মায়ের বিয়ে – মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা: আজ আমার মায়ের বিয়ে!! কারো মায়েরই তো বিয়ে হয় না। তবে আমার মায়ের কেনো বিয়ে হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারি না। ছোট মামার পিছে পিছে অনেক্ষণ থেকে ঘুরি, আর প্রশ্ন করি কেন আমার মায়ের বিয়ে। মামা উত্তর দিচ্ছেন না। আমিও নাছর বান্দা। কুল কিনারা না পেয়ে অবশেষে মামা খুব বিষন্ন মনেই উত্তর দিলেন, তুই এখন বুঝবিনা। বড় হলে বুঝতে পারবি। সত্যিই পাঁচ বছরের একটা ছেলের বোঝার কথা না- কেনো তার মায়ের বিয়ে হয় হচ্ছে!
আজ মায়ের বিয়ে
হয় হোক। তাতে কি? মা তো আমার মা-ই। তার বিয়ে হলেই কি আর না হলেই কি? কিন্তু না, আমাকে মায়ের কাছেও ঘেসতে দেয়া হলো না। মাকে কত সুন্দর করে সাজানো হলো তা দেখতে দেয়া হলো না। মায়ের কাছে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হলো না। মাকে যখন গাড়িতে করে নিয়ে গেলো তখন আমাকে কাছে যেতে দেয়া হলো। আমি মায়ের সঙ্গে যেতে চাইলাম। আমাকে নেয়া হলো না। খোকা খোকা বলে আমার মায়ের করুন কান্না চললো কিছুক্ষণ।
তারপর মা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সে অবস্থায় মাকে নিয়ে গেলো ওরা। আমার বুকটা ফেটে গেলো। সেদিনও আমার এমনি ভাবে বুকটা ফেটেছিলো- যে দিন আমার বাবা বাড়ি ফেরার কথা ছিলো। কিন্তু ফিরেনি, ফিরেনি আর কোনো দিন। মা সেদিন অনেক কেঁদে ছিলো। কান্নার কারণগুলো তখনো আমি অনুভব করতে শিখিনি। তবুও সেদিন আমার বুক ফেটেছিল মায়ের আকাশ বাতাস ভারী করা সে চিৎকারে। আজও আমার বুক ফাটছে মায়ের অমন যাত্রা দেখে।
আমার মায়ের বুক থেকে নেমে গেলাম আমি। আর সে বুকে চাপলো এক হাহাকার। সে হাহাকার শুধু আমার মায়ের ই ছিলো না। সে যে আমারও ছিলো তা সেই পাঁচ বছর বয়সেই ভালো মত বুঝে গেলাম। অতটুকু বয়সে মা বেঁচে থেকেও মা নেই। ছোট মামা আমাকে খুশী রাখবার জন্য কত চেষ্টাই না করতেন। বেড়াতে নেয়া, খেলনা কিনে দেয়া কোনো কিছুই আমার মনটাকে ভরাতে পারতো না। মনের ভিতর সে কি কঠিন পিপাসা কিন্তু কোনো জুসেই সে পিপাসা মেটে না। চোখ থেকে কেবল বড় বড় জলের ফোটা বাইরে বেড়িয়ে আসে। মনের ভিতর থেকে মায়ের গায়ের গন্ধটা পাবার জন্য কেমন জানি একটা অনুভুতি তৈরী হয়! মায়ের বুকটা ঘেষে ঘুমাতে ইচ্ছে করে। দৌড়ে এসে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কিছুই পাই না।
মায়ের বিদায়
এবার বুঝি আমার মা আর আমার নেই। আমার মা ওদের বাড়ির বউ হয়ে গেছে। আমার মা আর কোনো দিনই আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবে না। আমার কপালে আলতো আদরে আমাকে মাখিয়ে দেবে না। মায়ের হাতের দুধ মাখা ভাত এখন কাকে খায়। প্রতিদিন আমার পিপাসা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। আমি বিছানা ধরি। জীবনী শক্তি ফুরিয়ে আসে। মা ফিরে আসে না।
মা এলো। ছোট মামা গিয়ে নিয়ে এসেছে। আমার কত সুন্দর মা! কিন্তু এমন পচা দেখতে হয়ে গেলো কেন বুঝতে পারলামনা।
আমাকে বুকে চেপে ধরে মায়ের কিযে কান্না! আমার অপার সুখ। কি যে শান্তি! কি যে আরাম! সে সুখ কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যায়না। সে আনন্দ জীবনের সব কিছুর বিনিময়ে হলেও লাভ করতে ইচ্ছা জাগে। মিটে যায় আমার যত পিপাসা। চলে যায় আমার মা।
আবার পিপাসায় কাতর হই। আবারো আমার মা আসে। পিপাসা মেটে। মা চলে যায়। আবারও আসে, চলে যায় “ওদের” মা।
ছোট মামা বলেছিলো, বড় হলে বুঝবি। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। এখন আমার পিপাসাটাও অনেক কমে গেছে। আর কাতর হইনা। ওদের মাও তেমন আসেন না।
এখন প্রায়ই পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন ওদের মা। আমি যাই সে পিপাসা মেটাতে।
মায়ের চির বিদায়
তবে আমার যাওয়াটা ওদের তেমন ভালো লাগেনা। তাই হাজার তৃষাতেও তৃষ্ণা মেটাতে পারি না ওদের মায়ের। তৃষ্ণিত প্রাণ তৃষ্ণায় তৃষ্ণায় একদিন শুকিয়ে যায়। হারিয়ে যায় আমার তৃষ্ণার জল। হারিয়ে যায় ওদের মা।
সে দিন আমার যাওয়াটা ওদের কারো খারাপ লাগেনি বোধ হয়। তখন আমি ত্রিশ বছরের পরিণত যুবক, নিজ হাতে ওদের মাকে কবরে শুয়ে দিলাম। আমার আজন্ম তৃষ্ণাকে মাটিতে মিশিয়ে দিলাম। আরো একবার বুকটা ফেটে গেলো আমার।
পরে এক সময়ে আমার জন্য রেখে যাওয়া মায়ের একখানা কাপড়ের ভাজ থেকে পাওয়া যায়, মায়ের হাতে লেখা এক চিরকুট। যাতে লেখা ছিলো-
“সমাজের ভীতে ভিত্তিহীন এক দূর্বল নারী তাই,
জীবন নিয়া জীবনের এই ছিনিমিনি খেলা রুধিতে পারি নাই।”
কৈশরেই মাতৃত্বে আলিঙ্গন করা একজন নারী তার জীবনের ভার বইবার যোগ্য হয়ে ওঠেনি বলেই অন্যের নির্দেশিত পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। সেই হতভাগ্য নারীর সন্তান এই আমি স্বপ্ন দেখি সাবলম্বী হোক সকল নারী, নিজেরাই চালাক নিজেদের জীবনের গতি।
আরো পড়ুন: আদর্শ ছেলে – মায়ের প্রতি ছেলের ভালবাসা