এলিয়েন রহস্য পর্ব ৫ – এলিয়েন মানবের গল্প: গত পর্বে দেখেছি কিভাবে শ্রাবণ ও স্নেহা তাইসনের রাজ্যে প্রবেশ করে। তাদের দুজনকে তাহির সাদরে গ্রহণ করলেও তাইসন মোটেও করে নি তা। বরং মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। আজ তবে দেখার পালা কি হয় দুজনের আর কিভাবে তাইসন এরকম এতবড় স্রামাজ্য গড়ে তুলেছে? তাইসন আসলে কে? চলুন রহস্যভেদ করি।
নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টায় শ্রাবণ
পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে তাহির কে ফেলে দিয়ে তাইসন বলে, কাল সন্ধ্যের আগ পর্যন্ত যা খাওয়ানোর শ্রাবণ আর ওর বৌকে খাইয়ে নে। কালকের রাতই হবে ওদের জীবনের শেষ রাত।
হঠাৎ শ্রাবণের চোখ খুলে যায়। কেমন একটা চাপা কষ্ট অনুভব হতে থাকে তার বুকের ভিতরে। তাইসন বুড়ো বুড়ি বলতে কাদের বুঝালো! শ্রাবণের বার বার মনে হতে থাকে, বুঝিয়েছে রহিম আলী এবং তার বউ এর কথা। ও কি তবে নিজের বাবা মা কেও খুন করলো! আর নিজের বড় ভাইয়ের সাথেই বা এরকম ব্যবহার করছে কেন!
তাইসন শ্রাবণকে মেরে ফেলার কথা বলছে এতে মোটেই ভীত হচ্ছেনা শ্রাবণ। কিন্তু তার এই উগ্র আচরণ এবং হেমন্তপুর গ্রামের পিছনে এমন একটা সম্রাজ্য গড়ে তোলার পিছনের রহস্যটা শ্রাবণের মাথায় নাড়া দিচ্ছে বার বার।
সকাল সকাল কিছু লোকজন শ্রাবণ ও স্নেহার জন্য নাস্তা নিয়ে আসে।
স্নেহা তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শ্রাবণ ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে হেমন্তপুরের গ্রামটা ঘুরে দেখার জন্য বের হয়। বাইরে পা রেখেই অনেকটা অবাক হয় তাকে। রাতে চারপাশে যেরকম মানুষের আনাগোনা ছিল, এখন তেমন টা নেই। চারদিকটা কেমন একদমই নির্জন। তবে চারপাশে সুশোভিত সব কিছু। রাস্তার পাশে সারি সারি ফুলগাছ। পাখ পাখালির কিচিরমিচির শব্দ। ফলগাছগুলো থেকে পাকা ফল খেয়ে যাচ্ছে কিছু সবুজ তোতা পাখি। স্নিগ্ধতা ও নির্জনতা মিলিয়ে যেন একটা মানবহীন মায়াপুড়ি।
আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে শ্বেত মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো দিঘীর ঘাটে যায় শ্রাবণ। দিঘীর পানি টলমলে স্বচ্ছ। মাঝখানে ফুটে আছে কিছু দুর্লভ নীল পদ্ম। মাছেদের দলের ছুটোছুটি স্পষ্ট দেখা যায়। মার্বেল পাথরের ঘাট টার একপাশে একটি টেবিল দেয়া। দুপাশে দুটি চেয়ার। টেবিলের উপর সজ্জিত একটা দাবা কোর্ট। অদ্ভুত ভাবে দাবাকোর্টটির দুপাশেই কালো গুটি সাজানো।
ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে দিঘীর হাঁটুজলে নেমে যায় শ্রাবণ। স্বচ্চ পানির দিকে তাকাতেই ভেসে আসে নিজের চেহারা।
আর তখনই একটা প্রশ্ন দোল খেয়ে যায় শ্রাবণের মনে.. আমি কে? আমার পরিচয় কি? প্রশ্নগুলোর উত্তর অজানা এটা মনে হতেই আর নিজের চেহারাকে আর দেখতে ইচ্ছে করে না তার। হাত দিয়ে ঢেউ তুলে দিঘীর জলের উপরে সৃষ্টি হওয়া নিজের প্রতিবিম্ব আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। এ আঁকাবাঁকা চেহারাটা যেন আরো বিভৎস। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় শ্রাবণ। বুকের ডান পাশটা হালকা জ্বালাপোড়া করছে তার। জামা সরিয়ে সেখানটা উন্মুক্ত করে জীবনে তৃতীয় বাড়ের মত প্রচন্ড অবাক হয় সে। বুকের চামড়া ভেদ করে ফুটে উঠেছে একটি মাঝারি কালো সার্কেল। সার্কেলের ভিতরে অনেকটা মানুষের এবং বাঘের মাথার খুলির সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি চিহ্ন। চোখের সামনে কেমন যেন ঘোর লাগে তার। মার্বেল পাথরের বাঁধানো ঘাটের হাঁটুজলে দাঁড়িয়েই ভাবতে থাকে সেই প্রলয়ঙ্করী ঘটনার কথা।
শ্রাবণকে যুদ্ধের ইঙ্গিত
কালো পোশাক পরিহিত বিকট আকৃতির শ্রাবণ হাতে কালো রঙের ধারালো অস্ত্র নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে আসছিল আহত, ক্ষত-বিক্ষত শ্রাবণের দিকে। আকাশের পানে তাকায় শ্রাবণ। আকাশে দুটো সূর্য। একটা সাদা, একটা কালো। সে বুঝতে পারে এটা একটা মহাযুদ্ধ। ইটস এ ওয়ার অফ লাইট এন্ড ডার্কনেস। সে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। একটু সামনেই পরে থাকা সাতজনের লাশের পাশ থেকে তাদের ই একটা তরবারি কোনমতে হাতে তুলে নেয়।
ইতিমধ্যে কালো পোশাকের শ্রাবণ তার সামনে এসে পরেছে। সাদা সূর্যের আলো কালো সূর্যের অন্ধকারে ক্রমশ বিলীন হয়ে আসছে। নিজের চেহারার ভয়ানক কুৎসিত লোকটি তার অস্ত্র উঠিয়ে শ্রাবণের উপর হামলা করে। শ্রাবণ কোন রকম তরবারি দিয়ে সেই আঘাত প্রতিহত করলেও ছিটকে দূরে সরে যায়। গা থেকে নতুন করে রক্ত ঝরা শুরু হয়।
শ্রাবণ মনে মনে ভাবতে থাকে, ছোট থেকে এ পর্যন্ত সে কোন প্রকারের জঘন্য পাপ কাজ করে নি। কিন্তু তবুও তার ভিতরের ডার্কনেস বা খারাপ দিক এতটাই শক্তিশালী কিভাবে হয়!
শ্রাবণ নিজেকে সাহস দেয়। সে হয়ত শুধু শুধুই ডার্কনেস কে খুব শক্তিশালী ভাবছে , কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার ডার্কনেস অতটাও শক্তিশালী নয়।
তাহলে শ্রাবণকে মেরে এরকম আহত করলো কে!
হিসেবটা মিলিয়ে নেয় সে নিজেই। ৬ তলা থেকে লাফ দিয়ে আহত হওয়ার কারণেই হয়ত নিজেকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে শ্রাবণ। কিন্তু এই ক্ষতবিক্ষত দেহটাও তার খারাপ দিকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। মনে মনে কথাগুলো ভেবে অনেকটাই আত্মবিশ্বাস পায় শ্রাবণ।
আপনা আপনি-ই শ্রাবণের গলা চিড়ে বের হয়ে আসে ভয়ানক এক গগন কাঁপানো হুংকার। যে হুংকারে পুরো যুদ্ধক্ষেত্রটাই যেন কেঁপে উঠে। তার সাদা পোশাক ছিন্নভিন্ন হয়ে, চেহারা এবং শরীরেরঅনেক অংশ উন্মুক্ত হয়ে যায়।
ডার্কনেসের জগতে শ্রাবণ
সাদা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে শ্রাবণের চুল এবং চোখ দিয়ে। হাত থেকে তরবারি ফেলে সে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় কালো পোশাক পরিহিত শ্রাবণের দিকে। কাছাকাছি এসে শ্রাবণ হাত বাড়িয়ে দু আংগুলের ইশারায় তার ডার্কনেস কে আহবান করে। চোখে আগুনের বিজলী নিয়ে তার ডার্কনেসও গর্জন করতে করতে শ্রাবণের দিকে ছুটে আসে। কাছাকাছি এসেই এক লাফে শ্রাবণের বুকের মাঝে বিঁধিয়ে দেয় তার ভয়ানক অস্ত্রটি। কালো পোশাকের শ্রাবণের চোখে তখন প্রশান্তির হাসি। এই বোধ হয় শ্রাবণ লুটিয়ে পরবে মাটিতে। কিন্তু না, তা আর হলো না। বরং তার অস্ত্রটিই আস্তে আস্তে গলতে শুরু করলো।
এক পর্যায়ে শ্রাবণের শরীরের উজ্জ্বল আলো তার ডার্কনেসের গায়ে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে। ও এখন পালিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে। হাত ধরে ফেলেছে শ্রাবণ। আস্তে আস্তে কালো পোশাকের শ্রাবণের বিভৎস দেহটা গলতে শুরু করে। ভয়ানক আর্তনাদে শ্রাবণের কাছে জীবন ভিক্ষা চায় সে। কিন্তু শ্রাবণ তার সিদ্ধান্তে অটল। সে তার ডার্কনেস কে কিছুতেই বাঁচতে দেবে না। একটু একটু করে কালো পোশাকের শ্রাবণ পুরোটাই গলে যায়। একদম বাতাসে মিলিয়ে যায়।
শেষ, সব কিছু শেষ। সব যুদ্ধ শেষ। আকাশ থেকে কালো এবং সাদা সূর্য ধীরে ধীরে অস্তমিত হয়। সেখানে উদিত হয় টকটলে লাল একটি নতুন সূর্য। সূর্য পরিবর্তনের সাথে সাথে যেন চারপাশের পরিবেশটাও বদলে যায় চোখের সামিনেই। শ্রাবণের চারদিকে মৃত মানু্ষের হাড়গোড় দেখা যাচ্ছে। অদূরেই দেখা যাচ্ছে ডালপালাযুক্ত পাতাহীন কালো গাছ।
একটি গাছের ডালে দড়িতে ঝুলে আছে একজন মেয়ে মানুষের লাশ। দূর থেকে ঝুলে থাকা লাশটার দেহের অবয়বটা ই বোঝা যাচ্ছে শুধু। বাতাসে দোল খাচ্ছে ঝুলন্ত লাশটির লম্বা চুল।বাকি গাছগুলোও যেন শ্রাবণের দিকে ভৌতিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হা হা হা হা করে অনেকগুলো কন্ঠে গায়েবি হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে দূর কোথাও থেকে। সাথে আরো শোনা যাচ্ছে অনেকগুলো কন্ঠ গম্ভীর গলায় ক্রমাগত অদ্ভুত শব্দে জিকির করে চলেছে। শ্রাবণের কাছে মনে হচ্ছে এটা যেন একটা ডেভিল’স ওয়ার্ল্ড।
সামনের দিকে একটা সরু রাস্তা চলে গিয়েছে। শ্রাবণ অজানা জগতের সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়।কিছুক্ষণ আগানোর পরে দেখতে পায় তার রাস্তার সামনে একটা মানুষের মাথার খুলি উল্টে বাটির মত রাখা হয়েছে। আর তার ভিতরেই রাখা আছে সবুজ রঙ এর পানীয়। শ্রাবণ নিচু হয়ে খুলিটি হাতে নেয়। সবুজ রঙ এর পানীয়টি পায়েসের মত ঘন। আচমকা ই প্রচন্ড পিপাসা পায় শ্রাবণের। খুলিটি মুখের কাছে নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু তরল খেয়ে ফেলে সে। তার অনেক্ষণের পিপাসা মিটে যায়।
