আমার তুমি আছো (সিজন ২: শেষ খণ্ড) – Abegi moner kichu kotha: আমি পিয়াস এর দিকে সামান্য রাগী চোখে তাকাই, কিন্তু আবার ভালও লাগলো। আমার ছেলে ঋভু এসে তার এক হাত বাবার কাঁধে আর এক হাত আমার কাঁধে রাখলো।
পর্ব ৬
আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা আড়চোখে আমাকে দেখে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলো।
আজিব তো! বলা নাই কওয়া নাই হুট করে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লো! আবার এমন ভাবে এলো যেনো নিজের বাড়িতেই আসছে। কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। আচ্ছা ওই মেয়েটার কি এই বাড়িতে আসা যাওয়া করে! আর পিয়াস এর খোঁজ করলো, পিয়াস এর রুমে গেলো কেন? ব্যপারটা দেখতে হবে আমায়।
আমি রুমে যাওয়ার জন্য সিঁড়িতে পা দিতেই মেয়েটা দেখলাম তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেলো। আমি কিছুক্ষণের জন্য থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
পিয়াসকে দেখলাম শার্ট এর হাতার বোতাম লাগাতে লাগাতে আসছে। আমাকে দেখে গম্ভীর গলায় বললো,
~ নাস্তা দে জলদি। এমনিতেই লেট হয়ে গেছি।
আমি পিয়াসের আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। পিয়াসের প্লেটে নাস্তা দিলাম। পিয়াস এর মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ বিরক্তি নিয়েই খাচ্ছে।
আজকের নাস্তায় আমি আলুর পরোটা বানিয়েছি তার সাথে বুটের ডাল আর শশার রায়তা।
পিয়াস খেয়েই যাচ্ছে, কিছুই বলছে না। আমি অনেকক্ষণ পর চেয়ার টেনে পিয়াসের পাশে বসে পড়ি।
~ উহু কি পচা খেতে হয়েছে আলুর পরোটা। বুটের ডালটা তো প্রচন্ড ঝাল হয়ে গেছে। আর শশার রায়তাটাও বেশ জঘন্য খেতে হয়েছে।
~ হুম কি বলছিস!
~ বলছি নাস্তাটা ভীষণ পচা খেতে হয়েছে।
~ কই খেতে তো আমার বেশ মজা লাগছে।
~ ও তাই না! তাহলে কিছু বলছো না কেন?
~ ওহ আচ্ছা তুই আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলি, তাই বল। কোন রেস্তোরাঁ থেকে খাবার টা অর্ডার করেছিস রে?
~ ভালো হবে না বলছি, ধূররর, ।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়তে গেলেই পিয়াস আমার হাতটা টেনে ধরে নিজের কোলে বসিয়ে নেয়। আমার গালটা সামান্য টেনে জোরে হেসে দেয়।
~ পাগলী, তোর হাতে এতো টেস্ট আছে জানতাম না তো। সত্যিই দারুণ হয়েছে রে। আমার আলো যে এতো সুন্দর রান্না করতে জানে আমি জানি না তো!
~ তোমার মনে আছে নতুন পরোটা বানিয়ে ছিলাম তেল বেশী দিয়ে। তুমি আমাকে তেল খাইয়ে দিয়েছিলে।
~ আলো পুরোনো কথাগুলো ভুলে যা। আর আমাকে ক্ষমা করে দে।
পিয়াস আমার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করায়। আমার গলায় ঠোঁট ডুবাতে গেলেই আমি উঠে পড়ি।
~ ওহহ পিয়াস যখন তখন শুরু হয়ে যাও তুমি। নাস্তা টা শেষ করো আগে।
পিয়াস মুখটাকে পেঁচার মতো করে খেতে লাগলো।
~ ওই মেয়েটা কে?
আমার এমন প্রশ্নে পিয়াস একটু ঘাবড়ে গেলো।
~ আমার বান্ধবী ওর নাম অনামিকা। তোকে কিছু বলেনি?
~ না কিছুই বলেনি, দরজা খোলার সাথে সাথেই তো তোমার রুমে চলে গেলো আমাকে কোন পাত্তা না দিয়েই।
~ ও আমার ওপর রেগে ছিলো তাই হয়তো। আচ্ছা তোর সাথে ওর আলাপ করিয়ে দিবো। মেয়েটা ভীষণ ভালো।
~ ও আচ্ছা।
আর এই নিয়ে আমি কোন কথা বললাম না। পিয়াস বেরিয়ে গেলে আমি নাস্তার টেবিল পরিস্কার করে নিই।
মনটা অনেক ফুরফুরে লাগছে তাই বাগানের ফুল গাছ গুলোতে পানি ঢালছি। সেবার যখন এসেছিলাম ঘুরে দেখা হয়নি যে এই বাড়ির মধ্যে একটা বাগান আছে। এই বাগান পরিচর্যা করে আবুল চাচা। ওনাকে একটু রেস্ট নিতে বললাম। আমি ফুল গাছ গুলোতে পানি ঢালছি। গোলাপ, জুঁই, রজনীগন্ধা আরো অনেক নাম না জানা ফুলগাছ।
পিয়াস এর সাথে হাসি মজা করে কেটে গেলো দু’মাস। পিয়াস কে এর মাঝখানে নতুন করে চিনলাম জানলাম। অনামিকা আপু এর মাঝেই আমাদের বাড়িতে এসেছে অনেকবার, আমার সাথে বেশ ভাব জমিয়েছে। সত্যিই আপুটা অনেক ভালো। অনামিকা আপু পিয়াসের ক্লাসমেট ছিলো, ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড।
~ কেমন আছিস আলো মা?
~ আমি বেশ ভালো আছি ছোট আম্মু। জানো পিয়াস এখন আমার অনেক কেয়ার করে।
~ তাই, আমি অনেক খুশি হয়েছি তোর কথা শুনে। তোরা সারাজীবন ভালো থাক।
~ ছোট আব্বু কেমন আছে বলো?
~ ভালো আছে।
ছোট আম্মুর সাথে কথা বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে বিছানার ওপর বসলাম। হ্যা আমি ভালো আছি খুব ভালো আছি। পিয়াস সত্যিই আমার অনেক কেয়ার করে। আমাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে। তবু কোথাও যেনো একটু অপূর্ণতা আছে। কি জানি হয়তো বেশি ভালোবাসা পেয়েও আরো বেশি চাইছি! পিয়াস আমাকে ভালোবাসে,
কিন্তু আমার মনকে, না কি আমার শরীরকে, সেটা এখনো বুঝতে পারি না!
পর্ব ৭
ঘড়িতে এখন ভোর 3টে বাজে। আজও দু’টো শরীর এক হয়েছে কিছুটা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও।
একজন তার সব কিছু বিলিয়ে দিয়েছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও। আর একজন জোর করে নিজের চাহিদা মিটিয়েছে।
পিয়াস নিজের কাজ হাসিল করে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। শাড়িটা শরীরের মধ্যে পেঁচিয়ে নিই। গুটি গুটি পায়ে ওয়াশরুমে যাই। শাওয়ার এর তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বসে পড়ি। চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
আমি আজ সুখী হয়েও যে সুখী নই। দিন শেষে আমারো হৃদয় ভাঙা একটা যন্ত্রণা আছে। আমারো ইচ্ছা করে কারুর বুকে মাথা রেখে কষ্ট গুলো ভাগ করে নিতে। আমি কি পিয়াসকে সত্যিই বুঝতে পারি নি! না কি পিয়াস আমাকে বুঝে উঠতে পারে নি!
ব্যালকেনীতে দাঁড়িয়ে আছি, ফুরফুরে বাতাস বইছে, মাথার চুল গুলো থেকে পানি পড়ছে টুপটুপ করে। চুলগুলো মুছার জন্য রুমে যাই। পিয়াস আধশোয়া হয়ে মাথায় হাত দিয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে বললো,
~ মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে টিপে দাও তো।
পিয়াসের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। বিছানায় গিয়ে বসতেই পিয়াস আমার কোলে মাথা রাখলো। আমি পিয়াসের কপালে হাত দিয়ে টিপতে লাগলাম। পিয়াস কিছুক্ষণ পর আমার শাড়ির আঁচল সরিয়ে পেটে ঠোঁট ছোঁয়াতে থাকে। পিয়াস এর ঠোঁটের ছোঁয়া আমার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধলো। আমি রাগে পিয়াসকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াই।
~ সারারাত তো এই শরীরটা নিয়েই পড়েছিলে। এখনো মেটেনি না তোমার?
চিৎকার করে কথাগুলো বলে আমি কেঁদে ফেলি। পিয়াস আমার কথা গুলো শুনে বিছানা থেকে নেমে পড়ে।
~ কি বলছিস তুই! মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
~ আমার ভালো লাগছে না পিয়াস। পিয়াস তুমি কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো? এই পিয়াস!
আমি পিয়াসের হাত দুটো ধরে আরো বেশি কেঁদে ফেলি। পিয়াস বোধহয় রেগে যায়। বিরক্তির স্বরে চিৎকার করেই বলে,
~ তখন থেকে কি ফালতু বকে চলেছিস বলতো?
~ আমি বুঝতেছিনা তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো কি না? আমার তো মনে হয় তুমি আমাকে না, আমার শরীরকে ভালোবাসো! যতক্ষণ আমার কাছে থাকো আমার শরীরটা নিয়েই তো পড়ে থাকো।
~ হ্যা থাকি তো! তোর শরীর টাকেই ভালোবাসি হয়েছে, শান্তি, ।
~ ছিহ পিয়াস, তুমি একটুও প্লাটাওনি এক আছো।
পিয়াস আমার হাতদুটো মুচড়ে ধরে।
~ এই কি বলছিস! না প্লাটাইনি! কি করবি তুই ছেড়ে দিয়ে চলে যাবি? আরে বলনা কি করবি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবি! যা না যা খুন করে ফেলবো তোকে। আমার থেকে আলাদা হতে চাইলে মেরে ফেলবো। তুই শুধু আমার, আমারি থাকবি। তোকে আমি বিয়ে করেছি তোর শরীরের ওপর শুধু আমার একার অধিকার কাছে। আমি চাইলেই যা খুশি করতে পারি তুই বাঁধা দেওয়ার কে শুনি!
কথাগুলো বলেই পিয়াস আমাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে মেতে উঠলো।
আচ্ছা এই কি সেই আমার পিয়াস ভাইয়া যে কিনা ক্ষমা করে দেওয়ার জন্যে হাজার কাকুতি মিনতি করতো! সব কিছু যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে।
কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতে দেখি একজন বয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে বললেন উনি আমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন। আমি দু তিন মাস এখানে আছি, উনি আমাকে দেখতেন কিন্তু কখনো আলাপ করেননি তাই আলাপ পরিচয় করতে আসলেন। আমি চা নিয়ে এসে ওনার সামনে রাখলাম।
~ মা তুমি আবার চা করতে গেলে কেন? আমি এমনিই কথা বলতাম আর চলে যেতাম।
~ না এই প্রথম আমার বাড়িতে আসলেন শুধু মুখে কি করে যেতে দি বলেন তো!
উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেলেন।
~ বড়ো লক্ষী মেয়ে মা তুমি। আমার ছেলে মেয়েরা তো সব বিদেশে থাকে। স্বামীকে হারিয়েছি এক বছর আগে। সময় কাটে না গো মা। তাই তোমার সাথে গল্প করতে চলে আসলাম।
~ ও ভালো করেছেন। আমি এই বিকালের টাইমটা একাই থাকি, সকালে এটা ওটা কাজ করে সময় চলে যায়। বিকালে সময়টা পরিবারের সাথে ফোনে কথা বলে কিংবা বাগানের গাছগুলোতে পানি দিয়েই সময় কাটাই।
~ খুব ভালো কাজ করো মা। মা তোমরা ক ভাই বোন?
~ আমি একাই। আমার মা বাবা আমাকে খুব ছোটবেলায় রেখেই মারা যায়। আমি ছোট আম্মু ছোট আব্বু মানে আমার চাচা চাচীর কাছে মানুষ। আর আমার স্বামী পিয়াস, ইনি আমার মায়ের বান্ধবীর ছেলে। আমি খালাম্মা বলতাম আমার শাশুড়ী মাকে।
~ ও আচ্ছা। তা মা তুমি কি তোমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী?
পর্ব ৮
~ ওহ আচ্ছা। তা মা তুমি কি তোমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী?
ভদ্রমহিলার কথা শুনে আমার মাথায় যেনো বাজ পড়লো। কি বলছেন উনি! দ্বিতীয় স্ত্রী! আমি নিজের ঠোঁট দুটোয় জিহ্বা বুলিয়ে নিই।
~ আন্টি আমি আপনার কথা বুঝলাম না? আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী কেন হতে যাবো?
~ শোন মা আমি পিয়াসকে পাঁচ বছর ধরে চিনি জানি। ছেলেটা বেশ ভালো, মুরব্বিদের সম্মান করে চলে। ফ্ল্যাট এর বাচ্ছা থেকে বড়ো সবাইকে ভালোবাসে আর ওরাও ভালোবাসে। ফ্ল্যাটের আশেপাশে সবাই জানে ও বিবাহিত অবশ্য ও কিছু বলেনি কাউকে। পিয়াস ওর স্ত্রীকে নিয়ে সুখে সংসার করছিলো। অবশ্য ওর স্ত্রীর সঙ্গে আমার কোন কথা হয়নি। তবে ছাদে দেখেছি অনেক বার।
~ কি বলেন আন্টি!
আমার মন সায় না দিলেও আমি আমার ফোনের গ্যালারি থেকে অনামিকা আপুর ছবিটা ওনার সামনে কাঁপা কাঁপা হাতে ধরলাম।
~ আ, আন্টি এই কি সেই মেয়ে!
~ না মা এই মেয়ে নয়। এই মেয়ে তো জানি পিয়াস এর বন্ধু। মা সন্ধ্যা হয়ে গেলো আজ আমি উঠি।
~ জ্বী।
পিয়াস এর আগেও বিয়ে করেছে! আমার মাথা কাজ করছে না। এই মুহুর্তে আমার ঠিক কেমন আচরণ করা উচিৎ আমি বুঝে উঠতে পারছি না! শুনেছিলাম যে খালাম্মা পিয়াসকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলো, তাহলে কি! আর তাই যদি হয় তাহলে আমার কাছ থেকে পিয়াসের বিয়ের ব্যাপারটা গোপন করা হলো কেন! আচ্ছা আমি ধরে নিচ্ছি পিয়াস বিয়ে করেছে, পরিবার এর সবাই আমার কাছ থেকে গোপন রাখছে, কিন্তু পিয়াস এর স্ত্রী! মেয়েটি কোথায়! বিয়ে হয়ে যাবার পর কোন মেয়েই তো আর চাইবে না যে বিয়েটা ভেঙ্গে যাক।
তাহলে কি পিয়াস এর সাথে মেয়েটার বনিবনা হয় নাই বলে ডিভোর্স হয়ে গেছে! আর তাই জন্যই হয়তো বাবাই চেয়েছে নিজের ছেলের সংসারটাকে আবার নতুন করে সাজিয়ে তুলতে, তাই জন্য আমাকে বৌমা হিসাবে দেখতে চেয়েছে। পৃথিবীর সব পিতামাতাই তো চাইবে যে তার সন্তান ভালো থাকুক। আমি পাঁচ বছর যোগাযোগ রাখিনি হয়তো বিয়ে করেছিলো।
তাই যদি হবে আমি কেনো খবর পেলাম না! কই এমন কোনো খবর পেলাম না তো! খালাম্মা, ভাবী বলছিলো যে পিয়াস ভাইয়া অনেক কষ্টে ছিলো আমাকে ছাড়া, আমাকে একবারও তো বললো না পিয়াসের বিয়ে এর আগেও হয়েছে! বাবাই তো কিছুই বললো না!
পিয়াসকে তো এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করাই যাবে না, আর তা করলেও উত্তর পাওয়া যাবে না আমি তা নিশ্চিত। সব কিছু গোপন রাখতে চায় রাখুক। আমাকে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। নিজেই বুদ্ধি খাঁটিয়ে এই রহস্যএর ভেদ করতে হবে।
পিয়াসের জন্য খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে থেকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা টেরই পাই নি। চোখ মেলে তাকাতেই দেওয়াল ঘড়িতে চোখ পড়লো রাত 12:30। পিয়াস এখনো আসেনি, এতো লেট তো কোনদিন করে না! কল দিলাম ফোন সুইচ অফ! খুব ভয় করছে কোনো বিপদ হলো না তো! বার কয়েক ফোন করলাম। অনামিকা আপুর নাম্বার টায় কল দিলাম আপুর ফোনটাও সুইচ অফ। সারা রাতটা আমার উদ্বিগ্নে কাটলো।
ভোরের দিকে কখন চোখটা লেগে গেছে বুঝতে পারি নি। হাই তুলতে তুলতে রুমে উঠে আসি। পিয়াস বিছানায় বসে ল্যাপটপে টাইপিং করছে আর ফাইল একটা করে তুলছে আর রাখছে। আমি চুলটা হাত খোঁপা করে নিয়ে বিছানায় বসে পিয়াসের দিকে তাকালাম।
~ তুমি কখন আসছো? কাল সারারাত বাড়ি ফেরোনি না কি? আমি তোমাকে কতোবার ফোন করছি, ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিলে কেনো?
আমার কথা শুনে পিয়াস কোন রেসপন্স করলো না। তবে ওর মুখ দেখে বুঝতে পারছি ও খুব বিরক্ত হচ্ছে। আমি এবার ওর পায়ে হাত রাখলাম।
~ কি গো।
পিয়াস পা গুটিয়ে বসে জোরে গম্ভীর গলায় ধমকে উঠলো।
~ দেখছিস তো কাজ করছি। কেনো ডিস্টার্ব করছিস। যা তো এখান থেকে।
আমি শুধু পিয়াস এর দিকে একবার তাকালাম। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অনেকক্ষণ হলো ব্যালকেনীতে দাঁড়িয়ে আছি। পিয়াস এর দিকে একবার তাকালাম। সত্যিই হয়তো কাজের প্রেসার অনেক। কিছু খেয়েছে কি না কে জানে! আমি কফি বানানোর জন্য কিচেনে যেতে গেলেই কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলে দেখি অনামিকা আপু। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো।
~ গুড মর্নিং সুইটি।
~ হুম আপু।
~ কি হইছে, মুখটা এতো শুকনা লাগছে কেন?
~ কই আপু কিছু না তো।
~ হুমম বুঝেছি, হাবীর সাথে ঝগড়া হইছে বুঝি?
~ না না আপু তেমন কিছু না। তুমি উপরে যাও তোমাদের জন্য কফি নিয়ে আসছি।
কফি করে নিয়ে রুমে ঢুকতে যাচ্ছি পিয়াসের হাসির শব্দ পাচ্ছি আর অনামিকা আপুর কথা। আমি রুমে ঢুকে টি টেবিল এর ওপর ট্রে টা নামিয়ে রাখলাম। পিয়াস আমাকে দেখে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো অন্যপাশে। অনামিকা আপু হেসে ফেললো।
~ হুম বুঝেছি টোনাটুনির মান অভিমান হয়েছে।
কথাটা বলেই আমাকে আর পিয়াসকে একসাথে বসিয়ে দিলো।
~ একটা গুড নিউজ আছে। কাল আমি তোমার টোনার ইয়ে মানে তোমার হাবির পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট হয়েছি। তাই আজ আমি তোমাদের ট্রিট দিবো। আলো চটপট তৈরী হয়ে নাও আমরা লাঞ্চ করতে বেরোবো।
~ ওহ কনগ্ৰাজুলেশন! তোমরা যাও আমার ভালো লাগছে না।
~ আলো এটা স্পেশালি তোমার জন্য প্লান করলাম। প্লিজ চলো।
আমি পিয়াস এর দিকে একবার তাকালাম। পিয়াস শার্ট এর বোতাম আটকাচ্ছে। আমি মুখে শুকনো হাসি টেনে আনলাম।
~ আপু আমার শরীরটা ভালো লাগছে না তোমরা যাও।
~ কিন্তু আলো, ঠিক আছে জোর করবো না তোমায়।
পিয়াস একবারও আমাকে বললো না যাওয়ার কথা। ওরা দুজনে চলে গেলো।
আমি ওয়াশরুমে গিয়ে একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। বিছানায় শুয়ে চুলটা ঝুলিয়ে দিলাম। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। পিয়াস বিয়ে করেছিলো। ওর স্ত্রী এই বাড়িতেই ছিলো। এই বাড়িটা তল্লাশি করলে কেমন হয়! কিছু না কিছু তথ্য তো পাবোই!
প্রায় এক ঘন্টা ধরে পুরো বাড়ি চিরুনি তল্লাশি চালালাম। এই বাড়িতে কিচেন রুম ছাড়া ওপর নীচ চারটা রুম রয়েছে। না কোন কিছুই পেলাম না। তাহলে কি ওই আন্টি মিথ্যা কথা বললেন! তাই যদি হবে ওনার স্বার্থ কি আছে এর মধ্যে!
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে পানি খেয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখতে গিয়ে চোখ পড়লো একটা দরজায়।
এটাও একটা রুম, এতোটা কোণে থাকায় নজরে আসেনি এতোদিন। রুমটা লক ছিলো না, খুলতেই বুঝলাম এটা স্টোর রুম। অনেক জিনিস পত্র সব ধূলায় ভর্তি। আমি মুখে আঁচল চাপা দিই। কিছু জিনিস নাড়াচাড়া করতেই একটা……
পর্ব ৯
কিছু জিনিস নাড়াচাড়া করতেই বেরিয়ে এলো একটা ধূলায় মাখা গোলাপী রঙের ডায়েরি। আমি ডায়েরিটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঝেড়ে নিলাম। দেখলাম ডায়েরির ওপর আঁকা সোনালী রংএর ময়ূর, যা ডায়েরির আকর্ষণ দিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। কার ডায়েরি এটা! পিয়াস যে ডায়েরি লেখেনা তা আমি খুব ভালো মতোই জানি। তাহলে কি..!
আমি ডায়েরি টা পেছন থেকে খুলতে থাকি, সাদা দুধের মতো মসৃণ পাতা গুলো বেশ কিছু উল্টানোর পর নীল কালিতে দু লাইনের লেখাটায় চোখ আটকে গেলো।
~ না আমি পারলাম না। হাজার চেষ্টা করেও সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে পারলাম না।
লেখাটি পড়ে আমি ডায়েরিটা ঝপ করে বন্ধ করে দিলাম। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তাহালে কি ওই মহিলার কথাই সত্যি! পিয়াস বিয়ে করেছিল! হুম হয়তো পিয়াস এর আগের স্ত্রী ডায়েরি লিখতো! হ্যা এটাই হবে।
আমি এবার ডায়েরির প্রথম দিকে খুলতে যাবো, কলিং বেলের আওয়াজে থেমে গেলাম। ডায়েরিটা কোল থেকে নামিয়ে রেখে রুম থেকে দরজা খোলার জন্য বেড়োতে গেলাম, পিছনে ফিরে ডায়েরি টার দিকে একবার তাকালাম। ডায়েরিটা নিয়ে বেরিয়ে এসে রুমটা বন্ধ করে ড্রয়িং রুমের সোফার নীচে রেখে দিলাম। দরজা খুলতেই দেখলাম পিয়াস হাতে কিছু প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
~ দরজা খুলতে এতো সময় লাগে কেন তোর? কি এতো কাজে ব্যস্ত ছিলি?
পিয়াস কথাগুলো বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে। ডাইনিং টেবিলে প্যাকেট গুলো রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে যেতে বলে যায়,
~ খাবার আছে খেয়ে নে।
আমি প্যাকেট গুলো খুলে দেখি আমার পচ্ছন্দের খাবার তার সাথে আইসক্রিম আর চকলেট আছে।
আমি ঝটপট খাবার গুলো খেয়ে নিই। একছুটে রুমে চলে যাই। পিয়াস তখন মাথায় এক হাত রেখে শুয়ে আছে। আমি পিয়াস এর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ি। এক হাতে মাথা উঁচু করে তুলে ধরে পিয়াসের হাতের ওপর হাত রাখি।
~ উফ, সরে যা তো ভালো লাগছে না।
আমার হাতটা সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে কথাগুলো বলে পিয়াস আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
~ এই কি হয়েছে তোমার বলোতো? এমন ব্যবহার কেনো করছো তুমি?
আমি পিয়াসকে টেনে তুলে কথাগুলো বললাম। পিয়াস আমার গায়ে হাত তুলতে গিয়েও থেমে গেলো।
~ কি হলো থামলে কেনো? মারো আমায়, আরে মারো না। তুমি অবশ্য গায়ে হাত তোলা ছাড়া আর কি পারো!
~ তুই কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস না আলো। গতকাল সকাল থেকে তুই কি সব আজব কথা বলে চলেছিলিস মনে আছে! হুম আমরা স্বামী স্ত্রী আলো তাই তো! তোকে আমি স্পর্শ করলে আমার ছোঁয়া তোর বিষের মতো লাগে তাই না রে? আমি তোর স্বামী, তোকে আমি পবিত্র ভাবেই স্পর্শ করি কিন্তু তুই সেটাকে ছিহ্, ।
আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পিয়াস উঠে দাঁড়ায়। বেড সাইডের টেবিল থেকে বাইকের চাবিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি তিন চার বার ডাকলাম, সাড়া না দিয়েই চলে গেলো।
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ সোফায় বসে রইলাম। একটু পর উঠে সোফার তলা থেকে ডায়েরিটা বের করে বসলাম। ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় একজন সুদর্শন পুরুষ এর ছবি সেলোটেপ দিয়ে আঁটা। আর তারপরের পৃষ্ঠাতেই লেখা,
~ আমি জানতাম আমার আব্বু আম্মুর পচ্ছন্দ কখনো খারাপ হতেই পারে না। আব্বু বলেছিলো আমার জন্য রাজপুত্র এনে দিবে। সত্যিই আমাকে রাজপুত্র এনে দিয়েছে। আল্লাহ এবং আমার আল্লাহ সমান আব্বু আম্মু কে কোটি কোটি শুকরিয়া।
লেখাটা পড়ে আমি এতোটা বুঝলাম যে এটা কোন মেয়ের লেখা। কিন্তু এখানে ডায়েরি! ছবি! সম্পর্ক টিকলো না! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কি এগুলো!
পর্ব ১০
আমি কিছুক্ষণ সোফায় চুপচাপ বসে রইলাম। একটু পর উঠে সোফার তলা থেকে ডায়েরিটা বের করে বসলাম। ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় একজন সুদর্শন পুরুষ এর ছবি সেলোটেপ দিয়ে আঁটা। আর তার পরের পৃষ্ঠাতেই লেখা,
~ আমি জানতাম আমার আব্বু আম্মুর পচ্ছন্দ কখনো খারাপ হতেই পারে না। আব্বু বলেছিলো আমার জন্য রাজপুত্র এনে দিবে। সত্যিই আমাকে রাজপুত্র এনে দিয়েছে। আল্লাহ এবং আমার আব্বু আম্মুকে কোটি কোটি শুকরিয়া।
লেখাটা পড়ে আমি এতোটা বুঝলাম যে এটা কোন মেয়ের লেখা। কিন্তু এখানে ডায়েরি! ছবি! সম্পর্ক টিকলো না! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কি এগুলো!
সব কিছুই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আমি আবার আগের পাতায় ফিরে এলাম ছবিটার দিকে ভালো করে তাকালাম। অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেও ছেলেটিকে আমি চিনতে পারলাম না। দুটো পাতা উল্টে দেখলাম,
~ আল্লাহকে কোটি কোটি শুকরিয়া আমাকে এতো সুখী করার জন্য। সত্যিই আজ আমি অনেক সুখী।
আরো দুটো তিনটে সাদা পাতা উল্টে দেখলাম,
~ ইদানীং যেনো ও বড্ড বেশী বদলে গেছে। রাত করে বাড়ি ফেরে। কিছু বললেই গায়ে হাত তোলে।
আর একটা পাতা উল্টে,
~ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আত্মহত্যা যদি পাপ কাজ না হতো আমি তাহলে নিজেকে শেষ করে ফেলতাম।
এতোটুকু পড়েই বুঝতে পারছি মেয়েটির বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। তার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। কিন্তু এটা পড়ে বুঝতে পারছি না এর সাথে পিয়াস এর কি সম্পর্ক? কে এই মেয়ে? এই ডায়েরি এখানেই বা কেন?
অনেকগুলো পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে লেখা হুম তারিখ দেখে মনে হচ্ছে প্রায় ছয়মাস পর।
~ আল্লাহ আমার কথা শুনেছে, আমার দোয়া কবুল করেছে। এই মানুষটা ভীষণ ভালো। আমাকে মাথার ওপর ছাদ দিয়েছে, পড়ার কাপড়, খাবার সবকিছু দিয়েছে। মানুষটা জন্য আমার জীবনে ফেরেশতা।
আমি যদি খুব ভুল না করি তার মানে এই মানুষটাই পিয়াশ। হয়তো মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়েছিল। আবার বেশ কিছু পাতা উল্টে লেখা,
~ সত্যিই পিয়াস সাহেব মানুষটা ভীষণ মহান। ওনার জন্যই আমি আমার সংসার ফিরে পেলাম। আমার স্বামী আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। আবার আমরা এক হলাম। আজ পিয়াস সাহেবের একটা কথা বেশ মনে ধরেছে আমার, আমার যদি বোন থাকতো তাহলে আমি তার বিপদে এইভাবেই সাহায্য করতাম।
এরপরের সব পাতা সাদা শেষের পাতা খুললাম। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। পুরো ডায়েরি পরে বুঝলাম এক অসহায় মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিল পিয়াস। তাকে বোনের মতো আগলে রেখেছিল। ইসস আর আমি কি না কি সব কথা শুনে পিয়াসকে! কিন্তু এরপর মেয়েটির কি হল জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে!ডায়েরি থেকে মুখ তুলে ওপরে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে যাই। পিয়াস আমার সোজাসুজি বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কি বলবো বুঝতে পারি না, আমি উঠে দাঁড়াই।
~ আলো।
~ ইয়ে মানে পিয়াস আমি..।
~ তোর পিয়াস অতোটাও খারাপ না। এই পিয়াসের বুকে আলোই আছে আর আলোই থাকবে।
পিয়াস এগিয়ে এসে আমার কপালে গাঢ় চুম্বন করলো। আমি আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলাম। কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকলাম দুজনে।
~ ওই মেয়েটার নাম কি ছিল? তুমি ও কে কোথায় পেয়েছিলে? ওই মেয়েটি এখন কোথায়?
~ মেয়েটির নাম খুশবু। এই ঢাকা শহরেই থাকে। আমার গাড়ির তলায় মেয়েটি চাপা পড়ে যেতো যদি আমি অসাবধান হতাম। মেয়েটিকে দেখে মনে হয়েছিলো খুব ক্লান্ত ক্ষুধার্ত। আমার বাড়িতে নিয়ে চলে আসি। ওর মুখে ওর স্বামীর করা অত্যাচার এর কথা শুনি। মনস্থির করি ও কে আমিই এখানে রাখবো। মেয়েটির বাবা মা মারা যাওয়ায় মেয়েটি অনেক একা। তার বেশ কিছু দিন পর খুশবুর স্বামী ওর খোঁজ করতে করতে আমার বাড়ি চলে আসে। পায়ে হাতে ধরে নিয়ে যায়।
কিছু দিন সব কিছু ঠিকঠাক চললেও আবার অত্যাচার শুরু হয়। আমি খুশবুকে বলেছিলাম আমাকে যেনো নিজের বড়ো ভাই মনে করে। সমস্যা হলেই আমার কাছে চলে আসে। দু চার মাস পর রাত তখন 10:00 টা ড্রয়িং রুমে বসে থেকে উঠতে যাবো বেলের আওয়াজ পাই। দরজা খুলতে দেখি খুশবু কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছে। জিজ্ঞাসা করাতে বললো ভাইয়া আমাকে অনেক মেরেছে। খুশবুর কান্না দেখে আমার চোখেও পানি টলমল করছিলো। সেদিন আমার অনেক কষ্ট হয়েছিলো। তবে এখন ও ভালো আছে অনেক ভালো আছে নিজের মতো বাঁচতে পারছে। ও এখন একটা বাচ্চাদের স্কুলের টিচার মিরপুরে আছে।
পিয়াস আমাকে ছেড়ে চোখের পানি মুছে নিলো।
~ আমি অনেক বড়ো অপরাধ করেছি। এই অত্যাচার আমি তোর ওপর করতাম। তুই যে কতোটা কষ্ট পেতিস আমি যে তা বুঝতে পারছি রে। আমি, ।
আমি পিয়াস এর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিলাম।
~ আমিও তোমাকে ভুল বুঝে ছিলাম ওই ফ্ল্যাটের আন্টি টার কথায়।
~ আচ্ছা ছাড় এসব আর শোন তুই এখন অনামিকার বাড়িতে যা তোর প্রয়োজন আছে।
~ আপুর কিছু হয়েছে নাকি!
~ আমি কি জানি।
এখন বাজে রাত 11 টা অনামিকা আপুর কাছে বসে আছি। কিছুই হয়নি আপুর, অফিসের অনেক কাজ আমার সাথে গল্প করতে করতে কাজ করবে বলে ডাকলো আমায়।
আমি বিছানায় বসে পা দুলাচ্ছি আর চকলেট কামড়াচ্ছি। দু বার ঘুম দেওয়াও হয়ে গেছে। আর আমার বরটাই বা কেমন বউকে বান্ধবীর কাছে পাঠিয়ে খালাস। খোঁজ নিচ্ছে না এতো দেরী কেনো হচ্ছে!
রাগে গজগজ করতে করতে চলে আসলাম বাড়িতে। কলিংবেলের সুইচে হাত দিতে যাবো তার আগে দরজায় হাত রাখতেই দরজাটা খুলে গেলো।
ভেতরে একদম কালো কুচকুচে অন্ধকার। তখন তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেছি ফোনটাও নেওয়া হয়নি সাথে। আমি হাতড়ে হাতড়ে পা পা গেলাম। একটা লাইট আমার ওপর পড়লো। একটু অবাক হলাম সেই লাইটের ইশারায় একটা জায়গায় এসে থামলাম। উঁচু পাহাড়ের মতো কিছু একটা রাখা আছে তার ওপর একটা ক্রিম কালারের কাপড়। কাপড়টা তার ওপর থেকে সরাতেই আমার বুক সমান একটা কেক, আর তার সাথে সাথে, লাইট জ্বলে উঠলো। কানে ভেসে আসছে হাততালির শব্দ, আর শুনছি,
~ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ আলো।
আমি তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। খালাম্মা, বাবাই, বড়ো ভাইয়া, ভাবী, ছোট আম্মু, ছোট আব্বুরা সবাই হাততালি দিচ্ছে আর মুখে উইশ করছে। পিয়াস আমার কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো। আর পিচ্চি বাবুটা আমার হাতের আঙ্গুল গুলো টেনে ধরে বলছে,
~ হ্যাপি বার্থডে আলো মা। আজ তো তোমার জন্মদিন তুমি কেক কাটো।
এখন রাত বারোটা। আজ আমার জন্মদিন। আমি তো নিজেই ভুলে গেছিলাম। এই জন্মদিনের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই আমাকে অনামিকা আপুর বাড়িতে পাঠানো হয়েছিলো!
~ ওই আলো কেক টা কাট।
আমি পিয়াস ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ছুরিটা তুলে নিলাম। ক্যান্ডেল গুলো নিভাতে যাবো আর তখনই,
পর্ব ১১
ছুরিটা হাতে নিয়ে ক্যান্ডেল গুলো নিভাতে যাবো আর তখনই আমার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেলো।
প্রায় কতক্ষণ পর চোখ খুললাম জানি না! আমি চোখ মেলে তাকাতেই বুঝতে পারলাম আমি বিছানায় শুয়ে আছি। ছোট আম্মু আমার এক হাত ধরে আছে। খালাম্মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর হাসছে। সোজা তাকাতেই দেখি বাবাই, বড়ো ভাইয়া, ছোট আব্বু হাসছে। ভাবী আমার কাছে বসে আমার গালের থুতনি ধরে হাসে।
~ আমরা তোকে তোর জন্মদিন এর উপহার দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তুই তো আমাদের কেই এতো বড়ো একটা উপহার দিয়ে দিলি।
আমি ভাবীর কথা শুনে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে আছি, আসলে ভাবী কি বলছে সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
~ ভাবী আমি আবার কি উপহার দিলাম তোমাদের? আমি তো কিছুই বুঝতেছিনা!
আমার কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। পিচ্চি বাবুটা আমার কোলে উঠে বসে।
~ আরে আলো মা তুমি তো একটা জুনিয়ার গিফট করেছো। মাম্মাম বলেছে আমি তার সাথে খেলা করবো।
এবার আমার আর বুঝতে বাকি রইল না। তার মানে আমি! আমার মধ্যে একটা ছোট্ট প্রাণের সঞ্চার হয়েছে!
~ ও আলো মা জুনিয়র কবে আসবে গো? বলো না বলো না আমি তো তার সাথে খেলা করবো!
পিচ্চি বাবুটার কথায় হুশ ফিরলো। আমি সামান্য চমকে উঠতেই খালাম্মা আলো বলে ডাকলে আমি খালাম্মার বুকে মুখ লুকাই। সবাই আরো জোরে হেসে ওঠে।
~ আলো লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আজ থেকে যে আমাদের সবার আনন্দের দিন।
~ খালাম্মা আমি..!
~ হ্যা আলো তুই মা হতে যাচ্ছিস।
আমি তো আমার কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি মা হব! কেউ আমাকে মা বলে ডাকবে!
খালাম্মার বুক থেকে মাথা তুলে সোজা তাকাতেই দেখলাম পিয়াস দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিয়াস এর চোখে কিছু একটা কাজ করছে কিন্তু সে টা কি আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
সবাই হয়তো বুঝতে পেরেছে আমাদের দুজনকে স্পেস দেওয়া দরকার। তাই একে একে সবাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো। পিয়াস দরজাটা বন্ধ করে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো।
এবার কিছুটা ছুটে এসেই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আমার কপালে, চোখে, গালে চুমু দিয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর আমার পেটের কাছে হাত রাখে।
~ আলো সত্যিই কি তোর পেটে একটা ছোট্ট প্রাণ আছে! যে আমাকে আধো আধো গলায় বাবা বলে ডাকবে আর তোকে মা বলে ডাকবে।
আমি কিছু বলতে পারছি না আমার মুখের ভাষা যেনো হারিয়ে গেছে। ছলছল চোখে পিয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি এবার শক্ত করে পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। পিয়াস নিজের বুকের ওপর থেকে আমাকে তুলে আমার চোখ দুটো মুছিয়ে দেয়।
~ আরে অ্যাই পাগলী কাঁদছিস কেন? জানিস আলো আমি আজ খুব খুব খুশি আমি বাবা হব।
~ পিয়াস …. পিয়াস আর আমি মা হব। আমিও মা হব পিয়াস। আমার ভেতরে একটা ছোট্ট প্রাণ আছে ভাবলেই আমার মনে কেমন যেনো একটা ফিলিংস হচ্ছে।
~ আলো আমার কিন্তু একটা রাজকুমারী চাই!
~ না রাজকুমার।
না রাজপুত্র না রাজকন্যা করতে করতে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। কিন্তু কোথাও পিয়াস নেই। আমি উঠে ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পিয়াস দেখলাম নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলো।
~ গুড মর্নিং আমার রাজকন্যার মা।
~ ভেরী গুড মর্নিং আমার রাজপুত্রের বাবা।
আমি মুখে লম্বা হাসি টেনে এনে কথাটা বললাম। পিয়াস মুখটাকে পেঁচার মতো করে নাস্তার প্লেট নিয়ে আমার সামনে এলো।
~ সময়েই দেখা যাবে এখন আয় খেয়ে নে।
~ তুমি আমার জন্য নাস্তা আনতে গেলে কেন? আমি তো নিচেই যাচ্ছিলাম।
~ তুমি এখন কোন কাজ করবে না। তোমাকে টাইমে টাইমে আমি নিজে হাতে খাওয়াবো বুঝেছো।
~ তুমি খাইয়ে দিবে।
পিয়াস আর কিছু না বলে আমাকে খাইয়ে দিয়ে রেডি হতে বললো ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাবে। ডক্টর এর সাথে মিট করে গাড়িতে বসলাম। আধঘন্টা হয়ে গেলো গাড়িতে বসে আছি। গাড়ি চলছে না থেমে আছে সেটাই বুঝতেছিনা। অনেক গাড়ির আওয়াজ পাচ্ছি।
~ পিয়াস গাড়ি থেকে আমাকে নামিয়ে দাও। আমি হেঁটে চলে যেতে পারবো।
~ তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? আলো ভুলে যাস না এখন আর তুই একা নেই, যে দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করবি। আর এই দুপুর রোদ্দুরে তুই হাটতে যাবি কেন গাড়ি থাকতে? আর আমরা তো গাড়ি করেই বাড়ি যাচ্ছি।
~ ও আমি গাড়িতে আছি! আমি তো ভাবলাম শুধুই বসে আছি।
~ গাড়িতে উঠে কি মানুষ বসে থাকে না কি। দেখতে পাচ্ছিসনা আমি ড্রাইভ করছি?
~ কি জানি এর থেকে তো মনে হয় গরুর গাড়ির স্পীড বেশি।
~ গরুর গাড়ি! তুই কি বলছিস।
আমি এবার পিয়াসকে ধমকে উঠি।
~ তুমি জোরে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছো না। এমন করলে তো রাত হয়ে গিয়ে ভোর। হয়ে যাবে বাড়ি ফিরতে।
~ তো! দু দিন লেগে যাক বাড়ি ফিরতে আমি এভাবে যাবো। শুনলিনা ডক্টর কি বললো সাবধানে চলাফেরা করতে। আমি বেশি গাড়ির স্পীড তুলবো না। এভাবেই যাবো আমি।
উফফ এই পিয়াস এর বাচ্চাটাকে আমি যে কি করি, ।
~ পিয়াস তুমি এভাবে গাড়ি চালাচ্ছো অনেকের সমস্যা হচ্ছে রাস্তায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখো আমাদের গাড়ির পেছনে কতো গাড়ি।
পিয়াস আমার কথা শুনে গাড়ি একেবারেই থামিয়ে দিয়ে নীচে নামলো।
~ শুনুন আপনাদের সবাইকে বলছি আমার বউ মা হতে চলেছে। আমি আমার বউকে খুব ভালোবাসি। তার যত্নের ত্রূটি রাখতে চাই না। ও কে সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। আমি এইভাবেই আস্তে আস্তে গাড়ি চালাবো। আপনাদের সমস্যা হলেও আমিও দেখবো না।
পিয়াসের এই কথা শুনে সবাই হ্যা সূচক সম্মতি জানালো। আমার তো লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার লোক গুলো হয়তো কি না কি ভাবছে। তারা হয়তো মজাও পেলো, কারণ স্ত্রীর জন্য কেউ এভাবে গাড়ি চালায়! পিয়াস ঝপ করে এসে বসে পড়লো।
~ কারুর কোনো সমস্যা নাই। আমি এভাবেই যাবো।
~ তুমি পারোও বটে। আচ্ছা লোকেরা কি ভাবছে বলো তো!
~ কি আর ভাববে! ওরা ভাববে আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি।
~ ছাই, লোকে ভাববে তুমি বউ পাগলা।
বাড়ি ফিরে সবাইকে কথাগুলো বলতে সবাই হেসে লুটোপুটি খায়।
পিয়াসের হাত দুটো শক্ত করে ধরে আছি। পিয়াস আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি কাঁদছি, আমার মনের ভিতর আনচান করছে। আমি সব কাটিয়ে উঠতে পারবো তো!
~ পিয়াস আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি সব সামলে উঠতে পারবো তো?
~ ভয় পেও না সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আমার চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পিয়াস আমার হাত দুটো ধরে আছে। ওর চোখেও পানি টলমল করছে। কিন্তু আমরা দুজনে হাসছি আমাদের সন্তানের দিকে তাকিয়ে।
~ দেখলে তো সৃষ্টিকর্তা আমাদের দুজনের কথাই রেখেছে। রাজকন্যা আর রাজপুত্র দুটাই আমাদের দিয়েছেন।
~ হ্যা আলো আমাদের আশা পূরণ হয়েছে।
দেখতে দেখতে আমাদের কুড়ি বছর কেটে গেছে। এই কুড়ি বছরের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি বাবাইকে, ছোট আব্বুকে, খালাম্মাকে। ছোট আম্মুও শষ্যাশায়ী, যাই হোক মানুষ তো মরণশীল। আমি খুব সুখী আমার দুই সন্তান আর আমার স্বামীকে নিয়ে। আমার মনে আর কোন সংশয় বা খুঁত নেই।
পিয়াস আমাকে সত্যিই ভালোবাসে নিজের থেকেও বেশি। আমার জীবনে এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও আবার আমি সুখ পেয়েছি আর এই সুখ চিরস্থায়ী। পিয়াসের সত্যিকারের ভালোবাসা টানেই হোক বা আমার ভালবাসার টানে আমরা দুজন দুজনের সাথেই আছি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আর মিটিমিটি হাসছি। আমার কোমড়ে কারোর হাতের স্পর্শ পাই। বুঝতে পারি পিয়াশ এসেছে। আমি কিছু না বলেই তার দিকে ফিরে দু হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরি।
~ কি ব্যাপার আজ হঠাৎ এতো রোমান্টিক!
~ কেনো তোমার বর বুঝি রোমান্টিক নয়?
~ না তা নয় বুড়ো হয়ে গেছো তো। সামনের চুলগুলোতে পাক ধরেছে। এখনো রোমান্টিক থাকতে পারো তুমি সেটাই ভাবছি!
~ কি আমি বুড়ো! রোমান্টিক আছি কি না দেখতে চাও!
পিয়াস আমার দিকে ঠোঁট এগিয়ে আনছে দেখে আমি তার ঠোঁটে হাত চাপা দিয়ে দিলাম।
~ পিয়াস একদম না। বাচ্চারা আছে, যেকোন মূহুর্তে চলে আসতে পারে।
~ তাতে আমার কি! বাচ্চারাও তো দেখুক তার বাবা মার মধ্যে এখনো কতো প্রেম আছে।
কথাটা বলেই পিয়াস আমার ডান গালে গভীর ভাবে একটা চুমু দেয়। আর তখনই আমার মেয়ে ঋতজা এসে ক্যামেরায় আমাদের মুহুর্তটা বন্দী করে নেয়।
~ পাপা ইউ আর সো রোমান্টিক কাপল।
আমি পিয়াস এর দিকে সামান্য রাগী চোখে তাকাই, কিন্তু আবার ভালও লাগলো। আমার ছেলে ঋভু এসে তার এক হাত বাবার কাঁধে আর এক হাত আমার কাঁধে রাখলো।
~ পাপা আর মাম্মাম এরা তো রোমান্টিক তা তুই আজ জানলি। আমি তোর থেকে অনেক আগেই জানি। আমি তো ভাবছি পাপাকেই ফলো করবো।
আমার ছেলে মেয়ে এসে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলো। আকাশে বাতাসে আমাদের সুখী পরিবার এর হাসির শব্দ উড়ছে। আমি আর পিয়াস দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকালাম। চোখের ইশারায় জানালাম,
“আমার তুমি আছো “
লেখা – সুশমিতা জানা
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “আমার তুমি আছো (সিজন ২: শেষ খণ্ড) – Abegi moner kichu kotha” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – আমার তুমি আছো (সিজন ২: ১ম খণ্ড) – Moner abegi kichu kotha