিশবে না।
আনিশা অনিকের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বললো,
~ ওকে, পাপা।

অনিকও হেসে আনিশার নাক টেনে দিলো। পাশ থেকে অনিকের মা বলে উঠলো,
~ এই এ.এস. ম্যামটা আবার কে?
অনিক আনিশার ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বললো,
~ অনি, অনিন্দিতা সুলতানা। আশুর স্কুলের টিচার ও।
অনিকের মা রেগে বললো,

~ কীইইই? অনি আশুর স্কুলে পড়ায়! তাহলে তুই কোন আক্কেলে আমার নাতনিটাকে ঐ স্কুলে আবার পাঠাচ্ছিস? দেশে কি আর স্কুল নেই?
অনিক আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের স্যুট ঠিক করতে করতে বললো,
~ কাম অন, মা। অনির জন্য কেন আশু স্কুলে যাবে না? আর আমি আমার কলিজাকে স্কুলে একা ছেড়ে দিব সেটা তুমি ভাবলে কি করে?

বলেই রহস্যময় হাসি দিল।
অনিকের মা অবাক হয়ে বললো,
~ মানে?
~ মানেটা কিছুই না। তোমার এতো কিছু না জানলেও চলবে। চলো, আশু।
বলে আনিশাকে কোলে তুলে সিড়ি পেরিয়ে মেইন ডোর দিয়ে বাইরে চলে গেল। অনিকের মা ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছে,

~ এই বাপ-মেয়েকে আলাদা করো না, আল্লাহ। আমার ছেলেটা যে আশুকে ছাড়া বাচতেই পারবে না। কতবার ওকে বিয়ে করাতে চাই লাম। কিন্তু ওর একটাই কথা। মানুষের বাঁচার জন্য অক্সিজেন দরকার হয়, মা। আমার জীবনে আশুই সেই অক্সিজেন। ওকে নিয়েই আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু অনিকে দেখার পর আর ওর সম্পর্কে জানার পর মনটা খালি কু ডাকছে। আল্লাহ, ওদের রক্ষা করো। আমার অনিকটা জীবনে না পেয়েছে সংসার আর না পেয়েছে সুখ। ওকে এবার একটু শান্তি দাও।

অনিক আনিশাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে গেইট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আনিশা ভেতরে চলে যায়। অনিক গাড়িতে উঠে একজনকে ফোন করে। বলে,
~ অল ডান? সব কমপ্লিট তো?

~ ইয়েস স্যার। এতোদিন দশজন ছিল। আপনার কথা মতো আজ ত্রিশ জনকে লাগিয়েছি।
~ গুড জব। কিন্তু দায়িত্বে যদি গাফিলতি করিস, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। সবকটাকে মরতে হবে, হয় আমার হাতে নয়তো রিয়াদের হাতে।
অপরপাশের ব্যক্তি টা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
~ নো স্যার। আমরা ঠিক ঠাক ভাবেই আমাদের কাজ করবো আজ থেকে।

~ গুড।
~ স্যার আমাদের আজকের পেমেন্ট টা।
~ গিয়ে ব্যাংক একাউন্ট চেক করিস।
বলেই ফোন কেটে দিল।

এদিকে আনিশা স্কুলে আসার পর থেকে অনি ওর পেছনে আঠার মতো লেগে আছে। বার বার শুধু ওকে নোটিস করছে আর এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে। আনিশার এটা একটু বিরক্ত লাগলেও কিছু বলতে পারছে না। অনি আনিশার মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে বললো,
~ আশু, তুমি কি আমার কথায় ডিস্টার্বড হচ্ছো?

আনিশা অনির কথায় অবাক হয়ে যায়। তারপর হালকা গম্ভীর হয়ে বললো,
~ ম্যাম, স্যরি টু সেয়, আমায় আশু বলে ডাকবেন না। এই নামে শুধু আমায় আমার পাপা আর দাদুমনি ডাকে।
~ কেন? আমি ডাকলে সমস্যা?
~ হ্যাঁ। প্লিজ।
~ ওকে। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
আনিশা অবাক হয়ে বললো,
~ শর্ত! কী শর্ত?

~ তেমন কিছু না। জাস্ট আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। ইউ নো, আমার না একটা কাজে তোমার হেল্পের অনেক দরকার। আর তুমি নিশ্চয়ই মানুষকে হেল্প করতে ভালো বাসো।
অনির ইনোসেন্ট ফেস দেখে আনিশা রাজী হয়ে যায়। তার ছোট্ট মাথা তো আর অনির ষড়যন্ত্র ধরতে পারবে না। অনি খুশি হয়ে আনিশার গালে চুমু দিয়ে দেয়। আনিশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার হাত দিয়ে গাল ধরে আবার নামিয়ে একবার হাতের দিকে তাকায় তো একবার অনির দিকে তাকায়। অনিক ছাড়া তার গালে অন্য কাউকে চুমু দিতে দেয় না।

স্কুল ছুটি হলে অনি আনিশাকে নিয়ে নিজের গাড়িতে উঠায়। আনিশা গাড়িতে বসে বললো,
~ ম্যাম, পাপা তো আমায় ছুটির পর বাসায় নিয়ে যাবার জন্য গেইটের সামনে ওয়েট করে। আমি পাপার সাথে দেখা করে বলে আসি।

বলেই আনিশা যেই না গাড়ির দরজা খুলতে যাবে, ওমনি অনি খপ করে আনিশার হাত ধরে জোরপূর্বক হেসে বললো,
~ আরে, না না। তার দরকার নেই। আমি তোমার পাপাকে ফোন করে জানিয়েছি।
আনিশাও আর কিছু বললো না। গাড়ি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।
কিন্তু অনি তো আর জানে না যে ও খুব বাজে ভাবে ফেঁসে যেতে চলেছে।

এদিকে অনিক আনিশার অসুস্থতার জন্য স্কুল ছুটি হওয়ার একঘন্টা আগে থেকে গেইট এর সামনে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ছুটি হয়েছে ৪০ মিনিট হয়ে গেছে, আর স্কুল ও প্রায় খালি হয়ে গেছে। কিন্তু আনিশার কোনো খবর নেই। অনিক এবার গেইট এর ভেতর ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই তার ফোন বেজে ওঠে। অনিক ফোন রিসিভ করে বললো,
~ হুম, বল।
~ …..
~ ওদের ফলো কর। যেখানে গিয়ে থামবে ওখানের ঠিকানা আমায় পাঠিয়ে দিবি।
~ …..
~ না, আমার এখানে কয়েক টা কাজ না সারলেই নয়। আর এস. পি. মি. খানকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি সব।
বলেই ফোন কেটে অন্য একজনকে ফোন করে অনিক। তার সাথে কথা বলে সোজা চলে যায় প্রিন্সিপালের রুমে।

অনি আনিশাকে নিয়ে পৌঁছে যায় সানশাইন ম্যানশনে।


পর্ব ১১

অনি আনিশাকে নিয়ে সানশাইন ম্যানশনে পৌঁছে যায়। অনি গাড়ি থেকে নেমে আনিশাকে নামতে বললো। আনিশা গাড়ি থেকে নেমে বললো,
~ ম্যাম, আমরা কোথায় এলাম? এটা কার বাড়ি?

অনি হেসে বললো,
~ এটা আমার বাড়ি। আর এখন থেকে তোমারও বাড়ি।
আনিশা অবাক হয়ে বললো,
~ আমার বাড়ি মানে?
~ বলবো, আগে ভেতরে তো চলো।
আনিশা আর কিছু না বলে অনির সাথে সাথে বাড়ির ভেতর ঢুকলো।

এদিকে অনিক স্কুলে প্রিন্সিপালের রুমের সামনে দাড়িয়ে বললো,
~ মে আই কাম ইন?
~ ইয়েস কাম ইন প্লিজ।
অনিক ভেতরে ঢুকলে প্রিন্সিপাল অবাক হয়ে বললো,
~ মি. অনিক চৌধুরী, আপনি এখানে! এনি প্রবলেম?
অনিক চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
~ ইয়েস, আই হেভ আ বাঞ্চ অফ প্রবলেমস।

প্রিন্সিপাল ভয়ে ভয়ে বললো,
~ কী হয়েছে? একটু খুলে বলবেন কাইন্ডলি।
অনিক অসম্ভব রেগে আছে যা ওর চশমা ভেদ করা লাল লাল চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনিক চেয়ার টেনে পায়ের ওপর পা তুলে বসে বললো,
~ আমার মেয়ে এই স্কুলে পড়ে তা নিশ্চয়ই জানেন?

~ হ্যাঁ
~ আজ এই স্কুলের টিচার অনিন্দিতা সুলতানা ওরফে এ.এস ম্যাম আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে।
~ হোয়াটটটটট?
~ ইয়েস।

~ অনিন্দিতা কেন আপনার মেয়েকে কিডন্যাপ করতে যাবে? কোনো প্রমাণ আছে?
~ অনিক চৌধুরী এতো কাঁচা কাজ করে না। আর আপনাকে প্রমাণ দেখানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই আর না আছে কোনো লাভ। জাস্ট জানানোর জন্য এলাম। আসি।
বলেই চলে গেল অনিক। প্রিন্সিপাল তো পুরাই হতভম্ব হয়ে গেছে।

অনি আনিশাকে বেডে বসিয়ে মুখের সামনে খাবার বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
~ এই নাও। চিকেন বিরিয়ানি, আমি নিজের হাতে রান্না করেছি। এটা না তোমার ফেভারিট ডিশ?
আনিশা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
~ উহু, আমি চিকেন বিরিয়ানি খাই না। কাচ্চি বিরিয়ানি খাই। আর আপনি তো আমায় খেতে আনেন নি। কী কাজের জন্য এনেছেন তা বলুন?

আনিশার কথা শুনে অনির মুখটা চুপসে গেলো। তাও হাসি মুখে বললো,
~ আচ্ছা আনিশা, তোমায় যদি তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই, তাহলে তোমার কেমন লাগবে?
আনিশা মুখটা গম্ভীর করে বললো,
~ আমার মাকে চাই না। আমার মা নিশ্চয়ই ভালো না। নয়তো আমার পাপা অবশ্যই আমায় মায়ের সম্পর্কে বলতো। কিন্তু না, আমায় পাপা, দাদুমনি, রিয়াদ চাচ্চু, ফিহা আন্টি কেউই আমার মা সম্পর্কে কিছু বলেনি। আর আমার জানার ইচ্ছাও নেই। তবে পাপা আমায় কথা দিয়েছে যে, আমি বড় হলে আমায় আমার মায়ের সম্পর্কে বলবে।

অনি অবাক হয়ে বললো,
~ তোমার রিয়াদ চাচ্চু আর ফিহা আন্টি কে?
~ রিয়াদ চাচ্চু হলো আমার পাপার বন্ধু আর ফিহা আন্টি হলো রিয়াদ চাচ্চু এর ওয়াইফ।
~ রিয়াদ ভাই আর ফিহার বিয়ে হয়েছে?
~ হ্যাঁ, কিন্তু রিয়াদ ভাই মানে?

~ না কিছু না। আচ্ছা, তোমার মাকে ভালোবাসো না তুমি?
~ না, আমার মা নিশ্চয়ই খুব খারাপ। সবার মা সবাইকে কতো আদর করে আর আমার মা, সো তো আমার সাথে কখনো দেখাই করেনি। আমার পাপাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসি। আর বিশ্বাস ও করি। মা ভালো হলে পাপা আমায় মায়ের সম্পর্কে ঠিকই বলতো।

অনি আনিশার কথা শুনে প্রচুর রেগে গেল। চিৎকার করে বললো,
~ তোমার পাপার কাছে তুমি আর যেতে পারবে না, বুঝেছো তুমি? তোমাকে এখানেই থাকতে হবে। আমার সাথে থাকবে তুমি।
আনিশা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,

~ আমি আপনার সাথে কেন থাকবো, ম্যাম। আমাকে আমার পাপার কাছে দিয়ে আসুন।
~ একদম না। আমার সাথে তোমায় থাকতেই হবে। কারন আমি তোমার মা।
আনিশা অবাক হয়ে বললো,
~ কী?

~ হ্যাঁ, আমি তোমার মা। আর আজ থেকে আমি তোমায় তোমার পাপার কাছে যেতে দিব না।
আনিশা কেঁদে কেঁদে বললো,
~ আপনি আমার মা হন আর যেই হন, আপনি অনেক পচা। আমি আমার পাপার কাছে যাবো। আপনার সাথে থাকবো না। আপনি আমায় মিথ্যা বলে এখানে এনেছেন। আপনাকে আমি মা বলে মানি না।

আনিশার কথা শুনে অনি রেগে চিৎকার করে বললো,
~ আনিশাআআআআ।
বলেই আনিশার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে দিলো। আনিশার ফর্সা গালে চার আঙুলের লাল দাগ বসে গেছে আর ফুফিয়ে কেঁদে চলেছে।
অনি রেগে বললো,
~ তোমার সাহস কী করে হয়, আমায় এভাবে বলার।
~ আমার মেয়ের সাহস তো তুমি কিছু দেখোইনি।

হঠাৎ কারো কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকায় অনি। দেখে অনিক দাড়িয়ে আছে পাশে রিয়াদ পুলিশ এর ইউনিফর্ম পরা আর তার পাশে ফিহা। অনিক রেগে অনি র দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
~ কী ভেবেছিলে, আমার আশুকে স্কুল থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসবে, আর আমি কিচ্ছু জানবো না।
অনিকের অগ্নি দৃষ্টি দেখে অনি একটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
~ দে, দে, খো অনিক, তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না।

~ জাস্ট শাট আপ। তুমি ভাবলে কী করে আমার কলিজাকে আমি একটা জায়গায় একা পাঠিয়ে দিব, যেখানে তোমার মতো কালনাগিনী আছে জেনেও। আশু যেদিন থেকে স্কুলে ক্লাস করা শুরু করে, সেদিন থেকে ওর জন্য আমি দশজন গার্ড ঠিক করে দিয়েছি। আর তোমায় দেখার পর থেকে তা তিনগুণ কর দিয়েছি। আমি জানতাম তুমি কোনো একটা গন্ডগোল করবেই।
রিয়াদ বললো,
~ আর তুমি আনিশাকে নিয়ে স্কুল থেকে বের হওয়ার পর ই গার্ডরা তোমাদের ফলো করে এড্রেস আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়।

অনি অবাক হয়ে বললো,
~ রিয়াদ ভাই, আপনি এই ড্রেসে?
রিয়াদ হালকা হেসে নিজের কার্ড দেখিয়ে বললো,
~ এস. পি. রিয়াদ ইশতিয়াক খান।

আনিশা বসতে পারছে না। তার মাথা শুধু ঘুরছে। কী করে সহ্য করবে সে। এমনি এক সপ্তাহ অসুস্থ ছিল। তার ওপর এমন চড় জীবনে ও খায়নি। তাও অস্ফুট স্বরে বলে,
~ পাপা, তুমি এসেছো? আমি জানতাম।
অনিক ব্যস্ত হয়ে আনিশার কাছে গিয়ে বললো,
~ আশু কী হয়েছে তোমার? এমন করে ঢুলছো কেনো?

বলে যেই আনিশার গালে হাত রাখতে যাবে, ওমনি দেখলো ওর গালে আঙুলের লাল দাগ। এটা দেখে অনিকের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। অনিক ফিহালে বললো,
~ ফিহা আশুকে নিয়ে একটু বাইরে যাও।

ফিহা অনির দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আনিশাকে ধরে নিয়ে বাইরে গেলো।
অনিক অনির দিকে এগিয়ে গিয়ে কষে এক চড় বসিয়ে দিল ওর গালে আার অনি ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। অনিক আবার ওর চুল ধরে উঠিয়ে বললো,
~ তোর সাহস কী করে হয়, আমার কলিজার গায়ে হাত তোলার? আমি আশুকে আজ পর্যন্ত একটা ফুলের টোকা পর্যন্ত দেইনি আর তুই দুদিন ধরে এসে ওর গালে চড় মেরেছিস৷ ছলনাময়ী, তোকে আজ আমি মেরেই ফেলবো।

বলেই একের পর এক থাপ্পর দিয়েই চলেছে অনিক। অবস্থা বেগতিক দেখে রিয়াদ অনিককে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
~ আরে থাম৷ ও মরে যাবে তো।
অনিক ছুটোছুটি করতে করতে বললো,
~ মরুক, মারতেই তো চাই আমি। ওর মতো কালনাগিনীর বাঁচার কোনো অধিকার নেই।
রিয়াদ তখন তার লোকজনদের ডাকলো আর কয়েকজন মহিলা পুলিশ এসে অনিকে নিয়ে গেল। অনি বের হওয়ার সময় দেখলো বাইরে ওর বাবা-মা দাড়িয়ে আছে। অনিকে দেখার সাথে সাথে তারা নিজের মুখ ফিরিয়ে নিলো। সত্যিই সন্তান যখন কোনো অন্যায় করে তখন নিজেদেরই খুব অপরাধী মনে হয়।

অনির শাস্তি হয়েছে। সে এখন কারাদন্ড ভোগ করছে। আর অনিক আনিশাকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেছে।

পর্ব ১২

১৫ বছর পর…..
অনিক নিজের স্টাডি রুমে বসে খুব মনযোগ সহকারে বই পড়ছে। ইদানীং দায়িত্বের বোঝাটা একটু হালকা হওয়ায় বই পড়েই সময় অতিবাহিত করছে সে। বেশিরভাগ সময়ই ধর্মীয় বই পড়ে, মাঝে মাঝে গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়ে। কারণ বয়সটা তো আর কম হয়নি, আবার হু হু করে বেড়েই চলেছে। তাই এবয়সে একটু ধর্ম চর্চায় মনোনিবেশ করা উচিত। আর বই পড়া এমন একটা নেশা, যাতে বার বার ডুব দিতে বা ডুবে থাকতে মন্দ লাগে না।

অনিক বই পড়ায় মগ্ন এমনসময়ই হঠাৎ টেবিলের ওপরে থাকা ফোনটা কেঁপে কেঁপে বেজে ওঠে। অনিক বইটা টেবিলের ওপর রেখে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে স্ক্রিনের ওপর John নামটা ভেসে উঠলো। অনিক নিজের চশমাটা খুলে ভ্রু কুঁচকে বলে,
~ আল্লাহ জানে, আজকে আমার মেয়েটা কী অঘটন ঘটিয়েছে?
তারপর ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জন অস্থির স্বরে বলে,
~ Sir, get ready to receive a bad news.
অনিক তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বললো,

~ What happened, John? Anything serious?
~ Yes, sir. Today Anisha maam……
আরো কিছু বলার আগেই আনিশা খপ করে জনের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে অনিককে বললো,
~ পাপা, এই জনের কথা একদম বিশ্বাস করবে না। এই হনুমানটাকে কেন যে আমার পিছনে লাগিয়েছ, গড নোস। এর জন্য আমার লাইফ থেকে শান্তি নামক বস্তুটা জাস্ট হারিয়ে গেছে।!
অনিক কাঠ কাঠ গলায় বললো,
~ আশু, জন তোমার বডিগার্ড এন্ড তোমার সকল খবরাখবর আমায় দেয়াটা ওর দায়িত্ব। আর তুমি একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবে না। কী করেছো আজকে তুমি?

আনিশা আমতা আমতা করে বললো,
~ তেমন কিছুই না, জাস্ট একটা ছেলেকে মেরেছি।
~ হোয়াট, তুমি কবে এই মারধর করা ছা,
আর কিছু বলার আগেই ফোনের অপর পাশ থেকে টুট টুট শব্দ আসতে থাকে আর স্ক্রিনে ভেসে ওঠে The call is ended. অনিক ফোনটা টেবিলে রেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কী করবে যে তার এই মেয়েটাকে নিয়ে? পড়াশোনা শেষ করে কয়েকদিন আগে বিজনেসে হাত দেয় সে।
আনিশা সব ব্যাপারে একটু বেশি স্যান্সিটিভ, আবার সেই সাথে অনেক রাগী ও বদমেজাজি। তবে মনের দিক দিয়ে অনেক ভালো। স্টুডেন্ট লাইফে তেমন কারো সাথে ফ্রেন্ডশিপও হয়নি, আসলে সবাই ওর থেকে একশো হাত দূরে থাকে। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই রেগে যায় আর ঠাস-ঠুস চড় মেরে দেয়। আর অন্যায় দেখলে হাত পা একসাথে চালানো শুরু করে।
অনিক তার মেয়েকে এমন করে গড়ে তুলতে চায়নি, কিন্তু আনিশা অনেক নৈতিকতা সম্পন্ন ও প্রতিবাদী বলে কিছু বলতেও পারেনা।

~ দেখতো, এই ছেলেগুলোর মধ্যে কোনটা কোনটা তোর পছন্দ হয়।
অনিক মাথা তুলে দেখলো, ওর মা টেবিলের ওপর অনেকগুলো ছবি ছড়িয়ে ঘাটাঘাটি করছে। অনিক অবাক হয়ে বললো,
~ এগুলো কী মা? এতো ছেলের ছবি তুমি পেলে কোথায়? আর এসব দিয়ে হবেই বা কী?
~ কী হবে মানে? এদের মধ্যে থেকে তুই আমার আশু দাদুমনির জন্য ছেলে পছন্দ করবি। তুই জানিস, এই ছবি গুলো আমি কত জায়গা থেকে কত কষ্ট করে জোগাড় করেছি?
অনিক ভীতু গলায় বললো,

~ আমরা আশুর জন্য ছেলে দেখছি এটা যদি আশুর কানে একবারের জন্যও যায় না, কী কেলেঙ্কারি হবে ভাবতে পারছো? পুরো বাড়িতে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হয়ে যাবে।
~ তাই বলে কী তুই সারাজীবন আশুকে কুমারী বানিয়ে রাখবি নাকি? আমি ওকে বোঝাবো। আর আমার বিশ্বাস ও রাজী হবে। তবে বিয়েটা কিন্তু বাংলাদেশে হবে।
অনিক আনমনে বললো,
~ আগে ও রাজী তো হোক।

হঠাৎ নিচ থেকে কারো চিৎকার শোনা যাচ্ছে। অনিক আর তার মা নিচে গিয়ে দেখলো, আনিশা জনকে ইচ্ছা মতো বকছে আর জন আনিশার কথা বোঝার চেষ্টা করছে।
~ বজ্জাতের হাড্ডি, আজ তোর একদিন নয়তো আমার দশদিন। সবসময় আমার সব কথা পাপার কানে তুলে দেওয়ার জন্য বসেই থাকিস।

জন কিছুই বুঝতে পারছে না, কারন সে তো আর বাংলা বুঝে না। কিন্তু এটা ঠিকই বুঝতে পারছে যে, আনিশা তার ওপর সেই লেভেলের ক্ষেপে আছে।
এদিকে অনিক আনিশার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। আনিশা জামার হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা, হিজাব এলোমেলো হয়ে আছে, ওড়নাটা কোমরে বাঁধা আর স্যুট টা বারবার হাত দিয়ে মোচড়াচ্ছে আর জনের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে চলেছে।
অনিকের মা আনিশার মুখের ঘাম গুলো শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললো,
~ কী হয়েছে আমার দাদু মনি টার? এতো ক্ষেপে আছিস কেন?

আনিশা কিছু বলতে যাবে এমন সময় অনিক বলে উঠলো,
~ আজ কোথায় গুন্ডামী করে এসেছো, আগে সেটা বলো। তুমি এখন আর স্টুডেন্ট নও। তাই অযথা মারপিট করে নিজের এবং কোম্পানির সুনাম নষ্ট না করাটাই বেটার বলে আমার মনে হয়।
আনিশা জনের দিকে রাগী লুকে তাকিয়ে আবার অনিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ পাপা, কী বলল তুমি? আমি অযথা মারপিট করি? এই বজ্জাত জন তোমাকে যা বলবে তুমি তাই বিশ্বাস করবে? আসল কথা টাই তো শুনলে না।

অনিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
~ কিসের আসল কথা?
আনিশা সোফায় আরাম করে বসে বললো,
~ আমি অফিসের মিটিং শেষ করে পার্ক স্ট্রিট দিয়ে যখন আসছিলাম তখন গাড়ি থেকে কিছু টা দূরে একটা ছেলে একটা মেয়ের গায়ে বারবার হাত দিচ্ছিলো আর বাজে ভাবে হাসছিল, মেয়ে টা যতবার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিল ততোবারই ছেলেটা মেয়েটাকে আটকে দিয়ে হ্যারাস করছিল। আমি তখন গাড়ি থেকে নেমে ওই ছেলেটার কাছে যাই আর ছেলেটা আমায় দেখেও হাসতে লাগলো। আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করিনি, কারণ জানি সেই চেষ্টা করে লাভ নেই। ইচ্ছে মতো ধোলাই দিয়ে এসেছি, এখন হাসপাতালে ভর্তি মনে হয়।

বলেই একটা তৃপ্তির হাসি দিলো। অনিক আনিশার পাশে বসে ওকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
~ একদম ঠিক করেছো। কিন্তু এটা কত নাম্বার হলো।
~ জানি না। এই জনকে বলেছিলাম হিসাব রাখতে, কিন্তু এ সারাক্ষণ কূটনীতিতে ডুবে থাকে।
অনিক আনিশার কথা শুনে জোরে হেসে দিলো।

অনি কড়া রোদের মধ্যে রাস্তা দিয়ে একাকী হেঁটে যাচ্ছে, গন্তব্য সানশাইন ম্যানশন। তিন বছর আগে জেল থেকে বেড়িয়েছে সে। অনি জেলে থাকাকালীন আয়াশ তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে মালয়েশিয়া চলে গেছে। অনির কোনো খোঁজ খবর নেয় নি সে। অনি তখনই বুঝেছে, তার জীবনের পথচলাতে কত বড় ভুল সে করেছে। কিন্তু এখন সেই ভুল উপলব্ধি করতে পারলেই বা কী হবে? সে যে অনেক দেরী করে ফেলেছে।

অনি অনেক চেষ্টা করেছে অনিক ও আনিশাকে খুঁজে বের করতে। শুধু এটুকু খবরই পেয়েছে যে, তারা ১৫ বছর আগেই এদেশ ছেড়ে চলে গেছে। রাস্তায় যাওয়ার পথে অনিকের বাড়ীর দিকে নজর পড়ে অনির। সে মনে মনে বলে,
~ একবার যদি তোমাদেরকে দেখতে পেতাম, অনিক! শুধু ক্ষমা চাওয়ার একটা মাত্র সুযোগ যদি পেতাম! আমি জানি, আমার করা পাপের কোনো ক্ষমা হয় না।

ভাবতেই চোখ ঘোলা হয়ে আসে অনির। মলিন শাড়ির আঁচলের শেষ অংশ টা হাত দিয়ে টেনে চোখ দুটো মুছে নেয়। আবার হাঁটা শুরু করে দেয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর একটা লোকাল এনজিও তে চাকরি নেয় অনি, এখনো সেখানেই কর্মরত আছে সে। সানশাইন ম্যানশন আয়াশের কাছ থেকে নিজের নামে লিখে নেওয়ার এখন সেখানেই থাকে অনি। আপনজন বলতে কেউ নেই, তাই একাই দিনাতিপাত করছে আর নিজের কর্মফল ভোগ করছে। হয়তো পাপের বোঝা টা একটু বেশিই ভারী! তাই পনেরো বছরেও প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়নি।

পর্ব ১৩

আনিশা হাতে হাত চাপছে আর চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। আনিশার এই গম্ভীরতা যে ঝড়ের পূর্বাভাস, অনিক তা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে।
কিছুক্ষণ আগে,
অনিকের মা আনিশার রুমে এসে তাকে পাঁচটা ছবি দিয়ে বলেছে, এদের মধ্যে থেকে কাকে তার পছন্দ হয়? সাথে অনিকও এসেছে, কিন্তু সে একদম চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভীতু ফেস করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার এতো শখ নেই বাঘের সাথে কাবাডি খেলার।

আনিশা বেডে হেলান দিয়ে খুব মনযোগ সহকারে একটা ফাইল দেখছিল। অনিকের মায়ের কথায় উঠে বসে ছবিগুলো নিয়ে দেখে, কয়েকজন ছেলের ছবি। আনিশা ভ্রু কুঁচকে বলে,
~ এরা কারা? কী করবো এই ছবি গুলো দিয়ে?
অনিকের মা মেকি হেসে বলে,
~ শোনো মেয়ের কথা! কী করবি মানে? আমরা তোর জন্য ছেলে দেখছি, এই ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে কাকে তোর ভালো লাগে বলতো? বিয়ে তো করতেই হবে, সেটা আজ হোক বা কাল। মেয়ে দের তো আর আজীবন কুমারী থাকা চলে না।

আনিশা তখন থেকেই গম্ভীর হয়ে বসে আছে। অনিক সারা ঘরে বারবার চোখ বুলাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই আনিশা বিজনেসে জয়েন করবে বলে পুরো রুমের নতুন ডেকোরেশন করিয়েছে সে। আজ বোধ হয় সবকিছুর ওপর দিয়ে ভালোই ঝড় উঠবে!
আনিশা হঠাৎ থমথমে গলায় বললো,
~ পাপা, তুমি কি দাদুমনির সাথে একমত?

অনিক আমতা আমতা করে বললো,
~ বিশ্বাস করো, আশু। আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানতাম না। তোমার দাদুমনিই এই ছবি গুলো কালেক্ট করেছে। আমারও মনে হয়, তোমার দাদুমনি ঠিকই বলছে!
আনিশা তখন অনিকের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ এই ছবি দিয়ে কী হবে? এদের সবার বায়োডাটা নিয়ে এসো।

অনিক আর অনিকের মা চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আনিশা এটা দেখে নিজের ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ কী হলো? তোমরা এমন করে তাকিয়ে আছো কেন? আরো কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকলে চোখ দুটো আর চোখের জায়গায় থাকবে না, খুলে মাটিতে পড়ে যাবে।

অনিক বেডে বসে আনিশার কপালে ও গালে হাত ছুঁইয়ে বললো,
~ আশু, আর ইউ ওকে? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
~ শরীর বেঠিক হওয়ার কী হলো?
~ তার মানে, ইউ আর এগ্রিড টু গেট ম্যারেড?

আনিশা হেসে অনিকের গলা জড়িয়ে বললো,
~ কাম অন, পাপা। তোমার কী মনে হয়, আমি তোমার ইচ্ছাকে প্রায়োরিটি দিব না? আমি কখনো তোমার মতের বাইরে কাজ করেছি নাকি? তোমার দেওয়া আদেশ উপদেশ মেনে চলেছি বলেই আজ আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। হয়তো আমার রাগটা একটু বেশি! কিন্তু রাগ তখনই উঠে, যখন আনফেয়ার আর ডিসিপ্লিনের মেইনটেইন হয়না এমন কিছু দেখি।

অনিক আনিশার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
~ আমি জানি, আমার কলিজাটা অন্যায় এবং বিশৃঙ্খলা একদম পছন্দ করে না।
অনিকের মা অনিকের মাথায় চাটি মেরে বলে,
~ একদম তোর মতো হয়েছে তোর মেয়েটা। দুটোর স্বভাবে একদম কোনো পার্থক্য নেই। শুধু আমার আশুর চেহারাটা অনির মতোই সু,

বলার সাথে সাথেই থেমে গেল অনিকের মা। কী থেকে কী বলে ফেললো এটা ভেবেই নিজেকে ঝাড়তে লাগলেন।
অনির কথা শুনেই অনিকের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। আর আনিশার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। আনিশাকে যদিও অনিক কিছু জানায়নি কিন্তু আনিশা অনিকের মায়ের কাছ থেকে সব শুনে নিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য অনিকের মা বললো,
~ চলো নিচে, আমি এই ছেলেগুলোর বায়োডাটা বসার ঘরে ড্রয়ারে রেখেছি।
আনিশা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
~ চলো তাহলে।

তারপর তারা সবাই নিচে গিয়ে সোফায় বসলো। আনিশা কোনো ছেলেরই ছবি দেখছে না, শুধু বায়োডাটা গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। অবশেষে একটা ফাইল অনিক ও তার মায়ের সামনের টেবিলে রেখে বললো,
~ এই ছেলেটা বাকি সবগুলোর মধ্যে বেস্ট। ওনার স্টুডেন্ট লাইফের রেজাল্ট আমার থেকেও অনেক ভালো। তার ওপর প্রফেশনাল পর্যায়ে ওনার কোম্পানি আর আমারটা বলতে গেলে সেইম পজিশনে আছে। সো তোমরা এনার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো।

অনিক ফাইলটা হাতে নিয়ে দেখে, ছেলটার নাম মিনহাজ আহমেদ মুগ্ধ। অনিক ছবিগুলো ঘাটাঘাটি করতে লাগলো, কোন ছবিতে এই নামটা লিখা আছে। একটা ছবির নিচে দেখলো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা Minhaz Ahmed Mugdho. অনিক ছবিটা নিয়ে একবার ছবির দিকে আর একবার আনিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
~ বাহ্! বেশ ভালো মানিয়েছে তো। দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে, মেইড ফর ইচ আদার।
আনিশা ভ্রু কুঁচকে বললো,
~ মানে?

অনিক থতমত খেয়ে বললো,
~ না, মানে, কিছু না। আসলে আমি বলছিলাম যে, আমি ছেলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলবো। তারাও তো এখানেই থাকে, ঠিকানা আর কন্ট্যাক্ট নাম্বার দেওয়া আছে। আগমী সপ্তাহে আমরা বাংলাদেশ যাচ্ছি।

আনিশা অন্যমনস্ক হয়ে ছলছল চোখে বললো,
~ পনেরো বছর পর নিজের দেশে যাবো আমি। নিজের দেশ ভাবতেই মনের ভেতর একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়, যা শুধু তারাই বোঝে যারা নিজের দেশকে ছেড়ে অন্য দেশে থাকে।
অনিক আনিশার কাছে গিয়ে বলে,
~ একদম মন খারাপ করবে না। তুমি মুড অফ করে থাকলে কিন্তু আমি জোরে জোরে কান্না করবো।
অনিকের কথা শুনে আনিশা হেসে অনিককে জড়িয়ে ধরে।

আজ সকালের নিজেদের প্রাইভেট ফ্লাইটে অনিক, আনিশা, অনিকের মা এবং মুগ্ধের পরিবার বাংলাদেশে ফিরেছে। ভোর ছয়টায় প্লেন ল্যান্ডিং করার পর আনিশা ছুটে ফ্লাইট থেকে নেমে যায়। তার পেছন পেছন সবাই নেমে আসে। এয়ারওয়ের চারপাশ অনেক খোলামেলা, তার ওপর ভোরের মৃদুমন্দ ঝিরিঝিরি হাওয়া জানান দিচ্ছে এটাই বাংলাদেশ। কিন্তু কই, বিদেশের হাওয়া তো এমন ফুরফুরে লাগে না।

আনিশা নিজের সানগ্লাসটি চোখ থেকে খুলে ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে। অানিশার এই হাসিখুশি মুখটা দেখলে অনিকের মনের মধ্যে অনেক শান্তি অনুভূত হয়। যেন সকল যন্ত্রণা এক নিমিষেই উধাও হয়ে যায়।

এদিকে মুগ্ধ আনিশার দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
~ আহ্, এই মেয়ের মুখটা এতো মায়াবী কেন? যেন পৃথিবীর সব মায়া এখানে এসে জড়ো হয়েছে। এই হাসির দিকে তাকিয়েই সারাজীবন পাড় করে দেখতে যাবে। কিন্তু আমার তো মনে হয় যে, ও ছোট বেলায় আরো বেশি কিউট ছিল। তাহলে ওর মা কী করে পারলো ওকে ছেড়ে চলে যেতে? আমি কি ওকে ওর মা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবো? ও কেমন রিয়েক্ট করবে তখন?

হ্যাঁ, মুগ্ধ আনিশার মায়ের ব্যাপারে সবকিছুই জানে। অনিক তাকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। অনিক চায়না কেউ আনিশার ব্যাপারে কিছু না জেনে আনিশাকে বিয়ে করুক, আর আনিশা ওর মায়ের জন্য মাথা নিচু করে চলুক। আনিশার সবকিছু মেনে নিয়ে যদি কেউ ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়, তাহলে তার কাছেই আনিশা ভালো থাকবে।

পরেরদিন,
আনিশা একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। জন আনিশার থেকে একটু দূরে একটা টেবিলে বসে আছে। আজ মুগ্ধ আনিশার সাথে দেখা করতে চেয়েছে, কী কথা যেন বলবে এজন্য। কিন্তু টাইম দিয়েছিল বিকাল চারটায়, আর এখন সাড়ে চারটা বাজে। মুগ্ধের কোনো খবর নেই।

হঠাৎ করে মুগ্ধ ছুটে এসে আনিশার সামনের চেয়ারে বসে পড়ে আর টেবিলের ওপর থেকে পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানি শেষ করে ফেললো। এরপর আনিশার দিকে তাকিয়ে দেখে, আনিশা লাল লাল চোখে ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বললো,

~ সরি আশু, একচুয়েলি রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, তাই,
~ যখন এতো জ্যাম ছিল, তখন আপনার আরো আগে বাসা থেকে বের হওয়া উচিত ছিল। তাই না? লুজার মানুষদের আমার একদম পছন্দ না, যারা কথা ও কাজে মিল রাখে না এন্ড টাইম মেইনটেইন করতে পারে না।

মুগ্ধ অন্তত কষ্ট করে আনিশার মেজাজ ঠিক করলো। বেশকিছু ক্ষন বিভিন্ন কথা বলার পর মুগ্ধ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,

পর্ব ১৪

~ আচ্ছা আশু, তোমার মা কোথায়? তাকে তো কখনো দেখিনি?
কথাটা শুনেই আনিশার মুখটা কালো হয়ে গেলো। সাথে চোখ দুটো লাল হয়ে পানিতে ভরে উঠলো। মুগ্ধ আপন মনে বার্গার খাচ্ছিলো। খেতে খেতে বললো,
~ কী হলো? বলো।

বলেই আনিশার দিকে তাকিয়ে দেখে আনিশার গাল বেয়ে পানি পড়ছে আর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলের ওপর চেপে রেখেছে। মুগ্ধ ব্যস্ত হয়ে আনিশার পাশে গিয়ে বসে বললো,
~ হোয়াট হ্যাপেন্ড, আশু? তুমি কাঁদছো কেন? প্লিজ, কেঁদো না।
বলে যেই আনিশার কাধে হাত রাখতে যাবে, ওমনি আনিশা হাত উঁচিয়ে বাধা দিয়ে বললো,
~ স্টপ। আপনার সাথে আমার এখনো বিয়ে হয়নি। সো, আমার গায়ে টাচ করার কোনো রাইট আপনার নেই।

আনিশার কথা শুনে মুগ্ধ ওর দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
~ আশু, আম সরি। আমি আর কখনো তোমাকে তোমার মায়ের ব্যাপারে কিছু আস্ক করবো না। প্লিজ, পারডোন মাই মিস্টেক।

আনিশা সামনের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,
~ পাপা কি সত্যিই আপনাকে আমার মায়ের ব্যাপারে কিছু জানায়নি? পাপা এরকম একটা ইম্পর্ট্যান্ট বিষয়ে সবকিছু আপনাকে খুলে জানায়নি? আই ডোন্ট থিংক সো, মিস্টার মুগ্ধ।
মুগ্ধ অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলে,
~ একচুয়েলি, আম এক্সট্রেমলি সরি টু স্যায়, আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি। আংকেল আমায় আগেই সব বলেছেন।

আনিশা অবাক হয়ে বললো,
~ তার মানে, আপনি এতোক্ষণ আমার দূর্বলতা নিয়ে আমায় পিঞ্চ মারছিলেন! আই হ্যাভ নেভার এক্সপেক্টেড দিস ফ্রম ইউ, মিস্টার মুগ্ধ। আপনি আমার দূর্বল পয়েন্টে আঘাত করে আমায় অপদস্ত করতে চাচ্ছিলেন।

বলে উঠ চলে যেতে লাগলে মুগ্ধ আনিশার হাত ধরে টান দিয়ে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আনিশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
~ আমার কথাটা তো শোনো!
আনিশা মুগ্ধকে বলতে না দিয়ে বললো,
~ কী বলবেন আপনি, হে? কী বলারই বা আছে আপনার?

বলে মুগ্ধের দিকে ফিরে তাকাতেই কপালে বাড়ি লাগে। আনিশা নিজের হাত মুগ্ধের হাত থেকে ছাড়িয়ে বললো,
~ আপনাকে আগেও বলেছি, আমাকে টাচ করবেন না। তাও আপনি একই কাজ করছেন। আর আপনি এতো কাছাকাছি এসে বসেছেন কেন আমার? আমি কখনো কোনো পরপুরুষের সাথে এতো ক্লোজ ভাবে বসিনি, আর কেউ সাহসও পায়নি। কিন্তু আপনার সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। দূরে সরুন, এন্ড দুরত্ব বজায় রেখে কথা বলুন।

আনিশা বিরক্ত হয়ে বললো কথা গুলো। মুগ্ধ মুচকি হেসে আনিশার পাশ থেকে উঠে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে বললো,
~ আশু, আমি সত্যিই তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি। আমি আসলে বুঝতে চাইছিলাম, তুমি তোমার মায়ের ব্যাপারে কিছু শুনলে কেমন রিয়েক্ট করো। আর কয়েক দিন পর তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবে, তাই তোমার ফিলিংস, চাওয়া-পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ এসব কিছু জানাটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। জাস্ট এটুকু ভেবেই আমি তোমায় এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তবে বিশ্বাস করো, এসবে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। আমি শুধু তোমায় বিয়ে করছি, তোমার প্রোপার্টি অর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডকে না।

আনিশা একদৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুগ্ধ নামের ব্যক্তি যে তার কথা দিয়ে আনিশার প্রতিটি অনুভবে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা আনিশা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। আনিশা আনমনে বললো,
~ সত্যিই, আপনার নামের সাথে আপনার মেন্টালিটির বন্ডিংটা অনেক পারফেক্ট।

মুগ্ধ ভ্রু উঁচিয়ে হেসে বললো,
~ আচ্ছা! তার মানে ম্যাডামের রাগ ভেঙেছে তাহলে। তবে আমার উপর তুমি ইম্প্রেসড হয়েছো, এটা বুঝতে পেরে আমার যে কেমন ফিলিং হচ্ছে মুখে বলে প্রকাশ করতে পারবো না।
আনিস হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
~ কে বলেছে আমি ইম্প্রেসড হয়েছি?
মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে হেসে বলে,
~ সব কথা মুখে বলতে হয় না,
কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।

আনিশা মুগ্ধের কথা শুনে আশে পাশে তাকাতে তাকাতে বললো,
~ আই থিংক, আই শ্যুড গো নাও।
বলেই উঠে চলে যেতে লাগলো। মুগ্ধ জোরে জোরে বললো,
~ পালাচ্ছো? পালাও, পালাও। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? সেই আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। বিকজ, উই আর মেইড ফর ইচ আদার।

আনিশার পা অটোমেটিক আটকে গেল মুগ্ধের কথা শুনে। আসলেই সে অন্য কাউকে নিয়ে আর ভাবতে পারবে না। ভাবনার জগৎটা যে এই মুগ্ধ নিজের মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। এটা ভেবে আনিশার মুখ পুরো লাল হয়ে গেছে। তাই আর পেছন ফিরে না তাকিয়ে পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল, আর তার পিছনে পিছনে জনও বেড়িয়ে গেল। আশেপাশের সবাই ওদের কাহিনী দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।

আনিশা গাড়িতে উঠে জনকে বলতে লাগলো,
~ John, bring a bottle of cold drinks for me. You see, it is too much hot weather today.
জন সম্মতি জানিয়ে বললো,
~ Yes, maam. Wait for 2 minutes, I will right back soon with cold drinks and Ice-cream.

বলেই জন চলে গেল। আনিশা এসির পাওয়ার বাড়িয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলো, একজন মধ্যবয়সী মহিলা রাস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আর বারবার তার মলিন শাড়ির শেষাংশ দিয়ে মুখর ঘাম মুছছে। চার পাশে মানুষ জন তেমন একটা নেই, সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়বে আর কিছুক্ষন পরেই। কিন্তু এই ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে আনিশা, আর ভাবছে ওই মহিলাটা কীভাবে এই গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তার ওপর এই অসময়ে। এই জায়গাটার মধ্যে ঐ মহিলার দিকেই বারবার চোখ আটকে যাচ্ছে আনিশার। তাই আর কিছু না ভেবে তার দিকে ছুট লাগায়। কাছে গিয়ে বলে,
~ এক্সকিউজ মি, আন্টি।

এদিকে অনি আজ এনজিও থেকে ফেরার জন্য এই বাস স্টেশনে নামে। বাসায় ফেরার জন্য তাকে দুটো বাস বদলাতে হয়। এখান থেকে বাস নিয়ে ডিরেক্ট বাসার সামনে নামে সে। কিন্তু আজ ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। তাই এসময় বাসবে আনাগোনাও কম। অনি এখানে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ একটা মেয়ের মুখে আন্টি সম্বোধন শোনায় পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে একটা মেয়ে হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়ে। পরনে কুর্তি, মাথা হিজাব দিয়ে আবৃত আর তার ওপর দিয়ে কালো কালারের স্যুট পড়ে আছে। কিন্তু মুখটা অনেক মায়াবী আর চেনা চেনা ঠেকছে।

আনিশা অনির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,
~ ওনাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি। বাট, ওনাকে আমি যখন দেখেছিলাম তখন মে বি ওনি এমন ছিলেন না।

অনি আনিশাকে জিজ্ঞেস করলো,
~ কিছু বলবে?
আনিশা চমকে ওঠে তাকালো, আর মনে মনে বললো,
~ গলাটাও তো চেনা আর অতি পরিচিত লাগছে!
অনি আবার বললো,
~ কী হলো, মা? কিছু বলবে? কী ভাবছো আমার দিকে তাকিয়ে?

আনিশা জোর পূর্বক হেসে বললো,
~ না, আন্টি। তেমন কিছু না। আপনি এখানে এই সন্ধ্যা বেলায় এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যে?
~ আসলে বাসের জন্য ওয়েট করছি। কিন্তু বাসের কোনো নাম-গন্ধ নেই।
~ ওও, আন্টি, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি আপনাকে ড্রপ করে দিতে পারি।
~ এ মা, না না! তার কোনো দরকার নেই। আমি বাসের জন্য ওয়েট করছি, বাস না পেলে অটো নিয়ে চলে যাবো।

~ ওও, আচ্ছা। কিন্তু বেশি রাত করিয়েন না। আসি
~ আচ্ছা।
অনি মুচকি হেসে বললো। আনিশাও মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে বসলো আর গাড়িটাও একমিনিটের মধ্যে উধাও হয়ে গেলো। অনি মনে মনে বললো,
~ আনিশাও হয়তো এতো দিনে অনেক বড় হয়ে গেছে। আমি মনে হয় আর ওকে কোনোদিন দেখতো পাবো না। যাইহোক, বলে তো দিলাম অটো ধরে চলে যাবো। কিন্তু এতো টাকা তো আমার কাছে নেই। দেখি সামনে হাটতে থাকি। বাসের জন্য তো আর সারারাত এখানে পাড় করে দেয়া যায় না।

বলেই হাটা শুরু করে দেয় অনি।
একঘন্টা হাটার পর অনি হাঁপিয়ে ওঠে আর আশেপাশে তাকাতে তাকাতে দেখে রাত হয়ে গেছে। সামনেই অনিকের বাড়ি। কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে আলো আসছে।


অন্তিম পর্ব

অনি নিজের সমস্ত ক্লান্তি সাউডে রেখে দৌড়ে যায় অনিকের বাড়ির সামনে। পাঁচ মিনিটে পৌঁছে ও যায়। কিন্তু সে ভেতরে কী করে ঢুকবে? আশেপাশে অনেক গার্ড। অনি এবার নিশ্চিত হয় যে, অনিক সত্যি সত্যিই দেশে ফিরেছে। নয়তো বাড়ির সামনে এই গাড়ি গুলো ও গার্ড গুলো থাকতো না।

অনি অনেক কৌশলে গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে গাছের পিছন দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ির মেইন ডোর পর্যন্ত যায়। কিন্তু এখানেও দুজন গার্ড আছে, তবে দরজা টা খোলা। দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে, কিন্তু কীভাবে? হঠাৎ অনির মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে মাটি থেকে বড় একটা ইটের টুকরো নিয়ে মেইন ডোর থেকে একটু দূরের একটা ঝোপের মধ্যে ছুড়ে মারে। এতো ঝোপের ভেতর থেকে শব্দ আসে আর সেই শব্দ শুনে গার্ড দুটো সেদিকে চলে যায়। এ সুযোগে অনি বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়।

ভেতরে গিয়ে দেখে, অনিক কিছু কাগজপত্র উল্টে পাল্টে দেখছে। অনি অনিকের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়, অথচ চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। অনি ভাবছে,
~ অনিক, তোমায় দেখে আজ আমার আবার তোমাকে জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। তুমি সত্যিই একদম বুড়ো হয়ে গেছো!
অনি নিজের চোখের জল মুছে বললো,
~ অনিক!

হঠাৎ কারো মুখে নিজের নাম শুনে অনিক মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো, একজন মধ্যবয়সী মহিলা, গায়ে নরমাল নকশা পাড়ের সস্তা শাড়ি। মাথায় একটা সুতি ওড়না যা দিয়ে দুই বাহু আবৃত। অনিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
~ কে আপনি?

অনিকের কথায় অনি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ফুপিয়ে কেদে দেয় আর ফ্লোরে বসে পড়ে। অনিক কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে পরে অবাক হয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,
~ অনিইই, তুমি অনি, তাই না?

অনি কাদতে কাদতে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়। অনিক অনির এ অবস্থা দেখে উল্টো দিকে ঘুরে কেদে দেয়। যতই হোক, অনি তো তার স্ত্রী ছিল আর ভালোবাসার মানুষ হিসেবে তো সে শুধু অনিকেই ভাবতো, যার কারণে অন্য কাউকে আর সে জায়গাটা দিতে পারেনি। যদিও এর পেছনে আনিশা কারন হিসেবে ছিল। কিন্তু আনিশা যদি পৃথিবীতে না আসতো, তবুও কি অনিক পারতো অন্য কাউকে নিয়ে মুভ অন করতে? অনিক এটা ভেবে মাথা নাড়াতে থাকে, না সে পারতো না। কিন্তু অনি তো অপরাধী। সো ওর সাথে নো কম্প্রোমাইজ!

অনিক অনির দিকে তাকিয়ে বললো,
~ কেন এসেছো এখানে? আর কী চাও তুমি? আবার কোনো গন্ডগোল করতে এসেছো, তাই না? লিসেন, গতবার তুমি বেঁচে ফিরেছিলে। কিন্তু এবার,
অনি অনিককে থামিয়ে দিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো,
~ দয়া করো আমার ওপর অনিক। প্লিজ দয়া করো। আমার অবস্থা দেখে তোমার আদৌ মনে হচ্ছে যে, আমি এখানে ঝামেলা করতে এসেছি?

হঠাৎ অনিকের মা কোথা থেকে এসে বলে উঠলো,
~ না মনে হওয়ার কী আছে? বিষাক্ত সাপকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। যখন তখন দংশন করতেও সে দ্বিধা বোধ করে না।
অনিক ও অনি দুজনেই অনিকের মায়ের দিকে তাকালো। অনিকের মা আবার বলে উঠলেন,
~ কী অনি, কেমন জেল খাটলে? ১২ টা বছর তো পাড় করেছো কারাগার নামক নরকে। তা আগে তো অনেক রূপের দেমাক ছিল, তারপর আবার ওই আয়াশ নামের ছেলেটার সাথে বিয়ে হওয়ার পর টাকার গরমও তো কম দেখাতে না। তো এখন কোথায় গেলো তোমার রূপ আর টাকা।

সবকিছু তো খোয়ালে, সাথে নিজের চরিত্রের লী হাল করেছো, তা তো সেই ওপরওয়ালাই জানে!
অনিক হঠাৎ ঘর কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে,
~ মাআআআআ! কীসব আজেবাজে কথা বলছো তুমি? থামো, কাইন্ডলি। এখানে আমি আছি না? সো আমি দেখছি তো ব্যাপারটা!

অনিকের মা মুখ ভেংচিয়ে বললো,
~ কী দেখবি তুই, হে? কী দেখবি? ওকে বিশ্বাস করবি? যে মেয়ে নিজের সদ্যোজাত শিশুকে ফেলে পরপুরুষের সাথে চলে যায়, সে কোনো দিন ভালো হবে? আরে ওর মতো মেয়ে মানুষ শুধু চিনে টাকা আর রূপ। কিন্তু ওরা এটা জানে না, যে টাকা আর রূপ ক্ষণিকের জন্য যা সময়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে যা; এগুলো দিয়ে কোনোদিন ভালোবাসা হয় না, সংসার হয় না, আর না হয় কোনো আত্মিক বন্ধন। এসবের জন্য যে ভালো মনের দরকার! যা হাজারো বছরেও নষ্ট হয় না। ওর মতো সস্তা মেয়ে এসব বুঝবে না।

অনি উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে বললো,
~ আপনার বলা শেষ হয়েছে আশা করি। আমি এখানে শুধু একটা কথা বলতে এসেছি, যেটা অনিক জানে না। তাই বলাটা উচিত বলে আমি মনে করি।
অনিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
~ কী কথা বলবে তুমি?

অনি বললো,
~ আচ্ছা অনিক, তোমার আমার তো ডিভোর্স হয়নি, তাই না?
একথা শুনে অনিকের মা বললো,
~ দেখলি তো! আমি বলেছিলাম না, এরা শুধু টাকা চিনে। এতো দিন ঐ আয়াশের কাছে ছিল ওর টাকার জন্য, এখন আবার ওকে ছেড়ে তোর কাছে আসতে চাইছে টাকার জন্য। এরা নিজেদের লোভের জন্য একটা ধরে আবার একটা ছাড়ে।

অনিক বলে উঠলো,
~ মা, তুমি থামবে? আর অনি, এতো বছর পর এসব বলার মানে কী?
অনি বললো,
~ কারণ ঐ যে বললাম না, তোমার একটা কথা অজানা রয়ে গেছে। তার জন্য। এখন বলো তো, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
অনিক বিরক্ত হয়ে বললো,
~ না, হয়নি ডিভোর্স। তুমি তো চলেই গিয়েছিলে!

অনি মলিন হেসে বললো,
~ আমি জানতাম, তুমি কিছু জানো না। আসল সত্যি টা হলো, আমাদের ডিভোর্স হয়েছে আর তোমার আমার ডিভোর্স হওয়ার পরই আয়াশ আমায় বিয়ে করেছিলো।
অনিক অবাক হয়ে বললো,
~ কী! ডিভোর্স হয়েছিল! কিন্তু আমি তো কখনো কোনো ডিভোর্স পেপারে সাইন করিনি!
অনি বললো,

~ করেছিলে অনিক, কিন্তু তুমি জানো না। নিজের অজান্তেই করছিলে সাইন। তোমার মনে আছে, যেদিন আনিশার জন্ম হলো, সেদিন আমায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার পর তোমায় বন সাইন (একটা পেপার যেটাতে কোনো রোগীর অপারেশন শুরু করার আগে তার অভিভাবককে এই শর্তে সাইন করতে হয় যে, রোগীর মৃত্যুতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়) দিতে বলা হয়েছিল। তুমি কয়টা সাইন দিয়ছিলে সেদিন?

অনিক একটু ভেবে বললো,
~ আমি তো ঐ পেপার টার সবগুলো পেইজে সাইন দিয়েছিলাম। ওখানে যে রিসেপশনিস্ট ছিল, সে বলেছিল এটাই নাকি নিয়ম। কিন্তু আমি এতোটাই টেন্সড ছিলাম যে, পেপার গুলো না পড়েই সাইন দিয়েছিলাম।

অনি বললো,
~ সেই পেপার গুলোর মাঝেই তোমার আমার ডিভোর্স পেপার ছিল, যেটাতে তুমি সাইন করে দিয়েছো নিজের অজান্তেই। সেদিন যেদিন আমি হসপিটালের কেবিন থেকে পালিয়ে গিয়ে আয়াশের কাছে গিয়েছিলাম,
সেদিন,
আয়াশ: আমি তোমায় ততোক্ষণ পর্যন্ত বিয়ে করতে পারবো না, যতোক্ষণ না তুমি অনিককে ডিভোর্স দাও।

অনি: কিন্তু আয়াশ, আমি কীভাবে এই মুহূর্তে অনিককে ডিভোর্স দেব?
আয়াশ শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
~ এই পেপার টায় সাইন করে দাও। তাহলে ই হবে।
অনি পেপার টা হাতে নিয়ে দেখে ডিভোর্স পেপার, যাতে অনিকের সাইন ছিলো। পরে অনি আয়াশের কাছে সব শুনে নিজেও সাইন করে দেয়। এর পরই বৈধভাবে অনি- আয়াশের বিয়ে হয়।

অনিক হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। অনি গিয়ে অনিকের পায়ের কাছে হাটু গেড়ে বসে কেঁদে কেঁদে বললো,
~ আমি জানি, আমি অনেক বড় পাপ করেছি, অনেক জঘন্য ও নোংরা অপরাধ করেছি। নিজের দুধের শিশুকে ছেড়ে চলে গেছি। তোমাদের জীবনের #কালোঅধ্যায় ছিলে তুমি আখ্যা পেয়েছি। ১২ বছর কারাগার নামক অন্ধকারে থেকেছি। কিন্তু কী বলোতো, কিছু মানুষের পাপের বোঝা টা একটু বেশিই ভারী হয়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার প্রায়োশ্চিত্ত করে যেতে হয়। হয়তো মৃত্যুর পরে ও তা শেষ হয় না। আমিও সেই জঘন্য মানুষদের কাতারে পড়ি। আমি আমার ভুল, না না ভুল না, আমি আমার অপরাধ বুঝতে পেরেছি।

কিন্তু আমি সেই জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো না। কারণ আমার করা পাপের কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও পারলে আমার মাফ করে দিও। আর তোমার মেয়ে কে বলো, এই জঘন্য মহিলাটিকে যেন মাফ করে। ও সত্যিই তোমার সন্তান। আমি ওর কেউ না। আর আমি তোমাদের জীবনে ফিরে আসতে আসিনি, শুধু আমার করা অন্যায়ের জন্য এসেছি। নিজের দোষ স্বীকার করলে হয়তো মনটা একটু শান্তি পাবে।

বলেই উঠে দাঁড়ায় অনি। তারপর বললো,
~ আসি, ভালো থেকো। আর ধন্যবাদ, আমায় এতোগুলো সময় দেওয়ার জন্য।
বলে অনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে হাটা ধরলো। অনিক নিজের ডান হাত বাড়িয়ে অনিকে আটকাতে চাইলো, কিন্তু হাতটা আবার নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। কোন অধিকারে আটকাবে সে। তার তো অনির প্রতি কোনো অধিকার নেই। সে তো নিজের হাতে একটা কাগজে সাইন করে সব অধিকার, সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। এটা ভেবে অনিক নিজের ডান হাতের তালুর দিকে তাকালো আর তার ওপর নোনাজল গুলো আপন মনে পুঞ্জীভূত হতে থাকলো।

অনি বাড়ির মেইন ডোর থেকে বাইরে পা রাখবে ওমনি কেউ একজন জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে,
~ মাআআআআআ, স্টপপপপপ।
সবাই আওয়াজের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখে আনিশা শিড়ি দিয়ে দৌড়ে নামছে। মা ডাক শুনে অনির পা আটকে যায়। সে ঘুরে দাড়াতেই আনিশা অনির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকে। অনিও আনিশাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দেয়।

আসলে কিছুক্ষন আগে অনিকে মা যখন চিৎকার করছিল তখন আনিশা ঘর থেকে বেরিয়ে উপর থেকে সব কিছু দেখছিল। অনিকে দেখে সে অবাক হয়ে যায়। কারন আনিশা তো অনিকে রাস্তায় দেখেছিল। কিন্তু সবার কথাবার্তা শুনে আনিশা বুঝতে পারে যে, এটাই তার মা।
আনিশা অনিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
~ মা, ও মা, তুমি আবার আমায় ছেড়ে চলে যাবে? আমার জন্মের সময় আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। তুমি জানো, যখন সবাই সবার মাকে নিয়ে কতো মজা করে, কতো গল্প বলে, কত কিছু গিফট করে তখন আমার কেমন লাগে? পাপা যদিও আমায় কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। কিন্তু সবার মাঝে শুধু আমি একমাত্র মানুষ ছিলাম, যার মা কখনো তার সঙ্গ দেয়নি। তুমি আমায় আর ছেড়ে যেও না। দোহাই লাগে, আমায় আর কষ্ট দিও না।

অনিক আর অনিকের মা এসব দেখে আর সহ্য করতে পারছে না। নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
অনি আনিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
~ তা তো আর হবে না রে, মা।
আনিশা অনির বুক থেকে মাথা তুলে বলে,
~ কেন, কেন হবে না?

অনি আনিশাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। এই মেয়েটাই তো তাকে বাসায় ড্রপ করে দিতে চেয়েছিল। অনি অবাক হয়ে বললো,
~ তুমি ই আনিশা?
আনিশা মাথা উপরে নিচে নাড়িয়ে বুঝালো, হ্যাঁ। এরপর বললো,
~ তুমি কেন আমার সাথে থাকবে না?

অনি আনিশার দুই গালে হাত রেখে বললো,
~ আমার কোনো যোগ্যতা নেই তোদের সাথে থাকার। আমি যে অনেক বড় পাপী! তবু এটা আমার ভাগ্য যে, তোর মুখ থেকে মা ডাকটা শুনতে পেলাম।
আনিশা অনির দিকে তাকিয়ে বললো,
~ না, মা। তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যদি কেউ নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং অনুতপ্ত হয়ে একবিন্দু চোখের পানি ফেলে, তাহলে সেই পানিই যথেষ্ট জাহান্নামের আগুন নিভিয়ে ফেলার জন্য আর পৃথিবীতে বিদ্যমান সব পানি যদি ফেনা হয়ে যায় ও তার পাপ যদি সেই ফেনা পরিমানও হয়, তবুও আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন যদি সে একমনে প্রতিজ্ঞা করে যে, সে আর এরুপ অন্যায় করবে না। তবে আমরা কেন পারবো না তোমায় ক্ষমা করতে? আর আমাদের উচিত পাপকে ঘৃণা করা, পাপী কে নয়। তোমার ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথে তুমি পাপমুক্ত হয়ে গেছো, মা।

অনি আনিশার সারা মুখে অসংখ্য চুমু দিয়ে বললো,
~ আমি জানি না, কী ভালো কাজ আমি আমার জীবনে করেছিলাম যে, তোর মতো মেয়ে আর অনিকের মতো স্বামী আমার জীবনে পেয়েছিলাম।
অনিক দাঁড়িয়ে নিজের চোখ মুছে বললো,
~ তুমি আজ থেকে, এবাড়িতেই থাকবে অনি। শুধু আনিশার জন্য, আমার আশুর জন্য রাজি হয়ে যাও।

অনিকের মা বললো,

~ সত্যিই অনি, আমাদের পাপকে ঘৃণা করা উচিত, পাপী কে নয়। তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো, এটাই অনেক। আমাদের আর কোনো রাগ নেই তোমার ওপর।

আজ আনিশা আর মুগ্ধের বিয়ে হয়েছে। অনিক আনিশাকে বিদায় দেওয়ার পর থেকে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। অনি সেখানে গিয়ে বললো,
~ মন খারাপ করো না, অনিক। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

অনিক চশমা খুলে নিজের চোখ দুটো মুছে বললো,
~ কী করে সহ্য করবো আমি, বলতে পারো? এই দুটো হাত দিয়ে আমি আশুকে বড় করেছি। ওকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার সময় আমার বুকটা ছিড়ে যাচ্ছিলো। কাল থেকে আর কেউ আমার সারা বাড়ি পাপা পাপা বলে মাতিয়ে রাখবে না। সকাল বেলা কাউকে জোর করে ঘুম থেকে জাগাতে পারবো না।

অনি নিজের চোখের পানি মুছে বললো,
~ চিন্তা করো না, মুগ্ধ অনেক ভালো ছেলে। আনিশা ভালো থাকবে ওর কাছে।
~ তুমি যাও, ঘুমিয়ে পড়ো নিজের রুমে গিয়ে।
~ হুম, তুমি ও ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে। বেশি রাত জাগার দরকার নেই।
অনি চলে যেতে লাগলো। হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে অনিকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
~ ভালোবাসি অনিক, আজও তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি। সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে ভালোবাসি। কিন্তু কেন যে সেটা তখন বুঝিনি। বুঝলে হয়তো তোমায়, আমায় আর আশুকে এতো কষ্ট পেতে হতো না।

অনি চলে গেল।
অনিক আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
~ কেন তোমায় নিজের মন থেকে আজও মুছতে পারিনি? হয়তো কোনোদিন পারবোও না। যদি তুমি আমার ভালোবাসাটা বুঝতে, তাহলে আজ কতটা সুখী হতাম আমরা! তবু্ও তোমাকে এখন নিজের পাশে পেয়েছি। হোক না সেখানে কোনো অধিকার নেই, নেই কোনো সম্পর্ক। তাও তোমাকে বন্ধু হিসেবেই আমার পাশে চাই নিজের মৃত্যু পর্যন্ত। এর বেশি কিছু না।

লেখা – মাহফুজা আক্তার

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “কালো অধ্যায় ছিলে তুমি – Bangla golpo love” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – কালো অধ্যায় ছিলে তুমি (১ম খণ্ড) – Bangla golpo love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *