মেয়েদের জীবন – মেয়েদের কিছু কথা: একটি মেয়ের সুখ শুধুই একটি ছেলের মধ্যে নির্ধারিত নয়! একটি মেয়ের সুখ একটি পরিবার ঘিরেই সৃষ্ট। একটি মেয়ের ভাল থাকা শুধুই একটি ছেলের হাতে নয়!
মূলগল্প
১৬বছরের মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে চিৎকার করে কান্না করেছিলেন নবাব উল্লাহ। সেদিন বিয়ের মঞ্চে দুধের মতো ধবধবে সাদা মরিয়ম মেয়েটির হরিণী চোখের জল বুঝিয়ে দিয়েছিলো শেয়ালদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিজের পরিবার বাঘে পূর্ণ জঙ্গলে ছেড়ে দিচ্ছিলো তাকে।
কিন্তু মরিয়ম সেদিন চুপ ছিলো, ভাগ্যে ভালো কিছুও তো থাকতে পারে! বিয়ের মঞ্চে বসা মরিয়মের দিকে সেদিন অপরাধী চোখে বারবার তাকাচ্ছিলেন নবাব উল্লাহ। নামটাই ছিলো শুধু নবাব, কিন্তু মানুষটা ছিলো খুবি গরীব। নবাব নিজের মেয়েকে বাঁচাতেই সেদিন বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলো পাশের দুই গ্রাম পরেই মধুপুর গ্রামের এক বড় পরিবারের ছেলের সাথে।
মেয়ের সুখের জন্য বাড়ির পাশের ছোট্ট জমিটাও বিক্রি করেছিলেন নবাব।
প্রতিটা বাবা-মা নিজেদের সন্তানের জন্য ভালো কিছুই করতে চান, মরিয়মের বাবা-মাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না! জমি বিক্রির পরেও নিজের মেয়ের সুখের জন্য মেয়ের শশুড় বাড়ির সব ইচ্ছাই পূর্ণ করার জন্য গ্রামের এক ধনী লোকের কাছ থেকে অর্ধ লক্ষ টাকাও নিয়েছিলেন। নবাবের চিন্তায় শুধুই নিজের মেয়ের সুখটাই চাওয়া ছিলো।
বিয়ের আগের রাতে মরিয়মের হাত ধরে হাউমাউ করে কান্না করছিলেন নবাব। আর বলছিলেন, মারে আমায় ক্ষমা করে দিস? তোকে নিয়ে খুব বড় স্বপ্ন ছিলো আমার আর তোর মায়ের। কিন্তু গ্রামের কিছু খারাপ মানুষের জন্য সব কিছু মাটি চাপা দিতে হয়েছে। মারে কী করবো বল?
গরীবদের ঘরে কোনো সুন্দরী মেয়ের জন্ম নিতে নেই, বাবুই পাখির বাসায় মন্দ লোকেরা ঢিল ছুঁড়বেই। মারে তোর সাথেও তার ব্যতিক্রম না। গ্রামের ওই খারাপ লোকরাও তোর মতো কোনো নারীর গর্ভ থেকেই এই পৃথিবীতে এসেছে।
কিন্তু ওরা কখনো নারী প্রতি সম্মান জিনিসটাই বুঝেনি৷ তাইতো দেখছিস মা তোর সাথে কী কী করতে চেয়েছিলো ওই মাবুষগুলো?
সেদিন মরিয়ম নিজের বাবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলা কথাগুলোর উত্তরে খুব শান্ত ভাবেই বলছিলো।
তোমাদের উপর আমার কোনো রাগ নেই, কিন্তু অভিমান আছে। তোমরা চাইলেই আজ আমায় নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারতে।
মরিয়মের কথার উত্তরে নিজের ঠোঁট পর্যন্ত নাড়াতে পারেন নি নবাব। মরিয়মও আর কিছু বলেনি সেদিন।
নবাব নিজের কলিজাকে ভালো ছেলের হাতেই তুলে দিছিলেন সেদিন। কিন্তু নিজের কলিজাকে নিজেই টাকা দিয়ে বিক্রি করেছিলেন নবাব। মরিয়ম এর শশুড় বাড়ির পরিবারকে নিজের কলিজার সাথে দিয়েছিলেন বড় অংকের টাকা আর ওদের বড় বড় চাওয়ার জিনিস, নিজের কলিজাকে নবাব নিজের টাকায় অন্যের কাছে বিক্রি করেছেন।
নবাব বিয়ের দিন মনে মনে চিৎকার করে সেদিন কান্না করেছেন। একটা সন্তানের গরীব বাবা মা জানে মনেমনে চিৎকার করে কান্নার কষ্ট কেমন! বিষাক্ত সাপের বিষ এর চেয়েও কষ্ট মনের চিৎকার করে কান্নাটা।
তবুও চেয়েছিলেন মেয়েটা সুখী হোক।
হ্যাঁ মেয়েটা আজ অনেক সুখী, মরিয়ম এর সুখ দেখে আজ নবাব আর মরিয়মের মা চিৎকার করে কান্না করছেন।
মরিয়ম আজ এতটাই সুখী যে, তার সুখে বাবামা কান্না করছে চিৎকার করে। মনের চিৎকার লুফে নিয়েছে মরিয়মের এমন সুখ।
বিয়ের ৭মাসের মাথায় যে নিজের মেয়ের লাশ দেখবেন নবাব, তা হয়তো কখনো কল্পনা করেনি!
