ভোরবেলা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে আকাশে মেঘের বিকট শব্দ।বৃষ্টির কারণে অন্ধকারও হয়ে আছে। পাশের বাড়ির রহিমা চাচি, কাদা মাটিতে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আমাদের দরজায় নক করলেন। আমি ফজরের নামাজ পড়ে শুয়ে আছি। বাসার সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমি দরজা খুললে চাচিকে দেখলাম।
‘চাচি, কোন সমস্যা? এত ভোরে আসলেন? বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছেন। ‘
‘রানা, তোমার কাছে কিছু টাকা হবে? আমার মেয়েটাকে হাসপাতালে নিতে হবে। ধাই মহিলা বললো, হাসপাতালে না নিলে। বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে না। তোমার আম্মাকেও ডাক দেও। ‘
রহিমা চাচির বড় মেয়ে রিপার সন্তান হবে। তাঁর স্বামী দুমাস আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। চাচা মারা গেছে রিপা ছোটো থাকতেই। চাচি কষ্ট করে এদের বড় করেছেন।
আমি আম্মাকে ডাক দিলাম। আম্মা ঘুম থেকে উঠে আসলেন। আম্মার শরীরও বেশি ভালো নেই।
আম্মা রুমের দরজার এসে দাঁড়িয়ে বলেন,
“কিরে রিপার মা কি সমস্যা? এত ভোরে আসলে যে? “
“ভাবি,আমার মেয়েটার অবস্থা ভালো নেই। হাসপাতালে নিতে হবে। কয়ডা টাকা দেন। গাড়ি ভাড়া করে যাইতে হবে। “
‘কত টাকা লাগবে? আর কে নিয়ে যাইতেছে? ‘
“খাগড়াছড়ি হাসপাতালে যেতে ভাড়া চার’শত লাগবেই। আমি একাই যাবো। “
আম্মা,চাচির কথা শুনে আমাকে টাকা দিতে বললো৷ আমি মানিব্যাগ থেকে একশো টাকার দশটা নোট বের করে দিলাম। চাচি সেটা নিয়ে চলে গেলেন। গাড়ি, বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারবে না।
মাটির রাস্তা, বৃষ্টির কারণে কাদা হয়ে আছে। পাকা রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে গাড়িতে তুলতে হবে৷ রিপা হেঁটে যেতে পারছে না। ভোরে সবাই ঘুমিয়ে আছে। চাচি রিপাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চললো আস্তে আস্তে। মা সেটা দেখে আসলো।
বাড়ি এসে আমাকে ও আমার ছোটো ভাইকে ডাকলেন৷
‘রানা, ইমন উঠ তাড়াতাড়ি। রিপাকে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়। মেয়েটা হাঁটতে পারছে না৷ ‘
মায়ের কথা ফেলা সম্ভব নয়। তার উপর আমাদের প্রতিবেশী। রিপা আমার প্রাথমিক স্কুলের সহপাঠীও ছিলো।
আমি ও আমার ছোটো ভাই ছাতা নিয়ে দৌড়ে গেলাম। আমি ও ইমন রিপাকে কোলে নিয়ে হাঁটছি। চাচি ছাতা ধরলেন রিপার উপর৷ আমরা ভিজেই চললাম। মিনিট দশেক পর রিপাকে গাড়িতে তুলে দিলাম। গাড়ির ড্রাইভার আমার বন্ধু।
ড্রাইভারকে বললাম,
‘গাড়ি ভাড়া নিস না। আমি সেটা দিবো। ‘
রিপাকে নিয়ে গাড়ি চললো, তাইন্দং থেকে খাগড়াছড়ির দিকে। চল্লিশ কি.মি দূরে। পাহাড়ি এলাকা তাই বৃষ্টি হলেই গাছপালা পড়ে রাস্তায়।
আমরা দু-ভাই বাসায় চলে আসলাম৷ দুপুরে ঢাকা চলে যাবো। ইদের ছুটি শেষ। আমি বাসায় এসে শুয়ে রইলাম। ঘুম ভাঙলো মানুষের আহাজারিতে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল এগারোটা। মানুষের কান্নার শব্দ আসছে, রহিমা চাচির বাড়ি থেকেই৷ আমাদের ঘরে কেউ নেই৷ বাসা থেকে বের হলে শুনি, এম্বুলেন্স শব্দ করছে । গ্রামে কেউ আবার মারা যায়নি তো।
রহিমার চাচির ছোটো দুটা মেয়ে কান্না করছে। আমি হেঁটে পাকা রাস্তার দিকে গেলাম। এম্বুলেন্স এসে থামলেন। লাশটার পাশে একটা বাচ্চা কান্না করছে। চাচি সেটা কোলে নিয়ে বসে আছে। লাশটা ছিলো রিপার। একজন আগে দেখে আসছেন হাসপাতালে, সে নাকি বাড়িতে খবর দিলো রিপার মৃত্যুর কথা।
আমি সে দিন চাচির কোলের বাচ্চাটা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মেয়েটা এত সুন্দর ছিলো। রিপার চেয়ে অনেক সুন্দর। মেয়েটা একবারেই এতিম হয়ে গিয়েছে। জন্মের পূর্বে বাবা, জন্মের সময় মা হারালো।
সেইদিন আর ঢাকায় যাওয়া হয়নি৷ বিকালে রিপার লাশ মাটি দেওয়া হয়ে যায়। পরেরদিন আমি ঢাকায় চলে আসি। কোরবানি ইদে বাড়িতে গেলাম।
রহিমা চাচির ছোট দুটা মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। চাচি সেই রিপার মেয়েটা দেখাশোনা করে। মেয়েটার নাম রেখেছিলো রাইসা।
খাবার অভাবে কেমন পুষ্টিহীনতায় ভোগছে। আমার খুব মায়া হয়৷ আমাদের বাড়ির পাশে করিম চাচা গরুর দুধ বিক্রি করেন। দুধের দামও কম মাসিক দুশত হলেই মেয়েটার দুধের খরচ হয়ে যায়৷ আমি তখন ছয় মাসের টাকা দিয়ে আসি। মোবাইলের সময় ছিলো না। তাই কখনো খুঁজ খবর নেওয়ার মাধ্যমও ছিলো। ইদের ছুটি শেষ হলে ঢাকায় চলে আসি।
ততদিন আমার অন্য কোম্পানিতে আরো ভালো বেতনে চাকুরী হয়ে যায়৷ আমি বিয়ে করে ফেলি। ছোটো ভাইও ততদিনে ঢাকায় চলে আসে। বাড়িতে ছোটোবোন মা-বাবা থাকে।
আমি কিছু টাকা বাড়িতে দেই। বাবারও আয়ও ভালোই। নিজের জমিজমা, পুকুর এইসবের আয় দিয়ে সংসার চলে যায়।
বছর পর রোজার ইদে আমি বাড়ি গেলাম। শুনি রহিমা চাচির মেঝো মেয়ের রিমা, সংসার আর টিকে নি। যৌতুকের টাকার জন্য নির্যাতন করা হতো।
মেয়েটা স্বামীর ঘর ছেড়ে মায়ের কাছে চলে আসে।
মা অন্যের বাড়ি কাজ করে কোন রকম রাইসাকে নিয়ে চলে। অনাহারে ও কর্মজীবন নিয়ে কষ্টেই চলে।
রিমা তখন চট্টগ্রাম চলে যায়,একটা পোশাক ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। যা আয় করতো, সেটা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে, রহিমা চাচির জন্যও কিছু টাকা পাঠাতো। রাইসাকে নিয়ে চাচি কোন রকম চলতো জীবন।
রহিমা চাচি ২০০৮ সালে মারা যান। রাইসাকে রিমার ছোটো বোনের কাছে রেখে আসেন। পড়াশোনা করতে থাকে মেয়েটা।
গত বছর আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। রাইসা মেয়েটা আমাদের বাড়িতে আসে। আমি ডাক দিলাম।
‘রাইসা, পড়াশোনা কেমন চলছে? কোন কিছুর প্রয়োজন আছে? ‘
“না, মামা।আমার পড়াশোনা ভালোই চলছে। আমার জন্য দোয়া করবেন। “
‘কী নিয়ে পড়াশোনা করো? জীবনে ভালো কিছু করতেই হবে। কোন প্রয়োজন হলে আমাকে বলো। আমার সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করবো। আমার মেয়েটাও এবার এসএসসি দিবে।’
“আম্মু যা দিচ্ছে তাতেই ভালো চলছে৷ আমি ডাক্তার হতে চাই দোয়া করবেন। আমার আম্মু ও নানু টাকার জন্য ভালো চিকিৎসা করতে পারেনি। আমি ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। “
‘আচ্ছা, তোমার জন্য দোয়া রইলো। ‘
চোখের পানি ছেড়ে রাইসা বললো,
“মামা আমি শুনেছি, আমার জন্মের সময় আম্মুকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার টাকা ছিলো না। হাসপাতালে না নিলে, আমি মারা যেতাম। আম্মুকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার সেই টাকা আপনিই দিয়েছেন। আমার বেঁচে থাকার পিছনে আপনিই ছিলেন।”
‘মামা, এত কিছু বলতে নেই। দোয়া করি স্বপ্ন পুরুন হোক তোমার ‘
রাইসা স্কুল, কলেজ দু জায়গায় এ+ পায়। রিমা আর বিয়ে বসেনি। রাইসাকে মেয়ের মতো করেই বড় করে৷
কলেজ শেষ হলে, রাইসাকে চট্টগ্রাম নিয়ে যায় রিমা।
রাইসা একটা কোচিং করে। কিছু দিন আগে মেডিকেল ভর্তির রেজাল্ট দিয়েছে।আমাদের খাগড়াছড়ি থেকে কেবল একজনই মেডিকেল চান্স পেয়েছে। সেটা রাইসা।
আজকে একটা স্থানীয় পত্রিকায় রাইসাকে নিয়ে লেখা দেখে, বিশ বছর আগের কথা গুলো মনে পড়লো। আল্লাহ রাইসার ইচ্ছে পুরুন করুক এটাই কামনা করি৷ রিমার স্বপ্ন গুলোও রাইসাকে ঘিরে। তাইতো নিজের জীবনটা বিসর্জন দিয়েছে।
রাইসা যেন অসহায় মানুষের ডাক্তার হতে পারে সেটা চাই। জীবনে শেষ সময় রিমার জীবনটা সুখ হোক। জীবনের কষ্ট দূর হয়ে আলো আসুক।
অণুগল্প – আশার আলো (Real Life Story)
লেখা- সোলাইমান রানা
আরো পড়ুন- পরিপূর্ণ সংসার জীবনের গল্প