জ্বীনবর (সিজন ৩) – রোমান্টিক ভূতের গল্প

জ্বীনবর (সিজন ৩) – রোমান্টিক ভূতের গল্প: বিকালে জ্বীনসর্দার সুলাইমান যখন রাজকার্যে নিজের কক্ষের বাহিরে গিয়েছিছেন, খুব সাবধানে তার কক্ষে প্রবেশ করলাম। পুরো কক্ষে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম এই আশায় যদি বিশেষ কক্ষটা কোথায় সেটা জানা যায়।


পর্ব ০১

জামার গুটানো হাতা খুলে নিচের দিকে নামাতে নামাতে এসে করিম চাচার চা দোকানে বসলাম। চায়ের অর্ডার দেওয়ার পর খেয়াল করলাম হাতে এখনো রক্ত লেগে আছে, উঠে জগের পানি নিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম ভালো করে।

ততক্ষণে চায়ের দোকানে বসে থাকা লোকগুলো আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস শুরু করেছে। জানি আমাকে নিয়ে সমালোচনা করছে।

চোখেমুখে পানি দিয়ে আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম। ওরা আবার চুপ হয়ে গেছে, অজানা এক কারণে লোকগুলো আমার সামনে আমার বদনামী কর‍তে পারেনা। চায়ে চুমুক দিতেই দেখলাম পাড়ায় এ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে, ওই পশুগুলোকে ধরে নিয়ে চিকিৎসা করতে।

যা কেলানি কেলালাম আজ! চায়ের দোকানের পিচ্চিটা এসে বলল, ওস্তাদ, তোমারে খালা খুজতাছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাইতে কইসে। চায়ের বিল দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে হাটা ধরলাম, আজ কপালে শনি আছে সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।

আজো মা অনেক বকবে, বাবার পুরোনো লাঠি দিয়ে দু-এক ঘা লাগিয়ে কিছুক্ষণ বাদে নিজেই ফ্যালফ্যাল করে কাদবে, মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝাবে। প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেছে আমার জন্য।

যাই হোক, বাসার সামনে এসে দরজায় নক করতেই দেখি দরজা খোলা। বুকে থু থু দিয়ে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলাম। উদ্দেশ্য আগে নিজের রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে লম্বা ঘুম দিব। ততক্ষণে মায়ের মেজাজ ঠান্ডা হয়ে যাবে।
যেই রুমের দিকে যাচ্ছি, পিছন থেকে মায়ের ডাক, “ওয়াফাহ! এদিকে আয়।”

পর পর কয়েকবার ঢক গিলে মুখটাকে মাছুম বাচ্চার মত করে পিছু ফিরে দেখলাম মা সেই পুরোনো লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটু কাছে এসে বললাম, “মা, পরে কথা বলি। আগে একটু ফ্রেশ হয়ে আসি, বাহিরে যা গরম। তুমি খেতে দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে নিই।”

মা লাঠিটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, ফ্রেশ তো হবিই। আগে লাঠির কয়েক ঘা খেয়ে নে। বলেই পায়ে লাঠি দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দিল। ব্যথার তেমন কিছুই নেই এই আঘাতে, তাও ভান করে বললাম, “মা আমার লাগছে। এমনিতেও পায়ে ভীষণ চোট পেয়েছি।” সাথে সাথে মা লাঠি ফেলে আমাকে বসিয়ে পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, কোথায় চোট পেয়েছিস?

আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। মায়ের চোখ থেকে মুক্তাদানার মত পানি ঝড়ছে। আমার হাত ধরে হাতে মা কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল,
-কেন এসব করিস ওয়াফাহ? জানিস তো তোর মা এসব সহ্য করতে পারেনা। তুই কেন ভুলে যাস তুই একটা মেয়ে। এসব করলে লোকে কি বলবে? তোর তো কখনো বিয়ে হবেনা মা। আমি একা একটা মানুষ কতদিক সামলাব।

তুই ও যদি না বুঝিস, কে বুঝবে বল! আমার সব চিন্তা তো তোকেই ঘিরেই। সবাই তোকে আড়ালে গুন্ডি ডাকে, কত বাজে কথা বলে মা হয়ে আমি এসব সহ্য করব কি করে বল?

-মা, আমি তো নিজের জন্য গুন্ডামি করিনা। আজ পাড়ার ছেলেগুলো শান্তার ওড়না ধরে টানাটানি করছিল, বাজে বাজে কথা বলে স্কুলগামী মেয়েদেরকে উক্ত্যত করছিল এসব অন্যায় আমি কি করে সহ্য করি বলো? তাই ছেলেগুলোকে আমি আর রিতা, মীনা, বৈশাখী মিলে ইচ্ছেমত কেলিয়েছি। দেখলাম তো হসপিটালে পাঠাল। জন্মের শিক্ষা দিয়েছি ওদের আজ।

  • তুই জানিস তুই কাকে মেরেছিস? আমাদের বাড়িওয়ালার ভাগ্নে ও তার বন্ধুদের। ভয়ে আছি কখন এসে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়! তুই আর শান্তি দিবিনা আমায়। রাস্তায় বের হলে সবাই বলে তোকে কবে বিয়ে দিব? বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, যেকোনো একটা ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে।

তুই তো বিয়ে করতেই রাজি হসনা। এইদিকে পাড়ায় গুন্ডামি করে বেড়াস, তোকে বিয়ে করবে কে? বলে মা মুখে আচল চেপে কান্না করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

নিজের রুমে এসে দরজা লক করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। জানালার ফাকে আসা ক্ষীণ চাদের আলোর দিকে ভাবতে লাগলাম, আসলেই মা বড্ড কষ্ট দিই আমি। আমি ওয়াসিফা, মা আদর করে ওয়াফাহ ডাকে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি, তারপর থেকে মা ই আমার মা-বাবা সব। মায়ের আদরে বাবাকে প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু ভুলতে পারিনা, বাবার সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো, বাবার আপসহীন অন্যায় না মানা আদর্শগুলো মনে পড়ে।

আমিও বাবার মত অন্যায় সহ্য করতে পারিনা, তাই প্রতিবাদ করতে করতে সবার কাছে এখন গুন্ডি নামেই পরিচিত হয়ে গেছি। মা আমাকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে। এখন টেইলারি কাজ করেই সংসার চালান। আর আমি পাড়ায় ছেলেদের মত টইটই করে ঘুরি। আমার মা ছাড়া কেউ নেই, মায়ের ও আমি ছাড়া কেউ নাই। তাই অত শাসন করতে পারেনা, একটু করেই ফ্যালফ্যাল করে কেদে দেয়। এখন তার মাথায় আমার বিয়ের ভুত চেপেছে, যে করেই হোক বিয়ে দিবেই আমাকে।

কিন্তু কোনো পাত্রপক্ষ ই আমার এসব স্বভাব-চরিত্র শুনে ঘরের বউ করে তুলতে চায়না। পরে জানাবে বলে কেটে পড়ে, আমি এসব দেখে হাসি। জেনে গেছি, ওরা আর এ মুখো হবেনা। পাশের বাসার ভাবি-চাচীগুলো দেখে মজা লুটে, সহানুভূতির নামে মাকে খোচা মেরে দিয়ে যায়।

দরজায় কড়া নেড়ে উঠল। বুঝতে পেরেছি মা খাবার নিয়ে এসেছে। দরজা খুলে দিয়ে চুপচাপ মন খারাপের ভান ধরে খাটে এসে বসে পড়লাম। মা ফ্যাকাশে মুখে আমার পাশে বসে ভাত মাখাতে লাগলেন।
খানিকটা মেখে নেওয়ার পর নীরবতা ভেঙ্গে বলল, যতই বকি তোকে, তুই ভাল করেই জানিস আমার তুই ছাড়া কেউ নেই। তোকে কষ্ট দিয়ে আমিই কষ্ট পাই।

তোকে ছাড়া আমার গলা দিয়ে একফোটা পানিও নামেনা। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর আমিই তোকে বহুকষ্টে বড় করেছি। এত কষ্ট করে পড়ালেখা করালাম, কোন শিক্ষক তোকে অন্যায়ভাবে মেরেছে বলে সেটাও ছেড়ে দিলি।
এখন একটু সংসারের কাজকর্মে মন দিবি কিন্তু তা না করে ছেলে সেজে পাড়ায় গুন্ডামি করিস।
আর কত জ্বালাবি আমায় বল? শান্তিতে মরতে তো দিবি।

শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মাকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে, কেদেই দিলাম। মা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, বিয়ে করতে রাজি হয়ে যা মা, তোকে একটা ভাল ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলে আমি মরেও শান্তি।

-এসব কথা বলবানা তুমি। কোথাও যাবানা আমাকে ছেড়ে।

  • থেকে তোর এসব নিন্দে শুনব? সবাই আমার মেয়েকে গুন্ডি বলবে সেটা মেনে নিব?
    আমি মাকে ছেড়ে চোখ মুছে নিয়ে বললাম, আমি আর এসব করবনা। বিয়ে করে নিব কিন্তু তাও ছেড়ে যাওয়ার কথা বলোনা। আমার যে আর কেউ নেই না তুমি ছাড়া।

মা আমার কপালে চুমু খেয়ে ভাতের নলা আমার মুখে পুরে দিয়ে বলল, আমার লক্ষী মেয়ে। আর রাগ করে থাকিসনা মা, নে খেয়ে নে।

আমি প্লেট থেকে নলা উঠিয়ে মাকে খাইয়ে দিলাম। মা আমাকে বুকে টেনে নিলেন। আমি পরমশান্তিতে চোখ বুজলাম, অনুভব করলাম মায়ের চোখের পানি টপটপ করে ঝড়ছে। প্রতিবারের মত আবারো প্রতিজ্ঞা করে বসলাম, মাকে আর কষ্ট দিবনা, গুন্ডামি ছেড়ে লক্ষী হয়ে যাব।
হয়তো প্রতিবারের মত এইবার ও প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে ফেলব। তাও খানিকের শান্তির জন্য প্রতিজ্ঞা করা।

আমি যে শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গুন্ডামি করি তা নয়, নিজেকে রক্ষা করার জন্য ও। গুন্ডামি না করলে এই জানোয়ার রুপি মানুষগুলো সেই কবে আমাকে আর আমার মাকে ছিড়ে খেত। সবাই শুধু বাহিরের রুপ দেখেই আমাকে খারাপ বলে, মায়ের কাছে এসে নালিশ বসায়।
আল্লাহ যে কবে আমাকে বুঝার মত একটা মানুষ পাঠাবে।

ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে দেখি মা গভীর ঘুমে মগ্ন। যেদিন আমাকে শাসন করে সেদিন মাকে জড়িয়েই ঘুমাই। মা ই এসে পাশে শুয়ে পড়ে, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আমাকে নিয়ে তার স্বপ্ন গুলো পুনরাবৃত্তি করে।
শুয়ে থাকতে আর ভাল্লাগছেনা। উঠে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। বাহিরে অনুজ্জ্বল জ্যোৎস্না, দাওয়ার উপর বসে চোখ বুজে রইলাম।

দাওয়ার পাশে কতকগুলো ইটের টুকরো ছিল। আনমনে সেগুলো এইদিক সেদিক ছুড়তে লাগলাম। হঠাৎ চাপা স্বরে একটা আর্তনাদ, সাথে সাথে পাশের ঝোপটা সজোড়ে নড়ে উঠল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম…….


পর্ব ০২

লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
এত রাতে মানুষের স্বরে কে আর্তনাদ করছে? বাড়িতে আবার চোর ঢুকল না তো! ভেবেই একটা মোটা ডাল কুড়িয়ে ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঝোপটা এখনো কিঞ্চিৎ নড়ছে।

ডালটা নিয়ে সাবধানে ঝোপের পিছনে এসে দাড়ালাম। অনুজ্জ্বল জ্যোৎসায় দেখলাম একটা প্রতিমূর্তি মাটিতে উবু হয়ে বসে পায়ে হাত বুলাচ্ছে। বোধহয় পায়ে চোট পেয়েছে। এইবার মাথায় ডাল দিয়ে একটা আঘাত করে কুপোকাত করব ভেবে যেই ডাল টা উচিয়ে আঘাত করতে গেলাম, আঘাত করার আগমূহুর্তে প্রতিমূর্তিটা পিছনে না ঘুরেই হাত দিয়ে ডালটা শক্ত করে চেপে ধরল।

কিছু বুঝে উঠার আগেই মূহুর্তে সে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আমার ওড়না টেনে হাত বেধে ফেলল গলায় প্যাচ দিয়ে। এমনভাবে ওরনা টা গলায় পেচিয়ে দিল সে একটু শক্ত করে টেনে ধরলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। চোর তো দেখছি ভীষণ চালু। তাও দমে যাওয়া চলবেনা, তাই আমি হাতের বাধন খোলার চেষ্টা করলাম। সে আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, কে আপনি? এভাবে আঘাত করতে এসেছিলেন কেন?

আমি চেচিয়ে চেচিয়ে বললাম,
~ অন্যের বাড়ীতে চুরি করতে আসবেন আর আপনাকে আদর করবে। ছেড়ে দিন বলছি, সাহস থাকলে মুখোমুখি লড়াই করুন। পিছন থেকে আঘাত করে ভীতুর পরিচয় দিবেন না। ছিচকে চোর কোথাকার!
~ আস্তে কথা বলুন, জোরে কথা বললে কিন্তু বেঘোরে মারা পড়বেন। আমি একটু জোরে টেনে ধরলে আপনি শেষ। অতএব, আওয়াজ নিচে।
দমে গেলাম আমি। একি সত্যি সত্যি আমাকে মারার চিন্তা করছে নাকি?

~ চোরের আবার বড় গলা। এত সাহস কি করে হয় একটা মেয়েকে এভাবে হ্যারেজ করার। একে তো চুরি করতে এসেছেন, তার উপর আমার সাথে দেমাগ দেখাচ্ছেন। একবার হাত ছেড়ে দেখুন, নিজের নাম ভুলিয়ে দিব।
~ আপনাকে কে বলল আমি চোর? আর রাত-বিরাতে এভাবে ঢিল ছুড়ে আঘাত করছেন সেটা কেমন ভদ্রতা। না জেনে আবার চোর ভেবে এসেছেন আঘাত করতে। বেশ সাহস তো আপনার।
~ আপনি কত ভদ্র ছেলে! রাত-বিরাতে অন্যের বাড়ীতে ঘুরঘুর করেন। একটা অবলা মেয়েকে নির্যাতন করছেন। এখনো বলছি ছেড়ে দিন নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।

~ আপনাকে বললাম না আস্তে কথা বলুন। এইবারের মত ছেড়ে দিলাম। এরপর থেকে এসব কাজ আর করবেন না। বলে এক টানে প্যাচ ছাড়িয়ে দিল। ছাড়ানোর সাথে সাথে আমি মাটি থেকে ডাল তুলে যেই ছেলেটাকে আঘাত করতে যাব দেখি আশেপাশে কেউ ই নেই। একনিমিষে পালাল কি করে! এত বড় অপরাধ করেও বেচে গেল।

একবার হাতে পাই, তখন দেখে নিব। নিজে নিজে বিড়বিড় করতে করতে ওড়না তুলে নিয়ে বাসায় ঢুকে পড়লাম।
খুব রাগ হচ্ছে। একটুও শান্তি পাচ্ছিনা, ব্যাটাকে ধরে ইচ্ছেমত পিটুনী দিতে পারতাম শান্তি লাগত। অন্ধকারে চেহারাটাও দেখিনি যে পরে ধরতে পারব। এত চালু যে এক মূহুর্তে আমাকে কুপোকাত করে ছাড়ল।

চোরব্যাটা আপনি যতই চালু হন, আপনার ১২টা আমি বাজিয়ে ছাড়ব। এত বড় সাহস আমাকে বেধে ভয় দেখাল। আজ না হলে কাল তো সে আবার চুরি করতে বের হবে। কোনো না কোনো বাড়িতে তো ঢুকবে, তখন খপ করে ধরে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিব।
সাত-পাচ ভেবে রাগে ফুসতে ফুসতে এ পাশ ও পাশ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরেরদিন আর চোরটার কথা মনেও ছিলনা সারাদিনের আড্ডাবাজি আর গুন্ডামিতে। পাড়ার পাশের বস্তির কয়েকটা ছন্নছাড়া মেয়ে আমাকে সঙ্গ দেয়, ওদেরকে নিয়ে আমার গ্যাং। সারাদিন টইটই করে রাতে বাসায় ঢুকার সময় চোর ব্যাটার কথা মনে পড়ল। বাসায় না ঢুকে পাড়ার বাড়ীগুলোতে কয়েকবার চক্কর মেরে আসলাম। নাহ চোর ব্যাটার দেখা নেই। হয়ত টের পেয়ে এলাকা ছেড়েই পালিয়েছে। আমার না ওরে টাইট দেওয়া হলনা। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। অনিচ্ছায় ব্যাটাকে এই যাত্রায় ছেড়ে দিলাম।

হঠাৎ মাঝরাতে মায়ের বুকের ব্যথা বেড়ে গেল। বুকের ব্যথায় কাতরাতে লাগল। দিশেহারা হয়ে গেলাম আমি। মায়ের ওষুধের বাক্স ঘেটে দেখলাম ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। অথচ মা আমাকে একবারো বললনা। এত রাতে তো পাড়ার ফার্মেসী ও খোলা পাবনা।

তাও গেঞ্জির উপর শার্টটা চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাড়ার বাহিরের ফার্মেসীর উদ্দেশ্যে। প্রায়ই ওইটা অনেক রাত অব্ধি খোলা থাকে। ভাগ্য ভাল হলে আজো খোলা পাব। বেশ দূরে তাই তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগলাম। আল্লাহ সহায় হওয়ায় ফার্মেসী খোলা পেলাম, ওষুধ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাটা লাগালাম।

পুরো পাড়া নিস্তব্ধ, সবাই ঘুমে বিভোর। রাস্তায় দুই-একটা কুকুর শুয়ে শুয়ে ঝিমুচ্ছে। আরো জোরে পা চালালাম। খানিকটা পথ আসতেই আমার পথ আটকে ধরল ৫টা ছেলে। এরা তো সেই ছেলেগুলোই যাদের সে ইচ্ছেমত কেলিয়েছিলাম। ৭দিনের মাথায় হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরবে ভাবিনি।

এটাও ভাবিনি মাঝরাতে নির্জন রাস্তায় আমাকে একা পেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পথ আগলে দাঁড়াবে। না এখন এদের সাথে লড়াই করা চলবেনা। একে তো হাতে ওষুধের প্যাকেট, ওদিকে মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। তার উপর এই ৫টার সাথে একা পেরে উঠবনা।

শান্ত গলায় বললাম, শুন ভাই, লড়াই করবি ভালো কথা। কিন্তু এখন আমি লড়াই কর‍তে ইচ্ছুক না। লড়াই করার ইচ্ছে হলে কাল পাবলিকের সামনে আসিস। এখন আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।

পথ থেকে সরে দাড়া।
তাদের একজন হেসে হেসে বলল, এক্ষুনি লড়াই কর। দেখি তুই কত লড়াই করতে পারিস। আয়, আজ তোর গুন্ডামি ছুটাব। সেদিন কেলিয়ে হস্পিটালে পাঠিয়েছিস না? আজ আমরা তোকে জাহান্নামে পাঠাব। আমি কিছু বলার আগে দুটো ছেলে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরল, ওষুধের প্যাকেট টা দূরে ছুড়ে ফেলে দিল।

বাড়িওয়ালার ভাগ্নে রাফি পকেট থেকে একটা বোতল বের করে দেখিয়ে বলল,
~ এটা কি জানিস? এসিড। এটা দিয়ে আমি তোর মুখ ঝলসে দিব। তারপর দেখব আমাদের পাড়ার বড় গুন্ডির ছটফটানি। এই ঝলসে যাওয়া মুখ নিয়ে তুই বের হবি কি করে রে ওয়াফাহ। তোর গুন্ডামিগিরি কই থাকবে। বলতে বলতে রাফি আমার সামনে এসে দাড়াল। আমি ভয়ে চোখ বুঝে ফেললাম। আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম মনে মনে।

এখন এই অন্ধকার রাস্তায় কেউ আমাকে বাচাতে আসবেনা, আমার আর্তনাদ ও কারো কান অব্ধি পৌছোবেনা।
এই নির্জন রাস্তায় এসিডে ঝলসানো মুখ নিয়ে আমি ছটফট করতে থাকব। আল্লাহ তুমি আমার সহায় হও। এমনসময় ছেলেগুলো আমার হাত ছেড়ে দিল, বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল। এখন নিশ্চয়ই আমার দিকে এসিড ছোড়ে হবে।

কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর ও তেমন কিছু না দেখে চোখ মেললাম। মেলে দেখি পশু গুলো আমার থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে আর ছটফট করছে। আমি আশেপাশে চোখ বুলালাম, কোথাও তো কেউ নেই।
তখনি সামনে চাদর মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলল, আসুন আমার সাথে, আপনাকে বাসায় পৌছে দেই।

কন্ঠটা চিনতে আমার দেরী হলনা। এই তো সেই চোরের গলা। আমি মুখ ফিরিয়ে বললাম, আমি আপনার সাথে কেন যাব? আর এদের এই অবস্থা কি আপনি করেছেন।
~ বেশি কথা না বলে আসলে আসুন। কিংবা ইচ্ছে হলে ওদের সাথে থাকুন। ওরা আপনাকে আরো একটু আপ্যায়ন করুক। আমি চললাম।

বলে সে দ্রুতপদে হাটা দিল। আমিও দেরী না করে তার পিছু পিছু প্রায় দৌড়তে লাগলাম। এখন যে পরিস্থিতি এখন তার উপর ভরসা না করলেও আমার চলছেনা।

পুরো রাস্তা সে আমার থেকে ৭-৮হাত দুরত্ব রেখে চলল। এত জোরে হাটছে যে আমি দৌড়েও তার পাশাপাশি আসতে পারছিনা। এদিকে মনটা ও ভীষণ খারাপ হয়ে গেল হাতে যা কয়েকটা টাকা ছিল তার সব দিয়ে মায়ের জন্য ওষুধ কিনেছি। এখন ওষুধ না পেয়ে যদি মায়ের কিছু হয়ে তাহলে আমি কি করব! শয়তান গুলো যে কোথায় প্যাকেট টা ছুড়ে ফেলেছে।

আমার ভীষণ কাদতে ইচ্ছে করছে। লোকটা বাসার সামনে এসে দাড়াল, দরজার সামনে কি একটা রেখে অন্য দিক দিয়ে দ্রুত হেটে বেরিয়ে গেল। একবার পিছন ফিরেও দেখল না আজিব লোকটা। দরজার সামনে এসে দেখলাম প্যাকেট এখানে রেখে গিয়েছে লোকটা।

ঘাড় থেকে কত বড় চিন্তার বোঝা নেমে গেল।
একটু উকি দিয়ে বাহিরে তাকালাম লোকটা ততক্ষণে দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসায় ঢুকে দরজা লক করে দিলাম।

মা উঠে বসে আছে, তাড়াতাড়ি করে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু নিজের ঘুমের দেখা নেই। ছটফট করছি ভিতরে ভিতরে। আজ আমার কি যে হত! সত্যিই আমার মুখ দেখানোর জো থাকতনা। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, উনি এমন একজন পাঠিয়ে আমার সহায় হয়েছেন…..


পর্ব ০৩

ছেলেটা কে যত খারাপ ভেবেছি সে ততটাও খারাপ নয়। অন্তত ধন্যবাদটুকু তার প্রাপ্য। দূর আমি আবার ওই ব্যাটার ভাল-খারাপ ভাবতে বসলাম কেন? চোর তো চোরই। মানবতার খাতিরে আমাকে বাচিয়েছে বিনিময়ে আমি সেই রাতের রাগ উঠিয়ে নিলাম। সবি মাইনাসে মাইনাসে কাটা। সারারাত আর ঘুমালাম না, মায়ের মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলালাম।

ওষুধ খেয়ে ব্যথাটা অনেকটাই সেরে গেছে। বিকেলের দিকে ক্লাব থেকে হকিস্টিক কয়েকটা নিয়ে পাড়ার মোড়ে আসলাম। আজ অই কুত্তাগুলোকে উপরের টিকেট কাটাব, খুব লড়াই করার শখ হয়েছিল না! কাল রাতের সব সুদে আসলে এখন ফেরত দিব। হকিস্টিক নিয়ে ওই ছেলেগুলোর আড্ডাখানার দিকে যাচ্ছিলাম। পিছন থেকে মীনা ডেকে বলল, কিরে, কই যাস? তোর হাতে হকিস্টিক কেন? কেলাতে যাচ্ছিস আমাদেরকে ডাকলি না!
~ মোড়ের দোকানে যাচ্ছি। হ্যা কেলাতেই যাচ্ছি।
~ অইখানে কাকে কেলাবি?

~ রাফি আর তার চেলাগুলারে। আজ সবগুলার হাত-পা ভাঙ্গব।
~ হাত-পা ভাঙ্গা পোলাপাইনের আর কি হাত-পা ভাঙ্গবি?
~ আগের বারের মাইর ঠিক জায়গায় পড়েনি। সপ্তাহ না ঘুরতেই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসেছে। আজ আবার ১মাসের জন্য পাঠাব।

~ তুই জানিস না? হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে ফেরার পর ওরা আবার কেলানি খেয়েছে। এখন সবগুলো আবার হাসপাতালেই গেছে। কারো হাত ভেঙেছে৷ কারো পা, আর রাফির মাথা ফেটেছে। তার নাকি মুখ বেকে গেছে, ঠিকমত কথা বলতে পারছেনা। মাত্রই তো করিম চাচার দোকান থেকে খবর পেলাম।

আমি অবাক হয়ে চুপ করে রইলাম। এত সিরিয়াস অবস্থা ওদের!
~ কিরে চুপ করে আছিস যে? তুই আবার ওদের উপর ক্ষেপে গেলি কেন?
~ না তেমন কিছুনা। চল হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসি খবর সত্য কিনা! আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছেনা।
~ ঠিক আছে, চল।

হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম যা শুনেছি সবি সত্যি। ওদের চোখে ভয় দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে বেচারাদের চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। অথচ আমিই ওদেরকে কিছু করিনি। গভীর ভাবনায় পড়ল চোর ব্যাটা এদের কিছুসময়ের মধ্যে এমন কেলিয়েছে যে সবগুলো ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মীনাকে বিদায় দিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরছি। সাধারণত এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরিনা, মায়ের শরীরটা খারাপ তাই।

নামাজের টাইম তাই আশেপাশে মানুষ কম, কিছুক্ষণ হাটার পর মনে হল কেউ আমাকে ফলো করছে। পাত্তা না দিয়ে নিজের মত আবার শিস বাজাতে বাজাতে হাটতে লাগলাম। কিন্তু আবার মনে হল কেউ আমার পিছনে পিছনে আসছে, আমি পিছনে তাকাতেই সরে পড়ছে। একটা ছেলে উল্টাদিকে তাকিয়ে রাস্তার একপাশ ওপাশ তাকিয়ে কিছু একটা খুজছে।

শার্টের পকেট থেকে কাটার বের করে গাছের আড়াল থেকে পিছন থেকে ছেলেটার গলায় কাটার চেপে ধরলাম। ছেলে ভয়ে চুপ করে সোজা দাঁড়িয়ে গেছে। আমি কাটার আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
~ কিরে, তোর ঘরে মা-বোন নাই? এভাবে রাস্তায় মেয়েদেরকে ফলো করিস।

~ আপনাকে দেখে মেয়ে মনে হয়নি।
~ অই ব্যাটা, আমি মেয়ে না ছেলে সেটা দিয়ে তোর কি দরকার! ফলো করছিলি কেন? এখন এক পোচ টেনে উপরে পাঠিয়ে দেই?

ছেলেটা আমাকে এক ধাক্কা দিল, আমি কিছুটা পিছিয়ে গেলাম। সোজা হয়ে দাড়াতেই সে আমার সামনে কাটার নিয়ে দাড়াল। আমি নিজের হাতের দিকে তাকালাম কাটার টা কখন তার হাতে গেল। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঢক গিললাম। মুখটা চাদর দিয়ে পেচিয়ে রেখেছে, ছিনতাই কারীদের মত।

~ ভাই, আমার কাছে কিছু নেই। ছিনতাই করে কিচ্ছু পাবিনা, শুধু শুধু সময়টা নষ্ট করিসনা।
~ কি সমস্যা আপনার? একবার চোর, একবার ছিনতাইকারী বানিয়ে ফেলছেন।
সবসময় এমন গুন্ডামি করেন কেন?
~ ওহ আপনি সে চোর ব্যাটা।

কাটারটা একটু এগিয়ে ধরে বলল, ভদ্রভাবে কথা বলুন।
~ ভদ্রতা শেখাবেন না আমাকে। আপনি কত ভদ্রতা জানেন সেটাও দেখছে। এই নিয়ে দুইবার আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। আমাকে এভাবে ফলো করছেন।

~ আপনাকে ফলো করার কিংবা ভয় দেখানোর কোনো ইচ্ছে ই আমার নেই। আপনি অতিরিক্ত বলে ফেলেন তাই ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখি। এই নিন আপনার হাতের আংটিটা। কাল বোধহয় প্যাকেটের ভিতরে ছিল, ওরা ছুড়ে ফেলায় বাইরে পড়ে গেছে। আমি কুড়িয়ে রেখেছিলাম, পরে দিতে ভুলে গেছি।

পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আপনাকে চোখে পড়ল তাই দিতে এলাম।
আংটিটা কাটারের মাথায় গেথে দিয়ে সেটা আমার পকেটে রেখে দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হল। আমি পিছন থেকে ডেকে বলল, আপনি কে?

~ সেটা জেনে আপনি কি করবেন? আর যেন আপনার মুখোমুখি না হই আমি সেটাই চাই। এত গুন্ডি মেয়ে!
~ অই হ্যালো কি বললেন! দাড়ান বলছি। ছিচকে চোরব্যাটা।
আমার কথা তোয়াক্কা না করে হেটে চলে গেল।

রাগে ফুসতে লাগলাম। নিজেকে একদম সাধু পুরুষ ভাবতে থাকে, আপনার মুখোমুখি যেন আর না হই! আমি কি বলেছি আমার মুখোমুখি হতে? আলগা পিরিত দেখাতে আমার উপকার করতে আসেন। লাগেনা আমার এসব।
মা এসে আমাকে এভাবে বিড়বিড় করতে দেখে বললেন,
~ নিজে নিজে কি বিড়বিড় করছিস? আবার কি ঝামেলা করেছিস!
~ কিছু করিনি মা।

~তাহলে এমন বিড়বিড় করছিস কেন?
~ তেমন কিছুনা। তোমার শরীর ঠিক আছে তো?

~ হ্যা ঠিক আছে। শোননা, তোর জন্য একটা পাত্রের খোজ পেয়েছি। শুনলাম দেখতে খুব ভালো, অনেক ভালো ফ্যামিলি। বউকে একদম রাজরানী করে রাখবে। আমি তো শুনেই হ্যা করে দিয়েছি। এবার ওরা সময় করে তোকে দেখতে আসবে, পছন্দ হলে সোজা বিয়ে।

~ উফফ! মা, তুমি আবার আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছো। রোজ রোজ সঙ সেজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে আমার ভাল্লাগেনা। বিয়ে হবেনা আমার বুঝলে।

~ এসব বলিস কেন? আমার মেয়েটার কোন দিক থেকে কম আছে। দেখিস, এবার তোর বিয়েটা হয়ে যাবেন
~ মা প্লীজ বিয়ে নিয়ে কোনো প্যারা দিওনা। আমার বিয়ে-শাদি করার কোনো ইচ্ছে নেই। এমন আছি, ভালোই আছি।
~ থাক তুই এমন, যা খুশি কর। পোড়াকপাল আমার, এই কপালে সুখ দেখব না।
বলে মা উঠে চলে গেল।

মায়ের মন খারাপ দেখে আমারো ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু আমার ই বা কি করার! মাকে ছেড়ে কোথায় যাব আমি, আর আমার এসব জেনে আমাকে কে ই বা বিয়ে করবে। মন খারাপ করে জানালার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
এমনসময় ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করতে ইচ্ছে করছেনা, তাও রিসিভ করলাম। রীতা কল দিয়েছে।
~ হ্যালো ওয়াফাহ।
~ হ্যা বল।

~ কই তুই?
~ বাসায় আছি, কেন?
~ আয় দীঘির পাড়ে, গল্প করি।
~ আমার ভাল্লাগছেনা।
~ আমরা সবাই আছি, তুই ও আয়৷ ভাললাগবে।

~ আচ্ছা আসছি। বলে ফোন রেখে দিলাম। একবার মায়ের রুমে উকি দিলাম। চুপচাপ সেলাইন মেশিনে আওয়াজ তুলে কাজ করছেন। মনটা সত্যিই খারাপ আমার। একটু ঘুরে আসলে ভালো হবে এই আশায় বেরিয়ে পড়লাম।
দীঘির পাড়ে আসতেই দেখে সবগুলো এক তালে সিগারেট ফুকছে। ওদের পাশে গিয়ে বসলাম। রীতা বলল,
~ কিরে, কেমন আছিস?

~ ভাল, তুই আজ কোথায় ছিলি?
~ অহ, আর বলিস না। আমার দাদীকে নাকি জ্বীনে ধরেছে। তাই দেখতে গেলাম।
~ জ্বীনে ধরেছে মানে? এসব কিছু আছে নাকি আবার! বলেই খিকখিক করে হেসে লুটিয়ে পড়ল।
~ মজা করিসনা, সত্যি ই জ্বীন আছে।
~ আচ্ছা? তোহ জ্বীনবাবুকে বলিস আমার সাথে দেখা করতে। আমি ওকে বিয়ে করব। বলে আবার হাসতে লাগলাম।

~ তুই বিশ্বাস করছিসনা, যে দিন সামনে এসে পড়বে সেদিন বুঝবি ঠেলা।
~ কিসের ঠেলা আর? আমি বিয়ের জন্য পাত্র পেয়ে যাব আসলে।
~ ওয়াফাহ, মজার ব্যাপার নাহ এটা। জ্বীনেরা সত্যিই আছে, মানুষদের নাকি এরা ক্ষতি করে অনেক। আবার ভাল ও করে। তুই আবার হাসছিস, দূর তোকে এসব বলে লাভ নেই।

আমি হাসি থামিয়ে চুপ করে রইলাম। সত্যি যদি তেমন কিছু থাকত, তবে আমি চাইতাম এমন একটা জ্বীন আমার জীবনে আসুক। আমার জীবনটা পালটে দিক। মানুষগুলো কে দেখতে দেখতে ঘৃণা ধরে গেছে। এদের কাছে মনের কোনো মূল্য ই নেই।

দূর! আমিও আবার পাগলের প্রলাপ বকছি। এমন আবার কখনও হয় নাকি? এসব মানুষের মনের কল্পনা মাত্র। কল্পনা করলে আছে, না করলে নেই। এসব ভেবে আকাশ-পাতাল ভাবনা নাই বা ভাবলাম।

পর্ব ০৪

১২টা অবধি আড্ডা দিলাম দীঘির পাড়ে। মন খারাপ কিছুটা কাটল, সবাইকে বিদায় দিয়ে বাসায় ফেরার পথ ধরলাম। মাথার মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘুরছে, “সত্যিই কি জ্বীন বলতে কিছু আছে? ” মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মা ই জানতে পারে, মা তো আবার ধর্ম মেনে চলেন।

আমি সবসময় ছন্নছাড়া, এসবে মন নেই। তার মানে এই নয় যে, বিশ্বাস করিনাহ। কিন্তু জ্বীন বা অলৌকিক কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই। হাতে গাছের একটা ভাঙা ডাল নিয়ে দুলাতে দুলাতে গান গাইছিলাম আর হাটছিলাম আপন মনে। হঠাৎ দেখলাম এক বৃদ্ধ আমার সামনে আস্তে আস্তে পা ফেলে হাটছেন। অনেকটা লম্বা, বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন খানিকটা।

যাক পাত্তা দিলামনা, এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। জানিনা বাসায় আজ কেমন যুদ্ধ শুরু হবে! দ্রুত পা চালিয়ে বৃদ্ধকে পিছনে ফেলে হাটতে লাগল। উনি যেভাবে আস্তে হেটে চলেছেন, আমি উনাকে সাইড দিয়ে হাটলে বাসায় ফিরতে ঘন্টাখানেক লেগে যাবে।

একটু পিছনে ফেলে আসার পর একটা “আউচ” শব্দ শুনলাম। সাথে অনেকগুলো কাশির আওয়াজ। ফিরে দেখি বৃদ্ধলোকটা মাটিতে পড়ে আছেন পায়ে হাত দিয়ে আর অনবরত কাশছেন। দ্রুত তার কাছে এগিয়ে গেলাম, সম্ভবত পা মচকে গেছে। তাকে সবিনয়ে বললাম, দাদু আপনার কি পা মচকে গেছে?

উনি হকচকিয়ে আমার দিকে তাকালেন, ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তার নূরানী মুখ, মুখভর্তি সাদা দাড়ি। দেখেই কেমন জানি একটা ভক্তি কাজ করছে। উনি আমাকে অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে দাদু?
~ আমি এই এলাকার মেয়ে। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখলাম আপনি পড়ে আছেন। তাই এগিয়ে আসলাম। আপনি কে দাদু? এতরাতে কোথায় যাচ্ছেন? পায়ে কি বেশি চোট পেয়েছেন?

~ একটু পানি খাওয়াবেন দাদু?
~ হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি বরং আমার হাত ধরে উঠে গাছের নিচের বেঞ্চিতে বসুন। আমি আপনার জন্য পানি নিয়ে আসছি।

উনি কেমন জানি ইতস্তত বোধ করলেন আমার হাত ধরতে। আমিই তাকে কাধে ভর দিয়ে উঠিয়ে অদূরে একটা বেঞ্চিতে বসালাম। আশেপাশে তাকালাম, এখানে তো কোনো টিউবওয়েল ই নেই। কিছুটা হেটে এসে দেখলাম পাড়ার দোকানী দোকান বন্ধ করতে ব্যস্ত। আমি কাছে গিয়ে বললাম,
~ কাকু, একটা পানির বোতল দাও।
~ এখন তো দোকান বন্ধ করে দিয়েছি।

~ আহা, এখন আবার খুলে আমাকে দাও। বন্ধ করেছো চলে তো যাওনি।
~ আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। তুই এত রাতে এখানে কি করিস? যা বাড়িতে যা। আজ এমনিতেও দোকানের হিসাব মিলাতে গিয়ে দেরী হয়ে গেছে। তোর কাকিমা চোটপাট শুরু করবে। যা বাড়ি যা।
আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে, দোকানীর হাত থেকে একটানে চাবিটা কেড়ে নিয়ে দোকান খুলে পানির বোতল নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।

উনি অবাক হয়ে বলল,
~ এটা কি করলি? চাবিটা তার হাতে দিয়ে বললাম,
~ গুন্ডামি। ভালোই ভালোই চাইলাম, দিলানা। আর কোনো উপায় ছিলনা।
যাচ্ছি আমি।

~ দাম দিবে কে? তোর বাপ।
রাগে চোখ দুটো জ্বলে উঠল। ফিরে এসে তার কলার চেপে ধরে উরাধুরা কয়েকটা কিল-ঘুষি দিয়ে বললাম, ওই শালা বাপ টানিস কেন? পাড়ার চিপায় ঢুকে যে শ্যামলী খালার সাথে লুচ্চামি করিস অইটা কি তোর বাপে শিখায়। তোর বউরে দেখামু অইসব। শালা কুত্তাহ, তোর টাকা কাল দিয়ে দিব।

সাথে তোর বউকে লুচ্চামিগিরির প্রমাণ দিব। শুয়োর একটা।
মনের ঝাল মিটিয়ে পিটাইতে পারলামনা, বৃদ্ধের কথা মনে পড়ল। নিশ্চয়ই আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।
~ ভবিষ্যতে ওয়াফাহকে কিছু বলার আগে ভেবে নিবি শালা।
~ মাফ করে দে ভুল হয়ে গেছে মা।

~ রাখ তোর মাফ, যা ভাগ। কাল তোর টাকা মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে যাব লুইচ্চা।
প্রায় দৌড়ে সেই জায়গাটায় ফিরে এলাম। বৃদ্ধ পায়ে হাত দিয়ে হালকা টিপছেন, এখনো কেশে চলেছেন। কাছে গিয়ে পানির বোতলের ঢাকনা খুলে দিয়ে বললাম,
~ নাও দাদু, পানি খেয়ে নাও। কাশিটা কমে যাবে।

লোকটা কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে বোতল নিয়ে পানি খেল। খাওয়া শেষে শুকরিয়া বলে আমার জন্য দোয়া করল। তারপর উঠে দাড়াতে চাইল, কিন্তু পারলনা। আমি দেখে বললাম, দাদু তোমার পা কি মচকে গেছে?
~ হ্যাঁ, দাদু। সেটাই মনে হচ্ছে।
~ আচ্ছা তুমি বেঞ্চিতে বসো। আমি পাটা টেনে দিচ্ছি, দেখবে ১মিনিটে ঠিক হয়ে যাবে। পায়ে পরপর টান দিলাম। নাড়াচড়া করে দিলাম।

~ দাদু, এখন ঠিক আছে? উনি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
~ হ্যা, দাদু। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন, আজ যা করলে তার জন্য আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। আমি আসি।
~ কোথায় যাবেন আপনি? এই এলাকায় কি নতুন আপনি? আমাকে বলুন কোথায় যাবেন আমি আপনাকে পৌছে দিচ্ছি।

এই পা নিয়ে একা একা যেতে পারবেন তো!
~ হ্যাঁ, দাদু পারব। আপনাকে এমনিতেও অনেক ব্যস্ত করলাম।
~ এসব বলে লজ্জা দিবেননা। চলুন না, আপনাকে পৌছে দেই।
~ চলেন দাদু।

হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথায় যাবেন দাদু?
উনি কিছু বলার আগেই পিছন থেকে কেউ দাদাভাই বলে ডাক দিল। আমরা পিছনে তাকাতেই দেখি সেই চাদর পরা ছেলেটা ছুটে এল।

এসে বৃদ্ধের শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, দাদাভাই তুমি এখানে কেন?
আমার দিকে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার দাদুর সাথে কি করেন? আমি শান্তমুখে বললাম,
~ কিছুই না। উনাকে ঠিকানায় পৌছে দিতে যাচ্ছিলাম।
~ ধন্যবাদ। দাদাভাই চলো, এই গুন্ডি মেয়ের সাথে আর কথা বলবানা।

~ অইই কে গুন্ডি? আমার তো জানা ছিলনা দাদু একজন ছিচকে চোরের দাদাভাই হয়। উনাকে দেখে মনে হয় নি।
~ আপনি কিন্তু আপনার ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
~ সেটা আপনি আগেই ছাড়িয়ে গেছেন। কেমন মানুষ আপনি? একজন অসুস্থ বৃদ্ধকে এত রাতে একা একা ছেড়ে দিয়েছেন। ছেড়ে দিয়ে কোন বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিলেন? অপদার্থ একটা।

~ শুনুন আমি কি করব না করব, সেটা আপনার মত গুন্ডির থেকে নাই বা শিখলাম। এত রাতে আপনি বাহিরে কোন চোর পাহারা দিচ্ছেন?
~ আমি তো একটা চোরকেই চিনি। সেটা আপনি।

~ যান বাড়ি যান। এত রাতে একা মেয়ে ঘুরছেন।
~ হুহ, দাদু ভালো থাকবেন। আসি। বলে পা ছুয়ে সালাম করলাম।
দাদু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ঝগড়া দেখছিলেন।

আমাকে চলে আস্তে দেখে ছেলেটাকে বলল, যা না ওকে এগিয়ে দিয়ে আয়। একা একটা অবলা মেয়ে।
ছেলেটা হেসে উঠল। হাসিটা ভীষণ সুন্দর, কিন্তু এই মূহুর্তে আমার কাছে বান্দরের কিচিরমিচির লাগছে। হাসি থামিয়ে বলল,
~ দাদু উনি অবলা নন উনি একটা পাক্কা গুন্ডি। উনি কাউকে ভয় পায়না, উনাকে সবাই ভয় পায়। আশা করি একাই যেতে পারবে। তুমি চলো তো।

ভীষণ রাগে ফুসছি। ব্যাটা দাদু যদি সামনে না থাকত তোরে লবণ মাখিয়ে কাচাই খেতাম। মুখ বেকিয়ে বললাম,
~ যান যান, আমি আপনার হেল্প চাইনি। ছিচকে চোরকে আমি নিরাপদ মনে করিনা। দাদু অই ব্যাটাকে বকে দিয়ে বলল,
~ এভাবে কথা বলে কেউ? ক্ষমা চাও ওর কাছে। মেয়েটা সত্যি অনেক ভাল।
আমি গর্বে গর্বিত। ব্যাটাকে ভাগে পাওয়া গেছে। মনে মনে হেসে নিলাম।

ব্যাটা সেটা না শুনে বলল,
~ দাদাভাই, তুমি চলো তো। আমি পরে বলে নিব। আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।
~ সত্যি তো? ক্ষমা চাইবি তো। উনি মাথা নাড়ালেন।
আমার হাওয়ায় ভরা বেলুন টুস করে ফুটে গেল। ব্যাটা আমাকে পরে কত বলবে জানা আছে। ধোলাই দিতে পারলে শান্তি লাগত।

দাদু আবার আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রস্থান করলেন।
আমি বিরক্তিমুখে আবার হাটতে লাগল। ছেলেটা আবার পিছন থেকে ডেকে বলল, দুঃখিত গুন্ডি। কিছু বলতে যাব তারপর আগেই হাওয়া হয়ে গেল।

ব্যাটা দুঃখিত বলবি তো সুন্দর করে বল আবার গুন্ডি বলার কি দরকার ছিল।
আল্লাহ এর মুখোমুখি আমাকে আর করোনা। দেখলেই কেলাইতে ইচ্ছে করে।

পর্ব ০৫

লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
বাসায় আসতেই মায়ের মুখে বিস্তর হাসি দেখলাম। প্রতিদিনকার মত কোনো বকা-ঝকা নেই। নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। বুঝলাম না কাহিনী কি! সাত রাজার ধন পেল নাকি মা?

