একটুখানি রোদ – সংসারের গল্প

আমার শাশুড়ি আমাকে দেখতে পারেন না। তার অনেক কারণ আছে‌। আমি শ্যামলা, গাঢ় শ্যামলা। তার দুধে আলতা রঙের বউ লাগতো। তিনি তার ডাক্তার ছেলের জন্য ডাক্তার বউ চেয়েছিলেন। আমি টেনেটুনে ডিগ্রী পাশ। তার ইচ্ছা ছিলো বড় ঘরে ছেলের বিয়ে দেওয়া। আমার বাবা সামান্য হাইস্কুলের টিচার। সেই স্কুলটিও বেসরকারি। এই বছর এমপিওভুক্ত হয়েছে। এখনো সব কাগজপত্র পুরোপুরি আসেনি।

এই অবস্থায়, তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে হবার কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। তবুও হয়ে গেলো। হয়ে গেলো তার ছেলের কারণে। তার ছেলে ইফতি, আমার আপুর বান্ধবীর খালাতো ভাই। সেই বান্ধবীর মাধ্যমেই আমাদের পরিচয়। সে নাকি প্রথম দেখাতেই আমার প্রেমে পড়েছিলো। কেন পড়েছিলো, জানি না। সে আমাকে বলেছিলো, আসলে নাকি আমার চোখের প্রেমে পড়েছিলো সে। আমার চোখ নাকি ভীষণ গভীর। এমন গভীর চোখ নাকি আর কারো নাই।

আমি যদিও তার কথা বিশ্বাস করিনি।
আমাদের বিয়েটা হলো অনেক অনেক ঝামেলা করে। বিয়ের দিন ইফতির মা এলেন না। তিনি তো আমাকে পছন্দই করেননি একফোঁটাও, আসবেন কেন বিয়েতে। আমিও বললাম, বিয়ে করবো না। যে বিয়ের শুরুতেই এতো ঝামেলা, সেখানে বিয়ে হলে ঝামেলা আরো বাড়বে, একটুও কমবে না। ইফতির জন্যই শেষমেষ বিয়েটা করতে হলো। ও আমার হাত ধরে চোখে চোখ রেখে বললো, ‘আমি সব সামলে নিবো। ট্রাস্ট মি।’ ওর চোখের দিকে তাকানোই আমার ভুল হয়েছিলো সেদিন। আমার চোখ নাকি গভীর। অথচ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কোনো তল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার এক বিশাল বড় সর্বনাশ হয়ে গেলো সেদিন। আমি ওর চোখে ডুবে গেলাম।
আর আমাদের বিয়েটাও হয়ে গেলো।

বিয়ের পরদিন, সকালবেলায়, আমার শাশুড়ি আমাকে ডাকতে এলেন। সকাল ঠিক ছ’টায়। এসে বললেন, ‘গোসল করে রান্নাঘরে চলে এসো।’
ইফতিও তখন উঠে পড়েছে। ওর মায়ের কাছে গিয়ে বললো, ‘ও রাতে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছে। আরেকটু ঘুমাক। রান্নাঘরে যাবার জন্য তো সারাজীবনই পড়ে আছে।’
আমি আর ওর মা দুজনেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর মা আর কিছু না বলেই চলে গেলেন। আমি শাশুড়ির পিছু পিছু যাচ্ছিলাম, ইফতি আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো, ‘কই যাও?’
‘রান্নাঘরে।’
‘কেন? মানা করলাম না?’

‘এভাবে মানা করা ঠিক হয়নি। উনি গুরুজন, উনার মুখের ওপর এভাবে মানা করা যায় না।’
ইফতি হাত ধরে টান দিয়ে বললো, ‘এত্তো ভালো বউগিরি দেখাতে হবে না। চুপচাপ গিয়ে ঘুমায় পড়ো। দশটার আগে উঠবা না। আম্মাকে আমি সামলাচ্ছি।’
আমি ইফতির কথা শুনে শুতে গেলাম, কিন্তু ঘুম এলো না। ইফতি এর মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে কই যেন ঘুরে এলো। মনে হয় মাকে ম্যানেজ করে এসেছে। এসেই গোসল করে ফিটফাট হয়ে পড়লো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কই যাও?’

‘চেম্বার করে আসি। ছুটি নেই নাই তো আজকে। দুদিন পর হানিমুনে যাবো, তখন লম্বা ছুটি নিবো।’
আমি উঠে রান্নাঘরে গেলাম। মা দেখলাম রুটি বেলছেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘুমাও নাই?’
‘না মা। আমি রান্না করি আপনার সাথে?’

উনি ভীষণ রকম শীতল এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না। আজকে তোমার ছুটি। তোমার কোনো কাজ করতে হবে না।’
সেই শীতল দৃষ্টিতে আমার ভেতর পর্যন্ত জমে গেলো। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।

সকাল দশটার পর, আমাদের নাস্তা করা কেবল শেষ হয়েছে, সেসময় আশেপাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী আন্টিরা এলেন আমাকে দেখতে। আমাকে দেখেই তাদের কানাঘুষা শুরু হলো। কিন্তু তারা কানাঘুষা একটু উঁচু শব্দে করছিলেন কিনা, কথাগুলো আমরা সবাই শুনতে পারছিলাম। তাদের কথাগুলোর সারমর্ছিম ছিলো এই- ‘এত্তো সুন্দর একটা ছেলে এমন কালো মেয়েকে কিভাবে বউ করে নিয়ে আসলো? ফেঁসে গেছিলো নাকি?’
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের দৃষ্টিতে আগুন। ভীষণ উত্তপ্ত সেই আগুনে আমার পুরো অস্তিত্ব জ্বলতে লাগলো। তার আজকের এই যে অপমানটুকু হলো, তার সবটুকু দায়ভার যেন আমার।

সেদিন থেকেই বুঝলাম, তিনি তার সেই অপমানের প্রতিশোধ নেবেন। আমাকে তিনি শান্তিতে থাকতে দেবেন না।
আমাদের হানিমুনে যাবার দুদিন আগের কথা। সন্ধ্যায় আমরা সবাই একসাথে বসেছি‌। ইফতি বললো, ‘আমরা পরশুদিনই রওনা দেবো। দুদিন থাকবো কক্সবাজার, দুদিন সেন্টমার্টিন। এরপর সেখান থেকে বান্দরবান গিয়ে দুদিন বান্দরবান থেকে তারপর ঢাকা রওনা হবো। আমাদের দুজনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে।’
মা চুপচাপ শুনছিলেন। আমি জানি, নিশ্চয়ই ইফতি এই ব্যাপারে তাকে আগে বলেছে‌। একবার না, অনেকবার বলেছে‌। তবুও শেষকথাটা শুনে তিনি যেন ভয়ানক আঁতকে উঠে বললেন, ‘তোরা দুজন যাবি মানে? আমরা যাবো না?’

ইফতি অবাক হয়ে বললো, ‘তোমরা কেন যাবে?’
মা মুখটা দুখি দুখি করে বললেন, ‘আমি সারাটা জীবন শুধু এই সংসারের পিছনে খেটেছি। তোদের মানুষ করেছি। একটা বারও নিজের স্বাদ-আহ্লাদের দিকে তাকাই নাই। ছোটবেলা থেকেই আমার সমুদ্র দেখার শখ। তোর বাবাকে বলতাম। তিনি হাসি হাসি মুখে বলতেন- ছেলেরা বড় হোক শায়রা, এরপর আমরা আমাদের শখ মেটাবো। ছেলেরা বড় হলো। কই, শখ তো মেটানো হলো না আমাদের।’

ইফতি বললো, ‘মা, তুমি কি বলতে চাও বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমারও তো বুঝতে হবে। এটা আমাদের হানিমুন। আমাদের দুজনকে একটু আলাদাভাবে চেনার, জানার সুযোগ হবে হানিমুনে। তোমার শখ আমি অবশ্যই পূরণ করবো। কিন্তু সেটা পরে। আর একমাস পরেই আমরা পুরো পরিবার ঘুরতে যাবো কক্সবাজার। কিন্তু শুধু এই ক’টা দিন আমাদের দুজনের। আমাদের একা যেতে দাও।’

মা সোফা ছেড়ে উঠে ঘরে যেতে যেতে বললেন, ‘বুঝলাম বাবা। হয়েছে আমার সমুদ্র দেখা। যেই ছেলে বিয়ের পরদিন চেম্বার করতে যাওয়া লাগে, সে নাকি আমাদের আবার ছুটি নিয়ে সমুদ্র দেখাবে। থাক বাবা, তোরা যা। আমার আর সমুদ্র দেখার দরকার নেই।’
ইফতি ভয়ানক অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। শেষে আমিই বললাম, ‘চলো, সবাইকে নিয়েই যাই। আমাদের চেনা জানার জন্য তো সারাটা জীবন পড়েই আছে। এমনভাবে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে ঘোরার সুযোগ হয়তো আর পাবো না। চলো, আমরা সবাই মিলেই যাই।’

দুদিন পর,ইফতি, আমি আর ওর বাবা-মা চললাম আমাদের হানিমুনে। আমার দেবর এলো না। সে ভীষণ রেগে ওর মাকে বললো, ‘এইসব গেইম খেলা বন্ধ করো তো মা। বিয়ে তো হয়েই গেছে। এবার ভাইয়া আর ভাবীকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।’
আম্মাও প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন, ‘গেইম খেলছি মানে? তোর কি মনে হয় আমি ফাজলামি করছি? তুই ছোট থেকে বেয়াদব ছিলি, এখনো বেয়াদব রয়ে গেলি।’
আমরা কক্সবাজার গেলাম। কক্সবাজারে আগেই একটা হোটেল রুম বুক করা ছিলো। আর রুম পাওয়া গেলো না। আমরা বাবা-মাকে নিয়ে এক রুমেই থাকলাম।

আমাদের ছটা দিন বাবা-মায়ের সাথে কেটে গেলো। মা অতিযত্নে একটুও আমাদের কাছ-ছাড়া হতেন না। আমাদের দুজনের একান্তে কাটানো সময় মাঠে গুলি খেয়ে মারা গেলো।
আমরা ঢাকায় ফিরলাম।
এরপর মায়ের সাথে আমার ভীষণ সুন্দর সময় কাটানো শুরু হলো। মা অতিযত্নে আমার প্রত্যেক কাজে খুঁত ধরতে লাগলেন। রান্না করতে গেলে আমাকে কঠোরভাবে নির্দেশনা দিতে লাগলেন। রুটি বেলতে গিয়ে একটু গোলের জায়গায় লম্বা হলেই তিনি টুশটুশ করে দুটো কথা শুনিয়ে দিতেন।

আমাকে যত্ন করে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতেন। মোটামুটি ঘরের কাজ আমারই করতে হতো। ইফতি আর আমি বাইরে ঘুরতে যেতে চাইলে মুখ এমন করে গোমড়া করে বসে থাকতেন যে, বাইরে যাবার মন উঠে যেত। বাইরে গিয়েও ভালো লাগতো না।

এভাবে চলতে লাগলো। ইফতি সবই দেখতো, মাকে বোঝানোর চেষ্টা করতো, মা বুঝতেন না। একদিন সন্ধ্যাবেলায়, ইফতি ধুম করে একটা বোমা ফাটিয়ে দিলো। মা বাবার সামনে বলে দিলো, ‘আমি বাইরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিচ্ছি। এডভান্স দিয়ে দিয়েছি। আগামী মাসেই উঠবো। তিন রুমের ফ্ল্যাট, আমার দুজন খুব সুন্দরভাবে চলতে পারবো। তোমরা মাঝে মাঝে বেড়াতে এসো।’

আমার শ্বশুড় উদাস চোখে অন্যদিকে চেয়ে রইলেন। আমার মনে হলো, ব্যাপারটা তিনি জানতেন, হয়তো বুদ্ধিটাও তার দেয়া। কিন্তু মা তো আর জানতেন না। যতো যাই হোক, তিনি তার ছেলেকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। এমন কিছু ঘটবে, তিনি ভাবতেও পারেননি। এই একটা কথা ধুপ করে তার চোখে পানি এনে দিলো। তিনি বললেন, ‘তোকে ছাড়া কি আমি কখনো থেকেছি? তোকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো বাবা?’
ইফতি ওর মায়ের দিকে না তাকিয়েই বললো, ‘আমার এটা করা লাগবে মা। আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই।’

মা আর ছেলে দুজনেই চুপচাপ বসে রইলো। মা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন, ছেলে অন্যদিকে তাকিয়ে। কিন্তু দুজনের চোখেই পানি চিকচিক করছে। আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বলে ফেললাম, ‘আমি একটা কথা বলতে চাই।’
সবাই আমার দিকে তাকালো।
আমি বললাম, ‘দেখো ইফতি, এমন একটা ডিসিশন তুমি নিবে, অন্তত আমাকে জানাতে পারতে। যাক জানাও নাই, ভালো করেছো। এখন তুমি এই কাজটা করতে চেয়েছ, যেন আমি মায়ের কাছ থেকে দূরে গিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে পারি, তাই না? তুমি পুরো ভুল। এই কয়দিনে তুমি একটুও আমাকে চিনতে পারো নাই। আমি হেরে পালিয়ে যাবার মতন মানুষ না। আমি এখানেই থাকবো, এই বাসাতেই থাকবো। আর এখানে থেকেই সবার মন জয় করবো।’

ইফতি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি কি বলছো এসব? বুঝে বলছো? এই অবস্থার কিন্তু কোনো চেঞ্জ হবে না।’
‘না হলে না হোক। আমি এই বাসা ছেড়ে কোথাও যাবো না।’ বলেই আমি উঠে চলে এলাম। আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তার চোখে সেই হাড়হিম করা শীতল দৃষ্টিটা নেই।
পরদিন রান্নাঘরে ঢুকে মা বেশ অবাক হলেন। আমি তার আগেই রান্নাঘরে ঢুকে বসে আছি। তিনি বললেন, ‘তুমি এখানে কি করো?’

আমি বললাম, ‘আমি রান্না করতে এসেছি। আজকে আমি নিজের মতো রান্না করবো। আপনি কোনো কিছু বলতে পারবেন না আমাকে। কালকে বলেছি না, আমি হেরে যাবো না, সংগ্রাম করে যাবো।’
মা বিরক্তিতে তাকিয়ে বলেন, ‘কি বলো উল্টাপাল্টা। একটা রুটি ঠিকমতো বেলতে পারো না, আর আসছো রান্না করতে। তোমাকে দিয়ে জীবনেও এই কাজ হবে না। তুমি যাও, ইফতির কাছে গিয়ে বসে থাকো।’

আমি বললাম, ‘চলেন মা, আমরা একটা প্রতিযোগিতা করি। আপনিও রান্না করবেন, আমিও রান্না করবো। বাড়ির লোকদের খাওয়াবো। যার রান্না ভালো হবে, সেই আজকের বিজয়ী।’
‘এই, তুমি ফাজলামি করছো আমার সাথে? এখানে কি রিয়েলিটি শো চলছে?’
‘দেখেন মা, করেই দেখেন। দেখি কে জিতে।’

মা গজগজ করতে করতে রান্না করলেন। আমিও করলাম। খাবার টেবিলে আমাদের দুজনের রান্না করা খাবারই দেয়া হলো। কিন্তু কোনটা কার রান্না, বলা হলো না। বাড়ির সবাই খেতে বসলো। দেখা গেলো, আমার রান্নাটাই সবার আগে শেষ হচ্ছে।
আমার শ্বশুড় তো হাত চাটতে চাটতে বললেন, ‘ইফতির মায়ের রান্না খেয়ে অনেকদিন পর এতো মজা পেলাম। বিয়ের পর এমন করে রাঁধতো।’
মা অগ্নিদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালেন। বাবা তো আর জানেন না, ওটা আমার রান্না। তিনি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মায়ের রাগের কারণ তিনি বুঝতে পারলেন না।

আজকে রান্নায় আমি বিজয়ী হলাম। মা তার তরকারি বাদ দিয়ে আমার রান্না তরকারি খেতে খেতে বললেন, ‘ঝড়ে বক মেরেছে। প্রথমদিন তো, তাই একটু সুযোগ দিয়েছি। পরদিন আমি জিতবো।’
আমাদের প্রতিযোগিতা চলতেই লাগলো।কোনো কোনোদিন মা জিতেন, কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমিই জিতি। মা একদম বিরক্তিতে ফেটে পড়েন। খালি বলতে থাকেন, ‘এইসব বাচ্চামো কে করে? আমিও একটা পাগল এইসব বাচ্চামি কাজ করে বেড়াচ্ছি।’ কিন্তু তবুও তিনি প্রতিযোগিতা থেকে পিছপা হননা।

আস্তে আস্তে আমাদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র আরো বেড়ে গেলো। আমরা শুধু রান্নাবান্নাতেই থেমে থাকলাম না। ঘর গুছানো, কেনাকাটা করা, সবকিছুতেই আমাদের প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে পড়লো। আমি একদিন ড্রয়িংরুম গোছাই, মা ডাইনিং গোছান। এরপর আমরা তুলনা করি কারটা বেশি সুন্দর হলো। মা আমার দেবরের জন্য জামা কিনে আনেন, আমিও বাবার জন্য জামা কিনে আনলাম। এটারও তুলনা করা হয় কারটা বেশি ভালো হয়েছে। আমাদের এই প্রতিযোগিতায় সবাই খুব বিরক্ত হয়ে গেলো‌। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হলো ইফতি। ও বললো, ‘কি বিপদে পড়লাম। এর চেয়ে তো আলাদা বাসা নিয়ে থাকাই ভালো ছিলো। দেখবা, একদিন এইসব নিয়ে কঠিন সমস্যায় পড়বা।’

ইফতির কথা কয়েকদিন পর অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো। মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ভীষণ অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। খেতে পারেন না। কথা বলতে পারেন না।‌কেবল চোখ উল্টিয়ে পড়ে থাকেন। আশেপাশের লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, ‘আর উনার সময় নাই। দিন শেষ।’

ইফতি একদিন আমাকে কঠিন ঝাড়ি দিলো। বললো, ‘দেখো, তোমাদের এই প্রতিযোগিতা প্রতিযোগিতা করতে করতে মায়ের এই অবস্থা। সারাক্ষণ মানসিক টেনশনে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কতোদিন বলেছি এইসব আজেবাজে প্রতিযোগিতা বাদ দাও, শুনো নাই আমার কথা। এখন বোঝো। মায়ের এই অসুস্থতার জন্য তুমি আর মা দুজনেই দায়ী।’

আমি কিছু বললাম না। নীরবে ওর কথা শুনে গেলাম। হয়তো ও সত্যি বলেছে‌। হয়তো আমাদের এই ছেলেমানুষীর জন্যই মায়ের অসুস্থতা। মা এতো মানসিক চাপ নিতে পারেননি।
আমি মায়ের কাছে গেলাম। মায়ের যত্নের ভার পুরোপুরি নিজের ওপর নিয়ে নিলাম। তার মাথায় জলপট্টি বেঁধে দিলাম। খাওয়ালাম। গা মুছিয়ে দিলাম। রাতে তার পাশেই থাকলাম। ইফতি এসেছিলো আমাকে নিতে। বললো, ‘সারাদিন তো অনেক কষ্ট করেছো। এখন একটু বিশ্রাম নাও। যাও রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো। মাকে আমি দেখছি।’

আমি ইফতির কথা শুনলাম না। ইফতিকেই বরং রুমে পাঠিয়ে দিয়ে সারারাত মায়ের পাশে বসে থাকলাম। এতো রাগী মানুষটা কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে পড়েছেন। আমার খুব খারাপ লাগছিলো। কাঁদতে চাচ্ছিলাম না একটুও, তবুও চোখ বেয়ে দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। সারারাত মানুষটার মাথায় হাত রেখে বসে রইলাম। ঘুম এলো না একফোঁটাও।

দুদিন পর, মা অনেকখানি সুস্থ হয়েছেন। এখন উঠে বসতে পারেন, নিজে নিজে খেতে পারেন। আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, ‘মা, আমি যাই।’
মা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বল গলায় বললেন, ‘কই যাও?’

আমি বললাম, ‘আপনার এই অসুস্থতার জন্য দায়ী আমি। আমি আপনাকে মানসিকভাবে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তাই আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমি চাই না আপনি আর কষ্ট পান আমার জন্য। আমি আমার মায়ের বাসায় চলে যাচ্ছি। কিছুদিন ওখানেই থাকবো। আর ইফতি আপনার কাছেই থাকবে। ওকে আমি নিয়ে যাবো না আপনার কাছ থেকে।’
আমি বেড়িয়ে এলাম বাসা থেকে। মা কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না।

পরদিন দুপুরবেলায়। বাবার বাসায় আমার রুমটায় বসে আছি। ভালো লাগছে না। কতো পরিচিত আমার এই রুম, কতো বছর এখানে কাটিয়েছি। কিন্তু কেমন যেন অচেনা লাগছে‌। আমার মনে হচ্ছে জীবন থেকে কি যেন হারিয়ে ফেলেছি। একজনের সাথে প্রতিযোগিতা ছিলো, তাকে হারিয়ে জিতে যাবার চেষ্টা ছিলো। সেটা আর নেই। সে জায়গাতে এখন রয়েছে কেবল শূণ্যতা।

কলিংবেল বাজলো। কে যেন এসেছেন। আম্মু মনে হয় গেছে দরজা খুলতে। দরজা খোলার শব্দ পেলাম। এরপরই আম্মুর গলা, প্রায় চিৎকার করে বলছেন, ‘এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এভাবে চলে এসেছেন কেন?’
আমি রুম থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখি আমার শাশুড়ি-মা দাঁড়িয়ে আছেন। এখনও খুব দুর্বল। তবু আমাকে দেখে একটুখানি হাসলেন। এরপর বললেন, ‘বৌকে নিতে এলাম।‌ওকে ছাড়া ভালো লাগছিলো না।’
আমি জানি এই কথাটা সত্যি না। জানি এটা তার ভান। হয়তো ছেলে মন খারাপ করে বসে আছে, ছেলেকে অসম্ভব ভালোবাসেন বলেই ছেলের মনের দুঃখ কাটাতে আমাকে নিতে এসেছেন। তবু কথাটা শুনে কেন যে এতো ভালো লাগলো, বুঝতে পারলাম না। যতো মিথ্যাই হোক, এই কথাটাই আমার মনে একটা অন্যরকম পরশ বুলিয়ে দিলো। আমার চোখে পানি চলে এসেছিলো। আমি সেটা লুকাতে গেলাম। শাশুড়ি মা আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো তিনি দেখলেন তা।

আম্মু আমার শাশুড়িকে বললেন, ‘এইজন্য আপনার কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিলো? একটা ফোন করে দিলেই তো পারতেন। আর ও তো মাত্র গতকাল এসেছে। আরো কয়েকটাদিন বেরিয়ে যাক।’
আমি বললাম, ‘না আম্মু, আমি আজকেই চলে যাবো। মায়ের সাথেই যাবো।’
আম্মু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি ঘরে চলে গেলাম। এখন অনেক কাজ। ব্যাগ গুছাতে হবে।

বিকেলবেলা। শাশুড়ি-মা আর আমি রিকশায় চড়ে বাড়ি ফিরছি। দুজনেই চুপচাপ। মেইনরোড থেকে রিকশাটা গলির মুখে ঢুকতেই মা হঠাৎ বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জি, বলেন।’

‘তুমি তো আগে আমাকে অনেক ভয় পেতে। হানিমুনে গিয়েও আমাকে দেখে ভয়ে ভয়ে থাকতে। হঠাৎ তোমার পরিবর্তন হলো কেন?’
আমি হেসে বললাম, ‘আগে মনে হতো আপনি ভীষণ জাঁদরেল, আপনার মনে একদম মায়া মমতা নাই। আপনি যেভাবে রাগী চোখে আমার দিকে তাকাতেন, আমার খুব ভয় লাগতো।’
‘তারপর। ভয়টা হঠাৎ চলে গেলো কেন?’

‘ইফতি যেদিন আমাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবে বলেছিলো, আপনি সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন। আপনার চোখ দেখে সেদিন মনে হয়েছিলো, এই যে আমাকে এতো বকাঝকা করেন, এগুলো সব বাইরের রুপ। আপনার ভেতরে একজন মা আছেন, যার মধ্যে প্রচন্ড এক মায়া আছে। আমি সেই মায়ের খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই আর ভয় পাইনি।’
মা আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তার মুখ গম্ভীর, কিন্তু চোখে কেমন একটা হাসি হাসি ভাব ফুটে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু আজকে আপনি মিথ্যা বললেন কেন?’
‘কোন মিথ্যা?’

‘ঐযে বললেন বৌকে নিতে এসেছেন, আমাকে ছাড়া আপনার ভালো লাগছে না। এটা কেন বললেন?’
মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলি। আমার একটা বান্ধবী ছিলো, নাম রুনা। আমরা একসাথেই পড়ালেখা করতাম‌। ওর সাথে আমার প্রতিযোগিতা চলতো, কে রেজাল্ট ভালো করে সেটা নিয়ে। আমরা কলেজেও একসাথে পড়েছিলাম। একদিন ও এসে আমাকে বললো, ‘তোর খুব সুবিধা হলোরে শায়রা, আমার সাথে আর প্রতিযোগিতা করতে হবে না।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’ ও বললো, ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।’ এই বলে রুনা চলে গেলো। ও আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলো, ওর পর আর আমার কোনো ভালো বন্ধু হয়নি। আমার স্বামী হয়েছে, সংসার হয়েছে, ছেলেপিলে হয়েছে, কিন্তু বন্ধু বলে যে কেউ আছে, তেমন কাউকে আমি পাইনি। রুনার সাথে আমার তাও একটু যোগাযোগ ছিলো, সেই যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেলো। প্রথম বাচ্চা হতে গিয়ে মারা যায় রুনা।

তুমি সেদিন যখন চলে গেলে, আমার মনে হলো রুনা আবার আমার কাছ থেকে চলে গেলো। আমার খুব খারাপ লাগছিলো। তোমার বাসায় গিয়ে যে কথা বলেছিলাম, একটুও মিথ্যা বলিনি।’
শেষ বিকেল। শহরের মানুষেরা সারদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত পায়ে ফিরছে বাড়ি। তাদের পাশ কেটে আমাদের রিকশা এগিয়ে চলছে। বিকেলের মিষ্টি কমলা রোদ এসে পড়ছে আমাদের ওপর। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, আজ থেকে তো আমাদের প্রতিযোগিতা বাদ, তাই না?’
মা অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন?’

‘এই যে আপনার উপর একটা মানসিক চাপ যাচ্ছে।’
‘ধুর বোকা। এই প্রতিযোগিতা করার জন্যই তো আমি বেঁচে উঠেছি। নাইলে দেখতা জীবনেও সুস্থ হতাম না, আমাকে কাঁধে নিয়েই তোমার শ্বশুরকে বাকি জীবন পার করতে হতো।’

বলেই মা হাসতে লাগলেন। প্রাণখোলা হাসি। আমি চমকে উঠলাম। মাকে কখনো হাসতে দেখিনি। কি যে সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে। আমিও তার সাথে হাসিতে যোগ দিলাম। আশেপাশের লোকজন অবাক হয়ে আমাদের দেখতে লাগলো। দুজন দুই বয়সের মেয়ে রিকশায় বসে প্রাণখুলে হাসতে হাসতে যাচ্ছে, তারা ব্যাপারটা হয়তো মানতে পারছে না। না মানুক, তাতে কি? আমরা একটুও পাত্তা দিলাম না। দুজনে হাসতে হাসতেই ফিরতে লাগলাম বাড়ি। দিনের সূর্যটাও তখন মুচকি হেসে মুখ লুকোচ্ছে পশ্চিম আকাশে।

গল্প- একটুখানি রোদ
লেখা- সোয়েব বাশার

More:

স্বামীর ভালোবাসার গল্প

ত্রিভুজ প্রেমের গল্প

স্ত্রীর সত্যিকারের ভালোবাসা গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *