ইতি ২০২০ – নতুন জীবনের গল্প: অপু সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে রিমিকে সংসারের কাজেও যতটা সম্ভব সাহায্য করে যাবে। তাছাড়া শত মন কষাকষির পরও অপুর সামান্য শারীরিক অসুস্থতায় রিমি অস্থির হয়ে পড়ে। অপুর আদরযত্নের কমতি রাখে না৷
মূলগল্প
বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে গায়ের লাল ওড়নাটা খানিকটা আলগা করে মাথায় ঘোমটা টেনে নেয় ইরিন। আয়নায় নিজেকে দেখে আবিষ্কার করে এক লাল টুকটুকে নতুন বউকে। অন্য সময় হলে আনন্দে বা লজ্জায় তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠতো কিন্তু এখন চোখের কোণ ভিজে উঠছে। প্রায় ঘণ্টা খানেকের মত হাঁটু গেড়ে বাবার পায়ের কাছে বসে থেকেও ইরিন তার বাবার সিদ্ধান্ত নড়চড় করতে পারেনি।
ইরিন যখন কাতর কণ্ঠে তার বাবাকে বলছিলো,
- তুমি একটাবার ফাহাদের সাথে কথা বলে দেখো বাবা, প্লিজ।
আশানুরূপ কোনো প্রতিউত্তরের বদলে তার বাবা তখন সরাসরি বিয়ের কেনাকাটার প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলেন,
- তোমার ছোট খালামনিকে কাল চলে আসতে বলেছি৷ তাড়াতাড়ি কেনাকাটা শুরু করে দিতে হবে৷ অনলাইনে কোনো গয়নাগাটি বা শাড়ি পছন্দ হলে অর্ডার দিয়ে রাখো।
ওয়াশরুমের ভেতর থেকে ইরিন মোবাইলের রিংটোন শুনতে পাচ্ছে। ফাহাদ কল করেছে নিশ্চয়ই। পরপর কয়েকবার চোখমুখে পানি দিয়েও ইরিন কান্না সংবরণ করতে পারছে না। অথচ গতবছরের এইদিনটাতে সে কতখানি খুশি ছিল তা বলে বুঝাবার মত না। মনের সাথে কঠিন বোঝাপড়া শেষে সাহস করে ফাহাদকে সে তার মনের কথা জানিয়েছিলো। ফাহাদ তখন মুচকি হেসে তার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলো। তারপর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ইরিনকে আর কখনো কাঁদতে হয়নি।
দীর্ঘশ্বাসের হিসাব রেখে রাত কাটাতে হয়নি। নীরবে বালিশে মুখ চেপে বুকের ভেতরটা হালকা করতে হয়নি। তার পুরো জগতটা অন্যরকম এক সুখে ভরে গিয়েছিলো৷ কিন্তু কে জানতো, পুরো একবছরের সুখের দাম তাকে এই একদিনেই দিয়ে দিতে হবে!
শহরের রাতের আকাশজুড়ে একের পর এক ফানুশ উড়ছে, বাইরে আতশবাজির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সবাই নানারকম আয়োজনের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগতম জানাতে ব্যস্ত। এদিকে ইরিন চারদেয়ালের বন্ধ ঘরে বসে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে চলেছে। একবুক অভিমান নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো পার করছে। মা,বাবা আর ফাহাদের সাথে কাটানো সুখের স্মৃতিগুলো বারবার তার দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে। আর তার পাশেই পড়ে আছে ইদুর মারার বিষের খালি শিশিটা!
দুই কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে বাসের সিটে হেলান দিয়ে আছে সজীব। হেডফোনে কোনো গান বাজছে না৷ পাশের সিটের মেয়েটার অহেতুক অতিরিক্ত কৌতুহল এড়াতে সে গান শোনার ভান ধরে আছে। খানিকবাদে সজীব তার মুখের সামনে কিছু একটা নড়াচড়া করছে বলে অনুভব করলো৷ চোখ খুলে তাকালো সে। পাশের মেয়েটা কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে সিটে বসে থেকে হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে দেখে সজীব হালকা করে মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে কঠিন গলায় বললো,
- কি হচ্ছেটা কি এসব?
তাড়াতাড়ি করে কান থেকে হেডফোন নামিয়ে মেয়েটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, - আমাকে কিছু বলছেন?
- অসভ্যের মত এভাবে হাত পা ছুড়াছুড়ি করছেন কেন?
- ও আচ্ছা, এই কথা। আসলে নেহা কাক্কারের গান শোনার সময় আমি না একদমই নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। মনের সাথে সাথে শরীরটাও দুলে উঠে।
- দেখুন, আমার সমস্যা হচ্ছে। আপনি অন্য সিটে গিয়ে বসুন প্লিজ।
সজীবের কথায় কান না দিয়ে মেয়েটা প্রসঙ্গ পাল্টে বলতে শুরু করে, - আচ্ছা আপনি কি তিনবেলা ভাতের সাথে শুকনো মরিচ খান?
- মানে?
- অথবা আপনি কি মূলার তরকারি পছন্দ করেন খুব?
- আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। বাজে কথা রেখে আপনি সিট চেইঞ্জ করুন প্লিজ।
- তবে যত যাই বলুন, আমরা দুজনেই কিন্তু দুজনের সঙ্গ বেশ উপভোগ করছি। হতে পারে আমি বেশি উপভোগ করছি আর আপনি সেই তুলনায় কম। নয়তো এতক্ষণে আমাকে সিট চেইঞ্জ করার তাগিদ না দিয়ে নিজেই উঠে চলে যেতেন।
সজীব আর কোনো প্রতিউত্তর করে না। কাঁধ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। হুট করেই যেন স্থির হয়ে পড়েছে সে। একটু আগের সেই কাঠখোট্টা রকমের অস্থিরতাটা এখন আর নেই। কমবেশি ভালোলাগাও কাজ করছে মনের মধ্যে। কিন্তু এসবকিছুই আচমকা ঘটে যাচ্ছে।
- আজকে থার্টি ফার্স্ট নাইট। আমরা বন্ধুরা মিলে বাসার ছাদের উপর ছোটখাটো একটা বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছি। আপনি থাকবেন আমাদের সাথে?
মেয়েটার প্রশ্ন শুনে সজীব কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, - পার্টির সময়টুকু নাহয় আপনাদের সাথে থাকলাম কিন্তু বাকিসময়টুকু কি শুধু আপনার সাথে থাকা যাবে?
হসপিটালের কেবিনের বাইরে পেছনে দু’হাত বেঁধে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আসাদ সাহেব। চোখেমুখে তার দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট। একটু পরপর হাতঘড়িতে চোখ বুলাচ্ছেন। কেবিনের ভেতরে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না, তা নিয়েও দোনোমন্যতায় ভুগছেন। মাকে এরকম করে অসহায় অবস্থায় হসপিটালের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখতে তার একদমই ভালো লাগে না। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক কেবিন থেকে বের হয়ে আসাদ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
- আপনার মায়ের হাতে বেশি সময় নেই। আত্নীয়স্বজন যারা আছেন, তাদের ডেকে নিন। শেষ দেখা দেখে যেতে বলেন।
মুহূর্তেই আসাদ সাহেবের পুরো পৃথিবী যেন থমকে যায়। হাত পা অসাড় হয়ে আসতে শুরু করে। ধীর গতিতে তিনি কেবিনের দিকে পা বাড়ান।
অপলক দৃষ্টি নিয়ে মায়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবেন, তার সুখের সময় বুঝি শেষ হয়ে এলো৷ মাকে ছাড়া তিনি কিভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন! এতদিন ধরে মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে ছিলেন ঠিকই কিন্তু তবুও একটা স্বস্তি কাজ করতো মনের মধ্যে। দিনশেষে বাসায় ফিরে আসাদ সাহেব তার মায়ের মুখখানা দেখতে পারতেন৷ সামনে বসে দু’চারটা কথা বলতে পারতেন, শুনতে পারতেন। ছুটির দিনগুলোতে মায়ের হাত পায়ের নখ কেটে দিতেন,কাপড় ধুয়ে দিতেন,চুল আঁচড়ে দিতেন। কিন্তু এখন?
কার সেবা করবেন তিনি? বুক ভরা হাহাকার নিয়ে মায়ের ডান হাতটা নরম হাতে চেপে ধরেন আসাদ সাহেব। অথচ গতবছরের এই দিনে আসাদ সাহেবের পুরো পরিবার কত হৈ-হুল্লোড় করে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ায় ব্যস্ত ছিল। সেদিন বাড়িতে ইলিশ পোলাও রান্না হয়েছিলো। পুত্রবধূর বারণ থাকা সত্ত্বেও নিজের ইচ্ছায় রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন আসাদ সাহেবের মা, ছেলেকে ইলিশ পোলাও রেঁধে খাওয়াবেন বলে। কে জানতো, সেবারই ছিল ছেলের জন্য তার শেষ রান্না করা?
রিমি আর অপুর বিয়ের বয়স মাত্র চারমাস। বিয়ের পর প্রথম একমাস ঘুরাঘুরি আর দাওয়াত খেতে খেতে কেটে গেলেও পরের তিনমাস ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং একটা সময়। এরেঞ্জ ম্যারেজ হওয়ায় নিজেদের মধ্যে থাকা অমিলগুলো প্রথমদিকে দুজনের কেউই বুঝে উঠতে পারেনি৷ যখন বুঝে উঠতে শুরু করেছে, ঝামেলার শুরুও হয়েছে তখন থেকেই৷ দুজনের খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ঘুমানোর রুটিনটা পর্যন্ত আলাদা। সাথে মতের অমিল, পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব, একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা, দায়িত্বে অবহেলা এসব তো রয়েছেই।
সম্পর্কের দায়বদ্ধতা থেকে এতদিন ধরে বাইরের কাউকে ভেতরের খবর জানতে না দিয়ে নীরবে সংসার করে গেছে দুজন বিপরীত মেরুর মানুষ। কিন্তু এখন বোধহয় আর সম্ভব হচ্ছে না। সবকিছুর একটা সঠিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে দুজনেই। রিমি আর অপু দুজনেই চাকরীজীবি। রিমি লাঞ্চ টাইমে অপুকে কল করলো।
- হ্যালো।
- হ্যাঁ রিমি, বলো।
- ফ্রি আছো?
- হুম।
- আমার একটা কথা বলার ছিল।
ওপাশ থেকে অপু গম্ভীর কন্ঠে জানালো, - আমারও।
- ঠিক আছে, তোমারটা আগে শুনি তাহলে৷
- না, তুমি আগে বলো।
- উঁহু, তুমি আগে বলো না।
- আচ্ছা আমরা বরং বাসায় ফিরেই কথা বলি। এখন আর ফোনে বলতে ইচ্ছে করছে না৷
- আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে?
- চেষ্টা করবো।
তাদের ফোনালাপ শুনে বুঝার উপায় নেই যে, আজ সকালেই নাস্তার আইটেম নিয়ে দুজনের মধ্যে একদফা হয়ে গেছে। অপু রাতে বলে রেখেছিলো, সকালে পরোটা খাবে। কিন্তু রিমির ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যাওয়ায় বরাবরের মত পাউরুটি আর মাখন দিয়েই সকালটা চালিয়ে নিতে হয়েছে।
অফিস থেকে বের হয়ে অপু একটা পেস্ট্রিশপে ঢুকে যায়। তারপর দেখেশুনে রিমির পছন্দের হার্টশেপ রেড ভেলভেট কেক কিনে নিয়ে ভাবতে থাকে।
“এখন থেকে আর রিমির সাথে কোনো অশান্তি করবে না। কারণে অকারণে ঝগড়াঝাটি করবে না। আর এমনিতেও বেশিরভাগ সময় বাড়াবাড়িটা সে’ই বেশি করে। রিমিকে একটু বুঝেশুনে চললেই তো হয়৷ সারাদিন সে যতটা পরিশ্রম করে, রিমিও তার চেয়ে কোনো অংশে কম পরিশ্রম করে না। অপু সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে রিমিকে সংসারের কাজেও যতটা সম্ভব সাহায্য করে যাবে। তাছাড়া শত মন কষাকষির পরও অপুর সামান্য শারীরিক অসুস্থতায় রিমি অস্থির হয়ে পড়ে। অপুর আদরযত্নের কমতি রাখে না৷ তাই এতদিন যা হওয়ার হয়েছে, নতুন বছরটা শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়েই শুরু করতে চায় অপু।”
বাসায় ফেরার পথে রিক্সায় বসে রিমি মনে মনে ঠিক করে নেয়, আজ রাতে অপুর পছন্দের সব খাবার রান্না করবে সে। ঘুম না আসা অব্দি বেলকোনিতে বসে কফির মগ হাতে নিয়ে পরস্পরের মধ্যে জমে থাকা অভিমান আর অভিযোগগুলোর সুন্দর সমাপ্তি ঘটাবে কিছু শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে। নতুন বছরে সে আর কোনো অশান্তি চায় না। মনের মত করে সংসার করতে চায় আর অপুকে অনেক অনেক ভালোবাসতে চায়।
লেখা – নুসরাত খান অনি
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “ইতি ২০২০ – নতুন জীবনের গল্প”গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – না বলা ভালবাসার গল্প – প্রথম প্রেম কখনোই ভোলা যায়না