অনুভূতি – বেদনার কিছু গল্প কিছু কথা

অনুভূতি – বেদনার কিছু গল্প কিছু কথা: শোভা ডায়রিটা বন্ধ করে চুপচাপ খাটে গিয়ে শুয়ে পরলো। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। ভাবতে লাগলো, আচ্ছা মেঘা কি পরে ভালো হয়েছিলো? ওরা মিলে কি আবার নিত্য নতুন অনুভূতি সৃষ্টি করেছে?


পর্ব ১

হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, লাল টুকটুকে জামা পরে মিষ্টি একটা মেয়ে বসে বসে পা নাড়াচ্ছে আর মা খাইয়ে দিচ্ছে! ব্যাগ রেখে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মা বললো,
~ এই রোদ, চলে আসছিস! যা ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।
~ মা এই মেয়েটা কে?

~ আরে ওকে চিনিস নাই! অবশ্য চিনতে না পারার~ ই কথা। সেই ছোট্টবেলায় দেখেছিস। ও তোর সেই নবীন কাকুর মেয়ে।
আমি তখন ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, ওই যে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতো যে ওই পিচ্চি টা!

তখন মেয়েটা কপাল কুঁচকে বললো,
~ এহহ আমি মোটেও কাঁদি না। তাই না বলো কাকিমনি?
মা হেসে বললো, হ্যাঁ তাই তো! মেঘা তো খুউউউব লক্ষি মেয়ে।
মেঘা তখন হেসে কুটিকুটি।

আমি তখন বললাম,
~ ইশশ ওর নাম বুঝি মেঘা! এই জন্যই তো এতো কাঁদে! হিহিহি!
“এর পর একদিন জানলাম গাড়ি এক্সিডেন্টে ওর মা~ বাবা মারা গেছে। আর ওর বাবা~ মা পালিয়ে বিয়ে করেছিলো তাই ওদের পরিবার মেনে নেয় নি।

আর উনারা ও আর যোগাযোগ করে নি। আমার বাবা আর মেঘার বাবা ছিলো খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রায় ই দেখতাম কাকু আসতো বাসায়। কিন্তু মেঘাকে একবারই দেখেছিলাম!

ওর জন্মদিনে। যেদিন ওনাদের এক্সিডেন্ট হয় ওইদিন বাবাকে বলেছিল মেঘাকে নিজের মেয়ে ভেবে নিতে। মেয়েটা তো একা হয়ে যাবে নাহলে!

এর পর থেকে মেঘা আমাদের কাছেই রইল। মা~ বাবাকেও দেখিনি কখন পর ভাবতে।

মেঘার তখন ৮~ ৯ বছর হবে। প্রায় সময় দেখতাম একা একা বসে থাকত। মাঝেমাঝেই দেখতাম কাঁদতে। ও হয়তো ততদিনে মা~ বাবার শুন্যতাটা উপলব্ধি করছিল! মা~ বাবার শুন্যতা কি কেউ কখন পূরন করতে পারে?

এইভাবেই চলছিলো দিন। মেঘা আমি দুজনই বড় হতে লাগলাম। অদ্ভুত এক কারনে ওর আর আমার সবসময় ঝগড়া লেগেই থাকত। আমি যাই করতাম তাতেই ও খুঁত ধরতো! আমিও ওকে ক্ষ্যাপাতাম সারাক্ষণ।

আমি তখন নবম শ্রেনীতে পড়ি আর মেঘা ষষ্ঠ শ্রেনীতে। আমি আর মেঘা একই রুমে ভিন্ন টেবিলে পড়তাম। একদিন..

~ এই ভাইয়া, তুমি আস্তে পড়তে পার না! ষাড়ের মতো এমন চিল্লাউ ক্যান?

~ তোর কিরে বান্দরনি? তুই ও চিল্লাইয়ে পড়! আমি কি মানা করছি?
~ এই তুমি আমারে বান্দরনি বললা ক্যান?
~ তো কি কান্দনি বলমু? হেহে
~ ও কাকিমনি তোমার ছেলেরে কিছু বলবা?
মা এসে বকতো আর বলতো এই রোদ তুই আবার চেতাইতেছিস মেয়েটারে?

~ ওমাহ আমি চেতাইলাম কই! আমি জোরে পড়ি দেখে ওর নাকি ডিস্টার্ব হয়। তো ওর জন্য কি না পড়ে থাকবো! ওর মতো তো আর বই খুলে ঘুমাই না।

~ ইশশ! মিথ্যাবাদী। তুমি দেখছো আমারে ঘুমাইতে?
~ ওমাহহ না দেখে বললাম নাকি। একটু আগেও তো ঘুমাচ্ছিলি। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো তাই এখন এমন করতেসিস!

~ দেখলা কাকিমনি? ক্যামনে খোঁচা মারতেছে?
মা বিরক্তি নিয়ে বলতো, উফফ তোদের নিয়ে আর পারি না। যা মন চায় কর! আমি গেলাম।

এর পর থেকে অবশ্য আমাদের পড়ার রুম আলাদা করা হয়েছিলো। কিন্তু মেঘা নানা কারনে আমার উপর খবরদারি করত।
আমি রাত করে বাসায় ফিরলে আমার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে ফেলতো। ওর জন্য রাত জাগতেও পারতাম না। মাঝে~ মধ্যে ভার্সিটি যেতে না চাইলেও ঝগড়া করে পাঠিয়ে দিত।

এমন অনেক হয়েছে, আমি শুয়ে ফোন টিপছি ও কোথার থেকে এসে ফোন নিয়ে চলে যেত।

আমি বলতাম তুই কি রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছিস নাকি, আমি কি করছি না করছি?

ও মুখ উল্টে বলতো ~ ইশশ আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই তোরে পাহাড়া দিতে যামু।

ও আমাকে গ্রাহ্য না করে ফোন নিয়ে চলেযেতো!
মা~ বাবা ও ওকেই সাপোর্ট করতো। আমি ও সবার উপর চিল্লামিল্লি করতাম খুব।

মেঘা কে দিয়ে আমি একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি। মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি ম্যাচিওর হয়ে যায়। আর ওরা অধিকার খাটাতে বেশ পছন্দ করে।

মেঘার তো আমরা ছাড়া আপন কেউ ছিলো না। আর মা~ বাবাকে মেঘা ভীষণ সম্মান করতো। যেহেতু আমি আর মেঘা ছোটবেলা থেকে একসাথেই বড় হয়েছি, তাই ওর রাগ~ জিদ, অভিমান, অধিকার বোধ সব কিছুই আমার উপর এসে পরতো।

অবশ্য বাবা~ মায়ের ব্যাপারেও ও খুব কেয়ারিং ছিলো। কে সময় মতো খেলো, না খেলো সব কিছুই যেন ওর দায়িত্বে চলে গেলো। মা ও যেন ওর উপর সব ছেড়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাইলো।

মাকে প্রায়ই দেখতাম ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিছু ভাবতো। আমি যদি জিজ্ঞাস করতাম, মা কি ভাবো?

মা তখন হেসে বলতো, তেমন কিছু না। ভাবছিলাম মেঘা টা কেমন তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলো। সেই ছোট্ট মেয়েটা এখন সংসারের দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে! আমি তো প্রায় ওর উপর সংসারের হাল ছেড়েই দিয়েছি। সব দিকে কত নজর মেয়েটার দেখেছিস।

আমি মুখ উল্টে বলতাম, হ্যাঁ তোমরা লাই দিয়ে দিয়ে পাক্কা বুড়ি বানিয়ে ফেলছো আরো। দেখো না আমার সাথে কেমনে ঝগড়া করে সারাক্ষণ।

মা তখন আমার মাথায় বাড়ি দিয়ে বলতো, ঠিকই তো করে। তুই তো আজকাল যা ছন্নছাড়া হয়েছিস তোর সাথে এমনই করা উচিত।
~ হ্যাঁ দেও দেও আরো লাই দেও। আমি কিছু বললে তো ঠিকই আমাকে এসে বকো। এমন ভাব করো যেনো আমি পর অয় আপন।

মা তখন মুখ চেপে বললো~ চুপ আস্তে কি সব বলছিস! মেয়েটা শুনলে অনেক কষ্ট পাবে। আমরা কি ওকে কখন পর ভেবেছি নাকি। ও তো আমাদের লক্ষি একটা মেয়ে। কখন কোনো কিছু নিয়ে শাসন করা লাগে নি। বরং বলার আগে সব কিছুতেই পরিপাটি। ভাগ্য করে মানুষ এমন মেয়ে পায় মানুষ।

~ হ্যাঁ হ্যাঁ হইছে যাও। থাকো তোমাদের আদরের দুলালিরে নিয়ে।

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতে একটু বেশি~ ই রাত হয়ে গেছিলো। আমি বাড়ি ফিরে দেখলাম বাড়ি মোটামুটি চুপ। ভাবলাম সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এই ভেবে চুপিচুপি যেতে লাগলাম। হঠাৎ মেঘার কন্ঠ শুনে থেমে গেলাম। বলে উঠলো~
বাহহ! আজকাল দেখি রাতবিরেতে চোরের মতো বাসায় ফিরা হচ্ছে!

মেঘা জেগে আছে দেখে একটু অবাক~ ই হলাম। কারন তখন প্রায় 1 টা বাজে। যেই মেয়ে 10~ 11 টায় ঘুমে ঢোলে পরে সে এত রাতে জেগে আছে! এতে আমি খুবই অবাক হলাম!

বললাম, আরেহ তুই আবার পেঁচা হইলি কবে থেকে? ঘুমাসনি যে!
কথাটা বলে আমি হাসার চেষ্টা করলাম। মেঘা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আবছা আলোয় বেশ বুঝতে পারলাম ওর চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে রাগে। মেয়েটার ইদানিং খুব রাগ বেরে গেছে। আমি বললাম,

~ কি? তাকিয়ে আছিস ক্যান এভাবে? কিছু কি হইছে?
~ কই ছিলা এত রাত অবধি?

“ওর অধিকার বোধ টায় তখন আমার বিরক্ত লাগলো। চোখমুখ শক্ত করে বললাম”,

~ সেই কৈফিয়ত কি এখন আমার, তোরে দেওয়া লাগবে?
ও আমার প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করে বললো,
~ কোন ভালো ছেলেদের দেখছো এতো রাত অবধি বাড়ির বাহিরে থাকতে? তারপর আবার চোরের মতো ঘরে ঢুকতেছিলা। কাদের সাথে মিশা শুরু করছো তুমি!

~ মেঘা বেশি করে ফেলতেছিস কিন্তু। নিজের সীমায় থাক।
~ ওহহ এখন আমায় সীমানা দেখাচ্ছ? বাহহ ভালো তো!
~ তোকে আমার সব ব্যাপারে নাক গলানোর জন্য এই বাড়িতে রাখা হয় নাই। যেমন আছিস তেমন থাক, আমার সব বিষয়ে পণ্ডিতি করতে আসবি না খবরদার।

তুই আমার এমন কেউ হোস না, যার কথা মতো আমায় চলতে হবে। আজকাল তোর এই ব্যাপার গুলায় খুব বিরক্ত হচ্ছি। সব কিছুতে কর্তীত্ব ফলাতে আসবি না।
এক নাগারে কথা গুলো বলে গেলাম। মা~ বাবা ও ততক্ষণে চলে এসেছে।

আমি যখন কথা গুলো বলছিলাম পুরোটা সময় মেঘা আমার দিকে চেয়ে রইল। কথা বলা থামানোর সাথে সাথে ও একটা হাসি দিলো।
তারপর বললো, “আচ্ছা। মনে থাকবে কথাগুলো।”একথা বলে চলে গেলো।

জানিনা ওই হাসিটায় আর কথা গুলো তে কি ছিলো! বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো।

হঠাৎ মা এসে থাপ্পড় মেরে দিলো। তারপর বললো, তুই আসলেই অনেক বেয়াদব হয়ে গেছিস রোদ। ছিঃছিঃ এতো অধঃপতন হলো তোর! মেয়েটা কি তোকে খারাপ কিছু বলছে? মেয়েটাকে খোঁটা না দিলে তোর হজম হচ্ছিল না, না?

টেবিলের উপর থেকে একটা গ্লাস নিয়ে আছাড় মেরে, রুমে চলে গেলাম।

রুমে গিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। মেজাজ প্রচুর খারাপ হচ্ছিল। আর রাগ হলে আমার অনেক ঘুম পায়। কখন চোখ লেগে এসেছিলো জানি না।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। আধোঘুম আধো জাগরণে অনুভব করলাম কেউ যেনো গুনগুন করে কথা বলছে। উঠে বসে পরলাম। শব্দটা যেনো থেমে থেমে আসছিলো। শব্দের উৎস খুঁজতে রুম থেকে বের হয়ে বুঝলাম বারান্দায় কেউ কথা বলছে।

ভাবলাম, মা~ বাবা এতো রাতে জেগে থাকার প্রশ্নই আসে না! তারমানে মেঘা এখনও জেগে আছে! আশ্চর্য মেঘা এখনো কেনো জেগে আছে! ফোনে কথা বলছে নাকি, কারো সাথে!

সাবধানী হয়ে এমন ভাবে কাছে গেলাম, মেঘা যেনো টের না পায়। কাছে যেতেই শুনতে পেলাম…
“কেনো তোমরা আমাকে অন্যদের বোঝা করে দিয়ে গেলা মা? ও বাবা সেদিন কেনো তোমাদের সাথে নিয়ে গেলা না?

কাকু কাকিমনি কতো ভালোবাসে আর আমি কিনা তাদের ছেলের বিরক্তির কারন হচ্ছি!”
মেঘা কথাগুলো বলছিলো আর টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পরছিলো। ওর কথাগুলো সেদিন তীরের মতো এসে বুকে লাগতে লাগলো।

একটু বড় হওয়ার পর থেকে মেঘাকে কখন কাঁদতে দেখিনি। আমাদের তো কত শত ঝগড়া হয়েছে কিন্তু কখনো এমন বাচ্চাদের মতো করতে দেখিনি। মেয়েটার মনে কত বড় আঘাত দিয়ে ফেলেছি বুঝতেও পারি নি। খুব অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো। আমার কাছে পৃথিবীর অন্যতম বাজে দৃশ্য ছিলো, ওর মায়ামায়া চোখে কান্নার দৃশ্য টা।

ওইখান দাড়িয়ে থাকারা শক্তি রইলো না আর। মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। চলে আসলাম রুমে। কতক্ষণ আনমনে বসে ছিলাম বলতে পারবো না। আজানের ধ্বনিতে মৌনতা ভাঙলো।

আমি আবার গেলাম বারান্দায়! গিয়ে দেখলাম দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ছোট্ট মেয়েটা কবে এতো অভিমানি হয়ে উঠলো! তখন ওকে দেখে এত মায়া লাগতে লাগলো দেখে। এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। আমি মেঘার পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর…


পর্ব ২

তারপর মেঘার মাথায় হাত রেখে ডাকলাম, ‘এই মেঘা’।মেঘা চমকে চোখ মেললো।আমাকে দেখে চমকে উঠে দাড়িয়ে পরলো।আমি ও দাড়িয়ে পরলাম।কিন্তু এই প্রথম অনুভব করলাম আমি ওর দিকে তাকাতে পারছি না!
নিচে তাকিয়ে বললাম,’মেঘা সরি’।

~ আরেহ তুমি সরি বলতেছো ক্যান? সরি তো আমার বলা উচিৎ।আই এম সরি!
~ আসলে রাগ উঠে গেছিলো।কি বলতে কি বলে ফেলছি নিজেও জানি না।তুই তো জানিস আমি কেমন বল?কতটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম তোকে!
মেঘা হেসে দিয়ে বললো,’ঠিকই তো বলেছো।আমাকে যে তোমরা এতোটা দয়া করেছো সেটাই তো অনেক।তাঁর উপর আবার অধিকার ফলাতে গিয়েছি।হাহা।’
~ আমি আসলে ঠিক অভাবে..

কথা শেষ করার আগেই মেঘা আমাকে থামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল।আমিও আর বাঁধা দিলাম না।আমি বেশ বুঝেছি ও কতটা কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলেছে।

এর পর থেকে মেঘা বেশ নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
আগের মতো ঝগড়া করতো না।কথা বলতো না।একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো মেয়েটা।
তখন আমি আবিষ্কার করলাম আমি ওর সেই শাসন করা,ঝগড়া করা সব মিস করতে লাগলাম।এমনকি আমি নানা ভাবে ওকে রাগানোর চেষ্টা করতাম,ইচ্ছাকৃত ভাবে অনেক ভুল করতাম কিন্তু ওর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতাম না।বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়েও আমি ওর অভিমানী মুখটার কথা ভাবতাম।
একটা মেয়ে কতটা অভিমানী হতে পারে, মেঘাকে না দেখলে কখনও বুঝতেই পারতাম না!
ওর এমন বদলে যাওয়া আমি আর নিতে পারছিলাম না।

সেদিন যখন বাড়ি ফিরার পর মেঘা দরজা খুলে দিয়ে চলে যেতে লাগল,আমি ওর হাত ধরে ফেললাম।মেঘা অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকালো।আমি বললাম,
~ এমন করছিস ক্যান মেঘা।আমি তো মাফ চেয়েছি তোর কাছে।এত অভিমান কেন তোর?
~ আমার কোনো অভিমান নেই।আর যাদের আশ্রিতা হয়ে এতগুলো বছর পার করে দিলাম তাদের সাথে অভিমান করার স্পর্ধা নেই আমার।
~ প্লিজ,মেঘা এমন করিস না!আজকাল তোকে আমার খুব অচেনা লাগে।এভাবে আর নিতে পারছি না।
~ হাত ছাড়ো।ব্যাথা লাগছে।

হাত ছেড়ে, আমি দুহাত জোর করে মেঘার সামনে বসে পড়লাম।তারপর বললাম, ‘প্লিজ মেঘা,আগের মতো হয়ে যা।আই প্রমিস, আমি এখন থেকে তোর সব কথা শুনবো।এই দেখ কানে ধরতেছি।’
হঠাৎ আমি অনুভব করালাম আমার হাঁটুর উপর টপটপ করে পানির ফোঁটা পরছে।চমকে উঠে তাকাতেই দেখলাম ওর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে।আমার মাথা ঝিম মেরে উঠলো।শরীরের সমস্ত শক্তিতে হাত দিয়ে দেয়ালে একটা ঘুসি মেরে দিলাম।তারপর বললাম~ খবরদার তুই আমার সামনে একটু ও কাঁদবি না।

এরপর আর ওর সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিলো না।মেঘা তখনও দাঁড়িয়ে ছিলো।আমি চলে আসলাম রুমে।সারা শরীর অবস হয়ে আসতে লাগলো।হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লাম।হাত থেকে বোধহয় রক্ত পড়ছিলো।পড়ুক!তাতে আমার কিছু যায় আসে না এখন।

কখন জানি চোখ লেগে গিয়েছিল।হঠাৎ কারো ছোঁয়া অনুভব করলাম চোখ খুলে যা দেখলাম তাতে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না!দেখলাম মেঘা আমার পাশে বসে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে!আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম!ওর নাক~ মুখ এখনও লাল হয়ে আছে।আমি মৌনতা ভেঙে বললাম,
~ এই মেয়ে শোন!

~ হুহ
~ তুই কাদঁলে চোখ~ মুখ এমন টমেটোর মতো লাল হয়ে থাকে ক্যান!!আমি কাঁদলেও কি এমন টমেটোর মতো লাল হয়ে যাবে?
~ ইশশ আসছে!আমি কেমনে জানবো?আমার সামনে কখনও কাঁদছো নাকি?
~ এহহ! আমি কাঁদবো কোন দুঃখে?আমি কি তোর মতো কান্দনি নাকি?
তবে একদিন প্র্যাকটিস করে দেখতে হবে এমন টমেটোর মতো লাল হয় নাকি।যদি হয় তো,তোর সামনে গিয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবো।তখন বুঝবি এমন মুখ করে কাঁদলে অন্যদের মনের মধ্যে কেমন অনুভূতি হয়!

~ এই তুমি আবার আমাকে খোঁটা দিচ্ছো?ভালো হবে না, বলে দিচ্ছি কিন্তু।
~ ওয়েট !ওয়েট!বাই এনি চান্স আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?চিমটি দে তো একটা।

(আউউউচ)

~ কি? আউউচ বলো ক্যান এখন?তুমিইতো বললা চিমটি কাটতে।
~ ইশশ কত দিন পর এভাবে প্রান খুলে কথা বলতেছি তোর সাথে।এই কয়দিনে খুব বুঝেছি তুই ছাড়া আমি কত একা!
মেঘার মুখে আবার অন্ধকারের ছায়া পরে গেলো।আমি কথা ঘুরিয়ে ফেললাম।বললাম,’ভাবতেছি কাল ভার্সিটি যাব না।’মেঘা কপাল কুচকে তাকিয়ে বলল,
~ ইশশশ!না গিয়ে দেখোই না কি করি!
~ এতদিন যে ঝগড়া করিস নাই ওইগুলা উসুল করতে হবে না?
~ এহহ আসছে।

ওইদিন আমরা অনেক রাত অবধি কথা বলেছি।আহহ কতদিন পর অনেকটা শান্তি পেলাম।সেইদিন কার অপরাধবোধ টা এতদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো আমাকে।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছাকৃত ভাবে লেইট করতে লাগলাম।আমি আসলে অনেকদিন পর আবার মেঘার রিয়েকশন টা দেখতে চাচ্ছিলাম।হঠাৎ দেখলাম ফোসফোস করতে করতে রুমে প্রবেশ করলো।

তারপর চিল্লায়ে চিল্লায়ে বলতে লাগলো,’ও কাকিমনি,তোমাদের রাজপুত্র ছেলেরে ভালোয় ভালো উঠে ভার্সিটি যেতে বলো।নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।’
আমি অন্যদিক ফিরে মনেমনে হাসতে লাগলাম।
মা এসে বললো তোরা আবার চাল্লামিল্লি শুরু করে দিলি!
আমি বললাম, আমি চিল্লাচ্ছি নাকি?তোমার আদরের দুলালি এসেই তো ষাঁড়ের মতো চিল্লাচ্ছে।
কথা টা বলেই মনে হলো ‘হায় হায় আমি না ভান করে ছিলাম!’

মেঘা বললো,’দেখছো কাকিমনি? কত্ত বড় বান্দর তোমার ছেলে?এত বুড়া হইছে এখনও বাচ্চাদের মতো ফাঁকিবাজি করে!
~ এহহহ আসছে!কে বুড়ি মানুষ জানে।সারাদিন বুড়িগিরি করে বেড়ায় ঘরের মধ্যে।
মা হেসে দিয়ে বললো,তোরা আর ঠিক হইলি না।যা খুশি কর আমি গেলাম।
মা চলে যেতেই মেঘা বললো,’ভান করো না?দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা!’
এই বলে মেঘা রুম থেকে বেড়িয়ে, এক গ্লাস পানি এনে ঝপ করে আমার মুখে ছুড়ে দিলো।তারপর খিলখিল করে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।
মেঘা অন্য রুম থেকে চিল্লায়ে চিল্লায়ে বলতে লাগলো,’তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও নাহলে কিন্তু এখন গিয়ে গরম চা ঢেলে দিয়ে আসবো ওই তাহেরি হুজুরের মতো।হিহিহি।
এর মাঝে বেশ কিছু দিন চলে গেলো মেঘার এসএসসি তে ভীষণ ভালো রেজাল্ট করলো।
ভালো কলেজেও এডমিশন নিলো।কিন্তু বাসা থেকে অনেকটা দূরে ছিলো ওর কলেজ।আর মেঘার ও ইচ্ছা ওই কলেজে এডমিশন নেয়ার।এরপর…


পর্ব ৩

এরপর আর কি! ওকে দিয়ে আসার, নিয়ে আসার দায়িত্ব পরলো আমার উপর।

মেঘা মুখ উল্টে বললো, ইশশ! এখন এই গাঁধাটার সাথে যাইতে হবে বুঝি! লাগবে না বাপু আমি এখন বড় হয়েছি না? একাই বেশ যাওয়া আসা করতে পারবো।

আমি তখন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, এহহহ আসছে আমার কি বড় মানুষ টা রে, রাস্তার থেকে যেদিন ধরে নিয়ে যাবে তখন তো ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করা ছাড়া কিছুই করতে পারবি না। হেহে।
~ ভালো হইছে নিয়ে যাক আমাকে। তোমার কি তাতে?
~ আমার আর কি হবে। নেহাত বাবা~ মা তাদের আদরের দুলালিরে হারিয়ে কষ্ট পাবে দেখে একটু দয়া করতেছিরে কান্দনি।
~ এই কান্দনি বলবা না।
.
.
ওর কলেজ ছিলো খুব ভোরে। প্রায় সময় এমন হতো ও আমাকে ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে যেতো। তারপর আমাকে রেখে একাই চলে যেতো। পরে মা এসে চিল্লামিল্লি করে বলতো, মেঘা চলে যাচ্ছে তুই পরে পরে ঘুমা। তখন আমি উঠে শার্ট নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ওর নাগাল পেতাম।

মেঘা তখন কপাল কুঁচকে বলতো, আসলা ক্যান? যাও পরে পরে ঘুমাও আরো।

আমি তখন হেসে দিয়ে বলতাম, এহহ আমি আসতাম নাকি! মা জোর করে পাঠালো। কেউ যদি আবার তোকে চুরি~ টুরি করে নিয়ে যায়! সেই ভয়ে।

তখন মেঘা খিলখিল করে হেসে ফেলতো।

একবার তো হুলুস্থুলকান্ড করে ফেলছিলাম, মেঘাকে ক্লাসে দিয়ে এসে ওদের ক্যাম্পাসের সামনে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে ভাবলাম একটু রেস্ট নিয়ে যাই।

একটুপর অনুভব করলাম আমার চোখে পানির ছিটা দেয়া হচ্ছে। চোখ মেলে তাকিয়ে তো আমি অবাক।

দেখলাম আমাকে ঘিরে মোটামুটি একটা ভীড় হয়ে গেছে। মেঘা আমার দিকে ভীতু ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, কি হলো? সবাই এমন আমাকে ঘিরে আছে কেনো?

মেঘা বললো, “আমি কিভাবে বলবো? আমি কি তোমার কাছে ছিলাম নাকি? আমাকে তো জারা ডেকে বললো তুমি নাকি পড়ে আছো। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।

~ ভীতু মেয়ে, ভয় তো পাবি~ ই
~ ইশশ! আসছে আমার কি সাহসী রে! এই তোমার না আমাকে দিয়ে বাসায় যাওয়ার কথা? এখানে পরে ছিলা কেমনে?

“আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম তারপর বললাম, কি বলিস? এখানে শুয়ে থাকবো কোন দুঃখে? আমার কি বাড়িঘর নাই নাকি। আমি তো একটু হেলান দিয়ে বসে ছিলাম এইখানে। তারপর..
~ তারপর কি? ভূত আইসা তোমারে ফেলে দিয়ে গেছে?

আমার আর তখন বুঝতে বাকি রইলো না কিভাবে বসা থেকে শুয়ে গেলাম। তখন আমি হেয়ালি করে বললাম,
~ বাহহ! তোর গোবর ভর্তি মাথায় বুদ্ধি হয়েছে তো! তবে ভূত না কোনো পেত্নি হবে হয়তো।

দেখিস আমি কি ইয়াং, হ্যান্ডসাম একটা ছেলে! হয়তো কোনো পেত্নি ক্রাশ~ ট্রাশ খাইছে।

মেঘা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, “হ্যাঁ। ক্রাশ এর জায়গায় ট্রাশ খেয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। হিহি”
~ খুব হাসি হচ্ছে না? আমারে তোর চোখে লাগলো না, না? অবশ্য লাগবেই বা কেমনে চোখ আছে নাকি। কানী একটা।

তারপর একটা ভাব নিয়ে বললাম,
তুই যানিস ক্যাম্পাসের কত মেয়ে আমার উপর ক্রাশিত? কত সুন্দরীরা আমারে লাভ লেটার দেয়?

মেঘা তখন খিলখিল করে হেসে দিয়ে বললো হ্যাঁ জানি তো। ওইযে ওইদিন রিতুদের কাজের মেয়েটা চোখ টিপ মেরে চিরকুট দিয়ে গেলো! হাহাহা।

মেঘার হাসি তখন থামছিলোই না। আমার তো তখন মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। আমি রাগি রাগি স্বরে বললাম খবরদার ওই পাঁজি মাইয়াডার কথা বলবি না।

~ হিহিহি! কেনো বলবো না? তুমিই তো বললা কারা ক্রাশ খায় জানি নাকি। তাই তো প্রুফ দিলাম।

আমি বললাম, এহহ আসছে। ওনার পিছে যেনো রাজপুত্র ঘুরে!
মেঘা ভাব নিয়ে বললো, হ্যাঁ ঘুরেই তো। আমাদের কলেজের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলেটাও তো চান্স নিতে চায়। নেহাত আমি লক্ষি মেয়ে তাই ওইসব পাত্তা দি না। তবে ভাবতেছি একবার চান্স নিয়ে দেখা উচিৎ। কি বলো?

আমার তখন খুব গায়ে লাগলো। বললাম, এহহ ঠ্যাং ভেঙে ঘড়ে রেখে দিবো না একদম। খুব শখ না? কাল থেকে তোর কলেজ ছুটি হওয়া অব্দি বসে থাকবো। দেখবো কেমনে চান্স নেস।

তখন মেঘা, বোতলের পানিগুলা ঝপ করে আমার মুখে মেরে দিয়ে বললো, হ্যাঁ! তারপর মাঠের মাঝখানে পরে পরে ঘুমাবা। আজ বাসায় চলো খালি, তোমারে আজকে কাকিমনির কাছে কিভাবে মাইর খাওয়াই দেইখো।
~ আসছে আমারে হুমকি দিতে। যা যা।
মেঘা দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, “ইশশ! তোমার জন্য আজ আমার ইমপরট্যান্ট ক্লাসটাই মিস হইলো।”
.
সেইদিন বাসায় ফিরে মেঘা মায়ের কাছে খুব করে নালিশ করেছিলো। মা হেসে দিয়ে বললো, আমাকে বলিস ক্যান! বান্দরটা তো আমার থেকে বেশি তোকেই ভয় পায়।

মেঘা তখন মুখ বেঁকে বললো, আমাদের আর কি মানবে? ওনার তো এখন অন্য কাউকে মানার সময় হয়ে এসেছে।

আমি বললাম, হুম। আগেই জানতাম কোনো না কোনো কাহিনী আছে। ভনিতা না করে আসল কাহিনী বলে ফেলেন ম্যাডাম।
মেঘা বললো, হ্যাঁ। আপনি তো জানবেন~ ই। আপনি আমাকে দিয়ে আসার নাম করে তো মেয়ে পটাইতেই জান।

তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, জানো কাকিমনি কি হইছে আজকে?
মা অবাক হয়ে বললো, আমি তো কিছুই বুঝতেছি না!

মেঘা বললো, ওই যে আমাদের ক্লাসের জারা আছে না? ও বলছে কি জানো? ওর নাকি তোমার ছেলেরে মনে ধরছে। আজকেতো তোমার রাজপুত্র মাঠের মাঝখানে ঘুমিয়ে পরছিলো। ওই সীন দেখে ওর মনের টেলিফোন বেজে উঠছে। এখন আমাকে বলতেছে গিট্টু লাগিয়ে দিতে। কেমনটা লাগে কও?

মা জোরে হেসে দিলো তারপর চা নিয়ে উঠে যেতে যেতে বললো, তাহলে তো ভালোই হলো। আমি পাত্রী খোঁজার আগে, পাত্রী নিজে আইসা ধরা দিলো। হাহাহা।

মা চলে গেলো। তারপর আমি ভাব নিয়ে বললাম, খুব তো বলেছিলি আমার উপর নাকি পেত্নিরা ক্রাশ এর জায়গায় ট্রাশ খেয়ে ধাক্কা মেরে চলে যায়। কেউ নাকি পাত্তা দেয় না? আর ওই মেয়ে তো পেত্নি ও না, সাক্ষাত পরী! আহা সে কি রুপ। এখন পেলি তো প্রমাণ?

মেঘা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো, তো তোমার সেই পরী তোমারে না বইলা আমারে বলে ক্যান গিট্টু লাগাইতে?

~ আরেহ লজ্জা পাচ্ছে! বুঝিস না কেনো গাঁধী?

তারপর মেঘা টেবিলের উপর থেকে একটা টমেটো নিয়ে আমার দিকে মেরে চলে গেলো।

বিকেল বেলা দেখলাম এফবিতে মেয়েটা রিকোয়েস্ট পাঠালো। মেঘাকে রাগানো জন্য মেঘার কাছে যেতে দেখলাম মেঘা ঘুমাচ্ছে। আমি মাথায় হাত রেখে ডাকতেই মেঘা আমাকে দেখে কপাল কুচকে অন্যদিকে ফিরে গেলো।

আমি বললাম, আরেহহ একটা কাহিনী ঘটে গেছে তো!
মেঘা ওইদিক ফিরেই বললো, হ্যাঁ তোমার কাহিনী আমার জানা আছে। জারা রিকোয়েস্ট পাঠাইছে তাই তো।
~ আরেহ তুই জানলি কিভাবে?

মেঘা উঠে বসে বললো, আমিই তো তোমার আইডি দিলাম। এই বলে, বালিশটা আমার মুখে চেপে চলে গেলো।

সন্ধ্যে বেলায় দেখলাম মেঘা বারান্দায় দাড়িয়ে কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলছে।

মেঘা ফোন রাখতেই বললাম,
~ কার সাথে কথা বলছিলি?
~ তোমাকে বলা লাগবে নাকি?

~ তো কাকে বলবি? আমেকেই তো বলবি!
~ ওরে আল্লাহ্! খুব শখ না? তুমি কি আমাকে বলে সব করো নাকি?
~ ওয়েট! বাই এনি চান্স তুই ওই ছেলের সাথে কথা বলছিস না তো?
~ হ্যাঁ বলছিলাম। তো কি হইছে?
~ কেনো বলবি?
~ আমার ইচ্ছা।
~ তোর ইচ্ছা মতো সব হবে নাকি।

~ তো কি তোমার ইচ্ছা মতো আমি চলবো নাকি! আজব। যাও তো। সবাইকে নিজের মতো ভাবে!

“আমার তখন খুব রাগ হলো। আমি চলে আসলাম। রাতে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছিলাম। মেঘা একবার এসে দেখে গেলো। কিন্তু কিছু বললো না। তখনও আমার রাগ হলো।

মানুষ একসময় এসে অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আমিও বোধহয় মেঘার স্বভাবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো ওর অন্যরকম প্রতিক্রিয়া নিতে পারি না।

আমি ঠিক করে রেখেছিলাম পরদিন ওর সাথে যাব না। তাই যখন সকালে ও ডাকলো আমি শুনতে পেয়ে ও উঠলাম না। তারপর মেঘা চলে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর মনেহলো মেঘাকে একা ছাড়া ঠিক হয় নাই। আমি উঠে বের হওয়ার সময় মা বললো, এখন আর জাস কি করতে? সেই কখন বেরিয়ে গেলো মেয়েটা!

আমি কিছু না বলে ঝটপট বেরিয়ে গেলাম।
কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম, মেঘা বেশ সুদর্শন একটা ছেলের সাথে কথা বলছে!

ছেলেটা বাইকে বসে ছিলো আর মেঘা পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
আমি কাছে যেতেই মেঘা আমাকে দেখিয়ে ছেলেটাকে বললো, এই তো ভাইয়া চলে আসছে। তুমি চলে যাও।
আমি বললাম, কি হইছে রে?

~ আরেহ তেমন কিছুই না। আমি একা যাচ্ছিলাম তাই সোহান বললো ওর বাইকে যেতে। এই আর কি।
ছেলেটা বললো, আমি তো এখনো বলছি আমার সাথে যেতে। আমাদের গন্তব্যস্থল তো একই। শুধু ভাইয়া কষ্ট করে যাবে।

আমি কিছু বলতে যাবো তখন মেঘা আমাকে বাঁধা দিয়ে ছেলেটাকে বললো, আচ্ছা সোহান তুমি যাও ক্লাস ধরতে লেইট হয়ে যাবে নাহলে। অন্য কোনোদিন যাবোনে তোমার সাথে। এই বলে পাশ থেকে একটা রিকশা ডেকে আমাকে নিয়ে উঠে পড়লো।

রিকশায় উঠে মেঘা সোহানের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বিদায় জানালো। সোহান চলে গেলো। রিকশা ও চলতে শুরু করলো।
মেঘা নীরবতা ভেঙে বললো। কাল ওর সাথেই কথা বলেছিলাম।
~ ও! ভালো।
~ ওইদিনও ওর কথাই বলছিলাম।

~ ও আচ্ছা!

~ কি ও ও করতেছো? কি হইছে বলো তো? কাল সন্ধ্যা থেকে দেখতেছি অদ্ভুত বিহেভ করতেছো!

“তখন আমি মনে মনে ভাবলাম আসলেই তো! মেঘা কারো সাথে কথা বললে আমার এমন লাগে ক্যান? এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় ক্যান।”
আমি বললাম, আমার সব কিছুই তো তোর কাছে অদ্ভুত লাগে!
মেঘা তখন হেসে দিয়ে বললো, ইশশ ঢং কতো! ছেলেরা বুঝি এমন ঢং করতে জানে!

এই মেয়ের হাসি দেখলেই দুনিয়ার সব রাগ অভিমান যেনো উধাও হয়ে যায়!

আমি বললাম, হাসবি না একদম। খুব হাসি না? তখন তো ওই ছেলেটার সামনেও ৩২ টা দাঁত বের করে হাসতেছিলি!

~ তো তোমার জন্য কি এখন হাসতে ও পাড়বো না, নাকি!
~ না পারবি না। খালি আমার সামনে হাসবি। অন্যকারো সামনে হাসতে দেখলে দাঁত ভেঙে দিবো একদম।

মেঘা তখন খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
আমার তখন অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো।
~ মেঘা তোকে একটা কথা বলি?
~ না বলতে বললে কি বলবা না?

~ না বলতে বললেও বলবো।

~ তাহলে আবার ঢং করো কেনো? বলো।
~ তোর হাসি টা আমার অনেক ভালো লাগে। সবার থেকে আলাদা তোর হাসি!

~ ধুর ওইসবের বেইল নাই। ওরা কই আর তুই কই!
~ এহহ! মিথ্যুক।
~ আরেকটা কথা বলি?

~ না বইলো না। হিহি
~ তুই আমার সামনে কখনই কাঁদবি না।

মেঘা আমার দিকে তাকালো। কিন্তু আমি তাকাতে পারিনি। ওর চোখে অনেক মায়া! আল্লাহ সব মায়া যেনো ওর চোখে দিয়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি নিচের দিকে তাকিয়ে থেকেই আবার বললাম, তুই আমার দিকে এভাবে মায়া মায়া মুখ করেও তাকাবি না
সেদিন বাকি পথ আমারা কেউ আর কোনো কথা বলি নি। ওর কলেজ চলে আসতেই ও নেমে চলে গেলো। একবার পিছোন ফিরেও তাকায় নি।

আমি জানি মেঘার চোখে সেদিন ও পানি এসেছিলো। সেদিনকার এই অনুভূতির নাম কি ছিলো, জানা নেই! …


পর্ব ৪

আমি সেদিন বাসায় যাওয়ার পর মা~ বাবা আমাকে দেখে চোখ~ মুখ উজ্জ্বল করে বললো, রোদ এসেছিস? এদিকে আয় বস তাড়াতাড়ি। তোর সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপের জন্য বসে আছি।

মা~ বাবার হঠাৎ এতো খুশির কারন টা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমি বসতে বসতে বললাম, তা শুনি এতো খুশির কারণ টা কি? মা হাসি হাসি মুখ করে বললো, “তোর সেই রহমান কাকার কথা মনে আছে?”
আমি চিনতে পারলাম না প্রথমে। বললাম,
~ কার কথা বলছো? মনে পরছে না তো!

বাবা বললেন, “তোর তানভির এর কথা মনে নাই?”
তানভির এর কথা বলার পর আমি যেনো সেই ১০ বছর আগে ফিরে গেলাম!
~ ~
মেঘা তখন খুব ছোট। আমিও ছোটই ছিলাম। একদিন আমি আর মেঘা খেলছিলাম। খেলার মাঝখানে ঝগড়া হয় আমাদের। মেঘা কাঁদতে লাগলো। তখন হঠাৎ রহমান কাকারা আসলো আমাদের বাসায়। তানভির এসে মেঘাকে একটা চকোলেট দিলো আর তখন মেঘা খিলখিল করে হেসে দিলো। তারপর বললো, তুমি খুব ভালো।

তানভির তখন বললো, আমরা তাহলে বন্ধু এখন থেকে ঠিক আছে?
ওদের এই কান্ড দেখে তখন হেসে ফেললো সবাই। রহমান কাকা আর কাকিমনি ও খুব আদর করেছিলো সেদিন মেঘাকে।

মেঘা তখন বললো, তানভির ভাইয়া খুব ভালো। ভাইয়াকে আমাদের সাথে রেখে যাও না। রোদ ভাইয়া অনেক পঁচা খালি ঝগড়া করে। আমার সাথে। আমি এখন থেকে তানভির ভাইয়ার সাথেই খেলবো।

আমার তখন খুব গায়ে লাগলো। আমি তখন বললাম, ইশশ আমার বয়েই গেছে তোর সাথে খেলার জন্য! এতই শখ যেনো চলে যা না ওদের সাথে।”

তানভির তখন কাকা~ কাকিকে বলতে লাগলো, “নিয়ে চলো না ওকে আমাদের সাথে।”

রহমান কাকা বললো, আচ্ছা বাবা নিয়ে যাবো। তবে এখন না। সময় হলে নিয়ে যাবো।

হঠাৎ বাবার ডাকে অতীত থেকে ফিরে এলাম।
~ কিরে কি ভাবছিস? মনে পড়েছে?
~ হুম।

মা বললেন,
~ তানভির তো এই ৫~ ৬ বছর জাপান ছিলো। ৪~ ৫ দিন হয়েছে বাড়ি ফিরেছে। তো ওরা আজকে আসবে আমাদের বাসায়।
“আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হতে যাচ্ছে! অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো!”আমি চুপ করে আছি দেখে বাবা বললো, কিরে চুপ করে আছিস ক্যান? কিছু বলছিস না যে?”

~ কি বলবো! আসবে তো ভালো কথা। এর মাঝেই হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। অসহ্য লাগতে লাগলো সব কিছু। তবুও আমিই উঠে গিয়ে দড়জা খুললাম।

দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। দেখলাম একটা ছেলে আর তার পাশেই মেঘা দারিয়ে আছে। মেঘার আর ছেলেটা দুজনের মুখই হাসিহাসি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছেলেটা আমার দিকে একটা হাসি ছুরে দিয়ে বললো, “রোদ! এম আই রাইট?”

আমার আর তখন বুঝতে বাকি রইলো না ও যে তানভির।
আমিও একটা হাসি দিয়ে বললাম, “তানভির?”

বলার সাথে সাথে তানভির আমায় জরিয়ে ধরে বললো”হোয়াটস আপ ম্যান?”

আমি কিছুবলার আগেই পাশ থেকে মেঘা বলে উঠলো, “তোমরা কি বাহিরে দাড়িয়ে দাড়িয়েই কথা বলবা!?”
আমি বললাম, “ওহ শিট! আসো আসো। ভিতরে আসো।”
তারপর মেঘা ফ্রেশ হতে চলে গেলো আর তানভির মা~ বাবার কাছে। তানভির কে দেখে মা~ বাবার সেকি হইহুল্লোর।

আমি রুমে চলে আসলাম। আমার মাথায় তখন একটাই কথা ঘুরতে লাগলো তানভির মেঘাকে পেলো কোথায়!

তাহলে কি ওদের মধ্যে যোগাযোগ ছিলো! কিন্তু কিভাবে? আর মেঘা ও তো কিছু বললো না। আমার খুব রাগ হতে লাগলো।

মেঘাকে খোঁজার জন্য রুম থেকে বের হতে। দেখলাম মেঘা আমার রুম পাস করে যাচ্ছিলো। আমি ওর হাত টেনে আমার রুমে নিয়ে আসলাম। ব্যাপারটা হঠাৎ হওয়াতে মেঘা অবাক হয়ে গেলো। পরে আমাকে দেখে যেনো হাফছেরে বাঁচলো।

~ উফফ, তুমি! আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম!
~ কেনো? তুই কি ভেবেছিলি অন্যকেউ হবে?
~ অন্যকেউ কেনো ভাববো!

~ তাহলে চমকে গেলি যে?
~ আচমকা টান মারলা চমকাবো না!
~ মেঘা?
~ বলো না?

~ তানভির তোকে পেলো কোথায়? ও তোর কলেজ চিনলো কিভাবে?
~ আরেহ তোমাকে তো বলাই হয় নাই। আসলে ৩~ ৪ দিন আগে তানভির আহমেদ নামে একটা আইডি থেকে এফবিতে রিকোয়েস্ট আসছিলো। তো আমি এক্সেপ্ট করিনি দেখে মেসেজে পরিচয় দিলো।

তারপর বললো যে জাপান ছিলো এতো বছর এখন দেশে এসেছে, তাই আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে।
~ তারপর?

~ তারপর আর কি! কন্টাক্ট নাম্বার নিলো। তো আজ ফোন করে বললো যে আমাকে কলেজ থেকে নিয়ে আসবে তাই আমি কলেজের এড্রেস দিয়ে দিলাম। এই তো।

~ বাহ অনেক কিছুই হয়ে গেলো! কিন্তু আমি। কিছুই জানলাম না!
মেঘা এবার একটু রেগে গেলো। বললো,
~ তোমাকে কি সব কিছু বলতে হবে? তুমি কি আমাকে সব কিছু বলে কর? হাত ছাড়ো।

“আমার খেয়াল ই ছিলো না এতক্ষন যে মেঘার হাত ধরে ছিলাম। হাত ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে লাগলাম তখন মেঘা পিছন থেকে বললো,
~ রাগ করলা নাকি?

আমি ওর দিকে ফিরে একটা হাসি দিয়ে বললাম,
~ রাগ করবো কেনো? ঠিক~ ই তো বলছিস।

“মেঘা চুপ করে, আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।”
আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম,
~ তুই আজ অনেক খুশি, নারে?

মেঘা অবাক হয়ে বললো,
~ খুশি হওয়ার মতো কিছু কি হয়েছে?

~ কি বলিস, তোর এতদিনের ইচ্ছা পূরন হতে যাচ্ছে! আর তুই জিজ্ঞাস করতেছিস কিছু হয়েছে কিনা!
~ মানে? কি মিন করতেছো?

~ তোর তো খুব শখ ছিলো ওদের সাথে থাকবি। তখন তো ছোট ছিলি দেখে নিতে পারেনি এখন তো বড় হয়েছিস!
“মেঘা কপাল কুঁচকে বললো”,

~ ইশশ ছোট বেলা কি না কি বলেছি তুমি এগুলা নিয়ে খোঁটা দিচ্ছো এখন? তুমি আসেলই একটা খারাপ। যাও।
~ মেঘা!

মেঘা অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে বললো”,
~ কথা নাই, যাও।
“আমি মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বললাম”,
~ আমি সত্যি অনেক খারাপ নারে?

~ ধুর ওইটা তো আমি এমনি বলছি মজা করে। তুমি তো আমার দেখা সবচাইতে ভালো একটা ছেলে।
~ তোকে খুব জালাই তাই না?

~ ধ্যাত কিসব বলতেছো? কি হইছে বলো তো?
~ তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি তাই না?

~ আল্লাহ! কি বলে এই ছেলে! কই যাবো তোমাদের ছেড়ে? আমার তোমরা ছাড়া কে আছে আর?
~ আগে ছিলো না। এখন তো আছে।

~ আগেও কেউ ছিলো না, এখন ও কেউ নেই। তোমরাই আমার সব।
“মেঘার মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিলো। আমি জানি এখন কি হবে। তাই ওকে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।”

আমি জানি না আমার কি হচ্ছিলো! কেনো এমন করতেছিলাম! কিন্তু ওর প্রতি আমার যেই অনুভূতির জন্মেছিলো সেটাকে আমি কনট্রল করতে পারছিলাম না। মেঘার কি আমার জন্য কোনো অনুভূতি জন্মেছিলো? জানা নেই আমার।
~ ~
কাকা~ কাকিও চলে এসেছিলো এর মধ্যে।

আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। সব কিছু অসহ্য লাগতে লাগলো।
আমি বেরিয়ে পরার বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘা ফোন দিতে লাগলো। আমি কল কেটে আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা ধরলাম।

বাসায় গিয়ে দেখলাম সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি কাছে যেতেই রহমান চাচা উঠে এসে আমার সাথে কোলাকোলি করে বললো, আরে ইয়াং ম্যান! কি খবর তোমার?

~ এই তো কাকা ভালোই। আপনার শরীরের কি অবস্থা?
~ এই তো বাবা, আল্লাহ রেখেছেন ভালো।

“তারপর রহমান কাকা, মা~ বাবাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কত্ত বড় হয়ে গেছে আমাদের রোদ! সেই ছোট্ট বেলায় দেখেছি। মেঘা, রোদ, তানভির সবাই কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলো দেখলি?”

আমি মেঘার দিকে তাকালাম। দেখলাম মেঘা হাসিহাসি মুখ করে বসে আছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। কি আছে এই মেয়ের হাসিতে? আমি তাকিয়ে থাক্তে পারি না কেনো? …


পর্ব ৫

ইদানীং মেঘা খুব ভালো ভালো আইটেম রান্না করতে পারে। বেশ কিছুদিন থেকে ও মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু রান্না শিখে ফেলেছে। মাঝেমধ্যে ইউটিউব থেকেও নতুন নতুন আইটেম করে খাইয়েছে।

প্রথম প্রথম তো বিশ্বাস করতেই পারতাম না ও যে এতো মজা করে রাঁধতে পারে।

একবার একটা বিদেশি আইটেম রান্না করেছিলো। আমি জানতাম না যে মেঘা রান্না করেছে। ভেবেছিলাম মা রান্না করেছে।

অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞাস করলাম, মা, তুমি যে এতো ভালো বিদেশি আইটেম রান্না করতে পারো জানতাম না তো! সেই মজা হয়েছে। সবগুলো তো আমার একাই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করতেছে!
মা হাসতে হাসতে বললো, আমি রেঁধেছি নাকি। আমি তো এসব রাঁধতেই পারি না।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, তাহলে কে রান্না করলো? তুমি ছাড়া তো কেউ নাই রান্না করার মতো!

মা বললো, কে বলছে কেউ নাই? আমাদের ঘরের মেঘার মতো লক্ষি একটা মেয়ে থাকতে তুই বলিস কেউ নাই!

মেঘা তখন হেসে কুটিকুটি। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও একটা বাঁকা হাসি দিয়ে একটা ভাব নিলো। আমার মাথায় তখন শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেলো!

আমি তখন মুখ উল্টে বললাম, ইয়াক! কি বাজে খেতে! এই জন্যই তো বলি, মায়ের রান্না তো এমন বিস্বাদ হয় না!

মেঘা তখন রাগিরাগি মুখ করে বললো, ইশশ! একটু আগেই তো বললা খুব টেস্ট হইছে। এখন আবার বাজে বলতেছো! খারাপ ছেলে একটা!
~ আমি তো ভাবছি মা রান্না করেছে। এখন মাকে তো আর ডিরেক্ট বলতে পারি না খারাপ হইছে তাই একটু মিথ্যা বলছিলাম।

“মেঘা কপাল কুঁচকে রাগি রাগি চোখে তাকিয়ে রইলো। আমার খুব হাসি পাচ্ছিলো। হাসি চেপে রেখে আরো রাগানোর জন্য বললাম, “রান্নাবান্না কি সবাইকে দিয়ে হয়? পারিস না যখন করিস ক্যান? কি বাজে খেতে!”

মা বললো, “মাইর খাবি কিন্তু রোদ। মজাকরে খাচ্ছিস তবুও মেয়েটাকে রাগানোর জন্য এসব বলতেছিস।

মা কথা শেষ করতে না করতেই মেঘা প্লেট টা টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি অবাক হয়ে বললাম,
~ আরে আরে! কি করিস?

~ তোমার মাথায় ঢালবো এগুলা এখন। মজা হয় নাই নাকি? তাহলে আবার খাচ্ছো কেন?
দেও বলতেছি।

“আমি হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলাম, হায় হায় কি করলাম! নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো অবস্থা হইলো তখন আমার।”
এর মধ্যে মেঘা প্লেট নিয়ে চলে যেতে লাগলো। এত মজার খাবার হাত ছাড়া করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিলো।

আমার এই অবস্থা দেখে মা হাসতে হাসতে বললো একদম ঠিক হয়েছে।

আমি মায়ের কথায় কান না দিয়ে, আমি মেঘাকে ধরে থামিয়ে বললাম,
~ আরে বোকা আমি তো মজা করছিলাম। মজা হয়েছে তো। নিয়ে যাচ্ছিস কেন!

~ না না, যে একবার আমার রান্নার দুর্নাম করে তারে আমার খাবার খাওয়ানো যাবে না।

~ আর বলবো না। এই দেখ কান ধরতেছি। দে না।


আজকেও মেঘা নিজে সব রান্না করতেছে।
মেঘার হাতের বিরিয়ানি! উফফ অমৃত!

আজ মেয়েটারে পাওয়াই যাচ্ছে না। খুব বিজি আজ সে।

আমি একটু পরপর রান্নাঘরের দিকে ঢু মারতেছিলাম। মেঘা কয়েকবার আমাকে দেখেছে। যতবার দেখেছে ততবারই মাকে আর আমেনা খালাকে কি যেনো বলতেছিলো। যেদিন বাসায় মেহমান আসে ওই দিন আমেনা খালার ডাক পরে।

বাবা, রহমান কাকা, কাকি আর তানভীর কি নিয়ে যেনো হাসাহাসি করতেছিলো। আমার ওইদিকে মন নেই। আমি শুধু সুযোগ খুঁজতেছিলাম কখন মেঘা একা হবে আর আমি একটু ওর সাথে কথা বলতে পারবো।

হঠাৎ দেখলাম মা আমেনা খালাকে দিয়ে নাশতা পাঠালো। আমেনা খালা চলে যেতেই আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম। আমাকে দেখে মা বললো তোর কি এখনি খিদে পেয়ে গেলো নাকি? একটু পরপর ঢু মারতেছিস যে?

আমি হাসিহাসি মুখ করে বললাম। তুমি তো জানই এই মেয়ের হাতের বিরিয়ানি আমার কত্ত ফেভারিট!

মা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, হ্যাঁ জানি দেখেই তো বললাম।
মেঘা মিষ্টি মিষ্টি হাসতেছিলো।

আমি মাকে বের করার জন্য বললাম, তোমাকে বাবা ডাকতেছে যাও তাড়াতাড়ি। সবাই আড্ডা দিতেছে তুমি এখানে কি করো যাও।
মা বললো, হাতের কাজটা শেষ করে যাচ্ছি।

~ তোমার শেষ করা লাগবে না। আমি করতেছি তুমি যাও।
মেঘা তখন তাচ্ছিল্য করে বললো। তুমি করবা কাজ? এইটা ও আমাদের বিশ্বাস করা লাগবে?

আমি বললা, তুই চুপ করে থাক। বুড়িগিরি করবি না একদম।
তারপর মাকে ঠেলে বের করে দিলাম।

মা চলে যেতেই মেঘা হাসিহাসি মুখ করে বললো,
~ তোমার আসল মতলব টা কি বলো তো? কাকীমনিকে যে বের করে দিলা?

আমি মেঘার কাছে গিয়ে বললাম, মতলব আবার কি হ্যাঁ? তোরে মিস করতেছি খুব!

~ ইশশ! কি ঢংয়ের কথা! আমাকে যেনো কত জনম দেখো না!
~ হুহ! কত জনম ই তো দেখি না। সারাটা দিনই তো তোর নাগাল পেলাম না! যতক্ষণ ফ্রি ছিলি ততক্ষণই তো ওই গম্বুশটার সাথে ছিলি।
“মেঘা তখন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পরছিলো।”আমি মুখ চেপে ধরে বললাম, চুপ! এত জোরে হাসিস ক্যান! গম্বুশটা চলে আসবে পরে।
মেঘা মুখ থেকে হাত ছাড়িয়ে বললো,
~ গম্বুশ আবার কি! হিহিহি! কি সুন্দর ছেলেটারে তুমি গম্বুশ না জানি কি বানিয়ে ফেললা! হাসবো না?

আমি মেঘার একটু কাছে গিয়ে বললাম,
~ খুব সুন্দর?

~ হ্যাঁ! সুন্দরই তো!
~ চোখ গেলে দিবো একদম!
~ ইশশ! সাহস কত!
~ দেখবি আমার সাহস?
~ না থাক! তোমার সাহস দেখে কাজ নাই আমার। যাও সরো।
~ সরবো না।

~ ডাক দিই? তোমার ওই গম্বুশরে?
~ দে ডাক।

“মেঘা সত্যি সত্যি ডাক দিতে লেগেছিলো। আমি মুখ চেপে ধরলাম। মেঘা ছাড়ানো চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। আমি ওই অবস্থাতেই বললাম”,

~ বেশি তানভীর তানভীর করবি না বুঝেছিস! একদম চোখ গেলে দিবো।

“মেঘা এবার আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে চুলার কাছে গিয়ে বললো, ধ্যাত আমার বিরিয়ানি পুরে যাচ্ছিলো তো আরেকটু হলে। এই তোমার কাজ করতে আসার নমুনা।”

~ পুড়ে যাক। পুড়ে গেলে কি হবে? ওরা তোর রান্না খেতে পারবে না এই তো? তাহলে তো পুড়ে গেলেই বেশি খুশি হতাম। অন্যের প্রশংসা শুনার খুব শখ তাই না? তুই শুধু আমার প্রশংসাই শুনবি। বুচ্ছিস?
~ হইছে ঢং কইরো না তো। যাও এখান থেকে।
~ দেখি তোর হাত টা দে তো।

~ ক্যান হাত দিয়ে কি করবা?
~ খাবো।

“মেঘা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো”
~ কিহহ! রাক্ষস নাকি?
~ হ্যাঁ। দে বলছি।
~ এহহ! খাচ্চর।

“আমি মেঘার হাত টা নাকে কাছে নিয়ে ঘ্রান শুকে বললামআহহ কি সুন্দর ঘ্রান!”

মেঘা হাসতে হাসতে বললো, হ্যাঁ! মসলার। হিহি। পেটুক একটা।
আমি মেঘার হাত ছেড়ে দিতে দিতে বললাম, “পেটুক বললে কিন্তু সত্যি সত্যি খেয়ে ফেলবো! পরে আর টেস্টি টেস্টি খাবার রান্না করে অন্যদের খাওয়াতে পারবি না।”

সেদিন মেঘার রান্না খেয়ে সবার সে কি প্রশংসা। রহমান চাচা বললো, “মেয়েটা একদম সর্ব গুনে গুনান্বিত। যেমন রূপ তেমনি তার গুন।”

মা~ বাবা দুজন সম্মতি জানালো। মা বললো, “হ্যাঁ ঠিক বলেছেন ভাই। লক্ষি একটা মেয়ে আমাদের। আমাকে এখন কোন কিছুই করতে দেয় না। পুরো সংসারটাই এখন ও গুছিয়ে রাখে। ছোট মেয়েটা একটু বেশি তাড়াতাড়ি যেনো বড় হয়ে গেলো।”

মায়ের উপর ক্যান জানি রাগ হতে লাগলো। এতো প্রশংসা করার কি দরকার? অদ্ভুত!

মেঘা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল। আমার চোখে চোখ পড়তেই মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। আমার তখন ইচ্ছা হচ্ছিল গালটা টেনে ছিরে দেই। ও কি জানে না? এমন লজ্জা লজ্জা মুখ করলে পরীর মতো লাগে ওকে!

তানভীর খাচ্ছিল আর একটু পর পর মেঘার দিকে তাকাচ্ছিল। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল গিয়ে পাঁজি ছেলেটার চোখটা গেলে দিতে।
মেয়েটারে ছোট থেকে পাইলা~ লাইলা বড় করলাম আমি। আর এখন হিরো সাজতে আসছে উনি। …

পর্ব ৬

রহমান কাকারা চলে যেতে চেয়েছিলেন। ওরা চলে যাবে শুনে বেশ খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু মা~ বাবা ওদের যেতে দিলো না।
এমনিতেই মা~ বাবার দরদ দেখে শরীর জলে যাচ্ছিল। তার উপর পাকনা মাইয়াটাও সুর মিলিয়ে বলতে লাগলো, কাকা~ কাকী থেকে যাও।

আমার বুঝে আসে না, কেউ থাকতে বললে কি থেকে যাওয়া লাগে নাকি অদ্ভুত!

ওদের জালায় মেঘার সাথে পুরা একটা দিন ঝগড়া না করে কাটিয়ে দিতে হলো। বেটা গম্বুশ টা খালি মেঘার আসেপাশে ঘুরঘুর করতেছিলো। মন চাচ্ছিলো এক ঘুষি মেরে নাক টা ফাঁটিয়ে দেই।

আর মেঘা? সে কি কম নাকি! এহহ কি হেসে হেসে কথা। সব কিছুতেই যেনো এখন তার হাসি পায়! একটা চটকোনা মেরে টমেটোর মতো গাল দুইটা আরো লাল করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছিলো!

ঘুমের জন্য সবাই সবার রুমে চলে গেলো। আমি তানভির আর মেঘা বসে রইলাম। তানভির আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
~ সো রোদ! কি অবস্থা তোমার? তোমার সাথে তো আলাপই হলো না ঠিক মতো!

“আমি একটা মৃদু হাসি দিয়ে বললাম, এইতো যাচ্ছে দিন কাল। তোমার মতো ওতো চিল মুডে থাকা হয় না এই আর কি।”

তানভীর একটু অবাক হওয়ার ভান করে বললো, কি বলো! যে বাসায় মেঘার মতো এতো মিষ্টি একটা মেয়ে থাকে সেখানে কেউ চিল মুডে না থেকে পারে নাকি।

মেঘা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি বললাম, “হ্যাঁ এক~ দুই দিন দেখে তো এগুলাই বলবা। ছোট থেকে তো পাইলা বড় করো নাই। নাহলে বুঝতা কি ডেঞ্জারাস মেয়ে!”

মেঘা আমার হাতে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, চুপ থাকো।
“তখন তানভীর হেসে দিলো। তারপর বললো, তোমরা এখন ও ঝগড়া কর ছোট বেলার মতো! হাহাহা!”

মেঘা বললো, আমার সাথে ঝগড়া না করলে জনাবের শান্তি লাগে না।
আমি বললাম, হ্যাঁ হইছে! এখন ঘুমাতে যা।
তানভীর বললো, এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরবা তোমরা! সবে তো এগারোটা বাজলো!

আমি বললাম, মেঘা আরো আগেই ঘুমিয়ে পরে। ওর জন্য আমারও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরতে হয়। নাহলে বুড়িদের মতো শাসন করা শুরু করে দেয়।

তানভীর মুগ্ধ হয়ে বললো, বাহহ! ভালো তো! স্বাস্থ্য সচেতন।”

মনেমনে ভাবলাম, কাহিনী কি! এই পোলা তো দেখি মেঘার সব কিছুতেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। লক্ষণ তো ভালো ঠেকছে না! আর মেঘা ও দেখি সব কিছুতেই খুশি হয়ে যাচ্ছে। নাহ আর সহ্য করা যাচ্ছে না। মেঘা কে ডেকে বললাম,

~ কিরে তোর আজকে আর ঘুম আসছে না, নাকি?
মেঘা হাসিহাসি মুখ করে বললো
~ আসলেই আসতেছে না।

তানভীর বলে উঠলো, দ্যাটস গ্রেট! চলো আমরা তাহলে আড্ডা দেই আরো কিছুক্ষণ।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, রোদ, তোমার ঘুম পেলে তুমি বরং গিয়ে ঘুমিয়ে পরো।

আমার তখন পুরো শরীরে আগুন জলে উঠলো। কিছু না বলে উঠে যাচ্ছিলাম তখন মেঘা বললো,
~ সত্যি চলে যাচ্ছো নাকি?

~ দেখতে পাচ্ছিস না? তোর যেমন আজ নতুন করে ঘুম আসতেছে না আমার ও তেমনি আজ তাড়াতাড়ি ঘুম আসতেছে!
মেঘা কিছু বলতে যাবে তার আগে গম্বুশ টা বলে উঠলো, যেতে চাচ্ছে যখন যেতে দাও!

আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসলাম রুমে।
মেঘাকে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ও এমন বদলে যাচ্ছে কেন! ও তো এমন না।

আমারই বা এমন লাগছে কেন! ও যা ইচ্ছা করুক! আমার কি তাতে?
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই ওদের ওদিক থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। রাগে আমার শরীর জ্বলে~ পুড়ে যেতে লাগলো।

টেবিলের উপর থেকে সোপিস টা নিয়ে একটা আছার মেরে দিলাম। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। মেঝেতে বসে হাত দিয়ে কাঁচ গুলো উঠাতে লাগলাম। একটু পর দেখলাম মেঘা এসে দাঁড়ালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো, কিসের শব্দ হলো?

আমার তখন মাথায় আগুন জ্বলছিল। উঠে দাড়িয়ে বললাম, এখানে আসছিস ক্যান? উপ্স তোদের আড্ডায় ব্যাঘাত ঘটলো বুঝি?
যা এখান থেকে। কিছু হয় নাই!
মেঘা আমার কথা গ্রাহ্য না করে বললো,
~ ছাদে যাচ্ছি, যাবা?

~ জীবনেও তো রাতের বেলা ছাদে যেতে দেখলাম না! আজ হঠাৎ তোর সব অভ্যাস চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে দেখছি!
~ উফফ এতো কথা বলো ক্যান যাবা?

~ না যাবো না। তুই যা তোর ওই হিরোরে নিয়ে।
আচ্ছা যাচ্ছি বলে মেঘা চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পর মনে হলো, ধুর, ঢং করে”ঘুমোতে পারি না সারা রাত ধরে, বুকের ভিতর হাহাকার করে” টাইপ মুড নিয়ে বসে থেকে লাভ নাই। যাই একটু ঘুরেই আসি ছাদ থেকে। এই ভেবে ছাদের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে বাড়িটা অদ্ভুত নিশ্চুপ মনে হতে লাগলো।

ভাবতে ভাবতেই ছাদের দরজা খুলতেই এক সুরে ভেসে আসতে লাগলো, “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ রোদ!”বলতে বলতে চারদিক থেকে সবাই বেড়িয়ে আসতে লাগলো।

পুরো ছাদ জুরে নানান আলো আর বেলুনে ভরপুর! পুরো ছাদটা স্বপ্নপুরীর মতো লাগতে লাগলো। আমি কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম যানা নেই!
মা~ বাবা সহ সবাই কেই দেখতে পেলাম। অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞাস করলাম তোমরা সবাই জেগে ছিলে এতক্ষণ?

মা বললো, মেঘা তো আগেই সব প্লেন করে রেখে দিয়েছিলো। ঘুমাতাম কি করে?

আমি মেঘার দিকে তাকাতেই দেখলাম ও মুখ চেপে হাসছে। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম, আগে বললি না ক্যান? এসব করছিস!
মেঘা বললো, “আগে বললে বুঝি সারপ্রাইজ পাইতা এমন!”
~ আমি যদি এখন না আসতাম তাহলে কি করতি?
~ আমি তো যানতামই তুমি আসবা। হিহি।

“আমি কিছু বলতে যাব তখন মেঘা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, হইছে এখন আর কথা বাড়াতে হবে না। সবাই অনেক্ষন থেকে অপেক্ষা করতেছে। আসো কেক কাটবা।”

আমি অবাক হয়ে মেঘাকে দেখতে লাগলাম! ও এতো কিছু প্ল্যান করে রাখলো আর আমি কিসব ভাবলাম! ধ্যাত!

মা~ বাবা আর কাকাদের, মেঘা নিচে পাঠিয়ে দিলো। তানভীর ফোনে কথা বলছিলো। সেই সুযোগে আমি মেঘাকে সাইডে নিয়ে গেলাম। তারপর জিজ্ঞাস করলাম,
~ এতো কিছু কখন করলি?

~ তোমার ওসব জেনে কাজ নাই। ভালো লাগছে কিনা সেটা বলো?
~ হুমম খুউউউব! থ্যাংকিউ মেঘা!
~ ইশশ! খুব ঢং হচ্ছে!

~ না সত্যি! আমি খুব অবাক হয়েছি। আমি তো ভেবেছিলাম তুই বোধহয় ভুলেই গেছিস প্রতিবারের মতো!

~ হিহি! খুব কষ্ট হইছে মনে রাখতে।
~ একটা কথা বলি?
~ না বইলো না! হিহি!

~ তুই খুব ভালো! তোর মতো করে কেউ বুঝতে পারে না আমাকে।
~ হ্যাঁ! এমন সারপ্রাইজ পাইলে সবার মুখ দিয়েই এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হয়।

“মেঘার এই কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম! মেঘা বললো,
~ বাবাহ! তুমি আবার এমন করে হাসতে ও পারো!
~ তোর মতো ওতো মিষ্টি করে হাসতে পারি না!

~ ইশশ! খুব হইছে। সরোএখন। কত্ত রাত হয়ে গেলো!
~ তখন তো ওই গম্বুশটার সামনে খুব তো বললি, আজ তোর ঘুম পাচ্ছে না।

~ এমনি এমনি বলছি নাকি? তোমার জন্যই তো জেগে থাকা লাগলো! আর ওতো সুন্দর ছেলেটারে তুমি কি একটা নাম দিলা! গম্বুশ! হিহিহি!

~ খবরদার ওরে সুন্দর বলবি না। এহহ ছোটকাল থেকে জালাচ্ছিস আমাকে আর এখন পিরিত দেখাচ্ছিস ওর জন্য! মাইরা ফেলমু একদম!

“মেঘা খিলখিল করে হাসতে হাসতে
বললো, ওই দেখো তোমার গম্বুশ আসতেছে। যদি শোনে তুমি ওরে এমন একটা নাম দিছো, পিটাবে ধরে। হিহিহি।”

তানভীর কাছে এসে বললো, কি নিয়ে এতো হাসাহাসি হচ্ছে শুনি?
মেঘা হাসতে হাসতে বললো, তেমন কিছু না। তোমরা থাকো আমি যাচ্ছি।
তানভীর বাঁধা দিয়ে বললো, “আরেকটু থাকো না।”

মেঘা যেতে যেতে বললো, ” না না আর জেগে থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে।”

মেঘা চলে যেতেই তানভীর বললো, মেয়েটা কিন্তু বেশ!
আমি উপরে উপরে একটা হাসি দিলাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ইচ্ছা হচ্ছিল একটা উস্ঠা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেই! …

পর্ব ৭

ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি দেখে মাথা ঘুরে উঠলো! ওহহ শিট! দশটা বেজে গেছে! তার মানে তো মেঘা এতোক্ষনে কলেজ চলে গেছে! এ কথা ভাবতে ভাবতে লাফিয়ে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

তারপর মাকে ডাকতে লাগলাম। মা এসে বললো,
~ কি হইছে? চিল্লাচ্ছিস কেনো?

~ চিল্লাবো না তো কি করবো? দশটা বেজে গেলো আর তুমি আমাকে ডাকলা না ক্যান? মেঘাকে একা কলেজ যেতে দিলা!
মা হাসতে হাসতে বললো,

~ বাপরে সারাক্ষণ তো দেখি ঝগড়াই করিস। হঠাৎ এতো দায়িত্ব জ্ঞান উদয় হইলো কবে থেকে?

“মায়ের উপর ভীষণ রাগ হতে লাগলো। মায়ের সাথে কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে শার্ট নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলাম তখন মা থামিয়ে বললো,
~ আরে আরে! কই যাস?

~ ধুর মা, এমনিতেই খুব লেট হয়ে যাচ্ছে! তার উপর তুমি ঢং করে আরো লেট করাচ্ছো।

মা হাসতে হাসতে বললো, “মেঘা তো আজ কলেজেই যায় নি।”
~ সত্যি? তাহলে কই ও?

~ কাল না রিতুর বিয়ে? ভুলে গেলি নাকি?

~ ওহ হ্যাঁ! ভুলেই তো গিয়েছিলাম! তা বিয়ে তো কাল। আজ যায় নি কেনো? আর কই অয়?

ছে তাই মেঘাকে নিয়ে গেছে।
~ তো একা যাওয়ার কি দরকার ছিলো। আমি ছিলাম না নাকি?
~ আরে তানভীর এর সাথে গেছে।

“তানভীর এর কথা শোনার পর তো মাথা ঝিম মেরে উঠলো। আমি মাকে রেগে বললাম,
~ মানে কি? মেঘার দায়~ দায়িত্ব কি এখন তানভীর কে দিয়ে দিলা নাকি? নাকি আমি মরে গেছি?

~ আরে রাগ করতিছিস কেনো? তানভীররা ওই রোড দিয়ে যাবে তাই তানভীর বললো ও ড্রপ করে দিবে। তাই আর তোকে ডাকে নি।

“আমি আর কথা না বলে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে। তারপর মেঘাকে কল করে ওর থেকে শপিংমলের এড্রেস নিয়ে চলে গেলাম ওর কাছে। গিয়ে দেখলাম মেঘা, তানভীর, রিতু আর একটা ছেলে কিসব নিয়ে কথা বলছিলো। আমি কাছে যেতেই তানভীর বললো, আরেহ রোদ! তুমি ও চলে আসলা যে?

আমি মনে মনে বললাম, কেনো রে গম্বুশ? আমি আসছি তো, তোর প্রবলেম কোথায়? আমি আমার পা দিয়ে কষ্ট করে আসছি। তোর কি রে? কিন্তু মনের কথা মনে রেখে বললাম, “ওদের নিয়ে যেতে হবে না? তুমি তো আর উল্টা ঘুরে যাবা না! তাই আসলাম।

“তানভীর আর কিছু বললো না। মেঘার দিকে তাকাতে দেখলাম ওরা শাড়ি বাছাই করছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম,
~ তুই কিনবি নাকি?
মেঘা ভ্রু কুঁচকে বললো,
~ আমার কি বিয়ে নাকি?

এই বিয়ের শাড়ি আমি কিনবো কি জন্য?
~ না মানে, মেয়ে মানুষ তো! হঠাৎ শখ~ টক জাগলেও জাগতে পারে।
“মেঘা বিরক্তি বিরক্তি ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইলো। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওর কাছ থেকে সরে গেলাম। ওরে বিশ্বাস নাই, মানুষ জনের সামনেই ঠুস করে একটা চটকনা দিয়ে দিবে!

একবার রিকশার মধ্যে সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হলো। হঠাৎ করে ঠাসস করে একটা চটকনা দিয়ে দিছে। আমি হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। একটু পর মেঘা ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, থাক কাইন্দো না। চলে যাবে ব্যাথা!”

পুরো বাসা ভর্তি বিয়ে বিয়ে আমেজ। গায়ে হলুদ রিতুর আর বিজি বেশি মেঘা।

সন্ধ্যা থেকে একবার ও ওর দেখা পেলাম না। জারা ও এসেছিলো। রিতুদের কেমন আত্মীয় হয় যানি। আমাকে দেখলেই কেমন কেমন করে হাসে। একটু পরপর ঘুরঘুর করছিলো আমার আসে পাশে। আমার মনে দুষ্টু বুদ্ধি খেলা করছিল, কিন্তু মেঘারই তো দেখা পাচ্ছি না।

আনমনে রুম থেকে বের হচ্ছিলাম হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে পরে গেলাম। সরি বলে তাকাতেই দেখি জারা মিটিমিটি করে হাসছে। তারপর উঠে লজ্জা ভাব নিয়ে চলে গেলো। আমি ভেবে পেলাম না এখানে লজ্জার কি হলো! আজব মেয়ে একটা।

পুরো বাসা ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। আমি ছাদে চলে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ঝুনঝুন আওয়াজ শুনে পিছন ফিরতেই দেখলাম মেঘা কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি যত কাছে যাচ্ছিলাম ততোই অবাক হচ্ছিলাম একি মেয়ে নাকি পরী!

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মেঘা বলে উঠলো, তুমি নাকি জারার সাথে হিরোদের মতো ধাক্কা খেয়েছো?
আমার তখন ভীষণ হাসি পেলো। আমি হেসে দিয়ে বললাম।
~ হ্যাঁ খেয়েছিলাম তো।

“মেঘা আর কিছু না বলে চলে যেতে লাগলো। আমি হাত ধরে ফেললাম। তারপর বললাম,
~ কই যাস?

~ তোমার জারা কে পাঠাচ্ছি তোমার কাছে।
“বেশ বুঝলাম মেঘা রেগে গেছে। তাই বললাম”,
~ ধুর আমার ওইসব জারা~ টারা লাগবে না। আমার তুই হলেই চলবে।
~ আসছে এখন ঢং দেখাইতে।
~ একটা কথা বলি?

~ বলবা তো বলবাই শুধু ঢং করো ক্যান!
~ তোরে আজকে পরীর মতো লাগতেছে।
~ হ্যাঁ জানি। ছাড়ো হাত।
~ না ছাড়লে কি করবি?

~ নখ দেখছো কত বড়? একদম চিমটি দিয়ে মাংস তুলে ফেলবো। ছাড়ো বলতেছি।
~ দেখি কেমন তুলতে পারিস।

~ তোমার এই কথায় কথায় হাত ধরার স্বভাব টা ভীষণ খারাপ।

~ অন্য মানুষের হাত তো আর ধরি না। তোর টাই তো ধরি।
~ কেন ধরবা? যাও যার সাথে ধাক্কা খেয়েছো তার হাত ধরো। একদম খুশিতে আত্মহারা হয়ে হার্ট ফেইলই করে ফেলবে। হিহি।

~ থাক বাবা! পরে ওর বাবা~ মা আমার নামে মামলা দিয়ে দিবে।

“মেঘা ওর লেহেঙ্গার দুই সাইড ধরে হাসতে হাসতে ছুটে চলে গেলো।”
“একটা মানুষ এতো সুন্দর হওয়ার কি খুব দরকার ছিলো? আজব!”
নিচে নামতে দেখলাম জারা দাড়িয়ে আছে। আমি ওকে গ্রাহ্য না করে চলে যেতে চাইলাম, ও আবার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।

এইভাবে তিন চারবার হওয়ার পর আমার খুব রাগ হলো। তবুও নিজেকে কনট্রোল করে বললাম, কি হইছে জারা? কিছু বলবা?
জারা মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

আমি আবার জিজ্ঞাস করলাম, কি সমস্যা জারা?
~ ইয়েএএ মানে..

~ না মানে, আমার আপনাকে খুব ভাল্লাগে!
“এ কথা বলে জারা এক ছুটে চলে গেলো আমার সামনে থেকে। আমার ভীষণ হাসি পেলো। একটা ব্যাপার ভেবে খুব অবাক লাগে। জারা আর মেঘা দুজনই মেয়ে। দুজনই খুব সুন্দরী!

কিন্তু দুজনের মধ্যে আকাশ~ পাতাল তফাত! কত মেয়ে দেখেছি কিন্তু মেঘার মতো একজনকেও দেখিনি! ও সবার থেকে আলাদা। এই জন্যই হয়তো ওকে আমার এতো বেশি ভালো লাগে।
সবাই মেঘার মতো হয় না কেনো?

বিয়ে বাড়ির এতো এতো কিছুর মধ্যেও আমি কেবল ওকেই দেখছিলাম আর ওকেই ভাবছিলাম।

শাড়ি পরলে মেয়েদের এমন বউ বউ লাগে কেনো? মেঘাকেও সেদিন ঠিক বউ বউ লাগছিলো।

মেঘা হেসে হেসে কথা বলছিলো। আমি এসব কথা ভাবছিলাম। কোথা থেকে জানি মা এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। তারপর বললো,
~ রোদ আজ মেঘাকে দেখে একটা ব্যাপারে ভাবছি।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
~ কি ব্যাপারে মা?

~ আমাদের মেঘা অনেক বড় হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে মনেহয়। কেমন বউ বউ দেখাচ্ছে, দেখেছিস।
“আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। মা কি মিন করছে আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না।”

আমি কিছু বললাম না। মা আবার বললো,
~ মেয়েটা ছাড়া বাড়িটা বড়ই ফাঁকা ফাঁকা
লাগবে।

“মনে মনে ভাবতে লাগলাম মেঘা ছাড়া শুধু বাড়ি না মা। মেঘা ছাড়া আমিও ভীষণ ফাঁকা হয়ে যাব।”

হঠাৎ একদিন দেখলাম মা ফোনে কার সাথে জানি হাসিহাসি মুখ করে কথা বলছে। আমি কাছে যেতে মা বললো, রোদ খুব খুশির একটা খবর আছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। …

পর্ব ৮

হঠাৎ একদিন দেখলাম মা ফোনে কার সাথে জানি হাসিহাসি মুখ করে কথা বলছে। আমি কাছে যেতে মা ফোন রেখে বললো, রোদ খুব খুশির একটা খবর আছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।

মায়ের এমন অদ্ভুত খুশির কারনটা ঠিক ধরতে পারলাম না। আমি জিজ্ঞাস করতে যাব তার আগেই মা বলে উঠলো, “রোদ তানভীর রা আসবেন আমাদের বাসায়।”

আমি ভেবে পেলাম না এতে এতো খুশি হওয়ার কি আছে! আমি বললাম,
~ এমন ভাবে বলছো যেনো কি না কি হয়ে গেছে! ওরা আসবে এতে এতো খুশি হওয়ার তো কিছু দেখি না! এমন তো না যে প্রথমবার আসতেছে! ইভেন প্রথমবারেও তো এতো খুশি হতে দেখি নি!

মা খুশি খুশি মুখ করে বললো, আগের বার আর এবার অন্য হিসাব! আমার যে কি ভালো লাগছে! তোকে বলে বুঝাতে পারবো না!”
আমার খুব রাগ হলো। বললাম,
~ তোমার এই স্বভাবটায় আমার খুব রাগ লাগে মা। সহজ কথা সহজ ভাবে বলতেই পারো না!

~ আহা রাগ করিস কেনো? ওরা এবার মেঘার ব্যাপারে কথা বলতে আসবে। বুঝতে পারছিস কত ভালো একটা ব্যাপার হতে যাচ্ছে?
“আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি ঘটতে যাচ্ছে। কেমন একটা অনুভূতি হলো। জানিনা এমন কেনো লাগছিলো।”

মাকে শুধু বললাম,
~ মেঘাকে বিদায় করার জন্য দেখছি উঠেপড়ে লাগছো! ওদের আসতে মানা করে দাও।

মা অবাক হয়ে বললো,
~ কি বলিস? তানভীর এর মতো এতো সুন্দর, নম্র~ ভদ্র একটা ছেলে আজকাল পাওয়া যায় নাকি? আর তার থেকে বড় কথা, মেঘাকে আমি নিজের মেয়ের থেকেও বেশি ভাবি। ওর মতো লক্ষি একটা মেয়ের জন্য তানভীর~ ই যোগ্য। তুই আর বাঁধা দিস না তো।

“মায়ের কথাগুলো আমার কানে বাজতে লাগলো। ঠিকই তো! মেঘার জন্য তানভীর~ ই একদম পারফেক্ট। আমি কেনো বাঁধা দিচ্ছি এখানে! অদ্ভুত!”

“আমি চলে এলাম বাহিরে। বাসার সামনে চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসলাম। জাকির মামাকে বললাম, মামা চা দেও।
উনি হাসিহাসি মুখ করে বললো,
না মামা দেওন যাইবো না।

আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। বললাম,
~ কি কও তুমি?
~ হো হাসাই কইছি। মেঘা মামুনি না কইরা দিছে।

~ মেঘা আমাকে চা দিতে না করে দিছে? কিন্তু কেনো না করছে?
~ হয়। আফনে নাকি উঠতে বসতে সারাদিন খালি চা খান। হেরলাইগা কইছে দুই কাপের বেশি চা যেনো আমার দোকান থেইকা না দেই। সকালে দুইবার খাইয়া গেছেন, এহন আর দিতে পারমু না।

~ ধুর কি কও মিয়া! খালি একটু চা ই তো খাই। অন্য কিছু তো আর খাই না। দেও তো তুমি।

~ না মামু দিতারমু না। মেঘা মামুনির কথা আমি ফেলতে পারমু না।
~ হ্যাঁ, টাকা দেই আমি আর কথা শোনো মেঘার। যাও খামু না তোমার চা। কি হইবো?

~ হাহা! রাগ কইরাও লাভ হইবো না মামা!
“আমি দোকান থেকে উঠে পরলাম। আমি একটা ব্যাপার ভেবে খুব অবাক হই! কি আছে এই মেয়েটার মধ্যে? সবাই ওকে এতো কেনো ভালোবাসে!”

“বাসায় এসে দেখলাম মেঘা ফোনে কথা বলছে। আমি বারান্দায় চলে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘা এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।”
~ তোমার কি মন খারাপ নাকি? এখানে একা একা দাড়িয়ে আছো যে?
~ আমার মন~ টন খারাপ হয় না। তুই যা এখান থেকে।
~ ওকে।
“মেঘা সত্যিই চলে যাচ্ছিলো। আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম”,
~ আশ্চর্য! আমি বললেই কি চলে যেতে হবে নাকি?

~ তো কি করবো? দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঢং করবো নাকি!
“এই মেয়েটা এমনই ত্যারা! আর সেইজন্যই হয়তো ওকে এতো ভালোলাগে! আমি কথার টপিক চেঞ্জ করে ফেললাম।”

~ তুই নাকি জাকির মামাকে বলছিস, আমাকে দুই কাপের বেশি চা না দিতে?
~ হ্যাঁ বলছি। আর আমি যা বলছি তাই হবে।
~ কেনো?

~ কি কেনো? সারাদিন চা খেয়ে খেয়ে শরীরের বারোটা বাজাতে দিবো নাকি!

~ আমার শরীরের বারোটা বাজলে তোর কি?
~ আমার আবার কি হবে? কিছুই না।

“হঠাৎ মেঘার ফোনে কল আসলো। মেঘা কেটে দিলো। আমি আন্দাজ করতে পেরে বললাম,
~ তানভীর ছিলো?
~ হ্যাঁ।
~ কাটছিস কেনো?

~ আমার ইচ্ছা হইছে তাই।
~ আমি সামনে আছি তাই লজ্জা পাচ্ছিস?

~ তোমাকে লজ্জা পাওয়ার কি আছে! অদ্ভুত।
~ তাহলে কেটে দিলি কেনো?
~ ওর সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কি সব ঢং করে কথা বলে। বিরক্ত লাগে।

~ প্রথম প্রথম তো একটু ঢং করেই কথা বলবে। ও কি আমার মতো ঝগড়া করবে নাকি তোর সাথে।

“মেঘা হেসে দিয়ে বললো”,
~ সবাই তোমার মতো হলে তো হতোই। আর তুমি ছাড়া আমি কারো সাথে ঝগড়া করি না।
~ হ্যাঁ আমার সাথেই তো পারিস।

“মেঘা একটু হাসলো। এই মেয়ের হাসি এতো মিষ্টি কেনো? এতো মায়া মায়া মুখ করে এতো হাসার ই বা দরকার কি! অদ্ভুত। ওর এই হাসিহাসি মুখ, ওর অভিমানী মুখ, ওর ঝগড়া, ওর শাসন আর ওকে ছাড়া আমি একটা দিন ও কল্পনা করতে পারি না। আমার এই নামহীন অনুভূতিটা কুড়েকুড়ে খাচ্ছিলো।”

আমি মেঘার মুখটা আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম, মেঘা তুই কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলি! তোকে আমাদের বিদায় করার ও সময় চলে এসেছে! হাহাহা!

“মেঘা মুখ উল্টে বললো, বিদায় হলে তবে তো বিদায় করবা! যতই খুশি হও লাভ নাই। আমি তোমাদেরকে এতো সহজে ছাড়তেছি না।”
হঠাৎ দরজায় কলিংবেল এর আওয়াজ শুনলাম। তারপর শুনতে পেলাম মা কার সাথে যেনো উচ্ছাস মাখা স্বরে কথা বলছে। আমি মেঘার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ হঠাৎ কে এলো রে?

~ আমি কিভাবে বলবো! কাকী মনির কথা শুনে তো মনে হচ্ছে চেনা কেউ~ ই হয়তো আসছে। চলো গিয়ে দেখি।
“ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি তানভীর হেসেহেসে মায়ের সাথে কথা বলছে। মাও দেখি খুশিতে গদগদ করছে। এই মহিলার এতো খুশি দেখে আমার শরীর জলে যাচ্ছে!”

তানভীর মেঘাকে দেখেই একটা হাসি দিয়ে বললো, “তোমাকে কল দিলাম ধরলা না যে?”

মেঘা আমার দিকে একবার তাকালো। তারপর তানভীরের দিকে তাকিয়ে বললো, এমনি।

মা বললো, আহা, দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি কথা বলা শুরু করলা? এসো, বসে কথা বলো।

~ না না আন্টি। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে একটু দেখা করে যাই।

~ খুব ভালো করেছো বাবা।
“মেঘা চলে যেতে লাগলো, তানভীর পিছন থেকে ডেকে বললো, কল দিলে কল ধরবা কিন্তু। মেঘা কিছু না বলে হালকা একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো।”

তানভীর চলে যেতেই মা বললো,
~ সোনার টুকরো একটা ছেলে। কি সুন্দর আদব~ কায়দা!
~ তাহলে আমি কিসের টুকরো? এমন ভাবে বলছো যেনো আমি কয়লার টুকরো!

“মা হাসি মাখা মুখে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, তুই তো আমার হিরের টুকরো ছেলে।
.
“কোথাও মেঘাকে না দেখে ওর রুমে যেতেই, মেঘা আমাকে দেখে চমকে উঠে কিছু একটা লুকিয়ে ফেললো! তারপর আমার দিকে রাগি রাগি মুখ করে তাকিয়ে বললো,
~ তোমাকে কত বার বলছি হুট~ হাট আমার রুমে চলে আসবা না?
~ বাব্বাহ, তোর রুমে আসতে হলে বুঝি এখন আমার পারমিশান নেওয়া লাগবে? আচ্ছা চলে যাচ্ছি।

~ চলেই যখন আসছো এখন আবার চলে যাবা কেনো! কিছু কি বলবা?
~ না, এমনি আসলাম। কথা বলতে ইচ্ছা হলো তাই! কয়দিন পর তো চলেই যাবি! তাই আজকাল সারাক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছা করে তোর সাথে।

~ বেশি ঢং!
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
~ তানভীর কে তোর ভালো লাগে, তাই না?
~ ভালো না লাগার কি কোনো কারন আছে?
~ না।

“মেঘা কিছু না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আমি তখনও বসে রইলাম। হঠাৎ আমার চোখ একটা ডায়রিতে আটকে গেলো! ভাবতে লাগলাম মেঘা কি তখন আমাকে দেখে এটাই লুকালো! কারো ডায়েরি পারমিশানি ছাড়া ধরা ঠিক না জানি। কিন্তু জানার খুব আগ্রহ হলো কি আছে এতে। মেঘা ছোট থেকেই ভীষণ চাপা স্বভাবের। এখানে কি এমন কিছু আছে যা আমি জানি না!

আমি সেদিন মেঘার ডায়রি টা নিয়ে আমার রুমে চলে এসেছিলাম। শুরু থেকে শেষ অব্দি পুরোটা পড়া শেষ করে আমার শরীর ঝিমঝিম করতে লাগলো। আমি যেনো একটা গোলকধাঁধায় আটকে গিয়েছিলাম। ওর ডায়রির পুরোটা জুড়ে আমি ছিলাম। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমেই!

মেঘার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতি গুলো, সেদিন আমার মাটির দলার সমান অনুভূতি টাকে পাহাড় সমান বড় করে দিয়েছিলো!

একটা মানুষের ভিতরকার অনুভূতি আমরা কেউই কখনো উপলব্ধি করতে পারি না। মেঘার অনুভূতি টাও আমি বুঝতে পারি নি।

কিন্তু আমি কি করবো! কিই বা করা উচিৎ আমার? আমি বুঝতে পারছিলাম না ওর জন্য কি শুধুই ভালো লাগার অনুভূতি ছিলো? নাকি অন্য কিছু! মেঘার অনুভূতি টাকেই বা কি নাম দিবো আমি?

পাগল পাগল লাগছিলো আমার। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কি মেঘার মুখোমুখি হওয়া উচিত? নাহ আর ভাবতে পারছিলাম না!
“আমি ডায়রিটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। মেঘাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে আমি মাকে জিজ্ঞাস করতেই মা বললো মেঘা ছাদে গেছে।”

রাতের বেলা মেঘা তখনই ছাদে যায় যখন ওর খুব মন খারাপ হয়! আজ কেনো গেলো? আর বেশি কিছু না ভেবে আমি ছাদে চলে গেলাম।

আমি যেতেই মেঘা চলে আসতে লাগলো!
আমি ওর হাত টেনে আমার সামনে নিয়ে আসলাম। অন্য সময় হলে ও আমার দিকে তাকাতো কিন্তু তখন তাকাচ্ছে না দেখে আমি খুব অবাক হলাম। আমি ডাকলাম,
~ মেঘা?

~ আমার দিকে তাকাচ্ছিস না কেনো?
~ এমনি। সরো, আমি নিচে যাব। কাকিমনি চিন্তা করবে।
~ না চিন্তা করবে না। শোন?
~ কি?

~ তোর কি আজ মন খারাপ খুব?
~ না।
~ তাহলে এই সময়ে ছাদে আসলি কেনো?
“মেঘা এবার আমার দিকে তাকালো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো।”
~ আমার মন খারাপ হলেই কি এই সময়ে ছাদে আসি?
~ হুম।

~ তুমি কি আমার সব কিছু জানো?
~ হুম।
~ উঁহু! তুমি কিছুই জানো না।

“আমি ডায়রিটা ওর দিকে ধরে বললাম, আগে আমার কনফিউশান ছিলো মেঘা, কিন্তু এখন নেই!”

“মেঘা টান দিয়ে আমার হাত থেকে ডায়রিটা নিয়ে নিলো! আমি দেখলাম ওর নাক~ মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। ও ডায়রিটা নিয়ে হাটুভাজ করে বসে পরলো তারপর পৃষ্ঠা গুলো ছিড়তে লাগলো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিলো!”

আমিও বসে পড়লাম তারপর ওকে বাঁধা দিতেই ও সেই ভিজাভিজা চোখ জোড়া দিয়ে আমার দিকে তাকালো!

নাহ! আমি তাকিয়ে থাকতে পারিনি! আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, তোকে আমার সামনে কাঁদতে মানা করেছি! তারপরও কেনো কাঁদিস?

তুই কি জানিস পৃথিবীর অন্যতম বাজে দৃশ্য এটা?
মেঘা চুপ করে ছিলো! আমি বললাম, তোকে আমি পড়ে ফেলেছি। কিন্তু তুই কি আমাকে পড়তে চাস না? আমি তো মরে যাচ্ছি। প্লিজ একটু আমাকে পড়ে উদ্ধার কর। খুব বেশি সময় নেই মেঘা।

মেঘা চোখ মুছে কঠিন গলায় বললো, “আমাদের এই অনুভূতির কোনো নাম নেই! আর আমি এই অনুভূতির কোনো নাম দিতেও চাই না।

সেই ছোট্ট বেলাতে বুঝ হওয়ার আগেই মা~ বাবাকে হারিয়েছি। কিন্তু কাকু আর কাকিমনি আমাকে কখন মা~ বাবার অভাব বুঝতেই দেয়নি! এতো এতো ভালোবাসা বিনিময়ে কি করে আমি তাদের এতো বড় আঘাত টা দিবো? আমি মরে যাবো, তবুও কখনও তাদের অবাধ্য হতে পারবো না।”

আমি মেঘার সামনে হাত জোর করে বসে পরলাম। বললাম, “প্লিজ এমন করিস না। আমি মা~ বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। ওরা তো তোকে কত পছন্দ করে। ওরা ঠিক বুঝবে। তোকে ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না। প্লিজ একটু বুঝতে চেষ্টা কর।”

মেঘা রাগি মুখ করে বললো, “খবরদার তুমি ওদের যদি কিছু বলেছো তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম। তুমি ওদের কিচ্ছু বলবা না। আমি তানভীরকেই বিয়ে করবো। তুমি এখানে আর কোনো সিনক্রিয়েট করবা না।”এ কথা বলে মেঘা চলে গেলো। আমি ঠিক কতক্ষণ সেখানে ওইভাবেই বসে ছিলাম জানা নেই! …

পর্ব ৯

সেদিন রাতে সারারাত জেগে টুকরো টুকরো কাগজে আমার আর মেঘার সবটুকু অনুভূতি লিখে যেতে লাগলাম। এর চাইতে বেশি কিইবা করার ছিলো তখন আমার? একটা ঘোড়ের মধ্যে রাতটা কেটে যেতে লাগলো।

হঠাৎ ঘোর কাটতেই কাগজগুলো হাত দিয়ে দুমড়ে~ মুচড়ে পুরো রুম ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেললাম। যেই অনুভূতির কোনো পরিণাম নেই, কি লাভ সেই অনুভূতিকে লালন করে? আমি ভাবতে লাগলাম, আমি তো এমন ছিলাম না! তাহলে এখন এমন হয়ে গেলাম কেনো?

এসব ভাবতে ভাবতে কখন রাত পেরিয়ে বেলা হয়ে গেলো আমি বুঝতেই পারিনি। আমার জীবনে একটা নির্ঘুম রাত কেটে গেলো আমার অজান্তেই!

হঠাৎ দরজায় টোকা পরতেই চমকে উঠলাম! দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসতে লাগলো,

~ এই রোদ! কত বেলা হলো এখনও ঘুমাচ্ছিস? আজ কত কাজ বাড়িতে আর তোর কোনো চিন্তাই নাই!

“আমি ঝটপট কাগজ গুলো একসাথে করে সবগুলো খাটের নিচে ছুড়ে ফেললাম। তারপর চোখমুখ মুছে গলাটা পরিষ্কার করে বললাম, আসছি মা”

তানভীর রা চলে এসেছিলো। মা~ বাবাকে খুব খুশি খুশি লাগছিলো। আমি ভেবে পেলাম না, মেঘা ওদের কাছেই থেকে গেলে কি খুব বেশি খারাপ হয়ে যেতো?

মেঘাকে সেদিন একটা মিষ্টি পরীর মতো লাগছিলো। মায়ের লাল কালারের একটা শাড়ি পড়েছিলো।

আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না সেদিনের সেই লাল কালারের একটা জামা পরে, মিষ্টি মিষ্টি মুখ করে বসে থাকা ছোট্ট মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেলো কবে? কিভাবে নিজের অনুভূতি টাকে মেরে ফেলতে শিখে ফেললো?
রহমান কাকা, কাকি, মা~ বাবা, তানভীর সবাইকে খুব খুশি খুশি লাগছে। মেঘা চুপচাপ বসে রইলো। আহ! কি শান্তি লাগে মুখটার দিকে তাকালে!

তানভীরকেও অসাধারণ লাগছিলো। খুব মানাবে মেঘার পাশে। ভাবতে লাগলাম আমিই বা কেনো শুধু শুধু বাঁধা দিতে যাচ্ছিলাম! মেঘার মতো এতো লক্ষি একটা মেয়ের জন্য তানভীরই পারফেক্ট।

“আমার ইচ্ছা হচ্ছিল এখান থেকে উঠে চলে যেতে। সবাইকে অসহ্য লাগছিলো আমার। সেই মূহূর্তে আমার মনে হতে লাগলো, মেঘার ডায়রিটা না পড়লেই বরং ভালো হতো! তাহলে হয়তো আমার ক্ষুদ্র অনুভূতি টা এতো বিশাল আকার ধারন করতো না।

আমি আড়চোখে কয়েকবার মেঘার দিকে তাকালাম। কিন্তু মেঘা কারোর দিকেই তাকাচ্ছে না।

রহমান কাকা মেঘার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, মেঘার মতো এতো মিষ্টি একটা মেয়ে আমাদের ঘর আলো করতে যাবে তা ভাবতেই তো ভালো লাগছে।

উনার সাথে সম্মতি জানিয়ে কাকিমনি ও বললো, একদম ঠিক বলেছো। আর তার চাইতে বড় কথা আমাদের তানভীর ও মেঘাকে অসম্ভব পছন্দ করে। এখান থেকে যাওয়ার পর থেকে ওর মুখে তো শুধু মেঘা আর মেঘা। সবাইকে একদম মায়ায় ফেলে দিলো মেয়েটা।”
আমি তানভীরের দিকে তাকাতেই দেখলাম ও একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে হাসি দিলো। মেঘার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

মা বলে উঠলো, মেয়েটা চলে গেলে আমাদের কি হবে তা ভেবেই কেমন খালি খালি লাগছে। কিন্তু এটা ভেবে শান্তি লাগছে যে ও আপনাদের মতো একটা পরিবার পাচ্ছে।

আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। উঠে চলে যাচ্ছিলাম তখন তানভীর আমাকে ডেকে বললো, আরে রোদ কই যাচ্ছো?

আমি অনিচ্ছাকৃত হাসি দিয়ে বললাম, “আমি এখানে থেকে কি করবো। তোমাদের ব্যাপার তোমরা সামলাও। এ কথা বলে মেঘার দিকে তাকাতেই দেখলাম, মেঘা কেমন ব্যর্থ চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে ফেললো।

বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলাম। আর এক মুহূর্ত ও না দাড়িয়ে বেরিয়ে আসলাম বাসা থেকে। আনমনে কত রাত পর্যন্ত হেটেছিলাম জানা নেই!

বাড়িতে যখন ফিরেছি তখন অনেক রাত। তানভীর রা চলে গেছে। মেঘাকে হারানোর দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেছে! আর অল্প কয়েকটা দিন মেঘা এই বাড়িতে থাকবে, তা ভাবতেই মাথা ভারী হয়ে যাচ্ছিলো।

এসব ভাবতে ভাবতে রুমে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মেঘার রুম থেকে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো। আমি বুঝে গেলাম ও এখনও জেগে আছে।

কিছু না ভেবেই আমি মেঘার রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আবছা আলো ছায়ায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম, মেঘা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে হাঁটু ভাজ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। সাজগোজ তখনও যেমনটা তেমনই ছিলো! শাড়িটা ও চেঞ্জ করেনি তখনও!
আমার তখন কেমন অনুভব হচ্ছিল জানা নেই!

মেঘা আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ছুটে এসে দরজা আটকে দিলো।
আমি এপাশ থেকেই বললাম,
~ মেঘা, দরজাটা খোলনা প্লিজ।

মেঘা ওপাশ থেকেই বললো,
~ তুমি এখানে এসেছো কেনো! যাও এখান থেকে।

“আমি আর কিছু বললাম না। দরজার সাথেই হেলান দিয়ে বসে রইলাম। ওইভাবেই কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম জানি না। হঠাৎ কেমন জানি অনুভব করতে লাগলাম। চোখ খুলে দেখতে পেলাম মেঘা ভেজা ভেজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ খুলতেই মেঘা উঠে চলে যেতে লাগলো।

আমি ওর হাত টেনে বসিয়ে ফেললাম। মেঘা হাত ছুটানোর চেষ্টা করছিলো। আমি জানি ওর অস্বস্তি লাগছিলো!”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ তুই পারবি আমাকে ছাড়া থাকতে?
মেঘা কঠিন গলায় বললো,

~ আমি সব পারি! আর তোমার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক নাই যে, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
“মেঘা কথাগুলো বলছিলো ঠিকই কিন্তু ওর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিলো।”

আমি মেঘার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম, তুই হয়তো আমাকে ছাড়া খুব ভালো থাকবি কিন্তু তোকে ছাড়া আমি আমার একটা মুহূর্ত ও কল্পনা করতে পারি না রে!

তুই চাইলেই কিন্তু আমাদের অনুভূতি গুলোকে জোড়া লাগিয়ে একটা নাম দিতে পারতাম।

মেঘা কিছু না বলে উঠে চলে গেলো।

রহমান কাকারা চেয়েছিলেন খুব ধুমধাম করে বিয়েটা হোক। কিন্তু মেঘা নাকি বলেছে ও চায় সবটা যেনো ঘোরোয়া ভাবেই হয়।
প্রথম প্রথম সবাই একটু মন খারাপ করলেও পরে সবাই মেঘার ইচ্ছেটাই মেনে নেয়।

কিন্তু আমি তো জানি মেঘা কেনো এমনটা চাচ্ছে।

“জীবনের এই পর্যায় এসে নিজেকে খুব একা আর অসহায় মনে হচ্ছিল। কবে কখন কিভাবে একটু একটু করে ওর জন্য এতোটা অনুভূতি জন্মে গেলো বুঝতেই পারলাম না!

চলেই যখন যাবে কেনো এতোটা জুড়ে ছিলো! এসব ভাবতে ভাবতে পুরো শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিলো।

সবাই ততক্ষণে চলে এসেছিলো। সবার চোখে মুখে খুশির ছোয়া। কিন্তু আমি জানি মেঘার কতটা কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ওর একরোখামির জন্যই আজ ওকে আর আমাকে এতোটা কষ্ট পেতে হচ্ছে।

কি এমন হতো মা~ বাবাকে বললে। ও চলে যাবে ভেবে মা~ বাবা ও তো কত টা কষ্ট পাচ্ছে। কেনো মেঘা মা~ বাবাকে সবটা বলতে দিলো না। খুব বেশি কি খারাপ হয়ে যেতো এতে? আমার ও তখন জীদ চেপে গেলো।
ও কতটা কষ্ট সহ্য করতে পারে তা দেখার জন্যই আমি তখন অপেক্ষা করছিলাম।

এর মাঝেই মা মেঘাকে নিয়ে এলো। কিন্তু আমি একবার ও তাকাইনি! কি লাভ অজথা মায়া বাড়িয়ে।

সবাই এসে গিয়েছিল কিন্তু তানভীরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না।
সবাই অবাক হয়ে গেলো তানভীরকে না দেখতে পেয়ে! রহমান কাকা তানভীরকে কল করতে যাচ্ছিললো ঠিক তখনই ও এসে দাঁড়ালো। তারপর…

পর্ব ১০

তারপর তানভীর আমার সামনে এসে দাড়িয়ে ঠাসস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে দিলো!

সবাই বেশ অবাক হয়ে গেলো। মিনিটের মধ্যে পুরো ঘরে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি কি করেছি!

রহমান কাকা ধমক দিয়ে বলে উঠলো, কি হচ্ছে টা কি তানভীর!
বাবা আর কাকিমনি যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না তানভীর এর এমন প্রতিক্রিয়া!

মা ছুটে এসে তানভীর এর কাছে জিজ্ঞাস করলো, কি হয়েছে বাবা? রোদ কি কিছু করেছে?

তানভীর এর চোখমুখ দিয়ে যেনো আগুন বের হচ্ছিলো! ও ওর হাত থেকে কিছু কাগজ মায়ের কাছে দিয়ে বললো, পড়ে দেখুন আন্টি!

“কাগজ গুলো দেখে আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো! হায় আল্লাহ্ এ তো সেই দিন রাতের মেঘাকে নিয়ে লেখা সেই কাগজ গুলো! কিন্তু ভেবে পেলাম না, তানভীর ওগুলো কোথায় পেলো! আমি অবাক এর উপর অবাক হয়েই যাচ্ছিলাম!”
মেঘা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো আমাদের দিকে। হয়তো অনুমান করার চেষ্টা করছিলো, কি হচ্ছে!

প্রথম প্রথম আমি কিছুটা অবাক হলেও পরবর্তীতে আমার এটা ভেবে ভালো লাগছিলো যে, হয়তো এই শেষ পর্যায়ে এসে কোনো একটা মিরাকেল ঘটবে! মনের সুপ্ত আসা নিয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম মায়ের চোখ ছলছল করছে! এই দৃশ্য দেখে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভাবতে লাগলাম তাহলে কি মেঘা সত্যিই বলেছিলো! এই ব্যাপারটা কি মায়ের খারাপ লাগার কারণ হয়ে দাঁড়ালো?

মা কাগজ গুলো বাবার দিকে দিয়ে আমার সামনে এসে মা ও একটা থাপ্পড় মেরে দিলো। মনে মনে ভাবলাম, হচ্ছেটা কি! সবাই কি সরকারি গাল পাইলো নাকি? সবাই একটা একটা করে থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছে!
তানভীর তখনও রাগে ফেটে যাচ্ছিলো। বাবার দিকে তাকাতেই দেখলাম, কাগজ গুলো পড়ছিলো আর হাত কাঁপছিল।

তানভীর এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ছিঃছিঃ রোদ! মেঘার মতো মেয়েটাকে ধরে রাখার সৎ সাহস দেখাতে পারোনি? একবার তো বলে দেখতে পারতা আঙ্কেল~ আন্টি কিভাবে নেয় বিষয়টা! মেঘা নিষেধ করেছে বলে তুমিও ওর কথা মেনে নিলা? এতো বছর একসাথে থেকে এতটুকু চিনলা ওকে? ওর ভিতর দিয়ে কি যাচ্ছে, ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বললো, আমি আগেই এমন একটা কিছু ধারনা করতে পারছিলাম। কিন্তু কোনো ক্লু পাচ্ছিলাম না! ভাগ্যিস আজ তোমার রুমে গিয়েছিলাম! তা না হলে কি হতো বলো তো?

এই পর্যায়ে এসে তানভীরকে আমার অসাধারণ ছেলে মনে হলো। মনে হলো তানভীরের সাথেই মেঘার বিয়ে হওয়া উচিৎ!

ওই মূহূর্তে মা~ বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখন মেঘা ছুটে এসে মা~ বাবার সামনে এসে বললো, “প্লিজ কাকু প্লিজ কাকিমনি তোমরা এসব কিছু বিশ্বাস করো না! আমি মন থেকেই বলছি আমি তানভীরকেই বিয়ে করতে চাই। তোমরা তো জানো তোমাদের ছেলে কেমন পাগল! প্লিজ ওর এসব দেখে কষ্ট পেয়ো না।”

“তানভীর তখন মেঘার কাছে গিয়ে বললো মেঘা, তোমাকে আমি সাহসী আর স্পষ্টবাদি ভাবতাম! ভাবতাম সত্যি কথা বলতে তুমি ভয় পাও না! বাট নো! আই ওয়াজ রং!”

রহমান কাকা আর কাকিমনি কিছুই বুঝতে পারছিলো না। তানভীরকে দেখলাম ও ওনাদের কি সব বুঝাচ্ছিলো।

মেঘা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলো। সেই মূহূর্তে আমাকে নিয়ে ওর কোনো রকম ভ্রুক্ষেপই নেই। ওর তখন একটাই ভাবনা কেউ ওকে ভুল না বোঝে! ওর মনে হয়তো অপরাধ বোধ কাজ করছিলো মা~ বাবা কষ্ট পাচ্ছে ভেবে।

ঠিক তখন মা এসে কাঁদো কাঁদো মুখ করে মেঘার মাথায় হাত রেখে বললো, আমি যে তোকে কত ভালোবাসি তুই কি সেটা জানিস না বল? তোর মতো লক্ষি একটা মেয়ে যে ঘরে থাকবে সে ঘর তো আলোয় আলোকিত হয়ে থাকবে।

কিন্তু আমি তো কখনও বুঝতেই পারিনি তোদের মনে এমন সুপ্ত অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছিস! বুঝতাম কি করে বল? সারাক্ষণ এমন একজনের পিছে আরেকজন লেগে থাকতিস।

মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাবা বলে উঠলেন, আমার মেঘা মা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে শুনে তো আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো! এখন বেশ শান্তি শান্তি লাগছে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ওই আহাম্মক টাকে দিয়ে তো কিছুই হবে না! তানভীর এর যায়গায় যদি অন্যকেউ হতো, তাহলে যে কি হতো আজ।

আমার কাছে তখন পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নের মতো লাগছিলো। সবাই কত সুন্দর সবটা মেনে নিলো। আর বাবার একটা কথা কানে বাজতে লাগলো(তানভীর যদি না থাকতো কি হতো তখন)আসলেই তো! কি হতো ও না থাকলে?

এ কথাটা ভাবতেই আমি তানভীরের কাছে গিয়ে ওকে জরিয়ে ধরে বললাম, লাভ ইউ ব্রাদার!

তানভীর আমাকে এক হাত দিয়ে সরিয়ে বললো, ধুর রাখো তোমার লাভ! একটুর জন্য বড়সড় একটা ছ্যাঁকা থেকে বেঁচে গেলাম!
তারপর একটা হাসি দিয়ে আবার বললো, মেঘাকে ছোট্ট বেলাতেই আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিলো। তাহলে ওর মনে তোমার জন্য যে অনুভূতি জন্মেছে তা হয়তো আমার জন্য জন্মাতো! খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছি! হাহাহা!

তানভীরের সাথে সবাই হেসে উঠলো।

মেঘা তখন কাঁদছিলো আবার হাসছিলো! একসাথে দুইটার কম্বিনেশনে ওকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো!

আমি মেঘার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, যাহ! শেষমেশ আমাকে জালানোর জন্য থেকেই গেলি!

মেঘা তখন আমার হাতে হালকা করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, ইশশশ! বয়েই গেছে তোমার কাছে থাকতে!
(শেষ অংশ)

তারপর অবশ্য আমাদের খুব বড় করেই বিয়ে হয়েছিল। রহমান কাকারা এসেছিলো কিন্তু তানভীর আসেনি। ওর নাকি কি কাজ ছিলো!
পুরো বাড়িটা মেঘা মাতিয়ে রাখতে লাগলো। মেঘা অধিকার বোধটাও আগের থেকে অনেক গুন বেড়ে গিয়েছিলো।

আমার সাথে তো খুনসুটি লেগেই থাকতো। ওর রাগি রাগি মুখ, কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকা, অভিমানী মুখ আর মিষ্টি মিষ্টি হাসি গুলো তখন আমি খুব করে উপভোগ করতে লাগলাম।

প্রায় সময় আমার পাশে এসে বসে বলতো, তুমি খুব বদলে গেছো।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করতাম, কি বলিস?

মেঘা অভিমানী মুখ করে বলতো, তা নয়তো কি? তুমি এখন আর আমার সাথে আগের মতো ঝগড়া করো না!

আমার তখন খুব হাসি পেতো। আমি জোরে হেসে দিয়ে বলতাম, তুই তো রেকর্ড গড়ে ফেললি। এই প্রথম কাউকে দেখলাম ঝগড়া না করার জন্য অভিমান করতে। হাহাহা!

মেঘা তখন আমার হাতে একটা ঘুষি দিয়ে বলতো, যাহ! তোমার সাথে আর কথাই বলবো না! এ বলে উঠে চলে যেতো।

মেঘার সাথে কাটানো প্রতিটা মূহূর্ত আমার মনে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি করতো। প্রতিটা মূহুর্তে মনে হতো, আমি এতো সুখি কেনো?

এই শোভা কি করছিস তুই?
শোভা চমকে উঠে ডায়রিটা লুকিয়ে ফেললো। তারপর পিছন ফিরতেই দেখলো রিয়া দাড়িয়ে আছে। শোভা বড় করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো, উফফ তুই!

রিয়া মিটিমিটি করে হাসতে হাসতে বললো, কেনো? লাভ লেটার লিখছিস নাকি? যেভাবে চমকে উঠলি!

~ আরেহ না। ওতো টাইম নাই আজাইরা।
~ তাহলে চমকে উঠলি কেনো?

শোভা ডায়রিটা রিয়ার সামনে ধরে বললো, এই যে এইটা পড়ছিলাম। তুই দিলি তো ব্যাঘাত ঘটিয়ে।
~ এটা আবার কার ডায়রি?

~ আরে মনে নাই ওইদিন যে ঝালমুড়ি মামার কাছ থেকে এটা নিলাম?
রিয়া হাসতে হাসতে বললো, পুরোনো ফেলনা জিনিস গুলো কালেক্ট করা এই স্বভাবটা যে কবে যাবে তোর! কে জানে! কার না কার ডায়রি উনি মনোযোগ সহকারে পড়ছে!

শোভা বললো, তুই তো গাঁধী! এইটার মজা বুঝবি কি? যাহ এখন! পড়ে শেষ করতে দে।

রিয়া চলে যেতেই শোভা আবার পড়তে শুরু করলো।
এর মাঝে আমার গ্র্যাজুয়েশান ও কমপ্লিট হয়ে গেলো। একটা ভালো চাকরি ও হয়ে গেলো। সব মিলিয়ে আমাদের খুব ভালোই দিন যাচ্ছিলো।

সেদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মেঘা মিষ্টি মিষ্টি মুখ করে বললো, আজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসবা কেমন? আজ আমরা অনেক গল্প করবো।

আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম, বাব্বাহ! তোর মাথায় এতো সুবুদ্ধি এলো কবে!

মেঘা মুখ উল্টে বললো, যাও! আসা লাগবে না তাড়াতাড়ি। ভালো কথা বললে ঢং বেরে যায়।

আমি একটা হাসি দিয়ে বলেছিলাম, রাগ করে না মেঘবালিকা! তাড়াতাড়ি~ ই আসবো।

অফিসে আসার পর, হঠাৎ বাসা থেকে আমার অফিসে ফোন আসলো মেঘা সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পরে গেছে। ওকে হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে! আমি যেনো তাড়াতাড়ি চলে আসি।

ডায়রিটার এতটুকু পড়ে শোভার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো! ওর হাত কাঁপতে শুরু করলো। একটু থেমে আবার পড়তে শুরু করলো।

তখন আমার মধ্যে কেমন অনুভব হচ্ছিল তা কোনো শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা সম্ভব না!

আমি কোনোমতে ফোন টা ফেলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।

কোথায় যেনো শুনেছিলাম মানুষের জীবনে খুব ভয়াবহ একটা সময় যায়। আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ সময় ছিলো সেই সময়টা। আমার পুরো পৃথিবী যেনো ওই মূহুর্তে থমকে গিয়েছিল!

আমি হসপিটাল পৌছতেই মা~ বাবা ছুটে এসে কাঁদতে লাগলো। আমার পুরো শরীর যেনো ক্রমেই অবশহয়ে যাচ্ছিলো।

কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে বললো পেশেন্ট এর অবস্থা ক্রিটিক্যাল। পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে!

কিন্তু সেবার আল্লাহর অশেষ কৃপায় মেঘা বেঁচে গিয়েছিলো। কিন্তু একটা অনুভূতিহীন মানুষ হয়ে বেঁচে ছিলো।

মেঘা কোমায় চলে গিয়েছিলো। ব্রেনে খুব বড় আঘাত লেগেছিলো।
এর পর থেকে মেঘা আমার সাথে আর ঝগড়া করে না! শাসন করে না! আমার কোনো কথার উত্তর ও দেয় না। আমি কোনো অন্যায় করলেও রাগি রাগি চোখ করে তাকায় না। আমি কত করে ডাকি, একটু কথা বল মেঘা! একটু রাগি রাগি মুখ করে তাকা! একবার ধমক দিয়ে জিজ্ঞাস কর এই কাজ টা কেনো করলা?

কিন্তু মেয়েটা আমার কোনো কথাতেই কোনো সাড়া দেয় না! শুধু অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে থাকে!

“শোভা ডায়রিটা বন্ধ করে চুপচাপ খাটে গিয়ে শুয়ে পরলো। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। ভাবতে লাগলো, আচ্ছা মেঘা কি পরে ভালো হয়েছিলো? ওরা মিলে কি আবার নিত্য নতুন অনুভূতি সৃষ্টি করেছে? এ জগতে তো নিত্য কতই মিরাকেল ঘটনা ঘটে! হলো নাহয় আরো একটা! ক্ষতি কি?”

নাহ আর ভাবতে পারছে না! শরীর অবশ হয়ে আসছে।

লেখা – কাজী সানজিদা আফরিন মারজিয়া

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “অনুভূতি – বেদনার কিছু গল্প কিছু কথা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – কথা বলাটা আর হল না – মনের বেদনার গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *