চোখের জলের ঋণ – শিক্ষনীয় ছোট গল্প: কী অদ্ভুত কান্ড, হসপিটালের নার্সগুলোও যে কী জোকার, জন্ম মৃত্যু নিয়েও কী কেউ এমন মজা করে!
মূলগল্প
কাপড় ইস্ত্রি করতে গিয়ে আয়েশা আমার শার্টটা পুড়ে ফেলেছে। কী বিচ্ছিরি কান্ড! সকাল আটটায় অফিস। অন্য কোন জামাও ধোয়া নেই যে নতুন করে ইস্ত্রি করে পড়বো। নাস্তা খেতে বসেছিলাম আমি, তখন এসে দুঃসংবাদটা জানায় আয়েশা। টেবিলের এক কোনায় খানিক সময় দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে করে বলে, এই–।
কাঁধ ফিরিয়ে তাকাই আমি, চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আয়েশা কাঁচুমাচু করে বললো, শার্টটা না খানিক ঝলসে গেছে!
বলে নিচ দিকে মাথা নামিয়ে তাকিয়ে থাকে আয়েশা। আমার ভীষণ রাগ ছড়ে যায় কথাটা শুনে। শার্টটা ঝলসে গেছে! প্লেটটা দূরে সরিয়ে হাত না ধুয়েই ঘরের ভেতর ঢুকলাম।
তারপর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখলাম কোথাও ঝলসে যাওয়া জায়গা নেই। কী অদ্ভুত কান্ড! আয়েশা মিথ্যা বললো কেন আমায়? যখন মিথ্যা বললো কেন আমায় এমন ভাবলাম তখন দেখি মিথ্যে নয়, সত্যি বলেছে। পকেটের নিচে বোতামের একেবারে কাছাকাছি জায়গায় পুড়েছে। একটু নয়, অনেকটাই। এক আঙ্গুল ঢুকে যাবে পুড়ে যাওয়া স্হানে। আমি সত্যি সত্যিই পরীক্ষা করে দেখলাম, আঙ্গুল ঢুকে যায়।
তারপর সকালের শান্ত মেজাজটা আর শান্ত থাকে না, ভীষণ রকম গরম হয়ে উঠে। এই শীতের সকালেও শরীর ঘেমে যেতে থাকে আমার, চোয়ালের রগগুলো বনপাতার মতো কেঁপে উঠে হঠাৎ।
আয়েশা এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল আমার পেছনে, যেভাবে সামান্য ভুল করার পর সব স্ত্রীরাই শঙ্কা মনে দাঁড়ায়, ঠিক সেভাবেই। আমি পেছন দিকে কাঁধ ফিরিয়ে তাকালাম, তারপর সব রাগী আর বদমেজাজি স্বামীদের মতো হাত তুলে একটা চড় বসিয়ে দিলাম আয়েশার গালে। চড়টা খুব আস্তে ছিল না তাই আমার স্ত্রী আঘাত প্রাপ্ত জায়গায় হাত ধরে বসে গেল। তারপর কাঁদলো, নিঃশ্বব্দে।
তার চোখ থেকে টপটপ করে পানির ফোয়ারা ঝরে পড়লো। আমি ঝরে পড়তে থাকা পানির ফোঁটাগুলো গুণলাম।
এক, দুই, তিন করে–
অফিস না থাকলে অথবা অফিসে না গেলে সব পুরুষই ঘুমের গাধা হয়। দিনরাত বিছানায় পড়ে পড়ে কাঁথা-লেফ মুড়ি দিয়ে ঘুমায়। আমারও ঘুমানোর কথা ছিল কিন্তু মেজাজটা এতোটাই খারাপ ছিল যা আমায় ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করে। ঘর থেকে বের হয়ে আমি এখানে ওখানে এলোমেলো হেঁটেছি।
চায়ের স্টলে বসে চা খেয়েছি। সিগারেট ধরিয়েছি। সিগারেটের জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকিয়ে ভেবেছি, কীভাবে আমার ভেতরটা ছাই করে দিচ্ছে আয়েশা। আমি খুব করে চেয়েছিলাম মেচ্যুয়ুর একটা মেয়ে বিয়ে করবো, যে মেয়েটা হবে অনেক স্মার্ট, সবকিছু বুঝবে, ছটফট কাজ করবে আর আমার সাথে ঘুরতেও বের হবে। কিন্তু কী দূর্ভাগ্য আমার, মা আমার জন্য গাঁয়ের ঠান্ডা, সৌম্য – শান্ত আর ধার্মিক মেয়ে এনেছে ঘরের বউ করে।
মার ধারণা গাঁয়ের মেয়েরা হয় স্বামী ভক্ত। আর আমি ছিলাম মা ভক্ত। মায়ের প্রতি এই অগাধ ভক্তি দেখাতে গিয়ে এখন আমার কপাল পুঁড়লো। বন্ধুরা যখন তার স্ত্রীর প্রশংসা করতে করতে ফেনিয়ে তুলে তাদের মুখ তখন আমি লজ্জিত হই। ভীষণ রকম লজ্জায় কুঁকড়ে উঠতে থাকি।
এমন এক মেয়ে আমার স্ত্রী, যার সার্টিফিকেট খুব বেশিই ছোট, আর কথা বলায়ও এতো অদক্ষ যে আমার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় ওর সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেই।
আমার আফশোস হতে থাকে বন্ধুদের জীবনের প্রতি তাকিয়ে। বড় ইচ্ছে করে জীবনটা নতুন করে একবার শুরু করতে, যে জীবনে থাকবে বড় সার্টিফিকেটের অতি সুন্দরী মেয়ে, যে কিনা কথায় কথায় ইংরেজি বলবে, ছুটির দিনে আমার সাথে রাস্তায় হাত ধরে হাঁটবে, আর আমায় দেখে যুবকেরা নিজের প্রতি দুঃখ করে বলবে, কী জীবন তার, কী জীবন তার!
রাতে বাড়ি ফিরে মাথায় বারান্দায় ঝুলে থাকা উইন্ড চাইম নাড়িয়ে দিয়ে দরজায় টোকা দেই। ঠক ঠক ঠক।
দরজাটা খুলতে দেরি হয়। একবার দুবার তারপর তিনবার টোকা দিয়েও যখন সাড়া পাইনা ভেতর থেকে তখন ইচ্ছে হয় শক্ত কাঠের দরজাটা ভেঙে দিতে।
আমি জানি আমার পায়ের লাথিতে দরজার ক্ষতি না হয়ে আমার পায়েরই হবে। তবুও দেই, প্রচন্ড জোরে। কেউ আসেনা তবুও দরজাটা খুলতে। আমি চেঁচিয়ে ডাকি, আয়েশা, এই আয়েশা, মরে টরে গেছিস নাকিরে!
শালার জীবন আমার, আজ খোল শুধু দরজাটা তারপর তোকে বুঝাবো স্বামীর হুকুমের অবহেলা করার শাস্তি কী! মনে মনে ভাবি। ভেবে আরেকবার কলিং বেল চাপি।
ঠিক তখন ভেতর থেকে দরজাটা খুলে দেয় আয়েশা। আয়েশার মাথায় ওঠানো হিজাব। হিজাবের আড়ালে খানিক ঢেকে আছে তার রক্ত শূন্য ভয়ার্ত মুখটা। আমার তো জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল, কোথায় ছিলে এতোক্ষণ তুমি, কী করছিলে, এতো দেরি করলে কেন দরজাটা খুলতে?
