হিয়ার মাঝে – valobashar choto golpo: রাফিকার স্পর্শে ধ্যান ভাঙলো সায়নের। গোলাপী রাঙা ঠোঁট গুলো নড়ছে, শুধু ঠোঁট নয়, চোখ গাল সব কিছুই যেনো কথা বলছে তার সাথে।
মুলগল্প
“আমার বরের দামী গাড়ী, দামী বাইক না থাকলেও চলবে। ভাঙাচোরা একটা সাইকেল চড়েই না হয় দুজন ভোরে রাস্তায় বের হবো কোয়াশাছন্ন শীতের সকাল উপভোগ করবো”
চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে যখন রাফিকা কথা গুলো বলছিলো, চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে উপভোগ করছিলো সায়ন সেই মুগ্ধতা।
চেয়ার ছেড়ে ওঠে বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে মিষ্টি রোদ উপভোগ করতে লাগলো রাফিকা। চোখ দুটো বন্ধ করে দু হাত দুদিকে মেলে বললো, “সায়ন ভাইয়া এদিকে এসো না, দেখো সকালের মিষ্টি রোদ টা কতো মজা”
সায়ন মুচকি হেসে চায়ের কাপটা রেখে বেলকুনিতে চলে গেলো। রাফিকার পিছনে দাঁড়িয়ে দুহাত পকেটে গুজে অপলক দৃষ্টি তে চেয়ে রইলো রাফিকার মুখ পানে। “এই মেয়ে সবসময় নিজের মুগ্ধতায় ডুবে মারতে চায় কেনো আমাকে? ও কি বুঝে না ওর মুগ্ধতায় আমি মুগ্ধ হতে হতে মুগ্ধতার চরম সীমানায় পৌঁছে যাচ্ছি” এক ধ্যানে তাকিয়ে কথা গুলো ভাবছিলো সায়ন।
রাফিকা সামনে এসে হাত নাড়ছে সেদিকে খেয়ালই নেই। বিরক্ত হয়ে রাফিকা হাতে ধরে ধাক্কা দিলো।
সায়ন ভাইয়া, ও সায়ন ভাইয়া তুমি কি দাঁড়িয়েই জ্ঞান হারালে,
রাফিকার স্পর্শে ধ্যান ভাঙলো সায়নের। গোলাপী রাঙা ঠোঁট গুলো নড়ছে, শুধু ঠোঁট নয়, চোখ গাল সব কিছুই যেনো কথা বলছে তার সাথে।
সায়ন মৃদু হেসে বললো “না জ্ঞান হারায়নি ভাবছি কাকা কাকি তো তোকে অনেক বড় লোক ছেলের কাছে বিয়ে দিবে তার তো গাড়ি, বাড়ি থাকবে। তাহলে তোর সাইকেল চড়া কি করে হবে?”
রাফিকার মুখ টা মলিন হয়ে গেলো। মুখটা ভাড় করেই বললো, “কি বলছো ভাইয়া আমার কি আর সাইকেল চড়া হবে না?”
সায়ন রাফিকার ওড়নার এক কোনা হাতে নিয়ে বুলিয়ে বুলিয়ে বললো, “কেনো হবে না, আমি সাইকেল করে ঘুরাবো তোকে।”
রাফিকার চোখে মুখে হাসির ঝলক দেখা গেল। আবার সাথে সাথেই মুখ মলিন হয়ে গেলো।
“কিন্তু আমিতো ভেবেছিলাম বরের সাথে”
সায়নের বুকের ভিতর ধক করে ওঠলো। কেমন অজানা অনুভূতি এসে চাপ দিলো। কিন্তু সেই অনুভূতি তে না ছিলো সুখ না ছিলো দুঃখ। চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো শুধু।
রাফিকা দশম শ্রেনীতে পড়তো আর সায়ন অনার্স থার্ড ইয়ার। সম্পর্কে চাচাতো ভাই হওয়াতে রাফিকাকে রোজ সকালে পড়ানোর দায়িত্ব টা ছিলো তার। পড়ানো, স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, একসাথে ঘুরতে যাওয়া সব টা জুরেই ছিলো রাফিকা।
১৫, ১৬ বছর বয়সি এক মেয়ের হাজারো স্বপ্নের শাক্ষী হতে হতে কখন যে নিজেকে তার স্বপ্ন পূরনের কারিগর করে তুলেছে টেরই পায়নি। রাফিকাও সায়ন ছাড়া কিছু বুঝে না। কিন্তু সায়নের পাশে বসে, সায়নের সাথে থেকে সর্বক্ষন স্বপ্ন দেখে যায় অন্যপুরুষের। যতোবার সায়ন তার না বলা কথা বুঝাতে গিয়েছে ততোবারই ব্যার্থ হয়েছে।
আর মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে “যাক না দিন যেভাবে যাচ্ছে। আমার মনের তীব্র ভালোবাসার কথা তাকে নাইবা জানালাম। এই যে সর্বক্ষন পাশে পাচ্ছি, সে আমাকে ছাড়া কিছু বুঝে না, আমি তাকে ছাড়া কিছু বুঝিনা, এর নাম কি ভালোবাসা নয়।”
ভালোবাসি বলা হয়নি তবুও তো ভালোবাসি। থাকুক না কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশিত।”প্রকাশিত ভালোবাসার চেয়ে অপ্রকাশিত ভালোবাসার গভীরতা বেশী।”
তে দেখতে কেটে যায় কয়েকটা বছর। কয়েক বছরে সায়নের মনের ভালোবাসা তীব্রতর হতে থাকে। কিন্তু রাফিকা?
সে কি তার ভালোবাসা বুঝেছিলো? না বুঝেনি।
বাবা, মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে ঠিক বিয়ে করে নিয়েছে সে। সায়ন নিজের ভালোবাসা কে কবর দিয়ে, ভালোবাসার মানুষের সুখের প্রার্থনাই করে যাচ্ছে দূর থেকে। বাস্তবতা কে মেনে নিয়ে বুকে চাপা কষ্ট পুষে কাটিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসা হীন জীবন। আর রাফিকা বিয়ের প্রথম রাতে যখন স্বামী তাঁর কামনা, বাসনা পূরন করতে তার শরীর ছুঁয়েছিলো। স্বামীর প্রথম সে ছোঁয়া তাঁর বুকে রক্তক্ষরন যন্ত্রণা বয়িয়ে দিচ্ছিলো। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিলো সেই দিনগুলোর কথা,
“সায়ন ভাইয়া, ও সায়ন ভাইয়া। আমার অনেক বড় সড় একটা প্রশ্ন আছে তোমার কাছে”
সায়ন শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো বলে ফেল।
“আমি যখন ই বেশী ছুটাছুটি করি বা কোন কিছুর অবাধ্য হই তুমি কেনো আমার ওড়নার এক কোনায় হাত বুলাও। বাবা, মা তো মাথায়, পিঠে হাতে ধরে বোঝায় সব, আদরও করে। তুমি কেনো ওড়নায় হাত বুলাও?”
সায়ন মুচকি হেসে রাফিকার ওড়না টেনে বিছানায় বসালো। তারপর নিজের হাত দেখিয়ে বললো “এই দেখ আমার হাতগুলা কেমন লোহার মতো শক্ত, মনে নেই তোর আগের বছর ঈদে তোকে জোর করে টেনে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। তুই পাড়ার ছেলেদের সাথে ঝগরা করছিলি। সেদিন তো আমার হাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠেছিলো তোর হাতে। তুই তো ব্যাথাও পেয়েছিস বল। কতো চোখের পানি ফেলেছিস বল তো, তোর ঐ চোখের পানি আমার এই খানে লেগেছে” বুকের বা পাশে দেখিয়ে বললো।
“যেহেতু তুই ও ব্যাথা পেয়েছিস আর তোর ব্যাথায় আমারো ব্যাথা লেগেছে সেহেতু আমি পন করেছি আমার এই লোহার হাত দিয়ে তোর ঐ মোমের শরীরে ছুঁবোনা”
বাসর রাতে স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার মূহর্তে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেছিলো রাফিকা।”সায়ন ভাইয়া কে কেনো মনে পড়ছে। আমি তো অন্যকারো ঘরের বউ তাহলে কেনো আজ সায়ন ভাইয়া কে এতো মনে পড়ছে।
কেনো বার বার মনে হচ্ছে আমার স্বামীর জায়গায় আজ সায়ন ভাইয়া থাকলে আমার জীবনটা খুবই সুখময় হতো। তাহলে কি আমার মনের গভীরে সায়ন ভাইয়ার নাম লেখা ছিলো?” কিন্তু কপালে লেখা ছিলো না তাই পাইনি? নাকি আমার কোন ভুল হয়ে গেলো?
যে ভুল শোধরাবার কোন পথ নেই।
সময় চলে গেছে সময়ের গতিতে। বয়স ও বেড়ে গেছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনের সুপ্ত অনুভূতি গুলোর সাথেও পরিচিত হয়েছে রাফিকা। হ্যাঁ সেই অনুভূতি যে অনুভূতি টা আজীবন অপ্রকাশিতই রয়ে যাবে।
সারাদিনের ব্যাস্ততা কাটিয়ে ক্লান্ত শরীর টা যখন বিছানায় মেলে দেয় গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, মনে পড়ে যায় হাজারো স্মৃতি। সবজি কাঁটতে গিয়ে যখন হাতটা কেটে ফেলে, “স্বামী বলে ফার্স্ট এইড বক্স থেকে ওষুধ লাগিয়ে নিতে”
ঠিক সেসময় কিছু ক্ষনের জন্য রাফিকা ডুব দেয় পুরোনো স্মৃতি তে।
কাঁচা আম কাটতে গিয়ে যখন হাতটা কেটে ফেলেছিলো রাফিকা। সায়ন দৌড়ে এসে হাত ধরে একবার ফু দিচ্ছিল তো আরেকবার বকছিলো। নিজের হাতে স্যাভলন দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে নিজের হাতে খাওয়িয়ে দিতো। বোধ হয় ব্যাথা সে না সায়নই পেয়েছিলো। তার আদর মাখা যত্নগুলো তখন অনুভব করতে না পারলেও এখন বেশ অনুভব করতে পারে।
চোখের কোনে বিন্দু জলকনা বেরিয়ে আসে আফসোসের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।”কেনো বুঝিনি আগে, কেনো অনুভব করতে পারিনি? কেনো সেদিন তার না বলা কথা গুলো শুনিনি আমি?”
বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেরদিনের ঘটনা,
সায়নের মুখ টা ছিলো বিষন্নতায় ভরা, চোখ গুলো ছিলো ঝাপসা,
“সায়ন ভাইয়া, তোমার কি ঠান্ডা লেগেছে। নাক এমন লাল কেনো? চোখ এমন হয়ে গেছে কেনো?”
সায়ন হালকা হেসে বললো, “রাফিকা চল ছাদে যাই তোর সাথে আমার খুব জরুরি একটা কথা আছে।”
“কি যে বলোনা ভাইয়া আমার হবু বর ফোন করবে তো, তার সাথে কথা বলে ভাব করে নিতে হবেনা। তুমি না কিচ্ছু বুঝনা। বুরো হয়ে যাচ্ছো বিয়েও করছো না। আর কদিন পর তো মেয়েরা তোমায় বিয়েই করবে না বলে হাসতে লাগলো রাফিকা”
সায়ন সেই হাসির দিকে চেয়ে ছিলো অপলক দৃষ্টি তে।
“মেয়েটা কতো খুশি। হবু বরের জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার জন্য কি তার সময় আছে? আমিও না বড় বোকা, বোকামি করে তার সব খুশি নষ্ট করতে যাচ্ছিলাম। আমিতো চাই ও সুখে থাকুক ভালো থাকুক। ওর সুখেই তো আমার সুখ” মনে মনে ভেবে বললো,
“রাফিকা”
সায়নের ডাকে চোখ তুলে তাকালো রাফিকা। ভ্রূ উঁচুয়ে বললো কি,
“তুই সত্যি খুশি তো? তোর আবার মন খারাপ হবে না তো কারো জন্য?”
রাফিকা বললো, “আরে মন খারাপ হবে কেনো? আমিতো একবারে যাচ্ছি না। তাছাড়া তোমাদের কথা মনে পড়লেই চলে আসবো। মেয়ে হয়েছি পরের ঘরে তো যেতেই হবে”
ফোন বেজে ওঠতেই রাফিকা বললো, “এই তো ও ফোন করেছে আমি কথা বলি তুমি এখন যাও কেমন।”
বলেই সায়নের হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিলো। সাথে সাথে সায়নের বুকটা ধক করে ওঠলো। এক চাপা শ্বাস ছেড়ে চলে গেলো।
রাফিকা জানালায় মাথা ঠেকালো। চোখের কোনে বিন্দু, বিন্দু জলকনারা ভীড় জমালো। দূরের পথে তাকিয়ে গান ধরলো –
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে,
দেখতে আমি পাইনি তোমায়
দেখতে আমি পাইনি,
বাহির পানে চোখ মেলেছি,
বাহির পানে
আমার হ্রদয় পানে
চাইনি আমি,
আমার সকল ভালোবাসায়
সকল আঘাত, সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে
তুমি ছিলে
আমি তোমার কাছে যাইনি।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে …..
তুমি মোর আনন্দ হয়ে।
ছিলে আমার খেলায়।
আনন্দে তাই ভুলে ছিলেম।
কেটেছে দিন হেলায়।
গোপন রহি গভীর প্রানে।
আমার দুঃখ সুখের গানে।
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।
দেখতে আমি পাইনি, আমি দেখতে আমি পাইনি।
“আমাদের জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা আমাদের মনের গভীরে চুপিচুপি অবস্থান করে নেয়।
কিন্তু আমরা সেটা ততোক্ষন না অনুভব করতে পারি যতোক্ষন না তারা আমাদের সীমানার বাইরে চলে যায়, বা আমরা তার সীমানার বাইরে চলে যাই।”
“মনের ভীতরে কিছু সুপ্ত অনুভূতি থাকে যা আমরা সঠিক সময়ে অনুভব করতে পারিনা।
কিন্তু সেই অনুভূতি প্রকাশিত না হওয়ার ফলে জীবন থেকে যখন মহামূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলি ঠিক সে সময়টায়ই পাষন্ড অনুভূতিগুলো জাগ্রত হয়ে ওঠে।”
লেখা – জান্নাতুল নাঈমা
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – উপলব্ধি – খুব চমৎকার একটি শিক্ষণীয় গল্প