শুধু মেয়ের লাশ না, রুমে আরো একটা লাশ আছে, সেই লাশটাও অন্য কারো না! লাশটা নিজের মেয়ের বরের।
নবাব নিজের মেয়ের দিকে একবার তাকাচ্ছেন আবার মেয়ের বরের দিকে তাকাচ্ছেন।
দুটো ক্ষতবিক্ষত শরীর মাটিতে পড়ে আছে।
নবাব পেরেছিলেন নিজের কলিজাকে ভালো একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু পারেন নি ভালো পরিবারের হাতে তুলে দিতে। তাই তো আজ টাকা আর সম্পদের লোভে নিজেদের ছেলেকেও রেহাই দেয় নি ওরা।
নবাব নিজের কান্না থামিয়ে নিজের মেয়ে আর মেয়ের বরকে পুলিশের সাহায্য নিয়ে দাফন করেন।
মরিয়ম এর শশুড় বাড়ির পরিবারের সবাই পলাতক। কতোটা নিষ্ঠুর হলে নিজের ছেলেকেও খুন করতে পারে সেটা হয়তো নবাব নিজ চোখেই দেখে নিলেন।
নবাব নিজের মেয়েকে ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচাতে একজন ভালো ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। মেয়ে সুখে থাকবে বলে নবাব নিজের সব সম্পদ পর্যন্ত বিক্রি করেছিলেন। নিজের মেয়ের সাথে বড় অংকের টাকাও দিয়েছিলেন, কিন্তু মেয়েকে সুখের নদীতে পারেন নি বাসাতে।
নবাব নিজের মেয়ে আর মেয়ের বরের কবরের দিকে তাকিয়ে আছেন। উপলব্ধি করতে চাচ্ছেন! এই দুই পাখির মৃত্যুর সময়ের শেষ কথাগুলো কী ছিলো? কী বলেছিলো আর্তনাদ করে?
নবাব নিজের ১৬বছরের মেয়েকে হারিয়ে নিরাশ হননি, হয়েছেন লজ্জিত, সত্যিই সেদিন চাইলেই পারতেন নিজের মেয়েকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। তাহলে হয়তো আজ হারাতে হতো না দুটি প্রাণ।
নবাব অন্ধকার আকাশের নিচে বসে বসে ভাবলেন, একটি মেয়ের জন্য কখনো একটি ভালো ছেলে উপযুক্ত নয়! একটি মেয়ের জন্য নিশ্চয় একটি ভালো পরিবার উপযুক্ত।
একটি মেয়ের সুখ শুধুই একটি ছেলের মধ্যে নির্ধারিত নয়! একটি মেয়ের সুখ একটি পরিবার ঘিরেই সৃষ্ট। একটি মেয়ের ভাল থাকা শুধুই একটি ছেলের হাতে নয়! একটি মেয়ের ভালো থাকা নিশ্চয় সেই ছেলেটির আশেপাশের মানুষ ঘিরেই।
নবাব দীর্ঘশ্বাস নিলেন অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে। নিজের মেয়ের সুখ খুঁজতে হেরে গেছেন কিছু লোভী মানুষের কাছে।
মরিয়মের অভিমানটা থেকে গেলো এই পৃথিবীতে।
লেখক – হানিফ আহমেদ
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “মেয়েদের জীবন – মেয়েদের কিছু কথা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – শুরুতেই শেষ – প্রেমিকার মৃত্যু