এসবের কিছুই বলার সময় ছিল না আমার কারণ রাগে উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিল আমার মাথা আর পা হয়ে গিয়েছিল আমার অবাধ্য। তারপর দরজার উপর যে শক্তি প্রয়োগে লাথিটা ছুড়েছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োগ করে লাথিটা দিলাম তার পেটে।
আমার স্ত্রী আয়েশা, নিজেকে সামলাতে না পেরে পাঁচহাত দূরে বিছিয়ে রাখা জায়নামাজের উপর গিয়ে ছিটকে পড়লো বলের মতো। আমি তাকিয়ে দেখলাম একটা বলেরও চোখ আছে, মানুষের পায়ের আঘাতে তার চোখ থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরে।
সব পুরুষেরাই এক সময় অমানুষ থাকে আর তাদের মানুষ করে নারী। নারীরা যে নিজেকে দূর্বল ভাবে এটা তাদের ভুল। আমি জানি, নারীরা পুরুষের চেয়ে কুটি কুটি গুণ বেশি শক্তিশালী। আমার স্ত্রী আয়েশাও এর ব্যতিক্রম নয়। আয়েশা ছিল প্রেগন্যান্ট, তার পেটের ভেতর ছিল আমার কলিজা, আমার সারাটা জীবনের সকল ভালোবাসার উৎস-আমার সন্তান।
আমি তো তখন বুঝতে পারিনি একটা লাথি যা শুধু আমার স্ত্রীর পেটেই পড়বে না তা আমার সন্তানের পেটেও পড়বে। আমার সন্তানের খুব খুব ক্ষতি হয়ে যাবে, মরেও যেতে পারে পেটের ভেতর। আয়েশার পেটের ভেতরে থাকা আমার বাবুর তখন সাত মাস বিশ দিন বয়স।
লাথি খেয়ে বাচ্চাটা তখন তার পেটের ভেতর বোধহয় কেঁদে ফেলেছিল, চোখ থেকে টপটপ করে পানি ফেলেছিল তার মায়ের মতন। একটা অপরাধবোধ কাকের মতো এসে জেঁকে বসেছে এখন আমার মস্তকে। আর ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে আমার মগজ, যার সাথে গভীর সম্পর্কিত হতভাগা বিবেক। আমি এখন সবকিছু বুঝতে পারছি স্পষ্ট, কেন তার শুধু দেরি হয়ে যেতো আমার ডাকে, কেন পুড়ে গিয়েছিল আমার শার্ট!
যে জায়নামাজে খানিক আগে আয়েশার মস্তক অবনত হয়েছিল তার রবের প্রেমে সে জায়নামাজ আমি অপবিত্র রক্তে কীভাবে রঞ্জিত করতে পারলাম! আমার যেহেতু এমন অনুশোচনা এসে গেছে তবে বোধহয় আমি মানুষ হতে পারবো। কিন্তু মানুষ হওয়ার জন্যে অনেক পরিশ্রম আছে, কঠোর সাধনা আছে, তা কী পালন করতে পারবো আমি?
শীতের রাতে পাতলা একটা জামা পরে হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে কতটুকু কষ্ট হয় আপনি জানেন? যারা অমানুষ তারা এখনও জানেন না। আমি জানতে পারছি। এখন আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। শীতের জন্য নয়, ভয়ে আর অপরাধ বোধে। আমি জানি না ভেতরে এখন কী হচ্ছে।
আমার স্ত্রী আয়েশার কতটুকু কষ্ট হচ্ছে। আর তার পেটের ভেতর থাকা আমার সন্তান কী ভাবছে আমায় নিয়ে।
আমার ধারণা হচ্ছে সে পৃথিবীতে এসেই প্রথম কাঁদবে আমায় ভেবে, ভাববে যে এমন নিঠুর আর অত্যাচারী পিতার ঘরে কেন পাঠালেন তাকে খোদা?
আমি কী করে আমার সন্তানকে কোলে তুলে নিবো, যদি সে রাগে এবং দুঃখে আমার দিকে চোখ তুলে আর না তাকায়!
তারপর শরীরের কাঁপুনি টা আরো বাড়লো আর দেখলাম হসপিটালের প্রত্যেকটি কামড়ায় ঝুলে থাকা সাদা পর্দা গুলোও ভীষণ রকম কাঁপছে। যেন নিঃস্প্রাণ কাপড়েরাও বুঝে গেছে কত বড় পাপ আমার, কত বেশি শাস্তি পাবো আমি!
হঠাৎ ভীষণ কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। ইচ্ছে করে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। কত কতদিন ধরে কাঁদিনা আমি, এখন ঠিক কান্নাও ভুলে গেছি। তাছাড়া এখানে গলা ছেড়ে কাঁদলে মানুষ ভাববে কী!
অত্যন্ত নিঃশ্বব্দে কাঁদলাম আমি। টপ টপ করে ঝরে পড়লো আমার চোখ থেকে পানি। আমি গুণলাম চোখের ঝরে পরা প্রত্যেকটি ফোঁটা,
এক দুই তিন—
তারপর সময় এলো হৃৎপিণ্ড কাঁপার। আমার হৃৎপিণ্ড প্রচন্ড রকম কাঁপছে। কী সংবাদ আসে আমি জানি না! এদিকে ওদিকে উঁকি ঝুঁকি বেয়ে দেখতে থাকি কাঁচের দরজা ঠেলে সাদা পর্দা সরিয়ে কেউ বের হয় কিনা। অবশেষে কেউ একজন বের হলো, তার মুখ একেবারে শুকনো, মলিন। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম এবং মৃত্যুযন্ত্রণায় ভোগা রোগীর মতো শেষ প্রশ্ন করলাম, আমার কী সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে?
কী অদ্ভুত কান্ড, হসপিটালের নার্সগুলোও যে কী জোকার, জন্ম মৃত্যু নিয়েও কী কেউ এমন মজা করে!
আমি বসে আছি আয়েশার সামনে। আয়েশার সেন্স এখনও ফিরেনি। তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে হসপিটালের লোহার তৈরি বেডে। বেডের উপর তুলোর শক্ত বিছানা।
বিছানায় বসে আমার খুব কষ্ট লাগলো। আমার মন বললো, এরচেয়ে ভালো তুলতুলে একটা বিছানার প্রয়োজন ছিল আয়েশার। তারপর আবার প্রচন্ড রকমের ভয় ঢুকলো মনে। আমি জানি এখন আয়েশার সেন্স ফিরবে আর সে চোখ মেলে তাকাবে, তারপর তার সামনে আমাদের নবাগত মেহমানকে আনা হবে।
একসাথে বাবা মা দুজন দেখবো। কিন্তু আমার ভীষণ রকম লজ্জা পেয়ে বসছে এখন, ভয়ও করছে, যদি আয়েশা আমায় ক্ষমা না করতে পারে! যদি সে বলে ফেলে এই সন্তানের কোনো বাবা নেই।
সন্তানের বাবাও আমি মাও আমি। আর আমার সন্তানও যদি মায়ের ন্যাওটা হয়, যদি মায়ের কথায় আর না তাকায় আমার মুখের উপর, যদি আমার কোলে উঠার আগেই গগণবিদারী চিৎকার শুরু করে!
কিন্তু এর বিপরীতেও একটা বিষয় আছে আর তা সব পুরুষেরই জানা। এই জানা বিষয়টা হলো মেয়েদের সক্ষমতা নিয়ে। আসলে পৃথিবীর মেয়েরা সব পারে।
ক্ষমা করতে পারাটাই তাদের সবচেয়ে বড় গুণ। স্বামী আর সন্তানের পাহাড় সমান অপরাধ ক্ষমা করার যোগ্যতা নিয়েই তাদের জন্ম হয়। এই জন্যই বুঝি আয়েশা আর তার মেয়ে আমার দিকে তাকিয়েই হেসে ফেললো। আমার এখন কী করা উচিত ভেবে না পেয়ে প্রশ্নই করে ফেললাম একবার আয়েশাকে।
বললাম, আয়েশা, আমার কী আর কিছুই করার নেই এখন?
আয়েশা মৃদু হেসে বলল, আছে। তোমার মেয়ের কানে আজান দেও।
আমি খোদার শুকরিয়া আদায় করে আমার মেয়ের কানে ফিসফিস করে আজান দিলাম-
আল্লাহু আকবার
আল্লাহু আকবার।
লেখা – অনন্য শফিক
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “চোখের জলের ঋণ – শিক্ষনীয় ছোট গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – জল শ্রাবণের নদী – Golpo holeo shotti