ভাবী থেকে মা – হৃদয় স্পর্শ ভালোবাসার গল্প: আমার চোখ কেমন ছলছল করে উঠছে হঠাৎ। মুখ ভেঙে কেমন কান্না এসে যাচ্ছে। অনেক অনেক দিন পর আমার মনে হলো মায়ের কথা।
মূলগল্প
ভাবী আমাদের বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার তিন মাসের মাথায় মা মারা যান।
তখন আমার বয়স আট কী নয়। ক্লাস থ্রিতে পড়ি আমি। ঘরে বোন নাই। বাবা তো সেই কবে থেকেই সহ্যাশায়ী রোগী। সংসারটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে উঠতে চাইলো হঠাৎ। সবাই বললো, এবার ওদের সংসার ভাঙবেই ভাঙবে। সবাই যখন আমাদের সংসার ভাঙার লীলা দেখার প্রস্তুতি নিলো তখন ভাবী দেখিয়ে দিলেন উল্টো লীলা।
মার মৃত্যুর পর যেন নতুন মা হয়ে ফিরে এলেন তিনি। গায়ের সাজসজ্জা, বাহারি নেলপলিশ, চুড়ি, টিপ সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে নিজের হাতে তুলে নিলেন তিনি আলমাড়ির চাবির গোছা, রান্না ঘরের হাড়ি পাতিল, আব্বার সেবা যত্ন, অষুধ খাওয়ানো, আমার পড়া তৈরি করে দেয়া, গোসল করানো, খাইয়ে দেয়া, ঘুম পাড়ানো, সব, সবকিছু। মার শোক কী জিনিস তা আমি আদৌ বুঝতে পারলাম না।
অবশ্য প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগতো। মার গায়ের গন্ধ নিয়ে যে পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ আসতে পারে না তাই! কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে অনেকেই আসতে পারে। আমরা বলি না যে ইনি আমায় ঠিক ছেলের মতোই দেখেন!
ভাবী ছিলেন এরও বেশি। কতদিন আমি দুষ্টুমি করে ঘরের এটা ওটা ভেঙে দিয়েছি। এর জন্য ভাইয়া রাগ করলেও ভাবী কিন্তু মোটেও রাগ করতেন না। ভাইয়াকে বরং বুঝিয়ে বলতেন, ‘ছোট সময় এমন কত কীই তো তুমি আমি করে এসেছি। নয়নও তো তেমনই। ছোট মানুষ। ওর কী এখনও বোঝ এসেছে বলো?
ভাইয়া বলতেন, ‘লায় দিয়ে দিয়ে তো মাথায় তুলছো বাদরটাকে।’
ভাবী হাসতেন। বলতেন, ‘দেখো, বাদরটা একদিন অনেক বড় হবে।’
বাবা একটু পর পর ভাবীকে ডাকতেন। একবার অষুধের জন্য, একবার মাথা গরম হয়ে গেছে বলে একটু জল ঢেলে দিতে, একটু শরবতের জন্য আরো কত কী!ভাবী হাসিমুখে সব করে দিতেন।
কোনদিন তাকে আমি বিরক্ত হতে দেখিনি। কিন্তু ভাবীর মনে একটা দুঃখ ছিল। অবশ্য এই দুঃখ তিনি কখনো প্রকাশ করতেন না। মানুষ বলতো, ‘খেয়া, তোমার যে সন্তান সন্ততি নাই তোমার মন খারাপ হয় না এতে?’
ভাবী অবাক হয়ে বলতেন, ‘কে বলেছে আমার সন্তান নাই? নয়ন কী আমার সন্তান না?’
প্রতিবেশীরা বলতো, ‘এইসব শুধু মুখের কথাই হয় বাস্তবে হয় না। পরের সন্তান কী আর নিজের সন্তান হয় কোনদিন?’
ভাবী তখন চুপ হয়ে যেতেন। তারপর ঘরে এসে সেদিন আমায় পড়াতে বসে মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বলতেন, ‘নয়ন, তুই আমার কী হস বলতো?’
আমি অনেক্ষণ ভেবে বলতাম, ‘ভাই।’
ভাবী তখন মুখটা কালো করে ফেলতেন। বলতেন, ‘আর কখনো ভাই বলবি না। বলবি সন্তান। তুই আমার সন্তান।’
আমি ডান দিকে মাথা নুইয়ে হ্যা বলতাম।
দীর্ঘদিন রোগে ভোগে বাবা মারা গেলেন। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ভাবীও এ বাড়িতে অনেকটা পুরনো হয়ে গেছেন। এতদিনে তার শরীরে সত্যিকারের মা মা একটা গন্ধ এসেছে। চেহারা থেকে বৌ বৌ রুফটা একেবারেই মিলিয়ে গেছে। এই বৌ বৌ রুফ মিলিয়ে যাওয়ায় বোধহয় ভাবীর জন্য কাল হলো। ওদিকে বাবাও নাই। আমি ছোট।
এই সুযোগে ভাইয়া যেন কেমন হয়ে উঠলেন। ভাবীকে আজকাল তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। বন্ধ্যা বলে দূরে সরিয়ে রাখেন। এক খাটে শুতে পর্যন্ত যান না। ভাবী কাছে আসলে বলেন, ‘তুই আমার কাছে আসবি না। তোরে দেখলে আমার মাথায় আগুন ধরে।’
ভাবী অসহায়ের মতো বলতেন, ‘কই যাবো বলো আমি। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে?’
‘ভণিতা ছাড়। দূরে যাইয়া ভাব দেখা। আমার কাছে তোর জায়গা নাই।’
ভাবী বলতেন, ‘মাইয়া মাইনষের বিয়ের পর ঠিকানা একটাই। তার স্বামীর বাড়ি। এই বাড়ি ছাইড়া আমি কোথাও যাবো না।’
ভাইয়া রাগে গজগজ করতে করতে বলতেন, ‘যাইবি যাইবি। একশো একবার যাইবি। যাওয়ার জিনিস আনতেছি।’
ভাবী ভেবেছিলেন ভাইয়া বুঝি ওইদিন এমনিতেই এই কথা বলেছিলেন। কিন্তু কদিন পরেই দেখা গেলো এমনি এমনি নয়। ভাইয়া সত্যিকারেই একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছেন।
সেই বউ বাড়িতেই তুলে এনেছেন। এবার শুরু হলো বাড়িতে অন্য লীলা। যারা আমাদের বাড়ির সংসার ভাঙার লীলা দেখতে চেয়ে আশাহত হয়েছিল আগে এখন যেন তারা নতুন দৃশ্য দেখার জন্য একটু আড়মোড়া ভেঙেই বসলো।
নতুন ভাবী সাধারণ মেয়েদের মতো অত হাসিখুশির মানুষ নন। তিনি সব সময় চুপচাপ থাকেন। বাড়িতে তার যা কথা হয় ভাইয়ার সাথেই। খেয়া ভাবী হয়ে গেলেন এ বাড়ির আসবাবপত্রের মতো। তার সাথে কেউ কখনো কথাও বলে না, তার কোন প্রয়োজনের কথাও কেউ কখনো ভাবে না।
ভাইয়ার সাথে কথা বলতে গেলে তার অপমানিত হতে হয়। মার খেতেও হয়েছে কতবার। কোন কারণ ছাড়াই ভাইয়া হাত উঠাতে পারেন ভাবীর উপর। স্বামীর অধিকার। স্বামীর অধিকারটা ছিল শুধু তার মারের বেলায়। অন্য বেলায় নয়। ভাবী ইচ্ছে করলে বাড়িতে সালিশ ডাকতে পারতেন। প্রতিবেশীরা বলতো, ‘সালিশ ডাকো বউ। তোমারে না জানাইয়া বিয়া করছে এর জন্য ওর কঠিন শাস্তি হওন দরকার।’
কিন্তু ভাবী মানলেন না।
তিনি বললেন, ‘জোর খাটাইয়া আর যায় হোক ভালোবাসা আদায় হয়না। যে মানুষ আমারে দূরে সড়াইয়া দিবো তারে জোর করে কাছে রাখা যাইবো না। রাখলেও থাকবো না। একদিন দূরেই যাইবো।’
হঠাৎ একদিন বাড়িতে আনন্দের সংবাদ এলো। নতুন ভাবীর সন্তান হবে। ভাইয়া এতে কী যে খুশি!খেয়া ভাবীও খুশি। ঘরে সন্তান আসবে। তাকে না হোক ভাইয়াকে তো বাবা বাবা বলে ডাকার কেউ আসবে পৃথিবীতে। খেয়া ভাবী আনন্দে বাড়িতে হুজুর দাওয়াত করলেন। নানান পদের ভালো ভালো খাবার রান্না করে নিজের হাতে তাদের খাওয়ালেন।
কিন্তু আনন্দে এইসব খাওয়ানো আরও কাল হলো তার জন্য। নতুন ভাবী ভাইয়ার কানে বললেন, খেয়া ভাবী নাকি তাদের অমঙ্গলের জন্য দোয়া করিয়েছেন। শুনে সাত পাঁচ না ভেবেই ভাইয়া ভাবীর উপর হাত তুললেন। ভাবীকে সে রাতে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘আমি তোরে তালাক দিবো।’
ভাবী কেঁদে কেটে ভাইয়ার পা ধরলেন। বললেন, ‘বিশ্বাস করো, আমি মঙ্গলের জন্য দোয়া করাইছি।’
ভাইয়া বিশ্বাস করলেন না। সে রাতেই, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক বলে ভাবীর সাথে তার সমস্ত সম্পর্কের অবসান ঘটালেন।
সে রাতে আমি ছিলাম প্রচন্ড ঘুমে। সেই ঘুম ভাঙিয়ে ভাবী আমার কপালে চুমু খেলেন, তারপর কান্না ভেজা গলায় বললেন, ‘নয়ন, আমার সব শেষ হয়ে গেল রে! আমি কোনদিন ভাবিনি তোদের ছেড়ে চলে যেতে হবে এভাবে!এই বাড়ি থেকে যে মৃত্যুর আগে বেরিয়ে যাবো তা আমার কল্পনাতেও আসেনি।’
কথাগুলো শেষ করতে পারলেন না ভাবী। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অনেক্ষণ পর কান্না থামিয়ে ভাবী বললেন, ‘তোর ভাইয়ার সাথে তো আর এখন আমার কোন সম্পর্ক নাই। সব ভেঙে গেছে।
তুই কী এখন একবার আমায় মা বলে ডাকতে পারবি না নয়ন?’
আমার চোখ কেমন ছলছল করে উঠছে হঠাৎ। মুখ ভেঙে কেমন কান্না এসে যাচ্ছে। অনেক অনেক দিন পর আমার মনে হলো মায়ের কথা। স্পষ্ট মনে হলো, আমার আপন মা আমায় মা ডাক শেখাচ্ছেন। বলছেন, ‘খোকা, বলো তো, মা।’
আমি উচ্চারণ করতাম, ‘ম ম মা ম্মা।’
সেই দিনের মতো আমি ফের উচ্চারণ করলাম ভাঙা ভাঙা শব্দে, ‘ম ম মা ম্মা।’
ভাবী চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। ভাইয়া আর নতুন ভাবী তাদের মতো করে জীবন যাপন করতে লাগলেন। শুধু উল্টে গেল আমার জীবন। মা বাবার মৃত্যুর এই এতদিন পর আমার মনে হলো অনেক অনেক দিন পর আমি এতিম হয়েছি। মনে হলো এই বাড়িতে এখন আর আমার আপন কেউ নাই।
আমি অপেক্ষা করতে থাকি শুধু বড় হওয়ার জন্য। আমার প্রবল বিশ্বাস, আমি একদিন বড় হবো। সেদিন ভাবীকে খুঁজে কোথাও না কোথাও পাবো। তাকে ফিরিয়ে আনবো আমার ঘরে। সেদিন অবশ্য তার আর আমার পরিচয় দেবর-ভাবীর থাকবে না। পরিচয়টা থাকবে মা -ছেলের। সেদিন আর ভাঙা শব্দে নয়, তাকে স্পষ্ট করে ডাকবো ‘মা মা মা ‘বলে।
লেখা – ফিরোজ হাসান
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “ভাবী থেকে মা – হৃদয় স্পর্শ ভালোবাসার গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – চুক্তির বউ যখন প্রেগন্যান্ট – Bangla love story