প্রথম প্রেম – ব্রেকাপের পর এক্স প্রেমিকার সাথে বিয়ের গল্প: আজ আমাকে ছেলেপক্ষরা দেখতে এসেছে। আমার বড় আপা যত্ন করে আমায় সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করে ছেলেপক্ষের সামনে নিয়ে এসেছে। ছেলে আসার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। ছেলে যদি আমাকে পছন্দ করে তাহলে আজই বিয়ের পর্বটা শেষ হয়ে যাবে।
বিয়ে ও আমি
বাবা আমার স্টেশন মাস্টার। আমরা চার বোন। আমিই সবার ছোট। আমার বিয়েটা হয়ে গেলে, কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার খাতা থেকে বাবার নামটা কেটে যাবে। লোভী ঘটকদের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যাবে এই বাড়িতে। পরিবারের খরচ কিছুটা কমে যাবে। যদিও আমার বিয়ের দকল কাটিয়ে উঠতে সময় লেগে যাবে বহুদিন।
কুষ্টিয়া রেলস্টেশনের পাশেই আমাদের বাড়িটা। মায়ের পৈত্তিক সম্পত্তি বিক্রি করে আর বাবার কিছু জমি বিক্রি করে আমি হওয়ার আগেই এই বাড়িটি করা হয়েছে। স্টেশনের আশেপাশে আগে পাকা বাড়ি বলতে আমাদের বাড়িটাই ছিল। এলাকার মানুষরা আমাদের দালান বাড়ির মেয়ে বলে ডাকত।
বাহিরে ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই ভেতর ভেতর বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি ভাবছি যদি ছেলে এসে আমাকে অপছন্দ করে তাহলে এমন ঝুমঝুম বৃষ্টিতে পরিস্থিতিটা কি দাঁড়াবে! আমার বাসার সবার উপর আকাশ থেকে বিজলী বিচ্ছুরিত হবে। আর ছেলেপক্ষ অপ্রস্তুত হয়ে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াবে।
রাত আটটা বেজে গেল। ছেলের সাথে এখনও দেখা নেই। মফস্বল শহরের গ্রাম অঞ্চল ঝড় বাদলের দিনে বিদ্যুত একবার চলে গেলে এদিকটায় এক দুদিন আর বিদ্যুতের দেখা মিলে না। বাহিরে বৃষ্টির ভাবটাও তীব্র হয়ে উঠেছে। যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে রাস্তাঘাটে পানি জমে যাবে মনে হচ্ছে। সারা বাড়িটা পোলাও রোস্টের গন্ধে মৌ মৌ করছে। বাড়িটা জুড়ে কেমন একটা আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করছে।
ছেলের নাকি ঢাকাতে একটা মিটিং ছিল। কাল ঢাকাতে গিয়েছে। ওখান থেকে আজ এখানে চলে আসার কথা। ছেলের দেরি দেখে বাবা মা দুশ্চিন্তায় পরে গেছেন। কিন্তু ছেলেপক্ষকে একদমই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তারা বসবার ঘরে বসে জমিয়ে খোশগপ্প করছে। তাদের সাথে আসা বাচ্চাকাচ্চাগুলো ঘর মাতিয়ে রেখেছে। মহিলারা এ রুম ও রুমে অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি বারান্দায় বসে কয়েকগজ দূরে রেললাইনটার দিকে তাকিয়ে আছি। সবাই হয়ত ভাবছে আমি ছেলের জন্য পথ চেয়ে আছি। আসলে ভেতরে কোথাও বসার জায়গা নেই দেখে বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। আর কারোর জন্য পথ চেয়ে থাকার ব্যাপারটা সাত বছর আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
প্রথম প্রেমের গল্প
সাত বছর আগে আমি যখন কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে ইন্টার সেকেন্ডিয়ারে পড়তাম। তখন রোহানের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল কলেজের একটা অনুষ্ঠানে। রোহান আমার তিন বছরের সিনিয়র ছিল। তারপর পরিচয় থেকে পরিণয় হলো। এরপর পরিণতি হলো দুজনের বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদটা হয়েছিল রোহানের কারণেই।
রেলের ঐ রাস্তাটা ধরে শেষ বিকেলে রোহানের হাত ধরে কত হেঁটেছি। আগে রেলের দুইপাশে এত বাড়িঘর ছিল না। গাছগাছালিতে ভরা সবুজের মনোরম শোভা ছিল চারিদিকে।
আমি যখন স্বপ্নের আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে উড়ে স্বপ্ন ছুঁয়ে বেড়াই রোহানকে নিয়ে। ঠিক তখনি একদিন চৈত্রের ঘুঘু ডাকা বিষন্ন দুপুরে রোহান বলে দিল তারপক্ষে আর সম্পর্কটা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সম্পর্ক থাকলে তার ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব হবে না। বহু বোঝানো বহু মিনতির পরও রোহান সিদ্ধান্ত থেকে টলেনি। অবশেষে নিজের মনটাকে বুঝালাম আমার মত স্টেশনমাস্টারের মেয়েকে হয়ত রোহানের মতো প্রফেসরের ছেলে কখন ভালোই বাসেনি। রোহানের বাবা বদলি হয়ে ঢাকাতে চলে গেল। তারপর থেকে রোহানের কোন খবর আমি জানি না। আজও আমি চোখ বন্ধ করলে চোখের সামনে আমাকে ফেলে রেখে রোহানের চলে যাওয়াটা পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠে।।
ঘড়ির কাঁটার সাথে বাবার দুঃচিন্তা পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে। গ্রামাঞ্চল এত রাতে যদি ছেলে না আসে বা এসে বিয়ে না করে উঠে যায়, তবে লজ্জা শরমে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।
রাস্তায় একটু একটু পানি জমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষন নেই। বাসার সামনে একটা প্রিমিও গাড়ী এসে থামল। রাস্তায় জমে থাকা পানির উপর একটা লম্বাটে ছায়া পড়ল। একটা সুঠাম দেহের মানুষ। তাহলে এই কি সেই! যার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ করে রোহানের জন্য মনটা কেমন অস্থির লাগছে। সেদিনের পর রোহান আর কোনদিন যোগাযোগ করেনি। তাই জানি না সে কেমন আছে কোথায় আছে?
হারানো প্রেমিক যখন বর
বড়আপা এসে আমায় ভেতরে নিয়ে গেল। আমায় আরেক দফা সাজের ফিনিশিং টাচ দিয়ে দিল। আর বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে আমায় ফুঁ দিয়ে দিল যেন আমায় পছন্দ করে। বড়পা আমায় ধরে নিয়ে আগাচ্ছে আমার পা একদম আগাচ্ছে না এতোগুলো দিন শেষে আজ রোহানের দেখানো স্বপ্নগুলো বড্ড বেশী নাড়া দিচ্ছে আমাকে। একবার বড় আপাকে বলতে ইচ্ছে হলো আমি বিয়ে করব না।
বসার ঘরে ডুকতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। এতক্ষণ অপেক্ষা করা ছেলেটি আর কেউ নয় সাত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আমার রোহান। রোহান বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
আমি মাথা নীচু করে বসে রইলাম। আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপতঙ্গ বোধহীন হয়ে গেল। হঠাৎ কেমন শীত শীত লাগছে। ভয় হচ্ছিল রোহান বিয়েতে অমত করবে বলে।
সবাই রোহানকে বলল মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিনা। সে খুব জোরে বলল- আলহামদুলিল্লাহ্।
আমার আর রোহানের বিয়ে হয়ে গেল। আমার অনুভূতিগুলো যেন সব স্থির হয়ে গেল। বিয়ের পড়ানোর পর অনেক বলার পরও রোহান বাসাতে থাকতে রাজী হলো না। বলল একেবারে অনুষ্ঠানের পর থাকবে। এক সপ্তাহ পর অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করা হলো।
রোহানরা চলে যাচ্ছে। সবাই বিদায় নিয়ে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে।
এতক্ষণ রোহান আর আমার মাঝে কোন কথা হয়নি। হঠাৎ ঘরভর্তি মানুষের সামনে রোহান আমার মাথায় হাত দিয়ে মুচকি হেসে বলল “আসছি”। আমার স্থির তবে অনুভূতিগুলো সব অস্থির হয়ে উঠলো।
ইচ্ছে হলো নায়িকাদের মতো বলি… যেও না সাথী ও ও ও।
রাত তিনটে বেজে গেল ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় হাত পা ছেড়ে দিলাম। আমার ব্যক্তিগত ড্রয়ার খুলে সাদাটেপে মুড়ানো শপিং ব্যাগটা খুললাম। খুলে সাত বছরের পুরানো রোহানেরটি শার্টটা বুকে চেপে ধরলাম। যখন রোহান আমার প্রেমে বিভোর তখন ওর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। কোন কারনে যদি দেখা হতে দেরি হত বা ওকে মিস করতাম তখন টি শার্টটা নাকে চেপে ধরে ওর গায়ের গন্ধ নিতাম। রোহান আমার একটা ওড়না চেয়ে নিয়েছিল। ও ঠিক একই কাজ করত।
ব্রেকাপ থেকে বিয়ের পরের গল্প
আমি আজ অনেকদিন পর টি শার্টটা বুকে চেপে ধরেছি। আমি আসলেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার বিয়ে আমার প্রথম ভালোলাগা ভালোবাসার মানুষের সাথেই হয়েছে। একি মিরাক্কেল নাকি স্বাভাবিক ঘটনা। সহস্র প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনে।
আলতো আলতো ঘুম লেগে এসেছে চোখে। মোবাইলের ভাইবেশনের ভোঁ ভোঁ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
অজানা নাম্বার রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না।
তারপর একটা মেসেজ এলো। দয়া করে ফোনটা ধর। আমি তোমার হ্যান্ডসাম।
হ্যান্ডসাম শব্দটা শুনতে শরীরের রক্ত চলাচল বেড়ে গেল। প্রেমের সময় আমি রোহানকে কখনও নাম ধরে ডাকিনি। মাই হ্যান্ডসাম বলেই ডাকতাম।
ফোন রিসিভ কররলাম।
বউ, কেমন আছ?
আমি কিছুই বলতে পারছি না। যদিও বউ ডাকটা রোহানের মুখে নতুন নয়। প্রেমের পুরোটা সময় জুড়ে আমাকে রোহান কখনও নাম ধরে ডাকেনি। বউ বলেই ডাকত।
সাত বছর পর এই ডাক শুনলাম অথচ একটু অচেনা মনে হয়নি। আমার চোখ থেকে গরম জল গড়িয়ে পড়ল।
কি, কথা বলবে না। সাত বছর আগের কষ্ট এখনও পুষে রেখেছ। ভুলে যাও সব। কাল সারাটা দিন আমরা একসাথে কাটাব। সকালে রেডি থেকো। আমি এসে নিয়ে যাব।
বাসার সামনে সাদা প্রিমিও গাড়ীটা থেকে নেমে রোহান উপরে তাকিয়ে হাসছে। আমি বড় আপার সাথে বারান্দায় দাড়িয়েছিলাম। বড় আপা ওকে দেখে বলল “দেখ কেমন হাসি দিয়েছে? মনে হয় তোকে কত চেনে।”
আমি নিচে নামতেই গাড়ীর দরজা খুলে দিয়ে বলল “ম্যাম আজ আমার এই গাড়ী ধন্য হলো।” এক হাতে গাড়ী চালাতে চালাতে আরেক হাতে আমার হাতটা বুকে চেপে ধরে রোহান বলল “বউ নিয়তি সব সময় নিষ্ঠুরতা দেখায় না। নিয়তিও মানুষকে ভালোবাসে।” কারো কারো প্রতি কখনো কখনো নিয়তি অনেক সদয়।
মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা কিছু প্রশ্নের উত্তর আর জানতে চাইলাম না। রোহানের কাঁধে মাথা রেখে আমার প্রথম প্রেম নিজের করে পাওয়ার সুখটা অনুভব করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।
আরো পড়ুন- সত্যিকারের ভালোবাসা বোঝার নিনজা টেকনিক