কালো অধ্যায় ছিলে তুমি – Bangla golpo love: ফিহার তো হাত পা কাঁপা কাপি শুরু হয়ে গেছে, সাথে বার বার শুকনো ঢোক গিলছে। যতোই হোক, এরা মাস্টার্সের স্টুডেন্ট, ওদের থেকে তিন বছরের সিনিয়র। অনির সাথে সাথে নিজেও বাজে ভাবে ফেঁসে না যায় সে কথাই ভাবছে।
পর্ব ১
~ পাপা, ও পাপা! সবাই কাল তার মাকে নিয়ে স্কুলে যাবে। আমার মা কি কালও আমার কাছে আসবে না? আমার সাথে স্কুলে যাবে না?
কেঁদে কেঁদে বলছে আনিশা। কিন্তু অনিকের কাছে এর উত্তর থাকলেও সে তার মেয়েকে এসব কিছু জানাতে পারবে না। সে আনিশার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তার চোখের পানি গুলো মুছে দেয় এবং সামনের ছোট ছোট চুল গুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বললো,
~ কালকে আমি যাবো তোমার সাথে। তোমার সব ফ্রেন্ডসদের সাথে আমায় ইন্ট্রডিউসড করাবে তো?
~ কিন্তু পাপা, কালতো মাদার্স ডে! তাই সবাই যার যার মাকে নিয়ে স্কুলে যাবে। তুমি কীভাবে যাবে?
~ সবার কাছে মা আছে, কিন্তু তোমার কাছে নেই। তবে তাতে কী হয়েছে? তোমার কাছে পাপা আছে এবং সেও যথেষ্ট ভালো। রাইট?
আনিশা অনিকের গলা জড়িয়ে ধরে খুশি হয়ে গালে চুমু দিয়ে বললো,
~ ইয়েস। মাই পাপা ইজ দ্য বেস্ট!
~ হুম, এখন তাড়াতাড়ি করে শুয়ে পড়ো। কাল সকালে আবার স্কুলে যেতে হবে।
আনিশা শুয়ে পড়লো আর অনিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর, আনিশা ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু অনিকের চোখে ঘুম নেই। সে বারান্দায় চলে গেল। যখন যন্ত্রণাময় অতীত মানুষের স্মৃতিতে জেগে ওঠে, তখন সেই অতীত স্মৃতি রোমন্থন করার একটা সুন্দর সময় হলো রাত এবং সঠিক স্থান হলো তারা ভর্তি আকাশের নীচে ছাদ বা বারান্দা। অনিক নিজেই নিজেকে বলছে,
~ আশু(আনিশাকে অনিক আশু বলে ডাকে) আজও তোমার জন্য কাঁদে, অনি। কালো অধ্যায় ছিলে তুমি, অনি। পৃথিবীর সবকষ্ট আমার সহ্য হয় কিন্তু আশুর চোখের পানি সহ্য হয় না। আশু তো আর জানে না যে, তার মা একটা স্বার্থপর, একটা ছলনাময়ী। ও তো এখনো অনেক ছোট।
সকালে,
অনিক আনিশাকে ঘুম থেকে উঠতে বলছে,
~ আশু মা, উঠো তাড়াতাড়ি। স্কুলে যেতে লেট হয়ে যাবে তো।
আনিশা ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
~ পাপা, আরেকটু ঘুমাতে দাও না। প্লিজ।
অনিক বললো,
~ তোমাকে খেতে হবে, রেডি হতে হবে। সো, এখনি উঠতে হবে। তুমি জানো না, যারা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারে না তারা লুজার হয়। আমার আশু তো লুজার না। সে তো অনেক অ্যাক্টিভ, তাই না?
আনিশা ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বললো,
~ হুম, জানো পাপা, এ.এস. ম্যামও না বলে, আমি নাকি অনেক অ্যাক্টিভ। আমি বলি, আমার পাপা শিখিয়েছে।
~ তাই নাকি, আচ্ছা এখন চলো হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিবে।
এরপর অনিক আনিশাকে ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দিল, সাথে নিজেও খেয়ে নিল।
খাওয়া শেষ করে আনিশাকে রেডি করিয়ে দেয়। জামাকাপড় পরিয়ে মাথার চুল গুলো দুই ঝুটি করে দেয়। তারপর তারা স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।
গাড়িতে আনিশা খুব মনযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। অনিক গাড়ি ড্রাইভিং করলেও আনিশার ভাবনাটা খেয়াল করলো। তার মেয়েকে যে সে জন্মের পর থেকে দেখছে। তাই তার সবকিছুই সে বেশ ভালো করে বুঝে।
অনিক আনিশাকে জিজ্ঞেস করলো,
~ আশু, তুমি কি কোনো কিছু নিয়ে আপসেট?
আনিশা বললো,
~ না, পাপা। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে সেটা নিয়েই ভাবছি।
অনিক বললো,
~ কী সারপ্রাইজ?
~ বলবো না।
স্কুলের অডিটরিয়ামে বসে আছে অনিক আর সব অভিভাবকেরা। আনিশা টিচারের সাথে গেছে। কী করবে কে জানে? সামনের স্টেজটাও সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।
একজন টিচার এনাউন্স করলো, স্টুডেন্ট রা নাকি তাদের মায়েদের নিয়ে স্পিচ দিবে। সব মায়েরাই অনেক খুশি। তাদের সন্তান তাদের নিয়ে স্পিচ দিবে এটা সত্যিই খুব আনন্দের। কিন্তু অনিক ভাবছে আনিশা কী বলবে? আনিশা তো ওর মা সম্পর্কে কিছু জানে না! হয়তো আনিশা আজও কোনো স্পিচ দিবে না আর মায়ের জন্য কাদবে।
এক এক করে অনেকে বক্তব্য রাখলো। এবার একজন টিচার বলে উঠে,
~ এখন স্টেজে আসবে, আনিশা চৌধুরী।
অনিক পুরাই শকড হয়ে গেছে। তার মেয়ে কী বলবে এটাই ভাবছে।
আনিশা স্টেজে এসে মাইক হাতে নিয়ে অনিকের দিকে তাকিয়ে দেখল সে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। আনিশা মুচকি হেসে বলা শুরু করলো,
~ গুড মর্নিং টু ইউ অল।
আজকে মাদার্স ডে বলে সবাই মাকে নিয়ে স্পিচ দিলো। কিন্তু আমি আমার মাকে নিয়ে কিছু বলবো না। কারন আমি আমার জন্মের পর থেকে কখনো আমার মাকে দেখিনি, এমনকি তার ছবিও না। তার নামও জানি না, তার ব্যাপারে আমায় কেউ কখনো কোনো কিছু বলেওনি। আর আমার জানার ইচ্ছাও নেই। কারন হলো আমার পাপা, যে আমায় কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি।
হ্যাঁ, আজ আমি আমার পাপাকে নিয়ে স্পিচ দিব যেহেতু ওনিই আমার পাপা, আর ওনিই আমার মা। প্রতি সকালে পাপা আমার কপালে চুমু দিয়ে দিন শুরু করে আর রাতে ঘুমানোর আগে চুমু দিয়ে দিন শেষ করে। তিনবেলা পাপাই আমায় খাইয়ে দেয়। আমি যতক্ষন স্কুলে থাকি পাপা শুধু ততক্ষণই অফিস সামলায়, বাকি সারাদিন আমার সাথে কাটায়। আমি কাঁদলে পাপা খুব কষ্ট পায়, তার চোখও ছলছল করে। আমি একটু অসুস্থ হলে পাপা সারাদিন আমার পাশে থাকে, সারারাত জেগে থাকে। আজ পাপার অনেক বড় একটা বিজনেস ডিল ছিলো। কিন্তু পাপা সেটা ক্যান্সেল করে দিয়েছে শুধু মাত্র আমার সাথে স্কুলে আসার জন্য, যাতে আমি আজ মায়ের অভাব ফিল না করি। সত্যিই মাই পাপা ইজ গ্রেট। আই লাভ ইউ পাপা।
অনিকের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। তার মেয়ে যে তাকে এভাবে সারপ্রাইজ দিবে ভাবেনি। আশেপাশে সবাই অবাক হয়ে গেছে আনিশার স্পিচ শুনে। এই টুকু মেয়ে কী ভাবে এতো সুন্দর করে বক্তব্য দিতে পারে সেটা নিয়েই সবাই অবাক।
আজকের এই বক্তব্য দিয়ে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে আনিশা। আনিশার নাম এনাউন্স হবার পর সে স্টেজে উঠে বলে,
~ পাপাকে ছাড়া আমি ট্রফি নিব না।
অনিক স্টেজে উঠে আনিশাকে জড়িয়ে ধরে। একজন টিচার বলে উঠে,
~ আনিশার হাতে ট্রফি তুলে দিবেন, অনিন্দিতা ম্যাম।
কিছুক্ষণ পর অনিন্দিতা স্টেজের পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ করলো। অনিককে দেখে তার পা আটকে যায়।
অনিক অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
~ অনি!
আনিশা খুশি হয়ে বলে,
~ এ.এস. ম্যাম।
অনিক বুঝে গেছে অনিই আনিশার এএস ম্যাম। অনিকে দেখে তার চোখে রাগ ও ঘৃণা দুটো একসাথে খেলা করছে। কিন্তু সে এখানে কোনো সিন ক্রিয়েট করতে চায় না। তাই চুপ করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
অনি আনিশার হাতে ট্রফিটা তুলে দিয়ে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে এবং সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এক পর্যায়ে কেদে দিয়ে বললো,
~ আমার সন্তান।
অনিক এতোক্ষণ চুপ করে থাকলপও এখন আনিশাকে ছোঁ মেরে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল ও চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠে,
~ আশু শুধু মাত্র আমার সন্তান। ওর জীবনে আমি ছাড়া মা নামের তৃতীয় কোনো ব্যক্তির স্থান নেই আর না আছে কোনো অধিকার। আমিই ওর মা আর আমিই ওর বাবা। আমাদের জীবনে শুধু মাত্র একটা কালোঅধ্যায় ছিলে তুমি।
বলেই আনিশাকে কোলে তুলে হনহন করে চলে গেল।
অনি অঝোরে কেঁদে চলছে এবং ভাবছো,
অতীত,
পর্ব ২
স্টেজের ওপর বসে অঝোরে কেঁদে চলেছে অনি। আজ নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হচ্ছে তার। আনিশা তার মেয়ে, ভাবতেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। একই সাথে এটা ভেবে দুঃখ হচ্ছে যে, সে তার সন্তানের ওপর মায়ের দায়িত্ব গুলো পালন করতে পারেনি। সত্যিই আনিশার মা হওয়ার কোনো যোগ্যতা তার নেই। যোগ্য মা হতে পারে নি অনি।
এসব ভাবতে ভাবতে অডিটরিয়ামের দরজার দিকে তাকালো অনি। এতোক্ষণে অনিক আনিশাকে নিয়ে চলে গেছে। সে আটকাতে পারেনি। কারণ অনিককে আটকানোর কোনো অধিকার তার নেই। ভাবতেই নিজের প্রতি নিজের ঘৃনা হচ্ছে। আর সহ্য হচ্ছে না। তাই শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে অডিটরিয়াম থেকে বের হয়ে এলো অনি।
গাড়িতে আনিশাকে বসিয়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো অনিক এবং গাড়ি স্টার্ট দিলো। আনিশা কিছু বুঝতে পারছে না, কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই ওর ছোট মাথায় ঢুকছে না। ঢুকবে কী করে? আনিশা যে অনেক ছোট ; বয়স মাত্র আট বছর। তাই এ বয়সে এতো কঠিন বাস্তবতা না বুঝতে পারাটাই স্বাভাবিক। যদিও অনিক আনিশাকে অনেক বোধবুদ্ধি, তীক্ষ্ণ বিবেচনা বোধ ও বিচারশক্তি সম্পন্ন করে গড়ে তুলছে। আর এজন্যই আনিশার মনে এখন পাহাড় সম জিজ্ঞাসা এসে ভীড় জমাচ্ছে।
অনিক দাঁতে দাঁত চাপছে আর কার ড্রাইভিং করছে। চোখ দুটো রাগে লালবর্ণ ধারণ করেছে।
আনিশা উৎসুক দৃষ্টিতে অনিকের চোখে অনিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
~ পাপা, এ.এস. ম্যাম আমায় ওনার সন্তান কেন বললেন? আর তুমি কি ম্যামকে আগে থেকে চিনো? তুমি ম্যামকে এভাবে বকলে কেন?
অনিক কিছু বলছে না চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভিং করছে। আনিশা বারবার জিজ্ঞেস করছে একই প্রশ্ন। অনিক এবার গাড়ি ব্রেক করে রাস্তার সাইডে দাড় করিয়ে রেগে আনিশাকে জোড়ে একটা ধমক দিল,
~ চুপপপপ! দেখছো না ড্রাইভ করছি, তাও ফ্রিকোয়েন্টলি প্রশ্ন করেই যাচ্ছো। একদম চুপচাপ এখানে বসে থাকবে, একটা কথাও যেন আর না শুনি।
বলে আনিশার দিকে তাকিয়ে দেখল, ওর চোখ দিয়ে পানি পরছে। আনিশার চোখের প্রতিটি অশ্রু বিন্দু অনিকের হৃদয়ে সমুদ্রসম রক্তক্ষরণ করছে। অনিক গাড়ির স্টিয়ারিং এ জোরে একটা ঘুষি দিয়ে নিজেই নিজেকে মনে মনে বললো,
~ আমার আশুকে আজ আমি কষ্ট দিয়ে ফেললাম। ওর চোখের জলের কারণ আমি! কী করে পারলাম আমি এটা করতে।
অনিক আনিশার দিকে ঘুরে বসলো। আনিশা কাঁদছে। অনিক আনিশাকে বললো,
~ আশু
~ …..
~ আশু, লুক এট মি!
আনিশা অনিকের দিকে তাকাচ্ছে না। কোনো কথাও বলছে না। শুধু নিঃশব্দে কাঁদছে। অনিক এবার আনিশার দুই গালে দুই হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। ছলছল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
~ খারাপ লেগেছে আমার কথা?
আনিশা তার নিচু মাথা উপর-নিচ নাড়িয়ে বুঝালো যে, তার খারাপ লেগেছে।
অনিক আবার জিজ্ঞেস করলো,
~ রাগ করছো আমার উপর?
আনিশা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিল।
অনিক অবাক হয়ে বললো,
~ আমি বকেছি তোমাকে আর তুমি রাগ করোনি! কেন?
আনিশা এবার মুখ খুললো। অনিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ কারন আমি জানি আমার পাপা আমায় কতটা ভালোবাসে। আর দোষ তো আমারই ছিলো। আমিই তোমাকে ইন্টারাপ্ট করেছি।
আনিশার কথা শুনে অনিক আনিশাকে কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। সত্যিই সে পেরেছে তার আশুকে যথাযথ ভাবে গড়ে তুলতে।
বাসায় ফিরে অনিক আনিশাকে গোসল করিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নেয়। এরপর চলে যায় কিচেনে। গিয়ে সার্ভেন্টসদের বলে,
~ আজ তোমাদের রান্না করতে হবে না। আজ আমি আমার প্রিন্সেসের জন্য রান্না করবো। তোমরা অন্যান্য কাজ করো।
অনিকের কথা শুনে সবাই ওকে স্যার বলে চলে গেল। কারণ এ আর নতুন কিছু নয়। এই বাড়িতে আসার থেকেই তারা এসব দেখে অভ্যস্ত। সবাই অনিককে দেখে অবাক ও হয় যে, বাবা কীভাবে মেয়েকে এমন পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে? এটা সত্যিই বিরল!
অনিক খাবার নিয়ে রুমে গিয়ে দেখলো, আনিশা শুয়ে আছে। খাবারটা বেডসাইড টেবিলে রেখে আনিশার পাশে বসে ওকে ডাকতে লাগলো অনিক।
~ আশু, এই আশু! তুমি এই ভর দুপুরে শুয়ে আছো কেন?
অনিকের ডাকে আনিশা আধো আধো চোখ খুলে তাকালো। এটা দেখে অনিক ব্যস্ত হয়ে আনিশার কপালে, গালে হাত ছুঁইয়ে বললো,
~ আশু, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? তোমায় এতো দুর্বল দেখাচ্ছে কেন?
আনিশা মিলন হেসে উঠে বসলো এবং অনিকের কোলে বসে বললো,
~ পাপা, আমি একদম ঠিক আছি।
অনিক সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
~ আমার কাছ থেকে একদম কিছু লুকানোর চেষ্টা করবে না। তুমি গতবার নিজের অসুস্থতা লুকিয়েছিলে বলে কতো সাফার করেছিলে মনে আছে! তুমি জানো না, তুমি কষ্ট পেলে তার থেকে শতগুণ কষ্ট আমার হয়।
আনিশা অনিকের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
~ আমি জানি। আমার কিছু হয়নি পাপা। শুধু একটু দুর্বল লাগছে, হয়তো খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
অনিক আনিশার সামনে খাবার এনে বললো,
~ তাহলে তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নাও। আজ আমি তোমার জন্য স্পেশাল রান্না করেছি।
~ সত্যিইইইই!
~ হুমম
বলেই আনিশাকে খাইয়ে দিল অনিক। আনিশাও তৃপ্তি সহকারে খেল।
রাতে,
অনিক আনিশাকে ডিনার করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছে। এতোক্ষণ আনিশার সাথে খুনসুটি করায় অনিকের মাথায় অনির কথা একবারের জন্যও আসেনি। কিন্তু এখন বারান্দার দোলনায় একা বসে থাকায় তা বারবার সকালের ঘটনাটা মনে পরছে। পুরোনো ক্ষততে ঘাঁ লাগায় সেটা আজ তরতাজা হয়ে উঠেছে আবার। আর এই একাকিত্ব, অন্ধকার আকাশ ও চারদিকের শুনশান নিস্তব্ধতা যেন সেই ক্ষতটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। অনিকের চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে তার অতীত, তার জীবনের কালোঅধ্যায়।
অতীত
অনিক নিজের বাইকটা পার্ক করছে এমন সময় রিয়াদ এসে বললো,
~ দোস্ত, এখন আসার সময় হলো তোর? আমরা সবাই এতো তাড়াতাড়ি ভার্সিটিতে আসি, আর তুই, প্রতিদিন শুধু লেট করে আসিস! কেন বলতো?
বলেই গাল ফুলালো রিয়াদ। রিয়াদের এক্সপ্রেশন দেখে অনিক হেসে দেয়, ওর হাতে হালকা চাপর দিয়ে বলে,
~ আমার জীবনটা তোদের মতো সহজ নয় তাই! তুই তো জানিস আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আর বাবা এখন আর উপার্জন ক্ষম নেই। তাই আমার কাধেই সব দায়িত্ব। এখন পার্টটাইম জব করছি। একবছরের মধ্যে মাস্টার্স শেষ হলে ভালো একটা জবের চেষ্টা করব।
রিয়াদ অনিকের কাধে হাত রেখে বললো,
~ তুই এখন কষ্ট করছিস ঠিক। তবে একটা কথা কি জানিস? যারা কষ্ট করে, তারাই সুখ পায় এবং সফল হয়। দেখবি তুইও সফল হবি!
অনিক টিটকারি দিয়ে বললো,
~ যাক দোয়া করছিস তাহলে। হাউ লাকি আই অ্যাম!
রিয়াদ কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
~ শালা, তোর জন্য সবসময়ই দোয়া করি আমি।
রিয়াদের কথায় অনিক হোহো করে হেসে দিলো।
এদিকে,
আজ অনিন্দিতা প্রথম ভার্সিটিতে এসেছে। আগের ভার্সিটি থেকে ট্রান্সফার হয়ে এই ভার্সিটিতে তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হয়েছে সে।
পর্ব ৩
অনি ভার্সিটিতে ঢোকার সাথে সাথে সবাই ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কারণ হলো তার বাহ্যিক সৌন্দর্য। অনি দেখতে অসম্ভব রকমের সুন্দর। আর এখন তো এডমিশন সিজনও না যে নতুন স্টুডেন্ট ভর্তি হবে, তাহলে অনি কীভাবে ভর্তি হলো- এটাই এখন সবাই অবাক হয়ে ভাবছে। অনি ক্লাসে ঢোকার পর ফিহা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় ও ফ্রেন্ডশিপ হয়।
ক্লাস শেষ করে বের হচ্ছে অনিক ও রিয়াদ। দুজনেই একে অপরের সাথে বকবক করে যাচ্ছে। ফ্রেন্ডসদের সাথে থাকলে আর কিছু হোক বা না হোক, বকবকটা হবেই! হঠাৎ রিয়াদের চোখ অনি আর ফিহার দিকে যায়। ওরা একটা গাছের নিচে বসে কথা বলছে, যা রিয়াদ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
কিন্তু অনিকে দেখে চিন্তে না পারায় অনিকের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
~ আচ্ছা, ওই যে ঐ গাছের নিচে দুটো মেয়ে বসে আছে তার মধ্যে ওই লাল পোশাক পড়া মেয়েটা কে রে? পাশেরটাকে তো দেখেছি, কিন্তু একে তো কখনো দেখিনি!
অনিক মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে রিয়াদকে বললো,
~ হয়তো নতুন স্টুডেন্ট।
~ কিন্তু এখন কীভাবে ভর্তি হলো? এটা কি ভর্তির সময়?
~ আমি কি জানি? আর আমার এখন এতো কিছু ভাববার সময় নেই। আমি গেলাম।
~ আরে আরে, কই যাস?
~ বাসায়। মা ফোন করেছিল, বাবার ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। দুপুরের জন্য ওষুধ নিয়ে যেতে হবে। তাই যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।
~ আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।
ক্লাস শেষে ফিহার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে বাসায় ফিরবে অনি। ভার্সিটির গেইট ক্রস করে বাহিরে বেড় হয়ে বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে সে। কিছু দূর এগোতেই মনে হলো তার ওড়না কোথাও আটকে গেছে। তাই সে ঘাড় ঘুরিয়ে দাড়ালো ওড়না ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু যা দেখলো তা ওর মাথায় রক্ত উঠিয়ে দিলো। সাথে সাথে আবার ভয়ও করছে। একদল বখাটে ছেলে একসাথে আড্ডা দিচ্ছে আর তাদের মধ্যেরই একজন ওর ওড়না ধরে রেখেছে। অনি ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ওরা ছাড়ছে না বরং আরো শক্ত করে ধরে রেখেছে। অনির এবার হাত পা কাঁপা কাপি শুরু করলো। আজ প্রথম দিনেই এরকম একটা পরিস্থিতিতে পরতে হবে কল্পনাও করতে পারে নি। তার আগেই তা বাস্তবে রূপ ধারণ করছে।
ছেলেটা ওড়না আঁকড়ে ধরে বললো,
~ কী ব্যাপার, তুই কী নতুন স্টুডেন্ট নাকি? আগে তো দেখিনি! যাই হ নতুন বা পুরান, দেখতে…….
আর বলতে পারলোনা, তার আগেই ছেলেটার নাক বরাবর জোরে শোরে একটা ঘুষি পরলো আর ছেলেটা দূরে ছিটকে পড়লো, নাক মুখ থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে।
সবাই ঘুষির উৎস ব্যক্তির দিকে তাকালো। তাকিয়ে দেখল, অনিক রাগে কিড়মিড় করছে। আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। সবাই একটা কথাই বলছে,
~ একদম ঠিক হয়েছে। রোজ রোজ এভাবে ভার্সিটির গেইট এর সামনে বসে থাকে আর মেয়েদের হ্যারাস করে। বখাটে ছেলে পেলে! এদের জন্য মেয়েরা কোথাও নিরাপদ না। এদেরকে জন্মের পর খুন করে ফেলা উচিত ছিলো।
আরও অনেক কথা বলছিল মানুষ জন। অনি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বলছে।
আসলে অনিক এদিক দিয়েই বাইক চালিয়ে গেইট ক্রস করে যাচ্ছিলো। তখন দেখলো, কয়েকজন ছেলে একটা মেয়ের ওড়না ধরে টানাটানি করছিল। ব্যাস, এটাই যথেষ্ট ছিলো অনিকের রাগ ওঠানোর জন্য। বাইকটা ব্রেক করে রাস্তার সাইডে রেখে সেদিকে এগিয়ে গেল। ভেবেছিলো শুধু বুঝিয়ে মেয়েটাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু কাছে যেতেই এসব বাজে কথা শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি।
অনিক ছেলেটাকে ঘাড় ধরে উঠিয়ে দাড় করালো। ছেলেটা অনিকের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে। অনিক ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে দাঁড় করালো। তারপর বললো,
~ কী হলো? কেমন লাগছে নিজের বাবা-মা কে নিয়ে এসব কথা শুনতে? হয়তো খুব ভালো লাগছে তোদের? এছাড়া তোদের কাছ থেকে আর কীই বা আশা করা যায়। আচ্ছা, একবার এই মেয়েটার (অনিকে উদ্দেশ্য করে) জায়গায় নিজের বোনকে বসিয়ে দেখতো! সহ্য করতে পারবি নিজের বোনের সম্মান হানি? কী হলো বল?
ছেলেগুলো কিছুই বলছে না, শুধু মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। এতোক্ষণ যাদের চোখে আগুন জ্বলছিল, এখন তারা নিজেরাই সেই আগুনে পুড়ছে, নিজরাই জ্বলছে। সত্যিই তো! নিজের আপন বোনের সাথে যদি কেউ এমন করতো, তাহলে তারা কীভাবে তা সহ্য করতো! ভাবতেই বুকটা ধ্বক কর উঠলো! সবার চোখের সামনে এখন তাদের নিজেদের আদরের ও ভালোবাসার বোনটির মুখ ভেসে উঠছে। কিন্তু তারা এমন কত মানুষের বোনের সম্মান হানি করেছে হিসেবে নেই।
অনিক আবার বলে উঠলো,
~ শুধু ঘরের মা-বোনদেরকেই সম্মান দিলে চলবে না। বাইরে যারা আছে তাদেরকেও সম্মান দিতে শিখ। সব মেয়ের মাঝেই একটা আলাদা সত্তা আছে, যাকে আমরা মাতৃত্ব বলি। সেই মাতৃত্বের সত্তার জন্যই তোরা এই পৃথিবীর আলো দেখছিস। সুতরাং এই সত্তা যারা বহন করছে তাদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া উচিত।
এবার অনিক আশেপাশের মানুষদের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ এই যে, আপনারা! এতোক্ষণ এই ছেলেগুলোকে কত কিছু বলছিলেন। কিন্তু কই? এই মেয়েটাকে তো একবারও সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন না। আপনারা কি এদের চেয়ে বেশি অপরাধী নন?
অনিকের কথায় সবাই মাথা নিচু করে ফেললো। সত্যিই তারা কখনো এগিয়ে আসে না। এজন্য এরা আরো বেশি আস্কারা পায়।
ছেলে গুলো অনির দিকে এগিয়ে গেল। অনি তো ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সবগুলো ছেলে ওর কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগলো।
~ মাফ করে দেবেন, বোন। আমরা এমনভাবে ভেবে দেখিনি। আর কখনো এমন করবো না। দয়া করে ক্ষমা করে দেন।
বলেই কাঁদতে লাগলো। অনি বললো,
~ আচ্ছা, ঠিক আছে! ঠিক আছে! আর কখনো এমন করবেন না কারো সাথে।
ছেলোগুলো মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। সবাই নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে গেল। অনিক ও নিজের বাইকটা স্টার্ট দিয়ে হুট করে চলে গেল। অনি অনিকের যাওয়ার পানে কিছুক্ষন অপলক তাকিয়ে রইলো। তারপর বাসস্ট্যান্ডের দিকে আবার এগিয়ে যেতে লাগলো।
পর্ব ৪
ক্লাস শেষে অনি আর ফিহা একে অপরের সাথে গল্প করছে।
অনি ফিহাকে গতদিন ওর সাথে ঘটে যাওয়া সব কথাই বলেছে। ফিহা উৎসুক দৃষ্টিতে অনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
~ এখনকার জমানায়ও এমন ছেলে আছে! ভাবতেই অবাক লাগে। নিশ্চয়ই আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে। নাম কী রে?
~ জানি না। কথা বলিনি ওনার সাথে।
ফিহা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
~ তুই আসলেই একটা যা তা। একজন মানুষ তোকে কত বড় সাহায্য করলো, আর তুই, উনার সাথে না কথা বললি না ধন্যবাদ জানালি। অকৃতজ্ঞ কোথাকার!
~ আরে, আমি সুযোগ পেলে না জিজ্ঞেস করবো, কথা বলবো। উনি তো আমার সাথে কোনো কিছু না বলেই বাইক নিয়ে হুট করে উধাও হয়ে গেলেন।
~ তুই ডাক দিতি ওনাকে। নিশ্চয়ই উনি তোর কথা শুনতেন।
~ জানি না। কিন্তু আমাকে তো উনি পাত্তা দিলেন না৷ আমারও এতো ঠেকা পড়ে নাই ওনাকে ডেকে ডেকে কথা বলার।
~ দেখ ভাব কম ধর। এখানে পাত্তা দেওয়া না দেওয়ার কিছু নেই।
~ অবশ্যই আছে। একবার আশেপাশে তাকিয়ে সব ছেলেদের দৃষ্টি অনুসরণ কর।
ফিহা সবার দিকে তাকিয়ে দেখল, সবাই অনির দিকে তাকিয়ে আছে অথবা কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছে।
ফিহা অনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
~ আচ্ছা, সবাই তোর দিক তাকাচ্ছে কেন বলতো?
অনি বাকাঁ হেসে বললো,
~ কারন এই অনিন্দিতা সুলতানা কে পাত্তা না দেওয়ার মতো ছেলে এ পৃথিবীতে আছে বলে আমার মনে হয় না।
ফিহা হা করে তাকিয়ে আছে অনির দিকে, এই মেয়ের কত কনফিডেন্স!
অনি আর ফিহা হেঁটে গেইটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর অনিক উল্টো দিক থেকে তার বাইকের পার্কিং স্পটের দিকে যাচ্ছে। অনি তো ফিহার সাথে গল্পে মশগুল আর অনিক ফোনে তার বসের সাথে একটা ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপারে কথা বলছে। তারও দুনিয়ার কোনো দিকে খেয়াল নেই।
দুজন কাছাকাছি আসতেই মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় অনি পড়ে যেতে নিলে ফিহা ধরে ফেলে। অনি রেগে কিছু বলতে যাবে এই ভেবে অনিকের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
~ আপনিইইইই!
অনিক অনিকে চিনতে পারছে না, আর এতো কিছু ভাববার সময় তার নেই তাই বললো,
~ সরি সরি! আম এক্সট্রেমলি সরি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
বলেই চলে গেল। অনি হা করে তাকিয়ে আছে অনিকের যাওয়ার পানে। ফিহা অনিকে জিজ্ঞেস করলো,
~ ইনি তো বোধ হয় মাস্টার্সে পড়ে। তুই ওনাকে দেখে এমন রিয়েক্ট করলি কেন? ওনাকে চিনিস তুই? কিন্তু ওনাকে তো দেখে মনে হলো না তোকে চিনে!
অনি রেগে বললো,
~ আজকেও এভয়েড করলো আমায়! এমন একটা ভাব ধরলো, যেন আমায় কোনো দিন দেখেই নি।
ফিহা অবাক হয়ে বললো,
~ মানে! কী যা তা বলছিস তুই! কী এভোয়েড করলো আবার?
~ আরে ইনিই গতদিন আমায় সাহায্য করে উধাও হয়ে গেছিলো।
~ কী? ওনি?
~ হ্যাঁ। আর আজ কেমন করে চলে গেলো দেখলি?
ফিহা হালকা হেসে বললো,
~ আরে, এতো ওভার কনফিডেন্স ভালো না, সেটা বুঝলি তো এবার? ওনি হয়তো সবার থেকে আলাদা।
অনি নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,
~ ওনি আমায় পাত্তা দিতে বাধ্য।
~ আরে বাদ দে ইয়ার! ওনি তোর ফেসই ভুলে গেছে। আর পাত্তা! মাই গড!
~ চ্যালেঞ্জ করছিস? ওকে, আই এক্সেপ্টেড ইয়র চ্যালেঞ্জ।
বলেই গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। ফিহা পুরাই টাস্কি খেয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
পরেরদিন ভার্সিটিতে,
অনি ফিহাকে বললো
~ আজকে দেখবি, ব্যাটাকে কেমনে নাকানি চুবানি খাওয়াই!
বলেই রহস্যময় হাসি দিল।
ফিহা অবাক হয়ে বললো,
~ কাকে নিয়ে এসব আকাশ পাতাল ভাবছিস তুই?
~ কে আবার! ঐ ছেলেটা যার বিষয়ে আমি তোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। চল এখন ওই ডিপার্টমেন্টটায় যাই, যেখান থেকে ওনাকে বের হতে দেখেছিলাম। উনি মে বি ওই ডিপার্টমেন্টেরই স্টুডেন্ট।
বলেই ফিহাকে হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো অনি।
ক্লাস শেষ করে বের হচ্ছে অনিক ও রিয়াদ, সাথে আরো অনেক ফ্রেন্ড আছে। এমন সময় অনি সেখানে গিয়ে পৌছাল। সে তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে ; এখানে আসতে না আসতেই পেয়ে গেল কোনো কষ্ট ছাড়া।
ফিহার তো হাত পা কাঁপা কাপি শুরু হয়ে গেছে, সাথে বার বার শুকনো ঢোক গিলছে। যতোই হোক, এরা মাস্টার্সের স্টুডেন্ট, ওদের থেকে তিন বছরের সিনিয়র। অনির সাথে সাথে নিজেও বাজে ভাবে ফেঁসে না যায় সে কথাই ভাবছে।
অনির দিকে চোখ যেতেই অনিক আর রিয়াদ বাদে সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। অনি অনিকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
~ শুনুন, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
অনিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো অনির কথা শুনে। তার সাথে আবার কী কথা থাকবে? অপরিচিত ছেলেকে কী করে এমন কথা বলতে পারে একটা মেয়ে, তাও আবার উইদাউট এনি হ্যাজিটেশান!
অনিক ভদ্রতার খাতিরে বললো,
~ জ্বি, বলুন।
অনি নিঃসংকোচে বললো,
~ আপনার সাথে আমার পার্সোনালি কিছু কথা আছে, সেগুলো এতো মানুষের সামনে বলা যাবে না।
অনিক কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
~ কিন্তু আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। যদি বলার হয় তো এখানেই বলুন নয়তো আপনি আসতে পারেন।
অনি বললো,
~ আরে, আমার,
অনির কথার মাঝেই রিয়াদ বললো,
~ ইয়ার, যা না!
এমন করছিস কেনো? হয়তো ওর কোনো দরকার!
অনিক বললো,
~ আমাকেই কেন দরকার, এখানে তো আরো অনেকেই আছে। তাদেরকে তো বললো না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি তো ওনাকে চিনিই না; তাহলে আমার সাথে কী এমন দরকার?
অনি হালকা ঝাড়ি দিয়ে বললো,
~ সেটা না শুনলে বুঝবেন কী করে? অপরিচিতদের সাথে কী কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না।
অনিক আবার কিছু বলতে নিবে তখনই রিয়াদ বলে উঠে,
~ ওতো ঠিকই বলেছে, যা তো কথা বলে আয়।
সবাই ওকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দেয় অনির সাথে। অনির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে ওঠে।
অনি আর ফিহা অনিককে নিয়ে একটা গাছের নিচে দাড়ালো। জায়গাটায় মানুষ তেমন নেই, মাঝে মাঝে কিছু মানুষ আসা যাওয়া করছে।
অনি অনিকের দিকে তাকিয়ে আছে, আর ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে চলেছে। ফিহা অনির কান্ড দেখে অনিকে বললো,
~ তোরা কথা বল, আমি ঐ দিকটায় আছি।
বলেই ফিহা চলে গেল।
অনিক ফিহার যাওয়ার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে অনির দিকে তাকালো। অনি এখনো দাত কেলাচ্ছে। অনিক এটা দেখে নাক মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললো,
~ কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন। এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আপনার দাত কেলানো দেখার সময় আমার নেই।
~ তাহলে কিসের সময় আছে?
~ মানে?
~ না, মানে, বলছিলাম যে, আপনি কি আমায় সত্যিই চিনতে পারছেন না নাকি এমনি ভাব দেখাচ্ছেন, অভিনয় করেছেন।
অনিক এবার রেগে বললো,
~ হোয়াট দ্য হেল! আমি কেন আপনার সাথে অভিনয় করতে যাবো।
অনি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বললো,
~ আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি রাগার মতো কী বললাম? আমায় আপনি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন, ভাবিনি। এর আগে আমাদের দুই বার দেখা হয়েছে হুম, দুই বার (আঙুল দেখিয়ে)।
অনিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
~ দুই বার দেখা হয়েছে? হতেই পারে। পৃথিবীটা গোল, বুঝলেন? তো আমাদের দুবার কেন, পাঁচ দশ দেখা হওয়াটাও না আশ্চর্যের কিছু না। কিন্তু আমার তো আপনাকে মনে পরছে না। কোথায় দেখেছি, বলুন তো?
~ ঐ যেএএএএএ?
~ ঐ যে মানে? কোথায়?
~ ঐ যে দুদিন আগে আমায় কয়েকজন ছেলের হাত থেকে বাচালেন।
~ ওওওও, ঐ দিন ওটা আপনি ছিলেন।
~ হ্যাঁ।
~ আসলে আমার খেয়াল ছিলো না আপনার ফেস, তাই চিনতে পারিনি। আচ্ছা, আরেকদিন কোথায় দেখা হয়েছিলো?
~ আরে কালকে আপনি আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে নিচ্ছিলেন। তখনও খেয়াল করেননি?
~ ও, সেটাও তুমি ছিলে। তো এখন কি এসব স্মৃতিচারণের জন্য আমায় ডেকে নিয়ে এসেছো?
~ হ্যাঁ (আনমনে)
~ হোয়াট?
~ না মানে, না না। আমি তো আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য ডেকেছি। আপনি যদি সেদিন না থাকতেন তাহলে যে আমার কী হতো!
~ ছিলাম তো, আর কিছু হয়ও নি। কী থাকলে কী হতো, কী থাকলে কী না হতো, এসব ভাবা বোকামি ছাড়া আর কিছু না। আর এখানে ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই। এটা আমার দায়িত্ব ছিলো আর আমি সেটাই পালন করেছি। দ্যাটস ইট।
বলেই উল্টো দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যেতে লাগলো।
~ আরে, আপনার নামটা তো বললেন না।
অনির কথায় অনিক ঘুরে তাকিয়ে বললো,
~ অনিক, অনিক চৌধুরী।
বলে চলে গেল।
অনি জোরে জোরে ডেকে বলতে লাগলো,
~ শুনুন, আরে আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। এই যে মিস্টার,।
তখনই ফিহা এলো আর অনিকে বলতে লাগলো,
~ কাজ হলো না তো! আমি আগেই জানতাম! ওনি একদম আলাদা।
বলেই হাসতে লাগলো।
অনি এতোক্ষণ অনিকের যাওয়ার দিক তাকিয়ে দাত কিড়মিড় করছিল। ফিহার কথায় ওর দিকে তাকিয়ে রেগে বললো,
~ হারামি একটা! আমি এখনো হাল ছেড়ে দেইনি। চল আমার সাথে।
~ কোথায়?
~ অনিক চৌধুরীর ফ্রেন্ডদোর কাছে। ওনাদের কাছ থেকে কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করতে হবে।
তারপর ওরা রিয়াদের কাছে গেল। রিয়াদ প্রথমে কিছু বলতে চাইছিল না। কিন্তু অনির ইমোশনাল ব্লেকমেইলের কাছে হার মেনে সব বলতে বাধ্য হলো। সব খবর নিয়ে অনির মুখে ডেবিল হাসি খেলা করে উঠে।
রাতে,
অনিক কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে ফিরেছে। এখন কিছু ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। হঠাৎ তার রুমের বারান্দায়…………..
পর্ব ৫
হঠাৎ অনিকের রুমের বারান্দায় কেমন যেন শব্দ আসতে লাগলো। অনিক পর্দা ঠেলে বারান্দায় গিয়ে দেখলো দুটো হাত বারান্দার রেলিং এর নিচের অংশ আঁকড়ে ধরে উপরে উঠার চেষ্টা করছে আর হাতের চুড়ি গুলো বারবার স্টিলের রেলিং এর সাথে বারি লেগে শব্দ হচ্ছে। অনিক এগিয়ে গিয়ে মাথা ঝুকিয়ে দেখলো, এটা কে। অনিকে দেখে ও চোখ দুটি রসগোল্লার মতো করে তাকিয়ে বললো,
~ আপনিইইইই!
হঠাৎ কারো গলার আওয়াজ শুনে অনি কেঁপে উঠল। তারপর চোখ তুলে তাকাতেই অনিককে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
~ ও আপনি, আমাকে মেরে ফেলার জন্য এমন আচমকা অ্যাট্যাক করলেন নাকি? আরেকটু হলে আমার হাওয়া ফুসস হয়ে যেতো!
~ আপনি আমার বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলছেন কেন? আপনার সাহস তো কম না? মরার এতো শখ থাকলে অন্য কোথাও যান। যত্তসব!
~ আরে আমার মরার শখ কেন হবে? আমি তো এই গাছটা বেয়ে আপনার রুমে আসার চেষ্টা করছিলাম এন্ড সাকসেসফুল হয়েও গেলাম। এখন আমায় তাড়াতাড়ি বারান্দায় উঠতে সাহায্য করুন!
~ নো ওয়ে! আপনি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান। নয়তো সারারাত এখানে ঝুলে থাকুন।
বলেই রুমে ঢুকে দরজা ভিতর থেকে লক করে দিল অনিক। অনি রেগেমেগে নিজেই বারান্দায় উঠার চেষ্টা করতে লাগলো আর একসময় সফলও হয়ে গেল।
দরজায় একের পর এক থাপ্পর দিয়েই চলেছে অনি।
~ এই যে, শুনছেন! দরজাটা ভালো মানুষের মতো খুলুন বলছি।
রুমের ভিতর থেকে অনিক বললো,
~ আপনাকেও আমি ভালো মানুষের মতো চলে যেতে বলছি।
~ লাস্ট বারের মতো বলছি খুলবেন নাকি খুলবেন না?
~ খুলবো না! খুলবো না! খুলবো না! কী করবেন আপনি?
~ সত্যিই তো! আমি করবো তাহলে?
~ বাসায় চলে যান, তারপর সেটা নিয়ে ভাবিয়েন।
~ না, আমি এখনি ভাববো। কী করি, কী করি? ধুর কাজের সময় পুরো মাথাটা ফাঁকা হয়ে যায়।
~ বললাম তো, চলে যান ; কেন শুধু শুধু আমায় বিরক্ত করছেন? আজিববব!
অনি হঠাৎ খুশিতে আত্মহারা হয়ে হালকা চিৎকার করে বলে উঠলো,
~ পেয়ে গেছি!
অনিক অবাক হয়ে বললো,
~ কি পেয়েছেন? আমি তো বারান্দায় কিছু রাখিনি। যদি পেয়েও থাকেন, তাহলে সেটা নিজের মনে করে চুরি করে নিয়ে যাবেন না।
অনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
~ নিজের মনে করে চুরি! সেটা আবার কী জিনিস? যাই হোক, আপনি দরজা না খুললে কী করব সেটা পেয়ে গেছি। আপনি যদি ১০ সেকেন্ডের মধ্যে দরজা না খুলেন, তাহলে আমি জোরে জোরে চিৎকার করে সবাইকে ডাকবো। আর বানিয়ে বানিয়ে যা বলবো সেটা আমায় আপনার রুমে দেখলেই সবাই বিশ্বাস করে নিবে।
বলেই ডেভিল হাসি দিল।
~ ছিঃ ছিঃ ছিঃ, আপনার মনে কী একটু ভয় ডর নেই? একটা অপরিচিত ছেলের ঘরে ঢোকার জন্য কীসব আজেবাজে থ্রেট দিচ্ছেন?
~ না, নেই। এখন দরজা খুলবেন নাকি আমি আমার মিশন স্টার্ট করবো।
~ এই না না। দাড়ান, খুলছি।
বলে অনিক মনে মনে আবার বলে উঠলো,
~ আমায় জ্বালানো! দাড়াও দেখাচ্ছি মজা। একসপ্তাহ ভার্সিটিতে না যাওয়ার ব্যাবস্থা করবো আজ।
অনিক দরজার সামনে কিছু তেল ঢেলে তার ওপর পাপোশ বিছিয়ে দিলো। এরপর দরজা খুলে দেখলো অনি কোমরে দুই হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে।
~ আরে, আসুন আসুন! ভেতরে এসে বসুন।
মুখে নকল হাসি টেনে বললো অনিক এবং ঢোকার জন্য রাস্তা ছেড়ে দিল।
অনি ভেতরে ঢোকার জন্য এক পা পাপোশে রেখে আরেক পা বাড়াতেই ধড়াম করে পা পিছলে পড়ে গেল। অনি চিৎকার করতে যাবে তার আগেই ওর মুখে হাত চেপে ধরে অনিক।
অনিকের রুমে কিছু পড়ার শব্দ শুনে ওর মা এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলো,
~ কী হয়েছে, অনিক? তোর ঘর থেকে কিসের আওয়াজ আসলো?
অনিক আমতা আমতা করে বললো,
~ এমনি কিছু না, মা! ঐ, বড় ফ্লাওয়ার ভাসটা পড়ে গেছে আর কি!
~ ও, তাই বল; আমি আরো ভাবলাম তুই বোধ হয় পড়ে গেছিস।
বলেই চলে গেলো।
অনিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
~ যাক, মা কিছু বুঝেনি। এবার আপনি বাসায় ফিরে যান। যে ব্যথা পেয়েছেন, একসপ্তাহ লাগবে রিকোভারির জন্য।
~ ও, মাগো! আমার কোমড় পুরো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে গো! আমাকে একটু উঠিয়ে বসান তো!
অনিক অনিকে টেনে তুলে চেয়ারে বসায়। অনি বললো,
~ আমার কথা শেষ না হলে আমি বাসায় যাবো না। আর আপনিও ডিমান্ড দেখিয়ে এখন এখান থেকে যেতে পারবেন না!
অনিক চোখ ছোট ছোট করে বললো,
~ কী কথা!
~ এটাই যে, কাল থেকে আপনি আমার সাথে ভাব কম দেখাবেন আর আমায় ইগনোর করার সাহস দেখাবেন না।
~ শুনুন, আপনি ভার্সিটিতে অনেক ছেলে মেয়ে পাবেন, তাদের সাথে এসব পাগলামি করুন গিয়ে! আমার ব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না। তাই,
~ নাম অনিক চৌধুরী। বর্তমানে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে পড়ছে। বাবা মা এর একমাত্র সন্তান। বাবা বর্তমানে শয্যা শায়ী তাই পরিবারের জন্য পার্ট টাইম জব করেন। গ্রামে অনেক জায়গা সম্পদ থাকলেও সেগুলো নষ্ট করেননি, পরে কাজে লাগাবেন ভেবে। একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে হওয়ায় আত্মসম্মানবোধটা বেশি, সাথে ব্যক্তিত্ববোধটাও।
অনিক অবাক হয়ে বললো,
~ আপনি এতো কিছু কিভাবে জানেন?
~ যেভাবে জানার জেনেছি। সেটা নিয়ে আপনার টেনশন না করলেও চলবে, এখন আর বলতে পারবেন না যে আমি আপনার সম্পর্কে কিছু জানি না। সো, তাড়াতাড়ি আমার কথা মেনে নেন।
~ এসব করে আপনার কী লাভ?
~ এটাই যে আমায় পাত্তা দেয় না এমন কোনো মানুষ না থাকে।
~ আপনার মতো ইগোইস্টিক মানুষ আমি আমার জীবনে দেখিনি।
~ দেখেননি, এখন দেখুন। আর আমার কথায় রাজী হয়ে যান।
~ কোনোদিনও না। যান আপনি আপনার বাসায় ফিরে যান।
~ আমি কিন্তু আপনাকে রোজ রোজ এভাবে বা অন্যকোনো ভাবে জালাবো।
~ কী করবেন করে নিয়েন? এখন এখান থেকে বিদায় হোন।
অনি রাগে কটমট করতে করতে যেভাবে এসেছিল, সেভাবে চলে গেল। অনিক অনির কান্ড মনে করে হাসতে লাগলো।
পর্ব ৬
ছয় মাস পর,
আজ থেকে অনিকের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু আর অনির থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। এই ছয় মাসে অনি অনিকের চুল টেনে ছিড়াটাই বাকি রেখেছে। প্রতি দিনই ক্যাম্পাসে অনিকের পেছন পেছন ঘুর ঘুর করতো আর রাত হলেই কারনে অকারণে ফোন দিয়ে বা মেসেজ দিয়ে ডিস্টার্ব করতো। নিজের ইগো বজায় রাখার জন্য এসব করলেও এখন এসব না করলেও ভালো লাগে না। অনিকেরও এখন এসব অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। এটাই হয়তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
অনিক কাল সারারাত ঘুমায়নি। ঘুমাবে কী করে? একদিকে অফিসের কাজ, আরেক দিক দিয়ে নিজের পড়াশোনা, আবার অন্য দিকে অনির দৈনন্দিন অত্যাচার তো আছেই। তাও পরীক্ষার প্রস্তুতি টা ওভার অল ভালো। কিন্তু হলে ঢুকে যে এতো বড় ঝাটকা খাবে, তা কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি।
পরীক্ষার জন্য সিট প্ল্যান করা হয়েছে এভাবে যে: প্রতি বেঞ্চে দুই জন করে বসবে এবং একই বেঞ্চে সেইম ইয়ারের স্টুডেন্ট বসতে পারবে না। অনিক হলে গিয়ে নিজের সিটে গিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। আশেপাশে কী ঘটছে সেদিকে তার নজর কম। বরং চুপচাপ বসে বসে এটাই ভাবছে যে, এইটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এবং সর্বশেষ পরীক্ষা। তাই যেভাবেই হোকনা কেন, তাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে।
হঠাৎ পাশের জনের বাজখাঁই গলার কাশিতে ভাবনার সুতো ছিড়ে গেল। বিরক্তি নিয়ে পাশে তাকাতেই অনিক চোখ দুটি ইয়া বড় বড় করে বললো,
~ তুমিইইইই! ওহ নো!
অনি একগাল হেসে বললো,
~ আপনি যেখানে, আমিও সেখানে।
অনিক দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ জাস্ট শাট আপ! পরীক্ষার মাঝে আমায় একদম ইরিটেট করার চেষ্টা করবে না বলে দিলাম।
অনি তেড়ে গিয়ে বললো,
~ এ্যাহহহহ! পরীক্ষা কি শুধু আপনারই নাকি? আমার ও পরীক্ষা বুঝলেন! নিজেকে কী ভাবেন আল্লাহ মালুম।
~ হেই ইউ লিসেন! আমি,
আর কিছু বলার আগেই টিচার হলে প্রবেশ করলো, তাই অনিকও চুপ হয়ে গেলো।
সবাই মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে শুধু মাত্র অনি বাদে। সে তো অনিককে জ্বালাতেই ব্যস্ত। অনিকও কিছু বলতে পারছে না। যখনই চোখ গরম করে তাকায়, তখনই অনি ওকে চোখ মেরে দেয়। অনিক তাই অনির সব অত্যাচার সয়ে সয়ে পরীক্ষা শেষ করলো।
পরীক্ষা শেষে ফিহা অনির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এটা দেখে অনি বিরক্ত হয়ে বললো,
~ কী হলো? তুই আমায় এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিস কেন বলতো?
~ কেসটা কী আগে সেটা বল? অনিক সিট আর তোর সিট একসাথে কীভাবে পরলো? আমার কাছে তো ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগছে না।
~ বাহ! তুই তো বহুত ইন্টেলিজেন্ট। আসলে আমি কেয়ারটেকার মামাকে দিয়ে সব সেট করিয়েছি।
~ কীইইইই!
~ হ্যাঁ, এখন চল তাড়াতাড়ি।
বলেই পিছনে ঘুরে যাকে দেখলো তাকে দেখে অনির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তাই বার বার শুকনো ঢোক গিলছে। রিয়াদ অনির দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনির কাছে এগিয়ে আসলে অনি কাপাকাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
~ ভাইয়া, আ, আপনি?
অনির অবস্থা দেখে রিয়াদ ফিক করে হেসে দিলো। অনি রিয়াদের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। রিয়াদ হাসতে হাসতে বললো,
~ বাহ, অনি! তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হবে। আই স্যালুট ইউ।
অনি ভয় মিশ্রিত গলায় বললো,
~ আপনি অনিক চৌধুরীকে কিছু বলবেন না তো?
~ সেটা না হয় বলবো না, কিন্তু এটার পিছনে কোনো ব্যাপার স্যাপার নেই তো?
~ কীসের ব্যাপার স্যাপার থাকবে? আমার তো ওনাকে জ্বালাতে হেভি লাগে। এজন্যই অনিক চৌধুরীকে বিরক্ত করি।
আজ সব পরীক্ষা শেষ হলো। এই কয়েকটা দিনে অনিক অনেক কষ্ট করে পরীক্ষা গুলো দিয়েছে। আবার এনজয়ও করেছে। অনির জ্বালাতন গুলোয় আগে অনেক বিরক্ত হতো, এখনও বিরক্ত হয় আবার পরে সেগুলো মনে পড়লে হাসিও পায়। মেয়েটা সত্যিই পাগল!
এসব ভাবতে ভাবতে একা একাই হাসছিল অনিক। অনিকের মা এসে এটা দেখে বললো,
~ কী রে, তুই একা একা এভাবে হাসছিস কেন?
অনিক থতমত খেয়ে বললো,
~ ওই আসলে, আর কি, এমনি এমনিতেই। তা তুমি কিছু বলবে?
~ হ্যাঁ, তোর তো পরীক্ষা শেষ। একটা মেয়ের খোঁজ পেলাম। কালকে দেখতে যাই, কী বলিস?
~ মা, আমি তোমাদের কথার ওপর কখনো কথা বলেছি? কিন্তু আমায় একটা ভালো চাকরি তো পেতে দাও। এতো তাড়ার কী আছে?
~ ভালো চাকরির জন্য বসে থাকলে আরো দুই তিন বছর বসে থাকতে হবে। তার থেকে বরং তুই এখন বিয়েটা সেরে ফেল। এখন তো আর তুই বেকার না। চাকরি তো করছিসই। হয়তো বেতন কম। কিন্তু তা দিয়েই আমরা ভালোভাবেই পুষিয়ে নিতে পারবো।
অনিক হেসে বললো,
~ তোমার সাথে লজিক খাটানোর ক্ষমতা আমার নেই। তুমি যা ভালো বুঝো করো। আমার কোনো আপত্তি নেই।
–
পরের দিন অনিক ও তার মা এসেছে মেয়ে দেখতে। অনিককে দেখে তো মেয়ের বাবা-মা এর অনেক পছন্দ হয়েছে। আর পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। অনিকের মধ্যে সব যোগ্যতাই বিদ্যমান। তবে মেয়ের বাড়ির অবস্থা দেখে অনিক এটা বুঝে গেছে, হয়তো তারা তেমন স্বচ্ছল না। তবে এসব বিষয়ে অনিকের কিছু যায় আসে না। তার একজন ভালো মনের যোগ্যতা সম্পন্ন মেয়ে দরকার, যে সুখে দুঃখে ছায়ার মতো পাশে থাকবে। এটুকুই এনাফ।
পর্ব ৭
অনিক মনে মনে বলছে,
~ কপালটাও এই মেয়ের সাথে জোড়া হলো! এর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই প্রতিটি জায়গায় ও থাকবেই। এখন মেয়ে দেখতে এসেও এর হাত থেকে রেহাই নেই। মেয়ে যদি এর বোন হয়, তাহলে আমি তো গ্যায়া কাম সে, বায় গড।
অনিকের মা অনির দিকে তাকিয়ে ওর বাবা মা কে বকছে,
~ বাহ! আপনাদের মেয়ে তো দেখতে কোনো রাণীর চেয়ে কম না। আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। মাশাল্লাহ।
অনিক ওর মায়ের কথার আগা মাথা কিছু বুঝতে পারছে না। তাই মায়ের কানে ফিসফিস করে বললো,
~ মা, মেয়েকে দেখে তারপর পছন্দ করিও। মেয়ের বাড়ির লোককে না।
~ কী যা তা বলছিস! মেয়ে তো তোর সামনে দাড়িয়ে আছে। এই তো অনিন্দিতা।
এই কথা শুনে অনিকের চোখ বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। তার মানে অনির সাথে ওর বিয়ে ঠিক হতে চলেছে। ভাবলেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে। অনিক অনির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। অনিও সুযোগ বুঝে অনিককে চোখ মেরে দেয়।
আসল কথা হলো, অনিকের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার ব্যাপারে অনি কিছুই জানতো না। এখানে অনিককে দেখে বুঝতে পারছে যে অনিকই তার জীবনসঙ্গী হতে চলেছে।
ফাইনালি অনিক-অনিন্দিতার বিয়েটা হয়ে গেছে। অনিক অনির সব প্রয়োজন ঠিক মতো পূরণ করতে না পারলেও ভালোবাসার কোনো ঘাটতি রাখেনি। তাই বৈবাহিক জীবনে তারা সুখেই আছে বলতে গেলে।
আজ তাদের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। অনিক একাই এসেছে, অনি ইচ্ছে করেই আসেনি। অনিকের রেজাল্ট অনেক ভালো হয়েছে, কিন্তু অনির এভারেজ রেজাল্ট। তেমন ভালো না। অনিক ভাবলো,
~ রেজাল্ট দিয়ে কী হবে? আমি তো অনিকে চাকরি করতে কখনোই বলবো না। ও যা রেজাল্ট করেছে তাতেই আমি খুশি। কিন্তু বাসায় এসে যে আরেক অনিকে দেখবে তা কল্পনাও করেনি।
অনিক বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে মাথা মুছছে। এমন সময় অনি এসে বললো,
~ অনিক, তোমার সাথে আমার কথা আছে।
অনিক হেসে বললো,
~ বাহ্, আজকে এতো সিরিয়াস যে!
~ অনিক, প্লিজ, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না।
~ ওকে বলো।
~ আমি তোমার বাবা মা এর সাথে একসাথে থাকতে পারবো না। আমায় আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
~ হোয়াটটটট!
~ হ্যাঁ, আমি আর এখানে থাকতে পারবো না!
~ কিন্তু কেন? আমার মা বাবা তো তোমায় কোনো ডিস্টার্ব করে না। আর আমি চলে গেলে আমার বাবা মা এর খেয়াল রাখবে কে? আমার এখনো ভালো চাকরিও হয়নি যে দুই পরিবার চালাবো।
~ সেসব কিছু আমি জানি না, তোমার ঐ অসুস্থ বাবা এবং বুড়ি মাকে আমার সহ্য হয় না।
~ অনিইইইই
বলেই অনির গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল অনিক। রেগে বললো,
~ তুমি যে এতোটা নিচ মানসিকতার, তা আমি আগে জানলে কখনোই তোমায় বিয়ে করতাম না। তোমায় এই বাড়িতেই থাকতে হবে এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।
বলে হেঁটে বাইরে চলে যাচ্ছিলো অনিক। হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে পিছন ফিরে দেখে অনি অজ্ঞান হয়ে গেছে।
–
In hospital………
অনিক ব্যস্ত হয়ে বললো,
~ ডক্টর, আমার ওয়াইফের কী হয়েছে?
~ Congrats, Mr. Anik. You are going to be a father. Your wife has been pregnant for 2 months.
অনিকের চোখ মুখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। সে ডক্টরের হাত ধরে বলে উঠলো,
~ সত্যি, ডক্টর! আপনি সত্যি বলছেন?
~ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি মিষ্টিমুখ করান।
বলেই চলে গেল।
অনিক অনির পাশে বসে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
~ থ্যাংক ইউ, অনি। আমায় এতো বড় একটা গুড নিউজ দেওয়ার জন্য। আজকে আমি অনেক খুশি। সাথে সরিও, তোমার গায়েহাত তোলাটা উচিত হয়নি।
~ ইট’স ওকে। আমি আপাতত তোমার বাসায় ই থাকবো, পরে তোমার ভালো চাকরি হলে দেখা যাবে।
পাঁচ মাস পর অনি মায়ের কাছে চলে যায়। অনিকও বাঁধা দেয় নি। কারন এসময় অনেক কেয়ারিং এর প্রয়োজন হয়। কিন্তু সে অনিকে সময় দিতে পারবে না। আর তার মা ও তার অসুস্থ বাবাকে সেবা করার পর অনিকে এক্সট্রা কেয়ার দিতে পারবে না।
কিন্তু ইদানীং অনির ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ওর ফোন অনেক বেশি বিজি থাকে। অনিক ফোন দিলেও নানান ব্যস্ততা দেখিয়ে কেটে দেয়।
আজ অনিক হসপিটালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করছে। বর মনে মনে দোয়া করছে মা ও বেবি দুজনই যেন সুস্থ থাকে। রিয়াদ, ফিহা, অনির বাবা মা, অনিকের মা সবাই এসেছে। হঠাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজে সবাই দরজার দিকে তাকায়। একজন নার্স একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে অনিকের কোলে দিয়ে বললো,
~ নিন, আপনার মেয়ে হয়েছে।
অনিকের চোখ দিয়ে টপটপ করে দুই ফোটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অনিকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। অনিক গিয়ে দেখলো, অনি ঘুমাচ্ছে। ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলে বললো,
~ উনার শরীর একটু দুর্বল তাই ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। কাল কথা বলতে পারবেন।
কিন্তু পরের দিন অনিক অনিকে কেবিনে দেখতে না পেয়ে ওয়াশরুমে তাকায়। কিন্তু ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ আর ভেতর থেকে শব্দ আসছে। অনিক গিয়ে দরজা খুললে একজন নার্স বেড়িয়ে এসে বলে,
~ এই কেবিনের রোগী পালিয়েছে। আমায় বোকা বানিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে।
অনিক রেগে বললো,
~ হোয়াট ননসেন্স! ও অসুস্থ শরীর নিয়ে পালাবে কিভাবে?
~ জানিনা, তবে পালিয়েছে এটা শিয়র থাকেন।
হঠাৎ বালিশের ওপর একটা কাগজ দেখতে পেয়ে সেটা হাতে নিয়ে খুলল অনিক। সেটাতে লেখা ছিল,
আমি পারবো না তোমার সাথে থাকতে, অনিক। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি এবং তার সাথে চলে গেলাম। ভুলে যেও আমায়। ভালো থেকো।
অনিক চিঠিটা পড়ে রাগে সেটাকে মুচড়ে ফেলে দিল এবং চিৎকার করে বললো,
~ তোর মতো ছলনা ময়ীকে ভুলে যাবো কিভাবে? একবার নিজের মেয়েটার কথাও মনে আসেনি তোর? এই চিঠিতেও বলিসনি! নিজের স্বার্থ এতো বড় হয়ে গেছে তোর কাছে যে মাতৃত্বের কোনো মূল্যই নেই। বাহ!
পর্ব ৮
অনিক নিজের মেয়ের কাছে গিয়ে তার কপালে, দু গালে ও দুই হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
~ কথা দিলাম তোকে, কোনোদিন তোকে মায়ের অভাব বুঝতে দিব না। তোর মায়ের জন্য কোনোদিন চোখের পানি ফেলতে দিব না। আমি একাই একসাথে তোর বাবা ও মা হয়ে দেখাবো। আর ঐ অনিন্দিতা সুলতানার স্বার্থান্ধতার কাহিনীও জানতে দিব না। কারণ আমি চাই না, তোর চোখে ওর জন্য ঘৃণা দেখতে।
হঠাৎ বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। অনিক ওকে কোলে তুলে সারা বাড়ি ঘুরে হেসে খেলে কান্না থামালো আর ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ওর জলে ভেজা ঘুমন্ত চোখ জোড়ায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলে,
~ আমার আনিশা, আনিশা চৌধুরী। আমার আশু তুই। তোকে নিয়েই আমি আমার বাকি জীবন পাড় করে দিতে পারবো। অন্য কাউকে নিয়ে আর জীবন বাধবো না। আমার পৃথিবীতে শুধু তুই আর বাবা মা থাকবে। আর অনি শুধু একটা কালোঅধ্যায় হয়ে থাকবে। হ্যাঁ, আমার আর আশুর জীবনে শুধু মাত্র একটা #কালোঅধ্যায় ছিলে তুমি অনি।
সেই কালোঅধ্যায় ভুলে নতুন করে বাচবো আমরা। আমি তোমার প্রয়োজন গুলো মেটাতে পারিনি বলে আজ অন্যের হাত ধরে চলে গেলে। এবার দেখবে এই অনিক চৌধুরী কিভাবে জীবনে শাইন করে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
অনিকের কাছে অনির বাবা, মা অনির খবর জানতে চাইলে অনিক ওনাদের অনির লেখা চিঠিটা দেয়। তাদের বিশ্বাস করতেও বিবেকে বাধছিল যে অনি এমন একটা কাজ করতে পারে। কিন্তু অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই, অনিক মিথ্যা কেন বলবে? আর ও কেমন ছেলে তা অনির বাবা-মা খুব ভালো করে জানে। তাদের মেয়ে যে লোভে পড়ে এমন একটা কাজ করেছে তা বুঝতে আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু অনির একটু ধৈর্য ধরা উচিত ছিলো। কারন অনির বাবা-মা জানতো অনিক একদিন অনেক উন্নতি করতে পারবে। শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু অনি সেটুকু অপেক্ষাও করেনি।
ফিহা আর রিয়াদ এটা শোনার পর থেকে নিজেদের কানকেও বিশ্বাস করতে পারেনি। সত্যি অনি এরকম একজন মেয়ে, যে নিজের সৌন্দর্যের আড়ালে কুৎসিত মনটা লুকিয়ে রেখেছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই অনিক নিজের কোম্পানি খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। বড় চাচার সহায়তায় ব্যবসায় হাত লাগায় সে। তখন আনিশার বয়স মাত্র দুই মাস। অনিক ব্যবসার প্রতি সম্পুর্ন মনোনিবেশ করলেও আনিশার যত্নের কোনো কমতি রাখেনি। আনিশার জন্য আলাদা নেনীও রাখেনি, যদি ওর যত্নের কোনো কমতি হয় এ ভয়ে নিজের কেবিনের একসাইডে আনিশাকে একটা দোলনায় রাখতো আর সারাদিন খেয়াল রাখতো।
তিন বছরের মধ্যে অনিকের কোম্পানি অন্যতম সনামধন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অনির খবরও শুনেছে সে। আয়াশ আহনাফ হাসান নামের একজন বিজনেস টাইকুন কে বিয়ে করেছে সে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অনিক চৌধুরী এখন তার থেকেও বড় বিজনেস টাইকুন হিসেবে পরিচিত।
-অতীত সমাপ্ত
হঠাৎ ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসায় অতীতের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো অনিক। নিজেই নিজেকে বললো,
~ তুমি কেমন আছো, তা আমি জানি না, অনি। জানতেও চাই না। কিন্তু আমি অনেক ভালো আছি। দশ বছর আগের যে #কালোঅধ্যায় ছিলে তুমি সেটা ভুলিয়ে আমার জীবনে এঞ্জেল হয়ে এসেছে, আমার আশু। যাই আমার প্রিন্সেসটাকে দেখে আসি। সারারাত তো বারান্দায় পাড় করে দিলাম।
ঘরে গিয়ে দেখে আনিশা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। আনিশার এই নিষ্পাপ মায়াবী মুখটা দেখলেই অনিকে সমস্ত কষ্ট, ক্লান্তি ও হতাশা দূর হয়ে যায়। অনিক মুচকি হেসে ওযু করে নামাজ পড়ে নিলো। এরপর আনিশার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য হাত রাখতেই কেঁপে উঠল অনিক। আনিশার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। অনিক ব্যস্ত হয়ে আনিশাকে ডাকতে লাগলো,
~ আশু, এই আশু! তোমার গাঁ এতো গরম কেন? চোখ খোল, আশু।
কিন্তু আনিশা চোখ খুলছে না। অনিক পারলে পুরো হাসপাতাল বাসায় নিয়ে আসে। অনিক কাঁদছে আর বার বার ডক্টরকে জিজ্ঞেস করছে,
~ ডক্টর, কী হয়েছে আমার আশুর? ও চোখ খুলছে না কেন? আমি আমার আশুর খেয়াল রাখতে পারলাম না। কেমন বাবা হলাম আমি?
~ মি. চৌধুরী, শান্ত হোন। আপনার মেয়ে অতিরিক্ত জ্বরের কারণে সেন্সলেস হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসবে। টেনশনের কিছু নেই। আমি এখন আসি।
~ আসবেন মানে? কোথায় যাবেন আপনি? আজ সারাদিন এখানেই থাকবেন আপনি আর এই নার্সরা। যতোক্ষণ না আশু সুস্থ হচ্ছে ততোক্ষণই আপনারা এই বাড়িতে থাকবেন।
~ কিন্তু,
~ নো মোর ওয়ার্ডস। আর আপনাদের পেমেন্টসের ব্যাপারে কোনো চিন্তা করতে হবে না। নরমালি যা পেতেন তার থেকে ট্রিপল পাবেন।
ডক্টর আর কিছু বললো না। কারন সে জানে, এখন তার কথা না শুনলে পুরো হসপিটাল বন্ধ করে দিতে দ্বিতীয় বার ভাববে না অনিক চৌধুরী।
আনিশা এখন ঘুমিয়ে আছে আর হাতের ক্যানোলা দিয়ে স্যালাইন লাগানো। পাশে বসে অনিক নিঃশব্দে চোখের জল মুছছে।
এদিকে অনি ক্লাসে ঢুকেই আনিশাকে খুজতে লাগলো। কিন্তু আনিশাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।
~ আজ কি আনিশা আসেনি?
ভাবতে ভাবতে সবাইকে জিজ্ঞেস করলো,
~ আনিশা কোথায়? ও তো ক্লাস মিস করে না! তাহলে আজ ওকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
একজন বললো,
~ ম্যাম, আনিশা আজ স্কুলে আসেনি। কেন আসেনি তা জানি না।
একথা শুনে অনির মনে ভয় লাগতে শুরু করে। হয়তো অনিক আনিশাকে আর এ স্কুলে পাঠাবে না। অনি নিজের মেয়েকে কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেললো ভাবতেই চোখ দিয়ে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।
লেখা – মাহফুজা আক্তার
চলবে
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “কালো অধ্যায় ছিলে তুমি – Bangla golpo love” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – কালো অধ্যায় ছিলে তুমি (শেষ খণ্ড) – Bangla golpo love