শেষ বিকেলের রোদ – Bangla premer golpo: আমি তোকে ভালোবাসি তো? ভালোবাসার মানবী আমার কাছে সবসময় অচিনপুরের শেহজাদী! যেমন তুই এখন সে জায়গাটা দখল করে নিয়েছিস!
পর্ব ১
‘এই আহির! তুই আমায় যে সারাদিন জ্বালাস আমি কিন্তু ফুপিকে সব বলে দিবো!
আমি কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে বললাম, কোথায় জ্বালিয়েছি? আপনি আমার বইটা নিয়ে লুকিয়ে রেখেছেন কেন?
একশো বার লুকোবো। সারাদিন পড়তে পড়তে এই ষোলো বছর বয়সেই মোটা ফ্রেমওয়ালা দাদীর চশমা চোখে ঝুলায়া বসে আছিস! সুন্দরী চেহারাটা পুরা চশমার আড়ালে ঢেকে গেছে!
উনার মুখে একথা শুনে ড্যাবড্যাব করে বোকার মতো উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এই! তুই কী ট্যারা? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
আপনাকে দেখছি!
উনি ভাব নিয়ে বসলেন। সিল্কি কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো ফু দিয়ে বললেন, দেখ দেখ আমার মতো ড্যাশিং ছেলে আর ক’টা আছে এই এলাকাতে? তোর ক্লাসের সবগুলো মেয়ে আমায় দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। ওইদিন তো সিমি নামের মেয়েটা আমায় একটা প্রেমপত্রও দিয়েছিলো।
আমি অবাক হয়ে বললাম, সিমি! ওই ক্লাস সেভেনে পড়া সিমি?
হুম। তুই ভাবতে পারিস আমি পড়ি কলেজে আর ওই পুচকি আইসা কীভাবে আমায় প্রেমপত্র দিয়ে গেলো?
আপনি ও তাতে তাল দিয়েছেন, তাই না? নইলে ও এতবড় সাহস পেত না। যেখানে আপনাকে সবাই ভয় পায়
মানে? তুই বলতে চাইছিস আমি ওকে উস্কানি দিয়েছি? তোর আমাকে এতোটা নিচু মনে হয়?
নিচুদের তো নিচুই মনে করবো, তাই না মৃন্ময় ভাইয়া?
তুই আবারো আমায় ভাইয়া বলছিস? (রেগে)
ভাইয়াকে তো ভাইয়াই বলবো, তাই না?
এইভাবে কথা কাটাকাটি করে একসময় আমরা দু’জন ঝগড়া লেগে যেতাম। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতাম না। যে যাকে যতভাবে পারি পচিয়েই ছাড়তাম। সাদা ভূত, গুন্ডা, বখাটে এই তিনটা ওয়ার্ড ছাড়া আর কোনো
গালাগালি আমি জানতাম না। এই ওয়ার্ডগুলো ওনার উপরই প্রয়োগ করতাম!
কিন্ত আজ? আজ পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। দু’জন দুজনের কাছ থেকে অনেক দূরে। এককথায় যোজন যোজন মাইল দূরে! উনি দূরে যাওয়ার পর থেকে প্রতিটা দিনই আমার পালটে গেছে। এখন একেকটা দিন নিত্যনতুন কষ্ট নিয়ে আসে!
‘দিনগুলো এমন কেন? একেকটা দিন একজীবন কষ্ট নিয়ে আসে। প্রত্যেকটি রাত একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে হাজির হয়। চারিপাশ নীরব -নিস্তব্ধ! যেন কেউ নেই।
কেমন একটা অদ্ভুত মূহুর্ত, বিষাদময় জীবন। বুঝতে পারি না এমন কেন হয়, কেন হচ্ছে? বুকের ভেতর কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্ত মস্তিষ্ক সেটাকে থামিয়ে দেয়। চুপচাপ বসে থাকাটাই শ্রেয়, এটাই যেন নিয়তি!
বিকেলবেলা। বসে বসে হুমায়ূন আহমেদের ‘বৃষ্টিবিলাস’
নামক উপন্যাসটি পড়ছিলাম। অলস বিকেল কাটানোর এই একটা কাজ আমি খুব মনোযোগের সাথে পালন করি। ঠিক তখনই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, ‘ফিউচার সাহিত্যিকা, কেমন আছেন?’
চমকে পেছনে তাকালাম, ‘কে?’
আড়াল থেকে আবারো কে উত্তর দিলো, ‘আমার সাথে বৃষ্টিবিলাস করবেন না?’
অচেনা কারো মুখে এই কথাটা শুনে আমি খুবই অবাক হলাম! বুকের ভেতর আটকে রাখা মনপায়রাটা ডানা মেলে উড়াল দিলো আকাশে।
‘কী? কিছু বলছেন না যে?’
অচেনার কথায় আমার ঘোর কাটলো! ঘন পাপড়িযুক্ত চোখ ফিরিয়ে লোকটাকে দেখে অবাক হলাম!
আপনি? কে আপনি?
ওহহএত সহজেই আমাকে ভুলে গেলে?
ভনিতা না করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন!
আমি? আমি আপনার এক পরিচিত!
কিন্তু আপনাকে চিনি বলে মনে হচ্ছে না আমার!
কীভাবে মনে থাকবে? ছোটবেলার কথা কী আপনার মতো ‘ফিউচার সাহিত্যিকার’মনে থাকবে?
কাটাকাটা গলায় বললাম, ‘কে আপনি?’
অচেনা এবার হু হা করে হেসে উঠলো। বললো, সিরিয়াসলি আহির? তুই আমায় চিনতে পারিসনি?
লোকটার মুখে নিজের নাম শুনে অবাক হলাম! চিন্তিতমুখে বললাম, ‘মৃন্ময় ভাইয়া?’
এতক্ষণে চিনলি তাহলে?
আমি মুখে হাসির রেখা টেনে বললাম, আপনার মতো বড় মাপের লোক যে আমার সামনে বসে আছে তা আমি
আর ভাবতে পারিনি!
উনি বাঁকা হাসি হেসে বললেন, তাই? কেন?
হুম। আপনার বেশ-ভূষা, পোশাক, আচার-আচরণের মধ্যে আপনার উচ্চশিক্ষা ও জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ পাচ্ছে না যে!
আচ্ছা, বাদ দে!
হুম। কবে ফিরলেন দেশে?
আজ!
অবাক গলায় বললাম, আজ?
হুম। এসেই সবার সাথে দেখা করে সোজা সবাইকে নিয়ে তোদের বাসায় চলে এলাম।
কেন?
কতদিন দেখি না তোকে? কতদিন হতে চললোতুই তো চিনলিই না! ঝগড়া না করতে পেরে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল, তাই ঝগড়া করতে চলে এলাম!
আপনি সেই পাগলই রয়ে গেলেন! মোবাইলে মাঝেমধ্যে কথা বলতেন কিন্ত ভিডিও কল কখনো দেননি, তাই হঠাৎ করে চিনে উঠতে পারিনি। আগের থেকে বেশ সুন্দর হয়ে গেছেন!
তুই তো আগের মতোই চশমা পড়ে সাহিত্যিকা রয়েই গেলি!
দেখেন, মোটেও খ্যাপাবেন না আমায়!
খ্যাপাচ্ছি কই? তোর মন ভালো করার চেষ্টা করছি। আজকাল তো তুই অলওয়েজ মুড অফ রাখিস! কীসব ভাবিস বল তো? প্রেমেটেমে পড়েছিস নাকি? নাকি ছ্যাকা খাইছিস?
স্টপ ইট ভাইয়া! আপনি এসব কী বলছেন?
ভাইয়া বলছিস কেন? আমি তোর কোন জন্মের ভাই?
শুরু হয়ে গেল উনার পকপকানি! সেই ছোটবেলার মতোই ঝগড়াঝাটি। ভেবেছিলাম এত বছর পর দেশে ফিরেছে, তাই ওসব ভুলে গেছে। কিন্তু না সামান্যতম বদল ঘটেনি ওনার। আমিও কম না। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিলাম। হাজারো কষ্ট যেন ওনার আগমনে চাপা পড়ে গেলো।
সবসময়ই উনার সাথে আমার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। দুজন দুজনকে কীভাবে খোঁটা দিয়ে কথা বলবো তাতেই ব্যস্ত। ঠিক ছোটবেলার মতো!
আপনি আমার এই জন্মের ভাই।
উনি রেগে বললেন, থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো। তোর নিজের ভাইকে ভাই বল, আমায় না!
তাহলে আপনি ও আপনার বোনের সাথে ঝগড়া করুন, আমার সাথে না। ভাব নিয়ে বললাম।
শোন আমি তোর সাথে ঝগড়া করছি না। (হতাশ কন্ঠে)
ঝগড়া করছেন না তাহলে কী আমার সাথে মিষ্টিমধুর বাক্যালাপ করছেন? আচ্ছা, আপনার মাথার প্রবলেমটা কী এখনো যায়নি? নাকি আগের চেয়েও বেশী?
শোন তোর এইসব ফাউল কথাবার্তায় আমি কান দেই না, যত্তসব! এই এই তোর ওই মোটা কিটকিটে চশমাটা এখনো পড়িস? কেন রে চোখে কিছু দেখতে পারিস না কানাই রয়ে গেলি? (সন্দেহ নিয়ে)
আমি রেগে বললাম, আমি মোটেও কানা না। চশমা পড়লেই কেউ কানা হয়ে যায় না। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে!
আর তোর কারণ হচ্ছে বই! বই পড়তে পড়তে এক্কেবারে চোখের তেরোটা বাজিয়ে ফেলেছিস! আবার আমাকে বলছিস যে, আমার মাথায় প্রবলেম! তোর আসলে অনেক প্রবলেম
আরে আজব তো! আপনি কিন্তু অনেক বাড়াবাড়ি করছেন! সবসময় আমার পেছন লাগার স্বভাব এই বুইড়া বয়সেও যায়নি। ফাউল লোক এক
এটুকু বলতেই কানে এলো আম্মুর ডাক। ডাকাডাকি করে পুরো বাসা ফাটিয়ে দিচ্ছে!
পর্ব ২
‘কী এভাবে ডাকছো কেন? তোমার ভাইয়ের ছেলে যে সূদুর অস্ট্রেলিয়া থেকে আসলো, আমাকে জানালেই না?
তোকে জানাবো কেন? আমার ভাইয়ের একমাত্র ছেলে সে আসছে না আসছে তোকে বলবো কেন? তুই কী প্রধানমন্ত্রী? (আম্মু ঝাঁঝের সাথে বললো)
ওহহভাইয়ের ছেলেই সব! আর আমরা, আমরা ভাই-বোনেরা তোমার কাছে কাজের লোক? তো কাজের মেয়েকে এত ডাকাডাকির কারণটা দয়া করে বলবেন কী আম্মাজান?
তুই আবার আমার সাথে বেয়াদবি করছিস? (রেগে)
বেয়াদবি না আম্মাজান! আপনার হুকুম শোনার আশায় কান পেতে বসে আছি! দয়া করে বলুন!
তুই আমার ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে এতবড় কথা বলেছিস যখন তখন এর শাস্তি হলো, তুই কোনো সাহায্য করবি না আমায়!
আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। আম্মুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুমে চলে আসলাম। এসে দেখি, মৃন্ময় ভাইয়া ‘বৃষ্টিবিলাস’ বইটি নিয়ে বসে আছেন। মুখ থমথমে কিছু কী হয়েছে, আপনার?
উনি জবাব দিলেন না!
কথা বলুন! নাকি বোবা হয়ে গেলেন? (সন্দেহ নিয়ে)
এই ডেয়ারিং মেয়ে! তুই আমায় বোবা বললি? (রেগে)
ওহহহমুখে খই ফুটলো তাহলে?
কী বললি? (ভ্রু নাচিয়ে রেগে)
আরেআপনি কালা নাকি? এতক্ষণ যাবৎ ডাকছি আপনি উত্তর দিচ্ছিলেন না কেন? কথায় বলে ‘ভালোর কোনো দাম নেই’। ভালো করে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বললেন না, যেই বোবা ডাকলাম এমনি শুনে ফেললেন? আজব!
তোর আজ কী হাল করি, দেখিস!
আজব! কী করলাম আমি?
তুই এত পড়িস কেন?
তাতে আপনার কী?
এইজন্যই তুই এতদিন গোমড়া মুখ করে ঘুরতি, তাই না?
আজব! বই পড়ে আবার গোমড়া হওয়া যায় নাকি?
ডেফিনেটলি হওয়া যায়।
যেমন?
যেমন, তুই!
আমি? আমি কী? (অবাক হয়ে)
দেখ, এই ‘বৃষ্টিবিলাস’ বইটার লাস্ট অংশটা পড়লাম একটু! পড়ে আমার বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় শুরু হলো। কেমন কষ্ট কষ্ট অনুভূতি, তার মাঝে ভালোলাগার মিশ্র অনুভূতি! সবশেষে গল্পের নায়িকা ‘শামা’ একটা দারুণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে! তার চোখে জল এসেছে, এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার কারণেকেমন কঠিন এক সিদ্ধান্ত, দেখলি?
তাতে কী হয়েছে?
অনেক প্রবলেম!
আপনার এসব ফাউল কথা শুনার টাইম আমার নাই!
এইসব রোমাঞ্চকর কাহিনী পড়ে তুই এমন হয়েছিস, তাই না? (সন্দেহ নিয়ে)
এই আপনি এসব ফাউল কথা বন্ধ করুন তো!
তোকে দেখে নিবো আহির! আমায় পাত্তা না দেওয়া? (রেগে)
পরে দেইখেন! এখন আম্মু ডেকেছে, খাবার খেতে যান!
তোর মা? আমায় আবার জ্বালিয়ে খাবে! জানিস, আসার পর থেকে ফুপি বলে আমি নাকি শুকিয়ে কাঠ! কি খাই, কেন খাই, এত কম খাই কেন? আমার যত্ন কে নেয়! বাবারে বাবাএখন আবার খাওয়ানোর নামে অত্যাচার করবে!
আমি উনার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। আর উনি বেক্কলের মতো তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ করেই উনি একটানে আমার চশমা খুলে নিলেন!
আমি হাসি থামিয়ে’
পর্ব ৩
আমার চশমা দিন!
দেবো না! কী করবি তুই? (ভাব নিয়ে)
দিন বলছি! (রেগে)
খুব তো হাসছিলি! এখন হাস! হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়!
দেখুন!
কী দেখবো? যে তুই ট্যারা? আরে তোর বিয়ে দিতে তো অনেক প্রবলেম হবে! কী যে করিস না তুই!
আমি ট্যারা না!
ওহহতুই ট্যারা না? তাহলে চশমা চাইছিস কেন?
আমার চশমা আমি চাইবো না চাইবো সেটা আপনাকে জানাবো কেন? কে আপনি? যত্তসব ফাউল লোক!
তুই ফাউল! দেখিস!
কী দেখবো?
যখন সময় হবে তখন দেখবি!
আপনি যাবেন এখান থেকে? আজব প্রানী তো! (রেগে)
আহি, , , , রর, , , র, , , তুই আমায় প্রাণী বললি? (রেগে)
উনার রাগী চেহারা দেখার আগেই আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। দৌড়ে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে থাকা মামানির পাশে বসে পড়লাম। আমায় দেখে মামানি বললো, তো? এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
কোথায় আবার? রুমে বসে পড়ছিলাম, আর
আর?
আর এমনিই তোমার গুণধর ছেলে চলে এলো ঝগড়া করতে!
সেকী? এসেই ঝগড়া? (অবাক হয়ে)
আমার আম্মু নামক ব্যক্তিটি বললো, থাক না ভাবী। ছেলেটা কতদিন পর এলো। আর ঝগড়া আমার ভাইয়ের ছেলে করেনি। আমার ধ্যাড়ি মেয়েইই করেছে। ওর স্বভাব তো আমার অজানা নয়!
আহআহির ভালো মেয়ে। ও কখনো ঝগড়া করতে পারেনা। মৃন্ময় আমার ছেলে আমিই ওকে চিনি। ঝগড়া করতেই ও এসেছে। মামানির এককথা।
আম্মু যেরকম মৃন্ময় ভাইয়ার পক্ষে থাকে সবসময়। মামানিও তেমন সবসময় আমার পক্ষে থাকে। এই নিয়ে এখন আম্মু আর মামানি কথা বলছে, যে কে ঝগড়া করে, আমি না মৃন্ময় ভাইয়া?
ওদের কথা শুনে আমি এখান থেকে উঠে চলে এলাম। মামা আমায় ডাক দিয়ে বলল, কেমন আছো? হিয়া?
ভালো, তুমি?
আমিও ভালো। আমাদের বাসায় যাও না কেন? রাগ করেছ মামণি?
আরে বলে কী? দুদিন আগেই গিয়ে আসলাম আর বলে কী? মামা মামাণি সবসময় এমন। একদিন ওদের বাসায় না গেলেই হার্টফেল। আদিবাকে পাঠাবে বাসায়, আমাকে নেওয়ার জন্য!
আমিও বললাম, যাবো! আদিবা কোথায়?
ওদিকে হয়তো!
তাসমী, জেনিফা, আবির আসেনি? দাদীমা? ওরা আসেনি?
এসেছে! ভেতরে আছে সবাই!
আমিও যাই তাহলে মামু?
হুম যাও মামণি!
আচ্ছা!
আমি মামুর সাথে কথা বল ভেতরের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সামনে এসে দাঁড়ালো মৃন্ময় নামক ঝঞ্ঝাটটি। আমাকে দেখে বলল, এই! তোর হাইট এত কম কেন? আমি দেখ কত লম্বা!
লম্বা হলে তালগাছের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। আপনাকে ওখানেই মানায়, এখানে না।
আমাকে ইনসাল্ট? তুই বড্ড বাড় বেড়েছিস আহির!
আমিও চুটকি বাজিয়ে বললাম, তাই নাকি?
তুই আমার সামনে ভাব নিচ্ছিস? ট্যারা কোথাকার! (রেগে)
একশো বার ভাব নিবো।
আমার মাকে কিভাবে হাত করলি? ডাইনী মেয়ে!
আপনি আমার মাকে কীভাবে হাত করলেন? অসভ্য লোক!
কীহহহহ(রেগে)
আমিও বললাম, কীহহহহহ
ভেঙ্গাচ্ছিস আমায়?
ভেঙ্গাচ্ছিস আমায়?
উনি রেগেমেগে ফায়ার হয়ে বললেন, আহির!
আমি ভয়ে ফায়ার ব্রিগেডকে খবর দেওয়ার পরিবর্তে দৌড়ে গিয়ে মামানির পাশে বসে পড়লাম। যাক বাবা বেঁচে গেছি। মনে মনে দোয়া পড়ছি আর এমন সময়’
পর্ব ৪
তোকে যে কী করবো রে আহির, তা পরে টের পাবি! আমার মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠালো মৃন্ময় ভাইয়া!
যাকগে, পরে যা করার করবে। এখন নিশ্চিন্তে মামানিদের পাশে বসে ওদের গভীর আলাপ শুনছি! ওদের আলাপের প্রধান বিষয়বস্তু হলো, মৃন্ময় ভাইয়ার ছোটবেলার কাহিনী ! আমিও মনোযোগ দিয়ে সব শুনছি। একপর্যায়ে মামানি আম্মুকে আর খালামণিকে বললো,
জানো, মৃন্ময় ছোটবেলায় যা দুষ্টু ছিলো, একবার এক খৃষ্টান মেয়েকে দেখে বাসায় আসলো। দুদিন ছেলের মন খারাপ, ওর আব্বু গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে বাবা? মন খারাপ কেন? তোহ ও কী বলল, জানো?
আমি উৎসাহ নিয়ে মামানিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলল?
বলল যে, ওর নাকি ওই খৃষ্টান মেয়ে নাকি ওকে বকা দিয়েছে! আমি জিজ্ঞাস করলাম, কেন? তারপর বলল,
কী?
ওই খৃষ্টান মেয়েকে নাকি ওর খুব পছন্দ, মৃন্ময় নাকি ওই মেয়েকে বিয়ে করবে! তো মৃন্ময় ওইমেয়ের পিছু পিছু একদিন গীর্জায় পৌঁছলো আর সুযোগ পেয়ে ওই মেয়েকে প্রপোজ করলো, তাও জবা ফুল দিয়ে! আর ওই মেয়ে এই পিচ্চি ছেলের এসব কান্ড দেখে যতটা না রাগলো তার চেয়েও বেশি রাগলো গীর্জার বাগানের জবা ফুল ছেঁড়ার অপরাধে!
আমি হেসে মামানিকে বললাম, তাই? বেচারার মনটা ভেঙ্গে গেছে।
আম্মু আমার হাসি দেখে রেগে বলল, তুই হাসছিস কেন? আমার ভাইয়ের ছেলে রাগ করেছে, ওর মন খারাপ হয়েছে, আর তুই দাঁত কেলাচ্ছিস! বেহায়া মেয়ে!
তোমার ভাইয়ের ছেলের পছন্দটা দেখলা না? খৃষ্টান মেয়ে! আচ্ছা, মামানি তখন ওদের বয়স কত ছিল?
মৃন্ময়ের সাত আর মেয়েটার ষোলো! মামানি হেসে বললো! মৃন্ময় কিন্ত সত্যিই মেয়েটাকে অনেক পছন্দ করতো। বয়স কম হলে কি হবে, , , , পছন্দটা তো মনের ব্যাপার!
ইয়া খোদা, তোমার ছেলে! ওহহওই বুদ্ধদেব বসুর একটা কবিতা আছে না? দাঁড়াওবলেই রুমের দিকে আসতে লাগলাম।
মামানি বলল, কোথায় যাস? এখানে বস!
রুমে যাই। তোমরা গল্প করো।
রুমে এসে দেখি ব্যাটা আমার গোছানো বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। হাত পা ছড়িয়ে! দেখেই রাগ হলো আমার!
আস্তে আস্তে উনার কাছে গিয়ে বসলাম। কুচকুচে কালো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে! আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলাম, মনের ভেতর কোথাও সেই রাগটা আর খোঁজে পেলাম না! উনার পাশে বসে আমি যেন কোন ভাবনায় হারিয়ে গেলাম!
তখন বিকেলটা মরে এসেছে! চারদিক জানান দিচ্ছে শীতের আগমন। ফুলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। ড্রইংরুম থেকে আসছে হাসির আওয়াজ। এমন মরা বিকেলে কোনো এক আশ্চর্য অনুভূতি মনের কোণে জাগ্রত হচ্ছে। ধীরে ধীরে টের পেলাম কারো হাত যেন আমার কোমরে জামার উপর দিয়েভাবনার জগৎ থেকে পরক্ষণেই নিজের অস্তিত্বে ফিরে আসলাম।
কিন্ত একী? আমার কোমরে হাত দিলো কে? রুমে তো কেউ নেই! পাশে শুয়ে আছেন মৃন্ময় ভাইয়া, কিন্ত উনি তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! তাহলে?
এটা কী হ্যালুসিলেশন? নাকি কল্পনা? যেটাই হোক, তার স্পর্শে ছিলো অনেকটা ভালোবাসা, বিশ্বাস, আকুতি। এ মুহূর্তটাই যেন এক অন্যরকম ভালোলাগা বয়ে নিয়ে এসেছে।
কী? আমার পাশে বসে কী করছিস রে? (সন্দেহ নিয়ে)
আমি আমতাআমতা করে বললাম, কিছু না, ভাইয়া। এমনি!
তাই?
হ্যাঁ হ্যাঁ!
কিন্ত আমার তো অন্যকিছু মনে হচ্ছে!
কী?
এই যে, তুই আমাকে বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলতে এসেছিস। চুপিচুপি কেউ জানবে না! তোর এই মতলব ছিলো, রে আহির? আমায় মেরে ফেলতে চাস? (সন্দেহ নিয়ে)
আমি অবাক হয়ে বললাম, কীহ?’
পর্ব ৫
‘হুম, তুই তো আমাকে মেরেই ফেলতে চাস। নইলে ঘুমের মধ্যে তুই আমার পাশে বসে কী মতলব আঁটছিলি? তোকে আমার চেনার বাকি নেই, বুঝলি? ফাজিল মেয়েসাংঘাতিক! বাবারে বাবাআমি এতক্ষণে না জাগলে তুই নিশ্চয় বালিশচাপা দিতি আমায়! আর আমি দমবন্ধ হয়ে হাত-পা ছুঁড়ে মরে যেতাম। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে
রেগে বললাম, আমার অন্যায় হয়েছে আপনার পাশে বসা। আমার বিছানায় ঘুমিয়েছেন, একলিস্ট থ্যাংকস না বলুন সম্মানটা দিতে পারতেন। আসলে আপনার নিজের প্রতি নিজেরই সম্মান নেই, অন্যদের আর কি রেসপেক্ট করবেন! হোয়াট ডু ইউ থিংক?
ভ্রু কুঁচকে, এটা তোর বিছানা যে তার কোনো প্রুফ আছে? যদিও তোর হয়, তাহলে শুনে রাখ! এতক্ষণ আমি রুমে ঘুমিয়েছি না ডাস্টবিনে ঘুমিয়েছি সেটা খোদাই জানে! সো আই রিকুয়েস্ট ইউ, রুমটা তোর হলে প্লিজ পরিষ্কার কর! নাক সিঁটকে
এই কথা শুনে পুরাই রেগে গেলাম। আমাদের বাসা অলওয়েজ পরিষ্কার থাকে। কোনোসময়ই নোংরা থাকেনা। আর উনি ইচ্ছে করে আমায় ইনসাল্ট করছেন আমি বেশ বুঝতে পারছি!
রাগলে তোর চেহারা পুরোই পেত্নী হয়ে যায়। আসলে তুই ভাবিস রাগলে তোকে হিরোইন লাগে, তাই না। তোর ধারণা আসলে ভুল!
তো নোংরা ঘরে বসে আছেন কেন? নোংরা রুমে তো নোংরা মানুষই থাকে। আমি নোংরা হলে আপনি ও নোংরা!
বাদ দে। এখন গান শোনা, কতদিন শুনি নাকথায় পাত্তা না দিয়ে
জেনে রাখুন, আই গিভ আপ সিঙ্গিং সং! ভাব নিলাম
কেনো, লেখিকা হবি বলে? সন্দেহ নিয়ে
আই উড নট লাইক টু এক্সপ্লেইন মাইসেলফআমি বলতে চাই না।
বেশী ভাব শিখেছিস? রেগে!
ভাবের কি আছে? আমি আমার ডিসিশন আপনাকে বলবো কেন? পাগলা কুকুর কামড়াইছে আমাকে?
বিকজ আই নিড এ সলিউশন
আমি আপনার সাথে কিছু শেয়ার করতে চাই না।
উনি আমার দিকে রেগে বালিশ ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, বলতেই হবে তোকে। আমাকে বলবি না? এতবড় সাহস? বল বল
ওহহ রাস্তার কুকুর বললেই আমি তাকে সব বলে দিবো? আজব পাবলিক সব!
এভাবে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দুজনে ঝগড়া শুরু করলান। ঝগড়া শেষ পর্যন্ত মারামারিতে নিয়ে গেলো। মৃন্ময় ভাইয়া বালিশ ছুঁড়ে মারেন, আমি বই ছুঁড়ে মারি। উনি আমার খাতা, জামা-কাপড় সবকিছু আমার দিকে ছুঁড়ে মারছেন। আমিও ছুঁড়ছি।
একসময় ক্লান্ত হয়ে আমি দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। আর বেচারা রেগে ফায়ার। সে নাকি আমায় দেখে নেবে। আমিও হুমকি দিলাম যে, ব্যাটার অবস্থা খারাপ না করলে আমি আহির না!
এভাবেই ঝগড়া, খুনসুটি করতে করতে তিন মাস কেটে গেলো। দুজনেরই দা-কুমড়া সম্পর্ক! দিনদিন বেড়েই চলেছে। আমার মনে হয়, উনার একমাত্র লক্ষ্য হলো, আমাকে শান্তিতে থাকতে না দেওয়া। সারাক্ষণ পিছু লাগবে! দুদণ্ড নিস্তার নেই।
এভাবেই শীতকাল এসে গেলো। শীতের সময়টা এবার গ্রামে কাটানোর ইচ্ছে মামু, আব্বুর। তাই সবাই প্ল্যান করেছে গ্রামে যাবে। এ নিয়ে আমি আর আমার বোন মহাখুশি। কিন্ত ওই মৃন্ময় ভাইয়া যাবে, তাতেই আমার আপত্তি। যেদিন যাবো তার আগের দিন আমি, আম্মু, মামানি আর শপিংয়ে গেলাম।
অনেক অনেক শপিং করে নিয়ে আসলাম। শপিংয়ের প্রধান জিনিসটা ছিলো, শীতের কাপড়! গ্রামের গরীবদের বিলিয়ে দেয়ার জন্যও কেনা হয়েছিলো।
যাইহোক, এটা নিয়েও উনার সাথে মাথাভাঙ্গা ভাঙ্গি রকমের ঝগড়া হয়ে গেলো।
তুই নিজেকে মহান সাজাতে চাস?
মোটেও না।
জানি জানি।
কী জানেন?
তোর কুমতলব গুলো।
আমার কোনো কুমতলব নেই!
তোকে আমার থেকে বেশী আর কে চেনে? শীতবস্ত্র বিলিয়ে দিয়ে গ্রামের মানুষের কাছে নেত্রী সাজতে চাস? পরেরদিন খবরে দেখাবে, ‘আহির নামে এক বিদুষী নারী গ্রামের অসহায়দের মাঝে শীতবস্ত্র বিলিয়ে দিয়ে মহান কাজ করেছেন, সবাই উনাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন! ‘
অসহ্য!
সত্য বললে সবারই গায়ে লাগে। বলে উনি আমার দিকে এগুতে লাগলেন। আমি পিছাতে পিছাতে চেয়ারের উপর বসে পড়লাম। কাটাকাটা গলায় বললাম, আপনার এসব অসামাজিক কর্মকান্ডগুলো আপনাকে মানায় না।
উনি আমার চুলগুলোতে ফুঁ দিয়ে বাঁকা হাসি হেসে বললেন, তাই? তুই জানিসআমি’
পর্ব ৬
পরদিন রাতের শেষ করা আধাবাক্য ব্যয় করতে চলে এলেন আমাদের বাসায়! এসেই বকবক শুরু করলেন!
তুই জানিস আমি কত ভালো এবং রোমান্টিক ছেলে?
আমার জানার দরকার নেই। আপনি সামনে থেকে সরুন। আমার কলিজার উপর উঠছেন কেন?
হোয়াট? তোরও কলিজা আছে আহির? আমি তো ভাবলাম তুই একটা রোবট, কোনো কলিজা নেই তোর। আর কলিজা থাকলে আমার সামনে এত কথা বলতে পারতি না। আমার থেকে দশ হাত সামাজিক দূরত্ব মেইনটেইন করতি!
মৃন্ময় ভাইয়ার এসব কথা শুনে আমার মেজাজ চড়ে গেল। ঝড়ো গলায় বললাম, আমি মানুষ, রোবট না। আমি না হয় চশমা পড়ে কানা হলাম আর আপনি? এতবড় আস্ত মেয়েমানুষটাকে চোখে পড়লো না?
সিরিয়াসলি আহির? তুই মেয়েমানুষ? আমি তো ভাবলাম যে
আমি সন্দেহী চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, কী?
মানে হিজড়া আরকি!
কীহহহআমি হিজড়া? আমাকে দেখে আপনার হিজড়া মনে হয়? মামানি একটু জোড়েই চিৎকার করেছিলাম আর এই চিৎকার শুনে মৃন্ময় ভাইয়া আমার মুখ চেপে ধরলো! আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম
তখন বিকেল মরে এসেছে। শেষ বিকেলের সোনা মোড়ানো রোদ ঝিকঝিক করে আছড়ে পরছিলো। জানালা গলে আসছিল শেষ বিকেলের হৈমন্তী বাতাস! মন কেমন করা মিষ্টি ফুলগন্ধী বুনো হাওয়ায় বাতাস ভারী! এই মূহুর্তে নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিলো ভাবনার চাদরে মুড়ে থাকা শেষ চিন্তাটুকুর মাঝেই ফট করে আমার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বসলো মৃন্ময় ভাইয়া!
সময় যেন থমকে গিয়েছে, বাতাসে ফুলগন্ধী হাওয়াটা আরও যেন ঘন হচ্ছে! আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মৃন্ময় ভাইয়া তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো। আমার মনে হলো উনি পালিয়ে গিয়েছেন
আমি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে উনার এই কাজের মতলব খুঁজতে লাগলাম। মস্তিষ্কে ঘাম ঝড়িয়ে ফেললাম তাও কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। ভাবনার খাতা বন্ধ করে ড্রয়িংরুমে গেলাম। গিয়ে দেখি উনি নেইবোধহয় বাসায় চলে গিয়েছেন। আমি আমাদের তিনতলার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
আকাশ যেন তার মন খারাপের কথা ভুলেই গিয়েছে। আগের দিন দুপুরের দিকে একটু রোদের দেখা পেলেও দিনের শেষভাগে আবারও ধেয়ে এসেছিলো ঠান্ডা বাতাস। সঙ্গে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সন্ধ্যায় রেলস্টেশনে নিজের সালোয়ার -কামিজের উপর লাগানো ওভারকোট আর মাফলার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি আমি। আমার আবার এতটুকুতেই ঠান্ডা লাগার ধাঁচ!
তাই আম্মুর আদর মাখা বকবকানি নামক প্যারায় অতিষ্ঠ হয়ে মাফলার নামক বিরক্তিকর জিনিসটা দিয়ে নাকমুখ প্যাঁচিয়ে রেখেছি। নিজেকে এলিয়েন মনে না হলেও এইমূহুর্তে জঙ্গি মনে হচ্ছে! বিরক্তির ঠ্যালা নিয়ে ঝিম ধরে বসে আছি স্টেশনের বসার জায়গায়।
শীতের রাত হওয়াতে মানুষজন কম। ট্রেন ছাড়তে আরো একঘন্টা লেইট হবে। আব্বু আর মৃন্ময় ভাইয়া তো রেগে বকাবকি করছে রেল কর্তৃপক্ষের সাথে। একপর্যায়ে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো।
সেদিনের পর মৃন্ময় ভাইয়া আর আমাদের বাসায় আসেননি, হয়তো আমার কারণে, আমি যদি কিছু মনে করি বা বলি! যাইহোক, আমি তো এর কারণ জানবোই জানবো। এখন উনাকে ছাড় দিচ্ছি, কথা বলছি না।
যাইহোক, বৃষ্টির তোড় বেড়ে যাওয়ায় আম্মু এসে বসলো আমার পাশে। গজগজ করতে করতে বললো, যত্তসব ঝামেলা। তোর আব্বু হলো এক নম্বর গাধার গাধা!
আমি আড়চোখে তাকিয়ে বললাম কেন?
কত করে বললাম, গাড়ি দিয়ে চলে যাই, ঝামেলা হবেনা! আমার কথা শুনলো না তো! তাই এখন বিপদে পড়েছে! বুঝুক ঠ্যালা
ট্রেনেই তো ভালো। মজা হবে
ওহহআসছো বাপের ব্যাটি! একচড়ে দাঁত ফেলে দিবো। যদি বাপের সাইড নিয়ে কথা বলিস!
তুমি বুঝতে চাইছ না কেন? ট্রেন দিয়ে গেলে কত সুন্দর চাঁদ দেখা যায়। অনেক গ্রাম, সুন্দর নদী, রাতের আকাশ
তোর মাথার ভূত গুলো এখনো যায়নি। সাহিত্যিকের মতো কথাবার্তা ছাড়। নইলে চুলের মুঠি ধরে দিবো এক চড়!
আম্মু তুমি বুঝতেছনা
তুই ই বুঝতুই আমার সন্তান। তাই আমি যা বোঝাবো তুই তাই ই বুঝবি
মা মেয়ের কথাবার্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন মৃন্ময় ভাইয়া। আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ! ‘
পর্ব ৭
‘মৃন্ময় ভাইয়া আমার দিকে না তাকিয়ে আম্মুকে বললেন, ফুপি তোমার এই রুগীলা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছো যে, গিয়ে তো শুধু শুধু ঝামেলা বাড়বে। এই করবে সেই করবে তারপর অসুস্থ হয়ে যাবে।
আম্মু ভেবে বললো, ঠিক বলেছিস। এই ঢ্যাঙ্গীকে নিয়ে কি করবো বল। তোর ফুপ্পার মাথায় তো ভিমরতি ধরেছে, দেখিস না। যত্তসব। যেমন বাপ তেমন মেয়ে।
আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আম্মুকে কটা কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে আব্বুর পাশে গিয়ে বসে রইলাম।
আর আম্মু যেন আমার কথা গায়েই মাখলো না। দিব্যি মৃন্ময় ভাইয়ার সাথে আলাপ জমাচ্ছে। এতো কিসের আলাপ বুঝলাম না!
বৃষ্টির তোড় কমেছে একটু, মৃন্ময় ভাইয়া সবার জন্য স্টেশনের টি-স্টল থেকে ধোঁয়া উঠা গরম চা এনেছে। সবার হাতে হাতে কাপ ধরিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু আমাকে দিলো না। রাগে, অপমানে আমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে আসলো পানি।
কিছুক্ষণ পর দেখি উনি একটা বড় কফির মগ নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, খেয়ে নে। গরম আছে এখনো।
বলেই গটগটিয়ে হেঁটে আম্মুর পাশে গিয়ে বসলেন। থেমে থেমে চায়ের কাপে চুমু দিচ্ছেন আর এদিক ওদিক দেখছেন।
আমিও গরম কফির লোভ সামলাতে না পেরে খেতে লাগলাম। সবার জন্য চা আর আমার জন্য কফি। বাহ! নিজেকে স্পেশাল স্পেশাল মনে হলো।
চারপাশ কেমন অদ্ভুত, চুপচাপ। বৃষ্টির ছিটছিটে পানিতে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। কুয়াশারা ধোঁয়ার মতো উড়ছে হাওয়ায়। মিষ্টি মধুর হাওয়া উত্তাল। ধোঁয়া উঠা গরম কফির স্বাদটা লাগছে অমৃতের মতো।
রাতের আকাশে দুরন্ত গতিতে চলছে সাদা সাদা মেঘের কুঞ্জ। উড়ে চলছে শঙখচিলের ঝাঁক, এতো রাতে তা দেখে আমি অবাক। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে আমি হারিয়ে গেলাম কবিতার রাজ্যে। অস্পষ্ট গলায় আবৃত্তি করতে লাগলাম আরণ্যক বসুর কবিতা,
‘পালকের মতো ভাসতে ভাসতে সাদা মেঘ যায় দূরে
নীলকন্ঠীর ডানার উড়ানে শঙখচিলের সুর,
লাল-টুকটুক একটা ঘুড়িও দুলছে মেঘের পাশে
কাশ -দিগন্ত চিঠি পাঠিয়েছে শিউলি ফুলের মাসে। ‘
‘ট্রেনে উঠে সবার ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস আছে, এখনো সেটাই হয়েছে। আমি চুপচাপ সিটে হেলান দিয়ে বসে আছি। কামরাতে বেশি মানুষ নেই। আমরা আমরাই দশ-বারোজন আছি।
ইতিমধ্যেই মৃন্ময় ভাইয়ার আব্বু মানে আমার মামা নাক ডেকে ঘুম দিয়েছেন। বাকিরাও সবাই ঢুলুঢুলু। আর ওদিকে আমি সজাগ, তাকিয়ে দেখছি বাইরের দৃশ্য।
রাতের বেলা সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। দূরের ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, গমক্ষেত বাতাসে দুলছে। অন্ধকারে সেসব লাগছে কালো। নদীগুলোর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভীষণ ভালো লাগছে আমার। জানালার পাশে বসে আছি আমি। দূরের গ্রামগুলোতে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। দেখা যাচ্ছে সেগুলো কারো চোখ। আমি এসব দেখছি আর শিহরিত হচ্ছি।
বাইরে আবারও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ায় আমি হাতটা জানালার বাইরে রাখলাম। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে মৃন্ময় ভাইয়া এসে আমার পাশে বসলেন এবং আমার হাতটা টেনে বাইরে নিয়ে আসলেন।
আমি রেগে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি হলো?
কোনটা? ভ্রু কুঁচকে।
আমার হাত ভিতরে নিয়ে আসলেন কেন?
আমার ইচ্ছে বলেই সিটে হেলান দিয়ে বসে দুপা উপরে তুলে দিলেন। মোবাইল টিপতে টিপতে বললেন, এই আহির! তোর মাথায় কি কোনো ছিট আছে?
আমি রেগে বললাম, না।
তাহলে এরকম কান্ড করলি কেন?
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি কান্ড?
এই যে, এতো রাতে ট্রেনের জানালা খোলা রেখেছিস, আবার সুন্দর হাত দুটো বাইরে মেলে দিয়েছিস!
তাতে কি হয়েছে?
কিছু হয়নি বলছিস?
আরে কি সমস্যা, আমার হাত আমি বাইরে দিবো না দিবো তাতে কার কি সমস্যা হবে?
জানিস না, রাতে ট্রেনের জানালা খোলা রাখা নিষেধ?
কেন?
কারণ দুবৃত্তরা রাতে ট্রেনে হামলা করে। চোর, ডাকাত বাটপারেরা সব রাতে বের হয়। তাই।
এই অদ্ভুত কারণে আমি জানালা বন্ধ করে বসে থাকবো? আজব!
আরে গাধী, তুই যেভাবে বাইরে হাত দিয়েছিস এখন যদি কেউ তোর হাতটা কেটে ফেলতো, তখন? তখন কি করতি? বা জানালা দিয়ে কেউ এসিড ছুড়ে দিল বা অন্যকিছু করলো, তখন?
এভাবে তো ভেবে দেখিনি। কিন্ত অন্যকিছু মানে কি বোঝাতে চেয়েছেন?
মৃন্ময় ভাইয়া মোবাইলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, সিরিয়াসলি আহির? তুই অন্যকিছুর মানে বুঝলি না? আমাকে ডিটেইলসে বলতে হবে?
না বললে বুঝবো কিভাবে? আজব!
মৃন্ময় ভাইয়া বিস্ময়ে হা করে বললেন, সিরিয়াসলি? লাইক সিরিয়াসলি। মাই গড। তোকে এসব রোমান্স টাইপ কথা শিখাতে হবে?
আমি চোখ ঘুরিয়ে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিহ?
উনি হতভম্ব হয়ে আমার হাত ধরে মুচকি হেসে বললেন,
শিখতে চাইলে শিখাতে পারি। আমি আবার এসবের বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তুই শিখবি নাকি আমার কাছ থেকে?’
পর্ব ৮
‘ছিহ! আপনি এসব কি বলছেন?
কেন? তোর মোটামোটা বইতে কি এসব রোমান্স টাইপ কথাবার্তা লেখা থাকে না?
সেসব কি আপনার কাছে এক্সপ্লেইন করতে হবে? ফালতু লোক একটা।
বাদ দে তো। এখন আমার পা টিপে দে। যা হাঁটাহাঁটি করলাম না
হাঁটাহাঁটি কোথায় করলেন? মাত্র সবাইকে চা খাওয়ালেন আর ব্যাগপত্র তুললেন এটাতেই হাঁপিয়ে গেলেন?
এই তোকে এত কথা বলতে বলেছি আমি? চুপচাপ পা টিপ।
হুহ, আমি আপনার দাসী নাকি?
মনে কর তাই! মহারাজের আদেশ তুই ফেলতে পারিস না। এতবড় স্পর্ধা তোর এখনো হয়নি।
ওহহ! তা আপনি কোথাকার মহারাজা? মহারাজার নামটা কি? আর মহারাজার এমন বেহাল ফকিরের দশা কেন?
শেহজাদীর খুঁজে বেরিয়েছি তো তাই এমন মুসাফিরের বেশ ধরতে হয়েছে রে। তুই চুপচাপ পা টিপ।
বয়েই গেছে আমার। বসে বসে মোবাইল টিপুন। আমি যাই।
বলেই ওখান থেকে চলে এসে আদিবার পাশে বসলাম। আদিবা ঘুমিয়ে কাদা। মুখের উপর আছড়ে পড়ছে চুলগুলো।
আমি ব্যাগ থেকে একটা রিবন বের করে ওর চুলগুলোতে বিনুনি করে দিলাম। তাও বেচারির ঘুম ভাঙ্গলো না।
মৃন্ময় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি মোবাইল রেখে সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আরেক সিটের উপর পা তুলে একমনে বাইরে তাকিয়ে আছেন। বাতাসের ঝাপটায় উনার মুখচোখ একটু পরপর কুঁচকে যাচ্ছে, যা দেখে আমার হাসি পাচ্ছে প্রচুর।
চশমাটা খুলে ব্যাগে রেখে দিলাম। ব্যাগে করে প্রচুর বই নিয়ে এসেছি। বই ছাড়া আমার একদিন ও চলে না।
আমার এ কাজে আম্মু বেশ বিরক্ত হয়েছিলো, কিন্তু আব্বুর যুক্তির কাছে বরাবরের মতোই হার মানতে বাধ্য হলেন।
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘রোমিও জুলিয়ট’ এদের কাহিনী পড়তে পড়তে কখন যে চোখ লেগে গেলো বুঝতেই পারলাম না।
ঘুম ভাঙ্গলো আম্মুর ধাক্কাধাক্কিতে। ঠান্ডায় জমে যাবার অবস্থা আমার।
আম্মু ফ্লাক্স থেকে এক মগ গরম দুধ হাতে দিয়ে বললেন, খেয়ে নে।
আমি দুধ খাই না, আম্মু!
আম্মু চোখ রাঙ্গিয়ে বললো, খেতে হবে।
প্লিজ
বললাম তো খেতে হবে।
আমি আর না করতে পারলাম না। বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে কোনোমতে আধাগ্লাস দুধ খেলাম।
বাকিটা আম্মুর হাতে দিয়ে বললাম, আর পারছি না। প্লিজ!
আচ্ছা রাখ আর খেতে হবে না।
হুম, ধন্যবাদ তোমায় আম্মু! !
ঢঙ করতে হবে না। সারাদিন বাপের পিছনে পইড়া থাকিস এখন আসছিস ধন্যবাদ দিয়ে নাটক করতে?
যাও যাও। আর বলবো না।
আম্মু মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলেন। আমি ঠিকঠাক করে বসলাম সিটে। তারপর বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চলে গেলাম গভীর ঘুমে।
কারো ধাক্কায় ঘুম থেকে জেগে উঠলাম আমি। মৃন্ময় ভাইয়া আমাকে ধাক্কাচ্ছেন। আমি চোখ খুলে লাফ দিয়ে উঠে বললাম, একি? আপনি আমার রুমে কেন? আমি কিন্তু আম্মুকে ডাক দেবো। বেরুন আমার ঘর থেকে।
মৃন্ময় ভাইয়া একথা শুনে হু হা করে হেসে বললো, সিরিয়াসলি ম্যান! তুই এতোটাও বোকা? চশমা কই তোর?
আরে আমার চশমা কই? নিশ্চয়ই আপনি লুকিয়েছেন?
আরে গাধী! তুই চারপাশে তাকিয়ে দেখ! এটা ট্রেন। তোর বস্তি টাইপ রুম না।
এতক্ষণে আমার হুশ আসলো। প্রচুর লজ্জা পেলাম।
উনি বললেন, আর লজ্জায় পেত্নী হবার দরকার নেই। উঠ এবার। চলে এসেছি তো গ্রামে।
তাই নাকি?
হুম। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বললেন, শেহজাদীকে তো পরী পরী লাগছে! এত পরী পরী লাগলে তো আমি আর তার আশেপাশেই থাকতে পারবো না। ওহহ! মৃন্ময়, তুমি কি পাগল-ছাগল হয়ে যাচ্ছো? একটা মেয়ের জন্য এতোটা বাহানা না করলেও পারো!
এই আপনি মিনমিন করে কি বলছেন? ভ্রু কুঁচকে সন্দেহী গলায় বললাম আমি।
আহির তুই মুখচোখ ধুয়ে নে। তোকে পুরা গ্রাম্য ফকিন্নি লাগছে বলেই আমার হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
আমি অবাক হয়ে উনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম! ‘
পর্ব ৯
‘গ্রামে এসেছি আজ পাঁচদিন। প্রচুর মজা করে কাটাচ্ছি। শীতের কাপড় যেগুলো এনেছিলাম সেগুলো আম্মু আর মৃন্ময় ভাইয়া সব বিতরণ করে দিয়েছেন। সারা গ্রাম আমি এবং আদিবা ঘুরে বেড়িয়েছি।
প্রচুর মজা করেছি! কিন্তু আজ দুদিন কেউ আমার সাথে খুব একটা কথা বলছে না। সবাই যেন গোপনে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে, শুধু মৃন্ময় ভাইয়াই হাসিখুশি মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর আমাকে দেখলেই বলেন, “ক্যায়সা লাগা ম্যারা মাজাক! “
মানে?
উনি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললেন, তোকে বলিনি। চুপ থাক।
আমি মুখ ভেঙিয়ে চলে এলাম। পুকুর পাড়ে আদিবাকে দেখে আমিও গেলাম। আদিবা মেহেদীর সাথে ঝগড়া করছে কারণ আদিবাকে মেহেদী নৌকায় উঠতে দিচ্ছে না, মেহেদী পুকুরে মাছের খাবার ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে। মেহেদী হলো আমাদের দূরসম্পর্কের মামার ছেলে। গ্রামের বাড়িতে কেউ না থাকায় এখন এই বাড়িতে ওরাই থাকে।
আপু দেখো তো, এই মেহেদী আমায় নৌকায় তুলছে না!
দাঁড়া আমি বলে দেখি! এই মেহেদী আমাদেরকে নৌকায় তুলো না! প্লিজ
তোমাদের নৌকায় উঠা নিষেধ।
বললেই হলো!
পেছন থেকে মৃন্ময় ভাইয়া বলে উঠলো, অবশ্যই! অবশ্য তোরা যদি উঠতে চাস তাহলে আমার সাথে উঠতে হবে।
পাগল হয়ে গেছি নাকি আমরা? মাঝ পুকুরে নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়ার মতলব খালি, হুহ!
উঠলে উঠ, না উঠলে ভাগ! এই আদিবা চল, , তুই উঠবি তো?
হুম, উঠবো।
তাহলে চল, এই মেহেদী নৌকাটা এদিকে নিয়ে আয়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আর কেউ চাইলে যেতে পারে!
‘আমি দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগলাম। নৌকাটা সামনে এনে রাখতেই আমি একলাফে উঠে গিয়ে পাটাতনে বসে পা দুটো বরফ শীতল পানিতে ডুবিয়ে দিলাম। মৃন্ময় ভাইয়া একগাল হেসে আমার মুখোমুখি অন্য দিকে বসে দাঁড় বাইতে লাগলেন। নৌকার মাঝখানে বসে আদিবা আনন্দে বারবার চিৎকার করছে। ‘
‘তখন আকাশ কেমন লালচে রঙ ধারণ করেছে। শ্যামল বাতাসে পুকুরের দুপাশের ঘন জঙ্গলটাকে কেমন স্বর্গরাজ্য লাগছে। শেষ বিকেলের রোদের আলো কুচি কুচি করে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো দাঁড় বাইতে থাকা মৃন্ময় ভাইয়ার চোখে, মুখে। সেই অদ্ভুত মানবের এমন সৌন্দর্য দেখে আমি কয়েকটা হার্টবিট মিস করে ফেললাম। চোখ সরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। মনে আসলো রবিবাবুর বিখ্যাত গান, সেই সুর!
“কতবারও ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া, তোমারই চরণে দি
হৃদয় ও খুলিয়া!
চরণে ধরিয়া কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি!
ভেবেছিনু তুমি স্বর্গেরও দেবতা
কেমনে তোমারে কবো প্রণয়েরও কথা! “
“বাড়ি ফেরার পর দেখি পুরো বাড়িতে একটা আলাদা ভাব, যেন কোনো উৎসব হবে। ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না। মৃন্ময় ভাইয়া আমার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বোধহয় কিছু আঁচ করতে পারলেন। হাতে পানির গ্লাসটা দিয়ে বললেন, ছাদে যাবি? চল!
আপনি যান!
যাবি না?
আসছি আমি, আপনি আগে যান।
ঠিক আছে।
কিছুসময় পর আমি ছাদে এলাম। ছাদটা বেশ বড়। টবে লাগানো গাঁদা ফুল আরও অনেক শীতকালীন বিভিন্ন ফুল। নারকেল গাছের লম্বা পাতাগুলো বাতাসে দুলছে। বেশ ঠান্ডা লাগছে আজ। শেষ বিকেলের রোদে নরম নরম ভাবটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। সময়টা যদি থেমে যেত এই শেষ বিকেলের সোনার চেয়েও দামী রোদটুকুতে, তাহলে পৃথিবীটাই অন্যরকম হয়ে যেতো।
গুচ্ছ গুচ্ছ শুকনো জলপাই গাছের পাতাগুলো বাতাসে আমার উপর আছড়ে পড়ছে। বাড়ির পাশেই গাছটা, ঝাঁকড়া শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন রোমাঞ্চকর একটা মুহূর্তে প্রিয় মানুষটার সাথে কাটালে মন্দ হতো না। আমি চশমাটা খুলে গায়ে জড়ানো শালটা দিয়ে কাচটা পরিষ্কার করে নিলাম। “
পেছন থেকে মৃন্ময় ভাইয়া বলে উঠলো, তুই জানিস বাড়িতে এসব কেন হচ্ছে?
আমি চমকে পেছন ফিরে বললাম, না তো!
জানতে চাস?
সিরিয়াস ইস্যু না হলে জানতে চাই না।
সিরিয়াস বিষয়ই, এবং সেটা তোর আর আমার সারাজীবনের জন্য সিরিয়াস বিষয়!
আমি হুট করে মুখ তুলে চাইলাম ওনার দিকে, বুঝতে না পেরে বললাম, মানে?
মানে, তোর আর আমার বিয়ে!
শেষ রোদের সোনাঝরানো রোদ যেন চিক করে উঠলো হঠাৎ। চারপাশে যেন অসংখ্য শীতের পাখিরা বিচরণ করছে, তাদের কিচিরমিচির শব্দে আমি যেন অদ্ভুত অনুভূতির টের পেলাম। বললাম, মানে?’
পর্ব ১০ (অন্তিম)
‘মানে তোর সাথে আমার বিয়ে! সহজ কথাটা বুঝতে পারছিস না? এই, তুই কি এখনো বার্লি খাস? নাকি বই পড়তে পড়তে মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে তোর?
চুপ থাকেন তো! আর আপনি কি আমার সাথে ফাজলামো করছেন? আমার বিয়ে আর কেউ জানেই না?
সবাই সবকিছু জানে রে, শুধু তুই লেখিকা হয়ে বুঝলি না!
কি বুঝিনি?
এই যে, সবাই বুঝে যে আমি তোকে ভালোবাসি, তোকে বিয়ে করবো ইভেন তোকে বিয়ে করে নিজের বউ বানাবার উদ্দেশ্যে সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে এসেছি! সবাই জানে আর তুই বুদ্ধু কিছু বুঝতেই পারলি না! !
কথাগুলো যেন আমার মাথার উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে বয়ে গেলো। আমি ভাবনা-চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।
উনি চোখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বললেন, কি রে? ভাবুকদেবী? আবার কই হারিয়ে গেলি?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, হুহ! মিথ্যা কথা বলার জায়গা পান না!
নিজের চোখে সবকিছু দেখে তোর কাছে সব মিথ্যা মনে হয়?
জ্বি হয়!
এমন সময় মেহেদী ছাদে এসে বললো, কী মৃন্ময় ভাইয়া, নতুন বউয়ের সাথে এখনই গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করো? ছিঃ তুমি যে এতো পর ভাবো আমাদের জানতাম না!
এটুকু বলে মেহেদী চোখ টিপ দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো। আর আমি হ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছি। তার মানে এসব সত্যি? সবাই জানে আর আমাকে কেউ জানায়নি, হুহ!
কি আমাকে বিয়ে করবি না?
জানি না।
তাহলে না করে দিই? তোর যখন এতই কনফিউশান হচ্ছে! !
আরে আমি কি বলেছি নাকি?
ওকে বল তাহলে, জাস্ট একমিনিট দিচ্ছি।
এতো তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেবো কি করে?
তোকে একটা সহজ টেকনিক শিখিয়ে দিই?
সহজ টেকনিক মানে?
মানে তুই চোখ বন্ধ করে ভাব, তোর ভাবনায় বর হিসেবে যদি আমি আসি তাহলে তুই ফটাফট বলে দিবি যে আমাকে বিয়ে করতে চাস! সিম্পল,
এতো সোজা?
উনি আমাকে নিজের কাছে টেনে নিলেন, কোমড় জড়িয়ে ধরে মৃদু কন্ঠে বললেন, হুম এত সোজা। ভালোবাসিস তো আমাকে? দেখবি সব সোজা।
আমি হুট করে উনার চুলগুলো টেনে ধরে বললাম, ভালোবাসি তো শেষ বিকেলের সাদা ভূতটাকে! বলেই জিহবায় কামড় দিলাম। ইশ, কি বলে ফেললাম।
উনি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন, কি বলিস আজব কথা?
না কিছুনা।
জানিস তো, তুই যে আমার শেহজাদী!
না।
ধুরতুই এতো বোকা কেন?
আমি আবার কি বোকামি করলাম?
আমি তোকে ভালোবাসি তো? ভালোবাসার মানবী আমার কাছে সবসময় অচিনপুরের শেহজাদী! যেমন তুই এখন সে জায়গাটা দখল করে নিয়েছিস!
ওহহ! তাহলে আপনি আমার শেষ বিকেলের নরম রোদের মানব! সিম্পল।
উনি বাঁকা হেসে আমাকে বললেন, চোখ বন্ধ করে বল তুই আমায় বিয়ে করবি কি না?
আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম, প্রথমেই ভেসে উঠলো শেষ বিকেলের রোদে জঙ্গলে বসে থাকা মানবটার চেহারা! কুচি করা রোদের টুকরোয় যার চেহারায় উজ্জ্বল রঙ ফুটে উঠেছে ভালোবাসার অদ্ভুত অনুভূতি মতো। হ্যাঁ, একেই তো চেয়েছিলাম মনে প্রাণে। এই-ই যে আমার মানবটা, সামনে দাঁড়ানো মৃন্ময় ভাইয়া।
আমি চোখ খুলে বললাম, হুম রাজি।
উনি আমার হাত ধরে টেনে নিচে নিয়ে আসলেন। ড্রয়িংরুমে বসে থাকা প্রতিটা মানব/মানবী আমাকে আর উনাকে দেখে মুখ টিপে হাসছেন। মেহেদীর আম্মু বলে উঠলো দুজনকে বেশ মানিয়েছে তো মাশাল্লাহ!
মৃন্ময় ভাইয়া বলল, আমার বউ তো বিয়েতে রাজি। যান, সবাই মিলেমিশে সুন্দর করে বিয়ের ব্যবস্থা করুন। বলেই হ্যাঁচকা টানে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আসলো সবার হাসির শব্দ। আম্মু/আব্বু, মামু/মামানির মুখে ফুটে উঠলো সুখী সুখী ভাবের লালচে আভা।
পুকুর পাড়ের দুপাশ জঙ্গলে ঘেরা। মৃন্ময় ভাইয়া বললো, যাবি আমার অচিনপুরে?
হুম।
তাহলে চল। বলেই আমার হাতে হাঁটতে লাগলেন। মুখে প্রশান্তির ঊষ্ণ হাসি, নয়নের অন্তরীক্ষে ভালোবাসার অদ্ভুত অনুভূতি!
টের পেলাম বুকের ভেতর কেমন ভালো লাগার অদ্ভুত সুখ! শেষ বিকেলের রোদে ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে অচিনপুরে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা পূরণ হবে! আমার অজানা একতরফা ভালোবাসাটাও যে শুরু হয়েছিলো কোনো এক গল্পের রুপকথার অজানা রাজ্যেতে, শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদে! ‘
লেখা –
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “শেষ বিকেলের রোদ – Bangla premer golpo” টি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – একটি বিষাক্ত প্রেমের সম্পর্ক – X Girl Friend Story