অদ্ভুত অবয়বে শ্রাবণ
তখন অনেকটা স্বস্তি বোধ করলেও কিছুক্ষণ পর ই তার বুকের ডান পাশের চামড়ার উপরে অসহ্য রকমের জ্বালাপোড়া করতে থাকে। সাদা পোশাকের কিছু অংশ সরিয়ে বুকের উপরের জায়গাটা উন্মুক্ত করে শ্রাবণ।
মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোন বস্তু চামড়ার নিচ থেকে কেটে কেটে তার বুকের উপর কোন একটা সাইন এঁকে দিচ্ছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ভের হচ্ছে ক্রমাগত। কিন্তু এ রক্তের রঙ লাল নয়। সবুজ। শ্রাবণের যন্ত্রনা হচ্ছিল খুব। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান যখন ফেরে তখন সে নিজ বাসার বিছানায় শুয়ে ছিল। বাড়ি থেকে শ্রাবণের মা ফোন দিয়ে যাচ্ছিলেন বার বার। মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ। মোবাইলে তারিখ দেখে শ্রাবণ বুঝতে পেরেছিল প্রায় দু দিন কাটিয়ে ফেলেছে সে। টেবিলের উপরে রাখা বিদায়ী চিরকুট তখনো কফির মগের নিচে চাপা দেয়া।
মাথায় হাত দিতেই ছোট খাট একটা শক খেয়েছিল সে। একটা চুল ও নেই মাথায়। দৌড়ে আয়নার সামনে যেতেই দেখতে পায় মাথার কয়েকটা অংশে জোড়াতালি দিয়ে সেলাই করার মত। এ নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবার ইচ্ছে শ্রাবণের ছিল না। কারণ, শ্রাবণ জানে ভাবলেও হয়ত কোন লাভ হত না।
কিন্তু সেদিনের সেই সাইনটার সাথে, আজ বুকের উপর স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠা সাইন টার হুবুহু মিল, এবং তাইসন ও তাহিরের কথোপকথন চোখ বুজেই দেখতে পাওয়াটা শ্রাবণকে নতুন করে ভাবাতে বাধ্য করছে।
দিঘীর ঘাটে হাঁটুজলে নেমে আধাঘণ্টার উপর পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ, দৃশ্যটা তাইসন তার নিজ মহলের বারান্দা থেকে দেখতে পায়। মেজাজ খারাপ হয়ে আসে তাইসনের। তাইসনের রাজ্যে কেউ একবার ভুল করেও ঢুকে পরলে তাকে সারাজীবন তাইসনের গোলামি করে কাটাতে হয়। যে একবার তাইসনের এই সুন্দর প্রাসাদের সৌন্দর্য চোখ দিয়ে উপভোগ করেছে সে বাইরে গিয়ে যে কাউকে কিছু বলবে সেটার সুযোগ দেয় না তাইসন। হয়ত গোলামি নয়ত মৃত্যু স্বাদ গ্রহণ করতে হয় আগন্তুক কে। শ্রাবণের ও শেষ পরিণতি সেটাই হবে। তবে ঘুমন্ত স্নেহাকে দেখে তাইসনের খুব লোভ জেগেছে। মেয়েটা একটু অন্যরকম।
দেখতে দেখতে ঘন্টা পার হয়ে যায়। শ্রাবণ তবুও হাঁটুজল পানিতে স্টাচুর মত দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা তাইসন কে শান্তি দিচ্ছে না। সে তাহির কে পাঠায়, ওখানে আসলে কি ঘটলো তা দেখার জন্য। তাহির শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হতেই তাইসন গিয়ে স্নেহার রুমে প্রবেশ করে। স্নেহা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলো তখনো।
তাহির ও শ্রাবণ
এদিকে তাহির হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় শ্রাবণের কাছে। পেছন থেকে অনেক ডাকাডাকির পর ও শ্রাবণের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে তাহির শ্রাবণের কাছে গিয়ে তার শরীরে হালকা ধাক্কা দেয়। এতেই শ্রাবণের ঘোর কাটেম তাহিরের কাছ থেকে খুব গোপনীয়ভাবে বুকের চিহ্নটা আড়াল করে ফেলে শ্রাবণ।
তাহিরের হাত ধরে উপরে উঠে আসে সে।
তাহির আবারও শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে।
শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
শ্রাবণঃ কি ব্যাপার আপনি কাঁদছেন কেন?
তাহিরঃ তোমরা কেন এদিকে আসতে গেলে শ্রাবণ? তুমি জানো? যে একবার এই রাজ্যে প্রবেশ করে তারা কেউ বাইরে যেতে পারে না। এজন্যই এই জায়গাটা খুব গোপনীয়।
শ্রাবণঃ এখানে যে লোকজনরা কাজ করে, তারা কোথায়?
তাহিরঃ কাল আসার পথে যে তাবু দেখেছ, ওখানে ওরা বিশ্রাম নেয়। রাতে কাজ করে। শ্রাবণ ভাই আমার আমি তোমাকে প্রধান দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। তুমি এখান থেকে পালাও।
শ্রাবণঃ পালানোর জন্য আমি এখানে আসি নি।
তাহিরঃ তাহলে কি জন্য এসেছ?
শ্রাবণঃ আমার পরিচয় জানতে। আমি যখন আপনাদের কাছে এসেছিলাম প্রথম আপনারা যা বুঝিয়ে দিয়েছেন আমি তাই বুঝেছি। এবার ঠিক ভাবে বলুন, আমার পরিচয় কি! আমি কে! আমার মা কে! বাবা কে!
তাহিরঃ এটা আমি আজ তোমাকে বলতাম। ভালো হয়েছে, তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করেছ।
শ্রাবণঃ বেশ বলুন তবে।
তাহিরঃ এখন না। আজ রাতে বলবো। এখন বললে সমস্যা হবে।
দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে তাইসনের মহলে ফিরে।
রহস্যভেদের আগ্রহে শ্রাবণ
শ্রাবণ রুমে প্রবেশ করার সময় তাইসন কে স্নেহার রুম থেকে বের হয়ে যেতে দেখে। স্নেহার ঘুম ইতিমধ্যে ভেংগে গিয়েছে। খাওয়াদাওয়া পর্ব ও শেষ ওর। শ্রাবণকে দেখে স্নেহা একটু খুশি হয়। পুরো জার্নিটা কেমন অদ্ভুত ছিল, সেটা সম্পর্কে শ্রাবণের সাথে আলোচনা শুরু করে। শ্রাবণ শুধু হুঁ, হা বলে স্নেহার কথার জবাব দিচ্ছিল। তাহির স্নেহা এবং শ্রাবণকে নিয়ে চারপাশের পরিবেশ টা ঘুরে দেখে।
কোনরকম জটিলতা ছাড়াই সেদিন টা ভাল ভাবেই কেটে যায়। বিকেলে তাইসনের বানানো আঙ্গিনা অপরূপ সৌন্দর্য লাভ করে। শ্রাবণের মন মেজাজ ও বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়।
স্নেহা বায়না করে শ্রাবণের কাছে, তাকে নীল পদ্ম এনে দিতে। শ্রাবণ উত্তরে জানায়, কোন একদিন হয়ত এনে দেয়া যাবে।
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে তাহির স্নেহা এবং শ্রাবণ গল্প করে বেশ অনেক্ষণ। তাইসনের দেখা পাওয়া যায় না।
স্নেহা কয়েকবার ওর কথা জিজ্ঞেস করলে তাহির কৌশলে এড়িয়ে যায়।
খুব তাড়াতাড়ি তাহির সেদিন স্নেহা ও শ্রাবণ কে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
শ্রাবণের চোখে ঘুম নেই। স্নেহা ঘুমিয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। মেয়েটা অনেক বেঘোরে ঘুমায়।
প্রচন্ড ঘুমের ভিতরে ঘোড়ার খুড়ের টগবগ আওয়াজ শুনতে পায় স্নেহা। হঠাৎ করেই তার ঘুম ভেংগে যায়। ঘুম ভাংগার পরে দেখে শ্রাবণ স্নেহার পাশে নেই। স্নেহার ভিতিরটা ধক করে উঠে। বাইরে প্রচন্ড জোরে ঘোড়ার ডাকের চিঁহিঁহিঁ আওয়াজ ও ঘোড়ার খুরের শব্দ। স্নেহা ভয় পায় প্রচন্ড। তবে এই ঘোড়াটি আসলেই সেই ধোঁয়ার সৃষ্ট ঘোঁড়া কিনা তা দেখার ভীষন ইচ্ছে জাগে স্নেহার। লুকিয়ে লুকিয়ে সে তার রুম থেকে বের হয়। উদ্দেশ্য, ছাদে উঠে ঘোড়াটিকে দেখা।
স্নেহা খুব দ্রুত পা ফেলে ছাদে চলে যায়। রাতে চাঁদের আলো চারিদিকে সু উচ্চ বিল্ডিং থেকে চারদিকটা খুব ভাল দেখা যায়। স্নেহা ছাদে গিয়ে শব্দ অনুসরণ করে তাকাতেই দেখতে পায় ঠিক সে স্বপ্নে সেদিন যেরকম দেখেছিল সেরকম একটি ঘোড়া চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। তবে এ ঘোড়াটি উচ্চতায় অনেক বড়।প্রায় একটি হাতির সমান। সামনের দিকটা ঘোড়ার অবয়ব থাকলেও পেছনের দিকটা শুধুই কালো ধোঁয়া। দৌঁড়ে দৌঁড়ে অনেক দূরে কোথাও একটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
শ্রাবণ ও তাইসনের আসল পরিচয়
হঠাৎ একটা শীতল হাত স্নেহার কাঁধ স্পর্শ করে। সাথে সাথে স্নেহা ভয়ে চিৎকার দিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়।
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তাহির। তাহিরের পেছনে কেউ একজন। অন্ধকারের কারণে তার চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না ঠিক ভাবে।
স্নেহা কাঁপতে কাঁপতে ছাদে বসে পরে। তাহির মাথা নিচে ঝুঁকিয়ে প্রশ্ন করে, তুমি ও শ্রাবণ কি এখানে এসেছ ওর পরিচয় সম্পর্কে জানতে?
স্নেহা মাথা নাড়িয়ে জানায়- হ্যাঁ।
তাহির বলে, বেশ শোন তবে।
তাহিরঃ আমার বয়স তখন ১২। রাস্তার পাশে আমার বাবা এক অদ্ভুত মেয়েকে পরে থাকতে দেখে তাকে বাসায় নিয়ে আসে। ঐ মেয়েটিকে রেপ করেছিল আমাদের এই অঞ্চলের তিনজন ছেলে। দুজন অদ্ভুত রোগে ভুগে সুইসাইউ করে। একজন কে পাওয়া যায় নি। সেই মেয়েটি আমাদের বাসায় থাকা শুরু করে। এক পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারি সে আমাদের মত স্বাভাবিক মানুষ নয়। অস্বাভাবিক কেউ।
তবুও আমাদের অভাবের সংসারে তাকে আমরা রেখে দেই। কথাটা গোপন থাকে চারদিকে। ঠিক ছয় মাস পরে অলৌকিক মেয়েটা ধোঁয়ায় মিলিয়ে যায়। আর জন্ম দিয়ে রেখে যায় একটি শিশু সন্তান। সেই সন্তানটি ছিল আরো অদ্ভুত। তার এক বছর পরে আমার মায়ের কোলে আসে আরো একটা ফুটফুটে শিশু। তিনজন শিশুর খরচ চালানোটা আমাদের জন্য ছিল অসম্ভব। এজন্য আমরা ঠিক করি একজন ছেলেকে আমরা ভাল কোথাও পালতে দিব। আমার বাবা মা কখনো সেই অদ্ভুত ছেলেটাকে অন্যদের ছেলে মনে করেনি। সব সময় তার ভালর কথা চিন্তা করেছে। আর এজন্য ই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সদ্য জন্ম গ্রহণ করা বাচ্চাটি যখন মায়ের দুধ ছেড়ে বাইরের খাবার খাওয়া শুরু করবে তখন তাকে অন্যত্র পালার জন্য দেয়া হবে। কারণ অলৌকিক শিশুটাকে অন্য কোথাও পালতে দিলে তার বিভিন্ন অস্বাভাবিক কাজ কর্ম দেখে মানুষ ভয় পাবে এবং তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে। শ্রাবণ, আমার আপন ছোট ভাই। তার বাবার নাম রহিম আলী, মায়ের নাম জাহানারা খাতুন। বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেলে তাহির।
আবছা অন্ধকার থেকে এবার বেড়িয়ে আসে শ্রাবণ।
তাহিরকে জিজ্ঞেস করে,
আগে একথা বলেন নি কেন?
তাহির উত্তর দেয়-
তাইসন। ও আমাকে বলতে দেয় নি। ও বড় হওয়ার সাথে সাথে আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে। ওর ভিতর একটি অতিপ্রাকৃত শক্তি আছে। তা হলো ও রাত হলে সম্পূর্ণ ধোঁয়ায় পরিণত হতে পারে। ওর পছন্দের প্রাণী ঘোড়া। তাই ও ঘোড়ার রূপ ধরে রাতে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে ওর অপছন্দ হলে বাতাসের সাথে তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং তাকে নিজ আয়ত্তে নিয়ে আসে। এ শক্তি ব্যবহার করেই ও এ গ্রামের হাজার হাজার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। অনেক লোককে ওর গোলাম বানিয়ে রেখেছে। এই এড়িয়ায় যারা প্রবেশ করে তারা কেউ আর বেঁচে ফিরতে পারে না।
আমার বাবা মা, যারা ওকে বড় করেছে তারা ওর অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় অনেক আগেই তাদের উধাও করে দিয়েছে। কোথায় আছে, কেমন আছে আমি জানি না। ও আজ রাতে বের হয়েছে ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে নিয়ে আসতে। লুটের টাকা দিয়েই ও এত বড় আলিসান বাড়ি গড়ে তুলেছে। ওর আসতে বেশ দেরী হবে। এই সুযোগে তোমরা পালিয়ে যাও। নইলে ফিরে আসার পর তোমাদেরও গোলামে পরিণত করবে।
শ্রাবণ জবাব দেয়, আমরা পালিয়ে গেলে তোমাকে ও জীবিত রাখবে তো! আমাদের আটকে রাখার দায়িত্ব তো তোমার উপরে।
তাহিরঃ আমি তোর ভালবাসার মাঝে বেঁচে থাকব মরে গেলেও ছোট ভাই।
শ্রাবণঃ আমি কোথাও যাচ্ছিনা। এখানে থেকেই মোকাবেলা হবে।
আই কিলড মাই ওউন ডার্কনেস, এবার তাইসনের পালা।
কথাটা বলার সাথে সাথেই শ্রাবণের জামা ভেদ করে বুকের উপরে সবুজ রঙে প্রজ্জলিত হয় সেই বৃত্তাকার সাইন।
তাহির এবং স্নেহা দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। শ্রাবণের মুখে সেই বাঁকা হাসি..
পরের পর্ব- এলিয়েন রহস্য পর্ব ৬ – এলিয়েন মানবের গল্প