মা কি কি সব বলে চলল, আমার তার কথার দিকে একটুও মনোযোগ নেই। আজ বৃদ্ধটার জন্য আমি একটু বেশী করে ফেলেছি। এমনটা আমি কারো জন্য ই করিনা, কিন্তু বৃদ্ধটাকে দেখে মনের মধ্যে কেমন একটা মায়া জাগ্রত হল। নিজের দাদুর কথা মনে পড়ে গেল, দাদুর বয়সী লোকটাকে দেখে হয়ত যা করা উচিত তাই ই করলাম। কিন্তু ভাবতেই পারিনি এমন একটা ভালো মানুষ ওই ছিচকে চোরের দাদু হবে।

ওই ব্যাটার কথা মনে পড়লে মাথা পুরো গরম হয়ে যায়। কথায় কথায় গুন্ডি বলে, আরেহ ব্যাটা আজ যদি গুন্ডামি না করতাম তোর দাদু কেশে কেশে জান্নাতে যেত। ব্যাটা হাড়ে বজ্জাত, আসে আবার ভদ্রতা শিখাতে।
সকালে মা অনেক বড় লিস্ট বানিয়ে বাজারে পাঠালেন, সচরাচর বাজার-সদাই মা ই করেন।

আমি গেলে নাকি দোকানীদের সাথে দাম নিয়ে ঝামেলা করি। কিন্তু আজ আমাকেই পাঠিয়ে দিলেন। ওয়ালেটে টাকা নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলাম, এত বড় লিস্ট? আজ কি বাড়িতে মেহমান আসবে নাকি মা? মা হেসে হেসে বলল,
~ হ্যারে মা, তোমার জেঠিমা আসবে।

~ বাব্বাহ, তা কেন আসবে এতদিন পর?
~ কেন আবার? আসতে পারেনা।
~ পারেই তো। ভুড়ি কমে গেলে আবার বাড়ানোর জন্য তো ছুটে আসতেই হবে।
~ এসব কি কথাবার্তা! কবে বড়দের সম্মান করতে শিখবি তুই? কম তো বয়স হলোনা তোর। এইবার একটু আদব-কায়দা শিখ।

~ এর থেকে আমার গুন্ডামি হাজার গুনে ভাল। আমি বের হচ্ছি।
~ দেরী করিসনা, তাড়াতাড়ি ফিরিস। রান্না বসাতে হবে আবার।
~ হ্যা বুঝেছি। আসছি।

বাজার করে ফেরার পথে দোকানীর চোখে চোখ পড়ল। বেচারার আমাকে দেখে মুখ শুকিয়ে গেছে, ভালোই টাইট দিয়েছি শালাকে। বউকে বাঘের মত ভয় পায়, অথচ বউয়ের আড়ালে লুইচ্চামির অন্ত নেই। শালার সব পুরুষ ই এক। মুখের উপর টাকা ছুড়ে দিয়ে বলল, আমার বাপ না আমি দিয়ে গেলাম।

~ দরকার ছিলনা তো মা। আমি তো বারণ করেছি তোকে।
~ মাইনকা চিপায় গেথে গেলে সবাই একটু আধটু আলগা পিরিত দেখায়। তাই তোমার অই আলগা পিরিতের ধার আমি ধারিনা। ব্যাটা শুয়োর।

বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখি রান্নাঘরের বেড়ার ধারে বসে জেঠিমা খুশিমনে পান চিবুচ্ছে আর এদিক সেদিক পিক ফেলছে। আমি সালাম দিয়ে রান্নাঘরে বাজারগুলো রেখে আবার বাইরে চলে আসলাম। জেঠিমা ডাক দিয়ে বলল,
~ কোথায় যাচ্ছিস?
~ আরো কিছু কাজ বাকি আছে তো জেঠিমা। অইগুলো সেরে আসতে।

~ কোথাও যাওয়া লাগবেনা। এদিকে আয়।
দাতে দাত চেপে তার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। পানের পিক আমার পায়ের সামনে ফেলে এক আঙ্গুল মুখে পুরে বলল,
~ এসব কি পড়েছিস ছেলেদের মত? শার্ট, গেঞ্জি এসব মেয়েরা পড়ে?

~ আসলে হয়েছে কি জেঠিমা, বাজারে আজকাল মেয়েদের জামা-কাপড়ের দাম খুব বেশি। তাই সস্তায় ফুটপাতে এইগুলো পেয়েছি, কিনে নিয়েছি। যদি আপনার পছন্দ না হয় আমাকে কিছু ড্রেস কিনে দিতে পারেন। সেগুলোই এইবার থেকে পড়ব। আমার কথা তার পছন্দ হলনা, আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
~ সে তো দিব ই। তুই আমার দেবরের একমাত্র মেয়ে, তোকে তো আর ফেলে দিতে পারিনা। মনে মনে হাসলাম, যে জেঠিমা কখনো একটা সুতো কিনে দেয়নি, সে বলছে আমাকে ফেলে দিতে পারেনা।

মাকে ডেকে বলল, সোহানা, আজ আমাদের ওয়াসিফা রান্না করবে। তুই আজ রান্নাঘরে ঢুকিসনা। আমি থ মেরে গেলাম, “বুড়ি বলে কি! আমি রান্না করব!”
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আচলে হাত মুছতে মুছতে বলল,
~ ভাবি, ওয়াফাহ তো রান্না জানেনা। পরে করতে গিয়ে দেখবেন খেতেই পারছেন না।

আমিই রান্নাটা করব ভাবি।
~ লাই দিয়ে দিয়ে মেয়েটার কি অবস্থা করেছিস দেখ! এত বড় ঢেঙ্গা মেয়ে হল, তাও বিয়ে হচ্ছেনা। ঘরের কাম-কাজ ও জানেনা। খালি পোলা মানুষের মত জামা কাপড় পড়ে টইটই করে ঘুরতে পারে। তোর কিছু হয়ে গেলে, মেয়েটা কোন চুলোয় যাবে বল তুই।

আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলেছি রাগে। কিছু একটা কড়া করে বলতে যাব মা আমাকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল। চুপ করে রইলাম, জেঠিমা টেনে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিলেন। মোড়া টেনে আমার পাশে বসলেন তিনি।
আমি কি রান্না করব, চুলা কিভাবে ধরায় সেটাও তো জানিনা। জেঠিমা সব বলে বলে করালেন, মুরগী কাটতে গিয়ে হাত কেটে রক্ত বের হতে লাগল। উনি দেখে মুখ বেকিয়ে বলল, এমন হাত কত কাটছে আমাদের। এসবে মনোযোগ দিলে চলবেনা। হাত পুড়িয়ে নীরবে চোখ থেকে টপটপ করে পানি ছেড়ে দিলাম।

রান্না শেষে কালিমাখা মুখ নিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালাম। নিজেকে খানিকটা সংসারী মনে হচ্ছে। কিন্তু হাতটা ভীষণ জ্বালা করছে। চোখ বুজে জ্বালা সহ্য করছি নীরবে। টের পেলাম মা হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। চোখ মেলে চাইতেই বুকে টেনে নিয়ে বলল, তোর যখন বড় ঘরে বিয়ে দিব, দেখবি এসব কিছু করতে হবেনা তোকে। রাজরাণী হয়ে থাকবি। আজ বিকালে তোকে দেখতে আসছে, তোর জেঠিমা ই সম্বন্ধটা এনেছে। অনেক বড় ঘরের ছেলে, তোকে ভীষণ সুখে রাখবে। আমি কিছু বললামনা, চুপ করে মায়ের হাসিমুখটা দেখলাম শুধু।

প্রতিবারের মত সঙ সেজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হবে এই আর কি! এতেই মা অনেক খুশি হয়ে যান। বিকালে জেঠিমা কালো পাড়ের শাড়ি পরিয়ে দিলেন, কাজল-লিপস্টিক আরো হেন তেন দিয়ে সাজিয়ে দিলেন। এর আগে কখনো এসব পড়িনি আমি, খুব অস্বস্তি হচ্ছে। শাড়ি সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।

মা এসে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, মাশা আল্লাহ। আমার মেয়ের রুপ ফুটেছে। মায়ের কথা শুনে আয়নার দিকে তাকালাম।
সত্যি আজ নিজেকে পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে। এমন মনে হচ্ছে, এই এক অন্য ওয়াফাহ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আগের ওয়াফাহকে খোজার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বৃথা।

যথারীতিতে পাত্রপক্ষের সামনে বসলাম। একনজরে পাত্রের দিকে তাকালাম, শকড হয়ে গেলাম। এই তো ছেলে নয়, একটা বয়স্ক ব্যাটা। ইয়া বড় ভুড়ি ব্যাটার, আমার দিকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ওয়াফাহ তুমি কোনটা বেশী ভালো পারো?
~ আমি কেলাতে ভীষণ ভাল পারি, একবার যে খায় সারাজন্মেও ভুলে না।

ব্যাটার মুখ কালো হয়ে গেল। পরক্ষণে হেসে বলল,
~ কোন রান্নাটা ভালো পারো?
~ মুরগীর কলিজার শরবত, গরুর মাংস দিয়ে কচুর লতির হালুয়া।
ব্যাটা শুনে ঢক গিলল। জেঠিমা আমাকে পিছন থেকে গুতা দিল। তারপর লোকটা বলল, আচ্ছা তুমি ভেতরে চলে যাও।

চুপচাপ উঠে চলে এলাম ঠিকি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগলাম। ব্যাটা বলল, ওয়াফাহকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার চার নাম্বার বউ করতে আপত্তি নেই যদি আপনারা রাজি থাকেন।
জেঠিমা খুশী হয়ে বলল, এই তো খুব খুশির কথা। আমরা রাজি।

~ তবে আজ উঠি, দিনক্ষণ ঠিক করে আপনাদের জানাব।
মন খারাপ করে রুমে চলে এলাম। দেখি মা অন্যমনস্ক হয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার পায়ের কাছে বসে বললাম, মা, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি? মা চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকাল।

জেঠিমা ঘরে ঢুকে বলল,
~ রাজি হবেনা কেন? এত বড় ঘরের সম্বন্ধ হাতছাড়া করা যায় নাকি! আর তুই ই বা কোন রাজ্যের রাজকুমারী যে তোর জন্য রাজকুমার আসবে। যা জুটসে তাও তোর জন্য রাজকপাল। মা-মেয়ে মিলে তো বাপটারে খাইসোস, পাড়ায় পাড়ায় গুন্ডামি করে বেড়াস। এসব জেনে কোন পোলা আইব তোর জন্য।
রেগে গিয়ে বললাম, জেঠিমা, মুখ সামলান আপনার।

মা আমাকে সজোড়ে থাপড় দিলেন। চোখ গরম করে বললেন,
~ ভাবি তো ভুল কিছু বলেনি। হয় এই বিয়েটা কর, নাহলে গলায় কলসি বেধে দীঘিতে ঝাপিয়ে মর। তোর কপালে এর চেয়ে ভাল কিছু জুটবে না। এতদিন যা করেছিস, সব মুখ বুজে সহ্য করেছি। আর পারছিনা, এখন মুক্তি দে আমাকে।
আমি থ মেরে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম, তারপর ছুটে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম।

পর্ব ০৬

বাসা থেকে বেরিয়ে ছুটে দীঘির পাড়ে এসে দাড়ালাম। ভীষণ কান্না পাচ্ছে, গুন্ডি হওয়ার পর কখনোই আমি চোখের পানি ফেলিনি। আজ যেন কান্না আটকানোর চেষ্টা বৃথা। হাটু ভেঙ্গে বসে পড়লাম সেখানে, ইচ্ছেমত চিৎকার করে কাদলাম। কাদলে নাকি হালকা লাগে, কিন্তু আমার নিজেকে আরো ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে, জীবনটা এখানে থেমে গেলেই ভালো হবে। মা আমার কাছে মুক্তি চাচ্ছে, মায়ের কাছেও আমি অসহ্য হয়ে গেছি। মাও আমাকে বুঝলনা, আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করেছি মা এই বিয়েতে রাজি কিনা! মা যদি একবার মুখ ফুটে বলত আমি কিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে যেতাম। মা আমার কাছে শুধু মুখ ফুটে মুক্তি ই চাইল। এইটুকু দিতে না পারলে আমি তার কিসের মেয়ে হলাম।

ঠিক করলাম মাকে মুক্তি দিব। এক্ষুনি দীঘিতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করব, আমি সাঁতার জানিনা ঠিকিই মরে যাব।
চোখ মুছে উঠে দাড়ালাম, আস্তে আস্তে দীঘির পাড় থেকে সিড়ি দিয়ে এক পা এক পা করে নেমে যাচ্ছি। দেখতে দেখতে আমি কোমড়সমান পানিতে নেমে গেলাম, যেই এখন ঝাপ দিব কেউ আমাকে হেচকা টান দিয়ে উপরে তুলে নিল। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু এত শক্ত করে হাত টা ধরে রেখেছে যে হাত অবশ হয়ে আছে। কি ঠান্ডা স্পর্শ! শরীর কেপে উঠল মূহুর্তে। আবছা অন্ধকারে তার মুখপানে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম সে কে। কিন্তু ঠাহর করতে পারলামনা।

সে মুখ খুলে বলল,
~ আত্মহত্যা করা মহাপাপ জানেন না? যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বাচার সংগ্রাম করে যায়৷, সেখানে আপনি নিজেকে শেষ করতে যাচ্ছেন। আল্লাহর প্রদত্ত জিনিসের এভাবে অবহেলা করতে নেই। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে শক্ত রেখে আল্লাহর কাছে বিপদ কাটানোর জন্য প্রার্থনা করতে হয়।

কন্ঠ শুনে বুঝলাম উনি সেই চোর উপাধি পাওয়া ব্যক্তি। তাও আমি চুপ করে তার সব কথা শুনছি, কিছু বলতে ইচ্ছে করলনা। হঠাৎ অবিবেচকের মত কাজ করে বসলাম। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনি লম্বা হওয়ায় আমার মাথাটা কেবল তার বুক অব্ধিই স্পর্শ করল। জড়িয়ে ধরে সশব্দে মন খুলে কান্না করলাম। উনি কিছুক্ষণ চুপটি করে ছিলেন আমাকে কোনোপ্রকার বাধা দিলেননা। বরং কাপা কাপা হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়েও দিলেন না। শান্তস্বরে বললেন,
~ শান্ত হোন, এভাবে ভেঙ্গে পড়বেননা।

নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। এই কথা শোনার পর আমার হুশ ফিরল, ইস! আমি এতক্ষণ কি করছিলাম। এভাবে একটা পরপুরুষের বুকে মাথা রেখে কাদছিলাম। কিন্তু নিজের মধ্যে অনুভব করলাম অনেকটা হালকা লাগছে নিজেকে। কষ্ট টা অনেকটা কমে গেছে মনে হচ্ছে, তার বুকের মধ্যে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ এক তৃপ্ত প্রশান্তি আর স্বস্তি আমাকে ঘিরে রেখেছিল। অনুভূতি যেন এমন, আমার সবচেয়ে সুখের আর নিরাপদ জায়গা তার প্রশস্ত বুক।

হঠাৎ দীঘির দিকে কারা যেন টর্চের আলো ছুড়ছিল, উনি সেটা লক্ষ করে আমাকে বিদায় জানিয়ে মূহুর্তে প্রস্থান করলেন। বুঝলামনা উনি কেন এভাবে চলে গেলেন কাউকে আসতে দেখে।

আস্তে আস্তে তার প্রতিমূর্তি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আমি একদৃষ্টিতে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছিলাম। নিজেকে বড্ড শূন্য মনে হচ্ছে। এমনসময় টর্চের আলো ফেলে রীতা আর মীনা এগিয়ে এল আমার দিকে। রীতা আমাকে আধভেজা দেখে বলল,
~ তুই সত্যিই মরতে যাচ্ছিলি?

আমি নিরুত্তর রইলাম। রীতা আমার নীরবতা দেখে বলল,
~ জানিস খালাম্মা পাগলপ্রায় হয়ে গেছে তোর হুট করে উধাও হওয়ার কথা জেনে। ফোন করে আমাদের তোর খোজ করতে বলল, মরতে যাচ্ছিস একবারো ভাবলিনা তুই মরলে খালাম্মার কি হবে? বাচ্চামি কেন করিস বল তো।

শোন, ওয়াফাহ ভাগ্য কে মেনে নে। তোর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। শত চেষ্টা করেও সেটা খন্ডাতে পারবিনা। আর কোনো পাগলামী করিসনা, খালাম্মা কত খুশি তোর বিয়ে নিয়ে। এইটুকু খুশি কি তুই উনাকে দিতে পারিস না? তোকে খালাম্মা সেই ছোট থেকে একা একা এত কষ্ট করে বড় করেছে।

আর আজ তুই তার কথা চিন্তা না করে এত কষ্ট করে বড় করা সত্ত্বা কে শেষ করে দিচ্ছিস। মীনা রীতার সাথে তাল মিলিয়ে শুকনো গলায় বলল,
~ রীতা কিছু ভুল বলেনি ওয়াফাহ। তুই বিয়েতে রাজি হয়ে যা, আর কষ্ট দিসনা খালাম্মাকে।

আমি হাটতে হাটতে চুপচাপ ওদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু মাথায় শুধু একটা কথা ই গেথে আছে, “আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।” সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, ভাগ্যকে মেনে নিব। দেখি আল্লাহ আমার ভাগ্যে আর কত পরিমাণ দুঃখ লিখে রেখেন। বাসায় ঢুকামাত্র মা এসে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন, আমি মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
~ মা তুমি যা চাও, তাই হবে। আমি এই বিয়ে করতে রাজি।

মা হকচকিয়ে উঠে চোখ মুছে আমার মুখ দুহাতে স্পর্শ করে বললেন,
~ তুই সত্যিই রাজি?
~ হ্যাঁ মা।
~ ভাবী দেখেছো, আমার মেয়ে রাজরাণী হতে রাজি। রাজার ঘরে যাওয়ার জন্য রাজি। বলেছিলাম না, আমার মেয়ে আমার কথা ফেলবেনা। আমি আমার ওয়াফাহ কে সুশিক্ষা দিয়েছি।

আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ রুমে চলে এলাম। সেই কখন থেকে আধভেজা শাড়ি পরে আছি, ড্রায়ার থেকে একটা সেলোয়ার-কামিজ নামিয়ে নিলাম। অনেকদিন পর এগুলো পরার জন্য নামিয়েছি। মা কত বলত পড়ার জন, শখ করে দু-একটা সেলাই করে রাখত। কিন্তু তার ঠাই হত ড্রায়ারের এক কোণে অযত্নে।

আজ কেন জানি পড়তে ইচ্ছে করছে। শাড়ি খুলতে গিয়ে টের পেলাম আমার শরীরে ভীষণ মনকাড়া সুন্দর একটা সুভাস। যেটা ওই ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরার সময় পেয়েছিলাম। তবে কি তার শরীরের গন্ধ এখন আমার শরীরে লেপ্টে গেছে! ভীষণ ভালো লাগছে সুভাসটা। এতক্ষণ যে শুন্যতা আমার মধ্যে বিরাজ করছিল এখন যেন তা পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।

খুব সাবধানে শাড়িটা খুললাম, যাতে সুভাসটা আমার শরীর থেকে হারিয়ে না যায়। খাটে চিত হয়ে শুয়ে জানালার দিকে মুখ করে ভাবছিলাম,
“আজ কেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে এমন একটা অবিবেচকের মত কাজ করে বসলাম, তাও একটা ছিচকে চোরের সাথে। লজ্জায় মরে যাচ্ছি এখন।”

সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখলাম কিছু মহিলা আমাদের বাড়ীতে ভীড় করে আছেন। উঠোনে মাটি কেটে ইট দিয়ে চুলো বানানো হয়েছে, তাতে বড় বড় ডেকচিতে পোলাও, মুরগী রান্না হচ্ছে। কয়েকটা লোক বাশ-কাপড় দিয়ে ছোটখাট স্টেজ বানাতে ব্যস্ত। কিছু বুঝতে না পেরে মাকে খুজতে লাগলাম এই ঘর, ও ঘর। সবখানেই পাড়ার মহিলা আর কিছু অপরিচিত মহিলার ভীড়। কিছুক্ষণ খোজার পর মাকে দেখলাম জেঠিমা আর কিছু মহিলার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।

মায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই রীতা হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে আসল।
আমি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম,
~ এসব কি হচ্ছে রীতা?
~ তোর বিয়ের আয়োজন। আজ দুপুরেই তোর বিয়ে হবে।
~ কি বলছিস? কোনো আগাম খবর না দিয়েই বিয়ে।

~ তোর জেঠিমা আর মা মিলেই ঠিক করেছে। তুই কাল হ্যা বলেছিস তাই তারা আর দেরী করতে চায়নি। খালাম্মার ভয় তোর যদি আবার মত বদলে যায়, তাই সকাল না হতেই তোর বিয়ের কাজ আরম্ভ করে দিয়েছেন।
আমি চুপ করে রইলাম। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলাম, “নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য ই করেন।”

রীতা আমাকে জড়িয়ে কেদে ফেলল। খানিকটা কেদে বলল,
~ তুই আমাদেরকে ভুলে যাবি না তো ওয়াফাহ? এর উত্তর আমার সত্যিই জানা নেই, কারণ আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আমি তাও রীতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ আমি যেখানেই থাকি, তোদের কখনোই ভুলবনা।

এমনসময় অপরিচিত মহিলাগুলো আমাকে টেনে নিয়ে হলুদ মাখানো আর মেহেন্দী পরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সাজিয়ে-গুজিয়ে নিতে নিতে বাহির থেকে শুনলাম, বর এসে গেছে। সবাই আমাকে রেখে বাহিরে চলে গেল।
আয়নার দিকে একনজর তাকাল। বেশ লাগছে আজকের ওয়াফাহকে বউবেশে। লাল শাড়ি, হালকা মেক-আপ, গাঢ় লিপস্টিক আর ভারী গয়নায় নিজের নিজে বধু নয় জোকার মনে হচ্ছে। যাকে নিয়ে কিছুক্ষণ পর সারাজীবনের জন্য শোতে খেলা দেখানো হবে।

রীতা আর মীনা এসে বাহিরে স্টেজে নিয়ে বসাল আমাকে। আমি জীবন্ত লাশের মত চুপচাপ সব করে যাচ্ছি, সবটা আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দিলাম। কিচ্ছুক্ষণ পর ই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। এমনসময় হট্টগোল লেগে গেল, বয়স্ক ব্যাটা বেকে বসল আমাকে বিয়ে করবেনা। মা রীতিমত কান্না শুরু করলেন, বারবার শুধু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন “কেন, বিয়ে করতে চাইছে না আমাকে? “

এমন সময় রাফি আর তার চেলাগুলো মায়ের সামনে এসে ফোনে একটা কিছু দেখিয়ে বলল, “আপনার মেয়ে যে নষ্টা, চরিত্রহীনা তাই। বিয়ের আগে রাতবিরাতে পরপুরুষের সাথে ঘেষাঘেষি করে দীঘির পাড়ে। মুখে বললে তো বিশ্বাস করবেন না তাই একদম ফকফকা ছবি তুলে এনেছি। ওয়াফাহর নাগরকে চিনিনি ঠিকিই কিন্তু ছেলে টা আমাদের এলাকার কেউ নয়। আপনার মেয়ে বাহিরে থেকে পরপুরুষ এনে এসব করে পাড়ার বদনাম করে।
এতদিন তো জানতাম আপনার মেয়ে গুন্ডি, এখন জানলাম সে শুধু গুন্ডি নয় একটা বেশ্যা ও বটে।”

আমার প্রচুর রাগ হচ্ছে, এরা আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগাচ্ছে। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই বয়স্ক লোকটা মাকে বলল,
~ আপনার চরিত্রহীনা মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারবনা। এই সবাই চলো। বড়বউ ওই মেয়ের গা থেকে আমার দেওয়া সব গয়না খুলে আনো।

মা তার সামনে হাত জোর করে বলল,
~ আমার মেয়ের এত বড় সর্বনাশ করবেন না। এই বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে ওর আর সহজে বিয়ে হবেনা। বদনাম রটে যাবে আমার মেয়ের। বিশ্বাস করুন, আমার মেয়ে এসব কাজ করতে পারেনা।

লোকটা মাকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেলেন। আমি রাগে ফুলে উঠে দাড়ালাম গায়ের সব গয়না খুলে লোকটার গায়ে ছুড়ে মারলাম। রান্নাঘর থেকে দা বের করে তাকে দেখিয়ে বলল, শালা শুয়োর এক্ষুনি এখান থেকে বিদায় হ। নাহলে একটা কোপ ও মাটিতে পড়বেনা।

সবগুলাও হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। রাফির গলা বরাবর দা ধরে বললাম,
~ তোদের লজ্জা করেনি আমার নামে মিথ্যা বদনাম রটাতে! আজ তোকে খুন ই করে ফেলব আমি।

মা এসে আমার গাল বরাবর পরপর দু-তিনটে থাপড় দিয়ে বলল,
~ তোকে এখন বিয়ে করবে কে পোড়াকপালী? গুন্ডামি দেখাস তাইনা, ছবিতে তো ভুল কিছু নেই। তুই সত্যিই একটা পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছিস্ম এতটা নিচে নেমে গেছিস তুই। এতটা খারাপ আমার মেয়ে আমি ভাবতে পারছিনা। অভাগী তোকে এবার বিয়ে করবে কে?

আমি দা ফেলে দিয়ে চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে কাদতে লাগলাম। ভীড় সরিয়ে সেই দোকানী যাকে পানির বোতলের কাহিনী নিয়ে কেলিয়েছিলাম মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
~ আমি করব ওয়াফাহকে বিয়ে, সব জেনেশুনে স্বেচ্ছায়।

পর্ব ০৭

মা কান্না বন্ধ করে অবাক হয়ে দোকানীর অর্থাৎ রহমত মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি চোখের পানি মুছে সুক্ষ্মদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। এত নিলর্জ্জ একটা মানুষ কি করে হয়? আমার হাতে এত কেলানী খেয়েও আমার বিপদের দিকে বেহায়ার মত বিয়ের কথা বলছে।

একটা বিবাহিত বয়স্ক পুরুষ নিজের বউকে এত ভয় পায় তাসত্ত্বেও এমন কথা মুখে আনল কি করে! ছিঃ! পুরুষের জাতটাই আসলে খারাপ। রীতা এগিয়ে এসে বলল,
~ এসব আপনি কি বলছেন রহমত কাকু? আপনার ঘরে একটা বউ থাকতেও আপনি বেহায়ার মত বিয়ের কথা বলছেন।

~ একটা আছে ওই ব্যাটার মত তো ৩টা নাই। আর ওইটা তো আমার থেকেও বয়স্ক ছিল, আমার টাকা-পয়সা ও ওইটার থেকে কম নাই। আমারো যথেষ্ট সাধ্য আছে ওয়াফাহরে পায়ের উপর পা তুলে খাওয়াতে পারব। রাজরাণী করে রাখমু।

তাইলে তোমাগো আপত্তিটা কোনখানে?
ওইডার কাছে দিতে পারলে আমার কাছে দিতে পারবানা কেন?
জেঠিমা অনেকক্ষণ পর মুখ খুলে বলল,
~ আপনার বউ রাজি হইব এটা মানতে?

~ কেন হইব না! হে তো আমারে এখনো অবধি বংশপ্রদীপ দিতে পারলনা। বাজা হওয়া সত্ত্বেও আমার ঘাড়ের উপর পা তুলে রাজত্ব করতাছে। অন্য ব্যাটাদের মত এখনো বের করে দিই নাই বাজা বলে, এর চেয়ে বড় কপাল ওর আর কি হইতে পারে!
ওয়াফাহরে শুধু আমার বংশরক্ষার জন্য বিয়া করমু। আপনারাই বলেন, এসব ঘটনের পরও কি কেউ ওরে বিয়া করতে রাজি হইব? ও ওয়াফাহর মা তুমি কও, মনমত জামাই-ঘর খুজে পাইবা তো। মাইয়াগো কলঙ্ক এত সহজে মুছে নাহ। তাও আমি সব জেনে রাজি হইসি, এটা ওর কপাল।

ওর দরকার ভালা একটা ঘর, যেখানে ও আরাম-আয়েশে জীবন কাটাইতে পারব। আর আমার দরকার আমার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এখন তোমরাই ভাইবা কও মাইয়ারে আমার কাছে বিয়া দিবা নাকি আজীবন ঘরে বসাইয়া মাইনষের কথা হুনবা! আমি এখানে বসলাম, তোমরা ভাইবা জানাও।

জেঠিমা মাকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি উনার দিকে এগিয়ে এসে বললাম,
~ এত লালা কিসের তোর? এত কেলানী খাওয়ার পরও কোন মুখে আমাকে বিয়ের কথা বলিস? বেহায়া হারামজাদা।

~ হাহাহা, দে ইচ্ছেমত গালি দে। এসবের শোধ তুলমু শুধু একবার আমার উঠোনে পা রাখ। খুব দেমাগ বাড়ছিল তোর! তোর এসব আমি ছুটামু ওয়াফাহ। আজ তোরে আমার দ্বিতীয় বউ কইরা ঘরে তুলমু।
~ তোর এ শখ জীবনেও পূরণ হইব না। বলে মাটি থেকে দা টা হাতে নিলাম।

উচিয়ে ধরে বললাম, ভালোই ভালোই বলছি এই মূহুর্তে আমার বাড়ী থেকে বের হ। নাহলে আজ তোর মাথা তোর মাথার জায়গায় থাকবেনা।
মা বেরিয়ে এসে বলল, রহমত মিয়া আপনার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নাই। আপনি এখনি বিয়ের কাজ শুরু করতে পারেন।

শুনে আমার হাত থেকে দা পড়ে গেল। রহমত মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে পৈশাচিক হাসি হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি মায়ের কাছে ছুটে এসে বললাম, মা তুমি এসব কি বলছো? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দেওয়ার সময় তুমি একবারো ভাবছো না?

মা কঠিনদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ঘরের মেয়ে যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন আর কিছু ভাবার থাকেন। নষ্টামির শেষ সীমানা পার করে ফেলেছিস, এখন যা হচ্ছে চুপচাপ মেনে নে। আমি নষ্ট মেয়ে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারবনা। এই বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তুই ভুলেও আমার সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করবিনা।

আমি ভুলে যাব, তুই আমার মেয়ে ছিলি।
আর তুই ও ভুলে যাবি, তোর মা ছিল। বলে মা আবার ঘরে ঢুকে গেল। আমি ঘরের দাওয়ায় বসে পড়লাম। জেঠিমা আমাকে তুলে আবার স্টেজে বসাল।

কাজী বিয়ে পড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি মরে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত। আল্লাহ এ তোমার বিচার? এ তোমার ভালো করা! আমি তো তোমার উপর ভরসা রেখেছি, তাও কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে!
কাজী বার বার তাগাদা দিচ্ছে কবুল বলার জন্য। কিন্তু আমার পাথর হয়ে যাওয়া মুখ দিয়ে টু শব্দ টিও বের হচ্ছেনা। জেঠিমা আমার গায়ে জোরে একটা গুতো মেরে বললেন, কিরে বেশ্যা, এখন কবুল বলতে পারস না কেন?
রাত বিরাতে তো ঠিকিই নাগরের লগে নষ্টামি করতে পারিস। কবুল বল, আর পাপমুক্ত হ। তোর পাপের মুখ আমার আর সহ্য হচ্ছেনা।

নিঃশেষ হওয়ার অন্তিম সময় বোধহয় ঘনিয়ে এসেছে। আর কোনো উপায় নেই এই বিয়েটা করা ছাড়া। ভিতর থেকে না আসলেও বাহির থেকে আমাকে কবুল বলতে হবে।
কবুল বলতে যাব এই মূহুর্তে কেউ একজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
~ ওয়াফাহ, আপনি কবুল বলবেননা।

মুখ তুলে কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে দেখলাম, একটা ভীষণ টকটকে লাল ফর্সা, লম্বা, সাদা পাঞ্জাবি পড়া সুদর্শন ছেলে তার প্রচন্ড মায়াভরা ডাগর ডাগর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক চিনতে পারলামনা উনাকে। রহমত মিয়া ক্ষেপে গিয়ে বলল, ওই মিয়া, তুমি কেডা? ও কবুল বলবে কি বলবেনা সেটা তুমি ঠিক করে দেওয়ার কে!
ছেলেটা মূহুর্তে বলল, ওয়াফাহ আমার জন্য কবুল বলবে। আমি তাকে নিকা করব।

~ অই মিয়া, মগের মুল্লুক পাইসো? আমার কেনা মাল নিজের বইলা নিয়া যাইবা। এত সাহস হয় কেমনে! ভালা চাইলে এখান থেইক্কা চইলা যাও।

~ হ্যা যাব তো বটেই। কিন্তু একা নয়, আমার বউ ওয়াফাহকে সঙ্গে নিয়ে।
তার মুখে বউ শব্দটা শুনে ভেতরটা কেপে উঠল। আমি আবার তার বউ হলাম কবে? কিছুই তো বুঝতে পারছিনা, এই ছেলেটাই বা কে?

চুপ করে তার কান্ড দেখতে লাগলাম আমি, আসলে সে কি করতে চায় তা বুঝতে। রহমত মিয়া আরো ক্ষেপে গিয়ে বলল, তুই কি যাবি এখান থেকে?
~ আমি নয় আপনি যাবেন। দেখুন আপনার স্ত্রী আপনাকে নিতে এসেছে। তার কথা শুনে বাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাকীমা ঝাটা হাতে দাঁড়িয়ে রাগে ফুসছে। বিশ্রী টাইপের গালি দিতে দিতে রহমত মিয়ার দিকে ছুটে আসলেন।

এসে আচ্ছামত ঝাটা পিটা করতে লাগল আর বলতে লাগল,
~ হালার পো, আমারে ২সপ্তাহের জন্য বাপের বাড়ী পাঠিয়ে তুই নিজের মেয়ের বয়সী কচি একটা মাইয়ারে বিয়ে করতে আইসোস। এই জন্য ই তো বলি কাল রাত থেকে এত গদগদ ভাব কেন? সকাল না হতে গাড়ী ডেকে আমি পাঠিয়ে দেওয়া। চল তুই বাড়ীতে, তোর বংশরক্ষা আমি ছুটামু হালা।

রহমত মিয়ার অবস্থা ছিল পুরো দেখার মত। ঝাটার পেটা খেতে খেতে বাড়িতে গেল লুইচ্চাটা। এই ঘটনায় সবাই নীরব হয়ে গেল, তাকিয়ে তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখতে লাগল। আমি নিজেও ভাবছি এই অচেনা আগন্তুক কে?
এইবার আর দ্বিমত না করে ছেলেটাকে বিয়ে করে নিলাম। শেষমূহুর্তে যে ফেরশতার মত আমাকে বাচালেন, তাকে বিয়ে করতে আপত্তি থাকার কথা নয়। জেঠিমা তার পরিচয় জানার জন্য খুটখুট করছিলেন কিন্তু কি ভেবে যেন রাজি হয়ে গেলেন। ভাব টা এমন যেন পরিচয়-কেয়ামত সব পরে আগে আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে তাড়ানোর ব্যবস্থাটা করতে হবে।

২বার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে ৩য় বার ভাঙ্গলে হয়ত তার ঘাড়ে গিয়ে পড়তে পারি, তাই চুপচাপ বিয়ের কাজ টা সেরে যেতে চাচ্ছেন। কবুল বলার সময় তার চোখে চোখ রাখলাম। উনি নিষ্পাপ চাহনীতে আশ্বাস দিলেন আমি ভুল করছিনা।

কবুল পড়ে মোনাজাত শেষ করে মায়ের কাছে গেলাম।
মা দরজা বন্ধ করে রুমের মধ্যে বসে আছে। বাইরে থেকে এতবার ডাকলাম, সাড়া দিলনা। শেষমূহুর্তে বলল,
~ তোর জন্য আমার উচু মাথা হেট হয়ে গেল, স্বামীর নাম খারাপ হয়ে গেল। তোর মুখ আমি আর দেখতে চাইনাহ। বিদায় হয়ে যা এখান থেকে।

কেদে কেদে বললাম,
~ মা আমি চলে যাচ্ছি, একটাবার সালাম করতে দিবানা?
~ নাহ। কোনো নষ্ট মেয়ের জন্য আমার দোয়া আসবেনা।

ছেলেটা এসে আমার পাশে দাড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে, চলুন। মায়ের অভিমান ভাঙ্গলে উনি নিশ্চয়ই আপনাকে আবার ডেকে নিবে। এখন তাকে একা থাকতে দিন।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম তাও বার বার পিছন ফিরে তাকালাম এই আশায় হয়ত মা একবার দরজা খুলবেন। কিন্তু খুলল না।

কাদতে কাদতে রীতা আর মীনাকে বিদায় দিয়ে তার ডেকে আনা রিকশায় উঠলাম। উনি আমার পাশে বসল তাও এমন ভাবে যাতে গায়ের সাথে গা না ঘেষে। কান্না করছিলাম দেখে একটা টিস্যু দিয়ে বললেন,
~ চোখ মুছে নিন। কাজল লেপ্টে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে।
মন খারাপ তাই কিছু বলতে নিয়েও বললাম না। একটু পরে নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, রিকশায় করে নতুন বউকে শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে যাবেন?

~ কেন ট্রাক ভাড়া করা উচিত ছিল বুঝি!
রেগে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম, কি ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর তার! এই ছেলের সাথে সংসার করব কি করে! আল্লাহ, তুমি কপালে আর কি কি লিখে রাখছো!
নিজে নিজে রাগ ভেঙ্গে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
~ আপনি কে সেটাই তো জানলামনা।

~ কেন নিজের স্বামী ভাবতে কষ্ট হচ্ছে?
কথাটা শুনে মনে হল আমি গাল উজে উজে পেতে দিচ্ছি। আর উনি চট করে থাপড় মারছেন। আর কিছু জিজ্ঞেস করলামনা রাগে।

পর্ব ০৮

রিকশা মোটামুটি একটা নির্জন রাস্তায় এসে থামল। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নামুন। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, কই আশেপাশে তো বাড়ী দেখছি না। গলিও দেখছি না যে গলির ভিতর রিকশা ঢুকবেনা বলে আমাকে হেটে যেতে হবে। তবে কি উনি আমাকে এখানে ছেড়ে দিয়ে যাবেন?

চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে নামব কেন? আপনি কি আমাকে এই মাঝরাস্তায় নামিয়ে চলে যাবেন, তাহলে বিয়েটা করলেন কেন?

উনি হালকা রাগ দেখিয়ে বললেন, আপনার বেশী বোঝার স্বভাব টা কি কখনো যাবেনা? নামতে বললাম নেমে একপাশে গিয়ে দাড়ান। আমি চুপচাপ রিকশা থেকে নেমে রাস্তার একপাশে গিয়ে দাড়ালাম।

উনি ভাড়া মিটিয়ে আমার পাশে এসে দাড়ালেন। এইদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। আমি উনার মুখের দিকে তাকালাম। মুখ হালকা লালবর্ণ ধারণ করায় তাকে বেশ কিউট লাগছে। আমার দিকে তাকাতে আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। হঠাৎ সামনে একটা ভ্যানগাড়ি দেখে থামালেন। আমাকে বললেন,
~ উঠে বসুন, বাকিটা পথ ভ্যানে যাবেন।

আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। নতুন বউকে ভ্যানে করে শ্বশুড়বাড়ি নিবে এই বরব্যাটা। ইচ্ছে করছে ভ্যানটা ওকে দিয়ে চালিয়ে নিই। এই দুপুরের রোদে ব্যাটা আমাকে ভ্যানে করে নিবে। কিচ্ছু বললামনা, বিশ্বাস নেই আবার মুখে উপর বলে বসবে, “এবার কি বাস ভাড়া করতে হবে? “
রাগে ফুসতে ফুসতে ভ্যানে চেপে বসলাম। এটুকু কান্ডজ্ঞান নেই, আসছে আবার বিয়ে করতে। ব্যাটা শয়তান।

উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ মনে মনে গালিগালাজ করে কি হবে? ইচ্ছে হলে সামনাসামনি করুন, তাতে রাগ টা কমবে আপনার।
চমকে উঠলাম। ব্যাটা দেখি মনের কথা ও পড়তে পারে। এর সাথে সাবধানে চলতে হবে। আস্ত চালাক। ভ্যানগাড়ির চালক আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। জিদ চেপে গেল, আর চুপ থাকতে পারলামনা।

চেচিয়ে বললাম,
~ ওই ব্যাটা তুই হাসিস কেন? জোরে চালা। আর একবার খালি হেসে দেখ, হাসার জন্য মুখ থাকবেনা। ভ্যানওয়ালা ভয়ে চুপসে গেল, জোরে প্যাডেল মারতে লাগল। উনার মুখের দিকে তাকালাম আড়চোখে। মুখটায় কিছুটা রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমি চোখ নামিয়ে ফেলতেই বলল,
~ এসব গুন্ডামি ছাড়ুন। বড়দেরকে সম্মান দিতে শিখুন।

আমি উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। অন্যের জন্য আমি নিজেকে কখনোও চেঞ্জ করতে পারবনা। তাতে ছেড়ে গেলে, চলে যাক। বদনামি হবে, সেটাও হোক। যখন আমার পাশে কেউ ছিলনা, তখন এই গুন্ডামিই আমার ঢাল হয়ে আমাকে রক্ষা করেছে। কিন্তু ছেলেটা জানল কি করে এসব? উনি তাহলে আমাকে আগে থেকে চিনেন।
~ সত্যি করে একটা কথা বলুন তো কে আপনি?

~ কে বললে খুশি হবেন?
~ আসল পরিচয় বললে খুশি হব।
~ এত জ্বালাচ্ছেন কেন তখন থেকে? জানতে তো পারবেন ই। আগে বাসায় চলুন তারপর। আর হ্যা যদি পারেন গুন্ডামিটা সেখানে দেখাবেন না, একান্ত অনুরোধ আপনার কাছে।

লজ্জা পেয়ে আর কিছু বললামনা। অনেকক্ষণ পরে একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে ভ্যান থামল। ভ্যান থেকে নেমে বাড়ির গেইটের সামনে দাড়ালাম। মন ছুয়ে যাওয়ার মত একটা বাড়ি। যদিও অতকিছুই নেই, তবুও ভীষণ ভালোলাগছে। গেইটের পাশে বাগানবিলাসের গাছ, সেটার ডালপালা ছাড়িয়ে গেছে গেটের উপর, তাতে ফুটে আছে রাশিরাশি গোলাপী ফুল, বাড়ির চারপাশে বাউন্ডারি করা, নির্জন একটা পরিবেশ, চারিদিকে খুব বাতাস।

উনি গেইট ঠেলে ঢুকলেন, আপনমনেও হাটতে লাগলেন। সাথে করে যে একজন কে এনেছেন সেটা ভাব দেখেই মনে হচ্ছেনা, একবারো বললেন না, “আমার সাথে ভেতরে আসুন, এটাই আপনার শ্বশুড়বাড়ি।”
আমি মেজাজ খারাপ করে আস্তে আস্তে হাটতে লাগলাম। উনি থেমে পিছনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আলাদা করে আসতে বলতে হবে? এত আস্তে হাটছেন কেন? আসুন তাড়াতাড়ি।

কথাটা শুনে মুখ বাকালাম। এই ছেলেকে মনে হয় জন্মের সময় মধুর বদলে করলার রস খাইয়ে ছিল। তাই মুখ দিয়ে মিষ্টি কথা বের হয়না, তিতা কথাই বলে। হাটতে হাটতে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। বাসার সামনে একটা ছোটখাট বাগান, তাতে কত প্রজাতির ফুল। এ্যালোভেরা গাছ, ক্যাকটাস, পাথরকুচি কি নেই! বাগানের মাঝখানে আবার বাধাই করা ছোট একটা কুয়োর মত পুকুর, তাতে ফুটে আছে নীলপদ্ম। সিড়িও আছে বসার জন্য, সবমিলিয়ে বাহিরের পরিবেশটা আমার মনে ধরেছে।

উনি বাসার দরজায় নক করলেন। ততক্ষণে আমি তার পাশে এসে দাড়ালাম, মাথার ওড়নাটা টেনে নিলাম, শাড়ি, চুড়ি সব ঠিকঠাক আছে কিনা একবার চেক করে নিলাম। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলল আমার বয়সী সুন্দরী মেয়ে। বকতে বকতে দরজা খুলতে লাগল। দরজা খুলে উনার উপর ঝাপিয়ে পড়ল,
~ তোর ফিরতে এতক্ষণ লাগে?

সেই ভোরে বেরিয়েছিস, একবার বলে যাওয়ার ও প্রয়োজনবোধ করিসনা। বলতে বলতে আমার দিকে চোখ পড়ল। হা করে তাকিয়ে থেকে বলল, এই মেয়েটি কে? কাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছিস তুই? ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ ওসব পরে বলব। আগে তুই সবাইকে ডেকে দে। মেয়েটি গোমড়ামুখে ভিতরে চলে গেল।

আমি ভাবতে বসলাম, এখন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ছেলেটির মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই আমাকে চেপে ধরবে। বাসা দেখে তো মনে হচ্ছে এখানে কম মানুষ থাকেনা। নিজেকে ভেতর থেকে প্রস্তুত করে নিলাম।
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি ফিরে এসে বলল, তোদেরকে ভিতরে ডাকছে। আয়।

ছেলেটি মেয়েটার পিছুপিছু ঢুকে গেল। আমি বিসমিল্লাহ পড়ে আল্লাহর নাম জপ্তে জপতে ঢুকলাম।
ভিতরে ঢুকে আরো অবাক হলাম। বাহিরে থেকে দেখে মনে হয়না ভেতর টা এত সুন্দর করে সাজানো। পরিপাটি ঘর-দোর দেখে বুঝলাম এরা অনেকটা স্বচ্ছল পরিবার।

যাই হোক, তার পিছু পিছু একটা রুমে ঢুকলাম। সেখানে বেডে একজন লোক বসে বই পড়ছে আর পাশে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে পান চিবুচ্ছে। আমাকে দেখে উনি চিবুনো বন্ধ করে ভ্রু কুচকে তাকালেন। ঠাহর করতে পারলামনা উনি আমার শ্বাশুড়ি কিনা!
মুখে সালাম দিলাম উনাকে। উনি সালামের উত্তর নিলেন সহজভাবে। তারপর ছেলেটি লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
~ দাদাভাই, আমি এসেছি।

শুনে উনি বইটা নামিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। দেখে আমি পুরাই হতবাক। একবার লোকটার দিকে আরেকবার উনার দিকে পরপর তাকাতে লাগলাম। এই তো সেই দাদুটা, যাকে আমি সেরাতে পানি খাইয়েছিলাম।
তার মানে আমার বর আর কেউ নয়, সেই ছিচকে চোরটা। এতক্ষণ পাশে থাকার পরও আমি বুঝতে পারলামনা। এইটা জানার পর আমি কাদব না হাসব সেটাও বুঝতে পারছিনা।

উনি পাশ থেকে ফিসফিস করে বললেন,
~ অবাকতার ঘোর কাটলে দাদুকে সালাম দিন। উনার কথা শুনে চুপচাপ দাদুর কাছে এগিয়ে এসে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। উনি খুশি হয়ে বললেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আমার বেহেশতী হুর আমার ঘরে চলে এসেছে। আল্লাহ তোমাদেরকে সুখী করুক।

তারপর মহিলা আর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললে, ও আমার মুহিবের বউ। আমার ঘরের জান্নাতী হুর। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। দাদু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদু তোমার নাম টা কি?
~ ওয়াসিফা বিনতে শাহনাম। সবাই ওয়াফাহ ডাকে।
~ মাশা আল্লাহ। যেমন নাম, তেমনি গুন। তোমরা ওকে নিয়ে যত্নাত্তি করো। অনেক দূর থেকে এসেছে, ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দাদুভাই তুই আমার কাছে থাক।

মহিলাটা এসে আমাকে নিয়ে গেল। সিড়ি বেয়ে উপরের রুমে ঢুকলাম। বেশ বড় রুম, একপাশে বেড আর বেডটেবিল। তার বিপরীত পাশে ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, একসেট সোফা আরো কিছু তৈজসপত্র দিয়ে সাজানো। ভালোই লাগল। তার পাশে এটাচড ওয়াশরুম আর নামাযের ঘর।

সেখানে কুর আন, তসবীহ, জায়নামায রাখা আছে সুন্দরভাবে। দেয়ালে মক্কা শরীফসহ কিছু কালামের ওয়ালমেট। সবমিলিয়ে আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে।
রুমের শেষমাথায় বারান্দা আছে। সেখানে নকল ঘাসের কার্পেট বিছানো, ঝুলানো ফুলের টব, বসার জন্য একটা দোলনা আর রঙবেরঙ্গের লতানো লাইটগুলো।

মহিলাটি বলল, তুমি কি সাথে করে জামাকাপড় কিছু এনেছো?
আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম, না। উনি মুচকি হেসে বলল,
~ তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি তোমার জন্য শাড়ি পাঠাচ্ছি।
~ আপনাকে কি বলে ডাকব?

~ ফুপি বলে ডেকো। আমি মুহিবের ফুপি হই। তুমি ওয়াশরুমে যাও।
বলে উনি রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিতে দিতে ভাবলাম, শেষ পর্যন্ত কিনা একটা ছিচকে চোরের বউ হলাম। যাকে আমি একদমই সহ্য করতে পারিনা, দেখলেই কেলাতে মন চায়। আল্লাহ যে কোথায় এনে ফেলল আমাকে।

ফ্রেশ হতে গিয়ে শাড়ি ভিজিয়ে ফেললাম। ভেজা শাড়ি নিয়ে বের হয়ে বসে রইলাম, এখনো কেউ শাড়ি বা কোনো কাপড় নিয়ে রুমে আসলনা। আমিও লজ্জায় বের হলামনা। আমার অল্পতে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার অভ্যাস। বেশিক্ষণ ভিজে শাড়ি পড়ে থাকতে পারবনা। তাই শাড়ি খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ছিচকে চোর নক না করে রুমে ঢুকে পড়ে আর আমাকে দেখামাত্র আতকে চিৎকার করে উঠে। তার চিৎকার শুনে ডাকাত পড়েছে ভেবে আমিও চিৎকার করে উঠি।

পরে তাকিয়ে দেখি আমার রুমে ডাকাত পড়েনি, ছিচকে চোর ঢুকেছে।
আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
~ আপনি এখানে, এই অবস্থায় কেন?

পর্ব ০৯

আমি বললাম, তো কি হইসে?
~ এটা আমার রুম। আমি চুলে বান করতে করতে বললাম,
~ তাহলে তো ঠিক ই আছে। এখন আমার আপনার রুমেই থাকার কথা। আপনি এখানে কেন এসেছেন?

এভাবে চিৎকার করার ই বা কি হল বুঝলাম না!
উনি রুমের ভেতরে ঢুকে হাতের কিছু প্যাকেট বিছানার উপর রেখে বলল,
~ আপনি আমার শার্ট-প্যান্ট পড়ে আছেন কেন?

আগে যেমন শার্ট-গেঞ্জি পরে ঘুরতেন, এখনো কি তাই করবেন নাকি? ভুলে যাচ্ছেন কেন, এখন আপনি এই বাড়ির বউ। বাসায় বয়স্ক রা আছে, দেখলে কি ভাববে?
গুন্ডি সারাজীবন গুন্ডিই থাকবেন।

~ অই ব্যাটা! আবার গুন্ডি বলস? আমি কি ইচ্ছে করে শার্ট-প্যান্টে হাত দিসি নাকি? আমার শাড়ি ভিজে গিয়েছিল, আমার আবার অল্পতে ঠান্ডা লেগে যায়। তাই পরেছি। বলতে বলতে একটা হাচ্চু দিয়ে দিলাম।

~ অহ বুঝেছি। আর এসব কি ভাষা! বার বার বলছি এসব ছাড়ুন, নাহলে যেখান থেকে এনেছি সেখানে রেখে আসব। আর প্যাকেটতে আপাতত কিছু শাড়ি আর রেডিমেড ব্লাউজ এনেছি। পরে নিন, আর ভুলেও আমার কোনো কাপড়ে হাত দিবেননা। আমার প্রিয় শার্টের হাতায় ভাজ ফেলে কি করেছে!😒
যত তাড়াতাড়ি পারেন ধুয়ে ইস্ত্রি করে আলমারিতে রেখে দিবেন।

আমি মুখ বেকিয়ে বললাম, হুহ, রেখে দিব। খেয়ে ফেলছি না এই কচুর শার্ট। শার্ট লাগলে আমাকে বলবেন, আমার বাসায় আমার ছেড়া শার্টের টুকরো গুলো পড়ে আছে। নিয়ে আসব আপনি পরার জন্য।

~ গুন্ডি একটা। বলে উনি আবার বেরিয়ে গেলেন। হুহ, এই ছিচকে ব্যাটাকে নাকি আমার সারাজীবন সহ্য করতে হবে। আমাকে দেখলে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে, আল্লাহ কি বুঝে এডার লগে আমারে মিলাইলা! রুপ টুকু ছাড়া আর কোনো কচুও নাই ব্যাটার। শার্ট-প্যান্ট গুলো খুলে ইচ্ছেমত ঝেড়ে দিসি, কাপড় ধোয়ার মত জোরে জোরে আছাড়লাম। বজ্জাতটাকে তো কিছু করতে পারবনা, এইগুলো রাগ ঝাড়ার উপায়।

সন্ধ্যার দিকে উনি আবার রুমে আসলেন। ঢুকে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলল, সেই ঘন্টাখানেক আগে আপনাকে শাড়ি দিয়ে গেলাম। আপনি কিনা শাড়ি না পরে আবার আমার নতুন শার্ট-প্যান্টে হাত দিয়েছেন। আগের গুলো কি করেছেন? মেঝেতে ফেলে রেখেছেন কেন? এটুকু আক্কেলবোধ টুকু নেই আপনার। তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে নিন, আপনাকে নিচে ডাকছে। এখন কেউ চলে এসে এভাবে দেখলে আমার মুখ থাকবে?

আমি সোফা থেকে উঠে বসে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে চুলকোতে চুলকোতে বললাম,
~ এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমি শাড়ি পরতে পারিনা, কখনো নিজে নিজে পড়িনি। ঘন্টাখানেক ধরে চেষ্টা করলাম পারিনা। তো কি করব!
~ শুধু অভদ্রতা আর গুন্ডামিটাই শিখলেন। আর তো কিছুই জানেন না।
~ মুখ সামলে কথা বলুন। আমি এই অবস্থায় ই নিচে যাব।

~ দাড়ান এখানে। বলে উনি কিছু একটা ভেবে নিলেন, তারপর বললেন ব্লাউজ-ছায়া পরে আসুন ওয়াশরুম থেকে।
~ শাড়ি পরাবে কে?
~ এত কথা কেন বলছেন? তাড়াতাড়ি যান, কেউ এসে আপনাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলার আগেই।
~ দেখলে কি হবে?

~ সবাই জেনে যাবে, আমি একটা অকালকুষ্মান্ড গুন্ডিকে বিয়ে করেছি। সেটা আপনার জন্য সম্মানের হবে?
শুনে মুখ কালো করে ওইসব নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। পরে এসে উনার সামনে দাড়ালাম। উনি আমার দিকে না তাকিয়ে শাড়ি হাতে নিয়ে বলল,
~ হাত উপরে তুলুন। আমি শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি।

~ আপনি পরাবেন মানে কি? বাসায় তো ফুপি আছে, উনাকে ডেকে দিন।
~ হ্যা উনি এসে দেখুক, আমার বিয়ে করা গুন্ডি একটা সামান্য শাড়ি পরতে পারেনা। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকুন।
ভাবলাম, এই সুযোগে ব্যাটাকে একটু জ্বালানো যাক। শাড়ি পরাতেই পারছেন না আমার অতিরিক্ত নড়াচড়া আর সুড়সুড়ি পাওয়ার ভান করার কারনে। ১০মিনিট আমার সাথে যুদ্ধ করে আর না পেরে শাড়ি হাতে ক্লান্ত হয়ে বেডে বসে পড়লেন।

আমার এখন প্রচুর হাসি পাচ্ছে, আটকে রাখতে না পেরে হেসে দিলাম।
উনি চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালেন। জানিনা বুকের ভিতরে কেমন জানি একটা ভয় উথলে উঠল। হাসি থামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা দিয়ে দিলেন।

আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন জানি একটা ভালোলাগা কাজ করছে, তার চোখের অতলে হারিয়ে যাচ্ছি মনে হল। উনি চোখ সরিয়ে বললেন, এভাবে ঘোমটা দিয়ে সবাইকে আবার সালাম করবেন গিয়ে। আর কিছু সাজগোজ বাকি থাকলে সেরে তাড়াতাড়ি নিচে আসুন। আমার ক্ষিধেতে পেট ফেটে যাচ্ছে, আপনার জন্য এখনো খেতে পারছিনা।

দোয়া করে, তাড়াতাড়ি নিচে এসে আমাকে বাচিয়ে দিন।
বলে মূহুর্তে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

আয়নার সামনে এসে আয়নার দিকে তাকালাম। কচি কলাপাতা রঙ্গের শাড়িতে বেশ মানিয়েছে আমাকে, ঘোমটা দেওয়ায় যেমন বউ বউ ফিল হচ্ছে তেমন পবিত্র লাগছে নিজেকে। কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে প্যাকেট থেকে কাজলটা বের করে একটু লাগিয়ে নিলাম। ব্যাস! সাজ কম্পলিট।

চুপচাপ নিচে চলে এলাম। সবাই দেখি টেবিলে বসে আছে। দাদু আমাকে দেখে বললেন, আয় তোর জন্য ই অপেক্ষা করছিলাম। দাদুর কাছে এসে সালাম দিয়ে টেবিলের দিকে তাকালাম। মুরগী মাংস দিয়ে বিরিয়ানি, চিংড়ি মাছ ভাজা, কয়েকপ্রকার মিষ্টি টেবিলে সাজানো আছে।

দাদুর পাশের চেয়ার টেনে বসব, এমন সময় দেখি ফুপি আমার দিকে কেমন একটা লুক দিয়ে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আমি কোনো অভদ্রতামি করে ফেলেছি।
কিছু না বুঝতে পেরে উনার দিকে তাকালাম। উনি ইশারা করে বললেন সবাইকে যেন পরিবেশন করে দিই।

এতক্ষণে বুঝলাম ফুপির এমন লুক দেওয়ার কারণ। উনাকে আর মেয়েটিকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে আমি পরিবেশন করে দিলাম। দাদু আমার প্রশংসা করে বলল,
~ দেখেছিস, আসতে না আসতে কেমন নিজের দায়িত্বটা বুঝে নিয়েছে আমার জান্নাতি হুর টা। দোয়া করি, সুখে থাকো।

এই প্রথম কারো মুখে নিজের প্রশংসা শুনে কেমন একটা লজ্জা ভর করে বসল। এত পছন্দের খাবার হওয়া সত্ত্বেও মনমত খেতে পারলামনা। মিষ্টির কথা আর বলব, এত্ত এত্ত ভাল্লাগছে যে মনে হল সব খেয়ে ফেলি।
কিন্তু একটার বেশি কপালে জুটলনা।

খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ পর উনি দাদুসহ আসলেন রুমে। আমি বসা থেকে উঠে দাড়ালাম। দাদু আমাকে একটা ছোট হার উপহার দিয়ে বললেন, এটা আমার নাতির বউয়ের জন্য। তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক। এই বাসররাত থেকে তোমার সংসার আগলে রাখার দায়িত্ব একান্ত ই তোমার।

আমি চমকে উঠলাম, কিসের বাসর রাত? আমি কে? আমি কোথায়?
এই কেমন বাজে স্বপ্ন দেখছি আমি। এই ছিচকে ব্যাটার সাথে নাকি আমার বাসর রাত আজ! অসম্ভব, এটা রে আমি কোনোমতেই সহ্য করতে পারিনাহ। বর ভাবা তো দূরের কথা। আজ কোনো অভদ্রতামি করতে আসলে ব্যাটাকে ধরে ছেচা দিব।

দাদু বেরিয়ে গেলে উনি দরজা লক করে বেডের পাশে এসে দাড়ালেন। আমি বেডটেবিলে রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে ফল কাটার ছুরি টা নিয়ে উচিয়ে বললাম,
~ খবরদার, কাছে আসলেই কোপ দিব। ছিচকে ব্যাটা একটা!

~ অইটা ছুরি, দা নয় যে কোপ দিবেন। আর আমি আপনার কাছে আসতে যাব কেন? শুনুন, আপনাকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে বা আগ্রহ আমার ছিলনা। দাদু শুনেছে, আমাকে নিয়ে আপনার বদনাম রটেছে তাই আমাকে বলল আপনাকে বিয়ে করতে। আমার নিজের কাছেও নিজে অপরাধী মনে হয়েছে তাই করেছি।
নাহলে আপনার মত গুন্ডিকে বিয়ে করব আমি অসম্ভব।

~ যান, ভাগেন। আমারো শখ নাই ছিচকে চোরের বউ হব।
~ বিছানা ছাড়ুন, আমি ঘুমাব।
~ আমি কেন ছাড়ব? আমি বিছানায় ই ঘুমাব।
আপনি অন্য কোথাও ঘুমান।

~ আমি বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারিনা। অন্য কোথাও ঘুমালে আমি নাক ডাকি।
আমার চিরশত্রুর নাম বলল😒 আমার নাকডাকা একদমি সহ্য হয়না। মা ডাকে, তাই মায়ের সাথে ঘুমাইনা।
~ ডাকতে হবেনা নাক। আমি কোথায় ঘুমাব?

~ সোফা আছে, নিচে ফ্লোর আছে। যেখানে ইচ্ছে ঘুমান।
মনে মনে একশ একটা গালি দিতে দিতে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। উনি আমার দিকে একটা বালিশ ছুড়ে দিলেন। এই ব্যাটারে জব্দ করতে হবে।

উনার চোখ লেগে আসামাত্রই পেট ব্যথার অভিনয় করতে লাগলাম, ব্যথার স্বরে আওয়াজ করতে লাগলাম।
উনি হুড়মুড়িয়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ কি হয়েছে? এভাবে পেচার মত ডাক শুরু করলেন কেন?

~ আমার পেটে ব্যথা করছে। 😠
~ কেন? 😒
~ ক্ষুধা লাগছে তাই। আমার জন্য খাবার নিয়ে আসুন।
~ এত রাতে কিসের খাবার আনব আমি? আপনি নিজে গিয়ে নিয়ে আসুন। এমন ডাক পেরে ঘুমের ডিস্টার্ব করবেননা।

যেই শুয়ে পড়লাম, আমি আরো জোরে আওয়াজ করলাম
~ কি ব্যাপার? এত জোরে চিৎকার করছেন কেন?

~ ক্ষুধা বেশি লাগসে। উঠতে পারছিনা, যান না নিয়ে আসুন। নাহলে চিৎকার করব।
~ উফফ! চুপ করুন। বাসায় বয়স্ক রা ঘুমাচ্ছেন, আমি খাবার নিয়ে আসছি।
বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। ফিরে এলেন বিরিয়ানি নিয়ে, আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন গিলুন। আর বিরক্ত করবেননা।

~ মিষ্টি কই? শুনে বিরক্ত হয়ে আবার নিচে গেলেন। এক বাটি মিষ্টি নিয়ে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
~ এই যে শুনছেন? আমার না ডিম ওমলেট খেতে ইচ্ছে করছে।
একটু বানিয়ে নিয়ে আসুননা।
~ কি পেয়েছেন টা কি আমাকে? আমি আর কিছু করতে পারবনা।

আমি মিথ্যে কান্নার অভিনয় করতে লাগলাম। উনি বিব্রত হয়ে বললেন, অপেক্ষা করুন, ভেজে নিয়ে আসছি।
~ শুনুন, পেয়াজ আর মরিচ বেশি করে দিয়ে ভাজবেন। ঘন হলুদ রঙ্গ ধরলেই হবে। শুনে উনি আবার নিচে গেলেন। আমি বিরিয়ানির প্লেট হাতে নিয়ে খেতে খেতে উনার পিছু পিছু রান্নাঘরে এলাম।

উনি পেয়াজ কাটতে বসলেন। আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে হেলান দিয়ে বিরিয়ানি খাচ্ছি। বেচারার চোখ থেকে পানি পড়ছে। আহারে!
~আরো একটু কুচি করে কাটুন।

~ কাটছি
প্রচুর জ্বালানি সহ্য করে ডিম ভেজে আনল। খেয়ে উনার হাতে খালি প্লেটগুলো দিয়ে বললাম, ধুয়ে রেখে আসবেন। আমার ঘুম পাচ্ছে ঘুমাব।

আর হ্যা ধন্যবাদ ডিম ভাজিটা মজা ছিল যদিও ঘন হলুদ হয়নি। সমস্যা নাই, নেক্সট টাইম থেকে। অকে?
উনি রেগেমেগে কিছু বলার আগেই পাশ ফিরে ঘুমানোর ভান করলাম। বেচারা একা একা ফুসতে ফুসতে বের হয়ে যায়।
আচ্ছা জব্দ করেছি ব্যাটাকে। আহ! ভীষণ শান্তি লাগসে।

পর্ব ১০

সকাল সকাল কারো কুরআন তিলওয়াতের আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙ্গল। কি মিষ্টিস্বরে তিলওয়াত করছে! শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। উঠে বসে ব্যালকুনির জানালায় উকি দিয়ে দেখি এখনো ভোরের আলো ফুটেনি।

এইসময় আবার কে কুরআন তিলওয়াত করছে। উঠে নামাযঘরে উকি দিতে দেখি ছিচকে ব্যাটা কুরআন পড়ছে। চুপচাপ দরজার কোণে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তিলওয়াত শুনছি। এমন সময় আযান দিল, উনি কুরআন শরীফে চুমু খেয়ে রেখে দিয়ে মুনাজাত ধরলেন।

আমি ভাবতে লাগলাম, মাত্রই তো আযান দিল। তাহলে উনি কিসের মুনাজাত ধরছেন? মোনাজাত শেষে আমার দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বললেন, নামায পড়বেন না? আমি হকচকিয়ে উঠে মাথা নিচু করে বললাম,
~ আমি তো নামায পড়তে পারিনা।

উনি মুচকি হেসে বললাম, আমি শিখালে পড়বেন?
আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। উনি বললেন, ওযু করে আসুন। একসাথে নামায পড়ব।
~ আমি ওযু করতে পারিনা সহীহভাবে।
~ আচ্ছা, আসুন আমার সাথে। আমি ওযু করিয়ে দিব।

আমি কিছু না বলে উনাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। মানুষটাকে ঠিক বুঝতে পারছিনা। এত জ্বালানোর পর ও আমার সাথে শান্ত গলায় কথা বলছে। আমিও তার উপর আর রাগ করতে পারছিনা।
উনি এক বালতি পানি আমার সামনে নিয়ে এসে বলল,
~ আপনাকে স্পর্শ করতে পারি?

আমি মাথা নাড়ালাম। উনি আমার হাত ধরে পানি দিয়ে ধুয়ে দিলেন, আর বুঝিয়ে দিতে লাগলেন কিভাবে কি করতে হয়! হাতের কোষে পানি নিয়ে আমাকে কুলি করিয়ে দিলেন, ওযু শেষ করে তার সাথে নামাযে দাড়ালাম। মনে হল ভীষণ ভালোলাগায় ডুবে আছি। মনটা অনেক ফ্রেশ আছি। দোয়া-সূরা কিছুই পারিনা, মন দিয়ে উনাকে অনুসরণ করে নামায পড়লাম।

উনি কিছু যিকির শিখিয়ে দিয়ে বললেন, এগুলো সবসময় পড়বেন।
চোখ বন্ধ করে কয়েকবার যিকির পড়ার পর চোখ খুলে দেখলাম উনি আমার পাশে নেই। এত তাড়াতাড়ি উনি কোথায় উধাও হলেন!

উঠে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে ব্যালকুনিতে এসে দাড়ালাম। সূর্য তার লালচে আভা নিয়ে পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে। পাখিগুলো কিচিরমিচির শুরু করেছে। ভীষণ ভালোলাগছে।
কখনোই এত সুন্দর সকাল দেখিনি আমি। ঘড়ির দিকে তাকালাম রুমে এসে, এতক্ষণে বোধহয় সবাই উঠে পড়েছে। আজ সবার জন্য নিজের হাতে চা-নাস্তা বানালে মন্দ হবেনা। এই ভেবেই শাড়ি পালটে বড় ঘোমটা টেনে নিচে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম।

কিন্তু বানাব টা কি? আমি তো কোনো রান্না ই জানিনাহ। চা টাই বানাই তাহলে। একটু-আধটু জানি কিভাবে বানায়! করিম চাচা যখন চা বানাত, চোখ বড় বড় করে দেখতাম।

পানিতে চা-পাতা দিয়ে চুলার উপর বসালাম। রঙ ধরছে না দেখে রাগ উঠে গেল, চুলা থেকে নামিয়ে আরো পানি ঢেলে আবার বসালাম কিন্তু হচ্ছেনা। রেগে যেই পানি বাহিরের দিকে ছুড়ে ফেললাম। সবটা গিয়ে উনার গায়ে পড়ল।
মুখ লাল করে আমার দিকে তাকালেন উনি। আমি জিভ কেটে বললাম,
~ স্যরি।

~ এভাবে কেউ চা বানায়? চা ও বানাতে জানেন না?
~ শিখিনি। মা ও শিখায়নি।
~ গুন্ডামিটা তো কেউ শিখিয়ে দেয়নি।
~ বেশি বলে ফেলছেন কিন্তু।
~ পানি গরম করুন।
~ কিহ?

~ বলেছি পানি গরম করতে। সেটাই করুন চুপচাপ।
উনার কথামত আবার পানি চুলায় বসালাম। এক এক করে সব বলে দিলেন পাশে দাঁড়িয়ে। সব করে দেখি চা তো পুরো কমপ্লিট।

উনার দিকে তাকিয়ে বিজয়সূচক হাসি দিলাম। উনি তার তোয়াক্কা না করে বিড়বিড় করতে করতে উপরে চলে গেলেন। আমিও মুখ ভেঙ্গিয়ে দিলাম বেশ করে।

চা ঢেলে কাপ নিয়ে দাদুর রুমে আসলাম। দাদু তখন তসবীহ গুনতে গুনতে জানালায় মুখ রেখে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, আরেহ আমার জান্নাতী হুর যে!
~ শুভ সকাল দাদু। এই নাও তোমার চা।

~ আহ! আমার জন্য চা করে এনেছো।
চুমুক দিতে দিতে বললেন, বাহ, বেশ ভাল হয়েছে। তুমি কি করে জানলে আমার কড়া লিকারের চা খুব পছন্দ?
কি বলব ভেবে না পেয়ে বললাম, উনি বলেছেন।

~ আমার নাতীটা তাহলে তোমার সাথে ভালোই মিলে গেছে।
ও তো আবার মানুষদের সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করে।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক বুঝলাম না। মানুষদের সাথে মিশতে মানে?
দাদু আমার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলেন। কিছুটা সময় চুপ থেকে বললেন,
~ অনেকে আছেনা, যারা বাহিরের মানুষদের সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করে। ও ও এমন। বাহিরের কারো সাথে তেমন মিশে নাহ।

আমি মনে মনে বললাম, অস্বস্তিবোধ করেনা ছাই। সুযোগ পেলে ঠিকিই গলায় ওরনা, ছুরি ধরে ভয় দেখাতে পারে। ছিচকে ব্যাটা একটা।

আমি উত্তরে মুচকি হেসে বললাম, জ্বি বুঝেছি।
এমনসময় ফুপি দাদুর রুমে ঢুকে বলল, বাবা, তোমার চা দিতে দেরী হল। আজ দেরী হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠতে। দাড়াও আমি এক্ষুনি বানিয়ে আনছি।

~ ব্যস্ত হস না রোকেয়া। আমার নাতবউ আমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে।
~ আহা! আসামাত্রই তুমি আবার রান্নাঘরে ঢুকতে গেল কেন?

আমি বিনয়ের স্বরে বললাম, খুব ইচ্ছে হল সবাইকে নিজ হাতে চা বানিয়ে খাওয়াব তাই ঢুকেছিলাম। দাদু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
~ আজ থেকে এই সংসার তোমার। তোমার যা ইচ্ছে হয় করবে। নিজের মত করে আগলে রাখবে।

সবচেয়ে বড় জিনিসটা হল আমার নাতী। ওকে সবসময় আগলে রেখো। এতদিন ওকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার উপর ছিল, আজ থেকে সেই দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। আমি আর কয়দিন এই দুনিয়ায় আছি বলো!
বলতে বলতে কান্না শুরু করলেন। আমার ভীষণ খারাপ লাগল।

আমি উনার হাত জড়িয়ে বললাম,
~ এসব বলোনা দাদু। তুমি যা চাও, তাই হবে।
আমাকে যখন দায়িত্ব দিয়েছো, সেটা আমি পালন করব।

ফুপি শান্ত গলায় বলল, এভাবে বলছো কেন বাবা? আমরা কি মরে গেছি নাকি! তোমাত মুহিবকে আমরা দেখে রাখব। তুমি এভাবে বলোনা তো, বেচারি ঘাবড়ে যাবে।
দাদু চোখ মুছে বলল, মুহিবের কোনো কথায় কষ্ট পেয়োনা ওয়াফাহ। ওর সবার মত না, একটু অন্যরকম। রাগী ঠিক ই, তবে মনটা অনেক ভালো।

একদিন ঠিকিই বুঝবা।
ও ভালোবাসার কাঙ্গাল, একটু ভালোবেসো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে বুঝে নেওয়াটাও সহজ হবে।
আমি চুপ করে মাথা নাড়লাম। ভালোবাসা সেটা আবার আমাকে দিয়ে, কল্পনার বাহিরে আমার। বুঝতে পারছিনা কি করব। ভাবনা কাটিয়ে বললাম,
~ ফুপি চা দিব?

~ হ্যা দাও। চা ছাড়া আমার সকাল হয়না।
আর শোনো, মুহিবকে উপরে চা পাঠিয়ে দিও।
আমি মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম। উনার জন্য চা নিয়ে গেলাম। দেখলাম ব্যালকুনিতে বসে কি নিয়ে যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললাম, আপনার চা।
~ রেখে যান।
~ পারবনা, হাতে নিন।

~ পাশে রেখে যেতে বললামনা।
~ বললাম না পারবনা। হাতে নিন।
বিরক্তমাখা মুখ নিয়ে হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে বললেন,
~ শান্তি? এবার আসুন আপনি।

~ নাহ শান্তি হয়নি। চা টা কেমন হয়েছে খেয়ে বলুন।
~ ভালো হয়েছে।
~ না খেয়েই বলে দিলেন।

~ রেসিপিটা যেহেতু আমার, সবকিছু হাতে হাতে করে দিয়েছে খারাপ হবার প্রশ্ন উঠেনা।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ” এই শুরু হল খোচা মারা। একটু না হয় দেখিয়ে দিলি, তার জন্য এত খোচাবে! এই ব্যাটার দ্বারাই সম্ভব এসব।”
আমার বিড়বিড় করা দেখে বললেন, বেশি খোচা সহ্য করতে না চাইলে তাড়াতাড়ি ফুপির থেকে এসব শিখে নিন। আপনার জন্য ই ভালো।

আমি আর এক মূহুর্ত ও দাড়ালাম না সেখানে। এর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছি আজ। যে আমি নিজের হাতে পানি নিয়ে খেতামনা কখনোও, সে আমি সবার জন্য চা বানাচ্ছি। নিজেকে বাড়ির বউ হিসাবে উপস্থাপন করছি। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত।

সত্যিই কি গুন্ডিরুপ ছেড়ে আমি এখন সংসারী হচ্ছি? নিজেকে অই ব্যাটার বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি!
ছোট পুকুরের ধারে বসে এসব ভাবছিলাম। এমনসময় মনে হল, পাশে কেউ এসে বসল। তাকিয়ে দেখি সে মেয়েটা যাকে কাল দরজা খুলতে দেখেছি।
এর পর আর আলাদা করে কথা হয়নি।

সে পাশে বসে বলল,
~ ভাবি কি ভাবছো?
~ তেমন কিছুনা। শুধু ভাবছি আপনার সাথে পরিচয় হলনা ঠিকমত।
~ আমি মুহিবের ফুফাতো বোন রুকাইয়া। একসাথেই বড় হয়েছি দুজন। আমার সাথেই তো মুহিবের বিয়ে ঠিক হয়েছিল।

মাঝখানে এখন সব এলোমেলো।
তবে আমি এখনো মুহিবকে খুব ভালোবাসি।
এসব বলার সময় আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। কি অনর্গলে বলে যাচ্ছে এসব! মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, এসব খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

আমি উত্তরে মুচকি হেসে বললাম, ওহ।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেমন জানি খারাপ লাগছে ভাবতে ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। নিজেকে ঠিক বুঝতে পারছিনা কেন এমন হচ্ছে আমার।

প্রতিদিনের মত উনার সাথে মনমত ঝগড়া বাধিয়ে সোফায় ঘুমাচ্ছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রথমে ভুল শুনেছি বলে পাত্তা দিলামনা। কিন্তু কান্নার শব্দ টা তীব্র হতেই উঠে বসলাম। ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখলাম উনি বিছানায় নেই।

এইদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি ব্যালকুনির রঙ বেরঙ্গের আলোগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। উঠে ব্যালকুনিতে এলাম। এসে দেখি উনি দোলনায় বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছেন। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, এত রাতে উনি এভাবে কাদছেন কেন? ডাকার সাহস হচ্ছেনা আমার।

ডাকব কি ডাকব না ভাবতে ভাবতে উনার পাশে গিয়ে বসে উনার কাধে আলতো করে হাত রাখলাম। উনি টের পেয়ে আমার দিকে তাকালেন।
আলোতে দেখতে পেলাম কান্নাভেজা চোখগুলো হালকা ফুলে লাল হয়ে আছে। নাক-মুখ ও টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে আপনার?
উনি কোনো কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলেন। আমার খুব কান্না পাচ্ছে উনার এই অবস্থা দেখে।

বেশ কিছুক্ষণ পর উনি আমার থেকে নিজের ছাড়িয়ে নিলেন। চোখ-মুখ মুছে কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিছন থেকে অনেকবার ডাকলাম কিন্তু ফিরেও তাকালেননা।

আমি হতাশ হয়ে দোলনায় বসে পড়লাম। নিজের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। উনার আসলে কি হয়েছে না জানা অবধি শান্তি পাচ্ছিনা। এভাবে এত রাতে হুট করস কোথায় চলে গেলেন উনি।
সারারাত ব্যালকুনিতে বসে রইলাম, কিন্তু উনি আর ফিরলেন না।

পর্ব ১১

কাধে পড়া থাকা শাড়িটা কিছুটা ভিজে আছে। হাত দিয়ে দেখলাম এটা উনার চোখের পানিতে ভিজে গেছে। ছেলেটা এত কাদছে কেন? কিসের এত কষ্ট তার?

ভেতরটা কেমন ছটফট করতে লাগল। ভোর হয়ে আসছে উনি এখনো ফিরলেননা। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম, উনি যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন। এমনসময় ফজরের আযান দিল।

এই কয়দিনে নামায পড়া কিছুটা আয়ত্ব করতে পেরেছি। উঠে ওযু করে নামায পড়লাম। মোনাজাতে আল্লাহকে বললাম,
” উনার সব কষ্ট দূর করে দিন আপনি।

আপনি তো রহমতের মালিক, সবার সৃষ্টিকর্তা, আপনি চাইলে কিনা করতে পারেন। আমরা তো কেবল আপনার বান্দা। আজ আপনার কাছে হাত পেতে এক নিকৃষ্ট বান্দী তার স্বামীকে সহীহ সালামতে ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করছে। আপনি তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না। উনাকে নিরাপদে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।”

মোনাজাত করতে করতে যখন যে চোখের পানি ঝড়ে হাতে পড়ল বুঝতে পারলামনা। এটাও বুঝতে পারলামনা, আমি কাদছি কেন? এই প্রথম মোনাজাতে কারো জন্য চোখের পানি ফেললাম। ভাবতেই সশব্দে কান্না পেয়ে গেল। কান্না চেপে রাখতে না পেরে সিজদায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।

এমন সময় রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠল। উনি ফিরে এসেছেন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।

উনি ঠিকিই বলেছেন, কেউ যদি আল্লাহর কাছে হাত পেতে কিছু চায়, উনি তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। শোকরানাস্বরুপ আরো দুই রাকাত নফল নামায পড়লাম।

তারপর উঠে ছুটে গেলাম শোবার রুমে। উনি ক্লান্তিমাখা মুখ নিয়ে বালিশে মুখ রেখে আড়াআড়িভাবে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। সেই মূহুর্তটা আমার জন্য যে কেমন আনন্দের ছিল, তা ভাষায় প্রকাশের নাহ। মানুষটার মুখ কেমন লাল হয়ে আছে, চোখটা ফুলে আছে, ক্লান্তিভরা আবেশ মুখে সবমিলিয়ে অন্যরকম লাগছিল তাকে। ইচ্ছে করছিল মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুমু একে দেই।

ছি! ছি! এসব কি ভাবছি আমি। দিন দিন কি সব লজ্জা উঠে যাচ্ছে আমার।
ঘুমোন উনি, আমি বরং উনার জন্য একটা কফি বানিয়ে রাখি। উঠে খেলে ক্লান্তিটা কমে যাবে।

রান্নাঘরে চা-কফি বানাতে গেলাম। খুশি হয়েছি ঠিকিই তারপরো মনটা ভার হয়ে আছে। কাজ করতে করতে কেমন জানি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি, চোখের সামনে উনার কাদার দৃশ্যগুলো ভাসছে শুধু। উনি ঘুম থেকে উঠলেও উনাকে এসব জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হবেনা, আর আমার-উনার এমন রিলেশান নেই যে উনি নিজে থেকে আমাকে কিছু বলবেন।

তবে কিভাবে জানব উনি কেন কেদেছিল? না জানা অবধি তো শান্তি পাচ্ছিনা। আসল ব্যাপারটাই বুঝতে পারছিনা আমি কেন উনার ব্যাপারে এত সেন্সিটিভ? উনি কাদুক বা হাসুক তাতে আমার কি এসে যায়?
তাহলে কেন এমন হচ্ছে? উনার কান্নার কথা মনে পড়লে মনে হয় কলিজাটা ফেটে বুক ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। আচ্ছা দাদু কি এসব ব্যাপারে কিছু জানেন?

উনি কি বলতে পারবেন কেন কাদছে!
চা নিয়ে দাদুর কাছে গেলাম। উনি কুরআন তিলওয়াত করছিলেন, আমাকে দেখে সেটা গুছিয়ে রেখে চাটা হাতে নিলেন। আমাকে এমন অন্যমনস্ক দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে দাদু তোমার? এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে যে?
~ একটা ব্যাপার নিয়ে খুব চিন্তিত আমি দাদু। ব্যাপারটা মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছিনা। তাই একটুও শান্তি লাগছেনা।

~ কি ব্যাপার? আমাকে বলতে পারো?
~ কাল মাঝরাতে উনাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে দেখলাম। কিন্তু হুট করে কিছু না বলে কান্নারত অবস্থায় ই বের হয়ে গেলেন। ভোরে নামায শেষ হওয়ার পর রুমে আসলেন। উনার কান্নাটা দেখে মনে হল উনি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন।

অনেক দুঃখ তার।
~ আসার পর তুমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেছো?
~ না দাদুহ। আমার নামায শেষ হতে হতে উনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই আর বিরক্ত করিনি। আপনি কি জানেন এর কারণ কি?

দাদু কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন,
~ আর বলোনা, ও হয়ত কোনো বাজে স্বপ্ন দেখেছে। ও তো মাঝে মাঝে এমন করে। খারাপ স্বপ্ন দেখলে অনেক কান্নাকাটি করে, বাসা থেকে বেরিয়ে এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটতে থাকে। মন হালকা হলে বাসায় ফিরে ঘুম দেয়।

আমার মনে হয় তেমনি কোনো বাজে স্বপ্ন দেখেছে তাই এমন করেছে।
তুমি চিন্তা করোনা।
~ আচ্ছা। বলে মাথা নাড়ালাম। দাদু বলাসত্ত্বেও আমার মনের খুতখুত টা যাচ্ছেনা। খারাপ স্বপ্ন দেখে কেউ এভাবে কাদতে পারে জানা ছিলনা।

দাদু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ ওকে এসব নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করোনা। মনে পড়লে মন খারাপ করে থাকবে। আর আগেও বলেছি ও একটু অন্যরকম। সামান্য ব্যাপারগুলোতে ও খুব সিরিয়াস। যাই হোক, তুমি টেনশান করোনা।
আমি ছোট মুচকি হেসে দাদুর রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এতক্ষণে বোধহয় ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সেই ভেবেই কফি নিয়ে রুমে ঢুকলাম। উনি তো এখনো ঘুমাচ্ছে। রাতে ঘুম ভালো হয়নি নিশ্চয়ই।

কফিটা ঢাকা দিয়ে বেডটেবিলের পাশে রেখে চলে যাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি উনি বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন।
উনার মাথার পাশে বসে শোনার চেষ্টা করলাম।
উনি বিড়বিড় করে বললেন, মাথায় একটু হাত বুকিয়ে দিবা?

শুনে চমকে গেলাম। এই প্রথমবার আমাকে উনি তুমি বলে সম্বোধন করলেন। জানিনা কথাটায় কেমন টান ছিল। সে টান উপেক্ষা করতে না পেরে হাত দিবনা দিবনা ভেবে দিয়ে ফেললাম। হাত দিয়ে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।

একি জ্বরে তো উনার গা পুড়ে যাচ্ছে। এত জ্বর নিয়ে উনি এভাবে শুয়ে আছেন?
দেরী না করে উনার গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিলাম। জলপট্টি এনে মাথায় লাগালাম।

কিন্তু জ্বর একটুও কমল না বরং তার হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। উনি জ্বরের ঘোরে খুব ফোপাচ্ছিলেন। দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। ইচ্ছে করছিল কোনো ম্যাজিক করে উনাকে এক্ষুনি সারিয়ে তুলি।
দাদু এসে উনার এ অবস্থা দেখে ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তার এসে দেখে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন। তাও অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছিলনা।

সারারাত উনার মাথার পাশে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর পর মাথায় জলপট্টি দিলাম, ওষুধ খাওয়ালাম। একমিনিটের জন্যও চোখের পাতা এক করিনি।

রাতে হঠাৎ উনি আমার হাতটা উনার উষ্ণ বুকের সাথে জোরে চেপে ধরে বললেন,
~ ওয়াফাহ ভালোবাসা কি সেটা আমি জানিনা। কিন্তু তোমাকে আমার ভালোলাগে, অনুভব করি। আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস, সুখ-দুঃখের অংশীদার তোমাকে করতে চাই। আচ্ছা তুমি অনুভব করো আমাকে?

আমি ফ্যালফ্যাল করে উনার মুখের দিকে তাকালাম। কি নিষ্পাপ চেহারা! নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, হ্যা করি। ভালোবাসি কিনা জানিনা তবে আমার প্রতিটি মোনাজাত আপনাকে ঘিরে। সব ভাবনা আপনার ভালো-খারাপ নিয়ে।

~ আমাকে ছেড়ে যাবেনা তোহ?
~ কখনোই নাহ। বলে উনার প্রশস্ত কপালের চুল সরিয়ে কাপা কাপা ঠোট দিয়ে ছোট একটা চুমু দিলাম। আস্তে আস্ত্র তার জাপটে ধরে রাখা হাত আলগা হয়ে আসছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন।

হয়ত জ্বরের ঘোরে উনারা এসব কথা বলা। কিন্তু আমি সব মন থেকেই বলেছি। সত্যিই উনাকে নিয়ে আমি প্রচন্ড ভাবি, আমার প্রতিটা মোনাজাতে উনি থাকেন। উনাকে ছাড়া আমার সময়গুলো অচল। পুরো একটা দিন ঝগড়া করিনি, উনার মুখে গুন্ডি ডাক শুনিনি, উনার রেগে যাওয়া লাল টমেটো চেহারাটা দেখিনি তাতেই মনে হচ্ছে আমি প্রচন্ড রকমের রিক্তশুন্য। নিজের পৃথিবীতেই নেই।

চোখ আর টলছেনা। মনে হচ্ছে আমি অনেকদিন ঘুমাইনি। কিছুতেই খোলা রাখতে পারছিনা। ২দিন না ঘুমিয়ে থেকে কেমন জানি শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। বেশিক্ষণ আর চোখ খোলা রাখতে পারলামনা।

ঘুম ভাঙ্গতেই আমি নিজের উনার বুকে আবিষ্কার করলাম। উনার ঠোটজোড়া আমার কপালের সাথে লাগোয়া, এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন।
আমি উনার বুকে মাথা গুজে আছি।

আস্তে করে উনার হাত সরিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে কি করে ফেললাম নিজেও বুঝতে পারলামনা। উনি যদি দেখতেন কি ভাবতেন।
তাড়াতাড়ি শাড়ি পালটে নিচে চলে গেলাম উনি উঠে পড়ার আগেই। উনার সামনে পড়লে লজ্জার শেষ থাকবেনা।

পর্ব ১২

সন্ধ্যার দিকে জ্বর সারতেই উনি একটু বের হলেন। সারাটাদিন আমার সাথে তেমন কথা বললেননা, ঝগড়াও করলেননা। কেমন জানি থ মেরে আছেন। আমি সেধে সেধে কতবার কথা বললাম।

হু, হ্যা, ওহ ছাড়া কোনো প্রতিউত্তর করলেননা। শুধু তার উপর আমার রাগ ই হলোনা, প্রচন্ড অভিমানও হচ্ছিল।
কেন উনি এমন করছেন বুঝতে পারলামনা? উনি কি তবে কাল রাতে আমার বলা কথাগুলো শুনে রিয়েক্ট করলেন।

হুট করে কিছু না বলে অসুস্থ শরীর নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। খুব ছটফট করছি ভিতরে ভিতরে। কখন ফিরবেন উনি? সময় যেন কাটছে ই না। ব্যালকুনিতে দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে ২দিনের প্রতিটা ভালো মূহুর্তগুলো স্মরণ করছি। কত ভালো ছিল সময়গুলো! যদি যেকোনো মূল্যে আবার ফিরে পেতাম।
ভাবতে ভাবতে গাল বেয়ে পানি ঝড়ছিল।

এমনসময় ফিল করলাম কেউ আমার গলার খুব কাছাকাছি আছে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার গলায় এসে পড়ছে। প্রতিটা নিঃশ্বাস আমাকে ছুয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আমি কেপে কেপে উঠছি। চোখ খুলতে যাব তখনি সে ফিসফিস করে বলল, একদম চোখ খুলোনা। অনুভব করো।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তার নিঃশ্বাস ফিল করছি। খানিকটা পর, সে আমার হাত ধরে উঠাল। চিরচেনা কন্ঠে গুনগুন করে বলল, আমি বলা ছাড়া চোখ খুলবেনা।
হাত ধরে আমাকে নিয়ে চলল সে। কিছুক্ষণ পর বলল,
~ আস্তে আস্তে চোখ খুলো।

আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি রুমের মেঝেতে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো, সারি সারি রঙ্গিন মোমবাতি দিয়ে “ভালোবাসি” লেখা। অবাক হয়ে মুখে হাত দিতেই আমার গায়ের উপর বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি ঝরতে লাগল। খুশি হয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই উনি সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাত তার হাতে রেখে ৩বার ভালোবাসি বলল। আমি শুনে খুশিতে কেদে দিলাম, উনার বুকে মুখ গুজলাম।

উনি আমার থুতনিটা হাত দিয়ে তুলে বলল, আমায় ভালোবাসো গুন্ডি?
উনার বুকে মাথা রেখে বললাম, প্রচন্ড ভালোবাসি। আপনি আমাকে চিমটি কাটুন প্লীজ।
~ চিমটি কাটব কেন? আমি মাথা তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আমার সবটা খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, কিচ্ছুক্ষণ পর ঘুমটা ভেংগে গেলে স্বপ্নটা আর দেখতে পাবনা।

~ এটা স্বপ্ন নয় একদম সত্যি। কাল রাতে আমি কোনো কথাই জ্বরের ঘোরে বলিনি শুধু তুমি কি উত্তর দাও সেটা জানতেই বলেছি। তোমার ঝগড়া, ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চামীর প্রেমে পড়ে গিয়েছি আমি। বিশ্বাস করো, মন থেকে টান অনুভব করি তোমার জন্য। কখন যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি সেটা সত্যিই জানিনা।
~ এই গুন্ডিটাও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে।

~ কতটা?
~ তার গুন্ডামির চেয়েও বেশি। শুনে মুক্তঝরা হাসি দিয়ে আমাকে কোলে তুলে ঘুরাতে লাগলেন উনি। আমি ভয় পেয়ে উনার গলা শক্ত করে জড়িয়ে বলল,
~ নামান আমাকে!
~ কেন?

~ যদি আছাড় মেরে ফেলে দেন😭
~ পাগলীটাহ। অহ হ্যা, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
~ কিহ সারপ্রাইজ?
~ দেখবে?

~ হুম দেখান। উনি আমাকে কোল থেকে নামিয়ে ব্যালকুনির দরজা লক করলেন, তারপর রুমের দরজা লক করে আমার পাশ ঘেষে দাড়ালেন। কি করবেন উনি দরজা লক করে? আমার কেমন জানি শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে, হাত-পা কাপাকাপির পর্যায়ে চলে গেছে। এটা ভয় নাকি শিহরণ বুঝতে পারছিনা! একটা মোম জ্বালিয়ে রেখে বাকি মোমগুলো সব নিভিয়ে দিলেন। আমি চুপচাপ উনার কর্মকান্ড দেখতে লাগলাম।

আজ উনি স্বামীত্ব ফলাতে চাইলেও আমি বাধা দিবনা। আমার সম্পর্ক টা খুব পবিত্র, আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি। ভীষণ শিহরণ কাজ করছে আমার মধ্যে কেন জানি আমিও চাচ্ছি আমাদের সম্পর্ক টা পাঁচ-দশটা সাধারণ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে পরিনত হোক।

এই প্রথমবার আমাকে উনি খুব আদুরে গলায় বউ ডেকে বললেন, তাকিয়ে দেখো। বউ শব্দটা শুনে সেদিনের মত চমকে উঠলাম, আজ সেদিনের মত অবাকতা নয় ভীষণ ভালোলাগা কাজ করছে। অতিরিক্ত শিহরণ আর উচ্ছ্বাসে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। উনার কথা শুনে সাথে সাথে চোখ মেলে দেখি, সারারুমে জোনাকি পোকা উড়ছে। হলদে আলোয় পুরো রুমটাকে তারা ভরা আকাশ মনে হচ্ছে। ঘুরে ঘুরে শুধু জোনাক গুলো দেখছিলাম, মিছে মিছে ছুতে চেষ্টা করছিলাম।

উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, পছন্দ হয়েছে তোমার?
~ ভীষণ। বলে উনার দিকে তাকালাম, উনি হাতের কোষে একটা জোনাকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার হাতে ওটা দিয়ে দিলেন।

আমার ঘোর যেন এখনো কাটছেনা।
উনি হালকা রোমান্টিক সুর ছেড়ে দিলেন রেকর্ডারে। আমার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলেন, আমি হাত রাখতেই এক টানে তার বুকের কাছে নিয়ে আসলেন। আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

আমি আমার কাপা হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরলাম। উনি উনার মুখ আমার মুখের আরো কাছে নিয়ে আসলেন। এতটাই কাছে যে উনার লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার নিঃশ্বাস আমার মুখে পড়ছে, শুনতে পাচ্ছিলাম তার নিঃশ্বাসের শব্দ, অনুভব করতে পারছিলাম তার বুকের ধুকপুকানি।

মুহিব তার ঠোট টা আমার ঠোটের কাছে এনে আলতো করে ছুয়ে দিলেন।
আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তার শার্ট এর পিছনের অংশ শক্ত করে চেপে ধরলাম। উনি আস্তে করে ছোয়াছুয়িটা তীব্র করে তুললেন। আমি তার গলার নিচে মুখ লুকিয়ে ছোট্ট একটা চুমু খেলাম। উনি আমার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে দিলেন। হারিয়ে গেলাম এক অজানা শিহরণে।

ব্যালকুনিতে বসে একসাথে দোল খেতে খেতে চাঁদ দেখছি। ও সযত্নে আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে চুলে, কপালে চুমু খাচ্ছে। আমি তার আঙ্গুলের ফোকরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরে রাখলাম।

নিজেক্স ভীষণ সুখী মনে হচ্ছে। এত ভালোবাসে ছেলেটা আমায়! কি ছিলাম আর আজ কি হয়ে গেলাম। আগে পরিচয় ছিল এক গুন্ডি, এখন পরিচয় মুহিবের বউ। এক গুন্ডির জীবন বদলে দিল ছেলেটা।
শাড়ির আচল থেকে সিগারেট টা বের করে হাতে নিলাম। মোমবাতির আগুনে জ্বালিয়ে নিলাম। ও হাল্কা কপাল কুচকে বলল,
~ তুমি এসব খাও?

~ উহু।
~ তাহলে এটা তোমার কাছে কেন?
~ আমার বান্ধবীরা বলত এটা খেলে নাকি ডিপ্রেশন কমে। তুমি বাসায় ফিরছিলেনা তাই খুব ডিপ্রেশনে পড়ে গিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম খাব।

আমার হাতটা জ্বলন্ত সিগারেট টা কেড়ে নিচে ফেলে দিয়ে এক টানে কাছে টেনে বলল, তোমার ডিপ্রেশনের কারণ ও হব, ওষুধ ও হব। এসব আর চলবেনা বুঝচ্ছো।

বলে ঠোটে ঠোট ছুয়ে দিল। সে কখনো জানবেনা, এমন একটা স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। কেউ একজন আমার হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ছুড়ে ফেলে বলবে, এসব আর চলবেনা বুঝচ্ছো! স্বপ্নটা পূরণ হবে কিনা জানতেই প্রথমবার সিগারেট হাতে নিলাম।
জ্বলতে থাকা সিগারেট ছাই হয়ে নিভে যায়, আর চাদটা আমাদের দেখে লজ্জা পেয়ে মেঘের আড়ালদ মুখ লুকালো।

ভোররাতে উঠে দেখি বরটা আমার আচল জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল, মুচকি হেসে আচল ছাড়িয়ে নিচে নেমে এলাম। পানির তৃষ্ণা পেয়েছে খুব, টেবিল থেকে পানি নিয়ে খেলাম। ফিরে আসব তখনি দেখি দাদুর রুমের আলো জ্বলছে। এখনো তো আযান দেয়নি তাহলে দাদুর রুমের আলো জ্বলছে কেন?

দাদু কি এখনো ঘুমায়নি! আমি নিঃশব্দে দাদুর রুমের পাশে এসে উঁকি মারলাম।
যা দেখলাম তাতে আমি ভীমড়ি খেয়ে পড়লাম। কি করব বুঝতে পারছিনা।

পর্ব ১৪

আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালাম। চোখ খুলে চিরপরিচিত দেয়ালটা দেখলাম, একটু হুশ ফিরতেই বুঝলাম আমি আমাদের রুমে শুয়ে আছি। মাথাটা ভার হয়ে আছে এখনো।

আমার মুহিব কোথায়? এদিক, সেদিক তাকিয়ে ওকে খুজতে লাগলাম। বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বের হওয়ার সময় দেখি ফুপি আর রুকাইয়া আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞেস করলাম,
~ ফুপি, মুহিব কোথায়?

উনি আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। আমি ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। উনি দাত কড়মড়িয়ে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে বললেন,
~ নিজের জামাইটারে নিযে খুন করে আইসা এখন ঢং দেখায়।
~ এসব কি বলছেন ফুপি?

~ চুপ, তোরে চেনা হয়ে গেছে। গুন্ডা মাইয়া, যার জন্মের কোনো ঠিক নাই। আসছে এত বড় সম্পত্তির মালিক হইতে। ভেবেছিস মুহিবকে বিয়ে করে গোটা সম্পত্তিটা হাতিয়ে নিবি। রুকাইয়া পাশ থেকে বলল,
~ আমার মুহিবকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে শয়তানী। নাহলে আমিই ওর বউ হয়ে সব সম্পত্তির রাজত্ব করতাম।

~ ফুপি, আমার ব্যথা লাগছে। আমার চুল ছেড়ে দিন।
~ ব্যথা তো এবার লাগবে, তোরে এখন পুলিশে দিব আমি মুহিবকে মেরে ফেলার দায় দিয়ে। তখন বুঝবি আসল ব্যথা কাকে বলে!
~ আমি আমার স্বামীকে মারিনি।

~ সেটা কেউ বিশ্বাস করবেনা, উচু ডিবি থেকে তুই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিস। তারপর জ্ঞান হারানোর নাটক করলি যাতে তোকে কেই সন্দেহ না করে। এখুনি আমি পুলিশকে ফোন দিচ্ছি।
~ ফুপি, এমন নীচ অপবাদ আমাকে দিবেননা। আমি আমার স্বামীকে মারিনি।
~ তোকে ছেড়ে দিব কেবল এক শর্তে।

তুই একটা কাগজে স্বাক্ষর করে জবাবদিহি দিবি মুহিব মরে যাওয়ার পর তোর নামে যে সব সম্পত্তি হস্তান্তর হবে সব আমার নামে লিখে দিচ্ছিস।
~ আমার মুহিব মরেনি।

~ মুহিব মরে গেছে আর তাকে তুই মেরেছিস। এখন ভালোই ভালোই সই করে দে।
অত্যাচার করে অবশেষে সই টা নিয়েই নিল। আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই বাড়ির ত্রিসীমানায় তোকে যাতে আর না দেখি। বেরিয়ে যা।
রুকাইয়া নিচু গলায় বলল,
~ মা, ওকে এই বেশে ছেড়োনা।

ও এখনো রঙিন কাপড়, গহনা পড়ে আছে এটা দেখে ও বিধবা সেটা সবাই কি করে বুঝবে। আর যদি না বুঝে তবে উকিল কিছুতেই হস্তান্তরের ব্যাপারটা দেখবেনা। আইন এখন অনেক কড়া, একটু ভুলের জন্য সব বানচাল হয়ে যাবে।
~ ভুল বলিসনি তো। ওকে ধরে সাদা শাড়ি পরিয়ে দে।

বিধবার বেশে বাড়ি থেকে বের করে দে। শত চেষ্টা করেও ওদেরকে আমাকে বিধবা সাজানোর জেদ থেকে নড়াতে পারলামনা। আটকাতে গিয়ে উলটো তলপেটে সজোড়ে লাথি খেয়েছি। গেইটের বাহিরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। সহ্য করে নিয়েছি চোখ বুজে, কেননা আমার বিশ্বাস আমার জ্বীনবর একদিন ঠিক আমার কাছে ফিরবে।

কিন্তু কবে!
প্রাণহীন দেহ নিয়ে মায়ের দরজায় গিয়ে দাড়ালাম। বারান্দায় ধপাস করে বসে ছোট করে বললাম, মা। মা আমার কন্ঠ শুনে প্রায় ছুটে এসেছিলেন আমার কাছে। লোকদেখানো মুখের রূঢ় ভাবটা নিমিষেই কান্না আর অবাকতায় পরিণত হল আমার বিধবার বেশ দেখে।

আমাকে বুকে টেনে বলল, তোর কপাল ও পুড়ল হতভাগী। স্বামীসুখ তোর কপালেও জুটলনা। আমি কিছু বলিনি, ছলছল করে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। কারণ মুহিব আমাকে বলেছে, ও ফিরে আসবে।
আর আল্লাহ যা করেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই করেন।

মায়ের কোনো কথার উত্তর দিলামনা। শুধু একটা কথা ই জিজ্ঞেস করলাম,
~ মা আমাকে একটু আশ্রয় দেবে তোমার কাছে। মুহিব আসলেই চলে যাব।

মা মুখে আচল চেপে অঝোড়ে কাদতে লাগলেন। হয়ত ভেবে নিয়েছে তার মেয়ে স্বামীশোকে পাগল হয়ে গেছে।
প্রতিটা দিন আমার মুহিবের অপেক্ষায় কাটে। এই বুঝি ও ফিরল, আচ্ছা ও কি জানবে আমি মায়ের কাছে আছি! ওই বাড়িতে না পেয়ে যদি ফ্যালফ্যাল কপ্রে কাদে! রোজ শ্বশুড়বাড়ির গেইটের সামনে থেকে ঘুরে আসতাম, ঢুকতে পারতামনা বলে ঘন্টার পর ঘন্টা বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম।

মা এসব দেখে কাদে আর আমার জন্য আফসোস করে। আমিও কাদি প্রতিটি মোনাজাতে। যাতে সেইদিনের মত আল্লাহ আমার মুহিবকে তাড়াতাড়ি আমার কাছে ফিরিয়ে দেন।

বোধহয় সঠিক সময়টা আসেনি, তাই এত দেরী করছেন আল্লাহ। মায়ের সাথে বসে বসে কাপড় সেলাই করি, পর্দা করে হাটে যাই। লোকে কটুক্তি করে, হাতটা শক্ত হয়ে আসে। কিন্তু তুলিনা কারো উপর। আমার জ্বীনবরকে যে আমি কথা দিয়েছি আমি কখনো গুন্ডামি করবনা আর।
একদম ওর ভালো বউ হয়ে থাকব। তাই নিজেকে পুরো পরিবর্তন করে ফেলেছি।
শুধু আমার মুহিবের ফেরার অপেক্ষা কেবল।

ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠে বসল মেয়েটি। গলা শুকিয়ে আছে ওর, শরীরটা কাপছে অনেক। ভয়ে আটসাট হয়ে আছে, বুকের ভিতর কেমন একটা চিনচিন করছে। কেউ একজন তার দিকে পানিভর্তি পিতলের গ্লাস এগিয়ে দিল।
একনিমিষে ঢকঢক করে পুরো পানি খেয়ে নিল মেয়েটি। সবটুকু পানি শেষ করে গ্লাস পাশে রেখে দিল। মহিলাটি তার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ কি হইসে সিমরান? শইল খারাপ লাগে?

~ না আমেনা বু। একটু খারাপ স্বপন দেখছি।
~ তোরে কতবার কই আজেবাজে চিন্তা করবিনা, হেসবে মাথার ঘিলু পাকাইয়া যায়। এর লাইগা বাজে স্বপন দেহোস।

আর শুন, কাল তোর একটা নতুন বাড়ীতে কাম হইব। ভালাই বেতন দিব কইল। তুই খালি মন দিয়া কাম করবি।
দেখবি খাওয়া-পরার অভাব হইবনা। আমার শইলটা দিন দিন খারাপ হইতাছে, কামে যাইতে পারিনা। দুইদিন ঘরে চাল বাড়ন্ত, কাইল বাজারে গয়া তোরে দেওন আগাম টাকা থেইকা কিছু সদাইপাতি কিনে আনিস।

মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। বুকের চিনচিন ব্যথাটা যাচ্ছদনা এখনো। এটা কি তবে আগাম বিপদের সংকেত!
নিজেকে নিজেই বুঝতে পারেনা সে, এসব ভেবে আর কাজ নেই। দুদিন পেটে ভাত পড়েনি তাই বুকে ব্যথা উঠছে। মন দিয়া মানুষের বাসার কাজ করলে তবেই পেট চলবে।

আমেনা বুর ও থেকে থেকে পেটে পীড়া উঠে। টাকার অভাবে ওষুধ কিনে খাওয়াতে পারেনা মানুষটাকে, পেটেই নাই ভাত ওষুধ এর চিন্তা করা তো ছেড়া কাথায় শুয়ে লাখটাকার স্বপ্ন দেখার মত।

বয়স তো কম হলনা, এই বয়সস মেয়েরা শ্বশুড়বাড়ি যায়। তাদের দিকে তাকিয়ে মনটা ছটফট করে। ইস! আজ যদি মা-বাবা থাকত, তবে আমিও টুকটুকে শাড়ী পরে শ্বশুড়বাড়ি যেতাম।
পরক্ষণে নাক-মুখ খেচিয়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ যসভাবে রেখেছে আমি সেভাবেই খুশি। চোখ আবার বুজে নেয় স্বস্তিতে। কাল যে নতুন বাসায় কাজ পেয়েছে, এইবার আর না খেয়ে থাকতে হবেনা।

পর্ব ১৫

তাওহীদ মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকায়।

চেহারা দেখে মনে হচ্ছেনা এ কোনো সাধারণ ঘরের মেয়ে। নীল ডাগর চোখ, সুশ্রী চেহারা যেন জ্যোতি ছড়াচ্ছে নূরের মত, মাথায় পুরনো ওড়না দিয়ে একহাত লম্বা ঘোমটা দেওয়ায় চুল দেখতে পেলনা সে।

আসলেই মেয়েটা একটা ফুটফুটে পরী, উচ্চবংশীয় পরিবারে জন্ম নিলে এতদিনে ছেলের লাইন পড়ে যেত। মেয়েটি অনবরত মাথা নিচু রেখে পা দিয়ে মেঝে খুটছে, অস্বস্তিবোধ করছে বোধহয়।
গলা ঝেড়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, সব কাজ করতে পারবেন তো?
~ জ্বি।
~ আমার সব কাজ রুটিন মেনে করতে হয়। রুটিনে হেরফের করলে আর কাজে রাখিনা। তাই এসব দিক একটু নজরে রাখবেন।
~ জ্বি আচ্ছা।

~ কেয়ারটেকার চাচার থেকে সব কাজ বুঝে নিয়ে যাওয়ার সময় আগাম কিছু টাকা নিয়ে যাবেন। এখন এক কাপ চা পাঠিয়ে দিন আমার রুমে, চিনি জাস্ট ২চামচ।
~ আচ্ছা। বলে মেয়েটি চলে যাচ্ছিল।
~ এই যে, আপনার নামটা কি?

~ সিমরান। তাওহীদের কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটি খুবই চটপটে, কিন্তু কোনো কারণে তার চাঞ্চল্যে ভাটা পড়ে গেছে। অবিবাহিত মেয়েকে সে কাজে রাখতে চায়না, কারণ সে মেয়েদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায়। আগের জনের বাচ্চা হওয়ায় কাজে আসতে পারেনা, কেয়ারটেকার চাচা ই বা আর কত দিক সামলাবে। প্রাইভেট কোম্পানীর সিইও সে, বাসায় তার দেখাশুনা করার জন্য কাউকে লাগে।

মা-বাবা বিদেশে থাকে, অবশ্য যোগাযোগ নেই। দুজনেই পরকিয়া করে আলাদা হয়ে গেছেন। তাই সে নিজের জীবন নিজে গুছিয়ে নিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি চা নিয়ে আসে। বাহ বেশ চালু আছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝলাম চিনি পরিমাণের বেশি দিয়ে ফেলেছে।
~ কয় চামচ চিনি দিয়েছেন?
~ চার চামচ।
~ আমি কয় চামচ দিতে বলেছি?

~ উমম, মনে হয় ২চামচ।
~ তাহলে?
~ মনের ভুলে দিয়ে ফেলেছি।
~ এত ভুল করলে আপনাকে কাজে রাখব কি করে?

~ এমনটা আর হবেনা স্যার। এরপর থেকে মন দিয়ে কাজ করব।
আশ্বাস পেলেও ভরসা পেলামনা। মেয়েটা পরে না আবার আমার চুল ছিড়তে বসে যায়। সিমরান কাজ শেষ করে বাজারের দিকে আসে। চায়ের দোকান গুলো না পের হতেই পিছন থেকে শিসের আওয়াজ আসে।

এটা নতুন কিছু নয়, বস্তির বখাটে ছেলে রাতিম রোজ তাকে উত্ত্যক্ত করে। প্রতিবার ই সিমরান সালাম দিয়ে সুন্দরভাবে বোঝায়। কিন্তু কিছুতেই লাভ হয়নাহ। তাই কানে না নিয়ে সোজা হাটতে থাকে। রাতিম পথ আগলে বলে,
~ তোকে যে ডাকছি শুনতে পাস না?
~ জ্বী শুনেছি। ডাকছেন কেন?

~ শুনেও সাড়া দিলিনা কেন? দেমাগ বাড়ছে তোর তাইনা?
~ আমার তাড়া আছে। আমেনা বু ঘরে অসুস্থ।
~ কি আমেনা বু কে নিয়ে পড়ে থাকিস? কতবার বলি আমায় বিয়ে কর। তোকে রাজরাণী করে রেখে দিব। মানুষের বাসায় খেটে কাজ করতে হবেনা।

~ তা আপনি কি করেন?
~ যা করি তাতে শুয়ে-বসে খেতে পারবি।
~ ছিনতাই, নেতাদের পা চাটা এটাই তো পেশা তাইনা?

~ সিমরান!
~ উত্তেজিত হবেননা। আল্লাহ তাকেই সাহায্য করে, যে নিজেকে সাহায্য করে। আপনি তো নিজেকেই সাহায্য করেননা, অন্যকে কি করে করবেন।

আসি, আসসালামু আলাইকুম।
পাশ কাটিয়ে চলে আসে সিমরান। রাতিম ফুসতে ফুসতে দোকানের আড্ডায় ফিরে যায়। তার এক বন্ধু হেসে হেসে বলল,
~ আজ ও রিজেক্টেড হলি?

~ আমারে হাদিস শুনায়, সৎচরিত্র দেখায় নিজের। কিন্তু কতদিন আর! খুব তাড়াতাড়ি এই দেমাগীরে আমার ঘরে তুলমু। সেদিন ওর সব ছুটামু আমি।

বাজার এনে রান্না চড়িয়ে দেয় সিমরান। আমেনা বেগম শুয়ে শুয়ে হাক ডাকে,
~ তুই এসেছিস?
~ হ্যা, বু। তোমার জন্য ওষুধ এনেছি।
উঠে বসোতো।

~ আবার শুধু শুধু টাকা নষ্ট করতে গেলি ক্যান? সামান্য অসুখ, সেরে যাবে।
~ আহা, আর কথা বলো না তো।
বলে সিমরান আমেনার বুর হাতে দুটো ওষুধ আর পানির জগ টা ধরিয়ে দেয়। সামনে দাঁড়িয়ে খাইয়ে তবে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

আমেনা বেগমের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। কত সুন্দর আর ভালো মেয়ে সিমরান! নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে কখনো নিজের প্রয়োজন মিটাবেনা। নিজের ভালোলাগা পূরণ করবেনা, তোর ভাগ্য যে কত খারাপ ভাগ্যের ফেরে এক ভিখারিনীর ঘরে এসে জুটলি।

ভালো ঘরে পড়লে তোর কোনোকিছুর কমতি হতনা। ভেবে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আগুনটাকে বড্ড ভাললাগে সিমরানের। রান্না করতে এসে নিষ্পলক আগুনের দিকে চেয়ে থাকা ওর অভ্যাস। তখন মনে মনে একটা প্রশান্তির ছোয়া পায় সে।
ইদানিং তার যেন কি একটা হয়েছে, নিজের মধ্যে পরিবর্তন খুজে পায় সে।

এসব স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক বুঝে উঠতে পারেনা।
শুধু অনুভব করে তার কিছু একটা হয়েছে।
ও ঘর থেকে আমেনা বুবুর ডাক আসে, তাড়াহুড়োয় চুলায় লাকড়ি ঠেলতে গিয়ে আগুনের আচ লাগে হাতে। কিন্তু যন্ত্রণা অনুভব করে না সে।

ইচ্ছে করছে পুরো হাতটা আগুনে ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু পরেরবার আবার ডাক পড়ায় উঠতে বাধ্য হয় সিমরান।
আমি উঠোনে রোদে বসে পুইশাক কুটতে ব্যস্ত। কাজের মধ্যে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। মুহিব আমাকে ছেড়ে গেছে আজ মাসখানেক হয়েছে। যে জায়গাটায় ওর সাথে প্রথম দেখা হয়েছে, সেটা চোখে পড়লেই কলিজায় কেমন একটা টান পড়ে, চোখগুলো ছলছল করে উঠে।

বিধবার বেশটা এখনো আমার শরীর থেকে সরাতে পারিনি। মা বার বার বলে, ৪মাস ১১দিন বিধবার বেশ গা থেকে মুছে ফেলতে নেই, স্বামীর কবরে আযাব হয়। যদিও আমি মনপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমার মুহিব মারা যায়নি। তবুও ওর কষ্ট হবে ভেবে পড়ে থাকি। মনের বিশ্বাসটাই বড় যেখানে আজ অবধি কেউ আচড় কাটতে পারেনি।

সেখানে শরীর বেশ দিয়ে কি হবে!
এমনসময় রাফির বাবা আমাদের উঠোনে এসে দাড়ালেন। আমি বড় করে ঘোমটা টেনে নিলাম। মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলেন, ঝাড়ু গেলে গদগদ হয়ে তার দিকে মোড়া এগিয়ে বললেন, গরীবের দুয়ারে হাতির পা। কি সৌভাগ্য আমার!
~ কেমন আছো?
~ আল্লাহর রহমতে আর আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি।

~ কাল তোমাদের জন্য যে চালের বস্তা, কিছু সদাইপাতি পাঠিয়েছি তা ঠিকঠাক মত পেয়েছো তো?
~ হ্যা, পেয়েছি। আপনি দয়া করে কত কিছু পাঠিয়েছেন এই অসহায়ের জন্য।
~ আরেহ দয়া বলছো কেন? এসব দয়া-ফয়া কিছুনাহ।

কাজ কর‍তে করতে আমি হাত থেমে যায়। কাল এত কিছু আসতে দেখে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে, এসব কোথা থেকে আসল।
উনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন, পরে জোরাজুরি করাতে বললেন,
~ জমানো টাকা দিয়ে কিনেছি।

মা আমাকে মিথ্যা বলল কেন? তাদের কথার দিকে আবার মনোযোগ দিলাম।
রাফির বাবা বিনয়ের সাথে বলল,
~ আমি আপনাদের সাথে আত্মীয়ের সম্পর্ক করতে চাই।

~ মানে বুঝলামনা। আমাদের মত নিঃস্বের সাথে কিসের আত্মীয়তা করবেন।
~ আপনি তো জানেন, আমার একমাত্র ছেলে রাফি এখন রাজনীতির বড় পদে আছে। ইনকাম ও সেই লেভেলের করে। বয়স তো হয়েছে ওর, চাচ্ছি বিয়ে করাতে।

ওর নাকি একটা মেয়েকে ইদানিং খুব মনে ধরেছে। আর ও তাকেই বিয়ে করবে। জানেন ই তো ছেলের থেকে বড় আমার কাছে কিছু নেই। তাই ওর মনের ভাব বুঝে আমিও রাজি হয়ে গেলাম। বিনা যৌতুকে, বিনা দাবিতে ওই মেয়েকে যেকোনো মূল্যে ঘরের বউ করব।

~ এ তো খুব ভাল কথা। তা মেয়েটা কে আফজাল সাহেব?
~ তোমার মেয়ে ওয়াফাহ। আমার রাফির সাথে একসময় দ্বন্দ ছিল ঠিকিই। কিন্তু রাফি এখন ওকে ভালোবাসে, ওকে বিনা শর্তে ঘরের বউ করতে চায়।

মা খুশিতে নেচে উঠে বললেন,
~ এ তো আমার কাছে স্বপ্ন। আপনাদের মন আসলেই অনেক বড়।
আমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই।

আমি আর স্থির থাকতে পারলামনা। হাতের বটিটা নিয়ে উনার দিকে ধেয়ে এসে উনার গলায় চেপে ধরলাম,
~ কি ভাবিস ব্যাটা! আগের মত গুন্ডামি করিনা বলে ওয়াফাহকে নিয়ে যা খুশি তাই করবি। তোদের এক একটাকে চেনা হয়ে গেছে শুয়োর।

আর কোনোদিন যদি এই বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখি ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দিব। যা ভাগ শালা।
উনি কোনোরকম জান নিয়ে পালালেন। মা তার বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে গালে সজোড়ে চারটা চড় মারলেন। রেগে বললেন,
~ হতভাগী, তুই আমাকে আর শান্তি দিবিনা।

জামাইয়ের বাড়ী তো গিয়েছিস, সেই টা ও তো ধরে রাখতে পারলিনা। উস্টা খেয়ে মায়ের কাছে ফিরে এলি। তাও তোর এত বড় বড় কথা আসে কোথা থেকে।

এই লোকটা দিচ্ছে বলে এখনো ইজ্জত ঠিক রেখে দুবেলা গিলতে পারছিস।
আগের মত সেলাই করতে পারিনা, বাজারে নতুন দোকান হওয়ায় অর্ডার আসা ও বন্ধ হয়ে গেছে। না খেয়ে মরার অবস্থা।

হতভাগী তুই মরতে পারিসনা।
বলে মা ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করে দেয়।
মা কিছু মিথ্যে বলেনি। ইদানিং একবেলা খাবার জুটানোর সামর্থ্য নেই তাদের। আমি এত অভাগী কেন? আল্লাহকে এই প্রশ্ন টা ভীষণ করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। সব কেড়ে নিয়ে একটা সুন্দর সংসার দিয়েছিল, স্বামীসুখ দিয়েছিল।

কি পাপ করেছিলাম? সেটাও আমার থেকে কেড়ে নিয়ে গেল।
আর বাচতে ইচ্ছে করছেনা। আমিও আমার মুহিবের কাছে চলে যাব।
মাটি থেকে উঠে বসে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। কেরাসিনের বোতল হাতে নিলাম। খুলে গায়ে ঢেলে দিলাম।
অনেক খুজে দিয়াশলাইয়ের বাক্সটা পেলাম।

ঠুকে দিয়ে আগুনটা জ্বালিয়ে নিলাম। মৃত্যুকে খুব কাছে দেখতে পাচ্ছি। আর কিছু সময়ের অপেক্ষা। তারপর আমার আর মুহিবের মাঝখানে কোনো দূরত্ব থাকবেনা।
এক হয়ে যাব আমরা। কালেমা পড়ে নিলাম।

পর্ব ১৬

তাওহীদ আড়চোখে সিমরানের দিকে তাকায়। মেয়েটি মন দিয়ে সবকিছু নিপুনভাবে গোছগাছ করছে।

মাঝে মাঝে সব ঘুলিয়ে ফেলে, চায়ে প্রায়ই ৪চামচ চিনি দিয়ে ফেলে, এর জন্য তার কাছে বকাও খায়। তবে ব্রেইন অনেক ক্লিয়ার। অনেককিছুই মূহুর্তে ভেবে ফেলতে পারে। ল্যাপটপে কাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করেছি,
~ পড়ালেখা কিছু জানো?
~ হ্যা কিছুটা করেছি।

চোখ না তুলেই উত্তর দেয় সিমরান।
~ আমার বিছানাটার চাদর চেঞ্জ করে দিও। ড্রায়ারে লাল রঙ্গের চাদর আছে।
ভুলে যেও না আবার।
~ আচ্ছা।

এর মধ্যেই তাওহীদের ফোনে কল আসে। সে ফোন কানে নিয়ে বেরিয়ে যায়। কেমন জানি লোকটা, সারাদিন ল্যাপটপ আর ফোনে মুখ গুজে বসে থাকে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শরীর অবশ হয়ে যায় সিমরানের। সারা শরীরে সুচ ফোটানোর ব্যথা অনুভব করতে থাকে।

সহ্য করতে না পেরে বিছানায় বসে পড়ে। কেউ যেন তাকে ভীষণভাবে কষ্ট দিচ্ছে। ছটফট করতে থাকে বিছানায়। তাওহীদ রুমে ঢুকে দেখে সিমরান বিছানায় ছটফট করছে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করতে থাকে বারবার। কিন্তু সিমরান কিছু বলছেনা, একসময় তার শরীর নেতিয়ে পড়ে আর জ্ঞান হারায়।

তাওহীদ সিমরানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন একটা মায়াজড়ানো ওর চোখে-মুখে। বেচারী ওকে বড্ড ভয় পায়, সারাদিন বকাঝকার উপর রাখে। সে আর কি করবে! এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছে, যেখানে মায়া-মমতার স্থান নেই।

সিমরানের জ্ঞান ফিরতেই সে দেখে তাওহীদ তার মুখের দিকে ঝুকে তাকিয়ে আছে। ধড়পড়িয়ে উঠে ওড়না ঠিক করে। তাওহীদ ওকে অভয় দিয়ে বলল,
~ তুমি ঠিক আছো তো?

~ জ্বী আমি ঠিক আছি। আমি বাড়ি যাব।
~ চলো তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।

~ আমি একা যেতে পারব।
~ তুমি অসুস্থ, একা যেতে পারবেনা।
~ নাহ, আমি ঠিকি পারব।
তাওহীদ একটা ধমক দিয়ে বলল, বললামনা, আমি ড্রপ করে দিয়ে আসব।

সিমরান চুপ করে মাথা ঝাকায়। আস্তে আস্তে গিয়ে গাড়িতে বসে। বাহিরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, আমি আসলে কি হয়েছে! কেন এত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি নিজের মধ্যে। তাওহীদ ড্রাইভ করতে করতে বলে,
~ সিমরান তোমার শরীর সত্যি ঠিক আছে তো?
~ জ্বী স্যার।
~ তোমার বাসায় কে কে আছে?

~ আমেনা বু ছাড়া আর কেউ নেই।
~ তোমার মা-বাবা? প্রশ্নটা শুনে সিমরান চমকে যায়। সে নিজেও তো জানেনা তার মা-বাবা কোথায়? কখনো দেখেওনি। অবশ্য আমেনা বু বলেছে ওরা সে ছোট থাকতেই মারা গেছে।

~ কি হল? চুপ করে আছো যে?
~ নেই। তাওহীদ আর প্রশ্ন বাড়ায় না। গলির দোকান থেকে কিছু ফল কিনে তাকে বাড়ি অব্ধি পৌছে দিল।

সিমরান অস্ফুটস্বরে বলল,
~ রান্না করে ফ্রিজে রেখে এসেছি। কেয়ারটেকার চাচাকে বলবেন গরম করে দিতে।
~ আমাকে নিয়ে ভেবোনা। তুমি নিজের খেয়াল রাখো অকে!
শরীর বেশি খারাপ থাকলে কাজে আসতে হবেনা। রেস্ট নাও।

যাওয়ার আগে সিমরানের কপালে একবার হাত ছুয়ে গেল তাওহীদ। না জ্বর নেই ভেবে নিশ্চিন্তে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। সিমরান তাওহীদের যাওয়ার পানে অপলক তাকিয়ে রইল। মানুষ টা একটু মেজাজী, কিন্তু খুব ভাল।
কপালে হাত ছুয়ে দিতেই কেমন একটা ভালোলাগা কাজ করছিল সিমরানের।
শরীরটা ওর খারাপ হয়নি, কিন্তু অদৃশ্য যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছিল সে।

রাতের আধারে কাদতে কাদতে বেরিয়ে পড়লাম আমি। জানিনা কোথায় যাব। আত্মহত্যা করতে গেলাম বাতাসে দিয়াশলাই নিভে গেল। মনে হল মুহিব কানের কাছে এসে বলছে, আমি ফিরে আসব ওয়াফাহ।
আল্লাহ যা করেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্য করেন।

পারিনি আত্মহত্যা করতে। অগাধ বিশ্বাস জন্ম দিয়ে বেচে আছি ওর অপেক্ষায়। মুহিব ঠিকিই ফিরবে আমার কাছে।
মা আমার সাথে রাফির বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। মা ইদানিং কেমন জানি পরিবর্তন হয়ে গেছে। মায়ের দোষ ই বা কি করে দেই। উনিও তার মেয়েকে এভাবে দেখতে পারছেননা। আমি মুহিবের স্ত্রী, তাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

তাই ঘর ছেড়ে পথে দাঁড়ানো ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলনা। আচ্ছা আমি যে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, মুহিব ফিরলে আমাকে খুজে পাবে কি করে? খুজে না পেয়ে যদি ফ্যালফ্যাল করে কেদে ফেলে।
ভেবে পা থমকে যায় পথের মাঝখানে।

মুহিব আমার জ্বীনবর। ও তো সাধারণ ৫-১০টা ছেলের মত নয়, ও ওর বউ কে ঠিক খুজে বের করবে। আল্লাহ তুমি ওর সহায় হয়ো। আমার যত পরীক্ষা নেওয়ার নাও, তবুও আমার জ্বীনবর কে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।
দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। ভোর হওয়ার আগেই এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে আমাকে।

কেননা, ভোরের শেষেই আমার বিয়ের আয়োজন শুরু হবে। হাত দিয়ে গায়ের চাদরটা কে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে পা চালালাম অজানার উদ্দেশ্যে। জানিনা আল্লাহ ভাগ্যে আর কি কি লিখে রেখেন।
তার সবকিছু ভালোর জন্য ভেবেই ভরসা করে আছি।

সিমরান কফির মগটা নিয়ে তাওহীদের দরজায় নক করে। তাওহীদ চুপচাপ ব্যালকুনিতে বসে আছে। নক করেও কোনো সাড়া না পেয়ে ধীরপায়ে ব্যালকুনিতে আসে সিমরান। তাওহীদ দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে। সিমরান নিচু গলায় বলল, আপনার কফি।

কিন্তু তাওহীদ কোনো সাড়া দিলনা। সিমরান আরো একটু উচু গলায় বলল,
~ স্যার, আপনার কফিটা?

তাওহীদ মুখ তুলে সিমরানের দিকে তাকাল। সিমরান দেখে তাওহীদের চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। কাদো কাদো চেহারা নিয়ে সিমরানকে কিছু না বলে বেডরুমে চলে এলেন।

সিমরানের ভীষণ খারাপ লাগছে, এমন মেজাজী, রাগী মানুষটার চোখে পানি কেন। তাওহীদ বিছানার উপর বসে বলল,
~ সিমরান। সিমরান চমকে উঠে বলল,
~ জ্বী স্যার।

~ কফিটা রেখে আমার পাশে বসো। সিমরান অবাক হলেও চুপচাপ তার কথামত বিছানার পাশে এসে বসে। তাওহীদ সিমরানের চোখ চোখ রেখে বলল,
~ তোমার কোলে একটু মাথা রাখি।

সিমরানের অবাকতা আরো মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তাওহীদ এমন ভাবে বলল যে সে না করতে পারলনা। তাওহীদ সিমরানের কোলে মাথা রাখে।
~ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে একটু।

সিমরানের কোনো প্রশ্ন ছাড়াই দ্বিধা নিয়ে তাওহীদের মাথায় পরমযত্নে হাত বুলাতে লাগল। তাওহীদ একটু চুপ থেকে বলল,
~ জানো, সিমরান। আমারও না একটা সুন্দর ছোট পরিবার ছিল। মা-বাবা আর আমি। স্বপ্নের মত সুন্দর ছিল দিনগুলো। মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলাম আমরা। প্রতিদিন বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসতেন।
আমিও খুশি হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম।

প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম বাবার জন্য। বাবা আসলে সবাই একসাথে খাব। বাবাও কখনো দেরী করতেননা। ঠিক ৯টা বাজে বাসায় ফিরতেন। ছুটির দিনে বাবা-মা দুজন মিলে রান্না করতেন, বিকালে ঘুরতে যেতাম, রাতে মায়ের গল্প শুনতে শুনতে বাবা আর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। সুখের কোনো অভাব ছিলনা আমার পরিবারে।

বলে তাওহীদ একটু থামল। হাত দিয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে নিল। নাকটা টেনে আবার বলতে শুরু করল,
~ হঠাৎ অফিসে বাবার প্রমোশন হল।

৯টা গিয়ে ১০টায় থামল। তাও সবমিলিয়ে ঠিকঠাক চলছিল। একটা সময় দিন দিন বাবা রাত করে বাড়ি ফিরত। আগের মত তার পকেট হাতরিয়ে চকলেট পেতামনা, যেটা পেতাম সেটা হল বকা, তাচ্ছিল্য। অফিস থেকে ফিরলে তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছিল। নিষেধ অমান্য করলে বকা খেতে হত।

বাবার উপর বড্ড অভিমান হত। রোজ রাতেই মা-বাবার ঝগড়া হত। ঝগড়া করা ছাড়া একটা রাত কাটত না। আমাকেও অন্য রুমে শিফট করে দেয় উনারা। মায়ের গল্প শুনতে শুনতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আর ঘুমানো হতনা। সবকিছুই ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগল।

ইদানিং বাবার সাদা শার্টে লাল লাল ছোপ পেতাম। মাকে বলতে শুনতাম বাবার গায়ে নাকি মেয়েদের পারফিউমের ঘ্রাণ পাওয়া যেত, কোটের বোতামে লম্বা চুল, সাদা শার্টে ঠোটের ছাপ।
সিমরান দেখল তাওহীদের চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছে। তারও ভীষণ খারাপ লাগছে মা-বাবা না থাকায় অনাদর পাওয়া আর মা-বাবা থেকেও অনাদরে থাকাটা কত কষ্টের।

তাওহীদ মুচকি হেসে বলল,
~ তারপর কি হয়েছে জানো? প্রায়ই সময় ই আমাদের বাসায় অচেনা লোক আসত। কিছুক্ষণ থেকে তারপর ফিরে যেত। মাকে জিজ্ঞেস করলে বলত,
ও তোমার মামা হয় বাবুহ।

নিজের জগত নিয়ে পড়ে থাকতাম, এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। তারপর একদিন আমার ভীষণ জ্বর ছিল, সেদিন প্রচুর বৃষ্টি ছিল। আমি ব্রজপাত ভীষণ ভয় পেতাম তাই সেদিন মায়ের সাথে শুয়েছিলাম।
বাবা তখনো ফেরেননি। আজকাল তার তেমন বাড়ি ফেরা হয়না। এমনসময় কলিংবেল বাজলে মা দরজা খুলেন। সেই মামাটা এসে ঢুকে বাসায়।

মা একপ্রকার জোর করে আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়ে মামা সহ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি আমার রুমে এক কোণে বসে ভয়ে কাপছিলাম।
ততক্ষণে বাবাও ফিরে এলেন।

তাদের রুম থেকে অনেক হট্টগোলের আওয়াজ পেলাম। একসময় দেখলাম মা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আমার কাছে এসে বলল,
~ চল তাওহীদ, আমরা অন্য বাসায় থাকব।

বাবা এসে আমাকে কোলে নিয়ে বললেন,
~ তুমি চলে যাও। আমার ছেলে আমার কাছে থাকবে। আমাকে নিয়ে বিরোধ চলতে চলতে একসময় ঠিক হল আমাকে বোর্ডিং দিয়ে দিবে।
জানো সেখানে প্রতি সপ্তাহে সবার মা-বাবা আসত কত মজার মজার খাবার-খেলনা নিয়ে। কিন্তু আমার মা-বাবা ই শুধু আসতনা।

৬-৭মাসে এসে একবার দেখা করে যেত, আর বোর্ডিং এর পেমেন্ট করে যেত। এই ছিল আমার জীবন।
এসব শুনে সিমরানের চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে লাগল। অনুভব করতে লাগল তাওহীদের কষ্টটা। ছেলেটার আসলেই কষ্টের সীমা নেই।

অনেকক্ষণ সিমরান অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল তাওহীদ চুপ করে আছে। তাওহীদের দিকে তাকিয়ে দেখে সে সিমরানের কোলে ঘুমাচ্ছে, তার ওড়না আঙ্গুলে পেচিয়ে। ঠিক ছোট্ট বাচ্চাদের মত।
সীমরানের খুব মায়া লাগছিল তাওহীদকে দেখে। নিজের চোখের পানি কিছুতেই থামাতে পারছেনা।

পর্ব ১৭

সিমরান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১০টা ১৭ বেজে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। একবার তাওহীদের মুখের দিকে তাকায় সে। তাওহীদ এখনো তার কোলে আরামে ঘুমোচ্ছে।

আস্তে করে তাওহীদের মাথাটা কোল থেকে সরিয়ে বালিশে রেখে দেয়। যেই বিছানা থেকে নেমে চলে যাবে, ওড়নায় টান পড়ল সিমরানের। পিছু তাকিয়ে দেখে তাওহীদ তার আঙ্গুলে সিমরানের ওড়না পেচিয়ে রেখেছে।

সিমরান কাছে এসে আলতো করে ওড়না খুলে নিচ্ছে তখন তাওহীদের নিঃশ্বাস সিমরানের গায়ে লাগছে।
অস্বস্তিটা শিহরণ জাগানো ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেছে। আর দেরী করলে চলবেনা, এক্ষুনি না বের হলে ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। কেয়ারটেকার চাচাকে তাওহীদের খেয়াল রাখতে বলে আল্লাহর নাম নিয়ে সিমরানের বাড়ির দিকে হাটা দিল। ওড়না দিয়ে মুখটা বেধে নিল। দ্রুত হাটলে ১০ মিনিটেই বস্তিতে পৌছে যাবে।

তাই তাড়াতাড়ি পা চালালো সে। বস্তির গলিতে ঢুকে পড়ল, গলিটা এমনিতেই অন্ধকারাছন্ন। সবসময়ই নির্জন থাকে। এই গলি দিয়ে শর্টকার্টে যাওয়া যায়। গলির মাঝখানে আসতেই দেখে রাতিম আর তার চেলাগুলো একটা মেয়েকে ঘিরে ধরে মজা করছে। মেয়েটার হাত-পা আর মুখ বেধে রেখেছে।

সিমরানের রাগ উঠে গেল এসব দেখে। চিৎকার করে বলল,
~ তোরা কি করছিস মেয়েটার সাথে? ওকে ছেড়ে দে।
রাতিম এগিয়ে এসে বলল, ছাড়বনা। তোকেও ধরে রেখে দিব। আমাকে ছেড়ে কোন নাগরকে ধরেছিস? গলি অবধি গাড়ি করে ছেড়ে দেয়। নতুন মাল নাকি! কত করে দেয় তোকে? কতবার বলেছি এর থেকে বেশি আমি তোকে দেব।

আমার কাছে চলে আয়। কিন্তু তুই আসলিনা, তাই ঠিক করেছি জোর করে আদায় করে নিব। এত রাতে সেই সুযোগটাই করে দিলি।

মাম্মা, আজ খেলা হবে।
বলে সে সিমরানের ওড়না ধরল। সিমরানের চোখ রাগে লাল হয়ে গেল। থরথর কাপছে সে। রাতিমের হাতটা বেকিয়ে টেনে নিয়ে উলটো করে ঘাড়ের কাছে নিয়ে এল। হাড় ভাঙ্গার মত কটমট শব্দ হল।

রাতিম জোরে চিৎকার করে উঠল। এবার সিমরান রাতিমের ঘাড়টা ধরে মটকে দিল। ব্যথা পেয়ে আরো জোরে চিৎকার করে নিচে পড়ে যায় রাতিম। ওর চেলাগুলো ওর এই অবস্থা দেখে আর সিমরানের দিকে এগোয় না। সিমরানের রক্তলাল চোখ দেখে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সিমরান শান্ত হয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসে। বাধন খুলে দিলে মেয়েটি তাকে শুকরিয়া জানায়। সিমরান মুচকি হেসে বলল,
~ আপনি এতরাতে কোথায় যাচ্ছেন বুবু?

~ এই বস্তিতে বৈশাখী নামের কেউ থাকে?
~ উমম, হ্যা থাকে। আপনি কি তার কাছস এসেছেন?
~ হ্যা।
~ আসুন আপনাকে পৌছে দেই।
~ না বোন, এমনিতেও তোমাকে কষ্ট দিলাম।

~ কি যে বলেন, বোন যখন ডেকেছেন এই টুকু তো করতেই পারি।
সিমরান মেয়েটির হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে সামনে সামনে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে চলল। সিমরান বলে উঠল,
~ আপনার নাম কি বুবু? কোথায় থাকেন?

~ আমার নাম ওয়াফাহ। তোমার নাম কি বোন?
~ সিমরান। এটাই বৈশাখী বুর ঘর। আপনি যান, উনি ভিতরেই আছে বোধহয়।
বুবু, আমি আসি? বাসায় আমার বু একা আছে।
~ যাও বোন। আল্লাহ হাফেজ।

স্থিরদৃষ্টিতে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখে ওয়াফাহ। আজ ওই ছেলেগুলো ওকে কাবু করে ফেলেছিল অজ্ঞাননাশক ওষুধ স্প্রে করে। জ্ঞান ফিরে দেখে ওকে এভাবে বেধে রেখেছে। আশ্রয়ের আশায় প্রাণের সই বৈশাখীর ভরসায় তার কাছে এসেছে ওয়াফাহ।
মনে মনে মেয়েটিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ঢুকল ওয়াফাহ।

ঘরের ভাঙ্গা বেড়ার ফাক দিয়ে চাদ দেখছে সিমরান। এত রাত হয়ে গেল তবুও ঘুম আসছেনা তার। এখনো তাওহীদের জন্য খারাপ লাগছে, ছেলেটার সাথে এতবড় কিছু হয়ে গেল যা যে কারো পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর।
হয়তো এভাবে অবহেলা পেতে পেতে ছেলেটা এমন রূঢ হয়ে গেছে। পাশ ফিরে শুতেই আরেকটা চিন্তা তার মাথায় এসে জট বাধল। রাতিমকে মারার মত এত শক্তি তার কাছে কি করে এল?

রাতিম প্রচুর শক্তিশালী, ওর সাথে দু-চারজন মেয়ে লড়লেও তাকে কাবু করতে পারবেনা। সবচেয়ে বড় কথা হল,
সিমরান কখনো এসব করতে পারতনা, তাহলে এটা কি করে সম্ভব হল?
ভাবনাটা থেকে থেকে মাথার মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠছে।

আমি একটা দর্জি দোকানে কাজ নিয়েছি। যা রোজগার হয় তাতে খেয়ে-পড়ে চলে যাবে আমার। এই বিপদের সময় যদি বৈশাখী আশ্রয় না দিত, না জানি আমার অবস্থা কি হত। মুহিবকে খুব মনে পড়ছে।
অনেকদিন ওকে দেখিনা, ওকে জড়িয়ে ধরিনা। বৈশাখী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, জানালার ধারে বসে কি ভাবছিস?

~ তোর অবদানের কথা। তোর ঋণ আমি যে কি করে শোধ করব?
~ দূর কি যে বলিস! তুই হলি আমার জানের দোস্ত। তোর বিপদে আমি পাশে না থাকলে কে থাকবে?
এই নে, সিগারেট খা।
~ তুই তো জানিস আমি এসব খাইনা।
~ আজ খা, টেনশান কমে যাবে।
~ নারে।

~ তুই এত চেঞ্জ হলি কি করে? যে মেয়ে সারাদিন গুন্ডামি করত, যাকে তাকে গালি দিত, শার্ট-প্যান্ট ছাড়া অন্যকিছু পরতে পারতনা। সে তুই আজ পর্দা করিস, নামায পড়িস, অপ্রয়োজনে কথা বলিসনা।
~ এই পরিবর্তন আমার স্বামী করে দিয়েছে। মানুষ টা আমার জীবনে না আসলে জানতামনা এসবে এত শান্তি।
~ তো কোথায় উনি?

আমি চুপ করে রইলাম। আমি নিজেও জানিনা উনি কোথায়। মৃত তো বলতে পারবনা, আমি সেটা বিশ্বাস করিনা। সব ঘটনা বললে আমার জ্বীনবরের কথা ও বিশ্বাস করবেনা।
~ হারিয়ে গেছে। একদিন ঠিক ফিরে আসবে কথা দিয়ে গেছে।

~ কি যে বলিস, হারিয়ে যাওয়া মানুষ কখনো ফিরে নাকি!
~ আমার স্বামী ফিরবে, দেখে নিস।
~ তোর বিশ্বাস যেন সত্যি হয়।
~ ইনশাআল্লাহ। তুই এখন কোথায় বের হচ্ছিস?
~ একটু বাজারে যাব, শাক-সবজি ফুরিয়ে এসেছে।

~ আমি যাচ্ছি। আমায় দে।
~ আহা, তুই কেন যাবি?
~ সমস্যা নেই, দে।
~ আচ্ছা, এই নে টাকা।

~ লাগবেনা, আজ আমি বাজার করে খাওয়াব। বলে বেরিয়ে বাজারে এলাম। সবকিছু দর-দাম করে দেখে দেখে কিনছি। হঠাৎ চোখ পড়ল একটা মুখের দিকে। অবিকল আমার মুহিবের মত দেখতে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তার কাছে ছুটে যাব, সে মুখটা ভীড়ের মাঝে মিশে গেল। কত খুজলাম আর পেলামনা।

তবে কি আমার চোখের ভুল? ওটা অন্য কেউ ই ছিল। কিন্তু এতটা ভুল আমি কি করে করতে পারি।
সিমরান তাওহীদের বিছানায় বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। তাওহীদ যে কি বলবে সে নিজেও বুঝতে পারছেনা। বাধা দিচ্ছেনা, কাদুক কিছুক্ষণ। কাদলে মন হালকা হয়। একসময় তাওহীদ সিমরানের হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বলল,
~ কেদোনা। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছে।
এতে আমার তোমার হাত নেই। বরং আমেনা বুর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসীব করেন। এভাবে কাদলে উনার রুহ কষ্ট পাবে।
সিমরান তাওহীদের হাতের উপর মাথা রেখে বলল,
~ আমার যে আর কেউ রইল না দুনিয়ায়।

~ পাগলী মেয়ে, এসব ভাবছো কেন? আমি আছি না!
চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল, কেদোনা। আজ থেকে তুমি এই বাসায় থাকবে। বস্তিতে তো তোমার আর কেউ ই নেই। সেখানে আর একা থাকতে হবেনা কারো টানে।

~ না আমি এখানে থাকতে পারবনা।
তাওহীদ চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, বললামনা এখানে থাকবা। যাও অন্য রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।
সিমরানের কাছে আজ বকাটা খারাপ লাগলনা, কেয়ারিং মনে হল। চুপচাপ অন্য রুমে চলে গেল সে।

আমার খুব অস্থির লাগছে। রান্না করছি কিন্তু রান্নায় মন নেই। আনমনে কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত আমি। বৈশাখী দ্রুত আমার পাশে ঘেষে বসে চুলার আগুন কমিয়ে দিয়ে বলল, আরেহ কি করছিস কি! পুড়ে যাবে তো।
আমি ব্যস্ত হয়ে তরকারী নামাতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা লাগে। বৈশাখী হাতটা দেকগে বলল, ইস! কতটা পুড়ে গেছে। দাড়া টুথপেস্ট লাগিয়ে দেই জ্বালা কমে যাবে।
~ ব্যস্ত হস না। ঠিক হয়ে যাবে।

~ চুপ করে বসে থাক। ও আমার হাতে পেস্ট লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,
~ কি এত ভাবছিস বল তো? এসবে মন ই নেই।
~ একটা কিছুর হিসাব মিলাতে পারছিনা।
~ কিসের?

~ জানিস, আমি বাজারে আমি একটা মুখ দেখলাম। অনেকটা মুহিবের মত। যখন মুখটা কে খুজতে গেলাম পেলামনা।
~ তুই কি বলছিস মুহিব ফিরে এসেছে আর সে এই বস্তিতেই আছে?

~ আমি জানিনা। নিজের চোখকে ভুল ও বলতে পারছিনা।
এতটা ভুল কি আমার হতে পারে বল!
~ আমার মনে হয়, তুই মুহিবকে নিয়ে অনেক বেশি ভাবিস। তাই সব জায়গায় ওকে দেখিস।
~ আরেহ না দোস্ত। এমন হলে আরো আগেও দেখতাম।

~ মুহিবের কোনো ছবি আছে তোর কাছে?
~ না, ও খুব ধার্মিক। এসব ছবি তুলেনা।
~ তাহলে খোজ করব কি করে?

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আদৌ কি মুহিব নাকি অন্য কেউ ছিল?
কাকে বিশ্বাস করব? নিজের চোখকে নাকি মনের ভুলকে?

পর্ব ১৮

তাওহীদ এসে সিমরানের মাথার পাশে বসে। কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা, চোখটা এখনো ভেজা ভেজা। ল্যাম্পের লালবর্ণের আলো তার মুখে পড়ায় কবির মায়াবতীর মত লাগছে।

আলতো করে মাথায় হাত রাখে তাওহীদ। আস্তে আস্তে হাত বুলাতে থাকে, ভাবতে থাকে মেয়েটার মুখ দেখলে কেমন একটা শান্তি কাজ করে ভিতরে। বকাবকি করলে নিজেরও খারাপ লাগে।

সবাই বলে, ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে নেই, সেটা নীরবে থাকাই শ্রেয়। তাই বকাবকিই করি বেশি। ভালোবাসা বুঝতে পেরে যদি দূরে চলে যায়। মা-বাবার পর এই প্রথম কাউকে প্রিয়োরিটি দিচ্ছে সে। কাউকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে।

তাকে হারালে চিরদিনের মত অন্ধকারে হারিয়ে যাবে সে।
ভাবতে ভাবতে চোখের পানি ছেড়ে দেয় তাওহীদ। শক্ত করে সিমরানের হাতটা চেপে ধরে, তারপর হাত ছেড়ে উঠে যায় পাশ থেকে। এখন তার একা থাকাটা খুব দরকার। মন খুলে একটু কাদার ইচ্ছে। উঠে যেতেই কেউ তার হাত টেনে ধরে।

পিছু ফিরে দেখে সিমরান তার হাতটা ধরে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
তাড়াতাড়ি চোখের পানি আড়াল করে ফেলল তাওহীদ। হাত ছাড়িয়ে পাশে বসে বলল, ঘুমাওনি কেন এখনো?
সিমরান চুপ করে তাকিয়ে আছে। তারপর চোখ নামিয়ে বলল,
~ আপনি কাদছেন কেন?

~ কই কাদছি নাতো! ঘুমাচ্ছোনা কেন?
~ আপনি এত ভাবছেন কেন আমাকে নিয়ে?
~ তোমার ভাল-খারাপ দায়িত্ব আমি নিয়েছি তাই ভাবছি। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়। আমি যাচ্ছি।
~ শুনুন।

~ হ্যা বলো।
~ আমি একটা ছেলেকে ভালবাসি এবং তাকে বিয়ে করতে চাই।
শুনে তাওহীদ প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
~ কে সে?

~ আমাদের বস্তির। আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে পারবেন? আপনি তো আমার দায়িত্ব নিয়েছেন বললেন। তাই আমার ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব ও তো আপনার।
~ হুম করব। ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে তার ঠিকানাটা আমায় দিও।
আমি নিজ দায়িত্বে তোমাদের বিয়ে দিব। আসছি।

তাওহীদ তাড়াহুড়ো করে সিমরানের রুম থেকে বের হয়ে গেল। নিজের রুমে বসে ইচ্ছেমত কাদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর দরজার চোখ যেতে দেখে সিমরান দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে। চোখের পানি মুছতে লাগল তাড়াতাড়ি।
~ আপনি কাদছেন কেন? প্রশ্নটা সিমরান তাওহীদের দিকে ছুড়ে দিল।

~ এমনি?
~ আমার বিয়ের কথায় আপনি কেন কষ্ট পাচ্ছেন? আপনার কি এসে যায়?
তাওহীদের চেহারা পালটে গেল এইটা শুনে। কান্নারত চেহারা মূহুর্তেই রাগান্বিত চেহারায় পরিণত হল।

উঠে এসে সে শক্ত করে সিমরানের বাহু চেপে ধরে বলল,
~ আমার এসে-যায়। কারণ, মা-বাবার পর তুমি ই একজন যাকে ভালোবেসেছি। যাকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমি পারবনা এটা মেনে নিতে।
সিমরান একবার তাওহীদের শক্ত করে চেপে হাতের দিকে তাকিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ওড়নাটা মাথায় টেনে বলল,
~ বিবাহের ব্যবস্থা করুন।

শুনে তাওহীদ হাত আলগা হয়ে গেল। এসব শুনার পর ও সিমরানের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ভেবেছিল সিমরান অন্তত একটু হলেও ওর কষ্ট টা বুঝবে। সিমরানের হাত ছেড়ে দিয়ে তাওহীদ জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়।

সিমরান পিছু এসে বলল,
~ আপনি জানেন না, বিয়ের আগের প্রেম অবৈধপথে তাড়না করে। আর আমি চাইনা আমাদের পবিত্র ভালোবাসাটা অবৈধ হয়ে যাক। এর জন্য খুব তাড়াতাড়ি আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে কবুল করে নিতে চাচ্ছি।
এতে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে?

তাওহীদের নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এটা কি ঠিক শুনল সে? মূহুর্তে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। চোখের পানি মুছে বলল,
~ আমি কাল ই তোমাকে বিয়ে করব সিমরান।

আর এক দিন দেরী করে ভালোবাসাটাকে অবৈধে পরিণত করবনা।
সিমরান লজ্জা পেয়ে গেল। তাওহীদ তাকে বুকে টেনে নিল। সাথে সাথে সিমরানের শরীরে শক লাগে। দূরে ছিটকে পড়ে। নিজেই ভয় পেয়ে যায় এমন হল কেন? তাওহীদের শরীরের সাথে নিজের শরীরের স্পর্শ লাগতেই এমন শক লাগল কেন? তাওহীদ অবাক হয়ে বলল,
~ কি হল? দূরে চলে গেলে কেন?

~ বিয়ের আগে আমরা দুজন দুজনকে স্পর্শ করবনা। সহীহ্ ভাবে স্পর্শ করব।
আমি রুমে যাচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।

সিমরান কোনোরকম পালিয়ে রুমে চলে আসল। কি হচ্ছে এসব তার সাথে? তাওহীদকে স্পর্শ করতেই এভাবে ছিটকে পড়ল কেন সে? আল্লাহ এসব তোমার কিসের ইংগিত? মাথা থেকে ঝাড়তে গিয়েও ঝাড়তে পারলনা সিমরান।
তাও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল।

বৈশাখীকে নিয়ে পুরো বস্তিতে চক্কর দিল ওয়াফাহ। কিন্তু সেই মুখের সন্ধান আর পেলনা। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে তার। ঘরের দাওয়ায় বসে পড়ল ক্লান্ত হয়ে। বৈশাখী খাবার নিয়ে এসে বলল,
~ দুটো খেয়ে নে ওয়াফাহ। সারাদিন তো কিছুই খেলিনা।
~ আমার কিছু ভাললাগছেনা।

ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। নিজের মনের সাথে, সমাজের সাথে লড়াই করতে করতে। বৈশাখী ওয়াফাহকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
~ ওয়াফাহ, সত্যিটা মেনে নে। তোর মুহিব আর বেচে নেই।
যে বেচে নেই তাকে তুই কিভাবে খুজে পাবি?
~ ও আমাকে কথা দিয়েছে ও আমার কাছে ফিরবে।

~ আল্লাহ তোদের মিলন এই দুনিয়ায় লিখে রাখেনি। আখিরাতে তোরা দুজন দুজনকে পাবি। আল্লাহ চায়নি মুহিব তোর কাছে ফিরে আসুক, তাই নিজের কাছে নিয়ে গেছেন ওকে।

ওয়াফাহ পাগলের মত কাঁদতে শুরু করল। বৈশাখী মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
~ এসব ভুলে যা ওয়াফাহ। অতীত মুছে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে থাক।
তুই তোর মায়ের কাছে ফিরে যা, আর রাফি কে বিয়ে কর।

~ তুই এসব কি বলছিস? আমি শুধু মুহিবের স্ত্রী। আর কারো হতে পারবনা।
~ সারাজীবন এভাবে থাকতে পারবিনা। মেয়েদের জন্য এই দুনিয়া বড্ড কঠিন। বুঝতে চেষ্টা কর। এখন যদি তুই আত্মহত্যার চেষ্টা করস, ওখানে মুহিব কষ্ট পাবে। ওর রুহ কষ্ট পাবে, নতুন করে নিজেকে গড়ে নিলে। ও খুশি ই হবে।

তোদের ভালোবাসা নিখাদ হলে জান্নাতে তোরা একসাথেই থাকবি।
এভাবে তুই আর বাচতে পারবিনা। সমাজ তোকে প্রতিনিয়ত পিষে মারবে।
ওয়াফাহ একদম মৃতের মত পাথরদৃষ্টিতে বৈশাখীর দিকে চেয়ে রইল।

একসময় বৈশাখীর গায়ের উপর ঢলে পড়ে।
বৈশাখী তাকে নাড়া দিতে লাগল, ওয়াফাহর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। নিশ্বাস-পালস কিছুই পাচ্ছেনা।
তবে কি ওয়াফাহ এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল?

সিমরানকে সাজানো হচ্ছে। তাওহীদ একজন মহিলাকে নিয়ে এসেছে, উনি তাকে যত্ন করে বউ সাজাচ্ছেন। নিজের কাছে ভীষণ খুশি লাগছে, আজ সে একটা পরিচয় পাবে। আজ থেকে সে হবে তাওহীদ মাহমুদের স্ত্রী। মহিলাটা হেসে বলল, দেখুন, আপনাকে কেমন সুন্দর লাগছে? আপনার রুপ কেমন ফুটে ওঠেছে?

সিমরান চোখ মেলে আয়নার দিকে তাকাল। লাল লেহেঙ্গা, ভারী গয়না, মেকাপ, চুলে ফুলের খোপা সবমিলিয়ে নিজেকে সত্যি বউ বউ লাগছে। লজ্জাসূচক একটা হাসি দেয় সিমরান। মহিলাটি বলল,
~ আল্লাহ আপনাদেরকে সুখে রাখুক। আমি আসি।
সিমরান মিষ্টি হেসে বলল, আমাদের শুভ মূহুর্তে আমাদের কে দোয়া না করে যাবেননা। মহিলা সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেল।

আর কিছুসময়ের অপেক্ষা তারপর কাজী তাদের বিয়ে পরাবে। সিমরান তাওহীদকে সারাজীবনের জন্য কবুল করে নিবে। সিমরানের ইচ্ছেতে ছোট ঘরোয়াভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। বস্তির খাদেজা খালা, বৈশাখী বু আর অই ওয়াফাহ বোনকে দাওয়াত পাঠিয়েছিল। ওরা কখন আসবে?
বাদ যোহর কাবিননামা হবে।

তাওহীদ সিমরানেরর কাছে এল তাকে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য। একটু পরেই তাদের বিয়ে হবে। রুমে ঢুকতেই তাওহীদের মুখ কালো হয়ে গেল। কোথাও সিমরান নেই। সব ঠিক আছে শুধু সিমরানকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। চারিদিকে খোজ চালানো হল, সিমরান কোথাও নেই। তবে সিমরান ওকে বিয়ে করতে চায়না বলে পালিয়ে গেছে।
এমনটা কি করে করতে পারল সিমরান?

পর্ব ১৯

বৈশাখী হসপিটালের করিডরে এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছে। ওয়াফাহকে ভেতরে ডাক্তাররা এখনো দেখছেন। ওয়াফাহর অবস্থা খুব সিরিয়াস।

যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর টেনশানে এখন কোমায় চলে যাওয়ার অবস্থা। এখন আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটা আর শান্তিই পেলনা।

ওয়াফাহর মা চলে এসেছেন। উনিও এককোণে বসে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। মেয়ে যা ই করুক না কেন উনি তো তার মা। মেয়ের এমন অবস্থায় ছুটে আসাটা স্বাভাবিক। এক একটা মূহুর্ত এখন সহস্র বছরের সমান মনে হচ্ছে। আল্লাহ তুমি ওয়াফাহকে সুস্থ করে বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল বৈশাখী। আল্লাহর বিচার এত নিষ্ঠুর কেন? এত ভালো মনের মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে।

ঘন্টাখানেক পর সিমরান তাওহীদের সামনে এসে দাড়াল। তাওহীদ পাগলের মত ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় গিয়েছিলে তুমি? তুমি জানো এখনো বিয়ে পড়ানোটা বাকি। হুট করে কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিলে তুমি! চুপ করে আছো কেন? জবাব দাও।”

সিমরান নিষ্প্রাণদৃষ্টিতে তাওহীদের দিকে একবার তাকায়। তারপর কাজীর দিকে তাকিয়ে বলে, “কাজী সাহেব, রেজিস্ট্রি তো হয়ে গেছে। বাকিটা সেরে নিন।”

তাওহীদ আর সিমরান মুখোমুখি বসে। মাঝখানে পাতলা পর্দা টেনে দেওয়া হয়। কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে। তাওহীদ বার বার সিমরানের দিকে তাকাচ্ছে। সিমরানকে কেমন মনমরা লাগছে।

এতক্ষণ সিমরান ছিল ই বা কোথায়! তাওহীদ কবুল বলার পর কাজি সিমরানকে কবুল বলতে বলে। সিমরানের ঠোট কাপছে কবুল বলতে। কিন্তু সবকিছু এখন ওর হাতের বাহিরে চলে গেছে। অস্ফুটস্বরে বলে, কবুল হে।
সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে মোনাজাত ধরে।

বিয়ের সবকিছু সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর সিমরান এক মূহুর্ত দেরী না করে রুমে চলে আসে। সবাইকে বিদায় দিতে দিতে রাত হয়ে যায়। সবাইকে বিদায় দেওয়া শেষে তাওহীদ রুমে ঢুকল।

ঢুকে দেখে সিমরান এখনো রুমের আলো জ্বালেনি। ব্যালকুনির এক কোণে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছে। তাওহীদ রুমের আলো জ্বালিয়ে দেয়। তারপর সিমরানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
~ আজকের দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন। তোমাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্নটা আজ পূরণ হয়েছে। আজ থেকে আমাদের ভালোবাসা আর অবৈধ নয়, একটা পরিচয় পেল। তোমাকে স্পর্শ করতেও আর বাধা নেই।

বলে সিমরানের হাতে হাত রাখল তাওহীদ। সিমরান মুখ ঘুরিয়ে একবার তাওহীদের দিকে তাকাল, তারপর হাত সরিয়ে রুমে চলে এল।
তাওহীদ ভাবে, সিমরানের নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ। আজকে ওর বিশেষ একটা দিনে ওর পরিবারের কিংবা আপন কেউ ই উপস্থিত নেই। তাদের শূন্যতা অনুভব করছে নিশ্চয়ই।

তাওহীদ এসে সিমরানের পাশে বসল। টেবিল থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলল, সারাদিন তো কিছু খাওনি, তাই তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি নিজহাতে খাইয়ে দিব বলে। সিমরান এই কথা শুনে কোমলদৃষ্টিতে তাওহীদের দিকে তাকাল।

তাওহীদ ভাতের লোকমা সিমরানের মুখের কাছে এনে ধরে বলল, হা করো। তুমি তো নথ পড়ে আছো? খাবে কি করে!
দাড়াও আমি খুলে দিচ্ছি। তাওহীদ সযত্নে সিমরানের নাকের নথ খুলে দেয়। সিমরান চুপচাপ শুধু তাওহীদকেই দেখছে। মানুষটা কত্ত কেয়ারিং, অনেক ভালো।

তাওহীদের ডাকে সিমরানের ধ্যান ভাঙ্গে। “এভাবে চেয়ে থাকবে? নাও হা করো”
সিমরান হা করতেই তাওহীদের খুব যত্ন করে সিমরানকে খাইয়ে দিল। নিজের হাতেই পানি খাইয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দিল। তারপর হাত ধরে বলল,
~ সিমরান আমি তোমাকে ভীষণ ভালবাসি।

এতটাই ভালবাসি যে তোমাকে হারাতে পারবনা কখনোই।
এসো, আজ থেকে আমরা নতুন জীবন শুরু করি, টোনাটুনির মত ছোট্ট একটা সংসার করব আমরা। সেখানে থাকে তুমি, আমি আর ভালবাসা।

বলে সিমরানকে বুকে টেনে নিল তাওহীদ। সিমরান স্বস্তিতে চোখটা বুজল।
হঠাৎ তাওহীদ সিমরান থেকে দূরে ছিটকে পড়ল। অবাক হয়ে সিমরানের দিকে তাকিয়ে রইল সে। সিমরান তাকে এভাবে কেন ধাক্কা দিল?

সিমরান বিছানা থেকে উঠে এসে একপাশে দাড়াল। তাওহীদ অবাক হয়ে বলল,
~ কি হয়েছে সিমরান? এভাবে ধাক্কা দিলে কেন?
সিমরান রূঢ়কন্ঠে তাওহীদকে বলল,
~ আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন। আমি চাইনা আপনি আমার কাছে আসুন।
~ কেন? এসব বলার কারণ কি?

~ কারণ আছে। আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটা আমি চাইনা। লোকদেখানো ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কোনো স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থাকবেনা।
~ কেন থাকবেনা?

তাওহীদ সিমরানের কাধ দুহাতে চেপে ধরে বলল,
~ তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? সিমরান তাওহীদের হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল, জ্বি নাহ।
তাওহীদ কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলল, তবে বিয়ে করলে কেন?

~ বুঝেননা কেন? আমার মত নিম্নশ্রেণীর কাজের লোকরা বিলাসিতা চায়, টাকা চায়। যেটা আপনার কাছে আছে, এগুলো পাওয়ার একটাই উপায় আপনাকে বিয়ে করে নেওয়া। আর আমি সেটাই করেছি, আপনাকে বিয়ে করে রাজরাণী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। আমার স্বার্থ এটাই, এর জন্য আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারব।

ক্ষমা করে দিবেন আমায়। আপনার সাথে ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয় করে ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা।
তাওহীদের পুরো থ হয়ে গেল। সিমরান এসব বলছে! চোখের সামনে পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে এল, মনে হচ্ছে ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে।

এত বড় বেইমানীর শিকার হয়েছে সে। মা-বাবার মত সিমরান ও ওকে দূরে ঠেলে দিল। কাদতে কাদতে বলল,
~ তুমি চাইলে আমি তোমাকে সেগুলো এমনিতেই দিতাম। এমন ভাবে আমাকে না ঠকালেও পারতে। এভাবে আমার মন নিয়ে খেলে কি পেলে বলো?

~ সারাজীবন তো আপনাদের মত বড়লোকরা আমাদেরকে নিয়ে খেলে। আজ আমি তার উল্টোটা করে আপনাদের মত বড়লোকদের উপর মনের ঝাল মেটালাম। আপনি আমাকে আর এসব বলে বিরক্ত করবেননা।
আপনার এসব ন্যাকামি দেখতে আমি ইচ্ছুক নই।

আমার ঘুম পাচ্ছে, বিছানার পাশ থেকে সরুন। আর বললেন না আপনি আমাকে এসব এমনিতেই দিতেন। আমি আপনার করুনা নিতে পারবনা, যেটা আমার চাই সেটা আমি এভাবেই আদায় করে নিই।
এখন যদি আপনার ন্যাকামিপনা শেষ হয়ে থাকে রুম থেকে বেরিয়ে আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিন। আপনার এসব আমার একটুও সহ্য হচ্ছেনা।

তাওহীদ পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। এভাবে ঠকে যাবে কখনো ভাবেনি, সবার মত শেষ পর্যন্ত সিমরানও তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। এক পা এক পা করে পিছিয়ে কাদতে কাদতে তাওহীদ রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
সিমরান দরজা লক করে শাড়ী নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

ডাক্তার হাতে থাকা রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে বলল,
~ পেশেন্টের অবস্থা অত ভালোর দিকে নেই। একটু খেয়াল রাখবেন। আর উনি মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছেন, দু-তিন সপ্তাহের বেশী হয়ত কারো সাথে কথা বলবেননা। চুপচাপ নিজের মত থাকবেন। এসময় তাকে কোনো কিছু জবরদস্তি করবেননা। ভুল করেও আগের কোনো কথা তার সামনে উঠাবেননা।
আল্লাহ অশেষ দোয়ায় উনি কোমা যাওয়ার পথ থেকে ফিরে এসেছেন।

অতএব, একটু সর্তক থাকবেন। যতটা সম্ভব হাসিখুশি রাখার ট্রাই করবেন।
বৈশাখী গলা কেশে বলল, আজ কি ওকে রিলিজ করিয়ে নিয়ে যেতে পারব?
~ হ্যাঁ, পারব। আপনি আমার সাথে আসুন, কিছু ফর্মালিটি সম্পন্ন করতে হবে।
ওয়াফাহর মা তার কেবিনে ঢুকল।

ওয়াফাহ নিষ্প্রাণ চাহনী মেলে তাকিয়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে আছে, চোখের নিচে গর্ত হয়ে গেছে। এত চিন্তা করলে মানুষ বাচে? আমার কথা শুনে যদি রাফিকে বিয়ে করতি, কতই না সুখে থাকতি।
আমারো চোখের সামনে মেয়ের এমন অবস্থা দেখতে হত। আল্লাহ এবার তো আমার মেয়ের উপর একটু রহম করো।

একটু শান্তি দাও ওকে। মুহিবকে ওর কাছে ফিরিয়ে দাও। এভাবে আমার মেয়েটা আর বাচবেনা।
বৈশাখী এসে ওয়াফাহর মায়ের কাধে হাত রেখে বলে, চিন্তা করোনা খালা। আল্লাহ সব কিছু দেখছেন, উনি ওয়াফাহর কপালে আবার সুখ ফিরিয়ে দিবেন।
উনি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেননা।

পর্ব ২০

সিমরান আস্তে আস্তে পাশের রুমে ঢুকল। দেখল তাওহীদ গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে, কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে গেছে বেচারা। তাওহীদের এমন অবস্থা দেখে তার বুক ফেটে কান্না আসছে।

কিন্তু সে নিরুপায়, এমন বিহেভ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা। তাওহীদের গায়ে চাদর টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে আসে সিমরান। চোখের পানি মুছে ভাবতে থাকে সে মূহুর্তের কথা, যে মূহুর্ত তাকে এই পরিস্থিতিতে টেনে আনতে বাধ্য করেছে।

আয়নায় নিজেকে যখন নিজেকে দেখছিলাম আমার পিছনে একটা কালো ছায়া দৌড়ে চলে যেতে দেখে। হয়ত মনের ভুল এটা। এমনটা কয়েকবার হল আমার সাথে।

তখনি উকিল বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার নিয়ে আসে, আমি সাইন করার সময় দেখি ছায়াটা আমার সামনে বৃত্তাকারে ঘুরছে। ঘুরে ঘুরে একটা সুড়ঙ্গ তৈরী করছে। উকিল সাহেবকে দেখে মনে হলনা, উনি এটা দেখছেন।
সাইন করা শেষে উনি পেপারটা নিয়ে চলে গেলেন। ছায়াটা তাকে নির্দেশ করল,
~ এই সুড়ঙ্গে ঢুকো।

~ কে আপনি? এসব কি হচ্ছে আমার সাথে?
~ ঢুকো এই সুড়ঙ্গে। সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।
আমি ভয়ে ভয়ে সে সুড়ঙ্গে ঢুকলাম। সরু কালো একটা সুড়ঙ্গ, হালকা আলোতে হেটে যাচ্ছি। কিছুটা যাওয়ার পর একটা বড় আলোকিত গর্ত দেখতে পেলাম। অদৃশ্য আওয়াজ আসল, প্রবেশ করো।

ধীরে ধীরে গর্তে প্রবেশ করলাম। এই গর্তের চারদিকে আয়নায় লাগানো। আমার সামনে একটা বড় রাজকীয় আয়না। কিন্তু সেটায় আমি দেখা যাচ্ছেনা। অদ্ভুত লাগল, ভয় ও করতে লাগল। এই কেমন লীলাখেলা চলছে আমার সাথে! আল্লাহ আমাকে রক্ষা করো। ভাবতে না ভাবতে একটা দাড়িওয়ালা নূরানী মুখ আমার সামনে ভেসে উঠল। মিহি কন্ঠে আমাকে বলল,
~ আসসালামু আলাইকুম জ্বীনকন্যা মুসকান।

~ কে জ্বীনকন্যা? কে মুসকান?
~ তুমি।
~ এসব কি বলছেন কি আপনি?
~ ঠিক বলছি। তুমি কোনো সাধারণ মেয়ে নন। তুমি জ্বীনবংশের একজন উত্তরাধিকারী। তুমি নাম সিমরান নয় মুসকান।

~ বিশ্বাস করছি না আমি। আপনি কে? এমন গোলকধাঁধায় কেন এনে ফেলেছেন আমাকে?
~ এটা গোলকধাঁধা নয়। এটা জ্বীনরাজ্যের আয়নামহল। আর আমি তোমার বংশীয় জ্বীন। তোমার ছোট দাদা। তোমার বাবার চাচ্চু।

~ কে আমার বাবা? আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন এসব আজগুবি গল্প শোনাতে?
~ আজগুবি নয়। তুমি একটু ভাবো, তুমি বিবাহযোগ্যা হওয়ার পর অব্ধি তোমার সাথে ঘটে যাওয়া কাহিনী। আগুনের সাথে খেলতে ইচ্ছে করে তোমার, আগুনে তোমার কিছু হয়না। জ্বীনরা আগুনের তৈরী, আর তুমি জ্বীন বলে তোমার আগুনের আচে কিছু হয়না। উলটো আগুন নিয়ে খেলতে ভাললাগে।

তুমি মারামারির কোনো কিছুই জানোনা, কিন্তু সেদিন অই বখাটেদের তুমি একাই কাবু করেছো। বিয়ের আগে তোমার বাগদত্তা তোমাকে পূর্ণাঙ্গ ভাবে স্পর্শ করায় তুমি শক খেয়েছিলে।

মনে করে দেখো, ঘটনা গুলো কেবল মাত্র একটা জ্বীনকন্যার সাথেই ঘটতে পারে।
এরপরো যদি বিশ্বাস না হয় তোমার হাত দিয়ে একটা আয়না হালকা আচড় কাটো। তুমি যদি সাধারণ মেয়ে হও এই আয়নায় একটু দাগ ও লাগবেনা।

উনার কথা শুনে কাপা কাপা হাতে আমি আয়নায় আচড় কাটলাম। আয়না দুভাগ হয়ে গেল। অবাক হয়ে গেলাম আমি।
~ এবার তুমি আবার হাত লাগাও।

লাগানোর সাথে সাথে আয়না জোড়া লেগে গেল। সাথে সাথে একটা মুখ ভেসে উঠল যেটা অবিকল দেখতে আমার মত। আমি ভয়ে দুপা পিছিয়ে গেলাম। এই কেমন তেলেসমতি।
~ এই জ্বীনকে একমাত্র তুমিই উদ্ধার করতে পারো।

সে বড্ড বিপদে আছে। আর যতদিন না তুমি তাকে খুজে উদ্ধার করতে পারছো, ততদিন তুমি তোমার স্বামীকে কাছে আসতে দিবেনা। যদি সে তোমার পূর্ণাঙ্গ কাছে আসে, তবে তুমি তোমার জ্বীনি শক্তি হারাবে হয় যাবে এক সাধারণ কন্যা। তোমার স্বামী ও তখুনি মারা যাবে এবং তোমার রুহ শরীর ছাড়া হয়ে দুনিয়ায় ঘুরতে থাকবে কেয়ামত অব্ধি।

পদে পদে তোমার লাঞ্চনা, গ্লানি আর কষ্ট থাকবে। না পারবে মুক্ত হতে আর না পারবে সইতে।
~ কিন্তু এই জ্বীনটা কে?

~ আমাকে ফিরে যেতে হবে মুসকান। আমার না বলা অব্ধি নিজের পরিচয় তুমি কাউকে দিবেনা। এতে তোমার প্রাণহানির আশংকা রয়েছে।
তোমার জ্বীনিশক্তি অপ্রয়োজনে ব্যবহার করবেনা। সেটা ক্ষয় হলে পূর্ণ করতে সময় লাগবে। এখন অদৃশ্য হয়ে আগের স্থানে ফিরে যাও।

চোখ বুজতেই আমি আগের রুমে চলে আসলাম। ভাবনায় পড়ে গেলাম আমার সাথে যা হল তা কি আসলেই কল্পনা নাকি বাস্তব। বিয়ে পড়ানো শেষ হওয়ামাত্র আমি উপরে চলে আসলাম।

ড্রায়ার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি নিয়ে নিজের আঙ্গুলে আগুন ধরিয়ে দিলাম। সত্যিই আমার কিছুই হচ্ছেনা।
আমার আঙ্গুল সম্পূর্ণ অক্ষত।
বিশ্বাস করতে দেরী হলনা, লোকটা যা বলল সবি সত্যি।

তখন থেকেই আমার চিন্তাভাবনা বেড়ে গেল। কাকে উদ্ধার করতে হবে আমার? কিভাবে করব আমি? তাওহীদের বুকে মাথা গুজতেই আমার সেই সর্তকবাণী মনে পড়ল। তাই আমি এমন খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য হলাম।

নিজের ভিতরে আরো ভয় কাজ করছে যে দিন তাওহীদ আমার আসল পরিচয় জানবে তখন কি হবে? আমাকে আর ভালবাসবেনা।

ওয়াফাহ একা একা বাহিরে বসে আছে। আগের থেকে অনেকটা সুস্থ হয়েছে সে। মুহিবের জন্য এখনো ভেতরটা অস্থির হয়ে থাকে। বিশ্বাসটা এখনো মুছে যায়নি। এমন সময় তার সামনে এক প্রকান্ড ছায়া এসে দাঁড়ায়। ভয় পেয়ে আতকে উঠে বললাম,
~ কে?

~ ভয় পেওনা নাতবউ। আমি তোমার দাদু।
হালকা চাদের আলোয় মুখটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। মূহুর্তে ভয় ভুলে গিয়ে খুশি হয়ে উঠলাম জেনেও তিনি অনেক আগেই গত হয়েছেন। উনি একটু হেসে বলল, অত উদ্বিগ্ন হসনা, তোর কষ্টের দিন শেষ।

তোকে যারা তোর দুঃসময়ে শ্বশুড়বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে তারা নিজেদের শাস্তি পেয়েছে। ওরা বড্ড লোভী ছিল৷ আমার মেয়ে হয়েও সে এত নীচ চরিত্রের জানা ছিলনা।
~ দাদু আমার শ্বশুরবাড়ি, ধনসম্পদ কিচ্ছু চাইনা।
আমার মুহিবকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দাও।

~ তোর বিশ্বাস সত্যি হয়েছে তোর মুহিব এখনো বেচে আছে। খুব তাড়াতাড়ি সে তোর কাছে ফিরবে।
~ আল্লাহর অসীম কৃপা।
ভিতর থেকে মায়ের গলা,
~ কার সাথে কথা বলছিস ওয়াফাহ?

মা এসে ওকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। কুয়াশার মত মিলিয়ে যেতে লাগল দাদুর রুহ।
তাওহীদ সকাল থেকে আমার সাথে কোনো কথা বলল না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবি কষ্টকর। যতবার কথা বলতে যাচ্ছি ততবার ই ও আমাকে রেডি হওয়ার বাহানায় এড়িয়ে যাচ্ছে।
মন খারাপ করে রান্নাঘরে চলে এলাম।
এসে দেখি নাস্তা আমার জন্য রেডি করা আর একটা চিরকুট রাখা আছে পাশে।

তাতে লেখাঃ
” তুমি আমাকে যেই কারণেই বিয়ে করো না কেন তুমি আমার বিয়ে করা বউ। তোমার সর্বোচ্চ যত্ন আমি নিব আর সারাজীবন তোমাকে ভালবাসব।
ভালোবাসি বউ।”

পর্ব ২১

ছেলেটা পারেও বটে। এত ভালবাসা কি আমার কপালে সইবে? যেদিন ও জানবে আমি একটা জ্বীন, সেদিন ও এত ভালবাসবে আমায়? নাকি ভয়ে দূরে ঠেলে দেবে? ভয়টা ভীষণ ঝেকে বসল।

তাওহীদকে আমি হারাতে পারবনা। কিন্তু আমরা দুজন ই দুই জগতের বাসিন্দা। আদৌ আমাদের একসাথে সম্ভব! সেটা তো দুনিয়ার নিয়মের বাহিরে। ভাবতে ভাবতে চোখে পানি চলে এল।

কিচেন থেকে বের হতেই দেখলাম তাওহীদ টাই বাধছে, কিন্তু পারছেনা ঠিক মত বাধতে। আমি এসে ওর টাই ঠিক করে দিলাম। ও একবার চোখে চোখ রেখে চোখ সরিয়ে নিল। অভিমানটা এখনো ধরে বসে আছে। টাই বেধে দেওয়ার পর ও সরে যাওয়ার মূহুর্তে আমার গলার হার ওর বোতামে আটকে গেল। ও আমার দিকে না তাকিয়ে ওটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি অপলক ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কত্ত কাছে আমরা চাইলে একে অপরকে নিঃশ্বাস দিয়েই ছুতে পারব কিন্তু দূরত্বটা অনেক আমাদের।

চাইলে সম্ভব নয় এই দূরত্ব কাটিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলা, “আমিও তোমায় ভীষণ ভালোবাসি তাওহীদ।” ভাবতে ভাবতে দেখি ও খুলে ফেলেছে। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে সরে চলে যেতে চাইল। আমি ওর হাত টেনে ধরলাম। ও ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, কিছু বলবেন?
আমি এগিয়ে এসে ওর মানিব্যাগ আর রুমালটা হাতে দিয়ে বললাম, ফেলে যাচ্ছিলেন। ও পকেটে ঢুকিয়ে বলল, ধন্যবাদ। আসি।
~ শুনুন।

~ জ্বি। আমি শাড়ির আচল টেনে ঘোমটা দিয়ে ওর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। এটা কালকে করার কথা ছিল। মাথা থেকে সব বেরিয়ে গিয়েছিল তখন। সালাম শেষ করে আয়াতুল কুরসি পড়ে ওর গায়ে ফু দিয়ে দিলাম। ও তখনো অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
~ মন থেকে যখন স্বামী ভাবেন না, তখন চার দেয়ালের মধ্যে স্ত্রীর কর্তব্য পালন করতে হবেনা। আর কখনোই এসব করবেন না, আমার কষ্ট হয়। খুব তাড়াতাড়ি আমার সব সম্পত্তি আপনার নামে হস্তান্তর করে দেব। তারপর আপনি চাইলে কাগজে-কলমে তালাকের কাজ টাও সেরে ফেলব। আসি।

বলে হড়হড় করে বেরিয়ে গেল। আমি পাথরের মত সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। সত্যি ই আমাদের এক হওয়া আর সম্ভব হবেনা। আমার জগত ইতিমধ্যে আমাদেরকে আলাদা করে এক এক প্রান্তে ছুড়ে ফেলেছে।
চোখের পানি মুছে কিচেনে চলে এলাম। শাড়ির আচল কোমরে গুজে রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বার বার ভাবতে লাগলাম, একটা জ্বীনকে আমার সাহায্য করতে হবে কেন?

আর যদি করতেই হয় তবে আমি কেন? তবে কি সে জ্বীন আমার বংশোদ্ভুত কেউ যাকে আমি ছাড়া আর কেউ ই সাহায্য করতে পারবেনা।
আমার উপর যখন দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে তবে আমি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করব।

সবজি কাটার সময় মনে হল আমার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে গো গো আওয়াজ করছে। চমকে উঠলাম, এই সময় বাসায় আমি ছাড়া কেউ নেই তবে কে এমন আওয়াজ করছে। গো গো শব্দ টা আরো নিকটতর হচ্ছে। এক্ষুনি হয়ত ঝাপিয়ে পড়বে আমার উপর। সাথে সাথে সরে পড়লাম আমি।

পচা মাংসগলিত একটা হাত এসে টেবিলে পড়ল। অইখানে আমি থাকলে নিশ্চিত বড় নখ গুলো আমার শরীর ভেদ করত। তাকিয়ে দেখি একটা লোকাকৃতি মানুষ, সারা গা থেকে পচামাংস গলে গলে পড়ছে। বাজে গন্ধ আসছে তার থেকে। চোখগুলো প্রচন্ড কালো, যেন ঠেলে বেড়িয়ে আসছে।

ধারালো নখ গুলো তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আবার আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল, আমি সাথে সাথে সরে পড়লাম। এভাবে এর হাত থেকে বেশিক্ষণ বাচা যাবেনা। লড়াই করতে হবে ওর সাথে, কিন্তু আমার কাছে পূর্ণ শক্তি নেই। যা শক্তি আছে তা এক্ষুনি ব্যবহার করলে আমি জ্বীনটিকে সাহায্য করব কি করে?

হাতে থাকা সবজি কাটার ছুরিটা ছুড়ে মারলাম। অইটা ওর শরীর ভেদ করে চলে গেল। কিচ্ছু হলনা তার। এভাবে হবেনা, এ নিশ্চয়ই খুব শক্তিশালী আর অভিশপ্ত শয়তান। টেবিল হাতিয়ে কাটাচামচ পেয়ে হাত নিলাম। আয়াতুল কুরসী পড়ে কাটাচামচটা শয়তান দিকে ছুড়ে মারলাম। নিশানা গিয়ে ঠিক বুকে পড়ল। প্রচন্ড জোরে আর্তনাদ করতে করতে শয়তানটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম সবকিছু স্বাভাবিক। কে সে যে আমাকে পিছন থেকে আক্রমণ করতে চাচ্ছে? জ্বীনজাতির কেউ? কিন্তু আমি তো তাদের বংশের মেয়ে তবে আমাকে কেন আঘাত করবে?

কেউ কি চায়না আমি কিছু করি? তাই এভাবে মারতে পাঠাল। একবার যখন আমার উপর আক্রমণ হয়েছে নিশ্চয়ই সে আবার আমার উপর আক্রমণ করবে। সর্তক থাকতে হবে অনেক। দুশ্চিন্তা হচ্ছে অনেক। মনে হচ্ছে আবার খুব খারাপ কিছু ঘটবে। এমনসময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। এই সময় আবার কে আসল?
ধীরে ধীরে গিয়ে দরজা খুললাম।
~ আরেহ বৈশাখী বু।

~ কেমন আছিস?
~ হ্যা ভাল, এসো ভেতরে এসো।
~ এই নে ধর। কিছু মিষ্টি নিয়ে আসলাম।
~ কেন যে এসব আনতে গেলে? এখানে বসো।

বলে বৈশাখীবু কে ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসালাম।
~ বিয়েতে তোমাকে আর তোমার সখীকে দাওয়াত পাঠিয়েছিলাম। এলেনা কেন?
~ আসতাম কিন্তু ওয়াফাহ অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় কোমায় চলে যাওয়ার অবস্থা।

এখন সুস্থ হতেই আসলাম। অবাক হয়ে বললাম,
~ এমন অবস্থা হল কেন? দেখে তো অনেক স্ট্রং আর হাসি-খুশি মনে হয়েছিল।
~ অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর টেনশানে।
~ কিসের টেনশান?

~ ওর স্বামীকে নিয়ে। সে অনেক কথা।
~ ওনার বিয়ে হয়ে গেছে? স্বামী কোথায় উনার?
~ সবাই জানে মারা গেছে। কিন্তু ও বিশ্বাস করেনা, ওর বিশ্বাস ওর স্বামী আবার ওর কাছেই ফিরে আসবে।
~ অনেক বেশি ভালোবাসে। ওনার জন্য মায়া হচ্ছে।

~ মেয়েটা আগে গুন্ডি ছিল, স্বামীর ভালোবাসায় সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছে। পর্দাশীন, নামাযী। সেদিন নাকি তার স্বামীর মত কাউকে দেখেছে, তারপর থেকে ওর অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সারাদিন বস্তিতে ঘুরেও ওর স্বামীর মত কাউকে পাইনি।
~ তুমি কি ওর স্বামীকে দেখেছো?

~ না। ওর বিয়ে হওয়ার আগেই আমার এখানে চাকরী হয়ে যায়। চলে আসি, কাজের চাপে যাওয়া হয়নি ওইদিকে।
~ খারাপ লাগছে উনার জন্য। তো উনাকে আনোনি কেন? একটু ঠিকমত কথাও হয়নি উনার সাথে।
~ ও তো এখন আমার কাছে থাকেনা। মায়ের কাছে ফিরে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে ওর স্বামীকে পেলে যেন ওকে খবর দেই।
~ কত্ত ভালোবাসা থাকলে এমন করতে পারে বল।

~ হ্যা, অনেক ভালোবাসে নিজের স্বামী। তোর কি খবর বল? সুখে আছিস তো স্বামীর সাথে?
~ হ্যা অনেক সুখে আছি।
মনে মনে ভাবলাম, সুখ আমার কপালে কবে ছিল? না জুটল মা- বাবার স্নেহ আর না স্বামীসুখ।
~ কি এত ভাবছিস?

~ তেমন কিছু না।
~ আজ উঠি।
~ একি! দুপুরে আমার সাথে খেয়ে যাও।
~ না বোন, আমার অফিসে যেতে হবে আবার। আসি।
~ আবার এসো।

ওয়াফাহ বুর জন্য কেমন জানি টান অনুভব করলাম। বেচারীর সাথে কেমন অবিচার হয়ে গেল। মারা গেছে জেনেও স্বামীকে এত ভালোবাসে, আর আমি স্বামীর কাছাকাছি থেকেও তাকে ভালোবাসতে পারছিনা। নিজের জন্য করুণা হচ্ছে। এমন হবে জানলে কখনোই তাওহীদকে নিজের সাথে জড়িয়ে ওকে কষ্ট দিতামনা।

সকাল থেকে মনে হচ্ছে আমি ছাড়াও বাসায় কেউ আছে। কারো অস্তিত্ব টের পাচ্ছি মূহুর্তে মূহুর্তে। আমি হাটলে অন্য কারোও হাটার আওয়াজ পাচ্ছি। ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করছি। অন্য রুমে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু সেই রুমে গিয়ে কিছু দেখিনা। কি হচ্ছে আমার সাথে?

এসব আমার মনের ভুল নয় মোটেও। কেউ আমার উপর আক্রমণ করার অপেক্ষায় আছে। সন্ধ্যায় কিচেনের লাইট অফ করতেই দেখি সেখানে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। লাইট জ্বালাতেই সেটা উধাও। আবার লাইট অফ করতেই সেটা দেখা যাচ্ছে। আর লাইট অফ করলামনা, কেমন জানি ভয় ভয় করতে লাগল। মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হবে আমার সাথে। তাওহীদ এখনো কেন অফিস থেকে ফিরছে না? এমনসময় লোডশেডিং হয়ে গেল।

মনে মনে যা ভাবছিলাম তাই। সুযোগের অপেক্ষা করছিল কেউ। অন্ধকার নামতেই আমার গায়ে ঝাপিয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করলাম। শেষ পর্যায়ে একটা হাত আমার গলা চেপে ধরল শক্তভাবে।
মনে হচ্ছে এক্ষুনি মারা যাব। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আর কয়েক সেকেন্ড এভাবে থাকলে আমি মারা যাব।
আর একটাই পথ আছে এর থেকে বাচার।

নিজের শক্তি ব্যবহার করা। এই মূহুর্তে শক্তি ক্ষয়ের চিন্তা না করে নিজেকে বাচাতে হবে। কাপা কাপা হাতে বিসমিল্লাহ পড়ে শয়তানকে একটা জোরে ধাক্কা দিলাম। সেটি আমার গলা ছেড়ে দূরে ছিটকে পড়ে আর্তনাদ করতে লাগল।

এমনসময় কারেন্ট টাও চলে এল। রুমের সবকিছু স্বাভাবিক। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম। সারা শরীর প্রচন্ড ব্যথা। কিছু স্থানে কেমন একটা জ্বালা করছে।
আরো কিছুক্ষণ আগে কারেন্ট আসলে শক্তি টা খরচ করতে হতনা।

কলিংবেলটা বেজে উঠল। উঠার মত শক্তি পাচ্ছিনা। এই শয়তান টা প্রথমটার চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী।
কাবু করা কষ্টসাধ্য। অনেক কষ্টে উঠে দরজা খুললাম। তাওহীদ ঘরের দরজায় দাড়িয়েই আমাকে ঢ্যাপড্যাপ করে দেখতে লাগল। ওর এমন চাহনী দেখে আমি হকচকিয়ে উঠলাম।

ও কি আমাকে চিনতে পেরেছে? জেনে গেছে আমি জ্বীন। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। ও তাড়াতাড়ি আমার হাত চেপে তালু দেখে বলল,
~ আপনার হাতে এত রক্ত এল কোথা থেকে? সারাশরীরে এমন আচড়ের দাগ কিসের? এখন বুঝলাম এতক্ষণ জ্বলছিল কেন?
আমার একটু সর্তক থাকা উচিত ছিল।

আমি হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
~ ও কিছুনা। মাংস কাটছিলাম তখন একটা বিড়াল আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এভাবে আচড় কেটে দেয়। তাই ওকে কাটাচামচ দিয়ে আঘাত করেছিলাম।
~ বিড়াল এমন করেছে?

~ হ্যা। বোধহয় জঙলা বিড়াল।
আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি খাবার দিচ্ছি।
চলে গেলাম ওর সামনে থেকে। বড্ড বাচা বেচে গেছি আজ।

পর্ব ২২

আমি একপাশ হয়ে শুয়ে আছি। ঘুমানোর চেষ্টা করছি কিন্তু সেটা বৃথা। এমনসময় মনে হল কেউ আমার ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে, সেই সাথে অদ্ভুত গো গো আওয়াজ টা।

এক্ষুনি কামড় বসাবে মনে হচ্ছে। সাথে সাথে ধড়পড়িয়ে উঠে গেলাম। তাওহীদ পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে এভাবে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেল। “স্যরি আমি শুধু আমার ফোনটা আর বালিশ নিতে এসেছিলাম।” তাওহীদ বলল। আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
ও বালিশ আর ফোন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মূহুর্তে আমি পিছু ডেকে বললাম,
~ আজ এখানে ঘুমালে হয়না?

~ এখানে কেন ঘুমাব? আমি তো সেদিন রাত থেকে পাশের রুমেই ঘুমাই।
~ আজ এখানে ঘুমান।
~ নাহ।
~ প্লীজ।

তাওহীদ ফিরে এসে নিচে বিছানা করতে লাগল। আমি বাধা দিয়ে বললাম,
~ ফ্লোরে শুলে ঠান্ডা লাগবে। আপনি বরং বিছানার একপাশে ঘুমান। তাওহীদ এটা শুনে হয়ত রেগে গেছে। মনে মনে ভাবছে, এত বিনয় নিয়ে ডেকে এখন একপাশে শুয়ে পরতে বলছে! স্বামী হিসেবে যদি নাই বা মানবে তো ডাকল কেন! ভেবেছি হয়ত সব দূরত্ব মুছে দিয়ে বলবে, এসো তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাব।
এই জন্যই বলে বেশি আশা করতে নেই।

~সমস্যা নেই। আপনি ঘুমান।
~ কিন্তু…..
~ কিন্তু কিছু না। আপনার ভয় লাগছে, আপনি ঘুমানোর ট্রাই করুন।

আমি আছি। আমি ওর সাথে তর্ক করে পারলামনা। আমার পাশে ঘুমালে কি হত? ঘুমের বাহানায় একটিবার ছুতে তো পারতাম। যাই হোক, আমার মনটা ভীষণ কু ডাকছে। খারাপ কিছু নিশ্চয়ই ঘটবে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে এল। হঠাৎ গোঙ্গানীর আওয়াজ শুনে উঠে পড়লাম।

তাকিয়ে দেখি ভয়ংকর শয়তান ওর গলা চেপে ধরেছে। আমি আর এক মূহুর্ত দেরী না করে লাথি দিয়ে ওইটাকে দূরে সরিয়ে দিলাম। ভীষণ ধস্তাধস্তি করছিলাম। তাওহীদ কিছু বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে। ওইটার গলা ধরে শুন্যে উঠিয়ে ধরতেই দেখি, তাওহীদের পিছনে আরো একজন দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে তাওহীদের গলা চেপে ধরল। আমার হাত আলগা হয়ে গেল দেখে, ওইটাকে ছেড়ে যেই তাওহীদের কাছে যাব তখন শয়তানটা আমার গলা শক্ত করে চেপে ধরল। নখগুলো আমার বুকের কাছে এগিয়ে দিচ্ছে।

আর একটু পরেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে আমার শরীর। কি করব বুঝতে পারছিনা। আর একটা উপায় ই আছে নিজের শক্তিকে প্রয়োগ করা। তাড়াতাড়ি দোয়া পড়ে ওই শয়তানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম।
তাওহীদের দিকে দৃষ্টি দিতে আমার চোখ থেকে আগুনের গোলা বের হয়ে ওইটাকে জ্বালিয়ে দিল। ওইটা তাওহীদকে ছেড়ে দিতেই তাওহীদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

আশংকা করছিলাম তাওহীদের কিছু হয়ে গেল কিনা! কাছে এসে রুমের আলো জ্বালিয়ে ওর মাথাটা আমার কোলে রাখলাম। আল্লাহর রহমতে ওর কোনো ক্ষতি হয়নি কেবল জ্ঞান হারিয়েছে মাত্র। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। সকালে ওর জ্ঞান ফিরে এল, নিজেকে আমার কোলে আবিষ্কার করল। ধড়পড়িয়ে উঠে বসে বলল, আপনি ঠিক আছেন তো?
~ জ্বী, আমার কি হবে?

~ রাতে কেউ আক্রমণ করেছিল…
~ কই কে আক্রমণ করেছে? আপনি কি স্বপ্ন দেখছিলেন?
~ উফফ, স্বপ্ন নয়। আমার গলা জোরে চেপে ধরেছিল কেউ৷ তারপর মনে হল আপনি কারো সাথে ধস্তাধস্তি করছেন।

~ ওহ হো তাওহীদ সাহেব। আপনি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিলেন। কেউ যদি আপনার গলা জোরে চেপে ধরত আপনার গলায় দাগ নিশ্চয়ই থাকত। আমার গায়ে চোট থাকত। দেখুন কিছুই নেই। রাতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন তাই আপনার পাশে বসেছিলেন। ফ্রেশ হয়ে আসুন।

তাওহীদ ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। উফফস! ভেবেছিলাম তাওহীদ সব ভুলে গেছে। কিন্তু কিছুই ভুলেনি, রাতে আমি ঠিকিই আন্দাজ করেছিলাম ওরা আমাকে দূর্বল করতে তাওহীদের উপর ই আক্রমণ করবে।

তাই তাওহীদকে আমার কাছে রেখে রুমের লাইটগুলো মেইন সুইচ অফ করে দিয়েছিলাম। যাতে ওরা আক্রমণ করলেও তাদের ভয়ংকর চেহারা তাওহীদ না দেখে। আমার আক্রমণাত্বক দৃশ্য না বুঝতে পারে। তাওহীদের গলায় থাকা দাগ আর আমার গায়ের আচড়ের দাগ সব উধাও করে দিয়েছি।

কে সে যে পিছন থেকে বার বার আমার উপর আক্রমণ করছে? তার উদ্দেশ্যটা কি? সে যেই হোক, আমার হাত থেকে তার নিস্তার নেই। এইসময় পুরো রুমে একটা অদৃশ্য বুকফাটা হাসির আওয়াজ কানে আসতে থাকে। তার মানে যে আমার ক্ষতি চাচ্ছে সে আমার সব কথা শুনছে, আমার আশেপাশে আছে।
আরেকটু সাবধান হতে হবে আমায়।

এভাবে কতদিন লড়াই চালিয়ে যেতে পারব জানিনা! শক্তি অনেকটা এসব লড়াইয়ে ব্যয় করে ফেলেছি। খুব তাড়াতাড়ি ওই জ্বীনদাদুর সাথে কথা বলতে হবে। এই সামান্য শক্তি নিয়ে আর লড়াই করতে পারবনা আমি। না বাচতে পারব, না বাচাতে পারব।

ওয়াফাহ বার বার বলতে থাকে, মা বিশ্বাস করো, মুহিব বেচে আছে। দাদু আমাকে নিজে এসে বলে গেছেন। মা গো, খুব তাড়াতাড়ি তোমার জামাই আমার কাছে ফিরবে। তুমি এমন করোনা।
~ তুই তো বলেছিলি তোর দাদাশ্বশুর মারা গেছে।

~ হ্যা, উনি আমাকে দেখা দিয়েছেন। সালেহা খাতুন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। তার মেয়ে দিন দিন মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছেনা, যে চলে যায় সে ফিরে আসেনা। মুহিব ও ফিরবেনা। মেয়েটার পাগলামী দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিভাবে বলে বসল, ওর দাদাশ্বশুড় বলে গেছে। আল্লাহ আমার সব তো কেড়ে নিলে, এখন একমাত্র সম্বল মেয়েটাকেও পাগল বানিয়ে দিলে। এখন আমি কার মুখে দেখে বাচব?

এমন জানলে তো সমাজ আমার ওয়াফাহকে পিষে মারবে। আমি কি করব বলে দাও? এক কাজ করো, আমার মেয়েটাকে তুমি নিজের কাছে উঠিয়ে নাও, নাহলে আমি ওকে গলা চেপে মেরে ফেলি। আমার ওর কষ্ট হচ্ছেনা।
সালেহা খাতুন হাত দুটো বাড়ায় ওয়াফাহর গলা চেপে ধরার জন্য। পরক্ষণেই গুটিয়ে নেয়, মা হয়ে কি করে নিজের মেয়েকে মারবে সে?

কিন্তু সমাজ ও তো তার মেয়েকে বাচতে দিবেনা, তিলে তিলে মারবে যখন জানতে পারবে ওয়াফাহ এমন পাগলামী করছে। কেউ যে ওকে দেখতে পারেনা, সবার ওর উপর রাগ। যাদের উপকার করেছিল নিজের সবটুকু দিয়ে তারাও আজ ওর সাথে নেই।

নাহ, নিজের মেয়েকে বাচাতে হলে এবার ওকে জোর করে হলেও বিয়ে দিতে হবে। নতুন জীবন পেলে আমার মেয়েটা আবার নতুন করে বাচতে পারবে। সব পাগলামী ভাল হয়ে যাবে। আজ ই আমি ওর জন্য ছেলে দেখব। ছেলে যেমনি হোক না, বিয়ে দিয়ে দিব ওয়াফাহর।

বিড়বিড় করতে করতে সালমা খাতুন উঠে নিজের ঘরে ফিরে যায়। যাওয়ার আগে আলো নিভিয়ে ওয়াফাহর গায়ে কাথা টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। ওয়াফাহর চোখে ঘুম নেই, কবে ওর মুহিব ওর কাছে নেই। আল্লাহ আর কত দিন?
ভেবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকে ওয়াফাহ।

হঠাৎ একটা ডাক আসে। ওয়াফাহ ধড়পড়িয়ে উঠে বসে। মনে হল, কেউ ওকে ডাকল। কান পেতে আবার শোনার চেষ্টা করল। না কেউ তো ডাকেনি, ভুল শুনেছি নিশ্চয়ই। ভেবে শুয়ে পড়ে ওয়াফাহ।
আবার ডাকটা আসে। ওয়াফাহ আবার উঠে বসে, এইবার আর ভুল শুনেনি। ওর মুহিবের কন্ঠে বউ ডাক শুনেছে। সামনে তাকিয়ে দেখে একটা হালকা সাদা ছায়া, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা। ওয়াফাহ খুশী হয়ে ডাকে, মুহিব।
~ বউ, কেমন আছো?

~ একটুও ভাল নেই তোমাকে ছাড়া। তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? একবারো ভাবলে না, তোমার ওয়াফাহ কত কষ্ট পাবে। কেউ বিশ্বাস করেনা, তুমি বেচে আছো। সবাই আমাকে তোমায় ভুলে যেতে বলছে।
ওরা বুঝেনা, তোমাকে ভুলে যাওয়া মানে নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যাওয়া।

~ বউ, তুমি আর কষ্ট পেয়োনা। তোমার মুহিব তোমার কাছেই আছে।
~ একবার জড়িয়ে ধরবা আমায়?
ছায়াটা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি একটুও অনুভব করলাম না, কান্না পাচ্ছিল। এতটা কাছে থেকেও আমরা দুজন দুজনকে স্পর্শ করতে পারছিনা।

মুহীব কান্নামাখা গলায় বলল,
~ কেদোনা ওয়াফাহ। আমার কষ্ট হয় তুমি কাদলে।

চোখ মুছে নিলাম আমি। সে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ বউ, আমি এমন এক জায়গায় আছি। যেখান থেকে এখন সরাসরি শরীর নিয়ে আসা অসম্ভব। তাই আমার রুহ আমার শরীর ছেড়ে তোমাকে এক পলক দেখার জন্য অনেক কষ্টে ছুটে এসেছে। জানিনা, কবে মুক্তি পাব। বউ, আল্লাহ যদি আমাদের মিলন ভাগ্যে না রাখে তুমি এভাবে কষ্ট পেয়োনা।

ভাল কাউকে জীবনসঙ্গী করে নিও। আমাদের ভালোবাসা যদি আল্লাহ পবিত্র মনে করেন হাশরের ময়দান এবং জান্নাতে এক সাথে থাকার তওফীক দিবেন।
ভুলেও আত্মহননের চিন্তা করোনা।

সব ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করো। আমি জানিনা, আমি আদৌ আর কখনো তোমার কাছে ফিরতে পারব কিনা। বেচেও থাকব কিনা!
আল্লাহ যদি ভাগ্যে রাখেব তবে আবার আমাদের দেখা হবে।

এভাবে নিজেকে কষ্ট দিওনা আর, আমি তোমার কষ্ট দেখে শেষ হয়ে যাচ্ছি।
বলতে বলতে কেদে ফেলল মুহিব।
~ এটা কখনোই সম্ভব না। আমি একমাত্র তোমাকেই স্বামী হিসাবে কবুল করেছি। আর কাউকে সেস্থানে বসাতে পারবনা।

~ একটু বুঝো বউ। আমি যতটা কষ্টে তোমার কাছে এসেছি, তুমি তা কল্পনা করে এক্ষুনি আমার মৃত্যুকামনা করবে। আমার শরীরে প্রতিটি ইঞ্চিতে ক্ষতের দাগ। দেখলে তুমি সইতে পারবেনা।

এভাবে আমি বেশিদিন বাচবনা। তাই তোমার কাছে অনুরোধ, এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করোনা। আল্লাহর প্রদত্ত কিছু পায়ে ঠেলতে নেই।
এইটুকু বিশ্বাস রাখো, একদিন না একদিন আমাদের মিলন ঠিকি হবে হয়ত ইহকার নয়ত পরকাল।

মুহিব আরেকবার আমাকে বুকে টেনে নিল, কপালে চুমু খেল। আমি কিছুই অনুভব করতে পারছিনা, কিন্তু মন দিয়ে অনুভব করে নিলাম। দুজন দুজনকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কেদে ফেললাম। ইচ্ছে হচ্ছিল, সময়টা চিরদিনের জন্য এখানে থামিয়ে দেই, এখানে আমাদের জান কবজ হয়ে যাক। তাহলে আমাকে আর মুহিবকে হারাতে হবেনা।
কিন্তু ভাগ্য আর সময় দুটোই আমাদের সাথে বেঈমানী করল।

কোথা থেকে কয়েকটা আগুনের গোলা এসে ওর রুহকে আমার থেকে ছুড়ে ফেলে দিল ভস্ম করে দিচ্ছিল। আমি হাত বাড়িয়ে ওকে ছুতে চেষ্টা করছিলাম। চোখের পলকে ওর রুহ অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি চিৎকার দিয়ে উঠে পড়লাম। ভীষণ ভাবে হাপাচ্ছি।
মা ছুটে এসে আলো জ্বালালেন। আমি হাত বাড়িয়ে চিৎকার করছি,
~ মুহিব, যেয়োনা।

মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কি হয়েছে তোর মা?
~ মা, ও মা। আমার মুহিব এসেছিল আমার কাছে। কিন্তু ওই ওরা ওকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গেল। ওরা নাকি আমার মুহিবকে বেশীদিন বাচতে দিবেনা। মা আমার মুহিবকে ফিরিয়ে এনে দাওনা, মাগো দাওনা।
আমি যে অকে ছাড়া থাকতে পারবনা। মাগো, এনে দাওনা আমার মুহিবকে।
তোমার দুটো পায়ে পড়ি।

সালেহা খাতুন মেয়েকে বুকের সাথে জাপটে ধরে। আচল মুখে চেপে হু হু করে কেদে উঠেন। ওয়াফাহ কাদতে কাদতে নিস্তেজ হয়ে যায়। সালেহা খাতুন ওকে শুয়ে দিয়ে মোনাজাত ধরেন,
” মাওলা, ও মাওলা আর কত কষ্ট দিবেন আমার মেয়েটাকে। কোনো সুখ ই তো ওর কপালে স্থায়ী করলেননা। এভাবে চললে আমার মেয়েটা মরে যাবে। মা হয়ে চোখের সামনে কি করে সন্তানের মৃ্ত্যু দেখি! আপনি রহমত করুন মাওলা।”

হঠাৎ আমার চোখ ছুটে গেল। পুরো শরীরে কেমন একটা অস্বস্তিবোধ করছি। একটুপর অনুভব করলাম সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে আমার। জ্বালা একটু হালকা হতেই গায়ে যেন এক একটা চাবুকের বাড়ি পরছে। ভীষণ ছটফট করছি বিছানায়।
তাওহীদ দেখতে পেয়ে ছুটে এলে আমার কাছে……

পর্ব ২৩

আমি ছটফট করতে করতে তাওহীদকে শক্ত করে চেপে ধরলাম। কষ্টটা বেড়েই যাচ্ছে। অদৃশ্য কে আমাকে এত নৃশংসভাবে আঘাত করছে? আল্লাহ সহায় হও। আল্লাহ সহায় হও। আস্তে আস্তে অত্যাচার টা বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু শরীরে প্রচুর জ্বালা করছে, ব্যথার চোটে কাতরাচ্ছি।

তাওহীদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বার বার উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে তোমার? কোথায় যন্ত্রণা হচ্ছে তোমার? আমি নিস্তেজ হয়ে তাওহীদের কাধে মাথা সপে দিলাম। কাপা কাপা কন্ঠে বললাম, আমাকে একটু পানি খাওয়াবেন?

তাওহীদ আমার মাথা পিছনের বালিশে হেলান দিয়ে ছুটে গেল পানি আনতে। পিপাসায় বুকে ফেটে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অনেকদিন আমি পানি খাইনি। তাওহীদ পানি এনে খাইয়ে দেয় আমাকে। হঠাৎ দেখলাম কালো ধোয়ার কুন্ডলি বাড়ির ছাদে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাওহীদ আস্তে করে শুইয়ে দিল বলল, ঠিক আছো তুমি?

~ হুম। আমি বুঝতে পারছি জ্বীনদাদু আমার সাথে কথা বলতে চায়। যেভাবে হোক তাওহীদকে এখান থেকে সরাতে হবে, নতুবা আমাকে একটা নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। ও মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ কিছু লাগবে তোমার?
~ খুব খারাপ লাগছে। একটু স্যুপ খেতে ইচ্ছে করছে।

~ আচ্ছা আমি বানিয়ে আনছি।
~ আমি পারব
~ তোমায় উঠতে হবেনা। বসো তুমি, আমি বানিয়ে আনছি।
~ বাসায় স্যুপের প্যাকেট নেই।

~ এখনো বেশি রাত হয়নি, বের হলে কোনো শপ খোলা পাব। তুমি চোখ বুজে শুয়ে থাকো। আমি আসছি।
মনে মনে এটাই চাচ্ছিলাম। তাওহীদ বেরিয়ে পড়ার সাথে সাথে আমি দরজা আটকে আয়নার সামনে এসে দাড়ালাম। ঘুর্ণীয়মান কালো ছায়াটা আয়নায় ঢুকে পড়ল। নদীর মত কালো ঢেউ উঠাতে লাগল। একটু পরেই সেই নূরানী চেহারার জ্বীনদাদু আমার সামনে ভাসমান হল। সুন্দরভাবে সালাম দিলাম।

উনি সালামের উত্তর নিয়ে বলল, তোমার উপর নিশ্চয়ই এই কয়েকদিনে অনেক হামলা হয়েছে। অনেক বেশি শক্তি খরচ করে ফেলছো। এখন যা শক্তি আছে তা নিয়ে তুমি কিছুতেই কাউকে উদ্ধার করতে পারবেনা।
~ আমিও সেটাই ভাবছিলাম। কিন্তু এখন কি উপায়?

~ তোমাকে পূর্ণশক্তি ফিরে পেতে হবে।
~ কি করে ফিরে পাব?

~ সামনের শুক্রবারের গভীর রাতে তোমাকে জ্বীনরাজ্যে যেতে হবে।
~ জ্বীনরাজ্যে কেন? সেটাই বা কোথায়?
আমাকে সেখানে অন্য জ্বীনরা ঢুকতে দেবে?

~ জ্বীনরাজ্যে ঢুকার পথ কালো ছায়ার পিছু পিছু গেলেই পাবে। সে তোমাকে পথ দেখিয়ে দিবে। জ্বীনরাজ্যে ঢোকা কিন্তু মোটেও সহজ নয়। অনেক সাবধানে থাকতে হবে, এমন কারো সাথে মিশে এমন কোনো কথা বলবেনা যাতে ওরা বুঝে যায় তুমি সাধারণ জ্বীন নও।

সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে তুমি যদি সুরম্য প্রাসাদে ঢুকে বিশেষ কক্ষ থেকে জ্বীনি তলোয়ার নিয়ে ফিরতে পারো তবে তুমি তোমার পূর্ণ শক্তি ফিরে পাবে। কিন্তু মনে রেখো প্রাসাদে অনেক কড়া পাহারা। সহজে প্রবেশ করতে পারবেনা।

একটা ছোট ভুল ও তোমাকে সারাজীবন কারাবাস করাতে কিংবা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আর তোমার এই যাত্রার কথা যেন কেউ জানতে না পারে।

তারপর কি করতে হবে সব আমি পরে বলে দিব। সাথে করে ছোট আয়না নিয়ে যেও। যেকোনো সময় আমি তোমার মুখোমুখি হতে পারি।
~ আচ্ছা। কিন্তু সেই জ্বীনটা কে যাকে আমার উদ্ধার করতে হবে?

~ সেও তোমার মত বিশেষ জ্বীন। তোমার বংশেরই। যাকে একমাত্র তোমাকেই উদ্ধার করতে হবে।
আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব এমনসময় দরজায় তাওহীদ কড়া নাড়ল। বার বার কড়া নাড়ছে আর ডাকছে। আমি গিয়ে দরজা খুললাম। খুলে আয়নার সামনে এসে দাড়ালাম। জ্বীন দাদু চলে গেছে দেখে আশ্বস্ত হলাম।

তাওহীদ গরম স্যুপ টেবিলে রেখে বলল, দরজা বন্ধ ছিল যে?
~ ভয় লাগছিল তাই বন্ধ করে রেখেছি।
~ আচ্ছা, এবার বিছানায় উঠে বসো হেলান দিয়ে।
~ কেন?

~ বসো। তার কথামত বসে রইলাম। ও স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে ফু দিয়ে অল্প অল্প করে খাইয়ে দিল। বলতে লাগল,
~ আরেকটু হলে স্যুপের প্যাকেট পেতাম না। শপ অফ করে দিয়েছিল, মালিককে দিয়ে আবার ওপেন করে তবে এনেছি। তাড়াতাড়ি করে বানিয়ে ফেললাম।
যদিও একটু দেরী হয়ে গিয়েছে।

আমি চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাগী ছেলেটা কত্ত কিছু পারে। ওর সাথে হয়ত আমার বেশীদিন থাকা হবেনা। জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার পর আমি মরেও যেতে পারি। যাওয়ার আগে ও সবকিছু জানিয়ে যাব। যাতে বেচারা আমার জন্য কষ্ট না পেয়ে নতুন একটা জীবন শুরু করে। নিজেকে এখন থেকে সব জাগতিক মায়া থেকে দূরে সরিয়ে প্রস্তুত রাখতে হবে। সব ভুলে যেতে হবে।

তাওহীদ আমার শরীর ঝাকিয়ে বলল,
~ কি গো, কি ভাবছো?

~ কিছুনা। আর খাবনা।
~ আর একটু তো।
~ উহু, ইচ্ছে করছেনা। পানি খাব
~ এই নাও।

এসো শুয়ে পড়ো, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
তাওহীদের প্রতিটি যত্নে, কথায় আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছি। আমি যতই চাচ্ছি ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, ততই যেন আষ্টেপৃষ্ঠে আকড়ে ধরছে আমায়।

মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি। ওকে ছাড়া একটা মূহুর্ত ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। আমার জীবন আর ওর জীবন এক নয়, আলাদা একদিন না একদিন তো হতেই হবে। এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিলাম।
~ আমি আপনার কাছে সহানুভূতি চেয়েছি? এসব করে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, স্বামীত্ব ফলাচ্ছেন তাইনা? আমি এসব চাইনাহ। আপনি যান এখান থেকে।
তাওহীদের মুখ লাল হয়ে গেছে। এক্ষুনি কেদে দিবে মনে হচ্ছে। ঝট করে উঠে চলে গেল। আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম।

ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি, ওর চোখের পানি মুছে দেই। কিন্তু আর ১টা দিন আমি ওর সাথে আছি। এই ১টা দিনে আর ওকে মায়ায় ফেলতে চাইনা। উঠে গিয়ে দেখি ও সত্যি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। টেবিলের উপর থেকে সবকিছু নিচে ফেলে দিচ্ছে। মেঝেতে বসে হাটুতে মুখ রেখে মন খুলে কাদছে।
ওর কাছে ছুটে যেতে চাইলাম কিন্তু আমার মস্তিষ্ক আমাকে বাধা দিল।

ওয়াফাহ মনমরা হয়ে বসে আছে। কানে এখনো মুহিবের বলা কথাগুলো বাজছে। ওকে ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করা আসলেই কি সম্ভব? মুহিবের প্রতিটা কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে এসেছি, বিশ্বাস করেছি। এটাও বিশ্বাস করি, আমরা একদিন না একদিন এক হব। কিন্তু নতুন কাউকে নিয়ে সংসার শুরু করা অসম্ভব। এটা আমি কিছুতেই করতে পারবনা।

উঠোনে বয়ে যাওয়া বাতাসে আমার চুলের খোলা অংশ মুখে এসে পড়ল। মনে হল মুহিব যেন আলতো করে সেগুলো সরিয়ে দিল। তক্ষুনি উঠে বসে ওকে চারিদিকে খুজতে লাগলাম। কোথাও নেই সে।
মা এসে বলল, মুহিবকে খুজছিস?

আমি উত্তর না দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম।
~ দেখ, যে চলে গেছে সে আর কখনোই ফিরবেনা। তার স্মৃতি কেন আকড়ে ধরে বসে আছিস? ভুলে যা মা।
~ তাহলে তুমি কেন বাবাকে ভুলোনি?

কেন নতুন করে জীবন শুরু করোনি? মা রেগে গেল তাও শান্তগলায় বলল,
~ আমার তো তুই ছিলি।

কিন্তু তোর তো কেউ নেই। কিছুদিন পর আমিও কবরে চলে যাব, তখন তোর কি হবে একবার ভেবে দেখেছিস?
মা তুই রাজি হয়ে যা। ছেলে হিসেবে রাফি খারাপ হবেনা। ও আগের মত খারাপ নেই। আর এভাবে জীবন টা নষ্ট করিসনা।

শুকনোমুখে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
~ তোমার যা ভাল মনে হয় তাই করো।
মা খুশি হয় আমার মাথায় চুমু খেল।

আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। ভাগ্যটাকে উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিলাম। যে দিকে নিয়ে যায়, সেদিকেই যাব। শুধু বিনিময়ে উনি আমার মুহিবকে ভালো রাখুক। জালেমের হাত থেকে রক্ষা করুক। আমার জন্য আর কিছুই চাওয়ার নেই। যদি জীবনে কোনো পূন্য করে থাকি আল্লাহ যেন পরকালে আমাদের এক করে দেন।

রাত ১টা বাজে। সবকিছু গোছগাছ করে নিয়েছি। তাওহীদের মুখের দিকে একবার তাকালাম। কত নিষ্পাপ লাগছে তাকে, গভীর ঘুমে অচেতন। আস্তে করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। জানিনা আর কখনো দেখা হবে কিনা?
আল্লাহ তুমি ওকে ভাল রেখো। খামে ভরা চিঠিটা তার মাথার কাছে রেখে দিলাম।

ইচ্ছে হল তার কপালে একটু চুমু একে দেই। কিন্তু ছায়াটা বড্ড তাড়া দিচ্ছিল। কারণ এই সময়ে জ্বীনরাজ্যে প্রবেশের গুপ্তপথ কেবল ১মিনিটের জন্য খুলে। এর মধ্যে না ঢুকতে পারলে সামনের মাসের তিন শুক্রবার অপেক্ষা করতে হবে। তাই আর কিছু করতে পারলামনা। ছুটে আয়নার কাছে চলে গেলাম।

শেষবারের মত তাওহীদের দিকে একপলক তাকিয়ে আয়নায় লাফ দিলাম।
ঢুকে গেলাম অন্য এক জগতে। এখানকার সব কিছু লালচে লাগছে।

ছায়াটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ এটা লালাভভুমি। এখানকার ভূমির মাটি রক্তখেকো মাটি। পদে পদে ধারালো কাচ লুকিয়ে আছে। অসাবধানে পা দিবে তো পা কেটে যাবে আর তোমার শরীর অধের্ক রক্ত ওরা চুষে নিবে। বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে তুমি।
অতএব সাবধান।

শুনেই ভয় লাগছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মাটিতে অনেকটা অংশ ছুড়ে রক্ত ছিটানো। তার মাঝে মাঝে একটু একটু খালি জায়গা। সেখানের মাটিতে রক্ত নেই, সাধারণ মাটির মতই। বিসমিল্লাহ বলে রক্তমাখা মাটিতে পা দিলাম। দেখে দেখে সব রক্তমাখা মাটিতে পা দিয়ে লালাভভূমি থেকে বের হয়ে আসলাম। ছায়াটা ডিবির উপর আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমাকে দেখতে পেয়ে খুশি হল এবং বলল,
~ তুমি খুব বুদ্ধিমতী। আল্লাহর রহমতে তোমার কিছুই হয়নি।
~ শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে।
~ কি করে করলে এটা?

~ আমার কাছে এটা খুব নিপুণ ফাদ মনে হয়েছে। রক্তমাখা জায়গা গুলোই নিরাপদ কেননা, রক্ত দেখলে কেউ ই ভয়ে সেখানে পা দিবেনা। খালি মাটিতে পা দিয়ে আসবে। আর সেখানে লুকিয়ে থাকবে ধারালো কাচ।
~ এই না হলে জ্বীনকন্যা।

এসো এগিয়ে যাই আমরা। মনে একটু স্বস্তি লাগল একটা ধাপ পেরোতে পেরে। জানিনা আর কত ধাপ পেরিয়ে গেলে আমি সফল কিংবা কোন ধাপে লেখা আছে আমার মৃত্যু। আল্লাহ মালুম❤

পর্ব ২৪

তারপর ছায়াটার পিছু পিছু আবার হাটতে লাগলাম। যতো সামনে এগোচ্ছি তাওহীদের সেই নিষ্পাপ ঘুমিয়ে থাকা চেহারার কথা মনে পড়তেছে। ইচ্ছে করছে ছুটে যাই তার কাছে কিন্তু না তা তো সম্ভব না এখন।

সামনে এগিয়ে যাওয়াটা যতটা দুঃসাধ্য ভয়ংকর ঠিক তেমনি এখান থেকে পিছপা হওয়াটা আরও বেশী ভয়ংকর। কিছুটা যেতেই একটা বিরাট জলাশয় পড়ল। ছায়াটা থমকে গিয়ে বলল, এই জলাশয়ের ওপারে রয়েছে জ্বীনরাজ্যের গুপ্ত সদরদরজা।

এই ধাপটা ভীষণ কঠিন। হয়ত মরতে হবে নয়ত মারতে হবে। এই জলাশয়ের পানি অনেক বেশি ঠান্ডা। বরফগলা পানি বলতে পারো। ১৫মিনিটের বেশি থাকলে দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে। তাছাড়া এই জলাশয়ে জোক আর কুমিররুপী জ্বীন রয়েছে। এরা অনেকদিনের অভিশপ্ত আর প্রচন্ড হিংস্র। তুমি পানিতে নামার সাথে সাথেই এরা তোমাকে আক্রমণ করবে।

শুনে ঢোক গিলে একবার জলাশয়ের দিকে তাকালাম। দেখতে ভীষণ শান্ত এবং সুন্দর। কিন্তু এর পিছনে এটার এত ভয়ানক রুপ। ছায়াটা আমাকে বলল,
~ এই পুরোটাই তোমাকে সাতরে পার হতে হবে। আর সেটা ১৫মিনিটের মধ্যেই। জলাশয় টা যত বড় তাতে খুব বেশী জোরে সাতরে গেলে ৪৫মিনিট লাগবে। যা থাকে কপালে। প্রস্তুত হয়ে নিলাম। কোমড়ের আচলে একটা ছোট ছুড়ি ছিল।

সেটা বের করে হাতে নিলাম। জানিনা এটা দিয়ে ওদের সাথে মোকাবেলা করতে পারব কিনা! তবে মৃত্যুর আগ অব্ধি লড়াই করে যাব। ভেবে আল্লাহর নাম নিয়ে জলাশয়ে ঝাপ দিলাম। ছায়াটা যা বলেছিল একদম সত্যি। পানি এতটাই ঠান্ডা যে ৫মিনিটে কেউ দম আটকে মরে যেতে পারে। সাতরাতে লাগলাম অনেক জোরে জোরে। একটু পর দেখলাম আমার চারপাশে অগণিত জোক আর কুমির।

এক এক করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। হাতের ছুরি দিয়ে কয়েকটা মারলাম। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ! পারছিনা আর, একদিকে হাত-পা অবশ হতে শুরু করেছে। এদিকে যত মারছি তত এরা এগিয়ে আসছে। একটা কুমির আমার হাতে সজোরে কামড় বসাল।

ব্যথায় হাত থেকে ছুরিটা পড়ে অতল পানিতে তলিয়ে গেল। এবার কি হবে ভাবছি! মূহুর্তে ডুব দিলাম। এরাও ঢুব দিয়ে আমাকে খুজতে লাগল। পানির একটুনিচে থাকলে এরা আমাকে ধরে ফেলবে। তাই পানির একদম গভীরে নেমে গেলাম। এভাবে ডুব সাতার দিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। আর পারছিনা, দম বন্ধ হয়ে আসছে। এভাবে আর কয়েক মূহুর্ত থাকলে মরে যাব। তাড়াতাড়ি পানির উপরে মাথা তুললাম। আলহামদুলিল্লাহ আমি ডাঙ্গার কাছেই আছি। দেরী না করে সাতরে উঠে পড়ল। শরীর এখনো থরথর করে কাপছে। নিশ্চিত নিউমোনিয়া ই হবে। তাও আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছি।

জ্বীনকন্যা হওয়ার শাস্তি এত জানা ছিলনা। ছায়াটা কোথা থেকে আবার ফিরে এল। একটা মোটা চাদরের মত কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে নিতে বলল। তার কথামত পেচিয়ে নিলাম। সে খোশমেজাজে বলল,
~ তুমি পেরেছো।
~ আল্লাহ সহায় ছিলেন।
~ শোকরান।

সামনেই জ্বীনজগতের সদরদরজা। সেটা পের হলেই জ্বীনজগতের দুনিয়ায় যাবে তুমি। খুব সাবধানে থেকো। আমি তোমার সাথে আর যেতে পারবনা। তবে এটা মনে রেখো, সেখানে পদে পদে তোমার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।

আর হ্যা, তুমি পোশাক পালটে খাদিমার সেজে নাও। যাতে কেউ তোমাকে দেখে একজন দাসী ছাড়া আর কিছুই না ভাবে। তোমার ব্যাগে পোশাক রয়েছে। সুযোগমত পালটে নিও।
এগিয়ে যাও। আমি আসি। আল্লাহ তোমার সহায় হন।
~ জ্বি। ফি-আমানিল্লাহ।

তাওহীদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। উঠে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নিল। আজ এতবেলা হওয়ার পর ও সিমরান আমাকে ডেকে দিলনা। সে জানে আমাকে না ডেকে দিলে আমার ঘুম ভাঙ্গবেনা।

ওহ, কাল রাতের ঘটনার পর আমার তার কাছে এসব আশা করা বৃথা। ভাবতে ভাবতে তাওহীদ ফ্রেশ হয়ে নিল। এতক্ষণ হয়ে গেল রান্নাঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছেনা কেন! সিমরানের কি হল আজ?
ধীরপায়ে তাওহীদ রান্নাঘরে আসল। কোথাও তো সিমরান নেই।

তাওহীদের মন অজানা আশংকায় কেপে উঠল। পাগলের মত পুরো বাড়ি সিমরানকে খুজল। কোথাও সিমরান নেই। তবে কি সত্যি সিমরান আমাকে ছেড়ে চিরদিনের মত চলে গেছে? আমার পবিত্র ভালবাসা তাকে আটকে রাখতে পারেনি।

বিছানায় উপর হতাশ হয়ে বসে পড়ল। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে। সিমরানকে একটাবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, কি দোষ ছিল আমার? আমার ভালবাসায় তো কোনো খাদ ছিলনা? কেন এমন হল আমার সাথে?
হঠাৎ বিছানার উপর রাখা খামটা চোখে পড়ল আমার। এটা নিশ্চয়ই সিমরান ই রেখে গেছে। খামটা ছিড়ে সাদা ভাজ করা কাগজটা বের করলাম।

সেখানে সিমরানের কাচা হাতের কিছু লেখা ছিলঃ
প্রিয় স্বামী,
আমার সালাম নিও। মনে মনে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমাকে ভীষণ অপরাধী ভেবে নিয়েছো।

অনেক বেশী কষ্ট ও পেয়েছো। আমি সত্যি ই তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি। আমি চাইনা তুমি সারাজীবন আমাকে অপরাধী ভেবে নিজেই কষ্ট পাও। তাই আসার আগে তোমাকে সবটা জানানো উচিৎ মনে হয়েছে। মুখে বলার মত সাহস আমার নেই, তাই চিঠিই শেষ ভরসা।

তোমাকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম আর এখনো ভালবাসি। আমার জীবন কিংবা অতীত সম্পর্কে তুমি অবগত নও যেমনটা তোমার আমার বিয়ের আগ অবধি আমি ছিলামনা। সেদিন হঠাৎ করে আমার উধাও হওয়ার কারণ এটাই আমার আসল জীবনের সম্পর্কে জানার জন্য কেউ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল অন্য এক জগতে।

তুমি হয়ত ৫-১০টা মানুষের মত বিশ্বাস করবেনা কিন্তু এটাই সত্যি আমি তোমার মত রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ নয়। আমি জ্বীনকন্যা মুসকান। জ্বীন এর সন্তান আমি। যদিও পুরো সঠিক পরিচয় আমি জানিনা। একজন জ্বীনকন্যা হিসাবে আমার উপর একটা দায়িত্ব ছিল একজন অসহায় জ্বীনকে উদ্ধার করা। যেটা করতে গেলে আমার শক্তি আর সামর্থ্য প্রয়োজন। তোমার আমার মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক গড়ে উঠলে সেটা আমার এসব নষ্ট করে দিত। তাই আমাকে নিষেধ করা হয়েছিল। আর সেজন্য বাধ্য হয়ে আমি তোমার সাথে এসব করেছি।

বিশ্বাস হচ্ছেনা, তাহলে সেদিন রাতের কথা ভেবে দেখো যেদিন আমাদের উপর আক্রমণ হয়েছিল।
এসবের সাথে লড়াই করতে গিয়ে আমার সব শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই আমি জ্বীনরাজ্যে যাচ্ছি নিজের শক্তি আর দায়িত্ব পালন করতে। জানিনা কোন পদে আমার মৃত্যু লেখা আছে। তবে হয়ত আমাদের আর দেখা হবেনা।
তুমি আমার আশায় থেকোনা।

ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করো। নিজের খেয়াল রেখো, নিজেকে কষ্ট দিওনা।
আল্লাহ হাফেজ। ফি-আমানিল্লাহ।

চিঠিটা পড়ে তাওহীদ হতভম্ব হয়ে গেছে। কি বলবে বুঝতে পারছেনা! একটু নীরব থেকে বলল, তুমি সিমরান হও কিংবা মুসকান। আমি তোমাকেই ভালবাসি। নতুন জীবন তোমার সাথেই শুরু হয়ে গেছে।
তোমার জন্যই অপেক্ষা করব সারাটা জীবন।
আল্লাহ তুমি ওর সহায় হও।

মুসকান পোশাক পালটে নিল। ছোট আয়নায় দেখে নিল তাকে একজন খাদিমার মতই লাগছে। তার দুকদম সামনে বিশাল স্বর্ণের শক্ত দরজা, দরজার উপরে আরবিতে লেখা, “এই জগত তারই জন্য, যে আগুনের তৈরী। আল্লাহ জ্বীনকে নিশ্চয়ই আগুন দিয়ে তৈরী করেছেন।”
“শোকর করুন তার দরবারে।”

পর্ব ২৫

সদরদরজায় কোনো পাহারা নেই দেখে অবাক হলাম। অবশ্য এর আগে যত কঠিন ধাপ আছে তাতে সাধারণ কারো পক্ষে তা অতিক্রম করা অসম্ভব। এইজন্যই হয়ত নিশ্চিন্তে আছে তারা, কোনো পাহারা ও নেই। আয়নাটা ব্যাগে ঢুকাতেই আয়নায় ভীষণ জোরে আচড় কাটার শব্দ এল।

আয়নাটা আবার হাতে নিলাম। জ্বীনদাদুর প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল। আমি সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন, অভিনন্দন এত কঠিন ধাপগুলো পার হয়ে লক্ষ্যের মুখে প্রবেশ করছো। কিন্তু এতেই ভেবোনা তোমার বিপদ শেষ।
~ তবে কি আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে?

~ তোমার জন্য প্রতিটা পদক্ষেপেই বিপদ। যা পার করেছো তার চেয়ে বেশী ভয়ংকর। এই সদরদরজায় কোনো পাহারা নেই তাই ভেবেছো খুব সহজে ঢুকতে পারবে। এটাও একটা নিপুন ফাদ। দরজায় খুলে তার ভিতরে প্রবেশ করলেই অনেকগুলো বরফি তলোয়ার তোমার দিকে ছুটে আসবে ঝাকে ঝাকে।

তাও চোখের পলকে। সেগুলোর একটা না একটা তোমাকে আঘাত করবেই যতই যা করো তুমি। যেহেতু তুমিও আগুনে তৈরী, সেই বরফি তলোয়ার তোমার শরীরে লাগলেই তুমি মাটিতে মিশে যাবে। তোমার শরীরের অস্তিত্বই থাকবেনা, আর রুহ আটকে যাবে জলাশয়ে মরে থাকা কোনো জোক-কুমিরের শরীরে।

যতদিন না মারা যাচ্ছো, ততদিন ওই জলাশয়েই তোমাকে বন্দি হয়ে জীবন কাটাতে হবে। আমার বুক ফুড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, এক একেকটা ধাপ আমার কাছে মৃত্যুর কাছাকাছি সীমানা মনে হচ্ছে।
~ তাহলে আমি প্রবেশ করব কি করে?
~ সেই উপায় তোমাকেই বের করতে হবে। আসি।
আল্লাহ তোমার সহায় হন।

~ আমিন। আয়নাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ভাবতে লাগলাম কিভাবে তলোয়ারের হাত থেকে নিজেকে বাচাব। জ্বীনদাদু বলেছে শরীরে স্পর্শ করলেই আমি মাটিতে মিশে যাব। তার মানে এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে তলোয়ার আমার শরীর স্পর্শ না করতে পারে। কিন্তু আমি তো সাথে করে এমন কিছু আনিনি যা দ্বারা শরীর আবৃত করতে পারি।

হঠাৎ চোখে পড়লাম মস্ত বড় এক পাথর। ওটা বহুকষ্টে সদরদরজার ভিতরে ঢুকালাম, তারপর আমি ঢুকলাম। পাথরটা আমার চেয়ে চারগুন বড়। তার জন্য আমি সামনের কিছুই দেখতে পারছিনা। এইটুকু পথ ঠেলে এনেই আমার দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ করে পাথরটা নড়তে লাগল আর কড়কড় শব্দ হল।

নিশ্চয়ই তলোয়ার গুলো আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি পাথরটাকে সর্বশক্তি দিয়ে আবারো ঠেলতে লাগলাম। ওটা গড়িয়ে যেতে লাগল। সরে এসে দেখি তলোয়ার ছোড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমার চারদিকে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া তলোয়ার পড়ে আছে। সামনে এত শক্ত বড় পাথর থাকায় ওরা আমার শরীর স্পর্শ করতে পারেনি। নিরাপদে জ্বীনরাজ্যে ঢুকে গেছি আমি।

হাটতে হাটতে চারিদিকটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। উন্মুক্ত প্রান্তর, চারিদিকে আঙ্গুর-খেজুর সহ বিভিন্ন ফলের বাগান, গাছে গাছে থোকা থোকা ফল ঝুলছে। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির, প্রজাপতিও উড়ছে। ভীষণ মনোরম দৃশ্য, ফলগুলো দেখে ক্ষিদে পেয়ে গেল। কিন্তু ওইগুলোর দিকে হাত বাড়ালামনা।
কে জানে ওসবে কোন বিপদ আমার জন্য ওত পেতে আছে!
তাই সোজা হাটতে লাগলাম।

কিছুটা হাটার পর একটা বাজার দেখতে পেলাম। ওখানে মানুষের মতই দেখতে অনেক জ্বীনের আনাগোনা। কি অদ্ভুত লাগছে! পুরো মানুষদের মতই ওদের নিজস্ব একটা দুনিয়া আছে। তবুও ওরা এই দুনিয়া ফেলে রেখে মানুষের দুনিয়ায় কেন যায়? এই প্রশ্নটা মনে খোচখোচ করছে।
অনেক জ্বীনমহিলাও দেখতে পাচ্ছি। অনেকে পর্দা করে আছেন, অনেকে কিছুটা খোলামেলা। কিছু উৎসুক চোখ আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে।

কে জানি সন্দেহ করছে কিনা! এদিকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, ক্ষুধা ও লেগেছে কিছুটা। বাজারের একটা ফাকা জায়গায় বসে পড়লাম। যা পরিস্থিতি বুঝলাম, একদিনে ঘুরে ঘুরে আমার কার্যসাধন করা সম্ভব না।
আমাকে এখানে কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। কিন্তু কার কাছে আশ্রয় নিব?

না আমাকে কেউ চিনে না আমি কাউকে!
এমনসময় দেখি ৪-৫ বছরের একটা বাচ্চা আমার পাশে বসে কাদছে। আমি ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাচ্চাটা শুভ্রসাদা, দেখতে ভীষণ কিউট। গাল টা ফোলাফোলা, চোখের মণিটা অন্যরকম। দেখেই মানুষের থেকে আলাদা মনে হয়। এ নিশ্চয়ই জ্বীনের বাচ্চা। জিজ্ঞেস করব কি করব না ভাবতে ভাবতে করেই ফেললাম,
~ কাঁদছো কেন বাবুহ?

সে কান্না থামিয়ে আমার দিকে চোখ বড়বড় করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
সেটা খেয়াল করে বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। এ বাচ্চা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
~ এভাবে তাকিয়ে আছো কেন বাবুহ?

~ তুমি আমাকে বাবুহ বললা কেন? আমি কি বাবুহ নাকি! আম্মাহুজুর বলেছে আমি বড় হয়ে গেছি। তুমি আর আমাকে বাবুহ ডাকবানা।
এর কথা শুনে হাসব না কাদব বুঝতে পারছিনা। পায়ে দিয়ে সালাম করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, আচ্ছা দাদু তোমার বয়স কত?

দেখেই মনে হচ্ছে এ খুব রাগী আর ত্যাড়া টাইপের। হিসেব করে কথা বলতে হবে এর সাথে।
~ আমি তো জানতামনা।
~ কি জানতে না? আমাকে বাচ্চা মনে হয় তোমার পিচ্চি মেয়ে!
এবার আমার অবাকতা সীমা ছাড়িয়ে গেল। এক বাচ্চা ছেলে আমাকে পিচ্চি বলছে। জ্বীনের বাচ্চা বলে কথা, এমন তো হবেই।

~ আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তো তোমার নাম জানিনা তাই বলে ফেললাম।
~ ওহ। আমার নাম আবদুল্লাহ আল সাজ্জাদ বিন তাশফীকুর জুহানী।
এত বড় নাম শুনে আমি হতভম্ব। ডাকনাম জিজ্ঞেস করেছি সে আমাকে নামের লিস্ট ধরিয়ে দিল। পারেও বটে।
~ শুনো, আবদুল্লাহ।

~ আবদুল্লাহ আল সাজ্জাদ বিন তাশফীকুর জুহানী। পুরোটা বলে ডাকো। এভাবে ডেকে আমার নাম পরিহাস করবানা। আম্মাহুজুর কত্ত সুন্দর নাম রেখেছে এইটুকু ডাকার জন্য না।
~ আমার তো পুরো নাম মনে থাকেনা। তোমার ডাকনাম নেই?

~ আছে তো। আম্মাহুজুর ডাকে সোনামানিক, আব্বাহুজুর ডাকে আব্বুজান, বন্ধুরা ডাকে বন্ধু, ভাইয়া ডাকে আমার কলিজার ভাইটা, প্রতিবেশী ফুফু আম্মা ডাকে আমার বাবাটা….
শুনে আমি হতাশ। এই কি ছেলে না আগুনের ফুলন্ত ছটা! বলেই যাচ্ছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই। তাকে চুপ করানোর প্রচেষ্টা চালালাম,
~ আমি তোমাকে কি ডাকব?

সে আমার দিকে ভাল করে তাকিয়ে বলল, জুহানী ডাকবা। তোমার জন্য নাম ছোট করলাম, সুন্দর করে ডাকবা বুঝছো!
~ আচ্ছা জুহানী, তুমি কাদছিলে কেন?
~ আমি ভীড়ের মধ্যে আম্মাহুজুরকে হারিয়ে ফেলেছি।
এখন খুজে পাচ্ছিনা।

আমি এদিক সেদিক তাকালাম একবার। আসলেই বাজারে এখন ভীষণ ভীড়। কিন্তু কোনো মহিলাকে এদিকে আসতে দেখছিনা।
~ তুমি তোমার আম্মাহুজুরকে নিয়ে কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

~ ওই যে বলে একটা মস্ত বড় শামিয়ানার দোকান দেখাল। সেখানে এখনো উপচে পড়া ভীড় মহিলাদের।
~ তুমি তোমার আম্মাহুজুরের কাছে যাবে?
~ হ্যা যাব। তবে একটু পর।
~ একটু পর কেন?

~ তোমাকে যে নাম ছোট করে দিলাম তার জন্য উসুল নিব না।
~ কি উসুল নিবে তুমি?
~ তোমার পরিচয় নিব। তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো?

~ আমি মুসকান, একজন খাদিমা। অনেক দূরের গ্রাম থেকে এসেছি।
~ তোমাকে দেখে তো খাদিমা মনে হয়না।
~ কেন?
~ সেটা পরে বলব।

বাচ্চাটার কথা শুনে এবার আমার মনে ভয় ঢুকে গেল। এটাকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরিয়ে নিজের পথ ধরতে হবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
~ তোমার আম্মাহুজুরের কাছে যাবেনা?

~ যাব, একটু পর। উনি বেরিয়ে আসুক ওখান থেকে।
~ এতক্ষণ কাদছিলে তার জন্য! এখন পরে যাবে কেন?

~ তোমার সাথে গল্প করতে ভালোলাগছে। আমি চুপ হয়ে গেলাম। বাচ্চাটাকে কি করে সরাব সেটা ভাবছি। এমন সময় দেখি এক মহিলা ছুটে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। বাচ্চাটা এগিয়ে এসে মহিলাটার কোলে উঠে গেল।
মহিলাটা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মাহুজুর কে ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে সোনামানিক?

~ হারিয়ে গিয়েছিলাম। পরে এই বুবুটার কাছে চলে এসেছি। গল্প করেছি উনার সাথে।
~ ধন্যবাদ মা। এতক্ষণ তুমি ওকে দেখে না রাখলে হয়ত হারিয়ে যেত।
~ শুকরিয়া।

~ কে তুমি? আগে তো কখনো দেখিনি!
~ আমি খাদিমার কাজ করি। অনেক দূর থেকে এসেছি কাজের সন্ধানে।
ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিধে পেল তাই এখানে বসে পড়লাম।
~ আহারে। কাজ পেয়েছো?

~ না পাইনি। আরেকটু খুজতে হবে হয়ত।
~ আমার একজন খাদিমার প্রয়োজন আমার সন্তানকে দেখাশুনা করার জন্য। তোমার যদি আপত্তি না থাকে এই কাজটা করতে পারো।

~ আমার কোনো আপত্তি নেই খালা। খুশিমনে কাজটা করতে রাজি আমি।
~ আমারো তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। কত দিনার নিবে?
~ লাগবেনা খালা। শুধু আশ্রয় আর দুবেলা খেতে দিলেই হবে।
~ ঠিক আছে। চলো আমার সাথে।

বাচ্চাটা মায়ের কোল ছেড়ে আমার কোলে উঠতে চাইল। কোলে নিলাম, পুরো পথ পাকা পাকা কথা বলে জ্বালাল।
মহিলার বাড়িতে ঢুকলাম। ভীষণ সুন্দর বাড়িটা। গুছানো সংসার, আল্লাহ ভক্ত ও খুব। ব্যবহার ও মাশা আল্লাহ। স্বামী, উনি আর দু ছেলেকে নিয়ে ছোট সংসার। সবাই ই আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলল।

উনার বড়ছেলে আমার দিকে কেমন জানি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। হয়ত তার ও বিশ্বাস হলনা আমি একজন সাধারণ খাদিমা। এদের একটু বাকাদৃষ্টি আমার ভয়ের কারণ। নিজের জান মালের ভয় নয়, ভয় এটাই যদি কোনোভাবে ধরা পড়ে যাই তবে আমার কার্যসাধন হবেনা কিছুতেই।

জুহানীর সাথে আমার গলায় গলায় ভাব হয়ে গেল। ভীষণ মিষ্টি ছেলে। সারাক্ষণ বুবু বুবু বলে পিছু লেগে থাকে। তাওহীদের কথা ভেবে মনটা বেশিক্ষণ খারাপ থাকতে পারেনা পিচ্চিটার জন্য। আমার কাছে ঘুমায়, খাওয়া-দাওয়া করে সবমিলিয়ে ওর দেখাশোনা আমিই করি। পরিবারটাও ভীষণ ভাল, এই কিছুদিনে আমাকে অনেক আপন করে নিয়েছে।
অনেক বিশ্বাস করে। এদেরকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই খারাপ লাগে।

সেদিন জুহানীর সাথে ঘুরতে বেরিয়ে বড় সুরম্যপ্রাসাদটা দেখলাম। পুরো ছবিতে দেখানো রাজপ্রাসাদের মত। ফটকের বাহিরেই এত সৈন্যসামন্ত পাহারায় রাখা, ভেতরে না জানি কত কঠোর নিরাপত্তা। সুযোগের অপেক্ষায় আছি, সুযোগ পেলেই প্রাসাদে ঢুকব।
খুজে নিব জ্বীনি তলোয়ারটা।

আজ জ্বীনমহিলাটা আমাকে একান্তে তার কক্ষে ডাকল। কিছুদিন ধরে উনি আমাকে কেমন একটা দৃষ্টিতে দেখছেন। বুঝলামনা একা কেন আমাকে ডাকলেন। এভাবে তো কখনোই ডাকেন না।
তবে কি উনি বুঝে নিয়েছেন আমি সাধারণ কেউ না…..

পর্ব ২৬

ভয়ে ভয়ে উনার কক্ষে ঢুকলাম। উনি আমাকে দেখে কোর আন পড়া বন্ধ করে তুলে রেখে কাছে ডাকলেন। আমি কাছে যেতেই মাথায়-গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, জুহানী ঘুমিয়েছে?

~ হ্যা খালা, ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছি।
আমাকে ডাকলে যে?
~ তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিল। মনোযোগ দিয়ে শুনবি, শুনে ভেবেচিন্তে তোর মতামত টা আমাকে জানাবি।
~ কি কথা খালা?

~ এই কয়েকদিনে তুই আমাদের অনেক আপন হয়ে গেছিস। তোকে আমাদের খাদিমা মনে হয়না। নিজের মেয়ে মনে হয় তোকে। অনেক মায়ায় বেধে দিয়েছিস সবাইকে।
~ এই পরিবারটাকে আমার নিজের পরিবার ই ভাবি খালা।
~ সে আমি জানি। কিন্তু আমি তোকে এই পরিবারের একজন করে নিতে চাই স্থায়ীভাবে, তোকে বৈধতা দিতে চাই।
~ কি করে?

~ আমার বউমা বানিয়ে। আমার বড়ছেলে জুরাইনের বউ বানাব তোকে। তাতে তুই আমাদের পরিবারের একজন হয়ে যাবি। তোর মত এত ভাল একটা মেয়েই আমার জুরাইনের জন্য খুজছিলাম। জুরাইন ই ও তোকে ভালবাসে, পছন্দ করে সেটা আমি জানি। তুই ভেবেচিন্তে আমাকে জানা।

আশা করি, তোর কোনো আপত্তি ই থাকবেনা। তুই আমার কথায় সম্মতি জানাবি। যেহেতু এটা পুরোজীবনের ব্যাপার তুই একটু ভেবে দেখ কেমন!
এখন যা নামায পড়ে খেয়ে নে।

আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ ই দিলনা। বড় একটা ঝামেলায় ফেসে গেলাম। আশ্রয়ের উপায় করতে গিয়ে নিজের বিপদ ই ডাকলাম। যে করে হোক, এই পরিবারের ভুল ভাঙ্গিয়ে আমাকে প্রাসাদে প্রবেশ করতে হবে। তারপর তলোয়ার টা নিয়ে এখান থেকে ফিরে যাব। একের পর এক ঝামেলা হয়ে আসছে, জীবনটাই গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে। যেদিকেই যাই, সব পথ ই এক। দেরী না করে উপায় ভাবতে হবে।

কি করে প্রাসাদে যাওয়া যায়!
এসব ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাটতে লাগলাম। কিছুদূরে অনেক মেয়ের জটলা দেখে এগিয়ে আসলাম। কথা বলে জানতে পারলাম প্রাসাদের জ্বীনসর্দার তার নিজের জন্য বিশ্বস্র খাস-জারিয়া খুজছেন।

তাই আগ্রহীদের কে কাল প্রাসাদে মনোনয়নের জন্য যেতে বলেছেন। শুনে খুশি হলাম। প্রাসাদের ভিতরে ঢোকার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। কোনোভাবে খাস-জারিয়া হিসেবে নির্বাচিত হলে প্রাসাদে থাকার সুযোগ পেয়ে যাব। আর সেটা কাজে লাগিয়ে বিশেষ কক্ষ খুজে বের করব।

বাসায় ফিরতেই জুহানী ছুটে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল,
~ এতক্ষণ তুমি ছিলে বুবু? ঘুম থেকে উঠে তোমায় কত্ত খুজলাম। এভাবে না বলে কোথায় যাও তুমি! ভয় লাগেনা পিচ্চি মেয়ে।

~ কোথাও যাইনি সোনা। তোমার বুবু তোমার কাছে তো আছে।
বলে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। খালা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল,
~ কোথায় গিয়েছিলি মা?

~ বাহিরে গিয়েছিলাম।
~ এতক্ষণ লাগল কেন ফিরতে?
~ প্রাসাদে খাস-খাদেমা নেওয়ার জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। সেটার ব্যাপারেই জানতে গেলাম।
~ তুই আমাদের ছেড়ে প্রাসাদে যাবি খাস-জারিয়া হতে? তুই ভুলে যা তুই একজন খাদেমা ছিলি। এসব কিছু তোকে আর করতে হবেনা। তোকে নতুন জীবনের পথ দেখাচ্ছি। সেটা করে ভালোভাবে থাক। আমার ঘর আলো করে সবটা জুড়ে থাক।

ইনশাআল্লাহ অনেক ভাল থাকবি।
~ সেটা সম্ভব নয় খালা।
~ কেন সম্ভব নয়?

~ খালা আমি বিবাহিতা। স্বামীর সাথে ঝগড়া করে তাকে ছেড়ে এখানে চলে এসেছি। ছেড়ে এলেও আমি তাকে মনেপ্রাণে খুব ভালবাসি।
ওকেই আমার স্বামী বলে মানি। তাই তোমার পরিবারের বৈধতা পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। কাল আমি প্রাসাদে খাস-জারিয়ার আবেদনপ্রার্থী হিসেবে যাব।

যদি নির্বাচিত হয়ে যাই তোমাদের সাথে হয়ত থাকা হবেনা আর। এক্ষেত্রে তোমার অনুমতি চাই খালা।
খালা ছলছল করা চোখ লুকিয়ে বললেন,
~ তোর যা খুশি তুই তাই কর। তোর আপন হতে পারিনি। আমি কে তোকে অনুনতি দেওয়ার? দুদিনের জন্য মায়া দেখাতে এসেছিস কেবল।

বলে খালা হনহন করে তার কক্ষে গিয়ে দরজা এটে দিল। জুহানী কয়েকবার ডেকে থমকে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তুমি সত্যি আমাকে ছেড়ে যাবে বুবু?
~ হ্যাঁ। আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল,
~ যেয়োনা বুবু। আমার খুব কষ্ট হবেনা।

~ যেতে হবে সোনা। বেচে থাকলে আর আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে।
ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাদতে কাদতে বলল,
~ তুমি আর আমার সাথে কথা বলবেনা। খুব বাজে তুমি।

দৌড়ে চলে গেল জুহানী। পিছন থেকে ডাকার সাহস পেলামনা। সত্য যেটা সেটাই বলেছি। শত চেষ্টা করলেও ওর কাছে থাকা আমার সম্ভব নয়। আমার কাধের উপর যে অনেক দায়িত্ব।

এমনসময় জুরাইন ঘরে ঢুকল। আমাকে ওকে দেখে নিজের কক্ষে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। ও পিছন থেকে আমার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আমার হাত জড়িয়ে বলল,
~ আমার বউ হবে মুসকান? বৈধতা নিবে আমার পরিবারের একজন হওয়ার?
ভেবে দেখো, তুমি একটা পরিবার পাবে। আমার উজাড় করা ভালবাসা পাবে। অনেক ভালবেসে ফেলেছি তোমায় বিশ্বাস করো।

কথা দিচ্ছি আমার ঘরে তুমি রাণীরুপে থাকবে এবং ভালবাসার কোনো কমতি থাকবেনা। আমি শুনে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললাম,
~ জুরাইন ভাইয়া আমি বিবাহিতা।

অনেক আগেই আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এভাবে বেগনা নারীকে স্পর্শ করবেননা, এসব কথা কখনো মাথায় আনবেননা। আমার পক্ষে অসম্ভব নিজের স্বামীকে ফেলে আপনার সাথে সংসার সাজানো।
এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। জুরাইন শুনে প্রতিউত্তর না করে কাদতে কাদতে বেরিয়ে গেল। আমার আর কিছু সহ্য হচ্ছেনা। কখন এখান থেকে বের হব আমি! একের এক ঝামেলায় ফেসে যাচ্ছি। আর দেরী করা যাবেনা।

কাল ই এই ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। ছেড়ে যাব ভাবতে খারাপ লাগছে, এই কয়েকদিনে পুরো পরিবারটাকে অনেক আপন করে নিয়েছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। একদিকে আমার দায়িত্ব, অন্যদিকে আমার স্বামীর প্রতি ভালবাসা। কোনোটাই হার মানতে দিবনা।

সকাল হতেই সব গুছিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে প্রাসাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছে করে জানাইনি, বিদায় বেলা কোনো নতুন মায়ার বাধনে বাধা পড়তে চাচ্ছিনা। জুহানী আমাকে চলে যেতে দেখলে অড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করবে। যার কারণে আমার ওকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করবেনা। ঘুমন্ত অবস্থায় ওর কপালে চুমু দিয়ে চলে এসেছি। ভালো থাকুক ও। কখনোই ভুলবনা ওকে।

প্রাসাদের সামনে তো প্রচুর ভীড়। অনেক মেয়ে জটলা বেধে আছে। এক এক জন করে ঢুকছে আর মুখ কালো করে বেরিয়ে আসছে। মনোনিত হতে পারেনি বোধহয়। আমার ও ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। আল্লাহ তুমি আমাকে এই সুযোগটা পাইয়ে দাও। যে করে হোক আমাকে নির্বাচিত হতে হবে।

এক সময় আমার ডাক আসল। প্রাসাদের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম অনেক বিলাসবহুলভাবে সাজানো প্রাসাদটা, আর বড় ও। সৌন্দর্য্য থেক্ব চোখ ফেরানো মুশকিল। এত বড় প্রাসাদের কোন কোণায় বিশেষ কক্ষটি আছে কে জানে।

খাস-দরবারে এসে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করতেই দেখলাম বড় পালঙ্কের এক কোণায় পায়ের উপর পা তুলে এক সুদর্শন ছেলে বসে আছে। বয়স তাওহীদের সমান ই, লম্বাটে, গোলাকার চেহারা, চেহারা দেখেই মনে হয় খুব শক্তিশালী আর কঠিন প্রকৃতির। আদাবের সহিত সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন, নাম কি তোমার?
~ মুসকান।

~ খাস-জারিয়া হতে এসেছ যে কি কি কাজ জানো?
~ আলহামদুলিল্লাহ সব ই পারি। ভরসা করে দেখতে পারেন, বাকিটা আমার কাজ ই বলবে।
~ আমাকে দেখেশুনে রাখা, আমার সব কাজ করে দিতে পারবে তো?

~ আস্থা রাখতে পারেন।
~ আমার খাস-জারিয়া হতে হলে সৎ, সাহসী, দক্ষ এবং বুদ্ধিমতী হতে হবে। কেননা, তোমাকে দিয়ে আমি সামান্য ছোট-খাট কাজ করাবনা।

~ আমার বিশ্বাস আমার মধ্যে সবগুলোই আছে। তবুও আপনি যাচাই করতে পারেন।
~ ঠিক আছে, তাহলে হয়ে যাক এক দফা পরীক্ষা।
~ জ্বী, আমি প্রস্তুত।

উনি হাতের ইশারা করতেই এক দাসী আমার সামনে পানিভর্তি পাত্র নিয়ে এল। জ্বীনসর্দার আমার দিকে চেয়ে বলল,
~ এই পানিভর্তি পাত্রের দিকে তাকাও, দুটো পাথর আছে সেখানে। একটা সাদা আর একটা রঙ্গিন পাথর। তোমাকে শুধু দেখেই বলতে হবে এখানের কোন পাথর বেশী মূল্যবান?

আর কোনটি মূল্যহীন!
আমি পাত্রের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভালো করে ভাবলাম। দুটো পাথর ই পানির নিচে ঝকঝক করছে, ধাধায় ফেলে দিল উনি এভাবে। কিছুটা সময় পর উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি উত্তর দিতে প্রস্তুত? ‘

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, এই পাথর দুটো অধিক মূল্যবান। কিন্তু রঙ্গিন পাথরটা অধিক মূল্যবান। কেননা, সেটা রঙ্গিন পাথর না ওটাই আসল সাদা পাথর। আর যে সাদা পাথরটা আছে সেটা রঙ্গিন পাথর। তার উপর কেবল সাদা প্রলেপ করা হয়েছে। উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ কি করে বুঝলে?

~ আসল জিনিস তার আসল রুপ যেকোনো সময় ই দেখায়। পানির নিচে রঙ্গিন পাথর বেশি ঝকঝক করছিল।
উনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, তুমি মনোনিত হয়েছো। আজ থেকে তুমি আমার খাস-জারিয়া হিসেবে এ প্রাসাদে বিচরণ করবে। দাসী ওকে দাসী মহলে নিয়ে যাও।

ওর যাতে কোনো অসুবিধা না হয় দেখবে। মহলে ঢুকে পালঙ্কে গা এলিয়ে দিলাম। আর ভাল লাগছেনা এসব। তাওহীদের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আজ যদি জ্বীনকন্যা না হয়ে কোনো সাধারণ মেয়ে হতাম তবে সুখে সংসার করতাম দুজন মিলে। আচ্ছা কেমন আছে ছেলেটা?

আমার চিঠিটা পড়ে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। ও কি সত্যিই আমাকে ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করে ফেলল!
কিছুদিনের মধ্যে জ্বীনসর্দারের মন জয় করে ফেলেছিলাম। তার সবকিছু নিপুণভাবে সামলাতে আমি লাগলাম। তার দেখা-শুনা সব আমিই করি।

আমার মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম,
~ এই মহলের সবচেয়ে কড়া নিরাপত্তা কক্ষ কোনটা?

~ এটা এই মহলের কোথাও পাবেনা।
~ তবে কোথায় আছে সে।
আমার দিকে রাগান্বতি চোখে তাকিয়ে বলল খাস-জারিয়া আছো সেটাই থাকো। এসবের বাহিরে আর কোনো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবেনা।

মন খারাপ করে চলে এলাম। এর পেট থেকে কিছু বের করা যাবেনা। যা করার আমাকেই করতে হবে। কিন্তু কি করা যায়।
একটু ভাবার পর একটা বুদ্ধি পেয়েছে। এখন সাবধানে কাজে লাগাতে পারলেই হল। আর কোনো সমস্যা থাকবেনা

পর্ব ২৭

বিকালে জ্বীনসর্দার সুলাইমান যখন রাজকার্যে নিজের কক্ষের বাহিরে গিয়েছিছেন, খুব সাবধানে তার কক্ষে প্রবেশ করলাম। পুরো কক্ষে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম এই আশায় যদি বিশেষ কক্ষটা কোথায় সেটা জানা যায়। খুজতে খুজতে হয়রান হয়ে গেলাম।

তাও পেলামনা। এমনসময় কারো আসার ইঙ্গিত পেয়ে বড় ট্রাংকটার পিছনে লুকিয়ে পড়তে গেলাম, ততক্ষণে সুলাইমান আমাকে পিছন থেকে ডাকলেন,
~ মুসকান। ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
~ জ্বি হুজুর।

~ তুমি এইসময় আমার কক্ষে কি করছো? তুমি তো নিশ্চয়ই জানো আমি বেরিয়ে ছিলাম। তবে কেন এসেছো?
কি বলব বুঝতে পারছিনা। কথার যথাযথ সংগতি না পেলে আমাকে সন্দেহ করবে। এর জন্য প্রাসাদ থেকে বের কিংবা কারাদন্ড ও দিতে পারে। তখন আমার এত কষ্ট বৃথা হয়ে যাবে। হঠাৎ নিজের হাতের আংটির দিকে চোখ পড়ল। খুলে সিন্দুকের পাশে ছুড়ে দিলাম।

খোজার ভান করে বললাম,
~ আমার প্রিয় আংটিটা কাল রাতের পর থেকে পাচ্ছিনা। সবখানে খুজলাম পেলামনা। ভাবলাম কাল রাতে তো আপনার কক্ষে এসেছিলাম এখানে পড়েছে নাকি। তাই আপনার অনুমতি ছাড়া খুজতে এলাম। ভুল মার্জনা করবেন।
~ পেয়েছো?
~ নাহ।

~ সিন্দুকের পাশে এটা কি? চকচক করছে।
আমি তক্ষুনি আংটিটা হাতে তুলে নিয়ে খুশি খুশি ভাব করে বললাম,
~ হ্যা এটাই তো আমার আংটি। ধন্যবাদ হুজুর।

~ এখন তুমি এসো। আমার বিশ্রামের প্রয়োজন।
~ জ্বি আচ্ছা। বলে ঠোট কামড়াতে কামড়াতে চলে এলাম। কিছুই পেলামনা যা দিয়ে বিশেষ কক্ষ খুজব। এভাবে আর বসে থাকলে চলছেনা। নিজেই খুজে বের করতে হবে।

হাটতে হাটতে পুরো প্রাসাদ, প্রতিটা কক্ষ ভাল করে খুজে দেখলাম। কিন্তু তেমন কোনো কক্ষ ই নেই। খাস-জারিয়া বলে কেউ কিছু বললনা, তবুও বুঝতে পারছি ব্যাপারটা কেউ ভাল চোখে দেখছেনা। তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি কেবল চিন্তিত কি করে বিশেষ কক্ষ টা খুজে বের করব।

নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ব্যাগ থেকে ছোট আয়নাটা বের করলাম।
মনে মনে জ্বীনদাদুকে স্মরণ করতে লাগলাম। একটু পর আয়না টা কেপে দাদুর প্রতিবিম্বটা দেখতে পেলাম। সালাম করে বললাম,
~ আমি প্রাসাদে আছি। কিন্তু এত বড় প্রাসাদের কোথাও বিশেষ কক্ষটা পেলামনা।

~ তলোয়ারটা জ্বীনজাতির কাছে এতই মূল্যবান যে সেটা লোকচক্ষুর আড়ালে নিরাপদে রাখা হয়। সেখানে লোকপূর্ণ প্রাসাদের কোণায় রাখবে এমন বোকা তারা নয়। অতএব এটা প্রাসাদের পারিপার্শ্বিক কোথাও নেই কিন্তু প্রাসাদেই আছে।

~ কেমন গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে! এটা প্রাসাদের কোথাও নেই কিন্তু প্রাসাদেই আছে। দাদু আপনি জানেন না, বিশেষ কক্ষটা কোথায়?

~ আমি মারা যাওয়ার পর বিশেষ কক্ষের স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। আর কেবল জ্বীনসর্দার ই বলতে পারে বিশেষ কক্ষটা কোথায়! সবটা তাদের হাতেই থাকে।

~ সুলাইমান জ্বীন তো এই ব্যাপারে কিছু বলা তো দূরে থাক মুখেও আনতে চাননা। তার পেট থেকে এসব বের করা আকাশ-কুসুম কল্পনা বৈকি! খুব হতাশ লাগছে।

~ সেটা তোমার দায়িত্ব। তুমি কি করে ওর থেকে কথা আদায় করবে! তবে জেনে রাখো আজ রাত মহিমান্বিত রাত। আজ রাতেই আল্লাহ শ্রেষ্ঠ মানুষজাতির পিতাকে পৃথিবীতে পাঠয়েছিলেন। তাই আজ রাত ই তোমার জন্য শেষ সুযোগ।

আগামী ৪ঘন্টার মধ্যে যদি তুমি তলোয়ার উদ্ধার করতে না পারো, বিশেষ জ্বীন-উপাধি, অধিকার হারাবে। ৫-১০টা সাধারণের জ্বীনের মত তোমাকে জ্বীনরাজ্যেই জীবনযাপন করতে হবে। তখন তলোয়ার পেলেও তুমি সেটা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হবে। তলোয়ার নিতে গেলে তোমাকে সুলাইমানের বিশ্বস্ত কিছু কারিন জ্বীনের মুখোমুখি হতে হবে।

ওরা ভীষণ ভয়ংকর। সবসময় আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে।
~ আপনি যা বলবেন তাই হবে।

জ্বীনদাদু বিদায় নিতেই আমার চিন্তা আবার জড়ো হল। হাতে মাত্র ৪ঘন্টা আছে, এর মধ্যেই যা করার করতে হবে। কিন্তু কিভাবে করব? সুলাইমান জ্বীন কিছুতেই আমাকে বিশেষ কক্ষের কথা বলবেননা। ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে গেলাম। জ্বীনসর্দার হিসেবে সুলাইমান খুব ই উৎশৃঙখল। মদ্যপান, জলসা হারাম জেনেও সে সবে অভ্যস্ত। মেয়েলোক নিয়ে নষ্টামি তো আছেই।

তার পছন্দের পানীয় নিয়ে তার কক্ষে ঢুকলাম। বসে বসে কিসব জানি ভাবছিলেন। আমি যেতেই পাশে বসতে বলে বললেন,
~ আজ সারা প্রাসাদ ঘুরেছো শুনলাম।
~ আসার পর তেমন ঘুরে দেখিনি। তাই আজ ঘুরে দেখলাম, আপনার রাজত্ব-রাজ্য দুটোই সুন্দর আর সুশৃঙখল।
~ হতেই হবে। এ হচ্ছে জ্বীনসর্দার সুলাইমানের রাজত্ব।

আমার দাদু হামনাদ খালিদ মারা যাওয়ার পর আমিই গোটা রাজ্য নিজের মত করে চালাচ্ছি।
মনে মনে অবাক হলাম। উনি আর কেউ নয়, আয়নায় দেখা জ্বীনদাদুর নাতী। এত ভালো একটা জ্বীনের নাতী হয়েও এত উৎশৃঙখল ভাবা যায়না।
~ এই নিন আপনার পানীয়।

~ আহ! এনেচো? দাও। ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, দাদু আমায় একদম ই যোগ্য মনে করত না এই রাজত্ব পরিচালনার জন্য। তার মতে, আমার উপর নাকি মোটেও ভরসা করা যায়না। ক্বারিন জ্বীন পালি তো কি হয়েছে? ওরা না হয় একটু খারাপ ই, পুরো জগতে খারাপ কেউ কি নেই? আমি তো মনে মনে বলি দাদু এসো দেখে যাও, আমি কত সুনিপুনভাবে রাজ্য চালাচ্ছি। জ্বীনি তলোয়ার তোমার থেকেও বেশি সুরক্ষায় আমি রেখেছি।

বলে পাগলের মত হাসতে লাগল।
আমার টোটকা কাজ করেছে। আস্তে আস্তে নেশায় বুদ হয়ে মাতলামি শুরু করেছে সুলাইমান জ্বীন। এবার কেবল পেট থেকে কথা বের করা দরকার।
~ কোথায় আছে সেই জ্বীনি তলোয়ার?

~ এক বিশেষ কক্ষে। অনেক নিরাপদে, এই প্রাসাদেই।
~ বিশেষ কক্ষটা কোথায়? পুরো প্রাসাদে তো এমন কোনো কক্ষ ই নেই। আপনি মিথ্যে বলছেন।
~ মোটেও না। বিশেষ কক্ষটা এই প্রাসাদেই আছে, সবার চক্ষুর আড়ালে।
~ কিন্তু কোথায়?

~ হুসসসসস! কাউকে বলবেনা তো তুমি?
~ না বলবনা। বলুন।
~ এই প্রাসাদের মাটির নিচে একটা গুহা আছে। সেখানে একটা কুয়ো আছে ওটার ৩নাম্বার কক্ষেই তলোয়ার টা রাখা। ভীষণ আড়ালে আছেনা বলো?

~ কি যে বলেন? এত নিরাপত্তায় রাখলেন কেউ তো টের ই পাবেনা।
~ সেইজন্য ই তো রেখেছি। কত মূল্যবান তলোয়ারটা।
এটা যার কাছে থাকে সেই ই এই জ্বীনরাজ্য হাতের মুঠোয় রাখতে পারে। কেউ তার গায়ে আচড় ও কাটতে পারেনা। কিন্তু আমি এর ব্যবহার জানিনা।

দাদুকে কতবার বলেছি আমাকে শিখাও, শিখালেন না। রাগ উঠে দিলাম তার ঘাড় বরাবর এক কোপ। অনেকদিন বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে মারা ই গেলেন।

দাদুর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা শুনে খুব খারাপ লাগল। সুলাইমানের প্রতি চাপা ক্রোধ জন্ম নিল। কিন্তু সেটা সময়মত প্রশমিত করা যাবে। হাতে আর মাত্র দুঘন্টা আছে। উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ গুহা যাওয়ার পথ কোনদিকে?

~ ওই যে আমার সিন্দুকটা দেখছো, যার পাশে তোমার আংটি পড়ে ছিল। ওটার ভিতরেই গুপ্তপথটা আছে। বলে বলে সে নিস্তেজ হয়ে গেল। নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর দেরী করা যাবেনা, এক্ষুনি যেতে হবে। ছোট একটা মশাল জ্বালিয়ে সিন্দুক টা খুললাম। সত্যিই সিন্দুকের ভিতরে অনেক গুলো সিড়ি ধাপে ধাপে নিচের দিকে কাটা।

দেরী না করে মশাল নিয়ে নেমে পড়লাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেতরে। অনেকটা হেটে কুয়ার কাছে চলে আসলাম। এতটা আসলাম কিন্তু কোনো বিপদের সম্মুখীন হলামনা। তার মানে, তলোয়ারের নিরাপত্তা কিংবা বিপদ দুটোও কুয়ার মধ্যেই অপেক্ষা করছে। অনেক গভীর সাধারণ কুয়ো।

নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক ছিটে আলো এসে পড়ছে। মশাল শক্ত করে ধরে কুয়োয় লাফ দিলাম। নিচে পড়ে গিয়ে মাথায় একটু চোট লাগল। তা পাত্তা না দিয়ে আলোটা অনুসরণ করে সেখানে থাকা দরজায় ঢুকে গেলাম। ঢুকতেই ৩টা দরজা আমার সামনে পড়ল। উপরে আরবিতে লেখা ভেসে উঠল,
~ বেছে নাও যেটি তোমার জন্য উত্তম।

যার একটিই তুমি খুলতে পারবে, আর সেটাই তোমার ভাগ্যের ফলাফল নির্ধারণ করবে। ৩টি দরজার একটি স্বর্ণের, একটি জহরতে আরেকটি পান্নার তৈরী।

সৌন্দর্যে কেউ কারো থাকে কম নয়। কিন্তু কোনটায় তলোয়ার আছে?
হঠাৎ মনে পড়ল সাদা পাথরের ঘটনা। সেদিন সাদা পাথর ই অধিক মূল্যবান ছিল যেটায় প্রলেপ দেওয়া ছিল। জহরত আর পান্নার দুটো দরজাই সাদা বর্ণের।
তার মানে স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া কক্ষেই আছে তলোয়ারটি।

সেটি খুলতেই দেখি সুন্দর কাচের বাক্সে তলোয়ারটি সাজানো। ওটার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কিছু ঘুর্ণিয়মান বাতাস আমাকে ঘিরে ধরল। মনে হচ্ছে কেউ আমাকে জোরে জোরে আঘাত করছে। রড কিংবা হাতুড়ি দিয়ে মারছে। আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। হঠাৎ আমাকে শুণ্য তুলে মাটিতে আছাড় দিল। ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। চারদিক থেকে অগণিত হাসির শব্দ আসছে, কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা।

মাটিতে একটা আরবি লেখা ভেসে উঠল,
বহিয়ে রক্তের নহার
ধরিও তলোয়ারের ধার। তবেই তোমার ফলাফল তুমি অবশ্যই পাবে। নিশ্চয়ই উত্তম প্রতিদানই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কয়েকমূহুর্ত ভেবে উঠে ছুটে গেলাম কাচের বাক্সের দিকে। সাথে সাথে চারদিক থেকে বিভৎস চিৎকার, মুখ ভেসে উঠল।

সবশক্তি প্র‍য়োগ করে এক আঘাতে কাচের বাক্স ভেঙ্গে ফেললাম। আমার হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। হাতের সবস্থানে বড় বড় কাচ ঢুকে গেছে। যন্ত্রণা করছে খুব তাও তলোয়ারটা হাতে তুলে নিলাম। সাথে সাথে তলোয়ার থেকে এক বজ্রশক্তি বেরিয়ে চারিদিকে রক্তের বন্যা বয়ে দিল। একটু পরে দেখি বীভৎস আকৃতির কিছু প্রাণীর ছিন্নভিন্ন দেহ এদিক ওদিক পড়ে আছে।

আমি তলোয়ার উদ্ধার করতে পেরেছি, এক্ষুনি এই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। হাতের কাচ গুলো ও তুলে ফেলা হয়নি। এক এক করে টেনে সব কাচ খুলে ফেললাম, রক্ত গলগল করে বের হতে লাগল আরো। জ্বলছে ক্ষতস্থানগুলো।

ওড়নার টুকরো ছিড়ে হাত বেধে নিতে হবে। ওড়না ছিড়তে গিয়ে তাড়াহুড়োয় তলোয়ারের সুচালো অংশ হাতে লাগল। সাথে সাথে ক্ষতস্থান মিলিয়ে যেতে লাগল।

তলোয়ারের শক্তি পূর্ণ কাজ করতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি তলোয়ার নিয়ে উঠে এলাম। সিন্দুক থেকে বের হতেই দেখি সুলাইমান তার তলোয়ার নিয়ে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমি মুচকি হেসে তলোয়ার ওর গলায় ধরলাম।

~ এই তলোয়ারের কাছে আপনি কিছুইনা। আমি চাইলে এক্ষুনি আপনার গর্দান নামিয়ে দিতে পারি। এই তলোয়ার যতক্ষণ আমার কাছে আছে, এই জ্বীনজগত কিংবা মানুষ্যজগতের কেউ আমার কিছুই করতে পারবেনা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া।

শয়তান তোর তো জাহান্নামে ও জায়গা হবেনা। নিজের দাদুকে কষ্ট দিয়ে মেরেছিস। একি কষ্ট তোকেও দিব আমি, তিলে তিলে মরবি তুই। তলোয়ার দিয়ে ওর হাতে একটু আঘাত করে ওর শক্তি ছিনিয়ে নিলাম।

তারপর ঠেলে সিন্দুকে ফেলে দিয়ে সিন্দুকের দরজায় তালা দিয়ে দিলাম। এইবার এখানেই তিলে তিলে পচে মরবে শয়তানটা। আমার অর্ধেক কাজ শেষ এখন নিজের জগতে ফেরার পালা। ব্যাগে তলোয়ার ঢুকিয়ে প্রাসাদ থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে হাটা লাগলাম।

ওয়াফাহর জেঠি মুখে পান পুরে চিবাতে চিবাতে বলল, এবার কি ঠিকমত বিয়ে হবে? নাকি তোর মেয়ে আবার পালাবে! সালেহা খাতুন বিস্তর হাসি দিয়ে বলল,
~ ও আমাকে ওয়াদা করেছে এই বিয়েটা করবে। সবকিছুই তো ভালোই ভালোই সম্পন্ন হল। একটু পরে বরযাত্রী আর কাজি সাহেব আসবেন। ওদের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে আমার মরেও শান্তি।

ওয়াফাহ জানালা দিয়ে একদৃষ্টে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকজন কত ব্যস্ত। কেউ পানি আনছে, কেউ রান্নায় ব্যস্ত, কেউ অতিথিদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছে। সেদিনের মতই বাড়িটা সাজানো হয়েছে। শাড়ি-গয়না পরিয়ে শঙ সাজানো হয়েছে। মুহিবের কথা মনে পড়ছে শুধু, ক্ষণিকের জন্য তার জীবনে উকি মেরে আবার অস্ত নেমে গেছে। শুধু রুহহীন দেহটার ই বিয়ে হচ্ছে, মন তো আগে থেকে মুহিবের কাছে রয়ে গেছে।

লোকজনের শোরগোলের আওয়াজ আসছে। বর এসেছে, বর এসেছে বলে ছোট পিচ্চি গুলো চিৎকার করছে। ওয়াফাহর যেন টনক নড়ছেনা তাতে, আবছা অন্ধকারে প্রাণহীন মূর্তির মত বসে আছে। এত মিহি করে নিশ্বাস ফেলছে তাতে নিজের কাছে নিজেকে মৃত মনে হচ্ছে। সালেহা খাতুন এক গাল হাসি নিয়ে কাজীসহ ঘরের দরজা খুলে ঢুকল।

ঢুকে যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা সালেহা খাতুন। এবার ও ওয়াফাহ বিয়ে না করার জন্য এসব শুরু করেছে।

পর্ব ২৮

ওয়াফাহ ঘরের কোথাও নেই। কয়েক মূহুর্তে পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খোজা হল।

কিন্তু কোথাও ওয়াফাহকে পাওয়া গেলনা। সালেহা খাতুন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। রিতা আর বৈশাখী অবাক হয়ে বলল, মাত্র কয়েক মূহুর্তে ও কি করে পালাল? পালালেও তো বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়।

সালেহা খাতুন কান্না করতে করতে বললেন, এবারো মুখপুড়ি আমার মুখে চুনকালি দিল? বিয়ে যখন করবি ওয়াদা কেন করলি! আজ থেকে তুই আমার কাছে মৃত। সব শোরগোল, ব্যস্ততা একনিমিষে থেমে গেল। কিন্তু ওয়াফাহ কোথায় গেল, কেন গেল সেটা সঠিকভাবে কেউ ই জানলনা। মূর্তির মত অবশ হয়ে বসে থাকা ওয়াফাহর মনে কি চলছিল কে বা জানত!
প্রাসাদ থেকে বের হয়ে হাটতে লাগলাম।

অবশেষে তলোয়ারটা হাতে পেয়ে কি যে শান্তি লাগছে, ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। এখন জ্বীনটাকে উদ্ধার করলেই আমার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু তারপর কি হবে? আমি কি আমার তাওহীদের কাছে ফিরে যেতে পারব? আমাদের দূরত্বের অবসান হবে! ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে পানি জমা হল।

সামনে তাকিয়ে দেখি জুহানী পথ আটকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, তারপর ও কাছে ডাকলাম। ও এল না বরং কান্না জুড়ে দিয়ে বলল, আমাকে লুকিয়ে এভাবে চলে গেলা?
~ কিছু করার ছিলনা। আমার যে বিশাল কাজ ছিল।
~ কি কাজ?

~ আমার উপর দায়িত্ব ছিল সোনা, তলোয়ার নিয়ে একটা ভাল জ্বীনকে দুষ্ট দের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। এই জন্যই আমি প্রাসাদে গিয়েছিলাম সোনা।
বুবুর উপর আর রাগ করে থেকোনা।
~ তোমার তো কাজ শেষ। এবার আমার সাথে থাকতে পারোনা?

কি বলে বুঝ দিব বুঝতে পারছিলামনা। ততক্ষণে খালা আর জুরাইন জুহানীর পাশে এসে দাড়াল। খালা শুকনো মুখে বলল,
~ কোন পাষন্ডের কাছে আবদার করছিস? ও প্রয়োজন ছিল তাই আমাদের কাছে ছিল, মিশেছে। এখন প্রয়োজন নেই তাই চলে গেছে। জুরাইন বাধা দিয়ে বলল,
~ আম্মি, এভাবে কেন বলছেন? এটাই পুরো জগতের নিয়ম।
এ নিয়ে উনাকে কথা শুনাবেন না। উনার কি দোষ এতে?

আমি খালার হাত জড়িয়ে বললাম, আমাকে ভুল বুঝোনা খালা। আমি যে কতটা যন্ত্রণায় আছি তা বুঝতে পারলে তোমরা আমাকে অপরাধী ভাববেনা। বিয়ের পর সব মেয়েরা স্বপ্ন দেখে স্বামীর সাথে সুখে সংসার করবে। কিন্তু বিয়ের পর ই জানতে পারি আমি মানুষের দুনিয়ায় পালিত এক জ্বীন। আমাকে আমার স্বামী থেকে দূরে থাকতে হবে। লড়তে হবে পদে পদে।

আমি কোনো সাধারণ জ্বীন নই। জুহানী বলল,
~ এই জন্যই তোমাকে দেখে আমার খাদিমা মনে হয়নি।
~ হ্যা সোনা। তুমি ঠিক ই ধরেছো। খালা, এবার তুমিই বলো আমার কি সম্ভব ছিল তোমাদের সাথে থেকে তোমাদের উপর বিপদ ডেকে আনা।

খালা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই আসলে কে?
~ সেটা আমিও জানিনা খালা। আমার আসল পরিচয় কি? কেন আমি সাধারণ কেউ নই? কেন ই বা আমি মানুষের দুনিয়ায় ছিলাম? কিছুই জানিনা।

আমাকে মাফ করে দাও খালা। কিন্তু একটা কথা ই জানি, তোমাদেরকে আমি কখনোই ভুলতে পারবনা। তোমরা আমাকে মনে যে স্থান দিয়েছো তা আমি কোনোকিছুর বিনিময়ে শোধ করতে পারবনা।
খালা আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
~ ভালো থাক মা। আল্লাহ তোর প্রতিটি কাজের সহায় হন।

আমাকে মাফ করে দিস, আমি তোকে যা তা বলে ফেলেছি না জেনেই।
~ কি বলো এসব? তুমি আমার মায়ের মত। আমার অন্য একটা আম্মি। এসব বলে আমাকে কষ্ট দিওনা। আমাকে যেতে হবে খালা।

আবার যদি পারি তোমাদের এসে দেখে যাব।
জুহানীর কপালে চুমু দিয়ে বললাম, আম্মির সব কথা শুনবে বুঝেছো। হাত ছেড়ে ভীড়ের মধ্যে ঢুকবেনা কিন্তু। আমি আসি সোনা।

~ আবার আসবে তো বুবু?
~ হ্যা আসব সোনা। বিদায় নিয়ে আবার হাটতে লাগলাম। খারাপ লাগছে, আসলেই একটা পরিবার পেয়েছি। আল্লাহ উনাদেরকে ভালো রাখুন, হেফাজতে রাখুন। ব্যাগ থেকে আয়নাটা বের করে জ্বীনদাদুকে ডাকলাম।
~ দাদু।

~ আমি খুব ই খুশি রে দাদু। তুই আমার মৃত্যুর শোধ নিয়ে দিয়েছিস।
~ এটা ওর প্রাপ্য দাদু। তুমি কেদোনা।

তলোয়ারটা আমি উদ্ধার করতে পেরেছি দেখো।
~ তুই যে পারবি জানতাম। এখন ওই জ্বীনকে উদ্ধার করতে হবে তোর।
তুই ছায়াটার পিছু পিছু আবার সে জগতে ফিরে যা। বাকিটা পরে হবে। তলোয়ারটা নিজের কাছে গোপনে রেখে দিস।

~ আচ্ছা দাদু।
ছায়াটার পিছু পিছু আয়নায় দিয়ে আবার সেই চিরচেনা আমার আর তাওহীদের রুমে চলে আসলাম। রুমে কেউ নেই, পুরো রুম ই এলোমেলো। ও কি অফিসে চলে গেছে? এতক্ষণে ওর অফিস তো ছুটি হয়ে যাওয়ার কথা। নিচে গিয়ে কেয়ারটেকার চাচাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, তাওহীদ কোথায়?

~ তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?
~ সে সব পরে বলব। তাওহীদ কোথায়?
অফিস থেকে ফিরেনি?

~ কাল থেকেই তাওহীদ বাবা নিখোঁজ। কোথাও খুজে পাচ্ছিনা ওকে।
কয়েকদিন ধরে অফিসেও যায়নি, সারাদিন বাসার ভিতর ই থাকে। কাল দুপুরের খাবার দিতে গিয়ে দেখি ও নেই। ফোন ও তো নেয়নি সাথে।

আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ করে কাউকে কিছু না জানিয়ে কোথায় চলে গেল ও। কোনো অঘটন করে ফেলল না তো! কিছুই ভাবতে পারছিনা। কোথায় খুজব ওকে? কিছুই ভাললাগছেনা। নিঃস্ব মনে হচ্ছে নিজেকে।
কপালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম।

কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল খেয়াল ই করিনি। রুমের আলো ও জ্বালানো হয়নি। অন্ধকারে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। এমনসময় টের পেলাম আমার ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে কেউ। সেই পুরোনো গোঙানীর শব্দ। কিছু বুঝে উঠার আগেই এক বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে আসল। চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম।

কারো হাসির প্রচন্ড আওয়াজ পেলাম। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি আমি মাটিতে পড়ে আছি গুহার মত একটা জায়গায়। চোখ খুলে উঠে বসে চারিদিকে তাকালাম। তাওহীদের হাত-পা বাধা একটা গুড়ির সাথে, ওর দিকে তাকাতেই ও আমায় ডাক দিল। অন্যদিকে ওয়াফাহ বুবু ও একিভাবে বাধা আছে। আমার দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওদের কাছে যাওয়ার আগেই এক বুড়ো বয়স্ক লোক, উদ্ভুত পোশাক পড়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ জ্ঞান ফিরেছে তাহলে?

স্বাগতম তোকে শয়তানের দুনিয়ায়। চারদিকে বিভৎস চেহারার শয়তান গুলো দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে গোলক আকা, তার মধ্যে যজ্ঞের মত আগুন জ্বলছে। ঠিক বুঝতে পারলাম না এ কে? কেন ই বা তাওহীদ আর ওয়াফাহ বুবুকে এভাবে বেধে রেখেছে? আসল উদ্দেশ্যটা কি?
~ কে আপনি?

~ শান্ত! আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে। ২১বছরের সব রহস্য আজ ই উন্মোচন হবে জ্বীনকন্যা। এ বলে হাতের তালি দিল। দাঁড়িয়ে থাকা শয়তানদের মধ্যে দুজন পাথর ভেদ করে ভিতরে চলে গেল। বেরিয়ে এল এক যুবককে নিয়ে। যার হাত-মুখ কাপড় দিয়ে বাধা। লোকটা আমাকে দেখিয়ে বলল,
~ চিনিস ওকে?

~ কে উনি?
~ যাকে উদ্ধার করতে ছুটছিস সে ই। তোরা দাড়য়ে আছিস কেন?
মুখ খুলে দে।

মুখ থেকে কাপড় সরানোর পর আমি অবাকদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। এ কি আসলেই গোলকধাধা নাকি সত্যি। ওয়াফাহ চিৎকার করে উঠল, মুহিব।
আমি একবার ওয়াফাহর দিকে তাকিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম। কি হচ্ছে আসলেই বুঝতে পারছিনা।
~ উনি আসলেই কে?

আপনি কি আমার সাথে গোলকধাঁধার খেলা খেলছেন?
~ মোটেও না। তোর সাথে এসব খেলা খেলব না আমি। খেলব প্রতিশোধ আর ক্ষমতাপরায়ণের খেলা। বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল লোকটা।

আমি একপলকে ছেলেটার দিকেই তাকিয়ে রইলাম।
তাওহীদ অবাক হয়ে বলল, এটা কি করে সম্ভব সিমরান?
~ আমিও সেটাই ভাবছি।

~ এ বাজে লোকটা নিশ্চয়ই কোনো বাজে খেলা খেলছে।
ছেলেটার ও জ্ঞান ফিরে এল ততক্ষণে। সেও আমার দিকে চোখ পড়তেই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল। ওয়াফাহ বলল,
~ বাজে খেলা কিনা জানিনা! তবে উনি আমার স্বামী মুহিব।

পর্ব ২৯

লোকটা হেসে হেসে বলল,
~ ছেলেটা আর তোর একি চেহারা দেখে অবাক হচ্ছিস, তাইনা?

সত্যি ই তাই। ওয়াফাহর স্বামী মুহিবের চেহারা আর আমার চেহারা হুবহু এক ই। কিন্তু বুঝলাম না এটা কি করে সম্ভব! মুহিব ও মুসকানের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুই বুঝতে পারছেনা।

লোকটা যজ্ঞের জায়গায় বসে আবার আগুনে কিসব ছিটাল। তারপর শয়তানগুলোকে ইশারা করল আমাদেরকে বেধে রাখার। আমি চুপচাপ করে রইলাম। এক্ষুনি কিছু করে পরিস্থিতি গুলিয়ে ফেলতে চাচ্ছিনা। আমাকে বুঝতে হবে আসল রহস্যটা কি! লোকটা তার মস্ত দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ তোরা নিজেদের আসল পরিচয় জানিসনা। আমি বলছি তোরা কে?

তোরা দুজন যমজ ভাই-বোন। জ্বীন মেহরাব আর মানুষকন্যা মুশায়রার যমজ ছেলে মুহিব আর মেয়ে মুসকান।
শুনে অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালাম। এটাই তবে আমাদের আসল পরিচয়। আরেকটু জানতে হবে।

লোকটা একটু থেমে বলল,
~ তোরাই জ্বীনবংশের যোগ্য উত্তরসূরি। তোদের জন্মের পর তোদের মা-বাবার ইচ্ছে ছিল তোদের নিয়ে জ্বীনরাজ্যে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু আমি তা করে হতে দেই? তাদের জন্য তো আমি সব হারিয়েছি, পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি।

রাগে-কষ্টে চরম প্রতিশোধ ঝেকে বসল।
যে করে হোক, তাদের পুরো বংশ আমি শেষ করে ছাড়ব। এ কাজে সফলতা পাওয়ার জন্য আমি শয়তানের আরাধনা শুরু করি। ব্ল্যাকমাজিক করা আয়ত্ব করি। অবশেষে শয়তান আমাকে শক্তি দেয়, আর তক্ষুনি তোর মা-বাবাকে মারার জন্য ছুটে যায়।

বাধ সাধল মেহরাবের চাচা হামনাদ খালিদ। সে জানতে পেরে তোদের নিয়ে পালায়। দুজন কে দুজায়গায় দিয়ে দেয়, যাতে তোদের খোজ আমি না পাই। তোদেরকে না পেয়ে সেদিন ধারালো নখ দিয়ে তোদের মা-বাবার শরীরের সব মাংস বের করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার রাগ কমলনা।

আমার প্রতিশোধ আরো তীব্র হয়ে গেল। তাতে ঘি ঢালল শয়তান। সে আমাকে শর্ত দিল, ২১বছর বয়সে তোদের দুজনের আত্মা যদি তাকে দিয়ে দেই, তবে সে আমাকে গোটা পৃথিবীর সাম্রাজ্য দিবে। এতবছর ধরে তোদের আমি খুজে আসছি। মুহিবকে যখন পেয়েছিলাম তখন সুলাইমানের ক্বারিন জ্বীনরা তাকে পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছিল। আমি তাকে এনে এখানেই বন্দি করি।
নিয়মিত আমার ক্ষোভ ওর শরীরের উপর অত্যাচার করে মিটাই।

আর তোর সন্ধান পাওয়ামাত্র তোকে আঘাত করার জন্য শয়তান গুলোকে পাঠাই। জানি তোর কাছে শক্তি আছে, ওদের সাথে লড়াই করে তোর শক্তি শেষ হয়ে যাবে। তখন তোকে আমার বশে নিয়ে আসব।
এইজন্য তোদের দুজনের দূর্বলতাদের ও আমার আস্তানায় নিয়ে আসি।

আজ তোদের দুজনকেই আমি শয়তানের নামে জবাই দিব আর পেয়ে যাব গোটা পৃথিবীর মালিকানা।
মা-বাবার এমন নৃশংস মৃত্যুর কথা শুনে রাগেকষ্টে আমার শরীর ঘিরঘির করে উঠল। এত কিসের রাগ ছিল শয়তানটার? কেন এমন করল?
মুহিব রেগে বলে উঠল,
~ কে তুই?

~ ওহহো আমার পরিচয় দেওয়া হয়নি তাইনা?
আচ্ছা দিচ্ছি। আমি হচ্ছি মুশায়রার চাচা। যাকে মুশায়রা আর মেহরাব মিলে উম্মের হাতে মারতে চেয়েছিল। কেড়ে নিয়েছিল মুশায়রার বাবার থেকে জোর করে আদায় করে নেওয়া সব সম্পত্তি।

আমার সবকিছু মাটিতে মিশিয়ে দিল। দিনের পর দিন জ্বীন উম্মের হাত থেকে বাচার জন্য পালিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছি। তিল তিল করে সাজানো সব প্ল্যান নষ্ট করে দিল।

রাগে আমার গা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। আজ এই শয়তানটাকে মেরে নিজের মা-বাবার মৃত্যুর শোধ নিব।

মুহিব ভাইয়া কেদে ফেলেছিল এসব শুনে। তাকে চোখ দিয়ে শান্ত্বনা জানালাম। এতবছর পর দুই ভাই-বোন একসাথ হয়েও একে অপরকে জড়িয়ে ভাই-বোন ডাকতে পারছিনা। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে নিলাম।

শয়তান টা তপজপ শুরু করেছে। কোমড়ে আচল দিয়ে গুজে রাখা তলোয়ারের দিকে তাকালাম। আনতে ভুলিনি, এবার ওর খেলা শেষ করব।

শক্তি ব্যবহার করে পাশের শয়তান দুটোকে দূরে সরিয়ে দিলাম। শক্তি যেন অবশ হয়ে আছে, ঠিকমত ব্যবহার করতে পারছিনা। ঠিকি শয়তান দুটো ছিটকে পড়ে কাতরাচ্ছে।

শয়তানটা উঠে দাঁড়িয়ে অগ্নিচোখে তাকিয়ে বলল, জানতাম এমন ই কিছু হবে। তাই গুহাটা শয়তানের দ্বারা বন করে রেখেছি। শুভ শক্তি এখানে ক্ষীণ কাজ করবে। আর দেরী নয়, এক্ষুনি তোদের জবাই করব।

আমাদের আরো শক্ত করে বেধে নিল। ওয়াফাহ বুবু রীতিমত কেদে দিল, তাওহীদ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
হাত এত শক্ত করে বেধেছে তলোয়ার হাতে নেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা, আমার শক্তি তো কাজ ই করছেনা। মুহিব ভাইয়া আমার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। নিজের শক্তি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে আমার হাত খুলতে চাইল।

কয়েকবার চেষ্টার পর আমার হাতের বাধন আলগা হয়ে এল। পাশের শয়তানকে লাথি দিয়ে উঠে দাড়ালাম। তাড়াতাড়ি তলোয়ার টা হাতে নিয়ে এলোপাথাড়ি কোপানো শুরু করেছি চেলাগুলোকে।
এমন অবস্থা দেখে শয়তানটা দিশেহারা হতে গেল। নিজের শক্তি ব্যবহার করতে লাগলাম, কিন্তু কিছুতেই আমাকে বন্দি করতে পারছেনা।

অবশেষে ব্যর্থ হয়ে মুহিব ভাইয়াকে আঘাত করল। ভাইয়া ব্যথা পেয়ে মাটিতে বসে পড়ল। জেদ উঠে গেল আমার।
তলোয়ারের থেকে সবুজ রশ্মি বের করে তাকে আঘাত করতে চাইলাম। পারলামনা, সে অদৃশ্য হয়ে হাসতে লাগল। হাসির আওয়াজ শুনে আঘাত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বরাবরের মত ব্যর্থ হচ্ছি।
ক্লান্ত হয়ে মাটিতেই বসে পড়লাম। শয়তানের হাসি যেন আর থামছেইনা। চারিদিকেই হাসির আওয়াজ। এভাবে আমাকে কুপোকাত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

তলোয়ারের উপর নিজের প্রতিবিম্ব ভাসতে দেখে জ্বীনদাদুর কথা মনে পড়ল। উনি নিশ্চয়ই কোনো সাহায্য করতে পারে এই ব্যাপারে।
মনে মনে স্মরণ করতেই জ্বীনদাদুর প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল।

~ দাদু!
~ আসল সত্য আর শত্রুটার মুখোমুখি হয়ে গেছিস তাহলে
~ হ্যা, এখন কি করে একে শেষ করব বলো।
কিছুতেই পারছিনা। উলটো হেরে যাচ্ছি বার বার।

~ এভাবে ওর সাথে পেরে উঠবিনা। তুই আয়াতুল কুরসি পড়ে তলোয়ারটা ওর দিকে ছুড়ে মারবি যখন মহররমের নতুন চাঁদ মেঘ থেকে বেরিয়ে আসবে। একমূহুর্ত যাতে এদিক ওদিক যাতে না হয়।

তোরা দুজন দুবার ওকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করবি পর পর।
আমি গুহার ফাক দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। চাদটা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, ততক্ষনে শয়তানটাও দৃশ্যমান হল। হয়ে বলতে লাগল,
~ পারবিনা আমার সাথে।

২১বছরের সাধনা আমার, তোদের মত পুচকুদের কাছে হেরে যাওয়ার জন্য না।
আমি মুহিব ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ও ততক্ষণে পায়ে ব্যথা নিয়েও উঠে দাড়িয়েছে। দুজনেই আয়াতুল কুরসি পড়ে নিলাম।

আড়াল করা মেঘটা আস্তে আস্তে করে চাঁদ বেরিয়ে আসছে। এখন ই সঠিক সময়।
একলাফে শয়তানটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেই তলোয়ারটা মুহিব ভাইয়ার দিকে ছুড়ে দিলাম।
ভাইয়াও ছুটে এসে শয়তানটার বুক বরাবর তলোয়ার বসিয়ে দিল। শয়তানটা উচ্চস্বরে গোঙ্গাতে শুরু করল। তার চোখের ভেসে উঠল দুটো সুন্দর মুখ। হ্যা চিনতে পেরেছি আমাদের আম্মি-আব্বুর চেহারা। তাদের মুখে উজ্জ্বল হাসিটা লেগে ছিল। আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল তাদের মুখ দুটো।

তাওহীদ আর ওয়াফাহকে বাধন মুক্ত করে দিলাম।
মুহিব ভাইয়া আমাকে ডেকে বলল, কাছে আয় বোন।
পরমতৃপ্তিতে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। দুই ভাই-বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাদছি। অনেকদিন পর ভীষণ শান্তি লাগছে।

ব্যালকুনির দোলনায় বসে আছে তাওহীদ। আজকের রাতটা ভীষণ সুন্দর, চাদের জোৎস্না লুটোপুটি খাচ্ছে ব্যালকুনিতে থাকার ফুলের গাছগুলোর উপর।
তার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে ওয়াফাহ। হঠাৎ ধড়মড়িয়ে উঠে বলল, কত রাত হয়ে গেল। তুমি খাবেনা?
~ বেশ তো ঘুমাচ্ছিলে। উঠলে কেন?

তোমাকে না বলেছি একদম আমাকে নিয়ে ভাববেনা। আমাকে এখন তোমায় নিয়ে ভাবতে দাও।
~ ফাজলামি রেখে এসো খাবে। আমি টেবিল সাজাচ্ছি। চুলে বান করতে করতে ওয়াফাহ ভিতরের ঘরে ঢুকে যায়। তাওহীদ চাদটার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। ভিষণ মিষ্টি বাতাস বয়ছে, রাতে নিশ্চয়ই হালকা বৃষ্টি হবে। ভিতর থেকে ওয়াফাহর গলা ভেসে আসল, কিগো, আর কতক্ষণ?

তাড়াতাড়ি এসো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাওহীদ উঠে ভেতরের দিকে যায়। সময়মত না গেলে বাসায় গুন্ডামি শুরু হয়ে যাবে।

পর্ব ৩০

তাওহীদ অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতে হতে বলল, আমার আসতে লেট হতে পারে। বেশি খারাপ লাগলে ফোন দিও।

বুয়া এসে রেধে দিয়ে যাবে, আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যেওনা। ওয়াফাহ মুচকি হেসে বলল,
~ তোমার টাই বাধা হয়নি!
~ উফ! এত তাড়াহুড়ো করি আমি। বেধে নিচ্ছি।

~ দাড়াও আমি বেধে দিচ্ছি।
তাওহীদ হ্যাসূচক মুচকি হাসি দিল। ওয়াফাহ যত্নসহকারে টাই বেধে দেয়। ওয়ালেট আর রুমালটা তাওহীদের হাতে দিয়ে দেয়। তাওহীদ ওয়াফাহর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি আবার রান্নাঘরে ঢুকেছো?
~ কই না তো।

~ তোমার গালে হলুদ লাগল কি করে?
ওয়াফাহ তক্ষুনি গালে হাত দিয়ে মুছার চেষ্টা করে। তাওহীদ হেসে বলল,
~ এভাবে মুছবেনা! ওয়েট করো।
তাওহীদ টিস্যু দিয়ে মুছে দেয়। নাক টিপে দিয়ে বলে, গুন্ডিটাহ।

ওয়াফাহ হেসে লুটিয়ে পড়ে তাওহীদের গায়ে। দুজন ই একসাথে হাসতে থাকে। হঠাৎ তাওহীদের চোখ যায় দরজার দিকে। সেখানে মুসকান আর মুহিব একসাথে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাওহীদকে চুপ হয়ে যেতে ওয়াফাহও তাকে অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এটা নিজের কল্পনা নয় তো! প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাওহীদের মুখের দিকে তাকায়। নিজেকে তাওহীদের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে যায় মুহিবের কাছে।

জড়িয়ে ধরতে চায় মুহিবকে, মুহিব হাত দিয়ে বাধা দেয়। এমন করতে দেখে ওয়াফাহর চোখ ছলছল করতে থাকে। মুসকান শান্তভাবে তাওহীদের সামনে দাঁড়ায়। তাওহীদ খুশি হয়ে কিছু বলতে চাইলে মুসকান কষে একটা চড় দেয়। তাওহীদ এমন আকস্মিক ঘটনায় অবাক হয়ে যায়, ওয়াফাহ ছুটে এসে বলল,
~ তুমি ওকে মারলে কেন বোন?

মুসকান অগ্নিদৃষ্টিতে ওয়াফাহর দিকে তাকায়। তারপর বলে,
~ কষ্ট হচ্ছে ওকে মেরেছি বলে?

যদিও চড়টা তোমার ই প্রাপ্য। কিন্তু তুমি আমার বয়সে বড় আর আমার ভাইয়ের বউ। তাই নিজের স্বামীকে শাসন করার চেষ্টা করছি। আমাদের মাঝে তুমি এসোনা, তাহলে আমি ভুলে যাব তুমি আমার ভাবী।
ওয়াফাহ এমন কথা শুনে প্রচন্ড কষ্ট পায়। মুহিবের কাছে গিয়ে তার হাত চেপে বলল,
~ মুসকান এমন করে কেন বলছে?

মুহিব হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করলে ওয়াফাহ। তারপর ভিতরের রুমে চলে যায় মুহিব। ওয়াফাহ নীরবভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। মুসকান তাওহীদের হাত টেনে রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
হাত ছুড়ে মারে ঢুকেই। রাগান্বিত গলায় বলল,
~ এ তোমার ভালোবাসা? বউ চোখের আড়াল হতেই অন্য বিবাহিত মেয়ের সাথে পরকিয়া করছো! ছিঃ! তাওহীদ।
~ এসব বাজে কথা বলবানা মুসকান।

আমি ভাবীর সাথে কোনোরকম পরকিয়া করিনি। তুমি ভুল বুঝছো।
~ এখন ভাবী হয়ে গেছে? এতক্ষণ তো স্বামীর মত আচরণ করছিলে!
~ তুমি একটু শান্ত হও। তারপর আমার কথাটা শুনো।
~ তোমার কাছে আমার আর কিছুই শোনার নেই।

বলে কাদতে কাদতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল মুসকান। তাওহীদ এতবার ডাকল, দরজায় কড়া নাড়ল। কিন্তু মুসকান কোনো সাড়া ই দিলনা। হতাশ হয়ে তাওহীদ ছাদে এসে বসে রইল। কাদতে শুরু করল হাটুতে মুখ গুটিয়ে। কেউ তার কাধের উপর হাত রাখল। চমকে উঠে পিছু ফিরে তাকাল।

শুকনো মুখে ওয়াফাহ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়াফাহকে দেখে তাওহীদ চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ তুমি এখানে? মুহিবের কাছে যাওনি?
~ তাওহীদ, আমার জন্য তোমার আর মুসকানের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আমার জন্য তোমরা কষ্ট পাচ্ছো। বলে কাদতে শুরু করল।

তাওহীদ ওয়াফাহকে শান্ত্বনা দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ ও কিছুনা। অনেকদিন দূরে থাকলে এমন অভিমান হতেই পারে।

তোমাকেও তো মুহিব ভুল বুঝে আছে। দেখবে কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। ওরা দুজন সুস্থভাবে ফিরে এসেছে এর চেয়ে বড় খুশির কথা কি হতে পারে বলো!
দেখবে এবার ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিবে।

ওয়াফাহ কেদে কেদে বলল,
~ তাই যেন হয়। আল্লাহ যেন এবার সব ঠিক করে দেন।

মুহিব মনে মনে অনুশোচনা করতে লাগল। এভাবে ওয়াফাহকে বকাবকি করাটা ঠিক হয়নি। সবকিছু ভুলে ওকে কাছে টেনে নিব। আমি তো কেবল ওর জন্য ই ফিরে এসেছি। ও ছাড়া তো এই পৃথিবীতে আমার আর কোনো আকর্ষণ নেই।

গুন্ডি বউটা নিশ্চয়ই এখন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে।
গুন্ডিটা এখন অনেক ইমোশোনাল হয়ে গেছে। যাই ওকে কাছে টেনে সব ঠিক করে ফেলব। ভাবতে ভাবতে পুরো বাসায় মুহিব ওয়াফাহকে খুজতে লাগল।
অবশেষে ছাদে গিয়ে দেখে ওয়াফাহর মাথায় হাত বুলাচ্ছে তাওহীদ। তাওহীদের কথা শুনে ওয়াফাহ হাসছে। দুজনের মুখে রাঙা হাসি।

দৃশ্য টা দেখে মুহিব থমকে গেল।
কাদতে কাদতে রুমে চলে আসে। মুসকান মুহিবকে এভাবে কাদতে কাদতে রুমে ঢুকতে দেখে ডাক দেয়। কিন্তু মুহিব সাড়া না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

মুসকান বুঝতে পারে ঘটনা। সে নিজেও দৌড়ে ছাদে চলে আসে। তাওহীদ ওয়াফাহর চোখের পানি মুছে দিয়ে হাসতে বলছে। মুসকান এসে ওয়াফাহকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ওয়াফাহ ফুলের টবের সাথে হোচট খেয়ে পড়ে যায়।
তাওহীদ রেগেমেগে মুসকানের দিকে তাকায়।
~ এটা কি করলে তুমি?

~ শুনো ভাবী, তুমি আজ থেকে আমার বরের আশেপাশেও আসবেনা।
তোমার নিজের ও তো একটা সংসার আছে। সেটা সামলাও, আমার ভাইটাকে কষ্ট দিচ্ছো। এতদিন পর ভাইটা সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এলো। আর তুমি অন্যের স্বামীকে নিয়ে ব্যস্ত।

তোমার কাছে হাত জোড় করছি। আমার সংসারে আগুন লাগিওনা।
ওয়াফাহর চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝড়তে থাকে। উঠতে চেষ্টা করে, তাওহীদ এগিয়ে আসতে চাইলে মানা করে। উঠে চুপচাপ নিচে চলে যায়।

তাওহীদ বলল, তুমি কি এটা ঠিক করেছো?
~ ঠিক-ভুল আমি আর বুঝতে চাইনা। এতদিন পর আমি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছি সারাজীবন কাটাব বলে। আর তুমি ওই ওয়াফাহকে নিয়ে ব্যস্ত।
এটা নিয়ে আর কোনো কথা বলবানা।

আর যদি তুমি ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করেছো তাহলে আমি ওয়াফাহকে বাসা থেকে বের করে দিব, সেইসাথে আমার ভাইয়ের জীবন থেকেও। গড়গড় করে কথা গুলো বলে মুসকান নিচে নেমে গেল।
রাতের খাবারের পর হঠাৎ ওয়াফাহ বমি করতে চলে গেল। করার পর নিস্তেজ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। মুহিব ওয়াফাহকে কোলে নিয়ে রুমে নিয়ে আসল। শুইয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল অপলক।

নিজের মধ্যে কেমন অস্থিরতা কাজ করতে লাগল। মেয়েটার শরীর খারাপ তাও একবারো জানাল না। ওয়াফাহর মাথায় হাত বুলাতে লাগল মুহিব। এমনসময় মুসকান তাওহীদের হাত ধরে মুহিবের কাছে আসল। মুহিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ তুই ওকে এভাবে টেনে আনলি কেন?
মুসকান কাদতে কাদতে বলল, আমি আগেই বুঝেছিলাম ভাবীর বমি করা, মাথা ঘুরে পড়া স্বাভাবিক রোগ না। ভাবী সন্তানসম্ভবা।

তাওহীদের ওয়্যারড্রোবে এই রিপোর্টগুলো পেলাম, তাতে স্পষ্ট লেখা, ” ভাবী ২মাসের অন্তর্সত্ত্বা। মুহিব রেগে তাওহীদের দিকে তাকাল।
~ ভাইয়া, বিশ্বাস করুন। এমন কিছুই না যেটা আপনারা ভাবছেন।
মুহিব তাওহীদের গালে একটা ঘুষি মারে। তাওহীদ ব্যথা পেয়ে নিচে বসে পড়ে।

মুসকান মুহিবকে থামিয়ে বলে, ভাইয়া, শান্ত হও।
ও আমার স্বামী, এভাবে মারতে পারোনা ওকে।
ড্রয়িংরুমে তাওহীদ, ওয়াফাহ, মুহিব আর মুসকান গোল হয়ে বসে আছে।

সবাই নিশ্চুপ। ওয়াফাহ কিছু বলতে চাইলে মুহিব বাধা দেয়। তারপর কাছে এসে ওর হাত ধরে বলে, আমি তোমার সুখটাই চাই বউ। আমার অনুপস্তিতিতে তুমি তাওহীদকে আকড়ে ধরে নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছো, এতে তোমার কোনো দোষ নেই। আমি সেদিন তোমাকে যে অবস্থায় ফেলে চলে গিয়েছিলাম, তাতে তুমি কেন তোমার জায়গায় যে কোনো মেয়ে হলে নতুন করে বাচতে চাইত।

মুসকান তোর যদি আপত্তি না থাকে, তাওহীদ আর ওয়াফাহ নিজেদের সংসার গুছিয়ে নিক।
মুসকান নীরবিভঙ্গিতে বলল, আমার কোনো আপত্তি নেই ভাইয়া। যে আমার না, সে আমার হবেনা। এতে আমার কোনো আফসোস নেই।

বলে তাওহীদের দিকে তাকাল। তাওহীদ কিছু বলার আগেই মুহিব বলে উঠল,
তাহলে তালাকের ব্যাপারটা সেরে নিই।
শুনে ওয়াফাহ আতকে উঠল।

পর্ব ৩১

ওয়াফাহ মুহিবের হাত চেপে বলল, এমন কথা বলোনা। সন্তানটা তোমারই। তুমি যা ভাবছো তার কিছুই নাহ।
তাওহীদ বলে উঠল, হ্যা ভাইজান। ওয়াফাহ ভাবী মিথ্যে বলছেনা।

মুহিব আশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কিন্তু….
তাওহীদ গড়গড় করে বলতে লাগল, ” শয়তানটাকে মেরে ফেলার কিছুদিন পর যখন জ্বীনদাদু আপনাদেরকে জ্বীনরাজ্যে চলে যেতে বলেন, তখন ওয়াফাহ ভাবী হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তারের কাছে নিলে জানায় ভাবী প্রেগন্যান্ট।

ভাবী যতটা খুশি হয়েছিল তার থেকে বেশি ভেঙ্গে পড়েছিল। যদি আপনি জ্বীনরাজ্য থেকে আর না ফিরেন, তাহলে বাচ্চাটার কি হবে?
কে দেখবে তাদেরকে?

এসব চিন্তায় ভাবী মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যান। আমি ভাবীকে অনুরোধ করি আমার কাছে থাকার জন্য। সে তা না শুনে তার মায়ের কাছে ফিরে যায়, সেখানে গিয়ে শুনে ভাবীর মা নাকি কিছুদিন আগেই মারা গেছে!
নিরুপায় হয়ে ভাবী আবার আমার কাছেই ফিরে আসে। মুসকানের চিন্তায় আমিও হতাশ হয়ে পড়েছি। আদৌ জানতে পারছিলামনা আপনারা ফিরে আসবেন কিনা?

জ্বীনজাতি আপনাদেরকে এখানে ফিরতে দিবে কিনা! তখন ভাবীর মানসিক অবস্থা বুঝে আমি তার সকল দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করি। ভাবী রাজি হতে চায়নি, পরে আপনাদের বাচ্চার কথা ভেবে রাজি হয়। আপাততদৃষ্টিতে আমাকে আর ওয়াফাহ ভাবীকে অন্য কিছু মনে হলেও আমরা ভাই-বোনের মতই ছিলাম।

আমার কোনো বড়বোন নেই, তাই ওয়াফাহ ভাবীকে নিজের বোনের জায়গায় বসিয়েছিলাম। তার আর তার বাচ্চার দায়িত্ব নিয়েছি। আচ্ছা মুসকান ভাই কি বোনের মাথা কোলে রেখে হাত বুলাতে পারেনা? চোখের পানি মুছিয়ে হাসাতে পারেনা?
বোন ভাইকে টাই পরিয়ে দিতে পারেনা?

তোমার দৃষ্টিতে যদি এটা নোরাংমি হয় তবে পৃথিবীর সব ভাই-বোনের সম্পর্ক ই নোংরা। মুসকান এটা শুনে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। না জেনে কি না বলে ফেলেছে ভাবী আর তাওহীদকে। তাওহীদ একটু থেমে বলল,
~ আচ্ছা মুসকান তুমি ২মাস আগে সেদিন রাতে যখন বললে, তাওহীদ আমি জ্বীনরাজ্যে যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো। আমি কি একবারো জিজ্ঞেস করেছি কেন? ফিরবে কিনা? বাধা দিয়েছি?

কারণ তোমাকে আমি ভীষণ বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি আমাকে, আমার কথা বাদ দাও আমার ভালোবাসাকে বিশ্বাস করলে না! মুহিব ভাইয়া নাহয় আমাকে চিনেনা, তুমি তো আমাকে চিনো।
মুহিব শক্ত করে ওয়াফাহকে জড়িয়ে ধরে কাদতে শুরু করল।
~ স্যরি বউটাহ। আমাকে ক্ষমা করে দিও।

ওয়াফাহ মুহিবের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, এভাবে কাদে কেউ? আমার পিচ্চি জ্বীনবরটাহ। কান্না থামাও। আমাদের বাবুহ কি বলবে বলো তো! লজ্জা দিবেনা তার বাবাকে?

মুসকান আস্তে আস্তে তাওহীদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর আলতো করে তাওহীদের কাধে মাথাটা এলিয়ে দেয়। তাওহীদ প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুসকানের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুসকান শান্তস্বরে বলল,
~ ক্ষমা করে দাও তাওহীদ।

তাওহীদ মুসকানের কপালে ঠোটটা আলতো করে ছুয়ে দেয়। মুসকান তাওহীদের হাত জড়িয়ে বলে, জ্বীনদাদু চেয়েছিল জ্বীনরাজ্যটা আমরা পরিচালনা করি। কিন্তু আমাদের পক্ষে তোমাদের কে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই দাদু শর্ত আরোপ করল যোগ্য কাউকে দায়িত্বে বসিয়ে আমাদের সব জ্বীনিশক্তি ফেরত দিয়ে তবেই সাধারণ জ্বীন রুপে দুনিয়ায় ফিরে আসতে পারব।

তোমাদের সাথে জীবন কাটাতে আর কেউ বাধা দিতে পারবেনা। তোমাকে যে বলেছিলাম জুহানীর কথা। ওকেই পরিচালনার দায়িত্ব এসেছি, আমাদের সব জ্বীনিশক্তি ওর কাছে। আর ও ভীষণ বুদ্ধিমান। কয়েকদিনেই রাজ্যভার সুনিপুন ভাবে বহন করছে।
এখন আর কোনো বাধা নেই আমাদের সংসারে।

শুনে সবার মুখে খুশির ছাপ ফুটে ওঠল। হঠাৎ রুমে কালো ছায়া ঘুরে ঘুরে উড়তে দেখা গেল। মুসকান অবাক হয়ে বলল,
~ জ্বীনদাদু আবার কেন আসল?
মুহিব উৎকন্ঠা নিয়ে বলল, আবার কোনো সমস্যা হল না তো?
~ এসো ভাইয়া, আয়নার কাছে যাই।

সবাই আয়নার সামনে দাড়াল। আয়নার প্রতিবিম্ব নড়ে উঠল। মূহুর্তের মধ্যে আয়নায় জ্বীনদাদুর প্রতিবিম্ব দেখা গেল। সবাই সালাম দিল একসাথে।

~ আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুক। আমি তোমাদের কিছু বলতে এসেছি মুহিব মুসকান। মুহিব বলল,
~ কোনো সমস্যা হয়নি তো জ্বীনদাদু?

~ না দাদাভাই। আমি বলতে এসেছি আগাম ভবিষ্যতের কথা।
ওয়াফাহর গর্ভে মুহিবের সন্তান ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। যেহেতু মুহিব বিশেষ জ্বীন থাকা অবস্থায় এই সন্তান গর্ভে এসেছে তাই সেও বিশেষ জ্বীন হয়ে উঠবে।
মুসকান অবাক হয়ে বলল, কিন্তু আমরা তো সব শক্তি ত্যাগ করে এসেছি। তবে কি করে সে জ্বীন গোত্রের বিশেষ একজন হয়ে উঠবে?

~ মুহিবের অনেকটা শক্তি ওর মাঝে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই সন্তান ই হবে জ্বীনরাজ্যের পরবর্তী সর্দার। ২১বছর বয়সে সে তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে এবং জ্বীনরাজ্য শাসন করবে। তখন তোমরা সে কাজে কোনোরুপে বাধা সৃষ্টি করতে পারবেনা।

আর মুসকান তোমার অনাগত সন্তান মানুষ্যসন্তান ই হবে। সাধারণ মানুষের মতই তার জীবনযাপন হবে। সুখে থাকো তোমরা।
মুহিব আর ওয়াফাহ একে অপরের দিকে তাকাল।

জ্বীনদাদু একটু থেমে বললেন,
~ আর তোমাদের মা-বাবার রুহ তোমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে। তাদের সাথে দেখা করো। সাথে সাথে আয়নায় মেহরাব আর মুশায়রার চেহারা ভেসে উঠল। মুসকান মা বলে ডাক দিল।

মুশায়রা মিষ্টি করে বলল, সুখে থাক তোরা। আল্লাহ তোদের সহায় হন।
আমার নাতি-নাতনীদের ভালো রাখিস। ওয়াফাহ মা তুমি একটা জ্বীনবর পেয়েছো, জ্বীনসন্তান পাবে এই নিয়ে গর্বিত হও। মন খারাপ করে থেকোনা, বরঙ তাকে এমনভাবে তৈরী করো যাতে সে জ্বীনবংশের সেরা জ্বীনসর্দার হতে পারে।

মুসকান মা, সবাইকে সুন্দরভাবে আগলে রাখিস।
আল্লাহর উপর ভরসা রাখিস।

মেহরাব দূর থেকে সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর সব উধাও।
জ্বীনদাদু এসে বলল, দাদুভাইরা, আমার রুহ ও এতদিনে শান্তি পেয়েছে। এখন আমাকে ফিরে যেতে হবে। ভালো থেকো তোমরা।

মুসকান ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে। তাওহীদ এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভালোবাসি জ্বীনকন্যা।
মুসকান তাওহীদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ভীষণ ভালবাসি তাওহীদ।
তারপর জড়িয়ে ধরে বলল, আমি ভীষণ খুশি। সব পূর্ণতা আমাকে ধরা দিয়েছে। তোমার মত ভালো, মিষ্টি একটা মানুষসন্তান আমি পাব।

তাওহীদ একটু দুঃখের ভান করে বলল, তখন আমার আদর কমে যাবে। আমার আদরে ভাগ বসাবে আমার জ্বীনি রাজকন্যা কিংবা রাজপুত্র।
~ বাচ্চাদের মত কি যে বলো তুমি?

সত্যিই ভেবেই ভালোলাগছে, একটা মানুষ্য সন্তান আমার কোল আলো করে আসবে। ছোট ছোট পা ফেলে পুরো ঘর হেটে বেড়াবে। আধো আধো বুলিতে মা মা ডাকবে। খুব ভালো আর সাধারণ হবে তার বাবার মত।
তাওহীদ মুসকানের কানে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, জ্বীনরাণী অনেক ভালোবাসি তোমায়। মুসকান চোখ বন্ধ করে ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল।

মুহিবকে আগের মত ওয়াফাহকে কোলে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগল। ওয়াফাহ হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, কি ভাবছো?
~ ভাবছি আমাদের সন্তান ২১বছরের পর আর আমাদের থাকবেনা। চলে যাবে জ্বীনরাজ্যে, শাসন করবে সে রাজ্য।

~ আমার কিন্তু ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।
~ তোমার খারাপ লাগছেনা? ও আমাদেরকে ছেড়ে জ্বীনরাজ্যে চলে যাবে।

~ সেটার জন্য একটু খারাপ লাগলেও আমি কিন্তু সত্যিই গর্বিত। একজন সাহসী বিশেষ জ্বীনবর পেয়েছি আর একজন দায়িত্ববান সেরা জ্বীনসন্তান পাচ্ছি। একজন মায়ের কাছে গর্ব কি জানো? যখন তার সন্তান বিশেষ কোনো স্থানে সম্মান লাভ করে। আমার সন্তান পুরো জ্বীনরাজ্য সুনিপুন আর সুন্দরভাবে পরিচালনা করবে এবং সেরা জ্বীনসর্দার হবে। এতেই আমার আনন্দ।

~ গুন্ডি বউটাহ আমার।
~ এই শুনোনা জ্বীনবর।
~ হুম বলো।
~ ক্ষিধে পেয়েছে।

~ এত রাতে?
~ হুম
~ রান্নাঘরে বিরিয়ানি আছে, দাড়াও নিয়ে আসছি।
~ না বিরিয়ানি খাবনা। যাও না একটা ডিম ভেজে দাও।

ডিমটা একটু হলুদ হলুদ রাখবা বুঝছো জ্বীনবর!
~ আগের মত জ্বালানি শুরু হয়ে গেলনা তাইনা!
ওয়াফাহ হাসতে হাসতে মুহিবের বুকে মাথা গুজে। মুহিব হেসে হেসে জড়িয়ে ধরে ওয়াফাহর মাথায় আলতো চুমু খায়। ওয়াফাহ মিহিকন্ঠে বলে উঠল,
~ জ্বীনবরটা আমার।

আর ভাবতে থাকে, আমি আসলেই সৌভাগ্যবতী। এমন জ্বীনবর পাওয়া সবার ভাগ্যে থাকেনা। জ্বীনবরের ভালোবাসায় যুগ যুগ বেচে থাকবে ওয়াফাহ, মুশায়রা। সবাই শুনে শুনে আক্ষেপ করবে, “ইস আমিও যদি একটা জ্বীনবর পেতাম।” হালকা ঈর্ষা ও করবে তাদের। ওরা ভীষণ ভাগ্যবতী বলে কথা!

লেখা – আস্থা রহমান শান্তনা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “জ্বীনবর (সিজন ৩) – রোমান্টিক ভূতের গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – জ্বীনবর (সিজন ৪) – ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প শোনাও

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *