সে এবং চারুলতা – ভালোবাসার ছোট গল্প

সে এবং চারুলতা – ভালোবাসার ছোট গল্প: রাগে গা ঝিমঝিম করে উঠল চারুর। কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশেপাশে নজর গেলো তার। মানুষ কিভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে….


_ ‘এই যে মিস! আপনার ব্যাগ ছিঁড়ে গেছে। রাস্তায় সব কিছু ছঁড়িয়ে-ছিটিয়ে হাঁটছেন। খেয়াল আছে?’

চমকে গেলো চারু। পেছনে ফিড়ে একজন সুদর্শন ছেলেকে দেখতে পেলো সে। চোখে সানগ্লাস, প্যান্টের দু’পকেটে দু’হাত রেখে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে যুবকটি। চারুর এক দৃষ্টিতে তাকানো দেখে অস্বস্তি হলো তার। গলা খাকিয়ে কেঁশে উঠতেই চোখ ফিড়িয়ে নিলো চারু।

কাঠকাঠ কণ্ঠে যুবকটি বলল, ‘আমার দিকে নির্লজ্জের মতো না তাকিয়ে নিচে দেখুন। আপনার টাকা, আটাময়দা, সব এদিক-ওদিক পরে আছে।’

অবাক হলো চারু। তার মতে সে তো কোনো আটাময়দা রাখে নি তার ব্যাগে। তাহলে আটাময়দা আসবে কোত্থেকে? ভাবতে ভাবতেই নিচে তাকালো চারু। সাথে সাথে কেঁদে দেওয়ার অবস্থা হলো চারুর। তার এত সখের মেকআপ প্রডাক্সগুলো রাস্তায় নাজেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। লিপস্টিক, কাজল আর ফেসপাউডার ভেঙ্গে গুড়গুড় হয়ে গেছে। সাথে কিছু টাকাও এদিক-ওদিক পড়ে আছে।

অর্থাৎ, ছেলেটা তার মেকআপ প্রডাক্স গুলোকে আটাময়দা বলছিল? রাগ হলেও তা প্রকাশ করল না চারু। একরাশ বেদনা নিয়ে সেগুলো রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিলো। যুবকটির দিকে একবার তাকিয়ে চলে যেতে নিলে যুবকটি মজা নেওয়ার ছলে আবারো বলে উঠল, ‘মিস! পরের বার খেয়াল রাখবেন কিন্তু। আটাময়দা তো আপনাদের জীবন।’

দাঁড়িয়ে গেল চারু। ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো যুবকটির দিকে। একে তো হেল্প করেছে দেখে চারু কিচ্ছু বলে নি। কিন্তু হেল্প করে আবার খোঁচা দিচ্ছে কেন? মানুষ মাত্রই তো ভুল, তাই না?
ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল সে, ‘দেখুন মিস্টার, বাড়াবাড়ি করছেন আপনি। হেল্প করেছেন দেখে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এমন ব্যবহার করছেন কেন?’

যুবকটি ডান ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমার তো মনে হয় নি আপনি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ। একটা ‘থ্যাংকিউ’ও তো বলেন নি আমায়। উল্টো চলে যেতে নিচ্ছিলেন।’

চারু মুখ কুঁচকে তাকালো যুবকটির দিকে। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আপনি তো কম ছ্যাঁচড়া না। আমি থ্যাংকিউ বলি নি সেটা আবার গর্ব করে বলছেন। আমি বুঝি না মনে করেছেন? সব আপনার মেয়েদের সাথে কথা বলার ধান্দা।’
যুবকটি মৃদু হাসলো। হাত দু’টো বুকে পেঁচিয়ে বলল, ‘আপনার মতো আটাময়দার সাথে কথা বলার ধান্দা, ইম্পসিবল!’

_ ‘তাই নাকি? এতই যখন ইম্পসিবল, তাহলে সেধে সেধে কথা বলছেন কেন? নিজের রাস্তা মাপুন, যান!”

যুবকটি আবারো হাসলো। এত হাসির কি আছে সেটাই বুঝতে পারছে না চারু। যুবকটি নিজের চুলে হাত বুলিয়ে নম্র কণ্ঠে বলল, ‘আপনি একজন অকৃতজ্ঞ মানুষ। যাকে কৃতজ্ঞতা শিখাচ্ছিলাম আমি। এখানে সেধে সেধে কথা বলার কি দেখলেন আপনি?’

চারু মৃদু চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।’
যুবকটির উত্তর, ‘কেমন বাড়াবাড়ি করছি?’

রাগে গা ঝিমঝিম করে উঠল চারুর। কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশেপাশে নজর গেলো তার। মানুষ কিভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এবার রাগের পাশাপাশি লজ্জাও পেলো সে। ছেলেটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার মাথা!’

কথাটা বলে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো চারু। যুবকটি শত ডাকলেও সাড়া দিলো না আর। মনের ভুলেও না।

এর কয়েকদিন পর চারু প্রতিদিনকার মতো বিকেলে, বারান্দায় গাছে পানি দিচ্ছিল। হঠাৎ নজর যায় নিচের ল্যাম্প পোস্টের দিকে। একজন যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার নজর চারুর দিকেই। ভ্রু কুঁচকে গেলো চারুর। ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগলেও ঠিক ‘কে’ তা মনে পড়ছে না। তবে যুবকটির তাকানোতে বড্ড রাগ হচ্ছে তার। হুট করে যুবকটি চারুকে উদ্দেশ্য করে হেসে দিলো।

হাতের ইশারায় নিচে আসতে বলল তাকে। চারু অবাক হলো। কোথাকার কে! তাকে কেন নিচে ডাকছে? নাকি অন্যজনকে ডাকছে, যা চারু বুঝতে পারছে না। চারপাশে একবার চোখ বুলালো চারু। তার পাশে, পেছনে, এমনকি রাস্তায়ও মানুষ নেই তেমন। নির্জন এলাকায় সবসময়ের মতো নির্জনতাই ছেয়ে আছে। তাহলে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো যুবকটির দিকে। এতে যেন যুবকটি মহা বিরক্ত। আশেপাশে খুঁজে একটা পাথর হাতে নিলো সে। ইশারা করে বলল, ‘যদি নিচে না আসো তাহলে পাথর ছুঁড়ে মারব।’

চোখ বড় বড় হয়ে গেলো চারুর। রুমে চলে গেলো দ্রুত। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, নিচে নামবে না সে। কিন্তু তা তো ভাগ্যে ছিল না। কিছুক্ষণ পরই পাথরের কারাঘাত শোনা গেল বারান্দার দেয়ালে। বুঝতে বাকি রইলো না, নিচে না যাওয়ায় যুবকটিই পাথর মারছে তার বারান্দায়। এবং তা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। বাধ্য চারু খুবই সতর্কতার সঙ্গে চলে এলো নিচে। বাসায় শুধু তার মা আছেন। তিনিও ঘুমে থাকায় তেমন অসুবিধে হয় নি চারুর। ক্রুদ্ধ মনে যুবকটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো চারু।

প্রথমেই ঝাঁঝালো কণ্ঠ ছুড়ে মারলো, ‘সমস্যা কি? কে আপনি? মেয়েদের ডিস্টার্ব করছেন কেন? গণধোলাই খাবেন?’
প্রতিউত্তরে যুবকটি হেসে বলল, ‘আমার নাম তীব্র। এত তাড়াতাড়ি চেহারা ভুলে গেছ?’

পূর্ণ দৃষ্টিতে তীব্রর দিকে তাকালো চারু। চেহানা চেনা চেনা লাগছে তার। কিন্তু চিনতে পারছে না। একটু কেশে বলল, ‘কে আপনি ঠিক করে বলুন। নতুবা মানুষ জড়ো করতে বাধ্য হবো আমি।’
তীব্র বাঁকা হাসলো। এক কদম এগিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘তুমি মানুষ জড়ো করবে না। করলে প্রথমেই করতে।’


গল্পটির pdf download লিংক – সে এবং চারুলতা pdf


কথাটা সত্য হলেও এ মুহুর্তে বিরক্ত লাগছে চারুর। কঠিন গলায় বলল, ‘যা বলেছি তার উত্তর দিন। কে আপনি?’
চারুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তীব্র বলল, ‘সত্যিই ভুলে গেছো? ওই যে, কয়েকদিন আগে তোমার ব্যাগ ছিঁড়ে গিয়েছিল? আটাময়দা লাগিয়ে বের হয়েছিলে বাসা থেকে, কিছু আটাময়দা পরেও গিয়েছিল রাস্তায়। তুমি বেয়াদবি করায় আমি কৃতজ্ঞতা শেখাচ্ছিলাম? মনে পরেছে?’

চারু কতক্ষণ নিজে নিজে আওড়ালো কথাগুলো। বুঝতে পারছে না, ছেলেটা তাকে বলছে নাকি অপমান করছে? পরপরই মনে পড়লো এটা তো সেই বেয়াদপ ছেলেটা। সাথে সাথে চারুর রাগ কয়েক ধাপ বেড়ে গেলো।

তীব্রর দিকে ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘তো এখানে এসেছেন কেন আবার? কৃতজ্ঞতা শেখাতে?’
তীব্র দ্রুত বলল, ‘না। অন্য কিছু করতে।’
চারু ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কি?’

তীব্র লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিলো। মুখে সেই হাসি হাসি ভাব নেই এখন। কেমন নার্ভাস লাগছে তাকে। চারু আবারো জিজ্ঞেস করতেই হুট করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তীব্র। প্যান্টের পকেট থেকে একটা কিটক্যাট বের করে চারুর সামনে ধরে বলল,

_ ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি চারু। প্রথম দিনই তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। তোমার রাগী রাগী ভাব, নাল ফুলানো সব! এজন্যই বেশি বেশি রাগিয়ে ছিলাম তোমাকে… বিশ্বাস করো ওইদিনের পর থেকে প্রতিটা মুহুর্তে তোমার কথা চিন্তা করছি আমি। না চাইতেও আমার কল্পনা জুড়ে তুমি চলে এসেছো চারু। আমি একয়দিন পাগলের মতো তোমার নাম, বাসার ঠিকানা সব জোগাড় করেছি। দুই’দিন ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি শুধু মাত্র তোমাকে একপলক দেখার জন্য। আজকে আমাদের মধ্যে যে দূরত্বটা আছে সেটা কমাতে এসেছি আমি।

তুমি যদি আমাকে ফিড়িয়ে দাও, আই প্রমিস আমি কখনো তোমার সামনে আসবো না। কিন্তু যদি হ্যাঁ বলো, তাহলে আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে তোমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করবো। কখনো হাত ছাড়বো না। দুই বছর জমিয়ে প্রেম করার পর একটা চাকরি নিয়ে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিবো। বিয়ে করব, ছোট্ট একটা বাসায় আমি তুমি, আমরা থাকবো। আমাদের থাকবে একটা ছোট্ট টোনাটুনির সংসার।’
এতটুকু বলে থামলো তীব্র। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে হঠাৎ-ই হেসে দিলো। হাতের কিটক্যাট চকলেটটা দেখিয়ে বলল, ‘আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অত টাকা ছিল না বিধায় সামান্য একটা চকলেট এনেছি। তুমি কি নিবে?’

এতক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল চারু। তীব্রর হঠাৎ প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলো। কি উত্তর দেবে তা বোধগম্য হচ্ছে না তার। তীব্রকে কি সে ফিরিয়ে দেবে? তীব্রর দিকে তাকালো চারু। একরাশ আশা আর মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। চারুর জন্য অবিরাম ভালোবাসাটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার আঁখি জোড়ায়। সংশয় নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই পাশের বিল্ডিংয়ের গেট খোলার আওয়াজ এলো কানে। দিক-বেদিক না দেখে চারু তীব্রর হাত থেকে চকলেট-টা নিয়ে ছুটে চলে গেলো বাসায়। সিঁড়ির কাছে এসেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে দাঁড়িয়ে গেলো চারু। বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে সে। হাত-পা ভীষণ ভাবে কাঁপছে তার। হাতের চকলেটটার দিকে তাকিয়ে আনমনেই ভেবে উঠল সে, ‘ভয়ংকর কাজ করে ফেলেছি আমি। এর শাস্তি কি হবে? নিজেকে ভালোবাসায় উজাড় করা।’

চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো চারু। সে জানে না সে কি করেছে। বেহায়া মনের কথা শুনে তীব্রর ভালোবাসায় সারা দিয়েছে সে। এখন যা হবে তা মাথা পেতে নিতে রাজী। তবে একটা প্রার্থনা, ‘শেষটা যেন সুন্দর হয়।’

লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা


সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “”গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ুন – অফিসের বসের সাথে প্রেম – ১ম পর্ব

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *