অন্তরালে – Voyonkor vuter golpo in bengali

অন্তরালে – Voyonkor vuter golpo in bengali: হঠাৎ, খুট করে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল নিচ থেকে আসলো শব্দ টা। ছাদ থেকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে শব্দ টার উৎস খুঁজতে লাগলাম আমি। হঠাৎ, সীমানা প্রাচীরের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। দেখলাম কেউ একজন প্রাচীর থেকে ঝুপ করে নীচে লাফিয়ে পড়লো। এভাবে আরেকজন ও নেমে এলো। তারপর অতি সন্তর্পণে এগিয়ে আসতে লাগলো আমাদের সদর দরজার দিকে। তারপর…


পর্ব-১

ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে স্ন্যাকস খাচ্ছিলাম, আর ফ্রেন্ডসরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ঈপ্সি বার্গারের অর্ধেকটা মুখে পুরে নিয়ে চিবচ্ছিলো। কিন্তু, হঠাৎ ওর চিবানো থেমে গেলো। দেখলাম নিস্পলক ভাবে সামনে তাকিয়ে আছে ও। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালাম।
দেখলাম ক্যান্টিনে ঢুকছে একটি ছেলে। ছ’ফুট মত লম্বা হবে। ফর্সা, সুদর্শন।

ভীষণ তীক্ষ্ণ ও গভীর ঘোলা দুটি চোখ। ঘাড় অবধি নেমে আসা চুল ব্যাক ব্রাশ করা। কাল ব্লেজার সাথে ম্যাচিং করে পড়েছে কাল জিন্স প্যান্ট। কেমন একটা রাগী লুক ফুটিয়ে রেখেছে চেহারায়। লম্বা, লম্বা পা ফেলে দাম্ভিক ভঙ্গিতে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল ছেলেটি। ওহ, আচ্ছা এটাই তাহলে ভার্সিটির সব মেয়েদের ক্রাশ। শুনেছি অনেক মেয়েরই নাকি ওকে দেখে হার্টবিট থেমে যাবার উপক্রম হয়। মনে মনে টিপ্পনি কাটলাম আমি।

আমার বান্ধবী ঈপ্সিও নাকি সেই লেভেলের ক্রাশ খেয়েছে ছেলেটার উপর। কয়েকদিন ক্লাসে না আসার কারণে এসব কিছুই জানতে পারি নি। আজই শুনলাম ওর মুখ থেকে। ছেলেটার সাথে পরিচিত হবার জন্য ও নাকি কথা বলতে গিয়েছিল। কিন্তু, ছেলেটা নাকি ওকে কোন পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। শুনেই মেজাজ টা ১০০ ডিগ্রিতে পৌঁছে গেছে আমার।

এমনিতেই মারপিট এর জন্য ভালো দুর্নাম আছে আমার। তাই, ঈপ্সির মুখ থেকে ছেলেটার ব্যাপারে সবকিছু শোনার পর থেকেই হাত নিশপিশ করছিল তখন থেকেই। ইতিমধ্যে ছেলেটা এক গ্লাস জুস আর স্যান্ডউইচ নিয়ে সাইডের দিকের একটা টেবিলের সামনে যেয়ে বসলো। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম ঈপ্সি কে। কিন্তু, দেখলাম রীতিমত হেলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে ও ছেলেটার দিকে। প্রচন্ড রাগ লাগলো আমার। পাশে তাকিয়ে দেখলাম ইরিন, রুমপি আর তিথি ও খাওয়া বাদ দিয়ে ক‍্যাবলার মত ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে।

টেবিলের সামনা যেয়ে ঈপ্সি ছেলেটার অপজিট দিকের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। একটা হাত হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দিয়ে বললো-হাই, আমি ঈপ্সি। ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টে আছি। ওই যে, ওখানে যারা বসে আছে ওরা আমার বান্ধবী। আঙ্গুল দিয়ে আমাদের টেবিলের দিকে ইশারা করলো ও।

কিন্তু, ছেলেটা কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে জুস খেতে লাগলো। এদিকে বকবক করে চলেছে ঈপ্সি। আমি বাবা মায়ের একটামাত্র মেয়ে। সবাই আমাকে অনেক আদর করে। আমার প্রিয় নায়ক সিদ্ধার্থ মালহোত্রা। জানো ওর সাথে না তোমার অনেকটা মিল আছে।

হঠাৎ ছেলেটা ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটা আঙ্গুল তুলে যন্ত্রচলিতের মত বললো গেট আউট।

আমি এতক্ষন ঈপ্সির গাধামি আর ছেলেটার দেমাগ দেখে রাগে ফুসছিলাম। আর সহ্য হলো না আমার। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে ওভাবে উঠতে দেখে পিছন থেকে ইরিন, রুমপি ওরা চেঁচিয়ে উঠলো-আফরিন প্লিজ মাথা ঠান্ডা কর। যাস না প্লিজ।

কিন্তু, আমার মেজাজ ততক্ষনে সপ্তমে চড়ে গেছে। গটগট করে হেঁটে ঈপ্সির সামনে যেয়ে হ্যাচকা টানে ওকে উঠিয়ে দিলাম। তারপর ছেলেটার মুখোমুখি বসলাম।

কিন্তু, ততক্ষনে ছেলেটার খাওয়া হয়ে গেছে। ও আমার দিকে না তাকিয়েই উঠে দাঁড়ালো কাউন্টারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ওর ব্লেজারের একটা সাইড টেনে ধরলাম আমি। কড়া কন্ঠে বললাম-এই শোনো, এইটা আমাদের এলাকার ভার্সিটি। এখানে আমাদের সাথে এত ভাব নেওয়া চলবে না। ঘুরে দাঁড়ালো ছেলেটি। এক ঝটকায় আমার হাত টা সরিয়ে দিয়ে কাউন্টারের দিকে এগোতে লাগলো।

রাগে, অপমানে ক্ষোভে যেন আগুন ধরে গেল আমার শরীরে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভার্সিটিতে আমরা প্রথম বর্ষ হলেও আমাদের গ্রুপ টা অনেক বড় বিধায় একটা পাওয়ার আছে আমাদের মধ্যে।

কেউ আমাদের সাথে সহজে লাগতে আসতো না। এ কারণে অপমান টা হজম করতে পারলাম না আমি। দ্রুত হেঁটে ওর সামনে যেয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে ওকে লক্ষ্য করে একটা ঘুষি বাড়িয়ে দিলাম। খপ করে ধরে ফেলল ও আমার হাতটা। তারপর এক ঝটকায় আমাকে টেনে নিয়ে হাতটা পিছনে মুড়িয়ে দিল। ব্যাথায় উফঃ করে উঠলাম আমি। ছেলেটা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে রুক্ষ ভাষায় বললো-এটা তোমার বাবার ভার্সিটি নয় যে যা খুশি করবে। এটুকু বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাউন্টারে যেয়ে বিল পরিশোধ করে গটগট করে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে গেল ছেলেটা।

বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল আমার। স্কুটি টা বাসার সামনে রেখে ঘরে ঢুকে পড়লাম আমি। এরপর, ঘাড়ে ঝোলানো ব্যাগ টা সোফায় ছুড়ে ফেলে নিজের রুমে যেয়ে ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আমি এসেছি বুঝতে পেরে আম্মু এসে কতক্ষন দরজায় নক করে গেল। কিন্তু, আমার সাড়া না পেয়ে চলে গেল। এদিকে আমি রুমে ঢুকে কিছুক্ষন খাটের উপর চুপ করে বসে রইলাম। তারপর ওয়াশ রুমে ঢুকলাম ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত মুখ ধুতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার হাতের যে অংশটা ছেলেটা মুচড়ে দিয়েছিল সেখানে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে নীল হয়ে গেছে। অবাক হয়ে গেলাম। কিভাবে সম্ভব। অল্প সময়ের জন্যই ও ধরে রেখেছিল জায়গাটা। তারমধ্যেই এত গাঢ় দাগ কিভাবে বসে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ভাবতে লাগলাম। ও কি মানুষ? না অন্য কিছু….


পর্ব-২

আম্মুর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম ৭:২৭ বাজে। তারমানে পাক্কা আড়াই ঘন্টা ধরে ঘুমিয়েছি। ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে মোবাইল ঘাটছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বলতেই পারব না। যাইহোক, ফ্রেশ লাগছে অনেক। দুপুরের বাজে ব্যাপারটাও মনের মধ্যে জমে বসে নেই আর।

বিছানা থেকে উঠে রুমের দরজা খুলেই আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। আম্মু হেসে দিল। বলল-পাগলী মেয়ে আমার। কি যে করি তোকে নিয়ে। বড় হচ্ছিস আর বেয়ারা হয়ে যাচ্ছিস। আমি একা তোকে কিভাবে সামলাই বলত? কথার মাঝে দুজনে সোফার দিকে এগিয়ে গেলাম। আম্মুকে সোফায় বসিয়ে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। আম্মু আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-তোকে নিয়ে অনেক চিন্তা হয় রে মা। হঠাৎ করে আমার হাতের দিকে চোখ পড়ে গেল আম্মুর। সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠলো আম্মু। বললো-কি হয়েছে এখানে? নিশ্চয়ই কারও সঙ্গে আবার ঝামেলা করেছিস? এটা বলে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই দৌঁড়ে ফ্রিজ থেকে বরফ এনে আমার হাতে ঘষে দিতে লাগলো।

আমি আম্মুর হাত ধরে বললাম- কিছু হয় নি আম্মু। তুমি বস তোহ। আম্মু পাশে বসে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললো-শুধু শুধু ঝামেলায় জরাস কেন বলতো মা। আমি বললাম-আম্মু সমাজে আমরা যত নিরীহ হয়ে থাকব, ভাল হয়ে থাকব সমাজের কিছু খারাপ মানুষ ততই আমাদের উপর জুলুম চালাতে থাকবে।

তাদের প্রতিপত্তি বিস্তার করতে চাইবে। বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে কম নির্যাতিত হয়েছি আমরা? এই জমিটা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য রিয়েল স্টেট এর কিছু অসাধু মানুষগুলো কি কম হেনস্থা করেছে আমাদের, বল তোহ? এ কারণেই নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলেছি আমি। মার্শাল আর্ট শিখেছি, ক‍্যারাটে শিখেছি নিজের সেফটির জন্য। অতএব, তুমি এটা জেনে রেখ, তোমার মেয়ে অন্যায় কিছু করবে না।

কথা শেষ করে হেসে আম্মুর দু গাল আলতো ভাবে নেড়ে দিলাম আমি। তারপর বাচ্চাদের মত আহ্লাদি কণ্ঠে বললাম-খুব ক্ষুদা লেগেছে আম্মু। আম্মু হেসে বললেন-খাবি চল। তোর প্রিয় বিফ বিরিয়ানি রান্না কিরেছি আজ। ইয়েস বলে চিৎকার দিয়ে ডাইনিং এর দিকে ছুটলাম আমি।

ডিনার করে বাবার ল্যাবরেটরি তে ঢুকলাম। এখানেই বেশিরভাগ সময় কাটত বাবার। কেন জানি আজ অনেক মনে পড়ছে বাবাকে। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায় বাবা। বাবা একটা অখ্যাত ভার্সিটির রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। তাছাড়া, একজন বিজ্ঞানীও ছিলেন আমার বাবা।

বাবার নিখোঁজ হওয়ার আগের রাতের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমার। রাত ৩:০০ টার দিকে আব্বুর উচ্ছসিত কণ্ঠে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। বিছানা থেকে উঠে আব্বু আম্মুর রুমে যেয়ে দেখি বাবা খুব উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে আম্মুর সাথে। চোখ চকচক করছে খুশির ঝলকে। আমাকে দেখে দৌঁড়ে এসে বলছিলেন-জানিস মা, তোর বাবার এতদিনের সাধনা সফল হয়েছে। জিতে গেছে তোর বাবা।

তারপড় দিন সকালে ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু, আর ফেরত আসেন নি। আজ পাঁচ টা বছর হয়ে গেছে। কিন্ত, তবুও বাবার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। পুলিশে কমপ্লেইন করা হয়েছিল, এ নিয়ে অনেক লেখালিখি-রিপোর্ট ও তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু, সময়ের স্রোতে সব চাপা পরে গেছে। সবাই ভুলে গেলেও আজও আমি আর আম্মু পথ চেয়ে আছি বাবা একদিন ফিরবে সেই আশায়।

অনেকক্ষন পর্যন্ত বাবার ল্যাবরেটরি টা পরিস্কার করলাম। তারপর ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার ফকফকা চাঁদ উঠেছে আজ। ঝিরিঝিরি বাতাসে আমার ছাদ বাগানের হাসনাহেনার ঘ্রানে মাতোয়ারা হয়ে আছে চারিদিক। ছাদের এক কর্নারে একটা হাউজ তৈরি করে আর্টিফিশিয়াল পন্ড তৈরি করেছিলেন বাবা। নিচের দিকটায় নীল রঙের টাইলস ব্যাবহার করেছিলেন পানিতে নীলচে রঙ আনার জন্য।

কিছু পদ্মপাতা এবং কয়েকটা সৌখিন মাছ ছেড়ে দিয়েছিলেন তাতে। একটা ট‍্যানেলের সাহায্যে পানির সংযোগ দিয়ে দিয়েছিলেন পন্ড টায়। ওটার মাধ্যমে কুলকুল করে অবিরামভাবে পানি পড়ে যায় পন্ড এর ভেতরে।

পূর্ণিমার চাঁদ, হাস্নাহেনার ঘ্রান পানির কুলকুল শব্দ সব মিলে যেন এক নৈসর্গিক পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। দুচোখ ভরে এই সৌন্দর্যই নিচ্ছিলাম আমি।

হঠাৎ, খুট করে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল নিচ থেকে আসলো শব্দ টা। ছাদ থেকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে শব্দ টার উৎস খুঁজতে লাগলাম আমি। হঠাৎ, সীমানা প্রাচীরের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। দেখলাম কেউ একজন প্রাচীর থেকে ঝুপ করে নীচে লাফিয়ে পড়লো। এভাবে আরেকজন ও নেমে এলো। তারপর অতি সন্তর্পণে এগিয়ে আসতে লাগলো আমাদের সদর দরজার দিকে।

ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে কিছুক্ষন মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু, লোক দুটকে সদর দরজার দিকে আসতে দেখে দৌঁড়ে নিচে নেমে এলাম। রান্নাঘর থেকে কিচেন নাইফ নিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।

কিন্তু, দশ মিনিট কেটে যাবার পরও কোন সাড়া না পেয়ে, কেমন একটা ধস্তাধস্তির শব্দে সিকিউরিটি হোল দিয়ে তাকাতেই রীতিমত চমকে উঠলাম আমি। দেখলাম দু হাত দিয়ে ওই লোকদুটোর গলা চেপে শূন্যে উঠিয়ে রেখেছে এক কাল আলখেল্লা পড়া মুখোশধারী। এক পর্যায়ে মুখোশধারী ছেড়ে দিলো লোকদুটো কে। ধপ করে নীচে পরেই পড়িমরি করে দৌড় লাগলো লোক দুটো। এরপর আলখেল্লা ধারীও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আমার চোখের সীমানার বাইরে….


পর্ব-৩

ওইদিন রাতে একরাশ দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমতে গেলাম। যে লোকদুটো পাঁচিল টপকে ঘরে ঢুকেছিল ওদের উদ্দেশ্যে যে ভালো ছিলনা সেটা ভালোই আন্দাজ করতে পেরেছি আমি। কিন্তু, কালো আলখেল্লা পড়া লোকটা কে ছিল তাহলে? সে কি আমাদের সুভাকাঙ্খী নাকি ওই লোকদুটোর মত কোন বদ উদ্দেশ্য ছিল লোকটার। কিন্তু, আমাদের ঘরে চুরি বা ডাকাতি করার মত কি এমন জিনিস আছে?

থাকার মধ্যে বাবার করে যাওয়া এই একতলা বাড়িটাই এখন আমাদের সম্বল। বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে তা থেকে প্রাপ্ত টাকা ব্যাংকে রেখে দিয়েছে আম্মু। যা দিয়ে আমার পড়াশোনা চলছে। আর বাদ বাকি জমি বর্গা দেওয়া আছে। সেখান থেকে উৎপাদিত শস্যের কিছু অংশ আমরা পাই।

ওইসব শস্যের বিক্রীত অর্থ দিয়ে মোটামুটি ভালভাবেই চলে যাচ্ছে আমাদের। কিন্তু, চোর-ডাকাতের নেওয়ার মত কোন সম্পদ আমাদের নেই। তাহলে কি উদ্দেশ্য ছিল ওদের? রিয়েল স্টেট এর লোক নয় তোহ ওরা। আমাদের পটিয়ে কাজ হাসিল করতে পারি নি। তাই এখন জবরদস্তি করে কাজ হাসিল করতে চাচ্ছে এখন।

অনেক ভেবেচিন্তে কোন কুল-কিনারা বের না করতে পারলাম না আমি। শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই সদর দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে বাড়ির চারপাশ টা ঘুরে দেখলাম আমি। কিন্তু, কয়েকটা পায়ের ছাপ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না আমার। শেষে নিরাশ হয়ে রুমে ফিরে আসলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে আম্মু বলে উঠলো-কিরে, এত সকালে উঠলি যে আজ?

কালকের ঘটনাটা সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে এক গেল হেসে দিয়ে বললাম-মাঝে মাঝে সকালের ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগানো শরীরের জন্য উপকারী বুঝলে আম্মু।

আম্মু আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। যেন কোন এলিয়েন দেখছে। অবশ্য অবাক হওয়ারই কথা। কারণ আমার কানের কাছে ড্রাম সেট বাজলেও কোন দিনও আমি ওত সকালে ঘুম থেকে উঠি না।

ব্রেকফাস্ট করে ৯:১৫ টা নাগাদ স্কুটি নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম আমি। মেইন রোডে উঠে কিছুক্ষন যেতেই সিগন্যালে আটকে গেলাম। মাথায় হেলমেট টা ঢিলে হয়ে ছিল। ওটা ঠিক করতে যেয়ে হঠাৎ সামনের লুকিং গ্লাসে চোখ চলে গেল আমার। মনে হলো পিছন থেকে বাইকে বসে কেউ একজন আমাকে ফলো করছে। সাই করে ঘুরে গেলাম আমি। কিন্তু, ততক্ষনে সিগন্যাল শেষ হয়ে যাওয়ায় অসংখ্য গাড়ির মধ্যে হারিয়ে গেল বাইক টা। আর খুঁজে পেলাম না ওটাকে আমি।

ভার্সিটিতে পৌঁছে বাইক স্ট্যান্ডে স্কুটি টা লক করে সামনে এগুতেই দেখলাম, ঈপ্সি, ইরিন, রুমপি, নাদিয়া, রওনক ও নাফিজ গ্রাউন্ডে গোল হয়ে বসে গল্প করছে। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে সবাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। দ্রুত পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কাছে গিয়ে কাঁধের ব্যাগটা ঘাসের উপর রেখে ধপ করে বসে পড়লাম। রওনক বললো-কিরে, দোস্ত তোরে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? নাফিজ বললো-কি সমস্যা একবার খালি ক। দেখ মুশকিল আহসান কইরা দিমু।

আমি বললাম-আর বলিস না। আজ ভার্সিটি তে আসার সময় মনে হল যে, কেউ যেন আমাকে ফলো করছে। তাছাড়া, কাল রাতের ঘটনাটাও খুলে বললাম আমি ওদেরকে। আমার কথা শুনে ঈপ্সি ইরিনরা সবাই হাঁ হয়ে গেল।

ইরিন একটা হাত গালে রেখে বললো-ক্রিস, নিশ্চয়ই ক্রিস হইব দোস্ত। ওয়াও, ভাবতেই ভাল লাগছে চাঁদনী রাত, ফুলের ঘ্রান, কুলকুল পানির শব্দ। দুইটা ভিলেইন। একটা হিরো আর তার হিরোইন। তারপর ফাইট ঢিসুম-ধাসুম। বলতে বলতে ও সত্যিই যেন হারিয়ে গেল ওর কাল্পনিক দৃশ্যপটের মধ্যে।

ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললাম আমি-তুই তোহ সব সময়ই রোমান্টিক মুডে থাকিস গাঁধী। আমার মনে হয় প্রথম লোক দুটো ছিঁচকে চোর ছিল আর আলখেল্লা পড়া লোকটা হয়তো চোরের উপর বাটপারি করতে এসেছিল। তারপর আর কি চোর আর বাটপারের মধ্যে ফাইট লেগে গিয়েছিল হয়তো। বলেই হেসে দিলাম আমি।

রওনক বললো-তুই যাই বলিস না কেন আফরিন। আমার কিন্তু বিষয়টা জটিল মনে হচ্ছে। উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম আমি কিন্তু, এমন সময় কমন রুম থেকে ভীষণ চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল। এজন্য মুখের কথা মুখে রেখেই কমন রুমের দিকে ছুটলাম আমি সহ অন্য সবাই। কমন রুমে ঢুকে দেখি তুলকালাম কান্ড। সাব্বির আর লিমন সমানে একে ওপর কে ঘুষি মেরে চলেছে। সাব্বির আমাদের ফ্রেন্ড। জিম করা পেটানো শরীর ওর।
অপরদিকে লিমন অন্য গ্রুপ এর লিডার। সব সময় লেগে থাকে অন্যের পেছনে।

দৌড়ে গিয়ে সাব্বির কে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম আমরা। অন্যদিক থেকে লিমন কে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে ওর গার্ল ফ্রেন্ড রিয়া। আর মুখে ইংরেজিতে গালির তুবড়ি ফুটিয়ে বলে চলেছে-চলে এসো লিমন। তোমাকে না কতবার বলেছি এসব ক্লাসলেস ছোটলোকদের সাথে লাগতে যাবে না। ফুঁসে উঠে ওর দিকে এগিয়ে যেতে চাচ্ছিল নাদিয়া, রুমপি ওরা। কিন্তু, আমি ওদের ঠেকিয়ে দিয়ে বললাম ছেড়ে দে।

এরপর সাব্বির কে সরিয়ে আনলাম একপাশে। তারপর কড়া কন্ঠে বললাম। কি হয়েছে রে। কেন লাগতে গিয়েছিলি ওদের সাথে। সাব্বির একটা হাত দিয়ে কর্নারে বসে থাকা শুভ্রর দিকে ইশারা করে বললো-দেখ ওকে ঘুষি দিয়ে কি করেছে শালা লিমন কু*

ঘটনার আস্মিকতায় এতক্ষন শুভ্রর দিকে নজরই পড়েছিল না কারো। সবার আগে নাদিয়া দৌড়ে গেল ওর দিকে। দেখলো কপালের এক পাশে ফুলে নীল হয়ে গেছে শুভ্রর। ব্যাগ থেকে ব্যান্ডেজ বের করে ওর কপালে লাগিয়ে দিল নাদিয়া। তারপর দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো ওরা।

ওদের কাছে গিয়ে কৃতিম কাশি দিয়ে শুভ্র কে লক্ষ্য করে বলে উঠলাম আমি-আসল ঘটনাটা কি হয়েছিল বলত? শুভ্র বললো-কমন রুমে দাঁড়িয়ে রিয়া আমাদের গ্রুপ কে টিপনি কেটে বলছিলো-ওদের গ্রূপের সবাই অনেক মডার্ন আর ক্লাসি। আমি শুধু আস্তে করে বলেছিলাম-ক্লাসি যা জেলাসি। আর তাতেই লিমন এসে……

আমি ঝাঁজ মেশানো কণ্ঠে বললাম-তোরা পারিস ও বটে। এবার চল ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে। সবাই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বলল-হ্যাঁ, চল চল।

ওইদিন আর ক্লাস নিলেন না স্যার। কিন্তু, নতুন একটা ঘোষণা দিলেন। দুইটা টিম গঠন করে নতুন একটা বিষয়ের উপর রিসার্চের জন্য শিক্ষা সফরে যেতে চাচ্ছেন তিনি। সর্বোচ্চ দশ দশ করে মোট বিশ জন স্টুডেন্টদের কে সাথে নিয়ে যাবেন। সেখানে কিছুদিন থাকতেও পারেন তারা। আগ্রহীরা যাতে তাদের টিম তৈরি করে ও টিম লিডার চুজ করে তার একটা লিস্ট স্যারের কাছে জমা দেয়। স্যার চলে যাওয়ার পর ক্লাসের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।

রিয়া আর লিমন আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বললো-আমরা তো অবশ্যই যাচ্ছি। কিন্তু, ভীতুরা হয়তো নাও যেতে পারে। ঈপ্সি, ইরিন নাদিয়া ওদের দিকে মুখ ভেংচিয়ে বললো-আমরা ও যাচ্ছি এবং আমাদের গ্রূপ লিডার হবে আফরিন। আমি বললাম-ধুর পাগল হয়ে গেছিস তোরা? আমি এইসবের মধ্যে নেই। কিন্তু, ওদের জোড়া জুরির কাছে হেরে গিয়ে বললাম-ওকে বাবা ওকে। পরে ভেবে দেখবো। এখন চল বাইরে যাই।

ক্লাসের বাইরে এসে সবাই এক জায়গায় জড় হয়ে আলোচনা করতে লাগলাম আমরা। কিন্তু, আমরা কেউ লক্ষ্য করলাম না। কিছুটা দূরে কাঠ বাদাম গাছের আড়াল থেকে একজোড়া চোখ আমাদেরকে ফলো করে চলেছে আর ওয়াকিটকি দিয়ে কার সঙ্গে যেন নিচু গলায় কথা বলে যাচ্ছে…..


পর্ব-৪

অতঃপর সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমরা গ্রূপের সদস্যদের একটা লিষ্ট তৈরি করে স্যারের কাছে যেয়ে জমা দিয়ে এলাম। তবে লিষ্টে সামান্য পরিবর্তন করা হয়েছে। দু গ্রুপ থেকে ২০ জন সদস্যর বদলে মোট ৩০ জন নেওয়া হয়েছে। আগামী পরশুই রওনা দিয়ে দিতে চাচ্ছেন স্যাররা।

স্যার-ম‍্যাম দের মধ্যে থেকে মোট চারজন যাচ্ছেন আমাদের সাথে। দুজন স্যার, দুজন ম‍্যাম। রিসার্চের জন্য ওনারা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তর্গত বান্দরবান জেলা কে মননিত করেছেন। কম জনবসতি সম্পন্ন অঞ্চল হওয়ার কারনে সম্ভবত স্যার রা বান্দরবান কেই রিসার্চের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্বাচন করেছেন।

সামনে হাতে মাত্র একটা দিন থাকায় সেদিন সবাই দ্রুত যার যার বাড়ি চলে এলাম। আম্মু শুনে অনেক খুশি হলেন। কিন্তু, আমার আম্মুর জন্য অনেক চিন্তা হতে লাগলো। কি করা যায় ভাবতে লাগলাম। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক হল গ্রাম থেকে নানিজান কে কাল খবর দিয়ে আনা হবে। অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম আমি। কারণ, আমার নানিজান একজন শক্ত ধাঁচের মহিলা। বয়স ৬০ এর উপরে। তবুও ওনার ভয়ে এখনো বাড়ির ত্রিসীমানায় চোর-ডাকাতেরা পা রাখতে সাহস বোধ করে না।

মাঝের দিনটা অন্য সব সাধারণ দিনের মতোই কেটে গেল। বিকেলের মধ্যেই নানিজান চলে এলো। রাতে নানিজানের সাথে গল্পগুজব করে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। ব্যাগেজ গোছাতে যেয়ে হঠাৎ হাতের দিকে নজর পরে গেল আমার। সাথে সাথে মনের মধ্যে একটা সন্দেহ উঁকি দিলো। কাল রিমপি বলছিলো লম্বা মত ছেলেটা নাকি ওদের কলেজের স্টুডেন্ট না। শুধু দুই-তিনদিন প্রিন্সিপালের রুমে যেতে দেখেছে ওরা। কিন্তু, ওইদিনের ঘটনার পর থেকে ছেলেটাকে আর দেখা যায় নি।

তাহলে কি ওই ছেলেটাই ওকে ফলো করছিলো? ওর কোন ক্ষতি করার জন্য। মনে মনে ভাবতে ভাবতে বাবার ল্যাবরেটরিতে ঢুকলাম আমি। বুকসেলফে রাখা বইগুলোর মধ্যে কিছুক্ষন হাত বুলালাম। তারপর পুরনো ধাঁচের একটা বই বের করে শুধু শুধুই পাতা ওল্টাতে লাগলাম।
সমস্ত পাতা উল্টানো শেষ করে বইটা আগের জায়গায় রেখে ফিরে আসতে যেয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। তারপর ছুটে যেয়ে বইটা নামিয়ে ক্রমাগত পাতা উল্টিয়ে চললাম। মাঝের পৃষ্ঠায় যেয়ে কাগজের টুকরো টা চোখে পড়লো আমার। প্রথমেই নজরে পড়েছিল। কিন্তু, চিন্তামগ্ন থাকায় নজর এড়িয়ে চলে গিয়েছিল।

ছোট এক টুকরো কাগজে একটা ছন্দ ও কিছু আঁকিবুকি লিখে রেখেছেন বাবা। কাগজের টুকরো টায় লেখা আছে-

” জীবন বলি তারে, আবার জীবন বিনাশ করে। সেই জীবনকেই ধরে রেখেছি ছোট্ট চমৎকারে। সেথায় তুমি যাও, গুপ্তধন খুঁজে নাও”।

বারবার, কয়েকবার পড়লাম আমি। কিন্তু, কিছুই বুঝতে পারলাম না। শেষমেষ, কাগজের টুকরো টা হাতে নিয়ে ল্যাবরেটরি থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। কাগজটা, মেট্রেসের নীচে রেখে আর দেরি না করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে আম্মু ও নানিজানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা রিক্সায় করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিলাম। ভার্সিটিতে পৌঁছে দেখলাম যে রীতিমত অনেকেই পৌঁছে গেছে। চারিদিকে কেমন যেন একটা উৎসব, উৎসব আমেজ তৈরি হয়েছে। আমাকে দেখতে পেয়ে আমার গ্রূপের সবাই হইহই করে উঠলো। ওদের সাথে যেয়ে যোগ দিলাম আমিও।
ইতিমধ্যে, কম্পাউন্ডে দাঁড়ানো দুটো বাস থেকে হর্ন বেজে উঠলো। হইহই করতে করতে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসে যেয়ে উঠে বসলাম সবাই। ওইদিকে, অন্য গ্রুপের গ্রুপ লিডার লিমন আর ওর দলবল রা যেয়ে ওপর বাসে উঠে বসলো। প্রত্যেক বাসে, একজন স্যার, ও একজন ম‍্যাম নিয়োগ করা হলো।

খুব সকাল থাকতে রওনা দেওয়ার কারনে দুপুর ২:০০ টা নাগাদ চট্টগ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। ওইখানে, বাসেই লাঞ্চটা সেরে নিয়ে বান্দরবান এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিলাম। বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম সেখানে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা এবড়ো থেবড়ো পথে বাস ঢোকানো সম্ভব না দেখে অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে আমাদের। সবার সেফটির সুবিধার্থে আদিবাসি বসতি গুলো থেকে কাছেই পাহাড়ের পাদদেশে একটা নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়েছেন স্যাররা।

আমাদের এবং স্যার-ম‍্যাম দের থাকার জন্য টিন দিয়ে মোট চারটি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। একটি স্যারদের জন্য, একটি ম্যাডাম দের। আর বাদ বাকি দুটির একটা ছেলেদের জন্য আর একটা মেয়েদের। রান্নার জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি অস্থায়ী পাকের ঘর। তাছাড়াও বানানো হয়েছে দুইটা টয়লেট।

সারাদিনের ক্লান্তির ধকলে ওইদিন আর কোথাও বের হতে পারলাম না আমরা। তাছাড়া, সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো বলে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুমতে চলে গেলাম সবাই।

মাঝরাতে, ঈপ্সির ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। বিরক্ত কণ্ঠে বললাম-কিরে, কি হয়েছে। ও ফিসফিস করে বললো-ভালভাবে শোন। একটু মনযোগ দিতেই শুনতে পেলাম শব্দ টা। মনে হচ্ছে টিনের গাঁয়ে কিছু একটা যেন আচর কেটে চলেছে। সাথে সাথে উঠে বসলাম। মাটির মেঝেতেই মোটা দুপরত কার্পেট বিছিয়ে তার উপরে তোষক পেতে ঘরের একপ্রান্তে শুয়েছি আমাদের গ্রূপের মেয়েরা।

অন্য প্রান্তে রিয়াদের গ্রূপের। ইতিমধ্যে, আমাদের কথার আওয়াজে উঠে বসেছে রিমপি, আইরিন, নাদিয়া, । সাবরিনা আর টুম্পা ঘুমাচ্ছে এখনো। আমাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলো ওরা-কিরে, কোথায় যাচ্ছিস। আমি বললাম-বাইরে দেখতে যাচ্ছি। শব্দর উৎস টাকে। ওরা বললো-আমরাও যাবো।

ফিসফিস করে বলে উঠলাম-আয় তাহলে। ছোট টর্চ টা জ্বেলে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। ঘুরে চলে এলাম ক্যাম্পের পিছন সাইডে। টর্চের আলো ফেলতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল আমাদের…..


পর্ব-৫

টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমরা, সারা গায়ে বড় বড় পশম জড়ানো কালো ভালুক প্রজাতির কোন একটা প্রাণী নখের সাহায্যে ক্যাম্পের টিনের দেয়ালে আঁচড় কেটে চলেছে। টর্চের আলো পরাতে আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো প্রানী টা। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে আসতে লাগলো আমাদের দিকে।

প্রাণীটাকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে পিছু হটতে লাগলাম আমরা। হঠাৎ পিছন থেকে কারও ধমকে ঘুরে তাকালাম সবাই। দেখলাম লিমন দাঁড়িয়ে আছে। ধমকের সুরে আবারো বললো লিমন-কি ব্যাপার? এত রাতে এখানে কি করছিস তোরা? ঈপ্সি কাঁপতে কাঁপতে আঙ্গুল দিয়ে পিছনের দিকে ইশারা করলো। লিমন ওর ইশারা অনুযায়ী টর্চের আলো ফেলে বললো-হ্যাঁ, কি ওখানে? কই কিছু নাই তোহ।

সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সত্যিই কিছু নাই। একে অপরের দিকে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকাতে লাগলাম আমরা। কিন্তু, লিমন কে কিছুই বললাম না। লিমন আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল-আমার কি মনে হয় জানিস?

তোদের সব কয়টারই ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস আছে। যা রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পর। আর হুটহাট করে কখনো এভাবে বাইরে বের হবি না।
এমনিতেই ঘটনার আকষ্মিকতায় অপ্রস্তুত হয়ে ছিলাম আমরা। তাই, ওর কথা মত আর দেরি না করে রুমে যেয়ে শুয়ে পড়লাম সবাই। কিন্তু, সাথে সাথেই ঘুমতে পারলাম না কেউ ই। কারণ সবার মনে তখন একই ভাবনা চলছিল আমাদের।

খুব সকালে অসংখ্য পাখির কলকাকলি তে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। একে একে আইরিন, রিমপি, ঈপ্সি সাবরিনা, নাদিয়া টুম্পা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলাম আমি। সাবরিনা ঘুম বিজড়িত কণ্ঠে বলল-আরেকটু ঘুমতে দে না দোস্ত। আমি কৃতিম রাগ দেখিয়ে বললাম-মেমসাহেব, এখানে আমরা ঘুমতে আসি নি। অনেক কাজ আছে আমাদের। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন।

আমার কথার দমকে ওপাশ থেকে রিয়া আর ওদের গ্রূপের মেয়েদের সবার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ ডলতে ডলতে আমার দিকে বিরক্তির চোখে তাকাতে লাগলো ওরা। মুখ টিপে কোনমতে হাসি আটকিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। সাথে সাথে অস্ফুট একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো সবার মুখ থেকে-ওয়াও হোয়াট এ সিনারি। সূর্য্য সবে উঠি উঠি করছে। আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পথে প্রান্তরে।

আমাদের ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে কিছুটা দূরেই একটা জঙ্গল শুরু হয়েছে। বসন্তের শুরুতে প্রত্যেকটা গাছে গাছে সবুজ কচি পাতা দিয়ে ভরে গেছে বনটা। সেই সাথে গাছের ডালে ডালে হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে পড়েছে চারিদিক। দূরে অস্পষ্ট ভাবে সারিসারি পাহাড়ের টিলা দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া, আরেকটা জিনিস খুব ভাবে নজর করলো আমাদের। কিন্তু, বুঝতে পারলাম না জিনিস টা কি।

ক্যাম্প বরাবর কমপক্ষে এক মাইল দূরে কিছু একটা চকচক করছে যেন। সেটা থেকে রুপার মত দুত‍্যি ঠিকরে পড়েছে চারিদিকে।

এত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহহীত হয়ে পড়েছিলাম সবাই। স্যারের গলার আওয়াজে হুস ফিরলো আমাদের। তিনি সবাইকে ডেকে পাঠালেন। বললেন-৩০ মিনিটের মধ্যে গুছিয়ে মাঠে এসো সবাই। তাড়াহুড়া করে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম আমরা। দ্রুত ফ্রেস হয়ে স্যারের কথামত মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই।

আব্দুর রউফ স্যার সবার উদ্দেশ্যে বললেন-মনযোগ দিয়ে শোন সবাই। তোমার যে দুটো গ্রুপ তৈরি করেছ। গ্রুপ দুটিকে দুটো সংকেতে বিভক্ত করলাম আমি। একটা হচ্ছে গ্রুপ( A) আরেকটা গ্রুপ (B)। গ্রুপ (A) এর কাজ হচ্ছে আশেপাশে থেকে বিভিন্ন উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করা। ভিন্নধর্মী উদ্ভিদ হলে তোহ কোন কথাই নেই।

আর প্রাপ্ত নমুনা সমূহ এনে জমা দিবে তোমাদের উদ্ভিদ বিজ্ঞান স্যার আব্দুর রউফ স্যারের কাছে। অর্থাৎ, আমার কাছে।

আর গ্রুপ (B)এর কাজ হচ্ছে বিভিন্ন প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করা। না, তোমাদের বড় কোন প্রাণী ধরে আনতে বলছি না। স্যারের কথার ধরণ দেখে হেসে দিলাম সবাই। স্যার আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন-ছোট, ছোট কীটপতঙ্গ সংগ্রহ করবে তোমরা। আর সেটা এনে জমা দিবে তোমাদের জীব বিজ্ঞান স্যার রায়হান স্যারের কাছে।

আর হ্যাঁ, পাশে যেই জঙ্গলটা দেখেছ ওটার ভিতরে যেতে পারো তোমরা। তবে একটা নির্দিষ্ট এরিয়া পর্যন্ত। মাঝ জঙ্গলে যাওয়া চলবে না। খবর পেয়েছি ওটায় কোন হিংস্র জন্তু নেই। তবুও কোন প্রকার রিস্ক নিতে চাচ্ছিনা আমরা। এখন তোমরাই ঠিক কর কে কোন গ্রুপ নিতে চাও। আমরা কিছু বলার আগেই লিমন দের গ্রুপ থেকে রিয়াসহ কতগুলো ছেলেমেয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো ওরা (B) গ্রুপ নিতে আগ্রহী। আমরাও রাজি হয়ে গেলাম(A) গ্রুপ এর জন্য।

ঠিক হলো ম‍্যাম দের সাথে প্রত্যেকদিন পালা করে দুজন থাকবে। রান্নায় এবং ঝর্ণা থেকে পানি আনার কাজে সাহায্যের জন্য। তখন স্যারের কাছে দূরের চকচকে জিনিস টা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম আমি। স্যার বলেছিলেন ওটা নাকি ছোটখাট একটা জলপ্রপাত। ওখান থেকেই খাবার পানি সংগ্রহ করতে হবে আমাদের।

সকালের নাস্তা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নমুনা সংগ্রহের জন্য। আজকে গ্রুপ (B) থেকে দুজন ক্যাম্পে থেকে গেল মাম দের সাহায্যের জন্য। ঠিক করলাম আজ জঙ্গল টার মধ্যে ঢুকব আমরা। আর ওরা যাবে জল প্রপাত টার দিকে। সবার হাতে ছোট ছোট লাঠি নিলাম জঙ্গল সাফ করে ভিতরে ঢোকার জন্য। আর সাব্বির নিলো একটা বড় ছুরি। ডালপালা কাটার জন্য।

আমাদের গ্রুপের মোট সাতজন মেয়ে আর আট জন ছেলে ঢুকে পড়লাম জঙ্গল টার মধ্যে। সামনে থেকে সাব্বির ডাল পালা কেটে পথ তৈরি করে দিতে লাগলো। আর আমরা ওই পথ ধরে এগুতে লাগলাম।

অনেক্ষন ধরে আমরা বিভিন্ন উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করলাম। এরপর আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। সূর্য তখন মাথার উপর উঠে গিয়েছিল। কিছুদূর আসার পরে পিছন থেকে হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেলাম আমরা। চমকে উঠলাম সবাই। ঠিক তখনই মনে হলো জঙ্গলের ডালপালা ভেঙেচুরে কিছু একটা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। প্রথমে বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো আমাদের। পরে বিপদের আশঙ্কা আচ‍ করতে পেরে ছুটতে শুরু করলাম সবাই। জিনিস টাও আমাদের পিছন পিছন ছুটে আসতে লাগলো।

কিছুদূর এগোনোর পর টুম্পা হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পরে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে ওকে তুলতে গেলাম সবাই। কিন্তু, মনে হলো জিনিসটা খুবই কাছে চলে এলো আমাদের। কেননা, সামনের ঝোপটা নড়তে শুরু করেছে ততক্ষনে…….


পর্ব-৬

ঝোপ টার দিকে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইলাম আমরা। হঠাৎ সাব্বির আমার হাত থেকে লাঠি টা নিয়ে ঝোঁপের দিকে ছুড়ে দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো-যত জোরে পারিস দৌড়া সবাই। ওর কথা শেষ হতেই ছুটতে শুরু করলাম সবাই।

ক্যাম্পের কিছুটা কাছে এসে ভীষণভাবে হাঁপাতে লাগলাম আমরা সবাই। শুভ্র কুঁজো হয়ে হাঁটু ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলো-জিনিস টা কি ছিলো বলে তোদের মনে হয় বলতো?
ফাহিম নিচুস্বরে বললো-অলৌকিক কিছু নয়তো?

ওর কথা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল টুম্পার। তোতলাতে তোতলাতে বললো-মা আ নে……ভুতপ্রেত।

ওদেরকে থামিয়ে দিয়ে বললাম আমি-তোরা কি পাগল হয়ে গেছিস। ওটা ভুতপ্রেত বা হিংস্র কোন পশু হতে পারে না। কারণ স্যারের কাছ থেকে শুনেছিস নিশ্চয়ই এই জঙ্গলে কোন হিংস্র জন্তু নেই। আমার মনে হয় বুনো শেয়াল হবে ওটা।

তাহলে কালরাতে কি ছিল ওটা? জিজ্ঞাসু কন্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললো আইরিন। প্রচন্ড রাগ লাগলো ওর উপর আমার। কারও সামনে এই কথা গুলো তুলতে নিষেধ করেছিলাম আমি।
সাব্বির, শুভ্র, তন্ময় একসথে বলে উঠলো-কাল রাতে মানে? কি সব বলছিস তোরা?
শেষে বাধ্য হয়ে ওদেরকে সব খুলে বললাম আমি। সব শুনে সাব্বির বললো-তোদের তোহ সাহস কম না। আবার কখনো এমন কিছু দেখলে আমাকে ডাকবি সবার আগে।

ওর কথায় সম্মতি প্রদান করে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে চললাম সবাই। প্রচুর ক্ষুধার্ত ছিলাম আমরা। তার উপরে ক্যাম্প থেকে ভেসে আসা খাবারের ভুরভুর গন্ধে খিদেটা যেন দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছিল সবার। তাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম সবাই ক্যাম্পের দিকে।

পরপর দুইদিন কোন ঝামেলা ছাড়াই কেটে গেল আমাদের। তারপরদিন আমরা গেলাম দূরের পাহাড়ি উপত্যকা ঘেঁষে গড়ে ওঠা মারমা পল্লীর পাশে কতগুলো ছোটবড় ঝোপঝাঁরের দিকে। ঘুরে ঘুরে উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করতে যেয়ে কিছু মারমা তরুণ তরুণীদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমাদের। আমাদের মধ্যে থেকে কারুরই ওদের ভাষা জানা না থাকলেও দেখলাম ওদের মধ্যে অনেকেরই বাংলা ভাষা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান আছে।

এ কারণে ওদের সাথে কথা চালিয়ে যেতে আমাদের কোন সমস্যা হলো না। ওদের মধ্যে থেকে মিচাং নামের একটি মেয়ে বললো-আজ রাত ১২ টার দিকে ওদের একটা উৎসব আছে। তাই ওরা সবাই চাচ্ছে আমরা যেন ওদের উৎসবে যোগ দিতে যাই।

ওদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে, এবং সম্ভব হলে অবশ্যই ওদের উৎসবে যোগ দিতে যাবো বলে ওইদিনের মত ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম আমরা। ক্যাম্পে ফিরে দেখলাম যে সেখানে আর এক কান্ড ঘটেছে। ম‍্যাম দের মধ্যে থেকে একজন নাকি রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। আর একজন গিয়েছিল সাহায্যকারী দুজন স্টুডেন্টের সাথে জলপ্রপাত থেকে পানি আনতে। ম‍্যাম নাকি এক ফাঁকে বাইরে গিয়েছিল পরে এসে দেখে নাকি অদ্ভুত কেউ একজন রান্না ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।

পরে নাকি ম্যামের চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে কাউকেই খুঁজে পান নাই স্যাররা। এ কথা শুনে চট করে একটা চিন্তা ঘুরতে লাগলো আমার মাথায়। আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর সাথে এখানে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনাগুলোর মধ্যে কোন যোগসূত্র নেই তোহ। কারও কি আমাদের সাথে কোন লেনাদেনা আছে? নাকি শুধুমাত্র আমার সাথে।

এমন সময় আমার চিন্তায় ছেদ ঘটলো স্যারের গলার আওয়াজে। সবাইকে দুপুরের খাবার নেয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি।

খেতে বসে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প করছিলাম আমরা। এমন সময় শুভ্র আমাদের দিকে তাকিয়ে অপরপ্রান্তে বসে থাকা লিমন দের গ্রুপ এর সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে উঠলো–হেই গাইজ, জানো সবাই, আজ জলপ্রপাত থেকে পানি আনার সময় একজন কে দেখলাম কাঁদায় মাখামাখি হয়ে আছে।

ওর কথা শুনে নাদিয়াসহ আমাদের গ্রুপের অনেকেই হাহা করে হেসে উঠলো। আমি স্পষ্ট বুঝলাম ওদের দলের রিয়া কে টিপনি কেটে কথা গুলো বললো ও। তাড়াহুড়া করে আমি কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইলাম অন্য দিকে। কিন্তু, ততক্ষনে রিয়ার কৃতিম কান্না জড়িত নাকি নাকি কন্ঠ শুনতে পেলাম আমি। লিমনের দিকে তাকিয়ে বলছে ও-দেখলে লিমন, আমাকে কিভাবে অপমান করছে ও। তুমি কিছু বলবে না ওকে।

ওর কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে শুভ্র দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো লিমন। শুভ্রর কাছে এসে ওর দিকে একটা ঘুষি বাগিয়ে দিতে গেল ও কিন্তু ওর হাত ধরে ফেলল সাব্বির। এবার সাব্বিরের সাথে লাগতে যাচ্ছিল লিমন। আর সহ্য করতে পারলাম না আমি। ওদের কাছে গিয়ে দুহাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দুদিকে সরিয়ে দিলাম দুজনকে।

তারপর দুজনের দিকে তাকিয়ে ভৎসনার সুরে বললাম-লজ্জা করে না তোদের? এভাবে একে অপরের সাথে লড়তে। অথচ, ভার্সিটিতে এসেই দেখেছি তোরা একে অপরের জিগ্ৰী দোস্ত ছিলি। কি এমন ঘটলো যে এভাবে একে অপরের শত্রু হয়ে গেলি। এরপর লিমনের দিকে তাকিয়ে বললাম-নাকি, ভালোবাসার জন্য নিজের বন্ধুত্ব টাকেও পায়ে দুমড়ে ফেলেছিস তুই?
আমার কথা শুনে দুজনেই কেমন যেন একটা উদাস হয়ে গেল। অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলো একে অপরের দিকে। তারপর দুজন দুদিকে চলে গেল।

সন্ধ্যায় সাব্বির আর অন্যান্য দের সাথে আলোচনা করে ঠিক করলাম রাতে যাবো আমরা মারমা পল্লীতে। কিন্তু, অতি সাবধানে। স্যার-মাম বা লিমন দের গ্রুপের কেউ যেনো ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে বিষয় টা।

আলোচনা শেষে বয়েজ ক্যাম্পে চলে গেলো ওরা। আর আমরা গল্পগুজব করে সময় কাটাতে লাগলাম। সবাই-ই সাথে করে মোবাইল এনেছিলাম আমরা কিন্তু, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্যাপচার করতে যেয়ে কম বেশি সবার মোবাইলই চার্জ শূন্য হয়ে পড়ে আছে।

ওইদিন ডিনারের পর দ্রুত শুয়ে পড়লাম সবাই। সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ, তীক্ষ্ণ একটা শিস শুনে ঘুম ভেঙে গেল আমার। বুঝতে পারলাম ১২ টা বেজে গেছে। সাব্বির সংকেত পাঠাচ্ছে তাই। পাশে তাকিয়ে দেখলাম একে একে উঠে বসেছে সবাই। গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়িয়ে পা টিপে টিপে বের হয়ে এলাম সবাই। দেখলাম কিছুটা দূরে সাব্বির সহ অন্যরা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

ওদের কাছে যেয়ে পাহাড়ি পথ ধরে হাটা শুরু করলাম আমরা। এমন সময় দূর থেকে মারমা গোষ্ঠীর সমবেত কন্ঠের গান, ঠুনরি ওঢাক- ঢোলের শব্দ শুনতে পেলাম সবাই। রাতের আকাশ যেন আগুন রাঙা হয়ে উঠেছে ওদের তৈরি অগ্নিকুণ্ডের লেলিহানে। কেমন একটা মোহগ্রস্থের মত শুনশান পাহাড়ি পথ পেরিয়ে কুয়াশার মায়াজাল ভেদ করে এগিয়ে চললাম আমরা…….


পর্ব-৭

৪৫ মিনিটের মধ্যেই মারমা পল্লীতে পৌঁছে গেলাম সবাই। দেখলাম উঠানের মাঝখানে বিশাল একটা অগ্নিকুন্ড জ্বালিয়ে তার চারপাশ ঘিরে থামি পরিহিত একদল মারমা তরুণ-তরুণী ছন্দের তালে তালে নৃত্য পরিবেশনা করছে। একটু দূরে একদল বাদক ঢাক-ঢোল ও ঠুনরি করতালের মাধ্যমে অপূর্ব মহরণকারী এক অদ্ভুত বাজনার সৃষ্টি করেছে। সেই সুরের মূর্ছনায় আপ্লুত হয়ে রাতের আকাশ থেকে লক্ষ লক্ষ তারা যেন চোখ মেলে দিয়েছে এই অনাবিল সৌন্দর্য্য দৃষ্টিগোচর করার জন্য।

নৃত্যরত তরুণ-তরুণীর মধ্যে থেকে আমরা মিচাং কে দেখতে পেলাম। হাত নেড়ে ইশারা করলাম সবাই ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। আমাদের কে দেখতে পেয়ে ছুটে চলে এলো মিচাং এবং অন্য ছেলেমেয়েগুলো। তারপর হাত ধরে নিয়ে চললো আমাদেরকে মূল অনুষ্ঠানের দিকে।

অগ্নিকুন্ড টার সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম আমরা। মিচাং ওদের বাবা, মা এবং অন্যান্য সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমাদের। সবাই আমাদের কে সাদরে অভর্থনা করলো। অনেক মজা করলাম ওদের সাথে সবাই। নৃত্য করলাম, গান করলাম, সাথে খেলাম মজাদার বিভিন্ন নাম না জানা পিঠা এবং বনমরোগ ঝলসানো। এরপর ওদের আতিথিয়তায় মুগ্ধ হয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম আমরা।

ক্যাম্পের কিছুটা কাছে আসতেই থমকে দাঁড়ালাম সবাই। দেখলাম আলো জ্বলছে স্যার দের রুম থেকে। তাহলে কি স্যার রা জানতে পেরে গেল সব কিছু। ভয়ে আত্মা কাঁপতে লাগলো আমাদের। ঠিক করলাম সরাসরি না যেয়ে ঘুরে ক্যাম্পের পিছন সাইড দিয়ে যেয়ে জানালা দিয়ে ব্যাপারটা দেখবো আগে।

যেই কথা সেই কাজ। পা টিপে টিপে ক্যাম্পের পিছন দিকটায় চলে এলাম সবাই। এরপর জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল সবার। দেখলাম হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় দুইটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আসেন স্যার রা। নিচে এককোনে সমস্ত স্টুডেন্ট দের সাথে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে ম‍্যাম দুজন।

আর সবার দিকে অস্ত্র ধরে আছে একদল সশস্ত্রবাহিনী।

ওদের মধ্যে থেকে ওরাংওটাং এর মত দেখতে একটি লোক হাতে ধরে রাখা একটি ছড়ি ঘুরিয়ে রাগে আস্ফালন করতে করতে বলতে লাগলো-এখানে আসার পর থেকে কম জ্বালাওনি আমাকে তোমরা। কখনো জঙ্গলের মধ্যে থেকে লাঠি ছুড়ে দিয়ে আমার মাথায় আলু গজিয়ে দিয়েছো। ওইদিন আবার তোমাদের ওই ম্যাডাম জানালা দিয়ে আমার দিকে গরম পানি ছুড়ে মেরে আমাকে ঝলসানোর ফন্দি এতেছিল। ভাগ্গিস সরে গিয়েছিলাম।

এই বিপদের মধ্যেও মুখে হাত চেপে খুকখুক করে হেসে উঠলো ঈপ্সি। বুঝতে পারলাম, জঙ্গলের মধ্যে এই ওরাং ওটাং ই আমাদের পিছু নিয়েছিলো তাহলে। আর ওইদিন রান্নাঘর দিয়ে উকিঝুঁকিও মারছিল এই লোকটা। মাম হয়তো কোন জন্তু মনে করে গরম পানি ছুঁড়ে দিয়েছিল লোকটার দিকে।

হঠাৎ লোকটা আবারো গর্জে উঠলো-নেহাৎ, বস এর হুকুম ছিল কারও কোন ক্ষতি করা চলবে না তাই সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। না হলে…..এতটুকু বলে হাতে ধরে রাখা ছড়ি টা মাথার উপর নিয়ে ঘুরাতে লাগলো লোকটা। কিন্তু, হঠাৎ হাত ফসকে ঘুরতে ঘুরতে সপাত করে লোকটার মাথার উপরেই এসে পড়লো ছড়ি টা। ‘উফ গেলাম রে’ বলে বিষন্ন দৃষ্টিতে মাথা ঘষতে ঘষতে বলতে লাগলো লোকটা-ধুর ভাগ্যই ভালো না।

এরপর, দলের অন্য লোকদের দিকে তাকিয়ে চড়া গলায় বলে উঠলো-তোদের না বললাম, বাসার আশপাশ দিয়ে অন্য ছেলেমেয়েগুলোকে আরেকবার খুঁজে দেখ। ওই মেয়েটা কেই তোহ পেলাম না এখনো। ওকে না নিয়ে গেলে বস আস্ত রাখবে না আমাদের। দলের লোকগুলো হাই তুলতে তুলতে বললো-দুবার খুঁজেছি বস। ওরাং ওটাং এর মত লোকটা হুঙ্কার দিয়ে বললো-আবারো খুঁজে আয়।

-ওকে বস বলে দলের লোকগুলো রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এতক্ষন একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমরা যেন কোন মঞ্চ নাটকের দৃশ্য দেখছিলাম। কিন্তু, লোকগুলো কে বাইরে বের হতে দেখে ঘাবড়ে গেলাম সবাই। ভাবলাম ঘুরে দৌঁড় লাগবো। কিন্তু, তার আগেই হঠাৎ করে পিছন থেকে কারা যেন আমাদের মুখ চেপে ধরল। এরপর ইশারা করলো না চিল্লাতে।

অনেকক্ষন হলো ছোটছোট টিলা পেরিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা। সামনে আর পিছনে রয়েছে রহস্যময় আগন্তুক গুলো। এরা যে ওই ওরাং ওটাং বাহিনীর লোক নয়। সেটা আন্দাজ করতে পেরেছি আমরা। তাহলে কারা এরা? কি এদের উদেশ্য? প্রশ্নগুলো ভীষন ভাবে ভাবিয়ে তুললো আমাকে।

এভাবে ঘন্টা খানিক হাঁটার পর ঝরঝর একটা শব্দ শুনতে পেলাম আমি। আর একটু এগোতেই বুঝলাম ঝর্ণা থেকে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে অমন। ঝর্ণা টার পাশে একটা পাহাড়ের গুহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল লোকগুলো। তারপর গুহার মুখে রাখা একটা পাথর সরিয়ে আমাদের নিয়ে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলো ওরা।

গুহার ভিতরে চারকোনে চারটা মশাল জ্বলছে। মশালের ম্লান আলোয় চারপাশের কিছুই স্পষ্ট ভাবে দেখতে পেলাম না আমি। হঠাৎ ওদের দলের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে আমাদের মুখের স্কচটেপ খুলে দিল। এরপর ওরাও একে একে মুখ থেকে মুখোশগুলো খুলে ফেললো। কিন্তু, কাউকেই চিন্তে পারলাম না আমি।

কিন্তু, সবার শেষে যে মুখোশ খুললো তাকে দেখে বিস্ময়ে চোখের পলক পর্যন্ত পড়লো না আমার। ঘোলাটে চোখের সেই ছেলেটা। রাগে ফুঁসতে লাগলাম আমি। কেন ধরে এনেছে আমাদের কে ও? । আমার অবস্থা দেখে একপাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো ছেলেটা। চোখ দিয়ে ওকে ভস্ম করতে করতে পাশে তাকিয়ে দেখলাম অন্য সবার মুখ ও হা হয়ে গেছে বিস্ময়ে।

কিন্তু, আমার চমকানোর কি এখানেই শেষ? হয়তো না। ছেলেটার সাথে দেখা না হলে আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতাম না এর চেয়েও কত বড় চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য……


পর্ব-৮

আমাদেরকে অবাক হতে দেখে এগিয়ে এলো ছেলেটি। একে, একে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে পরিচয় দিতে লাগলো নিজের। সবার শেষে আমার কাছে এসে মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো-হ্যালো মিস আফরিন, আমি রওনক হাসান।

হাত না বাড়িয়েই বললাম আমি-আপনি আমার নাম জানলেন কি ভাবে? যতদূর, সম্ভব মনে পড়ছে ওইদিনের পরে আমাদের আর দেখাও হয়নি।

হেসে হাত সরিয়ে নিল ছেলেটি। বললো-কে বলেছে দেখা হয়নি? অসংখ্য বার হয়েছে। কখনো ভার্সিটির সামনে ফুচকা বিক্রেতা হিসেবে দেখেছেন আমাকে, কখনো ঝালমুড়ি বিক্রেতা হিসেবে। আবার কখনো রেস্টুরেন্টের ওয়েটার হিসেবে।

সন্দেহাতুর কণ্ঠে বলে উঠলাম আমি-আপনি কে বলুন তোহ? কি উদ্দেশ্য আপনার?
ছেলেটি বললো-উদ্দেশ্য তোহ একটা আছেই। সকাল হলেই জানতে পারবেন সবাই। এখন একটু বিশ্রাম নিন। সকাল হয়ে আসছে প্রায়। এটা বলে আমাদের মেয়েদের কে গুহার ভেতরের দিকে একটা কক্ষে দিয়ে গেল ছেলেটি। মশালের ম্লান আলোয় দেখলাম টুকটাক আসবাবপত্র এবং একপাশে বড় একটা মেট্রেস পাতা আছে কক্ষটার ভেতরে।

সবাই মিলে মেট্রেস টার উপরে গিয়ে আড়ষ্ট ভাবে বসলাম। প্রচন্ড দুঃশ্চিন্তা হতে লাগলো আমার, অন্যান্য স্টুডেন্টস এবং স্যার মাম দের কথা ভেবে। যতদূর মনে হচ্ছে এদের উদ্দেশ্য হয়তো খারাপ না। তবুও ১০০% শিওর হতে পারলাম না এটা নিয়ে। তাই, সকাল হবার প্রতিক্ষা করতে লাগলাম অধীর আগ্রহ নিয়ে।

কারও শান্ত ও স্নিগ্ধ কন্ঠের আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বসলাম আমি। কোন ফাঁকে চোখ লেগে গিয়েছিল আমার। কক্ষের বাইরে থেকে আবারও শুনতে পেলাম কণ্ঠ টা। বলছে-মিস আফরিন, সকাল হয়ে গেছে। আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানবেন না? ঝট করে উঠে বসলাম মেট্রেস থেকে। পাশে তাঁকিয়ে দেখলাম রিমপি, আইরিন ওরা ঘুমাচ্ছে সবাই। ওদেরকে জাগালাম না আর। একাই বের হয়ে এলাম রুম থেকে। দেখলাম রওনক হাসান দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।

আমাকে দেখে বললো-আসুন আমার সাথে। এরপর পাহাড়ের গুহা থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে হেঁটে আরেকটা ছোট গুহার ভেতরে গিয়ে প্রবেশ করলাম আমরা। গুহা টাকে দেখে কোন গবেষণাগার মনে হলো আমার। কাচের বোতলে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ভরে আছে গুহা টা। গুহার শেষ প্রান্তে হুইল চেয়ারে আমাদের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসে আছে কেউ একজন। গুহার মধ্যে অন্ধকার থাকায় ঠিকমত বোঝা যাচ্চিলো না কিছুই। রওনক হাসান কোন একটা সুইচ চেপে ধরতেই গুহার ভেতরটা ঝলমলে আলো দিয়ে ভরে গেল।

এরপর লোকটার কাছে গিয়ে ওনার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো রওনক হাসান-দেখুন তো স্যার চিনেতে পারেন কি না এনাকে? এরপর উনি হুইল চেয়ার টাকে ঘুরিয়ে ধরলো আমার দিকে।

তাজ্জব হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। শুধু তাকিয়েই রইলাম। যেন পলক পড়ছিল না দুচোখের। শুধু দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরতে লাগলো। কান্নার দমকে মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারছিলাম না আমি। অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে একবার বের হলো-বাবা। এরপর দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। তারপর পাগলের মত বলতে লাগলাম-বাবা, তোমার এমন অবস্থা কিভাবে হল? কিছু বল বাবা। কিন্তু, বাবা তখন কথা বলার মত পরিস্থিতি তে ছিলেন না। অনেক অসুস্থ দেখাচ্ছিল বাবাকে।

দেখলাম বাবার চোখেও পানি। সযত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন তিনি। আমি একটু ধাতস্থ হলে রওনক হাসান আমার কাছে এসে বললো-প্লিজ শান্ত করুন নিজেকে। আপনার বাবা যে এখানে আছে সেটা এখনই কাউকে জানানো যাবে না। ওনার দিকে তাকিয়ে আদ্র কণ্ঠে বললাম আমি-কোথায় এবং কিভাবে পেলেন আমার বাবাকে?

রওনক হাসান বলতে শুরু করলো-আমি আপনার বাবার একজন অতি প্রিয় স্টুডেন্ট। আমার কাছেও স্যার ছিলেন পিতৃতুল্য। ওনার ছত্র ছায়ায় ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলাম আমি। এক সময়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য লন্ডনে পাড়ি জমাই আমি। ঠিক করে যাই লন্ডন থেকে পি.এইচ.ডি করে এসে স্যারের সাথে নতুন নতুন কিছু ইনভেনশন করার কাজে নিয়োজিত করব নিজেকে। বাবা ছিলেন না আমার। স্যার ই একমাত্র উদ্দীপক ছিলেন আমার কাছে।

কিন্তু, দুবছর পর ফিরে এসে শুনলাম স্যার কিডন্যাপ হয়েছেন। দারুন ভাবে ভেঙে পড়লাম আমি। কিন্তু, এক সময় নিজেকে শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করলাম যেভাবেই হোক স্যারকে খুঁজে বের করব। এরপর তদন্তে নেমে পড়লাম নিজেই। স্যারের দেওয়া একটা লিংক ধরেই এগোতে থাকলাম আমি। অনেকদিন আগে স্যারের মুখে শুনেছিলাম তার একজন প্রতিদ্বন্ধি আছে।
মেহরাব আহমেদ নাম লোকটার। উনি নাকি স্কুল লাইফ থেকেই স্যারের সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করে আসছিল। এই লোকের সমস্ত ডিটেইলস জোগাড় করি আমি।

কিছু সূত্রও পেয়ে যাই। এই সূত্র ধরে এগিয়ে স্যারের সন্ধানও পেয়ে যাই এক সময়। কিন্তু, একা আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিলনা। পুলিশের উপরও অতটা ভরসা ছিল না আমার। তাই নিজেই ছোটখাট একটা গ্যাং তৈরি করি এবং মেহরাব আহমেদের গাং থেকে অনেক কষ্টে উদ্ধার করে আনি স্যারকে। এবং স্যারের সেফটির জন্য এই বিরল জায়গায় চলে আসি স্যারকে নিয়ে।

এতটুকু বলে থেমে বড় একটা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে রওনক হাসান। কিন্তু, সম্প্রতি জানতে পারি ওরা আপনাদের উপর নজর রাখছে। স্যারের আবিস্কৃত একটা মেডিসিনের ফর্মুলার জন্য। সেদিন থেকেই আপনাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিভিন্নভাবে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি। এতটুকু বলে থেমে গেল রওনক হাসান।

আমি বললাম-তাহলে, কালো আলখেল্লা এবং বাইকে করে আমার উপর নজর রাখা লোকটা আপনিই ছিলেন। রওনক হাসান জবাব দিলো-হ্যা।

কিন্তু, ক্যান্টিনে অভাবে এত ভাব নিচ্ছিলেন কেন? আর আমার হাত…………
-আসলে ক্যান্টিনে তখন শত্রু পক্ষেরও একজন উপস্থিত ছিল। কিন্তু, আপনার বান্ধবী আমার সাথে পরিচিত হবার জন্য এমনভাবে উঠে পড়ে লেগেছিল যে অমন ব্যাবহার না করলে তার সাথে কথা বলে যেতে হত আমার। নজর রাখতে পারতাম না লোকটার উপর। তারমধ্যে আপনি আবার এলেন ঘুষি বাগিয়ে।

লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলাম আমি। মৃদুসরে বললাম-সরি।

রওনক হাসান বললেন-ইটস ওকে। কিন্তু, একটা জিনিস ভীষণ ভাবে ভাবিয়ে তুলেছে আমায় ভার্সিটির বাইরে একটা লোককে ওয়াকিটকি দিয়ে কারো সাথে কথা বলতে দেখেছি আমি। ওই লোকটাই ওইদিন ক্যান্টিনের মধ্যে ছিল। তারমানে, ভার্সিটির ভেতরে আরও এমন কেউ রয়েছে যে বিভিন্ন তথ্যের আদান প্রদান করে যাচ্ছে শত্রু পক্ষের সাথে। তা না হলে, আপনারা যে এখানে এসেছেন শত্রু পক্ষ সেটা জানল কিভাবে।

উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু, অন্য গুহার ঐদিক টা থেকে কেমন একটা শোরগোলের শব্দ শুনতে পেলাম তখনই। বাবাকে গাছ কেটে তৈরি করা একটা খাটে শুইয়ে গুহার মুখ বনধ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম দুজনে।

বড় গুহাটার কাছে আসতেই দেখতে পেলাম রওনক হাসানের কিছু লোক শুভ্র কে ঘিরে রেখেছে। আর অন্যদিকে সাব্বির, তন্ময়, শিহাব সহ অন্যান্য স্টুডেন্টস রা চিৎকার করে শুভ্র কে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে ওদের কাছ থেকে।

কাছে যেয়ে রওনক হাসান লকগুলোর দিকে তাকিয়ে কড়া কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো -কি হচ্ছে এসব? ওকে ধরে রেখেছো কেন?

লোকগুলো যেন রওনক হাসানের জন্যই অপেক্ষা করছিল এতক্ষন। দলের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে একটা ওয়াকিটকি বাড়িয়ে ধরলো রওনক হাসানের সামনে। বললো-বস, এই ছেলেটা গোপনে কাউকে এখানকার ইনফরমেশন দেওয়ার চেষ্টা করছিল। হাতেনাতে ধরে ফেলেছি আমরা।

বিশাল বড় একটা ধাক্কা খেলাম যেন আমিসহ অন্যান্য সবাই। নাদিয়া কে অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি নিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম শুভ্রর দিকে। সাব্বির গালি দিয়ে ঘুষি বাগিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলো শুভ্র কে লক্ষ্য করে। ওর হাত ধরে থামিয়ে দিলাম ওকে আমি। তারপর এগিয়ে যেতে লাগলাম শুভ্রর দিকে…..


পর্ব-৯

শুভ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। শীতল কন্ঠে বল্লাম-কেন করলি এমন?
কোন উত্তর দিলো না ও। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

কি যেন হয়ে গেল আমার মধ্যে। এক হাতে দিয়ে ওর কলার ধরে অন্য হাত দিয়ে পাগলের মত চড় মারতে লাগলাম ওকে। আর মুখে বলতে লাগলাম-বল, কেন করলি এমন? কি এমন কমতি ছিল আমাদের বন্ধুত্বে? কেন বেইমানি করলি সবার সাথে।

কিন্তু, তবুও ও কোন জবাব না দিয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো। ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বললাম-নিয়ে যান ওকে সবার সামনে থেকে।

সকালের ঘটনাটার জন্য অনেকটাই শকড হয়ে পড়েছিলাম আমরা। এক একজন এদিক সেদিক ঝিম মেরে বসেছিলাম সবাই। দুপুরে সবাইকে একত্র করে বললাম আমি-যা হবার সেটা হয়ে গেছে। এখন মেহরাব আহমেদের গ্যাং থেকে কিভাবে স্যার/মামসহ অন্যান্য স্টুডেন্টস দের মুক্ত করা যায় সেটা ভাবতে হবে আমাদেরকে। একটু থেমে আবার বললাম-একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়।

ওদের যেহেতু আমাকে দরকার, সেহেতু আমি নিজেই যাব ওদের কাছে। শুভ্রই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। এবং আজ রাতেই করতে হবে সেটা।

এতটুকু বলতেই ওরা সবাই বাঁধা দিয়ে বললো-না, না তোকে আমরা এভাবে একা ওদের কাছে যেতে দিতে পারি না। যেতে হলে আমারা সবাই যাব।

ওদেরকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু, কিছুতেই রাজী করানো গেল না ওদেরকে। শেষমেষ ঠিক হলো সবাই এক সাথেই যাব। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন রওনক হাসান। বললেন-কোন চিন্তা করবেন না আমিও আছি আপনাদের সাথে। কিন্তু, সমস্যা হলো ওদের তুলনায় আমাদের জনবল কম।

আর আমরা যে পুলিশের সাহায্য নিব, কিন্তু এখানকার পুলিশও যে ওদের সাথে মিলিত নেই, তার গ্যারান্টি ও দিতে পারছি না। আর ঢাকা থেকে পুলিশ আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। তারমধ্যে স্টুডেন্টস দের যদি কোন ক্ষতি করে ফেলে ওরা?

ওনার কথা শেষ হতেই একটু ভেবে বললাম আমি-আচ্ছা, আমরা কিন্তু এখানকার মারমা জনগোষ্ঠীর সাহায্য নিতে পারি। আমার মনে হয় আমাদের এমন বিপদের কথা শুনলে ওরা না করতে পারবে না।

রওনক হাসান বললেন-এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। অনেকদিন ধরেই তোহ ওদের মাঝে আছি। ওরা অনেক হেল্পফুল সেটা জানি আমি। তাহলে এখনই আপনারা এক দল মারমা পল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিন। আর আমি এদিকটায় সব গোছগাছ করে রাখছি।

মারমা পল্লীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। সেখানে পৌঁছে মিচাং কে সব সমস্যার কথা খুলে বললাম আমি এবং ওদের সাহায্য চাইলাম। ও আমাদেরকে একটু ওয়েট করতে বলে ভিতরে গেল সবার সাথে আলোচনা করতে। দলবলসহ ফিরে এলো কিছুক্ষন পরেই। বললো-ওরা সাহায্য করতে রাজি আছে আমাদেরকে। প্রয়োজনে অন্য পল্লী থেকে আরো লোক এসে যোগ দেবে ওদের দলে, তবুও আমাদের শিক্ষক ও বন্ধুদেরকে উদ্ধার করে আনবেই ওরা।

ওদের মহানুভবতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমরা। সাথে সাহস ও দশগুন বেড়ে গেল আমাদের। মিচাং দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাহাড়ে ফিরে এলাম আমরা। এসে দেখি এদিকটারও সব কিছু গুছিয়ে ফেলেছে রওনক হাসান। এখন শুধু রাতের জন্য অপেক্ষা।
রাত ১২:৩০ এর দিকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। মারমাদের একটা তরুণ দল রয়েছে আমাদের সাথে। তাছাড়া রওনক হাসানসহ তার একদল লোক যাচ্ছে আমাদের সাথে। আর একদল লোককে বাবার কাছে পাহারার জন্য রেখে আসা হয়েছে। সর্বমোট ৫০ জন রয়েছি আমরা। রওনক হাসান অবশ্য আমাদের মেয়েদের কে সঙ্গে নিতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু, আমাদের জিদ এবং দৃঢ় মনবলের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে।

পাহাড়ের উঁচুনিচু-আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে জঙ্গল টার দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। শুভ্র সবার সামনে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। দুপাশ থেকে দুজন ধরে রেখেছে ওকে। এভাবে অনেক্ষন হাঁটতে হাঁটতে গভীর জঙ্গলে পৌঁছে গেলাম আমরা। আর কিছুদূর হাঁটার পর দূরে অস্পষ্ট মিটিমিটি আলো চোখে এসে পড়লো আমাদের। শুভ্র বললো ওটাই ওদের আস্তানা।
আরো কিছুটা এগিয়ে যেতেই গাছের আড়াল থেকে কিছু সশস্ত্র বাহিনী পিছন থেকে আমাদের সবার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ধরলো। চাপা কন্ঠে বললো-চিল্লাপাল্লা বা নড়াচড়ার চেষ্টা করলেই গুলি করে দিবে। ওদের কাছে সেরেন্ডার করলাম আমরা সবাই।

লোকগুলো আমাদের কে একটা পুরোনো দুর্গের মধ্যে নিয়ে এলো। এটা পূর্বে একটা পুরোনো বৌদ্ধ মন্দির ছিল সম্ভবত। একটা সময় মারমারা হয়তো এ মন্দিরে পূজো করতো। কিন্তু এখন এটা পরিত্যাক্ত অবস্থায় অপরাধীদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। মনে মনে এসবই ভাবছিলাম আমি।

চিন্তায় ছেদ পড়লো যখন দেখলাম একটা বড় হলরুমে এনে দাঁড় করানো হলো আমাদেরকে। হলরুমের একপ্রান্তে স্যার-ম‍্যাম সহ বাকি স্টুডেন্টদের দেখতে পেলাম আমরা। অন্য প্রান্তে ওরাং ওটাং এর মত লোকটা আর কিছু অস্ত্রধারীলোক এবং মাঝখানে চেয়ার পেতে বসে আছে সম্পূর্ণ সাদা চুলে মেহেদী রং করা, মুখে ফ্রেন্সস্কাট দাড়ি সমেত একজন লোক। বয়স ৪৫-৫০ এর কোটায়। খুব বেশি মোটা না। আবার খুব বেশি পাতলাও না। মাঝারি গরণ।

বুঝলাম ইনিই মেহরাব আহমেদ। আমাদের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল-আয় বাবা বুকে আয়। কতদিন দেখি নি তোকে। আমার কথা অনুযায়ী এদের ভার্সিটিতে ভর্তি হলি, এদের সাথে বন্ধুত্ব ও করলি। কত বাধ্য ছেলে তুই আমার। চকিতে শুভ্রর দিকে তাকালাম সবাই। তারমাবে ও মেহরাব আহমেদের ছেলে!


পর্ব-১০ (অন্তিম পর্ব)

শুভ্রর দিকে তাকিয়ে খিস্তি দিয়ে উঠলো সাব্বির সহ কয়েকজন। কিন্তু, শুভ্রর মধ্যে কোন পরিবর্তনই পরিলক্ষিত হলো না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো ওইভাবে। এবার মেহরাব আহমেদ উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমাদের দিকে। আমাদের তখন কিছুই করার ছিল না। কারণ সমস্ত অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছিল সবার কাছ থেকে।

একে, একে ঈপ্সি, সাবরিনা, নাদিয়া রিমপি ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো মেহরাব আহমেদ। এরপর বললো-ওহো, তুমিই তোহ সেই মেয়েটা। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মোঃইমতিয়াজ হোসেন এর মেয়ে। শেষের কথা টায় স্পষ্ট বিদ্রুপের আভাস মেশানো ছিল। বুঝতে পারলাম সেটা।

উত্তর না দিয়ে ওনার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। এবার পকেট হাতড়ে একটা কাগজের টুকরো বের করলেন মেহরাব আহমেদ। তারপর একটু কেশে নিয়ে পড়তে লাগলেন “জীবন বলি তারে, আবার জীবন বিনাশ করে। সেই জীবনকেই ধরে রেখেছি ছোট্ট চমৎকারে। সেথায় তুমি যাও, গুপ্তধন খুঁজে নাও”। পড়া শেষ করে আমার দিকে তাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি-এটার মানে কি, বলতো তোহ হে মেয়ে।

মুখে একরাশ বিস্ময় ফুটিয়ে বললাম আমি-এটা তোহ একটা বাচ্চাদের ছড়া মনে হচ্ছে আঙ্কেল। আর এই বয়েসে কি না আপনি একটা ছড়া নিয়ে গবেষণা করছেন? ছি ছি আঙ্কেল। আমার কথা বলার ধরণ দেখে হাহা করে হেঁসে উঠলো আমাদের গ্রূপের সবাই।
শাট আপু বলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলেন তিনি-শোন, মেয়ে চালাকি করার চেষ্টা করবে না একদম। তোমার বাবার কাছে তার উদ্ভাবিত মেডিসিনের ফর্মুলাটা চাওয়ায় বারবার এই আজব ছড়াটাই বলেছেন তিনি। বল তোহ ঝটপট কি মানে এটার।

এমনিতেই লোকটার উপর প্রচুর রাগ ছিলো আমার তার উপর তার এই ধমকানি শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেল আমার। বললাম-জি আঙ্কেল, আমি সব জানি কিন্তু বলব না। কি করবেন বলুন তোহ?

আমার এমন উদ্ধত আচরণ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন তিনি। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন-কি করব? দেখবে। এটা বলে চিৎকার করে কাউকে ডাকলেন তিনি-মোখলেস, মোখলেস। ডাক শেষ হতে না হতেই ওরাং ওটাং এর মত লোকটা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। বললো-জি, বস কি করতে হবে শুধু একবার বলুন।

মি.মোখলেস এর দিকে তাকিয়ে এবার হাহা করে হেসে উঠলাম আমি। বললাম-এই ওরাং ওটাং, থুক্কু মোখলেস আঙ্কেল আমাদের কি করবে? ওনাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন একবার আমাদের ছোড়া লাঠির আঘাতে মাথায় আলু গজিয়ে ছিল ওনার। আরেকবার তোহ ম্যামের ছোড়া গরম পানিতে ঝলসে ঝামা হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

আবারও হাহা করে হলরুম কাঁপিয়ে হাসির বন্যা বয়ে গেল। মি.মোখলেস এর দিকে কড়া চোখে তাকালেন মেহরাব আহমেদ বললেন-তারমানে আমার কাছে যেসব বাহাদুরীর গল্প বলেছিলে সব মিথ্যে। দিশেহারা কণ্ঠে বলে উঠলো মি.মোখলেস-না, না বস। আসলে ছেলেমেয়েগুলো সহ এদের স্যার-ম্যাডাম গুলোও যে কি পাজি বস। কি আর বলব।

কাল ধরে আমাকে যেন একদম নাস্তা নাবুদ করে ছেড়েছে। স্যার দুটো মিনিটে মিনিটে চা দাও। ম্যাডাম আর তার মেয়ে স্টুডেন্ট গুলো গোসল করব গরম পানির ব্যবস্থা করো, এটা খাবো না, ওটা বানিয়ে দাও, ছেলেগুলো তোহ গান-বাদদী শুরু করে দিয়েছিল রীতিমত। উফ, সে কি গান। কানের পোকা বের করে ছেড়েছে একদম। নেহাতই আপনার হুকুম ছিল, ওদের খাতির যত্ন করার জন্য। নাহলে…..

বুঝলাম ইচ্ছা করেই সবাই মিলে জ্বালিয়েছে মি.মোখলেস কে। হাসি হাসি মুখ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম-সাবাস দোস্ত, একটা কাজের মত কাজ করেছিস তোরা। ওপাশ থেকে হইহই করে উঠলো ওরা।

এবার ভীষণ রেগে গেলে মেহরাব আহমেদ। শুভ্রর দিকে একটা পিস্তল ছুঁড়ে দিয়ে বললেন তিনি-বুঝতে পেরেছি এভাবে কাজ হবে না। এরপর হলরুমের এক প্রান্তে বন্দি থাকা অন্য স্টুডেন্ডস এবং স্যার/মামদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি-শুট ডেম মাই চাইল্ড।

পিস্তল তাক করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো শুভ্র। আমরা সবাই যেন পাথর হয়ে গেছি। হা করে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। স্টুডেন্ডস এবং স্যার/মামদের সামনে যেয়ে থমকে দাঁড়ালো শুভ্র। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়ালো ও। এরপর মেহরাব আহমেদ দিকে পিস্তল তাক করে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো-বাবা, তোমার লোকদের কে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে বলো।

এমন পরিস্থির জন্য যেন মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না মেহরাব আহমেদ। গর্জে বলে উঠলেন তিনি-তোর এতবড় সাহস, আমার দিকে পিস্তল তাক করেছিস? কিন্তু, শুভ্রর নির্লিপ্ততা দেখে ইশারায় নিজের লোকদের অস্ত্র ফেলে দিতে বললেন তিনি।

আবারও একই ভাবে বলে উঠলো শুভ্র-হ্যাঁ, বাবা। তুমিতো জীবনে কোন ভাল কিছু শিখাও নি আমাকে। তাই, তোমার শেখানো জিনিস তোমার উপরেই ট্রাই করলাম আজ। ভালকিছু তোহ শিখেছি আমার এইসব বন্ধুদের কাছ থেকে। ওরাই আমাকে নিঃস্বার্থে ভালবেসেছে, ভালবাসতে শিখিয়েছে। কিন্তু, আমি ওদের ভালবাসার যোগ্য নই।

ওর কথা শেষ হতে না হতেই সাব্বিরসহ আমাদের গ্রূপের অনেকেই এক সাথে বলে উঠল-উই স্টিল লাভ ইউ দোস্ত। চকিতে তাকিয়ে দেখলাম নাদিয়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। বুঝতে পারলাম বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার অশ্রু এটা। ওপর প্রান্ত থেকে লিমনদের কেও বলতে শুনলাম-উই লাভ ইউ টু দোস্ত। ভিজে চোখে ওদের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম ইতিমধ্যে রওনক হাসান, সাব্বির মারমা তরুণেরা পৌঁছে গেছে সেখানে। সবার বাঁধন খুলে দিয়ে, মেহরাব আহমেদের লোকদেরকে বেঁধে সমস্ত্র অস্ত্র এক জায়াগায় জড় করে ফেলেছে ওরা।

এতক্ষন মোহগ্রস্থের মত সব যেন দাঁড়িয়ে দেখছিলেন মেহরাব আহমেদ। কিন্তু, হঠাৎ করে পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে শুভ্রর দিকে তাক করে বলে উঠলেন-প্রথমে তোকে শুট করব। পরে এগুলোকে। বলে ট্রিগার টিপতে গেলেন। কিন্তু, দু প্রান্ত থেকে সাব্বির আর লিমন ডাইভ দিয়ে কিক বসিয়ে দিলেন মেহরাব আহমেদের হাত লক্ষ্য করে। ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়লো রিভলবার টা। এরপর ওরা দুজন একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেললো মেহরাব আহমেদ কে।

একটু পরেই দূর থেকে অনেক মানুষের গুঞ্জন ও পুলিশের হুইসেল শুনতে পেলাম আমরা। বাইরে বের হতেই দেখতে পেলাম সমস্ত বাগানটা যেনো মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম আমাদের আসতে দেরি দেখে মারমারা পুলিশ নিয়ে ঘিরে ফেলছে পুরো বাগানটা। এখন আর কোথাও পালাতে পারবে না ওরা।

দুদিন পরে…..

বাবাকে ধরে ছাদে হাটাচ্ছিলাম আমি। এখন বাবা আগের চেয়ে অনেক সুস্থ্য আছেন। কথাও বলেছেন বেশ ভালোই। হঠাৎ, বাবাকে বললাম-বাবা, কাগজে লেখা অনুযায়ী ওই ছন্দ টার মানে কি ছিলো আর তোমার উদ্ভাবিত ফর্মুলাটিই বা এখন কোথায়?

বাবা মৃদু হেসে বললেন-চল ওদিকটায়। বলে আর্টিফিশিয়াল পন্ড টার দিকে নিয়ে যেতে বললেন তিনি আমাকে। পন্ড টার কাছে যেয়ে আর্টিফিশিয়াল যে পদ্ম ছিল, সেখান থেকে একটা পদ্ম তুলে আনলেন বাবা। তারপর ফুলটা খুলে ফেলতেই ভেতর থেকে একটা ছোট শিশি বেরিয়ে এলো। দেখতে পেলাম যেটায় রয়েছে ফর্মুলাটা।

এবার হেসে বললেন তিনি-জীবন বলি তারে। মানে এই পানিকেই আমরা জীবন বলি। আবার জীবন বিনাশ করে। দূষিত পানি জীবন বিনাশেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই জীবনকেই আমি আমার এই চমকপ্রদ আর্টিফিশিয়াল পন্ড টায় ধরে রেখেছি। বুঝলি তোহ ব্যাপারটা এবার।

বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলে উঠলাম-বাবা, সত্যিই তুমি গ্রেট। এমন সময় আম্মুর ডাকে দুজনেই ঘুরে তাকালাম আমরা। মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন আম্মু-নীচে যেয়ে দেখ কারা এসেছে। বাবাকে নিয়ে নিচে নামতেই দেখতে পেলাম-স্যার ম‍্যামসহ, রওনক হাসানশুভ্র, সাব্বির, লিমন, রিয়া, ঈপ্সি, রিমপি, নাদিয়া ওরা সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

কাছে যেতেই আব্দুর রউফ স্যার আব্বুকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠলেন-স্যার, কাল আমাদের ভার্সিটি থেকে আপনাকে একটা সংবর্ধনা দিতে চাচ্ছে। আসা করছি কাল আমাদের মাঝে থাকবেন আপনি।

বাবা মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রদান করলে সবাই আনন্দে হইহই করে উঠলো। এবার এগিয়ে এলো রওনক আহমেদ। বাবার কাছে এগিয়ে একটা কাগজ এগিয়ে ধরে বললেন-স্যার, এটা হচ্ছে আপনার আর আমার স্বপ্নের রিসার্চ সেন্টারের অনুমোদন কপি। এক হাত ধরে কাগজ টা ধরে, অন্য হাত দিয়ে কাগজটার গায়ে হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা। ওনার চোখে স্বপ্ন পূরণ ও আনন্দের অশ্রু দেখত পেলাম আমি।

বন্ধুরা মিলে ছাদে গল্প করছিলাম সবাই। নীচে স্যার/মামসহ রওনক হাসান ছিলেন আব্বুর সাথে। আম্মু কাউকেই যেতে দেন নি। দুপুরে লাঞ্চ করে যেতে বলেছেন সবাই কে। এমন সময় শুভ্র একটা ঘোষণা দিলো আমাদের মাঝে। নেক্সট মান্থ এ এনগেজমেন্ট করছে ও আর নাদিয়া। খুশিতে হাত তালি দিয়ে সিটি বাজাতে লাগলাম সবাই।

এমন সময় রওনক হাসানের গলার আওয়াজে ঘুরে তাকালাম সবাই। আমাদের কে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি-বন্ধুদের আড্ডায় আমিও কি জয়েন হতে পারি।

সবাই একসাথে বললাম-অবশ্যই। দু মিনিটেই সবার সাথে জমিয়ে ফেললেন তিনি। কথার একপর্যায়ে ঈপ্সি বলে উঠলো-কিই না ভাব নিচ্ছিলেন ওইদিন। আমি তো পুরাই ফিদা হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, সত্যি বলুন তো? কেউ কি আছে, যার ক্ষেত্রে এই ভাব প্রযোজ্য নয়।
চোখে মুখে একটা দুষ্ট ভাব এনে বললেন উনি, হম আছে একজন, কিন্তু উনি যেই মারকুটে, প্রোপোজ করলে না জানি আমাকে মেরেই তক্তা বানিয়ে দেন।

স্পষ্ট ভাবে বুঝে গেলো সবাই। আমাকে ইঙ্গিত দিয়ে কথা টা বলেছেন উনি। আরেকবার করা হাততালি আর শীষের আওয়াজে মুখর হয়ে গেল জায়গাটা। ইতিমধ্যে, ঈপ্সি, নাদিয়া ওরা আমাকে খোঁচানো শুরু করে দিলো। কৃতিম রাগ দেখিয়ে, চা বানানোর অজুহাতে কোনমতে ওদের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচলাম আমি।

লেখা – আফরিন স্বপ্না

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “অন্তরালে – Voyonkor vuter golpo in bengali” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ। )

আরো পড়ূন – আমি বাবা হবো না – অটুট থাকুক ভালোবাসা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *