বাবার সাথে রাগ করে মা বিকালে নানার বাড়ি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বাবাকে বললেন,
“সংসার যেহেতু তোমার, তুমি চালাও। আমি বাপের বাড়ি গেলাম।”
বাবাও রাগ দেখিয়ে বললেন,
“যাও, যাও। হারাদিন কী এমন কাম করো দেহা আছে আমার। এইটুকু আমি দোকানদারির ফাঁকেও করতাম পারমু।”
আমার দিকে ইশারা করে মা বললেন,
“রিফাত, তোর বাপে যেন আমারে আনতে না যায়। এই বয়সে আমার বাপের বাড়ি গিয়া নাটক না করলেও চলব।”
বাবা আবার আমাকে ইশারা করে বললেন,
“তোর মা চাইতাছে আমি যাতে পাও ধইরা যাওয়া আটকাই, যাইতাম না আনতাম।”
মা বেরিয়ে গেলেন নানার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পাশের গ্রাম। বিশ মিনিট লাগে হেঁটে যেতে। মা এর আগেও কয়েকবার রাগ করে নানার বাড়ি গিয়েছেন। পরদিন সকালেই বাবা আনতে যান মা’কে। আমি জানি এবারও বাবা কালই মা’কে আনতে নানার বাড়ি ছুটবেন।
আমার বাবা আর মা একজন আরেকজনকে অনেক ভালোবাসেন। তাদের প্রেমের বিয়ে। মায়ের কাছে শুনেছি, বিয়ের আগে বাবা নানার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতেন মায়ের সাথে দেখা করার জন্য। নানা একদিন ধমক দিয়েছিলেন বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করার জন্য। বাবা সেই রাগে রাতের বেলা নানার বাড়ির খড়ের গাদায় আগুন দিয়েছিলেন। নানা বুঝতে পেরেছেন এই কাজ কার দ্বারা সম্ভব। দাদা তখন বেঁচেছিলেন। নানা এলেন আমার দাদার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। দাদাকে বললেন,
“আমার মাইয়ারে পুতের বউ কইরা লইয়া আইয়েন। আম্নের পুতে আইজ কুটাপাড়ায় আগুন দিছে, দুইদিন পরে আমার বাড়ি ঘর জ্বালাইয়া দিব।”
আমি বড়ো হয়েছি। বড়ো আপুর বিয়ে হলো। এখনো বাবা মায়ের খুনসুটি আর ঝগড়া থামে না। তবে আজ অবধি বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলেননি। তাদের ঝগড়া মুখেই। তবে প্রতিবারই বাবা ঝগড়ায় জিতলেও আবার নিজে হেরে গিয়ে মা’কে আনতে যান নানার বাড়ি। নানা এখনো বেঁচে আছেন। শেষবার যখন বাবা নানার বাড়ি মা’কে আনতে গেলেন, মা কিছুতেই আসবেন না। শেষে নানা অনুরোধ করে মা’কে বললেন,
“নিতো আইছে, যা। কুটাপাড়াত আগুন দিছিলো মনে নাই? তহন তো কইছস তোর লাইগ্যা সব করত পারব। এহন এত রাগ কইত্তে আইয়ে?”
মা নানার সাথে রাগ দেখিয়ে বলেছিলেন,
“থাকতাম না তোঙ্গো বাড়ি। গেলাম গা।”
আমি জানি, বাবা যদি নানার বাড়ি যায় মায়ের রাগ তখন পানি। বাবার সাথেই চলে আসেন। শুধু বাবা’কে চড়া গলায় বলেন,
“মাইয়া বিয়া দিছো, পোলা বড়ো অইছে। চক্ষে লাজ-শরম নাই কিছু? এহনও ঝগড়া করো কিয়ের লাইগ্যা?”
এবার বাবার রাগ দেখে মনে হচ্ছে বাবা নানার বাড়ি সহজে যাবেন না। আমি তো জানি, বাবার রাগ সকাল হওয়া অবধি স্থায়ী থাকে না।
রাস্তার পাশে বাড়ি হওয়াতে পাশেই আমাদের বড়ো একটি মুদি দোকান। অত্র এলাকায় আরেকটি টঙ দোকান থাকলেও বেচা-বিক্রি আমাদের দোকানেই বেশি। পশ্চিমের আকাশে সূর্য্য তলিয়ে সন্ধ্যার আগমন। বাবাকে দোকান বন্ধ করতে দেখে একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,
“কী ব্যাপার! এই সন্ধ্যাবেলা নানার বাড়ি যাচ্ছ না-কি?”
বাবা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। মনে হচ্ছে সব রাগ আমার উপরে ঝারবেন। দাঁতে কটমট করে বললেন,
“তুই তো তোর মা’র পক্ষ লইয়া কথা কস। হাস-মুরগী যে ডাকতাছে হুনছস? ঐগুলারে খোয়াড়ে দিতে পারলি না?”
আমি মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই বাবা শুরু করলেন। একবার হাঁসের দিকে গিয়ে ডাকেন,
“আয় তৈ তৈ, তৈ তৈ আয়।”
আরেকবার মুরগীর দিকে গিয়ে ডাকে,
“আয় তি তি, আয় আয়।”
আমার খুব হাসি পাচ্ছে। কিন্তু হাসতে পারছি না। এমতাবস্থায় আমার হাসি দেখলে বাবা আরও রেগে যাবেন। আমি পা টিপে টিপে ঘরে চলে গেলাম। বাবার গলা তখনো শোনা যাচ্ছে,
“আয় তৈ তৈ, আয় তি তি।”
পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্য উদয় হলো বহু আগে। বাবা দোকান খুলে বসলেন। আমি পান্তাভাত খেয়ে নিলাম। গতকাল মা দুপুরে রান্না করেছিলেন দুই বেলার। মা বাড়িতে না থাকায় রাতে খাননি। ভাত বেঁচে যাওয়াতে বাবা ভাতে পানি দিয়ে রেখেছিলেন। গরমের দিন সকালবেলা পান্তাভাত খেলে সারাটাদিন শান্তি শান্তি লাগে। বাবা দোকানে বসে রুটি কলা খেয়ে নিলেন। আমাকে ডেকে বললেন,
“রিফাত, দোকানে আইয়া বস তো একটু।”
আমি মুচকি হাসলাম। বাবা মনে হয় নানার বাড়ি ছুটবেন মা’কে আনতে। আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বললেন,
“কয়ডা বাজার কইরা আনি। আইজগা আমি রানমু। খাইয়া দেহিস কত মজা। বেডি মাইনষের চাইতে ভালা রানতাম পারি।”
বাবা ছুটলেন বাজার করতে। আমি চুপচাপ আছি। বাবা-মায়ের মিষ্টি ঝগড়া আমি বেশ উপভোগ করি। সেই ঝগড়ায় আমি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করি। আমি বড়ো হয়ে কখনো বাবাকে রান্না করতে দেখিনি। একবার মা অসুস্থ হয়ে পড়াতে বাবা গিয়ে আপুকে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসলেন। তবুও নিজে রান্না করেননি। আজ বাবা রান্না করার মনস্থির করলেন। বাজার নিয়ে ফিরলেন বেলা এগারোটার দিকে। দোকানে উঁকি দিয়ে আমাকে বললেন,
“কেউ আমার কথা জিগাইলে কইবি হাঁটে গেছি। আমি রানতাম যাই।”
আমার আজ এত হাসি পাচ্ছে। আবার মনটাও কেমন করছে। মা নিশ্চয় ভেবে বসে আছেন প্রতিবারের মতো বাবা আনতে যাবেন। কিন্তু বাবা না গিয়ে রান্নার আয়োজন করছেন। ইচ্ছে করছে আমি গিয়ে মা’কে নিয়ে আসি।
বাবা এলেন একটু পর চোখে পানি নিয়ে। আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাবা বললেন,
“দেশী পিঁয়াইজে ধাক অনেক। চক্ষেদা পানি বাইর কইরা ছাড়ছে। কয়ডা শুকনা মইচ দে। মইচ বাটা নাই।”
-বাবা থাক এইসব। বহুত হইছে। মারে গিয়া লইয়া আইয়ো।
-চুপ কর। কইছি না আমি যাইতাম না। পরতেক বার যাই দেইখ্যা? এইবার আর যাইতাম না।
বাবা আবারও ছুটলেন রান্নার উদ্দেশ্যে। আমি দোকান থেকে বের হয়ে ডানে বামে একবার তাকালাম। দুপুরবেলা দোকানে কাস্টমার কম আসে। সূর্য মাথার উপরে। মানুষজন গাছতলায় গিয়ে বসে একটু বাতাসের আশায় গা জুড়ানোর জন্য। বাড়ির সাথে লাগোয়া দোকান। আমি রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম। বাবা পাটায় শুকনো মরিচ, রসুন পিষে চলেছেন। আমাদের দোকানেই মরিচের ফাঁকি আছে। কিন্তু মা বাটা মশলা ছাড়া কখনো রান্না করেন না। বাবাও সেজন্য মশলা বেটে চলেছেন এক এক করে।
দাদা বলতেন,
“তিন মাথা এক জায়গায় কইরা যেকোনো কাম আগায় বেশি।”
তিন মাথা বলতে দাদা বুঝিয়েছিলেন, দুই হাঁটু আর মাথা। এমনভাবে বসা, দুই হাঁটু মাথার সাথে থাকবে। এই হলো তিন মাথা। এভাবে কাজ করলে কাজের অগ্রগতি হয় বলে দাদার ধারণা ছিল। বাবা তিন মাথা একত্র করে কাজে মনোযোগী হলেন। চূলায় ভাত বসানো। ভাত রান্না করা খুবই সোজা, আমিও রান্না করতে পারি। কিন্তু তরকারিতে মশলার পরিমান কতটুকু দরকার তা ঠাহর করতে পারি না। বাবা হঠাৎ চমকে উঠলেন। বসা ছেড়ে উঠলেন। আমি দ্রুত পায়ে দোকানের কাছে চলে গেলাম। বাবা আমাকে ডেকে বললেন,
“রিফাত, হাস-মুরগী ছাড়তে হইবো না? দুপুর হইলো। কৎকৎ কইরা ডাকতাছে হুনোস না?”
বাবা রান্না রেখে হাঁস-মুরগী ছাড়তে গেলেন। হাঁস মুরগী ছাড়ার সময় দুয়েকটা বের হতে চায় না। লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে বের করতে হয়। বাবা উঁকি দিয়ে লাঠি দিয়ে হাঁস-মুরগী বের করার সময় আমাকে আবার ডাকলেন,
“রিফাত, চূলায় ভাত। আগুনডা কমাইয়া দে।”
আমি দৌড়ে গিয়ে লাকড়ি কিছুটা বের করে নিলাম চূলার মুখ থেকে। বাবা এসে বললেন,
“দোহানে যা। পোলাপাইনে নিবো গা সব।”
দোকানে গিয়ে চূড়ান্ত অবাক হলাম। মা ফিরে এসেছেন। আমি মা’কে দেখে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করলাম। আমাকে মা জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর বাপে কই?”
-রান্ধে।
-কী কস? হাত পাও পুঁড়ব।
মা কথাটুকু বলে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। আমি মায়ের পিছুপিছু। রান্নাঘরের দরজায় আমি আর মা দাঁড়ানো। চূলা নিভে গেছে। বাবা নিচু হয়ে চূলায় ফুঁ দিচ্ছে আগুন ধরানোর জন্য। ধোঁয়া কুণ্ডুলি পাকিয়ে উপরে উঠতে লাগল। খুক খুক করে দুইবার কাশতে গিয়ে বাবার চোখ দরজার দিকে। মা’কে দেখে অবাক হলেও তিনি যে খুশি হয়েছেন তা চেহারা দেখলেই বুঝা যায়।
“হে হে, থাকতা পারছ না! কইছি না আমি এইবার যাইতাম না। কী মনে করছ? তোমারে ছাড়া সংসার চলত না?”
-কিমুন চলতাছে হেইডা তো দেখতাম ঐ পারতাছি। বাইর হও এহান থেইক্কা। তরকারিত ধোঁয়ার গন্ধ কইবো। ঢাকনাও দেয় নাই।
বাবা কিছু না বলে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আমাকে বললেন,
“দোহান খুইল্লা আইয়া পড়ছোস। এনো কি সিনেমা চলতাছে?”
-দোহান বন্ধ করছি।
-দেখছসনি, তোর মায় আইয়া পড়ছে। কইছি না এইবার যাইতাম না আনতাম!
মা রান্নাঘর থেকে বললেন,
“আমি না আইলে খুশি আছিলা? আরেক বেডি বাইত আনার শখ আছিলো? পরতেকবার আনতে যাও, এইবার গেছো না। মনে করছি বাইত অসুখ-বিসুখ হইলোনি। হের লাইগ্যা আইছি।
-এহন তো দেখছ অসুখ-বিসুখ নাই, আবার যাওগা।
-পোলারে ঘাস খাওয়াইতা? যাইতাম না আমি। এইডা আমার সংসার। তুমি যাওগা।
-হুনছসনি রিফাত? কালকা কইছে আমার সংসার আমারে দিয়া গেছেগা। আজগা কী কয়!
আমি এবার মুখ খুললাম। বললাম,
“কী শুরু করছ তোমরা? এইবার কইলাম আমি যামুগা। পরে শান্তিতে থাহো দুইজনে। পরে হারাদিন কাইজ্জা লাগো।”
এবার দু’জনের মুখেই তালা। কেউ কোনো কথা বলছে না। আমি রাস্তার দিকে বের হওয়ার সময় বাবার গলা শোনা গেল।
“সহালে খাইছোনি কিছু? আমি কইলাম রুডি-কলা খাইছি।”
-তোমার পেডে খাওন গেলো কেম্নে? আমি তো রাইতেও কিছু খাইছি না।
আমি আর দাঁড়াইনি। পথে বেরিয়ে গেছি। দু’জনে ঝগড়া করে একটা দিনও থাকতে পারে না। তবুও খুনসুটি লেগেই থাকে। আমার কোনো প্রেম-ভালোবাসার মানুষ নেই। ভয় লাগে। বাবা রান্না করার সাহস করেছেন আজকে। কিন্তু আমি তো রান্নাও পারি না। বিয়ের আগে রান্না শিখাটা জরুরী। অন্তত ঝগড়া লাগলে না খেয়ে থাকতে হবে না।
…সমাপ্ত….
গল্প: সংসার
ওমর ফারুক শ্রাবণ
আরো পড়ুন – জীবনের রংধনু – স্বামী স্ত্রীর সংসারের গল্প