শুষ্ক পাতার ভাজে (শেষ খণ্ড) – Valobasar Golpo: তৃনা ভয়ে ভয়ে পেছন দিক তাকায়। হাতটা টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে নদীর জলে হাত ভেজায়। গায়ের চামড়ায় হলুদ লেগে ফর্সা হাত হলুদ হয়ে আছে যা উঠবার নয়। শাড়ির আচল দিয়ে হাত মুছলেও হলুদ দাগ যাচ্ছে না।
পর্ব ১২
মাসুদ পুরো বিরক্ত রায়ানের উপর। তার মধ্যে রোহান শপিং এর দায়িত্ব মাসুদের উপর দিয়েছে। উশখোশ করছে বার বার। রায়ান ব্যপারটা খেয়াল করে। রাতে মাসুদের বাসায় ডিনারের পর বের হওয়ার সময় মাসুদ কে সাথে আসতে বলে। দুজনে ফ্লাইওভার ব্রিজের উপর উঠে। সিগারেটের আগুন ধরিয়ে ফুক দেয় দুজনেই। ধোয়ার সাথে বেরিয়ে যায় বিরক্তি গুলো।
রায়ান বলে, “তোর কি হয়েছে রে? এমন মুড অফ কেনো? খুশি হস নি আমার বিয়েতে?”
“তুই খুশি?”
রায়ান চুপ।
“তৃনলতা ছাড়া তোর কারো সাথে বিয়ে হলে আমি খুশি না।”
“বার বার কেনো এই একটা নাম বলিশ তুই আমাকে বলতো? পারবি তাকে এনে দিতে? আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার তৃনলতা কে। হারিয়ে ফেলেছি।”
“তোর বোকামোর জন্য এসব।”
“আমি কিন্তু বোকামো করি নি। আমি ছিলাম পরিস্তিতির শিকার। তুই জানবি কিভাবে? তুই তো এসেছিস অনেক পরে। এসেই আমার মুখে তৃনলতা তৃনলতা শুনে শুনে এখন তোর মনে হয় আমার সাথে তৃনলতাই থাকবে আর কেউ না।”
“সব থেকে মজার ব্যপার কি জানিস দোস্ত? তোর আর তৃনলতা সম্পর্কের দৌড় কতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে সেটাই জানি না আমি। অথচ যত বার তুই তৃনলতা নামটা বলেছিস ততবার তোর মুখে অদ্ভুদ একটা আলোর ঝলক দেখেছি যা ভেতর থেকে এসেছে।”
রায়ান হেসে ফেলে।
“এখনো দেখতে পাচ্ছি।”
“তৃনলতা কি জানিস? আমার একটা শান্তির জায়গা। তৃনলতাকে আমি আমার জন্য আকুল হতেই বেশি দেখেছি। একটা মেয়ে এতো ভালোবেসেছিলো আমি এখনো ভেবে শান্তি পাই। তার সেই অফুরন্ত ভালোবাসা পাওয়ার মনে হয় যোগ্য ছিলাম না আমি। তাই সৃষ্টিকর্তাও চায় নি। দমকা হাওয়ায় সব উলট পালট করে দিয়েছে সব। আমার যে তৃনলতা কে খুব প্রয়োজন দোস্ত।”
“তাহলে তৃষাকে বিয়ে করছিস কেনো?”
“তৃষার মাঝে আমি তৃনলতাকে দেখতে পাই। তৃষার আচার ব্যবহার পছন্দ ৮০% তৃনলতার সাথে মিলে যায়। তৃনলতা আমাকে জেনেও আমাকে ভালোবেসে বার বার আমার কাছে এসে বলেছে একটু ভালোবাসতে।
তৃষাও তেমনি একজন যে আমার সম্পর্কে জেনে আমার মেয়েকেও মেনে নিয়েছে আমাকে ভালোবাসার জন্য। আমার উচিত তৃষাকে ভালোবাসা”
“মেনে নিলাম। চল হাটি।”
দুজনে হাটতে থাকে ব্রিজের উপর দিয়ে। মাসুদ বলে,
“কবে বুঝেছিলি যে তুই তৃনলতার উপর উইক?”
“স্টাডি টুরে গিয়েছিলাম পাহাড়ে বড়ারের কাছে। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে বড়ার পাস করার রিস্ক নিয়েছিলাম। জায়গাটা খালি দেখেই কাটাতারের বেডা টপকালাম। তখন ছিলে গিয়েছিলো শরীরের কিছুটা অংশ। কয়েক মিনিট পর বিএসএফ চলে আসে। এসেই গুলি তাক করে গালি দিতে থাকে। কোন মতে প্রান নিয়ে যখন দৌড়ে এপাশের ভিতর দিকে চলে এলাম তখন আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছি। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বন্ধুরা চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যেই গালে নরম দুটো হাতের ছোয়া পাই। তাকিয়ে দেখি আর্তনাদ করে কাদছে আমার তৃনলতা। ব্যথা যেনো আমার নিমেষেই দূর হয়ে যায়। কাদতে ভুলে যাই আমি। তৃনলতার কান্না, সেবায় সব ভুলে যাই আমি। চিরে যাওয়া জায়গায় যখন পানি দিচ্ছিলো তখন আরে জালা করে। ডক্টর যখন অষুধ লাগাচ্ছিলো তখন আরো জালা করে।
তৃনলতাকে বুকে মুখ গুজে যন্ত্রনা সহ্য করছিলাম আমি। সেই প্রথম আর শেষ বারের মতো আমার তৃনলতাকে আকড়ে ধরা। তার পর থেকে আমার তৃনলতা ছাড়া অন্যকাউকে সহ্য হতো না। মেয়েটা আমার সামনে আসতো কম। কিন্তু আমিই যেনো দেখার জন্য ছটফট করতাম। বড্ড উইক হয়ে পড়েছিলাম। উইক হয়েই বা কি লাভ হলো? যখন সব ছেড়ে লিনার সাথে ব্রেকাপ করে তৃনলতার কাছে আত্মসর্পন করতে চাইলাম তখনিতো ঝড়টা উঠলো। একটাই আফসোস কি জানিস? কখনো বলতে পারিনি যে তৃনলতা তুমি ঠিক ই আমার হৃদয়ে হানা দিয়ে কেড়ে নিয়েছিলে আমাকে।”
“বাসায় চল। অনেক রাত হয়ে গেছে।”
সেদিন বাসায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো কতক্ষন। জীবনের কি রুপ! একটা অবহেলা করা ভালোবাসা তার অবহেলার জবাব দেওয়ার জন্য বার বার স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে। অথচ একজনের সাথে রিলেশন ছিলো তাকে বিয়ে করে সংসার ও হলো, ফুটফুটে একটা মেয়েও হলো, সংসারটা ভালোবাসায় ভরপুর ও ছিলো কিন্তু হায় তার কথা একটি বারের জন্য মনে পড়ে না। আজ বাদে কাল যার সাথে বিয়ে হবে যার সাথে দুই বছর থেকে রিলেশন যে তাকে এতোটা ভালোবাসে তার কথা মনে পড়ে না একটি বারের জন্য। অস্থির লাগছে রায়ানের। এই অস্থিরতা কাটানোর জন্য তৃষাকে প্রয়োজন। ফোন দেয় তৃষার ফোনে। দু বার রিং হওয়ার পর ও যখন রিসিভ না হয় তখন রায়ান ধরেই নেয় তৃষা ঘুমুচ্ছে। ডায়রিটা হাতে তুলে নেয় রায়ান। একের পর এক পৃষ্টা উল্টোতে থাকে।
সেদিনের শেষ করা পৃষ্টার পরের পাতা পড়ে
“আমি জানি তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু সব সময় প্রকাশ পায় না ভালোবাসাটা। হয়তো তুমি এমনি। কিন্তু জানো যখন এই ভালোবাসা বিন্দুমাত্র প্রকাশ হয় তখন নিজেকে সব থেকে সুখী মনে হয়। তোমার ছোয়ায় আমার মন শরীর দুটোই জুড়িয়ে যায়। তুমি হয়তো জানো না তুমি অনেক সুন্দর করে জড়িয়ে ধরতে পারো।”
পরের পৃষ্টায় তোমাকে ব্যান্ড গুলো জানিয়ে দিলাম যেগুলো আমি ইউজ করি। আলতার ব্যান্ডের কথা ভুলে গেলে অনেক কাদবো কিন্তু আমি। আমি চাই বিয়ের পর প্রত্যেকদিন তোমার হাতে পায়ে আলতা পড়তে। আলতা রাঙা পায়ে যখন চুমু দিবে তখন মুখ ঢেকে রাখবো কিন্তু হাত দিয়ে। ভীষন লজ্জা লাগবে আমার।”
এটুকু পড়েই হাসে রায়ান। তৃষাকে এতো এতো কসমেটিকস কিনে দিয়েছে যে কোন নাম ই মনে নেই আর পাগলীটা আলতায় পড়ে আছে। পরের পৃষ্টায়-
“হিরোর মতো দেখতে হওয়ায় অনেক মেয়েই তোমার পিছে পড়ে থাকে। রুপ দেখে হয়তো তুমিও দুর্বল হয়ে যাও। এতে আমার কোন অভিযোগ নেই। যতদিন উড়বে ততোদিন আমি উড়তে দিলাম আমি। যেদিন পুরোপুরি আমার হবে তখন থেকে পুরোটা আমারি থাকবে। আমি জানি এখনো তুমি আমার। তোমার গার্লফ্রেন্ডকে পেছনে ফেলে আজ বা কাল আমার কাছেই আসবে। অপেক্ষায় রইলাম।”
ঘুম এসে গেছে ক্লান্তিতে দুই চোখে। ডায়রিটা বন্ধ করে বলে”তুমি জিতে গেছো তৃষা। আর আমিও হাপিয়ে গেছি। চার পাচঁটা মানুষের মতো আমিও স্বাভাবিক জীবন চাই।”
পর্ব ১৩
আজকাল তৃষার মাঝে তেমন প্রান নেই। চুপ চাপ থাকে। একা একা কাদে তা কেউ না বুঝলে তৃনা আর পারুল ঠিক ই বুঝে। পারুল সব টা শুনে মেয়েকে সাহস দেয়। এরকম থাকেই তাই বলে এতো বড় ঘর ছাড়ার কোন প্রশ্ন ই উঠে না। বাচ্চার জন্য বাচ্চার ইয়াং দাদা দাদী আছে। এতোকাল উনারাই বড় করেছে বাকিটা উনারাই দেখে নিবেন। তবুও তৃষার মনে দ্বিধা থেকে যায়। যতই হোক সে তো ফুলকন্যা। তৃনা নিজের ঘরে এসে দেখে তৃষা বসে আছে। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এসে তৃষার সামনে বসে। মুখ ভার করে দাত দিয়ে আঙ্গুল কামড়াচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তৃষার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে বলে, “কি হয়েছে আমার বোন টার?”
তৃষা ফুপিয়ে উঠে তৃনাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকে। তৃনা তৃষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে”আজ বাদে কাল বিয়ে অথচ আমার বোনটা কাদছে। এটা কোন কথা? দেখি দেখি মুখটা। ওমা কেদে কেটে ফুলিয়ে ফেলেছে চাদ মুখ খানা। এটা কিন্তু একদম ই ঠিক নয়।”
“আপু এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে আমার?”
“কি হয়েছে বল আমাকে?”
“আপু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কি করবো আপু? আমি সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছি। রায়ান ডিভোর্সি ওর একটা মেয়ে আছে। আমি এতো বোঝা মাথায় নিতে পারছি না। আমার ফিউচারে কি হবে?”
“তুমার মন কি চায়?”
“আমি জানি না কিচ্ছু জানি না। আম্মু বলে আমি আমার অধিকার থেকে না পিছিয়ে আসি। আচ্ছা আপু তুমি কিভাবে সহ্য করো এই ভালোবাসা নামের কষ্ট টা?”
“বুঝবিনা।”
“আমি বুঝি আপু। তুমি মুখে না বললেও আমি সবটা জানি।”
“ভালোবাসা কখনো কষ্ট না তৃষা। ভালোবাসা হচ্ছে এক বিন্দু সুখ। যার জল কখনো শুকায় না বরং আস্তে আস্তে বর্ধিত হতে থাকে। ভালোবাসার মানুষটার একটু ছোয়া সারাজীবন ছোয়ার সমান। ভালোবাসার মানুষটার বুকে একবার মাথা রাখলে সারাজীবন তার বুকে মাথা রাখার সুখটা পাওয়া যায়। ভালোবাসার মানুষটার সৌন্দর্য একবার বাজেয়াপ্ত করলে সকল সৌন্দর্যকে হার মানায়। ভালোবাসার মানুষটার পাশে একবার থাকলে মনে হয় সারাজীবন তার পাশেই আছি। আর কিচ্ছু লাগে না। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন অঘাত ভালোবাসা আর খাদহীন অনুভব। আমি সব পেয়েছি। আমার কোন কষ্ট নেই।
তৃষা খেয়াল করে তৃনা হাসছে অথচ তার চোখে জল টলমল করছে। তৃনাকে জড়িয়ে ধরে তৃষা। তৃনাও তৃষাকে জড়িয়ে ধরে। তৃষা বলে, “আমি তোমার মতো হয়তো কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা।
তবে দুলাভাইয়া কিন্তু খুব লাকিরে আপু। দোয়া রেখো আমি যেনো রায়ানকে নিয়ে সুখী হই। তার অতীত যেনো কখনো আমাদের মাঝে না আসে।”
তৃনার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। তৃষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলে”আসবেনারে বোন। পাসপোর্ট হাতে পেয়ে গেছি। চলে যাবো তদের থেকে বহু দূরে। যেখানে তোর হাজবেন্ড আর আমার মাঝে অনেক ফারাক থাকবে। তোরাও সুখি হবি আর তোদের সুখে আমিও সুখী হবো। কখনোই আসবোনা রায়ান আপনার সামনে। কখনোই না।”
কেনাকাটা সবার বিয়ের জন্য হলেও তৃনার কেনাকাটা বিদেশ যাত্রার জন্য। একা এসেছে আজ। নিজের জন্য কিছু ভালো বোরখা নিয়েছে। শো রুম থেকে বের হতেই দেখে রোহানা আর রোহান চিল্লাচিল্লি করছে আর বলছে আমার নাতনী টাকে নিয়ে গেলো ধরো ওকে ধরো। নাতনী মানে রুমু। তৃনাও দৌড় দেয় বাইরের দিকে।
ঢাকা শহরের লোকজন একটু পিছু নিয়েই থেমে যায়। কিন্তু তৃনা পিছু ছাড়ে না। গাড়িটির পিছু পিছু সি এন জি দিয়ে ফলো করে। ইতিমধ্যে লোকাল থানায় রুমুকে কিডনাপ করার খবর দিয়ে দেয় রোহান। একটা পুরোনো বিল্ডিং এর কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। সেখানে গিয়ে গাড়িটি থামে। রুমুকে অচেতন অবস্থায় কোলে নিয়ে ভিতরে একটা মেয়ে চলে যায়। মেয়েটাকে পেছন থেকে দেখে খটকা লাগে তৃনার।
পরক্ষনে ড্রেস থেকে চিনতে পারে। এই হলুদ টপ আর স্কার্ট টা দুই মাস আগে তৃনাই তৃষাকে কিনে দিয়েছিলো। তৃনা ভাড়া মিটিয়ে তৃষা যেদিকে গিয়েছে সেইদিকে যায়। এদিক সেদিক দেখে কিন্তু কোথাও পায় না। পুরো জায়গাটা তন্ন তন্ন করে খুজে কিন্তু কোথাও পায় না। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছাদে যায়। ছাদথেকে এদিক ওদিক দেখতে থাকে।
পাশের ছোট বিল্ডিংটার পেছন থেকে কান্নার আওয়াজ আসে আর একটা কালো ড্রেস পড়া মেয়েকেও হাফটা দেখা যায়। তৃনা ঝড় বেগে নিচে নেমে এসে ওদিকটা যায়। যা দেখে শুনে তা শুনে তৃনার চোখ ছানাবড়া। তৃষা আর লিনা দাড়িয়ে কথা বলছে আর রুমু লিনার কোল থেকে নামার জন্য চেষ্টা করছে। তৃনা জোরে তৃষাকে ডাক দেয়। তৃষা তৃনার দিক ফিরেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তৃনাকে বলে ~ আপু তুমি এখানে কেনো?
সজোরে থাপ্পর পড়ে তৃষার গালে। তৃষা গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকে। রুমু তৃনাকে চিনতে পেরে কান্না বন্ধ করে তৃনার কোলে এসে পড়ে। তৃনা রুমুকে কোলে নিয়ে তৃষাকে বলে, “তুই এতো নিচে নেমে গেছিস আজ না দেখলে বিশ্বাস ই করতে পারতাম না আমি।”
লিনা বলে, এই যে মিস কিসের নিচে নেমে গেছে? কতটুকু জানেন আপনি? রুমুর মম আমি। জানেন একটা মায়ের মেয়ের জন্য কতটুকু হৃদয় পুড়ে? তৃষা আমার মেয়েকে আমার কাছে দিতে এসেছে। ওকে তো নিয়ে আপনার গর্ব করা উচিত।”
রুমু আরো জোরে তৃনার গলা জড়িয়ে ধরে। তৃষা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাদছে। তৃনা বলে, “এতোই যখন হ্যদয় পুড়ে তো ছেড়ে গিয়েছিলেন কেনো দুধের শিশুটাকে ছেড়ে?
একটা মা কখনো এমন করতে পারে না। মায়ের অধিকার নিয়ে ঐ ফেমেলির সামনে দাড়াতে পারতেন তা না করে কিডনাপ করিয়ে নিলেন আমার অবুঝ বোনটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে? আর তুই ভালোই কিডনাপ করতে পারিস। এখানে আছিস কেনো? ডাকাত দলে নাম লেখা ভালো ডাকাতি করতে পারবি। তারপর ধরা পড়লে ভাইয়া তো আছেই। ভাইয়া না থাকলে আমি আছি।”
লিনা বলে, “হেই বেশি কথা বলো তুমি। দাও আমার মেয়েকে আমার কাছে দাও।”
“না তুমি ওর মম না ও তোমার মেয়ে। রুমু কে পাবে না তুমি চুন্নি কথাকার। লোভী মহিলা তোমার মতো মহিলা কখনোই মা হতে পারে না। আর কখনো রুমুর ধারে কাছে যেনো না দেখি তোমাকে।”
চারিদিকে পুলিশ ঘেরাও করে। তৃনা রুমুকে নিয়ে চলে আসে। পিছু পিছু তৃষাও আসে। লিনাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
রায়ানের ফোনে একটা ভয়েজ রেকর্ড আসে হুয়াটসএপ এ আননোন নাম্বার থেকে। অন করতেই রুমুর গলা শুনতে পায়।
রুমু বলছে পাপা তুমি পচা। আমাকে আমাল মাম্মাল কাছে যেতে দাও না। তুমি একটুও লাভ কলো না আমাকে। আদল কলো না। শুধু দাদু মনি আল দাদু ভাই ই আমাকে আদল কলে। আমাল মাম্মাও আমাকে আদল কলে। আমি আল থাকবোনা তুমাল সাথে। আমি চলে যাবো মাম্মাল কাছে। মাম্মা আমাকে নিতে আসছে। আমি চলে যাচ্ছি মাম্মাল কাছে। তুমি আল এসোনা আমাল কাছে। পচা পাপা তুমি ভালো থেকো। বাই বাই। টা টা।”
রায়ানের মাথায় বাজ পড়ে যায়। ফোন দেয় সেই নাম্বারে কিন্তু পায় না। বাসায় ফোন করে পায় না। দারোয়ানকে ফোন করতেই দারোয়ান জানায় সবাই মিলে মলে গিয়েছে। বাসায় আসতেই দেখে রোহান রেহানা ড্রয়িংরুমে বসে কাদছে। রায়ানকে দেখে রেহানার কান্না বেড়ে যায়। রায়ানকে ধরেই কাদতে থাকে। রায়ান বলে, “মম রুমু কোথায়? রুমুকে এনে দাও আমার কাছে। ওর পাপাও আমি মাম্মাও আমি। ওর কোন মমের প্রয়োজন নেই। আমার কলিজাটাকে আমার কাছে এনে দাও।”
রোহান বলে, “আমরা কেনাকাটা করছিলাম দাদুভাই হেটে হেটে বেরাচ্ছিলো আমাদের সাথেই। হটাৎ চিৎকার করতেই তাকিয়ে দেখি একজন দাদুভাইকে নিয়ে চলে যাচ্ছে দৌড়ে। আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার দাদুভাইকে নিয়ে চলে গেলো। আমি আটকাতে পারলাম না।”
রায়ানের ফোন আসতেই দেখে মাসুদ ফোন করেছে। ধরতেই বলে”দোস্ত রুমুকে পেয়েছি। আসছি আমরা চিন্তা করিস না।”
রোহানাকে সরিয়ে দিয়ে রুমে চলে আসে রায়ান। বুকের সাথে বালিশ চেপে চোখ বন্ধ করে থাকে। বার বার কেনো তার মেয়েটার সাথে এমন হয়? ঐ টুকুন মেয়েটা তার আর কত সহ্য করবে? চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। ঘন্টা খানিক বাদে রুমুকে নিয়ে আসা হয়। তৃনার কোলে রুমুকে দেখে রোহানা রোহান দৌড়ে আসে।
তৃনাকে দেখে বলে”মাগো তুমি বার বার আমার নাতিটাকে বাচিয়ে দিচ্ছো। আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। পেছনে তৃষাকে দেখে অবাক হয়। তৃষা কাচুমাচু করতে থাকে। ড্রেস দেখে চিনে ফেলবে বলে তৃনার বোরখা পড়ে নেয় গাড়িতেই। রোহান বলে, “তৃষা মা?”
মাসুদ বলে, “ভাবিরা দুই বোন হয়।”
“ওওও তাই নাকি?
তৃনা নির্লিপ্তে বলে”রুমুর পাপা কোথায়?”
“উপরে রুমে আছে মা। ঐ মা কে স্যারের রুমে নিয়ে যা।”
কাজের লোকের সাথে রায়ানের রুমের সামনে চলে আসে। দরজায় নক করা শুনে দরজা খুলে রায়ান। তৃনার কোলে রুমুকে দেখে বড় শ্বাস ফেলে। তৃনার দিকে চোখ পড়ে। নিকাবে শুধু ছল ছল করা চোখ দুটোয় ভেসে আছে। চোখদুটো চেনা চেনা লাগে রায়ানের কাছে। তৃনা ভিতরে ঢুকে রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। ঘুমন্ত রুমুকে রায়ান কোলে তুলে নিয়ে তৃনার দিকে তাকিয়ে বলে”ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবোনা আপনাকে। বসুন প্লিজ। কেমন আছেন?”
তৃনা রায়ানের দিকে তাকায়। খাটে বসে বলে, “আলহামদুলিল্লাহ। একটা কথা বলবো আপনাকে যদি অনুমতি দেন।”
রায়ান তৃনার সামনে বসে বলে, “বলুন”
“অনুরোধ বলতে পারেন।”
“সিউর বলুন।”
তৃনা রায়ানের চোখে চোখ রেখে বলে, “একটু ভালোবাসবেন রুমুকে?
মুহূর্তেই রায়ানের বুক কেপে উঠে। এ কোন চাহনি? এ কোন আকুলতা ভরা ভালোবাসার আবেদন? মন ঢেকে উঠে তৃনলতা…।
তৃনা উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে
“আসি।”আসসালামু আলাইকুম।”
উঠে যেতে নিলে রায়ান বলে, “নাম কি আপনার?”
“আমি তৃষার বড় বোন। তৃষা বাইরে দাড়িয়ে আছিস কেনো? ভেতরে আয়। উনার সাথে কথা বল।”
দরজার পাশে তৃষা দাড়িয়ে ছিলো। তৃষা ভেতরে আসতেই তৃনা বেরিয়ে যায়। তৃষা রায়ানের সামনে গিয়ে দাড়ায়। রায়ান তৃষাকে এক হাত ধরে কাছে নিয়ে বলে”থ্যাংক ইউ তৃষা। আমার মেয়ে টাকে বাচানোর জন্য। এখন তো ও শুদু আমার নয় ..আমার আর তোমার মেয়ে।”
তৃষার নিজের উপর নিজের ঘৃনা হচ্ছে এবার। এতোটা খারাপ কাজ কিভাবে করলো ও। ওর ই বা দোষ কি! লিনা এসে এমন ভাবে কান্নাকাটি করেছিলো যে রুমুর জন্য ও মরেই যাবে। মায়ের আর্তনাদ শুনে রুমুকে মায়ের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলো। সে তো আর জানতো না লিনা কতটা স্বার্থপর মহিলা। আর সে নিজেও রুমুকে একটা ভেজাল ভাবে। পরের মেয়েকে নিজের মেয়ে ভাবতে পারবেনা সে কখোনোই। নিজেকে সামলে বলে
“আমি না আপু বাচিয়েছে রুমুকে।”
“এই তোমার বোন? তোমার বোনকে তো আগে কখনো দেখিনি। তোমাদের বাসায় গিয়েও দেখলাম না। শ্বশুর বাড়িতে ছিলো বুঝি?”
“আপু বিয়ে করে নি।”
“কেনো? আমি কি ফাস্ট হয়ে যাচ্ছি?”
“আপু কোনদিন বিয়ে করবে না। আপু একজনকে ভালোবাসতো। কিন্তু আপুকে ঐ লোক ভালোবাসতো না। লোকটা বিয়ে করে ফেলে। আপু আর কাউকে মেনে নিতে পারেনি।
“
“স্ট্রেঞ্জ। তবে এটাও ঠিক। যাকে একবার মন থৈকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো ভুলা যায় না। তবুও জীবন জীবনের গতিতে চলতে দেওয়া উচিত। থেমে গেলে সব শেষ।”
“কেউ পারে কেউ পারে না।”
পর্ব ১৪
বাসা থেকে বেরোনোর সময় দারোয়ান এসে একটা চিঠি রায়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে”স্যার একজন মহিলা আপনাকে এই চিঠিটা দিয়ে যেতে বলেছেন।”
রায়ান হেসে দিয়ে বলে, “চিঠি! এই যুগে আবার কেউ চিঠি দেয় নাকি! মহিলার নাম বলে নি?”
“না স্যার শুধু বলেছে আপনার হাতেই যেন দেই।”
“দেখতে কেমন?”
“বোরখা পড়া ছিলো স্যার।”
“ওকে। গেইট খুলো। গাড়ি বের করবো।”
চিঠিটা হাতে নিয়ে রায়ান ভাবতে থাকে কে দিলো চিঠি? আবার কি খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে? গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। রেস্টুরেন্টে এসে বসে। সামনে বিয়ে জন্য তারাহুরা করে সব ক্লাইন্টের সালে মিটিং গুলো করে ফেলতে হচ্ছে। ক্লাইন্টকে ফোন দিতে গিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতেই চিঠিটা পড়ে যায়। রায়ান চিঠিটা তুলে নেয়। ক্লাইন্টের সাথে কথা বলে যানতে পারে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পৌছে যাবে। এতক্ষন ওয়েট করতে হবে জন্য একটা কফি অর্ডার করে। বসে চিঠিটা হাতে তুলে নেয়। খুলতেই হাতের লেখা দেখে মনে হয় খুব চেনা হাতের লেখা।
পড়তে থাকে আসসালামু আলাইকুম,
মি. রায়ান চৌধুরী আমি আপনার হবু বড় শালিকা তৃষার বড় বোন। আশা করি চিনতে পেরেছেন। একপ্রকার বাধ্য হয়েই আপনাকে চিঠি লিখলাম। আপনার কাছে বিশেষ অনুরোধ যে আপনি আমার এই চিঠি লেখার কথা নিজের মাঝেই রাখবেন। আমি আপনার অতীত বর্তমান সম্পর্কে অনেকটাই জানি। আর তৃষাকে চিনি। জানেন তো আমি কখনো চাই নি আপনার মতো কারো সাথে তৃষার বিয়ে হোক।
শুধু আমি কেন সব বোনই চাইবে তার আদরের বোনটার এমন একজনের সাথে বিয়ে হোক যে হবে উত্তম চরিত্রের পুরুষ। আপনার কতটুকু টান আছে তৃষার প্রতি আমি জানি না কিন্তু তৃষার কথা জানি। এমন পরিস্থিতিতে তৃষা দোটানায় ভুগছে এবং আমি এটা স্বাভাবিক মনে করি। ব্যপারটা বিয়ে অব্দি গড়িয়েছে এবং দুদিন পর আপনাদের বিয়ে তাই আর সম্ভব না পিছিয়ে যাওয়া। আপনারা সুখী হন মনে প্রানে চাই কিন্তু আপনার মেয়েটাও একটু ভালো থাকুক সেটাও চাই। দুদিনে মেয়েটার প্রতি মায়া পড়ে গেছে।
জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি হুটহাট একজনের মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে মেনে নেওয়া যায় না। আস্তে আস্তে মায়া পড়ে যায়। রুমুর সম্পর্কে যা জানলাম মেয়েটা জন্মের পর থেকে দুঃখী। হয়তো তার ভাগ্য ই এমন। তৃষার না হয় একটু সময় লাগবে অন্যের মেয়ে তাই কিন্তু আপনার তো নিজের মেয়ে। প্লিজ নতুন জীবনের সূচনার ঢেউয়ে মেয়েকে ভুলে যাবেন না। রুমুর আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আপনার বাবা মা আর কতো দিনই বা বাচবে। মেয়ের প্রতি যত্মশীল হন। অনধিকার চর্চা করে ফেললাম। ক্ষমা করবেন।
ইতি,
রুমুর শুভাকাঙ্খী
চিঠিটা পড়ার পর থেকে রায়ান ভাবুক হয়ে উঠে। তৃষার যদি রুমুকে নিয়ে কোন দ্বিধা থেকে থাকে তাহলে এই বিয়ে কিছুতেই করা উচিত নয়। প্রত্যেক্ষ ভাবে রুমুকে একজন মম দেওয়ার জন্যই এই বিয়ে। নয়তো আমার কারো প্রতি কোন _
রোহানা রায়ানকে ডেকে বলে, “এতোগুলো গহনা কারো হাতে পাঠানোর সাহস পাচ্ছি না। তুই একটু যানা বাবা দিয়ে আয় গহনা গুলো।”
“মম আমার যাওয়া কি ঠিক হবে? পরশু বিয়ে আজ কি ভাববে সবাই?”
“মাসুদ টা তো কাজে ব্যস্ত। নয়তো ওকে দিয়েই দিতাম দিয়ে আসার জন্য। যা না বাবা প্লিজ।”
“ওকে।”
রায়ান হাতে গহনার বক্স গুলো নিয়ে তৃনাদের বাড়িতে চলে আসে। বাড়ি সাজানো হচ্ছে ডেকারেশনের লোক দিয়ে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে জন্য ভিতরেই সাজাচ্ছে। রায়ান ও গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকতে যতক্ষন লাগে ততক্ষনে ভিজে গেছে। রায়ান ভেতরে যেতেই রায়ানকে দেখে কয়েকজন গিরে ধরে রসিকতা শুরু করে দেয়। পারুলকে বলে তোমার জামাই এসেছে গো। কোথায় সরে থাকছো জামাই কে ছেড়ে। তৃষার সমবয়সীরা বলে আমাদের তৃষার কি কপাল ..বিয়ের একদিন বাকি তাতেই যে তর সইছে না। দেখা করতে চলে আসছে একদম ভিজে ভিজে। রায়ান এতো মানুষের মাঝে বাড়ির কাউকে দেখতে পায় না।
রান্নাঘর থেকে পারুলকে আসতে দেখে ভিড় ঠেলে পারুলের কাছে যায়। পারুল গহনা গুলো হাসি মুখে নিলে রায়ান কিছুটা সংকোচ নিয়েই বলে
“আন্টি বাড়ির আর সবাই কোথায়?”
পারুল বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বলে, “উপরে বাবা। যাও তুমি।”
রায়ান উপরে চলে আসে। উদ্দেশ্য তৃষার সাথে কথা বলা রুমুকে নিয়ে। রুমে এসে দেখে কেউ নেই। বেরিয়ে যেতেই সিড়ির দিকে একটা মেয়েকে যেতে দেখে। এগিয়ে যেতেই সিড়ি বেয়ে উঠতে দেখে এক রমনী কে। ছাই রঙ্গের জরজেট শাড়িতে ছিমছাম গড়নে নজর কেডে নিচ্ছে। শাড়ি লুজ হয়ে পেছনে কোমড়টা বেরিয়ে আছে। হাটু পর্যন্ত লম্বা চুলের বেনুনী হাটার তালে তালে দুলছে। তৃষা কখনো শাড়ি পড়বেনা এই সময় আর পড়লেও এই রঙ্গের পড়বেনা। তাহলে কে? তৃষার বোন?
পেছন পেছন পা বাড়ায় রায়ান। ছাদের দরজা পেরিয়ে বৃষ্টির জলে গা ভিজিয়ে দেয়। ছাদের রেলিং ধরে আকাশের দিকে মুখ করে নিজেকে উৎসর্গ করে বৃষ্টি জলে। দরজা অব্দি থেমে যায় রায়ান। বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে লেপ্টে গেছে শাড়ী। বুকের ভিতর ডিপ ডিপ করে রায়ানের। ঘোর লেগে যায় রায়ানের চোখে। বৃষ্টির সুরে মিস্টি কন্ঠে গান ভেসে আসে~ –
যদি মন কাদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়
এসো ঝরঝর বৃষ্টিতে, জলভরা দৃষ্টিতে
যদি কোমলও শ্যামলও ছায়
চলে এসো তুমি চলে এসো এক বরষায়
যদি মন কাদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়
যদিও তখন আকাশ থাকবে তৈরী
কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরী
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ঝলকে ঝলকে নাচিবে বিজলি আলো
তুমি চলে এসো এক বরষায়
যদি মন কাদে তুমি চলে এসো এক বরষায়। …
পিছু ঘুরতেই চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে দরজায় লেগে পড়ে রায়ান। মাথাটা ঘুরে যায় এক মুহুর্তের জন্য। শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ পতঙ্গ যেনো আর্তনাদ করে উঠে তৃনলতা বলে। পায়ের নিচে ছাদটা যেনো কাপছে মনে হয়। আর দাড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে পড়ে রায়ান। কাপা ঠোটে মৃদু স্বরে বলে উঠে”তৃনলতা…”।
অসার দেহটি তুলে কোনমতে উল্টোদিকে পা ফেলে।
তৃষা একটু বের হবে কিন্তু মনোয়ার একা বেরোতে না করেছে। তৃনা মাত্রই বাসায় ফিরেছে। টায়ার্ড থাকার জন্য যেতে পারছেনা। তৃনা বলে
“তৃষা তুই ভাইয়াকে নিয়ে যা।”
“কিন্তু ভাইয়া কোথায়?”
“ফোন দে তাহলেই তো হবে।”
তৃষা ফোন তৃনার হাতে দিয়ে বলে”তুমি বলো আপু। আমার সাথে ঝগড়া করেছে।”
“তোরা আবার ঝগড়া করেছিস! পারিস ও বটে।”
তৃনা ফোন দিচ্ছে কিন্তু ধরছে না রবিন। পারুল এসে বলে”রবিন তো বাসাতেই আছে।”
তৃনা রেগে যায়। রবিন কে কক্ষোনো পায় না। রবিনের রুমে এসে দেখে রবিন নেই। হতাশা নিয়ে বিছানায় বসে আবার কল দেয়। রুমেই ফোন বেজে উঠে। এদিক ওদিক খুজে দেখে বালিশের নিচে ফোন বাজছে। তার মানে রবিন বাসাতেই আছে। রবিনের ফোন হাতে নিয়ে চমকে উঠে। যুথিকা ইজ কলিং! তৃনা ফোন কেটে আবার ফোন দেয়।
আবার স্কিনে ভেসে উঠে”যুথিকা ইজ কলিং”। ফোন কেটে তৃনা রবিনের কল লিস্ট দেখে সবার নাম্বার সবার নামে সেভ করা শুধু যুথিকা নামের নাম্বারটা তৃষার নাম্বার। আননোন নাম্বার আর খুজে পায় না তৃনা। তার মানে কি? তৃনা গ্যালারি তে ঢুকে আরো অবাক। যুথিকা দিয়ে এক গ্যালারি ভর্তি শুধু তৃনার ছবি। তার মানে যুথিকাই তৃনা? তৃনাই ভাইয়ার যুথিকা!
খট করে বাথরুমের দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে রবিন।
তৃনার হাতে নিজের ফোন দেখে দৌড়ে এসে ছো মেরে নিয়ে নেয়। রবিনকে কিছু বলতে না দিয়ে তৃনাই বলে”যুথিকা ভাবিই আমাদের তৃষা তাই না ভাইয়া?”
রবিন পিছু ঘুরে বলে, “না। তৃষা কেনো হবে?”
“মিথ্যা বলো না ভাইয়া। তুমি তৃষাকে ভালোবাসো। তৃষাকেই তুমি যুথিকা বলে ডাকো। এর জন্যেই যতবার আমি যুথিকাকে দেখতে চেয়েছি ততোবার ই তুমি আমাকে এড়িয়ে গিয়েছো। ছবিও দেখাওনি। কখনো বলোনি আমাকে তৃষাই তোমার যুথিকা। এর জন্যেই তৃষার প্রতি তোমার এতো রাগ এতো ক্ষোভ। তৃষার বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে তুমার সব কিছু চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমি আর চিনতে পারিনা আমার ভাইয়াকে। তুমার মুখে সব সময় কষ্টের ছাপ দেখতে পাই আমি।”
“চুপ হয়ে যা তৃনা। বোনের বিয়ে মজা কর যা।”
তৃনা এসে রবিনের দু হাত ধরে বলে, “এ হয় না ভাইয়া। এতো যখন ভালোবাসো তখন কেনো ওর বিয়ে হতে দিচ্ছো? আমি পারবোনা আমার ভাইয়াকে এভাবে দিনে দিনে কষ্ট পেতে দেখতে। তুমি আমার ভাইয়া আমি তোমাকে চিনি। তুমিও আমার মতোই জীবন বেছে নিচ্ছো। যে কষ্ট আমি পেয়েছি সেই কষ্ট আমি তোমাকে পেতে দিবো না। এই বিয়ে এক্ষুনি পন্ড করবো আমি। তুমি আমাকে আগে কেনো বলোনি ভাইয়া …”
“চুপ চুপ। আর একটাও কথা নয়। তুই বলেছিস তোর কোন কথা?”
চুপ হয়ে কাদতে থাকে তৃনা।
“ভাইয়া এখোনো সময় আছে ফুপি আর বাবাকে বলো প্লিজ।”
“বলেছিলাম।”
“কি বলেছে উনারা? রাজি হয় নি তাই না?”
“দুই বছর আগে তোর মনে আছে আমি ড্রিংস করতাম? তৃষার জন্য করতাম। বাবাকে বলেছিলাম বাবা আমি তৃষাকে বিয়ে করতে চাই। বাবা অবাক হয়। তারপর আম্মু বাবাকে বুঝিয়ে বলে যে নিজেদের মেয়ে এতোবছর ভালোবাসা দিয়ে লালন পালন করলো বাইরে কোন ছেলের হাতে না দিয়ে নিজেদের ঘরের মেয়ে ঘরেই রাখলে ভালো। তার পর বাবা ফুপির কাছে এই প্রস্তাব রাখতেই ফুপি বলে”আগেই বলতে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। এতো বছর খাওয়ালে পড়ালে জন্য এখন শোধ বোধ চাইছো?”
বাবা অপমান বোধ করে। তারপর রাতে ফুপি আমার রুমে এসে আমার গায়ে হাত তুলে। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমি নাকি তৃষার যোগ্য না। সুন্দরী দেখতে বলে বোনের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিই। আমার থেকে হাজার গুন ধনী ভালো ছেলে তৃষা ডিজার্ব করে। আমি সামান্য চাকরী করি তৃষার খরচ বহন করার ক্ষমতা আমার নেই। তৃষা রাজরানী হয়ে থাকবে তৃষার পেছনে কতো ধনী বাবার ছেলেরা ঘুড়ে বেড়ায় সেখানে আমি কোন ছা পোষা! আমাকে কসম দেয় যেনো আমি আর তৃষার দিকে হাত না বাড়াই। শুধু আমাকে না তোর নামেও অনেক বাজে কথা বলে আমি তোকে বলতে পারবো না সেসব কথা।
দরজায় দাড়িয়ে বাবা সব ই শুনে। বাবা ফুপির উপর রেগে যায়। ফুপিকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চায়। কিন্তু আম্মু বাবাকে বুঝায় যে ফুপির বাবা ছাড়া কোন স্থান নেই। ফুপি ভুলভাল কথা বলেছে কিন্তু তৃষা তো কিছু করেনি। ফুলের মতো মেয়েটা রাস্তায় পড়ে থাকবে এটা কিভাবে হতে দেওয়া যায়? বাবা মেনে নেয়। পরদিন বাবা আমাকে ডেকে সাবধান করে দেয়। আমি যেনো তৃষাকে বোন ছাড়া অন্য কোন চোখে না দেখি আর তৃষার থেকে দূরে দূরে সরে থাকি কথা আদায় করে নেয়। আমি মেনে নিয়েছিলাম সবটা।
কিন্তু সহ্য করতে পারিনি। এতোটা অপমান আমার পাওনা ছিলো না। শুরু করি ড্রিংস করা। তারপর যুথিকা নামে একটা ফ্রেন্ড আমার জীবনে আসে। আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে। অয়েকদিন পর ওর বিয়ে হয়ে যায়। যুথিকার দিকে আমি সবসময় তাকিয়ে থাকতাম। ওর মধ্যে আমি তৃষাকে দেখতে পেতাম সব সময়। আমার মনে হতো এইতো তৃষাকে পেয়েছি আমি। তৃষার নাম দিলাম যুথিকা। আমার যুথিকা বিয়ে হবে এবার।”
“একবার চলে গেলে আর পাবে না ভাইয়া। চলো বাবাকে বলো। আমিও এবার ফুপিকে বুঝাবো। তুমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবো না আমি।”
“তৃষাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবি? তৃষা কিন্তু রায়ানকে ভালোবাসে বিয়ে করছে আর রায়ান ও। এখন চাইলেও কিছুই আটকানো যাবে না তৃনা। ওদের যে গায়ে হলুদ। আর আমি চাই তৃষা ভালো থাকুক।”
“আমি তোমার কষ্ট ও সহ্য করতে পারবোনা আর তৃষার কষ্ট ও সহ্য করতে পারবো না।
“
“তৃষার কষ্ট তোকে সহ্য করতে হবে না। তুই আমার কষ্ট সহ্য কর যেমনটি আমি করেছিলাম যখন তুই হুট করেই দুই দিন অজ্ঞান হসপিটালে পড়ে ছিলি। ছেলেটা কে আমি আজো জানতে পারলাম না।”
তৃনা ছল ছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে
“জানো ভাইয়া ছেলেটা কে?”
“কে? বল আমাকে। আমি খুজে বের করবো ওকে।”
“তোমার যুথিকার হবু বর।”
পর্ব ১৫
বাসায় ফিরে রুমের দরজা বন্ধ করে ফ্লোরেই বসে পড়ে রায়ান। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে এক পলক তাকিয়ে থাকে। টেবিলে গিয়ে ডায়রীটা বের করে হাতের লেখা এক দেখে বুঝতে পারে এতোদিন তার হাতে তৃনলতার ডায়েরীই ছিলো। পাতা উল্টিয়ে আগের পড়া পৃষ্টার পর পৃষ্টাগুলোয় চোখ রাখে।
ডায়েরীতে ~ –
“তুমিযে ভালোবাসো আমাকে তা আমার অজানা নয়। তুমি আড়ালে আবড়ালে ঠিক ই আমাতে নজর রাখো। তোমার একটু একটু প্রশংসায় তা প্রকাশ্য। আজকাল সাজতে ইচ্ছা হয় খুব তোমার একটুকু প্রশংসা পাওয়ার লোভে।”
“বাবা বলল একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। জিনিসপত্রগুলো হাতে নিয়েই তোমাকে আবিষ্কার করি। দৌড়ে গিয়ে তোমাকে দেখেই আমার কলিজা কেপে উঠে। শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম সারাজীবনের জন্য। তুমি মরে গেলে আমার বেচে থাকার সব টা শেষ হয়ে যাবে। বাবা আম্মুর জন্য ভাইয়া আছে। তোমার ক্রেডিট কার্ডের টাকা দিয়ে আর আমার রক্ত দিয়ে বাচিয়েছিলাম তোমায়। আমার রক্ত তোমার শিরায় শিরায় মিশে গেছে।
এবার দেখি ভালোনাবেসে থাকো কোথায়!”
“লিনা আপু, মিম আপু, জারা আপু প্রায়ই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। আমি তোমাকে কিছুই বলিনা। কারন আমি জানি তুমি ওদের উচিত জবাব দিবে। তারপর তারা আমার উপর হিংস্র হয়ে উঠবে। লিনা আপু মিসবিহেব ও করে। আমার তাতে দুঃখ নেই। কারন দিন শেষে তুমি আমার ই।”
“আজ এতটা কাছে পাবো তোমায় সপ্নেও ভাবি নি। বুকের ঠিক মাঝখানটায় ছিলে তুমি। এতোটা কঠিন যন্ত্রনার সুখ আমি কখনো পায়নি। ক্ষতস্থানের জালায় আমার পিঠেও নখ বসিয়ে দিয়ে ক্ষত করে দিয়েছো তুমি। এই ক্ষত যেনো কখনো না মিশে। আমার প্রথম ভালোবাসার পরশ অক্ষত যেনো থাকে। তোমার তপ্ত নিঃশ্বাস বুকটাকে জালিয়ে দিয়েছে আমার।
হায় ..এই পুড়া বুক আমি কাকে দেখাই!”
“আজ আমি তোমায় দেখিলাম অন্য একজনের সাথে
যেভাবে সপ্নে এসে চুম্বন দিয়ে যাও আমার শুষ্ক ওষ্ঠে।”
“তোমাকে নিয়ে হাটতে চেয়েছিলাম,
জীবনভর মরন ডরে ..
সে বোধয় আর হয়ে উঠবেনা, মনে হচ্ছে বাধা পড়বে
আমার এই শুষ্ক পাতার ভাজে _“
“অপেক্ষা করবো আজীবন, জানে এই নরাধম
ফিরে আসিবে তুমি এই তটিনীতে।”
“তোমার চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি। সময় কথা বলে। একবার কাছে এসো। অফুরন্ত ভালোবাসা আদায় করে নিবো একটু ভালোবাসবেন আমায় বলে বলে।”
“আমি ভুল ছিলাম। ব্যর্থ আমি। তোমার হৃদয়ে এতোটুকু জায়গা করতে পারিনি বলে। আমি ছুয়ে দিতে পারিনি তোমাকে।
আমার কান্না কষ্ট রক্ত কোন কিছুই ব্যথিত করতে পারেনি তোমাকে।”
“স্বজ্ঞানে ফিরে আসার জানতে পারি তিনদিন পেরিয়ে গেছে এই হসপিটালের বেডে। জ্ঞান না ফিরলে একটু হয়তো সুখ পেতাম কারন জানি তুমি হীনা হবোনা কখনোও সুখী।
তোমাকে নিয়ে লেখার ছিলো অনেক কিছু কিন্তু ভাষা হারিয়েফেলেছি ছন্দ হারিয়ে ফেলেছি যতটুকু ছিল সবটাই চাপা পড়ে থাকুক ডায়েরির শুষ্ক পাতার ভাজে ভাজে”
বুকের ভেতর কি হচ্ছে একমাত্র সেই বুঝছে। চিঠিটা সহ ডায়েরীটা বুকে জড়িয়ে চোখের দু ফোটা জল ফেলে বলে”আমি ব্যর্থ তৃনলতা। আমার জন্য ই তুমি আজো একা। নিজের সাথে অন্যকাউকে জড়াতে দাও নি। এতোটা ভালোবাসো আমাকে তুমি।
তৃনলতা…আমি তোমার অযোগ্য তৃনলতা। তুমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছো। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয় আমি। আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি তৃনলতা। দিনের পর দিন আমি তোমাকে কষ্ট দিয়ে গেছি। আমি তোমাকে সামনে পেয়েও চিনতে পারিনি। কিন্তু দিন শেষে আমি তোমার ই রয়ে গেছি। তোমাকে পারিনি কিছুতেই ভুলতে।
তুমি থাকাকালীন আমি কাউকে চুমু দেই নি। জারা হুটহাট চুমু দিয়ে বসে। ওকে সরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। তার আগেই তুমি দেখে নিয়েছিলে। আমি স্বজ্ঞানে তোমার বুকে মাথা রেখেছিলাম। কারন আমি আমার মমের পরে তুমার বুকে আশ্রয় খুজেছিলাম। তোমার কান্না তোমার কষ্ট তোমার ঠোটের রক্ত আমাকে স্তব্দ করেছিলো তৃনলতা। আমার প্রতিবাদ তোমার চোখে পড়েনি। আই এম সরি তৃনলতা। আই এম সরি।”
বৃষ্টি রাতেই থেমে গিয়েছে। সকালের মধ্যে তারাহুরা করে বাইরেরটা ডেকোরেট করা হয়ে গিয়েছে। তৃষাকে সাজাতে পার্লারের মেয়েরা এসেছে। রায়ানের দেওয়া হলুদের লেহেংগা টি পড়ছে তৃষা। পড়া শেষে আয়নায় নিজেকে দেখে লাফিয়ে উঠে। গোলাপী শরীরে গোলাপী লেহেংগা সৌন্দর্য হাজার গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। লেহেংগা উচিয়ে ধরে আনন্দে একবার ঘুরে। তুলিকে বলা ছিলো ভিডিও করতে। ভিডিও টি সহ আরো কয়েকটি সেলফি কুলফি রায়ানকে সেন্ড করে দেয়। গায়ের গহনা গুলো পড়ে নিয়ে ফটোশুট করতে থাকে। তৃনার একটা স্পেশাল ক্লাস নেওয়ার ছিলো বলে কলেজে আসতে হয়েছে। কলেজের গেইটে ডুকতেই দাড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন ছাত্র বসে বসে মেয়েদের দেখে দেখে গান গাইছে।
~ আইতেও দেখি, যাইতেও দেখি, দেখি সারাক্ষন
তোমায় না দেখিলে ভাল্লাগেনা
ও ভার্সিটির ছোট বউ, সরি বোন।
টুনি নামের একটা মেয়েকে দেখে গাইতে থাকে
ঐ টুনির মা তোমার টুনি দুই দিন ভার্সিটি আসে না
টুনিরে না দেখলে আমার মন ভরে।
টুনি মেয়েটি পেছন থেকে লাথি দেখিয়ে চলে যায়।
আরেকটা মেয়ে সামনে দিয়ে যেতেই ডাক দেয়
~ এই এই এই ময়দা সুন্দরী কাম হেয়ার।
মেয়েটা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। গুটি গুটি পায়ে ছেলে গুলোর সামনে চলে যায়।
~ ফাস্ট ইয়ার?
মেয়েটা মাথা নাড়ায়।
~ আরে..ভাই .. আমাদের ভার্সিটির মধ্যে এতো ময়দা সুন্দীর উপদ্রব বেড়েছে আগে কইবিনা? স্প্রে মাইরা দিতাম। তো আপু কোন ব্রান্ডের ময়দা মেখেছো দেখি।
গালে হাত দিতেই মেয়েটা সরে দাড়ায়। ভয়ে ভয়ে বলে
~ এটা আমার ন্যাচারাল স্কিন ভাইয়া।
~ আরে মাইয়া কি বলে? ন্যাচারাল স্কিন নাকি!
~ জি ভাইয়া।
~ তুমি বললে আর আমি বিশ্বাস করলাম তাই না? কই দেখি দেখি।
আবার গালে হাত দিলে মেয়েটি সরিয়ে দিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে ~ বার বার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?
এবার আর তৃনা সহ্য করতে পারে না। এগিয়ে গিয়ে ছেলেগুলোর সামনে দাড়িয়ে বলে
“কলেজে কি মেয়েরা কি করলো কি না করলো সেটা দেখার জন্য এসেছো? এসব কি হচ্ছে টা কি?”
“মেম আমি শুধু দেখছিলাম ছোট বোনের ন্যাচারাল কি না।”
“ও বলেনি ন্যাচারাল স্কিন? যারা সেজে গুজে আসে তাদের পিছু তো লাগতে পারো না। যেই দেখেছো সুন্দরী আর ফাস্ট ইয়ার সেই ছলে বলে গালে হাত দিচ্ছো। বিশ্বাস হয়না না? এটাও কি বিশ্বাস হয় না?
মুখ থেকে নেক আপ খুলে বলে ~ ধরো। ধরে দেখো ন্যাচারাল কি না? নাকি এটাও বলে আর্টিফিসিয়াল বিশ্বাস হচ্ছে না ব্লা ব্লা?
ছেলেগুলো থতমত খেয়ে যায় তৃনার এমন বিহেব দেখে। এই প্রথম তৃনা নিজের মুখ খুলেছে ভার্সিটি প্রাঙ্গনে। আশেপাশের ছেলে মেয়েরাও তাকিয়ে আছে স্মিগ্ধ মায়াময়ী মুখপানে। সাথে গেইটের বাইরে গাড়ি থেকে আরো দু জোড়া চোখ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ছেলেগুলো ভয় পেয়ে তৃনার পায়ে পড়ে যায়। মিনতি করে বলে ~ মেম মেম এবারের মতো মাফ করে দেন।
আর হবে না এমন। এবারের মতো মাফ করে দেন।
~ তোমাদের ব্যান করার ব্যবস্থা করছি আমি।
গাড়ি থেকে নামতেই রায়ান বলে, “মাসুদ কোথায় যাস?””তোর তৃনলতাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগটা কাজে লাগাতে যাচ্ছি।”
মাসুদ তৃনার সামনে যেতেই তৃনা বলে, “আপনি রুমুর আংকেল তাইনা?”
“আর আপনি তৃনলতা।”
চমকে উঠে তৃনা। কিছু না বলে জোরে হেটে প্রস্থান করে।
তৃনাকে ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দেয় তৃষা। হাতে গোলাপি পাড়ের একটা হলুদ শাড়ি দিয়ে বলে, “আজকে না শুনবোনা আপু। আজকে সাজতেই হবে। আমি সাজিয়ে দিবো তোমাকে।”
“আমি সাজি না তৃষা।”
“মানলাম তুমি সাজো না। আমার গায়ে হলুদের দিন তো সাজতেই পারো আপু। তোমাকে আমার পাশে দেখতে চাই। চলেই তো যাবো। এই টুকুনিই তো চাওয়া।”
তৃনাকে শাড়ি পরিয়ে দেয় তৃষা। চুলগুলো খোলে দেয়। কানের পাশে হলুদ গাধা ফুল আটকে দেয়। মুখে একটু সাঝ। তাতেই যেনো চোখ ফেরানো দায়। তৃষা বোনকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা। গালে চুমু দিয়ে বলে”আল্লাহ আপু তুমার এতো রুপ কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে?”
তৃনা মুচকি হাসে। তৃষা অনেকগুলো সেলফি তুলে রায়ানকে পাঠিয়ে দেয়। তৃষার পাশে এই সাঝে তৃনাকে দেখে রায়ানের নয়ন জোড়ায়।
সন্ধ্যায় আনন্দে হৈ হুল্লা করে হলুদ অনুষ্টান হয়। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তৃনা বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। ভিতরের কষ্ট গুলো চারদেয়ালে আর বন্দি না করে চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে চাইছে। ঠান্ডা হাওয়ায় রাস্তার পাশ দিয়ে আনমনে হাটতে থাকে। এলোমেলো চুল গুলো হাওয়ায় আরো এলোমেলো হয়ে গেছে। শাড়ির লম্বা আচল উড়ে যাচ্ছে পার বার। হাটতে হাটতে কখন যে রাস্তার মাঝে এসে পড়ে খেয়াল করেনি। একটুর জন্য গাড়ি চাপা পড়ে না।
গাড়ির ড্রাইভার বকতে বকতে চলে যায়। হাটতে হাটতে নদীর পাড়ে চলে আসে। নদীর তীরে দাড়িয়ে আধো আলোয় ঢেউয়ের খেলা দেখতে থাকে। এই ঢেউগুলো সবাই দেখতে পায় আর বুকের মধ্যে যে ঢেউ চলছে সেটা কে দেখবে? কে গুনবে এই উত্তাল গুলো? ঘাসের উপর বসে ভেতরের আর্তনাদ গুলো বের করে দেয়। রাতের পরিবেশ হয়ে উঠে এক নারী অসহায়ের চিৎকারে অশান্ত।
আধার কেটে সকালের আলো ফুটে উঠে। কেটে যায় এক নির্ঘুম রাত। বাড়ি ফিরতে হবে ভেবে উঠে দড়ায় তৃনা। পেছন ঘুরতেই চমকে উঠে। এক পা দু পা পিছিয়ে চলে যেতে চেয়ে পিছু ঘুরতেই হাতে টান পড়ে। হলুদে হলুদ হয়ে যায় শক্ত বাধনে আটকানো হাত টুকু। ঝাঝরা করে দেয় এক মোহনীয় ডাক”তৃনলতা………”
পর্ব ১৬
{ বিবাহ পর্ব }
তৃনা ভয়ে ভয়ে পেছন দিক তাকায়। হাতটা টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে নদীর জলে হাত ভেজায়। গায়ের চামড়ায় হলুদ লেগে ফর্সা হাত হলুদ হয়ে আছে যা উঠবার নয়। শাড়ির আচল দিয়ে হাত মুছলেও হলুদ দাগ যাচ্ছে না। সেই হাতের দিকে তাকিয়ে বলে ~ কেমন আছো তৃনলতা?
চোখ তুলে তাকায় তৃনা। হলুদ পাঞ্চাবীতে হলুদ লাগানো গায়ে দাড়িয়ে আছে রায়ান। পাঞ্জাবীতে গতকালের লাগানো হলুদ কিছুটা শুকিয়ে শুকিয়ে আছে। রায়ান খেয়াল করে বলে ~ গোছল করা হয়নি। এখানেই ছিলাম এতোক্ষন। এভাবে সারারাত একা বাইরে কাটানোর দুঃসাহস তুমিই দেখাতে পারো। চোখ নামিয়ে নদীর ওপারে তাকায় তৃনা। মনে মনে আওড়াতে থাকে”এই দেখা না হলেও পারতো। আমি চাই নি ..আমি চাইনি এটা। হে আল্লাহ সবটা স্বাভাবিক রাখো আল্লাহ। আমাকে শক্ত করো।”
রায়ান এসে তৃনার দুহাত দূরত্বে বসে পড়ে।
“আমি কি একটার ও উত্তর ডিজার্ব করিনা?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”
“একা একা নদীর তীরে বসে ভুল করেছো।”
“আমার জীবনটাই ভুলে ভরা। আর কোন সমস্যা হয়নি তো। এখনো কিছু ভালো মানুষ পৃথিবীতে আছে। সবাই সৌন্দর্য শরীরের পূজারী নয়।”
চোখ নিচে নামিয়ে নেয় রায়ান। অপরাধবোধের ডালাটা উপচে পড়ে।
“এখানে কেনো আপনি? কখন এসেছেন?”
“কাল রাতে। এরকম লুকোচুরি না করলেও পারতে তৃনলতা।”
“করলেই কি আর না করলেই কি? আপনি কি বিয়েটা বেস্থে দিতে চাইছেন? দয়া করে এটা করবেন না। আপনি আমাকে নাই বা সহ্য করতে পারেন কিন্তু আমার বোনকে তো ভালোবাসেন, তার জন্যই তো বিয়ে করতে চাইছেন। তৃষা সব দিক থেকেই আপনার যোগ্য। আমার বোনটাকে নিয়ে সুখী হন দোয়া করি।”
“আই এম সরি তৃনলতা।”
“আমার নাম তৃনা।”
রায়ান দুবার মাথা ঝাকায়। দুজনে চুপচাপ বসে থাকে নদীর পানির দিকে তাকিয়ে। সূর্য তখন প্রায় মাথার উপরে। কেউই নড়াচড়া করছে না। উঠেও যাচ্ছে না। আজীবন বসে থাকতে ইচ্ছা করছে। হটাৎ ই রায়ান বসা থেকে উঠে নদীতে ঝাপ দেয়। এক ফালি নদীর জল ভিজিয়ে দেয় তৃনার মুখ শাড়ী। রায়ানের দিকে একনজর তাকিয়ে উঠে পড়ে তৃনা। অসার হয়ে যাওয়া শরীরটা নিয়ে ধীরপায়ে এগুতে থাকে। পেছন থেকে সেই চলে যাওয়া দেখে একমনে রায়ান।
বড় রাস্তার কাছাকাছি আসতেই দেখে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে রবিন। তারমানে ভাইয়াই রায়ান চৌধূরীকে জানিয়েছে? কিন্তু কেনো করলো এটা ভাইয়া? রবিন গাড়ির গেইট খুলে বলে”উঠে বস।”
“আমি উঠবোনা।”
“থাপ্পর না খেতে চাইলে এক্ষুনী উঠবি। বাবার উপর রাগারাগি করে কখনোই গাড়িতে উঠিস না। সব সময় রিকসা সিএনজিতে চলাচল করিস। কিচ্ছু বলিনি আমি।”
“আমি এই গাড়িতে উঠবোনা ভাইয়া।”
“তাহলে ঐ বাড়িতেও থাকিস না। বাড়িটাও তো বাবার ই। বাবা কি তোর খারাপ চায়? একবার ও ভেবে দেখেছিস বাবা যা করে সব আমাদের দুই ভাই বোনের জন্যই করে।”
“হেটে যেতে পারবো।”
“রায়ানের সাথে যাবি? রায়ান ও হেটে যাবে।”
একনজর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসে তৃনা। রবিন রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামে। একটা প্যাকেট দিয়ে লুকিং গ্লাসে ইশারায় তাকাতে বলে। তৃনা তাকিয়ে নিজেকে একবার দেখে নেয়। এলোমেলো বড় চুল। সামনে ভেজা চুল গুলো মুখের উপর লেপ্টে আছে। সামনের শাড়িও ভেজা। বিদ্ধস্ত চেহারা। তৃনা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেবলে
“পাগলী লাগছে তাই না ভাইয়া?”
“চেঞ্জ করে আয়।”
তৃনা বড় করে মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়। প্যাকেট নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে যায়। রবিন গাড়ি পার্কিং করে রেস্টুরেন্টে চলে আসে। টেবিলে বসে খাবার অর্ডার করে। তৃনা ওয়াশ রুমে গিয়ে শাড়ি খুলে ফেলে। প্যাকেট খুলে অবাক হয়ে যায়। লাল বেনারসী শাড়ি। সাথে ব্লাউজ, পেডিকোট, দোপাট্টা আর টাওয়েল এর গায়ে লেখা”গোছল করে নিস।”এগুলো কেনো? এগুলো কেনো পড়বে? দুটানায় পড়ে যায় তৃনা। আগের শাড়িটাও ভেজা বাধ্য হয়ে পড়তেই হবে। গোছল শেষে শাড়িটা পড়ে নেয়। টাওয়েল দিয়ে চুল বেধে নেয়। আগের কাপড় গুলো প্যাকেটে নিয়ে লম্বা করে ঘোমটা দিয়ে বেড়িয়ে আসে।
আউট ডোরের দিক যেতেই রবিন ভেতর থেকে ডাক দেয়। তৃনা দেখে রবিন বসে বসে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। তৃনা গিয়ে সামনে বসতেই রবিন চোখ তুলে তাকায়। লাল শাড়িতে ঘোমটা দেওয়াতে নতুন বউ লাগছে। গোছল করার জন্য অনেক ফ্রেশ লাগছে। রবিন তৃনার সামনে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
“খেয়ে নে। বাসায় গিয়ে তো আর খাওয়ার সুযোগ পাবি না হাজার রকম ব্যস্ততায়।”
“রায়ান চৌধুরীকে কেনো বলেছো যে আমি ওখানে গিয়েছি?”
“আমি কি জানি তুই ওখানে গিয়েছিস? রায়ান ই আমাকে বললো যে তুই ওখানে। রায়ানের এক ফ্রেন্ড নাকি দেখেছে তোকে। সামনাসামনি হয়েই গেলি।”
“একটা নরমাল ড্রেস দিলেই তো হতো ভাইয়া। শাড়ি দোপাট্টা এসব কেনো?”
“বোনের বিয়েতে নরমাল ড্রেস কে পড়ে? সুতি শাড়ি পড়বি তুই? আর সবার সামনে তো কালকের মতো থাকবিনা। কাল তো বাড়িতে নিজের লোকেরাই ছিলো তাই চুল ছেড়ে শাড়ি পড়ে বসে ছিলি। আজ তো সব বাইরের মানুষ ই দেখবি যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই। তাই দোপাট্টা দিলাম মাথায় দেওয়ার জন্য।
খেয়ে উঠ লিপিস্টিক আছে একটা। লিপিস্টিক ছাড়া লাল মানাবেনা তাই কিনেছি।”
“আমি সাদা কালো মানুষ রঙ্গিন হতে চাই না ভাইয়া।”
“আমার সব থেকে প্রিয় মানুষটি হচ্ছিস তুই। আমার একমাত্র বোন বেস্ট ফ্রেন্ড। অন্যদের কথা না ভাব। যে কটা দিন বেচে আছি মনে রঙ্গ লাগিয়ে নিজেদের মতো ভালো থাকতে দোষ কি? এইটুকু তো চাইতেই পারি আমি তোর কাছে।”
“তুমি কেনো গেঞ্জি পড়ে আছো ভাইয়া? নিশ্চয় নিজের জন্য শপিং করো নি। চলো তোমাকে পাঞ্জাবী কিনে দিবো।”
“অবশ্যই। বোনের বিয়ে বলে কথা সাজতে তো হবেই।”
শপিংমলে একটা পাঞ্জাবী চুজ করে দিয়েছে তৃনা। রবিন চেঞ্জ করতে গেছে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে লিপিস্টিক লাগায় ঠোটে। একদম বউ বউ লাগছে এবার। দোপাট্টা খুলে ফেললে ভালো হতো। একটা লাল হিযআপ কিনে পড়ে দোপাট্টা খুলে ফেলে প্যাকেটে পুরে দেয়। এখন অনেকটা কমফোর্ট লাগছে। এতোক্ষন তো সবাই নতুন বউ বলে তাকিয়েই ছিলো।
এদিকে রবিন খুজে চলেছে তৃনাকে। থার্ড ফ্লোর থেকে সেকেন্ড ফ্লোরে এসে দেখে এই অবস্থা। রবিনকে দেখে তৃনা হাতের ইশারায় নাইস বলে মুচকি হাসে। রবিন বাসায় ফেরার সময় গাড়িতে তৃনার হাতে একটাবক্স এগিয়ে দিয়ে বলে”হাত খালি লাগছে। পড়ে নে। লোকে দেখে তো ছি ছি করবে।”
তৃনা বক্স খুলে দেখে দুইটা চুর।
“ভাইয়া এতো দামি জিনিস কোথায় পেলে?”
“তুই যখন হিযআপ পড়ছেলি তখন সোনার দোকান থেকে কিনেছি।”
“আমি এসব দিয়ে কি করবো ভাইয়া? আমি পড়ি না।”
“এখন দিলাম তোকে তুই পড়। রাখতে না চাইলে ভবিষৎ এ তোর ভাবিকে দিয়ে দিস। আমি তো আর তোর মতো সারাজীবন একা কাটানোর ব্রত পালন করতে পারি না। বিয়ে করবো। তোর ভাতিজি হবে।”
তৃনার মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি।
“আমি তো ইনকাম করি ভাইয়া। আমার ভাবি আর ভাতিজিকে কিছু দেওয়ার সামর্থ্য রাখি।”
“কি আর ইনকাম করিস তুই জানা আছে আমার। সব তো এতিম খানাতেই ঢেলে দিস।”
“আমি খুব হেপি ভাইয়া তুমি বিয়ে করবে শুনে।”
বাসার সামনে এসে গাড়ি থামাতেই দেখে লোকজন জমজমা। তৃনা বলে,
“বর পক্ষরা চলে এসেছে তাইনা ভাইয়া?”
রবিন কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
“তোর চোখ এমনিই কাজল কালো নয়তো কাজল পরাতাম। ভাই হয়েছি জন্য কাজলকালি দিয়ে নজর ফোটা দিতে পারছি না। তবে দোয়া করছি কোন কুনজর যেনো তোর উপর না পড়ে। ভেতরে যা। আমি পার্কিং করে আসছি।
তৃনা ভেতরে যেতেই রায়ানের চোখে চোখ পড়ে। রায়ান হা হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে তৃনা তাড়াতাড়ি চলে যেতে নেয়। সিড়ি দিয়ে উঠে নিজের রুমে যাওয়ার আগেই তৃষা এসে জড়িয়ে ধরে। তৃষাকে অন্যসাজে দেখে অবাক হয় তৃনা। আরো অবাক হয় তৃষা কাদছে দেখে। ভয় ঢুকে যায় বুকে। তৃষার মুখ দুহাতে ধরে সামনে এনে বলে,
“কাদছিস কেনো তুই? কি হয়েছে আমাকে বল।”
“তোমার যা হয় আমাকে বলো তুমি? কখনো বলেছো? যে ডায়েরিটা ফেলে দিয়েছিলে সেটা কুড়িয়ে এনেছি বলেই তো জেনেছি আমি। তোমার কান্না হা হা কার অনুভব করেছি আমি। যত্ম করে নিজের ডায়েরির ভিতর রেখেছি আমি। হটাৎ সেই ডায়েরিটা আর খুজে পাই না। কাল রাতে রায়ান ফোন করে আমাকে বলে
~ তোমার রুম থেকে একটা ডায়েরি এনেছি আমি পিংক কালার।
~ ওটা তো আপুর ডায়েরী। তুমি পড়েছো ডায়রীটা?
~ হ্যা।
~ আপু না ভাইয়াকে খুব ভালোবাসে। ভাইয়াটাকে যদি খুজে পেতাম আমার আপুর সব দুঃখ শেষ করে দিতাম।
~ আমি হলে আমাকেও দিয়ে দিবে?
~ কি বলছো?
~ তোমার ভাইয়াটা আর কেউ নয়। আমি নিজে।
আপু রায়ান ভাইয়া যদি না বলতো আমি তো জানতেই পারতাম না।”
“জেনেছিস ভালো করেছিস। এখন বউ সাজ তাড়াতাড়ি নিচে বর পক্ষ চলে এসেছে।”
“তুমি নিজেকে কি ভাবো আপু? সব সেক্সিফাইজ তুমিই করে যাবে সবার জন্য? কেউ তোমার জন্য কিছুই করতে পারবে না? মহান ভাবো নিজেকে তাই না?”
নিচ থেকে মনোয়ার ডাক দেয়”তৃষা তৃনাকে নিচে নিয়ে আসো।”
তৃনাই তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে আসে বলে
“বাবা …”
“চুপ থাকো তুমি। তৃষা রায়ানের পাশে গিয়ে বসাও তৃনাকে।”
“বাবা হচ্ছে টা কি?”
“শিল্পী তৃনার মাথায় দোপাট্টা দিয়ে ঘোমটা দিয়ে দাও”
“বাবা কি বলছো এসব?”
“ঠিক ই বলছি। রায়ানের সাথে তুমার বিয়ে হবে। তৃষা যাও ওকে রায়ানের পাশে বসিয়ে দাও।”
তৃষা ধরতে গেলেই তৃনা সরে দাড়িয়ে বলে, “বাবা পাগল হলে তোমরা? কি করছো টা কি? জোর করে বিয়ে দিবে নাকি আমাকে?”
“সেটাই করছি যেটা আরো আগে করা উচিত ছিলো।”
“আমি এই বিয়ে করবো না। তৃষা রায়ান চৌধুরীকে ভালো বাসে। ওদের দুই বছরের রিলেশন। আমার বোনটাকে কষ্ট দিও না তোমরা।”
তৃষা বলে, “সেটা তো রবিন ভাইয়ার সাথেও তিন বছর রিলেশন ছিলো রবিন ভাইয়াকেও তো ভালোবাসতাম। বলে নি তোমাকে রবিন? ও না বললেও আমি বলছি। কেউ মেনে নিলো না বলেই তো আমাদের সম্পর্ক টা ভেঙে গেলো।”
অবাক হয়ে তাকায় তৃনা রবিনের দিকে। এতোকিছু ঘটনা ঘটে গেছে আর সে কিছুই জানে না! সেও তো বুঝে নি। কেউ তাকে বলেনি? অবশ্য বলবেই বা কেনো? সেও তো কাউকে কিছু বলেনি। এসব বিষয় বেশির ভাগ না বলাই থাকে।
তৃষা তৃনার মাথায় দোপাট্টা দিয়ে দেয়। আরো দুজন মেয়ে এসে জোর করে রায়ানের পাশে বসাতেই হুস ফিরে তৃনার। চিৎকার করে বলে”বাবা আমি বিয়ে করবো না। এসব মিথ্যা বলছে ওরা। যেই জানতে পেরেছে সেই সেক্সিফাইজ করছে।”
“এখনো জোর গলায় কথা বলো না তুমি। রায়ানকে তুমি ভালোবাসো আগে বললে আমি যে করেই হোক তুমার সাথে বিয়ে দিতাম।”
“বাবা আমি রায়ান চৌধুরীকে বিয়ে করবোনা বাবা। রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে আমি আপনার মতো লোককে বিয়ে করবোনা শুনেছেন আপনি?”
রায়ান ভীষন কষ্ট পায়। তবুও হাল ছাড়বে না। তৃনার একা জীবন কাটানোর থেকে ওর সাথে থাকুক সামনে থাকুক, রুমুর মতো মেয়ে পাক সেটাই স্রেয়।
রবিন এসে বলে, “রায়ানকেই বিয়ে করতে হবে তোকে। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।”
“এভাবে বিয়ে হয়না”
“তো কিভাবে বিয়ে হয়? বরের গায়ের হলুদ লাগিয়েছিস, গোছল করেছিস, বেনারসি পড়েছিস, গহনা পড়েছিস, বউ সেজেছিস, বিয়ের আসরে বসেছিস আর কি চাস? এখন বিয়েটাও করে ফেল। ভালোবাসার মানুষটাকেও পাবি ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান ও পাবি।”
“না……”
আল্লাহর কালাম পড়ে জোর জবর দস্তি করে হলেও বিয়েটা হয়ে যায়।
অঝোরে কাদতে থাকে তৃনা। রুমু পেছন থেকে গলা জড়িয়ে গালে চুমু দিয়ে বলে, “আমার চুইট মাম্মা। এত্তোগুলা চুন্দল মাম্মা। কাদেনা মাম্মা।”
পর্ব ১৭
বিদায় বেলা দু বোন দু বোনকে জড়িয়ে প্রচুর কান্না করে। সাথে যোগ দেয় রবিন। এই বাড়ির ছাদে আর তিনজন এক হয়ে যখন তখন আড্ডা দিতে পারবেনা। একজন চলে যাচ্ছে পরের বাড়িকে নিজের বাড়ি করে নিতে। সাথে নিতে যাচ্ছে পরিবারের বড় দায়িত্ব। সাথে হচ্ছে এক মা। সব পরিবর্তন হয়ে যাবে জীবনের। চাইলেও সব সময় এক হতে পারবেনা তিনজন। মনোয়ার দুজনকে সরিয়ে তৃনাকে বুকে আগলিয়ে কয়েকফোটা জল ফেলে। এই মেয়ের সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছে অথচ একটি বার জানতে চায়নি তার মেয়ে কত কষ্ট বুকে নিয়ে আছে। শেষ পর্যায়ে শিল্পিকে ছাড়তেই চায় না।
সাপোর্টিপ হিসেবে মাকেই সব সময় কাছে পেয়েছে তৃনা। রবিন মনোয়ার দুজনে ধরে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে দেয় তৃনাকে। গাড়ি চলে যেতেই বাড়ির ভিতরে চলে আসে সবাই। তৃষাকে বলা হয় দরজা খুলে দিতে। তৃষা গিয়ে রুমের দরজা খুলতেই পারুল বেরিয়ে এসে তৃষাকে দেখে মরা কান্না শুরু করে দেয়।
“আজ আমার তৃষার বিয়ের কথা ছিলো। স্বার্থপর গুলো আমার মেয়েটার বিয়েটা হতে দিল না। ঐ শাকচুন্নির সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো। পেত্মী টা জাদু করেছে ঐ ছেলেকে তাই ঐ বিয়ে করেছে। আমার তৃষাটাকেও জাদু করেছে। আমার তৃষার সুখ কোনকালেই দেখতে পারেনি। আমার তৃষার সাথে হিংসা করে পেত্মীটা। পেত্মীটা সারাটাজীবন আমার তৃষার থেকে বেশি বেশি পেয়েছে সব সময়। ও ভাই তুমিও আমার তৃষাটার সাথে চিট করে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে। এই তুমি আমার মেয়েকে বাবার মতো ভালোবাসো?
এই ছিলো তোমার মনে আম্মু যার যার বাবা তার তার কথাই ভাববে। আমার বাবা আমার কথা ভাববে আপুর বাবা আপুর কথা ভাববে। পরের জিনিসে আমাকে ঠেকিয়ে বসাও কেনো? যা নিজের না তাতেই যা পেয়েছি কোন মামা তার ভাগনীকে দেয় দেখাতে পারবে?”
“ঐ তুই চুপ থাক। জাদু করছে তোকে জাদু তাই কিছু বুঝতে পারছিস না। ওরে আল্লারে আমার মেয়েরে কে বিয়ে করবে এবার?”বলেই প্রলাপ বকতে থাকে ফ্লোরে বসে হাত দিয়ে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে। রবিন ওয়েটারকে দিয়ে একবাটি চিকেন ললিপপ এনে সোফায় বসে খাচ্ছে আর পারুলের বিলাপ দেখছে। পারুলের কথাতে মনোয়ার নাখুশ হয়ে যায়।
বোনের জন্য যে টুকু মায়া ছিলো সেটুকুও উঠে যায়। নিজের কপাল চাপড়ে বলতে থাকে”হায় হায় রে এ আমি দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পোষলাম এতোদিন। যার মেয়ের কেউ নাই দেখে এতো আদরে বড় করলাম সে দেখি আমার সন্তানদের ই সহ্য করতে পারে না।
ছেলেটা ভুল করেছিলো বলে মেনে নিলেও আমার ফুলের মতো মেয়েটাকেও নিয়ে এতো সমস্যা ওর? যে মেয়ে ফুপি বলতেই পাগল এতো আদর করে এতো জিনিসপত্র এনে দেয় তাকেও হিংসা করে। অনেক হয়েছে। আমি আর এই কালসাপকে পোষবো না।”
ও ভাইজান বলে দৌড়ে এসে মনোয়ারের পা ধরে পারুল। বলে, “ভাই আমার তৃষাকে কে বিয়ে করবে এবার? সব শেষ হয়ে গেলো। কিছু একটা করো। এতো নির্দয় হয়ো না।”
“পা ছাড় পারুল। আমি নির্দয় না শুধু আমি এবার স্বার্থপর হবো।”
“ও রবিন বাপ …”
“ফুপি তোমার মেয়েকে নিয়ে চিন্তা কিসের? আরেকটা বাচ্চা ওয়ালার সাথে প্রেম করলেই চলবে। বিয়ে দিয়ে দিও।”
তৃষা রবিনের দিকে তাকিয়ে। রবিন একবার তাকানোতেই চোখা চোখি হয়ে যায়। চোখ নামিয়ে নেয় রবিন কিন্তু তৃষা তাকিয়েই আছে।
“রবিন বাবা এমন কথা বলো না। তুমি তো ..”
“বাবা আমি চাইনা আর নিজের ঘরে শত্রুকে পালতে।”
বলেই রবিন উপরের দিকে হাটা দেয়। তৃষা সহ সেই পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনোয়ার বলে, “সব গুছিয়ে নে। দুইদিনের মধ্যে চলে যাবি আমার বাসা থেকে।”
“ও ভাইজান কোথায় যাবো বলো। আমার যে কেউ নাই। ও ভাইজান। …”
মনোয়ার রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। ড্রয়িং রুমে বসে কাদতে থাকে পারুল।
সারা রাস্তায় কেদেছে তৃনা। তৃনার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না এই বিয়েতে। রুমু রায়ানের কোলে বসে টিসু দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়েছে তৃনার। বাসর ঘরে বসেও কাদছে তৃনা। সাজানো ফুল গুলোকে বিষফুল মনে হচ্ছে তৃনার। পা ঝুলিয়ে বসে আছে খাটে। কিছুক্ষন পর রায়ান ঢুকে রুমে। তৃষাকে এখনো কাদতে দেখে বারান্দায় চলে যায়। কিছুক্ষন নিরবতায় আওড়ায় নিজেকে।
তারপর রুমে চলে আসে। তৃনার কান্না থেমে গেছে সেই কখন রায়ানকে দেখেই। তৃনার সামনে দাড়িয়ে রায়ান বলে, “আমাকে মেনে নিতে সমস্যা হবে জানি। কিন্তু কোন কারনে আমাকে মেনে নিতে পারবেনা সেটা জানার রাইট আছে আমার। প্লিজ বলো। আমি ডিভোর্সি নাকি আমার বেবি আছে নাকি আমার সাথে তোমার বোনের রিলেশন ছিলো ঠিক কোন কারনে?”
চোখ তুলে তাকায় তৃনা।
“আপনি আমাকে কেনো বিয়ে করলেন?”
“আমার লাইফে তোমাকে প্রয়োজন।”
“তৃষার সাথে চিট করলেন কেনো বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে?”
“তৃষা নিজেই পিছিয়ে গেছে আমি কিছু করিনি।”
“আমাকে আপনার জীবনে প্রয়োজন বলে আপনি বিয়ে করেছেন। ভালো করেছেন। কিন্তু আমার জীবনে আপনার কোন প্রয়োজন নেই। আমি চলে যাচ্ছি। বাই।”
তৃনা উঠে যেতেই রায়ান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তৃনা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে”ঐ অপবিত্র হাতে একদম ধরবেন না আপনি আমাকে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরা হচ্ছে তাই না? রোমান্স করা হচ্ছে? আমাকে প্রয়োজন তাই না? ফুরিয়ে গেলেই ফেলে দিবেন। কত নাম্বার আমি আপনার লাইফে? বলুন উত্তর দিন।”
রায়ান চুপ।
“চুপ করে আছেন কেনো? উত্তর নেই তাই না? আসলে আপনি নিজেই তো জানেন না আপনার লাইফে কত গুলো মেয়ে আছে। আমি কত নাম্বার জানবেন কিভাবে?”
রুম থেকে বেরিয়ে যায় রায়ান। তৃনা ফ্লোরে বসে কাদতে থাকে।
মাসুদ ছাদে এসে দেখে রায়ান হুইস্কি বোতল হাতে নিয়ে বসে আছে। বোতল কেড়ে নিতেই দেখে এখনো মুখ খুলা হয়নি। মাসুদ জোরে শ্বাস নেয়। রায়ান মাসুদকে দেখে বলে, “আমার খাওয়ার দিন শেষ দোস্ত। তোর জন্য এনেছি। ইনজয় কর আমার আর তৃনলতার বিয়ের জন্য।”
“থ্যাংক ইউ সো মাচ। এবার বল এখানে কেনো এখনো তুই?”
“তোর ভাবি একটু হাইপার হয়ে গেছে। শান্ত হোক তারপর যাবো।”
“কি বলে?”
“তৃনলতা আমার জীবনে কত নাম্বার?”
“তৃনলতার জায়গায় তৃনলতা ঠিক। এরকম না করলেও পারতি।”
“মেন্টালিটি পরিস্তিতি ঘোলাটে ছিলো একদম। কি করবো বল?”
“কই পারলি নাতো কাউকে তৃনলতার আসনটা দিতে। দুই বছর সংসার করে বউকেও দিতে পারলি না।”
“ঐ মেয়ের কথা বলবিনা আমার সামনে। কেউ নেই আমার জীবনে শুধু তৃনলতা ছাড়া।”
“বলেছিস ওকে?”
“বলবো।
“আজ প্রথম তোর তৃনলতাকে দেখলাম। আর এটাও বুঝলাম যে কেনো তার মায়া থেকে বের হতে পারিসনি।”
রায়ান মুচকি হাসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে।
রুমে এসে দেখে তৃনা কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফ্রেশ না হয়ে ভাড়ি শাড়ি পড়েই কি সুন্দর কুজো হয়ে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে আসে রায়ান। কিন্তু তৃনাকে কিভাবে চেঞ্জ করাবে? অন্তত হিযআপটা খুলা দরকার ভেবে পিন খুজে খুজে হিযআপ খুলে দেয়। চুল গুলো আধশুকনা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। খোপা আগলা করে দেয়। কেদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে তাও যেনো সুন্দর লাগছে। দু হাতে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয় রায়ান। তৃনা একটু নড়েচড়ে উঠে আবার ঠিক হয়ে যায়।
ছোট ছোট চুল গুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে মায়াবী চেহারা মুগ্ধ হয়ে দেখে রায়ান। কতোনা বছর এই মুখটা দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়েছিলো সে। দেখতে দেখতেই লাল টকটকে ঠোটজোড়ায় গভীর ভাবে চুমু খায়। তারপর বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
বাড়িতে কারো চোখে ঘুম নেই। যে যার অবস্থানে যেমনটি ছিলো তেমনটিই চলছে। নিচতলা পারুলের কান্নায় মুখোরিত। উপরতালা শুনশান। ছাদে দাড়িয়ে ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে রবিন। তৃনার মেসেজ”আমার জীবন টা নয় গুছিয়ে দিলে এবার আমাকে তোমার জীবনটা গুছিয়ে দিতে দাও।”
ভেবে কুল কিনারা পায়না রবিন। তৃনা কি বিয়ে করতে বলবে আমাকে? আমি তো পারবোনা কারো জীবন নষ্ট করতে। যাকে ভালোবাসতে পারবোনা তাকে ঠকাবো কেনো? এ হয় না। নাকি তৃষাকেই বিয়ে করতে বলবে? এও যে হয় না। যে পথ থেকে একবার চলে এসেছি সেই পথে আর পা বাড়াবো না।
ভাবনার বিশ্ছেদ ঘটে তৃষার ডাকে। জবাব দেয় না রবিন। তৃষা এসে দাড়ায় রবিনের পাশে। কোন ভনিতা ছাড়াই বলে
“তোমার অফিসে কোন পোস্ট খালি আছে?”
“চাকরি করবি নাকি?
“হুম। একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও। থাকার ব্যবস্থা আমি করে নিতে পারবো। ভাবছি বাবাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। বাবার দায়িত্ব নিবো।”
“আর আম্মুর?”
“আম্মুর জন্য তো আম্মুর ভাই ই আছে। তুমি কি ভেবেছো মামা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে বলে মামা সত্যি সত্যি আম্মুকে বের করে দিবে? নাকি আম্মু কোথাও যাবে? এতো বছরে সবাইকে চেনা হয়ে গেছে আমার।”
“রবিনকে চিনিস?”
থমকে যায় তৃষা। চোখ ঘুরিয়ে পাশের বিল্ডিং এর দিকে তাকায়। রবিন বলে, “যে বিল্ডিং এ দাড়িয়ে আছিস সেই বিল্ডিং এ রবিন নামের কেউ নেই।”
চোখ নামিয়ে নেয় তৃষা। রবিন হালকা হাসে।
“চাকরি করে কি করবি? বিয়ে করে ফেল? এখন তো আর তৃনা নেই যে তোর পথের কাটা হবে। ফলো করতি যখন এখন ফলো করে বিয়েটাও করে নে।”
“আপুর মতো আমারো খুব চাইতে ইচ্ছে করে, বলতে ইচ্ছে করে খুব।”
“কি?”
“শুনবে তুমি?”
“শুনবো।”
রবিনের একেবারে সামনে এসে দাড়ায় তৃষা। চোখে চোখ রাখে।
“একটু ভালোবাসবে আমায়?”
{আমি অসুস্থ তাই গল্প ঠিক ঠাক কন্টিনিউ করতে পারছি না। একটু সুস্থ হয়ে নিয়ে গল্প দিবো রেগুলার ইনশাআল্লাহ। }
পর্ব ১৮
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে রায়ানের বুকে পায় তৃনা। রায়ানের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপে চোখের জল ফেলে। ঘুমন্ত মুখটায় হাত দিতে গিয়ে হাত নামিয়ে নেয়। সরে যেতে নিলেই রায়ানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। দুই হাতে তৃনাকে আটকে ধরে। কিন্তু তৃনা জোরে ধাক্কা দিয়ে উঠে যায়। বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে গলা ছেড়ে কাদে। কান্নার আওয়াজটা রায়ানের কান অব্দিও চলে আসে। আজ সব চেয়ে বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। রায়ানের চোখ বেয়েও জল গড়িয়ে পড়ে কোন ভাবেই আটকাতে পারছে না নিজেকে।
ঘন্টা খানেক পর তৃনা বেড়িয়ে আসে। রায়ান আড় চোখে তৃনার দিকে তাকায়। নতুন বধু বিয়ের পরের দিন সদ্য গোছল করে নতুন শাড়িতে ভেজা চুলে বের হওয়া এমন রুপ দেখে নিমেষেই মুখে প্রশান্তির ছোয়া মেলে রায়ানের। তৃনা রায়ানের দিকে একবার তাকিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ডাইনিং এ এসে রায়ান দেখে তৃনা সবার সামনে খাবার সার্ভ করছে। রায়ান বসতেই রায়ানের প্লেটে খাবার দিয়ে পাশে বসে পড়ে তৃনা। সবকিছু নরমাল বাট রায়ানের সাথেই কথা বলছে না। এমন ব্যবহার রায়ান মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই।
তৃনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে সবটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিবে খেতে খেতে ভাবে। কিন্তু তৃনা কি তাকে ক্ষমা করবে? তৃনার দিকে তাকিয়ে ভাবছে রায়ান। তৃনা আড় চোখে দেখছে আর অসস্তি ফিল করছে। আর যাই হোক কেউ এভাবে খেতে পারছে না। রুমু এসে বলে”গুড মর্নিং মাম্মা পাপা”
রায়ান রুমুকে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বলে, “গুড মর্নিং মাই প্রিন্সেস। ঘুম ভেঙেছে আমার প্রিন্সেসটার?”
“ইয়েস পাপা। মাম্মা ক্ষুদা লাগছে।”
তৃনা মিস্টি হেসে রুমুর কপালে চুমু দিয়ে নুডুলসের বাটি থেকে চামচ দিয়ে নডুলস খাইয়ে দেয়। রুমু রায়ানের সাথে কথা বলতে বলতে খেতে থাকে। রোহান রোহানা এই দৃশ্য দেখে মুচকি হেসে খাওয়া শেষে চলে যায়। রুমু খাওয়া শেষ করেই লাফাতে লাফাতে চলে যায় দাদুর কাছে। তৃনা বাটি গুছিয়ে উঠতে নিলেই রায়ান হাত টেনে ধরে ধপ করে চেয়ারেই বসিয়ে দেয়।
তৃনা তাকাতেই বলে, তুমি তো কিছুই খেলে না। বস আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
রায়ান পরটা ছিড়ে তৃনার মুখের সামনে ধরে। তৃনা পরটার দিক তাকিয়ে আছে চুপ চাপ।
“তৃনলতা…. হা করো আমার বউটা।”
বুক কেপে উঠে তৃনার। অশ্রু সজল চোখে রায়ান দিকে তাকায়। রায়ান চোখ মুছে দেবার জন্য হাত বাড়াতেই তৃনা বলে, “এভাবেই খাইয়েছেন লিনা মনা ছোয়াকে তাই না?”থমকে যায় রায়ান। মাথাটা নিচু হয়ে যায়। তৃনা উঠে রুমে চলে আসে। রায়ান উঠে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত করে। সব কিছু এলোমেলো লাগে রায়ানের কাছে। রুমে ঢুকেই দেখে তৃনা বসে আছে খাটে হেলান দিয়ে একটা ম্যাগাজিন হাতে। সাথে রুমু খাটে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। তৃনা রায়ানকে দেখে উঠে দাড়িয়ে বলে”মম আপনাকে খাবার দিতে বলেছে আমায়। ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি।”
তৃনা পা বাড়াতে ডাকে রায়ান তৃনলতা…”ফিরে তাকায় তৃনা। দু হাত ধরে খাটের সামনে এসে দাড় করিয়ে বলে”বসো।”তৃনা বসে। তৃনার সামনে হাটু ভাজ করে বসে তৃনার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। তৃনা খেয়াল করে রায়ানকে। অগোছালো লাগছে অনেকটা। নিজেই জিজ্ঞাসা করে
“কিছু বলবেন আমায়?”
মাথা নাডায় রায়ান।
“একটা সত্য কথা বলবে তৃনলতা?”
“বলুন।”
“তুমি কি চাও না আর আমার ভালোবাসা?”
“আমি আর আগের মতো বোকা নই।”
“কিন্তু আমি তো বোকা হয়ে গেছি। কাঙ্গাল হয়ে গেছি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। খুব বেশি ভালোবাসি তোমায় তৃনলতা। বিশ্বাস করো খুব ভালোবাসি। তুমার মায়ায় পড়ে গিয়েছি। ভালোবাসা না পাওয়ার বেদনা আমিও বুঝি তৃনলতা। আমার জীবন থেকে যেদিন হারিয়ে গিয়েছিলে সেদিন থেকে বুঝেছি তোমাকে কতটা ভালোবাসি আমি। আমি খুব খুজেছি তোমায় তৃনলতা। কোথাও পায় নি। জানতাম তোমাকে আর আমার জীবনে জড়াতে পারবোনা কারন লিনা ছিলো আমার জীবনে তবুও একবার সরি বলার জন্য খুজেছি তোমায়। তোমার বাসা পর্যন্ত খুজেছি আমি পাই নি তোমায়। আজ এতোবছর পর তোমাকে পেলাম।
আল্লাহ নিজে আমাদের মিলিয়ে দিয়েছে এর জন্য তার দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া। আর কিচ্ছু চাই না আমার তুমি ছাড়া। খুব ভালোবাসি তোমায় তৃনলতা। খুব ভালোবাসি। একটু ভালোবাসবে আমায়? জাস্ট একটুখানি ভালোবাসলেই চলবে।”
“আমি আপনাকে ভালোবাসি মি.রায়ান চৌধুরী। মিথ্যা বলবো না। খুব ভালোবাসি। এতোদিন যেভাবে ভালোবেসেছি সেভাবেই ভালোবেসে যাবো অনন্তকাল ধরে।”
উঠে দাড়ায় তৃনা। অঝোরে পানি পড়ছে রায়ানের চোখ দিয়ে। রায়ানকে দেখে মুচকি হাসে তৃনা।
“ভালো লাগলো আমার জন্য আপনার চোখে জল দেখে। নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।”
“আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না তৃনলতা? একটুও ভালোবাসা যায় না?”
“ভালোবাসিতো। আপনাকে। আপনার হৃদয়টাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা একটু অন্যরকম। অন্যদের মতো ধন দৌলত আর সৌন্দর্যকে ভালোবাসতে পারি না আমি।”
কেদে উঠে রায়ান। উঠে গিয়ে তৃনাকে জড়িয়ে ধরে রায়ান। তৃনাও মুচকি হেসে রায়ানকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে”আপনি ব্যর্থ। আপনি আপনার ভালোবাসার সঠিক মর্যাদা দিতে পারেন নি। কেউ যদি কাউকে ভালোবাসে তাহলে অন্য কারো প্রতি মুগ্ধ হয়ে রিলেশনশিপে জড়াতে পারে না। কেন করলেন বলুনতো এমন? ভালোই তো ছিলো সব।”
“আমার ভুল হয়ে গেছে তৃনলতা। লিনা নামের মেয়েটা আমার সব কেড়ে নিয়েছে। তোমাকে আমার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি শুধু তুমি ছাড়া তৃনলতা। আমিতো সব সম্পর্ক শেষ করে তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলাম। শেষে ঐ সম্পর্ক ই মেনে নিয়ে ছিলাম কিন্তু আমি ঠকে গেছি তৃনলতা।
আমি সব হাড়িয়েছি। নতুন করে বাচতে চেয়েও পায়নি। একটু শান্তির জন্য ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু কারো কাছে একটু শান্তি পাই নি একটু ভালোবাসা পায়নি। তোমাকে আমার হৃদয় থেকেও সরাতে পারিনি। শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। একের পর এক জি এফ পাল্টিয়েছি কিন্তু কেউ তোমার মতো ভালোবাসতে পারেনি। আমি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম তৃনলতা। কিন্তু যখন তৃষা আমার জীবনে আসে তখন থেকে অন্যদের থেকে আলাদা হতে থাকি আমি। তৃষার মাঝে আমি কেনো যেনো তোমাকে খুজে পেতাম।
ভালো লাগতো আমার। তৃষার চালচলনে তোমার ছায়া পেতাম। সব কিছুতে আমি তোমাকেই খুজে পেতাম। তখন তো আর জানতামনা যে তৃষা তোমার ই বোন। আস্তে আস্তে বিয়ে পর্যন্ত ব্যপারটা এগিয়ে যায়। আমি মুখোমুখি হই তোমার। আজ তুমি আমার স্ত্রী। আমি তোমাকে নিয়ে নতুন জীবন গড়তে চাই তৃনলতা। আমি আমার সব টুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিতে চাই তোমায় তৃনলতা।”
“চাইলেই তো সব কিছু হয়না মি. রায়ান চৌধুরী। আমি চেয়েছিলাম। পায় নি তো। কিভাবে বিশ্বাস করি আপনাকে বলুনতো? সেই জায়গাটুকু কি আপনি রেখেছেন? আপনি কি জানেন লিনা আপু আপনাকে ছেড়ে গিয়ে উচিত কাজটা করেছে! যে ছেলে একটার পর একটা মেয়ে ছাড়ে তাকে একটা মেয়ে ছেড়ে দিলে ক্ষতি কি?”
“আমি কিছু করিনি তখন তৃনলতা।”
“মানলাম আপনি কিছু করেননি। তার পর তো আর বাকি রাখেন নি। কিসের ভালোবাসেন আপনি আমাকে? আপনি আমাকে ভালোবাসতে পারেন নি। লিনা আপু চলে যাওয়ার পর খুজেছিলেন একটিবারের জন্য আমাকে? আমি কিন্তু ঠিক ই আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। তখন আপনি আপনার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তারপর এই দুধের শিশুটাকেও এতিম করে চলে গেলেন নিজের দুনিয়ায়। আমাকে ভুলার নাম করে একটার পর একটা মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে গিয়েছেন পেয়েছেন সাময়িক সুখ ছাড়া অন্যকিছু? আপনি কি জানেন আমাকে ভালোবাসার নাম করে যতবার অন্য মেয়ের সাথে রিলেশনে গিয়েছেন ততোবার আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছেন।
একের পর এক মেয়ে নিজের লাইফে জড়িয়ে নিজে হাতে আমার ভালোবাসাকে মেরে ফেলেছেন আর নিজেকে বানিয়েছেন নষ্টা ছেলে। আপনি যতোই ভালোবাসেন না কেনো আপনার ভালোবাসা থেকে আমার ভালোবাসার গভীরতা শত গুনে বেশি। কই আমিতো এসব করিনি? আপনার স্মৃতিকে জড়িয়ে সারাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজ আপনাকে দেখলে আমার ঘৃনা হয়। আমি কিছুতেই পারছিনা আপনাকে মেনে নিয়ে আপনার সাথে সংসার চালিয়ে যেতে। আমার নিজের প্রতি ঘৃনা হয় এখন।”
রায়ান তৃনার হাত মাথায় ঠেকিয়ে নিচে বসে বলে,
“এভাবে বলো না প্লিজ। আমি ভুল ছিলাম। প্লিজ তৃনলতা আমাকে ক্ষমা করো। আমি ক্ষমার অযোগ্য তবুও ক্ষমা চাইছি আমি। এতোটা শাস্তি দিও না সহ্য করতে পারবোনা আমি।”
“শাস্তি! শাস্তি তো আপনি অবশ্যই পাবেন। আপনি শাস্তি না পেলে যে আমার পাপ হবে। আমি দেবো আপনাকে শাস্তি। শাস্তি যদি সহ্যই করার মতো হয় তাহলে মূল্য কি সেই শাস্তির?”
রায়ান কিছুক্ষন তৃনার দিকে তাকিয়ে থেকে শক্ত হয়ে বলে
“আমি মাথা পেতে নিবো তোমার দেওয়া সব শাস্তি। শুধু আমাকে তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করো না।”
মৃদু হাসে তৃনা।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে আর দেখা মিলে না তৃনার। রোহান রোহানা মুখ ঘোমড়া করে বসে আছে। রায়ান জিজ্ঞাসা করতেই বলে”ভেবেছিলাম তুই সবটা ঠিক করে নিতে পারবি। কিন্তু আফসোস তোর ভাগ্যটাই খারাপ।”
“এসব কথা কেনো বলছো পাপা? তৃনলতা কোথায়?”
“চলে গেছে। আর আসবেনা তুমার মতো কুলাঙ্গারের সাথে সংসার করতে।”
“পাপা এ হয়না।”
“এটাই হয়েছে। আমার বাড়ির লক্ষী চলে গেছে এবার তুই ও বের হ আমার বাড়ি থেকে। এতো দিন অনেক সহ্য করেছি। তোর সমস্ত বেয়াড়াপনা মেনে নিয়েছি আর নিবো না। আমাদের সব আশা শেষ করে দিয়েছিস তুই। আমি তোকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি। ভুল আমিই করেছি। ওমন ফুলের মতো মেয়ের জীবনটা যে নষ্ট করেছি তোর দিক চেয়ে সেটাই বড় ভুল আমার। আমার দাদুমনির জন্য আমরা বেচে আছি। তোর কোন প্রয়োজন নেই না কোনদিন ছিলো আমাদের জীবনে। চলে যা তুই আমার সামনে থেকে। বের হ বলছি।”
“পাপা তুমি এটা করতে পারো না। কিচ্ছু শেষ হয়নি। আমি আনছি তৃনলতাকে তুমি কিছুক্ষন সময় দাও।”
“তৃনলতা আর কোন দিন আসবে না।”
“এটা হয়না পাপা। তৃনলতা লাভ মি। ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আমি ওর অভিমান ভাঙ্গাবো।”
“সে গুড়ে বালি। আর একটা কথা বলবিনা তুই। বের হ আমার চোখের সামনে এই বাড়ি থেকে।”
“মম পাপা কি বলছে? তুমি কিছু বলছো না কেনো?”
“চলে যা।”
“মম!”
রোহানা ধাক্কিয়ে দরজা দিয়ে বের করে দেয় রায়ানকে। দরজা বন্ধ করার সময় বলে, “যদি আমার ঘরের লক্ষীকে নিয়ে ফিরতে পারিস তাহলে একসঙ্গে এই চৌকাঠে পা রাখবি নয়তো কোনদিন আসবিনা এখানে।”
রায়ানের ফোনে টুং শব্দ হতেই ওপের করে দেখে তৃনার মেসেজ
“এটা আপনার শাস্তি। ছয়মাস পর ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবেন। ভালোবাসি আপনাকে। আগের মতোই ভালোবেসে যাবো। কখনো বঞ্চিত করবোনা। হারাম পথ ছেড়ে আল্লাহর পথে আসুন আখিরাত সুন্দর হোক আপনার দোয়া করি। আল্লাহ হাফেজ।”
পর্ব ১৯
সকালে তৃনা ঘুম থেকে উঠে দেখে রায়ানের বুকে গুটি শুটি হয়ে মুখ গুজে আছে। মুখ তুলে রায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে খুব নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে সে। এতো শান্তিতে যেন কত শত দিন পর ঘুমোচ্ছে। ঘুমন্ত রায়ানের গরম নিশ্বাস তৃনার সারা মুখে ছেয়ে পড়ছে। এই নিশ্বাসেই তো রাতে ঘায়েল হয়েছে তৃনা। আবার ঘায়েল হতে চায় না এই অসময়ে। রাতের কথা মনে হতেই লজ্জা লাগে খুব। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে আপনাআপনি। গত দশদিনেই চেহারার অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে রায়ান। তৃনা চেয়েছিলো বেশ কয়েকদিন রায়ান থেকে দুরে থাকতে একটু শাস্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি।
প্রতিদিন ই এসেছে তৃনাকে নেওয়ার জন্য। কান্নাকাটিও করেছে। সেদিকে তৃনা রুমুর থেকে ফোনে মম মম শুনে অস্থির হয়ে থাকে রুমুর কাছে যাওয়ার জন্য। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া কথাটা জেনে আরো আপসেট হয়। রায়ানের মিনতি কান্না দেখে হৃদয় পুড়ে তার। গতকাল সারাদিন বাসার সামনে বৃষ্টিতে ভিজে রাতে অসম্ভব জ্বর হয়ে সেন্সলেস হয়ে যায়। তারপর রবিন আর মনোয়ার বাসায় নিয়ে আসে। রায়ানের জ্বর কমে এলে তৃনাকে অনেক বকা ঝকা করে চলে যায়।
তৃনা রাতে রায়ানের পাশে বসে কান্নাকাটি করে। তার জন্যই আজ রায়ানের এই অবস্থা। নিজেকে দোষী সাব্বস্ত্য করে। রায়ান সজ্ঞানে আসতেই তৃনাকে বুকে টেনে নিয়ে চোখ মুছে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। তৃনা বাধা না দিয়ে আকড়ে ধরে রায়ানকে। আকড়ে ধরার দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে তৃনার। সাথে সাথে তৃনার হৃদস্পন্দন বাড়তে শুরু করেছে। এতো জোরে কেন হৃদশব্দ হচ্ছে ..রায়ান শুনতে পেয়ে গেলে কি বলবে? ভীষন লজ্জা করবে করছে তৃনার। যাহ উনি কিভাবে শুনবেন ..উনি তো ঘুমোচ্ছেন বলে চোখ খুলে উপর থেকে আস্তে করে রায়ানের হাত টা সরিয়ে দিল। কপালে হাত রেখে দেখে জর নেই এখন।
একটু নড়ে আবার স্থির হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় রায়ান। উঠে বসতেই চাদরে আটকে যায় তৃনা। আস্তে আস্তে প্যাচ খুলতেই পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে চেপে ধরে নিজের সাথে রায়ান। আকষ্মিত ঘটায় আহ করে উঠে তৃনা। রায়ান তৃনার গলায় মুখ গুজে লিক করে। কেপে উঠে তৃনা। ঘুম জড়ানো গলায় বলে
“কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ তাইনা? কোথাও যেতে দেবো না তোমায়। নিজের সাথে চেপে রাখবো তোমায়। ছাড়বোনা কখনো। আমার মৃত্যু পর্যন্ত তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।”
একটু দম ছেড়ে তৃনা বলে
“যেতে আর পারলাম কই ..আটকেই তো দিলেন। আমার সব কিছু আপনাকে দিয়ে আমি যে আজ নিঃস্ব।”
“আমি প্রথমে এইটাই ভাবতাম। কিন্তু পরে দেখলাম এটা সত্যি না। শরীর আর মন দুটোই স্বার্থপর। আর সেই মানুষ গুলো আরো বেশি স্বার্থপর। যদি এভাবেই আটকানো যেতো তাহলে আমাকে একা থাকতে হতো না এতোদিন।”
“আপনি কি আমাকে সেই মানুষ গুলোর দলে ভাবেন? ভুলেও এই কাজ টা করবেন না।”
রায়ান তৃনাকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। তৃনার উপরে উঠে চোখে চোখ রাখে। তৃনা কাপা গলায় বলে
I love you
-“I need you . তুমি চাইলেও দুরে যেতে পারবে না। আমি আমার সব টুকু দিয়ে বেধে রাখবো তোমায়। তুমি চেষ্টাও করো না।”
রায়ান তৃনার গলায় আবার মুখ গুজে। লিক করতে থাকে ঘাড় গলায়। মাঝে মাঝে ছোট্ট কামড় আর চুমুও দিচ্ছে। তৃনার পাগল হওয়ার অবস্থা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “ছাড়ুন আমি ওয়াস রুমে যাবো।”
“কোথাও যাবে না তুমি। ছাড়বোনা তোমাকে।”
রায়ান আরো জোরে চেপে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে তৃনার সারা মুখে।
“ফ্রেশ হতে হবে ছাড়ুন না ..।”
রায়ানের কান অব্দি পৌছায় না। না পেরে তৃনা রায়ানের মাথা শক্ত করে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে”রুমুর কাছে যেতে হবে তো। কতোদিন আর মম পাপা থাকবে মেয়েটা? মাম্মা পাপার কাছে থাকবে তো। ফ্রেশ হয়ে ওর কাছে যেতে হবে তো। এবার ছাড়ুন।”
রায়ান কিছুক্ষন তৃনার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে উপর নিচ মাথা ঝাকায়। তারপর চাদরটা ভালো করে দুজনে সমেত পেচিয়ে নেয়। তৃনাকে কোলে নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। তৃনা অবাক। এই লোকটা অসুস্থ তবুও কত শক্তি। একদম ছাড়লো না তৃনাকে। গোসল করে বেড়িয়ে এসে ব্লু কালার শার্ট আর ব্লাক প্যান্ট পড়ে নেয় রায়ান। আগেই কিনে রেখেছিলো মনোয়ার জামাইয়ের জন্য। তৃনার একটু লেট হচ্ছে। রায়ান দু একবার ডেকেছেও। তবুও বের হবার নাম নেই। শেষে রায়ান এসে হাত ধরে টেনে বের করে তৃনাকে। শাড়ি অর্ধেক পড়া হয়েছে আর অর্ধেক বাকি আছে। কুচিটাই দেওয়া হয়নি।
তৃনা নীল শাড়িটার কুচির কাপড় ধরে দাড়িয়ে আছে। রায়ান হাত থেকে নিয়ে কুচি দিতে শুরু করে। ঠিক ঠাক কুচি দিয়ে গুজতে গিয়ে তৃনার দিকে একবার তাকায়। সদ্য গোছল করা ভেজা চুলের ফ্রেশ স্মিগ্ধ লজ্জা মাখা মুখটা হৃদয়ে দাগ কাটে। রায়ান এভাবে তাকাতে তৃনার গাল দুটো লাল টমেটোর মত হয়ে যায়। তৃনা হালকা হেসে কুচি ধরে গুজে দেয়। কোমড়ে গাড় তিলটার দিকে চোখ আটকে যায় রায়ানের। আজ দ্বিতীয়বার দেখছে এই তিলটাকে। প্রথম বার দেখেছিলো মেঘকন্যা মেঘে ভেজার সময়।
হালকা করে একটা কামড় বসায়। ব্যথায় কাকিয়ে উঠে তৃনা। হালকা টানে আয়নার সামনে এনে বসায় তৃনাকে। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে আচড়ে দেয়। চুলের কাটা দিয়ে খোপার মতোন করে দেয় চুল গুলো। কানের পাশে এসে বলে একটু সাজিয়ে দেই প্লিজ। তৃনা কিছুই বলে না। চুপচাপ রায়ানের কাজ দেখতে থাকে। গালে হালকা করে ব্রাউন ফেস পাউডার লাগায়। চোখ জুড়া নীল কাজল একে দেয় খুব যত্ম নিয়ে। দুই ভ্রুর মাঝে ছোট্ট একটা টিপ বসিয়ে বলে না করবেনা প্লিজ..নীল টিপে তোমায় কেমন লাগে দেখবো। ঠোট দুটো এমনিতেই লাল হয়ে আছে। তৃনা লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। সাজ কমপ্লিট করে দাড় করায় তৃনাকে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি রেখে বলে আমার দেখা সম্পূর্ণা তৃনলতা।
তৃনা মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে একসাথে নিজের পার্টনারকে। রায়ান সারাজীবন তার পাশে এভাবে থাকবে ভেবেই চোখ ভরে আসে জলে। রায়ান নিজের দিকে ঘুরিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলে কেদে কেটে সময় নষ্ট না করে মেয়ের কাছে যাও। সেও তো মাম্মার জন্য কাদছে। তাইনা?
তৃনা মাথা ঝাকিয়ে বলে চলুন।
সকালের নাস্তা করে নেয় সবার সাথে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে নিজের বাড়ির উদ্দ্যেশে।
রায়ান ড্রাইভ করছে। ড্রাইভার ছুটিতে আছে তাই অসুস্থ হয়েও ড্রাইভ করছে। পাশে তৃনা বসা। মাঝ রাস্তায় এসে আচমকা রায়ান তৃনাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে। তৃনা এমন চাপে অস্থির হয়ে পড়ে। ছাড়ুন। গাড়ি ড্রাইভ করুন মন দিয়ে। ড্রাইভার থাকলে আপনাকে গাড়ি ড্রাইভ করতেই দিতাম না। এমনিতেই অসুস্থ দুর্বল তার উপর ড্রাইভ করছেন দুইসিডেন করলে অবস্থা খারাপ। রায়ান মৃদু হেসে এক হাতে গাড়ি চালাতে থাকে আরেক হাতে তৃনাকে জড়িয়ে ধরে বুকে। তৃনাওও চুপটি হয়ে যায়।
মুখের সামনে চুল গুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে গাড় করে চুমু খায়। তৃনা রেগে যায়। শাডির নিচে হাত রেখে পেটে হালকা চাপ দিতেই তৃনা ঝাঝিয়ে উঠে বলে, “লুচু একটা। গাড়িতেও তার লুচুগিরি করতে হয়। সারাটা জালিয়েও শান্তি হয়নি। রায়ান শব্দ করে হেসে বলে
কি করবো বলো ..লুচু না হয়ে কি আর উপায় আছে? সাথে নতুন বউ ..ফিলিংস ই অন্যরকম ডিয়ার জানু বউ। তাছাড়া সব বউদের কাছে স্বামীরা লুচুই হয়। লুচু না হলে বউ টিকে না গো।
তৃনা মনে মনে প্রশ্ন করে তাহলে আগের বউ কেন টিকলো না? মনে মনে বলতে গিয়ে বেচারা জোরে বলে ফেলে। রায়ান তৃনাকে ছেড়ে জোরে ব্রেক কষে। গেট খুলে বাইরে বেড়িয়ে আসে। তৃনার বোধগম্য হোওয়া মাত্রই সেও বেড়িয়ে পড়ে। রায়ান একটু এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে। তৃনাওও বসে পাশে। রায়ানের গালে হাত দিয়ে বলে
I am sorry . আর কখনো হবে না। রাগ করবেন না প্লিজ।
রায়ান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে গাড়ি থেকে নামলে কেন? গাড়িতে গিয়ে বস আমি আসছি। আমি একটু বেশি বেশি করে ফেলছি। sorry for that .
তৃনা রায়ানকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে
যেদিন থেকে আপনাকে মনের মনিকুঠায় বসিয়েছি সেদিন থেকেই আমি পুরোটাই আপনার হয়ে গেছি। শুধু বাকি ছিলো শরীরে আপনার অস্তিত্ব আপনার চিহ্ন সেটাও দিয়ে দিয়েছেন। আমি পুরোটাই আপনার। আপনার দেওয়া প্রত্যেকটা যন্ত্রনা, ব্যথা, ভালুপাসা, সুখ পাওয়ার জন্যই আমি আজ আপনার এতো কাছে।
আমি আপনার ..আপনি আপনার যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। সব সহ্য করবো বলেই ভালোবাসি। আপনার হাতে মৃত্যু হলেও যে আমার সুখী। আমি যেমন আপনার আপনিও তেমন আমার। আমাদের মাঝে আমি কাউকে আসতে দিবো না। এতোদিন দোটানায় ছিলাম আমার হাতে কিছু ছিলো না বলে আগলে রাখতে পারিনি। এখন দোটানার মৃত্যু ঘটেছে। যা আমার আমি তা কারো সাথে ভাগ করতে পারবো না। সবটা দিয়ে আগলে রাখবো। আপনি প্রমিজ করুন আমাকে কখনো দূরে ঠেলে দিবেন না।
তৃনার দু চোখ বেয়ে ঝরা জল হাতে মুছে দিয়ে বলে
মৃত্যু অব্দি ছাড়বো না।
I love you
I also need you বউ।
তৃনার ঠোটে ঠোট ডুবায় রায়ান। শুষে নিতে থাকে ভালবাসার মিষ্ট স্বাদ টুকু। তৃনা ঠেলে সরিয়ে বলে কি করছেন? এটা রোড়।
উহু। এটা পার্ক। পার্কের ভেতর দিয়ে গিয়েছে রাস্তাটা।
তৃনা আশে পাশে তাকিয়ে দেখে সত্যিই সে পার্কে বসে আছে। রায়ান বাকা হেসে বলে পার্কে এটা কমন বেপার। আরো কতো কি ঘটে ..। লজ্জা পেয়ে যায় তৃনা। রায়ান উঠে পাজা কোলে করে নিয়ে গাড়িতে যায়। ড্রাইভিং সিটে বসে তৃনাকে কোলে বসিয়ে দেয়।
-শোন আমি ড্রাইভ করবো আর তুমি ৩০ সেকেন্ড পর পর আমাকে কিস করবে।
পারবোনা আমি। দুইসিডেন্ট হলে তখন কি হবে?
ভয় লাগে? মরতে পারবেনা আমার সাথে?
তৃনা মাথা ঝাকায়। রায়ানের গালে গভীর ভাবে উচ্চ শব্দ করে চুমু দেয়।
পর্ব ২০ (অন্তিম)
বাড়ির চৌকাঠে পা রাখতেই রুমু মাম্মা পাপা বলে দৌড়ে আসে পাখির মতো। তৃনা দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় মেয়েকে। চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে। তৃনার কোল ছেড়ে রায়ানের কোলে যায় রুমু। রায়ানের গলা জড়িয়ে বলে”পাপা মাম্মা মিস ইউ।”
“উই মিস ইউ ট্রু মা।”
কোল থেকে নেমে গিয়ে দৌড়ে রোহান রোহানাকে ডেকে নিয়ে আসে। ছেলে ছেলে বউকে একসাথে দেখে খুশি হয়ে যায়। রোহানা রায়ানকে ধরে হু হু করে কেদে উঠে। রায়ান ও মমকে বুকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাদে। রায়ানের মুখে হাত বুলিয়ে বলে, “কি অবস্থা করেছিস চেহারার বাবা এই কয়দিনে। তৃনাটাও শুকিয়ে গেছে।”
“তোমার যত্মে দুজনেই ঠিক হয়ে যাবো মম।”
রোহানের কাছে গিয়ে বলে, “আমি তোমার বউমাকে নিয়ে এসছি পাপা। এবার তো এ বাসায় থাকতে পারবো।”
রোহান ছেলেকে একপাশে জড়িয়ে বলে, “আম হেপি মাই সন। এখন একটা পরিপূর্ন পরিবার আমরা।”
রোহানা বলে, “খেয়ে এসেছিস তো তোরা! আমি স্ন্যাকস পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে নে তোরা।”
রায়ান তৃনা রুমুকে নিয়ে রুমে চলে আসে। রায়ান রুমে এসেই বিছানায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। তৃনা তাড়াতাড়ি কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে দেখে আবার জ্বর চলে আসছে। রায়ানকে ধরে জোর করে শুইয়ে দিয়ে রুমুকে বলে রোহানাকে ডেকে দিতে। রোহানা এসে জ্বরের ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেয়।
তৃষার নতুন সংসার হয়েছে। রবিন তার অফিসে একটা চাকরির ব্যবস্হা করে দিয়েছে। অফিসের কাছেই একটি দু রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। সাথে এনেছে নিজের বাবাকে। পঙ্গু বাবাকে আনতে গেলে তার স্ত্রী সন্তান কেউই বাধা দেয় নি। উল্টো যেনো হিমশিম খাচ্ছিলো এই পঙ্গু বুড়োকে টানতে টানতে। তাই নিয়ে আসতে চাওয়ার সাথে সাথেই ব্যাগ পত্র সব গুছিয়ে দিয়েছে।
হাফ ছেড়ে বাচার ন্যায় মুখে ছিলো হাসির ছোয়া। তৃষা বাবাকে এনে নতুন বাপ মেয়ের সংসার পাতে। অফিস আর বাবার দেখা শুনা করেই দিন কাটে তার। দুদিন না যেতেই পারুল গিয়ে উপস্থিত হয়। পারুল কে দেখে তৃষা সাদরে আমন্ত্রন জানায়। অনেক দিনের সপ্ন পূরন হয় তার। নিজের একটা পরিবার হয় যে পরিবারে সে তার বাবা মার সাথে থাকতে পারছে।
পারুল স্বামীর কাছে ক্ষমা চাইলে পারুলকে ক্ষমাও করে দেয়। সব মিলিয়ে হ্যাপি ফেমেলি। কিন্তু পারুলের এখন মনে প্রানে চাওয়া রবিনের সাথে তৃষার বিয়েটা হওয়া। সেজন্য মনোয়ারকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটিও করা বাদ রাখে না। মেয়ের সুখের জন্য মরিয়া হয়ে আছে সে। তৃষা অফিসে কাজ শেষে বের হবার সময় রবিনের সাথে চোখাচোখি হয়। দিনে হাজার বার চোখা চোখি হয় তাদের কিন্তু সামনা সামনি দাড়িয়ে হয়না বললেই চলে। রবিন গলা খাকারি দিয়ে জিজ্ঞাসা করে
“কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
তৃষা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে।
“অসুবিধা হলে বল আমায়। হেল্প করতে পারি তো। টাকা পয়সার কোন সমস্যা হচ্ছে? সামান্য বেতনে চলতে সমস্যা হওয়ার ই কথা। তার উপর ফুপার ঔষধ কিনতে হচ্ছে। বলবিতো আমাকে। না বললে বুঝবো কি করে?”
“আমার ফাকা ফাকা লাগে।”
“কি ফাকা ফাকা লাগে?”
“বিছানার পাশটা। একজন পুরুষ নামি তুমি রবিন কে প্রয়োজন।”
“বাসায় যা।”বলেই হেটে চলে আসে রবিন। পেছন থেকে তৃষা গলা বাড়িয়ে বলে”একটু ভালোবাসবে আমায়?”দু পা থেমেও আবার চলে যায় রবিন। তৃষা দাড়িয়ে দাড়িয়ে মুচকি হাসে।
আজ তৃষার বাসায় যাওয়ার দিন তৃনার। বোনটার নতুন সংসার দেখতে যাবে সে। সাথে যাচ্ছে রায়ান আর রুমু। বাসার সামনে এসে তৃনা ফোন দেয় তৃষার নাম্বারে। তৃষা এগিয়ে আসে তৃনাদের রিসিভ করতে। তৃনাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। ছাড়ার পর চোখ পড়ে রায়ানের দিকে। হালকা হেসে দুজনেই ভাব বিনিময় করে। রুমুকে নিতে গেলে রুমু ভয়ে রায়ানকে শক্ত করে ধরে। তৃনা এসে রুমুকে কোলে নিয়ে বলে”মাম্মা যাও। তুমার খালামনি হয়। তোমাকে অনেকগুলো চকলেট দিবে।”
তৃষাও অনেক বুঝ দিয়ে কোলে তুলে নেয়। বাসার সামনের দোকান থেকে অনেকগুলো চকলেট কিনে দেয়। রুমু চকলেট খেতে খেতে বাসায় চলে আসে। পারুল তৃনাকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তৃনার কাছে ক্ষমা চায়। তৃনা পারুলকে সামলিয়ে ফুপার সাথে দেখা করতে যায়। রায়ান সোফায় বসে পারুলের সাথে কথা বলে। পারুল উঠে তৃনার কাছে যায়। তৃষা ট্রে তে ফ্রুটস নিয়ে আসে। রায়ানকে নিতে বললে রায়ান হাতে একটা আপেল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে”কেমন আছো? সব ঠিক ঠাক?”
তৃষা মাথা নাড়ায়।”তৃষা ফরগিভ মি। আমি এখন তোমার জিজু। আমি চাই আমাদের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক থাকুক আর পাচটা সম্পর্কের মতো।”
“প্যারা নাই দুলাই।”
“সব ভুলে যাও প্লিজ আমাদের মধ্যে যা ছিলো।”
“সত্যি? কিছু ছিলো নাকি দুলাই? তোমাকে একটা সিক্রেট বলি দুলাই। শোন। আমি কাল কার সাথে রিলেশনে ছিলাম সেটা আজকেই ভুলে গেছি। তোমার সম্পর্কে তো আরো সব ভুলে গেছি। আমি শুধু জানি তুমি আমার দুলাই। এগুলো ভুলা এই তৃষার ব্যপার না।”
“কই রবিন ভাইকে তো ভুলতে পারলে না।”
“পারবোও না। নাইবা বললে সেসব কথা।”
“বলবোতো অবশ্যই। তৃনা হাল ছাড়লেও আমি হাল ছাড়বোনা।”
“তা বোধহয় দরকার হবে না। মামার সাথে আম্মুর প্রতিদিন কথা হয়।”
তৃনা এসে বলে, “এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ঠিক করিস নি তৃষা।
“আমি ঠিক করেছি আপু। আমার একটা আলাদা পরিবার চাওয়ার ছিলো। যেখানে আমার বাবা আম্মু একসাথে থাকবে। আমাকে যদি তোমার ভাইয়ের বউ করে নিয়ে যাও সেখানে আম্মুর থাকাটা কি ঠিক? এতোদিন ভাইয়ের বাড়ি পরিচয়ে ছিলো এখন তো মেয়ের শ্বশুর বাড়ির পরিচয়ে থাকতে হবে। সমাজ এটি কোন চোখে দেখবে? তাছাড়া আমারো একটা সম্মান আছে। এখানে এসে সবার ভালো হয়েছে আপু। শেষ বয়সে হলেও আমার বাবা আম্মু একসাথে থাকছে। বাবা একটা বেটার লাইফ পেয়েছে। ঠিক ভাবে চিকিৎসা হচ্ছে। এর থেকে আর কি ভালো হতে পারে?”
রায়ান বলে, “তৃষা ঠিক বলেছে তৃনলতা। যাক শালিকার ঘটে একটু হলেও তাহলে বুদ্ধি আছে।”
তিনজনেই হেসে উঠে। ডিনার করে একবারে বাড়ি ফিরে তৃনা রায়ান রুমু।
রবিনের সাথে মিট করবে বলে রেস্টুরেন্টে ডেকে আনে তৃনা। এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে একসময় বলেই ফেলে”তুমি যা করছো তা ঠিক নয়। তৃষাকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এবার তোমার বিয়ে করা উচিত। ভাইয়া আমি এতো বছর পর ওকে নিজের করে পেয়েছি। কতো বাধা বিপত্তি ছিলো আমাদের মাঝে তবুও এক হয়েছি। তোমাদের মাঝে এখন কোন বাধা নেই। মান অভিমানের পালা শেষ করে এবার অন্তত কাছে টেনে নাও। এভাবে শুধু কষ্ট ই মিলবে সুখ মিলবে না।”
“তোর এতো ভাবতে হবে না। নিজের সংসার নিয়ে ভাব।”
“আমার ভাইয়ের সংসারটাও দেখতে চাই আমি। আমার বোনের সংসারটাও দেখতে চাই।”
“তোর বোন তো সংসার পেতেই নিয়েছে।”
“সেটা ফুপির সংসার। তৃষার সংসার তো হবে তোমার সাথে।”
“যখন হবে তখন দেখা যাবে।”
“তার মানে তুমি বিয়ে করবে?”
মুখে উচ্ছলতার ছোয়া।
“তোকে ভাতিজার মুখ দেখাতে হবে তো। আজ আসি। বাসায় চলে যা।”
রবিন চলে যায়। তৃনা সেখানেই বসে থাকে। বুক জুড়ে হাওয়া বয়ে যায়। এককাপ কফি হাতে খুশি গুলো আওড়াতে থাকে মনে মনে। সব ভাল তার শেষ ভালো যার। চোখ খুলেই কল্পনা করতে থাকে রবিন তৃষা বর কনে সেজে বাড়ির চৌকাঠে দাড়িয়ে। তৃনার চোখ মুখ বেয়ে আনন্দ গড়িয়ে পড়ে। হটাৎ কারো ওয়েটার ডাকে চেতনা ফিরে। চেনা গলা শুনে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে মাসুদ ওয়েটারের সাথে কথা বলছে। সামনে তার পুরো টেবিল খাবার। এমন কিছু দেখবে তৃনা ভাবেনি। উঠে সামনে যেতেই খাওয়া রেখে মাসুদ তাকিয়ে থেকে বলে তৃনলতা ভাবি?
তৃনা মাথা নাড়িয়ে সামনে বসে পড়ে। মাসুদ তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে। তৃনার জন্য অর্ডার দেওয়া কফি খেতে থাকে তৃনা। খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে মাসুদ বলে”ভাবি আপনি এখানে? খেতে এসেছিলেন বুঝি?”
“হ্যা ভাইয়া।”
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাবি। আমার বন্ধুটার ছন্নছাড়া জীবনটাকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“আপনাকেও ধন্যবাদ। সব সময় ওর পাশে থাকার জন্য।”
“সে আর পারলাম কোথাই? আপনি চলে গিয়েছিলেন সময়ে আপনাকে তো আর এনে দিতে পারিনি।”
“আপনার সাধ্যে ছিলো না তাই।”
“ভাবি মনে কিছু রাখবেন না। আসলে অতীত ভেবে ভুলে যান।”
“আমি যতো দূর জানি একটা মানুষকে কেউ কখনো আঘাত করলেই সে বিপথে যায় না। এর মধ্যে হাজারো মসলা থাকে। আমি কি সেই মসলা সম্পর্কে জানতে পারি ভাইয়া?”
মাসুদ ইতস্তত বোধ করে। তৃনা বলে, “ভাইয়া আমি কিন্তু চাইলেই আপনার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতে পারি। আমি যতদূর জানি ও বলবে আমাকে। কিন্তু আমি চাই না ও অতীতের কিছু নিয়ে ভেবে কষ্ট পাক। আমি চাই আমার আর রায়ানের মাঝে কোন কালো ছায়া না পড়ুক। রুমুকে আমার সন্তান হিসেবে মেনে নিয়েছি। রায়ান কেনো আমি নিজেও চাইনা অতীতের খারাপ কোন স্মৃতি মনে রাখতে। কিন্তু আমি শুধু সিওর হতে চাই। প্লিজ সে…….আমি যা ভাবছি তাই কি সঠিক?”
মাসুদ মাথা নাড়ায়।
“হ্যা ভাবি। আমি ঠিক ধরেছেন। রায়ানের পুরুষত্বে আঘাত করেছিলো রায়ান। অন্য একজনের সাথে রিলেশনে গিয়ে রায়ানের থেকে দূরে সরতে অনেক চেষ্টা করে লিনা। বিভিন্ন ভাবে অপবাদ দিতে থাকে। রায়ান তখন এক সন্তানের বাবা উল্টো ওদের লাভ ম্যারেজ ছিলো। রায়ান লিনাকে উল্টো বুঝাতো। কিন্তু কোনকিছুতেই কোন কাজ হয়না। রায়ানের সাজানো গার্লফ্রেন্ড বউ বচ্চা সবই আনা হয়। কিন্তু সব মিথ্যা প্রমানিত হয়। শেষে রায়ানের নামে এই অপবাদটা আনা হয়। একদিন ড্রাগস দিয়ে দুজন মহিলার সাথে রাখা হয়। পরদিন সকালে সবাই গিয়ে এই দৃশ্য দেখে। কিন্তু মহিলা দুটো উল্টো রায়ানের অক্ষমতা নিয়েই কথা শুনিয়ে যায়। তৃপ্তির হাসি হেসে লাগেজ নিয়ে দুধের বাচ্চাটাকে ছেড়ে বেড়িয়ে যায় লিনা।
তখন রুমুকেই নিয়ে থাকত রায়ান। কিন্তু আত্মীয় স্বজনের প্রতিবেশীর অফিসের সবার অকথ্য শ্রবন করতে করতে সুইসাইড করতে যায় রায়ান। তখন তাকে বাচায় ফাল্গুনী নামের এক সুন্দরী। সূচনা ঘটে রায়ানের ভুল জগতে পা দেওয়ার।”
“কিন্তু লিনা এসব করলো কেনো? সে তো এমনিই চলে যেতে পারতো।”
“পারতো না। কারন লিনার ফেমেলি, রায়ানের ফেমেলি আর এদের আত্মীয় স্বজন সবাই স্ট্রেট ছিলো ওদের সম্পর্কে। উপায় না পেয়ে এসব করেছে লিনা। ২১.
লিনার সাথে দেখা করতে এসেছে তৃনা। ক্ষমতাসীন রায়ান চৌধুরীর স্ত্রী হওয়ায় সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ মিলেছে।
দারোগার হুকুম পেতেই একজন পুলিশ তৃনাকে নিয়ে যায় লিনার কাছে। আজ তৃনা বোরখা নিকাবে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেনি। বেশভুষায় হয়ে গেছে প্রায় আট বছর আগের ফাস্ট ইয়ারের রায়ান পাগল তৃনলতাটি। গোলাপি রংয়ের থ্রিপিচ হলুদ রংয়ের হিযআপে সাজিয়েছে নিজেকে। লিনা চেয়ারে বসেই ঝিমুচ্ছিলো। তার উপর অনেক চাপ পড়ে দেখেই বুঝা যায়।
সম্প্রতি তার উপর আরো অভিযোগ যুক্ত হয়েছে। তার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে ড্রাগস ব্যবসায় যুক্ত ছিলো এবং ইদানিং শিশু পাচারেও তার নামের দেখা মিলে। স্বীকারোক্তি নেওয়ার জন্য নাজেহাল অবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তৃনার এতটুকুও মায়া হয়না।
কে জানে এর জন্যই হয়তো রুমুকে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। এদের সঠিক জায়গা হলো জেলখানা। এরাই সমাজকে দূষিত করে। তৃনা সামনের চেয়ারে বসে আস্তে করে ডাক দেয়”লিনা আপু …..”। দু একবার ডাকতেই উঠে পড়ে লিনা। সামনে বসা তৃনাকে দেখে চমকে উঠে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, “তুমি? এখানে কি করছো? তুমি কি পুলিশ তৃনলতা?
তৃনা ভাবলেশহীন ভাবে বলে, “নাহ আমি পুলিশ না। তবে আমার পরিচয় আছে। প্রথমত, আমি আপনার ভার্সিটির জুনিয়র। দ্বিতীয়ত, আমি এখন একজন প্রফেসর। তৃতীয়ত, আমি মিসেস রায়ান চৌধুরী। চতুর্থত, আমি রুমু চৌধুরীর মম।”
“হা হা হা হা। সিরিয়াসলি? আমার জায়গাটা নিতে চাইছো?”
“আমি আমার জায়গাটাই নিচ্ছি।”
“না। ওটা আমার জায়গা। রায়ান আমার হাজবেন্ড আর রুমু আমার মেয়ে। যা পেয়েছো সব ই আমার।”
“ছিলো। অস্বীকার করবো না। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি শুধু। তা হলো আপনি আমার জায়গাটা জোর করে নিয়েছিলেন। রায়ান আমাকে ভালোবেসে জেনে জোর করে বিয়ে করেছিলেন। মূলত পক্ষে রায়ান আমার ই ছিলো আছে থাকবে। আর রায়ানের সন্তান আমার সন্তান ই হওয়ার কথা। সেই হিসেবে রুমু রায়ানের সন্তান মানে আমার সন্তান। লিনা নামক কালো ছায়াটা আমি আমার জীবনে আর দেখতে চাই না। জানি আপনি চাইলেও এখান থেকে বের হতে পারবেন না। আর বের হলেও যেনো আমাদের মাঝে আপনাকে না দেখি।”
“থ্রেট দিচ্ছো তুমি আমাকে?”
“নাহ কুফাকে উপড়ে ফেলতে চাইছি। ইন্সপেক্টর সাহেব …. উনি কি কিছু স্বীকারোক্তি করেছেন?”
“না ম্যাম। উনাকে রিমাইন্ডে রাখা হয়েছে।”
“দেখি কিভাবে স্বীকারোক্তি নেন আপনারা আঙুল বাকা করে।”
ইন্সপেক্টর হালকা হেসে লিনাকে প্রহার করতে থাকে। লিনা অকথ্য ভাষায় তৃনাকে গালি দিতে থাকে আর চিল্লাতে থাকে। তৃনা প্রশান্ত মনে বেড়িয়ে আসে।
আজ রবিন তৃষার বিয়ে। বিয়ের বর খুশিতে নাচতে নাচতে আসে বিয়ে করতে। সাথে রায়ান রুমু তো আছেই। মামার কোলে চড়ে হৈ হৈ করতে করতে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে মামীকে নিয়ে যেতে আসছে। বিয়েতে রায়ান রুমু চলে গেছে বর পক্ষের দলে আর তৃনা চলে এসেছে কনে পক্ষের দলে। জামাই নামানোর জন্যে গেইটে দাড়িয়ে আছে পারুল শিল্পি আরো অনেকে। আম্মু আর ফুপিকে একসাথে দেখে রবিন বলে”আম্মু আমি তোমার ছেলে।”
“তৃষাও আমার মেয়ে। ছোট থেকে কোলে পিঠে করে বড় করেছি।”
রায়ান বলে, “হ্যা আম্মু। আপনার দুই জামাইকে বরন করুন। সাথে নানতীকেও।”
সবাই একযোগে হেসে ওঠে। শিল্পি মিস্টি খাওয়াতে গেলে রবিন আবার আপত্তি জনক মুখ করে বলে,
“আম্মু আমি তোমার পেটের ছেলে।”
“তো আমার পেটের ছেলে আপনি আমার কোলের মেয়ের দিকে নজর দিতে গেলেন কেনো? দেশে কি মেয়ের অভাব ছিলো নাকি?”
“তোমার জন্য ই তো। তৃনা চলে যাবে এখন তৃষা চলে গেলে তো কান্না কাটি করে ঘর ভাসাবে দুই মেয়েকে হারিয়ে। তাই একটু টেকনিক করে তোমার কোল ভরিয়ে রাখলাম।”
পারুল চোখ মুছে বলে, “আর আমার কোল খালি হয়ে গেলো।”
রায়ান টিপ্পনি কেটে বলে, “আর কতো কোলে নিবেন ফুপি? এখন তো আপনার কোলে উঠার দিন। ফুপা তো পুরোপুরি ওয়েল।”
সবাই হো হো করে হেসে ফেলে। পারুল রায়ানের কান মলে দেয় আচ্ছা মতো। রবিন বলে, “এইযে শাশুড়ীমা গন ঢুকতে দিন তো আপনাদের মেয়েকে দেখবে এবার আপনাদের জামাই।”
রায়ান বলে, “আমার বউ কোথায়? রুমু গালে হাত দিয়ে বলে”ওমা .. আমার মম কোথায়?”ভিড় ঠেলে সবাই হলে ঢুকে যায়। রবিন এগিয়ে যায় তৃষার দিকে। বধু সেজে বসে আছে তৃষা রায়ানের অপেক্ষায়। দোপাট্টায় বড় করে ঘোমটা টানা মুখের উপর। থুতনি টা বেরিয়ে আছে শুধু। রবিনকে দেখে দাড়িয়ে পড়ে তৃষা। কালো শেরোয়ানিতে ফর্সা গায়ের রং এ জ্বল জ্বল করছে। মুখে বাকা হাসিটাই ঘায়েল করে দিয়েছে তৃষাকে। রবিন থুতনি দেখেই পাগল প্রায়। তৃষার কাছে আসতেই বসিয়ে দেয় সবাই। রুমু দৌড়ে তৃষার কোলে উঠে বসে। পিচ্ছিল শাড়িতে কমফোর্ট না পেয়ে রবিনের কোলে চলে যায়। রবিন একটু হেলে কানের কাছে এসে বলে”তৃষা….”
তৃষা একটু কেপে উঠে।
“ঘোমটাটা একটু তুলি?”
তৃষা চুপ।
“একটু। শুধু দেখবো।”
তৃষা কাচুমাচু করে। কাবিনের আগে ঘোমটা তুলতে না করা আছে।
“এই তৃষা প্লিজ জানটা আমার। একটি বার শুধু দেখবো।”
তৃষা চুপ। বিরক্তি লাগে রবিনের। এবার বলে, “আহা আমার ময়দা সুন্দরী গো …. পাল্লারে গিয়ে আমার টাকায় কত মন আটা ময়দা মাখলি সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম। তোক কে দেখবে রে পেত্মী?”
রুমু দু হাতে গাল ধরে বলে”ওমা.. আটা তো ঝুর ঝুর কলে পলে। তাহলে পলছে না কেনো? দেখি দেখি”বলেই ঘোমটা তুলে দেয়। ঘুমটা তুলেই চিল্লিয়ে উঠে বলে”খালামনি তুমি খুব চুন্দল মামী।”ফিক করে হেসে দেয় তৃষা। রবিন তো আগে থেকেই হা হয়ে ছিলো এবার তো হাসিতে মরে যায় যায় অবস্থা। ফট করে হাত ধরে বলে, “বউ তুমি এতো সুন্দর কেনো? চল আমরা বাসর ঘরে চলে যাই।”তৃষা জোরে হাত ছাড়িয়ে নেয়। এমন কথায় লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলে। আশে পাশে তো হাসির রোল পড়ে গেছে। শালীরা বলছে”আরেকটু অপেক্ষা করুন ভাইয়া। বাসর ঘরে তো যাবেন ই।”রুমু বলে, “মামা বাসর ঘর চুন্দল ফুল। আমিও যাবো।”রবিন ঠোটে আঙুল দিয়ে বলে, “তুই চুপ কর মা। আর লজ্জায় ফেলিস না আমায়।”
তৃনাকে খুজতে খুজতে রায়ান হয়রান। কোথাও নেই। ফোনে বার বার কল দেওয়ার পর ফোন রিসিভ করতেই বলে”তৃনলতা…..কোথায় তুমি?”
“ওয়াস রুমে।”
“ওয়াসরুমে কেনো?”
“শাড়ি চেঞ্জ করছি। আগের টায় দই পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।”
“আসছি আমি।”
“আরে না। শোনেন।”
ফোন কেটে গেছে। রায়ান ওয়াশরুমে এসে প্রত্যেকটা ওয়াশরুমে খোজ করে লাস্টের টায় তৃনাকে পায়। দরজা ধাক্কাতেই তৃনা ভিতর থেকে বলে উঠে
“আসছি। এক মিনিট দাড়ান আমি তিন মিনিটে বের হচ্ছি।”
“কিহহ! তাড়াতাড়ি বের হও।”
তৃনা দরজা খুলে বের হয়ে বলে”কিহ? এতো জরুরী তলবে যে? শাড়িটাও পরতে দিলেন না ভালো করে। বলেন কি বলবেন? মেয়ে কার কাছে?”
রায়ানকে চুপচাপ দেখে আবার বলে, “কি হলো?”
আচমকা রায়ান তৃনাকে জড়িয়ে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে ঠোটে ঠোট মিশিয়ে দেয়। তৃনা উম উম করে কাধে হাত ঠেকিয়ে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও পারে না। শেষে সেও জড়িয়ে ধরে। বেশ কিছুক্ষন পর রায়ান ছেড়ে দিলে তৃনা ঠোট বাকিয়ে কাদো কাদো হয়ে বলে, “আমার সব লিপিস্টিক খেয়ে নিলো। এখন আমার কি হপ্পে!”
“আর যাই দাও না কেনো এখন লিপিস্টিক দিও না প্লিজ। আমি নিজেকে সামলাতে পারি না বউ।”
“আচ্ছা। ছাড়েন। কেউ এদিকে এলে দেখে ফেলবে।”
“দেখলে দেখুক। আমার অন্য কারো বউকে ধরিনি আমার বউকেই ধরেছি। তৃনলতা …আমার বউ… অনেক সুন্দর লাগছে। এতো সুন্দর কেনো তুমি? বুকে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে যাও।”
“নেভানোর দায়িত্ব টাও আমিই পালন করি।”
“কচু করো। দুই দিন থেকে তোমাকে না দেখে আমি শেষ প্রায়। কেমন কাটলো আমি ছাড়া এই দুদিন।”
“ভেবেছিলাম ঘুমোবো। কিন্তু বিয়ে বাড়ি ঘুমোনো যায় নাকি! ।”
“আমিও ঘুমাতে পারিনি। নরম কোলবালিশ ছাড়া ঘুম আসে না।”
“উফফ চুপ করুন না। চলুন তো।”
“ওকে চলো।”
দুজন থেকে কবুল নিয়ে খুব ভালোভাবেই হৈ চৈ এর মাধ্যমে বিয়ে হয়ে যায়। বাসর ঘরে তৃষাকে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায় সবাই। তৃষা পা ঝুলিয়ে বসে বসে পা দুলোচ্ছে। ঘন্টা খানেক পর আসে রবিন। তৃষাকে এভাবে দেখে বলে, “ঐ তুই এইসব ময়দা এখনো তুলিশনি? এই গুলো দিয়ে বসে বসে সারারাত রুটি বানাবো আমি?”
“রাস্তাঘাটে মেয়েদের কাছে গিয়ে মেখে মেখে ডো তৈরী করো রুটিটা না হয় আমার কাছেই করলে।”
“সব বানানো কথা তৃষা। তোর জেলাসটা দেখার জন্য করেছিলাম এমনটি।”
“জানি।
“ভালো। এখন ঘুমা।”
“ঘুমা মানে। আজ রাতে ঘুমায় নাকি কেউ?”
“তো কি করে?”
“ভালোবাসে।”
“যা ভালোবাস গিয়ে। তোর তো ডজন ডজন ভালোবাসা দেশে পড়ে আছে।”
“টপ লেভেলে তো তুমিই আছো। বাকি গুলো ভুলে গেছি। ওগুলো বাই বাই টা টা।”
রবিন তৃষার কাছে এসে মুচকি হেসে বলে, “আমাকে যাতে না ভুলিস সেই ব্যবস্থাই করবো।”
তৃষা রবিনের চোখে রেখে বলে, “সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি রবিন। একটু ভালোবাসবে আমায়?”
“অনেক ভালোবাসবো। অনেক।”
রুমুকে ঘুম পাড়িয়ে শুয়ে শুয়ে চোখের জল ফেলছে তৃনা। রায়ান এসে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ঘুমাও নি এখনো? আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?”
“হুম”
তৃনার ভাঙা গলা শুনে নিজের দিকে ফেরায় তৃনাকে। চোখ মুছে দিয়ে বলে”তৃনলতা…… বউটা আমার কাদছো কেনো তুমি? কি হয়েছে বলো আমাকে।”
“কাদছিনা তো। আজ আমি খুব খুশি। ভাইয়া তৃষার ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো।”
“হুম। এর জন্য কেউ কাদে নাকি?”
“রায়ান আই লাভ ইউ সো মাচ।”
“হুম। আই নিড ইউ তৃনলতা।”
“আই লাভ ইউ রায়ান।”
“আই নিড ইউ।”
“আই লাভ ইউ।”
“জানিতো।”
“রায়ান আমি ভালোবাসি তোমাকে।”
রায়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে চিৎকার করে কাদতে থাকে তৃনা। রায়ান থিতু হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। রাত পেরিয়ে মধ্যরাত চলে আসে। তৃনা বারান্দায় ফ্লোরে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে। পায়ের আওয়াজে তাকায় তৃনা। রায়ান তৃনার সামনে বসে তৃনার হাত দুটো নিজের হাতে নেয়। চুমু দিয়ে তৃনার চোখে চোখ রাখে বলে,
“আই লাভ ইউ তৃনলতা … একটু ভালবাসবে আমায়?”
ভেতরের কষ্টের সমুদ্রে সুখের ঝড় উঠে তৃনার। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠে। রায়ান শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে তৃনাকে। কানে চুমু দিয়ে বলে, “তৃনলতা ……..বউ আমার … ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। ঠান্ডা হয়ে গেছে হাত পা। চলো রুমে চলো।”
তৃনা আরো জোড়ে জড়িয়ে ধরে।
“তৃনলতা …. আমি এতোদিন ভালোবাসাহীন জীবন কাটিয়ে ছিলাম। এবার সময় এসেছে তোমার আমার ভালোবাসায় ভালোবাসার ঘর বাধার।”
তৃনা মাথা তুলে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে”আর ভালোবাসার ঘরে যে আরেকটা ভালোবাসা আসতে চলেছে সেই খেয়াল কি আছে আপনার?”
কপাল কুচকে তাকায় রায়ান। তৃনার মুখের দুষ্টু দুষ্টু হাসি বাজেয়াপ্ত করে ঠোট মেলে হেসে বলে,
“রিয়েলি? কখন জানতে পারলে?”
“আজ সকালে। কিটে দুইটি দাগ উঠেছে।”
“হায় হায় বলে কি? আর আমি কিনা বারান্দায় বসিয়ে আমার বউয়ের ঠান্ডা লাগাচ্ছি!”
“এখনি শুরু হয়ে গেলো না?”
“এই শুরু শেষ হবার নয়। লেটস গো মেডাম।”
শুষ্ক পাতার ভাজে আটকে থাকা ভালোবাসা প্রান পাওয়ার রাত আজ।
লেখা – লাবিবা তানহা লিজা
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “শুষ্ক পাতার ভাজে (শেষ খণ্ড) valobasar golpo 2019” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)